রেস্ট হাউজে প্রতি দু’জন একটা করে রুম পেয়েছে। কয়েকদিন থাকতে হবে এ বিনোদন সফরে। কেমন সঙ্গিনী পায় এ নিয়ে চিন্তা ছিল ফারহানার। কিন্তু সঙ্গী পেয়ে স্বস্তি পেল সে।
ওলগা তারই ক্লাশের মেয়ে। ওর মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। রুশ মেয়েরা যেমন সারাক্ষণই হৈ চৈ নিয়ে উড়ে বেড়ায়, তেমনটা সে নয়। একেবারেই অন্তর্মুখী, চুপচাপ থাকে। লাইব্রেরিতে ও দেখেছে এক কোণায় বসে লেখাপড়া করে। গতানুগতিক স্রোত থেকে তাকে আলাদাই মনে হয়। ওলগার অন্তর্মুখীতার কারণে তার সাথে অন্তরঙ্গতা হয়নি, কিন্তু সাধারণ আলাপ আছে। ওলগাকে পেয়ে খুশী হয়েছে ফারহানা।
রুম বন্টন ও গ্রুপ ঘোষণা হওয়ার পর ফারহানাকে খুঁজে নিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছে ওলগা। ফারহানাও ওলগার কপালে চুমু দিয়ে নিজের খুশী প্রকাশ করেছে।
সেদিন বিকেলে গোর্কিয়ায় পৌছার পর ঐ দিনের জন্য আর কোন প্রোগ্রাম রাখা হয়নি। গোটা সময়টাই বিশ্রাম। সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে রুমে চলে এলো ফারহানা ও ওলগা।
রুমের দু’পাশে দু’টি বেড। মাথার দিকে একটা হাফ টেবিল। টেবিলের দু’পাশে দু’টি সোফা চেয়ার। পেছনের দিকে একপাশে বাথরুম, অন্যপাশে একটা ওয়ার্ডরোব। মেঝে কার্পেটে ঢাকা। হিটার ঘরটাকে আরামদায়ক করে রেখেছে। ওলগা বিছানায় গা এলিয়ে বলল, ফারহানা তুমি কি পছন্দ কর, পড়া না গল্প করা?
বিছানায় গা স্পর্শ করেছিল ফারহানারও। ওলগার প্রশ্ন শুনে হেসে উঠে বসে বলল, বিশ্বাস কর ওলগা, এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে যাচ্ছিলাম।
-বেশ তুমিই আগে বল। বলল ওলগা।
-না তুমিই আগে বল। ফারহানা উল্টো চাপ দিল ওলগাকে।
ওলগা হাসল। বলল, প্রশ্নটা আমি আগে করেছি, অতএব
উত্তর জানার অগ্রাধিকার আমিই পাব। হাসল ফারহানাও। ঠিক আছে, বলল ফারহানা, তোমার সাথে গল্প করাই আমি পছন্দ করব।
-আমার কথাও এটাই। শোয়া থেকে উঠে বসে বলল ওলগা।
-বেশ তাহলে গল্প করা যাক।
-কি গল্প করা যায় বল।
একটু চিন্তা করে ফারহানা বলল, যখন ভাল লাগা লাগির কথা উঠেছে, তখন এ নিয়েই আলোচনা হোক। বল, দুনিয়ার কোন জিনিস তোমাকে আনন্দ দেয় বেশি?
শক্ত প্রশ্ন ফারহানা, বলল ওলগা। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, গাছ আমাকে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি।
গাছ! বিস্মিত কন্ঠ ফারহানার। বলল, এমন অদ্ভূত চয়েসের পিছনে তোমার যুক্তি কি ওলগা ?
ওলগা বলল, যুক্তি খুব সোজা। গাছ কারও কোন ক্ষতি করেনা শুধু উপকারই করে। কারো বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র তার নেই, পরার্থেই তার জীবন।
ওলগা থামল। ফারহানা তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকিয়েই থাকল। ওলগা বলল, কি দেখছ ফারহানা?
-তোমাকেই দেখছি, আচ্ছা ওলগা, মানুষ সম্পর্কে কি তুমি হতাশ ?
-হতাশ কিনা জানি না, তবে মানুষ আজ গাছ-পালা, পশু-পাখির অনেক নীচে। বিস্মিত ফারহানা ওলগার দিকে তাকিয়েই আছে। ধীরে ধীরে বলল এই অবস্থা কি স্বাভাবিক ওলগা ?
-আমি জানিনা। বলল ওলগা।
-কারন জান কিছু এই অবস্থার ? আবার প্রশ্ন করল ফারহানা।
-উঁহু, আমি আর কোন উত্তর দেবনা, প্রশ্নতো আমারও আছে। কৃত্তিম গাম্ভীর্য টেনে বলল ওলগা।
-বেশ প্রশ্ন কর।
-আমারও ঐ প্রশ্ন, দুনিয়ার কোন জিনিস তোমাকে আনন্দ দেয় বেশী?
ফারহানা একটু হাসল। একটু ভাবল। তারপর বলল, মানুষ ভূল করে কিন্তু তা স্বীকার করে সেটা থেকে ফিরে আসে, এ বিষয়টিই আমাকে সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয়।
ওলগা একটু চোখ বুঝল যেন। তারপর ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, এর মধ্যে বড় কথা কি আছে ফারহানা?
-মানুষ্যত্বের স্বভাবমুখী বিকাশের মূল কথাই তো এখানে নিহিত।
-মানুষ্যত্বের স্বভাবমূখী বিকাশ কি ?
-মানুষকে যে প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তার স্বাভাবিক বিকাশ।
-একটু বুঝিয়ে বল ফারহানা।
-দেখ মানুষকে একটা নির্দিষ্ট পরিসরে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। কিন্তু সীমিত ক্ষমতাকে সে সার্বভৌম ক্ষমতা ভেবে বাড়াবাড়ি করে, সীমালংঘন করে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, ইত্যাদির জন্ম দেয়। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী যেহেতু তাই এ ভূল ও তার একটা নেতিবাচক প্রকৃতি, যা তার জন্য ধ্বংসকর। মানুষ যখন তার এ ভূল স্বীকার করে সত্য অর্থাৎ তার স্বভাবিক অধিকারের মধ্যে ফিরে আসে, তখন মানবতা ধ্বংসকর অবস্থা থেকে রক্ষা পায়। জুলুম, শোষণ এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত ও হিংসা বিদ্বেষের থেকে বেঁচে যায় মানুষের সমাজ। তাই বলেছিলাম, মানুষ ভূল স্বীকার করে ফিরে আসাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়।
ওলগা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। ধীরে ধীরে এক সময় সে বলল, তোমার কথা কিছু কিছু আমি বুঝেছি। কিন্তু একটা বুঝতে পারছিনা তুমি বলছ মানুষ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়।
-নয়তো বটেই। দেখোনা চন্দ্র, সূর্য থেকে শুরু করে সৃষ্টির সব কিছুর কেউই স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, একটা নির্দিষ্ট অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী মাত্র। এই সৃষ্টিরই একটি মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে কেমন করে?
-বুঝেছি তোমার কথা ফারহানা। তুমি বলতে চাচ্ছ, চন্দ্র,সূর্য, তারকা যদি তাকে দেয়া অধিকারের সীমা লংঘন করে কক্ষপথ ছেড়ে ইচ্ছামত বিচরণ শুরু করে তাহলে যেমন আকাশ প্রকৃতিতে বিপর্যয় ঘটবে তেমনি মানুষকে দেওয়া তার ‘অর্পিত ক্ষমতার’ সীমা লংঘন মানব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, কথাটা এই তো?
-ঠিক বুঝেছ ওলগা। আমি আরও বলতে চাই, এই বিপর্যয় সৃষ্টি যদি মানুষ না করে তাহলে মানুষ সম্পর্কে তোমার হতাশ হবার প্রয়োজন নেই। তবে তুমি ঠিক বলেছ, মানুষ যদি তার অধিকারের সীমা ডিঙিয়ে যায়, ভূলের সমূদ্রে যদি ভেসেই চলে, তাহলে সে গাছ-পালা, পশু-পাখীর চেয়েও নীচে নেমে যায়। কারণ ওগুলো তাদের দেয়া অধিকারের তিল পরিমাণও লংঘন করে না। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বলেছে, ‘আহসনে তাকরীম’ -অর্থাৎ সর্বোত্তম রূপ প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু আবার সে তার কর্মের জন্য ‘আসফালা সাফেলীন’ অর্থাৎ নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। ওলগা ‘আসফালা সাফেলীন’ ধরনের মানুষেরাই তোমার হতাশার কারণ।
ওলগা কিছুক্ষন চুপ থাকল। তারপর বলল, তোমার সব কথাই বুঝলাম কিন্তু সৃষ্টির হাতে অর্পিত ক্ষমতার যিনি উৎস সেই ‘সর্বময় ক্ষমতাধর অর্পণকারী’ কে?
ফারহানা ওলগার দিকে তাকিয়ে বলল, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওটা। এর উত্তর আমি এখন দিতে পারবনা। এস দু’জনেই সন্ধান করি। আজ আর নয়।
বলে ফারহানা বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
ওলগা কোন আপত্তি করলনা। কি যেন ভাবছে সে। সেও গা এলিয়ে দিল বিছানায়।
পরদিন ভোর।
বাইরে পূর্ব দিগন্তে সোবহে সাদেকের স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠলেও তখনও বেশ অন্ধকার। ওলগা জেগে উঠেছিল। চোখ মেলে তাকাল সে। ঘরে তখন জমাট অন্ধকার। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, না রাত নেই, ভোর হয়ে গেছে।
ফারহানার বিছানার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল তাকে ডাকবে কিনা। হটাৎ সে দেখল মেঝেতে অন্ধকারের মধ্যে একটা জমাট অন্ধকার নড়ছে। সে তাকিয়ে থাকল। দেখল, অন্ধকারটি উঠছে, বসছে। গত রাতের কথা তার মনে পড়ল। দু’জনে শোবার অনেক পরে ফারহানা ওঠে। সে বাথরুমে যায়। কোন শব্দ হয়না। মনে হয় কাউকে সে জানতে দিতে চায় না।তারপর বাথরুম থেকে এসে সে মেঝেতে দাঁড়ায়। এই ভাবেই ওঠাবসা করে, প্রথমে ওলগা বিস্মিত হয়, ওর এই সন্তর্পন ভাব গতিতে কিছুটা ভয়ও পায়। পরে বুঝতে পারে ফারহানা ব্যায়াম করছে কিংবা প্রার্থনা করছে। রাতে শেষটা না দেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ওলগা দেখল, ফারহানা বসেছে আর উঠছেনা। স্থির বসেই আছে। ওর কাজ শেষ হয়েছে কি?
ওলগা তার বাম হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ টিপে দিল।উজ্জ্বল আলোয় ভোরে গেল ঘর।
ফারহানা দু’টি হাত তুলে প্রার্থনারত। সামনে থেকে আলো গিয়ে আছড়ে পড়েছে তার মুখে। সে আলোয় চক চক করে উঠল তার চোখের অশ্রু। চোখ দু’টি তার বোজা।
কাঁদছে ফারহানা? বিস্মিত হলো ওলগা! ফারহানা আস্তিক? সে প্রার্থনা করে? গতকালের আলোচনায় অবশ্য বুঝা গিয়েছিল সে ঈশ্বর মানে কিন্তু এতটা মানে সে?
ফারহানা মুনাজাত শেষ করল। হাসি মুখে উঠে দাড়াল। তারপর ওলগার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?
ওলগা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফারহানার দিকে। ফারহানা তার বিছানায় গিয়ে বসল। ওলগা ফারহানার দিকে তাকানো অবস্থায় ধীর কন্ঠে বলল তুমি প্রার্থনা কর বুঝি?
-হ্যাঁ।
-রাতেও বোধ হয় প্রার্থনা করেছিলে?
-হ্যাঁ, দেখছ তুমি ?
-ক’বার প্রার্থনা দিনে?
-পাঁচবার প্রার্থনা করতে হয়।
-এটাই কি বিধান ?
-হ্যাঁ
-ধর্ম বিশ্বাস এবং প্রার্থনা একটা ডিসকোয়ালিফিকেশন। তোমার ভয় করেনা ?
-করে, তাইতো গোপনে প্রার্থনা করি।
-এই তো আমি দেখে ফেললাম। আমি যদি রিপোর্ট করি?
-আমি আমার প্রার্থনা গোপন রাখতেই চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।
-এখন রিপোর্ট করলে কি হবে জান?
-জানি।
-এর পরও এমন ঝুঁকি নিয়ে প্রার্থনা না করলেই কি নয়?
-একমাত্র মৃত্যু এবং বেহুঁশ হয়ে পড়া ছাড়া পাঁচবার প্রার্থনা ছাড়া যাবেনা। আর এই কাজে জাগতিক কোন শক্তিকে ভয় না করতে বলা হয়েছে।
-তোমাদের মধ্যে সবাই কি এটা মানে?
-না।
-কেন?
-গতকাল আমি বলেছি না ভুল বিচ্যুতি মানুষের আছে।
কম্যুনিষ্ট শাসনাধীনে আমাদের অধিকাংশ এরই শিকার।
ওলগা চুপ। যেন অন্যমনস্ক সে। ভাবছে কিছু।
ফারহানা ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। জানালর ভারী পর্দাটা গুটাতেই ভোরের স্বচ্ছ আলো এসে প্রবেশ করলে ঘরে।
বিছানায় ফিরে এসে ফারহানা ওলগার দিকে চেয়ে বলল, কি ভাবছ ওলগা?
-ভাবছি তোমাদের স্রষ্টার কথা। তুমি যদিও কাল আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর দাওনি, তবু আমার কাছে পরিষ্কার। স্রষ্টাকেই তুমি সৃষ্টির হাতে অর্পিত সকল ক্ষমতার উৎস মনে কর, তিনিই সর্ব্ময় শক্তির অধিকারী; মানুষ নয়। তিনিই একমাত্র সাবভৌম ক্ষমতার মালিক। বল, আমি ঠিক বলেছি কিনা?
-হ্যাঁ ফারহানা বলল।
ওলগা উঠে এল বিছানা থেকে ফারহানার পাশে। তার মুখটা গম্ভীর চোখে যেন বেদনার একটা নীল ছায়া। সে ফারহানার চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি কি আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বল ?
-হ্যাঁ বলি। বলল ফারহানা।
-বল তাহলে, আমার মা আজ পাঁচ বছর ধরে বন্দী শিবিরে কেন? কথার সাথে সাথে ওলগার দু’গন্ড বেয়ে ঝরে পড়ল অশ্রুর দু’টি ধারা। ফারহানা ওলগার একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, এ কি বলছ তুমি ওলগা ?
-ঠিকই বলছি, আমার মা লমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডঃ নাতালোভা আজ পাঁচ বছর ধরে মস্কোভা বন্দী শিবিরে। তার অপরাধ ছিল, তিনি ধর্ম বিশ্বাসকে মানব প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য বলেছিলেন, তিনি ধর্ম বিশ্বাসকে মানব প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য বলেছিলেন, তিনি ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে এসেছিলেন।
চাদরে মুখ গুজে কাঁদছিল ওলগা। অনেক দিনের অবরুদ্ধ কান্না যেন প্রকাশের পথ পেয়েছে। স্তম্ভিত ফারহানা কিছুক্ষন কথা বলতে পারলনা। এই ওলগা কি সেই ওলগা। এত বড় জমাট বেদনা নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জন্যই কি সে এত নিরব, এত অন্তর্মুখী।
ফারহানা ওলগাকে টেনে নিল কাছে। সান্তনা দিল অনেক। ওলগা কিছুটা শান্ত হলে ফারহানা বলল, বোন ওলগা, তুমি যে প্রশ্ন করেছ তা খুবই পুরাতন প্রশ্ন। জুলুম, অত্যাচার, অবিচার আর প্রতিকারহীন অবস্থায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়, তখন স্রষ্টা সম্পর্কে এ প্রশ্নই মানুষ বার বার করে। আমি আগেই বলেছি, ওলগা , এসব জুলুম, অবিচারের কারণ স্রষ্টার দেয়া বিধান বা অধিকার থেকে মানুষের সরে আসা। তোমার প্রশ্ন, এখানে স্রষ্টা কি করেন? কিছু করেন না কেন? স্রষ্টা অবশ্যই করেন।দেখ তুমি পৃথিবীর জালেম, অত্যাচারীদের ইতিহাস পড়ে। তাদের কি করুণ পরিণতি হয়েছে। তবে স্রষ্টা সবাইকে একটা সীমা পর্য্ন্ত সুযোগ দেন। হয়তো বলবে, যারা অত্যাচারিত হয় তাদের কি লাভ হয় এতে। লাভ ক্ষতির হিসেব যদি এ দুনিয়াতেই শেষ হয়ে যেত, তাহলে একথা ঠিক হতো। কিন্তু তা নয় ওলগা, দুনিয়ার জীবনটা স্বপ্নের মতোই সংক্ষিপ্ত, সুতরাং এখানকার দুঃখ প্রকৃতই দুঃখ নয় এবং সুখও প্রকৃত সুখ নয়, পরজগতের চিরন্তন যে জীবন সেখানকার সুখই প্রকৃত সুখ এবং সেখানকার দুঃখই প্রকৃত দুঃখ।
ক্ষণস্থায়ী দুঃখের বিনিময়ে স্রষ্টা যদি চিরন্তন সুখ দান করেন, তাহলে সেটা স্রষ্টার অবিচার নয়, করুণাই তোমাকে বলতে হবে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে ওলগা, যারা জালেম তারা স্রষ্টার দেয়া সীমা বা অধিকার লংঘনের জন্য শাস্তি এখানে পাচ্ছে এবং পরকালেতো পাচ্ছেই। আর যারা জালেমের অত্যাচারে অধিকার হারাল, তাদের দুঃখের সীমা এখানকার সংক্ষিপ্ত জীবন পর্য্ন্তই। তুমি আমি জীবনটাকে এমন সামগ্রিক ভাবে দেখিনা বলেই সাময়িক দুঃখে হতাশ হই, ভেংগে পড়ি।
-তাহলে এই জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জুলুম-অত্যাচারকে যে শিরোধার্য করে নিতে হয়। শুকনো কন্ঠে বলল ওলগা।
-কখনও না, যারা আল্লাহর দেয়া সীমা লংঘন করে, তাদেরকে সীমার মধ্যে রেখে সমাজকে , মানুষকে জুলুম, অত্যাচার থেকে রক্ষা করা স্রষ্টার তরফ থেকে মানুষের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব। এ স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন না করাও মানুষের দুঃখ কষ্টের একটা বড় কারণ। জুলুম যেমন একটা বিচ্যুতি, জুলুম মাথা পেতে নিয়ে চলাও একটা বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতির কারনেই মানব সমাজের তাদের স্বউপার্জিত, দুঃখ-কষ্ট, জুলুম, অত্যাচার জেঁকে বসে।
ওলগা ভালো করে চোখ মুছে ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা বুঝেছি, কিন্তু এ পথ তো বিদ্রোহের।
-স্রষ্টা এ বিদ্রোহ চান। মুসলমানদের কলেমা বিদ্রোহের আপোষহীন এক আহ্বান। এ কলেমা উচ্চারণের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া সকল কর্তৃত্ব ও শক্তিকে অস্বীকার করে।
ওলগা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল ফারহানার দিকে। বলল, তোমার কথা খুবই ভালো লাগছে ফারহানা। আমার অনেক প্রশ্নও জিজ্ঞাসার আজ তুমি সমাধান করে দিয়েছ। কিন্তু চার-পাশের বাস্তবতা আমি ভুলতে পারছি না ফারহানা। আমার মা সোভিয়েত বিজ্ঞান একোডেমীর সদস্যা ছিলেন। লেনিন পুরষ্কারও তিনি লাভ করেছেন। তাঁর বন্ধু বান্ধব ও ভক্তের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু মা আজ পাঁচ বছর ধরে বন্দী শিবিরে। তাঁর পক্ষে একটি কথাও কেউ বলেনি। কারো কাছে সামান্য সহানুভুতিও আমি পাই নি।
আবার চোখ দু’টি ছল ছল করে উঠল ওলগার। ফারহানা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, কমিউনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষের সকল স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, সেই জন্যই এই অবস্থা। কিন্তু ওলগা, মানুষের বিবেকের এবং তাদের স্বাধীনতার চারদিক ঘিরে তারা যে বাঁধ দিয়ে রেখেছে, তা আর বেশীদিন টিকবেনা মনে রেখ।
-কেমন করে বলছ এ কথা ? ফিস ফিসে কন্ঠ তার।
-কান পেতে শোন, চোখ মেলে চারদিকে দেখ, তুমিও বলবে একথা।
কোন কথা বলল না ওলগা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফারহানা উঠল। বলল, ওলগা, তৈরী হও। ১৫মিনিটের মধ্যে আমাদের হল রুমে উপস্থিত হতে হবে। আজকের প্রোগ্রাম ব্রিফিং হবে সেখানে।
কয়েক দিন পর। পরদিনই ফিরতে হবে মস্কোতে। তখন বিকেল। ভল্লার তীরে যার যেমন ইচ্ছা প্রোগ্রাম চলছে। কেউ হাঁটছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ জোড়া বেঁধে গল্প করছে।
এই কোলাহল থেকে একটু দুরে ভলগার তীরে ওলগা এবং ফারহানা বসে। দু’জনে চেয়ে বহমান ভল্লার নীল পানির দিকে। একদম শান্ত নদী। একটা ছোট পখি এসে চকিতে এক ছোঁয়ে ঠোঁটটা পানিতে ডুবিয়ে আবার উড়ে গেল। নীল পালকে হলুদের ছোপ দেয়া তার। ফারহানা চিনেনা পাখিটাকে। ওলগাও নাম বলতে পারলোনা। ওটা নাকি সাইবেরিয়ার পাখি। এই সিজনে এদিকে আসে।
গোঁ গোঁ একটা শব্দে ওরা বামদিকে ফিরে তাকাল। দেখল একটা স্পীড বোট আসছে। সামনে এসে গেল বোটটা। শান্ত নদীর বুক চিরে এগিয়ে এল। ঢেউ এর মিছিল ছড়িয়ে পড়ছে বোটের দু’পারে। নদীর শান্ত জীবনে যেন একটা ঝড়।
বোটটা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দেখেই বুঝা গেল পুলিশ বোট। সামনে বোট ড্রাইভার। পেছনে ষ্টেনগান ধারী দু’জন পুলিশ। অবশিষ্ট ডজন খানেক লোক কয়েদীর পোশাক পরা। তাদের হাতে পায়ে হালকা শিকল। বোধ হয় সরকারী কোন প্রজেক্ট তারা বিনে পয়সায় শ্রম দিয়ে এল।
ওদিকে তাকিয়ে ওলগা আনমনা হয়ে পড়েছিল। বোট যতদূর দেখা গেল তার চোখ ততদুর অনুসরণ করল। কে জানে, ঐ কয়েদীদের মধ্য দিয়ে ওলগা তার মাকেই দেখছিল কি না।
বোট চোখের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এল ওলগার চোখ। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল সে। তারপর চোখ খুলে বলল, ফারহানা, কয়দিন থেকে তোমাকে একটা কথা বলব বলব মনে করছি।
কি কথা? আগ্রহে মুখ তুলল ফারহানা।
জবাব এলনা ওলগার কাছ থেকে। সে চিন্তা করছিল।
-কি কথা ওলগা?
ওলগা ফারহানার দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তোমাকে বলতে চাই, তুমি হয়তো ওদের কোন উপকার করতে পার। তোমার জাতির লোক ওরা।
ওলগা থামল। ফারহানা উৎসুক চোখ দু’টি তার দিকে মেলে ধরল। ওলগা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, মস্কোভা বন্দী শিবির থেকে দু’জন বোন পালিয়ে এসেছে। মা একটা চিঠি দিয়েছিলেন, ওরা আমার ওখানেই উঠেছে। এখন পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছি। কি করব বুঝতে পারছিনা।
সত্যই বিস্ময়ে ফারহানার চোখ দু’টি কপালে উঠল। বলল, বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে?
-হাঁ।
-কি বললে, ওরা আমার জাতির লোক?
-হাঁ, দু’জনেই উজবেক মেয়ে, তোমার মতই মুসলমান।
-কি নাম ওদের ওলগা?
-আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা।
নাম দু’টি শোনার সাথে সাথেই ফারহানার গোটা দেহ বিস্ময় ও আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেল। একটা অভাবিত আবেশ যেন তাকে আচ্ছন্ন করল। কান দু’টিকে বিশ্বাস হতে চাইলনা। তারা যে দু’জন বোনের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে, তাদেরকে আল্লাহ্ এমন করে তাদের হাতের কাছে এনে দিয়েছে।
বিস্ময় ও আনন্দের উচ্ছাসটা চেপে গেল ফারহানা। ওদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টা গোপন থাকাই দরকার। যেন চিন্তা করছে ফারহানা, এমন একটা টানা কণ্ঠে সে বলল, খুশি হলাম ওলগা, ওরা আমার জাতির লোক। ওদের অবস্থা জানিনা, দেখা হলে বুঝতে পারব কি করা যায় ওদের জন্য।
-ফেরার পথেই চলনা আমাদের বাসায়। সাগ্রহে বলল ওলগা।
এমন আমন্ত্রণ আসুক ফারহানা কামনা করছিল। বলল, ঠিক আছে, সেটাই ভাল হবে।
ওলগার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, জান, ওরা আসার পর থেকে আমার বুক কাঁপছে, জেল পালান এবং পলাতককে আশ্রয় দেয়া যে কত বড় অপরাধ তা তুমি জান। কিন্তু মা’র আমানত ওরা আমার কাছে। আমার নিরাপত্তার চেয়ে ওদের নিরাপত্তাকে আমি বড় মনে করি। আমি চাই, ওরা নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে সমর্থ হক।
দিনের আলো তখন ফিকে হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। কালো ছায়া নামছে ভল্গার বুকে।
রেস্ট হাউজে ফিরে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরী হচ্ছে। উঠে দাঁড়াল ওলগা এবং ফারহানাও। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »