৭. তিয়েনশানের ওপারে

চ্যাপ্টার

ধীরে ধীরে উপরের ঘুলঘুলিটিতে সাদা আলোর একটা ক্ষীণ রেখা জেগে উঠল। আহমদ মুসা জেগেই ছিল। উঠে বসল সে। ফজরের নামাজ পড়তে হবে।
অন্ধকার হাতড়ে সে পানির কলসিটি খুঁজে বের করল। দেখল পানি বেশি নেই। পানিটুকু দিয়ে সে অজু করে ফেলল। খাবার পানি আর থাকল না। আর পানির তার দরকারও হবে না।
কয়েক দিন পর অজু করে বেশ ভাল লাগল আহমদ মুসার। ফজরের নামাজ শেষ করেও অনেকক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকল আহমদ মুসা। পরম প্রভুর একান্ত মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করল। স্মরণ করল তাকে দেয়া আল্লাহর অতুল নেয়ামতগুলোর কথা। তারপর স্মরন করল নিজের দায়িত্বের কথা। বিবেকের কুটির থেকে তার দুয়ার খুলে কে যেন বলল, বন্দী হওয়ার পর থেকে তুমি স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছ। পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছ, নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছ তুমি।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তাই তো সে তো কিছুই করে নি। ঘটনার স্রোত তো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে প্রাণহীন খড় কুটার মত। কিন্তু মুসলমানের জীবন তো স্রোতে ভেসে চলার জন্য নয়। অশুভ শক্তির গতি পরিবর্তনই তো তার প্রকৃতি। একটা যুক্তি মনে এলো। বলতে চেষ্টা করল। মধ্য এশিয়ায় বিপ্লব হয়ে গেছে, তার দায়িত্ব শেষ, কোন কাজ তো আর নেই। কোন দায়িত্বে সে অবহেলা করছে না। কিন্তু বিবেকের কুটিরের সেই দরজা আবার নড়ে উঠল। কথা ভেসে এলো সেখান থেকে, একজন মুসলমানের দায়িত্ব তো মধ্য এশিয়ায় সীমিত নয়, তার দায়িত্বের অধীন গোটা বিশ্ব। তার দায়িত্ব তাই শেষ হতে পারে না।
এই কথা আহমদ মুসার গোটা দেহে একটা যন্ত্রনা ছড়িয়ে দিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, সিংকিয়াং, ককেশাস, থাইল্যান্ডের পাত্তানি, বার্মার রোহিঙ্গা, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, এবং আফ্রিকার কোটি কোটি মুসলমানের মর্মান্তিক জীবনচিত্র। চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মত তার সামনে ভেসে এল সর্বস্ব লুন্ঠিতা লাখো মা-বোনের বিবস্ত্র চেহারা, কানে তার এসে প্রবেশ করল লাখো মুসলিম এতিম শিশুর বুক ফাটা কান্না। অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার দু’চোখ দিয়ে।
জামার আস্তিন দিয়ে আহমদ মুসা চোখের পানি মুছে ফেলল। না, এবার তার নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটাবে। আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন, তা নিয়েই সে রুখে দাঁড়াবে। তার সামনে অনেক কাজ। এই চিন্তা করার সাথে সাথে অদম্য এক জীবন জোয়ারে জেগে উঠল গোটা দেহ, তার গোটা সত্তা।
আহমদ মুসা নামাযের আসন থেকে উঠে দাড়াল। পায়চারি করতে লাগল ঘরে।
আজ জেনারেল বোরিস আসবে। ভাত খাইয়ে যায় যে মেয়েটি, সে গত কাল এক চিরকুটে জানিয়েছে, আজ জেনারেল বোরিস আসবে। আজকেই সে ফাইনাল ডেট ঠিক করেছে। আর সে সময় দেবে না আহমদ মুসাকে। সব আয়োজন তার কমপ্লিট। মেয়েটি আড়ি পেতে জেনারেল বোরিসের শলাপরামর্শ শুনেছে।
মেয়েটি তার নিজের কথাও লিখেছে। নর পশুদের আড্ডা থেকে তার বাঁচার কোন উপায় নেই। সামান্য সন্দেহ হলেই মেরে ফেলবে। তার মত আরোও দুঃখিনি মেয়ে আছে। দাসিবৃত্তি ও দেহ দানের যন্ত্র তারা।
এদের পাষন্ডতায় গাঁ শিউরে ওঠে আহমদ মুসার। হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ হয় তার।
পায়চারি বন্ধ করে আহমদ মুসা ফিরে আসে তার বিছানায়। গড়িয়ে নেবার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা।
সারা দিন গেল, সন্ধ্যাও পার হলো, কিন্তু জেনারেল বোরিসরা এলো না। দুপুরে মেয়েটি ভাত খাইয়ে গেছে। কিন্তু কিছু জানায়নি। বোধ হয় কিছু সে জানতে পারেনি। তাহলে কি জেনারেল তার প্রোগ্রাম পাল্টাল?
প্রশ্নটা আহমদ মুসার মন থেকে মিলিয়ে যাবার আগেই দরজার ওপারে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। নিয়ম মাফিক ওপারে জ্বলে উঠল আলো।
আহমদ মুসা উঠল। দু’পা নিচে ঝুলিয়ে খাটিয়ায় বসল। দরজা খুলে গেল। দরজা দিয়ে প্রবেশ করল জেনারেল বোরিস। তার হাতে তার সেই কালো রং-এর বাঘা রিভলবারটি।
আহমদ মুসা দেখল, রুটিন মাফিক স্টেনগানধারী চারজন লোক দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
অভ্যাস মত জেনারেল বোরিস ঘরে কয়েকবার পায়চারি করে আহমদ মুসার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। বলল, কি সিদ্ধান্ত নিলে আহমদ মুসা?
-কিসের সিদ্ধান্ত?
-বাগাড়ম্বর করো না। উত্তর দাও।
-জেনারেল বোরিস, আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের তো কিছু ছিল না।
-কাগজ কলম পাঠিয়েছিলাম, চিঠি লিখেছ কিনা?
-আমি চিঠি লিখব, একথা তো আমি কখনই বলিনি জেনারেল বোরিস।
-জীবনের মায়া তোমার নেই আহমদ মুসা?
-যে মায়া ভয় থেকে আসে এমন কোন বাড়তি মায়া আমার নেই।
-কথা বাড়িয়ো না আহমদ মুসা। আমি শেষ জবাব চাই তুমি চিঠি লিখবে কি না?
-জবাব তো আমি দিয়েছি।
-ঠিক আছে, দ্বিতীয় আয়োজন আমার কমপ্লিট। হাত কাটার জন্যে আমাদের জল্লাদকে এনে রেখেছি। সবার সামনে প্রদর্শনী করেই একাজটা আমরা করতে চাই। তোমাদের রাষ্ট্র তো নেই, তাই এমন দৃশ্য কেউ দেখেনি অনেক দিন।
বলে জেনারেল বোরিস হাসল। তারপর বোধ হয় দ্বাররক্ষীদের কোন নির্দেশ দেয়ার জন্যে সে মুখ ঘোরাল।
এমন একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল জেনারেল বোরিসের ওপর। নিমেষে জেনারেল বোরিসের রিভলভারটি কেড়ে নিল তার হাত থেকে।
এক ঝটকায় বোরিস ফিরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা সে সুযোগ দিল না। সে তার বাম হাতটি জেনারেল বোরিসের গলার সামনে দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে নিজের দেহের সাথে চেপে ধরল। আহমদ মুসার বাম বাহুটা সাঁড়াশির মত চেপে বসছিল জেনারেল বোরিসের গলায়। আর তার ডান হাতের রিভলবারটা তাক করে আছে জেনারেল বোরিসের মাথা।
দরজায় দাঁড়ানো চারজন প্রহরী প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামলে নিয়ে যখন স্টেনগানের মাথা উঁচু করল, তখন দেখল আহমদ মুসার দেহ জেনারেল বোরিসের দেহের আড়ালে। গুলী করলে তো জেনারেল বোরিসকেই বিদ্ধ করবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তারা ছুটে এল ঘরের ভেতরে।
তারা ঘরের মাঝ বরাবর এসেছে। আহমদ মুসা কঠোর কন্ঠে বলল, আর তোমরা এক পা এগুলে জেনারেল বোরিসের মাথা গুড়ো করে দেব।
ওরা চারজন ঘরের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্বিতীয় নির্দেশ দিল, তোমরা জেনারেল বোরিসকে জীবিত চাইলে স্টেনগান মাটিতে রেখে সরে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াও।
ওরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে স্টেনগান মাটিতে রেখে কয়েক ধাপ এগিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল।
প্রথম দিকে জেনারেল বোরিস কিছু হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে খসিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার বাহুর ইস্পাত বেষ্টনী তার শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলায় অল্প কয়েক মুহূর্তেই তার দেহ নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার তার দেহ নেতিয়ে পড়া দেখে আহমদ মুসা বুঝল সে জ্ঞান হারিয়েছে।
তাকে ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে একটা স্টেনগান তুলে নিল সে।
আহমদ মুসা ছেড়ে দেয়ার পর সংজ্ঞাহীন জেনারেল বোরিস ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
ওরা চারজনই পেছন ফিরে তাকাল। তখন আহমদ মুসা স্টেনগান হাতে তুলে নিয়েছে।
স্টেনগান বাগিয়ে ওদের নির্দেশ দিল আহমদ মুসা, তোমরা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড় মেঝেতে।
ওরা নির্দেশ পালনে একটু দেরী করছিল। স্টেনগানের ট্রিগারে একটু চাপ দিল আহমদ মুসা। একরাশ গুলী বিদ্ধ করল মেঝেকে।
ওরা চারজন এরপর সুবোধ বালকের মত গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা অন্য তিনটি স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর দরজা বন্ধ করে চাবি ঘুরিয়ে তালা বন্ধ করে দিল। চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল অন্ধকার এক কোণায়।
আহমদ মুসা কড়িডোরের কোন দিকে যাবে যখন চিন্তা করছে, তখন মাথার উপর একটা ঘন্টা বেজে উঠল।
আহমদ মুসা বুঝল, ওটা বিপদ সংকেত। নিশ্চয় এ ঘরের ভেতর কোথাও বিপদ সংকেতের কোন গোপন সুইচ আছে। ওরা এই সুযোগই নিয়েছে।
আহমদ মুসা দেখল, লম্বা করিডোরের ডান দিকটা অন্ধকার। বাম প্রান্তে আর একটা আলো জ্বলছে। সে নিশ্চিন্ত হলো, বেরুবার প্যাসেজ ঐ দিকেই হবে।
আহমদ মুসা তিনটা স্টেনগান কাঁধে ঝুলিয়ে একটা হাতে নিয়ে ঐ আলোর দিকে ছুটল। ওখানে গিয়ে দেখল একটা সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে। উঠতে যাবে এমন সময় ওপরে পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। সে আর না উঠে ছুটে গিয়ে সিঁড়ির পেছনে লুকাল।
সিঁড়ি দিয়ে তিনজন লোক ছুটে নেমে এল। কোন দিকে না তাকিয়ে ওরা করিডোর ধরে ছুটে গেল সেই বন্দী খানার দিকে।
ওরা আড়াল হতেই আহমদ মুসা সিঁড়ি ধরে উপরে ছুটল।
সে উপরে সিঁড়ির মুখে পৌঁছেছে, এমন সময় দেখল ডানদিক থেকে চারজন লোক ছুটে আসছে সিঁড়ির দিকে। ওদের হাতে স্টেনগান। ওরা আহমদ মুসাকে দেখে প্রথমটায় ভূত দেখার মত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরক্ষণেই ওদের স্টেনগানের নল আহমদ মুসাকে তাক করতে গেল।
কিন্তু আহমদ মুসার স্টেনগান তৈরী ছিল। এক ঝাঁক গুলী ছুটে গেল ওদের চারজনের দিকে। করিডোরে লুটিয়ে পড়ল ওদের চারজনের দেহ।
এখানেও সেই লম্বালম্বি করিডোর। দু’পাশে ঘর। কোন দিকে যাবে একটু চিন্তা করে নিয়ে যেদিক থেকে ওরা চারজন আসছিল সেদিকেই ছুটল। করিডোরের মাথায় গিয়ে বাঁক নিতেই আরো চারজনের সে মুখোমুখি পড়ে গেল। ট্রিগারে হাত লাগানই ছিল আহমদ মুসার। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের চারটা দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল এক ঝাঁক বুলেটে।
ওরা চারজন যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকেই ছুটতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
এই সময় তাকে বন্দীখানায় খাবার দেয়া সেই মেয়েটি ছুটে এল তার সামনে। বলল, সামনে যাবেন না। ওদিকে আরও লোক আছে। ঐ দিকে চলুন, বেরুবার গেট ঐ দিকে।
আহমদ মুসা কড়িডোরের মোড় ঘুরে বাম দিকে যাচ্ছিল। এবার তারা ছুটল ডান দিকে।
করিডোরটি একটা ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই ঘরটিই গেট রুম।
ঘরটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন সময় পেছন থেকে অনেকগুলো পায়ের শব্দ ভেসে এল।
আহমদ মুসা পেছন দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে সেই ঘরে ঢুকতে গেল। মেয়েটি আগে, আহমদ মুসা পেছনে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে একঝাঁক গুলীর মুখোমুখি হল তারা। মেয়েটি আগেই ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে তার দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। একটা গুলি এসে আহমদ মুসার হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হলো।
আহমদ মুসার আঙুল ট্রিগারেই ছিল। সে ঘরের চৌকাঠের পাশে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে অগ্নি বৃষ্টি করল ঘরের ভেতর।
ঘরের ভেতর ছিল একজন প্রহরী। প্রহরীটি আহমদ মুসাকে তাক করার জন্য একটু ডান দিকে সরে গিয়েছিল। সেটা করতে গিয়ে আহমদ মুসার গুলির মুখে পড়ে গেল সে। মেয়েটির পাশেই তার দেহটি মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল। পেছন থেকে ওরা অনেকখানি কাছে এসে গেছে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল আহমদ মুসা। তারপর বাইরে বেরুবার দরজা খুলে ফেলল সে।
ওরা ভেতর থেকে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে। স্টেনগানের গুলি বৃষ্টি করছে ওরা দরজায়। কিন্তু ওদের শত ধাক্কা, শত গুলি বর্ষণেও কিছু হবে না ঐ স্টিলের দরজার।
আহমদ মুসা দরজা দিয়ে বাইরে পা রাখার আগে মেয়েটির দিকে একবার ফিরে তাকাল। রক্তে ভাসছে মেয়েটি। আহমদ মুসা স্বগত উচ্চারণ করল, বোন তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, কিন্তু তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে পারলাম না।
বাইরে পা বাড়াল আহমদ মুসা। এতক্ষণে অনুভব করল ডান পা তার যেন পাথরের মত ভারী। পা তুলতে পারছে না সে। রক্তে ভেসে গেছে হাঁটু থেকে নিচের অংশ।
তবু পা টেনে নিয়ে ছুটল সে। এক মুহূর্ত দেরী করা যায় না। ওরা অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। আহমদ মুসা স্টেনগানগুলো ফেলে দিয়েছিল। শুধু বোরিসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া পিস্তলটাই তার পকেটে আছে।
ছোট একটা অন্ধকার উঠান পেরিয়ে সে একটা সরু রাস্তায় গিয়ে পড়ল। পাথর বিছানো কাঁচা রাস্তা। রাস্তাটা দক্ষিণ দিক থেকে এসে এ বাড়ির সামনে বাঁক নিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। আশেপাশে কোথাও বাড়ি নেই।
আহমদ মুসা ঠিক করল, রাস্তা দিয়ে সে যাবে না। ওরা বেরিয়ে প্রথমে রাস্তাটাই খোঁজ করবে। সে জোরে চলতে পারবে না, সহজেই ওদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা।
রাস্তা ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসা বালু ও কংকরে ভরা গমের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল। সামনে কিছুদূর গিয়ে গাড়ির হেডলাইট ছুটাছুটি করতে দেখে সে বুঝল, নিশ্চয় ওটা কোন হাইওয়ে। কোন গাড়ির সাহায্য তার চাই।
সে ঐ হাইওয়ের লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করল।
সে বুঝতে পারল না সিংকিয়াং-এর কোন নগরী এটা। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখে বুঝারও উপায় নেই। গম তো সিংকিয়াং-এর বহু জায়গায় জন্মে।
মুক্ত বায়ুতে অনেক আরাম বোধ করল আহমদ মুসা। কিন্তু পা টেনে টেনে আর চলা সম্ভব হচ্ছে না তার।
হাইওয়েতে উঠে ধপ করে বসে পড়ল আহমদ মুসা। তখনও রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান দিয়ে। আহমদ মুসা জামার আস্তিন ছিঁড়ে ক্ষতটা বেঁধে ফেলল রক্ত পড়া রোধ করার জন্য।
পা টেনে নিয়ে অনেকখানি পথ সে এসেছে । শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। রক্ত কি খুব বেশি পড়েছে?
হাইওয়ের এই এলাকাটা অন্ধকার। সামনেই নগরীর আলো দেখা যাচ্ছে।
একটা গাড়ির হেড লাইট ছুটে আসছে দক্ষিণ দিক থেকে নগরীর দিকে। কাছাকাছি এসে পড়ল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। গাড়ির হেড লাইটে তার গোটা শরীর আলোর বন্যায় ভেসে গেল। গাড়ি দাঁড় করাবার জন্যে হাত তুলল আহমদ মুসা।
নিজের অসহায়ত্বের জন্য জীবনে কাউকে কোনদিন সে অনুরোধ করেনি। কি বলে আজ অনুরোধ করবে আহমদ মুসা। বেদনায় বুকটা যেন চিন চিন করে উঠল।
গাড়ি আহমদ মুসাকে সামনে রেখে দাঁড়াল। হেড লাইটের তীব্র আলো তার উপর।
গাড়ি থেকে কেউ নামল না, কেউ কথা বলছে না। ক্ষতস্থান চেপে ধরে আহমদ মুসা বসে পড়েছে। তীব্র আলোয় অস্বস্তি লাগছে তার।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাবে এমন সময় গাড়িটি নড়ে উঠল। একটু সরে এসে গাড়িটি একেবারে আহমদ মুসার পাশ ঘেষে দাঁড়াল।
গাড়ির সামনের দরজা খুলে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। নেসে এসে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল, উঠতে পারবেন একা?
আহমদ মুসা তার পা-টি টেনে নিয়ে অতি কষ্টে গাড়িতে উঠল।
মেয়েটি লাল স্কার্ট পরা। লাল স্কার্ট, লাল হ্যাট মাথায়। হ্যাটের নেমে আসা প্রান্তটা তার নাক পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখ প্রায় দেখাই যায় না।
গাড়ির ভেতরে আলো জ্বেলে দিয়েছে মেয়েটি। আহত পায়ের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে উঠল, এখনো তো প্রচুর রক্ত বেরুচ্ছে, কাপড়টি রক্তে ভিজে গেছে।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে তার মাথার রুমালটি বের করল। তারপর আহমদ মুসার পা থেকে বাঁধা কাপড়টি খুলে ফেলে দিল। হাতের রুমাল দিয়ে রক্তটা একটু পরিষ্কার করে মাথার রুমালটা কয়েক ভাঁজ করে ক্ষতস্থানটা ভালো করে বেঁধে দিল।
মেয়েটি গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিতে গেলে আহমদ মুসা বলল, দয়া করে রক্তমাখা কাপড়খন্ড এবং রুমাল গাড়ির ভেতরে নিন।
মেয়েটি একটু থমকে দাঁড়াল। একটু চিন্তা করল। তারপর ও দু’টো জিনিস রাস্তার উপর থেকে কুড়িয়ে গাড়ির ভেতর রেখে দিল।
‘শুকরিয়াহ’ জানাল আহমদ মুসা।
গাড়ি ছেড়ে দিলে আহমদ মুসা বলল, অনুগ্রহ করে আমাকে কোন ডাক্তারখানায় পৌঁছে দিন।
মেয়েটি কিছু বলল না।
তীব্র বেগে এগিয়ে চলল গাড়ি শহরের দিকে।
মিনিট দশেক পর গাড়িটি একটি বড় প্রাচীর ঘেরা বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দায় প্রবেশ করল।
বার কয়েক হর্ণ বাজিয়ে গাড়ির দরজা খুলে মেয়েটি বেরিয়ে এল। আহমদ মুসার দরজাটিও খুলে ফেলল।
এ সময় সেখানে এসে দাঁড়াল মাঝ বয়েসী একজন মানুষ।
মেয়েটি তাকে বলল, চাচা, আমার এ মেহমান অসুস্থ। এঁকে আমাদের দু’তলার মেহমানখানায় পৌঁছে দাও। আমি ডাক্তার ডাকছি।

ডাক্তার ক্ষতস্থান ঠিক-ঠাক করে ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, স্টেনগানের গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবার কারনে ক্ষত বিরাট হয়েছে, কিন্তু অন্য কোন ভয়ের আশংকা নেই। গুলি হাড় স্পর্শ করেনি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। সব মিলিয়ে সেরে উঠতে দেরী লাগবে।
নতুন এক সেট উইঘুর পোশাক পরে বালিশে হেলান দিয়ে আধ-শোয়া অবস্থায় আহমদ মুসা। তার আহত ডান পা-টা আরেক বালিশের ওপর। ডান হাতটা তার কপালের ওপর। তার শূন্য দৃষ্টি দরজা দিয়ে বাইরে ছড়িয়ে আছে।
চিন্তা করছে। সবটা ব্যাপার তার কাছে অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে। কি পরিচয় এই মেয়েটির? গাড়িতে সে মেয়েটিকে চিনতে পারেনি, কিন্তু বাসায় এসে চিনেছে। তিয়েনশান ভ্যালি থেকে কাশগড় আসার পথে এই মেয়েটিই জেনারেল বোরিসের সাথে ছিল। মেয়েটিকে জেনারেল বোরিস উদ্ধার করে অপহরনকারীদের কাছ থেকে। জেনারেল বোরিসকে এড়িয়ে তার ‘আপনার কিছু বলার আছে কিনা’ প্রশ্নের কথা আহমদ মুসার এখনও মনে আছে। তার সেদিনের সেই আচরণ এবং আজকের আচরণের মধ্যে মিল আছে। মেয়েটির পরিচয় কি?
চোখ দু’টি আহমদ মুসার বাইরে থেকে ঘরের ভেতর ফিরে এল। ঘরের চারদিকে ঘুরে এল একবার চোখ। ঘরের দেয়ালে কার্ল মার্কস-এর একটা ছবি এবং প্রথম কম্যুনিষ্ট মেনিফেস্টোর বাঁধানো কপি ছাড়া বাড়তি কোন জিনিস নেই।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি দেয়ালের সেই কম্যুনিষ্ট মেনিফেস্টোর দিকে আটকে থাকল। ভাবল সে, এরা অবশ্যই একটা সক্রিয় কম্যুনিষ্ট পরিবার। কার্ল মার্কসের ছবি অনেকেই রাখে। কিন্তু কোন কমিটেড কম্যুনিষ্ট ছাড়া প্রথম কম্যুনিষ্ট মেনিফেস্টোকে এভাবে মাথার মণি করে রাখে না।
এই চিন্তা এসে আবার মাথা গুলিয়ে যায় আহমদ মুসার। মেয়েটির পরিচয় যদি এই হয়, তাহলে জেনারেল বোরিসের সাথে তার পার্থক্য (cv_©K¨) কোথায়? তাহলে তার সাথে মেয়েটির আচরনের ব্যাখ্যা কি?
হঠাৎ তার মনে হল, জেনারেল বোরিসকে তার চেনার কথা নয়।
এ সময় পায়ের খস খস শব্দে আহমদ মুসা দরজার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, মেয়েটি ঘরে ঢুকছে। ধব ধবে সাদা স্কার্ট পরা, মাথায় সাদা রুমাল। আহমদ মুসা তার চোখ নামিয়ে নিল।
মেয়েটি ঘরে ঢুকে তার কাছে এসে বলল, কেমন লাগছে এখন?
আহমদ মুসা সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, বেশ ভাল।
মেয়েটি টেবিলে গিয়ে ওষুধের চার্টের দিকে নজর বুলাল। তারপর বলল, একটা ক্যাপসুল খেয়েছেন সন্ধ্যা সাতটায়, আরেকটা খেতে হবে রাত একটায়। আমি এ্যাটেনড্যান্টকে বলে যাচ্ছি। সে আপনাকে জাগিয়ে দেবে। এ সময় খাবারের ট্রলি ঠেলে ঘরে ঢুকল একজন পরিচারিকা।
পরিচারিকা ট্রলিটি এনে খাটের সাথে ভিড়িয়ে দিল।
মেয়েটি বলল, খেয়ে নিন। এখন রাত সাড়ে আটটা, ন’টার মধ্যে আপনার ঘুমানো উচিত।
বলে মেয়েটি বেরিয়ে গেল।
খাওয়া শেষে পরিচারিকা যখন ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে গেল, তখন আবার ঘরে ঢুকল মেয়েটি। ঘরের চারদিকে একবার চেয়ে বলল, সব ঠিক আছে।
তারপর টেবিলের কাছে এগিয়ে আহমদ মুসাকে একটা সাদা সুইচ দেখিয়ে বলল, আপনার জরুরী কোন প্রয়োজন হলে এই সুইচ টিপবেন। আপনি ঘুমাবার আগে লক টিপে দরজা বন্ধ করতে বলবেন এ্যাটেনড্যান্টকে। সে এই পাশের খাটেই থাকবে। আমি তাকে বলে দিয়েছি, একমাত্র আমি ডাকা ছাড়া রাতে সে দরজা খুলবে না।
মেয়েটি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
মেয়েটির শেষ কথায় আহমদ মুসা বিস্মিত হয়েছে। তার এই শেষ কথার অর্থ কি? সে কি কোন বিপদের আশংকা করে? আহমদ মুসার জন্যে তার এই সাবধানতা কেন?
তখন রাত একটা। ক্লান্ত-শ্রান্ত আহমদ মুসা গভীর ঘুমে অচেতন। এ্যাটেনড্যান্টও জেগে থাকার চেষ্টা করে আধা ঘন্টা আগে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে আহমদ মুসা জেগে উঠল। আবার দরজায় নক করার আওয়াজ হলো, ঠক ঠক ঠক।
আহমদ মুসা সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। দেখল, এ্যাটেনড্যান্ট টেবিলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।
আবার নক হল দরজায়।
আহমদ মুসা বলল, কে?
বাইরে একটা নারী কন্ঠ ভেসে এল। বলল, আমি মেইলিগুলি। রাত একটা বাজে। এ্যাটেনড্যান্টকে ডেকে ওষুধ খেয়ে নিন।
কথা শেষ করেই সে চলে গেল। তার পায়ের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
আহমদ মুসা অবাক হয়ে কিছুক্ষন বসে থাকল। এই রাত একটা পর্যন্ত মেয়েটি জেগে ছিল তাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্যে। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে দুর্বোধ্য লাগছে।
তবে এইটুকু ভেবে খুশী হল যে, মেয়েটির নাম জানা গেল।
পরদিন বেলা আটটা।
আহমদ মুসা নাস্তা সেরে বসে মেইলিগুলির পাঠানো একটা আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে নজর বুলাচ্ছে।
এই সময় মেইলিগুলি এসে ঘরে ঢুকল।
একটা হালকা নীল রংয়ের উইঘুর পোশাক পরেছে সে আজ। মাথায় নীল রুমাল।
আহমদ মুসা ম্যাগাজিনটা বন্ধ করল, কিন্তু মুখ তুলল না।
মেইলিগুলি বলল, কোন অসুবিধা নেই তো?
-না ভাল আছি। বলল আহমদ মুসা।
মেইলিগুলি কাপড়ের ভেতর থেকে একটা রিভলবার বের করে আহমদ মুসার সামনে রেখে বলল, রিভলবার সমেতই পরিচারিকা আপনার জামা নিয়ে গিয়েছিল। কাল রাতেই পেয়েছি, কিন্তু ফেরৎ দিতে ভুলে গেছি।
চুপ করল মেইলিগুলি।
আহমদ মুসা কৌতুহল আর চেপে রাখতে পারল না। বলল, মিস মেইলিগুলি, জেনারেল বোরিসের কাফেলায় আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। গাড়িতে আপনাকে চিনতে পারিনি, কিন্তু বাড়িতে এসে চিনতে পেরেছি।
-আমি আপনাকে গাড়িতে তুলে নেবার আগেই চিনেছি।
-কিন্তু মিস মেইলিগুলি, আপনি তো কাল থেকে একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, আমি আহত হলাম কোথায়, আমার গুলি লাগল কিভাবে, কেন এমন হল? আপনার এই অস্বাভাবিক নিরবতা আমাকে বিস্মিত করেছে।
-আমি সব বুঝেছি।
-কি বুঝেছেন?
-আপনি জেনারেল বোরিসের কারাগার থেকে পালিয়েছেন।
-হ্যাঁ, এটা বুঝা স্বাভাবিক। আপনি আমাকে ওর হাতে বন্দী দেখেছিলেন।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, রাতে দরজা না খোলার জন্যে আপনার যে সাবধানতা, সেটা কি জেনারেল বোরিসের আশঙ্কা থেকেই?
-আমি তেমন আশঙ্কা করি না, ওটা আমার বাড়তি সাবধানতা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা বলল না। তার মনের প্রশ্ন শেষ হয়নি, মন তার পরিষ্কার হয়নি, কিন্তু কি প্রশ্ন করবে তা খুঁজে পাচ্ছে না সে।
কিছুক্ষন পর মেইলিগুলিই মুখ খুলল। বলল, আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?
মেইলিগুলির মুখে হাসি।
মেইলিগুলির দুষ্টুমিভরা কথার টোনে আহমদ মুসা মুখ তুলল। তার হাসিতে তার চোখে একটা দুষ্টুমি দেখতে পেল।
আহমদ মুসা নিরবে আবার চোখ নামিয়ে নিল। কোন উত্তর দিল না।
মেইলিগুলি বলল, জানেন, আমি আপনাকে জানি।
চমকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। বলল, কি জানেন?
-আপনি এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। আপনি আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মুখ তুলল না। কিছুক্ষন কোন কথা বলতে পারল না।
মেইলিগুলি নিরব। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা মুখ খুলল। ধীর কণ্ঠে বলল, এ কথা কি জেনারেল বোরিস আপনাকে বলেছে?
-না, তার কাছ থেকে আপনার নামও শুনিনি।
-তাহলে জানলেন কি করে?
বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকাল মেইলিগুলির দিকে। দেখল, তার চোখে মুখে এখনও সেই দুষ্টুমি। ঠোঁটে সেই হালকা হাসি।
মেইলিগুলি বলল, আরেকটা শুভ খবর আছে আপনার জন্যে।
-কি খবর?
-হাসান তারিক এসেছে।
মেইলিগুলির এই খবর আহমদ মুসার মনে বিস্ময় ও আবেগের তরঙ্গ নিয়ে এল। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম সাথী হাসান তারিক এসেছে তার খোঁজে? আবেগ অশ্রুরূপ নিয়ে তার চোখের কোণ ভারি করে তুলল।
আহমেদ মুসা মেইলিগুলির দিকে চেয়ে বলল, জানি সে না এসে পারে না। কিন্তু আপনি তাকে জানলেন কি করে? কোথায় দেখা হল?
মেইলিগুলি আহমেদ মুসাকে তার সাথে হাসান তারিকের দেখা হওয়ার ঘটনা বলল।
সব শুনে আহমেদ মুসা জিজ্ঞেস করল, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানেন?
-না, সে আর যোগাযোগ করেনি। বলল মেইলিগুলি।
আহমদ মুসা ও মেইলিগুলি দু’জনেই নীরব।
একটা প্রশ্ন এখন আহমদ মুসার মনে কিলবিল করছে, সেটা হলো এই মেয়েটি কে? কি পরিচয় তার?
প্রশ্নটা সে করেই বসল। বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনার পরিচয় জানতে পারি?
মেইলিগুলি হাসল। বলল, আমার পরিচয় শুনলে আপনি দুঃখ পাবেন। পেশায় আমি চিত্রাভিনেত্রী, রাজনৈতিক পরিচয় যুব কম্যুনিস্ট পার্টির একজন কর্মী। আর পরিচয়ের যে টুকু বাকি থাকল, দাদি কিছুক্ষণ পরে আসবেন ওঁর কাছে তা জেনে নেবেন।
বলে মেইলিগুলি উঠে দাঁড়াল। বলল, চলি। অফিসে যেতে হবে। ভুলবেন না, আপনার ঔষধ খাওয়ার সময় কিন্তু বেলা একটা।
মেইলিগুলি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আহমেদ মুসার চোখ দু’টি তার চলার পথের দিকে একবার না তাকিয়ে পারল না। কি অদ্ভূত মেয়েটি। সে আবার অভিনেত্রী, যুব কম্যুনিস্ট কর্মী! কিন্তু এগুলোর কোন ছাপ তো তার চোখে-মুখে, আচার-আচরণে নেই?
কয়েকদিন পরের ঘটনা।
মেইলিগুলিকে মাঝখানে হঠাৎ দু’দিনের জন্য উরুমচি থেকে আশি মাইল দূরে তিয়েনশানের লেক হেভেনে যেতে হয়েছিল। আহমদ মুসা ঘুমিয়ে থাকায় তাকে বলে যাওয়া হয়নি।
লেক হেভেন থেকে ফিরে কাপড়-চোপড় ছেড়েই মেইলিগুলি আহমেদ মুসার রুমে আসল।
আহমেদ মুসা চোখ বুঝে শুয়েছিল। চোখ একটু ধরে আসছে তার। কিন্তু মেইলিগুলির পায়ের শব্দে তার ঘুমটা ছুটে গেল। কিন্তু চোখ খুলল না সে।
এ্যাটেনড্যান্ট মা-চু বাইরে দরজার সামনে বসে ছিল।
মেইলিগুলি ঘরে ঢুকে প্রথমে টেবিলের কাছে গেল। ঔষধের চার্টের সাথে ঔষধগুলো মিলিয়ে নিল। ক্যাপসুলগুলোও গুনে দেখল সে। হিসেবে একটা ক্যাপসুল বেশী হয়।
মেইলিগুলি ফিরে দাঁড়িয়ে মা-চুকে বলল, একটা ক্যাপসুল বেশী কেন?
নিশ্চয় একবার ঔষধ খাওয়ানো হয়নি?
মা-চু মুখ নিচু করেছিল।
অবস্থা দেখে আহমদ মুসাকেই মুখ খুলতে হল। বলল, ওর কোন দোষ নেই। গত রাত একটায় ঠিকই সে ডেকে দিয়েছিল। উঠেছিলামও। কিন্তু বাথরুম থেকে এসে ঔষধ না খেয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।
মেইলিগুলি হাসল। বলল, যারা অন্যের ব্যাপারে বেশী চিন্তা করে, তারা নিজেদের ব্যাপারে বেশী বেখেয়াল হয়।
কথা শেষ করেই মেইলিগুলি মা-চুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি দেয়াল থেকে ওদু’টো ফটো নামিয়ে দাও।
মা-চু এসে দেয়াল থেকে কার্ল মার্কস এবং কম্যুনিস্ট পার্টির মেনিফেষ্টো নামাতে গেল।
আহমদ মুসা বলল, ওগুলো নামিয়ে ফেলছেন কেন?
মেইলিগুলি আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আহমদ মুসার চোখে চোখ রাখল। বলল, আমি আপনাকে অনুরোধ করেছি, আমাকে ‘আপনি’ না বলার জন্যে।
আহমেদ মুসা তার চোখ নামিয়ে নিল। বলল, ভুলে গিয়েছিলাম, ঠিক আছে।
মেইলিগুলি বলল, ওগুলি নামাচ্ছি দাদির হুকুমে। দাদি বলে দিয়েছেন, ওগুলো যেন আমি আমার ঘরে টাঙিয়ে রাখি, এখানে নয়।
-দাদির ওপর রাগ হয়েছে বুঝি?
-না, আমি তাঁর আদেশ পালন করছি।
-না, ওগুলো নামাবার প্রয়োজন নেই। ওগুলো নামানোর কারণ যদি আমি হই, তাহলে বলছি, নিছক বাইরের পরিবর্তন আমার কাছে কোন বিষয়ই নয়।
-না আপনি কারণ নন। দাদি একটা সুযোগ গ্রহণ করেছেন মাত্র। দাদি এ দু’টো ফটো বাড়ির কোথাও টাঙাতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁর আওতার বাইরে এই মেহমান খানায় এনে টাঙিয়ে রেখেছিলাম।
-এখন যে এ দু’টো তোমার ঘরেই উনি টাঙাতে বলছেন?
মেইলিগুলির মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, আপনার তুলনায় বিন্দুমাত্র গুরুত্বও দাদির কাছে আমার এখন নেই। মনে হচ্ছে, দাদিকে আপনি জয় করে নিয়েছেন।
আহমদ মুসার মুখ নিচু। হাতের ম্যাগাজিনটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, না মেইলিগুলি, তোমার দাদিই আমাকে জয় করে নিয়েছেন। তোমার দাদির মধ্যে আমি গোটা সিংকিয়াংকে দেখতে পেয়েছি। তিয়েনশানের মাথার বরফের মতই এই অঞ্চলের সব মুসলমানের বেদনা ও বঞ্চনার অশ্রু ওঁর হৃদয়ে জমাট বেধে আছে। একটা অক্ষম প্রতিবাদের ঝড় বইছে তাঁর হৃদয়ে নিরন্তর।
বলতে বলতে আহমদ মুসার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য এক আবেগে।
মেইলিগুলি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করে থামল।
মা-চু ফটো দু’টি নামিয়ে রেখে বাইরে গেছে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল মেইলিগুলি। সে টেবিলের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। সে আহমদ মুসার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করেছে। ভাবছে সে।
দু’জনেই নীরব।
নীরবতা ভাঙল মেইলিগুলিই। বলল, আমার দাদিকে আমি চিনি, এ ভাবে এতটা চেনার দৃষ্টি আমার নেই। কিন্তু আপনার তিনটি বাক্য সিংকিয়াং এর নতুন রূপ আমার সামনে তুলে ধরেছে। আমার প্রশ্ন, কম্যুনিজম ও মুসলিম স্বার্থ কি এক সাথে চলতেই পারে না?
আহমদ মুসা বলল, দেখ দু’টার দুই জীবন দৃষ্টি। এক সাথে চলতে পারে কি করে? কম্যুনিজমে জীবন এখানেই শেষ, তাই ভোগবাদ তাদের ধর্ম। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের সাথে তার কোনই পার্থক্য নেই। কিন্তু ইসলামে এই জীবন এটা অসীম জীবনের প্রস্তুতি মাত্র, তাই ভোগের চেয়ে অন্যের জন্যে ত্যাগের শিক্ষা বড়। শান্তিময় ও সুশৃঙ্খল দুনিয়ার জন্য মানুষের ত্যাগের প্রবলতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। কম্যুনিজমের মাথার ওপর জওয়াবদিহী করার কোন অথরিটি বা আল্লাহ্‌ নেই, তাই কম্যুনিষ্টরা স্বেচ্ছাচারি হতে পারে। তারা তাদের ইচ্ছামত আইন করে, আবার ভাঙে। কিন্তু ইসলামের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানুষ নয়। আল্লাহ্‌র কাছে প্রতিটি কাজের জন্য তাকে জওয়াবদিহী করতে হয়। তাই মানুষের স্বেচ্ছাচারি হবার অবকাশ এখানে নেই। ফলে ‘মানুষ প্রভুদের’ জুলুম অত্যাচার থেকে মানুষ এখানে রক্ষা পায়। সর্বোপরি, কম্যুনিজমের আল্লাহ্‌ নেই বলে, পরকাল নেই বলে জীবনটাই সেখানে অর্থহীন, অসহনীয়।
কিন্তু ইসলামে আল্লাহ্‌ আছে ও পরকালে এক অসীম জীবন আছে বলে জীবন এখানে মূল্যবান, আনন্দময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
মেইলিগুলি গোগ্রাসে কথাগুলো যেন গিলছিল।
আহমদ মুসা থামলেও সে কিছুক্ষণ কথা বলল না। পরে ধীরে ধীরে বলল, আপনি ইসলামের যে রূপ তুলে ধরলেন, তা তো একটা নীতিকথা । বাস্তবে তো পুঁজিবাদের জয়জয়কার চলছে।
আহমদ মুসা হাসল একটু। বলল, নীতিই তো প্রয়োজন। যদি নীতি ঠিক থাকে তাহলে আজ না হলে কাল তার প্রয়োগ হবেই। তুমি পুঁজিবাদের যে জয়জয়কারের কথা বলছ, আসলে ওটার নাম স্বেচ্ছাচারিতা। এই স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ ঘটে কোথাও পুঁজিবাদের নামে কোথাও কম্যুনিজমের নামে। অপরাধের নাম ঐ একটাই। মুসলিম বিশ্বেও তুমি এ অপরাধ দেখ কারণ সেখানে ইসলাম স্বাধীন নয়। মুসলিম দেশগুলি ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়েছে কিন্তু ইসলাম সেখানে স্বাধীন হতে পারেনি। বিজাতীয় ঔপনিবেশিকদের গড়া ‘মুসলিম’ নামের লোকদের হাতে ইসলাম সেখানে বন্দী। ইসলামকে ওদের হাত থেকে মুক্ত করাই আমাদের সংগ্রাম। তুমি যাকে নীতি বলছ, মুক্ত ইসলামে সেটাই বাস্তবতা। আহমেদ মুসা থামল।
মেইলিগুলি বলল, বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু যে সংগ্রামের কথা বললেন তা পর্বতের চেয়েও তো ভারি।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ভারি বলেই আনন্দ এখানে বেশী, পুরুস্কারও অপরিসীম।
-সফল হলে তবেই তো?
-না পুরুস্কারের জন্যে সাফল্য শর্ত নয়। দেখ, গুলি আমার পায়ে লেগেছিল, বুকে লাগলেই মারা যেতাম। তাহলে আমার জীবন কি ব্যর্থ হতো? না। আমার আল্লাহ্‌ দেখবেন তার দেয়া জ্ঞান ও যোগ্যতাকে আমি তাঁর কাজে অর্থাৎ তাঁর বান্দাহদের কল্যাণে ব্যবহার করেছি কিনা। যদি করে থাকি তাহলেই আমি সফল, অসীম এক পুরুস্কারের মালিক হব আমি।
আহমদ মুসা থামলেও মেইলিগুলি কিছু বলল না। মাথা নীচু করে ছিল সে। রুমালটা মাথা থেকে কিছুটা নেমে গেছে। কয়েকটা চুল উড়ে এসে পড়েছে কপালের ওপর। রুমালের একটা প্রান্ত নিয়ে খেলা করছিল তাঁর দু’টো আঙুল।
অবশেষে মুখ তুলল মেইলিগুলি। আহমেদ মুসার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে নিয়ে বলল, দাদি তো আমার প্রফেশনকে ঘৃণা করেন, আপনার মত কি?
-তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার মেইলিগুলি, আমার মন্তব্য করা ঠিক হবেনা।
-আপনি ঠিক বলছেন না।
-কেন?
-নীতির প্রশ্নে কোন নিউট্রালিটি থাকতে পারে না।
-ঠিক বলেছ।
-তাহলে উত্তর দিন।
-তোমার মতটা কি শুনি?
-আমার মত তো আছেই, আমি আপনার মত জানতে চাই।
-মেইলিগুলি, আমি আমার নিজের জন্য এ প্রফেশন পছন্দ করতাম না।
-কেন?
-নীতিগতসহ অনেক কারণ আছে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে একটা কথাই তোমাকে বলব। সেটা হল, এতে পার্সোনাল লাইফের ক্ষতি হয়।
-পার্সোনাল লাইফকে একদম পবিত্র রেখে কেউ যদি এটা করতে পারে?
-নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে পবিত্র রাখার প্রশ্ন শুধু তো নয় মেইলিগুলি, অন্যের মন ও মননকে পবিত্র রাখার প্রশ্নও আছে।
আহমেদ মুসার শেষ কথাটার পর মেইলিগুলি তার চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তার নীল চোখ ও শুভ্র মুখের ওপর দিয়ে একটা সলজ্জ রক্তিম চাঞ্চল্য ভেসে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। এ সময় দাদি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঘরে।
মেইলিগুলির দিকে চোখ পড়তেই বলল, তোকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, তুই এখানে? ভাল। আল্লাহ্‌ তোকে সুমতি দিক। তোর অফিস-টফিসের চেয়ে এখানে বসে থাকা হাজারগুণ ভাল।
তারপর দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল, ওদু’টো তাহলে নামিয়েছিস, বেশ করেছিস, আর টাঙাস না কোথাও।
মেইলিগুলি চেয়ার থেকে উঠে দাদির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, তুমি না ওদু’টো আমার ঘরে টাঙাতে বলেছ?
-ওটা বলা নয়। তুই আমার এ ভাই কে জিজ্ঞেস কর, অনুমতি দিলে টাঙাবি।
-উনি তো অনুমতি দিবেন। এখান থেকে নামাতে উনি নিষেধ করেছিলেন। তোমার মত সবাই নন।
-চুপ, কথা বলবিনা। তুই আমার এ ভাইটিকে জানিস? এ বাড়ি আজ ধন্য। মাঝে মাঝে ভাবি স্বপ্ন দেখছি কিনা, স্বপ্ন না আবার ভেঙ্গে যায়। তোর পূর্ব পুরুষ পূণ্যাত্মা ইবনে সাদ এবং আব্দুল করিম সাতুক বোগরা খানদের দোয়ার ফলেই একে আমরা পেয়েছি। তোরা তো সব গোল্লায় গেছিস।
-কিন্তু দাদি, আমিই তো ওঁকে এনেছি। না হলে পেতে?
-বেশ করেছিস, এবার ভাল হ।
-আমি কি খারাপ?
-খারাপ নয়, কিন্তু নামায তুই চিনিস? আর কাজটা করছিস কি?
বলেই দাদি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই, তুমি আমার এ দুষ্টু বোনটিকে একটু নামায পড়তে বলে দাও। আমি বললে শুনে না। তুমি বললে শুনবে।
আহমদ মুসা মুখ নিচু করে একটা বই নাড়াচাড়া করছিল আর দাদি-নাতনির মধুর কথা কাটাকাটি শুনছিল। দাদির কথায় মুখ তুলল আহমদ মুসা। দাদি এবং মেইলিগুলি দু’জনেই তার দিকে তাকিয়ে।
দাদির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা একটু হেসে বলল, আপনার নাতনি এখন থেকে নামায পড়বেন দাদি।
কথা শেষ করার আগেই আহমদ মুসা তার চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।
মেইলিগুলির আরক্ত মুখের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই দাদি তার হাত তুলে মেইলিগুলির মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, শুনলিতো, এবার তোর মুখে বলতো শুনি?
‘বলব না’ বলে মেইলিগুলি ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

Top