মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সেই ঘোড়সওয়ার।
হাসান তারিক আব্দুল্লায়েভের দিকে তাকিয়ে বলল, ধূর্ত জেনারেল বোরিস চারজনকে সোজা পথটায় পাঠিয়ে উত্তরদিকের এ ঘোরা পথটা ধরেই কাশগড় গেছে।
সেই ঘোড়সওয়ারটি বলল, কিন্তু জনাব, আমরা সর্বক্ষন এ পথের ওপর চোখ রেখেছি, রাত তক এক বা একাধিক কোন ঘোড়সওয়ারই এ পথ দিয়ে যায়নি।
‘সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু জেনারেল বোরিস উত্তরের এ পথ ধরেই গেছে।’ বলে একটু থামল, একটু চিন্তা করল হাসান তারিক। তারপর উত্তরের পথ ধরে চলতে শুরু করল সে।
সেই থানার কাছাকাছি হাসান তারিকরা এসে পড়েছে। ওদিকে আলো দেখে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি? কোন বাড়ি?
-না ওটা থানা। আহমদ ইয়াং জবাব দিল।
থানার কথা শুনে হাসান তারিক থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল, জেনারেল বোরিসের হাতে মেইলিগুলি ছিল। প্রখ্যাত অভিনেত্রী সে, কিডন্যাপ হয়েছিল। পুলিশের সাহায্য সে পেতে পারে। জেনারেল বোরিস কি এরই সুযোগ গ্রহণ করেছে! কোন ঘোড়সওয়ার কাশগড় যায়নি। তার অর্থ ওরা কি এখনও থানায় থাকতে পারে? থানায় গিয়ে থানার প্যাঁচে আটকে পড়তেও তো পারে? একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা উঁকি দিল তার মনে।
হাসান তারিক একটু চিন্তা করল, তারপর আহমদ ইয়াং– এর দিকে চেয়ে বলল, থানায় একটু খোঁজ নেয়া যেতে পারে, আমার মনে হয় জেনারেল বোরিস এখানে আসতে পারে।
-তাহলে আপনারা দাঁড়ান, আমি খোঁজ নিয়ে আসি।
-ঠিক আছে, আমিও তোমার সাথে যাব। বলল হাসান তারিক
তারপর হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং দু’জনে থানার পথ ধরে এগিয়ে চলল। আহমদ ইয়াং আগে চলছে, পেছনে হাসান তারিক।
থানা প্রাচীর ঘেরা। সামনে লোহার বড় গেট। লোহার গেট ঘেঁষে ভেতরে একটা পুলিশ বক্স। ওখানে বন্দুকধারী একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। গেটের ডান পাশে জেনারেল বোরিসের রেখে যাওয়া সেই পাঁচটি ঘোড়া বাঁধা আছে তখনও।
আহমদ ইয়াং তখন গেটের কাছাকাছি পৌছেছে। হঠাৎ ঘোড়ারা হ্রেষা ধ্বনি করলে সে বাম দিকে চাইল। দেখল কয়েকটি ঘোড়া সেখানে বাঁধা। তাকে দেখে ঘোড়াগুলো পা ছুড়ছে এবং হ্রেষা ধ্বনি করছে।
আহমদ ইয়াং এর মনোযোগ ছিল গেটের দিকে, গেটের পুলিশের দিকে। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত সেদিকে চলল।
গেটের পুলিশকে দেখে আহমদ ইয়াং মনে মনে বেজার হলো। পুলিশটি হান গোষ্ঠীর। ওরা সিংকিয়াং-এর মূল বাসিন্দা মুসলমানদের ভালো চোখে দেখে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে ওদের বিপুল সংখ্যায় এনে সিংকিয়াং-এ বসানো হয়েছে। এ অঞ্চলের মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা পাল্টা শক্তি, এই মন্ত্র তাদের কানে দেয়া হয়েছিল। এটা তারা ভুলে যায়নি। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তারা শাসন করতেই এসেছে। এ ধারণা প্রকাশের কোন সুযোগই তারা ছাড়ে না।
আহমদ ইয়াং এসে দু’হাত গেটে রেখে গেট ঘেঁষে দাঁড়াল। সে জানে হানদের খুশী করতে হলে ওদের চীনা ভাষায় কথা বলতে হবে। আহমদ ইয়াং চীনা ভাষায় পুলিশটির প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলল, কোন মেহমান এসেছিল কি থানায়?
-কাদের কথা বলছ, মেইলিগুলি?
-রুশ কেউ?
-কয়েকজন রুশ মেইলিগুলির সাথেই এসেছিল। তাদের সাথে তোমার কি, কেন জিজ্ঞেস করছ?
-কিছু না খোঁজ করছি, ওরা আমাদের সাথী কিনা।
শেষ কথাটা শুনে পুলিশটি একটু খুশী হলো বলে মনে হলো। সাগ্রহে এবার বলল, মেইলিগুলিকে তোমরা কোথায় পেলে বলত? কি যে হয়রানী গেছে কয়দিন।
-পাহাড়ের পথে ওকে আমরা উদ্ধার করেছি।
-বড় ভাল মেয়ে তাই না, গোটা দেশে ও রকম একটি মেয়েও আমার চোখে পড়েনি। একেবারে সাক্ষাত পরী।
পুলিশের মুখে এবার কথার খই ফুটতে শুরু করেছে। আহমদ ইয়াং জানে মেইলিগুলির প্রসংগ নিয়ে কথা বললে ঘন্টাতেও শেষ হবে না। কিন্তু সময় নেই আহমদ ইয়াংদের। কথার মোড় ঘুরিয়ে সে বলল, ওরা এখন কোথায়?
-না ওরা সংগে সংগেই চলে গেছে। আমাদের সাহেব নিজে ওদের থানার গাড়িতে করে কাশগড় পাঠিয়ে দিয়েছে। ঐ দেখ ওদের ঘোড়া ওরা রেখে গেছে।
আহমদ ইয়াং ঘোড়াগুলোর দিকে ফিরে তাকালো। ঘোড়াগুলোর দিকে তাকাতে গিয়ে আহমদ ইয়াং আবার সেই দৃশ্যই দেখল, ঘোড়াগুলো তার দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে হ্রেসা রব করছে। ঘোড়াগুলোর এই আচরণে এবার বিস্মিত হলো আহমদ ইয়াং।
পুলিশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহমদ ইয়াং ঘোড়াগুলোর কাছে এল। পেছনে পেছনে হাসান তারিক।
ঘোড়াগুলোর কাছে এসে চক্ষু স্থির হয়ে গেল আহমদ ইয়াং–এর একরাশ বিস্ময় এসে যেন তার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিল। একি এ যে আমাদের ঘোড়া! সামনের দু’পায়ের সন্ধিস্থলে অস্পষ্টভাবে ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ এর প্রতীক রেড ক্রিসেন্ট আঁকা! ঘোড়াগুলোকে এবার স্পষ্ট চিনতে পারল আহমদ ইয়াং। আর চিনতে পারার সাথে সাথে এক অজানা আশংকায় গোটা দেহ শিউরে উঠল তার।
অভিভূতের মত এগিয়ে আহমদ ইয়াং একটি ঘোড়ার গায়ে হাত বুলাল।
ইতিমধ্যে গেটের পুলিশ ছুটে এল সেখানে। বলল, শুন, ঘোড়াগুলো ওরা কিন্তু আমাদের বড় সাহেবকে দিয়ে গেছে।
আহমদ ইয়াং একবার পুলিশের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। কাফেলার উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল আহমদ ইয়াং। তার পেছনে পেছনে হাসান তারিক।
চলতে চলতে বিস্মিত হাসান তারিক বলল, কি ব্যাপার আহমদ ইয়াং, ঘোড়াগুলোর ব্যাপারটা কি?
-তারিক ভাই, মনে হচ্ছে আমাদের একটা বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে।
-কি?
-‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় আপনাদের বিপ্লবের খবর পেয়ে গ্রুপের ডেপুটি লিডার উরুমচির হাজি সেলিম চ্যাং এর নেতৃত্বে একটা দল তাসখন্দের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল, এ ঘোড়াগুলো তাদেরই।
‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ চীনের বিশেষ করে সিংকিয়াং অঞ্চলের মুসলমানদের মুক্তিকামী একটা বিপ্লবী সংগঠন সাধারন মুসলমানদের কাছে এ সংগঠন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ নামে পরিচিত। নয় শ’ চৌত্রিশ খৃস্টাব্দে তিয়েনশানের এপারে পুর্ব তুর্কিস্তান অঞ্চলে ইসলাম প্রথম প্রবেশ করে। উইঘুর নেতা আবদুল করিম সাতুক বোগরা খান ইসলাম গ্রহণের পর পূর্ব তুর্কিস্থানে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই সাতুক বোগরা খানই চুরানব্বই খৃস্টাব্দে পূর্ব তুর্কিস্থানে ইসলামের প্রথম স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সে রাষ্ট্র ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার’ নামে অভিহিত ছিল। চীনের মুসলিম ভূখন্ডে কম্যুনিষ্ট নিপীড়ন শুরু হবার পর বিশেষ করে মাও এর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকালে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলুপ্তি হবার মুখে চীনের মুসলমানদের মুক্তির জন্যে লড়াইরত মুসলমানরা মুক্তির সম্মিলিত প্লাটফরম হিসেবে চীনের প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের নাম অনুসারে ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ নামে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করে। ‘ এম্পায়ার গ্রুপ’ আরো সংক্ষেপে ‘এম্পায়ার’ এখন চীনা মুসলমানদের প্রাণের সংগঠন। কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে আপোষহীন বিপ্লবী নেতা শহীদ ওসিমান এর ছেলে উরুমুচির ইউসুফ চিয়াং এখন ‘এম্পায়ার’ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন্ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ‘কালো দিন’ থেকে চীনা জনগণকে উদ্ধারকারী চীনের বর্তমান প্রশাসন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর অনেক দাবী ইতিমধ্যেই মেনে নিয়েছে। সংগঠনটি এখনও আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করছে। ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর প্রধান লড়াই কম্যুনিস্টদের আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ‘ফ্র’ এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্বংসাবিশিষ্ট ‘রেড ড্রাগন’ এর সাথে। চীনে ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগন’ কার্যত এক হয়ে এখন ‘ফ্র’ এর ব্যানারে কাজ করছে। সিংকিয়াং-এ তাদের এক নম্বর শত্রু মুসলমানরা এবং দু’নম্বর শত্রু হল নতুন চীন সরকার।
আহমদ ইয়াং এর কথা শেষ হলে একটু চিন্তা করে হাসান তারিক বলল, তারা যায়নি, এমনকি হতে পারে না?
-অসম্ভব। জেনারেল বোরিসের হাতে তাদের ঘোড়াগুলো পড়েছে এটাই প্রমাণ যে তারা গেছে।
হঠাৎ হাসান তারিকের মনে পড়ল পামিরে দেখা চীনা উইঘুর কাজাখদের দশটি লাশের কথা। সংগে সংগে হাসান তারিক দাঁড়িয়ে পড়ল। আহমদ ইয়াংও। হাসান তারিক বলল, ওরা কি দশজন ছিল?
-হ্যাঁ, দশজন, কেমন করে জানলেন আপনি?
-আমাদের চোখের দূর্ভাগ্য ইয়াং, আমরা তাহলে তাঁদের লাশই দেখে এসেছি পামিরে।
একটু ঢোক গিলে হাসান তারিক আবার বলতে শুরু করল, আমরা তখনই মনে করেছিলাম, ওদের ঘোড়া হাত করার জন্যেই ওদের হত্যা করা হয়েছে।
আহমদ ইয়াং দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল। তার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
ধীরে ধীরে হাসান তারিক কাঁধে হাত রাখল। বলল, চল ভাই, ওরা আমাদের প্রেরণা। শহীদের রক্ত আন্দোলনকে দুর্বল করে না, শক্তিশালী করে।
কান্না চেপে কম্পিত গলায় আহমদ ইয়াং বলল, তারিক ভাই, হাজী সেলিম ভাই যেদিন গেছেন, তার পরদিন তার প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম……
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ ইয়াং। কান্নায় জড়িয়ে গেল তার কথা।
হাসান তারিকের চোখটাও ভারী হয়ে উঠল। তবু আহমদ ইয়াংকে সান্তনা দিয়ে বলল, নিজের পুত্র, নিজের ভাই, নিজের স্ত্রী, নিজের আত্নীয় স্বজন সবার চেয়ে সেলিম ভাই যাকে বেশী ভালবাসতেন তার কাছেই তিনি গেছেন। ইয়াং, দু:খ করো না।
বলে হাসান তারিক আহমদ ইয়াং এর একটা হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল।
কাফেলায় ফিরে এল তারা। কাফেলা ছুটে চলল এবার কাশগড়ের দিকে।
কাশগড়ের কাছাকাছি এসে হাসান তারিক আবদুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াং বাদে অন্যদের অন্যপথ ধরে কাশগড় প্রবেশের নির্দেশ দিল, দলবেঁধে প্রবেশ সে ভাল মনে করল না। সে ধূর্ত জেনারেলকে কিছুতেই জানতে দিতে চায় না যে কেউ তাকে অনুসন্ধান করছে।
কাশগড়ে বিখ্যাত ইদগান মসজিদের উত্তর পাশে তিনতলা একটা বিল্ডিং এ ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর অফিস। কাশগড় এলাকার কাজ এখান থেকেই চলে।
অফিসের রেস্ট রুমে একটু গড়িয়ে নিল হাসান তারিক। অনেকদিন পর এই শয়ন। শোবার পর বুঝা গেল কি ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। শরীরের জোড়াগুলো যেন খুলে যাচ্ছে, বেদনায় শরীরটা ঝাঁঝরা।
নরম বিছানায় একটু আরাম বোধ হতেই মনে পড়ল আহমদ মুসার কথা। সংগে সংগে ভুলে গেল নিজের দেহের কথা। জেনারেল বোরিসের মত অমানুষের হাতে কেমন আছে সে? বিছানা থেকে উঠে বসল হাসান তারিক। ডাকল আবদুল্লায়েভ এবং আহমদ ইয়াংকে। আহমদ ইয়াং এর সাথে আলোচনা করল এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ‘ফ্র’ এর কর্মতৎপরতা নিয়ে, জানা গেল পুর্ব তুর্কিস্থান অর্থাৎ সিংকিয়াং এ ‘ফ্র’ এর হেড় কোয়ার্টার উরুমচি এলাকায়। খোটান, ইয়ারকন্দ, আলতাই, তুরপান থেকে উরুমচি পর্যন্ত শরহগুলোর সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় বাস। উরুমচির সাথে পনের দিনে একবার বিমান যোগাযোগ আছে।
সব শুনে হাসান তারিক বলল, আমার মনে হয় জেনারেল বোরিস আহমদ মুসাকে কাশগড়ে ইচ্ছা করে একদিনও রাখবেনা। যে শহর থেকে হুইরা মেইলিগুলিকে সরকারী তত্ত্বাবধান থেকে কিডন্যাপ করতে পারে, সে শহরে আহমদ মুসাকে রাখা নিরাপদ নয়।
একটু থেমে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, আমি কয়েকটা জিনিস জানতে চাই। উরুমচিতে বিমান ফ্লাইট কবে, উরুমচিতে বাস যাবার সবচেয়ে কাছের তারিখ কবে, উরুমচি যাবার প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।
আহমদ ইয়াং বলল, কাশগড়ে কোন প্রাইভেট গাড়ি মেলে না। আজ সকালে উরুমচিতে একটা ফ্লাইট গেছে। আগামী কাল উরুমচির উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ার দিন।
একটু চিন্তা করল হাসান তারিক। তারপর বলল, তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। আমরা যোহরের নামায পড়ে প্রথমে বিমান অফিস, তারপর বাস অফিসে যাব।
তারা যোহর নামায পড়ল ইদগান মসজিদে। কাশগড়ের সবেচেয়ে বড় মসজিদ। পনের হাজারেরও বেশি লোক এখানে একসাথে নামায আদায় করতে পারে। পাথরের দেয়াল। লক্ষণীয় মেহরাব এবং দেয়ালের বরাবর নিচের অংশটা খালি, সিমেন্ট বের হয়ে আছে।
হাসান তারিকের পাশে আহমদ ইয়াং নামায পড়ছিল। নামাযের ফাঁকে আহমদ ইয়াং কার্পেটের একটা অংশ উঠিয়ে দেখাল, মসজিদের মেঝেও এবড়ো থেবড়ো। আহমদ ইয়াং বলল, দেয়াল এবং মেঝে শ্বেত পাথরে আবৃত ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় কম্যুনিষ্টরা সব খুলে নিয়ে গেছে। মসজিদে ঝাড়বাতি ছিল, মূল্যবান কাঠের জানালা কপাট সবই ওরা নিয়ে যায়। বহুদিন মসজিদ জানালা কপাটহীন উন্মুক্ত ছিল। কুকুর বিড়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল মসজিদ।
-কেন নামায হতো না মসজিদে? জিজ্ঞেস করল হাসান তারিক।
-প্রকাশ্যে মসজিদে আসার সাধ্য তখন কারো ছিলনা। মসজিদের ইমাম মুফতি হাজী ইউনুস এবং মুয়াজ্জিন হাজী ওয়াংকে যেদিন ওরা শ্রম-শিবিরে নিয়ে গেল, সেদিন থেকে কার্যত মসজিদে নামায বাদই হয়ে যায়।
-ওরা এখন কোথায়?
-হাজী ইউনুস এবং ওয়াং?
-হ্যাঁ।
-ওরা আর ফিরে আসেননি। শুনেছি অমানুষিক পরিশ্রম এবং রোগে ভূগে শ্রম শিবিরেই মারা গেছেন।
-এখনকার ইমাম ইনি কে?
-হুজুর হাজী ইউনুসের ভাতিজা।
তখন ইনি কাশগড়ের মাদ্রাসাতুল হাদিসের ছাত্র ছিলেন। তাঁকে পাঁচ বছর দাস শিবিরে কাটাতে হয়। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি ছাড়া পেয়েছেন।
এ সময় ইকামত শুরু হলো। সবাই ফরজ নামাজ আদাযের জন্য উঠে দাঁড়াল।
নামায শেষে হাসান তারিক, আবদুল্লায়েভ এবং আহমদ ইয়াং বিমান অফিসে এল বিমান অফিস শহরের এক প্রান্তে। বিমান বন্দরের সাথে সংলগ্ন। দু’তলা বিল্ডিং।
বিমান অফিসের বুকিং কাউন্টারে ঢুকতে ঢুকতে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, দু’টো খোঁজ নিতে হবে। এক, আজকের সকালের ফ্লাইটে কারা গেছে তাদের নাম। দুই, কি কি লাগেজ বুক হয়েছে তার তালিকা।
বুকিং অফিসে ঢুকে ‘অনুসন্ধান’ ট্যাগ আটা কাউন্টারে গিয়ে আহমদ ইয়াং বলল, আমি আমার একজন আত্নীয়ের সন্ধান করছি, আজকের ফ্লাইটে যারা উরুমচি গেছে তাদের একটা তালিকা এবং লাগেজের একটা বিবরণী চাই।
অফিসারটি হান গোষ্ঠীর। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এ এক বিরাট ফিরিস্তির ব্যাপার। আমার এটা কাজও নয়।
কাউন্টার থেকে ফিরেই অফিসের একজন মেসেঞ্জারকে পেল। বয়স বিশ একুশ হবে। জাতিতে উইঘুর-মুসলমান। খুশী হল আহমদ ইযাং। সে তাকে জিজ্ঞেস করল, অফিসের বুকিং ইনচার্জ কে?
-কেন?
-আজকের ফ্লাইটের যাত্রী ও লাগেজের একটা তালিকা চাই।
-এ ধরনের তালিকা বাইরে দেয়ার নিয়ম নেই। একটু চিন্তা করে জবাব দিল যুবকটি।
-কিন্তু আমার যে জরুরী প্রয়োজন। জোর দিয়ে বলল আহমদ ইয়াং।
যুবকটি আহমদ ইয়াং-এর দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর তাদেরকে নিয়ে সে ওয়েটিং কর্ণারে এল। বসার পর যুবকটি চুপি চুপি বলল, একটাই পথ খোলা আছে। বুকিং ইনচার্জ হান জাতের একজন অফিসার। ঘুষখোর। আপনারা একজন তার রুমে যান। প্রথমে একটা মানিব্যাগ তার হাতে তুলে দিয়ে তার কাছে সাহায্য চাইবেন। আমার ধারণা কাজ হবে।
যুবকটির পরামর্শ কাজে লাগল। দশ মিনিট পর আহমদ ইয়াং যাত্রী ও লাগেজ তালিকার কপি নিয়ে বের হয়ে এল।
অফিস থেকে বেরুবার সময় আহমদ ইয়াং সেই মেসেঞ্জার যুবকটির হাতে পঞ্চাশ ইউয়ানের একটা নোট গুজে দিল।
যুবকটি বিনীতভাবে সেটা ফিরিযে দিয়ে বলল, আমি গরীব, কিন্তু এ টাকা নেয়ার আমার জন্য অন্যায় হবে। ঘুষ নেয়াকে আমার হুজুর বড় পাপ বলেছেন।
-তোমার হুজুর কে?
-আরতোশের হুজুরের কাছে আমি মাসে একবার কুরআন শেখার জন্য যাই।
আরতোশ কাশগড়ের কাছেই ছোট একটা শহর। কাশগড়ের চেয়েও প্রাচীন। এখানেই পূর্ব তুর্কিস্তানের প্রথম স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল করিম সাতুক বোগরা খানের মাজার। মাজার সংলগ্ন প্রাচীন একটা মসজিদ আছে সেখানে। বৃদ্ধ শেখ জামীরুদ্দীন সেখানকার ইমাম। তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসাও চালান। কোরআন-হাদীসে গভীর জ্ঞান ও পবিত্র চরিত্রের জন্যে তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে কুরআনের তাফসীর শুনতে যায়। গভীর রাতে তাঁর এ কুরআনের দরস শুরু হয়।
যুবকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসান তারিকরা বেরিয়ে এল বিমান অফিস থেকে। আসার সময় আহমদ ইয়াং যুবকটির পরিচয় জেনে নিল।
তারা ভাড়া করা একটা বেবী ট্যাক্সী নিয়ে বেরিয়েছিল। গাড়িতে ওঠার সময় হঠাৎ পেছনে নজর যাওয়ায় হাসান তারিক দেখল, অনুসন্ধান কাউণ্টারের সেই হান যুবকটি অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেসেঞ্জার যুবকটির সাথে আলাপ করছে। গাড়িতে ওঠা হলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
বেবী ট্যাক্সীতে মুখোমুখি চারটি সিট। হাসান তারিক বসেছিল সামনের সিটে। অর্থাৎ তার নজর ছিল পেছনের দিকে।
গাড়ি একটা টার্ন নেবার সময় হাসান তারিকের নজর আবার পেছনে গেল। সে দেখল, অনুসন্ধান কাউন্টারের সেই যুবকটি একটা বেবী ট্যাক্সীতে উঠছে। বেবী ট্যাক্সীটি নতুন। সামনের নাম্বার প্লেটে লাল অক্ষরে বড় বড় করে ৯৯’লেখা। চীনে এ এলাকায় সামনে পিছনে দু’দিকেই নাম্বার থাকে।
হাসান তারিক আহমদ ইয়াং এর কাছ থেকে বিমানের যাত্রী ও লাগেজ তালিকা নিয়ে ওতে নজর বুলাতে লাগল।
যাত্রী তালিকায় জেনারেল বোরিসের নাম পাবে না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। একটা সোভিয়েত নাম সে খুঁজছিল তাও পেল না। হতাশ হয়ে হাসান তারিক লাগেজের তালিকাটা তুলে নিল। লাগেজ তালিকায় সর্বশেষ আইটেমটি ছিল একটা কফিন। আশার একটা আবেশ ফুটে উঠল হাসান তারিকের চোখে। সে দ্রুত যাত্রী তালিকা তুলে নিয়ে সর্বশেষ নামটির দিকে চোখ বসাল। নামটি ইংলিশ-আলেকজান্ডার। হঠাৎ হাসান তারিকের মনে হল আলেকজান্ডার নাম ইউরোপে কমন। সোভিয়েতেও এ নাম আছে। খুশী হলো হাসান তারিক। আলেকজান্ডার যদি জেনারেল বোরিস হয় তাহলে তার ঐ কফিনে আহমদ মুসাকে পাচার করা যেতে পারে।
হাসান তারিকদের গাড়ি এসে দাঁড়াল বাস অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সবাই ঢুকে গেল অফিসের ভেতরে।
অফিসের ওয়েটিং রুমে পায়চারী করছিল হাসান তারিক। হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ যেতেই তার নজরে পড়ল, সেই ৯৯নং বেবী ট্যাক্সীটি রাস্তার ওপারে একটা ব্যাংকের পার্ক ষ্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে এবং ‘অনুসন্ধান’ কাউন্টারের সেই যুবকটি গাড়ির ভেতর বসে তাদের বেবী ট্যাক্সীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মনটা ছ্যাঁত করে উঠল হাসান তারিকের। ও কি ফলো করছে আমাদের?
এই সময় আহমদ ইয়াংরা অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। হাসান তারিক ইতিমধ্যেই একটা প্ল্যান দাঁড় করিয়েছে।
হাসান তারিক আবদুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াংকে এক পাশে ডেকে বলল, মনে হচ্ছে একটা ফেউ লেগেছে আমাদের পেছনে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।
হাসান তারিক একটু থামল। দ্রুত গাড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আসার পথে রাস্তায় একটা সিনেমা হল দেখলাম। ওখানে ইভিনিং শো শুরু হচ্ছে বেলা তিনটায়। তোমরা এখান থেকে সোজা গিয়ে হলে ঢুকবে। ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে বাসায় ফিরবে।
-আপনি? আহমদ ইয়াং জিজ্ঞেস করল।
-আমি ঐ ফেউকে পরখ করে দেখতে চাই।
নির্দেশ মোতাবেক আব্দুল্লায়েভ আহমদ ইয়াংকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হাসান তারিক জানালা দিয়ে দেখল, আবদুল্লায়েভদের চলে যাবার পর সেই ‘ফেউ’ বেবী ট্যাক্সীটিও চলতে শুরু করল।
ওরা চলে গেলে হাসান তারিকও আরেকটি বেবী ট্যাক্সী নিয়ে সেই সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই হলের সামনে বেশ ভীড়। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসান তারিক দেখল আবদুল্লায়েভরা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়ে হলে ঢুকে গেল! আর সেই ‘ফেউ’ যুবকটি মানিব্যাগ বের করে টাকা গুণল। তারপর কি ভাবল। যে দরজা দিয়ে আবদুল্লায়েভরা হলে ঢুকেছে সেদিকে একবার তাকাল। পরে হল থেকে বেরিয়ে হন হন করে গিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছেড়ে দিল তার।
হাসান তারিকও এসে গাড়িতে উঠল।
বেশী দূর যেতে হলো না। মাইল খানেক গিয়েই একটা আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করল। দু’পাশে ফ্লাট বাড়ির সারি। অনেক খানি দূরত্ব রেখে হাসান তারিকের গাড়ি এগুচ্ছিল। একটা চারতলা ফ্লাট বাড়ির সামনে গিয়ে আগের বেবী ট্যাক্সীটি দাঁড়াল।
হাসান তারিক দেখল, বাড়িটির চার তলায় ষোলটি ফ্লাট আছে। সবগুলোই এক রুমের ব্যাচেলর কোয়ার্টার।
ফেউ’যুবকটি যখন ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়িতে গিয়ে পা দিয়েছে সেই সময় হাসান তারিকের গাড়ি গিয়ে ফ্লাটের সামনে দাঁড়াল।
হাসান তারিক ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। হাসান তারিক গাড়িতে উঠার পর তার সব সময়ের সাথী ব্যাগ থেকে গোঁফ বের করে মুখে লাগিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং তাকে কেউ হঠাৎ করে দেখেই চিনতে পারবে না।
সে যুবকটি বেশ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আর হাসান তারিক বিড়ালের মত নিঃশব্দে তার পিছু নিয়েছে।
চার তলায় গিয়ে ফেউ যুবকটির পায়ের শব্দ থেমে গেল। হাসান তারিক উঁকি দিয়ে দেখল, সিঁড়ির বাম পাশের ফ্ল্যাটের সামনে যুবকটি দাঁড়িয়ে। আরেকটু উঠে উঁকি দিল। দেখল, ঐ ফ্ল্যাটের দরজার কি হোলে চাবি দিয়ে ঘুরাচ্ছে সে। দরজা খুলে গেল। যুবকটি ভেতরে প্রবেশ করলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে কি হোলে চাবি দেয়ার একটা ক্লিক শব্দও পাওয়া গেল।
হাসান তারিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা ও কি হোল ভাল করে দেখল। মনে মনে ভাবল, সে ভেতরে প্রবেশ করবে। ব্যাচেলর ফ্ল্যাট। যুবকটি একাই রয়েছে। ইচ্ছা করলে এখনই প্রবেশ করে প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু না, এখানকার ‘ফ্র’ এবং জেনারেল বোরিসকে সে এখনই জানতে দিতে চায় না যে কেউ তার পেছনে লেগেছে। নরপশু জেনারেল বোরিস তাহলে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে আহমদ মুসার উপর কোন জঘন্য প্রতিশোধ নিয়ে বসতে পারে।
হাসান তারিক ধীরে ধীরে চারতলা থেকে নেমে এল।
সে গাড়িতে উঠে বসলে গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িতে বসে হাসান তারিক হিসেব কশল, যুবকটি কাজ অর্ধ সমাপ্ত রেখে সম্ভবত টাকার ঘাটতি থাকায় বাড়িতে ফিরে এসেছে। শো ভাঙ্গার আগে অবশ্যই সে ফিরে আসবে যাতে করে ওদের অনুসরণ করে ঠিকানাটা জেনে নিতে পারে। যুবকটি যখন দ্বিতীয়বার এই কাজে বেরুবে, সেই সুযোগেই তার ঘরে প্রবেশ করতে হবে।
সেই সিনেমা হলে আবার ফিরে এল হাসান তারিক। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আবদুল্লায়েভদের বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। সেই ফেউ যুবকটি আসে কখন সেদিকেও তার নজর থাকল।
ঘন্টা খানেক পর আবদুল্লায়েভরা বেরিয়ে এলে হাসান তারিক তাদেরকে বাথরুমের দিকে ডেকে নিয়ে শো শেষ হওয়া পর্যন্ত হলে থাকতে বলল। শো শেষ হলে তবেই তারা যেন বের হয়।
আবদুল্লায়েভরা গোঁফওয়ালা হাসান তারিককে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। চিনতে পেরে নিজেদের বোকামীর জন্যে হেসেছে। আর হাসান তারিক খুশী হয়েছে এই ভেবে যে তার গোঁফ পরা সফল হয়েছে।
আবদুল্লায়েভরা আবার হলে ঢুকে গেল।
হাসান তারিককে আরও আধা ঘন্টা ভীড়ের মধ্যে অপেক্ষা করতে হল। তখন সাড়ে চারটা বাজে। সিনেমা হলের বিপরীত দিকে একটা দোকানের পাশে সে দাঁড়িয়েছিল। শব্দ করে একটা বেবী ট্যাক্সী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়াতে দেখে ওদিকে তাকাল হাসান তারিক। দেখল, সেই যুবক বেবী ট্যাক্সী থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে হলে উঠে গেল।
হাসান তারিক আরেকটা বেবী ট্যাক্সী নিয়ে এগিয়ে চলল সেই রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে।
খুবই সাধারণ ধরনের লক। সাধারণ মাষ্টার কি’তেই খুলে গেল।
মাষ্টার কি টা পকেটে রেখে এক হাতে ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটর, অন্য হাতে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল হাসান তারিক।
হাতের ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটরটা শান্ত। গোটা ঘরটা একবার ঘুরে এল। নিশ্চিত হল সে, না কোথাও ইলেক্ট্রিক ট্র্যাপ নেই।
ঘরটা একেবারেই সাদামাটা গোছের। একটা শোবার খাট। একটা টেবিল, একটা চেয়ার। একটা ওয়্যারড্রোপ। রান্না ঘরে একটা গ্যাস ষ্টোভ। ট্রাংক, সুটকেস, ব্রিফকেস কিছুই নেই। হতাশ হল হাসান তারিক। যুবকটি নিশ্চয় সাধারণ ইনফরমারের বেশী কিছু নয়!
টেবিলটা শুন্য। টেবিল ক্লথের নিচটাও শুন্য। টেবিলের ড্রয়ারে কয়েকটা ইউয়ান পড়ে আছে মাত্র। ড্রয়ারের ফ্লোরে একটা সাদা কাগজ বিছানো। চীনা এয়ারলাইন্সের প্যাডের একটা পাতা বেশ পুরানো। হাসান তারিক বুঝল, ড্রয়ারের কভার হিসেবে অনেক দিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দু’টো টেলিফোন নাম্বার লেখা দেখল। লেখা পুরানো, কালি বেশ ফেড হয়ে গেছে চার ডিজিটের নাম্বার। কাশগড়ের নাম্বার তিন ডিজিটের। তাহলে নাম্বারটা কাশগড়ের বাইরের। কাজে লাগতে পারে ভেবে নাম্বার দু’টো টুকে নিল হাসান তারিক।
ওয়্যারড্রোপ খুলল। তাতেও কিছু নেই। কয়েকটা জামা কাপড়। খুব ভালো করে পরীক্ষা করল, না কোন গোপন কেবিনও কোথাও নেই!
বালিশের নিচটা, তোষকের নিচটা সবই পরীক্ষা করল। না কিছুই কোথাও নেই।
হতাশ হলো হাসান তারিক। তাহলে সেকি একটা বাজে চুনোপুটির পিছনে ছুটে সময় নষ্ট করল!
কিচেনটা একবার দেখবে বলে ওদিকে পা বাড়াল, এমন সময় বাইরে থেকে দরজার তালা খোলার শব্দ হল। হাসান তারিক দ্রুত সরে গেল কিচেনে। পকেট থেকে রিভলবারটা হাতে তুলে নিয়েছে সে।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একটি মেয়ে। বয়স বিশ বাইশ বছর হবে।
চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে মেয়েটির দিকে নজর রেখেছিল হাসান তারিক। মেয়েটির ঘরে ঢুকার ভাব দেখে হাসান তারিক বুঝল, মেয়েটি এ ঘরের পরিচিত।
মেয়েটি ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় এসে বসল। জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট এক টুকরা কাগজ বের করল। তারপর বিছানা থেকে বালিশটি তুলে নিয়ে কভারটি খুলে ফেলল। বালিশের মাঝখানের সেলাইটি ফাঁক করে সেই কাগজের টুকরাটা বালিশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বালিশের কভার পরিয়ে যথাস্থানে রেখে যেমনভাবে এসেছিল ঠিক তেমনভাবে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
হাসান তারিক কিচেন থেকে বেরিয়ে দরজা লেগেছে কিনা দেখে এল। তারপর দরজা থেকে ফিরে এসে বালিশ থেকে সেই কাগজ বের করল সে। চীনা ভাষা্র একটা চিরকুট। চীনা ভাষা সে জানে না, মুশকিলে পড়ল সে। এখন এ চিরকুট না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু নিয়ে গেলে তার এখানে আগমন ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এছাড়া উপায় কি!
হাসান যখন রুম থেকে বেরিয়ে এল তখন বাজে সোয়া পাঁচটা। সিনেমা শো ভাঙ্গতে তখন পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকী।
হাসান তারিক ফিরে এল সেই সিনেমা হলের সামনে আবার।
ঠিক ছয়টার সময় বেরিয়ে এল আবদুল্লায়েভরা হল থেকে। হাসান তারিক লক্ষ্য করল তাদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল সেই ‘ফেউ’ যুবক!
হাঁটতে হাঁটতে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, ফেউ আমাদের পেছনে লেগেছে ও আমাদের আস্তানা দেখে তবেই ছাড়বে। আমরা তার উদ্দেশ্য সফল হতে দিতে পারি না।
একটু থেমে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, আরতোশ এখান থেকে কতদূর।
-পাঁচ মাইল।
-চল আরতোশ যাব, আবদুল করিম বোগরা খানের কবর জেয়ারত করে এশার দিকে ফিরে আসব। ইতিমধ্যে কেউ পিছু না ছাড়লে তার একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
একটা বেবী ট্যাক্সি নিয়ে আরতোশের দিকে ছুটল হাসান তারিকরা। গাড়িতে ওঠার সময় হাসান তারিক লক্ষ্য করল ‘ফেউ’ যুবকটি একটা বেবীতে উঠে বসছে।
আরতোশ শহরটি কাশগড় থেকে উত্তর পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় একটা বিখ্যাত ঝরণার পাশে।
সোয়া ছয়টার দিকে হাসান তারিকদের বেবী ট্যাক্সি শহর থেকে বেরিয়ে এল। ‘ফেউ’ এর বেবী ট্যাক্সি তখন পর্যন্ত সমান গতিতে তাদের পেছনে ছুটে আসছে। কিন্তু শহর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর বেবী ট্যাক্সিটি আর কেউ দেখতে পেল না। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন নেমে এসেছে। নিশ্চয় ‘ফেউ’ যুবকটি এই রাতের বেলা শহর থেকে বাইরে অনিশ্চয়তার পথে তাদেরকে অনুসরণ করতে সাহস পায়নি। হাসান তারিক হাফ ছেড়ে বাঁচল। অহেতুক একটা চুনোপুঁটিকে মেরে চারদিকে সাড়া জাগাতে চায় না, জেনারেল বোরিসদের সাবধান করে দিতে চায় না।
চলতে চলতে আব্দুল্লায়েভ জিজ্ঞেস করল, কিছু পেলেন তারিক ভাই?
-পেয়েছি। মুসা ভাইকে ওরা আজ সকালের ফ্লাইটেই উরুমচি নিয়ে গেছে।
-আর যে নতুন মিশনে গিয়েছিলেন সেখানে?
-‘ফেউ’ এর ওখানকার কথা বলছ?
-হ্যাঁ।
-শুরুতেই সন্দেহ হয়েছিল ও বোরিসের লোক, ‘ফ্র’ এর এজেন্ট, ঠিক তাই। ওর প্রত্যেক জামার কলারেই ‘ফ্র’ এর প্রতীক দেখেছি! তবে বিশেষ কিছু পাইনি। একটা চীনা ভাষার চিরকুট পেয়েছি। জানি না ওতে কি আছে।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসান তারিকরা আরতোশে পৌঁছাল। বেবী ট্যাক্সিকে অপেক্ষা করতে বলে তারা তিনজন ওজু খানায় ওজু করে বোগরা খান মসজিদে ঢুকে গেল। মসজিদের পাশেই কবর গাহ।
প্রথমে ওরা কবরগাহে গিয়ে দোয়া করল। অলঙ্কার বিহীন সাদা-সিদা কবর গাহ। বিল্ডিংটা জরাজীর্ণ। চারিদিকে লোহার রেলিং। মাঝে মাঝে ভেঙ্গে গেছে। ভেঙ্গে যাওয়া অংশ কাঠ লাগিয়ে পুরণ করা হয়েছে।
বোগরা খান মসজিদের অবস্থাও কবর গাহের মতই। দেয়ালের পাথরগুলো হা করে আছে। কোথাও কোথাও গর্ত হয়েছে। মসজিদের মেঝে এবড়ো-থেবড়ো। মসজিদের উঁচু মিনার দেখার মত, কিন্তু তার একাংশ ভেঙে গেছে। এখন মিনারে উঠে আর আযান দেওয়া হয় না। ওঠা বিপজ্জনক। ওখানে মাইকের হর্ণ লাগানো আছে। নিচে থেকে আযান হয়। মাইকের হর্ণটি নতুন, মাইকও নতুন। আহমেদ ইয়াং জানাল, মাইকটি অতি সম্প্রতি লেগেছে। এতদিন জোরে আযান নিষিদ্ধ ছিল। আর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তো আযান এবং নামাযও বন্ধ ছিল।
এশার নামায হাসান তারিকরা মসজিদেই পড়ল। বোগরা খান মসজিদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জিনিস গোটা মসজিদ জুড়ে থাকা লাল কার্পেট। ঠিক এ ধরনের কার্পেট হাসান তারিক কাশগড়ের ঈদগান মসজিদেও দেখেছে। হাসান তারিক আহমেদ ইয়াংকে জিজ্ঞেস করল, মসজিদের অবস্থার সাথে কার্পেট তো মিলে না?
আহমেদ ইয়াং বলল, ঠিক বলেছেন, মসজিদ চীনের কিন্তু কার্পেটগুলো চীনের নয়। ওগুলো সম্প্রতি মক্কা থেকে এসেছে। মক্কার রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী সম্প্রতি এ কার্পেটগুলো দান করেছে। সিংকিয়াং এর সব মসজিদেই এ রকম কার্পেট দেখতে পাবেন। ওরা আমাদের ইসলামী সমিতির (সরকার নিয়ন্ত্রিত) কাছে মসজিদ সমূহ সংস্কারের জন্যে অর্থ সরবরাহেরও অফার দিয়েছে। আগে তো মসজিদ সংস্কারের অনুমতি ছিল না। এখন কিছু কিছু মিলছে। এখন যদি সরকার রাবেতার সাহায্য নেয়ার অনুমতি দেয়, তাহলে মসজিদগুলোর দুঃসময় হয়তো কাটতে পারে।
নামায শেষে আহমেদ ইয়াং মসজিদের শেখ জামিরুদ্দিনের সাথে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভকে পরিচয় করিয়ে দিল।
বৃদ্ধ শেখ জামিরুদ্দিন তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে কেউ নেই দেখে বলল, বাবা, সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার মুক্তির খবর পেয়ে সেদিন কেঁদেছি আর প্রাণ ভরে দোয়া করেছি। এ ভাগ্য যেন আল্লাহ্ আমাদেরকেও দান করেন।
অনেক কথা হল শেখ জামিরুদ্দিনের সাথে। কিছু না খেয়ে আসতেই দিল না।
বিদায়ের সময় মসজিদের দিকে চেয়ে শেখ জামিরুদ্দিন বলল, মসজিদের এই বিধ্বস্ত দশা দেখে অনেক সময় দুঃখ হয়, কিন্তু যখন ভাবি মুসলিম সমাজের চেয়ে মসজিদ ভালো হবে কি করে, তখন অন্তরে বল পাই, কাজ করার শক্তি পাই। মুসলিম সমাজকে ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করতে পারলে তবেই মসজিদকে তার আপন জায়গায় বহাল করা যাবে।
হাসান তারিক বলল, ঠিক বলেছেন। মসজিদ হলো মুসলিম সমাজের স্বাধীনতার প্রতীক। মুসলিম সমাজের স্বাধীনতা না থাকলে মসজিদও অক্ষত থাকে না। আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দোয়া করুন, মুসলিম সমাজ এবং মসজিদ যেন তাদের হারানো দিন ফিরে পায়, যেদিন আবদুল করিম সাতুক বোগরা খান একদিন এদেশের মুসলমানদের জন্য এনেছিলেন।
হাসান তারিকরা বিদায় নিল শেখ জামিরুদ্দিনের কাছ থেকে।
ছুটে চলল তাদের ট্যাক্সি কাশগড়ের উদ্দেশ্যে। হাসান তারিক নামাযের ফাঁকে সেই চীনা ভাষার চিরকুটটি পড়ে নিয়েছে আহমেদ ইয়াং এর কাছ থেকে। ওতে উরুমচির একটা ঠিকানায় টেলেক্স করতে বলা হয়েছে। টেলেক্সে বলতে বলা হয়েছে যে, তিয়েনশানের ওপার থেকে দু’জন সন্দেহ জনক ব্যক্তি হুইদের সাথে কাশগড়ে আজ বেলা দশটায় প্রবেশ করেছে।
হাসান তারিক খুশী হয়েছে। উরুমচির ঠিকানাটা নিশ্চয় জেনারেল বোরিস কিংবা ‘ফ্র’-এর হবে।
বেবী ট্যাক্সি পাথুরে মরু পথের মধ্য দিয়ে ছুটছে কাশগড়ের দিকে পূর্ণ বেগে।
হাসান তারিক অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বলল, আপাতত কাশগড়ের কাজ শেষ। তারপর আহমেদ ইয়াং এর দিকে ফিরে বলল, যাবার পথেই আমরা বাস অফিস থেকে আগামীকাল সকালের জন্য উরুমচির তিনটা টিকিট করে নিয়ে যাব। প্রস্তুত আছ তো?
আহমেদ ইয়াং মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »