৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে

চ্যাপ্টার

‘ফ্র’ এর নতুন সিকিউরিটি চীফ জেনারেল বোরিস বেবিয়ার এর গোটা মুখটাই লাল টকটকে। বুকভরা ক্রোধ ও ক্ষোভের আগুন যেন ঠিকরে পড়েছে মুখ দিয়ে।
চেয়ার থেকে উঠে সে পায়চারী করছিল।
প্রশাসন ও নিরাপত্তা বিভাগের কয়েকজন উর্ধ্তন অফিসার টেবিল ঘিরে বসে আছে। সকলেরই মুখ গম্ভীর, অবস্থা বিব্রতকর।
জেনারেল বোরিসকে গত রাতের ঘটনা যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল। তার চোখের সামনে দিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি হাকিয়ে চলে গেল, কিছুই করতে পারল না সে! তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে আহমদ মুসা যেন ছেলেখেলার মত তাচ্ছিল্য করল।
কোথায় হাওয়া হয়ে গেল তারা। ব্রীজের পশ্চিমে কিছু দুরে সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার ভ্যানটা পরিত্যক্ত পাওয়া গেছে। কোন দিকে গেল ওরা? প্রধান সড়ক ধরে যায়নি। যেখানে গাড়ি পাওয়া গেছে সেখান থেকে তিনটা গলি তিন দিকে বেরিয়ে গেছে। রাতেই সে গলিগুলো এবং গলির আশে পাশের জায়গা আতি-পাতি করে সার্চ করা হয়েছে, কিন্তু কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। রাত তখন তো ১০টাও হয়নি। লোকজন সবাই রাস্তায় কিংবা বাড়ি বা বাড়ির আশে পাশেই ছিল। কিন্তু কেউ কিছুই বলেনি। সবারই এক জবাব, তারা তেমন কিছু দেখেনি। সব গাদ্দার। এরা দেখলেও কিছু বলবে না। ব্যাপারটা তাই ঘটেছে। তা না হলে নতুন চারজন লোক সবার সামনে দিয়ে চলে গেল আর কারোর নজরে পড়ল না, এটা একেবারেই মিথ্যা কথা। ঠিক আছে, মিথ্যার শাস্তি ওরা পাবে।
উত্তেজিত জেনারেল বোরিস তার অস্থির পায়চারীটা থামাল। থেমে দাঁড়িয়ে টেবিলের একেবারে ডান পাশে টেকো মাথা এক রাশ দুঃশ্চিন্তার ছাপ মুখে নিয়ে বসে থাকা গোয়েন্দা অফিসার কর্নেল ভাদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার তদন্ত শেষ হয়েছে? জামায়াতিন মরল কার গুলিতে?
কর্নেল বলল, আমাদের গোয়েন্দা কর্মীর গুলিতে।
-অর্থাৎ জামায়াতিন বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিয়েছিল?
-ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে। বলল ভাদিন।
-সবগুলো ডেড বডি পরীক্ষা শেষ হয়েছে?
-হ্যাঁ।
-উল্লেখযোগ্য কিছু আছে তাতে?
কর্নেল ভাদিন একটু নড়ে-চড়ে বসলো। তারপর বলল, গাড়িতে বিস্ফোরণে যারা মারা গেছে তাদের বাদ দিলে অবশিষ্ট দুজন ছাড়া সবাই মারা গেছে সাইমুমের বিশেষ ধরনের পিস্তুল এম-১০ এর গুলিতে। আর দুজন মারা গেছে সাধারণ পিস্তলের গুলিতে। একজনের দেহে ছিল একটা গুলি। আরেকজনের দেহে দুটি।
-এগুলীগুলো কোন পিস্তল থেকে তাহলে এসেছে?
-একটা পিস্তল জামায়াতিন। তার মৃত দেহের কাছেই তার পিস্তলটি পাওয়া গেছে। ওটা থেকে একটা গুলী ছোঁড়া হয়েছিল। অন্য দুটি গুলীর পিস্তলের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
এ সময় কথা বলে উঠল পুলিশ প্রধান তুরিন। সে টেবিলের বাম প্রান্তে বসেছিল। বলল সে, আমরা সারাকায়ার সবগুলো পিস্তল সিজ করেছি এবং সেগুলোকে পাঠানো হয়েছে কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার রিপোর্ট এখনি পাওয়া যাবে। তাতে হয়তো ঐ দুটো গুলীর উৎসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
তুরিন থামতেই সহকারী পুলিশ প্রধান এসে ঘরে প্রবেশ করল।
তার দিকে চেয়ে তুরিন বলল, এনেছ রিপোর্ট?
‘এনেছি’ বলে সহকারী পুলিশ প্রধান পকেট থেকে দুটো পিস্তল এবং রিপোর্টের কাগজ পুলিশ প্রধান তুরিনের হাতে তুলে দিল।
কাগজের দিকে নজর বুলিয়ে জেনারেল বোরিসের দিকে তাকিয়ে তুরিন বলল, স্যার আমাদের এক জনের দেহ থেকে যে দুটি গুলী পাওয়া গেছে তা দুজনার দুই পিস্তল থেকে এসেছে।
-কার পিস্তল? বলল জেনারেল বোরিস।
তুরিন পিস্তল দু’টি জেনারেল বোরিসের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, একটা হল তুঘরীল তুগানের এবং অন্যটা রশিদভের।
-এ কি বলছ! সত্যি বলছ তুরিন?
সত্যি স্যার, দেখুন পিস্তলের সাথের ট্যাগে মালিকের নাম রয়েছে।
জেনারেল বোরিস তুঘরীল তুগানের পিস্তলটি হাতে নিয়ে ট্যাগটির দিকে একবার নজর দিয়ে বলল, এর অর্থ কি তুরিন? কাল তো তুঘরীল তুগান সারাক্ষণ আমাদের সাথেই ছিল।
তুরিন বলল, রাসায়নিক রিপোর্ট বলছে রশিদভ ও তুঘরীল তুগানের এ পিস্তল থেকে এক সাথেই গুলী ছোঁড়া হয়েছে এবং গুলী দুটি আমাদের দ্বিতীয় লোককে হত্যা করেছে। তুঘরীল তুগান ও রশিদভের কাছ থেকেই ঘটনার সবটা জানা যাবে।
জেনারেল বোরিস মাথা নেড়ে বলল, ওদের কি গ্রেফতার করা হয়েছে?
উত্তর দিল সহকারী পুলিশ প্রধান। বলল, পুলিশ পাঠান হয়েছে। এখনি তারা গ্রেফতার করে নিয়ে আসবে।
এরপর একটুক্ষণ নীরবতা।
নীরবতা ভঙ্গ করল কর্নেল ভাদিন। বলল, স্যার, জামায়াতিন ও রশিদভের ব্যাপারটা এবং তুঘরীল তুগানের পিস্তল এর ঘটনার পর আমরা আর কাকে বিশ্বাস করব, কার উপর নির্ভর করব? আমি ওদের যতদিন থেকে জানি, জামায়াতিন এবং রশিদভ দুজন অত্যন্ত ভাল ছেলে ছিল, পার্টির কাজে জান কবুল করার মত নিবেদিত প্রাণ ছিল তারা।
পুলিশ প্রধান তুরিন মাথা নেড়ে সমর্থন করল ভাদিনের কথা। জেনারেল বোরিস বলল, তোমার কথা ঠিক ভাদিন। কিন্তু অতীতকে দিয়ে আর বর্তমান বিচার হবে না। ডেভিল সাইমুম সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। এই খারাপ মাথাগুলোকে গুড়িয়ে দিয়েই আমাদের কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল। জেনারেল বোরিস রিসিভার তুলে নিল। ওপারের কথা শুনে নিয়ে বলল, শুধু তুঘরীল তুগানকে পাঠিয়ে দাও।
অল্পক্ষণ পরেই তুঘরীল তুগান ঘরে প্রবেশ করল। একজন পুলিশ অফিসার তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।
তুঘরীল তুগান ধীর পদক্ষেপে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ভাবলেশহীন তার মুখ। কিন্তু তার মধ্য দিয়েও চিন্তার একটা কালো ছায়া ফুটে উঠছে চোখে-মুখে। তবে তার চখে-মুখে দৃঢ়তার ছাপ।
জেনারেল বোরিস তার দিকে তাকিয়ে সামনের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসুন মিঃ তুগান।
সবাই নীরব। জেনারেল বোরিস সোজা হয়ে বসে তুঘরীল তুগানের দিকে না চেয়ে অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বলল, আমরা দুঃখিত মিঃ তুগান আপনাকে আজ এভাবে এখানে আসতে হয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব দায়িত্বই।
একটু থেমে বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
-বলুন। ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল তুঘরীল তুগান। একটা পিস্তল তুঘরীল তুগানের দিকে এগিয়ে দিকে এগিয়ে দিয়ে জেনারেল বোরিস বলল, এ পিস্তলটা কার?
পিস্তলটা হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে বলল, আমার।
-গতকাল রাতে এ পিস্তলটা কার কাছে ছিল?
-আমার পিস্তল দু’টো। তার একটা গত রাতে আমার কাছে ছিল। আর এ পিস্তলটা ছিল আমার ড্রইং রুমের ড্রয়ারে। সকালে এটা সেখানেই পেয়েছি।
-রাতে কি এটা কেউ ব্যবহার করেছে?
-আমি জানি না।
-এ পিস্তলের গুলীতে আমাদের একজন গোয়েন্দা কর্মী মারা গেছে।
-এ পিস্তলের গুলীতে? ভীষণভাবে চমকে উঠল তুঘরীল তুগান।
-হ্যাঁ, এ পিস্তলের গুলীতে। বলল জেনারেল বোরিস।
এতক্ষণে একটা উদ্বেগ ও আশংকা তুঘরীল তুগানের মুখে-চোখে ফুটে উঠল। সে বলল, এটা কি করে সম্ভব?
-সেটাই তো আমাদের জিজ্ঞাসা তুগান।
বিমর্ষ তুঘরীল তুগানের কপালে চিন্তার গভীর বলিরেখা। ব্যাপারটা তার কাছে সত্যিই ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। সকলেই জানে, গতকাল ঘটনার সময় সে সারাক্ষণ জেনারেল বোরিসের সাথে সাথেই ছিল। কে তার পিস্তল ব্যবহার করবে? তাছাড়া তার পিস্তল খোয়া যায়নি, ড্রয়ারেই ছিল।
নিশ্চিত তুঘরীল তুগানের দিকে চেয়ে জেনারেল বোরিস বলল, ঘটনা আরও আছে মিঃ তুগান। তারপর অপর পিস্তলটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, এটা রশিদভের পিস্তল। এ পিস্তলের একটা গুলী এবং আপনার ঐ পিস্তলের একটা গুলী আমাদের নিহত একজন গোয়েন্দা কর্মীর দেহ থেকে পাওয়া গেছে। এর অর্থ আপনার পিস্তল এবং রশিদভের পিস্তল এক সাথেই ছিল।
তুঘরীল তুগানের অন্তরটা এবার সত্যিই কেঁপে উঠল। রশিদভের নাম শুনে হঠাৎ তার মানে ফায়জাভার মুখ ভেসে উঠল। জামায়াতিনের মত রশিদভ এবং ফায়জাভাও তো সাইমুমের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাহলে ফায়জাভাই কি কোন পাগলামী করেছে? তার পক্ষেই তো সম্ভব পিস্তল ড্রয়ার থেকে নিয়ে গিয়ে আবার যথাসময়ে যথাস্থানে এনে রাখা! এই ভাবনার উদয় হবার সাথে সাথে তার পিতৃমন কেঁপে উঠল থর থর করে। তাহলে কি ফায়জাভার কথা জানতে পেরেছে? রশিদভকে তো ওরা গ্রেফতার করেছে। ওর কাছ থেকেই তো ফায়জাভার কথাও বেরিয়ে আসবে। আর সাইমুম নিয়ে তার সাথেও রশিদভের আলোচনা হয়েছে, এ কথাও তো রশিদভের কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
এতক্ষণে তুঘরীল তুগান সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়ল।
তুঘরীল তুগানকে নীরব দেখে জেনারেল বোরিসই আবার বলল, বলুন মিঃ তুগান, আপনি কি বুঝছেন, কতটুকু কি জানেন?
স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে তুঘরীল তুগান বলল, আমি কিছুই জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। গত রাতে আমার গোটা ব্যাপারটাই আপনাদের সামনে আছে।
-তা জানি, বলল জেনারেল বোরিস। তার চোখে-মুখে বিরক্তি ও উত্তেজনার চিহ্ন। সে পুলিশ প্রধান তুরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, রশিদভকে এখানে হাজির কর। সব কথা তার কাছ থেকেই পাওয়া যাবে।
জেনারেল বোরিস কথা শেষ করতেই সহকারী পুলিশ প্রধান মিঃ রেকফ উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে গেল সে। কয়েক মিনিট পর রশিদভকে নিয়ে সে প্রবেশ করল ঘরে।
রশিদেভের চেহারায় কোন অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। চোখে মুখে শান্ত ভাব, কোন উদ্বেগের চিহ্ন তার চোখে পড়ছে না।
মিঃ বেকফ বসল। রশিদভ দাঁড়িয়েই থাকল। কেউ তাকে বসতে বললো না।
জেনারেল বোরিস তার তীক্ষ্ণ চোখটা রশিদভের দিকে একবার তুলে ধরে রশিদভের পিস্তলটা হাতে তুলে নিয়ে নাচাতে নাচাতে বলল, এ পিস্তলটা কার রশিদভ?
ধীরে অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে রশিদভ বলল, পিস্তলের ট্যাগে আমার নাম ও দস্তখত থাকলে ওটা আমার।
-পিস্তল থেকে কয়টা গুলী ছুড়েছিলে?
-একটা। দ্বিধাহীন কণ্ঠ রশিদভের।
-আমাদের গোয়েন্দা কর্মীকে হত্যা করেছ, এটা স্বীকার করছ?
-হ্যাঁ আমি তাকে গুলী করেছি।
তুঘরীল তুগানের চোখ দু’টি বিস্ফারিত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ঝড় তার ভেতরে। রশিদভের কি মাথা খারাপ হল, এমনভাবে সব স্বীকার করছে সে? এমনিভাবে কি তাহলে তার কথা এবং ফায়জাভার কথা সব বলে দেবে? এক অজানা ভয় এসে তাকে ঘিরে ধরল।
-ঐ গোয়েন্দা কর্মীর দেহে দুটি গুলী ছিল, দ্বিতীয় পিস্তল পাওয়া গেছে, লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সেই লোকটি কে যে তোমার সাথে ছিল?
রশিদভ এই প্রশ্ন শুনে ভাবল, তাহলে নিশ্চয় এরা ফায়জাভার সন্ধান পায়নি। তুঘরীল তুগানের নিশ্চয় কিছু বলার কথা নয়। তাছাড়া সে গত রাতের ব্যাপারটা জানেও না। গ্রেফতার না করার কারণ তাহলে এটাই। রশিদভ খুশী হল। ফায়জাভার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভাল লাগে তার ফায়জাভাকে। কবে এর শুরু সে জানে না। ফায়জাভার দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম, আদর্শ নিষ্ঠা সম্প্রতি তাকে রশিদভের হৃদয়ের একান্ত কাছে এনে দিয়েছে। গত রাতে বিদায়ের সময় রশিদভ ফায়জাভার হাত ধরতে গিয়েছিল, কিন্তু ফায়জাভা হাত টেনে নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলেছে, আমি মুসলিম, তুমিও মুসলিম, আগের সেই কমরেড নই। সুতরাং আল্লাহ আমাদের মাঝে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন তা আমারা মেন চলব। ফায়জাভার এই পবিত্রতা, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি তার আগ্রহ ফায়জাভাকে রশিদভের কাছে এক মহৎ আসনে সমাসীন করছে। তার যাই হোক, ফায়জাভার বাঁচা প্রয়োজন।
রশিদভ বলল, আমার সাথে আর কেউ ছিল না।
-তাহলে দ্বিতীয় গুলী কে করেছে?
-দ্বিতীয় গুলীটাও আমি করেছি।
-এই তো বললে, তুমি একটা গুলী করেছো?
-আমার পিস্তল দিয়ে একটা গুলী করেছি কিন্তু দ্বিতীয় পিস্তল দিয়ে দ্বিতীয় গুলী…।
-অর্থাৎ তোমার হাতে দুটো পিস্তল ছিল।
-দ্বিতীয় পিস্তলটি কোথায় পেলে?
-তুঘরীল তুগানের বাড়ি থেকে চুরি করেছিলাম। আবার কাজ সেরে রেখে আসি।
জেনারেল বোরিস কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ-মুখ লাল টকটকে। সে পায়চারী করতে লাগল। এ সময় সে রশিদভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি মিথ্যা বলছ রশিদভ, তোমার সাথে কে ছিল বল?
তুঘরীল তুঘানের তুগানের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে। গোটা শরীরটা তার কাঁপছে। এই বুঝি রশিদভ বলে দেয় ফায়জাভার নাম, রশিদভের পিস্তল চুরির কথা তারও বিশ্বাস হয়নি।
জেনারেল বোরিসের প্রশ্নের জবাবে রশিদভ বলল, আমি বলছি আমার সাথে কেউ ছিল না।
ক্রোধে কাঁপছিল জেনারেল বোরিস। রশিদভের জবাব শোনার সাথে সাথে তা চোখ দুটি জ্বলে উঠল আগুনের ভাটার মত। ডান হাত তুলে প্রচন্ড এক ঘুষি দিল সে রশিদভের গালে।
আকস্মিক এই আঘাতে রশিদভ পড়তে পড়তে আবার দাঁড়িয়ে গেল।
ঘুষি মনে হয় লেগেছিল দাঁতের মাড়িতে। রশিদভের মুখ দিয়ে রক্ত আসতে দেখা গেল।
জেনারেল বোরিসকে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন একটা ক্ষিপ্ত বাঘের মত মনে হচ্ছে। গতকাল থেকেই তার মেজাজ খারাপ। আহমদ মুসারা তার নাকের ডগার উপর দিয়ে চলে গেল একান্তই তাচ্ছিল্ল্য ভরে, এই ব্যর্থতার বেদনা যেন কিছুতেই ভুলতে পারছে না। হাতের কাছেই একটা শিকার পেয়ে যেন সে কালকের শোধটাও নিতে চাচ্ছে।
রশিদভের মুখের রক্ত ঠোঁট বেয়ে বুকের উপর গড়িয়ে পড়ছিল। সেদিকে চেয়ে ক্রুর হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, বল, কে ছিল তোর সাথে, আহমদ মুসারা মিটিং কোথায় করল, তা না হলে একেবারে ভর্তা করে ফেলবো।
রশিদভ কোনই জবাব দিল না। যেন কিছুই হয়নি তার, এমনি ভাবেই দড়িয়ে রইল। বেপরোয়া তার মুখ ভংগি।
রশিদভের এই ভাবে নীরব থাকা আগুন ধরিয়ে দিল যেন জেনারেল বোরিসের দেহে। ডান পা তুলে প্রচন্ড এক লাথই মারল রশিদভের কোমরে। রশিদভ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। শক্ত মেঝের উপড় পড়ে তার কপালের একাংশ কেটে গেল। পড়ে যাওয়া দেহের উপর আরেকটা লাথি ছুঁড়ে মেরে জেনারেল বোরিস চিৎকার করে বলল, তুরিন, তুরিন, হারামজাদাকে ছাদের সাথে টাঙ্গাও। দেখি ব্যাটা কতক্ষণ মুখ বন্ধ করে থাকে।
তুঘরীল তুগান মুখ নিচু করে বসেছিল। রশিদভের দিকে তাকাবার সাহস পাচ্ছে না। সমস্ত শরীরে কি এক বেদনা তাকে দহন করছে, হৃদয়টা এফোড় ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে তার বেদনায়।
রশিদভকে ছাদের সাথে টাঙ্গানো হলো। তারপর জেনারেল বোরিস নিজ হাতে চাবুক তুলে নিল। নরম স্টিলের মত চামড়ার চাবুক অসীম হিংস্রতা নিয়ে এলোপাথাড়ী পড়তে লাগল রশিদভের উন্মুক্ত শরীরে। রশিদভের গোটা দেহটাই ফেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল। ফোঁটায় ফোঁটায় তা পড়ে নীচের মেঝকে লাল করে তুলল। কিন্তু যাকে কথা বলাবার জন্য এই অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে, সে রশিদভ একেবারেই নিঃশব্দ, একটা ‘আ’ শব্দ তার মুখ থেকে বের হলো না।
তুঘরীল তুঘানের উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠার বেদনা এবার বিস্ময়ে পরিণত হলো। তার যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না, এ রশিদভ তাদের সেই রশিদভ। এমন নির্যাতন তো হাতিও চিৎকার করতো। এ ধৈর্য্যের শক্তি রশিদভ পেল কোথায়?
টেবিলের চারদিকে আরও যারা বসে আছে, তা তো তারা দেখেনি। ক্রোধে, ক্ষোভে, পরিশ্রমে ক্লান্ত জেনারেল বোরিস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘরের এক কোনে বসল। ২ মিনিট টাইম দিলাম। তোর সাথে কে ছিল, কারা আছে বল। তা না হলে একদম গুড়ো করে ছাড়ব।
রশিদভের চোখ বন্ধ ছিল। মুখ চোখ তার প্লাবিত ছিল রক্তে। নীচের দিকে ঝুলে থাকা একটা হাত তুলে অতি কষ্টে সে চোখটা পরিস্কার করল। হাতটা কাঁপছিল।
রক্তের বেড়াজাল ভেংগে চোখ খুলে তাকাল রশিদভ। তারপর ধীরে কন্ঠে বলল, মিথ্যা আশা করবেন না জেনারেল বোরিস, কিছু পাবেন না আমার কাছ থেকে। আমি আপনাদের কমরেড নই, আমি মুসলিম। অত্যাচার দিয়ে নিপিড়ন দিয়ে দেহকে দুর্বল করা যায়, শেষও করা যায়, কিন্তু বিশ্বাসের শক্তিকে স্পর্শ করা যায় না। আপনাদের কাছে আমি কিছুই আশা করি না, আমার ভরসা আল্লাহ…।
চুপ কর হারামজাদার বাচ্চা, আবার বক্তৃতা করা হচ্ছে। বলে জলন্তে এক অগ্নিপিণ্ডের মত লাফিয়ে উঠল জেনারেল বোরিস। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে নিয়ে রশিদভের মুখ লক্ষ করে ট্রিগার টিপল, এক, দুই, তিন। পর পর তিনটা গুলি গিয়ে আঘাত করল রশিদভের মুখে। সমগ্র মুখটা একটা রক্তের পিন্ডে পরিনত হল। প্রবল ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল রশিদভের দেহ কয়েকবার। তারপর একবারে স্থির।
তুঘরীল তুগান সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এখন আর তার মনে কোন ভয় নাই। রশিদভ তার মনের ভয়ের পর্দাটা যেন কোথায় সরিয়ে দিয়েছে। এখন নিজ হৃদয়ের অন্তঃপুর দিয়ে সুদূর অতিতকেও যেন সে দেখতে পাচ্ছে। সাহসী, সংগ্রামী, চির স্বাধীন, পুর্ব পুরুষের রক্ত যেন তার শিরায় শির শির করে জেগে উঠল। রশিদভের দেহটা যখন কেঁপে স্থির হয়ে গেল, তখন তুঘরীল তুগান চোখ বন্ধ করে মুসলমানের মৃত্যু সংবাদের যা পাঠ করতে হয় সেই ভুলে যাওয়া দোয়াই স্মরন করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। জেনারেল বোরিস পিস্তলটা পকেটে ফেলে বলল, তুরিন এই বিশ্বাসঘাতকের কি শাস্তি! আর সন্দেহজনক যাদের ধরেছ, কাউকে ছেড়ো না। হয় তারা মুখ খুলবে, নয়তো তাদের রশিদভের ভাগ্যই বরন করতে হবে।
তুঘরীল তুগানের দিকে চেয়ে জেনারেল বোরিস বলল, সাইমুমের খবর তুমি উপরে জানিয়েছ এবং গত রাতে তুমি আমাদের সাথে ছিলে এই কারনেই তুমি রক্ষা পাচ্ছ কিন্তু পিস্তল রহস্যের ব্যাপারটা তোমাকে সমাধান করতে হবে।
একটু থামল জেনারেল বোরিস। তারপর রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে তুঘরীল তুগানকে লক্ষ করেই বলল, তোমার পার্টির লোকজনদের নিয়ে এ্যাসেম্বলী হলে যাও। আমি আসছি।
কথা শেষ করে জেনারেল বোরিস গট গট করে বেরিয়ে গেল।

দু হাতে মুখ ডেকে কাঁদছিল ফায়জাভা। নিঃশব্দ কান্না।
রশিদভের কাহিনী বলছিল তুঘরীল তুগান। তার চোখের নীচে ঘুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কথা বলছিল সে। তার শুন্য দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে নিবদ্ধ। বলছিল সে, নিজের কথা স্বীকার করল কিন্তু বলল না তার সাথে কেউ ছিল।
চুপ করল তুঘরীল তুগান। চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবল। তার পর চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। একটু ঝুঁকে পড়ে ডাকল, মা ফায়জাভা!
ফায়জাভা মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া তার মুখ।
তুঘরীল তুগান বলল, তাদের গোয়েন্দা কর্মীর দেহ থেকে দ্বিতীয় যে গুলী পাওয়া গেছে, সেটা আমার পিস্তলের সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। সে গুলী ছুড়ল তা তারা বের করবেই। আমাকে যে তারা ছেড়েছে এটা তাদের সাময়িক কৌশল।
একটু থামল তুঘরীল তুগান, একটু ঢোক গিলল। আর একটু নড়ে-চড়ে বসে বলল, মা ফায়জাভা, তোকে নিয়ে আজ রাতেই কোথাও চলে যেতে চাই।
ফায়জাভা চমকে উঠল। মুখ তুলে বলল, কেন আব্বা?
রশিদভের মতই তোকে তারা নিয়ে যাবে, আমি তা সইতে পারবোনা। বলে দুহাতে মুখ ঢাকল তুঘরীল তুগান। শক্ত ও কঠোর প্রকৃতির তুঘরীল তুগান শিশুদের মত কেঁদে উঠল।
ফায়জাভা উঠে এল। পাশে দাঁড়িয়ে পিতার মাথায় বুলিয়ে বল, তুমি কিছু ভেবনা আব্বা, আমি কোন কিছুকেই ভয় করি না। ‘চুপ কর’, বলল তুঘরীল তুগান, ‘আমি জীবিত থাকতে তোর গায়ে কেউই হাত তুলতে পারে না, আমি তা হতে দেব না। আজ রাতেই আমরা চলে যাব এখান থেকে।’
পিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফায়জাভা বলল, কোথায় যাব আব্বা?
-জানি না। কেন এত বড় দেশে তোকে নিয়ে মাথা গুজবার এতটুকু জায়গা কোথাও পাবনা ?
এই কষ্টের মধ্যেও হাসি পেল ফায়জাভার। তার আব্বা অবুঝ হয়ে গেল নাকি? কম্যুনিস্ট দেশে সরকার সর্বনিয়ন্তা। তার সাথে বিরোধ করে কেউ এখানে বাঁচার অধিকার পায় না, নিরাপদ জায়গা তার আবার কোথায় মিলবে? আমরা কি দেশ ত্যাগ করতে পারব?
-প্রয়োজন হলে তাই করবো। আমাদের পুর্ব পরুষেরা এই কম্যুনিস্টদের অত্যাচারে, তাদের হাত থেকে নিজেদের ঈমান আকীদা রক্ষার জন্য লাখ লাখ সংখ্যায় দেশ ত্যাগ করেছে। আমরা তাদের পথ অনুসরন করব।
-কিন্তু সাইমুমেরা তো দেশের ভেতরে থেকেই দেশকে, জাতিকে মুক্ত করার জন্য কাজ করছে। বলল ফায়জাভা।
-আমার যেটুকু বোঝার বাকী ছিল রশিদভ তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। ওদের পাশে দাঁড়াতে পারলে গৌরব বোধ করব।
ফায়জাভা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় দারোয়ান এসে দরজায় দাঁড়াল। তার সাথে তিনজন পুলশি অফিসার।
পুলিশ অফিসারদের উপর নজর পড়তেই তুঘরীল তুগান উঠে দাঁড়াল। গোটা দেহে তার রক্তের এক উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল।
একজন পুলশি অফিসার দরজা পেরিয়ে এগিয়ে এল। বলল, ফায়জাভাকে জেনারেল বোরিসের অফিসে নিয়ে যেতে এসেছি।
চমকে উঠল না তুঘরীল তুগান। শুধু ডান হাতটা তার একবার মুষ্টিবদ্ধ হলো। এগিয়ে এল সে পুলিশ অফিসাররে দিকে। মুখ তার ভাবলশেহীন। কন্তিু চোখের দৃষ্টিতে এক তীক্ষ্মতা।
শেষ মুহূর্তে এগিয়ে আসা পুলিশ অফিসার বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছিল। তার হাতটা কোমরের বেল্টে ঝুলানো রিভলবারের বাঁটে উঠে এসেছিল। কিন্তু যতটা সে ভাবেনি, তার চেয়েও দ্রুত ঘটনাটা ঘটে গেল। তুঘরীল তুগান প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ অফিসারটির খাপ থেকে রিভলবার ছিনিয়ে নিল এবং সংগে সংগেই গুলী বর্ষিত হলো তার হাতের রিভলবার থেকে। ঢলে পড়ল পুলিশ অফিসারটির রক্তাক্ত দেহ।
চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। মুহূর্তের জন্য একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা ছড়িয়ে পড়ল বাকি দু’জন পুলিশ অফিসারের মধ্যে। কিন্তু পরক্ষণেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তুঘরীল তুগানের উপর। তুঘরীল তুগান তার রিভলবার উঁচু করে তুলে ধরছিল। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে রিভলবারের একটা ফায়ার হলো। গুলীটা ব্যর্থ হলো না। একজন পুলিশ অফিসারের বুকের বাম পাশে ঢুকে গেল গুলীটা। এক পাশে ঢলে পড়ে গেল তার দেহ।
তুঘরীল তুগান পড়ে গিয়েছিল। হাতের রিভলবার ছিটকে পড়েছিল হাত থেকে। তৃতীয় পুলিশ অফিসারটি এসে চেপেছিল তার উপর। পুলিশ অফিসারটির দু’হাত চেপে বসেছিল তুঘরীল তুগানের গলায়। তুঘরীল তুগান তার ডান হাত পাকিয়ে ঘুষি লাগাল তার কানের নীচে ঠিক নরম জায়গাটার লক্ষ্যে। কিন্তু মাথাটা চকিতে ঘুরিয়ে নেয়ায় ঘুষিটা গিয়ে লাগল ঘাড়ের নীচের জায়গাটায়। এই সময় পুলিশ অফিসারের হাতটা কিছুটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। তুঘরীল তুগান এক ধাক্কায় তাকে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়েই আবার ঝাঁপ দিল পুলিশ অফিসারটির উপর। কিন্তু পুলিশ অফিসারটি ততক্ষণে তার রিভলবারটি তুলে নিয়েছিল। সে রিভলবারের গুলী তুঘরীল তুগানের বুকটি একদম এফোড় ওফোড় করে দিল।
ফায়জাভা পিতার ছিটকে পড়া রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। পিতৃহন্তা পুলিশ অফিসারটির রিভলবার অন্য দিকে ঘুরবার আগেই ফায়জাভার রিভলবার অগ্নি বৃষ্টি করল পর পর দু’বার। পুলিশ অফিসারটির মাথা একেবারে গুড়ো হয়ে গেল।
গুলীর শব্দ শুনে বাইরে থেকে দু’জন পুলিশ অফিসার ছুটে আসছিল। উদ্যত রিভলবার হাতে তারা এসে দাঁড়াল সেই দরজায়।
ফায়জাভা গুলী করে রিভলবারটা ফেলে দিয়েই ঝুঁকে পড়েছিল পিতার মুখের উপর। পাগলের মত ডাকছিল সে তার আব্বাকে।
উদ্যত রিভলবার হাতে দাঁড়ানো দু’জন পুলিশ অফিসারের একজন বলল, এবার আসুন মিস ফায়জাভা, অনেক করেছেন।
চকিতে চোখ তুলে তাকিয়েই ফায়জাভা ছুটল রিভলবারের দিকে।
-রিভলবারে হাত দিবেন না ফায়জাভা, হাত একেবারে গুড়ো করে দেব-চিৎকার করে উঠল একজন পুলিশ অফিসার।
ফায়জাভা দাঁড়িয়ে গেল।
সেই পুলিশ অফিসার আবার চিৎকার করে উঠল, বেরিয়ে আসুন জেনারেল বোরিস অপেক্ষা করছেন।
ফায়জাভা দাঁড়িয়েই থাকল।
পুলিশ আবার গর্জে উঠল, শেষ বারের মত বলছি, আসুন আমাদের সাথে। তা না হলে বলপ্রয়োগ করতে হবে আমাদের।
এইবার ফায়জাভা বেরিয়ে এলো।
আগে আগে সে চলল, পিছনে দু’জন পুলিশ অফিসার।
বাইরে এসে গাড়ির দিকে তিনজন এগুচ্ছিল। আগে ফায়জাভা পেছনে উদ্যত রিভলবার হাতে দু’জন পুলিশ অফিসার।
হঠাৎ এ সময় দু’টো গুলীর শব্দ হলো। আর্তনাদ করে দু’জন পুলিশ অফিসার লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। দু’জনের মাথাই গুলীতে এফোড় ওফোড় হয়ে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ফায়জাভা। এই সময় দু’জন যুবক এসে দাঁড়াল তার পাশে। দু’জনেই ফায়জাভার পরিচিত। একজন কলখজের গণনিরাপত্তা অফিসার আহমদভ আরেকজন স্টোর সিকুরিটি অফিসার আলী খান।
তারা এসে সালাম দিল। তারপর নরম এবং দ্রুত কণ্ঠে বলল, মিস ফায়জাভা গাড়িতে উঠুন।
তাদের সালাম দেয়া শুনে ফায়জাভা যতটা আশান্বিত হয়েছিল, তাদের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে আশাটা তিরোহিত হতে চাইল। ফায়জাভা জিজ্ঞেস করল, আমাকে কোথায় যেতে হবে?
তারা মুখ না তুলে চোখ নীচু রেখেই জবাব দিল, আমরা সাইমুমের কর্মী, আমরা খোঁজ নিতে এসেছিলাম আপনাদের।
ফায়জাভা আর কোন কথা না বলে পুলিশের ঐ গাড়িতে এসে বসল। ড্রাইভিং সহ সামনের দুই সিটে গিয়ে বসল ঐ দুই যুবক।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
দু’জন যুবকের একজন বলল, দেরী করেছি আমরা আসতে মিস ফায়জাভা। ওরা আসবে আমরা জানতাম কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে জানতাম না।
ফায়জাভা বলল, আপনাদের এই পরিচয় জেনে খুশী হয়েছি।
-আপনাদের পরিচয় জেনেও আমরা খুশী হয়েছি। দুঃখিত যে, আমরা ওদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
তারপর সবাই চুপ। লাইট নিভিয়ে অন্ধকার পথে কলখজের বাইরের, এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছিল গাড়ি। প্রায় তিন ঘণ্টা পরে কলখজের উত্তর প্রান্তে পশ্চিমের এক উপত্যকায় এসে গাড়ি দাঁড়াল।
গাড়ি দাঁড়াতেই দু’দিক থেকে দু’টি ছায়ামুর্তি গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে আহমদভ সামনের জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি খবর আসলাম সবাই এসেছে?
-এসেছেন।
-শহীদরা?
-আনা হয়েছে। এখন জনাব ইউসুফ শামিল এলেই দাফন হবে।
ইউসুফ শামিল কলখজ আদালতের তিন বিচারপতিদের একজন। অবশিষ্ট দু’জন বিচারপতি রুশ। একমাত্র তিনিই তুর্কি। ইউসুফ শামিল সাইমুমের সারাকায়া ইউনিটের প্রধান।
গাড়িতে আবার উঠে বসল আহমদভ। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। মিনিট পনের চলার পর গাড়ি উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে এসে দাঁড়াল। সেখানে অনেকগুলো লোক, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। এক জায়গায় গোল হয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি দু’টো লাশ সেখানে রাখা। একটি জামায়াতিনের, অন্যটি রশিদভের। জামায়াতিনের লাশ ছিল মর্গে, আর রশিদভের লাশ বাজারে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু টাঙানো বেশীক্ষণ থাকেনি, রাতের অন্ধকার নামতেই স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মিলে সাইমুম কর্মীরা রশিদভের লাশ নিয়ে এসেছে। আর জামায়াতিনের লাশ মর্গ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। শহীদের লাশ অবমাননার শিকার হবে, কবর পাবে না, সাইমুম এটা বরদাশত করতে পারেনি। তাই এই দাফনের ব্যবস্থা।
ইউসুফ শামিল এসে পৌছলেন অল্পক্ষনের মধ্যেই। এসেই তিনি কথা বললেন ফায়জাভার সাথে। ফায়জাভাকে সান্তনা দিয়ে স্বস্নেহে বললেন, তোমার আব্বা, তুমি, রশিদভ ও জামায়াতিনের জন্য আমরা গৌরব বোধ করছি। দুঃখ করো না, তোমার কোন চিন্তা নেই। সাইমুম তোমার নিজ পরিবার। এখানে পিতার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা, ভাইয়ের আদর সবই পাবে।
কবর তৈরীই ছিল, ইউসুফ শামিল আসার সংগে সংগে জানাজা হয়ে গেল। তারপর দুই শহীদকে দাফন করা হলো। যাতে কবরের চিহ্ন সবার নজরে না পড়ে এ জন্য পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হলো সবটা জায়গা জুড়ে।
দাফন শেষে মুনাজাত শেষ করার পর ইউসুফ শামিল বলল, আমাদের পশ্চিম উজবেকিস্তানের এরাই প্রথম শহীদ। এদের দিয়েই উদ্বোধন হলো এখানকার শহীদী ঈদগাহের। এই শহীদী ঈদগাহ আমাদের জীবনের প্রতীক, জয়েরও প্রতীক। অনেক দুরে সুবহে সাদেকের যে আলোক রেখা ফুটে উঠেছে, তা মুক্তির সূর্যোদয়ে রূপান্তরিত হবে এ শহীদের রক্তভেজা পথ বেয়েই।
সবাই নীরব, কারো মুখে কোন কথা নেই। উপত্যকা পথে এগিয়ে আসা গাড়ির শব্দে নীরবতা ভংগ হলো। সবাই ওদিকে মুখ ফিরাল।
গাড়ি এসে থামল তাদের সামনে, গাড়িতে অনেকগুলো নতুন শহীদের লাশ। গাড়ি থেকে নামল আবদুল্লা জমিরভ, বলল সে, সন্দেহ করে আজ যাদের ওরা গ্রেফতার করেছিল, অকথ্য নির্যাতনের পর সন্ধ্যায় সবাইকে ওরা হত্যা করেছে। বাজারেই ফেলে রেখে গিয়েছিল ওদের সবাইকে, সকলের দেখার জন্য। আরো লাশ আসছে অন্য গাড়িতে।
কারো মুখে কোন কথা যোগাল না, নীরব সবাই, মাথা নীচু। রাতের অন্ধকার না থাকলে দেখা যেত কারো চোখই শুকনো নেই।
নীরবতা ভাঙল ইউসুফ শামিল, বলল, এমন একটা দিন আসবে জানতাম কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে তা ভাবিনি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা দরকার আমাদের মনে হচ্ছে মুক্তির সোনালী দিগন্ত আর খুব বেশী দুরে নয়।
এক পাশে দাড়িয়েছিল ফায়জাভা। রশিদভের দেহ কবরস্থ হওয়ার পর তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সেখানে এসে দাড়িয়েছে কঠোর শপথের এক দীপ্তি।
ইউসুফ শামিল তার দিকে এগিয়ে এল। বলল, এখন তোমাকে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেই। কাল তুমি যাবে আমাদের মহিলা হেডকোয়াটার লেনিন স্মৃতি পার্কে। অনেক সংগ্রামী বোন তুমি সেখানে পাবে।
নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিল ফায়জাভা।

Top