৫০. একটি দ্বীপের সন্ধানে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা তাহিতির স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
তারা গাড়িতে আগের মতই বসেছে। আহমদ মুসা বসেছে ড্রাইভারের পাশে। আর মারেভা বসেছে পেছনের সীটে।
ড্রাইভার আহমদ মুসাকে গাড়িতে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে তার সীটে ফিরছিল।
উৎসুক মারেভা আহমদ মুসাকে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, দেখলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ডিজি’র মত ফরাসি অফিসার আপনাকে গাড়ি, পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়েও তাই দেখলাম। আপনি কি এদের পূর্ব পরিচিত?’ মারেভা বলল। তার চোখে বিস্ময়।
আহমদ মুসা যে ফ্রান্সেরও নাগরিক, সে রিয়াদ থেকে আসার সময় সেখানকার ফরাসি রাষ্ট্রদূতের চিঠি নিয়ে এসেছিল, ফরাসি রাষ্ট্রদূত যে তাকে ফরাসি রাজপরিবারের জামাই বলেও পরিচয় দিয়েছিল, এসব কথা চেপে দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ মারেভা, এদের সাথে আমার পরিচয় আছে।’
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘মারেভা, দক্ষিন উপকূল ও উত্তর উপকূলের কিছুটা তো আমরা কয়েক দিনে দেখলাম। আজ যখন শহরে ঢুকেছি, তখন চল জিওগ্রাফিক্যাল যাদুঘরটা দেখব। তেপাও আপনি নিশ্চয় যাদুঘরটা চেনেন?’
‘জি স্যার। অনেক ইন্টারেষ্টিং স্যার। জিওগ্র্যাফিক্যাল যাদুঘরে গেল ফ্রেন্স পলেনিশিয়া দেখার কাজ অনেকটা হয়ে যায়।’ মারেভা বলল।
‘তুমি অনেকবার গেছ নিশ্চয়?’ মারেভাকে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমার পাঠ্য বিষয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটা পেপার আছে পলিনেশিয়ান আইল্যান্ডের ‘বেজ ও ওয়াল ফিজিক্যাল ফিচার’- এর উপর। এ জন্য এ যাদুঘরে আমাকে আসতে হয়।’ মারেভা মাইমিতি বলল।
আহমদ মুসার মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, তাহলে তো এ যাদুঘরে অ্যাটলগুলো সম্পর্কে জানার অনেক কিছুই থাকতে পারে এবং মারেভা তাকে এ ব্যাপারে অনেক সাহায্যও করতে পারবে। মনে মনে হাসল। গাইড দেখি তার সহকারী হবারও যোগ্যতা রাখে। বলল আহমদ মুস, ‘পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলো কি তথ্য এখানে আছে মারেভা।’
‘দ্বীপ ও অ্যাটল দ্বীপের প্রত্যেকটির একটা মিনি প্রতিকৃতি এখানে আছে। এ প্রতিকৃতি শুধু দ্বীপের উপরের অংশের নয়, দ্বীপের আন্ডার ওয়াটার ‘ওয়াল’ ও ‘বেজ’- এর প্রতিকৃতি কেমন তাও দেখানো আছে। দ্বীপগুলোর পাহাড় কোরাল রীফ, উপকূল, বনাঞ্চল ও লোকবসতি সম্পর্কে তথ্য আছে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর জীব-বৈচিত্র, ইত্যাদি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সেখানে পাওয়া যায়।’ বলল মারেভা।
আনন্দে আহমদ মুসার চোখ-দু’টি চক চক করে উঠল। এ যে মেখ না চাইতেই পানি। যা সে জানতে চায় এ এলাক সম্পর্কে তার সিংহভাগ সে পেয়ে যাবে এই যাদুঘরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
‘দ্বীপ ও অ্যাটলগুলোর মালিকানা কিংবা বড় বড় প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা স্থাপনা সম্পর্কে কেমন তথ্য আছে যাদুঘরে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
মারেভা মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ঠোঁটে এক টুকরো হাসিও ফুটে উঠল। বলল, ‘স্যার, কোথায় কোন দ্বীপ বা কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির কথা জিজ্ঞাসা করছেন, কিনবেন নাকি স্যার?’
‘কেনা যায় নাকি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘খুব কঠিন। কেনার জন্যে ফরাসি নাগরিক হতে হয় কিংবা ফরাসি সরকারের উপর প্রভাব থাকতে হয়। তবে বিদেশী নাগরিকরা দ্বীপ লীজ নিতে পারে, কিনতেও পারে তবে বিক্রি করতে পারে না। অবশ্য বিশেষ দ্বীপ ও বিশেষ এলাকার দ্বীপ, অ্যাটল লীজ নেয়া যায় না, কেনাও যায় না।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘যাদুঘরে কিছু তথ্য ভিজিবল, এমনিতেই পাওয়া, দেখা যায়। কিছু তথ্য অন রিকোয়েষ্ট পাওয়া যায়। কিছু তথ্য ক্ল্যাসিফায়েড। সেগুলো সিক্রেট সেকশনে সংরক্ষিত। ওগুলো পাওয়া যায় না। চলুন গেলেই সব দেখা যাবে।’
পাপেতির জিওগ্রাফিক্যাল যাদুঘর মধ্য পাপেতির বিশাল এলাকা জুড়ে। এ যেন এক মিনি ফ্যেঞ্চ পলিনেশিয়া।
অ্যাটলগুলোর প্রতিকৃতি আগাগোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল আহমদ মুসা। কিছু কিছু নোটও নিল।
পাঁচ ঘন্টা পরে যাদুঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা ও মারেভ।
‘মারেভা, তেপাওকে ডাক। চল, আমরা একটা রেষ্টুরেন্টে বসি। তৃষ্ণাও লেগেছে, একটু বিশ্রামও হবে।
‘যাদুঘরের পাশের একটা ভালো রেষ্টুরেন্ট প্যাসেফিক ইন্টারন্যাল- এ গিয়ে বসল।
বসেই আহমদ মুসা মারেভাকে বলল, ‘বেলা দু’টা বাজে। খেয়ে নেয়াই দরকার। একটু ভাল খাবার অর্ডার দাও। আমি ‘টয়লেট থেকে আসছি।’
বলে আহমদ মুসা চলল টয়লেটের দিকে।
আহমদ মুসা টয়লেট সেরে অজু করে বেরিয়ে এসে একটা নিরিবিলি স্পেস খুঁজে নিয়ে যোহরের নামাজ সেরে নিল।
টেবিলে ফিরে এসে দেখল, খাবার এসে গেছে। টেবিলের মাঝখানে রোলিং ডিস টেবিল। তাতে খাবার সাজানো। ঘুরছে রোলিং ডিস-টেবিলটা।
‘স্যার, আপনি ভাল খাবারের অর্ডার দিতে বলেছেন। তাহিতিতে এসে পর্যটকরা সবচেয়ে যা পছন্দ করে, তাই আমি আনিয়েছি। দেখুন পয়সন ক্রু আছে, সেভ্রেটিস আছে এবং ফ্রায়েড চিকেন ও রাইচ এবং গ্রিলড্ পর্ক। খাবার শেষে আছে, ‘পো’, যা টুরিষ্টদের সবচেয়ে পছন্দনীয়।’ বলল মারেভা।
‘থ্যাংকস’ বলে আহমদ মুসা বসল চেয়ারে। বলল হাসি মুখে, ‘যেমন ক্ষুধা তেমনি সুন্দর হয়েছে খাবার। নাও শুরু করা যাক।’
খেতে শুরু করল সবাই।
আহমদ মুসা খেল খুব আস্তে আস্তে। শুধু খেল ফ্রায়েড রাইচ, ফ্রেশ ওয়াটারের শ্রিম দিয়ে তৈরি সেভ্রেটিস, সালাদ। সব শেষে মজা করে খেল নারকেলের দুধে পেপে, ভ্যানিলা, কলাসহযোগে তৈরি মিষ্টি পুডিং।
আহমদ মুসার এভাবে অধিকাংশ খাবার এড়িয়ে যাওয়া লক্ষ্য করছিল মারেভা। এক সময় সে বলে, ‘স্যার আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না।’
‘না মারেভা, আমি খাচ্ছি।’ বলে না খাওয়া আইটেমগুলো রোলিং ডিশ টেবিল টেনে তার দিকে নেয়। টেনে নেয় বটে, কিন্তু ওসব ডিস থেকে কিছুই নেয় না। এটাও লক্ষ্য করেছিল মারেভা, কিন্তু সে আর কিছু বলেনি।
রেষ্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরুল আহমদ মুসা তাদেরকে নিয়ে।
বের হবার সময় এক ফাঁকে সুযোগ পেয়ে ড্রাইভার তেপাও মারেভাকে বলল, ‘স্যারকে যতই দেখছি বিস্মিত হচ্ছি! নরমে-গরমে, কঠোর-উদারতায় এমন মানুষ আমি জীবনে দেখেনি। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একদম অংকের মত টুদিপয়েন্ট চায়, আচরণের ক্ষেত্রে একদম মাটির মানুষ। এই প্রথম একজন ট্যুরিষ্ট একজন ড্রাইভারকে টেবিলে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন।’
মারেভা ড্রাইভারের কথার জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা ফিরে এসে বলল, ‘মারেভা, যাদুঘরের রিসেপশনে কিছু ফোল্ডার ও বুকলেট দেখলাম। মনে করেছিলাম, ফেরার পথে কিনে নিব। কিন্তু বের হলাম তো অন্যপথে। চল রিসেপশনে যাব।’
মারেভা আগেই থেমে গিয়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ‘ইয়েস স্যার, চলুন!’ বলে মারেভা ড্রাইভার তেপাওকে বলল, ‘আপনি গাড়িতে যান, গাড়ি নিশ্চয় গরম হয়ে গেছে, একটু ঠান্ডা করে নিন।’
আহমদ মুসা ও মারেভা চলল যাদুঘরের রিসেপশনের দিকে।
‘স্যার, একটা কথা বলব।’ বলল মারেভা।
‘বল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার খারাপ লাগছে, আমি অযথাই আপনার অনেক টাকা খরচ করেছি। আপনি কি গোশত খান না স্যার?’ বলল মারেভা।
‘কিন্তু চিকেনও তো খেলেন না। এমন কি ‘পইসন ক্রু’ ও খাননি, যা মাছ দিয়ে তৈরি।’ বলল মারেভা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল ‘পইসনে মাছের সাথে সাপও আছে। ওটা আমি খাই না।’
‘কিন্তু চিকেন?’ জিজ্ঞাসা মারেভার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘স্রষ্টা অর্থ্যাৎ ঈশ্বরের নাম নিয়ে জবাই করা না হলে সে জিনিস আমরা খাই না।’
‘আজব কথা! এমন কথা তো কোনদিন শুনিনি।’ বলল মারেভা।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘মারেভা বিষয়টা আমি তোমাকে বলতে চাইনি। আমি দেখছি, তোমার অবাক হওয়ার মতো ঘটনা আরও ঘটতে পারে। তাই আমার একটা পরিচয় তোমার জানা দরকার। মারেভা, আমি মুসলিম, ইসলাম ধর্মের অনুসারী।’
মারেভা একটু থমকে দাঁড়াল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। একটু উৎসুক দৃষ্টি তার চোখে। বলল, ‘হ্যাঁ, মুসলমান! টেলিভিশন, পত্রিকায় মুসলমান সর্ম্পকে অনেক কিছু শুনি। তবে কোন মুসলমান আমি দেখিনি। তাহিতিতে দু’চারজন মুসলমান আছে বলে শুনেছিলাম কার কাছে যেন। তাদের সাথে কখনও দেখা হয়নি। তবে একবার আরুতে গিয়ে আমাদের গ্রেট গ্রান্ড ফাদারদের এক কথাবার্তায় মুসলমানদের কথা শুনেছিলাম। তখন অনেক ছোট আমি। আচ্ছা, মুসলমানরা কি শুকর, সাপ ইত্যাদির মত অনেক কিছুই খায় না? স্রষ্টার নাম নিয়ে জবাই করা না করার মধ্যে কি পার্থক্য যে, এ জন্যে তা খাবারই আযোগ্য হয়ে যায়?’
‘সে অনেক কথা মারেভা, পরে একদিন বলব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। কিন্তু স্যার, টিভিতে আমি মাথা, মুখে, শরীরে কালো কাপড় জড়ানো মেয়েদের ছবি দেখেছি, এরা নাকি মুসলিম? এটা কি সত্যি স্যার?’ বলল মারেভা।
‘তুমি যেটা দেখেছ, সেটা প্রপাগান্ডা। তবে সত্যটা বুঝতে তোমার একটু সময় লাগবে। এক কথায় বললেই বুঝবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি অন্যদের থেকে অনেক আলাদা। মুসলমান বলেই কি?’
‘এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্ম, এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতির অনুসারিদের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই।’ বলল আহমদ মুসা।
তারা রিসেপশনে পৌঁছে গিয়েছিল।
পাশের পাবলিক রিলেশনস কাউন্টার থেকে ফ্রেন্স পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ বিশেষ করে অ্যাটল দ্বীপ সম্পর্কিত সব ফোল্ডার ও বুকলেট কিনে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসারা।
গাড়িটা চলে এসেছিল জাদুঘরের গাড়ি বারান্দায়। রিসেপশন থেকে বেরিয়েই গাড়ি পেয়ে গেল তারা।
গাড়িতে উঠে পেয়ে গেল তারা।
গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা ও মারেভা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা তিনটা বাজে।
‘মি. তেপাও, আমি হোটেল ফিরব। তার আগে মারেভাকে তুমি বাড়িতে নামিয়ে দাও। তারপর আমাকে হোটেলে নেবে।’ বলল আহমদ ড্রাইভারকে।
‘স্যার, গাড়ি সরাসরি হোটেলে নিন। আমি সেখান থেকে বাসায় ফিরব।’ মারেভা বলল।
‘মারেভা, এটা বাড়তি কোন সুবিধা নয়। হোটেলের পথেই তোমার বাসা। শুধু ভিন্ন একটা পথে যেতে হবে মাত্র।’ কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি স্যার।’ বলল মারেভা।
‘ম্যাডাম মারেভা, আপনার যাদুঘরে ঢোকার পরপরই একজন, সম্ভবত আপনার কোন বান্ধবী, আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি হোটেলে ফিরবেন, না বাসায় ফিরবেন। আমি বলতে পারিনি। একটু অপেক্ষা করে তিনি চলে গেছেন।’ ড্রাইভার তেপাও বলল মারেভাকে উদ্দেশ্য করে।
‘আমার বান্ধবী! তার সাথে ট্যুরিষ্ট ছিল মানে কোন ট্যুরিষ্ট নিয়ে এসেছিলেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা মারেভা।’
‘উনি একটা মাইক্রো থেকে নেমেছিলেন। ভেতরে কে ছিলেন আমি দেখিনি। তারা কেউ নামেনি।’ বলল ড্রাইভার।
মনে মনে কিছুটা বিস্মিত হলো মারেভা। আমার কোন বান্ধবী এখানে মাইক্রো নিয়ে তো আসার কথা নয়। ট্যুরিষ্ট নিয়ে এলে তো ট্যুরিষ্টরাই আগে নামতো। ট্যুরিষ্টদের ভেতরে রেখে তার আমার জন্যে অপেক্ষার তো কোন প্রশ্নই উঠে না! হিসাব মেলাতে পারলো না। বলল, ‘চিনলাম না। যাক, কেউ একজন হবে হয়তো।’
সবাই চুপচাপ।
গাড়ি চলছে।
কর্মহীন ভাবে একটু বসার সুযোগ পেতেই আহামদ মুসা মাথা এসে দখল করল যাদুঘরে দেখা অ্যাটলগুলো।
বিশেষ করে অ্যাটলগুলোই আহামদ মুসা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্ঠা করেছে।
সব দেখে হতাশ হয়েছে আহমদ মুসা। কোন অ্যাটলই বড় ধরনের কোন ঘাঁটি ধারণ করার উপযুক্ত নয়।
গোটা পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে তাহিতির পুবে তোয়ামতোই আসলে অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ। উল্লেখযোগ্য সব অ্যাটল এখানেই রয়েছে। প্রায় ৭৬ টি অ্যাটল এখানে রয়েছে। অন্যগুলো নিরেট অ্যাটল দ্বীপ। এই অ্যাটলগুলোর মধ্যে ডজন দেড়েক অ্যাটল রয়েছে যার ভূমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এগুলোতে কম-বেশি জনবসতি রয়েছে। কিন্তু এগুলোর ভূমি-অবস্থান অ্যাটলের মধ্যেকার লেগুন (পানি)-এর চারদিকে ঘিরে, যা এমন কোন বড় বা প্রশস্ত নয় যেখানে লোকচক্ষুর আড়ালে কোন বড় ধরনের ঘাঁটি বা স্থাপনা নির্মাণ করা যায়। তাছাড়া অন্য অ্যাটলগুলো ঘর-বাড়ি করে বসবাসের মত নয়। তাহলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট বিশাল ঘাঁটি গড়ার মত অ্যাটল এখানে কোথায় পাবে, যাকে বা যে অ্যাটলকে ক্ষমতার কেন্দ্র বলে অভিহিত করতে পারে?
অ্যাটলগুলোর যে চেহারা দেখেছে তাতে সে ধরনের কোন অ্যাটল তার চোখে পড়েনি।
এসব চিন্তা আহমদ মনের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল। তাহলে কার্যকরণ মতে সামনের রেখে আসা তাহিতির আশে-পাশের অ্যাটলেই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ঘাঁটি আছে বলে সে মনে করেছে, সেটা কি মিথ্যা হবে? আহমদ মুসার মন বলছে সে ঠিক পথেই চলছে। যে অনিশ্চয়তা দেখছে সে মাঠের বাস্তবাতায়, তার চিহ্ন কিন্তু তার মনে নেই।
হঠাৎ গাড়ি হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল।
চমকে উঠে আহমদ মুসা তাকাল চারদিকে। দেখল, বাম দিকে একটা পার্ক ও ডানদিকে বাগান-শোভিত একটা সংরক্ষিত টিলা।
‘দাঁড়ালেন কেন মি. তেপাও? এটা কোন জায়গা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘স্যার, আমি আ্যভেনিউ হিন্দি থেকে আ্যভেনিউ পোমা যাওয়ার জন্যে এই ডাইভারসন রোডে ঢুকেছি। সামনে পথের উপর হঠাৎ একটা মাইক্রো এসে দাঁড়িয়েছে স্যার।’ বলল তেপাও।
গাড়িটা আহমদ মুসার চোখে পড়েছিল আগেই। ভেবেছিল, এক বোকা ড্রাইভার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিচ্ছে। না, তা নয়। রাস্তা ব্লক করে গাড়িটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। মাইক্রোর জানালায় কাঁচ শেড দেয়া। ভেতরের কিছুই কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
মাইক্রোটা আহমদ মুসাদের গাগড়ি থেকে সাত আট গজ দুরে।
‘মি. তেপাও মাইকোর সামনের দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা কর। দেখা যাক, ওদের মতলব কিছু আছে কিনা।’ আহমদ মুসা বলল ড্রাইভারকে।
‘কি ঘটেছে? মাইক্রোটা আমাদের পথ আগলেছে কেন?’ বলল মারেভা। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘বুঝা যাচ্ছে না, দেখা যাক।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার তেপাও দ্রুত গাড়ির মাথা ঘুরিয়ে নিতে চলতে শুরু করল মাইক্রোকে পাশ কাটাবার জন্যে।
আহমদ মুসাদের গাড়ি মাইক্রোটির বরাবর আসতেই মাইক্রোর দু’দিক থেকে জনাছয়েক লোক নেমে ছুটে এল আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে।
লোকগুলোকে দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, গুন্ডা-বদমাস শ্রেণীর লোক হবে এরা। সবাই শ্বেতাংগ। আহমদ মুসার চোখ মাইক্রোর ফ্রন্ট সীটের দিকেও গিয়েছিল। দেখল, ড্রাইভিং সীটের পাশে একজন শ্বেতাংগ যুবতী বসে আছে। তার স্থির চোখ মনে হোল মারেভার দিকে।
ওরা ছয়জন এসে আহমদ মুসাদের গাড়ি ঘিরে ফেলল।
দু’জন গিয়ে মারেভার পাশের দরজায় লাথি দিয়ে বলল, ‘খোল দরজা। না হলে দরজা ভেঙে ফেলব।’
উদ্বেগ-আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল মারেভার মুখ। কাঁপছিল সে। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে।
‘দরজা খুলে দাও মারেভা।’ শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মু্সাও বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
মারেভা চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা কে? কি তাও তোমরা? আমি কি করেছি? ছাড় আমাকে।’
‘চল, তোকে প্রেম করতে করা শেখাব। তামাহি মাহিনের চেয়ে আমরা অনেক ভাল প্রেম করতে জানি।’ বলল ওদের একজন।
এদের কথা শুনে এবং মাইক্রোর সামনের সীটে বসা সান্ডা সুসানকে দেখে মূহুর্তেই সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল মারেভার কাছে। তাহলে সান্ডা যে থ্রেট দিয়েছেল, সেটারই বাস্তবায়ন করতে এসেছে সে। এরা কি তাহলে তাকে কিডন্যাপ করতে এসেছে!
ইতিমধ্যে দু’জন মারেভাকে টেনে বের আনল গাড়ি থেকে এবং কয়েকজন তাকে শূন্যে তুলে ধরে মাইক্রোর দিকে যাবার উদ্যোগ নিল।
‘ছেড়ে দাও, বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করছে মারেভা।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘ছোকরার দল, ছেড়ে দাও ওকে।’ শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠস্বর আহমদ মুসার।
ওরা সবাই ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। এমন শান্ত, শক্ত কন্ঠস্বরের সাথে তারা বোধ হয় পরিচিত নয়।
ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে একটু দেখে নিয়ে ওদের একজন বলল, ‘সরে যা নেটিভ ডগ, ছাতু করে দেব তা না হ…।’
কথা তাকে শেষ করতে দিল না আহমদ মুসা। এক ধাপ এগিয়ে এসে লোকটির বাম চোঁয়ালে ডান হাতের একটা ব্লু চালাল।
কথা শেষ না করেই লোকটি সটান পড়ে গেল মাটিতে। পড়ে গিয়ে একটুও নড়ল না। জ্ঞান হারিয়েছে সে।
তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল মারেভাকে শূন্যে তুলে নিয়ে। আর দু’জন দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে। এরা দু’জন সংজ্ঞা হারানো সাথীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। চোখ জ্বলছে ওদের বাঘের মত। বাঘের মতই ওরা এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা বিদ্যুৎ গতিতে পিছিয়ে এল আর সাথে সাথে ওদের দু’জনের মাথা এসে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার পায়ের কাছে। পড়েই ওরা উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা ডান পাশের লোকটির ডান কানের নিচে ডান পায়ের একটা লাথি ছুড়ে মারল। জুতার পয়েন্টেড মাথাটা সুতীব্র একটা ঘা মারল লোকটার কানের নিচের নরম জায়গায়। সংগে সংগেই লোকটার দেহ মাটির উপর খসে পড়ল। মাথায় এই ঘা খাওয়ার পর তার সংজ্ঞা থাকার কথা নয়।
বাম পাশের লোকটি তার দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কোমরটা তখনও সোজা করতে পারেনি। তার দেহের উপরের অংশ কোমরের উপর তখনও সমকৌণিক অবস্থানে।
আহমদ মুসা বাম হাতে লোকটার মাথার চুল খামচে ধরে ডান হাতের মোক্ষম কারাত চালাল তার ঘাড়ে। ঘাড়ের নাজুক জায়গাটায় হাতুড়ির মত আঘাতে যে কোন মানুষকে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে রাখার জন্যে যতেষ্ট।
এ লোকটির দেহটাও মাটিতে আছড়ে পড়ল।
আহমদ মুসা ডান হাতের কারাতের কাজ শেষ করেই তাকিয়েছিল মারেভা চ্যাংদোলা দেহ নিয়ে দাঁড়ানো তিন জনের দিকে। দেখল ওরা মারেভাকে ছেড়ে দিয়েছে। একজন তার পকেট থেকে রিভলবার বের করেছে।
চোখের পলকে আহমদ মুসার দুই হাত শূন্যে উঠেই ছুটল মাটির দিকে। আর পা দু’টি শূন্যে উঠে তীব্র গতিতে বৃত্তাকারে ঘুরে গিয়ে আঘাত করল রিভলবারধারীর হাত ও বুকে।
রিভলবারধারীর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রিভলবার এবং সেও পড়ে গেল চিৎ হয়ে।
আহমদ মুসার পা যখন লোকটিকে আঘাত করে মাটি স্পর্শ করল, তখন চক্রাকারে ঘুরে সোজা হয়েছে এবং দক্ষ এ্যাক্রব্যাটের মত আহমদ মুসা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেছে।
রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েই আহমদ মুসা পেছনে ওদের তিনজনের দিকে রিভলবার তাক করে ওদেরকে বলল, ‘কোন চালাকি না করে তোমরা ওপুর হয়ে শুয়ে……।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করার আগেই তিন জনের দু’জন আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসার রিভলবার তাক করা ছিল। কিন্তু গুলি না করে ধাক্কা মেরে মারেভাকে এক দিকে সরিয়ে দিয়ে সেও দ্রুত এক পাশে সরে গেল।
আহমদ মুসার উপর চড়াও হতে ব্যর্থ হয়ে দু’জন গর্জে উঠে আবার ঘুরে দাঁড়াল। তাদের সাথের তৃতীয় জনও এবার উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে যোগ দিল।
আহমদ মুসা বুঝল ওরা বেপরোয়া। ওদের চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই। তবু আহমদ মুসা গর্জে উঠল, ‘দেখ, তোমরা আত্মসসর্পণ কর, না হয় পালিয়ে যাও। অন্যথা করলে তিনজনই ….!’
এবারও আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে দিল না।
আহমদ মুসার রিভলবার পর পর তিনবার গুলিবর্ষণ করল। তিন জনই ওরা পায়ে গুলি খেল।
অদ্ভুদ ব্যাপার, তিনজনই ওরা গুলি খেয়ে বসে পড়ল বটে, কিন্তু দেখা গেল তিনজনই ওরা আহত হওয়ার দিকে ভ্রক্ষেপ না করে পকেট থেকে বের করে আনল ডিম্বাকৃতির হাত বোমা।
চোখে-মুখে ওদের চরম বেপরোয়া ভাব।
তিনজনের হাতই এক সাথে উপরে উঠল হাত বোমা ছোঁড়ার জন্যে। নিরুপায় আহমদ মুসা। গুলি করা ছাড়া আত্নরক্ষার আর কোন উপায় নেই। কিন্তু রিভলবারে গুলি আর কয়টা আছে কে জানে!
ওদের হাত উপরে ওঠার সংগে সংগেই আহমদ মুসার রিভলবার পরপর তিনবার গুলিবর্ষণ করল।
তিন জনেই কব্জি গুলিবিদ্ধ হলো। তাদের হাত থেকে খসে পড়ল বোমা। স্বস্তির নি:শ্বাস নিয়ে আহমদ মুসা তাকাল মাইক্রোর দিকে।
মাইক্রোর সেই মহিলাকে। আরও কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে আসছে এদিকে। তাদের সাথে ভয়ে-উদ্বেগে বিপর্যস্ত একজন তরুণ।
তরুণকে দেখেই মারেভা চিৎকার করে উঠেছে, ‘মাহিন!’ মারেভা কন্ঠ কান্নাজড়িত।
তরুণটি কাছাকাঠি আসতেই মারেভা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল, ‘ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন, স্যার যেন ঈশ্বরের হাত। কিভাবে কি ঘটে গেল।’ কেঁদে উঠল মারেভা।
পুলিশরা ছয়জনকে যখন হাতকড়া পরাছিল, তখন পুলিশের কর্তা ব্যাক্তিটি আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। একাই ছয়জনকে সামলেছেন। আমার কাছেও অবিশ্বাস্য লাগছে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি, আপনি হত্যা এড়িয়েছেন জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্বেও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আপনাকে এখানে নতুন মনে হচ্ছে। আগে আপনাকে দেখিনি।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল মারেভা। পুলিশকে আহমদ মুসার দিকে আসতে দেখেই মারেভা তামাহি মাহিনকে নিয়ে আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘স্যার, ইনি একজন টুরিষ্ট।’ আমি তার গাইডের কাজ করছি। ক’দিন আগে তিনি এসেছেন।’
‘ওয়েলকাম আপনাকে। কিন্তু ট্যুরিষ্টরা সাধারনত ভীতু হয়। তারা স্থানীয় কোন ব্যাপারে নিজেদের জড়ায় না। আপনি কিন্তু ব্যাতিক্রম।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘মানুষের সামনে বিশেষ কিছু বিষয় যখন আসে, তখন তার কাছে নিজদেশ আর পরদেশ বলে কিছু থাকে না। সবাই এটা করে। আমিও তাই করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সবাই করে না। ব্যতিক্রম হিসেবে কেউ কেউ করেন, যেমন আপনি।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘কিন্তু সবাইকেই করা উচিত। না করাটাই ব্যতিক্রম।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল পুলিশ অফিসারটি। বলল, ‘নীতিগত ভাবে আপনার কথাই ঠিক।’
কথাটা শেষ করেই পুলিশ অফিসার তাকাল তার পুলিশদের দিকে। বলল, ‘তোমাদের কাজ শেষ? রেডি তোমরা।’
‘ইয়েস স্যার!’ একজন পুলিশ একটু এগিয়ে এসে স্যালুট করে বলল।
পুলিশ তাদের সাথের তরুনটির দিকে চেয়ে বলল, ‘মাহিন তুমি ও মারেভা তোমাদের দু’জনকেই পুলিশ ষ্টেশনে যেতে হবে। মারেভার ষ্টেটমেন্ট নিতে হবে।’
বলেই পুলিশ অফিসার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি কোথায় উঠেছেন মারেভা জানে। আমরা ওর কাছ থেকে জেনে নিয়ে আপনার কাছে আমারদের একটু যেতে হবে। আপনার লিখিত সাক্ষ আমাদের দরকার হবে।’
‘ওয়েলকাম! আবার দেখা হবে।’ বলল আহমদ মুসা। পুলিশ অফিসার ‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়ির দিকে চলতে শুরু করল।
পুলিশ অফিসারকে লক্ষ করে মারেভা বলল, ‘আমরা আসছি।’ বলে মারেভা দাঁড়াল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, মাহিনের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। ও তামাহি মাহিন! আমার মত সেও ছাত্র।’ হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আরও পরিচয় হলো, তোমরা একে অপরের খুব কাছাকাছি। আমি আশা করি, একে অপরের জীবন সাথী হবে তোমরা। আরও খবর হলো, তোমার বিপদ সে আঁচ করতে পেরে পুলিশ নিয়ে এসেছিল তোমাকে বাঁচাতে। ধন্যবাদ তামাহি মাহিন!’ মুখস্তের মতই কথাগুলো এক নি:শ্বাসে বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ও তামাহি মাহিন দু’জনেরই মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘স্যার, এত সব বিষয় কখন আপনি জানলেন, কি করে জানলেন?’
‘সে সব কথা পরে হবে। তোমরা এখন যাও। পুলিশের ঝামেলাটা আগে শেষ করে এস।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আপনার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। কোন ধন্যবাদ বা কোন কিছু দিয়েই আপনার ঋন শোধ হবে না।’ তামাহি মাহিন বলল।
আহমদ মুসা হেসে বলল, ‘মনে হচ্ছে চির বিদায় নিয়ে যাচ্ছ। তোমাকে তো বিদায় দেইনি আমি। তুমি মারেভা সাথে করে আসবে আমার হোটেল।’
‘অবশ্যই স্যার। কয়েকটা কথা বলেই মনে হচ্ছে আপনাকে বহুদিন ধরে চিনি। তাহলে এখন চলি স্যার।’ বলল তামাহি মাহিন।
মারেভা মুখোমুখি হলো আহমদ মুসার। তার মুখ-চোখ ভারি। বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ দিলে আপনাকে ছোট করা হবে স্যার। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আপনি না থাকলে পুলিশ আসার আগেই ওরা আমাকে গায়েব করতো। ওরা সাংঘাতিক। ভবিষ্যতে আরও কি আছে জানি না স্যার।’ কান্নায় আটকে গেল মারেভার শেষ কথাগুলো।
‘কোন ভয় নেই যাও। পরি শুনব তোমাদের কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ওখানে কখন আসব স্যার।’ বলল মারেভা।
‘সব ঝামেলা শেষ করে যখন তুমি সময় পাবে, তখন মাহিনকে সাথে নিয়ে আসবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। ওকেও নিয়ে আসব। চলি স্যার। গুড বাই।’
বলে মারেভা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করল।
হাঁটতে গিয়েও তামাহি মাহিন দাঁড়িয়ে গিয়ে মারেভার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
দু’জনে এক সাথে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা এগোলো তার ট্যাক্সির দিকে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার তেপাও ভয়ে আড়ষ্ট স্থানুর মত বসেছিল তার সীটে। ভয় ও আতংক এখনও তার চোখ মুখ থেকে যায়নি।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে এসে পৌঁছতেই ড্রাইভার তেপাও আহমদ মুসার প্রতি স্থির দৃষ্টি নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এবং আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা বাউ করল। বলল, ‘আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। আমার চোখ ধন্য হয়েছে জীবন্ত এই দৃশ্য দেখে।’
আহমদ মুসা কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসল। বলল, ‘মি. তেপাও। বুঝলাম না, এটা নিছক নারী-অপহরণের কেস, না এর পিছনে অন্য কিছু আছে? তোমাদের এখানে কি প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে?’
‘স্যার, নারী কেন্দ্রিক ঝগড়া-ঝাটি আছে। কিন্তু এ রকম যুদ্ধ মানে সংঘবদ্ধ অপহরণের ঘটনা কখনও ঘটেছে বলে জানি না।’ বলল ড্রাইভার তেপাও।
আহমদ মুসা কিছু বলল না।
গাড়ির সীটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল আহমদ মুসা। বলল, ‘হোটেলে চল মি. তেপাও।’
গাড়ি ষ্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।

শুকনা মুখে সান্ড্রা সুসান গ্রান্ট টাইরেলির কক্ষে প্রবেশ করল। দুশ্চিন্তায় তার মুখ আচ্ছন্ন।
সান্ডা সুসান যে সাপ্লাই কোম্পানির পাপেতি কেন্দ্রের ষ্টেশন ম্যানেজার, সেই কোম্পানীর বড় কর্তা গ্রান্ট টাইরেলি। গ্রান্ট টাইরেলির তলব পেয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে সান্ডা সুসান।
গ্রান্ট টাইরেলিই তার পরিচিত মহলের সাহায্য নিয়ে উপরে দেন-দরবার করে থানা থেকে সান্ডা সুসান, গুলিবিদ্ধ তিনজন ও অন্য তিনজনকে ছাড়িয়ে এনেছে এবং এ নিয়ে আর তদন্ত –অনুসন্ধান না হয় সে ব্যাবস্থাও করেছে। লিখিত অংগীকার করতে হয়েছে যে তামাহি মাহিন ও মারেভাকে তারা আর কোনওভাবে বিরক্ত করবে না।
সান্ডা সুসান আশংকা করছে এই বিষয়েই তার কঠোর বস গ্রান্ট টাইরেলি তাকে কিছু বলবে। সান্ড্রা সুসান জানে কোন ভুলের মাফ নেই কোম্পানির উপরের বস টাইরেলির কাছে।
সান্ড্রা সুসান প্রবেশ করতেই বিশাল টেবিলের ওপাশে বসা দীর্ঘদেহি ও ঋজু শরীরের গ্রান্ট টাইরেলি টেবিলের উপর থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘ওখানেই দাঁড়াও সান্ড্রা।’
গ্রান্ট টাইরেলির সামনে একটা ফাইল খোলা ছিল।
‘ইয়েস স্যার’ বলে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গেল সান্ড্রা সুসান। টেবিলের সামনে বসার কোন চেয়ার নেই।
মিনিট দু’য়েক পরেই মুখ তুলল গ্রান্ট টাইরেলি ফাইল থেকে। অভিব্যাক্তিহীন পাথরের মত শক্ত মুখ। ঠান্ডা চোখ। সেই শক্ত মুখ থেকে বেরিয়ে এল কথা, ‘সান্ড্রা, তুমি কয়টি অপরাধ করেছ?’
কেঁপে উঠল সান্ড্রা। বলল, ‘দু’টি অপরাধ করেছি স্যার। এক, বাইরের একজনের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছি এবং দুই. আমার কারনেই বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়িয়েছে।’
‘তোমার সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো তুমি আমাদের স্থানীয় নীতি লংঘন করেছো। আমরা চাই না মানুষের দৃষ্টি কোনওভাবে আমাদের প্রতি আকৃষ্ট হোক, আমাদের পেছনে লাগুক, আমাদের সন্ধান করুক। তুমি এই কাজই করেছ, যা ক্ষমাহীন অপরাধ। তুমি এই অপরাধ স্বীকার কর?’ বলল গ্রান্ট টাইরেলি।
‘হ্যাঁ স্যার। আমি এই অপরাধ করেছি।’ বলল সান্ড্রা সুসান।
‘ধন্যবাদ!’ বলে গ্রান্ট টাইরেলি অত্যান্ত ধীরস্থিরভাবে ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করে গুলি কলল সান্ড্রা সুসানের বাম বুকে।
মাপ-জোক করা গুলি। এক গুলিতেই সান্ড্রা সুসানের দেহটা ঝরে পড়ল মেঝেতে। গুলি খাবার আগে সান্ড্রার দু’চোখ একবার বিস্ফোরিত হয়েছিল। কিন্তু মুখ দিয়ে চিৎকার বের হতে পারেনি।
গুলির শব্দ হওয়ার পর পরই দু’জন ঘরে প্রবেশ করল একটা ট্রলি ঠেলে। সান্ড্রা সুসানের লাশ তারা ট্রলিতে তুলে নিয়ে চলে গেল।
লাশ চলে গেল গেলে গ্রান্ট টাইরেলি চেয়ার থেকে উঠে ঘরের পাশের দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে প্রবেশ করল। সেখানে একটা টেবিলের সামনে চারজন লোক বসেছিল।
গ্রান্ট টাইরেলি টেবিল ঘুরে ওপাশে গিয়ে হোষ্টেল বড় চেয়ারটায় বসল। টেবিলের পাশের যে চারজন লোক উঠে দাঁড়িয়েছিল, তারাও বসল।
‘সান্ড্রা সুসান আমাদের একজন পুরানো ও পরীক্ষিত কর্মী ছিল। তার পতন আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। লর্ড অ্যালেক্সী গ্যারিন ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। ম্যাডাম গ্যারিনের একটা মেসেজ পেয়েছি আজ।’ চেয়ারে বসেই বলে উঠল গ্রান্ট টাইরেলি।
‘কি মেসেজ স্যার?’ চরজনের একজন বলল।
‘পাপেতির সাপ্লাই অফিস আজ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। ফা’তে যে বিকল্প অফিস নেয়া আছে, ওটা আজ থেকে চালু করতে হবে। তামাহি মাহিন ও মারেভার ব্যাপারে নির্দেশ এসেছে। আপাতত ওদের কিছু করা যাবে না। মারেভার উপর আক্রমণ ও থানা-পুলিশের ঘটনা যখন মানুষ কয়েক মাস পরে ভূলে যাবে, তখন সান্ড্রা যে শাস্তি পেয়েছে, ওরাও সেটাই পাবে। সান্ড্রার মৃত্যুর নিমিত্ত ওরা। তাই ওরাও একই শাস্তি পাবে।’ বলল গ্রান্ট টাইরেলি।
‘আমাদের অখন্ড গোপনীয়তার গায়ে কোন আঁচড় কখনও পড়েনি। সান্ড্রার ঘটনা আমাদের কতখানি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, তা কি আমরা জানতে পেরেছি?’ চারজনের মধ্য থেকে একজন বলল।
‘আমি যতটা ক্ষতিয়ে দেখেছি, তাতে সান্ড্রার বাইরে আমাদের কারো পরিচয় অন্য কোথাও বা কারো কাছে উন্মু্ক্ত হয়নি। সেই মাত্র যোগসূত্র হয়ে উঠছিল বা হতে পারতো। সে না থাকায় যোগসূত্র এখন উধাও। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।’ বলল গ্রান্ট টাইরেলি।
কথা শেষ করেই গ্রান্ট টাইরেলি তাকাল চারজনের একজনের দিকে। বলল, ‘নাশকা, আমাদের ‘ফা’ সাপ্লাই কেন্দ্রের দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়েছে। তুমি আজই চলে যাও ‘ফা’ সাপ্লাই অফিসে। সাপ্লাই রুটিন-এ কোন অনিয়ম হওয়া চলবে না।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি আজই ‘ফা’তে যাচ্ছি। অবশ্যই কোন অসুবিধা হবে না, সব ঠিক ঠাক চলবে।’ বলল লোকটি, যাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছিল গ্রান্ট টাইরেলি।
‘কথা এখানেই শেষ!’ বলে উঠে দাঁড়াল গ্রান্ট টাইরেলি।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই।

আহমদ মুসার হোটেল রুম।
মারেভাদের বসিয়ে আহমদ মুসা এইমাত্র ঢুকল তার বেডরুমে এটাচ্ড বাথে। হোটেলের জিমনেসিয়াম থেকে সবেমাত্র ফিরেছে সে।
মারেভার মারেভা মা পাশের আরেকটা সোফায় বসেছে। পাশাপাশি সোফায় বসেছে মারেভা ও তামাহি মাহিন। তারা সময়ের আগেই পৌঁটে গেছে আহমদ মুসার রুমে। পথে আরুতে একটা কাজ ছিল বলে একটু আগেই বেরিয়েছিল। কিন্তু সে কাজের সুযোগ হয়নি বলে সময় বেঁচে গেছে।
‘আরু’ নামের ধব্বংস প্রাপ্ত নগরী তামাহি মাহিন ও মারেভার পরিবারের অতীত বাসস্থান। মাহিন ও মারেভার বাবারা তাহিতির পমারী রাজবংশের সন্তান। পমারী রাজবংশের রাজধানী ‘আরু’ এখন একটা ধব্বংসাবশেষ। তবে পমারীদের একটা প্রার্থনা গৃহ এখনও টিকে আছে। তাছাড়া প্রার্থনা গৃহের শতায়ু বয়সের পুরোহিত মারেভাদের আত্মীয়। তার সাথেই তাদের কাজ ছিল। আহমদ মুসা চলে যেতেই সে পথের দিকে চোখ ফেরাল মারেভার মা। মূলত পুরোহিতের সাথে দেখা করার জন্যই মারেভার মা এসেছে মারেভাদের সাথে। এটা জেনে আহমদ মুসাই তাকে হোটেলে আনতে বলেছিল। আহমদ মুসার গমন পথের দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেই তামাহি মাহিন বলল, ‘স্যারকে যতই দেখছি, বিস্ময় ও কৌতূহল আমার ততই বাড়ছে। সেদিন ছয়জন হাইজ্যাকারের সাথে লড়াই করা দেখে মনে হয়েছে। সবজান্তা একজন লড়াকু তিনি। আবার সব মানুষের সাথে তার ব্যাবহার ও ভালোবাসা দেখলে মনে হয় তিন একজন মানবতাবাদী।’
‘উনি একজন অসম্ভব ভাল মানুষ! এটাই আমার মতে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি একা ঘরে থাকলে কেন তিনি ঘর খোলা রাখেন সেটা জেনেছি মা। ওদের ধর্মের এটাই বিধান। এ কয় দিনে ওদের ধর্মের অনেক কিছু জেনেছি। যা দেখছি, তাতে ওদের ধর্ম ‘মানবতার ধর্ম’ মা। মানে প্র্যাকটিক্যাল বাস্তব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ঠ।’
‘মুসলমানদের সাথে ওঠা-বসা করিনি। ওদের সম্পর্কে জানিও না। কিন্তু আমার দাদা শ্বশুরের কাছে শুনেছিলাম, তাঁর দাদা নাকি বলতেন আমাদের ‘পমারী’ বংশের সাথে মুসলমানদের গভীর যোগসূত্র ছিল। কি একটা বড় ঘটনা, বৃটিশদের আগমন, সবচেয়ে ফরাসিদের প্রতিপক্ষ-নিমূল অভিযানে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’ বলল মারেভার মা।
‘কি শেষ হয়ে গেছে খালাম্মা?’ বলতে বলতে বেড রুম থেকে বের হয়ে এল আহমদ মুসা।
খুব ফ্রেস দেখাচ্ছে আহমদ মুসাকে।
ফরমাল পোষাক পরেছে আহমদ মুসা। বাইরে বেরুবার ইচ্ছা তার নিশ্চয় আছে।
সবাই উঠে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল।
আহমদ মুসা মারেভার মা’কে বসিয়ে তারপর নিজে বসল।
মারেভার মা বসতে বলল, ‘বাচ্চারাও ছাড়ল না। আমিও ভাবলাম এদিক হয়েই যাই। আপনি কিন্তু একদিন যাব বলেছিলেন! ক’দিন হয়ে গেল আর তো গেলেন না।’
‘যাব একদিন। তবে খুব শীঘ্র তো যাওয়া হচ্চে না।’ সব কিছু হয়ে গেলে। কিছু কি ঘটেছে?’
‘না, এখনকার কোন বিষয় নয়। মুসলমানদের সাথে আমাদের পমারী রাজবংশের সম্পর্কের কথা বলছিলাম। কি একটা ঘটনা এবং বৃটিশ ও ফরাসিদের আগমন সব শেষ করে দেয়। সেটাই বলছিলাম।’ মারেভার মা বলল।
ভ্র কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘তাহিতির প্রাচীন রাজবংশ পমারীর কথা শুনেছি। কিন্তু তাদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক হবে কি করে?’
‘আমিও এব্যাপারে কিছু জানি না। একবার আমার দাদা শ্বশুর খবরের কাগজে কি একটা নিউজ পড়ে তাঁর দাদাকে কোট করে বলেছিলেন পমারী রাজবংশের সাথে মুসলমানদের গভীর সম্পর্ক ছিল। আমি এটুকুই জানি। সেটাই আমি ওদের বললাম।’ মারেভার মা বলল।
‘এমন কিছু অসম্ভব নয়। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মুসলমানদের যুদ্ধ ও বাণিজ্য জাহাজ আটলান্টিক, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর চষে ফিরত। তারপরও তিনশত বছর পর্যন্ত সাগরগুলোতে বিভিন্নভাবে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল। আমি তাহিতির পুরাতত্ব যাদুঘরে একদিন যেতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে স্যার, মুসলমানরা এক সময় দুনিয়া জোড়া রাজনৈতিক শক্তি ছিল?’ জিজ্ঞাসা তামাহি মাহিনের।
‘অবশ্যই। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মুসলমানরা তখনকার জানা পৃথিবীর সবটার উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। সপ্তদশ শতকে মুসলমানরাই প্রধান রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছে। বৃটিশ, ফরাসিসহ ইউরোপীয়রা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার সন্ধান পেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল মারেভার দিকে। বলল, ‘সান্ড্রা না কি যেন নাম? ওদের খবর কি, ওরা কি আর ডিষ্টার্ব করেনি?’
মারেভা জবাব না দিয়ে তাকাল তামাহি মাহিনের দিকে। বলল, ‘তুমিই বল মাহিন, অনেক কিছুই তো ঘটেছে?’
‘কেন, ওরা থানা থেকে ছাড়া পাবার পর আরও কিছু করেছে?’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠে কিছুটা বিস্ময়!
‘না স্যার, আমাদের কিছু করেনি। ওদের মধ্যেই অনেক কিছু ঘটেছে।’
‘অনেক কিছু ঘটেছে? কি ঘটেছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সেই সাপ্লাই অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। সান্ড্রা সুসানও বেঁচে নেই বলে মনে হয়।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘বেঁচে নেই? ঘটনা কি বলত?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাপ্লাই অফিসের ক্যারিয়ার ও প্যাকিংম্যান দু’জনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকেই এসব ঘটনা শুনলাম।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘কি বলেছে তারা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘যে দিন সান্ড্রারা থানা থেকে মুক্ত হয়, সেদিনও ওরা দু’জন অফিস করেছে। কিন্তু পরদিন অফিসে গিয়ে দেখে তাদের সাপ্লাই অফিস বন্ধ। ছোট্ট একটা নোটিশ টাঙানো দেখতে পায়। তাতে লেখা ছিল: ‘কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তক্রমে ব্যবসায় বন্ধ করে দিয়েছেন। দেনা-পাওনার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সাথে সরাসরি করবেন।’ নোটিশ দেখে হতাশ হয়ে ঐ দু’জন কর্মী সান্ড্রার সাথে দেখা করার জন্য তার বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে তার মাকে দেখতে পায় সাংঘাতিক ভীত। কথা বলতেও অস্বীকার করে। পাশের একজনের কাছ থেকে জানতে পারে সান্ড্রা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তার লাশ তার পরিবার পায়নি। কোম্পানিই নাকি তার সৎকারের ব্যবস্থা করেছে।’
‘ভ্র কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার। গোটা ঘটনার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পরিষ্কার। অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করল তার মনে। সান্ড্রা দূর্ঘটনায় মারা গেছে। তার লাশ তার পরিবার পায়নি। কোম্পানিই নাকি তার সৎকারের ব্যবস্থা করেছে।’
ভ্র কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার। গোটা ঘটনার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পরিষ্কার। অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করল তার মনে। সান্ড্রা দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার পরিবার ভীত কেন? সান্ড্রার দেহ ফেরত পেল না কেন? কে তার পরিবারকে ভয় দেখাল? সান্ড্রার কোম্পানি কি? কেন ভয় দেখাল? ব্যবসায় বন্ধ করল কেন কোম্পানি? থানা থেকে সান্ড্রা ও তার সাথীদের মুক্ত করল কে? কোম্পানিটা আসলে কি? তাহলে কোম্পানি তো সাংঘাতিক পাওয়ারফুল! তামাহি মাহিন জানিয়েছিল, পুলিশ তাকে বলেছিল সান্ড্রাদের তারা নি:শর্তে ছেড়ে দিয়েছিল, কারণ ওদের হাত সাংঘাতিক লম্বা! এসব নানান চিন্তা এসে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আহমদ মুসার মন।
আহমদ মুসাকে হঠাৎ চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে তামাহি মাহিন বলল, ‘স্যার কিছু ভাবছেন?’
আহমদ মুসা তাকাল তামাহি মাহিনের দিকে। বলল, ‘তোমাদের সান্ড্রার বিষয় নিয়েই ভাবছি।’
‘কি ভাবছেন?’ তামাহি মাহিন বলল।
‘আমার বিশ্বাস তোমাদের সান্ড্রাকে খুন করা হয়েছে।’
‘খুন?’ কে খুন করবে? বলল তামাহি মাহিন। বিস্ময় বিস্ফোরিত দু’চোখ তার।
‘যে কাহিনী তুমি শোনালে, তাতে তার কোম্পানি তাকে খুন করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার কোম্পানি? কেন খুন করবে? তারাই তো তাকে জেল থেকে বের করল!’ বলল তামাহি মাহিন।
‘কেন খুন করবে জানি না?’
বলে আহমদ মুসা মুহুর্তকাল ভাবল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা মাহিন, কোম্পানির হেড অফিস কোথায়?’
‘আমি জানি না।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তুমি কি কোম্পানির উপরের বসদের কাউকে দেখেছ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না দেখিনি।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘কোন দিন তারা আসেননি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার চোখে পড়েনি।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘টেলিফোনে কখনও কথা বলেছ? কিংবা তারা টেলিফোন করেছেন কখনও?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না। আমার অন্তত জানা নেই।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘তোমাদের কোম্পানি আর কি ব্যবসায় করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমার জানা নেই। কোম্পানি সম্পর্কে কোন আলোচনাই কখনও আমি অফিসে শুনিনি।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তোমাদের সাপ্লাই অফিস থেকে গড়ে প্রতিদিন কত টাকার পণ্য বিক্রি হতো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিক্রির টাকা কখনও আমি অফিসে আনতে দেখিনি। অফিস থেকে টাকা দিত, শুধু সেই টাকা দিয়ে পণ্য কিনে আমরা সাপ্লাই করতাম।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘কোথায় সাপ্লাই হতো?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘অ্যাটল এলাকায়।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘অ্যাটল কি বাজার আছে?’ আহমদ মুসা জানতে চাইল।
‘তোয়ামতো দ্বীপপুঞ্জের উত্তরের কয়েকটা দ্বীপে ছোট-খাট বাজার রয়েছে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সে সব বাজরেই তোমরা মাল পৌঁছাতে?’ সেখানে ও এখানকার দরের মধ্যে পার্থক্য কেমন?’
‘মূল্যের পার্থক্যটা আমি জানি না। কয়েকটার মাত্র আমাকে সাপ্লাই টিমের সাথে যেতে হয়েছে। কিন্তু কখনই সে সব বাজারে যাইনি।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সাপ্লাই তাহলে কোথায় দিত?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘স্যার, আমি তাহনিয়া দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছি।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘সেখানে বাজার নেই?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, সে দ্বীপে কোন জনবসতিই নেই, বাজার থাকবে কি করে?’ তামাহি মাহিন বলল।
‘জনবসতি নেই, তাহলে সাপ্লাই কোথায়, কাকে দিয়ে এলে, কেন দিয়ে এলে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, তাহানিয়া একটা অ্যাটল। সে অ্যাটলে ল্যান্ড বেন্টে একটা ছোট্ট গোডাউন আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। পণ্য ওখানেই কয়েকবার নামিয়ে দিয়ে এসেছি।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘ওটা কি কোন ফেরিঘাট? ওখান থেকে কি রিসাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা আছে?’ বলল আহমদ মু্সা।
‘না, ওটা কোন ফেরিঘাট নয়। ওখান থেকে কোন জনযান যাতায়াত করে না্। ওখান থেকে আরও অনেক উত্তরে কয়েকটি দ্বীপে জনবসতি আছে।’ তামাহি মাহিন বলল।
ভ্র কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। চোখে মুখে তার ফুটে উঠেছে অনেক জিজ্ঞাসা। বলল, ‘উত্তরের ঐ সব দ্বীপে মানে অ্যাটলে কি তাহানিয়া দ্বীপ হয়ে যেতে হয়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না স্যার। তাহিতি থেকে উত্তরের ঐ সব অ্যাটল বরং কাছেই। সোজাসুজি ওখানে যাওয়া যায়।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘তাহলে তাহানিয়া দ্বীপে সাপ্লাই পণ্য নামিয়ে আস কেন তোমরা?’ বলল আহমদ মুসা। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠা জিজ্ঞাসা আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে।
‘সেটা আমি জানি না স্যার। প্রশ্নটি আমার মনেও জেগেছে। কিন্তু কোম্পানির প্রয়োজন নেই এমন কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যায় না।’
গভীর একটা ভাবনার ছায়া পড়েছে আহমদ মুসার চোখে মুখে। বলল, ‘ঐ গোডাউন ছাড়া ঐ দ্বীপে আর কোন স্থাপনা নেই?’
‘নেই স্যার।’ বলল তামাহি মাহিন।
তামাহি মাহিনের কথা শেষ হলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। তার মুখ নিচু হয়েছে। ভাবছে সে।
তামাহি মাহিন ও মারেভাদের চোখে মুখেও কিছুটা বিস্ময় ফুটে উঠেছে! এতসব অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন আহমদ মুসা কেন করছে, এই জিজ্ঞাসা তাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই জেগে উঠেছে। এই কৌতুহল থেকেই তামাহি মাহিন জিজ্ঞাসা করল, ‘এতসব প্রশ্ন কেন করছেন স্যার? এসব কোন কৌতুহলের বিষয় বলে তো আমার মনে হয় না।’
আহমদ মুসা মুখ তুলল। তাকাল তামাহি মাহিনের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে। চোখ ফেরাল মারেভাদের দিকেও। বলল ধীর কন্ঠে, ‘আসলে আমি একটা দ্বীপের সন্ধান করছি।’
‘একটা দ্বীপের সন্ধান?’ প্রায় এক সংগেই বলে উঠল মারেভা ও তামাহি মাহিন।
‘হ্যাঁ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি দ্বীপ, কেমন দ্বীপ?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সেটা হতে হবে অ্যাটল দ্বীপ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোনো বিশেষ অ্যাটল দ্বীপ খুঁজছেন, না একটা ভাল অ্যাটল দ্বীপ খুঁজছেন?’ বলল মারেভা।
‘বিশেষ একটা অ্যাটল দ্বীপ খুঁজছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেমন সে দ্বীপ?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সেখানে বড় স্থাপনা থাকবে এবং চারদিকে থাকবে গোপনীয়তার আবরণ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তোয়ামতো দ্বীপপঞ্জে বড় স্থাপনা সম্বলিত দু’চারটি অ্যাটল দ্বীপ আছে। কিন্তু সেগুলো পাবলিক প্লেসে। সেখানে কোন গোপনীয়তা নেই।’ তামাহি মাহিন বলল।
‘আপনার সেই বিশেষ অ্যাটল দ্বীপ কি আমাদের এই তোয়ামতো দ্বীপপুঞ্জেই, আপনি নিশ্চিত স্যার?’ মারেভা বলল।
‘নিশ্চিত না হলে আমি এখানে ছুটে আসতাম না।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে মারেভারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল মারেভা, ‘স্যার, আপনি শুধু সে দ্বীপের সন্ধানেই এখানে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, খুবই কৌতুহল হচ্ছে জানতে কি আছে সে দ্বীপে কিংবা কি কাজা সেই দ্বীপে, যার জন্য হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে এখানে আসা!’ বলল মারেভার মা।
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো।
ভাবনার একটা ছায়াও তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। ধীর কন্ঠে বলল, ‘স্যরি খালাম্মা, বিষয়টা এই মুহুর্তে আমি বলতে পারছি না। এক সময় অবশ্যই আপনারা জানবেন। বিষয়টা আপনাদের ভয়-উদ্বেগই শুধু বাড়াবে। তবে এটুকু আমি বলতে পারি, বিষয়টা অত্যান্ত গুরুতর। ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের পিছু নিয়ে আমি এখানে এসেছি। একটা ধারণা ছাড়া আমিও ওদের সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানি না।’
আহমদ মুসার শান্ত, ঠান্ডা কন্ঠের কথাগুলো মারেভারা খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। তাদের সবার চোখে মুখেই ভয় ও উদ্বেগের একটা ছায়া নেমে এসেছে। আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও সংগে সংগে ওরা কেউ কথা বলল না।
নিরবতা ভাঙল মারেভাই, ‘স্যার, আপনার কথা থেকেই বিষয়টার গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু স্যার, এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপনি একা লড়াই করবেন কিভাবে?’ কি ষড়যন্ত্র তা জানা না থাকলে, ষড়যন্ত্রটা কার বিরুদ্ধে সেটা কি জানা যায়? আপনার একার বিরুদ্ধে নিশ্চয় ষড়যন্ত্র নয়?’
‘না, ষড়যন্ত্রটা আমার বিরুদ্ধে নয়। ষড়যন্ত্রটা এক অর্থে বলা যায় মানবতার বিরুদ্ধে, সভ্যতার বিরুদ্ধে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে তো তাহলে বিরাট ব্যাপার! কিন্তু ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার একটা এ্যাটল থেকে এই যড়ষন্ত্রটা কিভাবে হতে পারে?’
‘ষড়যন্ত্র হয়েছে, হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ ধরনের অ্যাটল দ্বীপ কি আমাদের তোমামতো দ্বীপপুঞ্জে আছে? কোনভাবে ভুল হচ্ছে না তো স্যার।’ বলল মারেভা।
‘অবশ্যই আছে। আমার ভুল হয়নি। আমি পারস্য উপসাগর থেকে একটা গুপকে তাড়া করে এখানে এসেছি। ওরা এখানকার কোন এক অ্যাটলে উঠেছে।’
‘আপনি বলছেন এটাই যথেষ্ট। সত্যের পক্ষে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আমরা চাই না। ওদের ষ্ট্যাবলিশমেন্টটা কত বড় স্যার?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আমি জানি না। তবে আমার ধারণা একশ’ লোকের কম হবে না। আহমদ মুসা বলল।
‘অসম্ভব স্যার! আমাদের কোন অ্যাটলেই এত বড় ষ্ট্যাবলিশমেন্ট নেই।’ বলল মারেভা।
‘তোমাদের এ অসম্ভব বলাটা রহস্যকে আরও ঘনিভূত করছে। এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। আমি প্রথমে তোমাদের তাহানিয়া দ্বীপ দেখতে চাই মারেভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই দেখবেন স্যার। কিন্তু হতাশ হবেন।’ বলল মারেভা।
‘হতাশার পাশেই আশা থাকে মারেভা। এই তাহানিয়া দ্বীপ দর্শনে মারেভা তো থাকবেই, তামাহি মাহিনকে অবশ্যই আমার সংগী হতে হবে। এখন থেকে তোমরা দু’জনই আমার গাইড হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘গাইড না গার্ড স্যার। আপনি তো পর্যটক নন। অতএব আপনার গাইড দরকার নেই।’ বলল মারেভা। তার মুখে হাসি।
‘মারেভার কথা ঠিক। গাইড না বলে গার্ড বলাই বেশি যুক্তি সংগত। তবে গার্ড যাকে বলে সেই গার্ড তোমাদের হতে হবে না। আমি আমার কোন বিপদে তোমাদের টানব না। তোমারা একটা বিপদে পড়েছিলে। তোমারা আবার কোন বিপদে পড়ো তা আমি চাইব না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সেদিন যেভাবে নিজের জীবন বাজি রেখে আমাকে বাঁচিয়েছেন, তাতে আপনার এ কথারই প্রমাণ মেলে। যারা নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যদের বাঁচায়, তার অন্যের জীবন বিপন্ন হওয়াকে পছন্দ করবে না। তবে স্যার, আমাদের গার্ড ভাবার দরকার নেই আপনার। সহযোগী হিসেবে ভাবুন। সহযোগীরা একে অপরের দুঃখ ভাগ করে নেয়। আমাদের মর্যাদা দিলেই আমরা খুশি হবো।’ মারেভা বলল।
‘আচ্ছা থাক এসব কথা! বলল মাহিন পুলিশ যে বলেছিল, তোমাদের কোম্পানির হাত খুব লম্বা, এটা কেন বলেছিল? ওরা প্রভাবশালী কোন দিক দিয়ে?’
‘আমি জানি না স্যার। তবে তাদের সম্পর্কে পুলিশের আরও কিছু কথা শুনেছিলাম। পুলিশরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিল ওরা ছয়কে নয় করার ক্ষমতা রাখে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘আচ্ছা বলত মাহিন, তোমাদের কোম্পানি তোমাদের স্থানীয় অফিস থেকে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে গড়ে যে শাক-সব্জি, মাছ-মাংস সাপ্লাই করতো তার গড় পরিমাণ কি একই রকমের?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি স্যার, গড় পরিমাণ একই রকমের। তামাহি মাহিন বলল।’
‘সে পরিমাণটা কি রকম? পঁচিশ তিরিশটা পরিবারে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহের উপযুক্ত?’ বলল আহমদ মুসা।
তামাহি মাহিন একটু ভাবল। মনে মনে অংকও কষল। বলল, ‘ঠিক স্যার পঁচিশ তিরিশটি পরিবারের মত। প্রতিদিন সব্জি কম বেশি একমণ, মাছ-মাংস প্রতিদিন গড়ে বিশ তিরিশ কেজির বেশি সাপ্লাই হতো না।’
আহমদ মুসার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘কিন্তু যে কয়েকটি অ্যাটলে জনবসতি আছে, তার মোট পরিবারে সংখ্যা পঁচিশ তিরিশের অনেক বেশি হবে নিশ্চয়?’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। কয়েকশ’ পরিবার অবশ্যয় হবে।’ বলল তামাহি মাহিন।
‘তাহলে মাহিন তোমাদের কোম্পানির সব্জি, মাছ, মাংশের সাপ্লাই অ্যাটলের পরিবারগুলোর চাহিদা পুরণের জন্যে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন স্যার?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘সব পরিবারের চাহিদা পুরনের জন্যে হলে চাহিদা বাড়া, কমা বা চাহিদা অনুসারে সাপ্লাইয়ের পরিমাণ কমবেশি হতো। সাপ্লাই ব্যবসায়ের এটাই নিয়ম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোম্পানির সাপ্লাই তাহলে কোন কারণে কি জন্যে একই ছিল?’ জিজ্ঞাসা তামাহি মাহিনের।
‘আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে সাপ্লাইয়ের অব্যবহত যে পরিমাণ, তা প্রমাণ করে সাপ্লাই ছিল বিশ পঁচিশটি পরিবার মানে শতখানেক মানুষের জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ফোরিত হয়ে উঠল তামাহি মাহিন ও মারেভার চোখ। বলল তামাহি মাহিন, ‘তার মানে স্যার, আপনি বলতে চাচ্ছেন একশ’ জনের যে ষড়যন্ত্রকারী ষ্ট্যাবলিশমেন্টর কথা আপনি বলেছেন, তাদের জন্যেই ছিল এই সাপ্লাই?’
‘আমি তা এখনও বলছি না। কিন্তু সকল যুক্তি তাদেরকে সন্দেহ করা পক্ষেই। এমন কি সান্ড্রা নিহত হওয়া বা গায়েব হওয়া, সামান্য কারণে সাপ্লাই অফিস বন্ধ হওয়ার মত বিষয়ও আমার সন্দেহকেই আরও প্রবল করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ দু’টি ঘটনা কি প্রমাণ করে?’ প্রশ্ন মারেভার।
‘দু’টি নয়, চারটি ঘটনা। মারেভাকে কিডন্যাপের চেষ্টা ও থানায় মামলা হওয়া, এ দু’টি ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ছিল সান্ড্রার নিহত হওয়া এবং সাপ্লাই অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়া।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে? কোম্পানির লোকরাই সান্ড্রাদেরকে ছাড়িয়ে নেয়?’ বলল তামাহি মাহিন।
‘যে কারণে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে সে একই কারণে সান্ড্রা খুন হয়েছে এবং সাপ্লাই অফিস বন্ধ হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে কারণটা কি হতে পারে স্যার?’ বলল তামাহি মাহিনই।
‘কোম্পানির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম না স্যার।’ বলল তামাহি মাহি্ন।
‘সান্ড্রা ও সাথী ছয় হাইজ্যাককারী থানায় থাকলে বা জেলে গেলে তাদের পরিচয়ের সাথে কোম্পানির পরিচয়ও প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয় ছিল। সে জন্যেই তাদের তড়িঘড়ি করে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে কিডন্যাপের ঘটনার মধ্যে দিয়ে সান্ড্রা ও সাপ্লাই অফিসের উপর থানা পুলিশসহ কিছু মানুষের চোখ গিয়ে পড়িছিল। এর মাধ্যমে কোম্পানির পরিচয়ও বেরিয়ে পড়ার ভয় সৃষ্টি হয়েছিল। সান্ড্রাকে গায়েব করা বা খুন করা এবং সাপ্লাই অফিস বন্ধ করে দেয়ার ফলে আশংকার সব দরজাই বন্ধ হয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
মারেভা ও মাহিনের মুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। মুগ্ধ মারেভার মা বলল, ‘বেটা তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে তুমি অত্যান্ত দক্ষ গোয়েন্দার মত তোমার সুক্ষ দৃষ্টি। আমি তোমার কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, আমি কোন গোয়েন্দা কাহিনী শুনছি। আমি ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বলছি, তুমি যে মিশনেই এসে থাক, তুমি সফল হবে। ঈশ্বর তোমাকে অদ্ভুদ ক্ষমতা দিয়েছেন। তুমি শূণ্যর উপরও প্রসাদ নির্মাণ করতে পার। সব চেয়ে বড় কথা হলো তুমি অত্যান্ত ভালো মানুষ। যে লোভগুলো মানুষকে দুশ্চরিত্র বানায়, অমানুষ বানায়, সে সব লোভ থেকে তুমি মুক্ত। আমার মেয়ে আমার পাশে থাকলে যতটা নিশ্চিত থাকি, তোমার সাথে থাকলেও ততটাই নিশ্চিত থাকি। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন বেটা।’ থামল মারেভার মা।
‘ধন্যবাদ খালাম্মা। মায়েরা সব সময় সন্তানদের ভালটাই দেখেন। আপনি তাই দেখেছেন। তবে খালাম্মা আমারও সবচেয়ে বড় চাওয়া এটাই যে, আল্লাহ যে রকম মানুষ চান, আমি যেন সে রকম একন মানুষ হতে পারি এবং আমি যাই করি তা যেন মানুষের উপকারে আসে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে ভাল কাজ সম্পাদনকেই মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে উভিহিত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘জীবন ও মৃত্যু আমি সৃষ্টি করেছি এটা দেখার জন্যে যে কারা ভাল কাজ করে।’
‘ধন্যবাদ বেটা। মারেভা তোমাদের ধর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি তো বললাম আমাদের পমারী বংশের সাথে মুসলমানদের একটা গভীর সম্পর্ক নাকি ছিল।’
‘আমি এ বিষয়টাও অনুসন্ধান করব খালাম্মা। আমি পমারী ডাইনেষ্টির ধ্বংস প্রাপ্ত রাজধানী ‘আরু’ এবং আপনাদের পুরাতত্ব ঘাদুঘরে যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও খুশি হবো বেটা। আঠারশ’ পনের অর্থ্যাৎ উনিশ শতকের শুরু থেকে দেশের খৃষ্টীয়করণ যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি ইতিহাস মুছে ফেলার ধুম চলচে। তাহিতির মূল অধিবাসিরা চায় ইতিহাস রক্ষা পাক, প্রকৃতি ইতিহাস উদ্ধার হোক।’
‘এই দায়িত্ব খালাম্মা মারেভা, মাহিনদের মত নতুন প্রজন্মের।’
‘এই প্রজন্ম জানেই না যে, তাদের স্বতন্ত্র কোন ইতিহাস আছে। আমাদের ইতিহাস শুরু হয়েছে বৃটিশদের ও ফরাসিদের আগমন থেকে। আজ আপনাদের কথা থেকে ইতিহাস নিয়ে যে উৎসাহ বোধ করছি, তা অতীতে কোন সময় হয়নি। আপনাদের বিশেষ করে স্যারকে ধন্যবাদ।’ বলল মারেভা।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর দেরি নয় সকলে উঠুন। লাঞ্চের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার ফ্লোরটা মারেভার কাছে থাকল। আজকের মত আলোচনা মুলতবি। আলোচনা আবার চলবে অন্য কোন দিন, অন্য কোন সময়ে?’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল হাসতে হাসতে। তার সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।

Top