৭. তিয়েনশানের ওপারে

চ্যাপ্টার

উরুমচির প্রাণকেন্দ্রে একটা তিনতলা ভবনের ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ। সময় তখন সকাল। কক্ষের একপাশে চেয়ারে বসে আছে হাসান তারিক, আব্দুল্লায়েভ এবং আহমদ ইয়াং। কক্ষের মাঝখানে একটা লোহার চেয়ারে বসে আছে ফেংফ্যাস- ‘ফ্র’ এর উরুমচি জোনের প্রধান। তার হাত দু’টি চেয়ারের সাথে বাঁধা। কক্ষে পায়চারি করছে ইউসুফ চিয়াং। ইউসুফ চিয়াং সিংকিয়াং ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর প্রধান।
ফেংফ্যাস গতরাতে ধরা পড়েছে এম্পায়ার গ্রুপের হাতে। মেইলিগুলির অফিস থেকে হাসান তারিক ফিরে আসার পর এম্পায়ার গ্রুপ গত কয়েক দিনে হন্যে হয়ে ঘুরছে জেনারেল বোরিসের সন্ধানে।
হাসান তারিক মেইলিগুলির কাছ থেকে হোটেল সিংকিয়াং-এ জেনারেল বোরিস অর্থাৎ আলেকজান্ডার বোরিসভের একটা স্যুটের সন্ধান পেয়েছিল। এ ছাড়া মেইলিগুলি উরুমচির নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন অফিসেও জেনারেল বোরিসের ঠিকানার খোঁজ করতে বলেছিল।
হাসান তারিক মেইলিগুলির অফিস থেকে ফিরে আসার পরদিনই ইউসুফ চিয়াং এবং আহমাদ ইয়াং ছুটে গিয়েছিল হোটেল সিংকিয়াং এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু আলেকজান্ডার বোরিসভের নামে কোন রিজার্ভ স্যুট পায়নি। এরপর তারা রিজার্ভেশন ইনডেক্স ফাইল থেকে গত পনের দিনের গেষ্ট চার্ট বের করে নেয়। তালিকায় পেয়ে যায় আলেকজান্ডার বোরিসভের নাম। মাত্র দুই দিনের জন্য রুম রিজার্ভ করেছিল। ফাইল ইনডেক্স থেকে জেনারেল বোরিসের লোকাল এড্রেস নিয়ে হতাশ হল ইউসুফ চিয়াং। এটা পুরানো এড্রেস। এখান থেকে সে আগেই পালিয়েছে। হাসান তারিকরা উরুমচি পৌছার পরদিনই এই ঠিকানায় তারা জেনারেল বোরিসের সন্ধানে যায়। কিন্তু পায়নি। কাশগড় থেকে লাল সংকেত পেয়েই সম্ভবত সে এ ঠিকানা হতে পালিয়ে যায়।
হোটেল সিংকিয়াং থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিল ইউসুফ চিয়াংরা।
এর পরদিন তারা যায় উরুমচির নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন অফিসে।
বিরাট অফিস। ইউসুফ চিয়াং খোজ-খবর নিয়ে জানল, নাগরিক রেজিষ্ট্রারটি এবং সংশ্লিষ্ট ফাইল অফিসের বড় কর্তার সেফ কাষ্টোডিতে থাকে। ওখানে পৌছা দুরুহ ব্যাপার।
ইউসুফ এ ব্যাপারটা নিয়ে নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন অফিসের ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ ইউনিটের সাথে আলোচনা করে। তারা আশ্বাস দেয় যে, তারাই এটা হাত করতে পারবে। না পারলে পরে অন্য ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যাবে।
ওরা গতকাল জেনারেল বোরিস অর্থাৎ আলেকজান্ডার বোরিসভের নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন দরখাস্তের ফটোকপি ইউসুফ চিয়াংকে পৌছে দিয়ে গেছে।
নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন দরখাস্তেও জেনারেল বোরিসের সেই পুরানো ঠিকানাটাই দেয়া। তবে এক্ষেত্রে তারা হতাশ হলেও দরখাস্তের সাক্ষী হিসেবে ফেংফ্যাস এর নাম এবং তার ঠিকানা তারা পেয়ে যায়। ঠিকানা পাওয়ার পর গত রাতেই তারা ঐ ঠিকানায় ছুটে যায়। ঠিকানাটা ছিল ফেং এর বাড়ির। বাড়িতে গিয়ে ফেংকে পেয়ে যায়। ধরে এনে এম্পায়ার গ্রুপের এই ঘাঁটিতে তাকে তোলা হয়েছে।
ইউসুফ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
গত আধা ঘন্টার জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে কিছুই আদায় করা যায়নি।
ইউসুফ চিয়াং বলল, তাহলে তুমি বলতে চাও কিছুই জান না তুমি? তোমাকে উরুমচির প্রধান বানিয়েছে ঘোড়ার ঘাস কাটার জন্যে?
-বিশ্বাস করুন, আসলেই আমাদের কোন কাজ নেই।
-মিথ্যা কথা।
-বিশ্বাস করুন, মিথ্যা নয়। আগে আমাদের অর্থ আসত মস্কো থেকে। এখন মস্কোতে ‘ফ্র’ বিরোধী গনতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা হবার পর আমাদের অর্থের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার ‘রেড ড্রাগন’ গ্রুপের কাছ থেকে ধার করে এখন আমরা চলছি। এরকম চললে দু’এক মাসের মধ্যে আমাদের অফিসও ছেড়ে দিতে হবে।
-কেন, জেনারেল বোরিসের কাছে তো অনেক টাকা। সে তো বিরাট কাফেলা নিয়ে এসেছে।
-বিশ্বাস করুন, জেনারেল বোরিস কোন টাকা নিয়ে আসেনি। কিছু সোনা নিয়ে এসেছে। কিন্তু চীনে ওগুলোর কোন বাজার নেই। ঐরকম তাল তাল সোনা বিক্রি করতে গেলেই সে ধরা পরবে। কালো বাজারই একমাত্র ভরসা। কিন্তু এজন্য সময় লাগবে।
-তুমি তো অনেক কিছু জান, জেনারেল বোরিসের সন্ধান জান না এটা মিথ্যা কথা।
-বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যা বলছি না। নাগরিক রেজিষ্ট্রেশন অফিসে নিয়ে যাবার দিন ঐ একবারই তাকে দেখেছি। আর…
-থামলে কেন?
-ও কিছু নয়।
-শোন ফেংফ্যাস, আমাদের বোকা সাজিয়ো না। তুমি সব জান, আমাদের কাছে মিথ্যা বলছ।
কঠোর কন্ঠে বলল ইউসুফ চিয়াং।
আসলে ফেংফ্যাস লোকটা ভীতু। ইউসুফ চিয়াং- এর এ ধমকে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রইল।
আহমদ ইয়াং বলল, ইউসুফ ভাই, ও ধাড়ি ইঁদুর। ও সহজে মুখ খুলবে না। শুধু শুধু আমাদের সময় নষ্ট করছে সে। ওকে ছাদে টাঙান। ইউসুফ চিয়াং বলল, শুনলে তো ফ্যাং। আমাকে তুমি বাধ্য করো না। জানি তোমার ছেলে আছে, স্ত্রী আছে……
ফেংফ্যাস এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল, আমাকে আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি বেশি কিছু জানি না। সম্প্রতি ‘রেড ড্রাগন’ গ্রুপের কাছ থেকে জেনারেল বোরিস নতুন একটা বাড়ি কিনেছে। ঐ বাড়িতে শুধু একবার আমি গেছি।
-বেশ তো একবার গেলেই চলবে। বল সে ঠিকানা।
বলে ইউসুফ চিয়াং এক টুকরো কাগজ এবং একটি কলম এগিয়ে দিল তার দিকে। ফেংফ্যাস সুবোধ বালকের মত ঠিকানা লিখে দিল।
ঠিকানার উপর চোখ বুলাতে বুলাতে ইউসুফ চিয়াং বলল, দেখ, ঠিকানায় যদি কিছু না পাই, তাহলে বুঝতেই পারছ।
বলে ইউসুফ চিয়াং কাগজের টুকরাটা পকেটে রেখে হাসান তারিকের দিকে চাইল।
হাসান তারিক বলল, দেরী নয়, এখনি আমারা যাব।
এই সময়ে ফেংফ্যাস তার মুখটা ঘুরিয়ে ইউসুফ চিয়াং এর দিকে চেয়ে বলল, ও বাড়ির পশ্চিম পাশে পাঁচিলের সাথে লাগানো একটা পায়খানা আছে। আসলে ওটা পায়খানা নয়। ঐ বাড়িতে আসা-যাওয়ার ভূগর্ভস্থ পথের ওটা গোপন দরজা।
ইউসুফ চিয়াং ফেংফ্যাস এর পিঠ চাপড়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল।
ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে সবাই বেরিয়ে এল। ইউসুফ চিয়াং কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে সবার পিছে পিছে ওপরে উঠে এল।
হাসান তারিক, আব্দুল্লায়েভ, ইউসুফ চিয়াং এবং আহমদ ইয়াং যখন জেনারেল বোরিসের সন্ধানে ঐ ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল তখন সকাল সাতটা।
হাসান তারিক বলল, জেনারেল বোরিসের ঘাটিতে হানা দেবার এটাই উপযুক্ত সময়। ওরা সাধারণত সারারাত জেগে এই সময়টায় বিছানায় পড়ে থাকে।
-আল্লাহ ভরসা, দোয়া করুন আমাদের উদ্দেশ্য আল্লাহ যেন সফল করেন। বলল ইউসুফ চিয়াং।
-মুসা ভাইকে তো ওরা ওখানে নাও রাখতে পারে? বলল আব্দুল্লায়েভ।
-হ্যা তা হতে পারে। আমরা জেনারেল বোরিসকে পেলে মুসা ভাইকেও পেয়ে যাব।
পনের মিনিটের মধ্যেই ওরা এলাকায় পৌছে গেল। ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াং গাড়ি থেকে নেমে দেখতে গেল।
কিছুক্ষন পর ওরা ফিরে এসে বলল, বাড়িটা আমরা দেখে এসেছি। গাড়ি আর যাবে না, এখানেই রেখে যেতে হবে।
গাড়ি থেকে নেমে ওরা ইট বিছানো সরু গলি পথ ধরে প্রায় শ’তিনেক গজ এগিয়ে যাবার পর একটা ফাঁকা উঠানের মুখোমুখি হলো। ছোট উঠানটা পেরুলেই দু’তলা বিরাট বাড়ি। সামনেই বিরাট দরজাওয়ালা ঘর। বুঝাই যায় ওটা গেট রুম। সামনে প্রাচীর নেই, কিন্তু বাড়ির পেছনটা প্রাচীর ঘেরা। দু’দিক থেকে প্রাচীর এসে ঐ গেট রুমে মিশেছে।
গেট রুমের দরজাটা বন্ধ। হাসান তারিকরা অনেকক্ষণ দাঁড়াল। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই।
হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং এর দিকে চেয়ে বলল, আমরা সামনে দিয়েই ঢুকব, কিন্তু একজন পশ্চিম দিকে পাঁচিলের পেছনে যাওয়া দরকার।
ইউসুফ চিয়াং আহমদ ইয়াং এর দিকে চেয়ে বলল, তুমি যাও।
হাসান তারিক বলল, সামনে দিয়ে নয়, এই রাস্তা হয়ে দক্ষিন দিকটা ঘুরে পাচিলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াবে যেখানে দরজা পাবে সেইখানে। আমরা না ডাকা পর্যন্ত সরবে না। তোমার দায়িত্ব হবে ঐ পথে কাউকে পালাতে না দেয়া।
আহমদ ইয়াং চলে যাবার পর ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর হাসান তারিক বলল, আমরা যেতে পারি এবার।
বলে হাসান তারিক আগে আগে চলল। তার পেছনে আবদুল্লায়েভ এবং ইউসুফ চিয়াং। তাদের সকলের হাত জ্যাকেটের পকেটে রিভলবারের ওপর রাখা।
হাসান তারিক দরজার সামনে মুহুর্তকাল দাড়াল। তারপর বাম হাতে দরজায় পর পর তিনবার টোকা দিল। কোন সাড়া নেই। আবার টোকা দিল হাসান তারিক। না কোন সাড়া নেই।
পকেট থেকে ডান হাতে রিভলবার বের করে নিয়ে বাম হাতে দরজায় চাপ দিল। একটু চাপ দিতেই দরজা ফাঁক হয়ে গেল একটু।
দরজা খোলা! বিস্মিত হাসান তারিক এবার ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। খুলেই তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। রক্তে ভাসছে ঘর। একজন মহিলা ও একজন পুরুষের রক্তাক্ত লাশ মেঝেয় পড়ে আছে।
রিভলবার বাগিয়ে তারা তিনজনই ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। গেট লাগিয়ে দিয়ে গেট রুম পার হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির ভেতর আরও আটটি লাশ তারা পেল। সিড়ি দিয়ে ভূগর্ভস্থ করিডোরেও তারা ঢুকল। করিডোরের দু’পাশের রুমগুলো উকি মেরে দেখল। কেউ কোথাও নেই।
অবশেষে করিডোরের পশ্চিম প্রান্তে আরেকটি সিড়ি দিয়ে উঠে পেল দরজা। দরজা খুলে পাচিলের বাইরে গিয়ে হাজির। আহমদ ইয়াং ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছিল আর কি। অন্ধকার থাকলে আর রক্ষা ছিল না।
হাসান তারিক আহমদ ইয়াংসহ সবাইকে আবার ভেতরে প্রবেশ করতে বলল।
ইউসুফ চিয়াং বলল, আর ভেতরে ঢুকে লাভ কি?
হাসান তারিক বলল, না বাড়িটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকতে হবে। যাতে কারো সন্দেহ করার অবকাশ না থাকে যে, বাড়িতে কেউ প্রবেশ করেছিল।
গেট রুমের দরজা সেভাবেই ভেজিয়ে দিয়ে হাসান তারিকরা এসে গাড়িতে বসল।
গাড়িতে বসেই ইউসুফ চিয়াং বলল, তারিক ভাই, কি বুঝলেন আপনি? রীতিমত তো যুদ্ধ হয়ে গেছে।
হাসান তারিক চিন্তা করছিল। বলল সে, হ্যাঁ তাই, কিন্তু যা দেখলাম তাতে লোক মরেছে এক পক্ষে। বুঝতে পারছি না দ্বিতীয় পক্ষটি কে? যারা মরেছে তারা জেনারেল বোরিসের পক্ষের, না অন্য কোন পক্ষের।
থামল একটু তারপরেই আবার মুখ খুলল হাসান তারিক। বলল, থাক এসব প্রশ্নের পালা। আমি এখন ভাবছি, এ বাড়িটা আমাদের পাহারা দেয়া দরকার। জেনারেল বোরিসের কেউ না কেউ এ বাড়িতে আসবেই।
ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াং দু’জনেই এক সাথে বলে উঠল ঠিক বলেছেন।
-সম্ভবত ওরা পুলিশের ঝামেলায় পড়ার ভয়েই পালিয়েছে। লাশ সৎকার করার জন্যে ওরা রাতেই আসবে।
-দিনেও তো আসতে পারে। বলল ইউসুফ চিয়াং।
-তা পারে, কিন্তু আজ আর আসবে বলে মনে করি না। সম্ভবত ওরা প্রতিপক্ষেরও ভয় করছে।
অবশেষে আলোচনায় ঠিক করল সন্ধ্যায় তারা ফিরে আসবে এবং রাতে পাহারা দেবে।
হাসান তারিকরা সন্ধ্যায় ফিরে এল সেই বাড়ির সামনে। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনো ভালভাবে নামেনি। বাড়িটির গেট রুমের দিকে তাকিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। ইয়া বড় তালা ঝুলছে গেটে। সবার মনেই এক প্রশ্ন, কখন লাগাল তালা? তাহলে কেউ এসেছিল?
হাসান তারিকের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যখন একবার ওরা এসেছে, তখন আবারও আসবে।
অন্ধকার একটু নামলে বাড়িটির উত্তর পাশ ঘেষে যে বড় গাছটি আছে সেখানে গিয়ে ওরা চারজন অবস্থান নিল। ওখান থেকে উঠান এবং গেটের সামনেটা পরিষ্কার দেখা যায়।
তিনরাত তারা ঐখানে বসে পাহারায় কাটিয়ে দিল। না, কেউ আসেনা। সবাই হতাশ হলো। কিন্তু হাসান তারিক নিশ্চিন্ত ওরা আসবেই।
তিন রাত পর হাসান দিনের বেলায়ও পাহারা বসালো। দু’জন দুপুরের পরে। আর রাতে পাহারায় থাকবে সবাই।
সপ্তম দিন বিকেল বেলা পাহারায় ছিল আহমদ ইয়াং এবং আবদুল্লায়েভ। বেলা তিনটার দিকে আহমদ ইয়াং হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাসান তারিককে বলল, বেলা তিনটায় দু’জন বাড়িতে ঢুকেছে। বাড়িতেই তারা আছে।
-তারা চীনা, না রুশ?
-চীনা।
হাসান তারিক এবং ইউসুফ চিয়াং শুয়ে ছিল। দুজনই উঠে বসল। তৈরী হয়ে তারা বেরিয়ে এল আহমদ ইয়াং এর সাথে।
রাত যখন প্রায় বারটা। ইউসুফ চিয়াং হাসান তারিককে বলল, ওরা তো বেরুল না, আমরা তো ঢুকতে পারি।
-না, ইউসুফ, বড় শিকার তো আসেনি। আমি জেনারেল বোরিসের অপেক্ষা করছি। বলল হাসান তারিক।
রাত তখন সাড়ে বারটা হবে। এমন সময় হাসান তারিকরা দেখল। গেট রুম দিয়ে একজন বাইরে বেরুল। তারপর আরেকজন। পরের জন প্রায় তিন ফিট লম্বা একটা বাক্স নিয়ে এল। তারপর ওরা দরজায় তালা লাগিয়ে বাক্সটি নিয়ে চলল উঠান পেরিয়ে।
হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল। বলল, আমরা ওদের ফলো করব। নিশ্চয় নতুন ঘাটিতে ওরা যাচ্ছে।
ওরা দু’জন সরু গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে দাড়িয়ে থাকা বেবী ট্যাক্সিতে উঠে বসল। ওদের বেবী ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
ওদের বেবী ট্যাক্সির পেছনে ছুটে চলল হাসান তারিকদের গাড়ি।
প্রায় পনের মিনিট চলার পর দেংশিয়াং রোডে একটা দু’তলা বাড়ির গেটে গিয়ে গাড়িটা থামল। কাছে-কুলে বাড়ি নেই। আশপাশটা অন্ধকার। হাসান তারিকদের গাড়ি প্রায় দু’শ গজ দুরে হেড লাইট নিভিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল।
বেবী ট্যাক্সি দাঁড়ানোর পর লোক দু’টি গাড়ি থেকে বাক্সটি নিয়ে নেমে গেল।
প্রায় মিনিট পনের পর বাড়ির গেট দিয়ে লোক দু’টি বেরিয়ে এল। সবার হাতেই স্টেনগান। পাঁচজন লোক বেবীতে উঠল। আবার বেবীটি ছেড়ে দিল। হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং-এর দিকে চেয়ে বলল, আমার সন্দেহ ঠিক হলে ঐ পাঁচজনের লম্বাজন জেনারেল বোরিস। ওরা কোন অভিযানে যাচ্ছে। চল ওদের পেছনে।
প্রায় বিশ মিনিট সরু আঁকাবাঁকা গলিপথে চলার পর গাড়ি উরুমচির অভিজাত এলাকা গুলিস্তান পৌছল। ইবনে সা’দ রোডের একটা গাছের তলায় গিয়ে বেবী ট্যাক্সিটি থামল। হাসান তারিকদের গাড়ি হেড লাইট নিভিয়ে আসছিল। বেবী ট্যাক্সিটি দাঁড়ালে তারাও দাঁড়াল।
যে গাছটির নিচে বেবী ট্যাক্সিটি দাঁড়াল, তার গজ পঞ্চাশেক সামনে একটা বিরাট বাড়ি। হাসান তারিক দেখল বেবী ট্যাক্সি থেকে পাঁচজন লোক নেমে ঐ বাড়ির দিকে চলল।
ওরা হাঁটা শুরু করলে হাসান তারিকদের গাড়ি ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এসে বেবী ট্যাক্সিটার সামনে দাঁড়াল।
হাসান তারিকরাও গাড়ি থেকে নামল। গাছের অন্ধকারে দাড়িয়ে তারা। ওদের পাঁচজনের একজন তর তর করে টেলিফোনের পিলারে উঠে টেলিফোনের তার কেটে দিতে লাগল। তারপর ওরা পাঁচজনেই পাচিঁল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল।
হাসান তারিক গাছের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে বাড়িটার এরিয়া এবং বিল্ডিং এর অবস্থানটা দেখে নিল। তারপর এসে ইউসুফ চিয়াংকে বলল, চল, আমরাও ভেতরে ঢুকব। সে কার কোন সর্বনাশ করতে গেল কে জানে?
ওরা পাঁচজন বাড়ির বড় গেটটির পূর্বদিক দিয়ে পাচিঁল টপকেছিল, আর হাসান তারিকরা গেটের পশ্চিম পাশের অন্ধকার মত জায়গা দিয়ে পাচিল টপকালো।

মেইলিগুলিদের বাসায় দু’তলার সিড়ির মুখেই তাদের ফ্যামিলি বৈঠকখানা। নিচের তলার বৈঠকখানা বাইরের অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে ব্যবহার হয়। আর দু’তলার এ বৈঠকখানা ফ্যামিলি গ্যাদারিং এর জায়গা। এর উত্তর পাশেই দাদির ঘর। তার পরেরটাতেই থাকে মেইলিগুলি। আরও উত্তরে ও পশ্চিমের ঘরগুলোতে থাকে মেইলিগুলির বাবা, মা ও অন্যরা। মেইলিগুলির আব্বা ও ভাইরা থাকে পিকিংএ। ওখানেই তাদের চাকুরী। মেইলিগুলি তার দাদী, মা, ফুফু এবং অন্যদের নিয়ে এ বাড়িতে থাকে। ফ্যামিলি বৈঠকখানার দক্ষিণ দিকে পারিবারিক অতিথিদের থাকার স্থান। নিচের তলাতেও অতিথিখানা আছে, কিন্তু তা বাইরের লোকদের জন্যে। ফ্যামিলি বৈঠকখানার পশ্চিম দেয়ালে একটা দরজা। ওটা দিয়ে পাকঘর ও স্টোর রুমের দিকে যাওয়া যায়।
ফ্যামিলি বৈঠকখানা কার্পেট ও অত্যন্ত মূল্যবান কাঠের সোফা সেট দিয়ে সাজানো।
বাড়ির প্রধান গেটে একজন বিশ্বস্ত দারোয়ান থাকে। আহমদ মুসাকে নিয়ে আসার পর থেকে মেইলিগুলি নিচের সিড়ির মুখে ওমর ওয়াং চাচাকে পাহারায় রেখেছে।
সেদিন ‘জেনারেল বোরিসের তরফ থেকে কোন আশংকা মেইলিগুলি করে কিনা’ এ প্রশ্নের মেইলিগুলি ‘না’ সূচক জবাব দিলেও মেইলিগুলি কিন্তু একদিনের জন্যেও এই আশংকা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আহত আহমদ মুসা সেদিন গাড়িতে ওঠার সময় রক্তমাখা রুমাল ও জামার আস্তিন বাইরে ফেলতে না দেয়া থেকেও সে বুঝেছে জেনারেল বোরিস কতটা ভয়ের বস্তু। তাই মেইলিগুলি রাতে ঘুমাতে পারে না। রাত বারটার পর উঠে সিড়ির মুখে বৈঠকখানা এবং দু’তলার করিডোর দিয়ে পায়চারী করে বেড়ায়।
সেদিন দাদি এটা ধরে ফেলেছে। তুই এই রাত দু’টায় এভাবে পায়চারী করে বেড়াচ্ছিস কেন? এর আগেও একবার পায়ের শব্দ আমি শুনেছি। তুই কি?
মেইলিগুলি উত্তর দিয়েছে, হ্যাঁ দাদি।
তারপর মেইলিগুলি সব কথা দাদিকে খুলে বলেছে। শুনে আশংকায় ও ভয়ে দাদির মুখ শুকিয়ে গেছে, বলেছে, তোর আশংকার কথা মুসাকে বলিসনি কেন?
-না দাদি, উনি অসুস্থ তার নিশ্চিন্ত থাকা দরকার। কয়েক দিন তো গেল। উনি উঠে চলাফেরা করতে পারলে আর ভয় থাকবে না। উনি জেনারেল বোরিসের গোটা একটা বাহিনীকে বুদ্ধি ও শক্তির জোরে পরাজিত করে ওদের বন্দীখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সুস্থ হলে উনি একাই যথেষ্ট হন।
দাদি মেইলিগুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, বোন, তোর অনেক পূণ্য হবে। তুই আমাকে মাফ করিস। কত খারাপ ভেবেছি তোকে। তুই আমার বংশের গৌরব।
মেইলিগুলি দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, না দাদি, তুমি এমন করে বল না। তুমি দোয়া কর, যাতে উনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারেন।
দাদি মেইলিগুলিকে বুক থেকে সরিয়ে তার মুখ নিজের মুখের কাছে তুলে ধরে বলেছে, তুই তাকে যেতে দিতে পারবি?
মেইলিগুলি চোখ বুজে আবার দাদির কোলে মুখ লুকিয়েছে। কোন উত্তর দেয়নি।
মেইলিগুলি নিত্যদিনের মত সে রাতেও পায়চারি করছিল। রাত তখন দেড়টা।
মেইলিগুলি সর্বদর্শী হলে দেখতে পেত, কি করে তিনটি ছায়ামূর্তি তার দারোয়ান ও ওমর চাচাকে ক্লোরোফরমে ঘুম পাড়িয়ে দোতলার সিঁড়ির দরজার তালা ল্যাসার বীম দিয়ে গলিয়ে ওপরে উঠে আসছে এবং কি করে আরও দু’টি ছায়ামূর্তি বাড়ির পেছনে পানির পাইপ বেয়ে ওপরে উঠে এল।
মেইলিগুলি তখন বৈঠকখানার মুখে দাঁড়িয়ে, সিঁড়ির মুখে পায়ের শব্দ শুনেই সে পেছন ফিরল। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে তিনজন লোক, হাতে স্টেনগান।
বিদ্যুৎ গতিতে মেইলিগুলির পিস্তল ওপরে উঠে এল। ট্রিগারে আঙুল চেপে বসতে যাচ্ছে। এমন সময় পেছন থেকে বিড়ালের মত ছুটে আসা এক ছায়ামূর্তি মেইলিগুলির ডান হাতের উপর রিভলভারের বাট দিয়ে আঘাত করল।
পিস্তল ছিটকে পড়ে গেল মেইলিগুলির হাত থেকে। কিন্তু ক্ষিপ্র বেপরোয়া মেইলিগুলি ছুটে গিয়ে পিস্তল তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। পিছন থেকে আঘাতকারী জেনারেল বোরিসের দিকে নজর যেতেই মেইলিগুলির পিস্তল উঠে এল তাকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু তার আগেই জেনারেল বোরিসের সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার গুলি বর্ষণ করল। গুলিটি মেইলিগুলির পিস্তলে এসে আঘাত করল। গুলির আঘাতে মেইলিগুলির শাহাদাত ও বুড়ো আঙুলের মাঝখানের কিছুটা অংশ ছিড়ে গেল। পিস্তলটি তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। মেইলিগুলি দক্ষিণের দরজা দিয়ে আহমদ মুসার রুমের দিকে ছুটতে গিয়েছিল। কিন্তু সিঁড়ির তিনজন লোক তাকে ঘিরে ধরল।
জেনারেল বোরিস এসে মেইলিগুলির ওড়না দিয়ে তার মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর তিনজনের একজনকে লক্ষ্য করে বলল ওয়াংচু, একে সোফার সাথে বেঁধে রাখ।
মেইলিগুলিকে বেঁধে ফেলা হল সোফার সাথে!
জেনারেল বোরিস বলল, সুন্দরী, সেদিনের অপমানের কথা আমি ভুলিনি। আরেক দিন রাতে এসেছিলাম তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে। তুমি লেক হেভেনে গিয়েছিলে, পাইনি তোমাকে। কিন্তু বড় শিকারের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলাম। দু’জন ছিলাম বলে সেদিন আহমদ মুসার গায়ে হাত দেইনি। আজ তোমাদের দু’জনকেই যেতে হবে আমার মেহমানখানায়।
বলে একজনকে সিঁড়ির মুখে ও এদিককার জন্যে পাহাড়ায় রেখে অন্য দু’জনকে নিয়ে আহমদ মুসার ঘরের দিকে চলল জেনারেল বোরিস। আরেকজনকে আগেই সে ওখানে পাঠিয়েছিল।
জেনারেল বোরিস চলে যাবার মিনিট খানেক পর হাসান তারিকরা উঠে এল দোতলার সিঁড়ি দিয়ে। আগে হাসান তারিক, পেছনে ওরা তিনজন।
বেড়ালের মত নিঃশব্দে উঠেছে হাসান তারিক। মেইলিগুলি চিৎকার করছিল। কিন্তু শক্ত করে বাঁধা মুখ থেকে অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া আর কিছু বেরুচ্ছিল না। সে প্রাণপণে হাত পা ছুড়ছিল বাঁধন খোলার জন্যে।
এখানে দাঁড়ানো জেনারেল বোরিসের প্রহরী লোকটা মেইলিগুলির ঐ দৃশ্য দেখে কৌতুক করে বলল, এটা শুটিং এর সেট………
তার কথা শেষ হলো না। দুপ করে একটা শব্দ হলো। গুড়ো হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে লোকটা নিঃশব্দে ঢলে পড়ে গেল মাটিতে।
সিঁড়ির দিকে তাকাতেই মেইলিগুলির চোখ পড়ল হাসান তারিকের ওপর।
হাসান তারিক ছুটে এল মেইলিগুলির কাছে। তাড়াতাড়ি মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, আপনি? আপনার বাড়ি এটা?
প্রশ্নের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মেইলি কেঁদে উঠল। বলল, আহমদ মুসাকে রক্ষা করুন। যান তাড়াতাড়ি।
-আহমদ মুসা? কোথায় তিনি?
বিস্ময়-আবেগে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে হাসান তারিকের চোখ।
মেইলিগুলি মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে বলল, জেনারেল বোরিসরা ওদিকে গেছে। যান তাড়াতাড়ি।
হাসান তারিক দ্রুত আহমদ ইয়াংকে বলল, তুমি একে খুলে দাও। আমরা ওখানে যাচ্ছি।
মেইলিগুলির দাদি, মা, ফুফু তখন প্রায় বাকরুদ্ধ অবস্থায় ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মেইলিগুলি হাসান তারিককে বলল, না আমাকে খুলতে হবে না। যান আপনারা।
ওরা চারজন ছুটে চলে গেল দক্ষিণের দরজা দিয়ে।
মেইলিগুলির দাদি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়েছিল মেঝেতে। মা এসে মেইলিগুলিকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
মেইলিগুলি বলল, মা শব্দ করোনা। জেনারেল বোরিস সতর্ক হবে।
কিডন্যাপ করতে এসেছে ওরা আহমদ মুসাকে।
ফুফু মেইলিগুলির বাঁধন খুলে দিল। মেইলিগুলির আহত হাত থেকে অবিরাম ঝরে পড়া রক্তে মেঝের সাদা কার্পেট অনেকখানি লাল হয়ে উঠেছে। তখনও রক্ত ঝরছে প্রবলভাবে। ফুফু ওড়না দিয়ে ক্ষতস্থানটি চেপে ধরল।
এই সময় প্রায় একসাথেই স্টেনগানের ব্রাস ফায়ার এবং রিভলভারের শব্দ ভেসে এল।
মেইলিগুলি ডান হাত চেপে ধরে ছুটল ওদিকে। তার পেছনে মা, ফুফু এবং দাদিও।
আহমদ মুসার ঘরের সামনে তিনটি রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে।
আর পড়ে আছে ক্লোরোফরম গ্যাস ট্রান্সমিশনের যন্ত্রপাতি ও নল।
হাসান তারিক নক করল দরজায়।
মেইলিগুলিও তাদের পেছন গিয়ে দাঁড়াল।
দরজার কাছেই মেইলিগুলি এগিয়ে গিয়ে ডাক দিল, মা-চু দরজা খোল!
দরজা খুলে গেল! দরজা খুলে মা-চু এক পাশে সরে দাঁড়াল।
টেবিলে রিভলভার। তার পাশেই পা ঝুলিয়ে খাটে বসে ছিল আহমদ মুসা।
ভেতরে ছুটে গেল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল গভীর আবেগে। কাঁদছিল হাসান তারিক। আহমদ মুসার দু’চোখও ভিজে উঠেছিল।
হাসান তারিকের পরে এগিয়ে এল আব্দুল্লায়েভ। আহমদ মুসা অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে থাকল তাকেও। আব্দুল্লায়েভও কাঁদছিল।
এই মিলন দৃশ্য দেখে কারোরই চোখ শুকনো ছিলনা। সজল চোখ দু’টি নিয়ে মেইলিগুলি অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
রুমালে চোখ মুছে নিয়ে হাসান তারিক, ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াংকে পরিচয় করিয়ে দিল আহমদ মুসার সাথে।
ওদেরকেও বুকে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসা।
ওদের দিকে গিয়েই আহমদ মুসার চোখ পড়েছিল মেইলিগুলির উপর। ডান হাতে জড়ানো রক্তে লাল হয়ে যাওয়া ওড়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি আহত মেইলিগুলি?
মেইলিগুলি মুখ নিচু করল।
হাসান তারিক বলল, উনিই প্রথম জেনারেল বোরিসকে বাধা দেন। ওকে আহত করে সোফায় কাঠের সাথে বেঁধে রেখে সে আপনার এ রুমে আসে।
আহমদ মুসা মা-চু’র দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, তুমি তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আন।
আর দাদির দিকে চেয়ে বলল, দাদি ওঁকে শুইয়ে দিন।
হাসান তারিক এ সময় বলল, জেনারেল বোরিসকে ধরতে চেয়েছিলাম, তাই ওকে মারিনি। কিন্তু ওর ডান হাত গুঁড়ো হয়ে গেছে। ঝুলন্ত গুঁড়ো হাত নিয়েই সে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পালিয়েছে। আপনি অনুমতি দিন, আমরা এখনি ওর ঘাঁটিতে হামলা করতে চাই। ওকে সময় দেয়া ঠিক হবে না।
-আমি তো এখন তোমাদের নেতা নই হাসান তারিক।
হাসান তারিক এগিয়ে এসে আহমদ মুসার ডান হাত তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেয়ে বলল, আপনি শুধু আমাদের নন, দুনিয়া জোড়া বিপ্লবী সংগঠনের নেতা।
আব্দুল্লায়েভ, ইউসুফ চিয়াং, আহমদ ইয়াং এসে ঐ একইভাবে চুম্বন করল আহমদ মুসার হাত।
-আমি অবসর চেয়েছিলাম হাসান তারিক?
-পরাধীন মুসলমানদের হাহাকার যখন চারদিকে, তখন আল্লাহ আপনাকে অবসর দেবেন কেন মুসা ভাই?
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, যাও হাসান তারিক, সকালেই কিন্তু চলে এস। কিছু শুনতে পারলামনা তোমাদের কাছ থেকে।
হাসান তারিকরা বেরিয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে গেলে মেইলিগুলি বলল এখন রাত দু’টা। কোন প্রকার সাবধান থাকার কি প্রয়োজন আছে?
-না মেইলিগুলি, ওর সাথীরা সবাই নিহত। ওর ডান হাতটা শেষ। ও আপাতত আত্মরক্ষায় ব্যস্ত থাকবে। তাছাড়া হাসান তারিকরা ওর পিছু নিয়েছে।
মেইলিগুলি হাঁটতে শুরু করল তার ঘরের দিকে।
মা-চু আগেই ডাক্তার ডাকতে চলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা মেইলিগুলির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ভাবল, কি অদ্ভুত মেয়ে, যন্ত্রণাদগ্ধ গুলিবিদ্ধ হাতের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, ভাবছে আহমদ মুসার নিরাপত্তার কথাই!

Top