৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস

চ্যাপ্টার

উরুমচির ইবনে সাদ রোড ধরে পুর্বদিকে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে শক্ত সমর্থ একটা হাই ল্যান্ডার জীপ।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। রাস্তার বিজলিবাতিগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে শহর-জীবনের এক সনাতন আলো আঁধারী। অভিজাত আবাসিক এলাকা এটা। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। ফুল স্পীডে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার জীপ। জীপে মোট পাঁচটি সিট। সামনে দু’টা, পেছনে তিনটা। ড্রাইভিং সিটে বসেছে আহমদ ইয়াং তার পাশেই আহমদ মুসা। পিছনে হাসান তারিক এবং মা-চু বসেছে।
আহমদ মুসা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে একনজর দেখলেন, সন্ধ্যা ৭ টা। আহমদ মুসা চিন্তা করলেন, ওয়াংহুয়া তার নতুন বসতিকামী কাফেলা নিয়ে নিশ্চয়ই দিনে রওয়ানা দিয়েছে। মধ্য রাত্রির নীরব প্রহরে শিহেজি উপত্যকায় পৌছতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং উরুমচিতে ওদের রাত দশটায় অবশ্যই পৌঁছা চাই। কিন্তু ওদের আটকাতে হবে উরুমচি থেকে অনেক দূরে বিজন পাহাড়ি অঞ্চলে।
কানশু প্রদেশ থেকে যে উরুমচি হাইওয়ে এগিয়ে এসেছে সেই পথেই ওয়াংরা আসছে।
আহমদ মুসার মানস দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে উরুমচি থেকে কানশু পর্যন্ত পথের দৃশ্য। কৈশোরে এই পথে সে একাধিকবার উরুমচি এসেছে। গোটা পথটাই তার চোখের সামনে এখনও জ্বল জ্বল করছে। পথটা তখনও পাকা হাইওয়ের রুপ নেয়নি। কাঁকর বিছানো সে পথে উট চলতো, ঘোড়ার গাড়িও চলতো অনেক। তখনকার চেয়ে এখনকার গতি অনেক বেড়েছে। ধীরে-সুস্থে গিয়েও একশ মাইল দূরের আল-খলিল উপত্যকায় রাত নটার মধ্যে তারা পৌছতে পারবে। তিয়েনশানের পাহাড়ের একটা ছোট দক্ষিণমূখী শাখায় এই আল-খলিল উপত্যকা। উরুমচি হাইওয়েটি পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে এই উপত্যকা অতিক্রম করে এসেছে। ঐ গিরিপথ হাইওয়ে দুপারে কয়েক মাইল বিস্তৃত উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। ওয়াংদের আগ্রাসী কাফেলাকে আটকাবার উপযুক্ত জায়গা এটাই। আহমদ মুসা ভেবে-চিন্তে এই স্থানটা নির্বাচন করেছেন। পরিকল্পনা অনুসারে রাত নটার মধ্যেই আল-খলিল উপত্যকায় তাদের পৌছতে হবে। ওয়াংরা ওখানে পৌছার আগে তাদের অনেক কাজ আছে সেখানে।
আহমদ মুসার চিন্তা হোঁচট খেল। পেছন থেকে মা-চুর বেসুরো কন্ঠ ধ্বনিত হলো, সামনেই বাঁ দিকে বাঁক নেবেন। বাঁ দিকের লেনটা হয়ে পিয়াও লিন রোডে পড়া যাবে।
তোমার পিয়াও লিন রোড কি আমাদের উরুমচি হাইওয়েতে নিয়ে যাবে? বললেন আহমদ মুসা।
না স্যার। পিয়াও লিন রোড থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে লিও শাও চি স্কোয়ার হয়ে আমরা পিং রোডে পড়ব, সেখান থেকে উংফু, তারপর…….
আহমদ মুসা তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, তারপর থাক। মাথায় ওসব থাকবে না। তুমি আহমদ ইয়াংকে সাহায্য কর।
একটু দম নিয়ে আহমদ মুসা বললেন, মা-চু তুমি আল-খলিল চেন?
চিনব না কেন? আল-খলিল তো উরুমচির দরজা। কিন্তু ওর নাম এখানে আল-খলিল নয়।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব ওর নাম তো দিয়েছে ‘মাও ভ্যালি’ সেই কবে। আপনি আল-খলিলের নাম জানলেন কি করে?
জানব না কেন মা-চু? আমি কি সিংকিয়াং-এর মানুষ না?
মনে ছিল না স্যার। কিছুটা কাঁচু-মাচু হয়ে বলল মা-চু।
আচ্ছা মা-চু, আল-খলিল গিরিপথে আমরা ওয়াং হুয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালে কেমন হবে?
খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মা-চুর। বলল ওখানে উপযুক্তভাবে দাঁড়াতে পারলে ওয়াং হুয়াদের কয়েকদিন তো ঠেকিয়ে রাখা যাবেই।
উপযুক্তভাবে বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ?
স্যার, উরুমচি হাইওয়ের আল-খলিল গিরিপথ থেকে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের দেয়াল গেছে মাইল চারেকের মত, আর উত্তর দিকে গেছে পাঁচ মাইল। গিরিপথে বাধা পেলে খাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ওদের পক্ষে মালসামান নিয়ে আল-খলিল উপত্যকায় নামা সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে ওরা চার-পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে উত্তর বাঁ দক্ষিণ দিক দিয়ে পাহাড় ঘুরে এপারের আল-খলিল উপত্যকায় নামার চেষ্টা করবে। এ চেষ্টার পথ যদি বন্ধ করা যায় তাহলে ওয়া আটকা পড়ে যাবে। হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে ওদের অবশ্যই কয়েকদিন কেটে যাবে।
চমৎকৃত হলেন আহমদ মুসা অভিজ্ঞ সমরকুশলীর মত মা-চুর কথায়।
বিস্ময় মানলেন যে, মা-চু তার মনের কথাই গড় গড় বলে যাচ্ছে ঠিক মাইক্রোফোনের মত।
মা-চু একটু দম নিলে আহমদ মুসা বলে উঠলেন, আচ্ছা, মা-চু, ওয়াং হুয়াদের পাহাড়ে ঘুরে আসা কি করে ঠেকাবে, চিন্তা করেছ?
ও তো সোজা স্যার। পাহাড় ঘুরে আমাদের উত্তর ও দক্ষিণের সংকীর্ণ পথ দুটার কৌণিক পরিমাপে কয়েক সারি বিস্ফোরক পাততে হবে। তাহলে ওদের গতি রুদ্ধ হয়ে যাবে।
মা-চু থামল। খুশিতে ভরে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। তিনিও তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না।
পাশে বসে অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল হাসান তারিক কিছু বলার জন্য। এবার সুযোগ পেয়ে বলল, মা-চু, আপনি তো সাংঘাতিক সমর প্রকৌশলী, আপনাকে সেনাবাহিনী থেকে ওরা ছাড়ল?
ছাড়েনি, পালিয়ে এসেছি। বে-দ্বীন শত্রুর সেনাদলে থেকে পরকাল খোয়াব নাকি?
বাসায় বসে বসে ভাল লাগে আপনার?
ভাল লাগে না, কিন্তু শান্তিতে ধর্ম-কর্ম করতে পারছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। তারপর আল্লাহ নিজেদের কোন সৈন্যদল দিলে তাতে যোগ দেব। এসব ভাবি বলে আপনাদের আমার খুব ভাল লাগে।
কি ভাল লাগে আমাদের?
জাতির জন্য আপনারাই আসলে কিছু করেছেন, করছেন।
আপনি কি সব জানেন?
আপামনি আমাকে সব বলেছে।
মা-চু থামল। হাসান তারিকও আর কিছু বলল না। কথা বললেন আহমদ মুসা। বললেন, মা-চু, আমাদের সাথে তুমি নিজেই আসতে চেয়েছ, না তোমার আপা তোমাকে পাঠিয়েছে?
মাফ করবেন স্যার। আপনাদের সাথী হবার সাহস কি আমার আছে? আপাই আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, তোমার স্যার সুস্থ হয়ে উঠেননি, তার পাশে পাশে তোমাকে থাকতে হবে।
মা-চুর সরল সোজা এ ধরনের প্রকাশে আহমদ মুসা কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। এক ঝলক রক্ত যেন তার মুখমণ্ডলকে মুহুর্তের জন্য লাল করে তুলে আবার মিলিয়ে গেল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এই সময়ে মা-চু বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এই তো আমরা লিও শাও চি স্কোয়ারে প্রবেশ করছি। স্কোয়ারের বাঁ পাশের রোডটাই পিং রোড।
লিও শাও চি স্কোয়ারে এসে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে গাড়ি পিং রোডে প্রবেশ করল।
পিং রোড বাণিজ্যিক এলাকা। নিয়ন সাইনের সমারোহ। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। গাড়িঘোড়াও প্রচুর। লিও শাও চি স্কোয়ারে এসেই গাড়ির স্পীড অনেকখানিই কমিয়ে দিতে হয়েছে। পিং রোড উরুমচির নতুন এলাকা। রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত। মনে হয় পঞ্চাশ বছর সামনের প্রয়োজনকে লক্ষ রেখেই রাস্তাগুলো তৈরী হয়েছে। তাই খুব স্বচ্ছন্দ গতিতে গাড়ি এগুতে পারছে। পিং রোডে ঢুকে গাড়ির গতি আবার কিছুটা বাড়ানোও গেছে।
পিং রোড গিয়ে পড়েছে উংফু এভেনিউ-এ। উংফু উরুমচির সবচেয়ে অভিজাত বিপনী কেন্দ্র। দীর্ঘ এই এভেনিউরই শেষ প্রান্তে সরকারী রেসিডেন্সিয়াল ব্লক এবং সরকারী প্রশাসনিক ভবনসমূহ। প্রধান প্রশাসনিক ভবনের পরেই ছোট্ট একটি লেক এবং বিশাল একটি উদ্যান। এই সংরক্ষিত এলাকার মধ্যেই সিংকিয়াং- এর গভর্নর লি ইউয়ান এর বাস ভবন।
লি ইউয়ান জাতিতে হান। পৈত্রিক বাড়ি উরুমচিতে। তার শিক্ষা জীবন কাটে ব্যবসায়ী পিতার সাথে সাংহাইয়ে। কর্ম জীবন তার শুরু হয় পিকিং-এ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগে তার পিতা নিহত হয়। লি ইউয়ানও চাকুরী হারিয়ে উরুমচিতে তার পৈত্রিক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। লি ইউয়ান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সে উরুমচিতে সবজি ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দুরের উপত্যকা অঞ্চল থেকে শাক সবজি কিনে মাথায় করে বয়ে এনে উরুমচির বাজারে বিক্রি করত সে।
লি ইউয়ান সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, তার পিতামহ একজন কাজাখ মুসলমান। তার পিতামহী ছিল হান বংশীয়। তার পিতার জন্মের অল্পকাল পরে পিতামহ মারা গেলে মাতামহী শিশুপুত্রকে নিয়ে হান পরিবারে ফিরে আসে। অতঃপর হানদের একজন হয়ে লি ইউয়ানের পিতা বড় হয়। লি ইউয়ান এখন পুরোপুরি হান বংশীয় বলে পরিচিত। কিন্তু, চেহারা মেলে না। টানা নীল চোখ, উন্নত নাসিকা, দীর্ঘ দেহ তার দেহে তুর্কী রক্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আহমদ মুসার জীপ পিং রোড থেকে উংফু এভিনিউতে এসে পড়ল।
উংফু এভিনিউ-এ জনসমাগম আরও একটু কম। গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল আহমদ মুসার জীপ।
বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল দুটো হেডলাইট। গতিটা একটু যেন বেপরোয়া। একদম কাছে এসে গেছে হেডলাইট দুটো।
এ সময় দুটো কার ওভারটেক করল আহমদ মুসার জীপকে। ওভারটেক করতে গিয়ে কার দুটো ছুটে আসা গাড়িটির পথটা অনেকখানি দখল করে ফেলেছিল। স্লো হয়ে গিয়েছিল ছুটে আসা গাড়িটির গতি।
কার দু’টো ওভারটেক করে তাদের লাইন পেরিয়ে গেল। ছুটে আসা গাড়িটি তখন আহমদ মুসার গাড়ির সমান্তরালে। গাড়ী দুটোর মধ্যে দুরত্ব চার গজের বেশী নয়।
‘বাঁচাও’ নারী কন্ঠের একটা চিৎকার ভেসে এল ঐ গাড়ী থেকে। সেই সাথে গোঙানিও। মনে হল অনেক বাধা ডিঙিয়ে গোঙানি মিশ্রিত চিৎকারটি ভেসে এল।
তা ছিল শব্দের এক ঝলক মাত্র। গাড়িটি ছুটে বেরিয়ে গেল পেছনে চোখের আড়ালে। চিৎকার শুনেই আহমদ মুসা চোখ ফিরিয়েছিলেন। চঞ্চল হয়ে উঠেছিল চোখের দৃষ্টি। একটা উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল সে দৃষ্টি থেকে।
দ্রুত ভাবছিলেন তিনি। না, তিনি একজন অসহায় নারীর ওই আবেদনকে মাড়িয়ে সামনে এগুতে পারেন না। সিদ্ধান্তের এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার চোখে মুখে।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াং- এর দিকে ফিরে বললেন, গাড়ি ঘুরাও আহমদ ইয়াং, ওই গাড়ীটাকে অনুসরণ কর।
আহমদ ইয়াং আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়েই গাড়িটি ঘুরিয়ে নিল। পেছনের সিটে বসা হাসান তারিক একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল: কিন্তু মুসা ভাই, আমাদের হাতে সময় তো কম।
জানি তারিক, কিন্তু কোন মজলুমের আবেদন কানে আসার পর তাকে তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
কিন্তু মুসা ভাই, যে দায়িত্ব আমাদের কাধে সেটা বড় নয়? সেটা বিবেচ্য নয়?
বড় অবশ্যই, কিন্তু একজন বিপদগ্রস্থা নারীর এই ‘বাচাও’ চিৎকার কানে আসার পর ওটা এখন আর প্রথম বিবেচ্য নেই।
হাসান তারিকের কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। আহমদ মুসাই আবার কথা বললেন। বললেন, মনে কর তারিক, ওই মেয়েটি যদি আমার বোন হত, মেয়ে হত, তাহলে তার ঐ চিৎকার শোনার পর আমরা কি এক পা-ও সামনে এগুতে পারতাম? পারতাম না। একজন মুসলমানের কাছে আল্লাহর প্রতিটি মজলুম বান্দাই সমান।
ঠিক বলেছেন, মুসা ভাই, আমি ভুল করছিলাম।
ভুল নয় তারিক, তোমার যুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা এই মুহুর্তে যা করণীয় তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আল্লাহ আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করুন।
আহমদ মুসাদের জীপ ছুটছিল সামনের গাড়িটির পেছনে। সামনের গাড়ীটি একটি ছোট্ট মাইক্রোবাস।
গাড়িটির কাছাকাছি হবার জন্য আহমদ মুসাদের জীপকেও গতি বাড়াতে হয়েছে। ফলে দুটো গাড়ীই ছুটছিল বেপরোয়া গতিতে।
উংফু এভিনিউ রিং রোডের মত। এভিনিউটি শহরের পুর্ব প্রান্তে উরুমচি হাইওয়ে থেকে বের হয়ে প্রথমে উত্তর দিকে এগিয়ে গভর্নর ভবনকে ক্রস করে পশ্চিম দিকে বাক নিয়েছে। নতুন উরুমচি নগরীর গোটা উত্তরপ্রান্ত বেষ্টন করে পুরোনো উরুমচি নগরীর প্রধান সড়ক বাজার রোডে গিয়ে লম্বাভাবে পড়েছে।
মাইক্রোবাসটিকে অনুসরণ করে আহমদ মুসার জীপ বাজার রোডে এসে পড়ল।
বাজার রোডটি উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। উংফু থেকে অনেক খানি সরু। রাস্তার দু ধারে দোকান-পাট খোলা। কিন্তু, রাস্তায় লোকজন ও গাড়ী-ঘোড়ার সমাগম খুব বেশী নয়।
নতুন উরুমচির সাথে পুরাতন উরুমচির এটাই পার্থক্য যে, নতুন উরুমচির বিপনিগুলো সন্ধ্যার পর ঝলমলিয়ে ওঠে, কিন্তু পুরাতন উরুমচির বাজার-বিপনিগুলোতে লোকের সমাগম তখন কমতে থাকে। মাগরিবের আযানের আগে থেকে এই ভীড় কমা শুরু হয়, এশার পর বাজারগুলো যেন ঘুমিয়ে পড়ে। মুসলিম শহর উরুমচির এ ঐতিহ্য অনেক আগের। তা এখনও চলছে। কম্যুনিস্ট শাসন এবং তারপরে সাংস্কৃতিক বিপ্লব মুসলমানদের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু, মুসলিম জনপদের অনেক অভ্যাসের মত এ অভ্যাসটিও দূর করতে পারেনি।
মাইক্রোবাসটি বাজার রোড ধরে সমান গতিতে এগিয়ে চলেছে।
আহমদ মুসা বললেন, ইয়াং ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে বলে মনে কর?
আমার মনে হয় না। ওদের গাড়ির স্পীডে কোন কমবেশি দেখছি না।
ঠিক বলেছ, বেশীক্ষণ আর গোপন থাকতে পারব না। উংফু এভিনিউতে প্রচুর গাড়ির ভীড়ে লুকানো গেছে। পুরানো উরুমচির ফাকা রাস্তায় আর তা সম্ভব নয়।
সত্তর কিলোমিটার গতিতে প্রায় দুশ গজের মত ব্যবধান রেখে এগিয়ে চলছিল গাড়ি দুটি। বাজার রোড ধরে কিছুক্ষণ চলার পর সামনের মাইক্রোবাসটির গতি হঠাৎ বেড়ে গেল।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে আহমদ ইয়াং-এর দিকে তাকালেন।
আহমদ ইয়াং তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। স্পীডোমিটারের কাটা একলাফে নব্বইতে উঠে এল।
গাড়িটার আরও কাছাকাছি যাও ইয়াং।
স্পিডোমিটারের কাটা আবার লাফিয়ে উঠল। একশ বিশ কিলোমিটারে উঠল গাড়ির গতি।
বাজার রোডের মাঝামাঝি জায়গায় এসে হঠাৎ মাইক্রোবাসটি বা দিকে মোড় নিয়ে পুর্বমুখী একটি রাস্তায় ঢুকে গেল।
ওরা পালাচ্ছে মুসা ভাই। পেছনে থেকে বলে উঠল হাসান তারিক।
ওরা যেখানে ঢুকল ওটা ওলুগবেগ রোড তারপর সুলেমানিয়া রোড হয়ে উংফুতে যাওয়া যায়।বলল মা-চু।
মিনিট খানেকের মধ্যেই আহমদ মুসাদের গাড়ি ওলুগবেগ রোডে প্রবেশ করল। মাইক্রোবাসটি তখন চারশ গজের মত দূরে।
ওলুগবেগ রোডটি আবাসিক। রাস্তার দুধারে কিছু কিছু দোকান-পাটও আছে। রাস্তায় দুচারজন লোক দেখা যাচ্ছে। গাড়ির পাগলাগতি দেখে মানুষ একবার এদিকে তাকিয়েই ছিটকে সরে যাচ্ছে পাশে।
কয়েক মাইল চলার পর মাইক্রোবাসটি ডানদিকের একটা রাস্তায় ঢুকে গেল।
পেছন থেকে মা-চু বলল, ওরা বিবিখান রোডে ঢুকল। বিবিখান রোড দক্ষিণ দিকে মাইল তিনেক এগিয়ে চ্যাংচিন রোডে পড়েছে।
বিবিখান রোড ধরে চ্যাংচিন রোডের কাছাকাছি আসার পর সামনের মাইক্রোবাস থেকে একটা হর্ণ শোনা গেল। তারপরই সামনে থেকে আর একটা হর্ণ বেজে উঠল। পরের হর্ণ যে গাড়ি থেকে আসল তা দেখা গেল না।
মা-চু পেছন থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল, স্যার ওদুটো হর্ণই রেড ড্রাগনের। আমি ওদের সংকেত জানি।
মুহুর্তের জন্যে কপালটা কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কিছু যেন ভাবলেন তিনি। তারপর সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন, হাসান তারিক তৈরি থাক। আমার মনে হয় সামনের মাইক্রোবাস আরেকজন সাহায্যকারীকে ডেকেছে অয়্যারলেসে।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। তারপর আহমদ ইয়াং-এর দিকে আরেকটু এগিয়ে একটা হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে বললেন, ইয়াং তুমি আমার সিটে চলে এস।
আহমদ ইয়াং পা দুটি সিটের উপর তুলে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত চলে এল আহমদ মুসার সিটে। আহমদ মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।
সামনেই মোড়। বিবিখান রোড গিয়ে পড়েছে চ্যাংচিন রোডে। চ্যাংচিন রোড পুর্ব পশ্চিম লম্বা।
সামনের মাইক্রোবাসটি মোড়ে গিয়ে পৌছেছে। মোড়ে গিয়ে বাক নিল বায়ে অর্থাৎ পুর্বদিকে।
এই সময় পশ্চিম দিক থেকে একটা ট্রাক এসে দাড়াল মোড়ে, একেবারে বিবিখান রোডের মুখে।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বুঝলেন, ওরা রাস্তা ব্লক করে মাইক্রোবাসটিকে সরে পড়ার সুযোগ করে দিতে চায়।
আহমদ মুসা মোড়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে পরিমাপ করে দেখলেন ট্রাকটা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে রাস্তা ধরে বা দিকে মোড় নেবার যো নেই। তবে, ফুটপাথ ধরে যাবার মত জায়গা আছে, কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বেবিট্যাক্সি। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
ট্রাকটা তখন একশ গজও দূরে নয়। আমহদ মুসা বললেন, তারিক আমি ফুটপাথে নামছি। ট্রাক ও লাইটপোষ্টের মাঝখানের ফাঁকা স্পেস দিয়েই আমরা স্লিপ করব। বেবিট্যাক্সির মতলব খারাপ না হলে আমাদের রাস্তা দিয়ে দেবে আর খারাপ হলে ওকে ধাক্কা দিয়ে আমাদের রাস্তা পরিস্কার করে নিতে হবে। তারিক তুমি ট্রাকের চাকা ফুটো করে দাও। ট্রাকের জানালা দিয়ে দুটি মাথা দেখা যাচ্ছে। ওদের হাত বের না হলে তাদের কিছু বলো না।
হাসান তারিক এম-১০ হাতে নিয়ে তাক করল ট্রাকের সামনের চাকায়।
আহমদ মুসা গিয়ার চেঞ্জ করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, জীপ লাফ দেবে সাবধান।
পরক্ষণেই প্রায় লাফিয়ে পড়ল জীপ ফুটপাথে। সেই সাথে গর্জে উঠল হাসান তারিকের হাতের এম-১০ মেশিন রিভলবার। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড গুলি বৃষ্টি করল। এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেল ট্রাকের সামনের চাকা। ট্রাকের বাঁ দিকটা কাত হয়ে বসে গেল।
অভ্যস্ত হাইল্যান্ডার জীপ অবিশ্বাস্য গতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগুলো। একজন লোককে স্টেনগান নিয়ে বেবিট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখে আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠলেন, তোমার সিটে শুয়ে পড়।
কিন্তু দরকার হলো না। তৈরী ছিল আহমদ ইয়াং। নজর ছিল তার বেবিট্যাক্সির দিকেই। লোকটি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে স্টেনগান সোজা করার আগেই গর্জে উঠল আহমদ ইয়াং-এর হাতের স্টেনগান। লোকটা স্টেনগান নিয়ে ঐখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর সেই সময়েই হাইল্যান্ডার জীপের এক ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের এক্সিলেন্ট শিল্ডের বাঁ প্রান্ত প্রচন্ড বেগে আঘাত করল বেবিট্যাক্সিটাকে। বেবিট্যাক্সি পাঁচ-সাত হাত দূরে ছিটকে পড়ে ভেঙে-দুমড়ে উলটে গেল। জীপটা একটা বড় ঝাঁকুনি খেল। কিন্তু স্টিয়ারিং ধরা আহমদ মুসার হাত একটুও কাঁপলো না। স্থির থাকল জীপের মাথাও।
এ সময় স্টেনগানের শব্দ এল পিছন থেকে। কয়েকটা বুলেট এসে জীপের স্টীল বডিতে আঘাতও করল।
কিন্তু ঐ টুকুই। জীপ প্রচণ্ড গতিতে ভাঙা বেবিট্যাক্সিটাকে পাশ কাটিয়ে উঠে এল চ্যাংচিন রোডে। তারপর তীরের ফলার মত ছুটে চলল সামনে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বাধাটা পেরুতে তেমন একটা এক্সট্রা সময় ব্যয় করতে হয়নি। সামনে তাকিয়ে দেখলেন মাইক্রোবাসের হেডলাইট দুশ গজের মতই দূরে।
আহমদ মুসা মুখটা ঈষৎ ঘুরিয়ে বললের, তারিক, মা-চু সব ঠিক আছে তো?
জী, ঠিক আছে। হাসান তারিক প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন।
ভাগ্যিস ওদের গুলিটা ওপর দিয়ে গেছে। টায়ারে লাগলে বিপদ হতো। বললেন আহমদ মুসা।
ঘটনা এইভাবে এত আকস্মিকভাবে ঘটবে তা তারা মনে করেনি। মনে হয় ওরা সম্মুখ যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে এসেছিল। মনে করেছিল গাড়িটা আমাদের থামবে তারপর শক্তি পরীক্ষা হবে। বলল আহমদ ইয়াং।
তোমার ধারনা ঠিকই ইয়াং। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে তাই মনে হয়।
আবার দৃষ্টি সামনে ফিরিয়ে নিয়েছেন আমহদ মুসা। তার দৃষ্টি সামনের মাইক্রোবাসের পেছনের লাল আলোর উপর।
এসময় হঠাৎ লাইটটি নিভে গেল।
দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা বললেন, মা-চু গাড়িটা মোড় নিল? মোড় নেবার এখানে কি জায়গা আছে?
না স্যার কোন রাস্তা নেই।
তাহলে কি ওরা আলো নিভিয়ে দিয়েছে? ওরা কি জানতে পেরেছে বাধা ডিঙিয়ে আমরা ওদের পিছু নিয়েছি?
হতে পারে। ট্রাক থেকে অয়্যারলেসে ওদের জানিয়ে দেওয়া হতে পারে। বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন, তারপর জীপের আলো নিভিয়ে দিলেন তিনি। বলল তারিক ইনফ্রারেড গগলসটা দাও।
ইনফ্রারেড গগলস চোখে লাগিয়ে জীপের গতি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন ওদের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে।
স্পীডোমিটারের কাঁটা মূহুর্তে একশ চল্লিশ কিলোমিটারে উঠল। গতির প্রচণ্ডতায় থর থর করে কাঁপছে জীপ। আহমদ মুসার শ্যেন দৃষ্টি সামনে পাতা। গাড়ি কোথায় হোঁচট খেলে রক্ষা নেই। ইনফ্রারেড গগলস অনেক দূর পর্যন্ত অন্ধকারকে ফিকে করে দিয়েছে। রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উঁচু-নিচু আন্দাজ করা কঠিন। রক্ষা যে, চ্যাংচিন রাস্তাটা নতুন। কোন ভাঙা কাটা কোথাও নেই।
মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা রোড সাইড লাইটের আলোতে মাইক্রোবাসটিকে এক ঝলক দেখা গেল। ঠিকই সামনে এগুচ্ছে। খুশি হল আহমদ মুসা। গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। একশ পঞ্চাশ কিলোমিটারে গাড়ির গতি। অল্পক্ষণ পরেই ইনফ্রারেড গগলসে কিছু দূরে একটা জমাট অন্ধকার দেখা গেল। বুঝলেন মাইক্রোবাসটি এখন নাগালের মধ্যে এসেছে। স্পীড কমিয়ে এনে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলেন। মাইক্রোবাসের চোখে তাঁরা ধরা পড়তে চান না। তারা বুঝুক আমরা তাদের হারিয়ে ফেলেছি। এটা ভাবা তাদের জন্য অনেকটাই স্বাভাবিক। কারণ যারা ধরতে আসে তারা সাধারনত আলো নিভায় না।
এলাকাটা নির্জন। রাস্তার দুধারে নতুন নতুন রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং সবে গড়ে উঠেছে। এলাকাটা অন্ধকারও। অনেক দূরে দূরে লাইট পোষ্ট। বড় ক্ষীণ সে সবের আলো।
বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে চলার পর হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল, কালো জমাট অন্ধকারের মাইক্রোবাসটি ডানদিকে চ্যাংচিন রোড পার হয়ে দক্ষিন দিকে যেতে শুরু করল। রাস্তার লাইটে তার পরিস্কার চেহারা দেখা গেল।
মা-চু, এখানে চ্যাংচিন থেকে কোন রাস্তা কি দক্ষিন দিকে গেছে? সামনে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলেন আহমদ মুসা।
বাইরে একটু নজর বুলিয়ে মা-চু বলল, হ্যাঁ এখান থেকে একটা রাস্তা উত্তর দিকে, আর একটা দক্ষিন দিকে চলে গেছে। আর দক্ষিণের রাস্তাটা নতুন হান এলাকায় গিয়ে প্রবেশ করেছে।
মাইক্রোবাসটি তাহলে হান এলাকার দিকেই যাচ্ছে।
লিও শাও চি স্কোয়ার দিয়ে না এসে এতদূর ঘুরে এল কেন ওরা? বললেন আহমদ মুসা।
নিশ্চয় চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য। বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা মোড়ে মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দক্ষিনমুখি সেই রাস্তায় প্রবেশ করলেন। আহমদ মুসার জীপের আগে আরো একটা জীপ প্রবেশ করল সেই রাস্তায়। বেশ দ্রুত যাচ্ছিল জীপটা। আর মাইক্রোবাসটা আলো নিভিয়ে চলার কারণে অপেক্ষাকৃত একটু ধিরেই চলতে হচ্ছিল। তার হেড লাইটের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সামনের মাইক্রোবাস।
মাইক্রোবাস ও জীপটির দূরত্ব তখন দশ গজেরও বেশি নয়। এ সময় সেদিক থেকে একপশলা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে টায়ার বার্ষ্ট হওয়ার শব্দ শোনা গেল। জীপটা এঁকে-বেঁকে কয়েক গজ এগিয়েই রাস্তার পাশের এক টিলার গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়ল।
মাইক্রোবাস মূহুর্তকালের জন্যে থেমেছিল। আবার দ্রুত চলতে শুরু করেছে। এবার আলো জ্বেলে দিয়েছে মাইক্রোবাস।
আহমদ মুসা বললেন, ভালই হল হাসান তারিক, মাইক্রোবাসটি ওই জীপটাকেই আমাদের জীপ মনে করেছিল। এখন ঐ জীপটাকে শেষ করে আলো জ্বেলে নিশ্চিন্তে এগুচ্ছে।
বিধ্বস্ত জীপটা অতিক্রম করার সময় আহমদ মুসা দেখলেন, জীপে একজন আরোহী ড্রাইভিং সিটে বসা। ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আহমদ মুসাদের জীপ আলো নিভিয়েই এগিয়ে চলল মাইক্রোবাসটির আলো লক্ষ করে।
রাস্তার দুধারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাড়ি। কোনটা তৈরী হয়েছে, কোনটা তৈরী হচ্ছে। বুঝা গেল এ এলাকায় প্রচুর লোক বাস করে। হানদের নতুন কলোনী। কোত্থেকে এল এরা? নিশ্চয়ই টানা হান এলাকা থেকে এদেরকে সিংকিয়াং-এ আমদানি করা হয়েছে।
এখানে কি সবাই হান মা-চু? জিজ্ঞেস করলেন আহমদ মুসা।
জি স্যার। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এ হান কলোনীর পরিকল্পনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উরুমচিতে এভাবে হানদের আমদানী করে মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবীরা পরাজিত হবার পর উরুমচিতে অন্যান্য কলোনী তৈরীর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু এই কলোনীতেই বসতি স্থাপিত হয়েছে।
এ রাস্তা দক্ষিণে কতদূর গেছে মা-চু?
অল্প দূরে একটা পাহাড়ের টিলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
পাথরের টুকরোর সাথে পিচ মিশিয়ে রাস্তায় কার্পেট করা। বেশ মসৃন। সোজা রাস্তা। রাস্তায় দুএকজন লোক দেখা যাচ্ছিল। তাও এখন আর নেই বললেই চলে। অন্ধকার হলেও খুব নিশ্চিন্তেই গাড়ি চালাতে পারছে।
এক জায়গায় এসে মাইক্রোবাসটি বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটা সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে একটা মাটির টিলার গোড়ায় গিয়ে থামল। টিলার ওপরে একটা বাড়ি। আমরা প্রায় রাস্তার প্রান্তে এসে গেছি। ঐ তো দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের কালো টিলা দেখা যাচ্ছে। বলল মা-চু।
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না। চারদিকে একবার নজর বুলালেন। তারপর গাড়িটাকে রাস্তার ডানদিকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন, এস নেমে পড়ি।
সবাই নেমে পড়ল।
মাটির টিলা এবং বাড়িটি অন্ধকারে ঢাকা। মাইক্রোবাসের আলো নিভে গেছে। ওটাকে একটা জমাট অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে।
আহমদ মুসারা গুটি গুটি পায়ে বিড়ালের মত ছুটলেন সেদিকে।
তিনদিকে খোলা গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোবাসটি।
আহমদ মুসার চোখে তখন ইনফ্রারেড গগলস। তিনি মাইক্রোবাসের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলেন, গাড়ি খালি। হঠাৎ মাঝখানের সিটে ছোট ব্যাগের মত কি একটা তার নজরে পড়ল। গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে উঠে গেলেন আহমদ মুসা।
ছোট লেডিস একটা হ্যান্ড ব্যাগ। গাড়ির ভেতরেই ব্যাগটা খুলে দেখলেন আহমদ মুসা। বেশ কিছু টাকা এবং একটি আইডেনটিটি কার্ড। কার্ডে একটা মেয়ের ছবি। নাম ‘নেইজেন’। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাল একটা সিল কার্ডে।
গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগটি আহমদ ইয়াং-এর হাতে দিতে দিতে বললেন, মেয়েটারই হবে এই ব্যাগ, আইডেনটিটি কার্ডও।
আহমদ ইয়াং তার পেন্সিল টর্চ দিয়ে আইডেনটিটি কার্ডটার ওপর চোখ বুলিয়েই বলে উঠল, মুসা ভাই, মেয়েটা একজন স্টেট ভিআইপি। নিশ্চয় খুব উঁচু সরকারী কেউকেটার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ হেব।
কিছু লেখা আছে ?
লাল সিল আছে। এ সিল খুব উঁচু সরকারী কাগজপত্রেই শুধু ব্যবহৃত হয়।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে অন্ধাকরে দাঁড়ানো বিশাল গেটটার দিকে এগুলেন।
গাড়ি বারান্দা পেরিয়ে সিড়িঁর তিনটা ধাপ উঠলেই গেট। মাত্র এ গেটটা ছাড়া আর কোন দরজা এদিকে দেখা গেল না। বাড়িটি একেবারেই অন্ধকার। কোন জানালার কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াংও।
পেন্সিল টর্চের আলো ফেলে দেখলেন কাঠের দরজা। হাত দিয়েই বুঝলেন খুব ভারী এবং মজবুত দরজা।
টর্চের ছোট্ট আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আহমদ মুসা দরজার কি হোলের ওপর দাঁড় করালেন। অটোমেটিক লক সিস্টেম।
লকটা ভাল করে দেখার জন্য আহমদ মুসা তর্জনী দিয়ে লকটা স্পর্শ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে হাতটা তার ছিটকে সরে এল প্রবল এক ধাক্কায়। ঝিম ঝিম করে উঠল হাতটা। চমকে উঠে আহমদ মুসা দুকদম পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
পেছন থেক মা-চু প্রায় আর্তনাদ করেই বলে উঠল, স্যার লকে ডিসি চার্জ আছে, ভাগ্যিস এসি নয়।
বলে মা-চু এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার যা করতে হয় আমাকে হুকুম করবেন।
কিন্তু আহমদ মুসার এদিকে কোন খেয়াল নেই। তিনি উৎকর্ন হয়ে কি যেন শুনছেন। মুহুর্তকাল উৎকর্ন থাকার পর বললেন, হাসান তারিক, কিছু শুনতে পাচ্ছ ?
হ্যাঁ এই মাত্র কানে ঢুকেছে একটা চাপা মিনি সাইরেনের আওয়াজ। বলল হাসান তারিক।
ঠিক বলেছ ভেতর থেকে আসছে। সম্ভবত এটা ওদের বিপদ ঘন্টা। নিশ্চয় এই লক সিস্টেমের সাথে ঐ বিপদ ঘন্টার সংযোগ আছে।
একটু থেমেই আবার আহমদ মুসা বললেন, তোমরা তৈরি থাক। আমাদের অনুমান সত্যি হলে মুখোমুখি হবার সময় আসছে।
সবাই প্রস্তুত ছিল। হাসান তারিকের হাতে এম-১০ মেশিন পিস্তল, আহমদ ইয়াং একটা স্টেনগান বাগিয়ে ধরে আছে। আর মা-চুর হাত তার ব্যাগের ভেতরে। ওখানেই ওর সব অস্ত্র।
এই সময় ভেতর থেকে স্টেনগানের এক পশলা গুলির আওয়াজ ভেসে এল। ক্ষীণ আওয়াজ।
চঞ্চল হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ল্যাসার পিস্তলটা?
হাসান তারিক এগিয়ে গেল। পকেট থেকে ক্ষুদ্র সাদা রঙের ল্যাসার পিস্তল উঁচু করল কী-হোল লক্ষ্য করে। পিস্তলের রক্ত রাঙা লাল ট্রিগারটায় চাপ দিল হাসান তারিক। মাত্র মুহুর্তের ব্যবধান। ইস্পাতের গোটা কী বোর্ডটাই হাওয়া হয়ে গেল। সুক্ষ্ম একটা ধাতব গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল শুধু চার দিকে।
মেশিন পিস্তলটা বাগিয়ে দরজা ঠেলে আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। মা-চু লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে বলল, স্যার আমি আগে একটু দেখে নিই। যারা দরজায় বৈদ্যুতিক সাইরেন ফিট করতে পারে, তাদের প্রস্তুতি এ টুকুতেই শেষ হবার কথা নয়।
বলে মা-চু বাঁ হাতে দরজাটা একটু ফাঁক করে ডান হাতে তার ইলেকট্রো ম্যাগনেটো নিউট্রালাইজার মেলে ধরে চাপ দিল তার সাদা সুইচটায়। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটির ক্ষুদ্র চোখ থেকে বিপদ সংকেত জ্ঞাপক লাল আলো বেরিয়ে এল, তার সাথে ব্লিতস ব্লিতস শব্দ। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই লাল আলো নিভে গিয়ে জ্বলে উঠল নীল আলো। থেমে গেল ‘ব্লিতস’ শব্দ। মা-চু’সহ সকলের চোখে-মুখেই স্বস্থি ফিরে এল।
ইলেকট্রো ম্যাগনেটো নিউট্রালাইজার চীনে উদ্ভাবিত সন্ত্রাস মুকাবিলার অত্যাধুনিক একটা যন্ত্র। পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ও বিস্ফোরক জাল শুধু সে চিহ্ণিতই করে না, এর অতি শক্তিশালী ম্যাগনেটিক পাওয়ার বিদ্যুৎ সঞ্চালনের গতি এবং বিস্ফোরকের সুইচ বিকল করে দিয়ে ওগুলোকে নিউট্রাল করে ফেলে। নীল আলো জ্বলে উঠতেই বুঝা গেল বিপদ কেটে গেছে।
আহমদ মুসা মা-চুকে চাপড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, শুকরিয়া মা-চু। মেইলিগুলি যা বলেছে তারচেয়েও অভিজ্ঞ তুমি।
আহমদ মুসার মুখে হাসি।
মা-চু বলল, লজ্জা দেবেন না স্যার, এ খুব ছোট ব্যাপার।
মা-চুর কথার দিকে আহমদ মুসার এখন কান নেই। তাঁর তখন অন্য ভাবনা। সাইরেন বেজেছে বেশ আগে। গেটের দিকে এখনও কেউ এল না কেন? ভেতর থেকে ব্রাশ ফায়ার কেন? কাকে কে গুলি করল? ওরা কি তাহলে মেয়েটাকে মেরে ফেলে পালাল?
কথাটা ভাবতেই চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মনটা, তাদের মিশন কি তাহলে ব্যর্থ হল?
ভেতরে প্রবেশ করলেন আহমদ মুসা।
ঢুকতেই একটা করিডোর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। অন্ধকার। আরেকটা করিডোর নাক বরাবর পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। করিডোরটার ঐ প্রান্তে এক টুকরো আলো এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ পিস্তলটি বাগিয়ে বিড়ালের মত নি:শব্দে সেদিকে এগিয়ে চললেন। তার পেছনে হাসান তারিক, আহমদ ইয়াং ও মা-চু।
আলোর কাছাকাছি গিয়ে আহমদ মুসা দেখলেন, ডান দিকের একটা খোলা দরজা দিয়ে আলোর টুকরোটি এসে পড়েছে করিডোরে।
কয়েক ধাপ এগিয়ে ঘরের দিকে চোখ পড়তেই আঁৎকে উঠলেন আহমদ মুসা। রক্তে ভাসছে অনেকগুলো লাশ। রক্তের স্রোত বেরিয়ে এসেছে দরজা দিয়েও।
ছুটে গেলেন আহমদ মুসা দরজার দিকে। তার পেছনে সবাই। দরজায় দাঁড়িয়ে চক্ষু স্থির হয়ে গেল সবার। মেঝেয় পড়ে আছে দশটি মেয়ের বুলেট ঝাঁঝরা দেহ। রক্ত ঝরছে তাদের অনেকের দেহ থেকে এখনো।
সম্ভবত পায়ের শব্দে লাশের সারি থেকে একটা মেয়ে মাথা তুলল। অতি কষ্টে ডান হাতের উপর মাথার ভারটি রেখে হাসান তারিক ও আহমদ ও আহমদ ইয়াং-এর দিকে চেয়ে বলল, আপনারা এলেন? এত দেরিতে?
মেয়েটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল হাসান তারিক ও আহমদ ইয়াং দুজনেই। তুরপান রোডের ‘ফ্র’ ঘাঁটিতে যে দশজন অসহায় মেয়েকে তারা পেয়েছিল, তাদেরই সে একজন। এর সাথেই তারা কথা বলেছিল।
দুজনেই ছুটে গেল তার দিকে। বলল, তোমরা এখানে কিভাবে? একি হয়েছে তোমাদের।
মেয়েটি তাদের কথার দিকে কান না দিয়ে ঘরের কোণায় দাঁড়ানো একটা আলমারির দিকে কাঁপা হাত দুলে ইংগিত করে বলল, ওরা ওদিক দিয়ে পালিয়েছে। একটা মেয়েকেও ধরে নিয়ে গেছে।
শোনার সাথে সাথে আহমদ মুসা বললেন, হাসান তারিক, মা-চু তোমরা এদের দেখ। আহমদ ইয়াং এস আমার সাথে।
বলে আহমদ মুসা ছুটে গেলেন আলমারির দিকে। এক টানে খুলে ফেললেন আলমারি। দেখলেন একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে। দ্রুত তার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন।
সিঁড়িটা বাড়ির পেছনে একটা লনে এসে শেষ হয়েছে। লনে নেমেই তারা দেখলেন, একটা চীনা বেডফোর্ড কারকে তিনজন লোক পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত গাড়িটা স্টার্ট নেয়নি। তাই স্টার্ট নেয়ানো এবং তাড়াতাড়ি কিছুটা দুরে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা। লোক তিনজনের কাঁধে ঝুলছে স্টেনগান।
দাঁড়াও। চীনা ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন আহমদ মুসা। সেই সাথে তিনি ছুটছিলেন তাদের দিকে।
লোক তিনজন চমকে উঠে পেছন ফিরল। চোখের পলকে স্টেনগানগুলো নেমে এল তাদের হাতে। কিন্তু তাদের তর্জনি স্টেনগানের ট্রিগারে পৌছার আগেই আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার এম-১০ এবং আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগান গর্জে উঠল।
তিনজনের দেহ গাড়ির পাশেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং ততক্ষণে গাড়ির পেছনে এসে পৌছেছিলেন।
ড্রাইভিং সিট থেকে একজন লোক বেরিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল। সেও মারা পড়ল আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগানের গুলীতে। গাড়ির পেছন থেকে গাড়ির দরজার দিকে এগুতে গিয়ে দেখল, স্টেনগানের একটি কালো নল বেরিয়ে এসেছে। চমকে দু’পা পিছিয়ে এলেন আহমদ মুসা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগান থেকে এক ঝাঁক গুলী বেরিয়ে এল। আহমদ মুসা দু’পা পিছিয়ে বসে না পড়লে দেহটা তাঁর এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেত।
আহমদ ইয়াং ততক্ষণে গাড়ির ওপাশের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মেয়েটা বসেছিল স্টেনগানধারী লোকটার এপাশে। তার মুখ কাগজের মত সাদা। আতংকে কাঁপছে সে।
আহমদ ইয়াং স্টেনগান ফেলে দিয়ে পিস্তল হাতে নিয়ে স্টেনগানদারী লোকটাকে বলল ফেলে দাও স্টেনগান।
অদ্ভুত ক্ষীপ্রগতিতে লোকটা আহমদ ইয়াং-এর কথা শেষ হবার আগেই স্টেগান সমেত এক ঝটকায় ঘুরে বসল। কিন্তু তার স্টেনগান থেকে গুলী বেরুবার আগেই আহমদ ইয়াং-এর প্রস্তুত রিভলবার থেকে একটি গুলী গিয়ে তার কপালটাকে তার গুড়ো করে দিল। গাড়ির সিটের উপর ঢলে পড়ল লোকটি। মেয়েটা ভীষণ কাঁপছিল।
আহমদ ইয়াং গাড়ির দরজা খুলে বলল, এস নেইজেন।
মেয়েটা কাঁপছিল। মনে হয় তার ওঠার শক্তি ছিল না। আহমদ ইয়াং-এর মুখে তার নাম শুনে একবার মুখ তুলে তাকাল।
আহমদ ইয়াং তাকে হাত ধরে টেনে বের করল। কিন্তু দেখল ঢলে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটি।
মুসা ভাই। ডাকল আহমদ ইয়াং।
আহমদ মুসা গাড়ির ওপাশ ঘুরে ইয়াং-এর কাছে এলেন। বললেন, ওকে ভেতরে নিয়ে চল। অনেক ধকল গেছে, ও জ্ঞান হারাচ্ছে।
আহমদ ইয়াং ওকে পাঁজা-কোলে করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পর মেয়েটা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, আমি হাঁটতে পারব।
আহমদ ইয়াং ওকে ছেড়ে দিল।
আহমদ মুসা বললেন, বোন আর ভয় নেই। এদের হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করার জন্যেই আমরা এখানে এসেছিলাম।
মেয়েটা একবার চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার নীল চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু শরীরের কম্পন এখনো তার শেষ হয়নি। ভাল করে হাঁটতে পারছিল না সে। আহমদ মুসা বললেন, আহমদ ইয়াং বোনকে একটু সাহায্য কর।
আহমদ ইয়াং তার একটা হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল।
লালচে ফর্সা দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটার দেহে চীনা কোন বৈশিষ্ট্যই নেই। লাল স্কার্টটি হাঁটুর দু’ইঞ্চি নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। লালচে গোলাপী শার্ট।
আরও কিছুদূর যাবার পর মেয়েটি নীরবে হাতটি ছাড়িয়ে নিল।
সেই সিঁড়ি দিয়েই উঠছিলেন আহমদ মুসারা। দু’ধাপ উঠেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে চলছিল আহমদ মুসা, মাঝখানে মেয়েটি, সবশেষে আহমদ ইয়াং। মেয়েটাকে দাঁড়াতে দেখে আহমদ মুসা বললেন, কোন অসুবিধা হচ্ছে বোন?
আহমদ মুসার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে একটু নীরব থেকে বলল, উঠতে পারছি না।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াংকে বললেন, তুমি একটু সাহায্য কর ওকে উঠতে।
আহমদ ইয়াং তার পাশে এসে তার বাঁ বাহুটা ধরল। ধরেই অনুভর করল মেয়েটা কাঁপছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সংকীর্ণ সিঁড়ি। কষ্ট হচ্ছিল পাশাপাশি উঠতে। মেয়েটির মাথা আহমদ ইয়াং-এর কাঁধে ঠেস দিয়ে আছে। বলতে গেলে তার দেহের গোটা ভারটাই আহমদ ইয়াং-এর ওপর।
সিঁড়ি দিয়ে আহমদ মুসারা সেই ঘরে এসে ঢুকলেন।
মেয়েটাসহ সবাইকে দেখে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করল হাসান তারিক। তারপর বলল, মুসা ভাই, মেয়েটাকে বাঁচানো গেল না। এই মাত্র মারা গেল। বড় হতভাগী এরা।
এরা কারা হাসান তারিক?
কেন আপনি তো জানেন, তুরপান রোডের ‘ফ্র’ ঘাঁটি থেকে সেই দশটি মেয়েকে উদ্ধার করে আমরা আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিলাম।
এরা তারা? তাহলে ‘ফ্র’ ওদের সন্ধান ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল?
তারপর কিছুক্ষণ কথা বললেন না আহমদ মুসা। কি যেন ভাবছেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পরে অনেকটা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতই বললেন, জেনারেল বোরিস ফিরে না এলে ‘ফ্র’ তো এভাবে সক্রিয় হবার কথা নয় তারিক।
কপালটা কুঞ্চিত দেখাল আহমদ মুসার। হঠাৎ আলোকিত ঘরে নেইজেন-এর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন আহমদ মুসা। তার শার্ট এবং স্কার্টের ডান দিকটা রক্তে ভেজা। তার দিকে দু’পা এগিয়ে বললেন তিনি, বোন তুমি আহত?
মেয়েটা মুখটা নিচু করে বলল, হ্যাঁ। গাড়িতে তোলার সময় আমি ধস্তাধস্তি করলে ওরা আমার ডান বাহুতে ছুরি মেরেছে।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াংকে বললেন, দেখ তো ক্ষতটা, মনে হয় এখনও রক্ত বেরুচ্ছে।
আহমদ ইয়াং আহত জায়গায় হাত দিতেই বেদনায় কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা।
হ্যাঁ, এখনও একটু একটু করে রক্ত বেরুচ্ছে। বলল আহমদ ইয়াং।
এই সময় মা-চু তার ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ডেজ বের করে আহমদ ইয়াংকে দিয়ে বলল, বেঁধে দিন।
হ্যাঁ বেঁধে দাও। আপাতত রক্ত বন্ধ করা দরকার।
আহমদ ইয়াংকে এই নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, চল আমরা বাড়িটি একটু ঘুরে দেখি। মেয়েটা আহত। এখনি ওকে পৌছে দিতে হবে। আমাদেরও অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই আহমদ মুসারা ফিরে এলো বাড়িটা ঘুরে দেখার পর। আহমদ মুসাকে চিন্তান্বিত দেখাল। ততক্ষণে আহমদ ইয়াং-এর ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গেছে। তারা সবাই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগুলেন।