৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে

চ্যাপ্টার

শাহিন সুরাইয়ার সহপাঠিনী বান্ধবীর ছোট বোন রাইছা। সেই সুত্রে সুরাইয়া গত তিন উইক এন্ড অর্থাৎ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে রাইছার ওখানে গেছে। রাইছা খুশি হয়েছে, অনেক আলাপ হয়েছে তার সাথে। গত শনিবারে রাইছার রুমে দেখা হয়েছে খোদেজায়েভা এবং তাহেরাভার সাথে। আলোচনায় দেশের প্রসংগও এসেছে। বুঝা গেছে দেশের সব ব্যাপারেই তারা সচেতন। এমনকি সরকারী কর্মচারী ও জননেতৃবৃন্দের গনস্থানান্তর সম্পর্কিত সব খবর তারা জানে। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। সাইমুম সংক্রান্ত কোন প্রসংগ তো তোলারই সুযোগ হয়নি। তবে সুরাইয়ার সন্দেহ নেই এই সচেতন মেয়েরা কম্যুনিস্ট সরকারের ধামাধরা হতেই পারে না।
অফিসের টেবিলে বসে শাহিন সুরাইয়া গত তিন সপ্তাহের মস্কো জীবনের হিসাব নিকাশ করছিল। কাল আবার শনিবার রাইছার ওখানে যাবে সুরাইয়া।
দেয়াল ঘড়ি থেকে দশটা বাজার সংকেত এল। দশটা অফিসের কাজ শুরুর সময়। সুরাইয়া সব ঝেড়ে ফেলে সামনের ফাইলের দিকে মনোযোগ দিল।
সুরাইয়া মস্কো এসে কোন বাইরের এসাইনমেণ্ট পায়নি। তাকে অফিসে বসানো হয়েছে। সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশের একটা কপি গোয়েন্দা বিভাগে আসে। সেই নির্দেশেগুলো রেকর্ড করা এবং তা গোয়েন্দা বিভাগের নির্বাহী ব্রাঞ্চে পাঠানোই তার দায়িত্ব। কাজটা একদমই একঘেয়ে এবং কষ্টকর। এই কয় দিনেই তার গোয়েন্দা অফিসারের চরিত্র কেরানী চরিত্রে রূপান্তরিত হবার যোগাড় হয়েছে।
সামনের ফাইল খুলে রেজিস্টারে নিতে শুরু করল সুরাইয়া। এ সময় মুভিং ক্যারিয়ারে একটা ফাইল এসে বাম দিকের ডেস্কে ছিটকে পড়ল। হোম মিনিস্ট্রির ফাইল। টপ সিক্রেট এবং ইমিডিয়েট ট্যাগ লাগানো। কেন জানি তৎক্ষণাৎ ফাইলটি দেখার কৌতুলহ সে রোধ করতে পারল না। হাতের কাজ বন্ধ করে ফাইলটি সে টেনে নিল। খুলে দেখল সংক্ষিপ্ত একটা নির্দেশ, ভ্যাকেশনে এশিয়ার সকল মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর বাড়ি যাওয়া নিষিদ্ধ। তাদের উপর চোখ রাখতে হবে, আটকাতে হবে তাদেরকে কোন বিনোদন ট্যুরের ব্যবস্থা করে হলেও।
পড়া শেষে ফাইল ক্লোজ করে সেটা আবার সেই ডেস্কের উপর রেখে দিয়ে আগের কাজে মনোযোগ দিল সুরাইয়া। এ সময় দরজা ঠেলে দ্রুত প্রবেশ করল সেকশন ইনচার্জ টেনিসভ। সে এসে ডেস্ক থেকে হোম মিনিস্ট্রির সেই ফাইল তুলে নিয়ে বলল, কখন এসেছে এ ফাইল?
-এই মাত্র।
-রেকর্ড করেছ?
-না।
-দেখেছ?
-না।
দেখার কথা অস্বীকার করল সুরাইয়া। অফিসারকে ফাইলটি তুলে নিতে দেখেই সে বুঝেছে ফাইলটা ভুল করে এখানে পাঠানো হয়েছে।
এখন দেখার কথা স্বীকার করলে ঐ ফাইলের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দা দফতরের আইন অনুযায়ী অন্তরীণ থাকতে হবে। অন্তরীণ থাকা তার কাছে বড় কথা নয় কিন্তু এই মুহূর্তে অফিসারটির হন্তদন্ত অবস্থা দেখে ঐ তথ্যটিকে তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, যা সাইমুমের কাজে আসতে পারে। সুতরাং মিথ্যা কথা বলা এখানে সে দূষণীয় মনে করেনি।
অফিসারটি ফাইল নিয়ে যেতে যেতে বলল, ফাইলটা আমার কাছেই থাকবে। রেকর্ডের সিরিয়াল আমার একথার নোট থাকলেই চলবে।
অর্থাৎ ফাইলটা রেকর্ড করার জন্যে সুরাইয়াকে দেওয়া হবে না। যেহেতু সে তুর্কী এবং বিশ্বাসে মুসলমান তাই তাকে তাদের বিশ্বাস নেই। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল সুরাইয়ার। মনে মনে বলল, বিশ্বাস করলে তাকে দেশের মাটির কোল থেকে ছিন্ন করে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এনে টেবিলে আটকে রাখত না।
অবরুদ্ধ একটা ক্ষোভ দীর্ঘ নিঃশ্বাসের আকারে বেরিয়ে এল সুরাইয়ার বুক থেকে।
সুরাইয়া আবার মনোযোগ দিতে চেষ্টা করল ফাইলে। কিন্তু ফাইলে মন বসছে না। মনে হল এ খবরটা তাড়াতাড়ি সাইমুমের কাছে পৌঁছানো দরকার। আর দিন পরেই ভ্যাকেশান। এখনই ওরা জানতে না পারলে সরকারের ফাদে ছাত্ররা সবাই আটকা পড়ে যাবে, কেউ দেশে যেতে পারবেনা।
সুরাইয়া ভাবল কাল শনিবার, না আজই একবার তাকে রাইছার কাছে যেতে হবে। পথ তাকে বের করতে হবে সাইমুমকে এ খবর জানানোর। আহমদ মুসার নির্দেশের কথা তার মনে পড়ল, পথ বের করার অর্থ আহমদ মুসা সাইমুমকে খুঁজে বের করার কথাই বলেছে। আহমদ মুসা তাকে সাইমুমের খোঁজ দিয়ে দিতে পারতো কিন্তু তা না দিয়ে খুঁজে নিতে বলেছে তাকে। এতে প্রথমে তার মন খারাপ হয়েছিল, পরে বুঝেছে সাইমুমের মত একটা আন্দোলনের জন্য এটাই স্বাভাবিক। এই বোধ আসার পর আহমদ মুসার নেতৃত্বের প্রতি তার দুরদর্শিতার প্রতি সুরাইয়ার ভক্তি শ্রদ্ধা আকাশস্পর্শী হয়ে উঠেছে। সে যে তিন সপ্তাহেও সাইমুমকে খুঁজে পায়নি এটা তার দুর্বলতা, এজন্যে নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে সুরাইয়ার।
সুরাইয়া ঠিক করল আজ অফিস শেষে বাসায় না ফিরে সে সোজা রাইছার ওখানে চলে যাবে। রাইছা ১২ টার দিকেই ক্লাস থেকে হলে ফিরে আসে। দুপুরেই তার সাথে দেখা হবে।
সুরাইয়া একটু আগে সাড়ে ১২ টার দিকেই অফিস থেকে বেরুল, যেতে হবে বাস বদল করে, সময় লাগবে তাতে।
ঠিক দেড়টার সময় সুরাইয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছল। রাইছার হলে পৌঁছতে আরও ২০ মিনিট সময় লাগলো তার। সুরাইয়া যখন রাইছার দরজায় দাঁড়াল, তখন বেলা ১ টা বেজে ৫০ মিনিট।
রাইছা রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কিছুক্ষণ দাঁড়াল সুরাইয়া কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া শব্দ নেই। অবশেষে দরজায় টোকা দিল এক দুই তিন। আবার কছু সময় কেটে গেল। টোকা দিল আবার সেই তিনটা। কোন সাড়া নেই। আবার কিছু সময় অপেক্ষা করল সুরাইয়া। কি ব্যাপার, রাইছা কি ঘুমালো নাকি এই অসময়ে? অসুস্থ নয়তো সে?
আর টোকা নয় এবার নাম ধরে ডাক দিল সুরাইয়া।
এবার একটু পরেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলেই রাইছা বলল, মাফ করবেন একটু দেরি হয়ে গেল।
আমিতো ভাবছিলাম তুমি ঘুমিয়ে গেছ, বলে ঘরে ঢুকল সুরাইয়া। দেখল রাইছার সাথে আরেকটা মেয়ে।
সুরাইয়া রাইসার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইতেই রাইছা বলল, এ আমার বান্ধবী। নাম ফাতিমা ফারহানা। তাজিক মেয়ে।
ফাতিমা ফারহানার সাথে কুশল বিনিময়ের পর সুরাইয়া বলল, তোমরা বোধ হয় নামাজ পড়ছিলে?
আকস্মিক এই প্রশ্নে রাইছা এবং ফাতিমা ফারহানা দুজনেই চমকে উঠল এবং মুহূর্তের জন্যে অপরাধ ধরা পড়ার মত একটা বিমূঢ় ভাব দেখা গেল তাদের মধ্যে।
তাদের অবস্থা দেখে হেসে উঠল সুরাইয়া। তারপর রাইছার গালে একটা টোকা দিয়ে বলল, তোমরা তো কোন অপরাধ করনি, আমি আনন্দিত হয়েছি।
রাইছা বলল, আপনি জানলেন কি করে আমরা নামাজ পড়ছিলাম?
-জানতে পারিনি, বুঝতে পেরেছি।
-কেমন করে?
-তোমাদের মুখের পবিত্রতা দেখে এবং তোমাদের দুজনের মাথায় ওড়না দেখে।
রাইছা ও ফারহানা দুজনেই এ কথা শুনে মাথায় হাত দিল এবং হেসে ওড়না নামিয়ে নিল।
সুরাইয়া গিয়ে ওদের মাথায় ওড়নাটা আবার তুলে দিয়ে বলল, নামিওনা বেশ লাগছে। আমাদের ঐতিহ্য কত সুন্দর!
-সুন্দর ঐতিহ্য আমরা অনুসরণ করতে পারছি কই? এইতো মাথার এই ওড়না কারও নজরে পড়লে সন্দেহ শুরু হয়ে যাবে যে, আমরা ধর্মের আফিম বোধ হয় আবার গলঃধকরণ করছি।
ঠিক বলেছ ফারাহানা, বলে সুরাইয়া একটু পিছন ফিরে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে বলল, এস তোমরা, বস, আমার জরুরী কথা আছে।
সবাই বসলে সুরাইয়া বলল, আমি একটা খবর নিয়ে এসেছি।
সামনের ভ্যাকেশনে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে যেতে দেওয়া হবে না, এ সংক্রান্ত অর্ডার খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আসছে।
-সত্যি! প্রায় কপালে চোখ তুলে প্রশ্ন করল ফারহানা।
-সত্যি। উত্তর দিল সুরাইয়া।
তারপর সবাই চুপচাপ।
নিরবতা ভাঙ্গল সুরাইয়াই। প্রশ্ন করল, তোমরা তো ছাত্র, বলতে পার সরকার কেন এই পদক্ষেপ নিচ্ছে?
রাইছা এবং ফারহানা পরস্পর একবার চোখ চাওয়া চাওয়ি করে চুপ করে থাকল। মনে হল তারা এ প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করছে।
সুরাইয়া একটু হাসল। বুঝতে পারছি তোমরা বলতে একটু দ্বিধা করছ। আমার পরিচয় শুন। আমি গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার। সারাকায়ার ঘটনা তোমরা নিশ্চয়ই জান। সে ঘটনায় আমার ছোট ভাই রশিদভ সাইমুমের হয়ে শহীদ হয়েছে। শাস্তিমূলক ট্রান্সফারের শিকার হয়ে আমাকে মস্কো আসতে হয়েছে। আসার পথে ভাগ্যক্রমে সাইমুম নেতা আহমদ মুসার সাথে আমার দেখা হয়, এখানে সাইমুমের সন্ধান করা এবং তাকে সাহায্য সহযোগিতা করা তারই নির্দেশ।
রাইছা ও ফারহানার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ফারহানা সুরাইয়ার একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু দিয়ে বলল, মাফ করুন আপা।
আমরা কি যে খুশি হলাম আপনাকে পেয়ে। একটু থেমে ফারহানা গভীর আগ্রহ নিয়ে বলল, কোথায় ওর সাথে আপনার দেখা হয়েছে?
-উজবেকিস্তানের মরুভূমিতে। বলে সুরাইয়া তার কাহিনীটা খুলে বলল তাদের। ওরা প্রায় মুখ হা করে গোগ্রাসে গিলল সে কাহিনীটা।
আবার প্রশ্ন করল ফারহানাই, ও কেমন আছে, ভাল?
রাইছা অলক্ষ্যে একটা চিমটি কাটল ফারহানাকে। মুখে গাম্ভীর্য টেনে বলল, এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন কেন? ওর প্রশ্ন শুনে উত্তর এখনো দেয়া হয়নি।
ফারহানার মুখে লজ্জার একটা লাল আভা খেলে গেল।
এ দৃশ্যটা নজর এড়াল না গোয়েন্দা অফিসার সুরাইয়ার। কিন্তু তা এড়িয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ ওটা কি ব্যাপার বলো। ফারহানার দিকে তাকিয়ে নিয়ে রাইছা বলল, সাইমুমের নির্দেশ এসেছে এবার ভ্যাকেশনে সবাইকে দেশে যেতে হবে। কর্মচারী ব্যবসায়ী যারা তাদেরও এ সময় দেশে ফিরতে হবে।
-কর্মচারীদেরকেও?
-হ্যাঁ।
-সবাই কি জানে? আমি তো জানতাম না।
-আপনার সাথে আমাদের পরিচয় না হবার কারনেই আপনি জানতে পারেন নি।
রাইছা কিছু বলার আগেই ফারহানা বলল, ভ্যাকেশনের আর মাত্র ১৫ দিন বাকী। ওরা আট-ঘাট বেধে ফেলার আগেই তো আমাদের কিছু করা দরকার।
-হ্যাঁ তোমরা চিন্তা কর। এ ব্যাপারে যতটুকু সহযোগিতা করতে পারি আমি করব। বলে দাঁড়াল, সুরাইয়া। রাইছা ও ফারহানাও উঠে দাঁড়াল। দুজনেই বলে উঠল, বসবেন না, একটু কিছু……..
-না না, আজ নয়। অফিস থেকে সোজা এসেছি।
সুরাইয়া ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মুখটা আবার ফারহানার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে তার থুতনিতে একটা টোকা দিয়ে বলল, ওকে ভাল সুস্থই দেখেছি। কবে দেখা হল ওর সাথে তোমার?
আকস্মিক এ প্রশ্নে ফারহানা যেন বিব্রত হয়ে পড়ল। একরাশ লজ্জা ছড়িয়ে পড়ল তার চোখে- মুখে।
ফারহানা কিছু বলার আগেই রাইছা বলল, সে এক বিরাট কাহিনী। আপা ঘুমন্ত রাজকুমার কি করে পাতালপুরীতে এল, কি করে রাজকুমারীর জীবন কাঠির স্পর্শে রাজকুমার জাগল সে এক অপরুপ….
ফারহানা রাইছাকে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, রাইছা বড় বেয়াদব। আপা ওকে বিশ্বাস করবেন না।
ফারহানার মুখটা লাল হয়ে গেছে লজ্জায়।
রাইছা তার কথা সমাপ্ত করতে না পারার দুঃখে গলা বাড়িয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল।
সুরাইয়া হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, আজ আর নয়, আরেকদিন এসে তোমাদের কথা শুনব।

মস্কো এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক উইং এর রুমের এক কোণে অনেকটা নিজেদের লুকিয়ে যেন দাঁড়িয়েছিল ফাতিমা, খোদেজায়েভা, তাহেরভা, রাইছা এবং আরও ৫ ছাত্রী। ওদের প্রত্যেকের মুখেই একটা চাঞ্চল্যের চিহ্ন। ৩টায় ফ্লাইট। সবে দেড়টা বাজে। সময় যেন একেবারেই যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটা আজ নড়ছেনা যেন।
দুটো বাজতেই ভেতরে ঢোকার ঘন্টা ধ্বনি হলো। ফারহানা খোদেজায়েভাকে কানে কানে বলল, তুমি সবাইকে নিয়ে ঢুকে যাও। আমি ওলগার জন্যে আর একটু অপেক্ষা করব।
-কিন্তু বেশী দেরী করোনা, কখন আমরা ওদের নজরে পড়ে যাই, ভয় করছে খুব। বলে খোদেজায়েভা সবাইকে নিয়ে বিমান বন্দরের ভেতর ঢুকে গেল। আরও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল।
ফাতিমা ফারহানা অস্থির হয়ে উঠেছে। তাহলে ওলগা আসবে না?
কিন্তু আসবে না তা হতেই পারে না।
হঠাৎ পেছন থেকে মাথায় কে যেন তার টোকা দিল। চমকে ঊঠে পেছন ফিরে দেখল ওলগা হাসছে। হেসে ঊঠে ফারহানা জড়িয়ে ধরল তাকে। এসেছ উঃ কি উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি। ভাবছি, বোধ হয় তোমার সাথে আর দেখা হলো না।
-উঃ না এসে বুঝি পারি? গাড়ির জন্যে একটু দেরী হয়ে গেল, বলল, ওলগা, জান একটা খবর আছে?
কি খবর? বলে উৎকণ্ঠিত চোখ দুটি ফারহানা তুলে ধরল ওলগার মুখের ওপর।
ওলগা ফারহানার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, মাকে ওরা মস্কোভা বন্দী শিবিরে নিয়ে গেছে সপ্তাহ খানেক হলো।
-অর্থাৎ তাকে সাধারণ আসামীর মত কায়িক পরিশ্রমও করতে হবে, ফারহানার কন্ঠ যেন আর্তনাদ করে উঠল। তার মুখটা মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল।
হঠাৎ ভেতরের অবরুদ্ধ আবেগ অশ্রুর রুপ নিল চোখের দু কোণায় এসে।
ওলগা ফারহানাকে সান্তনা দিয়ে বলল, আম্মা আমাকে কাঁদতে নিষেধ করেছেন। আমি আর কাঁদি না। কাঁদলে তো এরা খুশী হয়, আরও শক্তিশালী হয়। অশ্রু নয়, এদের অত্যাচারের সিংহাসন পুড়িয়ে দেয়ার জন্যে চোখে আগুন দরকার।
ফারহানা চোখের কোণ দুটি মুছে নিয়ে ওলগার হাত হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ঠিক বলেছ ওলগা, অশ্রু এদের কাছে দুর্বলতার প্রতীক।
বলল ওলগা, আরও খবর আছে। মাকে ওরা সাইবেরিয়া পাঠাবার পর আমার স্টাইপেন্ডও বন্ধ করে দিয়েছে।
-স্টাইপেন্ড বন্ধ করে দিয়েছে? এরপর আবার ফ্ল্যাটটাও কেড়ে নেবে নাতো?
-নিপীড়নের দ্বিতীয় অধ্যায় সবে শুরু, কি হবে জানি না।
-এখন তোমার লেখাপড়া কিভাবে চলবে?
-লেখাপড়া বাদ দিব ভাবছি।
-লেখাপড়া বাদ দেবে? না তা হতে পারেনা।
একটু ভাবল ফারহানা। তারপর ব্যাগ খুলে পাঁচ হাজার রুবলের একটা বান্ডিল ওলগার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, বড় বোন ছোট বোনকে এটা দিল। এতে তোমার মাস তিনেক চলবে। পরের ব্যবস্থা যেখানেই থাকি আমি করব।
বিব্রত ওলগাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চকিতে ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে ফারহানা বলল, ওলগা আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাইলে রাজী হবে?
এবার ওলগা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
ফারহানা তাকে বুকে জড়িয়ে বলল, কেঁদো না বোন, আমরা আছি, আল্লাহ্ আছেন।
একটু থেমে ফারহানা আবার বলল, কই আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিলেনা?
ওলগা বলল, একটাই খারাপ লাগবে, মার কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাব।
ওলগার চোখের উপর চোখ রেখে ফারহানা বলল, শুধু তোমাকে সরিয়ে নেয়া নয়, তোমার মাকেও কাছে আনার চেষ্টা আমাদের থাকবে।
শেষ কথাটায় ওলগার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তাকি সম্ভব হবে?
অসম্ভব কিছুই দুনিয়াতে নেই, তাছাড়া দিনও সব সময় একরকম যায় না, বলল ফারহানা।
সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফারহানা ওলগাকে একটা চুমু খেয়ে বলল, আমি চললাম, তুমি প্রতি সপ্তাহে কিন্তু চিঠি দিবে, নাহলে আমি ভীষণ রাগ করব।
বলে ফারহানা বিমান বন্দরে ঢোকার জন্যে ফিরে দাঁড়াল। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে কয়েক কদম গেছে এমন সময় একজন লোক পাশ থেকে তার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে চলে গেল।
চমকে উঠেছিল মুহূর্তের জন্যে। তারপর স্বাভাবিক গতিতে সে ঢুকে গেল বিমান বন্দরে। চিঠিটা কি তা দেখার জন্যে তার মন বড় উসখুস করছিল। কিন্তু দেরী হয়ে যাওয়ায় বিমানে উঠার আগে চিঠি পড়ার আর সুযোগ পেল না সে। বিমানে পাশাপাশিই তাদের দশজনের সিট পড়েছিল। ফারহানার পাশেই বসেছিল খোদেজায়েভা।
চিঠিটা ছোট্ট। লেখা আছে, বাসে, বিমানে, ট্রেনে তোমরা ভ্যাকেশনের আগেই যে চলে যাছ এ খবর তাদের কাছে এই মাত্র পৌঁছল। তোমাদের ব্যাপারটাও এখনি তাদের জানা হয়ে যাবে। সুতরাং হুশিয়ার থেকো। তাসখন্দ বিমান বন্দরে তোমাদের অবতরণ নিরাপদ নাও হতে পারে।
চিঠিতে কোন স্বাক্ষর নেই। কিন্তু হাতের লেখা দেখেই ফারাহানা বুঝতে পারল এ চিঠি সুরাইয়ার।
চিঠিটা পড়ে ফারহানা সেটা খোদেজায়েভার হাতে দিল। খোদেজায়েভা ওটার ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, আল্লাহ্ ভরসা, আমরা এ প্লেনে যাচ্ছি সেটা সাইমুমকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ্যারোফ্লোতের বিমানটি সন্ধ্যা ৬ টায় ল্যান্ড করল তাসখন্দ বিমান বন্দরে।
অজানা এক আশংকা পীড়িত দুরু দুরু মন নিয়ে ফারহানারা বিমানের সিড়ি দিয়ে নিচে নামল। ফারহানা বলল, আমরা তো কোন অপরাধ করিনি, হল কর্তৃপক্ষর বৈধ অনুমতি পত্র নিয়েই আমরা এসেছি। তাছাড়া দেশে আসতে কোন সময় আমাদের নিষেধ ও করা হয়নি। সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে করার তাদের কি আছে? খুব বেশী করলে যেটা পারে সেটা হল আমাদের আবার মস্কো ফিরিয়ে নেয়া।
খোদেজায়েভা এবং রাইছা মাথা নেড়ে সায় দিল ফারহানার কথায়। বিমান বন্দরের লাউঞ্জে প্রবেশ করার পরই একজন পুলিশ অফিসার তাদের কাছে এল। বলল, আপানারা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের তো? ফারহানা বলল, জি হ্যাঁ।
তারপর পুলিশ অফিসারটি একটা লিস্ট থেকে ১০ জনের নাম পড়ল এবং বলল, আপনাদের এই দশজনকে এখনই আমার সাথে মিনিস্ট্রি অব হোমে যেতে হবে।
যেন আকাশ থেকে পড়ল এমন ভাব নিয়ে ফারহানা বলল, কেন?
পুলিশ অফিসারটি হাল্কা ভাবে বলল, এই তেমন কিছুনা, হয়ত হবে কোন রুটিন চেকিং এর কাজ। আমি বেশি কিছু জানি না।
ফারহানা আগে থেকেই জানে, এ ধরনের ব্যাপারে আপত্তির কোন মূল্য নেই, বরং তাতে আরও ক্ষতির সম্ভবনা বেশী।
তাদের সবাইকে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হলো। একজন পুলিশ ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিল।
ফারহানারা দেখল, জনা চারেক পুলিশ নিয়ে আরেকটা জীপ পেছন পেছন আসছে। বুঝতে তাদের কারও বাকী রইল না যে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা আর স্বাধীন নয়। ফারহানার মনটা আনচান করে উঠল, দেশমুখী সব ছাত্র-ছাত্রীদের কি এই পরিণতি হচ্ছে!
এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তা তাদের মনে স্রোতের মত আসতে লাগল। ওরা যদি একবার সন্দেহ করে এবং ওদের হাতে পড়া যায় তাহলে কি পরিণতি যে হতে পারে তা তাদের কারোই অজানা নেই। আর সন্দেহ না করলে তো তাদের ধরাই হত না। সুতরাং সবারই মুখ শুকনো। কি ঘটতে যাচ্ছে তার ভয়ে আতংকিত। একবার মস্কোভা বন্দী শিবিরের কথাও ফারহানার মনে পড়ল। এটা মনে করতে গিয়ে আয়েশা আলিয়েভার কথা মনে পড়ল। সেই সাথে ফারহানা কিভাবে গাড়িতে পুলিশ প্রহরীদের পরাভূত করে নিজেকে মুক্ত করেছিল সেটা মনে পড়ল এবং মনে পড়ল ড্রাইভার কে কাবু করে গাড়ি দখলের তার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। একটা আলোর সন্ধান যেন সে পেল। মুখটা তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আশেপাশে সে তাকাল, না তেমন কিছু নেই। হঠাৎ তার মনে পড়ল, ব্যাগের মধ্যে স্টিলের একটা ব্যাটন আছে যা সে তার ভায়ের ফরমায়েশ হিসেবে কিনেছে। এটা ফোল্ড করলে হাতের মুঠোর মধ্যে এসে যায় এবং আন-ফোল্ড করলে দু’ফুট লম্বা ওজনদার এক মারাত্মক ব্যাটনে পরিণত হয়।
খুশী হয়ে ফারহানা খোদেজায়েভার কানে ব্যাপারটা বলল। খোদেজায়েভাও খুশী হল। কিন্তু পরক্ষনেই তার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বলল, ড্রাইভারকে না হয় কাবু করলাম, কিন্তু পিছনের পুলিশের গাড়ি কি হবে? ওর স্পীড তো এ মাইক্রোবাসের চেয়ে অনেক বেশী।
ফারহানা বলল, সে চিন্তা পরে করা যাবে কিন্তু এ পথ ছাড়া তো এদের হাত থেকে মুক্তির কোন পথ দেখি না।
ফারহানার কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে হর্নের শব্দ পাওয়া গেল এক সঙ্গে কয়েকবার। ফারহানা ও খোদেজাভার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, এতো সাইমুমের গাড়ির কোড হর্ন। তাহলে তারা এসে গেছে।
ফারহানা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগ খুলে সেই ব্যাটনটি বের করল। তারপর ড্রাইভারের পেছনের সিটে একটা আসন খালি ছিল, ফারহানা গিয়ে সেখানে বসল।
এই সময় পিছন থেকে একটা গুলির শব্দ হলো। সংগে সংগে প্রচন্ড শব্দে একটা টায়ার বাস্ট হবার শব্দ পাওয়া গেল এর মুহূর্তকাল পরেই ব্রাস ফায়ারের শব্দ কানে এল।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার পাশের জানালা দিয়ে একবার পিছন দিকে তাকিয়েই গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল।
ফারহানা জানালা দিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল টায়ার ফাটা পুলিশের জীপ রাস্তায় দাড়িয়ে পড়েছে। জীপের দুপাশে দুজন পুলিশের লাশ পড়ে আছে। সাইমুমের জীপটি পুলিশের গাড়ির পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে।
ফারহানা তার কর্তব্য ঠিক করে নিল। ব্যাটনের মাথার সুইচটায় চাপ দিতেই ব্যাটনটি নিঃশব্দে আন-ফোল্ড হয়ে গেল। প্রায় সের খানেক ওজন হবে ব্যাটনের।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার পেছনে নড়াচড়া বোধ হয় টের পেয়েছিল। চকিতে সে একবার পেছনে ফিওে চাইল। পেছনে ফারহানাকে উঠে দাড়াতে দেখে ড্রাইভিং হুইল থেকে দ্রুত একটা হাত নামিয়ে পাশে রাখা রিভলভারে সে হাত দিতে যাচ্ছিল।
কিন্তু রিভলভার হাতে নেয়ার সুযোগ ফারহানা আর তাকে দিল না, ফারহানার ব্যাটন বিদ্যুৎ গতিতে একবার উপরে উঠে আড়াআড়ি ভাবে গিয়ে আঘাত করল তার বাম কানের ঠিক উপরে। ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল ড্রাইভারের দেহটা। ফারহানা তার দেহটা কাত হয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল ড্রাইভিং হুইলের উপর, পায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরল ব্রেক। মাইক্রোবাসটা তার মাথা কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে রাস্তার একপাশে গিয়ে থেমে গেল।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার আঘাতটা সামলে নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছিল। ফারহানা পাশে পড়ে থাকা ব্যাটনটি তুলতে যাবে এমন সময় পাশে এসে একটি গাড়ি থামল। পরক্ষনেই দুজন এসে মাইক্রোবাসের জানালায় দাঁড়াল। তাদের একজনকে দেখে ফারহানা অপূর্ব এক ভাবাবেগে নিশ্চল হয়ে গেল। ব্যাটনটি তুলতে গিয়ে সে যেভাবে ছিল সেভাবেই ছিল।
আহমদ মুসা সেদিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত ড্রাইভিং দরজা খুলে ফেলল। ড্রাইভার-পুলিশ ইত্যবসরে তার পিস্তলটি তুলে নিয়েছিল। ওদিকে নজর পড়তেই আহমদ মুসা প্রচন্ড বেগে গাড়ির দরজা বন্ধ করার জন্যে ধাক্কা দিল। ড্রাইভার পুলিশটির একটা পা এবং মাথা দরজার বাইরে এসেছিল, দরজার ধাক্কায় পা এবং মাথা একেবারে থেতলে গেল, রিভলভারটি ছিটকে গাড়ির মধ্যেই পড়ে গেল।
গাড়ির দরজা আবার খুলে ফেলল আহমদ মুসা। তারপর ড্রাইভার-পুলিশকে টেনে বের করে ছুড়ে দিল রাস্তার বাইরে।
তারপর দ্রুত উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। ফারাহানা ওড়না দিয়ে মাথা মুখ প্রায় ঢেকে ফেলে ড্রাইভারের পাশের সিটেই বসে পড়েছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত বলল, ফারহানা তোমাকে ধন্যবাদ, গাড়ি দাঁড় না করাতে পারলে অসুবিধা হতো। একটু থেমে বলল, ফারহানা তুমি পেছনের সিটে যাও। তারপর বাইরে মুখ বাড়িয়ে বলল, হাসান তারিক তুমি উঠে বস।
ফারহানা পেছনে চলে গেল। হাসান তারিক এসে বসলে জীপকে লক্ষ্য করে বলল, কুতাইবা একেবারে সোজা লেনিন স্মৃতি পার্কে।
মাইক্রোবাস আবার ফুল স্পীডে চলতে শুরু করল। তার পেছনে কুতাইবার জীপ।
পুলিশের জীপের অবশিষ্ট দুজন পুলিশ গুলি করতে করতে ছুটে আসছিল কিন্তু তারা শীঘ্র পিছনে দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেল।
শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে সময় কাটল খোদেজায়েভা এবং অন্যান্য মেয়েদের। এর মধ্যেও ফারহানার আকষ্মিক পরিবর্তন, তার লাজ নম্র নির্বাক চেহারা এবং মাথায় ওড়না উঠে আসা তাদের নজর এড়ায়নি। যে ফারহানা ব্যাটন হাতে একজন পুলিশ অফিসারকে কাবু করে গাড়ি দখলের সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পারে, সে ঐ লোকটিকে দেখে অমন সংকুচিত হয়ে গেল কেন? এ কৌতুহল তারা দমিয়ে রাখতে পারছিল না।
গম্ভীর খোদেজায়েভাই প্রথম প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার ফারহানা, তোমার কি হল?
খোদেজায়েভার প্রশ্ন শেষ না হতেই রাইছা প্রশ্ন করে বসল, ইনিই বোধ হয় আহমদ মুসা? তার মুখে হাসি বিস্ময় দুটোই।
ফারহানা গম্ভীর কন্ঠে বলল, হ্যাঁ, উনিই।
রাইছা কিছু বলতে যাচ্ছিল, ফারহানা তার মুখ চেপে ধরে সেই গম্ভীর কন্ঠেই বলল, এটা আমাদের ড্রইং রুম নয়।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কিছু বলব না, কিন্তু বলতো আমি কি করে বুঝলাম উনি আহমদ মুসা? বলল রাইছা।
-নিছক অনুমান করেই।
-না।
-তাহলে কি?
-তোর কাপুনি আর তোর লাল মুখ দেখে। কত নায়ক-নায়িকার মুখোমুখি হবার দৃশ্য আমি উপন্যাসে দেখেছি।
ফারহানা খোদেজায়েভার দিকে ফিরে বলল, আপা, ওকে সামলাও। সীমা লংঘন করছে ও।
-ঠিক আছে, তওবা করছি, এই মুখ বন্ধ করলাম। বলে রাইছা সত্যিই সত্যিই দু আংগুলে ঠোট চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে সিটের উপর শুয়ে পড়ল।
তাসখন্দ এয়ারপোর্ট থেকে লেনিন স্মৃতি পার্ক প্রায় হাজার মাইল। গোটাটাই জনমানবহীন পথ। যাতে শত্রুরা ঠিক করতে না পারে কোথায় তারা যাচ্ছে এজন্যে আহমদ মুসা বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে কেউ অনুসরণ করছে না নিশ্চিত হয়ে তবেই লেনিন স্মৃতি পার্কের পথে গিয়ে পড়ল।

জেনারেল বোরিসের পি এস ভিক্টর কুমাকভ ঠিক সাড়ে আটটায় অফিসে গিয়ে পৌঁছল। জেনারেল বোরিস অফিসে আসেন নয়টায়। তাঁর জন্য সব ফাইল রেডি করা এবং দিনের কাজের একটা আউট লাইন দাঁড় করতে আধা ঘন্টা সময় ভিক্টর কুমাকভের দরকার হ্য়। সেই জন্য ভিক্টর কুমাকভের অফিস আওয়ার সাড়ে আটটা থেকেই।
অফিসে বসে ভিক্টর কুমাকভ সবে ফাইলে হাত লাগিয়েছে এমন সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল অপারেশনাল উইং-এর ডিজি টিটভ। তার হাতে একটা ফাইল। ফাইলটা টেবিলে রেখে বলল, ফাইলটার কাজ ইমিডিয়েটলি হওয়া দরকার। আমি দশটায় ফাইল ফেরত নেয়ার জন্য আসব।
ভিক্টর কুমাকভ মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
বেরিয়ে গেল টিটভ।
ভিক্টর কুমাকভ হাতের ফাইল্টা রেখে ‘টপ সিক্রেট’ ‘টপ প্রায়োরিটি’ লেবেল আঁটা টিটভের ফাইলে মনোযোগ দিল। দেখল ফাইলের ভিতরে একটা ইনভেলাপ আঠা দিয়ে মুখ আঁটা। বিশেষ গোপনীয় ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ছাড়া কোন ডকুমেন্টই মুখ আঁটা অবস্থায় পি,এস এর কাছে আসেনা।
ইনভেলাপটি হাতে নিয়ে কয়েকবার নাড়াচাড়া করল ভিক্টর কুমাকভ। অপারেশনাল উইং থেকে আসা এমন জরুরী মুখবন্ধ ডকুমেন্টের অর্থ হলো এর মধ্যে নিশ্চয় কোন অপারেশন সংক্রান্ত পরিকল্পনা আছে। এই চিন্তার সাথে সাথে ইনভেলাপের ডকুমেন্টের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেল ভিক্টরের।
পাঠকদের মনে থাকার কথা এই ভিক্টর কুমাকভের আসল নাম যুবায়েরভ। সাইমুমের গোয়েন্দা ইউনিটের একজন কর্মকর্তা ইনি। আগে ইনি সিক্যুরিটি বিভাগের রেকর্ড সেকশনে ছিলেন। অরুশ তূর্কী, বিশেষ করে মুসলিম অফিসার কর্মচারীদের রুশ অঞ্চলে ট্রান্সফার করার পর এখানে আগে থেকে কর্মরত রুশ কর্মচারীরা তাদের অভিজ্ঞতার কারণে বড় বড় শিফট পেয়ে যান। সেই সুবাদে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে পরিচিত যুবায়েরভ জেনারেল বোরিসের পার্সোনাল সেক্রেটারী পদ লাভ করেছে। সাইমুম একে তাদের প্রতি আল্লাহর এক বিশেষ রহমত হিসেবে মনে করছে।
ইনভেলাপ শেষ পর্যন্ত খোলারই সিদ্ধান্ত নিল যুবায়েরভ। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল তখন ৮ টা ৭ মিনিট। যুবায়েরভ তাড়াতাড়ি উঠে পাশের টেকনিক্যাল রুমে গেল। সর্বাধুনিক ইনভেলাপ ওপেনারও আছে সেখানে। সুইচ টিপে যন্ত্রের মধ্যে ইনভেলাপটি ঢুকিয়ে দিল ইনভেলাপের আঠা বিন্দুমাত্র নষ্ট না করেই ইনভেলাপ খুলে দেয়। কাজ সেরে ইনভেলাপের আঠাতেই সেটা আবার বন্ধ করা যায়। ধরবার কোন উপায় থাকেনা।
ভিক্টর ইনভেলাপ ওপেনার দিয়ে দ্রুত ইনভেলাপটি খুলে ফেলল।
ইনভেলাপের ভিতরে টাইপ করা দুটো কাগজ। একটা হল তথ্য-বিবরণী, আরেকটা অপারেশন প্ল্যান।
যুবায়েরভ দ্রুত কাগজ দু’টির ফটো করে নিল। তারপর মূল কাগজ দুটি ইনভেলাপে ঢুকিয়ে আবার ইনভেলাপের মুখ বন্ধ করে দিল।
ঠিক ন’টায় বোরিস অফিসে এল। যুবায়েরভ নিয়ম অনুসারে অপারেশনাল উইং-এর টপ প্রায়োরিটি তার কাছে পেশ করল।
যুবায়েরভের মনটা উসখুস করছিল। তথ্য-বিবরণী ও অপারেশন প্ল্যানের শিরোনাম ছাড়া আর কিছুই পড়া হয়নি তার। শিরোনাম দেখেই বুঝেছে লেনিন স্মৃতি পার্ক নিয়ে তারা কিছু করতে যাচ্ছে।
এসময় টেলিকম কথা বলে উঠায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল। টেলিকমে কথা বলছিল জেনারেল বোরিস। বলল সে, ভিক্টর টিটভ কখন আসবে বলেছে?
-দশটায়। বল যুবায়েরভ।
-না দশটায় নয়, এখুনি আসতে বল।
-বলছি স্যার।
টেলিকম বন্ধ হয়ে গেল। যুবায়েরভ অয়্যারলেসে টিটভের সাথে যোগাযোগ করল। তাকে জানাল জেনারেলের নির্দেশের কথা।
অয়্যারলেস বন্ধ করে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল যুবায়েরভ। ব্যাপারটা নিশ্চয় জরুরী। তা নাহলে জেনারেল বোরিস ১০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবেননা কেন! আর স্থির থাকতে পারলো না যুবায়েরভ। অবশেষে কাগজ দু’টো নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল সে।
প্রথমে অপারেশন প্ল্যানটায় চোখ বুলাল যুবায়েরভ। চোখ বুলাতে গিয়ে চোখ দু’টো ছানাবড়া হয়ে উঠল তার। আজ রাত ১ টা থেকে লেনিন স্মৃতি পার্কে ওদের কম্বিং অপারেশন। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে আফগান সীমান্তে সশস্ত্র গোয়েন্দাদের পাহারা বসান হবে যাতে একটা পিঁপড়াও সীমান্ত অতিক্রম না করতে পারে।
লেনিন স্মৃতি পার্কের সব বিষয়ে নজর রাখার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে গোয়েন্দা মোতায়েনের উল্লেখ আছে। বেলা ৩ টায় ষ্ট্যালিনবাদ থেকে আর্মি মুভ করাবে, রাত ৯ টায় লেনিন স্মৃতি পার্কে তারা পৌঁছবে।
তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ আছে, লেনিন স্মৃতি পার্কে সাইমুম বিরাট এক অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে। লেনিন স্মৃতি পার্কের প্রধান প্রবেশ পথে যে গোপন ক্যামেরা আছে তার ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মস্কোভা জেল থেকে পালানো আয়েশা আলিয়েভ ও রোকাইয়েভা, রোকাইয়েভার মা, হিসার দূর্গের মোল্লা আমীর সুলাইমানের মেয়ে শিরীন শবনম এই লেনিন স্মৃতি পার্কে প্রবেশ করেছে। তারা বের হবার প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। সর্বশেষ মস্কো থেকে পালানো ১০ জন ছাত্রীও সেদিন এখানেই এসে উঠেছে। সব মিলিয়ে ধরে নেয়া হয়েছে লেনিন স্মৃতি পার্ক সাইমুমের এক বিরাট ঘাটি। পড়া শেষ করে যুবায়েরভ বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। উদ্বেগে ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন হৃদয়টা। এই মূহূর্তেই খবর পৌঁছানো দরকার হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু বেলা ১টার আগে অফিস থেকে বেরুবার কোনই উপায় নেই।
নিদারুণ উদ্বেগে সময় কাটছিল যুবায়েরভের। চেয়ারে হেলান দিয়ে মনটাকে একবার স্থির করতে গিয়ে ঘুম এসে গিয়েছিল তার চোখে। এ সময় রুমে প্রবেশ করল জেনারেল বোরিস। যুবায়েরভের অবস্থা দেখে জেনারেল বোরিস একটু উদ্বিগ্ন হয়েই বলল, তোমার শরীর খারাপ নয়তো ভিক্টর?
দ্রুত সোজা হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যুবায়েরভ বলল, একটু খারাপ বোধ করছি স্যার।
-এতক্ষণ বলনি কেন? আমার আজ তেমন কাজ নেই। তুমি চলে যেতে পার।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করে যুবায়েরভ বেলা ১১ টায় অফিস থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে সোজা চলে এল বাড়ীতে।
নিজের রুমে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। ষ্টীল আলমারীটা খুলে বের করল একটা এটাচি কেস। এটাচি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটি শক্তিশালী রেডিওগ্রাহক যন্ত্র। বৈধ লাইসেন্সের অধীনে রাখা অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রাহক যন্ত্র এটা। কিন্তু এই গ্রাহক যন্ত্রের নিচের অংশে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে অত্যাধুনিক একটি রেডিও ট্রান্সমিটার।
হাজার বর্গমাইলের মধ্যে যে কোন জায়গায় এর মাধ্যমে খবর প্রেরণ ও গ্রহন করা যায়। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এর ট্রান্সমিশনের অবস্থান ডিটেক্ট করার কোন যন্ত্র এখনও উদ্ভব হয়নি।
যুবায়েরভ চিন্তা করল, প্রথমেই ব্যাপারটা লেনিন স্মৃতি পার্কে আলদর আজিমভকে জানিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, না প্রথমে হেড কোয়ার্টারকেই জানানো উচিত। এই খবর কোথায় কিভাবে কতখানি পাঠানো হবে সেটা হেডকোয়ার্টারই ভাল বুঝবে।
যুবায়েরভ সালাম জানিয়ে বলল, মুসা ভাই জরুরী মেসেজ।
-ভাল আছ তো?
-জি হ্যাঁ।
-বল তোমার মেসেজ।
যুবায়েরভ তার স্মৃতি থেকে তথ্য বিবরণী ও অপারেশন প্ল্যানের পুরো বিবরণ রিলে করল আহমদ মুসার কাছে।
মেসেজ শেষ হলে ওপার থেকে আহমদ মুসা বলল, বড় একটা জায়গাকে ওরা টার্গেট করেছে যুবায়েরভ। আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের সাহায্য করবেন। তোমাকে মোবারকবাদ, আল্লাহ তোমাকে দিয়ে জাতির একটা বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন।
এপার থেকে যুবায়েরভ বল, দোয়া করুন মুসা ভাই। দুনিয়ার স্বার্থ সম্পদ কিছুই আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা চাই আল্লাহর বান্দাহদের কল্যাণ এবং যা কিছু করতে পারছি তার বিনিময়ে আল্লাহ যেন দয়া করে আমাদের পরকালীন মুক্তির ব্যবস্থা করেন।
আহমদ মুসা ওপার থেকে ‘আমিন’ বলে অয়্যারলেসের লাইন কেটে দিল।
শহিদ আনোয়ার পাশা ঘাঁটিতে আহমদ মুসার রুমে পরামর্শে বসেছে আহমদ মুসা, হাসান তারিক এবং কর্ণেল কুতাইবা। যুবায়েরভের পাঠানো তথ্য নিয়ে অনেক আলোচনা হল। সবশেষে আহমদ মুসা বলল, আমরা লেনিন স্মৃতি পার্কে ‘ফ্র’-এর সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাইনা। ভেতর থেকেই আজ যখন এরা ভেংগে পড়ার মুখোমুখি, তখন একে আমি অনর্থক মনে করি। আমি লেনিন স্মৃতি পার্ক ঘাঁটি সরিয়ে আনতে চাই। শুধু আলদর ক্ষুদ্র দল নিয়ে ওখানে থাকবে। অস্ত্রগুলো সীমান্তের ওপারে আমাদের আফগান ঘাটিতে আপাতত রাখা হোক। মেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে বখশ নদীর তীরে আলী ইব্রাহীমের ওখানে গুলমহল ঘাঁটিতে। আর ষ্ট্যালিনবাদ থেকে যে কম্যুনিষ্ট সেনাদল লেনিন স্মৃতি পার্কে যাত্রা করবে তাদের আমরা পথেই আটকাতে চাই। আমার মতে উদ্ভূত পরিস্থিতি আমরা এভাবেই মোকাবিলা করতে পারি।
হাসান তারিক এবং কুতাইবা মাথা নেড়ে সায় দিল আহমদ মুসার কথায়।
পরামর্শের পর আহমদ মুসা গিয়ে বসল অয়্যারলেস সেটের পাশে। যোগাযোগ করল লেনিন স্মৃতি পার্কে আলদর আজিমভের সাথে। মুসা তাকে বলল, আমি তো মনে করি ওখানকার গোয়েন্দাদের ট্যাকল করতে তোমার লোকরাই যথেষ্ট!
ওপার থেকে আলদর আজিমভ বলল, দোয়া করুন, মোতায়েন হবার পর ওদের গোয়েন্দারা আমাদের হাতে ধরা পড়ে যাবে।
আহমদ মুসা আবার বলল, লেনিন স্মৃতি পার্ক ঘাঁটি থেকে আপাতত জমা অস্ত্রগুলো এবং মেয়েদের সরিয়ে নিতে হবে। সব পরামর্শ দিয়ে ওখানে হাসান তারিক এবং কুতাইবাকে পাঠাচ্ছি। সবাইকে আমার সালাম বলো। বলে আহমদ মুসা অয়্যারলেস বন্ধ করে দিল।
তারপর বখশ নদীর তীরের ঘাটিতে আলী ইব্রাহীমের সাথে যোগাযোগ করে বলল, তোমরা তৈরী থেকো আমি আসছি। একটু থেমে বলল, আমার মনে হয়, প্রস্তুত হয়ে তোমরা যদি পশ্চিমে এগিয়ে যাও এবং বখশ শহরের ৫০ মাইল পূর্বের ব্রীজ টার কাছে ৫টার মধ্যে পৌছে যাও তাহলে সেখানেই আমার সাথে তোমাদের দেখা হতে পারে এবং এটাই সবদিক থেকে ভাল হবে।
ওপার থেকে আলী ইব্রাহিম বলল, আমরা আপনার এ পরামর্শ অনুসারে কাজ করব।
আরেকটা জরুরী কথা, বলল, আহমদ মুসা, গুলমহলে আমাদের ঘাটির কাজ কি কমপ্লিট?
-জি হ্যাঁ। বলল, আলী ইব্রাহীম।
একটূ থেমে আবার সে বলল, এখন আমরা আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারি।
-না করে আর উপায়ও নেই আলী ইব্রাহীম। আমাদের লেনিন স্মৃতি পার্ক ছাড়তে হচ্ছে। সম্ভবত আজই আমাদের মেয়েরা গুলমহল ঘাটিতে পৌছে যাবে।
-ঠিক আছে, ওখানে সব ব্যবস্থাই কমপ্লিট। হাসান তারিক ভাই সব কিছু জানেন।
-আর কোন কথা আলী ইব্রাহিম?
-নেই জনাব।
-ইনশাআল্লাহ ৫টার মধ্যে ওখানে আমাদের দেখা হচ্ছে।
বলে আহমদ মুসা অয়্যারলেস রেখে দিল। তারপর উঠে ফিরে দাঁড়াল হাসান তারিক ও কুতাইবার দিকে। বলল তোমরা এখনি রওনা হও লেনিন স্মৃতি পার্কে। সীমান্তের ওপারে অস্ত্র পাঠানোর কাজ সহজেই হয়ে যাবে। আগামী ভোরের আগেই তোমরা আমাদের মেয়েদের গুলমহল ঘাটিতে পৌছাতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আমরাও আলী ইব্রাহিমের ঘাটি হয়ে ওখানে সকালের দিকে যেতে পারি।
বলে আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে দিল ওদের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্যে।
হ্যান্ডশেক করতে করতেই কুতাইবা বলল, আপনার সাথে কে যাচ্ছে মুসা ভাই?
-জীপ নিয়ে যাব। দেখি, দু’একজন কেউ সাথে গেলেই চলবে। আহমদ মুসা বিদায় হলো ওদের কাছ থেকে। জীপ রেডি ছিল। ঘাঁটি প্রধান আলী আমর লোক বাছাই করে আগেই তুলে দিয়েছিল জীপে। আহমদ মুসা এসে জীপের ড্রাইভিং সিটে বসল। স্টার্ট নিল জীপ। আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলার সাথে চলতে শুরু করল। জীপ ছুটে চলল পামির সড়কের দিকে।
ব্যবসার কাফেলার আনাগোনা ছাড়া পামির সড়ক আজকাল প্রায় শূন্যই থাকে। ‘ফ্র’ এর কম্যুনিস্ট সরকারের বাহিনী এখন বড় বড় দল ছাড়া বিচ্ছিন্ন ভাবে বের হয় না। স্থানীয় লোকদের নিয়ে গঠিত সরকার ও কম্যুনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে দেবার পর তারা নিজেরাও এখন নিজেদেরকে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবছে। সুতরাং জনগনকে তারা ভয় করে। বিরাট কোন বাহিনী বহর ছাড়া এখন রাস্তায় বের হয় না বললেই চলে। সুতরাং সাইমুমের জন্য মধ্য এশিয়ার সব রাস্তা আজ প্রায় নিরাপদ হয়ে গেছে।
পামির সড়ক দিয়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে সেই ব্রীজের দিকে যাচ্ছিল আহমদ মুসার জীপ। ৪টার দিকে বখশ শহর অতিক্রম করে সোয়া চারটার দিকে সে বখশ শহর থেকে ৫০ মাইল দুরের সেই ব্রীজের কাছে পৌছল।
জায়গাটার নাম সফেদকোহ। এই এলাকার সবচেয়ে উচু পর্বত এখানেই। এ পর্বতের মাথায় আইস ক্যাপ আছে। ওখানে বরফ জমে থাকে প্রায় সারা বছরই। এই থেকে এ জায়গাটার নাম হয়েছে সফেদকোহ। এখানে এসে পামির সড়ক অনেক উচু। সফেদকোহর মাঝখান দিয়ে একটা সংকীর্ণ ও গভীর উপত্যকা। সে উপত্যকা দিয়ে অত্যন্ত খরস্রোতা একটা পাহাড়ী নদী প্রবাহীত। উপত্যকার উপর একটা বড় ব্রীজ পামির সড়কের সংযোগ সাধন করেছে।
ব্রীজের কাছে এসে আহমদ মুসা সাইমুমের কোডে হর্ন বাজাল। মুহূর্ত কয়েকের মধ্য রাস্তায় স্বয়ং আলী ইব্রাহীম নেমে এসে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল।
আহমদ মুসা প্রথমেই তাকে বলল, জীপটাকে কোথাও সামলানো দরকার। মুহূর্তে সামলানো হলো জীপটা। কিছু পথ ঘুরে পাহাড়ের একটা গলিপথ দিয়ে জীপটাকে একটা পাহাড়ের আড়ালে নিয়ে আসা হলো।
তারপর আহমদ মুসা আলী ইব্রাহীমকে নিয়ে পরামর্শে বসল। প্রথমে আলী ইব্রাহীমের কথা শুনে নিয়ে আহমদ মুসা উপসংহার টানল এইভাবে। আমাদের লোকেরা ব্রীজের এপারে রাস্তার দুধারে পাহাড়ে মোতায়েন থাকবে। রাস্তার একপার তুমি, অন্য পারে আমি তাদের সাথে থাকব। ব্রীজ আমরা ওদের পেরোতে দেবো না। আমার জীপে দেখ একটা স্ট্যান্ড সাইন বোর্ড আছে। ওটা আমরা ব্রীজ থেকে দু’শ গজ ওপারে রাস্তার উপর রেখে দেব। ওতে নির্দেশ দেখার পর তারা স্বাভাবিক ভাবেই মনে করবে ব্রীজের ওপারে তাদের জন্যে প্রতিরোধ অপেক্ষা করছে, এ অবস্থায় তারা তিনটা কাজ করতে পারে। এক, তারা এখানে সামনে অগ্রসর হবে। দুই, তারা পিছনে সরে যাবে। তিন, তারা এখানে নেমে পড়ে রাস্তার দুধারে আশ্রয় নিয়ে স্ট্যালিনবাদ কিম্বা বখশ শহর থেকে বিমান সাহায্যর জন্য অপেক্ষা করবে। তিন অবস্থার মধ্যে তারা যদি পিছিয়ে যায় তাহলে আমরা তাদের যেতে দেব। কিন্তু যদি তারা সামনে অগ্রসর হয় কিম্বা নামার চেষ্টা করে অথবা অন্য কোন তৃতীয় পন্থার আশ্রয় নেয়, তাহলে আমরা তৎক্ষণাৎ ওদের উপর এন্টি ট্যাংক ডিনামাইট দিয়ে আক্রমন চালাব রাস্তার দুপাশ থেকে।
এ্যান্টি ট্যাংক ডিনামাইট সাইমুমের অস্ত্রাগারে নতুন আমদানী। কম্যুনিস্ট সরকারেরই এক মুসলিম বিজ্ঞানীর ফর্মূলায় তৈরী এটা। তৈরীও হয়েছে কম্যুনিস্ট সরকারের ফ্যাক্টরীতে। এই ডিনামাইট ছোড়ার ঝুঁকি অতি সামান্য কিন্তু ৯০ ফুট আয়তনের মধ্য এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা অতি ভয়াবহ।
বেলা ৫ টা বেজে ৪মিনিট। এ সময় আহমদ মুসার দূরবীনে ধরা পড়ল ৩০টি সামরিক ট্রাকের একটা কনভয় উঠে আসছে পামির সড়কের ঢাল বেয়ে।
আহমদ মুসা দ্রুত হিসাব করল সাইনবোর্ড স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে ৩০টি ট্রাক পিছন দিকে কতটুকু জায়গা নেবে। হিসাব করে পকেট অয়্যারলেসে রাস্তার ওপারে আলী ইব্রাহীমকে জানিয়ে দিল তার লোকজনদের পিছনের দিকে কতটা ছড়িয়ে দিতে হবে।
ঠিক ৫টা ১০মিনিটে ৩০টা ট্রাকের কনভয় এসে হাজির হলো আহমদ মুসাদের বেষ্টনীর মধ্যে। ট্রাক বহরের সামনে ছিল একটা জীপ। জীপটা রাস্তার স্ট্যান্ড সাইনবোর্ডের ৫গজের মধ্যে এসে দাঁড়াল। এক এক করে সব গুলি ট্রাক একটার পেছনে আরেকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
জীপে ড্রাইভারের পাশের সিটে একজন ব্রিগেডিয়ার বসেছিল। সে সাইনবোর্ড পড়ল তারপর পিছনের অফিসারদের সাথে আলোচনা করল।
আহমদ মুসা সাইন বোর্ডের সমান্তরাল এক পাথর খন্ডের আড়াল থেকে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিল। আহমদ মুসার পাশেই ডিনামাইট হাতে প্রস্তুত একজন।
জেনারেল তার অধঃস্তনদের সাথে কি পরামর্শ করল জানা গেল না। কিন্তু দেখা গেল অয়্যারলেস মুখের কাছে তুলে নিয়ে কি যেন নির্দেশ দিল। পরক্ষণেই দেখা গেল ৩০টি ট্রাকের দুপাশের মোতায়েন রাখা কামানের লোকগুলো নড়ে চড়ে প্রস্তুত হয়ে উঠল। তারপর জেনারেলের জীপ নড়ে উঠে দ্রুত অগ্রসর হলো সামনে।
জীপটি তখন রাস্তার সেই সাইনবোর্ডের উপর গিয়ে পড়েছে, জীপের বলিষ্ট চাকার আঘাতে সাইনবোর্ডটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যখন ছিটিয়ে পড়ছে, ঠিক সে সময় রাস্তার দুপাশ থেকে দুটো ডিনামাইট এসে জীপকে আঘাত করল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড! প্রচন্ড বিস্ফোরণের মধ্যে জীপটি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। গোটা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আগুন।
প্রথম ডিনামাইট দুটির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই রাস্তার দুধার থেকে ৩০টি সামরিক ট্রাক লক্ষ্যে বৃষ্টির মত নিক্ষিপ্ত হল ডিনামাইট।
তারপরের দৃশ্যটা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। কোন কোন কামানের নল একটু উচু হয়েছিল গোলাবষর্ণের জন্যে, কেউ কেউ কামানের বোতাম টিপতে যাচ্ছিল কিন্তু সব ডুবে গেল অনেক ডিনামাইটের সম্মিলীত বিস্ফোরণের আকাশ ভেদী শব্দে। মুহুর্তে গোটা রাস্তা অগ্নিগোলকে পরিণত হল। অনেক্ষন পর সেই আগুন কিছুটা থামল, তখন ট্রাকগুলো দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া চেসিস এবং ইতঃস্তত ছিটানো ইস্পাতের টুকরো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।
আহমদ মুসা দূরবীন চোখে ধরেই বসে ছিল, মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্য থেকে সে চোখ সরাতে পারছিল না। এইতো জ্বলজ্যান্ত মানুষগুলো ছিল, কোথায় হারিয়ে গেল নিমেষে! কি মর্মান্তিক এই হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এদের মা আছে, স্ত্রী আছে, ছেলে মেয়ে আছে। কত স্নেহ কত আকুলতা নিয়ে তারা পথ চেয়ে থাকবে। তারপর যখন খবর পৌছবে কি ভাববে তারা? কেমন হবে তখনকার দৃশ্য? তারা কি বুঝবে সেই রাজনীতির কথা যে রাজনীতি তাদের ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর মুখে, যে রাজনীতি মানবতার কন্ঠ রোধ করা আর মানুষের শান্তি স্বাধীনতা হরণ করার অস্ত্র হিসাবে তাদের প্রিয়জনদের ব্যবহার করছে। চোখ দুটি আহমদ মুসার সিক্ত হয়ে উঠেছিল।
আলী ইব্রাহীম এসে ধীরে ধীরে একটা হাত রাখল আহমদ মুসার কাঁধে।
আহমদ মুসা ধীরে মুখটা তার ঘুরিয়ে নিয়ে আলী ইব্রাহীমের দিকে চেয়ে বলল, আমরা তো এই হত্যাযজ্ঞ চাইনি আলী আব্রাহীম, কেন তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে আমাদের উপর।
কন্ঠ ভারী আহমদ মুসার।
আলী ইব্রাহীম বলল, জনসমর্থন হারিয়ে ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। একমাত্র শক্তির জোরে রক্ত সাগর বইয়ে হলেও ওরা টিকে থাকতে চায়। তা না হলে ওরা লেনিন স্মৃতি পার্কের মত জায়গায় বাড়তি ৩০ ট্রাক সৈন্য পাঠাবে কেন?
ছাই এর স্তুপ, পোড়া দেহ এবং কুন্ডলি পাকান ইস্পাত রাশির দিকে আবার চোখ ফিরিয়ে আহমদ মুসা অনেক স্বগত কন্ঠেই বলল, কাজ আমাদের দ্রুত করতে হবে আলী ইব্রাহীম। আল্লাহর বান্দাদেরকে এদের ধ্বংশকারী অক্টোপাশ থেকে বাঁচাতে হবে।
বখশ নদী তীরের আলী ইব্রাহীমের ঘাটি এবং এই নদীর তীরে অবস্থিত আলী ইব্রাহীমের গ্রাম গুলমহলের মাঝামঝি জায়গায় পাহাড়ের দেয়াল আর নদী ঘেরা উপত্যকায় গড়ে তোলা হয়েছে গুল মহল ঘাটি। সবুজ বনানীর মধ্যে সবুজ রং করা পাথর দিয়ে গড়ে তোলা এই লোকালয় উপর থেকে চোখই পড়ে না। একটু দুর থেকেও এর অস্তিত্ব ভালভাবে বুঝা যয় না। আলী ইব্রাহীমের ঘাটি হয়ে আসাই এখানে আসার সবচেয়ে সহজ পথ। খরস্রোতা বখশ নদীপথে স্পিডবোট দিয়েও এখানে আসা যাওয়া করা যায়।
সাইমুমের হাসপাতাল এবং মেয়েদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবেই একে গড়ে তোলা হয়েছে।
গতরাতে লেনিন স্মৃতি পার্ক থেকে মেয়েদের এখানে আনা হয়েছে।
সম্প্রতি মস্কো থকে পালিয়ে আসা ছাত্রীরাও এখানে আশ্রয় নিয়েছে, একমাত্র ফারহানা ছড়া।
লেনিন স্মৃতি পার্ক থেকে অস্ত্র সরান এবং মেয়েদের এখানে নিয়ে আসরা সব বিবরণ দিচ্ছিল তারিক আহমদ মুসার কাছে।
সে বলছিল, এ কাজে কোন অসুবিধাই হয়নি। আলদর আজিমভের পাতা ফাঁদে ‘ফ্র’ এর সব গোয়েন্দা ধরা পড়ে যায়। লেনিন স্মৃতি পার্ক প্রশাসনের কিছু বুঝার আগেই আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি। বিনা রক্তপাতেই আমরা সবকটা কাজ সমাধান করতে পেরেছি। রাত ৯টায় আর্মি আসা এবং ১টায় অপারেশন এই রুটিন প্রোগামের দিকেই তাদের সবার নজর ছিল। এর বাইরে কোন কিছু তারা চিন্তা করতে পারেনি।
একটু থেমে হাসান তারিক বলল, আসার পথে পামির সড়কে হঠাৎ করে আব্দুল্লায়েভের সাথে আমাদের কাফেলার দেখা হয়ে যায়। পিতার ভীষণ অসুখের খবর শুনে ফারহানা ঐখানে নেমে পড়ে আব্দুল্লায়েভের সাথে চলে যায়।
উদ্বিগ্ন আহমদ মুসা প্রশ্ন করল, অসুখের কিছু বিবরণ শুনেছ?
-অল্প শুনেছি, পাহাড় থেকে নামার পথে পড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে শরীরটা ক্রমশ তার খারাপ হয়েই চলছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের পিতা রাজী হয়নি।
আহমদ মুসা আর কিছু বলল না। বৃদ্ধ আব্দুল গফুরের চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওয়াদা দিয়েছিল সে মাঝে মাঝে ওখানে যাবার কিন্তু সময় করে উঠতে পারেনি আহমদ মুসা। আজ মনটা যেন বলে উঠতে চায়, অসুখের খবর পেয়ে ফারহানা ছুটে গেছে, তারও উচিত যাওয়া।
এ সময় খবর এল দাদী তাদের ডাকছে। রোকাইয়েভের দাদীই আজ সকলের দাদীতে পরিণত হয়েছে। সকলের কাছে দাদী অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র। গোটা মেয়ে মহলের অভিভাবিকা এখন সে। তার ডাক পেয়ে আহমদ মুসা এবং হাসান তারিক দুজনেই সেদিকে চলল।
মেয়েদের জন্য যে হল বরাদ্দ হয়েছে তার, অতিথি রুমে গিয়ে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক বসল।
সাদা চাদর গা মুড়ে দাদী এসে ভেতরের দরজার পাশেই একটা চেয়ারে বসল। বয়সের ভারে দেহটা একটু নুয়ে পড়েছে। কিন্তু হাঁটতে পারেন ভালভাবেই। চশমাও ব্যবহার করতে হয় না।
দাদী এসে প্রবেশ করতেই আহমদ মুসা এবং হাসান তারিক তাকে সালাম জানাল।
দাদী সালাম নিয়ে বসতে বসতে বলল, বেঁচে থাক ভাইয়া, আল্লাহ তোমাদের হায়াত দরাজ করুন।
-দাদী আমাকে মাফ করবেন, নানা কাজে ব্যস্থ থাকায় এতদিন আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ করে উঠতে পারিনি। বলল আহমদ মুসা।
– না না, ঠিক আছে তাতে হয়েছে কি! আমি তো জানি তোমরা কত ব্যস্ত। তোমরা আমার গর্ব।
একটু থামল দাদী, তারপর বলল, হাসান তুমি একটু বাইরে যাও মুসার সাথে একা কয়েকটা কথা বলব।
হাসান তারিখ বাইরে বেরিয়ে গেল। হাসান তারিক বেরিয়ে গেলে আহমদ মুসা একটু নড়ে চড়ে বসে বরল, বলুন দাদী।
-আমি বলতে চাই, তুমি তোমার বোনদের কথা কিছু কি ভাব?
-কোন বোনরা দাদী?
-তোমার যে বোনরা এখানে আছে?
-হ্যাঁ ভাবিতো। কোন ভাবনার কথা বলছেন?
-আমি তোমার বোনদের বিয়ের কথা বলছি। ইসলামী শরিয়তের বিধান, মেয়ে বড় হলে তাড়াতাড়ি তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে আমি মাঝে মাঝে অস্বস্তিবোধ করি কিন্ত তোমরা কিছুই ভাব না।
-দাদী, আপনি অভিভাবক হিসেবে এ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা খুশি হবে।
-বোকা ভাই তুমি তো সকলের সর্দার, তোমাকেই ভাবতে হবে, সব ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।
-দাদী জানেন তো, আমি খুব ব্যস্ত।
-আমি জানি সেটা কিন্ত ইসলাম তো ভারসাম্যের ধর্ম। যুদ্ধের ময়দানে তুমি যাবে, জেহাদের ময়দানে তুমি থাকবে কিন্তু তার অর্থ তোমার ঘর থাকবেনা তা নয়। ঘর এবং বাইর দুটো নিয়েই তোমার জীবন, কোন একটি বাদ দিয়ে নয়। এ ব্যাপারে ইসলামের স্পষ্ট বিধানও আছে তুমি জান।
-জানি দাদী, একটু থেমে আহমদ মুসা বরল, পরামর্শ দিন দাদী।
-তোমার কোন চিন্তা আছে কিনা জানালে আমার পরামর্শ বলতে পারি।
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, সকলের মত আমার জানা নেই, তবে আমার মনে হয়েছে আয়েশা আলিয়েভাকে হাসান তারিক, শিরীন শবনমকে কুতাইবা এবং রোকাইয়েভাকে যুবয়েরভের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা আমরা চিন্তা করতে পরি। অন্যদের ব্যাপারেও এইভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে।
দাদী একটু হাসল, বলল, আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন।
তুমি ঠিকই ভেবেছ, আমিও এরকম চিন্তা করেছি।
একটু থেকে দাদী আবার বলল, হাসান তারিক, কুতাইবা এখানে হাজির আছে, যুবায়েরকে খবর দিলে সেও আসবে, তোমাকেও পেয়েছি। আমি আজই এই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চাই।
-আমি আপনার সাথে একমত দাদী কিন্ত ওদের মতটা না জেনে একেবারে ফাইনাল করা..।
-তিন ছেলের মত সম্পর্কে তোমার বক্তব্য?
-এ প্রস্তাবের সাথে তারা দ্বিমত করবে না।
-ঠিক আছে আমি মেয়েদের মতটা নিয়ে আসছি।
বলে দাদী ভেতর চলে গেল।
ভেতরে লাইব্রেরীতেই সবাইকে পেল। আয়েশা আলিয়েভা, শিরীন শবনম ও রোকাইয়েভাকে রেখে সবাইকে লাইব্রেরী থেকে বের করে দিল দাদী।
-কি ব্যাপার দাদী সবাইকে বের করে দিলেন কেন? প্রশ্ন রাখলো আলিয়েভা।
-তোমাদের তিনজনের সাথে জরুরী কথা আছে।
-কি ব্যাপার, আমরা কি কিছুর আসামী নাকি? বলল রোকাইয়েভা।
কিন্তু রোকাইয়েভার কথার দিকে কান না দিয়ে দাদী গম্ভীর কণ্ঠে বলল, দেখ তোমাদের বয়স হয়েছে। তোমাদের ব্যাপারে তোমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখ। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে আহমদ মুসার কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে, প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি তোমাদের মত জানতে চান।
আহমদ মুসা যার জন্যে যে নাম প্রস্তাব করেছে, সে নাম লেখা চিরকুট তাদের সামনে দিয়ে দিল দাদী, তারপর বলল, সত্ত্বর মত দাও তোমরা।
দাদীর মুখে বিয়ের কথা শুনে তিনজনেরই হাসি উবে গিয়েছিল। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়েছিল তারা। এর মধ্যে আশা নিরাশার একটা কষ্টকর অনুভুতি তাদের পীড়িত করছিল।
তারপর দাদীর চিরকুটে চোখ বুলিয়ে লজ্জায় তিনজনের মুখ লাল হয়ে উঠল। দাদী যখন মত জানতে চাইল, রোকাইয়েভা তখন ‘তুমি সব জান, আমি জানিনা,’ বলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গের। আর দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল আয়েশা আলিয়েভা এবং শিরীন শবনম।
ওদের কাছে কোন জবাব না পেয়ে দাদী উঠে গিয়ে ওদের দু’জনের মুখ তুলে ধরল। দেখল অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে ওদের মুখ। দাদী একটু হেসে ওদের দু’জনের গালে স্নেহের দুটো টোকা দিয়ে বলল, জবাব পেয়েছি বুড়িরা, আনন্দের অশ্রু জবাব দিয়ে দিয়েছে।
দু’জনে মুখ ঢাকল আবার।
দাদী বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাইরে দরজার পাশেই দাড়িয়েছিল রোকাইয়েভা। দাদীকে দেখে রোকাইভেয়া পালাতে যাচ্ছিল। ওর হাতটা চেপে ধরল দাদী। বলল, এখনি সরছিস দাদীর কাছ থেকে? যুবায়ের আসলে কি দাদীর কথা আর মনে রাখবি?
এবার রোকাইয়েভা জড়িয়ে ধরল, দাদীকে। কেঁদে ফেলল সে।
বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবনা দাদী।
দাদী হেসে জবাব দিল, ঠিক আছে তুই একথা যুবায়েরকে বলিস।
দাদী অতিথি রুমে ফিরে এল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, সব ঠিক আছে, বিয়ের ব্যবস্থা কর।
-ঠিক আছে দাদী, তাহলে এখন উঠি।
-না বস, বলল দাদী।
দাদী একটু থামল। তারপর আবার বলল, তোমার কথা তুমি ভাবছ কিছু?
-কি কথা দাদী্
-তোমার বিয়ের কথা।
-না দাদী আমি ভাবছি না, ভাবতে পারছি না।
-তুমি না পারলেও তোমার দাদীকে তো ভাবতে হচ্ছে।
আহমদ মুসা চুপ করে থাকল। দাদীই আবার কথা বলল, আমাদের এক বোন আমাদের সাথে ছিল, পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে চলে গেছে। তুমি অনুমতি দিলে তার নাম প্রস্তাব করতে পারি।
আহমদ মুসার মুখটা মুহুর্তের জন্যে রাঙা হয়ে উঠল কিন্তু সামলে নিয়ে আহমদ মুসা গম্ভীর হল। একটু ভেবে নিয়ে বলল, না থাক দাদী। আমি যাযাবর, আমি কিছু চিন্তা করতে পারছি না।
দাদী আহমদ মুসার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল। তারপর একটু কঠিন স্বরেই বলল, তুমি নিজের উপর জুলুম করবে, এ অধিকার ইসলাম তোমাকে দেয়নি।
আহমদ মুসার অন্তরটা সত্যিই কেঁপে উঠল। দাদীর যুক্তিকে খন্ডন করার যুক্তি সে পেলনা। তার খুব ভাল লাগল দাদীর এ ধমক। এক আপনাত্বের সুর আছে এ ধমকে। দাদা দাদীকে সে দেখেনি। বাবা-মা’র স্নেহও বেশী দিন ভাগ্যে জোটেনি তার। আপনজনের এমন স্নেহ মাখানো ধমক সে কতদিন শোনেনি। চোখটা তার ছলছল করে উঠতে চাইল। অশ্রু গোপন করার চেষ্টা করে আহমদ মুসা বলল, দাদী! ওর অভিভাবক আছে, এ প্রসংগটা আজ থাক।
দাদি বলল, ঠিক আছে আজকের মত থাক। কিন্তু মনে রেখ, তুমি কচি হৃদয়ের উপর জুলম করছ।
দাদীর একথাটা বুকের কোথায় যেন খোঁচা দিল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার চোখের সামনে ভেসে উঠল ফাতেমা ফারহানার বিনত সলজ্জ মুখ। মনে পড়ল পুলিশের হাত থেকে তাদেরকে উদ্ধারের সেদিনের ঘটনা। আহমদ মুসাকে দেখে সেদিন ফাতেমা ফারহানা বিদ্যুতে শক পাওয়া মানুষের মত নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ফারহানা একেবারেই। আহমদ মুসা জোর করেই সেদিন কিছু বুঝতে চায়নি। কিন্তু সেই দৃশ্য তার অবচেতন সত্তায় একটা তৃপ্তির বান ডেকেছিল, একটা পাওয়ার আনন্দ হৃদয়কে ভরে দিয়ছিল, একে সে অস্বীকার করবে কেমন করে? দাদী যা বলেছেন, সত্যি কি সে তার উপর জুলুম করছে, জুলুম করছে সে নিজের উপরও? দাদীর কথার উত্তরে আর কোন কথা যোগালোনা আহমদ মুসার মুখে। অল্পক্ষণ মাথা নীচু করে চুপ থেকে সে বলল, এখন উঠি দাদী।
দাদীকে সালাম জানিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বেরুতে বেরুতে বলল, দাদী বিয়ের জন্যে ভেতরের যা ব্যবস্থা সব করুন। আমি বাইরেরটা দেখছি।
বিকেলের মধ্যেই যুবায়েরভ এস পড়ল। কেনা কাটার যা কাজ আলী ইব্রাহীম তা সেরে এল। মাগরিব নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো।
গুলমহল উপত্যকা তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা, উপরে আকাশে নবমীর চাঁদ। এরই মধ্যে শান্ত-পবিত্র এক পরিবেশে দাদী লাজনম্র অশ্রু ধোয়া আয়েশা আলিয়েভাকে তুলে দিল হাসান তারিকের হাতে, শিরীন শবনমকে কুতাইবার হাতে এবং রোকাইয়েভাকে যুবায়েরভের হাতে। শেষ হাতটি তুলে দেয়ার সময় কান্নায় ভেংগে পড়ল দাদী। বোধ হয় তার মনে পড়ছিল শহীদ ওমর জামিলভের কথা এবং অতীত দিনের অনেক কথাই।

Top