৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার গাড়ি বাহরাইনের আল-মুহাররেক দ্বীপের উপকূল হাইওয়ে ধরে তীব্র বেগে এগিয়ে চলছিল পূর্ব উপকূলের ‘‘আল-হিদ’-এর দিকে।
‘আল-হিদ সাগরের পানি ঘেঁষে দাঁড়ানো বিখ্যাত পর্যটন শহর। আল-দুর বন্দরে নেমে খোঁজ-খবর নেয়ার পর আহমদ মুসারা বাহরাইনের রাজধানী মানামায় এসেছিল। মানামার একটা ব্রীফ চিত্র সামনে আনার পর মানামার শীর্ষ হোটেল গোল্ডেন টিউলিপের একটা কক্ষে বসে আহমদ মুসা বাহরাইনের মানচিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আল-হামাদীকে বলেছিল, আমার মনে হয় ওরা সব দিক বিবেচনা করে আল-মুহাররেক দ্বীপকে বেছে নিয়েছে। আহমদ মুসার কথা শুনে আল- হামাদী বলেছিল, আল-মুহাররেক দীর্ঘ দ্বীপ। কোথায় আমরা ওদের তালাশ করব? আহমদ মুসা বলেছিল, আল-মুহাররেকে দ্বীপে তেমন বন-বাদাড় নেই ওদের লুকিয়ে থাকার মত। সুতরাং ওরা মানুষের ভিড়কেই বেছে নেবে নিজেদের হাইড করার মত। তাছাড়া এমন এক স্থানে আশ্রয় নেবে যেখান থেকে তাদের চলে যাওয়া বা পালোনো সহজ হয়। এ জন্যে সমুদ্রের উপকূল, বিশেষ করে সমুদ্রের পানি সংলগ্ন জায়গা ওরা বেছে নেবে ওদের লুকানোর জন্যে। এ সব দিকের বিবেচনায আমি মুহাররেক দ্বীপের পূর্ব উপকূলের আল-হিদ’-কে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। মুল শহরটাই বলা যায় সমুদ্রের গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে আল-হিদের সবচেয়ে ক্রাউডেড হোটেল’ সী-গাল বাহরাইন’ আর ‘সী গাল বাহরাইন’ তো গোটাটাই সমুদ্রের উপর ভাসছে! গোটা বাহরাইনে এর চেয়ে আইডিয়াল জায়গা সমুদ্রচারী কিডন্যাপাদের জন্যে আর দ্বিতীয়টি নেই বলে আমার মনে হয়। আল-হামাদী সোৎসাহে আহমদ মুসার কথায় সায় দিয়েছিল।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ও আল-হামাদী আল-মুহাররেক দ্বীপের ‘আল-হিদে’র উদ্দেশ্য বের হয়।
‘আল-হিদ’ শহরে প্রবেশ করেছে আহমদ মুসাদের গাড়ি। আল-হিদ শহরটি উপকূল বরাবর লম্বালম্বি গড়ে তোলা হয়েছে।
গভীর সাগর থেকে উঠে আসা পাহাড়ের গোড়ায তৈরি হয়েছে শহরটি। পাহাড়ের পাদদেশটা পাথুরে, দীর্ঘ ও প্রশস্ত। এটাই আল-হিদ শহরের ভিত্তিভূমি। হোটেল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল আহমদ মুসাদের গাড়ি।
পার্কিং-এ গাড়ি রেখে দু’জনে হোটেলের লাউঞ্জে প্রবেশ করল।
‘মি. আল-হামাদী, আপনি এদের ডিসপ্লে ষ্ট্যান্ড থেকে হোটেলের ক্যাটালগটা নিয়ে আসুন।’
বলে আহমদ মুসা সোফায় গিয়ে বসল। হোটেলের ক্যাটালগ নিয়ে আল-হামাদী এসে আহমদ মুসার পাশে বসল।
আহমদ মুসা হোটেলের ক্যাটালগে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হোটেলে স্পেশাল স্যুট ছাড়াও এপার্টমেন্ট রয়েছে। স্যুট ও এপার্টমেন্ট প্রায় সব ক’টারই ফ্রন্ট দেখা যাচ্ছে সাগরের দিকে। যে সব স্যুট এপার্টমেন্টের ফেস সাগরের দিকে, সেগুলোর বাসিন্দাদের বিবরণ যোগাড় করুন। ইতিমধ্যে আমি দেখছি কোন এপার্টমেন্ট খালি আছে কিনা।’
উঠল আহমদ মুসা্। এগোলো রিজার্ভেশন কাউন্টারের দিকে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল আল-হামাদী্ও।
এপার্টমেন্ট রিজার্ভেশনে গিয়ে আহমদ মুস দেখল যে, একটিও খালি নেই। আহমদ মুসা মনে মনে একটা হিসাব কষে বলল, ‘কিন্তু আমি জেনেছিলাম একটা খালি আছে।’
‘স্যার, আজ সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দু’টি এপার্টমেন্ট খালি ছিল। পরে দু’টিই ভাড়া হয়ে গেছে।’ বলল রিজার্ভেশন অফিসার।
‘এক সাথে দু’টি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি, স্যার।’ বলল রিজার্ভেশনের লোকটি।
‘তাহলে কি আমার বন্ধুরা আগেই এসে গেছে! প্লিজ নামগুলো একটু দেখি। ওরা হলে তো আমাদের রিজার্ভেশনও হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুখে খুশির ভাব টেনে।
‘অবশ্যই স্যার, দেখুন। কিন্তু ওরা তো বিভিন্ন বয়সের। বাবার বয়সেরও আছেন।’
বলে রিজার্ভেশনের লোকটি রিজার্ভেশন রেজিষ্টারের সংশ্লিষ্ট পাতা আহমদ মুসার সামনে মেলে ধরল।
আহমদ মুসা দেখল, নামগুলো সব ইউরোপীয়ান। বিভিন্ন বয়সের। দু’জন পঞ্চাশোর্ধ্ব। দু’জনের বয়স চল্লিশের উপরে। একজনের তিরিশ। অবশিষ্টজনের পঁচিশ।
মনে মনে হতাশ হওয়ার ভংগিতে বলল আহমদ মুসা, ‘না, এরা নয়। তাহলে ওরা কি স্যুটে উঠেছে! আচ্ছা, বলুন তো আজ কয়টি স্যুটের রিজার্ভেশন হয়েছে?’
‘স্যার, আজ কোন স্যুটের রিজার্ভেশন হয়নি। সব স্যুট আগে থেকেই ভর্তি।’
বলে রিজার্ভেশনের লোকটি একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘স্যার, ঘন্টাখানেকের মধ্যে একটা এপার্টমেন্ট রিজার্ভেশনের জন্যে রেডি হবে। এ এপার্টমেন্টের পাশেই সে এপার্টমেন্টটি। আপনি ইচ্ছা করলে এখনি বুক করতে পারেন। ঘন্টাখানেক কষ্ট করতে হবে আপনাকে।’
আহমদ মুসা বসে ভাবল, আল্লাহ যখন তাদের জন্যে এই এপার্টমেন্টটাই মেলাচ্ছেন, তখন নেয়াই উচিত। পরের চিন্তা পরে হবে।
‘ঠিক আছে রিজার্ভেশন করে ফেলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
রিজার্ভেশন অফিসার একটি ফরম এগিয়ে দিলে আহমদ মুসা সেটা পূরণ করে টাকা দিয়ে ফিরে এল লাউঞ্জে আগের সোফায়।
একটু পর ফিরে আল-হামাদীও।
‘মি. আল-হামাদী, স্যুট ও এপার্টমেন্টে আশার আলো আমি দেখছি না। একমাত্র দু’টো এপার্টমেন্টে বেলা ১টার দিকে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। তারা সংখ্যায় ছয় বটে, কিন্তু বয়সে আকাশ পাতাল। দেখি আপনার লিষ্টটায় নতুন কিছু আছে কিনা। বলে আহমদ মুসা আর-হামাদীর হাত থেকে স্যুট ও এপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের তালিকা নিয়ে নিল। নজর বুলাল সব শেষে এপার্টমেন্টে ওঠা দুই এপার্টমেন্টের সেই ছয়জনের বিবরণের উপর। ছয়জনের সবাই নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। বলল, ‘নামগুলো দেখে ভেবেছিলাম এরা ইউরোপীয়, কিন্তু এখন দেখছি এরা নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। এটুকু নতুন পাওয়া গেল।’
‘তাহলে আমাদের এখানে আসাটা কি ব্যার্থ হলো?’ বলল আল-হামাদী।
‘অনেক বিবেচনা সামনে নিয়ে এখানে এসেছি। বিবেচনাগুলো আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। অতএব, হতাশা নয়। এপার্টমেন্টে উঠতে এখনও এক ঘন্টা বাকি। চলুন, সময়টা আমরা কফিখানায় কাটাই। বিকেলে তো কফিখানায় অনেক লোক পাওয়া যাবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দু’জনে চলল কফিখানার দিকে।
দু’জনের পরনেই শিখ ট্যুরিষ্টের ছদ্ধবেশ।
বিশাল কফিখানা। অনেক লোক, তবু ফাঁকাই মনে হচ্ছে।
কফিখানার এক প্রান্তের মঞ্চে আরবী পোষাকে একজন ইউরোপীয় গায়িকা হালকা সুরে সেতার বাজিয়ে গান গাচ্ছে। দু’জন সেই আরবী পোষাকে ইউরোপীয় তরুনী গানে সঙ্গ দিচ্ছে হালকা রকমের শরীর দুলিয়ে।
বাহরাইনের কফিখানায় বিকালেও কফি পানের চল আছে।
কফিখানায় নজর বুলাল। সাগর প্রান্তের টেবিলগুলোতেই ভিড় বেশি। দেখা গেল দু’টি চেয়ারের একটা টেবিল খালি আছে।
আহমদ মুসা নিউজ পেপার ষ্ট্যান্ড থেকে একটা ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে এগোলো সেই ফাঁকা টেবিলটার দিকে।
টেবিলও একটা ইংরেজি পত্রিকা পড়ে ছিল।
আহমদ মুসা টেবিলে পৌঁছতেই ওয়েটার কাগজটা নিয়ে যাচ্ছিল। ওটা ভিন্ন একটা ইংরেজি দৈনিক।
‘ওটাও আমি দেখব, রেখে যান প্লিজ।’ বলল ওয়েটারকে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও আল-হামাদী বসল টেবিলে। আহমদ মুসার পেছনেই আরেকটা টেবিল। চারজনের টেবিল। তাতে চারজন শ্বেতাংগ বসে আছে।
আহমদ মুসা কফির অর্ডার দিয়ে পত্রিকা খুলে পড়তে লাগল।
পেছনের টেবিলের কথাবার্তা নিচু স্বরে হলেও কিছু টুকরো টুকরো শব্দ তার কানে আসছিল। শব্দগুলো ইংরেজি নয়। দু’একটা কন্ঠ পরিচিত হিসাবে কানে বাজছে। মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দও আসছে। কিন্তু পরক্ষনেই কন্ঠ আবার অপরিচিত শব্দে চলে যাচ্ছে। আহমদ মুসা দেখল ওদের উচ্চারণচটা সাবলীল, কিন্তু অপরিচিত ভাষাটা তাদের কন্ঠে সাবলীল শোনাচ্ছে না।
যা হোক, ওদের কথাবার্তায় মনোযোগী হওয়ার এবং সেদিক থেকে মনোযোগ সরাতে না পারায় আহমদ মুসার খবরের কাগজ পড়া এগোল না। ইতিমধ্যে এসে গেল কফি।
এবার কফির কাপে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
এখন তার খেয়াল হলো পেছনের কথাবার্তা আর কানে আসছে না। সংগে সংগে মাথা ঘুরিয়ে দেখল পেছনের টেবিল খালি।
কফির সাথে সাথে এবার কাগজে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
‘বাহরাইন টাইমস’ পড়ার পর আহমদ মুসা ‘বাহরাইন ইন্টারন্যাল’ পত্রিকা টেনে নিল।
পত্রিকাটি খোলা অবস্থায় ভাঁজ করা ছিল। ভেতরের খোলা অংশের উপর চোখ পড়তেই চোখ আটকে গেল পত্রিকার মার্জিনে একটা লেখার উপর। তিন শব্দের একটা লেখা। ইংরেজি বর্ণমালায়, কিন্তু শব্দগুলো ইংরেজি নয়।
মনোযোগ দিয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, এ যে তাহিতিয়ান ভাষা! হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় এল, ‘পেছনের টেবিলের যে শব্দগুলো তার কানে এসেছে, সেগুলোও তো তাহিতিয়ান! তাহলে এ টেবিলেও কি ওদেরই কেউ বসেছিল? পাশ দিয়ে ওয়েটার যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে ডাকল। জিজ্ঞাসা করল, ‘এ টেবিলে আমাদের আগে কারা বসেছিল, জান?’
‘স্যার, আপনাদের পেছনের টেবিলের ৪ জনের দু’জন আগে এই টেবিলেই বসেছিল, পরে ওরা ঐ টেবিলে উঠে যায়।’ বলল ওয়েটার।
‘ধন্যবাদ ওয়েটার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মোস্ট ওয়েলকাম স্যার!’ বলে ওয়েটার চলে গেল।
আবার লেখার দিকে মনোযোগ চলে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা মিন্দানাও থাকাকালে মুর হামসারের কাছে তাহিতিয়ান ভাষা কিছুটা শিখেছিল। মুর হামাসার বলা যায় ঐ অঞ্চলের ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ প্রায়। তিন শব্দের তাহিতিয়ান ভাষায় যে অর্থ আহমদ মুসা দাঁড় করাল তা হলো: ‘অ্যাটল ক্ষমতার রাজধানী আজ।’
অর্থ করার পর আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, পত্রিকার যে মার্জিনে এই কথা লেখা আছে তার পাশেই পত্রিকার যে ফিচারটা লেখা তা ‘অ্যাটল’-এর উপর। পত্রিকার ৪ কলাম আট ইঞ্চি নিয়ে বিশাল ফিচারটা। ফিচারের শিরোনাম হলো: ‘স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি পৃথিবীর অ্যাটল দ্বীপগুলো।’
শিরোনামটা আহমদ মুসাকেও আকৃষ্ট করল। ‘অ্যাটল’ জাতীয় দ্বীপের কথা সে শুনেছে, কিন্তু কিছুই জানে না সে এই দ্বীপগুলো সম্পর্কে। পড়ল আহমদ মুসা ফিচারটা।
পড়ে আহমদ মুসাও স্বীকার করল ‘অ্যাটল দ্বীপ’ সত্যিই আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি! কিন্তু মার্জিনে তাহিতিয়ান ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার সাথে কোন সংগতি খুঁজে পেল না আহমদ মুসা। ‘অ্যাটল দ্বীপ’ সুন্দর, বিস্ময়কর ঠিক আছে, কিন্তু ক্ষমতার রাজধানী হলো কি করে?
এই জিজ্ঞাসার কোন উত্তর খুঁজে পেল না আহমদ মুসা। বিষয়টা অর্থহীন অবচেতন একটা মন্তব্যও হতে পারে।
‘স্যার, মাগরিবের নামাজ ঘনিয়ে আসছে। এদিকে আমাদের বরাদ্দ এক ঘন্টা সময়ও পূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা এপার্টমেন্টে গিয়ে নামাজ পড়তে পারি।’ বলল আল-হামাদী।
লেখা নিয়ে আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
আহমদ মুসা আল-হামাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হোটেলের মসজিদ দোতলায়। খাবারের প্রধান হলপরও দোতলায়। আমরা মসজিদে নামাজ পড়ে, ডিনার শেষ করে তারপর এপার্টমেন্টে নেমে যাব।’ সব এপার্টমেন্টই সাগরের উপর একতলার বিশাল বর্ধিত ডক অংশে তৈরি।
‘ঠিক আছে, এটাই ভাল হবে। নামাজ পড়ে খাওয়ার আগে আমি একটু খোঁজ নিতে চাচ্ছি যে, আজ বেলা ১ টার দিকে কারা হোটেলে এসেছে।’ বলল আল-হামাদী।
‘ঠিক বলেছেন, ওটা খুব জরুরী। খাবার ফাঁকে আমরা লিস্টটা দেখে নেব। রাত দশটার পর সন্দেহজনক টার্গেটগুলোর-আমরা খোঁজ-খবর নিতে চাই। ‘ছয়’ সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ স্যার।’ বলল আল-হামাদী।
‘ঠিক বলেছেন, ওটা খুব জরুরি। খাবার ফাঁকে আমরা লিষ্টটা দেখে নেব। রাত দশটার পর সন্দেহজনক টার্গেটগুলোর-আমরা খোঁজ খবর নেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের পাশের এপার্টমেন্টেরও আমরা একটু খোঁজ-খবর নিতে চাই। ‘ছয়’ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ স্যার।’ বলল আল-হামাদী।
‘অবশ্যই, মি. আল-হামাদী। এমন চিন্তা থেকেই তো ওদের পাশের এপার্টমেন্টটা নিয়েছি। শুধু ‘ছয়’ সংখ্যা নয় মি. হামাদী, ওরা একটার দিকে হোটেলে উঠেছে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ। ওদের বয়স অবশ্যই বড় কথা, কিন্তু বয়স নানাভাবে বাড়ানো-কমানো যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
আল-হামাদীর চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঠিক তো, এ দিকটা তো আমার মাথায় আসেনি!’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন।’
আল-হামাদী উঠে দাঁড়াল। দু’জন বেরিয়ে এল কফিখানা থেকে।
রাত ৯টায় আহমদ মুসারা লিফটে উঠল এ্যাপার্টমেন্টে নামার জন্যে।
এক তলায় লিফটের দরজা খুলতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ল আহমদ মুসাদের।
ডেকের তিন প্রান্ত দিয়ে সাগরের ধার ঘেঁষে এপার্টমেন্টের সারি। এপার্টমেন্টের ফেসগুলো সব সমুদ্রের দিকে। এপার্টমেন্টগুলোর দু’পাশ ও পেছন ঘিরে বাগান। পেছনের বাগানগুলোর পরে দীর্ঘ প্রশস্ত ডেকে টেনিস-ব্যাডমিন্টনের কোর্ট ও শিশুদের খেলাখুলা করার মত জায়গা। এসবের মধ্যে দিয়ে লাল পাথরের রাস্তা তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাটগুলোতে যাবার।
প্রতিটি এপার্টমেন্টের টপে নিয়ন সাইনে এপার্টমেন্টের নাম্বার লিখা।
আহমদ মুসাদের এপার্টমেন্ট নাম্বার ‘সিগাল সুইট-১১’।চোখ ঘুরাবার সময় সর্বশেষ নাম্বারটাও চোখে পড়ল:’সি-গাল তাজ-৩৩’।
আহমদ মুসাদের এপার্টমেন্ট মাঝ বরাবর থেকে একটু ডান পাশে। তার মানে সিরিয়ালটা শুরু হয়েছে দক্ষিণের প্র্রান্ত থেকে।
আহমদ মুসারা লাল পাথরের রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে এগুলো তাদের এপার্টমেন্টের দিকে।
প্রতিটি এপার্টমেন্টের পেছনের বাগানের ভেতর দিয়ে এপার্টমেন্টে ওঠার গেট।
আহমদ মুসারা বাগানের সু্ন্দর গ্রিলের গেট খুলে বাগানের ভেতরে প্রবেশ করল।
বাগানের ভেতর দিয়েও সেই লাল পাথরের রাস্তা।লাল রাস্তা ধরে আহমদ মুসারা এগুলো গেটের দিকে।
মাথায় নীল গম্বুজের পরা সুন্দর গেট। দামি কাঠের সুন্দর দরজা মুসলিম ঐতিহ্যের লতা-পাতার অপরূপ কারুকাজে ভরা।
একদম সামনের ফেসটা মজবুজ, সুন্দর, উঁচু ফেন্সে ঘেরা প্রশস্ত লন। ফেন্সের মাঝখানে তালাবদ্ধ একটা গ্রিলের দরজা আছে। দরজা খুললেই পাওয়া যাবে একটা সিঁড়ি এবং সেটি নীচে নেমে গেছে। সিঁড়ির গোড়ায় বাঁধা আছে বোট।
প্রতিটি এপার্টমেন্টের একই ব্যবস্থা কিনা, তা দেখার জন্যে আহমদ মুসা তাকাল পাশের এপার্টমেন্টের জন্য দশ দশ ফুটের সাইডগার্ডেনে নামা যায়।
পাশের এপার্টমেন্টের সামনে চোখ পড়তেই ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। দেখল এপার্টমেন্টটি থেকে সাগরে নেমে যাওয়া সিঁড়ির গোড়ায় একটা টিউব সাবমেরিন ভাসছে। টিউব সাবমেরিনের গায়ের একটা হোল দিয়ে একজন প্রবেশ করছে, আরেকজন অপেক্ষমাণ হোলের মুখে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মাথায় এল এটাই তো সেই নিউজিল্যান্ডের ছয় জনের ভাড়া নেয়া ‘সি-গাল আল-হামরা-১২’ এপার্টমেন্ট!
একটা প্রচন্ড ঝড়ে রহস্যের সব দরজা এক সাথেই খুলে গেল আহমদ মুসার সামনে।
মুহূর্তের জন্যে একটা বিমূঢ়তা এসে আহমদ মুসাকে আচ্ছন্ন করল।
তাকাল সে সাগরের সিঁড়িতে নামার গ্রিলের দরজার দিকে। ওটা তালাবদ্ধ। চাবি কোনটা বা কোথায় তা তার জানা নেই। খুঁজলে বা জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে। সে সময় কোথায়? এখনি ওদের আটকাতে হবে।
আহমদ মুসা হাতে রিভলবার আগেই উঠে এসেছিল। গুলি করে আহমদ মুসা গ্রিলের দরজার তালা ভেঙে ফেলল।
এক টানে দরজা খুলে ফেলল আহমদ মুসা। সাগরে নামার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল দ্রুত।
বুঝতে পেরেছে আল-হামাদীও।
সেও আহমদ মুসার পেছনে ছিল।
হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, ওরা বোমা ছুঁড়েছে!’
আল-হামাদীর কথা শেষ হবার আগেই একটা কিছু এসে বুম করে ফেটে গেল তাদের পাশের গ্রিলে।
আহমদ মুসার সেদিকে তাকাবারও সময় হলো না। কয়েকটা শব্দ তার কানে এল। তা ভাববারও তার সময় হলো না। তার দেহটা লুটিয়ে পড়ল খোলা দরজার উপর। তার পেছনে আল আল-হামাদীর দেহটাও ঝরে পড়ল দরজার পেছনে মেঝের উপর।

কতক্ষণ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ছিল তা ভাবতে পারছে না আহমদ মুসা। সংজ্ঞা ফিরে আসতেই আহমদ তার কষ্টকর অবস্থায় পড়ে থাকাটা প্রথম উপলব্ধি করল।
তার কোমর থেকে উপর দিকটা ছিল দরজার উপর। আর সিঁড়ির উপর ঝুলছিল দেহের পেছনের অংশ।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে বসে তাকাল পাশের এপার্টমেন্টের সামনে। যেখানে সাগরে দাঁড়িয়ে ছিল টিউব সাবমেরিন। কিছুই সেখানে নেই। শান্ত, নিস্তরঙ্গ সাগরের বুক।
আহমদ মুসা তাকাল হাত ঘড়ির দিকে। রাত ১ টা বাজে। তার মানে চার ঘন্টা সে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিল।
আহমদ মুসা হিসাব করল বাহরাইনের আল-মুহাররেক দ্বীপ থেকে পারস্য উপসাগরের মুখ হুরমুজ প্রণালীয় দূরত্বের কথা। ছয়শ’ কিলোমিটারের কম হবে না। চার ঘন্টায় ৬শ’ কিলোমিটার অতিক্রম করা টিউব সাবমেরিনের জন্যে কঠিন নয়।
তবু আহমদ মুসা তাঁর দেয়া অয়্যারলেস থেকে কল করল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান ইবনে আবদুল আজিজ আল-সউদের কাছে। আহমদ মুসা বুঝল ঘুম থেকে উঠে তিনি কল রিসিভ করলেন। আহমদ মুসা সালাম দিতেই ওপার থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ সালাম দিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসা, আপনি ভাল আছেন?’
‘এক্সিলেন্সি! চার ঘন্টা সংজ্ঞাহীন থাকার পর জ্ঞান ফিরে পেয়েই আপনাকে কল করছি!’
বলে আহমদ মুসা সব ঘটনা তাকে জানিয়ে বলল, ‘যদিও টিউব সাবমেরিন এতক্ষণে হুরমুজ প্রণালী অতিক্রম করে যেতে পারে। তবু আপনি নির্দেশ দিয়ে দেখতে পারেন, হুরমুজ প্রণালীতে এই মুহুর্তে আপনাদের নৌবাহিনী পাহাড়া বসাতে পারে কিনা। হুরমুজ প্রণালীতে ওদের আটকাতে না পারলে পরে আর তা সম্ভব নয়।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমি নির্দেশ দিচ্ছি। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি শুধু জানা নয়, কাছাকাছিও যেতে পেরেছেন। এটা বড় সাফল্য। আমরা দু:খিত আহমদ মুসা আপনাকে এই কষ্টে ফেলার জন্যে। এর কোন বিনিময় দেয়া তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ আপনাকে এর উপযুক্ত যাযাহ দিন।’বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। ওকে এক্সিলেন্সি আপনার সাথে পরে কথা বলব।আপনি ওদিকের কাজ সারুন। আসসালামু আলাইকুম।’
ধন্যবাদ দিয়ে, সালাম নিয়ে কল অফ করে দিল ওপার দিল থেকে আল-সউদ।
আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে মনোযোগ দিল আলী আল-হামাদীর দিকে। তার সংজ্ঞা এখনও ফিরে আসেনি।
আরও সময় নিল আলী হামাদীর সংজ্ঞা ফিরে আসতে।
আহমদ মুসা বসেছিল গ্রিলের দরজায়। তার দুই পা সাগরে নামা সিঁড়ির উপর।
সামনে পারস্য উপসাগরের দিগন্তপ্রসারী কালো কালো বুক। মাঝে মাঝে এই কালো বুকে তারার মত আলো জ্বলে উঠছে, আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে।
সেই ভাবনাটা আবার আহমদ মুসার মাথায় ফিরে এল। সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ কি চেষ্টা করলেন হুরমুজ প্রণালীতে তাদের আটকাতে। আশা কম। টিউব সাবমেরিনের ক্ষমতা সাধারণভাবেই বেশি। আর ওতে যদি কোন বিশেষ জ্বালানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাহলে গতিটা আরও বেশি হতে পারে। সুতরাং ওদিক থেকে কোন আশা নেই। কোথায় গেল ওরা?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল জ্ঞান হারাবার সময় ওদের কন্ঠ থেকে ভেসে আসা তিনটি শব্দের কথা।
মনে পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। শব্দগুলো তো তাহিতিয়ান! এদের মুখে তাহিতিয়ান ভাষা লেখা দেখেছে, তা কি এদের কেউ লিখেছে! তার টেবিলের পেছনে বসা যাদের মুখে তাহিতিয়ান ভাষা শুনেছে, তার কি এরাই? তারা এরাই, যুক্তি তো এটাই বলে। আহমদ মুসা এটাই ভাবল।
এর সাথে আরেকটা ভাবনা চেপে বসল আহমদ মুসার মনে। বুঝা গেছে, তাহিতিয়ান ভাষা এদের মাতৃভাষা নয়। নিজেদের কথা আড়াল করার জন্যে অপরিচিত তাহিতিয়ান ভাষা ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ তাহিতি, সেই তাহিতির ভাষা এরা ব্যবহার করল কেন?
মাথায় একটা চিন্তার উদয় হওয়ার সাথে সাথেই ভীষণভাবে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওরা কি তাহিতিতে থাকে? ওদের হেডকোয়ার্টার কি তাহিতিতে বা আশে-পাশে কোথাও?
আরেকটা প্রশ্ন আহমদ মুসার কাছে খুব বড় হয়ে দেখা দিল। কফিখানার সেই খবরের কাগজে অ্যাটল দ্বীপের প্রশংসা এভাবে এতটা করল কেন? যে অ্যাটল আজ ক্ষমতার রাজধানী। এটা কি একটা কথার কথা? না এর সাথে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কাজ কিংবা পরিকল্পনার কোন যোগ আছে?
সব এক সাথে আহমদ মুসার মাথায় জট পাকিয়ে গেল। কিন্তু সব ছাপিয়ে একটা বিষয় তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, তাহিতি দ্বীপ ও ‘অ্যাটল দ্বীপ’-এর সাথে ব্ল্যাক সানের কোন না কোন সম্পর্ক রয়েছে।
এই সংগে তার কাছে আরেকটি প্রশ্নও বড় হয়ে উঠল, বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপকারীরা তাহিতিয়ান ভাষা মানে তাহিতির সাথে সম্পর্কিত, এ বিষয়টিও খুবই স্পষ্ট। তাহলে কি কিডন্যাপকারীরা বিজ্ঞানীকে তাহিতিতে কিংবা তাহিতির দিকে কোথাও নিয়ে গেল?
উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। একটা নতুন আশার আলো জাগল তার মনে। কিডন্যাপড হওয়া অন্য সব বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদেরও তাহলে কি ঐ একই স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে!
সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে আলী আল-হামাদী। উঠে বসল সে।
‘মি. আলী আল-হামাদী, চিড়িয়া উড়ে গেছে আমাদের সংজ্ঞাহীন করে দিয়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এরাই কিডন্যাপার? আমাদের বিজ্ঞানীকে নিয়েই ওরা পালিয়েছে?’ বলল আলী আল-হামাদী।
‘হ্যাঁ, এরাই কিডন্যাপার। আমরা ওদের সন্দেহের আওতায় এনেও কিছু করতে পারিনি। হয়তো আল্লাহর এটাই ইচ্ছা। আল্লাহর পরিকল্পনা হতে পারে এমনটাই যে, ‘শুধু এক বিজ্ঞানী নয়, কিডন্যাপড হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের ব্যাপারেই আমরা চিন্তা করি।’ আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম না স্যার। আরও কি কিডন্যাপড হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা আলী আল-হামাদীর। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, মি. আল-হামাদী। এ পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ হারিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন অনুল্লেখযোগ্য নিউজ হিসাবে সেগুলো বের হয়েছে। কোন কোনটা প্রচারও পেয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া কোন হৈ-চৈ করেনি।’ বলল আলী আল-হামাদী।
‘তাজ্জবের ব্যাপার! এ নিয়ে হৈ চৈ হয়নি কেন? এসব নিয়ে তো হৈ চৈ হবারই কথা! পাশ্চাত্য মিডিয়া মানবাধিকার’ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে তো পাগল!’ বলল আলী আল-হামাদী।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সব কারণের কথা আমি জানি না। তবে বড় একটা কারণ এই হতে পারে কিডন্যাপড বা হারিয়ে যাওয়া প্রায় সবাই মুসলমান।’
‘হ্যাঁ, সাংঘাতিক কথা! এই সাংঘাতিকটাই সত্য আল-হামাদী।’ আহমদ মুসা বলল।
উত্তরে কথা বলল না আল-হামাদী। বলতে পারল না। তার বিস্ফরিত দুই চোখ নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার তার হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে, ‘রাত ২টার বেশি বেজে গেছে মি. আল-হামাদী। চলুন, ঘুমাতে হবে। এত টাকা দিয়ে এপার্টমেন্ট নেয়া হলো, ব্যবহার তো করতে হবে!’
তখনও আলী আল-হামাদী বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সে বলল, ‘স্যার, তাহলে সৌদি বিজ্ঞানীকেই শুধু উদ্ধার নয়, সকলকে সন্ধান করা, উদ্ধার করাই আপনার মিশন?’
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘হ্যাঁ, মি. আলী আল-হামাদী আমার ইচ্ছা এটাই, যদি আল্লাহ মঞ্জুর করেন।’
‘আরেকটা কথা স্যার, আমি আপনাকে সৌদি কোন শীর্ষ গোয়েন্দা বা কর্তৃপক্ষ মনে করেছিলাম। কিন্তু দেখছি, আপনার কাজ, কথাবার্তা, আচরণ সব কিছুই আমাদের ন্যায় পেশাদার গোয়েন্দার মত নয়। আপনার কাজ, তৎপরতা, আচরণ, কথাবার্তায় অফুরান প্রাণ আছে, সীমাহীন আবেগ আছে, গভীর স্থিরতা আছে। এমনটা আমি কারো মধ্যে কোথাও দেখিনি। আমি বড় বড় মার্কিন ও বৃটিশ গোয়েন্দাদের সাথে কাজ করেছি।’ বলল আলী আল-হামাদী গম্ভীর কন্ঠে।
আহমদ মুসার মুখে শান্ত একটা হাসি ফুটে উঠল। হাত রাখল আলী আল-হামাদীর কাঁধে। বলল, ‘আপনি আমাকে ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলেছেন। ধন্যবাদ আল-হামাদী।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘একটা জরুরি বিষয় আছে মি. আল-হামাদী। বাহরাইনে ভাল ভূগোলবিদ নিশ্চয় আছেন। আমি সে রকম একজনের সাথে দেখা করতে চাই।’
‘নিশ্চয় আছে। প্রয়োজনটা কি ধরনের, জানতে পারি স্যার?’ বলল আলী আল-হামাদী।
‘অবশ্যই। আমি দুনিয়ার ‘অ্যাটল দ্বীপগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। আমার সামনে এখন দু’টি ক্লু বা টার্গেটস্থল। এক, তাহিতি দ্বীপ, দুই, অ্যাটল দ্বীপ। আমার এখন জানা দরকার, দু’টি কি এক জায়গায়, এক লোকেশনে হতে পারে? না দুই জায়গায়। তাহিতি দ্বীপ আমি জানি। এখন ‘অ্যাটল’ দ্বীপগুলোর অবস্থান, অবস্থা সম্পর্কে আমার জানা দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে স্যার, আমি সকালেই এর ব্যবস্থা করব।’ বলল আলী আল-হামাদী।
‘ধন্যবাদ মি. আল-হামাদী।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘চলুন, এবার শয়নঘরগুলোর দিকে। শোবার মত অবস্থা আছে কিনা দেখি।’
আলী আল-হামাদীও উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘চলুন স্যার।’ শোবার ঘরের দিকে চলে গেল দু’জনে।

সকাল সাড়ে ৮টা।
নাস্তার টেবিলে আগেই এসে বসেছিল আহমদ মুসা।
সকালের খবরের কাগজগুলো এসে গেছে। তার উপর নজর বুলাচ্ছিল আহমদ মুসা।
আলী আল-হামাদী এল।
আহমদ মুসার মুখোমুখি নাস্তার চেয়ারে বসে বলল, ‘স্যার, একটু দেরী হয়ে গেল। ভূগোলবিদের বিষয়টাও ঠিক করে এলাম স্যার। স্যার, আরেকটা কথা, আমাদের মহামান্য সুলতানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রিন্স খালিদ ইবনে সালমান-আল-খালিফা আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
‘উনি আমার ব্যাপারটা জানলেন কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘স্যার, সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ তো তাকেই টেলিফোন করে আপনার কথা বলেছেন। উনি খুব গুণী মানুষ স্যার। উনি বৃটেনের স্যান্ডহার্টস ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু এই সাথে অত্যান্ত বিদ্যানুরাগী। বাহরাইনে আজ যে বিশাল সমৃদ্ধ লাইব্রেরী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, সেটা তারই অবদান। বাহরাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরীর মধ্যে একটি। দেশের বড় বড় শিল্পপতির সাথেও তার গভীর সম্পর্ক। আমাদের নিরাপত্তা প্রধান একজন ভাল ভূগোলবিদের ব্যাপারে তাঁকেই অনুরোধ করেছিলেন। সংগে সংগেই তিনি যোগাযোগ করে একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে ফেলেছেন। স্যার, আজ দশটায় আপনি তার সাথে চা খাবেন এবং সাড়ে ১১ টায় বাহরাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সমুদ্র ও দ্বীপ বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ আবদুল্লাহর সাথে আপনার সাক্ষাত। স্যরি, আপনার অনুমতি না নিয়েই কিন্তু আমি সব ঠিক করে ফেলেছি।’
‘অনুমতির কেন প্রয়োজন। আমি তো আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অসম্ভব দ্রুত আপনি সব ঠিক করে ফেলেছেন। আমি প্রিন্স খালিদের সাক্ষাত পেলে খুবই খুশি হবো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। আসুন স্যার, আমরা নাস্তা খেয়ে নেই।’ বলল আল-মাহাদী।
নাস্তা সারল দু’জনে।
হোটেলের রুম-সার্ভিস বিভাগ থেকেই এ নাস্তা এসেছে। এপার্টমেন্টে যারা নিজেরা রান্না-বান্নার ঝামেলায় যায় না, তাদের খাবার হোটেলের রুম সার্ভিস থেকেই সরবারাহ করা হয়।
সকাল দশটার মধ্যে আহমদ মুসারা প্রিন্স খালিদ ইবনে সালমান আল-খালিফার অফিসে পৌছলেন।
প্রিন্সের প্রাইভেট সেক্রেটারি গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসাদের গাড়ি সেখানে পৌঁছতেই পিএস নিজে এসে গাড়ির দরজা খুলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘এক্সিলেন্সি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
আলী আল-হামাদী আগেই নেমেছিল। বলল সে আহমদ মুসাকে, ‘স্যার, আমি অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।’
‘ধন্যবাদ মি. আল-হামাদী।’
বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল প্রিন্স খালেদ ইবনে সালমান আল-খালিফার পি.এস।
সুলতানের সেক্রেটারিয়েটের চার তলার একটা স্যুটে বসেন সুলতানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
সুলতানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা সুলতানের পক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের তদারকি করেন।
চার তলায় পৌঁছে প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার পি.এস আহমদ মুসাকে ভিআইপি গেষ্টরুমে বসিয়ে ইন্টারকমে বসকে খবর দিল।
খবর জানাবার পরপরই দরজা ঠেলে গেষ্টরুমে প্রবেশ করল সুলতানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
সালাম দিয়ে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল সে। সাথে নিয়ে ঢুকে গেল অফিস কক্ষে।
অফিস কক্ষের সাথেই তার পার্সোনাল গেষ্টরুম। সেখানেই সে বসল গিয়ে আহমদ মুসাকে নিয়ে।
আহমদ মুসাকে বসিয়ে নিজে বসেই প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা বলল, ‘মহান ভাই সৌদি আরবের নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ আপনার এত প্রশংসা করেছেন যে, আমি আপনার সাথে সাক্ষাত না করে থাকতে পারলাম না। কিন্তু আপনার নামই আমার জানা হয়নি। আমার মহান ভাই আল-সউদও বলেননি। তিনি বলেছেন, তাঁর নাম তাঁকেই জিজ্ঞাসা করবেন। বিষয়টা আমার কিউরিসিটি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন এই ‘নাম’ দিয়েই আমরা আমাদের কথা শুরু করতে পারি। আর একটা কথা বলি, ড. সালেহ আবদুল্লাহ যার সাথে আপনার সাড়ে ১১ টায় দেখা করার কথা, তিনি একটা জরুরি প্রয়োজনে আমার সেক্রেটারিয়েটে এসেছেন। আপনি চাইলে তাঁকে এখানে ডাকা যেতে পারে।’
‘আল-হামদুলিল্লাহ! এতে আমারই বেশি সুবিধা হবে। তার ওখানে যাওয়া থেকে বেঁচে যা। তাছাড়া যে আলোচনা তার সাথে করতে চাই, সেটা আপনার উপস্থিতিতে আরো ভালো হবে এক্সিলেন্সি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ’ বলে প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা ইন্টারকমে পি.এস.-কে নির্দেশ দিল, ‘তুমি গিয়ে ড. সালেহ আবদুল্লাহকে নিয়ে এস।’ ইন্টারকম থেকে ফিরে প্রিন্স খালেদ আহমদ মুসার দিকে তাকাতেই আহমদ মুসা বলল, ‘এক্সিলেন্সি নানা কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার নামটা গোপন রাখা হয়। সেটা আপনার ক্ষেত্রে নয়। এক্সিলেন্সি! আল-সউদ আমার নাম নিয়ে একটা রহস্য সৃষ্টি করে রেখেছেন মাত্র! আহমদ মুসা। খুবই ছোট নাম।’
নাম শুনেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো বাহরাইনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রিন্স আল-খালিফার। তার বিস্ময় ও কৌতুহল মিশ্রিত স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
‘আপনি কি সেই লিজেন্ড আহমদ মুসা, যিনি তরুণদের স্বপ্ন নায়ক আর প্রবীণদের গর্ব?’ আহমদ মুসার মুখের উপর চোঁখ ঐভাবে স্থির রেখেই প্রশ্ন করল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
আহমদ মুসার মুখ নত মত হলো। বলল, ‘এক্সিলেন্সি আমি সাধারণ মানুষ। আমি মানুষের কাজে লাগার চেষ্টা করি মাত্র।’ পরম ও বিনীত কন্ঠস্বর আহমদ মুসার।
আসন থেকে উঠে প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা। এগোলো আহমদ মুসার দিকে।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসাও।
প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের’ হবার প্রবাদ, কিন্তু সোনার এক টুকরা খুঁজতে গিয়ে অমূল্য হীরকখন্ড পাবার কোন প্রবাদ নেই। কিন্তু আমি কল্পনাতীতভাবে এক অমূল্য হিরকখন্ড পেয়ে গেলাম। আমার গর্ব, আমাদের গর্ব আপনি। আপনাকে স্বাগত: খোশ আমদেদ আপনাকে।’ আবেগে কন্ঠ ভিজে উঠেছিল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার। নিজের আসনে ফিরে গেল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ ভালো করে মুছে নিয়ে বলল, ‘সত্যি হঠাৎ অমূল্য হিরকখন্ড পেলে কপর্দকহীনের যে দশা হয়, সে রকমটাই আমার অবস্থা। গতবার হজ্জে গিয়ে গিয়ে মদিনায় ঘুরে বেড়াবার সময় পুলিশ পাহারায় থাকা একটা বাড়ি দেখিয়ে ভাই আল-সউদ আমাকে বলেছিলেন সেখানে আপনি থাকেন। কিন্তু তখন আপনি টার্কিতে ছিলেন। কিন্তু তখন আপনি টার্কিতে ছিলেন। দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি। তারপর কয়েকবার চেষ্ঠা করেছি। কিন্তু আপনাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। আমাদের মহামান্য সুলতানও আপনার সম্পর্কে জানেন। তিনি একবার আমাকে বাহরাইনে আপনাকে আমন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রথমত আপনাকে না পাওয়া, দ্বিতীয়ত আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ করে আনার মধ্যে উভয় পক্ষের নানা সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনা করে এই ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া যায়নি। সেই আপনাকে আজ হঠাৎ এভাবে চোখের সামনে হাজির দেখছি। এটা একজনের আবেগকে বাঁধভাঙা করে দেবার মতই। আল-হামদুলিল্লাহ।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি দুর্লভ মানুষ নই। ডাক পেলে আমি সেখানে যাই। তবে শুধু শুধু বেড়াবার সময় আমার কম হয়। এই দেখুন, আমাকে খুঁজে পাননি। কিন্তু আজ বিনা ডাকে আপনার দোরগোড়ায় হাজির।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যখন আপনাকে পেয়েছি। তখন আমার অনুরোধ মহামান্য সুলতানের সাথে আপনার দেখা করতে হবে’ বলল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
‘এক্সিলেন্সি সময় হলে দেখা করতে পারলে আমিও খুব খুশি হবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে একটু থামল, একটু ভাবল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা। সোফায় একটু হেলান দিল সে। বলল, ‘অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে মি. আহমদ মুসা আপনাকে। আপনার সব কাজই জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। বিষয়টি বিরাট উদ্বেগ-উত্তেজনার। অব্যবহত ভাবে এই উদ্বেগ-উত্তেজনা নিয়ে চলার অফুরন্ত শক্তি আপনি কোথা থেকে পান? ক্লান্তি, অবসন্নতার অনেক কিছুই তো সামনে আসার কথা।’
‘পৃথিবীটাই তো নানা রকম লড়াইয়ের ক্ষেত্র। প্রত্যেক মানুষই তার জীবন পরিচালনায় নানা রকম লড়াইয়ে ব্যস্ত। এই লড়াইয়ের মাধ্যমে মানুষের জীবনে শান্তি ও সাফল্য আসে। আমার লড়াইটাও মানুষের শান্তি ও সুবিচারের পক্ষে। আমার বিশ্বাস আমার শক্তির উৎস।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘তিনি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন এটা দেখার জন্যে যে মানুষ ভাল কাজ করছে।’ এই নি নির্দেশই আমার দায়িত্ব পালনের শক্তি। ভাল কাজ করার আরেকটা দিক হলো, মন্দ পরিত্যাগ করা এবং মন্দ কাজের প্রতিকার করে ভালোর প্রতিষ্ঠা করা। মজলুম কারো ডাক পেলে এই কাজে সাহায্য করি।’ বলল আ্হমদ মুসা।
‘এই কাজ অত্যান্ত কঠিন। এই প্রসংগে একটা প্রশ্ন, ভালোর প্রতিষ্ঠা মন্দ পথে হয় কি না? আমি বলতে চাচ্ছি, মন্দ পথে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আরেক সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, মন্দের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসাবে অপরাধী নিপরাধ নির্বশেষে হত্যা-হামলায় শিকার বানানো চলে কিনা?’ প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা বলল।
‘না, তা করা যায় না। মন্দ দুর করে ভালো’র প্রতিষ্ঠা করার মডেল হলেন আল্লাহর রসুল স.।আল্লাহর রসুল স.-এর গোটা জীবনে ভালো’র সাথে মন্দ পথ অনুসরণের এবং নির্দোষ-নিরপরাধিদের উপর হামলা ও হত্যা-নির্যাতনের কোন দৃষ্টান্ত নেই। এমনকি শত্রুর বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের ক্ষেত্রেও শত্রুপক্ষ বা শত্রু দেশের নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি তাদের নিরাপত্তা দেবার ঘোষনা করা হয়েছে। শত্রুপক্ষের লোকদের ক্ষেত্রেই যখন এই ব্যবস্থা, তখন যারা শত্রু নয় বা বিঘোষিত শত্রু নয়, তাদের নির্দোষ-নিরপরাধদের উপর হামলা-হত্যা-নির্যাতনের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না!’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা অন্য এক প্রসংগ। বিষয়টা অনেকটা ব্যাক্তিগত ধরনের। আপনার জীবনে অসংখ্য ঘঠনা আছে। অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আপনি এসেছেন। এসবের মধ্যে কোন ঘটনা, কোন ব্যক্তি আপনার জীবনে দাগ কেটেছে সবচেয়ে বেশি?’ বলল প্রিন্স খালেদ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এক্সিলেন্সি, আমি আপনার এই দুই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। আমি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই না। কারো সাথে কারো, কোন ঘটনার সাথে কোন ঘটনার তুলনাও আমি করি না। আমার দৃষ্টি শুধুই সামনে, সামনে ওগোতে চাই আমি।’
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, আপনার এমন জবাবই স্বাভাবিক। আচ্ছা মি. আহমদ….।’
প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার কথার মাঝখানেই তার ইন্টারকম বেজে উঠল।
কথা বন্ধ করে প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা ইন্টারকমের স্পীকার অন করে নিল।
সালাম দিয়ে ওপার থেকে তার পি.এস. বলল, ‘এক্সিলেন্সি, ড. সালেহ আবদুল্লাহ এসেছেন।’
‘নিয়ে এস তাঁকে।’ বলে ইন্টারকম রেখে দিল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা। কয়েক মূহুর্ত।
প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার পি.এস. ড. সালেহ আবদুল্লাহকে নিয়ে প্রবেশ করল।
প্রিন্স আবদুল্লাহ আল-খালিফা আহমদ ও আহমদ মুসা দু’জনেই উঠে এগিয়ে গিয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
‘প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা আহমদ মুসার সাথে ড. সালেহ আবদুল্লাহকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইনি আমাদের সম্মানিত অতিথি। সৌদি আরব থেকে এসেছেন। একটা বিষয়ে তিনি আপনার সাথে আলোচনা করতে চান, যে বিষয়ে আপনি বিশেষজ্ঞ।’ সরাই বসল।
‘আমি শুনেছি, দ্বীপ সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান। কিন্তু এ বিষয়ে সৌদি আরবের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বড় বিশষজ্ঞ আছেন!’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
‘স্যার, আমার জরুরি প্রয়োজন।’ সৌদি আরবে গিয়ে তাঁদের কাছে জানার মত সময় আমার হাতে নেই। এজন্যেই স্যার আপনাকে কষ্ট দেয়া।’ আহমদ মুসা বলল বিনীত কন্ঠে।
‘বুঝেছি ইয়ংম্যান! নো ম্যাটার। আমার কথায় আপনার যদি কোন সাহায্য হয়, তাহলে আমিই বেশি খুশি হবো।’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
এই সময় প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার পি.এস এসে তাঁকে জানাল, ‘এক্সিলেন্সি, টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে।’
সংগে সংগেই প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন, চা খেয়ে আসি। তারপর আমরা কথা বলব। সেটাই ভালো হবে। এই সাথে আমি আপনাদের জানাচ্ছি, লাঞ্চ না খেয়ে আপনাদের যেতে দেব না।’
সবাই উঠে দাঁড়াল।বলল ড. সালেহ আবদু্ল্লাহ, ‘আমরা আর কি করব, হোস্ট যদি আটকান, তাহলে গেস্টরা যাবেন কি করে? গেস্টের জন্যে যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে হোস্টের কথা রাখাই নিয়ম।’
‘ধন্যবাদ, ড. সালেহ আবদুল্লাহ।’
বলে পাশের কক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
সবাই তার সাথে চলল পাশের ঘরে নাস্তার টেবিলে।
নাস্তা শেষে সবাই ফিরে এল বসার ঘরে।
ড. সালেহ আবদুল্লাহ তার আসনে বসেই বলল, ‘হ্যাঁ মি. ইয়াংম্যান, আপনার নাম কিন্তু জানা হয়নি।’
আহমদ মুসা একবার চোখ তুলে প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘স্যার, আপনার নামের কাছাকাছি। আলী আবদুল্লাহ।’
নিজের নামটি তাকে বলতে পারল না আহমদ মুসা। কারণ যে বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে সে বিষয়ের সাথে আহমদ মুসার নাম যুক্ত হলে এবং কোনভাবে তা শত্রুপক্ষের কানে গেলে শত্রুরা অনেক বিষয়ই আঁচ করতে পারবে। আর বাহরাইন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব গোয়েন্দা সংস্থার জন্য একটা লোভনীয় স্থান। সুতরাং সতর্কতার প্রয়োজন মনে করেছে আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, মি. আলী আবদুল্লাহ। বলুন, আপনি কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান।’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
‘স্যার, আমি দুনিয়ার ‘অ্যাটল দ্বীপ’ সম্পর্কে জানতে চাই। দ্বীপগুলোর অবস্থান, দ্বীপগুলোর প্রকৃতি, এ সবের ব্যবহার কি রকম ইত্যাদি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, ইয়াংম্যান। বিষয়টা আমার সাবজেক্টের মধ্যে। কিন্তু মুখস্থ কতটুকু বলতে পারবো, সেটা আপনার কাজে আসবে কি না বলতে পারি না।’
একটু থামল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
শুরু করল পর মুহুর্তেই, ‘অ্যাটল দ্বীপ’ আল্লাহর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি সাগর বক্ষে! সাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে সাধারণত কোরাল রীফ থেকে অ্যাটল দ্বীপের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ফলে গলিত লাভা থেকেও অ্যাটল দ্বীপ তৈরী হতে পারে।
অ্যাটল সাগর বক্ষের এমন দ্বীপ যার চারদিক সাগর সারফেসের উপর জেগে ওঠা মাটির সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। এই ঘেরের মধ্যে থাকে পানি। এই পানির গভীরতা কম। বিভিন্ন অ্যাটলে গভীরতা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আবার অ্যাটলের চারদিকের সার্কলিং বা ঘেরটা আংশিকও হতে পারে। এক বা একাধিক জায়গায় ঘেরে ছেদ থাকায় অ্যাটলের ভেতরটা সাগরের সাথে উন্মুক্ত থাকতে পারে।
এই অ্যাটল ধরনের দ্বীপগুলো দেখা যায় পৃথিবীর গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও আধ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে। অক্ষরেখার ২৮ ডিগ্রি ২৪ ইঞ্চি উত্তরে ও ২৯ ডিগ্রি ৫৮ ইঞ্চি দক্ষিণে কোন অ্যাটল দ্বীপ নেই। আটলান্টিক মহাসাগরে কোন অ্যাটল দ্বীপ নেই, ছোট্ট একটা ব্যাতিক্রম ছাড়া। নিকারাগুয়ার সামনের সাগরে মাত্র আটটি অ্যাটল দ্বীপ রয়েছে। সব অ্যাটল দ্বীপ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে। ভারত মহাসাগরের অ্যাটল দ্বীপগুলো মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ ও সাগোজ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে মালদ্বীপের অ্যাটল দ্বীপগুলোই উল্লেখযোগ্য। দুনিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ২৬টি অ্যাটল দ্বীপের মধ্যে ৫টি মালদ্বীপে। মালদ্বীপের একটি অ্যাটল দ্বীপের মধ্যে ২৫৫টি ক্ষুদ্র দ্বীপ আছে। এই বৈশিষ্টে এটাই পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ। ২৬টি অ্যাটল দ্বীপ রয়েছে ভারত মহাসাগরে। প্রশান্ত মহাসাগর হলো অ্যাটল দ্বীপের সাম্রাজ্য। প্রশান্ত মহাসাগরের তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারেলিন দ্বীপপুঞ্জ, মাশাল দ্বীপপুঞ্জ, কোরাল সী দ্বীপপুঞ্জে অ্যাটল দ্বীপের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরে অ্যাটলগুলোর সংখ্যা, বৈচিত্র্য ও সাইজ সব দিক দিয়েই শীর্ষে।’ থামল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
‘ধন্যবাদ স্যার। অ্যাটল দ্বীপসমূহের সুন্দর একটা ধারণা তুলে ধরেছেন আপনি। স্যার, তাহিতি দ্বীপের আশেপাশে অ্যাটল দ্বীপ আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু বলুন।’
‘দু’টি দ্বীপ নিয়ে তাহিতি। গোটা তাহিতিই ভলকানিক দ্বীপ। এর পাশে কোন অ্যাটল দ্বীপ নেই। কিন্তু তাহিতি থেকে নীল সমুদ্র ধরে কিছু দুর এগোলেই পলিনেশীয় দ্বীপ সাম্রাজ্যের পূর্ব বাহুতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এটাই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ। এই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ বা গোটা দক্ষিণাংশ অনেক অ্যাটল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। মোট ৭টি দ্বীপ, এর মধ্যে ৭৩টিই অ্যাটল দ্বীপ। তিনটি দ্বীপ কোরাল। শুধু দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমাংশে তাহিতির দিকে একটা মাত্র দ্বীপ প্রকৃত অ্যাটল দ্বীপ।’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
‘স্যার, এই অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোনটিতে বড় স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব কিন, যেখানে বহু মানুষের থাকার ও কাজ করার জন্য উপযুক্ত?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্থাপনার জন্যে ল্যান্ড দরকার হয়, কিন্তু অ্যাটল দ্বীপগুলোতে ল্যান্ডের অভাবই সবচেয়ে বেশি। ২০০০ মাইল বিস্তৃত গোটা তুয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে ল্যান্ডের পরিমাণ ৮৮৫ বর্গ কিলোমিটার মাত্র। আর এই দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণাংশের ৭৮টি দ্বীপের মধ্যে ৭৩টিই অ্যাটল। এই ৭৮ টি দ্বীপের মোট লোক সংখ্যাই হলো মাত্র এক হাজার ছ’শো’র মত। মাত্র কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি আছে। অন্য গুলো খালি। অন্তত এই দ্বীপপুঞ্জের এই সব অ্যাটলে বড় কোন স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব নয়।’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
‘অ্যাটল দ্বীপে ল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনভাবে বড় স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগেই উত্তর দিল না ড. সালেহ আবদুল্লাহ। সোফায় হেলান দিয়ে বসল। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘তার মানে গোপন স্থাপনার কথা বলছেন। অ্যাটলের লেগুন-ফ্লোরের নিচে অথবা অ্যাটলের কোরাল দেয়ালের ভেতরে কোন বড় রকমের স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব কিনা এই তো?’ আমি এর কোন সম্ভবনা দেখি না। আমি মেরিন সাইনটিস্ট কিংবা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নই, একজন ভূগোলবিদ মাত্র। মেরিন সাইনটিস্টরাই এ ব্যাপারে সঠিক কথা বলতে পারে।
‘ধন্যবাদ স্যার। আরেকটি জিজ্ঞাসা, তোয়ামতুর অ্যাটল দ্বীপগুলোর মধ্যে নির্জনতা ও গোপনীয়তার দিক থেকে অগ্রগণ্য কোনটা হতে পারে?’ বলল আহমদ মুসা।
ড.সালেহ আবদুল্লাহ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। থামল একটু।বলল, ‘আপনি বলতে চাচ্ছেন, কোন অ্যাটল দ্বীপে বড় কোন গোপন কাজ কেউ গোপনে করে যেতে পারে কিনা, এইতো?’
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ‘বিষয়টা ও রকমই স্যার।’
‘তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অ্যাটল দ্বীপগুলো সম্পর্কে বলছি। আগেই বলেছি, এখানকার মাত্র কয়েকটা অ্যাটলে খুব সামান্য লোক বসতি আছে। অন্য সবই জনবসতিহীন নিরব, নিঝুম দ্বীপ। দিনের বেলা অল্প কিছু মাছ ধরার কাজ চলে। আর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যাঞ্চলের ফাকারাঙা, তাহানিয়া, মতুতুংনী, উত্তারাঞ্চলের রাবেহিয়া, নপুকা, টপোটো, ফাতুহিভা, হিভাওয়া, নকুহিভা এবং ওয়াপু, বাংগিরোয়া ও মাফতিয়ার মত কিছু দ্বীপ ও অ্যাটলে পর্যটকদের আবির্ভাব ঘটে দিনের বেল। মধ্য ও দক্ষিনাঞ্চলের অন্য সব অ্যটল দ্বীপ দিনের বেলাতেও নিরব-নিঝুম থাকে। আর রাতের বেলা দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটা দ্বীপ ও অ্যাটলে বাতি জ্বললেও গোটা দ্বীপপুঞ্জের এ অ্যাটলসমূহ থাকে জমাট অন্ধকারে ঢাকা, নিরব-নি:শব্দ এক মৃত্যুপুরী যেন! এমন পরিবেশ তো গোপন কাজেই জন্যেই উপযুক্ত! কিন্তু আমার কথা মানুষকে কাজ করার জন্যে পায়ের তলায় মাটি চাই, এস মাটি তো অ্যাটলগুলোতে নেই।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জল হয়ে উঠেছিল। কিছু প্রশ্নের স্পেসেফিক জবাব না পেলেও তোয়ামুত দ্বীপপুঞ্জের অ্যাটল রাজ্য সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ ধারণা সে পেয়ে গেছে। মূল যে কথাটা সে জানতে চায়, তাহিতি দ্বীপে বা এই অঞ্চলের অ্যাটল দ্বীপে তা আছে কিনা, সেটা জানা তার হয়ে গেছে। এখন তান নিশ্চিত মনে হচ্ছে, তাহিতি বা অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোথাও শয়তানরা আড্ডা গেড়েছে।
আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমি যা জানতে চেয়েছি, আল-হামদুলিল্লাহ তার চেয়ে বেশি জানতে পেরেছি। অনেক ধন্যবাদ স্যার, আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ ইয়াংম্যান। কিন্তু এ সব তো কেউ জানতে চায় না। আপনি কি করবেন এসব দিয়ে? কোন পেশায় আপনি জড়িত আছেন মি. আবদুল্লাহ?’ বলল ড. সালেহ আবদুল্লাহ।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্যার, হাতেম তায়ীর মত রহস্যের সন্ধান আমার নেশা-পেশা দু’টোই। যেমন অ্যাটল রাজ্যে যাবার সুযোগ নিতে পারি।’
‘চমৎকার! জীবনকে উপভোগ করার এক উৎকৃষ্ট পথ। আল্লাহর বিচিত্র সৃষ্টি মানুষ দেখুক, চিন্তা করুক এবং আল্লাহর সোলতানিয়াত মানুষ উপলদ্ধি করুক, এটা আল্লাহ চান। আর একটা জিজ্ঞাসা স্যার, আ্যটলের কোরাল দেয়ালে বা উপরে লেগুনের ফ্লোরের নিচে কোন স্থাপনা তৈরি করা যায় কিনা, এ বিষয়ে আমার মতটা বলেছি। কিন্তু কোরাল রীপগুলো আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি! অ্যাটলের দেয়াল কোথাও পিলার আকারেও উঠতে পারে। আবার কোথাও অ্যাটলের চারদিকের দেয়ালের ভেতরটা ফাঁকাও থাকতে পারে। কোথাও কোথাও আবার অ্যাটলের লেভেলের যে ফ্লোর তাতেও ফাটল থাকতে পারে, হোল থাকতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে তা আংশিক হতে পারে। এ সব বৈচিত্রাকে মেরিন সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নানাভাবে ব্যবহার করতেও পারে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। অ্যাটল সম্পর্কে এগুলো খুবই মূল্যবান তথ্য।আমার জিজ্ঞাসার উত্তর এর মধ্যে আছে। ধন্যবাদ স্যার, আপনাকে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা বলল, ‘ধন্যবাদ মি. আবদুল্লাহ, ধন্যবাদ ডক্টর। আপনাদের প্রশ্নোত্তরে মনে হচ্ছে আমিই উপকৃত হয়েছি সবচেয় বেশি। অ্যাটল দ্বীপের নাম জানতাম। কিন্তু অ্যাটল দ্বীপ যে সঠিক অর্থে দ্বীপ নয় আজই প্রথম জানলাম। অ্যাটল দ্বীপগুলোর লোকেশন সম্পর্কেও কিছু জানা ছিল না আমার। তাও জানলাম আজ। এখন দেখতে ইচ্ছে করছে অ্যাটল এলাকা। কিন্তু একটা বিষয় ….।’
প্রিন্স খালদ আল-খালিফার কথার মাঝখানেই মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
থেমে গেল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
‘মাফ করবেন!’ বলে মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা। স্ক্রিনে দেখল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদের নাম।
সালাম দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এক্সিলেন্সি, কেমন আছেন?’
ওপার থেকে আল-সউদ সালাম নিয়ে বলল, ‘আমরা সবাই ভাল। আপনি যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে জানাবার জন্যে এই টেলিফোন করছি এবং একটি খারাপ খবরও আপনাকে জানাতে চাই।’
‘বলুন, এক্সিলেন্সি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কাছ থেকে জানার পরই আমি আমাদের নৌবাহিনীর হুরমুজ প্রণালী ইউনিটকে জানিয়েছিলাম। তারা সংগে সংগেই হুরমুজ প্রণালীরর মুখে ছুটে গিয়েছিল। তারা সেখানে অপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে হুরমুজ প্রণালী কোস্টাল ষ্টেটস জয়েন্ট অথরিটিং মনিটরিং সার্চ করে। এতে জানতে পারে তারা হুরমুজ প্রণালীতে পৌঁছার আধা ঘন্টা আগে আন্ডারওয়াটার জলযান জাতীয় কিছু যান প্রণালী অতিক্রম করে। অতএব সে মিশনটি ফেল করেছে। এটাও খারাপ খবর। কিন্তু আরেকটা হুমকি আমরা পেয়েছি। সেটাকেই আমি খবর বলছিলম।’
‘সে হুমকিটা কি? ওরা হুমকি দিয়েছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘হ্যাঁ, আহমদ মুসা! ওরাই। তারা স্যাটেলাইট ই-মেইলে জানিয়েছে, তারা কোন প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব বরদাশত করে না। বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মক্কীকে উদ্ধারের চেষ্টা করে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছে। এই অপরাধে বিজ্ঞানীর সমস্ত রক্ত শুষে নিয়ে আজ থেকে তৃতীয় মাসের শেষ দিনে তাকে হত্যা করা হবে। আর তাকে উদ্ধারের আরও যদি চেষ্টা করা হয়, তাহলে সৌদি আরবের রকেট-বিজ্ঞানের জনক বিজ্ঞানী ড. আবদুল আজিজ আল-নজদীকে কিডন্যাপ করা হবে।’বলল আল-সউদ।
‘এই হুমকিকে আপনারা কিভাবে নিয়েছেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘একটা ক্রিমিনাল গ্রুপের আত্মরক্ষার একটা কৌশল হিসাবে।’ বলল আল-সউদ।
‘আপনারা এরপর কি ভাবছেন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ভাবনা আগের মতই। আমরা চাই আমাদের বিজ্ঞানী উদ্ধার হোক! ক্রিমিনালরা ধরা পড়ুক এবং এই ব্যাপারে আমরা আপনার সাহায্য চাই। আমরা আপনার সাহায্য চাই শুধু আমাদের স্বার্থে নয়, বহু বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞকে তারা কিডন্যাপ করেছে, সবার স্বার্থে। ক্রিমিনালদের এভাবে চলতে দিলে আরও প্রতিভার তারা সর্বনাশ করবে! এই কঠিন মিশনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। আমাদের সবার ইচ্ছা এটাই।’ বলল আল-সউদ।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি কতটা পারব সেটা আল্লাহর সাহায্যার উপর নির্ভর করছে। তবে একটা কথা বলতে পারি, সামনে আমার এগিয়ে যাবার পথ বোধ হয় উন্মু্ক্ত হয়ে গেছে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! আল্লাহর বিশেষ সাহায্য আপনার সাথে আছে, মি. আহমদ মুসা। আপনার প্রয়োজন আমাদের জানাবেন। দেশের ভেতর ও বাইরে সকল জায়গায় আমাদের সহযোগিতা আপনার জন্যে প্রস্তুত থাকবে।’ বলল আল-সউদ।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি! আসি জনাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি সৌদি আরবে ফিরছেন?’ জিজ্ঞাসা আল-সউদের।
‘এখনও সব কিছু ফাইনাল করিনি। আমি আজই স্ত্রীর সাথে কথা বলব। তবে সম্ভবত এখন ফেরা হচ্ছে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার সব সিদ্ধান্তের সাথে আমরা আছি, আহমদ মুসা।’ বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল আল-সউদ, ‘ওকে, মি. আহমদ মুসা আর কিছু?’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আল-হামদুলিল্লাহ! আসসালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’ ওপার থেকে বলল সৌদি নিরাপত্তা প্রধান আল-সউদ।
ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসাও সালাম নিয়ে কল অফ করে দিয়েছে।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে দিয়ে ‘স্যরি’ বলে সকলের দিকে তাকাল।
‘আহমদ মুসা আপনি কি আমাদের মহান বড় ভাই আল-সউদের সাথে কথা বললেন?’ জিজ্ঞাসা প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার।
‘জি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের কথার মধ্যে আমার মনে কিছু কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। আমি কি দু’একটা বিষয় জিজ্ঞাসা করতে পারি?’ ড. সালেহ আবদুল্লাহ বলল।
এক খন্ড হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘অবশ্যই স্যার, বলুন।’
‘কি এক হুমকির কথা শুনলাম। আবার তা আপনার সামনে উন্মুক্ত হওয়ার কথা শুনলাম। অন্যদিকে আপনার অ্যাটল দ্বীপ নিয়ে বিশেষ করে একটা অঞ্চলের অ্যাটল দ্বীপ নিয়ে আপনার আগ্রহ। ইত্যাদি সব বিষয় মেলালে মনে হচ্ছে, বড় কিছু একটা ঘটেছে, আপনারা কিছু একটার সন্ধান করছেন।’
আহমদ মুসা মুহুর্তের জন্যে চোখ তুলে তাকাল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফার দিকে। বলল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যার। একটা সন্ত্রাসী গ্রুপকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের কোথায় পাওয়া যেতে পারে, এব্যাপারে নানা বিকল্প আমাদের সামনে আসছে। সেগুলো আসছে। সেগুলো ভাবা হচ্ছে। এটাই ঘটনা স্যার।’
আহমদ মুসা বিজ্ঞানী কিডন্যাপড্ হওয়ার ঘটনা চেপে গেল।
‘আল্লাহ আপনাদের সফল করুন। সকলেই আমরা সন্ত্রাসের উচ্ছেদ চাই।’
কথাটা শেষ করেই হাত ঘড়ির দিকে তাকাল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা। বলল আবার, ‘আমরা এখন উঠতে পারি। লাঞ্চ রেডি।এখানে সুন্দর একটা ক্যান্টিন আছে সেখানেই আমরা যাব।’
উঠে দাঁড়াল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আজকের লাঞ্চটা একটু আগাম আমার প্রয়োজন ছিল। আমার আরেকটা প্রোগ্রাম আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা। বলল, ‘কিন্তু তার আগে আপনার আরও প্রোগ্রাম আছে। আমাদের মহামান্য সুলতানের সাথে দেখা করা। সে প্রোগ্রামও হযে গেছে। আমরা লাঞ্চের পরই সেখানে যাব।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, আমি খুশি হব তার সাথে দেখা করতে পারলে।এটাই আমার কাছে এখন সবচেয়ে প্রায়োরিটি প্রোগ্রাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. আবদুল্লাহ এই শুভেচ্ছার জন্যে।’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘থামুন, পাশেই আমার পার্সোনাল লিফট আছে।’ বলে হাঁটতে শুরু করল প্রিন্স খালেদ আল-খালিফা।
তাকে অনুসরণ করল আহমদ মুসারা।

Top