৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

পড়া থামিয়ে মাথা তুলল আহমদ মুসা। কাহিনীর মধ্যে সবাই ডুবে গিয়েছিল। পড়া বাদ দিয়ে থামতেই শোনার স্রোতটা একটা ধাক্কা খেল। সবাই মাথা তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
‘থামলেন কেন স্যার? কাহিনী উপন্যাসের চেয়ে সুন্দর, কিন্তু তা একজন মানুষের হৃদয় নিংড়ানো এক বাস্তবতা। বাস্তবতাটা একদিকে যেমন মর্মন্তুদ, অন্য দিকে তেমনি সুন্দর ও গৌরবের। মহান পূর্বপুরুষের জন্যে আমার গর্বে বুক ফুলে উঠেছে। একজন ভালো মানুষ শত বিপর্যয়, শত সংকট সততার দ্বারা জয় করলেন। কাহিনীর শেষ শব্দ পর্যন্ত শুনতে চাই, প্লিজ স্যার।’ বলল আদালা হেনরিকা।
‘সত্যি বলেছ আদালা। আমার দাদু তাঁর নামের অনুকরণে আমার নাম রাখায় আমি গৌরব বোধ করছি। কিন্তু তাঁর ও আমার মধ্যে কি আকাশ পাতাল পার্থক্য। তাঁর উত্তরসূরি বলে পরিচয় দেয়ারও অনুপযুক্ত আমি।’
একটু থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আদালা আমরা শেষ শব্দ পর্যন্ত শুনব, এখনো স্বর্ণমুকুটের প্রসঙ্গ তো আসেইনি। তবে নাস্তার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সবাই ক্ষুধার্ত এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে তুমি আদালাসহ আমাদের সম্মানিত মেহমানরা অনেক দূর থেকে এসেছেন সারারাত ধরে। তাদের বিশ্রাম তো হয়নি, সেজন্যে ভালো নাস্তা আরও বেশি প্রয়োজন।’
‘ঠিক বলেছ বাবা, বইয়ের কাহিনী আমাদের মনোযোগের সবটুকু কেড়ে নিয়েছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথাও ভুলে গেছি। যাই বাবা দেখি, নাস্তা টেবিলে দিয়েছে কি-না!’
আদালা উঠেছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাকে অভিভূত করেছে তার কাহিনীটা। কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সেই সময়কে দেখতে পাচ্ছি। তখনকার এই ঘটনাগুলো কোন ইতিহাসে নেই। আরও কত যে এমন কাহিনী সে সময় সৃষ্টি হয়েছিল, তা অজানার অন্ধকারেই থেকে যাবে। ধন্যবাদ আপনাদের পূর্বপুরুষকে, তাঁর কাহিনীর গবাক্ষ দিয়ে সেই কালকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাকে বিস্মিত করেছে তার বিজ্ঞতা ও পরিমিতি বোধ। শুধু জ্ঞানী হওয়া নয়, উন্নত পর্যায়ের মানবিক বোধে উজ্জীবিত না হলে এমন কেউ পারে না। তাকে দিয়েই বুঝা যায় ইসলামী সভ্যতা জ্ঞানে, গুণে, চরিত্রে সমৃদ্ধ কেমন মানুষ তৈরি করেছিল।
আদালা আবার বসে বলল, ‘স্যার, আমাদের গ্রান্ড গ্রান্ড দাদু তার মুসলিপ পরিচয় গোপন করেও তার ডাক্তার পরিচয় তিনি দিতে পারতেন।’
‘না, পারা স্বাভাবিক ছিল না। তার সময়ে তার মত ডাক্তার ইউরোপে ছিল না। তেমন ডাক্তার হবার কোন বিদ্যালয়ও ইউরোপে ছিল না।তাছাড়া খৃস্টানরা তখনও ঐ ধরনের ডাক্তারী পড়ার সাহস করত না চার্চের ভয়ে। ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিলে সার্টিফিকেট দেখাবার প্রয়োজন পড়ত। এসব নান কারণেই সম্ভবত তিনি তার ডাক্তার হওয়ার পরিচয়টি দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
পরিচারিকা এল সেখানে। বলল, ‘নাস্তা দেয়া হয়েছে টেবিলে।’
‘হ্যাঁ, আদালা মেহমানদের নিয়ে টেবিলে যাও। আমি আসছি। আজ নাস্তা তৈরিতেই দেরি হয়েছে। খেতে আর দেরি করো না।’ বলল আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার।
আদালা উঠল। সবাই উঠল।
নাস্তা সেরে আধাঘন্টার মধ্যে সবাই এল আবার সেই স্টাডিতে।
আদালার বাবা বাক্স থেকে খাতাটা বের করে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘কি অদ্ভুত কো-ইন্সিডেন্স। আজকেই ঘটনাটা ঘটল, আর আজকেই তুমি এলে। এসে শুধু আমাদের বাঁচালেই না, পরিবারের শতাব্দীর রহস্য উন্মোচনেও আমাদের সাহায্য করলে। কি অদ্ভুত! রহস্য উন্মোচনের জন্যে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ও ভালো আরবি জানা লোকের প্রয়োজন ছিল, সে লোকও তুমিই। আমাদের পরিবারের এক চরম বিপদের দিনে আমাদের জন্যে এক পরম সৌভাগ্যও লেখা ছিল। দিনটি আমাদের পরিবারের জন্যে টার্নিং পয়েন্ট এবং নতুন এক শুভযাত্রার শুরু। আমার হৃদয়বিদারক দু:খের এই দিনে পরম আনন্দে আমি আপ্লুত!’ বলল জোসেফ জ্যাকব আলগার। শেষের কথা তার আবেগের আবেশে ডুবে গেল। তার ঠোঁটের কোণার স্বচ্ছ-সুন্দর হাসির স্ফুরণ, কিন্তু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
আদালার বাবার কথা পরিস্থিতিকে ভারি করে তুলল।
‘আল্লাহর যা ইচ্ছা ছিল, সেটাই হয়েছে। আপনার পূর্বপুরুষ জনাব আল মানসুর যেদিন এই ডকুমেন্ট তৈরি করে বংশীয়দের জন্যে রেখে গিয়েছিলেন, সেদিনই এটা ঠিক হয়েছিল আজ আপনার দ্বারা এটা খোলা হবে এবং আমার দ্বারা পড়া হবে। আমরা সবাই একএ হবো, এটাও পূর্বনির্ধারিত। আমরা সবাই আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার অধীন। সুতরাং আমাদের উচিত সব ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, আমরা সবাই আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার অধীন হলে যা ঘটছে, যা আমরা ঘটাচ্ছি, তা ঈশ্বর বা আল্লাহই ঘটাচ্ছেন?’ জিজ্ঞাসা আদালার।
আদালার কথা শেষ হতেই ব্রুনা বলে উঠল, ‘ভাইয়া, এ প্রশ্ন আমারও।’
‘ভালো কিন্তু জটিল প্রশ্ন। বিষয়টা পরিষ্কার করতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। মানুষ ছাড়া মহাবিশ্বের সব কিছুই শতকরা শতভাগ আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। গাছপালা, জীব-জন্তু, গ্রহ-তারা, বাতাস-আগুন কিছুই আল্লাহর বিধি-বিধান লংঘন করতে পারে না, সে সুযোগ, শক্তি কিছুই তাদের নেই্। কিন্তু মানুষের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের দেহ অন্যান্য সৃষ্টির মতই শতভাগ আল্লাহর বিধি-বিধানের অধীন নি:শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত চলাচল, হাড়, স্নায়ু, টিস্যু, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ মানুষ নির্ধারণ করেনি, এটা আল্লাহর দ্বারা নির্ধারিত। শুধু মানুষের ইচ্ছা ও চিন্তার ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। মানুষ কি করবে, কি করবে না, কোন পথে চলবে, কোন পথে চলবে না, এসব মানুষের ইচ্ছা ও চিন্তাভিত্তিক সিদ্ধান্তের ফসল। শুধু আ…।’ কথা শেষ না করেই আহমদ মুসাকে থামতে হলো।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে আদালা বলল, ‘তার মানে মানুষ ইচ্ছা ও চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে তো স্রষ্টা, ঈশ্বর বা আল্লাহ বিভিন্ন বিধি-নিষেধ দিয়ে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা-চিন্তাকে শৃঙ্খলিত করেছেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি সে কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম। আল্লাহ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা চিন্তাকে শৃঙ্খলিত করেননি। আল্লাহ যুগে যুগে তার বার্তাবাহক বা নবী-রাসূল (স.)-দের মাধ্যমে মানুষের শান্তি ও কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন। তিনি তাদের মাধ্যমে মানুষকে জানিয়েছেন, এই শান্তি ও কল্যাণের পথে চললে দুটি পুরস্কার মানুষ পাবে। এক, প্রত্যেক মানুষ, মানুষের সমাজ এবং সারা বিশ্ব ও বিশ্বের মানুষ ইহজগতের পুরস্কার হিসাবে শান্তি-কল্যাণের মধ্যে থাকতে পারবে। দুই, এই কল্যাণ ও শান্তির পথে চললেই যা চাই তা পাওয়া যাবে মানে চিরন্তন জান্নাত লাভ করা যাবে। কিন্তু এই পথে চলতে মানুষকে বাধ্য করা হয়নি। শুধু এই খবর জানিয়েছেন, সে শান্তি ও কল্যাণের পথে না চললে দুনিয়াতে যেমন অকল্যাণ ও অশন্তি সৃষ্টি করবে, তেমনি পরজগতে জান্নাত লাভের অনন্ত পুরস্কার সে হারাবে এবং অকল্যাণ ও অশান্তির আগুনে সে অনন্তকাল জ্বলবে।’
‘মানুষকে স্বাধীনতা দেবার পর এ শাস্তির ব্যবস্থা কেন? তাহলে স্বাধীনতার কি মূল্য থাকল?’ বলল আদালা।
‘আল্লাহ চান মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমেই শান্তি ও কল্যাণের পথ বেছে নিক। এজন্যে আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে বিবেক দিয়েছেন এবং এই বিবেক সব সময় মানুষকে ভালো পথ, মন্দ পথ কোনট, কল্যাণ কোন পথে, অকল্যাণ কোন পথে তা বলে দেয়। এটা আল্লাহর তরফ থেকে মানুষকে সাহায্য করার একটা নিয়ম, যাতে মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাতেই কল্যাণের পথে চলে বা অকল্যাণের পথে না চলে। আল্লাহর এই ব্যবস্থা তার সৃষ্টির মূল দর্শনের সাথে জড়িত। আল্লাহ মানুষের ভোগ ও ব্যবহারের জন্যে গোটা সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। গোটা সৃষ্টিজগৎ নানাভাবে মানুষের জন্যে, মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। কিন্তু মানুষ কোন সৃষ্টিজগতের কাজে লাগে না। এই জগৎ-সংসারে সৃষ্ট সব বস্তুর মধ্যে মাত্র মানুষেরই অন্য সৃষ্টির জন্য কোন কাজ নেই, মানুষ যা করে তার নিজের বা নিজেদের জন্যে করে। অন্য কোন সৃষ্টির জন্যে করে না। এই সীমাহীন দান, দয়া, ইহসানের বিনিময়ে আল্লাহ মানুষের কাছে শুধু এটাই চেয়েছেন যে, মানুষ যেন নিজ ইচ্ছাতেই শান্তি ও কল্যাণের পথে চলে তার নিজের, মানুষের আর দুনিয়ার উপকার করে এবং এর বিনিময়ে আখেরাতের অনন্ত পরস্কার লাভ করে। শাস্তির যে ব্যবস্থা সেটা ব্যক্তি মানুষ, মানব সমাজ ও দুনিয়ার মঙ্গলের জন্যেই। মানুষের স্বাধীনতা এখানে অর্থহীন নয়। স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার বদলে অর্থবহ করার জন্যেই প্রকৃত পক্ষে শাস্তির এই ব্যবস্থা।’ আহমদ মুসা থামল।
আদালা, ব্রুনা সবাইকে চিন্তায় আত্নস্থ দেখাচ্ছে। আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোন কথা বলল না। কিছু মুহূর্ত কেটে গেল এভাবে।
নীরবতা ভেঙে কথা বলল ব্রুনা, ‘আপনি যে কথা বলেছেন, তা শুনতে সহজ হলেও পাহাড়ের মতই যেন ভারি।’
‘শুধু পাহাড় কেন বলছেন মিস ব্রুনা, আমার কাছে হিমালয়ের মত ভারি মনে হচ্ছে। মানব-দর্শন, মানুষের জন্ম, জীবন ও পর-জীবন ও পর-জীবনের মত বিষয় নিয়ে তিনি যা বলেছেন তা একটা পরম বাস্তবতা যতটুকু বুঝেছি তাতেই। তাঁকে ধন্যবাদ।’
বলে আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়াল আদালা। বলল, ‘স্যার, একটা কথা, মানুষকে পর-জীবনের পুরস্কার ও শাস্তির সাথে আল্লাহ মানুষকে না জড়ালে কেমন হতো?’
‘পরীক্ষা না থাকলে, পাস-ফেল না থাকলে ছাত্র জীবনটা কেমন হতো, যদি পরীক্ষা, টেস্ট না থাকতো, কৃতকার্যতা-অকৃতকার্যতা না থাকতো তাহলে কি কর্মকর্তা-কমর্চারি রিক্রুট হতো? পরকালে জবাবদিহিতা তথা পুরস্কার-শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে দুনিয়ার শান্তি-শৃঙ্খলা, নীতিবোধ কিছুই থাকতো না, বন্যতায় ভরে যেত সমাজ-সম্পর্ক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অন্তহীন পুরস্কার ঠিক আছে, কিন্তু অনন্ত শাস্তির বিষয়টা অতি বেশি ভারি নয়?’ বলল আদালা।
‘পুরস্কার অনন্তই, কিন্তু শাস্তির মেয়াদের বিষয়টা হতে পারে আল্লাহর দয়ার উপর নির্ভরশীল, পরম দয়ালু আল্লাহ যা চান তাই করতে পারেন। তবে মানুষের সমাজে, সৃষ্টি জগতে মানুষের দায়িত্ব বিশাল বলেই তাদের পুরস্কার ও শাস্তির বিধানও বিশাল। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিজগতের রাজা বানিয়েছেন। যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয়েছে ‘খলিফা। মানুষের পদ যেমন বড় তেমনি মানুষের দায়িত্বও খুব ভারি। মানুষ, পৃথিবী এবং এমনকি সব সৃষ্টির কল্যাণে মানুষের সঠিক দায়িত্ব পালনকে নিশ্চিত করার জন্যেই পরম পুরস্কার ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আল্লাহ এটা করেছেন সৃষ্টি ও মানুষের স্বার্থেই, তাঁর এতে কোন স্বার্থ নেই, তিনি বেনিয়াজ, অভাবমুক্ত ও মুখাপেক্ষীহীন। সমগ্র সৃষ্টি মিলে তাঁর কোন উপকারে আসতে পারে না, উপকার করতে পারে না, তেমনি গোটা সৃষ্টি মিলেও তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আদালা, ব্রুনাসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞাসার বদলে তাদের সারা মুখে এখন পরিতৃপ্তি। আদালা ব্রুনা দু’জনেই একসাথে উদ্ভাসিত কন্ঠে বলে উঠল, অনেক ধন্যবাদ স্যার, ‘একটা অতি কঠিন বিষয় সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। সত্যিই মনে হচ্ছে স্যার, স্রষ্টা, সৃষ্টি ও মানুষ নতুন অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘দেবার মত কিছু ধন্যবাদ আমাদের জন্যেও রাখ আদালা।’
বলে আহমদ মুসরা দিকে তাকিয়ে আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগার বলল, ‘গর্বে বুক ফুলে উঠেছে, মি. আহমদ মুসা এই ভেবে যে, আপনি মুসলমান, আমাদের পূর্বপুরুষও মুসলমান এবং এই বিশ্বাস মুসলমানদের।’
‘এ বিশ্বাস কি শুধু মুসলমানদের, আর কারও হতে পারে না?’ বলল ব্রুনা। তার কন্ঠে মিষ্টি প্রতিবাদের সুর।
‘না, ব্রুনা, এ বিশ্বাস সকল মানুষের জন্যে, শুধু মুসলমানদের জন্যে নয়। যে মানুষ এ বিশ্বাস ধারণ করে, তাকে মুসলমান বা আত্নসমর্পণকারী বলে। ‘মুসলিম’ মানুষের গুণবাচক পরিচয়জ্ঞাপক নাম মাত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ বিশ্বাস আমার, আমাদের পছন্দ হয়েছে, আমরা গ্রহণ করেছি, তাহলে কি আমার নাম মুসলমান হয়ে গেছে। আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।’ বলল ব্রুনা।
আহমদ মুসার মুখে গাম্ভীর্য নেমে এল। বলল, ‘বিশ্বাস মনে মনে পোষণ করাই যথেষ্ট নয়, বিশ্বাসের ঘোষণা দেওয়াও প্রয়োজন। এই ঘোষণার পর একজন মানুষের গুণবাচক পরিচয় ‘মুসলিম’ হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, বিশ্বাসের এই ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে যে গুণাবলিতে সে সমৃদ্ধ হয়, সে গুণাবলির প্রকাশও ঘটে কাজের মাধ্যমে। ফল, ফুলের মাধ্যমে যেমন গাছের পরিচয়, তেমনি কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে।’
‘বুঝেছি স্যার, প্র্যাকটিসিং মুসলিম না করে আপনি ছাড়বেন না।’ বলল ব্রুনা। হাসছে সে।
‘ব্রুনা, আমি নীতি ও বিধানের কথা বলেছি। এর মধ্যে মটিভ খুঁজে আমার উপর জুলুম করো না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি, ভাইয়া এমনি মজা করছিলাম। ব্রুনাদের মত মেয়েদের জন্যে যদি আহমদ মুসাকে মটিভের আশ্রয় নিতে হয়, তাহলে ব্রুনাদের জন্ম, জীবন ধন্য হতে পারে, তারা হতে পারে আকাশের চাঁদ।
‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, সেই সাথে সকলকে। সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আমরা সবাই অনেক উপকৃত হয়েছি। সত্যি বলতে কি, সারা জীবনে যা শুনিনি, যা বুঝিনি, খুব অল্প সময়ে তা শুনলাম, বুঝলাম। যা জীবনের এক মহাটার্নিং পয়েন্টের মূলধন হতে পারে।’
একটু থামল জোসেফ জ্যাকব আলগার। বলল মুহূর্ত পরেই, ‘এবার আমরা মূল কাজে ফিরে আসি। মি. আহমদ মুসা, প্লিজ আপনি শুরু করুন।’
‘ধন্যবাদ স্যার, আমাকে এই সুন্দর সুযোগ দেয়ার জন্যে।’
বলে খাতা খুলল আহমদ মুসা।
পড়া শুরু করল আবারঃ
‘সন্ধ্যার পর সম্রাট চতুর্থ অটোর পাঠানো রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমরা যাত্রা করলাম।
আমরা নিজেদের ঘোড়ার গাড়িতে চড়েই যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সম্রাট নাকি বলেছেন, সম্রাটের ছেলেকে যিনি চিকিৎসা করবেন তিনি রাজকীয় সম্মান নিয়েই আসবেন।
দুইঘোড়ার গাড়ি। ৪টি সিট।
পেছনের দুই সিট প্রহরীদের জন্যে। দু’জন প্রহরী আগে থেকেই বসা ছিল সেখানে। সামনের দুটি ভিআইপি সিট। আমি ও আমার মালিক ক্যাথারিনার বাবা বাকি দু’টি আসনে বসলাম।
গেটে দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল বাড়ির সবাই। ক্যাথারিনাও হাজির ছিল।সকালের পর এই প্রথম দেখলাম ক্যাথারিনাকে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। বেরুন বেকার তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। সে তার নানাকে টাটা দেখালো, পরে আমাকেও। আমিও বেরুন বেকারকে হাত নেড়ে টাটা দিলাম।
গাড়ি নড়ে উঠে চলতে শুরু করেছে। আমরা তখনও গেটে দাঁড়ানো সবার দিকে তাকিয়ে আছি। সবশেষে দেখলাম ক্যাথারিনার হাত উঠল আমার উদ্দেশ্যে। হাত নাড়ল আমাকে লক্ষ্য করে। আমিও জবাব দিলাম হাত নেড়ে। মনট আমার খুব প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হলো, ক্যাথারিনার এমন একটা সাড়া পাবার জন্যে আমার অবচেতন মনের একটা আকাঙ্খা যেন উন্মুখ হয়েছিল।
ঘোড়ার গাড়ি চলছিল বেশ দ্রুত। রাস্তাটাও সম্রাটেরই তৈরি।
ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক ও আমি দু’জনেই নীরব ছিলাম। আর কারও কথা বলার কথাও নয়। ঘোড়ার গাড়ি চলার শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই চারদিকে। নীরবতা ভেঙে ক্যাথারিনার বাবা এক সময় বলে উঠল, ‘সম্রাট খুব আস্থা ও আশা নিয়ে তোমাকে ডেকেছেন, তাই ভয় হচ্ছে আমরা তার আস্থা রাখতে পারবো কি না।’
আমি বললাম আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব, এটুকুই আমরা বলতে পারি।’
‘তা ঠিক। তোমার উপর আমার আস্থা আছে। তোমার আসল পরিচয় পেয়ে আমার আস্থা বহুগুণ বেড়েছে। আমার মনে হচ্ছে তুমি পারবে, এই আশাই আমি করব।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।
‘দোয়া করুন। মানুষ চেষ্টার মালিক। ফল আল্লাহ দেন।’ বললাম আমি।
‘হ্যাঁ আরগার। ঈশ্বরই সব কিছুর মালিক, সব কিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি আলগার। সম্রাটের সাথে দেখা হলে তো সম্মান দেখাতে হয়। তা খেয়াল রেখো।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমি বললাম, ‘এই সম্রাটকে সম্মান দেখানোর কি কোন বিশেষ নিয়ম আছে? আমি কিন্তু সেজদা করে বা মাথা নুইয়ে সম্মান দেখাতে পারি না।’
‘না, না আলগার। অন্য রাজা ও সম্রাটদের এই রীতি চালু আছে, কিন্তু স্যাক্সন সম্রাটরা, এমনকি স্যাক্সনরাও এটা করে না। তবে সম্রাটের শাসন ও শক্তির প্রতীক তার হাতের রাজদণ্ডকে চুমু খেতে হয়, এর বেশি কিছু নয়।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
‘রাজদণ্ড মানে অলংকারখচিত সিংহ বা হাতি কিংবা ক্রস-এর মত কোন কিছুর প্রতীকসংবলিত সুশোভন লাঠি, এই তো?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ঠিক বলেছ আলগার। তবে অলংকারখচিত সুশোভন লাঠি বা রাজদণ্ডটি হাতি বা সিংহমুখো নয়, কিংবা ‘ক্রস’ মাথাও নয়, বরং লাঠির মাথাটা মিনার আকৃতির। তবে মিরারের সূচালো মাথায় ক্রস নেই, আছে পাঁচ মাথ তারকা।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমি বিস্মিত হলাম। বললাম, ‘রাজদণ্ডের মাথায় বাঘ, সিংহ, হাতি না থাক, ক্রস থাকারই কথা, যেমন পোপের আছে। তার বদলে তারকা কেন?’
‘ও তুমি জান না। স্যাক্সনরা বিশেষ করে স্যাক্সন রাজারা খৃস্টান নয়। স্যাক্সনদের রাজা রোমানদের দখলে যাবার পর বাধ্য হয়ে অনেকেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে, অনেকেই আত্নপরিচয় গোপন করে ফেলে, আবার কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে। রোমান সম্রাট শার্লেম্যানের সময় খৃস্টানদের এই অত্যাচার ভয়াবহ আকারে শুরু হয় এবং চলতে থাকে। আমাদের সম্রাট চতুর্থ অটো রাজ্যহারা এক রাজকুমার। পরে নতুন এই স্যাক্সন ল্যান্ডে এসে তিনি রাজ্য স্থাপন করেন। আমরা নাইটরা খৃস্টান হয়েও তাঁকে সমর্থন করি। কারণ তিনি অত্যাচারী নন, স্বৈরাচারীও নন। সম্রাট হয়েও তিনি জনগণের একজন। দু’বছর পর পর তিনি নাগরিক সম্মেলন ডেকে তাদের কথা শোনেন এবং তার শাসনের ব্যাপারে তাদের রায় নেন। তার ছেলে যুবরাজ হয়েছে, তাও নাগরিক সম্মেলনের রায় অনুসারে। সম্রাট যুদ্ধের মত বড় কোন সিন্ধান্ত নিজে নেন না, নাগরিক সম্মেলন ডেকে নাগরিকদের রায় নিয়ে তা করেন।’
একটু হেসেছিলেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। সেই সুযোগে আমি বলে উঠলাম, ‘স্যাক্সন সম্রাটরা তো দেখছি গণতান্ত্রিক, রোমান সম্রাটদের মত অত্যাচারী ও অটোক্র্যাট নয়।’
‘এই ঐতিহ্য স্যাক্সন সম্রাটদের নয়, এই ঐতিহ্য স্যাক্সনদের। আদি স্যাক্সন সমাজ ছিল গণতান্ত্রিক সমাজ। খৃস্টান রোমানরা স্যাক্সন রাজ্য লণ্ডভণ্ড করার পরও সেই ঐতিহ্যের কিছু এখনও অবশিষ্ট আছে।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
‘ধন্যবাদ স্যাক্সন ও স্যাক্সন সম্রাটদের। আমাদের ইসলামী সমাজও গণতান্ত্রিক সমাজ।’
‘হ্যাঁ, আমরা এসে গেছি। ঐ তো সম্রাটের প্রাসাদের উঁচু গেট দেখা যাচ্ছে।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমরা এসে গেলাম সম্রাটের প্রাসাদে। প্রাসাদের গেটে ছোট একটা ঘোড়সওয়ার দল ছিল আমাদের স্বাগত জানাবার জন্যে। তারা আমাদের স্বাগত জানাল। আমরা গেটে পৌঁছার সাথে সাথেই একজন ঘোড়সওয়ার ছুটল প্রাসাদে সম্রাটকে খবর দেয়ার জন্যে। কিছুক্ষণ পরেই প্রাসাদের একজন অফিসার এলেন আমাদের নেবার জন্যে। তার সাথে রাজপ্রাসাদের ভেতরে চললাম। অফিসারটি জানাল, সম্রাট আজ দরবারের কাজ মুলতবি করেছেন এবং প্রাসাদের রাজকীয় চিকিৎসা ও সেবা বিভাগে যুবরাজকে নিয়ে অপেক্ষ করছেন।
আমাদের সরাসরি রাজপ্রাসাদের চিকিৎসা ও সেবা বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো।
সেখানে পৌঁছলে সম্রাট চতুর্থ অটো’র প্রধান স্টাফ অফিসার আমাদেরকে একটা বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে গেলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হবার পর আমাদেরকে ডিনারের টেবিলে নিয়ে যাওয়া হলো। ডিনারের টেবিলে খোদ সম্রাট এলেন। বিস্ময়ে হতবাক আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের জন্যে তার দিকে এগোচ্ছিলাম। সম্রাট হাত দিয়ে এগোতে নিষেধ করে আমাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, খাবার টেবিলে বসে উঠতে নেই। আসুন আমরা ডিনার সেরে নেই।
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সম্রাটের সাথে বসে ডিনার করলাম। মনে পড়ে গেল আমার দীন-দুনিয়ার বাদশাহ আমার রাসূলের (স.) কথা, সোনালি যুগের সোনার মানুষ খলিফা আবু বকর (রা.), খলিফা ওমর (রা.)-দের কথা। তাঁরা শাসক হয়েও মানুষের সেবক ছিলেন। তাঁদের স্থান ছিল মানুষের কাতারে, ক্লান্ত হলে শয্যা হতো খেজুর গাছের নিচে বালির উপর, নাগরিকরা যখন ঘুমিয়ে, তখন তাঁরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতো তাদের অবস্থা জানার জন্যে, চাকরের সাথে পালা করে উটের পিঠে চড়েছেন, আবার রশি ধরে উটকে টেনে নিয়েছেন, তাঁদের সিংহাসন ছিল খেজুরের চাটাই। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা কম্পন জাগাতো রোম সম্রাট, গ্রীক সম্রাট ও পারস্য সম্রাটদের হৃদয়ে। তাঁদের সে আদর্শেরই কিঞ্চিত একটা রূপ দেখলাম স্যাক্সন সম্রাট চতুর্থ অটো’র মধ্যে। আমার চোখের কোণ ভিজে উঠছে। আমি বললাম সম্রাটকে লক্ষ্য করে, ‘এক্সিলেন্সি, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, আপনার সাথে বসে খাওয়ার সৌভাগ্য হলো।’
সম্রাট চতুর্থ অটো’র চোখে-মুখে একটা সূক্ষ্ণ প্রসন্নতা ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর যে আপনি একে সৌভাগ্য বলছেন।
আসলে আমাদের স্যাক্সনদের জন্যে এটা স্বাভাবিক বিষয়। আমি সম্রাট, সেটা সামাজিক সিস্টেম হিসেবে। জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। স্বতন্ত্র কোন ইচ্ছা আমার নেই।’
‘ধন্যবাদ, এক্সিলেন্সি। এভাবে মানুষের মনের সম্রাট হওয়া যায়।
শাসক সম্রাটের চাইতে মনের সম্রাট অনেক বেশি শক্তিশালী। ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ আমি বললাম সম্রাটকে লক্ষ্য করে।
সম্রাট চোখ তুলে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘ডক্টর আপনি সাংঘাতিক কথা বলেছেন। সম্পূর্ণ নতুন পরিভাষা, সম্পূর্ণ নতুন প্রকাশ। আপনি কোথায় লেখাপড়া করেছেন?’
হঠাৎ আমার মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল, ‘স্পেনে লেখাপড়া করেছি।’
‘স্পেনে?’ বলে সম্রাট উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের বিস্ফোরণ। তার দুই চোখের স্থির দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ। আমার জন্যে আশার কথা যে, তার সে দৃষ্টিতে বিদ্বেষ, ঘৃণা বা হিংসার প্রকাশ নেই। আছে সবিস্ময় অনুসন্ধান।
সম্রাটের সাথে সাথে আমরাও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সম্রাট ধীরে ধীরে বসলেন। আমরাও বসলাম।
বসার সাথে সম্রাট তাঁর দুই চোখ বন্ধ করেছেন। আত্নস্থ হওয়ার প্রকাশ তার চোখে-মুখে। অনেক মুহূর্ত পার হলো।
সম্রাট চোখ খুললেন। বললেন, ‘ডক্টর, আপনার সাথে কি ওখানকার শাসকদের কারও কখনও দেখা হয়েছে? নিজ মুখে ওদের কথা-বার্তা শুনেছেন কখনও?’ বললেন সম্রাট।
‘হ্যাঁ, এক্সিলেন্সি। আমি তাঁদের দেখেছি, কথাও শুনেছি তাঁদের। বললাম আমি।
‘ওরা মানুষ কেমন? শুনেছি, শাসন নাকি ওদের আগের মত নেই!’ বললেন সম্রাট।
‘এক্সিলেন্সি ঠিকই শুনেছেন। ওরা মানুষ হিসেবে এখনও ভালো। তবে শাসক হলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যে দোষ-ক্রটি ঢোকে তা তারা মুক্ত থাকতে পারেনি। এ কারণেই তাদের শাসনও আগের মত নেই। বিভেদ-বিতর্ক ও হানাহানি তাদের নিজেদের মধ্যে বেড়েছে। সে কারণে তারা দুর্বলও হয়ে পড়েছে। দুর্বলতার কারণে তাদের রাজ্যও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।’ বললাম আমি।
সম্রাট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘আমরা এক সময় ওদের উপর অনেক নির্ভর করেছিলাম, অনেক আশা করেছিলাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা আশা করেছিলেন, তারা ও আমরা মিলে ইউরোপে একটা উদার ও মানবিক রাজ্যের প্রতিষ্টা করব। কিন্তু তা হয়নি।’
বিস্ময়ে আমার অবাক হয়ে যাবার পালা। সম্রাট এ কি বলছেন। স্পেনের মুসলিম সুলতানদের সাথে মিলে স্যাক্সন সম্রাটরা কিছু করতে চেয়েছিলেন? বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, দয়া করে কি বলবেন, স্পেনের মুসলিম সুলতানদের সাথে মিলে আপনাদের কিছু করার ব্যাপারটা কিভাবে ঘটেছিল, মাঝখানের বিশাল দূরত্ব ডিঙিয়ে?’
‘ডক্টর, প্রয়োজনের তাকিদে আমার পূর্বপুরুষ প্রথম অটো, তারপর দ্বিতীয় অটো এই বিশাল দূরত্ব ডিঙিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছি, আমাদের প্রয়োজনেই আমরা এটা করেছিলাম। আমাদের স্যাক্সনদের প্রথম সম্রাট অটো ‘দি গ্রেট স্পেনের মুসলিম সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। যোগাযোগ ছিল একটা ঘটনা উপলক্ষ্যে। স্পেনের সুলতানের সৈন্যরা আলপস-এর অনেকগুলো আলপাইন গিরিপথ দখল করে নিয়েছিল। তার ফলে সওদাগরী কাফেলার যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুলতানের সৈন্যরা আলপাইনের গিরিপথগুলো ছেড়ে দেয় অথবা সওদাগরী কাফেলাকে নিরাপদে যাতায়াত করতে দেয়, এই অনুরোধ নিয়েই স্যাক্সন সম্রাট প্রথম অটো ৯৫৩ খৃস্টাব্দে সুলতান আবদুর রহমানের রাজধানী কর্ডোভায় একটা প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদল এক মাস কর্ডোভায় ছিলেন। সুলতান তৃতীয় আব্দুর রহমান সম্রাট প্রথম অটো’র সম্মান রেখেছিলেন। একমাস পর প্রতিনিধিদলটি জার্মানীতে ফিরে এলে তাদের কাছে স্পেনের সুলতানদের কাহিনী শুনেছিলেন। এটা সম্রাট প্রথম অটোকে যারপরনাই আনন্দিত ও প্রভাবিত করেছিল। তিনি দেখেছিলেন মুসলমানদের সাথে স্যাক্সনদের অনেক মিল। স্যাক্সনদের মতই মুসলমানরা সরল জীবন যাপন করে। কোন আশরাফ-আতরাফের ব্যবধান তাদের মধ্যে নেই স্যাক্সদের মতই। সুলতান বা সম্রাটকে মুসলমানরা মনিব বা ঈশ্বরের মত করে ভাবে না, শাসককে সাথী বা ভাই মনে করে। স্যাক্সনদের রাজা-সম্রাটরাও তাই। স্যাক্সনদের মতই
মুসলমানরা কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতিকে দেবতা মানে না।মুসলমানদের প্রার্থনা গৃহের মিনারগুলো স্যাক্সনদের মিনারের মতই আকাশচুম্বী উঁচু। আরও শুনেছিলেন প্রতিনিধিদলের কাছে যে, রোমান ও গ্রীক সম্রাটরা মুসলমানদের ভয় করে। মুসলিম সুলতানদের এই শক্তির কথা শুনে সম্রাট অটোর হৃদয়ে একটা পুরানো কথা মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিল, সেটা হলো স্যাক্সনদের উপর রোমক খৃস্টানদের নৃশংস হামলা, আক্রমণ ও অবর্ণনীয় অত্যাচার। ৭৮২ সালে শার্লেম্যানের খৃস্টান বাহিনী একদিনে ৪ হাজার ৫শ’ স্যাক্সনকে পশুর মত হত্যা করেছিল। শার্লেম্যানের এই বাহিনীর কাছে স্যাক্সনদের মৃত্যুর বিকল্প ছিল খৃস্টধর্ম গ্রহণ করা। রাজনৈতিক সম্রাটের পরিবারও সেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সূত্রে এখন তারা খৃস্টান। কিন্তু এই বীভৎস অতীতকে স্যাক্সনরা ভোলেনি। শার্লেম্যানের বাহিনী তাদের হত্যা ও খৃস্টীয়করণই শুধু নয়, স্যাক্সনদের সমাজ, সংস্কৃতি সবই ধ্বংস করেছে। আইন করে মিনার তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। অতীতের এই দু:সহ বেদনা-তাড়িত স্মৃতি আমার পূর্বপুরুষ সম্রাট প্রথম অটোকে এক প্রতিকার চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, রোমানদের অত্যাচার-আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে স্পেনের সুলতানদের সাথে ঐক্য গড়া যায়। এই ঐক্য একটা বিরাট শক্তি হিসেবে দেখা দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের কাছে আরও একটা প্রতিনিধিদল পাঠালেন। একটা চিঠি পাঠালেন তিনি সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের উদ্দেশ্যে। এবারও মাসখানেক পর প্রতিনিধিদল ফিরে এল সুলতান আবদুর রহমানের একটা চিঠি নিয়। চিঠিতে সুলতান আবদুর রহমান সম্রাট প্রথম অটোকে যা লিখেছিলেন তার সারকথা হলো, ‘সম্রাটের বক্তব্য ও মতামতকে স্পেনের খিলাফত সাদরে গ্রহণ করেছে। আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর উত্তরসূরি এই খিলাফত জাতিগতসহ সকল অত্যাচার-অবিচারের বিরোধী। যে ঐক্য-সহযোগিতা মানুষের শান্তি, মর্যাদা ও সমৃদ্ধির স্বার্থে, আমরা তার পক্ষে। এ নীতির ভিত্তিতে সম্রাটের সাথে আমাদের ঐক্য ও সহযোগিতা হতে পারে। এই লক্ষ্যে সম্রাটের সাথে আমাদের আরও আলোচনা চলবে। ইতিমধ্যে আমরা একে-অপরের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখব।’ এই চিঠি পেয়ে সম্রাট খুব খুশি হয়েছিলেন।
আলোচনা শুরু হয়েছিল এবং অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু ৯৬১ সালে সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের মৃত্যু হলে আলোচনায় ছেদ পড়ে। অন্য দিকে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের উত্তরসূরি দ্বিতীয় হাকামের কাছে লেখা কনডোলেন্স ও আবার আলোচনা শুরু সংক্রান্ত প্রথম অটোর একটা চিঠি পথে সম্রাটের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে চুরি হয়ে যায় এবং তা পোপের হাতে পড়ে। তারপর তা পোপের হাত থেকে ক্রসেডারদের হাতে চলে যায়। সম্রাট অটো স্পেনের মুর সুলতানদের সাথে মিলে পোপ ও ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। হৈ চৈ শুরু করা হলো ইউরোপ জুড়ে। জার্মানীদের না্ইটদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। এই অবস্থায় সম্রাট অটো পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্যে চুপ হয়ে যান এবং স্পেনের সাথে যোগাযোগ আপাতত বন্ধ করে দেন। ক’বছর পর আবার যখন যোগাযোগ শুরু করতে যাবেন, তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে অসুখেই ৯৭৩ সালে তিনি মারা গেলেন। এভাবে সম্রাট প্রথম অটোর একটা স্বপ্ন একের পর এক ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ে গেল, যা আর সামনে আনা যায়নি।’
থামলেন সম্রাট চতুর্থ অটো। উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে বলল, ‘আমার উত্তরসূরিদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি, কিন্তু স্বপ্নটির কথা আমরা ভুলে যাইনি। আপনার ডাক্তারী শিক্ষা এবং বাড়ির ঠিকানা কর্ডোভায় শুনে সেই অতৃপ্ত স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেছে। যাক, আমি খুশি হয়েছি।’
‘এক্সিলেন্সি, আমি খুশি হয়েছি আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হওয়ায়। আমি আরও খুশি হয়েছি কর্ডোভা ও স্পেনের সুলতানদের সাথে আপনাদের পুরানো সম্পর্কের ইতিহাস শুনে। দুই পক্ষের এই স্বপ্ন সফল হলে আমার মনে হয় দুই পক্ষই উপকৃত হতো।’ আমি বললাম।
‘উপকৃত মানে? ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতে পারতো। অটো’দের সাম্রাজ্য তাহলে অত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হতো না এবং প্রায় দু’শ বছর অটো পরিবারকে রাজ্যহারা অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে হতো না।
অন্য দিকে স্পেনের সুলতানরাও খৃস্টান রাজাদের অনেক জ্বালাতন থেকে বাঁচতেন।’ বলল সম্রাট চতুর্থ অটো।
থামলেন সম্রাট। ঘুরে তাকালেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের দিকে। বললেন, ‘আসুন, যুবরাজ অপেক্ষা করছেন।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসুন ডক্টর।’
বলে চলতে লাগলেন তিনি। আমরা তার পিছু পিছু চললাম। বড় একটা সুসজ্জিত ঘর। দুগ্ধফেনা সদৃশ শয্যায় শুয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক। চোখ বুজে শুয়ে আছে সে।
তার মাথার পেছনে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে এ্যাটেনশন অবস্থায়। দরজায় ছিল দু’জন পরিচারিকা। সম্রাট ও আমাদেরকে দেখেই কুর্নিশ করে দু’পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল তারা।
সম্রাটের পেছনে আমরাও ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘সম্রাট যুবকটিকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, ‘ডক্টর এই আমার একমাত্র ছেলে, যুবরাজ পঞ্চম অটো।’
আমি এগিয়ে গেলাম বিছানার দিকে।
যুবরাজ উঠতে যাচ্ছিলেন। দু’জন নার্স ছুটে এসে যুবরাজকে ধরে বসিয়ে দিতে গেল।
আমি দ্রুত কন্ঠে বললাম ‘প্লিজ এক্সিলেন্সি, যুবরাজ। প্লিজ, আপনি উঠবেন না।’ বলে আমি ধরে তাকে আস্তে আস্তে করে শুইয়ে দিলাম।
.আমি উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাটের দিকে চেয়ে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, আমি কি যুবরাজকে দেখতে পারি?’
সম্রাট চতুর্থ অটো সুশোভিত একটা চেয়ারে গিয়ে বসেছেন। বললেন, ‘হ্যাঁ ডক্টর, প্লিজ শুরু করুন।’
ক্যাথারিনার বাবাও সম্রাটের পেছনে আরেকটা চেয়ারে গিয়ে বসেছেন সম্রাটের নির্দেশে।
আমি যুবরাজের পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম নরম স্নেহের সুরে, ‘এক্সিলেন্সি যুবরাজ, আমি একজন ডাক্তার। আপনার প্রতি অসীম শুভেচ্ছা নিয়ে আল্লাহর নামে আমি আমার কাজ শুরু করতে চাই। প্লিজ যুবরাজ আমাকে অনুমতি দিন, আপনার সহযোগিতা আমি চাই।’
যুবরাজ ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘আপনাকে ওয়েলকাম, যদিও চিকিৎসার প্রতি আমার আগের সেই আস্থা নেই। তবু সব সহযোগিতা আমি করব। আমার জন্যে কষ্ট করার জন্যে আপনাকে আগাম ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি প্রথমে দুই চোখ ভালো করে দেখবো। তারপর দরকার হলে কিছু জিজ্ঞাসা করব। তারপর সব অবস্থা দেখে সামনে এগোবো।’
পরীক্ষা শুরু করলাম আমি। আমি যুবরাজের দুই চোখের ভেতরের অবস্থা দেখলাম। আমি বিস্মিত হলাম দেখে যে, যুবরাজের দুই চোখের দুই আইবলসহ চোখের সব অবস্থা স্বাভাবিক। একটাই অস্বাভাবিকতা দেখলাম। সেটা হলো, দুই চোখেরই আইবলসহ ভেতরটা শুকনো এবং চোখের আইবলে কোন রিফ্লেকশন নেই। আমি নার্সকে একটা সুচ আনতে বললাম। নার্স দৌড়ে গিয়ে সুচ এনে আমাকে দিল। আমি সুচটা দেখে নার্সকে সেটা আগুনে জীবাণুমুক্ত করে দিতে বললাম। নার্স সুচটা পুড়িয়ে নিয়ে এল। আমি যুবরাজকে বললাম, প্লিজ যুবরাজ, চোখে যতবার আঘাত পাবেন, কথা বলবেন প্লিজ। চোখের আইলিডসহ চোখের ভেতরটায় প্রযোজনীয় অনুভুতিপ্রবণ অংশগুলোতে সুচের আগা দিয়ে আঘাত করে দেখলাম যুবরাজ প্রতিটাতেই রেসপন্স করছেন। আমি বিস্মিত হলাম চোখের স্নায়ুগুলো সব জীবিত আছে! তাহলে দুই চোখ শুষ্ক কেন? চোখের আইবলে রেসপন্স নেই কেন? তাহলে চোখের কালেকটিভ টিস্যু এবং দৃশ্য প্রবাহ মণিকে বহন ও বিতরণকারী গ্রন্থিগুলোতেই কি সমস্যা? কিন্তু পরীক্ষাটা একটু কঠিন ও কষ্টকর। আমি নার্সদের দিকে চাইলাম। বললাম এর চেয়েও সূক্ষ্ণ সুচ কি পাওয়া যাবে? নার্স বলল, স্যার, এ ধরনের সুচ নেই, তবে আকুপাংচারের সুচ আছে। আকুপাংচারের কতকগুলো সুচ অনেক লম্বা, খু্বই সূক্ষ্ণ।
আমি খুশি হয়ে বললাম , ‘ধন্যবাদ নার্স। ওগুলো আরও ভালো, বেশি কাজের। নিয়ে এস, দ্রুত।’ নার্স নিয়ে এল সুচ। সুচগুলোকে আগুনে সেঁকে জীবাণুমুক্ত করে নিয়ে এসেছে নার্স। আমি ধন্যবাদ দিয়ে সুচ হাতে নিলাম। যুবরাজের দুই চোখের উপরের দিকটায় মাপজোখ করে দুই চোখের তিনটি করে জায়গা ঠিক করলাম পরীক্ষার জন্যে। চোখের আইবলের গোড়ার দিক থেকে যে সূক্ষ্ণ সেলের অংশ মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত, সেগুলো চোখে প্রতিবিম্বিত হওয়া ইনফরমেশনকে
মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং মস্তিষ্ক সে ইনফরমেশনকে দৃশ্যে পরিণত করে চোখে পাঠায়। সুতরাং এই সেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে চোখ ও মস্তিষ্কের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় চোখ ও আইবল ভালো থাকলেও চোখ কিছুই দেখতে পায় না। আমি এই সেলগুলো পরীক্ষারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রস্তুত হয়ে আমি যুবরাজকে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, যুবরাজ, আপনি রোমে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং-এ শারীরিক ও মানসিক সহ্য-শক্তিরও পরীক্ষা নেয়া হয়। দেহে সুচ ফোটানোর কোন ট্রেনিং কি আপনার হয়েছে?’ যুবরাজ হাসলেন। বললেন, ‘ডক্টর নিশ্চয় কোথাও সুচ ফোটাতে চাচ্ছেন। যাই করুন ডক্টর আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ বললাম আমি। কাজ শুরুর আগে আবার আমি বললাম, ‘এক্সলেন্সি, এবার আপনার আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চাই। সুচ চামড়া ভেদ করার সময় ব্যথা লাগবে, অবশ্যই, কিন্তু তারপর সুচের আগা যে দিক দিয়ে এবং যেখানে গিয়ে থামছে সে স্থানগুলোতে ব্যথা লাগছে কি না সেটা আমি জানতে চাই। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
যুবরাজ বললেন, ‘ইয়েস ডক্টর, গড ব্লেস আস।’
প্রত্যেক চোখের আইবলের পেছনে নির্দিষ্ট স্থান বরাবর উপরে তিনটি ডট ঠিক করে নিলাম। প্রথমে দুই চোখের মাঝের দুই ডটে সুচ প্রবেশ করালাম। যুবরাজ বললেন, ‘চামড়ার অংশ ফুটো হবার সময় সামান্য কিছু অংশে ব্যথা বোধ করেছি, তারপর আর কোন ব্যথা লাগেনি।‘ আমি যুবরাজকে ধন্যবাদ দেবার পর ভেতরে ঢুকে যাওয়া সুচের দৈর্ঘ্য পরখ করে বুঝলাম চোখ ও মুস্তষ্কের সংযোগবিধানকারী সেলগুলোতে কোন অনুভূতি নেই। যুবরাজের অন্ধত্বের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। নিশ্চিত হবার পরও অবশিষ্ট চার পয়েন্টে আমি সুচ প্রবেশ করালাম। রেজাল্ট একই হলো। তবে একটা সুখবরও মিলল।সেটা হলো, ডান চোখের ডানের ডটে এবং বাম চোখের বামের ডটে সুচ ঢোকানোর সময় সুচের আগা সামান্য গেলেও যুবরাজ কিছু ব্যথা অনুভব করেছেন।এর অর্থ চোখ ও মস্তিষ্কের যোগাযোগ মাধ্যম সেল সবটাই সম্পূর্ণ মরে যায়নি। এটা আমার জন্যে বিরাট সুখবর। স্নায়ু ও সূক্ষ্ণ সেল শীতলকারী সেই সাথে এ্যান্টিসেপটিক একটা ভেষজ নির্যাস যুবরাজের চোখের উপরের অংশের আহত স্থানগুলোতে মালিশ করে দিয়ে আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, আমি শুনেছিলাম আপনি কিছুই দেখতে পান না, কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি সামান্য কিছু দেখতে পান। বিশেষ করে বাম চোখের বাম দিক এবং ডান চোখের ডান দিক দিয়ে কিছুটা দেখতে পান আপনি।’
‘হ্যাঁ ডক্টর, খুব সামান্য দেখতে পাই। কোন কিছুর ধোঁয়াটে একাংশ। কিন্তু ডক্টর আপনি এটা জানলেন কি করে? খুব উল্লেখযোগ্য নয় বলে কাউকে আমি জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।’ বলল যুবরাজ।
‘এক্সিলেন্সি যুবরাজ, আমি যে পরীক্ষা করলাম তাতে আমি এটা বুঝতে পেরেছি।’
বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমি সম্রাটের দিকে ফিরলাম। দেখলাম চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে ফিরতেই তিনি বললেন, ‘ডক্টর আপনি সুচ দিয়ে ফুঁড়েই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। কিভাবে?’
আমি বললাম, ‘এক্সেলেন্সি সম্রাট, এটা আমি পরে বলছি। তার আগে একটা কথা বলি, এক্সিলেন্সি যুবরাজের চোখের আঙ্গিকে কোন ক্ষত আমি দেখতে পাচ্ছি না। চোখের দৃশ্যমান সব অঙ্গই সেনসেটিভ। চোখ দু’টি শুকনো এবং আইবলে রিফ্লেকশান নেই এটাই শুধুমাত্র ব্যতিক্রম। এক্সিলেন্সি, আসল সমস্যা, চোখের পেছন থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত সংযোগকারী সেলগুলোতে। এই সেলগুলো রেসপন্স করছে না, সাড়া দিচ্ছে না। এক্সিলেন্সি, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, সাড়া না দেয়া এই সেলগুলোর মধ্যে বাঁ চোখের বাঁ দিকের এবং ডান চোখের ডান দিকের সেলের একটা অংশ সাড়া দিচ্ছে। সুচ দিয়ে যখন এ সেলগুলোতে আঘাত করা হয়েছে, তখন যুবরাজ কিছুটা ব্যথা অনুভব করেছেন।’
সম্রাট অটো দাঁড়িয়ে গেছেন। বললেন, ‘এর দ্বারা কি বুঝা যাচ্ছে ডক্টর? যুবরাজের চোখ ভালো হবে কি না?’
‘এক্সিলেন্সি আমি চোখের অবস্থা জানার চেষ্টা করছি। চোখের অসুবিধাটা কোথায়, কি কারণে চোখ কিছু দেখতে পায় না, সেটা আমার কাছে বোধ হয় পরিষ্কার। চোখ ও মস্তিষ্কের সংযোগকারী সূক্ষ্ণ সেলের কণিকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাই চোখে না দেখার কারণ।
একটা আশার কথা হলো যে, সেলগুলোর কিছুটা এখনও সক্রিয় রয়েছে।’ আমি বললাম।
‘ধন্যবাদ ডক্টর। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। যুবরাজের অনেক চিকিৎসা আমি করিয়েছি, কিন্তু কেউ চোখের এমন পরীক্ষা করেনি এবং চোখে কেন দেখতে পায় না তার কারণ কি তা কেউ বলেনি। আপনিই প্রথম একটা কারণের কথা বললেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর। আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আপনার কথা আমাকে আনন্দিত ও আশান্বিত করেছে।’ বলল সম্রাট অটো।
‘এক্সিলেন্সি যুবরাজকে আমার আরও কতকগুলো প্রশ্ন আছে। আমার খুব অবাক লাগছে চোখ ও মাথার সংযোগকারী মাঝের সেলগুলো এই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি করে?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ ডক্টর, কি জানতে চান আপনি জিজ্ঞাসা করুন। আমাদের উপস্থিতিতে তো সমস্যা নেই?’ বললেন সম্রাট চতুর্থ অটো।
‘না, না এক্সিলেন্সি, আপনাকেও দরকার। আমি যা জানতে চাই তা আপনি জানতে পারেন।’
বলে একটু থেমেই আবার বললাম, ‘এক্সিলেন্সি সম্রাট এবং যুবরাজ, আমার মনে হয় প্রচণ্ড একটা শক-এর কারণে চোখ ও মস্তিষ্কের মাঝের সেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুবরাজ চোখে এ ধরনের কোন শক পেয়েছিলেন কি না?’
যুবরাজই দ্রুত বললেন, ‘ডক্টর, চোখে কিসের শক, কি ধরনের শক?’
আমি বললাম, ‘তীব্র আলোর শকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।’
‘আলোর শক? এ ধরনের বড় কোন ঘটনা তো ঘটেনি। যুবরাজ দু’বছর রোমে ছিলেন। এ সময় কি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে যুবরাজ?’ বললেন সম্রাট চতুর্থ অটো।
যুবরাজ বললেন, ‘এমন কোন ঘটনার কথা তো মনে পড়ছে না।’
আমি বললাম, ‘যুবরাজ আপনি কি বিদ্যুৎ চমকের দিকে কখনও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন?’
‘না ডক্টর, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি।‘
‘কখন থেকে আপনি চোখের অসুবিধা অনুভব করে আসছেন যুবরাজ?’ বললাম আমি।
‘গত বছরের নভেম্বরের দিক মানে প্রায় এক বছর আগে থেকে চোখের অসুবিধা অনুভব করছি ডক্টর।’ বলল যুবরাজ।
‘গত বছরের নভেম্বর থেকে।’ কথা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল অক্টোবর মাসের সূর্যগ্রহণের ঘটনার কথা। আমি দ্রুত কন্ঠে বললাম, ‘যুবরাজ, গত বছর অক্টোবর মাসে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আপনি কি ঐ সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন?’
আমার প্রশ্ন শুনেই যুবরাজ উঠে বসলেন। বললেন, ‘ঠিক ডক্টর, আমি সূর্যগ্রহণ দেখেছিলাম। তখন চোখে সামান্য অসুবিধা হয়েছিল। পরে তা ঠিক হয়ে যায়।’
‘কি ঘটেছিল?’ বললাম আমি।
‘একটা মাটির বড় প্লেটে পানি নিয়ে সবার মত আমিও সূর্যগ্রহণ দেখছিলাম। দেখার পর আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার চোখ ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।’ বললেন যুবরাজ।
‘ঠিক হয়ে যায়নি যুবরাজ। প্রাথমিক আঘাতের পর যে ঝাপসা ভাবটা ছিল, তা অল্প সময়ে কেটে যায়। কিন্তু আলোর যে প্রচণ্ড আঘাত চোখের উপর পড়েছিল, সেটাই ক্ষতি করেছে চোখের পেছনের সেলগুলোর। সেলগুলোকে আপাতত প্রাণহীন করে ফেলেছে।’ আমি বললাম।
‘ডক্টর, আপনি বললেন, চোখের সামনের সেল মোটামুটি ভালো আছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চোখের পেছনের সেলগুলো। প্রচণ্ড আলোর কারণে ক্ষতি হয়ে থাকলে চোখের সামনের সেল ক্ষতি হলো না, পেছনের সেল হলো কেন?’ সম্রাট চতুর্থ অটো বললেন।
আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, চোখ অনেক অনেক প্রশস্ত। কিন্তু তার পেছনে মস্তিষ্কের সাথে সংযোগকারী সেল-এর চ্যানেলটা অনেক ন্যারো। যে পরিমাণ আলো যে তীব্রতা নিয়ে চোখের উপর এসে পড়েছিল, সেই আলো সেই তীব্রতা নিয়ে যখন চোখের পেছনের সেল-এর ন্যারো চ্যানেলে প্রবেশ করে, তখন স্বল্প পরিসরের চাপে আলোর আঘাতের প্রচণ্ডতা বহুগুণ তীব্রতর হয়ে উঠে। সেই আঘাতে টিস্যুগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।’
সম্রাট চতুর্থ অটো’র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ডক্টর, আমি যেমনটা ভাবছিলাম তার চেয়ে আপনি অনেক বড় ডাক্তার। আপনি যে পরীক্ষা করলেন, সে ধরনের পরীক্ষার কথা অন্য কোন ডাক্তার বোধ হয় চিন্তাই করতে পারেনি। আপনি রোগের যে কারণ ধরেছেন, সে কারণও কেউ ধরতে পারেনি। সত্যি আমি দারুণ বিস্মিত হয়েছি, আপনি এইমাত্র চোখের পেছনের সেল নিষ্ক্রিয় হওয়ার যে কারণ বললেন, তা শুধু বড় ডাক্তার হওয়া নয়, শারীরিকবিজ্ঞান সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক। ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে আপনার দেখা এভাবে আমরা পেয়েছি। এখন বলুন ডক্টর, রোগের কারণ তো জেনেছেন, এখন চিকিৎসা সম্পর্কে বলুন। যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমার একমাত্র ছেলে যুবরাজ তার চোখের আলো ফিরে পাক।’
সম্রাটের শেষের কথা ভারি হয়ে উঠেছিল।
‘মানুষের কাজ মাত্র চেষ্টা করা ফল দেন স্রষ্টা। ডাক্তাররা সবসময় আশাবাদী হয়। আমিও আশাবাদী সম্রাট। আজ যুবরাজকে আমার দেখা হয়ে গেছে। কাল আমি চিকিৎসা শুরু করব।’ আমি বললাম।
পরদিন চিকিৎসা আমি শুরু করলাম। রাতভর আমি ভেবেছি। চোখের পেছনের সেলগুলোকে যদি তাজা না করা যায়, তাহলে যুবরাজের চোখ ভালো হবে না। আর মনে মনে ভাবলাম মরে যাওয়া সেল ভালো করার ট্রেডিশনাল কোন ওষুধ বর্তমান ওষুধ বিজ্ঞানে নেই। ভরসা যে কিছু সেল এখনও জীবন্ত আছে। সেলগুলোতে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী স্টিমুলেটিং কিছু ওষুধ প্রয়োগ করলে জীবন্ত সেল থেকে একটা চাঞ্চল্য মৃত টিস্যুগুলোর উপর ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার সাথে সেলগুলোকে ভিজিয়ে রাখার ব্যবস্থা ভালো ফল দিতে পারে। এজন্যে যুবরাজের মাথায় সর্দি সৃষ্টি করতে হবে যাতে নাকের সাথে চোখ দিয়েও প্রচুর পানি গড়ায়। এই চিন্তা মাথায় আসায় আমি খুব খুশি হলাম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
সকালেই আমি প্রথমেই সম্রাটের বাগান ঘুরে প্রয়োজনীয় ওষুধের গাছ ও সম্রাটের ভাণ্ডার থেকে কিছু অনুপান যোগাড় করলাম। দুই ধরনের ওষুধ তৈরি করলাম। এক, খাবার ওষুধ ও চোখে ফোঁটা আকারে প্রয়োগের জন্যে টিস্যুর উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী স্টিমুলেটিং ওষুধ এবং দুই, মাথায় সর্দি সৃষ্টির জন্যে কপালে লাগানোর জন্যে প্রলেপ। ক্যাথারিনার বাবা সব সময় আমার সাথে থেকে আমাকে সাহায্য করলেন। সেই সাথে সম্রাটের লোক ও চিকিৎসকরাও চাহিদা মোতাবেক সব কিছু সরবরাহ করলেন।
সেদিন বেলা দশটায় সম্রাটের উপস্থিতিতে যুবরাজের চিকিসা শুরু হলো। আল্লাহর কাছে যুবরাজের শেফা প্রার্থনা করে যুবরাজকে ওষুধ খাওয়ালাম এবং চোখেও কয়েক ফোঁটা ওষুধ ফেললাম। পরদিন দুপুরের পর ভাটি বেলা শুরু হলে যুবরাজের কপালে প্রলেপ লাগালাম। এর পরদিন দুপুর থেকেই যুবরাজের ভীষণ সর্দি এল। নাক ও চোখ দিয়ে প্রচুর পানি পড়তে লাগল। সেই সাথে শুরু হলো হাঁচি। ওষুধ খাইয়ে চললাম নিয়ম মত। সর্দিতে বাধা দিলাম না।
উত্তেজনার মধ্যে কাটল সাত দিন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা হারাইনি। সাত দিন পর সর্দি কমতে শুরু করল। হাঁচি থাকল না। নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অপার আনন্দের মধ্যে দেখলাম চোখ দু’টি আর আগের মত শুকনো নয়। চোখে সজীব-সজলতা ফিরে এসেছে। চোখের পেছনের সেই টিস্যুগুলো জীবন্ত হওয়ার লক্ষণ নিশ্চয় এটা। আমি সম্রাটকে বললাম, এক্সিলেন্সি, আগামী তিন দিন কালো কাপড় দিয়ে যুবরাজের চোখ ঢেকে রাখতে হবে এবং পরবর্তী সাত দিনে সরাসরি আলো প্রবেশ করে না এমন একটা আলো-আঁধারী ঘরে যুবরাজকে রাখতে হবে।
এই ব্যবস্থা করা হলো। দশ দিনের তিন দিন যাবার পর কালো কাপড় চোখ থেকে সরাবার সময় দেখা গেল আলো-আঁধারী ঘরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছে, তবে ঝাপসা। সম্রাট আনন্দে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তুমি অসম্ভব একটা বাঁধনে আমাকে বেঁধে ফেললে। তুমি…।’
আমি সম্রাটকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, যুবরাজের সামনে এসব কথা আর নয়। তাকে একেবারে শান্ত হতে হবে।’ এরপর যুবরাজের কাছে গিয়ে বললাম, ‘যুবরাজ আনন্দের কিংবা দু:খের কোন চিন্তাই মনে আনবেন না। মনকে আত্নস্থ করে শুধু ঈশ্বরের কথা ভাবুন।’
‘স্যরি ডক্টর। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আপনি ঠিকই বলেছেন। যুবরাজের স্নায়ুতে কোন প্রকার প্রেসার আনা যাবে না। আমি এবং ওর মা-সহ আমরা বরং কেউ এখানে আর না আসি। মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক কোন খবর আপনার তরফ থেকে থাকলে আমাদের জানাবেন।’ বলল সম্রাট চতুর্থ অটো।
‘হ্যাঁ, সেটাই ভালো সম্রাট। আমি ঠিক ১১তম দিনে যুবরাজকে আধো অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাব। ঐ দিন আপনারা সকলে আসুন।’ বললাম আমি।
এগারতম দিনে সম্রাট এলেন, সম্রাজ্ঞীও এলেন। রাজপরিবারের সবাই এলেন। আগে থেকেই আমি ও ক্যাথারিনার বাবা ছিলাম। আগের দিন আমরা যুবরাজকে ট্রায়াল দিয়েছিলাম তার চোখের ইনডিউর‌্যা্ন্স লেভেল দেখার জন্যে। ঘরের সব জানালা-দরজা খুলে দেয়া হয়েছিল। আলোতে ঘর ভরে গিয়েছিল। যুবরাজের চোখ সবকিছুই ভালোভাবে দেখেছিল। চোখে তার অসুবিধা হয়নি। যুবরাজকে শোয়া থেকে বসাচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ‘স্যার, আমাকে এক্সিলেন্সি বলবেন না। আপনি আমার কাছে ঈশ্বরের মত। আমার নতুন জন্ম হয়েছে আপনার হাতে।’
আমি যুবরাজকে সান্ত্বনা দিয়ে তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, যুবরাজ, এসব কথা এখন নয়। আপনাকে আবেগ থেকে মুক্ত ও সম্পূর্ণ শান্ত থাকতে হবে। আমি সামান্য ডাক্তার মাত্র। আমি চেষ্টা করেছি, স্রষ্টা ফল দিয়েছেন, সব সময় তাঁর কথা স্মরণ করুন এবং তাকে ধন্যবাদ দিন।’
এগারতম দিন সকাল ১০টা। সম্রাট, সম্রাজ্ঞীসহ পরিবারের সকল সদস্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল উদগ্রীবভাবে।
আমি যুবরাজকে নিয়ে ঘর থেকে বেরুলাম। আমার পাশে ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।
ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘরের বাইরে বিশাল একটা লাউঞ্জ, কার্পেটে মোড়া, সোফায় সাজানো। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীসহ সকলে লাউঞ্জের মাঝখানে ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমরা দরজায় এসে যুবরাজকে বললাম, আপনি গিয়ে পিতা-মাতা ও সবার সাথে মিলুন। যুবরাজ ওদিকে ওগোলেন।
সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর যুবরাজ একে-একে পরিবারের সবার সাথে মিশলেন।
এরপর সকলে মিলে হাঁটু গেড়ে বসে হাত উপরে তুলে প্রার্থনা করতে লাগল। আনন্দে স্রষ্টার অসীম শ্রদ্ধায় সবাই শিশুর মত কাঁদল।
প্রার্থনা শেষে সম্রাট আমাদের ডাকলেন। আমি ও ক্যাথারিনার বাবা সেখানে গেলাম। সম্রাট আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আবেগে কেঁদে ফেলে বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার এ সন্তানের জন্যেই। তা না হলে আমাদের স্বপ্নের দেশ কর্ডোভার ডাক্তার আমাদের ঘরে আসবেন কি করে! ডক্টর আপনাকে ধন্যবাদ দেবার কোন ভাষা আমার জানা নেই। বিস্ময়কর আপনার রোগের কারণ অনুসন্ধান, আরও বিস্ময়কর আপনার চিকিৎসা!’ বলে সম্রাট আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাততালি দিলেন।
সুশোভিত এক বড় ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল একজন খাস পরিচারিকা এসে বাউ করে সম্রাটের পেছনে দাঁড়াল। সম্রাটের পিএস এসে ট্রের উপরের কাপড় তুলে নিল। ট্রে’তে সোনার উপর হীরকখচিত একটা মুকুট। তার পাশে সম্রাটের ফরমান দণ্ডে লাল কাপড়ে জড়ানো কিছু।
সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা গিয়ে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।
সম্রাট ট্রে থেকে প্রথমে ফরমান আকারের বান্ডেলটা খুললেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে ঘোষণা দিচ্ছি এখানে, তা আমি দরবারেও দিতে পারতাম। কিন্তু বিষয়টা আমার পারিবারিক। তাই পারিবারিকভাবেই ঘোষণা দেবার সিন্ধান্ত নিয়েছি।’
একটু থামলেন সম্রাট। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তিনি দয়া করে আমার যুবরাজকে নতুন চক্ষু দান করেছেন। আমি ঈশ্বরকে আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি এই কারণে যে, যার উপলক্ষে আমি আমার সন্তানের চোখ ফিরে পেলাম, সেই মহান ডক্টর কর্ডোভার মানুষ। কর্ডোভার সুলতানরা ছিলেন আমাদের স্যাক্সন রাজবংশের ঐতিহাসিক মিত্র, যদিও সে সময়ের অবস্থা ও ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা দুই মিত্র মিলে বড় কিছু করতে পারিনি। কর্ডোভার এই মহান ডাক্তার যে ঋণে আমাকে এবং স্যাক্সন রাজবংশকে আবদ্ধ করেছেন তা শোধ করার সাধ্য আমার নেই। তবে তাঁর এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কিছু একটা করার সিন্ধান্ত আমি নিয়েছি।’
বলে তিনি হাতের ফরমান মোড়কটা খুললেন। পড়লেন ফরমানটা। সম্রাটের সে ফরমানের সারাংশ হলো, ‘সালজওয়াডেল অঞ্চলে আমার বিশেষ অমাত্য ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের জমিদারির পাশে ৪১ মৌজার মনোরম ভূখণ্ডটি আমি ডাক্তারকে লাখেরাজ হিসেবে দান করলাম। বংশ পরম্পরায় তিনি স্থায়ীভাবে তা ভোগ-দখল করবেন। দু’একদিনের মধ্যে আমি সেখানে নিজে গিয়ে তাকে দখল বুঝিয়ে দেব।’
বলে তিনি এগিয়ে এসে আমার হাতে ফরমানটি গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ ডক্টর গ্রহণ করুন। আমি ও আমার পরিবার খুশি হবো।’
এরপর সম্রাট ট্রে থেকে মুকুটটি তুলে নিলেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি মুকুটটি তৈরি করেছিলাম যুবরাজের জন্যে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা অনেক মাপজোখ করে তৈরি করা সত্ত্বেও মুকুটটি বড় হয়েছে যুবরাজের মাথায়। হয়তো ঈশ্বর সম্মানিত ডক্টরের মাথার জন্যেই এটা তৈরি করিয়েছিলেন। আমি যুবরাজের রোগমুক্তির মহাস্মৃতি হিসেবে মুকটটি ডাক্তারের মাথায় পরিয়ে দিতে চাই।’
সম্রাট এটা বলে-আমি সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুকুটটি আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে আমার দু’টি হাত ধরে বললেন, ‘ডক্টর আপনাকে সম্মানিত করার জন্যে এ মুকুট নয়, আমরা সম্মানিত বোধ করব যদি দয়া করে এটা নেন। এ মুকুট যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষের ভয়াবহ এক অন্ধত্ব ও বিস্ময়কর এক নিরাময়ের কথা মানুষ স্মরণ করবে। কর্ডোভার মহান জাতি এবং জার্মানীর স্যাক্সনদের সম্পর্কেরও ঐতিহ্যবাহী এক স্মারক হবে এটা।’
এভাবেই আমি একটা জমিদারি ও স্যাক্সন সম্রাটের অকল্পনীয় মূল্যের একটা মুকুটের মালিক হয়ে গেলাম।
যুবরাজের জন্যে সাত দিনের ওষুধের ব্যবস্থা করে সাত দিন পর আবার আসব বলে আমি ক্যাথারিনার বাবার সাথে সালজওয়াডেলে চলে এলাম সম্রাটের দেয়া ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে।
আমি ও ক্যাথারিনার বাবা পাশাপাশি বসেছিলাম। বিভিন্ন কথার ফাঁকে এক সময় বললেন, ‘তোমার অনুমতি ছাড়াই একটা আয়োজন করে ফেলেছি। তুমি কিছু মনে করবে না তো?’
‘কি আয়োজন জনাব?’ আমি বললাম।
‘সেদিন বিয়ের কথা হয়েছিল। আগামী কাল তারই আয়োজন করা হয়েছে। তুমি চিকিৎসার চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলে তাই তোমাকে কিছু বলিনি।’
বিয়ে হবে এবং খুব শীঘ্রই হবে, সেটা সেদিনের আলোচনায় আমি বুঝেছিলাম। সুতরাং বিষয়টা আমার কাছে বিস্ময়ের ছিল না। তবু আমি বললাম, ‘ক্যাথারিনার সুস্পষ্ট মত নেয়া দরকার ছিল, সেটা হয়েছে কি না?’
‘আমি ক্যাথারিনাকে জানি বেটা। আমার শ্যালক অসওয়ার্ল্ড তার ভাগ্নিকে না জানিয়ে এ প্রস্তাব পেশ করেনি। তুমি ভেবো না। ক্যাথারিনার মা তার সাথে আলোচনা করেই দিন ঠিক করেছে।’
আমি আর কোন কথা বললাম না। একটা অস্বস্তির ভাব আমার মনকে আচ্ছন্ন করে তুলল। প্রেমময়ী স্ত্রীর স্মৃতি ডিঙিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্যেই কি এই অস্বস্তি? না, মন তা বলছে না। নতুন স্ত্রী যে নেই তার স্মৃতির প্রতিদ্বন্ধী হতে পারে না।
আমার চিন্তায় ছেদ টেনে ক্যাথারিনার বাবা বলে উঠলেন, ‘একটা সমস্যা হয়েছে আলগার। ক্যাথারিনা বলেছে, ‘বিয়ে ইসলাম ধর্মের বিধান মতে হবে। কিন্তু…।’
তাঁর কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, ক্যাথারিনা বলেছেন একথা?’
‘হ্যাঁ আলগার, তার মায়ের কাছে শুনেছি সে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক চলার চেষ্টা করছে।’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
বিস্ময়ের ব্যাপার এই কথা শোনার সাথে সাথেই আমার মনের অস্বস্তি কোথায় যেন চলে গেল। মনটা আমার স্বচ্ছ হাসিতে হেসে উঠল।
ক্যাথারিনার বাবা একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু সমস্যা হয়েছে বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের বিধান তো আমরা কেউ জানি না। শেষে এটাই আলোচনা হয়েছে। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই বিয়ে হবে। আচ্ছা বলত, ইসলাম ধর্মের বিয়েতে আনুষ্ঠানিক জটিলতা কিছু আছে?
‘জটিলতার কিছু নেই। তবে বর ও কনেকে তাদের স্বীকৃতি জিজ্ঞাসা করার জন্যে বিয়ের পরিচালক একজন লোকের দরকার হয়। বর-কনের স্বীকৃতি জানার জন্যে উভয় পক্ষের তিনজন করে মোট ছয়জন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হয়। প্রথমে কনের স্বীকৃতি আসার পর তা সবার সামনে ঘোষণা করে তারপরে সবার সামনে বরের স্বীকৃতি নেয় হয়। এরপর বিয়ের পরিচালক ব্যক্তি বর-কনের শুভ কামনা করে সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান এতটুকুই।’ আমি বললাম।
‘দুই পক্ষের সাক্ষীর তো অভাব হবে না, কিন্তু পরিচালক ব্যক্তিটি কে হবেন, কে স্বীকৃতি নেবেন, কে দোয়া করবেন। এটা সমস্যা হবে না?’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
‘এ সমস্যাগুলো মৌলিক নয়। বর-কনের স্বীকৃতি নেয়ার কাজ আপনিও করতে পারবেন। স্বীকৃতি নেয়ার কথাগুলোও খুব সাধারণ। আমি বলে দেব। দোয়া নিজেরা করলেও চলে, আর সকলের শুভেচ্ছা কামনাটাই তো দোয়া।’ আমি বললাম।
‘তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। ধন্যবাদ আলগার। আমি চিন্তায় পড়েছিলাম এসব নিয়ে।’
আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম। পরদিন বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের দিন সকালে ক্যাথারিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অজু করার নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছিলাম আমি আগেই। মাথায় রুমাল বেঁধে ও হাতাওয়ালা পবিত্র পোশাক পরে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল ক্যাথারিনা। হঠাৎ কি হয়ে গেল। পরিবারের কর্তা ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক ঘোষণা দিলেন তিনিও ইসলাম গ্রহণ করবেন। তারপর পরিবারের সবাই ঘোষণা দিল তারাও সবাই ইসলাম গ্রহণ করবে। আমার সামনে ঘোষণা দিয়ে সবাই ইসলাম গ্রহণ করল ক্যাথারিনার মতই। সবাই ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘ইহুদি, খৃস্টানসহ অতীতের সব একত্ববাদী ধর্মকে ইসলাম স্বীকার করে, অতীতের সব নবী-রাসূলকে ইসলাম সম্মান করে। অতীতের এই ধর্মগুলোকে যারা পালন করে চলতে চায়, তাদের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। তবে ইসলাম নীতিগত ও স্বাভাবিক কারণেই মনে করে, অতীতের ধর্মগুলোর কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। সর্বকনিষ্ঠ ও সামনের সর্বযুগের জন্যে পরিকল্পিত ধর্ম হিসেবে ইসলাম মানুষের আধ্যাত্নিক ও ব্যবহারিক দুই জীবনের জন্যেই অপরিহার্য একটা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ইসলাম আল্লাহর কোন কল্যাণ করে না, এই ব্যবস্থা ইসলাম গ্রহণকারী ও সব মানুষের কল্যাণের জন্যেই। এই কল্যাণ মানুষের ইহকাল ও পরকাল দুই কালের জন্যেই। এই মূল বিষয়টা বুঝে নিলে ইসলাম ও মানুষ, ইহজীবন ও পরজীবন সবকিছুকেই ভালোবাসা যাবে, জীবন সুন্দর হবে, সহজ হবে।’
আমার কথা শেষ হলে ক্যাথারিনার বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নানা কারণে আমাদের ইসলাম গ্রহণের এই কথা এখন গোপন রাখতে হবে। সবাই যেন আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকি।’
বিয়ের পর যখন আমার ঘরে এসে বসলাম, তখন মাথাটা নুয়ে এল আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায়। স্বাধীন মানুষ ছিলাম, খ্যাতিমান ডাক্তার ছিলাম। সেখান থেকে পেশা, পরিবার, দেশ সব হারিয়ে হলাম ক্রীতদাস। আবার ক্রীতদাস থেকে হলাম এক জমিদার এবং একজন জমিদার কন্যার স্বামী। মহান আল্লাহর বাণী, ‘ফাইন্নামা’আল উসরে ইউসরা, ইন্নামা’আল উসরে ইউসরা’ অর্থাৎ ‘দু:খের পর সুখ আসে’।
বিয়ের পর স্ত্রী ক্যাথারিনার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় নানা কথার ফাঁকে তাকে বললাম, ‘ক্রীতদাসের সাথে বিয়ের পর মালিক-কন্যার প্রতিক্রিয়া কি?’
ক্যাথারিনা বলল, ‘যে ক্রীতদাস তার মালিকদের দাস বানিয়ে ফেলেছে, তার সাথে বিয়ে তো সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
‘মালিকদের কিভাবে সে দাস বানাল?’ আমি বললাম।
‘আল্লাহ বলেছেন, যে মুমিন হয়, আল্লাহ তার জান, মাল সব কিনে নেন। আপনি সবাইকে মুমিন বানিয়ে তাদেরকে আল্লাহর ক্রীতদাস করে ফেলেছেন।’ বলল ক্যাথারিনা।
আমি হাসলাম। বললাম, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কথার অর্থ ঠিক এতটুকু নয়। যাক তুমি ভালো বলেছ।’
ক্যাথারিনা বলল, ‘আমার কথা শেষ নয়। আমার উত্তরের মাত্র একাংশ বলেছি।’
‘আচ্ছা। বল বাকি অংশ কি?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘ক্রীতদাসকে আমি বিয়ে করিনি। ক্রীতদাসের সাথে আমার বিয়ে হয়নি। একজন স্বাধীন মানুষ এবং একজন জমিদারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।’ বলল ক্যাথারিনা।
সেদিন আমার স্ত্রী ক্যাথারিনার কাছ থেকে শোনা কথা দিয়েই আমার এই ছোট্ট আত্নকথা শেষ করব। আমি দাস হিসেবে বিয়ে করিনি, দাস হিসেবে আমার পরিবার-জীবনের যাত্রা শুরু হয়নি, হয়েছে স্বাধীন মানুষের স্বাধীন পরিবার হিসেবে। এই কথাগুলো এভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না। বলতে হলো এই কারণে যে, অন্ধকার ইউরোপের অন্ধ-কূপমণ্ডুকতা কাটতে আরও অনেক শতাব্দীর প্রয়োজন হবে। সেই অন্ধকারে আমার পরিবারও নিজেদের হারিয়ে ফেলতে পারে। তারাও কূপমণ্ডুকতার শিকার হয়ে হীনমন্ন্যতায় ভুগতে পারে। এমন সব দিনের কথা ভেবেই আমি আমার জীবনের কথা লিখে গেলাম যাতে তাদের আবার আলোকিত হয়ে ওঠার পথ তৈরি হয়, নিজের পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার তারা সুযোগ পায়।’
পড়া শেষ করলো আহমদ মুসা।
খাতার উপর থেকে মুখ তুলল সে। তাকাল চারদিকে। দেখল, সবার মুখ নিচু। চোখ বন্ধ আদালার বাবা জোসেফ জ্যাকব আলগারের। সবাই আত্নস্থ।
ধীরে ধীরে চোখ খুলে গেল আদালার বাবা আলগারের। সে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি এই মুহূর্তে ঘোষণা দিতে চাই-।’
উপস্থিত সবাই তাকাল আদালার বাবার দিকে। তাদের চোখে-মুখে ঔৎসুক্য।
আদালার বাবা বললেন, ‘ঈশ্বরের অসীম দয়া যে, আমরা আমাদের রুটের সন্ধান পেলাম, পূর্বপুরুষকে জানলাম। আমরা জানলাম আমরা দাসবংশের লোক নই। হলেও ক্ষতি ছিল না। সোনালি সভ্যতার স্বর্ণযুগের মানুষ, সেরা ডাক্তার ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুরের বংশধর হয়ে দাসবংশ নাম নিতেও আমার আপত্তি নেই। সবাইকে আমি জানাচ্ছি, আমার মহান পূর্বপুরুষ যে আলোকিত পথের দিকে তাঁর পথহারা বংশধরদের আহবান জানিয়ে তার কাহিনী শেষ করেছেন, তাঁর সে আহবানে সাড়া দিয়ে আমি ঘোষণা করছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের ধর্মে এই মুহূর্তে ফিরে যেতে চাই এবং ঘোষণা দিচ্ছি আজ থেকে আমার নাম জোসেফ জ্যাকব আলগার নয়, আমার নাম ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর।’
বলে আদালার বাবা ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ আহমদ মুসা আমাকে আপনি ইসলাম ধর্মের দীক্ষা দিন। কোন ফর্মালিটি থাকলে প্লিজ আমাকে বলুন। আমি তা করছি।’
‘ইসলাম গ্রহণে তেমন কোন ফর্মালিটি নেই। বিষয়টা একটা বিশ্বাস ও স্বীকৃতির ঘোষণা। শুধু বিশ্বাসের সাথে এই ঘোষণা দিলেই হলো।’
‘ঘোষণাটা কি?’ বলল আদালার বাবা ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর।
‘বিশ্বাসের সাথে এই ঘোষণা দেয়া যে, ‘আল্লাহ ছাড়া উপাস্য কেউ নেই, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর বার্তাবাহক।’ এই ঘোষণা এভাবেও দেয়া যায়, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া উপাস্য কেউ নেই, আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক (রাসূল) ।’
আদালার বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই আদালা বলে উঠল, ‘বাবা শুধু আপনার কথা বললেন কেন? আমাদেরও সাথে রাখুন। আমাদের মহান পূর্বপুরুষের ডাক আমাদের কাছেও পৌঁছেছে। আমরাও সেই আলোকিত মানুষ হতে চাই।’
‘ঠিক বলেছ আদালা। রক্তের সম্পর্কে আমার পূর্বপুরুষ তারা নন বটে, কিন্তু আমার স্বামী ও সন্তানের তারা পূর্বপুরুষ। তাই তাঁরাও আমার পূর্বপুরুষ। যেভাবে ক্যাথারিনার বাবা, ক্যাথারিনারা আমাদের ডক্টর পূর্বপুরুষের ধর্মকে ভালোবেসে ফেলেছিল, সেভাবে আমিও ভালোবেসে ফেলেছি। বিশ্বাসের ঘোষণা দিতে আমি প্রস্তুত।
আদালা, আদালার বাবা এবং আদালার মা একসংগেই বিশ্বাসের ঘোষণা দিয়ে নিজেদের ধর্মে ফিরে এল।
ব্রুনা ও তার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডের চোখে-মুখে বিমুগ্ধ ভাব। বলল আলদুনি সেনফ্রিড, আদালার পূর্বপুরুষের যে কাহিনী শুনলাম তা রূপকথার মত সুন্দর, কিন্তু ইতিহাসের মত বাস্তব। আহমদ মুসাকে দেখার পর ডক্টর ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুরকে বিস্ময়কর মনে হয়নি, কিন্তু তার কাহিনী ইসলাম সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও পূর্ণ ও মজবুত করেছে। ধন্যবাদ আপনাদের, যারা বিশ্বাসের ঘোষণা দিলেন।’
‘আমিও ধন্যবাদ দিচ্ছি আপনাদের। আমরা আপনাদের সাথে শামিল আছি। আমরা একটা সংকটে রয়েছি। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মহাবিপদে আছেন। তার সাথে আমাদের পরিবারের গোটা অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আজ আপনাদের পরিবারে মিলনমেলার মত আনন্দের দিন, আমরাও তেমন দিনের অপেক্ষা করছি। সেদিন আমরা সকলে মিলে এই ঘোষণা দেব ইনশাআল্লাহ। মহাআনন্দের বিষয় হলো, আহমদ মুসা আজ আপনাদের জন্যে আনন্দের দুয়ার উন্মুক্ত করলেন। আমাদের আশা তিনি আমাদের জন্যেও এমন সুদিন ডেকে আনবেন।’ বলল ব্রুনা।
‘মাফ করবেন, আপনারা আমাদের অসীম উপকার করেছেন। প্লিজ আমরা কি জানতে পারি, এতবড় বিপদের ঘটনাটা কি?’ বলল আদালার বাবা ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর।
আলদুনি সেনফ্রিড তাকালো আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল এখন করনীয় কি, কি বলা যায় এটাই জানতে চাচ্ছে ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড।
দায়্ত্বিটা আহমদ মুসাই গ্রহণ করল। বলল, ‘অনেক বড়, অনেক জটিল ঘটনা মি. আল মানসুর।’
বলে আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনা তাদেরকে জানাল। এ কথাও বলল যে, তারা ব্রুনার মা কারিনা কারলিনের সন্ধানে ব্ল্যাক লাইট , ব্ল্যাক বার্ডের আস্তানার খোঁজেই অ্যারেন্ডসীতে যাচ্ছে। কাহিনী শুনে আদালা, আদালার মা ও আদালার বাবা সবার চোখে-মুখে মুষড়ে পড়া ও বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। আদালার মা বলল, ‘এতবড় সংকট মাথায় নিয়ে আপনারা এতটা শান্তভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আল্লাহ এর উত্তম বিনিময় দিন।’
আদালার বাবা আল মানসুরের চোখে-মুখে অস্থির একটা ভাবনা। কিছু যেন খুঁজছে সে। হঠাৎ কিছু খুঁজে পাওয়ার মত চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।
‘কি বললেন, ব্ল্যাক লাইট?’ বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘হ্যাঁ, ব্ল্যাক লাইট, আর দলের নেতা ‘ব্ল্যাক বার্ড।’ এমন নাম কি কোথাও শুনেছেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা আমার মনে পড়ে গেছে। বেশ অনেক দিনই মানে এক বছর আগে বড়দিনের ছুটির পরদিনই নিওর্যালজিক পেইন নিয়ে হামবুর্গ হাসপাতালে নিওর্যালজিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার কেবিনের পাশের কেবিনে আরেকজন মহিলা ভর্তি ছিলেন। আমার কেবিনটা সারির একদম দক্ষিণ মাথায় ছিল। সারির পুব পাশ বরাবর দীর্ঘ করিডোর। করিডোরটা ঘুরে এসে আমার কেবিনের দক্ষিণ পাশে একটা বারান্দার সৃষ্টি করেছিল। কেবিনের একটা জানালাও দক্ষিণ দিকে ছিল। এয়ারকন্ডিশনের কারণে জানালা বন্ধই থাকে। কিন্তু দিনের বেলা আমি মাঝে মাঝে জানালা খুলে দিতাম ফ্রেশ বাতাসের জন্যে। এতে আমার খুব ভালো লাগত। মহিলাটির কেবিন আমার পরেই, মানে দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয়। মহিলাটির কেবিনের অ্যাটেনড্যান্ট কিংবা যারা ভিজিটর আসত, তারা প্রায়ই দক্ষিণের উন্মুক্ত বারান্দাটায় আসত। তাদের কারো কথোপকথনের মধ্যে ‘ব্ল্যাক লা্ইট’ শব্দটা আমার কানে গিয়েছিল।’ বলল আদালার বাবা ইউসুফ আল মানসুর।
‘ধন্যবাদ স্যার। কথোপকথনগুলোর কিছু কি আপনার মনে আছে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘মনে আছে মি. আহমদ মুসা। রোগশয্যায় শুয়েছিলাম। মাথার কোন কাজ ছিল না। আর জানালার ওপাশেই কথা হচ্ছিল, যদিও নিচু স্বরে কথা বলছিল তারা। কিন্তু নীরব পরিবেশে কথা শুনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।’ বলল আদালার বাবা।
‘কি কথা বলছিল তারা?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি যখন কথাগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম, তখন একজন বলছিল, ‘…ব্যাপারটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। নকল একজনকে এনে রাখতে হবে, আসলকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আসলের আত্নীয়-স্বজনের কাছে ধরা পড়ে যাবার আশংকাই বেশি। চেহারা এক রকমের হলেই হবে না, স্বামী-ছেলে-সন্তানরা কথা বললে, গায়ে হাত দিলেই বুঝতে পারবে আসল-নকল। ম্যাডাম কারলিন বনেদী জমিদার ঘরের একজন। ধরা পড়লে আস্ত থাকবে না।’ এ কথা শোনার পর আরেকটা কন্ঠ সংগে সংগে বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক লাইটকে আপনি চেনেন না। তাদের কাজে কোন খুঁত থাকে না। যাকে নকল বলছেন, সে আসলের চেয়েও আসল। তাকে পঁচিশ বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে।’ দ্বিতীয় ব্যক্তি কথ শেষ করলে প্রথম ব্যক্তি আবার বলল, ‘যাই বলুন, কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমি মনে করেছিলাম বিষয়টা একজনকে কিডন্যাপের। এটা কঠিন নয়। একজনকে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় আরেকজনকে বসানো খুব কঠিন, খুব ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টা পুরোপুরি আমাকে আপনারা জানাননি।’ প্রথম জনের এই কথার উত্তরে দ্বিতীয়জন বলল, ‘দেখুন ব্ল্যাক লাইট কাউকে অনুরোধ করে না, নির্দেশ দেয়। আমি যা করতে চাই তা করব। আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে আপনি তা করবেন। সামান্য অসহযোগিতা যদি করেন তাহলে আপনিসহ আপনার গোটা গোষ্ঠীকে আমরা শেষ করে দেব। মনে আছে তো কি করতে হবে। আবার শুনুন, রুমের সিসিটিভি ক্যামেরা বিকল করতে হবে, নার্স আসলকে প্রেসক্রাইবড ইনজেকশন দেয়ার নামে বেহুসের ইনজেকশন দেবে। এরপর আপনি আসলকে কাপড়ে মুড়ে রুম ড্রেসিং-এর ট্রলি গাড়িতে তুলে স্টোরে নিয়ে রাখবেন। সেখান থেকে লন্ড্রিখানার গাড়িতে করে আসলকে আপনি হাসপাতালের পেছনে এক তলায় নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে তাকে গার্বেজের গাড়িতে তুলে হাসপাতালের বাইরে নেবেন। তার পরের দায়িত্ব ব্ল্যাক লাইটের।’ দ্বিতীয় জন থামলেও প্রথম জনের কন্ঠ শোনা গেল না। মনে হয় সে ভয়ে তার কথায় রাজি হয়ে গেছে।’ থামল আদালার বাবা।
‘এসব কথা কার ব্যাপারে বা কোন কক্ষের রোগীর ব্যাপারে তা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন?’ জিজ্ঞাসা আলদুনি সেনফ্রিডের। তার চোখে-মুখে বিস্ময় উত্তেজনা।
‘তা আমি নিশ্চিত বুঝতে পারিনি। প্রথমে আমার পাশের কক্ষের রোগীর সাথে তাদের কথার সম্পর্ক আছে ভেবেছিলাম। কিন্তু তা অন্য কক্ষের রোগীর ব্যাপারেও হতে পারে।’ বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘হামবুর্গের হাসপাতাল বিরাট। কয়েকটা ‘রো’ রয়েছে সেখানে। আপনি কত নাম্বার কক্ষে ছিলেন?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘আমার রুম নাম্বার ছিল চারশ’ এক। ‘বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘আর ঐ সময় আমার ওয়াইফ ব্রুনার মা ভর্তি ছিলেন ৪০২ নাম্বারে। তার মানে এই ষড়যন্ত্রটা আমার ওয়াইফ কারিনা কারলিনাকে নিয়ে। তাহলে…।’
কথা শেষ করতে পারল না আলদুনি সেনফ্রিড। তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল আবেগ জড়িত এক বেদনার উচ্ছ্বাসে।
‘হ্যাঁ, মি. সেনফ্রিড, এতে এখন আর কোন সন্দেহ নেই ষড়যন্ত্রটা ব্রুনার মাকে নিয়েই হয়েছে। একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল মি. সেনফ্রিড যে, ব্রুনার মাকে সরিয়ে সেখানে নকল একজন ব্রুনার মায়ের ছদ্মবেশে সেট করা হয়েছিল। আর নকল একজনকে ২৫ বছর ধরে তৈরি করা হচ্ছিল এই কাজের জন্যে। আর ২৫ বছরের কথায় এটাও এখন পরিষ্কার যে, ব্রুনার মায়ের জায়গায় বসানো নকল মহিলাটিকে ক্লোন করে তৈরি করা হয়। ক্লোন করে তৈরি করা বলেই তার ক্লোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পঁচিশ বছর আগে কার ক্লোন করে তাকে তৈরি করা হয়? ব্রুনার মায়ের?’ জিজ্ঞাসা আলদুনি সেনফ্রিডের। বিস্ময়ে তার চোখ যেন কপালে উঠেছে।
‘ব্রুনার মায়ের ক্নোন না হলে সে হুবহু ব্রুনার মায়ের মত হতো না, এটা তো সত্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্ত কিভাবে? এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার!’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘হতে পারে সেটা আরেক ষড়যন্ত্র।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ষড়যন্ত্রটা ব্রুনার মাকে নিয়ে হলো কেন?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘কারণ, ব্রুনার মা জার্মানীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা এস্টেট-এর মালিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, সেটা তো ওরা দখল করেছে মি. আহমদ মুসা।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
বলেই সে আবার প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু ক্লোন কিভাবে করেছে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু চুপ করে থেকে আহমদ মুসা বলল, ‘মি. সেনফিড, আপনি কিংবা ব্রুনা বলেছিলেন অনেক বছর আগে ব্রুনার মা আরও একবার ঐ হামবুর্গ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে প্রবেশ করেছেন। বয়স আঠার উনিশ ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
সংগে সংগেই ব্রুনা বলে উঠল, ‘আমিই আপনাকে বলেছিলাম ভাইয়া। কথাটা মা আমাকে নিজে বলেছিলেন।’
‘ধন্যবাদ ব্রুনা। এখন ওদের ২৫ বছরকে যদি তোমার মায়ের সেই ১৮ বছরের সাথে যোগ দেয়া হয়, তাহলে যোগফল পাওয়া যাচ্ছে ৪৩ বছর, সেটাই তোমার মায়ের আসল বয়স কি না?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ ব্রুনা ও তার বাবা একসংগে বলে উঠল।
‘তাহলে আমি নিশ্চিত, ব্রুনার মা আঠার-উনিশ বছর বয়সে যখন হামবুর্গ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তখনই কিছু ঘটেছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি ঘটেছিল মি. আহমদ মুসা?’ বলল ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড। ‘আমার মনে হয়, ক্লোন করার ঘটনাটা তখনই ঘটানো হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আবারও সেই প্রশ্ন করছি মি. আহমদ মুসা। চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া একটা মেয়ের ক্নোন করা কিভাবে সম্ভব?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘কিভাবে করেছে, সেটা আমি জানি না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, একটা মেয়ের ডিম্বাণু, এমনি তার বিশেষ টিস্যু যদি কোনভাবে সংগ্রহ করা যায়, তাহলে বিশেষ প্রসেসের মাধ্যমে অন্য কোন গর্ভাশয়ে ফেলে ক্লোন তৈরি করা সম্ভব। গোপনে হয়তো বিজ্ঞান আরও এগিয়ে থাকতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামলেও কথা বলল না ব্রুনা, কিংবা ব্রুনার বাবা। বিস্ময়ে বিমূঢ় তাদের চোখ-মুখ।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ অথবা ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট কেউ ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকলে সহজেই ডিম্বাণু ও টিস্যু সংগ্রহের কাজটা করা যায়। আমার মনে হয় সেটাই ঘটেছে।’
‘টিস্যু সংগ্রহ সহজ, ডিম্বাণু সংগ্রহ তো সহজ নয়।’ আলোচনায় যোগ দিয়ে বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘অজ্ঞান বা আধা অজ্ঞান করে, বা কোন মাদক খাইয়ে চেতনা ও বুদ্ধি একদম ভোঁতা করে দিয়ে, অথবা কোন ওষুধ খাইয়ে চেতনা ও বুদ্ধিকে বিকৃত বা অস্বাভাবিক করে দিয়ে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা সম্ভব। আমরা জানি না, চিকিৎসাবিজ্ঞানের হয়তো আরো কৌশল আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন মি. আহমদ মুসা। এ রকমটা হতে পারে। থাক এ প্রসংগ, এখন আমাদের করনীয় কি দাঁড়াচ্ছে?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘আমি ভাবছি মি. সেনফ্রিড, অ্যারেন্ডসীতে এখনি না গিয়ে আগে আমাদের হামবুর্গ যাওয়া দরকার।’
থামল একটু আহমদ মুসা। একটু ভাবল। আদালার বাবার দিকে চেয়ে কিছু দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘আপনি জানালার ওপারে যাদের কথা শুনেছিলেন, তাদের প্রথম লোক তা হাসপাতাল প্রশাসনেরই কেউ। আপনি কি চিনতে পেরেছিলেন তাকে?’
‘আমি তখন চিনতে পারিনি। কিন্তু তার কথা শুনে আমি তাকে পরে চিনতে পেরেছিলাম। তিনি হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর চীফ সুপার। নাম আলদুস আলারী। হাসপাতালের খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি। ডাক্তাররাও তাকে সমীহ করে চলে।’ বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘বয়স কেমন? কত বছর তিনি হাসপাতালে আছেন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘তার বয়স বলা কঠিন। তার আড়ালে সবাই বলে, লোকটা কোন দিন বুড়ো হবে না। আঠার বছর বয়সে ওয়ার্ডক্লার্ক হিসেবে হাসপাতালে যোগ দেন, তারপর ৩২ বছর ধরে সে আছে হাসপাতালে। এই হিসেবে তার বয়স দাঁড়ায় ৫০ বছর। কিন্তু দেখলে মনে হয় ৪০ বছরও হবে না।’ বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘উনি কি ক্যাম্পাসেই থাকেন?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘না, হাসপাতাল ক্যাম্পাসে কোন রেসিডেন্স নেই, সবাই বাইরে থাকেন।’ বলল আদালার বাবা।
‘ধন্যবাদ মি. আল মানসুর। আপনার কাছ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য আমরা পেলাম।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডের দিকে। বলল আহমদ মুসা, ‘মি. সেনফ্রিড আমাদেরকে অ্যারেন্ডসী নয়, প্রথমে হামবুর্গ যেতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’
‘হামবুর্গ? আলদুস আলারীর সন্ধানে? আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে আহমদ মুসা।’ বলল ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড।
‘ধন্যবাদ!’ বলে ব্রুনার বাবার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিল আদালার বাবা আলা মানসুরের দিকে। বলল, ‘স্যার, এবার আপনার অনুমতি চাই, আমাদের উঠতে হবে।’
সংগে সংগে উত্তর দিল না আদালার বাবা। আহমদ মুসার কথার সাথে সাথে গভীর একটা ম্লান ভাব ফুটে উঠেছিল তার চোখে-মুখে। একটুক্ষণ নীরব থেকে সে বলল, ‘আমার এতক্ষণ মনেই হয়নি যে, আপনারা চলে যাবেন। আপনার সামনেই, বলা যায়, আপনার হাতেই আমার পরিবারের নবজন্ম হলো্। এই নবজন্মের এই মুহূর্তে আপনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। আপনাকে আমরা ছাড়ব কি করে?’ ভারি হয়ে উঠেছিল আদালার বাবা আল মানসুরের গলা।
‘স্যার, আমারও মনে হয়নি, আমরা আপনাদের থেকে আলাদা কেউ। এখনও তাই মনে করছি। কিন্তু স্যার, আপনি জেনেছেন, আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে আছি। প্রতি মুহূর্ত আমাদের জন্যে মূল্যবান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই আহমদ মুসা। অবশ্যই একটা মুহূর্তও আপনাদের নষ্ট করা ঠিক নয়। কিন্তু এটাই কি আমাদের শেষ দেখা? এটা তো আমরা সহ্য করতে পারছি না।’ বলল আদালার বাবা আল মানসুর।
‘আর দেখা হবে না, কিংবা আবার দেখা হবে কোনটাই বলা যাবে না মি. আল মানসুর। এটা আল্লাহর হাতে যিনি আমাদের সকলকে পরিচালনা করেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্লিজ স্যার, আপনি এসব কথা বলবেন না। বলুন আবার দেখা হবে। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। আমরাও আমাদের জন্যে আশা চাই। স্যার, আমরা হয়তো আপনার চলার পথের ক্ষণিকের দৃশ্য। কিন্তু আমি, আমরা আপনাকে সে রকম ভাবতে পারছি না। সারাজীবন দেখেও অনেক দেখা হৃদয়ে দাগ কাটে না, কিন্তু সামান্য সময়ের অনেক দেখা চিরদিনের জন্যে হৃদয়ে দাগ কেটে বসে। যদি বলেন ইনশাআল্লাহ দেখা হবে, তাহলে আশার সান্ত্বনা আমাদের বেদনায় একটা প্রলেপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’ বলল আদালা। তার কথায় গভীর আবেগ।
‘তুমি ঠিক বলেছ আদালা। বিদায়ের সময় ‘আবার দেখা হবে’ বলাই সঙ্গত। আর বান্দাহ আশা করুক আল্লাহ এটাই চান। ধন্যবাদ আদালা।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে হঠাৎ একটা ভাবান্তর দেখা দিল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মুখ নিচু করে তৎক্ষণাৎ আবার মুখ তুলে আলদুনি সেনফ্রিডকে বলল, ‘আমি একটা কথা ভাবছি মি. সেনফ্রিড। আমি মনে করছি, আপনি ও ব্রুনা এখানে থেকে যান, আমি হামবুর্গ থেকে ঘুরে আসি।’
সংগে সংগে উত্তর দিল না ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড। একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘এতে ভালো দিক কি মি. আহমদ মুসা।’
‘ভালো দিক তেমন কিছু নেই। আমার ওখানে যে কাজ, আর তাতে যে সময় লাগবে-ততক্ষণ আপনারা এখানে অপেক্ষা করতে পারেন। এর একটা ভালো দিক আছে, সেটা হলো আপনাদের নিয়ে বিপদের বাড়তি একটা চিন্তা আমার থাকবে না। আমরা যদি সেখানে ব্ল্যাক লাইট-এর নজরে পড়ে যাই, তাহলে তো সর্বশক্তি নিয়ে আমাদের উপর ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনারা এখানে অপেক্ষা করলে আমাদের বিপদের পরিধি কমবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কমবে! তার মানে বিপদের সবটুকু আপনার উপর নিতে চান?’ বলল ব্রুনা ভারি গলায়।
‘না ব্রুনা, ওখানে আমার উপর যে বিপদ আসবে, তোমরা ওখানে না থাকলে সে বিপদ আমার বাড়বে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার স্ত্রী হামবুর্গ হাসপাতালে ছিল। আমি তাকে অ্যাটেন্ড করেছি। আপনার যে কাজ, তাতে আমিও কাজে হয়তো লাগতে পারি।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘মি. আলদুনি সেনফ্রিড, আপনি ঠিক বলেছেন। এ দিকটা আমার মাথায় আসেনি। ধন্যবাদ আপনাকে। তাহলে ব্রুনা থেকে যাক এখানে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার থাকতে আপত্তি নেই, যেহেতু ভাইয়া বলছেন। কিন্তু আপনাদের বা কারও বিপদ হলে জানব কি করে? এ দিকটার কারণে আমি এখানে যে টেনশনে থাকব, তার কষ্ট ওখানে থাকার কষ্টের চেয়ে কম নয়। আর একটা কথা ভাইয়া, বহুদিন পর বাবার সাথে মিলেছি। আবার আলাদা হতে আমার ভয় করছে।’
আহমদ মুসা বলল। ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে ব্রুনা।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল আদালার বাবা আল মানসুরের দিকে। বলল, ‘স্যার। এবার তাহলে আমরা উঠি।’
‘আপনাদের সবকিছু শুনেছি। আমাদের কিছু বলার নেই। শুধু অসীম কৃতজ্ঞতা আপনাদের প্রতি। দুনিয়াটা যদিও চলার পথ, ফেরার পথ নয়। কিন্তু চলার পথেও তো বার বার দেখা হয়। তাই আশা করব, আমার মা আদালা যেমন আশা করেছে, আবার আমাদের দেখা হবে।’ বলল আদালার বাবা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই।
নিচে সিঁড়ির মুখেই আহমদ মুসাদের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
সবাইকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল আহমদ মুসারা।

Top