৬
পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোড ধরে দুই গাড়ির একটা বহর প্রবেশ করল রক ক্রিক পার্ক এলাকায়।
বহরের আগের গাড়িটি ফোর হোয়েল ড্রাইভ হাইল্যাণ্ডার জীপ। এইট সিটের। পেছনের গাড়িটা একটা ক্যারিয়ার।
হাইল্যান্ডার জীপের মাঝের সারির এক পাশে বসে আছে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন, অন্য পাশে সারা জেফারসন। সামনের ড্রাইভিং সিটে এফবিআই প্রধানের ব্যক্তিগত ড্রাইভারের পাশে তার পার্সোনাল সহকারি হেনরিয়েটা।
পেছনের মুখোমুখি চার সিটের দু’জন এফবিআই প্রধানের সিকিউরিটি, অন্য দু’জন ডগ স্কোয়াডের গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের একজনের হাতে ধরা ডগ স্কোয়াডের একটা কুকুর।
আর পেছনের ক্যারিয়ার ভ্যানে এফবিআই-এর একজন অফিসার ড্রাইভার ও ড্রাইভারের পাশে বেঞ্জামিন বেকন। পেছনে ক্যারিয়ারে দশজন এফবিআই সদস্য। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেঞ্জামিন বেকন।
রক ক্রিক পার্ক এলাকায় প্রবেশ করেছে গাড়ি।
‘তুমি অনেক জেদ করে সাথে এসেছ। আল্লাহ তোমার আশাটাকে স্বার্থক করুন।’ বলল এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনকে লক্ষ করে।
‘আমিন। আল্লাহ আমাদের সফল করুন।’ সারা জেফারসন বলল।
‘ওয়াশিংটনের চারদিকের সন্দেহ করার মতো সব জায়গায় অনুসন্ধান হয়ে গেছে। রক ক্রিক অঞ্চলটাই বাকি। আমার অনুমান সত্য হলে আহমদ মুসাকে ওয়াশিংটনের অঞ্চলের বাইরে নেয়া হয়নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আংকেল ওটা নির্ভর করবে ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে কি করতে চায় তার উপর। আহমদ মুসাকে ওরা প্রকৃতপক্ষে কি জন্যে কিডন্যাপ করেছে আমরা জানতে পারিনি।’ সারা জেফারসন বলল।
‘এটাই তো চিন্তার বিষয় সারা। তবে এইচ থ্রি বা এইচ কিউব নামের অস্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান একজন বড় কাউকে কিডন্যাপ করার যে তথ্য জানা গেছে, সেটা সত্য হলে এবং সেই কিডন্যাপ করা ব্যক্তি আহমদ মুসা হলে একটা আশা জাগে যে তার মতো ব্যক্তিকে সতর্ক প্রহরায় নিযে অতি অল্প সময়ে ওয়াশিংটনের বাইরে নেয়া সম্ভব হয় নি।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সারা জেফারসন কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোড থেকে বেরিয়ে যাওয়া ২ নং এক্সিট রোডের সাইনবোর্ড। এই এক্সিট রোডটি মধ্য রক ক্রিক পার্কের পূর্ব এলাকার গভীর জংগলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আবার পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক রোডে উঠেছে। সারা জেফারসন ভাবল জংগলের পথেই তাদের যাওয়া দরকার। দু’পাশের বিরাট অঞ্চলের উপর আমাদের অনুসন্ধান চলতে পারবে।
‘আংকেল, আমি মনে করি দুই নাম্বার এক্সিট ধরে জংগলের পথে আমাদের অগ্রসর হওয়া দরকার।’ সারা জেফারসন জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে তাকিয়ে বলল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছ মা।’
বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন সামনে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যান্ড্রু দুই নাম্বারে এক্সিট নাও।’
দুই নাম্বার এক্সিট ধরে এগিয়ে চলল জর্জ আব্রাহাম জনসনদের দু’টি গাড়ি।
দুই পাশে গভীর বন। তার মাঝ দিয়ে পাথুরে রাস্তার উপর দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে গাড়ি দু’টি।
এক স্থানে এসে শিকারী কুকুরটি ঘেউ ঘেউ আর লাফালাফি শুরু করল।
‘অ্যান্ড্রু গাড়ি থামাও।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
গাড়ি থেমে গেল রাস্তার পাশে গিয়ে।
ডগ স্কোয়াডের অফিসার দু’জন কুকুরটি নিয়ে লাফ দিয়ে নামল।
জর্জ আব্রাহাম জনসনও নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে।
একটু সামনে জংগলের পাশের একটা জায়গা লক্ষ করে অস্থির হয়ে উঠেছে কুকুরটি।
‘ওকে ছেড়ে দাও জন। কিছু সন্দেহ করেছে সে।’ বলল আব্রাহাম জনসন।
সারা জেফারসন গাড়ি থেকে নেমে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবার চোখেই গভীর ঔৎসুক্য ও আশার আলো।
পেছনের গাড়িটাও এসে দাঁড়িয়েছে।
বেঞ্জামিন বেকন এসে জর্জ আব্রাহাম জনসনের পেছনে দাঁড়াল।
ছেড়ে দেয়ার সংগে সংগে কুকুরটি ছুটে গিয়ে জংগলের প্রান্তের একটা জায়গা শুঁকতে লাগল এবং লেজ নাড়তে লাগল সেই সাথে। সবাই দ্রুত গিয়ে দাঁড়াল সেই স্থানের পাশে।
‘বেকন সন্তর্পণে জায়গাটা পরীক্ষা করো। নিশ্চয় কুকুরটি কিছু সন্দেহ করেছে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কাজে লেগে গেল বেঞ্জামিন বেকন।
সারা জেফারসনও ধীরে ধীরে সেদিকে এগোলো।
ডগ স্কোয়াডের দু’জন লোক গিযে কুকুরটির বেল্টটা হাতে নিল।
সবাই দেখতে লাগল।
প্রথম কথা বলল সারা জেফারসন। বলল, ‘আংকেল লম্বালম্বি একটা জায়গার ঘাস দেখা যাচ্ছে চেপ্টা হয়ে গেছে। লম্বালম্বি জায়গাটার শেষ প্রান্তে কচি গাছ, ঘাস পিষে গেছে। দীর্ঘক্ষণ, অন্তত এক দুই ঘণ্টার বেশি চাপা পড়ে ঘাসের যে অবস্থা হয়, সেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয়, লম্বালম্বি জায়গাটা মেপে দেখা দরকার।’
‘ঠিক বলেছ সারা। বেকন মেপে দেখ। আমার মনে হচ্ছে আহমদ মুসার একটা চিহ্ন আমরা পেলাম।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আমিন। আলহামদুলিল্লাহ।’ সারা জেফারসন বলল।
ওদিকে বেকন পিঠের ব্যাগ থেকে টেপ বের করে ধীরে সূস্থে মাপল লম্বালম্বি জায়গাটা। মাপ শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, লম্বালম্বি মাপ ছয় ফিট।’
‘আহমদ মুসার উচ্চতার সামান্য কিছু বেশি। মাপতে গিয়ে নিশ্চয় দুই এক ইঞ্চি কম বেশি হয়েছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহর অশেষ শুকিরয়া যে, আহমদ মুসার একটা চিহ্ন আমরা পেলাম !’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। আবেগের উচ্ছাসে তার কণ্ঠ ভারি।
‘কিন্তু আংকেল, তিনি জংগলের পাশে এভাবে পড়েছিলেন কেন? কি অবস্থায় ছিলেন? তারপর কি হল তার? সবগুলো প্রশ্নই ভয়াবহ আংকেল। তিনি কি পালাচ্ছিলেন? আবার কি ধরা পড়েছেন শত্রুর হাতে?’ বলল সারা জেফারসন। তার কণ্ঠ ভেঙে পড়েছিল শেষ দিকে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন সারা জেফারসনের কাঁধে হাত রেখে সান্তনার স্বরে বলল, ‘আল্লাহর সাহায্য তার সাথে আছে মা।’
কথা শেষ করেই বেঞ্জামিন বেকনের দিকে চেয়ে জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন খেয়াল করেছ, আমাদের গাড়ি ছাড়া আরও একটা গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আরও কিছু পায়েরও এলোমেলো চিহ্ন দেখ। জুতার দাগুলোর মধ্যে একটা লেডিস স্যান্ডেলেরও দাগ আছে। তার মানে ওরা ও আহমদ মুসাকে দেখেই গাড়ি থেকে নেমেছিল। আবার শত্রুও ওরা হতে পারে। যা হোক, আমাদের ফলো করা দরকার। আর কুকুরও সামনের দিকে লক্ষ করেই অস্থিরতা দেখাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ির চাকা দেখা যাচ্ছে সামনের দিকেই গেছে।’
বেঞ্জামিন বেকন ঝুঁকে পড়ে গাড়ির চাকার দাগ দেখছিল। বলল, ‘কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে ওরা এখান থেকে গেছে। ওদের সন্ধান করতে কুকুরের ঘ্রাণ শক্তির উপরই নির্ভর করতে হবে আমাদের।’
‘তার মানে আমরা কমপক্ষে ৬০ কিলোমিটার পিছনে। আল্লাহ ভরসা। চল, আর দেরি নয়।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
চলতে শুরু করল আবার দু’টি গাড়ি।
এবার বেঞ্জামিন বেকন-এর ক্যারিয়ার ভ্যান আগে নেয়া হয়েছে। ডগ স্কোয়াডের একজনকে তার শিকারী কুকুর সমেত ক্যারিয়ার ভ্যানের ড্রাইভারের পাশে বসানো হয়েছে।
এক্সিট রোড অতিক্রম করে গিয়ে উঠল পটোম্যাক-রক ক্রিক পার্ক হাইওয়েতে।
‘স্যার, আমরা পশ্চিম দিকে রক ক্রিকের আরও গভীর অঞ্চলের দিকে যাচ্ছি। কুকুরের ইংগিত বাম দিকেই।’ জর্জ আব্রাহাম জনসনের ওয়্যারলেসে বেঞ্জামিন বেকনের কথা ভেসে এল।
‘ও.কে বেকন, আগাও। ডগের সিলেকশনে বেশি স্ট্রেস না দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত চলো।’
এক জায়গায় এসে সামনের ক্যারিয়ার ভ্যানটি সিগন্যাল দিয়ে থেমে গেল।
পাশেই একটা বিশাল গেট।
জর্জ আব্রাহামের গাড় থামল সেই সংগে। অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘এটা তো ধনকুবের ব্যবসায়ী শিমন আলেকজান্ডারের পাহাড়ী অবকাশ কেন্দ্র। পাহাড়-বন অঞ্চলের নীরব পরিবেশে তিনিসহ তাঁর পরিবার এই বাড়িতেই বেশি সময় থাকেন। এখানে গাড়ি থামল কেন?’
জর্জ আব্রাহামের গাড়ি থামার প্রায় সংগে সংগেই বেঞ্জামিন বেকন দ্রুত এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘স্যার, অদ্ভুত ব্যাপার, ডগ গেটের দিকে যেতে চাচ্ছে, আবার ফ্লাইওভারের দিকেও ছুটতে চাচ্ছে।’
‘সোজা রক ক্রিক পার্ক রোডের দিকে?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।
‘স্যার, ওদিকে ডগ লক্ষই করছে না।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।
‘তাহলে এ দু’দিকের যে কোন একদিকে তারা গেছে। দু’দিকেই ইন্ডিকেট করার অর্থ হতে পারে, প্রথমে কোন একদিকে গিয়েছিল, তারপর দ্বিতীয় দিকে গেছে। দ্বিতীয় দিক কোনটা দেখ। গেটম্যানকে জিজ্ঞাসা কর, তারা সবকিছুই জানে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘ইয়েস স্যার।’ বলে আবার ছুটল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আংকেল, আমিও একটু দেখি।’ বলে সারা জেফারসনও গাড়ি থেকে নামল।
হাইওয়ে থেকে অনেকখানি ভেতরে গেটের দুই পাশে দুই সিকিউরিটি বক্স। সিকিউরিটি বক্স গেটের ভেতরে।
গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়াতে দেখে সিকিউরিটির লোকেরা আগেই বেরিয়ে এসেছে।
বেঞ্জামিন বেকন তাদেরকে ডাকতেই তারা সামনে এসে দাঁড়াল।
‘দেখ, আমাদের ডগ স্কোয়াডের কুকুর ভেতরে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। হয়তো ডগের পরিচিত কোন লোককে ভেতরে নেয়া হয়েছে। এখন বল, বাইরের কোন লোককে, অসুস্থ বা আহত অবস্থায় ভেতরে নেয়া হয়েছে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে ‘ জিজ্ঞাসা বেঞ্জামিন বেকনের।
সিকিউরিটির লোক দু’জনে একে অপরের দিকে তাকাল। একজন বলল, ‘আপনাদের লোকজন তো কিছুক্ষণ আগে এসেছিল। আপনারা কিছু জানেন না?’
‘আমাদের লোকজন মানে পুলিশ?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘জি হ্যা।’ বলল সিকিউরিটির সেই লোকটি।
‘কেন এসেছিল? কি করেছিল তারা?’ বেঞ্জামিন বেকনের জিজ্ঞাসা।
‘তারা সেই অসুস্থ লোককে নিতে এসেছিল।’ বলল সেই লোকটি।
‘কোন অসুস্থ লোক?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আমাদর ছোট ম্যাডাম ও তার বন্ধু যে অসুস্থ লোককে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে, তাকেই পুলিশ নিতে এসেছিল।’ সিকিউরিটির লোক বলল।
‘নিয়ে গেছে?’ বেঞ্জামিন বেকনের জিজ্ঞাসা।
‘না তারা নিয়ে যেতে পারেনি। তার আগেই ছোট ম্যাডাম ও তার বন্ধু তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’ সিকিউরিটির সেই লোক বলল।
‘সরিয়ে নিয়ে গেছে মানে? পুলিশকে দিল না কেন?’ বলল বেঞ্জামিন বেকন।
‘আমরা তা জানি না স্যার। বড় সাহেব আমাদের বলে গিয়েছিলেন, পুলিশ আসবে অসুস্থ লোকটিকে যেন তাদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই ম্যাডাম তাকে নিয়ে যান। আমরা বড় সাহেবের কথা বললে ম্যাডাম বলেন, তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। ম্যাডামের গাড়ি যখন গেট থেকে বের হয়, পুলিশের গাড়ি তখনিই এসে গিয়েছিল। কিন্তু ম্যাডাম পুলিশকে এড়িয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে ওপারে গিয়ে একটু বামের এক্সিট ধরে চলে যায়। ঐ পুলিশদের সাথেও কুকুর ছিল। কুকুরটি ছুটে গিয়েছিল ম্যাডামের গাড়ির পেছনে পেছনে। পুলিশের বাধার মুখে ম্যাডাম ওয়াশিংটনের দিকে যেতে না পেরেই ঐ এক্সিটের পথ ধরেছিল বলে মনে হয়।’
‘ধন্যবাদ!’ বলে গেটম্যানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বেঞ্জামিন বেকন তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম, আর কিছু জানার আছে আমাদের?’ বেঞ্জামিন বেকনের কণ্ঠে সম্মান ও শ্রদ্ধার সুর।
সারা জেফারসন কিছু না বলে গেটম্যানের দিকে চেয়ে বলল, ‘অসুস্থ লোকটিকে আপনারা দেখেছেন?’
‘জি ম্যাডাম, আমাদের ছোট ম্যাডাম যাবার সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছিলেন। সেই সময় আমাদের চোখ ম্যাডামের গাড়ির ভেতরেও যায়।’ বলল একজন গেটম্যান।
‘কি দেখেছ?’ জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।
‘অসুস্থ লোকটি শুয়ে ছিল। মুখ দেখে মনে হয়েছে লোকটি শ্বেতাংগ নয়।’ গেটম্যান বলল।
‘অনেক ধন্যবাদ।’ বলে সারা জেফারসন মুখ নিচু রেখেই বলল, ‘চলুন মি. বেকন। আংকেলকে রিপোর্ট করতে হবে।’
ওরা ফিরে এল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছে। বেঞ্জামিন বেকন গেটম্যানের কাছে শোনা সব কথা রিপোর্ট করতে লাগল জর্জ আব্রাহামকে।
সারা জেফারসন গাড়িতে উঠে বসল।
সব কথা শোনার পর জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন রক ক্রিকের পুলিশ অফিস এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টারে টেলিফোন করে দেখ কোন আসামীর সন্ধানে বা কাউকে উদ্ধারের জন্যে এই সময়ের মধ্যে কোন অভিযান পরিচালিত হয়েছে কিনা।’
সংগে সংগেই ওয়্যারলেস করার জন্যে বেঞ্জামিন বেকন একটু সরে গেল।
‘আংকেল, একটা মজার বিষয়, এদের বড় সাহেব ছোট ম্যাডামের পিতা অসুস্থ ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে বললেন। আর ছোট ম্যাডাম তাকে পুলিশের হাতে না দিয়ে তাকে নিয়ে পালালেন। বড় সাহেব সঠিক হলে ছোট ম্যাডাম সন্দেহভাজন হয়ে দাঁড়ান। অন্যদিকে ছোট ম্যাডাম ঠিক হলে বড় সাহেব সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন।’ সারা জেফারসন বলল।
‘ঠিক বলেছ মা। রহস্যের একটা গ্রন্থি মনে হচ্ছে একে। পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পেলেই বুঝা যাবে ঘটনা কি?’
বেঞ্জামিন বেকন এসে গেল। বলল, ‘স্যার, পুলিশের তরফ থেকে কোন অভিযান পাঠানো হয় নি। আমাদের সাথের ডগ স্কোয়াড ছাড়া ডগ স্কোয়াডের কেউ এদিকে আসেনি।’
‘বুঝা গেল পুলিশরা ভুয়া ছিল। ছোট ম্যাডামরা আহমদ মুসাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। এস দোয়া করি সবাই, আহমদ মুসাকে ছোট ম্যাডামরা যেন শত্রুর হাতে পড়া থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হোন।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘আমিন।’ সারা জেফারসন বলল।
বেঞ্জামিন বেকনও ‘আমিন’ বলে অনুমতি চাইল, ‘আমার এবার গাড়ি স্টার্ট করতে পারি স্যার।’
‘হ্যাঁ, বেকন। দ্রুত চল। আমার মনে গয় এই এক্সিট রোডেই আমরা ছোট ম্যাডামদের সাক্ষাৎ পেয়ে যাব।’ বলল জর্জ আব্রাহাম।
‘আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’ বেঞ্জামিন বেকন বলল।
দ্রুত গিয়ে সামনের গাড়িতে উঠল সে।
দুটি গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল।
রক ক্রিক রিভারের তীর ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল জর্জ আব্রাহামের গাড়ি।
‘সামনেই একটা বড় খাড়ি। খাড়িতে গিয়ে রাস্তা ইউটার্ণ নিয়েছে। খাড়ির পরেই একটা ঘাট আছে। কিছু দোকান-পাট, বাংলোও আছে। প্রচুর পর্যটক এখানে আসে। বোট ভাড়া পাওয়া যায় এখানে।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আরও কিছুটা এগিয়ে খাড়ির কাছে পৌঁছতেই দেখা গেল একটা গাড়ি এদিকে আসছে।
গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই আগের গাড়ির শিকারী কুকুর ভীষণ ঘেউ ঘেউ আর লাফালাফি শুরু করল।
সামনের গাড়িটি স্পিড স্লো করে থেমে গেল।
জর্জ আব্রাহামের গাড়িও থামল।
বেঞ্জামিন বেকনসহ ডগ স্কোয়াডের লোকেরা এবং পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে গেছে।
সারা জেফারসনও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
‘দেখ মা, গাড়ি যখন একটা, তখন ছোট ম্যাডামদের গাড়িও হতে পারে।’ সারা জেফারসনকে উদ্দেশ্য করে বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
বেঞ্জামিন বেকনের নির্দেশে পুলিশরা এগিয়ে আসা গাড়িটার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
এগিয়ে আসা গাড়িটি পুলিশের ব্যরিকেডের সামনে এসে থেমে গেল।
বেঞ্জামিন বেকন ও সারা জেফারসন ছুটে গেড় গাড়ির কাছে।
আর ঐ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমেছে আলাইয়া অ্যানজেলা।
সারা জেফারসনের উপর চোখ পড়তেই ছুটে এল আলাইয়া অ্যানজেলা।
‘গুড ইভিনিং ম্যাডাম। আপনি এখানে?’ সারা জেফারসনের কাছে এসে উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল আলাইয়া অ্যানজেলা।
এদিকে ডগ স্কোয়াডের কুকুরটি লাফ দিয়ে আলাইয়া অ্যানজেলার গাড়িতে উঠে গেছে এবং মাঝের যে সিট আহমদ মুসা শুয়েছিল সে জায়গাটা কুকুরটি অস্থিরভাবে শুঁকছে, লেজ নাড়ছে আর গোঁ গোঁ শব্দ করছে।
সারা জেফারসনও অবাক হয়েছে অ্যানজেলাকে ঐ গাড়ি থেকে নামতে দেখে। দেশপ্রেমিক তরুণ আমেরিকানদের যে সংগঠন ‘ফ্রি আমেরিকা’ তার নেতা সারা জেফারসন, সেই ‘ফ্রি আমেরিকা’র কর্মী আলাইয়া অ্যানজেলা। সভা-সম্মেলনে অনেকবার দেখা হয়েছে তাদের।
সারা জেফারসন আলাইয়া অ্যানজেলাকে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এই সময় বেঞ্জামিন বেকন ওই গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘ম্যাডাম, গাড়িতে কেউ নেই। তবে এখানে স্যার ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
সারা জেফারসন ও আলাইয়া অ্যানজেলা দু’জনেই বেঞ্জামিন বেকনের কথা শুনল।
বেঞ্জামিন বেকনের কথা শেষ হতেই আলাইয়া বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন। সাথে পুলিশও দেখছি। আমার গাড়িতে কে ছিলেন? কাকে স্যার বলা হচ্ছে?’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করল আলাইয়া অ্যানজেলা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
এ সময় শ্যালন হার্সও এসে অ্যানজেলার পাশে দাঁড়াল।
এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনও সারা জেফারসনের দিকে আসছিলেন।
তাকে দেখেই একটু সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল সারা জেফারসন। বলল অ্যানজেলাদের লক্ষ করে, ‘উনি আসছেন, এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসন।’
‘ও গড!’ বলে অ্যানজেলা সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্যালন হার্সও।
জর্জ আব্রাহাম আসতেই অ্যানজেলা ও শ্যালন হার্স একটু বাউ করে ‘গু ইভনিং স্যার’ বলে স্বাগত জানাল।
সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে দেখিয়ে জর্জ আব্রাহামকে বলল, ‘আংকেল ইনি আলাইয়া অ্যানজেলা, আমাদের ‘ফ্রি আমেরিকা’র কর্মী।’
বলেই তাকাল শ্যালন হার্সের দিকে। সংগে সংগেই আলাইয়া অ্যানজেলা বলল, ‘এ শ্যালন হার্স। আমার বন্ধু। পেশায় ডাক্তার।’
কথা শেষ করেই অ্যানজেলা আবার বলে উঠল জর্জ আব্রাহামকে লক্ষ করে, ‘এক্সকিউজ মি. স্যার, বুঝতে পারছি আমার গাড়িতে কাউকে খোঁজা হচ্ছে। কে সে? আমার গাড়িতে একজন ছিলেন।’
‘ছিলেন মানে কোথায় তিনি? সেই পুলিশরা তাকে কেড়ে নেয়নি তো?’ জিজ্ঞাসা এফবিআই প্রধানের।
‘স্যার, ওই পুলিশরা তাকে কেড়ে নিতে পারেনি? ওদের কথা আপনারা জানলেন কি করে? ওরা তো আপনাদের লোক নয়।’ অ্যানজেলা বলল।
‘ওরা আমাদের লোক নয় তুমি জানলে কি করে?’ বলল জর্জ আব্রাহাম। তার চোখে বিস্ময়।
‘সে অনেক কথা স্যার। আমার গাড়িতে যে ছিল, সে নিজেই চলে গেছেন। অদ্ভুত লোক সে।’ অ্যানজেলা বলল।
‘কোথায় গেলেন? কখন গেলেন?’ জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।
আলাইয়া অ্যানজেলা তার গাড়ির আগে-পিছে সেই পুলিশের গাড়ি ও হেলিকপ্টারে উপর থেকে ঘেরাও হবার পর তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে লোকটি গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলল। শুনেই জর্জ আব্রাহাম বলল, ‘চল সেখানে।’
তিনটি গাড়িই চলল খাড়ির ধারে।
গাড়ি থেকে নেমে সবাই গিয়ে দাঁড়াল খাড়ির পাশে নদীর ধারে।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের একপাশে সারা জেফারসন, অন্যপাশে আলাইয়া অ্যানজেলা।
‘স্যার, ঘেরাও হবার পর উনি বলেছিলেন, ওরা আমাকে যে কোন মূল্যে হাতে পেতে চাইবে। কারণ ওদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের তথ্য আমার জানা হয়ে গেছে। আমি ওদের হাতের বাইরে যাওয়া মানে ওরা বহু বছর ধরে আশার যে প্রাসাদ রচনা করেছে, তার ধূলিসাৎ হওয়া। আমার কাছে আমেরিকার সিকিউরিটি বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, আমাকে ওদের হাতে পড়া চলবে না। উনি গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ওরা চলে আসে। হেলিকপ্টার ক্রেন দিয়ে নদী থেকে গাড়িটা তীরে তুলে আনে। গাড়িতে তাঁকে পাওয়া যায় নি। তারপর তারা এক ঝাঁক মানুষ নেমেছিল নদীতে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর পানির উপরে সে উঠেনি। শুরু থেকে গোটা সময় আমরা তীরে দাঁড়িয়েছিলাম। মনটা আমাদের দারুণ খারাপ হয়ে যায়। জানতে পারি কি স্যার, উনি কে? এত বিনয়ী, সিদ্ধান্তে এত কঠোর এবং এমন দুঃসাহসী মানুষ আমি দেখিনি, পড়িওনি গল্পে।’
‘তিনি অত্যন্ত মূল্যবান মানুষ। আহমদ মুসার নাম তুমি নিশ্চয় শুনেছ? ইনি আমাদের সেই আহমদ মুসা।’ বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
‘উনি আহমদ মুসা!’ স্বগোতোক্তির মতো কথাগুলো বেরুল অ্যানজেলার মুখ থেকে। অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছে সে জর্জ আব্রাহামের দিকে।
কয়েক মূহূর্ত তার মুখ থেকে আর কোন কথা বেরুল না। তার বিস্ময়পীড়িত মুখ থেকে আবার বেরিয়ে এল, ‘স্যার, আমরা তাহলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আহমদ মুসাকে উদ্ধার করেছিলাম! তিনি এতটা সময় আমাদের সাথে ছিলেন আবার আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলেন! ও গড, আমরা কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানানোরও সুযোগ পেলাম না!’ গভীর আবেগ ও আন্তরিকতার স্পর্শ নিয়ে কথাগুলো বেরুল অ্যানজেলার মুখ থেকে।
‘উনি হারিয়ে যাননি, হারিয়ে যেতে পারেন না। তুমি অভিনন্দন জানাতে পারবে ইনশাআল্লাহ।’ সারা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি, মুখ গম্ভীর। তার শূন্য দৃষ্টি নদীর দিকে নিবদ্ধ।
জর্জ আব্রাহাম অ্যানজেলার দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সারা ঠিকই বলেছে মিস অ্যানজেলা। আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করবেন, এ ভরসা আমাদের আছে। কোন দায়িত্ব সামনে এলে তিনি নিজের কথা ভুলে যান। এজন্যেই আল্লাহ তাঁকে ভুলেন না কোন সময়ই।’
‘গড সেভ হিম।’ বলল অ্যানজেলা। এই সাথে মনে পড়ল তার পিতার কথা। সে আহমদ মুসা বলেই হয়তো তার পিতা তাকে সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ বলেছিলেন। কিন্তু তার পিতার কাছে তিনি এত মূল্যবান ছিলেন কেন? তিনি পুলিশের ছদ্মবেশে হলেও তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন কেন? আহমদ মুসা কোন্ ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন? আব্বা কি কোন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত আছেন? মনে মনে আতংকিত হয়ে উঠল অ্যানজেলা। ভাবল সে, খুব তাড়াতাড়ি পিতার সাথে তাকে কথা বলতে হবে। তার পিতার মতো সৎ সজ্জন মানুষ খুব কমই আছে, কিন্তু তার কি হলো? কেন তিনি ঐ ভাবে আহমদ মুসাকে তাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইলেন ! আহমদ মুসার সাথে তার আব্বাদের সম্পর্ক কি!
জর্জ আব্রাহাম অ্যানজেলাকে কথা কয়টি বলেই ফিরে দাঁড়িয়েছিল বেঞ্জামিন বেকনের দিকে। বলল, ‘বেঞ্জামিন বেকন, এরিক এন্ডারসনকে ওয়্যারলেস লাগাও।’
এরিক এন্ডারসনকে ওয়্যারলেস লাইনে পেয়ে বলল জর্জ আব্রাহাম, ‘এরিক রক ক্রিক নদীটির ভাটির মুখ থেকে রক ক্রিক ঘাট-২ এর উজানে সিকি মাইল পর্যন্ত নদী স্ক্যান কর। এখনি লোকদের কাজে লাগাও। আমরা দুই নাম্বার ঘাটে আছি।’
কথা শেষ করে ওয়্যারলেস কল অফ করে বলল, ‘চল আমরা রেস্ট হাউজে গিয়ে বসি।’
অ্যানজেলার দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরাও আসতে পার অ্যানজেলা।’
রেস্ট হাউজটা খাড়ির ওপারে নদীর তীর ঘেষে। খাড়িটা ঘুরে ওখানে যেতে হবে।
সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল।
আলাইয়া অ্যানজেলা অনুরোধ করে সারা জেফারসনকে তার গাড়িতে নিয়ে গেল। দু’জন পেছনে উঠার পর অ্যানজেলা ড্রাইভিং সিটে বসা শ্যালন হার্সকে বলল, ‘হার্স ড্রাইভ করতে আপত্তি নেই তো?’
‘বল কি অ্যানজেলা! সারা ম্যাডামকে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। ওয়েলকাম।’ শ্যালন হার্স বলল।
‘ধন্যবাদ মি. হার্স। সৌভাগ্যক্রমেই আপনাদের ুদু’জনের এক সাথে দেখা পেয়েছি।’
‘আপনি এভাবে বললে লজ্জা পাই ম্যাডাম। আপনাদেরকে আমরা আমাদের অভিভাবক পরিবার বলে মনে করি। আমেরিকবাসীরা কৃতজ্ঞ আপনাদের পরিবারের প্রতি। ভার্জিনিয়ার জেফারসন হাউজকে আমি আমাদের সিনাগগের চেয়ে সম্মান করি।’ শ্যালন হার্স বলল।
‘ধন্যবাদ মি. হার্স।…..’
কথা শেষ করতে পারল না সারা জেফারসন। তার কথার মাঝখানেই অ্যানজেলা বলল, ‘ম্যাডাম প্লিজ, এদিকে একটু……।’
কথা শেষ না করেই অ্যানজেলা থেমে গেল।
‘বল অ্যানজেলা। কি বলছিলে?’ বলল সারা জেফারসন।
‘স্যার আহমদ মুসা আমেরিকার বিরুদ্ধে ওদের যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের তথ্য দিলেন, সেটা কি হতে পারে। উনি যাকে ভয়ংকর বলেছেন তা যে কত বড় ভয়ংকর হতে পারে, তা ভাবতেও আমার বুক কাঁপছে।’ আলাইয়া অ্যানজেলা বলল।
‘হ্যা, উনি যে বিষয়কে এভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা খুবই গুরুতর হবে। প্রশ্ন, কি সেটা?’ বলল সারা জেফারসন।
‘ম্যাডাম, আহমদ মুসার কথা অনেক পড়েছি, অনেক শুনেছি। কিন্তু আজ দেখলাম অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ওদের কাছে আবার ধরা পড়লে ওদের ভয়ংকর ষড়যন্ত্র ফাঁস করার উপায় থাকবে না, এই জন্যে মৃত্যুকে আলিংগন করার মতো গাড়ি সমেত নদীতে সে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। মৃত্যুর ব্যাপারে কোন মানুষ এমন বেপরোয়া হতে পারে, তাও আমার কল্পনায় ছিল না।’ অ্যানজেলা বলল।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের বুক থেকে তার অজান্তেই। বলল, ‘ওঁর আপনজনদের কাছে তিনি যতটা গৌরবের, ততটাই উদ্বেগের।’
সারা জেফারসনের এই দীর্ঘশ্বাস কান এড়াল না আলাইয়া অ্যানজেলার। সংগে সংগেই সে চোখ তুলেছিল সারা জেফারসনের দিকে। সারা জেফারসনের দু’চোখে শূন্যতা, মুখ জুড়ে ছিল বেদনার গভীর প্রলেপ। জেফারসন পরিবারের প্রতিভাবান সন্তান, ‘ফ্রি আমেরিকা’র প্রধান, একজন অনড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সারা জেফারসনের এমন বেদনার্ত মুখ সে আশা করেনি। কোন সাহায্য-সহায়তাকারীর জন্যে এই বেদনা স্বাভাব্কি নয়। সারা জেফারসন যা বলল, এটা সেই আপনজনদের উদ্বেগ বেদনার মতো। ভ্রু কুচকে উঠল আলাইয়া অ্যানজেলার। তাহলে কি কোন সম্পর্ক….। চিন্তাটা সম্পূর্ণ করার সাহস হলোনা তার। কিন্তু মন থেকে তার আরেকটা প্রশ্ন মাথা তুলল, এফবিআই ও পুলিশের সাথে সারা জেফারসন কেন এসেছেন? সাহস তার ফিরে এল। অসম্ভব কি! একদিকে আমেরিকার একটি শ্রেষ্ঠ বনেদী পরিবার, অন্যদিকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এক ব্যক্তিত্ব।
অ্যানজেলা এসব চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল।
সারা জেফারসনই আবার প্রশ্ন করল, ‘ওঁর জ্ঞান কোথায় কতক্ষণে ফিরেছিল?’
সারা জেফারসনের কথায় সম্বিত ফিরে পেল আলাইয়া অ্যানজেলা। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। সেই গম্ভীর বেদনার্ত মুখ।
চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল অ্যানজেলা, ‘সে এক মজার কথা ম্যাডাম।’
বলে অ্যানজেলা আহমদ মুসার জ্ঞান ফেরা, তার সাথে কথা সবকিছু সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত দুরদৃষ্টির মানুষ! সামনে কি ঘটলে কি করবেন তা নিখুঁতভাবে ঠিক করে রাখতে পারেন। সেই সাথে দারুণ বিনয়ী একজন ভদ্রলোক।’
‘হ্যা, অ্যানজেলা, তাঁর শত্রুরাও তার প্রশংসা করেন।’ বলল সারা জেফারসন। সারা জেফারসনের কণ্ঠ অসীম শ্রদ্ধায় সিক্ত।
শ্রদ্ধাসিক্ত কণ্ঠ অন্তর স্পর্শ করল অ্যানজেলার! তার মনে হলো, অপার ভালোবাসার ভিত্তি ছাড়া কারো মনে এমন শ্রদ্ধা সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু এই পরিবেশে এমন বিষয়ে ইংগিতেও কোন কথা বলা যাবে না চিন্তা করে অ্যানজেলা অন্য প্রসংগ টেনে বলল, ‘জনাব আহমদ মুসা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কি হয়েছে, কি হতে পারে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। একজন মানুষ এভাবে লা-পাত্তা হয়ে যেতে পারে কেমন করে?’
‘কিছুই বুঝা যাচ্ছে না অ্যানজেলা। কিন্তু একটা বিষয় আমি বলতে পারি সেটা হলো, এসব ক্ষেত্রে তিনি যখন কোন কাজ করেন, তখন পরবর্তী কাজটা কি হবে তাও চিন্তা করে রাখেন।’ বলল সারা জেফারসন।
‘সে কাজটা কি সেটাই বুঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, নদীর স্ক্যানিং থেকে কি পাওয়া যায়।’
খাড়ির এ প্রান্তে পৌছে গেছে তারা।
নদীর তীর ঘেষে রেস্ট হাউজ। এক্সিট রোডটা তার সামনে দিয়ে।
রেস্ট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে জর্জ আব্রাহামের গাড়ি।
তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল অ্যানজেলার গাড়ি ও পুলিশ ভ্যান।
‘আপনার আর্জেন্টিনা যাওয়া কি চূড়ান্ত?’ বলল ফোম (আর্মি অব ম্যান’স ফিউচার) এইচ থ্রি (হ্যান্ড অব দ্যা হাই হ্যান্ডস )-এর নির্বাহী প্রধান ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।
‘হ্যা, চুড়ান্ত। আমাকে কয়েকদিন বাইরে থাকতে হবে।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার, ফোম ও এইচ থ্রি-এর প্রধান ও গড ফাদার।
‘কিন্তু হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের আমি কারণ বুঝতে পারছি না। আমরা সাংঘাতিক একটা জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়েছি। বড় বড় সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন হবে। এই সময় আপনার অনুপস্থিতির কথা আমরা চিন্তাই করতে পারছি না।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে ক্যানিংহাম।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘কি ঘটনা স্যার?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘তুমি জান, আমাদের বাড়ির সিকিউরিটিকে বলে এসেছিলাম পুলিশ আসবে অসুস্থ লোকটিকে নিতে, তাদের সাহায্য করো। পুলিশের বেশে আমাদের লোকেরা সেখানে পৌছার আগেই আহমদ মুসাকে নিয়ে আমার মেয়ে চলে যেতে চেষ্টা করে। আমাদের পুলিশের বেশধারী লোকরা তাকে গেটে পেয়ে যায়। কিন্তু আমার মেয়ে অন্য পথ ধরে সরে পড়তে সক্ষম হয়। এ থেকে আমার কাছে পরিষ্কার, আমার মেয়ে হয় কোনওভাবে কিছু জানতে পেরেছে বা সন্দেহ করেছে। সবচেয়ে বড় ঘটনা এফবিআই প্রধান একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। আমার গেটের সিকিউরিটি, আমি তাদের যা বলেছিলাম, সব এফবিআই প্রধানকে বলেছে। তার উপর আমার মেয়ের সাথে এফবিআই প্রধানের দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এফবিআই প্রধান সব জেনে ফেলেছে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘কিন্তু স্যার, আমি তো এতে কোন দোষ দেখছি না। পুলিশের পরিচয়ে কেউ যদি আপনাকে টেলিফোন করে আপনার হেফাজতের কোন লোক তাদের আসামী বা অন্য কিছু দাবী করে, আপনি যদি তাকে বিশ্বাস করে ঐ ধরনের নির্দেশ দেন, তাতে দোষের কিছু নেই।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘ঘটনা ঐটুকু হলে তো কোন কথা ছিল না। ঘটনা তা নয়। আমার মেয়ে আহমদ মুসাকে নিয়ে চলে যাবার পর আমি বাড়ি ফিরি। আমাদের বাড়ির সিসিটিভি’র ভিডিও চিত্রও চেক করি। চেক করতে গিয়ে দেখতে পাই আমি তোমার সাথে পুলিশের ছদ্মবেশে আমাদের লোক পাঠানোর কথাসহ যা বলেছিলাম, তার প্রায় সবই আমার মেয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে। আর এই বিষয়টা কারও কাছে গোপন নেই। কথাগুলো এফবিআই প্রধানকে সে বলে দিতেই পারে। আর ….।’
শিমন আলেকজান্ডারের কথার মাঝখানেই কোহেন ক্যানিংহাম বলল, ‘মেয়ে কি তার বাপকে এইভাবে বিপদে ফেলতে পারে?’
‘পারে কোহেন। আমেরিকার তরুণদের সংগঠন ‘ফ্রি আমেরিকা’র সদস্য সে। তুমি তো জান, ফ্রি আমেরিকানরা দেশপ্রেমের কাছে কোন কিছুকেই স্থান দেয় না। দেশপ্রেমের দাবির কাছে ওরা কোন সম্পর্ককেই বড় করে দেখে না। সুতরাং তার কাছে কি আশা করতে পারি, বুঝতেই পারছ।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘কিন্তু আমি শুনেছি স্যার, এই সংগঠনটি নাকি এখন আর অ্যাকটিভ নেই।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘সম্প্রতি আবার অ্যাকটিভ করা হয়েছে। এর পেছনে নাকি সরকারেরই গোপন হাত আছে। সরকার চান তরুণদের এমন একটা সংগঠন দেশে সক্রিয় থাকা দরকার।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘ও গড!’
বলে একটা দম নিয়েই কোহেন ক্যানিংহাম আবার বলল, ‘স্যার, তাহলে পরিস্থিতি কি দাড়াচ্ছে?”
‘বলেছি তো, আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অথবা কিডন্যাপকারীদের আমি জানি, তাদের সাহায্যও করেছি। সুতরাং আমাকে গ্রেফতার করার জন্যে তারা প্রথমেই ছুটে আসবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘আলাইয়া অ্যানজেলার কথায় সরকার আমাদের কতটুকু জানতে পারবে? কতটুকু ক্ষতি হবে আমাদের?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘আমাকে আইডেনটিফাই করা ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষতি হয়নি এখনও। আহমদ মুসা ওদের কাছে ফিরতে পারলে, সেটা হবে আমাদের সর্বনাশা ক্ষতি।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘আহমদ মুসাকে এখনও তো ওরা খুঁজে পায়নি?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘না, খুঁজে পায়নি। প্রায় গোটা রক ক্রিক নদীটাকেই তারা স্ক্যান করেছে, নদী থেকে উপরে উঠে আসার সম্ভাব্য সব জায়গা তারা পরীক্ষা করেছে। কিন্তু নদীর ভেতরে কিংবা নদী থেকে পাড়ে ওঠার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি। নদীতে তার জুতা ও জ্যাকেট পাওয়া গেছে মাত্র।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘বুঝা যাচ্ছে আহমদ মুসা শরীরকে হাল্কা করার জন্যে জুতা ও জ্যাকেট খুলে ফেলেছিল। কিন্তু সে গেল কোথায়? একটা মানুষ তো হাওয়া হয়ে যেতে পারে না?’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেছে। স্ক্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেই সময় নদীতে টিউব সাবমেরিন চলার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই টিউব সাবমেরিনে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিরা গোপনে চলাফেরা করে থাকে। এ ধরনের কোন সাবমেরিন তাকে তুলে নিতে পারে। এ ধরনের চিন্তা এফবিআই করছে। আবার এ চিন্তাও করা হচ্ছে, নদীতে পড়ার সময় আহমদ মুসা গুরুতর আহত হয়। জুতা ও জ্যাকেট খুলে হালকা হয়ে সে বাঁচার চেষ্টা করে, কিন্তু সফল হয়নি। পাহাড়ী নদীর স্রোত আহত আহমদ মুসাকে পটোম্যাকে টেনে নিয়ে গেছে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
মুখে কিছুটা প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠল কোহেন ক্যানিংহামের। বলল, ‘ভালো হয়, আমরা মহাবিপদ থেকে বেঁচে যাই যদি দ্বিতীয় চিন্তা সত্য হয়। আচ্ছা, টিউব সাবমেরিন যদি তাকে তুলে নিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কি? কার হাতে সে পড়তে পারে?’
‘তুমিও জান, আমাদের কিছু ইনল্যান্ড রিভারে টিউব সাবমেরিন চলে থাকে। এর মধ্যে কিছু এফবিআই-এর সাবমেরিন আছে, আর কিছু আছে বেসরকারি রেজিস্টার্ড ফার্মের। এ প্রাইভেট টিউব সাবমেরিনের নিয়ন্ত্রণও অনেকটা সরকারের হাতে। প্রতিদিনের রুট ও যাত্রী সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হয় সরকারের কাছে। তাছাড়া গোপন খবর হলো, অপরিচিত ও বৈধ রেজিস্ট্রি ছাড়া দু’একটা টিউব সাবমেরিনও এসব নদীতে যাতায়াত করে। সরকারি সাবমেরিন তাকে তুলে নিলে তখনই খবর হয়ে যেত। প্রাইভেটগুলো যদি তুলে নিয়ে থাকে, তাহলে অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকার তা জানতে পারবে। কিন্তু অপরিচিত কোন টিউব সাবমেরিন তাকে তুলে নিয়ে তারা এটা গোপন রাখতে পারে, যদি তারা প্রয়োজন দেখে।’ শিমন আলেকজান্ডার বলল।
‘অপরিচিত টিউব সাবমেরিন কাদের হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা কোহেন ক্যানিংহামের।
‘এ প্রশ্ন করছ কেন? তুমি জান না?’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।
‘মিলিয়ে নিতে চাচ্ছি স্যার। মাফ করবেন।’
বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
হাসল শিমন আলেকজান্ডার। বলল, ‘এটা মনে করা হয় বৈরী কোন দেশ, কোন গোপন সংগঠণ, বৈরী কোন গোয়েন্দা সংস্থারও হতে পারে অপরিচিত টিউব সাবমেরিনগুলো।’
‘গড আমাদের সাহায্য করুন। আহমদ মুসা বৈরী কারও হাতে পড়লে আমাদের জন্যে ভালো হয়। আহমদ মুসা দীর্ঘ আট ঘণ্টাতেও উদ্ধার না হওয়া কি এদিকেই ইংগিত দিচ্ছে না।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘কিছুই বলা যাচ্ছে না কোহেন।’
কথা শেষ করে মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কোহেন ক্যানিংহামের দিকে চেয়ে শিমন আলেকজান্ডার বলল, ‘এসব আলোচনা পরেও করা যাবে। এস এবার কাজের কথায় আসি।’
শুরু করল শিমন আলেকজান্ডার সামনে দোরগোড়ায় আমাদের জন্যে গুরুতর সংকট। অথচ আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। বোধ হয় সে সময় আমরা পাচ্ছি না। ভালো করে শোন, আমাদের জন্যে সামনে দু’টো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আহমদ মুসা যদি সরকারের কাছে পৌছে যায়, সরকার যদি তাকে পেয়ে যায়, তাহলে সরকার সব জেনে ফেলবে। সেক্ষেত্রে আমাদের গোটা আয়োজন ধ্বংসের মুখে পড়বে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। তার আগেই আমাদের আঘাত করতে হবে। সরকারের সাথে আহমদ মুসার দেখা হওয়ার সাথে সাথেই মার্কিন সকল সাইলো ও অস্ত্রভাণ্ডারকে টার্গেট করে আমাদের ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে সরকারের পদক্ষেপগুলোর দিকে। ওরা আমাদের উপর আঘাত হানার আগে আমরা আঘাত হানব ওদের উপর। আমাদের MFW-এর ট্রিগারগুলো একসাথে টিপা হবে, যাতে দ্বিতীয় চিন্তার তারা কোন সুযোগ না পায়। মুহূর্তেই ওদের সাইলো ও অস্ত্রভাণ্ডারকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, আহমদ মুসাকে সরকার যদি খুঁজে না পায়, তাহলে বলা যায় আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে যাব। আমাদের পরিকল্পনা সরকারের অজানাই থেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাজ যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলবে। শুধু রক ক্রিকের জংগল এলাকার আমাদের অফিস হেড কোয়ার্টারটা ধ্বংস করে আমাদের ভিন্ন জায়গায় সরে যেতে হবে। কারণ সাবধানের মার নেই। সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসা যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, সে জায়গাটা আমাদের হেড কোয়ার্টারের খুবই কাছে। আরেকটা কথা শোন, আমার বিষয় নিয়ে তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। আহমদ মুসা যদি ফিরে যেতে না পারে সরকারের কাছে, তাহলে তেমন কোন সমস্যা নাও হতে পারে আমার। বিষয়টা আমার ফ্যামিলিই ডিল করতে পারবে।’
থামল শিমন আলেকজান্ডার।
‘স্যার, এসবই বড় বড় সিদ্ধান্ত। প্রত্যেকটারই ফলোআপ আছে। বিশেষ করে প্রথম অপশনে আমরা যদি যাই, তার পরবর্তী পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ ও দ্রুত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘কেন, এসব তোমার জানা নেই?’ শিমন আলেকজান্ডার বলল একটু শক্ত কণ্ঠে।
‘হ্যাঁ, জানা আছে স্যার। কিন্তু দেশপ্রেমিকের সংখ্যা স্যার নব্বই ভাগ। সব চিন্তা সামনে রেখেই আমাদের এগোতে হবে। কোন ভুল করা যাবে না। এ জন্যেই আমার সতর্কতা।’ বলল কোহেন ক্যানিংহাম।
‘ধন্যবাদ কোহেন। সতর্কতা ভাল। কিন্তু সতর্কতা যথা সময়ে কাজ করার ক্ষেত্রে যেন বাঁধা সৃষ্টি না করে। আমরা যা করতে যাচ্ছি তা যুগান্তকারী, দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন। নজিরবিহীন এই ঘটনা পৃথিবীতে একদিন আমাদের আগমনকে অবধারিত করে তুলবে। তুমি ঠিকই ………..।’
কথা শেষ করতে পারল না শিমন আলেকজান্ডার। তার ওয়্যারলেস বিপ বিপ করতে শুরু করেছে। কথা তার বন্ধ হয়ে গেল।
ওয়্যারলেস মুখের কাছে এনে বলল শিমন আলেকজান্ডার, ‘বল জ্যাকব।’
‘স্যার, রক ক্রিক নদী অঞ্চলে আহমদ মুসাকে খোঁজার কাজ তারা পরিত্যাগ করেছে। আমাদের ইনফরমার এইমাত্র আমাকে জানালো, এফবিআই এবং হোয়াইট হাউস মনে করছে, আহমদ মুসা অবশ্যই বেঁচে আছে। কিন্তু সে কোন বৈরি শক্তির হাতে পড়েছে, অথবা সাংঘাতিক অসুস্থ বা আহত অবস্থায় কেউ তাকে উদ্ধারও করে থাকতে পারে। সুতরাং তারা আগের মতোই অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে। বলল ওপার থেকে জ্যাকব নামের লোকটি।
‘সুখবর জ্যাকব। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। সে যদি কোন বৈরি শক্তির হাতে পড়ে থাকে তাহলে সবচেয়ে ভাল। অসুস্থ অবস্থায় যদি কারও আশ্রয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে হাতে কিছু সময় পাব। যাক, আর কোন খবর?’ শিমন আলেকজান্ডার।
‘স্যার, এফবিআই রক ক্রিক ও পটোম্যাক নদী দিয়ে ঐ দিন ঐ সময় চলা সব টিউব সাবমেরিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তারা প্রাইভেট সাবমেরিনকেই বেশি সন্দেহ করছে।’ জ্যাকব নামের সেই লোকটি বলল।
‘ধন্যবাদ জ্যাকব। তোমার পরবর্তী খবরের জন্য অপেক্ষা করব।’ ওভার।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।
ওয়্যারলেস রেখে শিমন আলেকজান্ডার তাকালো কোহেন ক্যানিংহামের দিকে। বলল, ‘কোহেন, ওরা চেষ্টা করছে আহমদ মুসাকে খুঁজে পাবার জন্যে। আর আমরা আহমদ মুসাকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় চাই, এটা আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন। ঈশ্বর আমাদের কিছুটা সুযোগ দিয়েছেন আহমদ মুসাকে সরকারের হাতে পড়তে না দিয়ে। এর পুরো সদ্ব্যবহার আমাদের করতে হবে।’
‘অবশ্যই স্যার। আমাদের অনুসন্ধানী দল এখানো মাঠে। আমরা আরও তৎপর হবো। কিন্তু একটা বিষয় স্যার, আহমদ মুসাকে সরকার খুঁজে পেয়েছে, এটা যদি জানতে না পারি?’ কোহেন ক্যানিংহাম বলল।
‘কেন জানা যাবে না? সারা জেফারসনের বাড়ি, হোয়াইট হাউজ এবং এফবিআই হেড কোয়ার্টার সব জায়গায় আমাদের লোকেরা সক্রিয় রয়েছে। সারা জেফারসনের বাড়িতে আমাদের লোক নেই বটে, কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এমন এক জায়গায় তারা রয়েছে, যেখান থেকে ও বাড়িতে কে আসছে, কে যাচ্ছে, কি হচ্ছে সব মনিটর করতে পারবে। আহমদ মুসা ফিরে এলে এই তিন জায়গায় খবর হবেই। সুতরাং তারা খবর না পাওয়ার কারণ নেই কোহেন।’ বলল শিমন আলেকজান্ডার।
কথা শেষ শোন কোহেন, সরকার আমাদের বিষয় জানতে পেরেছে সন্দেহ হলেই মুহূর্ত দেরি না করে MFW- কে অ্যাকটিভেট করে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাবে। তুমিই তো ব্যবস্থা করেছ, দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকাল অ্যাকটিভেশনের ব্যবস্থা ব্যবস্থা ছাড়াও জরুরি সময়ের জন্যে সব লোকাল MFW- এর কেন্দ্রীয় অ্যাকটিভেশনের ব্যবস্থা আছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই। এক অপারেশন রুমে বসেই সব সাইলোতে থাকা মোতায়েন করা সব শক্তি গুড়ো করে দিতে পারবো আমরা। তারপর সরকার ও প্রশাসনে যে কম্পন শুরু হবে, তা থামার আগেই দেখা যাবে FOAM ওভাল অফিস দখল করে বসেছে। তখন আহমদ মুসার বাবাও কিছু করতে পারবে না। আমরা তাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাব। ঈশ্বর আমাদের সে সুযোগ দাও।’
কথা শেষ করেই ‘গুড ইভিনিং’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল শিমন আলেকজান্ডার।