৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সুন্দরী এক তরুনী।
তাহিতিয়ান চেহারা। কিন্তু মুখের আদলে সাউথ-ইষ্ট এশিয়ান ছাপ আছে। দেখলেই মনে হবে এ মেয়েটিকে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মনে হবে দেখেছি। মিষ্টি একটা চেহারা। কিন্তু পোষাকটা ব্যতিক্রম।
তাহিতিয়ান অবয়বকে দখল করেছে এসে ইউরোপিয়ান পোষাক।
পরণে কালো প্যান্ট। শর্ট সাদা সার্ট। কোমরে সাদা সার্টের উপর ফিতার মতো প্রশস্ত কালো চেইন।
পাশে একটা খাতা পড়ে আছে। হাতে বই। পড়ছে সে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে অভিজাত চেহারার এক তরুণ এগিয়ে আসছে মেয়েটির দিকে, তার পরণে তাহিতিয়ান ট্রেডিশনাল পোষাক। অবয়বেও সে তাহিতিয়ান। কিন্তু তারও চুল, চোখ ও মুখের গড়নে কিছুটা সেমেটিক, কিছুটা মঙ্গলীয় ছাপ।
তরুণটি নিশব্দে এগিয়ে এল।
একেবারে পাশে এসে দাঁড়ালেও টের পেল না তরুণীটি।
তরুণটি মুখ টিপে হেসে তর্জনি দিয়ে টোকা দিল তরুণীটির মাথায়।
চমকে উঠে ফিরে তাকাল তরুণীটি। তরুণকে দেখে মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যরি।’
তরুণটির নাম তামাহি মাহিন পোপা। তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। পার্ট টাইম কাজও করে একটা সাপ্লায়ার প্রতিষ্টানে।
‘তুমি কি ক্লাস শেষ করে এসেছ মারেভা?’
‘তোমার যখন মোবাইল পেলাম, তখন আমি ক্লাসে। আসতে একটু দেরি হলো। খুব জরুরি কিছু?’ বলল তামাহি মাহিন পোপা।
মারেভার পুরো নাম মারেভা মাইমিতি পাপেতি। সে কলেজ অব টেকনলজিতে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রী। অন্যান্য অনেক তাহিতিয়ান ছেলে-মেয়ের মত সেও পার্টটাইম পর্যটক গাইড হিসাবে কাজ করে।
তামাহি মাহিন পোপার সাথে মারেভা মাইমিতির মন দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক তাদের স্কুল জীবন থেকেই। দু’জনে উত্তর পাপেতি শহরের একই স্কুলে পড়ত।
‘জরুরী নয়, কিন্তু তোমাকে বলা দরকার। সেই জন্যেই ডাকা। সান্ডা সুসানের আচরণে আমার খুব অস্থির লাগছে। গতকাল টেলিফোনে আবার সে আমাকে থ্রেট দিয়েছে। আমি তোমাকে আবারও বলছি পার্ট টাইম চাকরিটা তুমি ছেড়ে দাও।’
‘কেন, সান্ড্রা সুসান আবার তোমাকে কি বলেছে?’ শুকনা কন্ঠে বলল তামাহি মাহিন। তার মুখও মলিন।
সান্ড্রা সুসান তামাহি মাহিনের বস। পাপেতির একটা সাপ্লাই অফিসের ষ্টেশন ম্যানেজার। এই অফিসেই তামাহি মাহিন সুপারভাইজিং অফিসার হিসাবে কাজ করে।
‘কি বলবে, সেই একই কথা। গতকাল তো গালিগালাজ করেছে। আর বলেছে আমাকে তোমার পথ থেকে সরে দাঁড়াতে।’ বলল মারেভা মাইমিতি। তার কন্ঠ ভারি।
‘এটা সে অন্যায় করেছে। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। মাইমিতি তোমাকে তো আগেই বলেছি যে, আমি যখনই বুঝলাম সে আমার ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তখনই আমি তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি তোমার আমার সম্পর্কের কথা। আমি তাকে কখনও সামান্য প্রশ্রয়ও দেইনি। সে আমার বস, আমি তাকে আর কি বলতে পারি।’ তামাহি মাহিন বলল। তার কন্ঠে অসহায়ত্বের সুর।
‘কিছু তুমি বলতে পারবে না, সে জন্যেই বলছি তুমি ঐ চাকরি ছেড়ে দাও।’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘চাকরিটা খুব ভাল মারেভা। সকাল ৯টা থেকে ১০টা এই এক ঘন্টা সকালের সব্জি, মাছ, গোশতের কোয়ালিটি পরীক্ষা করে কেনা-কাটার একটা তালিকা তৈরি করে অফিসকে দিতে হয়। আর সন্ধ্যার পর এ ঘন্টা জিনিসগুলো বাইরে ডেলিভারি দিতে হয়। এ সময় প্যাকিংগুলো চেক করতে হয়, যাতে প্যাকিং করা জিনিসগুলোর কোন ক্ষতি না হয়। শেষে ডেলিভারির একটা তালিকা অফিসে আমাকে ফাইল করতে হয়। হঠাৎ কখনও কখনও মালের ডেলিভারির জন্যে আমাকেও বাইরে যেতে হয়। মোটামুটি দুই ঘন্টার চাকরি। কিন্তু আমি পাই ফুল চাকরির বেতন। তবু চাকরি আমার বড় নয়, তুমি বড়। তোমার জন্যে চাকরি কেন, আরও কিছু হলেও তা ছাড়তে রাজি আছি’ তামাহি মাহিন বলল। আবেগরুদ্ধ হয়ে উঠিছিল তার কন্ঠ।
মারেভা মাইমিতি দু’হাত দিয়ে তামাহি মাহিনের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে মাথা রাখল তামাহি মাহিনের কাঁধে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে একটা গাড়ি প্রবেশ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে তাদের সামনে এসে ব্রেক কষল।
গাড়ির জানালা খোলা। ড্রাইভিং সীটে একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের শ্বেতাংগ যুবতী। সে তাকিয়ে ছিল তামাহি মাহিনদের দিকে।
তামাহি মাহিনরাও তাকে দেখছিল।
মারেভা মাইমিতি মাহিনের হাত ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসেছিল।
শ্বেতাংগ যুবতী গাড়িতে কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে নেমে এল গাড়ি থেকে। সে আসছিল তামাহি মাহিনদের দিকে।
উঠে দাঁড়াল তামাহি মাহিন। তার মুখে অস্পষ্ঠ একটা বিরক্তির ও বিমর্ষ ভাব।
তামাহি মাহিনের সাথে মারেভা মাইমিতিও উঠে দাঁড়িয়েছে।
শ্বেতাংগ যুবতীটি কাছাকাছি আসতেই তামাহি মাহিন বলল মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে, ‘হাই মিস সান্ড্রা সুসান, কিছু ঘটেছে? জরুরি কোন ব্যাপার?’
‘হাই মাহিন, আমি তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম। পাইনি, তাই আসতে হলো। অফিসে জরুরি কাজ পড়েছে। একটু তোমাকে যেতে হবে চল।’ সান্ড্রা সুসান বলল।
এই সান্ড্রা সুসানই তামাহি মাহিনের অফিসের বস। মেয়েটা শ্বেতাংগ হলেও আকৃতিতে সে ফিলিপাইনি। তার চোখ দু’টিতে নারীসুলভ কমনীয়তার চাইতে রুক্ষতাই বেশি। কথায় দ্বিধাহীন নির্দেশের সুর।
তামাহি মাহিন হাতঘড়ির দিকে তাকাল। তাকাল মারেভা মাইমিতির মলিন মুখের দিকেও। বলল মারেভা মাইমিতিকে, ‘তাহলে আসি আমি। তুমি বাসায় যা্ও। ফিরে এসে আমি কল করব।’ তামাহি মাহিনের কন্ঠে একটু বেপরোয়া ভাব।
সে কথা শেষ করেই তাকাল সান্ড্রা সুসান দিকে। বলল, ‘চলুন মিস সান্ড্রা সুসান।’
‘তুমি গাড়িতে গিয়ে বস আমি আসছি।’ বলল সান্ড্রা সুসান তামাহি মাহিনকে।
মনে মনে আশংকিত হলো তামাহি মাহিন সান্ড্রা সুসান তাহলে মারেভার সাথে কথা বলতে চায়। কি কথা বলবে। আবার গালি-গালাজ করবে নাকি? মনে মনে ক্ষুদ্ধ হলো তামাহি মাহিন। কিন্তু কিছু না বলে সে গাড়ির দিকে চলল।
মলিন মুখে দাঁড়িয়েছিল মারেভা মাইমিতি।
তামাহি মাহিন চলে গেলে সান্ড্রা সুসান দু’ধাপ এগিয়ে মারেভা মাইমিতির মুখোমুখি হলো। সান্ড্রা সুসানের চোখে-মুখে চরম অসন্তোষ ও ক্রোধের প্রকাশ। বলল সে মারেভা মাইমিতিকে, ‘কাল তোমাকে কি বলেছি মনে নেই?’
মারেভা মাইমিতির চোখে-মুখে রুখে দাঁড়াবার ভংগি ফুটে উঠল। বলল, ‘মনে থাকলে কি হবে? আমি মাহিনকে ছেড়ে চলে যাব? আমাদের সর্ম্পককে বাইরের কেউ ডিকটেট করতে পারে না।’
চোখ দু’টি যেন জ্বলে উঠল সান্ড্রা সুসানের। বলল, ‘সামান্য একজন নেটিভের খুব বাড় তো দেখছি! আমি বাইরের লোক কে বলল তোমাকে। তামাহি মাহিন আমাদের ওখানে চাকরি করে। সে এখন আমাদের লোক।’
‘নেটিভ!’ শব্দটি খুব আঘাত করেছিল মারেভা মাইমিতিকে। তার র্স্বণালী চেহারা অপমানে লাল হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘তুমি কিন্তু ‘নেটিভ’দের দেশে এসেছ, আমি কিন্তু অনেটিভদেরই একজন। আর শোন আমি তোমার কোন ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না, আমি পছন্দ করব না আমার কোন ব্যাপারে তুমি নাক গলাও।’
সান্ড্রা সুসানের দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। তার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে হাত দু’টি। বলল সে চাপা তীব্র কন্ঠে, ‘কথা তুমি অনেক বড় বলে ফেলেছ।এর উপযুক্ত জবাব আমি দিতে পারি, কিন্তু আজ নয়। আমি তোমাকে শেষ বারের মত সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি তামাহি মাহিনের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এবং সেটা আজ থেকেই। তা না হলে তোমার পরিণতি কি হতে পারে তা তুমি কল্পনা করতে পারছ না্।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলল গাড়ির দিকে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসতে সে বলল, ‘মাহিন, এ মেয়েটাতে খুব বেয়াদব? কথা বলতেও জানে না। এ রকম মেয়ের সাথে বসে বসে কথা বল কি করে তুমি! যাক ভালো করে শাসিয়ে দিয়েছি।’
তামাহি মাহিনের মুখটা অসন্তুষ্টিতে ভরে গেল। কিন্তু কোন কথা বলল না সে।
সান্ড্রা সুসান একবার তাকাল তামাহি মাহিনের দিকে। তার চোখে একটা চকচকে দৃষ্টি। চোখ ফিরিয়ে সে তাকাল সামনে। দু’হাত সে চেপে ধরল ষ্টেয়ারিং হুইল। ঠোঁটে একটা ঠান্ডা হাসি।
গাড়ি চলতে শুরু করল।

অফিসে বসের আচরণে তামাহি মাহিন খুব পেরেশান হয়ে পড়েছিল। সে সোজা চলে এসেছে মারেভাদের বাড়িতে।
গাড়ি থেকেই তামাহি মাহিন দেখল মারেভা মাইমিতি গেট দিয়ে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করছে।
‘মারেভা।’ ডাকল তামাহি মাহিন।
থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল মারেভা মাইমিতি। তামাহি মাহিনকে দেখে তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। খরব না দিয়ে, টেলিফোন না করে তো মাহিন এভাবে আসে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর এমন অসময়ে সে কখনও আসে না। উদ্বিগ্ন হলো মারেভা মাইমিতি।
ছুটে এল সে তামাহি মাহিনের কাছে।
সাধারণত দেখা হলেই মাহিনের যে স্বভাজাত হাসির উচ্ছসিত প্রকাশ দেখে তা আজ দেখতে পেল না মারেভা। তার বদলে চোখে-মুখে একটা দুশ্চিন্তার প্রকাশ। আরও উদ্বিগ্ন হলো মারেভা।
‘কি ব্যাপার মাহিন? এমন সময়ে, কোন খবর না দিয়ে? চল ভেতরে।’ বলল মারেভা উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
‘না ভেতরে নয়, চল পাশের পার্কে গিয়ে বসি।’ তামাহি মাহিন বলল।
মারেভা মাইমিতি তামাহি মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাড়িতে এসেও পার্কে গিয়ে কথা বলবে! আশংকিত হলো মারেভা মাইমিতি। কি হলো মাহিনের?’ কিছু ঘটেছে তাহলে?কি সেটা?
‘ঠিক আছে আমি বাসায় বই রেখে আসি। তুমি একটু দাঁড়াও।’ বলল মারেভা মাহিন।
বলে দৌড় দিল সে বাড়ির ভেতরে।
ফিরে এল মিনিট খানেকের মধ্যেই।
তামাহি মাহিনের হাত ধরে বলল, ‘চল।’
মারেভা মাইমিতির বাড়ির পাশ দিয়েই অ্যাভেনিউ ডি পোমেরা। র্পাকটিও এ অ্যাভেনিউ-এর ধারে আর মারেভা মাইমিতিদের বাড়রি পাশেই।
অ্যাভেনিউ হয়ে না গিয়েও মারেভাদের বাড়ি থেকেও পার্কে প্রবেশ করা যায়।
পার্কে ঢুকে একটা গাছ পেছনে রেখে তার ছায়ায় এক বেঞ্চিতে বসল দু’জন, মারেভা ও মাহিন।
‘কি ঘটেছে বলত?’ একটা কথাও বলছ না।’ বসেই মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মারেভা মাইমিতি।
‘ঘটনাটা বলার জন্যেই এসেছি মারেভা।’
বলে একটুক্ষণ চুপ থাকল তামাহি মাহিন। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘সেদিন তোমাকে আমার বস সান্ড্রা সুসান যে থ্রেট করেছিল, আমি গাড়িতে বসেই তা শুনতে পেয়েছিলাম। সেদিন আমি কিছু বলিনি। পরদিন আমি লিখিতভাবে অফিসকে জানাই যে, আগামী মাসের এক তারিখ থেকে আমি আমার কাজ রাখতে পারবো না। এই চিঠিকেই আমার ইস্তেফা পত্র হিসাবে গ্রহন করা হোক।’ আমি অফিস শেষে বাড়ি আসার সময় এই ইস্তেফা পত্র অফিসে দিয়ে আসি।’ থামল তামাহি মাহিন।
‘এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। তুমি ভাল কাজ করেছ। কিন্তু তোমার মুখ মলিন কেন? হাসি নেই কেন মুখে?’ বলল মারেভা মাইমিতি।
মারেভার একটা হাত তামাহি মাহিন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আমি কথা শেষ করিনি মারেভা। আমার ইস্তেফা পত্র ওরা গ্রহণ করেনি। আমি ইস্তেফা পত্র দিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই অফিস থেকে গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যায়। বস অফিসেই বসেছিল। আমাকে দেখে সে হাসল। হাসিটা ঠিক যেন সাপের হাসির মত। বলল, ‘চাকরিতে তুমি ঢুকেছ তোমার ইচ্ছার অধীন। চাকরি ছাড়ার তোমার সুযোগ নেই। অফিসে আসা বন্ধ করলে লোকরা গিয়ে তোমাকে ধরে আনবে। আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও পালিয়ে থাকার সাধ্যও তোমার নেই। আর যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে প্রথমে প্রাণ যাবে তোমার প্রেমিকার। তারপর তোমার। অন্যদিকে আমার কথা মেনে যদি চল তাহলে তোমার, তোমার বাড়ির, পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হবে। এসব কথা সে হাসতে হাসতে বলেছে। সে হাসির ধার আমার কাছে ছুরির ধারের চেয়েও ভয়ংকর মনে হয়েছে।’
থামল তামাহি মাহিন। মুষড়ে পড়া বিধ্বস্ত তার চেহারা।
মারেভা তাকিয়েছিল তামাহি মাহিনের মুখের দিকে। তারও মলিন মুখ উদ্বেগে ভরা।
তামাহি মাহিন থামলেও তখনি কথা বলতে পারল না মারেভা। তার বুক কাঁপছে। কোন মানুষ এমন নির্লজ্জ আর নিষ্ঠুর হয়!
তামাহি মাহিনও নিরব।

অন্ধকারের মত ভারি নিরবতা ভাঙল মারেভাই। বলল, ‘তুমি কি ভাবছ? আপাতত চাকরি না ছাড়লেই তো একটা সমাধান হয়।’
‘অসম্ভব। ওর ওধীনে ভেবে দেখেছ? ওরা জোর করে তোমাকে অফিসে নিয়ে যাবে। না গেলে কি হবে সে থ্রেট তো দিয়েই রেখেছে।’ মারেভা বলল। ওরা তোমার করে বসে?
‘আমি নিজের জন্যে এক বিন্দুও ভাবছি না। ওরা বাড়াবাড়ি করলে আমি আমি পুলিশ কে বলব। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার কথা।যদি কোন ক্ষতি করে বসে?সে থ্রেট তো সান্ড্রা দিয়েছেই।বললাম না ওর হাসিটাও সাপের মত, ছুরির মত। ওরা সব পারে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আমাকে নিয়ে ভেব না। দেশটায় আমাদের আইন এখনও আছে। বাইরের থেকে এসে ওরা আমাদের নেটিভ বলে গালি দেবে, আর যা ইচ্ছা তাই বলবে আর তা আমাদের মেনে নিতে হবে! কিন্তু এখনই গন্ডগোল না পাকিয়ে তুমি আরও কিছু দিন নিরবে চাকরি করে যাও।’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘ভয় ও ঘৃণা দুই-ই সৃষ্টি হয়েছে আমার তার প্রতি। ওর পাশে চাকরির অভিনয় করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অফিসে প্রায় আমরা এক সাথে থাকি। কোন সময় কোন ঘটনা সৃষ্টি করে, কখন কোন অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনে তার ঠিক নেই। আমি কাল থেকেই আর অফিসে যাচ্ছি না।’ তামাহি মাহিন বলল।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে মারেভা ও মাহিন দু’জনেই পেছনে ফিরে তাকাল। দেখলো মারেভার মা তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মারেভারা দু’জনেই উঠে দাঁড়াল।
‘মা, তুমি এখানে?’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘হ্যাঁ, আমি পার্কে অনেকক্ষণ এসেছি। ফেরার পথে তোমাদের দেখে এলাম। তোমরা এখানে কেন? আর তোমাদের এতটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? আসতে আসতে মাহিনের মুখে কার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা, আর কাল থেকে অফিসে আর না যাবার কথা শুনলাম। এসবের অর্থ কি?’ বলল মারেভার মা।
দু’জনেই নিরব। তাকাল একে-অপরের দিকে।
তামাহি মাহিনই কথা বলল, ‘আন্টি, আপনার কাছে কিছুই লুকানো ঠিক নয়। কিন্তু আন্টি তাতে আমাদের মতই আপনার মন খারাপ হবে, উদ্বিগ্ন হবে।’
‘বাছা, ছেলে মেয়েদের উদ্বেগ বাবা-মা শেয়ার করবে না তো কে করবে? বল বাছা, কি হয়েছে তোমাদের?’
তামাহি মাহিন তার অফিসের বস সান্ড্রা সুসানের সাথে কি ঘটেছে, তামাহি মাহিন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সব বলল মারেভার মাকে।
শুনতে শুনতে উদ্বেগে ভরে গেল মারেভার মা’র মুখ। তামাহি মাহিনের কথা শেষ হতেই বলল, ‘মারেভা ঠিক বলেছে চাকরি অব্যাহত রেখে কি করা যায় তা ভাবার সুযোগ নেয়া দরকার। লোক ওরা সাংঘাতিক মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু আন্টি, যে ভয়ের কারণে চাকরি অব্যাহত রাখার কথা বলছেন, যা ঘটেছে তার পর আমি চাকরি অব্যাহত রাখলে সে ভয় আরও বাড়বে। পরে কিছু করতে গেলে তাদের জিঘাংসা আরও বৃদ্ধি পাবে।’ তামাহি মাহিন বলল।
ভাবছিল মারেভার মা। বলল, ‘তোমার কথাও ঠিক মাহিন। তাহলে আমাদের কি করা কর্তব্য? পুলিশকে আমরা বলতে পারি। কিন্তু জানি না বাছা, ফরাসীদের নিয়ন্ত্রিত পুলিশ সাদা চামড়ার সান্ড্রা সুসানদের বিপক্ষে কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা। নেটিভদের অভিযোগ অনেক সময়ই তাদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তবু এটাই একমাত্র বিকল্প। আর এখনি এপথে না গেল আমি যা মনে করি চাকরি অব্যাহত রেখে সময় ক্ষেপণের পথ নিতে হবে।’
‘তারা কি করতে পারে আন্টি? আমার ভয় শুধু মারেভাকে নিয়ে। তাদের জিঘাংসার প্রথম টার্গেট হতে পারে মারেভাই।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আমি ভয় করি না মাহিন। ওরা একটা হুমকি দিয়েছে বলেই আমরা গেয়ে পায়ে পড়ব? কেন এদেশ আমাদের নয়। এরা তো একে একে আমাদের জাতীয় সব কিছুই নিয়ে নিয়েছে, আমাদের ব্যাক্তি সত্ত্বাও আমাদের থাকবে না, তা হয় না। এটাই আমার পরিষ্কার কথা মা। মারেভা মাইমিতি বলল।’ আবেগরুদ্ধ মারেভার কন্ঠ।
মারেভার আবেগ মারেভার মা ও তামাহি মাহিনকেও স্পর্শ করেছে।
মারেভা থামলেও সংগে সংগে কথা বলতে পারলো না মারেভার মা ও তামাহি মাহিন।
নিরবতা ভাঙল মারেভার মা। বলল, ‘মারেভার আবেগ ঠিক আছে। কিন্তু আবেগ দিয়ে সব সময় বাস্তবতার বিচার চলে না। যা হোক, মারেভা তুমি অন্তত কিছুদিন কলেজ যাওয়া বন্ধ রাখ। বিষয়টা নিয়ে কি করা যায় দেখা যাক। আর আমি মনে করি, মাহিনকেও সাবধান থাকতে হবে। তুমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেও না। পারলে বাইরে থেকে বেড়িয়ে এস।’
‘কিন্তু মা, কলেজে যাওয়া কয়েকদিন বন্ধ রাখলেও গাইডের কাজটা বন্ধ রাখতে পারবো না। ট্যুরিষ্টদের পিক সিজন শুরু হয়েছে। আমার এ বছরের রেজিষ্ট্রশনও হয়েছে। কাল থেকেই আমি কাজ শুরু করছি।’ বলল মারেভা।
‘আন্টি, মারেভা এটা করতে পারে। প্রতি বছরই তো করছে। চাকরি ছেড়েছি যেহেতু, আমিও চিন্তা করছি এ কাজে লাগার।’ তামাহি মাহিন বলল।
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারেভার। বলল, ‘তাহলে তুমি কাল নাম রেজিষ্ট্রেশন করাও। এবার একটু কড়াকড়ি। নাম রেজিষ্ট্রেশন না করলে গাইডের কাজ করা যাবে না।’
‘হ্যাঁ, তোমরা যদি এক সাথে কাজটা করতে পারো, তাহলে মন্দ হয় না। সব সময় মানুষ নিয়ে কারবার, মানুষের মধ্যে থাকতে হবে, এর মধ্যে একটা নিরাপত্তা আছে। তবে আসা-যাওয়াটা যাতে দু’জনের এক সাথে হয় তার জন্যে চেষ্টা করো তোমরা।’ বলল মারেভার মা।
‘ঠিক আছে এটা করা যাবে। আমিই মারেভাকে বাসা থেকে নিয়ে যাব।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। একবার ভয়ের কাছে আত্মসর্মপণ করলে এ থেকে আর মুক্তি পাওয়া যাবে না।’ মারেভা বলল।
‘তুমি আর কথা বাড়িও না মারেভা। কোন বিধিবদ্ধ আইন করা হচ্ছে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা তুমি আমি সবাই করতে পারবো।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘ধন্যবাদ তোমাদের। মনে রেখ ভয় থাকাটা সবসময় খারাপ নয়। ভয় মানুষকে সাবধান করে। এর প্রয়োজন আছে। আশা করি তোমাদের মনে থাকবে কথাটা। চল এবার উঠা যাক।’ মারেভার মা বলল।
সবাই উঠে দাড়াল।

পাপেতি বিমানবন্দর।
লাগেজ সার্কেলের বাইরে আউটার।
আউটার লাউঞ্জে সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে মারেভা মাইমিতি। যাত্রী ও ট্যুরিষ্টরা বের হতে শুরু করেছে।
কাঁচের দেয়াল ঘেরা লাগেজ সার্কেল দেখা যাচ্ছে, এদের অধিকাংশই ট্যুরিষ্ট।
সব সময় যা হয় ট্যুরিষ্টদের ধরার জন্যে গাইডদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
আজও সেই কাড়াকাড়ি।
পাশ থেকে বান্ধবী তিউ অন্য সবার সাথে ছুটে গেছে পর্যটকদের দিকে।
মারেভা মাইমিতি যায়নি। সে টানা-হেঁচড়া পছন্দ করে না, সে ভাগ্যে বিশ্বাসী।
তার বন্ধু-বান্ধবীরা, তার পরিচিতজনরা এবং অন্যরা ট্যুরিষ্টদের নিয়ে একে একে চলে যাচ্ছে।
এল তার বান্ধবী তিউ দু’হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে। ‘পেছনে একজন ট্যুরিষ্ট আসছে। কোন গাইড নেয়নি।’ একথা বলে তিউ চলে গেল।
মারেভার তাকাল যেদিকে তিউ ইংগিত করেছিল সেদিকে। দেখল, এশিয়ান এক যুবক। পোষাকে-আশাকে অন্যান্য ট্যুরিষ্টদের মতো বিদঘুটে নয়, পরনে পরিচ্ছন্ন পোষাক। মাথার চুলের আকার ও অবস্থায় কোন স্বেচ্ছাচারিতা নেই। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। আকৃষ্ট হলো মারেভা।
ট্যুরিষ্ট যুবকটি কাছাকাছি আসতেই মারেভা মাইমিতি দু’ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘স্যার মে আই হেলপ ইউ? সার, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
ট্যুরিষ্ট যুবকটি তাকাল মারেভার দিকে।
শান্ত, কিন্তু সাগরের মত গভীর দৃষ্টি ট্যুরিষ্ট যুবকটির চোখে। থমকে দাঁড়িয়েছে সে। মিষ্টি একটা অস্ফুট হাসি ফুটে উঠেছে ট্যুরিষ্ট যুবকটির ঠোঁটে। বলল, ‘ধন্যবাদ, হ্যাঁ আমাকে পথ দেখিয়ে সাহায্য করতে পার।’
‘অনেক ধন্যবাদ স্যার।’
বলে মারেভা মাইমিতি ট্যুরিষ্ট যুবকটির হাত থেকে ব্যাগটি নিতে চাইল।
‘না মিস…….. আমাকে পথ দেখিয়ে সাহায্য করতে বলেছি, ব্যাগ বহন করতে বলিনি। আর আমি তোমার চেয়ে, শক্তিও বেশি হবে নিশ্চয়? সুতরাং ব্যাগ আমরই বহন করা উচিত।’ বলল ট্যুরিষ্ট যুবকটি হাসি মুখে মারেভার দিকে না তাকিয়েই।
ট্যুরিষ্ট যুবকটির কথা শুনে অবাক-বিস্ময় নিয়ে মারেভা তাকাল ট্যুরিষ্ট যুবকটির দিকে। এমন অদ্ভুদ মানুষ সে জীবনে দেখেনি। শোনেওনি কখনো এমন ট্যুরিষ্টের কথা। বলল, ‘স্যার, আমার নাম মারেভা মাইমিতি।’
বলে মারেভা ট্যুরিষ্ট যুবকটির দিকে হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকে জন্যে। এটা তাহিতির একটা কালচার।
ট্যুরিষ্ট যুবকটি হাত না বাড়িয়ে ‘ধন্যবাদ’ বলে জানাল তার নাম, আমি আবু আহমাদ।’
ট্যুরিষ্ট আবু আহমদ।’
ট্যুরিষ্ট যুবকটি আবু আহমদ আসলে আহমদ মুসা। অন্যান্য অনেক সময়ের মত সংগত কারণেই ছদ্মনামের আশ্রয় নিল। তার সন্দেহ সত্য হলে এখানে ছদ্মনামের আশ্রয় নিল সে। তার সন্দেহ সত্য হলে এখানে ছ্দ্মনাম গ্রহণের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
‘আবু আহমাদ’ নামটি মারেভা মাইমিতি শুনল বটে, কিন্তু ধন্যবাদ দিতে পারলো না। আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক না করায় অপমানিত বোধ করল মারেভা মাইমিতি। সে মনে করল ‘গাইড’ বলে তাকে ছোট মনে করা হলো। আবার আহমদ মুসার স্বচছ-সরল মুখ দেখে কিন্তু এটা তার মন মেনে নিতে চাইলো না। যা হোক, এমন আচরণ কোন ট্যুরিষ্টের মধ্যে সে এর আগে দেখেনি। আহত মনটাকে সে বুঝাতে পারল না।
এ সব চিন্তায় একটু দ্বিধায় পড়েছিল মারেভা মাইমিতি। কিঞ্চিত সময় নষ্ট হলো।
পরে মুখে জোর করে হাসি টেনে বলল, ‘চলুন স্যার।’
তারা বেরিয়ে এল কার পার্কে।
‘মিস মারেভা, ট্যুরিষ্টদের ভীড় কম, এমন ভাল হোটেল আছে পাপেতিতে?’ বলল আহমদ মুসা।
পাওয়ার ক্যাপিটাল হয়েছে বা হতে পারে এমন একটা অ্যাটল দ্বীপের সন্ধানে সে এসেছে। ট্যুরিষ্ট নয়, এ অঞ্চলের বা অন্য কোন অঞ্চলের নাগরিকদের সাহচর্য তার দরকার যারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আসে ও যায়।
মারেভা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আছে স্যার, তবে খুব এক্সপেনসিভ। বেশি খরচ বলে ট্যুরিষ্টরা সেগুলোতে যায় না বললেই চলে।’
‘গুড, সে হোটেলগুলোর মধ্যে উপকূলের ধারে এমন একটি হোটেলে চল।’ আহমদ মুসা বলল।
মারেভা একটা বেবিট্যাক্সি ডাকল। সিংগল ট্যুরিষ্টরা সাধারনত এগুলোই ব্যবহার করে।
‘না মিস মারেভা, বেবিট্যাক্সি নয়, ম্যান ট্যাক্সি ডাকুন।’ বলল আহমদ মুসা। তার ঠোঁটে হাসির রেখা।
মারেভা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ম্যান ট্যাক্সি মানে স্যার…!’
‘ফুল ট্যাক্সি, ৪ সীটের ট্যাক্সি। বেবিট্যাক্সি নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথার ধরনে হেসে ফেলল মারেভা।
ওকে স্যার। আমি ফুল ট্যাক্সি ডাকছি। বলল মারেভা।
ট্যাক্সি নিয়ে এল মারেভা।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে হাতের ব্যাগটা পেছনের সীটে রেখে সামনে ড্রাইভারের পাশের সীটে গিয়ে বসল।
বিস্মিত মারেভা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। এ রকমটা রকটা রীতি নয়। ট্যুরিষ্ট, অতিথিরা যারা আসেন তার এরকম করেন না। গাইড বসে ড্রাইভারের পাশের সীটে, ড্রাইভারকে গন্তব্য বলতে হয় তাকেই। আর ট্যুরিষ্ট, অতিথি একজন হলেও পেছনের সীটেই বসেন।
আহমদ মুসা সীটে বসে বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকা মারেভাকে বলল, ‘তুমি পেছনের সীটে বস। স্যরি, তুমি বলে ফেললাম!’
বিস্মিত মারেভা পেছনের সীটে গিয়ে বসল।
মনে মনে বলল, ‘কি পাগলরে বাবা। সব উল্টো কাজ। আমাকে পেছনের বসাল। একটুও ভাবল না যে, তাহলে আমিই গাড়ির মনিব হয়ে গেলাম। দু’সীটের হলেই যেখানে চলে সেখানে চরগুণ ভাড়া দিয়ে নিল ক্যাডিলাক কার। ট্যুরিষ্টদের প্রিয় হোটেল নিল না, নিল সবচেয়ে এক্সপেনসিভ হোটেল। টাকা আছে না হয় খরচ করল, কিন্তু এসব পাগলামি কেন? হ্যান্ডশেক করে না, বিশেষ করে মেয়েদের সাথে! এমন আজব লোক আমি জীবনে দেখিনি কোন দিন।
গাড়ি চলছে পাপেতির প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে।
এক সময় আহমদ মুসা মুখ পেছন দিকে না ফিরিয়েই মারেভাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি যেন হোটেলের নাম বললে? কোন নাম কি বলে দিয়েছ আমাদের এই কার-মালিক ভাইকে?’
‘বলে দিয়েছি স্যার। হোটেলের নাম ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ তাহিতি’। উনি হোটেলটি ভাল করে চেনেন স্যার।’ বলল মারেভা।
‘একটু বেশি দামী। কিন্তু চমৎকার সিলেকশন, স্যার। পাহাড়ী নদী টাওনার মোহনায় ঐতিহাসিক বদ্বীপের উপর হোটেলটি। হোটেলটির পা ধুয়ে দিচ্ছে বিস্তৃত টাওনা লেক। লেকটার চারদিকেই কোরাল রীফ। কিন্তু ডান-বাম দু’টি দিকেই প্রশস্ত পথ আছে বেরিয়ে যাবার। আর সামনে সাগরের দিকটাই বেশি খোলা।’ বলল গাড়ির ড্রাইভার।
‘বদ্বীপকে ঐতিহাসিক বলছেন কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ।
‘স্যার, ১৮৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত তাহিতির পোমা রাজবংশের অবকাশকালীন প্রাসাদ ছিল এই বদ্বীপে। তাহিতি দ্বীপ ও এই অঞ্চলকে ফরাসীরা ফ্রান্সের অংগীভূত করে নেবার পর অনেকদিন রাজার লোকরা এই প্রাসাদে ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে প্রাসাদ বিরান হয়ে যায়। এই প্রাসাদের ধ্বংসস্তুপের উপর রাজকীয় স্ট্যাইলে লা ডায়মন্ড ড্রপ হোটেলটি তৈরি হয়েছে। আপনি…..।’
হঠাৎ থেমে গেল ড্রাইভার। থেমেই সে আসার বলে উঠল, ‘আমরা লা ডায়মন্ড ড্রপে এসে গেছি স্যার।’
লেকের দিকে মুখ করে হোটেলটি তৈরি।
হোটেলের বিশাল গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। চারদিকে তাকিয়ে চমৎকৃত হয়ে গেল সে। তিন দিক থেকে লেক ঘিরে আছে হোটেলটিকে। লেকের ডান-বাম দু’দিকেই দেখা যাচ্ছে কোরাল প্রাচীর। সে সামনেও মাইল খানেক দূরে দেখা যাচ্ছে কোরাল প্রাচীরের মাঝখানে একটি প্রণালী লেককে সাগরের সাথে এক করে দিয়েছে। প্রণালীর দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রশান্ত সাগরের অন্তহীন নীলবুক।
দৃষ্টি ফিরে এলে বদ্বীপের পাশ দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ী নদী টাওনাকে দেখতে পেল। অদ্ভূদ সুন্দর মিলনের এই দৃশ্যটি। পাহাড়ী নদীর চঞ্চল সফেদ স্রোত অবিরাম এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে লেকের নিরব-নিস্তরঙ্গ কালো বুকে।
‘সত্যি অপরূপ এই পরিবেশ, যা শুধু উপলদ্ধিই করা যায়, ভাষায় এর বর্ণনা চলে না।’ বলল অনেকটা স্বগতকন্ঠে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে মারেভা মাইমিতি।
আহমদ মুসা ‘ধন্যবাদ’ বলে মারেভার হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে বলল, ‘গাড়ি এখন ছেড়ে দেব মারেভা?’
‘আপনি কখন বেরুতে চান? আপনার কি প্রোগ্রাম?’ বলল মারেভা।
‘না, বিকেলের আগে বেরুচ্ছি না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে গাড়ি ছেড়ে দিন।’ মারেভা বলল।
‘ভাড়া কত দিতে হবে মারেভা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘মাইলের হিসাবে গাড়ির মিটারে ২০ ডলার ভাড়া উঠেছে স্যার।’ মারেভা বলল।
আহমদ মুসা ৫০ ডলারের একটি নোট বের করে মারেভাকে দিয়ে বলল, ‘ওকে পুরোটাই দিয়ে দাও’
ড্রাইভার ভাড়া ও আশাতীত বখশিস পেয়ে হয়ে বলল, ‘স্যার, গাড়ি দরকার হলে যখন আসতে বলবেন আসতে পারি স্যার।’
‘ধন্যবাদ, আপনার টেলিফোন নাম্বার মারেভাকে দিয়ে যান। আমরা আপনাকে ডেকে নেব। কথন ফ্রি পাওয়া যায় আপনাকে, নাম কি আপনার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আমার নাম, তেপাও।’ এরপর ড্রাইভার ‘ধন্যবাদ’ বলে দীর্ঘ একটা বাও করে গাড়িতে উঠল।
আহমদ মুসা ‘এস মারেভা’ বলে হাঁটা শুরু করল হোটেলে ঢোকার জন্যে।
বুকিং কাউন্টারে গিয়ে আহমদ মুসারা জানতে পারল হোটেলে হাউজ ফুল। একটামাত্র ডবল ডিলাক্স রুম খালি। তাও হোটেলের পেছনের অংশে। এ দিক থেকে লেকের বা সাগরের দৃশ্য উপভোগ করা যায় না। তবে পেছন দিকে হোটেলে আঁকা-বাকা রাস্তাসহ পাহাড়ী ল্যান্ড-স্পেসটা দেখা যায়।
‘এত ভীড় এমন দামী হোটেলেও!’ আহমদ মুসার এমন স্বগতোক্তির জবাবে বুকিং অফিসার বলল, ‘স্যার এটা আমাদের পাপেতির সৌভাগ্য যে, গোটা ফ্রেন্স পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্র যেমন তাহিতি দ্বীপ, তেমনি এর হার্ট হলো পাপেতি। সুতরাং ফ্রেন্স পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে ব্যবসায়, ভ্রমণ বা যে উদ্দেশ্যেই আসুন তার গেটওয়ে, অবস্থান স্থল ও ডিপারটার দরওয়াজা এই পাপেতি। ভীরটা এ কারণেই স্যার।’
‘ধন্যবাদ’ দিয়ে আহমদ মুসা পেছন দিকের খালি ডবল ডিলাক্স কক্ষটিই নিয়ে নিল।
চাবিটি নিয়ে মারেভা ফ্লোরে রাখা আহমদ মুসার ব্যাগটি তুলে নিল। বলল, ‘আসুন স্যার’।
আহমদ মুসা মারেভার হাত থেকে ব্যাগটি নিতে গেলে মারেভা ত্বরিত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘ছোটরাও বড়দের ব্যাগ বহন করে স্যার, বড়দের সম্মান ও নিজেদের ধন্য করার জন্যে।’
মারেভা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে লাগল লিফটের দির্কে। বলল, ‘আসুন স্যার।’
হোটেলের দশতলায় রুমটা। চাবি দিয়ে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করল মারেভা। প্রবেশ করল আহমদ মুসাও। মারেভার পেছনে পেছনে। দরজা খোলা রেখেই এল আহমদ মুসা। বিশাল কক্ষ।
দরজা দিয়ে ঢুকেই হাতের বামে বড় টয়লেট। ডান পাশে কাপড়-চোপড় রাখার বড় সেলফ। তার পাশে লাগেজ বেঞ্চ। মাঝখানে শর্ট করিডোর। ভেতরে আর একটু এগোলে ডান দিকে দু’টো বেড পাশাপাশি। বেডে ওপারে একটা সোফা সেট, তার সাথে ‘টি-টেবিল।’ সোফা সেটের বিপরীত দিকে ঘরের ওপাশে লম্বা টেবিল দেয়ালের সাথে সেঁটে রাখা।
তার সাথে দু’টি চেয়ার। টেবিলটির উপর এক প্রান্তে ফলের একটা বাস্কেট। টেবিলের পাশে একটা মিনি ফ্রিজ।
ঘরে প্রবেশ করে মারেভা হাতের ব্যাগটি দেয়ালের সাথের টেবিলটিতে রেখে বলল, ‘স্যার, আমি বাতিগুলো, টয়লেট, এসি’র কন্ট্রোলটা একটু দেখে নেই।’
ঘুরেই মারেভা খোলা দরজা দেখে বলল, ‘স্যরি, দরজা খোলা আছে লাগিয়ে দিয়ে আসি।’
এগোবার জন্যে পা তুলল মারেভা।
‘না দরজা খোলা থাকবে মারেভা।’ বলল আহমদ মুসা।
সোফায় বসে জুতা খুলছে আহমদ মুসা।
বিস্মিত চোখে তাকাল মারেভা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘দরজা খোলা থাকবে কেন? এভাবে কেউ খোলা রাখে না। এটা দেখতে অড লাগে এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন তো আছেই।’
‘এখন দরজা খোলা থাকুক মারেভা! আর ওসব চেক করতে হবে না। আমি সব দেখে নেব। তুমি ঐ চেয়ারটায় বস। কয়েকটি বিষয় একটু জেনে নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
ঘরের ও প্রান্তে দেয়ালের সাথের টেবিলে যে রাইটিং চেয়ার আছে, সেটাই দেখিয়ে দিল আহমদ মুসা মারেভাকে বলেছে বসার জন্যে।
মারেভার চোখ মুখের জিজ্ঞাসু ভাব কাটেনি। সে ধীরে ধীরে গিয়ে চেয়ারে বসল। বলল, ‘বলুন স্যার।’
আহমদ মুসা জুতা খুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে। ভাবছিল। আধ খোলা তার চোখ। ঐ অবস্থায় বলল, ‘তাহিতির সবচেয়ে সুন্দর কি মারেভা?’
‘উপকূলের রাস্তা ধরে সাগর আর পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ড্রাইভ করা।’ বলল মারেভা।
‘আর কি আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসা।
‘উপকূলে লেগুনের ওপারে কোরাল রীফের উপর কটেজগুলোতে জোৎস্না রাতে আদিগন্ত সাগরের দিকে চেয়ে থাকা।’ বলল মারেভা।
‘এরপর কি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঐ কটেজগুলোতে বসে জোৎস্নাবিহীন রাতে আকাশে তারার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া এবং অন্ধকার সাগরবক্ষে কান পেতে সাগরের নি:শব্দ ভাষণ শোনা।’ মারেভা বলল।
‘ঐ কটেজগুলোতে বসে জোৎস্নাবিহীন রাতে আকাশে তারার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া এবং অন্ধকার সাগরবক্ষে কান পেতে সাগরের নি:শব্দ ভাষণ শোনা।’ মারেভা বলল।
‘আর কিছু আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তাহিতির সর্ব্বোচ পাহাড় চড়ায় উঠে প্রশান্ত মহাসাগরকে দেখা।’ বলল মারেভা।
সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি। তার চোখ দু’টি খবরের কাগজে। বলল, ‘আমি তো তাহিতির আলোচনা বা বর্ণনায় এসবের কথা পড়িনি। কোথায় পেলে এসব?’
‘এগুলো আমার নিজস্ব চয়েস।’ বলল মারেভা।
‘তুমি কি গল্প-কবিতা লেখ?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘আমি গল্প-কবিতার ভাল পাঠক স্যার।’ মারেভা বলল।
‘এগুলো পাঠকের কথা নয়, লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। থাক, তাহিতির কথা তো শুনলাম। এখন গোটা ফ্রেন্স পলিনেশিয়ার কথা বল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলুন স্যার, কি জানতে চান।’ মারেভা বলল।
‘ফ্রেন্স পলিনেশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দর্শনীয় বস্তু কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নি:সন্দেহ স্যার, এর অ্যাটলগুলো। এটা আমার শুধু নয়, সবার চয়েস।’ মারেভা বলল।
‘তুমি কি অ্যাটলে কি লোকজন আছে। তোমরা গেছো, সেটা কি কোন দরকার?’ আহমদ বলল।
‘কোন দরকারে নয় স্যার, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে স্রেফ বেড়াতে গেছি।’ বলল মারেভা।
‘আচ্ছা, অ্যাটলগুলো কার মালিকানায়, এখানকার সরকারের?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না স্যার, অ্যাটলগুলোর মালিক কেন্দ্রীয় ফরাসি সরকার। আমাদের লোকাল সরকার তাদের দেয়া আইনের অধীনে শুধু দেখা-শুনা করে।’ বলল মারেভা।
‘আচ্ছা, অ্যাটল কেউ কিনতে বা লীজ নিতে কিংবা খাজনার ভিত্তিতে পত্তনি নিতে পারে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘জানতাম যে ফরাসি সরকার এভাবে অ্যাটল কাউকে দেয় না। শুধু অনুমতি নিয়ে জমি কিনে বা লিজের ভিত্তিতে বাড়ি করে কেউ বসবাস করতে পারে। তবে সম্প্রতি শুনেছি দু’একটা অ্যাটল নাকি ফরাসি সরকার কিছু শর্তাধীনে বিক্রি বা লীজ দিয়েছে।’ বলল মারেভা।
মারেভার কথা শেষ হয়েছে। আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
এ সময় একজন লোক এসে দরজায় দাঁড়াল। তারপর উপর দিকে তাকিয়ে রুম নাম্বার দেখেই বলল, ‘স্যরি।’
চলে গেল লোকটা।
আহমদ মুসা ও মারেভা মাইমিতি দু’জনেই তাকিয়েছিল দরজার লোকটির দিকে।
লোকটি চলে গেলে মারেভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসি স্যার।’
‘না, মারেভা। দরজাটা খোলাই থাকবে।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বসে পড়ল মারেভা। বলল, ‘দরজা কেন খোলা থাকবে বুঝতে পারছি না স্যার। কারও কি আপনি অপেক্ষা করছেন।’
‘না, কেউ আসার কথা নেই। আচ্ছা মারেভা, বিকেলে তুমি কয়টায় আসতে পারবে?’
‘সেটা আপনিই ঠিক করবেন। যখন চাইবেন, তখনই আমি আসব। আপনি কয়দিন থাকছেন স্যার?’
‘ঠিক আছে, তুমি পাঁচটায় এস। আমি কতদিন থাকব ঠিক নেই। তবে খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছি না।’
কথাটা শেষ করে মুহুর্তকাল থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলল, ‘তোমাদের ‘ফি’ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। ট্যুরিষ্ট গাইডে একটা কিছু দেখেছিলাম। সেটা সম্ভবত অনেক আগের।’
মারেভার সুন্দর স্বর্ণালী মুখে একগুচ্ছ রক্তিম লজ্জা ছড়িয়ে পড়ল। মারেভা এখনও পেশাদার গাইড হয়ে উঠতে পারেনি। তবুও ‘ফি’ এর কথা জানাতে হয়, তাই সেও জানায়। কিন্তু তার কাছে আহমদ মুসা এক বিস্ময়কর মানুষ। এমন সভ্য-ভব্য সুন্দর ট্যুরিষ্ট সে এর আগে কখনও দেখেনি। অন্য ট্যুরিষ্টদের চকচকে দৃষ্টি ও ঘনিষ্টতাকে সব সময় এড়িয়ে চলতে হয়। আর এই অদ্ভূত লোকটিই তার চোখের দৃষ্টিকে আমার থেকে আড়াল করে রাখছে। এক দু’বার ছাড়া মারেভার চোখে সে চোখই ফেলেনি। এক দু’বার দেখার মধ্যেই লোকটির চোখে যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা দেখেছে তা চিরদিন স্বরণ রাখার মত। এমন লোকটিকে ‘ফি’র কথা বলতে তার লজ্জা লাগছে। এসব ভেবে মারেভা বলল ‘ফি’র একটা আউট লাইন তো পেয়েছেনই। আমি কিছু বলতে চাই না, স্যার। আপনি আমাদের অতিথি। আমি আনন্দের সাথে আপনাকে সহযোগিতা করব।’
‘ধন্যবাদ, মারেভা। তাহলে এই কয়েকটা টাকা তুমি অগ্রীম রাখ।’ বলে আহমদ মারেভার হাতে একটা ইনভেলাপ তুলে দিল।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলে মারেভা না দেখেই তা পকেটে রেখে দিল।
‘তাহলে আসি স্যার।’ বলে ‘গুডবাই’ জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মারেভা যাবার জন্য।
মারেভা দরজার কাছে পৌছতেই আহমদ মুসা বলল, ‘প্লিজ মারেভা, দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।’
মারেভা ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাব!’ মারেভার চোখে নতুন এক বিস্ময়!
‘হ্যাঁ, মারেভা। এরপর একা থাকবো তো। ভয়ের ব্যাপার আছে।’ বলল আহমদ মুসা। তার ঠোঁটে হাসি।
মারেভা আহমদ মুসার কথার কোন জবাব দিল না। তার চোখের দৃষ্টি গভীরতর হলো। কিন্তু সে দৃষ্টিটা আহমদ মুসার অবনমিত চোখে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। আহমদ মুসার কথা বিশ্বাস করেনি মারেভা। কিন্তু সত্যটা কি তাও বুঝতে পারল না সে।
বাড়িত ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে তার ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে মারেভা।
মারেভার মা ঘরে ঢুকল। বলল, ‘মাকে খুব খুশি দেখছি। কাজ পেয়েছিস বুঝি? অনেক ট্যুরিষ্ট এসেছে?’
‘হ্যাঁ মা, কাজ একটা পেয়েছি। কিন্তু মা ….।’
বলে উঠে ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘কিন্তু লোকটা আজব!’
‘কেমন?’ জিজ্ঞাসা মায়ের।
‘লোকটা আমার সাথে হ্যান্ডশেক করেনি। আমি হাত বাড়ালে, সে হাত সরিয়ে নিয়েছে। আবার তা ব্যাগ বহন করতে চাইলে বলেছে আমি তোমার চেয়ে বড়, শক্তিও নিশ্চয় বেশি হবে। অতএব, ভারটা আমারই বহন করা উচিত। আর দেখ, ট্যাক্সিতে উঠে সে ড্রাইভারের’
পাশে বসল এবং আমাকে পেছনের সীটে বসতে বাধ্য করল। তারপর মা, হোটেলের রুমে ঢুকের দরজা বন্ধ করতে বলল না। আমি বন্ধ করতে চাইলেও বন্ধ করতেই দেয়নি। কিন্তু আমি যখন চলে আসছিলাম, তখন বললেন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে যেও।’ বলল মারেভা।
তার মা মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল। তার চোখে-মুখে কিছু বিস্ময়, কিছু ভাবনাও।
মারেভা থামলে সে বলল, ‘লোকট কি রকম, কেমন বয়সের?’
‘একদম স্লীম যুবক মা। মনে হয় ব্যায়াম-ট্যায়াম করেন। মনে হলো বেশ কিছু দিন থাকবেন, অ্যাটল অঞ্চলে ঘুরবেন।’
‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লোক সে, কেমন হলো তাকে? বলল মারেভার মা।’
‘খুবই ভদ্রলোক মা। স্বল্পভাষী, কারও উপর নির্ভশীল হতে চায় না। কেমন বলতে, যদি তুমি চরিত্রের কথা বুঝিয়ে থাক, তাহলে এর উত্তর দেওয়াটা মুস্কিল। চোখের দৃষ্টি থেকেই মানুষের মনের কথা বুঝা যায়। কিন্তু তাঁর চোখে চোখ ফেলা মুস্কিল। উনি চোখ নামিয়ে শান্তভাবে কথা বলেন। মাত্র বার দু’য়েক উনি সরাসরি তাকিয়েছেন আমার দিকে। বহু মানুষ, বহু ট্যুরিষ্টের চোখের দৃষ্টি আমি দেখেছি মা। সে দৃষ্টিতে আমি একটা লেহনভাব দেখেছি, যা চোখকে পীড়া দেয়, মনকেও। কিন্তু যতটুকু দেখেছি তাতে তার দৃষ্টিকে আমার কাছে গভীর শান্ত সাগরের মনে মতো হয়েছে। ঐ দৃষ্টি মানুষকে পীড়া দেয় না, প্রসন্ন করে।’ মারেভা বলল।
মারেভার মা একটু হাসল। বলল, ‘বেশি প্রশংসা করে ফেলছিস মা। ঐ টুকু পরিচয়ে অত প্রশংসা চলে না। তবে একথা ঠিক, লোকটি অন্যদের থেকে ভিন্ন। নিজের লাগেজ নিজে বহন করেছে, এটাকে আমি খুব বড় মনে করছি না। মানবতার ব্যাপারে সেনসেটিভ কেউ একজন এটা করতে পারে। কিন্তু হ্যান্ডশেক করল না কেন? অহংকার থেকে কেউ এটা নাও করতে পারে। কিন্তু তোমার কথায় যা বুঝা গেল তাতে তার মধ্যে অহংকার নেই। অহংকার থাকলে লাগেজ বহন করবে কেন? সুতরাং এ বিষয়টি হোটেলের দরজা খোলা রাখার বিষয়টির মতোই দুর্বোধ্য। আমার তুমি চলে আসার সময় দরজা বন্ধ করতে বলল কেন?’
একটু থামল মারেভার মা। ভাবছিল। মূহুর্ত কয়েক পরেই সে বলল, ‘তুমি যতক্ষণ ঘরে ছিলে ততক্ষণ ঘরের দরজা খোলা ছিল। তুমি চলে আসার পর তা বন্ধ হলো। মজার ব্যাপার। এর অর্থ কি?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন, মা, এর অর্থ কি?’ বলল মারেভা।
মারেভার মা উঠছিল।
‘না মা, একটু বস। আমার আজকের ইনকাম দেখে যাও। কিছু টাকা তিনি অগ্রীম দিয়েছেন। দেয়ার পর আমি পকেটেই রেখে দিয়েছি। আমিও দেখিনি।’
বলে মারেভা উঠে গিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে খামটা নিয়ে এল। বসল মায়ের পাশে। খামটি খুলতেই চমকে উঠল। দেখল অনেকগুলো মার্কিন একশ ডলারের নোট। গুনে দেখল দুই হাজার ডলার। তার মানে চার হাজার তাহিতিয়ান ফ্রাংক। বলা যায়, এট ট্যুরিষ্ট সিজনের তা দুই মাসের আয়। অবাক বিস্ময় নিয়ে মারেভা টাকাগুলো মা’র হাতে দিয়ে বলল, ‘মা দেখ, লোকটার আরেক পাগলামি।’
টাকাগুলো দেখে মারেভার মা বলল, ‘পাগলামি নয়, গাইডদের পারিশ্রমিক সম্পর্কে হয়তো তার কোন ধারনা নেই।’
না মা, গাইডের পারিশ্রমিক সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি বলিনি, কিন্তু তাহিতিয়ানের অতীতের পারিশ্রমিক সম্পর্কে তিনি জানেন বলেছিলেন।’ মারেভা বলল।
‘যাক, এর ব্যাখ্যা উনিই দিতে পারেন। এটা খুব বড় বিষয় নয়। হয়তো তিনি টাকাটা একবারেই দিতে পারেন। অথবা হতে পারে, তিনি অনেক দিন থাকবেন তাহিতিতে।’ বলল মারেভার মা।
‘হ্যাঁ মা, উনি বেশ কিছুদিন থাকবেন বলেছেন।।’ মারেভা বলল।
‘এটাই আসল ঘটনা মারেভা।’ হেসে বলল মারেভা মা।
বলে মারেভার মা টাকাগুলো মারেভার হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মারেভা আর একবার গা এলিয়ে দিল ইজি চেয়ারে।

Top