১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল আহমদ মুসার। ঘুম ভাঙলেই সে বুঝতে পারল অসময়ে তার ঘুম ভেঙেছে। কেন? উৎকর্ণ হয়ে উঠলো সে।
অস্পষ্ট একটা ধাতব শব্দ। শুনেই বুঝতে পারল দরজার তালা খোলার চেষ্টা হচ্ছে।
আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা। ঘরে শত্রুর হানা। সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রীতে আগুন ধরে গেল আহমদ মুসার। তড়াক করে উঠে বসল সে।
পাশের খাটেই হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা বালিশের তলা থেকে রিভলভার দু’টি নিয়ে লাফ দিয়ে হাসান সেনজিকের খাটে গিয়ে পড়ল।
হাসান সেনজিকের গায়ে হাত দিতেই হাসান সেনজিক উঠে বসল ভীষণভাবে চমকে উঠে।
আহমদ মুসা দ্রুত কানে কানে বলল, তাড়াতাড়ি আলমারির আড়ালে দাঁড়াও।
বলেই আহমদ মুসা বিড়ালের মত নিঃশব্দে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল দরজায়।
ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আহমদ মুসা দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
দরজার তালা খোলার ধাতব শব্দ তখন বন্ধ হয়ে গেছে।
দরজা খুলে গেছে বলে আহমদ মুসা মনে করল।
আহমদ মুসা একটা হাত আলতোভাবে দরজার গায়ে রেখেছিল। সে অনুভব করল দরজা তার হাতের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। অর্থাৎ দরজা খুলে যাচ্ছে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাথে সাথে আহমদ মুসাও সরে এল। দরজা ঠেলে দু’টি ছায়ামুর্তি ঘরে প্রবেশ করল।
ওদেরকে মনে হল চলন্ত জমাট অন্ধকার। দু’টি দেহের মাঝখানে ব্যবধান একহাতও নয়। আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে আছে দরজার আড়ালে দরজার মুখেই। আহমদ মুসা থেকে ওদের ব্যবধানও একহাতের বেশী নয়।
আহমদ মুসা ডান হাতের রিভলভারটি বাম হাতে নিয়ে এবং বাম হাতের রড ডান হাতে তুলে নিল।
রডটি এক ফুট লম্বা। ষ্টিলের রড, রূপোর নিকেল করা। বেশ ভারী। রডের মুখে একটা ক্যাপ আছে। ক্যাপ খুলে গোড়ায় চাপ দিলে ক্লিক করে দুধারী ছুরির ফলা বেরিয়ে আসে। তেমনি আরেকটা চাপ দিলে ভেতরে ঢুকে যায়। সুন্দর রড-ষ্টিকটি গতকাল মাজুভ আহমদ মুসাকে উপহার দিয়েছে। রডটি আলমারীর উপর রাখা ছিল।
আহমদ মুসা রড-ষ্টিকটি ডান হাতে নিয়ে অন্ধকারে খুব হিসেব করে পেছনের লোকটির ঘাড় লক্ষ্যে আঘাত করল।
‘কোঁৎ’ করে একটা শব্দ উঠল লোকটির মুখ দিয়ে। তারপর ঢলে পড়ে গেল মেঝের উপর। সামনের লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরছিল।
আহমদ মুসা প্রথম আঘাত করেই এক পা এগিয়ে দ্বিতীয় আঘাত করল সামনের লোকটিকে। এই আঘাত সে করেছিল ঘুরে দাঁড়ানো লোকটির কাঁধ ও কানের মাঝখানে। প্রায় কেজি ওজনের রড থেকে প্রচন্ড গতির আঘাত। এ লোকটি মুখ দিয়ে কোঁৎ করে একটা শব্দ তুলে ঢলে পড়ে গেল মেঝেতে।
আঘাত করেই আহমদ মুসা পেছনে সরে এসেছিল দরজার আড়ালে। আহমদ মুসার বিশ্বাস, দু’জন ঘরে ঢুকেছে নিশ্চয় পেছনে আরও কেউ আছে।
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। আহমদ মুসা দরজার আড়ালে সরে আসতে না আসতেই আধ খোলা দরজা থেকে ঘরের মধ্যে টর্চের আলো ছুটে এল এবং সেই সাথে ষ্টেনগানের এক পশলা গুলি।
গুলি করতে করতে ওরা ঘরে ঢুকছিল। আহমদ মুসা তৈরি হয়েছিল। ওরা ঘরে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজা প্রচন্ড বেগে ঠেলে দিল চৌকাঠের দিকে।
মুহূর্তে টর্চের আলো নিভে গেল। গুলিও বন্ধ হয়ে গেল। মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া কয়েকটা শব্দও শোনা গেল।
আহমদ মুসার হাতের কাছেই সুইচ ছিল। আলো জ্বালিয়ে দিয়ে রিভালভার বাগিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে। দু’জন ঘরে ঢুকছিল। দরজার প্রচন্ড বাড়ি খেয়ে দু’জনই তখন মেঝে লুটোপুটি খাচ্ছিল। একজনের কপাল এবং আরেকজনের মাথার পেছন দিকটা ফেটে গেছে। পায়েও ওদের সম্ভবত আঘাত লেগেছিল। ওরা উঠে দাঁড়াতে পারছিল না।
আহমদ মুসা ওদের সামনে দাঁড়াতেই ওরা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল। একজনের মুখ রক্তে ভেজা। কপালের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। আরেকজনের পিঠ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, ফেটে যাওয়া মাথার রক্তে। ওরা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়ে ওরা দু’জনেই পকেট থেকে রিভালভার বের করল।
আহমদ মুসা ওদেরকে আর গুলি করার সুযোগ দিল না। পর পর দু’টি গুলি বেরুল আহমদ মুসার রিভলভার থেকে। বসা লোক দু’টি লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। আহমদ মুসা গুলি করে জুতো পরে নিল। তার মনে তখন একটা উৎকট আশংকা উঁকি দিল, আজকের টার্গেট তো শুধু হাসান সেনজিক নয়, মাজুভও। গতকাল কসভোতে অনেকেই মাজুভকে হাসান সেনজিকের সাথে দেখেছে।
জুতা পরতে পরতে আহমদ মুসা হাসান সেনজিককে বলল, তুমি এস, মাজুভের কি হল দেখি।
বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বের হতেই বাড়ির লনে কান্না শুনতে পেল। আহমদ মুসার বুঝতে কষ্ট হলো না ওটা নাতাশার কান্না।
আহমদ মুসা মাজুভের ঘরের দিকে না ছুটে, ছুটল লনের দিকে। কিন্তু কয়েক ধাপ এগুবার পরেই সামনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। একাধিক লোক ছুটে আসছে এদিকে। আহমদ মুসা দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল।
ওরা দু’জন। টর্চ জ্বেলে ছুটে আসছে। ছুটে আসছে আর চিৎকার করছে, টিটো তোদের এত দেরি কেন, কোথায় তোরা।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করতে চাইল না। মাজুভের চিন্তা তাকে চঞ্চল করে তুলেছে।
আবার আহমদ মুসার রিভলভার থেকে পর পর দু’টি গুলি বেরিয়ে এল। ওরা দু’জন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল করিডোরে।
এই সময় হাসান সেনজিক এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়ালো।
আহমদ মুসা করিডোরে ছিটকে পড়া ওদের দু’টি রিভলভার কুড়িয়ে নিয়ে ছুটল লনের দিকে।
লনে দু’টি জীপ দাঁড়িয়েছিল।
সামনের জীপটির পাশে নাতাশা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিল।
আহমদ মুসা ছুটে নেমে এসেছিল লনে। কিন্তু লনে নেমেই তার খেয়াল হল সে ধরা পড়ে গেছে। লনটি আলোকজ্জ্বল।
খেয়াল হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাটিতে শুয়ে পড়ল। আর সে সময়ই একটা রিভবারের গুলি ছুটে গেল তার মাথার উপর দিয়ে।
হাসান সেনজিক তখনও লনে নামেনি।
আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়েই দ্বিতীয় জীপটির আড়ালে গিয়ে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়েই সামনের জীপ ষ্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনতে পেল। আহমদ মুসা বুঝতে পারল, মাজুভকে নিয়ে ওরা পালাচ্ছে।
চিৎকার করে কেঁদে উঠল নাতাশা।
আহমদ মুসা দ্রুত দ্বিতীয় জীপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামনের জীপটি তখন গেটের কাছাকাছি চলে গেছে।
হাসান সেনজিকও তখন আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসার কাছে ছুটে এল নাতাশাও।
আহমদ মুসা দ্রুত হাসান সেনজিককে গাড়ীতে উঠতে নির্দেশ দিয়ে নাতাশাকে বলল, কেঁদোনা বোন, আমরা ইনশা-আল্লাহ মাজুভকে নিয়ে ফিরে আসব।
বলে আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। হাসান সেনজিক তার পাশের সিটে উঠে বসেছে।
নাতাশা কেঁদে উঠে বলল, আমিও যাব, আমিও রিভলভার চালাতে জানি।
আহমদ মুসা নাতাশার দিকে একবার চেয়ে বলল, ঠিক আছে বোন, উঠ। নাতাশা উঠে বসল পেছনের সিটে। ষ্টার্ট নিল জীপ।
সামনের জীপটি তখন গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়েছে।
আহমদ মুসার জীপ লাফিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করল।
আহমদ মুসার জীপ যখন রাস্তায় এসে পড়ল সামনের জীপটি তখন দু’শ গজ সামনে।
রাত তিনটার জনমানবহীন রাস্তা।
আহমদ মুসার স্পিডোমিটারের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
তীরের মত ছুটে চলেছে আহমদ মুসার জীপ।
সামনের জীপটিও সমান স্পিডে চলছে। এরাস্তা ওরাস্তা ঘুরে শেষ পর্যন্ত সামনের জীপটি বেলগ্রেড হাইওয়েতে এসে উঠল। তারপর ছুটল বেলগ্রেডের দিকে।
আহমদ মুসা ভাবল, সামনের জীপটির লক্ষ্য কি বেলগ্রেড, না কোন উপায় না দেখে এই পথই বেছে নিয়েছে?
বেলগ্রেড হাইওয়ে সুপ্রশস্ত ও সরল রাস্তা। এ হাইওয়েতে উঠে আহমদ মুসা ফুলস্পীড দিল জীপে।
নতুন জীপ। খুশি হলো আহমদ মুসা। গতির প্রেসারে থর থর করে কাঁপছে গোটা জীপ।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, দুই জীপের মাঝে ব্যবধান একটু একটু করে কমছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবধান একশ’ গজের মধ্যে চলে এল।
প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর ব্যবধান ৫০ গজে নেমে এল। আহমদ মুসা বলল, নাতাশা হাসান সেনজিক তোমরা সিটের উপর শুয়ে পড়। ওরা কাছাকাছি এসে গেছে, সামনে থেকে গুলি করতে পারে।
আরও কিছুক্ষণ চলার পর ব্যবধান আরও কমে প্রায় ২০ গজের মধ্যে চলে এল।
আহমদ মুসা রিভলভার তুলে নিল হাতে।
আহমদ মুসা আশ্চর্য হলো, এত কাছে আসার পরেও ওপক্ষ থেকে কোন গুলি আসছে না কেন? ষ্টেনগান, সাব-মেশিন গানের আওতায় তারা তো এসেই গেছে। হতে পারে আহমদ মুসার গাড়ির হেডলাইট নেভানো থাকার কারনে তাদের সঠিক অবস্থান তারা জানতে পারছে না। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে একটু খেয়াল করলেই এ অবস্থান ঠিক করা সম্ভব। আহমদ মুসা আরও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ব্যবধান আরও কমিয়ে গাড়ির হেডলাইট অন করে দিয়েই টার্গেটকে ভালো করে দেখে নিয়ে পরপর তিনটি গুলি করল।
একটি গুলি গিয়ে পেছনের ডান টায়ারে বিদ্ধ হলো। গাড়িটি প্রবল ঝাকুনি খেয়ে কিছুদুর এঁকে বেঁকে এগিয়ে থেমে গেল। থামার সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক ড্রাইভিং সিট থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড় দিল।
আহমদ মুসার জীপ ততক্ষণে সামনের জীপের সমান্তরালে এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসার রিভলভার তৈরিই ছিল। লোকটির আর পলানো হলোনা। গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়।
আহমদ মুসা গাড়ি থামাল।
আহমদ মুসার গাড়ি থামতেই ওই জীপ থেকে একটা কন্ঠ চিৎকার করে উঠল ‘মুসা ভাই, একজনকে এখানে ধরে রেখেছি, আসুন।’
সবাই চিনতে পারল মাজুভের গলা।
আহমদ মুসা, হাসান সেনজিক গাড়ি থেকে ছুটল সেদিকে।
নাতাশাও নামল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে জীপের পাশে দাঁড়াল।
মাজুভ একজনকে গাড়ির মেঝেতে ফেলে হাত দু’টিকে পিছমোড়া করে ধরে রেখেছিল।
-এভাবে একে ধরে রেখেছ কেন? এর ‘সদগতি’ করে ড্রাইভিং সিটের ওকেতো কাবু করতে পারতে।
-একে আপনার জন্যে রেখেছি। আপনি একে ছেড়ে দিয়েছিলেন তো, তাই আমি একে মারলাম না।
-অর্থাত ব্রীজের সেই দু’জনের একজন?
-হ্যাঁ মুসা ভাই।
-তুমি নেমে এস মাজুভ, আমি ওকে দেখি।
মাজুভ নেমে এল জীপ থেকে।
যুবকটি গাড়ির মেঝেতেই উঠে বসল।
আহমদ মুসা ওকে নেমে আসতে বলল।
মুহূর্ত দেরি না করে সুবোধ বালকের মত নেমে এল যুবকটি। তার মুখ ফ্যাকাশে, কাঁপছিল।
-তুমি যে আবার? আহমদ মুসা পিস্তল নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
-আমি আসতে চাইনি, ওরা আমাকে জোর করে এনেছে। বলল যুবকটি।
-বানানো কথা।
-দোহাই স্যার, বানানো নয়, না আসতে চাইলে আমার ভাইকে ওরা আমার সামনে হত্যা করেছে, পরে আমি আর আপত্তি করতে সাহস পাইনি।
-যেভাবেই হোক, তুমি অভিযানে যোগ দিয়েছ, মাজুভকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলে।
-স্যার, বিশ্বাস করুন। আমি সাথে ছিলাম, কিন্তু কিছুই করিনি। ঐ স্যারকে জিজ্ঞাসা করুন, ওকে ধরে রেখেছিলাম, কিন্তু পকেট থেকে আমি পিস্তলটাও বের করিনি। বলে যুবকটি পকেট থেকে পিস্তল বের করে দেখাল।
আহমদ মুসা হেসে উঠল।
-ও ঠিকই বলেছে, ওকে কাবু করতে গিয়ে দেখলাম ও আমাকে তেমন বাধা দিলনা। পিস্তল ও বের করেনি। বলল মাজুভ।
-ড্রাইভারকে কাবু করতে এগুলে না কেন? বলল আহমদ মুসা।
-গেলাম না কারণ ও ব্যাটা দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে, যে জোরে গাড়ী চলছিল। আর দেখলাম, আপনি যখন আসছেন তখন আর ঝুকি নেবার প্রয়োজন নেই।
আহমদ মুসা এবার যুবকটির দিকে মনোযোগ দিলে যুবকটি বলল, আমাকে মেরে ফেলুন স্যার, না হলে ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিয়ে মারবে।
-কেন? বলল আহমদ মুসা।
-সেদিনও আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন, আজ ওরা সবাই মরেছে, আমি যদি না মরি তাহলে বলবে, আমার কোন যোগ-সাজস আছে। বলে যুবকটি আহমদ মুসার হাতে পিস্তল তুলে দিল।
আহমদ মুসা পিস্তল হাতে নিয়ে বলল, তুমি বাড়িতে পালিয়ে যাও।
-না স্যার, যেখানেই যাই, সেখান থেকে ওরা ধরে আনবে, ওদের হাত থেকে নিস্তার নেই। ওদের বাধা দেবার কেউ নেই। শুধু আপনাদেরই ভয় করে ওরা।
-ভয় করলে ওভাবে আমাদের বাড়িতে হানা দিতে সাহস করতো?
-ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইয়েলেস্কু ও জর্জের মৃত্যু ওদের পাগল করে তুলেছে। বহু হিসেব-নিকেশ করে সার্ভিয়া প্রদেশের মিলেশ বাহিনীর কমান্ডার, যিনি দলের দু’নম্বর ব্যক্তি, জারজেস জিবেঙ্কুর নেতৃত্বে আজকের হামলা চালানো হয়েছিল। মুখোশ পরা সেই লোকটিই জারজেস জিবেঙ্কু।
জারজেস জিবেঙ্কুর নাম শুনে চমকে উঠল মাজুভ।
এ এক সাক্ষাত রক্তপায়ী শয়তান। ইয়েলেস্কু ও জর্জরা হুকুম পেলে হত্যা করত, কিন্তু জেবেঙ্কুর কোন নির্দেশের প্রয়োজন হয়না। কত হাজার লোক যে তার হাতে নিহত হয়েছে, সে হিসেব কেউ দিতে পারবে না। মিলেশ বাহিনীর সবাই তাকে ‘কিলার মেশিন’ বলে ডাকে। বলা হয়, সে দলে প্রভাবশালী হবার পর থেকেই মুসলিম বিরোধী হত্যাকান্ড গণরূপ নিয়েছে। মাজুভ জারজেস জিবেঙ্কুর নাম শুনে যতটা চমকে উঠেছিল, ততটাই মনে মনে হালকা অনুভব করল। বলল সে, ওকে আমি চিনতে পারিনি, গোটা অভিযানে একটা কথাও সে বলেনি।
-সে আপনার উপর সাংঘাতিক ক্ষিপ্ত। এ কারনে আপনাকে ধরার জন্যে সে নিজেই গেছে। বলল যুবকটি।
-জানি, দলত্যাগীদের সে গায়ের চামড়া খুলে মারে। ও এক জীবন্ত নরক। নাতাশা এত কেঁদেছে একটা কথাও সে বলেনি।
-আপনি জানেন না, ওদের পরিকল্পনা ছিল নাতাশাকেও নিয়ে আসা। সে আগেই বলে দিয়েছিল, নাতাশার যেন কেউ ক্ষতি না করে, নাতাশাকে সে তার জন্যে অক্ষত নিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলোনা, তড়িঘড়ি করে তাকে পালাতে হলো।
মাজুভ ও নাতাশা দু’জনেই শিউরে উঠল। বিশ্বাস করল তারা, জিবেঙ্কু এই চরিত্রেরই লোক।
মাজুভ আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ধন্যবাদ মুসা ভাই, শয়তানদের ষড়যন্ত্র আপনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। ওরা ক’জন ছিল, ক’জন মরেছে।
-ওরা ছিল আটজন। দু’জন আমাদের ঘরে সটান হয়ে আছে। দু’জন আমাদের দরজায় এবং আরও দু’জন করিডোরে মরে পড়ে আছে। একজন এখানে মরল।
-তাহলে এখন এই যুবকটির কি হবে? বলল মাজুভ।
আহমদ মুসা যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?
-জাকুব। বলল যুবকটি।
-তুমি কি ইহুদি?
-না।
-কিন্তু কোন খৃষ্টানের নাম তো জাকুব অর্থাৎ ইয়াকুব হয় না? ইহুদি অথবা মুসলমানরা এ ধরনের নাম রাখে।
যুবক কোন উত্তর দিলনা। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ নিরব থাকল। তারপর একবার মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে চাইল।
-তুমি কিছু গোপন করতে চাইছ।
-ঠিক আছে গোপন করব আর কোন ভয়ে? আমি তো বাঁচতেই চাই না।
বলে যুবকটি একটু নিরব হলো, তারপর বলল, আমার দাদা পর্যন্ত সবাই মুসলমান ছিলেন। আমার আব্বা একজন খৃষ্টান মেয়েকে বিয়ে করেন এবং আমি যখন কোলে সেই সময় আমার আব্বা, চাচারা সবাই খৃষ্টান হয়ে যান। আমাদের বাড়ি বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর রিকায়। খৃষ্টান না হলে আমার আব্বা-চাচাদের রিকা ছাড়তে হতো। রিকা তখন প্রায় মুসলিম মুক্ত শহর। তাই খৃষ্টান হয়ে তারা রিকায় থাকা পছন্দ করেন। আমার জাকুব নাম আমার দাদা রেখেছিলেন। আমার জন্মের পরেই তিনি মারা যান।
-তোমার এ পরিচয় তুমি গোপন করেছিলে কেন?
-ছোট বেলা থেকেই আব্বার নিষেধ, কোন মুসলমানের কাছে এ কথা প্রকাশ যেন আমরা না করি। মুসলমানদের কাছে ধর্মত্যাগ নাকি ভয়ানক অপরাধ। মৃত্যুদন্ড নাকি এর শাস্তি।
-ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র সত্যপথ, শান্তির পথ। মানুষ সত্য ও শান্তির পথ থেকে মুখ-ফিরাক, স্রষ্টা তা চান না বলেই এই কঠোরতা। এই কঠোরতা মানুষের মঙ্গলের জন্যেই।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, তা ইসলাম ত্যাগ করে তোমাদের পরিবার কেমন আছে?
-স্যার, আমরা এখন না খৃষ্টান, না মুসলমান, আমরা গীর্জাতেও যাই না, মসজিদেও যাই না। কিন্তু সত্য বলছি, মসজিদের দিকেই আমার আব্বার টান বেশি। মনে পড়ে একবার আমি এবং আব্বা মাগরেব শহরের একটা মসজিদের ধার দিয়ে যাচ্ছিলাম। মসজিদের দরজা খোলা ছিল। একটা কুকুর ঢুকছিল দরজা দিয়ে। আব্বা ছুটে গিয়ে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিয়ে মসজিদের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, কুকুর মসজিদে ঢুকতে নেই, কুকুর নাপাক। আবার একটা ঘটনা মনে পড়ে। ঘটনাটা ঘটেছিল জার্মানিতে। সূর্য ডোবার সময় আমরা হাটছিলাম এক মসজিদের পাশ দিয়ে। এই সময় আজান শুরু হলো। আব্বা সংঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালেন। মাথা নিচু করে গোটা আজান শুনলেন। আজান শেষ হলে তিনি যখন মুখ তুললেন, তখন মনে হলো তার চোখের কোণ ভিজা। মিলেশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছি বাধা দেয়ার সাধ্য তার ছিলনা। কিন্তু খুব ব্যাথা পেলেন তিনি, যেদিন খবরটি প্রথম শুনলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন তোমার দাদা এবং পূর্বপুরুষ মুসলমান ছিল মনে রেখো বাছা। আব্বার কথা আমি মনে রেখেছি, মুসলমান কাউকে বাঁচাতে হয়তো পারিনি, কিন্তু কোন মুসলমানের কোন ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি।
-ধন্যবাদ জাকুব। তুমি জান আমরা কে?
-জানি। আপনি আহমদ মুসা এবং সাথে ষ্টিফেন পরিবারের হাসান সেনজিক।
-আমি আহমদ মুসা একথা কে বলল?
-কেউ বলেনি। মিলেশ বাহিনী আগে বুঝতে পারেনি আপনি কে। কিন্তু এখন তারা নিশ্চিত আপনি আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ নন।
-তুমি আমাদের সাথে থাকতে চাও?
-ওখানে গিয়ে মরার চেয়ে এখানে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ভাল মনে করি কিন্তু আমি যে খৃষ্টান?
-তোমাকে মুসলমান হতে হবে এ শর্ত তো আমরা আরোপ করিনি জাকুব?
-আমি মুসলমান হতে পারবো?
-এ দরজা সকলের জন্য সব সময় খোলা। আর তোমরা তো অবস্থার শিকার ছিলে।
জাকুবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
আহমদ মুসা মাজুভকে বলল, চল এখন আমরা প্রিষ্টিনায় ফিরে যাই। ওদিকটা একবার দেখে সকালেই আমরা বেলগ্রেড যাত্রা করব।
মাজুভ মাথা নেড়ে সাঁয় দিল।
সামনের জীপে উঠল আহমদ মুসা। এ জীপের পিছনের দু’টি সিটে বসল হাসান সেনজিক এবং জাকুব, আর পিছনের জীপে উঠল মাজুভ এবং নাতাশা। তারা দু’জন পাশাপাশি সিটে।
জীপ দু’টি প্রিষ্টিনার দিকে ছুটতে শুরু করল। প্রিষ্টিনার কাছাকাছি চলে এসেছে তাদের গাড়ি। আর পাঁচ কিলোমিটারের মত গেলেই শহরের উপকন্ঠে পৌঁছা যাবে। এই সময় আহমদ মুসাদের জীপের সামনে দ্রুত ছুটে আসা দু’টো গাড়ির চারটি হেডলাইটের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আহমদ মুসাদের জীপ এবং এগিয়ে আসা গাড়ি দু’টি কাছাকাছি এসে পড়ল। আহমদ মুসা ওদের সাইড দেবার জন্যে রাস্তার বাম পাশ বরাবর চলতে শুরু করল। আহমদ মুসার জীপ ওদের হেডলাইটের আওতায় এসে গেছে।
ওদের সামনের গাড়িটার হেডলাইটের আলো একবার আহমদ মুসার জীপে এসে পড়ল। তার পর মূহুর্তের জন্যে সরে গেল। তারপর পুনরায় তা ফিরে এসে আহমদ মুসার উপর স্থির হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বিরক্ত হলো এভাবে আলো ফেলা আইন সিদ্ধ নয়।
হেডলাইটের সেই আলোটি আহমদ মুসার জীপের উপর থেকে আর সরল না, বরং আলোটা কয়েক বার নিভিয়ে জ্বালিয়ে এবং কয়েকবার হর্ণ বাজিয়ে সামনের গাড়িটি রাস্তার বাম পাশে সরে এসে বলা যায় আহমদ মুসার গাড়ির পথ রোধ করে দাঁড়াল।
এই সময় পেছন থেকে জাকুব প্রায় আর্তস্বরে বলল, সামনের গাড়ি দু’টি মিলেশ বাহিনীর।
কেমন করে বুঝলে? বলল আহমদ মুসা।
হর্ণ আর আলোর সংকেতে বুঝেছি। মিলেশ বাহিনীর কোডে ওরা সংকেত দিয়েছে।
এতক্ষণে আহমদ মুসার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ওরা হেডলাইটের আলোতে জীপের নাম্বার দেখেই চিনতে পেরেছে এ জীপ দু’টি মিলেশ বাহিনীর। তারপর জীপে মিলেশ বাহিনীর লোক আছে কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্যেই ওরা আলো ও শব্দের সংকেত দিয়েছে। উত্তর না পেয়েই তারা ধরে নিয়েছে এ জীপগুলো শত্রুর দখলে।
আহমদ মুসার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে সে যখন রিভলবার তুলেছে সামনের গাড়ির হেডলাইটে গুলি করার জন্যে, সেই সময় সামনের গাড়ি থেকে ছুটে এলো বৃষ্টির মত মেশিন গানের গুলি।
‘জীপের মেঝেতে শুয়ে পড় হাসান সেনজিক তোমরা,’ বলে আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল সিটের নিচে।
গুলির শুরুতেই গাড়ির উইন্ডশিল্ড উড়ে গেল। টুকরো টুকরো কাঁচ এসে পড়ল আহমদ মুসার গায়ের উপর। দুই সিটের ফাঁকে গিয়ারের কাছে সে একটা তোয়ালে পেল। তোয়ালেটা মাথার উপর চাপাল সে। সামনের গাড়ির হেডলাইটের আলোতে জীপ এবং এর দু’পাশ আলোকিত। আহমদ মুসা মাথা তুলে দেখল ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গাড়ি থেকে নামা সম্ভব নয়। একমাত্র বিকল্প হিসেবে গাড়ি কোনভাবে সামনে এগিয়ে নেবার জন্যে ড্রাইভিং প্যানেলের দিকে চোখ ফেরাতে যাবে এমন সময় তার চোখের সামনে মাত্র ফুট দেড়েক দূরে একটি গোলাকার পিন্ড এসে পড়ল। পিন্ডটি আহমদ মুসার চোখে পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে সে তোয়ালেই মুখগুজে তোয়ালে দিয়ে নাক চেপে ধরল প্রচন্ড ভাবে।
পড়েই পিন্ডটি শব্দ করে ফেটে গেলে। ফেটে যাবার সংগে সংগে তুলোর মত সাদা গ্যাস বাতাসের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
পিন্ডটি আহমদ মুসার চোখে পড়তেই বুঝতে পেরেছিল ওটা ক্লোরোফরম বোমা। মানুষকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সেন্সলেস করার অত্যন্ত কার্যকরী অস্ত্র। বিস্ফোরিত হবার পর কার্যকরী মাত্র ৩০ সেকেন্ড। কিন্তু এই ত্রিশ সেকেন্ডের ক্রিয়া মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা। যদি জ্ঞান ফেরানোর কোন ব্যবস্থা না করা হয়।
প্রথম বোমা বিস্ফোরিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আরও চারটি ক্লোরোফরম বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল পেছনের জীপ সহ দু’টি জীপে।
আহমদ মুসা প্রায় দেড়মিনিট নাক বন্ধ করেছিল। এর পরেও তার সন্দেহ হচ্ছিল তার জ্ঞান আছে কিনা। সে পা নেড়ে দেখছিল, না তার জ্ঞান ঠিক আছে।
দেড়মিনিট পর আহমদ মুসা নিশ্বাস নিল। পরিষ্কার বাতাস, শুধু বারুদের গন্ধ, গ্যাস বোমার সম্মোহনকারী মিষ্টি গন্ধ আর নেই।
গুলি তখন বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বুঝল, ওরা নিশ্চিত হয়ে গেছে জ্ঞান আর কারো অবশিষ্ট নেই। সেই সাথে সে বুঝল, এখন ওরা আসবে। এই সময় পায়ের শব্দ পেল জীপের সামনে। কে যেন কথা বলে উঠল, ওদেরকে মাইক্রোবাসে তুলে নাও। আর তোমরা জীপে উঠ।
যে কন্ঠটি কথা বলছিল, সে কথা বলতে বলতেই জীপের দিকে আসছিল। পদশব্দে মনে হল লোকটি তার জীপের দরজায় দাঁড়ল। দরজা খোলার শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা টর্চ জ্বলে উঠল। কে যেন তার মাথার চুল ধরে টেনে মুখ উপরে তুলল। আহমদ মুসা মরার মতই পড়ে ছিল।
এ সময় পিছনের জীপের দিক থেকে কে যেন ছুটে এসে বলল, স্যার ও জীপে মাজুভ এবং নাতাশা।
আহমদ মুসার মাথার চুল ধরে যে তুলেছিল, সে বলল, এখানে তিনজন। জাকুব বেঁচে আছে, জাকুব কে দেখছি হাসান সেনজিকের সাথে এখানে। আহমদ মুসার চুল ছেড়ে দিতে দিতে বলল, তাহলে এই লোকটিই তাহলে হবে সেই আহমদ মুসা। গাড়ি থেকে লোকটি নেমে গেল।
গাড়ি থেকে লোকটি নেমে যাবার পর কয়েকটি পায়ের শব্দ এগিয়ে এল। তিনজন লোক। তারা আহমদ মুসাদের ধরা ধরি করে নামিয়ে নিয়ে চলল ওদের মাইক্রোবাসের দিকে।
আহমদ মুসাদের চার জনকে মাইক্রোবাসে তুলে দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। বাইরে দরজায় চাবি লাগানোর শব্দও আহমদ মুসা শুনল।
আহমদ মুসা মনে মনে খুশী হলো এই ভেবে যে, জাকুবকে তাহলে ওরা অবিশ্বাস করেনি।
অল্পক্ষণ পরেই গাড়ী নড়ে উঠল। চলতে শুরু করল গাড়ী।
আহমদ মুসা খেয়াল করল গাড়ী তার দিক পরিবর্তন করল না। অর্থাৎ তারা বেলগ্রেডের দিকে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে দেখল, রাত সাড়ে চারটা। খুশি হলো ঘড়ি তারা নেয়নি। পকেট থেকে দু’টো রিভলভার ও ছুরিটাই শুধু নিয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রিয় লেসার পিস্তলটা রয়ে গেছে উরুর সাথে টেপ দিয়ে সেঁটে রাখা।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভিং কেবিনে দু’জন আরোহী। একজন ড্রাইভার এবং তার পাশে একজন। পাশের জনের হাতে ষ্টেনগান। সে বলা যায় পেছন ফিরে অর্থাৎ আহমদ মুসাদের দিকে তাকিয়েই বসে আছে।
ভোর ৬টার দিকে আহমদ মুসাদের নিয়ে চারটি গাড়ির বহর কোকা শহরে পৌঁছল। কোকা প্রিষ্টিনার চেয়ে বড় শহর নয়। কোকার পরের শহরটিই বেলগ্রেড।
কোকা শহরের বেলগ্রেড হাইওয়ের উপরেই একটা বিরাট ত্রিতল বাড়ীর গেট দিয়ে প্রবেশ করল গাড়ির বহরটি। দাঁড়াল বিরাট বাড়ির প্রশস্ত গাড়ি বারান্দায়। থামল গাড়ি।
আহমদ মুসা আবার আগের মতই মরার মত গা এলিয়ে দিল চোখ বন্ধ করে।
রাত এখনও দেড় ঘন্টা বাকি।
সব গাড়ি দাঁড়ালে আবার সেই কন্ঠ শোনা গেল, যে কন্ঠকে আগে একবার নির্দেশ দিতে শুনেছিল আহমদ মুসা।
ভারি গলায় লোকটি এবার নির্দেশ দিল, এদেরকে নিয়ে নিচের মাল খানায় রাখ। সকালে সবাই আমরা বসব, তখন ওদের ওখানে নিয়ে জ্ঞান ফিরালেই হবে, সবাই মজাটা দেখবে। আর জাকুবকে নিয়ে ওর জ্ঞান ফেরাও, ওর কাছ থেকে কথা শুনতে হবে।
পদ শব্দে মনে হলো লোকটি কথা বলেই গট গট করে চলে গেল।
আহমদ মুসাদেরকে মালের বস্তার মত টেনে টেনেই গাড়ি থেকে নামানো হল। তারপর ওদেরকে টেনে হেচড়ে নিয়ে চলল করিডোর দিয়ে। নাতাশাকে যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সে এক শিষ দিয়ে বলে উঠল, খাসা মালরে।
আরেক জন বলে উঠল, চুপ বড় সাহেবদের এ সব মালে চোখ দিতে নেই।
অন্য একজন বলল, মাজুভ এবং এই নাতাশা দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আজ সকালে যা ঘটবে তা দেখার মত হবে। ঐ সুন্দর অঙ্গ দেখবি শকুনের মত সবাই খাবে।
এই ভবনটি কোকা শহরে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার। তিন তলা ভবনের মাটির তলায় একটি ঘর, এটাই মালখানা বা বন্দীখানা। খুব গুরুত্বপূর্ন কয়েদিদের এখানে রাখা হয়। এক তলার শেষ ঘরটির উত্তর দেয়ালে সুইচ বোর্ডে ‘O’ মার্কিং করা একটা সুইচ আছে, সেটা টিপলেই সুইচ বোর্ডের নিচেই মেঝের একটা অংশ সরে যায়। মেঝটা সরে গেলেই সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নামলেই মালখানা। ভেতর থেকে বের হবার জন্যেও অনুরূপ একটা সুইচ আছে। কিন্তু সে সুইচ টিপলে মেঝেটা সরে যায়না। সে সুইচ আসলে একটা কলিং বেল। সে কলিং বেল শুনে যে ঘরের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরের সিঁড়ি সে ঘরের প্রহরী গিয়ে সুইচ টিপে সিঁড়ির মুখ খুলে দেয়।
আহমদ মুসাদেরকে বন্দীখানার মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে যখন ওরা উঠে যাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা চোখ খুলল, ওরা কি করে বেরুচ্ছে তা দেখার জন্যে। আহমদ মুসা শব্দ শুনেই বুঝেছে তারা সকলে সিঁড়িতে নামার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির মুখ আবার বন্ধ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা দেখল, ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে একজন হাত বাড়িয়ে সবচেয়ে উপরের সিঁড়ির ডান প্রান্তে কিছু একটাতে চাপ দিল। তার কিছুক্ষণ পরেই খুলে গেল সিঁড়ির মুখ। ওরা বেরিয়ে গেল।
বন্ধ হয়ে গেল সিঁড়ির মুখ।
সিঁড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আহমদ মুসার চোখ ফিরে এল হাসান সেনজিক ও মাজুভদের দিকে। ওরা পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে।
স্বাভাবিকভাবে জ্ঞান ফিরতে ওদের আরও পাঁচ ছয় ঘন্টা দেরী। কিন্তু শয়তানরা ফিরে আসার আগে এদের জ্ঞান ফিরাতে না পারলে তাদের উদ্ধার কিঠন হয়ে পড়বে।
অজ্ঞান করার জন্যে যে ক্লোরোফরম বোমা ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারণ শ্রেণীর। খুব মারাত্মক নয়। শরীরের স্নায়ুগুলোকে উত্তেজিত ও অবস্থাগত একটা পরিবর্তন আনতে পারলেই স্নায়ুর অবসাদ কেটে গিয়ে জ্ঞান ফিরে আসবে। আহমদ মুসা ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলাল। ঘরের এক কোনে পানির বেসিন দেখে খুশি হলো। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখল, পানির কলে পানি আছে।
পানির বেসিনের পাশেই আহমদ মুসা ফুটখানেক লম্বা ইলেকট্রিকের তার পড়ে থাকতে দেখল। খুশি হলো আহমদ মুসা।
মেঝে থেকে, তার তুলে নিয়ে এর দুই প্রান্ত থেকে রবারের কভারিং খুলে মাথা দু’টিকে তীখ্ন করল।
পাশেই পড়েছিল নাতাশা। আহমদ মুসা হাতে করে গরম পানি নিয়ে নাতাশার মুখে ছিটিয়ে দিল। তারপর তার পায়ের কাছে বসে ইলেট্রিক তারের দুই মাথা একত্রিত করে নাতাশার পায়ের তালুতে আঁচড় কাটতে শুরু করল। মিনিট খানেক আঁচড় কাটার পর নাতাশার পা নড়ে উঠল।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা নাতাশার মুখে আরো একটু পানি ছিটিয়ে দিল। তারপর আরো এক মিনিট নাতাশার দু’পায়ে আঁচড় কাটার পর নাতাশা চোখ খুলল।
চোখ খুলেই নাতাশা উঠে বসল এবং মাজুভদের ঐ ভাবে পড়ে থাকতে দেখে কেঁদে উঠল বলল, আমরা কোথায়, এদের কি হয়েছে?
আহমদ মুসা উঠে পানির কলের দিকে যেতে যেতে বলল, আমরা মিলেশ বাহিনীর হাতে বন্দী। তোমার জ্ঞান ফিরল, ওদের জ্ঞান এখনও ফেরেনি।
বলে আহমদ মুসা হাত ভরে পানি নিয়ে এসে মাজুভের মুখে ছিটিয়ে দিল।
নাতাশা নিজের মুখে হাত দিয়ে দেখল তার মুখেও পানি এবং চুল ও কাপড় কিছু ভিজা।
আহমদ মুসা মাজুভের পায়ের কাছে বসে তার পায়ের তালুতে তারের দুই তীখ্ন মাথা দিয়ে আঁচড় কাটতে শুরু করল।
নাতাশাও তার পায়ের তালু দেখল। দেখল তার পায়ের তালু লাল হয়ে আছে এবং তার মধ্যে গভীর লাল অনেক আঁচড়। সব বুঝল নাতাশা। গভীর কৃতজ্ঞতায় তার দু’চোখের কোন ভিজে উঠল।
মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই মাজুভ জ্ঞান ফিরে পেল।
এরপরে হাসান সেনজিকের জ্ঞান ফিরে পাবার পর চারদিকে চেয়ে তাদের মুখে অন্ধকার নামল। তারা বুঝতে পারল, তারা সম্ভবত মিলেশ বাহিনীর হাতে বন্দী। কিন্তু কি করে বন্দী হলো তারা বুঝতে পারলো না।
নাতাশাই প্রথম কথা বলল, আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে সে জিঞ্জেস করল, আমরা কি করে বন্দী হলাম, কিভাবে জ্ঞান হারালাম? কি করে আপনার জ্ঞান ফিরল?
আহমদ মুসা বলল, আমি জ্ঞান হারাইনি। ওদের গুলি বর্ষনের সময় প্রথম ক্লোরোফরম বোমা এসে আমার সামনে পড়ে। আমি তোয়ালেই মুখ গুজে দেড় মিনিট নিশ্বাস বন্ধ করে রাখি। আমি জ্ঞান না হারালেও জ্ঞান হারানোর মত পড়ে থাকি আমাদের সবাইকে ওরা বন্দী করে আনে। আহমদ মুসা থামল।
সবাই নিরব।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। বলল, সকাল হলেই ওরা আমাদের নিয়ে যাবে। তারপর কি হবে আমি জানি না। আবার ওদের হাতে পড়ার আগে আমাদের সরতে হবে।
-যে লোক এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে সে স্বয়ং কনষ্টানটাইন। আমি ওর গলা শুনেই চিনেছি। বলল মাজুভ।
-ও যার গলা শুনেছি, সেই তাহলে কনষ্টানটাইন। এখানে আসার পর সর্বশেষ হুকুমটাও সেই দিয়েছে। বলেছে সকালে ওদের দরবারে আমাদের নিয়ে যেতে। ওখানেই মজা করে আমাদের জ্ঞান ফেরানো হবে। বলল আহমদ মুসা।
-জাকুব কোথায়?
-জাকুবকে সম্ভবত ওরা বিশ্বাস করেছে। ওরা হয়তো মনে করেছে আমরা ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম।
-আমরা কোথায় বেলগ্রেডে?
-না, দেড় ঘন্টায় কি বেলগ্রেড আসা যাবে?
-না, গাড়ি কি দেড় ঘন্টা চলেছে?
-হ্যাঁ, সাড়ে ৪টা থেকে ৬টা।
-তাহলে নিশ্চয় এটা ‘কোকা’ শহর হবে। এর পরের শহরই বেলগ্রেড। এখানে মিলেশ বাহিনীর ভাল অফিস আছে, এটাই সেই অফিস। আমি এ অফিসে এসেছি।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। মাথা নিচু করে ভাবছিল সে।
সবাই নিরব।
অনেক্ষণ পর আহমদ মুসা বলল, এখান থেকে ওরা বের হয়েছে কিভাবে আমি দেখেছি। এই সিঁড়িটার উপর একটা গোপন সুইচ আছে। ওটা টিপলে মেঝের একটা অংশ সরে যাবে। কিন্তু একটা সমস্যা সেটা হলো, উপরের ঘরের সুইচ টিপলে সঙ্গে সঙ্গেই মেঝেটা সরে গিয়ে সিঁড়ি পথ বের হয়েছিল। কিন্তু দেখলাম, সিঁড়ির সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটা সরে যায়নি। বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছে মেঝের অংশটা সরে গিয়ে দরজা বের হতে। আমার মনে হচ্ছে, সিঁড়ির সুইচটা টিপলে অন্য কোথাও খবর হয়, সেখান থেকে নির্দেশ দিলেই সম্ভবত সিঁড়ির মুখটা খুলে যায়। তাই যদি হয়, তাহলে এ সুইচ টেপার অর্থ হবে আমাদের সবার জ্ঞান ফিরেছে। সেক্ষেত্রে ওদের সন্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।
-তাহলে কি চিন্তা করছেন? বলল মাজুভ।
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিল না। অনেক্ষণ পর বলল, আমি ভাবছি ওদের জন্যে অপেক্ষা করাটাই স্বাভাবিক হবে। কি বল তোমরা?
মাজুভ বলল, আমাদের মত চেয়ে লজ্জা দেবেন না। আমি আগে ভাবতাম, আমি এ লাইনে যথেষ্ট বুদ্ধি ও দক্ষতা অর্জন করেছি। কিন্তু এখন আপনাকে দেখার পর আমার মনে হচ্ছে, শিশুত্বই আমার এখনও কাটেনি।
সাড়ে ছয়টার দিকে আহমদ মুসা তায়াম্মুম করে ফজরের নামায পড়ল। তার সাথে নামাজ পড়ল হাসান সেনজিক।
দীর্ঘ কেরায়াতের সাথে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে নামাজ পড়ল আহমদ মুসা। তার তেলাওয়াত অত্যন্ত মিষ্টি ও হৃদয়গ্রাহী। মনে হয় প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা অক্ষর যেন হৃদয়ের কোমল ছোঁয়া নিয়ে বের হয়ে আসছে। কেরায়াতের সময় চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল আহমদ মুসার।
দীর্ঘ মুনাজাত করল আহমদ মুসা। মুনাজাতে সে বিশ্বের মজলুম মুসলমান, মজলুম মানুষের জন্যে দোয়া করল। তাদের মুক্তি প্রার্থনা করল আল্লাহর কাছে। সেই সাথে নিজেদের বিপদের কথা জানিয়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করল।
মাজুভ এবং নাতাশা মন্ত্রমুগ্ধের মত আহমদ মুসার নামাজ দেখছিল। প্রার্থনা এত সুন্দর, এত প্রভাবশালী হতে পারে। আহমদ মুসার নামাজ, তার তেলাওয়াত, তার প্রার্থনা সেই ছোট্ট ঘরে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যাতে আহমদ মুসা যে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে-বিনত হচ্ছে তার উপস্থিতি যেন মাজুভ, নাতাশাও অণুভব করতে পারছে।
নামাজ শেষ করে আহমদ মুসা ফিরে বসলে মাজুভ তাকে বলল, মুসা ভাই একটা কথা ক’দিন থেকে বলব বলব ভাবছি বলা হয়নি। আমি মুসলমান হতে চাই।
মাজুভের কথা শেষ না হতেই নাতাশা বলল, এ সিদ্ধান্ত আমি আগেই নিয়ে রেখেছি।
নাতাশার কথা শেষ হলে আহমদ গম্ভীর কন্ঠে বলল, তোমরা ইসলামকে বুঝে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছ তো?
-কতটুকু বুঝতে হবে জানি না, তবে আমি এতটুকু বুঝেছি, ইসলাম বাস্তববাদী ধর্ম। সেই সাথে আধ্যাত্মবাদীও। বলল মাজুভ।
-আপনারা কেউ জানেন না, এ ক’দিনে মোহাম্মাদ (স) এর জীবনী পড়ে আমি শেষ করেছি। আরকাইভস লাইব্রেরীতে বইটা পেয়েছিলাম। বলল নাতাশা।
-তুমি জাননা, তোমার আনা বইটা তোমার আগে আমিই শেষ করেছি, এক রাত আমার লেগেছে।
-তাহলে তো তোমরা জানো, আমাদের মহানবী (স) এর উপর চারিদিক থেকে কেমন বিপদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছিল। আজ বলকানের মুসলমানদের উপরও এ ধরনের বিপদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে। এসব বিবেচনা করে কি তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
উত্তরে দু’জন প্রায় একই রকম কথা বলল। তারা জানাল, ধর্মত্যাগী হিসাবে আমরা আরও বেশি হিংসার শিকার হতে পারি, এটা ধরেই নিয়েছি। কিন্তু সত্য ধর্ম গ্রহণের আনন্দ ও তৃপ্তির চেয়ে এই দুঃখ আমাদের কাছে বড় হবে না।
আহমদ মুসা মাজুভের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তুমি আমার হাতে হাত রাখ, আর নাতাশা তোমার হাতে হাত রাখবে।
আহমদ মুসা ওদের কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করাল।
সাড়ে সাতটায় সুর্য ওঠে। সাড়ে সাতটার পরেই আহমদ মুসা মাজুভদের বলল, তোমরা যে যেখানে পড়েছিলে, সেখানে মরার মত শুয়ে থাক। আমি বলার আগে উঠবে না।
আহমদ মুসাকে সিঁড়ির নিচেই ফেলে রেখে গিয়েছিল। আহমদ মুসা গিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ল। ৮টা বাজতে পাঁচমিনিট বাকি থাকতে সিঁড়ির মাথায় কট করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় পায়ের শব্দ হলো। পায়ের শব্দ গুলো দ্রুত নিচে নামতে লাগল।
আহমদ মুসা এক নিমেষ তাকিয়ে দেখে নিয়েছিল, সামনে আট জন খালি হাতে, পেছনে একজনের হাতে ষ্টেনগান।
সিঁড়ি থেকে পায়ের শব্দগুলো মেঝেয় নেমে এলো।
আহমদ মুসা প্রস্তুত হলো। এখন প্রয়োজন শুধু ষ্টেনগানধারীর অবস্থান জানা।
উঠে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে চোখ খুলল। দেখল, তার পা থেকে ফুট তিনেক দুরে সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে ষ্টেনগানধারী। আর খালি হাতে একজন লোক তার পায়ের কাছে, আরেকজন আসছে মাথার দিকে সম্ভবত তাকে তুলে নেবার জন্যে।
আহমদ মুসা চোখ খুলেই স্প্রিং এর মত উঠে দাঁড়িয়ে ঝাপিয়ে পড়ল ষ্টেনগানধারীর উপর।
ষ্টেনগানধারী লোকটি সিঁড়ির উপর পড়ে গেল। আহমদ মুসা তার ষ্টেনগান হাতে করেই উঠে দাঁড়াল। উঠে মেঝের উপর দাঁড়িয়েই ষ্টেনগানের ট্রিগার চাপল আহমদ মুসা। শুরু করল ষ্টেনগানধারী থেকেই। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ষ্টেনগানের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিল গোটা ঘরের উপর দিয়ে।
আহমদ মুসাকে আকস্মিকভাবে উঠতে দেখে ঘরের মেঝেয় দাঁড়ানো আটজনই চমকে উঠল। তারা ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা কেটে উঠার আগেই দেখল আহমদ মুসার হাতে ষ্টেনগান। আটজনই কিংকর্তব্যবিমুঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় তারা ষ্টেনগানের গুলি বৃষ্টির মুখে পড়ল।
তিরিশ সেকেণ্ড লাগল না। ৯টি লাশ ঝরে পড়ল ঘরের মেঝেতে।
‘তোমরা উঠে দাঁড়াও।’ বলেই আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উপরে উঠল।
সিঁড়ির মুখ বন্ধ হয়নি। সম্ভবত এখনি তারা বন্দীদের নিয়ে উপরে উঠবে এই জন্যেই সিঁড়ির মুখ বন্ধ করা হয়নি।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে সিঁড়ির খোলা মুখ দিয়ে মেঝের উপরে মাথা তুলে দেখল ঘরের দরজায় একজন প্রহরী। সে সিঁড়ি মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। ষ্টেনগানটা তার কাঁধে ঝুলানো।
আহমদ মুসা তড়াক করে সিঁড়ি থেকে মেঝতে উঠেই ষ্টেনগান উঁচু করল প্রহরীকে লক্ষ্য করে।
প্রহরী ষ্টেনগান কাঁধ থেকে হাতে নেয়ার সুযোগ আর পেল না।
আহমদ মুসা প্রহরীকে নির্দেশ দিল ঘরের ভেতর সরে আসার জন্যে।
প্রহরী এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়ালো। কাঁপছিল সে।
এই সময় মাজুভ, হাসান সেনজিক ও নাতাশা সিঁড়ি দিয়ে মেঝেতে উঠে এল।
আহমদ মুসা বলল, মাজুভ, ওর ষ্টেনগানটা নিয়ে নাও।
আহমদ মুসা প্রহরীটিকে সিঁড়ি দিয়ে আন্ডার গ্রাউণ্ড ঘরে নামার নির্দেশ দিয়ে বলল, সিঁড়ির মুখ বন্ধ করতে হবে কিভাবে?
প্রহরী কাঁপতে কাঁপতে দেয়ালের সেই সুইচ দেখিয়ে বলল, প্রথমবার চাপলে সিঁড়ির মুখ খুলে যায়। দ্বিতীয় বার চাপ দিলে সিঁড়ির মুখ সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায়।
‘আর নিচের সিঁড়িতে যে সুইচ আছে সে সুইচ টিপলে কিভাবে দরজা খুলে?’ প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
প্রহরীটি ঘরের দরজার পাশে ছোট কলিং বেল দেখিয়ে বলল, ঐ সুইচ টিপলে এ কলিং বেলে শব্দ হয়, তখন প্রহরী গিয়ে সুইচ টিপে সিঁড়ির মুখ খুলে দেয়।
‘ঠিক আছে এবার ভিতরে যাও।’ প্রহরীটিকে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
সে সিঁড়িতে নেমে গিয়ে দেয়ালের সেই সুইচ চাপ দিল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের ভেতর থেকে মেঝের একটা অংশ এসে সিঁড়ির মুখ বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা এবার ষ্টেনগান বাগিয়ে বাইরে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে ছুটল।
দরজার পরেই লম্বা করিডোর। আহমদ মুসার মনে পড়ল করিডোরের মাঝখানে গাড়ি বারান্দায় নামার সিঁড়ি। গাড়ি বারান্দার পরেই ছোট একটি লন। তার পরেই গেট।
আহমদ মুসা করিডোরে পা দিল। বাইরে ঘন কুয়াশা। আট-দশ হাত দূরেও কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুশি হলো আহমদ মুসা।
ষ্টেনগান বাগিয়ে দ্রুত এবং সাবধানে করিডোরের সিঁড়ির দিকে এগুলো। তার পিছনে হাসান সেনজিক, তারও পিছনে মাজুভ এবং নাতাশা।
আহমদ মুসা করিডোরের সিঁড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। আর মাত্র হাত চার-পাঁচ দূরে।
এই সময় আহমদ মুসা পায়ের শব্দ পেল। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে কে যেন করিডোরে নামছে। করিডোরের সিঁড়ি সোজা করিডোর থেকে উঠে গেছে দোতালার সিঁড়িতে। দোতালার সিঁড়ির মুখ স্টিলের একটি কোলাপসিবল গেট। সেটা খোলা।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সিঁড়ি থেকে লোকটির করিডোরে নামার অপেক্ষা করতে লাগল।
লোকটি করিডোরে পা রাখল। তাকে দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। লোকটি জাকুব। জাকুবের দৃষ্টি পড়েছিল আহমদ মুসার উপর। সে চমকে উঠেই তার তর্জ্জনিটা ঠোটে ঠেকিয়ে পরক্ষণেই ইশারা করল পেছনে সরে যাবার জন্যে। জাকুবের ভয়ার্ত দৃষ্টি গাড়ি বারান্দার দিকে।
গাড়ি বারান্দায় একটা গাড়ি এসে দাঁড়ানোরও শব্দ পেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা বুঝল ব্যাপারটা। দ্রুত সে কয়েক হাত পিছনে সরে থামের আড়ালে দাঁড়াল। তার সাথে মাজুভরাও।
থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে সামনের আবছা কুয়াশার মধ্য দিয়ে দেখল, করিডোরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একজন দীর্ঘদেহী এবং আর একজন বেঁটে মত লোক দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসারা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। জাকুব ছুটে এসে বলল, সবাই ওরা উপরে দরবারে বসেছে। গাড়ি বারান্দায় গাড়ি আছে। যান আপনারা। বেলগ্রেডে কোথায় যোগাযোগ করব?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চুপ করল জাকুব।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই হাসান সেনজিক বলল, টিটো স্মরণী-এক, ষ্টিফেন পরিবারের বাড়ি।
কথাটা শুনেই জাকুব পেছন ফিরে ছুটল। সিঁড়ি দিয়ে সে দ্রুত উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসারা গাড়ি বারান্দায় নেমে এল।
গাড়ি বারান্দায় তখন দু’টা গাড়ি। একটা মাইক্রোবাস। আহমদ মুসা দেখেই চিনতে পারল রাতের সেই মাইক্রোবাস। আরেকটি জীপ। জীপটি তখনও গরম। তাহলে এই জীপেই লোকটি এসেছে।
আহমদ মুসা জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। তার পাশে বসল হাসান সেনজিক। পেছনের সিটে মাজুভ এবং নাতাশা বসল।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে জীপ ষ্টার্ট দিল। আহমদ মুসা নিশ্চিন্ত। উপরে দোতলা, তিনতলা থেকে ওরা কুয়াশার মধ্যে লনের জীপ দেখতে পাবে না। সমস্যা শুধু, আহমদ মুসা ভাবল, গেটে কোন ঝামেলা পোহাতে হয় কিনা।
লন পেরুলেই বিশাল লোহার গেট। গেটের পাশেই গেটরুম। সেখানে সার্বক্ষণিক প্রহরী। সুইচ টিপে দরজা খোলা হয়। তারপর দরজা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।
আহমদ মুসা লাইট না জ্বালিয়ে এবং কোন প্রকার হর্ণ না দিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গেটের মুখোমুখি হলো। আলো এবং হর্ণের এদের নিজস্ব কোড আছে, সুতরাং ও দু’টা ব্যবহার করলে বিপদ আছে।
আহমদ মুসার জীপ যখন গেটের হাত পাঁচেক দূরে। গেটটি তখন খুলে গেল। আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল।
আহমদ মুসা বলল, বেলগ্রেড কোনদিকে, ডাইনে?
‘হ্যাঁ’ উত্তর দিল মাজুভ।
আহমদ মুসা গাড়ি ডানদিকে ঘুরিয়ে নিল।
গাড়ির ‘ফগ লাইট’ জ্বালিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
বেলগ্রেড হাইওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
পেছন থেকে মাজুভ বলে উঠল, আমাদের ভাগ্য ভাল মুসা ভাই। এ জীপটা কনষ্টানটাইনের। তাই গেটম্যান জীপের নাম্বার দেখেই গেট খুলে দিয়েছে।
‘কেমন করে তুমি বুঝলে জীপটা কনষ্টানটাইনের’ বলল আহমদ মুসা।
‘যে দু’জন লোক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল, তার মধ্যে দীর্ঘদেহী লোকটিই কনষ্টানটাইন।’ বলল মাজুভ।
‘সত্যিই ভাগ্য ভাল আমাদের, কনষ্টানটাইনকেও চেনা আমার হয়ে গেল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ভাবছি, আমাদের সাথে আপনিও যদি জ্ঞান হারাতেন, তাহলে কি হতো।’ বলল নাতাশা।
আহমদ মুসা বলল, তাহলে আল্লাহ অন্যভাবে সাহায্য করতেন।
‘আপনি খুবই সংবেদনশীল, আপনি সব মানুষকে ভালবাসেন, কিন্তু এই যে ন’জন মানুষ আপনার গুলিতে মরল, মায়া লাগল না আপনার?’ বলল নাতাশা।
‘হৃদয় ভরা এই মায়া নিয়েই তো যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ মারতে হয় নাতাশা। হত্যা না করলে যেখানে হত্যা হতে হবে সেখানে হত্যা করা জীবনের মতই জরুরী। প্রহরী আত্নসমর্পণ করেছে, ওকে আমি মারিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই রক্তপাত, এই হানাহানি কি বন্ধ করা সম্ভব?’ বলল নাতাশা
‘বোধ হয় সম্ভব নয়।’
‘কেন সম্ভব নয়?’
‘কারণ, সত্য ও মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায়ের সহাবস্থান হতে পারে না। যতদিন দুনিয়াতে অন্যায় ও অমঙ্গলের পথ থাকবে, যতদিন মানুষ এই অন্যায় ও অমঙ্গলের পথে চলবে, ততদিন এই রক্তপাত ও হানাহানি বন্ধ হবেনা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অন্যায় ও অমঙ্গলের পথ বন্ধ করা কি সম্ভব নয়?’ বলল নাতাশা।
‘ইসলামতো এই জন্যই এসেছে, ইসলামী আন্দোলন তো এ লক্ষ্য সামনে রেখেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুনিয়া এ আন্দোলনের সাফল্য ও শান্তির মুখ কবে দেখবে?’
‘জানিনা নাতাশা, আমাদের দায়িত্ব হলো এই সাফল্য ও শান্তির জন্যে কাজ করা। যদি আমরা তা করি তাহলে আমরা মুক্তি লাভ করব, পুরষ্কার হিসেবে আখেরাতে আমরা লাভ করব অনন্ত শান্তি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আল্লাহ তো চাইলেই, এ দুনিয়াতেও শান্তির সমাজ কায়েম হতে পারে। তাঁর ইচ্ছাই তো যথেষ্ট।’
‘আল্লাহ্‌ তা কেন চাইবেন নাতাশা। পরীক্ষকরা যদি পরীক্ষার হলে সব উত্তর পরীক্ষার্থীদের বলে দেয়, তাহলে তো সবাই পাশ করবে। ভালো-মন্দের পরীক্ষা তাহলে হবে কেমন করে? আল্লাহ তো পরীক্ষা করতে চান ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্য থেকে কে কোনটা বেছে নেয়। আল্লাহ তো সে অনুসারেই আখেরাতে পুরষ্কার ও শান্তি দেবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে ইসলামী আন্দোলন কেন?’ বলল নাতাশা।
‘ইসলামী আন্দোলন দয়াময় আল্লাহর তরফ থেকে আসা এক অসীম নেয়ামত। এ নেয়ামত মানুষকে জানায় ন্যায় কোনটা, অন্যায় কোনটা, মুক্তির পথ কোনটা, আর সর্বনাশের পথ কোনটা, যাতে করে মানুষ এ দুনিয়াতেও শান্তি লাভ করতে পারে এবং পরকালেও লাভ করতে পারে অনন্ত শান্তি।’ বলল আহমদ মুসা।
নাতাশা কোন কথা আর বলল না। তাঁর মুখ গম্ভীর, চোখে উজ্জ্বল এক আলোর দীপ্তি।
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর মুখ একটু ফিরিয়ে মাজুভকে লক্ষ্য করে বলল, গাড়ির নাম্বার পাল্টাতে হবে মাজুভ। ওরা এতক্ষণে নিশ্চয় সব পথের সব পয়েন্টেই এ গাড়ির নাম্বার জানিয়ে দিয়েছে।
‘ঠিক আছে মুসা ভাই আমি দেখছি।’ বলল মাজুভ।
প্রায় মিনিট পাচেঁক গাড়ি চলার পর এক জায়গায় এসে মাজুভ আহমদ মুসাকে গাড়ি থামাতে বলল।
গাড়ি থামল গাড়ির বড় একটা ওয়ার্কশপের সামনে। ওয়ার্কশপের সামনে বেশ কয়েকটা ভাঙ্গা গাড়ি দাঁড়িয়ে। একটা জীপও আছে। দেখলেই বোঝা যায় অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। জীপের উপরের কভার নেই। টায়ারগুলোও জীর্ণ। নাম্বার প্লেটের একটা মাথা খসে গিয়ে ঝুলছে। মাজুভ দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। কোন লোকজন নেই। ওয়ার্কশপ খুলতে দেরি আছে।
মাজুভ জীপের নাম্বার প্লেট দু’টি খুলে নিয়ে এ জীপে লাগিয়ে নিল। আর এ জীপের নাম্বার প্লেট দু’টি দুমড়ে দলা পাকিয়ে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিল।
আবার ছুটতে শুরু করল জীপ।
বেলা ১০টার দিকে আহমদ মুসারা লাজারাভেক এসে পৌঁছাল। মাঝখানে রাস্তার পাশের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ওরা সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে।
লাজারাভেক বেলগ্রেড ও কোকার মাঝখানে একটা ছোট্ট বাজার। আহমদ মুসা মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখল, লাজারাভেক থেকে একটা রাস্তা প্রথমে সোজা পূর্বদিকে, তারপর পূর্ব-উত্তর কোণে এগিয়ে দানিয়ুব তীরের গ্রোকা শহর পর্যন্ত চলে গেছে। ওখানে দানিয়ুব পেরোলেই দানিয়ুবের পূর্ব তীর ধরে বেলগ্রেড পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া দানিয়ুব হাইওয়েতে পৌঁছা যাবে।
মানচিত্র থেকে মুখ তুলে আহমদ মুসা বলল, মাজুভ, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে যতগুলো রাস্তা বেলগ্রেডে প্রবেশ করেছে সবগুলো রাস্তায় মিলেশ বাহিনী নিশ্চয় কড়া পাহারা বসাবে। যদিও আমরা গাড়ির নাম্বার প্লেট বদলেছি, তবুও মানুষ কিন্তু আমরা ঠিকই আছি। ওরা শুধু গাড়ির নাম্বার নয়, গাড়ি ও মানুষের বিবরণও জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ঝামেলা এড়াবার জন্যে আমরা সামনে লাজারাভেক থেকে লাজারাভেক গ্রোকা রাস্তা ধরে এগিয়ে দানিয়ুব পার হয়ে পূর্ব দিক দিয়ে বেলগ্রেডে প্রবেশ করতে পারি।
মাজুভের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, সবচেয়ে সুন্দর ও নিরাপদ পথ আপনি বের করেছেন মুসা ভাই। বেলগ্রেডে প্রবেশের এর চেয়ে নিরাপদ বিকল্প পথ আর নেই। আমার মাথায় এপথের কথা আসতোই না। মুসা ভাই আপনাকে মুবারকবাদ।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিলনা। লাজারাভেক বাজারে গাড়ি তখন প্রবেশ করেছে। বাজারে গাড়ি থামাল না আহমদ মুসা। একবার সে ফুয়েল ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। গাড়ি দুটি চলল দানিয়ুব তীরের গ্রোকার উদ্দেশ্যে।

Top