৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

চ্যাপ্টার

কোলে ঘুমিয়ে পড়া আহমদ আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত আদরের সাথে তুলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল সারা জেফারসন।

সারা জেফারসনের বেডে তার বালিশের পাশেই ছোট একটা বালিশ আহমদ আব্দুল্লাহর জন্যে। মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের ঘরের মাঝখানের ঘরটি আহমদ আব্দুল্লাহর। সেখানেই তার বেড। কিন্তু সারা জেফারসনকে ছাড়া সে শুতে চায় না। ঘুমানোর পর তাকে তার বেডে রেখে এলেও ঘুম ভাঙলে সে ছুটে চলে আসে। মারিয়া জোসেফাইন শেষে অনুমতি দিয়েছে, ‘ঠিক আছে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনের কাছে ঘুমাবে। অনেক দিন পর সারা জেফারসনকে সে দেখছে তো তাই কাছে কাছেই থাকতে চাচ্ছে আবার পালিয়ে না যায় সেই ভয়ে।’ বলে মুখ টিপে হেসেছে মারিয়া জোসেফাইন। সারা জেফারসন হেসে প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘আমি পালাইনি। আমি আহমদ আব্দুল্লাহকে বলেই এসেছিলাম তুমি বুঝতে পারনি।’ কিন্তু আমার কাছ থেকে পালিয়েছিলে।’ বলেছিল মারিয়া জোসেফাইন। সলজ্জ হেসে সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘প্লিজ আপা, সে অতীতের কথা তুল না। মাফ কর প্লিজ।’ মাফ তোমাকে তখনি করেছি আমি। আমি তোমার মতোই তো মেয়ে, তোমাকে বুঝব না। কিন্তু ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। শুধু আমি নই, উনি মানে আহমদ আব্দুল্লাহর আব্বা, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেনি জান, নিজেকে নিজের মধ্যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছিল।’ বলেছে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইনের এই কথার পর সারা জেফারসন কোন কথা বলতে পারেনি। আকস্মিক এক বেদনার ঝলকে শক্ত হয়ে উঠে তার মুখ। একটা অজুহাত তুলে সে পালিয়ে বাঁচে।

আহমদ আবদুল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা আদরের চুমু খেয়ে উঠে বসল সারা জেফারসন। কিন্তু চোখ সরাতে পারল না আহমদ আবদুল্লাহর মুখ থেকে। কপাল ও চোখ ঠিক আহমদ মুসার মতো। গাল, ঠোঁট ও মুখের আদল একদম মায়ের, আবার দাঁত ও হাসি একেবারে আহমদ মুসার। দু’জনের অপরূপ প্রতিচ্ছবি ঘুমন্ত আহমদ আবদুল্লাহর দিকে চেয়ে থাকতে গিয়ে এক সময় মিষ্টি হাসিতে ভরে গেল সারা জেফারসনের মুখ। মনে পড়ল আহমদ আবদুল্লাহর আমেরিকা আসার প্রথম দিনের কথা। সে ও তার মা জিনা জেফারসন এয়ারপোর্টে গিয়েছিল ওদের রিসিভ করতে। সারা জেফারসনকে দেখেই আহমদ আবদুল্লাহ ছুটে এসেছিল। সারার হাতে ছিল ফুলের তোড়া। ফুল দিতে গিয়েছিল সে আহমদ আবদুল্লাহকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ তার ছিল না। সোজা ছুটে এসে সে জড়িয়ে ধরেছিল সারা জেফারসনকে। ‘মাম্মি মাম্মি’ বলে মিষ্টি চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কিছুটা বিব্রত হলেও সারা জেফারসন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। হাতের ফুলের তোড়া মেঝের উপর ছেড়ে দিয়ে তুলে নিয়েছিল আহমদ আবদুল্লাহকে। বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল, ‘মাম্মি নয় বেটা; আন্টি বলতে হয়।’ কিন্তু সংগে সংগেই আহমদ আবদুল্লাহ প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, আমি মাম্মি বলব। আম্মিকে তো আমি আম্মি বলি।’ সারা জেফারসন আর কোন যুক্তি না দিয়ে আহমদ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনকে মাম্মি বলেই ডাকে। মারিয়া জোসেফাইন বলেছে, ‘আমি আন্টি বলতে বলাতে সে একই যুক্তি দিয়েছে, আপনাকে আম্মি বললে ঐ মাম্মিকে মাম্মি বলব না কেন।’ সারার মা জিনা জেফারসন বলেছে, ‘বাচ্চারা বেহেশতের ফুল। যা ভালো লাগে বলুক। তোমরা তাকে কিছু বলো না।’ বলবে কি সারা তাকে! ওর কচি কণ্ঠের সুন্দর মাম্মি ডাক তার প্রাণ ভরে দেয়। প্রতি ডাকেই ইচ্ছা করে বুকে জড়িয়ে ধরতে।

আহমদ আবদুল্লাহর গায়ে কম্বলটা একটু ভালো করে তুলে দেয়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের বুক থেকে। অবুঝ শিশু আহমদ আবদুল্লাহ তাকে যতটা বিব্রত করেছে, তার চেয়ে বড় বিব্রতকর বিষয় তুলেছে মারিয়া জোসেফাইন আপা। জোসেফাইন আপারা আসার কয়েকদিন পর সেদিন অনেক রাতে অনেক গল্পের পর এই বেডেই সারা জেফারসনের মাথা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘সারা, তোমাকে তো আমি নিতে এসেছি।’ আমি কথাটা বুঝিনি। বলেছিলাম, ‘কোথায় নিতে এসেছ?’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমার করে নিতে এসেছি।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘আমি তো তোমার আছিই। না হলে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে আমার কাছে এলে কেমন করে! ধন্যবাদ তোমাকে।’ জোসেফাইন আপা বলেছিল, ‘আমি তোমাকে চিরদিনের করে নিতে এসেছি। আমরা পাশাপাশি থাকব। আমরা দুই স্রোত এক মোহনায় গিয়ে সাগরে মিশব। সে সাগর হবে আমার তোমার ভালবাসার ধন আহমদ মুসা।’ জোসেফাইন আপার কণ্ঠ শেষে এসে আবেগে ভেঙে পড়েছিল। জোসেফাইন আপার কথায় আমার সমগ্র সত্তা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে উঠেছিল। আমি উঠে বসতে গিয়েছিলাম। জোসেফাইন আপা আমাকে উঠতে দেয়নি। শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছিল। তার বাহুবন্ধনে আটকে থেকে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে আমি তার দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম আমার মুখে কোন কথা সরেনি। আমার ভাবনার অতীত এমন একটা বিষয়কে সে কিভাবে আমার কাছে পাড়তে পারল। জোসেফাইন আপাও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর আপাই নীরবতা ভেঙে বলেছিল, ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা দেখছি তোমার! ভাবছ এ প্রস্তাব কেমন করে তোমাকে দিলাম ফরাসি মেয়ে হিসাবে এমন প্রস্তাবের মুখে তোমর মতোই আমার অবস্থা হতো। কিন্তু দেখ, আমি সেই ফরাসি মেয়েই এক সময়ের অকল্পনীয় একটা বিষয় তোমাকে বলেছি! বলতে পারছি কারণ, বাস্তব ধর্ম ইসলাম, জীবনের ধর্ম ইসলাম আমাকে বাস্তববাদী বানিয়েছে; জীবনবাদী বানিয়েছে।’ অসম্ভব নরম কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিল জোসেফাইন আপা। অন্তরের কথা অন্তর স্পর্শ করে। আমারও তাই হয়েছিল। আমি আর পাল্টা কিছু না বলে কেঁদে ফেলে বলেছিলাম, ‘আমিও মুসলিম আপা, আমি এ ব্যাপারে পড়েছি। যেহেতু আল্লাহ একে অপরিহার্য করেননি, তাই একে আমি সম্পূর্ণভাবেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।’ জোসেফাইন আপা আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমিও একে অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্চিত, অনাকাঙ্খিত বলে মনে করি। আমার ও তোমার মতো প্রতিটি মেয়েই এ কথা বলবে। আমাদের মনে এ কথা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন না, জানতেন না? জানতেন। তা না হলে এই ব্যবস্থা তিনি রাখলেন কেন? এ নিয়ে তুমি নিশ্চয় ভাবনি, আমি অনেক ভেবেছি। ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই ব্যবস্থা না রাখলে মানুষের প্রতি অবিচার করা হতো, ইসলাম স্বাভাবিক ও মানবিক ধর্ম হতোনা।’ বলে জোসেফাইন আপা আমাকে আরও কোলে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘তোমার কথা ভাবতে গিয়ে আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে এসেছিল। আর সেই সাথে আমার হৃদয়টা আতংকে কেঁপে উঠেছিল, আল্লাহ এই ব্যবস্থা না রাখলে কি করতাম! আমার তখন কি মনে হয়েছিল জান? মনে হয়েছিল, সৃষ্টির আগেই আল্লাহ যেন তোমার এ কথা জানতেন!’ অসীম মমতায় ভরা জোসেফাইন আপার নরম কথাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। পাল্টা কিছু বলতে না পেরে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না আপা। জীবনের সবকিছুই আমার গুলিয়ে যাচ্ছে।’ জোসেফাইন আপা আমার চোখ মুছে দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, বলতেও হবে না। মনে রেখে, প্রেম স্বর্গীয়। যারা এর পবিত্রতা বজায় রাখে, আল্লাহ তাদের পুরষ্কৃত করেন। তোমার পবিত্র প্রেম, তোমার অতুলনীয় ত্যাগ আমরা কেন, আল্লাহ স্বয়ং বৃথা যেতে দেবেন না। আমি আজ তোমাকে যা বলছি, তা আল্লাহরই ইচ্ছা বোন!’ জোসেফাইন আপার এই কথার পর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছিল আমার মুখ। বলেছিলাম, ‘আর বলো না আপা। আমি ক্লান্ত, আমি দুর্বল, আমার বুক এত ভার সইতে পারছে না। একটা অসম্ভবকে ধারণ করার শক্তি আমার নেই।’ জোসেফাইন আপা ‘থাক, আর নয়’ বলে আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ঘুমাও। আমি একটু মাথায় হাত বুলাই।’ সত্যিই তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, পরদিন সকালে উঠে নামাজ পড়েই আমি তার ঘরে ছুটে গিয়ে তার বিছানায় তাকে ধরেছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্যরি আপা, কাল কতক্ষণ ছিলে জানি না। আমি তোমাকে ‍ভুগিয়েছি। স্যরি।’ জোসেফাইন আপা মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘স্যরি আমাকেই তো বলতে হবে। তোমাকে অনেক কাঁদিয়েছি।’ মনে পড়ল রাতের কথা। রাজ্যের লজ্জা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করেছিলাম, ‘গোটাটাকেই রাতের প্রথম প্রহরের একটা স্বপ্ন বলে মনে কর।’ বলে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু জোসেফাইন আপা একটু ঝুঁকে খপ করে আমার একটা হাত ধরে আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘দুষ্টু, আমার অত কথা সব স্বপ্ন হয়ে যাবে। তা হচ্ছে না….।’ তার কথার মধ্যেই আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলেছিলাম, ‘আমি আহমদকে নিয়ে বাগানে বেড়াতে যাচ্ছি।’

আহমদ আবদুল্লাহর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সারা জেফারসনের চোখ এক সময় অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। শেষে তা আবার দুষ্টুমির আনন্দে ভরে যায়- সে দিনের সে পালানোর কথা মনে পড়ায়। আহমদ আবদুল্লাহর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল, সত্যি জোসেফাইন আপার কোন তুলনা হয় না, চুম্বকের মতো মানুষকে কাছে টানতে পারে, আপন করে নিতে পারে। তার সামনে দাঁড়ালে আমি যেন এক বালিকার মতো ছোট হয়ে যাই। মনে হয়, আমাকে আদেশ দেয়া, বকা, শাসন করা সবই তার অধিকার। আবার কোলে টেনে যখন আদর করে তখন মনে হয় এটা বড় বোনের কাছে ছোট বোনের অধিকার এবং এটা আমার প্রাপ্য।

দরজায় নক করার শব্দে সারা জেফারসন ফিরে তাকাল দরজার দিকে। দেখল দরজায় দাড়িয়ে মারিয়া জোসেফাইন।

‘আহমদ আবদুল্লাহ নিশ্চয় ঘুমিয়েছে? আসতে পারি ম্যাডাম।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, ম্যাডাম অনুমতি দেবে না। সারা অনুমতি দিতে পারে।’ সারা জেফারসনও বলল হেসে।

‘আমি আমার বোন সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’ মারিয়া জোসেফাইনও হেসে বলল।

‘না হলো না, বল আমার প্রিয় বোন সারার কাছে।’ বলল সারা দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে।

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আমার প্রিয় বোন, আমার প্রিয়তম বোন, আমার সোনা বোন, সারার কাছে অনুমতি চাচ্ছি।’

‘যদিও এক বিশেষণের জায়গায় তিন বিশেষণ এসেছে, যা চাওয়ার খেলাফ, তবুও অনুমতি মঞ্জুর।’ বলল সারা জেফারসন যাত্রা দলের অভিনয়ের মতো করে।

হেসে মারিয়া জোসেফাইন প্রবেশ করল ঘরে।

উঠে দাঁড়িয়েছিল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

জোসেফাইন গিয়ে সারা জেফারসনকে ধরে নিয়ে বেডে বসে পড়ল। সারার মাথা কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, ঘুম নষ্ট করতে এলাম। ঘুমাতে যাচ্ছিলে তুমি।’

‘আবার ম্যাডাম?’ শাসনের স্বরে বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ম্যাডামের চেয়ে বড়। আহমদ মুসার কাছ থেকে সব শুনেছি। তুমি একটা মহান আন্দোলনের নেত্রী। তুমি আমেরিকার নতুন প্রজন্মের মুখপাত্র।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন হেসে বলল, ‘নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছি। প্রয়োজনও আর নেই। উনি আমেরিকাকে রাহুমুক্ত করার পর নতুন আমেরিকার জন্ম হয়েছে।ৎ

‘কিন্তু উনি বলেন সারা, রাহুমুক্ত করার চাইতে রাহুমুক্ত দেশ গড়ার কাজ অনেক কঠিন। তোমাদের কাজ আরও বেড়েছে।’

‘উনি যতদূর দেখতে পান, আমি মানে আমরা তা পাই না।’ হেসে বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন মুখ টিপে হেসে সারা জেফারসনের কাঁধের উপর একটা মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘দেখতে না পেলে স্বপ্ন দেখ কি করে, তোমার দাদুদের নতুন আমেরিকা গড়ার স্বপ্ন?’

চমকে উঠে সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের চোখের দিকে। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘উনি বোধ হয় তোমাকে সব বলেন?’

সারা জেফারসনকে আরও নিবিড়ভাবে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘উনি যা করেন, যা বলেন, যা শোনেন, সবই আমাকে বলেন। আমিও বলি। আমাদের মাঝে ব্যক্তিগত বলে কোন বিষয় নেই।’

‘সবটুকু দিয়ে তুমি তাকে ভালোবাস, তাই না?’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, অবশ্যই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সবটুকু দিয়ে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন, তাই না?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।

‘হ্যা, অবশ্যই সারা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

গম্ভীর হলো সারা জেফারসন। বলল, ‘আমিও এটা জানি আপা। তিনি ও তুমি এই দুই ভালো মানুষের জন্যে এটাই স্বাভাবিক। তোমাদের মধ্যে কোন ‘তৃতীয়’-এর উপস্থিতি অসম্ভব আপা, এমন আশা তুমি করতে পার না!’

‘ও তুমি আমার অস্ত্রে আমাকে আক্রমণ করেছ! ভুলে গিয়েছিলাম তুমি পলিটিশিয়ান।’ হেসে কথাগুলো বলে গম্ভীর হলো মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘পারি আমি সারা জেফারসন। কারণ আমি তাঁকে ভালোবাসি, ওঁর প্রতি আমার ভালোবাসাকে আমি চিনি। সে ভালোবাসা একান্ত আমারই ভালোবাসা, ‘কোন তৃতীয়’-এর ভালোবাসা এবং তার স্থানেও এটা নয় সারা।’ মারিয়া জোসেফাইনের গম্ভীর কণ্ঠ সীমাহীন এক আবেগে ভেঙে পড়ল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, দু’টোকে এক করো না। তোমার এই ভালোবাসার কোন দ্বিতীয় নেই।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার ভালোবাসাকে তুমিই জান না সারা। তোমাকে দেখার আগে তোমার স্বপ্নের কথা আমি শুনেছি। একে তুমি তোমার ভবিতব্য মনে কর, সেটা আমি জেনেছি। তোমার চিঠিটাও আমি পড়েছি। তোমার এই ত্যাগ কত বড় তুমি জান না। তার ইস্তাম্বুল মিশনে তুমি অলক্ষে তার পাশে দাঁড়িয়েছ। নিজের নিরাপত্তার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে তার নিরাপত্তার কথা ভেবেছ। সব শেষে অলক্ষেই তুমি ইস্তাম্বুল ছেড়েছ। এই ত্যাগ অমূল্য সারা। ভালোবাসা সাগরের মতো অতল, আর আকাশের মতো অসীম না হলে নীরবে এই ত্যাগ কেউ করতে পারে না সারা। তোমার পবিত্র এই প্রেম তোমার সাথে আমাকে একাত্ম করেছে সারা। তাতিয়ানা, মেইলিগুলি, ফারহানা, মেরীদের কেউ নেই। ওদের হারিয়েছি, দেখারও সৌভাগ্য হয়নি ওদের। তোমাকে পেয়ে হারাতে পারবো না। তাই ছুটে এসেছি আমি তোমার কাছে। তোমাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।’

‘আপা, তোমার কোন কথাই আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু আপা, তুমি অসম্ভব এক দাবি নিয়ে এসেছ। সারাজীবন আমি কুমারী থাকার চেয়েও ওটা কঠিন। সব ভালোবাসাই সফল হয় না, ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েও জীবন কাটানো ….।’

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের মুখ চেপে ধরল। বলল, ‘এসব কথা বলতে হবে না। একটা হালালকে হারাম করতে চেয়ো না।’

‘এটা হারাম করা নয়, একটা হালালকে গ্রহণ করতে না পারা।’ বলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা, একটা হালালকে গ্রহণ না করার অধিকার আছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। যখন কোন হালাল বর্জন করা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন বর্জন করা বৈধ হয় না।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘কিভাবে ক্ষতি করছি বা আমার সিদ্ধান্তে কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে?’ বলল সারা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের গালে একটা চিমটি কেটে আদর করে বলল, ‘ক্ষতি দেখতে পাচ্ছ না, ন? এক. তোমার জীবনের সীমাহীন ক্ষতি, দুই. আহমদ মুসার কষ্ট।’

চকিতে মুখ তুলে তাকাল সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখে তার বিস্ময় ! বলল, ‘আমার যে বিষয়টাকে ক্ষতি বলছ, তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাঁর কষ্ট কিভাবে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা, তোমার কষ্ট অনেকটাই সবাক। সবাই দেখবে, অনেকেই বুঝবে। কিন্তু উনি কোন্ কষ্টের শিকার ! তুমি যে চিঠি ওঁর কাছেঁ লিখেছিলে, তাতে ওঁর অশ্রুর অনেকগুলো ফোঁটার চিহ্ন রয়েছে। আর….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আর বলো না আপা। আমি শুনতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম ….।’ ভেঙে পড়া কণ্ঠ তার থেমে গেল।

‘কি ভেবেছিলে?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভেবেছিলাম তাঁর মতো অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ, জটিল সব মিশন নিয়ে যার কাজ, দুঃখী, বিপদগ্রস্ত মানুষের চিন্তা যার মাথায় সব সময়, তিনি কি করে আমেরিকার একটা মেয়েকে নিয়ে ভাববেন! তার কষ্টের কথা তো আমি চিন্তাই করিনি।’ বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে জেফারসন।

‘না সারা, তুমি তার প্রতি অবিচার করেছ। তিনি শুধু নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষায় এত বড় বড় ও জটিল মিশন নিয়ে কাজ করেন আর সেটা এ জন্যই করেন যে, তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। যারা মানুষকে এভাবে ভালোবাসে তাদের হৃদয়-মন হয় অসম্ভব সংবেদনশীল। তার এই সংবেদনশীল মন এক বোবা যন্ত্রনার সব সময় বিপর্যস্ত হয়েছে। তুমি….।’

সারা জেফারসন হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের মুখ চেপে ধরে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘তুমি এভাবে বলো না আপা। তাঁকে সত্যিই আমি বুঝিনি। আমি মনে করেছিলাম, পাথরের মতো কঠিন চরিত্র ওঁর। এসব ব্যাপার ওঁর জন্যে কোন সমস্যা নয়, আমি আমাকেই শুধু সমস্যা মনে করেছি। আমি আমাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আপা। আরও মনে করেছি আপা, ইসলামের যে কঠোর নৈতিকতা অনুসরণ করেন তিনি, আমার অন্যায় ও অনৈতিক চিন্তা তাঁর কাছে আমলই পাবে না।’

‘কোনটাকে অনৈতিক, অন্যায় চিন্তা বলছ? তোমার চিঠি কিংবা তোমাকে নিয়ে যা ঘটেছে সেটা? এমন ভাবনা, এমন চিন্তা অবৈধ নয়, অনৈতিক নয়। কেউ যদি কারও সম্পর্কে ভাবে আর সে ভাবনা যদি পবিত্রতা ও আইনের সীমা লংঘন না করে, তাহলে সে ভাবনা দোষের নয়, বরং মানবিক। এমন যদি ঘটে তাহলে অন্য পক্ষেরও ভাববার প্রয়োজন। এ অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন। না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে কি করে? আল্লাহ মানুষকে রোবট বা যন্ত্র করে সৃষ্টি করেননি। মানুষকে তিনি আবেগ-অনুভূতিপ্রবণ মন দিয়েছেন। অনেক কিছুই এই মানব মনে আবেগের ঢেউ তুলবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন চিন্তা, কোন আবেগ সক্রিয়তায় পৌছে সীমা লংঘন না করা পর্যন্ত তা পাপ নয়। তুমি এ সীমা লংঘন করনি।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের এসব কথার কোন জবাব দিল না। সে মারিয়া জোসেফাইনের কোলে মুখ গুজে চুপ করে রইল।

মারিয়া জোসেফাইন সারার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আর কি বলব তোমাকে সারা?’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত টেনে নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘আর কিছু বলো না আপা। ভেতরটায় যে ঝড় বইছে, তা আর সইতে পারছি না।’ কথার সাথে সাথে সারা জেফারসনের দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘ঠিক, আর কোন কথা নয়। তুমি ঘুমাও সারা। তবে একটা কথা বলি, তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা তুমি সাজতে চেয়ো না, তা চাইলে ঝড় আরও বাড়বে। আল্লাহকে তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা স্বীকার কর।’

‘আমি জানি না, ভেতরে এত ঝড় কেন? আল্লাহর ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছিঁ না।’ বলল সারা জেফারসন।

‘অন্তরের বেদনা অশ্রু হয়ে তোমার চোখ দিয়ে নামছে, সেই অন্তরে বেদনার কেন্দ্রে খুঁজে দেখো আল্লাহর ইচ্ছা তুমি দেখতে পাবে।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘আপা বুঝতে পারছ না, ঐ খুঁজে দেখতেই ভয় আমার। বুক কাঁপছে।’ বলল সারা জেফারসন অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শান্ত হও বোন। এস শুয়ে পড়।’ বলে মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিল। তার গায়ে কম্বলটা তুলে দিয়ে বলল, ‘আমি যাই বোন সারা !’

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘আর একটা কথা। আমি মা’র সাথে কথা বলতে চাই। বলতে পারি সারা?’

সারা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। একটু ভাবল। একটু ম্লান হাসল। বলল, ‘এটা বুঝি জিজ্ঞাসা করতে হয় আপা। তিনি তোমারও মা। তোমার যা ইচ্ছা সবই বলতে পার।’

‘ধন্যবাদ সারা। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে ৯টা। শোবার আগে আরও আধ-ঘণ্টা সময় তার হাতে আছে। সোফার পাশের ছোট্ট বুকস্ট্যান্ড থেকৈ একটা ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে সোফায় বসল জিনা জেফারসন।

দরজায় নক হলো।

‘এস।’ জিনা জেফারসন বলল।

ঘরে প্রবেশ করল মারিয়া জোসেফাইন।

উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন। বলল, ‘এস মা।’

‘আপনি বসুন মা। আমি বসছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন বসল।

মারিয়া জোসেফাইন গিয়ে জিনা জেফারসনের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসল।

জিনা জেফারসন তাকে সংগে সংগেই টেনে তুলতে তুলতে বলল, ‘করছ কি মা। তুমি আমার মেয়ের মতো বটে, কিন্তু তুমি ফ্রান্সের বুরবন রাজকুমারী। ইউরোপের একটা শ্রেষ্ঠ রাজবংশের রাজরক্ত তোমার দেহে।’

জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে পাশে বসাল।

‘মা, সব মানুষেরই রক্তের রং লাল, সবার একই রক্ত। এর বাইরে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা অদৃশ্য। সৃতরাং মানুষকে বড়-ছোট আমরা করতে পারি না। রাজ্য একটা মানুষকে রাজা করে আর রাজ্য না থাকলে সে সাধারণ মানুষ।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘সাধারণভাবে একথা সত্য, আইনের ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকেও এ কথা সত্য। ইসলামের এসব বিষয় পড়ে জানলাম, মানুষকে বড়-ছোট করা চলে না। কিন্তু মা, আল্লাহর রসূলও বংশকে একটা গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন কোরাইশ বংশ জ্ঞান, মান-মর্যাদায় আরবের শীর্ষে ছিল।’ বলল, জিনা জেফারসন।

‘আপনার কথা ঠিক মা। তবে এখন আমি তো আর রাজকুমারী নই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক আছে মা, কিন্তু মানুষ রাজকুমারী বললে আটকাবে কে। অতএব চুপ থাকা ভালো।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘আচ্ছা মেনে নিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে ‘মেয়েরে মতো’ বলেছেন। আমি কি আপনার মেয়ে নই?’ অনেকটা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন হেসে এক হাত দিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘কে বলল তুমি আমার মেয়ে নও। তুমি সারার চেয়েও আমার ভালো মেয়ে।’

‘কি বলছেন মা, সারার চেয়ে মা-ভক্ত মানুষ আমি কম দেখেছি। সে খুব ভালো।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ভালো, কিন্তু অনেক কথাই আমার শোনে না।’ বলল জিনা জেফারসন।

অনেক কি কথা শোনে না জিজ্ঞাসা করতে ভয় হলো মরিয়া জোসেফাইনের। যদি তার অন্যত্র বিয়ের কথা বলে? তাহলে একটু অসুবিধায় পড়বে মারিয়া জোসেফাইন। মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘মা’ বলেই মেয়েরা অনেক আবদার করার সুযোগ পায়। অনেক কথা না মানারও অধিকার ভোগ করে মা।’

‘জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তো গুরুজনদের কিছু কথা শুনতে হয় মা।’ বলল জিনা জোফারসন গম্ভীর কণ্ঠে।

চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন, কথা উনি তো ওদিকেই নিচ্ছেন। ভাবল মারিয়া জোসেফাইন। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।

‘মা, একটা কথা বলতে চাই।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘অবশ্যই মা, বল।’ সারা জেফারসনের মা জিনা জেফাসরন বলল।

‘একটা জিনিস চাইব মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

জিনা জেফারসন তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। হাসল। বলল, তুমি চাইবে, তা আবার বলতে হয়! চেয়ে ফেল।’

হাসল মারিয়া জোসেফাইনও। বলল, ‘না বলবেন না তো মা?’

‘মেয়ে মায়ের কাছে সাধ্যের বাইরের কিছু চায় না। তাই না দেয়ার কোন প্রশ্ন নেই মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা আমি সারাকে চাই আমার পাশে চিরদিনের জন্য।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারার মা জিনা জেফারসন চোখ তুলে তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে। চোখ তার জিজ্ঞাসা আছে, কিন্তু বিস্ময় নেই। বিস্ময় নেই কারণ প্রথম দিন দেখার সাথে সাথে আহমদ আবদুল্লাহ যে ভাবে ‘মাম্মি’ বলে জড়েয়ে ধরেছিল সারাকে, তাতেই তার মনে ভাবনাটার হঠাৎ উদয় হয়েছিল: ইসলামে তো একাধিক বিয়ের অনুমতি আছে। সে রকম কিছূ কি ঘটতে পারে? ঘটা উচিত? পরের দিনগুলোতে মারিয়া জোসেফাইনের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হয়েছে। মনে হয়েছে, মারিয়া জোসেফাইনও বোধ হয় তারই মত চিন্তা করে। আজ সে কথাটাই মারিয়া বলল। কিন্তু এর পরেও তার মনে জিজ্ঞাসা আমেরিকান সমাজে এটা কতদূর গ্রহণযোগ্য হবে!

সারার মতো সচেতন ও শীষ মর্যাদার আমেরিকানের পক্ষে এ ধরনের জীবন মেনে নেয়া কি সম্ভব!

এসব ভাবতে গিয়ে মারিয়া জোসেফাইনের কথার জবাব দিতে দেরি হয়ে গেল।

‘কি ভাবছেন মা?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ভাবছি তোমার চাওয়া খুব বড় নয়। কিন্তু এক কথায় দুই কথায় এর জবাব নেই।’ বলল জিনা জেফারসন।

‘ঠিক বলেছেন মা। কিছু কথা বলুন আপনি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘দেখ মা, আহমদ মুসা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। ইসলাম দিয়েছে আমাদের নতুন জীবন। কিন্তু এর পরও আমরা আমেরিকান সমাজের একজন। এ সমাজে এমনকি মুসলিমরাও একাধিক স্ত্রীর কথা চিন্তা করে না। এ সবই ভাবার কথা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আপনি মায়ের মতোই বাস্তব চিন্তার কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামে একাধিক স্ত্রীর বিষয়টি সাধারণ নয়, সবার জন্যে নয়, ব্যতিক্রমধর্মী একটা অনুমতি। মানুষের স্বাভাবিক জীবন রক্ষা, অসহনীয় এক জীবন-জটিলতার মানবিক সমাধানের জন্যেই এই ব্যতিক্রমী বিধান করেছেন মানুষের স্রষ্টা মানুষের জন্যে। যে সমাজ এটা ভালো চোখে দেখে না, সেটা সর্বাঙ্গীণ সুস্থ সমাজ নয় মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ঠিক বলেছ মা। সারার বিষয়টা নিয়েই আমি ভেবেছি। সব প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। অন্যত্র বিয়ে হবার পর সুখের সংসারও তারা করতে পারে। কিন্তু দুনিয়াতে এর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রয়েছে। সারার ঘটনা তার একটি। সারার মতো মেয়েরা যা একবার গ্রহণ করে, তা বর্জন করতে পারে না। এ ধরনের ক্ষেত্রের জন্যেই স্রষ্টা ঐ ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রেখেছেন এবং এটাই বাস্তব ও স্বাভাবিক। আমি একমত মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘তাহলে মা, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমি আপনার সাহায্য চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমার সারা তার গ্রান্ড দাদু টিজে মানে টমাস জেফারসনের চরিত্র পেয়েছে। নীতির ব্যাপারে সে অনড়। তাকে নিয়ে আমার খুব ভয়। দেখ মা, আহমদ মুসাকে সেই যে চিঠি লিখে তার সামনে থেকে সরে গেল, এখনও তার সামনে আসেনি। ইস্তাম্বুলে সারা দু’বছর ছিল। শেষ দিকে এক মিশনে আহমদ মুসাও সেখানে যায়। তোমার কাছ থেকেই শুনেছি সারা গোপনে তাকে সাহায্য করেছে এই বিষয়টি গোপন রেখেই ইস্তাম্বুল থেকে চলে আসে। এই সারাকে দিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করানো যাবে সেটা বলা মুশকিল। বুঝতে পারছি না, আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারবো।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘মা, আহমদ মুসার সাথে সে দেখা করেনি, এটা ঠিক, কিন্তু আহমদ মুসাকে সে তার সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালোবাসে মা। এত ভালোবাসে বলেই সারা দূরে থাকছে, দূরে থাকতে পারছে সে।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘আমি জানি মা। সে পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটাকে। আমার কাছে সে সব ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি তো মা! সন্তানের মন আমি বুঝব না। সেও অনেক সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মনে পড়ে একদিনের কথা। সারা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। পুরনো কাপড় বাছতে গিয়ে আহমদ মুসার একটা শার্ট পেলাম। আমি ভাবছিলাম পুরনো কাপড়ের সাথে এটাও বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলব কিনা। আমার কথা শুনে সে আঁতকে উঠেছিল। বলেছিল, ‘না মা, ওঁর শার্ট পুরনো হলেও ওটা ওঁরই শার্ট। ওটা ফেলে দেয়া যাবে না।’ আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে মা তুমি রেখে দাও।’ সারা বলেছিল, ‘তুমিও রাখ মা, ওঁ কোন দিন এলে দিয়ে দিও।’ আমি রেখে দিলাম। সেদিনই রাত দু’টো, আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙে যায়। ঘরের ডিম লাইটে দেখলাম আমার ক্লথ হ্যাংগার খুলে আহমদ মুসার শার্ট নিয়ে গেল সারা। দেখলাম, সে এখনও ঘুমায়নি। সে তো এমন অনিয়ম করে না! আমার কৌতুহল হলো, আমি তার পিছু পিছু গেলাম। তার ঘরের দরজা খোলা। সে ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম, বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে সারা। বালিশে আহমদ মুসার শার্টের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। ‍বুঝা গেল শার্টের উপরই মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে। কাঁদছে সে। অবরুদ্ধ কান্নার চাপে তার দেহ ফুলে ফুলে উঠছে। কোন শব্দ নেই, নীরব কান্না, ঠিক রাতের নীরব প্রহরের মতো। মন বলল, গিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু আবার মনে হলো, নীরবে কাঁদছে সে, কাঁদুক, কাঁদা তার দরকার। আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। আর ঘুমাতে পারলাম না। সারার এই কান্নার শেষ কোথায়? কোন উত্তর আমার জানা নেই। আমারও ‍দুই গণ্ড বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ঢল। জানি না মা জোসেফাইন, আমার সারা এভাবে কত কেঁদেছে।’ জিনা জোসেফাইন থামল। তার কণ্ঠ কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে।

মারিয়া জোসেফাইনেরও দুই চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে। বলল, ‘এই সারাকে আমিও চিনি মা। এ জন্যেই তো আমি ছুটে এসেছি। আমি তাকে নতুন জীবন দিতে চাই মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘তুমি খুব ভালো মা। তোমার মতো মেয়ে আছে, গল্পে শুনলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি গল্প-রূকপথার চেয়েও বিস্ময়কর। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা কত নিশ্ছিদ্র, কত গভীর এবং পারস্পরিক আস্থার বিষয়টা কত দৃঢ়, কত অভঙ্গুর হলে একজন স্ত্রী আরেকজন মেয়েকে নিজের স্বামীর অধিকারে ভাগ বসাতে দিতে পারে! এমন ভালোবাসা, এমন আস্থা বিশ্বাসের কথা পাশ্চাত্যের স্বামী-স্ত্রীরা ভুলে গেছে। তোমাকে ধন্যবাদ মা।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘না মা, পাশ্চাত্যেও এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে। সারা তো পাশ্চাত্যের মেয়ে, তার ভালোবাসা নিশ্ছিদ্র, নিখাদ, নিবিড়তায় বেনজীর। আমি যাকে ভালোবাসি আমার সবকিছু দিয়ে, তার প্রতি সারার এই নিঃস্বার্থ, নির্লোভ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, আমাকে গৌরবান্বিতও করেছে মা।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘বিধাতা কিভাবে তোমাদের দু’জনকে এভাবে এক করলেন! তুমি সারার ভালাবাসাকে নিঃস্বার্থ, নির্লোভ বলছ, কিন্তু তোমার স্বামীকে তার সামনে হাজির করে তুমি তোমার স্বার্থের যে কুরবানী দিলে, তা সারার ত্যাগের চেয়ে অনেক বড়, অসীম, অতল।’ জিনা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।

‘একজন মুসলিম নারীর জন্যে এটা বড় নয় মা। আল্লাহ যখন এটাকে হালাল করেছেন, তখন এর মধ্যে মানুষের জন্যে কল্যাণই রয়েছে। আমার জন্যে, সারার জন্যে আমি সে কল্যাণই চাচ্ছি।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কিন্তু সব মুসলিম মেয়ে কি এটা বুঝে মা? এ নিয়ে কত অশান্তি, কত মামলা-মোকদ্দমার কথাও শুনেছি।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক মা। কিন্তু বাড়তি বিয়ের ক্ষেত্রে অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণ এবং দেহগত কামনার পরিতৃপ্তি এক জিনিস তো নয়। মানুষ যখন আল্লাহর দেয়া একটা ব্যতিক্রমী সুযোগকে দেহগত কামনা পূরণের জন্যে অপব্যবহার করে, তখনই সৃষ্টি হয় তাদের জীবনে অশান্তি। এর আরেকটা কারণ দেহগত কামনা যার উপর বিজয়ী হয়, সে স্ত্রীদের সাথে সুব্যবহার, সমব্যবহার করতে পারে না। এর স্বাভাবিক পরিণতি অশান্তি, ঝগড়া-ফাসাদ এবং মামলা-মোকদ্দমা। আহমদ মুসা, সারা জেফারসন অর্থাৎ আমাদের কেসটা এদের থেকে একেবারেই ভিন্ন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ মা জোসেফাইন।’ বলে জিনা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় মেয়ে তুমি আমার।’

‘প্রথম মেয়ে নয় কেন? আমি সারার চেয়ে বড়।’ বরল মারিয়া জোসেফাইন। তার মুখে হাসি।

‘ঠিক আছে মা, তুমি দ্বিতীয় নও, আমার প্রথম মেয়ে তুমিই।’ হেসে বলল জিনা জেফারসন।

মারিয়া জোসেফাইন জিনা জেফারসনের কোল থেকে মাথা তুলল। হাসিমাখা মুখ তার একটু গম্ভীর হলো। বলল, ‘সামনে এগোবার পথ কি মা, সারা তো এখনও ইয়েস বলেনি।’

‘আমিও সেটা ভেবেছি জোসেফাইন। বলেছি, সারার ব্যক্তিত্ব তার টিজে দাদুর মতো। এই কারণে তাকে আমি ভয়ও করি। আমেরিকায় আহমদ মুসার সবচেয়ে বড় অভিভাবক, আমাদের পরিবারেরও বন্ধু এবং সারার গুরুজন এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম আমার এখানে এসেছিলেন সারার সাথে আহমদ ‍মুসার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। তিনি আমার কাছে সব কথা শুনে সারাকে আর বলতে সাহস পাননি। আমরা একমত হয়েছিলাম সারাকে সময় দেয়া তার মনের স্থিতিশীলতার জন্যে। আমি মনে করি সারাকে কোন বিষয়ে রাজী করানোর ক্ষেত্রে তুমি সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। সারা যেমন তোমাকে ভালোবাসে, তেমনি সম্মানও করে তোমাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তুমি আহমদ মুসার স্ত্রী। পারলে একমাত্র তুমি পারবে সারাকে রাজী করাতে।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘এ বিশ্বাস আমারও ছিল মা। কিন্তু সে বিশ্বাস আমার এখন নেই। আমার সব যুক্তি শেষ। আমার যুক্তি সে অস্বীকার করছে না, শুধু কাঁদছে এবং বলছে সে এ নিয়ে ভাবতে পারছে না।’ বলল জোসেফাইন।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল জিনা জেফারসন। এ সময় সারা জেফারসন ঘরে প্রবেশ করল। বলল, ‘আপা তুমি এখানে, আমি ওদিকে খুঁজে হয়রান।’

‘আহমদ আবদুল্লাহ ঘুমিয়েছে সারা?’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘হ্যা, ঘুমিয়েছে আপা।’ বলল সারা

‘কম্পিউটার থেকে তুলে নিয়ে এত তাড়াতাড়ি তাকে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিলে কি করে? তোমার হাতে জাদু আছে সারা।’

বলেই উঠে দাঁড়াল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘এখন চলি মা।গুড নাইট।’

‘হ্যা, এস মা। ঘুমাতে দেরি করো না যেন।’ জিনা জেফারসন বলল।

‘ঠিক আছে মা। চল সারা।’ বলে হাঁটতে শুরু করল মারিয়া জোসেফাইন।

তারা দু’জন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সারার শোবার ঘরে যাবার পথে একটা বড় ফ্যামিলি লাউঞ্জ ক্রস করছিল। হঠাৎ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে টেনে নিয়ে লাউঞ্জের একটা সোফায় বসে পড়ল। বসেই জড়িয়ে ধরে থাকল সারা জেফারসনকে। বলল, ‘উনি তো আসছেন সারা। আমি কিন্তু এগোচ্ছি।’

সারার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার দপ করে নিভে গেল। সে জোসেফাইনের কোলে মুখ গুঁজে বলল, ‘আপা আমি ওঁর আছি, আমৃত্যু আমি ওঁরই থাকব। কিন্তু আমি ওঁকে আমার করতে পারবো না। ও তোমার, শুধুই তোমার।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের গলা।

‘তার মানে সারা, আহমদ মুসা আমার বলেই তাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করছ?’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘না, না আপা। আমি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করছি না। প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। মাত্র ওঁকে আমার করতে পারছি না।’ সারা জেফারসন বলল কান্না জড়িত কণ্ঠে।

‘ও আমার এ জন্যেই তো?’ বরল মারিয়া জোসেফাইন ভারি কণ্ঠে।

‘না আপা, ওজন্যে নয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি আপা। তোমার কোন কষ্ট, তোমার ক্ষতি আমি বরদাস্ত করতে পারি না, পারবো না।’ সারা জেফারসন বলল।

‘দুঃখিত সারা, আমার আনন্দ, আমার খুশিকে-আমার কষ্ট, আমার ক্ষতি বলছ। তুমি আমাকে এতটুকুই বুঝেছ বোন!’ বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে মারিয়া জোসেফাইন।

সারা জেফারসন জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আমাকে মাফ কর, ভুল বুঝোনা আমাকে আপা। আমি মনে করি, স্বামী মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। এই জায়গাকে সব মেয়েই তার সবকিছু দিয়ে আগলে রাখতে চায়। আমি এই অর্থে কথাটা বলেছি আপা।’ ভারি, কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর তার।

সারাকে আরও কোলে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। ওটা মেয়েদের সবচেয়ে স্পর্শকতার জায়গা। আমারও। আমি দশ বছর ধরে ওঁকে আমার সবকিছু দিয়ে আগলে রেখেছি। উনি তো উড়ন্ত পাখি। এবার আমরা দু’জনে মিলে ওঁকে সামলাব। আজ ‘কবুল’ না বললে তোমাকে ছাড়ছি না।’

‘তুমিও দেখছি ‘কবুল’ শব্দ বলছ। মুসলিম মতে বিয়ের যে বিবরণ পড়েছি। তাতেও স্বীকারোক্তির ক্ষেত্রে ‘কবুল’ শব্দটা দেখেছি।’ বলে হেসে ফেলল সারা জেফারসন।

‘হ্যা সারা, ওটা একটা পরিভাষাগত শব্দ। থাক এ কথা। তুমি ঘুরিয়ে কথা অন্যদিকে নিও না। বল সারা, আমি শুনতে চাই।’

গম্ভীর হলো সারা। বলল, ‘আপা, তোমার এসব কথা কি উনি জানেন?’

‘না সারা। জানেন না। আমি তাঁকে বলিনি। তবে উনি আমাকে এখানে আসার অনুমতি দিয়েছেন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘কেন বলনি?’ বলল সারা জেফারসন।

‘তোমাকে নিয়েই আমার ভয় বেশি। তোমাকে পেলে আমি ওঁকেও পাব। তাই তোমাকেই প্রথম রাজী করাতে চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ওঁকে নিয়ে তোমার ভয় নেই আপা? ওঁ বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর পাথরের মতো কঠিন। আমি কত দুর্বলতা দেখিয়েছি, ওঁর সামান্য দুর্বলতাও কখনও প্রকাশ পায়নি। চিঠিতে তুমি পড়েছ আমি দুর্বত্তদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ওকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্ত ‍এই পরিস্থিতিতেও তিনি সৌজন্যের সীমার মধ্যে থেকেছেন। এই মানুষকে ভয় না করে আমার মতো দুর্বলকে ভয় করছ আপা!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি তাঁর আরও দিক জানি। আবেগের ক্ষেত্রে বরফের মতো ঠাণ্ডা, আর নৈতিকতায় উনি পাথরের মতো শক্ত বটে, কিন্তু তিনি যুক্তির কাছে ‍দুর্বল, মানুষের কষ্টের কাছে আরও দুর্বল। সবচেয়ে দুর্বল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কাছে। সুতরাং তোমাকে যদি পাশে পাই, তাঁকে রাজী করানো আমার জন্যে কঠিন নয়।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের কোল থেকে উঠে বসল। মারিয়া জোসেফাইনের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পাশে আছি। এর বেশি কিছু প্লিজ আমার কাছ থেকে আদায় করতে চেষ্টা করো না। তুমি তো জানই আপা, আমি ওঁর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারি না।’

মারিয়া জোসেফাইন হেসে সারা জেফারসনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘বুঝেছি, তুমি ওঁর মতটা আগে জানতে চাও তো! কিন্তু উনি তোমার মতোই যদি তোমার মত কি তা জানতে চান? কি বলব আমি?’

লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সারা জেফারসনের মুখ। সে মারিয়া জোসেফাইনের বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘বলেছি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না আপা। তোমাদের ইচ্ছার বাইরে যাবার সাধ্য কি আমার আছে?’

হাসল মারিয়া জোসেফাইন। বলল, ‘সারা জেফারসন এক সুপারম্যান এবং আহমদ মুসা আর এক সুপারম্যান। দুই সুপারম্যানের মাঝখানে সাধারণ এক মারিয়া জোসেফাইনের অবস্থা দেখছি ত্রিশংকু!’

সারা জেফারসন পাশ থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে মারিয়া জোসেফাইনের পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘দুই সুপারম্যানকে যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায় সে বুঝি সাধারণ!’

বলে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাতে পালাতে বলল, ‘আমি শুতে গেলাম। গুড নাইট। আসসালাম।’

সেদিকে তাকিয়ে হাসিভরা মুখ নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনও উঠে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল সে তার ঘরের দিকে।

যে দিন সে আমেরিকায় পা রাখে, সেদিনও তার মনে অনিশ্চয়তার যে গুরুভার ছিল তা এখন নেই। আবার প্রাণ খুলে হাসারও পরিবেশ হয়নি। আহমদ মুসার সাথে কোন আলোচনাই হয় নি। অন্যদিকে সারা জেফারসন একটা ‘কিন্তু’ রেখেই দিয়েছে।

আপাতত সব চিন্তা মত থেকে ঝেড়ে ফেলে শোবার বিছানার দিকে এগোলো মারিয়া জোসেফাইন।

ওয়াশিংটানের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর। ভিভিআইপি লাউঞ্জে বসে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, তার স্ত্রী, নাতি, আহমদ মুসার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন, সারা জেফারসন এবং আহমদ মুসার ছেলে আহমদ আবদুল্লাহ।

টিভি স্ক্রীনে দেখা গেল জার্মানীর লুফথানসা বিমান ল্যান্ড করেছে।

লুফথানসাকে ল্যান্ড করতে দেখে জর্জ আব্রাহামের নাতি বলে উঠল, ‘এই লুফথানসা! এই প্লেনেই তো আংকেল আসছেন।’

‘হ্যাঁ দাদা ভাই, এই তো এখনি তোমার আংকেলকে দেখতে পাবে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।

‘তাহলে চল না দাদু প্লেনে যাই। আংকেলকে নিয়ে আসি।’ বলল জর্জ আব্রাহামের নাতি।

‘না দাদু ভাই, সকলে যেতে নেই। প্রেসিডেন্টের পিএস এবং তোমার আরেক দিদিভাই তোমার ঐ সারা আন্টির মা গেছেন তোমার আংকেলকে স্বাগত জানাতে প্লেনে।’ জর্জ আব্রাহাম বলল।

চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসনের। তার চোখে মুখে আনন্দ-অস্বস্তির মিশ্রণ! তার মনে একটা প্রবল তোলপাড়। কেমন করে তার সামনে দাঁড়াবে সে! সেই যে চিঠি লিখে পালিয়েছিল, তারপর সে আর আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়নি। হয়নি নয়, মুখোমুখি সে হতে পারেনি। অবশেষে আজ তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিমান বন্দরে আসা থেকে সে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু মারিয়া জোসেফাইন নাছোরবান্দা। সারা না এলে সেও আসবে না, সাফ কথা। তাই আসতে হয়েছে তাকে। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াবার সময় আনন্দ, তার সাথে প্রবল অস্বস্তি ও লজ্জা। সব মিলিয়ে তার বুকে অদ্ভুত এক কম্পন। সবার মুখে হাসি, কিন্তু সে হাসতে পারছে না। সারা অনুভব করল মারিয়া জোসেফাইন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাকেও তার দিকে তাকাতে হলো। জোসেফাইনের মুখে হাসি। সারা জেফারসনও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু সে এক বিব্রতকর হাসি।

‘সারা তোমার মুখে অর্ধেক হাসি, পুরো হাসি চাই।’ মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘মনো করো না অনেকদিক পরে দেখা হচ্ছে। মনে করো কাল দেখা হয়েছে, আজ আবার দেখা হচ্ছে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

‘ধন্যবাদ আপা, প্লিজ আপা, ওঁর সামনে আমাকে ঐ সব কিছু বলো না যেন। প্লিজ!’ বলল সারা জেফারসন।

‘তুমি কোনভাবে বিব্রত হও, তা আমি চাই না সারা। সারা জেফারসনকে শুধু ভালবাসি না, সম্মানও করি।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘এতক্ষণ তো আহমদ মুসাকে নিয়ে চলে আসার কথা।’

মোবাইল বের করে কল করল প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে। টেলিফোনে রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না।

দ্বিতীয় বার কল করল জর্জ আব্রাহাম জনসন। এবারও কোন সাড়া পেল না ওপার থেকে।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের। উঠে দাঁড়াল সে। বলল সারা জেফারসনকে লক্ষ করে, ‘মা, জন জুনিয়রকে দেখো। আমি আসছি।’

সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনের কল করা খেয়াল করছিল। বলল, ‘আংকেল কোন সমস্যা?’

‘না সারা, তেমন কিছু নয়। আমি প্রেসিডেন্টের পিএস কলিনসকে পাচ্ছি না। ও আচ্ছা, তুমি তোমার মাকে টেলিফোন কর তো। উনি তো সাথেই আছেন?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন, এফবিআই প্রধান।

সংগে সংগেই সারা জেফারসন তার মাকে টেলিফোন করল। রিং হলো। উৎকর্ণ হলো সারা জেফারসন। রিং হয়েই চলেছে। কোন উত্তর নেই ওপার থেকে। রিং ক্লোজ হয়ে গেল।

সারা জেফারসন উদ্বিগ্ন। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, ‘আংকেল, মার কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। এমন তো হবার কথা নয় আংকেল।’

‘আচ্ছা তোমরা বস, আমি ওদিকে দেখছি।’

বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দরজার কাছে পৌছার আগেই একজন এফবিআই অফিসার দ্রুত ঘরে প্রবেশ করল। জর্জ আব্রাহাম জনসনকে স্যালুট দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, সাংঘাতিক খবর স্যার। প্রেসিডেন্টের পিএস, ম্যাডাম জিনা জেফারসন, এয়ার লাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার এবং এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি অফিসারকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে এই ভিভিআইপি লাউঞ্জের প্রবেশ মুখের ঘরটায়।’

‘আহমদ মুসা কোথায়?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, আহমদ মুসাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।’ অফিসারটি বলল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দু’জনেই দাঁড়িয়ে উদ্বেগের সাথে কথা শুনছিল। অফিসারটির কথা শুনে সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সারা জেফারসন। মুহূর্তে যেন তার মুখের সব রক্ত শূন্য হয়ে গেছে।

আর মারিয়া জোসেফাইনের কাছে কথাটা এসেছিল বজ্রাঘাতের মতো। মুখের সব আলো দপ করে নিভে গিয়েছিল তার। তবে অন্ধকারের মধ্যে তার সামনে বিন্দুর মতো একটা আলো জ্বলজ্বল করছিল। তার সাথের সবাই সংজ্ঞাহীন, তিনি নেই। এর অর্থ শত্রুরা কাউকেই হত্যা করেনি। ওঁকে নিশ্চয় কিডন্যাপ করা হয়েছে।

‘হে আমার প্রভু আল্লাহ, তাঁকে নিরাপদ রাখুন’ বলে মারিয়া জোসেফাইন দু’চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

চোখ খুলে ফিরে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। দেখল মরার মতো পাণ্ডুর তার মুখ। উদভ্রান্ত তার দৃষ্টি। তার মানে নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তার নেই। মারিয়া জোসেফাইনর দ্রুত গিয়ে তার পাশে বসল। সান্তনা ও সাহস দেয়ার জন্যে তাকে বাম হাত দিয়ে পেচিয়ে ধরল।

সারা জেফারসনের মাথাটা এলিয়ে পড়ল মারিয়া জোসেফাইনের কাঁধের উপর।

চমকে উঠল জোসেফাইন। দেখল সারা জেফারসন সংজ্ঞা হারিয়েছে!

‘সারা মা, তোমরা একটু….।’

জর্জ আব্রাহম জনসন ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল সারা জেফারসনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সারা জেফারসনের অবস্থা দেখে দ্রুত ছুটে এল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘সারা সংজ্ঞা হারিয়েছে মা?’

‘জি হ্যাঁ, আংকেল। আমি সারাকে দেখছি। আপনি ওদিকে দেখুন আংকেল। ওরা এ সময়ের মধ্যে বিমান বন্দরের বাইরে না যেতে পারার কথা।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ঠিক মা, আমি ওদিকটা দেখি। আমি অ্যাটেনড্যান্টকে বলে যাচ্ছি।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরক্ষণেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করল অ্যাটেনডেন্ট।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনকে শুইয়ে দিয়েছে। অ্যাটেনড্যান্টকে দেখেই বলল, ‘আপনি এক বোতল ঠাণ্ডা পানি আনুন।’

‘এখানেই পানি আছে, আনছি ম্যাডাম।’

অ্যাটেনড্যান্ট চলতে শুরু করেছে। বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে তিনজন পুলিশ প্রবেশ করল।

শব্দ পেয়ে মারিয়া জোসেফাইন পেছন ফিরে তাকাল। দেখল তিনজন পুলিশকে। তাদের চোখে-মুখে শুধু ব্যস্ততা নয়, সংশয়-শংকাও। একটু অবাকও হলো। হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে দেখল ওদের একজনের হাত দ্রুত একটা রিভলবার বের করল। রিভলবারের সাইজ দেখে চমকে উঠল মারিয়া জোসেফাইন। ওটা তো গ্যাসগান! বুঝতে পারল জোসেফাইন যে কি ঘটতে যাচ্ছে।

এই চিন্তার চেয়েও দ্রুত জোসেফাইনর হাত পৌছে গেছে তার কোটের পকেটে। দ্রুত হাত বেরিয়ে এল এক ছোট রিভলবার নিয়ে। হাত উপরে তোলার মতোও সময় ব্যয় করল না মারিয়া জোসেফাইন। পকেট থেকে বের করে হাত নিচু অবস্থানে রেখেই ডিফিক্যাল্ট অবস্থান থেকে ডিফিক্যাল্ট অ্যাংগেলে গুলি করল জোসেফাইন।

পুলিশের রিভলবারও টার্গেটে উঠে এসেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার থেকেই প্রথমে গুলি বেরিয়েছিল। গুলিটা পুলিশ লোকটির একেবারে বুকে বিদ্ধ হয়েছিল।

গুলিটার আঘাত পুলিশ লোকটির দেহে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি করেছিল, তাতেই তার হাত থেকে গ্যাসগানটা খসে পড়ল।

ওদের তিনজনের একজন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আগেই মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার ধরা হাত পুলিশ দু’জনের প্যারালালে উঠে এসেছিল। দ্বিতীয় পুলিশ যখন গ্যাসগানটা নেয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তৃতীয় িএ পুলিশটিও তখন পকেট থেকে রিভলবার বের করেছিল।

কিন্তু মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবার টার্গেটে েএসে মুহূর্তও দেরি করেনি। গুলি করেছিল রিভলবার হাতে নেয়া তৃতীয় পুলিশকে।

সাথী দ্বিতীয় পুলিশ গ্যাসগান হাতে পাবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তৃতীয় পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ততার সাথে তার রিভলবার বের করেছিল। সারা জেফারসন, মারিয়া জোসেফাইন যাকেই পাওয়া যাক সংজ্ঞাহীন করে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ, হত্যার কথা তাদের বলা হয় নি। এই দ্বিধাগ্রস্ততা তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। মারিয়া জোসেফাইনের আগে সে রিভলবার ট্রিগার চাপতে পারেনি। অসহায়ভাবে তাকে বুক পেতে নিতে হলো মারিয়া জোসেফাইনের রিভলবারের গুলি।

মারিয়া জোসেফাইন দ্বিতীয় গুলি করেই তার রিভলবারের নল নামিয়ে নিয়ে এল অবশিষ্ট পুলিশটার দিকে।

মারিয়া জোসেফাইন ইতিমধ্যেই খেয়াল করেছিল, প্রত্যেক পুলিশই গ্যাসগান হাত করার জন্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওরা গ্যাসগান হাতে পেলে এবং সুযোগ পেলে কি হতো সেটাও সে বুঝে ফেলেছে।

গ্যাসগানের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া পুলিশটি গ্যাসগানটি হাতে পেয়ে শোয়া অবস্থাতেই হাত সামনে নিয়ে আসছিল।

মারিয়া জোসেফাইন আগের মতোই রিভলবার টার্গেটে নামিয়ে আনার পরে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করেনি। ট্রিগারে তর্জনি রাখাই ছিল, ট্রিগারটা চাপল মাত্র।

গ্যাসগানটা ফায়ার করার জন্যে সে সামনে এগিয়ে আনার সাথে সাথেই মাথা তুলেছিল। এবার তার মাথাটাই মারিয়া জোসেফাইনের গুলির শিকার হলো। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই তার দেহটা এলিয়ে মেঝের উপর পড়ল।

গুলির শব্দে জর্জ আব্রাহাম জনসনসহ কয়েকজন পুলিশ ও এফবিআই অফিসার কক্ষটিতে ছুটে এসেছে।

সারা জেফারসনও সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে উঠে বসেছে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এসে মারিয়া জোসেফাইনের পাশে দাঁড়াল। একজন পুলিশ অফিসার ছুটে গেল নিহত পুলিশদের দিকে।

‘কি ঘটেছে ম্যাডাম জোসেফাইন? ওরা তো পুলিশ?’ জর্জ আব্রাম জনসনের চোখে-মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুই-ই।’

‘ওরা গ্যাসগান ফায়ার করতে যাচ্ছিল। ওদের পায়ে দেখুন কেটস, ফরমাল বুট নয়। ওরা পুলিশ নয়।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

যে পুলিশ অফিসারটি নিহত তিনজনের দিকে গিয়েছিল, সে ওদের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখে বলল, ‘স্যার, এরা আমাদের পুলিশ নয়। এরা ইউনিফরম যোগাড় করেছে কোনভাবে।’

জর্জ আব্রাহাম জনসন মারিয়া জোসেফাইনের দিকে ফিরে একটা বাউ করে বলল, ‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, আপনি নিজেদেরসহ দুই শিশুরও জীবন রক্ষা করেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’

বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমার দিয়ে ধরে গ্যাসগানটা তুলে নিল। ইন্ডিকেটরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুল লোডেড নয় গ্যাসগানটা। আরও ব্যবহার হয়েছে। এই গ্যাসগানটাই কি আহমদ মুসাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে? না পেছনে এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে?’

স্বগত কথাগুলো শেষ করেই সামনের পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘তুমি ওদিকে দেখ। নিশ্চয় এরা আরও কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। আহমদ মুসাদের দিকে যারা গিয়েছিল, তারা অন্য টিম হতে পারে।’

অফিসারটি স্যালুট করে দ্রুত চলে গেল।

মোবাইল বেজে উঠল জর্জ আব্রাহামের। মোবাইল ধরেই বলল, ‘কি বব কার্টার, ঠিক সময়েই বিমান বন্দর ক্লোজ হয়েছিল? কি খবর ওদিকের?’

‘স্যার, সঙ্গে সঙ্গেই বিমান বন্দর ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্যার, খবর পাওয়া গেছে, বিমান বন্দর ক্লোজ করার ঠিক এক মিনিট আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জের সর্ব বামের একজিট দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে একজন যাত্রীর ফেরত মাল হিসাবে। পুলিশ …।’

অফিসার কার্টারের কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম দ্রুত কণ্ঠে বলল উঠল, ‘যে গাড়িতে উঠেছে এবং যে যাত্রীর মাল বলা হচ্ছে, তার হদিস হওয়া দরকার।’

‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে গাড়ির নাম্বার বের করা হয়েছে। সে নাম্বার সব পুলিশ ও ট্রাফিককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাত্রীটির কোন ট্রেস করা যায় নি স্যার। খোঁজ নেয়া হয়েছে, কোন যাত্রী কাউন্টার থেকে ঐ ধরনের বাক্স ফেরত দেয়া হয়নি এবং ঐ বর্ণনার কোন বক্স স্ক্যানও হয়নি।’ বলল বব কার্টার।

‘ধন্যবাদ বব, তোমাদের কাজে ত্রুটি নেই। এখন দেখ, বাক্সটা ডিপারচার লাউঞ্জ থেকে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে কিভাবে গেল। ভেতরের কারও যোগসাজশ আছে কিনা? আর শোন, ওদের আরও লোক থাকতে পারে ভেতরে, তাদের খোঁজ কর। ও.কে, বাই।’

কথা শেষ করে কল ফল করতেই আবার তার মোবাইল বেজে উঠল।

প্রেসিডেন্টের কল।

তাড়াতাড়ি মোবাইল তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি টেলিফোন করেছিলাম।’

‘ধন্যবাদ। মি. জর্জ আব্রাহাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কি করে এ ঘটনা অমন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ঘটতে পারল!’ বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘স্যার, যেভাবেই হোক ওদের একাধিক লোক ভিভিআইপি লাউঞ্জের এন্ট্রি লাউঞ্জে গোপনে অবস্থান নিয়েছিল। তারা আগেই এই লাউঞ্জের সিকিউরিটির দায়িত্বে দু’জন গোয়েন্দা ও একজন অ্যাটেনড্যান্টকে সংজ্ঞাহীন করে আড়ালে রেখে দেয়। এরপর আহমদ মুসাসহ আমাদের লোকরা এন্ট্রি লাউঞ্জে প্রবেশ করার সাথে সাথেই গোপন স্থান থেকে গ্যাসগান ফায়ার করে তাদেরকে সংজ্ঞাহীন করে ফেলে এবং আহমদ মুসাকে নিয়ে যায় তারা। তাদের পরনে এয়ারপোর্ট পুলিশের পোশাক ছিল। পথে অন্য কক্ষের কয়েকজন তাদের দেখেছে, তাদেরকে ওরা একজন ভিআইপি যাত্রী বলে পরিচয় দিয়েছে এবং অসুস্থ হওয়ার কথা বলে দ্রুত বেরিয়ে গেছে। ওদের কোন গাড়ি বা চিহ্ন কিছুই পাওয়া যায় নি। এই ভয়ানক খবরের…।’

এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামের কথার মাঝখানে প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘আহমদ মুসার খবর পেলেন সেটা বলুন মি. জনসন।’ প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে কিছুটা অস্থিরতা।

‘মি. প্রেসিডেন্ট স্যার, এই মাত্র জানলাম আমরা বিমান বন্দর সিল করে দেয়ার মিনিট দুই আগে অ্যারাইভাল লাউঞ্জ দিয়ে একটা বড় বাক্স বেরিয়ে গেছে। আমরা আশংকা করছি, সেই বাক্সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও গড! তারপর?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমরা গাড়িটার নাম্বার পেয়েছি। গাড়িকে পাকড়াও করার জন্যে চেষ্টা করা হচ্ছে। স্যার, ইতিমধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে। একটু সুখবরও আছে। আমরা যখন আহমদ মুসার ব্যাপার নিয়ে ওদিকে ব্যস্ত তখন আহমদ মুসার স্ত্রী-সন্তানদের কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হয়। পুলিশের ছদ্মবেশে ওরা তিনজন আসে এবং এখানে গ্যাসগান ব্যবহার করে ওদের সংজ্ঞাহীন করার চেষ্টা করে। ম্যাডাম আহমদ মুসা গুলি করে তিনজনকেই হত্যা করে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ভয়ানক এক বিপদ থেকে আমাদের ঈশ্বর রক্ষা করেছেন। ওরা কোথায়? ম্যাডাম আহমদ মুসাকে অভিনন্দন ও সমবেদনা দুই-ই জানাও। আর সারা কোথায়?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘এখানেই স্যার। আহমদ মুসার আকস্মিক খবরে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সারা। এখন ভালো আছে স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এই ঘটনা কারা ঘটাল, কিছু অনুমান করেছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আমেরিকায় যারা আহমদ মুসার শত্রু ছিল সবাই এখন তার বন্ধু, শুধু ইসরাইলি লবি ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী গোয়েন্দা গ্রুপ ছাড়া। এদের দিকেই প্রাথমিক সন্দেহ যায়। তবে ওদের তিনজন লোকের যে ডেড বডি পাওয়া গেছে তা-সহ অন্যান্য আলামত পর্যালোচনা করলে চূড়ান্ত কথাটা বলা যাবে স্যার। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা এফবিআই হেড কোয়ার্টারে মিটিং-এ বসছি স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ। আহমদ মুসার ব্যাপারে তোমাকে আমার বলা কিছু নেই। তার অমূল্য সার্ভিসের বিনিময়ে তার জন্যে যা করার তা করতে আমেরিকা গৌরববোধ করবে। শুধু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হিসাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি উদ্বিগ্ন আহমদ মুসার জন্যে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আমাদের যা সাধ্য, সবই আমরা করবো তার জন্যে মি. প্রেসিডেন্ট স্যার।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আর মি. জর্জ জনসন, আহমদ মুসার পরিবার এবং সারা জেফারসনের পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত হবে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘অবশ্যই স্যার।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ। তুমি টেলিফোনটা ম্যাডাম আহমদ মুসাকে দাও।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইয়েস স্যার। আমি দিচ্ছি।’ বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন মোবাইলটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে মারিয়া জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম, মি. প্রেসিডেন্ট স্যার কথা বলবেন।’

মারিয়া জোসেফাইন সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। মোবাইলটা নিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছ থেকে। ‘গুড মর্নিং, এক্সিলেন্সি। আমি জোসেফাইন।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। মর্নিংটা আমাদের গুড হয়নি। যা ঘটেছে তা নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। আহমদ মুসা আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘জানি এক্সিলেন্সি। আপনাদের এই শুভেচ্ছার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ। কিন্তু তার জন্যে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা তাঁকে উদ্ধারের জন্যে যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করবো। সব আমেরিকানের সমবেদনা আপনাদের প্রতি। আমি জানি, ধৈর্য্য ধরার অসীম শক্তি আপনার আছে।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘ধৈর্য্য ধারণ ও আল্লাহর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এই বিশ্বচরাচরের সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। যা কিছুই ঘটেছে তা তাঁর জানা ও শক্তির বাইরে নয়। সুতরাং তাঁর উপর আস্থা রাখলে কোন কিছুতে উদ্বেগ-কাতর হওয়া বেমানান।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথার মধ্যে আহমদ মুসার কণ্ঠ পেলাম। ধন্যবাদ। আমার অনুরোধ, প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় আমার সাথে কথা বলবেন। আমাদের সারা তো আপনার পাশেই থাকবে। আপনার কোন অসুবিধা হবে না। বাই, ম্যাডাম।’

মারিয়া জোসেফাইন আবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।

মোবাইল রেখে দিল জোসেফাইন।

মারিয়া জোসেফাইনের কথা শেষ হতেই সারা জেফারসন এসে জড়িয়ে ধরল মারিয়া জোসেফাইনকে। বলল, ‘আপা, স্যরি। একদিকে ভীষণ বিপদ, অন্যদিকে আমি আপনাদের বিব্রত করে ফেলেছিলাম।’

‘অবশ্যেই না বোন। বিব্রত হওয়ার প্রশ্ন আবার কেন? আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। ক’দিন থেকে তোমার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। আল্লাহর হাজার শোকর যে তুমি তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়েছ।’ বলল জোসেফাইন।

‘আজ আমি ভালো আছি। কিন্তু হঠাৎ যেন কি হয়ে গিয়েছিল। একটা হাতুড়ির ঘা এসে বুকে আঘাত করল। মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।’ সারা জেফারসন বলল।

মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি নিজেও জান না সারা, অনেক দিনের অনেক দূরত্বের পর তোমার হৃদয় তার অবচেতনে ওর সাক্ষাতের স্বপ্নে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। হৃদয়ের নিভৃত নরম অন্তরদেশ আঘাতটা সহ্য করতে পারেনি, সারা।’

সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলল, ‘ওঁর কি হলো, কেন এমন হলো আপা! ওঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানতা নিশ্চয় যথেষ্ট হয়নি!’

‘ধৈর্য্য ধরতে হবে বোন। আল্লাহ ওর নেগাহবান। উনি আসছিলেন আমাদের বিপদের কথা শুনে, কিন্তু বিপদটা এল ওর উপর। জানি না, আল্লাহর ইচ্ছা কি! তবে জানি সারা, যিনি সবার নিরাপত্তার কথা ভাবেন, আল্লাহ নিজে তাঁর নিরাপত্তার দিকটা দে-খ-বে-ন।’ মারিয়া জোসেফাইনের কণ্ঠও কান্নায় আটকে গেল।

মোবাইলে কথা বলছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা বলার জন্যে সরে গিয়েছিল ঘরের এক প্রান্তে। কথা শেষ হলে সে দ্রুত মারিয়া জোসেফাইনদের দিকে এগিয়ে এল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘সারা মা, তোমার মা-সহ সবাইকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তোমরা হাসপাতালে যাবে নিশ্চয়?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘জি আংকেল, আমরা হাসপাতালে যাব।’ সারা জেফারসন বলল।

‘তাহলে এস মা, বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমাদের গাড়ি সাথে যাবে, কিন্তু তোমরা পুলিশের গাড়িতে যাবে। এস মা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

চলতে শুরু করল সবাই।

‘এত দুঃসাহসিক, সুপরিকল্পিত কাজ কারা করল বলে আপনার ধারণা আংকেল?’ বলল সারা জেফারসন।

‘জায়নবাদী লবি বা তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকেই প্রথম নজর। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সরকারের সাথে তাদের চ্যালেঞ্জে আসাটা বাস্তব মনে হচ্ছে না। কিন্তু তারা ছাড়া তো মি. আহমদ মুসার বিরোধী উল্লেখযোগ্য কোন শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। বিষয়টা আমার কাছে এখনও জটিল। আলামতগুলো নিয়ে আরও ভাবতে হবে আমাদের। ম্যাডাম জোসেফাইনের কারণে আমরা ওদের তিনটা লাশ পেয়েছি। ঐগুলো এখন আমাদের মূল্যবান লিংক। এছাড়া আমরা সব অপশনই চেক করছি।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল, যারাই এটা করুক। তারা শক্তির নয়, বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ হত্যাও এড়িয়ে গেছে।’ বলল সারা জেফারসন।

দাঁড়িয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘একটা মূল্যবান পয়েণ্ট তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু মোসাদ কিংবা ইরগুন জাই লিউমির নেই।’

‘এমন নতুন শত্রু কে হতে পারে? আর ওরা আহমদ মুসার সাথে আমাদেরকেও কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল কেন? কেন শুধু কিডন্যাপ, কেন হত্যা নয়? আংকেল আমার মনে হয় এ প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ধন্যবাদ মা সারা। প্রশ্নগুলো খুবই ভাইটাল। বাচ্চা অথবা তোমাদের সবাইকে কিডন্যাপ করার একটা অর্থ হতে পারে, তারা আহমদ মুসার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। আর চাপের বিষয়টি প্রমাণ করে, তারা বড় অন্য কিছু পেতে চায়। সেটা কি? শত্রুকে চেনার আগে বোধ হয় এ প্রশ্নের জবাব মিলবে না।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘আংকেল সবদিকের বিচারে ঘটনাকে খুব বড় মনে হচ্ছে। বড় বলেই ওঁর নিরাপত্তার ঝুঁকিও বড় হতে পারে। ওরা খুব বেশি সময় আমাদের নাও দিতে পারে।’ বলল সারা জেফারসন।

‘ঠিক মা সারা, এটাই আমাদের জন্যে ভাবনার বিষয়।’ জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।

‘ধন্যবাদ আংকেল।’ বলল সারা। গাড়ি বারান্দায় তারা এসে গিয়েছিল।

পরপর তিনটা গাড়ি দাঁড়ানো।

মাঝখানে শেভ্রলেট কার। ড্রাইভিং সিটে একজন পুলিশ।

জর্জ আব্রাহাম জনসন দ্রুত এগিয়ে গাড়ির দরজা খুলে মারিয়া জোসেফাইনেকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ম্যাডাম আসুন।’

‘থ্যাংকস আংকেল’ বলে গাড়িতে উঠল মারিয়া জোসেফাইন।

ওপাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে সারা জেফারসন। পেছনের বেবি সিটে উঠল আহমদ আবদুল্লাহ।

সামনে ও পেছনের দুই গাড়িতে উঠল পুলিশের দুটি দল।

চলতে শুরু করল তিনটি গাড়ি।

চোখ থেকে কাপড়ের বাঁধন খোলা হলে আহমদ মুসা দেখল সামনে একটা সুন্দর বিজিনেস টেবিল। তার ওপাশে আরও একটা সুন্দর টেবিল। মনে হচ্ছে যেন কোন সিইও ওখানে বসেন।

আহমদ মুসাও সুন্দর একটা কুশন চেয়ারে বসে। ঘরে আর কেউ নেই।

কে একজন তাকে একটা লিফট থেকে নামিয়ে এনে এখানে বসিয়েছে। সেই তার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে গেছে। আহমদ মুসা তাকে পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে। তার পরনে সাদা পোশাক। প্যান্ট, শার্ট, কোট, বুট সবই সাদা। মুখেও সাদা মুখোশ। লাভ হলো না লোকটিকে দেখে।

আহমদ মুসা আন্দাজও করতে পারছে না তাকে কোথায়, কত দূরে আনা হয়েছে ! গত রাতেই তার জ্ঞান ফিরেছে! তখন সে একটা নরম বিছানায় শুয়ে ছিল। হাত ও পা তার বিশেষ শেকলে লক করা থাকলেও চোখ খোলা ছিল। ঘরটাতে খাট ছাড়া কিছুই ছিল না, একদমই নিরাভরণ। জানালা ছিল না, একটা দরজা। ঘরটা ছিল এয়ার কন্ডিশনড। অনেকটাই উন্নত জেলখানার মতো। এমন উন্নত জেলখানার মালিক কে? কারা তাকে ধরে এনেছে? আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝতে পারছে ক্লোরোফরম গ্যাসগান ব্যবহার করে তাদেরকে সংজ্ঞাহীন করে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

দরজার দিক থেকে পায়ের শব্দ কানে এল। পেছনের চিন্তা থেকে আহমদ মুসা বর্তমানে ফিরে এল।

দরজা দিয়ে প্রবেশ করল প্রায় ছয়ফুট লম্বা একটা স্লিম মানুষ। তার পরনেও সেই সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, সাদা কোট এবং মুখেও সেই সাদা মুখোশ।

লোকটি ঋজু দেহে সামরিক কায়দায় প্রবেশ করল ঘরে। ‘গুড মর্নিং’ বলে এসে সেই চেয়ারে বসল। তার কথার স্বরে আহমদ মুসার মনে হলো লোকটির বয়স চল্লিশের আশে-পাশে হবে।

লোকটি বসেই বলল, ‘স্যরি আহমদ মুসা, আপনার হাতে শেকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। এটা ঠিক শত্রুতা নয় আহমদ মুসা। আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই এটা করা হয়েছে।’ বলল মুখোশধারী লোকটি।

‘কিন্তু নিরাপত্তার ভয় তো আসে শত্রুর কাছ থেকেই।’ আহমদ মুসা বলল।

‘তা ঠিক। শত্রু না হলেও আপনাকে ধরে আনার কারণে আপনি আমাদের শত্রু মনে করবেন। সে জন্যেই নিরাপত্তার চিন্তা।’ বলল মুখোশধারী।

‘এটা মনে করার ব্যাপার নয়। শত্রুতা তো হয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘দুঃখিত। আমরা আপনাকে ধরে এনেছি বটে, কিন্তু আমরা আপনার সহযোগিতা চাই।’ বলল মুখোশধারী।

‘সহযোগিতা চাওয়ার ধরন আপনাদের চমৎকার তো!’ আহমদ মুসা বলল।

‘ঠিক বলেছেন। খাব না তবু খেতে বাধ্য করার মতো। আমার জন্যে কিছু করবেন না, তবু করতে বাধ্য হওয়ার মতো। সহযোগিতা এমনও হয় মি. আহমদ মুসা।’ বলল মুখোশধারী।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তার মানে আমাকে বাধ্য হয়ে সাহায্য করতে হবে।’

‘ঠিক বাধ্য হয়ে নয়, সাহায্য আমাদেরকে করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

‘যদি না করি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ভালো কাজে সহযোগিতা করবেন না কেন? অবশ্যই করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

‘সেটা আপনাদের মতে ভালো কাজ, আমার মতে ভিন্ন হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘অনেক সময় নিজের ভালো না লাগলেও অন্যের ভালো লাগা কাজও করতে হয়। আমরা সেটাই আপনার কাছে চাই।’ বলল মুখোশধারী।

আহমদ মুসা বুঝল ওরা তার সাহায্য আদায় করে নেয়ার জন্যেই তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। কি সে সাহায্য? হিটলার ও সোভিয়েতরা বিজ্ঞানীদের ধরে নিয়ে আসত তাদের ইচ্ছামত গবেষণা করিয়ে নেয়অর জন্যে। কিন্তু তাকে ওরা কি জন্যে এনেছে। কারা ওরা? আহমদ মুসা একবার ভাবল, তাকে জিজ্ঞাসা করবে কিনা যে, তারা কি সাহায্য চায়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মত পরিবর্তন করল। জিজ্ঞাসা করার অর্থ হবে আমি দূর্বল হয়ে গেছি, সাহায্য করতে আমি রাজি।

‘আপনার চাওয়া আমার চাওয়া নয়।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এখন নয়, তবে হবে। আমরা অপেক্ষা করবো।’ বলল মুখোশধারী।

‘তার মানে সাহায্য না করা পর্যন্ত বন্দী থাকতে হবে?’ আহমদ মুসা বলল।

‘সেটাই আমাদের ইচ্ছা। তবে এটা ঠিক বন্দী থাকার মতো ব্যাপার নয়। বলতে পারেন, মেহমান হিসাবে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা। আমাদের আশা যে, আপনি নিজের ইচ্ছাতেই আমাদের ভালো কাজে সাহায্য করবেন।’ বলল মুখোশধারী।

কথা শেষ করে আবার বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, কোন্ ভালো কাজে আমরা আপনার সাহায্য চাচ্ছি তা আপনার জানতে ইচ্ছা করছে না?’

‘বিষয়টা যেহেতু আমার নয়, আমার স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তাই আমার কোন আগ্রহ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমাদের আগ্রহ আছে আপনাকে জানানোর। তবে সে সময় আসেনি, এলে সবই আপনি জানবেন। তবে আপনার মানসিক প্রস্তুতির জন্যে কিছু আপনার জানা দরকার। আমরা পারমাণবিক সব ধ্বংসাত্মক অস্ত্র থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করতে চাই, দুনিয়াকে রক্ষা করতে চাই এবং সেটা যুদ্ধ করে নয়, বুদ্ধির জোরে। আমাদের এই প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্যে আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান লোকের সাহায্য দরকার।’

চেহারায় প্রকাশ না পেলেও মন তার চমকে উঠল। এরা তাহলে ছোট-খাট কোন গ্যাং নয়, বড় কোন ষড়যন্ত্রের সাথে এরা জড়িত। আণবিক মারণাস্ত্রের হাত থেকে দুনিয়াকে রক্ষা করবে বুদ্ধি দিয়ে! বিষয়টা কি? কি লক্ষ্য এদের? এরা আরেক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রধারী কিনা কিংবা সে রকম কোন অস্ত্রধারীর পক্ষে কাজ করছে কিনা? অন্য সকলের মারণাস্ত্র ধ্বংস করা গেলে নিজেদের সকলের মাথার উপর চেপে বসা সহজ হয়, সে রকমের কোন ব্যাপার কি না? প্রথমে এরা কার অস্ত্র ধ্বংস করতে চায়? আমেরিকার? এরা আমেরিকায় বসে যখন কাজ করছে, তখন এটাই স্বাভাবিক। এরা কি আমেরিকান, না অন্য কোন দেশের? সামনে বসে যে লোকটি কথা বলছে, তার উচ্চারণ আমেরিকান হলেও তিনটি মূল শব্দ বিদেশী ছিল- জাপানী, রুশ ও জার্মান ভাষার। শব্দের এই সমন্বয় বিস্ময়কর!

এসব চিন্তায় আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে নীরব দেখে মুখোশধারীই আবার প্রশ্ন করল, ‘কি ভাবছেন মি. আহমদ মুসা?’

‘ভাবছি আপনাদের ভালো কাজটি নিয়ে না, ভাবছি আপনারা কারা! আপনাদের একটা ভালো কাজের জন্যে আমাকে অপহরণ করে নিয়ে এলেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘এটা আপনি প্রথমেই ভাববেন, সেটা আমরা জানি। কিন্তু ভেবেও আপনি কুল পাবেন না। আমাদের পরিচয়ের আপনার কোন প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের পরিচয় আমরা বলব না। তবে এটুকু বলে দিতে চাই, আমরা জেনারেল শ্যারনদের মোসাদ কিংবা ইরগুনজাই লিউমি কিংবা আপনার পুরনো শত্রুদের কারও মতো নই। আমরা হৈ চৈ করি না অথবা ঘটনা ঘটিয়ে শত্রুকে সচেতন করি না বা শত্রুর সংখ্যা বাড়াতে চাই না। লক্ষ অর্জন আমাদের টার্গেট। নীরবে কাজ করে সেই লক্ষে পৌছতে চাই। তাই বলে আমরা দুর্বল নই, কাজ উদ্ধারের জন্যে রক্তসাগরও পাড়ি দিতে পারি আমরা।’ বলল মুখোশধারী।

‘কাজ উদ্ধারের জন্যে সবাই এটাই করে। ওরাও করে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘হ্যাঁ, এটা ওরাও করে, আমরাও করি। কিন্তু আমরা এবং ওরা এক নই। এই দেখুন না, আমাদের তিনজন কমান্ডো আপনার মতো করেই আপনার স্ত্রী ও সারা জেফারসনকে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিল এয়ারপোর্টেই। আমাদের হিসাব ও সেখানকার অবস্থার বিচারে শতভাগ সাফল্য- নির্দিষ্ট ছিল। তার উপর আপনি অপহৃত হবার খবরে আপনার প্রেমিকা সারা জেফারসন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আপনার স্ত্রী মারিয়া জোসেফাইন। সুতরাং পরিস্থিতি আমাদের আরও অনুকুল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আপনার স্ত্রী আমাদের তিনজন কমান্ডোকেই গুলি করে হত্যা করেছে। একসাথে তিনজন কমান্ডো প্রাণ হারাল আমাদের এই প্রথম। এই ঘটনা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার কোন সিদ্ধান্ত আমরা নেইনি। এমনকি আপনাকেও এ বিষয়টি জানাইনি কিংবা আপনার উপর এই হত্যার কিছু প্রতিশোধ নেব, সে রকম সিদ্ধান্তও আমরা নেইনি। এর কারণ লক্ষ অর্জনকেই আমরা গুরুত্ব দেই। এ ক্ষেত্রে আমরা যে কোন ক্ষয়-ক্ষতিকে স্বাভাবিক বলে মনে করি।’ মুখোশধারী বলল।

মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসনকে কিডন্যাপের চেষ্টার বিষয়টি বিস্মিত করল আহমদ মুসাকে। এরা জোসেফাইন ও সারাকেও কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করেছিল! তার উপর চাপ সৃষ্টির উপকরণ বানাতে চেয়েছিল ওদেরকে? আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। আল্লাহ এক বড় বিপদ থেকে তাদের বাঁচিয়েছেন। তার মনে প্রশ্ন জাগল, কি সাহায্য বা কোন কাজে তারা আমাকে ব্যবহার করতে চায়? নিশ্চয় সেটা সাংঘাতিক বড় কোন কাজ এবং তারা জানে সে কাজে আমি তাদের সাহায্য করতে চাইব না। এ জন্যেই তারা আমার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির জন্যে জোসেফাইন ও সারাকে ব্যবহার করতে চায়।

মুখোশধারী থামলে আহমদ মুসা বলল, ‘তার মানে আপনারা আমাকে বাধ্য করার জন্যে পণবন্দী হিসাবে ওদেরকে আটক করতে চেয়েছিলেন। এটা তো শ্যারনদেরই চরিত্র।’

‘না এটা শ্যারনদের চরিত্র নয়, কঠিন সব কাজ উদ্ধারের জন্যে এমন দুর্বল শিকারদের পণবন্দী করার রেওয়াজ অনেক পুরনো। এই পুরনো কাজটা করতে চেয়েছিলাম নির্দোষ উদ্দেশ্যে।’ বলল মুখোশধারী।

হাসল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, এরা যারাই হোক শ্যারনদের চেয়ে বিপদজনক। একটা জঘন্য পরিকল্পনা বা হিংসাত্মক কাজের পক্ষে ওরা এত ঠাণ্ডা মাথায় পক্ষ নিতে পারে না। আর সাথীদের রক্তের মূল্য আছে শ্যারনদের কাছে, কিন্তু এদের কাছে নেই। এরা সাথীদের নিহত হওয়াকে একটা স্বাভাবিক ঘটনামাত্র মনে করে। এদের সীমাহীন নৃশংসতার প্রমাণ এটাই। এরা একেবারেই কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার। এদের সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। এরা জোসেফাইনদের আবার কিডন্যাপ করার চেষ্টা করবে না তো? মনে হয় এই মুহূর্তে সেরকম কিছু করতে যাবে না তারা। তাদের ‘ভালো কাজে’র জন্যে আমাকে রাজী করাতে না পারলে শেষ অস্ত্র হিসাবে তারা জোসেফাইনদের কিডন্যাপের চিন্তা করতে পারে। তবে এ বিষয়ে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ওদের ‘ভালো কাজটা’ কি? নিশ্চয় মারাত্মক কিছু। কোন ছোট কাজের জন্যে আমাকে তারা বেছে নেয়নি? কেন তাদের নিজের লোক নয়? শুধু সাহস, শক্তি ও বুদ্ধির জন্যে আমাকে তারা বাছাই করেছে? শুধু এ জন্যেই আহমদ মুসাকে বাছাই করবে তা মনে হয় না। মনে হয় কাজটা এমন হতে পারে, আমার নাম-পরিচয় সে কাজটা করার জন্যে সুবিধাজনক। কি কাজ হতে পারে?

এই ভাবনার মধ্যে আহমদ মুসা আনমনা হয়ে পড়েছিল।

‘কি ভাবছেন আহমদ মুসা?’ বলল মুখোশধারী।

‘ভাবছি আপনাদের ‘নির্দোষ উদ্দেশ্য’ নিয়ে। উদ্দেশ্য নির্দোষ হলে দূষণীয় পথে তা কেউ অর্জনের চেষ্টা করে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘নীতি যারা তৈরি করেছে এটা তাদের কথা। আমাদের কথা হলো, ভালো কাজ করতে হবে এটাই শেষ কথা। ভালো কাজটি যেভাবে যে পথেই সম্পন্ন করা যাক, তা করতে হবে।’ বলল মুখোশধারী।

‘আর ভালো কাজের সংজ্ঞাও তাহলে আপনাদের নিজস্ব?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরা যেটা ভালো মনে করি, ভালো জানি, সেটাই নির্ধারণ করি। এটাই স্বাভাবিক।’ বলল মুখোশধারী।

কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল মুখোশধারী। বলল, ‘আমি উঠছি মি. আহমদ মুসা। নতুন পরিবেশে নতুন একটা নিয়মে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। প্রয়োজনে আপনার সাথে আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা সেখানে আছে। ওটাকে ঠিক বন্দীখানা ভাববেন না। আরামদায়ক এক নিরাপত্তা কাস্টোডি ওটা। আপনার মতো যাদের আমরা সাহায্য চাই, তাদেরকে আমরা ওখানেই রাখি।’ বলে মুখোশধারী দরজার দিকে একধাপ এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনি কত বার কিভাবে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছেন, সব রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে। পালাবার চিন্তা বাদ দিয়ে প্রশান্ত মন নিয়ে থাকবেন, এটা আমার আশা।’

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুখোশধারী।

তার যাবার সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

আহমদ মুসা বসেছিল।

তার পেছনে বাতাস আন্দোলিত হবার শব্দ হলো। পেছনে তাকাল সে। দেখল, একটা দরজা খুলে গেল। ওটা সেই লিফটের দরজা, যে লিফটে সে এসেছিল।

লিফটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তিনজন।

তিনজনের হাতেই কারবাইন জাতীয় ক্ষুদ্র ভয়ংকর অস্ত্র। তাদের তিনজনের মুখেই মুখোশ।

তাদের তিনজনের হাতের কারবাইনই আহমদ মুসার বুক লক্ষে তোলা। কারবাইনের ট্রিগারে তাদের তর্জনি।

দু’জন এসে আহমদ মুসার দু’পাশে দাঁড়াল। তাদের কারবাইনের লক্ষ আহমদ মুসার দিকে স্থির।

তৃতীয়জন কারবাইনটা কাঁধে ঝুলিয়ে পকেট থেকে এক খণ্ড কালে কাপড় বের করে আহমদ মুসার চোখ বেঁধে ফেলল।

আহমদ মুসা হাসল। তারপর বলল, ‘তোমরা আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, তা দেখাতে চাও না। তোমাদের অফিস কোথায়, এখানে কি আছে তা আমার চোখ থেকে আড়াল করতে চাচ্ছ। তার মানে তোমরা ভয় কর যে, আমি তোমাদের বন্দীখানা থেকে পালাতে পারি?’

তিনজনের কেউ কিছু বলল না। তার দিকে তাকালও না। নীরবে তারা আহমদ মুসাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে লিফটে ঢোকাল।

লিফটটির একটি বৈশিষ্ট হলো এর চলাটা টের পাওয়া যায় না। চলছে কিনা, কোন্ দিকে চলছে, উপরে না নিচে, তা বুঝা যায় না। এরপরও আহমদ মুসার সচেতন স্নায়ুতন্ত্রী তার উপর গতির অদৃশ্য চাপ থেকেই বুঝতে পারল, লিফট নিচে নামছে। আহমদ মুসা কিছুটা বিস্মিতই হলো। মুখোশধারীর সঙ্গে যে কক্ষে দেখা হলো, সেখানেও তাকে লিফট থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল নিচের দিকে। তখন আহমদ মুসা বুঝেছিল, তাকে আন্ডার গ্রাউন্ড কোন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ি করে তাকে এনে যে কক্ষে তুলেছিল সেটাও ঠিক ভূমির সমতলে নয়। আহমদ মুসা পরিষ্কার বুঝেছিল, এক জায়গা থেকে গাড়ি নিচে নামতে শুরু করেছিল। খাড়া নিচে নামা নয়, কিংবা নিম্নমুখী হওয়া অতটা সার্প ছিল না। কয়েক গজ নিচে নামার পর সমান্তরাল গতিতেই চলেছিল গাড়িটা। প্রথমে তাকে রাখা হয়েছিল এই সমান্তরাল অবস্থানের কোন ঘরে। সেখান থেকে তাকে আরও নিচে নামিয়ে আনা হয় মুখোশধারীর কক্ষে। সেখান থেকে আবার তাকে নিচে নামানো হচ্ছে। তার মানে তাকে যেখানে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে সারফেস লেভেলে কোন স্থাপনা নেই। মনে হয় যে স্থাপনার মধ্যে সে রয়েছে, তার গোটাটাই আন্ডারগ্রাউন্ড, মাটির তলে। এখানে নিশ্চয় সারফেসে উঠারও কোন ব্যবস্থা নেই। বলতেই হবে সুরক্ষিত এক বন্দীখানায় সে ঢুকেছে।

এক সময় মনে হলো, দেহের স্নায়ুর চাপ যেন হঠাৎ আর নেই। বুঝল আহমদ মুসা লিফট থেমে গেছে। তারা ঠিকানায় এসে পৌছে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত পরে লিফটের দরজা খুলে গেল, এটা আহমদ মুসা বুঝল কোন শব্দে নয়, বাতাসের গন্ধ ও তাপের পরিবর্তনে।

দরজা খুলে যাবার পরে পরেই লিফট থেকে আহমদ মুসাকে বের করে আনা হলো এবং তার হাতের হাতকড়াটি খুলে তাকে সামনে পুশ করা হলো।

আহমদ মুসার মনে হলো পেছন থেকে ওরা আরও পেছনে সরে গেল।

আহমদ মুসার হাতকড়া খোলা হলেও তার চোখের বাঁধন খোলা হয়নি।

আহমদ মুসা খুলে ফেলল তার চোখের বাঁধন। দেখল, সে দুই স্টিলের দেয়ালের মাঝখানের একটা করিডোরে। পেছনে তাকাল। সেখানেও স্টিলের সলিড দেয়াল। দেয়ালের ঠিক মাজ বরাবর সাদা অক্ষরে এইচ কিউব (H3) লেখা।

সামনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, দু’পাশের স্টিলের দেয়াল যেখানে শেষ হয়েছে, তার একটু সামনেই সুন্দর একটা বাংলো জাতীয় বাড়ি। ঐ ঘরের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন বিকল্প নেই। এগোলো আহমদ মুসা সেদিকে।

দেয়াল পার হয়েছে আহমদ মুসা। সংগে সংগেই পেছনের বাতাস আন্দোলিত হবার একটা ছোয়া পেল সে।

তাকাল পেছনে। সেই দুই দেয়ালের কোন অস্তিত্ব আর নেই।

চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। চারদিক ঘিরে স্টিলের দেয়াল। মাথার উপরের ছাদটা গম্বুজের মতো উঠে গেছে উপরে। নিচের চত্বরটি কৃত্রিম ঘাসে ঢাকা। দেখে মনে হয় মাটির উপরে গম্বুজাকৃতির ঘর এটা। এই ধারণা সৃষ্টির জন্যেই এটা করা হয়েছে।

চারদিকের স্টিলের দেয়াল থেকে দশ গজ ভেতর দিয়ে চার পাঁচ ইঞ্চি চওড়া একটা রেড সার্কেল। সে সার্কেলের ভেতরে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা অনুমান করল, এগিয়ে থাকা সেই দেয়াল দু’টো রেড লাইনের এপার পর্যন্ত ছিল। সে রেড লাইন ক্রস করে এসেছে বলে মনে পড়ছে না। দেয়াল ও রেড লাইনের ভেতরে চত্বরটির দুই প্রান্তে আরও দু’টি ছোট বাংলো জাতীয় ঘর। ঐ দু’টি ঘরেও কি মানুষ আছে, প্রশ্ন জাগলো আহমদ মুসার মনে।

চারদিকের একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে সে তার বাংলো টাইপ ঘরের দিকে এগোলো। একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর, একটা গোসলখানা ও খাবার ঘর নিয়েই তার বাংলোটা। শোবার ঘরটা বড়। শোবার খাট, পড়ার টেবিল, একটা বুক শেলফ, কাপড়-চোপড়ের একটা র‌্যাক। সব কিছুই স্টিলের। টয়লেটের পাশের কক্ষই গোসলখানা। গোসলখানার পরের কক্ষটিই খাবার ঘর। সবগুলো ঘরেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা জিনিসও নেই। আর সবগুলোই স্টিলের।

আহমদ মুসা ঘরে ফিরে এল। মন চাইল বেডটা একবার ওলট-পালট করে সবটা দেখে নেয়। কিন্তু শরীরটা ভেঙে আসছে তার। মুক্তভাবে রেস্ট নেয়া হয়নি কয়েকদিন।

বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা।

রাত-দিনের কোন পার্থক্য আহমদ মুসার কাছে নেই। তার হাতের ঘড়ি শুরুতেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার নতুন বাসগৃহে কোন ঘড়ি নেই। তার চারপাশের গোলাকার যে চত্বর সেখানেও দিন-ক্ষণ বুঝবার কোন কিছু নেই। আহমদ মুসার মনে হয়েছে এটাও এক ধরনের মানসিক প্রেসার।

তার এ বন্দীখানায় একটা বিস্ময় হলো কোন মিরাকল উপায়ে খাবার আসা। বন্দীখানায় প্রথম দিন রেস্ট নেবার জন্যে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠেছিল রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে। খাবার কে দেবে, কিভাবে আসবে তার কিছুই জানা ছিল না।

এই সময় একটা মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এল,‘মি. আহমদ মুসা ডাইনিং-এ আপনার খাবার রেডি। খেয়ে নিন।’

এই কণ্ঠ আহমদ মুসাকে তার গোটা বন্দী জীবনে নির্দেশ দিয়েছে। তার শোবার ঘর, টয়লেট, গোসলখানা ও ডাইনিং সব জায়গায় স্পিকার রয়েছে। ঠিক সময় বেধে চারবার খাবার এসেছে। এই খাবারগুলোকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, নাস্তা ও ডিনারে ভাগ করা যাবে না। গেলে সময় আন্দাজ করা যেত। চার বারের খাবারের মান, পরিমাণ, মেনু একই রকম। একই মেনু ঘুরে ফিরে সব সময়ই আসে। এক কথায় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার একাকার। সুতরাং খাবারের রকম দেখে সময় ভাগ করার কোন উপায় ছিল না।

‘খাবার রেডি’ ঘোষণা শুনে ডাইনিং-এ গিয়েছিলাম। দেখলাম, ওভেনের উপর ফুড ক্যারিয়ার। স্টিলের। খুললাম ফুড ক্যারিয়ার। বাইরে স্টিল হলেও ভেতরে উৎকৃষ্টমানের হটপট সিস্টেম। খাবার থেকে একদম ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

অবাক হয়েছিলাম, খাবার কোত্থেকে এল? কে দিয়ে গেল? আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় হয়তো কেউ খাবার দিয়ে গেছে।

পরের খাবার ঐভাবে পেয়েছিলাম। কে কখন খাবার দিয়ে যায় তা দেখার জন্যে আমি সর্বক্ষণই বলা যায় এলার্ট ছিলাম। কেউ আসেনি, খাবার ঠিক এসেছিল।

বরাবরই খাবার পেয়েছি এই ওভেনের উপর। ওভেনটা সচল নয়। সুইচগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, ওভেনের মেনু সুইচ টিপে নানাভাবে আঙুল চালিয়ে দেখেছি সবই অচল।

এই ওভেনের খাবার কোত্থেকে আসে। খাবার ঘরে কি অন্য কোথাও কোন গোপন দরজা আছে? কিন্তু গোপন দরজায় ঢুকতে হলে তো দিনে চার বার চোখ এড়িয়ে ফাঁকা চত্বর পার হয়ে এখানে আসতে হবে। এটা অসম্ভব।

আহমদ মুসার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, সব সময় খাবারটা ওভেনের উপর থাকে কেন? টেবিলের উপর বা অন্য কোথাও নয় কেণ? চট করে আহমদ মুসা ওপরের দিকে তাকাল। ওভেনের ঠিক মাথার উপরে ছাদে একটা চিমনি। চিমনির মাথাতেও একটা স্টিলের ঢাকনা।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার।

কিছু দিন আগে পড়া একটা বিষয় হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টা ছিল ম্যাগনেটিক ফোর্সের সামরিক ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার সম্পর্কে। ম্যাগনেটিক ওয়েভে ভারি জিনিসও পাঠানো যায়। চিমনির পথে এ রকম কোন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা তার কাছে খাদ্য পাঠানোর জন্যে? এখানকার সবকিছুই স্টিলের। সবকিছুর উপরেই কি ম্যাগনেটিক নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে! এর বিকল্প কিছু সে আর খুঁজে পায়নি সেদিন।

পরদিনই সে সহবন্দী আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাবদের কাছে বন্দীখানার পরিবেশ নিয়ে আলোচনার সময় শুনেছিল বন্দীখানা অনেকটাই গ্রীনহাউজ ফার্মের মতো। গম্বুজাকৃতি স্থাপনা স্থানটিকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করলেও এখানে যেমন কৃত্রিম ঘাস দেখা যায়, তেমনি কৃত্রিম মেঘও দেখা যায়। তাদের এই বক্তব্য তার ম্যাগনেটিক ক্লাউডের ধারণাকে আরও মজবুত করেছিল।

আর নিয়মিত ব্যায়াম শেষে পায়চারি করতে বাইরের চত্বরে বেরিয়েছিল আহমদ মুসা। ব্যায়াম ও পায়চারির একটা সময় সে ঠিক করে নিয়েছিল।

চার বারের খাবারের মধ্যে দুই বারের খাবার দেয়ার বিরতি অন্য তিন বারের বিরতির চেয়ে দীর্ঘ। আর সেটা প্রায় ৯ ঘণ্টা। অন্য তিন বারের বিরতির গড় দৈর্ঘ্য ৫ ঘন্টার বেশি নয়। বড় বিরতিকেই আহমদ মুসা রাত বলে ধরে নিয়েছে। এই বিরতির শেষটাকে সকাল হিসাবে ধরে নিয়ে সে ব্যায়ামের সময় নির্দিষ্ট করেছে। তারপর আরও ঘণ্টাখানেক জগিং ও পায়চারি করে এসে গোসল শেষে ফ্রেশ হয়ে খাবার খায়।

আজও জগিং শেষে পায়চারি করছে আহমদ মুসা প্রতিদিনের মতোই। এ সময় দেখা হয়, কথা হয় আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাবের সাথে।

আব্রাহাম আবনার ও মানসী মেরাব আহমদ মুসার মতোই দুই বন্দী। আহমদ মুসাকে বন্দীখানায় এসে বন্দীখানার জন্যে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়। তার নিজের পোশাক তার সংজ্ঞাহীন অবস্থার পরে ওদের নির্দেশে পাল্টে ফেলতে হয়েছিল। বন্দীখানায় এসে নতুন পোশাক পেয়েছে সে। কিন্তু আগে বুঝেনি ওটা ঠিক বন্দীখানার পোশাক। কিন্তু আব্রাহম ও মানসীর পরনে একই পোশাক দেখে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল ওরা তার মতোই বন্দী এবং বন্দী হিসাবেই ঐ পোশাক তারা পরেছে। ওরাও যে বন্দী তা এভাবেই সে জানতে পারে। ওরা দু’জন থাকে গোল চত্বরটির দু’প্রান্তের সেই ছোট দুই বাংলোতে।

তবে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না আহমদ মুসার। ওদের একজন এসে গেল। দ্বিতীয় জনও নিচে আসছে। সেই রেড সার্কেলের পাশে এসে দাঁড়াল মেয়েটি মানে মানসী মেরাব। রেড সার্কেল যে প্রাণঘাতী, সেটা ওদের কাছ থেকেই আহমদ মুসা শুনেছে। কোন কিছু রেড লাইনের ঠিক ওপরে আসার সাথে সাথে তা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়। রেড লাইন স্পর্শ করলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ক্রস করতে গেলেই ভয়াবহ ম্যাগনেটিক রশ্মিতে তা ধ্বংস হয়ে যায় কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

রেড লাইনের ওপারে মানসী মেরাব যেখানে দাঁড়িয়েছিল, এ পাশে তার বরাবর স্থানে আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আব্রাহাম আবনার কোথায়?’

‘বাড়ির একটা স্বপ্ন দেখে সে দারুণ ভেঙে পড়েছে। রাতের অবশিষ্ট অংশ ঘুমায়নি। সকালে গিয়ে দেখলাম শয্যা নিয়েছে।’ বলল মানসী মেরাব।

ভ্রু কুঁচকালো আহমদ মুসা। বলল, ‘এই ছেলেমানুষি কেন? কেঁদে লাভটা কি?’

‘এটা তাকে বুঝাবে কে? সুযোগ পেলেই ওদের কাছে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আবেদন-নিবেদনের অন্ত নেই।’ বলল মানসী মেরাব।

‘কিন্তু মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ ও দুর্বল মনের হয়। কিন্তু তোমার তো ওর মতো অবস্থা হয়নি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘মন খারাপ আমারও। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ওরা যা চায় তা না পেলে আমাদের মুক্তি মিলবে না।’ বলল মানসী মেরাব।

‘তোমাদের কাছে কি চায় ওরা?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমাদেরকে আপনার সহযোগী হতে হবে। আমাদের বলা হয়েছে, আপনি যত তাড়াতাড়ি তাদের কাজে রাজী হবেন, তত তাড়াতাড়ি আমাদের মুক্তি মিলবে। সেজন্যে আপনি যাতে সানন্দে রাজী হয়ে যান- সে চেষ্টা করতে আমাদের বলা হয়েছে।’ বলল মানসী মেরাব।

আহমদ মুসা বলল, ‘আমাদের কাছে ওরা কি চায়?’

‘সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। আপনাকে পেন্টাগনে ঢুকতে হবে। সেখানকার অতি গোপন স্থান থেকৈ ছোট্ট একটা জিনিস আনতে হবে। আপনি প্লিজ রাজী হয়ে যান স্যার।’ বলল মানসী মেরাব।

মনে মনে আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। কিছুঁটা বুঝতে পারল ওদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু নিজের আঁতকে উঠা ও কৌতুহল চেপে রেখে হালকা কণ্ঠে বলল, ‘এদের তো অনেক লোক। এই একটা ছোট কাজে এত ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে ধরে আনা হয়েছে কেন?’

‘ছোট কাজ কোথায়? পেন্টাগনের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান থেকে যে জিনিসটা আনতে হবে, তা ক্ষুদ্র একটা ‘পিন’ হলেও দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দামি ওটা আজ। আর পেন্টাগনের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের বাইরে একমাত্র আপনার পক্ষেই পেন্টাগনে প্রবেশ সহজ। আপনাকে কেউ সন্দেহত করবে না, করলেও আপনাকে গুলি করার সাহস কেউ করবে না। এরই সুযোগ নিয়ে আপনাকে সেই গোপন স্থঅন থেকে মহামূল্যবান সেই ‘পিন’টি নিয়ে আসতে হবে। এটাই ওরা আপনার কাছে চায়।’

আহমদ মুসার মনের কোণে যে একটা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল, সে প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে উঠল। সে ভেবে পেল না তার মতো বন্দী হয়েও তারা এসব জানে কেমন করে? কিন্তু এ বিষয়ের দিকে না গিয়ে আহমদ মুসা মানসী মেরাবের কথার প্রসঙ্গ ধরে বলল, ‘পিনটা কি? এত মূল্যবান কেন?’

‘সেটাও তারা আমাদের কাছে বলেছে। বিষয়টা ওদের খুবই গোপনীয়। আপনি জানেন স্যার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র SDI (Strategic Defense Initiative)- এর আওতায় ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধক অস্ত্র তৈরি করেছে। কিন্তু এই অস্ত্রও প্রতিরক্ষা শতভাগ নিশ্চিত করে না। এই উদ্বেগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ গবেষণার পর এমন একটা অস্ত্র আবিষ্কারা করেছে যা অত্যন্ত নীরবে এবং খুবই স্বল্প সময়ে শত্রুর সকল কৌশলগত অস্ত্র অচল করে দিতে পারে। প্রতিরক্ষার জন্যে SDI জাতীয় কোন প্রতিরক্ষা অস্ত্রের প্রয়োজন আর নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ পরম পরিতৃপ্ত হয়ে আছে যে, গোটা পৃথিবীকে ডমিনেট করার মোক্ষম অস্ত্র তাদের হাতে। কিন্তু অস্ত্রটির ফর্মূলা চুরি হয়ে গেছে, তারা তা জানে না। এরাই এই ফর্মূলা চুরি করে মোক্ষম অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। অস্ত্র তৈরি করলেও অপারেশনাল সিস্টেম এখনও তৈরি হয় নি। এই অস্ত্রকে অপারেশনাল করার জন্যে একটা ‘কিং পিন’ প্রয়োজন। যা অবিশ্বাস্য শক্তির এক ম্যাগনেটিক ওয়েভকে সক্রিয় করবে। এই মিরাকল ম্যাগনেটিক পিন-এর ফর্মূলা এদের কাছে নেই। অনেক চেষ্টা করেও তা তারা হস্তগত করতে পারেনি। পিনটি ‘কিং পিন’ এ কারণে যে, পিনটি যে সিগন্যাল দিবে, সে অনুসারেই ম্যাগনেটিক ওয়েভ কাজ করবে। ম্যাগনেটিক পিন এরাও তৈরি করেছে, কিন্তদু সে পিন ব্যবহার করে দূর থেকে কৌশলগত অস্ত্রকে ধ্বংস করা যায়, অচল করে দেয়া যায় না। স্ট্রাটেজিক সব অস্ত্র অচল করে দেয়ার পিন পেন্টাগনের কাছে আছে। ওটাই চুরি করতে হবে।’ বলল মানসী মেরাব।

‘অচল করে দেয়ার পিন কেন দরকার, ধ্বংস করে দেয়ার কাজটাই তো ভালো। ধ্বংস করার অস্ত্র রেখে লাভ কি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘যারা শত্রুকে নিরস্ত্র করে শুধু তার রাজ্য নয়, তার অস্ত্রভাণ্ডারও দখল করে নিতে চায়। তারা অস্ত্র ধ্বংস করবে কেন? অন্যদের সব অস্ত্র অচল করে দিয়ে নিজের অস্ত্রের জোরে দুনিয়ার শক্তিগুলোর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং অচল করার সেই পিন তাদের চাই।’

ষড়যন্ত্রটা বুঝল আহমদ মুসা। এ এক বিরাট ষড়যন্ত্র, যে ধরনের চিন্তা সে করেছিল তার চেয়ে অনেক বড়। এদের আণবিক অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার রিমোট সিস্টেম এরা আয়ত্ত করেছে। তার মানে এরা যে কোন সময় চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বা একাধিক আণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে মহাবিপর্যয় ঘটাতে পারে। তার উপর কৌশলগত সব মারণাস্ত্র অচল করার ‘কিং পিন’ তারা হাত করার আয়োজন করেছে। এদের পরিকল্পনা ও আয়োজন বিশাল। তার ধারণার চাইতেও বড় গ্রুপ এরা! কারা এরা? সেই মুখোশধারী বলেছিল, তারা মোসাদ, ইরগুনজাই লিউমিদের আশু লাভের মতো বোকামী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে না। তার মানে এরা ওদের চেয়েও বড় বুদ্ধিমান। কারা এরা? আরেকটা বিষয়ও আহমদ মুসাকে অবাক করেছে। তার মনের প্রশ্নটাকেও আরও জোরদার করেছে। মানসী মেরাব যেসব কথা গড়গড় করে বলে গেল, তাতে ওকে তার মতো কোন বন্দী বলে মনে হলো না। মনে হলো ও যেন এদেরই একজন।

হঠাৎ করেই আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে মানসী মেরাবের দিকে তাকাল। কয়েকদিন ধরে সে আব্রাহামের সাথে মেয়েটিকেও দেখছে। কিন্তু ভালো করে দেখেনি। তার অবয়বকে সে দেখেছে, তবে যাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা বলে সেভাবে দেখেনি।

মানসী মেরাব শুধু অপরূপ সুন্দরীই নয়, তার মুখে ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির দীপ্তি খুবই লক্ষণীয়। অন্যদিকে আব্রাহাম আবনারও অত্যন্ত চৌকশ ও বুদ্ধিমান ছেলে। এদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে শুধু আহমদ মুসার সহযোগী হবার জন্যে এবং সব কিছুই এরা জানে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটাই স্বাভাবিক যে, এদের এখানে রাখা হয়েছে তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে, হয়তো পরিকল্পনার সব কথা আহমদ মুসাকে বলে বিষয়টাকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে।

মানসী মেরাব তার দিকে আহমদ মুসাকে গত কয়েক দিনের ব্যতিক্রম ও খুব গভীর দৃষ্টিতে চাইতে দেখে বলল, ‘স্যার, এভাবে দেখছেন কেন? যাক, তবু আপনার দৃষ্টি কেমন দেখা হলো। গত কয়েক দিনে এ সুযোগ হয়নি। ধন্যবাদ। নিশ্চয়, কিছু বলবেন স্যার।’

‘আমি যদি এদের সাহায্য না করি তাহলে এরা কি করবে মানসী মেরাব?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি জানি আপনি এদের সাহায্য করবেন না। কিন্তু আপনি স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে বাধ্য হবেন।’ বলল মানসী মেরাব।

বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে হবে মানে সাহায্য করতে না চাইলেও আমি তাদের সাহায্য করবো, এই তো?’

‘ঠিক স্যার।’ বলল মানসী মেরাব।

‘কিন্তু কেন, কিভাবে?’ আহমদ মুসা বলল।

সংগে সংগে কথা বলল না মানসী মেরাব। একটু ইতস্ততভাবে আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর বলল একটু নিচু স্বরে, ‘আপনার চিন্তা ও মনোভাবকে তারা বদলে দেবে। একটা বিশেষ ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পালসের মাধ্যমে আপনার ব্রেন থেকে অতীত মুছে দিয়ে সেখানে তারা যা চায় সেটা ইনসার্ট করবে। এই কাজে আমরাও কিছুটা সহযোগিতা করবো তারা যা চায় বার বার তা আপনার সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে। এছাড়া ওরাও আপনার সাথে সরাসরি কথা বলবে।’ থামল মানসী মেরাব।

মানসী মেরাবের কথায় ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা। শয়তানরা শেষ পর্যন্ত এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছে ! আহমদ মুসার মনে পড়ল অনেক আগেকার কথা। ফ্রান্সে ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ক্যামেরুনের এক জমিদার তরুণের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা হয়েছিল এই পদ্ধতিতে। তারা সফল হবার আগেই আহমদ মুসা তাকে রক্ষা করেছিল। এখন আহমদ মুসার পাশে কেউ নেই আল্লাহ ছাড়া। আরেকটা প্রশ্নও আহমদ মুসার সামনে এল, মানসী কি করে জানে যে আমি এদের সাহায্য করবো না? সেও কি আমাকে জানে?

‘মানসী মেরাব তুমি বলেছ, তুমি জান আমি এদের সাহায্য করবো না? কি করে জান?’ আহমদ মুসা বলল।

মানসী মেরাব একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমি আপনাকে জানি স্যার।’

‘কি জান তুমি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে জানি। আপনার কাজ সম্পর্কেও জানি স্যার। আপনি আহমদ মুসা।’

আহমদ মুসা বিস্মিত হলো না। একটু অবাক হলো এই মানসীরা তাহলে অভিনয় করছে ওদের পক্ষে? এরা ওদের লোক! তাহলে তার সন্দেহ সত্য প্রমাণ হলো। এ নিয়ে প্রথম থেকেই তার মনে প্রশ্নের ‍সৃষ্টি হয়েছিল।

মানসী মেরাব, নিশ্চয় তুমি অস্বীকার করবে না, তোমরা ওদের লোক?’ আহমদ মুসা বলল।

‘অস্বীকার, স্বীকার কোনটাই করবো না। সত্যি স্যার, আমি আপনার একজন ভক্ত, নিকট থেকে আপনাকে দেখার ও কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য।’ বলল মানসী মেরাব।

‘ধন্যবাদ। একটা কথা যদি আমি জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কারা?’

‘স্যার, আমাকে আর আগাতে বলবেন না। আমি এই পক্ষের মানে যিনি এখানকার সর্বময়কর্তা তার মেয়ে। আমারও একটা দায়িত্ব আছে। আর এই যে কথা বলছি আমরা, তা রেকর্ড হচ্ছে রিমোট সাউন্ড ট্রাকিং এর মাধ্যমে। আর ….।’ কথা শেষ করতে পারল না মানসী মেরাব।

পেছনের কোন অদৃশ্য স্থান থেকে গুলির শব্দ হলো। পিঠে গুলি বিদ্ধ হয়ে ‘ও গড’ বলে টলতে টলতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল মানসী মেরাব।

আর তখনই পেছনের অদৃশ্য এক স্থান থেকে একটা যান্ত্রিক কন্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘স্যরি আহমদ মুসা। জেনেছ মানসী আমার মেয়ে। কিন্তু তার সীমা সে লংঘন করেছিল। আমি নির্দেশের অন্যথাকারীকে ক্ষমা করি না। তবে আপনার ব্যাপারটা আলাদা। আপনি আমাদের মেহমান। আমি আপনার সহযোগিতা চাই এবং নিশ্চয় আপনি সহযোগিতা করবেন।’ থামল কণ্ঠটি।

আহমদ মুসা এই আকস্মিক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মানসী মেরাব থেকে মাত্র গজ তিনেক দূরে। আহমদ মুসা দেখল, মানসী মেরাব আস্তে আস্তে মুখ তুলে তার দিকে তাকাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মানসী মেরাবের দেহটা উল্টে গেল, সেই সাথে তার ডান হাত একটু উঁচু হয়ে তার মাথার উপর দিয়ে মাথার পেছনে ছিটকে এল।

আর তার সাথে কিছু একটা এসে পড়ল আহমদ মুসার পাশেই। চোখ সেদিকে ছুটে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসা তার পাশে মেটো রঙের বড় মার্বেলের মতো গোল একটা জিনিস দেখতে পেল।

মানসী মেরাব এটা ছুড়ে দিয়েছে! কিন্তু রেড লাইন কাজ করল না কেন? রেড লাইনের ম্যাগনেটিক সিস্টেম কাজ করে না এমন কিছু দিয়ে তৈরি ওটা? ওটা কি? মুমূর্ষু অবস্থায় এত কষ্ট করে পাঠানো জিনিসটা নিশ্চয় খুব জরুরি। কি হতে পারে? এখন তো ওটা তুলে নেয়া ঠিক হবে না। ওরা এটা দেখতে পেয়েছে কিনা কে জানে?

তাকাল আহমদ মুসা মানসী মেরাবের দিকে। নেতিয়ে পড়েছে তার মাথা। গোটা শরীর দেখা যাচ্ছে নিঃসাড়। তার মানে মানসী মেরাব আর বেঁচে নেই। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তার কাছ থেকে কিছু না শুনেই নিজের মেয়েকে হত্যা করল? কি অমানুষ! স্বার্থ তাদের কত বড় অন্ধ বানিয়েছে? করণীয় নিয়ে তাকে দ্রুতই ভাবতে হবে। মগজ ধোলাইয়ের যে বৈজ্ঞানিক পন্থাটি হাতে নিয়েছে, তা সত্যিই বিপজ্জনক! এর মোকাবিলা সে করবে কি দিয়ে?

আহমদ মুসা পায়চারি করতে শুরু করল এদিক ওদিকে। কিন্তু খুব দূরে গেল না। ব্যায়াম করার মতো হাঁটাহাঁটি করেছে। ঘেমে উঠেছে সে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ, গলা ও ঘাড় ভালো করে মুছে নিল। আবার হাঁটতে শুরু করল। সে মার্বেল আকারের জিনিসটির পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার হাত থেকে রুমাল পড়ে গেল জিনিসটার উপর। দু’ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়েছিলিআহমদ মুসা। পেছন ফিরে আহমদ মুসা এসে রুমালটি তুলে নিল। রুমালের সাথে মার্বেলের মতো গোলাকার জিনিসটিও তার হাতে চলে এল। পায়চারি আরও কিছুক্ষণ অব্যাহত রাখল আহমদ মুসা। তারপর এক সময় চলে এল বাংলোতে।

বেঞ্জামিন বেকন তার হাত ঘড়ির উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ডেভিড বেকহ্যাম যদি নির্দিষ্ট স্পীডে আসে, তাহলে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে এই চৌমাথায় এসে পড়বে।’

‘দেখ, এর আগে তিন বার সে আমাদের বোকা বানিয়েছে। এবার কি হয় দেখা যাক। অবশ্য এবার আমরা ঠিক সময়ে সঠিক ইনফরমেশন পেয়েছি এবং ছবিও পাওয়া গেছে।’ বলল জন নিক্সন।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। তবে তিনবারই সে এফবিআই ও সিআইএ-কে বোকা বানিয়েছে তার ছদ্মবেশ ধারণের দক্ষতা দিয়ে। এবার সেটা হচ্ছে না। এবার আমরা কম্পিউটারের সাহায্যে তার আসল চেহারাকে সামনে রেখে সে কতভাবে ছদ্মবেশ নিতে পারে, তার প্রিন্ট বের করেছি। সুতরাং চোখে ধুলা দেয়া তার জন্যে কঠিন।

বেঞ্জামিন বেকন এফবিআই-এর একজন নামকরা এজেন্ট এবং সেইসাথে ফ্রি আমেরিকারও সদস্য। আর জন নিক্সন সিআইএ-এর এজেন্ট।

ডেবিড বেকহ্যাম ইসরাইলি জায়নিস্টদের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা ফোম (Foam- Army of Man’s Future)- এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন কমান্ডার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোসাদ ও ইরগুনজাই লিউমি’র বদনাম ও বেআইনি হবার পর নতুন এই সংস্থাটি কাজ করছে। সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে এবং একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিনত হয়েছে। ডেভিড বেকহ্যাম তাদের অত্যন্ত ধুরন্ধর, দুর্ধর্ষ ও প্রতিভাবান নেতা। এর নেতৃত্বেই নিউইয়র্কে আহমদ মুসার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিয়ে আহমদ মুসাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। একে ধরার জন্যে এফবিআই ও সিআইএ-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব গোয়েন্দা সংস্থা কয়েকদিন ধরে হন্যে হয়ে ফিরছে। আজ একটা নিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ নিয়ে তারা অবস্থান নিয়েছেন এই চৌমাথায়।

আনাপোলিশ-এর দিক থেকে যেসব গাড়ি আসছে শুধু সেসবই চেক করছে সাদা পোশাকের পুলিশরা। চেকিং কাজটা একটা টিলার আড়ালে হচ্ছে। এখানে এসে সড়কটি টার্ন নিয়ে টিলা ঘুরে চৌমাথার দিকে গেছে। এজন্যে কোন গাড়িই টিলা পার হওয়ার আগে বুঝতেই পারছে না যে, গাড়ি চেকিং হচ্ছে।

পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বেঞ্জামিন বেকন ও জন নিক্সন গাড়ির আরোহীদের পর্যবেক্ষণ করছে।

একটা গাড়ি এসে থামল।

ছয় সিটের বড় আমেরিকান জীপ গাড়ি। মাঝের সিটে দু’জন। ‍সুটেড-বুটেড সাদা আমেরিকান।

ড্রাইভিং সিটে একজন শিখ ড্রাইভার। তাদের চেহারা পরিষ্কার। সন্দেহের কিছু নেই।

‘ও.কে। ছেড়ে দাও।’ বলল জন নিক্সন। বেঞ্জামিন বেকন গভীর মনোযোগের সাথে দেখছিল শিখ ড্রাইভারকে। সবই ঠিক আছে, কিন্তু শিখ ড্রাইভারের নাকটা অত পাতলা কেন? শিখদের নাক তো পুরু হয়ে থাকে।

জন নিক্সনের কথা বেঞ্জামিনের বেকনের কানে যেতেই সাথে সাথে বেঞ্জামিন বেকন বলল, ‘নি নিক্সন, ড্রাইভারকে নামিয়ে নাও। আরেকটু চেক করার প্রয়োজন আছে।’

জন নিক্সন বেঞ্জামিন বেকনের দিকে একবার তাকিয়ে নজর ফেরাল ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘নেমে আসুন সরদারজী।’

জন নিক্সনের কথা শিখ ড্রাইভারের কানে যেতেই সে নড়ে উঠল। ডান হাতটা সে স্টিয়ারিং-এ রেখে বাম হাত সিটের দিকে নামিয়ে একটু ঘুরে গেল, যেন সে সিট থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এর পরেই সে সামনের দিকে একবার তাকিয়ে বিদ্যুৎ বেগে তার বাঁ হাতটা গাড়ির অন্য পাশে ঘুরিয়ে নিল, জন নিক্সনরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে ফিরাল। হাতে তার ক্ষুদ্র, কিন্তু ডাবল ব্যারেলের ভয়ংকর রিভলবার। গুলির ঝাঁক বেরিয়ে এল তার রিভলবার থেকে। বুঝে উঠার আগেই নিক্সনসহ কয়েকজন পুলিশ গুলি খেয়ে পড়ে গেল। তারপর বিদ্যুৎ বেগে তার বাম হাতটা জীপের বাম দরজার দিকে ঘুরে গেল এবং সেই সাথে গুলিবৃষ্টি। সেখানেও সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, তারা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম অবস্থায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারা যখন পকেট থেকে অস্ত্র বের করছিল, সেই সময় ওরা গুলিবৃষ্টির মুখে পড়ে গেল।

বেঞ্জামিন বেকন দাঁড়িয়েছিল জন নিক্সনের পেছনে, দরজার সোজাসুজি নয়। সুতরাং গুলিবৃষ্টি তার নাগাল পায়নি।

শিখ ড্রাইভারটি বাম দরজার দিকে গুলি করার সাথে সাথে স্টার্ট দিয়েছিল তার গাড়ি।

দরজা খোলা অবস্থায় গাড়ি চলতে শুরু করল।

বেঞ্জামিন বেকন রিভলবার বের করেছিল।

গাড়ি স্টার্ট নেয়ার পর বুঝতে পারল পালাচ্ছে ডেভিড বেকহ্যাম।

গোটা ঘটনা ঘটে গেল মুহূর্তে, চোখের পলকে।

বেঞ্জামিন বেকন দু’ধাপ ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠল। শিখ ড্রাইভার ডেভিড বেকহ্যাম বেঞ্জামিন বেকনকে গাড়িতে উঠতে দেখেই তার রিভলবার ধরা হাত দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে এল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে।

বেঞ্জামিন বেকন এমনটা ঘটবে চিন্তা করেই গাড়িতে উঠেছিল। সে গাড়িতে উঠেই পেছনের দু’জনকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি করেই তার রিভলবার ঘুরিয়ে নিয়েছিল ডেভিড বেকহ্যামের দিকে।

ডেভিড বেকহ্যামের রিভলবারও ঘুরে আসছিল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে।

বেঞ্জামিন বেকনের রিভলবার থেকেই প্রথমে গুলি বেরুল। পর পর দু’টি। গুলি দু’টি গিয়ে বিদ্ধ করল ডেভিড বেকহ্যামের রিভলবার ধরা এবং স্টিয়ারিং ধরা দু’টি হাতকে।

ঠিক এই সময় গাড়ির দু’পাশ দিয়ে গুলির ঝাঁক ছুটে এল। বেঞ্জামিন বেকন বুঝল বেকহ্যামের গাড়ির সহযোগিতায় একাধিক গাড়ি আছে। সে গাড়িগুলো থেকেই গুলি আসছে তাদের পুলিশদের লক্ষ করে। নিশ্চয় পুলিশরা এই আকস্মিক আক্রমণের সামনে থেকে পালাতে পারেনি।

গুলি করেই বেঞ্জামিন বেকন বেকহ্যামকে টেনে এদিকে নিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছিল।

বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত রিভলবার বাগিয়ে ধরে রাখল বেকহ্যামের দিকে। বলল, ‘মি. ডেভিড বেকহ্যাম, সামান্য শয়তানিও যদি কর, তাহলে তোমার পা দু’টি শেষ করে দেব।’

বেঞ্জামিন বেকন গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। চৌমাথা থেকে যে রাস্তা সোজা ওয়াশিংটন চলে গেছে, সে রাস্তায় উঠল বেঞ্জামিন বেকন।

গাড়ির রেডিও এর স্বয়ংক্রিয় স্পীকারের বাটন সিগনাল দিতে শুরু করল।

বেঞ্জামিন বেকন বুঝল ডেভিড বেকহ্যামের সাথে কেউ কথা বলতে চায় কিংবা কোন মেসেজ দিতে চায়। বাটনটিতে চাপ দিলেই কথা শোনা যাবে। নিশ্চয় পেছনের গাড়ি থেকেই কেউ কথা বলতে চায়। ওদের সকল গাড়িই তাহলে একক ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের অধীনে!

বেঞ্জামিন বেকন তাকাল ডেভিড বেকহ্যামের দিকে। বলল, ‘নিশ্চয় তোমার পেছনের লোকরা কথা বলবে। তুমি ওদেরকে দু’টি কথা বলবে, এক. তুমি ভালো আছ, দুই- তুমি ওয়াশিংটন যাচ্ছ। ওদেরকে বাল্টিমোরের দিকে তোমাদের কোন আড্ডায় যেতে বলবে।’

বেঞ্জামিন বেকন বাম হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে রিভলবার ডান হাত দিয়ে রেডিও’র অটো স্পিকারের সুইচ অন করে দিল এবং রিভলবার বেকহ্যামের মাথায় চেপে ধরল।

ডেভিড বেকহ্যাম বেঞ্জামিন বেকনের দিকে একবার চেয়ে স্পিকার লক্ষে বলল, ‘আলবার্ট দানিয়েল, আমি ভালো আছি। শোন, আমি জরুরি কাজে ওয়াশিংটন যাচ্ছি। তোমরা বাল্টিমোরে যাও। ওভার।’

‘ও.কে স্যার।’ ওদিক থেকে আলবার্ট দানিয়েল নামের লোকটি।

‘ধন্যবাদ বেকহ্যাম। মৃত্যুর ভয় তোমারও আছে?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘মৃত্যুর ভয় নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেঞ্জামিন বেকন।’ ডেভিড বেকহ্যাম বলল।

‘তোমার এই দর্শনের জন্যে ধন্যবাদ, কাজে লাগবে।’

বলে বেঞ্জামিন বেকন গাড়ি অটোড্রাইভে ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে সিল্কের সরু কর্ড বের করল। বলল, ‘মি. ডেভিড বেকহ্যাম আমি ঝুঁকি নিতে চাই না, একটু নিশ্চিন্তও থাকতে চাই। এজন্যে তোমাকে বেঁধে রাখাই ভালো মনে করছি।’

সিল্কের কর্ড দিয়ে ডেভিড বেকহ্যামের দুই হাত ও দুই পা বেঁধে ফেলল। মুখ বন্ধ রাখার জন্যে মুখে আঠালো টেপ লাগিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার হাতের দ্রুত চিকিৎসা দরকার, দ্রুতই আমরা পৌছে যাব ওয়াশিংটনে।’

বেঞ্জামিন বেকন টেলিফোন করল এফবিআই হেড কোয়ার্টারে। এখানকার সব খবর জানাল। জন নিক্সনসহ পুলিশরা কেউ বেঁচে আছে কিনা বলতে পারল না। তার নিজের গাড়ির লোকেশন জানিয়ে বলল, ‘দ্রুত সাহায্য পৌছা দরকার।’

বেঞ্জামিন বেকন অটোড্রাইভ থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং আবার হাতে নিল। আট দশ মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টারের শব্দ পেল। গাড়ির স্কাই ভিউ এর সুইচ টিপে দিল বেঞ্জামিন বেকন। স্ক্রিনে আকাশে তিনটা হেলিকপ্টার দেখতে পেল। দু’টি পেছনের দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয় যাচ্ছে চৌমাথার ঐ ঘটনাস্থলের দিকে। অন্য হেলিকপ্টারটি তার গাড়ির দিকে এল।

বেঞ্জামিন বেকনের গাড়ি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। গাড়ির সাথে সাথে এগিয়ে চলল হেলিকপ্টারটিও।

এফবিআই হেড কোয়ার্টারে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন এর অফিস কক্ষে জর্জ আব্রাহাম চার চেয়ারে বসে। তার কাছে টেবিলের ডান পাশে সিআইএ-প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। অপারেশন কমান্ডার এরিক এন্ডারসন, ‘… স্যার ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যে ওয়াশিংটন থেকে বাইরে যাবার এবং ওয়াশিংটনের ভেতরের নৌ ও রেলসহ সব রাস্তা নজরদারীর মধ্যে আনা হয়েছিল। আহমদ মুসাকে ওয়াশিংটনের বাইরে খুব দূরে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব কম। জায়নিস্টদের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা ফোম-এর কিছু লোককে কাস্টোডিতে নিয়েছিলাম। তাদের গ্রেফতারের দু’ঘণ্টার মধ্যে ওয়াশিংটন ও তার আশেপাশের ওদের সব ঘাঁটি আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। সেগুলোর কোনটাতেই আহমদ মুসাকে পাওয়া যায়নি। আমাদের ডগ স্কোয়াড প্রমাণ করেছে যে, ওগুলোর কোনটাতে নেয়া হয়নি আহমদ মুসাকে। যাদের আমরা ধরেছিলাম, তাদের সব রকম জিজ্ঞাসাবদ করেও কিছু জানা যায়নি। এমনটা…।’

এরিক এন্ডারসনের কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘হতে পারে তারা তাদের কোন ঘাঁটিতে আহমদ মুসাকে তোলেনি।’

‘ইয়েস স্যার। এটা হতে পারে। যাদের ধরা হয়েছে তাদের কাছ থেকে এটাও জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা এক কথায় বার বার বলেছে যে, তারা আহমদ মুসাকে জানে না, আহমদ মুসা তাদের কাছে নেই। আমরা তাদের কাছ থেকে তাদের অনেকের বাড়ির সন্ধানও পেয়েছি। সেসব বাড়িতেও খুব দ্রুত এবং একই সাথে হানা দিয়েছি। কিন্তু কিছুই মেলেনি।’ বলল এরিক এন্ডারসন।

‘তাহলে তাদের সব ঘাঁটি ও বাড়ির সন্ধান আমরা পাইনি।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সিআইএ প্রধান।

‘এটাই মনে হচ্ছে স্যার। তবে ‘ফোম’-এর অপারেশন কমান্ডার ডেভিড বেকহ্যাম ধরা পড়েছে, এখন হয়তো সেটা জানা যাবে কিংবা জানা যাবে আহমদ মুসাকে তারা কোথায় রেখেছে।’ এরিক এন্ডারসন বলল।

‘সে এখন কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।

জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল এরিক এন্ডারসনের দিকে। এরিক এন্ডারসান বলল, ‘গতকাল থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিছুক্ষণ আগে বেঞ্জামিন বেকনের সাথে কথা হয়েছে। সে আসছে স্যার।’

জর্জ আব্রাহাম জনসনের ইন্টারকমে তার পিএ কথা বলে উঠল। ‘বেঞ্জামিন বেকন এসেছে’ বলে সে জানাল। জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিল পিএ-কে।

বেঞ্জামিন বেকন এল। স্যালুট দিয়ে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।

‘ওয়েলকাম বেকন। বস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

বসল বেঞ্জামিন বেকন।

‘বল বেকন, তার মুখ খুলতে পেরেছ তোমরা?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘স্যার, মুখ খুলেছে, কিন্তু আহমদ মুসা সম্পর্কে কোন তথ্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায় নি। আমরা …..।’

বেঞ্জামিন বেকনের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল সিআইএ প্রধান এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার। বলল, ‘পাওয়া যায়নি’ বলছ কেন? দেয়নি বলছ না কেন?’

‘স্যার, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমার মনে হয়েছে আহমদ মুসা সম্পর্কে কোন তথ্য তার কাছে নেই। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে তাকে কথা বলার জন্যে সব রকম কৌশল আমরা ব্যবহার করেছি। আমার বিশ্বাস হয়েছে, আহমদ মুসা সম্পর্কে সে জানলে তা না বলা তার জন্যে স্বাভাবিক ছিল না। সে তার সংগঠন সম্পর্কে এমন কিছু গোপন তথ্য দিয়েছে যা তার পক্ষে দেয়ার মতো নয়। তাছাড়া সব শেষে আমরা তাকে ‘ট্রুথ’ মেশিনের মুখোমুখি করেছিলাম। সেখানকার রেজাল্টও আমাদের বিশ্বাসের পক্ষে।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার দু’জনেরই মাথাটা একটু নিচু হলো। তাদের চোখে-মুখে হতাশার চিহ্ন।

সবাই নীরব।

মাথা তুলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, ‘নিউইয়র্কে তারা বৈঠক করে আহমদ মুসার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, এর ব্যাখ্যা সে কি দিল?’

‘স্যার, বৈঠকের কথা সে স্বীকার করেছে। বৈঠকের গোটা বিষয় সে বলেছে এবং যে ক্রিমিনাল গ্রুপগুলো তাতে অংশ নিয়েছিল তাদের পরিচয়ও সে দিয়েছে। সে বলেছে তাদের পরিকল্পনা ছিল আহমদ মুসার পরিবারের সদস্য বা সদস্যদের কিডন্যাপ করা কিংবা হত্যা করা। কিন্তু সে পরিকল্পনার আলোকে কাজ সবে তারা শুরু করেছে। আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ তারা করেনি। এমনকি, আহমদ মুসা আসছে সেটাও তারা জানতো না।’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।

‘এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে আরও একটা পক্ষকে আমাদের খুঁজতে হবে, যারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছে এবং যাদেরকে আমরা জানি না।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমেরিকায় অপর পক্ষ আর কে আছে? আমেরিকায় আহমদ মুসার পুরনো শত্রু যারা তারা সবাই এখন আহমদ মুসার মিত্র। আর নতুন শত্রু হওয়ার মতো কোন কারণ তো ঘটেনি। এত বড় কাজ এত নিখুঁতভাবে যারা করেছে, তারা নিশ্চয় বড় রকমের কোন গ্রুপ। কারা তারা?’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘আমরা এ বিষয়টা আগে ভাবিনি। এখন এটাই সবচেয়ে বড় ভাবনা। এমন কোন গ্রুপের সন্ধান এফবিআই-এর কাছে নেই। অত বড় ও দক্ষ গ্রুপ কি আমেরিকায় সত্যিই আছে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘স্যার একটা বিষয়। কিছুক্ষণ আগে নোয়ান নাবিলা আমাকে টেলিফোন করেছিল। আহমদ মুসার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিল। তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু আমরা জানতে পেরেছি কিনা জানতে চেয়েছিল। আমরা জানতে পারিনি বলায় সে জানাল যে, সেও সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে পারেনি। তবে একটা সন্দেহ তার মনে ‍ঢুকেছে। সে আসতে চায় এখানে।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘হ্যাঁ, নোয়ান নাবিলা খুব বুদ্ধিমান ও দক্ষ গোয়েন্দা কর্মী। আসতে বলেছি বলে দাও তাকে, এখনি?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এক্সকিউজ মি স্যার। আমি তাকে আসতে বলেছি। বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘এক্সকিউজ মি’ বলছ কেন? ঠিক কাজ করেছ তুমি। জিজ্ঞাসার জন্যে ওয়েট করার মতো নয় এসব কাজ। ধন্যবাদ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ধন্যবাদ স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘বেঞ্জামিন বেকন কখন তোমার কথা হয়েছে নাবিলার সাথে?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহাম জনসনের।

‘আমি এখানে আসার কিছুক্ষণ আগে স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

‘সে কি আসছে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমার সাথে কথা বলতে বলতেই সে গাড়িতে উঠেছে স্যার। এখনি সে এসে যাবে স্যার।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।

বেঞ্জামিন বেকনের কথা শেষ না হতেই জর্জ আব্রাহাম জনসনের পিএ’র কণ্ঠ শোনা গেল ইন্টারকমে। বলল সে, ‘স্যার, মিস নোয়ান নাবিলা এসেছে। সে জানতে চায় মি. বেঞ্জামিন বেকন এখানে আছেন কিনা?’

‘বল আছে। আর তাকে নিয়ে এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

এল নোয়ান নাবিলা।

ঘরে এসেই পা ঠুকে স্যালুট করল জর্জ আব্রাহাম জনসন ও এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের উদ্দেশ্যে।

‘ওয়েলকাম নাবিলা, এস।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

নাবিলার পরনে কালো স্যুট, কালো বুট এবং মাথায় অফ হোয়াইট হ্যাট। তার অফ হোয়াইট হ্যাট নাবিলার অফ হোয়াইট মুখের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

নোয়ান নাবিলা খৃস্টান পিতা ও ইহুদি মায়ের সন্তান। মায়ের মতো সে ইহুদি ধর্ম পালন করে। মোসাদ থেকে পদত্যাগের পর সে একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মের সাথে যুক্ত আছে। ফার্মটি এফবিআই-এরই একটা গোপন ব্রাঞ্চ।

বেঞ্জামিন বেকনের পাশের একটি মাত্র খালি চেয়ারে সে বসল। বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার।’

‘নাবিলা, আমরা তোমার জন্যে ওয়েট করছি। বল, আমাদের জন্যে তোমার কি সাহায্য আছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ব্যাপারটা তেমন কিছু নয় স্যার। আমার একটা সন্দেহ মাত্র।’ থেমেছিল নোয়ান নাবিলা।

‘গো অন নাবিলা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ইয়েস স্যার। স্যার, গত রাতে একটা থিয়েটার শো’ থেকে বেরিয়ে রাশিয়ান স্পাই নাতাশা নাতালিয়েভার সাথে আমার হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। সুইজারল্যান্ডে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। মোসাদের পক্ষ থেকে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। এক নাইট ক্লাবে ওখানকার মোসাদ চীফ আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, নাতাশা নাতালিয়েভা রাশিয়ান স্পাই হলেও প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য করে। নাতাশারও পিতা রাশিয়ান, মা ইহুদি। দু’দিন আমি জেনেভায় ছিলাম, সেও ছিল। এ দু’দিনে তার সাথে আমার আন্তরিক একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। দেখা হওয়ার পর আমি তাকে আমার সাথে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ….।’

নাবিলার কথার মাঝখানেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উঠল, ‘তোমার ফ্লাটে?’

‘না স্যার, আমার ফ্ল্যাটে তাকে নেইনি। আমার হোটেল স্যুটে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’

‘ধন্যবাদ। গো অন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ইয়েস স্যার। এক সাথে ডিনারসহ প্রায় ঘণ্টা দুই নানা রকম আলোচনা করি। আমার পক্ষ পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আহমদ মুসার কথাও আসে। তার কিডন্যাপ হওয়ার খবর সেও জানতো। তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সে বলল, মোসাদ কিংবা ইরগুনজাই লিউমি তাকে কিডন্যাপ করেনি। করলে অবশ্যই আমি জানতে পারতাম। আমি বলেছিলাম, সেটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে আহমদ মুসাকে কারা কিডন্যাপ করতে পারে? আমেরিকায় এমন কোন সংস্থা বা গ্রুপ আমরা দেখি না। তাঁর কিডন্যাপ বড় কোন গ্রুপ করেছে এবং বড় উদ্দেশ্য ছাড়া হয়নি। সেও আমার সাথে একমত হয় যে পরিচিত কোন গ্রুপ এ ধরনের নেই। হঠাৎ সে বলে ওঠে, একটা টাটকা খবর কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আমার এক জার্মান বান্ধবী ন্যাটোর গোয়েন্দা টিমে কাজ করে। কিন্তু আসলে সে রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মী। তার সাথে দু’দিন আগে আমার দেখা হয়েছিল। সে কথায় কথায় তার একটা উদ্বেগের কথা জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘এইচ কিউব’ (H3) গোপন সংস্থা কাজ করছে। অস্ত্র-গবেষণা তাদের প্রধান কাজ। রাশিয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভার ও অস্ত্র-গবেষণা তারা ফলো করছে। কৌশলগত অস্ত্রের সবগুলোর কলাকৌশল আয়ত্ত শুধু নয়, অস্ত্রের উৎপাদনও তারা করছে। তারা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা অস্ত্র নিয়ে কাজ করছে, যে অস্ত্রের খবর বিশ্ব এখনও জানে না। এই কাজে নাকি তাদের একটা মানব অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। সে মানব অস্ত্র তারা নাকি পেয়ে গেছে। সম্প্রতি তারা তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ নাতাশা নাতালিয়েভার কাছ থেকে শেষ এই তথ্য শোনার পর আহমদ মুসার কথা আমার মনে হয়ে যায়। সেও তো কিডন্যাপ হয়েছে সম্প্রতি।’ থামল নোয়ান নাবিলা।

কেউ কোন কথা বলল না।

জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারের চোখ-মুখ বিস্ময়ে বিমূঢ়। একে অপরের দিকে চাইল তারা।

মুখ খুলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার, সিআইএ প্রধান। বলল, ‘ধন্যবাদ মিস নোয়ান নাবিলা। কান টানতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে মাথাই এসে গেল। নাতাশা কিছু বলেছে ‘এইচ কিউব’ এর উদ্দেশ্যটা কি?’

‘না স্যার, এ বিষয়ে কিছু বলেনি। জানা থাকলে সম্ভবত বলত।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘এইচ কিউব’-এর অর্থ কিছু বলেছে? এটা তো একটা সাংকেতিক নাম।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারই বলল।

‘জি স্যার বলেছে। ‘হ্যান্ড অব দ্যা হাই হ্যান্ডস’। সম্ভবত তিনটি ‘এইচ’ মিলে এইচ কিউব (H3) হয়েছে।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘তার মানে ‘বড়দের বড়’ ওরা। রহস্যপূর্ণ নাম। ন্যাটোর গোয়েন্দা রাশিয়ান স্পাই যখন জানে, তখন রাশিয়াও তো এটা জানার কথা।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘এ বিষয়টা আমি ঠিক জানি না স্যার, তবে আমার মনে হয় রাশিয়া জানলেও খুব সম্প্রতি জেনেছে। নাতাশাও এটা জেনেছে আহমদ মুসা কিডন্যাপ হওয়ার পর।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন্ গোপন অস্ত্র নিয়ে তারা কাজ করছে, কিছু বলেছে নাতাশা এ ব্যাপারে?’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থারই।

‘সে জানতে পেরেছে কিনা জানি না, তবে সে আমাকে কিছু জানায়নি।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

‘মানব অস্ত্র হিসাবে তারা যাকে কিডন্যাপ করেছে, তাকে কেন তুমি আহমদ মুসা বলে মনে করছ?’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আহমদ মুসার কথা আলোচনায় আসাতে নাতাশাই মানব অস্ত্র কিডন্যাপ হওয়ার কথা বলে। তার সন্দেহের ব্যক্তি আহমদ মুসাই, আমারও তাই মনে হয়েছে।’ নোয়ান নাবিলা বলল।

জর্জ আব্রাহাম জনসনের ভ্রু কুঞ্চিত। ভাবছিল সে। বলল, ‘অস্ত্র গবেষণার সাথে আহমদ মুসার সম্পর্ক কি? তাকে মানব অস্ত্র হিসাবে কি কাজে, কোথায় ব্যবহার করবে?’

‘মানব ঢাল নয়, মানব অস্ত্র। তার অর্থ তাকে কোন কাজে লাগাবে।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে?’ প্রশ্ন জর্জ আব্রাহাম জনসনের।

‘তাই তো মনে হয়।’ বলল এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার।

‘তা কি করে সম্ভব? আহমদ মুসার মতো ব্যক্তির কাছে কেউ কি করে এটা আশা করতে পারে?’ প্রশ্ন তুলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘এর কোন উত্তর নেই মি. জর্জ জনসন।’ এ্যাডমিরাল ম্যাক আর্থার বলল।

‘এখানে এসেই কিডন্যাপ হওয়া লোকটি আহমদ মুসা হওয়ার ব্যাপারে আমার সন্দেহ।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

একটু থেমেই জর্জ আব্রাহাম জনসন আবার বলে উঠল, ‘সে যাই হোক। ‘এইচ কিউব’ সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেল তা অত্যন্ত গুরুতর। এখন আহমদ মুসা এবং ‘এইচ কিউব’ দুই বিষয়ই আমাদের প্রায়রিটি দিতে হবে। আমার মনে হয়, এইচ কিউব-এর ব্যাপারে নোয়ান নাবিলাকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে আর বেঞ্জামিন বেকন আহমদ মুসার বিষয়টা তো দেখছেই। দুই অনুসন্ধান এক বিন্দুতে গি