১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

ওমর বিগোভিক হাঁফাতে হাঁফাতে ড্রইং রুম থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি বিপদ, এখন কি করি বলত মা নাদিয়া নুর।
নাদিয়া নুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, কি হয়েছে আব্বা?
‘এখনি শহীদ মসজিদ রোড থেকে একজন খবর দিয়ে গেল, স্বয়ং কনষ্টানটাইন তার বিপুল সংখ্যক লোকজন নিয়ে হাসান সেনজিকের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। সে কনষ্টানটাইনকে হাসান সেনজিকের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে এসেছে।’ একটু থামল ওমর বিগোভিক। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘হোয়াইট ক্রিসেন্টের একজন ছেলে সালেহ বাহমনের খোঁজে এসেছিল। সালেহ বাহমনকে না পেয়ে খবর দিয়েই সে চলে গেছে। সন্দেহ নেই, কনষ্টানটাইন এবার হাসান সেনজিকের মাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্যেই ওখানে গিয়েছে।’
থামল ওমর বিগোভিক। ঢোক গিলল। তারপর ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলল, সালেহ বাহমন, মাজুভ গেছে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। তাদের খোঁজে আবার আহমদ মুসা এবং জাকুবও সেখানে গেছে। এখন আমি কি করি? সর্বনাশ হতে তো আর দেরি নেই।
নাদিয়া নুর ভাবছিল। বলল, ‘একটা কাজ আমরা করতে পারি বসে না থেকে। সেটা হলো, হাসান সেনজিক এবং ডেসপিনাকে এ খবর আমাদের জানানো উচিত। তারা দু’জনেই হয়তো পরে বলতে পারে, কেন আমরা খবরটা তাদের দেইনি। কোন চেষ্টা হয়তো তারা করতে পারতো।’
‘ঠিক বলেছ মা। হাসান সেনজিক মাজুভের বোনের বাড়িতে আছে। সে ঠিকানা মাজুভ দিয়ে গেছে। আর ডেসপিনার বাড়ি তো তুমি চেনই।’
বলে ওমর বিগোভিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি তৈরি হয়ে এস নাদিয়া, আমি গাড়ি বের করছি।
ওমর বিগোভিক গাড়ি বের করল। নাদিয়া এসে তার আব্বার ড্রাইভিং সিটের পাশে বসল। গাড়ি ছুটল মাজুভের বোনের বাসার দিকে।
ডিফেন্স কলোনীতে মাজুভের বোনের বাসা খুঁজে পেতে মোটেই কষ্ট হলো না। গাড়ি বারান্দায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওমর বিগোভিক এবং নাদিয়া নুর নেমে এল গাড়ি থেকে। কলিং বেলের সুইচ টেপার কয়েক মুহূর্ত পরেই দরজা খুলে গেল।
দরজা খুলে দিয়েছে একজন যুবক। সুন্দর, সুঠাম দেহ যুবকটির। মুখে মিষ্টি সরল হাসি। চেহারায় উচু আভিজাত্য।
ওমর বিগোভিক সালাম দিয়ে বলল, আমি ওমর বিগোভিক, এ আমার মেয়ে নাদিয়া নুর। তুমি হাসান সেনজিক না?
যুবকটি ঠোটে আরও একটু স্পষ্ট হাসি টেনে বলল, জি আমি হাসান সেনজিক। আপনাদের কথা আমি শুনেছি। আসুন ভেতরে।
বলে হাসান সেনজিক এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে তাদের ভেতরে প্রবেশের জায়গা করে দিল।
ওমর বিগোভিক ভেতরে ঢুকে দরজার সামনেই থমকে দাঁড়াল। তার সাথে নাদিয়াও। ওমর বিগোভিক বলল, বাবা, আমাদের বসার সময় নেই। তোমাকে শুধু একটা খবর জানাতে এসেছি। গম্ভীর কণ্ঠস্বর ওমর বিগোভিকের।
হাসান সেনজিকের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। নেমে এল তার মুখে চিন্তার ছায়া। শুকনো কণ্ঠে বলল, কি খবর?
ওমর বিগোভিক একটা ঢোক গিলে শুরু করল, সালেহ বাহমন ও মাজুভ গেছে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে, তাদের খোঁজে সেখানে গেছে আহমদ মুসা এবং জাকুব। তাদের কোন খোঁজ আমরা জানি না। এদিকে খবর এল এই কিছুক্ষণ আগে, কনষ্টানটাইন তার বিরাট দল নিয়ে তোমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে এবং কনষ্টানটাইন তোমাদের বাড়িতে ঢুকেছে। আশংকা করা হচ্ছে, তোমার মাকে তারা কিডন্যাপ করবে। থামল ওমর বিগোভিক।
হাসান সেনজিক তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। সে মাথা নিচু করল। প্রচন্ড এক আবেগ এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
সে নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল। বিধ্বস্ত তার চেহারা। ধীর কণ্ঠে সে বলল, এখন আপনি কি ভাবছেন?
চেষ্টা করেও হাসান সেনজিক তার কাঁপা কণ্ঠ ঢাকতে পারেনি।
ওমর বিগোভিক বলল, আমরা এখন ডেসপিনাকে এ খবর দিতে চাই। ডেসপিনাই তোমার বাড়ির সব খবর রাখে। তার কাছে কোন সমাধান আছে কিনা জানা দরকার।
‘আপনারা কি এখনি যাবেন সেখানে?’ বলল হাসান সেনজিক।
‘হ্যাঁ বাবা, এ কারণেই আমরা বসে সময় নষ্ট করতে পারছি না।’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘একটু দাঁড়ান, বলে আসি। আমিও যাব।’ বলেই হাসান সেনজিক ভেতরে ছুটে গেল। ফিরে এল এক মিনিট পরেই।
সে ফিরে এলে ওমর বিগোভিক বলল, ‘বাবা আহমদ মুসা হাজির নেই। তাকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া কি ঠিক হবে?’
‘তিনি থাকলে অনুমতি আমি অবশ্যই নিতাম, কিন্তু যেহেতু তিনি নেই তাই সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে। এই অবস্থায় আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না।’ বলল হাসান সেনজিক।
মাজুভের স্ত্রী নাতাশা এ সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। সে নিজের পরিচয় দিয়ে ওমর বিগোভিককে উদ্দেশ্য করে বলল, সব ঘটনার কেন্দ্র বিন্দু হাসান সেনজিক। কনষ্টানটাইন আজ হাসান সেনজিকের মাকে ধরে আনতে গেছে তারও মূলে হাসান সেনজিক। সুতরাং আমার মনে হয় এ ধরনের জটিল সময়ে হাসান সেনজিকের বাইরে পা বাড়ানোই উচিত নয়।
হাতজোড় করে হাসান সেনজিক বলল, আপনি বাধা দেবেননা, আমি এ সময় ঘরে বসে থাকলে মরে যাব ভাবী। শেষের কথা তার কণ্ঠে জড়িয়ে গেল কান্নায়।
নাতাশা আর কোন কথা বলতে পারল না।
ওমর বিগোভিকও না।
নাদিয়া নুর নির্বাক হয়ে গেছে হাসান সেনজিকের বুক ভরা আবেগের উত্তাল তরঙ্গ দেখে। তার ভয়ও হলো, এ অবস্থায় মানুষ সব রকম ঝুকিই নিতে পারে। যদি না তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনা যায়।
গাড়িতে এসে ওমর বিগোভিক ড্রাইভিং সিটে বসল। নাদিয়া নুরকে ওমর বিগোভিক তার পাশের সিটে এসে বসতে বলল। আর হাসান সেনজিককে বলল পিছনের সিটে বসতে। মানুষের চোখ থেকে তাকে একটু আড়াল করার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
গাড়ি ষ্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি। চুপ চাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
অনেকক্ষণ উসখুস করার পর নাদিয়া নুর হাসান সেনজিককে প্রশ্ন করল, হাসান সেনজিক ভাই ডেসপিনাকে মনে আছে, জানেন আপনি তাকে?
জবাব দিতে একটু দেরি হলো হাসান সেনজিকের। তার বেদনাচ্ছন্ন বুকে বড্ড বেসুরো লাগল এ প্রশ্ন। কিন্তু এই বেসুরো প্রশ্নটাই ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে নিয়ে এল উত্তপ্ত শিহরণ। অনেকক্ষণ পর হাসান সেনজিক বলল, ওকে মনে পড়ে না নাদিয়া। কিন্তু ওকে জানি।
আর প্রশ্ন করতে সাহস পেল না নাদিয়া নুর।
নাদিয়া নুর পথ দেকিয়ে গাড়ি নিয়ে এল ডেসপিনাদের গাড়ি বারান্দায়। গাড়ি থামল।
গাড়ি থেকে প্রথম নামল নাদিয়া নুর। নেমেই সে ছুটে গেল।
দরজা খুলে দিয়েছে ডেসপিনা। দরজার উপরই ডেসপিনাকে জড়িয়ে ধরল নাদিয়া। বলল, হাসান সেনজিককে এনেছি। চল, খালাম্মাকে বলি।
বলেই ডেসপিনাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটল খালাম্মার কাছে খবরটা দিতে।
খবরটা শোনার পর ডেসপিনার গোটা শরীর যেন চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলল। সে নড়তে পারল না দরজা থেকে। পা দু’টি যেন তার আটকে গেছে মেঝের কার্পেটের সাথে।
হাসান সেনজিক এবং ওমর বিগোভিক দরজার দিকে এগিয়ে আসছিল। হাসান সেনজিক আগেই চলে এসেছিল। ওমর বিগোভিক গাড়িটা পার্ক করে আসতে গিয়ে পেছনে পড়ে গিয়েছিল।
হাসান সেনজিক এসে ডেসপিনার সামনে দাঁড়াল। ডেসপিনা মুখ তুলে তাকাল হাসান সেনজিকের দিকে। চার চোখের প্রথম মিলন হলো। এর আগে কেউ কাউকে দেখেনি। কিন্তু একটুও কষ্ট হলো না একে অপরকে চিনতে।
‘কেমন আছ ডেসপিনা?’ প্রথম জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল হাসান সেনজিকের কণ্ঠে।
কথা বলতে পারলো না ডেসপিনা। তার জিহ্বা যেন তালুর সাথে আটকে গেছে।
উত্তরহীনা ডেসপিনা তার অপলক চোখের উপর দু’টি হাত চেপে ছুটে পালাল হাসান সেনজিকের সামনে থেকে।
হাসান সেনজিক তার প্রশ্নের উত্তর পেল না। কিন্তু তার মনে হল, উত্তর না দিয়েই ডেসপিনা তাকে তার সব বলে গেল।
আনমনা হয়ে গিয়েছিল হাসান সেনজিক। দাঁড়িয়েছিল হাসান সেনজিক ডেসপিনার মত করেই।
ওমর বিগোভিক এসে বলল, কি ব্যাপার হাসান সেনজিক দাঁড়িয়ে কেন? নাদিয়া কোথায় গেল!
নাদিয়া ছুটে এল এ সময়।
নাদিয়া ওদেরকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসাল। হাসান সেনজিক বসতে যাচ্ছিল। নাদিয়া বলল, আপনি মেহমান নন। ভেতরে চলুন, খালাম্মা দাঁড়িয়ে আছেন।
ডেসপিনার মা, হাসান সেনজিকের খালাম্মা, ড্রয়িং রুমের ওপারেই দাঁড়িয়ে ছিল।
হাসান সেনজিক ভেতরে ঢুকতেই তার খালাম্মা কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরল হাসান সেনজিককে। হাসান সেনজিকও না কেঁদে পারল না।
শান্ত হয়ে বসার পর হাসান সেনজিক বলল, খালাম্মা, ডেসপিনাকে ডাকুন, জরুরী খবর আছে। ওর জানা দরকার।
পাশের ঘরেই ডেসপিনা বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিল। হাসান সেনজিকের কথা সে শুনতে পেল। শুনতে পেয়েই সে চমকে উঠল। কি খবর! সে উঠে বসল।
নাদিয়া এ সময় ঘরে ঢুকে ডেসপিনার গালে একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘তুমি ভেতরে ভেতরে এতদূর…..।’ তারপর একটু থেমে বলল, এস ডেসপিনা, খারাপ খবর আছে। গম্ভীর কন্ঠস্বর নাদিয়ার।
ডেসপিনা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, তুমি বলছ খারাপ খবর, উনি বললেন জরুরী খবর। কি ব্যাপার নাদিয়া!
উত্তর না দিয়ে ডেসপিনাকে টেনে নিয়ে গেল নাদিয়া। ওরা গিয়ে বসল সোফায়।
মুখ নিচু ডেসপিনার।
হাসান সেনজিক বলল, নাদিয়ার আব্বা, চাচাজান আমাকে একটা দুঃসংবাদ দিতে গিয়েছিলেন। সে সংবাদ তিনি দিতে এসেছেন ডেসপিনাকেও। ডেসপিনা আম্মার খবরাখবর বেশি রাখে তাই। থামল হাসান সেনজিক।
একটু থেমে আবার শুরু করল, কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে, মিলেশ বাহিনী গিয়ে আমাদের বাড়ি ঘিরে রেখেছে আম্মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মুসা ভাই, মাজুভ, সালেহ বাহমন সবাই গেছে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। ওদের কোন খোঁজ নেই।
ডেসপিনা সোজা হয়ে বসল। ভয়ে, উদ্বেগে তার মুখ পাংশু হয়ে গেছে। বলল, তাহলে….. কথা শেষ করতে পারলো না ডেসপিনা। উদ্বেগে, উতকন্ঠায় কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল তার।
‘তাহলে যা করতে হবে, আমি তা জানি ডেসপিনা।’ বলল হাসান সেনজিক।
ডেসপিনা মাথা সোজা করে তাকাল হাসান সেনজিকের দিকে। বলল, সেটা কি?
হাসান সেনজিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি সেখানে যাচ্ছি। আম্মাকে যদি তাদের হাত থেকে উদ্ধার করা না যায়, তাহলে আমাকে পেলেই তারা আমার অসুস্থ আম্মাকে ছেড়ে দেবে। আমার জন্যে আম্মা কষ্ট ভোগ করবেন তা হয় না।’ বলে হাসান সেনজিক পা বাড়াল বাইরে যাবার জন্যে।
ডেসপিনা উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে গিয়ে হাসান সেনজিকের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে বলল, এটা সমস্যার সমাধান নয়।
হাসান সেনজিক থমকে দাঁড়াল। শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল, আমার সামনে আর কোন বিকল্প নেই ডেসপিনা। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। পথ ছেড়ে দাও।
‘আপনি যদি যেতেই চান, তাহলে আমাকেও সাথে নিতে হবে।’ কান্নাজড়িত ভাষায় দৃঢ় কন্ঠে বলল ডেসপিনা।
এই সময় বাইরে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল। নাদিয়া ছুটে বাইরে গেল। কয়েক মুহুর্ত পরেই ছুটে এল ভেতরে। আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, হাসান সেনজিক ভাইয়ের মাকে নিয়ে এসেছে সালেহ বাহমন ও মাজুভ।
ঘটনার আকস্মিকতা, আনন্দের আতিশয্য ঘরের মানুষগুলোকে যেন বোবা করে দিল। হাসান সেনজিক ও ডেসপিনা যেভাবে দাঁড়িয়েছিল সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
দুই পরিচারিকার কাঁধে ভর করে হাসান সেনজিকের মা ঘরে প্রবেশ করল। তার পেছনে পেছনে হাসান সেনজিকের ফুফু।
মাকে সামনে দেখে হৃদয় উপচানো আবেগে কাঁপছিল হাসান সেনজিক।
ডেসপিনার মা উঠে এসেছিল। সে গিয়ে হাসান সেনজিকের মাকে ধরে হাসান সেনজিকের কাছে এনে বলল, আপা এই তোমার হাসান সেনজিক।
হাসান সেনজিকের মা চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল হাসান সেনজিককে। হাসান সেনজিক ‘মা আমার’ বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল তার মাকে।
হাসান সেনজিককে জড়িয়ে ধরেই তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। প্রায় পনের বছরের অবরুদ্ধ আবেগ এবং পাওয়ার অপরিমিত আনন্দের চাপ হাসান সেনজিকের অসুস্থ মা সহ্য করতে পারেনি।
ভয় ও উৎকণ্ঠায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠল হাসান সেনজিক জ্ঞান হারা মাকে কোলে নিয়ে। তার সাথে ডেসপিনাও।
হাসান সেনজিক ও ডেসপিনা ধরাধরি করে হাসান সেনজিকের মাকে নিয়ে শুইয়ে দিল। শুইয়ে দিয়েই ডাক্তারকে টেলিফোন করল ডেসপিনা।
ডাক্তার এল।
ডাক্তার বলল, ভয়ের কিছু নেই। দুর্বলতা ও অতিরিক্ত মানসিক চাপে জ্ঞান হারিয়েছেন। এখনি জ্ঞান ফিরে আসবে।
একটি ইনজেকশন ও কিছু ঔষধ দিয়ে ডাক্তার চলে গেল।
ফুফু ও খালাম্মাকে মায়ের কাছে থাকতে বলে হাসান সেনজিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ওদের কাছ থেকে আসি। কি ঘটেছে আমরা এখনও কিছু জানতে পারিনি। বলে হাসান সেনজিক বেরিয়ে গেল।
তার সাথে বেরিয়ে গেল ডেসপিনা ও নাদিয়াও। ওরা গিয়ে ড্রয়িং রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়াল। হাসান সেনজিক ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসেছে ওদের পাশে।
ওমর বিগোভিক সালেহ বাহমন ও মাজুভের সাথে গল্প করছিল।
হাসান সেনজিক বলল, আমার তর সইছে না মাজুভ ভাই। মুসা ভাই ও জাকুব তো আপনাদের সন্ধানে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে গেছেন। কোথায় তারা? আপনারা কখন শহীদ মসজিদ রোডে গেলেন?
সালেহ বাহমন বলল চাচাজানকে সব বলেছি; আবার বলছি। বলে সালেহ বাহমন ঘটনাগুলো আবার বলে গেল।
বলা শেষ করে সালেহ বাহমন থামতেই হাসান সেনজিক বলল, কনষ্টানটাইন ও তার দুর্ধর্ষ দলকে মোকাবিলার জন্যে শুধু মুসা ভাই থেকে গেলেন জাকুবকে নিয়ে! আমরা এখন যেতে পারি না ওখানে?
মাজুভ বলল, আহমেদ মুসা ভাই এ নির্দেশ দেননি। আপনার মার নিরাপত্তা বিধানই শুধু আমাদের দায়িত্ব। আপনিই ভালো জানেন, মুসা ভাই সামনের অনেক দূর দেখে সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং তার নির্দেশ ছাড়া কোন পদক্ষেপ নেয়া, বিশেষ করে এখান থেকে আমরা চলে যাওয়া সঠিক মনে করি না।
‘মাজুভ ভাই আপনার যুক্তি ঠিক। কিন্তু সেই ককেশাস থেকে মুসা ভাইকে আমি দেখে আসছি। আমি জানি, তিনি তার সাথীদের পারতপক্ষে কোন ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেন না, তিনি সব বিপদ সব ঝুঁকি নিজের কাঁধে তুলে নেন। সুতরাং তিনি নির্দেশ না দিলেও তার বিপদ কমানোর জন্যে আমরা কিছু করতে পারি, তিনি কিছু কখনই বলবেন না।’ বলল হাসান সেনজিক।
‘এমন বড় হৃদয়ের মানুষ, এমন দায়িত্ব পাগল নেতা আজকের দুনিয়াতে আছে তাঁর কথা না শুনলে আমার বিশ্বাস হতো না।’ বলল ওমর বিগোভিক।
হাসান সেনজিক বলল, কেমন দায়িত্ব পাগল তিনি, কেমন বিচিত্র তার জীবন, একটা কাহিনী শুনুন। বলে একটা দম নিয়ে আবার শুরু করল সে, সিংকিয়াং থেকে ককেশাসে আসার দিন যাত্রার এক ঘন্টা আগে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের আসর থেকেই তিনি এসে বিমানে ওঠেন। বিমান বন্দরে আসার পথে গাড়িতে কনের সাথে দু’চারটা কথা বলেন। ককেশাসে যেহেতু জরুরী প্রয়োজন, তাই কনের বাপ-মা এবং সকলের অশ্রুসজল অনুনয় সত্তেও তিনি একটা দিনও দেরি করতে রাজী হননি।
ঘটনা শুনে ওমর বিগোভিক, সালেহ বাহমন, মাজুভ সকলেই চোখ কপালে তুলল।
আড়ালে দাঁড়ানো নাদিয়া ও ডেসপিনার মুখ হা হয়ে গেছে বিস্ময়ে।
ওমর বিগোভিক বলল, এমন ঘটনা নাটক উপন্যাসে কখনো কখনো আমরা দেখি, বাস্তবেও তাহলে ঘটে! কিন্তু এমনভাবে বিয়ে হলো কেন?
হাসান সেনজিক বলল, সিংকিয়াং এর গভর্ণরের মেয়ে আহমদ মুসাকে ভাই ডাকত। মুসা ভাই তার সেই বোনের বিয়ে ঠিক করল সিংকিয়াং এর তার এক সাথীর সাথে। আহমদ মুসা হঠাৎ করে ককেশাসে আসার সিদ্ধান্ত নিল, তাই তিনি আসার আগেই তাড়াহুড়া করে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বিয়ের আসরে বসে তার বোন শর্ত আরোপ করল ভাইয়া বিয়ে না করলে সে এখন বিয়ে করবেনা। এই রকম প্যাচে পড়ে শেষ পর্যন্ত আহমদ মুসাকেও বিয়ে করতে হয়।
‘মুসা ভাই-এর বিয়ে কি ঠিক হয়ে ছিল?’ জিজ্ঞাসা করল মাজুভ।
হাসান সেনজিক বলল, সে আর এক কাহিনী। সিংকিয়াং এর বিখ্যাত মুসলিম পরিবারের মেয়ে মেইলিগুলি। একদিন একাকী গাড়ি নিয়ে যাবার সময় গুলিবিদ্ধ মুমুর্ষ অপরিচিত আহমদ মুসাকে পথের পাশে পায়। মেইলিগুলি তাকে তুলে নিয়ে যায়। প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে তখন আহমদ মুসার লড়াই চলছিল। আহমদ মুসাকে আশ্রয় দেয়ায় মেইলিগুলি এবং মেইলিগুলির পরিবার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মেইলিগুলির দাদি এবং মেইলিগুলি নিজেও গুলিতে আহত হয়। সবাই চাইতো এই মেয়েটির সাথে আহমদ মুসার বিয়ে হোক। সবচেয়ে বেশি চাইত আহমদ মুসার সেই বোন। সে-ই অবশেষে বেকায়দায় ফেলে আহমদ মুসাকে।
‘অদ্ভুত উপন্যাসের চেয়েও সুন্দর কাহিনী। এসব মুসা ভাইয়ের কাছে শুনেছেন হাসান সেনজিক ভাই?’ বলল সালেহ বাহমন।
‘না মুসা ভাই তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোন সময় কোন আলোচনা করেন না। এসব কথা আমি শুনেছি ককেশাসে মুসা ভাই এর এক সাথীর কাছ থেকে যিনি মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন তাঁর সাথে।’ বলল হাসান সেনজিক।
‘নিজের জীবনের দিকে না তাকিয়ে কেমন করে একজন মানুষ পরার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে!’ বিস্ময়ের সাথে বলল ওমর বিগোভিক।
‘মুসলমানরা পারে চাচাজান। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে শুরু করে আফ্রিকার গহীন অরণ্য পর্যন্ত ইসলামের যে বিস্তার তা সম্ভব হয়েছে এমনভাবে জীবন বিলিয়ে দেয়া মুসলিম মিশনারীদের দ্বারাই যারা নিজেদের দেশ-সংসার ফেলে, স্বজনদের মায়া-মমতার বন্ধন ছিন্ন করে বিদেশ বিভূয়ে অবিরাম ঘুরে বেড়িয়েছেন অন্ধকারে ইসলামের দ্বীপ প্রজ্বলনের জন্যে। আহমদ মুসা আর কেউ নয়, তাদেরই উত্তরাধিকার, তাদের মূর্তিমান আধুনিক দৃষ্টান্ত।’ বলতে বলতে আবেগ রুদ্ধ হয়ে গেল হাসান সেনজিকের কন্ঠ।
হাসান সেনজিকের এই আবেগ সকলকেই স্পর্শ করল। কারো মুখেই কোন কথা জোগাল না।
আড়ালে দাঁড়ানো ডেসপিনা ও নাদিয়ার সজল চোখে তখন ফুটে উঠেছে বোটানিকাল গার্ডেনের সেদিনকার সেই দৃশ্য। সম্পূর্ণ অপরিচিত দু’জন তরুণীর জীবন ও সম্মান রক্ষার্থে আহমদ মুসা ছুটে গিয়েছিল। নিজের নিরাপত্তার কথা, নিজের জীবনের জন্য এক মুহুর্তও সে ভাবেনি। এটাই আহমদ মুসার জীবন-রূপ, একজন মুসলমানের জীবন-রূপ।
এই সময়ে সেখানে ছুটে এল একজন পরিচারিকা। বলল, বড় বেগমের জ্ঞান ফিরেছে। উনি হাসান সেনজিককে চাইছেন।
নাদিয়া তাড়াতাড়ি দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইজান, খালাম্মার জ্ঞান ফিরেছে। উনি আপনাকে চাইছেন।
শুনেই হাসান সেনজিক ছুটে এল ভেতরে।

আনন্দ ও এ্যকশনের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলো দিন যেন চোখের পলকেই কেটে গেল আহমদ মুসার।
আনন্দটা হলো হাসান সেনজিকের সাথে ডেসপিনার এবং সালেহ বাহমনের সাথে নাদিয়া নুরের বিয়ে। হাসান সেনজিকের বিয়েতে খুব বেশি ধুমধাম হয়েছে। কয়েক যুগের মধ্যে ষ্টিফেন পরিবারের কোন বিয়ে প্রকাশ্যে হয়নি, ধুমধামতো দূরে থাক। বিয়ের ভোজ চলেছে তিনদিন ব্যাপী। বোসনিয়া, হারজেগোভিনা, কসভো প্রভৃতি রাজ্যসহ গোটা দেশের উল্লেখযোগ্য মুসলিম পরিবারগুলো দাওয়াত পেয়েছে বিয়েতে। ডেসপিনা ও নাদিয়া নুরের বিয়ে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে হাসান সেনজিকের বাড়িতেই।
আরও একটা বড় আনন্দের ঘটনা ঘটেছে। সেটা হলো বোসনিয়া ও হারজেগোভিনা রাজ্যে অর্ধশতাব্দির কম্যুনিষ্ট শাসন অবসানের পর প্রথম যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তাতে একজন মুসলমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনি হাসান সেনজিকের দাওয়াতে এসেছিলেন। আহমদ মুসার সাথে তার অনেক কথা হয়েছে। তিনি তো আহমদ মুসাকে না নিয়ে কিছুতেই যাবেন না তাঁর রাজধানীতে। পরে অবশ্যই যাবে এই ওয়াদা দিয়ে আহমদ মুসা রক্ষা পেয়েছে।
বোসনিয়া ও হারজেগোভিনাতে এই বিজয় কি করে সাধিত হলো তার জবাব আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন, জনসংখ্যার ৪০ ভাগ মুসলমান ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং তাদের প্রধান শত্রু মিলেশ বাহিনী হঠাৎ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বোসনিয়া ও হারজেগোভিনার প্রেসিডেন্ট আলিজ্য ইজ্বেত হাসান সেনজিককেও উৎসাহ দিয়ে গেছেন, নির্বাচনের জন্যে তৈরী হবার। সার্ভিয়ার মুসলিম জনসংখ্যাও বোসনিয়ার মতই। আর হাসান সেনজিক তাদের সবারই প্রিয়। সুতরাং সাহসের সাথে তাকে জাতির নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে।
আনন্দের সাথে সাথে দিনগুলো এ্যাকশনের মধ্যে দিয়েও কেটেছে।
সেদিন হাসান সেনজিকের বাড়ীতে কনষ্টানটাইন নিহত হবার পর আহমদ মুসা জাকুবকে নিয়ে ডেসপিনার ওখানে আসে এবং ঐ রাতেই মাজুভ ও জাকুবকে সাথে নিয়ে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়র্টারে আবার হানা দেয়। কোন বাধাই তারা পায়নি। তাদের আগমন টের পেয়েই কয়েকজন যারা ছিল পালিয়ে যায়।
আহমদ মুসা মিলেশ বাহিনীর অফিস অনুসন্ধান করে তাদের কাগজপত্র ও দলিল দস্তাবেজ হস্তগত করে। কনষ্টানটাইনের পার্সোনাল ফাইল ক্যাবিনেটের গোপন কুঠুরীতে কিছু যুগোশ্লাভ দিনার সহ প্রায় ১লাখ মার্কিন ডলার পায়। আহমদ মুসা টাকায় হাত দেয়নি। আহমদ মুসা তিন তলা থেকে কনষ্টানটাইনের স্ত্রীকে ডেকে এনেছিল। তার সামনেই সে এ অনুসন্ধানের কাজ করেছে। কনষ্টানটাইনের স্ত্রী প্রথমে আসতে ভয় করেছে। আহমদ মুসা স্বয়ং গিয়ে তাকে অভয় দিয়ে নিয়ে এসেছে। আহমদ মুসা প্রাপ্ত টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছে, আমরা মিলেশ বাহিনী সংক্রান্ত কাগজপত্র অনুসন্ধানের জন্যে এসেছি, টাকার জন্যে নয়।
গোটা সময় কনষ্টানটাইনের স্ত্রী একটা কথাও বলেনি। ভয় ও শোকে যেন সে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
অনুসন্ধান শেষে বিদায়ের সময় আহমদ মুসা কনষ্টানটাইনের স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আপনাকে বিরক্ত করতে হলো, এজন্যে দুঃখিত।
বলে আহমদ মুসা আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই আবার সে ফিরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, যা কিছু ঘটে গেল, তার জন্যে আমরা দায়ী নই। আমরা আত্মরক্ষা করেছি মাত্র।
‘এই যে রাতে এখানে হানা দিলেন, এটাও কি আত্মরক্ষার জন্য?’ এটাই প্রথম কথা ছিল কনষ্টানটাইনের স্ত্রীর।
উত্তরে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘হ্যাঁ আত্মরক্ষার জন্যেই এই হানা। মিলেশ বাহিনীর রেকর্ড থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিলেশ বাহিনীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আরও সম্যক ধারণা আমরা পেতে চাই।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল যাবার জন্যে। ‘শুনুন’ পেছন থেকে ডেকে উঠেছিল কনষ্টানটাইনের স্ত্রী।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়ালে কনষ্টানটাইনের স্ত্রী বলেছিল, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলেন না?
‘কোথায় শত্রু?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কেন আমি এবং আমার সন্তানেরা?’
‘না আপনাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই।’
‘আমার স্বামী থেকে আমি এবং আমার সন্তান বিচ্ছিন্ন নই।’
‘তা ঠিক, কিন্তু কনষ্টানটাইন আপনারা নন। আপনার কাছে পিস্তল আছে, কিন্তু সুযোগ পেয়েও আপনি সে পিস্তল ব্যবহার করেননি। কনষ্টানটাইন হলে সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করতো না।’ একটু হেসে বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কেমন করে জানলেন আমার কাছে পিস্তল আছে?’ চোখে বিস্ময় টেনে বলেছিল কনষ্টানটাইনের স্ত্রী।
‘আপনি পিস্তল হাতে না নিয়ে শত্রুর ডাকে আসতে পারেন না। সন্ধ্যা রাতে আপনিই তিনতলা থেকে গুলি করেছিলেন।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছিল কনষ্টানটাইনের স্ত্রীর চোখে। সে বলেছিল, তাহলে তো প্রমাণ হলো আমি আপনার শত্রু। কিন্তু বললেন যে আপনার শত্রু নই।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। বলেছিল, বলেছিতো আপনি পিস্তল ব্যবহার করেননি, যা করতো কনষ্টানটাইন।
কনষ্টানটাইনের স্ত্রী তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দেয়নি। সে গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। একটুক্ষণ নিরব থেকে সে আহমদ মুসার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, আমার একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আমার স্বামী কি করতেন আমি জানি। তিনি এ অবস্থায় আপনার পরিবারকে ছাড়তেন না।’
‘একজনের অপরাধে অন্যের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ মুসলমানরা করে না, এ অনুমতি ইসলামে নেই। ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে এসেছিল।
আহমদ মুসা মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়র্টারে মূল্যবান অনেক তথ্য পেয়েছিল। তার মধ্যে মিলেশ বাহিনীর বিভিন্ন শাখা অফিসের ঠিকানা এবং লোকদের পরিচয়। এই তথ্য গুলোই আশু প্রয়োজন ছিল আহমদ মুসার।
মিলেশ বাহিনীর শাখা অফিসগুলো ভেঙ্গে দেয়া এবং পরিচয় প্রাপ্ত লোকদের পাকড়াও করার পরিকল্পনা আহমদ মুসা সেই রাতেই গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা মোতাবেক আহমদ মুসা, মাজুভ, জাকুব এবং সালেহ বাহমন হোয়াইট ক্রিসেন্টের কর্মীদের সাথে নিয়ে গোটা যুগোশ্লাভিয়ার এ শহর থেকে সে শহরে, এ শাখা ঘাটি থেকে সে শাখা ঘাটিতে দিনের পর দিন পাগলের মত ছুটে বেড়ান। পরিশ্রমের ফলও তারা লাভ করে। মিলেশ বাহিনীর গোটা অবকাঠামোই ভেঙ্গে পড়ে, মাত্র দেড় সপ্তাহে মিলেশ বাহিনীকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হয়। সেই সাথে হোয়াইট ক্রিসেন্টের শক্তিশালী একটা কাঠামো গড়ে তোলা হয়।
এই বিজয়ের পর পরই খবর আসে বোসনিয়া ও হারজেগোভিনা রাজ্যে মুসলমানদের নির্বাচন বিজয়ের। এই বিজয়-সংবাদের উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যেই ডেসপিনা এবং নাদিয়ার বিয়ে আনুষ্ঠিত হয়।
এ সবের মধ্য দিয়ে সপ্তাহ তিনেক সময় কোন দিক দিয়ে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলো না আহমদ মুসা।

মাজুভের সাথে মাজুভের বোনের বাড়িতে উঠেছিল আহমদ মুসা। সেখানেই সে অবস্থান করছে। হাসান সেনজিক তার বাড়িতে যাবার জন্যে আহমদ মুসাকে অনুরোধ করেছে, জেদ করেছে, কিন্তু আহমদ মুসা যায়নি। হেসে বলেছে, স্থান পরিবর্তন না করে যেখানে এসে উঠেছি সেখানেই থাকি। যাচ্ছি তো তোমাদের বাড়িতে প্রতিদিনই। ডেসপিনা অভিমান করেছে। তার জবাবে আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলেছে, বোনদের কাছ থেকে দূরে যেতেই হবে, তাই আর কাছে যেতে চাই না।
সেদিন মাজুভের বোনের বাড়িতে হাসান সেনজিক এবং সালেহ বাহমন ও ওমর বিগোভিক পরিবারের দাওয়াত ছিল।
আহমদ মুসা খুব সকালে বাইরে গিয়েছিল। ফিরল ১১টার দিকে।
ভেতরে ফ্যামিলি ড্রইংরুমে বসেছিল নাতাশা, ডেসপিনা, নাদিয়া এবং মাজুভের বোন।
আহমদ মুসা বাইরের ড্রইংরুমে এসে বসার সাথে সাথেই ডেসপিনা দরজায় পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়াল। বলল, ভাইয়া, আপনি বেরিয়ে যাবার পরপরই ভাবী টেলিফোন করেছিলেন। ঠিক সময়ে এসেছেন, ১১টার পরেই ভাবী টেলিফোন করতে চেয়েছেন।
‘জরুরী কিছু বলেছে?’ উদ্বেগ ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কণ্ঠে।
‘না তেমন কিছু নয় আপনি টেলিফোন করে তাঁকে পাননি, তাই তিনি টেলিফোন করেছিলেন।’ বলল ডেসপিনা। এই সময় এসে ড্রইংরুমে ঢুকল মাজুভ, সালেহ বাহমন, জাকুব এবং হাসান সেনজিক।
ওরা সবে বসেছে, এই সময়ই ভেতর থেকে নাতাশা বলে উঠল, এসেছে টেলিফোন।
মাজুভ কিছু জানত না। সে বলে উঠল, কার টেলিফোন, কিসের টেলিফোন?
‘ভাইয়ার টেলিফোন, সিংকিয়াং থেকে ভাবী করেছেন।’ বলল নাতাশা।
মাজুভ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে নাতাশার কাছ থেকে টেলিফোনের কর্ডলেস রিসিভার নিয়ে এসে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরে সালাম দিল। আমিনা সালাম নিয়ে বলল, কেমন আছ?
-ভালো।
-তুমি কাল যখন টেলিফোন করেছিলে আমি আম্মাকে নিয়ে তখন মার্কেটে গিয়েছিলাম। তুমি কবে পৌঁচেছ যুগোশ্লাভিয়ায়?
-আর্মেনিয়া থেকে এসেছি একমাস হলো। আর যুগোশ্লাভিয়ায় এসেছি ২৭দিন।
-সকালে ডেসপিনা, নাতাশা ও নাদিয়ার সাথে কথা বলেছি। তোমার প্রশংসা করতে করতেই সময় শেষ করেছে। আমি খুব খুশি হয়েছি।
-কেন? কিসে?
-কেন তোমার গৌরবে।
-গৌরব আমার নয়, তোমার। তোমার ত্যাগটাই বড়।
-কি ত্যাগ করলাম?
-কেন তোমার অধিকার ত্যাগ করেছ।
-ইস, চাইলেই তো অধিকারকে ধরে রাখতে পারতাম না।
-পারতে কিনা আমি জানি এবং তুমিও জান।
-তাই?
-কেন, এয়ারপোর্টে আসার পথে কি বলেছিলে মনে পড়েনা? তুমি আমাকে থাকতে বলোনি, সে কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?
-তোমার এত কথা মনে থাকে! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
-দেখ, সব আবার ভুলে না যাও।
-আমি এক বন্দিনী, আমার গবাক্ষে আকাশ একটাই। আমি সারাক্ষন ওর দিকেই চেয়ে থাকি। আর মুক্ত বিহঙ্গ তুমি। প্রতি মুহূর্তেই তোমার কাছে নতুন আকাশ। ভোলার ব্যাপারটা তোমার ক্ষেত্রেই খাটে।
-তোমার বুঝি আশংকা হয়?
-কই তুমি তো জিজ্ঞাসা করলেনা আমি কেমন আছি?
-আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনা।
-কেমন?
-অসত্য বলার বিপদে তোমাকে ফেলতে চাইনি। তুমি ভাল না থাকলেও বলবে ভাল আছি।
-তুমিও কি তাই বলেছ নাকি?
-আমি মিথ্যা বলিনি। ভাল থাকার অনেক দিক আছে। শরীর ভাল থাকা, মন ভাল থাকা, পরিবেশ ভাল থাকা ইত্যাদি। আমি ভাল পরিবেশে আছি।
-তার মানে তোমার শরীর ভাল নেই? উদ্বেগ ঝরে পড়ল আমিনার কন্ঠে।
-চিন্তা করোনা। আমবার্ড দুর্গে মাথায় যে আঘাত পেয়েছিলাম। সেটা এখন ভাল। আর্মেনিয়া থেকে আসার সময় বাম বাহুতে বুলেটের যে আঘাত নিয়ে এসেছিলাম সেটা সেরে গেছে। এখানে কপালের দু’পাশে আঘাত পেয়েছিলাম সেটাও এখন আর নেই। সুতরাং শারীরিক ভাবেও আমি ভাল আছি।
-আল্লাহ তোমাকে সুস্থ রাখুন। কবে আসছ তুমি?
-বলকানের কাজ শেষ। তবে তোমার কাছে ফিরতে পারছি না। আমাকে স্পেনে যেতে হচ্ছে এবং আজকেই যাচ্ছি। গতকাল তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম একথা বলার জন্যেই। তোমার সম্মতি চাই।
-আবার চাইতে হয় বুঝি, সম্মতি কি তোমাকে দেইনি?
-দিয়েছ। তবু বার বার আমি নিশ্চিত হতে চাই আমি জুলুম করছি না। ঘরে এবং বাইরে উভয় জুলুমই সমান অপরাধের।
-তোমার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করো না, তুমি যে কাজ করছ তা আমারও কাজ।
-ধন্যবাদ আমিনা। আল্লাহ তোমাকে জাযাহ দিন।
-স্পেনে কেন যাচ্ছ?
-মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে একটা ডকুমেন্ট পেয়েছি। একটা ষড়যন্ত্র। সেটাকে কেন্দ্র করেই আমাকে যেতে হচ্ছে।
একটু থেমেই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে আহমদ মুসা বলল, দেশের খবর বল।
-তোমাকে পেয়ে দেশের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। দেশের ভেতরের দৃশ্যটা ভালো নয়।
-কি সেটা?
-একদিকে যেমন চীনকে আরও গণতান্ত্রিক করে গড়ে তোলার চেষ্টা ছাত্র-তরুণদের মধ্যে প্রবল, অপরদিকে তেমন মাওবাদী স্বৈরতন্ত্র জিইয়ে রাখার একটা ষড়যন্ত্র কাজ করছে এবং এই ষড়যন্ত্র ক্রমেই সরকার ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করছে।
-খুব খারাপ খবর শোনালে আমিনা। যদি এই ষড়যন্ত্র উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পায়, তাহলে সিংকিয়াংসহ মুসলিম অঞ্চলের অধিবাসীরা যে সুযোগ পেয়েছে তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
-হ্যাঁ এটাই চিন্তার বিষয়।
-আমিনা, তুমি আহমদ ইয়াংসহ সবাইকে আমার পক্ষ থেকে জানাবে তারা যেন সব রকমের পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুতি নেয়, প্রস্তুত থাকে।
-জানাব। আর কিছু বলবে তুমি আমাকে?
-তোমাকে একটা সুখবর জানাতে চাই। তোমাকে নিয়ে এক সাথে এ বছর হজ্জ্ব করার ইচ্ছা আছে আমার।
-আল-হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করুন, আর সে সৌভাগ্য আল্লাহ আমাকে দান করুন।
-রাখি আজকের মত।
-আচ্ছা খোদা হাফেজ।
-আসসালামু আলাইকুম।
আহমদ মুসা সালামের জবাব দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল।
মাজুভ, হাসান সেনজিক, সালেহ বাহমন সকলেই আহমদ মুসার পাশেই বসেছিল। আর ভেতরের ড্রইংরুমে ছিল নাতাশা, নাদিয়া, ডেসপিনা এবং মাজুতের বোন। আহমদ মুসা অনুচ্চ কন্ঠে কথা বলছিল, তবু তার প্রত্যেকটি কথাই সকলে শুনেছে। প্রথমে সবাই মজা পেয়েছে, কিন্তু যখন শুনেছে আহমদ মুসা স্পেনে যাচ্ছে এবং আজই যাচ্ছে, তখন সকলেরই হাসিখুশী উবে গেছে, সকলেই হয়ে পড়েছে বিস্মিত এবং বিষাদে আচ্ছন্ন।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখার সাথে সাথে সবাই তাকে ঘিরে ধরল।
হাসান সেনজিক বলল, আপনি ভাবীকে ওটা কি কথা বললেন?
-কি কথা? বলল আহমদ মুসা।
-আপনি স্পেনে যাচ্ছেন এবং আজই যাচ্ছেন। বলল মাজুভ।
-হ্যাঁ যাচ্ছি। ম্লান হেসে বলল আহমদ মুসা।
-না আপনার যাওয়া হবে না, আজ তো কিছুতেই নয়। দৃঢ় কন্ঠে বলল হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা হাসল। পকেট থেকে বিমানের টিকেট বের করে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল বিকেল ৩টায় প্লেন। তোমরা জেদ করো না ভাই।
কেউ কোন কথা বলল না। সবাই একবার প্লেনের টিকেটের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করল।
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সবার কন্ঠ।
অনেকক্ষণ পর হাসান সেনজিক অভিমান-রুদ্ধ কন্ঠে বলল, আমরা কি আপনার কেউ নই যে, আপনি এভাবে পালাচ্ছেন?
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের পিঠে একটা হাত রেখে ম্লান হেসে বলল, তুমি উল্টো কথা বলছ হাসান সেনজিক। বিদায় যেখানে কষ্টের, সেখানেই তো মানুষ পালায়। আর বিদায় কষ্টের হয় আপনজনদের কাছেই।
-না মুসাভাই আমরা আপনাকে এভাবে কিছুতেই যেতে দেব না। কান্না জড়ানো কন্ঠ হাসান সেনজিকের।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। সোফায় হেলান দিল। তারপর বলল, হাসান সেনজিক তোমার মনে আছে আলবেনিয়ার সমুদ্র সৈকতে এক নিরব সন্ধ্যায় আড্রিয়াটিকের কাল বুকের উপর চোখ রেখে তুমি স্পেনের একটা গল্প বলেছিলে। এক বৃদ্ধ প্রতিদিন সন্ধ্যায় গোয়াদেল কুইভার নদীর কার্ডোভা ব্রীজের রেলিং এ এসে বসত। নিরবে তাকিয়ে থাকত কর্ডোভার ভগ্ন প্রাসাদে ‘আল কাজারের’ দিকে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ত তার চোখ থেকে অবিরল ধারায়। মিশে যেত তা গোয়াদেল কুইভার নদীর স্রোতের সাথে। জিজ্ঞাসা করলে সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত। একদিন সে উঠে দাড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়নি। বলেছিল তোমাকেঃ ‘আমি অতীতের এক বিধ্বস্ত অবশিষ্ট, তাকিয়ে আছি অতীতের এক ধ্বংস-স্তুপের দিকে ‘আমার কান্নার আর কোন ব্যাখ্যা নেই।’ আমি তোমার বলা এই বৃদ্ধের কান্নার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম হাসান সেনজিক। কিন্তু সেদিন মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যে কাগজ পত্র পেয়েছিলাম, তার মধ্যে স্প্যানিশ কু-ক্ল্যাকস-ক্ল্যানের যে কয়েকটা ডকুমেন্ট পেয়েছি তা বৃদ্ধের সেই কান্নাকে আমার সামনে আবার বড় করে তুলে ধরেছে। একটি ডকুমেন্টে স্পেনের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ এক ষড়যন্ত্রের বিবরণ আছে। স্পেনের কু-ক্ল্যাকস-ক্ল্যান মিলেশ বাহিনীর মাধ্যমে কেজিবি’কে অর্থ দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এক বিশেষ ধরণের তেজস্ক্রিয় আমদানি করেছে। এই তেজস্ক্রিয়ের ধীর ক্রিয়া পুরো কংক্রিটের নতুন একটি বিল্ডিংকেও মাত্র ৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, এই তেজস্ক্রিয় বিল্ডিং ব্যবহারকারীদের প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস সহ তাদেরকে ধীর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় যদি যথাসময়ে তারা প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে। স্পেনের কু-ক্ল্যাকস-ক্ল্যান এই তেজস্ক্রিয় মাদ্রিদে কোটি কোটি ডলারের সৌদি অর্থ সাহায্যে নির্মিত মসজিদ কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। এছাড়া কর্ডোভা, গ্রানাডা, টলেডো, মালাগা প্রভৃতি এককালের মুসলিম সিটি গুলোতে যে মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য সমূহ এখনও বর্তমান আছে সেগুলো ধ্বংসের কাজেও এই তেজস্ক্রিয় ব্যবহার করা হচ্ছে। বহু বছরের বহু চেষ্টা সাধনার পর মাদ্রিদে নতুন মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে স্পেনে মুসলমানদের যে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে তাকে এই ভাবে তারা ধ্বংস করতে চায়। ডকুমেন্টে কোন তারিখ নেই। এই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন কবে থেকে শুরু হয়েছে জানি না। সুতরাং ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী। এই ষড়যন্ত্রকে যদি যথাসময়ে রোধ করা না যায়, তাহলে শুধু মসজিদগুলো ধ্বংস হবে তা নয়, মসজিদগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট গোটা মুসলিম কম্যুনিটি ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসান সেনজিক তুমি গোয়াদেল কুউভার নদীর সেতুর উপর বসা বৃদ্ধের চোখে যে অশ্রু দেখেছ সেই অশ্রু ঐ বৃদ্ধের নয়, সেটা কর্ডোভার অশ্রু, গ্রানাডা, মালাগা, টলেডোর অশ্রু। যদি ঐ ষড়যন্ত্র বানচাল করা না যায় তাহলে স্পেনে অশ্রুর আরেক অধ্যায় রচিত হবে। আহমদ মুসা থামল।
হাসান সেনজিক, মাজুভ, সালেহ বাহমন, জাকুব এবং ভেতরে ডেসপিনা, নাদিয়া, নাতাশা সকলেই সমোহিতের মত আহমদ মুসার কথা শুনছিল।
আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। সবার মাথা নিচু, সবাই নিরব।
ভেতর থেকে ডেসপিনা কথা বলে উঠল। বলল, স্পেনে আমাদের ভাইদেরকে এ ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দিলেই তো হয়ে যায় ভাইয়া।
‘কু-ক্ল্যাকস-ক্ল্যান অত্যন্ত ভয়ংকর সংগঠন। তারা ঠান্ডা মাথায় নিরবে কাজ সারতে চাচ্ছে। কিন্তু যখনি দেখবে তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখনি তারা হয়ে উঠবে ভয়ংকর। সাপের মত নিঃশব্দে জীবন-বিনাশী ছোবল মেরে চলবে একের পর এক।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই শিউরে উঠল। কু-ক্ল্যাকস-ক্ল্যানের কথা কমবেশি সকলেই জানে।
ডেসপিনাই আবার কথা বলল, ‘কিন্তু আপনি একা ওদের বিরুদ্ধে…….’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল ডেসপিনা।
‘আমি একা কোথায়। আল্লাহ আছেন সাথে। আর ওদের আমি কিছুটা চিনি। ফিলিস্তিনে এবং মিন্দানাও-এ ওদের আমি মোকাবিলা করেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আচ্ছা, মুসা ভাই একটা কথা বলব। আপনার দায়িত্ব চিন্তার বাইরে এসে আপনি আপনার মনের কথা কি কখনও ভাবেন, কখনও কি ফিরে তাকান আপনার মনের দিকে?’ ভারী কন্ঠে বলল হাসান সেনজিক।
‘কেন, মন কি আমার মাথা থেকে ভিন্ন সংসারে বাস করে মনে কর?’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
‘না, মুসা ভাই, ককেশাস থেকে বিদায়ের সময় সালমান শামিল, সোফিয়া এ্যাঞ্জেলাদের কান্না আমি দেখেছি, আলবেনিয়ার মোস্তফা ক্রিয়া ও সালমা সারাকায়াদের কান্নাও আমি দেখেছি, আমি শুনেছি আরো পেছনের অনেক কান্নার কথাও। এত কান্নার স্মৃতি যার বুকে তার মন কেমন করে সুস্থ থাকতে পারে।’ গম্ভীর কন্ঠে বলল হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা আবারো হাসল। বলল, হাসান সেনজিক, জীবনটা পায়ে চলার পথ। এ চলার পথে হাসি এবং কান্না উভয়ের সঞ্চয়ই তোমার থাকবে। সে সঞ্চয় নিয়ে তুমি হাসবে, কাঁদবে, পেছনেও ফিরে তাকাতে পার বার বার, কিন্তু থমকে দাঁড়াতে পারো না। কাল এবং জীবন উভয়ই বহমান, স্থবির নয়।
আহমদ মুসা থামলে কথা বলে উঠল নাতাশা। বলল, ভাইজান, কোন স্থান বা কারো মায়ার বাধনে বাঁধা পড়া বহমান জীবনের প্রতিকুল তো নয়।
‘ঠিক। কিন্তু সামনে থেকে আরও অশ্রুর হাতছানি, আরো দায়িত্বের আহ্বান যদি টেনে নিয়ে যায় কাউকে সামনে, তাহলে সেটাও জীবনের একটা বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকেও স্বীকার করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুসা ভাই, আপনি বলেছেন চলার পথে না থেমেও পেছন ফিরে তাকাতে পারি। আপনি পেছন ফিরে তাকান না? কত হাসি, কত কান্না, কত ঘটনার মিছিল আপনার পেছনে। আপনার কষ্ট হয় না?’ বলল মাজুভ।
‘অতীত শুধু কষ্টের নয়, অনুপ্রেরণারও। আমি অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি অতীত থেকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিছুই কষ্ট লাগেনা? এই আমরা যারা আপনার এত নিকট, আমরা সবাই কি আপনার জীবন থেকে হারিয়ে যাব?’ ভারি কন্ঠে বলল হাসান সেনজিক।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, হাসান সেনজিক এটাই সবচেয়ে কষ্টের যে মানুষ ইচ্ছা করলেই তার স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারে না। তাই মানুষের কর্মহীন দিনের অবসর মুহুর্ত এবং ঘুমহীন রাতের নিরব প্রহরগুলো অনেক সময়ই তার জন্যে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।’
‘আচ্ছা মুসা ভাই, আপনার ঘটনাবহুল জীবনের কোন ঘটনাটি আপনার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে? আপনি কিন্তু এ প্রশ্রের জবাব দেয়ার জন্যে ওয়াদাবদ্ধ আছেন।’ হেসে বলল হাসান সেনজিক।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল আহমদ মুসা। বলল, দুঃখিত হাসান সেনজিক তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি পারছি না। কাকে ছেড়ে আমি কার কথা বলব, অতীতকে আমি এভাবে বাছাই করতে পারবো না।
‘অতীত থাক, সবচেয়ে সাম্প্রতিক একটা বলুন।’ জেদ ফুটে উঠল হাসান সেনজিকের কন্ঠে।
আহমদ মুসা ধীর কন্ঠে বলল, ‘আমি সেদিন কনষ্টানটাইনের স্ত্রীর মুখোমুখি হতে গিয়ে খুব কষ্ট অনুভব করেছি। সে যখন বলেছে আমার উপর, আমার সন্তানদের উপর প্রতিশোধ নিলেননা কেন তখন আমার মন বেদনায় চিৎকার করে উঠতে চেয়েছে। ঠিক এ রকমই হয়েছিল আমি যখন ককেশাসের হোয়াইট ওলফের নেতা মাইকেল পিটারকে হত্যার পর তার স্ত্রী সভেতলানা এবং শিশু কন্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। খবর শুনেই সভেৎলানা জ্ঞান হারিয়েছিল, আর তার মা’র জ্ঞান হারানো দেখে শিশু কন্যা কেঁদে উঠে জিজ্ঞাসা করেছিল তার মা’র কি হয়েছে? অবুঝ শিশুর ঐ প্রশ্নের মুখে আমার সমগ্র সত্তা অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় কেঁদে উঠেছি।’
বলতে বলতে আহমদ মুসার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠল, তার দু’চোখের কোণায় দেখা দিল দু’ফোটা অশ্রু। থামল আহমদ মুসা।
সবাই নিরব। আহমদ মুসার অনুভূতি সবাইকেই যেন স্পর্শ করেছে।
পরে সালেহ বাহমন বলল, মুসা ভাই এত নরম মন নিয়ে এত কঠিন কাজ আপনি করেন কি করে? শত্রুকে, শত্রুর পরিবারকে, শত্রুর সম্পদকে ধ্বংস করাইতো সাধারণ ব্যাপার।
‘না বাহমন, ইসলামে নারী, শিশুর গায়ে হাত দিতে নিষেধ করা হয়েছে। ঘোষিত যুদ্ধের সময়ও নারী, শিশু এবং শত্রুর শস্য ক্ষেতের ক্ষতি না করতে মুসলিম সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হতো।’
ভেতর থেকে এ সময় নাতাশা বলে উঠল, মুসা ভাই এর টেলিফোন।
মাজুভ কর্ডলেস রিসিভার এনে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা টেলিফোনের মেসেজটি শুনে নিয়ে টেলিফোন রেখে হেসে বলল, বিমানের দু’ঘন্টা লেট হবার কথা ছিল তা হচ্ছেনা। এখন ঠিক সময়েই প্লেন ছাড়ছে। অর্থাৎ ১টায় বোর্ডিং।
খবর শুনে সকলের মুখেই বিষাদ নেমে এল। ভেতর থেকে ডেসপিনা ও নাদিয়া প্রায় এক সঙ্গেই ভারি কন্ঠে বলে উঠল ভাইজান, নিষ্ঠুরের মতো আপনি আমাদের কাছ থেকে পালাচ্ছেন।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিলনা। ম্লান হেসে সোফায় গা এলিয়ে দিল।
মাজুভ উঠে দাঁড়াল। বলল, মুসা ভাই আপনার গোছ-গাছ তো কিছুই হয়নি।
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কাপড়-চোপড়গুলো ব্যাগে ভরে দাও হাসান সেনজিক। আর মাজুভ ফার্ষ্ট এইডের কয়েকটা জিনিস শেষ হয়েছে। তুমি গিয়ে দেখ, কিনে আনতে হবে।
মাজুভ এবং হাসান সেনজিক ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সালেহ বাহমন ও জাকুব উঠতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, তোমরা বস তোমাদের হোয়াইট ক্রিসেন্ট সম্পর্কে আরও কয়েকটা কথা বাকি আছে।
ওরা আবার বসল।
ভেতর থেকে নাতাশা বলল, খাবার রেডি ভাইজান।
একটু থেমে নাতাশা বলল, ডেসপিনা ও নাদিয়া কাঁদছে।
‘ডেসপিনা, নাদিয়া বোন, তোমাদের এ কান্না আমার জন্যে বেদনাদায়ক হবে। সব তোমরা শুনেছ। অনেক ভাই, অনেক বোনের বিপদ ও দুঃখ-বেদনার কথা স্মরণ করে তাদের সাহায্যে ভাইকে তো হাসি-মুখে তোমাদের বিদায় দেয়া উচিত।’
‘মাফ করবেন আমাদের, এমনভাবে আপনি যাবেন তা আমরা কেউ ভাবিনি। আমার বাড়ি, নাদিয়ার বাড়ি কারো বাড়িতেই আপনি একদিনও থাকলেন না।’ বলল ডেসপিনা কান্না জড়িত কন্ঠেই।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ঠিক আছে এবার এলে তোমাদের ওখানেই উঠবো।
বলে আহমদ মুসা সালেহ বাহমন ও জাকুবের দিকে মনোযোগ দিল।

ঠিক বেলা ১টায় বেলগ্রেড বিমান বন্দর থেকে যুগোশ্লাভ এয়ার ওয়েজের একটা বিমান আকাশে উড়ল।
নিচে গ্যাংগুয়েতে দাঁড়িয়ে আছে হাসান সেনজিক, সালেহ বাহমন, মাজুভ, জাকুব, নাতাশা, ডেসপিনা এবং নাদিয়া।
তাদের সকলের চোখ পাখা মেলে উড়ে উঠা প্লেনের দিকে। তাদের কারোরই চোখ শুকনো নেই। অশ্রু গড়াচ্ছে সবার চোখ থেকেই। প্লেনটা যতই দুরে সরে যাচ্ছে, হৃদয়ের কোথায় যেন টানটা তাদের তীব্রতর হচ্ছে।
ওদিকে প্লেনের সিটে বসা আহমদ মুসার সামনে স্পেনের মানচিত্র। আর চোখে ভাসছে কর্ডোভা, গ্রানাডা, টলেডো প্রভৃতি বিধ্বস্ত নগরীর দৃশ্য আর গোয়াদেল কুইভার নদীর সেতুতে দাঁড়ানো সেই বৃদ্ধের অশ্রু ধোয়া মুখ।

সাইমুম সিরিজের পরবর্তী বই
কর্ডোভার অশ্রু

Top