৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

তাহিতিয়ান চেহারা। কিন্তু মুখের আদলে সাউথ-ইষ্ট এশিয়ান ছাপ আছে। দেখলেই মনে হবে এ মেয়েটিকে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মনে হবে দেখেছি। মিষ্টি একটা চেহারা। কিন্তু পোষাকটা ব্যতিক্রম।
তাহিতিয়ান অবয়বকে দখল করেছে এসে ইউরোপিয়ান পোষাক।
পরণে কালো প্যান্ট। শর্ট সাদা সার্ট। কোমরে সাদা সার্টের উপর ফিতার মতো প্রশস্ত কালো চেইন।
পাশে একটা খাতা পড়ে আছে। হাতে বই। পড়ছে সে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে অভিজাত চেহারার এক তরুণ এগিয়ে আসছে মেয়েটির দিকে, তার পরণে তাহিতিয়ান ট্রেডিশনাল পোষাক। অবয়বেও সে তাহিতিয়ান। কিন্তু তারও চুল, চোখ ও মুখের গড়নে কিছুটা সেমেটিক, কিছুটা মঙ্গলীয় ছাপ।
তরুণটি নিশব্দে এগিয়ে এল।
একেবারে পাশে এসে দাঁড়ালেও টের পেল না তরুণীটি।
তরুণটি মুখ টিপে হেসে তর্জনি দিয়ে টোকা দিল তরুণীটির মাথায়।
চমকে উঠে ফিরে তাকাল তরুণীটি। তরুণকে দেখে মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যরি।’
তরুণটির নাম তামাহি মাহিন পোপা। তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। পার্ট টাইম কাজও করে একটা সাপ্লায়ার প্রতিষ্টানে।
‘তুমি কি ক্লাস শেষ করে এসেছ মারেভা?’
‘তোমার যখন মোবাইল পেলাম, তখন আমি ক্লাসে। আসতে একটু দেরি হলো। খুব জরুরি কিছু?’ বলল তামাহি মাহিন পোপা।
মারেভার পুরো নাম মারেভা মাইমিতি পাপেতি। সে কলেজ অব টেকনলজিতে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রী। অন্যান্য অনেক তাহিতিয়ান ছেলে-মেয়ের মত সেও পার্টটাইম পর্যটক গাইড হিসাবে কাজ করে।
তামাহি মাহিন পোপার সাথে মারেভা মাইমিতির মন দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক তাদের স্কুল জীবন থেকেই। দু’জনে উত্তর পাপেতি শহরের একই স্কুলে পড়ত।
‘জরুরী নয়, কিন্তু তোমাকে বলা দরকার। সেই জন্যেই ডাকা। সান্ডা সুসানের আচরণে আমার খুব অস্থির লাগছে। গতকাল টেলিফোনে আবার সে আমাকে থ্রেট দিয়েছে। আমি তোমাকে আবারও বলছি পার্ট টাইম চাকরিটা তুমি ছেড়ে দাও।’
‘কেন, সান্ড্রা সুসান আবার তোমাকে কি বলেছে?’ শুকনা কন্ঠে বলল তামাহি মাহিন। তার মুখও মলিন।
সান্ড্রা সুসান তামাহি মাহিনের বস। পাপেতির একটা সাপ্লাই অফিসের ষ্টেশন ম্যানেজার। এই অফিসেই তামাহি মাহিন সুপারভাইজিং অফিসার হিসাবে কাজ করে।
‘কি বলবে, সেই একই কথা। গতকাল তো গালিগালাজ করেছে। আর বলেছে আমাকে তোমার পথ থেকে সরে দাঁড়াতে।’ বলল মারেভা মাইমিতি। তার কন্ঠ ভারি।
‘এটা সে অন্যায় করেছে। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। মাইমিতি তোমাকে তো আগেই বলেছি যে, আমি যখনই বুঝলাম সে আমার ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তখনই আমি তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি তোমার আমার সম্পর্কের কথা। আমি তাকে কখনও সামান্য প্রশ্রয়ও দেইনি। সে আমার বস, আমি তাকে আর কি বলতে পারি।’ তামাহি মাহিন বলল। তার কন্ঠে অসহায়ত্বের সুর।
‘কিছু তুমি বলতে পারবে না, সে জন্যেই বলছি তুমি ঐ চাকরি ছেড়ে দাও।’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘চাকরিটা খুব ভাল মারেভা। সকাল ৯টা থেকে ১০টা এই এক ঘন্টা সকালের সব্জি, মাছ, গোশতের কোয়ালিটি পরীক্ষা করে কেনা-কাটার একটা তালিকা তৈরি করে অফিসকে দিতে হয়। আর সন্ধ্যার পর এ ঘন্টা জিনিসগুলো বাইরে ডেলিভারি দিতে হয়। এ সময় প্যাকিংগুলো চেক করতে হয়, যাতে প্যাকিং করা জিনিসগুলোর কোন ক্ষতি না হয়। শেষে ডেলিভারির একটা তালিকা অফিসে আমাকে ফাইল করতে হয়। হঠাৎ কখনও কখনও মালের ডেলিভারির জন্যে আমাকেও বাইরে যেতে হয়। মোটামুটি দুই ঘন্টার চাকরি। কিন্তু আমি পাই ফুল চাকরির বেতন। তবু চাকরি আমার বড় নয়, তুমি বড়। তোমার জন্যে চাকরি কেন, আরও কিছু হলেও তা ছাড়তে রাজি আছি’ তামাহি মাহিন বলল। আবেগরুদ্ধ হয়ে উঠিছিল তার কন্ঠ।
মারেভা মাইমিতি দু’হাত দিয়ে তামাহি মাহিনের একটা বাহু জড়িয়ে ধরে মাথা রাখল তামাহি মাহিনের কাঁধে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে একটা গাড়ি প্রবেশ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে তাদের সামনে এসে ব্রেক কষল।
গাড়ির জানালা খোলা। ড্রাইভিং সীটে একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের শ্বেতাংগ যুবতী। সে তাকিয়ে ছিল তামাহি মাহিনদের দিকে।
তামাহি মাহিনরাও তাকে দেখছিল।
মারেভা মাইমিতি মাহিনের হাত ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসেছিল।
শ্বেতাংগ যুবতী গাড়িতে কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে নেমে এল গাড়ি থেকে। সে আসছিল তামাহি মাহিনদের দিকে।
উঠে দাঁড়াল তামাহি মাহিন। তার মুখে অস্পষ্ঠ একটা বিরক্তির ও বিমর্ষ ভাব।
তামাহি মাহিনের সাথে মারেভা মাইমিতিও উঠে দাঁড়িয়েছে।
শ্বেতাংগ যুবতীটি কাছাকাছি আসতেই তামাহি মাহিন বলল মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে, ‘হাই মিস সান্ড্রা সুসান, কিছু ঘটেছে? জরুরি কোন ব্যাপার?’
‘হাই মাহিন, আমি তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম। পাইনি, তাই আসতে হলো। অফিসে জরুরি কাজ পড়েছে। একটু তোমাকে যেতে হবে চল।’ সান্ড্রা সুসান বলল।
এই সান্ড্রা সুসানই তামাহি মাহিনের অফিসের বস। মেয়েটা শ্বেতাংগ হলেও আকৃতিতে সে ফিলিপাইনি। তার চোখ দু’টিতে নারীসুলভ কমনীয়তার চাইতে রুক্ষতাই বেশি। কথায় দ্বিধাহীন নির্দেশের সুর।
তামাহি মাহিন হাতঘড়ির দিকে তাকাল। তাকাল মারেভা মাইমিতির মলিন মুখের দিকেও। বলল মারেভা মাইমিতিকে, ‘তাহলে আসি আমি। তুমি বাসায় যা্ও। ফিরে এসে আমি কল করব।’ তামাহি মাহিনের কন্ঠে একটু বেপরোয়া ভাব।
সে কথা শেষ করেই তাকাল সান্ড্রা সুসান দিকে। বলল, ‘চলুন মিস সান্ড্রা সুসান।’
‘তুমি গাড়িতে গিয়ে বস আমি আসছি।’ বলল সান্ড্রা সুসান তামাহি মাহিনকে।
মনে মনে আশংকিত হলো তামাহি মাহিন সান্ড্রা সুসান তাহলে মারেভার সাথে কথা বলতে চায়। কি কথা বলবে। আবার গালি-গালাজ করবে নাকি? মনে মনে ক্ষুদ্ধ হলো তামাহি মাহিন। কিন্তু কিছু না বলে সে গাড়ির দিকে চলল।
মলিন মুখে দাঁড়িয়েছিল মারেভা মাইমিতি।
তামাহি মাহিন চলে গেলে সান্ড্রা সুসান দু’ধাপ এগিয়ে মারেভা মাইমিতির মুখোমুখি হলো। সান্ড্রা সুসানের চোখে-মুখে চরম অসন্তোষ ও ক্রোধের প্রকাশ। বলল সে মারেভা মাইমিতিকে, ‘কাল তোমাকে কি বলেছি মনে নেই?’
মারেভা মাইমিতির চোখে-মুখে রুখে দাঁড়াবার ভংগি ফুটে উঠল। বলল, ‘মনে থাকলে কি হবে? আমি মাহিনকে ছেড়ে চলে যাব? আমাদের সর্ম্পককে বাইরের কেউ ডিকটেট করতে পারে না।’
চোখ দু’টি যেন জ্বলে উঠল সান্ড্রা সুসানের। বলল, ‘সামান্য একজন নেটিভের খুব বাড় তো দেখছি! আমি বাইরের লোক কে বলল তোমাকে। তামাহি মাহিন আমাদের ওখানে চাকরি করে। সে এখন আমাদের লোক।’
‘নেটিভ!’ শব্দটি খুব আঘাত করেছিল মারেভা মাইমিতিকে। তার র্স্বণালী চেহারা অপমানে লাল হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘তুমি কিন্তু ‘নেটিভ’দের দেশে এসেছ, আমি কিন্তু অনেটিভদেরই একজন। আর শোন আমি তোমার কোন ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না, আমি পছন্দ করব না আমার কোন ব্যাপারে তুমি নাক গলাও।’
সান্ড্রা সুসানের দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। তার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে হাত দু’টি। বলল সে চাপা তীব্র কন্ঠে, ‘কথা তুমি অনেক বড় বলে ফেলেছ।এর উপযুক্ত জবাব আমি দিতে পারি, কিন্তু আজ নয়। আমি তোমাকে শেষ বারের মত সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি তামাহি মাহিনের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এবং সেটা আজ থেকেই। তা না হলে তোমার পরিণতি কি হতে পারে তা তুমি কল্পনা করতে পারছ না্।’
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলল গাড়ির দিকে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসতে সে বলল, ‘মাহিন, এ মেয়েটাতে খুব বেয়াদব? কথা বলতেও জানে না। এ রকম মেয়ের সাথে বসে বসে কথা বল কি করে তুমি! যাক ভালো করে শাসিয়ে দিয়েছি।’
তামাহি মাহিনের মুখটা অসন্তুষ্টিতে ভরে গেল। কিন্তু কোন কথা বলল না সে।
সান্ড্রা সুসান একবার তাকাল তামাহি মাহিনের দিকে। তার চোখে একটা চকচকে দৃষ্টি। চোখ ফিরিয়ে সে তাকাল সামনে। দু’হাত সে চেপে ধরল ষ্টেয়ারিং হুইল। ঠোঁটে একটা ঠান্ডা হাসি।
গাড়ি চলতে শুরু করল।

অফিসে বসের আচরণে তামাহি মাহিন খুব পেরেশান হয়ে পড়েছিল। সে সোজা চলে এসেছে মারেভাদের বাড়িতে।
গাড়ি থেকেই তামাহি মাহিন দেখল মারেভা মাইমিতি গেট দিয়ে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করছে।
‘মারেভা।’ ডাকল তামাহি মাহিন।
থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল মারেভা মাইমিতি। তামাহি মাহিনকে দেখে তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। খরব না দিয়ে, টেলিফোন না করে তো মাহিন এভাবে আসে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর এমন অসময়ে সে কখনও আসে না। উদ্বিগ্ন হলো মারেভা মাইমিতি।
ছুটে এল সে তামাহি মাহিনের কাছে।
সাধারণত দেখা হলেই মাহিনের যে স্বভাজাত হাসির উচ্ছসিত প্রকাশ দেখে তা আজ দেখতে পেল না মারেভা। তার বদলে চোখে-মুখে একটা দুশ্চিন্তার প্রকাশ। আরও উদ্বিগ্ন হলো মারেভা।
‘কি ব্যাপার মাহিন? এমন সময়ে, কোন খবর না দিয়ে? চল ভেতরে।’ বলল মারেভা উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
‘না ভেতরে নয়, চল পাশের পার্কে গিয়ে বসি।’ তামাহি মাহিন বলল।
মারেভা মাইমিতি তামাহি মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাড়িতে এসেও পার্কে গিয়ে কথা বলবে! আশংকিত হলো মারেভা মাইমিতি। কি হলো মাহিনের?’ কিছু ঘটেছে তাহলে?কি সেটা?
‘ঠিক আছে আমি বাসায় বই রেখে আসি। তুমি একটু দাঁড়াও।’ বলল মারেভা মাহিন।
বলে দৌড় দিল সে বাড়ির ভেতরে।
ফিরে এল মিনিট খানেকের মধ্যেই।
তামাহি মাহিনের হাত ধরে বলল, ‘চল।’
মারেভা মাইমিতির বাড়ির পাশ দিয়েই অ্যাভেনিউ ডি পোমেরা। র্পাকটিও এ অ্যাভেনিউ-এর ধারে আর মারেভা মাইমিতিদের বাড়রি পাশেই।
অ্যাভেনিউ হয়ে না গিয়েও মারেভাদের বাড়ি থেকেও পার্কে প্রবেশ করা যায়।
পার্কে ঢুকে একটা গাছ পেছনে রেখে তার ছায়ায় এক বেঞ্চিতে বসল দু’জন, মারেভা ও মাহিন।
‘কি ঘটেছে বলত?’ একটা কথাও বলছ না।’ বসেই মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মারেভা মাইমিতি।
‘ঘটনাটা বলার জন্যেই এসেছি মারেভা।’
বলে একটুক্ষণ চুপ থাকল তামাহি মাহিন। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘সেদিন তোমাকে আমার বস সান্ড্রা সুসান যে থ্রেট করেছিল, আমি গাড়িতে বসেই তা শুনতে পেয়েছিলাম। সেদিন আমি কিছু বলিনি। পরদিন আমি লিখিতভাবে অফিসকে জানাই যে, আগামী মাসের এক তারিখ থেকে আমি আমার কাজ রাখতে পারবো না। এই চিঠিকেই আমার ইস্তেফা পত্র হিসাবে গ্রহন করা হোক।’ আমি অফিস শেষে বাড়ি আসার সময় এই ইস্তেফা পত্র অফিসে দিয়ে আসি।’ থামল তামাহি মাহিন।
‘এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। তুমি ভাল কাজ করেছ। কিন্তু তোমার মুখ মলিন কেন? হাসি নেই কেন মুখে?’ বলল মারেভা মাইমিতি।
মারেভার একটা হাত তামাহি মাহিন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আমি কথা শেষ করিনি মারেভা। আমার ইস্তেফা পত্র ওরা গ্রহণ করেনি। আমি ইস্তেফা পত্র দিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই অফিস থেকে গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যায়। বস অফিসেই বসেছিল। আমাকে দেখে সে হাসল। হাসিটা ঠিক যেন সাপের হাসির মত। বলল, ‘চাকরিতে তুমি ঢুকেছ তোমার ইচ্ছার অধীন। চাকরি ছাড়ার তোমার সুযোগ নেই। অফিসে আসা বন্ধ করলে লোকরা গিয়ে তোমাকে ধরে আনবে। আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও পালিয়ে থাকার সাধ্যও তোমার নেই। আর যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে প্রথমে প্রাণ যাবে তোমার প্রেমিকার। তারপর তোমার। অন্যদিকে আমার কথা মেনে যদি চল তাহলে তোমার, তোমার বাড়ির, পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হবে। এসব কথা সে হাসতে হাসতে বলেছে। সে হাসির ধার আমার কাছে ছুরির ধারের চেয়েও ভয়ংকর মনে হয়েছে।’
থামল তামাহি মাহিন। মুষড়ে পড়া বিধ্বস্ত তার চেহারা।
মারেভা তাকিয়েছিল তামাহি মাহিনের মুখের দিকে। তারও মলিন মুখ উদ্বেগে ভরা।
তামাহি মাহিন থামলেও তখনি কথা বলতে পারল না মারেভা। তার বুক কাঁপছে। কোন মানুষ এমন নির্লজ্জ আর নিষ্ঠুর হয়!
তামাহি মাহিনও নিরব।

অন্ধকারের মত ভারি নিরবতা ভাঙল মারেভাই। বলল, ‘তুমি কি ভাবছ? আপাতত চাকরি না ছাড়লেই তো একটা সমাধান হয়।’
‘অসম্ভব। ওর ওধীনে ভেবে দেখেছ? ওরা জোর করে তোমাকে অফিসে নিয়ে যাবে। না গেলে কি হবে সে থ্রেট তো দিয়েই রেখেছে।’ মারেভা বলল। ওরা তোমার করে বসে?
‘আমি নিজের জন্যে এক বিন্দুও ভাবছি না। ওরা বাড়াবাড়ি করলে আমি আমি পুলিশ কে বলব। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার কথা।যদি কোন ক্ষতি করে বসে?সে থ্রেট তো সান্ড্রা দিয়েছেই।বললাম না ওর হাসিটাও সাপের মত, ছুরির মত। ওরা সব পারে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আমাকে নিয়ে ভেব না। দেশটায় আমাদের আইন এখনও আছে। বাইরের থেকে এসে ওরা আমাদের নেটিভ বলে গালি দেবে, আর যা ইচ্ছা তাই বলবে আর তা আমাদের মেনে নিতে হবে! কিন্তু এখনই গন্ডগোল না পাকিয়ে তুমি আরও কিছু দিন নিরবে চাকরি করে যাও।’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘ভয় ও ঘৃণা দুই-ই সৃষ্টি হয়েছে আমার তার প্রতি। ওর পাশে চাকরির অভিনয় করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অফিসে প্রায় আমরা এক সাথে থাকি। কোন সময় কোন ঘটনা সৃষ্টি করে, কখন কোন অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনে তার ঠিক নেই। আমি কাল থেকেই আর অফিসে যাচ্ছি না।’ তামাহি মাহিন বলল।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে মারেভা ও মাহিন দু’জনেই পেছনে ফিরে তাকাল। দেখলো মারেভার মা তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মারেভারা দু’জনেই উঠে দাঁড়াল।
‘মা, তুমি এখানে?’ বলল মারেভা মাইমিতি।
‘হ্যাঁ, আমি পার্কে অনেকক্ষণ এসেছি। ফেরার পথে তোমাদের দেখে এলাম। তোমরা এখানে কেন? আর তোমাদের এতটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? আসতে আসতে মাহিনের মুখে কার বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা, আর কাল থেকে অফিসে আর না যাবার কথা শুনলাম। এসবের অর্থ কি?’ বলল মারেভার মা।
দু’জনেই নিরব। তাকাল একে-অপরের দিকে।
তামাহি মাহিনই কথা বলল, ‘আন্টি, আপনার কাছে কিছুই লুকানো ঠিক নয়। কিন্তু আন্টি তাতে আমাদের মতই আপনার মন খারাপ হবে, উদ্বিগ্ন হবে।’
‘বাছা, ছেলে মেয়েদের উদ্বেগ বাবা-মা শেয়ার করবে না তো কে করবে? বল বাছা, কি হয়েছে তোমাদের?’
তামাহি মাহিন তার অফিসের বস সান্ড্রা সুসানের সাথে কি ঘটেছে, তামাহি মাহিন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সব বলল মারেভার মাকে।
শুনতে শুনতে উদ্বেগে ভরে গেল মারেভার মা’র মুখ। তামাহি মাহিনের কথা শেষ হতেই বলল, ‘মারেভা ঠিক বলেছে চাকরি অব্যাহত রেখে কি করা যায় তা ভাবার সুযোগ নেয়া দরকার। লোক ওরা সাংঘাতিক মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু আন্টি, যে ভয়ের কারণে চাকরি অব্যাহত রাখার কথা বলছেন, যা ঘটেছে তার পর আমি চাকরি অব্যাহত রাখলে সে ভয় আরও বাড়বে। পরে কিছু করতে গেলে তাদের জিঘাংসা আরও বৃদ্ধি পাবে।’ তামাহি মাহিন বলল।
ভাবছিল মারেভার মা। বলল, ‘তোমার কথাও ঠিক মাহিন। তাহলে আমাদের কি করা কর্তব্য? পুলিশকে আমরা বলতে পারি। কিন্তু জানি না বাছা, ফরাসীদের নিয়ন্ত্রিত পুলিশ সাদা চামড়ার সান্ড্রা সুসানদের বিপক্ষে কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা। নেটিভদের অভিযোগ অনেক সময়ই তাদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তবু এটাই একমাত্র বিকল্প। আর এখনি এপথে না গেল আমি যা মনে করি চাকরি অব্যাহত রেখে সময় ক্ষেপণের পথ নিতে হবে।’
‘তারা কি করতে পারে আন্টি? আমার ভয় শুধু মারেভাকে নিয়ে। তাদের জিঘাংসার প্রথম টার্গেট হতে পারে মারেভাই।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আমি ভয় করি না মাহিন। ওরা একটা হুমকি দিয়েছে বলেই আমরা গেয়ে পায়ে পড়ব? কেন এদেশ আমাদের নয়। এরা তো একে একে আমাদের জাতীয় সব কিছুই নিয়ে নিয়েছে, আমাদের ব্যাক্তি সত্ত্বাও আমাদের থাকবে না, তা হয় না। এটাই আমার পরিষ্কার কথা মা। মারেভা মাইমিতি বলল।’ আবেগরুদ্ধ মারেভার কন্ঠ।
মারেভার আবেগ মারেভার মা ও তামাহি মাহিনকেও স্পর্শ করেছে।
মারেভা থামলেও সংগে সংগে কথা বলতে পারলো না মারেভার মা ও তামাহি মাহিন।
নিরবতা ভাঙল মারেভার মা। বলল, ‘মারেভার আবেগ ঠিক আছে। কিন্তু আবেগ দিয়ে সব সময় বাস্তবতার বিচার চলে না। যা হোক, মারেভা তুমি অন্তত কিছুদিন কলেজ যাওয়া বন্ধ রাখ। বিষয়টা নিয়ে কি করা যায় দেখা যাক। আর আমি মনে করি, মাহিনকেও সাবধান থাকতে হবে। তুমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেও না। পারলে বাইরে থেকে বেড়িয়ে এস।’
‘কিন্তু মা, কলেজে যাওয়া কয়েকদিন বন্ধ রাখলেও গাইডের কাজটা বন্ধ রাখতে পারবো না। ট্যুরিষ্টদের পিক সিজন শুরু হয়েছে। আমার এ বছরের রেজিষ্ট্রশনও হয়েছে। কাল থেকেই আমি কাজ শুরু করছি।’ বলল মারেভা।
‘আন্টি, মারেভা এটা করতে পারে। প্রতি বছরই তো করছে। চাকরি ছেড়েছি যেহেতু, আমিও চিন্তা করছি এ কাজে লাগার।’ তামাহি মাহিন বলল।
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারেভার। বলল, ‘তাহলে তুমি কাল নাম রেজিষ্ট্রেশন করাও। এবার একটু কড়াকড়ি। নাম রেজিষ্ট্রেশন না করলে গাইডের কাজ করা যাবে না।’
‘হ্যাঁ, তোমরা যদি এক সাথে কাজটা করতে পারো, তাহলে মন্দ হয় না। সব সময় মানুষ নিয়ে কারবার, মানুষের মধ্যে থাকতে হবে, এর মধ্যে একটা নিরাপত্তা আছে। তবে আসা-যাওয়াটা যাতে দু’জনের এক সাথে হয় তার জন্যে চেষ্টা করো তোমরা।’ বলল মারেভার মা।
‘ঠিক আছে এটা করা যাবে। আমিই মারেভাকে বাসা থেকে নিয়ে যাব।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। একবার ভয়ের কাছে আত্মসর্মপণ করলে এ থেকে আর মুক্তি পাওয়া যাবে না।’ মারেভা বলল।
‘তুমি আর কথা বাড়িও না মারেভা। কোন বিধিবদ্ধ আইন করা হচ্ছে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা তুমি আমি সবাই করতে পারবো।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘ধন্যবাদ তোমাদের। মনে রেখ ভয় থাকাটা সবসময় খারাপ নয়। ভয় মানুষকে সাবধান করে। এর প্রয়োজন আছে। আশা করি তোমাদের মনে থাকবে কথাটা। চল এবার উঠা যাক।’ মারেভার মা বলল।
সবাই উঠে দাড়াল।

পাপেতি বিমানবন্দর।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top