৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে

চ্যাপ্টার

আল্লাবখশ গ্রামের মাঝখানে কম্যুনিটি ময়দানে আহমদ মুসার হেলিকপ্টার গিয়ে নামল। গ্রামে এই প্রথম একটি হেলিকপ্টারের অবতরণ। গ্রামের বহু লোক সেখানে জমা হয়েছে। আবদুল্লায়েভ এবং ইকরামভও সেখানে এসছে। সকলের মনেই জিজ্ঞাসা কে আসছে?
ছোট্ট এটাচিকেস হাতে আহমদ মুসা নামল হেলিকপ্টার থেকে। এখানে কারও সে পরিচিত নয়। শুধু ইকরামভ তাকে চিনল। বড় ভাই আবদুল্লায়েভ কে বলল, ইনিই আহমদ মুসা।
শুনেই আবদুল্লায়েভ দ্রুত সেদিকে ছুটল। কাছে গিয়ে বলল, মুসা ভাই আমি আবদুল্লায়েভ, ফারহানার বড় ভাই।
আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, দেখা এতদিন হয়নি কিন্তু আপনাকে জানি, বহু শুনেছি আপনার তৎপরতার কথা।
ইকরামভ কাছে আসতেই আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরল। কপালে চুমু খেয়ে বলল, এতদিন পরে মুসা ভাই?
-জান তো, কেমন অবস্থায় কেটেছে দিন, বলে তিনজন চলতে শুরম্ন করল। ইকরামভ আহমদ মুসার হাত থেকে এটাচি কেস নিজের হাতে নিয়েছে।
চলতে চলতে আহমদ মুসা আবদুলস্নায়েভকে বলল, আব্বা কেমন আছেন?
-ভাল নয়, গতকাল থেকে কথাও ভাল করে বলছেন না।
-এই অবস্থায় হাসপাতালে নেয়াই ভাল হবে।
-কিন্তু উনি কিছুতেই রাজী হন না।
-আপনারা রাজী থাকলে আমি কালই হেলিকপ্টারে তাঁকে তাসখন্দ নিয়ে যেতে চাই।
-ফারহানাও যদি রাজী হয় আমরা খুশীই হব।
-কেন ফারহানা রাজী নয়?
-তার কথা হল, আব্বা যা চান না, তাঁর জীবনের শেষ কালে তা করা আমাদের উচিত নয়।
-ঠিক আছে দেখা যাবে।
আহমদ মুসাকে এনে তুলল তারা আগের সেই বৈঠকখানাতেই। তবে এবার বৈঠকখানা কিছু বদলেছে। ফরাশের বদলে চেয়ার-টেবিল, সাধারণ খাটিয়ার বদলে সুন্দর খাট।
আহমদ মুসা বলল, অনেক পরিবর্তন তো দেখছি আবদুল্লায়েভ?
-হ্যাঁ, এগুলো ফারহানার কাজ। আমরা আব্বাকে বুঝাতে পারিনি, সেই আব্বাকে মতে এনে এসব করেছে।
বৈঠকখানায় বসে আহমদ মুসার মনে পড়ল প্রথম দিনের কথাগুলো।
মাত্র একদিনই সে এদের মাঝে ছিল। কিন্তু এক দিনই এই পরিবারের সাথে যেন সে এক হয়ে গেছে। বৃদ্ধ আবদুল গফুর তাকে তার হারানো ছেলের মতই স্নেহ করে। যাবার দিন ইকরামভের অশ্রুর কথা তার আজও মনে আছে। আর ফারহানা? চিন্তা করতে আর সাহস হল না আহমদ মুসার।
আবদুল্লায়েভ এবং ইকরামভ ভেতরে গিয়েছিল। বৈঠকখানার ভেতরে দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ হলো। পর মুহুর্তে সালাম দেয়র শব্দ ভেসে এল ওপাশ থেকে। ফারহানার গলা।
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে বলল, কেমন আছ ফারহানা?
-আপনার দোয়ায় ভাল আছি।
-আয়েশা-রোকাইয়েভাদের খবর শুনেছ?
-জী।
ফারহানা একটু থেমেই বলল, আপনাকে যদি মোবারকবাদ দিতে চাই তাহলে কি দোষ হবে?
-কেন, কি মোবারকবাদ?
-মনে আছে নিশ্চয়, এই বৈঠকখানাতেই একদিন আমি এই বিপ্লবকে অসম্ভব বলেছিলাম। আল্লাহর কি ইচ্ছা সেই বিপ্লব সফল করেই আপনি এই বৈঠকখানায় আবার এলেন।
-এ বিপ্লব তো তোমরা সবাই মিলে করেছ। আমার মোবারকবাদ তোমরা নিলে তোমাদের মোবারকবাদ আমার নিতে আপত্তি নেই।
-এ বিনয় আপনার মহত্ব। ফারহানার কন্ঠে যেন অনেকটা ভারী।
আহমদ মুসা কথা পাল্টিয়ে বলল, তুমি নাকি তোমার আব্বাকে হাসপাতালে পাঠাতে রাজী হচ্ছো না?
-আমি হচ্ছি না নয়, আব্বা রাজী নন। আমি তার পক্ষেই কথা বলেছি।
-এখন আমি যদি ওঁকে তাসখন্দ নিয়ে যেতে চাই?
একটু চুপ থেকে ফারহানা বলল, আপনার মতের বাইরে আমার কোন মত নেই। মনে হলো ফারহানার কথাগুলো তার হৃদয়ের কোন অন্ত্মস্থল থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসার হৃদয়টা কেঁপে উঠল। একজন নারী কখন আরেকজনের উপর এমন করে তার সব মত, সব অধিকারকে সঁপে দেয়। আহমদ মুসা হঠাৎ করে কোন কথা বলে উঠতে পারল না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার আব্বার কাছে যেতে চাই, আবদুল্লায়েভকে বল। আবদুল্লায়েভের সাথে আহমদ মুসা আবদুল গফুরের ঘরে প্রবেশ করল।
আবদুল গফুর শুয়েছিল। খুব দুর্বল সে, আহমদ মুসা পাশে গিয়ে বসল। আবদুল্লায়েভ তার আব্বার মাথার কাছে গিয়ে বসল। আব্বা, আমাদের আহমদ মুসা ভাই এসেছেন।
কয়েকবার বলার পর বৃদ্ধ আবদুল গফুর চোখ খুলে বলল, কে কি বললি, আহমদ মুসা! কোথায় আমার বাবা?
আবদুল্লায়েভ বৃদ্ধের মাথা একটু উচু করে তুলে ধরল। আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই বলল, বাবা তুমি এসেছ? এস বাবা………..
বলে দু’টি হাত উঁচু করল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা তার আরও কাছে এগিয়ে গেল।
বৃদ্ধের দুর্বল একটি হাত উঠে এলো উপরে। হাত বুলাল সে আহমদ মুসার মাথা, মুখ এবং গায়ে। বুলাতে বুলাতে বলল, গত সন্ধ্যায় রেডিওতে তোমার বক্তৃতা শুনেছি বাবা। আঃ কি আনন্দ। আজ আমি যদি যুবক হতাম, চিৎকার করে ঘুরে বেড়াতাম সারা অঞ্চলটা। বলতাম, মুসলমানরা মরে না। মরার জাতি নয় তারা।
প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল বৃদ্ধের কন্ঠ। ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে ধুকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আমার আল্লারাখা আজ জীবিত আছে কিনা জানি না। মরে গেলেও আজ তার আত্মা শান্তি পাবে। তোমরা সবাই তার জন্য দোয়া করো। বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ থেকে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু।
আবার থামল আবদুল গফুর। তারপর সে ধীরে ধীরে চোখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। তাকিয়ে দেখল অনেক্ষণ। আহমদ মুসা বৃদ্ধের একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, বলবেন কিছু?
-তুমি অনেক বড়, অনেক বড়, অনেক বড়, তা না হলে একটা কথা তোমাকে বলতাম।
-আমাকে লজ্জা দেবেন না, মানুষ হিসেবে কেউই বড় ছোট নয়। বলুন আপনার কথা।
-বলব? বলে বৃদ্ধ চোখ বুজল, কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চারদিকে তাকাল। দেখল সে আবদুল্লায়েভকে, ইকরামভকে। সবাইকে ছাপিয়ে তার চোখ গিয়ে পড়ল দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহানার উপর। বৃদ্ধ ডাকল, মা ফারহানা তুমি এসো তো মা।
দু’বার ডাকতেই চাদরে গা-মাথা ঢেকে মাথা নীচু করে সলজ্জ পদক্ষেপে পিতার মাথার কাছে এসে দাড়াল ফারহানা।
বৃদ্ধ ফারহানার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, এই আমার ফাতিমা ফারহানা। আমার আদরের ধন। মহানবী (স) এর মেয়ের নামের সাথে মিলিয়ে এর নাম রেখেছিলাম। সীমাহীন আদর দিয়ে গড়েছি আমার এই মাকে। এই মায়ের দায়িত্ব নেবার কথা কি আমি তোমাকে বলতে পারি বাবা?
আহমদ মুসা মাথা নীচু করে বসেছিল। বৃদ্ধের এই কথার জবাব কোন কথা হঠাৎ তার মুখে জোগাল না। নীরবতার মধ্যে দিয়ে তিল তিল করে বয়ে চলল সময়। সবাই মাথা নীচু ফারহানার দু’গন্ড বয়ে নেমেছে অশ্রুর ঢল।
ধীরে ধীরে মুখ খুলল আমহদ মুসা। মাথা নীচু করেই জবাব দিল, নেব আমি আপনার ফারহানাকে। কিন্তু আব্বা আমি যাযাবর, আমার কোন ঠিকানা নেই। আপনার আদরের ধন কি সুখী হবে আমার কাছে?
শেষের কথাগুলো আহমদ মুসার ভারী হয়ে ভেঙে পড়ল।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে বৃদ্ধ উঠে বসতে চেষ্টা করল, আবদুল্লায়েভ তাকে ধরে বসিয়ে দিল। বৃদ্ধ দু’টি হাত উপরে তুলে বলল, হে আল্লাহ! তুমি রহিম, তুমি রহমান। হযরত ফাতিমা (রা) এবং হযরত আলী (রা) এর মতই এদের জীবনকে তুমি সুখী কর, শান্তিময় কর, সুন্দর কর!
আহমদ মুসা, ফাতিমা ফারহানা, আবদুল্লায়েভ, ইকরামভ এবং আড়াল থেকে আবদুল্লায়েভের স্ত্রী এবং আবদুল্লায়েভের মা সবাই বৃদ্ধের সাথে হাত তুলেছিল। মুনাজাত শেষে উঠতে উঠতে আহমদ মুসা বলল, আব্বা আমি তাসখন্দকে জানিয়ে দিচ্ছি কালকেই কুতাইবারা আসবে। বিয়ের ব্যবস্থাটা ওরাই করবে।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার সাথে চলে এল আবদুল্লায়েভ এবং ইকরামভও।
তারা বেরিয়ে গেলে আবদুল্লায়েভের স্ত্রী এসে অশ্রুরুদ্ধ ফারহানাকে ধরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, পরম পাওয়ার কান্না বুঝি তাহলে এতই হয়।

জেনারেল বোরিস আশ্রয় নিয়েছিল আল্লাবখশ গ্রামের উত্তরে পামির সড়কের ধার দিয়ে যে পাহাড় সেই পাহাড়ে।
সেদিন সন্ধ্যায় আল্লাবখশ গ্রামে যখন আহমদ মুসার হেলিকপ্টারটি নামে, তখন জেনারেল বোরিসের একজন লোক নেমে এসেছিল এই গ্রামে। এখানে কারা থাকে তার খোঁজ নেবার জন্য। গ্রামের লোকদের মুখে সেই জানতে পারে আহমদ মুসা এসেছে আব্দুল গাফুরের বাড়িতে । সে ফিরে গিয়ে জেনারেল বোরিসকে এ খবর জানায়। এ খবর শুনে সাত রাজার ধন মানিক পাওয়ার মতই তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কি করতে হবে সংগে সংগে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
সন্ধ্যার পর পরই পাহাড়ী গ্রামগুলো ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ৯টার মধ্যেই আল্লাবখশ গ্রামের সব বাতি নিবে গেল।
রাত ১১টার দিকে ডজন খানিক সাথী নিয়ে জেনারেল বোরিস নেমে এল আল্লাবখশ গ্রামে। বিড়ালের মত নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে ওরা পৌছল আব্দুল গফুরের বাড়ীতে। আব্দুল গফুরেরে বৈঠকখানার দরজায় গিয়ে যখন ওরা পৌছল তখন রাত ১১টা পনের। দরজা ভাল করে পরীক্ষা করল জেনারেল বোরিস। ইস্পাতের কবজা দিয়ে চৌকাঠের সাথে দরজা লাগানো। হাসল জেনারেল বোরিস।
তারপর ব্যাগ খুলে একটা লম্বা তার এবং একটা ছোট হাইপাওয়ার ক্লোরোফরম সিলিন্ডার বের করল। তারটা সে সংযোগ করল ক্লোরোফরম সিলিন্ডারের সাথে। এরপর ছিদ্রওয়ালা তারটা দরজার নীচে ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল ঘরের ভিতর। ঘরের মাঝ বরাবর তারটা পৌছেছে এমনটা যখন মনে হল তখন সিলিন্ডারের সুইচটা অন করে দিল। গ্যাস তারের মধ্য দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে লাগল। পাঁচ মিনিটের খালি হয়ে গেল সিলিন্ডার। তারপর আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল জেনারেল বোরিস।
বাড়তি পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেলে জেনারেল বোরিস ব্যাগ থেকে লেসার বীম সিলিন্ডার বের করল। লেসার বীম দিয়ে দরজার সবগুলো কবজা কয়েক মিনিটে ধোঁয়া করে দিল। তারপর তিন-চার জনে ধরে দরজাটা সরিয়ে নিল।
জেনারেল বোরিসরা সবাই গ্যাস মাক্স পরা। তারা ঘরে ঢুকে পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে দেখল ঘরের এক পাশে আহমদ মুসা, আরেক পাশে ইকরামভ । তাদের নেড়ে-চেড়ে দেখল, তাদের কারোরই জ্ঞান নেই।
জেনারেল বোরিসের নির্দেশে তিনজন এগিয়ে এসে অজ্ঞান আহমদ মুসাকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিল আব্দুল্লায়েভ। নদীর ঘাটের কাজ সেরে বাড়ির ভিতর ঢুকতে গিয়ে দক্ষিণে বৈঠকখানার দরজার দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয় উঠল। বৈঠকখানার দরজা গোটাটাই দরজার এক পাশে বারান্দায় কাত হয়ে পড়ে আছে। কি ভূতুড়ে কান্ড। আব্দুল্লায়েভ দৌড়ে গেল বৈঠকখানায়। খোলা দরজা দিয়ে ভোরের আলো ঘরে ঢুকেছে। সব কিছুই পরিষ্কার চোখে পড়ছে। আহমদ মুসার বিছানার দিকে চোখ পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠল তার থর থর করে। আহমদ মুসার বিছানা খালি, নেই সে। অন্য বিছানায় শুয়ে আছে ইকরামভ। তাকে ধাক্কা দিল, কোনই সাড়া দিল না ইকরামভ। তার অংগ প্রত্যঙ্গ শিথিল। জ্ঞান হারিয়েছে ইকরামভ? আরেক দফা চমকে উঠার পালা আব্দুল্লায়েভের। হঠাৎ আব্দুল্লায়েভের মনে হল তার মাথা ঝিমঝিম করছে, এতক্ষণে অনুভব করল কি একটা অপরিচিত গন্ধ চারদিকে, গ্যাস কি? আঁৎকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এল আব্দুল্লায়েভ। বাড়ির ভেতরের আঙিনায় গিয়ে আব্দুল্লায়েভ চীৎকার করে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
সেই চীৎকার শুনে হন্ত-দন্ত হয়ে বেরিয়ে এল আব্দুল্লায়েভের মা, আব্দুল্লায়েভের স্ত্রী, এবং ফারহানা।
ফারহানাকে দেখেই আব্দুল্লায়েভ ডুকরে কেঁদে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে ফারহানা, বৈঠক খানার দরজা ভাঙা, আহমদ মুসা নেই। আব্দুল্লায়েভের কথা শেষ হবার সাথে সাথে ‘আল্লাহ’ বলে এক বুক ফাটা চীৎকার করে উঠল ফারহানা। জ্ঞানহীনা তার দেহটা ঢলে পড়ল মাটির উপর।
আব্দুল্লায়েভের স্ত্রী, আব্দুল্লায়েভের মা ছুটে গেল বৈঠকখানায়। ভাঙা দরজা, শূন্য ঘর, অজ্ঞান ইকরামভকে দেখে তারাও কেঁদে উঠল চীৎকার করে।
মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কুতাবার হেলিকপ্টার বহর যখন আল্লাবখশ গ্রামে পৌছল, তখন সুর্য সবে উঠেছে। হেলিকপ্টার থেকে নামল কর্নেল কুতাইবা, হাসান তারিক এবং তাদের সাথে বোরখা পরা দুই মহিলা শিরিন শবনম এবং আয়েশা আলিয়েভা।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে বিস্মিত হলো কুতাইবা, আহমদ মুসা নেই এমনকি আব্দুল্লায়েভও নেই। এমনটা তো হবার কথা নয়।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে তার একটু এগুতেই কুতাইবার পরিচিত ইমাম মোল্লা নুরুদ্দিন তাদের দিকে এগিয়ে এল। তার মুখ শুকনো, চেহারা বিধ্বস্ত।
বিস্তিত কুতাইবা প্রশ্ন করল, কি খবর নুরুদ্দীন?
নুরুদ্দীন কেঁদে ফেলল। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, আব্দুল গফুরের বৈঠকখানার দরজা ভাঙা, আহমদ মুসা নেই।
-কি বলছ নুরুদ্দীন, বলে চীৎকার করে উঠল কুতাইবা।
তারপর তারা দৌড় দিল আব্দুল গফুরের বাড়ীর দিকে। তাদের পেছনে আয়েশা আলিয়েভা এবং শবনম।
বৈঠকখানার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে কাঁদছিল আব্দুল্লায়েভ। কুতাইবা এবং হাসান তারিক সেখানে পৌছতেই সে উঠে দাড়াল। তাদের নিয়ে প্রবেশ করল বৈঠকখানায়।
ঘরে ঢুকে পাগলের মত হয়ে গেল কুতাইবা এবং হাসান তারিক। হাসান তারিক সেই গ্যাস সিলিন্ডার, সেই তার এবং চৌকাঠের কব্জাগুলো পরীক্ষা করে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে নেমে এলো অশ্রু। কুতাইবা আহমদ মুসার বিছানায় মুখ লুকিয়ে শিশুর মত কাঁদতে লাগল। দরজায় দাঁড়িয়ে আয়েশা আলিয়েভা এবং শবনম। দু’হাতে মুখ ঢেকে তারা কাঁদছে।
আব্দুল্লায়েভের মা এসে আয়েশা আলিয়েভাকে বলল, এস তোমরা ফারহানার কাছে। ওর জ্ঞান এখনও ফেরেনি।
-কোথায় ফারহানা, বলে ছুটল তারা বাড়ীর ভিতর।
ফারহানার জ্ঞান তখন ফিরে এসেছে, ইকরামভেরও জ্ঞান তখন ফেরানো হয়েছে। সবার অশ্রু শুকিয়ে গেছে।
বৈঠকখানার ভেতরের দরজায় ফাতিমাকে ঘিরে দাড়িয়েছিল শিরিন শবনম, আয়েশা আলিয়েভা, ফাতিমা ফারহানার মা ও ভাবী। বৈঠকখানার ভেতরে আব্দুল্লায়েভ, কুতাইবা হাসান তারিক এবং ইকরামভ। বৈঠকখানার বাইরের বারান্দা ও উঠানে সাইমুম কর্মীরা।
গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হাসান তারিক। কি অংক কষছে যেন সে। অবশেষে নীরবতা ভেংগে কথা বলল সে। বলল, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তাহলে আমি বলতে পারি মুসা ভাইকে জেনারেল বোরিস অথবা তার লোকেরা কিডন্যাপ করেছে। আমরা জানি, বিপ্লবের পর সে পামির সড়ক ধরেই পালিয়ে এসেছে। সে পাহাড়ে কোথাও আশ্রয় নিয়েছিল, আল্লাবখশ গ্রামে আসার কথা কোন ভাবে জানতে পারে সে এর সুযোগ গ্রহণ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করে সে কোথায় নিয়ে যাবে? নিশ্চয় এ দেশে সে থাকবে না, রাশিয়াতেও যাবে না, আফগানিস্তানও যেতে পারবে না। বাকি থাকে চীন। আমার মতে চীনেই সে যেতে পারে। সেখানকার ফ্রদের সাহায্য নেবার জন্যে।
থামল হাসান তারিক।
তারপর উঠে দাঁড়াল।বলল, আমি এই মূহুর্তেই জেনারেল বোরিসের অনুসরণ করতে চাই। পামিরের পথে প্রান্তরে কিংবা তিয়েনশানের ওপারে শিংকিয়াং এ অথবা যেখানেই হোক তাকে খুঁজে বের করব, তার হাত থেকে ছিনিয়ে আনব আহমদ মুসাকে, ইনশাআল্লাহ।
আব্দুল্লায়েভ এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল আমি আপনার পাশে থাকব। আমি এ অঞ্চল এবং চীনের বহুকিছুই চিনি।
অশ্রু ঝরছিল কুতাইবার চোখ দিয়ে। সে বলল, আমিও আহমদ মুসার ভাই, আমিও কি এ অভিযানে শামিল হতে পারিনা?
হাসান তারিক বলল, না আহমদ মুসা যে পবিত্র ও গুরুদায়িত্ব তোমাকে দিয়েছেন সেটা পালন করা তোমার প্রথম কর্তব্য।
একটু থেমে হাসান তারিক বলল, কুতাইবা তোমার এখনই যে দায়িত্ব সেটা হল, আমাদের এ ভূখন্ডের অধীন সমস্ত বন-জংগল এবং পাহাড় চষে ফেলা যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় জেনারেল বোরিস এদেশে নেই।
বেলা তখন ৮টা।
হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ প্রস্তুত হল যাত্রার জন্য। ফাতিমা ফারহানা, আয়েশা আলিয়েভা ও শবনম দাঁড়িয়েছিল।
ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাসান তারিক বলল, আয়েশা ফাতিমা ফারহানাকে নিয়ে তুমি তাসখন্দে দাদীর কাছে থাকবে। ফারহানার আব্বাকে আজই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। এদের পরিবারের সবাইকে আজই তাসখন্দে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মেয়েরা সবাই কাঁদছিল।
হাসান তারিক বলল, সবাই তোমরা সাইমুমের কর্মী। কাঁদা তোমাদের শোভা পায় না। যে বিপদ এসেছে আল্লাহ তা থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন। তোমরা দোয়া করো।
বলে হাসান তারিক ও আব্দুল্লায়েভ বেরিয়ে এল আব্দুল গফুরের বাড়ী থেকে। কিছুটা পথ তারা যাবে গাড়িতে। তারপর ইয়াকে চড়ে দুর্গম পামির পাড়ি দিয়ে তাদের পৌছতে হবে তিয়েনশানের ওপারে।
ফাতিমা ফারহানা, আয়েশা আলিয়েভা এবং শিরিন শবনম দরজায় দাঁড়িয়েছিল। হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ চোখের আড়ালে হারিয়ে যেতেই তিনজনের হাতই উপরে উঠল। আরজ করল তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে; ‘হে আল্লাহ এ অভিযান সফরের অভিভাবক একমাত্র তুমিই। তুমি তাদের সফল কর। আহমদ মুসা সহ তাদের সবাইকে আবার ফিরিয়ে এনো আমাদের মাঝে।‘
তিনটি হৃদয়ের কান্না বিজড়িত এই আকুল প্রার্থনার সবুজ শব্দমালা ইথারের পাখায় ভর করে উড়ে চলল আল্লাহর আরশের দিকে।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
তিয়েনশানের ওপারে

Top