৭. তিয়েনশানের ওপারে

চ্যাপ্টার

কয়দিন কাটল তার কোন হিসেব আহমেদ মুসার কাছে নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। পাথরের মেঝে, পাথরের দেওয়াল। অনেক উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। ওখানে মাঝে মাঝে একটা আবছা আলোর রেখা ফুটে ওঠে। আহমদ মুসা এখন বুঝেছে, ঐ আবছা আলোর রেখাটা দিনের লক্ষণ। যখন আবছা আলোটা থাকে না তখন রাত। এটা বুঝার পর আহমেদ মুসা আনন্দিত হয়েছে এই ভেবে যে, অন্তত রাত দিনের হিসেবটা সে রাখতে পারবে।
রাত দিনের পরিবর্তন বুঝার পর আহমদ মুসা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একটা সময় ঠিক করে নিয়েছে। হাত মুখ ধোয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। গোসল কবে থেকে নেই তার মনে পড়ে না। অন্ধকার মেঝের এক কোণায় একটা মাটির ছোট কলস আছে। টিনের মগ দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারে হাতড়ে ঐ মগ দিয়েই সে পানি খায়। মুখটা ধুয়ে নেয় মাঝে মাঝে। এই ঘরের সাথেই লাগানো একটা খুপরীতে পায়খানার জায়গা। সেখানেও পানির রেশন। প্রতিদিনের জন্যে এক মগ পানি বরাদ্দ।
ঘরের এক পাশে একটা খাটিয়া। কাঠের। কম্বল বিছানো। আরেকটা কম্বল আছে গায়ে দেবার। শীতটা যেন একটু বেড়েছে। সে বুঝতে পারে না, তার শরীর খারাপ না আবহাওয়ার পরিবর্তন। আবহাওয়ার পরিবর্তন কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে কি স্থান পরিবর্তন? সে কাশগড়ে এসেছে, এতটুকু সে জানে। কিন্তু কাশগড়ে তো এই শীত হবার কথা নয়! কোথায় সে তাহলে? মনে আছে সেদিন রাতে জেনারেল বোরিস তাকে একটা ইনজেকশন দেয়। ইনজেকশনের পর রাজ্যের ঘুম এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কি ঘটেছে কিছুই তার আর মনে নেই। সেই ঘুমানোর পর এই অন্ধকার ঘরেই সে চোখ মেলেছে।
পূর্ব, পশ্চিম কিংবা কেবলা কোন দিকে কিছুই তার জানা নেই। পাথরের দেয়ালে তায়াম্মুম করে মনে মনে একদিকে কেবলাকে ধরে নিয়ে সে নামায আদায় করে।
যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার, তেমনি নিঃসীম নিশব্দ চারদিক। এক অন্ধকার ছাড়া চোখ তার কিছু দেখে না। জীবনের একটা স্পন্দন হলো শব্দ, এ শব্দও তার কানে আসে না। ঘরটা কি তাহলে মাটির নীচে? জীবনের স্পন্দনহীন নিরব-নিথর অন্ধকারে মাঝে মাঝে নিজেকে অশরীর মনে হয়। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার ভয় ও রোমাঞ্চের কথা। দাদির কোলে বসে ভূতের গল্প শুনত সে, ভালো লাগত। অন্ধকারকে দারুণ সে ভয় করত। এমনকি অন্ধকার ঘরে ঢুকতেও সে ভয় পেত। তার আম্মা দাদির কাছে এসে অনুযোগ করতেন, আম্মা আপনার নাতি কিন্তু দেখবেন ভীতু হবে।
-কেন, কেন? দাদি বলতেন।
-আপনার কাছে ভূতের গল্প শুনে শুনে এখন তো সব জায়গায় ভূত দেখে।
তার আম্মার কথা শুনে দাদি হাসতেন। তাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথা নেড়ে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে বলতেন, তুমি কিছু ভেব না বৌমা, আমার এ ভাইটি আল্লাহ্‌ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। বড় হলে বাহাদুর হবে।
দাদির কথা শুনে তার আম্মার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তার আম্মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আম্মা দোয়া করবেন আমার আহমদের জন্যে। যেন সে আমাদের নাম রাখে, জাতির মান রাখে।
কোথায় গেল সেই দিন। সেই দাদি, সেই আম্মা কোথায়, তাদের বুক ভরা সেই ভালবাসা কোথায়? চোখের কোণ দু’টি ভারি হয়ে ওঠে আহমেদ মুসার। তার দাদি, তার মায়ের কবরও সে আর কোনদিন কি দেখতে পাবে? পাবে না।
কমিউনিষ্ট বাহিনী ওখানে হয়তো প্রস্রাব পায়খানার জায়গা তৈরী করেছে। মুসলমানদের যা কিছু পবিত্র তাকে অপবিত্র করাই ছিল ওদের প্রথম কাজ। মুসলমানদের কবর গাহ ওদের হিংসার আগুন থেকে বাঁচবে কেমন করে?
অবসর ও একাকিত্বের সুযোগ গ্রহণ করে কত কথা, কত ঘটনা রূপ ধরে তার সামনে এসে দাড়ায়। বাইরের দু’চোখ বন্ধ করলে নাকি মনের চোখের গতি বেড়ে যায়। তাই হয়েছে আহমেদ মুসার ক্ষেত্রেও। যে স্মৃতিকে সে দু’হাতে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তাই যেন তার সামনে এসে ভীড় করে বেশী। ফাতিমা ফারহানার অশ্রু ধোয়া মুখটি আবার মূর্তিমান হয়ে যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ আবদুল গফুর যখন ফারহানার হাত তার হাতে তুলে দিল, তখনকার তার হাতের উত্তপ্ত কম্পন তার হাতে যেন এখনও লেগে আছে। ও কেমন আছে? ফাতিমা ফারহানা যেন আরও নিবিড় হয়ে আসে তার কাছে। বৃদ্ধ আবদুল গফুরের বাড়িতে প্রথম দিন সেই ঔষুধ খাবার সময়, তারপর সেদিন ফারহানার হাত যখন হাতে এল সে সময় যে অপরিচিত এক সুবাস সে পেয়েছিল, তাও যেন এসে তাকে আচ্ছন্ন করছে। সচেতন হল আহমদ মুসা। দু’হাতে সে ঠেলে দিতে চাইল স্মৃতির ভাবকে। না, এমন নিবিড়তায় সে ওকে ভাবতে পারে না। আল্লাহ এ অধিকার এখনও তাকে দান করেননি। একজন মুমিনকে একজন মুমিনের চিন্তার কলুষতা থেকেও নিরাপদ রাখা দরকার।
এ সময় ঘরের ওপ্রান্তে দরজার ওপার থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল।
এ পায়ের শব্দের সাথে আহমদ মুসা পরিচিত। নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর ওরা আসে। দরজার ওপারে আলো জ্বলে ওঠে। দরজা খুলে যায়। দরজায় দাঁড়ায় উদ্যত ষ্টেনগান হাতে চারজন রুশ প্রহরী। একজন চীনা মেয়ে খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকে। খাবার ট্রে বিছানার ওপর রেখে পাশের দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেয়েটির বয়স বিশ/বাইশের বেশী হবে না। সুন্দরী। চোখে মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
যতক্ষণ আহমদ মুসা খায়, ততক্ষণ সে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খাওয়া হলে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায় দূরে।
এই অন্ধকার কুঠরীতে আসার পর জেনারেল বোরিস একবারই এসেছে। আনুমানিক সেটা গতকাল হবে। জেনারেল বোরিসের এত পরে আসায় আহমদ মুসা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। পরে বুঝেছে, আহমদ মুসাকে মানসিক ভাবে দূর্বল করার জন্যে সে সময় নিতে চায়।
গতকাল জেনারেল বোরিস একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। প্রস্তাব ছিল, আহমদ মুসা কর্ণেল কুতাইবার কাছে চিঠি লিখবে ‘ফ্র’ কে দশ বিলিয়ন ডলার দেবার জন্যে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাংক ও ট্রেজারিতে এ টাকা রয়েছে। এ টাকা হেলিকপ্টারে করে নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চলে যাবার পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দেবে। আর টাকা দিতে রাজী না হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে হত্যা করবে।
আহমদ মুসা কোন জবাব দেয়নি এ প্রস্তাবের। দেবার প্রবৃত্তি হয়নি তার। প্রস্তাব রাখার পর জেনারেল বোরিস দেরী করেনি। যাবার সময় বলে গেছে পরদিন আবার আসবে।
দরজার ওপাশের পায়ের শব্দ নিকটতর হলো। দরজার সামনে এসে তা থেমে গেল। ওপারে জ্বলে উঠল আলো। দরজার ফাঁক গলে ছুটে এলো জমাটবদ্ধ একগুচ্ছ আলোর কণা। চৌকাঠের প্রান্তকেই তা আলোকিত করল মাত্র।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় এসে দাঁড়াল সেই চারজন প্রহরী।
তারপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল জেনারেল বোরিস। হাতে তার রিভলভার।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। জেনারেল বোরিস লোকটা আসলে ভীতু। চারজন প্রহরী দাঁড় করিয়েও ভরসা নেই, নিজ হাতেও রিভলভার নাচাতে হচ্ছে।
জেনারেল বোরিস ঘরে প্রবেশ করে ঘরের এদিক-ওদিক একবার পায়চারী করল। তারপর আহমদ মুসার মুখোমুখি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কি চিন্তা করলেন?
-কোন ব্যাপারে?
-কালকে একটা চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম!
-জেনারেল বোরিস, আপনারা একটা আদর্শের জন্যে লড়াই করেন জানতাম, কিন্তু আপনারা এমন নিরেট অর্থলোলুপ তাতো জানতাম না?
-আমার প্রশ্নের জবাব চাই আহমদ মুসা।
গর্জে উঠল জেনারেল বোরিসের কন্ঠ। গোটা মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার।
-আমার একটা প্রশ্ন আছে জেনারেল বোরিস।
-কি প্রশ্ন?
-এই চিঠি আমাকে লিখতে বলছেন কেন?
-কে লিখবে তাহলে?
-জেনারেল বোরিস লিখবে, টাকা তো তারই দরকার।
-এ টাকা তোমারও দরকার। এ টাকার ওপর তোমার মুক্তি নির্ভর করছে। মনে করো না জেনারেল বাগাড়ম্বর করে। নির্দিষ্ট তারিখের নির্দিষ্ট দিন পার হয়ে গেলে তুমি আর এক মুহূর্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবে না। তোমাকে গুলি করে মারবো না। গায়ের চামড়া খুলে পশুর মত তোমাকে মরাব।
-আমাকে ভয় দেখাচ্ছো জেনারেল বোরিস?
-হ্যাঁ, ভয় দেখাবার মত শক্তি আমার আছে?
-মৃত্যুকে যে ভয় করে না, তাকে আর কোন ভয় দেখাবে জেনারেল বোরিস?
জেনারেল বোরিস পাগলের মত হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামলে আবার সে তার আগের প্রশ্নেরই পুনরাবৃত্তি করল, আমার প্রশ্নের জবাব জানতে চাই আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মৃদু হেসে বলল, জেনারেল বোরিস, তুমি কেমন করে ধারণা করলে যে আমি তোমার ব্ল্যাক মেইলিং এর সহায়ক হব?
-ইচ্ছায় না হলে অনিচ্ছায় তোমাকে সহায়ক হতেই হবে।
একটু থামল জেনারেল বোরিস। বাষ্পের মত ফুঁসছে সে। মুখ তার টকটকে লাল। যেন আগুন বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। বার কয়েক পায়চারি করে সে বলল, হ্যাঁ দরকার হলে জেনারেল বোরিসই চিঠি লিখবে। কিন্তু মনে রেখ, তোমার যে হাত চিঠি লিখবে না, সে হাতও ঐ চিঠির সাথে যাবে। তোমাদের ইসলাম ধর্মের তো হাত কাটার অভ্যাস আছে। আমরা এবার ওটার প্রয়োগ করব। তোমার ডান হাতটা যখন চিঠির সাথে ওদের কাছে যাবে, তখন তুমি চিঠি লেখার চেয়ে সেটা বেশী ফায়দা দেবে বলে আমি মনে করি।
বলে জেনারেল বোরিস আবার সেই হো হো করে হেসে উঠল।
যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল সে। যেতে যেতে বলল, এখন আহমদ মুসা তুমিই সিদ্ধান্ত নাও তুমি চিঠি দেবে, না হাত দেবে।
জেনারেল বোরিস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ওপারের আলো নিভে গেল। আবার সেই আঁধারে ডুবে গেল ঘর।
আহমদ মুসা তার দু’পা নিচে ঝুলিয়ে খাটিয়ায় বসে ছিল। ঐভাবেই বসে রইল। তার মনে ছুটে গেল হঠাৎ মধ্য এশিয়ায়। যুগ-যুগান্তের অপরিসীম ত্যাগ-তীতিক্ষার পর ওখানকার দুর্ভাগ্য মুসলমানরা স্বাধীন হয়েছে। ওদের হাজারো সমস্যা। এ সমস্যা মুকাবিলার জন্যে ওদের প্রচুর অর্থ চাই, যা ওদের নেই। এই অবস্থায় দশ বিলিয়ন কেন দশ ডলার ওদের অপচয় করা যাবে না। আহমদ মুসার জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ! দশ বিলিয়ন ডলার তাকে বাঁচাতে পারবে না। জেনারেল বোরিসের শেষ কথায় হাসি পেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার কাটা হাত ওখানকার সাথীদের দুঃখ দেবে, কিন্তু দশ বিলিয়ন ডলার দিলে আহমদ মুসা মুক্তি পাবে, এ বিশ্বাস তারা অবশ্যই করবে না করতে পারে না। মৃত আহমদ মুসার হাত কেটেও ওভাবে পাঠানো যায়!
এই চিন্তা আহমদ মুসার মনকে অনেক হালকা করে দিল। সে দু’টি পা বিছানায় তুলে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।
শুয়েই নজর পড়ল সেই ঘুলঘুলির দিকে। ওখানে সাদা আলোর যে রেখাটা ছিল, তা এখন নেই। অন্ধকার সেখানে এসে স্থান করে নিয়েছে। আহমদ মুসা বুঝল, মাগরিবের সময় হয়েছে, বা যাচ্ছে।
সে উঠে বসল বিছানা থেকে। দেয়ালে তায়াম্মুম করে নামাযে দাঁড়াল।

হোটেল সিংকিয়াং এ বিরাট এক ভোজ সভা। উরুমচির সবচেয়ে অভিজাত হোটেল এটা। ভোজের আয়োজন করেছে আলেকজান্ডার বোরিসভ। জেনারেল বোরিস এখন এই নামে উরুমচিতে বাস করছে। তার পরিচয় বড় একজন ব্যবসায়ী সে। রুশ অঞ্চল থেকে বহুদিন আগে হিজরত করে আসা একজন চীনা নাগরিক বহুদিন সাংহাই এ বসবাস করছে, এখন এসেছে উরুমচিতে।
ভোজে আমন্ত্রিত হয়েছে উরুমচির নামি-দামি অনেক লোক। এ ধরনের ভোজ সরকারী ব্যবস্থাপনা ছাড়া বড় একটা হয় না। তাই দুর্লভ এমন আমন্ত্রণ পেয়ে কেউ তা ছাড়েনি।
আজকের আমন্ত্রিতদের মধ্যমণি দেখা যাচ্ছে মেইলিগুলিকে। সবারই চোখ তার দিকে। সিংকিয়াং এর অপরূপ সুন্দরী এই নায়িকা ‘তিয়েনশান পাহাড়ের ফুল’ নামে অভিহিত। অপরিচিত এক ব্যবসায়ীর দাওয়াতে তাকে এ ভোজ সভায় দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছে।
এই বিস্ময়টা অমূলক নয়। মেইলিগুলি সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এক কল্পনার বস্তু। কিন্তু মেইলিগুলি জেনারেল বোরিসের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেনি। প্রথম কারণ, এ লোকটি তাকে বড় এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। দ্বিতীয়ত জেনারেল বোরিস তাকে টেলিফোন করার সংগে সংগে তার ঐ অদ্ভুত বন্দীর কথা মনে পড়েছিল। ঐ অদ্ভুত বন্দীটি কেমন আছে, কোথায় আছে, এটা জানার একটা অদম্য কৌতুহল তার জেগেছিল। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে এই আমন্ত্রণ সে গ্রহন করেছিল।
ভোজ সভায় জেনারেল বোরিস সারাক্ষণ মেইলিগুলির কাছে ঘুরঘুর করেছে। খেতেও বসেছে পাশা-পাশি। খেতে খেতে জেনারেল বোরিস বলেছিলেন, কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই, যদি খাবার পর সময় দেন দয়া করে।
ঘড়ি দেখে মেইলিগুলি তাকে বলল, আমি এখান থেকে বাড়ি হয়ে তবে অফিসে যাব, পাঁচ/সাত মিনিট সময় আপনি নিতে পারেন।
খাবার পর মেইলিগুলি জেনারেল বোরিসের সাথে তার হোটেল স্যুটে এল।
সোফায় মেইলিগুলির পাশেই বসল জেনারেল বোরিস। মেইলিগুলির ভ্রুটা একটু কুঞ্চিত হলো। যেন ভালভাবে নিল না সে এই আচরণকে। কথা শুরু করল বোরিস। বলল আপনার মত এক অপরূপ নায়িকা আমি খুজছিলাম মিস মেইলিগুলি?
-কেন?
-আমি একটা বই করতে চাই।
-বই মানে চলচ্চিত্র? আপনি?
-হ্যাঁ সব ঠিক, আপনি রাজী …।
মেইলিগুলির ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বুঝতে পারল, জেনারেল বোরিসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এদেশে যে বেসরকারী কোন চলচ্চিত্র হয় না তাও ভুলে গেছে। কিন্তু সে কথা আর না বাড়াবার জন্য বলল, সব ঠিক? তাহলে ঠিক আছে। পরে কথা বলব।
বলে মেইলিগুলি ঘড়ির দিকে চাইল। অর্থাৎ মেইলিগুলি এখন উঠতে চায়। হঠাৎ জেনারেল বোরিস মেইলগুলির আরেকটু কাছে সরে এল। তার বাম হাত চেপে ধরে বলল, প্লিজ মেইলিগুলি …
মেইলিগুলি এক ঝটকায় তার হাত কেড়ে নিল। তারপর কাপড়ের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা রিভলভার বের করে তার কপাল বরাবর ধরে বলল, ভদ্রবেশী শয়তান, আর এক পা এগুলে মাথাগুড়ো করে দেব। আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করি বটে, কিন্তু আমি উইঘুর মেয়ে।
জেনারেল বোরিসের যে চোখে এতক্ষণ ছিল কামনার আগুন সে চোখে এখন বিস্ময় ও ভয়ের চিহ্ন।
মেইলিগুলি বেরিয়ে এল জেনারেল বোরিসের হোটেল স্যুট থেকে। বেরিয়ে রিভলভারটা কাপড়ের তলায় আবার গোপন করে তর তর করে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে।
মেইলিগুলির এই আচরণ কোনো অস্বাভাবিক নয়। রিভলবার দিয়েই সে এর জবাব দিয়েছে। তাই এ রিভলবার তার অতি প্রিয়। বাইরে সে একপাও নড়ে না এ রিভলবার ছাড়া। তার স্টুডিও এবং শুটিং এর সময়ও সে অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার মুকাবিলা করেছে। একবার একজন বেয়াদব চিনা পরিচালক তার রিভলবার এর গুলিতে আহত পর্যন্ত হয়। পড়ে সে পরিচালকের চাকুরী যায়। এখন সবাই তাকে সমীহ করে চলে। অনেকেই প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা এতই যে, তার বিরুদ্ধে কোন কথাই কোথাও কাজে লাগেনি। বাইরের কোন শুটিং-এ সে তার পরিবারের সাথে ছাড়া যায় না।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে পার্কিং থেকে নিজের গাড়ি বের করে মেইলিগুলি ছুটল নিজের বাসার উদ্দেশে।
উরুমচির অভিজাত এলাকায় বিশাল বাড়ি মেইলিগুলির। বাড়িটা মেইলিগুলির পৈত্রিক। মেইলিগুলির পরিবার সিংকিয়াং এর সবচেয়ে পুরাতন সবচেয়ে সম্মানিত পরিবারের একটি। মেইলিগুলির পূর্ব পুরুষ ইবনে সাদ মক্কা থেকে সপরিবারে সিংকিয়াং এ আসেন। বলা হয় ইনি মহানবী (সঃ) এর একত্রিশতম বংশধরের পৌত্র। গোঁটা চীনে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ইবনে সা’দ স্থানীয় জনগনের সাইয়েদে পরিনত হন এবং তাদের অতুল ভালবাসা লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে শানসি, সিচুয়ান ও ইউনান প্রদেশের শাসন কর্তার পদ ও লাভ করেন। পড়ো জমি আবাদ করা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, সেচ ব্যাবস্থার বিস্তার, ডাক চলাচল ও উন্নত কৃষি ব্যাবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি তার জনহিতকর কাজগুলির কথা প্রবাদের মত এখনও মানুষের মুখে মুখে। সিংকিয়াং এ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা উইঘুরদের আব্দুল করিম সাতুক বোগড়া খানের পরিবারের সাথে সাইয়েদ ইবনে সাদের পরিবার ঘনিষ্ঠ হয়। এই উইঘুর পরিবারের এক রাজকুমারীকে বিয়ে করার মাধ্যমে সাইয়েদ পরিবার উইঘুরদের সাথে মিশে যায়। মেইলিগুলি এই সাইয়েদ উইঘুর পরিবারেরই সন্তান। শুধু উইঘুরই নয়, সিংকিয়াং এর হুই, কাজাখ, প্রভৃতি সব মুসলিম সম্প্রদায়ই এই সাইয়েদ পরিবারকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে। মাও এর সংস্কৃতিক বিপ্লব এর সময় মেইলিগুলিদের বাড়িটাও বিপ্লবীরা দখল করেছিল। কিন্তু উইঘুরদের অসন্তোষ হ্রাসের জন্যে পরে তারা এই বাড়িটা মেইলিগুলিদের ফিরিয়ে দেয়।
মেইলিগুলি একুশ বছরে পা দিয়েছে। গত বছরে সে উরুমচির সমাজ বিজ্ঞান কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েছে ইতিহাস বিষয়ে। তার শিক্ষার সাথে তার পেশা মেলে না। সিংকিয়াং এর সরকারি চলচ্চিত্র সংস্থা তিয়েনশান স্টুডিওতে যারা ঢোকে, তারা সকলেই কলেজ অফ আর্টস থেকে ডিগ্রি নেয়া। মেইলিগুলিই একমাত্র ব্যতিক্রম। প্রকৃত পক্ষে অনুকরন ও উপস্থাপনার অপূর্ব ক্ষমতা দেখেই যুব কম্যুনিস্ট পার্টি তাকে অভিনয়ে ঢুকিয়েছে। মেইলিগুলি উরুমচির যুব কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। মেইলিগুলি আজ তিন বছর হল অভিনয়ে ঢুকেছে।
মেইলেগুলি বাড়িতে পৌঁছে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল অফিসে, তার কর্মস্থল তিয়েনশান স্টুডিওতে।
দাদির ঘরের সামনে দিয়ে নিচের তলায় নামার সিঁড়ি।
দাদির ঘরের সামনে দিয়ে মেইলিগুলি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল।
দাদি ডাকল, আমিনা।
মেইলিগুলির দাদির ডাক শুনেই থমকে দাঁড়াল।
দাদির ঘরের দরজা খোলাই ছিল, মেইলিগুলি ছুটে ঘরে ঢুকে বলল, কি দাদি?
তার দাদির বয়স শত বর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর। একশ’ এক বছর চলছে এবার। শুভ্র কেশ, গা-মুখের চামড়া কুচকে গেছে, নড়া-চড়ায় তার কষ্ট হয়, অবয়ব ঘিরে এক শুভ্র পবিত্রতা। মনে হয় তার চোখ মুখ দিয়ে কি এক উজ্জ্বল্য যেন ঠিকরে পড়ছে।
দাদি বালিশে ঠেশ দিয়ে বসেছিল। মেইলিগুলি ঘরে ঢুকলে সে সোজা হয়ে বসল। ঠোটে স্নেহের হাসি জড়িয়ে বলল, আয় আমার পাশে বস।
মেইলিগুলি এসে তার পাশে বসতে বসতে বলল, অফিস এর সময় হয়েছে তো তাই একটু তাড়া, তিনটায় একটা কাজ আছে।
-কথা বলার জন্য তোকে আজ কাল দু’দণ্ডও পাই না।
-সত্যি ব্যস্ত দাদি, মাঝখানে আবার কাশগড় গিয়েছিলাম।
-কাশগড়ে তোর কি ঘটেছিল, সেটা পুরাপরি কেউ আমাকে বলল না।
-ও কিছু না দাদি। একটা এক্সিডেন্ট।
-এক্সিডেন্ট কি ঘটনা নয়?
দাদি একটু থামল। কণ্ঠটা তার ভারি শোনাল। একটা ঢোক গিলল দাদি। তারপর আবার শুরু করল, জানি, তোদের এ সব কাজ আমি পছন্দ করিনা, তাই তোরা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাস।
-না দাদি তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। আমি সত্যিই ব্যস্ত, প্রায়ই উরুমচির বাইরে যেতে হয়।
-কেন ব্যস্ত, কিসের কাজে তুই ব্যস্ত।
বলে দাদি মেইলিগুলির মুখ এক হাতে উঁচু করে তুলে ধরল। তার চোখে চোখ রেখে বলল, তোকে ওরা মেইলিগুলি বলে- ‘তুই তিয়েনশান পাহাড়ের ফুল’ ওদের কাছে। কিন্তু আমরা তো তোর নাম রেখেছিলাম, ‘আমিনাগুলি’ আমরা চেয়েছিলাম তুই ‘বিশ্বাসী ফুল’ হবি। তুই আজ ঐ পথে কেন?
মেইলিগুলি ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, দোষ কি এতে দাদি?
-দোষ তুই দেখতে পাবি না। বলত তুই কে?
-উয়ঘুর মেয়ে।
-শুধু কি তাই? তোর কি অতীত নেই, কোন ঐতিহ্য নেই?
মেইলিগুলি নরম কণ্ঠে বলল, দাদি আমি যুব কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। আমার তো কোন অতীত নেই।
-তুই এ কথা বলতে পারলি? তোর রক্ত তুই অস্বীকার করিস? সিংকিয়াং-এ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সকলের পরম শ্রদ্ধেয় ইবনে সাদ তোর পূর্ব পুরুষ । সিংকিয়াং-এ ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল করীম সাতুক বোগড়া খানের রক্ত তোর দেহে। তুই এসব অস্বীকার করিস?
বলতে বলতে দাদির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। চোখ দুটি তার নিচে নেমে গেল।
মেইলিগুলি দাদির একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, দাদি তুমি আমাকে ভুল বুঝ না, আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি। বাস্তবতাকেই শুধু আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।
-গায়ের জোরে একটা জিনিস চালু হয়ে গেলেই তা বাস্তব হয়ে যায় নারে! বাস্তবতার সাথে মানুষের বিশ্বাসের যোগ থাকতে হয়। সেটা এখন কোথাও নেই। মানুষের বিশ্বাসের সাথে তোর ঐ বাস্তবতার সংঘর্ষে মানুষ আজ ক্ষত -বিক্ষত হচ্ছে। তুই বুকে হাত দিয়ে বলত, তোর বিশ্বাসের সাথে তোর বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক আছে?
মেইলিগুলি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। একটু ভাবল, তারপর বলল, তোমার প্রশ্নের জবাব আজ দিতে পারলাম্ না। ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
বলে উঠে দাঁড়াল মেইলিগুলি। দাদির দু’টো হাত নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, দাদি, তোমার ‘আমিনাগুলি’ আমিনাগুলিই আছে, তোমার ‘বিশ্বাসী ফুল’- এতে কোনও অশুভ হাতের ছোঁয়া লাগেনি। অন্যান্য কম্যুনিস্টদের ব্যাপার যাই হোক, আত্ম সম্ভ্রম ও আত্ম মর্যাদা রক্ষার ঐতিহ্য আমার কাছে কোনও অতীত বিষয় নয়।
বলে মেইলিগুলি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তর তর করে নামল সিঁড়ি দিয়ে। হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট। আশ্বস্ত হল খুব একটা দেরী হবে না।

তখন বিকেল সাড়ে চারটা। তিয়েনশান স্টুডিওতে তার অফিস কক্ষে বসে মেইলিগুলি একটা স্ক্রিপ্ট এর ওপর চোখ বুলাচ্ছিল। এমন সময় এ্যাটেনডেন্ট মিস লি ওয়ান দরজায় এসে ভিতরে আসার অনুমতি চাইল।
মাথা নেড়ে অনুমতি দিল মেইলিগুলি।
লি ওয়ান ভিতরে ঢুকে একটা স্লিপ এগিয়ে দিল মেইলিগুলির সামনে। স্লিপটির উপর নজর বুলাল মেইলিগুলি। স্লিপে সাক্ষাতদানের একটা অনুরোধ। নিচে নাম স্বাক্ষর ‘হাসান তারিক’।
পড়ে ভ্রু কুঞ্চিত করল মেইলিগুলি। না এই নামের কাউকে সে চিনে না। এই নামের কোনও লোকের সাথে তার পরিবারের বা পেশাগত কোন সম্পর্কের কথাও সে স্মরণ করতে পারল না। নিশ্চয় কেউ বিরক্ত করতে এসেছে। এখন সাক্ষাত প্রার্থীর সংখ্যা প্রতিদিন প্রচুর। সবাইকেই ফিরে যেতে হয়। ফিল্ম সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে সে দেখা করে না। তবু ওয়েটিং রুমে ভীড় লেগেই থাকে। বেরুবার সময় এক মুহূর্ত দেখার জন্যে।
মিস ওয়ান এর দিকে মুখ তুলে মেইলিগুলি বলল, তুমি বলনি ফিল্ম সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে আমি দেখা করি না?
-বলেছি, কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। বলছে, অভিনেত্রী বলে তার সাথে দেখা করতে আসিনি। তবু আমি রাজি না হলে সে বলেছে’ বিদেশ থেকে সে এসেছে, একটা উপকার আপনি, তার করতে পারেন’ এই অনুরধ আপনাকে জানাবার জন্যে।
ভ্রু কুঞ্চিত হল মেইলিগুলির। আবার চোখ বুলাল নামটার উপর। ঠিক নামটা এদেশে স্বাভাবিক নয়।
-জিজ্ঞেস করেছো কোন দেশী? বলল মেইলিগুলি।
-না জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করে আসি।
বলে দরজার দিকে পা বাড়াল লি ওয়ান। মেইলিগুলি তকে থামিয়ে দিয়ে বলল, দরকার নেই জিজ্ঞাসার। তুমি তাকে নিয়ে এস।
লি ওয়ান বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পর হাসান তারিককে নিয়ে ফিরে এল।
হাসান তারিক ঘরে প্রবেশ করে মেইলিগুলির সাথে চোখাচোখি হতেই পরিষ্কার কণ্ঠে সালাম দিল।
মেইলিগুলি ছোট্ট করে সালামের জবাব দিয়ে বলল, বসুন।
মেইলিগুলিও উঠে দাঁড়িয়েছিল। হাসান তারিক বসার সাথে সাথে মেইলিগুলিও বসে পড়ল।
মেইলিগুলিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল হাসান তারিককে। পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়স। বলিষ্ঠ গড়ন। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে সারল্য, দৃষ্টির মধ্যে একটা পরিছন্নতা। বিরক্তির ভাবটা কেটে গেল মেইলিগুলির। এমন চেহারার লোক চারশো বিশ গোছের হয় না।
মেইলিগুলি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, মিস মেইলিগুলি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাফ চাইছি। একটা ব্যাপারে আমি আপানার সাহায্য চাই।
-আপনি কে, কি পরিচয় আপনার আগে বলুন।
-পরিচয় দেবার মত কোন পরিচয় আমার নেই। একজন সাধারন মানুষ আমি। এসেছি তাসখন্দ থেকে।
-তাসখন্দ থেকে? আচ্ছা ওখানে যে বিপ্লব হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু জানেন আপনি?
-হ্যাঁ, সেখানকার মুসলমানরা কম্যুনিস্টদের হটিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে।
-ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য। মনে হয় যা শুনেছি সবই রুপকথা। যাক, আপনার প্রয়োজন বলুন।
-জেনারেল বোরিসকে আপনি চেনেন?
জেনারেল বোরিসের নাম শুনে চমকে উঠল মেইলিগুলি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল হাসান তারিকের দিকে। ধীর কন্ঠে বলল, তার সাথে পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু কে তিনি তার বিস্তারিত কিছু জানি না।
-জেনারেল বোরিস কাশগড় থেকে উরুমচি এসেছেন, আপনি জানেন?
-জানি, এসেছেন।
একটু থামল হাসান তারিক। বোধহয় একটু ঢোক গিলল। মেইলিগুলির কথায় যেন তার চোখ দু’টি চকচক করে উঠেছে। ধীরে ধীরে সে বলল, মিস মেইলিগুলি, আপনি কি তার ঠিকানা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেন?
-দুঃখিত, মিঃ হাসান তারিক, তার ঠিকানা আমার জানা নেই। উনি উরুমচিতে আসার পর হোটেল সিংকিয়াং-এ একটা ভোজ সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমাকেও দাওয়াত করেছিলেন। সেখানেই তার সাথে দেখা। আর কিছুই জানি না আমি তার সম্বন্ধে।
বিরাট আশা হোঁচট খেল হাসান তারিকের। একটা বিষণ্ণ অন্ধকার নেমে এল তার চোখে মুখে। ব্যাপারটা মেইলিগুলির দৃষ্টি এড়ালনা। মনে মনে দুঃখই হলো তার। বেচারার কতইনা জরুরী কাজ ছিল।
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত মিস মেইলিগুলি’ বলে উঠে দাঁড়াল হাসান তারিক। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল সে।
মেইলিগুলি হাসান তারিককে বিদায় দেবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার ফিরে দাঁড়ানো দেখে বলল, কিছু বলবেন?
-আপনি তিয়েনশান ভ্যালি থেকে কাশগড় আসার পথে জেনারেল বোরিসের সাথে তো একজন বন্দী দেখেছিলেন।
-হ্যাঁ, কেন?
-কেমন দেখেছেন তাকে, কেমন ছিলেন তিনি? হাসান তারিকের স্বরটা ভারি।
মেইলিগুলিও কৌতুহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল, মিঃ হাসান তারিক, আপনি কাকে খুজছেন, বন্দীকে না জেনারেল বোরিসকে?
-বন্দীকে। আর বন্দীকে পাবার জন্যেই খুঁজছি জেনারেল বোরিসকে।
মেইলিগুলি দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। বসে পড়ল। হাসান তারিককেও বসতে বলল।
-বন্দীটি কে মিঃ হাসান তারিক?
-আহমদ মুসা। ফিলিস্তিন বিপ্লব, মিন্দানাও বিপ্লব এবং মধ্য এশিয়া বিপ্লবের অধিনায়ক।
বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে রইল হাসান তারিকের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে। পরে সে চোখ দু’টি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
কিছুক্ষন পর চোখ খুলে সে সোজা হয়ে বসল। অনেকটা স্বগত কন্ঠেই বলল, আমি দেখেই তখন তাকে অসাধারন কেউ ভেবেছিলাম। ঠিক হলো আমার ভাবনা। অসাধারন না হলে ঐ অবস্থায় অত নিশ্চিন্ত কোন মানুষ হতে পারে না।
তারপর হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, একটা কথাই আমি ওর সাথে বলার সু্যোগ পেয়েছি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর কিছু বলার আছে কিনা কাউকে? কি জবাব দিয়েছিলেন জানেন? চিরদিন মনে থাকবে আমার সেই জবাবটা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, জাতির কাজে লাগার শক্তি আপনাকে আল্লাহ দিন।
-মিস মেইলিগুলি, ওঁর গোটা জীবন, ওঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, ওঁর ধ্যান, জ্ঞান সব দুনিয়ার মুসলমানদের জন্যে নিবেদিত। স্বাধীন ইসলামী বিশ্ব ওর সর্বক্ষনের স্বপ্ন।
-সেদিন যা দেখেছি, এত বড় একজন বিপ্লবী এত শান্ত, এত সৌম্যও হতে পারে।
-অবসরকালীন আহমদ মুসার ঐ রুপ ওটা। কিন্তু এ্যাকশনের সময় সে সিংহের মত সাহসি, নেকড়ের মত ক্ষিপ্র। যাক, মিস মেইলিগুলি, আমি জানতে চেয়াছিলাম, কেমন ছিলেন তিনি?
একটু দ্বিধা করে মেইলিগুলি বলল, ওঁর গোটা পোশাক আমি রক্তে ভেজা দেখেছি। ওঁর মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারিনি, মাঝে মাঝে ওঁকে ওঁর মাথা চেপে ধরতে দেখেছি।
হাসান তারিক মুখ নিচু করেছিল। অশ্রু গোপন করতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারলনা। দু’চোখ বেঁয়ে নেমে এলো অশ্রু।
মেইলিগুলি হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বিব্রত বোধ করল সে। জিজ্ঞেস করল, মিঃ হাসান তারিক, ওঁর সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
হাসান তারিক চোখটা ভাল করে মুছে নিয়ে বলল, ওঁর সংগ্রামের একজন সাথী আমি।
-আচ্ছা জেনারেল বোরিস কে?
-জেনারেল বোরিস ‘ফ্র’ এর নেতা এবং মধ্য এশিয়ার কম্যুনিস্ট গভর্ণর জেনারেল ছিলেন।
-এবার সব বুঝেছি মিঃ হাসান তারিক।
হাসান তারিক একটু ভাবল। তারপর বলল, জেনারেল বোরিসকে ট্রেস করার আর কোন পথ আছে মিস মেইলিগুলি? আমরা একটা ঠিকানা উদ্ধার করেছিলাম কাশগড় থেকে। কিন্তু কাশগড় থেকে সে সম্ভবত ঐ খবর পেয়ে যায়। আমরা উরুমচিতে পৌছার আগেই সে তার ঐ ঠিকানা বদলে ফেলেছে।
চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে মেইলিগুলি। সে চিন্তা করছিল। এক সময় খুশি হয়ে সে বলল, আপনি হোটেল সিংকিয়াং-এ খোঁজ নিন, একটা স্যুট ওর নামে ছিল, সেটা আছে কি না? আরেকটা জিনিস জেনারেল বোরিস আলেকজান্ডার বোরিসভ নামে এখানকার চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হয়েছে। আপনি সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন। তার সাথে যোগাযোগের ঠিকানা সেখানে কি দেয়া আছে। তাছাড়া এই শহরে সে নতুন এসেছে। নিশ্চয় সিটিজেন রেজিষ্টারে তার নাম উঠেছে। সেখানেও ঠিকানা থাকার কথা। এ খোঁজগুলো আপনি নিন। আমিও এ ব্যাপারে দেখব।
‘শুকরিয়াহ’ বলে হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল।
মেইলিগুলি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, প্রয়োজন হলেই আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, দ্বিধা করবেন না।
হাসান তারিক চলে গেলে মেইলিগুলি ফিরে এল তার চেয়ারে। কিন্তু আর কাজে মন বসাতে পারল না। বার বার তার ঐ অদ্ভুত বন্দীর কথাই মনে আসছে। আজকের মুসলিম জাতির মধ্যে এমন মানুষও আছে। মনে মনে হাসি পেল তার। থাকবে না কেন, না থাকলে ফিলিস্তিন, মিন্দানাও এবং মধ্য এশিয়ায় বিপ্লব হলো কেমন করে?
সামনের স্ক্রিপটা বন্ধ করে ফাইলে রেখে দিল ।
এ সময় একটা টেলিফন এল!
রিসিভার তুলে নিতেই ওপার থেকে কথা ভেসে এলো, গতকালের প্রস্তাব সম্পর্কে তুমি তো কিছু বললে না।
-সরি স্যার, একটু ব্যস্ত ছিলাম। ঐ বইয়ে আমি অংশ নিতে পারছি না।
-কেন, কেন?
-তিনটি এমন দৃশ্য আছে, যে দৃশ্যে আমি অভিনয় করি না, করব না।
-যেমন?
-আলিঙ্গন, পানির নিচে জলকেলি, গোসল করে উঠে ভিজা কাপড়ে নাচা।
-ঠিক আছে ও দৃশ্যগুলি বাদ যাবে।
-ধন্যবাদ স্যার।
ওপারে টেলিফোন রেখে দিল। মেইলিগুলিও টেলিফোন রেখে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এলো অফিস থেকে।

Top