৫৭. আতংকের দিভিন উপত্যকা

চ্যাপ্টার

টিলার গা ঢালু। সোজা রাস্তায় সেই টিলায় উঠে যেতে কোনই কষ্ট হলো না আহমদ মুসার। টিলার মাথায় উঠে যেতেই আগুনের ভয়াবহ দৃশ্যটা তাদের সামনে এল।

মুখোমুখি দুটি একতলা বিল্ডিং-এ দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।

এ দুটি বিল্ডিংই এল প্যাটার্নের এবং মুখোমুখি। দুই এল-এর বটম টিলার দক্ষিণ দিক কভার করেছে। মাঝখানে একটা স্পেস, সম্ভবত ওপাশটায় মানুষ ও গাড়ি চলাচলের জন্য। আর দুই এল-এর লম্ব দুটি কভার করেছে পশ্চিম ও পুব প্রান্ত। টিলার উত্তর প্রান্ত উন্মুক্ত দুই এল-এর দুই লম্বের মাঝে বিরাট উন্মুক্ত চত্বর। চত্বরের মাঝখানে গোলাকার একটা শেড কয়েকটা পিলারের উপর দাঁড়ানো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওটা বিশ্রামকক্ষ কাম রেস্টুরেন্ট।

পশ্চিমের কিছু অংশ ছাড়া এল প্যাটার্নের দুটি বিল্ডিংই জ্বলছে।

চত্বরের মাঝখানের গোলাকার শেডটায় তখনও আগুন লাগেনি। উত্তর প্রান্ত দিয়েই রাস্তা উঠে এসেছে টিলায়। টিলাতে উঠেই গাড়িতে ব্রেক কষেছে আহমদ মুসা। গাড়ি দাঁড় করিয়েই গাড়ি থেকে নামল সে।

নামল ইভা নারিনও।

আহমদ মুসার দৃষ্টি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। তার কপাল কুঞ্চিত হলো। একটা উদ্বেগের ছায়া নেমে এল তার চোখে-মুখে।

ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, মিস ইভা নারিন, আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে দেখুন।

ইভা নারিন তাকাল আগুনের শিখার দিকে।

দেখছি আগুন! কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিনে মিস্টার আহমদ আবদুল্লাহ। বলল ইভা নারিন।

আগুনের ঊর্ধ্বমুখী শিখা তার শেষ প্রান্তে গিয়ে রেডিশ ব্ল্যাক হয়ে ধোঁয়ায় পরিণত হওয়ার কথা, কিন্তু দেখুন রেডিশ ব্ল্যাক না হয়ে সেটা বুয়িশ ব্ল্যাক রং ধারণ করছে। আহমদ মুসা বলল।

এটা কেন হচ্ছে? আপনি কিছু মনে করছেন কিনা? বলল ইভা নারিন।

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে আমি মনে করি আগুনের সাথে SMG নামে এক প্রকার গ্যাসও পুড়ছে। সারিন মাল্টিপুল গ্যাস আগুনের সাথে মিশে ধোঁয়ায় পরিণত হলে তা ভয়ংকর প্রাণঘাতী হয়ে। ওঠে। আহমদ মুসা বলল।

ও গড! তাহলে তো ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলেই মৃত্যু! বলল ইভা নারিন।

হ্যাঁ, ধোঁয়া থেকে কমপক্ষে ২০ ফুটের বেশি দূরে থাকতে হবে। ধোঁয়া থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত SMG গ্যাসের অদৃশ্য প্রভাব থাকে। আহমদ মুসা বলল।

ভেতরে কেউ থাকলে তারা তো আগুন জ্বলে ওঠার সংগে সংগেই মারা গেছে। বলল ইভা নারিন।

কেউ যেহেতু বেরিয়ে আসেনি, বেরিয়ে আসছে না, তার অর্থ আপনি যা বলেছেন সেটাই। তবু একবার দেখতে হয় ভেতরে কেউ আছে কিনা।

বলেই আহমদ মুসা গাড়ির ভেতর থেকে তার ব্যাগ নিয়ে একটা মিনি গ্যাস মুখোশ বের করে নিল। বলল, ইভা নারিন, একটাই গ্যাস মুখোশ আছে। অতএব আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।

আহমদ মুসা মুখোশ পরতে যাচ্ছিল। এমন সময় পেছনে একসাথে। অনেক হৈ চৈ শুনতে পেল।

পেছনে তাকাল আহমদ মুসা ও ইভা নারিন দুজনেই। আগুনের আবছা আলোয় দেখল একদল লোক এদিকে ছুটে আসছে।

এলাকার লোক নিশ্চয়! আগুন লাগা দেখে ওরা এদিকে ছুটে আসছে। আপনি ওদের আটকে রাখুন। আমি আসছি। বলেই ছুটল আহমদ মুসা জ্বলন্ত ঘরগুলোর দিকে। ধোঁয়ায় তখন মাঝখানের চত্বরটা আচ্ছন্ন। ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে মাঝখানের শেডটা। স্বাভাবিক ধোঁয়ার চেয়ে এ ধোঁয়া ভারি। এত নিচে এত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ এটাই।

আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে। বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়েছিল ইভা নারিন। স্থানীয় লোকগুলো ছুটে আসছিল প্রজ্বলিত টিলার দিকে।

টিলার গোড়ায় গ্যাস বাতির আলোতে ওদের দেখা গেল। অনেক লোক ওরা।

আরও কয়েক মিনিট সময় নিল ওরা টিলার উপর পৌঁছতে। গাড়ি দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। গাড়ির পাশে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল ইভা নারিন।

লোকরা দৌড়েই আসছে। টিলাতে উঠেও তারা ছুটে আসছিল।

ইভা নারিন কয়েক পা সামনে হেঁটে দুহাত তুলে দাঁড়াল। বলল, সামনে আর এগোনো যাবে না। প্লিজ।

ছুটে আসা লোকগুলোর সামনে মাঝবয়সী আর একজন মেয়ে। তার দুপাশে দুজন তরুণ-তরুণী।

তারাসহ ছুটে আসা লোকগুলো থমকে দাঁড়াল। তরুণটি চিৎকার করে বলল, তোমরা কে, কেন আমাদের বাধা দিচ্ছ, যখন আমাদের সম্পদ পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে? আগুন নেভাতে হবে। সরে দাঁড়াও।

বলে আবার তারা ছুটতে শুরু করল।

প্লিজ আপনারা এগোবেন না। আগুনের ধোঁয়া প্রাণহানিকর, বিষাক্ত। প্লিজ! চিৎকার করে বলল ইভা নারিন।

আবার থমকে দাঁড়াল লোকগুলো।

সেই তরুণটিই বলল, কে আপনারা? এসব কি বলছেন? আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছেন কেন?

এই তরুণটি আহমদ নেবেজ। দিভিন উপত্যকার যুব নেতা। ইয়েরেভেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

আহমদ নেবেজ থামতেই তার পাশের এক তরুণী বলে উঠল, সবাই এখানে দাঁড়াক। চল আমরা আগে ওর কাছ থেকে বিষয়টা কি জানি। যে মহিলা কথা বলছে, আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছে, তাকে তো এই। উপত্যকার লোক কিংবা কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।

কিন্তু কথা বলার সময় কোথায়? সময় নষ্ট করা কি ঠিক হবে? বলল আহমদ নেবেজ। তার কণ্ঠ কিছুটা শান্ত। যে তরুণীটি তার আগে কথা বলল সে দিভিন উপত্যকার সরদার মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের মেয়ে শেপল। সেও দিভিন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী এবং একজন তুখোড় সমাজকর্মী।

আহমদ নেবেজের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে মাঝ বয়সী একজন মেয়ে বলল দ্রুত কণ্ঠে, ধোঁয়া বিষাক্ত, প্রাণহানিকর! এসব কথা ভুয়া! আসলে এরাই আগুন দিয়েছে। আহমদ নেবেজ ঠিকই বলেছে, আর সময় নষ্ট করা যায় না।

বলে সে সামনে ছুটতে শুরু করল। তাঁর সাথে সাথে সবাই।

ইভা নারিনও তখন মরিয়া।

সে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে চিৎকার বলে বলল, সামনে যাওয়া যাবে না, ভয়ংকর বিপদ আছে সামনে।

উত্তেজনাকর অবস্থা। মিছিলের সামনের সারি থেকে এসে শেপল ফিরে দাঁড়িয়েছিল। তার সাথে আহমদ নেবেজও ফিরে দাঁড়াল। তারা হাত তুলে মিছিল থামাতে চেষ্টা করল। ঠিক এ সময় গুলির শব্দ হলো।

গুলি করা হয়েছিল ইভা নারিনকে লক্ষ করে। সে সংগে সংগে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিতে না পারলে যে গুলিটা তার বাহুতে বিদ্ধ হয়েছে, তা তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত।

ইভা নারিন গুলি খেয়েও মিছিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়নি। সে ডান হাত দিয়ে তার বাম বাহুটা চেপে ধরেছে মাত্র।

বিশৃঙ্খল অবস্থা। মিছিলের কেউ থমকে দাঁড়িয়েছিল, কেউ কেউ সামনে এগোচ্ছিল।

গুলি করেছিল মাঝ বয়সী ঐ মেয়েটি, যে কথা বলার পর মিছিল থেকে সামনে ছুটে গিয়েছিল।

প্রথম গুলির টার্গেট ব্যর্থ হতে দেখে মেয়েটি দ্বিতীয় গুলি করার জন্যে রিভলবার তুলেছিল ইভা নারিনের লক্ষে।

আহমদ মুসা বেরিয়ে আসছিল প্রজ্বলিত আগুন ও ধোঁয়ার দিক থেকে। তার কাঁধে একজন মানুষ। প্রথম গুলির শব্দ শুনে সে দ্রুত আসছিল। ঘটনাস্থলের দিকে। ইভা নারিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তা দেখতে পেল সে।

সে দেখতে পেল মিছিলের সামনে থেকে আবার একটি রিভালবার ওপরে উঠেছে ইভা নারিন লক্ষে। ইভা নারিনের দৃষ্টি ছিল নিজের আহত বাহুর দিকে। গুলিটা তার বাম বুকে লাগার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিতে পারায় গুলিটা বাম বুকে না লেগে বাম বাহুতে লেগেছে।

সময় ছিল না আহমদ মুসার হাতে। লোকটিকে কাঁধে রেখেই ডান হাত দিয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলি করল রিভলবার তুলে ধরা মেয়েটির হাত লক্ষে। _ ইভা নারিনকে লক্ষ করে রিভলবার তুলেছিল মেয়েটি। আহমদ মুসার গুলি তার ডান হাতকে বিদ্ধ করল। পড়ে গেল মেয়েটির হাত থেকে রিভলবার।

গুলি খেয়ে মেয়েটি একটু থমকে গিয়েছিল, কেঁপে উঠেছিল তার দেহটা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে নিজেকে মুহূর্তেই সামলে নিয়ে মেয়েটি বাম হাত দিয়ে তার কামিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট গোলাকার জিনিস বের করে ছুঁড়তে গেল আহমদ মুসাদের লক্ষ করে।

ব্যাপারটা দেখতে পেল আহমদ মুসা। বিস্মিত হলো সে, মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়েও পাল্টা আক্রমণে আসতে পারল! কি ছুড়ছে ওটা! বিষাক্ত গ্যাসের মত কিছু নয়তো!

আহমদ মুসা আর চিন্তা করতে পারল না। সে খুব সাবধানে গুলি করল মেয়েটির হাত নয়, বাম বাহু লক্ষে, যাতে বম্ব বা গ্যাস বম্ব জাতীয় বস্তুটি বিস্ফোরিত হবার কোন সুযোগ না পায়।

মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, শেপল, আহমদ নেবেজ, তোমরা সামনে। আগাও। ওরাই আমাদের সেন্টারে আগুন দিয়েছে, আমাদের সব ক্ষতির জন্যে ওরাই দায়ী। ওদের বাঁচতে দেয়া যায় না।

কথা শেষ করেই মেয়েটি আহত দুই হাত নিয়ে বসে পড়েছে।

মেয়েটির কথা শেষ হতেই সব লোক চিৎকার করে উঠল, ধর ওদের, যেন পালাতে না পারে। আমাদের সর্বনাশ করেছে ওরা।

লোকরা আবার ছুটতে শুরু করুল আহমদ মুসাদের দিকে।

আহমদ মুসা এসে ইভা নারিনের সামনে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে লোকটিকে দ্রুত নামাল। খুলে ফেলল মুখ থেকে মুখোশ। পকেট থেকে বের করল অটো মেশিন রিভলবার। কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়ে দৌড়ে আসা লোকদের একদম সামনে এসে দাঁড়াল দুই হাত তুলে ওদের বাধা দেয়ার ভংগিতে। শূন্যে এক পশলা গুলি ছুঁড়ে আহমদ মুসা চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও তোমরা! দেখ, তোমরা আমাদের মারতে চাইলে তোমরাও বাঁচবে না। আমরা তোমাদের শত্রু নই। আমরা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, আগুন লাগা দেখে আমরা এখানে এসেছি।

শেপল ও আহমদ নেবেজ তখন লোকদের সামনের সারিতে। শেপল থমকে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে আহমদ নেবেজও দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি মনে করি লোকটি ঠিক বলছে। সে ভেতর থেকে আমাদের একজন লোককে নিয়ে এসেছে। লোকটি গ্যাস মাস্ক পরে ছিল। তার মানে ধোঁয়া বিষাক্ত হওয়ার কথা মিথ্যা নয়। বলল শেপল উচ্চস্বরে পেছনের সবাইকে লক্ষ করে।

লোকরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে।

তোমার কথা ঠিক হতে পারে। কিন্তু বল তো, লোকটা ত্রিফা আপার দুহাতে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে কেন? কেন ঘটানো হলো এটা? বলল আহমদ নেবেজ শেপলকে লক্ষ করে।

ত্রিফা আপাই প্রথম গুলি করেছে ঐ মেয়েটিকে। হাতে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে মেয়েটি। সেই আহত মেয়েটিকেই আবার গুলি করে মারতে গিয়েছিল ত্রিফা। এই অবস্থাতেই তো প্রথমবার লোকটি ত্রিফা আপার হাতে গুলি করেছে। গুলি খাওয়ার পরেও কিন্তু আপা বোমা ছুঁড়তে গিয়েছিল। দ্বিতীয় গুলি করেছে লোকটি এই কারণেই। সুতরাং ত্রিফা আপাকে আহত করার জন্যে তুমি ওদের কাউকেই কোনভাবে দায়ী করতে পার না। বলল শেপল।

ভ্রূ কুঞ্চিত হলো আহমদ নেবেজের। বলল, আমার ওদিকটায় খেয়াল ছিল না। মনোযোগ ছিল আমার আগুনের দিকে। গুলির শব্দ শুনেছি। যখন এদিকে তাকিয়েছি তখন ত্রিফা আপাকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। ঠিক আছে শেপল। লোকদের আমরা এখানে দাঁড়াতে বলি। চল আমরা আগে কথা বলি লোকটার সাথে।

কথা শেষ করেই আহমদ নেবেজ লোকদের সামনে গিয়ে তাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা দাঁড়ান। আমরা ওদের সাথে কথা বলছি।

আহমদ নেবেজের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শেপল। তারা দুজন এগোলো আহমদ মুসার দিকে। দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।

আমাদের প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বলুন, আপনার কি বলার আছে? বলল শেপল শক্ত গলায়।

সেসব কথা পরে হবে। আগে এই লোকটিকে বাঁচাতে হবে। ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্যে সে নাকে-মুখে কাপড় দিয়েছিল এবং শ্বাস বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছিল বলে এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু সে নিরাপদ নয়। তার শরীরে প্রচুর পানি ঢালতে হবে। তার বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়। বলল আহমদ মুসা।

কথা কয়টা বলেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, মেয়েটির দুহাতে গুলি লেগেছে, বুলেট হাতে ঢুকে নেই। কিন্তু অবিলম্বে তার চিকিৎসা দরকার। তার বোমাটি তার সামনেই পড়ে আছে। বিষাক্ত গ্যাস বোমা ওটা। পিন নেই বোমায়। আর দুতিন মিনিটের মধ্যেই ওটায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে। বোমা সরিয়ে ফেলুন অথবা লোকদের সরে যেতে বলুন অন্তত বিশ গজ দূরে। বলেই আহমদ মুসা এগোলো ইভা নারিনের দিকে। _ শেপলের বিস্ময়ভরা দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে! অদ্ভুত লোক! আমাদের লোককে বাঁচানোর জন্য তার উদ্যোগটাই যেন বেশি। তার গুলিতেই আমাদের ত্রিফা আপা আহত হয়েছে। অথচ সেই-ই তার চিকিৎসার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তার হাতে বুলেট ঢুকে নেই, লোকটি বুঝল কি করে? বিষাক্ত বোমা, পিন নেই তাতে, দুতিন মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে, তাই বা জানল কি করে লোকটা? আর তার পরামর্শগুলো সবই হুকুমের সুরে। আর মনে হচ্ছে, তার হুকুমগুলো শিরোধার্য হয়ে উঠেছে। কে এই লোক!

বিস্ময়ভরা প্রশ্নগুলো নিয়েই সে তাকাল আহমদ নেবেজের দিকে। বলল, কি ভাবছ তুমি?

ভাবছি না, বিস্ময় সামলাচ্ছি। অদ্ভুত এই লোক তো? যেন সে আমাদের পক্ষে কাজ করছে, আমাদেরই নেতা সে। আহমদ নেবেজ বলল।

কিন্তু যা বলেছে তা তো এখনি করতে হবে।

বলেই শেপল তাকাল আহমদ নেবেজের দিকে। বলল, তুমি কাউকে নিয়ে দারিস্তান আংকেলের গায়ে পানি ঢালার ব্যবস্থা কর। আমি ওদিকটা দেখছি।

শেপল গিয়ে ত্রিফা বেফ্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে লোকদের দিকে চেয়ে : চিৎকার করে বলল, তোমরা সকলে অন্তত বিশ গজ দূরে সরে যাও। এখনই এখানে বোমা ফাটবে।

বলার সাথে সাথেই শেপল ত্রিফা বেফ্রিনকে ধরে দাঁড় করাল। বলল, চলুন, ক্লিনিকে যেতে হবে। রক্ত দেখছি এখনও সমানে বের হচ্ছে।

দ্রুত লোকরা সরে গেল। শেপল ত্রিফা বেফ্রিনকে ধরে নিয়ে চলতে শুরু করল।

আহমদ মুসা ইভা নারিনের বাহুতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল। শেপলদেরকে বসতি এলাকার দিকে যেতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুনুন মিস…।

শেপল শুনতে পেয়েছে আহমদ মুসার ডাক। সে ঘুরে দাঁড়াল।

তোমাদের ক্লিনিক, ডাক্তারখানা এখান থেকে কত দূর? আহমদ মুসা। বলল

আমার নাম শাহিন শেপল। একটা ক্লিনিকের মত আছে। সেটা বেশ দূরে, বসতির মাঝখানে। বলল শেপল।

তাহলে এখানে আসুন। আমাদের গাড়িতে ব্যান্ডেজ ও অন্যান্য কিছু আছে। প্লিজ আসুন। আহমদ মুসা বলল।

শেপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ত্রিফা বেফ্রিনকে নিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।

ইভা নারিনের ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ইভা নারিন আহমদ। মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

শেপলরা এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ত্রিফা বেফ্রিনের দুহাত কাঁপছিল। সে দাঁড়াতে পারছিল না।

মিস ইভা নারিন, আপনি ওকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিন। বলল আহমদ মুসা।

উনিও তো আহত। আমিই ত্রিফা আপাকে শুইয়ে দিচ্ছি। শেপল বলল।

গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। শেপল ত্রিফাঁকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, আমি মেডিকেল কলেজে পড়ি।

আমি এর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছি।

ধন্যবাদ মিস শেপল। বলল আহমদ মুসা শেপলকে।

ইভা নারিন মেডিকেল কিটটা এগিয়ে দিল শেপলের দিকে।

আমি ওদিকে দেখি লোকটির গায়ে পানি ঢালার কি হলো। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার কথা শুনতে পেয়েই শেপল বলল, স্যার, পানি ঢালার দায়িত্ব যাকে দেয়া হয়েছে, সে আহমদ নেবেজ। সেও মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

গুড নিউজ, ধন্যবাদ মিস শেপল। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা গেল আহমদ নেবেজের কাছে।

কারিগরি কমপ্লেক্সের বাইরে পেছনের দিকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্যে একটা চৌবাচ্চা রয়েছে। এই জায়গাটা বাতাসের বিপরীতে বলে। এখানে ধোঁয়া নেই, আগুনও এপর্যন্ত আসেনি। এখানেই প্রায় সংজ্ঞাহীন দারা দারিস্তানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পানির কলের নিচে একটা তক্তপোশের উপর তাকে শুইয়ে তার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে।

আহমদ মুসা গিয়ে লোকটির মাথায় হাত রাখল। তার মনে হলো, এই ঠান্ডা ধোঁয়াটে কোন কিছুর পরমাণুকে জমাট করার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। আর ঐ বিষাক্ত গ্যাসটির পরমাণু জমাট বাঁধার সাথে সাথে বিষের অ্যাকশন কভার্ডও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।

আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো মেডিকেলের ছাত্র। কি বুঝছ তুমি?

সংজ্ঞা ফিরে আসছে স্যার। এখনি কথা বলার পর্যায়ে আসবে।

কথা শেষ করেই আহমদ নেবেজ আবার বলে উঠল, স্যার এর গায়ে পানি ঢালতে বললেন কেন? ধোঁয়া যদি বিষাক্তই হয় এবং সে বিষে যদি সে আক্রান্তই হয়ে থাকে তাহলে পানি কি করে তাকে বাঁচাবে?

আহমদ নেবেজ তুমি খেয়াল করনি তার নাক মুখ ভিজে কাপড়ে বাঁধা। ছিল। ভিজে কাপড় ধোঁয়ার সাথে বিষকেও শুষে নিয়েছিল। কিন্তু ফিলটারড হয়ে যেটুকু দেহের ভেতরে প্রবেশ করেছিল, তাতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওয়াটার থেরাপি করতে যদি বেশি দেরি হয়ে যেত, তাহলে তাকে বাঁচানো যেত না। দেহে পানি ঢালার ফলে ঠান্ডায় দেহের ভেতরে ক্ষতিকর বিষ যেটুকু ঢুকেছিল, তা জমাট বাঁধার ফলে কভারড হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।

শেপলও এসে আহমদ নেবেজের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন ছিল দারা দারিস্তানের অবস্থা নিয়ে।

আমার খুব বিস্ময় লাগছে, এটা যদি সত্য হয় আপনি আগুন দেখে এখানে এসেছেন, তাহলে এসেই বুঝলেন কি করে যে, ধোঁয়াটা বিষাক্ত। আমরা তো বুঝতে পারিনি। আহমদ নেবেজ বলল।

আগুনের শিখা যেখানে বুইশ ব্ল্যাক রং নিয়েছে তা দেখেই আমি নিশ্চিত হই যে, আগুনে কোন ধরনের গ্যাসের সংমিশ্রণ আছে। দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলির কিছু কিছু আমি জানি। সেই জানা থেকেই আমার সন্দেহ হয় যে, গ্যাসটা বিষাক্ত হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।

শেপল ও আহমদ নেবেজের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল শেপল, স্যার, আপনি কি গ্যাস-রসায়ন বিশেষজ্ঞ? সূক্ষ্ম পার্থক্যটা আপনি বুঝলেন কি করে? আর দিভিনের ঘটনাবলি কি করে জানলেন? এসব তো কোন পত্রিকায় বা কোন মিডিয়ায় আসেনি! আপনি তো বিদেশি। দিভিন উপত্যকায়ই বা আপনারা ঢুকেছিলেন কেন? এই রাস্তা দিভিনের মানুষ ও সরকারি লোক ছাড়া কেউ, বিশেষ করে ট্যুরিস্টরা এ রাস্তা ব্যবহার করে না।

মিস শেপল, তুমি যত প্রশ্ন করেছ, জবাব দিতে সময় লাগবে। আমার কথা বিশ্বাস করা, না করা দুই অধিকারই তোমাদের রয়েছে।

বলে মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। আবার বলল, এই মুহূর্তের জরুরি কাজ হলো, সংজ্ঞাহীন লোকটির সংজ্ঞায় ফিরিয়ে আনা, তাকে এবং ত্রিফাঁকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া অথবা তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় কাজ হলো, এই প্রতিষ্ঠানটি কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আগুনের সাথে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে- এই অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করা। তৃতীয় কাজ হলো, পুড়ে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠান পাহারা দেয়া, যাতে পুলিশ আসার আগে কেউ আলামত নষ্ট করতে না পারে। থামল আহমদ মুসা।

বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে শেপল এবং আহমদ নেবেজের মুখ। তারা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তারা ভেবে। পাচ্ছে না, তাদের যা করার কথা, যা বলার কথা, তা সেই বলছে। যেন সেই আমাদের নেতা। আমাদের করণীয় বলছে, পরামর্শ দিচ্ছে। যা করার কথা তাদের মাথায়ই আসেনি, সে কাজের কথাগুলো সে গড়গড় করে বলে গেল। কে এই লোক! শেপলরা তাকে শত্রু ভেবে গুলি করতে গেছে, তার সংগীকে গুলি করে আহত করেছে, হত্যাও করতে যাচ্ছিল। যে কারণে সেও শেপলদের একজনের দুহাত গুলিবদ্ধ করেছে। এসবের কোন ফয়সালা এখনও হয়নি। কিন্তু এসব কিছুই যেন তার মনে নেই। সে অযাচিতভাবে শেপলদের পরামর্শদাতা সেজেছে। কে এই অদ্ভুত লোক! ত্রিফার দুহাতে গুলি করা থেকে বুঝা গেছে সে সাংঘাতিক ক্ষিপ্র ও নিখুঁত লক্ষভেদি। আবার ধোঁয়ার রং দেখে বিষাক্ত গ্যাস চিহ্নিত করা এবং বিষাক্ত গ্যাস আক্রান্ত মানুষকে ওয়াটার থেরাপি দেয়া- এসব তার অসাধারণত্বের প্রমাণ। কে এই অসাধারণ মানুষ!

কিছু বলতে যাচ্ছিল শেপল।

সেখানে দ্রুত এল ইভা নারিন। আহমদ মুসাকে বলল, ত্রিফা বেদনায় কষ্ট পাচ্ছে।

আপনাকে যে ট্যাবলেট দিয়েছিলাম, সে ট্যাবলেট আমার ব্যাগে আরও আছে। সেখান থেকে একটা খাইয়ে দিন। আর আপনি কেমন আছেন? বলল আহমদ মুসা।

আমি ভালো আছি। আমার অভ্যাসও আছে। ঠিক আছে যাই। মিসেস ত্রিফাঁকে ট্যাবলেট খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি। বলল ইভা নারিন।

ইভা নারিন চলে গেল।

স্যার আপনারা কে? আপনাদের নাম পরিচয় জানা হয়নি। আমাদের চেয়ে আমাদের নিয়ে আপনাদের উদ্বেগই বেশি! আপনাদের পরিচয় জানতে পারলে আমরা খুশি হতাম।

এসব এখন থাক মিস শেপল। আমার পরামর্শের সাথে তোমরা একমত হলে কাজগুলো এখনই করা দরকার। বলল আহমদ মুসা।

স্যার, এখনি থানায় লোক পাঠাচ্ছি। তারা থানায় মামলা দায়ের করে আসবে। পাহারার ব্যবস্থাও এখনি করছি। আমাদের সহকারী নিরাপত্তা প্রধান দারা দারিস্তান জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। তাদের রেস্টের জন্যে তাদের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এসব ঘটনার সব বিষয় দিভিনের সরদারকে এখনি জানাতে হবে। স্যার, আপনাদের ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি? আহমদ নেবেজ বলল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, মেজবান মেহমানদের কি ব্যবস্থা। করবেন, এটা মেহমানই বলে দেবে? বলল আহমদ মুসা।

দুই হাত জোড় করে বিব্রত কণ্ঠে শেপল বলল, ব্যাপারটা তা নয়। স্যার। আপনাদের পরবর্তী কোন প্রোগ্রাম আছে কিনা, এটা স্যার আমরা জানতে চাচ্ছি।

এখন রাত অনেক। তোমরা কোন আগম্ভককে এত রাতে রাস্তায় ছেড়ে দেবে, তা হতে দিতে পারি না। আমরা জোর করেই মেহমান সাজব, এটা আমরা ঠিক করে ফেলেছি। হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।

চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শেপল ও আহমদ নেবেজ দুজনেরই। * বলল শেপল, ধন্যবাদ স্যার, আমরা আপনাদের মেহমান মনে করছি না। আপনারা এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা কোন মেহমানের কাজ নয়, আপন জনেরে কাজ। চলুন স্যার, আমরা সরদারের ওখানে যাব। তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন।

তোমাদের সরদার কে? কোথায় থাকেন? বলল আহমদ মুসা।

আমাদের সমাজ প্রধান মানে সরদার মোহাম্মদ আসতি আওয়াত। শেপল তার মেয়ে। বাড়ি দিভিন উপত্যকার মাঝামাঝি।

আহমদ মুসা শেপলের দিকে তাকাল। বলল, পিতার সরদারী গুণ তুমি পেয়েছ। পরিস্থিতি সামাল দিতে যা করেছ আমি তা লক্ষ করেছি।

কথা শেষ করেই তাকাল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। স্বর একটু নামিয়ে বলল, মেহমান হওয়ার তো কোন বিকল্প নেই। আপনি কি ভাবছেন?

বড় একটা ঘটনা ঘটল। কয়েকজন লোক মারা গেছে, তাই শুধু নয়। হত্যা করা হয়েছে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে। যাতে সবাই বুঝে কোন কারণে আগুন লেগে বিরাট রকমের ক্ষতি হয়েছে, লোকও মারা। গেছে। দিভিনে যা ঘটছে, এটা তারই একটা ধারাবাহিকতা। এখান থেকেই আপনার কাজ শুরু হতে পারে।

আপনার কাজও তো এটাই। বলল আহমদ মুসা।

আমি তো আগারাক যাচ্ছি আমাদের একজন অফিসারের নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে। ইভা নারিন বলল।

সত্যের অর্ধেকটা বললেন। অন্য অর্ধেকটা বলুন। বলল আহমদ মুসা।

অস্পষ্ট এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ইভা নারিনের ঠোঁটে। বলল, হ্যাঁ, বাবা আমাকে আমাদের অফিসারের নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্তের সাথে সাথে দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলির উপর নজর রাখতে বলেছেন। কিন্তু আপনি এটা জানলেন কি করে?

আপনার দিভিন পর্যন্ত আসা থেকেই আমি এটা বুঝেছি। আপনার ডিস্টিনেশন শুধু আগারাক হলে আপনি কিছুতেই এ পথে আসতেন না। আর আপনি যে ঘটনার তদন্তে আগারাক যাচ্ছেন, তার মূল তো দিভিনে। বলল আহমদ মুসা।

আপনার কথা সত্য। তবে মিশন যাকে বলে, সে রকম কিছু নিয়ে আমি আসিনি। আগারাক গিয়ে কি সিদ্ধান্ত হয় দেখতে হবে। ইভা নারিন বলল।

তাহলে আপনি আগারাক যাচ্ছেন। কিন্তু আমি এদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি। আপনিও শামিল আছেন। যা ঘটেছে তার গুরুত্ব আপনিও জানেন। তাছাড়া আপনি আহত। আপনার ড্রাইভ করা ঠিক হবে না, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায়, তাও আবার রাতে! বলল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ, ঘটনার প্রতি আমারও আগ্রহ আছে। আমি থেকে যাচ্ছি। কিন্তু ভাবছি, ওদের বিব্রত করা হবে না তো? ইভা নারিন বলল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, এটা ওদের ব্যাপার। জোর করেই তো আতিথ্য নিলাম, আমাদের গরজে। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা ও ইভা নারিন কিছুটা নিচু স্বরে কথা বলছিল। আর শেপলরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল দারা দারিস্তান ও ত্রিফা বেফ্রিনকে পাঠানো, পাহারাদার ঠিক করা ও থানায় লোক পাঠানোর কাজে।

অল্পক্ষণ পর শেপলরা ফিরে এল। বলল শেপলই, এদিকের কাজ শেষ স্যার। আমরা এবার যেতে পারি।

তোমাদের গাড়ি আসবে, তারপর আহত ও অসুস্থদের নিয়ে যাবে। তাতে দেরি হবে। আমাদের গাড়ি করে ওদের নেয়া যায়। মাঝের সিটে শেপল মিসেস ত্রিফাঁকে নিয়ে বসবে, পেছনের সিটে আহমদ নেবেজ দারা দারিস্তানকে নিয়ে বসবে। অসুবিধা নেই। বলল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ স্যার। তবে আমাদের ত্রিফা আপা ইয়েরেভেন যেতে চাচ্ছেন। ইয়েরেভেনের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান। বলল শেপল।

আহমদ মুসা তাকাল শেপল ও আহমদ নেবেজের দিকে। একটু ভাবল আহমদ মুসা। বলল, কেন যেতে চান? তার দুহাতই আহত, কিন্তু কোনটাই বড় কিছু নয়। তার ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়া কি নিরাপদ হবে? তোমরা কি মনে কর? বলল আহমদ মুসা।

আপনারাও জানেন দেখছি স্যার। অনেক ধন্যবাদ। আমি ও আহমদ নেবেজ দুজনেই ইয়েরেভেন মেডিকেল কলেজে পড়ি। কলেজে আমরা যেতে পারি না। ইয়েরেভেনের হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি ঔষধের দোকানগুলোতেও আমরা অবাঞ্ছিত। প্রায় এক বছর ধরে ইয়েরেভেনের হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো আমাদের জন্যে বলা যায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মাদ বেহেজের স্ত্রী এবং দিভিনের একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে ত্রিফা আপা আরও বেশি। পরিচিত। সুতরাং ইয়েরেভেন তার জন্যে নিরাপদ নয়। বলল শেপল।

তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কেন? বলল আহমদ মুসা।

ত্রিফা আপা টেলিফোনে কার সাথে যেন আলাপ করলেন। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত নিলেন। আহমদ নেবেজ বলল।

মিসেস ত্রিফা বেফ্রিনের স্বামী মানে আপনাদের নিরাপত্তা প্রধান। মোহাম্মাদ বেহেজ কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

উনি সন্ধ্যার আগে নদী-বন্দরে গেছেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। রাতের মধ্যেই ফিরবেন। শেপল বলল।

অনেকক্ষণ ধরেই একটা চিন্তা উঁকি দিচ্ছিল আহমদ মুসার মনে। মিসেস ত্রিফা কি শেপল, আহমেদ নেবেজ এবং অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা? মিসেস ত্রিফা ইভা নারিন মানে আমাদের মেরে ফেলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? এতটা বৈরিতার কিছু তো সেখানে ঘটেনি? মাত্র একটা সন্দেহ যে, আমরা আগুন লাগানোদের সাথের লোক কিনা! শুধু এজন্যেই কি কেউ এতটা মরিয়া হতে পারে মেরে ফেলার জন্যে! তার মানসিকতা যদি এটাই হয়, তাহলে সে ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়ার কথা নয়। অংক মিলছে না! কেন মিলছে না?

আহমদ নেবেজের কথা আহমদ মুসার কানে গিয়েছিল, কিন্তু উত্তর দেয়া হয়নি। সেই উত্তরটাই অবশেষে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসা, তাহলে আহমদ নেবেজ তুমি মিসেস ত্রিফাঁকে বল যে, মোহাম্মাদ বেহেজ ফিরে না আসা পর্যন্ত তার ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টা চূড়ান্ত করা যাবে না।

ঠিক আছে স্যার, আমি তার সাথে কথা বলি।

বলেই আহমদ নেবেজ ছুটল মিসেস ত্রিফার দিকে। ব্যান্ডেজ শেষ হবার পরেই গাড়ির কাছ থেকে সরে গিয়ে একটু দূরে মোবাইল নিয়ে সে বসেছিল। তার সাথে কথা বলল আহমদ নেবেজ।

মিনিট দুই পরেই ফিরে এল আহমদ নেবেজ। তার মনটা খারাপ। আহমদ মুসা প্রশ্ন করতেই সে বলল, না স্যার, রাজি হলেন না। হাসপাতালেই যাচ্ছেন। হাসপাতালের সাথে কথা হয়েছে। উনি হাসপাতালেই যাবেন স্যার। উনি আমাদের নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মাদ বেহেজের সাথেও কথা বলেছেন।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, এরপর আর কোন কথা থাকতে পারে। উনি কি এখনি যাচ্ছেন? গাড়ি রেডি। এখনি বেরুচ্ছেন তারা। বলল আহমদ নেবেজ।

ঠিক আছে। এখন মাঝের সিটে উঠবে শেপল ইভা নারিনের সাথে আর তুমি দারা দারিস্তানকে নিয়ে পেছনের সিটে বস। বলল আহমদ মুসা।

একটু থেমেই আবার বলল আহমদ মুসা, যাওয়ার আগে আহমদ নেবেজ একটু দেখে নাও পাহারাদাররা তাদের দায়িত্ব নিয়েছে কিনা? থানায় যাদের পাঠিয়েছ তাদের খবর কিছু আছে কিনা। আর পাহারাদারদের ভালো করে বলে যাও পুলিশ আসার আগে অগ্নিদগ্ধ স্থানে। কোথাও যেন কেউ প্রবেশ না করে।

ঠিক আছে স্যার। সব খবর আমি নিচ্ছি। আর পাহারাদারদের দায়িত্ব। নিয়েছেন আমাদের এই ক্যুনিটি কমপ্লেক্সের পরিচালক জনাব বারজানি। তাঁকেই বিষয়টা বুঝিয়ে আসছি।

চলে গেল আহমদ নেবেজ কথা শেষ করেই।

সবাইকে নিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ি তখন যাত্রা শুরু করেছে।

গাড়ির পেছনে মোবাইল বেজে উঠল।

আহমদ নেবেজের মোবাইল।

আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে, মনোযোগও সামনে, ভাবনাও সামনের সময়কে নিয়ে।

টেলিফোনে আহমদ নেবেজের কথা আর তার কানে যায়নি।

কথা শেষ হয়ে গেছে আহমদ নেবেজের।

কল অফ করেই সে বলে উঠল, স্যার, একটা সুসংবাদ। ত্রিফা আপা ইয়েরেভেনের হাসপাতালে যাচ্ছেন না।

শুনেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, কেন? কোন কিছু ঘটেনি তো?

না কিছু ঘটেনি। উনি মত পাল্টেছেন। আহমদ নেবেজ বলল।

আহমদ মুসার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, আহমদ নেবেজ, তোমাদের মোহাম্মাদ বেহেজ দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান, তোমাদের ত্রিফা আপাও নিশ্চয় একজন অ্যাকটিভিস্ট?

না স্যার, ত্রিফা আপা শান্তশিষ্ট স্বভাবের, চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসেন। তবে তিনি সব প্রোগ্রামে যান। সব কাজে উপস্থিত থাকেন।

তিনি অ্যাকটিভিস্ট না হলে তার হাতে রিভলবার ও পয়জন বম্ব এল, কি করে? গুলি ছোঁড়ায় তার ভালো হাত আছে। তাকে খুব সাহসী ও বেপরোয়া মনে হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।

সেটা তো আমরাও ভাবছি স্যার। হঠাৎ উনি একি করলেন? সত্যিকারের রিভলবার বোমা তার কাছে থাকবে, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। শেপল বলল।

থাক এসব কথা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি দিভিনের নিরাপত্তা প্রধানের স্ত্রী। আকস্মিক সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি তার থাকতে পারে।

কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, আর কত দূরে তোমাদের বাড়ি শেপল?

এসে গেছি স্যার। আর অল্প পথ।

একটু থেমেই শেপল বলল, স্যার, একটা কথা বলা হয়নি আপনাকে। আজ সন্ধ্যায় আমার আম্মা মারা গেছেন। গম্ভীর, ভারি কণ্ঠ শেপলের।

তোমার মা মানে সরদারের স্ত্রী মারা গেছেন? বলল, আহমদ মুসা। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, দাফন হয়েছে?

না স্যার, দাফন হয়নি। মৃত্যুটা খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়েই আলোচনা চলছিল, এরই মধ্যে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। আমরা এদিকে ছুটে আসি। শেপল বলল।

বুঝলাম। মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় মানে অস্বাভাবিক। সেটা কি? বলল আহমদ মুসা।

শেপল তার অসুস্থতা ও ঔষধ না পাওয়ার বিষয় জানিয়ে বলল, মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্যে ১২ ঘন্টার মধ্যে যে ঔষধের দরকার ছিল, তা দিভিনে ছিল না, অন্য কেউ আমাদের কাছে বিক্রি করতেও চায়নি।

স্যরি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এই অবস্থার মধ্যে আমরা যাচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে। খুবই খারাপ লাগছে। বলল আহমদ মুসা।

খারাপ বোধ করার প্রয়োজন নেই স্যার। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা দিভিনে এতই ঘটেছে এবং ঘটছে যে, দিভিবাসীদের কাছে সব মর্মান্তিক ঘটনাই আজ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বলল শেপল। ভারি কণ্ঠ। তার।

শেপল থামতেই আহমদ নেবেজ বলল, স্যার, গাড়িটা ডাইনের লেনটায় নিতে হবে। ডান দিকে সামনের টিলাটায় শেপলদের বাড়ি। ডানের লেনটাই টিলায় উঠে গেছে।

আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।

আহমদ মুসা এবং সবার দৃষ্টি এখন সামনে, শেপলদের বাড়ির দিকে।

.

রাতে লাশ দাফন হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে সকালে লাশ দাফন করা হবে, দিভিন প্রধান মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের স্ত্রীর।

স্ত্রীর লাশ যে ঘরে রাখা আছে তার দরজার সামনেই বসে আছে। মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।

বাইরের উঠানের শেষ প্রান্তে যে উন্মুক্ত বৈঠকখানা সেখানে বসে আট দশজন লোক।

তাদের মধ্যে আহমদ নেবেজও রয়েছে। তারাও সারারাত থাকবে মাইয়েতের বাড়িতে।

বাইরের দিক থেকে এসে ছেলে এরদেলান মোহাম্মদ তার পিতা মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের পাশে বসল। বলল, বাবা আমি তো আছিই, আপনি একটু গিয়ে রেস্ট নিন।

রেস্ট নেয়ার সময় অনেক পাওয়া যাবে বেটা, এই রাত তো আর আসবে না। বলল মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।

সজল হয়ে উঠেছে এরদেলান মোহাম্মদের দুই চোখ। উত্তরে কিছু বলল না সে।

শেপল তার ঘরের দিক থেকে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল বসে থাকা পিতা ও ভাইয়ের সামনে।

মোহাম্মদ আসতি আওয়াত হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত তিনটা তখন। বলল সে, মা শেপল ঘুমাওনি? আবার উঠে এলে কেন?।

বাবা ঘুম ধরছে না। ভাবলাম, মায়ের পাশে বসে একটু কুরআন শরিফ পড়ি। শেপল বলল।

বস মা। মেহমানদের শোবার কি ব্যবস্থা করেছ? জিজ্ঞাসা করতে চেয়ে ভুলেই গেছি। বলল মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।

শেপল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ভাইয়ের পাশে বসল। বলল, আমাদের বাইরের মেহমানখানার দুটো রুম তাঁদের দিয়েছি বাবা।

আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তারা স্বামী স্ত্রী কি না? বলল আসতি আওয়াত।

আমিও জানি না বাবা, জিজ্ঞাসা করিনি। তবে স্যার বলেছিলেন, তোমার ম্যাডাম ইভা নারিনের জন্যে আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা কর। আমি যেকোন জায়গায় থাকতে পারব। শেপল বলল।

তোমার স্যারের নাম কি? নানা ঘটনায় আজ মনটা এতই বিক্ষিপ্ত যে, তার সাথে ভালো করে আলাপও করতে পারলাম না। নাম জিজ্ঞাসার কথাও মনে ছিল না। বলল আসতি আওয়াত।

স্যরি বাবা, নাম জিজ্ঞাসা করার তেমন সুযোগ আমরাও পাইনি। দুএকবার পরিচয় জানতে চেয়েছি। উনি বলেছেন, পরিচয় জানার সুযোগ অনেক পাবে, এসময়ের কাজগুলো করার সুযোগ সামনে আর আসবে না। আমরা আর কিছু বলতে পারিনি। শেপল বলল।

আমিও আশ্চর্য হয়েছি মা। খুব ভদ্র, শান্ত ও বিনয়ী লোকটি কিন্তু কথা যা বলে, করণীয় সম্পর্কে যে পরামর্শ দেয়, তা অনড় ও নির্দেশের শক্তিশালী মনে হয়। লোকটি কে? বলল আসতি আওয়াত।

সত্যি বাবা, অদ্ভুত তার কথার শক্তি।

ত্রিফা আপার গুলিতে ম্যাডাম ইভা নারিন আহত হওয়া, ত্রিফা আপা দ্বিতীয় গুলি করে ইভা নারিন ম্যাডামকে হত্যা করতে চেষ্টা করা, স্যার গুলি করে ত্রিফা আপার দুই হাত আহত করা, তারপর যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটতে যাচ্ছিল- সেটাকে স্যার কয়েকটা কথা বলে থামিয়ে দেন। তাঁর কথার অদ্ভুত শক্তি ও প্রভাবের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এরপর পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন এবং তিনি আমাদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমরা সবাই বিনা দ্বিধায় তার নির্দেশ-পরামর্শ মেনে চলেছি। মনে হয়েছে তিনি বন্ধু বা সাহায্যকারীর চেয়েও বড় কিছু। এ নিয়ে আমার বিস্ময় এখনও কমেনি বাবা। শেপুল বলল।

বাবা, নিশ্চয় আপনি খেয়াল করেছেন, আমাদের সাথে কথা বলার সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক ষড়যন্ত্রের উত্থান পর্ব থাকে। এক পর্যায়ে কোন ঘটনার প্রবল ধাক্কায় সে ষড়যন্ত্রের পতন পর্ব শুরু হয়। আজকের ঘটনা সেরকমই কিছু হতে পারে। তার একথার মধ্যে শুধু আমাদের জন্যে সান্ত্বনা নয়, তার তরফ থেকে একটা প্রতিশ্রুতিও আছে। এ থেকে তার কি পরিচয়, তা আমাদের কাছে খুব বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বলল এরদেলান মোহাম্মদ।

এরদেলান মোহাম্মদের কথা শেষ হতেই শেপল বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, হ্যাঁ ভাইয়া, কথাটা আমিও খেয়াল করেছি। তোমার কথা ঠিক। তুমি বুদ্ধিজীবী বলেই কথাটার তুমি ভেতরের অর্থও বের করেছ, আমি পারিনি। শেপল বলল।

তার মানে তোমরা বলতে চাচ্ছ, তিনি বা তারা দিভিনের পক্ষের? কিন্তু কে তারা? কি করবেন তারা? এর আগে পুলিশ, গোয়েন্দা, কিংবা বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষী যারাই দিভিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তারাই নিহত হয়েছেন। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা নয়। বলল আসতি আওয়াত।

আসতি আওয়াতের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই একসাথে কয়েকটা স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। শব্দ শেষ হবার পরেই একটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, য়ে আমাদের বাধা দেবে, যে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে, তাকেই ঝাঁঝরা করে দেবে আমাদের গুলির ঝাঁক। বাঁচতে চাইলে যে দুজন লোক এখানে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের আমাদের হাতে তুলে। দাও আমরা চলে যাব।

আসতি আওয়াতরা তিনজনই উঠে দাঁড়িয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তারা নির্বাক। শেপল একটু এগিয়ে উঁকি মেরে দেখল, তাদের উঠানের বিভিন্ন স্থানে মুখোশধারীরা স্টেনগান হাতে পজিশন নিয়েছে। কয়েকজন স্টেনগানধারী বৈঠকখানার লোকদের ঘিরে রেখেছে। শেপল ফিরে এসে আসতি আওয়াতদের সবটা জানিয়ে বলল, বাবা ওদের কথার কি জবাব দেবে?

আমরা কি জবাব দেব। মেহমানদের কেমন করে আমরা ওদের হাতে তুলে দেব। আমরা তা পারব না। যা ঘটার তাই ঘটবে। বলল আসতি আওয়াত।

বলেই আসতি আওয়াত এরদেলানকে বলল, হ্যান্ড মাইক্রোফোনটা নিয়ে এস।

এরদেলান দৌড় দিয়ে গিয়ে মাইক্রোফোনটা নিয়ে এল। আসতি আওয়াত মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বারান্দার আর একটু সামনে এগিয়ে মাইক্রোফোন মুখে তুলে উচ্চঃস্বরে বলল, তোমরা কে জানি না, তোমরা আমাদের মেহমানকে কেন চাও তাও জানি না, কিন্তু আমরা বলে দিচ্ছি, আমাদের মেহমানকে কোন অবস্থাতেই কারও হাতে আমরা তুলে দেব না।

এ কথার সঙ্গে সঙ্গে উঠান থেকে সেই কণ্ঠ আবার চিৎকার করে উঠল, আমরা যা বলি তা করি। এখন থেকে দশ পর্যন্ত গুনার মধ্যে যদি দুজনকে আমাদের হাতে তুলে না দেয়া হয়, তাহলে এখানে আটকে থাকা দশজনের মধ্যে থেকে প্রতি মিনিটে একজনকে হত্যা করা হবে।

কথা শেষ করেই লোকটি উচ্চঃস্বরে গুনা শুরু করল।

শেপল, এরদেলানরা আতংকিত হয়ে পড়ল। গম্ভীর আসতি, আওয়াত।

বাবা, এখন কি হবে? আমি মনে করি, ওরা যা বলেছে তা করবে। বলল শেপল শুকনো, ভয়ার্ত কণ্ঠে।

আমরা কি মেহমানদের ওদের হাতে তুলে দেব? না, তা হবে না। যা হয় হবে, আল্লাহ ভরসা।

এক গুনা শেষ হতেই বাড়ির পুবের অংশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল। বলল সে, তোমরা যে দুজনকে হাতে পেতে চাচ্ছ আমি তার একজন। তোমাদের দাবি মেনে আমি তোমাদের কাছে আসছি দুই শর্তে। এক, বাড়ির বিভিন্ন স্থানে মোতায়েনকৃত তোমাদের সব লোককে তোমার ওখানে সরিয়ে নাও, দুই. বৈঠকখানায় আটকে রাখা দশজনকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে এদিকে আসতে দাও। ওরা বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছবে, আমিও তোমাদের কাছে পৌঁছব।

আহমদ মুসা কথা শেষ করল। শান্ত-স্থির তার কণ্ঠ। আমরা তোমার শর্ত মানছি। কিন্তু তুমি একা আসলে হবে না, তোমার। সাথেরজনকেও নিয়ে আসতে হবে। বলল উচ্চঃস্বরে সেই কণ্ঠই।

দ্বিতীয়জন মহিলা, অসুস্থ। তারপরেও তোমরা জোর করলে ওরা দশজন এসে নিরাপদ হবার পর সে যাবে। চিন্তা কি! আমি তো তোমাদের হাতেই থাকছি। বলল আহমদ মুসা। তার সেই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠ।

ঠিক আছে, আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু ওরা দশজন ভেতরে প্রবেশের পরই তাকে আসতে হবে। আমরা এদের ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি এস। সেই লোকটি বলল চিৎকার করেই।

এতক্ষণে উদ্বেগ-আতংকে আসতি আওয়াতের মুখ ছেয়ে গেছে। বলল, আমরা মেহমানদের রক্ষা করতে পারলাম না।

বলেই আসতি আওয়াত মাইক্রোফোন মুখে তুলে নিল। বলল সে, আমি সম্মানিত মেহমানকে বলছি। আমরা সন্ত্রাসীদের কোন দাবিই মেনে নেব না। এতে যে পরিণতি হয় হোক, একসাথেই তা আমরা বরণ করব। প্লিজ মেহমান, আমরা অনেক কষ্টে আছি, কষ্ট দয়া করে আর বাড়াবেন না। প্লিজ! দৃঢ় কণ্ঠে কথা শুরু করেছিল আসতি আওয়াত, কিন্তু শেষে কণ্ঠটা তার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

শেপল ও এরদেলানের চোখ থেকেও অশ্রু গড়িয়ে এল।

দিভিনের সম্মানিত প্রধান আসতি আওয়াত, নিজেদের ইচ্ছায় ভেবে চিন্তেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্লিজ, বাধা দেবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। জীবন-মৃত্যুর মালিক তিনি।

কথা বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা চলতেও শুরু করেছে।

আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান এগিয়ে তাদের বারান্দার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা দেখল আহমদ মুসা ধীরপায়ে শান্তভাবে এগিয়ে। যাচ্ছে। চত্বরের মাঝখানে খুঁটিতে টাঙানো গ্যাস বাতির আলো আহমদ মুসার মুখে গিয়ে পড়েছে। মুখ একেবারেই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন। এরদেলান বলল, বাবা আমাদের মেহমানকে দেখ, আমরা উদ্বিগ্ন, আতংকিত, কিন্তু উনি দেখ একদম নিশ্চিন্ত। ভয়-উদ্বেগের চিহ্ন তার চোখে-মুখে নেই।

কি ঘটতে যাচ্ছে, আমার বুক কাঁপছে। স্যার কি কিছুই বুঝতে পারছেন না? না তিনি অবস্থার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন! বলল শেপল।

আগুন লাগার ওখানে তিনি যে কাজ করেছেন, এখনও সেই কাজই তিনি করতে যাচ্ছেন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু মানুষকে বাঁচাতে যাচ্ছেন। এমন মানুষ দুনিয়াতে খুব কম আছে। জানা হলো না কে তিনি! আসতি আওয়াত বলল। তার শেষের কথাগুলো কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।

আহমদ মুসা যেমন ওদের কাছে যাচ্ছে, তেমনি শেপলরা দেখল যে দশজন আহমদ মুসা যে মেহমানখানা থেকে বেরিয়েছে, সেই মেহমানখানার দিকে একসাথে আসছে। ওদের দশজনের সামনে হাঁটছিল আহমদ নেবেজ।

মাঝপথে আহমদ মুসার সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। আহমদ নেবেজ কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, স্যার এ কি করলেন? আপনার বিনিময়ে আমরা বাঁচতে চাই না স্যার।

আহমদ নেবেজ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার সাথে অন্যেরাও।

আহমদ নেবেজ, অশ্রু মুছে ফেল। বিপদের সময় কাঁদার অর্থ মরার আগে মরে যাওয়া। যা এখন ঘটছে তা ঘটতে দাও। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। যাও। নির্দেশের স্বরে বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ গম্ভীর, বলিষ্ঠ।

আহমদ নেবেজ চোখ মুছে মাথা নিচু করে আবার হাঁটতে শুরু করল।

অদ্ভুত, অদ্ভুত! এমন কথা, এমন কণ্ঠ কখনও কোথাও শুনিনি। কথায়। যেন যাদু আছে। মনে হচ্ছে, শক্তি, সাহস কোত্থেকে আমার মধ্যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আল্লাহ আমাদের এই ভাইটিকে রক্ষা করুন। অনেকটা শান্ত ও স্বগত কণ্ঠে বলল আসতি আওয়াত।

শেপল, এরদেলান দুজনেই বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। শেপলের স্বগত কণ্ঠ বলল, বাবা, শুরু থেকেই তাঁকে নেতার ভূমিকায় দেখছি। এখনও তিনি নেতার মতই নির্দেশ দিলেন। জানা হলো না বাবা এই বিস্ময়কর মানুষটির নাম-পরিচয়। শেপলের শেষের কথাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল।

উনি কাঁদতে নিষেধ করেছেন শেপল। বলল এরদেলান মোহাম্মদ। তার কণ্ঠ ভারি।

উনি মরার আগে মরতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমরা তো মরেই গেছি ভাইয়া। শেপল বলল কান্নাজড়িত কণ্ঠে।

সন্ত্রাসীরা বৈঠকখানার সামনে এসে সবাই জমা হয়েছিল। তাদের স্টেনগান উদ্যত আহমদ মুসার দিকে।

আহমদ মুসা হাঁটছিল ওদের লক্ষে।

আহমদ মুসা তখন চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছেছে। ওরা তখনও আহমদ মুসা থেকে পঁচিশ তিরিশ ফিট দূরে।

আহমদ মুসা চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছতেই ওদের মধ্যে থেকে সেই আগের লোকটি নির্দেশের স্বরে বলে উঠল, তুমি ওখানেই দাঁড়াও। তোমাকে সার্চ করা হবে, তারপর তুমি আসবে। তুমি দুহাত উপরে তোল।

সংগে সংগেই আহমদ মুসা, দুহাত উপরে তুলল। তবে দুকানের উপরে নয়। দুহাত তার দুকানের পেছন বরাবর গিয়ে স্থির হলো।

আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে দুহাত উপরে তুলতেই ওদের মধ্যে থেকে একজন স্টেনগাধারী আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল তাকে সার্চ করার জন্যে।

স্টেনগানধারী আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতের স্টেনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে দুহাত মুক্ত করে সার্চ করা শুরু করতে গেল। লোকটি আহমদ মুসার কাঁধ থেকে।

চোখের পলকে আহমদ মুসার দুহাত নেমে এল এবং লোকটিকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে চেপে ধরল বুকের সাথে। তার সাথে সাথেই আহমদ মুসার ডান হাত মাথার পেছনে গিয়ে জ্যাকেটের নিচে আটকানো অটো হ্যান্ড মেশিন রিভলবার বের করে নিল এবং ডান হাতটা দ্রুত সামনে এনেই ফায়ার শুরু করল।

সন্ত্রাসী ওরাও সবই দেখতে পেয়েছিল। তাদের স্টেনগানও উঠে এসেছিল আহমদ মুসার লক্ষে। কিন্তু গুলি করতে পারেনি। গুলি করলে তা আহমদ মুসাকে নয়, তাদের আজকের দলপতির দেহকেই ঝাঁঝরা করে দেবে। তাদের এই দ্বিধার সুযোগ আহমদ মুসা গ্রহণ করলো। তার অটো হ্যান্ড মেশিন রিভলবারের গুলির বৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এক ঝাঁক সন্ত্রাসীকে মাটিতে শুইয়ে দিল লাশ বানিয়ে। আর যার কণ্ঠনালিকে বাম হাত দিয়ে সাঁড়াশির মত পেঁচিয়ে ধরেছিল, সেও লাশ হয়ে ঝুলে পড়েছে আহমদ মুসার হাতে। বাঁ হাত সরিয়ে নল। চত্বরের উপর ঝরে পড়ল লোকটির লাশ।

ইভা নারিন এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। তার পেছনে এল আহমদ নেবেজরা। আসতি আওয়াত এবং শেপলরাও ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।

সবার বিস্ময় দৃষ্টি লাশের স্তূপের দিকে আর আহমদ মুসার দিকে। তাদের সামনে ভোজবাজির মত ঘটে গেল ঘটনা। মুহূর্তেই। আক্রমণকারীরা হলো আক্রান্ত আর অসহায় আক্রান্ত উঠে এল আক্রমণকারীর ভূমিকায়। একজন মানুষ এক ঝাঁক অস্ত্রধারীর সামনে এসে এই অঘটন ঘটাল! কে এই মানুষ!

আসতি আওয়াত এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, আমরা আপনাকে বুঝতে পারিনি। আপনি আমাদের সব চিন্তা ও বিবেচনাকে হার মানিয়েছেন। আপনি কে জানি না। কিন্তু দিভিনকে আজ নতুন কিছু শিখালেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, খোশ আমদেদ আপনাকে।

জনাব, এসব কথা বলার সময় এটা নয়। জরুরি কিছু করণীয়। আছে। বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে মোহাম্মদ আসতি আওয়াত বলল, কি সেই জরুরি বিষয়টা?

প্রথম বিষয় হলো, নিহতরা যে যেমন আছে, পুলিশ আসা পর্যন্ত সেভাবেই থাকবে। তাদের অস্ত্রেও হাত দেয়া যাবে না। দ্বিতীয় বিষয়। হলো, এই মুহূর্তে পুলিশ স্টেশনে লোক পাঠান। অভিযোগে বলুন, একদল অজ্ঞাত লোক আক্রমণ করেছিল, সংঘর্ষে তাদের সবাই মারা পড়েছে।

বলেই আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। ইভা নারিন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।

আসতি, আওয়াত খিবাত খলিলকে ডেকে বলল, তুমি কয়েকজনকে। সাথে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাও।

খেবাত খলিল স্থানীয় সরকারের অধীন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য। মধ্যবয়সী মানুষ। থানা, পুলিশ, সরকারি অফিস মহলে তার যাতায়াত আছে।

আমি যাচ্ছি জনাব। আমাদের আরও লোকজনদের খবর পাঠান। তারা আসুক। সন্ধ্যা থেকে দুইটা বড় ঘটনা ঘটল। আর ঘটবে না বলা যায় না। বলল খিবাত খলিল।

ঠিক আছি আমি দেখছি। তোমরা যাও। আসতি আওয়াত বলল। খেবাত খলিল আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে দ্রুত চলে গেল।

দিভিন প্রধান আসতি আওয়াত আহমদ মুসা ও ইভা নারিনের দিকে চেয়ে বলল, প্লিজ চলুন ঐ আটচালা টঙটায় আমরা বসি।

হাঁটা শুরু করল আসতি আওয়াত।

তার সাথে আহমদ মুসা ও ইভা নারিনও হাঁটতে লাগল। অন্যরাও।

আটচালা টঙঘরে গেল আসতি, আওয়াত ও অন্যরা। ঘরটা অনেক বড়। উপরে সিমেন্ট-পাথরের ঢালাই ছাদ। চারপাশ উন্মুক্ত। তবে প্রয়োজন হলে তাঁবুর মত চারদিক ঘেরার ব্যবস্থাও আছে। ফোল্ডিং চেয়ার পাতা রয়েছে ফ্লোরে। সামনে কয়েকটা বড় হাতাওয়ালা চেয়ার।

আসতি আওয়াত সামনের চেয়ারগুলোর দুটিতে বসাল আহমদ মুসা। ও ইভা নারিনকে বসাল। নিজে একটাতে বসল। অন্যেরা কেউ বসল। টঙঘরে, কেউ কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। সবাই গ্রুপ গ্রুপ হয়ে গল্প করছে।

আহমদ মুসাদের সামনে তিনটি ফোল্ডিং চেয়ারে বসেছে এরদেলান, আহমদ নেবেজ ও শেপল।

বসেই ইভা নারিন বলল ফিস ফিসেকণ্ঠে আহমদ মুসাকে, আমাদের। যারা পথে অনুসরণ করে এসেছে এবং এখানে কাজে বাধা দিয়েছে, হত্যার চেষ্টা করেছে, এরা কি তারা হতে পারে?

আমাদেরকে লোকেট করবার জন্যে তাদের যে অবলম্বন ছিল, সেটা নেই। আমি মনে করি এরা তারা নয়। বলল আহমদ মুসা।

তাহলে এরা কারা? যারা আগুন দিয়েছে তারাই কি এরা? ইভা নারিন। বলল।

এটা হতে পারে। কিন্তু তারা আমাদের ব্যাপারে এতটা মরিয়া হওয়ার কারণ?

কথাটা বলেই আহমদ মুসার মনে পড়ল ত্রিফা বেফ্রিনের কথা। সে ইভা নারিনকে হত্যার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? দুই ঘটনা কি কাকতালীয়? না…!

আপনার প্রশ্নটা আমারও প্রশ্ন! এমন মরিয়া হওয়ার কারণ কি? ইভা নারিন বলল।

আরেকজন মানে ত্রিফা বেফ্রিনও আপনাকে হত্যার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বলল আহমদ মুসা।

আপনিও বিষয়টা তাহলে খেয়াল করেছেন? এ ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও দুর্বোধ্য। ইভা নারিন বলল।

আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মোহাম্মদ আসতি আওয়াত বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, জনাব শেপল আমাকে সব বলেছে। আগুন লাগার ঐ স্থান থেকে এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর যেসব ঘটনা আপনি ঘটিয়েছেন, আমরা আপনাকে জানি না, আপনিও আমাদের জানার কথা নয়। তারপরও গতরাত থেকে সব কাজের দায়িত্ব আপনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, আজ আরও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ওরা আপনাদের ধরতে এসেছিল কেন? কে তারা? গতকালের আগুন লাগার ঘটনার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা? আপনারা এ বাড়িতে আছেন, এমনকি কোন্ কোন্ ঘরে আছেন, তাও ওরা জানল কি করে? এসব প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো আপনি কে? আপনারা কে? প্লিজ আমাদের অন্ধকারে রাখবেন না।

সংগে সংগে আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। একটু ভাবল। মনে মনে বলল, সত্যি ওদের কিছু বলার সময় এসেছে। সামনে এগোতে হলে ওদের সাহায্য দরকার। এই চিন্তা করে আহমদ মুসা আহমদ নেবেজকে লক্ষ করে বলল, সামনে তোমার লোকজন যারা ঘুরাফেরা করছে, তাদেরকে বাড়ির চারদিকে একটু নজর রাখতে বল। পুলিশ আসার আগে আমাদের সাবধান থাকা দরকার।

আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার কথাটার অর্থ বুঝল। সে দ্রুত উঠে গিয়ে সরদার আসতি আওয়াতের বরাত দিয়ে ওদের বাড়ির চারদিকে নজর রাখার জন্যে কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দিল।

ফিরে এল আহমদ নেবেজ তার আসনে।

ধন্যবাদ আহমদ নেবেজ। বলল আহমদ মুসা।

একটু থেমেই আবার শুরু করল, আমি আপনাদের একজন ভাই। বাইরের কোন এক দেশ থেকে এসেছি। দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি মোটামুটি জানি। আরও জানার জন্যে দিভিনে এসেছি। আমার পরিচয় সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন এখন নেই।

থামল আহমদ মুসা। বলল ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে, ইভা নারিন, প্লিজ আপনার পরিচয়টা দিন।

আমিও একটা সংস্থার পক্ষ থেকে দিভিন সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে কাজ করছি। ইয়েরেভেনে আমার বাড়ি। একটা সুযোগে আপনাদের এই অতিথির সাথে দিভিনে এসেছি। বলল ইভা নারিন।

ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।

একটু থামল আসতি আওয়াত। বড় একটা নিশ্বাস ফেলল যেন সে। বলল, আমাদের বিষয়টা দেখার জন্যে যে আপনারা এসেছেন সেজন্যে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমাদের সামনে হতাশার। অন্ধকারই শুধু, কোন আলো নেই। আমরা খুব খুশি হয়েছি।

আসতি আওয়াত আবারও একটু থেমে পুনরায় শুরু করল, আমাদের। সম্মানিত অতিথির নাম কি আমরা জানতে পারি না?

আমাকে আহমদ আব্দুল্লাহ বলে ডাকবেন। হেসে বলল আহমদ মুসা।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার কপালে সিজদার চিহ্ন দেখে আগেই বুঝেছিলাম আপনি মুসলিম। আপনি আপনাকে ডাকার জন্যে একটা নাম দিলেন। এটা তাহলে কি আপনার নাম নয়? আসতি আওয়াত বলল।

দুঃখিত জনাব। নানা কারণে আমি নামটা এখন বলব না। এক সময় সবই জানতে পারবেন। হয়তো নামটা তার আগে প্রকাশও হয়ে পড়তে পারে। শত্রুরা নামটা ইতিমধ্যে জেনেও ফেলতে পারে। বলল আহমদ মুসা।

থাক বাবা। নামটা প্রকাশ না হওয়ার মধ্যেই হয়তো কল্যাণ আছে। নামটা খুবই পরিচিত বা খুবই গুরুত্বপূর্ণ না হলে তা নিশ্চয় লুকাবার দরকার হতো না। শেপল বলল।

ঠিক বলেছ মা। কথা শেষ করেই আহমদ মুসার দিকে চেয়ে আসতি আওয়াত বলল, আপনাদের শত্রু কারা?

এখনও মনে হচ্ছে আপনাদের শত্রু যারা, তারাই আমাদের শত্রু। বলল আহমদ মুসা।

আপনারা রাতেই মাত্র এলেন। আমাদের শত্রুরা আপনাদের শত্রু বানাবার সময় পেল কখন? কেন শত্রু বানাবে? আর আমাদের চেয়ে বড় শত্রু তাদের কাছে আপনারা হলেন কি করে? শেপল বলল।

আরও প্রশ্ন আছে শেপল, আমরা যে তোমাদের বাড়িতে আছি এবং ঐ দুই ঘরে আছি তা তারা জানতে পারল কি করে? বলল আহমদ মুসা।

অপার বিস্ময়ের ছায়া নামল আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান ও আহমদ নেবেজদের চোখে-মুখে।

ঠিক বলেছেন, এটা তো আরও বিস্ময়ের! কোন্ দুই ঘরে আপনারা শোবেন, শোবার আগের সিদ্ধান্ত বাইরের কেউ এটা জানার কথা নয়। কিন্তু দূরের শত্রুরাও তা জানল কি করে? আসতি আওয়াত বলল।

কাছেও শত্রু থাকতে পারে জনাব। বলল আহমদ মুসা।

আসতি আওয়াত নড়ে-চড়ে বসল। চমকে উঠল শেপলরা।

কাছেও শত্রু মানে আমাদের মধ্যে কেউ এ রকম আছে? আপনি কি এটা মনে করেন? আসতি আওয়াত বলল।

বিদ্যুৎ চমকের মত ত্রিফা বেফ্রিনের চেহারা আহমদ মুসার মনে ঝিলিক দিয়ে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। বলল আহমদ মুসা, আপনাদের কেউ আছে বা নেই কোনটাই আমি এখন বলতে পারবো না। তবে শত্রুর কাছে ইনফরমেশন গেছে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

আসতি আওয়াত, শেপলদের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল আসুতি আওয়াত, ইনফরমেশন যখন গেছে, তখন কেউ পাঠিয়েছে। কে সে? আমি খুব উদ্বেগ বোধ করছি। ভেতরে শত্রু থাকলে তো আরও অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে।

কে সে, এটা জানার জন্যে আরও সময় প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে সাবধান থাকা দরকার। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তা শেষ আঘাত নয়। আমি ওদের যতটুকু জানি, তাতে আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।

আসতি আওয়াতের চোখ-মুখ উদ্বেগে ছেয়ে গেছে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু বলা হলো না। পুলিশের দুই তিনটি গাড়ি এসে প্রবেশ করল বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে।

আহমদ মুসা, আসতি আওয়াতসহ সকলেই উঠে দাঁড়াল।

Top