৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

রাইন পার হয়ে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। আহমদ মুসা ব্রুমসারবার্গ থেকে রাইনের তীর বরাবর এগিয়ে কবলেঞ্জের ব্রীজ দিয়ে রাইন পার হয়েছিল। উঠেছিল ফ্রাংকফুর্ট-বন হাইওয়েতে।
আহমদ মুসার টার্গেট ক্যাসেল, হ্যানোভার হয়ে অ্যারেন্ডসীর দিকে যাওয়া। এর জন্যে ফ্রাংকফুর্ট-ক্যাসেল কিংবা বন-ক্যাসেল হাইওয়েটা বেশি সুবিধাজনক। কিন্তু আহমদ মুসা এই দুই হাইওয়ে এড়িয়ে ফ্রাংকফুর্ট-বন হাইওয়ে আড়াআড়িভাবে ক্রস করে আঞ্চলিক রোড ধরে এগিয়ে চলছে ক্যাসেল-এর দিকে।
হাইওয়ে থেকে এ রাস্তা অনেক ভিন্ন। গাড়ির সেই ভিড় এখানে নেই, সেই স্পিডও কোন গাড়ির নেই। ড্রাইভ তাই এখানে অনেকটাই চাপবিহীন।
বামে টার্ন নিতে গিয়ে আহমদ মুসা রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাল। তাকাতে গিয়ে নজর পড়ল ড্যাশবোর্ডের উপর রাখা একগুচ্ছ গোলাপের উপর।
গোলাপ গুচ্ছটি তার মনকে টেনে নিয়ে গেল এক তরুণের দিকে। রাত ১২টার দিকে যখন তারা বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল গাড়ি নিয়ে সে সময় দেখা এই তরুণের সাথে।
একজন ফাদারের পোশাক পরা আলদুনি সেনফ্রিড গাড়ি থেকে নেমে গেট লক করছিল। আহমদ মুসা বসেছিল ড্রাইভিং সিটে।
সেই তরুণটি আহমদ মুসার পাশের জানালায় এসে দাঁড়িয়ে তুলে ধরে ঐ ফুলের গুচ্ছ।
আহমদ মুসা তরুণটির দিকে একবার তাকিয়ে ফুলের গুচ্ছটি হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল।
গোলাপের গুচ্ছ দেখেই আহমদ মুসার মন কথা বলে উঠেছিল।
ফুলের গুচ্ছ হাতে নিয়েই তাকিয়েছিল আহমদ মুসা গুচ্ছের মধ্যে একটা চিরকুটের সন্ধানে। তার সাথে সাথে মন একটা প্রশ্নও করেছিল, এ সময় ওদের চিরকুট আসবে কেন? তারা তো যাচ্ছে এখন অ্যারেন্ডসীতে।
ফুলের গুচ্ছের মধ্যে একটা লাল চিরকুটের উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার।
তাড়াতড়ি চিরকুটটি তুলে নিয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
একটি বাক্যমাত্র লেখা, ‘মিশন অন্য কোথাও যাচ্ছে শুনেছি, জানা গেলে মন্দ কিছু হতো না।’
একরাশ বিস্ময় আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল। আমরা অন্য কোথাও যাচ্ছি, এরা জানতে পারল কি করে!
আমরা তিনজন শুধু জানি। আমরা কেউ তাদের বলিনি। এটা নিশ্চিত। তাহলে এই বাড়ির মালিকের কাছ থেকে জানতে পেরেছে? আলদুনি সেনফ্রিড কিছুদিনের জন্যে বাড়ির বাইরে যাওয়ার বিষয়টা বাড়ির মালিককে বলার কথা, নিশ্চয় বলেছে। তার কাছ থেকে এরা জানতে পেরেছে। আহমদ মুসার মনে পড়ল, এ বাড়ির খবর তো এরাই আমাদেরকে দিয়েছে। বাড়ির মালিকের সাথে এদের সম্পর্ক কি? আসলে কারা এরা? বাড়ির মালিক কি এদের কেউ?
এসব প্রশ্নের কোনটিরই উত্তর জানা নেই আহমদ মুসার। কিন্তু ওরা যা জানতে চেয়েছে, তা ওদের জানাব কি করে?
তাকাল আহমদ মুসা জানালার বাইরের দিকে। বিস্ময়ের সাথে সে দেখল, দু’ধাপ পেছনে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণটি। আহমদ মুসা মনে মনে নিশ্চিত ছিল যে সে চলে গেছে। কারণ ইতিপূর্বে কোন সময়ই ফুলের গুচ্ছ হাতে দেয়ার পর কেউ দাঁড়ায়নি, দ্রুত সরে গেছে।
এ তরুণটি দাঁড়িয়ে আছে কেন? উত্তর নেবার জন্যে কি? তাই হবে। ভাবল আহমদ মুসা।
কিন্তু গন্তব্যের কথা কি ওদের বলা ঠিক হবে? বলা যাবে না কেন? ওরা যে অমূল্য সাহায্য করেছে, সেটা ওদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ। যা জানতে চাচ্ছে ওরা, এটা তাদের বলা যায়।
আহমদ মুসা ইশারা করে ডাকল তরুণটিকে।
এল তরুণটি।
‘ধন্যবাদ তোমাদের।’ বলল আহমদ মুসা যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ তরুণটি বলল।
‘ধন্যবাদ কেন, আমি বা আমরা তোমাদের জন্যে কিছু করিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি সবার জন্যে করেন।’
বলে একটু থেমেই সে বলল, ‘আমি যেতে পারি স্যার?’
‘তুমি অ্যারেন্ডসী চেন? বলতে পার সোজাপথ কোনটা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ফ্রাংকফুট-ক্যাসেল-হ্যানোভার হয়ে অ্যারেন্ডসী এবং বন-হ্যানোভার-অ্যারেন্ডসী এই দুই হাইওয়ের মধ্যে ফ্রাংকফুট হাইওয়ে বেশি সংক্ষিপ্ত। কিন্তু আরও সংক্ষিপ্ত পথ হলো কবলেঞ্জ থেকে ফ্রাংকফুট-বন হাইওয়ের যেখানে উঠবেন সেখান থেকে রিজিওনাল একটা সড়ক বহু গ্রাম-গঞ্জ মাড়িয়ে ক্যাসেল হয়ে হ্যানোভারকে বাঁয়ে রেখে স্যাক্সনীর ভেতর দিয়ে অ্যারেন্ডসী গেছে। এই পথে হাইওয়ের গতি নেই, কিন্তু জার্মানীর হৃদয় মানে গ্রামীণ জার্মানীর আনন্দ পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম, স্যার। আমি আসি।’ তরুণটি বলল।
‘জবাব নিলে না?’ মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘জবাব পেয়ে গেছি স্যার, ধন্যবাদ।’বলল তরুণটি।
‘আমার বিরাট একটা কৌতুহল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি, সেটা মেটাবার সাধ্য আমার নেই স্যার।’ বলল তরুণটি।
‘নো স্যরি, ওকে। কিন্তু একটা কথা বলো, বাদেন অঞ্চলের হের হেনরীকে তোমরা চেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই তরুণটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল।
‘এভাবে ছেলেটি চলে গেল কেন?’ বলল ব্রুনা।
‘ঠিকভাবেই গেছে ব্রুনা। তার মিশন শেষ করেই সে চলে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক ভাইয়া, তার জবাব সে নিয়ে গেছে। কিন্তু জবাব তো দিয়ে গেল না।’ বলল ব্রুনা।
‘আমার মনে হয়, জবাব সে দিয়েও গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জবাব দিয়ে গেছে? কিন্তু আপনার সুনিদিষ্ট জিজ্ঞাসার কোন জবাব না দিয়েই তো সে চলে গেল!’ বলল ব্রুনা।
‘তার নিরবে চলে যাবার মধ্যেই জবাব আছে। সরাসরি জবাব দেয়ার এখতিয়ার সম্ভবত তার ছিল না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জবাবটা কি? হের হেনরীকে তারা চেনে, মানে তারা সবাই এক?’ বলল ব্রুনা।
‘আমি তাই মনে করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে হের হেনরী তার কথা রেখেছেন। তার লোকেরা আমাদের খোঁজ-খবর রাখছে। তারা আমাদের অশেষ উপকারও করেছে।’ বলল আলদুনি-সেনফ্রিড, ব্রুনার বাবা।
‘ঠিক বলেছেন মি. সেনফ্রিড।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওদের কাজে আমি বিস্মিত হয়েছি। ওদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কি মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা আলদুনি সেনফ্রিডের।
‘ওরা সংঘবদ্ধ ও নিবেদিত। ওদের সম্পর্কে আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও ওরা বুদ্ধিমান ও দক্ষ। আমাকেও ওরা বিস্মিত করেছে মি. সেনফ্রিড।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি কি মনে করেন, স্যাক্সন ধর্মনেতা হেনরী আমাদেরকে সাহায্যের এই ব্যবস্থা করেছেন?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু তিনি ছাড়া বিকল্প কাউকে দেখছিও না। যাই হোক, আমরা খুশি যে একটা অদৃশ্য সাহায্যকারীর হাত আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।’
বলে আহমদ মুসা নড়ে-চড়ে বসল তার সিটে। সা্মনেই বড় একটা বাঁকের ইনডিকেটর।
স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গতিটাকে অ্যাডজাস্ট করে নিল আহমদ মুসা।
আলদুনি সেনফ্রিড ও ব্রুনাও সামনের দিকে তাকিয়েছে। তারাও আর কোন কথা বলল না।
চলছে গাড়ি, যেমনটা আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেকটাই দ্রুতবেগে।
ক্যাসেল পেরিয়ে হ্যানোভারকে বামে রেখে লোয়ার স্যাক্সন ও স্যাক্সন স্টেটের মিশ্র এলাকার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলছে আহমদ মুসাদের গাড়ি।
‘মি. আহমদ মুসা আমরা জার্মানীর আরেক স্যাক্সন এলাকার মধ্য দিয়ে চলছি। এটা জার্মানীর স্যাক্সন স্টেট। পাশেই লোয়ার স্যাক্সন এলাকা। রাইন এলাকা রোমানদের দখলে গেলে লোয়ার রাইনের স্যাক্সন পপুলেশনের বিরাট অংশ উত্তর জার্মানীর জলাভুমি ও বনাঞ্চলে মাইগ্রেট করতে বাধ্য হয়। বাদেনের কোন কোন অঞ্চলের মত এই অঞ্চলেও জার্মানীর আদি পপুলেশনের বাস। এ অঞ্চলেও রয়েছে জার্মানীর অনেক আদি পরিবারের মানুষ।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘ভালোই হবে যদি এখানে আর কোন হের হেনরীর সাথে দেখা হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, এই অঞ্চলে ক্রুসেড ফেরত ‘নাইট’দের অনেক উত্তরপুরুষের বাস। এদের বাস এক সময় ছিল রাইন তীরের দূর্গ ও প্রাসাদগুলোতে। কিন্তু এরাও এদের স্যাক্সন বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে গিয়ে বাধ্য হয় মাইগ্রেট করতে।’ বলল ব্রুনা।
‘ধন্যবাদ ব্রুনা। জার্মানী সত্যিই এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেশ। ইতিহাসকে জার্মানরা রক্ষা করে চলে বলেই ইতিহাসও জার্মাকে রক্ষা করে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইতিহাসই জার্মানদের শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস, ভাইয়া।’ বলল ব্রুনা।
‘সব জাতির জন্যেই এটা সত্য ব্রুনা। যে জাতির ইতিহাস মানে অতীত নেই, তার ভবিষ্যৎ ও থাকে না।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলার সময় ক্লাইমেট ইন্ডিকেটরের উপর নজর পড়েছিল আহমদ মুসার। দেখল, বাইরের আবহাওয়া দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি আসন্ন। তার সাথে প্রবল বাতাসেরও ফোরকাস্ট রয়েছে। সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘মি. সেনফ্রিড, যাত্রা শুরুর আগে আপনি বলেছিলেন, মে মাস আপনাদের এখানে সুন্দর আবহাওয়ার মাস। কিন্তু দেখুন ঝড়-বৃষ্টি আসছে।’
‘হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা। এখনও বলছি, আমি ঠিকই বলেছি। এটাই সাধারণভাবে সত্য। কিন্তু জার্মানীর আবহাওয়া বলা হয়ে থাকে অস্থিতিশীল ও আনপ্রেডিকটেবল। যে কোন সময় যা কিছু জার্মানীতে ঘটে যেতে পারে। হয়তো সেটাই ঘটতে যাচ্ছে।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
বাইরে বাতাস বাড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টিও দু’এক ফোঁটা করে পড়ছে। বাইরের দৃশ্য এখনও খুব স্পষ্ট নয়। প্রায় ৫০ কিলোমিটার আগে আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফজর নামাজ পড়ে নিয়েছে। এতক্ষণে সূর্য ওঠার কথা। মেঘ আর কুয়াশার কারনেই বাইরের এই অন্ধকার।
রাস্তায় গাড়ি তেমন একটা নেই।
রাতের চেয়ে গাড়ির স্পিড কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
বৃষ্টি কিছুটা বেড়েছে।
মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা ধরে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি। সামনেই একটা রাস্তার মোড়।
পাশ কাটিয়ে আসা ৫০ কিলোমিটার বামের প্রধান শহর হ্যানোভার থেকে একটা সড়ক এই মোড়ে এসে মিশেছে।
মোড়ে পেট্রোল পাম্প, পুলিশ ফাঁড়িসহ কিছু দোকান রয়েছে।
কিন্তু সেখানেও কোন লোক দেখা যাচ্ছে না। আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির মুখে সবাই রাস্তা-ঘাট থেকে সরে গেছে। আর জার্মানীর আবহাওয়া সাধারণভাবে পূর্বাভাসযোগ্য না হওয়ার কারণে মানুষ ঝড়-বৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদির প্রথম অবস্থায় অনেকটাই সাবধান হওয়ার চেষ্টা করে।
একদম রাস্তার সাথে লাগোয়া ছোট বাজারের মত জায়গাটার নাম খুঁজছিল আহমদ মুসা।
পথের পাশের জায়গাগুলোর যতটা সম্ভব নাম জানা এবং স্মরণে রাখার চেষ্টা আহমদ মুসার পুরানো অভ্যেস।
জায়গাটার নাম খুঁজতে গিয়েই আহমদ মুসা দেখতে পেল পেট্রোল পাম্পের ওপাশে রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে একজন মুখ ঘুরিয়ে্ আহমদ মুসাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। রেইনকোট গায়ে তার। ভিজে গেছে। দেহের সাইজ দেখে সে যে মেয়ে তা নিশ্চিত মনে হচ্ছে। ট্যাক্সিটি কি খারাপ? বিপদে পড়েছে কি সে? বুঝাই যাচ্ছে গাড়ির খোঁজে সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বিপদে না পড়লে আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির মুখে সে এভাবে দাঁড়িয়ে গাড়ির খোঁজ করতো না।
আহমদ মুসা গাড়ি তার পাশে নিয়ে দাঁড় করাল। গাড়ির জানালা খুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ ম্যাডাম, কোন সাহায্যে আসতে পারি?’
মেয়েটি আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার, আমার ভাড়া করা ট্যাক্সিটি খারাপ হয়ে গেছে। গ্যারেজে নেয়া ছাড়া ঠিক করা যাবে না। কিন্তু আমার জরুরি প্রয়োজন। অবিলম্বে আমাকে বাড়িতে পৌঁছতে হবে। এসব লোকাল রোডে বাসের নিয়মিত সার্ভিস নেই।’
‘ওকে, ম্যাডাম, আপনি কোথায় যাবেন? কোথায় আপনার বাড়ি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘সালজওয়াডেল।’ বলল মেয়েটি।
‘আমরা যাচ্ছি অস্টারবার্গ। এটা গেছে হেভেলবার্গের দিকে।’ আহমদ মুসা বলল। সে ইচ্ছা করেই ‘অ্যারেন্ডসী’র নাম গোপন করল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘আপনি তাহলে তো ঐ এলাকার? আপনি লিংকটা বলতে পারবেন।’
‘স্যার, অস্টারবার্গ, হেভেলবার্গের পথেই সালজওয়াডেল। তবে সামান্য একটু ঘোরা পথে।’ বলল মেয়েটি।
আহমদ মুসা তাকাল আলদুনি সেনফ্রিড ও ব্রুনাদের দিকে।
‘ঠিক আছে মি. আহমদ মুসা, তাকে লিফট আমরা দিতে পারি। অসুবিধা নেই। আমরা তো ওদিকেই যাচ্ছি।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
মেয়েটি গাড়ির দিকে দু’ধাপ এগিয়ে এসেছিল।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জার্মান শ্বেতাংগদের চেহারা যেমন মেয়েটিকে পুরোপুরি তেমন মনে হলো না আহমদ মুসার কাছে। চোখ, রং ও ইমপ্রেশনে কেমন একটা ভিন্নতা আছে।
‘ম্যাডাম, আপনি চাইলে আপনাকে লিফট দিতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
গাড়ির ভেতরটা দেখছিল মেয়েটি। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের অসুবিধা না হলে..।’
‘ওয়েলকাম!’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে ব্রুনার পাশের দরজাটা খুলে ধরল।
মেয়েটি তার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এসে ‘থ্যাংক ইউ অল স্যার’ বলে ভেতরে ঢুকে ব্রুনার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘ম্যাডাম, স্যরি ফর ট্রাবল।’
‘ওয়েলকাম। ট্রাবল কিসের? কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একজন সাথী পেলাম। আপনার নাম কি ম্যাডাম?’ বলল ব্রুনা।
‘প্লিজ ম্যাডাম নয়। আমার নাম আদালা হেনরিকা।’ বলল আদালা হেনরিকা নামের আগন্তুক মেয়েটি।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে।
‘সুন্দর নাম। আনকমন কিছুটা।’ ব্রুনা বলল।
‘তোমার নাম কি জানতে পারি?’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘শিওর, আমার নাম ব্রুনা ব্রুনহিল্ড। সামনে বামপাশে আমার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড। আর তাঁর ডানপাশে আমার স্যার, বড় ভাই আহমদ মুসা।’ ব্রুনা বলল।
আদালা হেনরিকার চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছিল। সে আগেই বুঝেছিল, ড্রাইভিং সিটের যার সাথে সে কথা বলছিল, সে জার্মান নয়, এশিয়ান ধরনের কেউ। এখন দেখা যাচ্ছে সে মুসলমানও। তা হলে ব্রুনার সে বড় ভাই হয় কি করে?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আদালা। এই সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতে করতে বলল, ‘প্লিজ, একটা কল এসেছে, কথা বলতে পারি?’ ব্রুনার দিকে চেয়ে বলল আদালা হেনরিকা।
‘অবশ্যই। কথা বলুন।’ বলে ব্রুনা জানালার দিকে একটু সরে হাতের ম্যাগাজিনের দিকে মনোযোগ দিল।
‘গুড মর্নিং। হ্যাঁ, মা, বল। আবার কি ঘটেছে? এভাবে কাঁদছ কেন?’ মোবাইল ধরেই ওপারের কথা শুনে বলল আদালা হেনরিকা। তার কন্ঠে আতংকের সুর।
আদালা হেনরিকার কথা শুনে সবার মনোযোগ তার দিকে নিবদ্ধ হলো। তাকালো সবাই তার দিকে।
তার কথা বলে আদালা হেনরিকা ওদিকের কথা শুনছিল।
এক হাতে মুখটা আড়াল করে মোবাইলে কথা বলছিল সে। হঠাৎ সে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠল, ‘মা আর বলো না, সইতে পারছি না মা।আমি আসছি।
বলে আদালা হেনরিকা হাতের মোবাইলটা সিটের উপর ছুড়ে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্না রোধ করতে চেষ্টা করতে লাগল।
ব্রুনা তার একটা হাত আদালার কাঁধে রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ঈশ্বর আছেন, ধৈর্য ধরুন। কি ঘটেছে জানতে পারি আমরা?’
ব্রুনার কথার সাথে সাথে অবরুদ্ধ কান্নার একটা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আদালা হেনরিকা।
কিন্তু শীঘ্রই নিজেকে সামলে নিয়ে দু’চোখ মুছে মাথা নিচু রেখেই বলল, ‘আমার পরিবার ভীষণ সংকটে পড়েছে। ওরা আমার ভাইকে রাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এই মাত্র তার লাশ বাড়ির গেটে ফেলে রেখে গেছে। শাসিয়ে গেছে, বিকেল ৫টার মধ্যে যে কোন সময় তারা আসবে। দাবি পূরণ না হলে বাবা-মা দু’জনকেই ওরা ধরে নিয়ে যাবে। আরও বলে গেছে যে, তাদের লোকরা আবার খোঁজ নিতে আসবে আমরা তাদের কথা মানছি কি না?’
বলেই আদালা দু’হাতে মুখ ঢাকল কান্না রোধের জন্যে।
পেছন দিকে না তাকিয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম, ওরা কারা?’
‘ওরা মুখোশ পরে বাড়িতে ঢুকেছিল। চিনতে পারেনি। তবে গির্জা ও সিনাগগ কেন্দ্রিক একটা গ্রুপ আমাদের পরিবারের সাথে অনেক দিন থেকে ঝামেলা করছে। পুলিশ তৎপর হওয়ার পর ঝামেলা চুকে যায় এবং তারা নীরব হয়ে যায়। আকস্মিকভাবে আবার এই ঘটনা ঘটল।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘স্যরি, জানতে পারি কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমাদের বাড়িতে কিছু অ্যান্টিক্‌স আছে। তার মধ্যে রয়েছে স্বর্ণের একটি মুকুট।
জার্মানীর সর্বপ্রাচীন রাজপরিবার স্যাক্সন ডাইনেস্টির দ্বিতীয় হেনরীর প্রপৌত্র চতুর্থ অটো উত্তর জার্মানীর নতুন স্যাক্সনল্যান্ডে নতুন একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছিল স্বর্ণের একটি রাজমুকুট। আমাদের স্বর্ণমুকুটটি একদম মূল মুকুটটির প্রতিকপি। আমাদের এই মুকুটটি তিনিই আমার প্রপিতামহের প্রপিতামহকে গিফট করেছিলেন। এটা নিয়েই ঝামেলা। আমাদের সালজওয়াডেলে সিনাগগ-গির্জা কেন্দ্রিক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির একটা শাখা আছে। হামবুর্গের একটা পুরাতাত্ত্বিক প্রদর্শনীতে তারা আমাদের অ্যান্টিকসগুলো দেখে। তারপর থেকেই শুরু হয় আমাদের মুকুটটা হাত করার চেষ্টা এই চেষ্টা ক্রমেই হুমকি-ধমকি ও বলপ্রয়োগে রুপান্তরিত হয়।’
‘পুলিশকে জানানো হয়েছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবার পর আম্মা পুলিশকে জানিয়েছেন। কিন্তু কারও নাম দেয়া সম্ভব হয়নি। সবাই মুখোশ পরিহিত ছিল। কাউকেই আইডেনটিফাই করা যায়নি।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘কিন্তু সন্দেহ তো করা যায়। যারা এক সময় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করেছিল, তারাই এবারও এটা করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি মাকে এটা বলেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। মা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ঐ সন্দেহভাজনদের কথা বলায় পুলিশ অফিসার বলেছিলেন যে, ক’মিনিট আগে পর্যন্ত ওরা পুলিশ স্টেশনেই ছিল। ওদের একটা ঘটনা নিয়ে ওরা পুলিশ স্টেশনে এসেছিল। এই অবস্থায় সন্দেহ কোন কাজে আসেনি।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘বুঝেছি। আচ্ছা ম্যাডাম, মুখোশধারীরা আপনার ভাইকে নিয়ে গেল, কিন্তু সেই অ্যান্টিক স্বর্ণমুকুটটা লুট করে নিয়ে গেল না কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঐ সমস্যার পর ওটা আমরা বাড়িতে না রেখে ব্যাংকের সেফ লকারে রেখেছি।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘বুঝেছি, এজন্যেই তাহলে ওরা ১২টা পর্যন্ত সময় দিয়েছে যাতে এর মধ্যে তা লকার থেকে তুলে আনার সময় হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক তাই স্যার। আমরা সেটা ব্যাংক লকার থেকে আনছি কি না সেটাও তারা জানতে আসবে।’ বলল আদালা হেনরিকা।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই কথা বলল না। একটু ভাবল। কথা বলল একটু পর। বলল, ‘ম্যাডাম, আমি আমার একটা মত বলতে পারি?’
সংগে সংগেই ব্রুনা আদালা হেনরিকার কানে কানে দ্রুত ফিসফিসিয়ে বলল, ‘উনি একজন মিরাকল মানুষ। তার মত মেনে নিলে ভালো হবে।’
আদালা হেনরিকা কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকাল ব্রুনার দিকে। তার মনে প্রশ্ন, এমন ভাষায় কেউ তো তার স্বজনেরও প্রশংসা করে না। আবার ব্রুনা তো তাকে স্যার বলেছে। তার মানে উনি এদের স্বজন কেউ নন। তাহলে?
মনের মধ্যে জেগে ওঠা প্রশ্নটা নিয়ে আর এগোলো না আদালা হেনরিকা। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘অবশ্যই স্যার, বলুন।’
‘ধন্যবাদ। আপনি বললেন, ওরা খোঁজ নিতে আসবে, আপনারা বিকেল ৫টায় অ্যান্টিক্‌সটা তাদের দেয়ার ব্যবস্থা করছেন কি না তা জানার জন্যে। আমার মত হলো, ওরা যদি আসে, তাহলে বলে দিতে হবে তাদের দেয়া সময়ের মধ্যেই অ্যান্টিক্‌স তাদের দিয়ে দেয়া হবে। আরও বলতে হবে, আমাদের মেয়ে আদালা হেনরিকা আসছে, সেই ব্যাংক থেকে ওটা তুলে নিয়ে আসবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু স্যার, আমার পরিবার জীবন গেলেও ওটা কাউকে এভাবে দিয়ে দিতে রাজি নয়। ওটা দিতে রাজি হলে তো ভাইকে মরতে হতো না। ভাইকে ওরা নিশ্চয় রাজি করাবার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা ব্যর্থ হলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই মনোভাব আমাদের পরিবারের সকলের।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘আমি এই মনোভাবের প্রশংসা করছি। দিয়ে দেয়ার পক্ষে আমিও নই। কিন্তু সময় কিল করার জন্যেই ওদের আশায় রাখা প্রয়োজন। কখন ওরা খোঁজ নিতে আসবে তা জানা নেই। খোঁজ নিতে এসেই যদি ওরা জানতে পারে, অ্যান্টিক্‌স তারা পাবে না, তাহলে আরও অঘটন তারা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি গিয়ে অ্যান্টিক্‌স নিয়ে আসব, এটা বলতে বলেছেন। সত্যিই কি আমি অ্যান্টিক্‌সটি আনব গিয়ে?’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘এটাও সময় কিল করা এবং ওদের আশায় রাখার জন্যে বলা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মাফ করবেন স্যার। এই সময় আমরা নিচ্ছি কেন? সময় নিয়ে আমরা কি করব?’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘আপনি, আমরা আপনার বাড়িতে পৌঁছা, পুলিশের সাহায্য পাওয়া, আত্নরক্ষার কৌশল ঠিক করা ইত্যাদির জন্যেই সময় প্রয়োজন।’ আহমদ মুসা বলল।
আদালা হেনরিকার চোখে-মুখে বিস্ময়। সে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার ধীর ও ঠাণ্ডা কন্ঠের যুক্তি শুনে মনে হচ্ছে, সে যেন কোন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ বা প্রবীণ দক্ষ পুলিশ অফিসার কিংবা একজন ঝানু গোয়েন্দার কথা শুনছে। তিনি কি এদের কোন একজন? কে তিনি?
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আদালা হেনরিকা বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। অনেক ধন্যবাদ। এত অল্প সময়ে ঘটনার এমন গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং এই মুহুর্তের করণীয়ও বের করেছেন। আপনি নিশ্চয় অনেক বড় কোন প্রফেশনাল।’
‘আমার মত সম্পর্কে বলুন। আপনি ভালো মনে করলে আপনার বাড়িতে এটা জানিয়ে দেয়া দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। আপনার মতের কোনো বিকল্প আমার জানা নেই। আমি এখনই বাড়িতে জানিয়ে দিচ্ছি স্যার।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম।’ আহমদ মুসা বলল।
বাইরে বৃষ্টি তখন জমে উঠেছে।
ঝড় না হলেও ঝড়ো হাওয়া বইছে।
রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা আগের মতই কম।
আহমদ মুসা আদালা হেনরিকাকে ধন্যবাদ দিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দিল। বাড়িয়ে দিল গাড়ির স্পীড।
বৃষ্টি ও ঝড়ের বাধা উপেক্ষা করে দ্রুত এগিয়ে চলেছে গাড়ি।
আহমদ মুসার দুই হাতে শক্ত করে ধরা স্টিয়ারিং হুইল।
অনেকটা দূরে থাকতেই আদালা হেনরিকা তার বাড়ি আহমদ মুসাকে দেখিয়ে দিয়েছিল।
রোড থেকে প্রায় ১০০ গজের ভেতরে আদালা হেনরিকাদের বাড়ি। সুন্দর তিন তলা বাড়ি ট্রিপলেক্স ধরনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে অনেক বড় বাড়ি। অতীতের বনেদি বাড়িগুলোর মতই বাড়িটা প্রাচীর ঘেরা। রোড়-সাইডে প্রাচীরে বড় একটা ফটক। বাড়িতে প্রবেশের গেট এটাই।
বাড়ি দেখেই আহমদ মুসা বলেছিল, ‘বাহ, বিরাট বাড়ি তো? জার্মানীর নাইট ও ভূ-স্বামীরাই দুর্গ কিংবা এ ধরনের বাড়িতে থাকতো।’
‘ঠিক স্যার, আমাদের বাড়িটা ভূ-স্বামীদের মতই ছিল। প্রায় নয় দশ জেনারেশন আগে আমাদের এক পূর্বপুরুষকে রাজা চতুর্থ অটো স্বর্ণমুকুটটিসহ বিরাট ভূ-সম্পত্তি দিয়েছিলেন। সুতরাং ভূ-সম্পত্তি আমাদেরও ছিল। বাড়ি এবং এই বাড়ি সংশ্লিষ্ট জমি ছাড়া সে ভূ-সম্পত্তি সবকিছুই এখন বেদখল হয়ে গেছে। আছে শুধু ঐ স্বর্ণমুকুটটি।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘কিন্তু ম্যাডাম, আপনাদের বাড়িটা তো সে রকম পুরানো মনে হচ্ছে না!’ আহমদ মুসা বলল।
‘না স্যার, এটা সেই পুরানো বাড়ি নয়। সে বাড়িটার কিছু অংশ একদম নষ্ট হয়ে যায়। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে আমার দাদুর সময়ে। আগের বাড়ির চেয়ে অনেক ছোট এ বাড়ি।’
আহমদ মুসাদের গাড়ি এসে গেছে আদালাদের বাড়ির প্রায় সামনে।
আদালাদের বাড়ি বামদিকে টার্ন নেয়ার জন্যে আহমদ মুসা গাড়ির গতি স্লো করে দিয়েছে।
টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছেনি তখনও আহমদ মুসার গাড়ি। একটা গাড়ি ওদিক থেকে এসে রোডে উঠে দ্রুত উত্তর দিকে চলতে শুরু করল।
গাড়িটা আদালা হেনরিকার বাসা থেকেই বেরিয়ে এসেছে, বুঝল আহমদ মুসা। বলল, ‘ম্যাডাম আদালা হেনরিকা, যে গাড়িটা আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সেটা কি আপনাদের গাড়ি?’
‘না স্যার, আমাদের কোন গাড়ি নয়।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘পুলিশের গাড়ি তো নয়ই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পুলিশ লাশ অনেক আগেই নিয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ আসার কথা নয়। আর ওটা পুলিশের গাড়ি নয়।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘অ্যান্টিক্‌স মুকুটের জন্যে ওরা আসবে, একথা আপনার বাড়ি থেকে পুলিশকে বলা হয়েছে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা্
‘না, পুলিসকে বলা হয়নি। ওরা শাসিয়েছে, পুলিশকে বললে বংশ সাফ করে দিয়ে যাবে।’ বলল আদালা হেনরিকা। কম্পিত তার কন্ঠ।
বাম দিকে টার্ন নিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি আদালার বাড়ির প্রাইভেট রাস্তাটায় ঢুকে গেল।
সামনেই বাড়ির গেট।
‘মা, গেটেই দাঁড়িয়ে আছেন।’ বলল আদালা হেনরিকা।
গাড়ি গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘ওয়েলকাম, সকলকে। আমরা এসে গেছি।’ বলে আদালা হেনরিকা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল ষাটোর্ধ মহিলা। আদালার মা। গাড়ি থামতেই সে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল।
গাড়ি থেকে নেমে আদালা হেনরিকা ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মা-মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁধ-ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে নামল আহমদ মুসা, ব্রুনা ও আলদুনি সেনফ্রিড।
তিন জন গিয়ে দাঁড়াল কান্নারত মা-মেয়ের সামনে।
আদালা হেনরিকা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
মাকে ছেড়ে দিয়ে সে চোখ মুছল।
মায়ের চোখ মুছে দিল। আহমদ মুসাদের দেখিয়ে বলল, ‘এরা আমাকে লিফট না দিলে আমার আসতে আরও অনেক দেরি হতো।’
বলে আদালা হেনরিকা মাকে সবার নাম পরিচয় করে দিল্। আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি আমাকে অভিভাবকের মত পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তোমাকে ওদেরকে বলার জন্যে যা বলেছি, তা তাঁর পরামর্শে।’
আদালা হেনরিকার মা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। লম্বা একটা বাউ করে বলল, ‘আমি আলিসিয়া, ধন্যবাদ বেটা। গড ব্লেস ইউ। আপনারা আমাদের মেহমান। প্লিজ ভেতরে আসুন।’
বলে আদালার মা আদালার দিকে চেয়ে বলল, ‘মা, ওঁদেরকে নিয়ে চল।’
আদালা, আহমদ মুসা সকলের দিকে চেয়ে ব্রুনা বলল, ‘আপনারা এগোন, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।’
‘ধন্যবাদ ব্রুনা।’ বলে আদালা আহমদ মুসাদের ভেতরে এগোবার অনুরোধ করল।
সবাই এগোলো।
ব্রুনা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠল।
সবাই গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
বিরাট এলাকা নিয়ে বাড়ি।
বাড়িটা আগের কাঠামো থেকে ছোট করা হয়েছে, তা বোঝা যায়।
ছোট করা হলেও ছোট মোটেই নয়।
বাড়ির বিল্ডিং-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সবাই।
বিল্ডিং-এর সামনের চত্বরটা পাথর বিছানো। চত্বরের শেষ প্রান্তে চত্বর থেকে আট নয় ফিট চওড়া সুন্দর সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে।
পৌঁছে গেল আহমদ মুসারা সিঁড়ির কাছাকাছি। আহমদ মুসার পাশাপাশি হাঁটছিল আদালা হেনরিকা। বলল, ‘আমাদের দোতলায় উঠতে হবে। নিচের ফ্লোরটা কিচেন, স্টোর ইত্যাদির মত কাজে ব্যবহার হয়।
‘মা আদালা, মেহমানদের তুমি উপরে নিয়ে যাও। আমি ব্রুনা মা’কে নিয়ে আসছি।’ বলল আদালা হেনরিকার মা্।
‘ঠিক আছে মা। তুমি এস।’ আদালা হেনরিকা বলল।
দোতলার ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে আহমদ মুসাদের বসতে বলল আদালা হেনরিকা।
বিশাল ড্রইংরুম। সোফা সেঁটে সাজানো। অনেক পুরানো। ঘরের সবকিছুই পুরানো, যা মোটামুটি এখন অ্যান্টিকে পরিণত হয়েছে।
আহমদ মুসার পাশের এক সোফায় বসল ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড। আর আহমদ মুসার ডান পাশের সোফায় বসল আদালা হেনরিকা।
বসেই বলল আদালা হেনরিকা, ‘স্যার, এখানকার সবই পুরানো। বলতে পারেন পুরানো এক টুকরো জার্মানী।’
‘ম্যাডাম আদালা হেনরিকা, এ দৃশ্য দুর্লভ। যা দুর্লভ তার প্রতিই মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ স্যার। তবে…।’
কথা শেষ করতে পারলো না আদালা। ঘরে প্রবেশ করল আদালা হেনরিকার মা ও ব্রুনা্
ঘরে প্রবেশ করে এগোতে এগোতে বলছিল, ‘ধন্যবাদ আদালা, মেহমানদের বসিয়েছ।’
আদালার মা আহমদ মুসার কাছে এসে বলল, ‘বাবা প্লিজ একটু বস। আমি আসছি। তোমার সাথে কিছু কথা আছে বাবা।’
বলে ভেতরে চলে গেল আদালা হেনরিকার মা।
মিনিট খানেকের মধ্যে একটা হুইল চেয়ার ঠেলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল আদালার মা। হুইল চেয়ারে সত্তরোর্ধ একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, চেহারা। রঙে পুরো শ্বেতাংগ যেন নয়, চোখ ও মুখের আদলের দিক থেকেও নয়। ঠিক ইহুদিরা যেমন শ্বেতাংগ হয়েও ঠিক শ্বেতাংগ হয় না তেমন।
প্রৌঢ়ের দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। খুব বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি।
হুইল চেয়ার ভেতরে প্রবেশ করতেই আদালা হেনরিকা উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘স্যার, ব্রুনা, মি. সেনফ্রিড, হুইল চেয়ারে বসা উনি আমার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।’
আহমদ মুসাসহ সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘গুড মর্নিং স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম সবাইকে। কিন্তু আপনারা শুনেছেন, আমাদের পরিবারের জন্যে আজকের সকাল এক সর্বনাশা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ বলল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার। তার কন্ঠ কিছুটা কাঁপা ও ভারি।’ তার উপর তার চোখে-মুখে অসুস্থতার ক্লান্তি।
কথা শেষ করেই আবার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘প্লিজ আপনারা বসুন। আপনারা মেহমান। আমাদের দু:খের কথা শুনিয়ে আপনাদের বিব্রত করা উচিত নয়। আমি আদালার মা আলিসিয়ার কাছে শুনলাম, আপনি আদালাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, শয়তানদের দাবি অনুসারে আমাদের স্বর্ণমুকুটটি তাদের দিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে। সে প্রতিশ্রুতি শয়তানদের দিয়ে দেয়াও হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুর, এমনকি জীবনের বিনিময়েও পরিবারের এই ঐতিহাসিক আমানতকে শয়তানদের হাতে আমরা দিতে পারি না।’ আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার এই কথাগুলো বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘স্যার, আমি আদালা হেনরিকাকে বলেছি ঠিকই, তবে আমার পরামর্শটা সময় কিল করার জন্যে, স্বর্ণমুকুটটি ওদের দিয়ে দেবার জন্যে নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সময় কিল করা কি জন্যে?’ জিজ্ঞাসা আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের।
‘আমরা এখানে পৌঁছা পর্যন্ত তারা কিছু করে না বসে এজন্যেই সময় কিল করার কথা বলেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবনার চিহ্ন তার চোখে-মুখে। একটু পর বলল, ‘তার মানে আপনারা কিছু করতে চান। আমরা পুলিশকে কিডন্যাপের পরপরই জানিয়েছিলাম। পুলিশ এসেছিল, আমাদের স্টেটমেন্ট নিয়েছিল। ‘আমরা উদ্ধারের চেষ্টা করছি’ বলে চলে গেছে। আবার সকালে লাশ যখন ফেলে গেল, তখন আবার জানানো হয়েছে। পুলিশ এসে আমাদের বক্তব্য নিয়েছে, তার পর লাশ নিয়ে চলে গেছে। শয়তানরাও এই সময় আসা-যাওয়া করেছে, পুলিশ স্টেশনের সামনে দিয়েই নিশ্চয়। ইয়ংম্যান বলুন, আর কি করার আছে?’
‘লোকাল পুলিশের সহযোগিতা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। ইতিমধ্যে আপনাদের ও স্বর্ণমুকুটের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘উর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া এবং পাওয়ার বিষয়টা সময়-সাপেক্ষ। সে সময়ের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘আমি একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি স্যার।’
বলে আহমদ মুসা তার মোবাইল পকেট থেকে বের করতে করতে বলল ‘আরও একবার স্বর্ণমুকুট নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, সে সময়টা কথন এবং কোন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এটা দেখা-শোনা করেছিলেন, তার নাম কি ছিল?’
‘গত বছর এপ্রিলে ঐ ঘটনা ঘটে। তখন এই স্যাক্সনী অঞ্চলের পুলিশ প্রধান ছিলেন মার্লিন ডেস্ট্রিস।’ বলল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলে আহমদ মুসা মোবাইলে কল করল জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিসকে।
মোবাইল কানের কাছে তুলে ধরেছে। রিং হচ্ছে ওপারে শুনতে পাচ্ছে আহমদ মুসা।
তিনবার রিং হতেই ওপার থেকে ভারি কন্ঠের ‘হ্যালো’ শব্দ ভেসে এল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাবে এ সময় সশব্দে দরজা ঠেলে ঝড়ের বেগে তিনজন মুখোশধারী প্রবেশ করল ঘরে। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান।
তিনটি রিভলবার সবাইকে তাক করেছে।
আহমদ মুসার কথা বলা হলো না। মোবাইল ধরা হাত ধীরে ধীরে নেমে এল পামে জ্যাকেটের পকেটের গা ঘেঁষে।
হাতের মোবাইটি সে ছেড়ে দিল সোফার উপর। তার হাতটি জ্যাকেটের পকেটের আরও ঘনিষ্ঠ হলো।
মুখোশধারীদের একজন আদালার মাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ তোমার মেয়ে আদালা হেনরিকাকে, সে সময় মত এসেছে এ জন্যে। তাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। তাকে লকারের চাবি কিংবা কোড দিয়ে দাও। মুকুটটি তুলে নিয়ে আমরা তাকে ছেড়ে দেব। আর ভালো লাগলে তোমার মেয়েও আমাদের সাথে থেকে যেতে পার। সুন্দর মেয়ে বানিয়েছ তোমরা।’
‘মুখ সামলে কথা বল শয়তানরা। আর মুকুট তোমরা পাবে না। এটা আমাদের পবিত্র সম্পদ, আমাদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান।’ বলল ক্রুদ্ধ কন্ঠে আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
হো হো করে হেসে উঠল মুখোশধারীদের একজন। বলল, ‘এটা তোমাদের পরিবারের পবিত্র সম্পদ নয়। তোমরা একে অপবিত্র করছ। আদি জার্মান রক্তের স্যাক্সন রাজা চতুর্থ অটো পোপের একজন প্রতিভূ ছিলেন। জার্মান রক্ত ও খৃস্টীয় বিশ্বাস দুই দিক দিয়েই তিনি ছিলেন পবিত্র। তার এই পবিত্র মুকুট তোমাদের মত আধা-জার্মান ও আধা-খৃস্টানদের কাছে একদিনও থাকতে পারে না। মনে রেখো, তোমরা দয়া করে আযাদ করা একজন দাস ব্যক্তির উত্তরসূরি।’
‘চুপ কর শয়তান। তোমাদের মত টেররিস্ট, ক্রিমিনালদের মুখে এ সব শুনতে চাই না। মুকুট তোমরা পাবে না। আমাদের মেরে ফেলতে পার সে শক্তি তোমাদের আছে। তবে মনে রেখো, এদেশে আইন, বিচার সবই আছে।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার শক্ত কন্ঠে।
হেসে উঠে বলল মুখোশধারীদের একজন, ‘পুলিশ তোমাদের নয়, আইন কি করবে, বিচার কোথায় পাবে? গত রাত থেকে দু’বার তোমরা পুলিশের কাছে গেছ। আমরা তোমার ছেলেকে রাতে ধরে নিয়ে গেলাম, তারপর সকালে এসে তার লাশ তোমাদের বাসায় ফেলে গেলাম, পুলিশ কিছু করেছে? করেনি। করবেও না।’
এ মুখোশধারী থামতেই আরেকজন মুখোশধারী শক্ত কন্ঠে নির্দেশের সুরে বলল, ‘আর কথা নয়। তুলে নাও আদালা হেনরিকাকে।’
একজন মুখোশধারী সংগে সংগে এগোলো আদালার দিকে।
আদালা জড়িয়ে ধরল তার মাকে।
মুখোশধারী আদালাকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে টানাটানি শুরু করল।
‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের মত শয়তানদের হাতে মেয়েকে ছেড়ে দেব না।’ চিৎকার করে বলল আদালার মা।
‘শোন তোমরা, ঠিক আছে আদালা হেনরিকা যাবে, তবে তার সাথে আমিও যাব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, আদালার সাথে কেউ যাবে না।’ নির্দেশের সুরে সেই মুখোশধারী আবার বলে উঠল।
তার কথা শেষ হতেই আদালা হেনরিকাকে ধরতে যাওয়া মুখোশধারী আদালাকে ছেড়ে দিয়ে তার স্টেনগানের নল আদালার মায়ের মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘তবে তুমি মর। তার পরেই আমরা নিয়ে যাব আদালাকে।’ তার তর্জনি স্টেনগানের ট্রিগারে চেপে বসছিল।
‘খবরদার গুলি করবে না আদালার মাকে। যদি কর তিনজনকেই মরতে হবে।’ চিৎকার করে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে উদ্যত রিভলবার।
আদালার মাকে গুলি করতে উদ্যত মুখোশধারীর তর্জনি সরে গেছে স্টেনগানের ট্রিগার থেকে আকস্মিক চিৎকার শুনে। সে আর অন্য দু’জন মুখোশধারী তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের কারো স্টেনগানই তখন আহমদ মুসার দিকে উদ্যত নয়। কিন্তু আহমদ মুসার দিকে ঘুরে তাকাবার পরই দু’জন মুখোশধারীর স্টেনগানের নল বিদ্যুত গতিতে উঠে আসছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল, এই বেপরোয়া টেররিস্টদের এই মুহুর্তে একমাত্র মৃত্যুই থামাতে পারে, অন্য কিছু নয়।
আহমদ মুসার তর্জনি চেপে বসেছে তার রিভলবারের ট্রিগারে। দু’টি গুলি বেরিয়ে গেল। দু’জন মুখোশধারী টেররিস্ট মাথায় গুলি বিদ্ধ হয়ে কোন শব্দ না করেই ছিটকে পড়ল মেঝের উপর।
বেপরোয়া তৃতীয় মুখোশধারী তার স্টেনগানের ব্যারেল আদালার মার মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার স্টেনগানের ব্যারেল দ্রুত উঠে আসছিল আহমদ মুসা লক্ষ্যে।
‘স্টেনগানের নল আর ওপরে তুলো না মুখোশধারী, অন্যথা করলে তোমার পরিণতি তোমার সাথীর মতই হবে।’
আহমদ মুসা মুখোশধারীর দিকে রিভলবার তাক করে তাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল।
কথাগুলো কানেই গেল না যেন মুখোশধারীর। তার স্টেনগানের ব্যারেল উঠে আসছিল। তার প্রস্তুত তর্জনিও স্টেনগানের ব্যারেলে।
মুখোশধারীল স্টেনগানের নল টার্গেটে উঠে আসার আগেই আহমদ মুসার রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি চেপে বসল। আহমদ মুসা ধীরে-সুস্থে টাগের্ট করেছিল তার বাহুসন্ধিকে।
ডান বাহুসন্ধিতে গুলি খাওয়ায় মুখোশধারীর হাত থেকে খসে পড়ল স্টেনগান।
কিন্তু বিস্ময়কর বেপরোয়া মুখোশধারী। বাহুসন্ধিতে গুলি খেয়ে স্টেনগান পড়ে যাওয়ার সংগে সংগেই তার বাম হাত ঢুকে গেল জ্যাকেটের পকেটে। বেরিয়ে এল পিংপং বলের মত গোলাকার বস্তু নিয়ে। বিদ্যুৎ গতিতে তার বাম হাতটি উঠে আসতে লাগল আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
গোলাকার বস্তুটি দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, ওটা ফায়ার বোম, ফায়ার গানও হতে পারে। ফায়ার বোম হলে আহমদ মুসা ও তার পাশের দু’একজন মারা যাবে। আর ফায়ার গান হলে শুধু আহমদ মুসাই মারা যাবে। ফায়ার গানের ফায়ার বুলেট রিভলবার ও স্টেনগানের বুলেটের মতই শরীরকে ভার্টিক্যালি বিদ্ধ করে।
আহমদ মুসার রিভলবার, ট্রিগার ও তার তর্জনি প্রস্তুত ছিল। তর্জনি চেপে বসল ট্রিগারে। বেরিয়ে গেল গুলি।
আহমদ মুসা এবার তার বাম বাহুসন্ধিমূল আহত করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুখোশধারী বোমা ছোড়ার জন্যে তার হাত উপরে তোলায় এবং দেহ কয়েক ইঞ্চি নড়ে যাওয়ায় গুলি গিয়ে একদম বিদ্ধ হলো তার বাম বুকে।
বোমা ছোড়া আর তার হলো না। গুলি বিদ্ধ তার দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।
রিভলবার সোফায় রেখে তুলে নিল মোবাইল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল মোবাইল অন আছে।
মোবাইল কানের কাছে তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যালো স্যার, আমি আহমদ মুসা।’
‘আহমদ মুসা আপনি ঠিক আছেন তো? মোবাইলে ভেসে আসা কন্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছি আপনি আহমদ মুসা।’ বলল ওপার থেকে জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘ধন্যবাদ স্যার, এই মুহুর্তে এখানে একটা বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার অন করা মোবাইলে আমি সব শুনেছি মি. আহমদ মুসা। কয়জন মারা গেছে? বলুন তো জায়গাটা কোথায়?’ বলল ওপার থেকে পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘তিনজন মারা গেছে। ওরা তিনজনই এসেছিল। আর জায়গাটার নাম ‘সালজওয়াডেল’। আহমদ মুসা বলল।
‘ঘটনাটা কোন পরিবারের বা বাড়ির নাম-নাম্বার কি?’ জিজ্ঞাসা করল ওপার থেকে বরডেন ব্লিস।
মুখের কাছে মোবাইলটা একটু সরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা আদালা হেনরিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার পরিবারের কোন নাম-পরিচয় বা বাড়ির নাম্বার বলুন।’
‘আমরা ‘আলগার’ পরিবার। বাড়ির নাম্বার ‘সালজওয়াডেল, এম-৯১’। আতংকগ্রস্ত আদালা হেনরিকা শুকনো, কম্পিত কন্ঠে বলল।
‘স্যার, ‘আলগার’ পরিবার, আর বাড়ির নাম্বার, সালজওয়াডেল এম-৯১।’ বলল আহমদ মুসা মোবাইল মুখের কাছে তুলে নিয়ে।
‘আচ্ছা, আচ্ছা। মনে পড়ছে। গত বছর শুরুর দিকে মুকুট নিয়ে তাদের কোন সমস্যা হয়েছিল, আমি দেখেছিলাম পুলিশ রিপোর্টে।’ পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস ওপার থেকে বলল।
‘জি স্যার, ঠিক বলেছেন। আমি ওদের কাছে শুনলাম গত বছরও এই সমস্যা হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রতিপক্ষ কি তারাই, যারা গত বছর এসেছিল?’ জিজ্ঞাসা বরডেন ব্লিসের।
‘ওরা এবারও মুখোশ পরে এসেছে। এরা চিনতে পারেনি। পুলিশ তাদের চেনে, এদের কথায় আমি জেনেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শুনুন, মি. আহমদ মুসা। আমি সব বুঝতে পেরেছি। আমি সালজওয়াডেলের পুলিশকে এখনি বলে দিচ্ছি। এখনি ওরা আলগার পরিবারে যাবে। আর মধ্য সালজওয়াডেলের পুলিশ স্টেশনের সবাইকে সাসপেন্ড করে আমি এখনি ওখানে নতুন অফিসার পাঠাচ্ছি।’ বলল বরডেন ব্লিস, জার্মানীর পুলিশ প্রধান।
‘ধন্যবাদ স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আচ্ছা, মি. আহমদ মুসা। আপনি কিভাবে এত দূরে এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়লেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধান বরডেনের।
‘আমরা ব্রুমসারবার্গ থেকে আসছিলাম হামবুর্গের দিকে আমার সেই কাজে। খারাপ আবহাওয়ায় গাড়ির জন্যে অপেক্ষমাণ আলগার পরিবারের মেয়ে আদালা হেনরিকাকে লিফট দিতে গিয়ে এখানে এসেছি এবং ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছি। আমরা মাত্র দশ পনের মিনিট আগে এখানে পৌঁছেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বরই আপনাকে এখানে এনেছেন। থ্যাংক গড। একটা পরিবারকে তিনি বাঁচিয়েছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আরও আপনার এই কলের জন্যে আরেকটা ধন্যবাদ। ওকে, মি. আহমদ মুসা। বাই।’ বলল ওপার থেকে পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘ধন্যবাদ স্যার আপনাকে।’
বলে আহমদ মুসা মোবাইলটা সোফায় নামিয়ে রেখে রিভলবারটা সোফা থেকে তুলে নিয়ে পকেটে পুরল।
মুহুর্তের জন্যে মাথা নিচু করে আত্নস্থ হয়ে আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করে মাথা তুলল। তাকাল সবার দিকে। সবাই পাথরের মত আতংকগ্রস্ত হয়ে বসে আছে। সবার চোখে আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। আহমদ মুসার চোখ একবার লাশ তিনটির উপর দিয়ে ঘুরে এল।
অবশেষে তাকাল আহমদ মুসা আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের দিকে। বলল, ‘স্যার। অল্পক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসছে। আর সন্ত্রাসীদের যোগ-সাজশকারী এখানকার পুলিশ অফিসার সবাই সাসপেন্ড হয়েছে। নতুন এক সেট পুলিশ অফিসার আসছেন এখানে।’
‘এখানে যা ঘটল, তা আমার কাছে স্বপ্ন। যা আপনি বলছেন তাও আমার কাছে স্বপ্ন। কি হবে, কি ঘটবে আরও, কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি, আপনি যে জন্যে সময় কিল করতে বলেছিলেন, তা ঘটেছে।’ বলে কান্না রোধ করতে দু’হাতে মুখ ঢাকল বৃদ্ধ জোসেফ জ্যাকব আলগার।
আদালা হেনরিকা এবং আদালার মা অ্যাল্লি আলিসিয়া দু’জনেরই মুখ নিচু হলো। উদ্বেগ-আতংকে তাদের চোখ-মুখ পাংশু।
‘আর কিছুই ঘটবে না স্যার। আমি বলতে পারি, আলগার পরিবারের উপর থেকে আল্লাহ বিপদটা দূর করে দেবেন।’ বলল আহমদ মুসা সান্ত্বনার সুরে।
মুখ তুলেছে আদালা হেনরিকা। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আপনি কার সাথে কথা বললেন?’
‘জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিসের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিসের সাথে?’ মুখ তুলে চোখ মুছে বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘জি হ্যাঁ। উনি আমাকে জানেন এবং আমিও তাঁকে জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
শুধু জোসেফ জ্যাকব আলগার নয়, আদালা ও আদালার মায়ের মুখেও নতুন বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো। প্রশ্নও তাদের চোখে-মুখে। জার্মানীর পুলিশ প্রধানের সাথে এভাবে বন্ধুর মত স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন, ‘কে ইনি?’
প্রশ্নটা করেই বসল জোসেফ জ্যাকব আলগার। বলল, ‘স্যরি, আপনার পরিচয় জানা হয়নি। ফিল্মে যা ঘটে তার চেয়ে বড় কিছু আপনি করেছেন। জার্মানীর পুলিশ প্রধান আপনার সাথে বন্ধুর মতই বলা যায় কথা বললেন।’
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে ব্রুনাই মুখ খুলল। বলল, ‘তাঁর নাম ইতিমধ্যেই আপনারা জেনেছেন, আহমদ মুসা। বলতে পারেন উনি আধুনিক যুগের একজন হাতেম তাই। রবিনহুডের কর্মক্ষেত্র ছিল একটা অঞ্চল, কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র গোটা বিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বহু দেশের উনি সম্মানিত নাগরিক। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তিনি থাকেন মুসলিম দুনিয়ার কেন্দ্র সৌদি আরবের মদিনায়। আমাদের একটা বড় কাজে সহযোগিতার জন্যে এসেছেন জার্মানীতে। আমাদের পুলিশ প্রধানসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেককেই ওঁর সম্পর্কে ব্রীফ করেছেন তাহিতি দ্বীপপু্ঞ্জের ফরাসি গভর্নর। আরেকটা বড় পরিচয় উনি ফ্রান্সের বুরবুক রাজকুমারীর স্বামী। আর ধর্মবিশ্বাসে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান।’
ব্রুনা থামতেই তাকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তোমাকে কথার মাঝখানে বাধা দেইনি বলে মনে করো না ব্রুনা, তোমার কথাগুলো আমি পছন্দ করেছি। কোন লোকের সামনে তার এভাবে প্রশংসা করা শুধু অসৌজন্যমূলক নয়, ক্ষতিকরও।’ গম্ভীর কন্ঠ আহমদ মুসার। তার চোখে-মুখে অসন্তুষ্টির চিহ্ন।
‘সংগে সংগেই ব্রুনা দু’হাত জোড় করে বলল, ‘মাফ করুন ভাইয়া। এখানকার ঘটনায় আমিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম বলে কথাগুলো আমি বলে ফেলেছি।’
উঠে দাঁড়িয়েছে আদালা এবং আদালার মা। তারা এবং আদালার বাবা আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে লম্বা বাও করে বলল, ‘ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ যে আমরা ঠিক সময়ে আপনাকে পেয়েছি। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করেছেন আপনাকে দিয়ে।’ আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের শেষ কথাগুলো অশ্রুরুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
একটু থেমেই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল আদালার বাবা। ঠিক এ সময়েই সিঁড়িতে অনেকগুলো বুটের শব্দ পাওয়া গেল।
আদালার বাবা থেমে গেছে। সবাই উৎকর্ণ।
‘পুলিশ আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
পরক্ষণেই একদল পুলিশ ঘরে প্রবেশ করল। তাদের সামনে রয়েছে মধ্য সালজওয়াডেল পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত অফিসার।
ভারপ্রাপ্ত অফিসার ঘরে ঢুকেই এগিয়ে গেল আহমদ মুসার কাছে। স্যালুট করে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় আহমদ মুসা, স্যার?’
স্যালুটের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি আহমদ মুসা।’
‘স্যার, পুলিশের বড় সাহেব আপনাকে সালাম বলেছেন।’
বলেই পুলিশ অফিসার এগিয়ে গেল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের দিকে। তাকে বলল, ‘স্যরি স্যার, আর কোন অসুবিধা হবে না। আমরা সব দেখছি।’
‘ধন্যবাদ।’ বললো জোসেফ জ্যাকব আলগার। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারটি ঘুরে দাঁড়িয়ে পুলিশদের নির্দেশ দিল, ‘যেমন আছে তেমনি লাশগুলোর ছবি তাদের অস্ত্রসমেত নিয়ে যাও। লাশ ও অস্ত্রগুলো যথানিয়মে হেফাজতে নাও। নিয়ে গাড়িতে তোল।’
লাশ ও অস্ত্র উঠানো হয়ে গেলে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আদালার বাবাকে বলল, ‘স্যার, আমরা রক্তমাখা কাপের্ট আলামত হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।’
আহমদ মুসাসহ সবাই উঠে দাঁড়াল।
পুলিশরা সোফা সরিয়ে কার্পেট তুলে নিয়ে গেল।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার দু’জন পুলিশকে নির্দেশ দিল, ‘কিছু রক্ত মেঝে পর্যন্তও এসেছ্ তোমরা জায়গাটা পরিষ্কার করে দাও।’
কাজ শেষ করে সব পুলিশ চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার একবার আহমদ মুসার দিকে আর একবার আদালার বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার, দু’জন পুলিশ সিঁড়ির গোড়ায়, দু’জন পুলিশ গেটে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকবে। কোন প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন স্যার।’
‘ধন্যবাদ অফিসার।’ বলল আহমদ মুসা।
আদালার বাবাও ধন্যবাদ দিল ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারকে।
আহমদ মুসাদের নিয়ে আদালার মা পাশের রুমে চলে গেল। বাবার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে আদালা হেনরিকা তাদের পেছন পেছন চলল।
সবাইকে বসিয়ে নিজে বসতে বসতে বলল, ‘একই মানুষের কি বিপরীত দুই রূপ! এই ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার রাতেও এসেছিলেন। সকালেও এসেছিলেন। তখন তার আচরণ দেখে মনে হয়েছিল, আমরা মহাদোষী আর উনি বিচারক। আর এখন মনে হলো, আমরা তাদের মনিব আর তারা আমাদের সার্ভ করার জন্যে তৈরি।’
‘তখন চাপ বা লোভে পড়েই তারা ঐ আচরণ করেছিলেন, এখন চাপ এসেছে আরও বড়। ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা জানা নেই।’ বলল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
বাবার কথা শেষ হতেই আদালা হেনরিকা আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘স্যার, আমার একটা বিস্ময়, আপনি একটা রিভলবার নিয়ে তিনজন স্টেনগানধারীকে মোকাবিলার সাহস করলেন কিভাবে? যদি ব্যর্থ হতেন, তাহলে কি হতো ভাবেননি?’
গম্ভীর হলো আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘যে সময়ের যা দাবি তখন তা করা উচিত। ভবিষ্যৎ আল্লাহর হাতে।’
‘ঈশ্বরের উপর আপনার এত বিশ্বাস, এত ভরসা?’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘আমার স্রষ্টা যিনি, আমার প্রতিপালক যিনি, আমার ভালো-মন্দ প্রকৃতপক্ষে যাঁর হাতে, তাঁর উপর ভরসা ছাড়া আর কার উপর ভরসা করব!’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধর্মে তো আপনার দারুণ বিশ্বাস!’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘আমার দাদু বলতেন, আমাদের পরিবার শুরু থেকে খুব ধর্মভীরু ছিল। কিন্তু মি. আহমদ মুসা, আমার একটা কৌতুহল, ‘ভবিষ্যৎ ঈশ্বরের হাতে’ এটা কিভাবে? আমি ঈশ্বরের উপর ভরসা করে আক্রমণকারী তিনজনের উপর চড়াও হলাম, এখানে ঈশ্বর কিভাবে সাহায্য করবেন?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘আল্লাহ যেমন মানুষের স্রষ্টা, তেমনি মানুষের শক্তি সাহসের নিয়ন্ত্রকও তিনি। আর সব শক্তি, সামর্থ্য, কৌশলের উৎসও তিনি। এই সাথে আল্লাহর বান্দারা প্রার্থনা করলে বাড়তি দানও করেন তিনি। তাই মানুষ যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে, নির্ভর করে কোন বিষয়ে, তখন আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তার শক্তি, সামর্থ্য, কৌশল বাড়িয়ে দেন। আর একটা কথা স্যার, মানুষ যখন নিজের শক্তির উপর ভরসা করে লড়াই করে, তখন তার মনে কি হবে, না হবে, এই উদ্বেগ, এই পিছু টান থাকে। যা তাকে দুর্বল করে। যার ফলে সে একজন তিনজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পায় না। পেলেও এই দুর্বলতার কারণে সে সফল নাও হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমুগ্ধের চমক। আদালা ও তার মা আলিসিয়াও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
‘কঠিন দার্শনিক কথা বলেছেন মি. আহমদ মুসা। ঈশ্বরের প্রতি এমন বিশ্বাস থাকলে আপনি যা বলেছেন ঘটতে পার। আমরা বোধ হয় একটু আগে এটাই দেখলাম। ধন্যবাদ আহমদ মুসা আপনাকে।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘ওয়েলকাম স্যার। স্যার, আমরা এখন উঠতে চাই। এখানের কাজ শেষ। এবার আমরা চলে যেতে চাচ্ছি।’ আহমদ মুসা বলল।
হুইল চেয়ারে একটু সোজা হয়ে বসল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার। দুই হাত জোড় করে বলল, ‘আমিও মনে করেছিলাম আপনার কাজ শেষ। পুলিশ আমাদের নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করেছে এবং আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এখন ভাবছি, আপনি একজন এশিয়ান মুসলিম। এশিয়ান মুসলিমরা খুব মেহমানদারী পছন্দ করেন। আমি আপনার কাছে এই মেহমানদারীর সুযোগ প্রার্থনা করছি। লাঞ্চের সময়ের বেশি দেরি নেই। আমার অনুরোধ আমার কথা আপনারা রক্ষা করবেন।’
আহমদ মুসা ব্রুনা ও তার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে একবার তাকিয়ে জোসেফ জ্যাকব আলগারকে বলল, ‘আপনি পিতৃতুল্য।
আপনার অনুরোধ আমাদের কাছে আদেশ। আমরা লাঞ্চ করেই যাব। কিন্তু একটা বিষয় আমার মনে কৌতুহল সৃষ্টি করেছে, যে বিষয়ে আমি জানতে চাই।’
‘কি সেটা মি. আহমদ মুসা?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘সন্ত্রাসীরা আপনাদের পরিবারকে হাফ জার্মান, হাফ খৃস্টান বলেছে। কেন ওরা তা বলল?’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগে কথা বলল না জোসেফ জ্যাকব আলগার। প্রশ্নটা শুনেই তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আদালা ও তার মা আলিসিয়ার মুখেও কিছুটা বিব্রত ভাব। তাদের আলগার পরিবারের একটা গোপন ও দুর্বল দিক এটা।
জোসেফ জ্যাকব আলগার একটুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘বিষয়টা আমাদের একটা ফ্যামেলি-সিক্রেট। এটা একটা বড় দুর্বলতা আমাদের পরিবারের। আমাদের দুর্বলতার এ বিষয়টি আমরা সব সময় গোপন করে আসছি। এরপরও বিশেষ মহল এটা খুঁজে বের করেছে। একবার হামবুর্গের আন্তর্জাতিক অ্যান্টিকস প্রদর্শনিতে মুকুটটি নিয়ে গিয়েছিল আমাদের পরিবার। রাজা চতুর্থ অটো’র দেয়া অতিমূল্যবান এ অ্যান্টিকস মুকুটটি তাদের নজরে পড়ে যায়। আমাদের বিপদ তখন থেকেই শুরু। ওরাই সন্ধান করে আমাদের পরিবারের হাফ জার্মান হাফ খৃস্টান ও দাস-ব্যাকগ্রাউন্ড বের করেছে এবং একে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।’ থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘আসল সত্যটা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জোসেফ জ্যাকব আলগার বলল, ‘আপনি অন্যদের মত নন। আপনার মত মুসলমানও আমার চোখে পড়েনি। আপনি পূর্বাপর সব জানা একজন ভালো ও নিষ্ঠাবান মুসলিম। আপনার মত বিজ্ঞ মুসলিমকে সব বলা যায় মি. আহমদ মুসা। তবে এখানে নয়। চলুন আমরা স্টাডিতে যাই।’
‘সেটাই ভালো হবে।’ বলল আদালা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে।
সবাই উঠল।
আদালা তার বাবার হুইল চেয়ার ঠেলে আগে আগে চলল। আর পেছনে তার মা আলিসিয়া আহমদ মুসাদের নিয়ে এগোতে লাগল।

কথা বলছে জোসেফ জ্যাকব আলগার।
তার হুইল চেয়ার ঘিরে কয়েকটা চেয়ার নিয়ে বসেছে আহমদ মুসা, আদালা, ব্রুনা, আদালার মা এবং আলদুনি সেনফ্রিড।
স্টাডি রুমটা তিন তলায়।
বিশাল রুম।
ঘরের চারদিকে দেয়াল বরাবর অনেক আলমারি। বইয়ে ঠাসা।
কয়েকটা কম্পিউটার আছে কক্ষে। অনেক কিয়টি পড়ার টেবিল। তার সাথে আরামদায়ক কুশন চেয়ার। ঘরে কয়েকটি ইজি চেয়ারও রয়েছে।
চেয়ার, আলমারি, টেবিল, ইজি চেয়ার সবই পুরানো। অ্যান্টিকস হিসেবে শো-রুমে থাকার মত।
ঘরের সবকিছুই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।
ঘরে ঢুকেই আহমদ মুসা বলেছিল, মনে হচ্ছে আমরা এক অ্যান্টিকস এর জগতে এলাম। কি করে আপনারা এগুলোকে এত সুন্দরভাবে রক্ষা করেছেন?’
জোসেফ জ্যাকব আলগার বলেছিল, ‘আমরা মূল্যবান ফার্নিচার রক্ষা করিনি, আমরা ঐতিহ্য রক্ষা করেছি। আর মি. আহমদ মুসা আমাদের বাড়ির সবকিছুই অ্যান্টিকস, শুধু আমরা ছাড়া। থালা-বাটি থেকে সবকিছুই দেখবেন সেই পুরানো ধাঁচের।’
‘পুরানো ধাঁচের বটে, কিন্তু পুরানো নয়। আজকের আধুনিকতার সময়হীন নিরাভরণ ও প্রতিযোগিতার বাজারে কষ্ট-ইফেকটিভ পণ্যের সয়লাবে অ্যান্টিকস আজ মর্যাদার আসন লাভ করেছে।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
জোসেফ জ্যাকব আলগার আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘সব বিষয়কে সুন্দর করে বলার শক্তি ঈশ্বর আপনাকে দিয়েছেন।’
কথা বলছিল জোসেফ জ্যাকব আলগার। তার ইজি চেয়ারের চারপাশে বসা আহমদ মুসা, ব্রুনা, আলদুনি সেনফ্রিড, আদালা ও আদালার মা আলিসিয়াদের অখণ্ড মনোযোগ তার দিকে।
বলছিল জোসেফ জ্যাকব আলগার, ‘যা বললাম তা সত্যি। আমরা হাফ-জার্মান, হাফ-খৃস্টান ও দাসবংশোদ্ভুত- তাদের এই অভিযোগ সম্পর্কে আমি বিস্তারিত কিছুই জানি না। আমার দাদুকে আমি বেশি দিন পাইনি। বাবাকে তো পেয়েছি, কিন্তু তিনি আমাকে কিছুই বলেননি। তবে বাবার কয়েকটা কথা আমি একদিন হঠাৎ শুনে ফেলেছিলাম। বাবা এই স্টাডিতে বসে আন্টির সাথে গল্প করছিলেন। আন্টি ছিলেন বাবার বড়। দরজা ও জানালা সব বন্ধ ছিল। আমি পাশের করিডোরটা ধরে জানালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আন্টির একটা কথা আমার কানে গেল, ‘হ্যাঁ জোসেফ, কথাগুলো সত্য যে, আমরা পুরো জার্মান নই, পুরোপুরি খৃস্টানও আমাদের কখনও মনে করা হয়নি। আমাদের দাসবংশোদ্ভুত একথাও একটা কঠিন সত্য। আন্টির কথা শুনেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। শুনতে লাগলাম তাদের কথা। ‘কিন্তু এই অভিযোগ কেন সত্য হবে? সত্য হলে পরিবারের সবাই এটা জানবে না কেন?’ বাবা প্রশ্ন করলেন আন্টিকে।
আমারও প্রশ্ন দাদুর কাছে এটাই ছিল। দাদু আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, জার্মানীতে প্রচুর অজার্মান ও নন-ইউরোপিয়ান এসেছেন সেই প্রাচীন কাল থেকে, মধ্যযুগের আরও বেশি আগে থেকে। তাদের বেশির ভাগ খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউ ইচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে। এরা আবার মুখে খৃস্টান হলেও মনেপ্রাণে খৃস্টান হয়নি। খৃস্টধর্মের মূল স্রোতে কখনও এদের গ্রহণ করা হয়নি। এদেরই বলা হয় হাফ খৃস্টান, হাফ জার্মান। আর এ কথাও সত্যি, মধ্যযুগের দাস ব্যবসায়ের যুগে যুদ্ধে পরাজিতদের কিংবা কোনওভাবে ধৃত বিদেশি, বিশেষ করে নন-ইউরোপিয়ানদের দাস হিসেবে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মত জার্মানীতেও প্রচুর মানুষ বিক্রি করা হয়েছে। তারাও হাফ খৃস্টানদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। মনে করা হয় আমাদের পরিবার এ ধরনেরই এক দাসবংশোদ্ভুত পরিবার। আমি দাদুর শেষ বাক্যটা শুনে বলেছিলাম, ‘মনে করা হয় কেন? সত্যটা কি?’ দাদু বলেছিলেন, ‘কারণ, কোন নিশ্চিত প্রমাণ নেই, আমাদের পরিবারেও এ ধরনের কোন দলিল নেই। তবে বোন, আমার দাদু জার্মানীর প্রথম আদমশুমারির বরাত দিয়ে আব্বাকে বলেছিলেন তাতে নাকি প্রত্যেক পরিবারের অরিজিন কি তার উপর একটা কলাম ছিল। সে কলামে নন-ইউরোপিয়ানদের জন্যে NE এবং দাস বংশোদ্ভুতদের s বর্ণ-সংকেত দেয়া ছিল। পরবর্তী আদমশুমারিতে এ ধরনের কলাম আর ছিল না। কিন্তু প্রথম আদমশুমারির তথ্যই বিভিন্ন ডকুমেন্ট ও লেখায় বিভিন্নভাবে উদ্ধৃত হয়ে আসছে।’ আন্টির কথা এ পর্যন্ত শুনেই আমি চলে এসেছিলাম। বিভিন্ন সময়ের এসব কথা থেকেই আমাদের পরিবারে সাধারণ সবা্রই জানা হয়ে গেছে যে আমাদের পরিবার দাস বংশোদ্ভুত এবং আমাদেরকে পুরো জার্মান ও খৃস্টান মনে করা হয় না।’ থামল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
থেমেই আবার সংগে সংগে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ভুলে গেছি। সেটা আমাদের একটা ফ্যামিলি সিক্রেট। এই সিক্রেট পরিবারের সবাই জানে না। পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে পরিবারের হেড অব দ্য ফ্যামিলী যখন ঠিক মনে করবেন বা প্রয়োজন মনে করবেন, তখন তিনি তাঁর সরাসবি উত্তরসূরি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ, তার অবর্তমানে সরাসবি উত্তরসূরি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাকে সিক্রেট জিনিসটি হস্তান্তর করে যান।’ থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
অপার বিস্ময় নামল আদালা হেনরিকা ও তার মা অ্যাল্লি আলিসিয়ার চোখে-মুখে। বলল আদালা তার পিতাকে লক্ষ্য করে, ‘এত গোপনীয় যে জিনিসটা, সেটা কি বাবা?’
‘এটা সত্যিই খুব গোপনীয়। কিন্তু কেন সেটা গোপনীয় আমি জানি না। বাবা-দাদাসহ আমাদের কোন পূর্বপুরুষই এটা প্রকাশ করেননি। আমিও পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসরণ করব, কোনভাবেই এটা প্রকাশ করব না। আজকের এই ঘটনার আগ পর্যন্ত আমার এটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু মি. আহমদ মুসাকে দেখার পর এই সিদ্ধান্ত আমার পাল্টে গেছে। আমার মনে হয়েছে মি. আহমদ মুসার মত এমন সচেতন, জ্ঞানী, নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী এবং সব দিক দিয়ে যোগ্য ও সহমর্মী এবং সেই সাথে দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম ইসলামের অনুসারী কোন মানুষের সাক্ষাৎ আমাদের পরিবার ইতিপূর্বে নিশ্চয় পায়নি। আমি যখন পেয়েছি, তখন সুযোগটা আমি গ্রহণ করবো।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘কিন্তু বাবা কি এমন বিষয় সেটা, যার জন্যে এমন লোকের সাক্ষাৎ জরুরি?’ আদালা হেনরিকা বলল।
‘গোপন জিনিসটার সাথে একটা ছোট্ট পরামর্শ যুক্ত আছে। সেটা হলো, একত্ববাদী সর্বকনিষ্ঠ ধর্মের অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও জ্ঞানী লোক বিষয়টির গোপনীয়তার রহস্য ভেদ করতে পারবেন। মি. আহমদ মুসাকে আমার এই ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘ধন্যবাদ। আমি জানি না আমি সেই ব্যক্তি কি না। বিষয়টি কোন কিছুর পাঠোদ্ধার বা ‘রিলিজিয়াস কোড’ ধরনের মত কোন কিছুর ডিকোড করার বিষয় হতে পারে। তাই কি জনাব?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনি ঠিক ধরেছেন। বিষয়টি ডিকোড ধরনের।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘ডিকোডের প্রয়োজন! তাহলে জিনিসটা কি বাবা?’ আদালা হেনরিকা বলল।
মাথা একটু নিচু করল জোসেফ জ্যাকব আলগার। মুহূর্তেই আবার মাথা তুলল সে। বলল, ‘সেটা একটা মেহগনি কাঠের বাক্স। বাক্সে সোনার কারুকাজ। লকটি পোড়ানো খাদহীন লোহার। লক-এর তিনটি ঘোরানোর উপযোগী তিনটি ক্ষুদ্র চাকার প্রত্যেকটিতে রয়েছে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো। সংখ্যার ধাঁধায় যুগ-যুগান্তর ধরে আটকে রয়েছে বাক্সটি।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘বাক্সটি কার?’ জিজ্ঞেস করল আদালা হেনরিকা।
‘এটা নির্দিষ্ট করে কেউ জানে না। বলা হয় এটা আমাদের আদি পুরুষের একটি পবিত্র আমানত। সেই পুরুষ জার্মানীতে আমাদের প্রথম পুরুষ, না দ্বিতীয় বা তৃতীয় তা আমরা কেউ জানি না।’
বলে্ একটু থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার। বলল আবার, ‘মি. আহমদ মুসা, আমি কি বাক্সটি আনতে পারি? বাক্সের কোড-রহস্য ভেদ করতে পারি কি আপনার সাহায্য চাইতে?’
‘ধন্যবাদ মি. জোসেফ জ্যাকব আলগার। আপনাদের কোন প্রকার সাহায্য করতে পারলে আমি খুব খুশি হবো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা।।
বলেই জোসেফ জ্যাকব আলগার ঘুরে তাকালো আদালা হেনরিকার দিকে। একটা আলমারি দেখিয়ে বলল, ‘মা, ঐ আলমারির নীচের তাকের বইগুলো নামিয়ে ফেল। কাঠের তাকটার দু’প্রান্তে দেখো দু’টো কাঠের স্ক্রু আছে। স্ক্রু দু’টো তুলে ফেল। তাকটা সরিয়ে দেখ আয়তাকার ছোট সুন্দর একটা বাক্স পাবে। ওটা বের করে আন।
‘পরিবারের পবিত্র আমানত বাক্সটা কি ঐখানে আছে বাবা?’ জিজ্ঞাসা আদালা হেনরিকার।
‘হ্যাঁ, মা। এখানে কতদিন ধরে আছে আমি জানি না। বাবা আমাকে এখানে দেখিয়ে গেছেন। আমার মনে হয় এই আলমারির বয়স ততদিন, যতদিন ধরে বাক্সটা এখানে আছে।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সাধারণ অথচ অসাধারণ নিরাপদ জায়গা এটা। যিনিই এটা করুন, তার অসাধারণ কল্পনাশক্তি ছিল।’
‘ধন্যবাদ স্যার, আমি উঠছি।’ বলে আদালা হেনরিকা উঠে দাঁড়াল।
যেভাবে তার বাবা বলেছিল, সেভাবেই ছোট সুন্দর বাক্সটি বের করে আনল আদালা। এনে তার বাবার হাতে তুলে দিল বাক্সটি।
আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার আস্তে আস্তে বাক্সটি হাতে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে সম্মান দেখাল বাক্সটিকে। তারপর লকটিকে একবার দেখে নিয়ে বাক্সের উপর উৎকীর্ণ দু’টি লাইনের উপর নজর বুলাল। পড়ল আবার, ‘পৃথিবীর একত্ববাদী সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম এবং নিষ্ঠার সাথে সেই ধর্ম পালনকারী, ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞ, বিদ্বান ও সৎ কোন ব্যক্তির জন্যে এই ধাঁধা। এই ধর্মের ধর্মগ্রন্থের প্রথম পঠিতব্য শ্লোকের বা বাক্যের ডিজিটাল নাম্বার হলো বাক্সের লক খোলার কোড।’
পড়ে নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘একত্ববাদী সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম তো আপনার ধর্ম ইসলাম, তাই না?’
‘জি, হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. আহমদ মুসা, প্লিজ এই বাক্সটি হাতে নিন। আপনিও বাক্সের উপরের ইনস্ট্রাকশনটা পড়ে দেখুন।’
বলে জোসেফ জ্যাকব আলগার বাক্সটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বাক্সটি হাতে নিল। আস্তে আস্তে বসল চেয়ারে। তার আগেই আহমদ মুসার দুই চোখ বাক্সের উপরে খোদাই করা উৎকীর্ণ লেখাগুলোর উপর আঠার মত আটকে গেছে।
বাক্সের উপরে মূল্যবান কাঠের উপর উৎকীর্ণ লেখা পড়ল আহমদ মুসা। একটা বিস্ময় জাগল আহমদ মুসার মনে, একত্ববাদী সর্বকনিষ্ঠ ধর্মের লোকের উপর লকের ধাঁধা ভাঙার দায়িত্ব ছাড়লেন কেন! তাহলে উনি কি মুসলিম ছিলেন!
‘কি পড়লেন মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞেস করল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘ধাঁধার বিষয়টাও নিশ্চয় দেখলেন?’ আবার বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘জি, হ্যাঁ। দেখেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মাফ করবেন, আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে। আপনি বুঝতে পারছেন, ডিকোড করা কি সম্ভব? কোন শ্লোক বা কাব্যের কোন ডিজিটাল নাম্বার থাকে, তা কোন দিন শুনিনি!’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘আরবি ভাষার বর্ণের একটা করে ডিজিটাল নাম্বার আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরবি ভাষা! সেটা আবার কোন ভাষা?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবি। এই ভাষাতেই মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে। আবার এটা আরব দেশগুলোর ভাষাও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনি সব জানেন দেখছি। আপনার ধর্মগ্রন্থ নিশ্চয় আপনার পড়া আছে? প্রথম শ্লোক তো অবশ্যই?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘প্রতিদিনই পড়ি, পড়তে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও! তাহলে তো ধর্মগ্রন্থ আপনার কাছেই আছে?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘আছে মানে এই ব্যাগেই আছে। না থাকলেও অসুবিধা হতো না। আমাদের ধর্মগ্রন্থের বিরাট অংশ আমার মুখস্থ আছে।’
‘বিরাট অংশ মুখস্থ আছে? এভাবে কোন বই মুখস্থ করা যায়? মুখস্থ কেউ করে?’ বলল বিস্মিত কন্ঠে আদালার মা আলিসিয়া।
‘আর কোন বই এত সহজে মুখস্থ করা বা মুখস্থ রাখা যায় কি না আমি জানি না। তবে আল্লাহর বাণী এই গ্রন্থ সহজেই মুখস্থ করা যায়, মুখস্থ করা হয়, মুখস্থ রাখাও হয়। এই গোটা ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ আছে এমন লক্ষ লক্ষ লোক দুনিয়ায় আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! বাইবেল কারও মুখস্থ আছে এমন কথা তো কখনও শুনিনি।’ বলল আদালার মা আলিসিয়া।
তার ও আদালার দু’জনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আমিও শুনিনি আলিসিয়া। যাক এদিকের কথা। মি. আহমদ মুসা আপনার ধর্মগ্রন্থ একটু দেখাবেন? আমি দেখিনি কখনও মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘অবশ্যই দেখবেন।’
বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে সুদৃশ্য চামড়ার কভারে মোড়া ছোট্ট কুরআন শরিফ বের করল। কভার খুলে কুরআন খুলে দেখাল সবাইকে।
‘এত ক্ষুদ্র অক্ষর। তবু ভলিউম এত বড় হয়েছে। এই গোটা ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করা ও মুখস্থ রাখা তো মিরাকল।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘সত্যিই বলেছেন ম্যাডাম আদালা হেনরিকা। বিষয়টা সত্যিই একটা মিরাকল।’ ব্রুনা ব্রুনহিল্ড বলল।
‘ধর্মগ্রন্থটা আমি একটু হাতে নিতে পারি জনাব আহমদ মুসা?’ বলল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘অবশ্যই স্যার।’ বলে আহমদ মুসা কুরআন শরিফটা জোসেফ জ্যাকব আলগারের হাতে দিল।
জোসেফ জ্যাকব আলগার কুরআন শরিফটা যত্নের সাথে হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে আহমদ মুসাকে ফেরত দিতে দিতে বলল, ’আমার পূর্বপুরুষরা কেন বাক্সের কোডকে এই ধর্মগ্রন্থের সাথে যুক্ত করলেন জানি না। তবে এটা ঠিক এ ধর্মগ্রন্থকে তারা জানতেন, হয়তো এর সাথে কোন সম্পর্কও তাদের ছিল। সে কারণে এ ধর্মগ্রন্থের প্রতি আমাদেরও ভালোবাসা থাকা উচিত।’
কুরআন শরিফটা ব্যাগে রেখে বাক্সটা আবার হাতে নিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘লকটি কি আমরা এখন খুলব মি. আলগার?’
‘হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা। আমরা খুব খুশি হবো। বাক্সের ভেতরে কি আছে, এটা জানার আগ্রহ আমাদের যুগ-যুগান্তরের। ধাঁধার আড়াল সৃষ্টি করে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই বাক্সে অমূল্য কি রেখে গেছেন, তা আমরা সব সময় জানতে চেয়েছি। সোনা-দানার মত অথর্থ-সংশ্লিষ্ট কিছু এ বাক্সে যে নেই এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। কারণ যে স্বর্ণমুকুটটি আমাদের হাতে আছে, অর্থের বিচারে তার চেয়ে মূল্যবান আমাদের কাছে আর কিছু নেই। এই মহামূল্যবান বস্তুর জন্যে সাধারণ শোকেসে রাখা ছাড়া অন্য কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কখনো করা হয়নি, অথচ বাক্সটা কঠিন ধাঁধার বাঁধনে বাঁধা। এর মাধ্যমে কোন জিনিসের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের পরিবারের রয়েছে অসীম আগ্রহ। প্লিজ, আমাদের সাহায্য করুন।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
আহমদ মুসা ভাবছিল। ধাঁধায় উল্লিখিত ধর্মগ্রন্থের পঠিতব্য প্রথম শ্লোক কোনটা? বিসমিল্লাহ, না সূরা ফাতেহার প্রথম আয়াত? ধর্মগ্রন্থের প্রথম শ্লোক না বলে পঠিতব্য প্রথম শ্লোক বলা হয়েছে কেন? সূরা ফাতেহার প্রথম শ্লোক বা আয়াত তো পড়তেই হয় সুরাটি পড়া শুরু করলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘পঠিতব্য’ শ্লোক বলা হয়েছে কেন? ‘পঠিতব্য’ অর্থ হলো আইনের দ্বারা পড়ার জন্যে নির্দেশিত। এই অর্থ বিবেচনা করলে ‘বিসমিল্লাহ’ই পঠিতব্য প্রথম আয়াত বা শ্লোক হয়। বিসমিল্লাহ পাঠ নির্দেশিত একটা বিষয়। আহমদ মুসার মন আনন্দে ভরে উঠল। অন্য বিবেচনাতেও বিসমিল্লাহ সেই সঠিক আয়াত। বিসমিল্লাহ সব কাজ শুরুর আগে পঠিতব্য আয়াত। তাছাড়া বিসমিল্লাহর ডিজিটাল ব্যবহার বহুল পরিচিত।
আহমদ মুসা মাথা তুলল। সবার উপর দিয়ে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। সবাই তাকিয়েছিল ভাবনায় ডুবে থাকা আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বোধ হয় সমাধান পেয়ে গেছি।’
বলে আহমদ মুসা লক-এর তিনটি ডিজিটাল চাকা একে একে ঘুরিয়ে ‘৭৮৬’ কম্বিনেশনে দাঁড় করাল। তারপর বাক্সের উপরের ঢাকনার উপর একটা চাপ দিল বিসমিল্লাহ বলে। ঢাকনা নড়ে উঠল। খুলে গেছে লক।
আহমদ মুসা বাক্সটি জোসেফ জ্যাকব আলগারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘লক খুলে গেছে।’
জোসেফ জ্যাকর আলগার, আদালা এবং আদালার মা আলিসিয়ার চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘বাবা, খুলুন বাক্সটা। আমাদের আর তর সইছে না।’ বলল আদালা হেনরিকা।
আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের চোখে-মুখে এবার উত্তেজনা, একটা বিমূঢ় ভাবও। বলল, ‘খুলবো আদালা? আমার যে সাহস হচ্ছে না। আমাদের পূর্বপুরুষ এতে আমাদের জন্যে কি রেখেছেন, কি দেখব এটা যে আমার হার্ট বিট বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
বলেই জোসেফ জ্যাকব আলগার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘প্লিজ আপনিই বাক্সটা খুলুন, আমার সাহস হচ্ছে না।’
‘না মি. জোসেফ জ্যাকব আলগার, বিষয়টার সাথে আপনাদের পরিবারের ঐতিহ্যিক দায়িত্ব, কর্তব্য ও সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। উত্তরাধিকারী হিসেবে এই বাক্স খোলার দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফ আলগার আহমদ মুসার কথার জবাবে কিছু বলল না। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বাক্স সমেত বাড়ানো হাত টেনে নিল সে। রাখল কোলের উপর।
চোখ দু’টি বন্ধ করে আত্নস্থ হলো সে। একটু পর চোখ খুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’
কথা শেষ করেই জোসেফ জ্যাকব আলগার উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হে মহান ঈশ্বর, আমার পূর্বপুরুষ সবার উপর শান্তি বর্ষণ করুন এবং আমাকে তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী হবার শক্তি দান করুন।’
বলে মাথা নিচু করে বাক্সের দিকে মনোযোগ দিল জোসেফ জ্যাকব আলগার। দু’হাত দিয়ে আয়তাকার বাক্সের দুই প্রান্ত ধরে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাক্সের উপরের ঢাকনার অংশে চাপ দিল। খুলে গেল বাক্স। ধীরে ধীরে ঢাকনা তুলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
উন্মুক্ত হলো বাক্স। সবার চোখ বাক্সের অভ্যন্তরে।
বাক্সের ভেতরে কালো কভার দেয়া বড়-সড় একটা খাতা দেখা যাচ্ছে। খাতাটি আস্তে আস্তে সম্মানের সাথে হাতে তুলে নিল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
সবার চোখ খাতাটার দিকে।
সুন্দর চামড়ার কভার। কত দিনের পুরানো? কভারের চামড়ার অবস্থা দেখে তা বোঝা যাচ্ছে না।
জোসেফ জ্যাকব আলগার আস্তে আস্তে কভার উল্টালো। প্রথম পাতাটায় কিছু লেখা নেই। এটা চামড়ার মূল্যবান একটা কাগজ। কাগজের রং কিছুটা বিকৃত এবং কাগজের প্রকৃতি কিছুটা শক্ত হয়ে গেলেও নিরাপদে পাতা উল্টিয়ে তা পাঠযোগ্য রাখার জন্য এটা যথেষ্ট উপযুক্ত। প্রথম পাতা থেকে দ্বিতীয় পাতায় গেল জোসেফ জ্যাকব আলগার। দ্বিতীয় পাতায় দ্বিতীয় শুধু একটা শব্দ লেখা। দুর্বোধ্য। পরবর্তী কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখল একই ধরনের লেখা, একই ভাষা এবং দুর্বোধ্য। জোসেফ জ্যাকব আলগার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, ভাষা দুর্বোধ্য। আমি ভাষাটাই চিনলাম না। দেখুন তো এটা কি আপনার ধর্মগ্রন্থের ভাষা?’
বলে জোসেফ জ্যাকব আলগার আস্তে আস্তে খাতাটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘আপনি একটু দেখুন মি. আহমদ মুসা।’
দু’হাত বাড়িয়ে খাতাটা হাতে নিল আহমদ মুসা। লেখার দিকে চোখ বুলিয়েই বলল, ‘মি. জোসেফ জ্যাকব আলগার, এটা আরবি ভাষা। আমাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা।’
‘মানে আগে যেটা বললেন এটা আরব দেশগুলোর ভাষা, আপনাদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘জি, হ্যাঁ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষের এমন সেফ কাস্টডিতে সংরক্ষণ করা এবং উত্তরপুরুষের জন্যে পবিত্র আমানত হিসেবে রাখা খাতা বা ডকুমেন্ট আরবি ভাষায় কেন?’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, এটা আমাদেরও জিজ্ঞাসা।’ বলল আদালার মা আলিসিয়া এবং আদালা হেনরিকা।
‘আপনাদের এই প্রশ্নের উত্তর হাতে লেখা ঐ খাতা বা বই থেকেই শুধু পাওয়া যেতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফ জ্যাকব আলগার তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথা শেষ হলে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জোসেফ জ্যাকব আলগার। কিন্তু তার আগেই আদালা হেনরিকা বলে উঠল, ‘বাবা দেখ তোমার বাক্সে ও দু’টো কি, মেডেলের মত?’
জোসেফ জ্যাকব সংগে সংগে তাকাল বাক্সের দিকে। বলল, ‘তাই তো দু’টো মেডেল।’
সে হাতে নিল মেডেল দু’টো। বলল, ‘ওজন ও রং দেখেই বুঝা যাচ্ছে সোনার মেডেল।’
জোসেফ জ্যাকব চোখ বুলাল মেডেল দু’টির উপর। উল্টে-পাল্টে দেখল। আবার তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে বিস্ময়। বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, এতেও মনে হচ্ছে সেই আরবি ভাষা। প্লিজ একটু দেখুন এগুলো আসলে কি, কিসের মেডেল?’
আহমদ মুসা হাতে নিল মেডেল। উল্টে-পাল্টে দেখল। সোনার মেডেলে উৎকীর্ণ আরবি অক্ষরে কিছু লেখা। লেখাগুলো পড়লো আহমদ মুসা। বিস্ময়াবিষ্ট সকলের অখণ্ড মনোযোগ আহমদ মুসার দিকে।
মেডেল দু’টির একটি হলো, কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেডেল অব এক্সিলেন্স’। বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিষয়ক পরীক্ষায় চুড়ান্ত পর্বে প্রথম স্থান লাভের পুরস্কার। প্রাপকের নাম: আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর।
দ্বিতীয়টি কর্ডোভা হাসপাতালের ‘মেডেল ফর ব্রিলিয়ান্ট সার্ভিস, ১২৩১’। বিষয়: বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সর্বোচ্চ আই-সার্জরি। সার্জন আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর।
দু’টি মেডেলে উৎকীর্ণ আরবি লেখার এই অর্থ দু’টোও শোনাল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আদালা হেনরিকা বলে উঠল, কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্ডোভা হাসপাতালের মেডেল। একজন আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুরকে মেডেলগুলো দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ মেডেল আমাদের বাড়িতে আমাদের পূর্বপুরুষের বাক্সে কেন?’ আদালা হেনরিকাসহ তার মা-বাবা এবং ব্রুনা ও আলদুনি সেনফ্রিড সকলেরই চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘বিষয়টি অবশ্যই বিস্ময়ের। মেডেল দু’টি খাতাটির সাথে ছিল। আর মেডেল দু’টির মত খাতাটিও আরবিতে লেখা। সুতরাং আমার বিশ্বাস খাতাটি থেকেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক মি. আহমদ মুসা। আমাদের পূর্বপুরুষের বাক্সে এই ধরনের মেডেলের অস্তিত্ব আমাকে হতবাক করেছে। প্লিজ আপনি খাতাটা পড়া শুরু করুন। পড়তে আপনার কষ্ট হবে। খাতাটার পৃষ্ঠা সংখ্যা চারশ’র কম হবে না। কিন্তু কি করা যাবে বলুন।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
‘মেডেল ও খাতার প্রতি আপনাদের যে আগ্রহ ও আকর্ষণ তার চেয়ে আমার আগ্রহ ও আকর্ষণ কম নয়। গোটা বিষয় আমাকে দারুণভাবে অবাক করেছে। পড়তে আমার কোনই কষ্ট হবে না। পৃষ্ঠা চারশ’র মত হলেও প্রতি লাইনের পরে একটা করে লাইন বাদ রাখা হয়েছে। আর হস্তাক্ষর বড় হওয়ায় স্টান্ডার্ড সাইজে একশ পাতার বেশি এটা হবে না।
আর খুব জরুরি নয়, এমন বর্ণনা ও বিষয় আমি আপাতত বাদ দিয়ে পড়ব। হেডিং বা সাব-হেডিং দেখেই আমি বিষয়টা বুঝতে পারবো আশা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, প্লিজ পড়া শুরু করুন।’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার।
পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা:
“পরম দয়ালু ও দাতা আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আমার কথা আমি লিখব আগে কখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম অতীতকে মুছে ফেলে একজন জার্মান হিসেবে নতুন জীবন শুরু করবো। আমাদের হাজারো নিবেদিত মিশনারি মানুষ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সে সব দেশের মাটি ও মানুষের সাথে একাত্ন হয়ে গেছে। আমি তাদেরই একজন, যদিও একজন মিশনারির কোন দায়িত্বই আমি পালন করছি না। বরং নাম-পরিচয় পাল্টে আমি নিজের না থেকে অন্যের হয়ে গেছি। সিদ্ধান্তটা আমার ছিল সাময়িক। কিন্তু সে সাময়িক সিদ্ধান্তই পরে স্থায়ী হয়ে যায়। এর মাধ্যমে আমি আমার পিছুটান একেবারেই মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ও পরিচয়কে আমার ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাইরে আমি পুরোপুরি জার্মান হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভুল ভাঙতে শুরু করে। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছলাম যখন আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আমি বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছি। জার্মান দেশে বাস করলেই, জার্মান ভাষায় কথা বললেই জার্মান হওয়া যায় না। সরকার ও সরকারের আইন যাই বলুক, এখানকার সমাজের মূল স্রোতের যে চরিত্র কিংবা এই মূল স্রোত যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের নিয়ম-নীতি কখনো বদলায় না। এই নিয়ম-নীতি এখানে বহিরাগত আর দাস-বংশীয়দের কখনো জার্মান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাতে বহিরাগতরা কোন কালেই জার্মান হয় না। তাদের বহিরাগত আর দাস-বংশীয় হবার অপবাদ বহন করেই চলতে হবে। এই চিন্তা করার পর আমি আমার নিজের কথা লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে আমার উত্তর পুরুষরা অন্তত একথা জানতে পারে যে, তারা ঐতিহ্যবাহী একটা জাতির অংশ। যারা ইউরোপকে সভ্যতা শিখিয়েছিল এবং যারা লন্ডন নগরী গড়ে ওঠার ৭শ’ বছর আগে গ্যাসবাতি ও পয়:প্রণালী সমৃদ্ধ নগর
সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের অনৈক্যের অভিশাপেই বিশেষ করে আমাদের এই সভ্যতার পতন ঘটে। অন্ধকার ইউরোপের হিরক খণ্ড কর্ডোভা, গ্রনাডা, মালাডার মত শিক্ষা-সভ্যতা ও শক্তির কেন্দ্রগুলো নিজেই অন্ধকারে ডুবে যায়।
আমার নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর। জন্ম আমার ১১৯৯ সালে। আমার জন্ম যে সময়, সে সময়টা গৌরবদীপ্ত মুসলিম সাম্রাজ্য স্পেনের পতন শুরুর কাল। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত, খণ্ড-বিখণ্ড স্পেনের একটা সালতানাতের রাজধানী, শিক্ষা-সভ্যতার জন্যে বিখ্যাত নগরী কর্ডোভায় আমার জন্ম। আমার জন্মের বছরই আল-মোহাইদ বাজবংশের খলিফা আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ইন্তেকাল করেন। ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে খলিফা আবু ইউসুফ ছিলেন ক্রমবর্ধমান ঔজ্জ্বল্যের এক প্রতীক। আমার আব্বা ছিলেন খলিফার দরবারের একজন কর্মকর্তা। খলিফার ইন্তেকালে শোকাহত আব্বা খলিফার নামানুসারে আমার নামকরণ করেন।
কর্ডোভার রাজকীয় স্কুলে আমার শিক্ষাজীবনের শুরু। আর আমার শিক্ষাজীবনের শেষ হয় কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পঁচিশ বছর বয়সে। আমার শিক্ষাজীবনের গোটাটাই ছিল কৃতিত্বপূর্ণ। বরাবরের মত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাতেও আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বিরাট অংশ ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের। গোটা ইউরোপে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, একটা মেডিকেল স্কুলও ছিল না। তখন ইউরোপে চিৎকিসাসহ সব ধরনের বিজ্ঞান চর্চা ছিল নিষিদ্ধ। কৃতিত্বের সাথে পাস করার পর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যাপকের চাকরি পাকাপোক্ত হয়ে গেল। কর্ডোভার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শেষ পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনটি যেমন ছিল আমার আনন্দের, তেমনি দিনটি ছিল বিষাদেরও। আমার রেজাল্ট নিয়ে বাসায় কি অপার আনন্দ হবে! আব্বা কি যে খুশি হবেন শীর্ষ কৃতিত্বসহ আমাকে ডাক্তার হতে দেখে! কিন্তু বাড়ির সীমানায় পা দিয়েই কান্নার রোলে আনন্দের শেষ রেশটুকুও আমার মন থেকে হারিয়ে গেল। আব্বাকে আর সুসংবাদ দেয়া হলো না, তাঁর ইন্তেকালের দু:সংবাদ নিয়ে আমি বাড়িতে প্রবেশ করলাম।
আমার পরিবারের যে দু:সময় তার চেয়ে বড় দু:সময় তখন চলছিল সুন্দর নগরী, শিক্ষার নগরী, সভ্যতার নগরী কর্ডোভার। ভয়ানক দু:সময় তখন গোটা মুসলিম স্পেনের। ১২২৭ সাথে আব্বা মারা যান। তখন একমাত্র গ্রানাডা ছাড়া কর্ডোভাসহ দক্ষিণ ও মধ্যস্পেনের বড় বড় শহরের কোনটিই আর মুসলমানদের অধিকারে ছিল না। কর্ডোভা তখন ছিল ক্যাস্টাই ও লিওনের খৃস্টান রাজার দখলে। এই অবস্থা অনেকের মত খলিফার দরবারের একজন কর্মকর্তা বাবাকেও দারুণভাবে আঘাত করেছিল। এই আঘাত ছিল বাবার মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমি পাস করার আগে থেকেই কর্ডোভার বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালে ইন্টারনি ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলাম। নতুন খৃস্টান শাসক কর্ডোভা নগরীর বিখ্যাত ও নগরীর বিখ্যাত মসজিদের অনেক ক্ষতি করলেও নগরীর বিখ্যাত হাসপাতালে গায়ে তাদের স্বার্থেই হাত দেবার চেষ্টা তারা করেনি। হাসপাতাল থেকে তারা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, সেই কারণে হাসপাতালের কোন কার্যক্রমে তারা হস্তক্ষেপ করেনি। আমরা স্বাধীনভাবেই হাসপাতালের কাজ করেছি।
পাস করার পর ডাক্তার হিসেবে হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেবার পর ১২২৮ সালে কর্ডোভার আঞ্চলিক এক মুসলিম সুলতান কর্ডোভাকে মুক্ত করেন। একটা আনন্দের প্রদীপ জ্বলে উঠল আমাদের মনে। কর্ডোভা-নগরী ও কর্ডোভা নগরীর কেন্দ্রবিন্দু কর্ডোভা মসজিদের ক্ষতস্থানগুলো সারিয়ে তোলার চেষ্টা চলল। আমাদের হাসপাতাল পূর্ণ প্রাণচাঞ্চল্য আবার ফিরে পেল।
কিন্তু ১০৩১ সালে শেষ উমাইয়া খলিফা তৃতীয় হিশাম চারদিকের ঘনায়মান অন্ধকারে ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাবার পর স্পেনে সীমাহীন বিরোধ-বিভক্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ইউসুফ ইবনে তাসফিনের আল-মুরাবাইদ বংশের শক্তিমান উত্থান তাকে রোধ করতে পারেনি, বরং ১১৩০ সালের দিকে আল-মোহাইদ বংশের উত্থান এই প্রচেষ্টার আরও ক্ষতিই করেছিল। পর্তুগাল, ইউরোপ ও উত্তর-স্পেন কেন্দ্রিক খৃস্টানদের সম্মিলিত উত্থানের মুখে ভেসে গিয়েছিল আল মোহাইদ, ইবনে হুদ ও নাসেরাইড ডাইনেস্টির মত শাসকরা।
কর্ডোভা আবার হাতছাড়া হলো। সেই কাস্টাইল বংশেরই রাজা তৃতীয় ফার্ডিন্যা্ন্ড তার বিশাল বাহিনী নিয়ে কর্ডোভা দখল করে নিল। এই দখলের হৃদয়হীন ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিল কর্ডোভাকে। মুসলিম নামের ক্ষমতালিপ্সু, নির্লজ্জ শাসকদের বিভেদ-সংঘাতের কারণেই এই মহাবিপর্যয় ঘটেছিল। তবু তাদের বোধোদয় হয়নি। এদেরই একজন স্পেনে নাসেরাইড ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আল হামার। কর্ডোভার পতনের পর কর্ডোভা বিজয়ী খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডকে মোহাম্মদ আল-হামার প্রস্তাব দিলেন যে, তিনি ফার্ডিন্যান্ডকে মুসলিম রাজ্য সেভিল জয়ে সাহায্য করবেন। বিনিময়ে ফার্ডিন্যান্ড মোহাম্মদ আল-হামারকে গ্রানাডার অনুগত স্বাধীন সুলতান হিসেবে মেনে নেবেন। এই চুক্তি অনুসারেই আল-হামার সেভিল জয়ে ফার্ডিন্যান্ডকে সাহায্য করেছিল। তারপর খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডের আনুগত্যের তকমা পরে আল-হামার গ্রানাডায় প্রবেশ করেছিল গ্রানাডার সুলতার হিসেবে। গ্রানাডায় প্রবেশের সময় বিবেকের দংশনে বিপর্যস্ত এই সুলতান স্লোগান তুলেছিল, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই’। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই’-এই কথাকে তিনি তাঁর রাষ্ট্রেরও মূল স্লোগান বানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত আল-হামরা প্রাসাদের দেয়ালে আরবি ভাষার অপরূপ কারুকার্যময় লিপিতে শতবার শতভাবে এই কথা লিখে রাখেন। আমার ক্রীতদাস জীবনের শুরুতে আমি যখন উত্তর ফ্রান্সের এক দাস বাজারে, তখন আমি এই খবরটা শুনেছিলাম। এটা শোনার পর আমি অঝোর নয়নে কেঁদেছিলাম আল-হামরার মত মুসলিম শাসকদের চিন্তা ও কাজের বেদনাদায়ক বৈপরীত্য দেখে। কর্ডোভার ভাইদের প্রতি না তাকিয়ে, সেভিলের ভাইদের বুকে ছুরি মেরে তাদের উপর খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডকে বিজয়ী করে যিনি গ্রানাডাকে তার পুরস্কার হিসেবে নিয়েছেন, সেই সুলতার কি করে পারলেন এই স্লোগান তুলতে আর আল-হামরা প্রাসাদের গায়ে লিখতে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই!’ দু’হাত তুলে সেদিন কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, এই সব শাসকের কথা ও কাজের এবং ঈমান ও আমলের এই বৈপরীত্যের মাশুল হিসেবে স্পেনের লক্ষ লক্ষ মুসলমান ধ্বংস হয়ে গেল, আমার মত হাজারো মানুষ ক্রীতদাসের শৃঙ্খল গলায় পরতে বাধ্য হলো। মা’বুদ আমার জীবদ্দশায় কর্ডোভা যদি মুক্ত হয়,
তাহলে আমাকে সেখানে যাবার সুযোগ দিও, যাতে গোয়াদেল কুইভারের ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে বলতে পারি, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বিজয়ী নয়, এ কথা সত্য, কিন্তু যে শাসক নিজের স্বার্থে অন্যকে বিজয়ী করে, তাদের অধিকার নেই এই পবিত্র বাক্য উচ্চারণের। এরা এদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে মুসলিম জনতাকে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জানি কর্ডোভা মুক্ত হয়নি, বরং তার উপর রাতের অন্ধকার আরও গভীরতর হয়েছে।
কর্ডোভার পতন হওয়ার দুর্ভাগ্যের দিনটিও ছিল আমার জন্যে পরম সৌভাগ্যের। এদিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে চিকিৎসা-বিজ্ঞানী হিসেবে অর্ধযুগের কাজের মূল্যায়নের স্বীকৃতি হিসেবে চিকিৎসা সেবায় সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর পুরস্কার লাভ করি আমি। একটা স্বর্ণের মেডেল এবং তার সাথে পাই এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে। একই সাথে এই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ও আমার শেষ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার মেডেল দিয়ে দেয়। আমার পিতার মৃত্যু আমাকে এতটাই আপসেট করেছিল যে, মেডেলটি সংগ্রহ ও বাড়িতে নেয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু এদিন বিশ্ববিদ্যায়ের প্রক্টর আমার প্রিয় শিক্ষক বললেন, চারদিকের অবস্থা ভালো নয়। হাজারটা বিপদ শহরের উপকন্ঠে, মেডেলটা নিয়ে যাও। আমি সে মেডেলটা নিয়ে ব্যাগে পুরেছিলাম। তবে হাসপাতালে ফিরে দেখলাম একের পর এক আহত সৈনিক ও সাধারণ লোকদের নিয়ে আসা হচ্ছে হাসপাতালে। জানতে পারলাম ফার্ডিন্যান্ডের বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। বিজয়ী হিসেবে তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ডের কর্ডোভায় প্রবেশ এবার ধ্বংসের ঝড় নিয়ে এল। পালাতে পারেনি এমন কোন মুসলমান সেদিন এই ঝড়ের কবল থেকে বাঁচেনি। এই ঝড়ের কথা আমি আগে কল্পনাও করতে পারিনি। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে সেদিন সারা দিন হাসপাতালেই ছিলাম। আহত খৃস্টান, মুসলমান সৈনিক ও সাধারণ মানুষ অবিরাম আসছিল হাসপাতালে। আমার যোগ্যতা ও শক্তির সবকিছু উজাড় করে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছি। আহার, বিশ্রাম সব কিছু ভুলে খৃস্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সকলের সমান সেবা করেছি। আমার ধর্ম ইসলামে আহত মানুষের কোন জাত নেই। তারা মানুষ। মানুষ হিসেবেই তাদের সমান সেবা করতে হবে। আমি তাই করার চেষ্টা করেছি। একদিন একরাতের পর সেদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর ঘুরে বসতেই মনে পড়ল বাড়ির কথা, একমাত্র সন্তান ও স্ত্রীর কথা। চমকে উঠলাম্। গত ২৪ ঘন্টা ওদের কথা মনে করিনি কেন? ওরা কেমন আছে? সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রাজপথে রক্তের স্রোত মাড়িয়ে বাড়ি পৌঁছলাম। অল্প কিছু দূরে গোয়াদেল কুইভারের তীরেই আমার বাড়ি।
বাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণে পৌঁছতেই দূর থেকে চোখে পড়ল আমার বাড়ির মূল গেট হা করে খোলা। আঁৎকে উঠলাম আমি। এমন তো হবার কথা নয়! এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির গেটের দরজা খোলা থাকার প্রশ্নই আসে না। দৌড় দিলাম আমি। গেটে পৌঁছেই দেখলাম গেটের দরজা খোলা নয়, ভাঙা। এবার দেহের রক্তে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। বুঝলাম কি ঘটেছে। বাড়ির ভেতরে পা বাড়াতে ভয় করছিল। কি দেখব সেখানে দিয়ে! কম্পিত পায়ে তবু এগোলাম। বৈঠকখানা ঘর খোলা, শূন্য। ভেতর বাড়িতে ঢুকলাম। সব ফাঁকা। পৌঁছলাম শোবার ঘরের সামনে। দরজা ভাঙা। আর এগোতে পারছিলাম না আমি। শরীরের সব শক্তি যেন নি:শেষ হয়ে গেছে। বুক কাঁপছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনটাকে শক্ত করে ঘরের ভেতরে পা বাড়ালাম। ঘরের ভেতরে চোখ পড়ল। আমার অজান্তেই বুক থেকে মুখ ভেদ করে একটা আর্তচিৎকার বের হয়ে এল। আমার তিন বছরের সন্তানের রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। তার মাথাটা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া। দৃষ্টি ছুটে গেল পাশেই একটু দূরে। পড়ে আছে আমার স্ত্রীর দেহ। একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। এবার চিৎকারও বের হলো না মুখ থেকে। চিৎকারের ভাষা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অবরুদ্ধ বোবা আবেগ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে দিল হৃদয়টাকে। টলতে টলতে গিয়ে আমি বিছানা থেকে চাদর তুলে এনে ঢেকে দিলাম আমার স্ত্রীর দেহ। ধপ করে বসে পড়লাম স্ত্রীর চাদর-ঢাকা দেহের পাশে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা। চারদিকের পৃথিবীটা আমার কাছে ছোট হয়ে গেছে। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ক্ষুধার্ত, অবসন্ন, বোবা হয়ে যাওয়া আমি তখন বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিলাম। অদ্ভুত একটা চিন্তা চলন্ত ছবির আকারে মাথায় এল। তা হয়তো স্বপ্ন ছিল। দু’টি লাশ কাপড়ে জড়িয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ির পাশের গোয়াদেল কুইভারের পানিতে নামিয়ে দিয়ে একটা পথ ধরে আমি এগিয়ে চলছি। পথটা নতুন। এর আগে কখনও দেখিনি। পথটা এগিয়ে আরও এগিয়ে দূর দিগন্তে আকাশের সাথে যেন মিশে গেছে।
তন্দ্র কেটে গেল আমার।
কিন্তু চিন্তাটা জীবন্ত দৃশ্যের মত সামনে রয়ে গেল আমার। ভাবলাম আমি, আমার প্রভুর নির্দেশ কি এটা আমার জন্যে! আমাকে কি কর্ডোভা ছাড়তে হবে? কোন নতুন পথ কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে? সে পথে একাই চলার ভাগ্য কি আমার?
দু’চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমে এল আমার। একা বেঁচে থাকাটা আমার জন্যে দু:সহ। তার চেয়ে ভালো হতো যদি ফার্ডিন্যান্ডদের লোকদের সাথে লড়াই করে জীবন দিতে পারতাম। তাহলে সকলের সাথে আমি কর্ডোভায় থাকতে পারতাম। কিন্তু তন্দ্রায় দৃশ্যগুলো আমার জীবনের জন্যে এক অমোঘ নির্দেশ বলে মনে হলো।
চোখের পানি মুছে বিমোহিতের মত উঠে দাঁড়ালাম। দু’টো লাশকে বিছানার চাদরে জড়িয়ে কাঁধে তুলে নিলাম। আমার প্রিয় বাড়িটির জন্যে একটুও মায়া মনে জাগল না। আমার দাদার তৈরি বাড়িটা বাবার অতিপ্রিয় ছিল, আর আমারও জীবনের সাথে অচ্ছেদ্য বাঁধনে জড়িয়ে ছিল বাড়িটা। কিন্তু এখন বাড়িটা ছাড়তে আমার কিছুই মনে হলো না। আমার বাড়ির সামনেই গোয়াদেল কুইভার নদী। বাড়ির পরে একটা পায়ে চলার রাস্তা। তার পর একটা ঘাট ধাপে ধাপে নেমে গেছে গোয়াদেল কুইভারের পানিতে। হাঁটু পরিমাণ পানিতে নেমে কাঁধ থেকে লাশ দু’টো নামিয়ে আদরের সাথে আস্তে আস্তে নামিয়ে দিলাম গোয়াদেল কুইভারের বুকে। তার নীরব স্রোতধারা যেন পরম স্নেহেই গ্রহণ করল লাশ দু’টোকে। মুহূর্তেই গোয়াদেল লাশ দু’টোকে আড়াল করল আমার চোখ থেকে। কিছুক্ষণ ওদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানি দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিল। ধীরে ধীরে উঠে এলাম সিঁড়ি বেয়ে উপরের রাস্তায়। মুহূর্ত মাত্র দাঁড়ালাম। তাকালাম বাড়ির দিকে। চিরপরিচিত বাড়ি। রাস্তার দিকে মুখ ফেরালাম। হাঁটতে শুরু করলাম। গোয়াদেল কুইভারের তীর বেয়ে পায়ে চলার পথ। এগিয়ে গেছে সামনে, এগিয়ে গেছে সীমাহীন সীমান্তের দিকে। এ যেন গোয়াদেল কুইভারের সেই পরিচিত রাস্তা নয়। সব মানুষের সামনে চলার এ যেন সনাতন পথ। সেই পথ আজ আমারও পথ। চলছি বিরামহীন, লক্ষ্যহীন।
এই পথ আমাকে নিয়ে এল স্পেন পেরিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে। সময় পার হয়েছে তিন মাস। আমার পিঠের ব্যাগটি অনেক বড় হয়েছে। এক কাপড়ে বেরিয়েছিলাম। আরেক প্রস্থ কাপড়, জ্যাকেট ইত্যাদি কিনতে হয়েছে। ব্যাগের পকেটের সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা ছিল আমার সম্বল। এই টাকা ভেঙেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে এসেছি আর পথ চলেছি। কোথায় যাব, পথের এই যাত্রা কোথায় থামাব, মন সে ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি।
দক্ষিণ ফ্রান্সের পথের ধারের পান্থশালায় আমি সেদিন ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সম্বলমাত্র ব্যাগটি আমার নেই। ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। কখন কে আমার মাথার তল থেকে ব্যাগটি নিয়ে গেছে জানি না। এবার প্রকৃতই আমি পথের মানুষ হয়ে দাঁড়ালাম। তবু খুশি হলাম এই ভেবে যে, আমার দু’টি মেডেল রক্ষা পেয়েছে। ও দু’টি আমি রেখেছিলাম আমার পাজামার কোমরে এক গোপন পকেটে।
খাওয়া-দাওয়া-নাওয়া কিছু নেই, পথ চলছিলাম। জনবসতি কম। মাঝে মাঝে পথের পাশে গুচ্ছ বাড়ি দেখা যাচ্ছে কিন্তু ভিক্ষুক হতে মন সায় দেয়নি। বেওয়ারিশ সব গাছের পরিচিত অপরিচিত ফল-মূল খেয়ে আমার সময় কাটছিল।
একদিন ক্ষুধা-কাতর অবসন্ন দেহে পথের পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিদ্রাচ্ছন্নের মত বসেছিলাম। একটা গাড়ি আমি যেদিক থেকে এসেছি সে দিক থেকে এগিয়ে আসছে শব্দ পাচ্ছিলাম। কিন্ত চোখ খোলার প্রবৃত্তি হয়নি। গাড়িটি আমার বরাবর এসে দাঁড়াল। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়েছে। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম একজন বলছিল, ‘দেখতে মুরদের মত লাগছে। নিশ্চয় মুরদের কোন পলাতক সৈনিক। বয়স দেখা যাচ্ছে চল্লিশ এখনও হয়নি। ধরে নাও। স্লেভ মার্কেটে মুররা এখন হট কেক।’ এর কথা শেষ হলে আরেকজন বলে উঠল, ঠিক বলেছ জ্যাকি। মুর সৈনিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের এ চালানে কিন্তু এখনও একজন মুর জোটেনি। একে পেলেই তো এবারের চালান পূর্ণ হয়ে যায়। চল ধরে ফেলি। ফাঁদটা বের কর।’
মনে হলো ওরা কয়েকজন গাড়ি থেকে নামল। ওদের মতলব বুঝতে পারলাম। পালাতে পারতাম কি না জানি না, কিন্তু পালাবার প্রবৃ্ত্তি হলো না। আমার চিন্তা শেষ হতে পারল না। কি যেন এসে আমার শরীরের চারদিকে অস্পষ্ট মোটা শব্দ তুলে পড়ল। চোখ মেলে দেখলাম, চারদিক থেকে দড়ির জালে আমি আবদ্ধ। জাল ওরা গুটিয়ে নিচ্ছে। আমি শুনেছি বন্য পশুকে এভাবেই ধরে থাকে। এখন ওরা পশুর মত করেই মানুষ শিকার করছে।
আমার পরিণতি কি হতে যাচ্ছে তা ওদের কথা থেকেই বুঝতে পেরেছি। ওদের ক্রীতদাস বাণিজ্যের চালানে এখনও একজন লোক কম আছে। আমাকে দিয়েই তারা ঐ শূন্যস্থান পূরণ করতে চায়। সব বুঝেও আমার কিছু করার ছিল না। চেষ্টা করেও ওদের হাত থেকে, ওদের ফাঁদ থেকে পালাতে পারতাম না। আর আমি আগেই নিজেকে পথের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছি। পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়।
বিরাট বড় ওদের গাড়ি। একটা কাভার্ড ভ্যান আরও চারটি কাভার্ড ভ্যানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

এখানে-সেখানে থেমে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি বহরটি গিয়ে পৌঁছল দক্ষিণ জার্মানীর সীমান্ত শহর স্ট্রাসবার্গে। এখানেই বসে মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় দাস বাজার। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, সুইডেন, ডেনমার্ক অঞ্চল থেকে এখানে খদ্দের আসে।
স্ট্রাসবার্গে গিয়ে বুঝতে পারলাম কতজনকে দাস মার্কেটে বিক্রির জন্যে আনা হয়েছে। আমরা সংখ্যায় ছিলাম একশ জন। একেক কাভার্ড ভ্যানে পঁচিশজন করে। পশুর মত গাদাগাদি করে আমাদের আনা হয়েছে।
দাস বাজারে স্লেভ ট্রেডারদের এক বা একাধিক খোয়াড় ধরনের জায়গা আছে। এগলোর ছাদ আছে এবং গোলাকার চারদিকটা লোহার শিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। খোঁয়াড়ে প্রত্যেকের জন্যে একটা করে বেড আছে। খোঁয়াড় থেকে একেকজন করে বেরিয়ে খাবার নিয়ে আসতে হয়। খোঁয়াড়েই ঘুরে বেড়াতে হয়। রাত ছাড়া শোয়ার হুকুম নেই। পূর্ণ রাত্রি ঘুম ও পর্যাপ্ত খাবার আমাদের দেয়া হয়। দাসদের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া বেশি দাম পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয়। খাওয়ার জন্যে বাইরে বের করে আনা হয় এটা দেখানোর জন্যে যে, সে শান্ত-শিষ্ট ও অনুগত। ভালো দাম পাবার জন্যে দাসকে শান্ত-শিষ্ট ও খুব অনুগত প্রমাণ করতে হয় ক্রেতার কাছে। যতদিন খদ্দের না পাওয়া যায়, তখন দাস বাজারের খোঁয়াড়েই থাকতে হয়। শীতের সময় রাতের বেলা খোঁয়াড়কে টিন শিট দিয়ে ঘেরা হয় এবং বাইরে চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে আবহাওয়া গরম রাখা হয়। আমার সংগীদের মধ্যে জনাদশেক ছাড়া সবাই আফ্রিকার খৃস্টান। অবশিষ্ট দশজনের সবাই মুসলিম। তাদের কাউকে আমি চিনি না। ওরা সবাই সৈনিক। বিভিন্ন অঞ্চল খেকে ওদের ধরে আনা হয়েছে। এদের সবাইকেই আমি মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়া অবস্থায় পেয়েছি। আমি ওদের সাহস দিয়েছি, আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলেছি। সুস্থ থাকা, শান্ত থাকা এবং যেহেতু এর বিকল্প নেই, তাই যা ঘটে তা মেনে নেয়ার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে বলেছি। সবাইকে হারালেও, সবকিছু হারালেও আল্লাহকে না হারাবার জন্যে ওদের উপদেশ দিয়েছি। আল্লাহ রাজি থাকলে কষ্টের এ দুনিয়ার পর অনন্ত সুখের সম্ভাবনা থাকে। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশই সোহেলী অঞ্চলের। সোহেলী ভাষা আমি মোটামুটি জানি। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনের মত মুসলমান পেয়েছি। আমাদের নামাজ পড়া দেখে তারাই এসে তাদের পরিচয় দিয়েছে। এটা ঘটেছে দাস বাজারের খোঁয়াড়ে আসার পর। আমি তাদের উপদেশ দেবার সুযোগ পেয়েছি। তারা সবাই আমার ভক্তে পরিণত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের এই নামাজ রাতের বেলা গোপনে পড়তাম। আমাকে তারা মুর জানত, কিন্তু সরাসরি জানত না আমি মুসলমান। আমি ইচ্ছা করেই আমার লেখা-পড়া, পেশা ও আমার ধর্ম গোপন করেছি শুরু থেকেই। খোঁয়াড়ের সবার সাথেই একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম কে কোথায় বিক্রি হয় তা জানার ও গোপনে লিখে রাখার চেষ্ট করব, যাতে ভবিষ্যতে ওদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমাদের একশজনের লটের মধ্যে আমিই প্রথম বিক্রি হয়ে যাই।
কয়েক দিন থেকেই আমি দেখছিলাম দীর্ঘ দেহী ‘নাইট’দের ইউনিফরম পরা বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত একজন ঘোড়সওয়ার দাস বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের খোঁয়াড়ে কয়েক বার ঘুরে গেছে।
সেদিন দুপুরে আমাদের স্টল থেকে আমি খাবার আনছিলাম। হঠাৎ আমি সেই ঘোড়সওয়ারের সামনে পড়ে গেলাম। ঘোড়সওয়ারও থমকে দাঁড়াল। আমাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তোমার নাম কি?’ আমি বলল, জোসেফ জ্যাকব আলগার।’
নামটি আমি আগেই ঠিক করে আমার মালিককে বলে দিয়েছিলাম। নামটি আমার মূল নাম ‘ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর’-এর খৃস্টীয়করণ। উভয় নামের অর্থ একই। ঘোড়সওয়ার লোকটি একটু ভ্রুকুঁচকে বলল, ‘দাসদের সবার নামই সংক্ষিপ্ত। তোমার এত বড় নাম? এ নামের অর্থ কি জান?’
আমি বললাম, ‘উত্তম যোদ্ধা জোসেফ জ্যাকব।’
গম্ভীর কন্ঠে বলল ঘোড়সওয়ার, ‘তুমি কি যোদ্ধা? যুদ্ধ করেছ?’
আমি বললাম, ‘যোদ্ধাও নই, যুদ্ধও করিনি। তবে যাদের নামে আমার নাম তারা সবাই এক ধরনের যোদ্ধা ছিলেন।’
‘কি ধরনের যোদ্ধা ছিলেন?’ বলল ঘোড়সওয়ার। সেই গম্ভীর কন্ঠেই।
‘শুনেছি তাঁরা মানুষ পরিবর্তনের যোদ্ধা ছিলেন।’ বললাম আমি। এবার আরও একবার ভ্রূকুঁচকে গেল ঘোড়সওয়ারের। বলল, ‘কোথায় শুনেছ তুমি?’
উত্তর আগেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। বলল, ‘গির্জার সামনে শুনেছি।’
ঘোড়সওয়ারের চেহারায় প্রসন্নতা দেখা দিল। বলল, ‘তুমি গির্জায় যাও?’
‘যেতাম।’ আমি বললাম।
‘তুমি লেখাপড়া জান?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘কোন রকমে লেখা ও পড়ার মত অক্ষরজ্ঞান আমার আছে।’ বললাম আমি।
‘তুমি জার্মান ভাষার নাম শুনেছ?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘শুনেছি। কিছু বলতে ও বুঝতে পারি।’ আমি বললাম।
এবার বিস্ময় ঘোড়সওয়ারের চোখে-মুখে। বলল, ‘কেমন করে জান, কোথায় শিখেছ?’
‘আমার একজন জার্মান প্রতিবেশী ছিলেন। তার কাছ থেকেই দিনে দিনে কিছুটা শেখা হয়ে গেছে।’ বললাম আমি।
‘তোমাকে কোথেকে ধরেছে?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘পশ্চিম স্পেনের যুদ্ধ সংলগ্ন এক গ্রাম থেকে প্রতিপক্ষ যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যায় এবং বর্তমান মালিকের কাছে বিক্রী করে।’ আমি বললাম। এটাই মালিক বলতে বলেছিল।দক্ষিন ফ্রান্সের শান্ত এলাকা থেকে এরা আমাকে ধরেছে, এ কথা না বলতে শাসিয়ে দিয়েছিল মালিক। আমি সেটাই বললাম।
‘দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে আমার খারাপ লাগেনি?’ জিজ্ঞেস করল মালিক।
‘এটাই মনে হয় আমার ভাগ্য।’ বললাম আমি।
‘এই ভাগ্যকে তুমি মেনে নিয়েছ?’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ভাগ্য তো ভাগ্যই। একে মেনে নেয়া, না নেয়ার কোন অবকাশ নেই।’ আমি বললাম।
‘তুমি খুব বুদ্ধিমান। আমি খুশি হয়েছি।’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আমি চলে এলাম আমার খোঁয়াড়ে। আমার খাওয়া শেষ করে আমি হাত-মুখ পরিস্কার করতে গিয়ে দেখলাম, সেই ঘোড়সওয়ার ও আমার মালিক কথা বলছে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম।
আমি ফিরে আসার পরপরই ফিরে এল আমার মালিক। হাসিমুখে আমার কাছে এসে বলল, ‘আমার সৌভাগ্য, তোমারও সৌভাগ্য। ক্রুসেড ফেরত একজন বিখ্যাত নাইট তোমাকে কিনে নিয়েছে। সে একজন বীর ও জ্ঞানী মানুষ। এটা তোমার সৌভাগ্য। আর আমার সৌভাগ্য হলো যে রেট চলছে, তার দ্বিগুণ দাম সে আমাকে দিয়েছে। তুমি রেডি হও। সে আধা ঘন্টার মধ্যে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। আমার সাথী খোঁয়াড়ের সবাইকে আমি ভাইয়ের মত ভালোবেসে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে মুসলিম ভাইদেরকে। আমার চলে যাওয়া মানে চিরতরে ওদের আমি হারিয়ে ফেলব।
মনটা আমার কেঁদে উঠলেও করার কিছু ছিল না। আধা ঘন্টার মধ্যেই ঘোড়সওয়ার আমার খোঁয়াড়ে গিয়ে হাজির হলেন একটা ঘোড়ায় টানা জার্মান গাড়ি নিয়ে। তার সাথে আরেকজন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক।
মালিক স্বয়ং খোঁয়াড়ের মুখে ছিল। আমি বের হয়ে এলাম খোঁয়াড় থেকে। বের হবার সময় হাত দিয়ে একবার দেখলাম নতুন পাতলুনের পকেটে আমার সেই দু’টো মেডেল আছে কি না। নিশ্চিত হয়ে সামনে এগোলাম।
ঘোড়সওয়ার আমাকে স্বাগত জানাল। সাথের যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো বেনেডিক্ট, আমার সেক্রেটারি। আর আমি ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। রাইনের একজন নাইট। এখন রাইন ছেড়ে সালজওয়াডেলে চলে গেছি। তুমি সেখানেই যাবে। গাড়ির পেছনে উঠে বস।’
বলে ঘোড়সওয়ার নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। তার পাশে বসল তার সেক্রেটারি বেনেডিক্ট।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আমি বললাম, ‘ঘোড়াটার কি হবে? ঘোড়া কে নিয়ে যাবে?’
‘ধন্যবাদ আলগার, তুমি ঘোড়াটার কথা মনে করেছ। ঘোড়াটা আমার ভাড়া করা ছিল। নাইটরা ঘোড়ায় চড়তেই বেশি গৌরব বোধ করে, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে নয়। এখানে এসে ভাড়া করেছিলাম ঘোড়াটা।’ বলল নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।’’
এই পর্যন্ত পড়ে আহমদ মুসা সামনের আরও পাতা উল্টিয়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘মি. আলগার, এর পরের কিছু পাতায় রয়েছে স্ট্রাসবার্গ থেকে জার্মানীর আরেক এলাকা সালজওয়াডেলে যাবার কাহিনী। এখানে পথের বর্ণনা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। আগেও কিছু কিছু বাদ দিয়েছি, এখানে বড় একটা অংশ বাদ দিতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
কোন জবাব নেই মি. আলগার কিংবা কারও তরফ থেকে। তাকাল আহমদ মুসা তাদের দিকে। দেখল, অপার বিস্ময় আর বেদনার দৃষ্টি নিয়ে আলগার তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আদালার মায়ের চোখেও একই বিস্ময় আর বেদনা। কিন্তু আদালার চোখ অশ্রুতে ভরা। চোখ ছাপিয়ে অশ্রুর ধারা তার দুই গণ্ডেও নেমে এসেছে।’
মি. আলগারই কথা বলল। সে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, জবাব তো আমরা পেয়ে গেছি। আমরা দাস বংশোদ্ভূত কেন, কেন আমরা নন-জার্মান, আমাদের মূল কোথায়, পরিচয় আমাদের কি-সব প্রশ্নের জবাব আমরা পেয়ে গেছি। আমার দাদু আমার নাম আমাদের প্রথম পুরুষের নাম অনুসারে রেখেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক দাস হিসেবে যাকে কিনে এনেছিলেন, সেই ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ওরফে জোসেফ জ্যাকব আলগার আমাদের প্রথম পুরুষ। তাঁর নতুন নামেই আমার নাম। আরও জানলাম, আমাদের মূলটা একটা গৌরবদীপ্ত সিভিলাইজেশন-এর সাথে। মূলে গিয়ে আমরা মুসলমান। জার্মানীতে আমার প্রথম পুরুষ মুসলমান ছিলেন। কিন্তু সব কিছুর পরেও মি. আহমদ মুসা আমরা দাস বংশোদ্ভূত আমরা নন-জার্মান, এটাই প্রতিষ্ঠিত হলো।’
থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার। বেদনায় ভেঙে পড়া তার কন্ঠ।
পিতা জোসেফ জ্যাকব আলগার থামতেই চোখ মুছতে মুছতে আদালা হেনরিকা বলে উঠল, ‘বাবা, তোমাকে আমি ডিপ্রেসড দেখছি। তোমার কন্ঠে বেদনার সুর বাবা। আমি এর প্রতিবাদ করছি। আমি আমাদের প্রথম পুরুষ ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ওরফে জোসেফ জ্যাকব আলগারের সীমাহীন দু:খ-বেদনা ও বিপর্যয়ে কেঁদেছি বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আমি গৌরব বোধ করছি। আমার পূর্বপুরুষকে যিনি কিনেছেন, সেই নাইট একজন যোদ্ধা ছিলেন মাত্র আর আমার পূর্বপুরুষ ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর গোটা ইউরোপে যখন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরে থাক, একটা মেডিকেল স্কুলও ছিল না ইউরোপ জুড়ে, তখন ছিলেন কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃতি ছাত্র এবং কর্ডোভা মেডিকেল কলেজের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃতি চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং সেই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতি অধ্যাপক। ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হওয়া ছিল একটা ঘটনাচক্র। আর বাবা, আমার মহান সেই পূর্বপুরুষ একজন ডাক্তার হিসেবে ধর্ম, দেশ পরিচয় নির্বিশেষে সকল আহতকে সেবা দিচ্ছিলেন, প্রাণ বাঁচা্চ্ছিলেন আহতদের, তখন তার সন্তান ও স্ত্রীকে বীভৎস পাশবিকতার সাথে হত্যা করা হয়। রাজ্য হারিয়ে, সন্তান ও স্ত্রীর মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য দেখে তিনি সব ব্যাপারে এতটাই নিরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, সব ত্যাগ করে পথের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, মানে ঈশ্বরের হাতে নিজেকে তুলে দিয়েছিলেন। ঈশ্বর বা আল্লাহ তাঁকে এই জার্মানীতে আনবেন বলেই এসব ঘটেছে। তাঁর গৌরব, তাঁর মর্যাদা এতে এতটুকুও ম্লান হয়নি। আমরা তাঁর বংশধর, আমাদের মর্যাদাকে ম্লান ভাবছি কেন? তিনি যে উন্নতশিরে দাস জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহর ইচ্ছা ভেবে, আমরাও তেমনি উন্নতশির হরো দাস বংশোদ্ভূত হওয়ার পরিচয় দানের ক্ষেত্রে।’ বলল আদালা হেনরিকা।
জোসেফ জ্যাকব আলগার ও তার স্ত্রী আদালার মা’র চোখ মুখ অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলল আদালার বাবা আলগার, ‘ধন্যবাদ আদালা, আমাদের মহান প্রথম পুরুষের সর্বকনিষ্ঠ উত্তরসূরির উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করেছ। আমরা যেটা পারিনি। পারিনি কারণ, এই দায়িত্ব নেয়ার জন্যে যে শক্তি ও প্রাণপ্রাচুর্য দরকার তা আমাদের বোধ হয় নেই। আমরা এখন শান্তি খুঁজি, স্বস্তিতে থাকতে চাই। আর শান্তি ও স্বস্তির সন্ধান মানুষকে অনেকটাই দুর্বল ও রক্ষণশীল করে তোলে। ধন্যবাদ তোমাকে আদালা। কিন্তু আমাদের মহান সেই প্রথম পুরুষ তার মুসলিম পরিচয় ও কৃতী চিকিৎসাবিজ্ঞানী হওয়ার পরিচয় সেদিন গোপন করেছিলেন কেন?’
‘বাবা, তুমি জান সে সময়টা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড উন্মাদনার সময়। এটা ফার্স্ট ক্রুসেডের পরবর্তী ঘটনা। তারপরও আরও কয়েকটি ক্রুসেড হয়েছে। সে সময় মুসলিম পরিচয় পেলে কিংবা মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীর পরিচয় পেলে ইউরোপের এই অংশের কোন দেশেই তার বাঁচার কোন সুযোগ ছিল না। আমি মনে করি, মুসলিম পরিচয় গোপন করে তিনি অন্তত প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তারপর তিনি আরও কি সুযোগ পেয়েছেন কিংবা কি’ ঘটেছে তা পরবর্তী পাঠ থেকে জানা যাবে বাবা। পড়া আমার শুরু হওয়া দরকার। আপাতত কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে পড়লে সংক্ষেপে সব জানার জন্যে তা ভালো হবে। পরে পুরো পড়ার সুযোগ নেয়া যাবে, যদি স্যার আমাদের প্রতি দয়া করেন।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘প্লিজ মি. আহমদ মুসা, আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন পড়া শুরু করুন। আদালার সাথে আমি একমত।’
আহমদ মুসা আবার পড়া শুরু করল:
“তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় সালজওয়াডেলে পৌঁছলাম। মাঝখানে দু’রাত আমরা বিশ্রাম নিয়েছি দুই হোটেল বা পান্থশালায়। সব জায়গায় দেখেছি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের ভীষণ খাতির। সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি, ইস্তাম্বুল অভিমুখের ষষ্ঠ ক্রুসেড পরিচালনায় তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার লোক হিসেবে আমরাও কম খাতির পাইনি।
সালজওয়াডেল নদীর ধারে বিশাল দুর্গসদৃশ বাড়ি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের। পরে শুনেছি নাইট ফ্রেডারিক যখন রাইনের দুর্গ ছেড়ে সালজওয়াডেল চলে আসেন, তখন কিং চতুর্থ অটো তাকে স্বাগত জানিয়ে এই বাড়ি দান করেন এবং নদীর উপর পাহারাদারীর দায়িত্ব দেন।
বাড়িতে পৌঁছে আমার নতুন মালিক নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক তার সেক্রেটারি বেনেডিক্টকে বলল, আলগারকে আপতত বিশ্রামের একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে নাস্তা করাও। তারপর তাকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে চুল কাটাও।
দাসদের চুলকাটা মানে মাথা, মুখ সবকিছুকে নগ্ন করা। জীবনে এই প্রথম দাড়ি,গোঁফ ও চুল কেটে নেড়ে হলাম।
চুল কাটার পর মালিকের সেক্রেটারি বেনেডিক্ট আমাকে জানাল, ‘আগামীকাল সকালে তোমাকে নাইট ফ্রেডারিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাঁর সাথে পরিবারের অন্য কেউ থাকতে পারেন। সেই দেখা করার পর ঠিক হবে কোন কাজ তোমাকে দেয়া হবে।’ বুঝলাম সাক্ষাৎকারটা আসলে একটা ইন্টারভিউয়ের মত। মানে যে দাসকে কেনা হলো তাকে দিয়ে কোন কাজটা করানো হবে।
পরদিন নাস্তার পর আমাকে মালিকের সামনে হাজির করা হলো। মালিকের দুর্গসদৃশ বাড়ির প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে বিরাট লন। লনের শেষ প্রান্তে বিরাট সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বাড়িটা সত্যিই দুর্গের মত দশ বারো তলার সমান উঁচু। দোতলায় সিঁড়ির মুখে একপাশে একটা টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসেছেন আমার নতুন মালিক। তার বামপাশে তার প্রায় সমবয়স্ক এক মহিলা, নিশ্চয় তার স্ত্রী হবেন। মহিলার পাশে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের আরেকজন যুবতী, তার পাশে আট দশ বছরের একটি শিশু। তাদের পরিচয় ঠিক বুঝলাম না, তবে মনে হলো মেয়েটি মালিকের মেয়ে এবং শিশুটি মালিকের নাতি হলে মানায়। সবাইকে দেখলম প্রসন্ন, কিন্তু ডাক্তারের চোখ দিয়ে বুঝলাম, যুবতী মহিলাটি মানসিকভাবে ডিপ্রেসড। অন্য সবার মধ্যে একটা জীবন্ত আগ্রহ দেখলাম, শুধু সে ছাড়া।
তাদের টী টেবিল থেকে দশ ফুট দূরে হাতজোড় করে আমাকে দাঁড়াতে হলো। মনে কষ্ট লাগল এভাবে দাঁড়াতে, কিন্তু বেনেডিক্টের নির্দেশে এভাবে দাঁড়াতে হলো। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কখনও হাতজোড় করিনি। কিন্তু আজ মানুষ মনিবের কাছে তা করতে হলো। আমার সামনে ছিল উঁচু ক্ষুদ্র একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপরে ছিল এক শিট কাগজ ও একটা কলম।
আমি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার নতুন মালিক নাইট মি. ফ্রেডারিক বলে উঠলেন, ডেস্কের উপরের কাগজটায় তুমি তোমার নাম, দেশের নাম, অঞ্চলের নাম, স্ত্রী-সন্তান আছে কি নেই, তোমার ভাষা, তোমার জানা অন্য ভাষা, তোমার অতীত পেশা, কোন ক্রাইম তোমার দ্বারা হয়ে থাকলে তা লেখ। এসব বিষয় স্লেভ ট্রেডারের হুকুমেও লিখতে হয়েছিল, সে যেমন বলেছিল সেইভাবে। তার পুনরাবৃত্তি আমি লিখে ফেললাম। স্ত্রী-সন্তান নিহত হয়েছে লিখলাম আর পেশা আগের মতই কারখানায় চাকরি লিখলাম। আমার লেখা শেষ হলে পাশে দাঁড়ানো বেনেডিক্ট কাগজ কলম নিয়ে আমার দুই হাত এবং হাতের আঙুলগুলো পরীক্ষা করল। তারপর কাগজে কিছু লিখল এবং কাগজ কলমটি রেখে এল মালিকের টেবিলে। মালিক কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে নজর বুলিয়ে স্ত্রীর হাতে দিল। তার স্ত্রী তা দেখে তার পাশের মেয়েটির হাতে দিল। মেয়েটি দেখে নিয়ে কাগজটি তার বাবার হাতে ফেরত দিল।
ফেরত পাওয়া কাগজটি হাতে নিয়ে মালিক একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘ফ্যাক্টরিতে তুমি কি কাজ করেছ?’
মিথ্যাটা আগেই সাজিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, ‘প্যাকিং-এর কাজ করেছি।’
আবার অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল মালিক আমার দিকে। বলল, ‘দেখ, আমি একজন মুসলিম ক্রীতদাস কিনতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল, একজন মুসলিমকে ক্রীতদাস বানিয়ে আমি প্রতিশোধ নেব। ক্রুসেডে আমি যা পারিনি এভাবে আমি তারই কিছুটা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। আমি চতুর্থ ক্রুসেডে যোগদানকারী জার্মানের একজন শ্রেষ্ঠ নাইট। পোপ তৃতীয় ইননোসেন্টের অধীনে পশ্চিম ইউরোপের সাথে আমরা জার্মানরাও সে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিল, মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেমকে আবার উদ্ধার করা। প্রথম ক্রুসেডে আমাদের পূর্বসূরিরা মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেম কেড়ে নিয়েছিলেন।
জেরুসালেম শহরের সত্তর হাজার মুসলমানকে যুদ্ধোত্তর অপারেশনে হত্যা করে আমরা চেয়েছিলাম জেরুসালেমকে আমাদের হাতেই রাখব। কিন্তু তা হয়নি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যাকে মুসলমানরা গাজী সালা্হউদ্দিন বলে, জেরুসালেম আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ক্রসেড পারেনি জেরুসালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে। এই জেরুসালেম উদ্ধারই ছিল আমাদের চতুর্থ ক্রসেডের লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। হয়নি ঘরের শত্রু বিভীষণকে বধ করতে গিয়ে। পোপের অধীন ক্যাথলিক চার্চ বিশেষ করে আমাদের জার্মানদের ঘোরতর শত্রু ছিল বাইজান্টাইন অরথোডক্স চার্চ। ওরা রোমান ক্যাথলিকদের আইন-নীতি ভংগকারী, অধর্মচারী, লোভী, রক্তপায়ী, বিশৃঙ্খল বর্বর, নোংরা ইত্যাদি ধরনের গালাগালি করতো। কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে এই বাইজেন্টাইনরা ক্যাথলিক পোপ ও জার্মানীর তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ক্রসেড যাত্রার পর আমরা গতি পরিবর্তন করে জেরুসালেম জয়ের পরিবর্তে কনস্টান্টিনোপল জয়ের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এই যাত্রা আমাদের সফল হয়েছিল। আমরা কনস্টান্টিনোপল জয় এবং তারপর তা বিধ্বস্ত করেছিলাম। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে বা্ইজেন্টাইন অর্থোডস্ক চার্চের সমাধি রচিত হলো বটে, কিন্তু মুসলমানদের গায়ে আমরা হাত দিতে পারলাম না। এই দু:খ আমাকে পুড়িয়ে মারছে। তাই চেয়েছিলাম একজন মুসলিম ক্রীতদাস এনে তার উপর মনের ঝাল মিটিয়ে দু:খ কিছু লাঘব করবো। তাও হলো না। তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হলো, তাই তোমাকে নিয়ে এলাম। সেই তুমি যাত্রা শুরু করলে মিথ্যা কথা বলে। তুমি ফ্যাক্টরিতে কাজ করনি। তোমার হাতের সবটুকু নরম হওয়া তারই প্রমাণ। আর তোমার কলমের আঁচড় প্রমাণ করে তুমি ভালো লেখায় অভ্যস্ত। ইচ্ছা করেই খারাপ করে লিখেছ। এই দুই মিথ্যার পর তোমার দেয়া তোমার পরিচয়ের উপরও এখন আমার আস্থা নেই। সুতরাং তুমি ভালো আচরণ পাওয়ার উপযুক্ত নও। তুমি আমার ফার্মল্যান্ডে কাজ করবে। ফার্মল্যান্ডের কঠোর পরিবেশ এবং কাজই মিথ্যাবাদীর জন্যে উপযুক্ত জায়গা।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল আমার নতুন মনিব। তাঁর সাথের সবাই উঠল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ফার্ম হাউজে। আমার মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের বাড়ির বিশাল এরিয়ার সীমা থেকেই তার ফার্মল্যান্ডের শুরু। সেখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে ফার্মল্যান্ডের মাঝখানে ফার্মহাউজ। এই ফার্মহাউজ থেকেই বিশাল ফার্মল্যান্ড পরিচালনা করা হয়।
হাসপাতালের একজন কৃতী ডাক্তার ছিলাম তা ভুলে গেলাম। ফার্মের শ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু হলো। শ্রমিকরা বেতন পায়, কিন্তু ক্রীতদাসরা বাঁচার জন্যে শুধুই খাবার পায়। তাদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। ক্রীতদাসদের সেই ভোরে কাজের শুরু হয়, আর ঘুমানো পর্যন্ত কাজ চলে। এভাবেই জীবন চলল।
একদিন মালিক-পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এলেন ফার্মে। ফার্মটা দেখা ও তত্ত্বাবধান করার পর তারা ফার্মহাউজে এলেন। ফার্মহাউজে গোডাউন ছাড়াও রয়েছে শ্রমিক কর্মচারি ও দাসদের আবাস। এই সাথে ফার্মহাউজে রয়েছে দোতলা সুরম্য ভবন। ফার্মল্যান্ডে এলে মালিকরা এখানে থাকেন।
সেদিন বেলা পাঁচটায় মালিকরা এলেন সেই ভবনে। সেদিন সন্ধ্যার পর সে ভবনের দোতলায় প্রচণ্ড কান্নাকটি হৈ চৈ শুনতে পেলাম। সারাদিন পর আবাসস্থলে সবে এসে বসেছি। কান্না হৈ চৈ শুনে সবাই সেদিকে ছুটল। কৌতুহলের বলে আমিও সেদিকে গেলাম।
ফার্মহাউজের মাঝের এই বাড়িটি আসলে বাড়ির মধ্যে আর একটা বাড়ি। একট গেট পেরিয়ে প্রাচীর ঘেরা এই বাড়িতে ঢুকতে হয়। আমরা গেটের বাইরে একটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের লোকদের বলাবলিতে জানলাম, মালিকের মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেলে হামবুর্গের রাজকীয় চিকিৎসালয়ে মাসখানেক চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছে সে। আজই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভীষণ মাথাব্যথা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আগেই শুনেছিলাম, মালিকের এই মেয়ে ক্যাথারিনার স্বামী একজন নাইট, ১২২৮ সালে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ক্রুসেডে যোগ দিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এই সময় ঘোড়ার গাড়িতে একজন ডাক্তার আসতে দেখলাম। ডাক্তার ভেতরে চলে গেল। আমি চলে এলাম। আধাঘন্টার মত পার হয়ে গেল। আমি ফার্মহাউজের পাশে ফার্মের গরুগুলো সামলা্চ্ছিলাম। আবার হৈ চৈ কানে এল, দৌড়াদৌড়ি দেখতে পেলাম। সেই সাথে মালিকের উচ্চকন্ঠ। কৌতুহলবশেই আমরা ছুটে গেলাম সেই বাড়ির দিকে। শুনলাম, ডাক্তার অপারগতা প্রকাশ করে চলে গেছেন। বলে গেছেন, রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন, তার বাইরে কোন ওষুধ নেই। সেই ওষুধে যখন কাজ করেনি, তখন আর করার কিছু নেই। রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেতে হবে এবং ঈশ্বরকে ডাকতে হবে।
মালিক এ সময় বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। বিপর্যস্ত তার চেহারা। বেদনায় নীল তার চোখ মুখ। একমাত্র সন্তান মেয়েকে খুব ভালোবাসেন তিনি। মালিক গেটে এসে গেটের পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারিকে বললেন, তুমি গাড়ি তৈরি করতে বল। ক্যাথরিনাকে আবার রাজকীয় চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ভেতরে কি যেন হয়ে গেল। ডাক্তার ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর আমার মধ্যে যেন তীব্রভাবে জেগে উঠল। হঠাৎ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মালিক, রোগটা কি আমি দেখতে পারি?’
মালিক বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আমার দিকে ঘুরল। তার চোখ-মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। দু’চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। তীব্রকন্ঠে বলে উঠল, ‘এতবড় স্পর্ধা..!’
কিন্তু হঠাৎ করেই তার কন্ঠ থেমে গেল। তার চোখ-মুখ সহজ হয়ে এল। নিভে গেল চোখের আগুন। মাথা নিচু করল। পরক্ষণেই মাথা তুলে বলল, আমার অন্য কোন শ্রমিক-কর্মচারি-ক্রীতদাস এমন কথা বললে তার আমি শিরচ্ছেদ করতাম। কিন্তু আমি দেখে আসছি তুমি সবার চেয়ে ভিন্ন। তুমি মিথ্যা কথা বল না, কাজে ফাঁকি দাও না, খাবার যা পাও, তার বেশি কোন দাবিও তোমার নেই। সবাইকে আমি চিনি, কিন্তু তোমাকে চিনতে পারিনি। তাই তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু বল, কেন তুমি এই কথা বললে? নিশ্চয় জান রাজকীয় চিকিৎসকের চিকিৎসাও ব্যর্থ হয়েছে।’
‘মালিক, কোন দুই ব্যক্তির বুদ্ধি, চিন্তা, দৃষ্টিকোণ সমান নয়। আর যে ঈশ্বর রোগ দিয়েছেন, তিনি তার ওষুধও দিয়েছেন।’ বললাম আমি।
মালিক কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তিনি কি যেন আমার মধ্যে খুঁজে পেলেন। তারপর বললেন, ‘এস।’ বলেই তিনি চলতে শুরু করলেন। আমিও তার পিছু পিছু চললাম। উঠলাম দোতলায়। তাঁর এই দোতলায় ওঠা তাঁর পরিবারের বাইরের কারো জন্যে এটাই বোধ হয় প্রথম।
দোতলার একটা ঘরে তিনি ঢুকলেন। মিনিট খানেক পরে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলেন। ঢুকলাম সেই ঘরে বিরাট সুসজ্জিত ঘর। দেখে কোন শাহবেগম বা শাহজাদীর ঘর বলে মনে হলো। ভাবলাম ফার্মহাউজের ঘর যদি এমন হয়, তাহলে আসল বাড়ির ঘরটা কেমন? বিধবা মেয়েকে মালিক কত ভালোবাসেন, এটা বোধ হয় তারই প্রমাণ।
মালিকের মেয়ের গোটা শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বালিশে মুখ গুঁজে সে চিৎকার করছে, ছটফট করছে। তার মাথার পাশে বসে আছেন মালিকের স্ত্রী। তিনি যখন আমার দিকে তাকালেন, মনে হলো ডুবন্ত মানুষের মত কোন সহায় যেন তিনি হাতড়াচ্ছেন। তিনি মেয়ের মাথার যে পাশে বসে আছেন, তার বিপরীত দিকে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনার মাথার পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম।
মেয়েটিকে মাথাগুঁজে ছটফট করতে দেখে আমি আশান্বিত হয়েছিলাম। যে সন্দেহটা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল সেই সন্দেহটাই তাহলে ঠিক?
আমি মালিকের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘মালিক ওকে চিৎ হয়ে শোয়াতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের স্ত্রী তার মেয়েকে বলল মা একটু চিৎ হয়ে শুতে হবে।’ বলে নিজে তাকে চিৎ হতে সাহায্য করতে গেল।
মেয়ে ক্যাথারিনা চিৎকার করে বলল, ‘আমি আর ওষুধ খেতে পারবো না। আমার মাথার সাথে এখন পেটও জ্বলতে শুরু করেছে। আমি মরে যেতে চাই, আমাকে মরতে দাও।’
মালিক গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর স্ত্রীর পাশেই। সে এগিয়ে গেল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা আমার, সোনা মা, আমরাও যে কষ্ট পাচ্ছি। একটু ঘুরে শোও। ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রাখ মা।’
‘কত ভরসা রাখবো বাবা, যতই দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে যন্ত্রণা। রাজবৈদ্যও তো চেষ্টার কম করলেন না। এই রোগে আমার মৃত্যুই বোধ হয় ঈশ্বরের ইচ্ছ। তার ইচ্ছাই পূরণ হোক। আমি মরতে চাই।’ বলল মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা। বলে বালিশে আবারও বেশি করে মুখ গুঁজল।
হঠাৎ করেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘মানুষ মরণশীল। সুস্থ ও অসুস্থ দুই অবস্থাতেই মানুষ মরতে পারে। মৃত্যুর জন্যে অসুস্থতা জিইয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না। আর ঈশ্বরের বিধান হলো, রোগ হলে চিকিৎসা করাতেই হবে।’
এক ঝটকায় মেয়েটি ঘুরে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘মৃত্যুর জন্যেই কি আমি অসুস্থতা জিইয়ে রাখছি?’ আমি একটা ছোট্ট বাউ করে বললাম, ‘স্যরি ম্যাডাম। আমি তা বলিনি, আমি একটা নীতিকথা বলেছি।’
সেই তীব্র কন্ঠেই মেয়েটি বলল, ‘রাজবৈদ্য যেখানে ব্যর্থ, এই মাত্র একজন বিখ্যাত ডাক্তারও যেখানে আর কিছু করণীয় নেই বলে চলে গেল, সেখানে একজন ক্রীতদাস চিকিৎসা করতে আসা একটা স্পর্ধা নয় কি!’
‘মাফ করবেন ম্যাডাম। প্রত্যেক মানব শিশু স্বাধীন হয়েই জন্মায়, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব তাকে নানা রূপ দিয়ে গড়ে তোলে, ক্রীতদাসও বানায়। রোগটা কি তা দেখতে চেয়েছি, এটা আমার স্পর্ধা নয়, মানুষের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থেকে এটা করেছি। একটা পথের শিশু হলেও আমি এটাই করতাম।’ বললাম খুব নরম, কিন্তু অনড় কন্ঠে।
মালিকের মেয়ের চোখ দু’টি বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে। তার পলকহীন চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। অবাক হয়ে কি যেন সন্ধান করছে সে আমার মধ্যে। ধীরে ধীরে তার পলকহীন চোখ বুজে গেল। নীরব হয়ে গেল সে। বুঝা যাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে সে তার অসহ্য যন্ত্রণা চাপা দেবার চেষ্টা করছে। আমি মেয়েটির মাথার আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি ঝুঁকে পড়ে তার দু’চোখ থেকে যে ধমনীগুচ্ছ মাথার দিকে চলে গেছে, তার ভেতর থেকে দুই প্রধান ধমনী খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম। তার শ্বেত-শুভ্র কপাল বেদনায় আরক্ত হয়ে গেছে। দুই চোখের দুই কোণার দূরত্ব বিবেচনায় রেখে আনুমানিক হিসেব থেকে সে দুই ধমনীর অবস্থান ঠিক করলাম। তারপর মালিক-পত্নীর দিকে চেয়ে বললাম, ‘মা, আপনি আপনার দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক এই দুই জায়গা মাঝারি শক্তিতে চেপে ধরে রাখুন।’
মালিক-পত্নী তাকাল মালিকের দিকে। বলল, ‘আমি বোধ হয় ঐভাবে ধরতে পারব না।’
আলগার, ব্যাপারটা তুমিই ভালো বুঝবে। কাজটা তুমিই করো।আমার দিকে তাকিয়ে বলল মালিক।
আমি তার মাথার পাশে ভালোভাবে বসে দুই হাতের দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সেই দুই ধমনী চেপে ধরলাম।
উপুড় হয়ে বালিশে তার মাথা গুঁজে থাকা, তার চোখ-মুখের রং ইত্যাদি দেখে আমার প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল তার যন্ত্রণার উৎস মাথা নয়, চোখ। যদি তাই হয় তাহলে চোখ থেকে উপরে ওঠা প্রধান ধমনী দু’টি নির্দিষ্ট পরিমাণে চেপে ধরলে ব্যথার উপশম হবে। আল্লাহর রহমতে তাই হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার মুখের অবস্থা সহজ হয়ে গেল। ধমনী দু’টি চেপে রেখে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আনন্দের সাথে দেখলাম, তার মুখে প্রশান্তি ও একটা শিথিলতার ভাব নেমে এসেছে। আমি তার কপাল থেকে হাত তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মালিকের দিকে চেয়ে বললাম, ‘এর সমস্যা মাথায় নয়, চোখে। চোখের সমস্যার কারণেই তাঁর মাথার যন্ত্রণা। চোখ থেকে মাথার দিকে উঠে যাওয়া প্রধান ধমনী দু’টোকে আমি যখন চেপে রেখেছিলাম, তখন দেখেছি তার মাথার যন্ত্রণা কমে গেছে। আমি ওর চোখ দু’টি একটু দেখতে চাই।
মালিক ও মালিক-পত্নী উভয়েরই চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। মালিক এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা একটু চোখ খোল। এখন কেমন মনে করছ মা?’
চোখ খুলল মেয়ে ক্যাথারিনা। তাকাল বাবার দিকে। বলল, যন্ত্রণা প্রায় ছিলই না। আঙ্গুলের চাপ তুলে নেবার পর মনে হচ্ছে একটু একটু করে বাড়ছে যন্ত্রণা।’ খুশি হলেন ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক, আমার মালিক। বললেন, ‘তাহলে তো আলগার ঠিকই বলেছে। সে চোখ দেখতে চায়, চোখটা দেখাও মা।’ বলে একটু সরে দ