৫৩. রাইন থেকে অ্যারেন্ডসী

চ্যাপ্টার

‘চারজন মারা গেছে, সেটা জানি ডরিস ডুগান। আমি জানতে চাচ্ছি কে মারল তাদের, কেমন করে মারল। কেন এটা ঘটল? ঐ চারজন তো ছিল আমাদের এলিট বাহিনীর অংশ। ওরা এভাবে বেঘোরে মারা যাবার কথা নয়।’ বলল ব্ল্যাক লাইটের প্রধান ব্ল্যাক বার্ড।
তার সামনে মাথা নিচু করে বসেছিল ডরিস ডুগান। ব্ল্যাক লাইটের অপারেশন চীফ।
আর টেবিলের অন্য পাশে ব্ল্যাক বার্ডের ডান দিকে বসেছিল গেরারড গারভিন। সে ব্ল্যাক বার্ডের বহুদিনের বিশ্বস্ত একজন উপদেষ্টা। সে জার্মানীর একজন শীর্ষস্থানীয় সিচুয়েশন এ্যানালিষ্ট। আজ ব্ল্যাক বার্ডের যে সফলতা ও সমৃদ্ধি, তার সাথে জড়িয়ে আছে গেরারড গারভিনের অবদান। ব্ল্যাক বার্ড থামলে ডরিস ডুগান মাথা নিচু রেখেই বলল, ‘আমরা হামবুর্গে যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম এবং আলদুস আলারীকে ভালোভাবে সাবধানও করা হয়েছিল। আলদুসের স্ত্রী বলেছেন, আমাদের ওঁৎ পেতে থাকাও সঠিক ছিল। আলদুসের সন্ধানে আসা লোকটিকে ঠিক সময়ে ঘেরাও করেছিল আমাদের লোকেরা। কিন্তু গুলিতে আহত হয়েও আমাদের চারজন লোককে হত্যা করে লোকটা আলদুস আলারীকে ধরে নিয়ে পালাতে সমর্থ হয়। এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা।’ বলল ডুরিন ডুগান।
‘ডরিন ডুগান, ওরা এ পর্যন্ত যা ঘটিয়েছে, সবই ছিল অ্স্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক ঘটনা তাহলে ঘটেই চলবে? গতকাল হামবুর্গ ঘটেছে, আগামীকাল কি অ্যারেন্ডসীতেও এটা ঘটবে? কি আশ্চর্য, একজন মানুষ কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করে চলেছে? সে কি করে আলদুস আলারীর সন্ধান পেল, ভাবতেও তো আমার বিস্ময় বোধ হচ্ছে।’ বলল ব্ল্যাক বার্ড। তার চোখে-মুখে হতাশা ও উদ্বেগের চিহ্ন।
‘ব্যর্থতা নিয়ে মন খারাপ করার সময় এটা নয় লিডার। ডরিন ডুগান ঠিকই বলেছে, আপনাদের চেষ্টা ও সাবধানতায় কোন ত্রুটি ছিল না। আসলেই সে অস্বাভাবিক অসাধারণ মানুষ। যে কোন পরিস্থিতিতে সে জয়ী হয়ে চলেছে।’ বলল গেরারড গারভিন।
‘তাহলে বল কি করনীয়? তাকে ঠেকানোর উপায় কি?’ ব্ল্যাক বার্ড বলল।
‘তার আলদুস আলারীর সন্ধান পাওয়া সত্যিই বিস্ময়ের। এই ঘটনা বলে দিচ্ছে, হামবুর্গ হাসপাতালে আলদুনি সেনফ্রিডের স্ত্রী কারিনা কারলিনকে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় একই চেহারার আরেকজনকে সেট করা হয়েছে, এটা তারা জেনে ফেলেছে। তার মানে সবচেয়ে বড় তথ্যই তারা জেনে ফেলেছে। ক্লোন করার বিষয়টাও তারা জেনে ফেলতে পারে। আর…।’
গেরারড গারভিনের কথার মাঝখানেই ব্ল্যাক বার্ড বলে উঠল, ‘কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমরা কয়েকজন এবং আলদুস আলারী ছাড়া আর কেউ এটা জানে না। প্রমাণ হলো, আলদুস আলারীর কাছ থেকে তারা কিছু জানেনি, জানলে এখন তাকে তাদের ধরে নিয়ে যাবার দরকার হতো না। তাহলে কি করে জানবে। অলৌকিকত্ব বলতে কোন জিনিস নিশ্চয় নেই?’
‘তা ঠিক। কিন্তু যেভাবেই হোক জানতে পেরেছে। এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় হামবুর্গের হাসপাতালের সন্ধান পেলে তারা অ্যারেন্ডসীর সন্ধান পাবে না কেন? আচ্ছা, আলদুস আলারীকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, তার কাছ থেকে নিশ্চয় কথা আদায় করতে চায়। সে আপনাদের মানে অ্যারেন্ডসী সম্পর্কে কতটুকু জানে?’ বলল গেরারড গারভিন।
‘অ্যারেন্ডসী’ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। তার সামনে কখনও এসব বিষয়ে কোন আলোচনাই হতো না। হসপিটালের ঐ ঘটনা ছাড়া সে কিছুই জানে না, এমনকি কারও নামও সে জানে না।’ বলল ডরিস ডুগান।
‘গুড। তাহলে তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে তারা কোন লাভ করতে পারবে না। সে যাই হোক, আমি মনে করি, এখন ধরে নিতে হবে যে, তারা অ্যারেন্ডসীকেও জেনে ফেলেছে এবং অ্যারেন্ডসী’তে তারা আসবে। এটা ধরে নিয়েই আমাদের যা করা দরকার করতে হবে।’ বলল গেরারড গারভিন।
‘আমি মনে করি আসল কাজটা দ্রুত সেরে ফেলা দরকার। কারিনা কারলিন বেঁচে থাকাটাই আমাদের জন্যে উদ্বেগের। কিন্তু আমরা চাচ্ছিলাম তার স্বামী ও মেয়েকে হাতে পাওয়ার পর এক সাথে সব শেষ করব। সব ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু তার স্বামী ও ছেলে তো এখন নকল আহমদ মুসার আশ্রয়ে। তাদের তো আমরা পাচ্ছি না। এই অবস্থায় ঔ দু’জনের আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। আমাদের বিন্দী ব্রিজিটি মানে নকল কারিনা কারলিনকে দিয়ে স্টেট হস্তান্তরের ব্যবস্থাটা অবিলম্বে করতে হবে। তারপর আসল কারিনা কারলিনকে সরিয়ে দিলে আমাদের বড় উদ্বেগ কেটে যায়।’ বলল ব্ল্যাক বার্ড।
‘এই কাজের কত দূর কি হলো? যে সব প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন তা শেষ হয়েছে কি না?’ গেরারড গারভিন বলল।
‘হস্তাক্ষর মোটামুটি হয়েছে। কিন্তু ফিংগার প্রিংটের প্রস্তুতি শেষ হয়নি, আরও কিছুদিন দরকার। এই জন্যে ঠিক করেছি, আসল কারিনা কারলিনের ফিংগার প্রিন্ট নেয়া হবে দলিলে। সেটাকেই জজ সাহেব তার সামনে টিপসই দেয়া হয়েছে বলে মেনে নিবেন। জজ সাহেবকে টাকার লোভ এবং প্রাণের ভয় দু’টোই দেখানো হয়েছে। তাঁর মত আজ জানা যাবে। উনি রাজি হলে দু’দিনের মধ্যে দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে।’ বলল ব্ল্যাক বার্ড।
‘গুড, কাজ তো সহজ করে ফেলেছেন। দলিলটা হয়ে গেলেই আমরা কারিনা কারলিনকে শেষ করে অ্যারেন্ডসী’র পাঠ চুকিয়ে সবাই সরে পড়তে পারব।’ গেরারড গারভিন বলল।
‘হ্যাঁ, গারভিন, জজ সাহেবের সম্মতি পেলেই কাজটা সম্পন্ন হবে। কারিনা কারলিনের স্টেটটা তো আগেই হাতে এসে গেছে। এখন দলিল সম্পন্ন ও কারিনা কারলিনের সদগতি করেই লম্বা ছুটিতে যাব আমরা। তারপর সব অনুসন্ধান ও গন্ডগোল মিটে গেলে মানে নকল আহমদ মুসার উপদ্রব শেষ করে ফিরে আসব। এভাবে এ পর্যন্ত সাতটা স্টেট আমাদের দখলে এসেছে। দক্ষিণ জার্মানীর লোভনীয় সব স্টেট আমি চাই।’ বলল ব্ল্যাক বার্ড।
এ সময় ব্ল্যাক বার্ডের বাম পাশের সাদা টেলিফোনটা থেকে নীল সংকেত আসতে লাগল।
পিএস হিংগিস্টের টেলিফোন।
ব্ল্যাক বার্ড ইন্টারকমের বোতাম টিপে বলর, ‘হ্যাঁ, হিংগিস্ট বল কি খবর? বরিস ফ্রেডম্যান কোন খবর দিয়েছে?’
‘জি স্যার, এই মাত্র টেলিফোন করে তিনি জানালেন, জজ সাহেব বিষয়টা মেনে নিয়েছেন। পরশুদিন সকাল ১০টায় দলিলের কাজ করার সময় ঠিক হয়েছে।’ বলল হিংগিস্ট ওপার থেকে।
‘ধন্যবাদ হিংগিস্ট।’ বলে ইন্টারকম অফ করে দিল ব্ল্যাক বার্ড।
‘আপনার বড় কাজ তো হয়ে গেল লিডার। এখন নিখুঁতভাবে কাজটা গুটিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।’ বলল গেরারড গারভিন ব্ল্যাক বার্ড কিছু বলার আগেই।
‘হ্যাঁ গারভিন। দলিলটার খসড়া হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি বনে দলিলটা চুড়ান্ত করার জন্যে। কাল সকালে ফিরেই ওতে দস্তখত ও টিপসই নিয়ে নেব কারিনা কারলিনের। তুমি কি যাবে আমার সাথে গারভিন?’ ব্ল্যাক বার্ড বলল।
‘অসুবিধা নেই। বললে অবশ্যই যাব। আমি চাই তাড়াতাড়ি হোক কাজটা।’ বলল গেরারড গারভিন।
‘ধন্যবাদ!’ বলল ব্ল্যাক বার্ড ডরিন ডুগানের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি ঘন্টাখানেক পরে এস। আমাদের ইস্টাবলিশমেন্টের সিকুরিটি নিয়ে তোমার সাথে কিছু কথা বলব।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে ডরিন ডুগান উঠে দাঁড়াল।
গেরারড গারভিনও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমিও উঠি লিডার। ফ্লাইটের ডিটেইলটা যেন আমাকে জানায়। আমি রুমেই থাকব।’
গেরারড গারভিন এবং ডরিন ডুগান বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

কুইন অ্যারেন্ডসী জেটির অল্প সামনে দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিলম্বিত সালজওয়াডেল স্ট্রিট। এই স্ট্রিটের পশ্চিম পাশে ১৬ তলা কুইন অ্যারেন্ডসী হোটেল। হোটেলের ১২ তলায় একটা স্যুট ভাড়া নিয়েছে আহমদ মুসারা।স্যুটে দু’টি বেড রুম, একটা ডাইনিং এবং একটা বড় লাউঞ্জ ড্রইং। ডাইনিং-এর পাশে রয়েছে সুন্দর ছোটখাট একটা কিচেন। কেউ চাইলে এখানে রান্না বা কিছু গরম করে খেতে পারে।
লাউঞ্জ ড্রইংটাই স্যূটের প্রধান আকর্ষণ। এটা হোটেলের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে। লাউঞ্জের এ প্রান্তে বসে অপরুপ অ্যারেন্ডসী হ্রদের গোটাটাই দেখা যায়। লেকের পশ্চিম প্রান্তটা এখান থেকে অনেকটাই স্পষ্ট।
স্যূটটা ভাড়া হয়েছে ব্রুনার বাবা আলদুনি সেনফ্রিডের নামে। আলদুনি সেনফ্রিডের ড্রাইভার পরিচয়ে আহমদ মুসা ও স্যুটে থাকছে। আর ব্রুনার জন্যে নেয়া হয়েছে দুই কক্ষ পরে আরেকটা রুম। ব্রুনা আলাদাভাবে এসে আলাদাভাবেই রুমটি ভাড়া নিয়েছে। ব্ল্যাক লাইটের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
রাতরে খাওয়া হয়ে গেছে। এ্যাটেন্ড্যা্ন্ট এসে বাসন-কোসন নিয়ে যাবার জন্য গুছাচ্ছিল। তখন দরজায় নক হলো। বয় গিয়েই দরজা খুরে দিল।
দরজায় দু’জন লোক দাঁড়িয়ে। বলল বয়কে, ‘আমরা সার্ভে করছি হোটেলগুলো গোয়েন্দা বিভাগ থেকে। এই স্যুটে কয়জন বাসিন্দা থাকে?’
‘দু’জন। একজন বোর্ডার মানে মালিক। আরেকজন ড্রাইভার।’ বলল বয় ছেলেটা।
‘কোন দেশি?’ জিজ্ঞাসা সেই দু’জনের এক জনের।
‘মালিক জার্মান আর ড্রাইভারও জার্মান। কিন্তু জাতিতে শিখ।’ বলল বয়।
‘শিখ? তাদের সাথে আর কেউ নেই?’ বলল সেই লোকরা।
‘না, এরা দু’জনই এসেছেন হোটেলে।’ বলল বয় ছেলেটা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’ বলে লোক দু’জন চলে গেল।
‘বয় ছেলেটা ফিরে এল। স্বগতই বলল, ‘অ্যারেন্ডসীতে এসব ছিল না। এখানেও শুরু হলো দেখছি। রেজিস্টার দেখলেই তো সব জানতে পারে, রুমে রুমে এসে ডিস্টার্ব করা কেন?’
‘তুমি ঠিক বলেছ। যেটা এক জায়গায় বসেই করা যায়, সেটার জন্যে রুমে রুমে জ্বালাতন তো ঠিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, ওরা মনে হয় গোয়েন্দা-টোয়েন্দা কেউ নয়, অন্য কোন হোটেল পক্ষের লোক হতে পারে স্যার।’
বলতে বলতে বয় বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মুখ-হাত ধুয়ে ডাইনিং-এ ফিরে এল আলদুনি সেনফ্রিড। বলল, ‘আসলে কে ছিল ওরা?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমার তো মনে হয় মরিয়া হয়ে ওঠা ব্ল্যাক-লাইটরাই এই অনুসন্ধানে নেমেছে। দেখলেন না, নন-ইউরোপিয়ান শিখ-এর কথা শুনেই ওরা একটু চমকে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করছিল আমাদের সাথে আর কেউ আছে কি না?’
‘ঠিক মি. আহমদ মুসা। এ না হলে ওরা আমাদের সাথে আর কেউ আছে কি না তা জানতে চাইবে কেন? ব্রুনাকে আমাদের সাথে না রাখার আপনার সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলর, ‘যাই মি. আলদুনি সেনফ্রিড, একটু কাজ সারি।’
আহমদ মুসা ল্যাপটপে অ্যারেন্ডসীর গুগল চিত্রটা সামনে নিয়ে এল। হ্রদের চারদিকে আবাসিক এলাকার অবস্থান, জংগল এরিয়া, রাস্তাগুলোর গতি-প্রকৃতি, জেটিগুলোর স্থান, সব কিছুই গভীর দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলো আহমদ মুসা। আলদুস আলারীর কাছে থেকে পাওয়া ‘৪৯০-এর সি’ বাড়িটা কোনটা? অ্যারেন্ডসীতর চারদিক ঘিরে যে রাস্তা রয়েছে, তাতে ৪৯০ একটিই রয়েছে। কিন্তু ৪৯০ এটা অ্যারেন্ডসী থেকে বিচ্ছিন্ন বাজার এলাকার বাসস্ট্যান্ডের একটা ‘রোড শপে’র নাম্বার। আর তাতে এবিসি ইত্যাদির মত কোন এক্সটেনশন নেই। তাহলে এটা ভুয়া নাম্বার? প্রাচীন ইউরোপ অংকগুচ্ছের সংখ্যামাণ দিয়েও ধাঁধাঁ তৈরি করা হতো। ৪৯০-এর সংখ্যা মানের সিরিয়াল যোগফল হলো ১৩০, তাহলে ১৩০ এবিসি কি আমাদের টার্গেট হতে পারে? গুগলে হ্রদের চারদিকের রাস্তার অবস্থান দেখে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ১৩০ নাম্বারটি হ্রদের পশ্চিম তীরের মাঝামাঝি কোথাও হবে। কিন্তু গুগল চিত্রে খুঁটেখুঁটে দেখেও ১৩০ নাম্বার পেল না।
আহমদ মুসা অন্যান্য ক্লু’র দিকে নজর দিল। ক্লুগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস’ ও ‘লেক প্যালেস’। ‘লেক প্যালেস’ বলতে হ্রদের তীরের কোন বাড়িকে বুঝানো হতে পারে। এর মধ্যে কোন অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু ‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস’ অর্থ কি? ট্যানেলেই তো ট্যানেলই -ঠিক আছে। কিন্তু হ্যাটটপ-এর তাৎপর্য কি? হ্যাটটপ ট্যানেলের সরলার্থ দাঁড়ায় ‘হ্যাটটপ’ জায়গায় ট্যানেল অথবা হ্যাটটপ-এর মত ট্যানেল। এ দু’টি অর্থের কোনটিকে গ্রহণ করা হয়েছে? হ্যাটটপ-এর মত কি ট্যানেল হতে পারে? ট্যানেল তো হয় লম্বা-অর্থ দাঁড়ায় যোগাযোগের মাধ্যম, হ্যাটের মত বন্ধ মুখ তো হয় না। হ্যাটের মত কিছু হলে সেটা হবে খন্দক, গর্ত-ট্যানেল তো হয় না। এটা কোন বাড়ির নাম হতে পারে অথবা লেক প্যালেসেরই এটা আরেক নাম হতে পারে।
আহমদ মুসা যখন এই জটিল চিন্তায় নিমজ্জিত, তখন ব্রুনা ও তার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড তার পাশে এসে বসেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা টের পায়নি। তারা কেউ কথা বলেনি। ধ্যানমগ্নের মত চিন্তায় নিমজ্জিত আহমদ মুসাকে তারা জাগাতে চায়নি। নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবছে সে।
পল পল করে সময় বয়ে যায়। হঠাৎ আহমদ মুসা ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখতে গিয়ে তার নজর পড়ল ব্রুনা ও আলদুনি সেনফ্রিডির উপর।
‘আরে! আপনারা কখন এলেন, ব্রুনা কখন এল আমাদের স্যুটে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা দশ মিনিট হলো এসে বসে আছি ভাইয়া।’ ব্রুনা বলল।
‘স্যরি, আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। খেয়াল করতে পারিনি। স্যরি।’ আমহদ মুসা বলল।
‘স্যরি নয়। কোন ভাবনার মধ্যে ডুবে আছেন দেখে আমরা কিছু বলিনি।’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘এতবড় কি ভাবনা ভাইয়া?’ ব্রুনা বলল।
‘ভাবনাটা বড়ই। আচ্ছা ব্রুনা, কোন স্থানের লোকেশন ইন্ডিকেট করতে গিয়ে যদি বলা হয় হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস, তাহলে তার অর্থ কি দাঁড়াবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস। মানে হ্যাটটপের মত ট্যানেল বা ট্যানেলটা হবে হ্যাটটপের মত।’ এই তো অর্থ দাঁড়ায়।
‘কিন্তু হ্যাটটপের মত হলে তা ট্যানেল হবে না। হ্যাটটপ তো ক্লোজড। ট্যানেল তো ক্লোজড হবে না। ট্যানেলের দুই মাথাই উম্মুক্ত কোন কিছুর সাথে যুক্ত থাকবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া, তাহলে হ্যাটটপ ট্যানেলের অর্থ কি দাঁড়াবে?’ বলে ভাবতে লাগল ব্রুনা।
‘দেখ তো ব্রুনা, হ্যাটটপ-এর মত জায়গায় ট্যানেল বা বাড়ি এই অর্থটা কেমন হয়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক ভাইয়া, এই অর্থটাই অ্যাপ্রোপিয়েট। হ্যাটটপের মত জায়গায় ট্যানেল বা বাড়ি এটাই সঠিক অর্থ ভাইয়া। কিন্তু বিষয়টা কি ভাইয়া?’ ব্রুনা বলল।
‘আলদুস আলারীর কাছ থেকে ব্ল্যাক লাইটের যে ক্লুগুলো পেয়েছিলাম, তার মধ্যে এটাও আছে। তাই এর অর্থ সন্ধান করছি। এর অর্থ পাওয়া খুবই জরুরি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তখন বলেছিলেন বাড়ির নাম্বারও পেয়েছিলেন। সেটাই তো সবচেয়ে সোজা কোন বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য।’ ব্রুনা বলল।
‘সে নাম্বার নিয়েও ধাঁধায় পড়েছি। ওটা অ্যারেন্ডসীর পশ্চিমের একটা বাজার এলাকার আন্তনগরী বাসস্ট্যান্ডের একটা ‘রোড শপে’র নাম্বার। ভেবে দেখেছি ওটা ব্ল্যাক লাইটের হতে পারে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভুয়া নাম্বার তাহলে ওটা?’ ব্রুনা বলল।
‘ভুয়া হতে পারে, আবার আসল নাম্বারও এর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা। বলে আহমদ মুসা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল ব্রুনাকে।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, একটা রুপকথায় আমি অংকের সংখ্যামাণ দিয়ে ধাঁধার কথা পড়েছি। তাহলে ১৩০ তো হতে পারে ঐ বাসার বা বাড়ির নাম্বার।’ ব্রুনা বলল।
কিন্তু সার্চ করে ১৩০ নাম্বারের কোন কিছু পেলাম না গুগলে। হতে পারে এ নাম্বারটা উল্লেখযোগ্য কোন কিছুর নয়। তাই গুগলে আসেনি। তবে নাম্বারটা অ্যারেন্ডসী হ্রদের পশ্চিম তীরের কোন এক জায়গার হতে পারে।’
কথাটা বলেই আহমদ মুসা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। পাশ থেকে ল্যাপটপ টেনে নিয়ে অ্যারেন্ডসীর স্যাটেলাইট ভিউ বের করল। বড় করে ছোট করে ভিউটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল। ভিউটাকে ব্রুনা ও আলদুনি সেনফ্রিডের সামনে ধরে বলল, ‘দেখুন তো, অ্যারেন্ডসীকে হ্যাট-সাইজের মনে হচ্ছে না?’
ব্রুনা ও তার বাবা আলদুনি সেনফ্রিড গভীর মনোযোগের সাথে দেখছে অ্যারেন্ডসী হ্রদের স্যাটেলাইট ভিউটা।
ব্রুনা চিৎকার করে বলে উঠল ‘চমৎকার! চমৎকার!! অ্যারেন্ডসীর আকার সুন্দর একটা হ্যাটের মত।’
‘এবং হ্যাটটপটা পশ্চিম উপকূলের মাঝ বরাবর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া, হ্যাটটপটা ঠিক পশ্চিম উপকুলের মাঝ বরাবর।’ বলল ব্রুনা।
‘তার অর্থ হলো, ‘হ্যাটটপ ট্যানেল প্যালেস’ ওখানেই পাওয়া যাব্।
এখন একটাই সমস্যা থাকলো এবং তা হলো ‘লেক প্যালেস’ কোথায় তা বের করা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘লেখ প্যালেস কি?’ বলল আলদুনি সেনফ্রিড।
‘আমি জানি না। এ নামটাও পেয়েছি আলদুস আলারীর কাছ থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন তাহলে কি পরিকল্পনা? কি করতে চাচ্ছেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা আলদুনি সেনফ্রিডের?
‘আমি আজ এগারটায় বেরুব। যে ক্লুগুলো পাওয়া গেছে তা পরখ করে দেখার চেষ্টা করব। ঘটনা কোথায় নিয়ে যায় দেখা যাক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি একা বেরুবেন?’ জিজ্ঞাসা ব্রুনার। তার চোখে-মুখে ভাবনার প্রকাশ।
‘একা নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘একা নয়? সাথে থাকবে কে তাহলে? আমি বাবা, আমরা নিশ্চয়ই নই?’ বলল ব্রুনা।
‘না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে কে?’ ব্রুনাই বলল।
‘আল্লাহ, আমার স্রষ্টা ও আমার অভিভাবক।’ আহমদ মুসা বলল।
ব্রুনা, আলদুনি সেনফ্রিড কেউ কথা বলল না। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
আনন্দ-উজ্জলতার অপূর্ব মিশ্রণ সেখানে। তাদের স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
‘এই জন্যেই বুঝি আপনার কোন ভয় নেই, কোন উদ্বেগ নেই?’ বলল ব্রুনা। বিমুগ্ধ তার দৃষ্টি।
‘অবশ্যই তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই ভয়, উদ্বেগ থাকে না কেন?’ জিজ্ঞাসা ব্রুনার।
‘কেউ যদি মনে করে জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ, অন্য কারো হাতে এটা নেই। যদি কেউ বিশ্বাস করে যে আল্লাহ যা নির্ধারিত করেছেন, তার বাইরে কিছু করার কারও ক্ষমতা নেই, তাহলে কারও মনে ভয়, কোন কিছুর জন্যে উদ্বেগ থাকার কথা নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন বিশ্বাস আমাদের হওয়া কি সম্ভব? সবার জন্যে সম্ভব?’ বলল ব্রুনা।
‘আল্লাহকে চেনা, তাঁর ক্ষমতা ও দয়াকে উপলব্ধি করা, তাকেঁ এবং তাঁর রাসূল স: কে মানা এই বিশ্বাস এনে দেয় ব্রুনা। আমার কথায় কি তোমার মনে নতুন উপলব্ধি আসেনি; সাহস ও শক্তি বাড়েনি? বেড়েছে। এভাবেই সেই বিশ্বাস ও বিশ্বাসের শক্তি সবার মধ্যে আসতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল।
সংগে সংগেই আলদুনি সেনফ্রিড বলল, ‘ব্রুনা, চল আমরা যাই। মি. আহমদ মুসার বিশ্রাম হওয়া দরকার।’ বলে আলদুনি সেনফ্রিড উঠে দাঁড়াল।
ব্রুনাও উঠল। বলল, ‘ভাইয়া আপনি কি মনে করেন মাকে ওরা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এবং এখানেই?’ কান্না ভেজা কন্ঠ ব্রুনার।
‘নিশ্চিত নই ব্রুনা। তবে এখানেই থাকার কথা। এবং আমার এখনও নিশ্চিত ধারণা স্টেট হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত এরা তাকে জীবিত রাখবে।’ বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহ আপনার কথা সত্য করুন। আপনাকে আল্লাহ সাহায্য করুন। আমি আল্লাহকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করছি। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ব্রুনা। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করল।
আলদুনি সেনফ্রিডও চলতে শুরু করল। তার মুখও বেদনায় পান্ডুর।

Top