৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

তাহানিয়া দ্বীপ তন্ন তন্ন করে খুঁজল আহমদ মুসা। কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই পেল না।
তাহানিয়া একটা নিরেট অ্যাটল দ্বীপ।
কোন জনবসতি নেই এই দ্বীপ।
তবে এই অ্যাটল দ্বীপ একটা ট্যুরিষ্ট স্পট। প্রায় ৭৫ টির মত অ্যাটল দ্বীপ নিয়ে গঠিত তোয়মতো দ্বীপ পুঞ্জে যে ট্যুরিষ্ট রুট রয়েছে তার একটা কেন্দ্র এই তাহানিয়া। বিচিত্র রংয়ের কোরাল ও মাছ দেখা এবং দীর্ঘ লেগুনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যে পর্যটকরা এখানে আসেন। কিন্তু তাহানিয়া অ্যাটলের চার প্রান্ত ঘিরে মাটির যে সীমান্ত রয়েছে তা এতই সংকীর্ণ যে সেখানে কোন স্থাপনা তৈরিই সম্ভব নয়। সুতরাং এ অ্যাটলে কোন স্থাপনা গড়ে ওঠার কোন প্রশ্নই নেই। মাহিনের কোম্পানির যে সাপ্লাই গোডাউন তা তাহানিয়ার পশ্চিম সীমানার বেশ কিছুটা প্রশস্ত। ঐ স্থানটিতেই গড়ে তোলা হয়েছে দ্বিতল সাপ্লাই গোডাউন। গোডাউনটিতে এসি লাগানো।
বোটে বসেই দেখছিল আহমদ মুসা তাহানিয়া অ্যাটল দ্বীপকে।
আহমদ মুসার পরনে খৃষ্টান ফাদারের পোষাক। তামাহি মাহিনের পরনেও তাই। আর মারেভা পরছে খৃষ্টান ‘নান’-এর পোষাক।
‘মারেভা, মাহিন! মিশন বোধ হয় আমার ব্যর্থ হলো। তাহানিয়া তো দেখছি সর্ব প্রকার বসবাসের অযোগ্য একটা অ্যাটল আচ্ছা, তোমরা কি জান, এই তাহানিয়া দ্বীপের মালিক কে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব দ্বীপের মালিক তো ফরাসি সরকার। তাহানিয়ার মালিকও তারাই হবেন।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তোমাদের কোম্পানি তাহানিয়াতে এভাবে গোডাউন তৈরি করল কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এভাবে স্থাপনা গড়ার জন্য কোন অ্যাটলের অংশ বিশেষ, এমনকি পুরো অ্যাটলও লীজ নেয়া যায়। নিশ্চয় কোম্পানি তাহানিয়ার এই জায়গাটা গোডাউন তৈরির জন্য লিজ নিয়েছে। আমি শুনেছি, পাশের ছোট্ট অ্যাটল মতুতংগারর গোটাটাই তার লিজ নিয়েছে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘মতুতুংগা গোটাটাই লিজ নিয়েছে? কোনটা সে দ্বীপ?’ আহমদ মুসা বলল। তার চোখের অনুসন্ধিৎসা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।
‘তাহানিয়ার দক্ষিণ পাশে একেবারে লাগোয়া। বোটে দাঁড়ালেও অ্যাটলটা আপনার চোখে পড়বে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সে অ্যাটল দ্বীপটা কেমন? ল্যান্ড বেল্ট কেমন সে অ্যাটলের?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। প্রবল আগ্রহ ঝরে পড়ল তার কন্ঠে।
‘স্যার, বলেছি তো দ্বীপটা তাহানিয়ার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। অ্যাটলের চার পাশের ল্যান্ড বেল্টের আয়তন তাহানিয়ার চেয়ে ভাল নয়। মতুতুংগা নামে এই অ্যাটল দ্বীপটিতে মানুষ বাস করে না।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তাহলে তোমাদের কোম্পানি ছোট্ট এই অ্যাটলটি কিনল কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও বুঝতে পারছি না কিনল কেন? ঐ দ্বীপ এমন কিছু নেই যা কাজে লাগতে পারে, অর্থকরি হতে পারে।’
তামাহি মাহিনের এই কথাগুলো আহমদ মুসার কানে গেল না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে সে। তামাহি মাহিনের কোম্পানিই যে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। তাদের ঘাঁটি যে তোয়ামতো দ্বীপপুঞ্জের কোন অ্যাটলে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এই তাহানিয়া দ্বীপ নিয়ে কোন রহস্য আছে। তাও বলা যায় নিশ্চিত করেই। এই দ্বীপে এই ছোট বেঢপ গোডাউন এখানে হলো কেন? এখান শাক-শব্জির চালান কোথায় যায়? গোডাউন এখানে হলো কেন? তাহলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সেই ঘাঁটি আশে-পাশেই কোথাও! মানব বসতিহীন, উপযুক্ত ভূমির সুযোগ নেই এমন ছোট এই অ্যাটল মতুতুংগা ওরা লীজ নিল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই আছে। কি সে জবাব?
আহমদ মুসা যখন ভাবনা আর অনেক প্রশ্নের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন তার পাশের ব্যাগ থেকে ভেসে আসা মাল্টিওয়েভ সিগন্যাল মনিটরিং (MOSM) বিপ বিপ শব্দ করে তার ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিল। জেগে ওঠা বা সতর্ক হবার এক প্রচন্ড প্রবাহ খেলে গেল তার সারা দেহে।
এই মাল্টিওয়েভ সিগন্যাল মনিটরিংটি (MOSM) অ্যাকটিভ করেছিল।
মাল্টিওয়েভ মনিটরিং এর বিপ বিপ শব্দ শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। অনেক পরে হলেও প্রয়োজনীয় এ যন্ত্রটির মিষ্টি বিপ বিপ শব্দ তার কানে বাজে। কিন্তু এখানে বিপ বিপ শব্দ আসবে কোথেকে? চারদিকে অথৈ আদিগন্ত সাগর। চারদিকের অ্যাটলগুলেত তেমন জনবসতিই নেই, ওয়েব সিগন্যাল কোথা থেকে আসবে?
পাশের ব্যাগ থেকে মাল্টিওয়েভ মনিটরিং ‘মম’ বের করে নিয়ে কল অন করে রেকর্ডে চাপ দিয়ে কানে ধরল। একটা শক্তিশালী কন্ঠের স্পষ্ট কথা ভেসে এল, ‘SOS’ সেভ আওয়ার সোল, উই আর সেভেনটি সিক্স (আমাদের বাঁচান, আমরা ৭৬জন)।’ কথাটা উচ্চারণের পরেই আকস্মিক তা বন্ধ হয়ে গেল। যেন সশব্দে কিছু আছড়ে পড়ে লাইন কেটে গেল।
আহমদ মুসা বার বার হ্যালো করে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করলো, কিন্তু লাইন আর ফিরে এলো না।
হতাশ আহমদ মুসা ‘সেভ’ বাটনটি টিপে ‘মম’টি রেখে দিল।
স্তম্ভিত বাকহীন অবস্থা আহমদ মুসার। তার শূন্য দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। এই ‘এস ও এস’ কাদের আর্তনাদ? ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট যাদের আটক রেখেছে, তাদের সংখ্যা তো এ রকমই। কোথেকে এল এই এস ও এস? তা এক বর্গমাইলের মধ্যে হবে নিশ্চয়। এর অর্থ ই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জেরই কোন অ্যাটল থেকে এসেছে এই এস ও এস।
বিস্ময় ও উদ্বেগ ভরা দৃষ্টি নিয়ে মারেভা ও মাহিন তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের মনেও অনেক প্রশ্ন, তাদের স্যারকে এখানে কে ম্যাসেজ পাঠাল। হটাৎ তা আবার কেটে গেল? কল পাবার পর তাদের স্যার এমন স্তম্ভিত ও বাকহীন হয়ে গেল কেন? কখনও কোন বিপদেই তো তাকে এমন অবস্থায় দেখিনি!
অস্বাভাবিক একটা নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল মারেভাই। বলল, ‘স্যার, কোন খারাপ কিছু? আমরা কি জানতে পারি?’
মুখ তুলল আহমদ মুসা।
মুখ তার গম্ভীর। বলল, ‘আমার মাল্টিওয়েভ মনিটরিং-এ একটা ‘এস ও এস’ ধরা পরেছে। আমি সেটা নিয়েই ভাবছি।’
‘এস ও এস কি?’ এক সাথেই বলে উঠল মারেভা ও মাহিন।
আহমদ মুসা তার মাল্টিওয়েভ মনিটরিং-’মম’ তুলে নিয়ে মেসেজ অপশনে গিয়ে ‘প্লে’তে চাপ দিয়ে লাউড স্পীকার অন করল।
বেশ উঁচু শব্দেই এবার ‘এস ও এস’ স্পষ্ট কানে এল।
‘ও গড! ৭৬জন মানুষের জীবন বিপন্ন? কিন্তু লোকেশন তো বলল না?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তার আগেই তার কন্ঠ বন্ধ হয়ে গেছে। যে অয়্যারলেস বা যে মাধ্যমে কথা বলছিল তা হয়তো তার হাত থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। কথার পরবর্তী শব্দগুলো একথাই বলে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সর্বনাশ! তাহলে বন্দী কিছু লোকের ‘এস ও এস’ এটা।’ বলল মারেভা। তার চোখে মুখে উদ্বেগ।
‘অবশ্যই মারেভা।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় বেদনামিশ্রিত স্থির দৃষ্টি মাহিনের আহমদ মুসার দিকে। বলল সে, ‘এরা কারা স্যার? এর কি তারা যাদের খোঁজে আপনি এ্রখানে এসেছেন?’
‘আমি নিশ্চিত মাহিন এরা তারাই। এই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে তারা ছাড়া এত সংখ্যায় বিপদগ্রস্থ হবার আর কেই নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
আতংক ফুটে ওঠে মারেভা ও মাহিন দু’জনের মুখে চোখেই। মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। বলল মারেভা কম্পিত কন্ঠে আস্তে আস্তে, ‘এত ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি আমাদের অ্যাটলের কোথাও? কিন্তু এমন জায়গা কোথায় স্যার? এই এস ও এস কোথেকে আসল, এই দ্বীপপুঞ্জ থেকেই যে আসল, কি করে বুঝলেন?’
‘আমার এই মাল্টিওয়েভ সিগন্যাল মনিটরিং-এর রেঞ্জ এক বর্গমাইল। এক বর্গমাইলের ভেতরের সিগনাল বা মেসেজই শুধু এই মনিটরে ধরা পড়ে। তার মানে এই এস ও এস এসেছে আমরা যেখানে বসে আছি তার চারদিকের এক বর্গমাইল এলাকার যে কোন এক স্থান থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে হতে পারে স্যার, আমরা ষড়যন্ত্রের আশে পাশেই আছি।’ বলল মারেভা। ভীত ও শুকনো কন্ঠ তার।
‘স্যার, কোন উপায় আছে, মেসেজের উৎস স্থানটিকে লোকেট করার।’ উদ্বেগ জড়িত ফিসফিসে কন্ঠে বলল তামাহি মাহিন।
‘মেসেজ বা সিগনাল চলা অবস্থায় এর উৎস চিহ্নিত করার সহজ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ওল্ড মেসেজ বা সিগন্যালের উৎস চিহ্নিত করতে হলে একটা হলে একটা অংক কষতে হবে। সেটাই আমরা এখন করব।’
বলে আহমদ মুসা তাকাল মারেভার দিকে। বলল, ‘কাগজ কলম নাও মারেভা।’
মাল্টিওয়েভ সিগন্যাল সিগন্যাল মনিটরিং-এ আবার মনোযোগ দিল আহমদ মুসা। এস ও এস মেসেজটি আবার অন করে সাউন্ড অপশনে গিয়ে অটোকাট বাটন চেপে দেখল শতভাগ সাউন্ডের ৭৫ ভাগ শক্তি অক্ষত আছে। তার মানে কাট হয়েছে ২৫ ভাগ।
আহমদ মুসা আবার তাকাল মারেভা দিকে। বলল, ‘আমার এই মাল্টিওয়েভ মনিটরিং-এ সাইন্ডের উৎসে সাইন্ডের শক্তি থাকে হানড্রেড পারসেন্ট। আর সাউন্ডের উৎস থেকে এক পয়েন্ট মানে এক মাইল দূরে এই সাউন্ডের মুভিং পাওয়ার জিরো। এখন হিসেব করো সাউন্ডের পঁচিশ ভাগ মুভিং পাওয়ার যদি লষ্ট হয়, তাহলে পঁচিশ ভাগ সাউন্ড লষ্ট হওয়ার উৎস থেকে সাউন্ডের আসল উৎসটা কত দূরে।’
‘এ আর হিসাব কি করবো স্যার। সোজা হিসাব, উৎসটি চারশ চল্লিশ গজ দূরে।’
‘৪৪০ গজ মানে উৎসটি এখান থেকে ১৩২০ ফুট দূরে। ধন্যবাদ মারেভার।’
বলে আহমদ মুসা মাল্টিওয়েভ সাউন্ড মনিটরিং স্ক্রিণে আবার চোখ নিবদ্ধ করল। এস ও এস মেসেজের অপশনে আবার গিয়ে ডাইরেক্ট বাটনে চাপ দিল। সংগে সংগেই স্ক্রিনে ‘শূন্য এস শূন্য’ (OSO) বর্গ-অংক ভেসে উঠল।
মুখ উজ্জল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘আল-হামদুল্লিহ!’ মারেভা, মাহিন উৎসটি এখান থেকে একদম সোজা দক্ষিণে।’
মারেভা ও মাহিন অনেকটা চমকে উঠেই যেন সোজা হয়ে বসল। তাদের চোখে মুখে ভয় ও আনন্দের অদ্ভূত এক মিশ্র দৃশ্য। তাকাল একে-অপরের দিকে। তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দুই জনের মুখ থেকেই এক বেরিয়ে এল, ‘সোজা দক্ষিণে এই রকম দূরত্বে তো ‘মতুতুংগা’ ছাড়া আর কোন দ্বীপ নেই। প্রায় সমদূরত্বের তেপেতো দ্বীপ সোজা দক্ষিণে নয় দক্ষিণ-পূর্বে।’
‘হ্যাঁ মারেভা, মাহিন! আমি যে দ্বীপের সন্ধানে এসেছি সে দ্বীপ এই মতুতুংগা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এস ও এস-এর দ্বীপ, সেই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের দ্বীপ তাহলে মতুতুংগা! বলল মারেভা ও মাহিন দু’জনে এক সাথেই। তাদের চোখে মুখে আতংক ও আশার এক অদ্ভুত দৃশ্য।’

পরবর্তী বই
প্যাসেফিকের ভয়ংকর দ্বীপে