৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

মদিনা মনোওয়ারা বিমান বন্দরে টপ ফ্লোরে ভিভিআইপি মিটিং রুম।
ওভাল সিটিং টিবিলের সভাপতির আসনে বসেছেন মদিনার গভর্নর। তার এক পাশে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্য পাশে বসেছে আহমদ মুসা। অভাল টেবিল ঘিরে অন্যদের মধ্যে রয়েছে সৌদি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান, সৌদি কাউন্টার টেররিজম গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, পুলিশ প্রধান ও মদিনা মনোয়ারা নিরাপত্তা কমিটির প্রধান।
মদিনার গভর্নর, আহমদ মুসা ও মদিনা মনোওয়ারা নিরাপত্তা কমিটির প্রধান ছাড়া অন্য সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে রিয়াদ থেকে এসেছেন।
মিটিং উদ্বোধন করেছিলেন মদিনার গভর্নর। তিনি উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, অল্প সময়ের জন্যে রিয়াদ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় দুই গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ও পুলিশ প্রধান এসেছেন। আহমদ মুসা ও তার পরিবার আমাদের নাগরিক হলেও আমাদের সম্মানিত ও মূল্যবান অতিথিও। সৌদি আরবে তাদের জীবনে উপর আক্রমণ এই প্রথম। এই আক্রমণ আসলে সৌদি সিকিউরিটি ব্যবস্থারর উপর। আমরা আনন্দিত যে, খাদেমুল হারামাইন শরীফাইনের মহান বাদশা বিষয়টিকে এভাবে দেখেছেন এবং একটি সবোর্চ্চ কমিটি রিয়াদ থেকে পাঠিয়েছেন। তারা আসার আগে আমরা আরও দু’বার বসেছি। আল-হামদুলিল্লাহ! আহমদ মুসার পরমর্শে আমরা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছি। একটা ষড়যন্ত্র নেটওয়ার্কের গোটাটাকেই মনে হয় আইডেনটিফাই করা গেছে। এ ব্যাপারে রিপোর্ট পেশ করার জন্য আমি মদিনা মনোওয়ারার সিকিউরিটি কমিটির প্রধানকে সংক্ষেপে রিপোর্ট পেশ করার জন্য অনুরোধ করছি।’
প্রাদেশিক রাজধানী মদিনা মনোওয়ারার নিরাপত্তা কমিটির প্রধান জেনারেল আলী আবদুল্লাহ আল-হাবশা সোজা হয়ে বসল। কথা শুরুর ফর্মালিটি শেষ করে বলল, ‘বিস্ফোরণের সময় আমি বিমান বন্দরের সিকিউরিটি কক্ষে ছিলাম।’ বিস্ফোরণের সংগেই বিমান বন্দর সীল করে দেয়া হয়। কাউকে ঢুকে ও বের হতে দেয়া হয়নি। আর সংগে সংগেই বিমান বন্দর সার্চ করা হয়েছে সন্দেহজনক কিছ কিংবা কাউকে পাওয়া যায় কিনা সেটা নিশ্চিত করার জন্য। বিস্ফোরিত বিমান ও বিস্ফোরণস্থল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ একই সাথে চালানো হয়। পরের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আমরা করি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে। তিনি আমাদের নির্দেশ দেন, গত রাতে থেকে বিস্ফোরণ পর্যন্ত যারা বিমান বন্দর, টার্মাক ও বিমানে প্রবেশ করেছে, তাদের তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে। বিমান…..।’
জেনারেল আলী আবদুল্লাহ আল-হাবশীর কথার মাঝখানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, ‘এই পরামর্শ বিমান বন্দর থেকে আহমদ মুসাই আমার কাছে পাঠিয়েছিল। স্যরি জেনারেল। বলুন আপনি।’
জেনারেল আলী আবদুল্লাহ আবার শুরু করল, ‘বিমান বন্দর, টার্মাক, বাইরে রাস্তা প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট সকল জায়গায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থেকে আমরা আগের মত সকাল ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টা সময়ে যারা বিমান বন্দরে, টার্মাক ও বিমানে প্রবেশ করেছেন, তাদের বিস্তারিত একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় আমরা দেড় হাজার লোককে- যাদের মধ্যে আউটগোয়িং প্যাসেঞ্জারের সংখ্যাই সাড়ে ১৪শ’।অবশিষ্ট পঞ্চাশ ননপ্যাসেঞ্জার। এই পঞ্চাশ জনের মধ্যে বিমান বন্দর অফিসিয়ালস, ইমিগ্রেশন অফিসিয়ালস সার্ভিসিং কর্মী ও কেবিন ক্রুর সংখ্যা ৪৯ জন। মাত্র একজন ননঅফিসিয়ালস। কিন্তু তিনিও একজন ভিআইপি। এরোমেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা আল-সিদরী। তিনি আমাদের বিমান-বাহিনীর একজন টেকনিক্যাল উপদেষ্টা। আজ ভোরে পাঁচটায় তাঁকে ডাকা হয় বিশেষ বিমানটির একটা চেক করার জন্য।’
একটু থামল জেনারেল আলী আবদুল্লাহ আল-হাবশী। সামনে গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে আবার শুরু, ‘এই পঞ্চাশ জনের ছবি ও বায়োডাটা নিয়ে একটা প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে এবং এরা সকলেই কর্মক্ষেত্রে কিংবা নিজ নিজ বাড়িতে হাজির আছে। বিনা অনুমতিতে তাদের মদিনার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এটা নিশ্চিত করার জন্যে তাদের প্রত্যেকের উপর নজর রাখা হয়েছে।’
বলে একটু থামল। একটু নড়ে-চড়ে বসে আবার শুরু করল, ‘বিমান বন্দরের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় এদের যে গতিবিধি ধরা পড়েছে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। এদের পার্সোনাল ফাইলে তাদের যে অতীত রেকর্ড পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। এটা প্রাথমিক অনুসন্ধানের ফল। নিরাপত্তা কমিটির পক্ষ থেকে বিষয়টি মহোদয় সমীপে পরামর্শ ও নির্দেশনার জন্য পেশ করা হলো।’ থামল জেনারেল আবদুল্লাহ।
সংগে সংগে কেউ কোন কথা বলল না। নিরব কিছুক্ষণ সবাই। মদিনা মনোয়ারার গভর্নর নিরবতা ভাঙল। বলল, ‘নিরাপত্তা কমিটিকে ধন্যবাদ। তারা গত তিন ঘন্টায় তদন্তের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এই রিপোর্টে আনন্দিত হবার কিংবা সামনে এগোবার কোন আলো দেখছি না। অপরাধীদের প্রতি কোন অঙুলি সংকেত নেই। রিপোর্ট আমরা সবাই শুনেছেন। এখন দয়া করে বলুন, আপনাদের পরামর্শ কি? কোন দিকে অঙ্গুলি সংকেত করার মত আপনারা কিছু দেখছেন কিনা।’ থামল গভর্নর।
মুখ খুলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, ‘তদন্ত কমিটি তার রিপোর্টের শেষে মন্তব্য করেছে, গত রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৭ টা পর্যন্ত বিমান বন্দরে এসেছে, টার্মাক ও বিশেষ বিমানটিতে ঢুকেছে, তাদের গতিবিধিতে কোন অস্বাবিকতা দেখা যাচ্ছে না এবং তাদের অতীত রেকর্ডেও সন্দেহজনক কিছু নেই। এই মন্তব্যের পর নতুন অনুসন্ধান ছাড়া কিছু বলার বা অপরাধী হিসেবে কারও দিকে অংগুলি সংকেতের কোন সুযোগ নেই। আমি ভাবছি, গুরুত্বপূর্ণ এই তদন্ত কাজটি পুলিশের অপরাধ অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে সরকারের ‘এন্টিটেররিষ্ট কমিশন’ ও ‘‘সেনা গোয়েন্দা সংস্থা’র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটা যৌথ কমিটির হাতে দেয়া উচিত। এ কাজে ভাই আহমদ মুসার সাহায্য পেলে ভাল হতো, কিন্তু অন্য একটা বড় কাজ তার হাতে আছে।’ থামল স্বরাষ্টমন্ত্রী।
উপস্থিত সবাই একে একে স্বরাষ্টমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানাল।
শুধু আহমদ মুসাই কিছু বলল না। ভাবছিল সে।
সবশেষে গর্ভনর আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, এবার প্লিজ আপনি কিছু বলুন। কোন আশার কথা বলুন।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি!’ বলে শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানণীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকই নিয়েছেন এমন ঘটনা তদন্তের জন্য ঐ রকম একটি চৌকস তদন্ত কমিটিরই প্রয়োজন। তবে আমি কয়েকটা বিয়ষ জানতে চাই, বলতে চাই।’
একটু থামল আহমদ মুসা। তাকাল জেনারেল আলী আবদুল্লাহর দিকে। বলল, ‘বিশেষ বিমানটির পাইলট অফিসার ও কেবিন ক্রদের দায়িত্বে যারা ছিলেন সবাই মারা গেছেন। বিশেষ বিমানটিতে ওঠার লোকদের মধ্যে শুধু বেঁচে আছেন এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা ও ফ্লাইট উত্তর সার্ভিসিং কর্মীরা। বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিভাগের সার্ভিসিং কর্মীরা যারা বিমানে উঠেছিলেন বা বিমানের কাছে গিয়েছিলেন কাজের জন্যে তাদের সংখ্যা কত হবে, মি. জেনারেল?’
‘স্যর, সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা পাঁচজন।’ বলল জেনারেল আলী আবদুল্লাহ।
‘এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জনাব আবুল ওয়াফাসহ এদের তথ্য-বিবরণী কি ম্যানুয়ালি রেকর্ড করেছেন, না শো করার মত কম্পিউটারাউজড্ বিবরণীও আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘দু’ভাবেই রেকর্ড করা হয়েছে স্যার।’ বলল জেনারেল।
‘এখন কি শো করা যায়?’ জানতে চাইল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই স্যার।’ বলল জেনারেল আলী আবদুল্লাহ।
‘তাহলে ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা আল-জিদয়ী দিয়ে শুরু করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওকে স্যার।’ বলে কাজ শুরু করে দিল সে।
সব ব্যবস্থা করাই ছিল টেবিলে।
টেবিলের বিশেষ ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একটা তাঁর বের করে জেনারেল আলী আবদুল্লাহ তার ল্যাপটপে ঢুকিয়ে দিল। সেই সাথেই সামনের দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গা থেকে তিন ফুট বর্গাকৃতির একটা স্লাটড সরে গেল। দেখা গেল সেখানে বড় একটা কম্পিউটার স্ক্রিন।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা ছবি।
‘স্যার, আমি ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা আল-জিদয়ী দিয়েই শুরু করছি।’ বলল জেনারেল আলী আবদুল্লাহ।
প্রথমে স্ক্রিনে এল ইঞ্জিনিয়ার আলী আবদুল্লাহর ছবি। তারপর একে একে জন্ম, পিতা-মাতার নাম ও তাদের ছবি, লেখা-পড়া, কর্মজীবনে প্রবেশ, বিয়ে, স্ত্রীর ছবি, নাম ও পেশা, উপদেষ্টা হিসেবে সৌদি এয়ারলাইন্সে যোগদান ইত্যাদিসহ ব্যক্তিগত জরুরি বিষয়সমূহ তুলে ধরা হলো। এভাবে মদিনা বিমান বন্দরের পাঁচজন গ্রাউন্ড ষ্টাফের সদস্যেরও পূর্ণ জীবন-বৃত্তান্ত কম্পিউটার স্ক্রিনে আনা হলো।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে সবার জীবন বৃত্তান্ত দেখছিল। বিভিন্ন সময় তার চোখে-মুখে প্রশ্ন, কিছু বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখা গেল।
জীবন বৃত্তান্ত দেখানো শেষ হলে আবার নিরবতা নামল সীটিং রুমে।
এবার নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। জেনারেল আলী আবদুল্লাহকে লক্ষ করে আহমদ মুসা বলল, ‘জেনারেল আলী আবদুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফার জন্ম, লেখা-পড়া, বিয়ে মিসরে, এটা তো দেখাই গেল। কিন্তু পাঁচ গ্রাউন্ড ষ্টাফ-সার্ভিসিং কর্মীর মধ্যে আলী হাসানের জন্ম, লেখা-পড়া বিয়ে কি মিসরে?’
‘ঠিক স্যার, এ বিষয়টি তার বায়োডাটাতে নেই। ঠিক আছে, তার পারসোনাল প্রোফাইলে ওটা পাওয়া যাবে।’
বলে জেনারেল আলী আবদুল্লাহ তার ল্যাপটপের ভিন্ন একটা ফাইলে গিয়ে ক্লিক করতেই দেয়ালের কম্পিউটার স্ক্রিনে আলী হাসানের বিশদ জীবন-বৃত্তান্ত এসে গেল। তাতে দেখা গেল আলী হাসানের জন্ম, লেখা-পড়া, বিয়ে সবই মিসরে।
আহমদ মুসা জেনারেল আলি আবদুল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, জেনারেল আরেকটা তথ্য পাওয়া কি সম্ভব, ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা বিয়ে করেছেন মায়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া বা মাতৃকুলের কাউকে কী?’
গভর্নর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
এসব প্রশ্ন জেনে কি দরকার, এটা তাদের ভাবনার বিষয় নয়। কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
জেনারেল আলী আবদুল্লাহ হাসল। বলল, ‘এর উত্তর আমরা অনেকেই জানি স্যার। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার মায়ের বোনঝি মানে তিনি তার খালার মেয়েকে বিয়ে করছেন।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল, আমার একটা খবর জানার কৌতুহল আছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের খালার নাম কি আমাত আল-কাদির?’
‘জি হ্যাঁ, তাঁর নাম আমাত আল-কাদির। মিসর-সিনেমার তিনি নাম করা অভিনেত্রী, আবার লেখিকাও। কিন্তু এটা আপনি জানলেন কি করে স্যার? আপনি কি তাকে চেনেন?’ বলল জেনারেল আলী আবদুল্লাহ।
‘না, চিনি না জেনারেল। অন্য একটা হিসেব থেকে আমি এটা বলেছি।’
বলে আহমদ মুসা ফিরে তাকাল গভর্নর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে।
বলল, ‘এক্সিলেন্সি, মদিনা মনোয়ারার গভর্নর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! আমার বিবেচনায় ভূল থাকতেও পারে, তবে মনে করছি ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা ও আলী হাসান ভিন্ন ভিন্নভাবে বা যুক্তভাবে আহমদ মুসাকে হত্যার এই ষড়যন্ত্র করেছিল। ষড়যন্ত্রের জাল অনেক আগেই বিস্তার করা হয়। তারা সুযোগের সন্ধানে থাকে। অবশেষে উপস্থিত একটা সুযোগকে তারা কাজে লাগায়। আমি মনে করি তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করে তদন্ত চালালে সবকিছু প্রমাণিত হয়ে যাবে।’
গভর্নর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উপস্থিত সকলের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়! ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা ও আলী হাসান দুই জনের কারো বিরুদ্ধেই তারা কিছুই দেখছে না। আহমদ মুসা কিভাবে এমন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। অবশ্য এটা ঠিক, আহমদ মুসা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেন না।
গভর্নর তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাকিয়েছিল গভর্নর দিকে। বোধ হয় বুঝল তারা দু’জনের কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনার পরমর্শ আমাদের কাছে নির্দেশ। মি. আহমদ মুসা, আমরাও সব দেখলাম শুনলাম, কিন্তু আমরা তো কিছু বুঝতে পারছি না। আমরা জানতে খুব আগ্রহী আপনি এই সিদ্ধান্ত কি কারণে, কি জন্য নিলেন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘শক্তিশালী কোন এভিডেন্স, যথেষ্ঠ রকম কোন কার্যকরণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত আমি নিইনি। দুর্বল একটা ক্লু আমি পেয়েছি, তার ভিত্তিতেই বড় এ সিদ্ধান্তটি আমি নিয়েছি।’
‘সেটা কি মি. আহমদ মুসা? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’
‘তিনটি বিবেচনা থেকে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমটি হলো, ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফার মা, স্ত্রী ও খালা এই তিনজন এবং আলী হাসানের স্ত্রীও ইহুদি। দ্বিতীয় বিবেচনা ছিল, সম্প্রতি আমি ইস্তাম্বুল ও পূর্ব আনাতোলিয়ার যাদের ষড়যন্ত্র ও স্বার্থ মাটি করে দিয়েছি, তাদের সাথে যুক্ত ছিল ইহুদি স্বার্থ। সুতরাং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়ার আশু আশংকা তাদের তরফ থেকেই আসার কথা। তৃতীয় বিবেচনা হলো, স্পেশাল ফ্লাইটের নির্দিষ্ট স্পেশাল প্লেনটির জন্যে তাকে কল করা হয়নি, তিনি বিমান বন্দরে এসে সুযোগ সৃষ্টি করে তবেই প্লেনে উঠেছিলেন। কল রেজিষ্টারে তার জন্য কল এন্ট্রি হয়েছে তিনি বিমান বন্দরে আসার পর। কলের কারণটাও স্পেসেফিক নয়, জেনারেল।’ থামল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। তিনটি বিবেচনা এক সাথে করলে আপনার সিদ্ধান্তকেই অপরিহায্য করে তোলে। কিন্তু মি. আহমদ মুসা, ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফার মা, স্ত্রী, খালা ও আলী হাসানের স্ত্রীকে ইহুদি বলছেন কেন?’ মুসলিম নাম নিয়ে এবং মুসলিম হিসেবেই ওরা ঘর-সংসার করছেন।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘একথা ঠিক, ইহুদিরা এখন এ নামগুলো ব্যবহার করে না। কিন্তু মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে মিসরে এই নামগুলোর ব্যাপক প্রচলন ছিল। সাধারণভাবে এই নামগুলো ইহুদীরা ব্যবহার করতো। মধ্যযুগের বিভিন্ন ইহুদী ডকুমেন্টে বিশেষ করে মিসরের সিনাগগ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া ‘Genij’ ডকুমেন্টগুলোতে এই সব ইহুদি নামের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফার স্ত্রীর নাম ‘আমাত আল-ওয়াহিত’ খালার নাম ‘আমাত আল-কাদির’ ও মায়ের নাম’ ‘আমাত আল-আজিজ’। মজার ব্যাপার হলো ইহুদিদের ‘গিনিজ’ ডকুমেন্টে এই তিনটি নাম এক সাথে রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারের বায়োডাটা মা ও স্ত্রীর নাম যথাক্রমে ‘আমাত আল-আজিজ’ ও ‘আমাত আল-ওয়াহিত’ দেখার পর যখন শুনলাম ইঞ্জিনিয়ার খালাতো বোনকে বিয়ে করেছে, তখন আমি ইহুদি সিরিয়াল অনুসারে না জেনেই তার খালার নাম বলেছি ‘আমাত আল-কাদির’ এবং তা ঠিক হয়েছে। আলী হাসানের স্ত্রীর ‘মিত আল-শাদা’ নামটিও ‘গিনিজ’ ডকুমেন্টের। এই ক্লু সামনে রেখেই আমি মহিলাদের ইহুদি বলেছি এবং তা প্রমাণিত হবে ইনশালল্লাহ!’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আল্লাহ আপনাকে লম্বা জীবন দান করুন। আপনার বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নির্ভূল। আমরা এক সাথে জীবন-বৃত্তান্তগুলো শুনলাম। কিন্তু আপনি এত চিন্তা, এত অনুসন্ধান ও এত বিশ্লেষন কখন করলেন! সত্যি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাকে তার অসীম নেয়ামত দিয়ে ধন্য করেছেন। আল-হামদুলিল্লাহ!’ বলল মদিনা মনোয়ারার গভর্নর।
‘সম্মানিত সভর্নর মহোদয় ঠিক বলেছেন। আল-হামদুলিল্লাহ! তিনি এই তদন্তকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, সহজ করে দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, তদন্ত অন্ধকার থেকে আলোতে চলে এসেছে। অপরাধীরা চিহ্নিত হয়েছে। এখন শুধু দেখার বিষয় ষড়যন্ত্রের শেকড় কোথায়, কারা এর পেছনে রয়েছে। এটা আমাদের গোয়েন্দারা পারবে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘কিন্তু ঐ বিষয়টাও জানা গেছে। আহমদ মুসা বলেছেন, তাকে হত্যা-প্রচেষ্টার সাথে ইহুদি ষড়যন্ত্র জড়িত রয়েছে। এখন শুধু বের করতে হবে, সৌদি আরবে কারা ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফাদের এ কাজে ব্যবহার করছে। আবুল ওয়াফা ও আলী হাসানদের গ্রেফতার করলেই পেছনের লোকদের কথা জানা যাবে।’ বলল গভর্নর।
এ সময় জেনারেল আলী আবদুল্লাহর টেলিফোন বেজে উঠল।
‘মাফ করবেন!’ বলে জেনারেল আলী আবদুল্লাহ মোবাইলসহ দ্রুত ঘরের বাইরে চলে গেল।
মিনিট খানেক পরেই ফিরে এল জেনারের আলী আবদুল্লাহ। নিজের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এক্সিলেন্সি, একটা খবর এসেছে, অনুমতি হলে বলতে পারি।’
গভর্নর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলেই তাকাল জেনারেল আলী আবদুল্লাহর দিকে।
‘বল জেনারেল, কি খবর।’ বলল গভর্নর। কন্ঠে প্রবল ঔৎসুক্য।
‘এই মাত্র আমাদের মদিনার পুলিশ প্রধান জানালেন, ইঞ্জিনিয়ার আবুল ওয়াফা সপরিবারে চলে যাচ্ছিলেন। সাদা পোষাকে পাহারায় থাকা পুলিশ তাদের আটকায়। জানায় যে, তাঁর মদিনা শরীফের বাইরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এ কথা শুনে উনি পকেট থেকে রিভলবার বের করে ফাঁকা গুলি করে গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেন। পুলিশ সামনে গিয়ে বাধা দিলে সে একজন পুলিশকে গুলি করে আহত করেন। অবশিষ্ঠ দু’জন পুলিশ চাকায় গুলি করে তার গাড়ি থামিয়ে দেয় এবং তাকে আটক করে।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ! মি. আহমদ মুসার কথা ঘরের বাইরে বেরুবার আগেই সত্য প্রমাণিত হয়ে গেল। ঘটনা যে ঘটিয়েছে, সে ধরা পড়ল। আল্লাহর হাজার শোকর। আবারো ধন্যবাদ আহমদ মুসা আপনাকে।’
‘তার গ্রেফতারের খবর দয়া করে সবার কাছ থেকে গোপন রাখুন। তার ধরা পড়ার কথা জানলে পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা পালাবে, তাদের ধরা কঠিন হয়ে পড়বে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব, প্লিজ আপনি ব্যবস্থা করুন। কিভাবে সবার কাছ থেকে বিষয়টা গোপন রাখা যায় দেখুন।’ বলল গভর্নর দ্রুত কন্ঠে।
‘ইয়েস এক্সিলেন্সি, আমি দেখছি। আমি এখানকার পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রধানের সাথে বসছি। আমি জানাব আপনাকে।’
একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সামনের গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করল’ ‘এক্সিলেন্সি, আমি সাড়ে ১২ টার দিকে আহমদ মুসাকে নিয়ে রিয়াদ যাত্রা করব। ওদিকের সংকটের কোনই সুরাহা হয়নি আপনি জানেন।’
‘অবশ্যই। বেগম ও সাহেবজাদাকে আমরা খুব কষ্ট দিলাম। সেই ৭টা থেকে ওরা এয়ারপোর্টে। আরও দেড় ঘন্টা থাকতে হবে। দু:খিত আহমদ মুসা আমরা সকলে।’ বলে গভর্নর তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘না, কোন কষ্ট নয়। ওরা পাশের স্যুটে বেশ ঘুমাচ্ছে আমি খোঁজ নিয়েছি। সুন্দর ব্যবস্থা করায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা! বলে গভর্নর সকলের দিকে তাকাল। বলল, ‘সকলকে ধন্যবাদ, একটা সফল মিটিং-এর জন্যে। আমরা এখন উঠতে পারি।’
কথা শেষ করেই গভর্নর উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই।

রিয়াদের গোয়েন্দা সদর দফতর।
চারদিক ঘুরিয়ে ঠিক পেন্টগনের আদলে তৈরি। ঠিক যেন আরেকটা পেন্টাগন!
মাইনাস থার্ড ফ্লোরে অর্থাৎ তিরিশ ফুট মাটির নিচে একটা সুরক্ষিত কক্ষ।
কক্ষের দক্ষিণ প্রান্তে চারটি টেবিল। প্রতিটি টেবিলে একটি করে ছোট রিভলভিং চেয়ার।
টেবিলের একটিতে বসেছে আহমদ মুসা। তার ডানপাশে সৌদি নিরাপত্তা প্রধান, বাম পাশে সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার বাম পাশে সৌদি গোয়েন্দা প্রধান।
কথা শুরু করেছিল গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ। সে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী স. এর প্রতি দরুদ পেশের পর বলল, ‘আমাদের মুয়াজ্জেজ মেহমান আহমদ মুসা জরুরি ভিত্তিতে যে তথ্যগুলো চেয়েছিলেন তার মধ্যে রয়েছে, ‘সেদিন ভোর রাত থেকে সন্ধ্যা রিয়াদ থেকে আউটগোয়িং রাস্তাগুলোর যান চলাচলের মনিটরিং রিপোর্ট, এই সময়ের সধ্যে এই রাস্তাগুলোতে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু ঘটেছে কিনা সে সম্পর্কে তথ্য, রিয়াদ থেকে বাইরে যাওয়া কোন গাড়িতে বা কয়টি গাড়িতে একাধিক নন-আরব, বিশেষ করে শ্বেতাংগ মেয়ে ও কয়েকজন ছেলেকে দেখা গেছে, যাদের সাথে একজন অসুস্থ বা ঘুমন্ত মধ্যবয়সী আরব ছিল।’
রিয়াদ থেকে আউটগোয়িং সব হাইওয়ে ও সড়কের মনিটরিং রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক বড় কিছু ঘটেনি। শুধু একটা মজার ঘটনা। সেটা হলো রিয়াদ থেকে দক্ষিনে আল-খারজ ক্রসিং পয়েন্টে এবং রিয়াদ থেকে পুবে ও হফুফ থেকে চার মাইল পশ্চিমে আল-জগুফ পয়েন্টে দু’টি গাড়ির ছবি ও তথ্যবলী রেকর্ড হবার পর মনিটরিং ফাইল থেকে তা মুছে গেছে।…..
গোয়েন্দা প্রধানের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা চোখ তুলে তাকাল গোয়েন্দা অফিসারের দিকে। তার কপাল কুঞ্চিত। কিন্তু কিছু বলল না।
গোয়েন্দা প্রধান বলছিল, ‘একাধিক শ্বেতাংগ মেয়েসহ কয়েকজন শ্বেতাংগ পুরুষকে কোথাও কোন গাড়িতে এই সময়ের মধ্যে দেখা যায়নি। আমাদের জন্যে দু:খ যে, মনিটরিং থেকে বড় ধরনের কোন ক্লু পাওয়া যায়নি দেখা যাচ্ছে। সম্মানিত মেহমান আল্লাহর অশেষ নেয়ামতে ধন্য আহমদ মুসাসহ সবাই মনটরিং দেখলে, আমাদের আশা আহমদ মুসা, নিশ্চয় আমাদের পথ দেখাবেন।’
থামল গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ।
সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মি. আবদুল্লাহ শুরু করুন।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি! বলে গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা লাল বোতামে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ডান, বাম ও সামনের দেয়াল বিশাল সফেদ স্ক্রিনে পরিণত হলো।
‘এক্সিলেন্সি, আমি প্রথমে রিয়াদ থেকে পুবে যে হাইওয়ে ও সড়ক গেছে সেগুলোর মনিটরিং রিপোর্ট দেখাবো। তারপর উত্তর, এরপর পশ্চিম এবং শেষে দক্ষিণ দিকের হাইওয়ে।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ।
গোয়েন্দা প্রধান থামলেই আহমদ মুসা বলল, ‘জনাব, পুবের পর দক্ষিন হাইওয়েটা প্লিজ আগে দেখান, যদি অসুবিধা না হয়।’
‘না স্যার, কোন অসুবিধা নেই। আপনি যা বলেছেন সেটাই হবে।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ।
বলেই গোয়েন্দা প্রধান একটা নীল বোতামে চাপ দিল।
দেয়ালের স্ক্রিনে একটা প্রশস্ত রাস্তার ছবি ভেসে উঠল।
‘এক্সিলেন্সি, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিসার্চ বাংলো।’ গোয়েন্দা প্রধান বলল।
দেয়ালের স্ক্রিনে দু’একটা করে গাড়ির দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগল। দেয়ালে গাড়ির দৃশ্য ফুটে উঠার সাথে সাথে দেয়ালের পরবর্তী বটমে গাড়িগুলো খুব ক্লোজ ছবি ফুটে উঠল। এতটাই ক্লোজ যে, ভেতরের আরোহী, গাড়ীর নাম্বার, আরোহীদের লাগেজ সব কিছুই নিখুঁতভাবে দেখা যাচ্ছে।
একই সাথে রিয়াদের পূর্বঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল, পশ্চিমের ধাপে সব দৃশ্যই দেখা গেল দীর্ঘ দুই ঘন্টা ধরে। আহমদ মুসার চোখ দু’টি আকুলভাবে খুঁজল একটি গাড়ি যাতে দেখা যাবে একাধিক শ্বেতাংগ মেয়ে, কয়েকজন যুবক ও সংগাহীন বা ঘুমন্ত একজন আরব যুবককে। কিন্তু এ রকম কোন কিছু মিলল না কোথাও।
রাস্তার দৃশ্য দেখানো বন্ধ হতেই আহমদ মুসা বলল গোয়েন্দ প্রধানকে উদ্দেশ্য করে, ‘ম. আবদুল্লাহ, রিয়াদের পূর্বে আল-জওফ ও দক্ষিণে আল-খারজ পয়েন্টে একটি করে গাড়ির ছবি ও তথ্য মুছে যাওয়ার সময়টা বলা যাবে?
‘জি হ্যাঁ, বলা যাবে স্যার। মনিটরিং রিলেতে একটা রেড ডট দিয়ে তা চিহ্নিত করা ছিল। আল-খারজে ঘটনাটা ঘটে ভোর পাঁচটায় এবং আল-জওফের ঘটনাটা ঘটে সকাল ৭টায়।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।
‘রিয়াদ থেকে আল-খারজ ও আ-জওফের দূরত্ব কত হবে, একশ’, তিনশ’ কিলোমিটার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঠিক বলেছেন স্যার। রিয়াদ আল-খারাজ-এর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার এবং আল-জওফের দূরত্ব ৩শ’ কিলোমিটার।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আরেকটা কথা মি. আবদুল্লাহ, সিসিটিভি’র মনিটরিং-এ এভাবে গাড়ির ছবি ও তথ্য মুছে যাওয়ার ঘটনা তো আর কোন হাইওয়েতে ঘটেনি।’
‘জি না।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।
‘কিন্তু আল-খারজ-এর ১০ নম্বর ও আল-জওফের ৪০ নম্বর হাইয়ের আর কোন পয়েন্টে এই ঘটেনি?’
‘এ ধরনের কোন খবর আসেনি। তবে এই অঞ্চলের হাইওয়ে আবার চেক করতে চাই। যদি কোথাও ঐ দুই জায়গার মত ইরেজের ঘটনা ঘটে থাকে সংশ্লিষ্ট তদারককারীরা তা চিহ্নিত না করলেও প্রমাণ পাওয়া যাবে। ইরেজের জায়গায় ফিল্ম ইরেজের প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন রং নিয়ে থাকে। জোরে স্ক্রোল করার সময় তা ‘ব্রেক’ আকারে স্পষ্টভাবে সামনে এসে যায়। আমি দেখছি স্যার।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।
‘তাহলে রিয়াদ থেকে যাওয়া সব হাইওয়ে আপনি চেক করুন। কতটুকু সময় লাগবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মিনিট মাত্র।’ গোয়েন্দা প্রধান বলল।
কথা শেষ করেই গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ ড্রয়ারে সুইচ-প্যানেলের একটা বোতাম চাপ দিল। সংগে সংগেই দেয়ালের স্ক্রিনে স্ক্রোল শুরু হয়ে গেল।
প্রথমেই স্ক্রোলে এল রিয়াদের পূর্ব দিকের হাইওয়ে। হাইওয়ের নাম্বার ফরটি। হাইওয়ে ফরটিতে স্ক্রোলের দু’জায়গায় পাওয়া গেল ‘ব্রেক’- এর সংগে সংগেই দেয়ালের বটম। দেয়ালের স্ক্রিনে এবার গাড়ির ক্লোজ দৃশ্যের বদলে স্থানটির নাম ও সময় ভেসে উঠছে। ৪০ নাম্বার হাইওয়েথে প্রথম ব্রেক দেখা গেল রিয়াদের পূর্বে আল-নজল স্থানে, দ্বিতীয়টি আল-জওফে। ৪০ নাম্বার হাইওয়েতে আর ‘ব্রেক’ পাওয়া গেল না। ৮৫ নাম্বার হাইওয়ের হফুফ নামক স্থানে দু’টি ‘ব্রেক’ পাওয়া গেল অল্প সময়ের ব্যবধানে। অল্প ব্যবধানে দু’টি ‘ব্রেক’ পাওয়ায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বিস্ময় ও গভীর ভাবনার ছায়া নামল তার চোখে-মুখে। কিন্তু কিছুই বলল না।
চতুর্থ স্থান আল-সালওতেও পাওয়া গেল দু’টি ব্রেক। আবার সেভাবেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। সেই বিস্ময়, সেই চিন্তা আবার তার চোখে-মুখে। রিয়াদ থেকে উত্তর ও পশ্চিমগামী কোন হাইওয়ের স্ক্রোলেই কোন ব্রেক পাওয়া গেল না। সবশেষে শুরু হলো রিয়াদ থেকে দক্ষিনগামী ১০ নাম্বার হাইওয়ের স্কোল। হাইওয়ে ১০-এ পাওয়া গেল দু’টি ‘ব্রেক’। ৮৫ নং হাইওয়ের ‘হফুফ’ গামী হাইওয়ের হারাদ-এ এসে স্ক্রোলে ব্রেক পড়তেই আহমদ মুসার চোখ-মুখ থেকে বিস্ময় ও ভাবনার চিহ্ন মুছে গেল। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ। বলল, ‘আর স্ক্রোলের দরকার নেই মি. আবদুল্লাহ। যা চাচ্ছিলাম তা পেয়ে গেছি।’
স্ক্রোল বন্ধ হয়ে গেল। বিস্ময় ও আনন্দে উদ্বেল গোয়েন্দা আবদুল্লাহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
তবে আহমদ মুসা অনেকটা নিরব। তার কন্ঠে ঝরে পড়ল অসীম হতাশা। ‘সৌদি আরব থেকে তারা পালিয়েছে কিনা জানি না। তবে তারা সকাল ৯টার মধ্যেই আল-মালওয়াতে পৌঁছে যায়। আল-মালওয়া থেকে আরও দক্ষিনে আরব আমিরাতের দিকে যাবার দৃশ্য কোন স্ক্রোল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হয় তারা আল-মালওয়া অঞ্চলের কোথাও আছে অথবা আল-মালওয়ার লাগোয়া কাতারে তারা প্রবেশ করেছে বা সাগর পথে একটু এগিয়ে বাহরাইনের প্রবেশ করতে পারে কিংবা তারা সাগর পথে অন্য কোথাও চলে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু ঘটনা ঘটার প্রায় সাথে সাথে অন্তত ছ’টার মধ্যে দেশের সকল হাইওয়ে, বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর ও কোষ্ট গার্ডের কাছে বিজ্ঞানিকে কিডন্যাপ করার বিববণসহ আমাদের নির্দেশ পৌঁচে গেছে। তাছাড়া আল-মালওয়ার সমুদ্র অঞ্চল ছোট ও খুবই ব্যস্ত। সৌদি কোষ্ট গার্ড ছাড়াও কাতার ও বাইরাইনের কোষ্ট গার্ডেরাও এখানে পাহারা দেয়। আমরা এলার্ট করার পর আমাদের বিজ্ঞানীসহ এই সাগর-পথ কারও পক্ষে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়।’ সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
‘আপনার কথা ঠিক জনাব। তবে ভাবনার বিষয় হলো তারা উপকূল থেকে পালাবার জন্যে কি ধরনের সমুদ্রযান ব্যবহার করেছেন। সড়ক পথের বিষয়টাই দেখুন। দুই গাড়ি নিয়ে ১০ নাম্বার হাইওয়ে ও ৪০ নাম্বার হাইওয়ের পথে ওরা হফুফ হয়ে আল-মালওয়াতে এসেছে। কিন্তু ধরা যায়নি তাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হাইওয়েতে যে দু’টি গাড়ির ছবি ও তথ্যবলী মনিটরিং ফাইল থেকে মুছে গেছে, সে দু’টি গাড়িকেই আপনি কিডন্যাপারদের বলে ধরছেন। এটা কি সন্দেহাতীত?’ বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
‘আমি কতকগুলো বিষয়ের উপর আমার বিশ্বাস দাঁড় করিয়েছি। বিষয়গুলো কোন ত্রুটি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি সেই বিষয়গুলো মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের।
দু’টি গাড়িই সিসিটিভিকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে এই টেকনলজি ব্যবহার করেছে, দ্বিতীয়ত, দুই গাড়ি এক শহর রিয়াদ থেকে বের হয়ে দুই পথে এগিয়ে আবার তারা হফুফে গিয়ে এক পথে উঠেছে এবং দু’টি গাড়িরই যাত্রা শেষ হয়েছে আল-মালওয়াতে গিয়ে। তৃতীয় বিষয় হলো, রিয়াদ থেকে দুই গাড়ি একই সময়ে যাত্রা শুরু করে আল-মালওয়ার উদ্দেশ্যে। শেষ কথা হলো, পরিবহন সিসিটিভি থেকে তারা নিজেদের আড়াল করতে চাচ্ছিল কেন? এ জন্যেই যে, তারা যাতে তাদের বন্দী ও নিজেদেরকে সবার চোখ থেকে আড়াল করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধানেরও। তাদের কাছেও বিষয়টা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।
কিন্তু পরক্ষণেই মুখে অন্ধকার নেমে এল সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের। বলল, ‘তাহলে মি. আহমদ মুসা, আমরা যদি নিশ্চিত হই যে, কিডন্যাপাররা বিজ্ঞানীকে নিয়ে আল-মালওয়াতে পৌঁছেছে, এ বিষয়েও তাহলে নিশ্চিত হতে হবে যে, কিডন্যাপাররা বিজ্ঞানীকে নিয়ে আমাদের দেশের বাইরে, মানে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।’
‘সৌদি আরবের বাইরে চলে গেছে কিনা, তা আমি নিশ্চিত জানি না। অবশ্য যাওয়ার আশংকাই বেশি। তবে তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে যায়নি। পৃথিবীতে থাকলে তাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই থাকতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! মি. আহমদ মুসা, সৌদি আরব থেকে ওদের চলে যাবার আশংকায় বেশি। তাহলে কম হলেও তাদের সৌদি আরবে থাকার একটা সম্ভাবনাও আছে। সে ক্ষেত্রে আল-মালওয়া অঞ্চলে আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত কিনা।’ বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
‘আমি সেটাই ভাবছি। ওরা এখনও সৌদি আরব থেকে পালিয়ে যেতে পারুক বা না পারুক, আমাদের ওখানে যাওয়া দরকার।’
বলে মুহুর্তের জন্যে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু নড়ে বসে চেয়ারটায় একটু হেলান দিল। শুরু করল আবার, ‘আপনারা প্লিজ একটা নির্দেশ দিন, সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী সময়ে আল-আলওয়া বে’র মারফেস ওয়াটার ও ইনার ওয়াটারে যত জলযান চলাফেরা করেছে, বিশেষ করে আল-মালওয়া বে’ থেকে আউট গোয়িং সব জলযানের বিবরণ ও নির্ঘন্ট তৈরি করে আপনাদের দিক। আপনাদের তরফ থেকে আরও একটা নির্দেশ দেয়া প্রয়োজন যে, আল-মালওয়া বন্দর ছাড়াও এর আশেপাশের উপকূল জুড়ে যে প্রাইভেট জেটি ও নৌ-টার্মিনালগুলো রয়েছে তাদেরও এই সময়ে একটা মনিটরিং দরকার। জানা দরকার যে, এই সময়ে কারা সেখানে গেছে। ‘ থামল আহমদ মুসা।
গোয়েন্দা প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের দিকে।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমি আমাদের নৌবাহিনী ও কোষ্ট গার্ডকে এখনি নির্দেশ দিচ্ছি।’
এটুকু শেষ করেই সৌদি নিরাপত্তা প্রধান তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, ‘আপনি পুলিশকে উপকূলের বন্দর, জেটি ও নৌ-টার্মিনালগুলোতে খোঁজ-খবর নিতে এবং মনিটরিংগুলো যোগাড় করতে বলুন।’
‘অবশ্যই, এখুনি আমি নির্দেশ পাঠাচ্ছি।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার মধ্যেই গোয়েন্দা প্রধানের ওয়ারলেস ‘বিফ’ সিগন্যাল দিতে শুরু করেছে।
ওয়্যারলেস নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান ঘরের এক প্রান্তে সরে গেল। মিনিট খানেক কয়েক কথা বলে গোয়েন্দা প্র্রধান দ্রুত ফিরে এল টেবিল। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা। চেয়ারে বসেই নিরাপত্তা প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, ‘আল-মালওয়ার আমাদের গোয়েন্দা প্রধান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর দিল। সেটা হলো, আল-মালওয়া বে’তে আমাদের নৌবাহিনীর ইনার-ওয়াটার কমান্ডের পেট্রল সাবমেরিন বে’র ফ্লোরে একটা পরিত্যক্ত টিউব সাবমেরিন খুঁজে পেয়েছে। দশ ফিট লম্বা, পাঁচ ফিট বেড়ের টিউব সাবমেরিনটির গায়ে কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয় বা কোম্পানীর পরিচয় চিহ্নিত নেই। প্রাথমিক এই খবরটুকুই আমাদের গোয়েন্দারা এখন পর্যন্ত পেয়েছে। টিউব সাবমেরিনটিকে আল-মালওয়ার নৌঁঘাটিতে নিয়ে আসা হচ্ছে।’
বিস্ময় নামল সকলের চোখে-মুখে। ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার।
‘ধন্যবাদ মি. আবদুল্লাহ। বিস্ময়কর এই ঘটনা। আমাদের পানিসীমায় এ ধরনের ঘটনার আর কোন নজির নেই। দেখি আমি জানতে চেষ্টা করছি। আর কিছু কি জানা গেল টিউব সাবমেরিন সম্পর্কে?’ বলে টেবিল থেকে তার অয়্যারলেস তুলে নিল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা সৌদি নিরাপত্তা প্রধানকে লক্ষ করে বলল, ‘জনাব, আপনি দয়া করে এ বিষয়টাও জানুন, পরিত্যক্ত টিউব সাবমেরিনটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়েছিল কোন তারিখে, কতটায় এবং টিউব সাবমেরিনটিতে মনোগ্রাম ধরনের কোন চিহ্ন আছে কিনা।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ!’ বলে সৌদি নিরাপত্তা প্রধান ওয়্যারলেস নিয়ে সরে গেল ঘরের এক প্রান্তে। কয়েক মিনিট পরে ফিরে এল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান। তার চোখে-মুখে আনন্দ ও উত্তেজনা দুই-ই!
চেয়ারে ফিরে এসেই বলল, ‘ইয়েস মি. আহমদ মুসা, টিউব সাবমেরিনটির ইঞ্জিন বন্ধ হয় ৯টা ৩০ মিনিটে। আর মনোগ্রাম বিষয়ে তারা জানাল মনোগ্রাম ধরনের কিছু তাদের চোখে পড়েনি। অবশ্য বিস্তারিত অনুসন্ধান সবে তারা শুরু করেছে।’
‘পরিত্যক্ত টিউব সাবমেরিনটি পাওয়া গেছে ঠিক কোন জায়গায়?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘হ্যাঁ, এ বিষয়টা আমিও ভেবেছি মি. আহমদ মুসা। বাহরাইনের পূর্ব উপকূল ও কাতারের পশ্চিম উপকূল থেকে প্রায় সমদূরত্বের সাগর তলে পাওয়া গেছে টিউব সাবমেরিনটা।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান, ‘টিউব সাবমেরিনের একমাত্র বডি ছাড়া কিছুই আস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ভেতরের ইঞ্জিনের কাঠামো ছাড়া সব কিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মনে করা হচ্ছে টিউব সাবমেরিন পরিত্যাগ করার সময় ইন্টারন্যাল বিশেষ বিস্ফোরণে ডিভাইসের মাধ্যমে ভেতরের সব কিছু সবংস করে দেয়া হয়। অন্যদিকে টিউব সাবমেরিনটির বাইরের বডি একেবারে ক্লিন, কোথাও কোন লেখা বা চিহ্ন কিছুই নেই।’ থামল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
‘ঠিক কোন লোকেশানে পাওয়া গেছে টিউব সাবমেরিনটি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘মি. আহমদ মুসা, আমি জানি কাতার ও বাহরাইনের মানচিত্র সম্পর্কে আপনার ভাল জানা আছে। ধরুন, কাতারের পশ্চিম উপকূলের মরুশহর আজুরাবা ও বাহরাইনের উপকূল শহর আল-দুর এই দুই শহরকে যদি এক সরল রেখায় যুক্ত করা হয়, তাহলে আল-দুরের কাছের যে বিন্দুটা হবে সেটাই পরিত্যক্ত টিউব সাবমেরিন খুঁজে পাওয়ার লোকেশন।’ বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান।
‘ধন্যবাদ। যারা টিউব সাবমেরিন থেকে আসে, তারা কোথায় যেতে পারে এ সম্পর্কে কেউ কি জানতে পেরেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, এ সম্পর্কে কেউ আমাকে কিছু বলেনি। নিশ্চয় তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। কিন্তু মি. আহমদ মুসা, তারা কোথায় গেল তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, তারা কারা?’ এই অদ্ভুত টিউব সাবমেরিন কেন এসেছিল আমাদের আল-মালওয়া বে’তে কোন পরাশক্তি বা অন্য কারো কি এটা একটা গোয়েন্দা মিশন?’ সৌদি নিরাপত্তা প্রধান বলল।
‘আমার কোন সন্দেহ নেই, এই টিউব সাবমেরিনে করেই কিডন্যাপাররা আমাদের বিজ্ঞানীকে নিয়ে পালাচ্ছিল। তারপর দুর্ঘটনায় পড়ে তারা টিউব সাবমেরিনটি পরিত্যাগ করে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ শুকিয়ে গেল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান, সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধানের।
‘সর্বনাশ, দুর্ঘটনায় আমাদের বিজ্ঞানীর তো কিছু হয়নি? যারা টিউব সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা এখন কোথায়? তাদের সাথেই কি আমাদের বিজ্ঞানীও রয়েছেন? না তার কোন বিপদ হয়েছে?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘এ প্রশ্নগুলো আমারও মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি যথাসম্ভব শীঘ্র আল-মালওয়া যেতে চাই। বাহরাইনেও যেতে হতে পারে, যদি অন্য কোন জলযানে ওদের স্থানান্তরিত হওয়ার প্রমাণ না যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সে সম্ভবনা কি আছে?’ জিজ্ঞাসা সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের।
‘যারা কিডন্যাপিং কাজে টিউব সাবমেরিন ব্যবহার করতে পারে, তাদের পক্ষে অমন ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
উদ্বেগে আড়ষ্ট হয়ে গেল সৌদি নিরাপত্তা প্রধানসহ সকলের মুখ। কথা বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান। বলল, ‘তাহলে কি ও কিডন্যাপিং এর সঙ্গে পরাশক্তিদের কেউ জড়িত? আমি জানি দু’একটি পরাশক্তির গোয়েন্দা বিভাগের গোপন সঞ্চয় ও ধরনের টিউব সাবমেরিন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু প্রথিবীর আর কোন সামরিক বাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে এ জিনিস নেই।’ সৌদি নিরাপত্তা প্রধানের কন্ঠ কম্পিত।
‘কিডন্যাপার সংগঠনের সাথে কোন পরাশক্তির যোগাগোগ বা যোগসূত্র আছে কিনা আমি জানি না। তবে কিডন্যাপার সংগঠন নিজেই অত্যান্ত পাওয়ারফুল, একেবারেই উত্তর-আধুনিক, ওদের হাতে অবিশ্বাস্য সব টেকনলজি রয়েছে। আপনার সাথে এ ব্যাপারে আমার কোন কথা হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আপনাদের গোয়েন্দা প্রধান ওদের সম্পর্কে সামান্য যা জানা গেছে জানা গেছে তা জানিয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, ‘ইয়েস এক্সিলেন্সি, জনাব আহমদ মুসা অনুমান করছেন গ্লোবাল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট এই কিডন্যাপের সাথে জড়িত আছে।’
‘ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট! বলে ভ্রু কুঞ্চিত করে সৌদি নিরাপত্তা প্রধান বলল, ‘এমন কোন সংগঠনের নাম তো আমি শুনিনি। কিন্তু অনুমান বলছেন কেন মি. আহমদ মুসা?’
‘অনুমান এই কারণে যে, এখনও বিষয়টা নিশ্চিত হয়নি। তবে গোটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে এমন কিছু দিক সামনে এসেছে তাতে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটকেই অভিযুক্ত করতে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! মি. আহমদ মুসা, ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, উদ্ধার-অনুসন্ধানের জন্যে এটা খুব বড় ব্যাপার। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন, আমাদেরও সাহায্য করুন। গোয়েন্দা প্রধান মি. আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ আপনার তাঁর সাথে যাওয়া উচিত।’
আবার একটু থেমে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার মহান আংকল খাদেমুল হারামাইন শরীফের মহান বাদশা আপনাকে রিয়াদে স্বাগত জানিয়েছেন। মানুষের প্রতি ও ইসলামের প্রতি আপনার নি:স্বার্থ খেদমত তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন, বর্তমান উদ্ধার-অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেয়ার আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন এবং আশা করেছেন, যত তারাতারি সম্ভব আপনার সাথে তার সাক্ষাত হবে।’
‘এক্সিলেন্সি, তিনি আমাকে স্মরণ করায় আমি। তাকে আমার সালাম পৌঁছাবেন। আল্লাহ তাকে ইসলামের, মানুষের আরো খেদমত করার তৌফিক দিন!’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা।’ বলে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি এখন উঠতে চাই। আস্সালামু আলায়কুম।’
উঠে দাঁড়াল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান। উঠে দাঁড়াল আবদুল রহমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ফয়সাল ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল আজিজ আল-সউদ। সবাই উঠে দাঁড়াল।

একটা ফেরি বোট আল-মালওয়া বে’র নীল বুক চিরে এগুচ্ছে বাহরাইনের দিকে।
এই বোটের একজন সাধারন প্যাসেঞ্জার আহমদ মুসা।
ফেরি বোটটি দু’তলা।
দু’তলার ডেক চেয়ারে বসেছে আহমদ মুসা।
আল-মালওয়া ও বাহরাইনের মধ্যে দিনে নিয়মিত কয়েকবার ফেরি যাতায়াত করে। ফেরিগুলো বাহরাইনের আল-দুর থেকে রাজধানী মানামা পর্যন্ত ভিন্ন ডেস্টিনেশনে যাতায়াত করে। অনেকে আল-দুর, জও, আরাকাস ইত্যাদি স্থানে নেমে সড়ক পথে বিভিন্ন স্থানে যায়।
আহমদ মুসা যাচ্ছে আল-দুরে, দক্ষিন থেকে বাহরাইনের পূর্ব উপকূলে প্রবেশের প্রথম বন্দর। আহমদ মুসা হিসাব করেই বাহরাইরেন এ ছোট্ট বন্দরকে এন্ট্রিপয়েন্ট হিসাবে বাছাই করেছে।
আহমদ মুসা আল-মালওয়া এসে আল-মালওয়া বে’থেকে উদ্ধার করা টিউব সাবমেরিন দেখেছে। টিউব সাবমেরিনে সে যা দেখার আশা করেছিল তা পেয়েছে। টিউব সাবমেরিনের বাইরে গা ও পুড়ে যাওয়া ভেতরের অংশে কোন চিহ্নই পায়নি। অবশেষে টিউব সাবমেরিনের কালো রংয়ের মাথায় কালো রংয়ের একটা মনোগ্রাম পেয়েছে। একটা কালো সুট ঘিরে সুঁচালো মাথার কালো ত্রিভুজ সজ্জিত কালো একটা রিং। রিং-এর শীর্ষ বিন্দুতে রিং-এর একটা ব্রেক। সেখানে ত্রিভুজের আকারে তীক্ষ্ণ ফলার সুদীর্ঘ বর্শা দাঁড়িয়ে। বর্শার দু’পাশে ছোট ছোট দু’টি ত্রিভুজ। আহমদ মুসা নি:সন্দেহ হয় যে, এটাই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সেই মনোগ্রাম। জোসেফাইন ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মনোগ্রামের এমন একটি বর্ণানাই দিয়েছিল।
টিউব সাবমেরিনেই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাদের বিজ্ঞানীকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল, এটা নিশ্চিত হবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা আল-দুরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। সে নিশ্চিত, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোকরা টিউব সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে যদি অন্য কোন জলযানে উঠে চলে না গিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তারা কূলে ওঠা ও অন্য কোথায় যাবার জন্যে সবচেয়ে কাছের আল-দুর বন্দরকেই ব্যবহার করেছে। যদি এটাই ঘটে থাকে, তাহলে দ্রুত বাহরাইনে পৌঁছতে পারলে ছোট্ট এই দেশে ওদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আহমদ মুসা এটাও চিন্তা করেছে যে, তারা বাহরাইনে পৌঁছতে পারলে ছোট্ট এই দেশে ওদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আহমদ মুসা এটাও চিন্তা করেছে যে, তারা বাহরাইন থেকে ডেষ্টিনেশনে যাবার বিকল্প ব্যবস্থা করতে অবশ্যই বেশি সময় নেবে না। তার মনে হয়েছে আজ দিনের অবশিষ্ট সময় ও রাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বোটের ডেকে আহমদ মুসা ছাড়া আরও অনেকে বসে আছে।
চাঁদোয়া টাঙানো থাকায় উন্মুক্ত ডেকের সুবিধা নেই, তবে সরাসরি সূর্যের তাপ থেকে বাঁচা যাচ্ছে। তার উপর সাগরের অব্যাহত বাতাস। পরিবেশটা ঘুম পাড়িয়ে দেবার মত।
আহমদ মুসার দু’পাশে, সামনে, পেছনে সব দিকেই বেদুইন শ্রেণীর আরব। তারা অবিরাম কথা বলছে। তাদের কথার মাঝখানে নিরব আহমদ মুসার অস্থিত্বই যেন হারিয়ে গেছে!
আহমদ মুসার চোখ কিছুটা ধরে এসেছিল। হঠাৎ তার পাশে দু’জন আরবের কথাবার্তা তার ঘুম ছুটিয়ে দিল।
আহমদ মুসার একদম পাশের জন বলছিল, ‘বেঁচে থাকলে আরও কত কি যে দেখতে হবে! আজ সকালে আমাদের ঘাট থেকে আল-দুরে যাবার সময় আমার নৌকার সামনে ৫ জন লোককে ভেসে উঠতে দেখলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি তারা মানুষ। কয়েকটা টিউব ভেসে উঠেছিল পানির উপর। টিউবের মাথায় টর্চের মত মাথাওয়ালা কিছু বসানো। টিউবের মাথা পানির উপর ভেসে ওঠার পরপরই টিউবের মাথা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে সরে যায়। তারপরই সেখান থেকে মানুষ বেরিয়ে আসে। তারা উপকূলে ওঠার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খাড়া উপকূলে উঠতে পারছিল না। আমার নৌকা ওরা দেখতে পায়। আমার সাহায্য চাইলে আমি ওদের নৌকায় তুলে নিয়ে একটু সামনে নিয়ে গিয়ে সমভূমির মত উপকূলে নামিয়ে দেই। ওরা নাকি ট্যুরিষ্ট! ঐ টিউবে ঢুকে পানির তল দিয়ে আল-আসকার থেকে নাকি এদিকে এসেছে। ওদের একজন অসুস্থ হওয়ায় ওদের কূলে উঠতে হয়েছে। লোকটি টিউবের মধ্যেই নাকি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। ওদের ডুবুরির পোষাক আমি দেখেছি। ওতে অক্সিজেন ট্যাংক সাথে নিতে হয় না। টিউবেও সে রকম কিছুই ছিল না। তাহলে ওরা অক্সিজেন ছাড়া ঘন্টার পর ঘন্টা পানির তলে থাকে কি করে! একদম ভূতুড়ে ব্যাপার!’ থামল লোকটি।
আহমদ মুসার মনে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা তখন চরমে।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে তাকিয়ে সুন্দর আরবী ভাষায় বলল, ‘ভাই, আপনার মজার কাহিনী আমিও শুনলাম। সত্যিই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার! ঘটনা আজকে ঘটেছে, কয়টায়?’
বেদুইন আরব আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
তার মুখে হাসি। বলল বেদুইন লোকটি, ‘তখন সময় সাড়ে নয়, পৌনে দশটা হবে। আমি আল-দুরে আসছিলাম সাড়ে দশটার ফেরি ধরব বলে। পথেই ঐ ঘটনা।’
‘ওরা কি বিদেশী? অসুস্থ লোকটাকেও দেখেছেন? লোকটা সংজ্ঞাহীন হওয়ার পরও ওরা কি টিউব চালিয়ে এসেছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। আহমদ মুসা তার উদ্দেশ্য আড়াল করার জন্যে বোকার মতও কিছু প্রশ্ন করছে।
‘অসুস্থ লোকটিকেও দেখেছি। সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেই ওরা নাকি থেমে গেছে। সবাই ওরা বিদেশী। তবে অসুস্থ লোকটির পোষাক অন্যদের মত নয়। তার পরনে ঢিলা পাজামা, কুর্তা ছিল। তার পায়ে-হাতে ছিল রাবারের মোজা দস্তানা। ওদের মোট ছয়জনের মধ্যে একজন মেয়ে ছিল। সেও ছিল পুরুষের পোষাকে।’ বলল বেদুইন আনন্দের সাথে।
‘যে টিউবের মধ্যে ওরা ছিল সেগুলো কি করল?’ বলর আহমদ মুসা।
‘সেটাও এক আশ্চর্য! টিউব যখন গুটাল তখন এক একটা ব্যাগে পরিণত হলো। ব্যাগগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে ওরা চলে যায়।’ বেদুইন লোকটা বলল।
‘টিউবের ভেতরে ইঞ্জিন ধরনের কিছু ছিল না?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঠিক ধরেছেন আপনি। কিছু ছিল টিউবের মধ্যে। তা না হলে ব্যাগগুলো কিছুটা ভারী হলো কেন?’ বলল বেদুইন।
বেদুইন যতটা আনন্দিত হয়ে জবাব দিচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ আহমদ মুসার মধ্যে। তাহলে কিডন্যাপাররা বাহরাইনে ঢুকেছে, সে ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই। অসুস্থ লোকটিই তাদের বিজ্ঞানী। তাকে বেদুইন লোকটি শ্বেতাংগ চেহারায় দেখেছে। কারণ তাকে শ্বেতাংগ-সিকনের মুখোশ পরানো ছিল। তার গায়ের রং আড়াল করার জন্যেই বিজ্ঞানীর হাতে-পায়ে মোজা-দস্তানা পরানো ছিল। তার পোষাক পাল্টানোর সময় কিডন্যাপররা পায়নি। ঢিলা পাজামা-কামিজ ছিল বিজ্ঞানীর ঘুমানোর পোষাক।
আবার কথা বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে, ‘ওদের একটা টিউব পেলে মন্দ হতো না! এগুলো আমাদের দেশে এখনও আসেনি।’
‘ঠিক বলেছেন। অমন জিনিস পেলে তাদের মত নিশ্চিন্তে পানিতে চলাফেরা করা যেত!’ বেদুইনও বলল হাসতে হাসতে।
‘ওরা আপনার সাথে কি ভাষায় কথা বলল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ট্যুরিষ্টরা যেমন বলে ইংরেজি মেশানো ভাঙা আরবিতে।’ বেদুইন বলল।
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি হলে কিন্তু বলতাম, একটা টিউব দিয়ে যাও।’
‘দেখি, আবার দেখা হলে কোথায় পাওয়া যায় ওগুলো, জেনে নেব।’ বেদুইন লোকটি বলল।
‘কোথায় গেল ওরা, থাকে কোথায়, কোথায় উঠেছে? ওরা বলেনি কিছু?’
‘হ্যাঁ, জিনিসগুলো দারুন মজার! কোথায় উঠেছে ওরা বলেনি। শুধু ঐটুকুই বলেছিল তারা আল-আসকার থেকে আসছে।’ বেদুইন বলল।
‘হ্যাঁ, ওখান থেকে আসতে পারে। তবে ট্যুরিষ্টরা প্রথমে আসে মানামাতেই।’ আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু মনে মনে আহমদ মুসা বলল, পুরোটাই ওরা আপনাকে মিথ্যা বলেছে বেদুইন ভাই। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাহরাইনে এসেছে ট্যুরিষ্ট সেজে। নিশ্চয় ওদের উদ্ধার করার জন্যে বিকল্প যান আসছে। যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণই মাত্র ওরা থাকবে বাহরাইনের কোথাও না কোথাও। কোথায় থাকবে তারা? ওরা বাহরাইনে থাকার এ সময়টা খুবই মূল্যবান। সে কি পারবে এই সময়ের মধ্যে ওদের কাছে পৌঁছতে?
আহমদ মুসা একটুক্ষণ নিরব হয়ে পড়েছিল এসব চিন্তায়। ইতিমধ্যে বেদুইন লোকটি তার ওপাশের সাথীর সাথে কথা শুরু করে দিয়েছে।
আহমদ মুসা খুশিই হলো। তার নিরিবিলি একটু সময় দরকার। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এদের বাহরাইনে ঢোকার এই খবর সৌদি গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহকে জানানো দরকার। ওদিক থেকে তিনিও বাহরাইন গোয়েন্দা পুলিশকে বলে এদের সন্ধানের চেষ্টা করতে পারেন। আহমদ মুসা বাহরাইনে আসছে এ ব্যাপারটা সৌদি সরকার আগেই বাহরাইনকে বলেছে।
এক সময় বেদুইন লোকটি আহমদ মুসার দিকে ফিরল। বলল, ‘আপনি বাহরাইনের নন, সউদি আরবেও নতুন নিশ্চয়।’
‘কি করে বুঝলেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার বেদুইনকে।
‘আমরা বেদুইনরা ভাষা চিনি, এমনকি আরবের কোন কবিলার ভাষা কেমন, তাও মোটামুটি আমরা জানি।’ বলল বেদুইন লোকটি অনেক গর্বের সাথেই।
‘ঠিক বলেছেন। তবে আমি মদিনা শরীফের বাসিন্দা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাহরাইনে ব্যবসায়-বাণিজ্য না বেড়াতে এসেছেন?’ জিজ্ঞাসা বেদুইনের।
‘এবার বেড়াতেই এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মদিনা থেকে এই অদ্ভুত পথে কেন, কিং ফাহাদ কজওয়ে বাদ দিয়ে?’ বলল বেদুইন।
বেদুইনের এই কথাবার্তায় বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তার এই সর্বশেষ প্রশ্ন ও ভাষা সম্পর্কে তার জ্ঞান সাধারণ বেদুইনের চেয়ে বড় কিছু তাকে প্রমাণ করে।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমাকে যে প্রশ্ন করলেন, এমন প্রশ্ন টিউবে করে পানি থেকে উঠে আসা ট্যুরিষ্টদের করা উচিত ছিল। যে ‘টিউব বডি ভেইকেল’ এর কথা আমাদের মত মানুষরা শোনেইনি, যে ‘টিউব বডি ভেহিকেল’ সাধারণ ট্যুরিষ্টরা এত সংখ্যায় পেল কি করে?’
বেদুইন লোকটিও হাসল। বলল, ‘প্রশ্ন করলে আরও কিছু মিথ্যা কথা শুনতে হতো। তাই প্রশ্ন করিনি।’
কিছুটা বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে! বলল, ‘তাহলে ওদের সন্দেহ করেছিলেন?’
‘কিছুটা।’ বলল বেদুইন লোকটি।
‘কিন্তু কিছু তো বলতো। কিন্তু প্রশ্ন না করে ছেড়ে দিয়েছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কে বলল ছেড়ে দিয়েছি? থানায় টেলিফোন করেছিলাম। ওরা বন্দী। নিশ্চয় এতক্ষন কথা কিছু বের হয়েছে।’ বলল বেদুইন লোকটি।
‘বন্দী! ওরা বন্দী সত্যিই?’ প্রবল উচ্ছাস আর বিস্ময় নিয়ে কথা কয়টি বের হয়ে এল আহমদ মুসার মুখ থেকে!
একটু চমকেই উঠল বেদুইন লোকটি। পাশের লোকরাও বিস্মিত কন্ঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু এসব দিকে আহমদ মুসার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বলল, ‘প্লিজ আপনি থানায় টেলিফোন করুন। থানায় আটক থাকার মত লোক ওরা নয়। কি হয়েছে দেখুন।’
বিস্ময় বেদুইন লোকটির চোখে-মুখে। বলল, ‘আপনি ওদের চেনেন?’
‘চিনি না, জানি আমি ওদের। ওদের সন্ধানেই আমি বাহরাইন যাচ্ছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি কারো সন্ধানে বাহরাইন যাচ্ছেন সেটা আমি জানি। বাহরাইন থেকেই আল-মালওয়াতে আমাকে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে আপনার সঙ্গ দিয়ে বাহরাইনে নেবার জন্যে।’ বলল বেদুইন লোকটি।
‘একটু দেরিতে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। ধন্যবদ আপনাকে। প্লিজ আপনি থানায় টেলিফোন করুন।’ আহমদ মুসা বলল দ্রুত কন্ঠে।
‘আমাদের বাহরাইনের থানাগুলো বিশ্বস্ত আর দক্ষও। আশা করি থানা তাদের ব্যাপারে আইনে প্রসেস শুরু করেছে।’ বেদুইন লোকটি পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে কথাগুলো বলল।
কল করল সে থানায়।
ওপার থেকে সাড়া পেতেই সালাম দিয়ে বেদুইন লোকটি জিজ্ঞাসা করল বন্দীদের কথা। ওপারের কথা শুনেই এক পোঁচ কালিতে তার মুখটা যেন ঢেকে গেল! বলল, ‘পরের খবর কি?’
ওপারের সাথে কথা শেষ করে কল অফ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল দ্রুত কন্ঠে, ‘কি খবর? খারাপ খবর? বন্দীরা পালিয়েছে?
‘স্যরি। আপনার কথাই সত্যি হয়েছে।বন্দীরা পালিয়েছে। বন্দীদের নিয়ে থানায় পৌছার পর থানার পুলিশরা কৌতুহলী হয়ে এসেছিল থানার হল ঘরে। তখন হঠাৎ সব পুলিশ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে এবং সেই সুযোগে তারা পালিয়ে যায়।’ বলল বেদুইন। শুষ্ক কন্ঠ তার।
সাধারন থানা ওদের আটকাতে পারবে না। আহমদ মুসা এটা জানলেও অবধারিত সে বিষয়টা খুবই কষ্টদায়ক হলো আহমদ মুসার জন্যে।
বেদুইন লোকটি থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলতে পারল না।
নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়। কোথায় পাওয়া যাবে এখন ওদের? হাত ফসকে বেরিয়ে যাবার পর ওরা এখন আরও সতর্ক নিশ্চয়। আহত বাঘের মত এখন ওরা। অতি দ্রুত তারা বাহরাইন থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করবে। অবশ্য বিকল্প যান না আসা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতেই হবে। কোথায় অপেক্ষা করবে? এই মুহুর্তে এই জায়গা খুঁজে পাওয়াই তাদের সামনের প্রধান কাজ।
আহমদ মুসার চিন্তা থেমে গেল বেদুইন লোকটির কথায়। বলল বেদুইন লোকটি, ‘আপনি দেখছি খুব কষ্ট পেয়েছেন? আসলে ওরা কারা?’
‘ওরা দুর্ধর্ষ একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলের সদস্য। আমাদের একজন শীর্ষ বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে ওরা পালাচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও ব্যাড লাক, ঐ অসুস্থ লোকটিই কি তাহলে ছিলেন বিজ্ঞানী।’ বলল বেদুইন লোকটি।
‘আচ্ছা, ওরা থানা থেকে বাহরাইনের কোথায় পালাতে পারে বলুন তো?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
বেদুইন লোকটি একটু ভেবে বলল, ‘উপকূলের কাছাকাছি কোন স্থানে?’
‘সেটা কোথায় হতে পারে?’
বিভক্ত হয়ে উপকূল এলাকার বিভিন্ন হোটেলে।’
‘শুধু বিভক্ত হয়ে নয় ছদ্ধবেশও নিতে নিতে পারে তারা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন। ওদের স্কিন মুখোশগুলো একেবারে নিখুঁত। ওরকম তাদের গ্লাভস মোজাও আছে নিশ্চয়।’ বলল বেদুইন লোকটি।
‘আমার সম্পর্কে তো আপনি ব্রিফড হয়েছেন। এবার আপনার নাম-পরিচয়টা বলে ফেলুন। আমরা আল-দুরে এসে গেছি প্রায়।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল বেদুইন লোকটি। বলল, ‘আমি প্রকৃতই এক বেদু্ইন পরিবারের ছেলে। বেদুইনের পোষাক পরতে আমি কমফর্ট ফিল করি বলে এই পোষাকই আমি সাধারনত পরে থাকি। বাহরাইনের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন অফিসার আমি। আমার নাম আবদুল আলী আল-হামাদী। আমার আর কিছু পরিচয় নেই। আপনার সম্পর্কে কার্যত কিছুই জানি না। আমার মোবাইলে আপনার ফটো পাঠিয়ে বলা হয়েছে ইনি একজন ভিভিআইপি ব্যাক্তিত্ব। একটা মিশন নিয়ে বাহরাইন আসছেন। তাঁকে সঙ্গ দেবেন এবং তিনি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করবেন। আপনার নামটাও তারা আমাকে জানাননি।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার নাম আহমদ।’
‘ধন্যবাদ, আর জানার দরকার নেই। আপনার মিশনটাও বুঝেছি। বিজ্ঞানীকে উদ্ধার।’ বলল আবদুল আলী আল-হামাদী।
আহমদ মুসা আল-হামাদীর সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘চলুন, আমরা বন্দর আল-দুর থেকে আমাদের কাজ শুরু করি।’
‘ওয়েলকাম স্যার। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা যাতে আমরা ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ বলতে পারি।’বলল আল-হামাদী।
‘সফল না হওয়ার ক্ষেত্রে আপনার মতে কি কি দিক আছে বলুন তো? আহমদ মুসা বলল।
‘প্রথম, ওদের ছদ্মবেশ নেয়ার দক্ষতা।দ্বিতীয়, প্রথমেই তারা গ্রেফতার হওয়ার মত ধাক্কা খাওয়ার পর ওরা সাগরেও নেমে যেতে পারে, এমনকি মাঝের অপ্রশস্ত উপসাগর পাড়ি দিয়ে কাতারেও চলে পারে।’ বলল আল-হামাদী।
‘ধন্যবাদ আল-হামাদী। ওরা যদি ভয় পেয়ে থাকে, তাহলে আপনার কথা সত্য হবে। কিন্তু ওরা দারুণ আত্মবিশ্বাসী। ভয় ওরা পায় না। ওদের এই আত্মবিশ্বাসই তাদের সাফল্য পুঁজি।’ আহমদ মুসা বলল। আল-দুরের জেটিতে নোঙর করল আহমদ মুসাদের বোট।
আল-দুরের জেটিতে নোঙর করল আহমদ মুসাদের বোট।
আহমদ মুসা ও আল-হামাদী উঠে দাঁড়াল এক সাথেই।

Top