৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

কোলে ঘুমিয়ে পড়া আহমদ আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত আদরের সাথে তুলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল সারা জেফারসন।

সারা জেফারসনের বেডে তার বালিশের পাশেই ছোট একটা বালিশ আহমদ আব্দুল্লাহর জন্যে। মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের ঘরের মাঝখানের ঘরটি আহমদ আব্দুল্লাহর। সেখানেই তার বেড। কিন্তু সারা জেফারসনকে ছাড়া সে শুতে চায় না। ঘুমানোর পর তাকে তার বেডে রেখে এলেও ঘুম ভাঙলে সে ছুটে চলে আসে। মারিয়া জোসেফাইন শেষে অনুমতি দিয়েছে, ‘ঠিক আছে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনের কাছে ঘুমাবে। অনেক দিন পর সারা জেফারসনকে সে দেখছে তো তাই কাছে কাছেই থাকতে চাচ্ছে আবার পালিয়ে না যায় সেই ভয়ে।’ বলে মুখ টিপে হেসেছে মারিয়া জোসেফাইন। সারা জেফারসন হেসে প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘আমি পালাইনি। আমি আহমদ আব্দুল্লাহকে বলেই এসেছিলাম তুমি বুঝতে পারনি।’ কিন্তু আমার কাছ থেকে পালিয়েছিলে।’ বলেছিল মারিয়া জোসেফাইন। সলজ্জ হেসে সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘প্লিজ আপা, সে অতীতের কথা তুল না। মাফ কর প্লিজ।’ মাফ তোমাকে তখনি করেছি আমি। আমি তোমার মতোই তো মেয়ে, তোমাকে বুঝব না। কিন্তু ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। শুধু আমি নই, উনি মানে আহমদ আব্দুল্লাহর আব্বা, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি জান, নিজেকে নিজের মধ্যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছিল।’ বলেছে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইনের এই কথার পর সারা জেফারসন কোন কথা বলতে পারেনি। আকস্মিক এক বেদনার ঝলকে শক্ত হয়ে উঠে তার মুখ। একটা অজুহাত তুলে সে পালিয়ে বাঁচে।

আহমদ আবদুল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা আদরের চুমু খেয়ে উঠে বসল সারা জেফারসন। কিন্তু চোখ সরাতে পারল না আহমদ আবদুল্লাহর মুখ থেকে। কপাল ও চোখ ঠিক আহমদ মুসার মতো। গাল, ঠোঁট ও মুখের আদল একদম মায়ের, আবার দাঁত ও হাসি একেবারে আহমদ মুসার। দু’জনের অপরূপ প্রতিচ্ছবি ঘুমন্ত আহমদ আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে থাকতে গিয়ে এক সময় মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল সারা জেফারসনের মুখ। মনে পড়ল আহমদ আবদুল্লাহর আমেরিকা আসার প্রথম দিনের কথা। সে ও তার মা জিনা জেফারসন এয়ারপোর্টে গিয়েছিল ওদের রিসিভ করতে। সারা জেফারসনকে দেখেই আহমদ আবদুল্লাহ ছুটে এসেছিল। সারার হাতে ছিল ফুলের তোড়া। ফুল দিতে গিয়েছিল সে আহমদ আবদুল্লাহকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ তার ছিল না। সোজা ছুটে এসে সে জড়িয়ে ধরেছিল সারা জেফারসনকে। ‘মাম্মি মাম্মি’ বলে মিষ্টি চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কিছুটা বিব্রত হলেও সারা জেফারসন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। হাতের ফুলের তোড়া মেঝের উপর ছেড়ে দিয়ে তুলে নিয়েছিল আহমদ আবদুল্লাহকে। বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল, ‘মাম্মি নয় বেটা; আন্টি বলতে হয়।’ কিন্তু সংগে সংগেই আহমদ আবদুল্লাহ প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, আমি মাম্মি বলব। আম্মিকে তো আমি আম্মি বলি।’ সারা জেফারসন আর কোন যুক্তি না দিয়ে আহমদ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনকে মাম্মি বলেই ডাকে। মারিয়া জোসেফাইন বলেছে, ‘আমি আন্টি বলতে বলাতে সে একই যুক্তি দিয়েছে, আপনাকে আম্মি বললে ঐ মাম্মিকে মাম্মি বলব না কেন।’ সারার মা জিনা জেফারসন বলেছে, ‘বাচ্চারা বেহেশতের ফুল। যা ভালো লাগে বলুক। তোমরা তাকে কিছু বলো না।’ বলবে কি সারা তাকে! ওর কচি কণ্ঠের সুন্দর মাম্মি ডাক তার প্রাণ ভরে দেয়। প্রতি ডাকেই ইচ্ছা করে বুকে জড়িয়ে ধরতে।

আহমদ আবদুল্লাহর গায়ে কম্বলটা একটু ভালো করে তুলে দেয়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের বুক থেকে। অবুঝ শিশু আহমদ আবদুল্লাহ তাকে যতটা বিব্রত করেছে, তার চেয়ে বড় বিব্রতকর বিষয় তুলেছে মারিয়া জোসেফাইন আপা। জোসেফাইন আপারা আসার কয়েকদিন পর সেদিন অনেক রাতে অনেক গল্পের পর এই বেডেই সারা জেফারসনের মাথা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘সারা, তোমাকে তো আমি নিতে এসেছি।’ আমি কথাটা বুঝিনি। বলেছিলাম, ‘কোথায় নিতে এসেছ?’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমার করে নিতে এসেছি।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘আমি তো তোমার আছিই। না হলে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আমার কাছে এলে কেমন করে! ধন্যবাদ তোমাকে।’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমি তোমাকে চিরদিনের করে নিতে এসেছি। আমরা পাশাপাশি থাকব। আমরা দুই স্রোত এক মোহনায় গিয়ে সাগরে মিশব। সে সাগর হবে আমার তোমার ভালবাসার ধন আহমদ মুসা।’ জোসেফাইন আপার কণ্ঠ শেষে এসে আবেগে ভেঙে পড়েছিল। জোসেফাইন আপার কথায় আমার সমগ্র সত্তা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে উঠেছিল। আমি উঠে বসতে গিয়েছিলাম। জোসেফাইন আপা আমাকে উঠতে দেয়নি। শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছিল। তার বাহুবন্ধনে আটকে থেকে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে আমি তার দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম আমার মুখে কোন কথা সরেনি। আমার ভাবনার অতীত এমন একটা বিষয়কে সে কিভাবে আমার কাছে পাড়তে পারল। জোসেফাইন আপাও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর আপাই নীরবতা ভেঙে বলেছিল, ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা দেখছি তোমার! ভাবছ এ প্রস্তাব কেমন করে তোমাকে দিলাম ফরাসি মেয়ে হিসাবে এমন প্রস্তাবের মুখে তোমর মতোই আমার অবস্থা হতো। কিন্তু দেখ, আমি সেই ফরাসি মেয়েই এক সময়ের অকল্পনীয় একটা বিষয় তোমাকে বলেছি! বলতে পারছি কারণ, বাস্তব ধর্ম ইসলাম, জীবনের ধর্ম ইসলাম আমাকে বাস্তববাদী বানিয়েছে; জীবনবাদী বানিয়েছে।’ অসম্ভব নরম কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিল জোসেফাইন আপা। অন্তরের কথা অন্তর স্পর্শ করে। আমারও তাই হয়েছিল। আমি আর পাল্টা কিছু না বলে কেঁদে ফেলে বলেছিলাম, ‘আমিও মুসলিম আপা, আমি এ ব্যাপারে পড়েছি। যেহেতু আল্লাহ একে অপরিহার্য করেননি, তাই একে আমি সম্পূর্ণভাবেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।’ জোসেফাইন আপা আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমিও একে অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্চিত, অনাকাঙ্খিত বলে মনে করি। আমার ও তোমার মতো প্রতিটি মেয়েই এ কথা বলবে। আমাদের মনে এ কথা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন না, জানতেন না? জানতেন। তা না হলে এই ব্যবস্থা তিনি রাখলেন কেন? এ নিয়ে তুমি নিশ্চয় ভাবনি, আমি অনেক ভেবেছি। ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই ব্যবস্থা না রাখলে মানুষের প্রতি অবিচার করা হতো, ইসলাম স্বাভাবিক ও মানবিক ধর্ম হতোনা।’ বলে জোসেফাইন আপা আমাকে আরও কোলে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘তোমার কথা ভাবতে গিয়ে আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে এসেছিল। আর সেই সাথে আমার হৃদয়টা আতংকে কেঁপে উঠেছিল, আল্লাহ এই ব্যবস্থা না রাখলে কি করতাম! আমার তখন কি মনে হয়েছিল জান? মনে হয়েছিল, সৃষ্টির আগেই আল্লাহ যেন তোমার এ কথা জানতেন!’ অসীম মমতায় ভরা জোসেফাইন আপার নরম কথাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। পাল্টা কিছু বলতে না পেরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না আপা। জীবনের সবকিছুই আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।’ জোসেফাইন আপা আমার চোখ মুছে দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, বলতেও হবে না। মনে রেখে, প্রেম স্বর্গীয়। যারা এর পবিত্রতা বজায় রাখে, আল্লাহ তাদের পুরষ্কৃত করেন। তোমার পবিত্র প্রেম, তোমার অতুলনীয় ত্যাগ আমরা কেন, আল্লাহ স্বয়ং বৃথা যেতে দেবেন না। আমি আজ তোমাকে যা বলছি, তা আল্লাহরই ইচ্ছা বোন!’ জোসেফাইন আপার এই কথার পর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছিল আমার মুখ। বলেছিলাম, ‘আর বলো না আপা। আমি ক্লান্ত, আমি দুর্বল, আমার বুক এত ভার সইতে পারছে না। একটা অসম্ভবকে ধারণ করার শক্তি আমার নেই।’ জোসেফাইন আপা ‘থাক, আর নয়’ বলে আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ঘুমাও। আমি একটু মাথায় হাত বুলাই।’ সত্যিই তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পরদিন সকালে উঠে নামাজ পড়েই আমি তার ঘরে ছুটে গিয়ে তার বিছানায় তাকে ধরেছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্যরি আপা, কাল কতক্ষণ ছিলে জানি না। আমি তোমাকে ‍ভুগিয়েছি। স্যরি।’ জোসেফাইন আপা মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘স্যরি আমাকেই তো বলতে হবে। তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছি।’ মনে পড়ল রাতের কথা। রাজ্যের লজ্জা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করেছিলাম, ‘গোটাটাকেই রাতের প্রথম প্রহরের একটা স্বপ্ন বলে মনে কর।’ বলে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু জোসেফাইন আপা একটু ঝুঁকে খপ করে আমার একটা হাত ধরে আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘দুষ্টু, আমার অত কথা সব স্বপ্ন হয়ে যাবে। তা হচ্ছে না….।’ তার কথার মধ্যেই আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলেছিলাম, ‘আমি আহমদকে নিয়ে বাগানে বেড়াতে যাচ্ছি।’

আহমদ আবদুল্লাহর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সারা জেফারসনের চোখ এক সময় অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। শেষে তা আবার দুষ্টুমির আনন্দে ভরে যায়- সে দিনের সে পালানোর কথা মনে পড়ায়। আহমদ আবদুল্লাহর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, সত্যি জোসেফাইন আপার কোন তুলনা হয় না, চুম্বকের মতো মানুষকে কাছে টানতে পারে, আপন করে নিতে পারে। তার সামনে দাঁড়ালে আমি যেন এক বালিকার মতো ছোট হয়ে যাই। মনে হয়, আমাকে আদেশ দেয়া, বকা, শাসন করা সবই তার অধিকার। আবার কোলে টেনে যখন আদর করে তখন মনে হয় এটা বড় বোনের কাছে ছোট বোনের অধিকার এবং এটা আমার প্রাপ্য।

দরজায় নক করার শব্দে সারা জেফারসন ফিরে তাকাল দরজার দিকে। দেখল দরজায় দাড়িয়ে মারিয়া জোসেফাইন।

‘আহমদ আবদুল্লাহ নিশ্চয় ঘুমিয়েছে? আসতে পারি ম্যাডাম।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, ম্যাডাম অনুমতি দেবে না। সারা অনুমতি দিতে পারে।’ সারা জেফারসনও বলল হেসে।

‘আমি আমার বোন সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’ মারিয়া জোসেফাইনও হেসে বলল।

‘না হলো না, বল আমার প্রিয় বোন সারার কাছে।’ বলল সারা দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে।

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আমার প্রিয় বোন, আমার প্রিয়তম বোন, আমার সোনা বোন, সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’

‘যদিও এক বিশেষণের জায়গায় তিন বিশেষণ এসেছে, যা চাওয়ার খেলাফ, তবুও অনুমতি মঞ্জুর।’ বলল সারা জেফারসন যাত্রা দলের অভিনয়ের মতো করে।

হেসে মারিয়া জোসেফাইন প্রবেশ করল ঘরে।

উঠে দাঁড়িয়েছিল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

জোসেফাইন গিয়ে সারা জেফারসনকে ধরে নিয়ে বেডে বসে পড়ল। সারার মাথা কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, ঘুম নষ্ট করতে এলাম। ঘুমাতে যাচ্ছিলে তুমি।’

‘আবার ম্যাডাম?’ শাসনের স্বরে বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ম্যাডামের চেয়ে বড়। আহমদ মুসার কাছ থেকে সব শুনেছি। তুমি একটা মহান আন্দোলনের নেত্রী। তুমি আমেরিকার নতুন প্রজন্মের মুখপাত্র।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন হেসে বলল, ‘নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছি। প্রয়োজনও আর নেই। উনি আমেরিকাকে রাহুমুক্ত করার পর নতুন আমেরিকার জন্ম হয়েছে।ৎ

‘কিন্তু উনি বলেন সারা, রাহুমুক্ত করার চাইতে রাহুমুক্ত দেশ গড়ার কাজ অনেক কঠিন। তোমাদের কাজ আরও বেড়েছে।’

‘উনি যতদূর দেখতে পান, আমি মানে আমরা তা পাই না।’ হেসে বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন মুখ টিপে হেসে সারা জেফারসনের কাঁধের উপর একটা মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘দেখতে না পেলে স্বপ্ন দেখ কি করে, তোমার দাদুদের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন?’

চমকে উঠে সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের চোখের দিকে। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘উনি বোধ হয় তোমাকে সব বলেন?’

সারা জেফারসনকে আরও নিবিড়ভাবে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘উনি যা করেন, যা বলেন, যা শোনেন, সবই আমাকে বলেন। আমিও বলি। আমাদের মাঝে ব্যক্তিগত বলে কোন বিষয় নেই।’

‘সবটুকু দিয়ে তুমি তাকে ভালোবাস, তাই না?’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, অবশ্যই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সবটুকু দিয়ে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন, তাই না?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।

‘হ্যা, অবশ্যই সারা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমিও এটা জানি আপা। তিনি ও তুমি এই দুই ভালো মানুষের জন্যে এটাই স্বাভাবিক। তোমাদের মধ্যে কোন ‘তৃতীয়’-এর উপস্থিতি অসম্ভব আপা, এমন আশা তুমি করতে পার না!’

‘ও তুমি আমার অস্ত্রে আমাকে আক্রমণ করেছ! ভুলে গিয়েছিলাম তুমি পলিটিশিয়ান।’ হেসে কথাগুলো বলে গম্ভীর হলো মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘পারি আমি সারা জেফারসন। কারণ আমি তাঁকে ভালোবাসি, ওঁর প্রতি আমার ভালোবাসাকে আমি চিনি। সে ভালোবাসা একান্ত আমারই ভালোবাসা, ‘কোন তৃতীয়’-এর ভালোবাসা এবং তার স্থানেও এটা নয় সারা।’ মারিয়া জোসেফাইনের গম্ভীর কণ্ঠ সীমাহীন এক আবেগে ভেঙে পড়ল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, দু’টোকে এক করো না। তোমার এই ভালোবাসার কোন দ্বিতীয় নেই।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার ভালোবাসাকে তুমিই জান না সারা। তোমাকে দেখার আগে তোমার স্বপ্নের কথা আমি শুনেছি। একে তুমি তোমার ভবিতব্য মনে কর, সেটা আমি জেনেছি। তোমার চিঠিটাও আমি পড়েছি। তোমার এই ত্যাগ কত বড় তুমি জান না। তার ইস্তাম্বুল মিশনে তুমি অলক্ষে তার পাশে দাঁড়িয়েছ। নিজের নিরাপত্তার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে তার নিরাপত্তার কথা ভেবেছ। সব শেষে অলক্ষেই তুমি ইস্তাম্বুল ছেড়েছ। এই ত্যাগ অমূল্য সারা। ভালোবাসা সাগরের মতো অতল, আর আকাশের মতো অসীম না হলে নীরবে এই ত্যাগ কেউ করতে পারে না সারা। তোমার পবিত্র এই প্রেম তোমার সাথে আমাকে একাত্ম করেছে সারা। তাতিয়ানা, মেইলিগুলি, ফারহানা, মেরীদের কেউ নেই। ওদের হারিয়েছি, দেখারও সৌভাগ্য হয়নি ওদের। তোমাকে পেয়ে হারাতে পারবো না। তাই ছুটে এসেছি আমি তোমার কাছে। তোমাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।’

‘আপা, তোমার কোন কথাই আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু আপা, তুমি অসম্ভব এক দাবি নিয়ে এসেছ। সারাজীবন আমি কুমারী থাকার চেয়েও ওটা কঠিন। সব ভালোবাসাই সফল হয় না, ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েও জীবন কাটানো ….।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মুখ চেপে ধরল। বলল, ‘এসব কথা বলতে হবে না। একটা হালালকে হারাম করতে চেয়ো না।’

‘এটা হারাম করা নয়, একটা হালালকে গ্রহণ করতে না পারা।’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, একটা হালালকে গ্রহণ না করার অধিকার আছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। যখন কোন হালাল বর্জন করা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন বর্জন করা বৈধ হয় না।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘কিভাবে ক্ষতি করছি বা আমার সিদ্ধান্তে কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে?’ বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের গালে একটা চিমটি কেটে আদর করে বলল, ‘ক্ষতি দেখতে পাচ্ছ না, ন? এক. তোমার জীবনের সীমাহীন ক্ষতি, দুই. আহমদ মুসার কষ্ট।’

চকিতে মুখ তুলে তাকাল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখে তার বিস্ময় ! বলল, ‘আমার যে বিষয়টাকে ক্ষতি বলছ, তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাঁর কষ্ট কিভাবে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা, তোমার কষ্ট অনেকটাই সবাক। সবাই দেখবে, অনেকেই বুঝবে। কিন্তু উনি কোন্ কষ্টের শিকার ! তুমি যে চিঠি ওঁর কাছেঁ লিখেছিলে, তাতে ওঁর অশ্রুর অনেকগুলো ফোঁটার চিহ্ন রয়েছে। আর….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আর বলো না আপা। আমি শুনতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম ….।’ ভেঙে পড়া কণ্ঠ তার থেমে গেল।

‘কি ভেবেছিলে?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভেবেছিলাম তাঁর মতো অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ, জটিল সব মিশন নিয়ে যার কাজ, দুঃখী, বিপদগ্রস্ত মানুষের চিন্তা যার মাথায় সব সময়, তিনি কি করে আমেরিকার একটা মেয়েকে নিয়ে ভাববেন! তার কষ্টের কথা তো আমি চিন্তাই করিনি।’ বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে জেফারসন।

‘না সারা, তুমি তার প্রতি অবিচার করেছ। তিনি শুধু নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষায় এত বড় বড় ও জটিল মিশন নিয়ে কাজ করেন আর সেটা এ জন্যই করেন যে, তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। যারা মানুষকে এভাবে ভালোবাসে তাদের হৃদয়-মন হয় অসম্ভব সংবেদনশীল। তার এই সংবেদনশীল মন এক বোবা যন্ত্রনার সব সময় বিপর্যস্ত হয়েছে। তুমি….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘তুমি এভাবে বলো না আপা। তাঁকে সত্যিই আমি বুঝিনি। আমি মনে করেছিলাম, পাথরের মতো কঠিন চরিত্র ওঁর। এসব ব্যাপার ওঁর জন্যে কোন সমস্যা নয়, আমি আমাকেই শুধু সমস্যা মনে করেছি। আমি আমাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আপা। আরও মনে করেছি আপা, ইসলামের যে কঠোর নৈতিকতা অনুসরণ করেন তিনি, আমার অন্যায় ও অনৈতিক চিন্তা তাঁর কাছে আমলই পাবে না।’

‘কোনটাকে অনৈতিক, অন্যায় চিন্তা বলছ? তোমার চিঠি কিংবা তোমাকে নিয়ে যা ঘটেছে সেটা? এমন ভাবনা, এমন চিন্তা অবৈধ নয়, অনৈতিক নয়। কেউ যদি কারও সম্পর্কে ভাবে আর সে ভাবনা যদি পবিত্রতা ও আইনের সীমা লংঘন না করে, তাহলে সে ভাবনা দোষের নয়, বরং মানবিক। এমন যদি ঘটে তাহলে অন্য পক্ষেরও ভাববার প্রয়োজন। এ অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন। না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে কি করে? আল্লাহ মানুষকে রোবট বা যন্ত্র করে সৃষ্টি করেননি। মানুষকে তিনি আবেগ-অনুভূতিপ্রবণ মন দিয়েছেন। অনেক কিছুই এই মানব মনে আবেগের ঢেউ তুলবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন চিন্তা, কোন আবেগ সক্রিয়তায় পৌছে সীমা লংঘন না করা পর্যন্ত তা পাপ নয়। তুমি এ সীমা লংঘন করনি।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের এসব কথার কোন জবাব দিল না। সে মারিয়া জোসেফাইনের কোলে মুখ গুজে চুপ করে রইল।

মারিয়া জোসেফাইন সারার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আর কি বলব তোমাকে সারা?’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত টেনে নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘আর কিছু বলো না আপা। ভেতরটায় যে ঝড় বইছে, তা আর সইতে পারছি না।’ কথার সাথে সাথে সারা জেফারসনের দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘ঠিক, আর কোন কথা নয়। তুমি ঘুমাও সারা। তবে একটা কথা বলি, তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা তুমি সাজতে চেয়ো না, তা চাইলে ঝড় আরও বাড়বে। আল্লাহকে তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা স্বীকার কর।’

‘আমি জানি না, ভেতরে এত ঝড় কেন? আল্লাহর ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছিঁ না।’ বলল সারা জেফারসন।

‘অন্তরের বেদনা অশ্রু হয়ে তোমার চোখ দিয়ে নামছে, সেই অন্তরে বেদনার কেন্দ্রে খুঁজে দেখো আল্লাহর ইচ্ছা তুমি দেখতে পাবে।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘আপা বুঝতে পারছ না, ঐ খুঁজে দেখতেই ভয় আমার। বুক কাঁপছে।’ বলল সারা জেফারসন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শান্ত হও বোন। এস শুয়ে পড়।’ বলে মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিল। তার গায়ে কম্বলটা তুলে দিয়ে বলল, ‘আমি যাই বোন সারা !’

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আর একটা কথা। আমি মা’র সাথে কথা বলতে চাই। বলতে পারি সারা?’

সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। একটু ভাবল। একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘এটা বুঝি জিজ্ঞাসা করতে হয় আপা। তিনি তোমারও মা। তোমার যা ইচ্ছা সবই বলতে পার।’

‘ধন্যবাদ সারা। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে ৯টা। শোবার আগে আরও আধ-ঘণ্টা সময় তার হাতে আছে। সোফার পাশের ছোট্ট বুকস্ট্যান্ড থেকৈ একটা ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে সোফায় বসল জিনা জেফারসন।

দরজায় নক হলো।

‘এস।’ জিনা জেফারসন বলল।

ঘরে প্রবেশ করল মারিয়া জোসেফাইন।

উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন। বলল, ‘এস মা।’

‘আপনি বসুন মা। আমি বসছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন বসল।

মারিয়া জোসেফাইন গিয়ে জিনা জেফারসনের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসল।

জিনা জেফারসন তাকে সংগে সংগেই টেনে তুলতে তুলতে বলল, ‘করছ কি মা। তুমি আমার মেয়ের মতো বটে, কিন্তু তুমি ফ্রান্সের বুরবন রাজকুমারী। ইউরোপের একটা শ্রেষ্ঠ রাজবংশের রাজরক্ত তোমার দেহে।’

জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে পাশে বসাল।

‘মা, সব মানুষেরই রক্তের রং লাল, সবার একই রক্ত। এর বাইরে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অদৃশ্য। সৃতরাং মানুষকে বড়-ছোট আমরা করতে পারি না। রাজ্য একটা মানুষকে রাজা করে আর রাজ্য না থাকলে সে সাধারণ মানুষ।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সাধারণভাবে একথা সত্য, আইনের ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকেও এ কথা সত্য। ইসলামের এসব বিষয় পড়ে জানলাম, মানুষকে বড়-ছোট করা চলে না। কিন্তু মা, আল্লাহর রসূলও বংশকে একটা গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন কোরাইশ বংশ জ্ঞান, মান-মর্যাদায় আরবের শীর্ষে ছিল।’ বলল, জিনা জেফারসন।

‘আপনার কথা ঠিক মা। তবে এখন আমি তো আর রাজকুমারী নই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক আছে মা, কিন্তু মানুষ রাজকুমারী বললে আটকাবে কে। অতএব চুপ থাকা ভালো।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে ‘মেয়েরে মতো’ বলেছেন। আমি কি আপনার মেয়ে নই?’ অনেকটা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন হেসে এক হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘কে বলল তুমি আমার মেয়ে নও। তুমি সারার চেয়েও আমার ভালো মেয়ে।’

‘কি বলছেন মা, সারার চেয়ে মা-ভক্ত মানুষ আমি কম দেখেছি। সে খুব ভালো।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ভালো, কিন্তু অনেক কথাই আমার শোনে না।’ বলল জিনা জেফারসন।

অনেক কি কথা শোনে না জিজ্ঞাসা করতে ভয় হলো মরিয়া জোসেফাইনের। যদি তার অন্যত্র বিয়ের কথা বলে? তাহলে একটু অসুবিধায় পড়বে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘মা’ বলেই মেয়েরা অনেক আবদার করার সুযোগ পায়। অনেক কথা না মানারও অধিকার ভোগ করে মা।’

‘জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তো গুরুজনদের কিছু কথা শুনতে হয় মা।’ বলল জিনা জোফারসন গম্ভীর কণ্ঠে।

চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন, কথা উনি তো ওদিকেই নিচ্ছেন। ভাবল মারিয়া জোসেফাইন। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।

‘মা, একটা কথা বলতে চাই।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘অবশ্যই মা, বল।’ সারা জেফারসনের মা জিনা জেফাসরন বলল।

‘একটা জিনিস চাইব মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। হাসল। বলল, তুমি চাইবে, তা আবার বলতে হয়! চেয়ে ফেল।’

হাসল মারিয়া জোসেফাইনও। বলল, ‘না বলবেন না তো মা?’

‘মেয়ে মায়ের কাছে সাধ্যের বাইরের কিছু চায় না। তাই না দেয়ার কোন প্রশ্ন নেই মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা আমি সারাকে চাই আমার পাশে চিরদিনের জন্য।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারার মা জিনা জেফারসন চোখ তুলে তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখ তার জিজ্ঞাসা আছে, কিন্তু বিস্ময় নেই। বিস্ময় নেই কারণ প্রথম দিন দেখার সাথে সাথে আহমদ আবদুল্লাহ যে ভাবে ‘মাম্মি’ বলে জড়েয়ে ধরেছিল সারাকে, তাতেই তার মনে ভাবনাটার হঠাৎ উদয় হয়েছিল: ইসলামে তো একাধিক বিয়ের অনুমতি আছে। সে রকম কিছূ কি ঘটতে পারে? ঘটা উচিত? পরের দিনগুলোতে মারিয়া জোসেফাইনের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হয়েছে। মনে হয়েছে, মারিয়া জোসেফাইনও বোধ হয় তারই মত চিন্তা করে। আজ সে কথাটাই মারিয়া বলল। কিন্তু এর পরেও তার মনে জিজ্ঞাসা আমেরিকান সমাজে এটা কতদূর গ্রহণযোগ্য হবে!

সারার মতো সচেতন ও শীষ মর্যাদার আমেরিকানের পক্ষে এ ধরনের জীবন মেনে নেয়া কি সম্ভব!

এসব ভাবতে গিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের কথার জবাব দিতে দেরি হয়ে গেল।

‘কি ভাবছেন মা?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভাবছি তোমার চাওয়া খুব বড় নয়। কিন্তু এক কথায় দুই কথায় এর জবাব নেই।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘ঠিক বলেছেন মা। কিছু কথা বলুন আপনি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘দেখ মা, আহমদ মুসা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। ইসলাম দিয়েছে আমাদের নতুন জীবন। কিন্তু এর পরও আমরা আমেরিকান সমাজের একজন। এ সমাজে এমনকি মুসলিমরাও একাধিক স্ত্রীর কথা চিন্তা করে না। এ সবই ভাবার কথা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আপনি মায়ের মতোই বাস্তব চিন্তার কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামে একাধিক স্ত্রীর বিষয়টি সাধারণ নয়, সবার জন্যে নয়, ব্যতিক্রমধর্মী একটা অনুমতি। মানুষের স্বাভাবিক জীবন রক্ষা, অসহনীয় এক জীবন-জটিলতার মানবিক সমাধানের জন্যেই এই ব্যতিক্রমী বিধান করেছেন মানুষের স্রষ্টা মানুষের জন্যে। যে সমাজ এটা ভালো চোখে দেখে না, সেটা সর্বাঙ্গীণ সুস্থ সমাজ নয় মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ঠিক বলেছ মা। সারার বিষয়টা নিয়েই আমি ভেবেছি। সব প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। অন্যত্র বিয়ে হবার পর সুখের সংসারও তারা করতে পারে। কিন্তু দুনিয়াতে এর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রয়েছে। সারার ঘটনা তার একটি। সারার মতো মেয়েরা যা একবার গ্রহণ করে, তা বর্জন করতে পারে না। এ ধরনের ক্ষেত্রের জন্যেই স্রষ্টা ঐ ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রেখেছেন এবং এটাই বাস্তব ও স্বাভাবিক। আমি একমত মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘তাহলে মা, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমি আপনার সাহায্য চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমার সারা তার গ্রান্ড দাদু টিজে মানে টমাস জেফারসনের চরিত্র পেয়েছে। নীতির ব্যাপারে সে অনড়। তাকে নিয়ে আমার খুব ভয়। দেখ মা, আহমদ মুসাকে সেই যে চিঠি লিখে তার সামনে থেকে সরে গেল, এখনও তার সামনে আসেনি। ইস্তাম্বুলে সারা দু’বছর ছিল। শেষ দিকে এক মিশনে আহমদ মুসাও সেখানে যায়। তোমার কাছ থেকেই শুনেছি সারা গোপনে তাকে সাহায্য করেছে এই বিষয়টি গোপন রেখেই ইস্তাম্বুল থেকে চলে আসে। এই সারাকে দিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করানো যাবে সেটা বলা মুশকিল। বুঝতে পারছি না, আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারবো।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আহমদ মুসার সাথে সে দেখা করেনি, এটা ঠিক, কিন্তু আহমদ মুসাকে সে তার সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালোবাসে মা। এত ভালোবাসে বলেই সারা দূরে থাকছে, দূরে থাকতে পারছে সে।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমি জানি মা। সে পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটাকে। আমার কাছে সে সব ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি তো মা! সন্তানের মন আমি বুঝব না। সেও অনেক সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মনে পড়ে একদিনের কথা। সারা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। পুরনো কাপড় বাছতে গিয়ে আহমদ মুসার একটা শার্ট পেলাম। আমি ভাবছিলাম পুরনো কাপড়ের সাথে এটাও বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলব কিনা। আমার কথা শুনে সে আঁতকে উঠেছিল। বলেছিল, ‘না মা, ওঁর শার্ট পুরনো হলেও ওটা ওঁরই শার্ট। ওটা ফেলে দেয়া যাবে না।’ আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে মা তুমি রেখে দাও।’ সারা বলেছিল, ‘তুমিও রাখ মা, ওঁ কোন দিন এলে দিয়ে দিও।’ আমি রেখে দিলাম। সেদিনই রাত দু’টো, আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙে যায়। ঘরের ডিম লাইটে দেখলাম আমার ক্লথ হ্যাংগার খুলে আহমদ মুসার শার্ট নিয়ে গেল সারা। দেখলাম, সে এখনও ঘুমায়নি। সে তো এমন অনিয়ম করে না! আমার কৌতুহল হলো, আমি তার পিছু পিছু গেলাম। তার ঘরের দরজা খোলা। সে ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম, বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সারা। বালিশে আহমদ মুসার শার্টের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ‍বুঝা গেল শার্টের উপরই মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে। কাঁদছে সে। অবরুদ্ধ কান্নার চাপে তার দেহ ফুলে ফুলে উঠছে। কোন শব্দ নেই, নীরব কান্না, ঠিক রাতের নীরব প্রহরের মতো। মন বলল, গিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু আবার মনে হলো, নীরবে কাঁদছে সে, কাঁদুক, কাঁদা তার দরকার। আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। আর ঘুমাতে পারলাম না। সারার এই কান্নার শেষ কোথায়? কোন উত্তর আমার জানা নেই। আমারও ‍দুই গণ্ড বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ঢল। জানি না মা জোসেফাইন, আমার সারা এভাবে কত কেঁদেছে।’ জিনা জোসেফাইন থামল। তার কণ্ঠ কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে।

মারিয়া জোসেফাইনেরও দুই চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে। বলল, ‘এই সারাকে আমিও চিনি মা। এ জন্যেই তো আমি ছুটে এসেছি। আমি তাকে নতুন জীবন দিতে চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘তুমি খুব ভালো মা। তোমার মতো মেয়ে আছে, গল্পে শুনলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি গল্প-রূকপথার চেয়েও বিস্ময়কর। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা কত নিশ্ছিদ্র, কত গভীর এবং পারস্পরিক আস্থার বিষয়টা কত দৃঢ়, কত অভঙ্গুর হলে একজন স্ত্রী আরেকজন মেয়েকে নিজের স্বামীর অধিকারে ভাগ বসাতে দিতে পারে! এমন ভালোবাসা, এমন আস্থা বিশ্বাসের কথা পাশ্চাত্যের স্বামী-স্ত্রীরা ভুলে গেছে। তোমাকে ধন্যবাদ মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘না মা, পাশ্চাত্যেও এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে। সারা তো পাশ্চাত্যের মেয়ে, তার ভালোবাসা নিশ্ছিদ্র, নিখাদ, নিবিড়তায় বেনজীর। আমি যাকে ভালোবাসি আমার সবকিছু দিয়ে, তার প্রতি সারার এই নিঃস্বার্থ, নির্লোভ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, আমাকে গৌরবান্বিতও করেছে মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘বিধাতা কিভাবে তোমাদের দু’জনকে এভাবে এক করলেন! তুমি সারার ভালাবাসাকে নিঃস্বার্থ, নির্লোভ বলছ, কিন্তু তোমার স্বামীকে তার সামনে হাজির করে তুমি তোমার স্বার্থের যে কুরবানী দিলে, তা সারার ত্যাগের চেয়ে অনেক বড়, অসীম, অতল।’ জিনা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।

‘একজন মুসলিম নারীর জন্যে এটা বড় নয় মা। আল্লাহ যখন এটাকে হালাল করেছেন, তখন এর মধ্যে মানুষের জন্যে কল্যাণই রয়েছে। আমার জন্যে, সারার জন্যে আমি সে কল্যাণই চাচ্ছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কিন্তু সব মুসলিম মেয়ে কি এটা বুঝে মা? এ নিয়ে কত অশান্তি, কত মামলা-মোকদ্দমার কথাও শুনেছি।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক মা। কিন্তু বাড়তি বিয়ের ক্ষেত্রে অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণ এবং দেহগত কামনার পরিতৃপ্তি এক জিনিস তো নয়। মানুষ যখন আল্লাহর দেয়া একটা ব্যতিক্রমী সুযোগকে দেহগত কামনা পূরণের জন্যে অপব্যবহার করে, তখনই সৃষ্টি হয় তাদের জীবনে অশান্তি। এর আরেকটা কারণ দেহগত কামনা যার উপর বিজয়ী হয়, সে স্ত্রীদের সাথে সুব্যবহার, সমব্যবহার করতে পারে না। এর স্বাভাবিক পরিণতি অশান্তি, ঝগড়া-ফাসাদ এবং মামলা-মোকদ্দমা। আহমদ মুসা, সারা জেফারসন অর্থাৎ আমাদের কেসটা এদের থেকে একেবারেই ভিন্ন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ মা জোসেফাইন।’ বলে জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় মেয়ে তুমি আমার।’

‘প্রথম মেয়ে নয় কেন? আমি সারার চেয়ে বড়।’ বরল মারিয়া জোসেফাইন। তার মুখে হাসি।

‘ঠিক আছে মা, তুমি দ্বিতীয় নও, আমার প্রথম মেয়ে তুমিই।’ হেসে বলল জিনা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন জিনা জেফারসনের কোল থেকে মাথা তুলল। হাসিমাখা মুখ তার একটু গম্ভীর হলো। বলল, ‘সামনে এগোবার পথ কি মা, সারা তো এখনও ইয়েস বলেনি।’

‘আমিও সেটা ভেবেছি জোসেফাইন। বলেছি, সারার ব্যক্তিত্ব তার টিজে দাদুর মতো। এই কারণে তাকে আমি ভয়ও করি। আমেরিকায় আহমদ মুসার সবচেয়ে বড় অভিভাবক, আমাদের পরিবারেরও বন্ধু এবং সারার গুরুজন এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম আমার এখানে এসেছিলেন সারার সাথে আহমদ ‍মুসার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। তিনি আমার কাছে সব কথা শুনে সারাকে আর বলতে সাহস পাননি। আমরা একমত হয়েছিলাম সারাকে সময় দেয়া তার মনের স্থিতিশীলতার জন্যে। আমি মনে করি সারাকে কোন বিষয়ে রাজী করানোর ক্ষেত্রে তুমি সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। সারা যেমন তোমাকে ভালোবাসে, তেমনি সম্মানও করে তোমাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুমি আহমদ মুসার স্ত্রী। পারলে একমাত্র তুমি পারবে সারাকে রাজী করাতে।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘এ বিশ্বাস আমারও ছিল মা। কিন্তু সে বিশ্বাস আমার এখন নেই। আমার সব যুক্তি শেষ। আমার যুক্তি সে অস্বীকার করছে না, শুধু কাঁদছে এবং বলছে সে এ নিয়ে ভাবতে পারছে না।’ বলল জোসেফাইন।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল জিনা জেফারসন। এ সময় সারা জেফারসন ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘আপা তুমি এখানে, আমি ওদিকে খুঁজে হয়রান।’

‘আহমদ আবদুল্লাহ ঘুমিয়েছে সারা?’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘হ্যা, ঘুমিয়েছে আপা।’ বলল সারা

‘কম্পিউটার থেকে তুলে নিয়ে এত তাড়াতাড়ি তাকে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিলে কি করে? তোমার হাতে জাদু আছে সারা।’

বলেই উঠে দাঁড়াল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘এখন চলি মা।গুড নাইট।’

‘হ্যা, এস মা। ঘুমাতে দেরি করো না যেন।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক আছে মা। চল সারা।’ বলে হাঁটতে শুরু করল মারিয়া জোসেফাইন।

তারা দু’জন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সারার শোবার ঘরে যাবার পথে একটা বড় ফ্যামিলি লাউঞ্জ ক্রস করছিল। হঠাৎ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে টেনে নিয়ে লাউঞ্জের একটা সোফায় বসে পড়ল। বসেই জড়িয়ে ধরে থাকল সারা জেফারসনকে। বলল, ‘উনি তো আসছেন সারা। আমি কিন্তু এগোচ্ছি।’

সারার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার দপ করে নিভে গেল। সে জোসেফাইনের কোলে মুখ গুঁজে বলল, ‘আপা আমি ওঁর আছি, আমৃত্যু আমি ওঁরই থাকব। কিন্তু আমি ওঁকে আমার করতে পারবো না। ও তোমার, শুধুই তোমার।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের গলা।

‘তার মানে সারা, আহমদ মুসা আমার বলেই তাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করছ?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, না আপা। আমি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করছি না। প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। মাত্র ওঁকে আমার করতে পারছি না।’ সারা জেফারসন বলল কান্না জড়িত কণ্ঠে।

‘ও আমার এ জন্যেই তো?’ বরল মারিয়া জোসেফাইন ভারি কণ্ঠে।

‘না আপা, ওজন্যে নয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি আপা। তোমার কোন কষ্ট, তোমার ক্ষতি আমি বরদাস্ত করতে পারি না, পারবো না।’ সারা জেফারসন বলল।

‘দুঃখিত সারা, আমার আনন্দ, আমার খুশিকে-আমার কষ্ট, আমার ক্ষতি বলছ। তুমি আমাকে এতটুকুই বুঝেছ বোন!’ বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আমাকে মাফ কর, ভুল বুঝোনা আমাকে আপা। আমি মনে করি, স্বামী মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। এই জায়গাকে সব মেয়েই তার সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতে চায়। আমি এই অর্থে কথাটা বলেছি আপা।’ ভারি, কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর তার।

সারাকে আরও কোলে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। ওটা মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকতার জায়গা। আমারও। আমি দশ বছর ধরে ওঁকে আমার সবকিছু দিয়ে আগলে রেখেছি। উনি তো উড়ন্ত পাখি। এবার আমরা দু’জনে মিলে ওঁকে সামলাব। আজ ‘কবুল’ না বললে তোমাকে ছাড়ছি না।’

‘তুমিও দেখছি ‘কবুল’ শব্দ বলছ। মুসলিম মতে বিয়ের যে বিবরণ পড়েছি। তাতেও স্বীকারোক্তির ক্ষেত্রে ‘কবুল’ শব্দটা দেখেছি।’ বলে হেসে ফেলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা সারা, ওটা একটা পরিভাষাগত শব্দ। থাক এ কথা। তুমি ঘুরিয়ে কথা অন্যদিকে নিও না। বল সারা, আমি শুনতে চাই।’

গম্ভীর হলো সারা। বলল, ‘আপা, তোমার এসব কথা কি উনি জানেন?’

‘না সারা। জানেন না। আমি তাঁকে বলিনি। তবে উনি আমাকে এখানে আসার অনুমতি দিয়েছেন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কেন বলনি?’ বলল সারা জেফারসন।

‘তোমাকে নিয়েই আমার ভয় বেশি। তোমাকে পেলে আমি ওঁকেও পাব। তাই তোমাকেই প্রথম রাজী করাতে চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ওঁকে নিয়ে তোমার ভয় নেই আপা? ওঁ বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর পাথরের মতো কঠিন। আমি কত দুর্বলতা দেখিয়েছি, ওঁর সামান্য দুর্বলতাও কখনও প্রকাশ পায়নি। চিঠিতে তুমি পড়েছ আমি দুর্বত্তদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ওকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্ত ‍এই পরিস্থিতিতেও তিনি সৌজন্যের সীমার মধ্যে থেকেছেন। এই মানুষকে ভয় না করে আমার মতো দুর্বলকে ভয় করছ আপা!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি তাঁর আরও দিক জানি। আবেগের ক্ষেত্রে বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর নৈতিকতায় উনি পাথরের মতো শক্ত বটে, কিন্তু তিনি যুক্তির কাছে ‍দুর্বল, মানুষের কষ্টের কাছে আরও দুর্বল। সবচেয়ে দুর্বল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কাছে। সুতরাং তোমাকে যদি পাশে পাই, তাঁকে রাজী করানো আমার জন্যে কঠিন নয়।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের কোল থেকে উঠে বসল। মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পাশে আছি। এর বেশি কিছু প্লিজ আমার কাছ থেকে আদায় করতে চেষ্টা করো না। তুমি তো জানই আপা, আমি ওঁর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারি না।’

মারিয়া জোসেফাইন হেসে সারা জেফারসনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘বুঝেছি, তুমি ওঁর মতটা আগে জানতে চাও তো! কিন্তু উনি তোমার মতোই যদি তোমার মত কি তা জানতে চান? কি বলব আমি?’

লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সারা জেফারসনের মুখ। সে মারিয়া জোসেফাইনের বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘বলেছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না আপা। তোমাদের ইচ্ছার বাইরে যাবার সাধ্য কি আমার আছে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা জেফারসন এক সুপারম্যান এবং আহমদ মুসা আর এক সুপারম্যান। দুই সুপারম্যানের মাঝখানে সাধারণ এক মারিয়া জোসেফাইনের অবস্থা দেখছি ত্রিশংকু!’

সারা জেফারসন পাশ থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে মারিয়া জোসেফাইনের পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘দুই সুপারম্যানকে যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় সে বুঝি সাধারণ!’

বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাতে পালাতে বলল, ‘আমি শুতে গেলাম। গুড নাইট। আসসালাম।’

সেদিকে তাকিয়ে হাসিভরা মুখ নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনও উঠে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল সে তার ঘরের দিকে।

যে দিন সে আমেরিকায় পা রাখে, সেদিনও তার মনে অনিশ্চয়তার যে গুরুভার ছিল তা এখন নেই। আবার প্রাণ খুলে হাসারও পরিবেশ হয়নি। আহমদ মুসার সাথে কোন আলোচনাই হয় নি। অন্যদিকে সারা জেফারসন একটা ‘কিন্তু’ রেখেই দিয়েছে।

আপাতত সব চিন্তা মত থেকে ঝেড়ে ফেলে শোবার বিছানার দিকে এগোলো মারিয়া জোসেফাইন।

ওয়াশিংটানের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর। ভিভিআইপি লাউঞ্জে বসে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, তার স্ত্রী, নাতি, আহমদ মুসার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন, সারা জেফারসন এবং আহমদ মুসার ছেলে আহমদ আবদুল্লাহ।

টিভি স্ক্রীনে দেখা গেল জার্মানীর লুফথানসা বিমান ল্যান্ড করেছে।

লুফথানসাকে ল্যান্ড করতে দেখে জর্জ আব্রাহামের নাতি বলে উঠল, ‘এই লুফথানসা! এই প্লেনেই তো আংকেল আসছেন।’

‘হ্যাঁ দাদা ভাই, এই তো এখনি তোমার আংকেলকে দেখতে পাবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘তাহলে চল না দাদু প্লেনে যাই। আংকেলকে নিয়ে আসি।’ বলল জর্জ আব্রাহামের নাতি।

‘না দাদু ভাই, সকলে যেতে নেই। প্রেসিডেন্টের পিএস এবং তোমার আরেক দিদিভাই তোমার ঐ সারা আন্টির মা গেছেন তোমার আংকেলকে স্বাগত জানাতে প্লেনে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।

চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসনের। তার চোখে মুখে আনন্দ-অস্বস্তির মিশ্রণ! তার মনে একটা প্রবল তোলপাড়। কেমন করে তার সামনে দাঁড়াবে সে! সেই যে চিঠি লিখে পালিয়েছিল, তারপর সে আর আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়নি। হয়নি নয়, মুখোমুখি সে হতে পারেনি। অবশেষে আজ তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিমান বন্দরে আসা থেকে সে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু মারিয়া জোসেফাইন নাছোরবান্দা। সারা না এলে সেও আসবে না, সাফ কথা। তাই আসতে হয়েছে তাকে। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াবার সময় আনন্দ, তার সাথে প্রবল অস্বস্তি ও লজ্জা। সব মিলিয়ে তার বুকে অদ্ভুত এক কম্পন। সবার মুখে হাসি, কিন্তু সে হাসতে পারছে না। সারা অনুভব করল মারিয়া জোসেফাইন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাকেও তার দিকে তাকাতে হলো। জোসেফাইনের মুখে হাসি। সারা জেফারসনও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু সে এক বিব্রতকর হাসি।

‘সারা তোমার মুখে অর্ধেক হাসি, পুরো হাসি চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘মনো করো না অনেকদিক পরে দেখা হচ্ছে। মনে করো কাল দেখা হয়েছে, আজ আবার দেখা হচ্ছে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

‘ধন্যবাদ আপা, প্লিজ আপা, ওঁর সামনে আমাকে ঐ সব কিছু বলো না যেন। প্লিজ!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি কোনভাবে বিব্রত হও, তা আমি চাই না সারা। সারা জেফারসনকে শুধু ভালবাসি না, সম্মানও করি।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘এতক্ষণ তো আহমদ মুসাকে নিয়ে চলে আসার কথা।’

মোবাইল বের করে কল করল প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে। টেলিফোনে রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না।

দ্বিতীয় বার কল করল জর্জ আব্রাহাম জনসন। এবারও কোন সাড়া পেল না ওপার থেকে।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের। উঠে দাঁড়াল সে। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ করে, ‘মা, জন জুনিয়রকে দেখো। আমি আসছি।’

সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনের কল করা খেয়াল করছিল। বলল, ‘আংকেল কোন সমস্যা?’

‘না সারা, তেমন কিছু নয়। আমি প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে পাচ্ছি না। ও আচ্ছা, তুমি তোমার মাকে টেলিফোন কর তো। উনি তো সাথেই আছেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন, এফবিআই প্রধান।

সংগে সংগেই সারা জেফারসন তার মাকে টেলিফোন করল। রিং হলো। উৎকর্ণ হলো সারা জেফারসন। রিং হয়েই চলেছে। কোন উত্তর নেই ওপার থেকে। রিং ক্লোজ হয়ে গেল।

সারা জেফারসন উদ্বিগ্ন। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আংকেল, মার কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। এমন তো হবার কথা নয় আংকেল।’

‘আচ্ছা তোমরা বস, আমি ওদিকে দেখছি।’

বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার কাছে পৌছার আগেই একজন এফবিআই অফিসার দ্রুত ঘরে প্রবেশ করল। জর্জ আব্রাহাম জনসনকে স্যালুট দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, সাংঘাতিক খবর স্যার। প্রেসিডেন্টের পিএস, ম্যাডাম জিনা জেফারসন, এয়ার লাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার এবং এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি অফিসারকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে এই ভিভিআইপি লাউঞ্জের প্রবেশ মুখের ঘরটায়।’

‘আহমদ মুসা কোথায়?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, আহমদ মুসাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।’ অফিসারটি বলল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দু’জনেই দাঁড়িয়ে উদ্বেগের সাথে কথা শুনছিল। অফিসারটির কথা শুনে সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সারা জেফারসন। মুহূর্তে যেন তার মুখের সব রক্ত শূন্য হয়ে গেছে।

আর মারিয়া জোসেফাইনের কাছে কথাটা এসেছিল বজ্রাঘাতের মতো। মুখের সব আলো দপ করে নিভে গিয়েছিল তার। তবে অন্ধকারের মধ্যে তার সামনে বিন্দুর মতো একটা আলো জ্বলজ্বল করছিল। তার সাথের সবাই সংজ্ঞাহীন, তিনি নেই। এর অর্থ শত্রুরা কাউকেই হত্যা করেনি। ওঁকে নিশ্চয় কিডন্যাপ করা হয়েছে।

‘হে আমার প্রভু আল্লাহ, তাঁকে নিরাপদ রাখুন’ বলে মারিয়া জোসেফাইন দু’চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

চোখ খুলে ফিরে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। দেখল মরার মতো পাণ্ডুর তার মুখ। উদভ্রান্ত তার দৃষ্টি। তার মানে নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তার নেই। মারিয়া জোসেফাইনর দ্রুত গিয়ে তার পাশে বসল। সান্তনা ও সাহস দেয়ার জন্যে তাকে বাম হাত দিয়ে পেচিয়ে ধরল।

সারা জেফারসনের মাথাটা এলিয়ে পড়ল মারিয়া জোসেফাইনের কাঁধের উপর।

চমকে উঠল জোসেফাইন। দেখল সারা জেফারসন সংজ্ঞা হারিয়েছে!

‘সারা মা, তোমরা একটু….।’

জর্জ আব্রাহম জনসন ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল সারা জেফারসনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সারা জেফারসনের অবস্থা দেখে দ্রুত ছুটে এল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘সারা সংজ্ঞা হারিয়েছে মা?’

‘জি হ্যাঁ, আংকেল। আমি সারাকে দেখছি। আপনি ওদিকে দেখুন আংকেল। ওরা এ সময়ের মধ্যে বিমান বন্দরের বাইরে না যেতে পারার কথা।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক মা, আমি ওদিকটা দেখি। আমি অ্যাটেনড্যান্টকে বলে যাচ্ছি।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল অ্যাটেনডেন্ট।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিয়েছে। অ্যাটেনড্যান্টকে দেখেই বলল, ‘আপনি এক বোতল ঠাণ্ডা পানি আনুন।’

‘এখানেই পানি আছে, আনছি ম্যাডাম।’

অ্যাটেনড্যান্ট চলতে শুরু করেছে। বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে তিনজন পুলিশ প্রবেশ করল।

শব্দ পেয়ে মারিয়া জোসেফাইন পেছন ফিরে তাকাল। দেখল তিনজন পুলিশকে। তাদের চোখে-মুখে শুধু ব্যস্ততা নয়, সংশয়-শংকাও। একটু অবাকও হলো। হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে দেখল ওদের একজনের হাত দ্রুত একটা রিভলবার বের করল। রিভলবারের সাইজ দেখে চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন। ওটা তো গ্যাসগান! বুঝতে পারল জোসেফাইন যে কি ঘটতে যাচ্ছে।

এই চিন্তার চেয়েও দ্রুত জোসেফাইনর হাত পৌছে গেছে তার কোটের পকেটে। দ্রুত হাত বেরিয়ে এল এক ছোট রিভলবার নিয়ে। হাত উপরে তোলার মতোও সময় ব্যয় করল না মারিয়া জোসেফাইন। পকেট থেকে বের করে হাত নিচু অবস্থানে রেখেই ডিফিক্যাল্ট অবস্থান থেকে ডিফিক্যাল্ট অ্যাংগেলে গুলি করল জোসেফাইন।

পুলিশের রিভলবারও টার্গেটে উঠে এসেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার থেকেই প্রথমে গুলি বেরিয়েছিল। গুলিটা পুলিশ লোকটির একেবারে বুকে বিদ্ধ হয়েছিল।

গুলিটার আঘাত পুলিশ লোকটির দেহে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি করেছিল, তাতেই তার হাত থেকে গ্যাসগানটা খসে পড়ল।

ওদের তিনজনের একজন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আগেই মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার ধরা হাত পুলিশ দু’জনের প্যারালালে উঠে এসেছিল। দ্বিতীয় পুলিশ যখন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তৃতীয় িএ পুলিশটিও তখন পকেট থেকে রিভলবার বের করেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার টার্গেটে েএসে মুহূর্তও দেরি করেনি। গুলি করেছিল রিভলবার হাতে নেয়া তৃতীয় পুলিশকে।

সাথী দ্বিতীয় পুলিশ গ্যাসগান হাতে পাবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তৃতীয় পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ততার সাথে তার রিভলবার বের করেছিল। সারা জেফারসন, মারিয়া জোসেফাইন যাকেই পাওয়া যাক সংজ্ঞাহীন করে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ, হত্যার কথা তাদের বলা হয় নি। এই দ্বিধাগ্রস্ততা তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। মারিয়া জোসেফাইনের আগে সে রিভলবার ট্রিগার চাপতে পারেনি। অসহায়ভাবে তাকে বুক পেতে নিতে হলো মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবারের গুলি।

মারিয়া জোসেফাইন দ্বিতীয় গুলি করেই তার রিভলবারের নল নামিয়ে নিয়ে এল অবশিষ্ট পুলিশটার দিকে।

মারিয়া জোসেফাইন ইতিমধ্যেই খেয়াল করেছিল, প্রত্যেক পুলিশই গ্যাসগান হাত করার জন্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওরা গ্যাসগান হাতে পেলে এবং সুযোগ পেলে কি হতো সেটাও সে বুঝে ফেলেছে।

গ্যাসগানের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া পুলিশটি গ্যাসগানটি হাতে পেয়ে শোয়া অবস্থাতেই হাত সামনে নিয়ে আসছিল।

মারিয়া জোসেফাইন আগের মতোই রিভলবার টার্গেটে নামিয়ে আনার পরে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি। ট্রিগারে তর্জনি রাখাই ছিল, ট্রিগারটা চাপল মাত্র।

গ্যাসগানটা ফায়ার করার জন্যে সে সামনে এগিয়ে আনার সাথে সাথেই মাথা তুলেছিল। এবার তার মাথাটাই মারিয়া জোসেফাইনের গুলির শিকার হলো। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই তার দেহটা এলিয়ে মেঝের উপর পড়ল।

গুলির শব্দে জর্জ আব্রাহাম জনসনসহ কয়েকজন পুলিশ ও এফবিআই অফিসার কক্ষটিতে ছুটে এসেছে।

সারা জেফারসনও সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে উঠে বসেছে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এসে মারিয়া জোসেফাইনের পাশে দাঁড়াল। একজন পুলিশ অফিসার ছুটে গেল নিহত পুলিশদের দিকে।

‘কি ঘটেছে ম্যাডাম জোসেফাইন? ওরা তো পুলিশ?’ জর্জ আব্রাম জনসনের চোখে-মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুই-ই।’

‘ওরা গ্যাসগান ফায়ার করতে যাচ্ছিল। ওদের পায়ে দেখুন কেটস, ফরমাল বুট নয়। ওরা পুলিশ নয়।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

যে পুলিশ অফিসারটি নিহত তিনজনের দিকে গিয়েছিল, সে ওদের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখে বলল, ‘স্যার, এরা আমাদের পুলিশ নয়। এরা ইউনিফরম যোগাড় করেছে কোনভাবে।’

জর্জ আব্রাহাম জনসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে ফিরে একটা বাউ করে বলল, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, আপনি নিজেদেরসহ দুই শিশুরও জীবন রক্ষা করেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমার দিয়ে ধরে গ্যাসগানটা তুলে নিল। ইন্ডিকেটরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুল লোডেড নয় গ্যাসগানটা। আরও ব্যবহার হয়েছে। এই গ্যাসগানটাই কি আহমদ মুসাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে? না পেছনে এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে?’

স্বগত কথাগুলো শেষ করেই সামনের পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘তুমি ওদিকে দেখ। নিশ্চয় এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। আহমদ মুসাদের দিকে যারা গিয়েছিল, তারা অন্য টিম হতে পারে।’

অফিসারটি স্যালুট করে দ্রুত চলে গেল।

মোবাইল বেজে উঠল জর্জ আব্রাহামের। মোবাইল ধরেই বলল, ‘কি বব কার্টার, ঠিক সময়েই বিমান বন্দর ক্লোজ হয়েছিল? কি খবর ওদিকের?’

‘স্যার, সঙ্গে সঙ্গেই বিমান বন্দর ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্যার, খবর পাওয়া গেছে, বিমান বন্দর ক্লোজ করার ঠিক এক মিনিট আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জের সর্ব বামের একজিট দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে একজন যাত্রীর ফেরত মাল হিসাবে। পুলিশ …।’

অফিসার কার্টারের কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম দ্রুত কণ্ঠে বলল উঠল, ‘যে গাড়িতে উঠেছে এবং যে যাত্রীর মাল বলা হচ্ছে, তার হদিস হওয়া দরকার।’

‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে গাড়ির নাম্বার বের করা হয়েছে। সে নাম্বার সব পুলিশ ও ট্রাফিককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাত্রীটির কোন ট্রেস করা যায় নি স্যার। খোঁজ নেয়া হয়েছে, কোন যাত্রী কাউন্টার থেকে ঐ ধরনের বাক্স ফেরত দেয়া হয়নি এবং ঐ বর্ণনার কোন বক্স স্ক্যানও হয়নি।’ বলল বব কার্টার।

‘ধন্যবাদ বব, তোমাদের কাজে ত্রুটি নেই। এখন দেখ, বাক্সটা ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে কিভাবে গেল। ভেতরের কারও যোগসাজশ আছে কিনা? আর শোন, ওদের আরও লোক থাকতে পারে ভেতরে, তাদের খোঁজ কর। ও.কে, বাই।’

কথা শেষ করে কল ফল করতেই আবার তার মোবাইল বেজে উঠল।

প্রেসিডেন্টের কল।

তাড়াতাড়ি মোবাইল তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি টেলিফোন করেছিলাম।’

‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কি করে এ ঘটনা অমন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ঘটতে পারল!’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, যেভাবেই হোক ওদের একাধিক লোক ভিভিআইপি লাউঞ্জের এন্ট্রি লাউঞ্জে গোপনে অবস্থান নিয়েছিল। তারা আগেই এই লাউঞ্জের সিকিউরিটির দায়িত্বে দু’জন গোয়েন্দা ও একজন অ্যাটেনড্যান্টকে সংজ্ঞাহীন করে আড়ালে রেখে দেয়। এরপর আহমদ মুসাসহ আমাদের লোকরা এন্ট্রি লাউঞ্জে প্রবেশ করার সাথে সাথেই গোপন স্থান থেকে গ্যাসগান ফায়ার করে তাদেরকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলে এবং আহমদ মুসাকে নিয়ে যায় তারা। তাদের পরনে এয়ারপোর্ট পুলিশের পোশাক ছিল। পথে অন্য কক্ষের কয়েকজন তাদের দেখেছে, তাদেরকে ওরা একজন ভিআইপি যাত্রী বলে পরিচয় দিয়েছে এবং অসুস্থ হওয়ার কথা বলে দ্রুত বেরিয়ে গেছে। ওদের কোন গাড়ি বা চিহ্ন কিছুই পাওয়া যায় নি। এই ভয়ানক খবরের…।’

এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামের কথার মাঝখানে প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আহমদ মুসার খবর পেলেন সেটা বলুন মি. জনসন।’ প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে কিছুটা অস্থিরতা।

‘মি. প্রেসিডেন্ট স্যার, এই মাত্র জানলাম আমরা বিমান বন্দর সিল করে দেয়ার মিনিট দুই আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জ দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে। আমরা আশংকা করছি, সেই বাক্সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও গড! তারপর?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমরা গাড়িটার নাম্বার পেয়েছি। গাড়িকে পাকড়াও করার জন্যে চেষ্টা করা হচ্ছে। স্যার, ইতিমধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। একটু সুখবরও আছে। আমরা যখন আহমদ মুসার ব্যাপার নিয়ে ওদিকে ব্যস্ত তখন আহমদ মুসার স্ত্রী-সন্তানদের কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হয়। পুলিশের ছদ্মবেশে ওরা তিনজন আসে এবং এখানে গ্যাসগান ব্যবহার করে ওদের সংজ্ঞাহীন করার চেষ্টা করে। ম্যাডাম আহমদ মুসা গুলি করে তিনজনকেই হত্যা করে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ভয়ানক এক বিপদ থেকে আমাদের ঈশ্বর রক্ষা করেছেন। ওরা কোথায়? ম্যাডাম আহমদ মুসাকে অভিনন্দন ও সমবেদনা দুই-ই জানাও। আর সারা কোথায়?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘এখানেই স্যার। আহমদ মুসার আকস্মিক খবরে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সারা। এখন ভালো আছে স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এই ঘটনা কারা ঘটাল, কিছু অনুমান করেছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আমেরিকায় যারা আহমদ মুসার শত্রু ছিল সবাই এখন তার বন্ধু, শুধু ইসরাইলি লবি ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী গোয়েন্দা গ্রুপ ছাড়া। এদের দিকেই প্রাথমিক সন্দেহ যায়। তবে ওদের তিনজন লোকের যে ডেড বডি পাওয়া গেছে তা-সহ অন্যান্য আলামত পর্যালোচনা করলে চূড়ান্ত কথাটা বলা যাবে স্যার। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা এফবিআই হেড কোয়ার্টারে মিটিং-এ বসছি স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ। আহমদ মুসার ব্যাপারে তোমাকে আমার বলা কিছু নেই। তার অমূল্য সার্ভিসের বিনিময়ে তার জন্যে যা করার তা করতে আমেরিকা গৌরববোধ করবে। শুধু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হিসাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি উদ্বিগ্ন আহমদ মুসার জন্যে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমাদের যা সাধ্য, সবই আমরা করবো তার জন্যে মি. প্রেসিডেন্ট স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আর মি. জর্জ জনসন, আহমদ মুসার পরিবার এবং সারা জেফারসনের পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘অবশ্যই স্যার।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ। তুমি টেলিফোনটা ম্যাডাম আহমদ মুসাকে দাও।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইয়েস স্যার। আমি দিচ্ছি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন মোবাইলটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম, মি. প্রেসিডেন্ট স্যার কথা বলবেন।’

মারিয়া জোসেফাইন সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। মোবাইলটা নিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছ থেকে। ‘গুড মর্নিং, এক্সিলেন্সি। আমি জোসেফাইন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। মর্নিংটা আমাদের গুড হয়নি। যা ঘটেছে তা নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। আহমদ মুসা আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘জানি এক্সিলেন্সি। আপনাদের এই শুভেচ্ছার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। কিন্তু তার জন্যে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা তাঁকে উদ্ধারের জন্যে যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করবো। সব আমেরিকানের সমবেদনা আপনাদের প্রতি। আমি জানি, ধৈর্য্য ধরার অসীম শক্তি আপনার আছে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘ধৈর্য্য ধারণ ও আল্লাহর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এই বিশ্বচরাচরের সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। যা কিছুই ঘটেছে তা তাঁর জানা ও শক্তির বাইরে নয়। সুতরাং তাঁর উপর আস্থা রাখলে কোন কিছুতে উদ্বেগ-কাতর হওয়া বেমানান।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথার মধ্যে আহমদ মুসার কণ্ঠ পেলাম। ধন্যবাদ। আমার অনুরোধ, প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় আমার সাথে কথা বলবেন। আমাদের সারা তো আপনার পাশেই থাকবে। আপনার কোন অসুবিধা হবে না। বাই, ম্যাডাম।’

মারিয়া জোসেফাইন আবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।

মোবাইল রেখে দিল জোসেফাইন।

মারিয়া জোসেফাইনের কথা শেষ হতেই সারা জেফারসন এসে জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আপা, স্যরি। একদিকে ভীষণ বিপদ, অন্যদিকে আমি আপনাদের বিব্রত করে ফেলেছিলাম।’

‘অবশ্যেই না বোন। বিব্রত হওয়ার প্রশ্ন আবার কেন? আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। ক’দিন থেকে তোমার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। আল্লাহর হাজার শোকর যে তুমি তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়েছ।’ বলল জোসেফাইন।

‘আজ আমি ভালো আছি। কিন্তু হঠাৎ যেন কি হয়ে গিয়েছিল। একটা হাতুড়ির ঘা এসে বুকে আঘাত করল। মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।’ সারা জেফারসন বলল।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি নিজেও জান না সারা, অনেক দিনের অনেক দূরত্বের পর তোমার হৃদয় তার অবচেতনে ওর সাক্ষাতের স্বপ্নে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। হৃদয়ের নিভৃত নরম অন্তরদেশ আঘাতটা সহ্য করতে পারেনি, সারা।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলল, ‘ওঁর কি হলো, কেন এমন হলো আপা! ওঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানতা নিশ্চয় যথেষ্ট হয়নি!’

‘ধৈর্য্য ধরতে হবে বোন। আল্লাহ ওর নেগাহবান। উনি আসছিলেন আমাদের বিপদের কথা শুনে, কিন্তু বিপদটা এল ওর উপর। জানি না, আল্লাহর ইচ্ছা কি! তবে জানি সারা, যিনি সবার নিরাপত্তার কথা ভাবেন, আল্লাহ নিজে তাঁর নিরাপত্তার দিকটা দে-খ-বে-ন।’ মারিয়া জোসেফাইনের কণ্ঠও কান্নায় আটকে গেল।

মোবাইলে কথা বলছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা বলার জন্যে সরে গিয়েছিল ঘরের এক প্রান্তে। কথা শেষ হলে সে দ্রুত মারিয়া জোসেফাইনদের দিকে এগিয়ে এল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘সারা মা, তোমার মা-সহ সবাইকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তোমরা হাসপাতালে যাবে নিশ্চয়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘জি আংকেল, আমরা হাসপাতালে যাব।’ সারা জেফারসন বলল।

‘তাহলে এস মা, বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমাদের গাড়ি সাথে যাবে, কিন্তু তোমরা পুলিশের গাড়িতে যাবে। এস মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

চলতে শুরু করল সবাই।

‘এত দুঃসাহসিক, সুপরিকল্পিত কাজ কারা করল বলে আপনার ধারণা আংকেল?’ বলল সারা জেফারসন।

‘জায়নবাদী লবি বা তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকেই প্রথম নজর। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সরকারের সাথে তাদের চ্যালেঞ্জে আসাটা বাস্তব মনে হচ্ছে না। কিন্তু তারা ছাড়া তো মি. আহমদ মুসার বিরোধী উল্লেখযোগ্য কোন শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। বিষয়টা আমার কাছে এখনও জটিল। আলামতগুলো নিয়ে আরও ভাবতে হবে আমাদের। ম্যাডাম জোসেফাইনের কারণে আমরা ওদের তিনটা লাশ পেয়েছি। ঐগুলো এখন আমাদের মূল্যবান লিংক। এছাড়া আমরা সব অপশনই চেক করছি।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল, যারাই এটা করুক। তারা শক্তির নয়, বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ হত্যাও এড়িয়ে গেছে।’ বলল সারা জেফারসন।

দাঁড়িয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘একটা মূল্যবান পয়েণ্ট তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু মোসাদ কিংবা ইরগুন জাই লিউমির নেই।’

‘এমন নতুন শত্রু কে হতে পারে? আর ওরা আহমদ মুসার সাথে আমাদেরকেও কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল কেন? কেন শুধু কিডন্যাপ, কেন হত্যা নয়? আংকেল আমার মনে হয় এ প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ধন্যবাদ মা সারা। প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল। বাচ্চা অথবা তোমাদের সবাইকে কিডন্যাপ করার একটা অর্থ হতে পারে, তারা আহমদ মুসার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। আর চাপের বিষয়টি প্রমাণ করে, তারা বড় অন্য কিছু পেতে চায়। সেটা কি? শত্রুকে চেনার আগে বোধ হয় এ প্রশ্নের জবাব মিলবে না।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল সবদিকের বিচারে ঘটনাকে খুব বড় মনে হচ্ছে। বড় বলেই ওঁর নিরাপত্তার ঝুঁকিও বড় হতে পারে। ওরা খুব বেশি সময় আমাদের নাও দিতে পারে।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ঠিক মা সারা, এটাই আমাদের জন্যে ভাবনার বিষয়।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ আংকেল।’ বলল সারা। গাড়ি বারান্দায় তারা এসে গিয়েছিল।

পরপর তিনটা গাড়ি দাঁড়ানো।

মাঝখানে শেভ্রলেট কার। ড্রাইভিং সিটে একজন পুলিশ।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত এগিয়ে গাড়ির দরজা খুলে মারিয়া জোসেফাইনেকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম আসুন।’

‘থ্যাংকস আংকেল’ বলে গাড়িতে উঠল মারিয়া জোসেফাইন।

ওপাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে সারা জেফারসন। পেছনের বেবি সিটে উঠল আহমদ আবদুল্লাহ।

সামনে ও পেছনের দুই গাড়িতে উঠল পুলিশের দুটি দল।

চলতে শুরু করল তিনটি গাড়ি।

চোখ থেকে কাপড়ের বাঁধন খোলা হলে আহমদ মুসা দেখল সামনে একটা সুন্দর বিজিনেস টেবিল। তার ওপাশে আরও একটা সুন্দর টেবিল। মনে হচ্ছে যেন কোন সিইও ওখানে বসেন।

আহমদ মুসাও সুন্দর একটা কুশন চেয়ারে বসে। ঘরে আর কেউ নেই।

কে একজন তাকে একটা লিফট থেকে নামিয়ে এনে এখানে বসিয়েছে। সেই তার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে গেছে। আহমদ মুসা তাকে পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে। তার পরনে সাদা পোশাক। প্যান্ট, শার্ট, কোট, বুট সবই সাদা। মুখেও সাদা মুখোশ। লাভ হলো না লোকটিকে দেখে।

আহমদ মুসা আন্দাজও করতে পারছে না তাকে কোথায়, কত দূরে আনা হয়েছে ! গত রাতেই তার জ্ঞান ফিরেছে! তখন সে একটা নরম বিছানায় শুয়ে ছিল। হাত ও পা তার বিশেষ শেকলে লক করা থাকলেও চোখ খোলা ছিল। ঘরটাতে খাট ছাড়া কিছুই ছিল না, একদমই নিরাভরণ। জানালা ছিল না, একটা দরজা। ঘরটা ছিল এয়ার কন্ডিশনড। অনেকটাই উন্নত জেলখানার মতো। এমন উন্নত জেলখানার মালিক কে? কারা তাকে ধরে এনেছে? আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝতে পারছে ক্লোরোফরম গ্যাসগান ব্যবহার করে তাদেরকে সংজ্ঞাহীন করে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

দরজার দিক থেকে পায়ের শব্দ কানে এল। পেছনের চিন্তা থেকে আহমদ মুসা বর্তমানে ফিরে এল।

দরজা দিয়ে প্রবেশ করল প্রায় ছয়ফুট লম্বা একটা স্লিম মানুষ। তার পরনেও সেই সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, সাদা কোট এবং মুখেও সেই সাদা মুখোশ।

লোকটি ঋজু দেহে সামরিক কায়দায় প্রবেশ করল ঘরে। ‘গুড মর্নিং’ বলে এসে সেই চেয়ারে বসল। তার কথার স্বরে আহমদ মুসার মনে হলো লোকটির বয়স চল্লিশের আশে-পাশে হবে।

লোকটি বসেই বলল, ‘স্যরি আহমদ মুসা, আপনার হাতে শেকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। এটা ঠিক শত্রুতা নয় আহমদ মুসা। আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই এটা করা হয়েছে।’ বলল মুখোশধারী লোকটি।

‘কিন্তু নিরাপত্তার ভয় তো আসে শত্রুর কাছ থেকেই।’ আহমদ মুসা বলল।

‘তা ঠিক। শত্রু না হলেও আপনাকে ধরে আনার কারণে আপনি আমাদের শত্রু মনে করবেন। সে জন্যেই নিরাপত্তার চিন্তা।’ বলল মুখোশধারী।

‘এটা মনে করার ব্যাপার নয়। শত্রুতা তো হয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘দুঃখিত। আমরা আপনাকে ধরে এনেছি বটে, কিন্তু আমরা আপনার সহযোগিতা চাই।’ বলল মুখোশধারী।

‘সহযোগিতা চাওয়ার ধরন আপনাদের চমৎকার তো!’ আহমদ মুসা বলল।

‘ঠিক বলেছেন। খাব না তবু খেতে বাধ্য করার মতো। আমার জন্যে কিছু করবেন না, তবু করতে বাধ্য হওয়ার মতো। সহযোগিতা এমনও হয় মি. আহমদ মুসা।’ বলল মুখোশধারী।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তার মানে আমাকে বাধ্য হয়ে সাহায্য করতে হবে।’

‘ঠিক বাধ্য হয়ে নয়, সাহায্য আমাদেরকে করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

‘যদি না করি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ভালো কাজে সহযোগিতা করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

‘সেটা আপনাদের মতে ভালো কাজ, আমার মতে ভিন্ন হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘অনেক সময় নিজের ভালো না লাগলেও অন্যের ভালো লাগা কাজও করতে হয়। আমরা সেটাই আপনার কাছে চাই।’ বলল মুখোশধারী।

আহমদ মুসা বুঝল ওরা তার সাহায্য আদায় করে নেয়ার জন্যেই তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। কি সে সাহায্য? হিটলার ও সোভিয়েতরা বিজ্ঞানীদের ধরে নিয়ে আসত তাদের ইচ্ছামত গবেষণা করিয়ে নেয়অর জন্যে। কিন্তু তাকে ওরা কি জন্যে এনেছে। কারা ওরা? আহমদ মুসা একবার ভাবল, তাকে জিজ্ঞাসা করবে কিনা যে, তারা কি সাহায্য চায়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মত পরিবর্তন করল। জিজ্ঞাসা করার অর্থ হবে আমি দূর্বল হয়ে গেছি, সাহায্য করতে আমি রাজি।

‘আপনার চাওয়া আমার চাওয়া নয়।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এখন নয়, তবে হবে। আমরা অপেক্ষা করবো।’ বলল মুখোশধারী।

‘তার মানে সাহায্য না করা পর্যন্ত বন্দী থাকতে হবে?’ আহমদ মুসা বলল।

‘সেটাই আমাদের ইচ্ছা। তবে এটা ঠিক বন্দী থাকার মতো ব্যাপার নয়। বলতে পারেন, মেহমান হিসাবে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা। আমাদের আশা যে, আপনি নিজের ইচ্ছাতেই আমাদের ভালো কাজে সাহায্য করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

কথা শেষ করে আবার বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, কোন্ ভালো কাজে আমরা আপনার সাহায্য চাচ্ছি তা আপনার জানতে ইচ্ছা করছে না?’

‘বিষয়টা যেহেতু আমার নয়, আমার স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তাই আমার কোন আগ্রহ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমাদের আগ্রহ আছে আপনাকে জানানোর। তবে সে সময় আসেনি, এলে সবই আপনি জানবেন। তবে আপনার মানসিক প্রস্তুতির জন্যে কিছু আপনার জানা দরকার। আমরা পারমাণবিক সব ধ্বংসাত্মক অস্ত্র থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করতে চাই, দুনিয়াকে রক্ষা করতে চাই এবং সেটা যুদ্ধ করে নয়, বুদ্ধির জোরে। আমাদের এই প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্যে আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান লোকের সাহায্য দরকার।’

চেহারায় প্রকাশ না পেলেও মন তার চমকে উঠল। এরা তাহলে ছোট-খাট কোন গ্যাং নয়, বড় কোন ষড়যন্ত্রের সাথে এরা জড়িত। আণবিক মারণাস্ত্রের হাত থেকে দুনিয়াকে রক্ষা করবে বুদ্ধি দিয়ে! বিষয়টা কি? কি লক্ষ্য এদের? এরা আরেক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রধারী কিনা কিংবা সে রকম কোন অস্ত্রধারীর পক্ষে কাজ করছে কিনা? অন্য সকলের মারণাস্ত্র ধ্বংস করা গেলে নিজেদের সকলের মাথার উপর চেপে বসা সহজ হয়, সে রকমের কোন ব্যাপার কি না? প্রথমে এরা কার অস্ত্র ধ্বংস করতে চায়? আমেরিকার? এরা আমেরিকায় বসে যখন কাজ করছে, তখন এটাই স্বাভাবিক। এরা কি আমেরিকান, না অন্য কোন দেশের? সামনে বসে যে লোকটি কথা বলছে, তার উচ্চারণ আমেরিকান হলেও তিনটি মূল শব্দ বিদেশী ছিল- জাপানী, রুশ ও জার্মান ভাষার। শব্দের এই সমন্বয় বিস্ময়কর!

এসব চিন্তায় আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে নীরব দেখে মুখোশধারীই আবার প্রশ্ন করল, ‘কি ভাবছেন মি. আহমদ মুসা?’

‘ভাবছি আপনাদের ভালো কাজটি নিয়ে না, ভাবছি আপনারা কারা! আপনাদের একটা ভালো কাজের জন্যে আমাকে অপহরণ করে নিয়ে এলেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘এটা আপনি প্রথমেই ভাববেন, সেটা আমরা জানি। কিন্তু ভেবেও আপনি কুল পাবেন না। আমাদের পরিচয়ের আপনার কোন প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের পরিচয় আমরা বলব না। তবে এটুকু বলে দিতে চাই, আমরা জেনারেল শ্যারনদের মোসাদ কিংবা ইরগুনজাই লিউমি কিংবা আপনার পুরনো শত্রুদের কারও মতো নই। আমরা হৈ চৈ করি না অথবা ঘটনা ঘটিয়ে শত্রুকে সচেতন করি না বা শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে চাই না। লক্ষ অর্জন আমাদের টার্গেট। নীরবে কাজ করে সেই লক্ষে পৌছতে চাই। তাই বলে আমরা দুর্বল নই, কাজ উদ্ধারের জন্যে রক্তসাগরও পাড়ি দিতে পারি আমরা।’ বলল মুখোশধারী।

‘কাজ উদ্ধারের জন্যে সবাই এটাই করে। ওরাও করে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘হ্যাঁ, এটা ওরাও করে, আমরাও করি। কিন্তু আমরা এবং ওরা এক নই। এই দেখুন না, আমাদের তিনজন কমান্ডো আপনার মতো করেই আপনার স্ত্রী ও সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিল এয়ারপোর্টেই। আমাদের হিসাব ও সেখানকার অবস্থার বিচারে শতভাগ সাফল্য- নির্দিষ্ট ছিল। তার উপর আপনি অপহৃত হবার খবরে আপনার প্রেমিকা সারা জেফারসন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আপনার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন। সুতরাং পরিস্থিতি আমাদের আরও অনুকুল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আপনার স্ত্রী আমাদের তিনজন কমান্ডোকেই গুলি করে হত্যা করেছে। একসাথে তিনজন কমান্ডো প্রাণ হারাল আমাদের এই প্রথম। এই ঘটনা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার কোন সিদ্ধান্ত আমরা নেইনি। এমনকি আপনাকেও এ বিষয়টি জানাইনি কিংবা আপনার উপর এই হত্যার কিছু প্রতিশোধ নেব, সে রকম সিদ্ধান্তও আমরা নেইনি। এর কারণ লক্ষ অর্জনকেই আমরা গুরুত্ব দেই। এ ক্ষেত্রে আমরা যে কোন ক্ষয়-ক্ষতিকে স্বাভাবিক বলে মনে করি।’ মুখোশধারী বলল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসনকে কিডন্যাপের চেষ্টার বিষয়টি বিস্মিত করল আহমদ মুসাকে। এরা জোসেফাইন ও সারাকেও কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করেছিল! তার উপর চাপ সৃষ্টির উপকরণ বানাতে চেয়েছিল ওদেরকে? আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। আল্লাহ এক বড় বিপদ থেকে তাদের বাঁচিয়েছেন। তার মনে প্রশ্ন জাগল, কি সাহায্য বা কোন কাজে তারা আমাকে ব্যবহার করতে চায়? নিশ্চয় সেটা সাংঘাতিক বড় কোন কাজ এবং তারা জানে সে কাজে আমি তাদের সাহায্য করতে চাইব না। এ জন্যেই তারা আমার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির জন্যে জোসেফাইন ও সারাকে ব্যবহার করতে চায়।

মুখোশধারী থামলে আহমদ মুসা বলল, ‘তার মানে আপনারা আমাকে বাধ্য করার জন্যে পণবন্দী হিসাবে ওদেরকে আটক করতে চেয়েছিলেন। এটা তো শ্যারনদেরই চরিত্র।’

‘না এটা শ্যারনদের চরিত্র নয়, কঠিন সব কাজ উদ্ধারের জন্যে এমন দুর্বল শিকারদের পণবন্দী করার রেওয়াজ অনেক পুরনো। এই পুরনো কাজটা করতে চেয়েছিলাম নির্দোষ উদ্দেশ্যে।’ বলল মুখোশধারী।

হাসল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, এরা যারাই হোক শ্যারনদের চেয়ে বিপদজনক। একটা জঘন্য পরিকল্পনা বা হিংসাত্মক কাজের পক্ষে ওরা এত ঠাণ্ডা মাথায় পক্ষ নিতে পারে না। আর সাথীদের রক্তের মূল্য আছে শ্যারনদের কাছে, কিন্তু এদের কাছে নেই। এরা সাথীদের নিহত হওয়াকে একটা স্বাভাবিক ঘটনামাত্র মনে করে। এদের সীমাহীন নৃশংসতার প্রমাণ এটাই। এরা একেবারেই কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার। এদের সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। এরা জোসেফাইনদের আবার কিডন্যাপ করার চেষ্টা করবে না তো? মনে হয় এই মুহূর্তে সেরকম কিছু করতে যাবে না তারা। তাদের ‘ভালো কাজে’র জন্যে আমাকে রাজী করাতে না পারলে শেষ অস্ত্র হিসাবে তারা জোসেফাইনদের কিডন্যাপের চিন্তা করতে পারে। তবে এ বিষয়ে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ওদের ‘ভালো কাজটা’ কি? নিশ্চয় মারাত্মক কিছু। কোন ছোট কাজের জন্যে আমাকে তারা বেছে নেয়নি? কেন তাদের নিজের লোক নয়? শুধু সাহস, শক্তি ও বুদ্ধির জন্যে আমাকে তারা বাছাই করেছে? শুধু এ জন্যেই আহমদ মুসাকে বাছাই করবে তা মনে হয় না। মনে হয় কাজটা এমন হতে পারে, আমার নাম-পরিচয় সে কাজটা করার জন্যে সুবিধাজনক। কি কাজ হতে পারে?

এই ভাবনার মধ্যে আহমদ মুসা আনমনা হয়ে পড়েছিল।

‘কি ভাবছেন আহমদ মুসা?’ বলল মুখোশধারী।

‘ভাবছি আপনাদের ‘নির্দোষ উদ্দেশ্য’ নিয়ে। উদ্দেশ্য নির্দোষ হলে দূষণীয় পথে তা কেউ অর্জনের চেষ্টা করে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘নীতি যারা তৈরি করেছে এটা তাদের কথা। আমাদের কথা হলো, ভালো কাজ করতে হবে এটাই শেষ কথা। ভালো কাজটি যেভাবে যে পথেই সম্পন্ন করা যাক, তা করতে হবে।’ বলল মুখোশধারী।

‘আর ভালো কাজের সংজ্ঞাও তাহলে আপনাদের নিজস্ব?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরা যেটা ভালো মনে করি, ভালো জানি, সেটাই নির্ধারণ করি। এটাই স্বাভাবিক।’ বলল মুখোশধারী।

কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল মুখোশধারী। বলল, ‘আমি উঠছি মি. আহমদ মুসা। নতুন পরিবেশে নতুন একটা নিয়মে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। প্রয়োজনে আপনার সাথে আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা সেখানে আছে। ওটাকে ঠিক বন্দীখানা ভাববেন না। আরামদায়ক এক নিরাপত্তা কাস্টোডি ওটা। আপনার মতো যাদের আমরা সাহায্য চাই, তাদেরকে আমরা ওখানেই রাখি।’ বলে মুখোশধারী দরজার দিকে একধাপ এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কত বার কিভাবে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছেন, সব রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। পালাবার চিন্তা বাদ দিয়ে প্রশান্ত মন নিয়ে থাকবেন, এটা আমার আশা।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুখোশধারী।

তার যাবার সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

আহমদ মুসা বসেছিল।

তার পেছনে বাতাস আন্দোলিত হবার শব্দ হলো। পেছনে তাকাল সে। দেখল, একটা দরজা খুলে গেল। ওটা সেই লিফটের দরজা, যে লিফটে সে এসেছিল।

লিফটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তিনজন।

তিনজনের হাতেই কারবাইন জাতীয় ক্ষুদ্র ভয়ংকর অস্ত্র। তাদের তিনজনের মুখেই মুখোশ।

তাদের তিনজনের হাতের কারবাইনই আহমদ মুসার বুক লক্ষে তোলা। কারবাইনের ট্রিগারে তাদের তর্জনি।

দু’জন এসে আহমদ মুসার দু’পাশে দাঁড়াল। তাদের কারবাইনের লক্ষ আহমদ মুসার দিকে স্থির।

তৃতীয়জন কারবাইনটা কাঁধে ঝুলিয়ে পকেট থেকে এক খণ্ড কালে কাপড় বের করে আহমদ মুসার চোখ বেঁধে ফেলল।

আহমদ মুসা হাসল। তারপর বলল, ‘তোমরা আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, তা দেখাতে চাও না। তোমাদের অফিস কোথায়, এখানে কি আছে তা আমার চোখ থেকে আড়াল করতে চাচ্ছ। তার মানে তোমরা ভয় কর যে, আমি তোমাদের বন্দীখানা থেকে পালাতে পারি?’

তিনজনের কেউ কিছু বলল না। তার দিকে তাকালও না। নীরবে তারা আহমদ মুসাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে লিফটে ঢোকাল।

লিফটটির একটি বৈশিষ্ট হলো এর চলাটা টের পাওয়া যায় না। চলছে কিনা, কোন্ দিকে চলছে, উপরে না নিচে, তা বুঝা যায় না। এরপরও আহমদ মুসার সচেতন স্নায়ুতন্ত্রী তার উপর গতির অদৃশ্য চাপ থেকেই বুঝতে পারল, লিফট নিচে নামছে। আহমদ মুসা কিছুটা বিস্মিতই হলো। মুখোশধারীর সঙ্গে যে কক্ষে দেখা হলো, সেখানেও তাকে লিফট থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল নিচের দিকে। তখন আহমদ মুসা বুঝেছিল, তাকে আন্ডার গ্রাউন্ড কোন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ি করে তাকে এনে যে কক্ষে তুলেছিল সেটাও ঠিক ভূমির সমতলে নয়। আহমদ মুসা পরিষ্কার বুঝেছিল, এক জায়গা থেকে গাড়ি নিচে নামতে শুরু করেছিল। খাড়া নিচে নামা নয়, কিংবা নিম্নমুখী হওয়া অতটা সার্প ছিল না। কয়েক গজ নিচে নামার পর সমান্তরাল গতিতেই চলেছিল গাড়িটা। প্রথমে তাকে রাখা হয়েছিল এই সমান্তরাল অবস্থানের কোন ঘরে। সেখান থেকে তাকে আরও নিচে নামিয়ে আনা হয় মুখোশধারীর কক্ষে। সেখান থেকে আবার তাকে নিচে নামানো হচ্ছে। তার মানে তাকে যেখানে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে সারফেস লেভেলে কোন স্থাপনা নেই। মনে হয় যে স্থাপনার মধ্যে সে রয়েছে, তার গোটাটাই আন্ডারগ্রাউন্ড, মাটির তলে। এখানে নিশ্চয় সারফেসে উঠারও কোন ব্যবস্থা নেই। বলতেই হবে সুরক্ষিত এক বন্দীখানায় সে ঢুকেছে।

এক সময় মনে হলো, দেহের স্নায়ুর চাপ যেন হঠাৎ আর নেই। বুঝল আহমদ মুসা লিফট থেমে গেছে। তারা ঠিকানায় এসে পৌছে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত পরে লিফটের দরজা খুলে গেল, এটা আহমদ মুসা বুঝল কোন শব্দে নয়, বাতাসের গন্ধ ও তাপের পরিবর্তনে।

দরজা খুলে যাবার পরে পরেই লিফট থেকে আহমদ মুসাকে বের করে আনা হলো এবং তার হাতের হাতকড়াটি খুলে তাকে সামনে পুশ করা হলো।

আহমদ মুসার মনে হলো পেছন থেকে ওরা আরও পেছনে সরে গেল।

আহমদ মুসার হাতকড়া খোলা হলেও তার চোখের বাঁধন খোলা হয়নি।

আহমদ মুসা খুলে ফেলল তার চোখের বাঁধন। দেখল, সে দুই স্টিলের দেয়ালের মাঝখানের একটা করিডোরে। পেছনে তাকাল। সেখানেও স্টিলের সলিড দেয়াল। দেয়ালের ঠিক মাজ বরাবর সাদা অক্ষরে এইচ কিউব (H3) লেখা।

সামনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, দু’পাশের স্টিলের দেয়াল যেখানে শেষ হয়েছে, তার একটু সামনেই সুন্দর একটা বাংলো জাতীয় বাড়ি। ঐ ঘরের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প নেই। এগোলো আহমদ মুসা সেদিকে।

দেয়াল পার হয়েছে আহমদ মুসা। সংগে সংগেই পেছনের বাতাস আন্দোলিত হবার একটা ছোয়া পেল সে।

তাকাল পেছনে। সেই দুই দেয়ালের কোন অস্তিত্ব আর নেই।

চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। চারদিক ঘিরে স্টিলের দেয়াল। মাথার উপরের ছাদটা গম্বুজের মতো উঠে গেছে উপরে। নিচের চত্বরটি কৃত্রিম ঘাসে ঢাকা। দেখে মনে হয় মাটির উপরে গম্বুজাকৃতির ঘর এটা। এই ধারণা সৃষ্টির জন্যেই এটা করা হয়েছে।

চারদিকের স্টিলের দেয়াল থেকে দশ গজ ভেতর দিয়ে চার পাঁচ ইঞ্চি চওড়া একটা রেড সার্কেল। সে সার্কেলের ভেতরে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা অনুমান করল, এগিয়ে থাকা সেই দেয়াল দু’টো রেড লাইনের এপার পর্যন্ত ছিল। সে রেড লাইন ক্রস করে এসেছে বলে মনে পড়ছে না। দেয়াল ও রেড লাইনের ভেতরে চত্বরটির দুই প্রান্তে আরও দু’টি ছোট বাংলো জাতীয় ঘর। ঐ দু’টি ঘরেও কি মানুষ আছে, প্রশ্ন জাগলো আহমদ মুসার মনে।

চারদিকের একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে সে তার বাংলো টাইপ ঘরের দিকে এগোলো। একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর, একটা গোসলখানা ও খাবার ঘর নিয়েই তার বাংলোটা। শোবার ঘরটা বড়। শোবার খাট, পড়ার টেবিল, একটা বুক শেলফ, কাপড়-চোপড়ের একটা র‌্যাক। সব কিছুই স্টিলের। টয়লেটের পাশের কক্ষই গোসলখানা। গোসলখানার পরের কক্ষটিই খাবার ঘর। সবগুলো ঘরেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা জিনিসও নেই। আর সবগুলোই স্টিলের।

আহমদ মুসা ঘরে ফিরে এল। মন চাইল বেডটা একবার ওলট-পালট করে সবটা দেখে নেয়। কিন্তু শরীরটা ভেঙে আসছে তার। মুক্তভাবে রেস্ট নেয়া হয়নি কয়েকদিন।

বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা।

রাত-দিনের কোন পার্থক্য আহমদ মুসার কাছে নেই। তার হাতের ঘড়ি শুরুতেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার নতুন বাসগৃহে কোন ঘড়ি নেই। তার চারপাশের গোলাকার যে চত্বর সেখানেও দিন-ক্ষণ বুঝবার কোন কিছু নেই। আহমদ মুসার মনে হয়েছে এটাও এক ধরনের মানসিক প্রেসার।

তার এ বন্দীখানায় একটা বিস্ময় হলো কোন মিরাকল উপায়ে খাবার আসা। বন্দীখানায় প্রথম দিন রেস্ট নেবার জন্যে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠেছিল রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে। খাবার কে দেবে, কিভাবে আসবে তার কিছুই জানা ছিল না।

এই সময় একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এল,‘মি. আহমদ মুসা ডাইনিং-এ আপনার খাবার রেডি। খেয়ে নিন।’

এই কণ্ঠ আহমদ মুসাকে তার গোটা বন্দী জীবনে নির্দেশ দিয়েছে। তার শোবার ঘর, টয়লেট, গোসলখানা ও ডাইনিং সব জায়গায় স্পিকার রয়েছে। ঠিক সময় বেধে চারবার খাবার এসেছে। এই খাবারগুলোকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, নাস্তা ও ডিনারে ভাগ করা যাবে না। গেলে সময় আন্দাজ করা যেত। চার বারের খাবারের মান, পরিমাণ, মেনু একই রকম। একই মেনু ঘুরে ফিরে সব সময়ই আসে। এক কথায় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার একাকার। সুতরাং খাবারের রকম দেখে সময় ভাগ করার কোন উপায় ছিল না।

‘খাবার রেডি’ ঘোষণা শুনে ডাইনিং-এ গিয়েছিলাম। দেখলাম, ওভেনের উপর ফুড ক্যারিয়ার। স্টিলের। খুললাম ফুড ক্যারিয়ার। বাইরে স্টিল হলেও ভেতরে উৎকৃষ্টমানের হটপট সিস্টেম। খাবার থেকে একদম ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

অবাক হয়েছিলাম, খাবার কোত্থেকে এল? কে দিয়ে গেল? আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় হয়তো কেউ খাবার দিয়ে গেছে।

পরের খাবার ঐভাবে পেয়েছিলাম। কে কখন খাবার দিয়ে যায় তা দেখার জন্যে আমি সর্বক্ষণই বলা যায় এলার্ট ছিলাম। কেউ আসেনি, খাবার ঠিক এসেছিল।

বরাবরই খাবার পেয়েছি এই ওভেনের উপর। ওভেনটা সচল নয়। সুইচগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, ওভেনের মেনু সুইচ টিপে নানাভাবে আঙুল চালিয়ে দেখেছি সবই অচল।

এই ওভেনের খাবার কোত্থেকে আসে। খাবার ঘরে কি অন্য কোথাও কোন গোপন দরজা আছে? কিন্তু গোপন দরজায় ঢুকতে হলে তো দিনে চার বার চোখ এড়িয়ে ফাঁকা চত্বর পার হয়ে এখানে আসতে হবে। এটা অসম্ভব।

আহমদ মুসার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, সব সময় খাবারটা ওভেনের উপর থাকে কেন? টেবিলের উপর বা অন্য কোথাও নয় কেণ? চট করে আহমদ মুসা ওপরের দিকে তাকাল। ওভেনের ঠিক মাথার উপরে ছাদে একটা চিমনি। চিমনির মাথাতেও একটা স্টিলের ঢাকনা।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার।

কিছু দিন আগে পড়া একটা বিষয় হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টা ছিল ম্যাগনেটিক ফোর্সের সামরিক ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার সম্পর্কে। ম্যাগনেটিক ওয়েভে ভারি জিনিসও পাঠানো যায়। চিমনির পথে এ রকম কোন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা তার কাছে খাদ্য পাঠানোর জন্যে? এখানকার সবকিছুই স্টিলের। সবকিছুর উপরেই কি ম্যাগনেটিক নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে! এর বিকল্প কিছু সে আর খুঁজে পায়নি সেদিন।

পরদিনই সে সহবন্দী আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাবদের কাছে বন্দীখানার পরিবেশ নিয়ে আলোচনার সময় শুনেছিল বন্দীখানা অনেকটাই গ্রীনহাউজ ফার্মের মতো। গম্বুজাকৃতি স্থাপনা স্থানটিকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করলেও এখানে যেমন কৃত্রিম ঘাস দেখা যায়, তেমনি কৃত্রিম মেঘও দেখা যায়। তাদের এই বক্তব্য তার ম্যাগনেটিক ক্লাউডের ধারণাকে আরও মজবুত করেছিল।

আর নিয়মিত ব্যায়াম শেষে পায়চারি করতে বাইরের চত্বরে বেরিয়েছিল আহমদ মুসা। ব্যায়াম ও পায়চারির একটা সময় সে ঠিক করে নিয়েছিল।

চার বারের খাবারের মধ্যে দুই বারের খাবার দেয়ার বিরতি অন্য তিন বারের বিরতির চেয়ে দীর্ঘ। আর সেটা প্রায় ৯ ঘণ্টা। অন্য তিন বারের বিরতির গড় দৈর্ঘ্য ৫ ঘন্টার বেশি নয়। বড় বিরতিকেই আহমদ মুসা রাত বলে ধরে নিয়েছে। এই বিরতির শেষটাকে সকাল হিসাবে ধরে নিয়ে সে ব্যায়ামের সময় নির্দিষ্ট করেছে। তারপর আরও ঘণ্টাখানেক জগিং ও পায়চারি করে এসে গোসল শেষে ফ্রেশ হয়ে খাবার খায়।

আজও জগিং শেষে পায়চারি করছে আহমদ মুসা প্রতিদিনের মতোই। এ সময় দেখা হয়, কথা হয় আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাবের সাথে।

আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাব আহমদ মুসার মতোই দুই বন্দী। আহমদ মুসাকে বন্দীখানায় এসে বন্দীখানার জন্যে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। তার নিজের পোশাক তার সংজ্ঞাহীন অবস্থার পরে ওদের নির্দেশে পাল্টে ফেলতে হয়েছিল। বন্দীখানায় এসে নতুন পোশাক পেয়েছে সে। কিন্তু আগে বুঝেনি ওটা ঠিক বন্দীখানার পোশাক। কিন্তু আব্রাহম ও মানসীর পরনে একই পোশাক দেখে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল ওরা তার মতোই বন্দী এবং বন্দী হিসাবেই ঐ পোশাক তারা পরেছে। ওরাও যে বন্দী তা এভাবেই সে জানতে পারে। ওরা দু’জন থাকে গোল চত্বরটির দু’প্রান্তের সেই ছোট দুই বাংলোতে।

তবে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না আহমদ মুসার। ওদের একজন এসে গেল। দ্বিতীয় জনও নিচে আসছে। সেই রেড সার্কেলের পাশে এসে দাঁড়াল মেয়েটি মানে মানসী মেরাব। রেড সার্কেল যে প্রাণঘাতী, সেটা ওদের কাছ থেকেই আহমদ মুসা শুনেছে। কোন কিছু রেড লাইনের ঠিক ওপরে আসার সাথে সাথে তা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়। রেড লাইন স্পর্শ করলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ক্রস করতে গেলেই ভয়াবহ ম্যাগনেটিক রশ্মিতে তা ধ্বংস হয়ে যায় কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

রেড লাইনের ওপারে মানসী মেরাব যেখানে দাঁড়িয়েছিল, এ পাশে তার বরাবর স্থানে আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আব্রাহাম আবনার কোথায়?’

‘বাড়ির একটা স্বপ্ন দেখে সে দারুণ ভেঙে পড়েছে। রাতের অবশিষ্ট অংশ ঘুমায়নি। সকালে গিয়ে দেখলাম শয্যা নিয়েছে।’ বলল মানসী মেরাব।

ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। বলল, ‘এই ছেলেমানুষি কেন? কেঁদে লাভটা কি?’

‘এটা তাকে বুঝাবে কে? সুযোগ পেলেই ওদের কাছে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আবেদন-নিবেদনের অন্ত নেই।’ বলল মানসী মেরাব।

‘কিন্তু মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ ও দুর্বল মনের হয়। কিন্তু তোমার তো ওর মতো অবস্থা হয়নি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘মন খারাপ আমারও। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ওরা যা চায় তা না পেলে আমাদের মুক্তি মিলবে না।’ বলল মানসী মেরাব।

‘তোমাদের কাছে কি চায় ওরা?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমাদেরকে আপনার সহযোগী হতে হবে। আমাদের বলা হয়েছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি তাদের কাজে রাজী হবেন, তত তাড়াতাড়ি আমাদের মুক্তি মিলবে। সেজন্যে আপনি যাতে সানন্দে রাজী হয়ে যান- সে চেষ্টা করতে আমাদের বলা হয়েছে।’ বলল মানসী মেরাব।

আহমদ মুসা বলল, ‘আমাদের কাছে ওরা কি চায়?’

‘সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। আপনাকে পেন্টাগনে ঢুকতে হবে। সেখানকার অতি গোপন স্থান থেকৈ ছোট্ট একটা জিনিস আনতে হবে। আপনি প্লিজ রাজী হয়ে যান স্যার।’ বলল মানসী মেরাব।

মনে মনে আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। কিছুঁটা বুঝতে পারল ওদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু নিজের আঁতকে উঠা ও কৌতুহল চেপে রেখে হালকা কণ্ঠে বলল, ‘এদের তো অনেক লোক। এই একটা ছোট কাজে এত ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে ধরে আনা হয়েছে কেন?’

‘ছোট কাজ কোথায়? পেন্টাগনের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান থেকে যে জিনিসটা আনতে হবে, তা ক্ষুদ্র একটা ‘পিন’ হলেও দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দামি ওটা আজ। আর পেন্টাগনের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের বাইরে একমাত্র আপনার পক্ষেই পেন্টাগনে প্রবেশ সহজ। আপনাকে কেউ সন্দেহত করবে না, করলেও আপনাকে গুলি করার সাহস কেউ করবে না। এরই সুযোগ নিয়ে আপনাকে সেই গোপন স্থঅন থেকে মহামূল্যবান সেই ‘পিন’টি নিয়ে আসতে হবে। এটাই ওরা আপনার কাছে চায়।’

আহমদ মুসার মনের কোণে যে একটা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল, সে প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে উঠল। সে ভেবে পেল না তার মতো বন্দী হয়েও তারা এসব জানে কেমন করে? কিন্তু এ বিষয়ের দিকে না গিয়ে আহমদ মুসা মানসী মেরাবের কথার প্রসঙ্গ ধরে বলল, ‘পিনটা কি? এত মূল্যবান কেন?’

‘সেটাও তারা আমাদের কাছে বলেছে। বিষয়টা ওদের খুবই গোপনীয়। আপনি জানেন স্যার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র SDI (Strategic Defense Initiative)- এর আওতায় ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধক অস্ত্র তৈরি করেছে। কিন্তু এই অস্ত্রও প্রতিরক্ষা শতভাগ নিশ্চিত করে না। এই উদ্বেগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ গবেষণার পর এমন একটা অস্ত্র আবিষ্কারা করেছে যা অত্যন্ত নীরবে এবং খুবই স্বল্প সময়ে শত্রুর সকল কৌশলগত অস্ত্র অচল করে দিতে পারে। প্রতিরক্ষার জন্যে SDI জাতীয় কোন প্রতিরক্ষা অস্ত্রের প্রয়োজন আর নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ পরম পরিতৃপ্ত হয়ে আছে যে, গোটা পৃথিবীকে ডমিনেট করার মোক্ষম অস্ত্র তাদের হাতে। কিন্তু অস্ত্রটির ফর্মূলা চুরি হয়ে গেছে, তারা তা জানে না। এরাই এই ফর্মূলা চুরি করে মোক্ষম অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। অস্ত্র তৈরি করলেও অপারেশনাল সিস্টেম এখনও তৈরি হয় নি। এই অস্ত্রকে অপারেশনাল করার জন্যে একটা ‘কিং পিন’ প্রয়োজন। যা অবিশ্বাস্য শক্তির এক ম্যাগনেটিক ওয়েভকে সক্রিয় করবে। এই মিরাকল ম্যাগনেটিক পিন-এর ফর্মূলা এদের কাছে নেই। অনেক চেষ্টা করেও তা তারা হস্তগত করতে পারেনি। পিনটি ‘কিং পিন’ এ কারণে যে, পিনটি যে সিগন্যাল দিবে, সে অনুসারেই ম্যাগনেটিক ওয়েভ কাজ করবে। ম্যাগনেটিক পিন এরাও তৈরি করেছে, কিন্তদু সে পিন ব্যবহার করে দূর থেকে কৌশলগত অস্ত্রকে ধ্বংস করা যায়, অচল করে দেয়া যায় না। স্ট্রাটেজিক সব অস্ত্র অচল করে দেয়ার পিন পেন্টাগনের কাছে আছে। ওটাই চুরি করতে হবে।’ বলল মানসী মেরাব।

‘অচল করে দেয়ার পিন কেন দরকার, ধ্বংস করে দেয়ার কাজটাই তো ভালো। ধ্বংস করার অস্ত্র রেখে লাভ কি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘যারা শত্রুকে নিরস্ত্র করে শুধু তার রাজ্য নয়, তার অস্ত্রভাণ্ডারও দখল করে নিতে চায়। তারা অস্ত্র ধ্বংস করবে কেন? অন্যদের সব অস্ত্র অচল করে দিয়ে নিজের অস্ত্রের জোরে দুনিয়ার শক্তিগুলোর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং অচল করার সেই পিন তাদের চাই।’

ষড়যন্ত্রটা বুঝল আহমদ মুসা। এ এক বিরাট ষড়যন্ত্র, যে ধরনের চিন্তা সে করেছিল তার চেয়ে অনেক বড়। এদের আণবিক অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার রিমোট সিস্টেম এরা আয়ত্ত করেছে। তার মানে এরা যে কোন সময় চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বা একাধিক আণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে মহাবিপর্যয় ঘটাতে পারে। তার উপর কৌশলগত সব মারণাস্ত্র অচল করার ‘কিং পিন’ তারা হাত করার আয়োজন করেছে। এদের পরিকল্পনা ও আয়োজন বিশাল। তার ধারণার চাইতেও বড় গ্রুপ এরা! কারা এরা? সেই মুখোশধারী বলেছিল, তারা মোসাদ, ইরগুনজাই লিউমিদের আশু লাভের মতো বোকামী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে না। তার মানে এরা ওদের চেয়েও বড় বুদ্ধিমান। কারা এরা? আরেকটা বিষয়ও আহমদ মুসাকে অবাক করেছে। তার মনের প্রশ্নটাকেও আরও জোরদার করেছে। মানসী মেরাব যেসব কথা গড়গড় করে বলে গেল, তাতে ওকে তার মতো কোন বন্দী বলে মনে হলো না। মনে হলো ও যেন এদেরই একজন।

হঠাৎ করেই আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে মানসী মেরাবের দিকে তাকাল। কয়েকদিন ধরে সে আব্রাহামের সাথে মেয়েটিকেও দেখছে। কিন্তু ভালো করে দেখেনি। তার অবয়বকে সে দেখেছে, তবে যাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা বলে সেভাবে দেখেনি।

মানসী মেরাব শুধু অপরূপ সুন্দরীই নয়, তার মুখে ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির দীপ্তি খুবই লক্ষণীয়। অন্যদিকে আব্রাহাম আবনারও অত্যন্ত চৌকশ ও বুদ্ধিমান ছেলে। এদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে শুধু আহমদ মুসার সহযোগী হবার জন্যে এবং সব কিছুই এরা জানে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটাই স্বাভাবিক যে, এদের এখানে রাখা হয়েছে তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে, হয়তো পরিকল্পনার সব কথা আহমদ মুসাকে বলে বিষয়টাকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে।

মানসী মেরাব তার দিকে আহমদ মুসাকে গত কয়েক দিনের ব্যতিক্রম ও খুব গভীর দৃষ্টিতে চাইতে দেখে বলল, ‘স্যার, এভাবে দেখছেন কেন? যাক, তবু আপনার দৃষ্টি কেমন দেখা হলো। গত কয়েক দিনে এ সুযোগ হয়নি। ধন্যবাদ। নিশ্চয়, কিছু বলবেন স্যার।’

‘আমি যদি এদের সাহায্য না করি তাহলে এরা কি করবে মানসী মেরাব?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি জানি আপনি এদের সাহায্য করবেন না। কিন্তু আপনি স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে বাধ্য হবেন।’ বলল মানসী মেরাব।

বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে হবে মানে সাহায্য করতে না চাইলেও আমি তাদের সাহায্য করবো, এই তো?’

‘ঠিক স্যার।’ বলল মানসী মেরাব।

‘কিন্তু কেন, কিভাবে?’ আহমদ মুসা বলল।

সংগে সংগে কথা বলল না মানসী মেরাব। একটু ইতস্ততভাবে আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর বলল একটু নিচু স্বরে, ‘আপনার চিন্তা ও মনোভাবকে তারা বদলে দেবে। একটা বিশেষ ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পালসের মাধ্যমে আপনার ব্রেন থেকে অতীত মুছে দিয়ে সেখানে তারা যা চায় সেটা ইনসার্ট করবে। এই কাজে আমরাও কিছুটা সহযোগিতা করবো তারা যা চায় বার বার তা আপনার সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে। এছাড়া ওরাও আপনার সাথে সরাসরি কথা বলবে।’ থামল মানসী মেরাব।

মানসী মেরাবের কথায় ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা। শয়তানরা শেষ পর্যন্ত এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছে ! আহমদ মুসার মনে পড়ল অনেক আগেকার কথা। ফ্রান্সে ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ক্যামেরুনের এক জমিদার তরুণের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল এই পদ্ধতিতে। তারা সফল হবার আগেই আহমদ মুসা তাকে রক্ষা করেছিল। এখন আহমদ মুসার পাশে কেউ নেই আল্লাহ ছাড়া। আরেকটা প্রশ্নও আহমদ মুসার সামনে এল, মানসী কি করে জানে যে আমি এদের সাহায্য করবো না? সেও কি আমাকে জানে?

‘মানসী মেরাব তুমি বলেছ, তুমি জান আমি এদের সাহায্য করবো না? কি করে জান?’ আহমদ মুসা বলল।

মানসী মেরাব একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমি আপনাকে জানি স্যার।’

‘কি জান তুমি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে জানি। আপনার কাজ সম্পর্কেও জানি স্যার। আপনি আহমদ মুসা।’

আহমদ মুসা বিস্মিত হলো না। একটু অবাক হলো এই মানসীরা তাহলে অভিনয় করছে ওদের পক্ষে? এরা ওদের লোক! তাহলে তার সন্দেহ সত্য প্রমাণ হলো। এ নিয়ে প্রথম থেকেই তার মনে প্রশ্নের ‍সৃষ্টি হয়েছিল।

মানসী মেরাব, নিশ্চয় তুমি অস্বীকার করবে না, তোমরা ওদের লোক?’ আহমদ মুসা বলল।

‘অস্বীকার, স্বীকার কোনটাই করবো না। সত্যি স্যার, আমি আপনার একজন ভক্ত, নিকট থেকে আপনাকে দেখার ও কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য।’ বলল মানসী মেরাব।

‘ধন্যবাদ। একটা কথা যদি আমি জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কারা?’

‘স্যার, আমাকে আর আগাতে বলবেন না। আমি এই পক্ষের মানে যিনি এখানকার সর্বময়কর্তা তার মেয়ে। আমারও একটা দায়িত্ব আছে। আর এই যে কথা বলছি আমরা, তা রেকর্ড হচ্ছে রিমোট সাউন্ড ট্রাকিং এর মাধ্যমে। আর ….।’ কথা শেষ করতে পারল না মানসী মেরাব।

পেছনের কোন অদৃশ্য স্থান থেকে গুলির শব্দ হলো। পিঠে গুলি বিদ্ধ হয়ে ‘ও গড’ বলে টলতে টলতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল মানসী মেরাব।

আর তখনই পেছনের অদৃশ্য এক স্থান থেকে একটা যান্ত্রিক কন্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘স্যরি আহমদ মুসা। জেনেছ মানসী আমার মেয়ে। কিন্তু তার সীমা সে লংঘন করেছিল। আমি নির্দেশের অন্যথাকারীকে ক্ষমা করি না। তবে আপনার ব্যাপারটা আলাদা। আপনি আমাদের মেহমান। আমি আপনার সহযোগিতা চাই এবং নিশ্চয় আপনি সহযোগিতা করবেন।’ থামল কণ্ঠটি।

আহমদ মুসা এই আকস্মিক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মানসী মেরাব থেকে মাত্র গজ তিনেক দূরে। আহমদ মুসা দেখল, মানসী মেরাব আস্তে আস্তে মুখ তুলে তার দিকে তাকাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মানসী মেরাবের দেহটা উল্টে গেল, সেই সাথে তার ডান হাত একটু উঁচু হয়ে তার মাথার উপর দিয়ে মাথার পেছনে ছিটকে এল।

আর তার সাথে কিছু একটা এসে পড়ল আহমদ মুসার পাশেই। চোখ সেদিকে ছুটে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা তার পাশে মেটো রঙের বড় মার্বেলের মতো গোল একটা জিনিস দেখতে পেল।

মানসী মেরাব এটা ছুড়ে দিয়েছে! কিন্তু রেড লাইন কাজ করল না কেন? রেড লাইনের ম্যাগনেটিক সিস্টেম কাজ করে না এমন কিছু দিয়ে তৈরি ওটা? ওটা কি? মুমূর্ষু অবস্থায় এত কষ্ট করে পাঠানো জিনিসটা নিশ্চয় খুব জরুরি। কি হতে পারে? এখন তো ওটা তুলে নেয়া ঠিক হবে না। ওরা এটা দেখতে পেয়েছে কিনা কে জানে?

তাকাল আহমদ মুসা মানসী মেরাবের দিকে। নেতিয়ে পড়েছে তার মাথা। গোটা শরীর দেখা যাচ্ছে নিঃসাড়। তার মানে মানসী মেরাব আর বেঁচে নেই। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তার কাছ থেকে কিছু না শুনেই নিজের মেয়েকে হত্যা করল? কি অমানুষ! স্বার্থ তাদের কত বড় অন্ধ বানিয়েছে? করণীয় নিয়ে তাকে দ্রুতই ভাবতে হবে। মগজ ধোলাইয়ের যে বৈজ্ঞানিক পন্থাটি হাতে নিয়েছে, তা সত্যিই বিপজ্জনক! এর মোকাবিলা সে করবে কি দিয়ে?

আহমদ মুসা পায়চারি করতে শুরু করল এদিক ওদিকে। কিন্তু খুব দূরে গেল না। ব্যায়াম করার মতো হাঁটাহাঁটি করেছে। ঘেমে উঠেছে সে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ, গলা ও ঘাড় ভালো করে মুছে নিল। আবার হাঁটতে শুরু করল। সে মার্বেল আকারের জিনিসটির পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার হাত থেকে রুমাল পড়ে গেল জিনিসটার উপর। দু’ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়েছিলিআহমদ মুসা। পেছন ফিরে আহমদ মুসা এসে রুমালটি তুলে নিল। রুমালের সাথে মার্বেলের মতো গোলাকার জিনিসটিও তার হাতে চলে এল। পায়চারি আরও কিছুক্ষণ অব্যাহত রাখল আহমদ মুসা। তারপর এক সময় চলে এল বাংলোতে।

বেঞ্জামিন বেকন তার হাত ঘড়ির উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ডেভিড বেকহ্যাম যদি নির্দিষ্ট স্পীডে আসে, তাহলে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে এই চৌমাথায় এসে পড়বে।’

‘দেখ, এর আগে তিন বার সে আমাদের বোকা বানিয়েছে। এবার কি হয় দেখা যাক। অবশ্য এবার আমরা ঠিক সময়ে সঠিক ইনফরমেশন পেয়েছি এবং ছবিও পাওয়া গেছে।’ বলল জন নিক্সন।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। তবে তিনবারই সে এফবিআই ও সিআইএ-কে বোকা বানিয়েছে তার ছদ্মবেশ ধারণের দক্ষতা দিয়ে। এবার সেটা হচ্ছে না। এবার আমরা কম্পিউটারের সাহায্যে তার আসল চেহারাকে সামনে রেখে সে কতভাবে ছদ্মবেশ নিতে পারে, তার প্রিন্ট বের করেছি। সুতরাং চোখে ধুলা দেয়া তার জন্যে কঠিন।

বেঞ্জামিন বেকন এফবিআই-এর একজন নামকরা এজেন্ট এবং সেইসাথে ফ্রি আমেরিকারও সদস্য। আর জন নিক্সন সিআইএ-এর এজেন্ট।

ডেবিড বেকহ্যাম ইসরাইলি জায়নিস্টদের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা ফোম (Foam- Army of Man’s Future)- এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন কমান্ডার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোসাদ ও ইরগুনজাই লিউমি’র বদনাম ও বেআইনি হবার পর নতুন এই সংস্থাটি কাজ করছে। সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে এবং একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিনত হয়েছে। ডেভিড বেকহ্যাম তাদের অত্যন্ত ধুরন্ধর, দুর্ধর্ষ ও প্রতিভাবান নেতা। এর নেতৃত্বেই নিউইয়র্কে আহমদ মুসার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিয়ে আহমদ মুসাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। একে ধরার জন্যে এফবিআই ও সিআইএ-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব গোয়েন্দা সংস্থা কয়েকদিন ধরে হন্যে হয়ে ফিরছে। আজ একটা নিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ নিয়ে তারা অবস্থান নিয়েছেন এই চৌমাথায়।

আনাপোলিশ-এর দিক থেকে যেসব গাড়ি আসছে শুধু সেসবই চেক করছে সাদা পোশাকের পুলিশরা। চেকিং কাজটা একটা টিলার আড়ালে হচ্ছে। এখানে এসে সড়কটি টার্ন নিয়ে টিলা ঘুরে চৌমাথার দিকে গেছে। এজন্যে কোন গাড়িই টিলা পার হওয়ার আগে বুঝতেই পারছে না যে, গাড়ি চেকিং হচ্ছে।

পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বেঞ্জামিন বেকন ও জন নিক্সন গাড়ির আরোহীদের পর্যবেক্ষণ করছে।

একটা গাড়ি এসে থামল।

ছয় সিটের বড় আমেরিকান জীপ গাড়ি। মাঝের সিটে দু’জন। ‍সুটেড-বুটেড সাদা আমেরিকান।

ড্রাইভিং সিটে একজন শিখ ড্রাইভার। তাদের চেহারা পরিষ্কার। সন্দেহের কিছু নেই।

‘ও.কে। ছেড়ে দাও।’ বলল জন নিক্সন। বেঞ্জামিন বেকন গভীর মনোযোগের সাথে দেখছিল শিখ ড্রাইভারকে। সবই ঠিক আছে, কিন্তু শিখ ড্রাইভারের নাকটা অত পাতলা কেন? শিখদের নাক তো পুরু হয়ে থাকে।

জন নিক্সনের কথা বেঞ্জামিনের বেকনের কানে যেতেই সাথে সাথে বেঞ্জামিন বেকন বলল, ‘নি নিক্সন, ড্রাইভারকে নামিয়ে নাও। আরেকটু চেক করার প্রয়োজন আছে।’

জন নিক্সন বেঞ্জামিন বেকনের দিকে একবার তাকিয়ে নজর ফেরাল ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘নেমে আসুন সরদারজী।’

জন নিক্সনের কথা শিখ ড্রাইভারের কানে যেতেই সে নড়ে উঠল। ডান হাতটা সে স্টিয়ারিং-এ রেখে বাম হাত সিটের দিকে নামিয়ে একটু ঘুরে গেল, যেন সে সিট থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এর পরেই সে সামনের দিকে একবার তাকিয়ে বিদ্যুৎ বেগে তার বাঁ হাতটা গাড়ির অন্য পাশে ঘুরিয়ে নিল, জন নিক্সনরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে ফিরাল। হাতে তার ক্ষুদ্র, কিন্তু ডাবল ব্যারেলের ভয়ংকর রিভলবার। গুলির ঝাঁক বেরিয়ে এল তার রিভলবার থেকে। বুঝে উঠার আগেই নিক্সনসহ কয়েকজন পুলিশ গুলি খেয়ে পড়ে গেল। তারপর বিদ্যুৎ বেগে তার বাম হাতটা জীপের বাম দরজার দিকে ঘুরে গেল এবং সেই সাথে গুলিবৃষ্টি। সেখানেও সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, তারা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম অবস্থায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারা যখন পকেট থেকে অস্ত্র বের করছিল, সেই সময় ওরা গুলিবৃষ্টির মুখে পড়ে গেল।

বেঞ্জামিন বেকন দাঁড়িয়েছিল জন নিক্সনের পেছনে, দরজার সোজাসুজি নয়। সুতরাং গুলিবৃষ্টি তার নাগাল পায়নি।

শিখ ড্রাইভারটি বাম দরজার দিকে গুলি করার সাথে সাথে স্টার্ট দিয়েছিল তার গাড়ি।

দরজা খোলা অবস্থায় গাড়ি চলতে শুরু করল।

বেঞ্জামিন বেকন রিভলবার বের করেছিল।

গাড়ি স্টার্ট নেয়ার পর বুঝতে পারল পালাচ্ছে ডেভিড বেকহ্যাম।

গোটা ঘটনা ঘটে গেল মুহূর্তে, চোখের পলকে।

বেঞ্জামিন বেকন দু’ধাপ ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠল। শিখ ড্রাইভার ডেভিড বেকহ্যাম বেঞ্জামিন বেকনকে গাড়িতে উঠতে দেখেই তার রিভলবার ধরা হাত দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে এল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে।

বেঞ্জামিন বেকন এমনটা ঘটবে চিন্তা করেই গাড়িতে উঠেছিল। সে গাড়িতে উঠেই পেছনের দু’জনকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি করেই তার রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েছিল ডেভিড বেকহ্যামের দিকে।

ডেভিড বেকহ্যামের রিভলবারও ঘুরে আসছিল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে।

বেঞ্জামিন বেকনের রিভলবার থেকেই প্রথমে গুলি বেরুল। পর পর দু’টি। গুলি দু’টি গিয়ে বিদ্ধ করল ডেভিড বেকহ্যামের রিভলবার ধরা এবং স্টিয়ারিং ধরা দু’টি হাতকে।

ঠিক এই সময় গাড়ির দু’পাশ দিয়ে গুলির ঝাঁক ছুটে এল। বেঞ্জামিন বেকন বুঝল বেকহ্যামের গাড়ির সহযোগিতায় একাধিক গাড়ি আছে। সে গাড়িগুলো থেকেই গুলি আসছে তাদের পুলিশদের লক্ষ করে। নিশ্চয় পুলিশরা এই আকস্মিক আক্রমণের সামনে থেকে পালাতে পারেনি।

গুলি করেই বেঞ্জামিন বেকন বেকহ্যামকে টেনে এদিকে নিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছিল।

বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত রিভলবার বাগিয়ে ধরে রাখল বেকহ্যামের দিকে। বলল, ‘মি. ডেভিড বেকহ্যাম, সামান্য শয়তানিও যদি কর, তাহলে তোমার পা দু’টি শেষ করে দেব।’

বেঞ্জামিন বেকন গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। চৌমাথা থেকে যে রাস্তা সোজা ওয়াশিংটন চলে গেছে, সে রাস্তায় উঠল বেঞ্জামিন বেকন।

গাড়ির রেডিও এর স্বয়ংক্রিয় স্পীকারের বাটন সিগনাল দিতে শুরু করল।

বেঞ্জামিন বেকন বুঝল ডেভিড বেকহ্যামের সাথে কেউ কথা বলতে চায় কিংবা কোন মেসেজ দিতে চায়। বাটনটিতে চাপ দিলেই কথা শোনা যাবে। নিশ্চয় পেছনের গাড়ি থেকেই কেউ কথা বলতে চায়। ওদের সকল গাড়িই তাহলে একক ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের অধীনে!

বেঞ্জামিন বেকন তাকাল ডেভিড বেকহ্যামের দিকে। বলল, ‘নিশ্চয় তোমার পেছনের লোকরা কথা বলবে। তুমি ওদেরকে দু’টি কথা বলবে, এক. তুমি ভালো আছ, দুই- তুমি ওয়াশিংটন যাচ্ছ। ওদেরকে বাল্টিমোরের দিকে তোমাদের কোন আড্ডায় যেতে বলবে।’

বেঞ্জামিন বেকন বাম হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে রিভলবার ডান হাত দিয়ে রেডিও’র অটো স্পিকারের সুইচ অন করে দিল এবং রিভলবার বেকহ্যামের মাথায় চেপে ধরল।

ডেভিড বেকহ্যাম বেঞ্জামিন বেকনের দিকে একবার চেয়ে স্পিকার লক্ষে বলল, ‘আলবার্ট দানিয়েল, আমি ভালো আছি। শোন, আমি জরুরি কাজে ওয়াশিংটন যাচ্ছি। তোমরা বাল্টিমোরে যাও। ওভার।’

‘ও.কে স্যার।’ ওদিক থেকে আলবার্ট দানিয়েল নামের লোকটি।

‘ধন্যবাদ বেকহ্যাম। মৃত্যুর ভয় তোমারও আছে?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘মৃত্যুর ভয় নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেঞ্জামিন বেকন।’ ডেভিড বেকহ্যাম বলল।

‘তোমার এই দর্শনের জন্যে ধন্যবাদ, কাজে লাগবে।’

বলে বেঞ্জামিন বেকন গাড়ি অটোড্রাইভে ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে সিল্কের সরু কর্ড বের করল। বলল, ‘মি. ডেভিড বেকহ্যাম আমি ঝুঁকি নিতে চাই না, একটু নিশ্চিন্তও থাকতে চাই। এজন্যে তোমাকে বেঁধে রাখাই ভালো মনে করছি।’

সিল্কের কর্ড দিয়ে ডেভিড বেকহ্যামের দুই হাত ও দুই পা বেঁধে ফেলল। মুখ বন্ধ রাখার জন্যে মুখে আঠালো টেপ লাগিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার হাতের দ্রুত চিকিৎসা দরকার, দ্রুতই আমরা পৌছে যাব ওয়াশিংটনে।’

বেঞ্জামিন বেকন টেলিফোন করল এফবিআই হেড কোয়ার্টারে। এখানকার সব খবর জানাল। জন নিক্সনসহ পুলিশরা কেউ বেঁচে আছে কিনা বলতে পারল না। তার নিজের গাড়ির লোকেশন জানিয়ে বলল, ‘দ্রুত সাহায্য পৌছা দরকার।’

বেঞ্জামিন বেকন অটোড্রাইভ থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং আবার হাতে নিল। আট দশ মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টারের শব্দ পেল। গাড়ির স্কাই ভিউ এর সুইচ টিপে দিল বেঞ্জামিন বেকন। স্ক্রিনে আকাশে তিনটা হেলিকপ্টার দেখতে পেল। দু’টি পেছনের দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয় যাচ্ছে চৌমাথার ঐ ঘটনাস্থলের দিকে। অন্য হেলিকপ্টারটি তার গাড়ির দিকে এল।

বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। গাড়ির সাথে সাথে এগিয়ে চলল হেলিকপ্টারটিও।

এফবিআই হেড কোয়ার্টারে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন এর অফিস কক্ষে জর্জ আব্রাহাম চার চেয়ারে বসে। তার কাছে টেবিলের ডান পাশে সিআইএ-প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। অপারেশন কমান্ডার এরিক এন্ডারসন, ‘… স্যার ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যে ওয়াশিংটন থেকে বাইরে যাবার এবং ওয়াশিংটনের ভেতরের নৌ ও রেলসহ সব রাস্তা নজরদারীর মধ্যে আনা হয়েছিল। আহমদ মুসাকে ওয়াশিংটনের বাইরে খুব দূরে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব কম। জায়নিস্টদের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা ফোম-এর কিছু লোককে কাস্টোডিতে নিয়েছিলাম। তাদের গ্রেফতারের দু’ঘণ্টার মধ্যে ওয়াশিংটন ও তার আশেপাশের ওদের সব ঘাঁটি আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। সেগুলোর কোনটাতেই আহমদ মুসাকে পাওয়া যায়নি। আমাদের ডগ স্কোয়াড প্রমাণ করেছে যে, ওগুলোর কোনটাতে নেয়া হয়নি আহমদ মুসাকে। যাদের আমরা ধরেছিলাম, তাদের সব রকম জিজ্ঞাসাবদ করেও কিছু জানা যায়নি। এমনটা…।’

এরিক এন্ডারসনের কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘হতে পারে তারা তাদের কোন ঘাঁটিতে আহমদ মুসাকে তোলেনি।’

‘ইয়েস স্যার। এটা হতে পারে। যাদের ধরা হয়েছে তাদের কাছ থেকে এটাও জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা এক কথায় বার বার বলেছে যে, তারা আহমদ মুসাকে জানে না, আহমদ মুসা তাদের কাছে নেই। আমরা তাদের কাছ থেকে তাদের অনেকের বাড়ির সন্ধানও পেয়েছি। সেসব বাড়িতেও খুব দ্রুত এবং একই সাথে হানা দিয়েছি। কিন্তু কিছুই মেলেনি।’ বলল এরিক এন্ডারসন।

‘তাহলে তাদের সব ঘাঁটি ও বাড়ির সন্ধান আমরা পাইনি।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সিআইএ প্রধান।

‘এটাই মনে হচ্ছে স্যার। তবে ‘ফোম’-এর অপারেশন কমান্ডার ডেভিড বেকহ্যাম ধরা পড়েছে, এখন হয়তো সেটা জানা যাবে কিংবা জানা যাবে আহমদ মুসাকে তারা কোথায় রেখেছে।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

‘সে এখন কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল এরিক এন্ডারসনের দিকে। এরিক এন্ডারসান বলল, ‘গতকাল থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিছুক্ষণ আগে বেঞ্জামিন বেকনের সাথে কথা হয়েছে। সে আসছে স্যার।’

জর্জ আব্রাহাম জনসনের ইন্টারকমে তার পিএ কথা বলে উঠল। ‘বেঞ্জামিন বেকন এসেছে’ বলে সে জানাল। জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিল পিএ-কে।

বেঞ্জামিন বেকন এল। স্যালুট দিয়ে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।

‘ওয়েলকাম বেকন। বস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

বসল বেঞ্জামিন বেকন।

‘বল বেকন, তার মুখ খুলতে পেরেছ তোমরা?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘স্যার, মুখ খুলেছে, কিন্তু আহমদ মুসা সম্পর্কে কোন তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায় নি। আমরা …..।’

বেঞ্জামিন বেকনের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। বলল, ‘পাওয়া যায়নি’ বলছ কেন? দেয়নি বলছ না কেন?’

‘স্যার, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমার মনে হয়েছে আহমদ মুসা সম্পর্কে কোন তথ্য তার কাছে নেই। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে তাকে কথা বলার জন্যে সব রকম কৌশল আমরা ব্যবহার করেছি। আমার বিশ্বাস হয়েছে, আহমদ মুসা সম্পর্কে সে জানলে তা না বলা তার জন্যে স্বাভাবিক ছিল না। সে তার সংগঠন সম্পর্কে এমন কিছু গোপন তথ্য দিয়েছে যা তার পক্ষে দেয়ার মতো নয়। তাছাড়া সব শেষে আমরা তাকে ‘ট্রুথ’ মেশিনের মুখোমুখি করেছিলাম। সেখানকার রেজাল্টও আমাদের বিশ্বাসের পক্ষে।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার দু’জনেরই মাথাটা একটু নিচু হলো। তাদের চোখে-মুখে হতাশার চিহ্ন।

সবাই নীরব।

মাথা তুলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘নিউইয়র্কে তারা বৈঠক করে আহমদ মুসার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, এর ব্যাখ্যা সে কি দিল?’

‘স্যার, বৈঠকের কথা সে স্বীকার করেছে। বৈঠকের গোটা বিষয় সে বলেছে এবং যে ক্রিমিনাল গ্রুপগুলো তাতে অংশ নিয়েছিল তাদের পরিচয়ও সে দিয়েছে। সে বলেছে তাদের পরিকল্পনা ছিল আহমদ মুসার পরিবারের সদস্য বা সদস্যদের কিডন্যাপ করা কিংবা হত্যা করা। কিন্তু সে পরিকল্পনার আলোকে কাজ সবে তারা শুরু করেছে। আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ তারা করেনি। এমনকি, আহমদ মুসা আসছে সেটাও তারা জানতো না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে আরও একটা পক্ষকে আমাদের খুঁজতে হবে, যারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছে এবং যাদেরকে আমরা জানি না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমেরিকায় অপর পক্ষ আর কে আছে? আমেরিকায় আহমদ মুসার পুরনো শত্রু যারা তারা সবাই এখন আহমদ মুসার মিত্র। আর নতুন শত্রু হওয়ার মতো কোন কারণ তো ঘটেনি। এত বড় কাজ এত নিখুঁতভাবে যারা করেছে, তারা নিশ্চয় বড় রকমের কোন গ্রুপ। কারা তারা?’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘আমরা এ বিষয়টা আগে ভাবিনি। এখন এটাই সবচেয়ে বড় ভাবনা। এমন কোন গ্রুপের সন্ধান এফবিআই-এর কাছে নেই। অত বড় ও দক্ষ গ্রুপ কি আমেরিকায় সত্যিই আছে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘স্যার একটা বিষয়। কিছুক্ষণ আগে নোয়ান নাবিলা আমাকে টেলিফোন করেছিল। আহমদ মুসার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু আমরা জানতে পেরেছি কিনা জানতে চেয়েছিল। আমরা জানতে পারিনি বলায় সে জানাল যে, সেও সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে পারেনি। তবে একটা সন্দেহ তার মনে ‍ঢুকেছে। সে আসতে চায় এখানে।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘হ্যাঁ, নোয়ান নাবিলা খুব বুদ্ধিমান ও দক্ষ গোয়েন্দা কর্মী। আসতে বলেছি বলে দাও তাকে, এখনি?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এক্সকিউজ মি স্যার। আমি তাকে আসতে বলেছি। বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘এক্সকিউজ মি’ বলছ কেন? ঠিক কাজ করেছ তুমি। জিজ্ঞাসার জন্যে ওয়েট করার মতো নয় এসব কাজ। ধন্যবাদ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘বেঞ্জামিন বেকন কখন তোমার কথা হয়েছে নাবিলার সাথে?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহাম জনসনের।

‘আমি এখানে আসার কিছুক্ষণ আগে স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘সে কি আসছে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমার সাথে কথা বলতে বলতেই সে গাড়িতে উঠেছে স্যার। এখনি সে এসে যাবে স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

বেঞ্জামিন বেকনের কথা শেষ না হতেই জর্জ আব্রাহাম জনসনের পিএ’র কণ্ঠ শোনা গেল ইন্টারকমে। বলল সে, ‘স্যার, মিস নোয়ান নাবিলা এসেছে। সে জানতে চায় মি. বেঞ্জামিন বেকন এখানে আছেন কিনা?’

‘বল আছে। আর তাকে নিয়ে এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

এল নোয়ান নাবিলা।

ঘরে এসেই পা ঠুকে স্যালুট করল জর্জ আব্রাহাম জনসন ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের উদ্দেশ্যে।

‘ওয়েলকাম নাবিলা, এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

নাবিলার পরনে কালো স্যুট, কালো বুট এবং মাথায় অফ হোয়াইট হ্যাট। তার অফ হোয়াইট হ্যাট নাবিলার অফ হোয়াইট মুখের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

নোয়ান নাবিলা খৃস্টান পিতা ও ইহুদি মায়ের সন্তান। মায়ের মতো সে ইহুদি ধর্ম পালন করে। মোসাদ থেকে পদত্যাগের পর সে একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মের সাথে যুক্ত আছে। ফার্মটি এফবিআই-এরই একটা গোপন ব্রাঞ্চ।

বেঞ্জামিন বেকনের পাশের একটি মাত্র খালি চেয়ারে সে বসল। বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার।’

‘নাবিলা, আমরা তোমার জন্যে ওয়েট করছি। বল, আমাদের জন্যে তোমার কি সাহায্য আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ব্যাপারটা তেমন কিছু নয় স্যার। আমার একটা সন্দেহ মাত্র।’ থেমেছিল নোয়ান নাবিলা।

‘গো অন নাবিলা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ইয়েস স্যার। স্যার, গত রাতে একটা থিয়েটার শো’ থেকে বেরিয়ে রাশিয়ান স্পাই নাতাশা নাতালিয়েভার সাথে আমার হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। সুইজারল্যান্ডে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। মোসাদের পক্ষ থেকে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। এক নাইট ক্লাবে ওখানকার মোসাদ চীফ আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, নাতাশা নাতালিয়েভা রাশিয়ান স্পাই হলেও প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য করে। নাতাশারও পিতা রাশিয়ান, মা ইহুদি। দু’দিন আমি জেনেভায় ছিলাম, সেও ছিল। এ দু’দিনে তার সাথে আমার আন্তরিক একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। দেখা হওয়ার পর আমি তাকে আমার সাথে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ….।’

নাবিলার কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উঠল, ‘তোমার ফ্লাটে?’

‘না স্যার, আমার ফ্ল্যাটে তাকে নেইনি। আমার হোটেল স্যুটে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’

‘ধন্যবাদ। গো অন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ইয়েস স্যার। এক সাথে ডিনারসহ প্রায় ঘণ্টা দুই নানা রকম আলোচনা করি। আমার পক্ষ পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আহমদ মুসার কথাও আসে। তার কিডন্যাপ হওয়ার খবর সেও জানতো। তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সে বলল, মোসাদ কিংবা ইরগুনজাই লিউমি তাকে কিডন্যাপ করেনি। করলে অবশ্যই আমি জানতে পারতাম। আমি বলেছিলাম, সেটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে আহমদ মুসাকে কারা কিডন্যাপ করতে পারে? আমেরিকায় এমন কোন সংস্থা বা গ্রুপ আমরা দেখি না। তাঁর কিডন্যাপ বড় কোন গ্রুপ করেছে এবং বড় উদ্দেশ্য ছাড়া হয়নি। সেও আমার সাথে একমত হয় যে পরিচিত কোন গ্রুপ এ ধরনের নেই। হঠাৎ সে বলে ওঠে, একটা টাটকা খবর কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আমার এক জার্মান বান্ধবী ন্যাটোর গোয়েন্দা টিমে কাজ করে। কিন্তু আসলে সে রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মী। তার সাথে দু’দিন আগে আমার দেখা হয়েছিল। সে কথায় কথায় তার একটা উদ্বেগের কথা জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘এইচ কিউব’ (H3) গোপন সংস্থা কাজ করছে। অস্ত্র-গবেষণা তাদের প্রধান কাজ। রাশিয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভার ও অস্ত্র-গবেষণা তারা ফলো করছে। কৌশলগত অস্ত্রের সবগুলোর কলাকৌশল আয়ত্ত শুধু নয়, অস্ত্রের উৎপাদনও তারা করছে। তারা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা অস্ত্র নিয়ে কাজ করছে, যে অস্ত্রের খবর বিশ্ব এখনও জানে না। এই কাজে নাকি তাদের একটা মানব অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। সে মানব অস্ত্র তারা নাকি পেয়ে গেছে। সম্প্রতি তারা তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ নাতাশা নাতালিয়েভার কাছ থেকে শেষ এই তথ্য শোনার পর আহমদ মুসার কথা আমার মনে হয়ে যায়। সেও তো কিডন্যাপ হয়েছে সম্প্রতি।’ থামল নোয়ান নাবিলা।

কেউ কোন কথা বলল না।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের চোখ-মুখ বিস্ময়ে বিমূঢ়। একে অপরের দিকে চাইল তারা।

মুখ খুলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সিআইএ প্রধান। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস নোয়ান নাবিলা। কান টানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে মাথাই এসে গেল। নাতাশা কিছু বলেছে ‘এইচ কিউব’ এর উদ্দেশ্যটা কি?’

‘না স্যার, এ বিষয়ে কিছু বলেনি। জানা থাকলে সম্ভবত বলত।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘এইচ কিউব’-এর অর্থ কিছু বলেছে? এটা তো একটা সাংকেতিক নাম।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারই বলল।

‘জি স্যার বলেছে। ‘হ্যান্ড অব দ্যা হাই হ্যান্ডস’। সম্ভবত তিনটি ‘এইচ’ মিলে এইচ কিউব (H3) হয়েছে।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘তার মানে ‘বড়দের বড়’ ওরা। রহস্যপূর্ণ নাম। ন্যাটোর গোয়েন্দা রাশিয়ান স্পাই যখন জানে, তখন রাশিয়াও তো এটা জানার কথা।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘এ বিষয়টা আমি ঠিক জানি না স্যার, তবে আমার মনে হয় রাশিয়া জানলেও খুব সম্প্রতি জেনেছে। নাতাশাও এটা জেনেছে আহমদ মুসা কিডন্যাপ হওয়ার পর।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন্ গোপন অস্ত্র নিয়ে তারা কাজ করছে, কিছু বলেছে নাতাশা এ ব্যাপারে?’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারই।

‘সে জানতে পেরেছে কিনা জানি না, তবে সে আমাকে কিছু জানায়নি।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘মানব অস্ত্র হিসাবে তারা যাকে কিডন্যাপ করেছে, তাকে কেন তুমি আহমদ মুসা বলে মনে করছ?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আহমদ মুসার কথা আলোচনায় আসাতে নাতাশাই মানব অস্ত্র কিডন্যাপ হওয়ার কথা বলে। তার সন্দেহের ব্যক্তি আহমদ মুসাই, আমারও তাই মনে হয়েছে।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের ভ্রু কুঞ্চিত। ভাবছিল সে। বলল, ‘অস্ত্র গবেষণার সাথে আহমদ মুসার সম্পর্ক কি? তাকে মানব অস্ত্র হিসাবে কি কাজে, কোথায় ব্যবহার করবে?’

‘মানব ঢাল নয়, মানব অস্ত্র। তার অর্থ তাকে কোন কাজে লাগাবে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে?’ প্রশ্ন জর্জ আব্রাহাম জনসনের।

‘তাই তো মনে হয়।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘তা কি করে সম্ভব? আহমদ মুসার মতো ব্যক্তির কাছে কেউ কি করে এটা আশা করতে পারে?’ প্রশ্ন তুলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এর কোন উত্তর নেই মি. জর্জ জনসন।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘এখানে এসেই কিডন্যাপ হওয়া লোকটি আহমদ মুসা হওয়ার ব্যাপারে আমার সন্দেহ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

একটু থেমেই জর্জ আব্রাহাম জনসন আবার বলে উঠল, ‘সে যাই হোক। ‘এইচ কিউব’ সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেল তা অত্যন্ত গুরুতর। এখন আহমদ মুসা এবং ‘এইচ কিউব’ দুই বিষয়ই আমাদের প্রায়রিটি দিতে হবে। আমার মনে হয়, এইচ কিউব-এর ব্যাপারে নোয়ান নাবিলাকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে আর বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসার বিষয়টা তো দেখছেই। দুই অনুসন্ধান এক বিন্দুতে গিয়ে শেষ হলে ভালোই হবে।’

‘ঠিক মি. জর্জ জনসন। নাবিলা ইজ গুড সিলেকশন। নাতাশাদের মতো ব্যক্তিত্বের সে সহযোগিতা আদায় করতে পারবে। একটা কথা আমি ভাবছি ‘এইচ কিউব’-এর মতো এত বড় সংস্থার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই! এটা হতে পারে কি করে?’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘সম্ভবত এই কিডন্যাপের আগে তারা বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটায়নি। ঘটালে তারা অবশ্যই অনুসন্ধানের আওতায় আসত এবং তাদের সম্পর্কে জানা যেত।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘তার মানে ওরা অন্য দলগুলোর মত নয়। নীরবে অস্ত্র-গবেষণা মানে অস্ত্র সংগ্রহ করে যাচ্ছে। কেন? নিশ্চয় বড় কোন টার্গেট আছে। আমার মনে হচ্ছে, এরা আমাদের পরিচিত অন্যগুলোর চেয়ে বিপজ্জনক।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

একটা ‘বিপ বিপ’ শব্দ উঠল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল সবার দিকে। বলল, ‘এক্সকিউজ মি, একটা কল এসেছে।’

বলে ওয়্যারলেস তুলে নিল ড্রয়ার থেকে।

‘ইয়েস গো অন।’ ওয়্যারলেস সামনে নিয়ে নিয়েছে আগেই।

প্রায় মিনিট তিনেক ধরে জর্জ আব্রাহাম জনসন ওয়্যারলেসে কথা শুনল। ম্যাক এর মাঝে দু’একটা প্রশ্ন করল।

‘ও.কে। ধন্যবাদ।’ বলে ওয়্যারলেস রেখে দিয়ে এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের দিকে তাকাল। বলল, ‘মি. ম্যাক আর্থার যে তিনজন লোক বিমান বন্দরে মিসেস আহমদ মুসার গুলিতে নিহত হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের ল্যাবরেটরি জানাল। নিহত তিনজনের একজন পোল্যান্ডের, একজন জার্মানীর এবং তৃতীয়জন স্প্যানিশ। তারা মিশ্র রক্ত জাত। মানে সেমেটিক ও আর্য রক্তের সংমিশ্রণ। তাদের সবারই শার্ট, কোট, প্যান্টের একই ব্রান্ড- এইচ কিউব। অন্য সব টেস্ট থেকে কিছুই মেলেনি। তবে হ্যাঁ, স্কিন টেস্ট থেকে একটা মজার জিনিস মিলেছে। সেটা হলো, দিনের আলো এবং মুক্ত আবহাওয়া থেকে দূরে আবদ্ধ কোন স্থানে বেশি দিন থাকলে শরীর চামড়ায় যে পরিবর্তন আসে, সে রকম পরিবর্তন তিনজনের চামড়ায় দেখা গেছে।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘মি. জর্জ জনসন তাহলে তো প্রমাণ হয়ে গেল, আহমদ মুসাকে ‘এইচ কিউব’ গ্রুপটিই গ্রেপ্তার করেছে। পোশাকে এইচ কিউব-এর ট্যাগ এটা প্রমাণ করে। অবশ্য নিয়ম হলো, সিম্বলিক কোন মনোগ্রাম বা ট্যাগ দেহে একটাই থাকে। ‍বুঝা যায় নিয়মটা ব্রেক করা হয়েছে ক্যামোফ্লেজ করার জন্যে, যাতে মানুষ বুঝে ওগুলো গার্মেন্টস ট্যাগ, কোন বিশেষ চিহ্ন বা মনোগ্রাম নয়।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘হ্যাঁ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার একটা সমস্যার সমাধান হলো। নাতাশা এইচ কিউব নামের যে বিপজ্জনক সংস্থার খবর দিয়েছেন নোয়ান নাবিলার কাছে, সেই এইচ কিউবই কিডন্যাপ করেছে আহমদ মুসাকে। তিনটি ইনফরমেশনের মধ্যে একটি অর্থ পাওয়া গেল। অন্য দু’টিও গুরুত্বপূর্ণ।’

থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

জর্জ আব্রাহাম থামতেই এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলে উঠল, ‘তিনজন তিন দেশের হওয়া এবং তারা ইউরোপবাসী হওয়া প্রমাণ করে ‘এইচ কিউব’ সংগঠনটি আন্তর্জাতিক এবং তারা একই ধরনের মিশ্র রক্ত হওয়ার অর্থ এই গোপন সংগঠনের লোক রিক্রুটের একক একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ আছে। এ বিষয়ে আরও চিন্তার অবকাশ আছে। কিন্তু আমি স্কিন টেস্টের রেজাল্টের বিষয়টি বুঝতে পারছি না।’

সংগে সংগে কথা বলল না জর্জ আব্রাহাম জনসন। ভাবছিল সে। এক সময় সে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমার মনে হয় ‘এইচ কিউব’-এর ঘাটি মাটির গভীর অভ্যন্তরে। দিনের আলো ও মুক্ত বাতাস থেকে দীর্ঘ দিন আবদ্ধ কোন স্থানে থাকার অর্থ এটাই।

‘ঠিক মি. জর্জ জনসন। এর দ্বারা আরেকটা জিনিস বুঝা যাচ্ছে, তাদের অস্ত্র গবেষণা এবং অন্যের গবেষণা চুরি করে সেই অস্ত্র তৈরি করাই তাদের কাজ। অতএব আন্ডার গ্রাউন্ড তাদের উত্তম জায়গা।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘আহমদ মুসাকে দিয়ে তারা আসলে কি করাতে চায়? নাতাশার কথা থেকে জানা যাচ্ছে, তাকে মানব অস্ত্র হিসাবে তারা ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু সেই কাজটা কি?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আহমদ মুসাকে মানব অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের বিষয়টা দুর্বোধ্য। এখন শরীরে যারা বোমা বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটায় তাদের বলা হয় মানব অস্ত্র। মানব অস্ত্রের কাজ এ ধরনেরই কিছু হতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসাকে এভাবে ব্যবহার করা তো সম্ভবের মধ্যে আসে না।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার সাথে সাথে তারা তার পরিবারের কাউকে কাউকে বা সবাইকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল। সন্দেহ নেই আহমদ মুসাকে কোন ব্যাপারে সম্মত করতে চাপ সৃষ্টির জন্যেই তারা এটা করেছিল। জানি না আমরা সে কাজটা কি? কিন্তু বেছে বেছে আহমদ মুসাকে তাদের এ কাজের জন্যে দরকার হলো কেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আহমদ মুসাকে কি তারা অভিযান বা অপারেশন-মিশনের জন্যে ব্যবহার করতে চায়? কোথাও মানব অস্ত্র পাঠানোও অবশ্য একটা মিশন।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘চাপ দিয়ে কথা আদায় করা যায়, কিন্তু চাপ দিয়ে অনিচ্ছাতে কাউকে তো অভিযানে পাঠানো যায় না, বিশেষ করে আহমদ মুসার মতো ব্যক্তিত্বকে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এটা একটা জটিল প্রশ্ন। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে কিছু এক্সপার্ট ভিউ নেয়া দরকার।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘ঠিক বলেছেন এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।’

কথা শেষ করে চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে তাকাল এরিক এন্ডারসন, বেঞ্জামিন বেকন এবং নোয়ান নাবিলার দিকে। বলল, ‘তোমরা কি ভাবছ?’

এরিক এন্ডারসন তাকাল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বেঞ্জামিন বেকন তাকাল নোয়ান নাবিলার দিকে।

‘আপনিই শুরু করুন মি. বেকন।’ বলল নোয়ান নাবিলা।

‘অবিলম্বে কয়েকটি ডগ স্কোয়াড আহমদ মুসাকে সন্ধানের জন্যে কাজে লাগানো যেতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এই সন্ধান শুরু করা উচিত। আর যে তিনজন নিহত হয়েছে, তাদের ফটো পৃথক পৃথকভাবে পত্রিকায় ছাপিয়ে তাদের আত্মীয় ও পরিচিত জনদের সন্ধান করা যেতে পারে। এ দু’টিই আমার প্রাথমিক পরামর্শ।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

এবার কথা বলল নোয়ান নাবিলা। বলল, ‘আমি মি. বেকনের দুই প্রস্তাবই সমর্থন করছি। আর ‘এইচ কিউব’-দের কোন আলামতই আমাদের কাছে নেই, ওদের তিনটি লাশ ছাড়া। ওদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারলে প্রয়োজনীয় আরও কিছু মিলতে পারে। ওদের সংগঠনের নাম জানতে পেরেছি। এই নামকে কোনভাবে কাজে লাগানো যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে। আমার মনে হয়, খুব ছোট একটা বিজ্ঞাপন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যেতে পারে। যাতে বলা হবে, এইচ কিউব (H3) ব্যবসায়ের সাথে যারা জড়িত তাদের অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এই বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর থেকেই সব টেলিফোন, মোবাইল ও ওয়্যারলেস কল মনিটর করতে হবে।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

এরিক এন্ডারসন বেঞ্জামিন বেকন ও নোয়ান নাবিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আমার নতুন কোন বক্তব্য নেই। মিস নোয়ান নাবিলার পরামর্শের সাথে আমার একটা যোগ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলের সাথে কেউ যোগাযোগ করছে কিনা, তাও দেখতে হবে।’ থামল এরিক এন্ডারসন।

‘ধন্যবাদ তোমাদের। সামনে এগোবার মতো পথ তোমরা দেখিয়েছ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ। মনে হয় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে কাজ আমরা শুরু করতে পারি। আমাদের সামনেটা একদমই অন্ধকার। কিছু তথ্য আমাদের সামনে এগোবার আলোর মশাল জ্বেলেছে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘এরিক, তুমি ওদের নিয়ে একটা ‘এক্সিকিউটিভ প্ল্যান তৈরি করে ফেল।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘জর্জ আব্রাহাম জনসনের বাম ড্রয়ারে তার লাল টেলিফোন বেজে উঠল।

জর্জ আব্রাহাম দ্রুত টেলিফোন ধরল। বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার।’

ওপার থেকে প্রেসিডেন্ট বলল, ‘গুড মর্নিং মি. জর্জ জনসন। কত দূর এগোলেন আপনারা, আমি খুবই উদ্বিগ্ন। মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার সব ক্যাপিটালই আহমদ মুসার বিষয়টা জেনে ফেলেছে। আমরা কি করছি, বার বার তারা জানতে চাচ্ছে। সউদি আরবের গোয়েন্দা প্রধান তো ওয়াশিংটন রওয়ানা দিয়েছেন।’

‘স্যার, আমরা কিছু দুর এগিয়েছি। মূল্যবান কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছে ‘এইচ কিউব’ নামের একদম অপরিচিত একটা সংস্থা। ওদের যে তিনজন নিহত হয়েছে, তারা পোল্যান্ড, জার্মানী ও স্পেনের। সেমেটিক ও আর্য রক্তের মিশ্রণ তিনজনের দেহেই। কোথাও ভূগর্ভে ওদের ঘাঁটি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় স্যার, এইচ কিউব অস্ত্র গবেষণা ও অস্ত্র উৎপাদনকারী গোপন একটা সংস্থা। ওরা রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র গবেষণাকে ফলো করছে। কৌশলগত সব অস্ত্রই তাদের উৎপাদনে আছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবশেষে যে কৌশগত অস্ত্র তৈরি করেছে, যার খবর বিশ্ববাসী কেউ এখনও জানে না, এমনকি রাশিয়াও নয়, সে অস্ত্রও প্রায় তাদের আয়ত্তাধীন। আর ….।’

‘থামুন মি. জর্জ জনসন। আগে বলুন, এই সংস্থাটি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে?’ জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথার মাঝখানে বলে উঠল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘হ্যাঁ স্যার, এই সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে।’ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ভয়াবহ খবর শোনালেন মি. জর্জ জনসন। আমাদের সিআইএ’র কাছে এ ব্যাপারে কোন তথ্য নেই! এ্যাডিমিরাল তো ওখানেই!’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘নেই স্যার, উনি বলেছেন।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘তাহলে তো এ বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামরিক গোয়েন্দাসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে অবিলম্বে বসতে হবে। তারপর নিরাপত্তা কমিটি নিয়ে বসতে হবে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুহূর্তও নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। ‘এইচ কিউব’-এর হয়তো ভয়াবহ কোন দুরভিসন্ধি আছে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

প্রবল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তার কণ্ঠে।

‘স্যার, আরেকটা খবর আছে। যে তথ্যটা আমাদের কাছে এসেছে, সেটা হলো আহমদ মুসাকে ওরা ‘মানব অস্ত্র’ হিসাবে কিডন্যাপ করেছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘মানব অস্ত্র? তার মানে তারা আহমদ মুসাকে তাদের অস্ত্র পরিকল্পনার কোন এক পর্যায়ে একটা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চায় এবং সেটা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের ক্ষেত্রে হবে। কিন্তু আহমদ মুসাকে তারা রোবট হিসাবে ব্যবহার করবে কেন? কিভাবে? যাক, এই তথ্য বিষয়টিকে আতংকের করে তুলেছে। কারণ যারা আহমদ মুসাকে রোবট হিসাবে ব্যবহার করার সামর্থ্য রাখে তারা খুব বড় কোন সংস্থা এবং তাদের কাজটাও খুব বড় বলতে হবে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইয়েস স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ জর্জ জনসন। আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই মিটিং ডাকছি। তৈরি থেকো। ও.কে। ধন্যবাদ।’

ওপার থেকে প্রেসিডেন্টের কল অফ হয়ে গেল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন টেলিফোন রেখে বলল, ‘এ্যাডমিরাল আর্থার প্রেসিডেন্ট খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। উনি ‘এইচ কিউব’-এর বিষয়টাকে দেশের নিরাপত্তার জন্যে ভয়াবহ বলে অভিহিত করেছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে গোয়েন্দা-সমন্বয় কমিটির মিটিং ডেকেছেন। এর পরেই নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক করবেন।’

‘থ্যাংকস গড, প্রেসিডেন্ট যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘থ্যাংকস গড। আমরা সামনে এগোচ্ছি। এরিক, তোমরা এক্সিকিউটিভ প্ল্যানটা তাড়াতাড়ি করে ফেল। ধন্যবাদ, এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা উঠতে পারি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন উঠে দাঁড়াল। তার সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই।

‘সারা, তুমি টেলিফোনটা ম্যাডামকে দাও। তাঁর সাথেও কথা বলি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও.কে আংকেল।’ বলে সারা জেফারসন টেলিফোন মারিয়া জোসেফাইনকে দিয়ে বলল, ‘আপা জর্জ আংকেল কথা বলবেন।’ সারার কণ্ঠ ভারি।

জোসেফাইন টেলিফোন নিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং আংকেল। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি, এ কথা বলার সময় আসেনি মা। আমার ভাই আহমদ আবদুল্লাহ কেমন আছে?’ বলল ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছে আংকেল।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘মা জোসেফাইন, আমি সারাকে সব বলেছি। আহমদ মুসার উদ্ধারে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি কারা এটা করেছে। তার উদ্ধারের আমরা সব রকম পদক্ষেপ নেব।’

‘ধন্যবাদ আংকেল। আমি সারার কাছে সব জেনে নেব।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘দোয়া কর মা যাতে আমাদের সবার প্রিয় আহমদ মুসাকে তাড়াতাড়ি আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমিন।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘আমিন। ও.কে মা, রাখি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও.কে আংকেল। আসসালামু আলাইকুম।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।

মারিয়া জোসেফাইন মোবাইলটা সারা জেফরসনকে দিতে গিয়ে দেখল, ‘মুখ নিচু করে বসে আছে সারা জেফারসন।

‘সারা।’ ডাকল মারিয়া জোসেফাইন।

মুখ তুলল সারা জেফারসন।

তার দু’চোখ অশ্রু ভরা।

তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সারা বলল, ‘হ্যাঁ, আপা। কথা হলো আংকেলের সাথে?’

জোসেফাইন উঠে সারার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘তোমার সামনে সোফায় বসে কথা বললাম, তুমি তাহলে কিছুই শোননি?’

‘না, শুনেছি…।’

সারার কথা শেষ না হতেই মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘শুনেছ, কিন্তু বোঝনি তাই তো?’

সারা মাথা ‍নিচু করল।

জোসেফাইন তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘জানি সারা, আংকেল ভালো খবর দিতে পারেন নি।’ ভারি কণ্ঠ জোসেফাইনের।

সারা জেফারসন আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল জোসেফাইনকে। তার শরীরটা কেঁপে উঠতে লাগল।

কাঁদছে সারা জেফারসন।

নিঃশব্দ কান্না।

জোসেফাইন তার কোলে মুখ গুঁজে রাখা সারা জেফারসনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কান্না নয় সারা, ওঁর জন্যে দোয়া কর। ওঁকে আল্লাহ যেন ভালো রাখেন, ভালোভাবে ফিরে আসেন।’ ভাবলেশহীন উদাস কণ্ঠ জোসেফাইনের। তার দু’চোখে শূন্য দৃষ্টি।

জোসেফাইনের কোল থেকে মুখ তুলল না সারা জেফারসন। বরং এবার সে সশব্দে কেঁদে উঠল।

জোসেফাইন তাকে কোল থেকে তুলল। তার মুখ সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘সারা, কোন নতুন খবর দিয়েছেন আংকেল?’

সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। সোজা হয়ে বসল।

চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘উনি বেঁচে আছেন, এ ছাড়া কোন ভালো খবর দেননি।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। এটাই এই মুহূর্তের জন্যে সবচেয়ে ভালো খবর সারা। এ খবর তো আনন্দের, আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের।’ বলল জোসেফাইন।

‘আপা, তুমি ওঁর যোগ্য স্ত্রী। উনি ধৈর্য্য, স্থিরতার প্রতিমূর্তি। তুমিও তাই। আল্লাহর উপর কতটা আস্থাশীল হলে এ রকম মন পাওয়া যায় আমি জানি না। এ মন আমি পাইনি, আমার নেই।’ কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলল সারা।

জোসেফাইন একটু হাসল। বলল, ‘তা নয় সারা, আমি তোমার চেয়ে বড়। আমার আবেগ অনেকটাই স্থিল এখন।’

কথা শেষ করেই গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তাঁর ব্যাপারে আর কি সন্ধান পাওয়া গেছে?’

চোখ মুছল সারা জেফারসন। বলল, ‘অপরিচিত এক বড় গ্যাং তাকে কিডন্যাপ করেছে। এরা নাকি খুব গোপন, সুসংগঠিত ও মারাত্মক এক লক্ষ নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন প্রশ্ন করে এসব আমি জেনেছি।’

‘কি লক্ষ তা কি ওঁরা জানতে পেরেছেন?’ বলল জোসেফাইন।

‘এ ব্যাপারে আংকেল একটা কথাই বলেছেন, সব বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের মনে হয়েছে, গোটা মার্কিন জাতি তাদের টার্গেট।’ সারা জেফারসন বলল।

‘তাহলে আহমদ মুসাকে কি ওরা কিডন্যাপ করেছে যাতে আহমদ মুসা মার্কিনীদের পক্ষে দাঁড়াতে না পারে এ জন্যে, না আরও কিছু কারণ আছে?’ বলল জোসেফাইন।

‘তাঁরা এটাও জানার চেষ্টা করছেন।’ সারা জেফারসন বলল।

‘গোটা মার্কিন জাতির বিরুদ্ধে একটা গ্যাং বা গ্রুপ দাঁড়াবার চিন্তা করতে পারে না। সুতরাং আমার মনে হচ্ছে, হয় আঙ্গিকের দিক দিয়ে, নয় তো সামরিক প্রস্তুতির দিক দিয়ে ওরা খুব বড় সংগঠন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা যদি তাদের শক্তির ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী সংগঠন হয়, তাহলে আহমদ মুসার মতো একজন ব্যক্তিকে তারা কিডন্যাপ করল কেন?’ বলল জোসেফাইন। তার কথা স্বগত উক্তির মতো।

সারা জেফারসন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোসেফাইনের দিকে। ভাবছিল সে। বলল, ‘ধন্যবাদ, খুব সুন্দর বিশ্লেষণ আপা তোমার। সত্যিই গ্রুপটি আংকেলরা যা ভাবছেন তার চেয়েও বড়, ভয়ংকর হতে পারে। তুমি সত্যি বলেছ আপা, তা না হলে আহমদ মুসাকে ওরা কিডন্যাপ করল কেন? উনি আমেরিকান নন! উনি একান্তই একজন ব্যক্তিমাত্র! এর জবাব আংকেলের কাছেও পাইনি।’

‘এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এর জবাব নিশ্চয় পাওয়া যায়নি এখনও। তবে সবকিছুর বিবেচনায় তাঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। কোন্ কাজে তাকে ব্যবহার করতে চায়।’ বলল জোসেফাইন।

আবার মুখে অন্ধকার নামল সারা জেফারসনের। বলল, ‘এটা তো উদ্বেগের আপা। তিনি ওদের পুতুল হতে পারেন না। তাঁকে বাধ্য করা হবে তাঁকে তাদের পক্ষে কাজ করতে। এ জন্যে….।’

আর বলতে পারল না সারা জেফারসন। তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আটকে গেল।

জোসেফাইন সারাকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। দেখল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন দু’জন আগন্তুক নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছে। একটু কাছে আসতেই জোসেফাইন চিনতে পারল তার এক বান্ধবী ফাতিমা নেলসন। বাড়ি ভার্জিনিয়ায়। খুব দূরে নয় ওয়াশিংটন থেকে। ওয়েলিংটন সমাধিক্ষেত্র পার হয়ে অল্প এগোলেই ওদের বাড়ি। বাড়িটা একটা হেলিপ্যাডের পাশেই। ওরা সেবার হজ্জ করতে গিয়েছিল। মদিনায় ওদের সাথে দেখা এবং পরিবারের সাথে পরিচয়। ওদেরকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল জোসেফাইন। আমেরিকায় এসে টেলিফোনে ওর সাথে কথা বলেছে। হঠাৎ করে ওদেরকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো জোসেফাইন।

উঠে দাঁড়িয়ে জোসেফাইন ওদের স্বাগত জানাল। জড়িয়ে ধরল ফাতিমা নেলসনকে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

সারার মা জিনা জেফারসন সবাইকে নিয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল।

বসেই ফাতিমা নেলসন বলল, ‘মাফ করবেন সবাই, আমি না জানিয়ে হঠাৎ এসে পড়েছি। জানতাম না, এখানে এত কড়াকাড়ি; মিসেস জেফারসনের দেখা না পেলে হয়তো ফিরেই যেতে হতো। আই অ্যাম স্যরি।’

‘মোস্ট ওয়েলকাম মিসেস ফাতিমা নেলসন। ফরমালিটি মানুষের তৈরি। আর ইনফরমালটাই স্বাভাবিক। আপনাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে এজন্যে আমরা দুঃখিত।’ বলল জিনা জেফারসন স্নেহের স্বরে।

‘ধন্যবাদ। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়েছে বলেই তাড়াহুড়া করে চলে এসেছি।’ মিসেস ফাতিমা নেলসন বলল।

তাড়াহুড়ার বিষয়টি কি মিসেস নেলসন?’ বলল জোসেফাইন।

‘বিষয়টি একটা মোবাইল। মোবাইলের মালিক আহমদ মুসা। আমার মনে হয়েছে, তিনি আপনার স্বামী আহমদ মুসা হবেন। যেহেতু আপনি জানিয়েছিলেন তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন, তাই এ মোবাইল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’ বলে মিসেস ফাতিমা নেলসন হাতব্যাগ থেকে মোবাইলটি বের করে জোসেফাইনের হাতে দিল।

প্রবল উদ্বেগ ও কৌতুহলে আচ্ছন্ন জোসেফাইনের মুখ।

মোবাইলটি হাতে নিয়েই নিশ্চিত হলো এটা আহমদ মুসার। এ মোবাইলটি জোসেফাইন প্রেজেন্ট করেছিল আহমদ মুসাকে। প্যারিস থেকে জোসেফাইন এই বিশেষ মোবাইলটি কিনেছিল। এর বিশেষ ফাংশন হলো মোবাইলটি বন্ধ থাকলেও এর অটো রেকর্ডার ফাংশন চালু থাকে, যদি না মোবাইল অফ করার পর এর গোপন বাটনটা অফ করে দেয়া হয়।

জোসেফাইন মোবাইলটি হাতে নিয়েই অটো রেকর্ডারের গোপন বাটনটি অন আছে কিনা দেখল। হতাশ হলো জোসেফাইন। গোপন বাটনটি অফ করা।

‘ম্যাডাম নেলসন, আপনি কি জানেন, মোবাইলটি যখন পাওয়া যায়, তখন এটা অফ ছিল, না অন ছিল?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল জোসেফাইন।

‘মোবাইলটি প্রথম খুঁজে পান আমাদের প্রতিবেশী মিসেস আর্নল্ড। তিনি বলেছিলেন, যখন তিনি মোবাইলটি পান, তখন ওটা বন্ধ ছিল।’

জোসেফাইন বুঝল, আহমদ মুসা প্লেনে উঠে মোবাইল বন্ধ করার পর আর খোলেননি। সে কারণে অটো রেকর্ডারের বাটনের দিকেও তিনি নজর দেননি।’

পাশে এসে বসেছিল সারা জেফারসন। তার হাতে মোবাইলটি দিয়ে বলল, ‘মোবাইলের সাথে অটো রেকর্ডারের বাটনও বন্ধ ছিল সারা। খোলা থাকলে কি ঘটেছিল কিছুটা জানা যেত।’

‘ম্যাডাম নেলসন, প্লিজ, মোবাইলটা কোথায় পাওয়া যায়, বলুন?’ বলল জোসেফাইন।

‘ওয়েলিংটন সমাধিক্ষেত্রের উত্তর প্রান্ত দিয়ে একটা হাইওয়ে পূর্ব প্রান্তে বনভূমিতে প্রবেশ করেছে। বনভূমিটা পার হবার পরেই হাইওয়ের ছোট্ট একটা জংশন আছে। হাইওয়ে থেকে রাস্তা বেরিয়ে সামনের হেলিপ্যাডের দিকে চলে গেছে। আরেকটা রাস্তা বনভূমির মধ্য দিয়ে পূর্ব-উত্তর দিকে গেছে। এখানে রাস্তার পাশে একটা বিকল গাড়িও পড়ে ছিল। এখানেই মোবাইলটি পান মিসেস ও মি. আর্নল্ড। পুলিশকে দেবার জন্যেই তারা মোবাইলটি তুলে নেন। পরে মোবাইলে মুসলমান একজনের নাম দেখে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং খোঁজ নেবার জন্যে মোবাইলটি আমাদের দিয়ে দেন।’ বলল মিসেস আর্নল্ড।

জোসেফাইন তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ওঁর মোবাইল ওখানে পাওয়া খুব বড় একটা বিষয়। তুমি জর্জ আংকেলকে এখনি এটা জানাও।’

‘ঠিক আছে আপা। ধন্যবাদ। আমি এখনি বলছি।’ বলে সারা জেফারসন মিসেস আর্নল্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম। আমি এখনি আসছি।’

পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে সারা জেফারসন ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে টেলিফোন করার জন্যে।

আহমদ মুসা গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল। শ্বেত-শুভ্র পোশাকের একজন লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। অপরূপ স্বর্গীয় তার চেহারা। তার দিকে চোখ তুলে চাইতেই তার দৃষ্টির স্নিগ্ধ পবিত্রতা তার হৃদয়কে ঠাণ্ডা করে দিল। সব দুর্ভাবনা তার মন থেকে মুহূর্তেই মুছে গেল। আর সেই অপরূপ স্বর্গীয় চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো মহাসম্মানিত কেউ। মনে হচ্ছে চিরচেনা তিনি। কে তিনি? ভাবতে গিয়ে কেঁপে উঠল তার শরীর। ভাবনা এগোতে পারল না, অভিভূত হয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা। আবেগে-উত্তেজনায় সে বাকরুদ্ধ। আর চোখ তুলে চাইবার সাধ্য তার হলো না। তিনি মধুমাখা কণ্ঠে আহমদ মুসাকে বললেন, “দুর্ভাবনা কেন তোমার? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এক এবং একক, তার কোন শরিক নেই। তিনি সর্বশক্তিমান। তার আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় নেই। তুমি সূরা ফাতিহা, সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাসের বর্ম পরিধান কর। দুনিয়ার কোন শক্তিকে ভয় করো না। আল্লাহ সকলের সহায়।’ কথা বন্ধ হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে চোখ তুলে সামনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল সেই স্বর্গীয় অবয়ব সামনে নেই।

বাতাসে পেল মনোমুগ্ধকর অপার্থিব এক সুরভি।

মনে হলো আহমদ মুসার যে এক সুশীতল ছায়ার আকর্ষণে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আকর্ষণ এখন নেই।

বোটা ছেঁড়া ফলের মতোই ধপ করে বসে পড়ল বিছানায় আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার মাথা বেশ জোরেই গড়িয়ে পড়েছে বালিশ থেকে।

ঘুম ভেঙে গেল আহমদ মুসার।

চমকে উঠে তাকাল চারদিকে।

তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে।

ভাবতেই তার দেহ-মন শিউরে উঠল। মনে পড়ল সব কথা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সেই স্বর্গীয় পুরুষ। সেই কথাগুলো আহমদ মুসার সামনে ধ্রুব নক্ষত্রের মতো স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিল। মনের আকাশে জ্বল জ্বল করা লেখাগুলো আবার পড়ল আহমদ মুসা। মন বলল, আশ্রয় ও নিরাপত্তার এমন একটা অবলম্বনই সে চাইছিল সমগ্র হৃদয় দিয়ে।

সেদিন মানসী মেরাবের কাছ থেকে আহমদ মুসার ব্রেনের উপর বিশেষ ম্যাগনেটিক পালস ব্যবহারের কথা শোনার পর আহমদ মুসা সত্যিই দুর্ভাবনায় পড়েছিল। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ পাচ্ছিল না সে। অথচ সময় বয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তার সাথে তার উদ্বেগও বাড়ছিল। তাহাজ্জুদ নামাজে আহমদ মুসা দীর্ঘ সূরা পড়ায় অভ্যস্ত। গত রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে জানা এবং বহুল পঠিত সূরা পড়তে গিয়ে বার বার তার ভুল হয়েছে। শুরুটাও মনে করতে অনেক ভাবতে হয়েছে তাকে। আরও একটা ঘটনা ঘটেছে গতকাল। আহমদ মুসার মন দেখতে চাইলেই তার চোখের সামনে পর্দায় জোসেফাইন, আহমদ আব্দুল্লাহসহ সবার চেহারা ভেসে উঠত। কিন্তু গতকাল থেকেই লক্ষ করছে সেই ছবিগুলো যেন আগের চেয়ে ঝাপসা। বিষয়টা আহমদ মুসাকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন করেছে। এই উদ্বেগ নিয়েই সে আজ রাতে শুয়েছিল। তারপর আল্লাহর সাহায্য চেয়ে সব দুর্ভাবনা দূর করে ঘুমাতে চেষ্টা করেছিল এবং ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তারপর এই স্বপ্ন সে দেখেছিল। স্বপ্নে তার দুর্ভাবনার এলাজ এল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মাধ্যমে, যাঁর দেখা আল্লাহর বিশেষ দয়া এবং তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ছাড়া মিলতে পারে না।

অসীম কৃতজ্ঞতায় তার চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুর ঢল। সে পড়ে গেল সিজদায়।

আহমদ মুসা তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে বসে স্বপ্নের নির্দেশের কথা স্মরণ করল। আহমদ মুসা মনে মনে নতুন করে বলল, ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ছাড়া আর কোন শক্তি ও আশ্রয়দাতা নেই। আমি তাঁর কাছেই শক্তি ও সাহায্য প্রার্থনা করছি।’ এই ঘোষণা ও প্রার্থনা শেষ করে আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে সূরা ফাতিহা, সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করল এবং গোটা দেহ মাসেহ করল। মনে মনে বলল, আমি আল্লাহর অনুগ্রহ ও আশ্রয়ের বর্ম পরিধান করলাম, আর কারও পক্ষ থেকে কোন ক্ষতির ভয় আমি করি না।

সংগে সংগেই প্রশান্তির এক পরম স্পর্শ অনুভব করল গোটা দেহে।

পরদিন নাস্তার পর টেবিলে বসতেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল মুমূর্ষূ মানসী মেরাবের কথা। তার দিকে ছুড়ে দেয়া ধূসর রঙের মার্বেলের মতো গোলাকার বস্তুটির কথা। আহমদ মুসা খুব খুশি হলো। ওটা যে খুব জরুরি তা তখনই তার মনে হয়েছিল। কিন্তু এতটা সময় ওটার কথা তার মনে পড়েনি কেন? বিস্মিত হলো সে। ওটাও কি তাহলে সেই বিশেষ ধরনের ম্যাগনেটিক পালসের কারসাজি? আহমদ মুসার মনে হলো, কয়েক দিন ধরে তার মনটা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো গুম হয়েছিল, আজ তেমনটা নয়। আজ মনটা হালকা, পরিষ্কার ও সক্রিয়, আগে যেমন ছিল। সন্দেহ নেই এই কারণেই মানসী মেরাবের সেই জিনিসটার কথা তার মনে পড়েছে।

মনের এই পরিবর্তন আহমদ মুসার বাইরে প্রকাশ পেল না। যদিও ওরা বলেছে এই বাংলোর ভেতরে কোন ক্যামেরা তারা রাখেনি। কিন্তু বিশ্বাস নেই ওদের কথায় আহমদ মুসার। নিশ্চয় ওরা আহমদ মুসার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।

আহমদ মুসা টেবিল থেকে উঠে বেডে শুয়ে পড়ল। এক সময় কাত হয়ে শুয়ে বালিশ টেনে নেবার ছলে উপুড় হবার ভংগিতে একটা হাত সন্তর্পণে ঢুকিয়ে দিল বালিশের কভারের ভেতরে এবং সংগে সংগে মানসী মেরাবের সেই মার্বেলাকার জিনিসটি নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর আরও দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থেকে আহমদ মুসা উঠে গেল বেড থেকে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে গিয়ে বসল বাইরে বেরুবার দরজা ও ভেতরের টয়লেটের মাঝখানে একটা কোণাকৃতি স্থানে দেয়ালের দিকে মুখ করে। কোন দিকের কোন ক্যামেরার চোখই এখানে পড়বে না।

মার্বেলাকৃতির সেই জিনিসটি বের করল আহমদ মুসা। যা মনে হয়েছিল তাই। ক্ষুদ্র বলটা মাটির। কিন্তু আহমদ মুসার মনে হলো বলটা মাটির হলেও যতটা ভারি হওয়ার কথা তার অর্ধেক ভারিও নয়। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আহমদ মুসার মনে হলো, দেখাই যাচ্ছে বলটা মাটির। তাহলে কি ভেতরে অন্য কিছু আছে? মনের একটা দরজা হঠাৎ খুলে গেল আহমদ মুসার। নিজের মনেই হাসল আহমদ মুসা। কেন এতক্ষণ মনে হয়নি তার যে, মাটির একটা মার্বেলাকৃতি বল মানসী মেরাব তার কাছে শুধু শুধু পাঠাবে?

বলটিতে জোরে চাপ দিতেই ভেঙে গেল মাটির বলটি। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গোল করে ভাঁজ করা একটি কাগজ। তাড়াতাড়ি কাগজটির ভাঁজ খুলল আহমদ মুসা।

এক খণ্ড সাদা কাগজের বুক জুড়ে ড্রইং। রেখা চিত্রটাকে একটা লেআউট বা ম্যাপ বলা যেতে পারে।

কিসের ম্যাপ?

এই বন্দীখানার কি?

বন্দীখানারই হবে, তা না হলে মানসী মেরাব এত কষ্ট করে তার মুমূর্ষূ অবস্থায় এটা তার কাছে পাঠাবে কেন?

ম্যাপটা ঠিক পেন্ডুলামওয়ালা সাবেক দেওয়াল ঘড়ির মতো। আর লেজের উপরে মাথার অংশটা একশ্রেণীর দেয়াল ঘড়ির মতো বহুকৌণিক।

এই ম্যাপটা মানসী মেরাব আমাকে দিল কেন? কোন্ উদ্দেশ্যে? সন্দেহ নেই, তাকে মুক্ত হতে সাহায্য করার জন্যেই এই ম্যাপ তাকে দিয়েছে। তাহলে নিশ্চয় এতে তার ইংগিত আছে।

ভালো করে ম্যাপটা দেখতে শুরু করল আহমদ মুসা।

লেআউট ম্যাপকে খুব প্রফেশনাল মনে হলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, বড় একটা লেআউপ ম্যাপকে ছোট করা হয়েছে। তাহলে এটাই কি অরিজিনাল ম্যাপ, প্রফেশনাল ডিজাইনার ইঞ্জিনিয়ারের আঁকা?

খুশি হলো আহমদ মুসা। এ থেকে নিখুঁত তথ্য পাওয়া যাবে।

লেআউট ম্যাপের অংকন থেকে বুঝা যাচ্ছে স্থাপনা নিচুতে। তার একটা ইন্ডেকেটরও আছে। ইন্ডিকেটরের মাথাটা উপরের দিকে। উপরের মাথায় জিরো, নিচের প্রান্তে ২৫ মিটার লেখা। তার মানে এদের স্থাপনা আন্ডারগ্রাউন্ডে, মাটির তলে? আন্ডারগ্রাউন্ড এই স্থাপনাটি মাটির ২৫ ফুট গভীরে? তাহলে সে যে ধারণা করেছিল তাই সত্য হলো। সে এখন আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনায় বন্দী।

ম্যাপটার উপর চোখ বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা লক্ষ করল ম্যাপের গোলাকার এরিয়ায় দু’টি লেয়ার রয়েছে। একটা উপরে, আরেকটা নিচে। উপরের লেয়ারের ফ্লোর ম্যাপের লেজের ফ্লোর প্রায় সমান্তরাল। আহমদ মুসার মনে হলো সে এই উপরের লেয়ারেই রয়েছে। ম্যাপের লেজের শেষ প্রান্তের প্রবেশ পথ দিয়েই তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ওখানে একটা এক্সিট আছে। আর কোথায় এক্সিট পাওয়া যাবে? খুঁটে খুঁটে ম্যাপটা দেখতে লাগল আহমদ মুসা।

উইনডো আকারের একটা এক্সিট মার্ক পেল ম্যাপের সেই লেজে। ওখান দিয়েই আহমদ মুসাকে প্রবেশ করানো হয়েছিল। ঐ রকম আর কোন এক্সিট পয়েন্ট পেল না আহমদ মুসা গোটা ম্যাপ খুঁজে। তার মানে এই আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনার এক্সিট পয়েন্ট একটাই! যে সার্কেলে সে বন্দী আছে, সেখান থেকেও বের হবার কোন এক্সিট নেই। লিফট দিয়ে নামার পর যে দরজা দিয়ে এই সার্কেলে তাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটারও কোন ইন্ডিকেশন নেই কেন? গোপন ঘাঁটি বা বন্দীখানা বলেই কি? ওদিকটা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে আহমদ মুসা সার্কেল লাইনের উপর গভীর কালো একটা বিন্দু দেখতে পেল। এই ধরনের কোন চিহ্ন সার্কেলটির কোথাও পেল না সে। নিশ্চয় তাই হবে। কিন্তু এত বড়, এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ঘাঁটির একটাই এক্সিট থাকবে এটা আহমদ মুসার মন মেনে নিতে পারল না। আবার খুঁজতে লাগল আহমদ মুসা।

স্থাপনাটির প্রশস্ত লেজটা, তার ঠিক বিপরীত দিকের প্রান্তিক দেয়ালে প্রায় অদৃশ্য ছাই রঙের একটা ভার্টিক্যাল লাইন লম্বের মতো উপরে উঠে গেছে। লম্বের মাথাটা বর্ষার ফলার মতো। রং সবুজ। ফলাটা ঠিক পাতার আদলে তৈরি। রং সবুজ হওয়ায় ঠিক পাতাই মনে হচ্ছে।

হঠাৎ আহমদ মুসার মন আনন্দে নেচে উঠল। এটা নিশ্চয় বাইরে বেরুবার মানে মাটির উপরে উঠার গোপন পথের ইংগিত। এই লম্বের ওখানে হয়তো উপরে উঠার গোপন পথটা আছে। লম্বের মাথার সবুজ পাতার সিম্বলটা মাটির উপরের সারফেসের প্রতীক। কিন্তু লম্বটির শুরু হয়েছে নিচের ফ্লোর থেকে। ওটা যদি গোপন পথ হয়, তাহলে তার গোপন দরজা কি নিচের তলাতেই? তাই হবে।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

মনটা হালকা হয়ে গেল তার।

হাতের ম্যাপটা পকেটে পুরে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বসল তার পড়ার টেবিলে।

কিন্তু মনের খুশি তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বন্দীখানার এই সার্কেল থেকে বের হবার উপায় কি? ম্যাগনেটিক সার্কেলকে ক্রস করতে পারে না কোন বস্তুই। শুধু মাটিই ব্যতিক্রম, যেহেতু মাটির উপর সে ম্যাগনেটিক সার্কেলটি স্থাপিত। এ জন্যে মানসী মেরাব ম্যাপের কাগজটি পাঠিয়েছে মাটি দিয়ে মুড়ে।

সার্কেল ক্রস করে ওপারে যেতে পারলে তবেই নিচের ফ্লোরে নামার গোপন পথের সন্ধান করা যাবে।

কিন্তু ম্যাগনেটিক সার্কেলটি ক্রস করার উপায় কি? যে কোন বেড়া হলে ডিঙানো যেত, জ্বলন্ত আগুনের সার্কেল হলেও তা ডিঙানো সম্ভব হতো। কিন্তু ম্যাগনেটিক সার্কেলের অদৃশ্য আগুনের আগ্রাসী আকর্ষণ এড়ানোর কোন উপায় নেই। তার উপর রয়েছে এই বাংলো। ম্যাগনেটিক সার্কেল ও চারদিকের চত্বরের উপর রয়েছে ইলেকট্রনিক চোখ।

হতাশা ঘিরে ধরতে চাচ্ছিল আহমদ মুসাকে। হঠাৎ মনে পড়ল ‘যত পথ তত খুলি’ বলে একটা প্রবাদ আছে। অর্থাৎ সবকিছুরই একটা বিকল্প থাকে। এদের এই যে অত্যন্ত টাইট সিকিউরিটি, এর একটা দুর্বলতা নিশ্চয় আছে। সেটাই তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

খেতে বসে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, এ খাবারগুলো আসলেই কিভাবে আসে? খাবার শেষে বাসন-কোসন সবকিছু যথাস্থানে ফুড বক্সে রেখে দেয় সে। ফুড বক্স কিভাবে এখান থেকে চলে যায়? এর ঠিক উপরে ফায়ার চিমনির মোভেবল টপের পথে কি? কিন্তু তার অনুসন্ধানে এটা স্বাভাবিক মনে হয়নি। তাছাড়া মানসী মেরাবের ম্যাপ অনুসারে এটাই উপরের ফ্লোর। এর উপরে মাটি আছে, কোন স্থাপনা নেই। চিমনি থেকেও কখনও ধোঁয়া বেরুনোর প্রয়োজন হয় না। কারণ এখানে রান্নার প্রয়োজন নেই। এই চিন্তা যদি সত্য হয়, তাহলে তার ফুড বক্স উপরে নয়, নিচে যায়। কিন্তু কোন্ পথে?

খাওয়া শেষ হয়ে গেছে আহমদ মুসার।

পায়চারি করতে লাগল সে। নিচে যাওয়ার সেই পথ কোনটা, কোথায়?

ভাবতে ভাবতেই সে বাসন-কোসন গুছিয়ে ফুড বক্সে ভরল। এই ফুড বক্সটাই এখান থেকে চলে যায়। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ফুড বক্সের নিচে কি আছে দেখতে হবে।

সে ফুড বক্সটি তোলার জন্যে অনেক টানাটানি করল, পারল না। বেজ এর সাথে কি এটা স্থায়ীভাবে সেট করা! কিন্তু যেহেতু এটা ফুড বক্স, পরিষ্কার বা নতুন ফুড বক্স সেট করার জন্যে এটা অবশ্যই খোলা হয়। খোলার কোন একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে। সেই ‘ব্যবস্থা’ আবার খোঁজ করতে লাগল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা দেখল, স্টিলের প্লেন শিটের উপর ফুড বক্সটি দাঁড়িয়ে আছে। ফুড বক্স ও স্টিল শিটের চারদিকের গাসহ স্টিল শিট যার উপরে বসে আছে, সেই চারকোনা বিশিষ্ট গোটা স্ট্রাকচার মেঝে পর্যন্ত গভীরভাবে পরীক্ষা করল এবং সম্ভাব্য সবকিছু টেপাটিপি করে দেখল গোপন বা প্রকাশ্য কোন সুইচ নেই, যা ফুড বক্সকে ডিটাচড করার কোন ইলেক্ট্রনিক বা যান্ত্রিক ব্যবস্থা খোলা-বন্ধের মাধ্যম হতে পারে। স্ট্রাকচারটির মাথার দিকসহ কিছু স্ক্রু আছে, যা দেখে আহমদ মুসা পরিষ্কার বুঝল সম্প্রতি এগুলোর কোনটাই খোলা হয়নি। এগুলো যে শো অথবা স্ট্রাকচার তৈরির সময়ের স্থায়ী অংশ তা পরিষ্কার বুঝা যায়। এগুলোর সাথে নিশ্চয় ফুড বক্সের কোন সম্পর্ক নেই। ফুড বক্স তাহলে ঐভাবে আটকে আছে কেমন করে? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল এরা ম্যাগনেটিক শক্তিকে ব্যবহার করে বেশি। দরজাগুলো, লিফট, বন্দীখানার প্রটেকটিভ সার্কেল, মারণাস্ত্র পরিকল্পনা সবকিছুতেই ম্যাগনেটিক শক্তির প্রাধান্য। ফুড বক্সের ক্ষেত্রেও নিশ্চয় তাই।

আহমদ মুসা ফুড বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে সেটিকে আগের মতো উপরের দিকে তোলার চেষ্টা না করে এবার ফুড বক্সের উপরের প্রান্তে হাত রেখে জোরের সাথে সামনের দিকে ঠেলে দিল। ‘কট’ করে একটা শব্দ হলো, ফুড বক্সটি উঠে পাশে পড়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি সেটা ধরে ফেলল। সত্যি বেজটা সলিড স্টিল। পরীক্ষার জন্যে তার জ্যাকেটের স্টিলের বাটন সে বেজের উপর নিতেই বাটনটাকে ঝড়ের বেগে টেনে নিল। ঠন করে বড় রকমের শব্দ উঠল। তার মানে ভেতরটা ফাঁকা, বুঝল আহমদ মুসা।

ফুড বক্স সমস্যার সমাধান হলো এবং বুঝল যে চারকোনা বিশিষ্ট বেজ কন্টেইনার স্ট্রাকচারটাই ফুড বক্সকে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায় আবার উপরে তোলে।

এই পথ কি নিচের ফ্লোরে নামার জন্যে ব্যবহার করা যায়? চারকোনা বেজ কন্টেইনার মেপে দেখল আহমদ মুসা। দুই স্কয়ার মিটার এর আয়তন। একজন মানুষের উঠা-নামার জন্যে যথেষ্ট।

আহমদ মুসা চিন্তা করল সে ফুড বক্স সেজে বেজ কন্টেইনারের উপর দাঁড়িয়ে নিচের ফ্লোরে নেমে যেতে পারে। উপরের মাথাটা এর ওপেন থাকছে। সুতরাং অসুবিধা হবে না।

কিন্তু আবার ভাবল, ফুড বক্সের ওজন ও বেজ-এর সাথে তার ম্যাগনেটিক এটাচমেন্টের কোন সম্পর্ক তার উঠা-নামার সাথে থাকতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। এটাই যদি সত্যি হয় তাহলে সহজেই ওরা জানতে পারবে এখানে কি ঘটেছে। তার ফলে ওরা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে এই পথটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে কি করবে আহমদ মুসা?

বেজ কন্টেইনারের বডির দিকে আরও গভীরভাবে দৃষ্টি বুলাল আহমদ মুসা। কন্টেইনার বডির ভেতরে ফাঁকা। বেজটিকে মাথার উপর একটা স্টিল টপ বসিয়ে স্ক্রু দিয়ে আটকে দেয়া। স্ক্রু খুলে বেজের ঢাকনা সরিয়ে নিলে কি দেখা যাবে? নিচে নেমে যাওয়া ফাঁপা একটা সুড়ঙ্গ। এর দৈর্ঘ্য নিশ্চয় হবে বিশ ফুটের মতো। ফাঁপা এই স্টিল বডিটি যখন নিচে যায়, তখন এর ফ্লোর পরিমাণ উচ্চতার অংশটি নিচের তলার নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে যায়। এই তলায় এর যে পরিমাণ অংশ উপরে আছে, নিচের ফ্লোরেও নিশ্চয় সে পরিমাণ অংশ উপরে থাকে। অবশিষ্ট অংশ অবশ্যই আন্ডারগ্রাইন্ডে ঢুকে যায়। নিচে নামার জন্যে জাম্প দিলে সুড়ঙ্গের তলায় আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে পড়তে হবে। বের হবার কোন পথ থাকবে না। অবশ্য খাদ্য নিয়ে যখন উপরে উঠবে তখন ফাঁপা স্টিল বডিটির শেষ প্রান্তটি থাকবে নিচের তলার ফ্লোরের সমান্তরালে। কিন্তু ততক্ষণ অক্সিজেন যোগাড় করবে কোত্থেকে?

চিন্তায় পড়ে গেল আহমদ মুসা।

হঠাৎ তার চোখ পড়ে গেল ফাঁপা স্টিল বডিটার গায়ে। দেখল ওটার গায়ে অনেক ছিদ্র।

আনন্দিত হলো আহমদ মুসা। ছিদ্র যে কারণেই হোক তার কাজে আসবে। উপরের ঢাকনা বন্ধ থাকলেও তার অক্সিজেনের অভাব হবে না।

স্টিল বডির বেজ-ঢাকনার ক্ষুদ্র স্ক্রু খুলতে শুরু করল আহমদ মুসা কাঁটা চামচের সূক্ষ মাথা দিয়ে। খুলে গেল একটা স্ক্রু। দেখল, ওটা স্ক্রু নয়, একটা শো। তার মানে ঢাকনাটি স্ক্রু দিয়ে আটকানো নয়।

ঢাকনা খুলে ফেলল আহমদ মুসা। ভেতরে তাকিয়েই চমকে উঠল সে। ছয় সাত ফুট নিচে ফাঁপা স্টিল বডিটার ফ্লোর। আর ফাঁকা স্টিল বডির ভেতরের দেয়ালে নিচে নামার জন্যে মইয়ের মতো ব্যবস্থা রয়েছে। ওগুলোও স্টিলের তৈরি।

তাহলে নিচের ফ্লোরটা একটা ল্যান্ডিং প্লেস। স্টিল বডিটা নিচের তলায় নামার একটা মাধ্যম? নিশ্চয় তাই। এটা তাহলে এক ধরনের লিফট? নিশ্চয় তাহলে এর একটা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও এখানে থাকবে?

ভেতরে নেমে পড়ল আহমদ মুসা। ল্যান্ডিং ফ্লোরটায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দেয়ালে চোখ বুলাল সে। হাঁটু বরাবর উঁচুতে দেয়ালের গায়ে আহমদ মুসা ঠিক দেয়ালের রঙের তিন চার ইঞ্চি লম্বা একটা লম্ব দেখতে পেল। তার নিচের ও উপরের দুই মাথায় তীর চিহ্ন দেখতে পেল। তীর চিহ্নটির প্রতি দৃষ্টি তার স্থির হলো। এই তীর চিহ্ন নিরর্থক নয়-বুঝল আহমদ মুসা। এর সহজ অর্থ এই যে, উপরের তীর চিহ্নে চাপ দিলে লিফটের মতো এই টিউব উঠবে আর নিচেরটায় চাপ দিলে নিচে নামবে।

ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা নিচের তীর চিহ্নটায় চাপ দিল। সংগে সংগে নিঃশব্দে ফাঁপা টিউবটি নিচে নামতে শুরু করল।

বুঝল আহমদ মুসা ফাঁপা এই স্টিল বডিটাকে শুধু খাদ্য পাঠানো নয়, লিফট হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। নিশ্চয় আহমদ মুসার অলক্ষে বা ঘুমিয়ে পড়লে তপার ওখানেও লোকরা নিয়মিত যাতায়াত করে।

লিফটটি এক সময় নিঃশব্দে থেমে গেল। আহমদ মুসা বুঝল লিফটটি নিচের ফ্লোরে এসে গেছে। তার এই ল্যান্ডিং স্থানটি নিশ্চয় ফ্লোরের সমান্তরালে রয়েছে।

লিফটটি কোথায় এসে থামল? কোন্ কক্ষে? কোন্ উন্মুক্ত স্থানে বা কোন্ হল রুমে? এই লিফটটি নেমেছে নিশ্চয় অসময়ে। এটা দেখে ওরা এখনি কি ছুটে আসবে এদিকে? প্রশ্নগুলো আহমদ মুসাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে দারুণ উৎসুক করে তুলল।

আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল। তার মাথা থেকে ফাঁপা স্টিল বডিটার শীর্ষ প্রান্ত প্রায় এক ফুটের মতো উপরে।

আহমদ মুসা হুকে পা রেখে এক ধাপ উপরে উঠল। বিসমিল্লাহ বলে মাথাটা ফাঁপা বডির ভেতর থেকে সামান্য উপরে তুলে দ্রুত চোখ বুলাল বাইরে। চোখ পড়ল একজনের উপর। গভীর বিস্ময় তার চোখে-মুখে। সেও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। বিদ্যুৎগতিতে তার হাতের রিভলবার উঠে এল।

আহমদ মুসাও চোখের পলকে ফাঁপা স্টিল বডির দুই প্রান্তে দু্ই হাত রেখে তার উপর ভর করে দুই পা বাইরে নিয়ে লাফিয়ে পড়ল মেঝেতে। ততক্ষণে একটি গুলির শব্দ হলো। লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে গুলি করেছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার চলন্ত বডি মেঝের দিকে ছুটতে শুরু করেছিল।

আহমদ মুসার পা’দুটি মেঝে স্পর্শ করার সংগে সংগেই আহমদ মুসা তার মাথা মেঝের দিকে চালিয়ে দিয়ে পা দু’টোর প্রচণ্ড আঘাত ছুড়ে মারল রিভলবারধারী লোকটির দিকে।

প্রথম গুলি ব্যর্থ হবার পর নতুন টার্গেট ফিক্সট করছিল লোকটি। কিন্তু ভাবেনি যে মেঝের উপর আহমদ মুসার বডি স্থির হবার আগেই দেহটা আবার চলন্ত হবে। আহমদ মুসার দু’পায়ের লাথি গিয়ে পড়ল লোকটির বুকে। লোকটি সশব্দে পড়ে গেল মেঝের উপর চিৎ হয়ে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই লোকটির রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির উপর। রিভলবার লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘তোমাদের নেতা এখন কোথায়? তোমরা কতজন লোক এখন এই ফ্লোরে রয়েছ? তিন গোনার মধ্যেই উত্তর না দিলে তোমার মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।’

‘এক… দুই…’ গুণতে লাগল আহমদ মুসা। লোকটির চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। ‘তিন’ গোনার আগেই লোকটি বলে উঠল, ‘বলছি, আমি বলছি। আমাদের চীফ হাই হাইনেস কোহেন ক্যানিংহাম আমাদের এখানে নেই। আজ বিকেলেই বাইরে গেছেন। আমরা এই ফ্লোরে এখন আমিসহ সাত জন আছি।’

‘আর লোকরা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘উপরের তলায় আছে চারজন, এক্সিট ওয়েতে আছে বিশ জন।’ বলল লোকটি।

‘এক্সিটটা ঠিক কোন্ দিকে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

লোকটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আহমদ মুসার অনুমান ঠিক হলো।

‘তোমার এখানকার সাথীরা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘ওরা এখন সবাই জিমে। আরও আধাঘণ্টা জিমে থাকবে।’ বলল লোকটি।

‘জিম কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘এখান থেকে সোজা দক্ষিণে গেলে শেষ প্রান্তের একটা হল ব্যায়াম ও ট্রেনিং-এর জন্যে ব্যবহৃত হয়।’ বলল লোকটি।

আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটির মাথায় আরও জোরে চেপে ধরে বলল, ‘এদের ভয়ংকর অস্ত্রটার নাম কি?’

‘ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ।’ বলল লোকটি।

‘ঐ অস্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি, আমি জানি। এখন তারা কোন্ অস্ত্রের উপর নির্ভর করে?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি সব জানি না স্যার। তবে শুনেছি, আমাদের ‘ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (এমএফডব্লিউ)’ রয়েছে।’ বলল লোকটি।

‘দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? দুটোই তো দেখছি ম্যাগনেটিক!’ আহমদ মুসা বলল।

‘প্রথমটি নিজের জায়গা থেকেই ফাংশন করে, কিন্তু দ্বিতীয়টিও নিজ জায়গা থেকে ফাংশন করে। তবে এ অস্ত্রটি টার্গেটকে ম্যাগনেটিক ব্ল্যাক ফায়ারে ধ্বংস করে দেয়। প্রথমটি সব কিছু নিস্ক্রিয় ও অচল করে দেয়, আর দ্বিতীয়টি যেখানেই ইলেকট্রনিক ও আণবিক মারণাস্ত্র রয়েছে, বিশেষ এক ম্যাগনেটিক আকর্ষণে ম্যাগনেটিক ব্ল্যাক ফায়ার সেখানেই ছুটে গিয়ে ভয়ংকর ও অদৃশ্য ম্যাগনেটিক আগুনে সব কিছুকেই ছাই করে দেয়। সৃষ্টি করে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা।’ বলল লোকটি।

‘এর ঘাঁটিটা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি জানি না। আমি মাত্র একজন পরীক্ষণ বিজ্ঞানী। তবে আমি ওদের কথা-বার্তায় ‘আরসিপি’ ধরনের একটা স্থানের সাংকেতিক নাম শুনেছি, যেখানে তাদের এই অস্ত্রের বড় ঘাঁটি।’ বলল লোকটি।

আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। শব্দ বেরুবার আগেই শুনতে পেল সামনে খুব কাছে হালকা শব্দ। শব্দটা লম্বা ও কাটা কাটা। তার মানে একাধিক লোক দৌড়ে সামনে এসে গেছে। তাই যদি হয়, তাহলে ওদের হাতে থাকবে তাক করা অস্ত্র।

এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লোকটির মাথঅয় চেপে রাখা রিভলবার তুলে চোখের পলকে সেই শব্দ লক্ষে পরপর তিনবার গুলি করল।

রিভলবারটি ছিল মাল্টি বুলেট রিভলবার। রিভলবারের ব্যারেল থেকে গুলি বেরুনোর পর তাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং বুটের দানা আকৃতির ২৫ টি সররা গুলি আরও তীব্র গতিতে বেরিয়ে যায়। গুলিগুলো ছোট হলেও ভয়ংকর। কোন দেহে বা কোথাও প্রবেশের সংগে সংগে আবার তাতেও বিস্ফোরণ ঘটে। সাধারণ বুলেটের চেয়েও এটা পাওয়ারফুল, ক্ষতি অনেক বেশি করে।

গুলি করেই আহমদ মুসা তাকাল সামনের দিকে। দেখল, তিনটি দেহ টলছে। তাদের হাত থেকে খসে পড়েছে রিভলবার। ওদের পরনে ড্রিলের পোশাক।

আহমদ মুসা দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে তাকাল সেই লোকটির দিকে। বলল, ‘তুমি ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে থাক।’ বলে আহমদ মুসা তার রিভলবারের বাট দিয়ে তার কানের নিচটায় জোরে আঘাত করল।

সত্যি লোকটি বার কয়েক কেঁপে উঠে সংজ্ঞা হারাল।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তাকাল চারদিকে। তাকে যেতে হবে দক্ষিণের প্রান্তিক দেয়ালের মাঝামাীঝ জায়গায়।

দক্ষিণের দেয়ালটা তার সামনের দিকে। আর মাঝামাঝি জায়গাটা হবে তার বাংলোর ঠিক দক্ষিণ দিকে। তার মানে সামনে বাঁ দিকে তাকে এগোতে হবে।

আহমদ মুসা নিহত তিনজনের রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে ছুটল সামনের দিকে। ঠিক এই সময়েই সামরেন দেয়ালগুলোতে লাল বাতি ফ্লাস হতে দেখল। আহমদ মুসা বুঝল, ঘাঁটিতে ইমারজেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। এর অর্থ তার নিখোঁজ বা পালানোর বিষয় ওরা সবাই জানতে পেরেছে।

এখনি সবাই ছুটে আসবে। এই ফ্লোরে আরও তিনজন রয়েছে, ওপরে রয়েছে এক ঝাঁক মানুষ।

সামনের দিকে ছুটল আহমদ মুসা।

এ সিগন্যাল কখন থেকে জ্বলছে সে জানে না। সিগন্যাল পেয়েই কি এ তিনজন এসেছিল? তাহলে তো এতক্ষণে আরও লোক নিচে এসেছে।

আহমদ মুসা সোজা এসে সারিবদ্ধ কক্ষের সামনে দাঁড়াল। তার সামনে দিয়ে লম্বা করিডোর। দু’দিকেই যত দূর চোখ যায় করিডোর চলে গেছে।

আহমদ মুসা বুঝল, দক্ষিণের সীমান্ত ঘেঁষেই এই কক্ষগুলো। এই কক্ষগুলোর কোনটির মধ্যে দিয়েই কি গোপন দরজার স্থানে পৌছতে হবে?

ঠিক এই সময় সামনে ও পেছন থেকে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল আহমদ মুসা। সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল রিভলবার উঁচিয়ে একদল ছুটে আসছে তার দিকে। পেছনেও তাই হবে। ভাবল আহমদ মুসা।

নিজেকে মাটির দিকে ছুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। দ্রুত গড়িয়ে চলল পাশের দরজার দিকে। ঘরটাতে ঢোকা গেলে হয়তো আত্মরক্ষার চেষ্টা করা যাবে, লড়াইয়ে ফিরে আসা যাবে।

গড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে হাত দিয়ে জোরে ধাক্কা দিল দরজায়।

স্টিলের দরজা। একটু ফাঁক হলো।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

গোটা দেহ ছুড়ল দরজার উপর। আরও অনেকখানি ফাঁক হলো। দেহটাও দরজার কিছু আড়াল পেয়েছে।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

দরজা বন্ধ করল।

অবাক হলো আহমদ মুসা, দরজা এত পুরু, এত ভারি দরজা! কেন? আরও অবাক হলো, দরজা বন্ধ করার জন্যে উপর ও নিচের হুড়কো দু’টো বলা যায় দুর্গের দরজার মতো মজবুত। এমন মজবুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন? অথচ ঘরে কয়েকটা সোফা, ছোট একটা ফ্রিজার ও সেন্টার টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই।

তাহলে এ কক্ষটা এত প্রটেকটেড কেন?

এ কক্ষের ভেতর দিয়েই সেই গোপন পথটা নয় তো?

দরজার দু’টি হুড়কোই লাগিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা। ছুটল কক্ষের পেছনের দেয়ালের দিকে। তার বিশ্বাস এটাই হবে সীমান্ত-ওয়াল, যেখানে থাকার কথা উপরে উঠার গোপন পথ।

দেয়ালের সামনে পৌছে একবার মেঝের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেয়ালে চোখ রাখল।

দরজার বাইরে অনেক পায়ের শব্দ। চেঁচামেচি।

একজন চিৎকার করে উঠেছে, বন্দীটি এই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

দরজা ধাক্কাতে লাগল কেউ কেউ। তাদের একজন বলল, ‘হাজার ধাক্কালেও এ দরজা ভাঙা যাবে না। এটা জরুরিকালীন শেল্টার আমাদের স্যারের।’

আরেকজন বলল, ‘তাহলে আমরা কি করবো?’

বাইরে যখন উত্তেজিত এই রকম কথাবার্তা চলছে, তখন আহমদ মুসা গোপন পথের খোঁজে দেয়ালটিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে চোখ বুলাচ্ছে।

গোটা দক্ষিণের দেয়াল তার দেখা হয়ে গেল, কিছুই মিলল না, দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছু তার চোখৈ পড়ল না। অন্য দেয়াল কি সে দেখবে? মন সায় দিল না।

এ সময় বাইরের একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হাই হাইনেস কোহেন ক্যানিংহাম নির্দেশ দিয়েছেন কক্ষের ভেতরে গ্যাস স্প্রে করে তাকে সংজ্ঞাহীন করে রাখতে। তিনি আসছেন।’

সংগে সংগেই আরেকজন বলে উঠল, ‘মি. জেমস, তাহলে এখনি সাইলো থেকে একটা গ্যাস স্প্রে আনুন যা এখানকার জন্যে দরকার।’

কথা শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার কাছে গ্যাস মাস্ক নেই। ওরা গ্যাস ছাড়লে নির্ঘাত ধরা পড়তে হবে।

দ্রুত দক্ষিণের দেয়ালেই আবার আহমদ মুসা ফিরে গেল। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে আবার খোঁজা শুরু করল আহমদ মুসা।

এবার দেয়ালের পূর্ব প্রান্ত থেকে খোঁজা শুরু করল।

অল্প এগোতেই বিদ্যুৎ ছকেটের মতো বর্গাকৃতির সেই প্লেটটা আহমদ মুসার নজরে পড়ল, যা আগেও একবার সে দেখে গেছে। প্লেটটা পাথরের সাদা দেয়ালের সাথে মিলানো সাদা রঙের। প্লেটের গায়ে দু’পিন, ত্রিপিনের ফুটো। কিন্তু প্লেটটা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পুরু। তার চেয়ে বিস্ময়ের হলো, প্লেটটিকে দেয়ালের সাথে আটকানোর মতো কোন স্ক্রু নেই। বিদ্যুতের ছকেট-প্লেট তো এমন হয় না! প্লেটটির এক কোণায় আঙুল দিয়ে জোরে চাপ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগে খসে পড়ল প্লেটটি।

বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্লেটের স্থানটিতে কোন বৈদ্যুতিক পয়েন্ট নেই, বৈদ্যুতিক তার নেই, প্লেন দেয়াল। তাহলে প্লেন দেয়ালের উপর বিনা কারণে প্লেটটা লাগানো থাকবে কেন?

আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল প্লেটটির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা দেয়ালখন্ডের উপর।

আহমদ মুসার চোখ পড়ল দেয়ালের সাদা রঙের সাথে মিলানো একটা তীর চিহ্ন, উপরের দিকে মাথা।

খুশি হলো আহমদ মুসা। ঠিক জায়গাতেই এসেছে আহমদ মুসা। এখানেই গোপন পথটা।

তীরের মাথায় চাপ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই দেয়ালের একটা অংশ উপরে উঠে গেল। তার সাথে একটা সিঁড়িপথ দেখা গেল।

আর সে সময়েই দরজার নিচে সেট করা পাইপ দিয়ে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কুণ্ডলি ভেতরে তীব্রগতিতে প্রবেশ করল।

অপরিচিত একটা গন্ধ পেয়েই চমকে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পেছনে একবার ফিরে তাকিয়েই শ্বাস বন্ধ রেখে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার সাথে সাথে নিচ থেকে ধেয়ে আসছে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কুণ্ডলি। গ্যাস তাকে ঘিরে ফেলেছে। প্রায় খাড়াভাবে উঠে যাওয়া সিঁড়ি। দ্রুত উঠা যাচ্ছে না। সিঁড়িটা এক্সেলেটরের মতো মুভিং কিনা তা দেখার তার সুযোগ হয়নি।

কষ্ট করে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। তার হিসাবে ভুল না থাকলে সিঁড়ি প্রায় ৪০ ফিট উপরে উঠার কথা।

বুক আকুলি-বিকুলি করছে অক্সিজেনের জন্য। অক্সিজেনের অভাবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ছে, শিথিল হয়ে পড়ছে হাত-পা। কিন্তু তাকে দুর্বল হলে চলবে না।

এক সময় সিঁড়ি শেষ হয়ে গেল। আহমদ মুসা দেখল, সে একটি কক্ষে।

কক্ষটি ইতিমধ্যেই গ্যাসে পূর্ণ হয়ে গেছে, দেখল আহমদ মুসা।

কক্ষের একটা দরজা। দরজায় ডিজিটাল লক।

সময় নেই আহমদ মুসার হাতে।

ডিজিটাল লকের উপর রিভলবার তাক করে ট্রিগার চাপল কয়েকবার।

বিস্ফোরণে ডিজিটাল লক উড়ে গেল। খুলে গেল দরজা।

টলছে আহমদ মুসার দেহ। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। গ্যাসও বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে তার সাথে সাথে

আর পারল না আহমদ মুসা। বুক ফেটে যাচ্ছে তার।

জ্যাকেটটা নাকে চেপে ধরে নাক দিয়ে একটা শ্বাস নিল আহমদ মুসা। কিন্তু শ্বাস নিয়েই বুঝল, একটা গন্ধ তার নাক দিয়ে ঢুকল। তবে বুকটা কিছু হালকা হলো। পরিণতিটা বুঝতে আহমদ মুসার দেরি হয়নি। কিন্তু এখানে তার সংজ্ঞা হারালে চলবে না। ছুটল আহমদ মুসা সব শক্তি একত্র করে। চোখে তার অন্ধকার নেমেছে। টলছে তার দেহ। তবু টলতে টলতেই অন্ধেল মতোই দৌড়াচ্ছে সে।

এক সময় শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। ঢলে পড়ল তার দেহ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।

‘আমার দৈনন্দিন সময়-সূচী নিয়ে তুমি তো এভাবে কোনদিন ভাবনি?’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘ভাবছি কারণ, তুমি আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ ও গম্ভীর হয়ে গেছ। সময়ে-অসময়ে কোথাও চলে যাও। রাজনীতি কর না। ব্যবসায় তোমার প্রাণ। কিন্তু ব্যবসায় তোমার দেখছি দ্বিতীয় অগ্রাধিকারে নেমে গেছে। মেয়েকেও মনে হচ্ছে তোমার সাথে নিয়েছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি উদ্বিগ্ন।’ বলল নোয়ান নাওমি, শিমন স্যামসন আলেকজান্ডারের স্ত্রী।

শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার একজন নীরব ব্যবসায়ী। রাজনীতি থেকে সে অনেক দূরে। ইহুদি হলেও ইহুদিদের রাজনৈতিক-সামাজিক ক্রিয়া-কর্মে সে নেই। মাত্র ৪০ বছর বয়সে সব মহল, সব দলের সম্মান ও বিশ্বাস সে অর্জন করেছে। সে যে ‘ফোম’ (Foam) –এর প্রধান এটা বাইরের কেউ কেন, ঘরেরও কেউ জানে না।

‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই নাওমি। ব্যবসায়ে আমার নীরব কাজ যেমন আমাকে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য দিয়েছে, তেমনি আমি আরও যা করছি, তাও জগৎ জোড়া এক সাফল্য আমাকে দেবে। ব্যবসায়ে যেমন আমি নাম্বার ওয়ান, তেমনি আমি শক্তিতেও নাম্বার ওয়ান হতে চাই। মেয়েকে কিন্তু এভাবে আমি সাথে নিতে চাইনি। মেয়েটি আমাদের খুব ইনটেলিজেন্ট, কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা ভিন্ন রকমের। তাই আমি তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছি।’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘আমি বুঝলাম না। তুমি রাজনীতি কর না। তাহলে শক্তিতে এক নাম্বার হওয়ার কথা আসছে কি করে?’ নোয়ান নাওমি বলল।

গম্ভীর হলো শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার। বলল, ‘রাজনীতির পথ ছাড়াও শক্তি অর্জনের আরও পথ আছে নাওমি। সবই জানবে, এখন নাইবা জানলে।’

‘কি সে পথ পেছন দরজার, অন্ধকারের পথ আলেকজান্ডার!’ বলল নাওমি।

‘লক্ষ মহৎ হলে তা অর্জনের পথ নিয়ে নৈতিক কোন প্রশ্ন উঠে না।’ শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার বলল।

‘তোমার সামনের সে মহৎ লক্ষটা কি?’ জিজ্ঞাসা নাওমির।

‘সেটা বিশ্ববাসীর জন্যে একটা সারপ্রাইজ। এর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে নাওমি। আমিও অপেক্ষা করছি।’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু আলেকজান্ডার, যে মহৎ লক্ষ নৈতিক পথ অনুসরণ করতে পারে না, তার মহৎ হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে। আমি তাই মনে করি। তুমি আমার মেয়েকে এর মধ্যে টেন না।’ নাওমি বলল।

হাসল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার। বলল, ‘মা হাওয়া বাবা আদমকে ভুল বোঝাতে পেরেছিল। কিন্তু আদমের উত্তরসূরিরা এখন কিন্তু সাবধান।’ বলে উঠে দাঁড়াল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

ঘর হতে বের হয়েই দেখল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার, তাদের মেয়ে আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার এদিকে আসছে।

‘তোমাকে খুঁজছি মা আমি। চল বসি।’ বলল মেয়েকে লক্ষ করে শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘চল বাবা।’ বলে পিতার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার বসলে আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডারও তার পিতার সামনের সোফায় বসল।

‘কি চিন্তা করলে অ্যানজি? তোমার মতো তরুণ প্রতিভাবান পারটিকেল বিজ্ঞানী এইচ কিউবের খুব বেশি প্রয়োজন।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার, অ্যানজেলার পিতা।

‘বাবা তোমার এইচ কিউব-এর সব বিষয় আমার জানা হয়নি। এইচ কিউব এমন এ্যাডভান্সড অস্ত্র গবেষণা কেন করছে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘কাজ শুরু কর, সবই জানতে পারবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কোন প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি না জেনে সে প্রতিষ্ঠানে আমি যোগ দিতে পারি না বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘প্রাইভেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান তো অনেক আছে। রপ্তানী খাতের অধিকাংশ অস্ত্র তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই সরবরাহ করে থাকে। সুতরাং এইচ কিউব সে ধরনেরই একটা প্রতিষ্ঠান মা।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘এই প্রতিষ্ঠানের নাম এর আগে শুনিনি। এইচ কিউব প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার্ড কিনা? সরকারের সাথে এর সম্পর্ক কি ধরনের বাবা?’ অ্যানজেলা বলল।

‘এইচ কিউব অত্যন্ত সেনসেটিভ একটা বিষয়ে গবেষণা করছে। সরকার জানতে পারলে তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সরকারের ভেতর অনেক লবি আছে, তাদের চোখে পড়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। তাই গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ হচ্ছে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু সরকারের অজ্ঞাতে এ ধরনের গবেষণা তো বেআইনি। অপরাধমূলক কাজ বাবা।’ অ্যানজেলা বলল।

‘বলেছি, সরকারের মধ্যে বিভিন্ন লবি আছে, বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ আছে। সরকারকে জানানো মানে তারা সবাই জানতে পারা। তাতে করে এই গবেষণা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু বাবা, গবেষণার ফল তো সরকারকেই দিতে হবে, রপ্তানী করতে হলেও তা সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। সুতরাং গবেষণা আড়াল করে লাভ নেই। আর এ ধরনের গবেষণা কেউ করতে চাইলে তার নিরাপত্তা বিধান ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমরা নিচ্ছ কেন? তোমরা তো সরকারেরও রোষানলে পড়ে যেতে পার।’ অ্যানজেলা বলল।

‘সরকারও সব জানবে, জনগণও সব জানবে। তুমি এসব নিয়ে ভেব না। তোমার কথাটা বল।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘তোমাদের এইচ কিউব এর অফিস, গবেষণা ল্যাবরেটরি কোথায় বাবা, যেখানে কাজ করতে হবে?’ অ্যানজেলা বলল।

শিমন আলেকজান্ডার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘এইচ কিউব সম্পর্কে আর কিছু জানতে হলে সার্ভিসে যোগ দিতে হবে এবং একটা শপথ তোমাকে নিতে হবে। তারপরই গোপনীয়তার সব দরজা তোমার কাছে খূলে যাবে।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আলাইয়া অ্যানজেলার। বিস্মিত হয়েছে সে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে অস্ত্র গবেষণার মতো প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তা থাকেই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা জানা যাবে না প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে শপথ না নিলে, এমন গোপনীয়তার ব্যাপারটা অকল্পনীয়। সরকারের রেজিস্ট্রেশন না থাকা, সব বিষয় সরকারের নজরের বাইরে থাকা, অস্বাভাবিক গোপনীয়তা সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি কোন সন্দেহজনক কাজে রত। কি সে কাজ? কোন্ উদ্দেশ্যে তার কাজ? কার স্বার্থে?

অনেকটা ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আলাইয়া অ্যানজেলা।

‘কি ভাবছ মা? কবে যোগ দিচ্ছ এইচ কিউব-এর সাথে?’ শিমন আলেকজান্ডারই আবার কথা বলল।

‘ভাবতে আরেকটু সময় দাও বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘ভাব। আরও আলোচনা করি এস, আজ আমার সময় আছে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘বাবা, আমার একটা কাজ আছে বাইরে।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘ঠিক আছে মা, তুমি ভেবে নাও। রাতে কিংবা কালকে তুমি….।’

কথা শেষ না করেই থেমে গেল শিমন আলেকজান্ডার।

তার মোবাইল বেজে উঠেছে।

মোবাইল হাতে নিল সে।

মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই শশব্যস্ত হয়ে সে মোবাইল ধরল।

‘গুড মর্নিং স্যামুয়েল, কি খবর? তোমার গলা কাঁপছে কেন?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

শিমন আলেকজান্ডার উৎকর্ণ, নীরব। শুনছে ওপারের কথা। আস্তে আস্তে চেহারা পাল্টে যাচ্ছে তার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার চোখ-মুখ।

এক সময় তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেন চিৎকারে রূপ নিল। বলল, ‘এই অসম্ভব ঘটনা কি করে ঘটল? তার পালানো অসম্ভব? সর্বনাশ হয়েছে আমাদের। কোহেনকে জানানো হয়েছে?’

ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম ‘আর্মি অব ম্যান’স ফিউচার’-এর সামরিক অপারেশনাল বা সামরিক উইং ‘এইচ কিউব’-এর প্রধান। আর শিমন আলেকজান্ডার উর্ধ্বতন প্রতিষ্ঠান ফোম-এর প্রধান।

‘জানানো হয়েছে স্যার। উনি আসছেন। কিভাবে ঘটনা ঘটল আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘটনা জানার সাথে সাথে আমরা তাকে আটকাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবজান্তার মতো বিস্ময়করভাবে গোপন পথে সে পালিয়ে গেছে।’ বলল ওদিক থেকে স্যামুয়েল লোকটা।

‘ঠিক আছে। কোহেন এলে যেন আমাকে টেলিফোন করে। আমি আসব। আর এদিকে আমি দেখছি কি করা যায়। ও.কে স্যামুয়েল। বাই।’

মোবাইল অফ করে দিয়ে তা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় গা এলিয়ে দিল শিমন আলেকজান্ডার।

আলাইয়া অ্যানজেলা অবাক হয়ে গিয়েছিল একটা টেলিফোন কল থেকে তার পিতার পরিবর্তনে। তার বাবাকে সে কোনদিন এমন মুষড়ে পড়তে দেখেনি, এমন উদ্বেগ-আতংকিত হতে দেখেনি। অ্যানজেলার বিস্ময়ও উদ্বেগে রূপ নিল। বলল, ‘কি হয়েছে বাবা? কি ঘটেছে?’

শিমন আলেকজান্ডার চমকে উঠে মাথা থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। অ্যানজেলা তার সামনে হাজির আছে, এ কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। তার টেলিফোনের কথা অ্যানজেলা শুনেছে দেখে তার চোখে অস্বস্তিও ফুটে উঠেছে।

মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘একটা সমস্যা হয়েছে মা।’

‘কার পালানোর কথা বললে বাবা। এমন কে পালিয়েছে যে তুমি এতটা আপসেট?’ অ্যানজেলা বলল।

‘এসব ব্যবসায়িক জটিলতার কথা মা। থাক এসব। তোমার কি যেন কাজ আছে বললে? সেরে এস। পরে কথা হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

আলাইয়া অ্যানজেলা বুঝল, বাবা তাকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। বাবা সম্ভবত একা থাকতে চান। সংকট নিশ্চয় বড় ধরনের কিছু। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কোন স্টাফ পালালে তো এমন ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়! ‘তার পালানো অসম্ভব!’ বলে বাবা যে কথা বলেছেন, সেটা রহস্যপূর্ণ। এটা কোন বন্দীর ক্ষেত্রে খাটে, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর ক্ষেত্রে খাটে না। কিন্তু বাবা কথা আড়াল করবেন কেন? হতে পারে মেয়েকে তা বলার মতো নয়।

মাথা ভরা ভাবনা নিয়েই বাবার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এল আলাইয়া অ্যানজেলা। ঘর থেকে বেরুবার সময় অ্যানজেলা পেছনে তাকিয়ে দেখল তার বাবা সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজেছে।

মনটা খারাপও হয়ে গেল অ্যানজেলার। বাবার এমন ভেঙে পড়া অবস্থা সে কখনও দেখেনি।

গাড়ি নিয়ে বেরুল অ্যানজেলা।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার পারটিকেল ফিজিক্সের সে তরুণ গবেষক। অত্যন্ত কৃতি ছাত্রী সে। পড়ার সময়ই তার অনেকগুলো গবেষণাপত্র বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে। পাস করেই সে বিশ্ববিদ্যালয়েল ডার্ক ম্যাটারের গবেষণা টিমে যোগ দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়েই যাচ্ছে সে।

সিলভার স্প্রিং- এ তাদের বাড়ি হলেও অধিকাংশ সময় ওয়াশিংটন ডিসি’র উত্তর সীমান্তে রক ক্রিক পার্ক এলাকার এই বাড়িতে তারা থাকে। পাহাড়-বনাঞ্চলের প্রান্ত ঘেসে প্রকৃতির এক সবুজ সমুদ্রে একগুচ্ছ মনোরম বাংলো নিয়ে প্রাচীর ঘেরা তাদের বাড়ি।

রক ক্রিক পার্কের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রক ক্রিক পার্ক-পটোম্যাক ফ্রি ওয়ে ধরে ছুটে চলেছে তার গাড়ি।

রক ক্রিক পার্কের মাঝামাঝি যেখানে অরণ্যটা প্রশস্ত ও ঘন হয়ে উঠেছে, সেখানে গিয়ে ৩নং এক্সিট নিল আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার। এক্সিট রোডটি প্রায় ১০ কিলোমিটার এগিয়ে আবার রক ক্রিক পার্ক-পটোম্যাক ফ্রি ওয়েতে গিয়ে মিশেছে।

এই এক্সিট রোডটি অ্যানজেলা আলেকজান্ডারের খুব পছন্দ। এ রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে তার মনে হয়, সবুজের এক আদিগন্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে সাদা ফেনিল স্রোতে যেন সে ভেসে চলেছে। এই ফ্রি ওয়ে দিয়ে এলে সে এই এক্সিট নেয় এ জন্যেই।

নদীর সমভূমির স্রোতের মতোই ধীরগতিতে গড়িয়ে চলছিল তার গাড়ি।

হঠাৎ তার নজরে পড়ল রাস্তার ধারে একজন মানুষ পড়ে আছে। তার মাথার অংশটা দেখা যাচ্ছে, বুক থেকে পেছনের অংশটা জংগলের ভেতরে।

জীবিত, না মৃত? দু’টোই হতে পারে, দেখা উচিত একবার তাকে।

গাড়িটা রাস্তার পাশে নিয়ে থামাল সে। লোকটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার দু’টি হাত সামনে প্রসারিত, যেন সে পালাবার বা বাঁচার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টার মধ্যেই ঐভাবে পড়ে গেছে। সে কি মৃত? না আহত?

গাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল সে পড়ে থাকা লোকটির কাছে। হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে।

তাড়াতাড়ি হাতের পালস দেখল। না বেঁচে আছে লোকটি। শরীরের ব্যাক অংশ যতখানি দেখা যাচ্ছে, তাতে কোন আঘাত দেখতে পেল না।

সংজ্ঞা লোপকারী গ্যাসে আক্রান্ত আহমদ মুসা ওদের ঘাঁটি এলাকা থেকে যতটা সম্ভব দূরে পালাতে চেয়েছিল। তার ভাগ্য ভালো, এই চেষ্টায় সে সফল হয়। যেখানে এসে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যায়, সেটা রাস্তার ধারের এই জায়গা।

আহমদ মুসার দেহটা উল্টে চিৎ করে শোয়ালো অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

সুন্দর এশীয় চেহারা। শরীরের রং সাদাটে সোনালি। পেশিবহুল একহারা শরীর। মনে হলো অ্যানজেলার, শরীরের সাইজের তুলনায় ওজনটা যেন একটু বেশি। মেদহীন পেটা শরীর বলেই হয়তো, ভাবল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

শরীরের সামনের অংশেও কোন আঘাতের চিহ্ন পেল না সে। তাহলে জ্ঞান হারালো কিভাবে সে? তার পরনের কাপড়-চোপড় কোন ফরমাল পোশাক নয়। কোন হোটেল, হসপিটাল বা প্রতিষ্ঠানের সেবক বা স্টাফদের ইউনিফরম বলেও মনে হলো না। অ্যানজেলা বিস্মিত হলো, এই লোক এই জংগলে এল কি করে? একে অবিলম্বে কোন ডাক্তার বা ক্লিনিকে নেয়া দরকার। জ্ঞান ফিরলে সব জানা যাবে।

অ্যানজেলা আহমদ মুসাকে কোনওভাবে টেনে গাড়ির কাছে নিল। তারপর ঐভাবে টেনেই গাড়িতে তুলল। তাকে উল্টাতে গিয়েই বুঝেছিল তাকে দুই হাতে তুলে নিয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আহমদ মুসাকে গাড়িতে তুলে নিয়েই অ্যানজেলা সিদ্ধান্ত নিল সংজ্ঞাহীন লোকটিকে শ্যালন হার্স-এর কাছে নেবে সে।

শ্যালন হার্স তার প্রেমিক। ডাক্তার। পাস করার পর সে জর্জ ওয়াশিংটন হাসপাতালে যোগ দিয়েছে। তার বাড়ি কাছেই, পটোম্যাক নদীর তীরে, যেখানে রক ক্রিক শেষ হয়েছে। সেটার পাশে দিয়ে একটা হাইওয়ে চলে গেছে রাজধানীর কেন্দ্রে। সেই হাইওয়ে ধরে অল্প এগোলেই শ্যালন হার্সদের বাড়ি।

চিন্তা করেই অ্যানজেলা শ্যালন হার্সকে টেলিফোন করল। শ্যালন হার্স বলল, ‘আমি তো এখন তোমাদের বাসায় যাচ্ছি, আমি এখন রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের সামনে।’

বিস্মিত হয়ে অ্যানজেলা বলল, ‘সে রকম কি কথা ছিল?’

‘অবশ্যই। কথা ছিলো আজ তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব।’ বলল শ্যালন হার্স।

‘ও গড। ঠিক তো! ভুলে গেলাম কি করে?’ অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘এমন ভুল তো স্বাভাবিক নয় অ্যানজেলা, বিশেষ করে তোমার মতো অতিসতর্ক একজনের জন্যে!’ বলল শ্যালন হার্স।

‘ঠিক বলেছ ডার্লিং। হতে পারে এর পিছনে দু’টি কারণ আছে। এক. বাবার কিছু কথা আমার চিন্তায় একটা ওলট-পালট অবস্থার সৃষ্টি করেছে। দুই. ভবিতব্য আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে এবং আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’ অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘তুমি কোথায়?’ বলল শ্যালন হার্স।

‘আমি রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের প্রায় মাঝখানে। তুমি এক্সিটের মুখ বরাবর স্থানে অপেক্ষা কর। আমি আসছি। খুব জরুরি বিষয় আছে। ও.কে ডার্লিং, বাই।’ অ্যানজেলা বলল।

‘ও.কে ডার্লিং। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।’ বলল শ্যালন হার্স।

অ্যানজেলার গাড়ি আগেই স্টার্ট নিয়েছিল। হাতের মোবাইলটা ড্যাশ বোর্ডে রেখে অ্যানজেলা পেছনের সিটে শুইয়ে রাখা আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তারপর সামনে ফিরে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল।

অল্প সময় চলার পর গাড়ির রিয়ার ভিউতে দেখতে পেল অ্যানজেলা, যেখান থেকে লোকটিকে তুলে এনেছে, সেখানে চার পাঁচজন লোক কি যেন দেখছে। তাদের কারও কারও মুখে গ্যাস মাস্ক, পিস্তলের মতো কিছু দেখতে পেল কারও কারও হাতে। বুঝতে পারল অ্যানজেলা এই লোকটিকেই ওরা খুঁজছে। লোকটি কি তাহলে কোথাও থেকে পালিয়েছে? কিন্তু কোথাও থেকে পালিয়ে সে এ জংগলে আসবে কেন? দু’পাশের বিশাল-বিস্তৃত জংগলের কোথাও তো কোন বাড়ি-ঘর নেই। বাড়ি-ঘর তৈরিও নিষিদ্ধ। বিশেষ অনুমতিতে পর্যটন বিভাগের কয়েকটি ট্যুরিস্ট এনক্লোজার আছে দু’পাশের জংগলের বিভিন্ন স্থানে। এগুলো ট্যুরিস্টদের বিশ্রাম ও রাত্রিবাসের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এ ট্যুরিস্ট এনক্লোজারগুলো আবার পর্যটন বিভাগ থেকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শর্তাধীনে লীজ দেয়া রয়েছে।

কিন্তু এখানে ঐ গ্যাস-মাস্কধারীরা এল কোত্থেকে? তারা কেন খুঁজছে এ লোকটিকে? ওদের হাতেই কি এ লোকটি বন্দী ছিল?

কোন ক্রিমিনাল নেটের সদস্য হবে, এ লোকটিকে দেখে তা মনে হয় না।

অ্যানজেলা আবার তাকাল পেছনের আহমদ মুসার দিকে। না, পবিত্র চেহারা যাকে বলে, লোকটির চেহারা সে রকমই। ক্রিমিনালদের হিংসা এবং হিংস্রতা তাদের রক্তে এক ধরনের কালো পারটিকেল (পরমাণুর পরমাণু) সৃষ্টি করে যার প্রকাশ তাদের মুখে-চোখে ঘটে। এই প্রকাশ পবিত্রতার বিপরীত হয়ে থাকে। লোকটির চোখে-মুখে সেই কালিমার কোন দৃশ্য নেই।

দ্রুত এগিয়ে চলছে অ্যানজেলার গাড়ি।

প্রায় ২০ কিলোমিটার ঘুরে অ্যানজেলা হাইওয়ের ব্যাক-ট্রাকে ফিরে এল।

চলে তার গাড়ি রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের বরাবর রাস্তায়। অ্যানজেলা দেখতে পেল একটু সামনে রাস্তার পাশে একটা ইমারজেন্সি পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে আছে শ্যালন হার্সের গাড়ি।

অ্যানজেলা আগেই লেন চেঞ্জ করে শেষ লেনটায় নিয়ে এসেছিল গাড়ি।

অ্যানজেলা তার গাড়ি শ্যালন হার্সের গাড়ির পাশে দাঁড় করাল। সংগে সংগেই বেরিয়ে এল সে গাড়ি থেকে।

শ্যালন হার্স তার গাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে এসেছে। সে এগিয়ে এল অ্যানজেলার গাড়ির দিকে।

অ্যানজেলাও গাড়ি থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করছে শ্যালন হার্সের।

শ্যালন হার্স এগিয়ে এল তার কাছে।

দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।

‘হার্স, তুমি ডাক্তার। তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ির ভেতর দেখ একজন সংজ্ঞাহীন মানুষ।’ বলল অ্যানজেলা।

‘সংজ্ঞাহীন মানুষ!’ বলে শ্যালন হার্স এগোলো অ্যানজেলার গাড়ির দিকে।

তার সাথে অ্যানজেলা।

শ্যালন হার্স গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। আহমদ মুসার পায়ের আঙুল, হাতের আঙুল, পালস ও চোখ পরীক্ষা করল শ্যালন হার্স।

অ্যানজেলাও গাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল।

‘ভয় নেই অ্যানজি। গ্যাসের প্রভাবে সে জ্ঞান হারিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমনিতেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’

‘গ্যাসের প্রভাবে?’

বলেই অ্যানজেলার মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগে জংগলে দেখে আসা গ্যাস-মাস্ক পরা লোকদের কথা। তাহলে ওরাই এ লোককে গ্যাস প্রয়োগ করেছিল সংজ্ঞাহীন করার জন্যে!

‘হ্যা, গ্যাসের প্রভাবে অ্যানজেলা। এখন কি করবে লোকটিকে? হাসপাতালে নেবে?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘হাসপাতালে নেবার কেস এটা নয় হার্স তুমিই তা বললে। বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। জ্ঞান ফিরলে লোকটার কাছ থেকে আমার কিছু জানারও কৌতুহল আছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘কৌতুহলটা কি?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘আমি সব জানি না। তবে মনে হচ্ছে, লম্বা কোন কাহিনী এর পেছনে আছে। লোকটিকে ছেড়ে দিলে তা জানা যাবে না। দেশের নাগরিক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু জানা দরকার। এখন আপাতত এতটুকুই।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

শ্যালন একটু হাসল এবং মনে মনে বলল, তুমি ‘ফ্রি আমেরিকা’ সংগঠনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, তুমি তে বলবেই এমন কথা।

‘ফ্রি আমেরিকা’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডার ফাদারস জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিংকন প্রমুখের আদর্শের পতাকাবাহী দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের একটা সংগঠন। এরা রাজনীতি করে না, কিন্তু রাজনীতি ও সমাজকে তারা ফাউন্ডার ফাদারসদের উপর রাখার জন্যে নিরলস কর্মী হিসাবে কাজ করতে চায়।

‘তুমি হাসলে কেন শ্যালন?’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘হাসা নয়, তোমার প্রশংসা করলাম। ‘ফ্রি আমেরিকা সংগঠন’ কাজ স্থগিত করেছে, কিন্তু তুমি কাজ স্থগিত করনি।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ফ্রি আমেরিকা সংগঠন হিসাবে তার কাজ স্থগিত করেছে, কিন্তু ফ্রি আমেরিকার লাখো দেশপ্রেমিক সদস্য তাদের কাজ বন্ধ করেনি। দেশের জন্যে এ কাজ বন্ধ হবার নয়, নাগরিকদের জন্যে এটা তো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।’ বলল অ্যানজেলা।

‘ধন্যবাদ অ্যানজেলা। ঠিক বলেছ, আমিও তাই মনে করি। চলো এবার। গাড়িতে উঠো, আমি তোমাকে ফলো করবো।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ হার্স, চলো।’ বলে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল গাড়ি অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

বাড়িতে পৌছল অ্যানজেলা।

অ্যাটেনডেন্টকে বলল স্ট্রেচার নিয়ে এসে লোকটিকে বাড়ির নার্সিং সেন্টারে নিয়ে যেতে।

বাড়ির নার্সিং কর্নারে সার্বক্ষণিক নার্স আছে। সাদা দুগ্ধ ফেনায়িত শয্যা, বকের পালকের মতো সুন্দর কার্পেট মেঝেয়। কক্ষগুলোর সবকিছুই অপরূপ সাদায় মোড়া।

আহমদ মুসাকে নিয়ে রাখল একটা বেডে।

‘শ্যালন, তুমি দেখ কি করতে পার, নার্স আছে কিছু দরকার হলে ওদের বলো। আমি একটু আসছি ভেতর থেকে।’ বলে অ্যানজেলা ভেতর বাড়িতে চলে গেল। নার্সিং স্টোর ভেতর বাড়িরই একটা অংশে। বাড়ির অসুস্থদের প্রাথমিক সেবা এখানেই হয়। অ্যানজেলা বেরিয়ে ভেতর বাড়িতে তার বাবাকে পেল। তার বাবা বলল, ‘তুমি ওদিক থেকে কেন? তুমি না বাইরে গিয়েছিলে?’

‘বাবা, রক ক্রিকের জংগলের ধারে একজন সংজ্ঞাহীন লোককে পেয়েছি, তাকে আমাদের নার্সিং কর্নারে নিয়ে এসেছি। শ্যালনও এসেছে। সে দেখছে লোকটাকে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘রক ক্রিক পার্কের জংগলে? লোকটি কেমন, আমেরিকান?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল। তার কথার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ঔৎসুক্য। ঔৎসুক্যটা অনাকাঙ্খিত কিছু খুঁজে পাবার আগ্রহের মতো।

অ্যানজেলারও তা দৃষ্টি এড়াল না। সে পিতার দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘হ্যা, বাবা, তাকে পেয়েছি রক ক্রিক পার্কের জংগলের পাশে ৩নং এক্সিট রোডের ধারে। লোকটিকে আমেরিকান নয়, এশিয়ান বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।’

‘এশিয়ান!’ আনন্দের বিস্ফোরণের মতো বেরুল শব্দটা শিমন আলেকজান্ডারের মুখ থেকে।

এবার অ্যানজেলার চোখে-মুখে বিস্ময় নেমে এল। ভেবে পেল না, ‘রক ক্রিক পার্ক-এর জংগল ও লোকটি এশিয়ান’ এই ঘটনার সাথে তার বাবার কি সম্পর্ক!

তার কথা শেষ করেই অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘মা অ্যানজি, দেখি তোমার লোকটাকে। যেই হোক, আমাদের গেস্ট তো।’

কথা শেষ হবার আগেই হাঁটা দিয়েছে শিমন আলেকজান্ডার।

অ্যানজেলা কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। তার মনে হলো বাবা লোকটিকে চিনতে পারে কিনা দেখা দরকার।

অ্যানজেলাও বাবার পিছনে পা বাড়াল। বাসার স্টাফ প্রধান মিস বারবারা অ্যানজেলা সামনে এসে দাড়াল। বলল, ‘ম্যাডাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনার একটা টেলিফোন এসেছিল। একটা জরুরি মেসেজ দিয়েছে।’

‘হ্যা, হতে পারে মিস বারবারা। গাড়িতে আমি মোবাইল বন্ধ রেখেছিলাম। দিন মেসেজটা।’

‘প্লিজ, এক মিনিট। ফাইলে আছে, আমি নিয়ে আসছি।’

বলে মিস বারবারা ছুটল তার অফিসের দিকে।

মেসেজটি নিয়ে এসে দিল অ্যানজেলার হাতে। মেসেজটির উপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে তা পকেটে পুরল অ্যানজেলা। দ্রুত এগোলো নার্সিং কর্নারের সেই রুমটির দিকে।

রুমটির কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়াল অ্যানজেলা। শুনতে পেল তার বাবা ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। কথাগুলো যেন তার নিয়ে আসা অসুস্থ লোকটি সম্পর্কে। বলছিল তার বাবা, ‘…না, কোন সন্দেহ নেই। এ লোকটি আমাদের বন্দী সেই লোকটিই। তাকে পাওয়া গেছে রক ক্রিক পার্কের জংগলে।’

তার বাবার কথায় একটা ছেদ পড়ল। সম্ভবত ওপারের কথা শুনছেন তিনি।

এক পা, দু’পা করে এগোলো অ্যানজেলা আরও কাছে। দেখল, তার বাবা কক্ষটির বাইরে করিডোরের এদিকের প্রান্তে এসে কথা বলছে।

তার বাবা আবার বলে উঠল, ‘শোন কোহেন, তুমি স্বয়ং লোকজনকে নিয়ে চলে এস। তোমরা পুলিশের ইউনিফর্মে আসবে। আমি গেটে বলে যাচ্ছি। সিকিউরিটির লোকরা তোমাদের সহযোগিতা করবে।’

থামল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার। ওপারের কথা শুনল। বলল আবার, ‘আমি থাকছি না। আমার মেয়ে ওকে এনেছে। থাকলে একটু সমস্যায় পড়তে হবে।’

থামল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার।

ওপারের কথা শুনে বিরক্তির সাথে শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘যে বাধাই আসুক তাকে তোমাদের নিয়ে যেতে হবে। সব বাধা ও অন্য সব বিপদের চেয়ে সে যে গুরুত্বপূর্ণ তা তোমাকে বলে দিতে হবে? তুমিই না তার সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জান! ও.কে, তোমরা এস।’

কথা শেষ করেই অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার দ্রুত বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াল। অ্যানজেলাও দ্রুত দেয়ালের আড়াল থেকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

তার বাবা চলে যেতেই আতংকিত অ্যানজেলা উদ্ধার করে আনা লোকটির কক্ষে চলে গেল। সেখানে ডাক্তার শ্যালন হার্স বসেছিল।

‘কতক্ষণ লাগবে ওর জ্ঞান ফিরতে শ্যালন?’ দ্রুতকণ্টে বলল অ্যানজেলা।

শ্যালন হার্স তাকাল অ্যানজেলার দিকে। বলল, ‘কিছু হয়েছে অ্যানজেলা? তোমাকে উদ্বিগ্ন লাগছে।’

‘বলছি। বল ওর জ্ঞান কতক্ষণে ফিরবে?’ বলল অ্যানজেলা।

‘আর বোধ হয় বেশি সময় লাগবে না। ওর জ্ঞান ফিরে আসছে ধীরে ধীরে।’ বলল শ্যালন হার্স।

‘শ্যালন এখনি ওকে বাইরে নিতে হবে। তুমি ওকে তৈরি কর। আমি আসছি।’

বলেই অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল।

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে শ্যালন হার্স তাকাল অ্যানজেলার দিকে। কিন্তু অ্যানজেলার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘অ্যানজেলা, ওকে আমি রেডি করছি।’

অ্যানজেলা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে দাড়াল নার্সিং কন্যারের ব্যালকনিতে। এখন থেকে তার বাবার গাড়ি বারান্দা দেখা যায়।

পাঁচ মিনিটও গেল না। অ্যানজেলা দেখল তার বাবা এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি তাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

অ্যানজেলা দ্রুত নার্সিং কক্ষে ফিরে এল। দেখল সংজ্ঞাহীন লোকটিকে হুইল চেয়ারে বসানো হয়েছে।

‘চল শ্যালন। এখনি বেরুতে হবে বাড়ি থেকে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘অ্যানজি, কোথায় তাকে নেবে?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ঠিক করিনি শ্যালন। তোমার হাসপাতাল নিরাপদ নয়।’

হুইল চেয়ার ঠেলে নিতে নিতে বলল শ্যালন হার্স, ‘কেন অ্যানজি, নিরাপদন নয় কেন আমাদের হাসপাতাল?’

‘কারণ বাবারা এই লোকের খোঁজে প্রথমেই তোমাদের হাসপাতালে যাবে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকাল শ্যালন হার্স তার পাশের অ্যানজেলা আলেকজান্ডারের দিকে।

‘বুঝেছি শ্যালন, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। বলব সব, এখন বলার সময় নয়।’ বলল অ্যানজেলা।

মিস বারবারা এদিকে আসছিল। সম্ভবত তার বাবাকে বিদায় দিয়ে এদিকে আসছে। তাকে দেখেই অ্যানজেলা বলল, ‘লোকটিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে শিফট করা দরকার। শ্যালনেরও এই মত। তাকে হাসপাতালে নিচ্ছি।’

মিস বারবারার চোখে-মুখে উদ্বেগের ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘কিন্তু স্যার তো বলে গেলেন…..।’

বলে থেমে গেল মিস বারবারা।

‘কি বলে গেছেন বাবা?’ জিজ্ঞাসা অ্যানজেলার।

‘পুলিশ আসছেন, এই লোককে তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছেন।’ বলল মিস বারবারা।

‘ঠিক আছে, পুলিশ এলে বলো লোকটির অবস্থা ভালো ছিল না, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে যেন তার খোঁজ করে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘কোন হাসপাতাল ম্যাডাম?’ মিস বারবারার জিজ্ঞাসা।

যত কাছের হাসপাতাল হয় ততই ভালো। যেখানেই এর পয়জন গ্যাসের এন্টিডোট পাওয়া যায় সেখানেই ভর্তি করা হবে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

অ্যানজেলারা চলে গেল গাড়ি বারান্দায়।

একটু পিছিয়ে থেকে মিস বারবারা তাদের অনুসরণ করছিল। টেলিফোন করছিল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডারকে।

কলটা তার বারবার ফেরত আসছিল।

এক সময় তাকে পেয়ে গেল সে। জানাল তাকে সব ঘটনা।

তখন গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছিল অ্যানজেলাদের।

অ্যানজেলার গাড়ি বেরিয়ে এল গেট দিয়ে।

গেট থেকে রক ক্রিক পটোম্যাক রোডটা বেশ কয়েক গজ দূরে। সে পর্যন্ত রোডটা প্রাইভেট, অ্যানজেলাদের তৈরি। লাল পাথরের সুন্দর রাস্তা। এ রাস্ত গিয়ে মিশেছে রক ক্রিক পটোম্যাক ফ্রি ওয়ের সাথে। যেখানে গিয়ে মিশেছে, সেখানে বহুমুখী ফ্লাইওভার।

ফ্রি ওয়ের বামপাশের সড়ক ওয়াশিংটন থেকে আউটগোয়িং এবং ডানদিকের সড়ক ওয়াশিংটনে ইনকামিং। এখানে সব দিকে এক্সিট নেয়ার ব্যবস্থা আছে। এক্সিট নেয়া ও ব্যাক-ট্র্যাকে ফেরার সব গাড়িগুলোকে ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে হয়।

  অ্যানজেলাদের গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠতে যাচ্ছিল। ড্রাইভ করছিল অ্যানজেলা। দেখল, তিনটি গাড়ি ছুটে আসছে তাদের গেটের দিকে। সামনেরটা জীপ, পেছনের দু’টি মাইক্রো। ভেতরে পুলিশের ইউনিফরম পরা মানুষ। অ্যানজেলা নিশ্চিতই বুঝল, ওরাই তারা। সংজ্ঞাহীন লোকটিকে নিতে এসেছে। অ্যানজেলা তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।

গাড়ি তিনটি থমকে দাঁড়িয়েছিল।

সামনের জীপ থেকে একটা কুকুর ছেড়ে দেয়া হলো। কুকুরটা সামনের দিকে ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল এবং চারদিকে বাতাস শুঁকার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই ছুটল ফ্লাইওভারের দিকে, যে ফ্লাইওভার হয়ে অ্যানজেলাদের গাড়ি এগোচ্ছিল। সামনের জীপ গাড়ি থেকে একটি ভারি গলা চিৎকার করে উঠল, ‘ফ্লাইওভারে ঐ যে গাড়ি যাচ্ছে, ওটা আটকাও।’

পেছনে তাকিয়ে কথাটা শুনল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার ও শ্যালন হার্স।

‘পুলিশ এসেছে অ্যানজেলা। ওরা আমাদের গাড়ি থামাতে চাচ্ছে। থামানো উচিত।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘না শ্যালন, ওরা পুলিশ নয়। পুলিশের ছদ্মবেশে ক্রিমিনাল। এই লোককে ওরা হাইজ্যাক করতে এসেছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘বল কি? জানলে কি করে তুমি?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘সব বলব। এখন কিভাবে ওদের হাত থেকে বাঁচা যায় বল। আমরা ওয়াশিংটনের দিকে যেতে পারছি না। দেখ, ওদের একটা মাইক্রো রাস্তার আইল্যাণ্ড অতিক্রম করে আমাদের যাবার পথ বন্ধ করতে প্রস্তুত হয়েছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘আমি মনে করি, বামের এক্সিটটাই নাও। রক ক্রিক-এর শেষ পর্যন্ত নেমে আসা নদীর তীর ঘেষে এই রাস্তাটা ওয়াশিংটন-মেরিল্যান্ড ফ্রি ওয়েতে উঠেছে। ওটাই আমাদের টার্গেট হবে।’ শ্যালন হার্স বলল।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে অ্যানজেলা বলল, ‘ঠিক বলেছ শ্যালন।’

শেষ মুহুর্তে খুব ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে হয়েছে অ্যানজেলাকে।

গাড়ি প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে। শুইয়ে রাখা আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহটা গাড়ির সিট থেকে পড়ে গেল গাড়ির মেঝেতে। পাশে বসেছিল শ্যালন হার্স। সে তাড়াতাড়ি তাকে তুলল গাড়ির সিটে। আহমদ মুসা সংজ্ঞা ফিরে পেল এ সময়। আহমদ মুসা মূহূর্তের জন্যে চোখ খুলেছিল। কিন্তু তাড়াতাড়ি সে চোখ বন্ধ করল। সংজ্ঞাহীনের মতোই শুয়ে রইল। পড়ে যাওয়ার ধাক্কাতেই সম্ভবত সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে আহমদ মুসা। সে তার সংজ্ঞা ফিরে পাবার ব্যাপারটা গোপন করতে চায় এই কারণে যে, শত্রু না বন্ধু কার হাতে তা সে জেনে নিতে চায়।

বামের এক্সিটে প্রবেশ করেছে গাড়ি।

কিছুটা চলার পর অ্যানজেলা ভীত কণ্ঠে বলল, ‘শ্যালন, ওদের দুই গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।’

শোনার পর শ্যালন হার্সও উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। সেও দেখতে পেল। বলল, ‘কিন্তু তৃতীয় গাড়িটা কোথায়?’

‘সম্ভবত এক্সিট ওয়ের সামনে থেকে আসবে সে আমাদের আটকাবার জন্যে।’ একটু চিন্তা করে বলল অ্যানজেলা।

‘সর্বনাশ! তাহলে উপায়?’ শ্যালন হার্স বলল। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।

অ্যানজেলারও চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, ‘কোন একটা উপায় বের করতে হবে। এই এক্সিটের মাঝ বরাবর নদীতে কয়েকটি জেটি আছে পর্যটন বিভাগের। আর পাশে রেস্তোরা, দোকান-পাট, বাড়ি-ঘরও আছে। ওখানে গিয়ে কিছু করতে হবে। বোটও আমরা নিতে পারি।’

‘কিন্তু অ্যানজেলা, আমি বুঝতে পারছি না, ওরা এই লোকটাকে পাবার জন্যে এমন বেপরোয়া কেন। তোমার গাড়িকে ফলো করার সাহস ওরা পায় কি করে? আমার দেখা ভুল না হয়ে থাকলে আমি বলছি, তোমার বাবা এই লোকটিকে চিনতে পেরেছেন। তোমার বাবার তাকে চেনা এবং ওরা এভাবে তাকে ধরতে আসার মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? ওরা পুলিশের বেশে এসে তোমাদের একজনকে নিয়ে যেতে সাহস পেল কি করে? এটাও তোমার বাবার ইচ্ছা? তাছাড়া তোমার গাড়ি ওরা চিনল কি করে? গাড়ি চিনেই তো ওরা কুকুর ব্যবহার করেছিল। এই লোকটাকে নিয়ে যেতে তুমি বাধা দিতে পার, এটা তোমার বাবার জানার কথা। তাছাড়া লোকটাকে তুমি নিয়ে যাচ্ছ বাইরে কোথাও, এটা তোমার বাড়ির দায়িত্বশীলদের মধ্যে জানে একমাত্র মিস বারবারা, তোমাদের বাড়ির চীফ অব স্টাফ। সেই এদেরকে বা তোমার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে কিনা?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ শ্যালন, তুমি যা ধারণা করছ সবই ঠিক। বাবা ওঁকে দেখে বাইরে বেরিয়েই এদের কাছে টেলিফোন করেছিলেন। টেলিফোনের সব কথা আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছি। মিস বারবারাই যে শেষ খবরটা বাবাকে বা এদেরকে জানিয়েছেন, আমিও সেটা সন্দেহ করছি।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু অ্যানজেলা, এই লোকটি কে, ওরাই বা কে? কেন এসব ঘটনা ঘটছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘আমিও সব জানি না শ্যালন। তবে বড় কোন একটা ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে আমি মনে করছি।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘এই লোককে না চিনলে, তাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে তুমি এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছ কেন?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘বাবার টেলিফোনের কথা-বার্তায় আমি শুনেছি, এই লোকটি সব বাধা, সব বিপদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এজন্যেই ওদের এই সাংঘাতিক বড় শিকারকে আমি বাঁচাতে চাই। এতে নিশ্চয় ওরা খুব অসুবিধায় পড়বে, এটা আমি চাই।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

কথা শেষ করেই রিয়ার ভিউ-এর দিকে তাকিয়ে অ্যানজেলা বলল, ‘ওরা আমাদের কাছাকাছি আসতে চাচ্ছে।’

বলেই অ্যানজেলা তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।

অল্পক্ষণেই ওদের গাড়ির সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল।

সিটে শোয়া সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসা এবার চোখ খুলল ও উঠে বসল।

শ্যালন হার্স আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আপনার সংজ্ঞা ফিরেছে, থ্যাংকস গড।’

অ্যানজেলা আলেকজান্ডারও পেছন ফিরে তাকাল। বলল, ‘থ্যাংকস গড। আপনার এখন কেমন লাগছে?’

‘ভালো। আমি দুঃখিত, ছোট্ট একটু প্রতারণা করেছি আপনাদের সাথে। কিসের বড় একটা ধাক্কায় কয়েক মিনিট আগে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। এ সময় থেকে আমি আপনাদের সব কথা শুনেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ওয়েলকাম। কিন্তু এটা করলেন কেন?’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘আমি কাদের হাতে, তারা শত্রু না মিত্র তা জানার সুযোগ নেয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরা শত্রু হলে কি করতেন?’ বলল অ্যানজেলা।

‘মুক্ত হবার চেষ্টা করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিভাবে? আমাদের দু’জনের কাছেই রিভলবার আছে।’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আকস্মিকভাবে উঠে মি. শ্যালন হার্সকে কাবু করে আপনাকে নিষ্ক্রিয় করতাম, আপনারা রিভলবার বের করার সময় পেতেন না।’

কিছু বলতে গিয়েও অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলতে পারল না। সে উৎকর্ণ হলো। একটা হেলিকপ্টারের শব্দ তার কানে এল। বলল, ‘মনে হচ্ছে একটা হেলিকপ্টার আসছে।’

আহমদ মুসাও উৎকর্ণ হয়েছিল। বলল, ‘হ্যা, একটা ফোর সিটার এই এক্সিট রোড বরাবর উড়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।’

অ্যানজেলা ও শ্যালন দু’জনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘ফোর সিটার কি করে বুঝলেন?’ বলল অ্যানজেলা।

‘শব্দ শুনে বুঝেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরাই ওদের টার্গেট কি করে বুঝলেন?’ অ্যানজেলাই বলল।

‘এই শত্রুদের আমি চিনি। ওরা জানে আমি যদি পালাতে পারি, ওদের অনেক বছরের পরিকল্পনা ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই যে-কোন মুল্যে ওরা আমাকে আটকাবে। ওদের হেলিকপ্টার এসেছে উপর থেকে আমাদের উপর নজরদারী করার জন্যে।’ আহমদ ‍মুসা বলল।

‘আপনাকে যে কোন মূল্যে আটকাবে বলছেন, কিন্তু আপনার মধ্যে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না!’ বলল শ্যালন হার্স।

‘উদ্বেগ ও ভয় এলে তো আমি দুর্বল হয়ে পড়ব। নিজেকে তাহলে বাঁচাব কি করে?” আহমদ মুসা বলল।

‘আপনার কিন্তু পরিচয় জানা হয়নি। আপনি ….. “ প্রশ্ন অ্যানজেলার।

তার চোখে-মুখে বিস্ময়। চরম বিপদ থেকে বেঁচে উঠা এবং পুনরায় চরম বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়া কারও নার্ভ এমন হতে পারে তা অকল্পনীয় তার কাছে।

আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় কিছু দূর সামনে রাস্তার ‍উপর আগুন জ্বলে উঠল।

মাথার উপরের হেলিকপ্টার সামনে চলে গিয়েছিল।

‘রাস্তার উপরে হেলিকপ্টার থেকে আগুনে বোমা ছুড়ে সামনে এগোবার রাস্তা ওরা বন্ধ করে দিল।’ আহমদ মুসা বলল।

‘সর্বনাশ! এখন তাহলে উপায়?’ বলল অ্যানজেলা।

‘আমি একটা অনুরোধ করবো মিস অ্যানজেলা।’ আহমদ মুসা বলল।

‘বলুন।’ অ্যানজেলা বলল।

‘প্লিজ, আমাকে ড্রাইভিংটা দিন। বিপদ আমাদের সকলের। কিন্তু তারা ধরতে চায় শুধু আমাকেই। সুতরাং বাঁচার একটা পথ আমাকে করতে হবে। ভয় নেই, আমি ভালো ড্রাইভ করি। আপনাদের অন্তত কোন বিপদ হতে দেব না।’ বলল আহমদ মুসা।

অ্যানজেলা মুখ ‍ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার যে মুখ সে দেখল তা স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবি। অ্যানজেলার মন বলল, ‘তাঁর পরিচয় যাই হোক তাঁর উপর সবকিছুর জন্যে নির্ভর করা যায়।

‘বেশ আসুন।’ বলে গাড়ি অটোড্রাইভে দিয়ে পাশের আসনে সরে গেল অ্যানজেলা।

আহমদ ‍মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।

এ সময় পেছন থেকে আরেকটা হেলিকপ্টারের শব্দ পাওয়া গেল।

‘মি. শ্যালন হার্স, মিস অ্যানজেলা আগে যাওয়ার পথ বন্ধ, পেছনে ও সামনের আকাশে হেলিকপ্টার এবং রাস্তায় দু’টি গাড়ি আমাদের দিকে ধেঁয়ে আসছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমরা তো তাহলে ধরা পড়ে যাচ্ছি।’ অ্যানজেলা বলল। আর্ত চিৎকারের মতো শোনাল তার কণ্ঠ।

‘মিস অ্যানজেলা, মি. শ্যালন, আমি গাড়ি স্লো করছি, আপনারা নেমে পড়ুন।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।

‘আর আপনি?’ বলল অ্যানজেলা উদ্বেগ ভরা কণ্ঠে।

‘সামনে নদীটার একটা খাড়ি পঁচিশ ত্রিশ গজ ভেতরে ঢুকে গেছে। রাস্তা এখানে ‘ইউ শেপড’। এ রাস্তাটা নদীর পাড় ঘেঁষে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। আপনার এই গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করে নদীতে গিয়ে পড়বে। আপনারা ওদের বলবেন, আপনাদের নামিয়ে দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট করে আমি নদীতে পড়ে গেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘না, এটা হবে না। আমরা নামব না। আপনি ধরা দিন, আমি আপনাকে বাঁচিয়ে নেব। আপনি এভাবে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে পারেন না।’ চিৎকার করে বলল অ্যানজেলা।

‘প্লিজ শুনুন। আপনার দামি গাড়ির কিছূ ক্ষতি হতে পারে। তবে এ উভচর গাড়ি পানি থেকে তুলে আবার চালাতে পারবেন। আর আমি মরব না, বাঁচার চিন্তা করেই এই প্ল্যান আমি করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিভাবে বাঁচবেন? এটা বাস্তব নয়। আপনি….’

অ্যানজেলাকে বাধা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘প্লিজ মিস অ্যানজেলা। সময় হাতে নেই। আমি আবার ওদের হাতে পড়তে চাই না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুতর সিকিউরিটি সংক্রান্ত একটা তথ্য আমি পেয়েছি। আমার অতিসত্বর মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন।’ অনেকটাই সিদ্ধান্তের সুর ধ্বনিত হলো আহমদ মুসার কণ্ঠে।

অ্যানজেলা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল আহমদ মুসার গম্ভীর ও শক্ত মুখ। আর চোখে পবিত্রতা ও বিশ্বাসের সম্মোহনকারী আলো। তার আবারও মনে হলো, লোকটির কথার প্রতিটি বর্ণ সত্য। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটির কথা শুনে একেবারেই থমকে গেছে সে।’

সম্মোহিত নরম কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, ঠিক আছে, আমরা নেমে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা, নদীতে পড়লেই কিন্তু আপনি নিরাপদ নন। গোটা নদী ওরা চষে ফেলবে হেলিকপ্টার, বোট ও ডুবুরী লাগিয়ে।’

‘চিন্তা করবেন না। যত বিপদ, বিপদ মুক্তির পথও ততটাই। আর সব ঘটনার একজন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক আছেন। তিনি আল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।

আকস্মিকভাবে গাড়ি স্লো হয়ে গেল। অ্যানজেলা এবং শ্যালন হার্স এক সাথেই চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।

তারা নামতেই গাড়ি তীরের মতো সামনে এগিয়ে চলল।

‘এস শ্যালন, আমার বুক কাঁপছে। আমাদের তো কিছুই করার নেই। অন্তত চল দেখি গিয়ে কি ঘটছে। ‘ বলল অ্যানজেলা।

ছুটতে লাগল অ্যানজেলা গাড়ির পিছু পিছু। তার পেছনে শ্যালন হার্সও।

তারা যখন নদীর ধারে রাস্তার বাঁকটায় পৌছল, দেখতে পেল শান্ত নদীর বুক। নদীতে ভাসছে গাড়ি। খাড়ির ওপাশ থেকেও দু’জন লোক তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ওরা নিশ্চয় দেখেছে গাড়িটিকে নদীতে পড়তে। মাথার উপরে দু’টি হেলিকপ্টারও এসে স্থির হয়েছে এ গাড়িটার উপর। পেছনের দু’টি গাড়িও এসে দাঁড়াল তাদের পেছনে।

পার্বত্য নদীটা খুব প্রশস্ত নয়।

খরস্রোতা হলেও স্রোতের অনুকুলে চলে নদীর ওপাড়ের ছড়াটায় পৌছতে আহমদ ‍মুসার খুব অসুবিধা হয়নি।

ছড়াটার মুখে পৌছে আহমদ মুসাকে একবার মাথা পানির উপর তুলতে হয়েছিল শ্বাস নেয়ার জন্যে। কিন্তু সেদিকে কারও চোখ যায়নি। হেলিকপ্টার ও নদীর পাড়ে যে কয়জন ছিল তাদের চোখ নিবদ্ধ ছিল গাড়ির দিকে ও নদীর উপর। আহমদ মুসা এমনটাই আশা করছিল।

দ্বিতীয় ডুব দিয়ে ছড়ার অনেক ভেতরে ঢুকে গেল আহমদ মুসা।

ছড়াটা আধা মাইলের মতো ভেতরে ঢুকে গেছে। তিনদিকেই খাড়া পাহাড়।

কিন্তু সব পাশ সমান উঁচু নয়।

পাহাড়ের মাথায় সবুজ বন।

বড় ব্ড় গাছও দেখা যাচ্ছে।

তিন দিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না মিলে হৃদের মতো এই খাড়ির সৃষ্টি করেছে। খাড়িটা নদীর সাথে মিশেছে। খাড়িটা গভীর।

আহমদ মুসা সাঁতরে শেষ প্রান্তে গিয়ে কুলে উঠল।

পানি পড়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে খাঁজের সৃষ্টি করেছে। খাঁজগুলো দেখতে প্ল্যাটফরমের মতো। ডান পাশটায় বড় একটা প্ল্যাটফরমের মতো দেখে সেখানেই উঠল আহমদ মুসা। প্ল্যাটফরমে উঠে বসে বিস্মিত হলো সে। প্ল্যাটফরমটা ভিজা বটে, কিন্তু তেমন একটা শেওলা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে-জুনে এমনটা কল্পনা করা যায় না।

একটু জিরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা সামনে পাহাড়ের দিকে তাকাল। একদম খাড়া পাহাড়। এই পাহাড় ডিঙিয়ে তাকে উপরে উঠতে হবে। কিভাবে উঠবে? একে খাড়া, তার উপর পিচ্ছিল।

ওদিকে আশার কিছু না দেখে আহমদ মুসা ঘুরে বসে পেছনে পাহাড়ের দেয়ালের দিকে তাকাল। প্রায় হাতের নাগালের কাছে ওপর থেকে কয়েকটা শিকড় নেমে এসেছে দেখল। উপরে তাকিয়ে দেখল পাহাড়ের শীর্ষে অচেনা এক বিশাল বৃক্ষ। তারই কয়েকটা শিকড় নিচে নেমে এসেছে। সম্ভবত পাহাড়ের গা ক্ষয়ে যাওয়ায় শিকড় কয়েকটা আলগা হয়ে পড়েছে।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

এগোলো শিকড়ের কাছে। হাত লাগাল শিকড়ে। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্ল্যাটফর্মের মতোই শিকড় একেবারে মসৃণ এবং প্রায় শেওলামুক্ত। উপরে তকিয়ে মোটা শিকড়ের সবটাই এ রকম মসৃণ মনে হলো।

কিন্তু প্ল্যাফরম ও শিকড় এমন শেওলা মুক্ত কেন?

শিকড়ের কাছ থেকে সরতে গিয়ে আহমদ মুসা নিচের পাথরের উপর চোখ পড়তেই সুতার মতো প্লাস্টিকের খণ্ড দেখতে পেল।

খণ্ডটা হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। নেড়ে-চেড়ে দেখে বুঝল প্লাস্টিকের দড়ির অংশ, কোনওভাবে দড়ি থেকে খসে পড়েছে।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। তার মানে মানুষ এখানে এসেছে বা আসে? এই শিকড় দিয়েই কি তারা নামে? এই প্ল্যাটফরম কি তারাই ব্যবহার করে? কিন্তু কষ্টকর শিকড় ব্যবহার করে কেন, প্রাচীন যুগের মানুষের মতো? আধুনিক মানুষের কাছে তো অনেক রকম ব্যবস্থা রয়েছে।

আহমদ মুসা তার মনের এই প্রশ্নের কোন সমাধান পেল না।

তবে খুশি হলো আহমদ মুসা। উপরে উঠার একটা অবলম্বন সে পেয়ে গেল।

শিকড় বেয়ে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। বিশার গাছ।

শিকড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে, গাছের গোড়াটাও বেশ বিস্তৃত হবে।

উপরের মাথায় পৌছে গেছে আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার মনে নানা প্রশ্ন কি আছে উপরে? যারা উঠা-নামা করে তাদের কেউ থাকে এখানে? কারা ওরা? কোন কালোবাজারি? কোন ভয়ংকর ধরনের ক্রিমিনালদের গোপন আস্তানা? যারাই হোক ভালো মানুষ হবে না তারা। অথবা হতে পারে এখানে কেউ থাকে না। এ গোপন পথে উঠে দূরে অন্য কোথাও যায়।

আহমদ মুসা শিকড় বেয়ে গাছের গোড়ার প্যারালালে এসে দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা তুলল উপরে দেখার জন্যে।

উপরে চোখ পড়তেই আকস্মিক বিপদের একটা গরম স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার শরীরে। দেখল সে, মুখোশ পরা তিনজন মানুষ। তাদের রিভলবার তাক করা আহমদ মুসার দিকে।

ওদের আকার-আকৃতি ও পোশাক দেখে বুঝল আহমদ মুসা ওদের একজন বয়ষ্ক, একজন যুবক ও একজন তরুণী।

আহমদ মুসা এক হাতে ভর দিয়ে মাথা ‍উপরে তুলেছিল। ঐ অবস্থাতেই আহমদ মুসা পা’দুটিকে গুটিয়ে তুলে নিয়ে প্রথমে শিকড়ের উপর বসল এবং ওদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা কে আমি জানি না? কিন্তু আমি আপনাদের শত্রু নই।’

‘তাহলে এখানে কেন এসেছেন?’ পরিষ্কার উচ্চারণে বলল বয়ষ্ক লোকটি।

‘আমি এখানে আসিনি, ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। উপরে উঠে সমভূমিতে, মানে কোন রকমে রাস্তায় পৌছার একটা পথ পাব, এই আশায় এখানে উঠেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘মিথ্যা বলবেন না। সমভূমি থেকে উঠে এলেন দুর্গম পাহাড়ে সমভূমিতে নামার জন্যে, এটা হাস্যকর।’ সেই বয়ষ্ক লোকটিই বলল।

‘হ্যা, কথাটা হাস্যকরই মনে হচ্ছে। আসলে ঘটনাটা হলো, তাড়া খেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। নদী নিরাপদ নয় ভেবে ওদের চোখ এড়িয়ে খাড়িতে প্রবেশ করি। তারপর নিরাপদ সরে পড়ার পথের খোঁজেই গাছের শিকড় বেয়ে উপরে উঠেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনি কে? কে বা কারা কেন আপনাকে তাড়া করেছে?’ সেই বয়ষ্ক মানুষটি বলল।

‘সবই জানতে পারবেন। সব কথা এখনই কি না জানলে নয়? আমার এই কথাগুলি যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে ঐ কথাগুলো শুনলেও কোন লাভ হবে না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনাকে দেখে মনে হয় বিশ্বাস করা যায়। কথাও মনে হচ্ছে সাজানো নয়। ‘

বলেই বয়ষ্ক লোকটি যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেটা, যাও ওকে সার্চ করো।’

যুবকটি তার হাতের রিভলবার বয়ষ্ক লোকটির হাতে দিয়ে আহমদ মুসার কাছে এলো।

আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল এবং মাথার উপরে হাত তুলল সার্চের সুবিধার জন্যে।

আহমদ মুসাকে সার্চ করে কিছুই পেল না।

‘ঠিক আছে বাবা, সাথে কিছুই নেই। টাকা-পয়সার মতোও কিছু নেই বাবা।’ বলল যুবকটি তার বাবাকে লক্ষ করে।

‘ধন্যবাদ জনাব, আসুন।’ বলল বয়ষ্ক লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে। তার চেহারা এখন অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ তার কেটে যাচ্ছে। সে ভাবছিল, শত্রু কেউ এভাবে একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আসতে পারে না। কিন্তু একটা বিস্ময় তার যাচ্ছে না। সেটা হলো, শিকড় বেয়ে এই উপরে উঠার এই পথের সন্ধান পেল কি করে লোকটি? এই রকম ভাবতে গিয়ে তার মনে হলো, লোকটি অসাধারন বুদ্ধিমান শুধু নয়, অত্যন্ত কুশলী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নও। আমাদের তিনটি রিভলবারের মুখে অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক ছিল সে। এমনটা সাধারণভাবে থাকা খুবই অস্বাভাবিক।

আহমদ মুসা গাছের গোড়া থেকে নেমে বয়ষ্ক লোকটির দিকে আসছিল।

আহমদ মুসা পানি থেকে উঠে এসেছে। তার পরনের কাপড়-চোপড় সব ভিজা। শরীরকে হাল্কা ও দ্রুত করার জন্য জ্যাকেট ও জুতা নদীতেই খুলে রেখে এসেছিল।

বয়ষ্ক লোকটি তাকাল তার পাশের তরুণীটির দিকে। বলল, ‘মা তুমি যাও। ওর পরনের মতো এক প্রস্থ কাপড় নিয়ে এসে। উনি ভিজা কাপড়ে আছেন।’

‘মেয়েটি তার হাতের রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে রেখে চলল পেছনের ঝোঁপের দিকে।

যেখানে বৃদ্ধরা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা পাহাড়ের স্বল্প-পরিসর একটা চত্বর। ছোট-খাট আগাছায় ভরা। কিন্তু তার পেছনেই ঘন ঝোঁপ এবং অপেক্ষাকৃত বড় গাছের ঘন বন। তার পেছনেই খাড়া পাহাড়। পাহাড়ও গাছ-গাছড়ায় ঢাকা। আর বারান্দার মতো চত্বরটার সামনে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে সেই খাড়ির পানি পর্যন্ত। সব মিলিয়ে জায়গাটা এমন যে এখানে মানুষের বসবাস কল্পনা করা যায় না। তাহলে এরা থাকেই বা কোথায়? এদিকে গভীর খাদ, আর ওদিকে খাড়া এবং অনেক উঁচু পাহাড়। মাঝখানে এই অল্প জায়গায় তো বাড়ি-ঘরের কোন চিহ্ন নেই।

আহমদ মুসা বয়ষ্ক লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে বলল, ‘যুবক, আমি নুহা ইউসেফ। তোমাকে সাথে নিয়ে এল সে আমার বড় ছেলে ডেভিড। আর যে মেয়েটিকে দেখলে সে আমার একমাত্র মেয়ে মারফি। তুমি….।’

কথা শেষ করতে পারল না নুহা ইউসেফ, বয়ষ্ক সেই লোকটি।

ঝোঁপের দিক থেকে ছুটে এল বয়ষ্ক লোকটির সেই মেয়ে, মেরি মারফি। তার হাতে প্যান্ট, শার্ট।

কিন্তু কাপড়ের প্রসঙ্গে না গিয়ে মেরি মারফি দ্রুত কণ্ঠে বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘বাবা, তোমার রিভলবারটা দেখতো লাইভ আছে কি না?

নূহা ইউসেফের চোখে-মুখে বিস্ময়! মেয়ের দিকে একবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করল।

রিভলবারটা সাধারণ নয়, লেজার ফায়ারড রিভলবার। এখানে রিভলবারের শব্দ নিরাপদ নয়, এজন্য নিঃশব্দ অথচ ভয়ংকর অস্ত্র তারা ব্যবহার করে। রিভলবার হাতে নিয়েই রিভলবারের দিকে তাকিয়ে নুহা ইউসেফ বলল, ‘না মারফি রিভলবার ডেড।’

‘হ্যাঁ বাবা, শুধু আমাদের রিভলবার নয়, আমাদের ইলেক্ট্রনিক সবকিছু অকেজো হয়ে পড়েছে।’ বলল মেরি মারফি।

‘তাহলে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আজ আবার?’ নূহা ইউসেফের ছেলে ডেভিড বলল।

‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। কিন্তু এমন হচ্ছে কেন?’ বলল নুহা ইউসেফ। তার কণ্ঠ শুকনো।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। চট করে আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল ‘ফোম’ নামের গোপন সংগঠনটির গবেষণা উইং এইচ কিউব-এর ম্যাগনেটিভ ডেথ ওয়েভ-এর কথা, যা ইলেক্ট্রনিক ও প্রক্রিয়াজাত ম্যাটারের যে কোন বিস্ফোরণধর্মী অস্ত্রসহ সব যন্ত্রপাতি অচল করে দিতে পারে। কিন্তু তাদের এই অস্ত্র তো ব্যবহার উপযোগী হয়নি। আবার ভাবল আহমদ মুসা, তা ছাড়া অন্য কারনেও তো এদের এখানে এমনটা ঘটতে পারে। তবে ব্যপারটা তার দেখা দরকার।

‘জনাব, আমার খুব বিস্ময় লাগেছে ! আমি কি দেখতে পারি কি কি জিনিস অচল হয়ে পড়েছে?’ বয়স্ক লোক নুহা ইউসেফের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।

‘হ্যাঁ যুবক, ব্যাপারটা বিস্ময়ের ! অবশ্যই আপনি দেখতে পারেন। কিন্তু তার আগে শুকনো কাপড় পরে নিন।’ বলল নুহা ইউসেফ।

মারফি তার হাতে নিয়ে ডেভিড আহমদ মুসাকে বলল, ‘আসুন।’

মারফি যে দিকে গিয়েছিল, ডেভিড আব্রাহাম সেদিকে নয়, অন্যদিকে চলল। লব্মা লব্মা গাছের ভেতর দিয়ে কিছু ঝোপ-জঙ্গল এড়িয়ে এগিয়ে খাড়া পাহাড়ের গোড়ায় পৌছল।

পাহাড়ের দেয়াল এখানে মোটামুটি মসৃণ। ডেভিড সামনের দেয়ালের এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো। দেয়ালটা এক জায়গায় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাম দিকে স্লাইড করল।

সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে একটা অংশ সরে গেল। একটা দরজা উন্মুক্ত হয়ে পড়ল।

ভেতরটা আলোক ‍উজ্জল।

ডেভিড আব্রাহাম। ভেতরে ঢুকল। বলল, ‘আসুন স্যার।’

আহমদ মুসা মনে করেছিল ভেতরটা একটা গুহা। কিন্তু গুহার চেয়ে ভালো কিছু। ভেতরটা আয়তাকার কক্ষ। দেয়ালটা মোটামুটি মসৃণই। ঘরে শোবার একটা খাট এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রয়েছে।

‘ডেভিড, শুনলাম ইলেকট্রনিক সব ম্যাকানিজম নষ্ট হয়ে গেছে! এ ঘরে যে আলো দেখছি?’ বলল আহমদ মুসা।

‘এটা গ্যাস বাল্ব স্যার।’

কথাটা শেষ করেই ডেভিড বলল, ‘স্যার, আপনি কাপড় পাল্টে নিন। আমি আসছি।’

কাপড় আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বেরিয়ে এল ডেভিড।

ভিজা কাপড় ছেড়ে ওদের শুকনো কাপড় পরে আহমদ মুসা ঘরের চারদিকে তাকাল। ঘরে ইলেকট্রনিক বা মেটালিক কিছুই দেখল না।

দরজায় নক করল আহমদ মুসা। ঘরে প্রবেশ করল যুবক ডেভিড। বলল, ‘আসুন।’

আহমদ মুসা ও ডেভিড বেরিয়ে এসে ডেভিডের পিতা নুহা ইউসেফ এর সামনে দাঁড়াল।

‘চলুন দেখি কি ঘটেছে, কি দেখতে চান।’ বলল নুহা ইউসেফ।

হাঁটতে শুরু করেছে নুহা ইউসেফ। তার পেছনে পেছনে আহমদ মুসা এবং আহমদ মুসার পেছনে ডেভিড ও মারফি।

স্লাইডিং দরজা ঠেলে একটা ঘরে প্রবেশ করল নুহা ইউসেফ। পেছনে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন, এটা আমাদের ইনফরমেশন এন্ড কম্যুনিকেশন রুম।’

ঘরটির দেয়াল বরাবর স্থান আলমারিতে ঠাসা। সারি সারি বই। ঘরের একপাশে দেয়ালের সাথে পাতা টেবিল বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। আর ঘরের মাঝখানে কয়েকটা চেয়ার এবং স্টাডি টেবিল।

‘জনাব বিদ্যুতের জন্য এখানে আমাদের নিজস্ব জেনারেটর আছে, গ্যাস সিলিন্ডারও আছে বিকল্প জ্বালানির জন্যে। আর আছে আমাদের নিজস্ব ওয়্যারলেস। আমাদের নিজস্ব ওয়েভ লেংথে আমাদের ওয়্যারলেস চলে। আমরা মোবাইল, টেলিফোন কিছুই ব্যবহার করি না। যোগাযোগর কাজ ওয়্যারলেসে চলে।’

একটু থামল নুহা ইউসেফ। পর মুহূর্তেই বলে উঠল, ‘আসুন, দেখুন সব কিছুই এখন অচল। আমাদের গ্যাস ব্যবহার সিস্টেমটা গোটাটাই প্লাস্টিকের বলেই আলো জ্বলছে। ইলেকট্রনিক, মেটারিক সবকিছুই এখন বিকল।’

আহমদ মুসা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। মেশিনগুলো স্পর্শ করে দেখল, কোন কোনটা খুলেও ভেতরটা দেখল। মেশিনগুলো যেন নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুটে খুটে দেখছিল আহমদ মুসা সব কিছু। মগ আকৃতির অনুচ্চ একটা পাথরের বাটির উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। তাতে দেখতে পেল কিছু আয়রন ডাস্ট। সে আরও দেখল, আয়রন ডাস্ট বাটির এক দিকে সুন্দরভাবে সরে এসেছে। আয়রন ডাস্টের সরে আসাটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল আহমদ মুসার। সরে আসাটা একদমই প্রাকৃতিক ধরনের, যেমন মরুভুমিতে বাতাসে বালির সরে যাওয়া। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। কিভাবে এমনটা ঘটল? বাতাসের ধাক্কা কিংবা অন্য কোনভাবে তো এটা সম্ভব নয়।

আহমদ মুসা তাকাল নুহা ইউসেফের দিকে। ডাকল তাকে।

নুহা ইউসেফ এল। তার সাথে এল ডেভিড আর মারফিও। আহমদ মুসা পাথরের বাটিটাকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল, সেটা তারাও খেয়াল করেছিল।

নুহা ইউসেফ কাছে এলে আহমদ মুসা বাটির আয়রন ডাস্টে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন, বাটির আয়রন ডাস্ট এভাবে বাটির এক প্রান্তে এল কি করে?’

নুহা ইউসেফ ওদিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, ‘আজ সকালেই আয়রন ডাস্ট বাটিতে ঢেলেছি। এমন তো ছিল না! কিন্তু আপনি এটা জানতে চাচ্ছেন কেন?’

আহমদ মুসা নুহা ইউসেফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আরেকটা জিনিস দেখুন মি. নুহা ইউসেফ। আমার মনে হচ্ছে আয়রন ডাস্টগুলো যেন সংকুচিত হয়ে গেছে। ডাস্টের যে ধারালো ক্যারেকটার থাকে তা নেই।’

নুহা ইউসেফ আয়রন ডাস্টে হাত দিয়ে দেখল। সত্যি ডাস্ট কণাগুলো আরও ছোট, আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। আর সত্যি মসৃণও হয়ে গেছে সেগুলো। যেন সেগুলো একটা প্রচণ্ড চাপে ডাস্ট-বল হয়ে গেছে। বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নুহা ইউসেফের ‍মুখ।

‘কিছুই বুঝতে পারছিনা জনাব। ডাস্টগুলোর এক প্রান্তে সরে আসা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিস্ময়কর ডাস্ট বলগুলো সংকুচিত হওয়া। কিন্তু এ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন। বিষয়টি আমার হয়তো নজরেই পড়তো না, আপনার নজরে পড়ল কেন?’ বলল নুহা ইউসেফ।

ভাবছিল আহমদ মুসা।

কিছুক্ষণ আগের সেই চিন্তাটআবার মাথায় এসে ভর করেছে। ওরা কি ‘কিং পিন’ কোনওভাবে পেয়ে গেছে, কিংবা তারা নিজেরাই তৈরি করেছে ফেলেছে? সে ওদের হাতছাড়া হওয়ার পর নিশ্চয় আতংকিত হয়ে পড়তে পারে যে, তাদের সব পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যেই ত্বরিৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই চিন্তা আতংকিত করে তুলল আহমদ মুসাকে। তাহলে তারা কি ব্যবহার করেই ফেলেছে তাদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভকে? নুহা ইউসুফের প্রশ্ন কানেই যাইনি আহমদ মুসার।

আহমদ মুসা দ্রুত ফিরে তাকালো নুহা ইউসেফের দিকে। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আপনাদের ওয়্যারলেস তো অকেজো। কোনওভাবে কি শহরের কারও সাথে যোগাযোগ করা যায়?’

আহমদ মুসার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উত্তেজনা।

আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে নুহা ইউসেফ, ডেভিড ও মারফি সবার চোখে-মুখে বিষ্ময় ফুটে উঠল। তারা বুঝতে পারল না এমন ছোট একটা বিষয় নিয়ে তাদের মেহমান এতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কেন?

‘ওয়্যারলেস বন্ধ। আর কোন পথ নেই বাইরে যোগাযোগের। কিন্তু কেন, কি দরকার আপনার? আপনাকে উদ্বিগ্নও মনে হচ্ছে। কি ঘটেছে?’ বললু নুহা ইউসেফ।

আহমদ মুসার হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল এই ম্যাগনেটিক প্রভাব আগেরবার কতক্ষণ ছিল?

সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, ‘আগের বার আপনাদের ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা কতক্ষণ ছিল জনাব?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা নুহারে উদ্দেশ্যে।

‘মিনিট দশেকের মতো।’ বলল নুহা ইউসেফ।

‘তাহলে ওটা টেস্ট কেস ছিল।’ ভাবল আহমদ মুসা।

এবারেরটাও কি টেস্ট কেন হতে পারে? মিনিট পাঁচেক ইতিমধ্যে চলে গেছে। আর পাঁচ মিনিট পরে হয়তো জানা যাবে এটাও টেস্ট করেছে কিনা। আশা জাগল মনে, সে যে আশংকা করছে তা সত্য নাও হতে পারে। এই সাথে আরও একটা প্রশ্ন জাগল মনে, এটাও যদি একটা টেস্ট কসে হয়ে থাকে, তাহলে কেন এই দ্বিতীয় টেস্ট?

‘জনাব এর আগে একবার আপনাদের ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি বিকল হয়েছিল। তার সাথে বর্তমানে বিকল হওয়ার কোন পার্থক্য দেখছেন কি?’ বলল আহমদ মুসা।

ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠল নুহা ইউসেফের চোখে-মুখে। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘হ্যাঁ জনাব। একটা পার্থক্য ইতিমধ্যেই আমার চোখে পড়েছে। এবার মেটালের আয়তন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। রিভলবারের ট্রিগার থেকে আয়রন ডাস্ট পর্যৃন্ত। কিন্তু জনাব এ বিষয়টা কি, কেন? মনে হচ্ছে বিষয়টাকে আপনি সিরিয়াসলি নিয়েছেন। প্লিজ বলুন, বিষয়টা কি?’ বলল নুহা ইউসেফ।

কথা শেষ হতেই তার চোখ গিয়ে আবার আটকে গেল আয়রণ ডাস্টের উপর। সে দেখল সংকুচিত আয়রণ ডাস্টগুলো আবার স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসছে। সংগে সংগেই সে বলে উঠল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, ‘দেখুন জনাব, আয়রণ ডাস্টগুলো স্বাভাবিক আকারে ফিরে এসেছে।’

আহমদ মুসা হাত দিয়ে নেড়ে দেখে বলল, ‘তােই তো ডাস্টগুলো তাদের আকার ফিরে পেয়েছে। দেখুন তো প্লিজ, আপনাদের রিভলবার, ওয়্যারলেস সক্রিয় অবস্থায় ফিরেছে কিনা। নিশ্চয় ফেরার কথা।

ডেভিড রিভলবার ও ওয়্যারলেস পরীক্ষা করে বলল, ‘না জবান, এগুলো এখনও সক্রিয় হয়নি। তবে সঙ্কুচিত সেই আকার এখন নেই।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। এ রকম হওয়ার অর্থ ! এক সাথেই সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার কথা।

চিন্তা করে কোন উত্তর এই মুহূর্তে পেল না আহমদ মুসা। চিন্তাতা আপাতত বাদ রেখে ফিরে এল নুহা ইউসেফের প্রশ্নে, ভাবল একটু আহমদ ‍মুসা। বলল, ‘বাইরে থেকে আসা ম্যাগনেটিক প্রভাবে এটা ঘটেছে।’

‘ম্যাগনেটিক প্রভাব? ইলেকট্রিক ও মেটালিক সব যন্ত্রপাতি অচল করে দিতে পারা এই ম্যাগনেটিক প্রভাব কোত্থেকে এল?’ বলল নুহা ইউসেফ। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘এসব কথা পরে হবে জনাব। দশ মিনিট নিশ্চয় হয়ে গেছে। আপনি প্লিজ দেখুন ওয়্যারলেস চালু হয়েছে কি না।’ আহমদ মুসা বলল।

নুহা ইউসেফ কিছু করার আগেই মারফি দ্রুত গিয়ে ওয়্যারলেস পরীক্ষা করে বলল, হ্যাঁ জনাব, ওয়্যারলেস চালু হয়েছে।’

তার মানে এবারও তারা দশ মিনিট পরেই ম্যাগনেটিক ওয়েভ অফ করেছে। আহমদ মুসা বলল, ‘ওয়াশিংটনের অন্য কোন এলাকায় প্লিজ ওয়্যারলেস করে একটু জানুন ঐ অঞ্চলে আজ ইলেকট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি অচল হয়েছিল কিনা এবং এর আগে কখনও অচল হয়েছে কিনা। হয়ে থাকলে দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল কিনা?’

নুহা ইউসেফ আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু কোন প্রশ্ন না তুলে ডেভিডের দিকে চেয়ে বলল, ‘ডুপন্টে ওয়্যারলেস করো। ওটা কেন্দ্র এলাকা। দেখ কিছু ঘটেছে কিনা। তিনটা প্রশ্ন বুঝেছ তো?’

‘ইয়েস ড্যাড। আমি দেখছি।’

ডেভিড এগোলো ওয়্যারলেসের দিকে।

ওয়্যারলেস অন করে ডেভিড বলল, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে বাবা।’

বলে কল করল ডেভিড।

ওপারের সাথে ডেভিড আহমদ মুসার তিনটি প্রশ্নই তুলে ধরল।

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আমাদের এক আত্মীয়ের কাছে ওয়্যারলেস করেছিলাম। সে জানাল তাদের ইলেকট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি আজ অচল হয়নি, অতীতেও কোন সময় এক সাথে অচল হয়নি।’

‘হ্যাঁ, বুঝেছি ডেভিড।’ আনমনা কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। রাজ্যের চিন্তা এসে তার উপর চেপে বসল। তার অজান্তেই যেন তার কণ্ঠ থেকে স্বগত উক্তির মতো বেরিয়ে এল, ‘ওরা নির্দিষ্ট এলাকায় তাহলে লিমিটেড টেস্ট করেছে। হৈ চৈ ও তাদের সন্ধান এড়াবার জন্যে এর প্রয়োজন ছিল নিশ্চয়।’

আহমদ মুসা গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল।

আহমদ মুসার স্বগতোক্তিগুলো নুহা ইউসেফ, ডেভিড, মারফি সবারই কানে গিয়েছিল। কথার কিছুই বুঝতে পারল না। কিসের টেস্ট? কিসের হৈ চৈ? কার সন্ধান?

‘কি বলছেন স্যার, কিছুই বুঝতে পারছি না!’ বলল ডেভিড। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

আহমদ মুসা সম্বিতে ফিরে এল। তাকাল ডেভিডের দিকে। বলল, ‘ডেভিড, তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। তার আগে আমার একটা জিজ্ঞাসা।’

‘কি জিজ্ঞাসা?’ বলল নুহা ইউসেফ।

‘আপনারা কে? কেন এখানে?’ আহমদ মুসা বলল।

নুহা ইউসেফরা তিনজন পরস্পরের দিকে চাইল। তাদের সকলেরই চোখে-মুখে অস্বস্তি।

তারা কেউই কথা বলতে পারল না।

‘আমি জানি, আপনারা নামে নুহা ইউসেফ, ডেভিড হলেও আপানারা মুসলিম। কিন্তু আপনারা এখানে কেন? এমন বিচ্ছিন্ন, গোপন বনবাসী জীবনে কেন?’ আহমদ মুসা।

ভয়-বিস্ময়ে নুহা ইউসেফদের সকলের মুখ হা হয়ে গেছে। কোন অপরাধী আকস্মিকভাবে ধরা পড়ে গেলে যে অবস্থা হয়, অনেকটা সে রকম। সম্ভবত তারা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।

মারফিই মাথা তুলল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কেন আমাদের মুসলিম বলছেন? কেন এটা আপনার মনে হলো স্যার?’ ভারি, কম্পিত কণ্ঠস্বর মারফির।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পোষাক পাল্টানোর জন্য তোমাদের যে ঘরে ঢুকেছিলাম, সেখানে নামাজের বিছানা দেখেছি। তাছাড়া তোমাদের ওয়্যারলেসের বেজ প্লেটে দেখ আরবীতে বিসমিল্লাহ লেখা।’

মারফিরা সবাই স্তম্ভিত, বিব্রত। তাদের কারও মুখে কোন কথা নেই।

আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল আহমদ মুসা নুহা ইউসেফকে লক্ষ করে, ‘আপনাদের অস্বস্তির কোন কারণ নেই। আমিও মুসলিম। আপনারা মুসলিম জেনে খুশি হয়েছি।’

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সংগে সংগে নুহা ইউসেফরা ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার !’ ধ্বনি দিয়ে উঠল।

নুহা ইউসেফ এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আমার নাম নুর ইউসুফ। আমার ছেলে ডেভিডের নাম দাউদ ইব্রাহিম ও মেয়ের নাম মরিয়ম মারুফা। এখন আপনি কে বলুন। কেন এখানে এসেছেন এভাবে? আপনাকে তো আমেরিকান বলে মনে হচ্ছে না।’

‘আমার প্রশ্নের আর এক অংশের জবাব এখনও পাইনি জনাব। বলুন, আপনারা এভাবে বনবাসে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘বুঝেছি, আমাদের সব বিষয় না জেনে কিছুই বলবেন না।’

বলে থামল নুর ইউসুফ। মাথা নিচু করল।

বোধ হয় একটু আত্মস্থ হবার চেষ্টা করল।

মুহূর্ত কয়েক পরে মাথা তুলল নুর ইউসুফ। বলতে শুরু করল: ‘আমি মৃত্যুদন্ডের একজন পালাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে এখানে বাস করছি। পুলিশের হাজতখানা ভেঙ্গে সেই ২৫ বছর বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছিলাম। সেই থেকে আমার এখানে বাস।’

একটু থামল নুর ইউসুফ।

‘অপরাধী হলে দণ্ড ভোগ করতেই হয়, পালালেন কেন আপনি? একজন মুসলিমের তো এটা সাজে না। সংগে সংগে বলে উঠল আহমদ মুসা।

নুর ইউসুফ একটা শুকনো হাসি হাসল। বলল, ‘ধর্মের তখন আমি বেশি কিছু জানতাম না। কিন্তু অপরাধ করলে শাস্তি মেনে নিতে হয় এটা জানতাম। আসলে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা ছিল একটা ষড়যন্ত্র। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ নির্দোষ। কেন আমি সাজা মেনে নেব! কোন আমার সংসারকে বিরান হতে দেব!’

‘তাহলে সাজানো একটা বিচার হয়েছিল। অভিযোগটা কেমন ছিল?’ আহমদ মুসা বলল।

সংগে সংগে জবাব দিল না নুর ইউসুফ।

একটু সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল, ‘ওয়াশিংটনস্থ ‘ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট’ উড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্রের আমি ছিলাম বাস্তবায়নকারী। আমাকে হাতে-নাতে ধরা হয়েছিল বিস্ফোরক পাতার স্কেচ ও পরিকল্পনা সমেত।’

‘হ্যাঁ, ওটা এক সাংঘাতিক ঘটনা ছিল। বিশ্বব্যাপী এ ঘটনা ব্যপক প্রচার পেয়েছিল। প্রাণদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত মূল অপরাধী পালিয়ে যায়, এটা আমরা শুনেছিলাম, টিভিতে দেখেওছিলাম। ঠিক, মনে পড়েছে। পালিয়ে যাওয়া সেই অপরাধীর ছিল নুর ইউসুফ।’ আহমদ মুসা বলল।

‘হ্যাঁ, আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম। কিন্তু বিপদে পড়েছিল মার্কিন মুসলমানরা। ইউরোপেও টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর যা ঘটেছিল, তার চেয়েও বড় ঝড় বয়ে যায় মুসলমানদের উপর দিয়ে। অথচ আমার উপর আরোপিত অভিযোগ গোটাটাই ছিল সাজানো।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘কি ঘটেছিল? কেন আপনার উপর সাজানো কাহিনী চাপাল?’ আহমদ মুসা বলল।

‘ইন্ডিপেনডেন্ট মনুমেন্ট’ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামী বানানো হয়েছিল আমাকে। তিন গার্ড হত্যারও আমি একক আসামী।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘কিভাবে তারা আপনার উপর এই অভিযোগ সাজালো? কেন সাজাল?’ আহমদ মুসা বলল।

‘কেন সাজিয়েছিল এর উত্তর আমার এখনও জানা নেই। তবে সাজানো হয়েছিল।’

বলে একটু থামল নুর ইউসুফ। আবার শুরু করল, ‘অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে আমাকে ফাঁসানো হয়। আমার বিরুদ্ধে কেন এই ষড়যন্ত্র তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

আবার একটু থামল নুর ইউসুফ।

ভাবল একটু। গুছিয়ে নিল বোধ হয় কথা। পুনরায় শুরু করল, ‘ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট’- এর সিকিউরিটি টিমের আমি সদস্য ছিলাম। চার শিফটের মধ্যে একটা শিফটের ইনচার্জও ছিলাম আমি। আমাদের প্রতিটি শিফটে আমরা ২১ জন করে থাকি। এদের মধ্যে সাতজন বাইরে, পাঁচজন গ্রাউন্ড ফ্লোরে আর নয়জন উপরের বিভিন্ন ফ্লোরে দায়িত্ব পালন করে। মনুমেন্টের বেজে আরও তিনটি ফ্লোর আছে। কিন্তু সেখানে সিকিউরিটির লোক থাকে না। এগুলো প্রাত্যাহিক ব্যবহৃতও হয় না। এ তিনটি ফ্লোরই আসলে ছিল ইমারজেন্সি শেল্টার। পারমাণবিক বা এয়ার-রেইডের মতো আকস্মিক হামলার সময় ব্যবহারের জন্যে এ ফ্লোরগুলো নির্মিত। ফ্লোরগুলো বিশাল। মনুমেন্টের বিস্তৃতি ও সারিবদ্ধ পিলার বাদ দিলে ফ্লোরের গোটাটাই ফাঁকা। অবশ্য গোলাকার সীমানা দেয়ালের প্রান্ত বরাবর তিন ফ্লোর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ।

দর্শনার্থী ও পর্য্টকরা গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ উপরের সব অংশেই অবাধে যেতে পারে। বেজমেন্টের তিনটি ফ্লোরে তাদের যাবার অনুমতি নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পত্র কেউ পেলে তাদের বেজমেন্টের ফ্লোরগুলোতে যেতে দেয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা শিফটের প্রধানকে তাদের সাথে থাকতে হয়।

সেদিন ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সবে লাঞ্চ শেষ করেছি। টেলিফোন পেলাম সিকিউরিটি কলিগ ইভিনিং শিফটের ইনচার্জ সালেম সোলাংকির কাছ থেকে। বলল, ‘নুর, একটা বিপদে পড়েছি আমি। আজ ডিউটি করতে পারছি না। তোমার তো অফ ডে। প্লিজ তুমি আমার ডিউটিটা করে দাও।’

‘কিভাবে সম্ভব? অনুমতি কোথায়?’ আমি বললাম।

‘আমি মন্ত্রণালয় থেকে বলছি। তাদের আমি বলেছি। তুমি রাজী হলেই অনুমতি নিতে পারি।’ সালেম বলল।

আমার কিছু বলার আর উপায় ছিল না। রাজী হয়ে গেলাম।

ইভিনিং শিফট শুরু বিকেল ৫টা থেকে। শেষ হয় রাত এগারটায়।

পর্য্টক ও দর্শনার্থীদের জন্যে ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট খোলা থাকে রাত ৮টা পর্য্ন্ত। আমার ডিউটি চলছিল।

সন্ধ্যা ৭ টায় তিনজন দর্শনার্থী আমার কক্ষে এল। বলল, ‘আমরা মনুমেন্টের উপরটা সব দেখেছি, এখন বেজমেন্টের ফ্লোরগুলো দেখতে চাই।’

বলার পরে একটা কাগজ আমার দিকে তুলে ধরল। কাগজটা আমি নিয়ে দেখলাম বেজমেন্টের ফ্লোরগুলো দেখার অনুমতি পত্র।

আমি ওদের নিয়ে বেজমেন্টের ফ্লোরে নামতে গেলাম। মনুমেন্টের প্রবেশ পথেই সবার বডি চেক করা হয় বলে কাউকে চেক করার আর দরকার হলো না।

লিফটে উঠে ওরা বলল, ‘মি. নুর, আমরা বটম ফ্লোর থেকে দেখতে দেখতে উপরের দিকে উঠব।’

‘ঠিক আছে।’ আমি বললাম।

আমরা বটম ফ্লোরে নেমে গেলাম।

ফ্লোরটির মাঝখানে গিয়ে ওরা তিনজন দাঁড়াল।

আমিও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সংগে সংগেই ওদের তিনজনের একজন বলল, ‘আ-হা কি ভুল! লিফটে আমাদের টিফিন বক্সটা ফেলে এসেছি।’

আমিও তাকালাম সেদিকে। দেখলাম আয়তাকার সিংগল কেবিনের একটা ছোট টিফিন বক্স।

‘ঠিক আছে, আমি ওটা নিয়ে আসছি। আপনারা দেখতে থাকুন ফ্লোরটা।’ আমি বললাম।

‘অনেক ধন্যবাদ। ওটা এনে এখানেই রাখবেন। চারটি মূল মধ্য পিলারের মাঝখানে এই জায়গাটায় রাখবেন। এখানে আবার এসে নিয়ে যাব।’

ওরা এগোলো ফ্লোরের বিভিন্ন অংশ দেখার জন্যে।

ফেরার সময় মাঝখানের ঐ জায়গাটায় আবার আমরা এলাম।

ওদের একজন বলল, ‘চলুন, এখানে আর নয়। ওপরের ফ্লোরে উঠি।’ বলে টিফিন বক্সটি নেবার জন্যে নিচু হলো।’

আমি আগে হাঁটতে লাগলাম। ওরা পেছনে।

আমি লিফটের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওরা লিফটে ঢুকে দরজার সামনেই দাঁড়াল। লিফট উঠল পরের ফ্লোরে।

ওরা তিনটি ফ্লোরই দেখা শেষ করে ৮টা বাজার দশ মিনিট আগেই চলে গেল।

রাত ৯টার দিকে একদল পুলিশ এসে প্রবেশ করল ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্টে।

ওরা ঝড়ের বেগে এল এবং বেজ মেন্টের ফ্লোরে নেমে গেল। তাদের সাথে ছিল বিস্ফোরক ইউনিটের কয়েকজন।

ওরা মনুমেন্টে ঢুকেই ঘোষণা করেছে, তারা নির্দেশ না দেয়া পর্য্ন্ত কেউ মনুমেন্টে ঢুকতে পারবে না, বেরুতেও পারবে না। যে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

ঘণ্টাখানেক পরে ওরা বেজমেন্ট থেকে ফিরে এল।

নেতৃত্বদানকারী পুলিশ অফিসার সোজা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি নুর ইউসুফ?’

‘জি, হ্যা। আমি নুর ইউসুফ।’ আমি বললাম।

‘আপনি সন্ধ্যা ৭টার পর বেজমেন্টে গিয়েছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল পুলিশ অফিসার।

‘হ্যা গিয়েছিলাম দর্শনার্থীদের সাথে।’ আমি বললাম।

পুলিশ অফিসার তার সাথের বিস্ফোরক টিমের একজনকে ডাকলেন। তিনি এলেন। তার গ্লাভস পরা হাতে দেখলাম সেই আয়াতাকার টিফিন ক্যারিয়ারটি।

‘এই টিফিন ক্যারিয়ারটি আপনি চেনেন?’ বলল অফিসার।

‘দেখেছি।’ আমি বললাম।

অফিসারটি তার পেছনে দাঁড়ানো অফিসারকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দিলেন গ্রেফতার করুন মি. নুর ইউসুফকে।

‘কি ঘটেছে স্যার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ আমি বললাম।

‘এই টিফিন ক্যারিয়ারে রয়েছে সাইলেন্ট কিলারের মতো ভয়ংকর তিনটি ডিমোলিশন বম্ব, যা গোটা মনুমেন্টকে ধুলায় পরিণত করতো আর আধা ঘণ্টা পর।’

শোনার সাথে সাথে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল ওরা।

পরদিন আমাকে লিখিতভাবে জানানো হলো মনুমেন্ট ধ্বংসের জন্যে তিনটি ডিমোলিশন বম্ব পাতার অভিযোগ আনা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। আরও জানতে পারলাম, ধ্বংসের এই ষড়যন্ত্র করতেই নাকি আমি অফডেতে ঐ ডিউটি নিয়েছিলাম। আরও বলা হলো আমাকে যে, দর্শনার্থীদের সঙ্গ দিতে আমি বেজমেন্টে গিয়েছিলাম, এটা আমার সাজানো কথা। টিফিন ক্যারিয়ারটিতে বোমা লুকিয়ে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম বেজমেন্টে বোমা পাতার জন্যে। শুধু আমারই ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে টিফিন ক্যারিয়ারে। অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল।’ থামল নুর ইউসুফ।

বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘অকাট্য প্রমাণ কিভাবে পেল? আপনার কলিগ তো ডিউটি বদলের দরকার বলে অনুমতি নিয়েছিল। তাছাড়া মনুমেন্টের সার্বক্ষণিক সিসিটিভিতে দর্শনার্থীদের ছবি এবং তাদের সেই টিফিন ক্যারিয়ারসহ সব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবার কথা! তাদেরও ফিংগার প্রিন্টও টিফিন ক্যারিয়ারে থাকার কথা।’

হাসল নুর ইউসুফ। বলল, ‘ওরা আট-ঘাট বেঁধেই নেমেছিল। প্রমাণ হয়েছিল আমার কলিগ সালেম সোলাংকি মিনিস্ট্রিতে ডিউটি চেঞ্জের দরখাস্ত করেন নি। দরখাস্ত করেছিলাম আমি। আমার স্বাক্ষর করা দরখাস্ত তারা আমাকে দেখিয়েছিল। আর ঐ দিন সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮ টা পর্যৃন্ত মনুমেন্টের সিসিটিভি বন্ধ ছিল। নষ্ট করা হয়েছিল সিসিটিভি এবং এটাও নাকি আমি করেছিলাম। সিসিটিভির যে যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, সেটা নাকি আমিই সরিয়েছিলাম। আমার ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে সেখানে। আর দর্শণার্থীদের ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যায় নি।’

‘দেখা যাচ্ছে, আপনার কলিগ সালেম সোলাংকিসহ সরকারের অফিস ও বাইরের অনেকেই এই ষড়যন্ত্রের শামিল ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।

‘খুব বড় ষড়যন্ত্র ছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা আসলেই ইন্ডিপিনডেন্স মনুমেন্ট ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আর আধা ঘণ্টা পরেই ডিমোলিশ বম্ব তিনটির একসাথে বিস্ফোরণ ঘটত এবং আমেরিকানদের স্বাধীনতার স্মারক ইন্ডিপিনডেন্স মনুমেন্টটি টুইন টাওয়ারের মতোই ধূলো হয়ে যেত। কিন্তু মনুমেন্টে সবার অলক্ষ্যে বিশেষ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সেট করা আছে, যার অতিসূক্ষ্ম বিকিরণ যে কোন বিস্ফোরকের উপস্থিতি ডিটেক্ট করে হোয়াইট হাউজের গোয়েন্দা সমন্বয় সেলে খবর পৌছায়। এ বিষয়টা ষড়যন্ত্রকারীদের জানা ছিল না। তাই রক্ষা পায় জাতীয় এই মনুমেন্টটি এবং সেই সাথে আমেরিকার মুসলিম কম্যুনিটি মস্ত বড় বিপদ থেকে বেঁচে যায়।’

‘কিন্তু এত বড় ষড়যন্ত্রের কি কারণ ছিল? শুধু আপনাকে ফাঁসানো?’ আহমদ মুসা বলল।

‘না, মুসলমানদের ফাঁসানো। এই কথা আমাকে বলেছিল আমার বন্ধু সালেম সোলাংকি। সে আমার সাথে কারাগারে দেখা করেছিল। সেই আমাকে সবকিছু বলেছিল। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর দুই যুগের ব্যবধানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অন টেরর’ ফিকে হয়ে গিয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেছে। ইহুদিবাদীরা ইন্ডিপেনডেন্স টাওয়ার ধ্বংস করে সেই ‘ওয়ার অন টেরর’কে আবার জিন্দা করতে চেয়েছিল।’

একটু থামল নুর ইউসুফ।

সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘কিন্তু নাম দেখে তো আপনার বন্ধুকে ইহুদি মনে হচ্ছে। এসব কথা কেন তিনি বললেন আপনাকে?’

‘সে আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু, পারিবারিক বন্ধুও। আমি ভালো মুসলিম ছিলাম, সেও ভালো ইহুদি ছিল। আমি নিয়মিত মসজিদে যেতাম। সেও সিনাগগের প্রার্থনা কোন সময় মিস করতো না। সে বলত, ইহুদিবাদ কোন ধর্ম নয়, ইসরাইল রাষ্ট্র ওদের ধর্ম-ঈশ্বর সব। ইসরাইল রাষ্ট্রকে ওরা পূজা করে।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘তাহলে ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্রে সে সাহায্য করল কেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘সে নিজের জীবন ও পরিবারকে রক্ষার জন্যেই এটা করেছে। বাধ্য করা হয়েছে তাকে ওদের সাথে শামিল হতে। বেচারা স্বামী-স্ত্রী খুব কেঁদেছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেছে কে জানে!’

একটু থামল নুর ইউসুফ। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। বলল, ‘পালানোর ব্যাপারে সেই আমাকে প্রথম উদ্বুদ্ধ করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানোর বন্দোবস্তও সেই করে দেয়।’

থামল নুর ইউসুফ।

আহমদ মুসা বলল, ‘তার পর থেকে আপনি এখানে, এই তো?’

হ্যা-সূচক মাথা নেড়ে নুর ইউসুফ বলল, ‘এবার জনাব আপনার কথা বলুন। আমাদের মতো সাধারণ লোক আপনাকে মনে হচ্ছে না। আপনার দৃষ্টি গোয়েন্দার মতো, জ্ঞান বিজ্ঞানীর মতো আর সাহস মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিকের মতো।’

‘বলছি। কিন্তু তার আগে আর একটা কথা বলুন। সমাজ-সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে বাস না করে অন্য দেশে চলে যেতে পারতেন।’ আহমদ ‍মুসা বলল।

‘পারতাম। কিন্তু আমি দেশ ছাড়ব কেন? দেশ তো আমার, আমারই আচে। একটা ষড়যন্ত্র আমাকে শাস্তি দিয়েছে। এর সাথে দেশের সম্পর্ক নেই। এখানে যেভাবেই থাকি, আমি তো দেশের মাটিতে আছি। আমি বলতে পারছি আমি আমেরিকান।’ বলল নুর ইউসুফ আবেগদীপ্ত কণ্ঠে।

‘ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।

একটু থেমেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘আমার সম্পর্কে কি বলব। আমার নাম আহমদ মুসা। ওয়াশিংটনের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে নেমেই আমি কিডন্যাপ হই।’

এটুকু বলে তার মুক্ত হওয়ার বিষয় সংক্ষেপে ওদের জানাল। যারা তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছিল, তারা তাকে কোন হাসপাতালে নিচ্ছিল। পথে তারা আক্রান্ত হন এবং ঘেরাও হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহমদ মুসা এদিকে চলে আসে। কথাগুলো বলে আহমদ মুসা থামল।

আহমদ মুসা থামতেই মারুফা বলে উঠল, ‘আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ বললেন না। আমাদের আমেরিকার বন্ধু মিরাকল ম্যান এক আহমদ মুসাকে আমরা জানি। আপনি কি সেই আহমদ মুসা?’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে দেখে কি মিরাকল ম্যান বলে মনে হয়। আমি তো সাধারণ একজন মানুষ।’

‘সাধারণ মানুষ আমেরিকার জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর থেকে কিডন্যাপ হয় না। আর আপনি মুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া পর্যন্ত যে কাহিনী বলেছেন, সে কাহিনীও কোন সাধারণ মানুষের নয়। আপনি শিকড় বেয়ে পাহাড়ে উঠলেন কষ্ট ও অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে, এটা সাধারণ কেউ করতো না। সুতরাং আপনাকে কনগ্রাচুলেশন। আপনি না বললেও আমি বলছি, জীবন্ত লেজেন্ড, আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের মহান আমেরিকার অতিথি মিরাকল আহমদ মুসার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে।’ বলল মরিয়ম মারুফা। তার কণ্ঠে আবেগের উচ্ছাস।

মারুফার কথা শেষ হতেই নুর ইউসুফ গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমাদের মতো বনবাসীদের কি পরম সৌভাগ্য আহমদ মুসা আজ আমাদের ঘরে! যাকে আমাদের প্রেসিডেন্ট স্বাগত জানান, তাঁকে আমাদের গরীব ঘর কিভাবে স্বাগত জানাবে!’

আহমদ ‍মুসা নুর ইউসুফের আলিংগন থেকে মুক্ত হয়ে বলল, ‘প্লিজ, আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি আমেরিকার জন্যে কার্যত কিছুই করিনি। প্রথমবার আমাকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে বন্দী অবস্থায় আমেরিকায় আনা হয়েছিল। আমি মুক্ত হওয়া এবং নিজেকে নিরাপদ করার জন্যে যা করেছি, তা আমেরিকারও কাজে এসেছে। যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে। সুতরাং আমার জন্যে প্রশংসার এতে কিছু নেই।’

‘ধন্যবাদ। এমন কথা আহমদ মুসাই শুধু বলতে পারেন। সত্যি সব আমার স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’ বলল নুর ইউসুফ। তার দুই চোখ ভরা প্রশংসার দৃষ্টি।

‘বাবা, আমি ভাবছি অন্য কথা। আহমদ মুসা যে দেশে যান, যেখানে যান, সেখানে, সে দেশে তখন কোন বড় ঘটনা ঘটে। বড় কোন ঘটনা সামাল দেবার জন্যেই তিনি আসেন। আমাদের আমেরিকায় আবার কি ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে, সেটাই ভাবছি।’ বলল নুর ইউসুফের ছিলে দাউদ ইব্রাহিম।

আহমদ মুসা এক ধাপ এগিয়ে দাউদ ইব্রাহিমের কাঁধে হাত রেখে ম্লান হেসে বলল, ‘ঠিক বলেছ। দুর্ভাগ্যটা বোধ হয় আমারই। এবারও আমি এবং আমেরিকা একটা বড় ঘটনার মুখোমুখি।’

নুর ইউসুফ সহ সবারই চোখে-মুখে সংগে সংগেই ঔৎসুক্যের একটা বান যেন নেমে এল। বলল দাউদ ইব্রাহিম, ‘যেটাকে আপনি দুর্ভাগ্য বলছেন সেটা আমাদের জন্যে সৌভাগ্য। আপনার জন্যেও। কারণ আল্লাহ যখন কোন কিছুর জন্যে কাউকে বাছাই করেন, সেটা তার জন্যে অবশ্যই সৌভাগ্যের।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ দাউদ ইব্রাহিম। তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা তার জন্যে, আমাদের সকল কাজ তাঁরই জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ধন্যবাদ স্যার। যা বললেন, আসলেই আমেরিকায় কি বড় কিছু ঘটতে চলেছে? আপনি আমেরিকায় পা দেবার সংগে সংগেই তো একটা ঘটনার শুরু।’ বলল মরিয়ম মারুফা।

আহমদ মুসা সংগে সংগেই উত্তর দিল না। একটু ভাবল। গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘হ্যা, খুব বড় ঘটনার আমি আশংকা করছি। আমার জানা-বুঝা যদি সত্যি হয়, আমি যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমেরিকার জন্যে হবে তা এক উদ্বেগজনক ঘটনা।’

আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর আহমদ মুসা ষড়যন্ত্রকারীদের নতুন ভয়ানক অস্ত্র ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভ (MDW), ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW)-এর বিবরণ, তাকে কিডন্যাপের উদ্দেশ্যসহ সবকিছুই সংক্ষেপে বলল এবং শেষে জানাল, ইলেকট্রনিক ও মেটারিক সবকিছু অচল করে দেয়ার যে ঘটনা অতীতে ঘটেছিল ও আজকে ঘটল। আমি মনে করি, সেটা একটা পরীক্ষামূলক।’

থামল আহমদ মুসা। নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা সবার চোখে-মুখে আতংক ফুটে উঠেছে। অন্ধকার হয়ে উঠেছে তাদের চোখ-মুখ। সংগে সংগে তারা কেউ কথা বলতে পারল না।

‘ভয়ংকর কথা আপনি শোনালেন। আমাদের সরকার এ বিষয়টা জানে না?’ প্রায় কম্পিত কণ্ঠে বলল নুর ইউসুফ।

‘সম্ভবত মার্কিন সরকার ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ অস্ত্রটি আবিষ্কারে সফল হয়েছে। কিন্তু অন্য কারো কাছে এই অস্ত্র আছে, এটা তারা জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘সর্বনাশ। তাহলে তো যে কোন সময় ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে।’ বলল আর্ত কণ্ঠে নুর ইউসুফ।

‘ভয় নেই জনাব। ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ তারা আবিষ্কার করেছে, তা তৈরি করে মোতায়েন করার পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু ডেটোনেট করার জন্যে যে ‘কিং পিন’ চাই তা তৈরি তারা সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তারা চেয়েছিল পেন্টাগনের কাছে পরিচিত আমাকে রোবটের মতো কাজে লাগিয়ে ‘কিং পিন’টি এবং তার ফরমুলা পেন্টাগন থেকে চুরি করতে। সে উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়নি। এখন নিজেরা আবিষ্কার অথবা সেটা কোনভাবে পেন্টাগন থেকে হাত করার আগে তারা MDW ব্যবহার করতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আবিষ্কার ইতিমধ্যে তারা করে ফেলতেও তো পারে।’ বলল মরিয়ম মারুফা।

‘আজকের ওদের টেস্ট প্রমাণ করেছে তাদের কাছে যে ডেটোনেট পিন রয়েছে, তা দিয়ে গোটা MDW উইপনকে এ্যাকটিভেট করতে পারছে না। এ কারণেই দেখা গেল ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক বস্তুকে কয়েক মিনিটের বেশি তারা নিষ্ক্রিয় করতে পারছে না। তাছাড়া কয়েক মিনিটের ম্যাগনেটিক ডেথ বাইটকে পূর্ণাংগ করতে পারেনি। সর্বশেষ তত্ত্ব অনুসারে ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভের অকল্পনীয় শৈত্য ম্যাটারের পরমাণুকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, পরমাণুর পারটিকেলগুলোও আলাদা হয়ে পড়ে। ফলে ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ যেসব টার্গেটে আঘাত করে, সেখানে ইলেকট্রনিক ও মেটালিক অস্ত্র-শস্ত্রসহ সবকিছুরই কার্যকর থাকাটা দৃশ্যমান হলেও বস্তুর ধর্ম অনুযায়ী কাজের উপযুক্ত থাকে না, সেগুলো সফট ও ফ্লেক্সিবল হয়ে পড়ে। আমরা সকলেই দেখলাম, মেটালিক বস্তুগুলো কিছুটা সংকুচিত হয়েছিল মাত্র, সফট ফ্লেক্সিবল পর্যন্ত পৌছেনি। এর অর্থ হলো, ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ পুরোপুরি কার্যকরি হতে পারেনি। ডেটোনেটর বা কিং পিন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফদের আতংক দূর হয়ে গেল। আনন্দের স্ফুরণ ঘটল তাদের চোখে-মুখে।

আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, যে রাষ্ট্রের আইনে এবং যে দেশের বিচারালয় চরম অবিচার করে প্রাণদণ্ড দিয়েছে নুর ইউসুফকে, সভ্যতার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে দূরে বনবাসে থাকতে বাধ্য করেছে গোটা পরিবারকে, সেই আমেরিকার প্রতি এঁদের এত ভালোবাসা!

‘যে দেশের আইন ও বিচার আপনাদের এই অবস্থা করেছে, সে দেশের প্রতি আপনাদের এত ভালোবাসা!’ আহমদ মুসা বলল।

হাসল নুর ইউসুফ। বলল, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে কিছু ব্যক্তি, একটা গ্রুপ, যারা প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা ও আমেরিকার আদর্শের শত্রু। ষড়যন্ত্রকারীরা আইনকে ব্যবহার করেছে এবং বিচারালয়কেও। এতে আমেরিকার কোন দোষ নেই। এর ফলে আমার স্বদেশ আমেরিকার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়েছে। আমেরিকাকে এই ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্ত করার ভাবনা আরও দৃঢ় হয়েছে।’

‘সে সুযোগ একটা এসেছে জনাব। বিশ্ব যায়নবাদের গোয়েন্দা সংগঠন Army of Man’s Future (FOAM) এর সামরিক শাখা এইচ কিউব (H3-Hand of the High Hands) আমেরিকার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করেছে, তাকে রুখতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিন্তু আপনি তো বললেন, ওরা ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ অস্ত্রকে এখনও কার্যকরি করতে পারেনি। আজকের টেস্টেও তা প্রমাণ হয়েছে! ভয় তো তাহলে কেটে গেছে। আপনি ওদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ায় ওরা পেন্টাগন থেকে ‘কিং পিন’ চুরিও করতে পারছে না।’ বলল নুর ইউসুফ। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগের প্রকাশ।

‘ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভকে অ্যাকটিভেট করতে না পারার ব্যর্থতা একটা সুখবর দেয়ার সাথে সাথে একটা দুঃসংবাদও দিচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা যদি হতাশই হয়ে যায় যে, তাদের ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভকে তারা কার্যকরি করতে পারছেই না এবং তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তারা তাদের ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW) ব্যবহার করতে পারে। এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা ভয়াবহ। এই MFW-কে তারা যদি ব্যবহার করে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইলোতে থাকা সব পারমাণবিক এবং কনভেনশনাল অস্ত্র ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে, যা সৃষ্টি করতে পারে অকল্পনীয় এক ধ্বংসলীলা। আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা সকলের মুখ আতংকে চুপসে গেছে। প্রায় আর্ত কণ্ঠে নুর ইউসুফ বলল, ‘সর্বনাশ জনাব, পরীক্ষায় এবারও তো MDW-কে কার্যকরী করতে পারেনি, তাহলে কি ওরা ঐ সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলতে পারে?’

গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। তার মুখে ভাবনার একটা ঢেউ খেলে গেল। বলল, ‘তারা এই ভয়ানক কাণ্ড ঘটাবে কিনা বলা কঠিন। তবে আমার কাছে আশংকার বিষয় মনে হচ্ছে তাদের এই সেকেন্ড টেস্টটাকে। আমি ওদের হাত থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা এই দ্বিতীয় টেস্টটা করেছে। তারা মরিয়া হয়ে চেয়েছিল MDW-কে কার্যকরি করতে, কিন্তু পারে নি। তারা জানে আমি ওদের সবকিছু জানতে পেরেছি, আমি মুক্ত হবার পর মার্কিন সরকারও এটা জানতে পারবে। সুতরাং মার্কিন সরকার ওদের উপর আঘাত হানার আগেই ওরা চাইবে মার্কিন সরকারের অস্ত্রভাণ্ডারের উপর আঘাত হানতে। সুতরাং আমার মনে হয়, আমাদের এখন প্রতি মুহূর্তই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আমি পালাতে পারলেও গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর বেঁচে আছি কিনা কিংবা আমি আহত হয়ে কোথায় কিভাবে আছি তা ওরা জানে না। কিন্তু মার্কিন সরকার আমাকে পায়নি, সেটা ওরা জানে। মার্কিন সরকারের সাথে আমার সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত ওরা নিশ্চিন্ত যে, মার্কিন সরকার তাদের ষড়যন্ত্র জানতে পারছে না। সে পর্যন্ত ওরা MFW অস্ত্র ব্যবহার না করে আমাকে খুঁজতে থাকবে, জানতে চেষ্টা করতে থাকবে আমি কোথায়।’ থামল আহমদ মুসা।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা তিনজন কম্পিত দেহে মাটিতে বসে পড়েছে। ভয়ে-আতংকে তাদের মুখ মরার মতো ফ্যাকাশে। কথা বলার শক্তিও যেন তাদের নেই।

আহমদ মুসাও পাশের একটা পাথরের উপর বসে পড়ল। বলল, ‘সামনে যে পাহাড় তার পেছনে কি আছে?’

‘পেছনে ‘ডেথ ভ্যালি’। চারদিকে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, মাঝখানে একটা সংকীর্ণ উপত্যকা। প্রায় তিন শ’ বছর আগে এদেশে ইউরোপীয় শ্বেতাংগদের উপনিবেশ শুরুর সময়ে রেড ইন্ডিয়ানদের সংগে যে যুদ্ধগুলো হয়, তার একটা ভয়ংকর যুদ্ধ বা হত্যাকাণ্ড এই উপত্যকায় সংঘটিত হয়। উপকূল এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের বিচ্ছিন্ন দলগুলো গোপনে এই সংকীর্ণ উপত্যকায় এসে সমবেত হয়। তারা তৈরি হয় ওয়াশিংটন এলাকায় ফাইনাল যুদ্ধের জন্যে। ইউরোপীয় কলোনিয়ান বাহিনী এটা টের পেয়ে যায়। তারা আকস্মিক এক আক্রমণে এই উপত্যকা ঘেরাও করে ফেলে। তারা চারদিকের পাহাড় থেকে সংকীর্ণ উপত্যকায় বারুদ ছড়িয়ে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেড ইন্ডিয়ানরা প্রতিরোধ-প্রতিকারের কোন সুযোগ পায় নি। সবাই সেই বারুদের আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই থেকে এটা ডেথ ভ্যালি। পরবর্তীকালের এক ভূমিকম্পে এই ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের একমাত্র গিরিপথটি বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এই ডেথ ভ্যালিতে এসেছিলেন। তখন চারদিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ডেথ ভ্যালিতে ফুল নিক্ষেপ করে। ডেথ ভ্যালির গাছ, ঝোপ-জংগল, মাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল। জর্জ ওয়াশিংটন ঘোষণা করেছিলেন, ডেথ ভ্যালিকে ব্যক্তিগত মালিকানা ও যে কোন ধরনের ব্যবহার থেকে মুক্ত রেখে পূর্বসূরি শহীদদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। সেই থেকে ভ্যালিটি নিষিদ্ধ এলাকা হিসাবে সংরক্ষিত আছে।’

বলল নুর ইউসুফ।

ডেথ ভ্যালির বিবরণ শুনতে শুনতে আহমদ মুসার মনটা সেই ডেথ ভ্যালিতে চলে গিয়েছিল। তার মনে এসে জমল নানা প্রশ্নের ভিড়। বন্দীখানায় মানসী মেরাবের কাছ থেকে যে তথ্য সে পেয়েছে, তাতে ‘রক ক্রিক পার্ক’-এ MFW মোতায়েনের জরুরি ব্যবস্থার কথা আছে।

‘এটা ঠিক কোন্ এলাকা জনাব নুর ইউসুফ।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এটা ওয়াশিংটনের পশ্চিম দিকে মেরিল্যান্ডের দু’প্রান্তের সীমানা যেখানে কৌণিক একটা দুর্গম পাহাড় এলাকা সৃষ্টি করেছে। সেই ‘রক ক্রিক পার্ক’ এলাকার সবচেয়ে দুর্গম স্থান এটা।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘RCP বা রক ক্রিক পার্কের সবচেয়ে দুর্গম এলাকা এটা?’ অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে আনন্দের স্ফুরণ। তাহলে ঠিক জায়গায় আল্লাহ তাকে এনেছে, মনে মনে বলল আহমদ মুসা।

‘হ্যা, রক ক্রিক পার্ক।’ বলল নুর ইউসুফ।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

উঠে দাঁড়াল সবাই।

আহমদ মুসা সামনে পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এ পাহাড়ের ওপারেই কি ডেথ ভ্যালি?’

‘জি হ্যা। রক ক্রিক পার্ক-এর এটাই দুর্গম কেন্দ্রীয় অঞ্চল।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘পাহাড়ের ওপারে যাবার কি কোন পথ আছে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।

‘কোন পথ নেই। সাধারণ মানুষের পক্ষে পাহাড়ের ওপারে যাওয়া সম্ভব নয়। পর্বতারোহীরা যে কায়দায় পাহাড়ে উঠে সেভাবে কেউ হয়তো এটা ডিঙাতে পারে।’

বলে একটু থেমেই নুর ইউসুফ বলে উঠল, ‘কিন্তু এটার খোঁজ করছেন কেন? ওপারে কি আছে?’

‘কিছু আছে কিনা আমি জানি না। আমার একটা সন্দেহ, ষড়যন্ত্রকারী FOAM-এর এইচ কিউব তাদের MFW অস্ত্র আপনাদের ডেথ ভ্যালি অঞ্চলের কোথাও মোতায়েন করে থাকতে পারে। এটা নিছকই আমার সন্দেহ। আমি এটুকু জানি যে, রক ক্রিক পার্ক ওদের অস্ত্র মোতায়েনের একটা জায়গা।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এই রক ক্রিক পার্কে ওদের ঐ ভয়ানক অস্ত্র মোতায়েন করা আছে?’ বলল স্বগত কণ্ঠে নুর ইউসুফ। তাদের চোখে-মুখে আতংক আবার ফিরে এসেছে।

‘হ্যা, এটা আমার সন্দেহ। সন্দেহের আরও একটা কারণ হলো, ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক বস্তুর উপর যে ম্যাগনেটিক ওয়েভের ফল আমরা দেখলাম তা এসেছে উত্তরের ডেথ ভ্যালির দিক থেকে। আপনারা দেখে থাকবেন, পাত্রের আয়রন ডাস্টগুলো পাত্রের দক্ষিণ দিকে কিছুটা সরে এসেছিল। ওয়েভের দক্ষিণমুখী প্রেসারের কারণে এটা ঘটে থাকতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কি আশ্চর্য! সবকিছুই যেন আপনার জানা, আপনার মুখস্থ। এত সূক্ষ্ম দৃষ্টি আপনার!’ বলল মরিয়ম মারুফা।

‘না মারুফা, আমি সবকিছু জানি না, আমার মুখস্থও নয় সব। জানলে তো এত চিন্তা-ভাবনা করতে হতো না।’ থামল একটু আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘জনাব নুর ইউসুফ, আপনার ওয়্যারলেসে কি এফবিআই-এর সাথে যোগাযোগ করা যাবে?’

‘কার সাথে যোগাযোগ করতে চান?’ জিজ্ঞাসা নুর ইউসুফের।

‘এফবিআই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন অথবা আপনাদের প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।

সবাই বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ওদের সরাসরি ওয়্যারলেস করতে পারেন আহমদ মুসা! সবার মনে পড়ল আমেরিকায় আহমদ মুসাকে নিয়ে ঘটনাগুলোর কথা।

চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সকলের ভাবনায় ছেদ টেনে নুর ইউসুফ বলে উঠল, ‘কিন্তু ওদের কারও ওয়্যারলেন্স রেফারেন্স আমাদের কাছে নেই।’

‘যোগাড় করা যাবে না?’ আহমদ মুসা বলল।

‘চেষ্টা করে দেখতে পারি স্যার।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।

‘আমরা মানে আপনি দাউদকে সাথে নিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে পারেন।’

‘আমাদের রাবারের নৌকা আছে। কয়েক মিনিটেই ওটাকে পানিতে ভাসানো যায়।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘ধন্যবাদ। তা পারা যায়। তবে এখান থেকে যদি যোগাযোগ করা যায়, সেটা ভালো হবে। দরকার হলে সামনের পাহাড়টাকেই ব্যবহার করতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা সকলেই একে অপরের দিকে চাইল। আহমদ মুসার কথা তারা বুঝতে পারেনি, এমনটাই তাদের মুখের ভাব। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে সাহস পেল না।

‘বাবা, আমি ওয়্যারলেসের দিকে যাচ্ছি। দেখি যোগাযোগের কি ব্যবস্থা করা যায়।’

বলেই দাউদ ইব্রাহিম চলল যে ঘরে ওয়্যারলেস আছে, সে ঘরের দিকে।

আহমদ মুসা তার পেছনে পেছনে চলল।

আহমদ মুসার পেছনে সবাই।

পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোড ধরে দুই গাড়ির একটা বহর প্রবেশ করল রক ক্রিক পার্ক এলাকায়।

বহরের আগের গাড়িটি ফোর হোয়েল ড্রাইভ হাইল্যাণ্ডার জীপ। এইট সিটের। পেছনের গাড়িটা একটা ক্যারিয়ার।

হাইল্যান্ডার জীপের মাঝের সারির এক পাশে বসে আছে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, অন্য পাশে সারা জেফারসন। সামনের ড্রাইভিং সিটে এফবিআই প্রধানের ব্যক্তিগত ড্রাইভারের পাশে তার পার্সোনাল সহকারি হেনরিয়েটা।

পেছনের মুখোমুখি চার সিটের দু’জন এফবিআই প্রধানের সিকিউরিটি, অন্য দু’জন ডগ স্কোয়াডের গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের একজনের হাতে ধরা ডগ স্কোয়াডের একটা কুকুর।

আর পেছনের ক্যারিয়ার ভ্যানে এফবিআই-এর একজন অফিসার ড্রাইভার ও ড্রাইভারের পাশে বেঞ্জামিন বেকন। পেছনে ক্যারিয়ারে দশজন এফবিআই সদস্য। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেঞ্জামিন বেকন।

রক ক্রিক পার্ক এলাকায় প্রবেশ করেছে গাড়ি।

‘তুমি অনেক জেদ করে সাথে এসেছ। আল্লাহ তোমার আশাটাকে স্বার্থক করুন।’ বলল এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনকে লক্ষ করে।

‘আমিন। আল্লাহ আমাদের সফল করুন।’ সারা জেফারসন বলল।

‘ওয়াশিংটনের চারদিকের সন্দেহ করার মতো সব জায়গায় অনুসন্ধান হয়ে গেছে। রক ক্রিক অঞ্চলটাই বাকি। আমার অনুমান সত্য হলে আহমদ মুসাকে ওয়াশিংটনের অঞ্চলের বাইরে নেয়া হয়নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আংকেল ওটা নির্ভর করবে ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে কি করতে চায় তার উপর। আহমদ মুসাকে ওরা প্রকৃতপক্ষে কি জন্যে কিডন্যাপ করেছে আমরা জানতে পারিনি।’ সারা জেফারসন বলল।

‘এটাই তো চিন্তার বিষয় সারা। তবে এইচ থ্রি বা এইচ কিউব নামের অস্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান একজন বড় কাউকে কিডন্যাপ করার যে তথ্য জানা গেছে, সেটা সত্য হলে এবং সেই কিডন্যাপ করা ব্যক্তি আহমদ মুসা হলে একটা আশা জাগে যে তার মতো ব্যক্তিকে সতর্ক প্রহরায় নিযে অতি অল্প সময়ে ওয়াশিংটনের বাইরে নেয়া সম্ভব হয় নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

সারা জেফারসন কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোড থেকে বেরিয়ে যাওয়া ২ নং এক্সিট রোডের সাইনবোর্ড। এই এক্সিট রোডটি মধ্য রক ক্রিক পার্কের পূর্ব এলাকার গভীর জংগলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আবার পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোডে উঠেছে। সারা জেফারসন ভাবল জংগলের পথেই তাদের যাওয়া দরকার। দু’পাশের বিরাট অঞ্চলের উপর আমাদের অনুসন্ধান চলতে পারবে।

‘আংকেল, আমি মনে করি দুই নাম্বার এক্সিট ধরে জংগলের পথে আমাদের অগ্রসর হওয়া দরকার।’ সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে তাকিয়ে বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছ মা।’

বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন সামনে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যান্ড্রু দুই নাম্বারে এক্সিট নাও।’

দুই নাম্বার এক্সিট ধরে এগিয়ে চলল জর্জ আব্রাহাম জনসনদের দু’টি গাড়ি।

দুই পাশে গভীর বন। তার মাঝ দিয়ে পাথুরে রাস্তার উপর দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে গাড়ি দু’টি।

এক স্থানে এসে শিকারী কুকুরটি ঘেউ ঘেউ আর লাফালাফি শুরু করল।

‘অ্যান্ড্রু গাড়ি থামাও।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

গাড়ি থেমে গেল রাস্তার পাশে গিয়ে।

ডগ স্কোয়াডের অফিসার দু’জন কুকুরটি নিয়ে লাফ দিয়ে নামল।

জর্জ আব্রাহাম জনসনও নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে।

একটু সামনে জংগলের পাশের একটা জায়গা লক্ষ করে অস্থির হয়ে উঠেছে কুকুরটি।

‘ওকে ছেড়ে দাও জন। কিছু সন্দেহ করেছে সে।’ বলল আব্রাহাম জনসন।

সারা জেফারসন গাড়ি থেকে নেমে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবার চোখেই গভীর ঔৎসুক্য ও আশার আলো।

পেছনের গাড়িটাও এসে দাঁড়িয়েছে।

বেঞ্জামিন বেকন এসে জর্জ আব্রাহাম জনসনের পেছনে দাঁড়াল।

ছেড়ে দেয়ার সংগে সংগে কুকুরটি ছুটে গিয়ে জংগলের প্রান্তের একটা জায়গা শুঁকতে লাগল এবং লেজ নাড়তে লাগল সেই সাথে। সবাই দ্রুত গিয়ে দাঁড়াল সেই স্থানের পাশে।

‘বেকন সন্তর্পণে জায়গাটা পরীক্ষা করো। নিশ্চয় কুকুরটি কিছু সন্দেহ করেছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

কাজে লেগে গেল বেঞ্জামিন বেকন।

সারা জেফারসনও ধীরে ধীরে সেদিকে এগোলো।

ডগ স্কোয়াডের দু’জন লোক গিযে কুকুরটির বেল্টটা হাতে নিল।

সবাই দেখতে লাগল।

প্রথম কথা বলল সারা জেফারসন। বলল, ‘আংকেল লম্বালম্বি একটা জায়গার ঘাস দেখা যাচ্ছে চেপ্টা হয়ে গেছে। লম্বালম্বি জায়গাটার শেষ প্রান্তে কচি গাছ, ঘাস পিষে গেছে। দীর্ঘক্ষণ, অন্তত এক দুই ঘণ্টার বেশি চাপা পড়ে ঘাসের যে অবস্থা হয়, সেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, লম্বালম্বি জায়গাটা মেপে দেখা দরকার।’

‘ঠিক বলেছ সারা। বেকন মেপে দেখ। আমার মনে হচ্ছে আহমদ মুসার একটা চিহ্ন আমরা পেলাম।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমিন। আলহামদুলিল্লাহ।’ সারা জেফারসন বলল।

ওদিকে বেকন পিঠের ব্যাগ থেকে টেপ বের করে ধীরে সূস্থে মাপল লম্বালম্বি জায়গাটা। মাপ শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, লম্বালম্বি মাপ ছয় ফিট।’

‘আহমদ মুসার উচ্চতার সামান্য কিছু বেশি। মাপতে গিয়ে নিশ্চয় দুই এক ইঞ্চি কম বেশি হয়েছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহর অশেষ শুকিরয়া যে, আহমদ মুসার একটা চিহ্ন আমরা পেলাম !’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। আবেগের উচ্ছাসে তার কণ্ঠ ভারি।

‘কিন্তু আংকেল, তিনি জংগলের পাশে এভাবে পড়েছিলেন কেন? কি অবস্থায় ছিলেন? তারপর কি হল তার? সবগুলো প্রশ্নই ভয়াবহ আংকেল। তিনি কি পালাচ্ছিলেন? আবার কি ধরা পড়েছেন শত্রুর হাতে?’ বলল সারা জেফারসন। তার কণ্ঠ ভেঙে পড়েছিল শেষ দিকে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনের কাঁধে হাত রেখে সান্তনার স্বরে বলল, ‘আল্লাহর সাহায্য তার সাথে আছে মা।’

কথা শেষ করেই বেঞ্জামিন বেকনের দিকে চেয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন খেয়াল করেছ, আমাদের গাড়ি ছাড়া আরও একটা গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আরও কিছু পায়েরও এলোমেলো চিহ্ন দেখ। জুতার দাগুলোর মধ্যে একটা লেডিস স্যান্ডেলেরও দাগ আছে। তার মানে ওরা ও আহমদ মুসাকে দেখেই গাড়ি থেকে নেমেছিল। আবার শত্রুও ওরা হতে পারে। যা হোক, আমাদের ফলো করা দরকার। আর কুকুরও সামনের দিকে লক্ষ করেই অস্থিরতা দেখাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ির চাকা দেখা যাচ্ছে সামনের দিকেই গেছে।’

বেঞ্জামিন বেকন ঝুঁকে পড়ে গাড়ির চাকার দাগ দেখছিল। বলল, ‘কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে ওরা এখান থেকে গেছে। ওদের সন্ধান করতে কুকুরের ঘ্রাণ শক্তির উপরই নির্ভর করতে হবে আমাদের।’

‘তার মানে আমরা কমপক্ষে ৬০ কিলোমিটার পিছনে। আল্লাহ ভরসা। চল, আর দেরি নয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

চলতে শুরু করল আবার দু’টি গাড়ি।

এবার বেঞ্জামিন বেকন-এর ক্যারিয়ার ভ্যান আগে নেয়া হয়েছে। ডগ স্কোয়াডের একজনকে তার শিকারী কুকুর সমেত ক্যারিয়ার ভ্যানের ড্রাইভারের পাশে বসানো হয়েছে।

এক্সিট রোড অতিক্রম করে গিয়ে উঠল পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক হাইওয়েতে।

‘স্যার, আমরা পশ্চিম দিকে রক ক্রিকের আরও গভীর অঞ্চলের দিকে যাচ্ছি। কুকুরের ইংগিত বাম দিকেই।’ জর্জ আব্রাহাম জনসনের ওয়্যারলেসে বেঞ্জামিন বেকনের কথা ভেসে এল।

‘ও.কে বেকন, আগাও। ডগের সিলেকশনে বেশি স্ট্রেস না দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত চলো।’

এক জায়গায় এসে সামনের ক্যারিয়ার ভ্যানটি সিগন্যাল দিয়ে থেমে গেল।

পাশেই একটা বিশাল গেট।

জর্জ আব্রাহামের গাড় থামল সেই সংগে। অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘এটা তো ধনকুবের ব্যবসায়ী শিমন আলেকজান্ডারের পাহাড়ী অবকাশ কেন্দ্র। পাহাড়-বন অঞ্চলের নীরব পরিবেশে তিনিসহ তাঁর পরিবার এই বাড়িতেই বেশি সময় থাকেন। এখানে গাড়ি থামল কেন?’

জর্জ আব্রাহামের গাড়ি থামার প্রায় সংগে সংগেই বেঞ্জামিন বেকন দ্রুত এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, অদ্ভুত ব্যাপার, ডগ গেটের দিকে যেতে চাচ্ছে, আবার ফ্লাইওভারের দিকেও ছুটতে চাচ্ছে।’

‘সোজা রক ক্রিক পার্ক রোডের দিকে?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।

‘স্যার, ওদিকে ডগ লক্ষই করছে না।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘তাহলে এ দু’দিকের যে কোন একদিকে তারা গেছে। দু’দিকেই ইন্ডিকেট করার অর্থ হতে পারে, প্রথমে কোন একদিকে গিয়েছিল, তারপর দ্বিতীয় দিকে গেছে। দ্বিতীয় দিক কোনটা দেখ। গেটম্যানকে জিজ্ঞাসা কর, তারা সবকিছুই জানে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ইয়েস স্যার।’ বলে আবার ছুটল বেঞ্জামিন বেকন।

‘আংকেল, আমিও একটু দেখি।’ বলে সারা জেফারসনও গাড়ি থেকে নামল।

হাইওয়ে থেকে অনেকখানি ভেতরে গেটের দুই পাশে দুই সিকিউরিটি বক্স। সিকিউরিটি বক্স গেটের ভেতরে।

গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়াতে দেখে সিকিউরিটির লোকেরা আগেই বেরিয়ে এসেছে।

বেঞ্জামিন বেকন তাদেরকে ডাকতেই তারা সামনে এসে দাঁড়াল।

‘দেখ, আমাদের ডগ স্কোয়াডের কুকুর ভেতরে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। হয়তো ডগের পরিচিত কোন লোককে ভেতরে নেয়া হয়েছে। এখন বল, বাইরের কোন লোককে, অসুস্থ বা আহত অবস্থায় ভেতরে নেয়া হয়েছে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে ‘ জিজ্ঞাসা বেঞ্জামিন বেকনের।

সিকিউরিটির লোক দু’জনে একে অপরের দিকে তাকাল। একজন বলল, ‘আপনাদের লোকজন তো কিছুক্ষণ আগে এসেছিল। আপনারা কিছু জানেন না?’

‘আমাদের লোকজন মানে পুলিশ?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘জি হ্যা।’ বলল সিকিউরিটির সেই লোকটি।

‘কেন এসেছিল? কি করেছিল তারা?’ বেঞ্জামিন বেকনের জিজ্ঞাসা।

‘তারা সেই অসুস্থ লোককে নিতে এসেছিল।’ বলল সেই লোকটি।

‘কোন অসুস্থ লোক?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘আমাদর ছোট ম্যাডাম ও তার বন্ধু যে অসুস্থ লোককে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে, তাকেই পুলিশ নিতে এসেছিল।’ সিকিউরিটির লোক বলল।

‘নিয়ে গেছে?’ বেঞ্জামিন বেকনের জিজ্ঞাসা।

‘না তারা নিয়ে যেতে পারেনি। তার আগেই ছোট ম্যাডাম ও তার বন্ধু তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’ সিকিউরিটির সেই লোক বলল।

‘সরিয়ে নিয়ে গেছে মানে? পুলিশকে দিল না কেন?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘আমরা তা জানি না স্যার। বড় সাহেব আমাদের বলে গিয়েছিলেন, পুলিশ আসবে অসুস্থ লোকটিকে যেন তাদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই ম্যাডাম তাকে নিয়ে যান। আমরা বড় সাহেবের কথা বললে ম্যাডাম বলেন, তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ম্যাডামের গাড়ি যখন গেট থেকে বের হয়, পুলিশের গাড়ি তখনিই এসে গিয়েছিল। কিন্তু ম্যাডাম পুলিশকে এড়িয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে ওপারে গিয়ে একটু বামের এক্সিট ধরে চলে যায়। ঐ পুলিশদের সাথেও কুকুর ছিল। কুকুরটি ছুটে গিয়েছিল ম্যাডামের গাড়ির পেছনে পেছনে। পুলিশের বাধার মুখে ম্যাডাম ওয়াশিংটনের দিকে যেতে না পেরেই ঐ এক্সিটের পথ ধরেছিল বলে মনে হয়।’

‘ধন্যবাদ!’ বলে গেটম্যানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বেঞ্জামিন বেকন তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম, আর কিছু জানার আছে আমাদের?’ বেঞ্জামিন বেকনের কণ্ঠে সম্মান ও শ্রদ্ধার সুর।

সারা জেফারসন কিছু না বলে গেটম্যানের দিকে চেয়ে বলল, ‘অসুস্থ লোকটিকে আপনারা দেখেছেন?’

‘জি ম্যাডাম, আমাদের ছোট ম্যাডাম যাবার সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছিলেন। সেই সময় আমাদের চোখ ম্যাডামের গাড়ির ভেতরেও যায়।’ বলল একজন গেটম্যান।

‘কি দেখেছ?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।

‘অসুস্থ লোকটি শুয়ে ছিল। মুখ দেখে মনে হয়েছে লোকটি শ্বেতাংগ নয়।’ গেটম্যান বলল।

‘অনেক ধন্যবাদ।’ বলে সারা জেফারসন মুখ নিচু রেখেই বলল, ‘চলুন মি. বেকন। আংকেলকে রিপোর্ট করতে হবে।’

ওরা ফিরে এল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছে। বেঞ্জামিন বেকন গেটম্যানের কাছে শোনা সব কথা রিপোর্ট করতে লাগল জর্জ আব্রাহামকে।

সারা জেফারসন গাড়িতে উঠে বসল।

সব কথা শোনার পর জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন রক ক্রিকের পুলিশ অফিস এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টারে টেলিফোন করে দেখ কোন আসামীর সন্ধানে বা কাউকে উদ্ধারের জন্যে এই সময়ের মধ্যে কোন অভিযান পরিচালিত হয়েছে কিনা।’

সংগে সংগেই ওয়্যারলেস করার জন্যে বেঞ্জামিন বেকন একটু সরে গেল।

‘আংকেল, একটা মজার বিষয়, এদের বড় সাহেব ছোট ম্যাডামের পিতা অসুস্থ ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে বললেন। আর ছোট ম্যাডাম তাকে পুলিশের হাতে না দিয়ে তাকে নিয়ে পালালেন। বড় সাহেব সঠিক হলে ছোট ম্যাডাম সন্দেহভাজন হয়ে দাঁড়ান। অন্যদিকে ছোট ম্যাডাম ঠিক হলে বড় সাহেব সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন।’ সারা জেফারসন বলল।

‘ঠিক বলেছ মা। রহস্যের একটা গ্রন্থি মনে হচ্ছে একে। পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেলেই বুঝা যাবে ঘটনা কি?’

বেঞ্জামিন বেকন এসে গেল। বলল, ‘স্যার, পুলিশের তরফ থেকে কোন অভিযান পাঠানো হয় নি। আমাদের সাথের ডগ স্কোয়াড ছাড়া ডগ স্কোয়াডের কেউ এদিকে আসেনি।’

‘বুঝা গেল পুলিশরা ভুয়া ছিল। ছোট ম্যাডামরা আহমদ মুসাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। এস দোয়া করি সবাই, আহমদ মুসাকে ছোট ম্যাডামরা যেন শত্রুর হাতে পড়া থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হোন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমিন।’ সারা জেফারসন বলল।

বেঞ্জামিন বেকনও ‘আমিন’ বলে অনুমতি চাইল, ‘আমার এবার গাড়ি স্টার্ট করতে পারি স্যার।’

‘হ্যাঁ, বেকন। দ্রুত চল। আমার মনে গয় এই এক্সিট রোডেই আমরা ছোট ম্যাডামদের সাক্ষাৎ পেয়ে যাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

দ্রুত গিয়ে সামনের গাড়িতে উঠল সে।

দুটি গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল।

রক ক্রিক রিভারের তীর ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল জর্জ আব্রাহামের গাড়ি।

‘সামনেই একটা বড় খাড়ি। খাড়িতে গিয়ে রাস্তা ইউটার্ণ নিয়েছে। খাড়ির পরেই একটা ঘাট আছে। কিছু দোকান-পাট, বাংলোও আছে। প্রচুর পর‌্যটক এখানে আসে। বোট ভাড়া পাওয়া যায় এখানে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

আরও কিছুটা এগিয়ে খাড়ির কাছে পৌঁছতেই দেখা গেল একটা গাড়ি এদিকে আসছে।

গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই আগের গাড়ির শিকারী কুকুর ভীষণ ঘেউ ঘেউ আর লাফালাফি শুরু করল।

সামনের গাড়িটি স্পিড স্লো করে থেমে গেল।

জর্জ আব্রাহামের গাড়িও থামল।

বেঞ্জামিন বেকনসহ ডগ স্কোয়াডের লোকেরা এবং পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে গেছে।

সারা জেফারসনও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।

‘দেখ মা, গাড়ি যখন একটা, তখন ছোট ম্যাডামদের গাড়িও হতে পারে।’ সারা জেফারসনকে উদ্দেশ্য করে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

বেঞ্জামিন বেকনের নির্দেশে পুলিশরা এগিয়ে আসা গাড়িটার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

এগিয়ে আসা গাড়িটি পুলিশের ব্যরিকেডের সামনে এসে থেমে গেল।

বেঞ্জামিন বেকন ও সারা জেফারসন ছুটে গেড় গাড়ির কাছে।

আর ঐ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমেছে আলাইয়া অ্যানজেলা।

সারা জেফারসনের উপর চোখ পড়তেই ছুটে এল আলাইয়া অ্যানজেলা।

‘গুড ইভিনিং ম্যাডাম। আপনি এখানে?’ সারা জেফারসনের কাছে এসে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল আলাইয়া অ্যানজেলা।

এদিকে ডগ স্কোয়াডের কুকুরটি লাফ দিয়ে আলাইয়া অ্যানজেলার গাড়িতে উঠে গেছে এবং মাঝের যে সিট আহমদ মুসা শুয়েছিল সে জায়গাটা কুকুরটি অস্থিরভাবে শুঁকছে, লেজ নাড়ছে আর গোঁ গোঁ শব্দ করছে।

সারা জেফারসনও অবাক হয়েছে অ্যানজেলাকে ঐ গাড়ি থেকে নামতে দেখে। দেশপ্রেমিক তরুণ আমেরিকানদের যে সংগঠন ‘ফ্রি আমেরিকা’ তার নেতা সারা জেফারসন, সেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র কর্মী আলাইয়া অ্যানজেলা। সভা-সম্মেলনে অনেকবার দেখা হয়েছে তাদের।

সারা জেফারসন আলাইয়া অ্যানজেলাকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এই সময় বেঞ্জামিন বেকন ওই গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘ম্যাডাম, গাড়িতে কেউ নেই। তবে এখানে স্যার ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

সারা জেফারসন ও আলাইয়া অ্যানজেলা দু’জনেই বেঞ্জামিন বেকনের কথা শুনল।

বেঞ্জামিন বেকনের কথা শেষ হতেই আলাইয়া বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন। সাথে পুলিশও দেখছি। আমার গাড়িতে কে ছিলেন? কাকে স্যার বলা হচ্ছে?’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করল আলাইয়া অ্যানজেলা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

এ সময় শ্যালন হার্সও এসে অ্যানজেলার পাশে দাঁড়াল।

এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনও সারা জেফারসনের দিকে আসছিলেন।

তাকে দেখেই একটু সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল সারা জেফারসন। বলল অ্যানজেলাদের লক্ষ করে, ‘উনি আসছেন, এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন।’

‘ও গড!’ বলে অ্যানজেলা সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্যালন হার্সও।

জর্জ আব্রাহাম আসতেই অ্যানজেলা ও শ্যালন হার্স একটু বাউ করে ‘গু ইভনিং স্যার’ বলে স্বাগত জানাল।

সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে দেখিয়ে জর্জ আব্রাহামকে বলল, ‘আংকেল ইনি আলাইয়া অ্যানজেলা, আমাদের ‘ফ্রি আমেরিকা’র কর্মী।’

বলেই তাকাল শ্যালন হার্সের দিকে। সংগে সংগেই আলাইয়া অ্যানজেলা বলল, ‘এ শ্যালন হার্স। আমার বন্ধু। পেশায় ডাক্তার।’

কথা শেষ করেই অ্যানজেলা আবার বলে উঠল জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ করে, ‘এক্সকিউজ মি. স্যার, বুঝতে পারছি আমার গাড়িতে কাউকে খোঁজা হচ্ছে। কে সে? আমার গাড়িতে একজন ছিলেন।’

‘ছিলেন মানে কোথায় তিনি? সেই পুলিশরা তাকে কেড়ে নেয়নি তো?’ জিজ্ঞাসা এফবিআই প্রধানের।

‘স্যার, ওই পুলিশরা তাকে কেড়ে নিতে পারেনি? ওদের কথা আপনারা জানলেন কি করে? ওরা তো আপনাদের লোক নয়।’ অ্যানজেলা বলল।

‘ওরা আমাদের লোক নয় তুমি জানলে কি করে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার চোখে বিস্ময়।

‘সে অনেক কথা স্যার। আমার গাড়িতে যে ছিল, সে নিজেই চলে গেছেন। অদ্ভুত লোক সে।’ অ্যানজেলা বলল।

‘কোথায় গেলেন? কখন গেলেন?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।

আলাইয়া অ্যানজেলা তার গাড়ির আগে-পিছে সেই পুলিশের গাড়ি ও হেলিকপ্টারে উপর থেকে ঘেরাও হবার পর তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে লোকটি গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলল। শুনেই জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘চল সেখানে।’

তিনটি গাড়িই চলল খাড়ির ধারে।

গাড়ি থেকে নেমে সবাই গিয়ে দাঁড়াল খাড়ির পাশে নদীর ধারে।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের একপাশে সারা জেফারসন, অন্যপাশে আলাইয়া অ্যানজেলা।

‘স্যার, ঘেরাও হবার পর উনি বলেছিলেন, ওরা আমাকে যে কোন মূল্যে হাতে পেতে চাইবে। কারণ ওদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের তথ্য আমার জানা হয়ে গেছে। আমি ওদের হাতের বাইরে যাওয়া মানে ওরা বহু বছর ধরে আশার যে প্রাসাদ রচনা করেছে, তার ধূলিসাৎ হওয়া। আমার কাছে আমেরিকার সিকিউরিটি বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, আমাকে ওদের হাতে পড়া চলবে না। উনি গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ওরা চলে আসে। হেলিকপ্টার ক্রেন দিয়ে নদী থেকে গাড়িটা তীরে তুলে আনে। গাড়িতে তাঁকে পাওয়া যায় নি। তারপর তারা এক ঝাঁক মানুষ নেমেছিল নদীতে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর পানির উপরে সে উঠেনি। শুরু থেকে গোটা সময় আমরা তীরে দাঁড়িয়েছিলাম। মনটা আমাদের দারুণ খারাপ হয়ে যায়। জানতে পারি কি স্যার, উনি কে? এত বিনয়ী, সিদ্ধান্তে এত কঠোর এবং এমন দুঃসাহসী মানুষ আমি দেখিনি, পড়িওনি গল্পে।’

‘তিনি অত্যন্ত মূল্যবান মানুষ। আহমদ মুসার নাম তুমি নিশ্চয় শুনেছ? ইনি আমাদের সেই আহমদ মুসা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘উনি আহমদ মুসা!’ স্বগোতোক্তির মতো কথাগুলো বেরুল অ্যানজেলার মুখ থেকে। অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছে সে জর্জ আব্রাহামের দিকে।

কয়েক মূহূর্ত তার মুখ থেকে আর কোন কথা বেরুল না। তার বিস্ময়পীড়িত মুখ থেকে আবার বেরিয়ে এল, ‘স্যার, আমরা তাহলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আহমদ মুসাকে উদ্ধার করেছিলাম! তিনি এতটা সময় আমাদের সাথে ছিলেন আবার আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলেন! ও গড, আমরা কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানানোরও সুযোগ পেলাম না!’ গভীর আবেগ ও আন্তরিকতার স্পর্শ নিয়ে কথাগুলো বেরুল অ্যানজেলার মুখ থেকে।

‘উনি হারিয়ে যাননি, হারিয়ে যেতে পারেন না। তুমি অভিনন্দন জানাতে পারবে ইনশাআল্লাহ।’ সারা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি, মুখ গম্ভীর। তার শূন্য দৃষ্টি নদীর দিকে নিবদ্ধ।

জর্জ আব্রাহাম অ্যানজেলার দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সারা ঠিকই বলেছে মিস অ্যানজেলা। আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করবেন, এ ভরসা আমাদের আছে। কোন দায়িত্ব সামনে এলে তিনি নিজের কথা ভুলে যান। এজন্যেই আল্লাহ তাঁকে ভুলেন না কোন সময়ই।’

‘গড সেভ হিম।’ বলল অ্যানজেলা। এই সাথে মনে পড়ল তার পিতার কথা। সে আহমদ ‍মুসা বলেই হয়তো তার পিতা তাকে সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ বলেছিলেন। কিন্তু তার পিতার কাছে তিনি এত মূল্যবান ছিলেন কেন? তিনি পুলিশের ছদ্মবেশে হলেও তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন কেন? আহমদ মুসা কোন্ ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন? আব্বা কি কোন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত আছেন? মনে মনে আতংকিত হয়ে উঠল অ্যানজেলা। ভাবল সে, খুব তাড়াতাড়ি পিতার সাথে তাকে কথা বলতে হবে। তার পিতার মতো সৎ সজ্জন মানুষ খুব কমই আছে, কিন্তু তার কি হলো? কেন তিনি ঐ ভাবে আহমদ মুসাকে তাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইলেন ! আহমদ মুসার সাথে তার আব্বাদের সম্পর্ক কি!

জর্জ আব্রাহাম অ্যানজেলাকে কথা কয়টি বলেই ফিরে দাঁড়িয়েছিল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন, এরিক এন্ডারসনকে ওয়্যারলেস লাগাও।’

এরিক এন্ডারসনকে ওয়্যারলেস লাইনে পেয়ে বলল জর্জ আব্রাহাম, ‘এরিক রক ক্রিক নদীটির ভাটির মুখ থেকে রক ক্রিক ঘাট-২ এর উজানে সিকি মাইল পর্যন্ত নদী স্ক্যান কর। এখনি লোকদের কাজে লাগাও। আমরা দুই নাম্বার ঘাটে আছি।’

কথা শেষ করে ওয়্যারলেস কল অফ করে বলল, ‘চল আমরা রেস্ট হাউজে গিয়ে বসি।’

অ্যানজেলার দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরাও আসতে পার অ্যানজেলা।’

রেস্ট হাউজটা খাড়ির ওপারে নদীর তীর ঘেষে। খাড়িটা ঘুরে ওখানে যেতে হবে।

সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল।

আলাইয়া অ্যানজেলা অনুরোধ করে সারা জেফারসনকে তার গাড়িতে নিয়ে গেল। দু’জন পেছনে উঠার পর অ্যানজেলা ড্রাইভিং সিটে বসা শ্যালন হার্সকে বলল, ‘হার্স ড্রাইভ করতে আপত্তি নেই তো?’

‘বল কি অ্যানজেলা! সারা ম্যাডামকে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। ওয়েলকাম।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ মি. হার্স। সৌভাগ্যক্রমেই আপনাদের ‍ুদু’জনের এক সাথে দেখা পেয়েছি।’

‘আপনি এভাবে বললে লজ্জা পাই ম্যাডাম। আপনাদেরকে আমরা আমাদের অভিভাবক পরিবার বলে মনে করি। আমেরিকবাসীরা কৃতজ্ঞ আপনাদের পরিবারের প্রতি। ভার্জিনিয়ার জেফারসন হাউজকে আমি আমাদের সিনাগগের চেয়ে সম্মান করি।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ মি. হার্স।…..’

কথা শেষ করতে পারল না সারা জেফারসন। তার কথার মাঝখানেই অ্যানজেলা বলল, ‘ম্যাডাম প্লিজ, এদিকে একটু……।’

কথা শেষ না করেই অ্যানজেলা থেমে গেল।

‘বল অ্যানজেলা। কি বলছিলে?’ বলল সারা জেফারসন।

‘স্যার আহমদ মুসা আমেরিকার বিরুদ্ধে ওদের যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের তথ্য দিলেন, সেটা কি হতে পারে। উনি যাকে ভয়ংকর বলেছেন তা যে কত বড় ভয়ংকর হতে পারে, তা ভাবতেও আমার বুক কাঁপছে।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘হ্যা, উনি যে বিষয়কে এভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা খুবই গুরুতর হবে। প্রশ্ন, কি সেটা?’ বলল সারা জেফারসন।

‘ম্যাডাম, আহমদ মুসার কথা অনেক পড়েছি, অনেক শুনেছি। কিন্তু আজ দেখলাম অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ওদের কাছে আবার ধরা পড়লে ওদের ভয়ংকর ষড়যন্ত্র ফাঁস করার উপায় থাকবে না, এই জন্যে মৃত্যুকে আলিংগন করার মতো গাড়ি সমেত নদীতে সে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। মৃত্যুর ব্যাপারে কোন মানুষ এমন বেপরোয়া হতে পারে, তাও আমার কল্পনায় ছিল না।’ অ্যানজেলা বলল।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের বুক থেকে তার অজান্তেই। বলল, ‘ওঁর আপনজনদের কাছে তিনি যতটা গৌরবের, ততটাই উদ্বেগের।’

সারা জেফারসনের এই দীর্ঘশ্বাস কান এড়াল না আলাইয়া অ্যানজেলার। সংগে সংগেই সে চোখ তুলেছিল সারা জেফারসনের দিকে। সারা জেফারসনের দু’চোখে শূন্যতা, মুখ জুড়ে ছিল বেদনার গভীর প্রলেপ। জেফারসন পরিবারের প্রতিভাবান সন্তান, ‘ফ্রি আমেরিকা’র প্রধান, একজন অনড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সারা জেফারসনের এমন বেদনার্ত মুখ সে আশা করেনি। কোন সাহায্য-সহায়তাকারীর জন্যে এই বেদনা স্বাভাব্কি নয়। সারা জেফারসন যা বলল, এটা সেই আপনজনদের উদ্বেগ বেদনার মতো। ভ্রু কুচকে উঠল আলাইয়া অ্যানজেলার। তাহলে কি কোন সম্পর্ক….। চিন্তাটা সম্পূর্ণ করার সাহস হলোনা তার। কিন্তু মন থেকে তার আরেকটা প্রশ্ন মাথা তুলল, এফবিআই ও পুলিশের সাথে সারা জেফারসন কেন এসেছেন? সাহস তার ফিরে এল। অসম্ভব কি! একদিকে আমেরিকার একটি শ্রেষ্ঠ বনেদী পরিবার, অন্যদিকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এক ব্যক্তিত্ব।

অ্যানজেলা এসব চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল।

সারা জেফারসনই আবার প্রশ্ন করল, ‘ওঁর জ্ঞান কোথায় কতক্ষণে ফিরেছিল?’

সারা জেফারসনের কথায় সম্বিত ফিরে পেল আলাইয়া অ্যানজেলা। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। সেই গম্ভীর বেদনার্ত মুখ।

চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল অ্যানজেলা, ‘সে এক মজার কথা ম্যাডাম।’

বলে অ্যানজেলা আহমদ মুসার জ্ঞান ফেরা, তার সাথে কথা সবকিছু সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত ‍দুরদৃষ্টির মানুষ! সামনে কি ঘটলে কি করবেন তা নিখুঁতভাবে ঠিক করে রাখতে পারেন। সেই সাথে দারুণ বিনয়ী একজন ভদ্রলোক।’

‘হ্যা, অ্যানজেলা, তাঁর শত্রুরাও তার প্রশংসা করেন।’ বলল সারা জেফারসন। সারা জেফারসনের কণ্ঠ অসীম শ্রদ্ধায় সিক্ত।

শ্রদ্ধাসিক্ত কণ্ঠ অন্তর স্পর্শ করল অ্যানজেলার! তার মনে হলো, অপার ভালোবাসার ভিত্তি ছাড়া কারো মনে এমন শ্রদ্ধা সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু এই পরিবেশে এমন বিষয়ে ইংগিতেও কোন কথা বলা যাবে না চিন্তা করে অ্যানজেলা অন্য প্রসংগ টেনে বলল, ‘জনাব আহমদ মুসা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কি হয়েছে, কি হতে পারে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। একজন মানুষ এভাবে লা-পাত্তা হয়ে যেতে পারে কেমন করে?’

‘কিছুই বুঝা যাচ্ছে না অ্যানজেলা। কিন্তু একটা বিষয় আমি বলতে পারি সেটা হলো, এসব ক্ষেত্রে তিনি যখন কোন কাজ করেন, তখন পরবর্তী কাজটা কি হবে তাও চিন্তা করে রাখেন।’ বলল সারা জেফারসন।

‘সে কাজটা কি সেটাই বুঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, নদীর স্ক্যানিং থেকে কি পাওয়া যায়।’

খাড়ির এ প্রান্তে পৌছে গেছে তারা।

নদীর তীর ঘেষে রেস্ট হাউজ। এক্সিট রোডটা তার সামনে দিয়ে।

রেস্ট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে জর্জ আব্রাহামের গাড়ি।

তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল অ্যানজেলার গাড়ি ও পুলিশ ভ্যান।

‘আপনার আর্জেন্টিনা যাওয়া কি চূড়ান্ত?’ বলল ফোম (আর্মি অব ম্যান’স ফিউচার) এইচ থ্রি (হ্যান্ড অব দ্যা হাই হ্যান্ডস )-এর নির্বাহী প্রধান ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।

‘হ্যা, চুড়ান্ত। আমাকে কয়েকদিন বাইরে থাকতে হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার, ফোম ও এইচ থ্রি-এর প্রধান ও গড ফাদার।

‘কিন্তু হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের আমি কারণ বুঝতে পারছি না। আমরা সাংঘাতিক একটা জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়েছি। বড় বড় সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন হবে। এই সময় আপনার অনুপস্থিতির কথা আমরা চিন্তাই করতে পারছি না।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে ক্যানিংহাম।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘কি ঘটনা স্যার?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘তুমি জান, আমাদের বাড়ির সিকিউরিটিকে বলে এসেছিলাম পুলিশ আসবে অসুস্থ লোকটিকে নিতে, তাদের সাহায্য করো। পুলিশের বেশে আমাদের লোকেরা সেখানে পৌছার আগেই আহমদ ‍মুসাকে নিয়ে আমার মেয়ে চলে যেতে চেষ্টা করে। আমাদের পুলিশের বেশধারী লোকরা তাকে গেটে পেয়ে যায়। কিন্তু আমার মেয়ে অন্য পথ ধরে সরে পড়তে সক্ষম হয়। এ থেকে আমার কাছে পরিষ্কার, আমার মেয়ে হয় কোনওভাবে কিছু জানতে পেরেছে বা সন্দেহ করেছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা এফবিআই প্রধান একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। আমার গেটের সিকিউরিটি, আমি তাদের যা বলেছিলাম, সব এফবিআই প্রধানকে বলেছে। তার উপর আমার মেয়ের সাথে এফবিআই প্রধানের দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এফবিআই প্রধান সব জেনে ফেলেছে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘কিন্তু স্যার, আমি তো এতে কোন দোষ দেখছি না। পুলিশের পরিচয়ে কেউ যদি আপনাকে টেলিফোন করে আপনার হেফাজতের কোন লোক তাদের আসামী বা অন্য কিছু দাবী করে, আপনি যদি তাকে বিশ্বাস করে ঐ ধরনের নির্দেশ দেন, তাতে দোষের কিছু নেই।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘ঘটনা ঐটুকু হলে তো কোন কথা ছিল না। ঘটনা তা নয়। আমার মেয়ে আহমদ মুসাকে নিয়ে চলে যাবার পর আমি বাড়ি ফিরি। আমাদের বাড়ির সিসিটিভি’র ভিডিও চিত্রও চেক করি। চেক করতে গিয়ে দেখতে পাই আমি তোমার সাথে পুলিশের ছদ্মবেশে আমাদের লোক পাঠানোর কথাসহ যা বলেছিলাম, তার প্রায় সবই আমার মেয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে। আর এই বিষয়টা কারও কাছে গোপন নেই। কথাগুলো এফবিআই প্রধানকে সে বলে দিতেই পারে। আর ….।’

শিমন আলেকজান্ডারের কথার মাঝখানেই কোহেন ক্যানিংহাম বলল, ‘মেয়ে কি তার বাপকে এইভাবে বিপদে ফেলতে পারে?’

‘পারে কোহেন। আমেরিকার তরুণদের সংগঠন ‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য সে। তুমি তো জান, ফ্রি আমেরিকানরা দেশপ্রেমের কাছে কোন কিছুকেই স্থান দেয় না। দেশপ্রেমের দাবির কাছে ওরা কোন সম্পর্ককেই বড় করে দেখে না। সুতরাং তার কাছে কি আশা করতে পারি, বুঝতেই পারছ।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘কিন্তু আমি শুনেছি স্যার, এই সংগঠনটি নাকি এখন আর অ্যাকটিভ নেই।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘সম্প্রতি আবার অ্যাকটিভ করা হয়েছে। এর পেছনে নাকি সরকারেরই গোপন হাত আছে। সরকার চান তরুণদের এমন একটা সংগঠন দেশে সক্রিয় থাকা দরকার।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘ও গড!’

বলে একটা দম নিয়েই কোহেন ক্যানিংহাম আবার বলল, ‘স্যার, তাহলে পরিস্থিতি কি দাড়াচ্ছে?”

‘বলেছি তো, আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অথবা কিডন্যাপকারীদের আমি জানি, তাদের সাহায্যও করেছি। সুতরাং আমাকে গ্রেফতার করার জন্যে তারা প্রথমেই ছুটে আসবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘আলাইয়া অ্যানজেলার কথায় সরকার আমাদের কতটুকু জানতে পারবে? কতটুকু ক্ষতি হবে আমাদের?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘আমাকে আইডেনটিফাই করা ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষতি হয়নি এখনও। আহমদ মুসা ওদের কাছে ফিরতে পারলে, সেটা হবে আমাদের সর্বনাশা ক্ষতি।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘আহমদ মুসাকে এখনও তো ওরা খুঁজে পায়নি?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘না, খুঁজে পায়নি। প্রায় গোটা রক ক্রিক নদীটাকেই তারা স্ক্যান করেছে, নদী থেকে উপরে উঠে আসার সম্ভাব্য সব জায়গা তারা পরীক্ষা করেছে। কিন্তু নদীর ভেতরে কিংবা নদী থেকে পাড়ে ওঠার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি। নদীতে তার জুতা ও জ্যাকেট পাওয়া গেছে মাত্র।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘বুঝা যাচ্ছে আহমদ মুসা শরীরকে হাল্কা করার জন্যে জুতা ও জ্যাকেট খুলে ফেলেছিল। কিন্তু সে গেল কোথায়? একটা মানুষ তো হাওয়া হয়ে যেতে পারে না?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেছে। স্ক্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেই সময় নদীতে টিউব সাবমেরিন চলার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই টিউব সাবমেরিনে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিরা গোপনে চলাফেরা করে থাকে। এ ধরনের কোন সাবমেরিন তাকে তুলে নিতে পারে। এ ধরনের চিন্তা এফবিআই করছে। আবার এ চিন্তাও করা হচ্ছে, নদীতে পড়ার সময় আহমদ মুসা গুরুতর আহত হয়। জুতা ও জ্যাকেট খুলে হালকা হয়ে সে বাঁচার চেষ্টা করে, কিন্তু সফল হয়নি। পাহাড়ী নদীর স্রোত আহত আহমদ মুসাকে পটোম্যাকে টেনে নিয়ে গেছে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

মুখে কিছুটা প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠল কোহেন ক্যানিংহামের। বলল, ‘ভালো হয়, আমরা মহাবিপদ থেকে বেঁচে যাই যদি দ্বিতীয় চিন্তা সত্য হয়। আচ্ছা, টিউব সাবমেরিন যদি তাকে তুলে নিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কি? কার হাতে সে পড়তে পারে?’

‘তুমিও জান, আমাদের কিছু ইনল্যান্ড রিভারে টিউব সাবমেরিন চলে থাকে। এর মধ্যে কিছু এফবিআই-এর সাবমেরিন আছে, আর কিছু আছে বেসরকারি রেজিস্টার্ড ফার্মের। এ প্রাইভেট টিউব সাবমেরিনের নিয়ন্ত্রণও অনেকটা সরকারের হাতে। প্রতিদিনের রুট ও যাত্রী সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হয় সরকারের কাছে। তাছাড়া গোপন খবর হলো, অপরিচিত ও বৈধ রেজিস্ট্রি ছাড়া দু’একটা টিউব সাবমেরিনও এসব নদীতে যাতায়াত করে। সরকারি সাবমেরিন তাকে তুলে নিলে তখনই খবর হয়ে যেত। প্রাইভেটগুলো যদি তুলে নিয়ে থাকে, তাহলে অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকার তা জানতে পারবে। কিন্তু অপরিচিত কোন টিউব সাবমেরিন তাকে তুলে নিয়ে তারা এটা গোপন রাখতে পারে, যদি তারা প্রয়োজন দেখে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

‘অপরিচিত টিউব সাবমেরিন কাদের হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা কোহেন ক্যানিংহামের।

‘এ প্রশ্ন করছ কেন? তুমি জান না?’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘মিলিয়ে নিতে চাচ্ছি স্যার। মাফ করবেন।’

বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

হাসল শিমন আলেকজান্ডার। বলল, ‘এটা মনে করা হয় বৈরী কোন দেশ, কোন গোপন সংগঠণ, বৈরী কোন গোয়েন্দা সংস্থারও হতে পারে অপরিচিত টিউব সাবমেরিনগুলো।’

‘গড আমাদের সাহায্য করুন। আহমদ মুসা বৈরী কারও হাতে পড়লে আমাদের জন্যে ভালো হয়। আহমদ মুসা দীর্ঘ আট ঘণ্টাতেও উদ্ধার না হওয়া কি এদিকেই ইংগিত দিচ্ছে না।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘কিছুই বলা যাচ্ছে না কোহেন।’

কথা শেষ করে মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কোহেন ক্যানিংহামের দিকে চেয়ে শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘এসব আলোচনা পরেও করা যাবে। এস এবার কাজের কথায় আসি।’

শুরু করল শিমন আলেকজান্ডার সামনে দোরগোড়ায় আমাদের জন্যে গুরুতর সংকট। অথচ আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। বোধ হয় সে সময় আমরা পাচ্ছি না। ভালো করে শোন, আমাদের জন্যে সামনে দু’টো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আহমদ মুসা যদি সরকারের কাছে পৌছে যায়, সরকার যদি তাকে পেয়ে যায়, তাহলে সরকার সব জেনে ফেলবে। সেক্ষেত্রে আমাদের গোটা আয়োজন ধ্বংসের মুখে পড়বে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। তার আগেই আমাদের আঘাত করতে হবে। সরকারের সাথে আহমদ মুসার দেখা হওয়ার সাথে সাথেই মার্কিন সকল সাইলো ও অস্ত্রভাণ্ডারকে টার্গেট করে আমাদের ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে সরকারের পদক্ষেপগুলোর দিকে। ওরা আমাদের উপর আঘাত হানার আগে আমরা আঘাত হানব ওদের উপর। আমাদের MFW-এর ট্রিগারগুলো একসাথে টিপা হবে, যাতে দ্বিতীয় চিন্তার তারা কোন সুযোগ না পায়। মুহূর্তেই ওদের সাইলো ও অস্ত্রভাণ্ডারকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, আহমদ মুসাকে সরকার যদি খুঁজে না পায়, তাহলে বলা যায় আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে যাব। আমাদের পরিকল্পনা সরকারের অজানাই থেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাজ যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলবে। শুধু রক ক্রিকের জংগল এলাকার আমাদের অফিস হেড কোয়ার্টারটা ধ্বংস করে আমাদের ভিন্ন জায়গায় সরে যেতে হবে। কারণ সাবধানের মার নেই। সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসা যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, সে জায়গাটা আমাদের হেড কোয়ার্টারের খুবই কাছে। আরেকটা কথা শোন, আমার বিষয় নিয়ে তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। আহমদ মুসা যদি ফিরে যেতে না পারে সরকারের কাছে, তাহলে তেমন কোন সমস্যা নাও হতে পারে আমার। বিষয়টা আমার ফ্যামিলিই ডিল করতে পারবে।’

থামল শিমন আলেকজান্ডার।

‘স্যার, এসবই বড় বড় সিদ্ধান্ত। প্রত্যেকটারই ফলোআপ আছে। বিশেষ করে প্রথম অপশনে আমরা যদি যাই, তার পরবর্তী পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ ও দ্রুত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘কেন, এসব তোমার জানা নেই?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল একটু শক্ত কণ্ঠে।

‘হ্যাঁ, জানা আছে স্যার। কিন্তু দেশপ্রেমিকের সংখ্যা স্যার নব্বই ভাগ। সব চিন্তা সামনে রেখেই আমাদের এগোতে হবে। কোন ভুল করা যাবে না। এ জন্যেই আমার সতর্কতা।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।

‘ধন্যবাদ কোহেন। সতর্কতা ভাল। কিন্তু সতর্কতা যথা সময়ে কাজ করার ক্ষেত্রে যেন বাঁধা সৃষ্টি না করে। আমরা যা করতে যাচ্ছি তা যুগান্তকারী, দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন। নজিরবিহীন এই ঘটনা পৃথিবীতে একদিন আমাদের আগমনকে অবধারিত করে তুলবে। তুমি ঠিকই ………..।’

কথা শেষ করতে পারল না শিমন আলেকজান্ডার। তার ওয়্যারলেস বিপ বিপ করতে শুরু করেছে। কথা তার বন্ধ হয়ে গেল।

ওয়্যারলেস মুখের কাছে এনে বলল শিমন আলেকজান্ডার, ‘বল জ্যাকব।’

‘স্যার, রক ক্রিক নদী অঞ্চলে আহমদ মুসাকে খোঁজার কাজ তারা পরিত্যাগ করেছে। আমাদের ইনফরমার এইমাত্র আমাকে জানালো, এফবিআই এবং হোয়াইট হাউস মনে করছে, আহমদ মুসা অবশ্যই বেঁচে আছে। কিন্তু সে কোন বৈরি শক্তির হাতে পড়েছে, অথবা সাংঘাতিক অসুস্থ বা আহত অবস্থায় কেউ তাকে উদ্ধারও করে থাকতে পারে। সুতরাং তারা আগের মতোই অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে। বলল ওপার থেকে জ্যাকব নামের লোকটি।

‘সুখবর জ্যাকব। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। সে যদি কোন বৈরি শক্তির হাতে পড়ে থাকে তাহলে সবচেয়ে ভাল। অসুস্থ অবস্থায় যদি কারও আশ্রয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে হাতে কিছু সময় পাব। যাক, আর কোন খবর?’ শিমন আলেকজান্ডার।

‘স্যার, এফবিআই রক ক্রিক ও পটোম্যাক নদী দিয়ে ঐ দিন ঐ সময় চলা সব টিউব সাবমেরিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তারা প্রাইভেট সাবমেরিনকেই বেশি সন্দেহ করছে।’ জ্যাকব নামের সেই লোকটি বলল।

‘ধন্যবাদ জ্যাকব। তোমার পরবর্তী খবরের জন্য অপেক্ষা করব।’ ওভার।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

ওয়্যারলেস রেখে শিমন আলেকজান্ডার তাকালো কোহেন ক্যানিংহামের দিকে। বলল, ‘কোহেন, ওরা চেষ্টা করছে আহমদ মুসাকে খুঁজে পাবার জন্যে। আর আমরা আহমদ মুসাকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় চাই, এটা আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন। ঈশ্বর আমাদের কিছুটা সুযোগ দিয়েছেন আহমদ মুসাকে সরকারের হাতে পড়তে না দিয়ে। এর পুরো সদ্ব্যবহার আমাদের করতে হবে।’

‘অবশ্যই স্যার। আমাদের অনুসন্ধানী দল এখানো মাঠে। আমরা আরও তৎপর হবো। কিন্তু একটা বিষয় স্যার, আহমদ মুসাকে সরকার খুঁজে পেয়েছে, এটা যদি জানতে না পারি?’ কোহেন ক্যানিংহাম বলল।

‘কেন জানা যাবে না? সারা জেফারসনের বাড়ি, হোয়াইট হাউজ এবং এফবিআই হেড কোয়ার্টার সব জায়গায় আমাদের লোকেরা সক্রিয় রয়েছে। সারা জেফারসনের বাড়িতে আমাদের লোক নেই বটে, কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এমন এক জায়গায় তারা রয়েছে, যেখান থেকে ও বাড়িতে কে আসছে, কে যাচ্ছে, কি হচ্ছে সব মনিটর করতে পারবে। আহমদ মুসা ফিরে এলে এই তিন জায়গায় খবর হবেই। সুতরাং তারা খবর না পাওয়ার কারণ নেই কোহেন।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

কথা শেষ শোন কোহেন, সরকার আমাদের বিষয় জানতে পেরেছে সন্দেহ হলেই মুহূর্ত দেরি না করে MFW- কে অ্যাকটিভেট করে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাবে। তুমিই তো ব্যবস্থা করেছ, দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকাল অ্যাকটিভেশনের ব্যবস্থা ব্যবস্থা ছাড়াও জরুরি সময়ের জন্যে সব লোকাল MFW- এর কেন্দ্রীয় অ্যাকটিভেশনের ব্যবস্থা আছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই। এক অপারেশন রুমে বসেই সব সাইলোতে থাকা মোতায়েন করা সব শক্তি গুড়ো করে দিতে পারবো আমরা। তারপর সরকার ও প্রশাসনে যে কম্পন শুরু হবে, তা থামার আগেই দেখা যাবে FOAM ওভাল অফিস দখল করে বসেছে। তখন আহমদ মুসার বাবাও কিছু করতে পারবে না। আমরা তাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাব। ঈশ্বর আমাদের সে সুযোগ দাও।’

কথা শেষ করেই ‘গুড ইভিনিং’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল শিমন আলেকজান্ডার।

‘আমি জর্জ আব্রাহাম বলছি, মিস অ্যানজেলা তুমি এখন কোথায়?’ বলল মোবাইলে জর্জ আব্রাহাম।

“স্যার, আমি শ্যালন হার্স-এর হাসপাতালে, তার অফিসে। আমরা রক ক্রিক থেকে সোজা গিয়েছিলাম শ্যালন হার্স-এর ফ্ল্যাট। সেখানে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমরা চলে এসেছি হাসপাতালে।’ অ্যানজেলা বলল।

‘কিন্তু মিস অ্যানজেলা আমরা তোমাদের বাড়ির গেটে। তোমাদের বাড়িতে আমাদের ঢুকতে হবে। গেটে শুনলাম, তুমি কিংবা তোমার বাবা কেউ বাড়িতে নেই। তাই তোমাকে টেলিফোন করলাম।’ বলল আব্রাহাম জনসন।

‘বুঝেছি স্যার। কিন্তু ঘটনার সাথে বাবার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে কি আপনারা নিশ্চিত হয়েছেন?’ জিজ্ঞাসা আলাইয়া অ্যানজেলার।

‘হ্যা নিশ্চিত মিস অ্যানজেলা। রক ক্রিকের যে জংগলের ধার থেকে তুমি আহমদ মুসাকে উদ্ধার করেছিলে, সেখান থেকে অল্প দূরে জংগলের গভীরে মাটির তলায় ফোম ও এইচ কিউব নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের হেড কোয়ার্টার আমরা খুঁজে পেয়েছি। সেখানে যে ম্যাটেরিয়াল ও দলিল-পত্র পাওয়া গেছে, তাতে সংস্থার অফিসিয়াল প্রধান হিসাব তাঁর নাম রয়েছে।’ বলল আব্রাহাম জনসন।

‘ও গড!’ অ্যানজেলার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো। বেদনার্ত তার কণ্ঠ।

একটু বিরতি। তারপরেই ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো অ্যানজেলার, ‘স্যার, আমার আম্মা, নোয়ান নাওমি এবং স্টাফ প্রধান মিস বারবারকে বাসায় পাবেন। তাঁরা আপনাদের নিশ্চয় সহযোগিতা করবে। আমরা আসছি।’

‘অনেক ধন্যবাদ অ্যানজেলা। তুমি এলে আমরা খুশি হবো। তোমাদের মতো তরুণ প্রজন্মরাই দেশ ও জাতিকে বাঁচাবে। এস মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘ধন্যবাদ স্যার। আমি দুঃখিত, মর্মাহত, কিন্তু আমি খুশি ষড়যন্ত্র ধরা পড়ায়। কি ষড়যন্ত্র অবশ্য জানি না আমি। স্যার, ম্যাডাম সারা জেফারসন কি আপনার সাথে আছে?’ বলল অ্যানজেলা। ভারি কণ্ঠ তার।

‘না মা, সে এখন আমাদের সাথে নেই।’ বলল আব্রাহাম জনসন।

‘ঠিক আছে। ধন্যবাদ স্যার। আমি আসছি।’ অ্যানজেলা বলল।

জর্জ আব্রাহাম তার মোবাইলের কল অফ করে তা জ্যাকেটের পকেটে রাখতে রাখতে পাশে অপারেশন কমান্ডার এরিক এন্ডারসনকে বলল, ‘বাড়ির চারদিকে চোখ রাখার ব্যবস্থা হয়েছে এরিক?

‘জি স্যার।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

‘ধন্যবাদ। এবার তোমরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ কর। তথ্য পাওয়া যেতে পারে এমন সবকিছুকে লোকেট কর। আমি আসছি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

জার্মান টাইপে একটা বাউ করে এরিক এন্ডারসন তার লোকদের নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

কয়েকটা কল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

কলগুলো শেষ করে জর্জ আব্রাহাম ভেতরে প্রবেশ করল। দেখল ভেতরের লিভিং রুমে এরিক এন্ডারসন তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

জর্জ আব্রাহাম লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই স্যালুট দিল এরিক এন্ডারসন। তার সাথে এফবিআই-এর অন্যান্য লোকও।

লিভিং রুমে বাড়ির কয়েকজনও দাঁড়িয়েছিল। মাত্র অভিজাত চেহারার একজন মহিলা বসেছিল মাঝের একটি সোফায়। তার চোখ-মুখ ভরা বিরক্তি। তার পেছেনে বসেছিল আরেকজন মহিলা, ভারি ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার।

‘ম্যাডাম ইনি জর্জ আব্রাহাম জনসন, এফবিআই প্রধান।’ জর্জ আব্রাহামকে দেখিয়ে বলল এরিক এন্ডারসন ম্যাডাম শিমন আলেকজান্ডারকে।

উঠে দাঁড়াল ম্যাডাম শিমন আলেকজান্ডার।

‘গুড ইভনিং মি. জর্জ আব্রাহাম।’ বলল ম্যাডাম শিমন আলেকজান্ডার।

‘স্যার, ইনি মিসেস নোয়ান নাওমি, ম্যাডাম শিমন আলেকজান্ডার।’ ম্যাডাম শিমন আলেকজান্ডারকে দেখিয়ে বলল এরিক এন্ডারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ করে।

একটা ছোট্ট বাউ-এর সাথে হ্যান্ডশেক করে জবাব দিয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘স্যরি, মিসেস আলেকজান্ডার আপনাদের কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমরা সত্যিই দুঃখিত।’

‘ও.কে মি. জর্জ আব্রাহাম। আপনার যেটা দায়িত্ব সেটা তো করবেনই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এসব কি ঘটছে? আমার স্বামী মি. শিমন আলেকজান্ডার মাত্র কয়েক মিনিট আগে প্লেন থেকে জানালেন তিনি আর্জেন্টিনা যাচ্ছেন। তার পরেই আপনারা আসলেন তার খোজে এবং বাড়ি সার্চ করতে। কেন এসব?’ বলল নোয়ান নাওমি, শিমন আলেকজান্ডারের স্ত্রী।

নোয়ান নাওমি যখন কথা বলছিল, তখন নীরবে এসে আলাইয়া অ্যানজেলা সোফায় তার মায়ের পাশে বসেছিল। তার মুখ ভারি। মায়ের কথা যখন শেষ হলো, তখন দেখা গেল তার চোখের দুই কোণ অশ্রুতে ভরে গেছে। তার মা না জানলেও সে তো কিছু জানে কেন তার প্রিয় বাবা আর্জেন্টিনা পালালেন।

‘মিসেস আলেকজান্ডার, আমাদের মনে হচ্ছে একটা বিপজ্জনক সন্ত্রাসী চক্রের সাথে মি. শিমন আলেকজান্ডার জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা তার সম্পর্কে আরও তথ্যানুসন্ধানের জন্যে এখানে এসেছি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আপনাদের ভুল হচ্ছে না তো? আপনারা কি ‍নিশ্চিত? সেই চক্রটি কারা, নাম কি সেই চক্রের?’ নোয়ান নাওমি বলল।

‘নিশ্চিত না হয়ে আমরা আসিনি মিসেস আলেকজান্ডার। নামটা এই মুহূর্তে আমরা প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। তবে রক ক্রিকের গভীর জংগল অংশে ওদের হেড কোয়ার্টার আমরা খুঁজে পেয়েছি। সেখানে পাওয়া দলিল-পত্রে সংগঠনটির অফিসিয়াল প্রধান হিসাবে মি. শিমন আলেকজান্ডারের নাম পাওয়া গেছে। মি. শিমন আলেকজান্ডারও এটা জানতে পেরেছেন। তাই গ্রেপ্তার এড়িয়ে তিনি তড়িঘড়ি করে আর্জেন্টিনা চলে গেছেন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘তাঁর অপরাধটা কি ধরনের মি. জর্জ আব্রাহাম? বিপজনক দলটারই বা এজেন্ডা কি, যার সাথে শিমন জড়িত? জিজ্ঞাসা নোয়ান নাওমির।

‘সব কথা আমরা এখনি প্রকাশ করছি না বিশেষ কারণে। তবে এটুক জেনে রাখুন মিসেস আলেকজান্ডার, রাষ্ট্রের প্যারালাল একটা শক্তি গড়ে তোলা হচ্ছিল।’

‘রাষ্ট্রের প্যারালাল শক্তি? প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠল নোয়ান নাওমি ও আলাইয়া অ্যানজেলা। তাদের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।

‘উদ্দেশ্য কি স্যার?’ অ্যানজেলা বলল। তার ভ্র্য কুঞ্চিত। সে যেন বিশ্বাস করতেই পারছে না তার বাবা এমন ভয়াবহ কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু তার বাবা চলে গেলেন কেন? তিনি কি এর মাধ্যমে প্রমাণ করে গেলেন যে এদের অভিযোগ সত্য? বুকটা খচখচ করে উঠল অ্যানজেলার।

‘আরও অনুসন্ধানের পর বলা যাবে অ্যানজেলা।’

একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের এই অনুসন্ধান কাজে আপনাদের সহযোগিতা চাই আমরা।’

‘বলুন মি. জর্জ আব্রাহাম।’ অ্যানজেলার মা নোয়ান নাওমি বলল।

‘পরীক্ষার জন্যে কিছু জিনিস আমরা নিয়ে যেতে চাই।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘কি জিনিস?’ জিজ্ঞাসা নোয়ান নাওমির। জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল এরিক এন্ডারসনের দিকে। বলল ‘এরিক, তোমার লিস্ট কমপ্লিট?

‘জি স্যার।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

‘দুই কপি রেডি?’ বলল জর্জ অব্রাহাম।

‘জি স্যার।’ এরিক এন্ডারসনের জবাব।

‘ম্যাডামকে পড়ে শোনাও।’ বলল আব্রাহাম জনসন।

জর্জ আব্রাহাম ও নোয়ান নাওমির সামনের সেন্টার টেবিলে কয়েকটা জিনিস রেখে এরিক এন্ডারসন বলল, ‘প্লিজ ম্যাডাম, আমরা চার ধরনের ৬ টা জিনিস নিয়ে যাচ্ছি। এক. মি. শিমন আলেকজান্ডারের পার্সোনাল কম্পিউটার ডিস্ক, দুই. সেভার ডিস্ক, কনফিডেন্সিয়াল পার্সোনাল হার্ডফাইল তিনটা এবং সিসিটিভি’র মনিটর ডিস্কের একটা কপি। আরেকটা জিনিস আমরা চাই, কিন্তু সেটা আমরা এখনো পাইনি।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

‘কি সেই জিনিসটা?’ জিজ্ঞাসা নোয়ান নাওমির।

‘কম্পিউটারের একটা লগে এবং হার্ডফাইলের একটা রেফারেন্সে মি. শিমন আলেকজান্ডারের পার্সোনাল ডাইরির কথা আছে। কিন্তু সেটা আমরা খুঁজে পাইনি।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

প্রায় সংগে সংগেই নোয়ান নাওমি বলল, ‘ওটা উনি সাথেও নিতে পারেন।’

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম।’ বলে এরিক এন্ডারসন সিজার লিস্টের দু’টি কাগজ নোয়ান নাওমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, একটিতে আমাদের দস্তখত আছে, ওটা আপনি রাখুন। অন্যটায় আপনি দস্তখত করে আমাকে দিন, প্লিজ।’

কাগজের শিট দু’টো হাতে নিয়ে নোয়ান নাওমি সেন্টার টেবিলের জিনিসগুলোর সাথে মিলিয়ে নিল এবং কনফিডেন্সিয়াল হার্ডফাইল তিনটির সিরিয়ালগুলোর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর দস্তখত করে কাগজটা এরিক এন্ডারসনকে দিয়ে দিল।

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম!’ বলে কাগজটা হাতে নিল সে।

‘ধন্যবাদ মিসেস শিমন আলেকজান্ডার। ধন্যবাদ অ্যানজেলা। আপনাদের অনেক কষ্ট দিলাম। আমরা উঠছি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম উঠে দাঁড়াল।

‘স্যার, আমি আসছি। আমি আপনাদের এগিয়ে দেব।’

বলে অ্যানজেলা ভেতর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।

পাঁচ মিনিট পর সে ফিরে এল।

‘মা ওঁদের এগিয়ে দিয়ে আমি আসছি।’ বলে অ্যানজেলা দ্রুত বেরিয়ে গেল।

গাড়ি বারান্দায় জর্জ আব্রাহাম অপেক্ষা করছিল অ্যানজেলার।

অ্যানজেলা পৌছল গাড়ি বারান্দায়।

এগিয়ে গেল জর্জ আব্রাহামের কাছে।

‘অ্যানজেলা, তুমি নিশ্চয় কিছু বলবে। এখানে বলবে না আমার গাড়িতে উঠবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

অ্যানজেলার মুখ গম্ভীর। বৃষ্টিপূর্ব মেঘের মতো অনেকটাই। বলল, ‘আপনার ফেভার পেলে গেটের বাইরে পর্যন্ত আপনার গাড়িতে আমি যেতে চাই।’

‘ওয়েলকাম। এস মা।’

বলে জর্জ আব্রাহাম গাড়ির দরজা খুলে অ্যানজেলাকে বসিয়ে নিজে গাড়িতে উঠে বসল।

গাড়ি স্টার্ট নিল।

আগে জর্জ আব্রাহামের গাড়ি চলল। পেছনে এরিক এন্ডারসনের দল।

‘বল মা কি বলবে? ‍তুমি খুব ভেঙে পড়েছ বলে মনে হচ্ছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘স্যার, আমার মা সত্যি কথা বলেননি। বাবার পার্সোনাল সেই ডাইরিটা বাড়িতেই রয়েছে।’ বলল অ্যানজেলা। ভাঙা ভাঙা ভারি কণ্ঠ তার। যেন বুক থেকে কথাগুলো অনেক কষ্ট নিয়ে বেরুচ্ছে।

জর্জ আব্রাহাম তাকাল অ্যানজেলার দিকে।

অ্যানজেলার মুখ নিচু।

জর্জ আব্রাহামের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। অ্যানজেলার বুকের কষ্টটা সে অনুভব করতে পারছে। বলল, ‘মা, ডাইরিটা তুমি নিয়ে এসেছ?’

অ্যানজেলা মুখ না তুলেই মাথা নেড়ে জানাল যে, সে ডাইরিটা নিয়ে এসেছে।

কয়েক মুহূর্ত পরে মাথা তুলল অ্যানজেলা।

তার মুখ ধুয়ে যাচ্ছে অশ্রুতে।

সে শার্টের নিচ থেকে ডাইরিটা বের করে তুলে ধরল জর্জ আব্রাহামের দিকে। বলল, ‘ডাইরিতে কি আছে আমি জানি না স্যার। বাবার বিনা অনুমতিতে বাবার প্রাইভেট কোন কিছুতে আমি কোন দিন হাত দেই না। বাবার প্রাইভেট বিষয় আমার কাছে বাবার মতোই সম্মানের।’

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।

জর্জ আব্রাহাম অ্যানজেলার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি মা। যে মেয়ে তার পিতার প্রাইভেট বিষয়কে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞানে সম্মান করে, সে মেয়ে পিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ কনফিডেনশিয়াল ডাইরি তার বিরুদ্ধ পক্ষের হাতে তুলে দিতে পারে কেমন করে! তুমি ইচ্ছা করলে মা ডাইরিটা ফেরত নিতে পার। তোমার পিতা সম্পর্কে আমাদের অভিযোগ আছে। কিন্তু একজন মেয়েকে তার বাবার কাছে ছোট করতে চাই না আমরা।’

‘স্যরি স্যার। পিতা আমার কাছে অনেক বড়, কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যদি তার অবস্থান হয়, তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থ আমার কাছে তার চেয়ে অনেক বড়। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই আমি বাবার ডাইরিতে হাত দিয়েছি।’ অ্যানজেলা বলল।

‘কিন্তু তারপরও তুমি কষ্ট পাচ্ছ মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘কষ্ট পাচ্ছি, কাঁদছিও স্যার। আরও হয়তো কাঁদতে হবে। এই কান্না এক পিতার জন্যে এক কন্যার কান্না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি শিমন আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে।’ অ্যানজেলা বলল। তার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে এসেছিল শেষ দিকে।

‘ধন্যবাদ মা। গর্বে আমার বুক ভরে যাচ্ছে তোমার মতো নতুন প্রজন্মের জন্য। তোমরা পারবে মা ফাউন্ডার ফাদারসদের স্বপ্নের আমেরিকাকে তাদের চাওয়ার মতো করে গড়তে। গড ব্লেস ইউ অল।’

‘ধন্যবাদ স্যার। আমি আসি।’ অ্যানজেলা বলল।

‘অনেক ধন্যবাদ মা। এস। কি ঘটছে তোমাকে সব জানানো হবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘গুড মর্নিং স্যার।’ বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল অ্যানজেলা।

অ্যানজেলা এগোলো তার বাড়ির গেটের দিকে। স্টার্ট নিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ি।

জর্জ আব্রাহাম জনসন তার সহকারীদের নিয়ে শিমন আলেকজান্ডারের বাড়ি থেকে কম্পিউটার ডিস্কগুলো এবং সিসিটিভি’র মনিটর ডিস্কগুলো পরীক্ষা শেষ করেছে। কনফিডেন্সিয়াল পার্সোনাল ফাইল তিনটি নিজেই দেখছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। শিমন আলেকজান্ডারের বাড়ি থেকে আসার সময় গাড়িতে বসেই শিমনের ডাইরির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। ডাইরির অর্ধেক পর্যন্ত লেখা। কিন্তু কিছু লেখা দেখে বিস্মিত হয়েছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। ডাইরিতে কয়েকটা হিব্রু ভাষায় গল্প লেখা। গল্প গুলোর মধ্যে প্রেমের গল্প রয়েছে, বিজ্ঞানের কল্পকথা রয়েছে, রয়েছে পর্যটকদের অভিযানের গল্প। কিছুটা পড়েছেও জর্জ আব্রাহাম। সবচেয়ে বিস্ময়ের যে ব্যপারটা লক্ষ করেছে, সেটা হলো, ডাইরির প্রতিটি পাতায় কিছু শব্দকে মার্কার দিয়ে কালার করা। বিষয়টা বিস্ময়কর ঠেকেছে জর্জ আব্রাহামের কাছে। রাতে শুতে গিয়ে ডাইরির ঐ বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে। শেষে আকস্মিকভাবে একটা সমাধান খুঁজে পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছে সে।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের দুই চোখ ‍ঘুমে জড়িয়ে এসেছে মাত্র।

তখনদ বেড সাইডে ছোট্ট টেবিলে লাল টেলিফোন বেজে উঠল।

চোখ খুলে একবার তাকাল লাল টেলিফোন সেটটির দিকে। তারপর লাফ দিয়ে উঠে বসেই টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

প্রেসিডেন্টের টেলিফোনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এই লাল টেলিফোনের।

‘ইয়েস এক্সিলেন্সি। আমি জর্জ আব্রাহাম।’ টেলিফোন রিসিভার তুলে নিয়েই বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘মি. জর্জ, আমি ঘণ্টখানেক আগে সফর থেকে ফিরেছি। এসে আপনার রিপোর্ট পেয়েছি। রিপোর্ট আমি কয়েকবার পড়েছি। রিপোর্টের সব বিষয় স্পষ্ট নয়। কিন্তু বিপজ্জনক কিছু তথ্য রয়েছে। আমি এই মুহূর্তেই এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বুঝতে চাই আমি সবকিছু। প্লিজ, আপনি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসুন। সবাইকেই আমি বলছি।’ বলল মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি আসছি এক্সিলেন্সি।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।

‘ধন্যবাদ জর্জ আব্রহাম। আসুন। ও.কে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

জর্জ আব্রাহাম টেলিফোন রিসিভার ক্যাডলে রেখে দ্রুত বেরিয়ে এল বেড থেকে।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে জর্জ আব্রহাম জনসন শিমন আলেকজান্ডারের ডাইরিটা নিয়ে স্টাডিতে গিয়ে বসল। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে মনোযোগের সবটাই নিবিষ্ট করল ডাইরির মধ্যে। প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের আগে ডাইরির সবটা বিষয় তার কাছে পরিষ্কার হতে হবে।

বৈঠক বসেছে প্রেসিডেন্ট ভবনের সিচুয়েশন রুমে।

বিশাল হাফরাউন্ড টেবিলের রাউন্ড অংশে বসেছে ছয়জন। বসেছে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা কমিটির ছয়জন সদস্যই। বাম দিকের প্রান্তে বসেছে প্রেসিডেন্টর নিরাপত্তা উপদেষ্ট ড. রন রবার্টসন, তারপর বসেছে সিআই প্রধান এ্যাডমিরাল মাইকেল মরিসন, সশস্ত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল লিংকন লিভিংস্টেন, সশস্ত্রবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শেরউড এবং একদম ডান প্রান্তে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন। টেবিলের অন্য প্রান্তে প্রেসিডেন্সিয়াল চেয়ার।

প্রেসিডেন্টের চেয়ার খালি।

ঠিক রাত ১২ টা বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি। ঠিক ১২ টায় সিচুয়েশন রুমের প্রেসিডেন্সিয়াল দরজা খুলে গেল।

প্রেসিডেন্ট প্রবেশ করলেন সিচুয়েশন রুমে।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাল। সাবার সাথে হ্যান্ডশেক করে নিজের চেয়ারে বসল প্রেসিডেন্ট। বসেই

প্রেসিডেন্ট বলল, ‘ওয়েলকাম অল জেন্টেলম্যান। দুঃখিত মধ্যরাতে সবাইকে কষ্ট দিয়েছি।’

সবাই তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। উপস্থিতদের মধ্যে তিনিই বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ, সম্মানিত।

‘ইয়োর এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট, মধ্যরাতের এই আহবানে আমরা আনন্দ ও গৌরব বোধ করছি। দেশের বিষয়ে আলোচনায় আপনার সাথে শরিক হবার সুযোগ দেয়ায় আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ জর্জ আব্রাহাম। গড ব্লেস ইউ অল।’

কথার শেষে একটু থেমেই আবার বলে উঠল প্রেসিডেন্ট, ‘আমি সবাইকে সংক্ষিপ্ত ব্রিফ পাঠিয়েছি। অতএব, সমস্যার পরিচয় সবাই জেনেছেন। তবু আমি ড. রন রবার্টসনকে সংক্ষেপে বিষয়টা তুলে ধরতে বলছি।’

প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অন্য সবাইকে সম্বোধন করে বলতে শুরু করল,‘মি. আহমদ মুসাকে যারা কিডন্যাপ করেছিল, তাদের হেড কোয়ার্টার আমাদের কব্জায় এসেছে। সেখানে প্রাপ্ত দলিল দস্তাবেজ থেকে মারাত্মক কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। মি. আহমদ মুসাকে কিডন্যাপকারী মূল সংগঠন Army of Man’s Future-FOAM-এর সামরিক শাখা H3 বা `Hand of the High Hands’-এর দলিল দস্তাবেজ থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, এটা অস্ত্র গবেষণার একটা প্রতিষ্ঠান। তারা বিপজ্জনক দুই ধরনের অস্ত্র বানিয়েছে বা বানাচ্ছে। তার একটা হলো, ‘ম্যাগনেটিক ফায়য়ার ওয়েভ’ (MFW), অন্যটি ‘ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ’ (MDW), প্রথম অস্ত্রটি কি তা আমরা জানলেও এই অস্ত্র আমাদের কাছে নেই। এই অস্ত্র সাইলোতে প্রটেকটেড অবস্থাতেও পারমাণবিক অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্রসহ সব ধরনের অস্ত্র ধ্বংস করতে পারে এই অস্ত্র। দ্বিতীয় ধরনের অস্ত্র MDW আমাদের কাছে।

অত্যন্ত গোপনে ও অত্যন্ত ফলপ্রসূ এই অস্ত্র। এই অস্ত্রের মাধ্যমে টার্গেটের অধীন সব ধরণের অস্ত্র, ইলেকট্রনিক ও মেটালিক সব স্থাপনা নীরবে, লোকচক্ষুর অন্তরালে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়ে টার্গেটেড দেশগুলোকে হাতের মুঠোয় আনা যায়। এই গোপন অস্ত্র দুনিয়ার আর কারও কাছে নেই। কিন্তু প্রাপ্ত প্রমাণ মতে FOAM-এর ‘এইচ থ্রি’ সংস্থা এই অস্ত্র তৈরি করেছে বা করছে। এই দুই ভয়াবহ অস্ত্রই আমাদের উদ্বেগের বিষয়। এই অস্ত্র কেন, এর নির্মাতাদের উদ্দেশ্য কি? এখন করণীয় কি? এই প্রশ্নগুলোর ত্বরিত সমাধান আমাদের প্রয়োজন।

থামল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা রন রবার্টসন।

প্রেসিডেন্ট বলল, ‘ধন্যবাদ রন রবার্টসন।

বলে প্রেসিডেন্ট তাকাল অন্য সবার দিকে। বলল, মি. রবার্ট যে তিনটি জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছেন, তার বাইরে আরও কিছু প্রশ্ন আছে।

ষড়যন্ত্রকারীদের প্রকৃত পরিচয় কি? তাদের প্রকৃত পরিচয় পেলে তাদের উদ্দেশ্যও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত এই অস্ত্র নির্মাতারা আহমত মুসাকে কিডন্যাপ করেছিল কেন? আর শেষ জিজ্ঞসাটা আমাদের সামনে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেটা হলো আমরা তাৎক্ষণিক কোন বিপদের সম্মুখীন কিনা?‘

একটু থামল প্রেসিডেন্ট। তারপর জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘গোটা বিষয় প্রত্যক্ষভাবে ডীল করছেন মি. জর্জ আব্রাহাম। তিনিই প্রথম প্রশ্নগুলোর উপর আরোচনা করুন, আমরা চাই।’

সবাই তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে।

জর্জ আব্রাহাম সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ইয়োর এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, অস্ত্র দু’টির পরিচয় সম্পর্কে মি. রন যা বলেছেন, সংক্ষেপে তার চেয়ে বেশি বলার কিছু নেই। প্রশ্ন দাঁড়ায় অস্ত্রগুলো কি তৈরি হয়েছে, না তৈরী হচ্ছে। এ বিষয়ে সত্যিকার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে নদীতে জাম্প করার আগে অ্যানজেলকে যা বলেছিল, তা থেকে আমার মনে হয়, অস্ত্রগুলো তৈরি হয়ে গেছে। আহমদ….

জর্জ আব্রাহামের কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলল, ‘স্যরি মি. জর্জ আব্রাহাম। আহমদ মুসা মিস অ্যানজেলাকে কি বলেছিলেন?

‘আহমদ মুসা বলেছিলেন, আমার ধরা পড়া চলবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি বিষয়ে গুরুতর একটা তথ্য আছে আমার কাছে।’

জর্জ আব্রাহামের কথা শুনের প্রেসিডেন্টসহ অন্য সবার চোখে-মুখে উদ্বেগের কালো ছায়া নেমে এল।

বলল উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্ট, ‘ধন্যবাদ জর্জ আব্রাহাম, আপনি ঠিকই বলেছেন, আহমদ মুসার এই কথার অর্থ অস্ত্র নির্মিত হওয়ার কথাই বুঝায়। কিন্তু আমার আশাংকা হচ্ছে, আর কোন গুরুতর তথ্য আহমদ মুসার কাছে আছে কিনা? তাঁর মতো শান্ত, ঠাণ্ডা মনের মানুষের উদ্বেগ দেখে আমার এ রকমটাই মনে হচ্ছে।’

‘মি. প্রেসিডেন্ট আমার মনও এটাই বলছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ঠিক আছে, ধরে নেয়া হলো অস্ত্র দু’টোই প্রস্তুত হয়েছে, একদম রেডি। কিন্তু উদ্দেশ্য কি তাদের?

‘মি. প্রেসিডেন্ট এ প্রশ্নেরও জবাব আমাদের কাছে নেই। ওরা ওদের হেড কোয়ার্টার ত্যাগ করার আগে সব ডকুমেন্ট ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকেই অমরা কিছু কিছু তথ্য উদ্ধার করেছি। কিছু ডকুমেন্ট পেয়েছি আমরা শিমন আলেকজান্ডারের বাড়ি থেকে। সেগুলোর অধিকাংশ অজ্ঞাত কোন প্রজেক্ট বড় বড় খরচের হিসাব। আর তার গোপন ডাইরিতে পেয়েছি ‘ফোম’-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা। ‘ফোম’ হবে ভবিষ্যৎ মানব জাতির সেভিয়ার বিশ্বশান্তির রক্ষক, এক বিশ্বরাষ্ট্রের জনক, লর্ড জিহোবার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ক। এসব থেকে যড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু অস্ত্রের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয় না।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ঠিক মি. জর্জ, শিমন আলোকজান্ডারের ডাইরি থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় অনকেখানিই জানা গেল, তাদের উদ্দেশ্যও জানা গেল। কিন্তু আমেরিকার মাটিতে এই সব ভয়াবহ অস্ত্রের আয়োজন কেন তা বুঝা যাচ্ছে না। তাহলে করণীয় আমরা কিভাবে ঠিক করবো?’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে কিছুটা হতাশা।

‘এক্সিলেন্সি, অস্ত্র তৈরি হয় ব্যবহারের জন্যে এবং কোন পক্ষকে টার্গেট করেই। অতএব FOAM-এরও টার্গেট কেউ আছে। সেটা কে? এ প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। আমেরিকার মাটিতে এ অস্ত্র তৈরি হয়েছে, সুতরাং আমেরিকাই টার্গেট, এটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন আছে এক্সিলেন্সি। অস্ত্রগুলো যে আমেরিকায় তৈরি হয়েছে বা আমেরিকায় জমা করা হয়েছে, এর কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। যে হেড কোয়ার্টার আমাদের হাতে এসেছে, সেখানে অস্ত্র-গবেষণারও কোন আলামত আমরা পাইনি। অস্ত্র কোথায় তৈরি হয়েছে, কোথায় জমা করা হচ্ছে, সেটাও অনুসন্ধানের মধ্যে থাকবে। সব মিলিয়ে এ বিষয়গুলো আরও অনুসন্ধান ছাড়া নিশ্চিত কিছু বলা ও করণীয় ঠিক করা সম্ভব নয়। একটাই আমি করণীয় হিসাবে সাজেস্ট করবো। সেটা হলো, ঐ দুই অস্ত্র থেকে আমাদের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে অবিলম্বে কাজ করা দরকার।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

গম্ভীর প্রেসিডেন্ট। কপালে তার হতাশার যে বলি রেখা দেখা যাচ্ছিল তার আরও গভীর হলো। বলল প্রেসিডেন্ট সিআইএ প্রধানকে লক্ষ করে, ‘বলুন এ্যাডমিরাল মরিসন।’

‘এক্সিলেন্সি, আমি মি. জর্জ আব্রাহমের সাথে একমত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নগুলো, অস্ত্রগুলো কার জন্যে, উদ্দেশ্য কি, তার কোন নিশ্চিত জবাব আমাদের কাছে নেই। আহমদ মুসাকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাঁর কাছে মারাত্মক তথ্য রয়েছে, যার কারণে তিনি বলেছিলেন ‘যে কোন মূল্যে তারা আমাকে ধরবে, যে কোন অবস্থায় আমাকে মুক্ত থাকতে হবে।’ তার মুক্ত থাকার বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটির প্রশ্নটিকে। আমার ধারণা এক্সিলেন্সি তথ্য তাঁর কাছে আছে।’ বলল সিআইএ প্রধান।

প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘মি’ জর্জ আহমদ মুসার ব্যাপারে আপনারা সর্বশেষ কি ভাবছেন। নদীর প্রায় সবটাই আপনারা স্ক্যান করেছেন, কোথায় যেতে পারে, তাঁর কি হতে পারে সব সম্ভাবনা নিয়ে আপনারা ভেবেছেন। সবশেষে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?’

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিন্ডেন্ট, নদীতে স্ক্যান, অনুসন্ধান ছাড়াও আমরা রক ক্রিক নদী এবং পটোম্যাক নদীর মধ্যে যেসব টিউব সাবমেরিন আসা যাওয়া করেছে, তার সবগুলোই চেক করেছি। তারাও এ ব্যাপারে বিছু বলতে পারেনি। আমাদের সন্দেহ, আনসিডিউলড কিংবা অপরিচিতি টিউব সাবমেরিনও চলাচল করে থাকতে পারে। সে রকম কোন টিউব সাবমেরিন তাঁকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। এই সন্দেহ আহমদ মুসার অনুসন্ধানকে আরও জটিল করে তুলেছে।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

জর্জ আব্রাহাম থামতেই সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শেরউড বলল, ‘এক্সাকিউজ মি এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আমি আহমদ মুসাকে যতদূর জানি তিনি যদি আবার শশ্রুর হাতে পড়ে গিয়ে না থাকেন, ঈশ্বর করুন তিনি যেখানে যেভাবে থাকুন ঠিক দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন।’

‘আমি জেনারেল শেরউডের সাথে একমত মি. প্রেসিডেন্ট। যে কোন অবস্থায় তার উপর নির্ভর করা যায়। কারও উপর বিপদকে নিজের বিপদ বলে তিনি মনে করেন। ঈশ্বর তাকে সাহায্য করুন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার কথাগুলো আবেগে ভারি।

‘আহমদ মুসাকে আমিও জানি। নিঃস্বার্থ এক বন্ধু তিনি আমাদের। পরার্থে জীবন যাদের তিনি তেমনই একজন মানুষ। তাঁর উপর নির্ভর করতে পারি আমরা। কিন্তু সে নির্ভরতার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা আছে। অথচ আমরা জরুরি অবস্থায় পতিত।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, এই অনিশ্চয়তার বিষটার কথা আমাদের এই মুহূর্তে ভাবা প্রয়োজন, সেটা হলো MFW বা MDW-এর বিরুদ্ধে আমরা কি করবো? প্রতিকারমূলক আমাদের…..।’

মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল লিংকন লিভিংস্টোনের কথার মাঝখানে উঠে দাঁড়ালো জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার হাতে ওয়্যারলেস। বলল, ‘এস্কিউজমি মি এক্সিলেন্সি, স্যরি টু ইন্টারুপট। ওয়্যারলেস জরুরী সিগন্যাল দিচ্ছে। দু’বার রিফিউজ করার পর তৃতীয় সিগন্যাল এসেছে।’

‘মি. জর্জ আব্রাহাম, আপনি কল অ্যাটেন্ড করে আসুন। প্লিজ জেনারেল লিংকন…….।’ সংগে সংগেই বলল প্রেসিডেন্ট।

জর্জ আব্রাহাম সরে গেল ঘরটার একপ্রান্তে।

প্রেসিডেন্ডসহ সবাই নীরব।

অপেক্ষা জর্জ আব্রাহামের ফিরে আসার। ঘরের প্রান্তে পৌঁছেই জর্জ আব্রাহাম ওয়্যারলেসে কল অন করে কথা শুরু করেছে।

কল অন করে নিজের পরিচয় দিয়ে ওপারের কথা শোনার পর তার বিস্ময় বিজরিত কণ্ঠ থেকে একটা উচ্চারণ বেরিয়ে এল, ‘আহমদ মুসা! আপনাকে খুঁজে আমরা হয়রান। কোথায় আপনি?’

জর্জ আব্রাহামের এই উচ্ছাসপূর্ণ কথাগেুলো ঘরের মাঝের টেবিলে বসা প্রেসিডেন্টসহ সবাই শুনতে পেল। সবার চোখ মুখের রং পাল্টে গেল। সবাই তাকাল জর্জ আব্রাহামের দিকে। উন্মুখ হয়ে উঠল সবাই।

কিন্তু কোন কথা নেই জর্জ আব্রাহামের মুখে। সে শুধু শুনছেই। আর মাঝে মোঝে ও.কে, ও.কে করছে। এক সময় চাপা স্বরেই বলে উঠল, ‘ঐ ব্যাপারে কোন নিশ্চিত তথ্য আমাদের কাছে নেই।

আবার চুপচাপ জর্জ আব্রাহাম জনসন। ওপারের কথা শুনছে সে। শোনার এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্ত আপনি একা! ব্যাপারটা কি ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে না? যদি আপনি………….।’

কথা থেমে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। ওপার থেকে আহমদ মুসা তার কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠেছে।

আবার কিছুক্ষণ কথা শুনেই চলেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন। এক সময় সে বলে উঠল, ‘ও.কে, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব কিভাবে?

আবার ওপারের কথা শুরু হলো। শুনতে লাগল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা শেষ করে যখন জর্জ আব্রাহাম জনসন টেবিলে ফিরে এল। তখন টেবিলে প্রেসিডেন্টসহ সবাই অপেক্ষার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। সবার চোখ তার দিকে নিবদ্ধ।

কথা বলল প্রেসিডেন্ট, ‘আহমদ মুসা কোথায়? তিনি বন্দি, না মুক্ত। কোথা থেকে কথা বললেন?

জর্জ আব্রাহাম জনসন চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘এক্সিলেন্সি, ওয়্যাররেসে কথাটা তিনি বলতে চাননি। তবে তিনি বলেছেন যেখানে তিনি আছেন তা সভ্যতার সকল সকল সুযোগ থেকে দূরে। যে ওয়্যারলেসে কথা বলছেন তা অনেকটাই হাতে তৈরি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এবার বলুন জর্জ আব্রাহাম জনসন, কি জানা গেল আহমদ মুসার কাছ থেকে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

বলতে শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন, ‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, ফোম- এর অস্ত্র দু’টি সম্পর্কে আরাত্মক তথ্য জানিয়েছেন আহমদ মুসা! বলেছেন, অস্ত্র দু’টিরই প্রাথমিকভাবে টার্গেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। MFW অস্ত্রটি MDW –এর বিকল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সামরিক অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংসের জন্য দ্বিতীয় অস্ত্রটি ব্যবহার করাই তাদের টার্গেট। কিন্তু ওরা ম্যাহনেটিক ডেথ ওয়েভ (MDW) অস্ত্রটি পুরোপুরি কার্যকরি করতে পারেনি। ট্রিগার পিনটি তাদের সম্পূর্ণ হয়নি। এই অবস্থায় যদি তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায় তাহলে তারা বিকল্প হিসেবে ম্যাগনেটিভ ফায়ার ওয়েভি অস্ত্রটি ব্যবহার করবে। এর পরই তিনি জানতে চেয়েছেন, ম্যাগনেটিভ ফায়ার ওয়েভ অস্ত্রটি মোকাবেলার কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা আছে কি না? আমি তাকে ইতিবাচক জবাব দিতে পারিনি। কারণ আমি যতটা জানি, এর মোকাবিলায় কোন অস্ত্র আমাদের নেই। এই অস্ত্র কারো কাছে আছে বলে আমি জানিও না। তাই এর প্রতিষেধক নিয়ে আমরা ভাবিনি।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

জর্জ আব্রাহাম জনসন থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ জর্জ আব্রাহাম জনসন আপনি ঠিকই জানেন। এরপর আহমদ মুসা কি বলেছেন?’

MFW যদি প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করা থাকে, আর যদি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা না করা যায়, তাহলে ভয়ানক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আহমদ মুসা ওদের হাত থেকে পালানো অর্থ হলো মার্কিন সরকারের সাথে তার সাক্ষাত হওয়া এবং তাদের ষড়যন্ত্রের বিষয় মার্কিন সরকার জানতে পারা। এই অবস্থায় মার্কিন সরকার অফেনসিভে যাবার আগেই তারা অফেনসিভে চলে আসবে এবং উন্মাদের মতো MFW কে ব্যবহার করবে। তাদের এই উন্মাদ পদক্ষেপকে ডিলে করানোর একমাত্র পথ হলো তাদের এই ধারণা দেয়া যে, আহমদ মুসা মরে গেছে বা মার্কিন সরকারের সাথে তার কোন দেখা সাক্ষাত হয়নি। তাহলেই শুধু MFW-এর ব্যবহার আপাতত বন্ধ রেখে কারা আহমদ মুসার সন্ধান করবে এবং মার্কিন সরকারের উপরও চোখ রাখবে।’ থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

জর্জ আব্রাহাম জনসন থামলেও কেউ কোন কথা বলল না। সবার চোখে স্থির দৃষ্টি। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বিপদের আস্মিকতায় স্তম্ভিত ও হতভম্ব যেন সবাই।

ধীরে ধীরে তাদের চোখে-মুখে নেমে এল আতংকের ছায়া। খোদ প্রেসিডেন্টের মনে হলো, তার চারিদিকের আলো যেন দপ করে নিভে গেল। সে যেন েএক গভীর খাদের মুখে দাঁড়িয়ে। কেঁপে উঠল প্রেসিডেন্ট।

‘আহমদ মুসা কি এই জন্যই আত্মগোপনে।’ বলল প্রেসিডেন্ট। তারপর প্রেসিডেন্ট সহজ হওয়ার চেষ্টা করল।

‘এক্সিলেন্সি, তিনি প্রথমে আত্মরক্ষার জন্যেই আংশিকভাবে একটা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু পরে গোটা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেছেন, সেই সাথে আড়ালে থাকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এর পেছনে তার আরও উদ্দেশ্য আছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘সেটা কি ‘ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আহমদ মুসা নিজের থেকেই খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি একটা স্থানকে MFW- এর মোতায়েন কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সেখানে তিনি অভিযান চালাতে চান। তার মতে বর্তমান অবস্থায় ওদের মোবাকেলায় এটাই একমাত্র নিশ্চিত পথ। তিনি………….।’

জর্জ আব্রাহামের কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘স্যরি মি. জর্জ, MFW মোতায়েনের স্থানটা কি আহমদ মুসা জানিয়েছে?’

‘জি না, এক্সিলেন্সি। আমি এ ব্যাপারে তাকে বলেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টা একাধিক কানে যাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে আর সেটা এমন জায়গা, যেখানে বাইরে থেকে যে কোন অভিযান পরিচালনা ঝুকির মধ্যে পড়তে পারে। তাদের টর্গেট করে সরকারী তরফের সামান্য অফেনসিভ সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ হলেই তারা MFW- কে ব্যবহার করে বসতে পারে। আমি সেই চেষ্টাই করছি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

প্রেসিডেন্টের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

সংগে সংগেই কিছু বলল না প্রেসিডেন্ট। কয়েক মুহূর্ত পরে তাকাল নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. রন রবার্টসনের দিকে। বলল, ‘আপনার ভাবনা বলুন ড. রন।’

‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা এক জটিল ও বিপজ্জনক অবস্থায় পড়েছি। যার উপর বলতে গেলে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আহমদ মুসার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নেই আমাদের। আহমদ মুসা লোকেশনটা জানালে হয়তো আমাদের হাতেও একটা অপশন থাকতো। তবে না জানানোর মধ্যে যুক্তি আছে। তথ্য লিক হবে না এমন নিশ্চিত গ্যারান্টি আমরা দিদে পারবো বলে আমার মনে হয় না। আর তথ্যটা যেখানে অত্যন্ত বিপজ্জনক, সেখানে ঐ রকম সাবধানতা অবলম্বন করা স্বাভাবিক। তাছাড়া আহমদ মুসা ঠিকিই বলেছেন, যে ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে গোপন ও এক বা দু’একজনের ছোট টিমের অপারেশনেই প্রয়োজন।’ প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা রন রবার্টসন বলল।

‘আপনারা বলুন, এ অবস্থা থেকে ওয়ে আউটের আর কি পথ আছে আমাদের সামনে?’ বলল প্রেসিডেন্ট সবাইকে লক্ষ করে।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, উদ্যত হয়ে ওঠা একটা ধ্বংসকরি অস্ত্রের মুখে যে ধরণের সাবধানতা প্রয়োজর, আহমদ মুসা আমাদের হয়ে সে ধরণের সাবধানতা অবলম্বন করেছেন, তার জন্য তার প্রতি আমার শত সহস্র ধন্যবাদ। তার সাথে আমিও একমত। তবে আমার আশংকা তাকে কোন ব্যাক আপ না দিলে তার জন্যে এই ভয়ংকর শক্তির বিরুদ্ধে লড়া কঠিন হবে।’ বলল সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল মাইকেল মরিসন।

‘মি. প্রেসিডেন্ট, এ্যাডমিরাল ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আহমদ মুসার অনিচ্ছায় ব্যাক আপ দেয়ার মতো কিছূ করার সুযোগ আমরা দেখছি না। আমরা তাকে এটুকু বলতে পারি, তার কিছু প্রয়োজন আছে কিনা বা আমাদের কিছু করার আছে কিনা।’ বলল জেনারেল শেরউড, সামরিক গোয়েন্দা সশস্ত্রবাহিনী প্রধান।

জেনারেল লিংকন সমর্থন করল জেনারেল শেরউডকে।

এর মধ্যে জর্জ আব্রাহাম জনসন ইশারায় প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে একটু বাইরে গিয়েছিল।

সে ফিরে এল এ সময়।

‘এক্সকিউজ মি!’ বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল প্রেসিডেন্টকে।

প্রেসিডেন্ট চিরকুটটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাল। তাতে লিখাঃ ‘আহমদ মুসার ওয়্যারলেসের ওয়েভলেংথ একদম অপরিচিত এবং চলমান ধারার সাথে মিলে না। ওয়্যারলেসের লোকেশনটা ডেথ ভ্যালির আশেপাশের কোন এক স্থানে। ওয়্যারলেসটির ওয়েভলেংথে হিট করা হয়েছিল, কোন রেসপন্স নেই। একদম ডেড। মনে হয় প্রাইভেট কোন ওয়্যারলেস, অকেশনালি ইউজ হয়।’

পড়া শেষ করে প্রেসিডেন্ট সবার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা যে ওয়্যারলেসে কথা বলেছেন, তার তথ্যগুলো সবাইকে জানাল। শুধু লোকেশান সংক্রান্ত তথ্য চেপে গেল।

একটু থেমে প্রেসিডেন্ট আবার বলল, ‘আলোচ্য বিষয়ে আমাদের কি আর কোন কথা আছে?’

‘গোপন সংগঠন ‘ফোম’ ও এইচ কিউব সম্পর্কে আমাদের যে অনুসন্ধান চলছে, তা চলবে। অন্যদিকে আহমদ মুসাকে তার অভিযানে সাহায্য করার সব রকম সুযোগই আমরা গ্রহণ করবো।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘অবশ্যই জর্জ, আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান আমাদের ওয়েতে চলবে। তবে তা যেন কোনও ভাবেই আহমদ মুসার কাজে বাধা সৃষ্টি না করে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইয়েস এক্সিলেন্সি। সে ব্যাপারে আমরা সাবধান থাকব।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।

জর্জ আব্রাহাম কথা শেষ করার পর কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘আমরা ঈশ্বরকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, একটা ভয়াবহ ষড়যন্ত্র তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ আমরা আহমদ মুসার কাছে। তিনি কিডন্যাপ না হলে এবং শত্রুর কবল থেকে তিনি পালাতে না পারলে ভয়াবহ এই ষড়যন্ত্র আমাদের অজানাই রয়ে যেত। আমরা আহমদ মুসার কাছে আরও কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমেরিকার হয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছেন। আমরা তাঁকে এই কাজের অ্যাসাইনমেন্ট দেই নি, অনুরোধও করিনি। তিনি নিজ থেকেই এ দায়িত্ব নিয়েছেন। একেই বলে পরার্থে জীবন। একেই বলে প্রকৃত মানবতা, মানুষকে ভালোবাসা এরই নাম। এই ভালোবাসার পথে স্থান-কাল-পাত্র কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মানুষকে এমন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার জন্যে মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে হয়। আহমদ মুসা বলেন, তাঁকে মানুষ বানিয়েছে ইসলাম, মানে তার ধর্ম।’

প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তার কণ্ঠ ভারি। মুখ গম্ভীর। চোখে ভাবলেশহীন দৃষ্টি। বলল আবার, ‘অথচ এই ধর্ম ইসলামকে আমরা অনেকে সন্ত্রাসের উৎস বলেছি। আহমদ মুসার মতো নিষ্ঠাবান মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলেছি। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজীকে সন্দেহ করেছি। বাস্তবতা ও আমাদের রাজনীতির মধ্যে যে কত দূরত্ব, আহমদ মুসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।’ থামল প্রেসিডেন্ট।

তার কণ্ঠে অপরিচিত এক আবেগ।

মুহূর্তকাল চুপ থেকে বলল প্রেসিডেন্ট, ‘প্রিয় সহকর্মী সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা উঠছি।’

প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।

সবাই উঠে দাঁড়াল তার সাথে।

এফবিআই প্রধান প্রেসিডেন্টের ‍রুম থেকে বেরিয়ে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে করিডোরের এক পাশে সরে গিয়ে টেলিফোন করল সারা জেফারসনকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সাথে জর্জ আব্রাহামের দেখা হওয়া দরকার এই রাতেই বা সকালে।

পরবর্তী বই

ডেথ ভ্যালি

Top