৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা কফির কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিল।
আহমদ আবদুল্লাহ ছুটে এসে আহমদ মুসার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝাঁকুনি লেগে কিছুটা কফি পড়ে গেল আহমদ মুসার শার্টে।
আহমদ মুসার এপাশে বসে জোসেফাইনও কফি পান করছিল।
তার মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তাকিয়েছে সে আহমদ আবদুল্লাহর দিকে। বলল একটু শক্ত কন্ঠে, ‘আহমদ আবদুল্লাহ! তোমার কাছে এমনটা আশা করিনি।’
কাপ থেকে কফি পড়ে যাওয়ায় আহমদ আবদুল্লাহ এমনিতেই অপরাধবোধ নিয়ে থমকে গিয়েছিল। তার উপর মায়ের বকুনি খেয়ে কেঁদে ফেলল। মায়ের এ ধরনের বকুনি তার কাছে নতুন।
আহমদ মুসা কফির কাপ পিরিচে রেখে আহমদ আবদুল্লাহকে টেনে নিল কোলে। বলল, ‘না বেটা, তোমার আম্মা তোমাকে বকেনি। উপদেশ দিয়েছে। মা তো ছেলেকে উপদেশ দেবেই।’
জোসেফাইন হাসল। আহমদ আবদুল্লাহর মাথায় হাত বুলিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে আদর করে বলল, ‘খুব ভালো ছেলে তুমি।’
দরজায় নক করে একটু পরে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল আয়া। ট্রেতে কফির দু’টি কাপ তুলে নিতে নিতে আহমদ আবদুল্লাহকে বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ, তুমি চলে এসেছ, আমাদের খেলা এখনো তো শেষ হয়নি!’
আহমদ আবদুল্লাহ আহমদ মুসার কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওহ! গুড আন্টি।’ বলেই ছুটে গেল আয়ার দিকে।
ওরা চলে গেল ভেতরে।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে স্ট্যান্ড থেকে কয়েকটা দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন নিয়ে এসে টি-টেবিলে রেখে বসল সোফায়। বলল, ‘আজকের কাগজগুলো দেখেছ জোসেফাইন?’
জোসেফাইন টি-টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে বলল, ‘দৈনিক পত্রিকা আমি তোমার পরে পড়ি। এতে তোমার কাছে শোনার পর আমার কম পড়লেই চলে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সময় ও পরিশ্রম কমানোর সুন্দর কৌশল তোমার। ধন্যবাদ জোসেফাইন।’
‘এসব হিসেব তোমার কাছ থেকেই শেখা জনাব।’ বলল জোসেফাইন হাসির সাথে।
আহমদ মুসা একটা ইংরেজি দৈনিক খুলে পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোমার সময়ের সেভিংটা কোন দিকে যাচ্ছে?’
‘যে দিকে সব মেয়ের যায়।’ বলল জোসেফাইন।
‘মানে সংসার, কিন্তু তুমি তো সব মেয়ের মত নও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি সব মেয়ের মত নই। তবে যাদের সংসার আছে, আমি সেই মেয়েদের মতই।’ বলল জোসেফাইন।
‘তুমি মারিয়া জোসেফাইন। ফরাসি রাজকণ্যা। দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপারে আপ-টু-ডেট। তুমি সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে থাকবে, এটা আমকে বিশ্বাস করতে বল?’ কাগজ থেকে মুখ তুলে মিষ্টি হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘পৃথিবীর মধ্যে যেমন সংসারের চার দেয়াল, তেমনি সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে পৃথিবী থাকতে পারে।’ বলল জোসেফাইন।
‘যাক, আমি আশ্বস্ত হলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কিনা? ধন্যবাদ জোসেফাইন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিশ্বাসটা অত দুর্বল হয়ে পড়েছিল কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘বিশ্বাস দুর্বল হয়নি, একটু ভয় ঢুকেছিল মাত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
‘বাচ্চা পাওয়ার পর মেয়েরা কনজারভেটিড হয়। বাচ্চার স্বার্থ মানে সংসারের স্বার্থের ব্যাপারে বেশি সচেতন হয় তারা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা কি খারাপ, যদি তা অন্যের ন্যায্য স্বার্থের কোন হানি না ঘটায়?’ হাতের ম্যাগাজিনটা বন্ধ করল জোসেফাইন।
‘অবশ্যই খারাপ নয়। তবে পৃথিবী কোন না কোন উপকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি তো বলেছি, সংসারের স্বার্থ ও পৃথিবীর স্বার্থ সাংঘর্ষিক নয়, যদি ভারসাম্য রাখা হয়।’ জোসেফাইন বলল।
‘ধন্যাবাদ!’ বলে আহমদ মুসা একটু ঝুঁকে জোসেফাইনের একটা হাত হাতে নিয়ে জোসেফাইনকে কাছে টেনে নিতে চাইল। জোসেফাইন দ্রুত নিজের হাত খুলে নিয়ে একটু সরে বসে হেসে বলল, ‘না জনাব, অন্য চিন্তা বাদ! ১০টার সময় তোমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট সৌদি পুলিশ প্রধানের সাথে। পত্রিকা পড়ার জন্যে এখন যথেষ্ট সময় নেই।’
‘অনেক ধন্যবাদ! ’ বলল আহমেদ মুসা।
হাতের দৈনিকটির দিকে মনোযোগ দিতেই একটা সিংগল কলাম বক্স নিউজের উপর চোখ দু’টো আটকে গেল আহমদ মুসার। নিউজটার হেডিং ‘প্রতিভাধর ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার উদ্বেগজনক রহস্য।’ খবরটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থ বিজ্ঞানের বেসরকারি বিখ্যাত ল্যাবরেটরি ‘সায়েন্স টুমরো’- এর এন্টিম্যাটার বিজ্ঞানী ড. ওমর আবদুল্লাহর দু’দিন আগে নিখোঁজ হবার তথ্য দিয়ে বলেছে, শুধু গত এক মাসেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও পাঁচজন প্রতিভাধর ব্যাক্তি নিখোঁজ হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন পদার্থ বিজ্ঞানী, একজন জেনেটিক বিজ্ঞানী ও একজন মেরিন বিজ্ঞানী।
ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। উদ্বেগ ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। মাত্র এক মাসে ছয়জন নিখোঁজ।
পত্রিকার উপর থেকে মুখ তুলে জোসেফাইনের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘জোসেফাইন, সেই দু:সংবাদের খবর আবার।’
‘কি খবর?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইন।
‘আর একজন বিজ্ঞানীর নিখোঁজের খবর।’
‘এই মাসেই ৬জন বিজ্ঞানী প্রতিভা নিখোঁজ হলেন জোসেফাইন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই ইন্টেলিজেন্স ম্যাগাজিনেও দেখছি এ ব্যাপারে নিউজ আছে।’
‘কি আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঐ ধরনের নিখোঁজ সংবাদ। আরও বিস্তারিত।’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘বল তো কি আছে নিউজে?’
গোটা নিউজের উপর চোখ বুলাল জোসেফাইন। বলল, ‘গত এক বছরে নিখোঁজ হওয়ার হিসাব দেয়া হয়েছে এই নিউজে, সেই সাথে কিছু বিশ্লেষণও দেয়া হয়েছে এই নিউজে। ৫১ জন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ প্রতিভা গত এক বছরে নিখোঁজ হয়েছেন। এদের মধ্যে ২১ জন পদার্থ বিজ্ঞানী। পদার্থ বিজ্ঞানীদের মধ্যে এন্টিম্যাটার বিজ্ঞানী ১১জন, কণাবিজ্ঞানী ৭ জন এবং ৩ জন মেরিন বিজ্ঞানী। এই ২১ জন ছাড়া অবশিষ্ট ৩০ জনের মধ্যে রয়েছেন ইতিহাস, অর্থনীতি, ভূগোল, রসায়ন জীব-বিজ্ঞান, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী এবং আরও রয়েছেন কয়েকজন প্রতিভাবান রাজনীতিক। নিউজে আরেকটা বিশ্লেষণও দেয়া হয়েছে। সেটা ধর্মীয় পরিচয়মূলক। গত এক বছরে মোট ৫১ জন নিখোঁজ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ৪৫ জনই মুসলিম। সবশেষে নিউজে লেখা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিখোঁজ এই বিজ্ঞানীদের কারোরই খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি ইন্টারপোলও টেক-আপ করেছে, কিন্তু কোন ফল হয়নি। কারও হদিস মেলেনি। এটা যে সংঘবদ্ধ একটা অপরাধ এ বিষয়ে কারোরই আর কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সংঘবদ্ধ চক্র কে তাও জানা যায়নি। দু’একটা নাম জানা গেলেও তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।’ থামল জোসেফাইন।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর বেদনা ও অস্বস্তির চিহ্ন। বলল, ‘তাহলে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই। মুসলিম বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধেই এ অভিযান।’
বলল জোসেফাইন, ‘কেন, অমুসলিম বিজ্ঞানীও তো আছেন কয় জন।’
‘আছেন কয়েকজন। সেটা নিশ্চয় ক্যামোফ্লেজের জন্যে। যারাই এই অপরাধমুলক কাজের পেছনে থাক, বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের নিখোঁজ করাই যদি তাদের লক্ষ্য হতো, তাহলে এত মুসলিম বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ নিখোঁজ হবার কথা নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ প্রশ্ন জোসেফাইনের।
‘কারণ এই মানের বিজ্ঞানী অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও বেশি পরিমাণে আছে। এদিক থেকে চোখ একতরফাভাবে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের প্রতি যাবার কথা নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক। তাহলে কি টার্গেট মুসলিম বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা? দেখা যাচ্ছে শুধু বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিরাই নয়, প্রতিভাবন মুসলিম রাজনীতিকও তাদের টার্গেট। এর অর্থ কি? বিষয়টি আমার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। মোটিভটা খুব সরল নয়। বিজ্ঞানীদের সাথে সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিকরাও নিখোঁজ হওয়া উদ্বেগজনক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি সেটা?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
‘অত্যন্ত কৌশলে একটা সম্প্রদায়কে ধীরে ধীরে মেধাশূণ্য করার ভয়াবহ একটা ষড়যন্ত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
চমকে উঠল জোসেফাইন। সামনে থেকে পর্দা সরে গেলে যা হয় তেমনি তার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কেঁপে উঠল তার মন। ‘গত এক বছরেই ৫১ জন বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ! পরিস্থিতি ভয়াবহ!’ বলল জোসেফাইন।
‘সত্যিই এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র এটা! এর বিস্তারও দেখছি গোটা দুনিয়াব্যাপী।’
‘হ্যাঁ জোসেফাইন, নিখোঁজের স্পট ছড়িয়ে আছে গোটা দুনিয়ায়। তার মানে গোটা দুনিয়া এদের নেট ওয়ার্কের আওতায়।’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন উঠে গিয়ে আহমদ মুসার পাশে তার গা ঘেঁষে বসল। বলল, ‘কেসটা তুমি নিচ্ছ।’
‘নিচ্ছি নয়, কে দেবে এ কেস আমাকে? এর তো কোন বাদী নেই। পৃথিবীর মানুষ, মানবতা এর বাদী। কিন্তু মানুষ ও মানবতার কোন মুখপাত্র নেই। মানব জাতির একজন সদস্য হিসাবে আমি, তুমিই এর বাদি। আমাদের পক্ষ থেকেই আমি এ কেস গ্রহণ করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ। আল্লাহ সাহায্য করুন! এ এক অন্ধকারে ঢাকা কঠিন পথ তোমার।’ বলল জোসেফাইন।
‘ঠিক জোসেফাইন। একবারেই অন্ধকারে ঢাকা পথটা। একটা সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম মাত্র শুনেছি। এর বাইরে আর কিছু অবলম্বন হাতে নেই। সন্ত্রাসী সংগঠনটির নামটাও অদ্ভূত: “ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট”। সেদিন সৌদি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। ওদের রেকর্ডে এমন কোন সংগঠনের নাম নেই। সৌদি পুলিশ প্রধান পরে কথা বলেছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও বৃটেনের এস-১০ এর প্রধানদের সাথে। তারাও জানিয়েছেন, এ ধরনের কোন ওয়ার্কিং সন্ত্রাসী সংগঠন বা গোপন কোন সংস্থার নাম তাদের রেকর্ডে নেই। এই বিষয়টিই আমাকে খুব বেশি বিস্মিত করেছে। তাদের নজরের বাইরে কোন সন্ত্রাসী সংগঠন বিশ্ব জুড়ে কাজ করছে, এটা অবিশ্বাস্য।’
ভাবছিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কথা বলল না জোসেফাইন। কিছু একটা খোঁজার চিহ্ন তার চোখে-মুখে। হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘একটা মজার নামের মিলের কথা তোমাকে বলি। সায়েন্স ফিকশনে আমি “ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট”- এর নাম পড়েছি। সেই নামের সাথে এই গোপন সংগঠনের নাম কিন্তু একদম মিলে যায়!’
আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময় নেমে এল! সেই সাতে প্রচন্ড উচ্ছাসে তার মুখ ফেঁড়েই যেন বেরিয়ে এল প্রশ্ন, ‘আশ্চর্য, একই নাম, ব্লাক সান সিন্ডিকেট!’
‘হ্যাঁ, ব্ল্যাক সান সিন্ডিককেট।’ বলল জোসেফাইন।
কপাল কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
‘সায়েন্স ফিকশনের মত সংগঠন এটা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। অত্যান্ত পাওয়ারফুল। এর ক্ষমতার বিস্তার ছিল আমাদের গোটা ছায়াপথ-গ্যালাক্সি জুড়ে।’ বলল জোসেফাইন।
‘মজার ব্যাপার তো! এদের পরিচয় সম্পর্কে আর কি আছে সায়েন্স ফিকশনে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওদের কথা তোমার কোন কাজে আসবে? ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট আমাদের ছায়াপথ-গ্যালাক্সির বিভিন্ন গ্যালাকটিক কিংডমগুলোতে সন্ত্রাস, কালোবাজারি ইত্যাদিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে তারা জড়িত ছিল না। তাদের উপস্থিতি, প্রভাব-প্রতিপত্তির অধীনে ছিল প্রায় গোটা গ্যালাক্সির গ্যালাকটিক রাজ্যসমূহ। ছায়াপথ-গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় সরকারেএ সিনিয়র দু’জন সামরিক অফিসার, ডারথ সিডিয়াম ও ডারথ মাউল, ব্লাক সান সিন্ডিকেট সম্পর্কে বলেছেন, এটা বিশাল এক ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের প্রভাব-প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমূহ অঞ্চল থেকে শুরু করে গ্যালাক্সির প্রান্ত পর্যন্ত সব গ্রহে পরিব্যাপ্ত। যে সম্পদ এদের হাতে আছে, তা সীমাহীন। এদের সৈন্য আছে লাখ লাখ। গ্যালাক্সির সাধারন বাসিন্দাদের মতে এই সিন্ডিকেট জানা মহাবিশ্বের অত্যান্ত ক্ষমতাধর সংগঠন। সায়েন্স ফিকশনে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অনেক উত্থান-পতনের কথাও বলা হয়েছে। খৃস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তাদের উত্থান। আর খৃষ্টপূর্ব ৩৩ বছর আগে তাদের মধ্যৈ ভাঙ্গন আসে। দু’বছরের মধ্যেই আবার সামলে ওঠে। ২৪ খৃষ্টাব্দে আবার ভেঙে পড়ে। কিন্তু পূর্ণ শক্তি ফিরে পায় আবার ১২৭ খৃষ্টাব্দের দিকে। গোটা গ্যালাক্সির রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনে, সংঘাত-সংকটে এই সিন্ডিকেট বড় ভূমিকা পালন করেছে। সকল বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য ওদের দেখা গেছে।’ থামল জোসেফাইন।
‘চমৎকার জোসেফাইন। চমৎকার কাহিনী ব্লাক সান সিন্ডিকেটের। নিশ্চয় আমাদের ব্লাক সান সিন্ডিকেট ছায়াপথ-গ্যালাক্সির আকাশচারী সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম কপি করেছে। কেন করেছে? একথা জানান দেয়ার জন্যে কি যে, আন্ত:গ্রহ সংগঠন ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মতই তারা ক্ষমতাধর?’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আচ্ছা, জোসেফাইন, কাহিনীর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান কাজটা কি ছিল?’
জোসেফাইন একটু ভেবে বলল, ‘তাদের সন্ত্রাস-দুর্নীতির আসল লক্ষ ছিল, আকাশ-রাজ্যের রাজ্যগুলোকে দুর্বল বা ধ্বংস করে নিজের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।’
‘তাহলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের আসল লক্ষ রাজনৈতিক। কিন্তু সেই রাজনৈতিক লক্ষটা কি? বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের অপহরণ করানোর সাথে সে লক্ষের সম্পর্ক কি? স্বগতকন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘এটা বলা মুশকিল। সায়েন্স ফিকশনের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট গেরিলাদের মত কাজ সব গোপনে করলেও সংগঠনটি গোপন ছিল না এবং কাজের ফলও প্রকাশ্যে ভোগ করতো। কিন্তু বাস্তবে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট সংগঠন হিসাবেও গোপন, তাদের কাজও গোপন। সুতরাং তাদের লক্ষ কি বলা মুশকিলই। রাজনৈতিক লক্ষ হলে তো তার জন্যে জনসমর্থন দরকার হয়। কিন্তু গোপন সংগঠন কাজ করে জনগণের সাথে পরিচিত হবে কি করে, জনসমর্থন পাবে কি করে? এ বিষয়টাই আমি বুঝতে পারছি না।’ বলল জোসেফাইন।
‘নিশ্চয় ওদের একটা রাজনৈতিক লক্ষ আছে এবং সে লক্ষ অর্জনে ওদের রোড ম্যাপও নিশ্চয় আছে। সেটা জানাও দরকার। কিন্তু এই মুহুর্তে এটা খুব বিষয় নয়। ওদের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টিই এখন বড়। আমাদের মনোযোগটা সেদিকেই আকৃষ্ট করবো।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আচ্ছা জোসেফাইন, সায়েন্স ফিকশনের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান চরিত্রে কারা? তাদের তার কি কাজ ছিল, মনে আছে তোমার?’
‘কিছু তো মনে আছেই। আমাদের ছায়াপথ-গ্যালাক্সির কোটি কোটি তারকা ও গ্রহ রাজ্য নিয়ে যে গ্যালাকটিক সাম্রাজ্য তার সম্রাট পালপেটাইন ও এই রিপাবলিকেরর সবচেয়ে প্রভাবশালী স্কাই কমোন্ডো-কমান্ডার ডারথ তাদের। এই গ্যালাকটিক রিপাবলিক জুড়েই প্রতিদ্বন্দী কমান্ডো শক্তি হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট। গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট কবে থেকে কাজ শুরু করে তার কোন তথ্য ফিকশনে নেই। ছায়াপথ গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে মহাকাশ বর্ষ (BY-birth year) গণনা শুরু হয়। সায়েন্স ফিকশনে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে যার নাম প্রথম এসেছে, তিনি আলেক্সি গ্যারিন। তিনি BBY (befor birth year) অর্থ্যাৎ মহাকাশ বর্ষ-পূর্ব ৩৩ অব্দে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান ছিলেন। তার নেত্বেত্বে গোটা ছায়াপথ-গ্যালাক্সি জুড়ে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের প্রেসিডেন্টের নিয়োজিত কমান্ডো নেতা ডারথ মাউল ও তার বাহিনীর হাতে আলেক্সি গ্যারিন ও তার ভিগোজ বা গভর্নররা নিহত হন। এরপর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকে্ট তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া ও হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অনেকগুলো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই সময় গ্যালাকটিক সাম্র্যজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গৃহযুদ্ধের সুযোগে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট গ্যালাক্সি জুড়ে তার প্রভাব প্রতিষ্টার কাজে ব্রতী হয়। সময়টা মহাকাশ বর্ষ (ABY2) দ্বিতীয় অব্দের পরের ঘটনা। ডেল পারহি ছিলেন ব্ল্যাক সানের নেতা এ সময়। তাকে সরিয়ে দিয়ে ব্ল্যাক সানের ক্যাপ্টেন ফলিন গ্রহ-রাজ্যের প্রিন্স জিজর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ক্ষমতায় বসেন। প্রিন্স জিজরের নেতৃত্বে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রভাব সর্বোচ্চে উন্নীত হয় এবং প্রিন্স জিজর গ্যালাকটিক রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট পালমেটাইন ও তাঁর প্রধান সেনাপতি কমান্ডো নেতা ডারথ ভাদেরের পরে তৃতীয় প্রভাবশালী ব্যাক্তিতে পরিণত হয়। প্রিন্সের বডিগার্ড ও ব্যাক্তিগত কমান্ডো গৌরী ছায়াপত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মহিলায় পরিণত হয়। অবশেষে ডারথ ভাদেরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়লে প্রিন্স জিজরের এলাকারই এক কক্ষপথে এক সংঘর্ষে ডারথ ভাদেরের ব্যাক্তিগত আকাশযান এক্সিকিউটর প্রিন্স জিজরের ব্যক্তিগত আকাশযান স্কাইলুককে প্রিন্স জিজরসহ ধ্বংস করে দেয়। আর এই সময়েই ভাদেরের ছেলে স্কাই ওয়াকার তার কমান্ডো বাহিনী নিয়ে প্রিন্স জিজরের প্রাসাদ ও হেডকোয়ার্টার ধ্বংস করে দেয়। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের আর একবার পতন ঘটে। নতুন নতুন নেতৃত্ব ব্ল্যাক সানকে প্রভাব-প্রতিপত্তির আগের জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্ঠা করে, যাদের একজন প্রিন্স জিজরের ভ্রাতুষ্পুত্র সাভান ও আরেকজন হলেন জোডি ডেক। অবশেষে একটা বড় বিপদ ব্ল্যাক সানকে উত্থানের সুযোগ করে দেয়। গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের সম্রাট ব্ল্যাক সানকে সমূলে উচ্ছেদ করতে চাইলেন। এজন্য তিনি কেসেল গ্রহের জেল কলোনি থেকে ভয়ংকর ব্যাগ স্কোয়াড্রনসহ সব ক্রিমিনালকে ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাক সানের হেডকোয়ার্টার গ্রহ কুরুস্ক্যান্টে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই সাথে তাদের সংগে অনুপ্রবেশ ঘটান সাম্রাজ্যের গোয়েন্দাদের যারা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের উৎখাত সম্পূর্ন করবে। কিন্তু গ্যালাকটিক সম্রাট বিপরীত ফল ফলাল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া জেকা থাইন ও মফ ফ্লেরীর মত ভয়ংকর ক্রিমিনালরা ব্ল্যাক সান সিন্ডিককেটের পুনরুজ্জীবন ঘটাল। ইউল আসিব-এর নেতৃত্বে ব্ল্যাক সান, এমনকি সম্রাটের রুলিং কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্ঠা করল। ব্যর্থ হলেও সেথ্রোস-এর নেতৃত্বে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট গোটা ছায়াপথ-গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সির গুরুত্বপূর্ণ লোকেশনে পৌছে যায়। কিন্তু এক সময় বিপদ নামে আবার তাদের উপর। গ্যালাকটিক সাম্র্যজ্যের বাহিনীর কাছে তারা পরজিত হয়। নিহত ও গ্রেফতার হয় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হাজার হাজার কমান্ডো। কিন্তু গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের ক্ষমতার লড়াই নিয়ে গৃহযুদ্ধের সুযোগে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট আবার সংগঠিত হয় এবং তাদের ক্ষমতা ফিরে পায়। কিন্তু বহু শতাব্দীর নীতি-পদ্ধতি পরিত্যাগ করে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট প্রকাশ্য সংগঠনে রূপ নিয়েছে। তাদের অফিস ও মহাকাশযানে এখন তাদের পতাকা ওড়ে। কিন্তু অপরাধমূলক কাজ তারা পরিত্যাগ করেনি। তবে তাদের প্রধান তৎপরতা এখন ছায়াপথ-গ্যালাক্সির আউটার স্পেসে। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অন্যান্য প্রধান চরিত্রের মধ্যে রয়েছে জাল সান, জারা, জিলাস, মেদিন, গ্রান্ট, টাইরেলি, নাশকা, নিলান্না ক্রিনিন। এরা সবাই আঞ্চলিক গভর্নর পর্যায়ের। বিখ্যাত কমান্ডো যারা নেতাদের সিকিউরিটি হিসাবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে ইভা, উইবো, জুটি। আর গৌরীর কথা তো আগেই বলেছি।’ থামল জোসেফাইন।
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এক কথা, এত নাম তোমার এভাবে মনে আছে! অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
থামল একটু আহমদ মুসা। থেমেই আবার শুরু করল, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে জোসেফাইন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট নিছক ক্রিমিনাল অর্গানাইজেসন নয়। ছায়াপথ সাম্রাজ্য দখলও তার লক্ষের মধ্যে রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, তারা সাম্রাজ্যের রুলিং কাউন্সিল দখলেরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু বলা মুশকিল ক্রাইম তাদের টার্গেট, না ক্ষমতা তাদের টার্গেট।’ বলল জোসেফাইন।
‘এটাই আসল কথা। আমার মনে হচ্ছে, নিছক ক্ষমতা তাদের টার্গেট নয়, ক্ষমতা তাদের কাছে বাড়তি উপলক্ষ। আসল টার্গেট তাদের অপরাধ-সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার নেতৃত্ব থেকে ওদের অপরাধ-সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব বড় হলো কেন?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
‘রাষ্ট্র একটা আইনের অধীন হয়, সরকারকেও আইন মেনে চলতে হয়। আর অপরাধ-সাম্রাজ্যের নেতাদের কথাই আইন, তারাই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। এটা এক ধরনের পাপ। পাপ মানুষকে ঐ বিকৃতির দিকে নিয়ে যায়। আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি, কাহিনীর এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। ছোট পাপ বড় পাপ করায়। বড় পাপ মানুষকে অমানুষ বানায়। এই অমানুষরা অপরাধের সাম্রজ্যে গড়ে তোলে। যেমন ছায়াপথ সাম্রজ্যের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট।’
থামল জোসেফাইন। একটু ভাবল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আবার বলে উঠল, ‘ছায়াপথের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কথা শুনলে, কি উপকার হলো তোমার? কি ভাবছ দুনিয়ার ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট নিয়ে?’
‘ভাবছি এই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট এই নাম গ্রহণ করর কেন? ছায়াপথ সাম্রাজ্যের ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কোন জিনিসটা এদের ভাল লেগেছে? গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যে ওরা যে সব অপরাধ করতো, সে সবের সাথে এদের অপরাধের মিল নেই। আন্ত:গ্রহ ও তারকালোকের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট প্রতিপক্ষ হিসেবে ছায়াপথ-রাষ্ট্রের সরকারি বাহিনীর সাথে অবিরাম সংঘাতে লিপ্ত ছিল, কিন্তু ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট কোন দেশের সরকারের সাথে কোন প্রকার সংঘাতে নেই। গ্যালাকটিক রাজ্যের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট একটা নির্দিষ্ট ও তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তাদের হেড-কোয়ার্টার স্থাপন করেছিল এবং ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে তাদেরর নিয়ন্ত্রিত বহু এলাকা ছিল। কিন্তু এই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এ রকম কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না, আর কোন দেশে তাদের পক্ষে এমন একটা নিয়ন্ত্রিত এলাকা স্থাপন সম্ভব নয়। ভারতে মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রিত বিশাল এলাকা আছে সত্য, কিন্তু মাওবাদীরা এই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মত সংগঠন নয়। মাওবাদীরা জনগণেরর ইস্যু নিয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে তাদের যুদ্ধ চালাচ্ছে। আর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাদের গোপন এজেন্ডা নিয়ে বলতে গেলে জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালাচ্ছে। আমাদের এই গ্রহের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ছায়াপথ-রাজ্যের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের একটা বড় মিল দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো, ঐ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মত এরাও গোপনে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু গোপনীয়তার এই এক মিলের কারণে এরা ঐ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের নাম গ্রহণ করেছে, এই যুক্তি খুব শক্তিশালী নয়। তাহলে এ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এই নাম গ্রহনের আর কি কারন থাকতে পারে? ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটকে বোঝার ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক বিষয়েরই কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না জোসেফাইন।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা উজ্জ্বল দিক ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের আছে। বহু শতাব্দি ধরে তারা এই নাম নিয়ে গোটা ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে কাজ করছে। অদম্য তারা। সব বিপর্যয়ের মধ্যে থেকে তারা নতুন শক্তিতে জেগে ওঠে। সবশেষে তারা প্রকাশ্য নামে কাজ করছে আগের সেই একই লক্ষে। এই বৈশিষ্ট্য যে কোন সংগঠনের লোভনীয় হতে পারে।’ বলল জোসেফাইন।
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। এটা হতে পারে। তাদের অদম্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই ব্ল্যাক সান তাদের নাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য ছিল ছায়াপথ গ্যালাক্সির ক্রাইম-লর্ড হওয়া, গড-ফাদার হওয়া এবং পারলে এই গড ছায়াপথ গ্যালাক্সির শাসকও হয়ে বসা। তাহলে এই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্য কি?’ বলল আহমদ মুসা্
মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
‘একদিনে সব প্রশ্নের জবাব আসবে না। তুমি টেলিফোন ধর।’ জোসেফাইন বলল।
আহমদ মুসা তুলে নিল মোবাইল।
আহমদ মুসা কল অন করে সালাম দিতেই ওপার থেকে কন্ঠ শুনতে পেল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
আহমদ মুসার কন্ঠ পেয়েই ওপার থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল, ‘মি. আহমদ, আমি একটু আপনার ওখানে আসতে চাই।’
‘ওয়েলকাম, এখন কিংবা যে কোন সময়। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো? আপনার নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই। আপনি তো শুধুই বেড়াতে আসতে পারেন না, তাও রিয়াদ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘একটা বিষয় নিয়ে আমি আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই। বিষয়টা ছোট, কিন্তু ইন্টারেষ্টিং।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে।
‘আমার তো দারণ আগ্রহ হচ্ছে। বলুন না বিষয়টা কি?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।।
‘আপনি শুনে হয়তো হাসবেন! কিন্তু কি জানি বিষয়টা আমরা এড়াতে পারছি না।’
বলে একটু থামল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সংগে সংগেই আবার শুরু করল, ‘আমাদের রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড টেকনলজি অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মক্কী একটা স্বপ্ন দেখেছেন। সে স্বপ্ন তিনি বলেছেন তার স্ত্রীকে। তার স্ত্রী স্বপ্নের তা’বীরের জন্যে যান ইমাম সউদ জামে মসজিদের খতিব প্রধান আলেমের কাছে। স্বপ্নের তা’বীর শুনে মুষড়ে পড়েন বিজ্ঞানীর স্ত্রী। তিনি বিজ্ঞানীর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এ নিয়েই বেঁধেছে সমস্যা। সরকার বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীর পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে দ্বিধা বোধ করছে।’ থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘মি, হোম মিনিষ্টার, স্বপ্নটা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘একদিন তিনি গাড়ি ড্রাইভ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছিলেন। তাঁর গাড়িটা যখন বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের কোন এক স্থানে পৌঁছেছে, তখন তিনি দেখতে পেলেন একজন লোক পাঁজাকোলা করে একজন মহিলাকে নিয়ে অস্থিরভাবে তাকে ডাকছে। ডাক শুনে বিজ্ঞানী সাহেব তাদের পাশে গিয়ে তার গাঁড়ি দাঁড় করালেন। গাড়ি পাশে দাঁড়াতেই লোকটি বলল, স্যার, আমি একজন ট্যুরিষ্ট। এখানে এসেছিলাম রিয়াদের সবচেয়ে প্রাচীন এই মসজিদ দেখতে। হঠাৎ আমার স্ত্রী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে। আমার স্ত্রী হার্ট-প্রব্লেম আছে। এখনি তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার, প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। ‘অবশ্যই’ বলে বিজ্ঞানী গাড়ির পেছনের দরোজা খুলে দিলেন। লোকটি সংজ্ঞাহীন স্ত্রীকে পেছনের সিটে তুলে দিয়ে সামনের সীটে এসে বসল। বিজ্ঞানী গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আবার ড্রাইভিং সীটে বসলেন তিনি। বিজ্ঞানী গাড়ি ষ্ট্যার্ট দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি অনুভব করলেন তার মাথার পেছনে শক্ত কিছু এসে যেন ঠেকল! পেছন ফিরে তিনি দেখলেন তার মাথায় তাক করা রিভলবার! রিভলবার সেই মেয়েটির হাতে যাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় গাড়িতে তুলেছিল লোকটি। বিস্মিত, ভীত বিজ্ঞানী চোখ ফিরিয়ে চাইলেন পাশে বসা লোকটির দিকে। দেখলেন লোকটির বাম হাত তার দিকে উঠে আসছে। তার হাতে রুমাল। বিজ্ঞানী কিছু বুঝে ওঠা, বলার আগেই লোকটির রুমাল তার নাকের উপর চেপে বসল। তারপর আর কিছু তার মনে নেই। প্রায় সংগে সংগেই তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। এই হলো স্বপ্ন।’ বলে থামল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা হাসল না, বরং তার কপাল কুঞ্চিত হলো। ‘মি. হোম মিনিষ্টার, বিজ্ঞানী কি নিয়ে গবেষণা করেন?
‘উনি একজন বহুমুখী বিজ্ঞান প্রতিভা, জনাব। স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তিনি বিশ্বের কয়েকজন বিরল প্রতিভার একজন। স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারি-এর তার সাম্প্রতিক দুই আবিষ্কার যুগান্তকারী। কল্পনার ‘এন্টি-ম্যাটার ফুয়েল’-কে তিনি বাস্তবে নিয়ে এসেছেন। এই ‘এন্টি-ম্যাটার ফুয়েল’ ব্যবহারের উপযোগী স্পেস-ক্র্যাফটের ইঞ্জিনও তিনি তৈরী করেছেন। এই ইঞ্জিন হবে প্রচলিত ইঞ্জিনের চেয়ে প্রায় পঞ্চাম গুণ হালকা, কিন্তু স্পেস অতিক্রম করার কয়েক লক্ষ গুন বেশি। এই ইঞ্জিন ব্যবহারিক পর্যায়ে এলে আন্ত:তারকা, আন্ত:গ্যালাস্কি স্পেস ট্রাভেল সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানী-এন্টি-ম্যাটার ব্যবহার উপযোগী হাল্কা এমন একটা মেরিন ইঞ্জিন ডেভলপ করেছেন যা আমাদের রোডকারের মত মেরিন কারে ব্যবহার করা যাবে।। এই ব্যবহার সফল হলে মহাসাগর-পরিবহনে একেবারে বিপ্লব এসে যাবে।’ থামল সৌদি স্বরাষ্টমন্ত্রী।
উজ্জল হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার চোখ-মুখ।
বলল, ‘আল-হামদুলিল্লাহ! এমন অবিশ্বাস্য প্রতিভা আমাদের আছে! কিন্তু তাকে নিয়ে তো কোন আলোচনা শুনিনি, তার এসব আবিষ্কারের কথাও শুনিনি কোথাও।’
‘তাকে নিয়ে কোন আলোচনা তিনি পছন্দ করেন না। তার গবেষণা-কর্মের বিষয়ও তিনি অপরিহার্য্য ক্ষেত্রগুলোর বাইরে যেতে দিতে চান না। তিনি কোনদিন কোন সংবাদ পত্রের পাতায়ও আসেননি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকও তাকে চেনেন না।’ সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি যে, তিনি দয়া করে এমন একটি প্রতিভা আমাদের মাঝে দিয়েছেন।’
বলে আহমদ মুসা চুপ করল। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। চিন্তার একটা গভীর ছায়া তার চোখে-মুখে। সাম্প্রতিককালে কিডন্যাপ হওয়া বিভিন্ন শাখা ও পেশার শীর্ষ ব্যাক্তিদের কথা মনে পড়ল। সেই কিডন্যাপের স্বপ্ন দেখলেন উনি, যিনি একজন বিজ্ঞানী। এমন বিজ্ঞানী যিনি অনন্য, অবিশ্বাস্য প্রতিভার অধিককারী। একই সাথে একজন বিজ্ঞানী ‘স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং’- এ গবেষণার শীর্ষে পৌছতে পারে! তা ভাবনারও অতীত ছিল।
‘তাঁর জন্যে আমরা সহযোগিতা চাই আপনার মি. আহমদ মুসা।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওপার থেকে।
‘কি সহযোগিতা মি. হোম মিনিষ্টার? আহমদ মুসা বলল।
‘স্বপ্নটা পরিষ্কার কিডন্যাপিং-এর। আর বিজ্ঞানী ও আউটষ্ট্যান্ডিং স্কলারদের কিউন্যাপিং ঘটনা সাম্প্রতিককালে ঘটেছে। পুলিশ প্রধানের কাছে শুনলাম, আপনি এই বিষয়টা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন। খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন মহান বাদশা একথা জানার পর এ বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্যে আপনাকেই অনুরোধ করতে বলেছেন।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্যমন্ত্রী।
‘বিজ্ঞানী মি. খালেদ আবদুল্লাহ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘কয়েকদিন থেকে সেনা-কমান্ডোদের পাহারায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছেন।’ সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ঠিক আছে মি. মিনিষ্টার, আমি রিয়াদে যাব। তবে কবে যাব তা আপনাকে জানাব। একটা দাওয়াত রিয়াদে আছে আমার ও আমার স্ত্রীর।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কোথায় দাওয়াত, কিসের দাওয়াত? আমরা তো কিছু জানি না মি. আহমদ মুসা।’
‘ফরাসি দূতাবাসের একটা দাওয়াত। দাওয়াতটা বিয়ের। রিয়াদের ফরাসি রাষ্ট্রদূত ও আমার স্ত্রী একই ফরাসি পরিবারের। সেই সূত্রেই দাওয়াত আমার স্ত্রীকে। স্ত্রীর সাথে আমিও আছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, ফরাসি রাষ্ট্রদূত মিস মেরী জেনিফারও তো ফ্রান্সের বুরবুন রাজবংসের মেয়ে। আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো আপনি ম্যাডামসহ আসছেন? কবে?’ সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘সরি, বিয়ের তারিখটা আমি জানি না। বিষয়টা ডিল করছেন তো আমার স্ত্রী। আমি জেনে আপনাকে জানাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না জনাব, আমিই টেলিফোন করব। তাহলে স্যার, এখনকার মত এখানেই ……।’
সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের কথা শেষ না হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ওকে মুহতারাম। আসসালামু আলায়কুম।’
‘ধন্যবাদ, ওয়া আলায়কুম আসসালাম।’ওপার থেকে ধ্বনিত হলো সৌদি স্বরাষ্ট্রন্ত্রীর কন্ঠ।
আহমদ মুসা কল অফ করতেই জোসেফাইন বলল, ‘বিয়ের তারিখ ২৭ রজব। আমরা তো যাব বিয়ের অন্তত দু’দিন আগে।’
কথাটা শেষ করে সোফায় সোজা হয়ে বসল জোসেফাইন।হাসল।বলল, ‘বিয়েতে তাহলে তোমার যাওয়া হচ্ছে না।’
‘কেন? যাওয়া আরও পাকাপোক্ত হয়েছে জোসেফাইন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হয়েছে, কিন্তু সেটা বিয়েতে যাওয়া নয়, যাচ্ছ নিজের মিশনে।’ বলল জোসেফাইন্ মুখে তার কৃত্রিম গাম্ভীর্য।
‘তা বটে, তুমি তো সব শুনেছই। কিন্তু বিয়েতে এ্যাটেন্ড করার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তোমার সাথে এর সম্পর্ক আছে। হয়তো বিয়ের আসরেও তুমি খুঁজবে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কাউকে।’ বলল জোসেফাইন। তার মুখ থেকে কৃত্রিম গাম্ভীর্য তখনও কাটেনি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছে জোসেফাইন। চোখ সেটা খোঁজা স্বাভাবিক, কিন্তু মন বিয়ের আনন্দ ষোল আনাই উপভোগ করবে তুমি নিশ্চিত থাক।’
হাসল এবার জোসেফাইনও।
সরে এল আহমদ মুসার কাছে। ঘনিষ্ঠ হলো স্বামীর। আহমদ মুসার কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘তুমি না বললেও এটা আমি জানতাম। যার যা পাওনা তাকে তুমি তা দাও। দ্বায়িত্বের দাবী তুমি পূরণ কর, আবার মনকে তুমি সামান্যও বঞ্চিত কর না।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন, তোমার এই সাটিফিকেটের জন্যে।জানো, আল্লাহ স্ত্রীর সাক্ষ্যকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য দেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আর স্ত্রীর জন্যে স্বামীর সাক্ষ্য?’ জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি এ সংক্রান্ত কোন হাদিস পড়িনি।’
‘স্ত্রীর জন্যে স্বামীর সাক্ষ্যের দরকার নেই?’ জোসেফাইন বলল।
‘মনে হয় আল্লাহ মেয়েদের ফেভার করেছেন। তিনি আখেরাতে মেয়েদের ভাগ্য স্বামীদের মুখাপেক্ষী করতে চান না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কোরআনে বলেছেন, ‘স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের অভিভাবক।’ মানে সমান তারা। তাহলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে সমান ট্রিটমেন্ট হবে না কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘আল্লাহর সৃষ্টিরই এটা একটা প্রকৃতি যে, সবলকে দুর্বলের সাক্ষ্যের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে, কিন্তু দুর্বলকে সবলের সাক্ষ্যের মুখাপেক্ষী করা হয়নি। কারণ সবলরা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলের প্রতি অবিচার করে, করতে পারে। আর ফেতরাতিভাবে নারীরা দুর্বল ও পুরুষরা সবল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চমৎকার, বুঝলাম। কিন্তু সাক্ষ্য আইনের ক্ষেত্রে দুই নারীর সাক্ষ্যকে এক পুরুষের সমান করা হয়েছে মানে বিচার্য কোন বিষয়ে একজন পুরুষের সাক্ষ্য যথেষ্ট হবে, আর সাক্ষী যদি নারী হয়, তাহলে দুই নারীর সাক্ষ্য না পেলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এখানে তো নারী পুরুষের অর্ধেক হয়ে গেছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘না জোসেফাইন, তোমাকে এখানেও বিষয়টাকে সবল ও দুর্বলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। নারীদের স্বভাবজাত কিছুটা অসুবিধা ও দুর্বলাতার কারণে সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে নারীদের কোন চাপ বা প্রভাবের শিকার হওয়ার আশংকা বেশি। তাই ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করার জন্যেই এক পুরুষের বদলে দুই নারীর সাক্ষ্য চাওয়া হয়েছে। দুই নারী একত্র হলে স্বাভাবিকভাবে তাদের ক্ষমতায়ন হয়, তাদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। সম্ভবত আল্লাহ এটাই চেয়েছেন।’ থামল আহমদ মুসা।
জোসেফাইনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি কঠিন বিষয়কে সহজ করে তুলতে পার। বিষয়টা এভাবে আমার মাথায় আসেনি…..।’
জোসেফাইনের কথার মধ্যেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল আবার।
‘এক্সকিউজ মি. জোসেফাইন!’ বলে আহমদ মুসা মোবাইল হাতে তুলে নিল।
কল ওপেন করে ‘হ্যালো’ বলে সাড়া দিতেই ওপার থেকে সালাম ভেসে এল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
আহমদ মুসা সালামের জবাব দিয়েই বলল, ‘খারাপ কোন খবর জনাব?’
‘হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা। আপনার সাথে কথা বলে টেলিফোন রাখতেই অয়্যারলেস পেলাম পুলিশ প্রধানের। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের বিজ্ঞানী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে আক্রান্ত হযেছেন। তিনি…..।
সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসার বলল, ‘কিডন্যাপ হননি, আক্রান্ত হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা, আল্লাহ রক্ষা করেছেন। কিডন্যাপ হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন। তাঁর পেছনের সেনা কমান্ডোর দু’টি গাড়িই ধ্বংস হয়েছে। মারা গেছেন ৬ জন কমোন্ডোর সবাই। বিজ্ঞানীর ড্রাইভারকে ওরা গুলি করে মেরেছে।বিজ্ঞানীকেও ওরা নিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় সেনাবাহিনীর দু’টি টহল গাড়ি দু’দিক থেকে এসে পড়ে। বিজ্ঞানীকে রেখেই ওরা পালিয়ে যায়। বিজ্ঞানী ……।’
আবারও সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাধা দিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ওরা কয়টি গাড়ি নিয়ে এসেছিল? বিজ্ঞানীকে ওরা গাড়িতে তুলতে পারেনি?’
‘ছোট একটা মাইক্রো নিয়ে তারা এসেছিল। ওরা বিজ্ঞানীর গাড়ির ড্রাইভারকে হত্যা করে তাকে বাইরে ফেলে দিয়ে ওদের একজন আমাদের বিজ্ঞানীকে সংজ্ঞাহীন করেছিল, অন্যজন গাড়ির সীটে উঠতে যাচ্ছিল, এ সময় সেনাবাহিনীর দু’টি গাড়ি এসে পড়ে। তখন ওরা বিজ্ঞানীর গাড়ি থেকে ছুটে এসে মাইক্রতে ওঠে। পালিয়ে যায় মাইক্রোটি। পরে স্পট থেকে একজন পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে জানলাম, বিজ্ঞানীর গাড়ির চাবিটা নিহত ড্রাইভারের হাতে ছিল। ড্রাইভার…………।’
সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার মাঝখানে আবার কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! বিজ্ঞানীর ড্রাইভার জীবন দিয়েছেন, কিন্তু বাঁচিয়ে গেছেন বিজ্ঞানীকে। আমার মনে হয়, বিজ্ঞানীর গাড়ি বহর আক্রান্ত হওয়ার পর যখন ওদেরকে বিজ্ঞানীর গাড়ির দিকে আসতে দেখে, তখনই ড্রাইভার গাড়ির চাবি হাতে নিয়েছিল কিংবা অজান্তেই গাড়ির চাবিটি তার হাতে এসে গিয়েছিল। গাড়িতে চাবি থাকলে সন্ত্রাসীরা বিজ্ঞানীসহ তার গাড়ি নিয়ে পালাত। সন্ত্রাসীরা কেউ মারা যায়নি? বলল আহমদ মুসা।
‘না, ওদের কেউ মারা যায়নি। যারা বিজ্ঞানীর গাড়িতে উঠেছিল, সেই দুই সন্ত্রাসীকেই শুধু দেখা গেছে। মাইক্রোতে কয়জন সন্ত্রাসী ছিল তা জানা যায়নি। যে দু’জন সন্ত্রাসী বিজ্ঞানীর গাড়িতে উঠেছিল, তাদের একজন মেয়ে মানুষ ছিল জানা গেছে। মনে হয় তাদের দু’জনেরই পোষাক বুলেট প্রুফ ছিল। দুই দিকের এক ঝাঁক গুলির মুখে তারা পড়েছিল, কিন্তু কোন ফল হয়নি।’ সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘ওদের একজন মেয়ে ছিল?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
‘তাই মনে করা হচ্ছে। দু’জনেরই এক রকম পোষাক ছিল। এরপরও একজনকে মেয়ে মনে হয়েছে।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘বিজ্ঞানীর দেখা স্বপ্নের দু’জন সন্ত্রাসীর একজন মেয়ে ছিল। এখানেও দু’জনের একজন দেখা যাচ্ছে মেয়ে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. আহমদ মুসা, এই মেয়েটিই গুলি করে ড্রাইভারকে মেরে ড্রাইভিং সীটে বসতে যাচ্ছিল।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘তাহলে স্বপ্নটা সত্যি হলো মি. স্বরষ্ট্রমন্ত্রী।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সত্যি হলো আংশিক। পুরোটা না সত্য হয়ে যায়, এই আতংক এখন আমাদের মি. আহমদ মুসা্।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা আহমদ মুসাকেও চমকেও দিল! ঠিক কথাই বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বপ্নের অর্ধেক সত্যি, অন্য অর্ধেকও সত্যি হতে পারে। অবশ্য নাও সত্যি হতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসারও আশংকা, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের নাম থেকে তাদের যেটুকু পরিচয় পাওয়া গেছে, তাতে এ ধরনের সংগঠন কখনও হার স্বীকার করে না। ‘ডু অর ডাই’ হয়ে থাকে ওদের মটো। কিন্তু ‘ডাই’ এড়িয়ে ওরা ‘ডু’-কেই বাস্তবায়িত করে।
আহমদ মুসার কথা বলতে দেরী দেখে ওপার থেকে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই কথা বলে উঠল, ‘কি ভাবছেন মি. আহমদ মুসা?’ এই মাত্র আমাদের আলোচনা হয়েছে। কালকে সকালে আপনাকে আমরা রিয়াদে চাই। ফরাসি দূতাবাসের বিয়ের আমরা খোঁজ নিয়েছি। সে অনুষ্টান সাত দিন পর হচ্ছে। বড় দেরী হয়ে যাবে। আমাদের অনুরোধ, কাল সকালেই আপনি এখানে এসে যাবেন। ম্যাডামদেরও দাওয়াত আমাদের এখানে। খাদেমুল হারামাইন শরীফাইনের সম্মনিত অতিথি হবেন আপনারা।’
‘বিষয়টিকে আমিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। পরাজিত ওরা আহত বাঘের মত হয়ে গেছে। আপনারা সাবধান থাকুন! আমি কাল সকালে আসছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ। আপনারা আসুন। আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা কর্ব।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ওকে, মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমরা আসছি ইনশাআল্লাহ আগামী কাল সকালে। কথা এখানেই শেষ।’
‘ধন্যবাদ মি. আ্হমদ মুসা। আসসালামু আলাইকুম।’ ওপার থেকে বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা সালামের জবাব দিয়ে কল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই জোসেফাইন বলে উঠল, ‘তাহলে কাল সকলেই আমাদের যেতে হচ্ছে রিয়াদে।’
‘স্যরি জোসেফাইন। তোমার সাথে পরামর্শের সুযোগ হলো না। রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। বিজ্ঞানী আক্রান্ত হয়েছেন। ছয়জন কমান্ডোর জীবন গেছে। কিন্তু আল্লাহ বিজ্ঞানীকে রক্ষা করেছেন। ঠিক সময় সেনাবাহিনীর গাড়ি দু’টি এসে না পৌঁছলে বিজ্ঞানী অপহৃত হতেন। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে বিজ্ঞানীর বিপদ যায়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি বলছ কেন? তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমার জন্যেও ভাল হলো। মেরী জেনিফারের সাথে কয়েক দিন বেশি সময় কাটাতে পারব।’ বলল জোসেফাইন।
‘ধন্যবদ জোসেফাইন। যতটুকু সহযোগিতা স্বাভাবিক, তবে চেয়ে অনেক বেশি সহযোগিতা তোমার কাছ থেকে পাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সহযোগিতা শব্দটা কেন? তোমার কাজ কি আমার কাজ নয়?’ বলল জোসেফাইন।
‘অবশ্যই জোসেফাইন!’ বলে আ্হমদ মুসা কাছে টেনে নিতে চাইল জোসেফাইনকে।
জোসেফাইন হেসে উঠে সরে যেতে যেতে আঙুল তুলল দরজার দিকে।
আহমুদ মুসা চোখ ফেরাল দরজার দিকে। দেখল দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে আহমদ আবদুল্লাহ। তার হাতে খেলনা রিভলবার।
সে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার কোলে।
‘রিভলবার কোথায় পেলে বেটা?’ আহমদ আবদু্ল্লাহকে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আন্টি ম্যাডাম আমার জন্যে এনেছে।’ বলল আহমদ আবদুল্লাহ।
‘বেশ ভাল করেছে। কিন্তু বেটা, তোমার রিভলবার হলো কলম।’ বলে আহমদ মুসা পকেটের দামী কলমটা আহমদ আবদু্ল্লাহর হাতে তুলে দিল।
আহমদ আবদুল্লাহ রিভলবার ফেলে দিয়ে আনন্দের সাথে কলমটা হাতে নিল। তারপর ছুটে গিয়ে মায়ের পাশে বসে বলল, ‘তুমি সেদিন এ কলমটা আমাকে নিতে দাওনি। আব্বু দিয়েছেন আমাকে।’
জোসেফাইন আহমদ আবদুল্লাহকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘তোমার আব্বা অনেক ভাল বেটা।’
‘তুমিও ভাল আম্মা।’ মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বলল আহমদ আবদু্ল্লাহ।
‘কে বলেছে?’ আহমদ আবদুল্লাহর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল জোসেফাইন।
‘কেন?’ আব্বা বলেছেন। বলনি আব্বা তুমি? মায়ের কোল থেকে মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল আহমদ আবদুল্লাহ।
‘হ্যাঁ, তোমার মা অবশ্যই একটু বেশি ভাল। আর বেটা, দুনিয়ার সব মানুষই ভাল, যারা খারাপ তারা ছাড়া। আল্লাহ সব মানুষকে ভালবাসেন। আমাদেরও সবাইকে ভালবাসা উচিত।’
বলে আহমদ মুসা আহমদ আবদুল্লাহর গালে স্নেহের একটা টোকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
জোসেফাইনও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল দেখি আহমদ আবদুল্লাহ, তোমার আন্টি ম্যাডাম আর কি নিয়ে এল?’

পরদিন সকাল ৭টার মধ্যেই আহমদ মুসারা মদিনা বিমানবন্দরে পৌছেছিল।
সৌদি বিমান বাহিনীর একটা বিশেষ বিমান আহমদ মুসাদের নিয়ে যাবে রিয়াদে।
আহমদ মুসারা বসেছিল ভিভিআইপি লাউঞ্জে। মিনিট খানেক আগে বিমান বন্দরের ষ্টেশন ম্যানেজার বলে গেছে আহমদ মুসাকে, বিমান রেডি স্যার। সেন্ট্রাল এয়ারট্রাফিকের একটা ফাইনাল সিগন্যালের অপেক্ষা করছে।
বসে বসে আজকের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে আহমদ মুসারা।
‘রিয়াদের গতকালকের খবরটা খুব ছোট করে ছাপা হয়েছে।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ করে বলল জোসেফাইন।
‘উদ্বেগের খবর মানুষের বিস্তারিত না জানাই ভাল, এদেশে এটা সাংবাদিকদের একটা দৃষ্টিভংগি।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা আবার কাগজে মনোযোগ দিতে চাচ্ছিল। এ সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রিনে নজর বুলাল। দেখল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোন।
কল অন করার সাথে লাউডস্পীকারও অন করে আহমদ মুসা বলল, ‘আসালামু আলায়কুম সালাম। ওয়েল কাম মি. আহমদ মুসা। আপনি আসুন। এদিকে শেষ রাতে মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। এ নিয়ে আপনি ভাবতে শুরু করুন, এজন্যেই আমার এই টেলিফোন।’
মুহুর্তের জন্যে ওপারে কন্ঠ থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। একটু বিরতিও অসহ্য মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। সে বলল, ‘কি মারাত্মক ঘটনা মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? বিজ্ঞানী মি. খালেদ আবদুল্লাহর কিছু ঘটেছে? কিডন্যাপড হয়েছেন তিনি?’
‘হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা, গত রাত সাড়ে তিনটায় তিনি কিডন্যাপড্ হয়েছেন বাসা থেকে।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উদ্বেগে ভেঙে পড়া তার কন্ঠস্বর।
‘ওনার বাসাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিচার্স হাউজিং ব্লকে?’ জিজ্ঞাসা আহম্মদ মুসার।
‘জি হ্যাঁ। হা্উজিং-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সিকিউরিটি ব্যবস্থা আছে।’ আমরাও হাউজিং-এর গেটে একদল পুলিশ দিয়েছিলাম।
তাছাড়াও সেনাবাহিনীর একটা কমান্ডো ইউনিট একজন কর্নেলের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীর বাড়ির গেটে পাহারায় ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার, কর্নেলসহ পাঁচজন কমান্ডোকেই গেটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।তাদের দেহে কোন আঘাত নেই। মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি।’ থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘বাউন্ডারি ওয়ালের পেছন দিকের প্রাচীর কেটে তাহরে ওরা প্রবেশ করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন। কি করে জানলেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। তার কন্ঠে বিস্ময়!
‘গেটে যখন কিছু ঘটেছে বলে আপনি বললেন না। তখন বুঝা গেছে ওরা বিকল্প পথে হাউজিং-এ ঢুকেছে। অন্তত পাঁচ ফিট পরিমাণ প্রাচীর কেটে ওরা গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন, মি. আহমদ মুসা। প্রাচীরের কাটা অংশ আমরা মেপে দেখিনি। তারা পেছনের প্রাচীর কেটে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘সেনা কমান্ডোদের পোষাক ওরা খুলে নিয়েছে মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘আপনার অনুমান সত্য, আহমদ মুসা। সেনা কমান্ডোদের পোষাক এবং গাড়ি নিয়েই ওরা পালিয়েছে। ওদের গাড়িটা পড়ে আছে বিজ্ঞানীর বাড়ির গেটে। গাড়িটা আনরেজিষ্ট্যান্ড। গতরাতেই একটা শো-রুম থেকে গাড়িটা চুরি গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘বাড়ির ভেতরে ওরা নিশ্চয় বাধা পায়নি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘বাড়ির ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে ছিল। ওরা ল্যাসার বীম দিয়ে লক উড়িয়ে দিয়ে নি:শব্দেই সব দরজা খুলে ফেলে। ম্যাডাম জেগে উঠেছিলেন। তাঁর সামনেই বিজ্ঞানীকে সংজ্ঞাহীন করে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় একটা মিনি রিভলবার দিয়ে ফায়ার করে ম্যাডামকে্ সংগে সংগেই ম্যাডাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ম্যাডাম কি বলেছেন, কয়জন ওরা ঘরে ঢুকেছিল?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘তিনজন ঘরে ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল মেয়ে। মেয়েটির ছিল খুব বেশি ক্ষিপ্র। সেই বিজ্ঞানীকে সংজ্ঞাহীন করে কাঁথে তুলে নেয়। পুরুষ দু’জন রিভলবার তুলে পাহারা দিচ্ছিল।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘কোন রুটে তারা পালিয়েছে, সেটা কি জানা গেছে?’ ওরা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করেছেন নিশ্চয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দেশের সকল সড়ক, নৌ ও বিমান বন্দরে রেড-এলার্ট জারি করা হয়েছে ভোর সারে পাঁচটা থেকে। কোথাও থেকে কোন তথ্য আমরা পাইনি।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘আপনাদের রিয়াদের রাস্তায় তো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার পাহাড়া আছে। তার রিপোর্ট থেকে কি জানা গেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেটা এক বিস্ময়! সব রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। কিন্তু মিলিটারি কমান্ডোদের যে গাড়ি নিয়ে ওরা পালিয়েছি সে গাড়িকে রিয়াদের কোন রাস্তায় দেখা যায়নি।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘তাহলে মাঝখানে তারা আবার গাড়ি পাল্টেছে অথবা গাড়িটিকে তারা জ্যামিং ক্যামোফ্লেজে ঢেকে নিয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ক্যামেরা চোখ আড়াল করার মত জ্যামিং ক্যামোফ্লেজে তো বিশ্বের একটা দুষ্পাপ্য ও অত্যান্ত ব্যয়বহুল টেকনলজি! মাত্র সাম্প্রতিককালে আমরা এই টেকনলজি নিয়ে এসেছি। একটা সন্ত্রাসী সংগঠন এটা পাবে কি করে?’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি জানি না, এই কিডন্যাপাররা কারা। তারা যদি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট হয়, তাহলে মনে করি কোন টেকনলজিই ওদের বাইরে নেই।’
‘আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে, মি. আহমদ মুসা।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘স্যরি, বাস্তবতা আমাদের সবাইকে জানতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, দু:খের মধ্যেও একটু রস করলাম। ওকে, আপনি আসুন। আর খাস কোন পরামর্শ থাকলে বলুন।’
‘ধন্যবাদ মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঘটনার পর যা করার আপনারা তা সবই করেছেন। আমার একটা অনুরোধ গত এক মাসে সৌদি আরবে যারা প্রবেশ করবেন তাদের ফটোসহ পার্টিকুলারস আমার প্রয়োজন। আপনারা দয়া করে এর ব্যবস্থা করবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, এসেই পেয়ে যাবেন। ওকে। এখানেই শেষ। আস্সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল। সবাই উদ্গ্রীবভাবে তাকিয়ে ছিল আহমুসার দিকে। সবার চোখে-মুখেই উদ্বেগ। ষ্টেশন ম্যানেজার আহমদ মুসাকে বলতে এসেছিল যে ষ্টেশন বিশেষ বিমান টেক-অফ পর্যায়ে আছে। আহমদ মুসারা উঠলেই বিমান ছাড়বে।কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলছেন জেনে এবং আলোচনার বিষয় শুনে কথা বলতে আর সাহস করেনি।
জোসেফাইনও বিব্রত অবস্থায় পড়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসাকে ডিস্টার্ব করা উচিত মনে করেনি। বিজ্ঞানী কিডন্যাপড্ হয়েছে তার মনটাও মুষড়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা মোবা্ইল পকেটে রেখে মাথা তুলে সামানে চাইতেই দরজায় দাঁড়ানো বিমান বন্দরের ষ্টেশন ম্যানেজারের নজরে পড়ে গেল। বলল, ‘স্যরি, প্রেন বুঝি দাঁড়িয়ে আছে?’
‘নো প্রব্লেম স্যার। প্লেনের সময় ২০ মিনিট পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।’ বলল ষ্টেশন ম্যানেজার।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘তার মানে আর দশ মিনিট সময় আমাদের হাতে আছে।’
আহমদ মুসার কথার রেশ বাতাসে মেলবার আগেই বাইরে থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল।
চমকে উঠল সবাই। প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠেছিল বিল্ডিংটাও।
সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এ বিস্ফোরণের শব্দ রানওয়ের দিক থেকে এসেছে। তার মানে কোন বিমানে বিস্ফোরণ ঘটেছে’।
বিস্ফোরণের শব্দ শুনেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ষ্টেশন ম্যানেজার।
কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই একজন পুলিশ অফিসার ছুটে এল আহমদ মুসার ভিভিআইপি কক্ষে। বলল আহমদ মুসাকে, ‘স্যার, যে বিশেষ বিমানে আপনার যাবার কথা ছিল, সে বিমানটি বিস্ফোরণে উড়ে গেছে।’
আহমদ মুসা বসে থেকেই শান্তভাবে কথাটা শুনল। হিসেব করে দেখল, টেলিফোন রিসিভের কারণে দেরি না হলে ঠিক সময়ে বিশেষ বিমানটি আকাশে উড়লে বিমানটি এখন রিয়াদের আকাশে থাকতো। রিয়াদের আকাশেই বিমানটি বিস্ফোরণে ভেঙে পড়তো তাদের সাথে নিয়েই। মূহুর্তের জন্যে তার চোখ দু’টি কঠোর হয়ে উঠল। একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল গোটা শরীরে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। জোসেফাইনের চোখ-মুখ ভয়ে আড়ষ্ট। সে আহমদ আবদুল্লাহকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আহমদ মুসা তার ডান হাত জোসেফাইনের কাঁধে রেখে বলল, ‘আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন। তিনিই তো আমাদের বাঁচালেন! ভয় করলে আল্লাহর এ সাহায্যর অমর্যদা হয় জোসেফাইন।
‘হাসবুনাল্লাহ! আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। ঠিক, তিনি নিজ হাতে আমাদের গোটা পরিবারকে বাঁচালেন। আল-হামদুলিল্লাহ!’
বলে জোসেফাইন আহমদ আবদুল্লাহকে পাশে বসিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যরি, মানবিক অনেক দুর্বলতা মানুষ অনেক সময় কাটিয়ে উঠতে পারে না। আমি সে ধরনের একজন মানুষ। আল্লাহ মাফ করুন।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে।
পুলিশ অফিসার কক্ষের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আরেকজন অফিসারও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আহমদ মুসা ওদের উদ্দ্যেশ্য করে বলল, ‘আমি বিস্ফোরণের জায়গায় যেতে চাই। ষ্টেশন ম্যানেজার কোথায়?’
পরে যে অফিসার এসেছে, সে পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকল। বিনয়ের সাথে বলল, ‘স্যার, বিমান বন্দরে আমি আপনার সিকিউরিটির দায়িত্বে আছি। গোটা বিমান বন্দরে এখন সার্চ চলছে স্যার। স্যার, সার্চ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এখানেই অপেক্ষা করতে অনুরোধ করা হয়েছে।’
পুলিশ অফিসারের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল। আহমদ মুসা দেখল মদিনা মনওয়ারার গভর্নরের টেলিফোন।
আহমদ মুসা কল অন করে সালাম দিতেই ওপার থেকে গভর্নরের কন্ঠ শোনা গেল। সালামের জবাব দিয়ে বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা’ আমি আসছি। গিয়েই কথা বলব। ওকে, আসসালামু আলাইকুম।’
সালামের জবাব দিয়ে কর অফ করতেই আবার বেজে উঠল আহমদ মুসার মোবাইল।
রিয়াদ থেকে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোন।
আহমদ কল অন করে সালাম দিল। ওপার থেকে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্ঠ শোনা গেল। সালামের জবাব দিয়ে বলল, ‘আল-হামদুলিল্লাহ! আল্লাহর হাজার শোকর যে প্লেনটা ডিলে হয়েছিল! আমি মদিনায় আসছি, মি. আহমদ মুসা। ঐ প্লেনেই আমি আপনাদের রিয়াদে নিয়ে আসব।’
‘ধন্যবাদ। আপনার আসাটা ভাল হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই ঘটনা একটা বড় ষড়যন্ত্র। আমি বিস্মিত হচ্ছি, গতকাল আপনার সাথে কথা বলে ঠিক করলাম, আজ আপনি আসবেন। আর বিমান বাহিনীর ঐ বিশেষ বিমানে আপনি আসবেন, সেটা ঠিক হয়েছে রাত ৮ টার পর কেমন করে এটা সম্ভব হলো?’ বলল ওপার থেকে উদ্বিগ্ন সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘এটা খুব সহজ তদন্ত মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনি নির্দেশ দিন। গত রাত ৮টা থেকে যত লোক বিমান বন্দরের টার্মাক এলাকায় প্রবেশ করেছে, যারা ঐ বিশেষ বিমানটিতে উঠেছে, তাদের সকলের উপর নজর রাখতে, তারা যেন কেউ সরে পড়তে না পারে।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমি নির্দেশ দিচ্ছি। আমি গভর্নর মহোদয়ের সাথে আলোচনা করেছি। একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে মদিনা মনোওয়ারার নিরাপত্তা প্রধানের নেতৃত্বে। তারা কাজ শুরু করেছে।’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘ধন্যবাদ মি.স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনার আগের টেলিফোন কলটা ছিল লাকি কল। কলটা দীর্ঘ হওয়ার কারণে ষ্টেশন ম্যানেজার প্লেনের সময় ২০ মিনিট পিছিয়ে দেন’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহর হাজার শোকর, আহমদ মুসা। আল্লাহ সাহায্য করেছেন। আমরা নিমিত্ত মাত্র। ওকে, মি. আহমদ মুসা। আর কিছু পরামর্শ?’ বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি।
‘আপনি আসুন, আলোচনা করা যাবে।’
‘ঠিক আছে মি. আহমদ মুসা। আসছি আমি। আসসালামু আলায়কুম।’
আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই সেই পুলিশ অফিসারটি ঘরে ঢুকল। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই কক্ষে প্রবেশ করল ষ্টেশন ম্যানেজার।
বিধ্বস্ত তার চেহারা। বলল সে আহমদ মুসাকে, ‘স্যার, ওপরে বিশ্রামের জন্যে আমাদের কয়েকটা ভিভিআইপি স্যুট আছে। সেনাবাহিনীর এক্সপ্লোশন ইউনিট সেগুলো সম্পূর্ণ স্ব্যান করে রেডি করেছে। ম্যাডামকে নিয়ে আপনি সেখানে চলুন স্যার।’
‘গভর্ণর সাহেব তো আসছেন। তিনি কোথায় আসছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যুটগুলোর পাশেই কয়েকটি সীটিং রুম রয়েছে। ওরা ওখানেই বসবেন স্যার।’ বলল ষ্টেশন ম্যানেজার।
‘ঠিক আছে চলুন।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। জোসেফাইনও।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে আছে আহমদ আবদুল্লাহ।