৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

‘সারা, তুমি টেলিফোনটা ম্যাডামকে দাও। তাঁর সাথেও কথা বলি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও.কে আংকেল।’ বলে সারা জেফারসন টেলিফোন মারিয়া জোসেফাইনকে দিয়ে বলল, ‘আপা জর্জ আংকেল কথা বলবেন।’ সারার কণ্ঠ ভারি।

জোসেফাইন টেলিফোন নিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং আংকেল। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি, এ কথা বলার সময় আসেনি মা। আমার ভাই আহমদ আবদুল্লাহ কেমন আছে?’ বলল ওপার থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছে আংকেল।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘মা জোসেফাইন, আমি সারাকে সব বলেছি। আহমদ মুসার উদ্ধারে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি কারা এটা করেছে। তার উদ্ধারের আমরা সব রকম পদক্ষেপ নেব।’

‘ধন্যবাদ আংকেল। আমি সারার কাছে সব জেনে নেব।’ বলল মারিয়া জোসেফাইন।

‘দোয়া কর মা যাতে আমাদের সবার প্রিয় আহমদ মুসাকে তাড়াতাড়ি আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে পারি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘আমিন।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘আমিন। ও.কে মা, রাখি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

‘ও.কে আংকেল। আসসালামু আলাইকুম।’ মারিয়া জোসেফাইন বলল।

‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।

ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।

মারিয়া জোসেফাইন মোবাইলটা সারা জেফরসনকে দিতে গিয়ে দেখল, ‘মুখ নিচু করে বসে আছে সারা জেফারসন।

‘সারা।’ ডাকল মারিয়া জোসেফাইন।

মুখ তুলল সারা জেফারসন।

তার দু’চোখ অশ্রু ভরা।

তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সারা বলল, ‘হ্যাঁ, আপা। কথা হলো আংকেলের সাথে?’

জোসেফাইন উঠে সারার পাশে বসতে বসতে বলল, ‘তোমার সামনে সোফায় বসে কথা বললাম, তুমি তাহলে কিছুই শোননি?’

‘না, শুনেছি…।’

সারার কথা শেষ না হতেই মারিয়া জোসেফাইন বলল, ‘শুনেছ, কিন্তু বোঝনি তাই তো?’

সারা মাথা ‍নিচু করল।

জোসেফাইন তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘জানি সারা, আংকেল ভালো খবর দিতে পারেন নি।’ ভারি কণ্ঠ জোসেফাইনের।

সারা জেফারসন আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল জোসেফাইনকে। তার শরীরটা কেঁপে উঠতে লাগল।

কাঁদছে সারা জেফারসন।

নিঃশব্দ কান্না।

জোসেফাইন তার কোলে মুখ গুঁজে রাখা সারা জেফারসনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কান্না নয় সারা, ওঁর জন্যে দোয়া কর। ওঁকে আল্লাহ যেন ভালো রাখেন, ভালোভাবে ফিরে আসেন।’ ভাবলেশহীন উদাস কণ্ঠ জোসেফাইনের। তার দু’চোখে শূন্য দৃষ্টি।

জোসেফাইনের কোল থেকে মুখ তুলল না সারা জেফারসন। বরং এবার সে সশব্দে কেঁদে উঠল।

জোসেফাইন তাকে কোল থেকে তুলল। তার মুখ সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘সারা, কোন নতুন খবর দিয়েছেন আংকেল?’

সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। সোজা হয়ে বসল।

চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘উনি বেঁচে আছেন, এ ছাড়া কোন ভালো খবর দেননি।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। এটাই এই মুহূর্তের জন্যে সবচেয়ে ভালো খবর সারা। এ খবর তো আনন্দের, আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের।’ বলল জোসেফাইন।

‘আপা, তুমি ওঁর যোগ্য স্ত্রী। উনি ধৈর্য্য, স্থিরতার প্রতিমূর্তি। তুমিও তাই। আল্লাহর উপর কতটা আস্থাশীল হলে এ রকম মন পাওয়া যায় আমি জানি না। এ মন আমি পাইনি, আমার নেই।’ কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলল সারা।

জোসেফাইন একটু হাসল। বলল, ‘তা নয় সারা, আমি তোমার চেয়ে বড়। আমার আবেগ অনেকটাই স্থিল এখন।’

কথা শেষ করেই গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তাঁর ব্যাপারে আর কি সন্ধান পাওয়া গেছে?’

চোখ মুছল সারা জেফারসন। বলল, ‘অপরিচিত এক বড় গ্যাং তাকে কিডন্যাপ করেছে। এরা নাকি খুব গোপন, সুসংগঠিত ও মারাত্মক এক লক্ষ নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন প্রশ্ন করে এসব আমি জেনেছি।’

‘কি লক্ষ তা কি ওঁরা জানতে পেরেছেন?’ বলল জোসেফাইন।

‘এ ব্যাপারে আংকেল একটা কথাই বলেছেন, সব বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের মনে হয়েছে, গোটা মার্কিন জাতি তাদের টার্গেট।’ সারা জেফারসন বলল।

‘তাহলে আহমদ মুসাকে কি ওরা কিডন্যাপ করেছে যাতে আহমদ মুসা মার্কিনীদের পক্ষে দাঁড়াতে না পারে এ জন্যে, না আরও কিছু কারণ আছে?’ বলল জোসেফাইন।

‘তাঁরা এটাও জানার চেষ্টা করছেন।’ সারা জেফারসন বলল।

‘গোটা মার্কিন জাতির বিরুদ্ধে একটা গ্যাং বা গ্রুপ দাঁড়াবার চিন্তা করতে পারে না। সুতরাং আমার মনে হচ্ছে, হয় আঙ্গিকের দিক দিয়ে, নয় তো সামরিক প্রস্তুতির দিক দিয়ে ওরা খুব বড় সংগঠন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা যদি তাদের শক্তির ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী সংগঠন হয়, তাহলে আহমদ মুসার মতো একজন ব্যক্তিকে তারা কিডন্যাপ করল কেন?’ বলল জোসেফাইন। তার কথা স্বগত উক্তির মতো।

সারা জেফারসন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোসেফাইনের দিকে। ভাবছিল সে। বলল, ‘ধন্যবাদ, খুব সুন্দর বিশ্লেষণ আপা তোমার। সত্যিই গ্রুপটি আংকেলরা যা ভাবছেন তার চেয়েও বড়, ভয়ংকর হতে পারে। তুমি সত্যি বলেছ আপা, তা না হলে আহমদ মুসাকে ওরা কিডন্যাপ করল কেন? উনি আমেরিকান নন! উনি একান্তই একজন ব্যক্তিমাত্র! এর জবাব আংকেলের কাছেও পাইনি।’

‘এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এর জবাব নিশ্চয় পাওয়া যায়নি এখনও। তবে সবকিছুর বিবেচনায় তাঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। কোন্ কাজে তাকে ব্যবহার করতে চায়।’ বলল জোসেফাইন।

আবার মুখে অন্ধকার নামল সারা জেফারসনের। বলল, ‘এটা তো উদ্বেগের আপা। তিনি ওদের পুতুল হতে পারেন না। তাঁকে বাধ্য করা হবে তাঁকে তাদের পক্ষে কাজ করতে। এ জন্যে….।’

আর বলতে পারল না সারা জেফারসন। তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আটকে গেল।

জোসেফাইন সারাকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। দেখল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন দু’জন আগন্তুক নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছে। একটু কাছে আসতেই জোসেফাইন চিনতে পারল তার এক বান্ধবী ফাতিমা নেলসন। বাড়ি ভার্জিনিয়ায়। খুব দূরে নয় ওয়াশিংটন থেকে। ওয়েলিংটন সমাধিক্ষেত্র পার হয়ে অল্প এগোলেই ওদের বাড়ি। বাড়িটা একটা হেলিপ্যাডের পাশেই। ওরা সেবার হজ্জ করতে গিয়েছিল। মদিনায় ওদের সাথে দেখা এবং পরিবারের সাথে পরিচয়। ওদেরকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল জোসেফাইন। আমেরিকায় এসে টেলিফোনে ওর সাথে কথা বলেছে। হঠাৎ করে ওদেরকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো জোসেফাইন।

উঠে দাঁড়িয়ে জোসেফাইন ওদের স্বাগত জানাল। জড়িয়ে ধরল ফাতিমা নেলসনকে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

সারার মা জিনা জেফারসন সবাইকে নিয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল।

বসেই ফাতিমা নেলসন বলল, ‘মাফ করবেন সবাই, আমি না জানিয়ে হঠাৎ এসে পড়েছি। জানতাম না, এখানে এত কড়াকাড়ি; মিসেস জেফারসনের দেখা না পেলে হয়তো ফিরেই যেতে হতো। আই অ্যাম স্যরি।’

‘মোস্ট ওয়েলকাম মিসেস ফাতিমা নেলসন। ফরমালিটি মানুষের তৈরি। আর ইনফরমালটাই স্বাভাবিক। আপনাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে এজন্যে আমরা দুঃখিত।’ বলল জিনা জেফারসন স্নেহের স্বরে।

‘ধন্যবাদ। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়েছে বলেই তাড়াহুড়া করে চলে এসেছি।’ মিসেস ফাতিমা নেলসন বলল।

তাড়াহুড়ার বিষয়টি কি মিসেস নেলসন?’ বলল জোসেফাইন।

‘বিষয়টি একটা মোবাইল। মোবাইলের মালিক আহমদ মুসা। আমার মনে হয়েছে, তিনি আপনার স্বামী আহমদ মুসা হবেন। যেহেতু আপনি জানিয়েছিলেন তিনি কিডন্যাপ হয়েছেন, তাই এ মোবাইল আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’ বলে মিসেস ফাতিমা নেলসন হাতব্যাগ থেকে মোবাইলটি বের করে জোসেফাইনের হাতে দিল।

প্রবল উদ্বেগ ও কৌতুহলে আচ্ছন্ন জোসেফাইনের মুখ।

মোবাইলটি হাতে নিয়েই নিশ্চিত হলো এটা আহমদ মুসার। এ মোবাইলটি জোসেফাইন প্রেজেন্ট করেছিল আহমদ মুসাকে। প্যারিস থেকে জোসেফাইন এই বিশেষ মোবাইলটি কিনেছিল। এর বিশেষ ফাংশন হলো মোবাইলটি বন্ধ থাকলেও এর অটো রেকর্ডার ফাংশন চালু থাকে, যদি না মোবাইল অফ করার পর এর গোপন বাটনটা অফ করে দেয়া হয়।

জোসেফাইন মোবাইলটি হাতে নিয়েই অটো রেকর্ডারের গোপন বাটনটি অন আছে কিনা দেখল। হতাশ হলো জোসেফাইন। গোপন বাটনটি অফ করা।

‘ম্যাডাম নেলসন, আপনি কি জানেন, মোবাইলটি যখন পাওয়া যায়, তখন এটা অফ ছিল, না অন ছিল?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল জোসেফাইন।

‘মোবাইলটি প্রথম খুঁজে পান আমাদের প্রতিবেশী মিসেস আর্নল্ড। তিনি বলেছিলেন, যখন তিনি মোবাইলটি পান, তখন ওটা বন্ধ ছিল।’

জোসেফাইন বুঝল, আহমদ মুসা প্লেনে উঠে মোবাইল বন্ধ করার পর আর খোলেননি। সে কারণে অটো রেকর্ডারের বাটনের দিকেও তিনি নজর দেননি।’

পাশে এসে বসেছিল সারা জেফারসন। তার হাতে মোবাইলটি দিয়ে বলল, ‘মোবাইলের সাথে অটো রেকর্ডারের বাটনও বন্ধ ছিল সারা। খোলা থাকলে কি ঘটেছিল কিছুটা জানা যেত।’

‘ম্যাডাম নেলসন, প্লিজ, মোবাইলটা কোথায় পাওয়া যায়, বলুন?’ বলল জোসেফাইন।

‘ওয়েলিংটন সমাধিক্ষেত্রের উত্তর প্রান্ত দিয়ে একটা হাইওয়ে পূর্ব প্রান্তে বনভূমিতে প্রবেশ করেছে। বনভূমিটা পার হবার পরেই হাইওয়ের ছোট্ট একটা জংশন আছে। হাইওয়ে থেকে রাস্তা বেরিয়ে সামনের হেলিপ্যাডের দিকে চলে গেছে। আরেকটা রাস্তা বনভূমির মধ্য দিয়ে পূর্ব-উত্তর দিকে গেছে। এখানে রাস্তার পাশে একটা বিকল গাড়িও পড়ে ছিল। এখানেই মোবাইলটি পান মিসেস ও মি. আর্নল্ড। পুলিশকে দেবার জন্যেই তারা মোবাইলটি তুলে নেন। পরে মোবাইলে মুসলমান একজনের নাম দেখে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং খোঁজ নেবার জন্যে মোবাইলটি আমাদের দিয়ে দেন।’ বলল মিসেস আর্নল্ড।

জোসেফাইন তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ওঁর মোবাইল ওখানে পাওয়া খুব বড় একটা বিষয়। তুমি জর্জ আংকেলকে এখনি এটা জানাও।’

‘ঠিক আছে আপা। ধন্যবাদ। আমি এখনি বলছি।’ বলে সারা জেফারসন মিসেস আর্নল্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন ম্যাডাম। আমি এখনি আসছি।’

পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে সারা জেফারসন ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে টেলিফোন করার জন্যে।

আহমদ মুসা গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল। শ্বেত-শুভ্র পোশাকের একজন লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। অপরূপ স্বর্গীয় তার চেহারা। তার দিকে চোখ তুলে চাইতেই তার দৃষ্টির স্নিগ্ধ পবিত্রতা তার হৃদয়কে ঠাণ্ডা করে দিল। সব দুর্ভাবনা তার মন থেকে মুহূর্তেই মুছে গেল। আর সেই অপরূপ স্বর্গীয় চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো মহাসম্মানিত কেউ। মনে হচ্ছে চিরচেনা তিনি। কে তিনি? ভাবতে গিয়ে কেঁপে উঠল তার শরীর। ভাবনা এগোতে পারল না, অভিভূত হয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা। আবেগে-উত্তেজনায় সে বাকরুদ্ধ। আর চোখ তুলে চাইবার সাধ্য তার হলো না। তিনি মধুমাখা কণ্ঠে আহমদ মুসাকে বললেন, “দুর্ভাবনা কেন তোমার? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এক এবং একক, তার কোন শরিক নেই। তিনি সর্বশক্তিমান। তার আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় নেই। তুমি সূরা ফাতিহা, সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাসের বর্ম পরিধান কর। দুনিয়ার কোন শক্তিকে ভয় করো না। আল্লাহ সকলের সহায়।’ কথা বন্ধ হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে চোখ তুলে সামনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল সেই স্বর্গীয় অবয়ব সামনে নেই।

বাতাসে পেল মনোমুগ্ধকর অপার্থিব এক সুরভি।

মনে হলো আহমদ মুসার যে এক সুশীতল ছায়ার আকর্ষণে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আকর্ষণ এখন নেই।

বোটা ছেঁড়া ফলের মতোই ধপ করে বসে পড়ল বিছানায় আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার মাথা বেশ জোরেই গড়িয়ে পড়েছে বালিশ থেকে।

ঘুম ভেঙে গেল আহমদ মুসার।

চমকে উঠে তাকাল চারদিকে।

তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে।

ভাবতেই তার দেহ-মন শিউরে উঠল। মনে পড়ল সব কথা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সেই স্বর্গীয় পুরুষ। সেই কথাগুলো আহমদ মুসার সামনে ধ্রুব নক্ষত্রের মতো স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিল। মনের আকাশে জ্বল জ্বল করা লেখাগুলো আবার পড়ল আহমদ মুসা। মন বলল, আশ্রয় ও নিরাপত্তার এমন একটা অবলম্বনই সে চাইছিল সমগ্র হৃদয় দিয়ে।

সেদিন মানসী মেরাবের কাছ থেকে আহমদ মুসার ব্রেনের উপর বিশেষ ম্যাগনেটিক পালস ব্যবহারের কথা শোনার পর আহমদ মুসা সত্যিই দুর্ভাবনায় পড়েছিল। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ পাচ্ছিল না সে। অথচ সময় বয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তার সাথে তার উদ্বেগও বাড়ছিল। তাহাজ্জুদ নামাজে আহমদ মুসা দীর্ঘ সূরা পড়ায় অভ্যস্ত। গত রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে জানা এবং বহুল পঠিত সূরা পড়তে গিয়ে বার বার তার ভুল হয়েছে। শুরুটাও মনে করতে অনেক ভাবতে হয়েছে তাকে। আরও একটা ঘটনা ঘটেছে গতকাল। আহমদ মুসার মন দেখতে চাইলেই তার চোখের সামনে পর্দায় জোসেফাইন, আহমদ আব্দুল্লাহসহ সবার চেহারা ভেসে উঠত। কিন্তু গতকাল থেকেই লক্ষ করছে সেই ছবিগুলো যেন আগের চেয়ে ঝাপসা। বিষয়টা আহমদ মুসাকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন করেছে। এই উদ্বেগ নিয়েই সে আজ রাতে শুয়েছিল। তারপর আল্লাহর সাহায্য চেয়ে সব দুর্ভাবনা দূর করে ঘুমাতে চেষ্টা করেছিল এবং ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তারপর এই স্বপ্ন সে দেখেছিল। স্বপ্নে তার দুর্ভাবনার এলাজ এল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর মাধ্যমে, যাঁর দেখা আল্লাহর বিশেষ দয়া এবং তাঁর বিশেষ ভালোবাসা ছাড়া মিলতে পারে না।

অসীম কৃতজ্ঞতায় তার চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুর ঢল। সে পড়ে গেল সিজদায়।

আহমদ মুসা তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে বসে স্বপ্নের নির্দেশের কথা স্মরণ করল। আহমদ মুসা মনে মনে নতুন করে বলল, ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ছাড়া আর কোন শক্তি ও আশ্রয়দাতা নেই। আমি তাঁর কাছেই শক্তি ও সাহায্য প্রার্থনা করছি।’ এই ঘোষণা ও প্রার্থনা শেষ করে আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে সূরা ফাতিহা, সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করল এবং গোটা দেহ মাসেহ করল। মনে মনে বলল, আমি আল্লাহর অনুগ্রহ ও আশ্রয়ের বর্ম পরিধান করলাম, আর কারও পক্ষ থেকে কোন ক্ষতির ভয় আমি করি না।

সংগে সংগেই প্রশান্তির এক পরম স্পর্শ অনুভব করল গোটা দেহে।

পরদিন নাস্তার পর টেবিলে বসতেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল মুমূর্ষূ মানসী মেরাবের কথা। তার দিকে ছুড়ে দেয়া ধূসর রঙের মার্বেলের মতো গোলাকার বস্তুটির কথা। আহমদ মুসা খুব খুশি হলো। ওটা যে খুব জরুরি তা তখনই তার মনে হয়েছিল। কিন্তু এতটা সময় ওটার কথা তার মনে পড়েনি কেন? বিস্মিত হলো সে। ওটাও কি তাহলে সেই বিশেষ ধরনের ম্যাগনেটিক পালসের কারসাজি? আহমদ মুসার মনে হলো, কয়েক দিন ধরে তার মনটা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো গুম হয়েছিল, আজ তেমনটা নয়। আজ মনটা হালকা, পরিষ্কার ও সক্রিয়, আগে যেমন ছিল। সন্দেহ নেই এই কারণেই মানসী মেরাবের সেই জিনিসটার কথা তার মনে পড়েছে।

মনের এই পরিবর্তন আহমদ মুসার বাইরে প্রকাশ পেল না। যদিও ওরা বলেছে এই বাংলোর ভেতরে কোন ক্যামেরা তারা রাখেনি। কিন্তু বিশ্বাস নেই ওদের কথায় আহমদ মুসার। নিশ্চয় ওরা আহমদ মুসার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।

আহমদ মুসা টেবিল থেকে উঠে বেডে শুয়ে পড়ল। এক সময় কাত হয়ে শুয়ে বালিশ টেনে নেবার ছলে উপুড় হবার ভংগিতে একটা হাত সন্তর্পণে ঢুকিয়ে দিল বালিশের কভারের ভেতরে এবং সংগে সংগে মানসী মেরাবের সেই মার্বেলাকার জিনিসটি নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর আরও দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থেকে আহমদ মুসা উঠে গেল বেড থেকে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে গিয়ে বসল বাইরে বেরুবার দরজা ও ভেতরের টয়লেটের মাঝখানে একটা কোণাকৃতি স্থানে দেয়ালের দিকে মুখ করে। কোন দিকের কোন ক্যামেরার চোখই এখানে পড়বে না।

মার্বেলাকৃতির সেই জিনিসটি বের করল আহমদ মুসা। যা মনে হয়েছিল তাই। ক্ষুদ্র বলটা মাটির। কিন্তু আহমদ মুসার মনে হলো বলটা মাটির হলেও যতটা ভারি হওয়ার কথা তার অর্ধেক ভারিও নয়। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আহমদ মুসার মনে হলো, দেখাই যাচ্ছে বলটা মাটির। তাহলে কি ভেতরে অন্য কিছু আছে? মনের একটা দরজা হঠাৎ খুলে গেল আহমদ মুসার। নিজের মনেই হাসল আহমদ মুসা। কেন এতক্ষণ মনে হয়নি তার যে, মাটির একটা মার্বেলাকৃতি বল মানসী মেরাব তার কাছে শুধু শুধু পাঠাবে?

বলটিতে জোরে চাপ দিতেই ভেঙে গেল মাটির বলটি। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গোল করে ভাঁজ করা একটি কাগজ। তাড়াতাড়ি কাগজটির ভাঁজ খুলল আহমদ মুসা।

এক খণ্ড সাদা কাগজের বুক জুড়ে ড্রইং। রেখা চিত্রটাকে একটা লেআউট বা ম্যাপ বলা যেতে পারে।

কিসের ম্যাপ?

এই বন্দীখানার কি?

বন্দীখানারই হবে, তা না হলে মানসী মেরাব এত কষ্ট করে তার মুমূর্ষূ অবস্থায় এটা তার কাছে পাঠাবে কেন?

ম্যাপটা ঠিক পেন্ডুলামওয়ালা সাবেক দেওয়াল ঘড়ির মতো। আর লেজের উপরে মাথার অংশটা একশ্রেণীর দেয়াল ঘড়ির মতো বহুকৌণিক।

এই ম্যাপটা মানসী মেরাব আমাকে দিল কেন? কোন্ উদ্দেশ্যে? সন্দেহ নেই, তাকে মুক্ত হতে সাহায্য করার জন্যেই এই ম্যাপ তাকে দিয়েছে। তাহলে নিশ্চয় এতে তার ইংগিত আছে।

ভালো করে ম্যাপটা দেখতে শুরু করল আহমদ মুসা।

লেআউট ম্যাপকে খুব প্রফেশনাল মনে হলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, বড় একটা লেআউপ ম্যাপকে ছোট করা হয়েছে। তাহলে এটাই কি অরিজিনাল ম্যাপ, প্রফেশনাল ডিজাইনার ইঞ্জিনিয়ারের আঁকা?

খুশি হলো আহমদ মুসা। এ থেকে নিখুঁত তথ্য পাওয়া যাবে।

লেআউট ম্যাপের অংকন থেকে বুঝা যাচ্ছে স্থাপনা নিচুতে। তার একটা ইন্ডেকেটরও আছে। ইন্ডিকেটরের মাথাটা উপরের দিকে। উপরের মাথায় জিরো, নিচের প্রান্তে ২৫ মিটার লেখা। তার মানে এদের স্থাপনা আন্ডারগ্রাউন্ডে, মাটির তলে? আন্ডারগ্রাউন্ড এই স্থাপনাটি মাটির ২৫ ফুট গভীরে? তাহলে সে যে ধারণা করেছিল তাই সত্য হলো। সে এখন আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনায় বন্দী।

ম্যাপটার উপর চোখ বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা লক্ষ করল ম্যাপের গোলাকার এরিয়ায় দু’টি লেয়ার রয়েছে। একটা উপরে, আরেকটা নিচে। উপরের লেয়ারের ফ্লোর ম্যাপের লেজের ফ্লোর প্রায় সমান্তরাল। আহমদ মুসার মনে হলো সে এই উপরের লেয়ারেই রয়েছে। ম্যাপের লেজের শেষ প্রান্তের প্রবেশ পথ দিয়েই তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ওখানে একটা এক্সিট আছে। আর কোথায় এক্সিট পাওয়া যাবে? খুঁটে খুঁটে ম্যাপটা দেখতে লাগল আহমদ মুসা।

উইনডো আকারের একটা এক্সিট মার্ক পেল ম্যাপের সেই লেজে। ওখান দিয়েই আহমদ মুসাকে প্রবেশ করানো হয়েছিল। ঐ রকম আর কোন এক্সিট পয়েন্ট পেল না আহমদ মুসা গোটা ম্যাপ খুঁজে। তার মানে এই আন্ডারগ্রাউন্ড স্থাপনার এক্সিট পয়েন্ট একটাই! যে সার্কেলে সে বন্দী আছে, সেখান থেকেও বের হবার কোন এক্সিট নেই। লিফট দিয়ে নামার পর যে দরজা দিয়ে এই সার্কেলে তাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটারও কোন ইন্ডিকেশন নেই কেন? গোপন ঘাঁটি বা বন্দীখানা বলেই কি? ওদিকটা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে আহমদ মুসা সার্কেল লাইনের উপর গভীর কালো একটা বিন্দু দেখতে পেল। এই ধরনের কোন চিহ্ন সার্কেলটির কোথাও পেল না সে। নিশ্চয় তাই হবে। কিন্তু এত বড়, এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ঘাঁটির একটাই এক্সিট থাকবে এটা আহমদ মুসার মন মেনে নিতে পারল না। আবার খুঁজতে লাগল আহমদ মুসা।

স্থাপনাটির প্রশস্ত লেজটা, তার ঠিক বিপরীত দিকের প্রান্তিক দেয়ালে প্রায় অদৃশ্য ছাই রঙের একটা ভার্টিক্যাল লাইন লম্বের মতো উপরে উঠে গেছে। লম্বের মাথাটা বর্ষার ফলার মতো। রং সবুজ। ফলাটা ঠিক পাতার আদলে তৈরি। রং সবুজ হওয়ায় ঠিক পাতাই মনে হচ্ছে।

হঠাৎ আহমদ মুসার মন আনন্দে নেচে উঠল। এটা নিশ্চয় বাইরে বেরুবার মানে মাটির উপরে উঠার গোপন পথের ইংগিত। এই লম্বের ওখানে হয়তো উপরে উঠার গোপন পথটা আছে। লম্বের মাথার সবুজ পাতার সিম্বলটা মাটির উপরের সারফেসের প্রতীক। কিন্তু লম্বটির শুরু হয়েছে নিচের ফ্লোর থেকে। ওটা যদি গোপন পথ হয়, তাহলে তার গোপন দরজা কি নিচের তলাতেই? তাই হবে।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

মনটা হালকা হয়ে গেল তার।

হাতের ম্যাপটা পকেটে পুরে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বসল তার পড়ার টেবিলে।

কিন্তু মনের খুশি তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বন্দীখানার এই সার্কেল থেকে বের হবার উপায় কি? ম্যাগনেটিক সার্কেলকে ক্রস করতে পারে না কোন বস্তুই। শুধু মাটিই ব্যতিক্রম, যেহেতু মাটির উপর সে ম্যাগনেটিক সার্কেলটি স্থাপিত। এ জন্যে মানসী মেরাব ম্যাপের কাগজটি পাঠিয়েছে মাটি দিয়ে মুড়ে।

সার্কেল ক্রস করে ওপারে যেতে পারলে তবেই নিচের ফ্লোরে নামার গোপন পথের সন্ধান করা যাবে।

কিন্তু ম্যাগনেটিক সার্কেলটি ক্রস করার উপায় কি? যে কোন বেড়া হলে ডিঙানো যেত, জ্বলন্ত আগুনের সার্কেল হলেও তা ডিঙানো সম্ভব হতো। কিন্তু ম্যাগনেটিক সার্কেলের অদৃশ্য আগুনের আগ্রাসী আকর্ষণ এড়ানোর কোন উপায় নেই। তার উপর রয়েছে এই বাংলো। ম্যাগনেটিক সার্কেল ও চারদিকের চত্বরের উপর রয়েছে ইলেকট্রনিক চোখ।

হতাশা ঘিরে ধরতে চাচ্ছিল আহমদ মুসাকে। হঠাৎ মনে পড়ল ‘যত পথ তত খুলি’ বলে একটা প্রবাদ আছে। অর্থাৎ সবকিছুরই একটা বিকল্প থাকে। এদের এই যে অত্যন্ত টাইট সিকিউরিটি, এর একটা দুর্বলতা নিশ্চয় আছে। সেটাই তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

খেতে বসে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, এ খাবারগুলো আসলেই কিভাবে আসে? খাবার শেষে বাসন-কোসন সবকিছু যথাস্থানে ফুড বক্সে রেখে দেয় সে। ফুড বক্স কিভাবে এখান থেকে চলে যায়? এর ঠিক উপরে ফায়ার চিমনির মোভেবল টপের পথে কি? কিন্তু তার অনুসন্ধানে এটা স্বাভাবিক মনে হয়নি। তাছাড়া মানসী মেরাবের ম্যাপ অনুসারে এটাই উপরের ফ্লোর। এর উপরে মাটি আছে, কোন স্থাপনা নেই। চিমনি থেকেও কখনও ধোঁয়া বেরুনোর প্রয়োজন হয় না। কারণ এখানে রান্নার প্রয়োজন নেই। এই চিন্তা যদি সত্য হয়, তাহলে তার ফুড বক্স উপরে নয়, নিচে যায়। কিন্তু কোন্ পথে?

খাওয়া শেষ হয়ে গেছে আহমদ মুসার।

পায়চারি করতে লাগল সে। নিচে যাওয়ার সেই পথ কোনটা, কোথায়?

ভাবতে ভাবতেই সে বাসন-কোসন গুছিয়ে ফুড বক্সে ভরল। এই ফুড বক্সটাই এখান থেকে চলে যায়। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ফুড বক্সের নিচে কি আছে দেখতে হবে।

সে ফুড বক্সটি তোলার জন্যে অনেক টানাটানি করল, পারল না। বেজ এর সাথে কি এটা স্থায়ীভাবে সেট করা! কিন্তু যেহেতু এটা ফুড বক্স, পরিষ্কার বা নতুন ফুড বক্স সেট করার জন্যে এটা অবশ্যই খোলা হয়। খোলার কোন একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে। সেই ‘ব্যবস্থা’ আবার খোঁজ করতে লাগল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা দেখল, স্টিলের প্লেন শিটের উপর ফুড বক্সটি দাঁড়িয়ে আছে। ফুড বক্স ও স্টিল শিটের চারদিকের গাসহ স্টিল শিট যার উপরে বসে আছে, সেই চারকোনা বিশিষ্ট গোটা স্ট্রাকচার মেঝে পর্যন্ত গভীরভাবে পরীক্ষা করল এবং সম্ভাব্য সবকিছু টেপাটিপি করে দেখল গোপন বা প্রকাশ্য কোন সুইচ নেই, যা ফুড বক্সকে ডিটাচড করার কোন ইলেক্ট্রনিক বা যান্ত্রিক ব্যবস্থা খোলা-বন্ধের মাধ্যম হতে পারে। স্ট্রাকচারটির মাথার দিকসহ কিছু স্ক্রু আছে, যা দেখে আহমদ মুসা পরিষ্কার বুঝল সম্প্রতি এগুলোর কোনটাই খোলা হয়নি। এগুলো যে শো অথবা স্ট্রাকচার তৈরির সময়ের স্থায়ী অংশ তা পরিষ্কার বুঝা যায়। এগুলোর সাথে নিশ্চয় ফুড বক্সের কোন সম্পর্ক নেই। ফুড বক্স তাহলে ঐভাবে আটকে আছে কেমন করে? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল এরা ম্যাগনেটিক শক্তিকে ব্যবহার করে বেশি। দরজাগুলো, লিফট, বন্দীখানার প্রটেকটিভ সার্কেল, মারণাস্ত্র পরিকল্পনা সবকিছুতেই ম্যাগনেটিক শক্তির প্রাধান্য। ফুড বক্সের ক্ষেত্রেও নিশ্চয় তাই।

আহমদ মুসা ফুড বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে সেটিকে আগের মতো উপরের দিকে তোলার চেষ্টা না করে এবার ফুড বক্সের উপরের প্রান্তে হাত রেখে জোরের সাথে সামনের দিকে ঠেলে দিল। ‘কট’ করে একটা শব্দ হলো, ফুড বক্সটি উঠে পাশে পড়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি সেটা ধরে ফেলল। সত্যি বেজটা সলিড স্টিল। পরীক্ষার জন্যে তার জ্যাকেটের স্টিলের বাটন সে বেজের উপর নিতেই বাটনটাকে ঝড়ের বেগে টেনে নিল। ঠন করে বড় রকমের শব্দ উঠল। তার মানে ভেতরটা ফাঁকা, বুঝল আহমদ মুসা।

ফুড বক্স সমস্যার সমাধান হলো এবং বুঝল যে চারকোনা বিশিষ্ট বেজ কন্টেইনার স্ট্রাকচারটাই ফুড বক্সকে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায় আবার উপরে তোলে।

এই পথ কি নিচের ফ্লোরে নামার জন্যে ব্যবহার করা যায়? চারকোনা বেজ কন্টেইনার মেপে দেখল আহমদ মুসা। দুই স্কয়ার মিটার এর আয়তন। একজন মানুষের উঠা-নামার জন্যে যথেষ্ট।

আহমদ মুসা চিন্তা করল সে ফুড বক্স সেজে বেজ কন্টেইনারের উপর দাঁড়িয়ে নিচের ফ্লোরে নেমে যেতে পারে। উপরের মাথাটা এর ওপেন থাকছে। সুতরাং অসুবিধা হবে না।

কিন্তু আবার ভাবল, ফুড বক্সের ওজন ও বেজ-এর সাথে তার ম্যাগনেটিক এটাচমেন্টের কোন সম্পর্ক তার উঠা-নামার সাথে থাকতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। এটাই যদি সত্যি হয় তাহলে সহজেই ওরা জানতে পারবে এখানে কি ঘটেছে। তার ফলে ওরা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে এই পথটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে কি করবে আহমদ মুসা?

বেজ কন্টেইনারের বডির দিকে আরও গভীরভাবে দৃষ্টি বুলাল আহমদ মুসা। কন্টেইনার বডির ভেতরে ফাঁকা। বেজটিকে মাথার উপর একটা স্টিল টপ বসিয়ে স্ক্রু দিয়ে আটকে দেয়া। স্ক্রু খুলে বেজের ঢাকনা সরিয়ে নিলে কি দেখা যাবে? নিচে নেমে যাওয়া ফাঁপা একটা সুড়ঙ্গ। এর দৈর্ঘ্য নিশ্চয় হবে বিশ ফুটের মতো। ফাঁপা এই স্টিল বডিটি যখন নিচে যায়, তখন এর ফ্লোর পরিমাণ উচ্চতার অংশটি নিচের তলার নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে যায়। এই তলায় এর যে পরিমাণ অংশ উপরে আছে, নিচের ফ্লোরেও নিশ্চয় সে পরিমাণ অংশ উপরে থাকে। অবশিষ্ট অংশ অবশ্যই আন্ডারগ্রাইন্ডে ঢুকে যায়। নিচে নামার জন্যে জাম্প দিলে সুড়ঙ্গের তলায় আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে পড়তে হবে। বের হবার কোন পথ থাকবে না। অবশ্য খাদ্য নিয়ে যখন উপরে উঠবে তখন ফাঁপা স্টিল বডিটির শেষ প্রান্তটি থাকবে নিচের তলার ফ্লোরের সমান্তরালে। কিন্তু ততক্ষণ অক্সিজেন যোগাড় করবে কোত্থেকে?

চিন্তায় পড়ে গেল আহমদ মুসা।

হঠাৎ তার চোখ পড়ে গেল ফাঁপা স্টিল বডিটার গায়ে। দেখল ওটার গায়ে অনেক ছিদ্র।

আনন্দিত হলো আহমদ মুসা। ছিদ্র যে কারণেই হোক তার কাজে আসবে। উপরের ঢাকনা বন্ধ থাকলেও তার অক্সিজেনের অভাব হবে না।

স্টিল বডির বেজ-ঢাকনার ক্ষুদ্র স্ক্রু খুলতে শুরু করল আহমদ মুসা কাঁটা চামচের সূক্ষ মাথা দিয়ে। খুলে গেল একটা স্ক্রু। দেখল, ওটা স্ক্রু নয়, একটা শো। তার মানে ঢাকনাটি স্ক্রু দিয়ে আটকানো নয়।

ঢাকনা খুলে ফেলল আহমদ মুসা। ভেতরে তাকিয়েই চমকে উঠল সে। ছয় সাত ফুট নিচে ফাঁপা স্টিল বডিটার ফ্লোর। আর ফাঁকা স্টিল বডির ভেতরের দেয়ালে নিচে নামার জন্যে মইয়ের মতো ব্যবস্থা রয়েছে। ওগুলোও স্টিলের তৈরি।

তাহলে নিচের ফ্লোরটা একটা ল্যান্ডিং প্লেস। স্টিল বডিটা নিচের তলায় নামার একটা মাধ্যম? নিশ্চয় তাই। এটা তাহলে এক ধরনের লিফট? নিশ্চয় তাহলে এর একটা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও এখানে থাকবে?

ভেতরে নেমে পড়ল আহমদ মুসা। ল্যান্ডিং ফ্লোরটায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দেয়ালে চোখ বুলাল সে। হাঁটু বরাবর উঁচুতে দেয়ালের গায়ে আহমদ মুসা ঠিক দেয়ালের রঙের তিন চার ইঞ্চি লম্বা একটা লম্ব দেখতে পেল। তার নিচের ও উপরের দুই মাথায় তীর চিহ্ন দেখতে পেল। তীর চিহ্নটির প্রতি দৃষ্টি তার স্থির হলো। এই তীর চিহ্ন নিরর্থক নয়-বুঝল আহমদ মুসা। এর সহজ অর্থ এই যে, উপরের তীর চিহ্নে চাপ দিলে লিফটের মতো এই টিউব উঠবে আর নিচেরটায় চাপ দিলে নিচে নামবে।

ভাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা নিচের তীর চিহ্নটায় চাপ দিল। সংগে সংগে নিঃশব্দে ফাঁপা টিউবটি নিচে নামতে শুরু করল।

বুঝল আহমদ মুসা ফাঁপা এই স্টিল বডিটাকে শুধু খাদ্য পাঠানো নয়, লিফট হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। নিশ্চয় আহমদ মুসার অলক্ষে বা ঘুমিয়ে পড়লে তপার ওখানেও লোকরা নিয়মিত যাতায়াত করে।

লিফটটি এক সময় নিঃশব্দে থেমে গেল। আহমদ মুসা বুঝল লিফটটি নিচের ফ্লোরে এসে গেছে। তার এই ল্যান্ডিং স্থানটি নিশ্চয় ফ্লোরের সমান্তরালে রয়েছে।

লিফটটি কোথায় এসে থামল? কোন্ কক্ষে? কোন্ উন্মুক্ত স্থানে বা কোন্ হল রুমে? এই লিফটটি নেমেছে নিশ্চয় অসময়ে। এটা দেখে ওরা এখনি কি ছুটে আসবে এদিকে? প্রশ্নগুলো আহমদ মুসাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে দারুণ উৎসুক করে তুলল।

আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল। তার মাথা থেকে ফাঁপা স্টিল বডিটার শীর্ষ প্রান্ত প্রায় এক ফুটের মতো উপরে।

আহমদ মুসা হুকে পা রেখে এক ধাপ উপরে উঠল। বিসমিল্লাহ বলে মাথাটা ফাঁপা বডির ভেতর থেকে সামান্য উপরে তুলে দ্রুত চোখ বুলাল বাইরে। চোখ পড়ল একজনের উপর। গভীর বিস্ময় তার চোখে-মুখে। সেও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। বিদ্যুৎগতিতে তার হাতের রিভলবার উঠে এল।

আহমদ মুসাও চোখের পলকে ফাঁপা স্টিল বডির দুই প্রান্তে দু্ই হাত রেখে তার উপর ভর করে দুই পা বাইরে নিয়ে লাফিয়ে পড়ল মেঝেতে। ততক্ষণে একটি গুলির শব্দ হলো। লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে গুলি করেছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার চলন্ত বডি মেঝের দিকে ছুটতে শুরু করেছিল।

আহমদ মুসার পা’দুটি মেঝে স্পর্শ করার সংগে সংগেই আহমদ মুসা তার মাথা মেঝের দিকে চালিয়ে দিয়ে পা দু’টোর প্রচণ্ড আঘাত ছুড়ে মারল রিভলবারধারী লোকটির দিকে।

প্রথম গুলি ব্যর্থ হবার পর নতুন টার্গেট ফিক্সট করছিল লোকটি। কিন্তু ভাবেনি যে মেঝের উপর আহমদ মুসার বডি স্থির হবার আগেই দেহটা আবার চলন্ত হবে। আহমদ মুসার দু’পায়ের লাথি গিয়ে পড়ল লোকটির বুকে। লোকটি সশব্দে পড়ে গেল মেঝের উপর চিৎ হয়ে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েই লোকটির রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির উপর। রিভলবার লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘তোমাদের নেতা এখন কোথায়? তোমরা কতজন লোক এখন এই ফ্লোরে রয়েছ? তিন গোনার মধ্যেই উত্তর না দিলে তোমার মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।’

‘এক… দুই…’ গুণতে লাগল আহমদ মুসা। লোকটির চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। ‘তিন’ গোনার আগেই লোকটি বলে উঠল, ‘বলছি, আমি বলছি। আমাদের চীফ হাই হাইনেস কোহেন ক্যানিংহাম আমাদের এখানে নেই। আজ বিকেলেই বাইরে গেছেন। আমরা এই ফ্লোরে এখন আমিসহ সাত জন আছি।’

‘আর লোকরা?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘উপরের তলায় আছে চারজন, এক্সিট ওয়েতে আছে বিশ জন।’ বলল লোকটি।

‘এক্সিটটা ঠিক কোন্ দিকে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

লোকটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আহমদ মুসার অনুমান ঠিক হলো।

‘তোমার এখানকার সাথীরা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘ওরা এখন সবাই জিমে। আরও আধাঘণ্টা জিমে থাকবে।’ বলল লোকটি।

‘জিম কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘এখান থেকে সোজা দক্ষিণে গেলে শেষ প্রান্তের একটা হল ব্যায়াম ও ট্রেনিং-এর জন্যে ব্যবহৃত হয়।’ বলল লোকটি।

আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটির মাথায় আরও জোরে চেপে ধরে বলল, ‘এদের ভয়ংকর অস্ত্রটার নাম কি?’

‘ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ।’ বলল লোকটি।

‘ঐ অস্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি, আমি জানি। এখন তারা কোন্ অস্ত্রের উপর নির্ভর করে?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি সব জানি না স্যার। তবে শুনেছি, আমাদের ‘ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (এমএফডব্লিউ)’ রয়েছে।’ বলল লোকটি।

‘দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কি? দুটোই তো দেখছি ম্যাগনেটিক!’ আহমদ মুসা বলল।

‘প্রথমটি নিজের জায়গা থেকেই ফাংশন করে, কিন্তু দ্বিতীয়টিও নিজ জায়গা থেকে ফাংশন করে। তবে এ অস্ত্রটি টার্গেটকে ম্যাগনেটিক ব্ল্যাক ফায়ারে ধ্বংস করে দেয়। প্রথমটি সব কিছু নিস্ক্রিয় ও অচল করে দেয়, আর দ্বিতীয়টি যেখানেই ইলেকট্রনিক ও আণবিক মারণাস্ত্র রয়েছে, বিশেষ এক ম্যাগনেটিক আকর্ষণে ম্যাগনেটিক ব্ল্যাক ফায়ার সেখানেই ছুটে গিয়ে ভয়ংকর ও অদৃশ্য ম্যাগনেটিক আগুনে সব কিছুকেই ছাই করে দেয়। সৃষ্টি করে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা।’ বলল লোকটি।

‘এর ঘাঁটিটা কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমি জানি না। আমি মাত্র একজন পরীক্ষণ বিজ্ঞানী। তবে আমি ওদের কথা-বার্তায় ‘আরসিপি’ ধরনের একটা স্থানের সাংকেতিক নাম শুনেছি, যেখানে তাদের এই অস্ত্রের বড় ঘাঁটি।’ বলল লোকটি।

আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। শব্দ বেরুবার আগেই শুনতে পেল সামনে খুব কাছে হালকা শব্দ। শব্দটা লম্বা ও কাটা কাটা। তার মানে একাধিক লোক দৌড়ে সামনে এসে গেছে। তাই যদি হয়, তাহলে ওদের হাতে থাকবে তাক করা অস্ত্র।

এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লোকটির মাথঅয় চেপে রাখা রিভলবার তুলে চোখের পলকে সেই শব্দ লক্ষে পরপর তিনবার গুলি করল।

রিভলবারটি ছিল মাল্টি বুলেট রিভলবার। রিভলবারের ব্যারেল থেকে গুলি বেরুনোর পর তাতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং বুটের দানা আকৃতির ২৫ টি সররা গুলি আরও তীব্র গতিতে বেরিয়ে যায়। গুলিগুলো ছোট হলেও ভয়ংকর। কোন দেহে বা কোথাও প্রবেশের সংগে সংগে আবার তাতেও বিস্ফোরণ ঘটে। সাধারণ বুলেটের চেয়েও এটা পাওয়ারফুল, ক্ষতি অনেক বেশি করে।

গুলি করেই আহমদ মুসা তাকাল সামনের দিকে। দেখল, তিনটি দেহ টলছে। তাদের হাত থেকে খসে পড়েছে রিভলবার। ওদের পরনে ড্রিলের পোশাক।

আহমদ মুসা দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে তাকাল সেই লোকটির দিকে। বলল, ‘তুমি ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে থাক।’ বলে আহমদ মুসা তার রিভলবারের বাট দিয়ে তার কানের নিচটায় জোরে আঘাত করল।

সত্যি লোকটি বার কয়েক কেঁপে উঠে সংজ্ঞা হারাল।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তাকাল চারদিকে। তাকে যেতে হবে দক্ষিণের প্রান্তিক দেয়ালের মাঝামাীঝ জায়গায়।

দক্ষিণের দেয়ালটা তার সামনের দিকে। আর মাঝামাঝি জায়গাটা হবে তার বাংলোর ঠিক দক্ষিণ দিকে। তার মানে সামনে বাঁ দিকে তাকে এগোতে হবে।

আহমদ মুসা নিহত তিনজনের রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে ছুটল সামনের দিকে। ঠিক এই সময়েই সামরেন দেয়ালগুলোতে লাল বাতি ফ্লাস হতে দেখল। আহমদ মুসা বুঝল, ঘাঁটিতে ইমারজেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। এর অর্থ তার নিখোঁজ বা পালানোর বিষয় ওরা সবাই জানতে পেরেছে।

এখনি সবাই ছুটে আসবে। এই ফ্লোরে আরও তিনজন রয়েছে, ওপরে রয়েছে এক ঝাঁক মানুষ।

সামনের দিকে ছুটল আহমদ মুসা।

এ সিগন্যাল কখন থেকে জ্বলছে সে জানে না। সিগন্যাল পেয়েই কি এ তিনজন এসেছিল? তাহলে তো এতক্ষণে আরও লোক নিচে এসেছে।

আহমদ মুসা সোজা এসে সারিবদ্ধ কক্ষের সামনে দাঁড়াল। তার সামনে দিয়ে লম্বা করিডোর। দু’দিকেই যত দূর চোখ যায় করিডোর চলে গেছে।

আহমদ মুসা বুঝল, দক্ষিণের সীমান্ত ঘেঁষেই এই কক্ষগুলো। এই কক্ষগুলোর কোনটির মধ্যে দিয়েই কি গোপন দরজার স্থানে পৌছতে হবে?

ঠিক এই সময় সামনে ও পেছন থেকে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পেল আহমদ মুসা। সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল রিভলবার উঁচিয়ে একদল ছুটে আসছে তার দিকে। পেছনেও তাই হবে। ভাবল আহমদ মুসা।

নিজেকে মাটির দিকে ছুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। দ্রুত গড়িয়ে চলল পাশের দরজার দিকে। ঘরটাতে ঢোকা গেলে হয়তো আত্মরক্ষার চেষ্টা করা যাবে, লড়াইয়ে ফিরে আসা যাবে।

গড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে হাত দিয়ে জোরে ধাক্কা দিল দরজায়।

স্টিলের দরজা। একটু ফাঁক হলো।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

গোটা দেহ ছুড়ল দরজার উপর। আরও অনেকখানি ফাঁক হলো। দেহটাও দরজার কিছু আড়াল পেয়েছে।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

দরজা বন্ধ করল।

অবাক হলো আহমদ মুসা, দরজা এত পুরু, এত ভারি দরজা! কেন? আরও অবাক হলো, দরজা বন্ধ করার জন্যে উপর ও নিচের হুড়কো দু’টো বলা যায় দুর্গের দরজার মতো মজবুত। এমন মজবুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন? অথচ ঘরে কয়েকটা সোফা, ছোট একটা ফ্রিজার ও সেন্টার টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই।

তাহলে এ কক্ষটা এত প্রটেকটেড কেন?

এ কক্ষের ভেতর দিয়েই সেই গোপন পথটা নয় তো?

দরজার দু’টি হুড়কোই লাগিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা। ছুটল কক্ষের পেছনের দেয়ালের দিকে। তার বিশ্বাস এটাই হবে সীমান্ত-ওয়াল, যেখানে থাকার কথা উপরে উঠার গোপন পথ।

দেয়ালের সামনে পৌছে একবার মেঝের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেয়ালে চোখ রাখল।

দরজার বাইরে অনেক পায়ের শব্দ। চেঁচামেচি।

একজন চিৎকার করে উঠেছে, বন্দীটি এই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

দরজা ধাক্কাতে লাগল কেউ কেউ। তাদের একজন বলল, ‘হাজার ধাক্কালেও এ দরজা ভাঙা যাবে না। এটা জরুরিকালীন শেল্টার আমাদের স্যারের।’

আরেকজন বলল, ‘তাহলে আমরা কি করবো?’

বাইরে যখন উত্তেজিত এই রকম কথাবার্তা চলছে, তখন আহমদ মুসা গোপন পথের খোঁজে দেয়ালটিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে চোখ বুলাচ্ছে।

গোটা দক্ষিণের দেয়াল তার দেখা হয়ে গেল, কিছুই মিলল না, দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছু তার চোখৈ পড়ল না। অন্য দেয়াল কি সে দেখবে? মন সায় দিল না।

এ সময় বাইরের একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হাই হাইনেস কোহেন ক্যানিংহাম নির্দেশ দিয়েছেন কক্ষের ভেতরে গ্যাস স্প্রে করে তাকে সংজ্ঞাহীন করে রাখতে। তিনি আসছেন।’

সংগে সংগেই আরেকজন বলে উঠল, ‘মি. জেমস, তাহলে এখনি সাইলো থেকে একটা গ্যাস স্প্রে আনুন যা এখানকার জন্যে দরকার।’

কথা শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার কাছে গ্যাস মাস্ক নেই। ওরা গ্যাস ছাড়লে নির্ঘাত ধরা পড়তে হবে।

দ্রুত দক্ষিণের দেয়ালেই আবার আহমদ মুসা ফিরে গেল। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে আবার খোঁজা শুরু করল আহমদ মুসা।

এবার দেয়ালের পূর্ব প্রান্ত থেকে খোঁজা শুরু করল।

অল্প এগোতেই বিদ্যুৎ ছকেটের মতো বর্গাকৃতির সেই প্লেটটা আহমদ মুসার নজরে পড়ল, যা আগেও একবার সে দেখে গেছে। প্লেটটা পাথরের সাদা দেয়ালের সাথে মিলানো সাদা রঙের। প্লেটের গায়ে দু’পিন, ত্রিপিনের ফুটো। কিন্তু প্লেটটা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পুরু। তার চেয়ে বিস্ময়ের হলো, প্লেটটিকে দেয়ালের সাথে আটকানোর মতো কোন স্ক্রু নেই। বিদ্যুতের ছকেট-প্লেট তো এমন হয় না! প্লেটটির এক কোণায় আঙুল দিয়ে জোরে চাপ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগে খসে পড়ল প্লেটটি।

বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্লেটের স্থানটিতে কোন বৈদ্যুতিক পয়েন্ট নেই, বৈদ্যুতিক তার নেই, প্লেন দেয়াল। তাহলে প্লেন দেয়ালের উপর বিনা কারণে প্লেটটা লাগানো থাকবে কেন?

আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল প্লেটটির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা দেয়ালখন্ডের উপর।

আহমদ মুসার চোখ পড়ল দেয়ালের সাদা রঙের সাথে মিলানো একটা তীর চিহ্ন, উপরের দিকে মাথা।

খুশি হলো আহমদ মুসা। ঠিক জায়গাতেই এসেছে আহমদ মুসা। এখানেই গোপন পথটা।

তীরের মাথায় চাপ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই দেয়ালের একটা অংশ উপরে উঠে গেল। তার সাথে একটা সিঁড়িপথ দেখা গেল।

আর সে সময়েই দরজার নিচে সেট করা পাইপ দিয়ে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কুণ্ডলি ভেতরে তীব্রগতিতে প্রবেশ করল।

অপরিচিত একটা গন্ধ পেয়েই চমকে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পেছনে একবার ফিরে তাকিয়েই শ্বাস বন্ধ রেখে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার সাথে সাথে নিচ থেকে ধেয়ে আসছে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কুণ্ডলি। গ্যাস তাকে ঘিরে ফেলেছে। প্রায় খাড়াভাবে উঠে যাওয়া সিঁড়ি। দ্রুত উঠা যাচ্ছে না। সিঁড়িটা এক্সেলেটরের মতো মুভিং কিনা তা দেখার তার সুযোগ হয়নি।

কষ্ট করে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। তার হিসাবে ভুল না থাকলে সিঁড়ি প্রায় ৪০ ফিট উপরে উঠার কথা।

বুক আকুলি-বিকুলি করছে অক্সিজেনের জন্য। অক্সিজেনের অভাবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ছে, শিথিল হয়ে পড়ছে হাত-পা। কিন্তু তাকে দুর্বল হলে চলবে না।

এক সময় সিঁড়ি শেষ হয়ে গেল। আহমদ মুসা দেখল, সে একটি কক্ষে।

কক্ষটি ইতিমধ্যেই গ্যাসে পূর্ণ হয়ে গেছে, দেখল আহমদ মুসা।

কক্ষের একটা দরজা। দরজায় ডিজিটাল লক।

সময় নেই আহমদ মুসার হাতে।

ডিজিটাল লকের উপর রিভলবার তাক করে ট্রিগার চাপল কয়েকবার।

বিস্ফোরণে ডিজিটাল লক উড়ে গেল। খুলে গেল দরজা।

টলছে আহমদ মুসার দেহ। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। গ্যাসও বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে তার সাথে সাথে

আর পারল না আহমদ মুসা। বুক ফেটে যাচ্ছে তার।

জ্যাকেটটা নাকে চেপে ধরে নাক দিয়ে একটা শ্বাস নিল আহমদ মুসা। কিন্তু শ্বাস নিয়েই বুঝল, একটা গন্ধ তার নাক দিয়ে ঢুকল। তবে বুকটা কিছু হালকা হলো। পরিণতিটা বুঝতে আহমদ মুসার দেরি হয়নি। কিন্তু এখানে তার সংজ্ঞা হারালে চলবে না। ছুটল আহমদ মুসা সব শক্তি একত্র করে। চোখে তার অন্ধকার নেমেছে। টলছে তার দেহ। তবু টলতে টলতেই অন্ধেল মতোই দৌড়াচ্ছে সে।

এক সময় শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। ঢলে পড়ল তার দেহ। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।

‘আমার দৈনন্দিন সময়-সূচী নিয়ে তুমি তো এভাবে কোনদিন ভাবনি?’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘ভাবছি কারণ, তুমি আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ ও গম্ভীর হয়ে গেছ। সময়ে-অসময়ে কোথাও চলে যাও। রাজনীতি কর না। ব্যবসায় তোমার প্রাণ। কিন্তু ব্যবসায় তোমার দেখছি দ্বিতীয় অগ্রাধিকারে নেমে গেছে। মেয়েকেও মনে হচ্ছে তোমার সাথে নিয়েছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি উদ্বিগ্ন।’ বলল নোয়ান নাওমি, শিমন স্যামসন আলেকজান্ডারের স্ত্রী।

শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার একজন নীরব ব্যবসায়ী। রাজনীতি থেকে সে অনেক দূরে। ইহুদি হলেও ইহুদিদের রাজনৈতিক-সামাজিক ক্রিয়া-কর্মে সে নেই। মাত্র ৪০ বছর বয়সে সব মহল, সব দলের সম্মান ও বিশ্বাস সে অর্জন করেছে। সে যে ‘ফোম’ (Foam) –এর প্রধান এটা বাইরের কেউ কেন, ঘরেরও কেউ জানে না।

‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই নাওমি। ব্যবসায়ে আমার নীরব কাজ যেমন আমাকে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য দিয়েছে, তেমনি আমি আরও যা করছি, তাও জগৎ জোড়া এক সাফল্য আমাকে দেবে। ব্যবসায়ে যেমন আমি নাম্বার ওয়ান, তেমনি আমি শক্তিতেও নাম্বার ওয়ান হতে চাই। মেয়েকে কিন্তু এভাবে আমি সাথে নিতে চাইনি। মেয়েটি আমাদের খুব ইনটেলিজেন্ট, কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা ভিন্ন রকমের। তাই আমি তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছি।’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘আমি বুঝলাম না। তুমি রাজনীতি কর না। তাহলে শক্তিতে এক নাম্বার হওয়ার কথা আসছে কি করে?’ নোয়ান নাওমি বলল।

গম্ভীর হলো শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার। বলল, ‘রাজনীতির পথ ছাড়াও শক্তি অর্জনের আরও পথ আছে নাওমি। সবই জানবে, এখন নাইবা জানলে।’

‘কি সে পথ পেছন দরজার, অন্ধকারের পথ আলেকজান্ডার!’ বলল নাওমি।

‘লক্ষ মহৎ হলে তা অর্জনের পথ নিয়ে নৈতিক কোন প্রশ্ন উঠে না।’ শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার বলল।

‘তোমার সামনের সে মহৎ লক্ষটা কি?’ জিজ্ঞাসা নাওমির।

‘সেটা বিশ্ববাসীর জন্যে একটা সারপ্রাইজ। এর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে নাওমি। আমিও অপেক্ষা করছি।’ বলল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু আলেকজান্ডার, যে মহৎ লক্ষ নৈতিক পথ অনুসরণ করতে পারে না, তার মহৎ হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে। আমি তাই মনে করি। তুমি আমার মেয়েকে এর মধ্যে টেন না।’ নাওমি বলল।

হাসল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার। বলল, ‘মা হাওয়া বাবা আদমকে ভুল বোঝাতে পেরেছিল। কিন্তু আদমের উত্তরসূরিরা এখন কিন্তু সাবধান।’ বলে উঠে দাঁড়াল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

ঘর হতে বের হয়েই দেখল শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার, তাদের মেয়ে আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার এদিকে আসছে।

‘তোমাকে খুঁজছি মা আমি। চল বসি।’ বলল মেয়েকে লক্ষ করে শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার।

‘চল বাবা।’ বলে পিতার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

শিমন স্যামসন আলেকজান্ডার বসলে আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডারও তার পিতার সামনের সোফায় বসল।

‘কি চিন্তা করলে অ্যানজি? তোমার মতো তরুণ প্রতিভাবান পারটিকেল বিজ্ঞানী এইচ কিউবের খুব বেশি প্রয়োজন।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার, অ্যানজেলার পিতা।

‘বাবা তোমার এইচ কিউব-এর সব বিষয় আমার জানা হয়নি। এইচ কিউব এমন এ্যাডভান্সড অস্ত্র গবেষণা কেন করছে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘কাজ শুরু কর, সবই জানতে পারবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কোন প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি না জেনে সে প্রতিষ্ঠানে আমি যোগ দিতে পারি না বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘প্রাইভেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান তো অনেক আছে। রপ্তানী খাতের অধিকাংশ অস্ত্র তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই সরবরাহ করে থাকে। সুতরাং এইচ কিউব সে ধরনেরই একটা প্রতিষ্ঠান মা।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘এই প্রতিষ্ঠানের নাম এর আগে শুনিনি। এইচ কিউব প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার্ড কিনা? সরকারের সাথে এর সম্পর্ক কি ধরনের বাবা?’ অ্যানজেলা বলল।

‘এইচ কিউব অত্যন্ত সেনসেটিভ একটা বিষয়ে গবেষণা করছে। সরকার জানতে পারলে তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সরকারের ভেতর অনেক লবি আছে, তাদের চোখে পড়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। তাই গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ হচ্ছে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু সরকারের অজ্ঞাতে এ ধরনের গবেষণা তো বেআইনি। অপরাধমূলক কাজ বাবা।’ অ্যানজেলা বলল।

‘বলেছি, সরকারের মধ্যে বিভিন্ন লবি আছে, বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ আছে। সরকারকে জানানো মানে তারা সবাই জানতে পারা। তাতে করে এই গবেষণা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু বাবা, গবেষণার ফল তো সরকারকেই দিতে হবে, রপ্তানী করতে হলেও তা সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। সুতরাং গবেষণা আড়াল করে লাভ নেই। আর এ ধরনের গবেষণা কেউ করতে চাইলে তার নিরাপত্তা বিধান ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমরা নিচ্ছ কেন? তোমরা তো সরকারেরও রোষানলে পড়ে যেতে পার।’ অ্যানজেলা বলল।

‘সরকারও সব জানবে, জনগণও সব জানবে। তুমি এসব নিয়ে ভেব না। তোমার কথাটা বল।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘তোমাদের এইচ কিউব এর অফিস, গবেষণা ল্যাবরেটরি কোথায় বাবা, যেখানে কাজ করতে হবে?’ অ্যানজেলা বলল।

শিমন আলেকজান্ডার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘এইচ কিউব সম্পর্কে আর কিছু জানতে হলে সার্ভিসে যোগ দিতে হবে এবং একটা শপথ তোমাকে নিতে হবে। তারপরই গোপনীয়তার সব দরজা তোমার কাছে খূলে যাবে।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আলাইয়া অ্যানজেলার। বিস্মিত হয়েছে সে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে অস্ত্র গবেষণার মতো প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তা থাকেই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা জানা যাবে না প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে শপথ না নিলে, এমন গোপনীয়তার ব্যাপারটা অকল্পনীয়। সরকারের রেজিস্ট্রেশন না থাকা, সব বিষয় সরকারের নজরের বাইরে থাকা, অস্বাভাবিক গোপনীয়তা সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি কোন সন্দেহজনক কাজে রত। কি সে কাজ? কোন্ উদ্দেশ্যে তার কাজ? কার স্বার্থে?

অনেকটা ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আলাইয়া অ্যানজেলা।

‘কি ভাবছ মা? কবে যোগ দিচ্ছ এইচ কিউব-এর সাথে?’ শিমন আলেকজান্ডারই আবার কথা বলল।

‘ভাবতে আরেকটু সময় দাও বাবা।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘ভাব। আরও আলোচনা করি এস, আজ আমার সময় আছে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

‘বাবা, আমার একটা কাজ আছে বাইরে।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।

‘ঠিক আছে মা, তুমি ভেবে নাও। রাতে কিংবা কালকে তুমি….।’

কথা শেষ না করেই থেমে গেল শিমন আলেকজান্ডার।

তার মোবাইল বেজে উঠেছে।

মোবাইল হাতে নিল সে।

মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই শশব্যস্ত হয়ে সে মোবাইল ধরল।

‘গুড মর্নিং স্যামুয়েল, কি খবর? তোমার গলা কাঁপছে কেন?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।

শিমন আলেকজান্ডার উৎকর্ণ, নীরব। শুনছে ওপারের কথা। আস্তে আস্তে চেহারা পাল্টে যাচ্ছে তার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার চোখ-মুখ।

এক সময় তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেন চিৎকারে রূপ নিল। বলল, ‘এই অসম্ভব ঘটনা কি করে ঘটল? তার পালানো অসম্ভব? সর্বনাশ হয়েছে আমাদের। কোহেনকে জানানো হয়েছে?’

ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম ‘আর্মি অব ম্যান’স ফিউচার’-এর সামরিক অপারেশনাল বা সামরিক উইং ‘এইচ কিউব’-এর প্রধান। আর শিমন আলেকজান্ডার উর্ধ্বতন প্রতিষ্ঠান ফোম-এর প্রধান।

‘জানানো হয়েছে স্যার। উনি আসছেন। কিভাবে ঘটনা ঘটল আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘটনা জানার সাথে সাথে আমরা তাকে আটকাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবজান্তার মতো বিস্ময়করভাবে গোপন পথে সে পালিয়ে গেছে।’ বলল ওদিক থেকে স্যামুয়েল লোকটা।

‘ঠিক আছে। কোহেন এলে যেন আমাকে টেলিফোন করে। আমি আসব। আর এদিকে আমি দেখছি কি করা যায়। ও.কে স্যামুয়েল। বাই।’

মোবাইল অফ করে দিয়ে তা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় গা এলিয়ে দিল শিমন আলেকজান্ডার।

আলাইয়া অ্যানজেলা অবাক হয়ে গিয়েছিল একটা টেলিফোন কল থেকে তার পিতার পরিবর্তনে। তার বাবাকে সে কোনদিন এমন মুষড়ে পড়তে দেখেনি, এমন উদ্বেগ-আতংকিত হতে দেখেনি। অ্যানজেলার বিস্ময়ও উদ্বেগে রূপ নিল। বলল, ‘কি হয়েছে বাবা? কি ঘটেছে?’

শিমন আলেকজান্ডার চমকে উঠে মাথা থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। অ্যানজেলা তার সামনে হাজির আছে, এ কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। তার টেলিফোনের কথা অ্যানজেলা শুনেছে দেখে তার চোখে অস্বস্তিও ফুটে উঠেছে।

মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘একটা সমস্যা হয়েছে মা।’

‘কার পালানোর কথা বললে বাবা। এমন কে পালিয়েছে যে তুমি এতটা আপসেট?’ অ্যানজেলা বলল।

‘এসব ব্যবসায়িক জটিলতার কথা মা। থাক এসব। তোমার কি যেন কাজ আছে বললে? সেরে এস। পরে কথা হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।

আলাইয়া অ্যানজেলা বুঝল, বাবা তাকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। বাবা সম্ভবত একা থাকতে চান। সংকট নিশ্চয় বড় ধরনের কিছু। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কোন স্টাফ পালালে তো এমন ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়! ‘তার পালানো অসম্ভব!’ বলে বাবা যে কথা বলেছেন, সেটা রহস্যপূর্ণ। এটা কোন বন্দীর ক্ষেত্রে খাটে, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর ক্ষেত্রে খাটে না। কিন্তু বাবা কথা আড়াল করবেন কেন? হতে পারে মেয়েকে তা বলার মতো নয়।

মাথা ভরা ভাবনা নিয়েই বাবার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এল আলাইয়া অ্যানজেলা। ঘর থেকে বেরুবার সময় অ্যানজেলা পেছনে তাকিয়ে দেখল তার বাবা সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজেছে।

মনটা খারাপও হয়ে গেল অ্যানজেলার। বাবার এমন ভেঙে পড়া অবস্থা সে কখনও দেখেনি।

গাড়ি নিয়ে বেরুল অ্যানজেলা।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার পারটিকেল ফিজিক্সের সে তরুণ গবেষক। অত্যন্ত কৃতি ছাত্রী সে। পড়ার সময়ই তার অনেকগুলো গবেষণাপত্র বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে। পাস করেই সে বিশ্ববিদ্যালয়েল ডার্ক ম্যাটারের গবেষণা টিমে যোগ দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়েই যাচ্ছে সে।

সিলভার স্প্রিং- এ তাদের বাড়ি হলেও অধিকাংশ সময় ওয়াশিংটন ডিসি’র উত্তর সীমান্তে রক ক্রিক পার্ক এলাকার এই বাড়িতে তারা থাকে। পাহাড়-বনাঞ্চলের প্রান্ত ঘেসে প্রকৃতির এক সবুজ সমুদ্রে একগুচ্ছ মনোরম বাংলো নিয়ে প্রাচীর ঘেরা তাদের বাড়ি।

রক ক্রিক পার্কের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রক ক্রিক পার্ক-পটোম্যাক ফ্রি ওয়ে ধরে ছুটে চলেছে তার গাড়ি।

রক ক্রিক পার্কের মাঝামাঝি যেখানে অরণ্যটা প্রশস্ত ও ঘন হয়ে উঠেছে, সেখানে গিয়ে ৩নং এক্সিট নিল আলাইয়া অ্যানজেলা আলেকজান্ডার। এক্সিট রোডটি প্রায় ১০ কিলোমিটার এগিয়ে আবার রক ক্রিক পার্ক-পটোম্যাক ফ্রি ওয়েতে গিয়ে মিশেছে।

এই এক্সিট রোডটি অ্যানজেলা আলেকজান্ডারের খুব পছন্দ। এ রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে তার মনে হয়, সবুজের এক আদিগন্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে সাদা ফেনিল স্রোতে যেন সে ভেসে চলেছে। এই ফ্রি ওয়ে দিয়ে এলে সে এই এক্সিট নেয় এ জন্যেই।

নদীর সমভূমির স্রোতের মতোই ধীরগতিতে গড়িয়ে চলছিল তার গাড়ি।

হঠাৎ তার নজরে পড়ল রাস্তার ধারে একজন মানুষ পড়ে আছে। তার মাথার অংশটা দেখা যাচ্ছে, বুক থেকে পেছনের অংশটা জংগলের ভেতরে।

জীবিত, না মৃত? দু’টোই হতে পারে, দেখা উচিত একবার তাকে।

গাড়িটা রাস্তার পাশে নিয়ে থামাল সে। লোকটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার দু’টি হাত সামনে প্রসারিত, যেন সে পালাবার বা বাঁচার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টার মধ্যেই ঐভাবে পড়ে গেছে। সে কি মৃত? না আহত?

গাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল সে পড়ে থাকা লোকটির কাছে। হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে।

তাড়াতাড়ি হাতের পালস দেখল। না বেঁচে আছে লোকটি। শরীরের ব্যাক অংশ যতখানি দেখা যাচ্ছে, তাতে কোন আঘাত দেখতে পেল না।

সংজ্ঞা লোপকারী গ্যাসে আক্রান্ত আহমদ মুসা ওদের ঘাঁটি এলাকা থেকে যতটা সম্ভব দূরে পালাতে চেয়েছিল। তার ভাগ্য ভালো, এই চেষ্টায় সে সফল হয়। যেখানে এসে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যায়, সেটা রাস্তার ধারের এই জায়গা।

আহমদ মুসার দেহটা উল্টে চিৎ করে শোয়ালো অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

সুন্দর এশীয় চেহারা। শরীরের রং সাদাটে সোনালি। পেশিবহুল একহারা শরীর। মনে হলো অ্যানজেলার, শরীরের সাইজের তুলনায় ওজনটা যেন একটু বেশি। মেদহীন পেটা শরীর বলেই হয়তো, ভাবল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

শরীরের সামনের অংশেও কোন আঘাতের চিহ্ন পেল না সে। তাহলে জ্ঞান হারালো কিভাবে সে? তার পরনের কাপড়-চোপড় কোন ফরমাল পোশাক নয়। কোন হোটেল, হসপিটাল বা প্রতিষ্ঠানের সেবক বা স্টাফদের ইউনিফরম বলেও মনে হলো না। অ্যানজেলা বিস্মিত হলো, এই লোক এই জংগলে এল কি করে? একে অবিলম্বে কোন ডাক্তার বা ক্লিনিকে নেয়া দরকার। জ্ঞান ফিরলে সব জানা যাবে।

অ্যানজেলা আহমদ মুসাকে কোনওভাবে টেনে গাড়ির কাছে নিল। তারপর ঐভাবে টেনেই গাড়িতে তুলল। তাকে উল্টাতে গিয়েই বুঝেছিল তাকে দুই হাতে তুলে নিয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আহমদ মুসাকে গাড়িতে তুলে নিয়েই অ্যানজেলা সিদ্ধান্ত নিল সংজ্ঞাহীন লোকটিকে শ্যালন হার্স-এর কাছে নেবে সে।

শ্যালন হার্স তার প্রেমিক। ডাক্তার। পাস করার পর সে জর্জ ওয়াশিংটন হাসপাতালে যোগ দিয়েছে। তার বাড়ি কাছেই, পটোম্যাক নদীর তীরে, যেখানে রক ক্রিক শেষ হয়েছে। সেটার পাশে দিয়ে একটা হাইওয়ে চলে গেছে রাজধানীর কেন্দ্রে। সেই হাইওয়ে ধরে অল্প এগোলেই শ্যালন হার্সদের বাড়ি।

চিন্তা করেই অ্যানজেলা শ্যালন হার্সকে টেলিফোন করল। শ্যালন হার্স বলল, ‘আমি তো এখন তোমাদের বাসায় যাচ্ছি, আমি এখন রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের সামনে।’

বিস্মিত হয়ে অ্যানজেলা বলল, ‘সে রকম কি কথা ছিল?’

‘অবশ্যই। কথা ছিলো আজ তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব।’ বলল শ্যালন হার্স।

‘ও গড। ঠিক তো! ভুলে গেলাম কি করে?’ অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘এমন ভুল তো স্বাভাবিক নয় অ্যানজেলা, বিশেষ করে তোমার মতো অতিসতর্ক একজনের জন্যে!’ বলল শ্যালন হার্স।

‘ঠিক বলেছ ডার্লিং। হতে পারে এর পিছনে দু’টি কারণ আছে। এক. বাবার কিছু কথা আমার চিন্তায় একটা ওলট-পালট অবস্থার সৃষ্টি করেছে। দুই. ভবিতব্য আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে এবং আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’ অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলল।

‘তুমি কোথায়?’ বলল শ্যালন হার্স।

‘আমি রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের প্রায় মাঝখানে। তুমি এক্সিটের মুখ বরাবর স্থানে অপেক্ষা কর। আমি আসছি। খুব জরুরি বিষয় আছে। ও.কে ডার্লিং, বাই।’ অ্যানজেলা বলল।

‘ও.কে ডার্লিং। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।’ বলল শ্যালন হার্স।

অ্যানজেলার গাড়ি আগেই স্টার্ট নিয়েছিল। হাতের মোবাইলটা ড্যাশ বোর্ডে রেখে অ্যানজেলা পেছনের সিটে শুইয়ে রাখা আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তারপর সামনে ফিরে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল।

অল্প সময় চলার পর গাড়ির রিয়ার ভিউতে দেখতে পেল অ্যানজেলা, যেখান থেকে লোকটিকে তুলে এনেছে, সেখানে চার পাঁচজন লোক কি যেন দেখছে। তাদের কারও কারও মুখে গ্যাস মাস্ক, পিস্তলের মতো কিছু দেখতে পেল কারও কারও হাতে। বুঝতে পারল অ্যানজেলা এই লোকটিকেই ওরা খুঁজছে। লোকটি কি তাহলে কোথাও থেকে পালিয়েছে? কিন্তু কোথাও থেকে পালিয়ে সে এ জংগলে আসবে কেন? দু’পাশের বিশাল-বিস্তৃত জংগলের কোথাও তো কোন বাড়ি-ঘর নেই। বাড়ি-ঘর তৈরিও নিষিদ্ধ। বিশেষ অনুমতিতে পর্যটন বিভাগের কয়েকটি ট্যুরিস্ট এনক্লোজার আছে দু’পাশের জংগলের বিভিন্ন স্থানে। এগুলো ট্যুরিস্টদের বিশ্রাম ও রাত্রিবাসের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এ ট্যুরিস্ট এনক্লোজারগুলো আবার পর্যটন বিভাগ থেকে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শর্তাধীনে লীজ দেয়া রয়েছে।

কিন্তু এখানে ঐ গ্যাস-মাস্কধারীরা এল কোত্থেকে? তারা কেন খুঁজছে এ লোকটিকে? ওদের হাতেই কি এ লোকটি বন্দী ছিল?

কোন ক্রিমিনাল নেটের সদস্য হবে, এ লোকটিকে দেখে তা মনে হয় না।

অ্যানজেলা আবার তাকাল পেছনের আহমদ মুসার দিকে। না, পবিত্র চেহারা যাকে বলে, লোকটির চেহারা সে রকমই। ক্রিমিনালদের হিংসা এবং হিংস্রতা তাদের রক্তে এক ধরনের কালো পারটিকেল (পরমাণুর পরমাণু) সৃষ্টি করে যার প্রকাশ তাদের মুখে-চোখে ঘটে। এই প্রকাশ পবিত্রতার বিপরীত হয়ে থাকে। লোকটির চোখে-মুখে সেই কালিমার কোন দৃশ্য নেই।

দ্রুত এগিয়ে চলছে অ্যানজেলার গাড়ি।

প্রায় ২০ কিলোমিটার ঘুরে অ্যানজেলা হাইওয়ের ব্যাক-ট্রাকে ফিরে এল।

চলে তার গাড়ি রক ক্রিক পার্কের ৩নং এক্সিটের বরাবর রাস্তায়। অ্যানজেলা দেখতে পেল একটু সামনে রাস্তার পাশে একটা ইমারজেন্সি পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে আছে শ্যালন হার্সের গাড়ি।

অ্যানজেলা আগেই লেন চেঞ্জ করে শেষ লেনটায় নিয়ে এসেছিল গাড়ি।

অ্যানজেলা তার গাড়ি শ্যালন হার্সের গাড়ির পাশে দাঁড় করাল। সংগে সংগেই বেরিয়ে এল সে গাড়ি থেকে।

শ্যালন হার্স তার গাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে এসেছে। সে এগিয়ে এল অ্যানজেলার গাড়ির দিকে।

অ্যানজেলাও গাড়ি থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করছে শ্যালন হার্সের।

শ্যালন হার্স এগিয়ে এল তার কাছে।

দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।

‘হার্স, তুমি ডাক্তার। তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ির ভেতর দেখ একজন সংজ্ঞাহীন মানুষ।’ বলল অ্যানজেলা।

‘সংজ্ঞাহীন মানুষ!’ বলে শ্যালন হার্স এগোলো অ্যানজেলার গাড়ির দিকে।

তার সাথে অ্যানজেলা।

শ্যালন হার্স গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। আহমদ মুসার পায়ের আঙুল, হাতের আঙুল, পালস ও চোখ পরীক্ষা করল শ্যালন হার্স।

অ্যানজেলাও গাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল।

‘ভয় নেই অ্যানজি। গ্যাসের প্রভাবে সে জ্ঞান হারিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমনিতেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’

‘গ্যাসের প্রভাবে?’

বলেই অ্যানজেলার মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগে জংগলে দেখে আসা গ্যাস-মাস্ক পরা লোকদের কথা। তাহলে ওরাই এ লোককে গ্যাস প্রয়োগ করেছিল সংজ্ঞাহীন করার জন্যে!

‘হ্যা, গ্যাসের প্রভাবে অ্যানজেলা। এখন কি করবে লোকটিকে? হাসপাতালে নেবে?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘হাসপাতালে নেবার কেস এটা নয় হার্স তুমিই তা বললে। বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। জ্ঞান ফিরলে লোকটার কাছ থেকে আমার কিছু জানারও কৌতুহল আছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘কৌতুহলটা কি?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘আমি সব জানি না। তবে মনে হচ্ছে, লম্বা কোন কাহিনী এর পেছনে আছে। লোকটিকে ছেড়ে দিলে তা জানা যাবে না। দেশের নাগরিক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু জানা দরকার। এখন আপাতত এতটুকুই।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

শ্যালন একটু হাসল এবং মনে মনে বলল, তুমি ‘ফ্রি আমেরিকা’ সংগঠনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, তুমি তে বলবেই এমন কথা।

‘ফ্রি আমেরিকা’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডার ফাদারস জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিংকন প্রমুখের আদর্শের পতাকাবাহী দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের একটা সংগঠন। এরা রাজনীতি করে না, কিন্তু রাজনীতি ও সমাজকে তারা ফাউন্ডার ফাদারসদের উপর রাখার জন্যে নিরলস কর্মী হিসাবে কাজ করতে চায়।

‘তুমি হাসলে কেন শ্যালন?’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘হাসা নয়, তোমার প্রশংসা করলাম। ‘ফ্রি আমেরিকা সংগঠন’ কাজ স্থগিত করেছে, কিন্তু তুমি কাজ স্থগিত করনি।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ফ্রি আমেরিকা সংগঠন হিসাবে তার কাজ স্থগিত করেছে, কিন্তু ফ্রি আমেরিকার লাখো দেশপ্রেমিক সদস্য তাদের কাজ বন্ধ করেনি। দেশের জন্যে এ কাজ বন্ধ হবার নয়, নাগরিকদের জন্যে এটা তো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।’ বলল অ্যানজেলা।

‘ধন্যবাদ অ্যানজেলা। ঠিক বলেছ, আমিও তাই মনে করি। চলো এবার। গাড়িতে উঠো, আমি তোমাকে ফলো করবো।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ হার্স, চলো।’ বলে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল গাড়ি অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

বাড়িতে পৌছল অ্যানজেলা।

অ্যাটেনডেন্টকে বলল স্ট্রেচার নিয়ে এসে লোকটিকে বাড়ির নার্সিং সেন্টারে নিয়ে যেতে।

বাড়ির নার্সিং কর্নারে সার্বক্ষণিক নার্স আছে। সাদা দুগ্ধ ফেনায়িত শয্যা, বকের পালকের মতো সুন্দর কার্পেট মেঝেয়। কক্ষগুলোর সবকিছুই অপরূপ সাদায় মোড়া।

আহমদ মুসাকে নিয়ে রাখল একটা বেডে।

‘শ্যালন, তুমি দেখ কি করতে পার, নার্স আছে কিছু দরকার হলে ওদের বলো। আমি একটু আসছি ভেতর থেকে।’ বলে অ্যানজেলা ভেতর বাড়িতে চলে গেল। নার্সিং স্টোর ভেতর বাড়িরই একটা অংশে। বাড়ির অসুস্থদের প্রাথমিক সেবা এখানেই হয়। অ্যানজেলা বেরিয়ে ভেতর বাড়িতে তার বাবাকে পেল। তার বাবা বলল, ‘তুমি ওদিক থেকে কেন? তুমি না বাইরে গিয়েছিলে?’

‘বাবা, রক ক্রিকের জংগলের ধারে একজন সংজ্ঞাহীন লোককে পেয়েছি, তাকে আমাদের নার্সিং কর্নারে নিয়ে এসেছি। শ্যালনও এসেছে। সে দেখছে লোকটাকে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘রক ক্রিক পার্কের জংগলে? লোকটি কেমন, আমেরিকান?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল। তার কথার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ঔৎসুক্য। ঔৎসুক্যটা অনাকাঙ্খিত কিছু খুঁজে পাবার আগ্রহের মতো।

অ্যানজেলারও তা দৃষ্টি এড়াল না। সে পিতার দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘হ্যা, বাবা, তাকে পেয়েছি রক ক্রিক পার্কের জংগলের পাশে ৩নং এক্সিট রোডের ধারে। লোকটিকে আমেরিকান নয়, এশিয়ান বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।’

‘এশিয়ান!’ আনন্দের বিস্ফোরণের মতো বেরুল শব্দটা শিমন আলেকজান্ডারের মুখ থেকে।

এবার অ্যানজেলার চোখে-মুখে বিস্ময় নেমে এল। ভেবে পেল না, ‘রক ক্রিক পার্ক-এর জংগল ও লোকটি এশিয়ান’ এই ঘটনার সাথে তার বাবার কি সম্পর্ক!

তার কথা শেষ করেই অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘মা অ্যানজি, দেখি তোমার লোকটাকে। যেই হোক, আমাদের গেস্ট তো।’

কথা শেষ হবার আগেই হাঁটা দিয়েছে শিমন আলেকজান্ডার।

অ্যানজেলা কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। তার মনে হলো বাবা লোকটিকে চিনতে পারে কিনা দেখা দরকার।

অ্যানজেলাও বাবার পিছনে পা বাড়াল। বাসার স্টাফ প্রধান মিস বারবারা অ্যানজেলা সামনে এসে দাড়াল। বলল, ‘ম্যাডাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনার একটা টেলিফোন এসেছিল। একটা জরুরি মেসেজ দিয়েছে।’

‘হ্যা, হতে পারে মিস বারবারা। গাড়িতে আমি মোবাইল বন্ধ রেখেছিলাম। দিন মেসেজটা।’

‘প্লিজ, এক মিনিট। ফাইলে আছে, আমি নিয়ে আসছি।’

বলে মিস বারবারা ছুটল তার অফিসের দিকে।

মেসেজটি নিয়ে এসে দিল অ্যানজেলার হাতে। মেসেজটির উপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে তা পকেটে পুরল অ্যানজেলা। দ্রুত এগোলো নার্সিং কর্নারের সেই রুমটির দিকে।

রুমটির কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়াল অ্যানজেলা। শুনতে পেল তার বাবা ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। কথাগুলো যেন তার নিয়ে আসা অসুস্থ লোকটি সম্পর্কে। বলছিল তার বাবা, ‘…না, কোন সন্দেহ নেই। এ লোকটি আমাদের বন্দী সেই লোকটিই। তাকে পাওয়া গেছে রক ক্রিক পার্কের জংগলে।’

তার বাবার কথায় একটা ছেদ পড়ল। সম্ভবত ওপারের কথা শুনছেন তিনি।

এক পা, দু’পা করে এগোলো অ্যানজেলা আরও কাছে। দেখল, তার বাবা কক্ষটির বাইরে করিডোরের এদিকের প্রান্তে এসে কথা বলছে।

তার বাবা আবার বলে উঠল, ‘শোন কোহেন, তুমি স্বয়ং লোকজনকে নিয়ে চলে এস। তোমরা পুলিশের ইউনিফর্মে আসবে। আমি গেটে বলে যাচ্ছি। সিকিউরিটির লোকরা তোমাদের সহযোগিতা করবে।’

থামল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার। ওপারের কথা শুনল। বলল আবার, ‘আমি থাকছি না। আমার মেয়ে ওকে এনেছে। থাকলে একটু সমস্যায় পড়তে হবে।’

থামল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার।

ওপারের কথা শুনে বিরক্তির সাথে শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘যে বাধাই আসুক তাকে তোমাদের নিয়ে যেতে হবে। সব বাধা ও অন্য সব বিপদের চেয়ে সে যে গুরুত্বপূর্ণ তা তোমাকে বলে দিতে হবে? তুমিই না তার সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জান! ও.কে, তোমরা এস।’

কথা শেষ করেই অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডার দ্রুত বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াল। অ্যানজেলাও দ্রুত দেয়ালের আড়াল থেকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

তার বাবা চলে যেতেই আতংকিত অ্যানজেলা উদ্ধার করে আনা লোকটির কক্ষে চলে গেল। সেখানে ডাক্তার শ্যালন হার্স বসেছিল।

‘কতক্ষণ লাগবে ওর জ্ঞান ফিরতে শ্যালন?’ দ্রুতকণ্টে বলল অ্যানজেলা।

শ্যালন হার্স তাকাল অ্যানজেলার দিকে। বলল, ‘কিছু হয়েছে অ্যানজেলা? তোমাকে উদ্বিগ্ন লাগছে।’

‘বলছি। বল ওর জ্ঞান কতক্ষণে ফিরবে?’ বলল অ্যানজেলা।

‘আর বোধ হয় বেশি সময় লাগবে না। ওর জ্ঞান ফিরে আসছে ধীরে ধীরে।’ বলল শ্যালন হার্স।

‘শ্যালন এখনি ওকে বাইরে নিতে হবে। তুমি ওকে তৈরি কর। আমি আসছি।’

বলেই অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল।

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে শ্যালন হার্স তাকাল অ্যানজেলার দিকে। কিন্তু অ্যানজেলার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘অ্যানজেলা, ওকে আমি রেডি করছি।’

অ্যানজেলা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে দাড়াল নার্সিং কন্যারের ব্যালকনিতে। এখন থেকে তার বাবার গাড়ি বারান্দা দেখা যায়।

পাঁচ মিনিটও গেল না। অ্যানজেলা দেখল তার বাবা এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি তাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

অ্যানজেলা দ্রুত নার্সিং কক্ষে ফিরে এল। দেখল সংজ্ঞাহীন লোকটিকে হুইল চেয়ারে বসানো হয়েছে।

‘চল শ্যালন। এখনি বেরুতে হবে বাড়ি থেকে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘অ্যানজি, কোথায় তাকে নেবে?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ঠিক করিনি শ্যালন। তোমার হাসপাতাল নিরাপদ নয়।’

হুইল চেয়ার ঠেলে নিতে নিতে বলল শ্যালন হার্স, ‘কেন অ্যানজি, নিরাপদন নয় কেন আমাদের হাসপাতাল?’

‘কারণ বাবারা এই লোকের খোঁজে প্রথমেই তোমাদের হাসপাতালে যাবে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকাল শ্যালন হার্স তার পাশের অ্যানজেলা আলেকজান্ডারের দিকে।

‘বুঝেছি শ্যালন, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। বলব সব, এখন বলার সময় নয়।’ বলল অ্যানজেলা।

মিস বারবারা এদিকে আসছিল। সম্ভবত তার বাবাকে বিদায় দিয়ে এদিকে আসছে। তাকে দেখেই অ্যানজেলা বলল, ‘লোকটিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে শিফট করা দরকার। শ্যালনেরও এই মত। তাকে হাসপাতালে নিচ্ছি।’

মিস বারবারার চোখে-মুখে উদ্বেগের ভাব ফুটে উঠল। বলল, ‘কিন্তু স্যার তো বলে গেলেন…..।’

বলে থেমে গেল মিস বারবারা।

‘কি বলে গেছেন বাবা?’ জিজ্ঞাসা অ্যানজেলার।

‘পুলিশ আসছেন, এই লোককে তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছেন।’ বলল মিস বারবারা।

‘ঠিক আছে, পুলিশ এলে বলো লোকটির অবস্থা ভালো ছিল না, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে যেন তার খোঁজ করে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘কোন হাসপাতাল ম্যাডাম?’ মিস বারবারার জিজ্ঞাসা।

যত কাছের হাসপাতাল হয় ততই ভালো। যেখানেই এর পয়জন গ্যাসের এন্টিডোট পাওয়া যায় সেখানেই ভর্তি করা হবে।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

অ্যানজেলারা চলে গেল গাড়ি বারান্দায়।

একটু পিছিয়ে থেকে মিস বারবারা তাদের অনুসরণ করছিল। টেলিফোন করছিল অ্যানজেলার বাবা শিমন আলেকজান্ডারকে।

কলটা তার বারবার ফেরত আসছিল।

এক সময় তাকে পেয়ে গেল সে। জানাল তাকে সব ঘটনা।

তখন গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছিল অ্যানজেলাদের।

অ্যানজেলার গাড়ি বেরিয়ে এল গেট দিয়ে।

গেট থেকে রক ক্রিক পটোম্যাক রোডটা বেশ কয়েক গজ দূরে। সে পর্যন্ত রোডটা প্রাইভেট, অ্যানজেলাদের তৈরি। লাল পাথরের সুন্দর রাস্তা। এ রাস্ত গিয়ে মিশেছে রক ক্রিক পটোম্যাক ফ্রি ওয়ের সাথে। যেখানে গিয়ে মিশেছে, সেখানে বহুমুখী ফ্লাইওভার।

ফ্রি ওয়ের বামপাশের সড়ক ওয়াশিংটন থেকে আউটগোয়িং এবং ডানদিকের সড়ক ওয়াশিংটনে ইনকামিং। এখানে সব দিকে এক্সিট নেয়ার ব্যবস্থা আছে। এক্সিট নেয়া ও ব্যাক-ট্র্যাকে ফেরার সব গাড়িগুলোকে ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে হয়।

  অ্যানজেলাদের গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠতে যাচ্ছিল। ড্রাইভ করছিল অ্যানজেলা। দেখল, তিনটি গাড়ি ছুটে আসছে তাদের গেটের দিকে। সামনেরটা জীপ, পেছনের দু’টি মাইক্রো। ভেতরে পুলিশের ইউনিফরম পরা মানুষ। অ্যানজেলা নিশ্চিতই বুঝল, ওরাই তারা। সংজ্ঞাহীন লোকটিকে নিতে এসেছে। অ্যানজেলা তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।

গাড়ি তিনটি থমকে দাঁড়িয়েছিল।

সামনের জীপ থেকে একটা কুকুর ছেড়ে দেয়া হলো। কুকুরটা সামনের দিকে ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল এবং চারদিকে বাতাস শুঁকার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই ছুটল ফ্লাইওভারের দিকে, যে ফ্লাইওভার হয়ে অ্যানজেলাদের গাড়ি এগোচ্ছিল। সামনের জীপ গাড়ি থেকে একটি ভারি গলা চিৎকার করে উঠল, ‘ফ্লাইওভারে ঐ যে গাড়ি যাচ্ছে, ওটা আটকাও।’

পেছনে তাকিয়ে কথাটা শুনল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার ও শ্যালন হার্স।

‘পুলিশ এসেছে অ্যানজেলা। ওরা আমাদের গাড়ি থামাতে চাচ্ছে। থামানো উচিত।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘না শ্যালন, ওরা পুলিশ নয়। পুলিশের ছদ্মবেশে ক্রিমিনাল। এই লোককে ওরা হাইজ্যাক করতে এসেছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘বল কি? জানলে কি করে তুমি?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘সব বলব। এখন কিভাবে ওদের হাত থেকে বাঁচা যায় বল। আমরা ওয়াশিংটনের দিকে যেতে পারছি না। দেখ, ওদের একটা মাইক্রো রাস্তার আইল্যাণ্ড অতিক্রম করে আমাদের যাবার পথ বন্ধ করতে প্রস্তুত হয়েছে।’ বলল অ্যানজেলা।

‘আমি মনে করি, বামের এক্সিটটাই নাও। রক ক্রিক-এর শেষ পর্যন্ত নেমে আসা নদীর তীর ঘেষে এই রাস্তাটা ওয়াশিংটন-মেরিল্যান্ড ফ্রি ওয়েতে উঠেছে। ওটাই আমাদের টার্গেট হবে।’ শ্যালন হার্স বলল।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে অ্যানজেলা বলল, ‘ঠিক বলেছ শ্যালন।’

শেষ মুহুর্তে খুব ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে হয়েছে অ্যানজেলাকে।

গাড়ি প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে। শুইয়ে রাখা আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহটা গাড়ির সিট থেকে পড়ে গেল গাড়ির মেঝেতে। পাশে বসেছিল শ্যালন হার্স। সে তাড়াতাড়ি তাকে তুলল গাড়ির সিটে। আহমদ মুসা সংজ্ঞা ফিরে পেল এ সময়। আহমদ মুসা মূহূর্তের জন্যে চোখ খুলেছিল। কিন্তু তাড়াতাড়ি সে চোখ বন্ধ করল। সংজ্ঞাহীনের মতোই শুয়ে রইল। পড়ে যাওয়ার ধাক্কাতেই সম্ভবত সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে আহমদ মুসা। সে তার সংজ্ঞা ফিরে পাবার ব্যাপারটা গোপন করতে চায় এই কারণে যে, শত্রু না বন্ধু কার হাতে তা সে জেনে নিতে চায়।

বামের এক্সিটে প্রবেশ করেছে গাড়ি।

কিছুটা চলার পর অ্যানজেলা ভীত কণ্ঠে বলল, ‘শ্যালন, ওদের দুই গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।’

শোনার পর শ্যালন হার্সও উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। সেও দেখতে পেল। বলল, ‘কিন্তু তৃতীয় গাড়িটা কোথায়?’

‘সম্ভবত এক্সিট ওয়ের সামনে থেকে আসবে সে আমাদের আটকাবার জন্যে।’ একটু চিন্তা করে বলল অ্যানজেলা।

‘সর্বনাশ! তাহলে উপায়?’ শ্যালন হার্স বলল। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।

অ্যানজেলারও চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, ‘কোন একটা উপায় বের করতে হবে। এই এক্সিটের মাঝ বরাবর নদীতে কয়েকটি জেটি আছে পর্যটন বিভাগের। আর পাশে রেস্তোরা, দোকান-পাট, বাড়ি-ঘরও আছে। ওখানে গিয়ে কিছু করতে হবে। বোটও আমরা নিতে পারি।’

‘কিন্তু অ্যানজেলা, আমি বুঝতে পারছি না, ওরা এই লোকটাকে পাবার জন্যে এমন বেপরোয়া কেন। তোমার গাড়িকে ফলো করার সাহস ওরা পায় কি করে? আমার দেখা ভুল না হয়ে থাকলে আমি বলছি, তোমার বাবা এই লোকটিকে চিনতে পেরেছেন। তোমার বাবার তাকে চেনা এবং ওরা এভাবে তাকে ধরতে আসার মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? ওরা পুলিশের বেশে এসে তোমাদের একজনকে নিয়ে যেতে সাহস পেল কি করে? এটাও তোমার বাবার ইচ্ছা? তাছাড়া তোমার গাড়ি ওরা চিনল কি করে? গাড়ি চিনেই তো ওরা কুকুর ব্যবহার করেছিল। এই লোকটাকে নিয়ে যেতে তুমি বাধা দিতে পার, এটা তোমার বাবার জানার কথা। তাছাড়া লোকটাকে তুমি নিয়ে যাচ্ছ বাইরে কোথাও, এটা তোমার বাড়ির দায়িত্বশীলদের মধ্যে জানে একমাত্র মিস বারবারা, তোমাদের বাড়ির চীফ অব স্টাফ। সেই এদেরকে বা তোমার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে কিনা?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘ধন্যবাদ শ্যালন, তুমি যা ধারণা করছ সবই ঠিক। বাবা ওঁকে দেখে বাইরে বেরিয়েই এদের কাছে টেলিফোন করেছিলেন। টেলিফোনের সব কথা আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছি। মিস বারবারাই যে শেষ খবরটা বাবাকে বা এদেরকে জানিয়েছেন, আমিও সেটা সন্দেহ করছি।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘কিন্তু অ্যানজেলা, এই লোকটি কে, ওরাই বা কে? কেন এসব ঘটনা ঘটছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ শ্যালন হার্স বলল।

‘আমিও সব জানি না শ্যালন। তবে বড় কোন একটা ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে আমি মনে করছি।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘এই লোককে না চিনলে, তাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে তুমি এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছ কেন?’ শ্যালন হার্স বলল।

‘বাবার টেলিফোনের কথা-বার্তায় আমি শুনেছি, এই লোকটি সব বাধা, সব বিপদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এজন্যেই ওদের এই সাংঘাতিক বড় শিকারকে আমি বাঁচাতে চাই। এতে নিশ্চয় ওরা খুব অসুবিধায় পড়বে, এটা আমি চাই।’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

কথা শেষ করেই রিয়ার ভিউ-এর দিকে তাকিয়ে অ্যানজেলা বলল, ‘ওরা আমাদের কাছাকাছি আসতে চাচ্ছে।’

বলেই অ্যানজেলা তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।

অল্পক্ষণেই ওদের গাড়ির সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল।

সিটে শোয়া সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসা এবার চোখ খুলল ও উঠে বসল।

শ্যালন হার্স আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আপনার সংজ্ঞা ফিরেছে, থ্যাংকস গড।’

অ্যানজেলা আলেকজান্ডারও পেছন ফিরে তাকাল। বলল, ‘থ্যাংকস গড। আপনার এখন কেমন লাগছে?’

‘ভালো। আমি দুঃখিত, ছোট্ট একটু প্রতারণা করেছি আপনাদের সাথে। কিসের বড় একটা ধাক্কায় কয়েক মিনিট আগে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। এ সময় থেকে আমি আপনাদের সব কথা শুনেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ওয়েলকাম। কিন্তু এটা করলেন কেন?’ বলল অ্যানজেলা আলেকজান্ডার।

‘আমি কাদের হাতে, তারা শত্রু না মিত্র তা জানার সুযোগ নেয়ার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরা শত্রু হলে কি করতেন?’ বলল অ্যানজেলা।

‘মুক্ত হবার চেষ্টা করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিভাবে? আমাদের দু’জনের কাছেই রিভলবার আছে।’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আকস্মিকভাবে উঠে মি. শ্যালন হার্সকে কাবু করে আপনাকে নিষ্ক্রিয় করতাম, আপনারা রিভলবার বের করার সময় পেতেন না।’

কিছু বলতে গিয়েও অ্যানজেলা আলেকজান্ডার বলতে পারল না। সে উৎকর্ণ হলো। একটা হেলিকপ্টারের শব্দ তার কানে এল। বলল, ‘মনে হচ্ছে একটা হেলিকপ্টার আসছে।’

আহমদ মুসাও উৎকর্ণ হয়েছিল। বলল, ‘হ্যা, একটা ফোর সিটার এই এক্সিট রোড বরাবর উড়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।’

অ্যানজেলা ও শ্যালন দু’জনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘ফোর সিটার কি করে বুঝলেন?’ বলল অ্যানজেলা।

‘শব্দ শুনে বুঝেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমরাই ওদের টার্গেট কি করে বুঝলেন?’ অ্যানজেলাই বলল।

‘এই শত্রুদের আমি চিনি। ওরা জানে আমি যদি পালাতে পারি, ওদের অনেক বছরের পরিকল্পনা ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই যে-কোন মুল্যে ওরা আমাকে আটকাবে। ওদের হেলিকপ্টার এসেছে উপর থেকে আমাদের উপর নজরদারী করার জন্যে।’ আহমদ ‍মুসা বলল।

‘আপনাকে যে কোন মূল্যে আটকাবে বলছেন, কিন্তু আপনার মধ্যে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না!’ বলল শ্যালন হার্স।

‘উদ্বেগ ও ভয় এলে তো আমি দুর্বল হয়ে পড়ব। নিজেকে তাহলে বাঁচাব কি করে?” আহমদ মুসা বলল।

‘আপনার কিন্তু পরিচয় জানা হয়নি। আপনি ….. “ প্রশ্ন অ্যানজেলার।

তার চোখে-মুখে বিস্ময়। চরম বিপদ থেকে বেঁচে উঠা এবং পুনরায় চরম বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়া কারও নার্ভ এমন হতে পারে তা অকল্পনীয় তার কাছে।

আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় কিছু দূর সামনে রাস্তার ‍উপর আগুন জ্বলে উঠল।

মাথার উপরের হেলিকপ্টার সামনে চলে গিয়েছিল।

‘রাস্তার উপরে হেলিকপ্টার থেকে আগুনে বোমা ছুড়ে সামনে এগোবার রাস্তা ওরা বন্ধ করে দিল।’ আহমদ মুসা বলল।

‘সর্বনাশ! এখন তাহলে উপায়?’ বলল অ্যানজেলা।

‘আমি একটা অনুরোধ করবো মিস অ্যানজেলা।’ আহমদ মুসা বলল।

‘বলুন।’ অ্যানজেলা বলল।

‘প্লিজ, আমাকে ড্রাইভিংটা দিন। বিপদ আমাদের সকলের। কিন্তু তারা ধরতে চায় শুধু আমাকেই। সুতরাং বাঁচার একটা পথ আমাকে করতে হবে। ভয় নেই, আমি ভালো ড্রাইভ করি। আপনাদের অন্তত কোন বিপদ হতে দেব না।’ বলল আহমদ মুসা।

অ্যানজেলা মুখ ‍ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার যে মুখ সে দেখল তা স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবি। অ্যানজেলার মন বলল, ‘তাঁর পরিচয় যাই হোক তাঁর উপর সবকিছুর জন্যে নির্ভর করা যায়।

‘বেশ আসুন।’ বলে গাড়ি অটোড্রাইভে দিয়ে পাশের আসনে সরে গেল অ্যানজেলা।

আহমদ ‍মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।

এ সময় পেছন থেকে আরেকটা হেলিকপ্টারের শব্দ পাওয়া গেল।

‘মি. শ্যালন হার্স, মিস অ্যানজেলা আগে যাওয়ার পথ বন্ধ, পেছনে ও সামনের আকাশে হেলিকপ্টার এবং রাস্তায় দু’টি গাড়ি আমাদের দিকে ধেঁয়ে আসছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমরা তো তাহলে ধরা পড়ে যাচ্ছি।’ অ্যানজেলা বলল। আর্ত চিৎকারের মতো শোনাল তার কণ্ঠ।

‘মিস অ্যানজেলা, মি. শ্যালন, আমি গাড়ি স্লো করছি, আপনারা নেমে পড়ুন।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।

‘আর আপনি?’ বলল অ্যানজেলা উদ্বেগ ভরা কণ্ঠে।

‘সামনে নদীটার একটা খাড়ি পঁচিশ ত্রিশ গজ ভেতরে ঢুকে গেছে। রাস্তা এখানে ‘ইউ শেপড’। এ রাস্তাটা নদীর পাড় ঘেঁষে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। আপনার এই গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করে নদীতে গিয়ে পড়বে। আপনারা ওদের বলবেন, আপনাদের নামিয়ে দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে সামনে এগোতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট করে আমি নদীতে পড়ে গেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘না, এটা হবে না। আমরা নামব না। আপনি ধরা দিন, আমি আপনাকে বাঁচিয়ে নেব। আপনি এভাবে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দিতে পারেন না।’ চিৎকার করে বলল অ্যানজেলা।

‘প্লিজ শুনুন। আপনার দামি গাড়ির কিছূ ক্ষতি হতে পারে। তবে এ উভচর গাড়ি পানি থেকে তুলে আবার চালাতে পারবেন। আর আমি মরব না, বাঁচার চিন্তা করেই এই প্ল্যান আমি করেছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিভাবে বাঁচবেন? এটা বাস্তব নয়। আপনি….’

অ্যানজেলাকে বাধা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘প্লিজ মিস অ্যানজেলা। সময় হাতে নেই। আমি আবার ওদের হাতে পড়তে চাই না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুতর সিকিউরিটি সংক্রান্ত একটা তথ্য আমি পেয়েছি। আমার অতিসত্বর মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন।’ অনেকটাই সিদ্ধান্তের সুর ধ্বনিত হলো আহমদ মুসার কণ্ঠে।

অ্যানজেলা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল আহমদ মুসার গম্ভীর ও শক্ত মুখ। আর চোখে পবিত্রতা ও বিশ্বাসের সম্মোহনকারী আলো। তার আবারও মনে হলো, লোকটির কথার প্রতিটি বর্ণ সত্য। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটির কথা শুনে একেবারেই থমকে গেছে সে।’

সম্মোহিত নরম কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, ঠিক আছে, আমরা নেমে যাচ্ছি। শুধু একটা কথা, নদীতে পড়লেই কিন্তু আপনি নিরাপদ নন। গোটা নদী ওরা চষে ফেলবে হেলিকপ্টার, বোট ও ডুবুরী লাগিয়ে।’

‘চিন্তা করবেন না। যত বিপদ, বিপদ মুক্তির পথও ততটাই। আর সব ঘটনার একজন অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক আছেন। তিনি আল্লাহ।’ আহমদ মুসা বলল।

আকস্মিকভাবে গাড়ি স্লো হয়ে গেল। অ্যানজেলা এবং শ্যালন হার্স এক সাথেই চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।

তারা নামতেই গাড়ি তীরের মতো সামনে এগিয়ে চলল।

‘এস শ্যালন, আমার বুক কাঁপছে। আমাদের তো কিছুই করার নেই। অন্তত চল দেখি গিয়ে কি ঘটছে। ‘ বলল অ্যানজেলা।

ছুটতে লাগল অ্যানজেলা গাড়ির পিছু পিছু। তার পেছনে শ্যালন হার্সও।

তারা যখন নদীর ধারে রাস্তার বাঁকটায় পৌছল, দেখতে পেল শান্ত নদীর বুক। নদীতে ভাসছে গাড়ি। খাড়ির ওপাশ থেকেও দু’জন লোক তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ওরা নিশ্চয় দেখেছে গাড়িটিকে নদীতে পড়তে। মাথার উপরে দু’টি হেলিকপ্টারও এসে স্থির হয়েছে এ গাড়িটার উপর। পেছনের দু’টি গাড়িও এসে দাঁড়াল তাদের পেছনে।

Top