৩
যুবায়েরভ এবং আবুল ওয়াফা আহমদ মুসা এবং হাসান তারিককে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তারপর সামনে এগিয়ে দুজন দুজনকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরল।
যুবায়েরভ মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল কুতাইবার এবং আবুল ওয়াফা ফিলিস্তিন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল মাহমুদের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছে। আবুল ওয়াফার সাথে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের কয়েক বছর পর দেখা। আর যুবায়েরভের সাথে এই সেদিন বিপ্লব পর্যন্ত এক সাথে করেছে তারা। আনন্দে ও আবেগে যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
আলিঙ্গন শেষে দুজনের একসাথে প্রশ্ন আপনারা তো ভাল ছিলেন? ভাল আছেন?
হ্যাঁ আমরা ভাল আছি। বললেন আহমদ মুসা।
মুসা ভাইকে কোথায় পেয়েছিলেন, কীভাবে পেয়েছিলেন?
যুবায়েরভ হাসান তারিকের দিকে এক সাথে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিল।
সব শুনবেন, মুসা ভাই-ই সব বলবেন। তার আগে ওদিকে সবাই কেমন আছে?
কেমন থাকবে, সবার অবস্থা পাগলের মত। সবাই সব কাজ করে কিন্তু যেন প্রান নেই কারও। কুতাইবা ভাইকে দেখলে চিনতে পারবেন না। একদম অর্ধেক হয়ে গেছে। আহমদ মুসা আলাপ করছিলেন আবুল ওয়াফার সাথে। যুবায়েরভের এ কথা তার কানে যেতেই তিনি বলে উঠলেন, কেন কি হয়েছে তার, কোন অসুখ-বিসুখ?
না কোন অসুখ নয় মুসা ভাই। আপনাকে হারাবার পর থেকেই উনি যেন কেমন হয়ে গেছেন। একদম নিরব। সারাদিন নীরবে কাজ করে যান। আর রাতের সাথী জায়নামায। রাতে চোখের পানি তার বোধ হয় শুকায় না।
ওখানে কি সবাই পাগল হয়ে গেছে? কোন কিছুর অভাবে বা কোন ব্যাথায় মুষড়ে পড়া তো ইসলামী চরিত্র নয়।
অনেকেই তাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেন, আমি তো মুষড়ে পড়িনি, আমি তো গাফলতি করছি না কোন কাজে? তার বার বার একটাই কথা, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি মুসা ভাইয়ের প্রতি।
পাগল, পাগল। আল্লাহর যে কি পরিকল্পনা এতে ছিল তা তো সে ভেবে দেখেনি।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। তারপর হাসান তারিকের দিকে ফিরে বললেন, তুমি আয়েশার খবর নিয়েছ? হাসান তারিকের মুখ লাল হয়ে উঠল। মাথা নিচু করল। বলল, ঠিক আছে, নেব পরে।
যুবায়েরভ এই কথা শুনেই উঠে দাড়াল। বলল, ওরা সবাই ভাল আছেন মুসা ভাই। আয়েশা ভাবী একটা চিঠি দিয়েছিল। এনে দিচ্ছি।
সুটকেস থেকে চিঠি এনে যুবায়েরভ হাসান তারিকের হাতে দিল। হাসান তারিক চিঠিটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল। তা দেখে আহমদ মুসা বললেন, তারিক যাও পাশের ঘরে, চিঠিটা পড়ে এস। জরুরী খবর থাকতে পারে।
হাসান তারিক একটু দ্বিধা করল। তারপর নির্দেশ মেনে চলে গেল পাশের ঘরে।
আহমদ মুসা বললেন, দেখ কি ভুল। আমাদের এ ভাইয়ের সাথে তোমাদের পরিচয় করে দেয়া হয়নি।
আহমদ ইয়াং পাশে একটা চেয়ারে বসে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মত অপলক কোছে এই মিলন দৃশ্য দেখছিল।
আহমদ মুসা তাকে দেখিয়ে বললেন, এ আহমদ ইয়াং। এখানকার ইসলামী আন্দোলন অর্থাৎ ‘টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপের’ একজন সিপাহসালার ও আমার একজন অতি প্রিয় সাথী।
যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফা এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ ইয়াংকে।
আলাপ পরিচয় শেষে সবাই স্হির হয়ে বসল। হাসান তারিক ফিরে এল পাশের রুম থেকে।
কোন ম্যাসেজ যুবায়েরভ? বললেন আহমদ মুসা।
আপনার জন্য একটা চিঠি আছে। একটা চিঠি গভর্নর লি ইউয়ানকে আমরা দিয়েছি। আমাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল সিংকিয়াং প্রশাসনের সহযোগিতায় আপনাদের খুজে বের করা।
কুতাইবা – মাহমুদরা কিভাবে নিশ্চিত হল যে, লি ইউয়ানের সাহায্য তারা পাবে।
পিকিংস্হ দুতাবাসের মাধ্যমে তার সাথে এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলাপ হয়েছিল। বিস্তারিত না জানিয়ে শুধু বলা হয়েছিল ‘ফ্র’ এর লোকেরা আমাদের একজন লোককে কিডন্যাপ করে এনেছে। গভর্নর এতে সহযোগিতা করতে রাজি হন। তারপরই বিস্তারিত প্রস্তাব নিয়ে আমরা তার কাছে এসেছি। মিন্দানাও প্রজাতন্ত্রের সরকারও পিকিং- এর উপর চাপ দিচ্ছে। তারাও দেখা করেছে গভর্নর লি ইঊয়ানের সাথে সিংকিয়াং-এর মুসলমানদের ব্যাপারে।
থামল যুবায়েরভ। তারপর সুটকেসটা টেনে একটা সিল করা বড় ইনভেলপ তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে খামটার উপর নজর বুলালেন। মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের নামাংকিত সরকারী ইনভেলপ।
খামটার উপর চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অনেকটা স্বগতঃই উচ্চারণ করলেন, কত ত্যাগ, কত সাধনা, কত লড়াই এর ফসল এই স্বাধীনতা। তিনি প্রশ্ন করলেন যুবায়েরভকে, সংস্কার-কাজ, মানুষের দুঃখ-মোচনের কাজ কেমন চলছে যুবায়েরভ?
শিক্ষা, মটিভেশন এবং তার সাথে সংস্কারের কাজ পাশাপাশি চলছে। প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
খুশি হলেন আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক করছ তোমরা। শুধু নাম বদল, পতাকা, মানুষ বদল ইত্যাদিতে কোন লাভ নেই যদি না আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যা চান তার ব্যবস্থা না করা যায়।
আহমদ মুসা ইনভেলপের একটা প্রান্ত ছিড়ে ফেললেন। বের করলেন বড় ধরনের একটা চিঠি। সুন্দর কাগজে লেখা। কাগজটা রুশ আমলের। লেটার হেডে ছাপা সোভিয়েত কম্যুনিস্ট প্রজাতন্ত্রের নাম কেটে তার পাশে মুসলিম মধ্য এশিয়ার নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
কাগজগুলো নষ্ট না করে এই ভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে তোমরা ঠিক করেছ যুবায়েরভ। শিশু রাষ্ট্রের সৌখিনতার চেয়ে অস্তিত্ব বহুগুণ বড়। বললেন আহমদ মুসা।
চিঠিটা তার চোখের সামনে মেলে ধরলেন আহমদ মুসা। দীর্ঘ চিঠি পড়তে শুরু করলেন তিনি।
আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাই,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনাকে এই সালাম পাঠাতে গিয়ে বেদনায় মনটা মুষড়ে পড়ছে। আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না। আমাদের সালাম আপনার কাছে কবে পৌছবে, আদৌ পৌছবে কিনা তাও জানি না। এই না জানার বেদনা আমাদে ক্ষত বিক্ষত করে চলছে। জেনারেল বোরিসের পেছনেই গেছে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ। তাদেরও কোন খোঁজ আমরা পাইনি। পিকিং সরকার এবং সিং কিয়াং এর প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা শুরু করেছি। ফিলিস্তিন ও মিন্দানাও সরকারও চেষ্টা করছে। সৌদি সরকারকেও অনুরোধ করা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনা, আল্লাহ আপনাকে নিরাপদে রাখুন, সুস্থ রাখুন।
এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছবে কিনা নিশ্চিত নই, তবু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এক বিষয়ে আপনাকে লিখছি যদি চিঠিটা আপনার কাছে পৌঁছে এই আশায়।
ককেশাস অঞ্চল নিয়ে ভয়ানক এবং জঘন্য এক ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। আপনি জানেন, পামির থেকে কাস্পিয়ানের উত্তর তীর এবং আফগান সীমান্ত থেকে কাজাখস্থানের শেষ প্রান্ত ইউরাল পর্বতমালা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে মুসলিম মধ্য এশিয়া সাধারণতন্ত্র গঠিত হয়েছে। আর নতুন রাশিয়ার রিপাবলিকের একটা সীমানা মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্র, ক্রিমিয়া এবং তাতারিয়া স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের উত্তর বরাবর এসে শেষ হবার কথা। এখান থেকে ইরান ও তুরস্কের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং তাতারিয়া এক কালের এই চার অঞ্চল নিয়ে গঠিত মুসলিম অধ্যুষিত ককেশাস অঞ্চল আজ মারাত্মক ষড়যন্ত্র ও সংঘাতের শিকার। সেখানে চেষ্টা হচ্ছে একটা খালেস খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েমের। কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধবর্তি এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই অঞ্চলে তারা চাচ্ছে পশ্চিমী স্বার্থের আজ্ঞাবহ একটা খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েম করতে। এ রাষ্ট্রের দুপাশে থাকবে দুই সাগর, পশ্চিম পাশে তুরস্ক, দক্ষিনে ইরান এবং উত্তর সীমান্ত গঠিত হবে ককেশাস পর্বত মালা দিয়ে। রাষ্ট্রটা হবে অবস্থান ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এখান থেকে শুধু দুই সাগর নিয়ন্ত্রন নয়, চারপাশের গুরুত্বপূর্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপরও খবরদারীর একটা পথ হবে। ওরা চেয়েছিল লেবাননকে দিয়ে এশিয়ায় একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের অভাব পূরণ করতে। কিন্তু সে আশা পূরন হয়নি। এখন ককেশাসকে দিয়ে সে সাধ পূরণ করতে চাচ্ছে। উত্তরের রাশিয়ান রিপাবলিক, যা মূলত খৃষ্টান জনঅধ্যুষিত, এতে তাদের লাভই দেখছে। তারা মনে করছে ককেশাসের ঐ অংশ যদি খৃষ্টানদের হাতে চলে যায়, তাহলে তাতারিয়া ও ক্রিমিয়াকে স্বাধীনতা না দিয়ে সে বাঁচতে পারে। এতে করে রাশিয়ান রিপাবলিকের সীমানা একদিকে ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত পৌঁছবে, অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে নামার পথ পাবে যা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। অতএব রাশিয়ান রিপাবলিক এবং পশ্চিমা কয়েকটি খৃষ্টান দেশ আজ এক জোট হয়ে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ১৯১৭ সালে লেনিনের পাঠানো কম্যুনিষ্ট রেড আর্মি আর্মেনিয় খৃষ্টান শামিউনের নেতৃত্বে ককেশাসের মুসলমানদের উপর গনহত্যা চালিয়ে অঞ্চলটিকে যেভাবে তাদের দখলে নিয়েছিল, সেভাবেই তারা এখন এগুচ্ছে। মুসলিম এলাকায় খৃষ্টান ও কম্যুনিষ্টদের মদদপুষ্ট গেরিলা সন্ত্রাস শুরু হয়েছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের অপহরণ ও হত্যার কাজও শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে সন্ত্রাসী ‘ফ্র’রাও জুটেছে এখানে এসে। ইরান ও তুরস্ক নানা কারনেই এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে নারাজ। হয়তো সে সুযোগ ও সামর্থ্যও তাদের নেই। এ অবস্থায় আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি। সেখানকার মুসলমানরা চরম আতংক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অবিলম্বে যদি তাদের ব্যাপারে কিছু না করা হয়, তাহলে ১৯১৭ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার।
এই বিপদ আমরা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরা কিভাবে কি করণীয় তা বুঝতে পারছি না। ফিলিস্তিনের মাহমুদ ভাইয়েরও এই কথা। আমরা আপনার পরামর্শ ও পরিচালনা চাই।
সবশেষে আল্লাহর কাছে আমাদের আকুল প্রাথর্না এই চিঠি যেন অতি সত্ত্বর আপনার হাতে পৌছে।
ওয়াসসালাম-
আপনার স্নেহ ধন্য কুতাইবা।
চিঠি পড়া শেষ করে আহমদ মুসা নীরবে তা তুলে দিলেন হাসান তারিকের হাতে।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »