৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

‘৪০২’ নাম্বার কক্ষটিই আপনাদের চাই?’ বলল ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্ট।
‘হ্যাঁ, ঐ কক্ষটাই চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু ঐ সারির সবই ভিভিআইপি কক্ষ। ৪০২-এর চেয়ে ৪০১ নাম্বার কক্ষ তো লোকেশনের দিক থেকে আরও ভালো।’
‘কিন্তু কক্ষটা লাকি। আমার একজন আত্নীয় ওখানে ছিলেন। তার নিরাময় হওয়া ছিল মিরাকল। তাই কক্ষটার প্রতি আমাদের এত টান।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পরনে খৃস্টান সন্ন্যাসীর পোশাক। মুখ ভরা তার কাঁচা-পাকা দাড়ি। দাড়ির মত গোঁফও তার প্রচুর, ঠোঁটের অস্তিত্বই তা ঢেকে ফেলেছে।
ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়াল একজন। ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্ট একটু এ্যাটেনশন হয়ে লোকটিকে গুড মর্নিং জানাল ‘স্যার’ বলে সন্বোধন করে।
‘কি বোয়ার, কি সমস্যা?’ বলল এসে দাঁড়ানো লোকটি, উত্তরে গুড মর্নিং বলার পর।
‘না স্যার, তেমন কিছু না। ইনি তার ঐ যে প্যাশেন্ট বসে আছেন তার জন্যে ৪০২ নাম্বার রুমটি চাচ্ছেন। আরেকজনের নামে রুমটি লিখেছিলাম।’ বলল ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্ট বোয়ার।
‘দক্ষিণ পাশের রুমটাও তো খালি আছে। ওটা দিয়ে দাও।’ বলল এসে দাঁড়ানো লোকটি।
‘না স্যার। তা নিচ্ছে না। তাদের ধারণা ৪০২ নং কক্ষটি লাকি, তাই ওটাই চায় তারা। ওদের কেউ নাকি একবার এখানে ছিল।’ ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্ট বোয়ার বলল।
সাধারণ কৌতূহলবশেই আহমদ মুসা তাকিয়েছিল এসে দাঁড়ানো লোকটির দিকে।
ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্টের কথা শুনে লোকটি হাসল। হাসিটা সোজা ও স্বচ্ছ নয়। বলল সে, ‘ঘরটা খুব লাকি, এটা ঠিক আছে। তারা যখন চাচ্ছে দিয়ে দাও না। ঐ পক্ষকে পাশের কক্ষটা দিয়ে দিতে পার।’
কথা শেষ করেই সে ‘ওকে, বাই বোয়ার’ বলে চলে গেল।
লোকটির হাসি এবং কক্ষটি সম্পর্কে তার কথার মধ্যে একটা মিল আছে তা আহমদ মুসার নজর এড়াল না। হাসি ও কথা উভয়ের মধ্যেই একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপও আছে। কিন্তু কেন? বিষয়টি আহমদ মুসার কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা তাকাল ডেস্ক এ্যাসিস্টেন্ট বোয়ার দিকে। বলল, ‘লোকটি কে? আপনাদের বস নাকি?’
বোয়ার হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, সবারই বস সে। হাসপাতালে তার মত পুরানো আর কেউ নেই। তিনি হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর চীফ সুপার।’
‘ওয়ার্ডগুলোর চীফ সুপার? নাম কি?’ বলল আহমদ মুসা। মনে মনে সে বলল, ওয়ার্ডগুলোর চীফ সুপারকেই তাদের দরকার।
‘উনি আলদুস আলারী।’ বলল বোয়ার।
‘আলদুস আলারী? তাকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
আলদুনি সেনফ্রিড মাথা ও হাত-পায়ের প্রবল স্নায়ুবিক ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেল। তার সাথে এ্যাটেনডেন্ট হিসেবে থাকল ব্রুনা। আর আহমদ মুসা রোগীর প্রয়োজনের দিকটা দেখ-ভাল করার জন্যে মাঝে মাঝে হাসপাতালে আসবে। এ ধরনের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।
রুম সার্ভিসের লোকরা রুমের ড্রেসিং এবং রুমের সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে পড়ে আলদুনি সেনফ্রিড বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি চমৎকার বুদ্ধি বের করেছেন। আমি মনে করি, আমাদের কাজের জন্যে এর চেয়ে কোন ভালো ব্যবস্থা আর হতো না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘ইতিমধ্যে তাকে চেনাও তো হয়ে গেছে। এখন তার সাহায্য পেলেই হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাহায্য কি করবেন? কেন করবেন? যা তিনি করেছেন সেটা শুধু ভয়ে নয়, টাকার বিনিময়ও নিশ্চয় ছিল।’ বলল ব্রুনা।
‘হ্যাঁ, ব্রুনা ঠিক বলেছ। তাছাড়া সে অবশ্যই স্বীকার করতে চাইবে না যে সে ভয়ানক কাজটিতে জড়িত ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে? তাকে কেন্দ্র করেই তো আমাদের একটা বড় আশা ছিল।’ বলল ব্রুনা। তার কন্ঠে হতাশার সুর।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে আগাম হতাশা ঠিক নয়। আর ভাবনার সময় এখনও আসেনি ব্রুনা।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলল ব্রুনা হাসতে হাসতে। একটু থামলেও কথা শেষ করল না ব্রুনা। বলে উঠল আবার, ‘একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। আপনি খৃস্টান সন্ন্যাসীর পোশাক কেন নিয়েছেন?’
‘এখানে আমার দু’টি ভূমিকা। খৃস্টান সন্ন্যাসীর কাজ হলো হাসপাতালে তোমাদের খোঁজ-খবর নেয়া। আর আহমদ মুসার কাজ ভিন্ন, যে কাজ নিয়ে আমরা এখানে এসেছি সেই কাজ করা। এক চেহারায় দুই কাজ হতো না ব্রুনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝেছি। সে কাজ কি তাহলে হাসপাতালের বাইরে?’ বলল ব্রুনা। তার মুখ এবার গম্ভীর। কিছুটা উদ্বেগও তাতে।
‘সেটা ঠিক বলা যাবে না। শুধু বাইরে নয়, হাসপাতালের ভেতরেও আহমদ মুসা কাজ করতে পারে। সেটা নির্ভর করবে পরিস্থিতির উপর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি বাইরে থাকবেন কোথায়?’ জিজ্ঞাসা ব্রুনার।
‘এখনও ঠিক করিনি। বাইরে বেরিয়ে একটা কিছু ঠিক করে নেব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আপনি থাকার ব্যাপারটাই আগে ঠিক করে আসুন। আপনার রেস্ট দরকার।’ বলল ব্রুনা।
‘কিন্তু ব্রুনা, এই মুহূর্তে আমার প্রধান কাজ হলো আলদুস আলারী কোথায় থাকেন, তা জানা। তারপর আমার ব্যাপারটা ঠিক করব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি করে জানবেন? জিজ্ঞাসা করলেই তো সন্দেহ জাগবে।’ বলল ব্রুনা।
‘আমি ইতিমধ্যেই খোঁজ নিয়েছি উনি ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে থাকেন, তারপর চলে যান। সন্ধ্যার পরে একবার আসেন পরের দিনের সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখার জন্যে। উনি হাসপাতাল থেকে আর কিছুক্ষণের মধ্যে বের হবেন। এরপর আমি কিছু খোঁজ-খবর নেব।
বেলা ২টা বাজার পর আহমদ মুসা তার ব্যাগটা নিয়ে ড্রেসিং রুমে ঢুকল। ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসার বেশে। আগের আহমদ মুসা থেকে এতটাই পার্থক্য যে, আগে গোঁফ ছিল না এখন গোঁফ আছে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। ব্রুনা বলল, ‘ভাইয়া, আপনি হাসপাতাল থেকে কোথাও যাচ্ছেন?’
‘না। বাইরে বেরুবো তো সন্ন্যাসী সেজে। আসছি অল্পক্ষণ পর।’
বলে আহমদ মুসা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আধা ঘন্টা পরে ফিরে এল আহমদ মুসা।
এসেই আহমদ মুসা পোশাক পাল্টে সন্ন্যাসীর পোশাক পরে পিঠে গেরুয়া একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে তৈরি হলো যাবার জন্যে। আলদুনি সেনফ্রিড রোগীর বেডে এবং ব্রুনা পাশের এ্যাটেনডেন্ট কক্ষে শুয়েছিল।
আহমদ মুসার সাড়া পেয়ে ব্রুনা এ ঘরে চলে এসেছিল। আহমদ মুসাকে তৈরি দেখে বলল সে, ‘ভাইয়া, এবার নিশ্চয় হাসপাতালের বাইরে যাচ্ছেন, আসছেন কখন?’
‘এখনও কিছু ঠিক করিনি? তুমি এদিকটা দেখ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘খুব কৌতুহল লাগছে। নিশ্চয় কোন বিশেষ কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। হলো কাজ?’ বলল ব্রুনা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘বলতে পারবো প্রথম মিশনটা সফল হলে।’
‘মনটা যদিও আকুলি-বিকুলি করছে, তবু জানতে চাইবো না মিশনটা কি?’ বলল ব্রুনা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ধন্যবাদ ব্রুনা। পরে অবশ্যই জানবে। আসি।’
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

রাত ৯টা।
টনডর্ফ বাস স্টেশনে এসে আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে আবাসিক এলাকার দিকে চলল।
টনডর্ফ আবাসিক এলাকা ছোট, ওস্টেনডার হ্রদের সামনে। হামবুর্গের অন্যতম অভিজাত আবাসিক এলাকা এটা। বাড়িগুলো একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বেশ স্পেস আছে একটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির মধ্যে।
রাত ৯টাতেই নীরবতায় ছেয়ে গেছে আবাসিক এলাকার সামনের রাস্তাটা।
এই রাস্তার শেষ প্রান্তের দিকে লেকের ধারে আলদুস আলারীর বাসা।
দিনের বেলা হাসপাতাল থেকেই আহমদ মুসা কৌশলে আলদুস আলারীর বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছিল। আলদুস আলারী তখন ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে এসেছিল। আহমদ মুসা পারসোনাল সেকশনের ডিলিং অফিসারকে বলেছিল, ‘তার সাথে আমার জরুরি কাজ আছে, এখনই তার সাথে দেখা করা প্রয়োজন। আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে, উনি চলে গেছেন।’
‘জরুরি হলে টেলিফোনে কথা বলতে পারেন। টেলিফোন নাম্বার নেই?’ বলেছিল ডিলিং অফিসার।
‘টেলিফোনে সব কথা হয় না, বলা যায় না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তার বাড়িই যেতে হবে আপনাকে। কয়েকদিন হলো উনি বাসা বদলেছেন। টনডর্ফ এলাকায় তার নিজের বাসা। এ বাসার ঠিকানা নিশ্চয় আপনার কাছে নেই। দাঁড়ান দিচ্ছি।’ বলেছিল অফিসার।
এভাবেই আহমদ মুসা আলদুস আলারীর বাসার ঠিকানা পেয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা বাড়ির ঠিকানা পাওয়ার পর পরই একবার আলদুস আলারীর বাড়ি দেখার জন্যে এসেছিল এখানে।
হ্রদের তীরে অভিজাত এক আবাসিক এলাকায় সুন্দর বাড়ি। তার মত চাকুরের এমন বাড়ি হবার কথা নয়। ব্ল্যাক লাইটের টাকায় কি তাহলে বাড়িটা করেছে সে।
আহমদ মুসা জেনেছে আলদুস আলারী শুধুমাত্র স্ত্রী নিয়ে এ বাড়িতে থাকে। তার ছেলেমেয়েরা সবাই হামবুর্গের বাইরে থাকে।
বাড়ি কিংবা রাস্তাতেও আলদুস আলারীর সাথে কথা বলা যেত, কিন্তু আহমদ মুসা বাড়িকেই বেছে নিয়েছে। জার্মানরা অফিস বা রাস্তায় কোন হট্টগোল পছন্দ করে না। এ রকম হলে তারা সোজা পুলিশ ডেকে বসে।
আহমদ মুসা রেন্ট-এ-কার থেকে ভাড়া করা গাড়িটা আলদুস আলারীর বাড়ির কাছাকাছি রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। আহমদ মুসার পরণে কালো প্যান্ট, কালো জ্যাকেট এবং মাথায় একটা কালো হ্যাট।
আহমদ মুসা রাস্তার পাশ ধরে দ্রুত হেঁটে চলল আলদুস আলারীর বাড়ির দিকে।
বাড়িটা সাড়ে তিন ফুটের মত উঁচু ওয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে কোন বাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল এর চেয়ে উঁচু হয় না। অনেক বাড়িতে বাউন্ডারি ওয়ালই নেই।
আলদুস আলারীর বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের সাথে যে গেটটা, সেটা গ্রিলের। গেটটা লক করারও ব্যবস্থা আছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করে ল্যাসার কাটারটা হাতে নিল। কিন্তু ল্যাসার কাটার ব্যবহার করতে হলো না। হাত দিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। আহমদ মুসা কিছুটা বিস্মিতই হলো। জার্মানরা তো এমন করে না সাধারণত। তারা কোন সিস্টেম করলে তা তারা রক্ষা করে। তাহলে আলদুস আলারী গেট লক করল না কেন?
আহমদ মুসা গেট খুলে ভেতরে ঢুকল।
একটা প্রশস্ত লাল পাথুরে রাস্তা এগিয়ে গেছে বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। ভেতরে কোন সাড়া নেই। মিনিট দুয়েক অপেক্ষার পর আহমদ মুসা আস্তে আস্তে দরজার নবের উপর চাপ দিল। নব ঘুরল না। দরজায় তালা, এটাই স্বাভাবিক।
দরজায় নক করল আহমদ মুসা। এক দুই তিনবার নক হলো।
তৃতীয় নকের পরেই দরজা খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়ানো লোকটির উপর নজর পড়তেই বুঝল আহমদ মুসা ইনিই আলদুস আলারী। শক্ত গড়ন, মেদহীন ভরাট মুখ, মাথাভরা সোনালি চুলের সমারোহ দেখে বুঝার উপায় নেই তার বয়স পঞ্চাশের কোঠায়।
আহমদ মুসা আলদুস আলারীর প্রতিক্রিয়ার ধরনে মনে মনে খুবই বিস্মিত হলো। আহমদ মুসা মনে করেছিল এত রাতে অপরিচিত, অনাহূত এবং কোন প্রকার খবর ছাড়া আসা এক অতিথিকে দেখে বিস্মিত, বিরক্ত হবেন আর এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টিতে এ সবের কিছুই ছিল না। কারও জন্যে অপেক্ষা করে থাকলে যে রকম প্রতিক্রিয়া হয় আলদুস আলারীর প্রতিক্রিয়া সে রকমের। তার ও প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে সন্দেহেরও উদয় হলো তার মনে।
‘কে আপনি? কি চাই? আসুন ভেতরে।’ বলল আলদুস আলারী। তার কথার মধ্যে কোন উদ্বেগ-আশংকার ভাব নেই। পরিচয় ও প্রয়োজন জানা ছাড়াই নি:সংকোচে ভেতরে নিয়ে চলল। আহমদ মুসা আলদুস আলারীর এই আচরণের কারণ বুঝতে পারল না। আলদুস আলারী কি খুব সাহসী? কিংবা হতে পারে সে এ ধরনের অতিথি আপ্যায়নে অভ্যস্ত।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসাল।
আলদুস আলারী আহমদ মুসার সামনের সোফায় মুখোমুখি বসল। বলল, ‘আমরা পরস্পরকে বোধ হয় চিনি না। বসুন কি জন্যে কষ্ট করে এত রাতে এসেছেন?’
‘আমি আপনার সাহায্য চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাহায্য? কি সাহায্য?’ বলল আলদুস আলারী।
আহমদ মুসা একবার স্থির দৃষ্টিতে আলদুস আলারীর দিকে তাকাল। বলল, ‘গত বছর ঠিক এই সময় আপনাদের হাসপাতালের একটা বেড থেকে একজন রোগিনী হারিয়ে যায়, তার জায়গায় আসে হুবহু তারই মত আরেকটি মেয়ে। আপনার হাসপাতালের এক বা একাধিক লোক এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আছে। এদের সন্ধান পেলেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির সন্ধান পাওয়া যাবে। এই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। হাসপাতালের সবচেয়ে পুরানো একজন কর্মকর্তা আপনি। আপনিই এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।’
আহমদ মুসা আলদুস আলারীর চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলছিল। আহমদ মুসা মনে করেছিল তার কথা শুনে আলদুস আলারী নিশ্চয় চমকে উঠবেন, চেহারা পাল্টে যাবে তার। কিন্তু কিছুই ঘটল না। তার মুখটা এমন দেখা গেল যেন এসব কথা শোনার জন্যে সে প্রস্তু্তই ছিল। আহমদ মুসার অভিজ্ঞতর ঘন্টায় যেন এলার্ম বেজে উঠল।
ঠিক সেই সময়ে হেসে উঠল আলদুস আলারী। আর আহমদ মুসা তার মাথার পেছনে স্টিলের শক্ত নলের স্পর্শ অনুভব করল। সামনে, ডান ও বাম থেকে দেয়াল ফুঁড়েই যেন তিনজন রিভলবার বাগিয়ে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল। সামনের লোকটা হাতের রিভলবারটা নাচিয়ে নাচিয়ে হো হো করে হেসে বলল, ‘তুমিই তাহলে সেই নকল আহমদ মুসা। তুমি খুব বুদ্ধিমান শুনেছি। কিন্তু আজ এতটা বোকামি করলে কি করে? কেমন করে তুমি ধরে নিলে যে, হাসপাতাল থেকে আলদুস আলারীর ঠিকানা জেনে নেবে আর সহজেই পেয়ে যাবে আলদুস আলারীকে? একজন এশিয়ান তার ঠিকানা যোগাড় করেছে, এটা জানতে পেরেই সে ব্ল্যাক লাইটের লোকদের জানিয়েছে। আমরা অনেক দিন ধরে হামবুর্গ ও অ্যারেন্ডসী’তে তোমার অপেক্ষায় জাল পেতে বসে আছি। আজ জালে ধরা পড়েছ।’ বলে আবার হো হো করে হেসে উঠল লোকটা।
সামনের লোকটা থামতেই ডান পাশের লোকটা বলল, ‘ভাগ্যিস আমরা আলদুস আলারীকেও সব ব্যাপারে জানিয়ে রেখেছিলাম।’
‘বেচারা নকল আহমদ মুসা সেজে অতি আত্নবিশ্বাসের কারণে আজ সহজেই জালে আটকে গেছে।’ বলল বাম পাশের জন।
‘তোমরা তাড়াতাড়ি আমার বাড়িকে ঝামেলা মুক্ত কর।’ আলদুস আলারী বলল।
‘কার্ল ওর পকেটগুলো সার্চ কর। আর নকল আহমদ মুসা তুমি হাত তুলে দাঁড়াও এখনি, গুলি না খেতে চাইলে।’
আহমদ মুসা এটাই চাচ্ছিল। আহমদ মুসা মাথার উপর হাত তুলতে তুলতে দাঁড়িয়ে গেল সংগে সংগেই।
পেছনের লোকটা আহমদ মুসার মাথা থেকে রিভলবার সরিয়ে নিয়ে সামনে এসে গিয়েছিল আহমদ মুসাকে সার্চ করার জন্যে।
আহমদ মুসা দাঁড়াবার সময়ই হাত উপরে তুলতে গিয়ে ডান হাত দিয়ে মাথার পিছনে জ্যাকটের আড়াল থেকে ছোট, কিন্তু ভয়ংকর রিভলবারটা নিয়েই ডান দিকের লোকটাকে গুলি করল। সেই একই সময়ে আহমদ মুসার বাম হাত সাঁড়াশীর মত দ্রুত সামনে এগিয়ে তাকে সার্চ করতে আসা লোকটিকে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরেছিল। ডান হাত প্রথম গুলিটা ছুড়েই বিদ্যু গতিতে সরে গিয়ে দ্বিতীয় গুলি করেছিল সামনের রিভলবারধারীকে। এই সময় বামের লোকটির নিক্ষিপ্ত গুলি এসে বিদ্ধ করল আহমদ মুসার বাম হাতকে। আহমদ মুসার বাম হাত শিথিল হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে লোকটিকে ধরে রেখে পেছন দিকে সোফার উপর আছড়ে পড়ল। আর সেই সাথে আহমদ মুসা লোকটিকে ধরে রাখা অবস্থাতেই ডান হাত একটু ঘুরিয়ে নিয়ে গুলি করল বাম দিকের লোকটিকে।
বাম দিকের লোকটি তাদের লোকের সাথে জড়াজড়ি করে পড়ে যাওয়ায় গুলি করার সুবিধা পাচ্ছিল না। আহমদ মুসা তাদের লোকের নিচে পড়ে যাওয়ায় আরও অসুবিধায় পড়েছিল। এটাই আহমদ মুসাকে সময়ও দিয়েছিল, সুযোগও দিয়েছিল। বাম দিকের লোকটিও মাথায় গুলি খাবার পর আগের দু’জনের মতই চিৎকার করার সুযোগটুকুও পেল না, ভূমি শয্যা নিল।
আহমদ মুসা তৃতীয় গুলি করার সময় তার সাথে পড়ে যাওয়া লোকটি তার হাত থেকে খসে গিয়েছিল এবং সোফার পাশে পড়ে যাওয়া তার রিভলবারটি খুঁজে পেয়েছিল। তার রিভলবার সে আহমদ মুসার দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসা তৃতীয় গুলি করার পর মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করল না, তার হাতটা সামনের দিকে ঘুরে আসতে যা সময় নিল। লোকটির রিভলবার ঘুরে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু আহমদ মুসার রিভলবার আওতায় ততক্ষণে লোকটির মাথা এসে গিয়েছিল। ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা। আধা দাঁড়ানো লোকটি সেই অবস্থাতেই বসে পড়ল মেঝের উপর। বিমূঢ়, কম্পমান আলদুস আলারী আতংকগ্রস্ত হয়ে এক পা দু’পা করে সরছিল ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে। পায়ের উপর শক্তি নিয়ে যেন সে দাঁড়াতে পারছিল না।
আহমদ মুসা তার দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘আর এক পা এগোলে আমি গুলি করব।’
আলদুস আলারী ডুকরে কেঁদে উঠে বসে পড়ল। এই সময় তার স্ত্রী ঘরে ঢুকল। প্রথমে সাদা চুলের মেয়েটাকে আলদুসের স্ত্রী বলে আহমদ মুসার মনে হয়নি। কিন্তু আহমদ মুসার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে যখন স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইল, তখনই বুঝল সে আলদুসের স্ত্রী। সে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘আমার স্বামীর কোন দোষ নেই। সে যেটুকু করেছে বাধ্য হয়ে করেছে।’
মহিলাটা ঘরে ঢুকলে আহমদ মুসা সোফার উপর রাখা হ্যাট মাথায় পরেছিল চেহারা কিছুটা আড়াল করার জন্যে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনার স্বামীকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। সে যদি আমাদের ভালো কাজে সহযোগিতা করে, তাহলে তার কোন ক্ষতি হবে না।’
‘নিয়ে যাবেন কেন? কি সহযোগিতা চান বলুন। সে সহযোগিতা করবে।’ আলদুসের স্ত্রী বলল।
‘কিছু লোক অন্যায় করেছে। সেটা আপনার স্বামী জানে। সেই ব্যাপারে আমরা কিছু জানতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু জানলে সে বলবে। এখানেই তাকে জিজ্ঞেস করুন।’ আলদুসের স্ত্রী বলল।
‘আমি কিছু বললে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বলতে পারবো না আমি।’ বলল আলদুস আলারী।
‘আর না বললে আমি মেরে ফেলব। এখন বল কোনটা চাও?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বাঁচতে চাই।’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠল আলদুস আলারী।
‘ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনার স্বামীকে আমি নিয়ে গেলাম। এটাই তার বাঁচার পথ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেমন করে?’ কান্না জড়িত কন্ঠে বলল আলদুসের স্ত্রী।
‘অত কথা বলার সময় আমার নেই। আমাকে বিশ্বাস করতে হবে ম্যাডাম।’ আহমদ মুসা বলল।
সজল চোখে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আলদুসের স্ত্রী আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার কন্ঠের কি যেন আকর্ষণ তাকে দারুণভাবে বিমোহিত করল। তার মানে হলো, এই কন্ঠকে বিশ্বাস করা যায়। এ কন্ঠ যেন মিথ্যা বলতে পারে না বলে তার মনে হলো।
আলদুসের স্ত্রী আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করলাম বেটা। আমার স্বামী করে ফেরত আসবে? আজই ফেরত আসবে তো?’
‘তার ফিরে আসা নির্ভর করছে সে আমাদের সহযোগিতা করছে কি না তার উপর।’ বলল আহমদ মুসা।
বলেই সে আলদুসের স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করল।
আলদুসের স্ত্রী ছুটে গিয়ে স্বামীর কাছে বসল। বলল, তুমি যা জান সব বলে দেবে। এরা ভালো মানুষ। দেখ না আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলেছে। আর ওরা তো মানুষ জ্ঞান করে না। তুমি যাও এর সাথে।’
উঠে দাঁড়াল আলদুস আলারী। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাঁচার কোন উপায় নেই।’
আহমদ মুসা লোকটির মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলল, ‘চোখের পানি মুছে ফেল। এটা কান্নার কোন সময় নয়। স্বাভাবিকভাবে রাস্তায় হাঁটবে। অন্যথা হলে জানবে, আমার রিভলবারের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’
আলদুস আলারী হাঁটতে লাগল। আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে আলদুস আলারীর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আসি ম্যাডাম।’
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।’ বলল আলদুসের স্ত্রী কম্পিত গলায়।
আহমদ মুসা পেছনে না তাকিয়ে মনে মনে বলল, তাহলে দুনিয়ার সব স্ত্রীরা একই রকম। কিন্তু আমরা স্বামীরা কতটুকু তা বুঝি।
রা্স্তায় আলদুস আলারী অস্বাভাবিক কিছু করল না।
আলদুস আলারীকে পাশে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। বাম হাতটা তুলতে পারছে না আহমদ মুসা। এতক্ষণ পরিস্থিতির উত্তেজনায় আহত হাতের দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি সে। এখন খুব ভারি মনে হচ্ছে হাতটা। বাহুর যেখানে গুলিটা লেগেছে, একটা মাংসপিণ্ড তুলে নিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। বাহুর লাগোয়া পাঁজরের পেশীতেও যন্ত্রণা হচ্ছে। তাহলে বুলেটটা বাহু থেকে বেরিয়ে সে পেশীকেও আহত করেছে?’
আহমদ মুসা শহর ছাড়িয়ে একটা নির্জন ফার্মল্যান্ডে এনে গাড়ি থামাল। পেছন থেকে ব্যাগ টেনে নিয়ে মেডিকেটেড ব্যাণ্ডেজ বের করল। আলদুস আলারীকে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে বলে গা থেকে জ্যাকেট খুলে ফেলল। ওষুধে ভেজানো তুলা দিয়ে যতটা সম্ভব আহত স্থানটা এক হাতের সাহায্যে ব্যাণ্ডেজ করল। পাঁজরের আহত স্থানটারও এভাবে এক হাত দিয়ে নার্সিং করল।
রক্ত ভেজা জ্যাকেট গাড়ির পেছনে রেখে আরেকটা শার্ট পরে নিয়ে আহমদ মুসা আলদুস আলারীকে সোজা হয়ে বসতে বলল।
মি. আলদুস আলারী চিন্তা করে কিছু কি ঠিক করলেন? আপনি আমাদের সহযোগিতা করবেন, না ওদের মত গুলি খেয়ে মরবেন?’ বলল আহমদ মুসা আলদুস আলারীকে লক্ষ্য করে।
‘স্যার, ওরা আমাকে আমার পরিবার সমেত মেরে ফেলবে।’ বলল আলদুস আলারী কম্পিত গলায়।
‘আমাকে সহযোগিতা না করলে আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব, এটা কে বলল?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বাঁচতে চাই স্যার। আমি তাহলে কি করব?’ বলল আলদুস আলারী।
কি করতে হবে, সেটা বলবো। কিন্তু তার আগে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দাও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জানতে চান স্যার?’ বলল আলদুস আলারী।
‘যে মেয়েটিকে তারা হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তাকে তারা কোথায় রেখেছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার
‘স্যার, ওদের সব কাজ অত্যন্ত গোপনীয়। আমার সব কিছু ওরা জানে, কিন্তু আমি ওদের কিছুই জানি না।’ বলল আলদুস আলারী কম্পিত গলায়।
ড্যাশ বোর্ডের উপর থেকে রিভলবার হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘জানি না, কথাটা আর বলবে না। কি জান সেটা বল।’
‘ওদের একটা টেলিফোন নাম্বার জানি স্যার।’ বলল আলদুস আলারী।
‘মোবাইল, না ল্যান্ড টেলিফোন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘একটা মোবাইল, অন্যটা ল্যান্ড টেলিফোন স্যার। মোবাইল নাম্বারটা আমাকে ওরা দিয়েছে এবং ল্যান্ড টেলিফোন নাম্বারটা টেলিফোনে একজনকে দিচ্ছিল সেটা আমি শুনেছি।’ বলল আলদুস আলারী।
আহমদ মুসা নাম্বার দু’টি নিজের মোবাইলে সেভ করে নিল।
মোবাইল পকেটে রেখে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এরপর বল। আর কি জান?’
‘স্যার, যেদিন মেয়েটাকে সরিয়ে নেয়, সেদিন ওদের একজন আরেকজনকে মেয়েটিকে ‘৪৯০-এর সি’-তে তুলতে বলেছিল। কিন্তু ওদের টীম লিডার যে ছিল সে শুনতে পেয়ে বলেছিল, না ‘সি’ তে নয়, ‘এ’-তে তোলার নির্দেশ হয়েছে। এ ছাড়া তাদের মুখে কয়েকবার ‘অ্যারেন্ডসী’র নাম শুনেছি। কয়েকদিন আগে যখন ওরা আমার কাছে আসে পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবধান করার জন্যে। একজন আরেকজনকে বলতে শুনেছি, ‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস’ ও ‘লেক প্যালেস’ এর সাথে বাড়িকে জুড়ে দিয়ে আরও নিরাপদ করা হয়েছে-চিন্তার কিছু নেই।’ থামল আলদুস আলারী।
‘তারপর মি. আলদুস?’ আহমদ মুসা বলল।
আলদুস দু’হাত জোড় করে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ওদের সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না স্যার। যা জানি সব বলেছি। স্যার, ওরা আমাকে ব্যবহার করেছে। পরিবার সমেত শেষ করে দেবার হুমকি দিয়ে আমাকে ওরা কাজ করতে বাধ্য করেছে।’
আদালার বাবা আলগার মানে আল মানসুরের কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। সত্যিই আলদুস প্রথমে রাজি হয়নি। তাকে বাধ্য করা হয়ে ভয় দেখিয়ে। বেচারা আলদুস আর কিছুই জানে না সেটা বিশ্বাস হলো আহমদ মুসার। তাহলে আলদুসের কাছে কি পাওয়া গেল? নিজেকে নিকেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। দু’টো টেলিফোন নাম্বার ও নাম্বারসত কয়েকটা ক্লু পাওয়া গেছে। ক্লুগুলো গুরুত্বপূর্ণ কি না অ্যারেন্ডসীতে গেলেই তা বুঝা যাবে। দু’টো টেলিফোন নাম্বার, একটা বাড়ি বা স্থানের নাম ও নাম্বার সামনের অন্ধকারে আলোকবর্তিকার মত মনে হচ্ছে তার কাছে। নিকষ অন্ধকারে দাঁড়ানো তার কাছে এটা একটা বড় পাওয়া।
আহমদ মুসা আলদুস আলারীকে বলল, ‘দশ পনের দিন তোমার লুকিয়ে থাকার মত কোন জায়গা আছে?’
‘কেন স্যার?’ জিজ্ঞাসা আলদুস আলারীর।
‘এখন বাড়ি গেলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। দশ পনের দিন তোমাকে সরে থাকতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আলদুস আলারীর। বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দেবেন স্যার?’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘এর বেশি কিছু জানই না যখন বলছ , তখন আর কি করব।’
‘আপনি খুব ভালো স্যার। ওরা মানুষ নয় স্যার। ‘ব্ল্যাক লাইট’ নামের খুব ভয়ংকর একটা দল ওরা স্যার। আরও কিছু জানলে অবশ্যই বলতাম স্যার।’
‘আচ্ছা গত দু’দিনে ওদের কয়টা টেলিফোন পেয়েছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দু’বার স্যার’। বলল আলদুস আলারী।
‘নাম্বারগুলো কি আছে তোমার মোবাইলে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না, স্যার। ওদের টেলিফোনের নাম্বার, নাম কিছুই শো হয় না আমার মোবাইলে।’ বলল আলদুস।
‘বুঝেছি। এখন বল তোমার সরে থাকার মত সে রকম জায়গা আছে কি না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, আছে স্যার। লোনবার্গে আমার ফুফু থাকেন। সেখানে আমি কিছু দিন থাকতে পারি। তিনি একাই থাকেন একটা ফ্লাটে।
‘গুড, জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। তাহলে এখন তুমি কিভাবে যাবে সেখানে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অসুবিধা নেই স্যার। বাসেও যাওয়া যায়। ট্যাক্সি নিয়েও যেতে পারি।
কিন্তু স্যার টাকা তো নেই পকেটে, বাড়ি কি যেতে পারি?’ বলল আলদুস আলারী।
‘না, ব্ল্যাক লাইটের হাতে পড়ে যেতে পার। ওদের কাছে এতক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে। ওরা তোমাদের ওখানে এসেও থাকতে পারে। সাথীদের লাশ তারাই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে, হাসপাতালে যেতে পারি? ওখানে গেলে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ বলল আলদুস আলারী।
‘না, বাড়ি, হাসপাতাল কোনটাই তোমার জন্যে নিরাপদ নয়। তোমার কত টাকা হলে চলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘যাতায়াতের জন্য শ’পাচেক মার্ক হলেই চলবে স্যার।’ বলল আলদুস আলারী।
আহমদ মুসা তার হাতে এক হাজার মার্ক তুলে দিয়ে বলল, ‘সাবধানে যাবে। তোমার স্ত্রীকে কিছুই জানাবে না। আমি জানাবার ব্যবস্থা করবো, যদি দরকার হয়।’
আহমদ মুসা আলদুস আলারীকে একটা বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল আলদুস আলারী। বলল, ‘আপনি খুব ভালো মানুষ স্যার। ঈশ্বর আপনাদের সাহায্য করুন।’
‘ধন্যবাদ আলদুস আলারী। চলি।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল।
গাড়িতে বসেই পোশাক পাল্টে আহমদ মুসা হোটেলে এল।
পরদিন সকাল আটটার দিকে আহমদ মুসা হাসপাতালে পৌঁছল।
কক্ষের দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দিল ব্রুনা। তার মুখ শুকনো।
উদ্বেগে কাতর চেহারা। আহমদ মুসাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেল। কথাই বলতে পারল না ব্রুনা। তার ঠোঁট দু’টো অবরুদ্ধ আবেগে কাঁপছিল। আহমদ মুসাকে দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে দাঁড়াল সে। আহমদ মুসা বিস্মিত হলো ব্রুনার অবস্থা দেখে।
‘তোমরা ভালো আছ ব্রুনা?’ বলে ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। ঘরে ঢুকে আলদুনি সেনফ্রিডকেও দেখল জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে থাকতে। আহমদ মুসাকে দেখে প্রাণ পাওয়ার মত সে যেন জেগে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন মি. আহমদ মুসা?’
‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু আপনাদের কি হয়েছে?’
ব্রুনা দরজা বন্ধ করে ফিরে এসেছিল। বলল, ‘স্যার, গত দু’ঘন্টায় আমরা প্রায় অর্ধেক মরে গেছি।’
‘কেন কি হয়েছে? কিছু ঘটেছে?’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘বসুন স্যার, বলছি।’ বলে ব্রুনা আহমদ মুসাকে বসার পথ করে দেবার জন্যে সরতে গিয়ে আহমদ মুসার বাম হাতের সাথে একটু ধাক্কা খেল।
আহমদ মুসা ‘আহ!’ বলে উঠল। অনেকটা অনিচ্ছাতেই তার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেছে।
থমকে দাঁড়িয়েছে ব্রুনা। তার চোখে-মুখে অপার প্রশ্ন। আলদুনি সেনফ্রিডও চমকে উঠেছে।
ব্রুনা দুই ধাপ সরে এসে বলল, ‘দেখি ভাইয়া, আপনার হাতটা।’
বলেই ব্রুনা হাতের উপর থেকে সন্ন্যাসীর আলখেল্লার হাতা তুলে ফেলল। দেখতে পেল বাহুর ব্যান্ডেজ।
চমকে উঠল ব্রুনা। তার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডও উঠে দাঁড়িয়েছে।
তাঁরও প্রশ্ন, ‘মি. আহমদ মুসার হাতে কি হয়েছে?’ তার কন্ঠে ঝরে পড়ল রাজ্যের উদ্বেগ।
‘বলছি মি. সেনফ্রিড। কিন্তু তার আগে বলুন আপনাদের কি হয়েছে। আমার খুব উদ্বেগ বোধ হচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বসুন ভাইয়া আপনি। বলছি আমি। জানি আমি, আমাদের কথা না বললে আপনার কথা জানতে পারবো না।’ বলল ব্রুনা।
আহমদ মুসা বসল।
আলদুনি সেনফ্রিড শুরু করল। বলল, ‘আজ সকাল ৬টায় আমরা খবর পেলাম, হাসপাতালের চীফ সুপার আলদুস আলারীর বাড়িতে চারজন অপরিচিতের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। সেই সাথে মি. আলারীকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। আমরা এই খবর শুনে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আপনার ঐ বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। অত..।’
আলদুনি সেনফ্রিডের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘অতএব আপনারা মনে করলেন চারজনের মধ্যে আমি…।’
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে দিল না ব্রুনা। ব্রুনা হাত দিয়ে আহমদ মুসার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘প্লিজ, এমন শব্দ মুখেও আনবেন না। এই দুই ঘন্টায় আমাদের আশংকা-আতংক মন ঝাঁজরা হয়ে গেছে। শুধু আপনার কথা নয়, ভাবীর কথা মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল আপনাদের চোখের মণি আহমদ আবদুল্লাহর কথাও।’ শেষের কথাগুলো ব্রুনার কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
‘ব্রুনা, এত তাড়াতাড়ি এভাবে ভেঙে পড়লে যুদ্ধে জিতবে কি করে? তোমাদের আরও সাহসী হতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আমরা সাধারণ মানুষ। যে শক্তি আমাদের নেই, তা আমাদের কাছে আশা করা উচিত নয়।’
একটু থেমে চোখ-মুখ মুছে নিয়ে বলল ব্রুনা, ‘ভাইয়া, এখন আমাদের প্রশ্নের জবাব দিন এবং আলদুস আলারীর বাড়ির সাংঘাতিক ঘটনা সম্পর্কে প্লিজ সব বলুন।’
‘ঘটনা জানবো না কেন? ঐ চারজনের একজনের গুলিতেই আমার বাহু আহত হয়েছে। আমাকে ধরার জন্যে ওরা আগে থেকেই আলদুস আলারীর বাড়িতে লুকিয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা জানল কি করে যে, আপনি আলদুস আলারীর বাসায় ঐ সময় যাচ্ছেন?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
আলদুস আলারীর ঠিকানা কিভাবে আহমদ মুসা হাসপাতাল থেকে নিয়েছিল, সেটা জানিয়ে বলল, ‘সম্ভবত হাসপাতাল থেকেই আলদুসকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, কে একজন ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু সে লোক যে আপনি তা কি করে জানল এবং ঐভাবে প্রস্তুত থাকল আপনার জন্যে?’ বলল ব্রুনা।
‘যে আলদুসের বাড়িতে যাচ্ছে সে এশিয়ান, এটা জেনে নেয় আলদুস আলারী হাসপাতাল থেকে। এশিয়ান শুনেই সে সন্দেহ করে। কারণ, ব্ল্যাক লাইট আগেই আলদুস আলারীকে সাবধান করে দিয়েছিল। তাই এশিয়ান শুনেই সে ব্ল্যাক লাইটকে খবর দেয় এবং ব্ল্যাক লাইটের চারজন তার বাড়িতে আমার জন্যে ওঁৎ পেতে বসেছিল। আমি যখন আলদুস আলারীর বাড়িতে গিয়ে হাসপাতাল থেকে তোমার মাকে সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম, তখন ওরা চারজন আমাকে ঘিরে ফেলে।’
‘সর্বনাশ, তারপর?’ বলল ব্রুনা।
‘তারপরের খবর তো শুনেছ। ওরা চারজনই মারা গেছে। তারা না মরলে আমাকেই মরতে হতো।’ আহমদ মুসা বলল।
ব্রুনা কিংবা আলদুনি সেনফ্রিড কেউই কোন কথা বলল না। তারা নির্বাক চোখে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। জীবন-মৃত্যুর কি ভয়ংকর খেলা সে খেলছে। এ পর্যন্ত তাদের সামনেই আহমদ মুসা অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। প্রতিবারই মারতে না পারলে আহমদ মুসাকেই হয়তো জীবন দিতে হতো। অনেক স্থানেই প্রতিপক্ষ সবাইকে মরতে হয়েছে আর প্রতিবারই ঈশ্বর আহমদ মুসাকে জয়ী করেছেন, সে বেঁচে গেছে। কিন্তু সব সময় যদি ঈশ্বরের সাহায্য না আসে! স্ত্রী কোথায়, ছেলে কোথায়, সংসার কোথায়, আর কোথায় সে! তার কিছু হলে কেউ তো জানতেও পারবে না! এটা আহমদ মুসা জানে, তার পরিবারও জানে। তাহলে কেমন করে ওরা সহ্য করছে এটা্ নিজেদের স্বার্থ তো কিছু নেই। একটা অচেনা, অজানা বিদেশি এক পরিবারের জন্যে এ কত বড় এক আত্নত্যাগ! ব্রুনা ও আলদুনি সেনফ্রিড দু’জনেরই চোখ থেকে অ্শ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
‘কি হলো আপনাদের? চোখে অশ্রু কেন? আমাদেরই তো জয় হয়েছে। আলদুস আলারীর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এতদিন অন্ধকারে ঘুরছিলাম, তার কাছ থেকে কিছু আলো পেয়েছি। অশ্রু কেন এ সময় আপনাদের চোখে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. আহমদ মুসা, কাল রাতে আপনার যদি কিছু হতো, তাহলে কিভাবে খবরটা দিতাম আপনার স্ত্রীকে, আপনার পরিবারকে! খুব অপরাধী মনে হচ্ছে আমাদের। আমাদের মত এক অনাত্নীয়ের জন্যে বার বার কেন মৃত্যুর মুখে গিয়ে দাঁড়াবেন?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।অশ্রু ভেজা তার কথাগুলো।
‘ও, এই কথা! আপ্নারা আমার অনাত্নীয় কে বলল?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার সাথে আমাদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই, অন্য ধরনের কোন পারিবারিক সম্পর্কও নেই, কেন আপনি আমাদের জন্যে বার বার মৃত্যুর মুখে গিয়ে দাঁড়াবেন?’ বলল সেনফ্রিড।
হো হো করে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘রক্তের সম্পর্ক নেই? বলন তো আদম হাওয়া মানে অ্যাডাম-ইভ আপনাদের কে? বাব-মা নয়? হ্যাঁ, বাবা-মা। আর ওরা আমারও বাবা-মা।’
‘মি. আহমদ মুসা, এটা দার্শনিক যুক্তির কথা। বাস্তবে এটা আমরা কেউ মানি না।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘মি. আলদুনি সেনফ্রিড, মানা না-মানা ভিন্ন কথা, সম্পর্কটা তো সত্য। সম্পর্কটা যদি কেউ মানে তাহলে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।’
চোখ ভরা পানি থাকলেও ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল ব্রুনার। বলল, ‘আপনার যুক্তি-বুদ্ধির অভাব নেই। আপনি ও ভাবী দু’জনেই সাধারণের অবস্থান থেকে অনেক উপরে। কিন্তু ভাইয়া, আমরা অসাধারণ নই। আমাদের নিজেদেরকে খুবই স্বার্থপর, অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। আমরা যখন রাতে নরম বিছানায় সুখনিদ্রা উপভোগ করছিলাম, তখন আপনি মৃত্যুর মুখে লড়ছিলেন এবং তা আমাদের জন্যে।’
গাম্ভীর্য নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘নিছক আবেগের কথা বলছ ব্রুনা, বাস্তবতা এটা নয়। মানুষ মানুষের জন্যে কাজ করবে, এটাই মানুষের সংস্কৃতি। একজন অভাবগ্রস্ত হবে, আরেকজন তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে-এটাই মানুষের আবহমান সংস্কৃতি। একজন বিপদগ্রস্ত হবে, আরেকজন বিপদ উত্তরণে সাহায্য করবে, মানুষের এই সংস্কৃতি চলে আসছে মানুষ এই পৃথিবীতে আসার সময় থেকে। কত মানুষ মানুষের জন্যে, মানুষের কল্যাণে বিনিদ্র রজনী কাজ করছে, অন্য মানুষরা তা জানেই না। এটাই হলো মানুষের স্বত:প্রবহমান সংস্কৃতি। মানুষ অকাতরে মানুষের জন্য জীবন দেয়। মানুষের এই সংস্কৃতি চলে আসছে মানুষের গোটা ইতিহাস ধরে। এই সংস্কৃতি যদি পাল্টে দাও, মানুষের সমাজ নামে কোন কিছু আর থাকবে না। প্রকৃত বিষয় হলো আমি ব্রুনাকে সাহায্য করছি না, আমি মি. সেনফ্রিডকেও সাহায্য করছি না। আমি সাহায্য করছি মানুষকে। এটা আমার অধিকার। আবার মানুষের স্রষ্টা যিনি তার দেয়া দায়িত্বও এটা।’
আলদুনি সেনফ্রিড ও ব্রুনা দু’জনেরই চোখ আবার অশ্রুতে ভরে গেছে, কিন্তু সেই সাথে তাদের মুখ আনন্দের রঙে উজ্জ্বল। আলদুনি সেনফ্রিড কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই ব্রুনা কথা বলে উঠল। বলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। কিন্তু এই মানুষকে বড় বেশি তো দেখা যায় না। তাই ভুল হয়, আমরা ভুল করি।’
‘না, ব্রুনা, মানুষের প্রতি আস্থাহীন হয়ো না। প্রতিটি মানুষই এই মানুষ। পরিবেশ-পরিস্থিতি, অন্যায়-অবিচার, অনাদর-অবহেলা অনেক সময় তাদের গায়ে অমানুষের পোশাক পরায়। কিন্তু এরাও ঠিক সময়ে জেগে ওঠে। এরাও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে। মানুষকে রক্ষার কাজে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে মানুষ করেই সৃষ্টি করেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি মি. আহমদ মুসা। আমরা স্রষ্টার পরিচয় যেমন ভুলে গেছি, তেমনি মানুষের পরিচয়ও আমি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ধন্যবাদ আপনাকে। এখন প্লিজ বলুন, আলদুস আলারীর কাছে আপনি কি তথ্য পেয়েছেন। তাকে কি আপনিই বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, মি. সেনফ্রিড। তার কাছ থেকে কয়েকটা মূল্যবান ক্লু পেয়েছি। আসলেই বেচারা ওদের সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্ল্যাক লাইট তাকে ব্যবহার করেছে মাত্র।’
‘কেমন ক্লু পাওয়া গেছে?’ বলল সেনফ্রিড।
‘দু’টো টেলিফোন নাম্বার পাওয়া গেছে। সম্ভবত ‘অ্যারেন্ডসী’র একটা বাড়ির নাম্বার পাওয়া গেছে। আর ‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস’, ‘লেক প্যালেস’ নামে দু’টো বা একটা বাড়ির নাম পাওয়া গেছে। বাড়ির নাম্বারটা এই বাড়িরও হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তথ্যগুলো তো ভালো মনে হচ্ছে মি. আহমদ মুসা।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ মি. সেনফ্রিড। আমি মনে করি, তথ্যগুলো আমাদের খুবই সাহায্য করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঈশ্বর সহায় হোন।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘ভাইয়া, আপনি নাস্তা করেছেন?’ বলল ব্রুনা।
‘হ্যাঁ, আজ ৭টার মধ্যে নাস্তা সেরেছি। এসব তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।’
ব্রুনাকে কথাগুলো বলে আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে হসপিটালের বেডে রোগী হয়ে শুয়ে থাকার সময় আপনার শেষ মি. সেনফ্রিড। আজ ১২টার মধ্যেই হাসপাতাল ছাড়বেন।’
খুশি হলো ব্রুনা ও ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড দু’জনেই।
‘এবার কোথায় আমরা যাচ্ছি মি. আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা আলদুনি সেনফ্রিডের।
‘সেই অরিজিন্যাল ডেস্টিনেশন, অ্যারেন্ডসীতে, মি. সেনফ্রিড।’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ওদিকে একটু যাই, ১২টার মধ্যেই রিলিজের ব্যবস্থা করতে হবে।’ উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।আহমদ মুসা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আহমদ মুসার বেরিয়ে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়েছিল আলদুনি সেনফ্রিড। এক সময় সে বলে উঠল, ঈশ্বর মন ভালো মানুষ এখনকার দুনিয়ায় সৃষ্টি করেছেন, না দেখলে বিশ্বাস হতো না ব্রুনা।’
‘শুধু ভালো মানুষ নন বাবা, ওর ব্যাক্তিত্ব পাথরের চেয়েও শক্ত বাবা। তোমাকে বলি বাবা, প্রথম দিনের ঘটনা থেকেই ওকে আমার ভালো লাগে। তারপর ওকে চাইতে শুরু করেছিলাম। একদিন গভীর রাতে বাবা আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম। ওকে প্রপোজ করেছিলাম। তিনি খুব কঠোর হয়েছিলেন আমার প্রতি। বকেছিলেন আমাকে। আমি খুব কেঁদেছিলাম। পরে উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার বড় ভাই হলে খুশি হতে পার না ?’ সত্যি বড় ভাইয়ের মতই কথাগুলো ছিল। আমার মনের দুঃখ , বেদনা সব মুছে গিয়েছিল। সেই থেকেই আমি ওকে ভাইয়া বলে ডাকি বাবা।’ বলল গম্ভীর ভারি কন্ঠে ব্রুনা।
‘আমি শুনেছি, মুসলমানরা সাধারণভাবে চরিত্রবান হয়। আহমদ মুসা আরও বড় ব্যাতিক্রম।’
বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
ব্রুনা উত্তরে কোন কথা আর বলল না। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেছে সে। আলদুনি সেনফ্রিডও উঠে তার বিছানায় গেল।
অনেকক্ষণ সবর থাকার পর নীরবতায় ছেয়ে গেল ঘরটা।

Top