৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

অ্যারেন্ডসী লেকের পশ্চিম তীরের যে এলাকাটাকে আহমদ মুসা হ্যাটটপ বলে ধরে নিয়েছিল, সেটা জংগল ও পাহাড়ী এলাকা। অ্যারেন্ডসী হ্রদের চারদিকে ঘুরে যে সার্কুলার রোড আছে, সেই রোড হ্রদের পশ্চিম তীরে এসে এই জংগল ও পাহাড়ী এলাকার বাইরে দিয়ে গেছে। এই রোড থেকে হ্রদের কিনারা পর্যন্ত পশ্চিম তীরের এই এলাকা গোটাটাই পাহাড় জংগলে ভরা। তবে জংগল ও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে জিগজ্যাগ অনেক পথ আছে। পথগুলো খুব সংকীর্ণ নয়। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে।
বিস্মিত হল আহমদ মুসা, এই জংগল ও পাহাড়ের মধ্যে হোটেল। রেস্টহাউজ এবং প্রাইভেট বাড়িও আছে। কোনটা পাহাড়ের উপর। কোনটা উপত্যকায়। কিন্তু পুরোটাই পাহাড় জংগলে ঢাকা।স্যাটেলাইট ম্যাপে এগুলো দেখা যায়নি। আহমদ মুসার মনে আশা জাগল। তাহলে এসব বাড়ি, রেস্টহাউজ ও হোটেল কোনটার নাম্বার ১৩০ এ হতে পারে বা ১৩০ ডি হতে পারে।
আহমদ মুসা এই জংগল ও পাহাড় এলাকায় প্রবেশ করেছে উত্তর দিক থেকে। অ্যারেন্ডসী হ্রদের পশ্চিম তীরের উত্তর অংশে বেশ বড় আবাসিক এলাকা আছে। এই এলাকা পার হয়ে একটা ঝোপের আড়ালে গাড়ি রেখে আহমদ মুসা জংগল ও পাহাড় এলাকায় প্রবেশ করেছিল।
দু’পাশের ঝোপ-জংগল, পাহাড়, পাহাড়ের টিলা। এর মধ্যে দিয়ে পাথর বিছানো রাস্তা এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে।
সেই হোটেল, বাড়ি, রেস্টহাউজগুলো বেশ দূরে দূরে। জংগল ও পাহাড় ঘেরা এগুলোকে একটা করে দ্বীপ বলে মনে হয়। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, জার্মানীর ‘হিউম্যান হ্যাবিটেশন এনসাইক্লোপেডিয়া’-তে অ্যারেন্ডসী সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখেছিল, অ্যারেন্ডসীর পশ্চিম তীরের জংগল অঞ্চলটা সরকারের সংরক্ষিত অঞ্চল। ট্যুরিজমের স্বার্থে এখানে কিছু হোটেল এবং রেস্টহাউজ করতে অনুমতি দিয়েছে খুব উঁচু মূল্য এবং শর্তের বিনিময়ে। কিছু প্রাইভেট বাড়ি হয়েছে, কিন্তু তাদের অনেক বেশি উচ্চমূল্য দিতে হয়েছে। তবে এই সুযোগেও এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
গাড়ি ছেড়ে আসার আগে আহমদ মুসা তার পোশাকও পাল্টে ফেলেছে। কালো জুতা, কালো প্যান্ট, কালো জ্যাকেট এবং কালো হ্যাট। ব্ল্যাক লাইটেরই পোশাক।
নি:শব্দে, কিন্তু দ্রুত হাঁটছে আহমদ মুসা।
এক জায়গায় একটা টিলার বাঁক ঘুরতেই সামনে একটা গাড়ি আসতে দেখল আহমদ মুসা। গাড়িটা শর্ট আলো জ্বেলে আসছে। লং ফোকাস থাকলে ওদের চোখে ধরা পড়ে যেত আহমদ মুসা। রাস্তার ধারে একটা ঝোপের আড়ালে সরে গেল আহমদ মুসা। ঝোপটার কাছাকাছি আসতেই গাড়ির গতি স্লো হয়ে গেল এবং ঝোপের পাশে গাড়িটা থেমে গেল। গাড়ি থেকে তিনজন নামল।
নামার সময়ই একজন বলল,’অযথা গাড়ি থামালো কেন? মানুষ এ পথে যাতায়ত করে না? করে।’
‘করে, ঠিক আছে। কিন্তু সে রাস্তায় নেই কেন? লুকালো কেন?’ দ্বিতীয় একজন বলল।
আহমদ মুসা বুঝল ওদের কাছে ম্যানডিটেক্টর আছে নিশ্চয়। এ জন্যই আহমদ মুসার উপস্থিতি তারা টের পেয়েছে।
আহমদ মুসা দেখল ওদের পরনেও কালো পোশাক। আপাদমস্তক কালো। ওরা তাহলে ব্ল্যাক লাইটের লোক। খুশি হলো আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তাহলে ঠিকই এসেছে। ওদের ১৩০ নাম্বার বাড়িটা নিশ্চয় এই জংগলেই পাওয়া যাবে।
ওদের থামতে দেখেই আহমদ মুসা জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার হাতে নিয়েছিল। সাইলেন্সার ফিট করলো রিভলবারে।
দ্বিতীয় জনের কথা শেষ হতেই প্রথমজন বলল, ‘এত রাত, এই জংগল, ভয়েও তো মানুষ পালাতে পারে।’
‘পারে, এটা সম্ভাবনার কথা। কিন্তু পালানোটা নিশ্চয়ই সন্দেহজনক।’ দ্বিতীয় জন বলল।
ঝোপের আড়ালে বসে আহমদ মুসাও মনে মনে বলল, ‘পালানোটা সন্দেহজনক ঠিকই ভেবেছে লোকটা। আর তার পালাবার কারণ তার গায়ের পোশাক। গাড়ির পরিচয় না জেনে এই পোশাকে সে গাড়ির মুখোমুখি হতে পারেনি। এখন প্রমাণ হচ্ছে, আহমদ মুসা পালিয়ে ঠিক করেছে।’
দ্বিতীয় জনের কথার উত্তরে প্রথম জন সাথে সাথেই বলল, ‘তাহলে এখন কি করবে? খুঁজবে? কোথায় খুঁজবে?’
‘এই ডিটেস্টর তাকে ধরিয়ে দেবে। এখন সে বাম দিকে আমাদের থেকে বিশ গজ দূরে কোন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়াও। দাঁড়ালে তার দাঁড়াবার লোকেশনও চিহ্নিত করা যাবে। রিভলবার প্রস্তুত কর তোমরা।’ বলল দ্বিতীয় জন।
‘কথা বলো না, শুনতে পেলে তো সে পালাবে।’ তৃতীয় একজন বলল।
আহমদ মুসা শুনে ফেলেছে। আহমদ মুসা মনে মনে বলল, সর্বাধুনিক ডিটেক্টর ওরা ব্যবহার করছে। এ ডিটেক্টর মানুষের লোকেশনও ‘পিন-পয়েন্ট’ করতে পারে।
আহমদ মুসা ওদেরকে রাস্তা থেকে সরিয়ে আনার জন্যে এবং নিজেকে আরও নিরাপদ করার জন্যে ঝোপের আড়াল থেকে দৌড়ে অল্প দূরে একটা বড় গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
‘সে আরও পূব দিকে পালাচ্ছে। যাবে কোথায়?’ বলর সেই দ্বিতীয় জন।
একটু থেমেই সে আবার বলল, ‘সে এবার চল্লিশ গজ দূরে অবস্থান নিয়েছে। এস তোমরা আমার সাথে।’
‘ও তো পালাতেই থাকবে। তাকে আমরা জানি না। কি লাভ তার পেছনে দৌড়ে?’ বলল সেই প্রথম জন।
‘পালিয়ে সে কোথায় যাবে? আর কিছু দূর এগোলেই তো লেকের পানি। আর তাকে জানি না বলেই তো তাকে জানতে হবে। এই রাতে সে কোথায় যাচ্ছে? নিজেকে আড়াল করল কেন?’ বলল দ্বিতীয় লোকটি।
সামনে টর্চের আলো ফেলে ওরা তিনজন দ্রুত এগোলো সেই গাছের দিকে। ডিটেক্টর ওদের নিখুঁতভাবে বলে দিচ্ছে আহমদ মুসা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে।
আহমদ মুসা বুঝল ওরা ডেসপারেট। আহমদ মুসাকে না ধরে ওরা ছাড়বে না। আর ধরতে পারলে এই পোশাক দেখার পর তাকে তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। সুতরাং আত্নরক্ষার জন্যে তাকে আক্রমণেই যেতে হবে এবং তা এখনই। সংগে সংগেই আহমদ মুসা নিজেকে গাছের সাথে সেঁটিয়ে রেখে মুখটাকে গাছের প্রান্তে নিয়ে ডান হাত বের করে আলোর উৎস লক্ষ্যে মেশিন রিভলবার দিয়ে একপশলা গুলি করল। গুলিবৃষ্টি একটা স্থান জুড়ে সমান্তরালে টেনে নিল।
টর্চ বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ওদিক থেকে গুলি এল না।
আহমদ মুসা গাছের আড়াল থেকে বেব হয়ে মাটিতে গড়িয়ে ওদের দিকে এগোলো।
ওদের কাছে পৌঁছে অন্ধকারেই বুঝল তিনটি মাটিতে পড়ে আছে।
এক হাতে রিভলবার নিয়ে অন্য হাতে ওদের টর্চটাই খুঁজে নিয়ে জ্বালল। আলো জ্বালতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল, মৃত একজনের হাতের পাশে ‘ম্যান ডিটেক্টর’ মেশিনটি পড়ে আছে। আহমদ মুসা প্রথমেই ওটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরল। এবার এই যন্ত্রটি তার সাথে নেই। তারপর টর্চের আলো ঘুরিয়ে দেখল দু’জন মারা গেছে। একজন বেঁচে আছে। সেও বুকের উপর কাঁধের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংঘাতিকভাবে আহত।
আহমদ মুসা তার মুখে টর্চের আলো ফেলে বলল, ‘তোমরা আমার পিছু নিয়েছিলে কেন? আমি কি দোষ করেছি?’
‘সন্দেহবশত এটা করা হয়েছে। আপনি না পালালে এ রকমটা হতো না।’ বলল লোকটি।
‘আপনি তো সাংঘাতিক আহত। এখনি কোন হাসপাতালে তো নিতে হয় আপনাকে।।’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, হাসপাতালে নয়। রাস্তায় গাড়ি আছে। গাড়িতে উঠতে পারলে বাসায় পৌঁছতে পারি।’
আহমদ মুসা তাকে ধরে তুলল। ধরে গাড়িতে নিয়ে গেল তাকে।
আহত লোকটিকে পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসা বলল, ‘কোথায় পৌঁছে দেব বলুন।’
বাড়ি নং ১৩০। অ্যারেন্ডসী ডয়েসল্যান্ড হোটেলের দু’শ গজের মত দক্ষিণে হবে।’ বলর লোকটি।
‘১৩০’ নাম্বার উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার সারা দেহে আনন্দের একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। একেবারে ওদের গাড়িতে চড়ে ওদের বাসায় যাওয়া।’
অ্যারেন্ডসী ডয়েসল্যান্ড হোটেল পার হয়ে ১৩০ নাম্বার বাড়ি পেতে কষ্ট হলো না। প্রাচীর ঘেরা বাড়ি। অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটা যেন লেকের ভেতরে ঢুকে গেছে। বাড়িটা তিন তলা। পাথুরে। বাইরে থেকে খুব নিরাভরণ দেখাচ্ছে। বেশ বড় গেট। গেটে স্টিলের দরজা।
গেটের সামনে গাড়ি থামতেই লোকটি আহমদ মুসাকে বলল, ‘ গেটের পিলারে দেখুন একটা ডিজিটাল বোর্ড আছে। ওখানে আপনি প্রথমে ওয়ান থ্রি জিরো মানে ১৩০ টাইপ করুন, তারপর ১৩০-কে উল্টো করে মানে জিরো থ্রি ও ওয়ান টাইপ করুন, এরপর ১৩০-এর মধ্যখান থেকে সিরিয়ালী টাইপ করে শেষে ওয়ান টাইপ করুন। মানে থ্রি জিরো ওয়ান টাইপ করতে হবে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গিয়ে গেটের পিলারে ঠিক পিলার রঙের কালো একটা ডিজিটাল বোর্ড পেল। হঠাৎ পিলারের দিকে তাকালে এ বোর্ডটা দেখা যায় না। ঠিক একই ধরনের রং হওয়ার কারণে তা চোখে পড়ে না।
টাইপ শেষ হওয়ার সংগে সংগেই নি:শব্দে দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসা গাড়িতে ফিরে এল।
এমন অযাচিতভাবে, এমন অকল্পনীয়ভাবে ব্ল্যাক লাইটের ঘাঁটির দূর্লভ কোড জানতে পারায় আহমদ মুসা ভীষণ খুশি হলো।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে এসে বসলে আহত লোকটি বলল,‘এবার ভেতর চলুন।’
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
গাড়ি নিয়ে ভেতরে ছোট একটা চত্বর। তারপর বড় একটা গাড়ি বারান্দা। গাড়ি বারান্দার দুই প্রান্ত দিয়ে নয় দশ ধাপের সিঁড়ি উঠে গেছে উঁচু বারান্দায়। বারান্দাটা বেশ লম্বা।
লম্বা বারান্দাটিতে তিনটি গেট। গেটগুলো একই রকম। তিনটি গেট দিয়েই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা যায় মনে করল আহমদ মুসা।
ভেতরে প্রবেশ করে কাউকেই দেখতে পেল না আহমদ মুসা।
গাড়ি বারান্দায় গিয়ে থেমেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে আহত লোকটি বলল, ‘আপনার নাম জানতে পারি?’
‘জো কার্লোস।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাড়ি কোথায়? জার্মানীতে?’ জিজ্ঞাসা লোকটির।
‘না, দক্ষিণ স্পেনে।’ বলল আহমদ মুসা।
দক্ষিণ স্পেনে বলল আহমদ মুসা এই কারণে যে, ওখানে মাল্টিকালার লোক বাস করে।
‘কোথায় যাচ্ছিলেন আপনি?’ লোকটি বলল।
‘হোটেল ডয়েসল্যান্ডে। ওখানে একজনের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ করে এসব প্রশ্নের মুখে পড়বে তা ভাবেনি আহমদ মুসা। মনে মনে হিসেব করল এ পর্যন্ত কোন ভুল করে বসেনি তো সে?
‘আপনার কাছে পিস্তল কেন?’ জিজ্ঞাসা আবার সেই আহত লোকটির।
‘অনেকটা নিজের সেফটি এবং অনেকটা শখের জন্যেও। এ রিভলবারের লাইসেন্স আছে আমার।’
আহত লোকটি আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। লোকটির চোখে অবিশ্বাস। বলল, ‘আপনার সাহস ও বন্দুকবাজি দেখে নিছক শখ ও আত্নরক্ষার কথা মনে হচ্ছে না।’
কথা শেষ করেই লোকটি আহমদ মুসাকে বলল, ‘আপনি সামনে ড্যাশবোর্ডের সবুজ বোতামটায় চাপ দেন।’
চাপ দিল আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়িতে কিংবা কোথাও কোন শব্দ শুনতে পেল না। কিন্তু দেখল চাপ দেয়ার পর বোতামটি লাল হয়ে গেছে।
বোতামে চাপ দেয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লম্বা বারান্দার তিন দরজা দিয়ে চার পাঁচজন করে লোক ছুটে বেরিয়ে এল। তাদের কারও হাতেই অস্ত্র নেই্। কিন্তু তারা যে সশস্ত্র তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকদের পেছনে মাঝ দরজা দিয়ে স্ট্রেচার ঠেলে বেরিয়ে এল দু’জন। তাদের দু’জনের গায়ে ডাক্তারের এ্যাপ্রোন।
বারান্দার একটা সিঁড়ির ধাপ সরে গিয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল স্লোপিং এসকালেটর জাতীয় কিছু। সে এসকালেটর দিয়ে ঠেলে স্ট্রেচার নামিয়ে নিচে এল। লোকটা এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল।
লিডার রকমের একজন লোককে ডেকে আহত লোকটি তার কানে কানে কি যেন বলল।
সংগে সংগেই লোকগুলো এসে আহমদ মুসাকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের সকলের হাতেই উঠে এসেছে পকেট মেশিনগান।
দু’জন আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার দুই হাত বেঁধে ফেলল।
গাড়ির দরজার সাথে ফিট করা স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ার সময় হাত বাঁধা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জো কার্লোস ধন্যবাদ আপনাকে, আপনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখে আমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্যরি মি. জো কার্লোস, যা ঘটেছে তাতে আপনাকে ছেড়ে দেয়া যায় না। আমাদের বসরা বাইরে। কালকে সন্ধ্যা নাগাদ তারা ফিরবেন। তারা আপনার পরিচয় যাচাই করে যা হয় করবেন। সেই সময় পর্যন্ত আপনাকে আটক থাকতে হবে।’
একটু থেমে আহত লোকটি তার লোকদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘একে বন্দী করে রাখ, কিন্তু ভালোভাবে রাখ।’
স্ট্রেচারে করে বারান্দা দিয়ে যাবার সময় আহত লোকটি মাথা উঁচু করে উচ্চ স্বরে বলল, ‘জো কার্লোসকে ‘ডি’-তে নিয়ে রাখ।’
‘সি’ শব্দটি শুনে আহমদ মুসার দেহে আনন্দের উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল।
‘সি’ মানে ‘১৩০-এর ডি’, যেখানে ব্রুনার মা কারিনা কারলিনাকে প্রথমে রাখার কথা বলেছিল। নিশ্চয় ‘১৩০-এর এ’ যেখানে ব্রুনার মাকে রেখেছে বা রেখেছিল, এর আশেপাশেই এটা হবে।
আহত লোকটি চলে গেলে আহমদ মুসার চার পাশের লোকদের একজন গিয়ে উঁচু বারান্দার দেয়ালের এক জায়গায় তিনবার নক করল। সংগে সংগে বারান্দার দেয়ালে দরজা বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসাকে ঘেরাও করে নিয়ে সবাই সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরটা বাইরের বিপরীত। সাদা মার্বেল পাথরের দেয়াল। নিচে ফ্লোরে পুরু সাদা কার্পেট। মনে হলো গোটা ফ্লোরটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
ফ্লোরটিতে সারি সারি ঘর। ক্রিস-ক্রস করিডোর। ঘরের দরজা সবগুলোই বন্ধ।
কিছু দূর চলার পর আহমদ মুসাকে একটা ঘরে প্রবেশ করিয়ে একজন বলল, ‘এটাই আপনার ঘর।’
ঘরে একটা বেড।
আহমদ মুসাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে পা বেঁধে ফেলল। হাত আগেই বাঁধা ছিল।
আহমদ মুসাকে বেডে রেখে সবাই বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় একজন বলে গেল, ‘অন্য একজন আসবে। সেই আপনার খাওয়া এবং প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করবে।’
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কথা বলা লোকটিই শুধু ভেতরে ছিল।
‘আচ্ছা জনাব, এই ফ্লোর তো ‘সি’ দেখলাম। ‘এ’, ‘বি’-ও আছে নাকি? তাহলে তো বিরাট বাড়ি।’ আহমদ মুসা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল।
‘শুধু ‘সি’ হয় নাকি! ‘সি’ থাকলে ‘এ’ ‘বি’ তো খাকবেই। এটা আবার জিজ্ঞাসা করতে হয় নাকি?’ লোকটি বলল।
‘কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে থাকতে হবে? বসরা কোথায় গেছেন? আগে আসতে পারেন না?’ বলল আহমদ মুসা বোকা-বোকা কন্ঠে।
‘আমরা কি ওসব জানি? শুনেছি তারা কোর্টে গেছেন। সন্ধ্যার আগে ফিরবেন না। আবার কাজ হয়ে গেলে ফিরতেও পারেন।’ বলেই লোকটি বের হয়ে গেল।
আহমদ মুসা তখন কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল কোর্টে যাওয়ার কথা শুনে। স্টেট কি হস্তান্তর হয়ে যাচ্ছে? নকল কারিনা কারলিন কি রেডি হয়ে গেছে। আসল কারিনা কারলিন এখন কোথায়। স্টেট হস্তান্তর হওয়া পর্যন্ত তো তাঁর বেঁচে থাকার কথা। তাহলে কালকেই তো তার শেষ দিন। কিছু করার সময় তো বয়ে যাচ্ছ্ আজ রাত এবং কাল দিনই মাত্র সময় আছে মনে হচ্ছে। যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। এভাবে এদের এই ডেরায় প্রবেশ করতে না পারলে ও সব বিষয় জানা হতো না। জানা যেত না যে, ঘটনা ফাইনাল স্টেজে পৌঁছে গেছে। সময় হাতে মাত্র এক রাত এক দিন।
আহমদ মুসা তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল রাত সাড়ে ১২টা।
আহমদ মুসা ঠিক করল ঘন্টা দুয়েক সে রেস্ট নেবে, তারপর করণীয় চিন্তা করে কাজে নামবে।
হাত পায়ের বাঁধনটা সামান্য শিথিল করে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে সে চোখ বুজল। রাত আড়াইটা।
হাত-পায়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে তার খুব অসুবিধা হলো না। পকেটের রিভলবার তার পকেটেই রয়ে গেছে, তারা আর তাকে সার্চ করেনি। এদিকে তার মোজার সাথে গুঁজা আছে লেজার গান, সেটাও খোঁজ করে নেয়নি। জুতার গোড়ালি থেকে ছুরি বের করে হাত পায়ের বাঁধন কেটে সে সহজেই মুক্ত হতে পেরেছে।
কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর আধা ঘন্টা ধরে ফ্লোরের এদিকের কক্ষগুলো সে দেখেছ। কক্ষগুলোর কোনটি অফিস রুমের মত, কোনটি বেড রুম, কোনটি আবার স্টোর রুমের মত। এখানে তেমন কিছুই পেল না।
ঘুরতে ঘুরতে আহমদ মুসা একটা ফাইবার পার্টিশন ওয়ালের কাছে এল। ওয়ালের দরজা কোথায় খুঁজতে লাগল সে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দরজা পেল না্ শেষে আহমদ মুসা লেজার কাটার দিয়ে ফাইবার ওয়ালের একটা অংশ কেটে ভেতরে প্রবেশ করল।
ভেতরটা একটা স্টোর রুম। নানা পণ্যে ঠাসা।
কিন্তু এই পণ্যগুলো এত সিক্রেট জায়গায় রয়েছে কেন? প্রশ্নের জবাব পেল না আহমদ মুসা।
ঘরের এক কোণায় একটা আলমারি পেল। আলমারিটি বেশ বড়।
আলমারিটি খোলার জন্যে হাতল ধরে টান দিল আহমদ মুসা। ওটা খুলল না।
বেশি চিন্তা করার সময় নেই আহমদ মুসার হাতে। লেজার রে’ দিয়ে আলমারির লক অংশটা কেটে তুলে ফেলল।
আলমারির দরজা খুলতেই দেখতে পেল একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
আলমারির দরজা বন্ধ করে আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। সে মনে মনে বলল, এই সিঁড়িকে ক্যামোফ্লেজ করার জন্যে তাহলে স্টোর রুমটা সাজানো হয়েছে।
নিচে নেমে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। উপরের মতই আরেকটা ফ্লোর নিচে রয়েছে।
এই ফ্লোরে কক্ষের সংখ্যা কম। কিন্তু কক্ষগুলো বড় বড় এবং সুসজ্জিত।
সামনেই মাঝখানের একটা বিশেষ কক্ষে আহমদ মুসা একটা কম্পিউটার দেখতে পেল। কম্পিউটারটা সুন্দর, বড় স্ক্রীনের। কক্ষটাও খুব সুসজ্জিত। কম্পিউটারটিতে নিয়মিত কাজ হয় বলে মনে হলো আহমদ মুসার। কম্পিউটারের পাশের টেবিলের বাস্কেটে কাগজ। টেবিলের নিচে ওয়েস্ট পেপারের বাস্কেটও রয়েছে।
আহমদ মুসা কম্পিউটারের চেয়ারে বসে টেবিলের নিচ থেকে ওয়েস্টে পেপারের বাস্কেটটাই টেনে নিল।
বাস্কেটের কাগজগুলো পরীক্ষা করতে লাগল।
অধিকাংশ কাগজই সাদা, খণ্ড খণ্ড।
একটা খণ্ড কাগজে কিছু লেখা দেখল। খণ্ডটিকে আহমদ মুসা চোখের সামনে নিয়ে এল। লেখার উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে। লেখা আছে জার্মান ভাষায়; প্রোসপেকট এন্ড বেনিফিট অব ক্লোন এইট, মানে ‘ক্লোন এইট’-এর সম্ভাবনা ও লাভ।
কাগজ খণ্ডটিতে এর বেশি আর কিছুই লেখা নেই।
‘ক্লোন-এইট’ কথাটা আহমদ মুসার মনে তোলপাড় সৃষ্টি করল। ব্রুনার নকল মা’র প্রেসক্রিপশনে দেখেছিল ‘ক্লোন সেভেন’। তার মানে ব্রুনার নকল মা ক্লোন সেভেন। ‘ক্লোন সেভেন’-এর কাজ সমাপ্তির পথে। এখন ‘ক্লোন-এইট’ তাদের নতুন প্রকল্প। এই প্রকল্পেরই প্রোসপেস্ট ও বেনিফিট হিসেব করা হয়েছে। এই হিসেবেরই খসড়া আছে হয়তো এই কাগজ খণ্ডের অংশ অন্য টুকরো কাগজগুলোতে। খুঁজতে লাগল আহমদ মুসা।
বাস্কেটে বেশি কাগজ ছিল না। কাগজের টুকরোগুলো পেয়ে গেলো সহজেই।
কাগজগুলোকে টেবিলের উপর রেখে এক সাথে জোড়া দিল আহমদ মুসা। পড়া যাচ্ছে গোটা বিষয়টা। সংক্ষেপে কথা এই;
‘স্টেটের কর্তা ব্যক্তির বয়স ৫০-এর মত হবে। তার কন্যা সন্তান নয় বছর বয়সের। তার ক্লোন তৈরি সহজ। পঁচিশ বছর পর এই স্টেট হাতে পাওয়া যাবে। স্টেটটি ১০ হাজার একরের। বার্ষিক আয় কমপক্ষে ১০ কোটি ডলার। এই প্রকল্পে ঝুঁকি তেমন নেই। স্টেটের কর্তা ব্যক্তি পরিবারে এবং এলাকায় খুবই আনপপুলার।’
প্রকল্পের বিবরণ থেকে স্টেটটিকে চেনার উপায় নেই, তবে এর মাধ্যমে ওদের ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে গেছে। ‘মানুষ ক্লোন’ করাকে তারা বড় বড় স্টেট, সম্পত্তি দখলের হাতিয়ার বানিয়েছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে এর আগে ব্রুনার মায়ের স্টেট ছাড়াও আরও ছয়টি স্টেট ছয়টি ক্লোনের মাধ্যমে ওরা দখল করেছে।
আহমদ মুসা খুব আগ্রহী হয়ে উঠল ছয়টি পরিচয় জানার জন্যে, যেগুলো ক্লোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ওরা দখল করে নিয়েছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, ‘ক্লোন এইট’ এর প্রোসপেক্ট ও বেনিফিট সম্পর্কে এখানে খসড়া করা হয়েছিল নিশ্চয় কম্পিউটারে রাখার জন্যে। তাহলে অন্য ক্লোনদের বিবরণও নিশ্চয় কম্পিউটারে রয়েছে।
খুব খুশি হলো আহমদ মুসা।
কম্পিউটার ওপেন করল। কিন্তু অপারেশনে যাওয়ার জন্যে কম্পিউটার পাসওয়ার্ড চাইল।
হতাশ হলো আহমদ মুসা।
এখানে পাসওয়ার্ড বেশি খোঁজাখুঁজি করার মত সময় দেয়ার সুযোগ তার নেই। তাকে দ্রুত এগোতে হবে। আসল কাজ এখনও বাকি।
আল্লাহর সাহায্য চেয়ে আহমদ মুসা ভাবল সে যদি ‘ব্ল্যাক লাইট’ হতো, তাহলে কি পাসওয়ার্ড রাখাকে বেশি প্রেফার করতো।
আহমদ মুসা অনেক বিকল্প নিয়ে চিন্তা করল এবং এসবকে পাসওয়ার্ড করতাম কি না ভেবে দেখল। এক এক করে সবই বাদ গেল। অবশেষে আহমদ মুসা সিলেকশন করল ‘ক্লোন প্রজেক্ট’। আহমদ মুসা মনে মনে বলল, আমি ব্ল্যাক লাইট হলে সৌভাগ্যের প্রতীক এই শিরোনামকেই আমি পাসওয়ার্ড করতাম। ব্ল্যাক লাইটের ‘ক্লোন প্রজেক্ট’টির কথা বাইরের কেউ জানে না। আবার অন্য কারও পক্ষে একে এই কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড মনে করাও অসম্ভব। সুতরা্ং যে কোন বিচারে এটাকেই আমি পাসওয়ার্ড করতাম।
মন স্থির করে আহমদ মুসা পাসওয়ার্ড হিসেবে ‘ক্লোন প্রজেক্ট’-এর ১২ টি বর্ণ টাইপ করল।
কিন্তু কম্পিউটার সংগে সংগেই জানাল এটা ‘ইনভ্যালিড পাসওয়ার্ড’।
আহমদ মুসার মনটা যতটা স্থির হয়েছিল, ততটাই আবার নড়বড়ে হয়ে গেল।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, এটা তো শুধু ‘ক্লোন প্রজেক্ট নয়, এটা’ ‘হিউম্যান ক্লোন প্রজেক্ট।’
এই চিন্তা করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ‘ক্লোন প্রজেক্ট’-এর ১২ বর্ণের আগে ‘হিউম্যান’-এর আরও পাঁচটি বর্ণ যোগ করল। এরপর আহমদ মুসা ‘সাইন ইন’-এ ক্লিক করল।
ক্লিক-এর সাথে সাথে বিশ্রী দু’টি শব্দ , ‘ইনভ্যালিড পাসওয়ার্ড’, আবার স্ক্রীনে ভেসে উঠল।
আহমদ মুসা এবার সত্যিই হতাশ হলো।
ঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা।
রাত সাড়ে তিনটা। উদ্বেগ বোধ করল আহমদ মুসা। আর এক ঘন্টার মধ্যে এখানকার সব কাজ তাকে শেষ করতে হবে।
মনটাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এল।
চোখ বন্ধ করে মনটাকে আল্লাহর দিকে রুজু করল।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, ‘হিউম্যান’ শব্দ ‘বিশেষ্য পদ’ নয়, খুব বেশি হলে গুণবাচক বিশেষ্য পদ। সেদিক থেকে এটা অনেকটাই ‘বিশেষণ’-এর পর্যায়ে পড়ে। সুতরাং পিওর নাউন ‘ম্যান’ যোগ হতে পারে ‘ক্লোন প্রজেক্ট’-এর সাথে।
আহমদ মুসা ‘ক্লোন প্রজেক্ট’-এর আগে ‘ম্যান’ শব্দ যোগ করে ১৫টি বর্ণ টাইপ করল পাসওয়ার্ড কলামে। বিসমিল্লাহ বলে ক্লিক করল ‘সাইন ইন’-এ।
এবার ক্লিক-এর পর স্ক্রীন পাল্টে গেল।
স্ক্রীনে চলে এল কতকগুলো ফাইল নামসহ। প্রত্যেকটি ‘ক্লোন প্রজেক্ট’-এর জন্যে ভিন্ন ফাইল। ক্লোন প্রজেক্ট-১ থেকে ক্লোন প্রজেক্ট-৮ পর্যন্ত সবগুলো প্রজেক্টের নাম শোভা পাচ্ছে কম্পিউটার স্ক্রীনে।
ক্লোন প্রজেক্ট-১ এর ফাইলে ক্লিক করল আহমদ মুসা। বেরিয়ে এল প্রজেক্টের হোম পেজ। হোম পেজে প্রজেক্টের লোকেশন, প্রজেক্টের টার্গেট, প্রজেক্টের পাত্র-পাত্রী, প্রজেক্টের প্রবলেম ও সলিউশন, প্রজেক্টের প্রসপেক্ট, এই প্রজেক্টের সাকসেস ইভ্যালুয়েশন ও ক্লোজিং।
দারুণ আনন্দিত হলো আহমদ মুসা। যা দরকার তার সবই আছে প্রজেক্ট ফাইলে। পড়ার সময় নয় এটা। কম্পিউটার থেকে হার্ডডিস্ক নিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা। এটা থেকে সবকিছু জানা যাবে এবং এটাই হবে প্রমাণ। ব্ল্যাক লাইট বিজ্ঞানের এক আবিস্কার ‘ক্লোনিং-কে কিভাবে অপব্যবহার করেছে, কিভাবে বড় বড় পরিবারের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি গ্রাস করার জন্যে ‘ম্যান-ক্লোনিং’-কে ব্যবহার করেছে, ভবিষ্যতে তার আরও কি পরিকল্পনা ছিল, সবই এই ডিস্কের মধ্যে পাওয়া যাবে।
জ্যাকেটের এক পকেট থেকে মাস্টার স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে কম্পিউটার থেকে হার্ডডিস্কটা বের করে নিল। বেরিয়ে এল আহমদ মুসা ঘর থেকে।
মাথায় এবার চিন্তা ব্রুনার মা কারিনা কালিনকে ওরা কোথায় বন্দী করে রেখেছে।
উপরের সেই স্টোর রুমে ওঠার জন্যে সিঁড়ির পা দিতে যাবে এমন সময় দেখতে পেল সিঁড়ির পেছনের দেয়ালে ‘এ’ লিখে ডান দিকে এ্যারো দেয়া। এ্যারোটা আবার বেঁকে উপরের দিক ইংগিত করেছে। তাহলে ‘এ’ হবে উপরের দিকে। আহমদ মুসা ছুটে গেল সেখানে।
আহমদ মুসা দেখল, এ্যারোর পরেই দেয়ালের সাথে প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকা একটা লিফট।
আহমদ মুসা লিফটের সুইচ খোঁজ করতে লাগল।
সে লিফটের তিন দিকেই ভালোভাবে সুইচ সন্ধান করল। সুইচ হতে পারে এমন কোন কিছুই চিহ্ন খুঁজে পেল না। নিচে ফ্লোরের দিকে তাকাল আহমদ মুসা। শ্বেত পাথরের ফ্লোর। আহমদ মুসা দেখল লিফটের মাঝামাঝি যে পাথরটা এসে লিফটের গোড়ায় এসে শেষ হয়েছে, সে পাথরের এ দিকের প্রান্তে একটা জায়গা থেকে পাথরের চলটা উঠে গেছে। সেখানে আরেকটা সাদা পাথর কেটে চটাটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। জোড়া লাগানো সাদা সিমেন্ট দিয়েই। এটা সাধারণ একটা বিষয়। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোন কারণ নেই। কিন্তু আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা বড় হয়ে দেখা দিল। এত সুন্দর ফ্লোরে এত সুন্দর দৃশ্যের একটা ছন্দপতন কেন ঘটানো হয়েছে? কেন পাথরটাকেই রিপ্লেস করা হয়নি। এটা কোন কিছুর ইংগিত কি?
আহমদ মুসা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিল চলটা ওঠা পাথরটার উপর। সংগে সংগেই চটা পাথর খণ্ডটি দেবে গেল এবং খুলে গেল লিফট।
আহমদ মুসা লিফট দিয়ে উঠতে শুরু করল। লিফটে গাইডিং কোন ব্যবস্থা নেই। লিফট কোথায় যাবে, কোথায় দাঁড়াতে হবে, তা নির্দেশ করার উপায় নেই। এসব চিন্তা করে আহমদ মুসা চিশ্চিত হলো, এ লিফট সোজা ‘এ’-তেই যাবে, যেমন দেয়ালের লেখায় নির্দেশ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই কয়েকটা ফ্লোর অতিক্রম করেছে লিফট। এমনটা ভাবার সময়ই লিফট দাঁড়িয়ে গেল।
লিফটের দরজা খুললে কি দেখবে কে জান্ পকেট থেকে লেজার গান হাতে নিল আহমদ মুসা। ডান হাতের তর্জনীটা রাখল লেজার গানের ট্রিগারে।
দরজা খুলে গেল। দরজাটার কিছু সামনেই একটা খাট। একজন শুয়ে সে খাটে। খাটের উপর দিয়ে আহমদ মুসার চোখ গিয়ে পড়ল চেয়ারে বসে থাকা একজন মহিলার চোখের উপর। তার দৃষ্টি ছিল আগে থেকেই আহমদ মুসার উপর। তার রিভলবারের নল আহমদ মুসার চোখ বরাবর স্থির হয়ে আছে।
আহমদ মুসা তার লেজার গান তোলার সুযোগ পেল না। ওদিক থেকে ট্রিগার টেপার একটা অস্পষ্ট শব্দও কানে এল আহমদ মুসার। অনুভব করল আহমদ মুসা গুলি ছুটে আসছে।
মাথাটা আহমদ মুসার আপনাতেই ডানদিকে সরে গেল পলকের মধ্যে।
বাম কানে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করল আহমদ মুসা। ঝর ঝর করে রক্ত নেমে এল কান থেকে। মুখের একাংশ এবং জ্যাকেটের বাম দিকে ছড়িয়ে পড়ল রক্ত।
কিন্তু আহমদ মুসরা ভ্রূ্ক্ষেপ নেই সেদিকে। তার লেজার গান তুলে নিয়েছে আহমদ মুসা। ট্রিগার টিপেছে সংগে সংগেই লেজার গানের।
চেয়ারে বসে থাকা মহিলাটি যখন বুঝতে পারল তার প্রথম গুলি ব্যর্থ হয়েছে, তখন দ্বিতীয় গুলি চালাবার তার আর সুযোগ হলো না। ততক্ষণে আহমদ মুসার লেজার গানের ভয়ংকর ছোবল মহিলাটির মাথার অর্ধাংশ উড়িয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসার নজর গেল খাটের উপর। খাটের উপর শুয়ে থাকা মহিলাটি উঠে বসেছে। আতংকিত সে। দুই চোখ তার আতংক-উদ্বেগে বিস্ফোরিত।
মহিলাটিকে দেখে চমকে উঠল এবং সেই সাথে আনন্দিতও হলো আহমদ মুসা। ছবির সাথে হুবহু মিল আছে এই মহিলার। আশ্চর্য! এ যে ব্রুনার মা।
আহমদ মুসা দ্রুত ব্রুনার মায়ের সামনে গেল। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘মা, আমি আপনার মেয়ে ব্রুনা ও আপনার স্বামী আলদুনি সেনফ্রিডের কাছ থেকে এসেছি আপনাকে উদ্ধার করতে।’
ব্রুনার মা কারিনা কারলিন নির্বাক। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
‘মা, এখনি আমার মনে হচ্ছে ওরা এসে যাবে। ওরা এসে গেলে আর হয়তো সরে পড়া যাবে না।’ আহমদ মুসা আবার বলল।
‘হ্যাঁ, তুমি ঐ শয়তানীকে মেরেছ, ভালো করেছ। সে আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে। কি বললে, তুমি ব্রুনা মা ও সেনফ্রিডের কাছ থেকে এসেছ? ঠিক বলেছ? ওরা কি বেঁচে আছে? ওরা মেরে ফেলেনি ওদের?’ বলল ব্রুনার মা।
‘না ওরা বেঁচে আছে, ভালো আছে এবং আপনার অপেক্ষা করছে। তারাই আমাকে পাঠিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এতক্ষণে ব্রুনার মা’র মুখটা কিছু স্বাভাবিক হলো। বলল, ‘তুমি কে? এরা তো ভয়ংকর। কিভাবে এলে এখানে? না, বুঝেছি। তুমি গুলি খেয়েও ক্লারা লিসবেথ শয়তানীকে মেরেছ। ঠিক করেছ তুমি। কিন্তু বাছা, তুমিও তো সাংঘাতিক আহত। তোমার কান তো গুলিতে ফুটো হয়ে গেছে। রক্ত নামছে তো এখনও।’ বলল ব্রুনার মা।
‘ওসব কিছু না, মা আপনি উঠুন। আমাদের পালাতে হবে। হাঁটতে পারবেন, না ধরব আমি আপনাকে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বেটা আমাকে ধরে নিয়েই চল।’ বলল ব্রুনার মা।
আহমদ মুসা ব্রুনার মাকে খাট থেকে নামিয়ে নিল। লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসা লিফট থেকে বের হওয়ার সময়ই দেখে নিয়েছিল লিফটা খোলার সেই একই ব্যবস্থা এখানে আছে।
ব্রুনার মাকে নিয়ে লিফট খুলতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘মা, একটু দাঁড়ান আমি এ রুমটাকে ভেতর থেকে লক করে আসি। রুমে কি ঘটেছে তা এই মুহূর্তে কাউকে জানতে দেয়া যাবে না।’
বলে আহমদ মুসা দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা লক করে এল।
তারপর ব্রুনার মাকে নিয়ে লিফটে ঢুকল। লিফট থেকে সেই ফ্লোরে নামল। কক্ষটা আগের মত। কেউ নেই।
সে কক্ষ থেকে আহমদ মুসা ব্রুনার মাকে ধরে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের সেই আলমারির ভিতর দিয়ে স্টোর রুমে ঢুকল।
‘বাবা, বেরুতে পারবে এদের ঘাঁটি থেকে আমাকে নিয়ে? এদের অনেক লোক। অনেক পাহারা। আর ওরা মানুষ মারে পাখির মত করে। আমার স্বামী-সন্তানরা বেঁচে আছে ঈশ্বর আছে বলেই। আমি কি পৌঁছতে পারব তাদের কাছে?’ বলল ব্রুনার মা।
‘পারবেন মা। ঈশ্বর আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
স্টোর রুম থেকে আহমদ মুসা ফাইবার ওয়াল কেটে যে দরজা করেছিল, সেই দরজা দিয়ে তাকে বন্দী করে রাখা সেই বিশাল কক্ষটিতে প্রবেশ করল। এ কক্ষেও কেউ নেই। আহমদ মুসা কক্ষ থেকে পালিয়েছে সেটা ওরা এখনও জানতে পারেনি। এখন লোকগুলো নিশ্চিন্ত মনে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাত ৪টা বাজতে যাচ্ছে। এ সময় স্টপ-কালচারের সভ্যতায় সবচেয়ে গভীর ঘুমের সময়। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
সেই উঁচু বারান্দার দেয়ালের যে দরজা দিয়ে আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকেছিল, সেই দরজা লক করা।
আহমদ মুসা ফিসফিসে কন্ঠে বলল, ‘মা, বাড়ির এটাই শেষ দরজা। এ দরজার পরেই গাড়ি বারান্দা ও চত্বর। এখানে ওদের পাহারা থাকতে পারে। মা একটা কথা মনে রাখবেন, ওরা যদি সামনে থেকে আক্রমণ করে তবে আপনি আমার পেছনে থাকবেন, আর যদি পেছন থেকে আক্রমণ করে তাহলে আপনি আমার সামনে থাকবেন।’
‘নিজে গুলি খেয়ে আমাকে বাঁচাতে চাও তুমি। কে তুমি বেটা? তোমাকে জার্মান বলে মনে হচ্ছে না?’
‘সব বলব মা। পরে। এটুকু ভাবুন, গোটা মানব সমাজ একটা পরিবার, সব মাই সবার মা, তেমনি সব ছেলেই সবার ছেলে।’
বলেই আহমদ মুসা পকেট থেকে লেজার কাটার বের করে দরজার লক হাওয়া করে দিল।
আস্তে খুলে ফেলল দরজা আহমদ মুসা।
সামনেই গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে জার্মান ছয় সিটের জীপ। সামনে কোন প্রহরী দেখলো না। ওরা কি বারান্দায় আছে?
আহমদ মুসা ব্রুনার মাকে কানে কানে বলল, ‘মা, আমার সামনে থাকবেন। দৌড় দিয়ে আমরা ঐ গাড়িতে উঠব। ঠিক এই সময়ই সাইরেনের একটা চাপা আওয়াজ তার কানে এল। শব্দটা আসছে ভেতর থেকে।
আহমদ মুসা ব্রুনার মায়ের হাত ধরে বলল, ‘মা, আসুন। ওরা জেনে ফেলেছে।’
দৌড় দিল আহমদ মুসারা। গাড়িতে উঠল তারা।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে এবং ব্রুনার মা আহমদ মুসার পাশের সিটে বসেছে।
গাড়ির চাবি লকের সাথেই লাগানো ছিল। গাড়ি চালিয়ে দ্রুত গেটের কাছে চলে গেল আহমদ মুসা।
গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েই দৌড়ে আহমদ মুসা গেটের পিলারের কাছে চলে গেল। গেটের গায়ে অদৃশ্য ডিজিটাল লকে দ্রুত আহমদ মুসা টাইপ করল ১৩০ ০৩১ ৩০১ অংকগুলো, এ কোড অংকগুলো দিয়েই আহমদ মুসা যাবার সময় লকগুলো খুলেছিল।
অংকগুলো টাইপ করার সময়ই বারান্দায় অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল বারান্দা দিয়ে অনেকগুলো লোক ছুটে আসছে। তাদের হাতের হ্যান্ড মেশিনগানগুলো তাকে লক্ষ্য করে তাক করা।
আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটির উপর। গুলির বৃষ্টি ছুটে এল তাকে লক্ষ্য করে। আহমদ মুসা বলের মত গড়িয়ে ছুটছিল গাড়ির দিকে।
গুলিবৃষ্টি চলছে অবিরাম।
আহমদ মুসা গড়িয়ে সামনে গিয়ে পৌঁছল এবং গাড়ির আড়াল নিয়ে দক্ষিণ পাশ দিয়ে গাড়িতে উঠল।
তারা বারান্দা ও বারান্দা থেকে নেমে আসা লোকদের সামনে বলে গাড়ির উত্তর পাশটা ওদের গুলিবৃষ্টির প্রধান শিকার।
গাড়ির পেছনের সিটে উঠে সিট ডিঙিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল ব্রুনার মাকে, ‘মা, আপনি সিটের উপর শুয়ে পড়ুন।’
গাড়ি স্টার্ট দেয়াই ছিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
কোডের শেষ অংক টাইপ করার সংগে সংগেই দরজা খুলে গেছে।
তীব্র বেগে গাড়ি বেরিয়ে এল গেট দিয়ে।
আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করছিল ব্রুনার মা। চমকে উঠল ফিনকি দিয়ে কাঁধ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে দেখে।
‘বেটা তোমার কাঁধে গুলি লেগেছে। রক্ত বেরুচ্ছে।’ বলল উদ্বেগ ও কম্পিত গলায় ব্রুনার মা কারিনা কারলিন।
‘মা, ওসব থাক। আগে আমাদের বাঁচতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
ছুটে আসা সব গুলির টার্গেট তখন আহমদ মুসার গাড়ি।
ব্রুনার মা শুয়ে পড়েছে গাড়ির সিটে।
আহমদ মুসা খুশি হলো যে, গাড়ি বারান্দায় আর গাড়ি নেই। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে হবে ওদের। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল-আজ আল্লাহ তাকে পদে পদে সাহায্য করছেন।
ছুটছিল আহমদ মুসার গাড়ি। জিগজ্যাগ, উঁচু-নিচু বিপজ্জনক রাস্তা। এ রাস্তায় মাঝারি স্পিডেও গাড়ি চালানো অসম্ভব। তার উপর বড় গাড়ি। ওরা সংগে সংগে ফলো করতে পারলে বিপদই হতো।
আহমদ মুসারা জংগলের প্রান্তে চলে এল। আহমদ মুসার গাড়ি রাস্তার যে দিকে পার্ক করা আছে ঝোপের আড়ালে তার বিপরীত দিকে রাস্তায় উপর সহজেই দৃশ্যমান একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসা ব্রুনার মাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটল নিজের গাড়ির দিকে। দৃশ্যমান জায়গায় গাড়ি ছাড়ল এ কারণে যে, গাড়ি দেখলে ওরা গাড়ি থেকে নামবে। কেন গাড়ি দাঁড় করালাম তা জানার চেষ্টা করবে। আশেপাশে আমরা আছি কি না এসব চিন্তায় অনেকটা সময় তারা নষ্ট করবে। এটা আহমদ মুসাদের জন্যে প্রয়োজন।
‘গাড়ি ছাড়লে কেন? কোথায় যাচ্ছ বেটা?’ ক্লান্ত স্বরে ব্রুনার মা বলল।
‘আমার গাড়ি লুকানো আছে এদিকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও, সব ব্যবস্থা করেই গেছ। দেখছি এদের চেয়ে তুমি অনেক বুদ্ধিমান।’ বলল ব্রুনার মা।
গাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল আহমদ মুসারা। বলল আহমদ মুসা, ‘মা গাড়িতে উঠুন।’ গাড়ির দরজা দ্রুত খুলে ধরল আহমদ মুসা।
ব্রুনার মাকে গাড়িতে তুলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। তার গাড়ি যখন রাস্তায় গিয়ে উঠল, তখন পেছনে কিছু দূরে একাধিক গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল।
কান ও কাঁধের ব্যথা আহমদ মুসা অনুভব করতে পারছে। এই কাঁধের নিচেই বাহুর মাসলে কয়েকদিন আগে সে গুলি খেয়েছিল। আহত হওয়ার কথা মনে হওয়ায় ব্যথা বাড়ছে।
কিন্তু এখন কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেবার সময় নয়।
আহমদ মুসা তার দুর্বল হয়ে পড়া বাম হাত দিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। কল করল আলদুনি সেনফ্রিডকে।
ওপার থেকে সাড়া পেতেই বলল, মি. সেনফ্রিড, আমাদের মিশন সফল। আপনি ও ব্রুনা এখনি চেকআউট করে হোটেলের গাড়ি বারান্দায় আসুন। আমি ওখানে পৌঁছার পর দেরি করা সম্ভব হবে না। আপনারা গাড়িতে এলেই সব দেখবেন। আমি রাখছি।’
কল অফ করে দিয়ে আহমদ মুসা মোবাইল পকেটে রাখল।
আহমদ মুসার কথা শুনছিল ব্রুনার মা কারিনা কারলিন। আহমদ মুসা কল অফ করতেই ব্রুনার মা বলে উঠল, ‘তুমি সেনফ্রিডের সাথে কথা বললে? ব্রুনা, সেনফ্রিড এখানে আছে? এখনি গাড়িতে আসবে ওরা?’ কান্না রুদ্ধ কন্ঠ তার। কষ্ট করে কান্না রোধ করছে সে।
‘হ্যাঁ মা, মি. সেনফ্রিডের সাথে কথা বললাম। মি. সেনফ্রিড ও ব্রুনাকে এখনি গাড়িতে দেখতে পাবেন।’ আহমদ মুসা বলল।
রাতের অ্যারেন্ডসী। ফাঁকা রাস্তা। দু’একটা গাড়ি কিঞ্চিত চোখে পড়ছে।
অ্যারেন্ডসীর তিন দিক ঘুরে গাড়ি এসে তাদের হোটেলের গাড়ি বারান্দায় প্রবেশ করল।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসা ব্রুনার মাকে সামনের সিট থেকে নামিয়ে নিয়ে পেছনের সিটে বসাল।
একবার এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল ব্রুনারা তখনও এসে পৌঁছেনি।
আহমদ মুসা ফিরে যাচ্ছিল তার ড্রাইভিং সিটে। এই সময় লবীর দরজা দিয়ে মি. সেনফ্রিড ও ব্রুনা বেরিয়ে এল। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ-উত্তেজনা। দ্রুত ওরা গাড়ির কাছে এল।
‘প্লিজ, আপনারা গাড়িতে উঠুন। মি. সেনফ্রিড পেছনটা ঘুরে আপনি বাম পাশে উঠুন।’
বলে আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।
ব্রুনা ও সেনফ্রিড একে-অপরের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ির দিকে এগোলো গাড়িতে ওঠার জন্যে। গাড়িতে উঠল ওরা।
ওরা গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করতেই আহমদ মুসা গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়িতে ওঠার পরপরই ব্রুনা ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল তার মা কারিনা কারলিনও।
গাড়ি রাস্তায় এসে পড়তেই আহমদ মুসা প্রায় ফাঁকা রা্স্তায় গাড়ির গতি শহরের সর্বোচ্চ সীমায় তুলল।
অ্যারেন্ডসীর গভীর রাতের নীরব প্রহর। মা, মেয়ে, বাবার মিলিত কান্নার আর্তকন্ঠ তবু কারও কানেই পৌঁছল না গাড়ির বন্ধ দরজা পেরিয়ে।
আহমদ মুসা কিছুই বলল না। কাঁদা উচিত ওদের।
গাড়ি অ্যারেন্ডসী শহর পেরিয়ে সালজওয়াডেলের রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
ব্ল্যাক লাইটের লোকরা আহমদ মুসাকে হামবুর্গের রাস্তায় তালাশ করবে। কারণ ওদের এটাই জানা যে আমি হামবুর্গ হয়ে এখানে এসেছি। সুতরাং সালজওয়াডেলের রাস্তা যেমন নিরাপদ, তেমনি অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত।
মা, মেয়ে, বাবার কান্না তখন থেমে গেছে। কথা বলতে ওরা শুরু করেছে।
এক সময় ব্রুনার মা কারিনা কারলিন বলে উঠল, ‘সেনফ্রিড, ব্রুনা তোমরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। আমার ঐ ছেলেটার খবর তোমরা জান না। সে দারুণভাবে আহত। তার কাঁধে গুলি লেগেছে। তার একটা কান গুলিতে ফুটো হয়ে গেছে। সেগুলো থেকে রক্ত ঝরছ। বাছাকে তোমরা দেখ। এই ছেলের সাহস ও বুদ্ধির কোন তুলনা হয় না। মনে হয় একাই সে একশজনের কাজ করতে পারে।’
‘কি বলছ মা?’ বলে আর্তনাদ করে উঠল ব্রুনা।
‘এই অবস্থায় উনি গাড়ি চালাচ্ছেন? আপনি দাঁড়ান ভাইয়া।’ উদ্বেগভরা কন্ঠে বলল ব্রুনা।
‘শুধু এই গাড়ি চালানো নয়! এমন আহত হয়েও গুলিবৃষ্টির মধ্যে সে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।’ বলল ব্রুনার মা।
‘আমরা শহর থেকে বের হয়ে এসেছি। সামনে একটা টিলাময় জংগল এলাকা আছে। ওখানে গিয়ে দাঁড়াব আমরা।’ আহমদ মুসা বলল।
সত্যিই কিছু দূরে গিয়ে জংগলপূর্ণ টিলা এলাকা পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা গাড়িটা রাস্তা থেকে একটা টিলার আড়ালে নিয়ে দাঁড় করাল। গাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়ে নামল আহমদ মুসা।
সবাই নামল। নামল ব্রুনার মা-ও!
‘আপনারা একটু দাঁড়ান। আমি ব্যান্ডেজ বেঁধে আসছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি, মি. আহমদ মুসা, যেখানে আপনার আঘাতটা লেগেছে সেখানে নিজের পক্ষে ব্যান্ডেজ বাঁধা সম্ভব নয়। গাড়ির হেড লাইটের সামনে আপনি বসুন। আমি বেঁধে দিচ্ছি। প্লিজ, মি. আহমদ মুসা। আমাদের জন্য এত করছেন আর আমাদের এটুকু করতে দেবেন না?’ আবেগরুদ্ধ ভারি কন্ঠ আলদুনি সেনফ্রিডের।
‘ঠিক আছে।’ বলে আহমদ মুসা বসে পড়ল। আসলে আহমদ মুসাও জানে তার ডান হাতকে বাম হাত পুরো সহযোগিতা করতে পারবে না। ব্যান্ডেজ যাকে বলে সেটা তো হবেই না।
জ্যাকেটসহ গায়ের জামা আস্তে আস্তে খুলল আলদুনি সেনফ্রিড।
গলা ও কাঁধের সংযোগস্থলের সামান্য বাইরে কাঁধে লেগেছে গুলি। ক্ষতটা বেশ বড়। কাঁধের মাসলে গুলি থাকতে পারে, সেটা আহমদ মুসাই বলল আলদুনি সেনফ্রিডকে।
কি করবে, কিভাবে কাজ শুরু করবে, এমন দিশেহারা অবস্থায় পড়ে গেল আলদুনি সেনফ্রিড। ওদিকে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আমার ব্যাগের ভেতরে দেখুন একটা সুইচ নাইফ কিটস আছে। সেখান থেকে ছুরিটা বের করে ক্ষতস্থানের সামনের দিকের কিছুটা চামড়া কেটে ফেলুন। বুলেটটা বেশি গভীরে যায়নি, উপরেই আছে বলে আমার মনে হচ্ছে।’
আহমদ মুসার কথা শুনেই আঁৎকে উঠল সেনফ্রিড। এই কাটাকুটো করা দূরের কথা, এটা দেখতেও তার ভয় করে।
ব্রুনা তার বাবার চেহারা দেখে সব বুঝতে পারল যে, তার বাবা এটা করতে পারবে না। কিন্তু কাজটা তো করতে হবে। গুলি বের না করলে আহমদ মুসার ক্ষতি হবে। এই চিন্তা ব্রুনাকে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলল। ব্রুনা কলেজে পড়ার সময় ফার্স্ট এইড ট্রেনিং নিয়েছে। সে আহত জায়গায় ড্রেসিং করতে পারবে। কিন্তু গুলি বের করা! এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার! হঠাৎ ব্রুনার মনে পড়ল, একটা নার্সিং ক্লাসে একজন ডাক্তার একদিন বলেছিলেন, একটা গুলি যখন কোথাও প্রবেশ করে তখন সে তার রাস্তা তৈরি করেই প্রবেশ করে। একটু সাহস করলে সে পথ দিয়ে তা বের করাটাও সহজ। ব্রুনার মনে সাহসের সৃষ্টি হলো। বলল সে তার বাবা সেনফ্রিডকে লক্ষ্য করে, ‘বাবা, তুমি এসবের কিছু জান না, করওনি কোনদিন। তুমি সরে এস বাবা, আমার ট্রেনিং আছে। আমি পারব।’
বলে ব্রুনা আহমদ মুসার দিকে এগোলো।
সরে দাঁড়াল মি. সেনফ্রিড।
আহমদ মুসা কিছুই বলল না।
ব্রুনা প্রথমেই ব্যাগ থেকে তুলা বের করে ক্ষতস্থানের রক্ত মুছে ফেলল। বলল, ‘ভাইয়া, প্রথমে গুলিটা বের করতে হবে। আপনার তো খুব লাগবে।
‘তুমি কাজ শুরু কর ব্রুনা্ ডাক্তাররা রোগীর প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা করে না, তোয়াক্কা করা উচিতও নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আমি ডাক্তার নই। কাটার জন্যে ছুরি কিভাবে ধরতে হয় সেটাও আমি জানি না। গুলিটা আমি বের করব, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। এখন বলুন, আপনার কাঁধের যন্ত্রনার কেন্দ্রবিন্দুটা ঠিক কোন জায়গায়?’ বলল ব্রুনা।
আহমদ মুসা কাঁধের ক্ষতস্থানের শেষ প্রান্তের একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলল, জায়গাটা ভারি হয়ে আছে এবং যন্ত্রণাও বেশি হচ্ছে।
‘গুলি এখানেই আছে ভাইয়া। আপনার কি মত?’ বলল ব্রুনা।
‘ধন্যবাদ ব্রুনা। তোমার ভালো কমনসেন্স আছে। তোমার সাথে আমি একমত।’ আহমদ মুসা বলল।
জায়গাটাকে ব্রুনা খুব ভালোভাবে দেখল। ক্ষতস্থানের শেষ প্রান্ত থেকে সেই যন্ত্রণা ও ভারি জায়গাটার শুরু। তার মানে গুলিটা ক্ষতস্থান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আর ক্ষতস্থানের শুরু ও শেষটা দেখে মনে হচ্ছে গুলিটা হিট করার পর উপরের দিকে স্লোপ করেছে। নিচের দিকে নয়। সম্ভবত গুলিটা লেগেছে গাড়িতে ওঠার সময়, পেছন থেকে। যদি তাই হয় তবে গুলি বেশি নিচে যাবার কথা নয়। ব্রুনা এই চিন্তা করল-বন মেডিকেল কলেজের একজন ডাক্তার ট্রেনার হিসেবে আসা তাদের একটা ফার্স্ট এইড ক্লাসে নানা দৈব দুর্ঘটনার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব কথা বলেছিলেন। ব্রুনার আজ কাজে লাগল সে কথাগুলো।
ব্রুনা আহমদ মুসার ভারি হয়ে থাকা ও ব্যথাযুক্ত অংশের কেন্দ্রটার ডান প্রান্ত দিয়ে সুইচ মেইড অদ্ভুত ছুরিটা ঢুকিয়ে দিল চোখ বন্ধ করে। ব্রুনার হিসেব ব্যর্থ হলো না। তার ছুরিটা একটা ধাতব বস্তু স্পর্শ পাওয়ার সিগন্যাল দিল। আনন্দে চোখ খুলল সে।
ছুরির ফলা যতটা ভেতরে ঢুকেছে তাতে ব্রুনা নিশ্চিত হলো, ছুরির ফলা বুলেটের দৈর্ঘ্য অতিক্রম করে গেছে।
ব্রুনা আবার চোখ বন্ধ করে ছুরিটাকে অর্ধবৃত্ত পরিমাণ ঘুরিয়ে নিল বাম দিকে।
এ সুইচ ছুরিটার তীক্ষ্ণ একটা ফলা আছে। ফলার নীচে বড়শীর মত বাঁকা ক্ষুদ্র একাধিক খাঁজ আছে। ব্রুনা ছুরিটা ঢুকাবার সময় ছুরির এ দিকটা বুলেটের দিক থেকে বাইরে রেখেছিল। সেটাই ঘুরিয়ে নিল।
ব্রুনা বাম হাতে আহমদ মুসার বাম কাঁধ চেপে ধরে ছুরিটা ধীরে ধীরে টানতে লাগল। শক্ত কিছুতে আটকে গেল ছুরি। এটাই কি বুলেট?
ক্ষতস্থান দিয়ে নতুন করে রক্ত বেরুতে শুরু করেছে। ব্যথাও নিশ্চয় সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। হাত কাঁপছিল ব্রুনার।
বুলেটটাকে ছুরির খাঁজে যাতে ভালো করে আটকানো যায় এ জন্যে ছুরিটাকে বাম দিকে আরও চেপে ধরে জোরে একটা টান দিয়ে ছুরি বের করে নিল।
চোখ খুলল ব্রুনা। দেখল ব্রুনা রক্তের সাথে বুলেটটা গড়িয়ে পড়ছে পিঠের উপর দিয়ে।
বুলেটটা হাতে নিয়ে ব্রুনা চিৎকার করে বলল, ‘থ্যাংক গড, বুলেট বেরিয়ে এসেছে।’
ব্রুনার বাবা-মা আগেই চোখ বন্ধ করে রেখেছিল দৃশ্যটা দেখতে পারবে না বলে। তারাও চোখ খুলল।
কিন্তু আহমদ মুসা পাথরের মত বসে আছে। মুখ থেকে তার একটা শব্দও বের হয়নি।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল আহমদ মুসার ক্ষতস্থান থেকে।
ব্রুনা চিৎকার করে কথাটা বলার পরই ছুটে গিয়ে গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে তোয়ালে বের করে সেটা দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরল। বলল, আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, খুব কষ্ট পেয়েছেন ভাইয়া। আনাড়ি হাতের কাজ তো?
‘আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও ব্রুনা। বুলেট তুমি সহজেই বের করেছ। এত সহজে বুলেট বের হয় না।’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠ কিছুটা অস্বাভাবিক। কন্ঠ তার কিছুটা বেদনাহত।
ক্ষতস্থানের উপর তোয়ালেটা কয়েক মিনিট ধরে রাখার পর তা সরিয়ে নিল। রক্ত বেরুনো কমেছে।
‘দু’ রকমের ব্যান্ডেজ, কোনটা দিয়ে বাঁধব ভাইয়া?’ বলল ব্রুনা।
‘দেখ একটা প্লেইন, আরেকটা মেডিকেটেড। মেডিকেটেডটা হাতে নাও।’
ব্যান্ডেজ বাঁধল ব্রুনা। আহত কানেও ফার্স্ট এইড দিল।
‘ব্রুনা, তুমি তো দেখছি ডাক্তার-নার্সদের মতই ব্যান্ডেজ বাঁধতে পার!’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড, ব্রুনার বাবা।
‘বাবা স্কাউট হিসেবেও এটা শিখেছি। আবার আমাদের নিয়মিত ক্লাস করতে হয়েছে ‘ফার্স্ট এইড’-এর উপর।’ বলল ব্রুনা।
‘ধন্যবাদ ব্রুনা।’ বলল তার বাবা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে আরেকটা গেঞ্জিজাতীয় জ্যাকেট বের করে পরে নিল। এ জ্যাকেট সে হামবুর্গে এসে কিনেছে মাত্র আগের দিন। আজই কাজে লাগল।
আহমদ মুসা জ্যাকেট পরে ব্রুনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘এই প্রথম কোন নন-ডাক্তার আমার দেহ থেকে বুলেট বের করল।’
‘তার মানে আপনার শরীর থেকে এর আগে অনেকবার বুলেট বের হয়েছে। কতবার?’ ব্রুনা বলল।
‘আমার গোনা নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
ব্রুনা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ব্রুনার মা কারিনা কারলিন বলল আহমদ মুসাকে, ‘আমি, কেন সকলেই আমরা স্তম্ভিত যে, শরীর থেকে একটা বুলেট বের করার মত এত বড় ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা ঘটল, কিন্তু তুমি বেটা একটুও উহ আহ পর্যন্ত করনি। এটা কি করে সম্ভব আমি বুঝতে পারছি না বেটা।
‘আমি উহ আহ করলে ব্রুনা কাঁধ থেকে বুলেটটা বের করতে ভয় করত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বেটা মানুষ যখন অসহনীয় ব্যথা পায়, তখন মুখ থেকে উহ আহ শব্দ আপনাতেই বের হয়। এটা কোন বিবেচনা দিয়ে কেউ রোধ করতে পারে না।’ বলল ব্রুনার মা।
‘মা, তুমি সাধারণ লোকের কথা বলছ, কিন্তু ইনি তো অসাধারণ। আমরা বিস্মিত হইনি এটা দেখে। তুমি যা দেখে বিস্মিত হচ্ছ মা, তার চেয়ে উনি অনেক বেশি বিস্ময়কর।’ ব্রুনা বলল।
‘ঠিক বলেছ ব্রুনা। আমাকে তার উদ্ধার করার দৃশ্যগুলো এখনো আমার চোখে ভাসছে। তুমি যা বলছ সে সময়গুলোতে আমার তাই মনে হয়েছিল।’ বলল ব্রুনার মা।
কথা বলার জন্যে মুখ হা করেছিল ব্রুনা। তাকে থামিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘এসব থাক প্লিজ। আমার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা।
সবাই তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিক্
আহমদ মুসা আবার বলতে শুরু করল, ‘আমাদেরকে সকালের মধ্যে বন-এ পৌঁছতে হবে। নকল কারিনা কারলিন কাল সকালেই ‘বন’-এর কোন কোর্টে আপনাদের স্টেট অন্যের কাছে হস্তান্তর করছে। এটা আমাদের রোধ করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
ব্রুনার মা কারিনা কারলিন, ব্রুনা, ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড সকলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে।
‘হ্যাঁ, এই সম্পত্তি পাবার জন্যেই ওরা সব কিছু করছে।’
‘আমাকে যারা বন্দী করেছিল, তাদের কিছু কথা-বার্তা থেকে আমি এটা বুঝতে পেরেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি বন্দী হয়েছিলেন? কখন? কিভাবে?’ বলল ব্রুনা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে।
আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল।
‘বন্দীত্ব থেকে নিজে মুক্ত হলে, আবার এত বড় ঘটনাও ঘটালে? বলল ব্রুনার মা।
ব্রুনার মা’র কথা শেষ হতেই আলদুনি সেনফ্রিড বলল, ‘স্টেটজাতীয় সম্পত্তির কেনা-বেচা হস্তান্তর সংশ্লিষ্ট প্রদেশের হেডকোয়ার্টার বা রাজধানীতে হয়। সুতরাং ঠিকই ধরেছেন কারলিনার স্টেটের হস্তান্তর ‘বন’-এ হবে।’
‘এ কারণে আমরা বন-এ যাচ্ছি। রেজিস্ট্রি আটকাতে হবে এবং ওদের ধরিয়ে দিতে হবে। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ওদের ষড়যন্ত্রও ফাঁস করে দিতে হবে যাতে করে আর কারও সর্বনাশ তারা করতে না পারে বিজ্ঞানের অপব্যবহারের মাধ্যমে।’ আহমদ মুসা বলল্
‘এত অল্প সময়ে কিভাবে সম্ভব সেটা মি. আহমদ মুসা?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড। তার কন্ঠে হতাশা।
‘দেখা যাক।’ বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করল আহমদ মুসা। কল করল জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিসকে। ওপারে বরডেন ব্লিস-এর নিদ্রাজড়িত কন্ঠ পেতেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি খুবই দু:খিত স্যার। ঘুম থেকে আপনাকে জাগালাম। কিন্তু বিষয়টি খু্বই জরুরি।’
‘মি. আহমদ মুসা, আপনি রাতে না ঘুমিয়ে কাজ করছেন! তার চেয়ে আমার ঘুম ভাঙানো কি খুব বড় হলো? বলুন মি. আহমদ মুসা, আপনার টেলিফোন আমাকে আনন্দ দেয়, গৌরবান্বিত করে। জরুরি বিষয়টি কি প্লিজ বলুন।’ বলল জার্মানীর পুলিশ প্রধান।
‘আমি যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করছি, সেটা আপনি জানেন স্যার। ব্রুমসারবার্গ স্টেটের মালিক কিডন্যাপড হওয়া মিসেস কারিনা কারলিনাকে ঘন্টা খানেক আগে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে তার স্টেটটা সকালেই হস্তান্তরিত হতে যাচ্ছে। বন্দী অবস্থায় তার ফিংগার প্রিন্ট তারা দলিলে নিয়েছে। কোর্টে তার জায়গায় হাজির করছে তার ক্লোন করা নকল কারিনা কারলিনাকে। আপনার সাহায্য ছাড়া এই হস্তান্তর ঠেকানো যাবে না স্যার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মানে আসল কারিনা কারলিনের ক্লোন তৈরি করা হয়েছে? কিন্তু বয়স? এটা ধরা পড়বে না?’ বলল ওপার থেকে পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্রুমসারবার্গ স্টেটের মালিক কারিনা কারলিনের সম্ভবত টিস্যু চুরি করে ২৫ বছর আগে এই ক্লোন তৈরি করা হয়েছে। চুলে রং করে, মেক আপ করে বয়সের পার্থক্য দূর করা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এতো সাংঘাতিক ব্যাপার মি. আহমদ মুসা। ঐ ক্লোন এবং ব্ল্যাক লাইট নামক গ্যাংয়ের লোকদের আমাদের হাতে পাওয়া দরকার। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমি এখনি ব্রুমসারবার্গ ও বন-এর পুলিশকে বলে দিচ্ছি। তারা বন-এর সব কোর্টে পাহারা বসাবে।
আর সেখানকার প্রসিকিউশনকেও কারিনা কারলিনের ব্রুমসারবার্গ স্টেটের কোন ব্যাপার হলে তারা যেন সেটা পুলিশকে জানায় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে চোখে চোখে রাখে। আর আপনি আহমদ মুসা আসল কারিনা কারলিনকে নিয়ে চলে আসুন।’ বলল জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘স্যার, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আপনাকে জানানো দরকার। এই ব্ল্যাক লাইট গ্যাংটি যেভাবে কারিনা কারলিনের ব্রুমসারবার্গ স্টেট দখল করতে চেষ্টা করছে, ঠিক এভাবেই এই গ্রুপটি এর আগে উত্তর জার্মানীর ৬টি স্টেট দখল করেছে। তারা…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস বলে উঠল, ‘তার মানে আহমদ মুসা, আরও ৬টি ক্ষেত্রে আসল মালিকের ক্লোন তৈরি করে সেই ক্লোন দিয়ে ৬টি স্টেট দখল করে নিয়েছে ঐ গ্যাং?’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। এটাই ঘটেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু কিভাবে প্রমাণ করব আমরা মি. আহমদ মুসা?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘মিসেস কারিনা কারলিনের কেসসহ ঐ ৬টি কেসের যাবতীয় বিবরণ, তথ্য, ফটোগ্রাফ ওদের কম্পিউটারে ছিল। আমি সে ডিস্ক নিয়ে এসেছি।’আহমদ মুসা বলল।
‘বলেন কি আহমদ মুসা? এসব যদি আমরা পেয়ে যাই, গ্যাং-এর রাঘব বোয়ালকে ধরতে পারি, তাহলে এটাই হবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা, শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মামলা। আর এর গোটা কৃতিত্ব আপনার হবে আহমদ মুসা। মি. আহমদ মুসা আমি নিজে বন-এ আসছি, আপনিও আসুন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমি ভোরে বন-এ পৌঁছাচ্ছি। আপনি ভালো আছেন তো মি. আহমদ মুসা?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘হ্যাঁ, ভালো আছি স্যার। তবে সামান্য আহত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আহত? গুলি লাগেনি তো?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘কাঁধে গুলি লেগেছিল। ওটা বের করা হয়েছে। এখন ভালো আছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাকে উদ্বেগের মধ্যে ফেললেন আহমদ মুসা। এই অবস্থায় আপনি কিভাবে বন-এ আসবেন? আপনি কোথায়? আমি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করব?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘না স্যার, হেলিকপ্টার লাগবে না। আমরা অনেক দূর এসে গেছি। আমরা ঠিক সকালের মধ্যেই বন-এ পৌঁছে যাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে, আপনার কথা মেনে নিলাম। আপনার জীবন আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান মি. আহমদ মুসা। নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন। তাহলে মি. আহমদ মুসা…।’ থামল পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস।
‘ঠিক আছে স্যার। এখনকার মত এটুকুই। রাখি স্যার। বাই।’ আহমদ মুসা বলল।
মোবাইলের কল অফ করে পকেটে রেখে আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. সেনফ্রিড কাজ হয়ে গেল। আর কিছু চিন্তা নেই। জার্মানীর পুলিশ প্রধান বরডেন ব্লিস এখনই বন ও ব্রুমসারবার্গের পুলিশ ও জুডিসিয়াল প্রসিকিউশনকে বলে দিচ্ছেন সব কোর্টের উপর নজর রাখতে এবং ব্রুমসারবার্গ স্টেট হস্তান্তরের জন্য যারা যাবে, তাদের নজরে রাখতে। আর পুলিশ প্রধান নিজেই সকালে ওখানে যাচ্ছেন।
আহমদ মুসা থামতেই ব্রুনার মা কারিনা কারলিন, ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড এবং ব্রুনা প্রায় এক সাথেই বলে উঠলো, ‘ক্লোন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যা যা বললেন আপনি, সবই তাহলে ঠিক?’
‘হ্যাঁ, ব্ল্যাক লাইটের সম্পত্তি দখলের বড় অস্ত্রই হলো ক্লোন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘নকল মা তাহলে মায়ের ক্নোন ছিল, এটা তাহলে প্রমাণ হলো।’ বলল ব্রুনা।
‘হ্যাঁ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র! কি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র! পঁচিশ বছর আগে মায়ের ক্লোন করা হয়েছে, এটা আপনি কিভাবে জানলেন।’ জিজ্ঞাসা ব্রুনার।
‘আমি এটা আলদুস আলারীর কাছ থেকে শুনেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার উঠল, ‘আর সময় নষ্ট করা নয়। সকালেই আমাদের পৌঁছতে হবে বন-এ। চলুন গাড়িতে উঠি।’ আহমদ মুসা বলল। সবাই উঠল।
‘বেটা আহমদ মুসা, তুমি এসব কি বললে! আমার কানকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আর তোমাকে মানুষ বলেও বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি এ্যাঞ্জেল বেটা! আমাদের ভাগ্যে কিভাবে সৌভাগ্যের সূর্য হয়ে উদয় হলে? ঈশ্বরকে আমি কিভাবে ধন্যবাদ জানাব!’ অনেকটা স্বাগত কন্ঠে বলল মিসেস কারিনা কারলিন। তার কন্ঠ ভারি, অশ্রুরুদ্ধ।
‘হ্যাঁ মা, আমরা সবাই আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাদের চালান। সব ধন্যবাদ, সব প্রশংসা তাঁরই জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই গাড়ির দিকে চলল।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠতে যাচ্ছিল।
ব্রুনা বাধা দিয়ে বলল, ‘এই অবস্থায় আপনি গাড়ি ড্রাইভ করবেন না ভাইয়া। আমি ড্রাইভ করছি। আপনি পাশে বসে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেই চলবে। বাবাকে জিজ্ঞিস করুন আমি ভালো ড্রাইভার কি না।’
‘ধন্যবাদ ব্রুনা। তুমিই ড্রাইভ কর।’ বলে আহমদ মুসা পাশের সিটে গিয়ে বসল।
আলদুনি সেনফ্রিড হাত ধরে গাড়িতে তুলল তার স্ত্রী কারিনা কারলিনকে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
নি:শব্দে চলছে গাড়ি।
নীরবতা ভাঙল ব্রুনা। বলল, ‘এই মুহুর্তে আমার মত সুখী দুনিয়াতে আর কেউ নেই। স্যার, আপনি আমার পাশে। আমার প্রিয় মা-বাবা আমার সাথে। এই চলা যদি চলতেই পারতাম অনন্তকাল।’ আবেগে ভারি কন্ঠ ব্রুনার।
‘আরে ব্রুনা, আনালিসার কথা তো বলছিস না, সে কোথায়?’
ব্রুনা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও বলতে পারল না। ঠোঁট তার কেঁপে উঠে থেমে গেল।
‘সে জার্মানীর বাইরে। এখন বল তোমার শরীর কেমন?’ আলদুনি সেনফ্রিড প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করল।
নানা ধরনের কথা শুরু হলো বাপ, মা ও মেয়ে এই তিনজনের মধ্যে। চলতেই থাকল কথা।
আহমদ মুসা তাদের আলোচনায় যোগ দিল না।
সে ভাবছে আগামী কাল সকালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।