৫১. প্যাসেফিকের ভয়ংকর দ্বীপে

চ্যাপ্টার

রাত সাড়ে দশটা।
আহমদ মুসা মারেভা ও মাহিনদের পৌঁছে দিয়ে হোটেলে ফিরছিল।
তেপাও-এর ট্যাক্সি হাইওয়ে থেকে উত্তর দিকে হোটেলের পথে নেবার পর রাস্তা একেবারে শুনশান। দু’একটা গাড়ি আসতে-যেতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু উপকূলের লেকপাড়ের হোটেল ডায়মন্ড ড্রপ নিকটবর্তী হওয়ার পর রাস্তা একেবারেই নিরব হয়ে গেল।
ঢালু পথে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে নামছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সামনেই ছোট একটা বাঁক। বাঁকের রাস্তাটুকু সমান, ঢালু নয়। তারপর আবার শুরু হয়েছে ঢালু রাস্তা। আহমদ মুসার গাড়ি বাঁক নেবার সময় গাড়ির গতি প্রায় ‘জিরো’তে নেমে এসেছিল।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার পাশে সম্প্রতি তৈরি এই রাস্তার স্পার্ক স্তম্ভের দিকে তাকাতে যাচ্ছিল, এমন সময় চমকে উঠল হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে মার্বেল টাইপের সাদা একটা বস্তু গাড়ির ভেতরে ছুটে যেতে দেখে।
মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠল আহমদ মুসার মাথা। বোমা কিংবা এই ধরনের কোন বস্তু হবে। গাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছিল না। শ্বাস বন্ধ করে সে গাড়ির সিটে নিজের দেহটাকে ছেড়ে দিল।
পল পল করে সময় বয়ে যেতে লাগল।
না, কোন বিস্ফোরণ ঘটল না। তার মানে ওটা বোমা নয়, কোন ধরনের গ্যাস বোমা। শ্বাস বন্ধ রাখার দিকে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
খোলা ছিল আহমদ মুসার চোখ। দেখল, একই সাথে গাড়ির দু’পাশের দরজা খুলে গেল। তার সাথে সাথেই হ্যান্ড মেশিনগানের দুই নল দুই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল এবং গ্যাস-মাস্ক পরা দুই মুখ।
‘ব্যাটা এশিয়ান কুপোকাত! জ্ঞান হারিয়েছে সে।’ বলল দু’জনের একজন।
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে দু’পা ধরে টেনে বের করল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা গোটা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। তাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ এখন নেই। সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, এখন সে সংজ্ঞাহীনের ভান করবে। আর একটা বিষয় ভাবল, এদের হাতে পড়লে এদের জানারও একটা সুযোগ হবে। এখন পর্যন্ত চেষ্টা করেও ওদের হেড কোয়ার্টার ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’-এর সন্ধান সে পায়নি। এর ফলে তার সন্ধান পাওয়ারও একটা পথ হতে পারে।
আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করতেই একটা নারী কন্ঠ বলল, ‘ওকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোল’।
কন্ঠটি গৌরীর। কথা শুনেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা। খুশি হলো আহমদ মুসা, তার সন্দেহ সঠিক হয়েছে। নিশ্চয় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে গৌরী।
একজন বলল, ‘ম্যাডাম, এ এশিয়ান তো সংজ্ঞাহীন, তারপরও বাঁধতে হবে?’
‘কখন জ্ঞান ফিরে পাবে, তোমরা বলতে পার না। সুতরাং কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তাকে বেঁধে ফেল।’
‘শোন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কোন আইন তোমরা ভাঙবে না।’ বলল গৌরী।
আড়াল থেকে একটা মাইক্রো বেরিয়ে এসেছে। মাইক্রোতে ওঠানো হলো সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে। তার পাশেই উঠল গৌরী। পেছনে আর চারজন। ড্রাইভারের পাশে একজন।
গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই ড্রাইভিং সিটের লোকটি বলল, ‘উপকূলে যাচ্ছি ম্যাডাম।’
‘না, উইরো। এক ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। একে দক্ষিণ পাপেতির ঘাঁটিতে নিয়ে চল। একে প্রথম বাজিয়ে দেখতে হবে এ কি জানে, কতটা জানে? তারপর যে সিদ্ধান্ত হয় করা হবে।’ বলল গৌরী।
আহমদ মুসার কানে সব কথাই গেল। তাকে ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। তবে বুঝা গেল ‘মতু’ সাগরের মাঝের কোন দ্বীপ হবে। পলিনেশীয় ভাষায় ‘মতু’ মানে দ্বীপ। এই ‘মতু’টা আবার কোথায়? ‘মতু’কি সেই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ না ‘মতু’ বলতে সাধারণভাবে দ্বীপ বুঝানো হয়েছে?
চলতে শুরু করেছে গাড়ি। প্রথমে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে মূল শহরে পৌঁছে দক্ষিণের কোন পথে যেতে হবে দক্ষিণ পাপেতিতে।
ছুটে চলছে গৌরীর গাড়ি।
আহমদ মুসা তখনও ‘মতু’ নিয়ে তার হিসাব-নিকাশ কষেই চলেছে।
পাশেই গৌরীর মোবাইল সিগন্যাল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো।
গৌরী তার জ্যাকেটের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে অন করে চোখ বুলালো স্ক্রীনে। স্ক্রীনে মেসেজটি পড়েই দুই চোখ ছানা-বড়া হয়ে গেল গৌরীর। দ্রুত সে গ্যালারি ওপেন করল। সদ্য প্রেরিত ছবিটা সে দেখল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ঠিক এটাই আবু আহমদ আব্দুল্লাহর ছবি, কোন ভূল নেই তাতে। তাহলে এটাই সেই আহমদ মুসা! গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত খেলে গেল গৌরীর। সেই দুর্ধর্ষ আহমদ মুসা যার মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার! সে এখানে এই তাহিতিতে! কোন মিশনে! দুশ্চিন্তার একটা কালো মেঘ উঁকি দিল গৌরীর মনে। আহমদ মুসার ইতিহাস সে জানে। সে এখনো অজেয়। তার বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি এখনও কেউ। একটা বিমূঢ়তা নেমে এল গৌরীর মনে, অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনোর মত। কিন্তু পরক্ষণেই বুক ভরে এক প্রবল যন্ত্রণা জেগে উঠল। যন্ত্রণা শীঘ্রই প্রতিহিংসার আগুনে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সে আগুন। আহমদ মুসা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হয়নি কখনও। কিন্তু ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের বহু বন্ধু ও মিত্র সংগঠনের সর্বনাশ করেছে সে। সে এখন তাদের হাতের মুঠোয়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘সকলে সাবধান, আমরা মশা ভেবে কিন্তু হাতিকে খাঁচায় ভরেছি।’
সামনের সিট থেকে গৌরীর অপারেশন সহকারী সিনথ্রোস চমকে উঠে পেছনে তাকাল এবং বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু খবর পেলেন? হাতিটি তাহলে কে?’
‘হ্যাঁ সিনথ্রোস, যাকে আমরা খুব সহজে বন্দী করেছি, সে আজকে সবচেয়ে ওয়ানটেড ও সবচেয়ে বড় শয়তান আহমদ মুসা!’
‘ও গড!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সিনথ্রোস।
তার সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল গৌরীর।
গৌরী মোবাইলের স্ক্রীনে একবার তাকিয়েই তটস্থভাবে মোবাইলটি মুখের কাছে নিয়ে এসে বলল, ‘ইয়েস মাই লর্ড!’
‘এসএমএস ও ফটো দেখেছ?’
মোবাইল ফোনের ওপার থেকে বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড!’ গৌরী বলল।
‘তোমার ও তোমার টিমকে ধন্যবাদ, অসাধারণ এক শিকারকে তোমরা জালে আটকিয়েছ। আমাদের অনেক উপকারে আসবে।‘ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিভাবে মাই লর্ড? সে তো বিপজ্জনক!’ গৌরী বলল।
‘সবচেয়ে বিপজ্জনক বলেই তো সবচেয়ে বেশি মূল্য আমরা পাচ্ছি।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘বেশি মূল্য মানে মাই লর্ড?’ বলল গৌরী।
‘হ্যাঁ, ওর লাশ বিক্রি করেছি আমরা ১ বিলিয়ন ডলারে।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিন্তু মাই লর্ড, এই অবিশ্বাস্য মূল্য দিয়ে কারা নেবে ওকে? আর লাশ বলছেন কেন?’ গৌরী বলল।
‘লাশ এজন্যে বলছি সে, একে কখনো আটকে রাখা যায় না বা আটকে রাখা যায়নি কখনো। তাই জীবন্ত বিক্রি করার ঝুঁকি নিতে চাই না। ক্রেতারাও নিশ্চিত হতে চায় যে, সে মরেছে। আর তখনই আমাদেরকে ঐ মূল্যটা দেবে?’
‘ওটা ওকে মারার মূল্য। এমন মূল্য বহুবার ঘোষনা করেও তাকে তারা মারতে পারেনি।’
মুহূর্তের জন্যে থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আমরাও তাকে আটকে রাখার ঝুঁকি নিতে চাই না। আর একটি কথা, তার মত বিপজ্জনক লোককে আমাদের রাজধানী ‘মতু’তে নিয়ে আসতে পারি না। আর সে শেষ হয়ে গেলে আমাদের ‘মতু’ থেকে প্রেরিত SOS –এর বিপজ্জনক একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতাও শেষ হয়ে যায়। আর দু’জন প্রত্যক্ষ শ্রোতা থাকল। ওদেরকেও বাঁচিয়ে রাখা হবে না। এখন তোমরা তাকে হত্যা করে লাশ নিয়ে এস।’
‘তাকে তাহলে ঘাঁটিতে নেবার তো প্রয়োজন নেই মাই লর্ড।’ গৌরী বলল।
‘না। তাকে শেষ করে দিয়ে তোমরা লেক টাওনায় ফিরে যাও। ওখানকার প্রাইভেট জেটিতে আমাদের উভচর ফেরি যাচ্ছে। ভয় নেই, প্রাইভেট জেটিটি এখন জনমানবশুন্য।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘মাই লর্ড, শেষ কাজটা কোন ধরনের হবে সে ব্যাপারে আপনার কোন নির্দেশ আছে?’ গৌরী বলল।
লাশটা অনেক দূরে যাবে। কোন রক্তপাত যেন না হয়, দৃশ্যমান কোনও আঘাতও যেন না থাকে!’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড, বুঝেছি। এটাই হবে।’ গৌরী বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মোবাইল জ্যাকেটের পকেটে রেখে গৌরী ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলল, ‘উইরো, গাড়িটা আবার ঘুরিয়ে সেই লেক টাওনার দিকে নিয়ে চল।’
গাড়ি থেমে গেল।
গাড়ি তখন এক পাহাড়ি পথ দিয়ে চলছিল। রাস্তা ও চারদিকটা জনমানবশুন্য।
‘সিনথ্রোস, কিছু বুঝেছ?’ গৌরী বলল।
‘ইয়েস ম্যাডাম, আপনার কথা তো কানে এসেছে। মাই লর্ডেরও কিছু কথা কানে এসেছে। বুঝেছি, এই এশিয়ানকে এখন মেরে তার লাশ নিয়ে যাবার নির্দেশ হয়েছে।’ বলল সিনথ্রোস।
‘আরও একটা সুখবর আছে সিনথ্রোস, লাশটা বিক্রি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে!’ গৌরী বলল।
‘ও মাই গড!লাশের মূল্যের ক্ষেত্রে এটাই বোধ হয় বিশ্বরেকর্ড! তাদের ধন্যবাদ।’ বলল সিনথ্রোস।
‘ধন্যবাদ! আর ধন্যবাদ এজন্যে যে, সেই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। আমি তোমার সিটে যাচ্ছি। তুমি এখানে এস। রক্ত ঝরবে না, লাশের গায়ে দাগও পড়বে না, এমন একটি লাশ বানাবার কাজ তোমাকে করতে হবে।’ গৌরী বলল।
বলে গৌরী নেমে এল গাড়ি থেকে।
ওদিক থেকে সিনথ্রোসও নামল।
সিনথ্রোস পেছনের সিটে আসার সময় ড্যাশবোর্ড থেকে একটা কুশন সংগ্রহ করল।
গৌরী সেদিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে মনের কোথায় যেন একটা খোঁচা খেল। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ-এর এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে আহমুদ মুসার সাথে সাক্ষাতের দৃশ্যগুলো, মনে পড়ল হ্যান্ডশেক প্রসঙ্গ নিয়ে বলা তার কথাগুলো। সাংঘাতিক নীতিবাগীশ ও আদর্শবাদী লোক সে। দৃষ্টিভংগিটাও খুব মানবিক। এ ধরনের লোকরা ক্রিমিনাল হতে পারে না। আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। তাতে মৌলবাদী এক হিংস্র লোক মনে হয়েছে তাকে। কূটবুদ্ধির চালে মানুষ মারাই হচ্ছে তার কাজ। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর তার ধারণাটা একেবারেই উল্টে গেছে। ভাল মানুষ এবং সুস্থ ও শান্তির সমাজ সে চায়। ঈশ্বর বোধ হয় এজন্যেই সব সময় তাকে সাহায্য করে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার নিজের কথা মনে হলো, মুক্ত সমাজ ও বাধা-বন্ধনহীন জীবন তাকে কি দিয়েছে। পাখির মত মানুষ মেরেছি, কিডন্যাপের পর কিডন্যাপ করেছি, কিন্তু কি পেয়েছি? পরিবার নেই, আত্মীয়-স্বজনকে ভুলে গেছি। বিধাতার দেয়া সুন্দর দেহকেও আমি রক্ষা করতে পারিনি, পশুদের তা যথেচ্ছ ভোগের শিকার। এ বিষয়ে তার বোধই ছিল না, জীবনের নগদ উপভোগ নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তার চোখ খুলে দিয়েছে। এখন জীবনটা তার কাছে উন্মুক্ত একটা পৃষ্ঠার মত হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক কাহিনী, অনেক বিজয়ের নায়ক, অপরাজেয় বলে অভিহিত আহমদ মুসা আজ পরাজিত, তার জীবন সাঙ্গ হতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি! কথাগুলোকে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই। আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহ সিটের উপর পড়ে আছে। সিনথ্রোসের হাতে দেখছি বর্গাকৃতির ছোট কুশন। ঐ কুশনটি আহমদ মুসার নাকে-মুখে চেপে বসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটবে তা পরিষ্কার। রক্ত ঝরবে না, কোথাও দাগও পড়বে না, কিন্তু প্রাণ থাকবে না দেহে। ভাবতে মনে সেই খোঁচাটা লাগল আবার। কোন মৃত্যু তার মনকে এমন চঞ্চল আর করেনি কখনও।
সিনথ্রোস গাড়িতে উঠে আহমদ মুসার মাথার কাছে বসল।
গৌরীও সামনের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গৌরীর টেলিফোনে কথোপকথন থেকে শুরু করে সব কথাই শুনেছে। তার লাশ এক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে, এটাও সে শুনল। মনে মনে হেসেছে আহমদ মুসা। মাথার কাছ থেকে গৌরী নেমে গেলে আহমদ মুসা হাতের বাঁধনটা পরীক্ষা করল। বাঁধনটা সরল। সম্ভবত সংজ্ঞাহীন মানুষকে এর চেয়ে কড়া বাঁধনের প্রয়োজন তারা অনুভব করেনি। দাঁত দিয়ে আহমদ মুসা হাতের বাঁধন ঢিলা করে দিল যাতে পরে সহজেই খুলে ফেলা যায়। তারপর অতি সন্তর্পণে পা এগিয়ে এনে এক হাত দিয়ে পায়ের বাঁধনও খুলে ফেলল, তবে বাঁধনের বাইরের খোলসটা থাকল।
গাড়িতে উঠে সিনথ্রোস প্রথমেই নজর বুলাল আহমদ মুসার দিকে। সিটের উপর গা এলিয়ে মরার মত পড়ে আছে। হাতও পায়ের বাঁধনও তার চোখে পড়ল।
‘ম্যাডাম, আহমদ মুসার হাত-পায়ের বাঁধন কি থাকবে?’ গৌরীকে লক্ষ করে বলল সিনথ্রোস।
‘তুমি মরে করলে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিত পার। বলির পশুকেও তো মুক্ত রেখেই বলি দেয়া হয়।’
‘আমিও সেটাই ভাবছি ম্যাডাম।’
বলে সিনথ্রোস আহমদ মুসার হাতের বাঁধনের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা বুঝল আমার হাতের বাঁধন যে খোলা তা সে এখনি টের পেয়ে যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই সিনথ্রোস আক্রমণে আসবে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, তাকে আগে আক্রমণে যেতে হবে।
ভাবনার সাথে সাথে আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ বেগে উঠে গিয়ে মাথার পেছনে ঘাড়ের সাথে লাগোয়া জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে সিনথ্রোসের বুকের একপাশে গুলি করল।
সিনথ্রোসের চোখে ধরা পড়েছিল আহমদ মুসার ডান হাত ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু তা বুঝে ওঠার পর সিটের উপর থেকে রিভলবার তুলে নিয়ে প্রস্তুত হবার আগেই সে গুলি খেল।
আহমদ মুসা গুলি করেই বাম হাত দিয়ে সিটের উপর পড়ে থাকা সিনথ্রোসের রিভলবার তুলে নিয়ে একই সাথে ডান হাত দিয়ে গৌরীর লক্ষ্যে এবং বাম হাত দিয়ে পেছনের লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়তে লাগল।
গৌরীর রিভলবার ধরা হাত গুলিবিদ্ধ হলো। ছিটকে পড়লো তার হাত থেকে রিভলবার।
অন্য দিকে পেছনের সিটের লোকরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি কি ঘটেছে। রিভলবার নিয়ে আহমদ মুসাকে দাঁড়াতে দেখে তবেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা নয়, তাদের সিনথ্রোসই গুলি খেয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে তারা আহমদ মুসার রিভলবারের টার্গেট হয়ে গেছে। তারা কেউ অস্ত্র তোলারও সুযোগ পেল না। গুলিবিদ্ধ হয়ে যেখানে বসেছিল সেখানেই ঢলে পড়ল।
গৌরীর ডান হাত গুলিবিদ্ধ হবার পর বাম হাত দিয়ে সে তার রিভলবার তুলতে যাচ্ছিল।
‘রিভলবার তুলবেন না মিস গৌরী। সে চেষ্টা করলে আমি গুলি চালাতে বাধ্য হবো। দেখছেন তো, আমার কোন গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ বলল আহমদ মুসা।
গৌরী রিভলবার তুলে নেয়ার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অন্যদের মত আমাকে গুলি না করে সাবধান করছেন কেন?’
‘দুই কারনে, এক, আপনি আহত, দুই, আপনি মহিলা। তাছাড়া আপনি এশিয়ানদের ভালবাসেন।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা একটু এগিয়ে গৌরীর রিভলবার তুলে নিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। বলল, ‘ড্রাইভিং সিটের লোকটি নিশ্চয় বাইরে গিয়ে পজিশন নিয়েছে?’
বলে আহমদ মুসা রিভলবার ধরা বাম হাত জানালায় ঠেস দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিল।
তখনই এক ঝাঁক গুলির কিছু জানালার বাইরে দিয়ে শূন্যে উড়ে গেল আর কিছু জানালায় আঘাত করল। আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিতে না পারলে তার মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা লোকটিকে দেখেছে। দরজার একটু পেছনেই সে বসে আছে। তার হাতে ধরা স্টেনগানের ব্যারেল ভয়ংকর। স্টেনগান উদ্যত করে সে বসে আছে।
গুলি তার থেমে গেল হঠাৎ।
সে কি পজিশন চেঞ্জ করল? আহমদ মুসা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল।
ড্রাইভিং সিটের লোকটি দরজা খোলা রেখেই নেমে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা লোকটিকে যেখানে দেখেছিল সেদিকে বাম হাতের রিভলবার উদ্যত করে পা দিয়ে দরজা বাইরের দিকে পুশ করল।
দেখতে পেল লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আহমদ মুসার চোখ ও রিভলবার এক সঙ্গেই কাজ করল। লোকটি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিভলবারের ট্রিগার তার আঙুলে চেপে বসেছিল। রিভলবারের একটি বুলেট উপর থেকে ০৫ ডিগ্রি কোণে গিয়ে ঠিক তার কপালে আঘাত করেছে। তার দেহটা ছিটকে পড়ল পেছনে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে সোজা হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। তাকাল গৌরীর দিকে। সে তার বাম হাত দিয়ে ডান হাতের গুলিবিদ্ধ কবজি চেপে ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে। গুঁড়িয়ে যাওয়া কবজি থেকে রক্ত তখনও বেরুচ্ছেই।
আহমদ মুসা হাতের রিভলবার সামনের ড্যাশ বোর্ডের উপর রেখে ওপাশের ড্যাশ বোর্ডের নিচের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। বক্স থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বের করে নিল আহমদ মুসা। তারপর গৌরীর ডান হাত টেনে নিয়ে কবজির পেছনে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে আহত স্থানটা ঢেকে দিল। বলল আহমদ মুসা, ‘এতে অন্তত রক্ত ক্ষরণটা বন্ধ হবে মিস গৌরী।’
বলে মুহূর্ত কয়েক থেমেই আবার কথা শুরু করল, ‘মিস গৌরী, প্লিজ, আপনি কি খোঁজ নেবেন, ওরা কেউ বেঁচে আছে কিনা।’
গৌরী অপলক চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল, ‘কেন, কি দরকার আপনার ওটা জেনে?’
‘ওদের মধ্যে কেউ আহত থাকলে কিছু শুশ্রুষা তার প্রয়োজন হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মানুষ মারার সময় তাদের কথা ভাবা হলো না, এখন আহতের কথা ভাবা হচ্ছে কেন? এটা কি গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত বিষয় নয়?’ বলল গৌরী।
ওরা যুদ্ধ চলা কালে মরেছে। এ মৃত্যু স্বাভাবিক। যুদ্ধ শেষে আহতরা কারও শত্রু নয়, আমাদের ধর্মের শিক্ষা এটা। যতটা সাধ্য ওদের সহযোগিতা করা উচিত। এই উচিত কাজটাই আমি করছি।’ আহমদ মুসা বলল। গৌরী মাথা একটু নিচু করল।
মুখে কিছু বলল না আহমদ মুসার কথা জবাবে।
মুহূর্ত খানেক পর মুখ তুলে তাকাল গাড়ির পেছনে হত-নিহত তার সাথীদের দিকে। একটু জোরে বলল, ‘নাশকা, তোমাদের খবর কি? তোমরা কে কেমন আছ বল?’
নাশকাই মুখ তুলল। বলল, ‘তিনজন মারা গেছে ম্যাডাম। আমার বাম বাহু ও ডান হাত গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
গৌরী ফার্স্ট এইড বক্স হাতে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি বসুন মিস গৌরী। এক হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায় না।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি লক করে চাবিটা পকেটে পুরে গৌরীর কাছ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে পেছনের সিটে যাবার জন্যে উঠল।
‘গাড়ি লক করলেন কেন?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
‘যাতে গাড়িটা আপনি দখল করতে না পারেন সেজন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার দিকে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি রেখে বলল, ‘আমি তো পালিয়ে যেতেও পারি?’
‘আমি আপনাদের বন্দী করিনি। আমি নিজেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, আমাদের কাছ থেকে আপনার কিছু জানার নেই। কেন আমরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম, সেটা আপনি জানতে চান না?’ বলল গৌরী।
‘জানার আগ্রহ থাকলেও জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা আমার নেই। কারণ আপনারাও হয়তো জানেন না। জানলেও আপনাদের তা বলার কথা নয়। যেমন আপনারা কোন এক ‘মতু’তে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি বিস্মিত হয়েছি, ‘মতু’ নামে তো তাহিতি কিংবা এর আশেপাশে কোন জায়গা নেই! আমি যদি এটা জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয় বলবেন না?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে হাসল গৌরী।
তাকাল আহমদ মুসার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে। বলল, ‘আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অনন্য! আপনি কিছুই জিজ্ঞাসা করতে চান না, কিন্তু এমন একটা বিষয় জিজ্ঞাসা করেছেন, যা আপনি জানলে আমাদের আপনাকে জানাবার আর কিছু বাকি থাকে না।’
‘এর মানে ‘মতু’ কি, কোথায়? এটা কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল না। আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন, এ প্রসঙ্গে আপনারাই ‘মতু’র নাম বলেছেন। এটা আমার জিজ্ঞাসার বিষয় নয়। কৌতূহল থেকেই আমি ‘মতু’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। আমার আরও কৌতূহল হলো, কেন আপনারা আমাকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলার সাথে সাথে গাড়ির পেছনে গিয়ে আহমদ মুসা দুই বাহুতে গুলিবিদ্ধ নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।
‘আপনাকে কেন আমরা কিডন্যাপ করতে চাই, সত্যিই কি তা আপনি জানেন না?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
বিপদে পড়ল আহমদ মুসা। এভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে মিথ্যা বলতে সে পারে না। অবশেষে দায়টা গৌরীর ঘাড়ে চাপানোর জন্যে বলল, ‘মিস গৌরী, প্রশ্ন আমি আগে করেছি। আপনারা কেন আমাকে কিডন্যাপ করতে এলেন?’
‘কিডন্যাপ করতে পারলে বলতাম। এখন তা আর বলা যাবে না।’ বলল গৌরী।
‘কিন্তু আপনারা অপরাধ করেছেন। তাই আপনারা বলতে বাধ্য।’
‘বাধ্য করলে হয়তো জানতেও পারতেন।’ বলল গৌরী।
‘আমি সেটা পারি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু পরাজিত বাদী আহতদের প্রতি তো আপনি নিপীড়ন চালান না।’ গৌরী বলল।
‘কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র আবার সৃষ্টি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
গৌরী কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
গৌরী মোবাইলটা বের করতে যাচ্ছিল।
‘না মিস গৌরী, আপনাকে টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি আমি দেব না।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির পেছন থেকে সামনের সিটে চলে এল। নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসে গৌরীকে বলল, ‘প্লিজ, মোবাইলটা দিন।’
মোবাইলটা তখনও বেজেই চলেছে।
গৌরী নিরবে মোবাইলটা তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা মোবাইলের কল অন করে বলল, ‘বলুন, আমি আহমদ মুসা, যাকে কিডন্যাপ করতে পাঠিয়েছিলেন।’
‘আপনি তাদের হত্যা করে গাড়ি দখল করে বসে আসেন?’ বলল ওপার থেকে।
‘না, গৌরী ও নাশকা আহত। অন্যরা নিহত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনিই আহমদ মুসা, এটা আগে জানলে কিডন্যাপের জন্যে মাত্র একটা গাড়ি পাঠাতাম না। যা ঘটেছে এটা ঘটার কথা ছিল না। এর প্রতিশোধ আমি নেব।’ বলল ওপার থেকে।
‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু আপনারা আমার বিরুদ্ধে লাগলেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা বাইরের কারো কোন প্রশ্নের জবাব দিই না। আপনার প্রশ্নের উত্তরও আমি দেব না।’ বলল ওপার থেকে।
‘না বললেও আমি জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জানেন?’ ওপার থেকে চমকে ওঠা কন্ঠস্বর।
আমিও কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। আহমদ মুসা বলল।
‘বেঁচে থাকলে তো জবাব দেবেনই! তবে দেবার সময় আপনি পাবেন না।’ বলল টেলিফোনের ওপার থেকে।
আহমদ মুসা পেছনে ও সামনে তাকাল। দেখল, দু’দিক থেকে দু’টি করে চারটি হেডলাইট ছুটে আসছে। হেড লাইটের অবস্থান ও ধরন দেখে বুঝল, ও দু’টি জিপ গাড়ি।
‘হ্যাঁ, আপনার পাঠানো দু’টি গাড়ি দুই দিক থেকে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোনের ওপার থেকে কন্ঠটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা, তোমার দখল করা গাড়িতে ট্রান্সমিটার ফিট করা আছে। গোলাগুলি ও গাড়ির সব কথাই আমরা শুনেছি। গাড়ির অবস্থান রিলে করার ব্যবস্থাও ঐ গাড়িতে আছে।’
‘ধন্যবাদ, এ তথ্যগুলো আমার জানা ছিল না। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ভবিষ্যত এখনও আছে বলে আপনি মনে করছেন?’ বলল ওপার থেকে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহর ভূমিকায় বসতে চাইবেন না। মানুষের শক্তি খুবই সীমিত।’
ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ ভেসে এল। বলল, ‘জবাব আমি দেব না, জবাব তুমি পেতে যাচ্ছ আহমদ মুসা। তুমি চারদিক থেকে ঘেরাও। দু’পাশের পাহাড়ে আমাদের হেলিকপ্টার কমান্ডো পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘ধন্যবাদ। তোমার শক্তি আর আমার আল্লাহ ভরসা।’
বলেই আহমদ মুসা চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মুখ ঘুরিয়ে গৌরীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ মিস গৌরী, আপনি গাড়ি থেকে নেমে যান, আর নাশকাকেও নামিয়ে নিন। তাড়াতাড়ি প্লিজ।’
বিস্ময় গৌরীর চোখে-মুখে। বলল, ‘কেন?’
সামনে ও পেছন থেকে আপনাদের দুই বা ততোধিক গাড়ি আসছে আমাকে টার্গেট করে। আপনারা এখন আমার কাস্টডিতে। কিন্তু একটু পরেই আমি আর আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর্যায়ে থাকবো না। তাই নিরাপদ হওয়ার জন্যে আপনাদের মুক্তি দিচ্ছি। প্লিজ মিস গৌরী! সময় নেই, তাড়াতাড়ি করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
স্তম্ভিত গৌরী! সে কোন শত্রুকে দেখছে, না হিংসা-বিদ্বেষের মত মানবিক প্রবণতামুক্ত কোন এনজেলকে দেখছে! বলল সে, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আপনিও তো সরে যেতে পারেন।’
সামনে ও পেছনের মত দু’পাশের পাহাড়ও আমার জন্যে নিরাপদ নয়। অন্ধকারে গুলি খাওয়ার চাইতে সামনা সামনি লড়াই করা ভাল মিস গৌরী।’ আহমদ মুসা আর কিছু বলল না।
গাড়ি থেকে নামল গৌরী। নামিয়ে নিল গুরুতর আহত নাশকাকেও।
গাড়ির দরজা গৌরীই এসে বন্ধ করে দিল। সেই সাথে গাড়ির দরজাও লক করে দিল গৌরী। সেই ফাঁকে ব্যাগ থেকে ছোট একটা বাক্স বের করে নিজের দেহের আড়ালে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে টুপ করে সেটি সিটের উপর রাখল গৌরী। বিষয়টা খেয়াল করল না কেউ। তার কানে এল সশব্দে দরজা বন্ধ ও লক হওয়ার আওয়াজ। গৌরীর এই অযাচিত সাহায্যের জন্যে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা নিজের পাশের দরজা খোলা রেখেছে ইমারজেন্সী এক্সিট হিসাবে, কিন্তু ওপাশের দরজা লকড থাকুক এটাই চেয়েছিল আহমদ মুসা।
গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ওপাশের জানালার দিকে তাকাতে গিয়ে ছোট বাক্সটা তার চোখে পড়ল। চমকে উঠে আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে বাক্সটি আস্তে করে টেনে নিল। বাম হাত দিয়ে বাক্সটি চোখের সামনে তুলতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেল আহমদ মুসার। বাক্সের উপর লেখা ‘ম্যাগনেটিক মেশিন জ্যামিং ডিভাইস(MMJD)’।
স্তম্ভিত আহমদ মুসা বাম হাতেই খুলে ফেলল বাক্সটি। ভেতরে ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন। এই মেশিন সম্পর্কে সে পড়েছে, শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। এই মেশিন মার্কেটেও আসেনি। বিজ্ঞানী ও প্রস্তুতকারকদের হাতেই মেশিনটা রয়েছে। এই মেশিন এখানে এল কি করে? সে নিশ্চিত গৌরীই তার ব্যাগ থেকে এটা রেখে গেছে। তার মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হাতে এই জ্যামিং মেশিন রয়েছে।
গৌরীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল আহমদ মুসার মন। তার সাথে অবাক বিস্ময়ও! গৌরী তার দলের সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল কেমন করে! ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোকরা মৃত্যুর মুখেও দলের ব্যাপারে মুখ খোলে না। আর গৌরী আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল তার লোকদের পরাজয়, এমনকি ধ্বংসের অস্ত্র।
আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন (এমএমজেডি) সম্পর্কে বিস্তারিত পড়েছে। অস্ত্রটি ছোট কিন্তু যুদ্ধের জগতে এক বিস্ময়। এই অস্ত্রের ম্যাগনেটিক ফায়ার যে কোন মেটালে তৈরি যন্ত্রকে মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। ট্যাংক থেকে পিস্তল ও স্টিলমিল থেকে খেলনা গাড়ি সবাই এই ক্ষুদ্র অস্ত্রের কাছে অসহায়। অস্ত্রটি মাল্টিডাইমেনশনাল ও সিংগল ডাইমেনশনাল হতে পারে। এর সাহায্যে সাংঘাতিক কার্যকরি ফায়ার ফোকাসকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টার্গেটের আয়তন যেমন হবে, এর ফায়ার ফোকাসকেও সেরকম করা যায়। তাতে আশেপাশের অনুরূপ কোন কিছু্র ক্ষতি হয় না।
হাসল আহমদ মুসা। গৌরী এক মোক্ষম অস্ত্র আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়েছে। এর মোক্ষম ম্যাগনেটিক ফায়ার শুধু ওদের গাড়িগুলোকে নয়, ওদের সব অস্ত্রকে অকেজো করে দেবে।
তাই হলো। সামনের গাড়ি ১০ গজ দূরে থাকতেই আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল, নিয়ন্ত্রিত ফায়ার। তারপর গাড়িটি মাত্র দুই গজ এগোতে পেরেছিল। আট গজের মাথায় গাড়িটা থেমে গিয়েছিল। পেছন থেকে আসা গাড়িও এই ভাগ্য বরণ করেছিল। তারা গাড়ি খুলতেও পারেনি। গাড়ির লক জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় তাদের মোবাইলও কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ সেগুলোও জ্যাম হবার কথা।
আহমদ মুসা নিজের গাড়ি থামিয়ে সামনে ও পেছনে ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল।
এবার আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি ঘুরিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করল। মাইল দুয়েক পশ্চিমে এগোলেই তার হোটেলে ফেরার রাস্তা সে পেয়ে যাবে।
পেছনের নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি বেরিয়ে এল।
নিশ্চিন্ত হলো সে। ছুটতে লাগল তার গাড়ি। কিন্তু একশ’ গজও এগোতে পারল না। দু’পাশ থেকে শুরু হলো গুলি বৃষ্টি।
আহমদ মুসার পাশের জানালা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তার সামনে দিয়েই কয়েকটা গুলি বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসার দেহটা রিল্যাক্স মুডে সিটের উপর এলিয়ে পড়ে না থাকলে তার দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
মুহূর্তেই আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। পাহাড়ের দু’পাশে যাদের নামানো হয়েছিল তার পালানো পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যে, তারাই তাদের বিপদগ্রস্থ গাড়ির দিকে ছুটে এসেছে। এদের মধ্যে গৌরী নিশ্চয় রয়েছে। তাদের গাড়িগুলোর কি বিপদ ঘটতে যাচ্ছে তা একমাত্র সেই-ই জানত। সেই-ই দ্রুত তার লোকদের সংগঠিত করার জন্যে এদিকে এসেছে। আহমদ মুসা বুঝল, কিছুটা এগোলেই সে এদের গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারবে। ইতিমধ্যেই দু’পাশের জানালা দিয়ে গুলি আসা প্রায় বন্ধ হয়েছে। এবার গুলি আসছে অপেক্ষাকৃত উপর থেকে। আঘাত করছে জানালার লেবেলের উপরে ও ছাদেও।
গুলি বৃষ্টির মধ্যে স্টিয়ারিং থেকে আহমদ মুসার হাত শিথিল হয়নি। সিটের সাথে সেঁটে থেকে হাত দু’টোকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে সে স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করছিল।
গুলি বৃষ্টি এখন আঘাত করছে আহমদ মুসার গাড়ির পেছন দিকে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ওদের গাড়ির রেঞ্জ থেকে। ওদের পক্ষে আহমদ মুসার গাড়ি ফলো করা সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু স্বস্তি তার স্থায়ী হলো না।
তার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
ওপারের কথা শুনেই আহমদ মুসা বুঝল, ব্ল্যাক সান এই কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছে।
লোকটি আহমদ মুসার কন্ঠ পেয়েই বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা ধন্যবাদ, আমাদের অস্ত্রে আমাদেরই ঘায়েল করলেন, সত্যিই আপনার নামের মতই আপনি! কিন্তু গৌরীর ব্যাগে যদি জ্যামিং মেশিন (MMJD) না পেতেন, তাহলে কিন্তু আপনার এই বিজয় লাভের সুযোগ ছিল না। গৌরী একটা ভুল করেছে। মেশিনটির সেফটি পিন খুলে নিলেই আপনার বুজরুগি সব হাওয়া হয়ে যেত!’
লোকটি একটু থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘জ্যামিং মেশিন ব্যবহার করেছি এটা আপনাকে কে বলল?’
‘অবান্তর প্রশ্ন। বলেছি তো, আপনার গাড়িতে সুপার সেনসেটিভ সাইট ট্রান্সমিটার আছে। সেটাই আমাকে বলে দিয়েছে। আরও বলে দিয়েছে, আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে জ্যাম হয়ে যাওয়া পেছনের গাড়ির পাশ কাটিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়েছেন। দু’দিকের পাহাড় থেকে আমাদের লোকরা আপনাকে আটকাবার চেষ্টা করে। গুলি বৃষ্টির মধ্যেও গাড়ি চালিয়ে আপনি বের হয়ে এসেছেন। এখন আপনি নিরাপদ, তাই না?’
‘তা মনে করারই কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ। বলল ওপারের কন্ঠ, ‘আহমদ মুসা, বিপদ তোমার মাথার উপর পৌঁছতে দু’এক মিনিটের বেশি দেরি হবে না। ‘আরু’র পাশের পাহাড়েই আছে আমাদের ফ্লাইং-লিফটের একটি ঘাঁটি। সেখানে এক আসনের ফ্লায়ার থেকে দশ আসনের মিনি হেলিকপ্টার রয়েছে। ওগুলো দিনের আলোতে বের হয় না। এখন রাত।’
বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। হাসির মধ্যেই ওপারের লাইন অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করল। চিন্তা করল, আরেকটা বিপদ আসছে। নিশ্চিত হওয়া গেল, পানির তলদেশ দিয়ে চলার জন্যে ওদের যেমন ক্ষুদ্র টিউব সাবমেরিন আছে, মিনি সাবমেরিন আছে, তেমনি আকাশে চলার জন্যে ওরা সম্ভবত ফ্লাইং টিউব, ফ্লাইং মডিউল, মিনি হেলিকপ্টার তৈরি করেছে। এসবের ফাংশন, চরিত্র, শক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই জানা নেই তার। তার কাছে অস্ত্র আছে বলতে ওদের কাছ থেকে পাওয়া স্টেনগান, গৌরীর ফেলে যাওয়া রিভলবার ও সেই জ্যামিং মেশিন।
চোখ খুলল আহমদ মুসা। তাকাল মাথার উপর গাড়ির ছাদের দিকে। দেখল যা ভেবেছিল তাই। ছাদের এ অংশটা স্লাইডিং।
আহমদ মুসা সুইচ টিপে স্লাইডিং ডোরটা খুলে ফেলল। দুই ফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা আয়তকার একটা স্পেস বের হয়ে গেল। তাকাল উপরের দিকে। আবার সেই ভাবনা, ফ্লাইং টিউব বা ফ্লাইং মডিউল অথবা মিনি হেলিকপ্টার যাই আসুক, তারা কি করতে চাইবে! বোমা মেরে গাড়ি সমেত তাকে ধ্বংস করবে? কিন্তু তা করলে তার আস্ত লাশ পাবে কি করে? লাশ না পেলে তো এক বিলিয়ন ডলার পাবে না। আকাশ থেকে গুলি বৃষ্টি করে তাকে মারবে! কিন্তু সেজন্যে ফ্লাইং বস্তুটিকে অনেকখানি নিচে নেমে আসতে হবে। সে ঝুঁকি তারা নেবে! কারণ আহমদ মুসার কাছেও স্টেনগানের মত অস্ত্র আছে, তা তারা ধরেই নেবে। অবশ্য বড় রেঞ্জের কোন লাইটগান তাদের হাতে থাকতেই পারে, এটা ভাবল আহমদ মুসা। কিন্তু তারা কি গুলি করবে? তারা অক্ষত মানুষ বা লাশ চায়।
আবার উপর দিকে চাইল আহমদ মুসা।
কোন দিকে থেকে কোন ধরনের শব্দ নেই। হঠাৎ তার মনে এল, ওরা শব্দহীন ফ্লাইং ভেহিকেলস তো তৈরি করতে পারে!
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। তার সন্ধানী চোখ ঘুরতে লাগল মাথার উপর আকাশে। তার চোখ ঘুরে আরু’র পুব আকাশে আসতেই অমাবস্যার চাঁদের মত গোলাকার চলন্ত অন্ধকারকে এগিয়ে আসতে দেখল।
চট করে আহমদ মুসার মনে পড়ল, ব্ল্যাক সানের সেই নেতা একটু আগে তাকে মোবাইলে জানালো আরু’র পাশের তাদের ফ্লাইং ঘাঁটি থেকে তাদের ফ্লাইং ভেহিকেল আক্রমণে আসবে। এই চলন্ত অন্ধকারই কি সেই অ্যাটাকিং ফ্লাইং ভেহিকেল!
চলন্ত গোলাকার সেই অন্ধকার যানটি দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল তার গাড়ির দিকে। এগিয়ে আসছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে। আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড সর্বোচ্চ সীমায় তুলল, কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখল, সেই গোলাকার অন্ধকারটি সঙ্গে সঙ্গেই তার কৌণিক অবস্থান এডজাস্ট করে নিল! আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না, তার গাড়ির ট্রান্সমিটারটিই ঐ ফ্লাইং অন্ধকার বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক সান-এর ফ্লাইং ভেহিকেলকে গাইড করছে।
তার মানে তার গাড়ির সাউন্ড ট্রান্সমিটার শুধু শব্দই ট্রান্সমিট করে না, নির্দিষ্ট এক ওয়েভ লেংথে তার অবস্থানকেও রিলে করে। সুতরাং তার গাড়ি যেখানেই যাক, ফ্লাইং ভেহিকেলটি তাকে লোকেট করবেই।
ফ্লাইং ভেহিকেলটি আহমদ মুসার গাড়ির চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেগে এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই ফ্লাইং ভেহিকেলটি ৭০ডিগ্রি কোণে উঠে এসেছে। মাথার উপর আসতে দেরি নেই।
আহমদ মুসা গাড়ি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
ফ্লাইং ভেহিকেলকে পিছু ছাড়াবার দেখা যাচ্ছে এটাই একমাত্র পথ।
হার্ড ব্রেক কষে আহমদ মুসা তার গাড়ি থামাল।
জ্যামিং মেশিন, গৌরীর রিভলবার ও একটি স্টেনগান নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা সামনের দিকে দৌড় দিল। আর শ’গজের মত এগোলেই দু’দিকের পাহাড় অতিক্রম করে অনেকটা সমতল এলাকায় গিয়ে পৌঁছবে। তাতে আশেপাশের তার মুভ করার সুযোগ হবে।
দু’পাশের পাহাড়ের দেয়াল পার হতেই আহমদ মুসার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার ‘হ্যালো’ বলে সাড়া দিতেই ওপার থেকে সেই ‘হো হো’ হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসি থামলে কন্ঠটি বলল, ‘আহমদ মুসা, তুমি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রক্ষা পাবে না । আমাদের সর্বগুণান্বিত ভেহিকেল জুনিয়র এক্সেকিউটর-১ পাঠিয়েছি। তার চোখ আপনাকে খোঁজে নিবেই। আপনার লাশ আমরা চাই-ই।
একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া সর্বগুণান্বিত ও সর্বশক্তিমান আর কেউ নেই। সবচেয়ে নিখুঁত বলে আমরা যাকে ভাবি তার মধ্যেই বড় খুঁত রয়ে যায়। নির্ভুল হবার সর্বশক্তিমান হবার অহংকার একমাত্র আল্লাহরই সাজে। তার সৃষ্টির এই দাবি করা মুর্খতা। আহমদ মুসা বলল।
ওপার থেকে আবার সেই হাসি। বলল, আমাদের সবচেয়ে ছোট অস্ত্র ‘জুনিয়র এক্সকিউটর-১’ আমরা পাঠিয়েছি। তার শক্তিটা একবার দেখ।এই কথা শেষ হবার পরে আবার তার সেই হাসি। কেটে গেল ওপার থেকে করা মোবাইলের লাইন।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ওপরে তাকিয়ে দেখল কথিত সেই জুনিয়র এক্সকিউটর-১ আরও অনেক নিচে নেমে এসেছে। এসে পৌছেছে প্রায় মাথার ওপর। স্টেস ভেহিকেল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এখনও গুলীর রেঞ্জের অনেক ওপরে। তবে নামছে এক্সকিউটর-১।
নেমে এল অনেক নিচে। কোন পথে আক্রমণ আসবে তার অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ ওপর থেকে এক পশলা গুলি বৃষ্টি ছুটে এল নিচে। শব্দ থেকে বুঝল গুলী স্টেনগান থেকেই এসেছে
একটা বড় পাথরের গা ঘেঁষে আহমদ মুসা বসে পড়েছিল। তার চারপাশে গুলীর একটা রিং তৈরী হলো। আহমদ মুসা বুঝল তাকে লক্ষ্য করে গুলী করা হয় নি।
ওপর থেকে গুলী বর্ষণ বন্ধ হতেই আহমদ মুসা তার স্টেনগান তুলে গুলী করল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ লক্ষ্য করে। গুলীগুলো, ফিরে এল নিচে। গোটা স্পেস ভেহিকেলটা বুলেট প্রুফ বুঝল আহমদ মুসা। একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। স্টেনগান অকেজো হয়ে পড়ার পর আত্মরক্ষা ও আক্রমণের আর কি অপশন বাকি থাকল তার কাছে ?
আহমদ মুসার ভাবনা শেষ হতে পারলো না হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল ওপর থেকে আসা ও ফিরে আসা বুলেটগুলো আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাতের স্টেনগানেও টান পড়েছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ম্যাগনেটিক পুলিং। কথাটা আহমদ মুসার মাথায় আসার সাথে সাথেই জ্যাকেটের পকেট জুড়ে থাকা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন টেনে বের করে দ্রুত পাওয়ার অন করে টপ ফোকাসের চারদিক সীমাবদ্ধ করে ফাংশন অপশন স্টার্ট করল। সংগে সংগে জ্যামিং মেশিনের অদৃশ্য ফায়ার ফোকাস ছুটল এক্সকিউটর-১ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার মাথার ওপরের আকাশে জুনিয়র এক্সকিটর-১ যেমন স্থির দাঁড়িয়েছিল, তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার কোন কাজ করল না বুঝল আহমদ মুসা। এর পর একটা জিনিস লক্ষ্য করল, নিচে গ্রাউন্ড থেকে বুলেটের মত মেটালিক দ্রব্য উপরে উঠে যাচ্ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেল। হাতে ধরা স্টেনগান ও জ্যামিং মেশিনও আর উপর থেকে টান অনুভব করল না। তার মানে জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুলকে তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফোকাস নিউট্রাল করে দিয়েছে। কিন্তু জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর কোন ক্ষতি করতে পারল না তার জ্যামিং মেশিন। নিশ্চয় ম্যাগনেটিক জ্যামিং প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা এতে আছে। তবে আহমদ মুসা আরেকটা জিনিস ভেবে খুব খুশি হলো, জুনিয়র এক্সকিউটর-১ থেকে গুলী করে তার কোন ক্ষতি করতে ওরা পারবে না। তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার বুলেটকেও নিউট্রাল করে দিতে পারে। এটা এক্সকিউটরও নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে।
তাহলে এক্সকিউটর এখন আগাবে কোন পথে ?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল তার নিজের কিডন্যাপ হওয়ার কথা। ব্ল্যাক সান-এর গৌরিরা তাকে কিডন্যাপ করেছে ক্লোরোফরম কিংবা ঐ জাতীয় চেতনা লোপকারী গ্যাস প্রয়োগ করে। আর কাউকে আস্ত কিডন্যাপ করার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। তাছাড়া তারা লাশ চাইলে জীবনবিনাশী কোন গ্যাসও ব্যবহার করতে পারে।
যতদুর পারা যায় এর আওতা থেকে দূরে সরতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো গাড়ি থেকে নামার পরও জুনিয়র এক্সকিউটর-১ তাকে অনুসরন করছে কিভাবে। ব্ল্যাক সানের লোকেরা বলছে আমি যেখানে যাই, এর হাত থেকে বাঁচতে পারবো না। এক্সকিউটর-১ এর চোখ আমাকে খোঁজে নিবেই। কিন্তু কিভাবে? গৌরীর গাড়িতে সাউন্ড ট্রান্সমিটার ছিল। কিন্তু আমার সাথে তো সাউন্ড ট্রান্সমিটার কিংবা অন্য কোন ট্রান্সমিটার নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অস্ত্রশস্ত্র সব কিছুর সাথে ট্রান্সমিটার চীপস লাগানো আছে। যেহেতু আমার সাথে গৌরীদের মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের একটি রিভলবার, একটি স্টেনগান এবং একটি জ্যামিং মেশিন আছে। এর সবগুলোতেই কিংবা কোন একটিতে ট্রান্সমিটার চীপস লাগনো রয়েছে।
আহমদ মুসা রিভলবার ও স্টেনগান ছুঁড়ে ফেলে দিল। কিন্তু হাতে নিয়েও জ্যামিং মিশিনটি ফেলে দিতে পারলো না । মেশিনটি তার দরকার। ভাবল আহমদ মুসা, জ্যামিং মেশিন নিয়ে সে সরে যাবে। এক্সকিউটর-১ যদি তাকে সেখানেও ফলো করে তাহলে বুঝা যাবে জ্যামিং মেশিনেও ট্রান্সমিটিং চীপস রয়েছে।
এসব চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে অন্ধকার। উচ্চতা ও চারদিক উন্মুক্ত হওয়ার কারণে কিছুটা স্তব্ধতা থাকলেও ভূমি সন্নিহিত স্থানে অন্ধকারটা একেবারে ঘুটঘুটে।
আহমদ মুসা রাস্তা এড়িয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত এগোলো পশ্চিম দিকে। মাইল খানিক এগোবার পর একটা টিলার গোড়ায় গিয়ে বসল। এখান থেকে কয়েক গজ এগোলেই হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে হোটেলের দিকে। আহমদ মুসার চোখ আকাশের দিকে। ব্ল্যাক সানের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ তাকে ফলো করছে কি না, এটাই তার দেখার বিষয়।
দু’তিন মিনিটও পার হয় নি। আহমদ মুসা দেখল এক্সিকিউটর-১ মানে সেই গোলাকার জমাট অন্ধকারটি দ্রুত এসে তার মাথার ওপর স্থির হলো। আর সংগে সংগেই এক্সিকিউটর-১ এর তলদেশে একটা নীল আলো জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল এক্সিকিউটর-১ এর দিকে। একটা মিষ্টি নীল আলো জ্বলে উঠে নিভে যেতে আহমদ মুসাও দেখল। একটু বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা এক্সিকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুল থ্রো হওয়ার সময়ও আলো জ্বলেছিল, তবে সেটা ছিল কমলা, কিন্তু এবার নীল আলো কেন? হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় এল, নীল রঙ হচ্ছে বিষের প্রতীক। নীল আলো কি সেই সংকেত দিল ? তার মানে বিষাক্ত কোন অস্ত্র তাক করা হয়েছে ?
সে ধরনের বিষাক্ত গ্যাস যদি কোন প্রকার গান থেকে ফায়ার করে থাকে তাহলে এখন তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কারণ উপরের এক্সিকিউটর-১ থেকে ফায়ার করা গ্যাসীয় ওয়েভ মাটিতে পৌছতে পাঁচ দশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। এই সময়ের মধ্যের এক্সিকিউটর-১ এর আওতা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
এই চিন্তার সংগে সংগেই আহমদ মুসা পকেট জ্যামিং মেশিন বের করে এক্সিকিউট-১ কে টার্গেট করল। সে জানেনা ম্যাগনেটেড জ্যামিং ওয়েভ বিষাক্ত গ্যাস ওয়েভের প্রতিরোধে কিছু আসবে কিনা। কিন্তু যেহেতু করার কিছু নেই তাই আল্লাহ ভরসা করা যা হাতে আছে সেটাই কাজে লাগাতে হবে।
বিষাক্ত গ্যাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হলো বাইরের বিষাক্ত গ্যাস দেহের ভেতরে ঢুকতে না দেয়া। বিষাক্ত গ্যাসের এ্যাকশন দেড় দু’মিনিটের বেশি থাকে না।
আহমদ মুসা পকেটের রুমাল আঁট ভাজ করে নাক ও মুখের উপর রাখল। তারপর মোবাইলের স্ক্রীন লাইট অন রেখে স্ক্রীনের পরিবর্তনের প্রতি নজর রাখল। বিষাক্ত গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী এবং কিছুটা অস্বচ্ছ। যা স্বচ্ছ স্ক্রীন লাইটের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। সেটায় দেখবে সাথে সাথে সে নাক, মুখ ও চোখ পুরোপুরি বন্ধ রাখবে। যেহেতু পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় নেই, তাই আত্মরক্ষার এটুকু ব্যবস্থা ছাড়া তার করার কিছু নেই।
সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সবটুকু মনোযোগ খোলা রেখে আহমদ মুসা অপেক্ষা করছিল। তার দুই চোখ আঠার মত লেগেছিল মোবাইলের স্ক্রীনে। কিন্তু স্ক্রীন সংকেত দেবার আগেই আহমদ মুসা তার শরীর থেকেই সংকেত পেয়ে গেল। হঠাৎই আহমদ মুসার মনে হলো একটা ভারী ঠান্ডা বাতাস যেন তার মাথার উপর চেপে বসল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা মুখ ও শ্বাস বন্ধ করে চোখ বুজল। পল পল করে সময় বয়ে চলল।
আহমদ মুসা অনুভব করছে সেই ঠাণ্ডা ভারী বাতাসের ছোয়া যেন চারদিক থেকে এসে আহমদ মুসাকে চেপে ধরল। বুঝল বিষাক্ত গ্যাসেরই ঠান্ডা ছোবল এটা। হিমশীতল মৃত্যু নিয়ে এলো এই ঠান্ডা ছোবল। কোন ধরনের বিষ এটা? কোন কেমিক্যাল গ্যাস, না সাইনাইডের গ্যাসীয় রূপান্তর এটা। এ প্রশ্নের উত্তর আহমদ মুসার কাছে নেই।
সময় বয়ে চলছে পল পল করে। একের পর এক বিষাক্ত গ্যাসের ওয়েভ আসছে। বয়ে যাচ্ছে তা দেহের উপর দিয়েই।
দেড় মিনিট পার হয়ে গেছে।
আহমদ মুসার ফুসফুস মুক্ত বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি শুরু করেছে। আকুলি-বিকুলিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই বিকুলিটা এক সময় বুক ফেটে যাওয়ার চিৎকারে পরিনত হলো। বিষাক্ত গ্যাসের মৃত্যু ছোবল তখন আহমদ মুসার কাছে গৌণ হয়েছে। অস্থির হয়ে উঠেছে তার শরীর। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। ইচ্ছার ওপর বুদ্ধির নিয়ন্ত্রন যেন শিথিল হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রন ভেঙে বন্ধ নাক বন্ধ মুখ যেন এখনি মুক্ত বাতাসকে গ্রোগ্রাসে গিলবে।
আহমদ মুসা মুখ ও নাকের রুমালকে নাক ও মুখের উপর আরও ভালভাবে সেঁটে ধরে ধীরে ধীরে রুমালের মধ্য থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ল ও গ্রহণ করল খুব ভয়ে ভয়ে। কিন্তু যেটুকু পেল তার কোন প্রতিক্রিয়া সে অনুভব করল না। আরও কিছুক্ষণ পর সে নাকে মুখে চেপে রাখা কাপড়ের ভেতর দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করল। না, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। হাত ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে চোখ বুলিয়ে দেখল ইতিমধ্যে দেখল আড়াই মিনিট পার হয়েছে। আহমদ মুসা দেখেছে এক্সিকিউটর-১ থেকে সেই ভয়ংকর নীল তিনবার জ্বলেছে। তার মানে জীবনবিনাশী বিষাক্ত গ্যাসের ফায়ার তিনবার হয়েছে। শেষ ফায়ার থেকে দুই মিনিট সময় পার হয়েছে। সুতরাং বিষাক্ত গ্যসের কার্যকরীতা এখন আর নেই। চারদিকের বাতাস এসে বিষাক্ত গ্যাসকে হজম করে ফেলেছে।
আরও কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা রুমাল সরাল তার নাক মুখ থেকে। সত্যি ফ্রেশ বাতাস পেল আহমদ মুসা। উন্মুক্ত নাক দিয়ে বুক ভরে বাতাস নিয়ে আহমদ মুসা এক্সিউকিউটর-১ মাথার ওপর ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। কি করণী এখন ভাবছে আহমদ মুসা। সে বেঁচে আছে জানলে এক্সিকিউটর-১ আবার আক্রমনে আসবে। আরও একটু ভেবে আহমদ মুসা উৎসাহিত হয়ে মনে মনে বলল।
আহমদ মুসা বেঁচে নেই এই ম্যাসেজ এক্সিকিউটরকে দেবার সহজ পথ হলো, জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে চলে যাওয়া। তার কাছে থাকা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের চীপসটি নিশ্চয় জ্যামিং মেশিনের সাথেই আছে। জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে যদি আহমদ মুসা চলে যায়, তাহলে এক্সিকিউটর-১ ভাববে আহমদ মুসা এখানেই আছে এবং মরে গেছে। কারণ বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে কোন ভাবে বাচলেও এখানে আর আমার কোন ভাবে থাকার কথা নয়, এটাই তার নিশ্চিত ভাবার কথা। সুতরাং জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে সে নিরাপদে চলে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।
জ্যামিং মেশিনটি পাথরের গোড়ায় একটা গর্তের মত জায়গায় লুকিয়ে রাখল যাতে মেশিনটি প্রথম দৃষ্টিতেই খুঁজে না পায়।
আহমদ মুসার কষ্ট লাগল জ্যামিং মেশিনটি এভাবে রেখে যেতে। কিন্তু শেষে ভাবল, সব বিষয় আল্লাহই ভাল জানেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারও বা অন্য কিছুর উপর আমি নির্ভরশীল নই।
আহমদ মুসা পাথরটির পেছনে দিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে মাটির সাথে সেঁটে রেখে ক্রলিং করে চলল রাস্তার সামনের মোড়টির দিকে, যেখান থেকে এক রাস্তা চলে গেছে তার হোটেলে। চলতে চলতে আহমদ মুসা ভাবল, এক্সিকিউটর-১-এ যদি নাইট ভিশন আই কিংবা রাতে দেখার মত অন্য কোন ব্যবস্থা থেকেও থাকে, তবু মাটিতে তাকে ক্রলিং অবস্থায় ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়।
ক্রলিং করে আহমদ মুসা রাস্তার মোড় পর্যন্ত পৌঁছল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তারার আলোতে যেটুকু স্বচ্ছতা, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছেনি।
আহমদ মুসা এক টিলার উপর বসে তাকাল পুব আকাশে। এক্সিকিউটর-১ অস্পষ্ট ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে। তখনও স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।
ভাবল আহমদ মুসা, এক্সিকিউটর-১-এর দৃষ্টিতে মৃত আহমদ মুসাকে নেবার জন্যে ওটা তো নিচে নামার কথা। কিন্তু এক ইঞ্চিও তো নিচে নামেনি! তাহলে কারও অপেক্ষা করছে কিংবা লাশ নেবার জন্যে তাদের গাড়িগুলোকে কি নির্দেশ দেয়া হয়েছে? শেষেরটাই স্বাভাবিক। কিছু দূরেই তো ওদের গাড়ি ও লোকজন রয়েছে। জ্যাম গাড়িগুলোকে নিশ্চয় এতক্ষণে সচল করা হয়েছে।
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। ওরা এসে যদি আহমদ মুসার লাশ না পায়, তাহলে আহমদ মুসার সন্ধানে ছুটবে আবার তারা। সেক্ষেত্রে আহমদ মুসাকে তারা প্রথমেই খুঁজবে হোটেলে তার কক্ষে।
আহমদ মুসাও হোটেলে ফেরারই সিদ্ধান্ত নিল। ওদের গতিবিধি সম্পর্কে আহমদ মুসারও জানা দরকার।
হোটেলের রাস্তা ধরে দ্রুত এগোল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের দু’টি গাড়ি ও অনেক লোক তন্নতন্ন করে খুঁজল চারদিক কিন্তু আহমদ মুসার লাশ কোথাও পেল না।
সবাই ফিরে এসে মাথা নিচু করে বসে বলল, শয়তানটার লাশ কোথাও নেই ম্যাডাম।
গৌরীর চোখে বিস্ময় ও বিহ্বল ভাব থাকলেও আহমদ মুসার লাশ পাওয়া গেল না এই খবরে গৌরী দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে খুশিই হলো যেন বেশি! চমকে উঠল গৌরী। মনকে শাসন করল সে। লোকদের দিকে চেয়ে দ্রুত বলল, সে বেঁচে থাকলে অবশ্যই সাথে করে জ্যামিং মেশিন নিয়ে যেত। নিশ্চয় সে বেঁচে নেই। তোমরা আরও ভাল করে দেখ।
এটা বলল বটে গৌরী। তবে নিজের কথায় নিজেই জোর পেল না।
লোকরা আবার চারদিকে ছুটল।
গৌরী মোবাইল করল ক্রিনিনকে।
বলল, ক্রিনিন আহমদ মুসার লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
ক্রিনিন জুনিয়র এক্সিকিউটর-১-এর কমান্ডার। গৌরীর কথার উত্তরে দুই চোখ কপালে তুলে সে বলল, পাওয়া যাবে না কেন? নিশ্চয় পাওয়া যাবে ম্যাডাম। আমি এক্সিকিউটরের লাইটভিশন টেলিস্কোপে দেখে তাকে টার্গেট করেই ফায়ার করেছি। ফায়ারের আড়াই মিনিটের মাথায় আবার আমি দেখেছি পাথরে তার দেহ ঠেস দিয়ে থাকা। সে বাঁচেনি, বাঁচতে পারে না। তার লাশ পাওয়া যাবে না কেন?
কিন্তু লাশ থাকলে তো জ্যামিং মেশিনের পাশেই থাকার কথা। জ্যামিং মেশিন পাথরের গোড়াতেই পাওয়া গেছে, কিন্তু তাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না! ক্রিনিন, তুমি এক্সেলেন্সি লর্ডকে কিছু জানিয়েছ? বলল গৌরী।
জি ম্যাডাম। আমি মাই লর্ডকে জানিয়েছি, ফায়ার সফল। আহমদ মুসাকে টার্গেট করেই ফায়ার হয়েছে।
ফায়ারের পর তার দেহকে একটা পাথরের সাথে দেখা গেছে। ক্রিনিন বলল।
ঠিক আছে ক্রিনিন। আমি দেখছি এদিকে। দেখা যাক, শেষটা কি দাঁড়ায়।
গুড বাই, জানিয়ে কল অফ করে দিল।
কিন্তু মোবাইল পকেটে রাখা আর হলো না।
মোবাইল বেজে উঠল আবার।
গৌরী মোবাইল এগিয়ে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই জড়সড় হয়ে গেল।
মোবাইলটা মুখের সামনে নিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি গৌরী।
লাশ ঠিকঠাক আছে? কি করছ তোমরা এখন? বলল ওপার থেকে আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ শুকিয়ে গেল গৌরীর। বলল, মাই লর্ড, এখনও লাশ আমরা খুঁজে পাইনি।
কি বলছ, লাশ পাওনি মানে? পাথরটির কাছে লাশ নেই? জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
মাই লর্ড, পাথরের গোড়ায় আমরা আমাদের জ্যামিং মেশিন পেয়েছি। কিন্তু লাশ আমরা পেলাম না। গৌরী বলল।
তার মানে ক্রিনিন মিথ্যা বলেছে। গৌরী, পাথরের কাছে যখন আহমদ মুসার লাশ পাওয়া যায়নি, তখন সেখানে ক্রিনিনের লাশ থাকবে। অপেক্ষা কর গৌরী। বলে আলেক্সি গ্যারিন কল অফ করে দিল ওপার থেকে।
কেঁপে উঠল গৌরী। সে জানে এরপর কি ঘটবে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল গৌরী। তিরিশ সেকেন্ডও পার হলো না।
একটা ভারী বস্তু এসে পড়ল গৌরীর কাছেই। আবার কেঁপে উঠল গৌরী। না দেখলেও সে নিশ্চিত যে, ওটা ক্রিনিনের লাশ।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটে ব্যর্থতার এটাই শাস্তি। এখানে বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দিতে বিলম্ব হয় না, বিলম্ব করে না আলেক্সি গ্যারিন। জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১-এ যেখানে কমান্ডার ক্রিনিনের আসন ছিল, সেখানে তার মাথা বরাবর পেছনে ইস্পাতের দেয়ালে একটা ফুটো আছে। সেই ফুটোতে ফিট করা রয়েছে দূরনিয়ন্ত্রিত বিশেষ ধরনের রিভলবারের ব্যারেল। রিমোট কনট্রোলের বোতাম চেপে এই গানে ফায়ার করেছে আলেক্সি গ্যারিন। হত্যা করে সিসি টিভি’তে তার ছবি দেখেছে সে। তারপর রিমোট কনট্রোলের আরেকটা বোতাম টিপে ক্রিনিনের সিটের নিচে এক্সিকিউটর-১-এর একটা অংশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেই উন্মুক্ত পথে সিট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে ক্রিনিনের লাশ। এই সব দৃশ্য, এ সব প্রসেস গৌরীর মুখস্ত। সে কারণেই চমকে উঠেছিল তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনে।
গৌরী গিয়ে ক্রিনিনের লাশ টেনে এনে পাথরের গোড়ায় রাখল।
আবার বেজে উঠল গৌরীর মোবাইলটা। গৌরী মোবাইল ধরল।
পেয়েছ ক্রিনিনের লাশ? ওপার থেকে জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
ইয়েস মাই লর্ড। ওটা নিয়ে পাথরের গোড়ায় রেখেছি। বলল গৌরী।
শোন, দু’তিনজনকে লাগাও লাশগুলোকে মানুষের চোখের আড়াল করতে। অবশিষ্টরা জিলাস-এর নেতৃত্বে আহমদ মুসাকে ফলো করবে। প্রথমে হোটেলে। তারপরের নির্দেশ আমি দেব। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
স্যরি মাই লর্ড, আমরা যারা তাকে ধরার জন্যে প্রথম অভিযানে এসেছিলাম, তারা তার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান হতে পারিনি। স্যরি মাই লর্ড, বলল গৌরী।
ব্যর্থতা তোমাদের নয় গৌরী, সফলতা আহমদ মুসার। সফলতা তার প্রায় অতিমানবিক বুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতার। প্রথমটায় আমিও তাকে অবমূল্যায়ন করেছিলাম গৌরী। সে যে আহমদ মুসা, এ বিষয়টাকে আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেইনি। আসলে আহমদ মুসা অপরাজিত এক ডেভিল। সে বারবার ফাঁদে পড়েছে, কিন্তু সব সময়ই ফাঁদ কেটে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেছে। বলা যায় গৌরী, আমাদের পশ্চিমা বন্ধুদের সব শক্তি তার কাছে পরাজয় বরণ করেছে। এ জন্যেই এখন তারা বলছে, তাকে ধরা নয়, দেখা মাত্র হত্যা করতে হবে। তারা যে ঠিক বলছে, আজকের রাতের ঘটনা তা প্রমাণ করল।
কিন্তু গৌরী ক্রিনিনকে জীবন দিতে হলো তার একটি ভুলের কারণে। বিষাক্ত গ্যাসে আহমদ মুসার সত্যিই মৃত্যু হয়েছে কিনা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে তা নিশ্চিত করেনি।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি ও নাশকা আহত। তোমরা চলে এস। বলে দিয়েছি, জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করছে সেখানে। গুড বাই।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন ওপার থেকে কল অফ করে দিল।
কিন্তু গৌরী মোবাইল হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। তার মাথায় কিলবিল করছে অনেক চিন্তা। তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিন আহমদ মুসাকে ‘ডেভিল’ বলেছে। এখন পর্যন্ত তাকে হারাতে না পারার কারণেই তাকে ডেভিল বলা হচ্ছে। মনে পড়ল তার ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ’ হোটেলের ‘অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে’ মানব-মানবীর সম্পর্ক বিষয়ে আহমদ মুসার একান্ত মানবিক কথাগুলো। মনে পড়ল তাদের প্রতি আহমদ মুসার বিস্ময়কর আচরণের কথা। এই মানুষ যদি ‘ডেভিল’ হয় তাহলে অ্যাঞ্জেল বলে কোন কিছু সৃষ্টিতে নেই। মানুষ অ্যাঞ্জেল হতে পারে না। মানুষ যদি মানুষ হতে পারে, তাহলে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড় হয়, এটা পড়েছি। আমার জীবনে আহমদ মুসাকে আমি প্রথম মানুষ দেখলাম যে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড়। আহত ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকাল গৌরী। এই ব্যান্ডেজ বেঁধেছে আহমদ মুসা। তার হাতের স্পর্শ লেগে আছে এই ব্যান্ডেজে। রোমাঞ্চিত হলো গৌরীর দেহ। বাম হাত দিয়ে ডান হাত তুলে নিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করল ব্যান্ডেজে।
পাশ থেকে শব্দ ওঠায় চমকে উঠে ফিরে তাকাল গৌরী।
জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করেছে।
এক্সিকিউটর-১ থেকে ডেপুটি কমান্ডার (এখন কমান্ডার) নিলাপ্পা।
তাকে দেখেই গৌরী বলল, হ্যাঁ নিলাপ্পা, তুমি ওয়েট কর। আমি এদিকের কাজ সেরে নিই। বলল গৌরী।
ইয়েস ম্যাডাম। বলল নিলাপ্পা।
গৌরী তার মোবাইলে একটা কল তৈরি করতে করতে একটু দূরে সরে গেল।

ক্যাপিটাল অব পাওয়ার।
বিশ্বমিলনায়তন (Hall of World Assembly)।
বিশ্বনির্বাহীদের কাউন্সিল বৈঠক।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এটাই সর্বোচ্চ পরামর্শ সভা। ব্ল্যাক সানের ৫ জন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই কাউন্সিলের সদস্য। ব্ল্যাক সানের সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট লর্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড আলেক্সি গ্যারিন এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
অর্ধ বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে বসেছে পাঁচজন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা।
টেবিলের বিপরীতে বৃত্তাকার প্রান্তের সামনে সূর্যাকার টেবিলের পেছনে কোন চেয়ার নেই।
ঠিক রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট ঘরের ছাদ ফুঁড়ে একটা টিউব লিফট নেমে এল। লিফটটি কালো ছিল। লিফটটি নেমে এল সূর্যাকার টেবিলটির পেছন পাশ ঘেঁষে।
লিফটটি নেমে মুহূর্তকাল স্থির হয়েই আবার উঠে গেল। লিফট উঠে যেতেই দেখা গেল সিংহাসনাকৃতির একটা চেয়ারে দীর্ঘাকৃতির একজন শিরদাঁড়া সোজা করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসে। দেহে তাঁর সামরিক পোশাক। মাথায় কালো সামরিক ক্যাপ। ক্যাপের সামনে ব্ল্যাক সানের একটা মনোগ্রাম। তাঁর দুই কাঁধ ও বুকে সেই একই মনোগ্রামের প্লেট।
কালো মূর্তিসহ নেমে আসা চেয়ারটি মেঝের উপর স্থির হতেই সামনে অর্ধ বৃত্তাকার টেবিলের পাঁচজন উঠে দাড়িয়ে বাউ করল।
এই কালো মূর্তিই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান আলেক্সি গ্যারিন। আলেক্সি গ্যারিন মুখোশ পড়েই সবার সামনে আসে। গৌরীর মত কিছু পার্সোনাল স্টাফ ছাড়া কেউ তাকে চোখে দেখেনি। শীর্ষ এই পাঁচজন কর্মকর্তাও তাঁর পার্সোনাল স্টাফের অন্তর্ভুক্ত।
আলেক্সি গ্যারিন এসে বসার পর পরই তাঁর পেছনে এক সারিতে তিনটি চেয়ার চলে এল। আলেক্সি গ্যারিনের ঠিক পেছনে মাঝের চেয়ারে গৌরী। তাঁর ডান পাশের চেয়ারে চীফ অব অপারেশন ‘জিজর’। সে সম্পর্কে আলেক্সি গ্যারিনের ছোট ভাই। আর গৌরীর বাম পাশে রয়েছে ব্ল্যাক সানের গোয়েন্দাপ্রধান এবং আলেক্সি গ্যারিনের আরেক ছোট ভাই ডারথ ভাদের।
গৌরী তাঁর চেয়ারে বসার আগেই একটা ফাইল নিয়ে রেখে দিল আলেক্সি গ্যারিনের সামনে টেবিলের উপর।
ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ তুলল ফাইল থেকে। সোজা হয়ে বসল।
একবার সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, শুভ সময় সকলকে। লং লীভ আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট। অমর হোক আমাদের স্লোগান ‘পাওয়ার ফর পাওয়ার’ অর্থাৎ শক্তির জন্য শক্তি।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। শুরু করল আবার, ব্ল্যাক সানের শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দ, আজ এক বিশেষ বৈঠকে আমি তোমাদের ডেকেছি। উদ্দেশ্য, আমাদের এ পর্যন্ত কাজের একটা পর্যলোচনা করা এবং উদ্ভূত একটা পরিস্থিতি সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা। প্রথমে আমাদের কাজ নিয়ে আলোচনায় আসি। আমাদের ‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের চীফ এক্সিকিউটিভ ‘পালপেটাইন’ তোমার বিভাগের কাজের বিবরন দাও।
‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের নির্বাহী পালপেটাইন নড়েচড়ে বসল। তাঁর সামনে স্পিকার বক্সের সিগন্যাল লাইট জলে উঠেছে। স্পিকার অন হয়ে গেল। বলতে শুরু পালপেটাইন, মাই লর্ড! ‘শক্তির জন্য শক্তি’ আপনার উদ্ভাবিত সবচেয়ে প্রিয় প্রোজেক্ট। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এই মহান প্রজেক্টের সাথে সামিল হতে পেরেছি। মাই লর্ডের এই মহান প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো, শক্তি দিয়ে শক্তি অর্জন, সেই শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্ব-চরাচরকে বশ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজন গোটা দুনিয়াকে মেধাশুন্য করার মাধ্যমে শক্তি শূন্য করা এবং প্রয়োজন আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের শক্তির রাজত্ব চিরস্থায়ী করার জন্যে দুনিয়া থেকে সকল নীতি- নৈতিকতার উচ্ছেদ ঘটানো। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেধাগুলো সরিয়ে আনছি দেশ ও জাতি সমুহের কাছ থেকে, বিশেষ করে মুসলিম দেশের মুসলিম মেধাকে সরিয়ে আনাকে প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। আজ দুনিয়াতে মুসলমানদের ইসলামই দুনিয়াকে ধর্মের শিক্ষামুক্ত ও নীতি- নৈতিকতামুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবিকৃত থাকায় মুসলমানদের বিশ্বাস খুবই জীবন্ত এবং মানুষের মধ্যে এর আবেদন খুবই কার্যকরি। এটাই আমাদের জন্যে বিপদ। এজন্যই মুসলিম জাতিকে মেধাশুন্য ও শক্তিশুন্য করার প্রতি প্রথমেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’ সরিয়ে এনেছি, তাঁদের ৯০ ভাগই মুসলিম। এর মাধ্যমে একদিকে মুসলিম জাতিকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল করা যাবে। অন্য দিকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও তাঁর ক্যাপিটাল অব পাওয়ার শক্তিশালী হবে। এটা আমাদের সফল প্রোগ্রাম। কয়েকদিন আগে আমরা সৌদি আরবের স্পেস ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও আলোক বিজ্ঞানের এ যুগের সবচেয়ে সফল বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কীকে সরিয়ে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের বর্ণনাতীত বড় একটা সাফল্য। স্পেসশীপ ও সমুদ্রযানে এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের টেকনলজি উদ্ভাবনে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। এ ব্যাপারে ক্লিনিক্যাল টেস্ট তিনি করেছেন এবং তা সফল হয়েছে। তিনি এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের উপযোগী স্পেস মেরিনের ডিজাইন তৈরির কাজও শেষ করেছেন। এখন এই বিজ্ঞানী আমাদের হাতে। তাকে কব্জায় আনার মাধ্যমে একদিকে আমরা মুসলিম জাতির শক্তিকেন্দ্র সৌদি আরবকে এক মহাশক্তির মালিক হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছি, অন্যদিকে এই শক্তির মালিক আমরা হতে যাচ্ছি। আমা….।
পালপেটাইনের কথার মাঝখানেই একমাত্র আলেক্সি গ্যারিন ছাড়া উপস্থিত সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল।
থেমে গিয়েছিল পালপেটাইন। আবার শুরু করে বলল, আমাদের মটো ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ প্রোজেক্ট নিয়ে সাফল্যের সাথে এগোচ্ছি। থামল পালপেটাইন।
পিনপতন নিরবতা।
কালো ইউনিফরমে আবৃত কালো মুখোশে ঢাকা আলেক্সি গ্যারিনের মুখ নড়ে উঠল। বলল, টুডে সাইন্স অব টুমরো বাই রোবটস (রোবটস গড়ার আগামীর বিজ্ঞান আজ) আমাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আমাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে। এই প্রকল্পটি আমি নিজে তত্তাবধায়ন করি। এই প্রকল্পের দৈনন্দিন দেখা-শুনা আমার পক্ষ থেকে গৌরী করে থাকে। আমি তাকে বলছি, এই প্রকল্পের কাজ কিভাবে এগোচ্ছে ও কতটা এগিয়েছে তাঁর উপর একটা রিপোর্ট পেশ করতে।
কোথা থেকে যেন গৌরীর মনে অপরিচিত একটা বিষণ্ণতা নেমে এল! চমকে উঠল গৌরী। সব সময় তো সে তাঁর লর্ডের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়ে গৌরব বোধ করেছে এবং লাভ করেছে সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু আজ এই বিষণ্ণতা কেন? সেই আনন্দের কথাগুলো বলতে আজ কষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে কেন?
সব ভাবনা ঝেরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো গৌরী। আলেক্সি গ্যারিনকে ইয়েস মাই লর্ড, বলে একটা লম্বা বাউ করে একটা নোটশিট ফাইল থেকে বের করে স্পিকারের সামনে বসল। বলতে শুরু করল, মাই লর্ড ও মাই কলিগস। ‘রোবটস গড়বে আগামীর বিজ্ঞান’-প্রকল্পটি মাই লর্ডের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী একটা পদক্ষেপ। বিজ্ঞানী গড়ে তাঁর কাছ থেকে থেকে বাঞ্ছিত কাজ পাওয়া অসম্ভব। আমাদের প্রকল্পে বিভিন্ন বিষয়ে গড়া প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের তাঁদের স্থান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের স্ব স্ব বিষয়ে কাজ নেয়া হচ্ছে। এই কাজে তাঁদের রোবটে পরিনত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাঁদের প্রতিভার শেষ বিন্দু বের করে নিয়ে আগামীর বিজ্ঞানী গড়ে তোলা হচ্ছে। কাজটা কঠিন হলেও মাই লর্ডের পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতিতে কঠিনকে সহজ করে ফেলা হয়েছে। প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীর অধিকাংশই আজ আজ্ঞাবহ নিরেট রোবট। যারা রোবট হয়নি তারাও হবে। যারা হবেনা তাঁদের জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
মূল উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে আমরা বহু দূর এগিয়েছি। সার্বিক কমুনিকেশনের ক্ষেত্রে এ্যান্টিম্যাটার যুগে প্রবেশ ও সামরিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে লেজার-উত্তর যুগে প্রবেশ করে অদ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ও আক্রমনের শক্তি আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি। আমাদের বিজ্ঞানীকে দিয়ে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি আমরা আবিষ্কার করেছি। পরিবহন ক্ষেত্রে সে জ্বালানীর সফল ল্যাবরেটরি টেস্টও আমরা করেছিলাম। আমরা এখন এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানীর মালিক। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন এ্যান্টিম্যাটার বিজ্ঞান। সৌদি আরব থেকে সরিয়ে আনা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মক্কীর সহযোগিতা যদি আমরা আদায় করতে পারি, তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি চালিত স্পেসশীপ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান ও সমুদ্রযান আমরা ব্যবহার করতে পারবো। তখন আমরা কয়েক মিনিটে চাঁদে যাতায়াত করতে পারবো। একদিনের মধ্যে আমরা সৌরজগতের শেষ সীমায় গিয়ে ফিরে আসতে পারবো। তখন দুনিয়ার সব পরিবহণ ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি তৈরির পাশাপাশি এ্যান্টিম্যাটার পরমাণুর আরও উন্নত রিপ্রসেসিং-এর মাধ্যমে এ্যান্টিম্যাটার বোমা তৈরির ক্ষেত্রেও আমরা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে যাচ্ছি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আমরা সমুদ্রতলে এর টেস্টের আয়োজন করতে পারবো। আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা এ্যান্টিম্যাটার পরমানু বোমার মালিক হবো। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ অর্জনের লক্ষ্য ষোল কলায় পূর্ণ হবে। দুনিয়ার সব অস্ত্র অচল হয়ে যাবে। বিশ্বে হবো আমরাই একমাত্র শক্তি। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট হবে দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারক। দুনিয়ার অচল অস্ত্রের মত ঈশ্বরও অচল হয়ে পড়বে। আমাদের লর্ড হবে দুনিয়ার লর্ড, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স। ধন্য….।
হাততালি দিয়ে উঠল সকলে।
হাততালির মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল গৌরীর কথা।
হাততালি শেষ হলে গৌরী বলল, আমার কথা এখানেই শেষ। ধন্যবাদ মাই লর্ড, ধন্যবাদ সকলকে।
আবার পিনপতন নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল আলেক্সি গ্যারিন। বলল, আজকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সব বিষয়ে আলোচনা করছি না। আজ শেষ আলোচনার বিষয় হল, একজন বিদেশী তাহিতিতে এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। বিষয়টি ছোট, কিন্তু আলোচনার দাবী রাখে। কারন ব্যাপারটি অনেক বড়। এ পর্যন্ত সে আমাদের পাঁচজন লোককে খুন করেছে।
একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন।
শীর্ষ নির্বাহীদের একজন হাত তুলল।
বল। কথা বলার অনুমতি দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, এটা একটা ব্যক্তির ব্যাপার। আপনি চাইলেও সে ইলিমিনেট হয়ে যায়। বলল সেই শীর্ষ নির্বাহী।
সে একজন ব্যক্তি বটে, কিন্তু সে একাই সহস্রের সমান। সে অপরাজিত এক ডেভিল। নাম তাঁর আহমদ মুসা। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
আহমদ মুসার নাম শুনে মাথা খাড়া করল পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীর সকলেই। একজন বলল, সে বিপদ এখানে এল কি করে? কেন এসেছে?
কেন এসেছে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তোমরা জান, আমাদের একজন রোবট একটা ম্যাসেজ বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, আংশিক পাঠিয়েছিল। প্রমানিত হয়েছে, যখন সে ম্যাসেজটি পাঠাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা এক বোটে তাহনিয়া দ্বীপের এ প্রান্তে ছিল। তাঁর মনিটরিং-এ এই মেসেজ ধরা পড়েছে আমরা নিশ্চিত। সে এ নিয়ে কি ভাবছে, কি করছে তা আমরা জানিনা। তাঁর আসাটাই সন্দেহজনক। বিনা কারনে সে এক পা ফেলেনা, এটা সবাই জানে । সে নিছক বেড়াতে তাহিতিতে এসেছে এটা ঠিক নয়। সে কথাই আমি তোমাদের বলতে চাচ্ছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, আহমদ মুসা খুবই বিপদজনক ব্যক্তি। শুরুতেই তাকে ইলিমিনেট করা দরকার। ঘটনাটিকে এগোতে দেয়া ঠিক নয় মাই লর্ড। বলল শীর্ষ নির্বাহীদের অন্য একজন।
সে ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। গৌরীর নেতৃত্বে একটা দক্ষ টীম পাঠিয়েছিলাম তাকে কিডন্যাপ করার জন্যে। ইতিমধ্যে পশ্চিমের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বন্ধু সংগঠন আমাদের জানাল, তাঁরা আহমদ মুসার লাশ চায়। তাঁরা অনুরোধ করে আহমদ মুসাকে হত্যা করার কোন সুযোগ ছেড়ে না দেয়ার। লাশের মুল্য হিসাবে তাঁরা দিবে ১ বিলিয়ন ডলার। তখন আহমদ মুসাকে আমরা কিডন্যাপ করে ফেলেছি। আমি গৌরীকে নির্দেশ দিলাম আহমদ মুসাকে হত্যা করার। কিন্তু তাকে হত্যা করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গৌরী ও নাশকা মারাত্নক আহত হয়, মারা যায় আমাদের পাঁচজন। সংগে সংগেই দুই গাড়িতে দু’টি টিম পাঠিয়েছিলাম তাকে ঘিরে ফেলতে। ঘিরে ফেলেও তাঁরা তাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের অস্ত্রে আমাদের ঘায়েল করে সে নিরাপদে বেরিয়ে যায়। তাঁর সাথে সাথেই আমি আমাদের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ পাঠিয়েছিলাম তাকে অনুসরন ও হত্যা করার জন্যে। কিন্তু এক্সিকিউটর-১ তাকে বাগে পেয়েও, সর্বশেষে বিষাক্ত গ্যাস তাঁর উপর প্রয়োগ করেও তাকে হত্যা করা যায়নি। তাঁর সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর পর থেকে। তাঁর ব্যাপারে আরও সিরিয়াসলি ভাবা প্রয়োজন বলেই কথাটা এই বৈঠকে তুলেছি। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
মাই লর্ড, আপনি কি আশংকা করছেন? আমাদের কি করা দরকার? আমাদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ? বলল অন্য একজন শীর্ষ নির্বাহী।
আমি ভাবছি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে। ব্লাক সান সিন্ডিকেটের নিরাপদ স্থান খুজতে আমি গোটা দুনিয়া চষে ফিরেছি। কিন্তু সব দিক নিরাপদ স্থান আমি পাইনি।সবশেষে সভ্যতা থেকে বহু দুরে সবচেয়ে বড় সাগরের মাঝামাঝি ও প্রায় জনশূন্য এই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলাম। দ্বীপগুলো অ্যাটল দ্বীপ হওয়ায় নতুন জনবসতির সুযোগ এখানকার দু’একটা ছাড়া কোন অ্যাটল দ্বীপেই নেই। আমার খুব ভালো লেগেছিল স্থানটা। অ্যাটল থেকে অ্যাটলে ঘুরে বেরিয়েছি মাসের পর মাস। কিন্তু ব্ল্যাক সান-এর ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ স্থাপিত হতে পারে এমন উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাইনি। তোয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র দ্বীপ ‘মাকাতিয়া’র পুরানো মন্দিরে বিশ্রাম কক্ষে বসেছিলাম। অ্যাটল দ্বীপগুলোতে ঘোরাফেরার পথে প্রায়ই এই বিশ্রামখানায় বসি। পাশের রেস্টুরেন্টে তাজা মাছের ভাজি ও তাজা ফল প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো আমার প্রিয়। সেদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আবার এসে বসেছিলাম মন্দিরের বিশ্রামকক্ষে। আমার সামনে বসেছিল বৃদ্ধ একজন সন্ন্যাসী। আর কেউ ছিল না বিশ্রামকক্ষে।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর চোখ সব সময় বন্ধই দেখলাম।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ ধরে এসেছিল।
বৎস, তুমি ঘুমালে? এই কথাগুলো কানে যাওয়ায় আমার তন্দ্রা কেটে যায়।
চোখ মেলে দেখি সন্ন্যাসী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই বলল, তোমার বাড়ি নিশ্চয় আমাদের অ্যাটল দীপপুঞ্জে নয়?
জি হ্যাঁ। বললাম আমি।
তুমি পর্যটকও নিশ্চয় নও? সন্ন্যাসী বলল।
জি না। আমি বললাম।
গত তিন মাসে তুমি এখানে তিরিশবার এসেছ। সন্ন্যাসী বলল।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম সন্ন্যাসীর দিকে। অনেকবার এসেছি তাহানিয়া দ্বীপের এখানে। কিন্তু তিরিশবার হয়েছে কিনা গুনে দেখিনি। আমি বললাম, বাবা, তিন মাসে আমি এখানে অনেকবার এসেছি, তিরিশবার হয়েছে কিনা আমি জানিনা। নিশ্চয় আপনার গুনা ঠিক বাবা।
তুমি নিশ্চয় কাউকে খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
কাউকে নয়, কিছু খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন হন্যে হয়ে কি খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
একটা জায়গা খুজছি বাবা। এই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ আমার ভালো লেগেছে। এখানে একটা নিরিবিলি স্থানে আশ্রয় গড়ার জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো প্রচুর! এত খুজছ কেন? সন্ন্যাসি বলল।
একটা বড় জায়গা যা মানুষের চোখের আড়াল হবে, এমন একটা জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো ডাকাতদের আড্ডার জন্য দরকার! তুমি সে রকম কিছু করতে নিশ্চয় চাওনা? সন্ন্যাসী বলল।
আমি হেসেছিলাম। তারপর গম্ভীর হয়ে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, ডাকাতির জন্য নয়, আমি জায়গা চাই বিশাল একটা গবেষণা সংস্থা গড়ার জন্যে যা দুনিয়াকে একশ’ বছর এগিয়ে নেবে।
এ্যাটম বোমা বানাবে এবং আমাদের পানিতে তা পরীক্ষা করবে নাকি, যেমন ফ্রান্স কয়েক যুগ ধরে করেছে। যেন আমরা ওদের গিনিপিগ! সন্ন্যাসী বলল।
বাবা, আমাদের গবেষণা ঐ ধরনের নয়। আমাদের গবেষণা আরও বড় বিষয় নিয়ে। লোক চক্ষুর আড়ালে তা হবে। মানুষ ও পরিবেশকে তা ডিস্টার্ব করবে না বাবা। আমি বললাম।
কিন্তু এর জন্যে তো ইন্সিটিটিউট ধরনের বিশাল বাড়ি ও বড় জায়গা দরকার। অ্যাটলের সারফেসে তো এমন জায়গা দেখিনা বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
সে জন্যই তো খুজেই ফিরছি বাবা! আমি বললাম।
ভাবছিল সন্ন্যাসী।
আমিও কিছু বললাম না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষন পর মুখ তুলল। তাকাল আমার দিকে। বলল, প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ‘মু’ নামে একটা মহাদেশ ছিল, এটা তুমি বিশ্বাস কর?
আমি শুনেছি বাবা। কিন্তু এ নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। তবে আগ্রহ আছে জানার। বললাম আমি।
আজকের তাহিতি দ্বীপ যেমন বাস্তবতা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব যেমন বাস্তবতা, তেমনি আজকের মধ্যপ্রশান্ত মহাসাগরের মহাদেশ ‘মু’ একটা বাস্তবতা। এই মহাদেশ ছিল বিশাল ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। পেরু ও গুয়েতেমালার পুরাকীর্তি এবং মায়া সভ্যতার বিস্ময় ‘মু’ সভ্যতারই খণ্ডাংশ। ‘মু’ মহাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের অন্তঃসার শূন্য গর্ব, ঈশ্বরকে ত্যাগ করা, ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের ধ্বংসকারী ব্যবস্থা এবং পরিশেষে ঈশ্বরের শাস্তি ভুমিকম্প ও প্লাবনের আঘাত ধ্বংস করে ‘মু’ মহাদেশকে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোন কোনটি সেই মহাদেশরই ধ্বংসাবশেষ হিসাবে টিকে আছে। এরকম একটি অ্যাটলের খবর আমি জানি, যার ভিতরে অক্ষত আছে ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যবর্গের একটি বহুতল প্রাসাদ। থামল সন্ন্যাসী।
বহুতল প্রাসাদ? আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ, বহুতল প্রাসাদ বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
অ্যাটলের অভ্যন্তরে? আমার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, অ্যাটলের ভিতরে। সন্ন্যাসী বলল।
আপনি সে অ্যাটলকে জানেন? জিজ্ঞাসা করলাম। বিস্ময় ও আনন্দে আমার ভেতরটা তখন কাঁপছে। রুপকথার মত মনে হচ্ছে তাঁর কথাগুলো।
অবশ্যই জানি বৎস। সেই জানাটাও একটা রুপকথার মত।
বলে একটু থামল সন্ন্যাসী। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, তখন আমার বয়স তিরিশ। সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে আমি তখন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরি। একদিন এই মন্দিরেই আমার মত নব্বই-ঊর্ধ্ব এক বুড়ো সন্ন্যাসীর সাথে দেখা। ঈশ্বরী ‘হিনার’ বন্দনা চলছিল সেদিন মন্দিরে। বন্দনা শেষ হতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। বন্দনা শেষ হবার পর মন্দিরের এক কক্ষে আমি সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসিকে শুইয়ে দিতে যাই। বিছানা ঠিক করে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমি তাকে বাতাস করছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে শোনা বন্দনায় অনেক কথাই মাথায় কিলবিল করছিল। তাঁর মধ্যে কিছু বিষয় আমাকে খুচাচ্ছিল বেশি। আমি গুরুকে বললাম, গুরু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
গুরু চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ খুলে বলেছিলেন, অনুমতি নিয়ে বলতে হবে কেন? বল তোমার কথা।
গুরু বন্দনার মধ্যে শুনলাম, ঈশ্বরী হিনা রাজপুত্র হেসানা হোসানা, সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর একমন একতনু প্রেমসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে অ্যাটলের এক প্রাসাদে তাঁদের মিলন ঘটিয়েছিলেন এবং প্রাসাদটি তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন-এটা কি সত্য ঘটনা? ঈশ্বরী হিনা কি সত্যিই এটা করেছিলেন?
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সন্ন্যাসী শোয়া থেকে উঠে বসেছিলেন। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিলেন, তোমার কি সন্দেহ আছে এ কথায়?
সন্দেহ নেই, কৌতূহল আছে। স্বর্গের ঈশ্বরী নেমে এসেছিলেন তাঁদের জন্যে এবং এই ধরনের একটা প্রাসাদ কোন অ্যাটলে আছে? গুরুজি এটা সত্যিই বিস্ময়ের। আমি বলেছিলাম।
স্রষ্টা ঈশর কি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসবেন না?
সৃষ্টির কান্না কি স্রষ্টার মন গলাবে না? তিনি কি সৃষ্টির অশ্রু মুসাতে আসবেন না? অবশ্যই আসবেন। রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন। রাজপুত্র হেসানা সাগরকন্যা শাবানুর জন্যে রাজ্য রাজত্ব সবই ছেড়েছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরে এই অ্যাটল রাজ্যে তিনি অবিরাম কেঁদেছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সব ভুলেছিলেন, ভুলেন নি শুধু সাগরকন্যার প্রেম। স্রষ্টা দেখেছিলেন তাঁর সৃষ্টি এই রাজপুত্র সাগরকন্যাকে না পেলে সাগরেই তাঁর জীবন শেষ করে দিবে। এই অবস্থায় স্রষ্টা ‘হিনা’ তাঁর সৃষ্টির চোখ মুসাতে না এসে পারেন? তাই তিনি এসেছিলেন। তিনি আদর করে তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মু’ মহাদেশের ধ্বংসাবশেষ অ্যাটল দ্বীপের সেই প্রাসাদে। সেখানেই তাঁদের মিলন ঘটেছিল। স্রষ্টা হিনা তাঁর সৃষ্ট দুই মানব-মানবীর পাগলপারা প্রেমে মুগ্ধ হয়ে খুলে দিয়েছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মহাদেশের স্মৃতিবাহী সুন্দর প্রাসাদটিকে।আমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তোমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই ঘটনা।
কথা শেষ করে সন্ন্যাসী আবার শুয়ে পড়েছিলেন। শুয়ে থেকেই বললেন, তরুন সন্ন্যাসী বেটা, তোমাকে আরও বলি এই অধমকেও স্রষ্টা হিনা দয়া করে সেই প্রাসাদটি দেখিয়েছিলেন। এই চর্ম চোখে আমি তা দেখেছি।
বলে থেমেছিলেন গুরু সন্ন্যাসী মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার শুরু করেছিলেন, তোমার মত আমার মনে প্রাসাদের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্ময় ছিলনা বটে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এক আকুতি ছিল আমার ঐ প্রাসাদটি দেখার জন্যে। এই আকুলতা নিয়ে আমি অবিরাম ঘুরে ফিরেছি অ্যাটল থেকে অ্যাটলে দিনের পর দিন। একদিন সন্ধ্যায় তাহানিয়া অ্যাটলের পাশ দিয়ে মাকাতিয়া দ্বীপে ফেরার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ল আমার ছোট বোটটি। এ অঞ্চলে ঝড় হয় না। যদি কখনও হয়, তাহলে তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন মনে করে যে যেখানে থাকে সে সেখানেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ঝড় সম্পূর্ণ থেমে গেলে আবার জীবন-কর্ম শুরু করে। সে অনুসারে আমি তাহানিয়া অ্যাটলে আমার ছোট বোটটি বেধে সেখানেই অপেক্ষা করলাম। অস্থির সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। মঙ্গলময় মমতাময় স্রষ্টা হিনা কিংবা তাঁর পাঠানো কোন স্বর্গীয় অ্যাঞ্জেল আমার কাছে এলেন। আলোয় ঢাকা তাঁর দেহ কিংবা বলা যায় আলোর এক অবয়ব তিনি। আমাকে বললেন, এসো মানব, আমার সাথে এসো। আমি উঠলাম, তাঁর পেছেনে পেছনে চললাম। বোঁট থেকে নেমে তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর এক যায়গায় দাঁড়ালো জ্যোতির্ময় অবয়ব। তাকাল মাটির দিকে। আমিও তাকালাম। সেখানে দেখলাম সফেদ ফুলের একগুচ্ছ গাছের ছোট্ট ঝোপ। জ্যোতির্ময় অবয়বটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছায় ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ এর ‘সিঁড়িমুখ’ বের হলো। সংগে সংগেই ফুলের গাছের ঝোপটি অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানে মাটির নিচে কিছু একটা দেখা গেল। গোলাকার সফেদ পাথর। আবার বলল জ্যোতির্ময় অবয়বটি, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় আমাদের পথ ছাড়ুন। কথার সাথে সাথেই পাশের মাটির ভেতরে হারিয়ে গেল সফেদ পাথরটি। সুন্দর সিঁড়িমুখ বের হয়ে পড়ল। সিঁড়িও সফেদ পাথরের। সেই সিঁড়িপথে ঢুকে গেলাম ভেতরে জ্যোতির্ময় অবয়বের সাথে। আসলেই ওটা প্যালেস। সম্মোহিতের মত আমি দেখেছি প্রাসাদটা। আয়তনে অনেক বড়, ছোট-খাটো একটা দ্বীপের সমান, তেমনি উচুর দিক দিয়ে কয়েক তলা হবে। এখানেই রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি ছিল? বলেছিলাম স্বাগত কণ্ঠে। জ্যোতির্ময় অবয়বের অ্যাঞ্জেল জবাবে বলেছিল, হ্যাঁ, এখানেই তাঁরা ছিল, এটাই ছিল তাঁদের বাড়ি। যতটা সম্ভব মানুষের কল্যান তাঁরা করেছে। কখন আমার প্রাসাদ দেখা শেষ হল আমি জানিনা। যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখলাম ভোর হয়ে গেছে। একটা স্বস্তি যেন আমার দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একই কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসতে লাগল, স্বপ্নটা আমার কি সত্যি। সত্যিই কি অ্যাঞ্জেল এসেছিল আমার কাছে। প্রাসাদ কি আমি দেখেছি তাঁর সাথে গিয়ে, সত্যিই কি তাহলে প্রাসাদ আছে। সকাল হতেই আমি বোঁট থেকে নেমে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত ধরে দক্ষিনে এগোতে থাকলাম। এখানে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্তটি প্রশস্ত। যতই দক্ষিনে গেছে আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমার চোখ সন্ধান করছিল সেই সফেদ ফুলের গাছের ঝোপ। পেয়ে গেলাম সফেদ ফুলের সেই ঝোপ। আমি বিস্মিত ও সম্মোহিতের মত দাড়িয়ে পড়লাম সফেদ ফুলের গাছের সেই ঝোপের পাশে। আমার গোটা শরীর রোমাঞ্চিত হলো। তাহলে স্বপ্ন আমার সত্য, অ্যাঞ্জেল সত্য, প্রাসাদও সত্য। আমি ছুটে গিয়ে বোঁট থেকে শাবল নিয়ে এলাম। সফেদ ফুলের গাছের ঝোপের পাশে গর্ত আকারে খুড়তে লাগলাম। মাটির দু’হাত গভীরে যাবার পর সত্যিই পেলাম স্বপ্নে দেখা সেই সফেদ পাথর। তাঁর মানে পাথর তুললেই সিঁড়ি। সিঁড়ির পড়েই সেই প্রাসাদ। সবই আমি পেয়ে গেলাম। প্রাসাদে ঢুকতে মন চায়নি। চাল-চুলাহীন সন্ন্যাসী, তাঁর তো প্রাসাদ দরকার নেই। যা দেখার সেটা তো অ্যাঞ্জেল আমাকে দেখিয়েছেন। গর্ত মাটি ঢেলে বন্ধ করে চলে এসেছিলাম। আর যাইনি। বলল তরুন সন্ন্যাসী, ‘মু’ মহাদেশের অবশিষ্ট স্মৃতি সেই প্রাসাদ সম্পর্কে আর জিজ্ঞাসা আছে? সৃষ্টির অশ্রু মোছাতে স্রষ্টা যে আসেন কিংবা সৃষ্টির আন্তরিক চাওয়া মেটাবার ব্যবস্থা করেন, সে বিষয়ে কোন বিস্ময় এখনও আছে?
গুরুজি একটি বিষয়, রাজপুত্র হেসানা সম্পর্কে আমার কোন কথা নেই। কারন সে পাপেতি রাজবংশের রাজকুমার আমরা জানি। কিন্তু ‘সাগরকন্যা’ তো বাস্তব নয়। বললাম আমি।
সন্ন্যাসী বলল, জানা গেছে, সে একটা জাহাজ ডুবির ফল। তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ উত্তর পাশ দিয়ে গুয়েতেমালার দিকে যাবার পথে একটা জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরে জানা গেছে, জাহাজটি পশ্চিম এশিয়ার কোন এক আরব দেশের। জাহাজ থেকে আর কেউ বেঁচেছে কিনা জানা যায়নি, তবে একজন শিশুকন্যা বেঁচেছিল। শিশুকন্যাটি একটা ডলফিনের পিঠে ভাসছিল। ডলফিন গিয়ে ভেড়ে পলিনেশীয়ার কোন দ্বীপে। সে দ্বীপেরই বনচারী, সাগরচারী একটা পরিবার শিশুকন্যাকে ডলফিনের পিঠ থেকে নিয়ে নেয়। তারাই তাঁর নাম রাখে ভাইমতি বা সাগরকন্যা। আর তাঁর গলার লকেটে পাওয়া নামের পাঠোদ্ধার করে সেটা এভাবেই এসেছে। শিশু ভাইমতি শাবানু একদিন বড় হয়। বন ও সাগর হয় তাঁর বাধা-বন্ধনহীন বিচরনের ক্ষেত্র। পাখির মতই সে ঘুরে বেড়ায় বনে ও সাগরে। সাগরকন্যা শেষ পর্যন্ত সাগরকন্যাই হয়ে যায়। এই সাগরকন্যার সাথেই একদিন দেখা হয় সাগরচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানার সাথে। প্রথম দর্শনেই স্রষ্টার ইচ্ছায় তাঁরা একে অপরের হয়ে যায়। এই কাহিনী আমি শুনেছি পূর্ব তাহিতির এক বৃদ্ধ জেলের কাছে। আমি নিশ্চিত, এই কাহিনির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন নেই। বিকল্পও নেই এই কাহিনীর। থামল একটু গুরু সন্ন্যাসী। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, তরুন সন্ন্যাসী বল, আর কোন কথা, আর কোন প্রশ্ন?
আমি বললাম, না, আর কোন প্রশ্ন নেই গুরু সন্ন্যাসী। আমি চলে এসেছিলাম গুরুজির কক্ষ থেকে।
তারপর এক সময় আমিও গিয়েছিলাম তাহানিয়া দ্বীপে সেই সফেদ ফুল গাছের ঝোপের সন্ধানে। সেই ঝোপ পাইনি। ঝোপ না পাওয়ায় আমার আগ্রহ কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল, পাথর ও প্রাসাদ ঐভাবে আছে কিনা তা দেখার জন্যে। অনেক দিনের অনেক খোঁজাখুঁজি, অনেক খোঁড়াখুঁড়ির এক রাতের শুভ ভোঁরে দু’হাত মাটির গভীরে পেয়ে গেলাম সেই গোলাকার সফেদ পাথর। পাথর পাওয়ার সাথে সাথে আমার গুরু সন্ন্যাসীর মত সব পাওয়া হয়ে গেল। সফেদ পাথর সরিয়ে ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারে’ প্রবেশ করতে মন চায়নি। ঘর-দোর ছাড়া পথের সন্ন্যাসী প্রাসাদ দিয়ে কি করব। যে কৌতূহল ছিল সেই কৌতূহল মিটিয়ে চলে এসেছি। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
আমি গোগ্রাসে যেন গিলছিলাম তাঁর কথা এবং তাঁর গুরু সন্ন্যাসীর কথা। মনে হছিল আমি যেন, স্বর্গের চাবি পেয়ে গেছি। আমি অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে গত তিন দিন ধরে যা খুজছিলাম, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি যেন পেয়ে গেছি। আনন্দ উত্তেজনায় মনে হল হার্টবিট আমার বেড়ে গেছে!
কথা শেষ করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী পাথরের বেঞ্চির উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বুজে গিয়েছে তাঁর।
আমিও কোন কথা বললাম না।
নীরব আমরা। বয়ে চলল সময়। এক সময় চোখ খুলল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
তাকাল আমার দিকে। বলল বৎস ‘প্যালেস অফ ওয়েলফেয়ার’ তোমার কাজে লাগবে। সৃষ্টির উপর গবেষণা ভালো জিনিস। এটা হয় মানুষের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব, তুমি প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। তুমি যেমন চাও প্রাসাদটি সে রকমই। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
স্বর্গ যেন কেউ আমার হাতে তুলে দিল।
আমি উঠে গিয়ে সন্ন্যাসিকে আভূমি প্রণাম করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুয়ে বললাম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই দানের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দু’হাত জোর করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, সন্ন্যাসীদের জন্যে কোন কৃতজ্ঞতা নেই। কৃতজ্ঞতা সব ঈশ্বরের জন্যে।
বলে আবার চোখ বুজল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। চোখ বুজে থেকেই বলল, যাও বৎস, ঈশ্বরের সম্পদ ঈশ্বরের জন্যে ব্যবহার কর। আমাদের হারানো ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যদের ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’-এর যথার্থ ব্যবহার কর। ঈশ্বরের মত ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালবাস। তাহলে তাঁর রোষের মুখোমুখি তোমাকে কোনদিন হতে হবেনা।
আরও কোন নসিহত শোনার ভয়ে তাড়াতাড়ি তাকে একটা প্রণাম করে আমি চলে এলাম।
সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সুপ্রিম বস আলেক্সি গ্যারিন।
বৈঠকে উপস্থিত পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীসহ চীপ অব অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরী পিনপতন নিরবতার মধ্যে আনন্দ, বিস্ময় ও কৌতূহলের সাথে আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনছিল। আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হলেও শ্রোতাদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। বাস্তব ঘটনা যে রুপকথার চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে, এ কাহিনী তারই প্রমান।
আলেক্সি গ্যারিন দীর্ঘ কথা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তবে শীঘ্রই সোজা হয়ে বসল। বলল, কাহিনী একটু দীর্ঘ হলেও তা তোমাদের বললাম, কিভাবে এই ঐতিহাসিক রাজকীয় প্যালেস পেলাম আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ঈশর দিবে আমি বিশ্বাস করিনা। আমাদের প্রাপ্য বলে আমরা এটা পেয়েছি। বলে একটু থামল। মুহূর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ঐতিহ্য ও নীতি-নৈতিকতায় আমি বিশ্বাস করিনা। সে জন্যই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী যে নীতি- নৈতিকতার উপদেশ আমাকে দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের প্রিয় ‘মু’ মহাদেশের রাজকীয় প্রাসাদের অংশ ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ বলে কথিত প্রাসাদটিই আজ আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’।
ওয়েলফেয়ার কি জন্যে? ওয়েলফেয়ার প্রয়োজন দুর্বলদের। দুর্বলদের জন্যে আমাদের কিছু করার নেই বরং আমরা দুনিয়ার সবাইকে দুর্বল বানাতে চাই। শুধু সবল থাকবে, শক্তিশালী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও সকল ক্ষমতার কেন্দ্র হবে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আলেক্সি গ্যারিন আবার বলল, বহু কষ্টে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ আমরা পেয়েছি। এর নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ প্রাইওরিটি। আহমদ মুসা কোন মিশন নিয়ে এখানে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সাথে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সে আমাদের চিনেছে, জেনেছে তাঁর কোন প্রমান আমি পাইনি। তবে তাঁর সাথে আমাদের সংঘাত শুরু হওয়ায় ধরে নেয়া যায় তাঁর মত বুদ্ধিমান লোক সবকিছুই জেনে যাবে।এটা অবধারিত ধরে নিয়েই আহমদ মুসাকে শেষ করার জন্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। বিপদ সম্পর্কে সবাইকে জানানো ও করনীয় ঠিক করার জন্যেই আজকের বৈঠকের আয়োজন। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভেঙ্গে বলল একজন শীর্ষ নির্বাহী, মাই লর্ড, আপনি যা বলেছেন সেটাই আমাদের করনীয়। শয়তানটাকে শেষ করার লক্ষ্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে চীপ অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরীকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি অপারেশন টীম গঠন করা হলো। এই টীম যাবতীয় উপায়-উপকরন ব্যবহার করবে এবং আহমদ মুসাকে খুঁজে বের করে, তাকে সার্বক্ষণিক নজরে রেখে যতটা সম্ভব শীঘ্রই তাকে শেষ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে তাঁর লাশও কিন্তু আমাদের পেতে হবে। সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করে দেখামাত্র তাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে হবে।
সবাই মাথা নাড়ল। কিন্তু মাথা নাড়তে পারল না গৌরী।
একটা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
কি দোষ আহমদ মুসার? তাকে আমরা কিডন্যাপ করতে গেছি। সেটা করতে গিয়ে আমাদের পাঁচজন মরেছে। সে তো আত্নরক্ষা করেছে মাত্র! সে তো আমাদের আক্রমন করেনি। তাহলে দেখামাত্র গুলী কেন? তাকে না দেখলে, তাঁর ভেতরটা না জানলে এ প্রশ্ন তাঁর মনে হয়ত আসতো না। লাশ নেবে কেন আর তাঁর লাশ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট বিক্রিই বা কেন করবে?
এসব নানা কথা, নানা প্রশ্ন গৌরীকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তাই তাঁর লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথায় সে সায় দিতে পারেনি।
টিমের কাজ শুরু হবে আজ এই মুহূর্ত থেকে। গুড নাইট সকলকে। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফ্লোরের ভেতরে থেকে কালো টিউব উঠে এল। আলেক্সি গ্যারিনের চেয়ারের চারদিক ঘিরে দেয়ালের মত উঠে এল টিউবটা। উঠে চলল ছাদ ফুঁড়ে উপরে।
বৈঠকের সবাই উঠে বাউ করে দাঁড়িয়েছিল।
টিউব-লিফট উপরে অদৃশ্য হয়ে গেলে শীর্ষ নির্বাহী পাঁচজনের একজন গৌরীকে লক্ষ্য করে বলল, আমরা উঠতে পারি, ম্যাডাম গৌরী?
গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের পিএ এবং আলেক্সি গ্যারিনের ব্যক্তিগত বাহিনীর কমান্ডার হলেও আলেক্সি গ্যারিনের অনুপস্থিতিতে সেই তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারিয়েটও গৌরী দেখে। ফলে উপরের সবার চেয়ে গোপন বিষয় সে বেশি জানে। আরেকটা বিষয়ও সকলে ওপেন সিক্রেট আকারে জানে এবং সেটা হলো, গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের স্ত্রী নয় তবে ডি-ফ্যাকটো স্ত্রী হিসাবে রয়েছে। এই বিষয়টি গৌরীর জন্যে খুবই স্পর্শকাতর। পরোক্ষভাবেও গৌরী কোন সময় এ ধরনের কথার মুখোমুখি হলে খুবই রিঅ্যাক্ট করে। এমন ক্ষেত্রে লুকিয়ে তাকে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ের সবাই এক সময়ের পূর্ব মার্লিন এলাকার রুশ বংশোদ্ভূত মেয়ে গৌরীকে সমীহ করে চলে। গৌরী যেমন অসম্ভব সুন্দরী, তেমনি সাহসী, বুদ্ধিমতি, ক্ষিপ্র ও দারুন উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। Rise and fall of the dynasties of the world, বিষয়ের উপর পিএইচডি গৌরীর। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনা করার কথা ছিল। কিন্তু গৌরী প্রকৃতিগতভাবে সাহসী ও বেপরোয়া বলেই সাজানো একটা খুনের মামলার আসামী হয়ে তাকে পলাতক হতে হয়। এই অবস্থায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাকে রিক্রুট করে। সাহস, মেধার জোরেই সে ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ে উঠেছে।
মাই লর্ড চলে গেছেন। মিটিং শেষ হয়েছে। আপনারা অবশ্যই যেতে পারেন। বলল গৌরী।
এখনই একটা মিটিং সেরে ফেলতে পারি।বলল জিজর।
ঠিক। মাই লর্ড তো এখন থেকেই কাজ শুরু করতে বলেছেন। ডারথ ভাদের বলল।
এ ধরনের মিটিং-এর জন্যে প্রস্তুতি দরকার। তবে একটা প্রাথমিক আলোচনা হতে পারে। বলল গৌরী।
পাশের আরেকটা কক্ষের একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা আলোচনা শুরু করল।
মিটিং চলল প্রায় একটা ঘণ্টা।
মিটিং শেষে বেরিয়ে আসার সময় গৌরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ৪টা। হাসল গৌরী। তাঁদের সব কাজ রাতেই। নামটা তাঁদের সার্থক।
গৌরী তাঁর কক্ষে যাবার জন্যে এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছিল। তাঁর মোবাইল বেজে উঠল। থমকে দাঁড়ালো গৌরী।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল স্বয়ং তাঁর লর্ডের কল। তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, কোন হুকুম?
তুমি এখনই একটু আমার বাংলোতে চলে এস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
অস্বস্তি, একটা অসহায়ত্ব যেন ছায়া ফেলল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি আসছি।
বলে গৌরী অন্য একটি বিশেষ এলিভেটরে উঠল। সংগে সংগেই তা চালু হয়ে গেল। এ এলিভেটর সরাসরি গেছে আলেক্সি গ্যারিনের বেডরুমে। এ এলিভেটর তাঁর ইচ্ছাতেই মাত্র চলে।

Top