৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে

চ্যাপ্টার

মার্শাল কারেনস্কী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল পেত্রভ সেদিন তাসখন্দে এসে পৌছল বেলা দশটায়। বিমান বন্দরে তাকে স্বাগত জানাল সাইমুম নেতা কুতাইবা। তাসখন্দের শাসন ও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব সাইমুম নেতা কুতাইবার উপরই অর্পণ করে হয়েছে।
এর আগে মস্কোতে ‘ফ্র’ সরকারের পতনের সাথে সাথে তাসখন্দ থেকে জেনারেল বোরিস তার দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। সরকারী কোষাগার উজাড় করে কোটি কোটি টাকা এবং একটি ট্রাক বহর বোঝাই অস্ত্র নিয়ে তার দলবল সহ পালিয়ে গেছে জেনারেল বোরিস সেদিন রাত দুপুরে।
সকালেই সাইমুম প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে এবং কুতাইবার হাতে তাসখন্দের দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
বিমান বন্দর এবং গোটা শহরে সাদা ইউনিফর্ম পরে সাইমুম কর্মীরা শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব পালন করছিল। জীবন যাত্রায় কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী লেনদেন ছাড়া সব কিছুই আগের মত চলছে। আগের থেকে শুধু একটাই বড় পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটা হলো জীবন যাত্রায় কোন আড়ষ্টতা নেই, সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। মসজিদ মিনারের যে মাইকগুলো বন্ধ ছিল, তা আবার মুখ খুলেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সেখান থেকে আযানের উদাত্ত আহ্বান ধ্বনিত হচ্ছে। যে সব মসজিদকে ক্লাব ও কম্যুনিটি হলে পরিণত করা হয়েছিল, সেসবগুলোকে জনগণ আবার ফিরিয়ে নিয়ে মসজিদ বানিয়েছে। বহু বছর পর সেখান থেকে আযানের পবিত্র আহ্বান ধ্বনিত হচ্ছে। মানুষ দলে দলে আসছে সেখানে নামায পড়তে।
কুতাইবা মিখাইল পেত্রভকে প্রধান মন্ত্রীর বাসভবনে এনে তুলল। গিয়ে বসল তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসেই। প্রধানমন্ত্রীর আসন খালি থাকল দু’জনের কেউই সেখানে বসল না।
বসে সোফায় হেলান দিয়ে মিখাইল পেত্রভ বলল, সব ঠিক-ঠাক চলছে তো? অন্তর্বর্তীকাল বড় একটা দুঃসময়।
কুতাইবা বলল, অসুবিধা হচ্ছে না। রুশ কর্মচারীদের কেউ কেউ কোন কোন অফিস থেকে পালিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এমনটা না ঘটে। স্বাভাবিক ভাবে কর্মচারী বিনিময়ের মাধ্যমেই এ সমস্যা দূর করা যাবে।
-আইন শংখলার কোন অসুবিধা নেই তো? জেনারেল বোরিস কোথায় পালালো?
-না কোন অসুবিধা নাই। জনগণের প্রত্যেকেই একজন পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে। সার্বিক তদারকিতে আছে সাইমুম কর্মীরা।
একটু থেমে কুতাইবা আবার শুরু করল, জেনারেল বোরিস পামিরের পথে পূর্ব দিকে পালিয়েছে। আমরা ইচ্ছে করলে তাকে আটকাতে পারতাম কিন্তু আমরা তা করিনি। ও ছিল একটা সিস্টেমের অংশ, ব্যক্তি বোরিসের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই।
-সত্যি কুতাইবা আহমদ মুসা এবং তোমরা জগতকে বিস্মিত করেছ। শক্তি এবং উদারতা দুটোতেই। রুশরাও তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তোমরা না এগুলে, ‘ফ্র’ এর উপর তোমরা সফল আঘাত না হানতে পারলে ঐখানে সেনাবাহিনীর চোখ খুলত না। এবং গণতন্ত্রী ও মানবতাবাদীরা এত তাড়াতাড়ি বর্তমান অবস্থানে আসতে পারতো না। মধ্য এশিয়ার সার্বিক বিদ্রোহ আমাদের বলে দিয়েছে, জনগনের প্রতিরোধ শক্তি এখনও মরে যায়নি, তারা যে কোন শক্তিমানের যে কোন পাষাণ কারা ভাঙতে পারে।
বলতে বলতে মিখাইল প্রেত্রভের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
-এ কৃতিত্ব মোটেই আমাদের নয়। আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করেছেন এবং দূরদর্শী কুশলী সংগ্রামী নেতা আহমদ মুসাকে আমাদের মাঝে পাঠিয়ে তিনি আমাদের সাহায্য করেছেন। বলল কুতাইবা।
-আহমদ মুসা কোথায়? জিজ্ঞেস করল প্রেত্রভ।
-তিনি এখন বোখারায়।
মুহূর্ত কয়েক চুপ করে থাকল মিখাইল প্রেত্রভ। তারপর বলল, আমি আজই সন্ধ্যায় ফিরে যেতে চাই, ক্ষমতা গ্রহণের অনুষ্ঠানটি কোথাই কিভাবে হচ্ছে?
-আহমদ মুসা বোখারায় আছেন, সে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা তিনি সেখানেই করেছেন।
-রাজধানীতে নয় কেন?
-বোখারাও তো এক সময় রাজধানী ছিল।
মিখাইল প্রেত্রভ কুতাইবার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মুখে তার হাসি ফুটে উঠলো। বলল বুঝেছি, সূর্য যেখানে ডুবেছিল, সেখান থেকেই সূর্যের উদয় ঘটাতে চাও তোমরা।
এই সময় ঘরে প্রবেশ করল আনোয়ার ইব্রাহিম। সাইমুমের পক্ষ থেকে সে তাসখন্দ জোনের সিকিউরিটি প্রধানের দায়িত্ব পালন করছে। ঘরে ঢুকে সে বলল, নাস্তা তৈরি আপনারা এলে বাধিত হবো।
নাস্তা শেষ হলো।
আনোয়ার ইব্রাহিম বলল, বোখারায় যাবার সবকিছু রেডি। ক’টায় বেরুনো যাবে?
কুতাইবা বলল, আমরা ১২ টায় বেরুবো। মুসা ভাই এর সাথে এ রকম কথা হয়েছে।

মিখাইল প্রেত্রভ এবং কুতাইবাদের নিয়ে বিমানটা যখন বোখারা বিমান বন্দরে পৌছাল তখন ১টা। বিমান বন্দরে তাদের স্বাগত জানাল আহমেদ মুসা, হাসান তারিক, আলী ইব্রাহিম, আলদর আজিমভ প্রমুখ সাইমুম নেতারা।
সবাই এসে উঠলো সরকারি অতিথি ভবনে। বিমান বন্দর থেকে আসার পথেই তারা ইমাম বোখারী মসজিদের আজান শুনল। সরকারী অতিথি ভবন থেকে দূরে নয় ইমাম বোখারীর বিখ্যাত মাদ্রাসা ও মসজিদটা। সবাই ওখান থেকে নামায পড়ে এল। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ করল।
আহমদ মুসা অতীতের স্মৃতি বিজড়িত ইমাম বোখারীর বিখ্যাত মাদ্রাসা চত্বরকেই ক্ষমতা গ্রহণের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সকাল থেকেই লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে মাদ্রাসার গোটা এলাকা। কাজাকিস্তান ও উজবেক এলাকা থেকে দলে দলে লক এসে হাজির হয়েছে বোখারায়।
উঁচু প্রাচীর ঘেরা ইমাম বোখারী মসজিদে নেতৃবৃন্দ অবস্থান করছেন। মাদ্রাসার বিশাল গেটের বাইরে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। সামনের জায়গাটা পরিষ্কার করে বিশাল ময়দানে পরিণত করা হয়েছে।
ঠিক আসরের নামাযের পরেই অনুষ্ঠান শুরু হল। আসর নামাযের পর মানুষ বসেছিল, সেই বসা থেকে তাদের আর উঠতে হল না। কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হল অনুষ্ঠান। কোরআন তেলাওয়াত করলেন ইমাম বোখারী মাদ্রাসার তরুণ মোহাদ্দেস সাইমুমের কর্মী হাফেজ মহিউদ্দিন বোখারী। তাঁর দরাজ কণ্ঠের প্রাণ স্পর্শী তেলাওয়াত লাখো জনতার মাঝে এক অভূতপূর্ব ভাবাবেগের সৃষ্টি করল। অনেকেরই মন চলে গিয়েছিল সুদূর অতীতে। এই বোখারায় এমন মুক্ত কণ্ঠের তেলাওয়াত একদিন হতো। তারপর কতদিন তা আর শোনা যায়নি। কে জানত আবার তা যাবে শোনা এমন করে। আল্লাহ্র অশেষ রহমত। তিনি ইমাম বোখারির বোখারাকে, ইমাম মুসলিমের বোখারাকে এবং লাখো মুসলিমের বোখারাকে আবার মুক্ত করেছেন। অনেকের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
কোরআন তেলাওয়াত শেষ হলে আহমদ মুসা মাইকে দাঁড়ালেন। লাখো উদ্বেলিত জনতার উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে তিনি বললেন, ‘আজ শুকরিয়া জ্ঞাপনের দিন। আপনারা রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা-কীর্তন করুন। আর আজ আমাদের নেতা মুহাম্মাদ রসুল্লাহকে মুক্ত কণ্ঠে হৃদয় ভরে সালাম জানাবার দিন। আপনারা তার জন্য দুরুদ পাঠ করুন। মুক্ত মধ্য এশিয়ার মুক্ত এই বোখারা নগরীতে মুসলিম সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আমরা সমবেত হতে পেরেছি আল্লাহর অশেষ দয়ার ফলেই এবং তার নবী (স) এর পথ অনুসরণের মাধ্যমেই। এই মহানগরীর পতনের মাধ্যমেই একদিন এই ভূখণ্ডে দু’শ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটেছিল, গলায় নেমে এসেছিল আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল। আজও চোখে ভাসছে, এই মহানগরীর পতনের শেষ মুহূর্তে ধন-সম্পদ রক্ষায় আকুল, প্রাণ ভয়ে ভীত দুর্বল ঈমানের শাসকরা পালিয়েছেন কিন্তু এই মাদ্রাসা চত্বরে মুজাহিদরা এক হাতে কোরআন জড়িয়ে, অন্য হাতে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন লাল ফৌজের সাথে। তাঁরা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। তাদের পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। সেই ভূলুণ্ঠিত পতাকা আজ আমরা তুলে ধরব আবার। এই পতাকা তুলে ধরবেন সাইমুম নেতা, কর্নেল কুতাইবা। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনই দেশকে নেতৃত্ব দেবেন আপনাদের অনুমতি নিয়ে। আপনারা সম্মত আছেন?
লক্ষ্য লক্ষ্য হাত উপরে উঠলো। ধ্বনি উঠলো লক্ষ্য কণ্ঠে, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ্ আকবর, আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, কর্নেল কুতাইবা জিন্দাবাদ, সাইমুম জিন্দাবাদ।
জনতার কণ্ঠ নীরব হয়ে এলে আহমদ মুসা বলল, আমি ভাই কুতাইবাকে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।
কুতাইবা কাঁদছিল। কয়েকজন ধরে তাকে মাইকের সামনে নিয়ে এল। সে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল, মুসা ভাই আপনি সরে দাঁড়াবেন না। এ দায়িত্ব আপনার। আমার উপর জুলুম করবেন না।
আহমদ মুসা তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ভাই আন্দলনের তরফ থেকে যার উপর যে দায়িত্ব আসবে তা গ্রহণ করতে পিছপা না হওয়াই তো ইসলামের শিক্ষা। তুমি না ইসলামের সৈনিক! এমন দুর্বল হলে চলবে কেন?
বলে তাকে মাইকে দাঁড় করিয়ে দিল আহমদ মুসা। কুতাইবা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বিসমিল্লাহ বলে সংক্ষেপে শুধু এইটুকু বলতে পারল, ‘আমাদের নেতা মুসা ভাইয়ের কণ্ঠে যে দায়িত্বের ঘোষণা হয়েছে, যে দায়িত্বের জন্য আপনারা আমাকে সমর্থন করেছেন, আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তাঁর সাহায্যের উপর ভরসা করেই সে দায়িত্ব আমি গ্রহন করলাম। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
কুতাইবা সরে এল মাইক থেকে। প্রথমেই আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল। তারপর একে একে এল হাসান তারিক, আলদর আজিমভ, আনোয়ার ইব্রাহিম, আলী ইব্রাহিম প্রমুখ সাইমুম নেতারা। সবশেষে রুশ সাধারণ তন্ত্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল প্রেত্রভ কুতাইবার একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
এরপর রুশ সাধারণ তন্ত্রের পক্ষ থেকে মিখাইল প্রেত্রভের কথা বলার পালা।
মিখাইল প্রেত্রভ মাইকে এলেন। জনতাকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বললেন, আপনাদের আবেগ-অনুভুতি, আপনাদের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং স্বাধীনতা-প্রীতি, আপনাদের নৈতিকতা, চরিত্র এবং ইতিহাস সৃষ্টি আমাকে অভিভূত করেছে। রুশ সাধারণতন্ত্রের পক্ষ থেকে আপনাদের মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের সরকার এবং জনগণকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি এবং আপনাদের স্বাধীনতাকে আমি অভিনন্দিত করছি। এই সাথে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অব্যাহত সুসম্পর্ক ও সহযোগিতা রক্ষা করে চলার ব্যাপারে রুশ সাধারণতন্ত্রের পক্ষ থেকে আমি প্রতিশ্রুতি দান করছি।
কথা শেষ করলেন মিখাইল প্রেত্রভ।
তিনি মাইক থেকে সরে এলেন। আহমদ মুসা তাকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানালেন। তারপর কুতাইবাও।
এরপর লক্ষ কণ্ঠের তকবীর ধ্বনির মধ্য দিয়ে এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কর্নেল কুতাইবা কালেমা খচিত পতাকা উত্তোলন করলেন। আহমদ মুসার কান্না বিজড়িত এবং হৃদয় নিংড়ানো মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হল মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানের ডায়াস থেকে নামছিলেন আহমদ মুসা। এমন সময় আহমদ মুসার সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত আবু আমর একটা চিঠি দিলেন তাঁর হাতে। ডায়াস থেকে নেমে খাম খুলে দেখল ফাতিমা ফারহানার চিঠি। চিঠি দেখেই চমকে উঠলো, কোন খারাপ খবর নয় তো।
পড়ল চিঠি। চিঠিতে ফারহানা লিখেছে তার পিতা খুবই অসুস্থ, দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটছে। তার পিতা দেখতে চায় একবার আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা চিঠিটা কুতাইবার হাতে দিল। কুতাইবা পড়ে তা হাসান তারিকের হাতে দিল।
কুতাইবা বলল, মুসা ভাই হেলিকাপ্টার নিয়ে আজই চলে যান আপনি। হাসান তারিক বলল, ব্যবস্থা তাহলে করে ফেলি মুসা ভাই?
আহমদ মুসা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, বেশ কর।

Top