১
আরাকস হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার জীপ।
বাকু থেকে পনের মাইল পশ্চিমে এসে নগরন-কারাবাখ সড়ক উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। এখান থেকে আরেকটা হাইওয়ে বেরিয়ে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে একেবারে আরাকস নদীর তীর ঘেঁষে। এটাই আরাকস হাইওয়ে। আরাকস নদীর তীর ঘেঁষে এই হাইওয়ে এগিয়ে গেছে ইয়েরেভেনের পাশ দিয়ে আরও উত্তরে। ইয়েরেভেন পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ’ মাইলের এই সফর।
আরাকস ও কুরা বিধৌত সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল আহমদ মুসার জীপ।
নগরন-কারাবাখ সড়ক হয়ে ইয়েরেভেন অনেক সংক্ষিপ্ত পথ। প্রায় ১শ’ মাইলের মত কম। কিন্তু তবু আহমদ মুসারা আরাকস হাইওয়েই বেছে নিয়েছে। নগরন-কারাবাখ সড়কের উপর হোয়াইট ওলফ নাকি হঠাৎ করে খুব নজর রাখতে শুরু করেছে। ইয়েরেভেন থেকে আসার পথে ওসমান এফেন্দীর গাড়ি তিনবার চেক করা হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কি পরিচয়, কোথায় যাবে, কেন যাবে ইত্যাদি। যারা চেক করেছে তারা স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরা। কিন্তু ওসমান এফেন্দীর বুঝতে কষ্ট হয়নি, কোন রুটিন চেক এসব নয়। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে স্টেনগান থাকে না, তাদের আচরণও অমন রুক্ষ্ম ও অসৌজন্যমূলক হয় না। ওসমান এফেন্দী যুক্তি দেখিয়েছে, আরাকস হাইওয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে। পাহাড়ের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সুদৃশ্য উপত্যকা বেয়ে প্রবাহিত সুন্দর নদী আরাকস-এর তীর বরাবর আরাকস হাইওয়েতে সাধারণত বিদেশি পর্যটকদেরই ভিড় থাকে বেশি। এসব চিন্তা করেই ওসমান এফেন্দী আরাকস হাইওয়েই পছন্দ করেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি প্রায় তীর বেগে দেড়শ’ মাইল রাস্তা পেরিয়ে এল। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, কোনই ঝামেলা হয়নি। আজারবাইজান সীমান্ত পেরুবার সময় একবার রুটিন চেক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত পেরুবার পর আর্মেনিয়া প্রবেশের সময় একটু বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আর্মেনীয় পুলিশরা। এ ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ নাকি আগে ছিল না। কিন্তু হোয়াইট ওলফের তৎপরতা শুরু হবার পর এটা হচ্ছে। নানা ঘটনা ও গুজবে আতংকিত হয়ে অনেক আর্মেনীয় মুসলিম পরিবার না কি ইরান ও তুরস্কে প্রবেশ করেছে। এতে আর্মেনিয়ার বদনাম হচ্ছে। এজন্যে আর্মেনীয় পুলিশরা ইরান ও তুরস্ক সীমান্ত বরাবর এখন একটু বেশি নজর রাখছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সাথে থাকলে না কি এ সীমান্ত পথে কাউকে চলতেই দিচ্ছে না। আহমদ মুসারা সে ক্যাটেগরিতে না পড়ায় একটু জিজ্ঞাসাবাদ বেশি করলেও বেশিক্ষণ তাদের আটকায়নি।
আরও ৫০ মাইল পেরুবার পর আগারাক শহর। আরাকস নদী-তীরের শিল্প নগরী। বলা যায় দক্ষিণ আর্মেনিয়ার প্রধান নগরী।
নগরীর পূর্ব প্রান্তে পাহাড়ের দেয়াল। দেয়ালটি নেমে গেছে একেবারে নদীর পানিতে। পাহাড়ে সুড়ঙ্গ করে আরাকস হাইওয়ে এগিয়ে নেয়া হয়েছে।
পাহাড়ের উপরিভাগ বরফে সাদা। নিচের অংশে সবুজের সমারোহ। একদম পাহাড়ের গোড়ায় গাছগুলো বেশ বড়।
সুড়ঙ্গের মুখ দু’শ গজের মত দূরে তখন। মাত্র ৭০ কিলোমিটার বেগে বলা যায় অত্যন্ত ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার জীপ। সুড়ঙ্গের ভেতরটা অন্ধকার। দূর থেকে সুড়ঙ্গের ভেতরের বিদ্যুৎ বাতিগুলোকে মনে হচ্ছে বাঘের চোখের মত।
আহমদ মুসা তার সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল। চোখটা তখন ধরে এসেছিল তার।
হঠাৎ আলী আজিমভের ডাকে তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল আহমদ মুসার।
চোখ মেলে তাকাতেই তার চোখ গিয়ে পড়ল সোজা সুড়ঙ্গের মুখে। দেখল, স্টেনগান হাতে দু’জন দাঁড়িয়ে সুড়ঙ্গের মুখে একদম রাস্তার উপর। দীর্ঘকায় দু’জন লোক। কাল ওভারকোট ওদের হাঁটুর অনেকখানি নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। মাথার হ্যাট কপাল পর্যন্ত নামানো।
ওরা তো পুলিশ নয় দেখছি। বলল আহমদ মুসা।
জ্বি, ওরা পুলিশ নয়। বলল ওসমান এফেন্দী।
যেই হোক, ওরা আমাদেরকে বড় রকমের কিছু সন্দেহ করেনি। ওদের স্টেনগানের মাথা নিচের দিকে নামানো।
বলতে বলতে জীপটি সুড়ঙ্গের মুখে এসে পড়ল।
আহমদ মুসা তার মাথার হ্যাটটা কপালের উপর আরেকটু টেনে দিল।
সুড়ঙ্গের মুখেই রাস্তার মাঝখানে ওরা দাঁড়িয়েছিল। দু’জনেই তারা তাকিয়েছিল গাড়ির দিকে।
জীপ একদম ওদের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল। গাড়ি দাঁড়াতেই দু’জনের একজন ধীরে হেঁটে গাড়ির পাশে চলে এল। ওদের স্টেনগানের মাথা তখনও নিচে নামানো।
লোকটি ওসমান এফেন্দীর জানালার পাশে এসে বাম হাতটা জানালার উপর রেখে মাথা নিচু করল। তার ডান হাতে ঝুলছে স্টেনগানটি।
ওসমান এফেন্দী জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল, কি ব্যাপার?
তার কথায় উত্তর আর্মেনিয়ার আঞ্চলিক ভাষার টান।
তোমরা আসছ কেত্থেকে? বলল লোকটি।
বাকু থেকে। বলল ওসমান এফেন্দী।
যাবে কোথায়?
ইয়েরেভেন।
থাক কোথায়?
ইয়েরেভেন।
কি কর?
ফলের ব্যবসা। ইয়েরেভেনে দু’টি ফলের দোকান আছে।
ওরা?
সবাই আমরা এক সাথে থাকি।
তোমার নাম?
ওসমান।
মুসলমান তুমি?
হ্যাঁ।
মনে হল লোকটির ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল, দেখি তোমার কার্ড।
ওসমান এফেন্দী তার বুক পকেট থেকে আর্মেনিয়ার নাগরিক কার্ড বের করে দিল লোকটির হাতে।
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল লোকটিকে। শক্ত-সমর্থ মাঝ বয়েসি লোক। দেথলেই বুঝা যায় পরিশ্রমী পেশীবহুল শরীর। তবে মুখটা বোকা বোকা।
লোকটা ওসমান এফেন্দীর আইডেনটিটি কার্ড হাতে নিয়ে চশমা বের করার জন্যে ওভারকোটের ভেতরের পকেটে হাত দিল।
হ্যাটের নিচ দিয়ে আহমদ মুসার দু’টি চোখ স্থির নিবদ্ধ ছিল লোকটির উপর। চশমা বের করার সময় লোকটির ওভারকোটের একটা অংশ উল্টে গেল। কোটের কাল ব্যান্ডের উপর একটা সাদা ব্যাজ ঝলমল করে উঠল। বাঘের একটা সাদা মুখ হা করে আছে স্পষ্টই বুঝা গেল। একটা উষ্ণস্রোত বয়ে গেল যেন আহমদ মুসার সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে। জীবন্ত এক ‘হোয়াইট ওলফ’ তার সামনে। ধীরে ধীরে হাতটি চলে গেল পিস্তলের বাঁটে। মন বলল, ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়। অনেক জানার আছে ওর কাছ থেকে। কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিল আহমদ মুসা। ওরা আক্রমণ না করলে ওদের ফাঁদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের গায়ে হাত দেয়া ঠিক হবে না। আপাতত লক্ষ্য আমাদের ইয়েরেভেন। ধৈর্য্য ধরতে হবে।
লোকটি ওসমান এফেন্দীর কার্ডের উপর নজর বুলিয়ে বলল, তুমি তো ইয়েরেভেনেরই লোক। ব্যবসায়ী। আবার মুসলমান কেন?
আমার পরিবার মুসলিম।
লোকটি মুখ ভেংচিয়ে কার্ডটি গাড়ির মধ্যে ছুড়ে দিয়ে বলল, যা, তবে মনে রাখিস, হয় মুসলমানি ছাড়বি, না হয় দেশ ছাড়বি।
বলে স্টেনগানের নল দিয়ে গাড়িতে এক গুঁতো দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল।
গাড়ির সামনে দাঁড়ানো লোকটিও সামনে থেকে সরে এ লোকটির দিকে এগিয়ে এল।
এমন সময় সুড়ঙ্গের ডান পাশের গাছের আড়াল থেকে একজন লোক দ্রুত বেরিয়ে এল লোক দু’টির দিকে। কি যেন ইশারা করল লোক দু’টিকে।
গাড়ি তখন নড়ে উঠেছে, ঘুরতে শুরু করেছে জীপের চাকা। সেই সময় কার্ড চেক করা সেই লোকটি হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, দাঁড়াও, দাঁড়াও।
গাড়ি তখন ছুটতে শুরু করেছে। ওসমান এফেন্দী একবার জানালা দিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরল স্টিয়ারিং হুইল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে দেখল, ওরা কয়েক গজ ছুটে এসে তারপর দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ে রইল গাড়ির দিকে।
তৃতীয় লোকটা কিছু মেসেজ নিয়ে এসেছিল মনে হয়। বলল আলী আজিমভ।
আহমদ মুসা পেছন থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, হবে হয়তো।
তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
ভাবছে সে। হোয়াইট ওলফ বড় আট-ঘাট বেঁধেই নেমেছে। দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই চোখ রেখেছে ওরা।
আগারাক শহর ডাইনে রেখে ছুটে চলল আহমদ মুসার জীপ আরাকস হাইওয়ে ধরে। আরও ২৫ মাইল চলার পর আর্মেনিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে গাড়ি আজারবাইজানের ছিটমহলে প্রবেশ করল। আজারবাইজানের এই এলাকাটা আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন একেবারে আর্মেনিয়ার পেটের ভেতর। এর পশ্চিম সীমান্তে ইরান। উত্তরের কিছু অংশে তুরস্কের সাথে বর্ডার আছে। আরাকস নদীই ইরান ও তুরস্ক থেকে আজারবাইজানের এই ছিটমহলকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
আজারবাইজানের এ ছিটমহল অবস্থানগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসলপূর্ণ উপত্যকা এবং মূল্যবান বন আচ্ছাদিত পাহাড় অধ্যুষিত এ ছিটমহলে ৬ লাখের মত মুসলমানের বাস। ইরান ও তুরস্কের মুসলমানদের সাথে এদের গভীর সম্পর্ক। আরাকস নদী পার হলেই এরা ইরান ও তুরস্কে প্রবেশ করতে পারে। হোয়াইট ওলফের অভিযোগ, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইরান ও তুরস্কের হস্তক্ষেপের একটা বড় চ্যানেল হলো এই ছিটমহল। হোয়াইট ওলফের এ অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। পশ্চিমী প্রভাবের অধীন ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক এখানে কোন তৎপরতা পরিচালনার উৎসাহই রাখে না, আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত শিয়া ইরান এদিকে তাকাবার কোন সময়ই পায় না। কিন্তু ভিত্তিহীন এ অভিযোগ তুলেই হোয়াইট ওলফরা আর্মেনিয়ার পেটের ভেতরের এ ছিটমহলে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।
প্রায় জনবিরল আরাকস হাইওয়ে ধরে আহমদ মুসার জীপ এগিয়ে চলেছে। জীপের গতি এবার উত্তর-পশ্চিমে।
দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ আহমদ মুসারা লেক আরাকস অর্থাৎ আরাকস হ্রদের তীরে গিয়ে পৌঁছাল। এখানে এসে আরাকস নদী বিশাল আরাকস হ্রদে মিশে গেছে। আরাকস হ্রদের পশ্চিমে ইরান এবং পূর্ব পাড়ে আজারবাইজানের ছিট মহলটি। দুই দেশের সীমানা হ্রদের মাঝ বরাবর। হ্রদের পশ্চিমাংশ ইরানের এবং পূর্বাংশ আজারবাইজানের। হ্রদের ইরানী অংশের নাম লেক লিবার্টি এবং আজারবাইজানের অংশের নাম লেক আরাকস।
আরাকস হ্রদে এসে আরাকস হাইওয়ে একটু পূর্ব দিকে বেঁকে আরাকস হ্রদের পূর্ব তীর ধরে উত্তরে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসার জীপ হ্রদের পূর্ব তীর ধরে এগিয়ে চলল। আরাকস হাইওয়ে এখানে এসে বেশ উচুঁ-নিচু। বেশ দুর্গম। বামে হ্রদ, ডাইনে পাহাড় এবং উপত্যকা। কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে কিংবা সুড়ঙ্গ করে রাস্তা এগিয়ে নেয়া হয়েছে।
একটা সুন্দর উপত্যকা দিয়ে এগিয়ে চলছিল জীপ। উপত্যকাটা খুব প্রশস্ত নয়। কিন্তু খুব সুন্দর। ঢালু হয়ে নেমে গেছে হ্রদের পানিতে। ডাইনে পূর্বদিকে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে উপত্যকাটি। উপত্যকার উত্তর প্রান্তের পাহাড়টি ধাপে ধাপে উঠে গেছে উপরে। পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের সমারোহ। একদৃষ্টে আহমদ মুসা তাকিয়েছিল সে সবুজ রূপের দিকে। হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ওসমান গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের ধাপে ওগুলো দ্রাক্ষা কুঞ্জ নয়?
জ্বি, মুসা ভাই। এ এলাকায় প্রচুর দ্রাক্ষা জন্মে। উপত্যকায় ধান গমও প্রচুর হয়। বলল ওসমান এফেন্দী।
কিন্তু উপত্যকায় তো ফসল দেখছি না?
না মুসা ভাই, উপত্যকায় ধানের ক্ষেত ছিল। একটু খেয়াল করে দেখুন ধান গাছের পুড়ে যাওয়া গোড়া দেখতে পাবেন।
গাড়ি থামাও তো ওসমান।
গাড়ি থেমে গেল। নেমে পড়ল আহমদ মুসা, আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দী সকলেই।
আহমদ মুসা উপত্যকার বুকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখল, ধানগাছের গুচ্ছাকায় গোড়াগুলো পোড়া। উপত্যকা বিস্তারিত বুক জুড়ে একই দৃশ্য-বিস্তৃত বিরান ক্ষেত।
আহমদ মুসা মুখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওসমান এফেন্দীর দিকে তাকাল।
ওসমান এফেন্দী বলল, ক্ষেত পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মুসা ভাই। হোয়াইট ওলফ পুড়িয়েছে। এ এলাকার বাসিন্দাদের শতকরা একশ ভাগই ছিল মুসলমান। উপত্যকা, পাহাড়ের গায়ে ফসল ফলিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। যুগ যুগ ধরে তারা সুখ শান্তিতে বসবাস করে এসেছে। কিন্তু গত এক বছর ধরে হোয়াইট ওলফের অত্যাচার এ অঞ্চলকে বিরান করে দিয়েছে। হত্যা, লুটতরাজ, ফসলের ক্ষেত জ্বালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুসলিম জনপদগুলোকে তারা উৎখাত করেছে। সীমান্ত এলাকায় এখন কোন লোক নেই। যারা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছে, তারা পালিয়ে বেঁচেছে। এই আরাকস হ্রদ, আরাকস নদী পাড়ি দিয়ে তারা ইরান ও তুরস্কে চলে গেছে।
এখনও চলছে এই অত্যাচার?
জ্বি, হ্যাঁ। আজারবাইজানের মূল ভূখন্ড ও আর্মেনিয়া অঞ্চলের চাইতে বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলে অত্যাচার ও উৎখাত অভিযান বেশি তীব্র।
আহমদ মুসা চোখ তুলে চাইল উপত্যকার প্রসারিত বুকের দিকে। উদাস, লক্ষ্যহীন তার দৃষ্টি। সেখানে বেদনার অন্তহীন ছায়া। শত মানুষের তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস যেন সে অনুভব করতে পারছে, তাদের কান্না, অসহায়দের চিৎকার তার কানকে যেন বিদীর্ণ করছে। আহমদ মুসা ধানগাছের একটা গোড়া তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেল। ধানগাছের গোড়ায় ওদের মমতাময় অশরীরি স্পর্শ যেন অনুভব করল আহমদ মুসা।
ধানগাছের গোড়া হাতে নিয়ে আহমদ মুসা একটু সামনে এগুলো।
উপত্যকার মাঝখান দিয়ে একটা ঝর্ণার ক্ষীণ ধারা বয়ে চলেছে। ঝর্ণাটা পড়ছে গিয়ে হ্রদে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এস আমরা ঝর্ণায় অজু করে নেই। যোহরের সময় হয়ে গেছে। অজু সেরে আহমদ মুসা বলল, ওসমান তুমি গাড়ি একটু এগিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় নিয়ে রাখ। রাস্তা থেকে নামিয়ে রাখবে, গাড়ি আসতে পারে। আমরা আর একটু এগিয়ে নামাজ পড়ব।
উপত্যকার উত্তর প্রান্তে পাহাড়ের প্রায় গোড়ায় একটা মসৃণ জায়গা দেখে ওরা নামাজে দাঁড়াল। আলী আজিমভ আজান দিতে চেয়েছিল। আহমদ মুসা বাঁধা দিয়ে বলল, আমরা রণাঙ্গনে, আজান না দিলেও চলবে।
ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর ফিরে বসতে গিয়ে পেছনের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। একজন যুবক দাঁড়িয়ে।
ফর্সা, দীর্ঘাঙ্গ যুবক। পরনে কাল প্যান্ট, গায়ে সাদা চাদর জড়ানো।
আহমদ মুসা তার দিকে চাইতেই সে এগিয়ে এল। একটু একটু খোঁড়াচ্ছে সে। আহমদ মুসা দেখল, তার বাম পায়ে ব্যান্ডেজ।
আহমদ মুসাকে বিস্মিত চোখে পেছনে তাকাতে দেখে আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দীও পেছনে তাকিয়েছে। সবার চোখেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
যুবকটি আরও কাছে এসে সালাম দিল। আহমদ মুসারা সালাম নিল। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই যুবকটি বলল, আমার নাম আবদুল্লাহ।
একটু দম নিয়েই যুবকটি বলল, আপনারা এখানে নিরাপদ নন। ওরা আবার ফিরে আসতে পারে।
ওরা কারা? বলল আহমদ মুসা।
পশুবাহিনী।
হোয়াইট ওলফকে আজারবাইজানিরা স্থানীয় ভাবে পশুবাহিনী বলে, ওদের পশুর মত আচরণের জন্যে।
তোমরা কে? আবার প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বলল, আমরা ওই উপরে জঙ্গলে লুকিয়ে আছি। এখানে আর দেরি করা যাবে না। চলুন উপরে, সব শুনবেন।
আহমদ মুসা আলী আজিমভ ও ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে বলল, চল যাওয়া যাক।
উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা মনে মনে বলল, পাহাড়ের খাঁজে ঝোপের আড়ালে আছে, হঠাৎ করে গাড়ি কারও নজরে পড়বে না। তারপর ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, গাড়িতে চাবি লাগিয়েছো তো?
জ্বি, হ্যাঁ। ওসমান বলল।
জঙ্গল ঠেলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওরা উপরে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতেই আহমদ মুসা আবদুল্লাহর কাছ থেকে শুনলো, এই উপত্যকা থেকে পূর্বে প্রায় মাইল পনেরো ভেতরে সানাইন গ্রামে তাদের বাড়ি। আজই সকালে তারা কয়েকটি পরিবার পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই জঙ্গলে। তিনদিন আগে সেদিন গভীর রাতে হোয়াইট ওলফের লোকরা এসে গ্রামের বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত গ্রামের নারী-শিশু-পুরুষ যারা বের হতে পারেনি, তারা পুড়ে মরেছে। আবার যারা বের হয়েছে তারাও পশুদের ব্রাশফায়ারের মুখে পড়েছে। ফলে আগুন থেকে যারা বেঁচেছিল, তারা অধিকাংশই ব্রাশফায়ারে মারা গেছে। অঞ্চলের সবচেয়ে বড়, বর্ধিষ্ণু সানাইন গ্রামের ২ হাজার বাসিন্দার মধ্যে মাত্র ৫০ জন বেঁচে আছে। যারা বেঁচে আছে তাদের মধ্যে অনেকেই আহত। আবদুল্লাহর পায়েও গুলি লেগে ছিল। সানাইনের পাশের জঙ্গলে তারা দু’দিন পালিয়ে ছিল। মনে করেছিল, পশুরা চলে গেলে বিরানভূমিতেই তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। বিশেষ করে আব্দুল্লাহর আব্বা, সমাজের নেতা, কিছুতেই দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তার কথা ছিল, অনেকেই গেছে ঠিক, কিন্তু সবাই চলে গেলে দেশের কি হবে? কিন্তু থাকা গেল না। দেখা গেল, তারা গ্রাম ছাড়ছে না। গ্রামে খৃস্টান বসতি গড়ার পরিকল্পনা তাদের।
আব্দুল্লাহ্ বলল, অবশেষে হিজরতেরই সিদ্ধান্ত নিতে হল আমাদের। লেক আরাকস পথে ইরানে প্রবেশ করা সবচেয়ে নিরাপদ। লেক আরাকসের মাঝ বরাবর উভয় দেশের সীমানা হওয়ায় লেক আরাকসে একবার ভাসতে পারলেই নিরাপদ হওয়া যায়। এই কারণে এই এলাকার বেশির ভাগ লোক এ পথেই হিজরত করেছে।
আমরাও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গত সন্ধ্যায় সানাইন থেকে বের হয়ে এলাম।
সম্ভবত পশুদের চর ছড়ানো ছিল চারদিকে। আমাদের এই হিজরত তারা টের পেয়ে যায়। আমাদের পিছু নেয় ওরা। আজ সকালে এই জঙ্গলে আমরা আশ্রয় নেয়ার এক ঘন্টা পরেই ওরা এই উপত্যকায় এসে পৌঁছে। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর ওরা সরে গেছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, ওরা চলে যায়নি। কোথাও ওঁৎ পেতে আছে নিশ্চয়।
তোমরা চলে যাচ্ছ জেনেও ওরা তোমাদের ধরার জন্যে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? বলল আহমদ মুসা।
আগে চলে যেতে ওরা দিয়েছে, কিন্তু ইদানিং ওরা আর চলে যেতে দিচ্ছে না। একেবারে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সম্ভবত ইরান ও তুরস্কে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান থেকে অনেক উদ্বাস্তু যাওয়ার পর দুনিয়াতে যে হৈ চৈ শুরু হয়েছে, তার কারণেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কথা বলতে বলতে পাহাড়ের প্রশস্ত একটা ধাপে ওরা এসে উঠল। বলা যায় পাহাড়ের বুকে যেন একটা সবুজ উপত্যকা।
ধাপে উঠতেই জঙ্গল ফুঁড়ে যেন একটা যুবক বেরিয়ে এল। তার হাতে একটা বন্দুক। সে নরম গলায় সালাম দিল আব্দুল্লাহকে।
সালাম নিয়ে আব্দুল্লাহ আহমদ মুসাদের দেখিয়ে বলল, এরা আমাদের ভাই।
যুবকটি সলজ্জ হাসিতে সালাম দিল আহমদ মুসাদের।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা যুবকটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি ভাই?
আলী। আমার চাচার ছেলে। আব্দুল্লাহ জবাব দিল।
কথা শেষ করে আলীর দিকে তাকিয়ে আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করল, আব্বা কোথায়?
পূর্ব প্রান্তের একটা বড় গাছের দিকে ইংগিত করে আলী বলল, ওখানে শুয়ে আছেন।
আব্দুল্লাহ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন যাই।
সামনে এগিয়ে চলল আহমদ মুসারা। চারদিকে ছোট ছোট গাছ আর দ্রাক্ষালতার দেয়াল। এরই ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। সবাই এদিক সেদিক বসে আছে, দু’একজন শুয়ে আছে। সবারই মুখ শুকনো, দৃষ্টি উদাস। একটা গাছের তলায় দশ বার জন মেয়েকে দেখা গেল। সবারই মুখ নিচু, চুপচাপ বসে আছে। বেদনার ভারে ওরা যেন ন্যুব্জ।
আব্দুল্লাহ বলল, যাদের দেখছেন, সবাই সব হারিয়ে নিঃস্ব। এক পরিবারের মধ্যে একজন বেঁচে আছে এমনদের সংখ্যাই আমাদের মধ্যে বেশি।
সামনে এগুচ্ছিল ওরা। সামনে আব্দুল্লাহ, তারপর আহমদ মুসা। এরপর আলী।
চারদিকের সবার উৎসুক দৃষ্টি আহমদ মুসাদের দিকে। সে ঔৎসুক্যের মধ্যে আশার আকুতি আছে। চলছিল ওরা। পাশ থেকে এক তরুণী ছুটে এল আব্দুল্লাহর সামনে। বলল, ভাইজান, আমার আব্বা —–
সে কথা শেষ করতে পারল না। কান্নায় বুজে গেল তার কণ্ঠ।
কি হয়েছে ফায়জা, অবস্থা আরও খারাপ? বলল আব্দুল্লাহ।
কোন জবাব না দিয়ে তরুণীটি বলল, শীঘ্রই চলুন আপনি। কেমন জানি করছেন।
আব্দুল্লাহ আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা বলল, চল আগে ফায়জার আব্বাকে দেখে আসি। উনি কি অসুস্থ?
একজন অপরিচিত লোকের মুখে ফায়জা তার নাম শুনে চোখ তুলে তাকাল। নেকাবটি নাকের উপর দিয়ে চলে গেছে। চোখ অশ্রু ধোয়া, বিষণ্ণ বেদনায় পীড়িত। যেন বিধ্বস্ত একটি ফুল।
আব্দুল্লাহ চলতে শুরু করে বলল, উনি আহত। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
অল্প দূরে একটা গাছের তলায় একটা চাদরে শুয়ে একজন শক্ত-সমর্থ মাঝ বয়েসি লোক চোখ বন্ধ করে মাথা ঠুকছিলেন। কষ্টে ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক।
আব্দুল্লাহ ছুটে গিয়ে তার মাথা তুলে নিল দুই হাতে।
লোকটির পাঁজরের কাপড়ে রক্তের দাগ। পাঁজরে গুলি লাগে তার। দেখলেই বুঝা যায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের শিকার সে। গোটা দেহ তার অসাড়। আহমদ মুসা বুঝল, আঘাতটা প্রাণহানিকর নয়, রক্ত বন্ধ হলেই তাকে হয়ত বাঁচানো যায়।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল লোকটি। চোখ খুলে আব্দুল্লাহকে দেখে তার চোখ দু’টি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই সাথে নেমে এল তার চোখ দিয়ে অশ্রুর দু’টি ধারা। ঠোঁট দু’টি তার নড়ে উঠল। অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে থেমে থেমে বলল, বাবা আব্দুল্লাহ, আমার সময় হয়েছে। আমার মা ফায়জার আর কেউ থাকল না। তোমার হাতেই ওকে দিয়ে গেলাম। ওকে দেখো।
ফায়জা দাঁড়িয়েছিল। বসে পড়ল। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল, আব্বা!
লোকটি, ফায়জার আব্বা, একটু দম নিয়েছিল। আবার সে বলতে শুরু করল, বাবা আব্দুল্লাহ, হতাশ হয়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা করো। তিনি সাহায্য করবেন। এ বিরান জনপদে দেখো আবার জীবনের জোয়ার জাগবেই।
শেষ কথা তার প্রায় ঠোঁটেই জড়িয়ে থাকল। ধীরে ধীরে বুজে গেল তার চোখ। শান্ত হয়ে গেল তার অশান্ত বুকটিও।
আব্দুল্লাহ ধীরে ধীরে হাত থেকে নামিয়ে রাখল তার মাথা।
ফায়জা পিতাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
আব্দুল্লাহও দু’হাতে মুখ ঢাকল তার। আহমদ মুসার চোখ দু’টিও ভিজা। বড় দু’ফোঁটা অশ্রু তার দু’চোখের কোণায় এসে জমা হয়েছে। কিন্তু তার মুখ যেন ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠল। ঠোঁট দু’টি তার দৃঢ় সংবদ্ধ।
অত্যন্ত দৃঢ় ও শক্ত গলায় আহমদ মুসা ডাকল, বোন ফায়জা, ভাই আব্দুল্লাহ!
নরম বেদনাবিধুর মৌন পরিবেশে তার এই শক্ত ও উচ্চকণ্ঠ বড় বেসুরো শুনাল।
ফায়জা ও আব্দুল্লাহ দু’জনেই প্রায় চমকে উঠে তার দিকে মুখ তুলল। ফায়জার মুখে সেই নেকাব তখন নেই।
আহমদ মুসা বলল, আব্দুল্লাহ, ফায়জা, আমি তোমাদের চোখে অশ্রু নয়, আগুন দেখতে চাই, শোকে মুষড়ে পড়া নয়, শক্তির প্রবল উচ্ছ্বাস দেখতে চাই। মুসলমানদের জন্ম কাঁদার জন্যে হয়নি, ইসলাম দুর্বলদের জন্যে নয়। রণাঙ্গনে লাশের পর লাশ পড়েছে, আমরা কি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের জন্যে যুদ্ধ করিনি?
ফায়জার আব্বার মৃত্যু সংবাদ শুনে নারী পুরুষ সবাই জমা হয়েছিল সেই গাছের তলায়। আব্দুল্লাহর আব্বাও। সবাই চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার কথা শুনছিল আর ভাবছিল, এমন নতুন করে কথা বলছে এই লোকটি কে, এই লোকরা কারা!
আহমদ মুসার কথায় সবার মধ্যেই শক্তির একটা শিহরণ জেগে উঠেছিল, শোকের ঢেউটা যেন দূরে সরে যাচ্ছিল।
আব্দুল্লাহ ও ফায়জার মুখ থেকেও যেন শোকের ছায়া সরে গেল। চোখের অশ্রু শুকাতে লাগল। এমন কথাতো তারা কারো কাছ থেকে শুনেনি! এতো শুধু কথা নয়, এ যেন জীবন্ত এক শক্তি, যা ভয়-ভাবনাকে মুহূর্তে তাড়িয়ে দেয়।
আব্দুল্লাহর আব্বা বৃদ্ধ আলী আবরার খান এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
কাছে এসে আহমদ মুসার একটা হাত তুলে নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, তুমি কে, তোমরা কারা বাবা?
এই সময় একজন চিৎকার করতে করতে ছুটে এল, সাবধান পশুরা আবার এসেছে।
লোকটি এসে আলী আবরার খানের কাছে দাঁড়াল। ভীষণ হাঁপাচ্ছে লোকটা।
আলী আবরার লোকটিকে বলল, কি খবর, কি দেখেছ তুমি শরীফ?
ওরা এসেছে, সাথে কুকুর দেখলাম। বলল শরীফ।
কুকুর? প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
–জি।
–কয়টি?
–দু’টি।
–ওরা কতজন?
–পনের-ষোলজন।
–কোথায় দেখেছেন ওদের?
–উপত্যকায়, এদিকে আসছে।
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করল। তারপর মুখ তুলল। তাকাল সবার দিকে। দেখল, একটা ভয়ের ছায়া নেমেছে সবার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা আলী আবরার খানের দিকে চেয়ে বলল, জনাব, আপনি মাইয়্যেতের দাফনের ব্যবস্থা করুন। কোন চিন্তা করবেন না, আমরা আসছি।
তারপর ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ওসমান তুমি এদের সাথে এখানে থাক। আমি ও আলী আজিমভ নিচে যাচ্ছি।
–কিন্তু মাত্র তোমরা দু’জন ——-
প্রশ্ন তুলল আলী আবরার।
–অসুবিধা নেই। শরীফ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
–অন্তত আব্দুল্লাহ, আলীসহ কয়েকজনকে নিয়ে যাও।
–দরকার হবে না, চাচাজান। আব্দুল্লাহ আহত। অবশ্য ইচ্ছা করলে আলী আমাদের সাথে যেতে পারে।
–আঘাত সামান্য, আমি পারব যেতে। বলল আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহর কাঁধ চাপড়ে হেসে বলল, তোমার উপর আমার আস্থা আছে আব্দুল্লাহ। তবু বলছি, তুমি এখানেই থাক। পশ্চাৎদেশ অরক্ষিত রাখা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজী নয়।
এই সময় নিচের দিক থেকে চাপা একটা গোঙ্গানী ভেসে এল।
–কুকুরের গোঙ্গানী। বলল আলী আবরার।
–কুকুর ওদের পথ দেখাচ্ছে, ওরা তাহলে উঠছে। বলল আহমদ মুসা।
বলেই আহমদ মুসা ওসমান এফেন্দীকে বলল, তুমি আব্দুল্লাহ, আলী এবং আরও যুবক যারা আছে তাদের নিয়ে নজর রাখবে, কোন ফাঁক গলিয়ে কেউ যাতে উপরে আসতে না পারে। আমরা আলীকে সাথে নিচ্ছি না। শরীফ আমাদের পথ দেখাবে।
আহমদ মুসা এবং আলী আজিমভ সবাইকে সালাম জানিয়ে নিচে নামার পথ ধরল। পেছনে পেছনে চলল শরীফ।
প্রায় দু’শ গজ নামার পর একটা টিলার পাশে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, আজিমভ, অগ্রসর হবার আগে একটু ভালোভাবে চারিদিকটা দেখা দরকার, ওরা কোন পথে এগুচ্ছে।
টিলার গোড়াতেই অনেকগুলো গাছ। বেশ উঁচু। আহমদ মুসা তারই একটিতে তরতর করে উঠে গেল।
গাছের মাঝামাঝি উঠতেই পাহাড়ের গোটা ঢালটা নজরে এল, উপত্যকাও নজরে আসছে।
আহমদ মুসা দূরবীন লাগালো চোখে। আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল গোটা পাহাড়ের ঢালটা। আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেখল, আহমদ মুসারা যেখানে আছে সেখান থেকে প্রায় ৪’শ গজ নিচে ওরা উঠে আসছে। গাছের আড়াল হওয়ার কারণে ওদের দলের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। এই সময় ওরা উন্মুক্ত একটা ধাপে উঠে এল। এবার সবাই দূরবীনের লেন্সে ধরা পড়ল। কিন্তু ওদের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওরা মাত্র ৮জন কেন? আর কুকুর কোথায়? চিন্তা করতে গিয়ে শিউরে উঠল আহমদ মুসা।
তরতর করে সে নেমে এল নিচে। ফিসফিস করে আজিমভকে বলল, সাবধান, যে কোন সময় আক্রমণের মুখোমুখি আমরা হতে পারি।
আহমদ মুসা এবং আলী আজিমভ দু’জনেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে এম-১০ রিভলভার বের করে আনল।
শরীফের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, তুমি আর কোথাও নড়ো না, এই টিলার গোড়ায় বসে থাক।
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। টিলার ওপাশ থেকে তীরের মত ছুটে এল দু’টি কুকুর। আহমদ মুসাদের দেখেই থমকে দাঁড়াল শিকারী কুকুর দু’টি। রক্তের মত লাল ওদের চোখ। আহমদ মুসা ও আলী আজিমভের হাতে উদ্যত রিভলভার। আলী আজিমভ ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা হাত তুলে নিষেধ করল। শিক্ষিত-শিকারী কুকুর দু’টি মুহূর্তকাল থমকে দাঁড়িয়েই ভীষণভাবে ঘেউ ঘেউ করতে করতে পেছনে সরে গেল।
আহমদ মুসা বলল, আজিমভ তুমি টিলার পশ্চিম পাশ আগলাও, আমি পূর্ব পাশে আছি। সামনেই একদল শত্রু, তার পেছনে আরেক দল আছে।
কুকুর পেছনে সরে যাওয়ার মুহূর্ত কয়েক পরেই চারজনকে উদ্যত স্টেনগান হাতে টিলার প্রান্তে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল। আহমদ মুসা টিলার প্রায় গা সেঁটে একটা গাছের গুড়িকে আড়াল করে শুয়ে ছিল। আর ওদের চোখ ছিল সামনে, উপরদিকে। আহমদ মুসাকে ওরা দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা উঠে বসল। তারপর এম-১০ এর বাঘা মুখটা ওদের দিকে তাক করে হুকুম দিল, হয়েছে, এবার স্টেনগান ফেলে দাও।
বিদ্যুৎ বেগে ওরা চারজনই এদিকে ঘুরে দাঁড়াল। সাথে ঘুরে গেল ওদের স্টেনগানও। কিন্তু আহমদ মুসা ওদের সুযোগ দিল না। তারা ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই আহমদ মুসার তর্জনী চেপে বসল ট্রিগারে। এম-১০ থেকে গুলির একটা ঝাঁক বেরিয়ে গেল।
ওরা চারজন যে যেখানে ছিল সেখানেই ঝরে পড়ল মাটিতে। একটি শব্দও ওদের মুখ থেকে বের হয়নি।
এদিকে আলী আজিমভ আহমদ মুসার নির্দেশ পাবার পর হামাগুড়ি দিয়ে গেল টিলার পশ্চিম প্রান্তে। তারপর টিলার পশ্চিম মাথা ঘুরে টিলার দক্ষিণ পাশটায় উঁকি দিল আলী আজিমভ। তার হাতে উদ্যত এম-১০।
উঁকি দিয়েই চমকে একদম মুখোমুখি হলো তাদের সাথে। ওরাও চারজন গুটি গুটি এগুচ্ছিল টিলার পশ্চিম প্রান্তের দিকে। চমকে উঠেছিল ওরাও। ওদের হাতেও উদ্যত স্টেনগান।
এই সময়ই গর্জে উঠেছিল আহমদ মুসার এম-১০। ওদের চোখটা মুহূর্তের জন্যে ওদিকে ঘুরে গিয়েছিল। আলী আজিমভ এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করল। অগ্নিবৃষ্টি করল তার এম-১০। মাত্র পাঁচ-ছয় হাতের ব্যবধান। ঝাঁঝরা দেহ ওদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা, আলী আজিমভ ও শরীফ তিনজনই টিলার দক্ষিণ পাশে উন্মুক্ত ছোট্ট ধাপটার উপর এসে দাঁড়াল। তারা দেখল, কুকুর দু’টি চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে যাচ্ছে। অল্পক্ষণ পরেই কুকুর দু’টির চিৎকার আর শোনা গেল না।
আহমদ মুসা দূরবীন হাতে নিয়ে আবার টিলার উপর উঠল। দূরবীন চোখে লাগাল। মাঝে মাঝে গাছের আড়াল থাকলেও সামনের এলাকাটার সবকিছুই মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে আহমদ মুসা। দেখল, কুকুর দুটি সাথে নিয়ে ওরা আটজন দ্রুত উপরে উঠে আসছে। এবার স্টেনগান ওদের কাঁধে নয়, হাতে।
আহমদ মুসা আরও দেখল, প্রায় ১শ’ সোয়াশ’ গজ নিচে পাহাড়ের বড় একটা ধাপ। তার দু’পাশেই গভীর খাদ। এ এলাকায় উপরে উঠার এই ধাপই একমাত্র পথ। ধাপের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছোট একটি টিলা। টিলার আড়ালে দাঁড়ালে গোটা ধাপটাই নজরে আসে।
আহমদ মুসা দ্রুত নেমে এল টিলা থেকে। বলল, আজিমভ চল, নিচের ঐ টিলাটা আমাদের দখল করতে হবে।
ক্রলিং করে দ্রুত ওরা নেমে এল ঐ টিলার পিছনে।
দশমিনিটও পার হয়নি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সেই ধাপের উপর প্রথম উঠে এল কুকুর দুটি। তারপর ওরা আটজন। ধাপে উঠেই কুকুর দুটি মহা ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল। ওরা একবার ছুটে এল টিলার দিকে।
আহমদ মুসা শুয়েছিল এক পাথরের আড়ালে। পাথরের সুড়ংগে তার এম-১০ রিভলভারের নল। সে ভাবল, আর ওদের সময় দেয়া যায় না।
আহমদ মুসা দৃঢ় ও উচ্চকণ্ঠে বলল, তোমরা আটজনই গুলির রেঞ্জে। স্টেনগান ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। পালাবার চিন্তা করলে মারা পড়বে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। গর্জে উঠল ওদের আটটি স্টেনগান। আহমদ মুসার মুখের শেষ শব্দটি স্টেনগানের গর্জনে ঢাকা পড়ে গেল। গুলি করতে করতে ওরা ছুটে এল।
আহমদ মুসার তর্জনী ট্রিগারেই ছিল। শেষ শব্দ উচ্চারণ করেই চেপে ধরল ট্রিগার। পাথরের ফাঁক দিয়ে ঘুরিয়ে নিল রিভলভারের মাথা। গুলির স্রোত বেরিয়ে গেল মেশিন রিভলভার এম-১০ এর বুক থেকে। প্রশস্ত ধাপের অর্ধেকের বেশি ওরা আটজন এগোতে পারেনি। গুলি লেগে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ওরা আটজনই আছড়ে পড়ল মাটিতে। কুকুর দুটিও এবার বাঁচল না। ওদের সাথেই ছিল কুকুর দুটি। ওদের সাথে একই ভাগ্য বরণ করল তারা।
আহমদ মুসারা তিনজনই টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। দাঁড়াল আটটি লাশের সামনে। রক্ত তখনও গড়াচ্ছে পাথরের কাল বুকের উপর দিয়ে। উন্মুক্ত গোটা ধাপটাই রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রবহমান লাল রক্তের দিকে।
এক সময় তার কণ্ঠ থেকে স্বগতঃ বেরিয়ে এল, আল্লাহর কাছে মানুষের রক্ত সবচেয়ে মূল্যবান। এজন্যই হন্তাকে তিনি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে রক্তপাত থেকে মানবসমাজ মুক্ত হতে পারে। কিন্তু, তবু এই রক্তপাত কেন?
কে এর জন্য দায়ী?
একটু থামল আহমদ মুসা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল সে আলী আজিমভ ও শরীফের দিকে। বলল, মানুষকে, মানবসমাজকে মানুষ-প্রভুদের অক্টোপাস থেকে, তাদের লোলুপ-গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারলে এ রক্তপাত থেকে আমাদের এ সুন্দর বিশ্বকে রক্ষা করা যাবে না।
শরীফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। ভেবে পেল না, কঠোর-কোমলে এমন অপরূপ মানুষ হয়! কে ইনি? কে এরা?
নিহত ষোল জনের দেহ সার্চ করে কিছু টাকা ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না, একটু কাগজও নয়। অর্থাৎ, হোয়াইট ওলফ এখানেও সামনে এগোবার কোন চিহ্ন রেখে গেল না।
ওদের ষোলটি স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে আহমদ মুসারা উঠে এল উপরে।
উপর থেকে আহমদ মুসাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে আব্দুল্লাহ, আলীসহ যুবকরা দ্রুত নেমে এল। শরীফ আব্দুল্লাহকে দেখেই চিৎকার করে উঠল, আব্দুল্লাহ ভাই, ওরা ষোলজন কেউ বাঁচে নি।
আব্দুল্লাহ এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, খোশ আমদেদ মুসা ভাই।
–আমার নাম কি করে জানলে?
–ওসমান আমাদের সব বলেছে। তাইতো বলি, আহমদ মুসা ছাড়া খল, ক্ষিপ্র, ক্রুর ও হিংস্র হোয়াইট ওলফকে চ্যালেঞ্জ করতে এভাবে আর কে এগিয়ে যেতে পারে!
–এটা ঠিক নয় আব্দুল্লাহ, প্রতিটি মুসলিমই অকুতোভয় সৈনিক।
–ঠিক মুসা ভাই, কিন্তু আমরা তো সেই মুসলিম নই।
–একথাও তুমি ঠিক বললে না আব্দুল্লাহ, সবই ঠিক আছে। অব্যবহারের ফলে তলোয়ারে শুধু মরিচা ধরেছে মাত্র।
–ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। আপনার সংস্পর্শ এই মরিচা তুলে দিচ্ছে। মুসা ভাই, এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত মৃত্যুভয় আমাকে ঘিরেছিল, কিন্তু এখন আর আমার মনে কোন ভয় নেই।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহর পিঠ চাপড়ে বলল, বাহাদুর ভাই এইতো চাই। মুসলমানরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গাজী হওয়ার জন্যেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তার কাছে জীবনের চেয়ে শাহাদাৎ বেশি লোভনীয়। এ ধরনের বাহিনী কখনও হারতে পারে না আব্দুল্লাহ।
আব্দুল্লাহ, আলী, শরীফ সকলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা সবাইকে তাড়া দিল, চল এবার।
যুবকরা যুদ্ধলব্ধ ষোলটি স্টেনগান হাতে নিয়ে আনন্দ করতে করতে উপরে ছুটে চলল।
উপরের ধাপের প্রান্তে নারী-পুরুষ সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। সকলের দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ আলী আবরার খান। তার পাশে ওসমান এফেন্দী।
যুবকরা স্টেনগানগুলো নিয়ে আলী আবরার খানের সামনে রাখল। কিন্তু সেদিকে বৃদ্ধের কোন মনোযোগ নেই। তার বিস্ময় বিজড়িত মুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা এসে সালাম করতেই বৃদ্ধ একটু এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলতে লাগল, আল্লাহর কি করুণা, আমাদের কি সৌভাগ্য, তোমাকে আমরা পেয়েছি বাবা। রূপকথার মত আমরা তোমার গল্প শুনেছি, আর গৌরব বোধ করেছি।
তারপর আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ সকলকে লক্ষ্য করে বলল, হে আমার কবিলার ছেলেমেয়েরা, তোমাদের সবচেয়ে বড় দুর্দিনে তোমাদের সবচেয়ে বড় এবং মহান ভাইকে আল্লাহ তোমাদের সাহায্যে পাঠিয়েছেন। তোমরা সকলে আল্লাহর শোকর আদায় কর।
বলে বৃদ্ধ নিজেই কেবলামুখী হয়ে সিজদায় পড়ে গেল। তার সাথে সকলেই।
যখন তারা সিজদাহ থেকে মুখ তুলল, দেখা গেল, সকলের মুখই চোখের পানিতে ধোয়া।
আহমদ মুসা, আলী আজিমভ, ওসমান এফেন্দী এ অভূতপূর্ব দৃশ্যের সামনে অভিভূতের মত দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখেও অশ্রু।
সবাই মাথা তুলে উঠে বসলে আহমদ মুসা বলল, প্রিয় ভাই-বোনেরা, আল্লাহর অনুগ্রহ ভিখারী আমি তারই এক নগণ্য বান্দাহ। আমি মুসলিম। আমি আমার নিপীড়িত মুসলিম ভাই-বোনদের ভালবাসি। এ ভালবাসাই আমার শক্তি এবং এটা আল্লাহরই দেয়া নেয়ামত। আপনাদের এই সিজদাহ আল্লাহ কবুল করুন এবং এ দেশের মুসলমানদের উপর যে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে তা থেকে সবাইকে আল্লাহ মুক্ত করুন।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, আসুন এবার আমরা প্রথমে মাইয়্যেতের দাফন সম্পন্ন করি।
পাহাড়ের এক গুহায় পাথর দিয়ে কবরে দাফন সম্পন্ন করে সবাই এসে বসলো। আলী আবরার খানের পাশে আহমদ মুসা।
আলী আবরার খানের দিকে মুখ তুলে আহমদ মুসা বলল, জনাব আমি কয়েকটা কথা বলব।
–বল।
–আমার প্রথম কথা, আপনার সাথে বাপ-মা হারা, পরিবার হারা যে ইয়াতীম মেয়েরা আছে, তাদের অভিভাবকত্বের চিন্তা করুন। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা খুব জরুরি।
–হ্যাঁ, আমিও এটা ভাবছি। তোমার কোন পরামর্শ আছে বাবা?
–মতামত নিয়ে ছেলে-মেয়েদের যাদের বিয়ের বয়স হয়েছে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করাই আমি উত্তম মনে করছি। আমার একটা প্রস্তাবও আছে, আব্দুল্লাহর সাথে ফায়জার বিয়ে দিন। ফায়জার মরহুম পিতার এটাই ইচ্ছা ছিল, আমি তার সাক্ষী।
পাশেই বসে ছিল আব্দুল্লাহ। অল্প কিছু দূরে ফায়জা, নেকাবে মুখ ঢাকা তার। আহমদ মুসার কথাগুলো তাদেরও কানে গেল। তারা মুখ নিচু করল।
–বাবা, তোমার দু’টো পরামর্শই উত্তম। আমি ব্যবস্থা করছি।
–আমার দ্বিতীয় কথা, আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? শুনেছি, আপনারা সীমান্তের ওপারে ইরানে হিজরত করতে চান।
–হ্যাঁ, হিজরত করব বলেই আরাকস হ্রদের এখানে এসেছি। একটা নৌকাও যোগাড় হয়েছে। এখন তুমি যে পরামর্শ দেবে, তা-ই করব। তোমাকে পাওয়ার পর কিন্তু হিজরতের চিন্তা আমার মনে আর নেই।
–চাচাজান, বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তা করেছি। আজারবাইজানের এ ছিটমহলের এলাকা নিরাপদ নয়। আর এত দূর থেকে দেশের অভ্যন্তরে অনিশ্চিতভাবে ফিরে যাওয়া আর নিরাপদ নয়। সুতরাং সাময়িকভাবে আপনাদের হিজরত করতেই হচ্ছে।
–বাবা, তুমি আমাদের নেতা। তোমার পরামর্শ আমাদের কাছে নির্দেশ।
–নৌকা আপনাদের কোথায়, কোন অসুবিধা আছে কি না?
–উপকূলে একটা ঝোপের আড়ালে বাঁধা আছে। ইঞ্জিন, তেল সবই ঠিক আছে। অসুবিধা ছিল নিরাপত্তার প্রশ্নে। সে দিকটাও এখন আর নেই।
–কখন আপনারা যাত্রা করতে চান?
–তোমার নির্দেশ হলে আজ সন্ধ্যায়। রাতের অন্ধকার ছাড়া হ্রদে নৌকা ভাসানো নিরাপদ নয়।
–আমার তৃতীয় কথা চাচাজান, আমাদের এখন যেতে হয়।
সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধ কোন উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে বলল, সব শুনেছি বাবা, তুমি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ইয়েরেভেন যাচ্ছ। প্রতি মুহূর্ত তোমার জন্যে মূল্যবান। কিন্তু মন কি বলছে জান, তোমার সঙ্গ যতক্ষণ পাব, সাহসের সঞ্চয় যেন আমাদের তত বেশি হবে। তোমাকে ছাড়ার কথা ভাবতেই বুক খালি হয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ ভাবল। চিন্তা করল, বিধ্বস্ত এই লোকদের এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক হবে কি না। অবশেষে সে বলল, ঠিক আছে চাচাজান, আপনারা নৌকায় উঠা পর্যন্ত আমরা আছি।
আলী আবরার খানের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সবচেয়ে খুশি হল আব্দুল্লাহ।
এই সময় খানা এল। শুকনো রুটি এবং ফল।
আলী আবরার খান ভারি কণ্ঠে বলল, মেহমানদারি করার আর কিছুই নেই বাবা আমাদের।
আহমদ মুসা হেসে বলল, যা ক্ষুধা, অমৃতের চেয়েও এ ভাল লাগবে।
নয়টি নতুন দম্পতিসহ সবাই নৌকায় উঠেছে। সবার চোখেই পানি। একবেলায় আহমদ মুসা সবার যে আপন হয়ে যাবে, কে ভেবেছে? বৃদ্ধ আলী আবরার খান চোখ মুছতে মুছতে নৌকায় উঠে গেল। তীরে দাঁড়িয়ে তখনও আব্দুল্লাহ এবং নববধূ ফায়জা।
আবদুল্লাহ ফুঁপিয়ে কাঁদছে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে। বলছে, আমাকে আপনার সাথে থাকতে দিন, আমি দেশ থেকে পালাতে চাই না।
আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তুমি পালাচ্ছ না। তুমি উদ্বাস্তু একটি জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছ। চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ডাকব। আর ওসমান এফেন্দীর ঠিকানা তোমার কাছে তো আছেই। দেরি করো না, যাও ভাই।
চোখ মুছতে মুছতে আব্দুল্লাহ ঘুরে দাঁড়াল এবং বলল, ঠিক আছে, আমি কিন্তু এসে যাব।
ফায়জা তখনও নতমুখে দাঁড়িয়ে। আব্দুল্লাহ চলতে শুরু করতেই ফায়জা একটু এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে বলল, বড় ভাই, পিতা-মাতা সব হারিয়ে আপনাকে ভাই পেয়েছিলাম, দোয়া কর——
কান্নায় কথা শেষ করতে পারলো না ফায়জা।
আহমদ মুসারও চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছিল। বলল, যাও বোন, আল্লাহ হাফেজ।
ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ তুলে নৌকা পানিতে ভাসল। ধীরে ধীরে তার গতি বাড়ল। নৌকার গলুইতে আব্দুল্লাহ ও ফায়জা দুই ছায়ামূর্তির মত দাঁড়িয়ে। ওরা বোধ হয় দেখতে চেষ্টা করছে উপকূলে দাঁড়ানো আহমদ মুসাদের।
ধীরে ধীরে তারা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
এবং একসময় নৌকাও আর দেখা গেল না। হ্রদের কালো পানির দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা তখনও দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি কিন্তু হ্রদের কালো পানিতে তখন নয়। ছুটে গেছে তা সুদূর সিংকিয়াং-এ। বিদায়কালীন আমিনার সজল চোখ তার সামনে ভেসে উঠেছে। ও কেমন আছে! কাঁদছে না তো ও! আর এক পশলা অশ্রু নেমে এল তার চোখ থেকে।
পেছনে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা।
চোখ মুছে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, চল আজিমভ, ওসমান গাড়ি রেডি করেছে।
গাড়িতে গিয়ে ওরা উঠল।
ওরা উঠে বসতেই ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। নড়ে উঠল গাড়ি।
বামে কাল হ্রদ, ডাইনে কাল পাহাড় মৌন প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে। সামনে আরাকস হাইওয়ের শূন্য কাল বুক। চারদিকের অখন্ড নীরবতার মাঝে একটানা এক চাপা শব্দ-তরঙ্গ তুলে তীব্র বেগে ছুটে চলল আহমদ মুসার জীপ।
এক ঘন্টার মধ্যে তারা তাগাবান শহরের উপকণ্ঠে গিয়ে পৌঁছল। তাগাবান শহর আরাকস ও আরপা নদীর সঙ্গমস্থলে আরপা নদীর তীরে অবস্থিত। আরপা নদী লেক সেভেনের দক্ষিণে মধ্য আর্মেনিয়ার পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে তাগাবান শহরের পশ্চিম পাশে এসে আরাকস নদীতে পড়েছে।
তাগাবান শহর ছোট্ট, কিন্তু আজারবাইজানের এ ছিটমহলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী। অবস্থানগত দিক দিয়েও তাগাবান গুরুত্বপূর্ণ। তাগাবান শহর থেকে আরাকস নদী ইরানের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাগাবান শহর থেকে ২৫ মাইল পর্যন্ত ইরানের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হবার পর, আরাকস তুরস্কের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হবার পর আবার আর্মেনিয়ার সীমানায় ফিরে এসেছে। তাগাবান শহরের কাছে আরপা নদী যেখানে গিয়ে আরাকসে পড়ছে, সে স্থানটিও ইরান সীমান্তের অভ্যন্তরে।
এই অবস্থানগত গুরুত্বের কারণে আজারবাইজান ছিটমহলের এ এলাকার উপর খৃস্টান আর্মেনিয়া এবং হোয়াইট ওলফের বিশেষ নজর পড়েছে। তাদের অভিযোগ হল, এই পথে ইরান ও তুরস্ক থেকে মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটছে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ায়। তারা বলছে, মুসলমানদের জন্যে অস্ত্র ও উস্কানি এপথ দিয়েই বেশি আসছে। কিন্তু আসল কথা হলো, হোয়াইট ওলফ এই এলাকায় মুসলমানদের উপর যে ব্যাপক নিপীড়ন চালাচ্ছে তাকে আড়াল করা এবং ইরান-তুরস্ক যাতে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার হতভাগ্য মুসলমানদের কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতার কথা চিন্তা করতে না পারে তার জন্যেই এই অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তাগাবান শহরের উপকণ্ঠে এসে জীপের গতি অনেকখানি কমিয়ে আনল ওসমান এফেন্দী। রাস্তায় লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া এখন দেখা যাচ্ছে।
তাগাবান শহরকে ডানে রেখে শহরের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে আরাকস হাইওয়ে এগিয়ে গেছে আরপা নদীর ব্রীজের দিকে। ব্রীজ পার হবার পর আরাকস হাইওয়ের আবার সেই দীর্ঘ যাত্রা। এখানে আরাকস হাইওয়ে থেকে নদীর এপার তীরে অবস্থিত ইরানের ও তুরস্কের বর্ডার আউটপোস্টের আলো পাহাড়ের ফাঁক গলিয়ে মাঝে মাঝেই দেখা যায়।
শহর প্রায় পেরিয়ে ব্রীজের গোড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেল আহমদ মুসার জীপ।
–কোন চেক তো হল না ওসমান এফেন্দী? বলল আহমদ মুসা।
–কেন আজারবাইজান থেকে আর্মেনিয়া এলাকায় গাড়ি প্রবেশ করার সময় চেক হয়েছে, আবার আর্মেনিয়া থেকে আজারবাইজান ছিটমহলে প্রবেশের সময়ও তো চেক হয়েছে। এখনও তো আমরা আজারবাইজান এলাকায়। এই তো সামনে যখন আজারবাইজানের এ ছিটমহল ছেড়ে আর্মেনিয়ায় আবার প্রবেশ করব, তখন চেক হবে।
গাড়ি ব্রীজের উপর এসে উঠল। শহরের মতই ব্রীজও আলোকোজ্জ্বল।
তাগাবান শহরটা আরপা নদীর দক্ষিণ পাড়েই সীমাবদ্ধ। উত্তর তীর ঘেঁষে পাহাড়ের দেয়াল। তাই ওপারে শহর বিস্তারের কোন সুযোগ হয় নি। একটা সংকীর্ণ গিরিপথ বরাবর তৈরি হয়েছে আরপা ব্রীজটি।
ব্রীজটিই আলোকোজ্জ্বল, তারপরেই অন্ধকার।
আহমদ মুসার জীপ ব্রীজ পেরিয়ে অন্ধকার গিরিপথের সংকীর্ণ রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
জীপ তখন স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসেনি। এমন সময় জীপের মাত্র কয়েকগজ সামনে ঠিক জীপের নাক বরাবর কাল ওভারকোটে দেহ ঢাকা এক ব্যক্তিকে হাত তুলে দাঁড়াতে দেখা গেল। লোকটির মাথায় হ্যাট, হাত তার খালি।
লোকটির মাত্র দু’গজ সামনে জীপটি প্রায় ধাক্কা খেয়েই থেমে গেল।
স্বভাববশতই আহমদ মুসা ও আলী আজিমভের হাত গিয়ে রিভলভার স্পর্শ করেছিল। এভাবে রাস্তার মাঝখানে গাড়ির নাক বরাবর দাঁড়িয়ে গাড়ি থামাবার দাবি জানানো স্বাভাবিক নয়।
কিন্তু রিভলভার বের করার সময় হলো না। গাড়ি ধাক্কা খেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই গাড়ির চার জানালা দিয়েই স্টেনগানের নল এসে প্রবেশ করল।
একজন ড্রাইভার সিটের জানালায় মুখ এনে ওসমান এফেন্দীকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি ওসমান এফেন্দী না?
হ্যাঁ! বলল ওসমান এফেন্দী।
আগারাক সুড়ঙ্গে আমাদের লোকদের খুব তো কলা দেখিয়ে চলে এসেছিলে, এখন?
তারা তো চেক করেই আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।
না, ছেড়ে দেয়নি।
পাশ থেকে কে একজন এই সময় বলল, কথা থাক, ভদ্রলোকের মত নেমে আসতে বল সবাইকে।
হাত উপরে তুলে নেমে এস সবাই, চালাকি করলে মারা পড়বে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল না, এরা আহমদ মুসাদের চিনতে পেরেছে না আগারাক সুড়ঙ্গমুখে ওদের লোকদের নিষেধ অমান্য করে চলে আসাটাই অপরাধ হয়েছে। সেখানে চলে আসার জন্য ছেড়ে দেবার পর তাদের দাঁড়াতে বলেছিল কেন? কোন নতুন খবর কি সেখানে পৌঁছেছিল? পৌঁছলে সেটা কি? আহমদ মুসা এসেছে, একথা হোয়াইট ওলফ জানে এবং সবাইকে ইতোমধ্যে জানিয়েও দিতে পারে। কিন্তু এই সমযের মধ্যে তার ফটো সংগ্রহ এবং তা সব জায়গায় পৌঁছানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে হোয়াইট ওলফরা যে তার আগের যে কোন শত্রুর চেয়ে সুসংগঠিত, ক্ষিপ্র এবং নিষ্ঠুর তা ইতোমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এরা পিছু হটে না এবং মৃত্যু ছাড়া এরা থমকেও দাঁড়ায় না। হিটলারের নাজীদের মতই বোধহয় এদের ট্রেনিং-হয় করতে হবে, নয় মরতে হবে। পরাজিত হওয়া এবং বাঁচা দুটো একসঙ্গে চলবে না। এদের দায়িত্ববোধ এবং যোগাযোগও চমৎকার। আগারাক সুড়ঙ্গের লোকদের কাছ থেকে এরা নিশ্চয়ই ওয়্যারলেসেই খবর পেয়েছে।
এসব কথা চিন্তা করতে করতে আহমদ মুসা দু’হাত উপরে তুলে বেরিয়ে এল।
বেরিয়েই ইয়েরেভেন এলাকার আঞ্চলিক আর্মেনীয় ভাষায় বলল, তোমরা অযথা আমাদের কষ্ট দিচ্ছ, আমাদের পরিচয়ের কিছু কি বাকি আছে? সবই তো বলেছি ওখানে।
–পরিচয়-টরিচয় বুঝি না। সকল হাইওয়ে, রেল এবং বিমানে মুসলমানদের চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
–কে নিষিদ্ধ করেছে?
–তোমার বাপ! হোয়াইট ওলফ-এর নাম শোননি?
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। সেই ভারি গলার লোকটি ধমক দিয়ে বলল, কোন কথা নয়, এবার চলতে হবে।
চারজন স্টেনগানধারী তখনও তাদের চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য তিনজনের কাঁধেও স্টেনগান ঝুলানো।
লোকটির কথা থামতেই একজন এসে আহমদ মুসাদের তিনজনকে পিছমোড়া করে বাঁধল।
আহমদ মুসা বলল, তোমায় আমাদের বলতে হবে, কি দোষ আমাদের?
–সেটা পরে ঠিক হবে। হুকুম হয়েছে, সড়ক-হাইওয়ে এবং রেল-বিমানে মুসলমানদের যাকেই যেখানে পাওয়া যাক, আগামী কয়েকদিন তাদের আটকে রাখতে হবে। তারপর কি করা হবে সে হুকুম আসবে।
আহমদ মুসা আশ্বস্ত হলো, আহমদ মুসাদের পরিচয় ওরা জানে না। পাইকারি ধর-পাকড়ের হুকুম অনুসারেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। হোয়াইট ওলফ-এর এ পদক্ষেপ কেন, আহমদ মুসা তা পরিষ্কারই বুঝতে পারছে। আহমদ মুসার ফটো তাদের পাওয়া এবং তা সব জায়গায় পাঠানো পর্যন্ত তারা এই ধর-পাকড় অক্ষু্ণ্ণ রাখতে চায়। আহমদ মুসা যাতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কিংবা হাতের বাইরে যেতে না পারে, সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। আহমদ মুসার ফটো পাওয়ার পর সব বন্দীর পরিচয় পরখ করার পরই হয়তো তারা বন্দীদের ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবে।
আরাকস হাইওয়ে থেকে নামিয়ে পাহাড়ের এক গলিপথ দিয়ে তাদের নিয়ে চলল। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাওয়া গলিপথটি মনে হল নদীর দিকেই গেছে।
চলতে চলতে আহমদ মুসা বলল, নিরপরাধ মানুষকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ, এটা কি ঠিক?
–এটা কষ্ট হলো? চোখ বাঁধার হুকুম আছে সেটা তো করিইনি!
–তোমরা মুসলমানদের উপর এভাবে জুলুম করছ কেন?
–জুলুম কই, এতো লড়াই। এই লড়াই অতীতে হয়েছে, এখন হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।
–গুপ্ত হত্যা, চোরা-গোপ্তা পাকড়াও করা ইত্যাদি তো যুদ্ধ নয়।
–লড়াইয়ের কৌশল বহু রকমের আছে।
কথা বলছিল ভারি গলার সেই লোকটি। লোকটির হ্যাট কপাল পর্যন্ত নামানো। চওড়া মুখের নাক থেকে নিচের অংশটা দেখা যাচ্ছে। কাঁধে তার স্টেনগান ঝুলানো। দু’হাত তার ওভারকোটের পকেটে। ডান হাত ওভারকোটের পকেটে উঁচু হয়ে আছে। মনে হল, এই লোকটিই টিম-লিডার। লোকটি কথা শেষ করে একটু থেমেই আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে আবার বলল, তুমি তো সাহসী লোক দেখছি! হোয়াইট ওলফের হাতে পড়ে এইভাবে তো কেউ কথা বলেনি! তুমি ভয় কর না?
–মৃত্যুকে ভয় করি না, কাকে আর ভয় করব?
–মৃত্যুকে ভয় কর না?
–ভয় করব কেন, সে তো আসবেই একদিন।
–তাহলে তুমি তো ভয়ানক লোক!
একটু থেমেই লোকটি ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি টেনে বলল, তবে মৃত্যু সম্বন্ধে আমাদের সাথে তোমার খুব মিল আছে। আমরা পাখির মত লোক শিকার করি, বিচিত্রভাবে করি। অনেকে আমাদের নিষ্ঠুর বলে। এতে নিষ্ঠুরতার কি আছে? যে মৃত্যু অবশ্যই আসবে, তাকেই তো আমরা আনি!
–মৃত্যুকে ভয় না করা এবং হত্যা করা এক জিনিস নয়। ন্যায়, অন্যায় নেই?
–প্রয়োজন যা, তা-ই ন্যায়।
–আমরা মুসলমানরা তা মানি না।
–দরকার নেই। এটা শুধু হোয়াইট ওলফের মানার কথা।
তারা নদীর ঘাটে এসে পৌঁছল। ঘাটতো নয়, একটা বড় পাথর, তার সাথে একটা মোটর বোট নোঙর করা।
দু’জন স্টেনগানধারী আগে বোটে উঠে গেল। তারপর আহমদ মুসাদের তোলা হল নৌকায়। তারপর ওরা পাঁচজন উঠে এল।
বোটে উঠতে উঠতে আলী আজিমভ আহমদ মুসার দিকে তাকাল। দেখল, আহমদ মুসার চোখে-মুখে চিন্তার লেশমাত্র নেই।
গোটা বোটটাই বড় একটা হল ঘরের মত উম্মুক্ত। মজবুত ছাদ, কাঠের মজবুত সাইড-ওয়াল। বোটের একেবারে পেছনে একটা কেবিন। সম্ভবত বোটের ওটা স্টোররুম।
ঐ স্টোররুমে আহমদ মুসাদের ঢুকিয়ে একমাত্র দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হল।
রুমটি খুব ছোট নয়। তবে অন্ধকার। আলোর ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তা তাদের জানার উপায় আপাতত নেই। জানালাও নিশ্চয় থাকতে পারে।
রুম তালাবদ্ধ করে ওরা সরে যেতেই আলী আজিমভ বলল, কি ব্যাপার, ওরা আমাদের সার্চ করল না?
–হতে পারে ওরা আমাদের সাধারণ কেউ মনে করেছে। আমরা ওদের বাঁধা দেইনি, এ কারণেও তাদের ঐ ধারণা আরো প্রবল হতে পারে। কিংবা তাদের মনে নাও থাকতে পারে। যাক, আল্লাহ এইভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
–মুসা ভাই, আপনি একদম চুপ থাকলেন, আমরা কি ওদের মোকাবিলা করতে পারতাম না?
–হয়তো পারতাম, কিন্তু হোয়াইট ওলফকে আমি এ পর্যন্ত যতটা জেনেছি, তাতে এ ঝুঁকি নেয়া ঠিক মনে করিনি। ক্ষিপ্রতা ও মৃত্যুভয়হীনতা—এ দুই দুর্লভ গুণ তাদের আছে। এ ধরনের শত্রু বড় বিপজ্জনক।
–এখন আমরা কি করব?
–চিন্তা করো না, এবার আমাদের কাজ শুরু হবে। ওরা আমাদের সার্চ করেনি, এটা আল্লাহ্র এক সাহায্য। আরেকটা সাহায্য হলো ওরা আমাদের আলাদা একঘরে রেখেছে।
তিনজনকেই পিছমোড়া করে বাঁধা। সরু প্লাস্টিক কর্ডের বাঁধন যেন কেটে বসে গেছে কব্জিতে।
আহমদ মুসা পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দিয়েই আলী আজিমভ ও ওসমান এফেন্দীর বাঁধন পরীক্ষা করল।
বাঁধন খুব শক্ত। বাঁধা হাত দিয়ে সরু প্লাস্টিক কর্ডের শক্ত গিট খোলা অসম্ভব। হঠাৎ জুতার গোড়ালির গোপন কুঠিতে রাখা ইস্পাতের ছুরির কথা আহমদ মুসার মনে পড়ল। উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ।
কিন্তু পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দিয়ে জুতার গোড়ালি থেকে ছুরি বের করা সহজ হলো না। ডান জুতার গোড়ালির ডান কেবিনে আছে ছুরিটা। গোড়ালির ঐ প্রান্তটির ঠিক জায়গায় ঠিকমত চাপ পড়লে তবেই গোড়ালির একাংশ সরে যাবে এবং ছুরিটি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু হাত দু’টি পিছমোড়া করে এমনই বিদঘুটে করে বাঁধা যে, বামহাতের আঙ্গুল কিছুতেই ঐ জায়গায় ভাল করে চাপ দিতে পারছে না। অবশেষে সফল হল আহমদ মুসা। ছুরিটা হাত করল।
মোটর বোটটি অনেকক্ষণ হল চলতে শুরু করেছে। আরপা নদী দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বোটটি। গতি বেশ তীব্র।
আহমদ মুসা খুব সাবধানে তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে আলী আজিমভের বাঁধন কাটতে লাগল। বাঁধনের গিট খুঁজে নিয়ে গিটের গোড়ায় ছুরি চালাল আহমদ মুসা।
ব্লেডের মত তীক্ষ্ণধার ইস্পাতের ছুরি। পানির মত কেটে গেল প্লাস্টিকের কর্ড।
মুক্ত হলো আলী আজিমভ। মুক্ত হলো সবাই।
আহমদ মুসা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকিয়ে দেখল, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। অর্থাৎ বোটটা পৌনে এক ঘন্টার পথ এগিয়ে এসেছে।
তারা পরীক্ষা করে দেখল কেবিনে কোন জানালা নেই। দরজার ফাঁক দিয়ে লম্বা এক চিলতে আলো দেখা যাচ্ছে।
বোটের ভেতরে ওদের কথা শোনা যাচ্ছে।
সবাই মিলে এই কিছুক্ষণ আগে খাওয়া-দাওয়া করল। এখন গল্প করছে। খোশগল্প।
এমন সময় বাইরে থেকে কেউ, বোধহয় বোটের চালক, চিৎকার করে উঠল, উস্তাদ, সামনে একটা বোট, আলো নেই।
বুঝা গেল, এই কথা শোনার পর সবাই একসাথেই বাইরে বেরিয়ে গেল।
সেই সাথে বোটের গতি অনেকটা স্থির হয়ে গেল।
–তোমরা কে? কোথায় যাবে? প্রশ্ন করল ভারি গলার সেই লোকটি।
একটু দূর থেকে একটা ভারি কণ্ঠ ভেসে উঠল, আমরা কাজরন থেকে আসছি। তাগাবান যাব আমরা।
–তোমাদের বোট আমাদের বোটে ভিড়াও।
কিছুক্ষণ নীরবতা। অল্পক্ষণ পরে মোটর বোটটা সামান্য দুলে উঠল, একটু শব্দ হল। মনে হল, সেই আলো নিভানো বোটটা বোধহয় এসে মোটর বোটের গায়ে ভিড়ল।
মোটর বোটের সামনে গিয়ে ভিড়ছে বোটটি। মনে হল, মোটর বোট থেকে কেউ কেউ নেমে গেল বোটটিতে। আস্তে আস্তে কি কথা বলল।
হঠাৎ ব্রাশফায়ারের শব্দ এবং সেই সাথে আর্তচিৎকার ভেসে উঠল। নারী ও শিশু কণ্ঠের ‘আল্লাহ আল্লাহ’ চিৎকার রাতের নীরবতাকে বিদীর্ণ করল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। গোটা স্নায়ুতন্ত্রীতে অসহ্য এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার।
প্রচন্ড এক লাথিতে কেবিনের দরজা ভেঙে ফেলল সে। ভাঙা ছোট তালাটা ছিটকে গিয়ে পড়েছে উন্মুক্ত কেবিনের এক কোণায়। দরজার দুটো ছোট্ট পাল্লা দু’পাশে সরে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে কেবিনের কাঠের দেয়ালের সাথে। কিন্তু দরজা ভাঙ্গাতে বড় ধরনের কোন শব্দ হয়নি। গুলির শব্দ ও চিৎকারের মধ্যে এ শব্দ সম্ভবত কারো কানে পৌঁছেনি।
আহমদ মুসা কেবিন থেকে বেরিয়ে মুহূর্ত কয়েক দেরি করল। না, কেউ এদিকে এল না। তারপর ডান হাতে রিভলভার ধরে বিড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত এগুলো বোটের সামনের দিকে। তার পেছনে আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দী।
বড় উন্মুক্ত কেবিনটির মুখে আরেকটি ছোট দরজা। তারপরেই উন্মুক্ত ডেক।
আহমদ মুসা সেই দরজা দিয়ে উঁকি দিল। দেখল, নৌকা থেকে দু’জন দু’টি মেয়েকে বোটে তুলে দিচ্ছে আর দু’জন বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে তাদের তুলে নিচ্ছে। মহিলা দু’টি অবিরাম ‘আল্লাহ বাঁচাও’ ‘আল্লাহ বাঁচাও’ চিৎকার করছে। বোটের লোক দু’টি তাদেরকে পাঁজাকোলা করে বোটে তুলে নিয়ে ডেকে আছড়ে ফেলার পর তাদের মুখে লাথি মেরে অশ্লীল ভাষায় গালি দিল। লুণ্ঠিত দ্রব্য-সামগ্রীও কিছু জমা হয়েছে বোটের ডেকে। গুলি তখন থেমে গেছে, নৌকা থেকে তখন শুধু চিৎকার ও কান্না শোনা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা এম-১০ মেশিন পিস্তলের ট্রিগারে তর্জনী চেপে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এসে ডেকে দাঁড়াল। ডেকে দাঁড়ানো দু’জন তার দিকে চোখ তুলেই স্টেনগানে হাত দিয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আহমদ মুসার এম-১০ এর গুলির ঝাঁক গিয়ে গ্রাস করল তাদের।
নৌকা থেকে যারা মেয়ে দু’টিকে তুলে দিয়েছিল, তারা আর দু’জনকে টেনে তোলার জন্যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসার এম-১০ এর নল তাদের দিকেও ঘুরে গেল। ঝরে পড়ল তারা নৌকার উপরেই।
নৌকার উপর হোয়াইট ওলফের আরও তিনজন ছিল। তাদের একজন লুণ্ঠনের কাজে ব্যস্ত ছিল। আর একজন এক বৃদ্ধকে পেটাচ্ছিল। অন্যজন স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল। গুলির শব্দ শুনেই সে তড়িৎ গতিতে ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সে স্টেনগানের লক্ষ্য স্থির করার আগেই আলী আজিমভের বুলেট গিয়ে তার মাথা গুঁড়ো করে দিল। আলী আজিমভের দ্বিতীয় গুলি লুণ্ঠনরত লোকটির বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল।
শেষ লোকটি, যে এক বৃদ্ধকে পেটাচ্ছিল, চট করে বৃদ্ধটির আড়ালে গিয়ে বসল। বৃদ্ধকে ঢাল হিসেবে সামনে ধরল। এখন বৃদ্ধকে না মেরে তাকে মারা যায় না। মুশকিলে পড়ে গেল আহমদ মুসারা।
লোকটি পিস্তল হাতে তুলে নিয়েছে। বেপরোয়া লোকটি এখন বৃদ্ধের আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায়।
আহমদ মুসারা নতুন কিছু ভাবার আগে ওর পিস্তলের গুলি থেকে বাঁচার জন্যে ডেকের উপর শুয়ে পড়ল। কিন্তু এই সময় অভাবিত এক কান্ড ঘটে গেল।
বৃদ্ধটি জাপটে ধরেছে লোকটিকে। হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে রিভলভার। তারপর বুকে জাপটে ধরেই তার মাথায় রিভলভারের নল বসিয়ে গুলি করেছে পরপর তিনবার। গুঁড়ো হয়ে গেল তার মাথা। সব ঘটনা মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল।
আহমদ মুসারা উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর এ দৃশ্য দেখল।
মোটর বোটে তোলা মেয়ে দু’টি তখন বসেছে। তারা কাঁপছিল তখনও। বোটের নারী, শিশুদেরও একই অবস্থা। বোটে অনেকগুলি লাশ পড়ে আছে। তার মধ্যে যুবকদের সংখ্যাই বেশি। কিছু লাশ হয়তো পানিতেও পড়ে গেছে। কিন্তু চারদিকে অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মোটর বোটের লাইট ও হেডলাইটের আলো অতি অল্প জায়গায়ই আলোকিত করেছে।
আহমদ মুসা একটু উচ্চস্বরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাই-বোনেরা, আল্লাহ সাহায্য করেছেন, আর কোন ভয় নেই।
বলে আহমদ মুসা নৌকায় নেমে সেই বৃদ্ধের কাছে গেল।
সম্ভবত অবসাদ-উত্তেজনায় নেতিয়ে পড়েছে সে নৌকার ডেকে। তার কপালে ক্ষতচিহ্ন-ফেটে গেছে। গড়িয়ে পড়া রক্তে সফেদ দাড়ি ভিজে গেছে। বৃদ্ধ হলেও লোকটা শক্ত-সমর্থ। মুখে পবিত্রতা ও আভিজাত্যের ছাপ। কপালে সিজদার চিহ্ন ম্লান আলোতেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা কাছে যেতেই বৃদ্ধ ধড়-মড় করে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তাকে সালাম দিল।
সালাম গ্রহণ করে কিছুক্ষণ সম্বিতহারার মত আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থাকল বৃদ্ধ। তার দু’টি হাত উপরে তুলে উর্ধ্বমুখী হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, হে আল্লাহ, তোমার পবিত্র কালামে পড়েছি, ফেরেশতা দিয়েও তুমি সাহায্য কর। কিন্তু কোনদিন তা দেখিনি। আজ দেখলাম। মজলুমের আবেদন তুমি শুনেছ। এ বান্দার শুকরিয়া তুমি গ্রহণ কর। তোমারই সমস্ত প্রশংসা।
বৃদ্ধের শেষ কথা কান্নায় প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
বৃদ্ধ চুপ করতেই আহমদ মুসা বলল, জনাব অনেকেই আহত। এদের শুশ্রুষা প্রয়োজন। আপনি সবাইকে মোটর বোটে উঠতে বলুন। শহীদদেরও দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কে বাবা তোমরা? আল্লাহর সাহায্য হয়ে কোত্থেকে তোমরা এলে?
সব বলব জনাব, আগে এ জরুরি কাজগুলো হয়ে যাক।
বৃদ্ধ সবাইকে মোটর বোটে উঠতে নির্দেশ দিল। নারী-শিশু মিলে ১৫ জন ছিল নৌকায়, দু’জন ছিল মোটর বোটের ডেকে। মোট ১৭ জন গিয়ে আশ্রয় নিল মোটর বোটের বড় কেবিনে। নৌকায় তখনও ৫ জন যুবক, ৩ জন নারী এবং ৩টি শিশুর লাশ।
আহমদ মুসা বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে বলল, আপনাদের আর লোক কোথায়?
গুলি শুরু করলে অনেকেই পানিতে লাফিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যুবকরা। নিশ্চয় আশে-পাশেই আছে।
কথা শেষ করেই বৃদ্ধ একটা তীক্ষ্ণ শীষ দিল। এ তীক্ষ্ণ শীষ চারদিকের নীরবতাকে যেন তীরের মত বিদ্ধ করল।
মুহূর্তকাল পরেই নদীর দু’তীর থেকে অনেকগুলো লোকের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। আহমদ মুসা, আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দী সাঁতরে যুবকদের টেনে তুলল মোটর বোটে। যুবকদের মাথা নিচু, মুখ ম্লান এবং চোখে একরাশ বিস্ময়।
আহমদ মুসা বলল, আল্লাহর হাজার শোকর যে, হোয়াইট ওলফের নিষ্ঠুর হাত থেকে তোমরা আত্মরক্ষা করতে পেরেছো।
আহমদ মুসা যুবকদের নিয়ে শহীদদের দাফন করার জন্যে তীরে উঠে গিয়েছিল। নদীর তীর থেকে একটু দূরে দু’টি পাহাড়ের গর্তে তাদের দাফনের ব্যবস্থা হয়েছিল।
আলী আজিমভ ও ওসমান এফেন্দী মোটর বোটের ডেকে স্টেনগান্ হাতে পাহারায় দাঁড়িয়েছিল। সেই বৃদ্ধ তাদের সামনেই বসেছিল। তার কপালে ব্যান্ডেজ।
বৃদ্ধের নাম মনসুর মোহাম্মদভ। সে বিখ্যাত কাজরন কবিলার নেতা। মধ্য আর্মেনিয়ায় আরপা নদীর দক্ষিণ পাশের বিশাল কাজরন উপত্যকায় এদের বাস। উৎকৃষ্ট ভেড়ার জন্যে গোটা ককেশাসে এই উপত্যকা বিখ্যাত। অর্থ-সম্পদেও এদের নাম ছিল। কিন্তু হোয়াইট ওলফের অব্যাহত হত্যা, সন্ত্রাস ও লুণ্ঠনের শিকার হয়ে এরা সব হারিয়েছে। অবশেষে অবশিষ্ট অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এরা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
আহত ছেলেদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজটা করেছিল আলী আজিমভ। নারী-শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছিল সাবেরা সুরাইয়া। কারাবাখ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী সে। এ বছরেরও প্রথম দিকে সে ক্লাস করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে দাংগা বা গুপ্ত হত্যার শিকার হবার ভয়ে। সুরাইয়া মনসুর মোহাম্মদভের মেয়ে।
সুরাইয়া শুধু প্রাথমিক চিকিৎসাই নয়, ছড়ানো জিনিসপত্রও একটু গোছ-গাছ করে নিয়েছে।
সব কাজকর্ম শেষে হাত পরিষ্কার করার জন্যে বাইরে এল সুরাইয়া।
পিতার মতই লম্বা, ফর্সা। মাথার রুমালটা কপাল পর্যন্ত নামানো। ম্লান মুখ, ঘামে ভেজা।
বালতি দিয়ে পানি তুলে মুখ-হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আব্বা, আপনি একটু বিশ্রাম নিলে হতো না?
না মা, প্রয়োজন নেই। ওদের অপেক্ষা করছি।
কি ভাবছেন আব্বা?
আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। ও ছেলে ঘুরে আসুক। এ ছেলেদের পরামর্শ কি সেটা জানতে হবে।
এরা কারা আব্বা? হোয়াইট ওলফকে কেউ এভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তা তো ভাবিনি।
আমিও জানতে পারিনি মা।
আলী আজিমভ স্টেনগান হাতে সামনে নদীর অন্ধকার বুকের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের শেষ কথাটার পর ঘুরে দাঁড়াল। বলল, চাচাজান, আমরা আরাকস হাইওয়ে দিয়ে ইয়েরেভেন যাচ্ছিলাম। এসেছি বাকু থেকে। আরপা ব্রীজ পার হবার পরেই হোয়াইট ওলফের এ লোকেরা আমাদের ঘিরে ফেলে। আত্মরক্ষার কোন সুযোগ হয়নি। তারপর এরা এই মোটর বোটের পেছনের কুঠরীতে বন্দী করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর আপনাদের চিৎকার শুনে দরজা ভেঙ্গে আমরা বেরিয়ে আসি।
কিন্তু আপনারা কে? জিজ্ঞেস করল সুরাইয়া।
আলী আজিমভ মুহূর্তকাল চুপ থাকল। তারপর বলল, বোন, তুমি ককেশাস ক্রিসেন্টকে চেন?
চিনি।
আমরা ককেশাস ক্রিসেন্টের লোক।
ককেশাস ক্রিসেন্টের লোক আপনারা?
বিস্ময় ঝরে পড়ল সুরাইয়ার কণ্ঠ থেকে। মুখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল। মুখের উপরের ম্লান কাল ছায়া দূর হয়ে গেল যেন হঠাৎ।
ততক্ষণে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে। সে আলী আজিমভের কাছে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে বলল, কি বলছ বাবা তুমি? সত্য বলছ? ওদের তো কত খুঁজেছি, পাইনি। শেষ পর্যন্ত এসেছ!
বলতে বলতে বৃদ্ধের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
আহমদ মুসার নাম শুনেছেন চাচাজান?
তাকে চিনব না, কি বল তুমি? বলল বৃদ্ধ মনসুর মোহাম্মদভ।
ওর সব কাহিনীই আমি জানি। বলল সুরাইয়া সাবেরা।
আলী আজিমভের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, তাকে দেখতে চাও বোন?
তিনি অনেক-অনেক বড়। অনেক ব্যস্ত। বিশ্বজোড়া কাজ তার। অসম্ভব আশা করি না।
না বোন, যেখানেই মুসলমানরা মজলুম, অসহায়, সেখানেই তিনি হাজির হন।
আমাদের যে সাথীটি শহীদদের দাফনে গেছে, তিনিই আমাদের মহান নেতা, মহান ভাই আহমদ মুসা।
‘আল্লাহু আকবর’ বলে এক চিৎকার করে বৃদ্ধ মনসুর মোহাম্মদভ বোটের ডেকে বসে পড়ল।
আর বিস্ময়ে বিমূঢ় সুরাইয়া যেন বাকরুদ্ধ। হঠাৎ চারদিকের পরিবেশটা যেন তার অবিশ্বাস্যরকম নতুন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, নতুন কোন জগতে সে, যেখানে কল্পনার আহমদ মুসা সশরীরে এসে হাজির।
এই সময় শহীদদের দাফন শেষ করে আহমদ মুসা ও অন্যান্য যুবকরা চলে এল।
সুরাইয়া নড়তে পারল না। তার পা দু’টি যেন আটকে গেছে ডেকের সাথে। তার চোখ দুটি থেকে বিস্ময়–আনন্দ ঠিকরে পড়ছে।
আহমদ মুসাকে দেখেই বৃদ্ধ মোহাম্মদভ উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা প্রথমে উঠে এল বোটে। উঠতে উঠতে বলল, এদিকে সব ঠিক তো আজিমভ?
‘জ্বি জনাব’। বলল আজিমভ।
আহমদ মুসা বোটে উঠতেই বৃদ্ধ মোহাম্মদভ আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি এতক্ষণ তোমার পরিচয় দাওনি বাবা। তোমাকে তোমার সম্মান আমরা দিতে পারিনি।
কথা শেষ করেই বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠল, হে আমার কাজরন কবিলার ছেলে-মেয়েরা, আজ আমাদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের দিন। দুনিয়ার মুসলমানদের সিপাহসালার আহমদ মুসা আজ তোমাদের মধ্যে।
আহমদ মুসা প্রায় হাতজোড় করে বলল, চাচাজান, এইভাবে আমাকে বলবেন না, আমি খুব বেদনা অনুভব করি। যে যোগ্যতা আমার নেই, তা আমার উপর চাপাবেন না। আমি জাতির একজন সামান্য সেবক। আমি জানি, আমি তাদের জন্যে কিছু করতে পারছি না। আজ এশিয়া আফ্রিকার হাজার প্রান্ত থেকে মজলুম মুসলমানদের আহাজারি উঠছে, লক্ষ নারী-শিশুর বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ পৃথিবীর বাতাসকে ভারি করে তুলছে, মুসলমানদের শত-সহস্র বিরান জনপদ আমাদের যোগ্যতাকে উপহাস করছে। আমরা তাদের জন্যে কিছুই করতে পারিনি, কিছুই করতে পারছি না চাচাজান! বলত বলতে আহমদ মুসার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ কেউই কথা বলতে পারল না।
বৃদ্ধ মোহাম্মদভ ধীরে ধীরে বলল, তোমার কথা ঠিক বাবা। তবু তুমি অনেক অনেক করেছ। আর আমরা? আমরা সারা জীবনটা খেয়ে এবং খাওয়ার জন্যে কাজ করেই কাটিয়ে দিলাম।
বৃদ্ধের শেষ কথাগুলো আবেগে ভেঙ্গে পড়ল। আবার নীরবতা।
নীরবতা ভাঙ্গল আহমদ মুসাই। বলল, চাচাজান এখনি আমাদের একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, চাচাজান, ভাইদের কাছ থেকে আমি আপনাদের সব কথা শুনেছি। এখন আপনি বলুন, আপনার হিজরতের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কি না?
এ সিদ্ধান্তের দায়িত্ব এখন তোমার বাবা। বলল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, বর্তমান অবস্থায় আপনাদের হিজরতের সিদ্ধান্তই সঠিক। সাময়িকভাবে আপনাদের ইরান, না হয় তুরস্কে যেতে হবে।
-আমি যদি ভুল বুঝে না থাকি, তাহলে বলব, হোয়াইট ওলফের সাথে এবার আপনার লড়াই বাঁধবে। এ লড়াইয়ে শরীক হওয়ার জন্যে কি আমরা দেশে থেকে যেতে পারি না? বলল সুরাইয়া সাবেরা।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে তার দিকে মুখ তুলে বলল, ঠিক বলেছ বোন, থাকা দরকার। কিন্তু ককেশাস ক্রিসেন্ট আজ এমন অবস্থায় যে, সাহায্য নেয়ার মত অবস্থাও সে সৃষ্টি করতে পারেনি। যতদিন তা না পারছে, তোমদের একটু সরে থাকতেই হবে, বিশেষ করে একবার যখন সরেই এসেছ।
আবার নীরবতা।
নীরবতা ভেঙ্গে আহমদ মুসাই বৃদ্ধ মোহাম্মদভকে উদ্দেশ্য করে বলল, চাচাজান, এই বোট নিয়ে কি আরপা হয়ে আরাকস লেক পাড়ি দিতে পারবেন?
–পারব। কিন্তু আরপা নদীর মুখে পুলিশ পাহারা আছে, আবার হোয়াইট ওলফও পাহারা দেয়।
–আজারবাইজানি পুলিশ কিছু বলবে না। আর হোয়াইট ওলফের পাহারাকে দেখা যাবে।
–তোমরা যাবে আমাদের সাথে?
–জ্বি, আমরা আরাকস লেক পর্যন্ত আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসব। বোট কি আপনারা চালিয়ে নিতে পারবেন?
–পারবো বাবা, আমাদের নিজেদেরই ৫টা মোটর বোট ছিল। ব্যবসায়ের বড় অংশ নদীপথেই আমরা করতাম। আমার মা সুরাইয়াতো ইঞ্জিনও মেরামত করতে পারে। সায়েন্স পড়েছে কিনা।
আহমদ মুসা সুরাইয়ার দিকে ইংগিত করে বলল, এ বুঝি আপনার মেয়ে?
–হ্যাঁ, মেডিকেল কলেজে পড়ত।
— কোন ইয়ারে পড়তে? সুরাইয়াকে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
–চতুর্থ বর্ষে। বলল সুরাইয়া।
–অল্পের জন্যে ডিগ্রি নেয়া হলো না। দুঃখ পেয়ো না বোন, আল্লাহ সুযোগ আবার করে দিতে পারেন।
–না জনাব, এখন আমার কোন দুঃখ নেই। আপনার দেখা পেয়ে মনে হচ্ছে, ডিগ্রি কেন, জাতির জন্যে সব ত্যাগই আমি করতে পারব।
–ধন্যবাদ বোন, এইতো চাই।
বলেই আহমদ মুসা আজিমভের দিকে ফিরে বলল, আজিমভ, বোট স্টার্ট দাও। আহমদ মুসার মোটর বোট যখন আরপা ব্রীজ পার হলো, তখন রাত ২টা। চারদিক নিঃশব্দ নিঝুম। ব্রীজের পশ্চিম পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশরা আটকায়নি। বোট কোত্থেকে এসেছে, কারা আছে, কোথায় যাবে, এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়ার পরই তারা ছেড়ে দিয়েছে। আজারবাইজানি ছিটমহলের পুলিশরা মজলুম উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগে সাহায্যই করে থাকে। তারা যেহেতু নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তাই নিরাপত্তার সন্ধানে এই চলে যাওয়াকে তারা বাঁধা দেয় না।
হোয়াইট ওলফের তরফ থেকেও কোন বাঁধা এল না। হতে পারে হোয়াইট ওলফের যে ইউনিটটি আহমদ মুসাদের হাতে ধ্বংস হলো, সে ইউনিটটিই এখানকার দায়িত্বে ছিল। সুতরাং বাঁধা দেয়ার আর কেউ ছিল না।
ইরানের সীমান্ত ফাঁড়ি থেকেও কোন বাঁধা এলো না। তাদের একটি মোটর বোট এসে এ মোটর বোটটি চেক করে শুধু ছেড়েই দিল না, অনেক খাবার এবং আহতদের জন্যে ঔষধপত্রও দিল।
ইরানের সীমান্ত এলাকার সৈনিক ও পুলিশরা সরকারি পলিসির বাইরেও অনেক সাহায্য-সহযোগিতা ককেশাস অঞ্চলের মুসলমানদের করে থাকে। কারণ, ইরানের তাব্রিজ এলাকার সুন্নী মুসলমানদের সাথে ককেশাসের এ অঞ্চলের সুন্নী মুসলমানদের ধর্মীয় বন্ধন ছাড়াও বংশগত যোগসূত্র আছে।
আহমদ মুসারা আরপা নদীর মুখ থেকে শ’ খানেক গজ উত্তরে এগিয়ে আরাকস নদীর তীরে নেমে পড়ল।
আহমদ মুসাকে বিদায় দিতে গিয়ে বৃদ্ধ মনসুর মোহাম্মদভ কেঁদে ফেলল। বলল, তোমাকে সামনে দেখে যতখানি খুশি হয়েছিলাম, তারচেয়ে অনেক বেশি বুক ছিড়ে যাচ্ছে তোমাকে বিদায় দিতে।
বিদায়ের সময় সুরাইয়াও বোটের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, আমি ডিগ্রি পাইনি, কিন্তু আমি একজন ডাক্তার। এই দুঃসময়ে জাতির কি কোনই কাজে লাগতে পারি না আমি?
-পার বোন। বলেছি তো, তোমরা যাচ্ছো সাময়িক প্রয়োজনে। তোমরা শীঘ্রই ফিরে আসবে, সে ব্যবস্থা আমরা করব।
একটু দ্বিধা করে সুরাইয়া বলল, আমার কৌতুহল, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব, অনুমতি দেবেন?
-হ্যাঁ, করতে পার।
-আপনার কে আছে, বাবা, মা, ——–
কথা শেষ না করেই সুরাইয়া থেমে গেল।
আহমদ মুসা সংগে সংগে কোন উত্তর দিতে পারলো না। প্রশ্নটা হঠাৎ যেন তাকে আনমনা করে দিলো। বেদনার একটা কালো ছায়া নেমে এল তার চোখে-মুখে।
পল পল করে সময় বয়ে চলল।
আহমদ মুসার এই পরিবর্তন দেখে সুরাইয়ার মুখের হাসি নিভে গেল। সে সংকুচিত হয়ে পড়ল। কিন্তু কিছু বলতেও পারল না।
ধীরে ধীরে আহমদ মুসা মুখ তুলল, বোন, তোমরা যেমন আজ অনেক আপনজনকে মাটি চাপা দিয়ে দেশত্যাগ করছ, তেমনিভাবে আমিও একদিন জন্মভূমি সিংকিয়াং ত্যাগ করেছিলাম। পেছনে পড়েছিল কম্যুনিস্ট বাহিনীর বুলেটে ঝাঁঝরা মা, বোমায় পুড়ে যাওয়া আব্বা, ভাই এবং অনেকের লাশ।
আহমদ মুসার নরম কণ্ঠ স্বগতঃই যেন উচ্চারণ করল কথাগুলো। জমাট বেদনার মতন শোনা গেল তা।
সুরাইয়া বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, মাফ করবেন ভাইজান, আমি এ প্রশ্ন করে ঠিক করিনি।
সুরাইয়ার এ কথাগুলো আহমদ মুসার কানে গেল কি না কে জানে। সে তার আগের কথার রেশ ধরেই বলল, আর এই সেদিন তোমার ভাবী হয়েছে, তাকেও রেখে এসেছি সিংকিয়াং-এ।
পাশের সীমান্ত ফাঁড়ির কেউ যেন হুইসেল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা চমকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, যাও সুরাইয়া, বোটে স্টার্ট দাও।
তারপর বৃদ্ধ মোহাম্মদভের দিকে ঘুরে বলল, আসি চাচাজান।