১. অপারেশন তেলআবিব-১

রাতের তেলআবিব। রাস্তার জন সমাগম কমে গেছে। পিচ ঢালা কালো মসৃণ রাস্তা। পাশে সরকারী বিজলি বাতিগুলো আলো আঁধারীর সৃষ্টি করেছে। বাতাস গায়ে লাগে না, কিন্তু কেমন যেন একটু ঠান্ডার আমেজ অনুভূত হয়। সাগর ভেজা বাতাসের স্বাদ এতে অনেকটা। এ বাতাসে নরম ঘুমের পরশ অনুভব করা যায়।

এক অভিজাত আবাসিক এলাকা। কদাচিত দু’একটি বাড়ির জানালা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। এ এলাকার রাস্তায় লোকের চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। ডি,বি, রোড। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ী চোখ ধাঁধিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে যাচ্ছে। ডি,বি, রোড থেকে একটা ছোট রাস্তা বেরিয়ে কিছু দক্ষিণে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে সুন্দর একাট দু’তালা বাড়ী।

দূরের কোন একটি পেটা গড়িতে ঢং ঢং করে ১২টা বেজে গেল। ধীরে ধীরে একটা কালো রং এর গাড়ী এসে অন্ধকারে দাঁড়ানো বাড়ীটির গেটে এসে থামল। কালো পোশাক দেহ ঢাকা এক ছায়ামূর্তি গাড়ী থেকে নেমে এল।

ঠক্ ঠক্ ঠক্। বন্ধ জানালার শক্ত কবাটে ধীরে ধীরে তিনটি শব্দ হল।

ছায়ামূর্তিটি বাড়ীটির সম্মুখের বাগানটি পেরিয়ে নীচের তলার একটি বন্ধ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। ছায়ামূর্তিটির তর্জ্জনী আবার শব্দ করল বন্ধ জানালার গায়ে – ঠক্ ঠক্ ঠক্।

ধীরে ধীরে এবার জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল ভিতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি হাত বেরিয়ে এল, ছায়ামূর্তিটি সে হাতে তুলে দিল ভাজ করা এক টুকরো কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে জানালাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। জানালাটি বন্ধ করে দিয়েই কর্ণেল মাহমুদ দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল। আকাশ থেকে একটি বড় উল্কা পিন্ড খসে পড়ল। মনে হল উল্কাটি যেন সামনের ২২তলা দালানটির ছাদের উপর এসে নামল। ব্যালকনি থেকে ডি,বি, রোড়ের মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। মাহমুদ দেখলো কাল গাড়ীটি ছোট রাস্তা পেরিয়ে ডি,বি, রোডে গিয়ে পড়ল। গাড়ীটির পিছনে রক্তাভ আলো দু’টি ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মাহমুদ সেখানে থেকে দৃষ্টি ফিরাতে গিয়েও পারল না। দেখল ছোট রাস্তা পেরিয়ে আর একটি গাড়ী গিয়ে ডি,বি, রোডে পড়ল।

চমকে উঠল মাহমুদ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মনে -অনুসরণ। তর তর করে সে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। ডি,বি, রোডে যখন কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী বেরিয়ে এল, তখনও দীর্ঘ পথের প্রান্তে অনুসরণকারী গাড়ীটির পিছনের রক্তাভ আলো দেখা যাচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদের ছোট্টগাড়ীটি তীব্র গতিতে ছুটে চলল। সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটির স্পীড ছিল মাঝারী গোছের। অল্প সময়ের মধ্যেই কর্ণেল মাহমুদের গাড়ীটি অনুসরণকারী গাড়ীটির দুশো গজের মধ্যে এসে পড়ল। কিছুক্ষণ চলার পর সামনের গাড়ীটির স্পীড হঠাৎ বেড়ে গেল। কর্ণেল মাহমুদও তার গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিল। মাহমুদ বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটি তাকে সন্দেহ করেছে। মাহমুদ ভেবে খুশি হল যে গাড়ীটি হয়তো এবার সামনের সাইমুমের গাড়ীটির অনুসরণ পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবে। কারণ দু’দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি সে সৃষ্টি হতে দিবে না, কিন্তু অল্পক্ষণেই ভুল ভেঙ্গে গেল মাহমুদের। সে দেখলো সমান গতিতে গাড়ীটি সামনের গাড়ীটির অনুসরণ করে যাচ্ছে। সামনের অনুসরণকারী গাড়ী থেকে মাহমুদরে গাড়ীর দুরত্ব কমপক্ষে দু’শ গজের মত। আর সে গাড়ী থেকে তার সামনের গাড়ীটির দূরত্ব কমপক্ষে একশত গজ। এ সময় গাড়ীর রিয়ারভিউ এ চোখ পড়তেই চমকে উঠল মাহমুদ, দেখলো পিছন থেকে পাশাপাশি জ্বলন্ত চোখের মত দু’টি অগ্নিপিন্ড তার দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে মাহমুদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী ‘মোসাদের’ (ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা) গাড়ীটি বেতারে চতুর্দিকে খবর পাঠিয়েছে। পিছনের মত সামনে থেকেও হয়তো অনুরূপভাবে গাড়ী তাদের দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে তার করণীয় ঠিক করে নিল কর্ণেল মাহমুদ। দেখতে দেখতে গতি নির্দেশক গাড়ীর কাঁটা ৫০ থেকে ৯০ এ গিয়ে পৌঁছল। মোসাদের গাড়ী সাইমুমের যে গাড়ীটি অনুসরণ করছিল, তা একই গতিতে চলছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেলআবিবের সাইমুম প্রধান কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী মোসাদের গাড়ীটির সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী থেকে একটি ডিম্বাকৃতি বস্তু তীব্র বেগে ছূটে গিয়ে মোসাদের গাড়ীটিকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ হল। ততক্ষণে কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী তার সহকর্মীটির গাড়ীর সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। কর্ণেল মাহমুদ একবার পিছনে ফিরে দেখল, মোসাদের গাড়ীটিতে আগুন জ্বলছে। পিছনের অনুসরণকারী গাড়ীটিও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। কর্ণেল মাহমুদ ও তার সহকর্মীর গাড়ী পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনেই ভিক্টোরী স্কোয়ার। এখানে পশ্চিম দিক থেকে হায়কল এভিনিউ উত্তর দিক থেকে গোলান রোড এবং পূর্ব থেকে ডি,বি, রোড এসে মিশেছে। হায়কল এভিন্যুকে দক্ষিণ পার্শ্বে এবং গোলান রোডকে পূর্ব পার্শ্বে রেখে ইসরাইলীরা এখানে গড়ে তুলেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্মারক স্তম্ভ। স্মৃতি স্মারক কেন্দ্রটিতে স্মরক স্তম্ভ ছাড়াও আছে সুপরিকল্পিতভাবে সাজান সুন্দর বাগান, বিশ্রামাগার, পাঠাগার এবং জাতীয় ইতিহাসের এক প্রদর্শনী কেন্দ্র। সর্বসাধারণের জন্য এ কেন্দ্রটি সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।

কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে জড়ল পশ্চিম দিক থেকে চারটি অগ্নি গোলক ছুটে আসছে। উত্তর দিকে গোলান রোডের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য নজরে পড়ল কর্ণেল মাহমুদের। কর্ণেল মাহমুদ মুহূর্তের মধ্যে তার কর্তব্য স্থির করে নিল। গাড়ীর ডান দিকের দরজা খুলে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে নেমে পড়ল সে। তারপর চোখের নিমিষে ভিক্টোরী স্কোয়ারের পাঁচিল টপকে সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কর্ণেল মাহমুদের চালকহীন গাড়ীটি প্রায় গজ পঞ্ঝাশেক দুরে গিয়ে এক লাইট পোষ্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উন্টে গেল। কিছু দূর গিয়ে কর্ণেল মাহমুদের সহকর্মীর গাড়ীটিও থেমে গেল। ইতিমধ্যে তিন দিক থেকে মোসাদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে এসে পড়েছে। এই সময় গাঢ় কাল সামনের রাস্তাঘাট আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মোসাদের কুকুরদের কাচকলা দেখিয়ে তার সহকর্মীও সরে পড়তে পেরেছে বলে কর্ণেল মাহমুদ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কর্ণেল মাহমুদ ভিক্টোরী পার্কের আরও অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। সে জানত মোসাদের লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ভিক্টোরী পার্ক চষে ফেলবে। তার আগেই পার্ক থেকে সরে পড়তে হবে। কর্ণেল মাহমুদ সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে এগুচ্ছিল, এমন সময় পাশের বিশ্রামাগার থেকে ধ্বস্তাধ্বস্তি তারপর নারী কন্ঠের চাপা চীৎকার শুনতে পেল সে। দ্রুত সে ওদিকে এগুলো। দেখতে পেল একটি নগ্ন প্রায় নারী দেহের উপর একটি লোক চেপে বসেছে। নারীটি মুক্তি পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদ কক্ষে প্রবেশ করল। পায়ের শব্দ থেকেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদের দিকে নিবদ্ধ চোখ দু’টি তার হিংস্রতায় জ্বলছে। মাহমুদকে লক্ষ্য করে সে বলল, বেরিয়ে যা কুকুর, নইলে… উত্তেজনায় সে কথা শেষ করতে পারল না।

মাহমুদ এক নিমিষে লোকটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো লোকটি তৃতীয় কোন অমানুষ। সে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘বেরিয়ে যাব কিন্তু তোমাকে নিয়ে।’ লোকটি পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল। মাহমুদ এর অর্থ বুঝে। সে এক লাফে লোকটির নিকটবতী হল। লোকটি পকেট থেকে হাত বের করবার আগেই মাহমুদের প্রচন্ড একটি লাথি গিয়ে তার তলপেটে পড়ল। কোঁথ করে একটি শব্দ বেরুল লোকটির মুখ দিয়ে। তার সাথে গোটা দেহটি তার সামনের দিকে বেঁকে গেল। পর মুহুর্তে আর একটি প্রচন্ড ঘুষি গিয়ে পড়ল লোকটির চোয়ালে। এবার নিঃশব্দে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কর্ণেল মাহমুদ এতক্ষণ পরে প্রথমবারের মত মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটি ইতিমধ্যে পোশাক ঠিক করে নিয়েছে। অবিন্যস্ত স্বর্ণাভ চুল কপালের একাংশ ঢেকে রেখেছে। নীল চোখ দু’টি থেকে আতংকের ঘোর তখনও কাটেনি। ইহুদীদের স্বভাবজাত উন্নত নাসিকার নীচে পাতলা রক্তাভ ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা শ্বেত স্বর্ণাভ মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে পদশব্দ শুনে সে থেমে গেল। পকেট থেকে রিভলভার বের করে সে দ্রুত দরজার আড়ালে সরে গেল এবং ইঙ্গিতে সে মেয়েটিকে বসে পড়তে বলল, দরজার ফাঁক দিয়ে মাহমুদ দেখলো, দু’জন লোক ঘরের কিছুদূর সামনে দিয়ে সুইমিং পুলের পূর্ব পাশ দিয়ে ঘুরে আবার দক্ষিণ দিকে চলে গেল। মাহমুদ মনে মনে হাসল, সাইমুমের লোক যে ভিক্টোরী পার্কের বিশ্রামাগারে আশ্রয় নিয়ে মোসাদের লোকের হাতে পড়ার মত বোকামী করবে না – ইসরাইলী গোয়েন্দাদের এই স্বাভাবিক বিশ্বাসই তাকে আজ এক অঘটন থেকে বাঁচাল। কর্ণেল মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে বলল, দেখনু আমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছি, ‘পুলিশের লোক আমার পিছু নিয়েছে, আমাকে এখনই সরে পড়তে হবে। আপনি পুলিশের সাহায্যে বাড়ী ফিরতে পারেন।’ বলে মাহমুদ বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল।

মেয়েটি ডাকল,শুনুন।

মাহমুদ ফিরে দাঁড়াল। মেয়েটি বলল, বাগানে আমার গাড়ী আছে। চলুন গাড়ীতে যাবেন। মাহমুদ বলল, এখন এখান থেকে গাড়ীতে যাওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তাহলে আমাকে পৌঁছে না দিয়ে আপনি যেতে পারেন কেমন করে? গাড়ী নিয়ে যাবেন, কোন বিপদ আপনার হবে না। কোন বিপদের ভয় না করেই তো হোটেল থেকে বাড়ীতে পথে বেরিয়ে ছিলাম, কিন্তু বিপদ তো হল। একটু থেমে মেয়েটি বলল,আমার সঙ্গে গাড়ীতে চুলন। আমি নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারি, পুলিশের লোক আমার গাড়ী সার্চ করবে না। দু’জন ঘর থেকে বেরুল। বাগানের এক অন্ধকার কোণে রাখা গাড়ী নিয়ে তারা খোলা গেট দিয়ে রাস্তায় বেরুল।

গাড়ী পূর্ণ গতিতে গোলান রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। দু’জনেই চুপচাপ। মাহমুদ তখন অন্য চিন্তা করছে। তাকে দেওয়া চিরকুটটি সে এখন ও পড়তে পারেনি। তাতে জরুরী কোন নির্দেশ থাকলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গাড়ী চালানোর ফাঁকে মেয়েটি ইতিমধ্যে কয়েকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়েছে। সুন্দর শান্ত দর্শন লোকটির অদ্ভুত বলিষ্ঠ গড়ন। ঐ শান্ত দর্শন দেহে যে অবিশ্বাস্য রকমের সাহস ও বিদ্যুৎ গতি রয়েছে, তা সে নিজ চোখেই দেখেছে। চোখ মুখ থেকে প্রতিভা তার যেন ঠিকরে পড়ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য মাহমুদের নির্বিকার ভাব।

নির্জন রাজ পথের উপর দিয়ে তীর বেগে গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে একটি মোড়। গাড়ী থামানোর লাল সংকেত জ্বলে উঠল। সাদা পোশাকধারী পুলিশ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। গাড়ী তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি গাড়ী থেকে মুখ বের করল। সে কিছু বলার আগেই পুলিশ স্যালূট দিয়ে গাড়ীর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। গাড়ী আবার ছুটে চলল। মেয়েটি এবার মুখে একটু হাসি টেনে কর্ণেল মাহমুদের দিকে চেয়ে বলল, কেমন ভয় পাননি তো?

মাহমুদ বুঝলো মেয়েটি সরকারী মহলে শুধু সুপরিচিতাই নয়, সম্মানিতাও। উত্তরে বলল, বেকায়াদায় পড়লে ভয় না পায় কে?

মাহমুদ আবার চুপচাপ। গড়ীর বাইরে আলো আঁধারের খেলা। নির্জন রাতের নিঃশব্দ পরিবেশের মধ্যে মৃদু স্পন্দন তুলে এগিয়ে চলছে গাড়ী। মেয়েটি স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সামনে তাকিয়ে আছে। মনে তার চিন্তার ঝড় পাশে বসা এই লোকটি কে? টাকা, প্রশংসা ও সুন্দরী নারীদেহের প্রতি লোভ মানুষের চিরন্তন। এই লোকটি কি সব কিছুর উর্ধ্বে? এতক্ষণের মধ্যে লোকটি তার পরিচয় এমন কি নামটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনি। ডেভিড বেনগুরিয়ানের সুন্দরী মেয়ে এমিলিয়া কোন যুবকের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না – এমন কথা অবিশ্বাস্য। শুনেছি, অর্থ সুনাম ও নারীদেহের মোহ যে কাটিয়ে উঠতে পারে, সে লোক অতি মানব। মেয়েটি আবার মাহমুদের দিকে তাকায়। সেই প্রশান্ত মুখ, সামনে প্রসারিত সেই অচঞ্চল দৃষ্টি।

গাড়ী এসে এক বিরাট প্রাসাদ তুল্য বাড়ীর ফটকে দাঁড়াল। বাড়ী দেখে মাহমুদ চমকে উঠল। এ যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং ইসরাইলী রাষ্ট্রের অন্যতম কর্ণধার ডেভিড বেনগুরিয়ানের বাড়ী। মেয়েটি সাম্পর্কে মাহমুদের মনে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হল। মুহুর্তের জন্য মেয়েটির দিকে মাহমুদ তার চোখ দু’টি তুলে ধরল। মেয়েটি কি তাহলে ডেভিড বেনগুরিয়ানের কেউ? সরকারী মহলে সম্মানিতা হবার কারণ তাহলে কি এইটিই? মাহমুদকে তাকাতে দেখে মেয়েটি বলল, বাড়ী এসে গেছি?

বাড়ীর ফটক খুলে গেল। মাহমুদ কিছু বলার আগেই ছুটে গিয়ে গাড়ী বারান্দায় দাঁড়াল।

মেয়েটি গাড়ী থেকে নেমেই গাড়ীর পাশ ঘুরে এসে দরজা খুলে দিল।

মাহমুদ গাড়ী থেকে বেরিয়ে মেয়েটির দিকে আর এক পলক তাকিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, এবার আসি।

মাহমুদ যাবার উদ্যোগ করতেই মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, দয়া করে একটু বসবেন, অন্ততঃ এক কাপ চা খাবেন চলুন। আমার জরুরী কাজ আছে, ক্ষমা করুন আমাকে। বলল মাহমুদ।

মেয়েটি এক মুহূর্ত থামল। তারপর ধীরে গম্ভির কন্ঠে বলল, আপনি যে উপকার আমার করেছেন সে ঋণ অপরিশোধ্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের … মাহমুদ বাধা দিয়ে বলল, মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব, তার বেশিকিছু আমি করিনি। বলেই মাহমুদ গেটের দিকে পা বাড়াল।

– শুনুন, আপনার পরিচয় দয়া করে কি বলবেন? মেয়েটির কন্ঠে এবার অনুনয়ের সুর।

মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আমরা সামান্য ব্যক্তি, দিবার মত কোন পরিচয় আমাদের নেই। তবে বেঁচে থাকলে দেখা হবে, এখন আসি।

ডেভিড বেনগুরিয়ানের গেট পেরুবার আগেই মাহমুদ একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১ টা। মাহমুদের মন আনচান করে উঠল। কিছুক্ষণ আগের পাওয়া চিঠিটি তার এখনও পড়া হয়নি। জরুরী কোন সংবাদ বা নির্দেশ তাতে থাকতে পারে। চলতে চলতেই মাহমুদ বাম পকেট থেকে চিঠিটি বের করে একবার তাতে চোখ বলাল। সাইমুমের সাংকেতিক অহ্মরে লেখাঃ

“আগামী সতের তারিখে ওসেয়ান কিং জাহাজে ইসরাইলের জন্য ইউরেনিয়াম, হেভিওয়াটার ও অন্যান্য আনবিক গবেষণার বহু মূল্যবান মাল মসলা আসছে। জাহাজটি রাত নয়টায় জাফা বন্দরে ভিড়বে। রাত এগারটায় জাহাজে প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান।’’

চিঠি পড়ে মাহমুদ মনে মনে তারিখ গুনল। আজ পনের তারিখ, হাতে সময় মাত্র দু’দিন। মাহমুদ গেটে আসতেই গেটম্যান গেট খুলে দিয়ে স্যালুট করে দাঁড়াল।

 

Top