৫২. ক্লোন ষড়যন্ত্র

চ্যাপ্টার

উত্তর দিয়েছিল ব্রুনা। বলেছিল, ‘আমরা যদি কারিসু দিয়ে যাই, তাহলে কিছু পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে কারিসু পার হলেই আমরা রাইনের তীরে গিয়ে পৌঁছব। তারপর রাইন তীরের হাইওয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে এগোলে আমরা ব্রুমসারবার্গে পৌঁছে যাব। আর যদি হেলব্রোন হয়ে যান স্যার, তাহলে খরস্রোতা, উচ্ছলা নেকার নদীর ছোঁয়া পাবেন, সেই সাথে পাবেন পর্বতভূমির পাদদেশের সবুজ, মনোহর ঘন বনাঞ্চল, তার ফাঁকে ফাঁকে দেখবেন জার্মানির শান্ত সুন্দর আদি গ্রামগুলো। আরো দেখবেন প্রাচীন জার্মানির একটা বিরান এলাকা। সেখানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষও দেখতে পাবেন। অতীতের স্মৃতিবাহী কিছু পরিবার সেখানে এখনো আছে, যারা জার্মানির সৌন্দর্য ও গৌরব। এখন স্যার, আপনিই পথ বেছে নিন।’
‘ব্রুনা, তোমার পথের বর্ণনাই বলে দিয়েছে কোন্ পথ আমি বেছে নেব। আমি হেলব্রোনের পথেই যাচ্ছি।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
গাড়ি কখনো সবুজ ঘন বনাঞ্চল, কখনো ছবির মত সুন্দর গ্রামের স্নিগ্ধ পরশ নিয়ে এগিয়ে চলছিল সামনে। ব্রুনার বর্ণনার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর এসব দৃশ্য।
প্রাচীন জার্মানির বিরান এলাকায় প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার মাইক্রো। হাইওয়েটা ফিরে এসেছে নিকার নদীর তীর বরাবর।
অনেকক্ষণ ধরে আহমদ মুসার কান উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল। দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। শব্দ আরও স্পষ্ট হলে বুঝতে পারল, শব্দটি হেলিকপ্টারের। কিছুক্ষণ ধরে শব্দের ডাইরেকশন অনুসরণ করে নিশ্চিত বুঝল, হেলিকপ্টারটি তাদের দিকেই আসছে।
আরও কিছু সময় পার হয়ে গেল।
গাড়ি তখন চলছিল এক ফালি ফাঁকা এলাকার উপর দিয়ে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে দেখল, হেলিকপ্টার অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে।
হেলিকপ্টারটি তাদের গাড়ির নাক বরাবর এগিয়ে আসছে। হেলিকপ্টারটি যেন তাদেরকেই টার্গেট করেছে।
হেলিকপ্টারের পরিচয় সম্পর্কে জানার জন্যে গভীরভাবে চাইতে গিয়ে নিচের দিকে উদ্যত মেশিনগানের নল দেখতে পেল। দূরবীনের চোখও নজরে পড়ল আহমদ মুসার।
চমকে উঠল আহমদ মুসা! তাহলে এটা একটা শত্রুপক্ষের হেলিকপ্টার? কিন্তু ওরা আহমদ মুসাদের সন্ধান পেল কি করে? উত্তরও সংগে সংগে পেয়ে গেল। আহমদ মুসারা তো ওদের মাইক্রো ব্যবহার করছে! এই মাইক্রোতে নিশ্চয় মাইক্রোর অবস্থান ও মাইক্রোর কথাবার্তা রিলে করার গোয়েন্দা ট্রান্সমিটার রয়েছে।
বিষয়টা আহমদ মুসার কাছে পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে সে গাড়ির স্পীড আকস্মিকভাবে বাড়িয়ে দিল। তার লক্ষ সামনের এক ফালি খালি জায়গা পার হয়েই ঘন গাছপালার মধ্যে প্রবেশ করা। সামনেই রাস্তার দু’পাশে ঘন গাছের সারি, মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সে রাস্তায় পৌঁছানোই আহমদ মুসার টার্গেট।
হেলিকপ্টারটিও সম্ভবত এটা বুঝতে পেরেছে। হেলিকপ্টারের দরজা দিয়ে দেখতে পাওয়া মেশিনগানের ব্যারেল নড়ে উঠল। নেমে এল এক পশলা গুলি।
আহমদ মুসার মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ করেছিল ব্রুনা। গাড়ির স্পীড হঠাৎ সপ্তমে উঠায় উদ্বিগ্ন ব্রুনা প্রশ্ন করল, ‘কিছু কি ঘটেছে স্যার?’
‘হ্যাঁ, মাথার উপরে একটা হেলিকপ্টার আমাদের ফলো করছে। মনে হচ্ছে এটা ওদের নতুন আক্রমণ।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই উপর থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। কয়েকটি গুলি মাইক্রোর পেছনে আঘাত করল।
দু’পাশের গাছ মোটামুটি আড়াল সৃষ্টির জন্য ওদের টার্গেট ষোল আনা লক্ষ ভেদ হয়নি।
আহমদ মুসা ব্রুনাদেরকে গাড়ির সিটের নিচে শুয়ে পড়তে বলে গাড়ির জিগজ্যাগ গতি আরও বাড়িয়ে দিল।
‘মি. আহমদ মুসা, আমরা তো হেলিক্টারের সাথে পারবো না। ওরা সহজেই আমাদের টার্গেট করতে পারবে। উপর থেকে ওরা বোমাও ছুঁড়তে পারে।’ বলল সেনফ্রিড। উদ্বেগে তার কন্ঠ কাঁপছে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বিপদের সময় বেশি ভাবতে নেই। সব সময় বিপদের সাথে পরিত্রাণের একটা রাস্তা আল্লাহ রাখেন।’
গাড়ির তীব্র গতির সাথে আহমদ মুসা নদীর একটা খাড়া ও উন্মুক্ত ধরনের স্থান খুঁজছিল। এই সাথে আহমদ মুসা উপরের হেলিকপ্টারের গতি পথও মনিটর করছিল। প্রথমবার গুলি বর্ষণের পর তারা আর গুলিও করেনি। তারা নিশ্চয় একটা উপযুক্ত স্থানের অপেক্ষা করছে যেখানে তারা সহজেই মাইক্রোটাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। তাছাড়া তাদের ভয়ও আছে গুলাগুলির ব্যাপারটা পুলিশের কানে গেলে তাদের বিপদ হবে। যা করার দ্রুত করে তাদের সরে পড়তে হবে।
যে ধরনের জায়গা খুঁজছিল আহমদ মুসা তা পেয়ে গেল। জায়গাটায় ছোট ছোট আগাছা ছাড়া বড় ধরনের গাছ নেই। নদী পাড়ের রেলিং সেখানে নেই। সম্ভবত ভেংগে যাওয়ার কারণে পুনঃনির্মাণের জন্যে খুলে ফেলা হয়েছে।
আহমদ মুসা জায়গাটা পার হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ব্রেক করে গাড়ি থামাল আহমদ মুসা। দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘ব্রুনা, মি. সেনফ্রিড, আপনারা তাড়াতাড়ি নেমে পেছনের ঝোপটায় লুকিয়ে পড়ুন। প্লিজ তাড়াতাড়ি করুন।’
ব্রুনা ও সেনফ্রিড গড়িয়েই গাড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছুটল ঝোপের দিকে। ব্রুনা একবার জিজ্ঞাসা করতে চাইল, স্যার আপনি আসবেন না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না!…
ব্রুনারা নেমে পড়তেই আহমদ মুসা গাড়ি ব্যাক ড্রাইভ করে সেই জায়গায় ফিরে এল। গাড়িটা নদীর পাড়ের প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল আহমদ মুসা। তারপর পেছন থেকে টেনে গাড়িটা নদীতে ফেলে দিয়ে একটু অপেক্ষা করে দেখল গাড়িটা পুরোপুরি নদীতে পড়ল কিনা।
নিশ্চিত হয়ে আহমদ মুসা ছুটে এল সেই ঝোপে।
সেখানে পৌঁছেই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. সেনফ্রিড, আমাদের আরও পেছনে সরে যেতে হবে। চলুন, পেছনের ঐ টিলায়। টিলায় যথেষ্ট ঝোপ-জংগল আছে আর ওটা বেশ উঁচুও। ওদের গতিবিধি ভালোভাবে দেখা যাবে।’
ছুটল ওরা কিছু দূরের টিলাটার দিকে।
ওদিকে হেলিকপ্টারটি অনেকখানি সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা খেয়াল করে দেখল নিচে রাস্তার উপর সেই গাড়িটা নেই। দ্রুত তারা ফিরে আসে। কিন্তু গাড়িটার দেখা তারা পায় না।
তাড়াতাড়ি হেলিকপ্টারটা হাইওয়ের সেখানকার ছোট সরু বাইলেনটাও চেক করে আসে। কিন্তু গাড়ির দেখা তারা পায় না।
পাগলের মত হেলিকপ্টার চারদিকে ঘুরতে থাকে। এক সময় হেলিকপ্টারটা নদীর উপর স্থির হয়ে দাঁড়ায়। তারপর হেলিকপ্টারটা ধীরে ধীরে ল্যান্ড করল নদীর পাড়ে।
‘ওরা এখন মনে করছে গাড়ি এ্যাকসিডেন্ট করে আমরা নদীতে পড়ে গেছি। ওরা এখন নিশ্চিত হবার জন্যে নদীতে নেমে গাড়ি পরীক্ষা করবে এবং লাশগুলোকে হাত করতে চাইবে। আমাদের সরে পড়ার এটাই উপযুক্ত সময়।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়-বিমুগ্ধ ব্রুনা বলল, ‘আপনি তাহলে এই উদ্দেশ্যেই মাইক্রোটিকে নদীতে ফেলে দিয়েছেন! ধন্যবাদ স্যার!’
আহমদ মুসা ব্রুনার কথার দিকে কর্ণপাত না করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন, আমরা যাত্রা শুরু করি।’
টিলা থেকে তারা নেমে এল।
‘জংগলের মধ্যে দিয়েই আমরা প্রথমে পূর্ব দিকে যাব, তারপর আমরা নেকার নদীর সমান্তরালে উত্তর দিকে চলব।’
বলে চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
‘পাশে একটু দূরেই তো রাস্তা আছে। আমরা সে রাস্তায় উঠতে পারি। সেখানে গাড়িও মিলবে।’ বলল ব্রুনা।
‘সেটাই সুবিধাজনক। কিন্তু রাস্তায় ওঠা ঠিক হবে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা জানতে পারবে গাড়িতে আমরা নেই। তারপরেই ওরা হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করবে। চারপাশের পথ তারা চষে ফিরবে। রাস্তায় উঠলে ওদের হেলিকপ্টারের চোখ এড়ানো কঠিন হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার, ঠিক বলেছেন। কিন্তু স্যার, এরকম বিপদে আমাদের মাথা সব সময় গুলিয়ে যায়। কিন্তু আপনার মাথা কি করে ঠাণ্ডা থাকে?’ বলল ব্রুনা।
‘সবারই মাথা ঠাণ্ডা থাকতে পারে, যদি সবাই সব ব্যাপারে আল্লাহর উপর নির্ভর করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বুঝলাম না স্যার।’ বলল ব্রুনা।
‘মাথা গুলিয়ে যাবার যে কথা বললে সেটা ভয়ের কারণে হয়। মৃত্যু ভয় সবচেয়ে বড় ভয়। এই ভয় যদি জয় করা যায়, তাহলে কোন ভয়ই আর থাকে না। মৃত্যুভয় দূর হয় আল্লাহর উপর নির্ভরতা থেকে। এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ যদি না চান দুনিয়ার কেউ মারতে পারবে না, আর আল্লাহ যদি চান, তাহলে দুনিয়ার সবাই মিলে চেষ্টা করেও কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। এই বিশ্বাস আল্লাহর উপর নির্ভরতা থেকেই আসে।’ আহমদ মুসা বলল।
চলতে শুরু করেছে তারা।
দ্রুত হাঁটছে তারা জংগল ঠেলে যতটা সম্ভব সামনে। মিনিট দশেক পার হয়ে গেল। তারা তখনও জংগলের পথেই চলছে।
হেলিকপ্টারের শব্দে তারা সকলেই পেছন দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, পেছনের আকাশে সেই হেলিকপ্টারটি উড়ছে।
‘নদীতে পড়ে যাওয়া গাড়ি পরীক্ষা করে ওরা নিশ্চিত হয়েছে যে, ওদের বোকা বানানো হয়েছে। এখন ওরা পাগলের মত খুঁজছে আমাদের।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চরম এই সংকটকালে ওদের বোকা বানাবার বুদ্ধি আপনার মাথায় এল কি করে স্যার! এটা আমার কাছে এখনও বিস্ময়!’ বলল ব্রুনা।
‘সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কে আরও জান ব্রুনা। মানুষ যখন উপায়হীন হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ স্বয়ং উপায় বের করে দেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আগে এই বিপদ থেকে বাঁচি তারপর আমি সব জানার চেষ্টা করব।’ বলল ব্রুনা।
‘ধন্যবাদ ব্রুনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, আমরা যে ঐ মাইক্রোতে আছি, হেলিকপ্টার থেকে ওরা তা বুঝল কি করে?’
‘ও মাইক্রোটা তো ওদের। ওরা…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই ব্রুনা বলে উঠল, ‘ঠিক স্যার। এ ধরনের মাইক্রো তো দেশে শত শত আছে। আর অত উপর থেকে গাছপালার মধ্য দিয়ে গাড়ির নাম্বার দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।’
‘খুব সহজ ব্যবস্থা ওদের ছিল, যা তাড়াহুড়ার মধ্যে আগে আমার মনে পড়েনি। ওদের প্রতিটি গাড়িতে ট্রান্সমিটার সেট করা থাকে। এর মাধ্যমে ওরা গাড়ির ভিতরের কথোপকথন, গাড়ির অবস্থান মনিটর করে। আমাদের গাড়িতেও ট্রান্সমিটার সেট করা ছিল আর সেটাই তাদের খবর দিয়ে ডেকে এনেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
ব্রুনা ও সেনফ্রিড দু’জনেরই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল! ভয়ে তাদের বুক কেঁপে গেল। শক্ররা এতটা সাবধান, এতটা ক্ষিপ্র! পরম ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাদের হৃদয়টা নুয়ে গেল আহমদ মুসার জন্যে। অজানা, অনাত্নীয় এই বিস্ময়কর মানুষটি জীবন বাজী রেখে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুদ্ধি ও শক্তি সব যুদ্ধেই সে অগ্রগামী।
আহমদ মুসা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ব্রুনারাও তার পেছনে পেছনে ছুটল।
‘এই এলাকাটা আমাদের তাড়াতাড়ি পার হতে হবে। ওরা পাগল হয়ে গেছে। ওরা এলাকাটা চষে ফেলবে। সবাই দ্রুত পা চালান।’ আহমদ মুসা বলল। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top