১
আরাকস হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছিল আহমদ মুসার জীপ।
বাকু থেকে পনের মাইল পশ্চিমে এসে নগরন-কারাবাখ সড়ক উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। এখান থেকে আরেকটা হাইওয়ে বেরিয়ে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে একেবারে আরাকস নদীর তীর ঘেঁষে। এটাই আরাকস হাইওয়ে। আরাকস নদীর তীর ঘেঁষে এই হাইওয়ে এগিয়ে গেছে ইয়েরেভেনের পাশ দিয়ে আরও উত্তরে। ইয়েরেভেন পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ’ মাইলের এই সফর।
আরাকস ও কুরা বিধৌত সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল আহমদ মুসার জীপ।
নগরন-কারাবাখ সড়ক হয়ে ইয়েরেভেন অনেক সংক্ষিপ্ত পথ। প্রায় ১শ’ মাইলের মত কম। কিন্তু তবু আহমদ মুসারা আরাকস হাইওয়েই বেছে নিয়েছে। নগরন-কারাবাখ সড়কের উপর হোয়াইট ওলফ নাকি হঠাৎ করে খুব নজর রাখতে শুরু করেছে। ইয়েরেভেন থেকে আসার পথে ওসমান এফেন্দীর গাড়ি তিনবার চেক করা হয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কি পরিচয়, কোথায় যাবে, কেন যাবে ইত্যাদি। যারা চেক করেছে তারা স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরা। কিন্তু ওসমান এফেন্দীর বুঝতে কষ্ট হয়নি, কোন রুটিন চেক এসব নয়। স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে স্টেনগান থাকে না, তাদের আচরণও অমন রুক্ষ্ম ও অসৌজন্যমূলক হয় না। ওসমান এফেন্দী যুক্তি দেখিয়েছে, আরাকস হাইওয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে। পাহাড়ের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সুদৃশ্য উপত্যকা বেয়ে প্রবাহিত সুন্দর নদী আরাকস-এর তীর বরাবর আরাকস হাইওয়েতে সাধারণত বিদেশি পর্যটকদেরই ভিড় থাকে বেশি। এসব চিন্তা করেই ওসমান এফেন্দী আরাকস হাইওয়েই পছন্দ করেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি প্রায় তীর বেগে দেড়শ’ মাইল রাস্তা পেরিয়ে এল। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, কোনই ঝামেলা হয়নি। আজারবাইজান সীমান্ত পেরুবার সময় একবার রুটিন চেক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত পেরুবার পর আর্মেনিয়া প্রবেশের সময় একটু বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আর্মেনীয় পুলিশরা। এ ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ নাকি আগে ছিল না। কিন্তু হোয়াইট ওলফের তৎপরতা শুরু হবার পর এটা হচ্ছে। নানা ঘটনা ও গুজবে আতংকিত হয়ে অনেক আর্মেনীয় মুসলিম পরিবার না কি ইরান ও তুরস্কে প্রবেশ করেছে। এতে আর্মেনিয়ার বদনাম হচ্ছে। এজন্যে আর্মেনীয় পুলিশরা ইরান ও তুরস্ক সীমান্ত বরাবর এখন একটু বেশি নজর রাখছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সাথে থাকলে না কি এ সীমান্ত পথে কাউকে চলতেই দিচ্ছে না। আহমদ মুসারা সে ক্যাটেগরিতে না পড়ায় একটু জিজ্ঞাসাবাদ বেশি করলেও বেশিক্ষণ তাদের আটকায়নি।
আরও ৫০ মাইল পেরুবার পর আগারাক শহর। আরাকস নদী-তীরের শিল্প নগরী। বলা যায় দক্ষিণ আর্মেনিয়ার প্রধান নগরী।
নগরীর পূর্ব প্রান্তে পাহাড়ের দেয়াল। দেয়ালটি নেমে গেছে একেবারে নদীর পানিতে। পাহাড়ে সুড়ঙ্গ করে আরাকস হাইওয়ে এগিয়ে নেয়া হয়েছে।
পাহাড়ের উপরিভাগ বরফে সাদা। নিচের অংশে সবুজের সমারোহ। একদম পাহাড়ের গোড়ায় গাছগুলো বেশ বড়।
সুড়ঙ্গের মুখ দু’শ গজের মত দূরে তখন। মাত্র ৭০ কিলোমিটার বেগে বলা যায় অত্যন্ত ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার জীপ। সুড়ঙ্গের ভেতরটা অন্ধকার। দূর থেকে সুড়ঙ্গের ভেতরের বিদ্যুৎ বাতিগুলোকে মনে হচ্ছে বাঘের চোখের মত।
আহমদ মুসা তার সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল। চোখটা তখন ধরে এসেছিল তার।
হঠাৎ আলী আজিমভের ডাকে তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল আহমদ মুসার।
চোখ মেলে তাকাতেই তার চোখ গিয়ে পড়ল সোজা সুড়ঙ্গের মুখে। দেখল, স্টেনগান হাতে দু’জন দাঁড়িয়ে সুড়ঙ্গের মুখে একদম রাস্তার উপর। দীর্ঘকায় দু’জন লোক। কাল ওভারকোট ওদের হাঁটুর অনেকখানি নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। মাথার হ্যাট কপাল পর্যন্ত নামানো।
ওরা তো পুলিশ নয় দেখছি। বলল আহমদ মুসা।
জ্বি, ওরা পুলিশ নয়। বলল ওসমান এফেন্দী।
যেই হোক, ওরা আমাদেরকে বড় রকমের কিছু সন্দেহ করেনি। ওদের স্টেনগানের মাথা নিচের দিকে নামানো।
বলতে বলতে জীপটি সুড়ঙ্গের মুখে এসে পড়ল।
আহমদ মুসা তার মাথার হ্যাটটা কপালের উপর আরেকটু টেনে দিল।
সুড়ঙ্গের মুখেই রাস্তার মাঝখানে ওরা দাঁড়িয়েছিল। দু’জনেই তারা তাকিয়েছিল গাড়ির দিকে।
জীপ একদম ওদের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল। গাড়ি দাঁড়াতেই দু’জনের একজন ধীরে হেঁটে গাড়ির পাশে চলে এল। ওদের স্টেনগানের মাথা তখনও নিচে নামানো।
লোকটি ওসমান এফেন্দীর জানালার পাশে এসে বাম হাতটা জানালার উপর রেখে মাথা নিচু করল। তার ডান হাতে ঝুলছে স্টেনগানটি।
ওসমান এফেন্দী জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল, কি ব্যাপার?
তার কথায় উত্তর আর্মেনিয়ার আঞ্চলিক ভাষার টান।
তোমরা আসছ কেত্থেকে? বলল লোকটি।
বাকু থেকে। বলল ওসমান এফেন্দী।
যাবে কোথায়?
ইয়েরেভেন।
থাক কোথায়?
ইয়েরেভেন।
কি কর?
ফলের ব্যবসা। ইয়েরেভেনে দু’টি ফলের দোকান আছে।
ওরা?
সবাই আমরা এক সাথে থাকি।
তোমার নাম?
ওসমান।
মুসলমান তুমি?
হ্যাঁ।
মনে হল লোকটির ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল, দেখি তোমার কার্ড।
ওসমান এফেন্দী তার বুক পকেট থেকে আর্মেনিয়ার নাগরিক কার্ড বের করে দিল লোকটির হাতে।
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল লোকটিকে। শক্ত-সমর্থ মাঝ বয়েসি লোক। দেথলেই বুঝা যায় পরিশ্রমী পেশীবহুল শরীর। তবে মুখটা বোকা বোকা।
লোকটা ওসমান এফেন্দীর আইডেনটিটি কার্ড হাতে নিয়ে চশমা বের করার জন্যে ওভারকোটের ভেতরের পকেটে হাত দিল।
হ্যাটের নিচ দিয়ে আহমদ মুসার দু’টি চোখ স্থির নিবদ্ধ ছিল লোকটির উপর। চশমা বের করার সময় লোকটির ওভারকোটের একটা অংশ উল্টে গেল। কোটের কাল ব্যান্ডের উপর একটা সাদা ব্যাজ ঝলমল করে উঠল। বাঘের একটা সাদা মুখ হা করে আছে স্পষ্টই বুঝা গেল। একটা উষ্ণস্রোত বয়ে গেল যেন আহমদ মুসার সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে। জীবন্ত এক ‘হোয়াইট ওলফ’ তার সামনে। ধীরে ধীরে হাতটি চলে গেল পিস্তলের বাঁটে। মন বলল, ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়। অনেক জানার আছে ওর কাছ থেকে। কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিল আহমদ মুসা। ওরা আক্রমণ না করলে ওদের ফাঁদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের গায়ে হাত দেয়া ঠিক হবে না। আপাতত লক্ষ্য আমাদের ইয়েরেভেন। ধৈর্য্য ধরতে হবে।
লোকটি ওসমান এফেন্দীর কার্ডের উপর নজর বুলিয়ে বলল, তুমি তো ইয়েরেভেনেরই লোক। ব্যবসায়ী। আবার মুসলমান কেন?
আমার পরিবার মুসলিম।
লোকটি মুখ ভেংচিয়ে কার্ডটি গাড়ির মধ্যে ছুড়ে দিয়ে বলল, যা, তবে মনে রাখিস, হয় মুসলমানি ছাড়বি, না হয় দেশ ছাড়বি।
বলে স্টেনগানের নল দিয়ে গাড়িতে এক গুঁতো দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল।
গাড়ির সামনে দাঁড়ানো লোকটিও সামনে থেকে সরে এ লোকটির দিকে এগিয়ে এল।
এমন সময় সুড়ঙ্গের ডান পাশের গাছের আড়াল থেকে একজন লোক দ্রুত বেরিয়ে এল লোক দু’টির দিকে। কি যেন ইশারা করল লোক দু’টিকে।
গাড়ি তখন নড়ে উঠেছে, ঘুরতে শুরু করেছে জীপের চাকা। সেই সময় কার্ড চেক করা সেই লোকটি হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, দাঁড়াও, দাঁড়াও।
গাড়ি তখন ছুটতে শুরু করেছে। ওসমান এফেন্দী একবার জানালা দিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরল স্টিয়ারিং হুইল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে দেখল, ওরা কয়েক গজ ছুটে এসে তারপর দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ে রইল গাড়ির দিকে।
তৃতীয় লোকটা কিছু মেসেজ নিয়ে এসেছিল মনে হয়। বলল আলী আজিমভ।
আহমদ মুসা পেছন থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, হবে হয়তো।
তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।
ভাবছে সে। হোয়াইট ওলফ বড় আট-ঘাট বেঁধেই নেমেছে। দেখা যাচ্ছে, সর্বত্রই চোখ রেখেছে ওরা।
আগারাক শহর ডাইনে রেখে ছুটে চলল আহমদ মুসার জীপ আরাকস হাইওয়ে ধরে। আরও ২৫ মাইল চলার পর আর্মেনিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে গাড়ি আজারবাইজানের ছিটমহলে প্রবেশ করল। আজারবাইজানের এই এলাকাটা আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন একেবারে আর্মেনিয়ার পেটের ভেতর। এর পশ্চিম সীমান্তে ইরান। উত্তরের কিছু অংশে তুরস্কের সাথে বর্ডার আছে। আরাকস নদীই ইরান ও তুরস্ক থেকে আজারবাইজানের এই ছিটমহলকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
আজারবাইজানের এ ছিটমহল অবস্থানগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসলপূর্ণ উপত্যকা এবং মূল্যবান বন আচ্ছাদিত পাহাড় অধ্যুষিত এ ছিটমহলে ৬ লাখের মত মুসলমানের বাস। ইরান ও তুরস্কের মুসলমানদের সাথে এদের গভীর সম্পর্ক। আরাকস নদী পার হলেই এরা ইরান ও তুরস্কে প্রবেশ করতে পারে। হোয়াইট ওলফের অভিযোগ, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইরান ও তুরস্কের হস্তক্ষেপের একটা বড় চ্যানেল হলো এই ছিটমহল। হোয়াইট ওলফের এ অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। পশ্চিমী প্রভাবের অধীন ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক এখানে কোন তৎপরতা পরিচালনার উৎসাহই রাখে না, আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত শিয়া ইরান এদিকে তাকাবার কোন সময়ই পায় না। কিন্তু ভিত্তিহীন এ অভিযোগ তুলেই হোয়াইট ওলফরা আর্মেনিয়ার পেটের ভেতরের এ ছিটমহলে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।
প্রায় জনবিরল আরাকস হাইওয়ে ধরে আহমদ মুসার জীপ এগিয়ে চলেছে। জীপের গতি এবার উত্তর-পশ্চিমে।
দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ আহমদ মুসারা লেক আরাকস অর্থাৎ আরাকস হ্রদের তীরে গিয়ে পৌঁছাল। এখানে এসে আরাকস নদী বিশাল আরাকস হ্রদে মিশে গেছে। আরাকস হ্রদের পশ্চিমে ইরান এবং পূর্ব পাড়ে আজারবাইজানের ছিট মহলটি। দুই দেশের সীমানা হ্রদের মাঝ বরাবর। হ্রদের পশ্চিমাংশ ইরানের এবং পূর্বাংশ আজারবাইজানের। হ্রদের ইরানী অংশের নাম লেক লিবার্টি এবং আজারবাইজানের অংশের নাম লেক আরাকস।
আরাকস হ্রদে এসে আরাকস হাইওয়ে একটু পূর্ব দিকে বেঁকে আরাকস হ্রদের পূর্ব তীর ধরে উত্তরে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসার জীপ হ্রদের পূর্ব তীর ধরে এগিয়ে চলল। আরাকস হাইওয়ে এখানে এসে বেশ উচুঁ-নিচু। বেশ দুর্গম। বামে হ্রদ, ডাইনে পাহাড় এবং উপত্যকা। কোথাও কোথাও পাহাড় কেটে কিংবা সুড়ঙ্গ করে রাস্তা এগিয়ে নেয়া হয়েছে।
একটা সুন্দর উপত্যকা দিয়ে এগিয়ে চলছিল জীপ। উপত্যকাটা খুব প্রশস্ত নয়। কিন্তু খুব সুন্দর। ঢালু হয়ে নেমে গেছে হ্রদের পানিতে। ডাইনে পূর্বদিকে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে উপত্যকাটি। উপত্যকার উত্তর প্রান্তের পাহাড়টি ধাপে ধাপে উঠে গেছে উপরে। পাহাড়ের গায়ে সবুজ গাছের সমারোহ। একদৃষ্টে আহমদ মুসা তাকিয়েছিল সে সবুজ রূপের দিকে। হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ওসমান গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের ধাপে ওগুলো দ্রাক্ষা কুঞ্জ নয়?
জ্বি, মুসা ভাই। এ এলাকায় প্রচুর দ্রাক্ষা জন্মে। উপত্যকায় ধান গমও প্রচুর হয়। বলল ওসমান এফেন্দী।
কিন্তু উপত্যকায় তো ফসল দেখছি না?
না মুসা ভাই, উপত্যকায় ধানের ক্ষেত ছিল। একটু খেয়াল করে দেখুন ধান গাছের পুড়ে যাওয়া গোড়া দেখতে পাবেন।
গাড়ি থামাও তো ওসমান।
গাড়ি থেমে গেল। নেমে পড়ল আহমদ মুসা, আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দী সকলেই।
আহমদ মুসা উপত্যকার বুকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখল, ধানগাছের গুচ্ছাকায় গোড়াগুলো পোড়া। উপত্যকা বিস্তারিত বুক জুড়ে একই দৃশ্য-বিস্তৃত বিরান ক্ষেত।
আহমদ মুসা মুখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওসমান এফেন্দীর দিকে তাকাল।
ওসমান এফেন্দী বলল, ক্ষেত পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মুসা ভাই। হোয়াইট ওলফ পুড়িয়েছে। এ এলাকার বাসিন্দাদের শতকরা একশ ভাগই ছিল মুসলমান। উপত্যকা, পাহাড়ের গায়ে ফসল ফলিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। যুগ যুগ ধরে তারা সুখ শান্তিতে বসবাস করে এসেছে। কিন্তু গত এক বছর ধরে হোয়াইট ওলফের অত্যাচার এ অঞ্চলকে বিরান করে দিয়েছে। হত্যা, লুটতরাজ, ফসলের ক্ষেত জ্বালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুসলিম জনপদগুলোকে তারা উৎখাত করেছে। সীমান্ত এলাকায় এখন কোন লোক নেই। যারা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছে, তারা পালিয়ে বেঁচেছে। এই আরাকস হ্রদ, আরাকস নদী পাড়ি দিয়ে তারা ইরান ও তুরস্কে চলে গেছে।
এখনও চলছে এই অত্যাচার?
জ্বি, হ্যাঁ। আজারবাইজানের মূল ভূখন্ড ও আর্মেনিয়া অঞ্চলের চাইতে বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলে অত্যাচার ও উৎখাত অভিযান বেশি তীব্র।
আহমদ মুসা চোখ তুলে চাইল উপত্যকার প্রসারিত বুকের দিকে। উদাস, লক্ষ্যহীন তার দৃষ্টি। সেখানে বেদনার অন্তহীন ছায়া। শত মানুষের তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস যেন সে অনুভব করতে পারছে, তাদের কান্না, অসহায়দের চিৎকার তার কানকে যেন বিদীর্ণ করছে। আহমদ মুসা ধানগাছের একটা গোড়া তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেল। ধানগাছের গোড়ায় ওদের মমতাময় অশরীরি স্পর্শ যেন অনুভব করল আহমদ মুসা।
ধানগাছের গোড়া হাতে নিয়ে আহমদ মুসা একটু সামনে এগুলো।
উপত্যকার মাঝখান দিয়ে একটা ঝর্ণার ক্ষীণ ধারা বয়ে চলেছে। ঝর্ণাটা পড়ছে গিয়ে হ্রদে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এস আমরা ঝর্ণায় অজু করে নেই। যোহরের সময় হয়ে গেছে। অজু সেরে আহমদ মুসা বলল, ওসমান তুমি গাড়ি একটু এগিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় নিয়ে রাখ। রাস্তা থেকে নামিয়ে রাখবে, গাড়ি আসতে পারে। আমরা আর একটু এগিয়ে নামাজ পড়ব।
উপত্যকার উত্তর প্রান্তে পাহাড়ের প্রায় গোড়ায় একটা মসৃণ জায়গা দেখে ওরা নামাজে দাঁড়াল। আলী আজিমভ আজান দিতে চেয়েছিল। আহমদ মুসা বাঁধা দিয়ে বলল, আমরা রণাঙ্গনে, আজান না দিলেও চলবে।
ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর ফিরে বসতে গিয়ে পেছনের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। একজন যুবক দাঁড়িয়ে।
ফর্সা, দীর্ঘাঙ্গ যুবক। পরনে কাল প্যান্ট, গায়ে সাদা চাদর জড়ানো।
আহমদ মুসা তার দিকে চাইতেই সে এগিয়ে এল। একটু একটু খোঁড়াচ্ছে সে। আহমদ মুসা দেখল, তার বাম পায়ে ব্যান্ডেজ।
আহমদ মুসাকে বিস্মিত চোখে পেছনে তাকাতে দেখে আলী আজিমভ এবং ওসমান এফেন্দীও পেছনে তাকিয়েছে। সবার চোখেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি।
যুবকটি আরও কাছে এসে সালাম দিল। আহমদ মুসারা সালাম নিল। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই যুবকটি বলল, আমার নাম আবদুল্লাহ।
একটু দম নিয়েই যুবকটি বলল, আপনারা এখানে নিরাপদ নন। ওরা আবার ফিরে আসতে পারে।
ওরা কারা? বলল আহমদ মুসা।
পশুবাহিনী।
হোয়াইট ওলফকে আজারবাইজানিরা স্থানীয় ভাবে পশুবাহিনী বলে, ওদের পশুর মত আচরণের জন্যে।
তোমরা কে? আবার প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বলল, আমরা ওই উপরে জঙ্গলে লুকিয়ে আছি। এখানে আর দেরি করা যাবে না। চলুন উপরে, সব শুনবেন।
আহমদ মুসা আলী আজিমভ ও ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে বলল, চল যাওয়া যাক।
উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা মনে মনে বলল, পাহাড়ের খাঁজে ঝোপের আড়ালে আছে, হঠাৎ করে গাড়ি কারও নজরে পড়বে না। তারপর ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, গাড়িতে চাবি লাগিয়েছো তো?
জ্বি, হ্যাঁ। ওসমান বলল।
জঙ্গল ঠেলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওরা উপরে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতেই আহমদ মুসা আবদুল্লাহর কাছ থেকে শুনলো, এই উপত্যকা থেকে পূর্বে প্রায় মাইল পনেরো ভেতরে সানাইন গ্রামে তাদের বাড়ি। আজই সকালে তারা কয়েকটি পরিবার পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই জঙ্গলে। তিনদিন আগে সেদিন গভীর রাতে হোয়াইট ওলফের লোকরা এসে গ্রামের বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত গ্রামের নারী-শিশু-পুরুষ যারা বের হতে পারেনি, তারা পুড়ে মরেছে। আবার যারা বের হয়েছে তারাও পশুদের ব্রাশফায়ারের মুখে পড়েছে। ফলে আগুন থেকে যারা বেঁচেছিল, তারা অধিকাংশই ব্রাশফায়ারে মারা গেছে। অঞ্চলের সবচেয়ে বড়, বর্ধিষ্ণু সানাইন গ্রামের ২ হাজার বাসিন্দার মধ্যে মাত্র ৫০ জন বেঁচে আছে। যারা বেঁচে আছে তাদের মধ্যে অনেকেই আহত। আবদুল্লাহর পায়েও গুলি লেগে ছিল। সানাইনের পাশের জঙ্গলে তারা দু’দিন পালিয়ে ছিল। মনে করেছিল, পশুরা চলে গেলে বিরানভূমিতেই তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। বিশেষ করে আব্দুল্লাহর আব্বা, সমাজের নেতা, কিছুতেই দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তার কথা ছিল, অনেকেই গেছে ঠিক, কিন্তু সবাই চলে গেলে দেশের কি হবে? কিন্তু থাকা গেল না। দেখা গেল, তারা গ্রাম ছাড়ছে না। গ্রামে খৃস্টান বসতি গড়ার পরিকল্পনা তাদের।
আব্দুল্লাহ্ বলল, অবশেষে হিজরতেরই সিদ্ধান্ত নিতে হল আমাদের। লেক আরাকস পথে ইরানে প্রবেশ করা সবচেয়ে নিরাপদ। লেক আরাকসের মাঝ বরাবর উভয় দেশের সীমানা হওয়ায় লেক আরাকসে একবার ভাসতে পারলেই নিরাপদ হওয়া যায়। এই কারণে এই এলাকার বেশির ভাগ লোক এ পথেই হিজরত করেছে।
আমরাও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গত সন্ধ্যায় সানাইন থেকে বের হয়ে এলাম।
সম্ভবত পশুদের চর ছড়ানো ছিল চারদিকে। আমাদের এই হিজরত তারা টের পেয়ে যায়। আমাদের পিছু নেয় ওরা। আজ সকালে এই জঙ্গলে আমরা আশ্রয় নেয়ার এক ঘন্টা পরেই ওরা এই উপত্যকায় এসে পৌঁছে। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর ওরা সরে গেছে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, ওরা চলে যায়নি। কোথাও ওঁৎ পেতে আছে নিশ্চয়।
তোমরা চলে যাচ্ছ জেনেও ওরা তোমাদের ধরার জন্যে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? বলল আহমদ মুসা।
আগে চলে যেতে ওরা দিয়েছে, কিন্তু ইদানিং ওরা আর চলে যেতে দিচ্ছে না। একেবারে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সম্ভবত ইরান ও তুরস্কে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান থেকে অনেক উদ্বাস্তু যাওয়ার পর দুনিয়াতে যে হৈ চৈ শুরু হয়েছে, তার কারণেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কথা বলতে বলতে পাহাড়ের প্রশস্ত একটা ধাপে ওরা এসে উঠল। বলা যায় পাহাড়ের বুকে যেন একটা সবুজ উপত্যকা।
ধাপে উঠতেই জঙ্গল ফুঁড়ে যেন একটা যুবক বেরিয়ে এল। তার হাতে একটা বন্দুক। সে নরম গলায় সালাম দিল আব্দুল্লাহকে।
সালাম নিয়ে আব্দুল্লাহ আহমদ মুসাদের দেখিয়ে বলল, এরা আমাদের ভাই।
যুবকটি সলজ্জ হাসিতে সালাম দিল আহমদ মুসাদের।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা যুবকটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি ভাই?
আলী। আমার চাচার ছেলে। আব্দুল্লাহ জবাব দিল।
কথা শেষ করে আলীর দিকে তাকিয়ে আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করল, আব্বা কোথায়?
পূর্ব প্রান্তের একটা বড় গাছের দিকে ইংগিত করে আলী বলল, ওখানে শুয়ে আছেন।
আব্দুল্লাহ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন যাই।
সামনে এগিয়ে চলল আহমদ মুসারা। চারদিকে ছোট ছোট গাছ আর দ্রাক্ষালতার দেয়াল। এরই ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। সবাই এদিক সেদিক বসে আছে, দু’একজন শুয়ে আছে। সবারই মুখ শুকনো, দৃষ্টি উদাস। একটা গাছের তলায় দশ বার জন মেয়েকে দেখা গেল। সবারই মুখ নিচু, চুপচাপ বসে আছে। বেদনার ভারে ওরা যেন ন্যুব্জ।
আব্দুল্লাহ বলল, যাদের দেখছেন, সবাই সব হারিয়ে নিঃস্ব। এক পরিবারের মধ্যে একজন বেঁচে আছে এমনদের সংখ্যাই আমাদের মধ্যে বেশি।
সামনে এগুচ্ছিল ওরা। সামনে আব্দুল্লাহ, তারপর আহমদ মুসা। এরপর আলী।
চারদিকের সবার উৎসুক দৃষ্টি আহমদ মুসাদের দিকে। সে ঔৎসুক্যের মধ্যে আশার আকুতি আছে। চলছিল ওরা। পাশ থেকে এক তরুণী ছুটে এল আব্দুল্লাহর সামনে। বলল, ভাইজান, আমার আব্বা —–
সে কথা শেষ করতে পারল না। কান্নায় বুজে গেল তার কণ্ঠ।
কি হয়েছে ফায়জা, অবস্থা আরও খারাপ? বলল আব্দুল্লাহ।
কোন জবাব না দিয়ে তরুণীটি বলল, শীঘ্রই চলুন আপনি। কেমন জানি করছেন।
আব্দুল্লাহ আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসা বলল, চল আগে ফায়জার আব্বাকে দেখে আসি। উনি কি অসুস্থ?
একজন অপরিচিত লোকের মুখে ফায়জা তার নাম শুনে চোখ তুলে তাকাল। নেকাবটি নাকের উপর দিয়ে চলে গেছে। চোখ অশ্রু ধোয়া, বিষণ্ণ বেদনায় পীড়িত। যেন বিধ্বস্ত একটি ফুল।
আব্দুল্লাহ চলতে শুরু করে বলল, উনি আহত। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
অল্প দূরে একটা গাছের তলায় একটা চাদরে শুয়ে একজন শক্ত-সমর্থ মাঝ বয়েসি লোক চোখ বন্ধ করে মাথা ঠুকছিলেন। কষ্টে ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক।
আব্দুল্লাহ ছুটে গিয়ে তার মাথা তুলে নিল দুই হাতে।
লোকটির পাঁজরের কাপড়ে রক্তের দাগ। পাঁজরে গুলি লাগে তার। দেখলেই বুঝা যায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের শিকার সে। গোটা দেহ তার অসাড়। আহমদ মুসা বুঝল, আঘাতটা প্রাণহানিকর নয়, রক্ত বন্ধ হলেই তাকে হয়ত বাঁচানো যায়।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল লোকটি। চোখ খুলে আব্দুল্লাহকে দেখে তার চোখ দু’টি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই সাথে নেমে এল তার চোখ দিয়ে অশ্রুর দু’টি ধারা। ঠোঁট দু’টি তার নড়ে উঠল। অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে থেমে থেমে বলল, বাবা আব্দুল্লাহ, আমার সময় হয়েছে। আমার মা ফায়জার আর কেউ থাকল না। তোমার হাতেই ওকে দিয়ে গেলাম। ওকে দেখো।
ফায়জা দাঁড়িয়েছিল। বসে পড়ল। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল, আব্বা!
লোকটি, ফায়জার আব্বা, একটু দম নিয়েছিল। আবার সে বলতে শুরু করল, বাবা আব্দুল্লাহ, হতাশ হয়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা করো। তিনি সাহায্য করবেন। এ বিরান জনপদে দেখো আবার জীবনের জোয়ার জাগবেই।
শেষ কথা তার প্রায় ঠোঁটেই জড়িয়ে থাকল। ধীরে ধীরে বুজে গেল তার চোখ। শান্ত হয়ে গেল তার অশান্ত বুকটিও।
আব্দুল্লাহ ধীরে ধীরে হাত থেকে নামিয়ে রাখল তার মাথা।
ফায়জা পিতাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
আব্দুল্লাহও দু’হাতে মুখ ঢাকল তার। আহমদ মুসার চোখ দু’টিও ভিজা। বড় দু’ফোঁটা অশ্রু তার দু’চোখের কোণায় এসে জমা হয়েছে। কিন্তু তার মুখ যেন ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠল। ঠোঁট দু’টি তার দৃঢ় সংবদ্ধ।
অত্যন্ত দৃঢ় ও শক্ত গলায় আহমদ মুসা ডাকল, বোন ফায়জা, ভাই আব্দুল্লাহ!
নরম বেদনাবিধুর মৌন পরিবেশে তার এই শক্ত ও উচ্চকণ্ঠ বড় বেসুরো শুনাল।
ফায়জা ও আব্দুল্লাহ দু’জনেই প্রায় চমকে উঠে তার দিকে মুখ তুলল। ফায়জার মুখে সেই নেকাব তখন নেই।
আহমদ মুসা বলল, আব্দুল্লাহ, ফায়জা, আমি তোমাদের চোখে অশ্রু নয়, আগুন দেখতে চাই, শোকে মুষড়ে পড়া নয়, শক্তির প্রবল উচ্ছ্বাস দেখতে চাই। মুসলমানদের জন্ম কাঁদার জন্যে হয়নি, ইসলাম দুর্বলদের জন্যে নয়। রণাঙ্গনে লাশের পর লাশ পড়েছে, আমরা কি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের জন্যে যুদ্ধ করিনি?
ফায়জার আব্বার মৃত্যু সংবাদ শুনে নারী পুরুষ সবাই জমা হয়েছিল সেই গাছের তলায়। আব্দুল্লাহর আব্বাও। সবাই চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার কথা শুনছিল আর ভাবছিল, এমন নতুন করে কথা বলছে এই লোকটি কে, এই লোকরা কারা!
আহমদ মুসার কথায় সবার মধ্যেই শক্তির একটা শিহরণ জেগে উঠেছিল, শোকের ঢেউটা যেন দূরে সরে যাচ্ছিল।
আব্দুল্লাহ ও ফায়জার মুখ থেকেও যেন শোকের ছায়া সরে গেল। চোখের অশ্রু শুকাতে লাগল। এমন কথাতো তারা কারো কাছ থেকে শুনেনি! এতো শুধু কথা নয়, এ যেন জীবন্ত এক শক্তি, যা ভয়-ভাবনাকে মুহূর্তে তাড়িয়ে দেয়।
আব্দুল্লাহর আব্বা বৃদ্ধ আলী আবরার খান এগিয়ে এল আহমদ মুসার দিকে।
কাছে এসে আহমদ মুসার একটা হাত তুলে নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, তুমি কে, তোমরা কারা বাবা?
এই সময় একজন চিৎকার করতে করতে ছুটে এল, সাবধান পশুরা আবার এসেছে।
লোকটি এসে আলী আবরার খানের কাছে দাঁড়াল। ভীষণ হাঁপাচ্ছে লোকটা।
আলী আবরার লোকটিকে বলল, কি খবর, কি দেখেছ তুমি শরীফ?
ওরা এসেছে, সাথে কুকুর দেখলাম। বলল শরীফ।
কুকুর? প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
–জি।
–কয়টি?
–দু’টি।
–ওরা কতজন?
–পনের-ষোলজন।
–কোথায় দেখেছেন ওদের?
–উপত্যকায়, এদিকে আসছে।
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করল। তারপর মুখ তুলল। তাকাল সবার দিকে। দেখল, একটা ভয়ের ছায়া নেমেছে সবার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা আলী আবরার খানের দিকে চেয়ে বলল, জনাব, আপনি মাইয়্যেতের দাফনের ব্যবস্থা করুন। কোন চিন্তা করবেন না, আমরা আসছি।
তারপর ওসমান এফেন্দীর দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ওসমান তুমি এদের সাথে এখানে থাক। আমি ও আলী আজিমভ নিচে যাচ্ছি।
–কিন্তু মাত্র তোমরা দু’জন ——-
প্রশ্ন তুলল আলী আবরার।
–অসুবিধা নেই। শরীফ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
–অন্তত আব্দুল্লাহ, আলীসহ কয়েকজনকে নিয়ে যাও।
–দরকার হবে না, চাচাজান। আব্দুল্লাহ আহত। অবশ্য ইচ্ছা করলে আলী আমাদের সাথে যেতে পারে।
–আঘাত সামান্য, আমি পারব যেতে। বলল আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহর কাঁধ চাপড়ে হেসে বলল, তোমার উপর আমার আস্থা আছে আব্দুল্লাহ। তবু বলছি, তুমি এখানেই থাক। পশ্চাৎদেশ অরক্ষিত রাখা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজী নয়।
এই সময় নিচের দিক থেকে চাপা একটা গোঙ্গানী ভেসে এল।
–কুকুরের গোঙ্গানী। বলল আলী আবরার।
–কুকুর ওদের পথ দেখাচ্ছে, ওরা তাহলে উঠছে। বলল আহমদ মুসা।
বলেই আহমদ মুসা ওসমান এফেন্দীকে বলল, তুমি আব্দুল্লাহ, আলী এবং আরও যুবক যারা আছে তাদের নিয়ে নজর রাখবে, কোন ফাঁক গলিয়ে কেউ যাতে উপরে আসতে না পারে। আমরা আলীকে সাথে নিচ্ছি না। শরীফ আমাদের পথ দেখাবে।
আহমদ মুসা এবং আলী আজিমভ সবাইকে সালাম জানিয়ে নিচে নামার পথ ধরল। পেছনে পেছনে চলল শরীফ।
প্রায় দু’শ গজ নামার পর একটা টিলার পাশে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, আজিমভ, অগ্রসর হবার আগে একটু ভালোভাবে চারিদিকটা দেখা দরকার, ওরা কোন পথে এগুচ্ছে।
টিলার গোড়াতেই অনেকগুলো গাছ। বেশ উঁচু। আহমদ মুসা তারই একটিতে তরতর করে উঠে গেল।
গাছের মাঝামাঝি উঠতেই পাহাড়ের গোটা ঢালটা নজরে এল, উপত্যকাও নজরে আসছে।
আহমদ মুসা দূরবীন লাগালো চোখে। আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল গোটা পাহাড়ের ঢালটা। আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেখল, আহমদ মুসারা যেখানে আছে সেখান থেকে প্রায় ৪’শ গজ নিচে ওরা উঠে আসছে। গাছের আড়াল হওয়ার কারণে ওদের দলের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। এই সময় ওরা উন্মুক্ত একটা ধাপে উঠে এল। এবার সবাই দূরবীনের লেন্সে ধরা পড়ল। কিন্তু ওদের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওরা মাত্র ৮জন কেন? আর কুকুর কোথায়? চিন্তা করতে গিয়ে শিউরে উঠল আহমদ মুসা।
তরতর করে সে নেমে এল নিচে। ফিসফিস করে আজিমভকে বলল, সাবধান, যে কোন সময় আক্রমণের মুখোমুখি আমরা হতে পারি।
আহমদ মুসা এবং আলী আজিমভ দু’জনেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে এম-১০ রিভলভার বের করে আনল।
শরীফের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, তুমি আর কোথাও নড়ো না, এই টিলার গোড়ায় বসে থাক।
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। টিলার ওপাশ থেকে তীরের মত ছুটে এল দু’টি কুকুর। আহমদ মুসাদের দেখেই থমকে দাঁড়াল শিকারী কুকুর দু’টি। রক্তের মত লাল ওদের চোখ। আহমদ মুসা ও আলী আজিমভের হাতে উদ্যত রিভলভার। আলী আজিমভ ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা হাত তুলে নিষেধ করল। শিক্ষিত-শিকারী কুকুর দু’টি মুহূর্তকাল থমকে দাঁড়িয়েই ভীষণভাবে ঘেউ ঘেউ করতে করতে পেছনে সরে গেল।
আহমদ মুসা বলল, আজিমভ তুমি টিলার পশ্চিম পাশ আগলাও, আমি পূর্ব পাশে আছি। সামনেই একদল শত্রু, তার পেছনে আরেক দল আছে।
কুকুর পেছনে সরে যাওয়ার মুহূর্ত কয়েক পরেই চারজনকে উদ্যত স্টেনগান হাতে টিলার প্রান্তে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল। আহমদ মুসা টিলার প্রায় গা সেঁটে একটা গাছের গুড়িকে আড়াল করে শুয়ে ছিল। আর ওদের চোখ ছিল সামনে, উপরদিকে। আহমদ মুসাকে ওরা দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা উঠে বসল। তারপর এম-১০ এর বাঘা মুখটা ওদের দিকে তাক করে হুকুম দিল, হয়েছে, এবার স্টেনগান ফেলে দাও।
বিদ্যুৎ বেগে ওরা চারজনই এদিকে ঘুরে দাঁড়াল। সাথে ঘুরে গেল ওদের স্টেনগানও। কিন্তু আহমদ মুসা ওদের সুযোগ দিল না। তারা ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই আহমদ মুসার তর্জনী চেপে বসল ট্রিগারে। এম-১০ থেকে গুলির একটা ঝাঁক বেরিয়ে গেল।
ওরা চারজন যে যেখানে ছিল সেখানেই ঝরে পড়ল মাটিতে। একটি শব্দও ওদের মুখ থেকে বের হয়নি।
এদিকে আলী আজিমভ আহমদ মুসার নির্দেশ পাবার পর হামাগুড়ি দিয়ে গেল টিলার পশ্চিম প্রান্তে। তারপর টিলার পশ্চিম মাথা ঘুরে টিলার দক্ষিণ পাশটায় উঁকি দিল আলী আজিমভ। তার হাতে উদ্যত এম-১০।
উঁকি দিয়েই চমকে একদম মুখোমুখি হলো তাদের সাথে। ওরাও চারজন গুটি গুটি এগুচ্ছিল টিলার পশ্চিম প্রান্তের দিকে। চমকে উঠেছিল ওরাও। ওদের হাতেও উদ্যত স্টেনগান।
এই সময়ই গর্জে উঠেছিল আহমদ মুসার এম-১০। ওদের চোখটা মুহূর্তের জন্যে ওদিকে ঘুরে গিয়েছিল। আলী আজিমভ এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করল। অগ্নিবৃষ্টি করল তার এম-১০। মাত্র পাঁচ-ছয় হাতের ব্যবধান। ঝাঁঝরা দেহ ওদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা, আলী আজিমভ ও শরীফ তিনজনই টিলার দক্ষিণ পাশে উন্মুক্ত ছোট্ট ধাপটার উপর এসে দাঁড়াল। তারা দেখল, কুকুর দু’টি চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে যাচ্ছে। অল্পক্ষণ পরেই কুকুর দু’টির চিৎকার আর শোনা গেল না।
আহমদ মুসা দূরবীন হাতে নিয়ে আবার টিলার উপর উঠল। দূরবীন চোখে লাগাল। মাঝে মাঝে গাছের আড়াল থাকলেও সামনের এলাকাটার সবকিছুই মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে আহমদ মুসা। দেখল, কুকুর দুটি সাথে নিয়ে ওরা আটজন দ্রুত উপরে উঠে আসছে। এবার স্টেনগান ওদের কাঁধে নয়, হাতে।
আহমদ মুসা আরও দেখল, প্রায় ১শ’ সোয়াশ’ গজ নিচে পাহাড়ের বড় একটা ধাপ। তার দু’পাশেই গভীর খাদ। এ এলাকায় উপরে উঠার এই ধাপই একমাত্র পথ। ধাপের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছোট একটি টিলা। টিলার আড়ালে দাঁড়ালে গোটা ধাপটাই নজরে আসে।
আহমদ মুসা দ্রুত নেমে এল টিলা থেকে। বলল, আজিমভ চল, নিচের ঐ টিলাটা আমাদের দখল করতে হবে।
ক্রলিং করে দ্রুত ওরা নেমে এল ঐ টিলার পিছনে।
দশমিনিটও পার হয়নি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সেই ধাপের উপর প্রথম উঠে এল কুকুর দুটি। তারপর ওরা আটজন। ধাপে উঠেই কুকুর দুটি মহা ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল। ওরা একবার ছুটে এল টিলার দিকে।
আহমদ মুসা শুয়েছিল এক পাথরের আড়ালে। পাথরের সুড়ংগে তার এম-১০ রিভলভারের নল। সে ভাবল, আর ওদের সময় দেয়া যায় না।
আহমদ মুসা দৃঢ় ও উচ্চকণ্ঠে বলল, তোমরা আটজনই গুলির রেঞ্জে। স্টেনগান ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। পালাবার চিন্তা করলে মারা পড়বে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। গর্জে উঠল ওদের আটটি স্টেনগান। আহমদ মুসার মুখের শেষ শব্দটি স্টেনগানের গর্জনে ঢাকা পড়ে গেল। গুলি করতে করতে ওরা ছুটে এল।
আহমদ মুসার তর্জনী ট্রিগারেই ছিল। শেষ শব্দ উচ্চারণ করেই চেপে ধরল ট্রিগার। পাথরের ফাঁক দিয়ে ঘুরিয়ে নিল রিভলভারের মাথা। গুলির স্রোত বেরিয়ে গেল মেশিন রিভলভার এম-১০ এর বুক থেকে। প্রশস্ত ধাপের অর্ধেকের বেশি ওরা আটজন এগোতে পারেনি। গুলি লেগে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ওরা আটজনই আছড়ে পড়ল মাটিতে। কুকুর দুটিও এবার বাঁচল না। ওদের সাথেই ছিল কুকুর দুটি। ওদের সাথে একই ভাগ্য বরণ করল তারা।
আহমদ মুসারা তিনজনই টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। দাঁড়াল আটটি লাশের সামনে। রক্ত তখনও গড়াচ্ছে পাথরের কাল বুকের উপর দিয়ে। উন্মুক্ত গোটা ধাপটাই রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রবহমান লাল রক্তের দিকে।
এক সময় তার কণ্ঠ থেকে স্বগতঃ বেরিয়ে এল, আল্লাহর কাছে মানুষের রক্ত সবচেয়ে মূল্যবান। এজন্যই হন্তাকে তিনি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে রক্তপাত থেকে মানবসমাজ মুক্ত হতে পারে। কিন্তু, তবু এই রক্তপাত কেন?
কে এর জন্য দায়ী?
একটু থামল আহমদ মুসা। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল সে আলী আজিমভ ও শরীফের দিকে। বলল, মানুষকে, মানবসমাজকে মানুষ-প্রভুদের অক্টোপাস থেকে, তাদের লোলুপ-গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারলে এ রক্তপাত থেকে আমাদের এ সুন্দর বিশ্বকে রক্ষা করা যাবে না।
শরীফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। ভেবে পেল না, কঠোর-কোমলে এমন অপরূপ মানুষ হয়! কে ইনি? কে এরা?
নিহত ষোল জনের দেহ সার্চ করে কিছু টাকা ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না, একটু কাগজও নয়। অর্থাৎ, হোয়াইট ওলফ এখানেও সামনে এগোবার কোন চিহ্ন রেখে গেল না।
ওদের ষোলটি স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে আহমদ মুসারা উঠে এল উপরে।
উপর থেকে আহমদ মুসাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে আব্দুল্লাহ, আলীসহ যুবকরা দ্রুত নেমে এল। শরীফ আব্দুল্লাহকে দেখেই চিৎকার করে উঠল, আব্দুল্লাহ ভাই, ওরা ষোলজন কেউ বাঁচে নি।
আব্দুল্লাহ এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, খোশ আমদেদ মুসা ভাই।
–আমার নাম কি করে জানলে?
–ওসমান আমাদের সব বলেছে। তাইতো বলি, আহমদ মুসা ছাড়া খল, ক্ষিপ্র, ক্রুর ও হিংস্র হোয়াইট ওলফকে চ্যালেঞ্জ করতে এভাবে আর কে এগিয়ে যেতে পারে!
–এটা ঠিক নয় আব্দুল্লাহ, প্রতিটি মুসলিমই অকুতোভয় সৈনিক।
–ঠিক মুসা ভাই, কিন্তু আমরা তো সেই মুসলিম নই।
–একথাও তুমি ঠিক বললে না আব্দুল্লাহ, সবই ঠিক আছে। অব্যবহারের ফলে তলোয়ারে শুধু মরিচা ধরেছে মাত্র।
–ঠিক বলেছেন মুসা ভাই। আপনার সংস্পর্শ এই মরিচা তুলে দিচ্ছে। মুসা ভাই, এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত মৃত্যুভয় আমাকে ঘিরেছিল, কিন্তু এখন আর আমার মনে কোন ভয় নেই।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহর পিঠ চাপড়ে বলল, বাহাদুর ভাই এইতো চাই। মুসলমানরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গাজী হওয়ার জন্যেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তার কাছে জীবনের চেয়ে শাহাদাৎ বেশি লোভনীয়। এ ধরনের বাহিনী কখনও হারতে পারে না আব্দুল্লাহ।
আব্দুল্লাহ, আলী, শরীফ সকলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা সবাইকে তাড়া দিল, চল এবার।
যুবকরা যুদ্ধলব্ধ ষোলটি স্টেনগান হাতে নিয়ে আনন্দ করতে করতে উপরে ছুটে চলল।
উপরের ধাপের প্রান্তে নারী-পুরুষ সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। সকলের দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ আলী আবরার খান। তার পাশে ওসমান এফেন্দী।
| | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »