৫২. ক্লোন ষড়যন্ত্র

চ্যাপ্টার

গৌরীর ডাইরীর পাতা উল্টিয়ে চলেছে আহমদ মুসা।
ডাইরির পাতার দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত লেখা।
বিস্মিত্ আহমদ মুসা! স্বগত কন্ঠে বলল, তবে যে গৌরী বলল সুড়ঙ্গে আমাকে প্রবেশ করতে দেখে সে ডাইরি লিখেছে, যা পড়ার জন্যে আমাকে বলেছে। কিন্তু পনের বিশ মিনিটে কি কেউ এতটা লিখতে পারে!
ডাইরির পাতা উল্টিয়েই চলল আহমদ মুসা।
ডাইরির পাতার দুই-তৃতীয়াংশের মত শেষ হলো।
শেষের কয়েকটা পাতা লাল কালিতে লেখা।
আহমদ মুসার বুঝার বাকি রইল না নিশ্চয় এই লাল কালির লেখাগুলোই গৌরী তার জন্যে লিখে গেছে।
পড়া শুরু করল আহমদ মুসা:
‘আমার নিজের কথা শেষ করতে পারলাম না। তোমাকে সুড়ঙ্গে দেখে…, মনে কিছু করো না ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করলাম। তোমাকে সেদিন হোটেলে দেখার পর থেকেই কেন জানি মনে হচ্ছে, শত বছরের চেনা তুমি আমার, যাকে ‘আপনি’ বলে দূরে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। যে কথা বলছিলাম, তোমাকে সুড়ঙ্গে দেখার পরেই আমার মনে হলো আমার সময় শেষ। তোমাকে আমার সাহায্য করতেই হবে। সেটা শুধু তোমার জন্যে নয়, আমার জন্যেও। আমার কথা, যা এ পর্যন্ত লিখেছি, পড়লে দেখতে পাবে, আমি আমাকে, আমার পরিবারকে মুক্ত করার জন্যে ব্ল্যাক সানে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে সবই হারিয়েছি। তুমি আর কি কি করবে সব আমি জানি না, কিন্তু তুমি আমার সেভিয়ার তা নিশ্চিত। তোমার দ্বারা মুক্তি ঘটবে আমার আত্নার, এই অন্ধকার জীবন থেকে। আমি আনন্দিত। দু:খ আমার একটাই আমার পরিবারকে আমি রক্ষা করতে পারলাম না। এই রক্ষা করতে না পারার দু:খ আমার, সে কথা তোমাকে বলার জন্যেই আমার এই লেখা।
সেটা আমার পরিবারের চরম দুর্ভাগ্যের কাহিনী, আমার আতংকের কাহিনী।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের আতংক আমার মাকে নিয়ে। আমার ২২ বছর বয়স পর্যন্ত মাকে নিয়ে আমার এই আতংক মনে জাগেনি। আমার মা আমাদের পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা দু’বোন ও আমার বাবার প্রাণ যেমন আমাদের মা, তেমনি আমরাও তার প্রাণস্বরূপ। অত্যন্ত সুখী ছিল আমাদের পরিবার।
আমার নির্মেঘ এই সুখের আকাশে প্রথম কালো মেঘ মাথা তুলল, আমার ২২ বছর বয়সে, যা আগেই বলেছি। শিক্ষা জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে সবে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি একজন জুনিয়র অধ্যাপক হিসাবে। শুরুর দিকে বাড়ি থেকে গিয়েই ক্লাস নিতাম, রাইন হাইওয়ে ও রাইন রেল কমিউনিকেশন এত সুন্দর যে, আমাদের বাড়ি থেকে বনকে ‘নেক্সট ডোর’ বলে মনে হতো। এর ফলে বাড়িতে অনেক বেশি সময় দিতে পারতাম। প্রথম ঘটনাটা ঘটল এই সময়ের এক রোববারে। দিনটা ছিল মেঘলা-যে কোন সময় বৃষ্টি আসবে এরকম অবস্থা। দু’তলায় আমার শোবার রুম থেকে নামছিলাম, নামতে নামতে দেখলাম সিঁড়ির জানালা খোলা। এগিয়ে যেয়ে জানালা বন্ধ করলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির ধাপের দিকে আসছিলাম। দেখলাম আমার আম্মার শোবার ঘরের পাশে তার ড্রেসিং রুমের ছোট ভেন্টিলেশনটা খোলা, যা সব সময় ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। বুঝলাম, সাপ্তাহিক ক্লিনিং-এর সময় নিশ্চয় ক্লিনার বেচারা ভেন্টিলেশনটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।
আমি ভেন্টিলেটরের দিকে এগোলাম। ইচ্ছা ছিল, মাকে ডেকে দেখি, যদি তিনি ঘরে থাকেন, তাহলে ভেন্টিলেটর বন্ধ করতে বলব।
ছোট্ট জানালা দিয়ে আমি উঁকি দিলাম।
এ জানালা দিয়ে মা’র ড্রেসিং রুমটা দেখা যায়। এর পরেই মায়ের বেড রুম।
ভিতরে তাকিয়েই অপার বিস্ময় নামল আমার চোখে-মুখে! মায়ের মাথা ভরা কালো চুল খোলা, এলোমেলো। হেয়ার ড্রাইয়ে শুকাচ্ছেন। বিস্ময়ে আমার দুই চোখ ছানাবড়া- মায়ের মাথা থেকে সাদা চুল কোথায় গেল! তার মাথার সামনের দিকে অন্তত কয়েক গুচ্ছ চুল সাদা। তিনি চুলে কালার ব্যবহার কোন সময়ই করেন না। তাহলে সাদা চুল গেল কোথায়? কৌতুহল আমার তুংগে। জানালা থেকে সরে আসতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু হলো না আসা। মা ড্রেসিং টেবিলে বসে ছিলেন। দেখলাম, তিনি দ্রুত ড্রয়ারের লক খুলে ছোট একটা বক্স বের করলেন। বক্সটি দ্রুত খুললেন। সাদা কালারের মত কিছু বের করলেন। তারপর সাদা কলপটি তুলে নিয়ে খুব যত্নের সাথে নির্দিষ্ট কয়েকটা গুচ্ছের উপর সাদা রংয়ের স্প্রে শুরু করলেন। অবাক বিস্ময়ে আমি দেখলাম, তার মাথার সামনের নির্দিষ্ট কয়েক গুচ্ছ চুল সাদা হয়ে গেল, যেমনটা আমরা দেখে আসছি।
ডায়িংটা ধীরে ধীরে শেষ করার সংগে সংগেই মা ডায়িং উপকরণগুলো ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে দরজা খুলে ড্রেসিং রুমের বাইরে চলে গেলেন। কৌতুহল ও বিস্ময় আমাকে এতটাই বিব্রত করেছিল যে, আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমিও নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। ডাইনিং-এ মায়ের সাথে আমার দেখা হলো। বিষয়টা নিয়ে তাকে কিছু বলতে গিয়েও গলায় আটকে গেল। মন যেন কোন কারণে প্রবল বাধা দিল!
আরেক দিনের ঘটনা। আমি মায়ের স্টাডি রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মায়ের একটা কথায় থমকে দাঁড়ালাম। তিনি বলছিলেন, ‘কি বলছ তুমি, আমি তো সবচেয়ে কষ্টে আছি! আত্নঘাতি অভিনয় করছি আমি। তাড়াতাড়ি শেষ করো।’
কথাগুলো আমার কানে পৌঁছার সাথে সাথে আমার গোটা দেহে দেহ অবশকারী এক ঠাণ্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল!
আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম, মা টেলিফোনে কথা বলছেন স্টাডি টেবিলে বসে।
আর শোনার ধৈর্য আমার ছিল না।
আমি সরে এলাম।
আমি ভেবে কুল পেলাম না। মা কী কষ্টে আছেন? কি আত্নঘাতি অভিনয় করছেন মা? কার সাথে টেলিফোনে কথা বলছিলেন তিনি?
প্রশ্নের কোন শেষ নেই! উত্তর নেই একটারও। এই সময় একদিন রাইনের তীরে নিরিবিলি একটা বেঞ্চিতে বসেছিলাম। একটু নিচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছিল রাইনের শান্ত স্রোত। ভাবছিলাম মাকে নিয়েই। যতই ভাবি ততই মায়ের বিভিন্ন অসঙ্গতি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সেদিন মায়ের বাম হাতের বুড়ো আঙুলে একটা কাটা দাগ দেখলাম। দাগটা প্রথম দেখলাম। তার হাত নিয়ে কত খেলা করেছি এ দাগ কখনো দেখিনি! দাগটা কিন্তু পুরাতন। এত দিন চোখে পড়েনি কেন? অল্প সময়েই আরেকটা বিষয় আমার নজরে পড়েছে। সেটা হলো, মা এখন আমাদের অতীত জীবন মানে ছোটবেলা নিয়ে কোন সম্প্রীতির গল্প বলেন না। অথচ আমাদের পরিবারিক গল্পগুজবে ও আমাদের ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট কথাবার্তাতেও আমাদের ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা ও কথাবার্তা আগে বলতেন। এখন মাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলতে শুনি না।
এসব চিন্তার মধ্যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এ সময় একটা কন্ঠ আমার কানে গেল, ‘মা, বসতে পারি?’
মাথা তুলে দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, ‘বসুন বাবা।’
বাবা এ সময় রাইনের তীর ধরে নিয়মিত হাঁটেন। আজকেও হাঁটছিলেন। আমাকে দেখেই সম্ভবত থেমেছেন।
বাবার সাথে কথা শুরু হলো। আবহাওয়া নিয়ে, এলাকার অবস্থা নিয়ে, শেষে আমার চাকরি, আমার বোনের লেখাপড়া নিয়ে অনেক কথা হলো। শেষে আলোচনা আমাদের মা ও পরিবার বিষয়ে গড়াল। এক সময় বাবা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে, বললেন, ‘তোমরা বোধ হয় খেয়াল করনি মা, তোমার মা’র সেই যে অসুখ হলো, হামবুর্গ হাসপাতালে থাকল, তারপর তার শরীর-স্বাস্থ্যের খুবই উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সে যেন বদলে গেছে মা।’
আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললাম, ‘তাই মনে করেন বাবা?’
‘তাই তো মনে হয়। অতীত যেন তার কাছে মুছে গেছে, অথচ ব্রেনের স্ক্যান আমাদের মেডিকেল ফাইলে আছে। ওদিক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ সে।’ বললেন বাবা।
‘তাহলে বাবা?’ আমি বাবার যুক্তিগুলো জানতে চাইলাম, যাতে আমার পাওয়া তথ্যের সাথে তা মেলানো যেতে পারে।
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মা। তবে আমি নিশ্চিত, তার দেহ, মন সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে।’ বলল বাবা।
আমি চমকে উঠলাম। বাবা কি বলছেন বুঝলাম না। তিনিই তো মায়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। সবই তিনি জানবেন। বাবার মুখের দিকে চাইতে পারলাম না। কিছু বলতেও পারলাম না আমি। বিস্ময়, বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গেল।
বাবাই কথা বললেন, ‘থাক মা এসব কথা। তুমি আমার বড় সন্তান, তাই তোমাকে আমি একথা জানালাম। তুমি এ কথাগুলো তোমার মধ্যেই রাখবে।’
বাবা উঠলেন। বললেন, ‘চল মা, বাসায় ফিরি।’
আমাদের বাসা ব্রুমসারবার্গ দূর্গ থেকে কয়েকশ’ গজ উত্তরে রাইনের তীরেই। আমাদের বাড়িটাও ব্রুমসারবার্গ দুর্গেরই একটা অংশ। ব্রুমসারবার্গ দুর্গের মালিকানা আমাদেরই ছিল। আমার নানী তার দাদুর কাছে শোনা অনেক গল্প বলতেন। নবম শতকে স্যাক্সনদের প্রথম রাজা হেনরি ও স্যাক্সনদের প্রথম সম্রাট অটো দি গ্রেটরা আমাদের পূর্বপুরুষ। তাদের দুর্গ ও প্রাসাদ ছিল এই ব্রুমসারবার্গেই। শুরুতে এর নাম ছিল দি নিডারবার্গ। ঊনিশ শতক পর্যন্ত অধিকাংশ সময় এই দুর্গ এই অঞ্চলের বিশপের অধীন ছিল। বিভিন্ন সময় নাইটরা এখানে এসে বাস করতো। এক সময় এটা তাদের দখলে চলে যায়। তবে আমাদের পূর্বপুরুষের ব্রুমসারবার্গ দুর্গ তাদের দখলে গেলেও এ দুর্গের কিছু দূরের আরেকটি প্রাসাদ আমাদের পারিবারিক দখলে থেকে যায়। এ প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল ১১৮০ খৃস্টাব্দে অটো দি গ্রেটের পৌত্র ডিউক হেনরি দি লায়নের জন্যে। হেনরি তার চাচাত ভাই সম্রাট ফ্রেডারিক রোমার আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন এবং স্যাক্সন-সম্রাট অটো দি গ্রেটের রাজা দুই ভাগ হয়ে যায় তাদের মধ্যে। সেই থেকে ডিউক হেনরির এই বাড়িটি নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে আমাদের পারিবারিক দখলে রয়ে গেছে। এছাড়াও রাইনের এপার-ওপারে দশ হাজার একরের একটা ফার্মল্যান্ড আছে আমাদের। অতীত সাম্রাজ্যের এই একটাই স্মৃতিচিহ্ন আমাদের।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাড়ি পৌঁছলাম।
ভিতরে ঢুকে অবাক হলাম। জিনিসপত্র সব লণ্ডভণ্ড।
প্যাকিং চলছে।
বাইরের ড্রয়িংই রুমেই আম্মা বসে আছেন।
আমরা ভিতরে ঢুকতেই আম্মা বসে থেকেই বলল বাবাকে লক্ষ্য করে, ‘তোমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারলে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। কাল সকালেই আমরা বনে শিফট হচ্ছি।’
‘সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছ?’ বলে আর কিছু না বলে বাবা তার ঘরের দিকে চলে গেলেন। অনেক দিন থেকেই মা জেদ ধরেছেন সবাইকে নিয়ে বনে গিয়ে থাকবেন। খুব সাধারণ হলেও থাকার মত বাড়িও কিনেছেন। তার যুক্তি, ছোট মেয়ে বনে লেখাপড়া করে, বড় মেয়ে বনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে। সুতরাং বনে থাকাই ভালো। মা’র এ প্রস্তাবে আমরা কেউ রাজি হইনি। বাড়ি ও ফার্মল্যান্ড আমাদের প্রাণ। এসব ছেড়ে বনে গিয়ে থাকার কোন যুক্তি নেই। কিন্তু মা আমাদের কথা মেনে নেননি। অবশেষে তার জেদই তিনি রাখলেন।
‘হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কি ঠিক হলো মা? কোথাও থাকার বিষয়টা তো সকলের।’ বাবা চলে যেতেই বললাম আমি।
‘চুপ করো। এ নিয়ে আর কোন কথা বলব না আমি।’ বলল মা।
‘এ তোমার জেদ মা। এত বড় বাড়িটার কি হবে?’ বললাম আমি।
‘সে ব্যবস্থা আমি করেছি। ফার্মল্যান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাদের দিচ্ছি, তারাই থাকবে এ বাড়িতে। এর জন্যে আলাদা পয়সা পাওয়া যাবে।’ মা বলল।
‘ব্যবস্থা তুমি কবে করলে মা? বাবা জানেন?’ বললাম আমি।
‘আমি যখন ওদের সাথে কথা বলি, তখন উনি আমার সব কথাই শুনেছেন।’ মা বলল।
‘বাবা কিছু বলেনি?’ বললাম আমি।
‘তোমার বাবার জন্যে বলার তেমন কিছুই ছিল না।’ মা বলল।
মা’র কথা আমার কানে খুব বাজল। মনে হলো বাবার কোন অবস্থানই তাঁর কাছে নেই। আমি চমকে উঠলাম। মা তো এমন ছিলেন না! বাবার মত নেয়া ছাড়া মা পরিবারের ছোট-খাট সিদ্ধান্তও নিতেন না। আমি চমকে উঠলাম ভীষণভাবে। মা কি বদলে গেছেন, বাবা যেমন বললেন? কিন্তু মা কি এভাবে বদলাতে পারেন? না, পারেন না। তাহলে?
পরদিন সকালে ব্রুমসারবার্গের আমাদের বাড়ি থেকে যাবার মুহূর্ত। মালপত্র সব চলে গেছে।
আমরাও যাবার জন্যে প্রস্তুত। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি গাড়ি।
আমাদের দু’টি, অন্যটি অপরিচিত।
‘ঐ গাড়িটি কেন?’ আমি বললাম।
আমার পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ‘আমি এনেছি।’
‘কেন? দু’টি গাড়িই তো আমাদের দরকার হয় না।’ আমি বললাম।
‘আমি হামবুর্গ যাচ্ছি মা, বন যাচ্ছি না।’ বলল বাবা।
হামবুর্গ আমার বাবার পৈত্রিক বাড়ি। উল্লেখ্য, ব্রুমসারবার্গ প্রাসাদ ও দশ হাজার একরের ফার্মল্যান্ড আমার মায়ের পৈত্রিক সম্পত্তি। এত বড় সম্পত্তি অরক্ষিত থাকবে এই কারণে মায়ের একান্ত অনুরোধ বিয়ের পর বাবা ব্রুমসারবার্গে এসে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন।
বাবার কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
আমি রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে মা’র দিকে তাকালাম। বললাম, ‘মা, বাবা হামবুর্গ যাচ্ছে? কেন?’
মা মুখ তুলল না। যেমন ছিল, তেমন থেকেই বলল, ‘আমি কিছু জানি না।’
বলে মা বাবার দিকে তাকাল। বলল, ‘সত্যি তুমি হামবুর্গ যাচ্ছ?’ মা’র নির্বিকার কন্ঠ। যেন কিছু্ই না বিষয়টা-এমন স্বাভাবিক মুখ তার!
‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’ বলল বাবা খুব স্বাভাবিক কন্ঠে।
মা শুনল। কিছুই বলল না। আমার মনে হলো তার মুখে বিস্ময় ও বিব্রত হওয়ার চাইতে স্বস্থির একটা উজ্জ্বলতাই ফুটে উঠেছে।
বিস্ময় আমাকে অভিভূত করে তুলল। মায়ের হলো কি? আমার মা এমন করতে পারেন না। আমার মা এমন নন। আমি ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। বললাম, ‘মা, বাবা কেন একা হামবুর্গ যাবেন? তাঁকে নিষেধ করছ না কেন?’
‘তোমার বাবা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি স্বাধীন। আমি কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করব না।’ বলল আমার মা।
আমার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। মনে হলো এটা আমার মায়ের কন্ঠ নয়।
কথা বলেই মা গাড়ির দিকে চলল।
আমি ছুটে গেলাম বাবার কাছে। বললাম, ‘বাবা তোমার হামবুর্গ যাওয়া হবে না, তুমি আমাদের সাথে বন যাবে।’
বাবা ম্লান হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা তোমরা মন খারাপ করো না। হামবুর্গ তো বেশি দূর নয়। তোমরা মা’র সাথে বন যাও।’ বাবার শান্ত, স্থির কন্ঠস্বর।
‘আলিনা, তাড়াতাড়ি এস।’ ওদিক থেকে মা আমাকে ডাকল।
হঠাৎ আমার বুকে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। মা সুস্পষ্টভাবে বাবাকে এড়াতে চাইছেন। কেন?
আমি ছুটে পেলাম মায়ের কাছে। তার দু’হাত ধরে অনেকটা চিৎকার করে বললাম, ‘মা, তুমি এমন করছ কেন? কি হয়েছে তোমার?’
মা একটা হ্যাঁচকা টানে তার দুই হাত ছাড়িয়ে নিল। গাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘যাও গাড়িতে গিয়ে ওঠ।’
হাত টেনে নিতে গিয়ে মা’র আঙুল থেকে একটা আংটি খুলে পড়েছিল মাটিতে। সেটা তুলে নেবার মত মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। আমি মার দিকে এক ধাপ এগিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললাম, ‘আমরা দু’বোন কি বাবার সংগে যাব?’
‘আমি কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করব না।’ তীব্র কন্ঠে মা বলল।
মার কথা তীরের মত গিয়ে বিদ্ধ হলো আমার বুকে। এবার কিন্তু ক্ষোভ নয়, জগৎ-জোড়া বিস্ময় নামল মনে! মা কি বাবার মত আমাদেরকেও এড়াতে চাচ্ছেন?
আমি পিছু হটলাম। মা’র গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি পেছনে হটে মা’র পড়ে যাওয়া আংটি মাটি থেকে তুলে নিলাম। এগোলাম আমাদের গাড়ির দিকে। গাড়ির পাশে আমার ছোট বোন ব্রুনা চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে পাথরের মত স্থির দাঁড়িয়েছিল! আমি তাকে নিয়ে গাড়িতে বসলাম।
মা’র গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে। আমাদের গাড়িও স্টার্ট নিল। ড্রাইভ করছে ব্রুনা।
বাবার গাড়ি তখনও দাঁড়িয়ে।
আমি পেছনে তাকিয়ে বাবার দিকে হাত নাড়লাম।
বাবাও আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেও হাত নাড়ল।
আমাদের পরে বাবার গাড়িও স্টার্ট নিতে দেখলাম।
বন চলে এলাম। সেদিনেরই রাত।
ঘরটা গুছিয়ে নেবার পর বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখছিলাম। যাচ্ছিলাম মায়ের বেড রুমের দরজার সামনে দিয়ে। মায়ের কন্ঠ পেলাম। কথা বলছেন কারও সাথে।
দরজায় দাঁড়ালাম। খোলা দরজা।
মা’র কন্ঠ ভেসে আসছে’.. পারব না কেন? আমি বিন্দী ব্রিজিটি। বুকে চেপে বসা বুড়ো শয়তানটাকে সরিয়েছি। বাকি থাকল অপগণ্ড দু’টি মেয়ে। ওদের মাইনাস করতে সময় লাগবে না।’
একটু নিরবতা। নিশ্চয় ফোনের অপর প্রান্ত কথা বলছে।
আবার কথা বলে উঠল মায়ের কন্ঠ: ‘ইয়ার্কি করছ? বুকে চেপে বসা নয়তো কি? নিজেকে তুলে দিয়েছি আরেকজনের হাতে। নেকড়েরা চিবিয়ে খেয়েছে আমাকে। বিষ পান করেছি দিনের পর দিন। তোমাদের স্বার্থে সব করেছি আমি। কিন্তু সে অনুভূতি তোমার নেই, তোমাদের নেই।’ শেষের দিকে অভিমানক্ষুদ্ধ মায়ের কন্ঠ।
গোটা শরীর আমার কাঁপছিল। মায়ের কথা আর শোনার প্রবৃত্তি হলো না। যা শুনেছি, তা গোটা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। মা নিজের নাম ‘বিন্দা ব্রিজিটি’ বললেন কেন? বাবাকে কি ‘বুড়ো শয়তান’ বলা হলো! বাবা কি তার বুকে চেপে বসে ছিলেন। বাবা কি ‘আরেক জন’ হলেন! মা কার স্বার্থে কি করছেন? ‘তোমাদের’ বলতে কাদের বুঝিয়েছেন?
আমি শিথিল পায়ে টলতে টলতে নিজের ঘরে চলে এলাম। মনে পড়ল মার কালো চুলে সাদা রং করার কথা। কিছুদিন আগে টেলিফোনে বলা মায়ের সেই কথাও। তিনি সবচেয়ে কষ্টে আছেন, আত্নঘাতি অভিনয় করছেন তিনি।
নিজের ঘরে ঢুকেই বেডের উপর নিজেকে ছুঁড়ে ছিলাম। শুয়েই দেখতে পেলাম আমার ছোট বোন ব্রুনা ব্রুনহিল্ড সোফার এক কোণে গুটি মেরে বসে আছে। চোখে-মুখে তার ক্ষোভের আগুন।
আমার ছোট বোন ব্রুনা ব্রুনহিল্ড বন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। খুব চঞ্চল, খুব মুখরা। সেই ব্রুনা যে ব্রুমসারবার্গের ঘটনা থেকে এ পর্যন্ত চুপ করে আছে, এটা বিস্ময়ের।
আমার মনের অবস্থা সামলে নিয়েছি। বললাম, ‘কিরে ব্রুনা, এখানে এসে চুপ করে বসে আছিস কেন?’
সে উঠে গটগট করে আমার বেডে আমার পাশে এসে বসে বলল, ‘আমি তোমার অপেক্ষা করছি।’
‘কেন? তোর ঘরের সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়েছিস?’ বললাম আমি।
‘না।’ বলল ব্রুনা।
‘তাহলে এখানে বসে কি করছিস? তোর জিনিসপত্র ঠিকঠাক রাখা হয়েছে কিনা দেখে নিবি না?’ আমি বললাম।
‘রাখ এসব। বল এসব কি হচ্ছে?’ বলল ব্রুনা। বিক্ষুদ্ধ কন্ঠ তার।
‘কিসের কথা বলছ তুমি?’ আমি বললাম।
‘মায়ের কি হয়েছে?’ মা এসব কি করছেন?’ বলল ব্রুনা তীব্র কন্ঠে।
‘আস্তে কথা বল ব্রুনা। নিজেকে সংযত কর।’ আমি বললাম।
‘না, আস্তে কথা বলব না। মা! আমাদের মা নেই। বদলে গেছেন। তিনি এখন অন্যের হাতে।’ বলল ব্রুনা। ক্ষোভ, আবেগ, উত্তেজনায় তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছিল।
আমি চমকে উঠেছিলাম তার শেষ কথায়! আমি উঠে বসে তাকে কোলে টেনে নিয়ে বললাম, ‘আস্তে আস্তে কথা বল! এটা তুমি কি বললে? মা অন্যের হাতে মানে?’
ঠিক তাই আপা। গতকাল যাদেরকে আমাদের বাড়ি ও ফার্মল্যান্ড দেখাশুনা করতে দেয়া হয়েছে তাদের একজন এসেছিল। তখন তুমি ও বাবা বাসায় ছিলে না। মা’র সাথে লোকটি নিরিবিলি কথা বলেছে। এসেই লোকটি মাকে যেভাবে সম্বোধন করেছে, তা আপত্তিকর। আমার কৌতুহল হওয়ায় আমি আড়ালে লুকিয়ে তাদের কথা শুনেছি…।’
ব্রুনার কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, আপত্তিকর বিষয়টা কি ব্রুনা?’
‘লোকটি মাকে ডারলিং বলে সম্বোধন করেছে!’ বলল ব্রুনা।
বুকে প্রচণ্ড এক খোঁচা লাগল। এতদিনের সব বিষয় সব সত্য ওলট-পালট হয়ে গেল।
আমি কিছু বলার আগেই ব্রুনা আবার শুরু করল, ‘আপা, আমি শুধু শুনিনি, দেখেছিও। শুধু ডারলিং বলা নয়, লোকটি মা’র গায়ে হা্তও দিয়েছে। প্রতি ব্যাপারে মাকে সে কমান্ড করেছে। তাদের নির্দেশেই ব্রুমসারবার্গ ও ফার্মল্যান্ড থেকে মা আমাদের সরিয়ে দিলেন। কিন্তু মাকে সরিয়ে দেয়া হয়নি। লোকটি মাকে বলেছে জঞ্জাল থেকে মুক্ত হলেই তুমি ব্রুমসারবার্গে ফিরে আসবে।’
‘জঞ্জাল কি?’ আমি বললাম।
‘এটা বুঝলে না আপা, মা’র সাথে বাবা, আমি, তুমি যারা আছি, তারাই জঞ্জাল।’ বলল ব্রুনা।
আমি বুঝিনি তা নয়, কিন্তু স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছিল। যা স্বীকার করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল, সেটা স্পষ্টবাদী ব্রুনা অবলীলাক্রমে বলে ফেলল। আরেকটা কথা এ সময় আমার কাছে খুব বড় হয়ে উঠল, আমরা যদি জঞ্জাল হই, তাহলে সে জঞ্জাল থেকে মা মুক্ত হবেন কি করে?
এ প্রশ্নের জবাবও কয়েক দিনের মধ্যেই মিলল।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় আমার সাথে ব্রুনাও যাচ্ছিল। আমরা ‘বন’-এর বিখ্যাত পার্কের মাঝের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। জনবিরল রাস্তা। এ্যাকসিডেন্টের শিকার হলাম। একটা হেভি জীপ ইচ্ছা করে রং সাইডে এসে আমাদের গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। আমি যদি শেষ মুহূর্তে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিতে না পারতাম, তাহলে আমাদের গাড়ির মাথাটা গুড়ো হয়ে যেত, তার সাথে সামনে বসা আমরাও শেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু আমরা দু’বোন আহত হবার মধ্যে দিয়ে বিরাট ফাঁড়া আমাদের কেটে গেল।
আমাদের দু’বোনকে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে জেনেছিলাম যে, গাড়িটা এ্যাকসিডেন্ট ঘটায় তার নাম্বারটা ভূয়া ছিল এবং গাড়িটাকে আর বনে পাওয়া যায়নি। তার মানে গাড়িটা পরিকল্পিতভাবেই এ্যাকসিডেন্ট ঘটায় এবং তার লক্ষ ছিল আমাদের মেরে ফেলা।
মা হাসপাতালে এসেছিলেন। আমাদের কিছু দেখাশুনাও করেছেন। কিন্তু সবই ছিল পোষাকি- তা বুঝতে আমাদের দু’বোনের কারোই কষ্ট হয়নি।
হাসপাতালের বেডে শুয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, বন থেকে শুধু নয়, জার্মানি থেকেও পালাতে হবে। বাবাকেও সাবধান করে দিলাম। বললাম, নিশ্চয় মা কোন কারণে একদমই বদলে গেছেন । তিনি এখন আমাদের কারও জন্যেই নিরাপদ নন। বাবা বলেছিলেন, ফার্মল্যান্ডের ১০ হাজার একরের বিরাট সম্পদই সকল অনর্থের মূল। এ সম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার মা’র। আমরা যদি না থাকি, তাহলে তোমার মা’র মাধ্যমে অন্য কেউ এ সম্পত্তির মালিক হতে পারে।’
বাবার এই কথায় সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও আমার মনে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল, আমার মা’র এই পরিবর্তন কিছুতেই হতে পারে না। তার কি হলো? কি ঘটলো? সমগ্র হৃদয়ের এই আকুল প্রশ্নের সমাধান পাইনি। আমার বোন ব্রুনা ও বাবারও কথা হলো, ‘এই মা, আমাদের মা নয়’। তাহলে ইনি কে? আমার মা গেল কোথায়? দু’জনের একমাত্র বয়স ছাড়া একই চেহারা হলো কি করে? এসব জিজ্ঞাসা ও থ্রিলিং কিছু করার ইচ্ছাই আমাকে বাধ্য করেছিল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটে যোগ দিতে। কিন্তু আমার সেই জিজ্ঞাসার পরিধি বেড়েছে বই কমেনি। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট আমাকে সাহায্য করেনি, বরং বলেছে যা গেছে ভুলে যাও, যা যায়নি তা রক্ষা কর। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করো না।’ তারা সাপের কথা বলায় আমার উদ্বেগ জিজ্ঞাসা আরও বেড়ে গেছে। তাহলে তো আমরা সাংঘাতিক এক ষড়যন্ত্রের শিকার। এই ষড়যন্ত্রের ছোবল থেকে আমার বোন, বাবা কি বাঁচবে? আমি তো পারলাম না, আমার সব প্রশ্ন, সব শংকা সামনে রেখে কেউ একজন কি সেই সাপের সন্ধানে এগোতে পারেন! এ ব্যাপারে প্রাথমিক সাহায্য করতে পারে আমার বোন ব্রুনা। তার ঠিকানা এই ডাইরির শেষ পাতায় থাকল।’
ডাইরি পড়া শেষ হলো আহমদ মুসার।
পাতা উল্টিয়ে সে শেষ পাতায় গেল।
শেষ পাতার দুই পৃষ্ঠায় কোন লেখা দেখল না আহমদ মুসা। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। এত সহজে ঠিকানাটা দেখা যাবে তা ভাবা ঠিক হয়নি। তার বোনের ঠিকানা তার বোনের মতই মূল্যবান। বোনকে যেমন সাপের ছোবল থেকে বাঁচাবার জন্যে লুকিয়ে রেখেছে, তেমনি ঠিকানা লুকাবারও তার দরকার পড়েছে। নিশ্চয় স্পাই ডাস্ট দিয়ে ঠিকানাটা পড়া যাবে।
আহমদ মুসা পাশ ফিরে ব্যাগ টেনে নিয়ে ইমারজেন্সি প্যাক থেকে একটা স্প্রে-টিউব বের করে প্রথমে উপরের পৃষ্ঠার উপর স্প্রে করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৃষ্ঠার মাঝখানে লাল রংয়ের তিনটি লাইন ফুটে উঠল। গৌরীর ছোট বোন ব্রুনা ব্রুনহিল্ড-এর ঠিকানা। মনোযোগ দিয়ে ঠিকানাটা একবার পড়ে নিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ডাইরি বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল।
গৌরীর পুরো নামটা তো জানা হলো না। তার ছোট বোন, মা, বাবার সবার নাম জানা হয়েছে, কিন্তু গৌরীর পুরো নাম জানা হয়নি। নিশ্চয় ডাইরির শুরুতে সে এটা বলেছে।
আহমদ মুসা ডাইরির পাতা উল্টিয়ে আবার তার শুরুতে চলে গেল।
শুরুতেই পেয়ে গেল গৌরীর নাম।
ডাইরি লেখা শুরুই করেছে এভাবে, ‘আমার নাম আনালিসা অ্যালিনা।’ খাস স্যাক্সন নাম। আমরা খাঁটি স্যাক্সন রাজপরিবারের উত্তরসূরী। আমার মা বলেছেন, স্যাক্সনদের প্রথম রাজা হেনরীর প্রথম মেয়ের নাম নাকি ছিল আনালিসা অ্যালিনা।’
গৌরীর নাম জানা হয়ে গেল। এখন আর অন্য কিছুর দরকার নেই। ডাইরি তো সাথেই থাকবে যা যখন প্রয়োজন দেখে নেবে।
ডাইরি বন্ধ করল আহমদ মুসা।
পা ছড়িয়ে ভালো করে শুয়ে পড়ল সে।
নৌবাহিনীর জাহাজটি চলছে দ্রুত তাহিতির উদেশ্যে।
মৃদু একটা কাঁপুনি জাহাজে।
আরামে শান্তির পরশে চোখ বুজল আহমদ মুসা।
চোখ বুজলেও মনের দরজা বন্ধ হলো না। নানা কথা, নানা চিন্তা ছুটে এল সেই দরজা পথে। এখন কি করণীয় আহমদ মুসার? গৌরীর মায়ের ঘটনা তাকেও স্বম্ভিত করে দিয়েছে। গৌরীর সব কথা থেকে একথা পরিষ্কার গৌরীর এ মা তার আসল মা হতে পারে না। কিন্তু এটাই বা সম্ভব হয় কি করে? মানুষের মত মানুষ হয়, কিন্তু দুই মানুষ এমনভাবে এক হতে পারে না। কিন্তু হলো কি করে? যা বুঝেছে আহমদ মুসা, তাতে দু’জনের মধ্যে বয়স ও আচরণের পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই্। আচরণের পার্থক্য মৌলিক বিষয় নয়। কারণ আচরণ কৃত্রিম হতে পারে। মৌলিক বিষয় শুধু বয়সটাই যা আড়াল করার জন্যে গৌরীর এ মা কলপ দিয়ে পাকা চুল তৈরি করে থাকে।
ভেবেই চলল আহমদ মুসা।
তার মনের খোলা দরজাটা এক সময় ধুসর হয়ে অন্ধকারের একটা যবনিকা নেমে এল।
ঘুমিয়ে পড়ল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার সম্মানে একটা বিদায়ী ভোজের আয়োজন করেছিল তাহিতির ফরাসি গভর্ণর তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত জনদের নিয়ে। ভোজ শেষ হয়েছে।
অতিথিরা প্রায় সবাই চলে গেছে।
আহমদ মুসা বসেছিল ডিনার হলের পাশের লাউঞ্জে। তার দু’পাশে সোফায় বসেছিল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান দ্যাগল।
অতিথিদের বিদায় দিয়ে তাহিতির গভর্ণর ফ্রাসোয়া বুরবন ফিরে এল। সে সামনে আসতেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান দ্যাগল। গভর্নরের দিকে একটা বড় ইনভেলাপ তুলে ধরে বলল, ‘সব হয়ে গেছে স্যার।’
ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসার পাশে বসল গভর্নর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডিনার ঠিক সময়ে শেষ হয়েছে আহমদ মুসা। তুমি ধীরে সুস্থে গিয়ে প্লেন ধরতে পারবে।’
বলে গভর্নর ফ্রাসোয়া বুরবন একটু থামল। হাতের ইনভেলাপের ভিতরটা একটু দেখে নিয়ে সেটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘আহমদ মুসা, ইনভেলাপে তোমার পাসপোর্ট ও প্লেনের টিকিট আছে। তোমার মার্কিন পাসপোর্টে ইউরো ভিসা লাগানো হয়েছে। কুটনৈতিক সমমানের ভিআইপি ভিসা তোমাকে দেয়া হয়েছে। কুটনীতিকদের অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা তুমি পাবে। ইনভেলাপের ভিতর আরেকটা ইনভেলাপ তোমার জন্যে ফরাসি প্রেসিডেন্টের লেটার অব থ্যাংকস রয়েছে। ফরাসিরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক অমূল্য সাহায্য দেয়ার জন্যে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে গেস্ট অব অনার হিসাবে ফ্রান্সের আগামী জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। আরেকটা কথা আহমদ মুসা, ফরাসি সরকার আমাদের অস্ট্রিয়া ও জার্মানিস্থ রাষ্ট্রদূতদের তোমার ব্যাপারে কমপ্লিট ব্রীফ করেছে। আর জার্মানির সাচেন প্রদেশের গোয়েন্দাপ্রধান আমার ক্লাসমেট। তোমার বন, ব্রুমসারবার্গ সবই তার এলাকায় পড়বে। সে তোমাকে সব রকম সাহায্য করবে।’
থামল গভর্নর, ফ্রাসোয়া বুরবন।
‘ধন্যবাদ স্যার্। আপনার সরকারকে অশেষ ধন্যবাদ। আমাকে এখন উঠতে হয় স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি সোনার মানুষ আহমদ মুসা। কারণ কোন বিনিময় তুমি চাও না। আমার সরকার আর কি করল তোমার জন্যে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা।’
বলেই গভর্নর উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ও স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান দ্যাগলও উঠল।
গভর্নর ফ্রাসোয়া বুরবনই আবার কথা বলল, ‘জানি তুমি তেপাও-এর গাড়িতেই যাবে। মি. দ্যাগলও একটা পুলিশ ফোর্স নিয়ে তোমার সাথে থাকবে।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়েলকাম। চল আহমদ মুসা।’ সবাই বেরিয়ে গভর্নর হাউজের গাড়ি বারান্দায় এল।
তেপাও-এর গাড়ির পাশে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে মারেভা ও মাহিন। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আচে ‘আরু’র রাজ উপাশনালয় প্রধান মা-কোহ।
আহমদ মুসা তাকে সালাম দিল। বলল, ‘স্যার, আপনি কষ্ট করে এসেছেন? দু:খিত, আমারই যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আরেকটা প্রোগ্রামে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে।’
‘সে জানি বেটা, তোমাদের মত লোকদের আল্লাহ গণ্ডায় গণ্ডায় সৃষ্টি করেন না। মতুতুংগার ঘটনায় গোটা দুনিয়া স্তম্ভিত। তোমার জন্যে আমরা গর্বিত। কিন্তু একথা বলার জন্যে আমি আসিনি বেটা। বলল মাহকোহ।
‘আদেশ করুন স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আদেশ নয়, বলতে এসেছিলাম, এবার ‘আরু’তে গেলে তোমার ভালো লাগত। সেই রাজউপাশনালয় এখন রাজমসজিদ। তুমি আসার পর রাজ-উপাশনালয়ের চারদিকটা পরিষ্কার ও সমান করতে গিয়ে একটা শিলালিপি পাওয়া গেছে। আরবি ও তাহিতি ভাষায় লেখা। ওটা যে মসজিদ তা ওতেই লেখা আছে। সন, তারিখও শিলালিপিতে লেখা হয়েছে। পমেরী বংশের প্রথম অংশ আরি আবদুল্লাহ অ্যারিন্যু এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি ধন্য হবে তোমাকে পেলে।’ বলল মাহকোহ।
‘আলহামদুলিল্লাহ! খুব খুশি হলাম এই খবর শুনে। প্রার্থনা করি তাহিতির মাটিচাপা ইতিহাস এভাবেই বের হয়ে আসুক। মুহতারাম, এবার আমি এসেছিলাম বিশেষ কাজে, তবে এরপর আসব বেড়াতে। সেবার প্রথমেই আপনার অতিথি হবো ইনশায়াল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়েলকাম বেটা! আল্লাহ তোমাকে সে ধরনের সময় দিন।’ বলল মাহকোহ।
‘তাহলে স্যার, দোয়া করুন।’ বলে আহমদ মুসা একবার হাতঘড়ি দেখে তাকাল মাহিন ও মারেভার দিকে। বলল, ‘সবাই গাড়িতে ওঠ, হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই।’
বলে আহমদ মুসা হাতের ব্যাগটা সামনের সিটে ঠেলে দিয়ে তাতে উঠে বসল।
সবাই গাড়িতে উঠেছে।
মাহিন, মারেভা ও মাহকোহ পেছনের সিটে বসলো। ড্রাইভিং সিটে তেপাও। তার পাশে আহমদ মুসা।
সামনে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান দ্যাগলের গাড়ি। পেছনেও আরও দুটি গাড়ি পুলিশের।
গাড়ি চলতে শুরু করল তাহিতি এয়ারপোর্টের দিকে।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যারেভা-মাহিন, তোমরা কথা বলছ না যে!’
কোন কথা এল না তাদের দিকে থেকে।
ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেল আহমদ মুসা। পেছন ফিরে দেখল, দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে মারেভা। কান্না চাপতে গিয়ে কাঁপছে সে।
ম্লান হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে।
একটা আবেগ এসে তাকেও স্পর্শ করল। এই যে দেখা হলো, পরিচয় হলো, মায়ার বাঁধন এসে বাঁধল। তারপর এই যে যাচ্ছে, আর কি দেখা হবে! সবাই আমরা বলি, আবার আসব। ক’জন ফিরে আসে! ফেরা কি যায়!
একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল নরম কন্ঠে, ‘মারেভা, বোন, তোমাদের খুব বাস্তববাদী বলে আমি জানি। তোমাদের তাই আশ্বস্ত করার কোন দরকার নেই। মিলন ও বিচ্ছেদ দু’টোই জীবনের বাস্তবতা। এর চেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, দুনিয়ার জীবনটা এক গতিমান চলার পথ। আমরা সবাই এই গতির অধীন, আর গতির নিয়ন্ত্রক স্বয়ং আল্লাহ। গতিমান চলার পথ কাকে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। চলার পথ আমাকে নিয়ে এসেছিল স্বপ্নের তাহিতিতে, আজ আবার চলে যাচ্ছি সেই তাহিতি থেকে। এই অমোঘ বাস্তবতা আমাদের সবাইকে মানতে হবে বোন।’
থামল আহমদ মুসা।
থামল না মারেভা। তার কান্নাটা আরও বাড়ল। আহমদ মুসা দেখল চোখ মুছছে ড্রাইভার তেপাও।
নিরবতা ভাঙল মাহকোহ। বলল, ‘অংকের নিয়মে তোমার কথা ঠিক বেটা। কিন্তু হৃদয় এই অংক মানে না। মানুষের ইতিহাস যত পুরনো, মানুষের বেদনার অশ্রু, বিয়োগের অ্শ্রু, শোকের অশ্রুর ইতিহাস বোধ হয় ততটাই পুরনো। অশ্রু হলো ভালোবাসাসিক্ত হৃদয়ের স্বর্গীয় প্রস্রবণ। মারেভা কাঁদুক আহমদ মুসা। ওর অশ্রু শুধু ওর নয় সমগ্র তাহিতির অশ্রু।’
থেমে গেল মাহকোহর শান্ত কন্ঠ।
আহমদ মুসা কিছু বলল না, বলতে পারল না। বিদায়ের বেদনাসিক্ত যে আবেগকে সে দূরে সরিয়ে রাখছিল, সেটা এবার এসে তাকে ঘিরে ধরল। দুই চোখের কোণ তারও ভারি হয়ে উঠল। চোখ বুজল আহমদ মুসা।
এক সময় চোখ খুলে পকেটে হাত দিয়ে একটা ইনভেলাপ বের করল। পেছনে তাকিয়ে ইনভেলাপটা মাহিনের দিকে তুলে ধরে বলল, এতে কয়েক হাজার ডলার আছে মাহিন। এটা দিয়ে তেপাওকে একটা ভালো গাড়ি কিনে দিও। ও কিছুতেই টাকা নিত না। তাই এ দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম।’
আগেই তেপাও-এর চোখে পানি গড়াচ্ছিল। এবার সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। কিছু বলল না। কান্নায় বাধাও দিল না।
চোখ দু’টি তার প্রসারিত হলো সামনে।
চোখে শূন্য দৃষ্টি।
তাতে যেন অচেনা ঠিকানার অজানা কাহিনীর অস্পষ্ট সব দৃশ্য!
চলছে গাড়ি।
চলছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

Top