৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে

চ্যাপ্টার

তাসখন্দের ১১ তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন। ভবনের ১০ম তলার বিশাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। উজবেক ফার্স্ট সেক্রেটারীর অফিস এটা, তার বিশাল চেয়ারটি শুন্য, তার শূন্য চেয়ারে বসে আছে জেনারেল বোরিস। সারাকায়ার ঘটনার পর ফিরে এসেই জেনারেল বোরিস উজবেকিস্থান সহ এ অঞ্চলের সবগুলো মুসলিম রিপাবলিকের সরকার এবং কম্যুনিষ্ট পার্টিকে বরখাস্ত করেছে। কোন মুসলিম নেতৃত্বকেই সে আর বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করে না।
জেনারেল বোরিসের মুখ সেই আগের মতই টকটকে লাল। সে কথা বলছিল সদ্য মস্কো থেকে আসা ঐ এলাকার জন্য ‘ফ্র’ নিযুক্ত গভর্নর আদ্রে শিপিলভের সাথে। বলছিল সে, প্রতিটি মুসলমান একটা করে শয়তানের বাচ্চা। সুযোগ পেলেই ওরা তোমাকে কাল সাপের মত ছোবল দেবে। সারাকায়ায় কম্যুনিষ্ট পার্টি, কমসমল কিছুই আমাদের হাতে ছিল না। কম্যুনিষ্ট পার্টি ও কমসমলের নেতারাই আমাদের নিরাপত্তা এজেন্টদের হত্যা করে সাইমুমের পথ নিরাপদ করে দিয়েছে। ছদ্মবেশী শয়তান তুঘরীল তুগানেরও মুখোশ শেষ পর্যন্ত খসে পড়েছে। অবাক ব্যাপার, সাধারণ মুসলমানরাও রাতারাতি যেন একদম পাল্টে গেছে। সাইমুমের কোন খবর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। রশিদভের লাশ তারা সরিয়ে নিয়ে মুসলিম কায়দায় দুরের এক উপত্যকায় দাফন করেছে। জেনারেশনের পর জেনারেশন কম্যুনিষ্ট শাসনে থাকলেও ওদের মুসলমানিত্ব আমরা খতম করতে পারিনি, মুসলমানিত্ব খতম না করে আমরা ওদের ঈমান খতম করতে পারবো না। বলশেভিকদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ‘ফ্র’রা কাজ করব। ওদেরকে আমাদের মনে করে যে শাসনের সুযোগ দিয়েছিলাম তা আর নয়।
-কিন্তু মুসলিম অফিসার ও কর্মচারীদের গণ ট্রান্সফারের আমাদের সিদ্ধান্ত, বলল আদ্রে শিপিলভ, মুসলিম জনগণের মধ্যে কি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না?
-করবে, বলল জেনারেল বোরিস, করবে জেনেও এটা করা হয়েছে। কারণ এর কোন বিকল্প নেই। জামিলভের মত বিশ্বস্ত অফিসার, তুঘরীল তুগানের মত বহু বছরের নির্ভরযোগ্য সাথী, রশিদভ ও জামায়াতিনের মত তুখোড় এবং নিবেদিত প্রাণ কর্মী যখন বিগড়ে গেছে, বিগড়ে গিয়ে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিয়েছে এবং তাদের বন্দুক নির্মম হয়ে উঠেছে আমাদের বিরুদ্ধে, তখন মুসলমানদের আর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। কারও উপরেই সামান্যতম নির্ভরতাও রাখা যায় না। এ অবস্থায় মুসলিম অঞ্চল থেকে তাদের সরিয়ে দেয়াই তাদের জন্য সবচেয়ে লঘু দন্ড। এই পদক্ষেপই আপাতত ‘ফ্র’ নিয়েছে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পথ না পেলেই তা অবশেষে থেমে যাবে। আর অফিসার কর্মচারীদের অসন্তোষ? ওর পরোয়া আমরা করি না। মস্কোসহ রুশ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে ওদের ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যে ওরা সেই পরিবেশে মাথা তোলার কোন সুযোগই পাবে না।
এই সময় জেনারেল বোরিসের ইন্টারকম কথা বলে উঠল। পি.এ জানাল ব্রিগেডিয়ার পুশকিন সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছেন।
জেনারেল বোরিস ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে জবাব দিল, ৫ মিনিট পর পাঠাও। পি.এ’র সাথে কথা শেষ করে সে ইন্টারকমে কথা বলল পার্সোনাল সেক্রেটারী ভিক্টর কমাকভের সাথে। বলল, ভিক্টর এখনি নির্বাচনের উপর ফাইলটা নিয়ে এস।
নির্বাচন সংক্রান্ত ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিল জেনারেল বোরিস। স্প্রিং-এর পার্টিশন ডোর ঠেলে প্রবেশ করল ব্রিগেডিয়ার পুশকিন।
ব্রিগেডিয়ার পুশকিন কম্যুনিষ্ট সেনাবাহিনীর সাউদার্ণ কমান্ডের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান ছিলেন। মুসলিম নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন ভেংগে দেবার পর হোম এ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।
ব্রিগেডিয়ার পুশকিন বসলে ফাইলে মুখ রেখেই জেনারেল বোরিস জিজ্ঞেস করল, কতদুর এগুলো পুশকিন?
নির্বাচনী জোনের পুনর্গঠন শেষ হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব বন্টনও শেষ করেছি। যে কোন সময় নির্বাচন….
কথা শেষ করতে না দিয়েই জেনারেল বোরিস অনেকটা বিরক্তির সাথেই বলে উঠল, আসল কথায় আসছ না কেন? মনোনয়নের কতদুর?
একটু ঢোক গিলেই ব্রিগেডিয়ার পুশকিন বলল, আমরা অনেকটা এগিয়েছি। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান- এই পাঁচটি রাজ্যের জন্য ১০০টি সুপ্রিম সোভিয়েতের সিট রয়েছে। এ ১০০টি সিটের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী ১০০ জন রুশীয়কে পাওয়া গেছে। কিন্তু রাজ্য কংগ্রেসের ৫০০টি সিটের জন্য দেড়শ’র বেশী রুশীয়কে অনেক চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তার উপর সমস্যা দাঁড়িয়েছে রুশরা কেউ ভয়ে প্রার্থী হতে রাজী হচ্ছে না।
প্রায় কথা কেড়ে নিয়ে জেনারেল বোরিস বলল, ভয় রাখ তোমার। ওরা সব নির্বাচিত হয়ে ঘাড়টা বাড়িয়ে দিয়ে তুর্কীদের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে নাকি যে ভয়ে ওদের কাঁপতে হবে।
একটু থেমে জেনারেল বোরিস আবার বলল, রাজ্য কংগ্রেসের বাকী সিটগুলোর জন্য এমন সব মুসলমান খুঁজে বের কর যারা আধুনিক শিক্ষিত এবং কোন প্রকার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই তোমাকে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। মুসলিম রিপাবলিকগুলোর সরকার ও কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙে দেয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে নানা সন্দেহ করার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিগত নিপীড়নের অভিযোগ ইতিমধ্যেই অনেকে তুলেছে। সুতরাং তাড়াতাড়ি একটা নির্বাচন করে সবাইকে বুঝাতে হবে নিছক একটা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবেই ঐ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কথা শেষ করে চেয়ারে পা এলিয়ে চোখ বুজল জেনারেল বোরিস। এর অর্থ কথা তার শেষ।
কোন কথা না বলে ফাইলটা হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাড়াল ব্রিগেডিয়ার পুশকিন।
তখন সন্ধ্যা।
৫ জন সৈনিক পরিবেষ্টিত নির্বাচনী অফিসার বেরিয়ে গেল আহমদ নুরভের বাড়ি থেকে। রুস নির্বাচনী অফিসার পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেত এক রাশ কালি যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে আহমদ নুরভের মুখে।
নির্বাচনী অফিসার বেরিয়ে গেলে আহমদ নুরভ অন্ধকার মুখ নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির হলরুমে তখন সন্ধ্যা নাচ চলছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, বন্ধু-বান্ধব সবাই ওখানে জুটেছে। প্রতিদিনই বিনোদনের এ আসর বসে। হলের মাঝখানে গোল টেবিলে সুদৃশ্য পানাধার এবং পানপাত্র। রুশীয় মদ ভদকার কড়া আমেজে নাচের উচ্ছ্বলতা পাখির মত যেন পাখা মেলে।
আষাড়ের আকাশের মত অন্ধকার মুখ নিয়ে আহমদ নুরভ গিয়ে নাচ ঘরের একটা সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। তার উপর প্রথমে চোখ পড়ল সাদেকার। সাদেকা আহমদ নুরভের বড় মেয়ে। বয়স বাইশ। তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে সে। সে এক বন্ধুর সাথে নাচছিল। নাচ ছেড়ে দিয়ে সে পিতার কাছে এসে বসল।
-কি হয়েছে আব্বা, অসুস্থ তুমি? বলল উৎকণ্ঠিত সাদেকা।
-না মা। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল আহমদ নুরভ।
-না আব্বা, আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি কেমন যেন মুষড়ে পড়েছ, কি হয়েছে বল। ডাক্তার ডাকব?
-না মা, আমি অসুস্থ নই।
-তাহলে?
-মন খারাপ লাগছে।
-কেন কি হয়েছে?
এই সময় আহমদ নুরভের স্ত্রী এসেও তাদের পাশে বসল। তার চোখেও প্রশ্ন।
সাদেকা বলল, আব্বা চল ড্রয়িংরুমে। বলে সাদেকা তার আব্বাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলল। পিছনে পিছনে আহমদ নুরভের স্ত্রীও চলল।
ড্রয়িং রুমে আহমদ নুরভের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সাদেকার হাতে তুলে দিল কিছু না বলে।
সাদেকা কাগজটিতে দ্রুত চোখ বুলাল। বলল, একি আব্বা, এ যে রাজ্য কংগ্রেজের জন্য তোমার মনোনয়ন পত্র। তুমি কি ভোটে দাঁড়াচ্ছ? শাদেকার শেষ বাক্যটি বিস্ময়সূচক এক চিৎকারের মত শোনাল।
আহমদ নুরভ বলল আমি দাঁড়াচ্ছি না, আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
-জোর করে?
-জোর করবে কেন আদেশ দিচ্ছে। এ আদেশ অমান্য করলে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে অভিযুক্ত হতে হবে।
-দাঁড়ানো, না দাঁড়ানোর মত নাগরিক স্বাধীনতাটুকুও কি নেই?
-হাসালে মা। সব বুঝেও স্বাধীনতার নাম করছ?
-তাহলে সাইমুম সব সত্য কথাই বলে।
-আমি পঁচে গেছি মা, ওদের মত সত্য বলার সৎ সাহসও আমার নেই। মনে হয় এ দিকটি বিবেচনা করেই ‘ফ্র’-এর কম্যুনিস্ট সরকার আমার উপর তাদের আস্থা স্থাপন করেছে।
-কিন্তু আব্বু, ‘বিদ্রোহী’ হওয়ার অভিযোগ থেকে বাঁচতে গিয়ে তো তোমাকে জাতির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করতে হবে। কম্যুনিস্ট সরকার মুসলিম প্রভাবিত প্রশাসন ও পার্টি ভেঙ্গে দিয়ে এই নির্বাচন নামের প্রহসনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের রুশ অধিবাসী এবং মুসলিম নামের লোকদের নিয়ে একটা বশংবদ পার্টি ও প্রশাসন গড়তে চায়। এ কাজে যে মুসলমান তাদের সহযোগিতা করবে তারা জাতি-বিদ্রোহী এবং দালাল হিশেবেই চিহ্নিত হবে।
-আমার তো সেটাই উদ্বেগের বিষয় মা। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বলল আহমদ নুরভ।
আহমদ নুরভ একজন সরকারী সুবিধাভোগী পার্টি কর্মী এবং গোয়েন্দা ও ইনফরমার। পূর্ব উজবেকিস্তানে এক বিরাট চরণ ক্ষেত্রের মালিক সে।
সবাই নীরব। এবারও প্রথমে কথা বলল সাদেকাই। বলল সে, চল আব্বা, তোমাকে মসজিদের বাবাখান হুজুরের কাছে নিয়ে যাই। এই অবস্থায় আমি মনে করি তিনিই উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারেন।
আহমদ নুরভ বলল, কোন দিন ওপথে পা বাড়াইনি, কোন দিন তার কাছে যাইনি, আজ কোন মুখে তার কাছে যাব সাদেকা?
-না আব্বা, তার মত লোক হয় না। দুনিয়ার কোন মানুষ সম্পর্কে তার কোন কু ধারণা নেই।
এবার মুখ তুলল আহমদ নুরভের স্ত্রীও। বলল সে, সাদেকা ঠিক বলেছে, আমি অনেকবার গেছি তার দরবারে।
-গেছ তুমি, কেন? বিস্ময়ে প্রশ্ন তুলল আহমদ নুরভ।
-সাদেকার নাম সুলতানা সাদেকা এবং ছেলে পেটভের নাম ‘আহমদ ওমর’ তার কাছ থেকেই নেয়া। ছেলে মেয়ের কানে তিনিই এসে কালেমা পড়ে গেছেন এবং আকিকা তার মাধ্যমেই দিয়েছি।
-এত সব তো আমি জানি না, বলনি তো কোন দিন আমকে?
-বলিনি ভয়ে।
আহমদ নুরভ কোন কথা বলল না। তার শূন্য দৃষ্টি চেয়ে থাকল ড্রয়িং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে মাঠের দিকে।
নীরবতা ভেঙ্গে সাদেকা বলল, চল আব্বা বাবাখান হুজুরের কাছে।
আহমদ নুরভ নীরভেই উঠে দাঁড়াল, বলল, চল।
বিবিখান গ্রামটি পাশ দিয়ে খরস্রোতা একটা ঝরনা। সে ঝরনার পাশে একটা উঁচু টিলা। টিলার উপর সবুজ বাগান বেষ্টিত একটা ভাঙ্গা মসজিদ। মসজিদের পাশেই ভাঙ্গা একটা মাজার। বলা হয় মাজারটি বিবিখানের। কাহিনী প্রচলিত আছে, বিবিখান আরব দেশীয় একজন পুণ্যবতী মহিলা। বাগদাদের পতনকালে হালুকার একজন সেনাপতি বন্দিনী বিবিখানকে বিয়ে করে মধ্য এশিয়ার এখানে নিয়ে আসেন। শীঘ্রই বিবিখানের চরিত্র-প্রভায় মধ্য এশিয়ার এ অঞ্চলে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বিবিখানে একটি মাদ্রাসা গড়ে সারাজীবন এলাকার মহিলাদের তালিম তরবিয়াতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি ছিলেন সবার মা। মানুষ অপরিসীম ভয় ও ভক্তি করত তাকে। তার মৃত্যুর পর মসজিদ-মাদ্রাসা গৃহের পাশেই তাকে কবরস্থ করা হয়। ভক্তদের দোয়া ও দর্শনের একটা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় সেটা। গড়ে ওঠে প্রভাবশালী এক মাজার। মধ্য এশিয়ার কোন শাসকই একবার বিবিখানে না এসে পারত না। কিন্তু কম্যুনিস্টরা দেশ দখলের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তাদের হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসা ধ্বংস তালিকার মধ্যে বিবিখানও ছিল। কিন্তু তারা জনমত দেখে বিবিখানে হাত দিতে পারেনি। তাই বিবিখান এখনও টিকে আছে কিন্তু ভাল অবস্থায় নয়। চারদিকে প্রাচীর ভেঙ্গে গেছে, মাজার ও মসজিদের দেয়াল ফেটে গেছে। সেখান থেকে ইট খসে পড়ছে কিন্তু কম্যুনিস্ট সরকার থেকে মেরামতের কোন অনুমতি নেই। তারা চায় এ মসজিদ-মাজার আপনাতেই ধ্বংস হয়ে যাক। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যেও ভক্তরা রাতের আঁধারে মসজিদ-মাজারের ভাঙ্গা স্থানে দু’একটি করে ইট সিমেন্ট লাগায়। এভাবেই ইবাদতের এই কেন্দ্রটি আজও বেঁচে আছে।
বৃদ্ধ সৈয়দ জিয়াউদ্দিন বাবাখান মসজিদ মাজারের ইমাম ও মুতাওয়াল্লি। কম্যুনিস্ট গোয়েন্দাদের কড়া নজরে ছিলেন তিনি। তিনি তার সবুজ টিলাটির বাইরে আর কোথাও যেতেন না। ইদানিং তিনি একটু করে বাইরে বের হন। সাইমুমের প্রভাব-প্রতিপত্তি এ অঞ্চলে বেড়ে যাওয়ায় মসজিদটাও এখন সরগরম হয়ে উঠেছে। যারা এতদিন নামাজের জন্য আসতে ভয় পেত তারা এখন মসজিদে আসতে শুরু করেছে। সৈয়দ জিয়াউদ্দিন বাবাখানের সাথে আহমদ মুসার আকস্মিক সাক্ষাৎ এ অঞ্চলে জাগরণের এক তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। সাক্ষাতের ঘটনাটা এই রকম।
সময়টা হবে মাস দুই আগের।
অনেক বছর পর অনেক অনুরুদ্ধ হয়ে কোকন্দের মীর-ই আরব মাদ্রাসায় বার্ষিক অনুষ্ঠানে তিনি গিয়েছিলেন। দু’দিন সেখানে অবস্থানের পর তিনি সেদিন বিবিখানে ফিরছিলেন। বেশ একটু রাত হয়েছে। মীর-ই আরব মাদ্রাসার ছাত্র তাঁর একমাত্র পুত্র সৈয়দ রফীউদ্দিনকে সাথে নিয়ে ফিরছিলেন তিনি। ঝরনার ধার বেয়ে সুন্দর রাস্তাটা ধরে আসছেন তারা। ঐ তো দূরে টিলার উপর সবুজ বাগান ঘেরা বিবিখানকে মনে হচ্ছে একটা জমাট অন্ধকার। হঠাৎ সেই অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে এল এক আজানের ধ্বনি। ইথারের কণায় ভর করে কেঁপে কেঁপে তা এসে প্রবেশ করল কানে।
চমকে উঠে জিয়াউদ্দিন বাবাখান হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, রাত ৮টা বাজে। বিবিখান মসজিদের এশার আযানের সময় এটা। ঠিক সময়েই আযান দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ আযান দিচ্ছে কে? আযান দেয়ার তো ওখানে, ঐ লোকালয়ে কেউ নেই! আর এত সুন্দর আযান। অপূর্ব ছন্দ, অপরূপ উচ্চারণ। প্রতিটি শব্দ যেন মর্মে পশে যাচ্ছে। এত মধুর হতে পারে আযান। এ কোন বেলাল এলো বিবিখানে।
দ্রুত পা চালান জিয়াউদ্দিন বাবাখান। ধীর লয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আযানের ধ্বনি। এমন উচ্চকণ্ঠে আযান বিবিখানে আর কখনও হয়নি কম্যুনিস্ট শাসনামলে। উচ্চকণ্ঠে আযান নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই কবে পণপ্রতিক্রিয়া আর পণ অশ্লীলতার অজুহাত তুলে। এ কোন দুঃসাহসী মানুষ লা-শরীকের উচ্চকণ্ঠের জয়গানে যুগ যুগান্তের সে নীরবতা ভাঙল? অজান্তেই জিয়াউদ্দিন বাবাখান এর চোখ দু’টি ভিজে উঠল আবেগের অশ্রুতে।
মসজিদ চত্বরে গিয়ে পৌঁছলেন জিয়াউদ্দিন বাবাখান। চত্বরে তখন আরো অনেক লোক জমেছে। বাবাখানকে দেখে তারা দু’পাশে সরে দাঁড়াল। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন বাবাখান। আযান দিচ্ছে সৌম্য শান্ত এক যুবক। সফেদ মুখে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত কালো দাড়ি। কোকড়া কালো চুল। নীল চোখ। বলিষ্ট দেহে সামরিক কায়দার পোশাক। কোমরে পিস্তল ঝুলছে। তাঁর দু’জন সাথী এক পাশে দাঁড়িয়ে। কি সুন্দর নুরানী চেহারা তাদের। উপস্থিত সবাই যেন গোগ্রাসে গিলছে। আযানের স্বর্গীয় সুমধুর সুর সবাইকে যেন সম্মোহিত করে তুলছে।
আযান শেষ হলো।
ঠোঁট নেড়ে আযান শেষের দোয়া পড়ল তারা।
আযান শেষে ঘুরে দাঁড়াল আযান দেয়া সেই স্বর্গীয় যুবক। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সে জিয়াউদ্দিন বাবাখানের উপর।
ধীরে যুবকটি এসে বাবাখানের সামনে দাঁড়াল। সালাম দিয়ে মুসাফাহা করল। আপনিই কি সৈয়দ বাবাখান, আমাদের মুরুব্বি!
-জি হ্যাঁ। তুমি বাবা? জিজ্ঞেস করল বাবাখান।
-আমি আহমদ মুসা।
‘আহমদ মুসা’ -স্বগত স্বরে উচ্চারণ করল বাবাখান। তাঁর বিস্ময়- বিস্ফারিত চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। কী এক ভাব-বিহবলতা তার চোখে-মুখে!
সাইমুম ও আহমদ মুসা সম্পর্কে বাবাখান কিছু কিছু কথা জানতেন। কিন্তু এবার মীর-ই-আরব মাদ্রাসায় গিয়ে তার কাছে সব পরিস্কার হয়েছে। ফিলিস্তিনে এবং মিন্দানাওয়ে আহমদ মুসা যা করেছে, এখানে সে এবং সাইমুম যা করছে সব শুনেছে বাবাখান। সব শুনে বাবাখানের মনে হয়েছে, মহান ইমাম মেহেদী যেদিন আসবেন আসুন, কিন্তু আহমদ মুসা মধ্য এশিয়ায় কম্যুনিষ্ট কবলিত মুসলমানদের ইমাম মেহেদী।
স্বপ্নের সেই আহমদ মুসা তার সামনে! বাবাখানের বিস্ময় ধীরে ধীরে আনন্দে রূপান্তরিত হল। দু’ধাপ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, বাবা তুমি দীর্ঘজীবি হও। তুমি আমাদের চোখের মণি আশার আলো। যেমন করে তোমার আযানের ধ্বনি এই এলাকায় যুগ-যুগান্তের জমাট নীরবতার পাষাণ কারা ভেঙেছে, তেমনি করে তোমাদের হাতে কম্যুনিজমের জিন্দানখানা থেকে মধ্য এশিয়ার কোটি কোটি মুসলমানের মুক্তি হোক।
বৃদ্ধের দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। এলাকার সমবেত অনেক মানুষ দেখছিল এই দৃশ্য। তাদের চোখে বিস্ময়! এ কোন যুবক যার কাছে তাদের বাবাখান এমনভাবে গলে যেতে পারে!
আহমদ মুসা বৃদ্ধ বাবাখানকে শান্ত করে তার সাথে পাশে দাঁড়ানো হাসান তারিক ও কর্ণেল কুতাইবাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
নামাযের সময় হলো। বাবাখান আহমদ মুসাকে ইমামের আসনে ঠেলে দিলেন। আহমদ মুসা আপত্তি জানালে বাবাখান বলল, ইসলামে ইমামের যে বিধিগত ধারণা তাতে ইমাম তুমিই।
নামায শেষে বাবাখান আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন উপস্থিত মুসল্লীদের সাথে। সেই সাথে তিনি বললেন সাইমুমের কথা এবং মুসলমানদের জীবনে আবার কিভাবে সুবহে সাদেকের উদয় হতে পারে সেই কথা। আনন্দে-বিস্ময়ে উপস্থিত সকলের সাথে আহমদ মুসা, হাসান তারিক এবং কর্ণেল কুতাইবা মুসাফাহ করলেন। অপরিচয়ের গন্ডি কোথায় মিলিয়ে গেল। মনে হল, কত পরিচিত স্বজন তারা। সেই থেকে বাবাখান এলাকায় নতুন একটা প্রাণ চাঞ্চল্য এসেছে।
বাদ মাগরিব বাবাখান তার জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছিলেন।
মসজিদে তখন কেউ নেই।
আহমদ নূরভ, তাঁর স্ত্রী রফিকা এবং মেয়ে সাদেকা এসে প্রবেশ করল মসজিদে। মসজিদে ঢোকার আগে আহমদ নূরভ অজু সেরে নিয়েছে এবং তার মাথায় একটা তুর্কি টুপি শোভা পাচ্ছে, যা এর আগে তার মাথায় কখনও দেখা যায়নি।
আহমদ নূরভের স্ত্রী রফিকা এবং সাদেকা মুখমন্ডল ছাড়া গোটা শরীরটা চাদরে ঢেকে নিয়েছে।
ওরা মসজিদ কক্ষের ডান পাশে গিয়ে বসল।
বেশ কিছুক্ষণ পর এদিকে মুখ ফিরাল বাবাখান। একবার এদিকে চেয়ে মুখটা নামিয়ে নিল। বলল, কি খবর তোমাদের, বলবে কিছু?
রফিকা কথা বলল। বলল, বাবাখান হুজুর, আমার স্বামী আহমদ নূরভের একটা ব্যাপারে পরামর্শের জন্য এসেছি।
-কি ব্যাপার? প্রশ্ন করল বাবাখান।
-হুজুর, আমি একটা বিপদে পড়েছি। বলল আহমদ নূরভ।
-বিপদটা কি?
আহমদ নূরভ পকেট থেকে কাগজ বের করে কাগজ বের করে উঠে গিয়ে সেটা বাবাখানের হাতে দিল। বাবাখান কাগজটির উপর নজর বুলিয়ে বলল, এতো দেখি তোমার মনোনয়ন, বিপদটা কোথায় দেখছ?
বাবাখানের মুখে এক টুকরো হাসি।
প্রায় আর্তনাদ করে উঠল আহমদ নূরভ। বলল, কি বলছেন, বিপদ নয় এটা আমার জন্যে?
-এ মনোনয়নে লাভ তো তোমার অনেক।
-কিন্তু বিপদ তো তার চেয়ে বড়।
-কি সেটা?
-জাতির লোকেরা আমাকে শত্রু জ্ঞান করবে, জাতি থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।
-বৈষয়িক স্বার্থের মোহে অনেকেই তো জাতির কোন পরোয়া করেননি।
আহমদ নূরভ হঠাৎ করে কোন জবাব দিল না। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থাকল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, বাবাখান হুজুর, আমি পাপী, আমি নষ্ট চরিত্র। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও বৈষয়িক স্বার্থকেই আমি সবার উর্ধ্বে স্থান দিয়েছি। কিন্তু এ মনোনয়ন হাতে পাবার পর আমার মনে হচ্ছে, আমি আমার জাতিকে ভালবাসি, আমার জাতি থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হতে পারব না। আমার স্ত্রীর কাছে আমি শুনলাম, আমার স্ত্রী হুজুরের কাছ থেকে আমার ছেলে-মেয়ের নাম নিয়েছে, ছেলে-মেয়েদের আকীকা করেছে এবং ছেলে-মেয়েদের কানে ইসলামের কালেমা পড়িয়ে দিয়েছে। এ কথা শুনে আমার রাগ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আজ দেখছি আমার মন গর্বে ফুলে উঠছে। আজ মনে হচ্ছে,আমি মনে-প্রাণে মুসলমান। মুসলমানিত্ব আমি ত্যাগ করতে পারবো না। কোন কিছুর বিনিময়েও না।
-তুমি মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করলে শুধু তোমার সহায় সম্পদ নয়, জীবন বাঁচানও তোমার দায় হয়ে উঠতে পারে।
-কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে ভারী মনে হচ্ছে আমার কাছে মনোনয়নকে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল বাবাখান। তারপর চোখ খুলে বলল, তুমি সাইমুমকে জান?
-জানি, জাতির মুক্তির জন্য ওরা সংগ্রাম করছে।
-সাইমুম সম্পর্কে তোমার এখন মত কি?
-কম্যুনিষ্ট সরকারের দালালী করার চেয়ে ওদের সহযোগিতা করে মৃত্যুবরণ করাকেই আমি এখন শ্রেয় মনে করছি।
বাবাখান মূহুর্তকাল চুপ করে থাকল। তারপর আহমদ নূরভের দিকে চেয়ে বলল, আহমদ নূরভ আমি তোমার নবজন্মকে অভিনন্দিত করছি। মনোনয়ন প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জাগতিক স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থের চেয়ে জাতির স্বার্থকে তুমি বড় করে দেখলে। আল্লাহ তোমাকে তার জাযাহ দিন এবং আল্লাহ সকলকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার তৌফিক দান করুন।
বাবাখানের কথা শেষ হলে আহমদ নূরভ ধীরে ধীরে উঠে বাবাখানের কাছে এল এবং তাঁর একটি হাত তুলে নিয়ে চুম্বন করে বলল, আপনার নির্দেশ শিরোধার্য করে নিলাম। আপনি দোয়া করুন অতীতের পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের উপর যাতে অটল থাকতে পারি।
বাবাখান ‘আমিন’ বলে চোখ বুজল।
আহমদ নূরভ বুঝল, তাদের যাবার নির্দেশ হয়েছে। তারা বেরিয়ে এল মসজিদ থেকে। বাইরের উন্মুক্ত বাতাস যেন প্রশান্তির এক পরশ বুলিয়ে দিল আহমদ নূরভের শরীরে। বাগানের সবুজটা তার কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশী সবুজ ও প্রাণদীপ্ত মনে হল। গাছের ডাল থেকে পাখির গান, গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া ঝরণার সফেদ পানি সবই তার কাছে নতুন মনে হল। হঠাৎ তার মনে হল হৃদয়টা যেন তার স্বচ্ছ স্ফটিকের মত। নতুন এক প্রশান্তি সেখানে। সামনের প্রতিটি পদক্ষেপ মনে হচ্ছে তার কাছে নতুন জীবনে পদার্পণ।

সারাকায়ার মহাসড়কটি খিভা, বোখারা, সমরকন্দ হয়ে তাসখন্দ গেছে, সেই পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল শাহীন সুরাইয়া। সেই-ই একমাত্র আরহী। গাড়ীর পেছনটা লাগেজে ভর্তি।
গাড়ি তখন বোখারা পার হয়ে সমরকন্দের পথে চলছিল। বেলা পড়ে এসেছে। রোদের সাদা রংটা এখন হলুদ।
মরুপথ ধরে এগিয়ে চলছিল গাড়ি। চারদিকেই দিগন্ত জোড়া মাঠ। জনমানবের চিহ্ন কোথাও নেই। অখন্ড এক নীরবতা চারদিক জুড়ে। এ নীরবতার একটা সৌন্দর্য আছে। কিন্তু এ সৌন্দর্যের অশরীরি স্পর্শের মাঝে ভীতির একটা শিহরণও রয়েছে। শাহীন সুরাইয়া গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরী করে। বিপদ-আপদের সাথেই তার খেলা। তবু জনমানবহীন পরিবেশের এ জমাট নীরবতা তার মনের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল।
প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে চলছিল শাহীন সুরাইয়ার গাড়িটি। হঠাৎ বিশ্রি এক শব্দ করে থেমে গেল ইঞ্জিন, দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি।
উদ্বিগ্ন শাহীন সুরাইয়া গাড়ি থেকে নামল। ইঞ্জিনের উপরের ডালাটা খুলে সে বুঝতে চেষ্টা করল ইঞ্জিনের কি হয়েছে। ইঞ্জিন দেখে সে চমকে উঠল, ইঞ্জিনের ফুয়েল লাইনটা একেবারেই জ্বলে গেছে। ইঞ্জিনের ডালাটা বন্ধ করে হতাশভাবে এসে রাস্তার উপর সে ধপ করে বসে পড়ল।
আরো উদ্বিগ্ন হলো সে বেলার দিকে চেয়ে। অল্পক্ষণ পরেই রাত নামবে। যদি কোন গাড়ি না আসে! এসব ভেবে মনটা কেঁপে উঠল তার। একটা অজানা ভয় এসে তাকে ঘিরে ধরল। সে যে মেয়ে মানুষ, এ বোধটাও এ সময় তার কাছে বড় হয়ে উঠল।
শাহীন সুরাইয়া কিছুক্ষণ বালির উপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকল। তারপর উঠে ব্যাগ খুলে দূরবীন লাগিয়ে রাস্তার উপরেই নজর বুলাল। রাস্তার দক্ষিণ প্রান্তে তাকাতে গিয়ে তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একদম দিগন্তের কোলে একটা সচল বিন্দু তার চোখে ধরা পড়ল, চোখ থেকে দূরবীন সে আর নামাতে পারল না।
ক্রমে সচল কালো বিন্দুটি বড় হয়ে উঠল। হ্যাঁ, একটি গাড়ি, একটি কার। গাড়িটি আরও এগিয়ে এলে নাম্বার দেখে বুঝল গাড়িটা বেসরকারী। যাই হোক , খুব খুশি হল শাহীন সুরাইয়া।
চোখ থেকে দূরবীনটি নামিয়ে পকেটে পুরে সে গাড়ির কাছে গেল। মনে করল, গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখবে যাতে করে দেরী না করে গাড়িতে উঠা যায়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে করল, কি হবে, না জেনে আগাম এসব করে লাভ কি!
গাড়ির কাছ থেকে সরে এসে আবার দূরবীনটি চোখে লাগাল সে। এবার গাড়ির সব কিছুই পরিস্কার। গাড়িতে তিনজন আরোহী। পিছনের সিটে দু’জন। সামনের ড্রাইভিং সিটে একজন, তিনজনই পুরুষ কিন্তু দূরবীনের লেন্সে তাদের মুখ এখনও ধরা পড়ছে না। আনন্দের মাঝেও একটা উৎকন্ঠা জাগছে, লোকগুলো কি তাকে গাড়িতে নেবে? কেমন হবে লোকেরা? রাস্তা-ঘাটে পশু-বৃত্তির খবর আজকাল প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে, বুকটা কেঁপে উঠল শাহীন সুরাইয়ার।
গাড়িটা কাছে এসে গেছে। তীব্র বেগে ছুটে আসছে গাড়িটা। সুরাইয়া তার গাড়িতে বাম হাত রেখে ডান হাত উঁচু করে গাড়িটাকে দাঁড়াবার জন্য সংকেত দিল। সংকেত পাওয়ার পরই গাড়িটার গতি শ্লো হয়ে গেল। গাড়িটা ধীর গতিতে এসে সুরাইয়ার গাড়ি অতিক্রম করে প্রায় ৫০ গজ গিয়ে থেমে গেল। দেখা গেল গাড়ির আরোহীরা গাড়িতে বসেই সুরাইয়ার গাড়িটাকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
সুরাইয়াও গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির আরোহী তিনজনই গাড়ি থেকে নেমে এল। তিনজন আরোহীর দু’জন ক্লিন শেভ অন্যজনের সুন্দর মুখ ঘিরে সুন্দর দাড়ি। প্রথম দৃষ্টিতেই তিনজনকে সৌম্য-শান্ত ভদ্রলোক বলে মনে হয়। সুরাইয়ার মন সাহসী হয়ে উঠল। তার উপর সুরাইয়ার মনে হল দাড়িওয়ালা মুখটাকে কোথায় সে দেখেছে।
সুরাইয়া কিছু বলার আগেই ওদের মধ্য থেকে সেই দাড়িওয়ালা লোকটা বলল আপনাদের গাড়ির কি হয়ছে?
-গাড়ির ফুয়েল লাইনটা জ্বলে গেছে।
নিজের গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে ক্লিন শেভদের একজনের দিকে তাকিয়ে সেই দাড়িওয়ালা লোকটা বলল দেখে এস ইঞ্জিনটা।
ওরা সবাই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ইঞ্জিন দেখে ফিরে এসে বলল মেরামতের কোন সুযোগ নেই এখানে।
দাড়িওয়ালা লোকটা শাহীন সুরাইয়ার দিকে চেয়ে বলল আপনার নাম কি? যাবেন কোথায়?
-যাব তাসখান্দে। নাম আমার শাহীন সুরাইয়া।
-গাড়ি তো আপনাকে রেখেই যেতে হবে, সমরকন্দ পর্যন্ত আমরা আপনাকে পৌছাতে পারব।
-ধন্যবাদ ঐ পর্যন্ত হলেই আমার চলবে, বাকি পথের ব্যবস্থাটা আমি করতে পারব। শাহীন সুরাইয়ার জিনিসপত্র সেই ক্লিন শেভড দু’জনই ধরাধরি করে এনে এ গাড়িতে তুলল, তারপর সামনের সীটে সুরাইয়াকে বসিয়ে দাড়িওয়ালা সহ একজন পেছনের সীটে বসল।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।
শাহীন সুরাইয়া ভুলতে পারছিলনা দাড়িওয়ালা ঐ চেহারাকে। সে যেন কোথায় দেখেছে। এক সময় সে মাথা ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি।
উত্তরে সেই লোকটি বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনার বাড়ি কোথায়?
-সারাকায়া।
-সারাকায়া?
আকস্মিক এক জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল লোকটির কণ্ঠে।
-সারাকায়া আপনি চিনেন?
-জানি সারাকায়াকে
-কাউকে চিনেনে?
-চিনি।
-দু একজনের নাম করুন।
-রসিদভ জামায়াতিন তুঘরীল তুগান।
-রসিদভকে চিনতেন আপনি আমি রসিদভের বোন।
-রসিদভের বোন আপনি। একটা বিস্ময়বেগ সেই লোকটির কণ্ঠে।
-রসিদভের খবর জানেন? কিছুটা ভারী কণ্ঠস্বর সুরাইয়ার।
-জানি, কিন্তু বলুন কেন এমন হল?
সুরাইয়া কোন জবাব দিল না। সে স্মৃতির গোটাটা হাতড়িয়ে ফিরছিল এই দাড়িওয়ালাকে সে কোথায় দেখেছে। অবশেষে সে প্রশ্ন করল আপনাকে কোথায় দেখেছি তা তো বললেন না?
-আমার প্রশ্নের আগে জবাব দিন।
-রসিদভ বিদ্রোহের শাস্তি পেয়েছে।
মানুষ কি মনে করে, সত্যই সে কোন অপরাধ করেছিল?
সুরাইয়ার স‌মৃতির দরজা যেন হঠাৎ খুলে গেল। তার গোয়েন্দা দপ্তরে রক্ষিত রাজনৈতিক টার্গেটদের ফটোর প্যানেল তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল। ফটোর আহমদ মুসাকে জলজ্যান্ত সামনে দেখে মুহূর্তের জন্য বিহবল হলো সুরাইয়া। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন দিকে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এবার আপনাকে চিনেছি আপনি আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা একটু হেসে নির্দ্বিধায় বলল, হ্যাঁ বোন আমি আহমদ মুসা। তুমি রশিদভের বোন। আমাকে তুমি না চিনলেও আমার পরিচয় তুমি পেতে। রশিদভ উত্তর উজবেকিস্তানের প্রথম শহীদ। কিন্তু একটা প্রশ্ন করি তুমি তো আমাকে কোথাও দেখার কথা না। দেখার কথা বলছ কেমন করে, চিনলেই বা কি করে?
সুরাইয়া বলল আমি গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরী করি। ফাইলে আপনার ছবি দেখেছি।
-গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরী কর? তোমার ভাইয়ের কথা তুমি জানতে না?
-জানতাম, আমি এসব ব্যাপারে সতর্ক হয়ে চলতেও বলেছিলাম। কিন্তু আবেগকে সে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
বলতে বলতে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল সুরাইয়ার
-তোমার ভাইয়ের জন্য আমরা গর্বিত সুরাইয়া।
-জনাব আমি আমার একমাত্র ভাইকে হারিয়ে বেদনা বোধ করি কিন্তু সে আমারও গর্বের বস্তু।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তীব্র বেগে এগিয়ে চলছে গাড়ি। নীরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই প্রথম। বলল বোন সুরাইয়া সম্ভবত তোমার কাছে অনেক খবর আছে।
-জি হ্যাঁ। বলল সুরাইয়া।
তারপর একটু থেমে আবার সেই কথা বলে উঠল, আমাকে মস্কোতে ট্রান্সফার করা হয়ছে। তাসখন্দ হয়ে আমি সেখানেই যাচ্ছি। আপনি খবর জানতে চেয়েছেন। ঠিকই খবর আছে। মুসলিম সংখ্যাধিক্য নিয়ে গঠিত সরকার ও পার্টি ভেঙ্গে দেবার পর সামরিক ও বেসামরিক সমস্ত মুসলিম আফিসারকে মধ্য এশিয়া অঞ্চল থেকে রুশ অঞ্চলে ট্রান্সফার করে হয়েছে সহায়-সম্পদ সব সহ। মনে হয় তারা আর কোন দিন দেশে ফেরার সুযোগ পাবে না। আমরা মনে করেছিলাম সরকারী কর্মচারীদের ট্রান্সফার করারা মধ্যেই ব্যাপারটা সীমিত থাকবে। কিন্তু তা নয়। রাজনৈতিক ও সমাজনেতাদেরকেও রুশ অঞ্চলে চালান দেয়া হচ্ছে। যাতে করে ক্ষমতাচ্যুত এই নেতারা এখানে থেকে কোন প্রকার অসন্তোষ ছড়াতে না পারে।
আহমদ মুসা চুপ করে তার কথা শুনছিল। সুরাইয়ার কথা থামলেও চুপ করেই থাকল আহমদ মুসা। যেন কোন ভাবনার অতলে নিমজ্জিত সে। অনেকক্ষণ পর কথা বলল আহমদ মুসা। বলল সে, আচ্ছা সুরাইয়া সরকারের কোন শাখা এটা ডিল করছে? কে কোথায় যাচ্ছে এই একজ্যাক্ট রেকর্ডটা কোত্থেকে জানা যাবে?
-এটা কয়েকদিন হল জেনারেল বোরিসের নিজস্ব দপ্তরে চলে গেছে। একমাত্র সেখান থেকেই এটা জানা যেতে পারে।
-আচ্ছা তুমি তো মস্কো যাচ্ছ। সেখানকার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেয়ার জন্যই?
-জি হ্যাঁ।
-তুমি কি কখনও ভেবছ সাইমুমের সাথে তোমার সম্পর্ক কি হবে?
-অতীতে ভাবতে সাহস পাইনি। আজ মনে হচ্ছে ভাবা দরকার। এখন আপনি যা আদেশ করবেন।
নতুন সমরখন্দ নগরীর প্রবেশ গেট আর বেশী দুরে নয়। গেটের উজ্জল আলোর নীচে চেকপোস্টের অবস্থান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আহমদ মুসা বলল, আমরা শহর কে বাম পাশে রেখে এখন দক্ষিন দিকে এগিয়ে যাব। তোমাকে গেটে নামিয়ে দিলেই তো চলে।
-জি হ্যাঁ, চলবে।
গাড়ি গেটের কাছাকাছি এসে গেছে। সুরাইয়া পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি তো নির্দেশ পেলাম না?
আহমদ মুসা বলল সুরাইয়া তুমি সচেতন এবং বুদ্ধিমতী। মস্কো গিয়ে তোমার চলার পথ তোমাকেই খুজে নিতে হবে। আমি আশা করি তা তুমি পারবে। নির্দেশও তুমি সে পথ থেকেই পাবে।
সুরাইয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল আমি তা পারব। দোয়া করবেন আমার চাকুরী যেন আমার জাতির কাজেই লাগে।
গেটের এপারেই বাস স্টপেজ এবং একটি যাত্রী ছাউনি। যাত্রীদের বিশ্রাম নেবার জায়গা। সুরাইয়া সেখানেই নেমে গেল।
সুরাইয়াকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটল দক্ষিণ দিকে। কর্নেল কুতাইবা গাড়ি ড্রাইভ করছিল। আহমদ মুসার পাশে ছিল হাসান তারিক।
তুর্কমেনিস্তানে ১০ দিনের সংগঠনিক সফর শেষে তারা ফিরছে হেড কোয়ার্টার শহীদ আনোয়ার পাশা ঘাটিতে।
পথ অনেক দুরের।
ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলছে গাড়ি।

Top