৪
কয়দিন কাটল তার কোন হিসেব আহমেদ মুসার কাছে নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। পাথরের মেঝে, পাথরের দেওয়াল। অনেক উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। ওখানে মাঝে মাঝে একটা আবছা আলোর রেখা ফুটে ওঠে। আহমদ মুসা এখন বুঝেছে, ঐ আবছা আলোর রেখাটা দিনের লক্ষণ। যখন আবছা আলোটা থাকে না তখন রাত। এটা বুঝার পর আহমেদ মুসা আনন্দিত হয়েছে এই ভেবে যে, অন্তত রাত দিনের হিসেবটা সে রাখতে পারবে।
রাত দিনের পরিবর্তন বুঝার পর আহমদ মুসা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একটা সময় ঠিক করে নিয়েছে। হাত মুখ ধোয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। গোসল কবে থেকে নেই তার মনে পড়ে না। অন্ধকার মেঝের এক কোণায় একটা মাটির ছোট কলস আছে। টিনের মগ দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারে হাতড়ে ঐ মগ দিয়েই সে পানি খায়। মুখটা ধুয়ে নেয় মাঝে মাঝে। এই ঘরের সাথেই লাগানো একটা খুপরীতে পায়খানার জায়গা। সেখানেও পানির রেশন। প্রতিদিনের জন্যে এক মগ পানি বরাদ্দ।
ঘরের এক পাশে একটা খাটিয়া। কাঠের। কম্বল বিছানো। আরেকটা কম্বল আছে গায়ে দেবার। শীতটা যেন একটু বেড়েছে। সে বুঝতে পারে না, তার শরীর খারাপ না আবহাওয়ার পরিবর্তন। আবহাওয়ার পরিবর্তন কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে কি স্থান পরিবর্তন? সে কাশগড়ে এসেছে, এতটুকু সে জানে। কিন্তু কাশগড়ে তো এই শীত হবার কথা নয়! কোথায় সে তাহলে? মনে আছে সেদিন রাতে জেনারেল বোরিস তাকে একটা ইনজেকশন দেয়। ইনজেকশনের পর রাজ্যের ঘুম এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কি ঘটেছে কিছুই তার আর মনে নেই। সেই ঘুমানোর পর এই অন্ধকার ঘরেই সে চোখ মেলেছে।
পূর্ব, পশ্চিম কিংবা কেবলা কোন দিকে কিছুই তার জানা নেই। পাথরের দেয়ালে তায়াম্মুম করে মনে মনে একদিকে কেবলাকে ধরে নিয়ে সে নামায আদায় করে।
যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার, তেমনি নিঃসীম নিশব্দ চারদিক। এক অন্ধকার ছাড়া চোখ তার কিছু দেখে না। জীবনের একটা স্পন্দন হলো শব্দ, এ শব্দও তার কানে আসে না। ঘরটা কি তাহলে মাটির নীচে? জীবনের স্পন্দনহীন নিরব-নিথর অন্ধকারে মাঝে মাঝে নিজেকে অশরীর মনে হয়। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার ভয় ও রোমাঞ্চের কথা। দাদির কোলে বসে ভূতের গল্প শুনত সে, ভালো লাগত। অন্ধকারকে দারুণ সে ভয় করত। এমনকি অন্ধকার ঘরে ঢুকতেও সে ভয় পেত। তার আম্মা দাদির কাছে এসে অনুযোগ করতেন, আম্মা আপনার নাতি কিন্তু দেখবেন ভীতু হবে।
-কেন, কেন? দাদি বলতেন।
-আপনার কাছে ভূতের গল্প শুনে শুনে এখন তো সব জায়গায় ভূত দেখে।
তার আম্মার কথা শুনে দাদি হাসতেন। তাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথা নেড়ে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে বলতেন, তুমি কিছু ভেব না বৌমা, আমার এ ভাইটি আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। বড় হলে বাহাদুর হবে।
দাদির কথা শুনে তার আম্মার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তার আম্মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আম্মা দোয়া করবেন আমার আহমদের জন্যে। যেন সে আমাদের নাম রাখে, জাতির মান রাখে।
কোথায় গেল সেই দিন। সেই দাদি, সেই আম্মা কোথায়, তাদের বুক ভরা সেই ভালবাসা কোথায়? চোখের কোণ দু’টি ভারি হয়ে ওঠে আহমেদ মুসার। তার দাদি, তার মায়ের কবরও সে আর কোনদিন কি দেখতে পাবে? পাবে না।
কমিউনিষ্ট বাহিনী ওখানে হয়তো প্রস্রাব পায়খানার জায়গা তৈরী করেছে। মুসলমানদের যা কিছু পবিত্র তাকে অপবিত্র করাই ছিল ওদের প্রথম কাজ। মুসলমানদের কবর গাহ ওদের হিংসার আগুন থেকে বাঁচবে কেমন করে?
অবসর ও একাকিত্বের সুযোগ গ্রহণ করে কত কথা, কত ঘটনা রূপ ধরে তার সামনে এসে দাড়ায়। বাইরের দু’চোখ বন্ধ করলে নাকি মনের চোখের গতি বেড়ে যায়। তাই হয়েছে আহমেদ মুসার ক্ষেত্রেও। যে স্মৃতিকে সে দু’হাতে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তাই যেন তার সামনে এসে ভীড় করে বেশী। ফাতিমা ফারহানার অশ্রু ধোয়া মুখটি আবার মূর্তিমান হয়ে যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ আবদুল গফুর যখন ফারহানার হাত তার হাতে তুলে দিল, তখনকার তার হাতের উত্তপ্ত কম্পন তার হাতে যেন এখনও লেগে আছে। ও কেমন আছে? ফাতিমা ফারহানা যেন আরও নিবিড় হয়ে আসে তার কাছে। বৃদ্ধ আবদুল গফুরের বাড়িতে প্রথম দিন সেই ঔষুধ খাবার সময়, তারপর সেদিন ফারহানার হাত যখন হাতে এল সে সময় যে অপরিচিত এক সুবাস সে পেয়েছিল, তাও যেন এসে তাকে আচ্ছন্ন করছে। সচেতন হল আহমদ মুসা। দু’হাতে সে ঠেলে দিতে চাইল স্মৃতির ভাবকে। না, এমন নিবিড়তায় সে ওকে ভাবতে পারে না। আল্লাহ এ অধিকার এখনও তাকে দান করেননি। একজন মুমিনকে একজন মুমিনের চিন্তার কলুষতা থেকেও নিরাপদ রাখা দরকার।
এ সময় ঘরের ওপ্রান্তে দরজার ওপার থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল।
এ পায়ের শব্দের সাথে আহমদ মুসা পরিচিত। নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর ওরা আসে। দরজার ওপারে আলো জ্বলে ওঠে। দরজা খুলে যায়। দরজায় দাঁড়ায় উদ্যত ষ্টেনগান হাতে চারজন রুশ প্রহরী। একজন চীনা মেয়ে খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকে। খাবার ট্রে বিছানার ওপর রেখে পাশের দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেয়েটির বয়স বিশ/বাইশের বেশী হবে না। সুন্দরী। চোখে মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
যতক্ষণ আহমদ মুসা খায়, ততক্ষণ সে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খাওয়া হলে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায় দূরে।
এই অন্ধকার কুঠরীতে আসার পর জেনারেল বোরিস একবারই এসেছে। আনুমানিক সেটা গতকাল হবে। জেনারেল বোরিসের এত পরে আসায় আহমদ মুসা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। পরে বুঝেছে, আহমদ মুসাকে মানসিক ভাবে দূর্বল করার জন্যে সে সময় নিতে চায়।
গতকাল জেনারেল বোরিস একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। প্রস্তাব ছিল, আহমদ মুসা কর্ণেল কুতাইবার কাছে চিঠি লিখবে ‘ফ্র’ কে দশ বিলিয়ন ডলার দেবার জন্যে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাংক ও ট্রেজারিতে এ টাকা রয়েছে। এ টাকা হেলিকপ্টারে করে নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চলে যাবার পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দেবে। আর টাকা দিতে রাজী না হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে হত্যা করবে।
আহমদ মুসা কোন জবাব দেয়নি এ প্রস্তাবের। দেবার প্রবৃত্তি হয়নি তার। প্রস্তাব রাখার পর জেনারেল বোরিস দেরী করেনি। যাবার সময় বলে গেছে পরদিন আবার আসবে।
দরজার ওপাশের পায়ের শব্দ নিকটতর হলো। দরজার সামনে এসে তা থেমে গেল। ওপারে জ্বলে উঠল আলো। দরজার ফাঁক গলে ছুটে এলো জমাটবদ্ধ একগুচ্ছ আলোর কণা। চৌকাঠের প্রান্তকেই তা আলোকিত করল মাত্র।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় এসে দাঁড়াল সেই চারজন প্রহরী।
তারপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল জেনারেল বোরিস। হাতে তার রিভলভার।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। জেনারেল বোরিস লোকটা আসলে ভীতু। চারজন প্রহরী দাঁড় করিয়েও ভরসা নেই, নিজ হাতেও রিভলভার নাচাতে হচ্ছে।
জেনারেল বোরিস ঘরে প্রবেশ করে ঘরের এদিক-ওদিক একবার পায়চারী করল। তারপর আহমদ মুসার মুখোমুখি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কি চিন্তা করলেন?
-কোন ব্যাপারে?
-কালকে একটা চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম!
-জেনারেল বোরিস, আপনারা একটা আদর্শের জন্যে লড়াই করেন জানতাম, কিন্তু আপনারা এমন নিরেট অর্থলোলুপ তাতো জানতাম না?
-আমার প্রশ্নের জবাব চাই আহমদ মুসা।
গর্জে উঠল জেনারেল বোরিসের কন্ঠ। গোটা মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার।
-আমার একটা প্রশ্ন আছে জেনারেল বোরিস।
-কি প্রশ্ন?
-এই চিঠি আমাকে লিখতে বলছেন কেন?
-কে লিখবে তাহলে?
-জেনারেল বোরিস লিখবে, টাকা তো তারই দরকার।
-এ টাকা তোমারও দরকার। এ টাকার ওপর তোমার মুক্তি নির্ভর করছে। মনে করো না জেনারেল বাগাড়ম্বর করে। নির্দিষ্ট তারিখের নির্দিষ্ট দিন পার হয়ে গেলে তুমি আর এক মুহূর্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবে না। তোমাকে গুলি করে মারবো না। গায়ের চামড়া খুলে পশুর মত তোমাকে মরাব।
-আমাকে ভয় দেখাচ্ছো জেনারেল বোরিস?
-হ্যাঁ, ভয় দেখাবার মত শক্তি আমার আছে?
-মৃত্যুকে যে ভয় করে না, তাকে আর কোন ভয় দেখাবে জেনারেল বোরিস?
জেনারেল বোরিস পাগলের মত হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামলে আবার সে তার আগের প্রশ্নেরই পুনরাবৃত্তি করল, আমার প্রশ্নের জবাব জানতে চাই আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মৃদু হেসে বলল, জেনারেল বোরিস, তুমি কেমন করে ধারণা করলে যে আমি তোমার ব্ল্যাক মেইলিং এর সহায়ক হব?
-ইচ্ছায় না হলে অনিচ্ছায় তোমাকে সহায়ক হতেই হবে।
একটু থামল জেনারেল বোরিস। বাষ্পের মত ফুঁসছে সে। মুখ তার টকটকে লাল। যেন আগুন বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। বার কয়েক পায়চারি করে সে বলল, হ্যাঁ দরকার হলে জেনারেল বোরিসই চিঠি লিখবে। কিন্তু মনে রেখ, তোমার যে হাত চিঠি লিখবে না, সে হাতও ঐ চিঠির সাথে যাবে। তোমাদের ইসলাম ধর্মের তো হাত কাটার অভ্যাস আছে। আমরা এবার ওটার প্রয়োগ করব। তোমার ডান হাতটা যখন চিঠির সাথে ওদের কাছে যাবে, তখন তুমি চিঠি লেখার চেয়ে সেটা বেশী ফায়দা দেবে বলে আমি মনে করি।
বলে জেনারেল বোরিস আবার সেই হো হো করে হেসে উঠল।
যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল সে। যেতে যেতে বলল, এখন আহমদ মুসা তুমিই সিদ্ধান্ত নাও তুমি চিঠি দেবে, না হাত দেবে।
জেনারেল বোরিস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ওপারের আলো নিভে গেল। আবার সেই আঁধারে ডুবে গেল ঘর।
আহমদ মুসা তার দু’পা নিচে ঝুলিয়ে খাটিয়ায় বসে ছিল। ঐভাবেই বসে রইল। তার মনে ছুটে গেল হঠাৎ মধ্য এশিয়ায়। যুগ-যুগান্তের অপরিসীম ত্যাগ-তীতিক্ষার পর ওখানকার দুর্ভাগ্য মুসলমানরা স্বাধীন হয়েছে। ওদের হাজারো সমস্যা। এ সমস্যা মুকাবিলার জন্যে ওদের প্রচুর অর্থ চাই, যা ওদের নেই। এই অবস্থায় দশ বিলিয়ন কেন দশ ডলার ওদের অপচয় করা যাবে না। আহমদ মুসার জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ! দশ বিলিয়ন ডলার তাকে বাঁচাতে পারবে না। জেনারেল বোরিসের শেষ কথায় হাসি পেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার কাটা হাত ওখানকার সাথীদের দুঃখ দেবে, কিন্তু দশ বিলিয়ন ডলার দিলে আহমদ মুসা মুক্তি পাবে, এ বিশ্বাস তারা অবশ্যই করবে না করতে পারে না। মৃত আহমদ মুসার হাত কেটেও ওভাবে পাঠানো যায়!
এই চিন্তা আহমদ মুসার মনকে অনেক হালকা করে দিল। সে দু’টি পা বিছানায় তুলে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।
শুয়েই নজর পড়ল সেই ঘুলঘুলির দিকে। ওখানে সাদা আলোর যে রেখাটা ছিল, তা এখন নেই। অন্ধকার সেখানে এসে স্থান করে নিয়েছে। আহমদ মুসা বুঝল, মাগরিবের সময় হয়েছে, বা যাচ্ছে।
সে উঠে বসল বিছানা থেকে। দেয়ালে তায়াম্মুম করে নামাযে দাঁড়াল।
হোটেল সিংকিয়াং এ বিরাট এক ভোজ সভা। উরুমচির সবচেয়ে অভিজাত হোটেল এটা। ভোজের আয়োজন করেছে আলেকজান্ডার বোরিসভ। জেনারেল বোরিস এখন এই নামে উরুমচিতে বাস করছে। তার পরিচয় বড় একজন ব্যবসায়ী সে। রুশ অঞ্চল থেকে বহুদিন আগে হিজরত করে আসা একজন চীনা নাগরিক বহুদিন সাংহাই এ বসবাস করছে, এখন এসেছে উরুমচিতে।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »