৫৪. আবার আমেরিকায়

চ্যাপ্টার

পার্বত্য নদীটা খুব প্রশস্ত নয়।

খরস্রোতা হলেও স্রোতের অনুকুলে চলে নদীর ওপাড়ের ছড়াটায় পৌছতে আহমদ ‍মুসার খুব অসুবিধা হয়নি।

ছড়াটার মুখে পৌছে আহমদ মুসাকে একবার মাথা পানির উপর তুলতে হয়েছিল শ্বাস নেয়ার জন্যে। কিন্তু সেদিকে কারও চোখ যায়নি। হেলিকপ্টার ও নদীর পাড়ে যে কয়জন ছিল তাদের চোখ নিবদ্ধ ছিল গাড়ির দিকে ও নদীর উপর। আহমদ মুসা এমনটাই আশা করছিল।

দ্বিতীয় ডুব দিয়ে ছড়ার অনেক ভেতরে ঢুকে গেল আহমদ মুসা।

ছড়াটা আধা মাইলের মতো ভেতরে ঢুকে গেছে। তিনদিকেই খাড়া পাহাড়।

কিন্তু সব পাশ সমান উঁচু নয়।

পাহাড়ের মাথায় সবুজ বন।

বড় ব্ড় গাছও দেখা যাচ্ছে।

তিন দিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না মিলে হৃদের মতো এই খাড়ির সৃষ্টি করেছে। খাড়িটা নদীর সাথে মিশেছে। খাড়িটা গভীর।

আহমদ মুসা সাঁতরে শেষ প্রান্তে গিয়ে কুলে উঠল।

পানি পড়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে খাঁজের সৃষ্টি করেছে। খাঁজগুলো দেখতে প্ল্যাটফরমের মতো। ডান পাশটায় বড় একটা প্ল্যাটফরমের মতো দেখে সেখানেই উঠল আহমদ মুসা। প্ল্যাটফরমে উঠে বসে বিস্মিত হলো সে। প্ল্যাটফরমটা ভিজা বটে, কিন্তু তেমন একটা শেওলা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মে-জুনে এমনটা কল্পনা করা যায় না।

একটু জিরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা সামনে পাহাড়ের দিকে তাকাল। একদম খাড়া পাহাড়। এই পাহাড় ডিঙিয়ে তাকে উপরে উঠতে হবে। কিভাবে উঠবে? একে খাড়া, তার উপর পিচ্ছিল।

ওদিকে আশার কিছু না দেখে আহমদ মুসা ঘুরে বসে পেছনে পাহাড়ের দেয়ালের দিকে তাকাল। প্রায় হাতের নাগালের কাছে ওপর থেকে কয়েকটা শিকড় নেমে এসেছে দেখল। উপরে তাকিয়ে দেখল পাহাড়ের শীর্ষে অচেনা এক বিশাল বৃক্ষ। তারই কয়েকটা শিকড় নিচে নেমে এসেছে। সম্ভবত পাহাড়ের গা ক্ষয়ে যাওয়ায় শিকড় কয়েকটা আলগা হয়ে পড়েছে।

খুশি হলো আহমদ মুসা।

এগোলো শিকড়ের কাছে। হাত লাগাল শিকড়ে। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্ল্যাটফর্মের মতোই শিকড় একেবারে মসৃণ এবং প্রায় শেওলামুক্ত। উপরে তকিয়ে মোটা শিকড়ের সবটাই এ রকম মসৃণ মনে হলো।

কিন্তু প্ল্যাফরম ও শিকড় এমন শেওলা মুক্ত কেন?

শিকড়ের কাছ থেকে সরতে গিয়ে আহমদ মুসা নিচের পাথরের উপর চোখ পড়তেই সুতার মতো প্লাস্টিকের খণ্ড দেখতে পেল।

খণ্ডটা হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। নেড়ে-চেড়ে দেখে বুঝল প্লাস্টিকের দড়ির অংশ, কোনওভাবে দড়ি থেকে খসে পড়েছে।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। তার মানে মানুষ এখানে এসেছে বা আসে? এই শিকড় দিয়েই কি তারা নামে? এই প্ল্যাটফরম কি তারাই ব্যবহার করে? কিন্তু কষ্টকর শিকড় ব্যবহার করে কেন, প্রাচীন যুগের মানুষের মতো? আধুনিক মানুষের কাছে তো অনেক রকম ব্যবস্থা রয়েছে।

আহমদ মুসা তার মনের এই প্রশ্নের কোন সমাধান পেল না।

তবে খুশি হলো আহমদ মুসা। উপরে উঠার একটা অবলম্বন সে পেয়ে গেল।

শিকড় বেয়ে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। বিশার গাছ।

শিকড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে, গাছের গোড়াটাও বেশ বিস্তৃত হবে।

উপরের মাথায় পৌছে গেছে আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার মনে নানা প্রশ্ন কি আছে উপরে? যারা উঠা-নামা করে তাদের কেউ থাকে এখানে? কারা ওরা? কোন কালোবাজারি? কোন ভয়ংকর ধরনের ক্রিমিনালদের গোপন আস্তানা? যারাই হোক ভালো মানুষ হবে না তারা। অথবা হতে পারে এখানে কেউ থাকে না। এ গোপন পথে উঠে দূরে অন্য কোথাও যায়।

আহমদ মুসা শিকড় বেয়ে গাছের গোড়ার প্যারালালে এসে দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা তুলল উপরে দেখার জন্যে।

উপরে চোখ পড়তেই আকস্মিক বিপদের একটা গরম স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার শরীরে। দেখল সে, মুখোশ পরা তিনজন মানুষ। তাদের রিভলবার তাক করা আহমদ মুসার দিকে।

ওদের আকার-আকৃতি ও পোশাক দেখে বুঝল আহমদ মুসা ওদের একজন বয়ষ্ক, একজন যুবক ও একজন তরুণী।

আহমদ মুসা এক হাতে ভর দিয়ে মাথা ‍উপরে তুলেছিল। ঐ অবস্থাতেই আহমদ মুসা পা’দুটিকে গুটিয়ে তুলে নিয়ে প্রথমে শিকড়ের উপর বসল এবং ওদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা কে আমি জানি না? কিন্তু আমি আপনাদের শত্রু নই।’

‘তাহলে এখানে কেন এসেছেন?’ পরিষ্কার উচ্চারণে বলল বয়ষ্ক লোকটি।

‘আমি এখানে আসিনি, ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। উপরে উঠে সমভূমিতে, মানে কোন রকমে রাস্তায় পৌছার একটা পথ পাব, এই আশায় এখানে উঠেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘মিথ্যা বলবেন না। সমভূমি থেকে উঠে এলেন দুর্গম পাহাড়ে সমভূমিতে নামার জন্যে, এটা হাস্যকর।’ সেই বয়ষ্ক লোকটিই বলল।

‘হ্যা, কথাটা হাস্যকরই মনে হচ্ছে। আসলে ঘটনাটা হলো, তাড়া খেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। নদী নিরাপদ নয় ভেবে ওদের চোখ এড়িয়ে খাড়িতে প্রবেশ করি। তারপর নিরাপদ সরে পড়ার পথের খোঁজেই গাছের শিকড় বেয়ে উপরে উঠেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনি কে? কে বা কারা কেন আপনাকে তাড়া করেছে?’ সেই বয়ষ্ক মানুষটি বলল।

‘সবই জানতে পারবেন। সব কথা এখনই কি না জানলে নয়? আমার এই কথাগুলি যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে ঐ কথাগুলো শুনলেও কোন লাভ হবে না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনাকে দেখে মনে হয় বিশ্বাস করা যায়। কথাও মনে হচ্ছে সাজানো নয়। ‘

বলেই বয়ষ্ক লোকটি যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বেটা, যাও ওকে সার্চ করো।’

যুবকটি তার হাতের রিভলবার বয়ষ্ক লোকটির হাতে দিয়ে আহমদ মুসার কাছে এলো।

আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল এবং মাথার উপরে হাত তুলল সার্চের সুবিধার জন্যে।

আহমদ মুসাকে সার্চ করে কিছুই পেল না।

‘ঠিক আছে বাবা, সাথে কিছুই নেই। টাকা-পয়সার মতোও কিছু নেই বাবা।’ বলল যুবকটি তার বাবাকে লক্ষ করে।

‘ধন্যবাদ জনাব, আসুন।’ বলল বয়ষ্ক লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে। তার চেহারা এখন অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ তার কেটে যাচ্ছে। সে ভাবছিল, শত্রু কেউ এভাবে একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আসতে পারে না। কিন্তু একটা বিস্ময় তার যাচ্ছে না। সেটা হলো, শিকড় বেয়ে এই উপরে উঠার এই পথের সন্ধান পেল কি করে লোকটি? এই রকম ভাবতে গিয়ে তার মনে হলো, লোকটি অসাধারন বুদ্ধিমান শুধু নয়, অত্যন্ত কুশলী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নও। আমাদের তিনটি রিভলবারের মুখে অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক ছিল সে। এমনটা সাধারণভাবে থাকা খুবই অস্বাভাবিক।

আহমদ মুসা গাছের গোড়া থেকে নেমে বয়ষ্ক লোকটির দিকে আসছিল।

আহমদ মুসা পানি থেকে উঠে এসেছে। তার পরনের কাপড়-চোপড় সব ভিজা। শরীরকে হাল্কা ও দ্রুত করার জন্য জ্যাকেট ও জুতা নদীতেই খুলে রেখে এসেছিল।

বয়ষ্ক লোকটি তাকাল তার পাশের তরুণীটির দিকে। বলল, ‘মা তুমি যাও। ওর পরনের মতো এক প্রস্থ কাপড় নিয়ে এসে। উনি ভিজা কাপড়ে আছেন।’

‘মেয়েটি তার হাতের রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে রেখে চলল পেছনের ঝোঁপের দিকে।

যেখানে বৃদ্ধরা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা পাহাড়ের স্বল্প-পরিসর একটা চত্বর। ছোট-খাট আগাছায় ভরা। কিন্তু তার পেছনেই ঘন ঝোঁপ এবং অপেক্ষাকৃত বড় গাছের ঘন বন। তার পেছনেই খাড়া পাহাড়। পাহাড়ও গাছ-গাছড়ায় ঢাকা। আর বারান্দার মতো চত্বরটার সামনে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে সেই খাড়ির পানি পর্যন্ত। সব মিলিয়ে জায়গাটা এমন যে এখানে মানুষের বসবাস কল্পনা করা যায় না। তাহলে এরা থাকেই বা কোথায়? এদিকে গভীর খাদ, আর ওদিকে খাড়া এবং অনেক উঁচু পাহাড়। মাঝখানে এই অল্প জায়গায় তো বাড়ি-ঘরের কোন চিহ্ন নেই।

আহমদ মুসা বয়ষ্ক লোকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে বলল, ‘যুবক, আমি নুহা ইউসেফ। তোমাকে সাথে নিয়ে এল সে আমার বড় ছেলে ডেভিড। আর যে মেয়েটিকে দেখলে সে আমার একমাত্র মেয়ে মারফি। তুমি….।’

কথা শেষ করতে পারল না নুহা ইউসেফ, বয়ষ্ক সেই লোকটি।

ঝোঁপের দিক থেকে ছুটে এল বয়ষ্ক লোকটির সেই মেয়ে, মেরি মারফি। তার হাতে প্যান্ট, শার্ট।

কিন্তু কাপড়ের প্রসঙ্গে না গিয়ে মেরি মারফি দ্রুত কণ্ঠে বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘বাবা, তোমার রিভলবারটা দেখতো লাইভ আছে কি না?

নূহা ইউসেফের চোখে-মুখে বিস্ময়! মেয়ের দিকে একবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করল।

রিভলবারটা সাধারণ নয়, লেজার ফায়ারড রিভলবার। এখানে রিভলবারের শব্দ নিরাপদ নয়, এজন্য নিঃশব্দ অথচ ভয়ংকর অস্ত্র তারা ব্যবহার করে। রিভলবার হাতে নিয়েই রিভলবারের দিকে তাকিয়ে নুহা ইউসেফ বলল, ‘না মারফি রিভলবার ডেড।’

‘হ্যাঁ বাবা, শুধু আমাদের রিভলবার নয়, আমাদের ইলেক্ট্রনিক সবকিছু অকেজো হয়ে পড়েছে।’ বলল মেরি মারফি।

‘তাহলে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আজ আবার?’ নূহা ইউসেফের ছেলে ডেভিড বলল।

‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। কিন্তু এমন হচ্ছে কেন?’ বলল নুহা ইউসেফ। তার কণ্ঠ শুকনো।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। চট করে আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল ‘ফোম’ নামের গোপন সংগঠনটির গবেষণা উইং এইচ কিউব-এর ম্যাগনেটিভ ডেথ ওয়েভ-এর কথা, যা ইলেক্ট্রনিক ও প্রক্রিয়াজাত ম্যাটারের যে কোন বিস্ফোরণধর্মী অস্ত্রসহ সব যন্ত্রপাতি অচল করে দিতে পারে। কিন্তু তাদের এই অস্ত্র তো ব্যবহার উপযোগী হয়নি। আবার ভাবল আহমদ মুসা, তা ছাড়া অন্য কারনেও তো এদের এখানে এমনটা ঘটতে পারে। তবে ব্যপারটা তার দেখা দরকার।

‘জনাব, আমার খুব বিস্ময় লাগেছে ! আমি কি দেখতে পারি কি কি জিনিস অচল হয়ে পড়েছে?’ বয়স্ক লোক নুহা ইউসেফের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।

‘হ্যাঁ যুবক, ব্যাপারটা বিস্ময়ের ! অবশ্যই আপনি দেখতে পারেন। কিন্তু তার আগে শুকনো কাপড় পরে নিন।’ বলল নুহা ইউসেফ।

মারফি তার হাতে নিয়ে ডেভিড আহমদ মুসাকে বলল, ‘আসুন।’

মারফি যে দিকে গিয়েছিল, ডেভিড আব্রাহাম সেদিকে নয়, অন্যদিকে চলল। লব্মা লব্মা গাছের ভেতর দিয়ে কিছু ঝোপ-জঙ্গল এড়িয়ে এগিয়ে খাড়া পাহাড়ের গোড়ায় পৌছল।

পাহাড়ের দেয়াল এখানে মোটামুটি মসৃণ। ডেভিড সামনের দেয়ালের এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো। দেয়ালটা এক জায়গায় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাম দিকে স্লাইড করল।

সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে একটা অংশ সরে গেল। একটা দরজা উন্মুক্ত হয়ে পড়ল।

ভেতরটা আলোক ‍উজ্জল।

ডেভিড আব্রাহাম। ভেতরে ঢুকল। বলল, ‘আসুন স্যার।’

আহমদ মুসা মনে করেছিল ভেতরটা একটা গুহা। কিন্তু গুহার চেয়ে ভালো কিছু। ভেতরটা আয়তাকার কক্ষ। দেয়ালটা মোটামুটি মসৃণই। ঘরে শোবার একটা খাট এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রয়েছে।

‘ডেভিড, শুনলাম ইলেকট্রনিক সব ম্যাকানিজম নষ্ট হয়ে গেছে! এ ঘরে যে আলো দেখছি?’ বলল আহমদ মুসা।

‘এটা গ্যাস বাল্ব স্যার।’

কথাটা শেষ করেই ডেভিড বলল, ‘স্যার, আপনি কাপড় পাল্টে নিন। আমি আসছি।’

কাপড় আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বেরিয়ে এল ডেভিড।

ভিজা কাপড় ছেড়ে ওদের শুকনো কাপড় পরে আহমদ মুসা ঘরের চারদিকে তাকাল। ঘরে ইলেকট্রনিক বা মেটালিক কিছুই দেখল না।

দরজায় নক করল আহমদ মুসা। ঘরে প্রবেশ করল যুবক ডেভিড। বলল, ‘আসুন।’

আহমদ মুসা ও ডেভিড বেরিয়ে এসে ডেভিডের পিতা নুহা ইউসেফ এর সামনে দাঁড়াল।

‘চলুন দেখি কি ঘটেছে, কি দেখতে চান।’ বলল নুহা ইউসেফ।

হাঁটতে শুরু করেছে নুহা ইউসেফ। তার পেছনে পেছনে আহমদ মুসা এবং আহমদ মুসার পেছনে ডেভিড ও মারফি।

স্লাইডিং দরজা ঠেলে একটা ঘরে প্রবেশ করল নুহা ইউসেফ। পেছনে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন, এটা আমাদের ইনফরমেশন এন্ড কম্যুনিকেশন রুম।’

ঘরটির দেয়াল বরাবর স্থান আলমারিতে ঠাসা। সারি সারি বই। ঘরের একপাশে দেয়ালের সাথে পাতা টেবিল বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। আর ঘরের মাঝখানে কয়েকটা চেয়ার এবং স্টাডি টেবিল।

‘জনাব বিদ্যুতের জন্য এখানে আমাদের নিজস্ব জেনারেটর আছে, গ্যাস সিলিন্ডারও আছে বিকল্প জ্বালানির জন্যে। আর আছে আমাদের নিজস্ব ওয়্যারলেস। আমাদের নিজস্ব ওয়েভ লেংথে আমাদের ওয়্যারলেস চলে। আমরা মোবাইল, টেলিফোন কিছুই ব্যবহার করি না। যোগাযোগর কাজ ওয়্যারলেসে চলে।’

একটু থামল নুহা ইউসেফ। পর মুহূর্তেই বলে উঠল, ‘আসুন, দেখুন সব কিছুই এখন অচল। আমাদের গ্যাস ব্যবহার সিস্টেমটা গোটাটাই প্লাস্টিকের বলেই আলো জ্বলছে। ইলেকট্রনিক, মেটারিক সবকিছুই এখন বিকল।’

আহমদ মুসা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। মেশিনগুলো স্পর্শ করে দেখল, কোন কোনটা খুলেও ভেতরটা দেখল। মেশিনগুলো যেন নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুটে খুটে দেখছিল আহমদ মুসা সব কিছু। মগ আকৃতির অনুচ্চ একটা পাথরের বাটির উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। তাতে দেখতে পেল কিছু আয়রন ডাস্ট। সে আরও দেখল, আয়রন ডাস্ট বাটির এক দিকে সুন্দরভাবে সরে এসেছে। আয়রন ডাস্টের সরে আসাটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল আহমদ মুসার। সরে আসাটা একদমই প্রাকৃতিক ধরনের, যেমন মরুভুমিতে বাতাসে বালির সরে যাওয়া। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। কিভাবে এমনটা ঘটল? বাতাসের ধাক্কা কিংবা অন্য কোনভাবে তো এটা সম্ভব নয়।

আহমদ মুসা তাকাল নুহা ইউসেফের দিকে। ডাকল তাকে।

নুহা ইউসেফ এল। তার সাথে এল ডেভিড আর মারফিও। আহমদ মুসা পাথরের বাটিটাকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল, সেটা তারাও খেয়াল করেছিল।

নুহা ইউসেফ কাছে এলে আহমদ মুসা বাটির আয়রন ডাস্টে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন, বাটির আয়রন ডাস্ট এভাবে বাটির এক প্রান্তে এল কি করে?’

নুহা ইউসেফ ওদিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, ‘আজ সকালেই আয়রন ডাস্ট বাটিতে ঢেলেছি। এমন তো ছিল না! কিন্তু আপনি এটা জানতে চাচ্ছেন কেন?’

আহমদ মুসা নুহা ইউসেফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আরেকটা জিনিস দেখুন মি. নুহা ইউসেফ। আমার মনে হচ্ছে আয়রন ডাস্টগুলো যেন সংকুচিত হয়ে গেছে। ডাস্টের যে ধারালো ক্যারেকটার থাকে তা নেই।’

নুহা ইউসেফ আয়রন ডাস্টে হাত দিয়ে দেখল। সত্যি ডাস্ট কণাগুলো আরও ছোট, আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। আর সত্যি মসৃণও হয়ে গেছে সেগুলো। যেন সেগুলো একটা প্রচণ্ড চাপে ডাস্ট-বল হয়ে গেছে। বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নুহা ইউসেফের ‍মুখ।

‘কিছুই বুঝতে পারছিনা জনাব। ডাস্টগুলোর এক প্রান্তে সরে আসা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিস্ময়কর ডাস্ট বলগুলো সংকুচিত হওয়া। কিন্তু এ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন। বিষয়টি আমার হয়তো নজরেই পড়তো না, আপনার নজরে পড়ল কেন?’ বলল নুহা ইউসেফ।

ভাবছিল আহমদ মুসা।

কিছুক্ষণ আগের সেই চিন্তাটআবার মাথায় এসে ভর করেছে। ওরা কি ‘কিং পিন’ কোনওভাবে পেয়ে গেছে, কিংবা তারা নিজেরাই তৈরি করেছে ফেলেছে? সে ওদের হাতছাড়া হওয়ার পর নিশ্চয় আতংকিত হয়ে পড়তে পারে যে, তাদের সব পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যেই ত্বরিৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই চিন্তা আতংকিত করে তুলল আহমদ মুসাকে। তাহলে তারা কি ব্যবহার করেই ফেলেছে তাদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভকে? নুহা ইউসুফের প্রশ্ন কানেই যাইনি আহমদ মুসার।

আহমদ মুসা দ্রুত ফিরে তাকালো নুহা ইউসেফের দিকে। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘আপনাদের ওয়্যারলেস তো অকেজো। কোনওভাবে কি শহরের কারও সাথে যোগাযোগ করা যায়?’

আহমদ মুসার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উত্তেজনা।

আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে নুহা ইউসেফ, ডেভিড ও মারফি সবার চোখে-মুখে বিষ্ময় ফুটে উঠল। তারা বুঝতে পারল না এমন ছোট একটা বিষয় নিয়ে তাদের মেহমান এতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কেন?

‘ওয়্যারলেস বন্ধ। আর কোন পথ নেই বাইরে যোগাযোগের। কিন্তু কেন, কি দরকার আপনার? আপনাকে উদ্বিগ্নও মনে হচ্ছে। কি ঘটেছে?’ বললু নুহা ইউসেফ।

আহমদ মুসার হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল এই ম্যাগনেটিক প্রভাব আগেরবার কতক্ষণ ছিল?

সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, ‘আগের বার আপনাদের ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা কতক্ষণ ছিল জনাব?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা নুহারে উদ্দেশ্যে।

‘মিনিট দশেকের মতো।’ বলল নুহা ইউসেফ।

‘তাহলে ওটা টেস্ট কেস ছিল।’ ভাবল আহমদ মুসা।

এবারেরটাও কি টেস্ট কেন হতে পারে? মিনিট পাঁচেক ইতিমধ্যে চলে গেছে। আর পাঁচ মিনিট পরে হয়তো জানা যাবে এটাও টেস্ট করেছে কিনা। আশা জাগল মনে, সে যে আশংকা করছে তা সত্য নাও হতে পারে। এই সাথে আরও একটা প্রশ্ন জাগল মনে, এটাও যদি একটা টেস্ট কসে হয়ে থাকে, তাহলে কেন এই দ্বিতীয় টেস্ট?

‘জনাব এর আগে একবার আপনাদের ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি বিকল হয়েছিল। তার সাথে বর্তমানে বিকল হওয়ার কোন পার্থক্য দেখছেন কি?’ বলল আহমদ মুসা।

ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠল নুহা ইউসেফের চোখে-মুখে। বলল একটু সময় নিয়ে, ‘হ্যাঁ জনাব। একটা পার্থক্য ইতিমধ্যেই আমার চোখে পড়েছে। এবার মেটালের আয়তন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। রিভলবারের ট্রিগার থেকে আয়রন ডাস্ট পর্যৃন্ত। কিন্তু জনাব এ বিষয়টা কি, কেন? মনে হচ্ছে বিষয়টাকে আপনি সিরিয়াসলি নিয়েছেন। প্লিজ বলুন, বিষয়টা কি?’ বলল নুহা ইউসেফ।

কথা শেষ হতেই তার চোখ গিয়ে আবার আটকে গেল আয়রণ ডাস্টের উপর। সে দেখল সংকুচিত আয়রণ ডাস্টগুলো আবার স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসছে। সংগে সংগেই সে বলে উঠল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, ‘দেখুন জনাব, আয়রণ ডাস্টগুলো স্বাভাবিক আকারে ফিরে এসেছে।’

আহমদ মুসা হাত দিয়ে নেড়ে দেখে বলল, ‘তােই তো ডাস্টগুলো তাদের আকার ফিরে পেয়েছে। দেখুন তো প্লিজ, আপনাদের রিভলবার, ওয়্যারলেস সক্রিয় অবস্থায় ফিরেছে কিনা। নিশ্চয় ফেরার কথা।

ডেভিড রিভলবার ও ওয়্যারলেস পরীক্ষা করে বলল, ‘না জবান, এগুলো এখনও সক্রিয় হয়নি। তবে সঙ্কুচিত সেই আকার এখন নেই।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। এ রকম হওয়ার অর্থ ! এক সাথেই সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার কথা।

চিন্তা করে কোন উত্তর এই মুহূর্তে পেল না আহমদ মুসা। চিন্তাতা আপাতত বাদ রেখে ফিরে এল নুহা ইউসেফের প্রশ্নে, ভাবল একটু আহমদ ‍মুসা। বলল, ‘বাইরে থেকে আসা ম্যাগনেটিক প্রভাবে এটা ঘটেছে।’

‘ম্যাগনেটিক প্রভাব? ইলেকট্রিক ও মেটালিক সব যন্ত্রপাতি অচল করে দিতে পারা এই ম্যাগনেটিক প্রভাব কোত্থেকে এল?’ বলল নুহা ইউসেফ। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘এসব কথা পরে হবে জনাব। দশ মিনিট নিশ্চয় হয়ে গেছে। আপনি প্লিজ দেখুন ওয়্যারলেস চালু হয়েছে কি না।’ আহমদ মুসা বলল।

নুহা ইউসেফ কিছু করার আগেই মারফি দ্রুত গিয়ে ওয়্যারলেস পরীক্ষা করে বলল, হ্যাঁ জনাব, ওয়্যারলেস চালু হয়েছে।’

তার মানে এবারও তারা দশ মিনিট পরেই ম্যাগনেটিক ওয়েভ অফ করেছে। আহমদ মুসা বলল, ‘ওয়াশিংটনের অন্য কোন এলাকায় প্লিজ ওয়্যারলেস করে একটু জানুন ঐ অঞ্চলে আজ ইলেকট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি অচল হয়েছিল কিনা এবং এর আগে কখনও অচল হয়েছে কিনা। হয়ে থাকলে দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল কিনা?’

নুহা ইউসেফ আহমদ মুসার দিকে একবার তাকাল। তার চোখে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু কোন প্রশ্ন না তুলে ডেভিডের দিকে চেয়ে বলল, ‘ডুপন্টে ওয়্যারলেস করো। ওটা কেন্দ্র এলাকা। দেখ কিছু ঘটেছে কিনা। তিনটা প্রশ্ন বুঝেছ তো?’

‘ইয়েস ড্যাড। আমি দেখছি।’

ডেভিড এগোলো ওয়্যারলেসের দিকে।

ওয়্যারলেস অন করে ডেভিড বলল, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে বাবা।’

বলে কল করল ডেভিড।

ওপারের সাথে ডেভিড আহমদ মুসার তিনটি প্রশ্নই তুলে ধরল।

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আমাদের এক আত্মীয়ের কাছে ওয়্যারলেস করেছিলাম। সে জানাল তাদের ইলেকট্রনিক ও মেটালিক যন্ত্রপাতি আজ অচল হয়নি, অতীতেও কোন সময় এক সাথে অচল হয়নি।’

‘হ্যাঁ, বুঝেছি ডেভিড।’ আনমনা কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। রাজ্যের চিন্তা এসে তার উপর চেপে বসল। তার অজান্তেই যেন তার কণ্ঠ থেকে স্বগত উক্তির মতো বেরিয়ে এল, ‘ওরা নির্দিষ্ট এলাকায় তাহলে লিমিটেড টেস্ট করেছে। হৈ চৈ ও তাদের সন্ধান এড়াবার জন্যে এর প্রয়োজন ছিল নিশ্চয়।’

আহমদ মুসা গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল।

আহমদ মুসার স্বগতোক্তিগুলো নুহা ইউসেফ, ডেভিড, মারফি সবারই কানে গিয়েছিল। কথার কিছুই বুঝতে পারল না। কিসের টেস্ট? কিসের হৈ চৈ? কার সন্ধান?

‘কি বলছেন স্যার, কিছুই বুঝতে পারছি না!’ বলল ডেভিড। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

আহমদ মুসা সম্বিতে ফিরে এল। তাকাল ডেভিডের দিকে। বলল, ‘ডেভিড, তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে হলে অনেক কথা বলতে হবে। তার আগে আমার একটা জিজ্ঞাসা।’

‘কি জিজ্ঞাসা?’ বলল নুহা ইউসেফ।

‘আপনারা কে? কেন এখানে?’ আহমদ মুসা বলল।

নুহা ইউসেফরা তিনজন পরস্পরের দিকে চাইল। তাদের সকলেরই চোখে-মুখে অস্বস্তি।

তারা কেউই কথা বলতে পারল না।

‘আমি জানি, আপনারা নামে নুহা ইউসেফ, ডেভিড হলেও আপানারা মুসলিম। কিন্তু আপনারা এখানে কেন? এমন বিচ্ছিন্ন, গোপন বনবাসী জীবনে কেন?’ আহমদ মুসা।

ভয়-বিস্ময়ে নুহা ইউসেফদের সকলের মুখ হা হয়ে গেছে। কোন অপরাধী আকস্মিকভাবে ধরা পড়ে গেলে যে অবস্থা হয়, অনেকটা সে রকম। সম্ভবত তারা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।

মারফিই মাথা তুলল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কেন আমাদের মুসলিম বলছেন? কেন এটা আপনার মনে হলো স্যার?’ ভারি, কম্পিত কণ্ঠস্বর মারফির।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পোষাক পাল্টানোর জন্য তোমাদের যে ঘরে ঢুকেছিলাম, সেখানে নামাজের বিছানা দেখেছি। তাছাড়া তোমাদের ওয়্যারলেসের বেজ প্লেটে দেখ আরবীতে বিসমিল্লাহ লেখা।’

মারফিরা সবাই স্তম্ভিত, বিব্রত। তাদের কারও মুখে কোন কথা নেই।

আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল আহমদ মুসা নুহা ইউসেফকে লক্ষ করে, ‘আপনাদের অস্বস্তির কোন কারণ নেই। আমিও মুসলিম। আপনারা মুসলিম জেনে খুশি হয়েছি।’

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সংগে সংগে নুহা ইউসেফরা ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার !’ ধ্বনি দিয়ে উঠল।

নুহা ইউসেফ এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আমার নাম নুর ইউসুফ। আমার ছেলে ডেভিডের নাম দাউদ ইব্রাহিম ও মেয়ের নাম মরিয়ম মারুফা। এখন আপনি কে বলুন। কেন এখানে এসেছেন এভাবে? আপনাকে তো আমেরিকান বলে মনে হচ্ছে না।’

‘আমার প্রশ্নের আর এক অংশের জবাব এখনও পাইনি জনাব। বলুন, আপনারা এভাবে বনবাসে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘বুঝেছি, আমাদের সব বিষয় না জেনে কিছুই বলবেন না।’

বলে থামল নুর ইউসুফ। মাথা নিচু করল।

বোধ হয় একটু আত্মস্থ হবার চেষ্টা করল।

মুহূর্ত কয়েক পরে মাথা তুলল নুর ইউসুফ। বলতে শুরু করল: ‘আমি মৃত্যুদন্ডের একজন পালাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে চল্লিশ বছর ধরে এখানে বাস করছি। পুলিশের হাজতখানা ভেঙ্গে সেই ২৫ বছর বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছিলাম। সেই থেকে আমার এখানে বাস।’

একটু থামল নুর ইউসুফ।

‘অপরাধী হলে দণ্ড ভোগ করতেই হয়, পালালেন কেন আপনি? একজন মুসলিমের তো এটা সাজে না। সংগে সংগে বলে উঠল আহমদ মুসা।

নুর ইউসুফ একটা শুকনো হাসি হাসল। বলল, ‘ধর্মের তখন আমি বেশি কিছু জানতাম না। কিন্তু অপরাধ করলে শাস্তি মেনে নিতে হয় এটা জানতাম। আসলে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা ছিল একটা ষড়যন্ত্র। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ নির্দোষ। কেন আমি সাজা মেনে নেব! কোন আমার সংসারকে বিরান হতে দেব!’

‘তাহলে সাজানো একটা বিচার হয়েছিল। অভিযোগটা কেমন ছিল?’ আহমদ মুসা বলল।

সংগে সংগে জবাব দিল না নুর ইউসুফ।

একটু সময় নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল, ‘ওয়াশিংটনস্থ ‘ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট’ উড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্রের আমি ছিলাম বাস্তবায়নকারী। আমাকে হাতে-নাতে ধরা হয়েছিল বিস্ফোরক পাতার স্কেচ ও পরিকল্পনা সমেত।’

‘হ্যাঁ, ওটা এক সাংঘাতিক ঘটনা ছিল। বিশ্বব্যাপী এ ঘটনা ব্যপক প্রচার পেয়েছিল। প্রাণদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত মূল অপরাধী পালিয়ে যায়, এটা আমরা শুনেছিলাম, টিভিতে দেখেওছিলাম। ঠিক, মনে পড়েছে। পালিয়ে যাওয়া সেই অপরাধীর ছিল নুর ইউসুফ।’ আহমদ মুসা বলল।

‘হ্যাঁ, আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম। কিন্তু বিপদে পড়েছিল মার্কিন মুসলমানরা। ইউরোপেও টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর যা ঘটেছিল, তার চেয়েও বড় ঝড় বয়ে যায় মুসলমানদের উপর দিয়ে। অথচ আমার উপর আরোপিত অভিযোগ গোটাটাই ছিল সাজানো।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘কি ঘটেছিল? কেন আপনার উপর সাজানো কাহিনী চাপাল?’ আহমদ মুসা বলল।

‘ইন্ডিপেনডেন্ট মনুমেন্ট’ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামী বানানো হয়েছিল আমাকে। তিন গার্ড হত্যারও আমি একক আসামী।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘কিভাবে তারা আপনার উপর এই অভিযোগ সাজালো? কেন সাজাল?’ আহমদ মুসা বলল।

‘কেন সাজিয়েছিল এর উত্তর আমার এখনও জানা নেই। তবে সাজানো হয়েছিল।’

বলে একটু থামল নুর ইউসুফ। আবার শুরু করল, ‘অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে আমাকে ফাঁসানো হয়। আমার বিরুদ্ধে কেন এই ষড়যন্ত্র তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

আবার একটু থামল নুর ইউসুফ।

ভাবল একটু। গুছিয়ে নিল বোধ হয় কথা। পুনরায় শুরু করল, ‘ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট’- এর সিকিউরিটি টিমের আমি সদস্য ছিলাম। চার শিফটের মধ্যে একটা শিফটের ইনচার্জও ছিলাম আমি। আমাদের প্রতিটি শিফটে আমরা ২১ জন করে থাকি। এদের মধ্যে সাতজন বাইরে, পাঁচজন গ্রাউন্ড ফ্লোরে আর নয়জন উপরের বিভিন্ন ফ্লোরে দায়িত্ব পালন করে। মনুমেন্টের বেজে আরও তিনটি ফ্লোর আছে। কিন্তু সেখানে সিকিউরিটির লোক থাকে না। এগুলো প্রাত্যাহিক ব্যবহৃতও হয় না। এ তিনটি ফ্লোরই আসলে ছিল ইমারজেন্সি শেল্টার। পারমাণবিক বা এয়ার-রেইডের মতো আকস্মিক হামলার সময় ব্যবহারের জন্যে এ ফ্লোরগুলো নির্মিত। ফ্লোরগুলো বিশাল। মনুমেন্টের বিস্তৃতি ও সারিবদ্ধ পিলার বাদ দিলে ফ্লোরের গোটাটাই ফাঁকা। অবশ্য গোলাকার সীমানা দেয়ালের প্রান্ত বরাবর তিন ফ্লোর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ।

দর্শনার্থী ও পর্য্টকরা গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ উপরের সব অংশেই অবাধে যেতে পারে। বেজমেন্টের তিনটি ফ্লোরে তাদের যাবার অনুমতি নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পত্র কেউ পেলে তাদের বেজমেন্টের ফ্লোরগুলোতে যেতে দেয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা শিফটের প্রধানকে তাদের সাথে থাকতে হয়।

সেদিন ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সবে লাঞ্চ শেষ করেছি। টেলিফোন পেলাম সিকিউরিটি কলিগ ইভিনিং শিফটের ইনচার্জ সালেম সোলাংকির কাছ থেকে। বলল, ‘নুর, একটা বিপদে পড়েছি আমি। আজ ডিউটি করতে পারছি না। তোমার তো অফ ডে। প্লিজ তুমি আমার ডিউটিটা করে দাও।’

‘কিভাবে সম্ভব? অনুমতি কোথায়?’ আমি বললাম।

‘আমি মন্ত্রণালয় থেকে বলছি। তাদের আমি বলেছি। তুমি রাজী হলেই অনুমতি নিতে পারি।’ সালেম বলল।

আমার কিছু বলার আর উপায় ছিল না। রাজী হয়ে গেলাম।

ইভিনিং শিফট শুরু বিকেল ৫টা থেকে। শেষ হয় রাত এগারটায়।

পর্য্টক ও দর্শনার্থীদের জন্যে ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্ট খোলা থাকে রাত ৮টা পর্য্ন্ত। আমার ডিউটি চলছিল।

সন্ধ্যা ৭ টায় তিনজন দর্শনার্থী আমার কক্ষে এল। বলল, ‘আমরা মনুমেন্টের উপরটা সব দেখেছি, এখন বেজমেন্টের ফ্লোরগুলো দেখতে চাই।’

বলার পরে একটা কাগজ আমার দিকে তুলে ধরল। কাগজটা আমি নিয়ে দেখলাম বেজমেন্টের ফ্লোরগুলো দেখার অনুমতি পত্র।

আমি ওদের নিয়ে বেজমেন্টের ফ্লোরে নামতে গেলাম। মনুমেন্টের প্রবেশ পথেই সবার বডি চেক করা হয় বলে কাউকে চেক করার আর দরকার হলো না।

লিফটে উঠে ওরা বলল, ‘মি. নুর, আমরা বটম ফ্লোর থেকে দেখতে দেখতে উপরের দিকে উঠব।’

‘ঠিক আছে।’ আমি বললাম।

আমরা বটম ফ্লোরে নেমে গেলাম।

ফ্লোরটির মাঝখানে গিয়ে ওরা তিনজন দাঁড়াল।

আমিও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সংগে সংগেই ওদের তিনজনের একজন বলল, ‘আ-হা কি ভুল! লিফটে আমাদের টিফিন বক্সটা ফেলে এসেছি।’

আমিও তাকালাম সেদিকে। দেখলাম আয়তাকার সিংগল কেবিনের একটা ছোট টিফিন বক্স।

‘ঠিক আছে, আমি ওটা নিয়ে আসছি। আপনারা দেখতে থাকুন ফ্লোরটা।’ আমি বললাম।

‘অনেক ধন্যবাদ। ওটা এনে এখানেই রাখবেন। চারটি মূল মধ্য পিলারের মাঝখানে এই জায়গাটায় রাখবেন। এখানে আবার এসে নিয়ে যাব।’

ওরা এগোলো ফ্লোরের বিভিন্ন অংশ দেখার জন্যে।

ফেরার সময় মাঝখানের ঐ জায়গাটায় আবার আমরা এলাম।

ওদের একজন বলল, ‘চলুন, এখানে আর নয়। ওপরের ফ্লোরে উঠি।’ বলে টিফিন বক্সটি নেবার জন্যে নিচু হলো।’

আমি আগে হাঁটতে লাগলাম। ওরা পেছনে।

আমি লিফটের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওরা লিফটে ঢুকে দরজার সামনেই দাঁড়াল। লিফট উঠল পরের ফ্লোরে।

ওরা তিনটি ফ্লোরই দেখা শেষ করে ৮টা বাজার দশ মিনিট আগেই চলে গেল।

রাত ৯টার দিকে একদল পুলিশ এসে প্রবেশ করল ইন্ডিপেনডেন্স মনুমেন্টে।

ওরা ঝড়ের বেগে এল এবং বেজ মেন্টের ফ্লোরে নেমে গেল। তাদের সাথে ছিল বিস্ফোরক ইউনিটের কয়েকজন।

ওরা মনুমেন্টে ঢুকেই ঘোষণা করেছে, তারা নির্দেশ না দেয়া পর্য্ন্ত কেউ মনুমেন্টে ঢুকতে পারবে না, বেরুতেও পারবে না। যে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।

ঘণ্টাখানেক পরে ওরা বেজমেন্ট থেকে ফিরে এল।

নেতৃত্বদানকারী পুলিশ অফিসার সোজা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি নুর ইউসুফ?’

‘জি, হ্যা। আমি নুর ইউসুফ।’ আমি বললাম।

‘আপনি সন্ধ্যা ৭টার পর বেজমেন্টে গিয়েছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল পুলিশ অফিসার।

‘হ্যা গিয়েছিলাম দর্শনার্থীদের সাথে।’ আমি বললাম।

পুলিশ অফিসার তার সাথের বিস্ফোরক টিমের একজনকে ডাকলেন। তিনি এলেন। তার গ্লাভস পরা হাতে দেখলাম সেই আয়াতাকার টিফিন ক্যারিয়ারটি।

‘এই টিফিন ক্যারিয়ারটি আপনি চেনেন?’ বলল অফিসার।

‘দেখেছি।’ আমি বললাম।

অফিসারটি তার পেছনে দাঁড়ানো অফিসারকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দিলেন গ্রেফতার করুন মি. নুর ইউসুফকে।

‘কি ঘটেছে স্যার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ আমি বললাম।

‘এই টিফিন ক্যারিয়ারে রয়েছে সাইলেন্ট কিলারের মতো ভয়ংকর তিনটি ডিমোলিশন বম্ব, যা গোটা মনুমেন্টকে ধুলায় পরিণত করতো আর আধা ঘণ্টা পর।’

শোনার সাথে সাথে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল ওরা।

পরদিন আমাকে লিখিতভাবে জানানো হলো মনুমেন্ট ধ্বংসের জন্যে তিনটি ডিমোলিশন বম্ব পাতার অভিযোগ আনা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। আরও জানতে পারলাম, ধ্বংসের এই ষড়যন্ত্র করতেই নাকি আমি অফডেতে ঐ ডিউটি নিয়েছিলাম। আরও বলা হলো আমাকে যে, দর্শনার্থীদের সঙ্গ দিতে আমি বেজমেন্টে গিয়েছিলাম, এটা আমার সাজানো কথা। টিফিন ক্যারিয়ারটিতে বোমা লুকিয়ে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম বেজমেন্টে বোমা পাতার জন্যে। শুধু আমারই ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে টিফিন ক্যারিয়ারে। অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল।’ থামল নুর ইউসুফ।

বিস্ময় আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘অকাট্য প্রমাণ কিভাবে পেল? আপনার কলিগ তো ডিউটি বদলের দরকার বলে অনুমতি নিয়েছিল। তাছাড়া মনুমেন্টের সার্বক্ষণিক সিসিটিভিতে দর্শনার্থীদের ছবি এবং তাদের সেই টিফিন ক্যারিয়ারসহ সব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবার কথা! তাদেরও ফিংগার প্রিন্টও টিফিন ক্যারিয়ারে থাকার কথা।’

হাসল নুর ইউসুফ। বলল, ‘ওরা আট-ঘাট বেঁধেই নেমেছিল। প্রমাণ হয়েছিল আমার কলিগ সালেম সোলাংকি মিনিস্ট্রিতে ডিউটি চেঞ্জের দরখাস্ত করেন নি। দরখাস্ত করেছিলাম আমি। আমার স্বাক্ষর করা দরখাস্ত তারা আমাকে দেখিয়েছিল। আর ঐ দিন সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮ টা পর্যৃন্ত মনুমেন্টের সিসিটিভি বন্ধ ছিল। নষ্ট করা হয়েছিল সিসিটিভি এবং এটাও নাকি আমি করেছিলাম। সিসিটিভির যে যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, সেটা নাকি আমিই সরিয়েছিলাম। আমার ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে সেখানে। আর দর্শণার্থীদের ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যায় নি।’

‘দেখা যাচ্ছে, আপনার কলিগ সালেম সোলাংকিসহ সরকারের অফিস ও বাইরের অনেকেই এই ষড়যন্ত্রের শামিল ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।

‘খুব বড় ষড়যন্ত্র ছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা আসলেই ইন্ডিপিনডেন্স মনুমেন্ট ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আর আধা ঘণ্টা পরেই ডিমোলিশ বম্ব তিনটির একসাথে বিস্ফোরণ ঘটত এবং আমেরিকানদের স্বাধীনতার স্মারক ইন্ডিপিনডেন্স মনুমেন্টটি টুইন টাওয়ারের মতোই ধূলো হয়ে যেত। কিন্তু মনুমেন্টে সবার অলক্ষ্যে বিশেষ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সেট করা আছে, যার অতিসূক্ষ্ম বিকিরণ যে কোন বিস্ফোরকের উপস্থিতি ডিটেক্ট করে হোয়াইট হাউজের গোয়েন্দা সমন্বয় সেলে খবর পৌছায়। এ বিষয়টা ষড়যন্ত্রকারীদের জানা ছিল না। তাই রক্ষা পায় জাতীয় এই মনুমেন্টটি এবং সেই সাথে আমেরিকার মুসলিম কম্যুনিটি মস্ত বড় বিপদ থেকে বেঁচে যায়।’

‘কিন্তু এত বড় ষড়যন্ত্রের কি কারণ ছিল? শুধু আপনাকে ফাঁসানো?’ আহমদ মুসা বলল।

‘না, মুসলমানদের ফাঁসানো। এই কথা আমাকে বলেছিল আমার বন্ধু সালেম সোলাংকি। সে আমার সাথে কারাগারে দেখা করেছিল। সেই আমাকে সবকিছু বলেছিল। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর দুই যুগের ব্যবধানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অন টেরর’ ফিকে হয়ে গিয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেছে। ইহুদিবাদীরা ইন্ডিপেনডেন্স টাওয়ার ধ্বংস করে সেই ‘ওয়ার অন টেরর’কে আবার জিন্দা করতে চেয়েছিল।’

একটু থামল নুর ইউসুফ।

সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘কিন্তু নাম দেখে তো আপনার বন্ধুকে ইহুদি মনে হচ্ছে। এসব কথা কেন তিনি বললেন আপনাকে?’

‘সে আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু, পারিবারিক বন্ধুও। আমি ভালো মুসলিম ছিলাম, সেও ভালো ইহুদি ছিল। আমি নিয়মিত মসজিদে যেতাম। সেও সিনাগগের প্রার্থনা কোন সময় মিস করতো না। সে বলত, ইহুদিবাদ কোন ধর্ম নয়, ইসরাইল রাষ্ট্র ওদের ধর্ম-ঈশ্বর সব। ইসরাইল রাষ্ট্রকে ওরা পূজা করে।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘তাহলে ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্রে সে সাহায্য করল কেন?’ আহমদ মুসা বলল।

‘সে নিজের জীবন ও পরিবারকে রক্ষার জন্যেই এটা করেছে। বাধ্য করা হয়েছে তাকে ওদের সাথে শামিল হতে। বেচারা স্বামী-স্ত্রী খুব কেঁদেছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেছে কে জানে!’

একটু থামল নুর ইউসুফ। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। বলল, ‘পালানোর ব্যাপারে সেই আমাকে প্রথম উদ্বুদ্ধ করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানোর বন্দোবস্তও সেই করে দেয়।’

থামল নুর ইউসুফ।

আহমদ মুসা বলল, ‘তার পর থেকে আপনি এখানে, এই তো?’

হ্যা-সূচক মাথা নেড়ে নুর ইউসুফ বলল, ‘এবার জনাব আপনার কথা বলুন। আমাদের মতো সাধারণ লোক আপনাকে মনে হচ্ছে না। আপনার দৃষ্টি গোয়েন্দার মতো, জ্ঞান বিজ্ঞানীর মতো আর সাহস মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিকের মতো।’

‘বলছি। কিন্তু তার আগে আর একটা কথা বলুন। সমাজ-সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে বাস না করে অন্য দেশে চলে যেতে পারতেন।’ আহমদ ‍মুসা বলল।

‘পারতাম। কিন্তু আমি দেশ ছাড়ব কেন? দেশ তো আমার, আমারই আচে। একটা ষড়যন্ত্র আমাকে শাস্তি দিয়েছে। এর সাথে দেশের সম্পর্ক নেই। এখানে যেভাবেই থাকি, আমি তো দেশের মাটিতে আছি। আমি বলতে পারছি আমি আমেরিকান।’ বলল নুর ইউসুফ আবেগদীপ্ত কণ্ঠে।

‘ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।

একটু থেমেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘আমার সম্পর্কে কি বলব। আমার নাম আহমদ মুসা। ওয়াশিংটনের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে নেমেই আমি কিডন্যাপ হই।’

এটুকু বলে তার মুক্ত হওয়ার বিষয় সংক্ষেপে ওদের জানাল। যারা তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছিল, তারা তাকে কোন হাসপাতালে নিচ্ছিল। পথে তারা আক্রান্ত হন এবং ঘেরাও হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহমদ মুসা এদিকে চলে আসে। কথাগুলো বলে আহমদ মুসা থামল।

আহমদ মুসা থামতেই মারুফা বলে উঠল, ‘আপনার পরিচয় সম্পূর্ণ বললেন না। আমাদের আমেরিকার বন্ধু মিরাকল ম্যান এক আহমদ মুসাকে আমরা জানি। আপনি কি সেই আহমদ মুসা?’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে দেখে কি মিরাকল ম্যান বলে মনে হয়। আমি তো সাধারণ একজন মানুষ।’

‘সাধারণ মানুষ আমেরিকার জন এফ কেনেডি বিমান বন্দর থেকে কিডন্যাপ হয় না। আর আপনি মুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া পর্যন্ত যে কাহিনী বলেছেন, সে কাহিনীও কোন সাধারণ মানুষের নয়। আপনি শিকড় বেয়ে পাহাড়ে উঠলেন কষ্ট ও অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে, এটা সাধারণ কেউ করতো না। সুতরাং আপনাকে কনগ্রাচুলেশন। আপনি না বললেও আমি বলছি, জীবন্ত লেজেন্ড, আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের মহান আমেরিকার অতিথি মিরাকল আহমদ মুসার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে।’ বলল মরিয়ম মারুফা। তার কণ্ঠে আবেগের উচ্ছাস।

মারুফার কথা শেষ হতেই নুর ইউসুফ গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমাদের মতো বনবাসীদের কি পরম সৌভাগ্য আহমদ মুসা আজ আমাদের ঘরে! যাকে আমাদের প্রেসিডেন্ট স্বাগত জানান, তাঁকে আমাদের গরীব ঘর কিভাবে স্বাগত জানাবে!’

আহমদ ‍মুসা নুর ইউসুফের আলিংগন থেকে মুক্ত হয়ে বলল, ‘প্লিজ, আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি আমেরিকার জন্যে কার্যত কিছুই করিনি। প্রথমবার আমাকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে বন্দী অবস্থায় আমেরিকায় আনা হয়েছিল। আমি মুক্ত হওয়া এবং নিজেকে নিরাপদ করার জন্যে যা করেছি, তা আমেরিকারও কাজে এসেছে। যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে। সুতরাং আমার জন্যে প্রশংসার এতে কিছু নেই।’

‘ধন্যবাদ। এমন কথা আহমদ মুসাই শুধু বলতে পারেন। সত্যি সব আমার স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’ বলল নুর ইউসুফ। তার দুই চোখ ভরা প্রশংসার দৃষ্টি।

‘বাবা, আমি ভাবছি অন্য কথা। আহমদ মুসা যে দেশে যান, যেখানে যান, সেখানে, সে দেশে তখন কোন বড় ঘটনা ঘটে। বড় কোন ঘটনা সামাল দেবার জন্যেই তিনি আসেন। আমাদের আমেরিকায় আবার কি ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে, সেটাই ভাবছি।’ বলল নুর ইউসুফের ছিলে দাউদ ইব্রাহিম।

আহমদ মুসা এক ধাপ এগিয়ে দাউদ ইব্রাহিমের কাঁধে হাত রেখে ম্লান হেসে বলল, ‘ঠিক বলেছ। দুর্ভাগ্যটা বোধ হয় আমারই। এবারও আমি এবং আমেরিকা একটা বড় ঘটনার মুখোমুখি।’

নুর ইউসুফ সহ সবারই চোখে-মুখে সংগে সংগেই ঔৎসুক্যের একটা বান যেন নেমে এল। বলল দাউদ ইব্রাহিম, ‘যেটাকে আপনি দুর্ভাগ্য বলছেন সেটা আমাদের জন্যে সৌভাগ্য। আপনার জন্যেও। কারণ আল্লাহ যখন কোন কিছুর জন্যে কাউকে বাছাই করেন, সেটা তার জন্যে অবশ্যই সৌভাগ্যের।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ দাউদ ইব্রাহিম। তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা তার জন্যে, আমাদের সকল কাজ তাঁরই জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ধন্যবাদ স্যার। যা বললেন, আসলেই আমেরিকায় কি বড় কিছু ঘটতে চলেছে? আপনি আমেরিকায় পা দেবার সংগে সংগেই তো একটা ঘটনার শুরু।’ বলল মরিয়ম মারুফা।

আহমদ মুসা সংগে সংগেই উত্তর দিল না। একটু ভাবল। গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘হ্যা, খুব বড় ঘটনার আমি আশংকা করছি। আমার জানা-বুঝা যদি সত্যি হয়, আমি যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমেরিকার জন্যে হবে তা এক উদ্বেগজনক ঘটনা।’

আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর আহমদ মুসা ষড়যন্ত্রকারীদের নতুন ভয়ানক অস্ত্র ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভ (MDW), ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW)-এর বিবরণ, তাকে কিডন্যাপের উদ্দেশ্যসহ সবকিছুই সংক্ষেপে বলল এবং শেষে জানাল, ইলেকট্রনিক ও মেটারিক সবকিছু অচল করে দেয়ার যে ঘটনা অতীতে ঘটেছিল ও আজকে ঘটল। আমি মনে করি, সেটা একটা পরীক্ষামূলক।’

থামল আহমদ মুসা। নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা সবার চোখে-মুখে আতংক ফুটে উঠেছে। অন্ধকার হয়ে উঠেছে তাদের চোখ-মুখ। সংগে সংগে তারা কেউ কথা বলতে পারল না।

‘ভয়ংকর কথা আপনি শোনালেন। আমাদের সরকার এ বিষয়টা জানে না?’ প্রায় কম্পিত কণ্ঠে বলল নুর ইউসুফ।

‘সম্ভবত মার্কিন সরকার ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ অস্ত্রটি আবিষ্কারে সফল হয়েছে। কিন্তু অন্য কারো কাছে এই অস্ত্র আছে, এটা তারা জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘সর্বনাশ। তাহলে তো যে কোন সময় ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে।’ বলল আর্ত কণ্ঠে নুর ইউসুফ।

‘ভয় নেই জনাব। ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ তারা আবিষ্কার করেছে, তা তৈরি করে মোতায়েন করার পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু ডেটোনেট করার জন্যে যে ‘কিং পিন’ চাই তা তৈরি তারা সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তারা চেয়েছিল পেন্টাগনের কাছে পরিচিত আমাকে রোবটের মতো কাজে লাগিয়ে ‘কিং পিন’টি এবং তার ফরমুলা পেন্টাগন থেকে চুরি করতে। সে উদ্দেশ্য তাদের সফল হয়নি। এখন নিজেরা আবিষ্কার অথবা সেটা কোনভাবে পেন্টাগন থেকে হাত করার আগে তারা MDW ব্যবহার করতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আবিষ্কার ইতিমধ্যে তারা করে ফেলতেও তো পারে।’ বলল মরিয়ম মারুফা।

‘আজকের ওদের টেস্ট প্রমাণ করেছে তাদের কাছে যে ডেটোনেট পিন রয়েছে, তা দিয়ে গোটা MDW উইপনকে এ্যাকটিভেট করতে পারছে না। এ কারণেই দেখা গেল ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক বস্তুকে কয়েক মিনিটের বেশি তারা নিষ্ক্রিয় করতে পারছে না। তাছাড়া কয়েক মিনিটের ম্যাগনেটিক ডেথ বাইটকে পূর্ণাংগ করতে পারেনি। সর্বশেষ তত্ত্ব অনুসারে ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভের অকল্পনীয় শৈত্য ম্যাটারের পরমাণুকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, পরমাণুর পারটিকেলগুলোও আলাদা হয়ে পড়ে। ফলে ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ যেসব টার্গেটে আঘাত করে, সেখানে ইলেকট্রনিক ও মেটালিক অস্ত্র-শস্ত্রসহ সবকিছুরই কার্যকর থাকাটা দৃশ্যমান হলেও বস্তুর ধর্ম অনুযায়ী কাজের উপযুক্ত থাকে না, সেগুলো সফট ও ফ্লেক্সিবল হয়ে পড়ে। আমরা সকলেই দেখলাম, মেটালিক বস্তুগুলো কিছুটা সংকুচিত হয়েছিল মাত্র, সফট ফ্লেক্সিবল পর্যন্ত পৌছেনি। এর অর্থ হলো, ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ পুরোপুরি কার্যকরি হতে পারেনি। ডেটোনেটর বা কিং পিন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফদের আতংক দূর হয়ে গেল। আনন্দের স্ফুরণ ঘটল তাদের চোখে-মুখে।

আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, যে রাষ্ট্রের আইনে এবং যে দেশের বিচারালয় চরম অবিচার করে প্রাণদণ্ড দিয়েছে নুর ইউসুফকে, সভ্যতার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে দূরে বনবাসে থাকতে বাধ্য করেছে গোটা পরিবারকে, সেই আমেরিকার প্রতি এঁদের এত ভালোবাসা!

‘যে দেশের আইন ও বিচার আপনাদের এই অবস্থা করেছে, সে দেশের প্রতি আপনাদের এত ভালোবাসা!’ আহমদ মুসা বলল।

হাসল নুর ইউসুফ। বলল, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে কিছু ব্যক্তি, একটা গ্রুপ, যারা প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা ও আমেরিকার আদর্শের শত্রু। ষড়যন্ত্রকারীরা আইনকে ব্যবহার করেছে এবং বিচারালয়কেও। এতে আমেরিকার কোন দোষ নেই। এর ফলে আমার স্বদেশ আমেরিকার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়েছে। আমেরিকাকে এই ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্ত করার ভাবনা আরও দৃঢ় হয়েছে।’

‘সে সুযোগ একটা এসেছে জনাব। বিশ্ব যায়নবাদের গোয়েন্দা সংগঠন Army of Man’s Future (FOAM) এর সামরিক শাখা এইচ কিউব (H3-Hand of the High Hands) আমেরিকার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করেছে, তাকে রুখতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কিন্তু আপনি তো বললেন, ওরা ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ অস্ত্রকে এখনও কার্যকরি করতে পারেনি। আজকের টেস্টেও তা প্রমাণ হয়েছে! ভয় তো তাহলে কেটে গেছে। আপনি ওদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ায় ওরা পেন্টাগন থেকে ‘কিং পিন’ চুরিও করতে পারছে না।’ বলল নুর ইউসুফ। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগের প্রকাশ।

‘ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভকে অ্যাকটিভেট করতে না পারার ব্যর্থতা একটা সুখবর দেয়ার সাথে সাথে একটা দুঃসংবাদও দিচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা যদি হতাশই হয়ে যায় যে, তাদের ম্যাগনেটিক ডেভ ওয়েভকে তারা কার্যকরি করতে পারছেই না এবং তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তারা তাদের ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW) ব্যবহার করতে পারে। এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা ভয়াবহ। এই MFW-কে তারা যদি ব্যবহার করে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইলোতে থাকা সব পারমাণবিক এবং কনভেনশনাল অস্ত্র ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে, যা সৃষ্টি করতে পারে অকল্পনীয় এক ধ্বংসলীলা। আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা সকলের মুখ আতংকে চুপসে গেছে। প্রায় আর্ত কণ্ঠে নুর ইউসুফ বলল, ‘সর্বনাশ জনাব, পরীক্ষায় এবারও তো MDW-কে কার্যকরী করতে পারেনি, তাহলে কি ওরা ঐ সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলতে পারে?’

গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। তার মুখে ভাবনার একটা ঢেউ খেলে গেল। বলল, ‘তারা এই ভয়ানক কাণ্ড ঘটাবে কিনা বলা কঠিন। তবে আমার কাছে আশংকার বিষয় মনে হচ্ছে তাদের এই সেকেন্ড টেস্টটাকে। আমি ওদের হাত থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা এই দ্বিতীয় টেস্টটা করেছে। তারা মরিয়া হয়ে চেয়েছিল MDW-কে কার্যকরি করতে, কিন্তু পারে নি। তারা জানে আমি ওদের সবকিছু জানতে পেরেছি, আমি মুক্ত হবার পর মার্কিন সরকারও এটা জানতে পারবে। সুতরাং মার্কিন সরকার ওদের উপর আঘাত হানার আগেই ওরা চাইবে মার্কিন সরকারের অস্ত্রভাণ্ডারের উপর আঘাত হানতে। সুতরাং আমার মনে হয়, আমাদের এখন প্রতি মুহূর্তই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আমি পালাতে পারলেও গাড়ি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর বেঁচে আছি কিনা কিংবা আমি আহত হয়ে কোথায় কিভাবে আছি তা ওরা জানে না। কিন্তু মার্কিন সরকার আমাকে পায়নি, সেটা ওরা জানে। মার্কিন সরকারের সাথে আমার সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত ওরা নিশ্চিন্ত যে, মার্কিন সরকার তাদের ষড়যন্ত্র জানতে পারছে না। সে পর্যন্ত ওরা MFW অস্ত্র ব্যবহার না করে আমাকে খুঁজতে থাকবে, জানতে চেষ্টা করতে থাকবে আমি কোথায়।’ থামল আহমদ মুসা।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা তিনজন কম্পিত দেহে মাটিতে বসে পড়েছে। ভয়ে-আতংকে তাদের মুখ মরার মতো ফ্যাকাশে। কথা বলার শক্তিও যেন তাদের নেই।

আহমদ মুসাও পাশের একটা পাথরের উপর বসে পড়ল। বলল, ‘সামনে যে পাহাড় তার পেছনে কি আছে?’

‘পেছনে ‘ডেথ ভ্যালি’। চারদিকে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, মাঝখানে একটা সংকীর্ণ উপত্যকা। প্রায় তিন শ’ বছর আগে এদেশে ইউরোপীয় শ্বেতাংগদের উপনিবেশ শুরুর সময়ে রেড ইন্ডিয়ানদের সংগে যে যুদ্ধগুলো হয়, তার একটা ভয়ংকর যুদ্ধ বা হত্যাকাণ্ড এই উপত্যকায় সংঘটিত হয়। উপকূল এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের বিচ্ছিন্ন দলগুলো গোপনে এই সংকীর্ণ উপত্যকায় এসে সমবেত হয়। তারা তৈরি হয় ওয়াশিংটন এলাকায় ফাইনাল যুদ্ধের জন্যে। ইউরোপীয় কলোনিয়ান বাহিনী এটা টের পেয়ে যায়। তারা আকস্মিক এক আক্রমণে এই উপত্যকা ঘেরাও করে ফেলে। তারা চারদিকের পাহাড় থেকে সংকীর্ণ উপত্যকায় বারুদ ছড়িয়ে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেড ইন্ডিয়ানরা প্রতিরোধ-প্রতিকারের কোন সুযোগ পায় নি। সবাই সেই বারুদের আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই থেকে এটা ডেথ ভ্যালি। পরবর্তীকালের এক ভূমিকম্পে এই ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের একমাত্র গিরিপথটি বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এই ডেথ ভ্যালিতে এসেছিলেন। তখন চারদিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ডেথ ভ্যালিতে ফুল নিক্ষেপ করে। ডেথ ভ্যালির গাছ, ঝোপ-জংগল, মাটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল। জর্জ ওয়াশিংটন ঘোষণা করেছিলেন, ডেথ ভ্যালিকে ব্যক্তিগত মালিকানা ও যে কোন ধরনের ব্যবহার থেকে মুক্ত রেখে পূর্বসূরি শহীদদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। সেই থেকে ভ্যালিটি নিষিদ্ধ এলাকা হিসাবে সংরক্ষিত আছে।’

বলল নুর ইউসুফ।

ডেথ ভ্যালির বিবরণ শুনতে শুনতে আহমদ মুসার মনটা সেই ডেথ ভ্যালিতে চলে গিয়েছিল। তার মনে এসে জমল নানা প্রশ্নের ভিড়। বন্দীখানায় মানসী মেরাবের কাছ থেকে যে তথ্য সে পেয়েছে, তাতে ‘রক ক্রিক পার্ক’-এ MFW মোতায়েনের জরুরি ব্যবস্থার কথা আছে।

‘এটা ঠিক কোন্ এলাকা জনাব নুর ইউসুফ।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এটা ওয়াশিংটনের পশ্চিম দিকে মেরিল্যান্ডের দু’প্রান্তের সীমানা যেখানে কৌণিক একটা দুর্গম পাহাড় এলাকা সৃষ্টি করেছে। সেই ‘রক ক্রিক পার্ক’ এলাকার সবচেয়ে দুর্গম স্থান এটা।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘RCP বা রক ক্রিক পার্কের সবচেয়ে দুর্গম এলাকা এটা?’ অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে আনন্দের স্ফুরণ। তাহলে ঠিক জায়গায় আল্লাহ তাকে এনেছে, মনে মনে বলল আহমদ মুসা।

‘হ্যা, রক ক্রিক পার্ক।’ বলল নুর ইউসুফ।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

উঠে দাঁড়াল সবাই।

আহমদ মুসা সামনে পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এ পাহাড়ের ওপারেই কি ডেথ ভ্যালি?’

‘জি হ্যা। রক ক্রিক পার্ক-এর এটাই দুর্গম কেন্দ্রীয় অঞ্চল।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘পাহাড়ের ওপারে যাবার কি কোন পথ আছে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।

‘কোন পথ নেই। সাধারণ মানুষের পক্ষে পাহাড়ের ওপারে যাওয়া সম্ভব নয়। পর্বতারোহীরা যে কায়দায় পাহাড়ে উঠে সেভাবে কেউ হয়তো এটা ডিঙাতে পারে।’

বলে একটু থেমেই নুর ইউসুফ বলে উঠল, ‘কিন্তু এটার খোঁজ করছেন কেন? ওপারে কি আছে?’

‘কিছু আছে কিনা আমি জানি না। আমার একটা সন্দেহ, ষড়যন্ত্রকারী FOAM-এর এইচ কিউব তাদের MFW অস্ত্র আপনাদের ডেথ ভ্যালি অঞ্চলের কোথাও মোতায়েন করে থাকতে পারে। এটা নিছকই আমার সন্দেহ। আমি এটুকু জানি যে, রক ক্রিক পার্ক ওদের অস্ত্র মোতায়েনের একটা জায়গা।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এই রক ক্রিক পার্কে ওদের ঐ ভয়ানক অস্ত্র মোতায়েন করা আছে?’ বলল স্বগত কণ্ঠে নুর ইউসুফ। তাদের চোখে-মুখে আতংক আবার ফিরে এসেছে।

‘হ্যা, এটা আমার সন্দেহ। সন্দেহের আরও একটা কারণ হলো, ইলেক্ট্রনিক ও মেটালিক বস্তুর উপর যে ম্যাগনেটিক ওয়েভের ফল আমরা দেখলাম তা এসেছে উত্তরের ডেথ ভ্যালির দিক থেকে। আপনারা দেখে থাকবেন, পাত্রের আয়রন ডাস্টগুলো পাত্রের দক্ষিণ দিকে কিছুটা সরে এসেছিল। ওয়েভের দক্ষিণমুখী প্রেসারের কারণে এটা ঘটে থাকতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কি আশ্চর্য! সবকিছুই যেন আপনার জানা, আপনার মুখস্থ। এত সূক্ষ্ম দৃষ্টি আপনার!’ বলল মরিয়ম মারুফা।

‘না মারুফা, আমি সবকিছু জানি না, আমার মুখস্থও নয় সব। জানলে তো এত চিন্তা-ভাবনা করতে হতো না।’ থামল একটু আহমদ মুসা। বলল আবার, ‘জনাব নুর ইউসুফ, আপনার ওয়্যারলেসে কি এফবিআই-এর সাথে যোগাযোগ করা যাবে?’

‘কার সাথে যোগাযোগ করতে চান?’ জিজ্ঞাসা নুর ইউসুফের।

‘এফবিআই-এর প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন অথবা আপনাদের প্রেসিডেন্ট।’ বলল আহমদ মুসা।

সবাই বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ওদের সরাসরি ওয়্যারলেস করতে পারেন আহমদ মুসা! সবার মনে পড়ল আমেরিকায় আহমদ মুসাকে নিয়ে ঘটনাগুলোর কথা।

চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সকলের ভাবনায় ছেদ টেনে নুর ইউসুফ বলে উঠল, ‘কিন্তু ওদের কারও ওয়্যারলেন্স রেফারেন্স আমাদের কাছে নেই।’

‘যোগাড় করা যাবে না?’ আহমদ মুসা বলল।

‘চেষ্টা করে দেখতে পারি স্যার।’ বলল দাউদ ইব্রাহিম।

‘আমরা মানে আপনি দাউদকে সাথে নিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে পারেন।’

‘আমাদের রাবারের নৌকা আছে। কয়েক মিনিটেই ওটাকে পানিতে ভাসানো যায়।’ বলল নুর ইউসুফ।

‘ধন্যবাদ। তা পারা যায়। তবে এখান থেকে যদি যোগাযোগ করা যায়, সেটা ভালো হবে। দরকার হলে সামনের পাহাড়টাকেই ব্যবহার করতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।

নুর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম মারুফা সকলেই একে অপরের দিকে চাইল। আহমদ মুসার কথা তারা বুঝতে পারেনি, এমনটাই তাদের মুখের ভাব। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে সাহস পেল না।

‘বাবা, আমি ওয়্যারলেসের দিকে যাচ্ছি। দেখি যোগাযোগের কি ব্যবস্থা করা যায়।’

বলেই দাউদ ইব্রাহিম চলল যে ঘরে ওয়্যারলেস আছে, সে ঘরের দিকে।

আহমদ মুসা তার পেছনে পেছনে চলল।

আহমদ মুসার পেছনে সবাই।

Top