৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

ওয়াশিংটানের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর। ভিভিআইপি লাউঞ্জে বসে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, তার স্ত্রী, নাতি, আহমদ মুসার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন, সারা জেফারসন এবং আহমদ মুসার ছেলে আহমদ আবদুল্লাহ।

টিভি স্ক্রীনে দেখা গেল জার্মানীর লুফথানসা বিমান ল্যান্ড করেছে।

লুফথানসাকে ল্যান্ড করতে দেখে জর্জ আব্রাহামের নাতি বলে উঠল, ‘এই লুফথানসা! এই প্লেনেই তো আংকেল আসছেন।’

‘হ্যাঁ দাদা ভাই, এই তো এখনি তোমার আংকেলকে দেখতে পাবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘তাহলে চল না দাদু প্লেনে যাই। আংকেলকে নিয়ে আসি।’ বলল জর্জ আব্রাহামের নাতি।

‘না দাদু ভাই, সকলে যেতে নেই। প্রেসিডেন্টের পিএস এবং তোমার আরেক দিদিভাই তোমার ঐ সারা আন্টির মা গেছেন তোমার আংকেলকে স্বাগত জানাতে প্লেনে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।

চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসনের। তার চোখে মুখে আনন্দ-অস্বস্তির মিশ্রণ! তার মনে একটা প্রবল তোলপাড়। কেমন করে তার সামনে দাঁড়াবে সে! সেই যে চিঠি লিখে পালিয়েছিল, তারপর সে আর আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়নি। হয়নি নয়, মুখোমুখি সে হতে পারেনি। অবশেষে আজ তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিমান বন্দরে আসা থেকে সে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু মারিয়া জোসেফাইন নাছোরবান্দা। সারা না এলে সেও আসবে না, সাফ কথা। তাই আসতে হয়েছে তাকে। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াবার সময় আনন্দ, তার সাথে প্রবল অস্বস্তি ও লজ্জা। সব মিলিয়ে তার বুকে অদ্ভুত এক কম্পন। সবার মুখে হাসি, কিন্তু সে হাসতে পারছে না। সারা অনুভব করল মারিয়া জোসেফাইন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাকেও তার দিকে তাকাতে হলো। জোসেফাইনের মুখে হাসি। সারা জেফারসনও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু সে এক বিব্রতকর হাসি।

‘সারা তোমার মুখে অর্ধেক হাসি, পুরো হাসি চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘মনো করো না অনেকদিক পরে দেখা হচ্ছে। মনে করো কাল দেখা হয়েছে, আজ আবার দেখা হচ্ছে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

‘ধন্যবাদ আপা, প্লিজ আপা, ওঁর সামনে আমাকে ঐ সব কিছু বলো না যেন। প্লিজ!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি কোনভাবে বিব্রত হও, তা আমি চাই না সারা। সারা জেফারসনকে শুধু ভালবাসি না, সম্মানও করি।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘এতক্ষণ তো আহমদ মুসাকে নিয়ে চলে আসার কথা।’

মোবাইল বের করে কল করল প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে। টেলিফোনে রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না।

দ্বিতীয় বার কল করল জর্জ আব্রাহাম জনসন। এবারও কোন সাড়া পেল না ওপার থেকে।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের। উঠে দাঁড়াল সে। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ করে, ‘মা, জন জুনিয়রকে দেখো। আমি আসছি।’

সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনের কল করা খেয়াল করছিল। বলল, ‘আংকেল কোন সমস্যা?’

‘না সারা, তেমন কিছু নয়। আমি প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে পাচ্ছি না। ও আচ্ছা, তুমি তোমার মাকে টেলিফোন কর তো। উনি তো সাথেই আছেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন, এফবিআই প্রধান।

সংগে সংগেই সারা জেফারসন তার মাকে টেলিফোন করল। রিং হলো। উৎকর্ণ হলো সারা জেফারসন। রিং হয়েই চলেছে। কোন উত্তর নেই ওপার থেকে। রিং ক্লোজ হয়ে গেল।

সারা জেফারসন উদ্বিগ্ন। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আংকেল, মার কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। এমন তো হবার কথা নয় আংকেল।’

‘আচ্ছা তোমরা বস, আমি ওদিকে দেখছি।’

বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার কাছে পৌছার আগেই একজন এফবিআই অফিসার দ্রুত ঘরে প্রবেশ করল। জর্জ আব্রাহাম জনসনকে স্যালুট দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, সাংঘাতিক খবর স্যার। প্রেসিডেন্টের পিএস, ম্যাডাম জিনা জেফারসন, এয়ার লাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার এবং এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি অফিসারকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে এই ভিভিআইপি লাউঞ্জের প্রবেশ মুখের ঘরটায়।’

‘আহমদ মুসা কোথায়?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, আহমদ মুসাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।’ অফিসারটি বলল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দু’জনেই দাঁড়িয়ে উদ্বেগের সাথে কথা শুনছিল। অফিসারটির কথা শুনে সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সারা জেফারসন। মুহূর্তে যেন তার মুখের সব রক্ত শূন্য হয়ে গেছে।

আর মারিয়া জোসেফাইনের কাছে কথাটা এসেছিল বজ্রাঘাতের মতো। মুখের সব আলো দপ করে নিভে গিয়েছিল তার। তবে অন্ধকারের মধ্যে তার সামনে বিন্দুর মতো একটা আলো জ্বলজ্বল করছিল। তার সাথের সবাই সংজ্ঞাহীন, তিনি নেই। এর অর্থ শত্রুরা কাউকেই হত্যা করেনি। ওঁকে নিশ্চয় কিডন্যাপ করা হয়েছে।

‘হে আমার প্রভু আল্লাহ, তাঁকে নিরাপদ রাখুন’ বলে মারিয়া জোসেফাইন দু’চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

চোখ খুলে ফিরে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। দেখল মরার মতো পাণ্ডুর তার মুখ। উদভ্রান্ত তার দৃষ্টি। তার মানে নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তার নেই। মারিয়া জোসেফাইনর দ্রুত গিয়ে তার পাশে বসল। সান্তনা ও সাহস দেয়ার জন্যে তাকে বাম হাত দিয়ে পেচিয়ে ধরল।

সারা জেফারসনের মাথাটা এলিয়ে পড়ল মারিয়া জোসেফাইনের কাঁধের উপর।

চমকে উঠল জোসেফাইন। দেখল সারা জেফারসন সংজ্ঞা হারিয়েছে!

‘সারা মা, তোমরা একটু….।’

জর্জ আব্রাহম জনসন ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল সারা জেফারসনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সারা জেফারসনের অবস্থা দেখে দ্রুত ছুটে এল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘সারা সংজ্ঞা হারিয়েছে মা?’

‘জি হ্যাঁ, আংকেল। আমি সারাকে দেখছি। আপনি ওদিকে দেখুন আংকেল। ওরা এ সময়ের মধ্যে বিমান বন্দরের বাইরে না যেতে পারার কথা।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক মা, আমি ওদিকটা দেখি। আমি অ্যাটেনড্যান্টকে বলে যাচ্ছি।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল অ্যাটেনডেন্ট।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিয়েছে। অ্যাটেনড্যান্টকে দেখেই বলল, ‘আপনি এক বোতল ঠাণ্ডা পানি আনুন।’

‘এখানেই পানি আছে, আনছি ম্যাডাম।’

অ্যাটেনড্যান্ট চলতে শুরু করেছে। বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে তিনজন পুলিশ প্রবেশ করল।

শব্দ পেয়ে মারিয়া জোসেফাইন পেছন ফিরে তাকাল। দেখল তিনজন পুলিশকে। তাদের চোখে-মুখে শুধু ব্যস্ততা নয়, সংশয়-শংকাও। একটু অবাকও হলো। হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে দেখল ওদের একজনের হাত দ্রুত একটা রিভলবার বের করল। রিভলবারের সাইজ দেখে চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন। ওটা তো গ্যাসগান! বুঝতে পারল জোসেফাইন যে কি ঘটতে যাচ্ছে।

এই চিন্তার চেয়েও দ্রুত জোসেফাইনর হাত পৌছে গেছে তার কোটের পকেটে। দ্রুত হাত বেরিয়ে এল এক ছোট রিভলবার নিয়ে। হাত উপরে তোলার মতোও সময় ব্যয় করল না মারিয়া জোসেফাইন। পকেট থেকে বের করে হাত নিচু অবস্থানে রেখেই ডিফিক্যাল্ট অবস্থান থেকে ডিফিক্যাল্ট অ্যাংগেলে গুলি করল জোসেফাইন।

পুলিশের রিভলবারও টার্গেটে উঠে এসেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার থেকেই প্রথমে গুলি বেরিয়েছিল। গুলিটা পুলিশ লোকটির একেবারে বুকে বিদ্ধ হয়েছিল।

গুলিটার আঘাত পুলিশ লোকটির দেহে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি করেছিল, তাতেই তার হাত থেকে গ্যাসগানটা খসে পড়ল।

ওদের তিনজনের একজন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আগেই মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার ধরা হাত পুলিশ দু’জনের প্যারালালে উঠে এসেছিল। দ্বিতীয় পুলিশ যখন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তৃতীয় িএ পুলিশটিও তখন পকেট থেকে রিভলবার বের করেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার টার্গেটে েএসে মুহূর্তও দেরি করেনি। গুলি করেছিল রিভলবার হাতে নেয়া তৃতীয় পুলিশকে।

সাথী দ্বিতীয় পুলিশ গ্যাসগান হাতে পাবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তৃতীয় পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ততার সাথে তার রিভলবার বের করেছিল। সারা জেফারসন, মারিয়া জোসেফাইন যাকেই পাওয়া যাক সংজ্ঞাহীন করে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ, হত্যার কথা তাদের বলা হয় নি। এই দ্বিধাগ্রস্ততা তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। মারিয়া জোসেফাইনের আগে সে রিভলবার ট্রিগার চাপতে পারেনি। অসহায়ভাবে তাকে বুক পেতে নিতে হলো মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবারের গুলি।

মারিয়া জোসেফাইন দ্বিতীয় গুলি করেই তার রিভলবারের নল নামিয়ে নিয়ে এল অবশিষ্ট পুলিশটার দিকে।

মারিয়া জোসেফাইন ইতিমধ্যেই খেয়াল করেছিল, প্রত্যেক পুলিশই গ্যাসগান হাত করার জন্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওরা গ্যাসগান হাতে পেলে এবং সুযোগ পেলে কি হতো সেটাও সে বুঝে ফেলেছে।

গ্যাসগানের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া পুলিশটি গ্যাসগানটি হাতে পেয়ে শোয়া অবস্থাতেই হাত সামনে নিয়ে আসছিল।

মারিয়া জোসেফাইন আগের মতোই রিভলবার টার্গেটে নামিয়ে আনার পরে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি। ট্রিগারে তর্জনি রাখাই ছিল, ট্রিগারটা চাপল মাত্র।

গ্যাসগানটা ফায়ার করার জন্যে সে সামনে এগিয়ে আনার সাথে সাথেই মাথা তুলেছিল। এবার তার মাথাটাই মারিয়া জোসেফাইনের গুলির শিকার হলো। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই তার দেহটা এলিয়ে মেঝের উপর পড়ল।

গুলির শব্দে জর্জ আব্রাহাম জনসনসহ কয়েকজন পুলিশ ও এফবিআই অফিসার কক্ষটিতে ছুটে এসেছে।

সারা জেফারসনও সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে উঠে বসেছে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এসে মারিয়া জোসেফাইনের পাশে দাঁড়াল। একজন পুলিশ অফিসার ছুটে গেল নিহত পুলিশদের দিকে।

‘কি ঘটেছে ম্যাডাম জোসেফাইন? ওরা তো পুলিশ?’ জর্জ আব্রাম জনসনের চোখে-মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুই-ই।’

‘ওরা গ্যাসগান ফায়ার করতে যাচ্ছিল। ওদের পায়ে দেখুন কেটস, ফরমাল বুট নয়। ওরা পুলিশ নয়।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

যে পুলিশ অফিসারটি নিহত তিনজনের দিকে গিয়েছিল, সে ওদের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখে বলল, ‘স্যার, এরা আমাদের পুলিশ নয়। এরা ইউনিফরম যোগাড় করেছে কোনভাবে।’

জর্জ আব্রাহাম জনসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে ফিরে একটা বাউ করে বলল, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, আপনি নিজেদেরসহ দুই শিশুরও জীবন রক্ষা করেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমার দিয়ে ধরে গ্যাসগানটা তুলে নিল। ইন্ডিকেটরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুল লোডেড নয় গ্যাসগানটা। আরও ব্যবহার হয়েছে। এই গ্যাসগানটাই কি আহমদ মুসাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে? না পেছনে এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে?’

স্বগত কথাগুলো শেষ করেই সামনের পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘তুমি ওদিকে দেখ। নিশ্চয় এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। আহমদ মুসাদের দিকে যারা গিয়েছিল, তারা অন্য টিম হতে পারে।’

অফিসারটি স্যালুট করে দ্রুত চলে গেল।

মোবাইল বেজে উঠল জর্জ আব্রাহামের। মোবাইল ধরেই বলল, ‘কি বব কার্টার, ঠিক সময়েই বিমান বন্দর ক্লোজ হয়েছিল? কি খবর ওদিকের?’

‘স্যার, সঙ্গে সঙ্গেই বিমান বন্দর ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্যার, খবর পাওয়া গেছে, বিমান বন্দর ক্লোজ করার ঠিক এক মিনিট আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জের সর্ব বামের একজিট দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে একজন যাত্রীর ফেরত মাল হিসাবে। পুলিশ …।’

অফিসার কার্টারের কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম দ্রুত কণ্ঠে বলল উঠল, ‘যে গাড়িতে উঠেছে এবং যে যাত্রীর মাল বলা হচ্ছে, তার হদিস হওয়া দরকার।’

‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে গাড়ির নাম্বার বের করা হয়েছে। সে নাম্বার সব পুলিশ ও ট্রাফিককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাত্রীটির কোন ট্রেস করা যায় নি স্যার। খোঁজ নেয়া হয়েছে, কোন যাত্রী কাউন্টার থেকে ঐ ধরনের বাক্স ফেরত দেয়া হয়নি এবং ঐ বর্ণনার কোন বক্স স্ক্যানও হয়নি।’ বলল বব কার্টার।

‘ধন্যবাদ বব, তোমাদের কাজে ত্রুটি নেই। এখন দেখ, বাক্সটা ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে কিভাবে গেল। ভেতরের কারও যোগসাজশ আছে কিনা? আর শোন, ওদের আরও লোক থাকতে পারে ভেতরে, তাদের খোঁজ কর। ও.কে, বাই।’

কথা শেষ করে কল ফল করতেই আবার তার মোবাইল বেজে উঠল।

প্রেসিডেন্টের কল।

তাড়াতাড়ি মোবাইল তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি টেলিফোন করেছিলাম।’

‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কি করে এ ঘটনা অমন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ঘটতে পারল!’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, যেভাবেই হোক ওদের একাধিক লোক ভিভিআইপি লাউঞ্জের এন্ট্রি লাউঞ্জে গোপনে অবস্থান নিয়েছিল। তারা আগেই এই লাউঞ্জের সিকিউরিটির দায়িত্বে দু’জন গোয়েন্দা ও একজন অ্যাটেনড্যান্টকে সংজ্ঞাহীন করে আড়ালে রেখে দেয়। এরপর আহমদ মুসাসহ আমাদের লোকরা এন্ট্রি লাউঞ্জে প্রবেশ করার সাথে সাথেই গোপন স্থান থেকে গ্যাসগান ফায়ার করে তাদেরকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলে এবং আহমদ মুসাকে নিয়ে যায় তারা। তাদের পরনে এয়ারপোর্ট পুলিশের পোশাক ছিল। পথে অন্য কক্ষের কয়েকজন তাদের দেখেছে, তাদেরকে ওরা একজন ভিআইপি যাত্রী বলে পরিচয় দিয়েছে এবং অসুস্থ হওয়ার কথা বলে দ্রুত বেরিয়ে গেছে। ওদের কোন গাড়ি বা চিহ্ন কিছুই পাওয়া যায় নি। এই ভয়ানক খবরের…।’

এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামের কথার মাঝখানে প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আহমদ মুসার খবর পেলেন সেটা বলুন মি. জনসন।’ প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে কিছুটা অস্থিরতা।

‘মি. প্রেসিডেন্ট স্যার, এই মাত্র জানলাম আমরা বিমান বন্দর সিল করে দেয়ার মিনিট দুই আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জ দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে। আমরা আশংকা করছি, সেই বাক্সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও গড! তারপর?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমরা গাড়িটার নাম্বার পেয়েছি। গাড়িকে পাকড়াও করার জন্যে চেষ্টা করা হচ্ছে। স্যার, ইতিমধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। একটু সুখবরও আছে। আমরা যখন আহমদ মুসার ব্যাপার নিয়ে ওদিকে ব্যস্ত তখন আহমদ মুসার স্ত্রী-সন্তানদের কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হয়। পুলিশের ছদ্মবেশে ওরা তিনজন আসে এবং এখানে গ্যাসগান ব্যবহার করে ওদের সংজ্ঞাহীন করার চেষ্টা করে। ম্যাডাম আহমদ মুসা গুলি করে তিনজনকেই হত্যা করে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ভয়ানক এক বিপদ থেকে আমাদের ঈশ্বর রক্ষা করেছেন। ওরা কোথায়? ম্যাডাম আহমদ মুসাকে অভিনন্দন ও সমবেদনা দুই-ই জানাও। আর সারা কোথায়?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘এখানেই স্যার। আহমদ মুসার আকস্মিক খবরে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সারা। এখন ভালো আছে স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এই ঘটনা কারা ঘটাল, কিছু অনুমান করেছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আমেরিকায় যারা আহমদ মুসার শত্রু ছিল সবাই এখন তার বন্ধু, শুধু ইসরাইলি লবি ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী গোয়েন্দা গ্রুপ ছাড়া। এদের দিকেই প্রাথমিক সন্দেহ যায়। তবে ওদের তিনজন লোকের যে ডেড বডি পাওয়া গেছে তা-সহ অন্যান্য আলামত পর্যালোচনা করলে চূড়ান্ত কথাটা বলা যাবে স্যার। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা এফবিআই হেড কোয়ার্টারে মিটিং-এ বসছি স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ। আহমদ মুসার ব্যাপারে তোমাকে আমার বলা কিছু নেই। তার অমূল্য সার্ভিসের বিনিময়ে তার জন্যে যা করার তা করতে আমেরিকা গৌরববোধ করবে। শুধু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হিসাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি উদ্বিগ্ন আহমদ মুসার জন্যে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমাদের যা সাধ্য, সবই আমরা করবো তার জন্যে মি. প্রেসিডেন্ট স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আর মি. জর্জ জনসন, আহমদ মুসার পরিবার এবং সারা জেফারসনের পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘অবশ্যই স্যার।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ। তুমি টেলিফোনটা ম্যাডাম আহমদ মুসাকে দাও।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইয়েস স্যার। আমি দিচ্ছি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন মোবাইলটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম, মি. প্রেসিডেন্ট স্যার কথা বলবেন।’

মারিয়া জোসেফাইন সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। মোবাইলটা নিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছ থেকে। ‘গুড মর্নিং, এক্সিলেন্সি। আমি জোসেফাইন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। মর্নিংটা আমাদের গুড হয়নি। যা ঘটেছে তা নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। আহমদ মুসা আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘জানি এক্সিলেন্সি। আপনাদের এই শুভেচ্ছার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। কিন্তু তার জন্যে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা তাঁকে উদ্ধারের জন্যে যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করবো। সব আমেরিকানের সমবেদনা আপনাদের প্রতি। আমি জানি, ধৈর্য্য ধরার অসীম শক্তি আপনার আছে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘ধৈর্য্য ধারণ ও আল্লাহর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এই বিশ্বচরাচরের সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। যা কিছুই ঘটেছে তা তাঁর জানা ও শক্তির বাইরে নয়। সুতরাং তাঁর উপর আস্থা রাখলে কোন কিছুতে উদ্বেগ-কাতর হওয়া বেমানান।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথার মধ্যে আহমদ মুসার কণ্ঠ পেলাম। ধন্যবাদ। আমার অনুরোধ, প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় আমার সাথে কথা বলবেন। আমাদের সারা তো আপনার পাশেই থাকবে। আপনার কোন অসুবিধা হবে না। বাই, ম্যাডাম।’

মারিয়া জোসেফাইন আবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।

মোবাইল রেখে দিল জোসেফাইন।

মারিয়া জোসেফাইনের কথা শেষ হতেই সারা জেফারসন এসে জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আপা, স্যরি। একদিকে ভীষণ বিপদ, অন্যদিকে আমি আপনাদের বিব্রত করে ফেলেছিলাম।’

‘অবশ্যেই না বোন। বিব্রত হওয়ার প্রশ্ন আবার কেন? আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। ক’দিন থেকে তোমার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। আল্লাহর হাজার শোকর যে তুমি তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়েছ।’ বলল জোসেফাইন।

‘আজ আমি ভালো আছি। কিন্তু হঠাৎ যেন কি হয়ে গিয়েছিল। একটা হাতুড়ির ঘা এসে বুকে আঘাত করল। মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।’ সারা জেফারসন বলল।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি নিজেও জান না সারা, অনেক দিনের অনেক দূরত্বের পর তোমার হৃদয় তার অবচেতনে ওর সাক্ষাতের স্বপ্নে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। হৃদয়ের নিভৃত নরম অন্তরদেশ আঘাতটা সহ্য করতে পারেনি, সারা।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলল, ‘ওঁর কি হলো, কেন এমন হলো আপা! ওঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানতা নিশ্চয় যথেষ্ট হয়নি!’

‘ধৈর্য্য ধরতে হবে বোন। আল্লাহ ওর নেগাহবান। উনি আসছিলেন আমাদের বিপদের কথা শুনে, কিন্তু বিপদটা এল ওর উপর। জানি না, আল্লাহর ইচ্ছা কি! তবে জানি সারা, যিনি সবার নিরাপত্তার কথা ভাবেন, আল্লাহ নিজে তাঁর নিরাপত্তার দিকটা দে-খ-বে-ন।’ মারিয়া জোসেফাইনের কণ্ঠও কান্নায় আটকে গেল।

মোবাইলে কথা বলছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা বলার জন্যে সরে গিয়েছিল ঘরের এক প্রান্তে। কথা শেষ হলে সে দ্রুত মারিয়া জোসেফাইনদের দিকে এগিয়ে এল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘সারা মা, তোমার মা-সহ সবাইকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তোমরা হাসপাতালে যাবে নিশ্চয়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘জি আংকেল, আমরা হাসপাতালে যাব।’ সারা জেফারসন বলল।

‘তাহলে এস মা, বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমাদের গাড়ি সাথে যাবে, কিন্তু তোমরা পুলিশের গাড়িতে যাবে। এস মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

চলতে শুরু করল সবাই।

‘এত দুঃসাহসিক, সুপরিকল্পিত কাজ কারা করল বলে আপনার ধারণা আংকেল?’ বলল সারা জেফারসন।

‘জায়নবাদী লবি বা তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকেই প্রথম নজর। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সরকারের সাথে তাদের চ্যালেঞ্জে আসাটা বাস্তব মনে হচ্ছে না। কিন্তু তারা ছাড়া তো মি. আহমদ মুসার বিরোধী উল্লেখযোগ্য কোন শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। বিষয়টা আমার কাছে এখনও জটিল। আলামতগুলো নিয়ে আরও ভাবতে হবে আমাদের। ম্যাডাম জোসেফাইনের কারণে আমরা ওদের তিনটা লাশ পেয়েছি। ঐগুলো এখন আমাদের মূল্যবান লিংক। এছাড়া আমরা সব অপশনই চেক করছি।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল, যারাই এটা করুক। তারা শক্তির নয়, বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ হত্যাও এড়িয়ে গেছে।’ বলল সারা জেফারসন।

দাঁড়িয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘একটা মূল্যবান পয়েণ্ট তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু মোসাদ কিংবা ইরগুন জাই লিউমির নেই।’

‘এমন নতুন শত্রু কে হতে পারে? আর ওরা আহমদ মুসার সাথে আমাদেরকেও কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল কেন? কেন শুধু কিডন্যাপ, কেন হত্যা নয়? আংকেল আমার মনে হয় এ প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ধন্যবাদ মা সারা। প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল। বাচ্চা অথবা তোমাদের সবাইকে কিডন্যাপ করার একটা অর্থ হতে পারে, তারা আহমদ মুসার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। আর চাপের বিষয়টি প্রমাণ করে, তারা বড় অন্য কিছু পেতে চায়। সেটা কি? শত্রুকে চেনার আগে বোধ হয় এ প্রশ্নের জবাব মিলবে না।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল সবদিকের বিচারে ঘটনাকে খুব বড় মনে হচ্ছে। বড় বলেই ওঁর নিরাপত্তার ঝুঁকিও বড় হতে পারে। ওরা খুব বেশি সময় আমাদের নাও দিতে পারে।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ঠিক মা সারা, এটাই আমাদের জন্যে ভাবনার বিষয়।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ আংকেল।’ বলল সারা। গাড়ি বারান্দায় তারা এসে গিয়েছিল।

পরপর তিনটা গাড়ি দাঁড়ানো।

মাঝখানে শেভ্রলেট কার। ড্রাইভিং সিটে একজন পুলিশ।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত এগিয়ে গাড়ির দরজা খুলে মারিয়া জোসেফাইনেকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম আসুন।’

‘থ্যাংকস আংকেল’ বলে গাড়িতে উঠল মারিয়া জোসেফাইন।

ওপাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে সারা জেফারসন। পেছনের বেবি সিটে উঠল আহমদ আবদুল্লাহ।

সামনে ও পেছনের দুই গাড়িতে উঠল পুলিশের দুটি দল।

চলতে শুরু করল তিনটি গাড়ি।