৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে বন-এ পৌছতে পারল না। অবশ্য পুলিশ প্রধান বরডেন ব্রিসের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ তাদের ছিল।
পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস সকাল ৮টায় বার্লিন থেকে বন পৌছেছিল।
সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই ব্ল্যাক লাইটের লোকদের পুলিশ লোকেট করে ফেলে। ওরা সাড়ে ৯টাতেই বন-এর একটা কোর্টে পৌছেছিল। সকাল ১০টায় ব্রুমসারবার্গ স্টেট হস্তান্তরের দলিল হবার কথা।
ঠিক সকাল ১০টায় ওরা দলিল রেজিস্ট্রির জন্যে কোর্টে ওঠে। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত হয়ে সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় দস্তক্ষত ও টিপসহির মাধ্যমে তার স্টেট হস্তান্তর করছে, এই হলফ যখন নকল কারিনা কারলিন করে এবং তা রেকর্ড হয়, তখনই পুলিশ গোটা কোর্ট ঘিরে অ্যারেস্ট করে নকল কারিনা কারলিন ও ব্ল্যাক লাইটের সব লোককে প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও আত্নসাতের অভিযোগে।
কোর্ট প্রাথমিক প্রমাণ চাইলে পুলিশ প্রধান স্বয়ং কোর্টকে জানান, ‘যে কারিনা কারলিন স্টেট হস্তান্তর করছে, তিনি সম্পত্তির মালিক নন। প্রকৃত মালিক আসল কারিনা কারলিনের তিনি ক্লোন, নকল। সাড়ে দশটার মধ্যেই আসল কারিনা কারলিন এসে পৌঁছাবেন।’
কোর্ট পুলিশ প্রধানের আবেদনে বেলা ১১টা পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করেন।
আহমদ মুসাদের গাড়ি কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছালে পুলিশ প্রধান স্বয়ং কোর্ট থেকে তাদের গাড়ির কাছে আসেন।
এসেই তিনি আহমদ মুসাকে সব জানান।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং বলেন ব্ল্যাক লাইটের যাদেরকে ধরেছেন তাদের মধ্যেই ব্ল্যাক লাইটের প্রধানও আছেন। তাকে চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আপনি অ্যারেন্ডসীর পুলিশকে বলুন অ্যারেন্ডসী লেকের পশ্চিম তীরে হোটেল অ্যারেন্ডসী ডয়েসল্যান্ডের উত্তর পাশে ১৩০ নাম্বার বাড়িটা ব্ল্যাক লাইটের একটা ঘাঁটি। পুলিশকে ওটা দখলে নিতে হবে।’
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি নির্দেশ পাঠাচ্ছি। আর ডিস্কটা আপনি দিন, সেই ছয়টা ক্লোন ও তার লোকদের এখনি ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
আহমদ মুসা আসল ডিস্কের একটা কপি পুলিশ প্রধানের হাতে তুলে দিল। আসার পথেই আহমদ মুসা ডিস্কটার একটা কপি করে নিয়েছিল। সাবধানতার একটা অংশ হিসেবেই করেছিল এটা আহমদ মুসা।
ডিস্কটা পকেটে পুরে পুলিশ প্রধান বলল, মি. আহমদ মুসা আপনাকে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন কি না?’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ব্রুনা দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার তাঁকে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। আজকেই উনি দু’বার গুলি বিদ্ধ হয়েছেন, কানে ও কাঁধে। এ ছাড়া দু’দিন আগে তিনি বাম বাহুতেও গুলি খেয়েছেন।’
‘সর্বনাশ, এসব কথা তো মি. আহমদ মুসা আমাকে বলেননি। এই আহত অবস্থায় আপনি কাজ করছেন। করবেনই তো! ভুলেই যাচ্ছি কেন যে, আপনি আহমদ মুসা। যাক, আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।’ বলে পুলিশ প্রধান বন-এর পুলিশ কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি মিসেস কারিনা কারলিন এবং তাঁর স্বামী ও মেয়েকে কোর্টে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি নিজে আহমদ মুসাকে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান।’
‘প্লিজ, আমাকে সামরিক হাসপাতালে নয়, পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে চলুন। হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে আমার দু’টি শর্ত আছে। এক, আমার নাম গোপন করতে হবে, দুই, চিকি্ৎসা হবে, কিন্তু কোন অপারেশন নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে তাই হবে আহমদ মুসা।’ বলে বনের পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস বললেন, ‘ঠিক আছে পুলিশ হাসপাতালেই নিন। আমাদের জন্য যে কেবিনগুলো বরাদ্দ, তার কোন একটিতে ওঁকে রাখবেন।’ বলল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
বিশাল পুলিশ বেষ্টনির মধ্য দিয়ে মিসেস কারিনা কারলিনদের নিয়ে পুলিশ প্রধান চললেন কোর্টের দিকে। আর আহমদ মুসাকে নিয়ে বন-এর পুলিশ কর্মকর্তা চললেন পুলিস হাসপাতালের দিকে। তার গাড়ির আগে-পিছে রয়েছে পুলিশের প্রহরা।
পরদিন জার্মানীর সকল কাগজে ৮ কলাম ব্যাপী হেডলাইন:
‘শতাব্দীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ষড়যন্ত্র দিনের আলোতে নিয়ে এসেছে জার্মান পুলিশ।’ বিবরণে লেখা হয়েছে কি করে বড় বড় স্টেট মালিকদের ক্লোন তৈরি করে মালিকদের হত্যা করে তার জায়গায় ক্লোনকে বসিয়ে একের পর এক সম্পত্তি গ্রাস করা হয়েছে তার কাহিনী। কারিনা কারলিনের ব্রুমসারবার্গের স্টেটসহ সাত সাতটি স্টেটের ক্লোন ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরন কাহিনী আকারে পত্রিকায় এসেছে। তারা লিখেছে , ব্রুমসারবার্গের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের উত্তরসূরি কারিনা কারলিনের ক্লোন তৈরি করে তাদের দশ হাজার একরের স্টেট দখল করতে গিয়ে এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা আসল কারিনা কারলিনকে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় তার ক্লোনকে বসিয়ে তার মাধ্যমে স্টেট হস্তান্তরের সব ব্যবস্থা চুড়ান্ত করেছিল। কিন্তু রেজিস্ট্রির সময় শেষ মুহূর্তে তারা ধরা পড়ে যায়। পুলিশ বিশ্বস্ত সূত্রের খবর পেয়ে তাদের ধরে ফেলে এবং পুলিশ ‘ব্ল্যাক লাইট’ নামক ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্রের রেকর্ডসংবলিত একটা কম্পিউটার ডিস্ক পেয়ে যায়। ডিস্ক থেকে তথ্য উদ্ধার করেই পুলিশ উত্তর জার্মানীর আরও যে ৬টি স্টেট ষড়যন্ত্রকারীরা ক্লোন করে দখল করে নিয়েছিল সেগুলোতে একযোগে অভিযান চালায় এবং ক্লোনসহ তাদের লোকদের ধরে ফেলে। এসব স্টেটের আসল মালিকরা কোথায় কিংবা তাদের কি করা হয়েছে পুলিশ এখনো তার অনুসন্ধান চালাচ্ছে। ভয়াবহ, বিপজ্জনক ও সুবিশাল এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলার কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্যে দেশের সকল প্রান্ত থেকে সকলেই পুলিশের প্রশংসা করছে এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে এবং পুলিশ প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার ও পুলিশদের জাতির পক্ষে পুরস্কৃত করার দাবি জানানো হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র বিষয়ে জনগণকে অবহিত করার ক্ষেত্রে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো আন্তরিক ভূমিকা পালন করছে। গতকাল থেকে তারা এই ঘটনার উপর অব্যাহতভাবে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। পুলিশ প্রধান, ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার, কারিনা কারলিনের পরিবারসহ ষড়যন্ত্রের শিকার ৭টি পরিবারের সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার ও বক্তব্য নেয়া হচ্ছে।
পুলিশ হাসপাতালের ভিভিআইপি কক্ষের বেডে শুয়ে আহমদ মুসাও পত্রিকার বিবরণগুলো পড়ছিল। এসব রিপোর্ট টিভিতে গতকাল থেকেই সে দেখে আসছে। ভীষণ খুশি আহমদ মুসা অন্যান্য ৬টি স্টেটের সম্পত্তি আত্নসাৎকারী ক্লোন ও তার লোকজন ধরা পড়ার সংবাদে।
পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস আহমদ মুসার কক্ষে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা একটা ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল।
পুলিস প্রধান বরডেন ব্লিস ঘরে প্রবেশ করেই জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি আপনার পিতার বয়সের মি. আহমদ মুসা। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে, আপনার পা ছুঁয়ে আপনাকে স্যালুট দিতে।’
আহমদ মুসা ও বরডেন ব্লিস কেউ-ই দেখতে পায়নি দরজায় এসে দাঁড়ানো ব্রুনা, ব্রুনার মা কারিনা কারলিন ও ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডকে।
পুলিস প্রধান থেমেই আবার বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে গোটা বিষয় জানিয়েছি। সেটা জানাতে গিয়ে আপনার কথা তাদের বলতে হয়েছে। আপনার নাম গোপন করতে বলেছিলেন, সেটা তাঁদের কাছে গোপন করা সম্ভব হয়নি। তারাও আপনাকে জানেন দেখলাম। আজই একবার তাঁরা আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন।’
‘ধন্যবাদ স্যার। ভালো হতো যদি আপনি আমার ব্যাপারটা তাঁদের কাছে গোপন রাখতে পারতেন। আমি…।’
‘কেন ভাইয়া, গোপন রাখতে হবে কেন? কত ভালো হতো যদি পত্রিকা ও অন্য মিডিয়াগুলো কাহিনীর পেছনের কাহিনী প্রচার ও প্রকাশ করতে পারতো।’ আহমদ মুসা কথার মাঝখানেই উচ্চস্বরে কথাগুলো বলতে বলতে ব্রুনা ঘরে প্রবেশ করল। তার সাথে তার বাপ-মাও।
‘ঠিক বলেছ মা। আমারও এটাই কথা। গোপন করার কি প্রয়োজন ছিল? কিন্তু বলতো, তোমাদের সাক্ষাৎকারে তোমরা ওর সম্পর্কে কিছু বললে না কেন?’ বলল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘এটা ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করুন স্যার। তিনি যেমন আপনার মুখ বন্ধ করেছেন, তেমনি আমাদেরকেও কড়া নির্দেশ দিয়েছেন তার সম্পর্কে একটা কথাও যাতে না বলি। তাঁর নির্দেশ না মানার সাধ্য আমাদের আছে?’ ব্রুনা বলল।
‘এই গোপনীয়তা কেন মি. আহমদ মুসা আপনার? ছবি তো নয়ই, আপনার ব্যক্তিত্ব, কাজ ইত্যাদি কেন আপনি প্রকাশ করবেন না? হাজারো মানুষকে এটা অনুপ্রেরণা দিতে পারে।’ বলল পুলিশ প্রধান গম্ভীর কন্ঠে।
‘আমি কখনও রিটায়ারমেন্টে গেলে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করব। কিন্তু মি. বরডেন ব্লিস! স্যার, আপনি অন্তত জানেন, স্বার্থে আঘাত দিয়েছি, ষড়যন্ত্র বানচাল করেছি, এমন শত্রু আমার দুনিয়াজোড়া। তারা দুনিয়াময় ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার কাজ, আমার কাজের ধরণ, কোথায় কোন রুপে কাজ করছি, আমার এখনকার লোকেশন ইত্যাদি মানে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ জানার জন্য। আমি আমার এসব প্রকাশ করে একদিকে যেমন তাদের মাথা ব্যথা বাড়াতে চাই না, তাদের উস্কে দিতে চাই না, অন্য দিকে তেমনি আমি যা করছি, তা একজন মানুষ হিসেবে আল্লাহর জন্যে করছি, মানুষের জন্যে মানুষ কিছু করলে আল্লাহ খুমি হন বলে করছি, কোন প্রশংসা, কোন ধন্যবাদ, কোন বিনিময় পাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তাই এসব আমি অহেতুক প্রকাশ্যে প্রচার করতে চাই না।’ আহমদ মুসা বলল। তার গম্ভীর কন্ঠ খুব নরম ও শান্ত। আহমদ মুসা থমল।
কেউ কোন কথা বলল না।
নির্বাক যেন সকলে। সম্মোহিত যেন তারা।
বিস্ময়-বিমুদ্ধ ব্রুনা ও ব্রুনার মা কারিনা কারলিনের চোখের কোণা ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। এক সময় নীরবতা ভেঙে পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস ধীর কন্ঠে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কাজের দিক দিয়ে যেমন আকাশস্পর্শী, তেমনি মনের দিক দিয়েও এক অতলান্ত সাগর। একটা কথা বলুন মি. আহমদ মুসা, আল্লাহ অর্থাৎ ঈশ্বরের জন্যে করা মানে মানুষের জন্যে করা, কারণ মানুষ মানুষের জন্যে কিছু করাকে ঈশ্বর পছন্দ করেন-এই মহান কনসেপ্টে আপনি উদ্ধুদ্ধ হলের কোথা খেকে?’
আমার ধর্ম ইসলাম আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট মানুষের কাছ থেকে এটা চান, কারণ পৃথিবীতে শান্তি ও স্বস্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে এটা খুবই প্রয়োজন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা!’ বলে আনন্দ-বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা পুলিশ প্রধান কিছু বলতে যাচ্ছিল, ‘এই সময় হাসপাতালের পরিচালক ঘরে প্রবেশ করল। বলল বরডেন ব্লিসকে, ‘স্যার, অয়্যারলেস পেলাম, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখানে আসছেন।’
শুনেই শশব্যস্ত হয়ে উঠল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস। বলল পরিচালককে, ‘সবকিছু ঠিক আছে তো। এই ঘরটাকে আরেকটু ড্রেসিং করুন। আরও সোফা এখানে নিয়ে আসুন।’
‘মি. আহমদ মুসা, আমরা চলি। পরে আসব।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘না মি. সেনফ্রিড। আপনারা বসুন ড্রইং রুমে। আপনাদের সাথে দেখা হলে খুশিই হবেন তারা।’ পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস বলল।
‘ঠিক আছে? অবশ্যই বসছি।’ বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এক সাথে অ্যাটাস্‌ড ড্রইং রুমে প্রবেশ করল ব্রুনারা।
আহমদ মুসার কক্ষকে ঠিকঠাক করার জন্যে অনেক লোক এসে গেল। হাসপাতালের অফিসার-কর্মচারিদের তখন ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেছে চারদিকে।
সর্বত্রই একটা সাজসাজ রব। কিন্তু তাদের সকলের মধ্যেই একটা কানাঘুষা চলছে ভিভিআইপি কক্ষটিতে কে আছেন? পুলিশ তো নয়; তাহলে কে, যার জন্যে পুলিশ প্রধান এসে বসে আছেন, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন?

আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না আহমদ মুসার। গতকাল ছাড়া পেতে চেষ্টা করেছিল হাসপাতাল থেকে। কিন্তু পুলিশ প্রধানের বাধায় সেটা হয়নি। দুর্বলতা কাটার জন্যে আরও দু’একদিন বিশ্রামে থাকা দরকার।
পাশ ফিরে শুয়ে আহমদ মুসা পাশ থেকে আইফোনটা তুলে নিল। পুলিশ প্রধান আইফোনটা তাকে প্রেজেন্ট করেছে।
আইফোন হাতে নিয়ে আহমদ মুসা হোমস্ক্রীন ওপেন করতেই একটা মেসেজ দেখতে পেল। ওয়াশিংটন থেকে সারা জেফারসন পাঠিয়েছে। ক্লিক করে ফুল টেক্সট তাড়াতাড়ি সামনে নিয়ে এল। সংক্ষিপ্ত মেসেজটা পড়েই চমকে উঠেছে সে। মেসেজটি পড়ল আহমদ মুসা:
‘গতকাল এফবিআই জানিয়েছে, দু’দিন আগে ওয়াশিংটনে আপনার শত্রু তিনটি শক্তিশালী সংগঠন মিটিং করেছে। সে মিটিং-এ আপনাকে শায়েস্তা করার জন্যে আপনার পরিবারের উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল থেকে বাড়িতে এফবিআই পাহারা বসিয়েছে। এফবিআইকে জানানো ছাড়া কোথাও বেরুতে নিষেধ করা হয়েছে। আপা এ সময় আপনাকে এসব জানিয়ে ডিস্টার্ব করতে চাননি। কিন্তু উদ্বেগ আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। আপনাকে সব জানিয়ে সেই উদ্বেগ কিছু হালকা করার চেষ্টা করলাম।’ সারা।
আহমদ মুসার মনে জোসেফাইনের সুন্দর মুখটা ভেসে উঠল। আহমদ মুসা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি সব সময় আমার সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাব, দুশ্চিন্তা থেকে আমাকে সব সময় দূরে রাখতে চাও। তোমার চিন্তা, দুশ্চিন্তা নিরাপত্তাহীনতা তোমার কাছে কিছুই নয়, কিন্তু আমার কাছে সবকিছু। মনে মনে ধন্যবাদ দিল সারা জেফারসনকে। স্বগতই বলল, ঠিক সময়ে জানিয়েছ তুমি সারা। ওরা তিন সংগঠন কারা আমি জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। তাদের হুমকি শূন্যগর্ভ অবশ্যই নয়।
মোবাইল বেজে উঠল এ সময়। কল অন করল আহমদ মুসা।
ওপার থেকে জোসেফাইনের গলা পেতেই সালাম দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘কেমন আছ তোমরা জোসেফাইন, তোমার টেলিফোনের আইডি হাইড করা কেন?’
‘ও কথার উত্তর পরে দেব। বল, কেমন আছ?’ বলল জোসেফাইন।
‘এখন ভালো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে আগে ভালো ছিলে না। কি হয়েছিল তোমার?’ বলল জোসেফাইন। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
‘আমি জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা কেমন আছ। তার জবাব এড়িয়ে গেছ। সে জবাব আগে দাও।’ আহমদ মুসা বলল।
হাসল ওপার থেকে জোসেফাইন। বলল, ‘হ্যাঁ , তাহলে শোন আমি ভালো আছি, সারা ভালো আছে, আহমদ আবদুল্লাহও ভালো আছে।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু আহমদ আবদুল্লাহ তিন নাম্বারে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বয়স অনুসারে সিরিয়াল।‘ বলল জোসেফাইন হেসে উঠে।
‘সারা এল তালিকায়, তার মা বাদ পড়ল কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আবার হাসল জোসেফাইন। বলর, ‘গ্রুপ’ বা ‘ফ্যামিলি’ বলে একটা কথা আছে না, আমরা একটা গ্রুপ। তাই তার নামটা মনে পড়েছে।’ বলল জোসেফাইন।
মুহুর্তের জন্যে থেমেই জোসেফাইন আবার বলল, ‘ থাক এসব। তুমি সত্যিই ভালো আছ তো? তোমার মিশনের কি অবস্থা?’
‘তুমি খুশি হবে জোসেফাইন, মিশন আমার সফল। কারিনা কারলিন উদ্ধার হয়েছে। তাদের স্টেট রক্ষা পেয়েছে। তার সাথে আরও ছয়টা স্টেট রক্ষা পেয়েছে রাহুগ্রাস থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘থ্যাংকস আল্লাহ। এবার তাহলে আমেরিকার টিকিট কাট।’ বলল জোসেফাইন।
‘কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন সেটা তুমিই জান।’ বলল জোসেফাইন।
‘জানি, আমার জোসেফাইন আমেরিকায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শুধু জোসেফাইন নয়, তোমার সব আমেরিকায়।’ বলর জোসেফাইন।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল, ‘কথা বাড়িও না। কবে আসছো আমেরিকায়?
‘তুমি যখন বলবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখনি এস।’ বলল জোসেফাইন। সে হাসল।
‘তাই আসছি। আহমদ আবদুল্লাহর তো গলা পাচ্ছি না?’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে সারার কাছে। সে সারাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে।’ বলল জোসেফাইন।
‘এটা কি ভালো জোসেফাইন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাচ্চার স্বাধীনতায় হাত দেবে নাকি?’ বলল জোসেফাইন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সবচেয়ে আগে যে টিকিট পাব, সে টিকিটেই আমি আসছি জোসেফাইন।’
ভালো থেকো, আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন।’ বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
চোখ বুজে কিছুক্ষণ হৃদয়ে গেঁথে রাখা জোসেফাইনের ছবি দেখল। তারপর মনে মনে তাকে বলল, জোসেফাইন কোন খারাপ খবর আমাকে দিতেই চাও না, যতটা পার নিজেই তার ভার বহন করতে চাও। তোমাদের বিপদের কথা এখনও গোপন করে গেলে।
আইফোন পাশে রেখে উঠে বসল আহমদ মুসা। হাসপাতালের প্যাড, কলম টেনে নিয়ে একটা চিঠি লেখার পর মোবাইলটা তুলে নিল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিসকে টেলিফোন করার জন্যে। আর এই সময়ই বরডেন ব্লিস দরজায় নক করে আহমদ মুসার ঘরে প্রবেশ করল।
‘আল হামদুলিল্লাহ, পেয়ে গেলাম আপনাকে। আপনাকেই টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি ব্যাপার মি. আহমদ মুসা? জরুরি কিছু?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আমার পরিবার এখন ওয়াশিংটনে। কিছু সমস্যা হয়েছে সেখানে। সবচেয়ে আগে যে ফ্লাইট পাব, সেটাতে আজই আমি ফ্লাই করতে চাই মি. বরডেন ব্লিস।’ বলল আহমদ মুসা।
এই সাথে পাসপোর্টের একটা কপি দিয়ে দিল বরডেন ব্লিসকে।
পাসপোর্টের কপি নিয়ে পুলিশ প্রধান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমি আসছি এখনি মি. আহমদ মুসা।’
ঘর থেকে বেরুলেন পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
পাঁচ সাত মিনিট পর পুলিশ প্রধান ফিরে এল হাসতে হাসতে। বলল, ‘কত তাড়াতাড়ি যাবেন দেখুন মি. আহমদ মুসা্। বেলা ২টায় লুফথানসা লন্ডন হয়ে ওয়াশিংটন। বিকেল ৪টায় বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিশেষ ফ্লাইট লন্ডন, মন্ট্রিল হয়ে ওয়াশিংটন। বিকেল ৫টায় ফ্রেন্স এয়ার লাইনস প্যারিস, রাবাত হয়ে ওয়াশিংটন। পরের ফ্লাইটগুলো আরও দেরিতে বলে সেগুলোর টাইম নেয় হয়নি।’
‘ধন্যবাদ মি. বরডেন ব্লিস। অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমি দুপুর ২টায় লুফথানসা ফ্লাইটে যেতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তার মানে অন্তত ১২টায় আপনাকে বের হতে হবে। তাহলে হাতে আপনার মাত্র ১ ঘন্টা সময়। পারবেন এর মধ্যে রেডি হতে? মি. সেনফ্রিডের বাসায় আপনাকে যেতে হবে না?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘না স্যার, ওখানে আর যাচ্ছি না। একটা চিঠি লিখেছি। এ চিঠিটা আপনার লোককে দিয়ে মি. সেনফ্রিডের বাড়িতে পৌছে দিতে হবে। আর স্যার, আমি গোসল করেই রেডি হয়ে যাব। প্লিজ, আপনি বিমান বন্দরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে আহমদ মুসা। আমি ওদিকের সব ব্যবস্থা করছি। আপনি গোসল করে রেডি হয়ে নিন।’
বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
আহমদ মুসা গোসল সেরে পোশাক পরে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়েই ছিল। পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস আসতেই তার সাথে বেরিয়ে পড়ল।
এয়ারপোর্টে যাবার জন্যে বরডেন ব্লিস আহমদ মুসার সঙ্গে একই গাড়িতে উঠল।
ভিআইপি লাউঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর পিএস এসে পুলিশ প্রধানকে তিনটা প্যাকেট দিয়ে গেল।
প্যাকেটগুলো পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস্ আহমদ মুসার সামনে নিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এগুলো আপনার জন্যে উপহার।’
‘কি আছে মি. বরডেন ব্লিস এগুলোতে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘একটাতে আছে হিরের নেকলেস মিসেস আহমদ মুসার জন্যে। দ্বিতীয়টিতে আছে হীরের নিবের সোনার কলম মাস্টার আহমদ আবদুল্লাহর জন্যে এবং তৃতীয়টিতে একটা পোষ্ট টুয়েন্টি ফার্স্ট সেনচুরি ০০১ রিভলবার। সিংগেল ট্রিগার এ থেকে ৪টা মিনি সাইজ গুলি বের হয়। এর প্রত্যেকটি গুলির বিস্ফোরণ ক্ষমতা হ্যান্ড মর্টারের একটা গুলির বিস্ফোরণ ক্ষমতার সমান।’ বলে পুলিশ প্রধান প্যাকেট খুলে রিভলবারটা আহমদ মুসাকে দেখাল।
একজন পুলিশকে বলে প্যাকেটগুলো আহমদ মুসার লাগেজে ঢুকিয়ে রি-প্যাক করে দিল।
ঠিক বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে আহমদ মুসা বিমানে উঠল।
পুলিশ প্রধান তাকে বিমান পর্যন্ত পৌঁছে দিল।

ব্রুনা, ব্রুনার মা ও আলদুনি সেনফ্রিড তাদের বন-এর বাসার বাইরের ড্রইংরুমে বসে ছিল। শুনছিল কারিনা কারলিন ব্রুনার কাছ থেকে তার বড় বোন আনালিসার কথা। আহমদ মুসা যাকে গৌরী বলে জানে।
একজন পুলিশ অফিসার গেটের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইল।
ব্রুনা বেরিয়ে গিয়ে তাকে নিয়ে এল।
ড্রইং রুমে এসে পুলিশ অফিসার কারিনা কারলিনকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় মিসেস সেনফ্রিড?’
‘জি, হ্যাঁ। বলুন তো কি ব্যাপার?’
‘কিছু নয় ম্যাডাম। একটা চিঠি আপনাকে দিতে এসেছি।’ একটা ইনভেলাপ তার দিকে বাড়িয়ে বলল পুলিশ অফিসার।
‘কার চিঠি?’ চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল কারিনা কারলিন।
‘আহমদ মুসার চিঠি। যিনি পুলিশ হাসপাতালে ছিলেন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘ছিলেন মানে? এখন নেই?’ প্রশ্ন ব্রুনার। তার কন্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
‘নেই ম্যাডাম। বেলা ২টায় তিনি ওয়াশিংটন যাত্রা করেছেন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
পুলিশ অফিসারের কথাটা কানে যেতেই ব্রুনার মনে হলো সে যেন আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল মাটিতে। আঘাতটা তার বুকে এস বিঁধল। হৃদয়ের কোন এক অন্ধকার কোণ থেকে সজীব যন্ত্রণার এক প্রস্রবণ তার হৃদয় মনে এক সয়লাব নিয়ে এল। সে সয়লাব অশ্রু হয়ে নেমে এল দু’চোখ দিয়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকেছে ব্রুনা।
পুলিশ চলে গেছে।
‘ব্রুনা দেখতো আহমদ মুসা কি লিখেছে?’
বলে ব্রুনার মা কারিনা কারলিন ব্রুনার দিকে চাইল। দেখল, ব্রুনা দু’হাতে মুখ ঢেকে সোফায় মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে।
কারিনা কারলিন সোফার ওদিকে একটু সরে গিয়ে ব্রুনার হাত টেনে নিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে মা তোমার? অসুস্থতা বোধ করছ?’
কিন্তু ব্রুনার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে দেখল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে তার দু’গণ্ড। কি হয়েছে মা? আহমদ মুসা চলে গেছে তাই কি?’
‘কারলিন, আহমদ মুসা কি লিখেছে পড়। জানাই তো গেল না ঘটনা কি?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
কারিনা কারলিন একবার তাকাল আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে। তার দুই চোখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা অনুসন্ধান।
‘ঠিক আছে পড়ছি সেনফ্রিড।’ বলে চিঠিটা মেলে ধরল তার চোখের সামনে।
“মা,
খুব ভালো হতো যদি আমি আপনার স্নেহের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে পারতাম। কিন্তু হলো না। খুব জরুরি হওয়ায় আকস্মিকভাবেই আমাকে ওয়াশিংটন যেতে হচ্ছে।
আপনাদের সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছা করেই তা করলাম না। বিদায়ের বেদনা আমি সইতে পারি না, বেদনার অশ্রু আমার কাছে অসহনীয় লাগে-এ জন্যেই পেছনে ফিরে তাকাতে ভয় পাই আমি। স্মৃতি আমার কাছে এক যন্ত্রণাদায়ক ইতিহাস। এই আমার অসৌজন্য ও বেয়াদবিকে আপনারা নিশ্চয় মাফ করবেন। ব্রুনাকে বুদ্ধিমতি, সাহসী ও স্পষ্টভাষী এবং মি. সেনফ্রিডকে পিতাসুলভ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিসেবে পেয়েছি। তাঁরা আমার মিশনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। খুবই ভালো লাগছে গৌরীর দেয়া দায়িত্ব আমি পালন করতে পেরেছি। আমার জীবন রক্ষায় গৌরীর আত্নবিসর্জনকে চিরদিন আমি সম্মান করে যাব।
আপনার ছেলে আহমদ মুসা।”
চিঠি শেষ করতে গিয়ে কারিনা কারলিনও কেঁদে ফেলল। বলল, ছেলেটা শুরু থেকেই আমাকে মা বলে ডেকেছে। তার এত সুন্দর মা ডাকে আমি কখন যেন তার মা হয়ে গেছি। বলে গেলেও পারত বাছা। আসলে ওর মনটা খুব নরম। এখন যেমন কাঁদছি আমরা, তখনও তো কাঁদতাম। এটাই সে এড়াতে চেয়েছে।
ব্রুনা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বলল, ‘মা, উনি আপার ঋণ পরিশোধ করতে এসেছিলেন। আমাদের সাথে সম্পর্ক ওঁর কাছে কিছুই নয় মা।’
‘মা ব্রুনা, মনে আছে একদিন সে বলেছিল, সময়ের স্রোতে সে ভাসমান। সময় তাকে কখন কোথায় নিয়ে যায়, এটা তিনিও আগাম জানেন না।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘না বাবা, উনি তো লিখেছেন, উনি বলে যেতে পারতেন। একজন লোক এভাবে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবেন। এই পৃথিবীতেই তিনি আছেন, কিন্তু তার কিছুই আমরা জানব না, একটা টেলিফোন নাম্বারও নয়, এটা কেন বাবা?’ বলল ব্রুনা। তার কন্ঠ কান্নারুদ্ধ।
‘ঠিক মা, এটা ভাবা যায় না। কিন্তু সে যে আহমদ মুসা। একটু ভিন্নভাবে তাকে দেখতেই হবে।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘ভিন্নভাবে দেখতে পারছি না বাবা। মানুষ মানুষই। এটা তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ বোঝে না।’ বলে উঠে দাঁডিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল ব্রুনা।
কারিনা কারলিন তাকাল আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে। বলল, ‘ছোট তো, মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। সেই তো শুরু থেকে আহমদ মুসার সাথে আছে।’
‘কষ্ট সে আগেই পেয়েছে কারলিন।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘কেন, কিভাবে, কোথায়?’ কারিনা কারলিনের চোখে কিছুটা উদ্বেগ।
‘না জেনে, না বুঝেই ব্রুনা বড় একটা আশার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।’ বলল সেনফ্রিড।
‘সে আশা কি আহমদ মুসাকে নিয়ে? তারপর?’ কারিনা কারলিন বলল।
‘পরে বলব, চল দেখি ব্রুনা কি করছে। বলে উঠে দাঁড়াল সেনফ্রিড।
কারিনা কারলিনও উঠল।

লুফথানসার ফ্লাইট সাঁতার কাটছে আকাশে।
এগোচ্ছে সে ওয়াশিংটনের দিকে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লুফথানসা পৌঁছবে ওয়াশিংটনের আকাশে।
আহমদ মুসার দু’চোখ জানালা দিয়ে বাইরে।
দেখছে অন্ধকার চাদরে ঢাকা আমেরিকাকে।
ঐ অন্ধকারের মত রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা এক ষড়যন্ত্রের পিছু নিতে আবার সে আমেরিকায়। ক্রল করছে জাহাজ ল্যান্ডিং-এর জন্যে।

পরবর্তী বই
আবার আমেরিকায়

Top