১১. দানিয়ুবের দেশে

চ্যাপ্টার

ঐ দিনই সন্ধ্যায় আহমদ মুসা আবার বেরুল শহীদ মসজিদ রোডে যাবার জন্যে। এবার সাথে মাজুভ। আহমদ মুসা একাই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মাজুভ নাছোড়বান্দা, একা ছাড়তে রাজী হয়নি আহমদ মুসাকে। তবে আহমদ মুসার সাথী হওয়ার জন্যে মাজুভকে ছদ্মবেশ নিতে রাজী হতে হয়েছে। মুখে গোঁফ লাগাতে হয়েছে, সেই সাথে লাগাতে হয়েছে কানের নিচ পর্যন্ত জুলফি।
আহমদ মুসা জীপে উঠে বলল, শহীদ মসজিদ রোডে ঢুকেছিলাম পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে। আর কোন রাস্তা নেই শহীদ মসজিদ রোডে ঢোকার?
মাজুভ বলল, আছে। পূব প্রান্ত এবং অন্য আরেকটি লেন দিয়েও আমরা ঢুকতে পারি। তবে সেটা কিছু গলিপথের মত হবে।
‘সেটাই তো ভালো।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ী ষ্টার্ট দিল।
বিভিন্ন গলিপথ ঘুরে আহমদ মুসার জীপ যখন শহীদ মসজিদ রোডে প্রবেশ করল তখন সন্ধ্যার লালিমা কেটে পুরোপুরি রাত নেমে এসেছে।
পুরানো বেলগ্রেডের মূল এলাকা এটা। বাড়িগুলো পুরানো, রাস্তাগুলোও সংকীর্ণ। সেই তুলনায় শহীদ মসজিদ রোড বলা যায় বেশ প্রশস্ত।
আহমদ মুসা ধীর গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করে এগুচ্ছিল। হাসান সেনজিকের বাড়ি বরাবর পৌঁছে গাড়ি দাঁড় করানো তার লক্ষ্য।
হাসান সেনজিকের বাড়ি রাস্তার উত্তর পাশে, আর সে গাড়ি চালাচ্ছিল রাস্তার দক্ষিণ পাশ দিয়ে।
রাস্তা, ফুটপাত বেশ আলোকোজ্জ্বল।
সামনেই রাস্তার উত্তর পাশে বিশাল পুরানো গেট দেখেই আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের বাড়ি চিনতে পারল। যে বর্ণনা সে শুনেছিল, তার সাথে মিলে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নামল। বলল, মাজুভ গাড়ি নিয়ে তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি বাড়ির সামনেটা একটু ঘুরে আসি।
আহমদ মুসার গায়ে লম্বা ওভার কোট। মাথায় ফেল্ট হ্যাট। কপাল পর্যন্ত নামানো।
আহমদ মুসা রাস্তা পার হয়ে ওপারের ফুটপাতে গিয়ে উঠল।
ফুটপাতের যেখানে গিয়ে উঠল, সেখানে কতকগুলো দোকান, রাস্তা বরাবর সারিবদ্ধ। দোকানগুলোর পরেই হাসান সেনজিকের বাড়ি।
আহমদ মুসা যখন ফুটপাতে উঠছে, ঠিক সে সময় তার পাশেই একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে নামল কয়েকজন লোক। আহমদ মুসার সামনে দিয়েই ওরা নামল।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো।
গাড়ির দু’দরজা দিয়ে দু’জন প্রথমে নেমে এসে ফুটপাতে দাঁড়াল। তারপর আরেকজন গাড়ি থেকে নেমে একজনকে হাত ধরে টেনে নামাল।
যাকে হাত ধরে টেনে নামাল, সে ফুটপাতে এসে দাঁড়াতেই তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে দিল। তারপর তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে দোকানের দিকে নিয়ে চলল।
আহমদ মুসা সেই লোকটির দিকে চেয়ে চমকে উঠল। এ যে জাকুব!
আহমদ মুসা এক অমোঘ টানে সেই লোকদের পেছনে পেছনে চলল।
জাকুবকে নিয়ে লোকগুলো সামনের দোকানগুলোর পুব প্রান্তের দোকানে ঢুকল।
দু’জন দোকানের কাউন্টারে দাঁড়াল। আরেক জন জাকুবকে টেনে নিয়ে কাউন্টারের ভেতরে চলে গেল।
সেলসম্যান ছেলেটির চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। জাকুবকে সে চিনতে পেরেছে। তাতেই তার আতংক আরও বেড়েছে। জাকুবকে কেন এখানে ধরে আনা হতে পারে, তা কিছু কিছু সে বুঝতে পারে।
যে লোকটি জাকুবকে নিয়ে কাউন্টারের ভিতরে প্রবেশ করেছে, সে জাকুবকে দেখিয়ে সেলসম্যান ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, চেন তুমি এ-কে?
সেলসম্যান ছেলেটি কোন উত্তর দিল না।
একই প্রশ্ন আবার জিজ্ঞাসা করল লোকটি সেলসম্যান ছেলেটিকে।
ছেলেটি কোন জবাব দিল না। বোবা দৃষ্টি মেলে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল।
লোকটি রিভলভার বের করল। রিভলভারটি ছেলেটির কপাল বরাবর তুলে ধরে বলল, তুমি সব জান, তোমাকে বলতে হবে সব। সেদিন একজন লোক এখানে খুন হয়েছে। এই লোকটি তার সাথে জড়িত ছিল।
সেলসম্যান ছেলেটি মুখ খুলল না।
লোকটির মুখ শক্ত হয়ে উঠল। চোখ জ্বলে উঠল তার। তার তর্জ্জনিটি হঠাৎ চেপে বসল রিভলভারের ট্রিগারের উপর। বেরিয়ে এল রিভলভার থেকে একটা গুলি। কপাল ফুটো করে তা ঢুকে গেল সেলসম্যান ছেলেটির মাথায়। লুটিয়ে পড়ল ছেলেটি মেঝের উপর।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে ছিল দোকানের বাইরে। ধীরে ধীরে সে এগুলো দোকানের দিকে। ঢুকল দোকানে। যেন সে রিভলভারের গুলির আওয়াজ শুনে প্রবেশ করেছে এমন ভাব নিয়ে।
আহমদ মুসা যখন কাউন্টারের পাশে দাড়াল, ঠিক তখনই লোকটির রিভলভার ঘুরে গেছে জাকুবের দিকে। জাকুবের কপাল বরাবর রিভলভার তুলে লোকটি বলল, সেলসম্যান ছেলেটির মৌনতাই প্রমাণ করে তুমি অপরাধী, হত্যাকারী।
বলে সে ট্রিগার চাপতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত বলল, থাম, কি হচ্ছে এখানে। এক সেলসম্যানকে হত্যা করলে, আবার আর একজনকে হত্যা করছ ব্যাপার কি?
লোকটি আহমদ মুসার দিকে মুখ ফিরাল। মুহুর্ত কাল চেয়ে থেকে বলল, বুঝেছি তুমিও তাহলে এর সাথী। সেদিন এর সাথে ছিলে। এখন এসেছ বাঁচাতে। তোমাকেই তাহলে আগে দেখতে হয়।
বলে লোকটি রিভলভারের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল, বেপরোয়া লোকটি নির্ঘাত গুলি করবে। আহমদ মুসার দু’টি হাত ছিল কাউন্টারের উপর। ডান হাতের কাছেই ছিল সেলসম্যানের পেপার ওয়েটটা। আহমদ মুসা সেটা তুলে নিয়ে চোখের নিমেষে ছুড়ে মারল লোকটির মাথা লক্ষ্যে।
এতদ্রুত ব্যাপারটা ঘটল যে লোকটি কিছু বুঝে উঠার আগেই ভারি পেপার ওয়েটটি বুলেটের মত ছুটে গিয়ে আঘাত করল লোকটির বাম কানের ঠিক ওপরের জায়গাটায়।
লোকটি একবার টলে উঠেই আছাড় খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
আহমদ মুসা পেপার ওয়েট ছুড়েই পকেট থেকে রিভলভার বের করে নিয়েছিল।
আহমদ মুসার সামনে সেলস কাউন্টারের পাশে যে দু’জন লোক দাড়িয়েছিল তারাও হাতে রিভলভার তুলে নিয়েছে।
আহমদ মুসা রিভলভার বের করেই সামনের লোকটিকে গুলি করেছিল, সে তখনও আহমদ মুসার দিকে রিভলভার তাক করে সারেনি। এ লোকটি গুলি খেয়ে পড়ে গেল, কিন্তু আহমদ মুসা দ্বিতীয় লোকটির গুলির মুখে পড়ে গেল। তার রিভলভারের নল তখন উঠে এসেছে আহমদ মুসার কপাল লক্ষ্যে।
রক্ষা করল জাকুব। পেপার ওয়েটের আঘাত খেয়ে যে লোকটি পড়ে গিয়েছিল, তার রিভলভারটি জাকুব সঙ্গে সঙ্গেই তুলে নিয়েছিল। দ্বিতীয় লোকটি ট্রিগার টেপার আগেই জাকুব গুলি করে তার মাথা গুড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করেনি, দোকানে যখন এসব গুলি-গোলা চলছিল, তখন মাইক্রোবাস থেকে আরও চার পাঁচজন লোক নেমে বিড়ালের মত নিঃশব্দে ছুটে এসেছে। তাদের কারো হাতে ষ্টেনগান, কারো হাতে পিস্তল, একজনের হাতে রড। ড্রাইভার লোকটিই আগে নেমেছিল রড নিয়ে।
জাকুব যখন দ্বিতীয় লোকটিকে গুলি করছিল সে সময়ই তারা আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা পেছনে পায়ের শব্দে মাথা ঘুরাতেই ওদের চার পাঁচ জনকে দেখতে পেল। কিন্তু রিভলভার তোলার আগেই রডের একটা আঘাত এসে পড়ল মাথায়।
আঘাত খেয়ে আহমদ মুসা পড়ে গিয়ে মনে হয় জ্ঞান হারাল।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার পর জাকুবও আর গুলি করতে পারে নি। ঐ পাঁচজন লোক অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আহমদ মুসা এবং জাকুবকে হিড়হিড় করে টেনে মাইক্রোবাসের দিকে নিয়ে চলল। সকলের আগে যাচ্ছে স্টেনগান ধারী লোকটি। সে আতংক সৃষ্টির জন্যে গুলি বৃষ্টি করতে করতে সামনে এগুচ্ছে।
মাজুভ দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসা কয়েকজন লোকের পেছনে দোকানের দিকে যাচ্ছে। দোকানে ঢুকে গেল তাও সে দেখল।
দোকানে গুলির শব্দ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মাজুভ। সে বেরিয়ে এল জীপ থেকে। রাস্তা পেরুতে পেরুতেই আরও দুটি গুলির শব্দ পেল। সে যখন ওপারের ফুটপাতে উঠল, তখন দেখল আর চার-পাঁচজন লোক দৌড়ে গিয়ে দোকানে উঠল।
মাজুভ দাড়িয়ে পড়ল। সে রিভলভার বের করল। এক পা দু’পা করে এগুতে লাগল। কিন্তু এই সময়েই ওরা গুলি বৃষ্টি করতে করতে ফিরে আসছে। মাজুভ ওদের গুলি বৃষ্টির মুখে পড়ে গেল।
মাজুভ দ্রুত শুয়ে পড়ে ফুটপাতের নিচে রাস্তায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। জায়গা ছিল আলো থেকে দূরে, প্রায় অন্ধকার। ওরা এদিকে খেয়াল করল না। ওরা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ-উত্তেজনায় কম্পিত হৃদয়ে মাজুভ ছুটল দোকানের দিকে।
দোকানে ঢুকে চারদিকে নজর বুলিয়ে চারটি লাশ পড়ে থাকতে দেখল। উদ্বেগে কাঁপতে লাগল মাজুভ। তাহলে কি আহমদ মুসা….। সে এক এক করে চারটি লাশেরই মুখ দেখল। না, এর মধ্যে আহমদ মুসা নেই। মনে একটু বল পেল মাজুভ। আহমদ মুসা অন্তত মরেনি। তাহলে কোথায়? সে কি সরে পড়েছে কোথাও? না, আহমদ মুসা তো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালান না। তাহলে সে কি বন্দী? আহমদ মুসাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে?
এই সময় মাজুভের নজর পড়ল সেলস কাউন্টারের গোড়ায় পড়ে থাকা একটা ফেল্ট হ্যাটের দিকে। দেখেই চমকে উঠল মাজুভ, ওটা আহমদ মুসার ফেল্ট হ্যাট। মাজুভ নীচু হয়ে ফেল্ট হ্যাটটি তুলে নিল। সে খেয়াল করল না ফেল্ট হ্যাটের অল্প দূরে একটা লোহার টুপিও পড়ে আছে।
ফেল্ট হ্যাট তুলে নিয়ে এর দিকে চোখ বুলাতে গিয়ে চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি নেমে এল মাজুভের।
একজন লোক গুটি গুটি পায়ে এসে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। সে মাজুভকে লক্ষ্য করছিল।
মাজুভ যখন ফেল্ট হ্যাট তুলে কেঁদে উঠেছিল তখন বাইরে দাড়ানো লোকটি দোকানে প্রবেশ করল।
পায়ের শব্দে চমকে উঠে মাজুভ মুখ ফিরাল। চোখ পড়ল আগন্তুক লোকটির উপর।
আগন্তুক লোকটি সালেহ বাহমন। গুলির শব্দে সেও ছুটে এসেছিল পাশের দোকান থেকে পেছন দিক দিয়ে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সেও দেখেছিল দু’জন লোককে টেনে কয়েকজন গাড়িতে তুলল। সে বুঝতে পারল মিলেশ বাহিনীর হামলা হয়েছে। সে বিষ্মিত হলো, তিনটি গুলি কার বিরুদ্ধে হলো? আর যাদেরকে টেনে ছেচড়ে গাড়িতে তোলা হলো, সে দু’জনের মধ্যে সেলসম্যান নেই, তাহলে ও দু’জন কে? সালেহ বাহমন ধাঁধায় পড়ে গেল, মিলেশরা কার বিরুদ্ধে লড়াই করল।
আগন্তুক সালেহ বাহমন মাজুভকে বলল, আমি আপনার শত্রু নই, আপনি মিলেশ বাহিনীর নন আমি জানি।
-কেমন করে জানেন? প্রশ্ন করল মাজুভ।
-আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আপনি মিলেশ বাহিনীর গুলি থেকে বাঁচার জন্যে ফুটপাতের নিচে গড়িয়ে পড়েছিলেন আর ওরা চলে যাবার পর আপনি দোকানে ঢুকেছেন।
-আপনি মিলেশ বাহিনীকে চিনলেন কেমন করে? আপনি কে?
-মিলেশ বাহিনীকে চিনব না কেন? ওরা তো আমাদের উৎখাতের চেষ্টা করছে। আমি সালেহ বাহমন।
-আপনি মুসলমান?
-হ্যাঁ। আপনি?
-আমি খৃষ্টান ছিলাম। আমি মিলেশ বাহিনীতে ছিলাম। আহমদ মুসা আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। আমি মিলেশ বাহিনী ত্যাগ করেছি, ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছি।
সালেহ বাহমনের চোখ দু’টি ছানা বড়া হয়ে উঠল। বলল, আহমদ মুসার সাথে কোথায় দেখা হলো আপনার? আপনার নাম কি মাজুভ?
-হ্যাঁ মাজুভ। কি করে জানলেন আমার নাম?
-জেনেছি জাকুবের কাছ থেকে। এই দোকানেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়। সে যাক, আহমদ মুসা ভাই কোথায়?
আহমদ মুসার নাম শুনতেই মাজুভের মুখ আবার বিবর্ণ হয়ে গেল। আবার উদ্বেগ-আশংকা ফুটে উঠল তার মুখে। বলল, আহমদ মুসার খোজেই আমি এ দোকানে এসেছি। তিনজন লোককে অনুসরণ করে তিনি এ দোকানে ঢুকেছেন। তারপরেই গুলি-গোলা। পরে আরও চার পাঁচজন এ দোকানে এসে ঢোকে। থামল মাজুভ।
-তাহলে আহমদ মুসা ভাই……। উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় কথা শেষ করতে পারলো না সালেহ বাহমন।
-এখানে যাদের লাশ আছে তারা সবাই মিলেশ বাহিনীর। মনে হয়, আহমদ মুসাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, তিনি আহতও হতে পারেন। তারপর সালেহ বাহমনকে ফেল্ট হ্যাট দেখিয়ে বলল, এটা আহমদ মুসার। আমি মনে করি তিনি আহত হয়ে পড়ে না গেলে তার মাথার হ্যাট পড়ে যেত না।
মাজুভের শেষের কথাগুলো কান্নায় বুজে গেল।
সালেহ বাহমন কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ওরা তো চলে গেছে, ওদের পিছু নেয়া আর যাবে না। তাহলে এখন করনীয়?
-মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার সম্প্রতি বদলেছে। আমি চিনি না। বলল মাজুভ।
-আমি জানি। জাকুব আমাকে ঠিকানা দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে যেতে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আর এ খবরটা সবাইকে জানানোও দরকার।
-ঠিক বলেছেন।
-চলুন আমরা যাই। তার আগে এদিকের ব্যবস্থাটা করে ফেলতে হবে। বলে সালেহ বাহমন পাশের দোকান থেকে তার লোকদের ডেকে বলল, এ দোকান বন্ধ করে দাও। মিলেশ বাহিনীর তিনটি লাশ ড্রেনে ফেলে দাও। আমাদের সেলসম্যানের লাশটি দাফনের ব্যবস্থা কর।
নির্দেশ দিয়ে সালেহ বাহমন মাজুভকে সাথে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, ভুলে গেছি জিজ্ঞাসা করতে, হাসান সেনজিক কোথায়?
-নিরাপদে আছে। আমার বোনের বাড়িতে আহমদ মুসাসহ আমরা ওখানেই আছি।
-চলুন তাহলে আমরা ওখানে যাই, তাপর আপনাকে নিয়ে আমি বেরুব।
-সেটাই ভাল, ওদের খবরটা জানানো দরকার।
রাস্তা পার হয়ে জীপের কাছে গিয়ে পৌঁছল দু’জন। মাজুভ জীপের ড্রাইভিং সিটে বসল। সালেহ বাহমান বসল পাশের সিটে।
জীপ চলতে শুরু করল।
মাজুভ বলল, আহমদ মুসা ভাই আহত ছিলেন। আজকেই তিনি আহত হয়েছেন।
-আজকেই? কোথায়, কিভাবে?
-বেলা দশটার দিকে এসেছিলেন উনি এই শহীদ মসজিদ রোডে একা। হাসান সেনজিকের বাড়ির পশ্চিম পাশে ফুটপাত থেকে একটি মাইক্রোবাস দু’টি মেয়েকে কিডন্যাপ করে এবং তারা ছিল মিলেশ বাহিনীর লোক। ওদের সাথে সংঘর্ষে কপালে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মিলেশ বাহিনীর দু’জন মারা যায়, দু’জন জ্ঞান হারায়।
-হাসান সেনজিকের বাড়ির পশ্চিম পাশ থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ওরা কি মুসলমান?
-হ্যঁ মুসলমান।
-নাম কি?
-আহমদ মুসা নাম জিজ্ঞেস করেননি।
সালেহ বাহমান কিছু বলল না। কিন্তু তার মনের কোথায় যেন খচ খচ করতে লাগল।
জীপ ছুটে চলল মাজুভের বোনের বাড়ির দিকে।

আহমদ মুসা মাইক্রোবাসের মেঝেতে মরার মত পড়ে ছিল। তার পায়ের কাছে, মেঝের উপর বসে ছিল জাকুব। মাইক্রোবাসে তুলে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে।
তাদের পাশেই সিটে বসেছিল তিনজন। তাদের একজনের হাতে ষ্টেনগান। আর দু’জনের হাতে রিভলভার। ড্রাইভিং সিটে একজন বসেছে। তার পাশের সিটে একজন। তার হাতেও একটি রিভলভার।
গাড়ির ভেতরে অন্ধকার।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পড়েছিল। তার মাথা গাড়ির দরজার দিকে। খুব সর্তকভাবে আহমদ মুসা একবার চোখ খুলল। তার পাশেই একজন বসে। তার হাতে ষ্টেনগান।
আহমদ মুসা রড়ের আঘাতে জ্ঞান হারায়নি। সে ফেল্ট হ্যাটের নিচে কপাল পর্যন্ত নামানো লোহার টুপি পরেছিল। রডের আঘাত লোহার টুপিতে পড়ে। কিন্তু আহমদ মুসা অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে গিয়েছিল আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে। কারণ পেছন থেকে ছুটে আসা পাঁচজনকে মোকাবিলা করা ঐ অবস্থায় আত্মাহুতির সমান ছিল। আহমদ মুসা অজ্ঞান হওয়ার ভান করে সময় নিতে এবং শত্রুকে বিশৃঙ্খল ও অসতর্ক করতে চেয়েছিল।
আহমদ মুসা যখন চোখ খুলেছিল সে সময়ই ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসা লোকটি রিভলভার নাচাতে নাচাতে বলল, জাকুবকে দু’ঘা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করতো হে, আমাদের তিন তিন জন লোককে মেরে ফেলল এই লোকটা কে?
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে জাকুবের কাছে বসা লোকটি জাকুবের দুই গালে দুই থাপ্পড় লাগিয়ে বলল, শুনলি তো বল তোর এই সঙ্গীটি কে?
জাকুব কোন জবাব দিল না।
ঐ লোকটি আবার বলল, চল কতক্ষণ মুখ বন্ধ করে রাখিস দেখা যাবে। সেদিন মেরেছিলি একজন, আজ তিনজন। এখন মনে হচ্ছে, প্রিষ্টিনাতে আমাদের যে ব্যর্থতা এবং তাতে আমাদের যে সাতজন লোক জীবন দিল, তাও তোরই জন্যে। গায়ের চামড়া খুলে মারলেও তোর অপরাধের শাস্তি যথেষ্ট হবেনা।
পাশের সিট থেকে একজন বলে উঠল, ব্যাটা টাকা খেয়েছে, হেভি টাকা। টাকা এখন বেরুবে।
সামনের সিটের একজন বলল, না টাকা নয়, আসলে ও ব্যাটা জাত সাপ। রক্তে ও মুসলমান। ওর দাদা ও পূর্বপুরুষ ছিল মুসলমান। মাঝখানে ওর বাপ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্যে। ভেতরে ভেতরে ওরা সবাই মুসলমানই রয়ে গেছে। মিলেশ বাহিনীর সাথে কোন খৃষ্টান বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেনা।
পেছন থেকে একজন বলে উঠল, কিন্তু উস্তাদ মাজুভতো জাত খৃষ্টান। সেও তো বিশ্বাস ঘাতকতা করল।
-মুসলমানরা জাদু জানে, ওরা মানুষকে হিপনোটাইজ করে। তাই ওদের সংস্পর্শে যাওয়া, ওদের কথা শোনা নিষেধ। বলল সামানের সেই লোকটা।
-ওদের শেষ না করে তো এসব সম্ভব নয়। ওদের অস্তিত্ব থাকলে মাজুভরা ওদের ফাঁদে পড়বেই। বলল ড্রাইভার।
-এ জন্যেই তো ওদের নির্মুল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বলল সামনের লোকটি।
-জাকুবদের মত ছদ্মবেশীদেরও এবার বাদ দেয়া হবেনা। বলল পেছনের ষ্টেনগানধারী লোকটি।
-সেটা আর বলতে হবে না। জাকুবের বাপ-মা সহ ওদের বিশ্বাসঘাতক পরিবারকে কালকেই বেলগ্রেডে দেখতে পাবে। ওদের চোখের সামনেই ওদেরকে দিয়েই জাকুবকে মারা হবে। বিশ্বাসঘাতক পরিবারের কেউই বাঁচবে না। বলল সামনের সিটের পিস্তলধারী।
কেঁপে উঠল জাকুবের হৃদয়। সে মৃত্যুকে ভয় করে না, কিন্তু তার জন্যে তার পিতা-মাতা, পরিবার নির্যাতিত হবে, এটা সে সহ্য করতে পারবেনা।
এই সময় সামনের লোকটি মাথা ঘুরিয়ে বলল, ঐ লোকটিকে বেঁধেছিস তো?
পেছন থেকে এজন বলল, সংজ্ঞাহীন একটা লোককে বাঁধার দরকার কি?
ধমক দিয়ে বলল সেই লোকটি, বেঁধে ফেল, স্যার দেখলে আস্ত রাখবেনা। ক্লোরোফরম বোমায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া লোকদের বেঁধে না রেখে কি ফল হয়েছে, ভুলে গেছ?
জাকুবের পাশেই সিটে যে লোকটি বসেছিল, সে লোকটি উঠে দাঁড়াল। বোধহয় বাঁধার নির্দেশ পালনের জন্যে।
আহমদ মুসা ভাবল, আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবেনা। সে প্রস্তুত হলো। ধীরে ধীরে সে চোখ মেলল। দেখল তার পাশের লোকটি ষ্টেনগানের বাট গাড়ির মেঝেতে রেখে খাড়া করে ধরে আছে। ষ্টেনগানের বাটটি তার ডান হাত প্রায় স্পর্শ করছে। আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাত ষ্টেনগানের বাট ধরে ফেলল। আর সেই সাথে বাম হাত ছুটে এসে আঁকড়ে ধরল স্টেনগানের ব্যারেল। দু’হাতে একটা হ্যাচকা টানে ষ্টেনগান কেড়ে নেয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল ষ্টেনগান উদ্যত করে।
পর মুহূর্তেই আহমদ মুসা ষ্টেনগানের ট্রিগার চেপে ব্যারেলটা একবার ঘুরিয়ে নিল তিনজনের উপর দিয়ে। তারপরের ব্যারেলটি ঘুরিয়ে নিল সামনের পিস্তলধারী লোকটির দিকে। লোকটি ব্যাপারটা বুঝে রিভলভার নিয়ে ঘুরে বসার আগেই ষ্টেনগানের গুলি বৃষ্টির সম্মুখীন হলো এ তিন জনের মত সেও ঝাঝরা দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়ল সিটের উপর।
আহমদ মুসা ড্রাইবারের দিকে ষ্টেনগান তাক করে জাকুবকে বলল, তুমি ঠিক আছো তো জাকুব?
জাকুব চিৎকার করে বলল, আমার সন্দেহ তাহলে ঠিক। ঠিকই আপনি মুসা ভাই। জিন্দাবাদ আহমদ মুসা। আমি ভাল আছি।
আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলল, রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাও। তুমি শত্রুতা না করলে তোমাকে কিছু আমরা বলবনা যদিও তুমিই আমার মাথায় রড় দিয়ে বাড়ি দিয়েছিলে।
ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল। আহমদ মুসা ষ্টেনগান ও তিনটা পিস্তল কুড়িয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। জাকুবও নামল।
জায়গাটা বেলগ্রেড সার্কুলার রোডের একটা জনবিরল অংশ। রাস্তার পশ্চিম পাশে একটা ঝিল। আহমদ মুসা ষ্টেনগানটি ঝিলে নিক্ষেপ করল। এবং পিস্তলের দু’টো গুলিতে মাইক্রোবাসটির দুটো টায়ার ফুটো করে দিল যাতে করে গাড়ি নিয়ে গিয়ে কোন ষড়যন্ত্রের সুযোগ ড্রাইভার না পায়। কারণ গাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত তাদের হাটতে হবে।
পিস্তলটি পকেটে রাখতে রাখতে আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলল, কষ্ট করে হেটে যাও। আমাদের হাতে গাড়ি থাকলে তোমার গাড়ির টায়ার আমরা ফুটো করতাম না।
বলে আহমদ মুসা ফুটপাত ধরে উত্তর দিকে হাটতে থাকল। তার পেছনে জাকুব। হাটতে হাটতে আহমদ মুসা জাকুবকে জিজ্ঞেস কল, তোমাকে সন্দেহ করল কিভাবে?
-সেদিন বেলগ্রেডে পৌঁছার পরই আমি আপনাদের কথা মত টিটো রোড অর্থাৎ শহীদ মসজিদ রোডে গিয়েছিলাম হাসান সেনজিকের বাসার খোঁজে। বাসাতো চিনলাম। ভয়ে ভেতরে ঢুকলাম না বাড়ির পূব পাশের একটা দোকানে উঠে জিজ্ঞাসা করছিলাম হাসান সেনজিকের বাসার কোন একজনকে পাওয়া যায় কিনা। আমার কথা শুনে ভেতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে আসে। পরে জেনেছি উনি হোয়াইট ক্রিসেন্টের লোক সালেহ বাহমান। এই সময় মিলেশ বাহিনীর একজন লোক সেখানে পৌঁছে। সে চিনতে পারে সালেহ বামনকে। সালেহ বাহমনকে বাঁচাতে আমি হত্যা করি মিলেশ বাহিনীর লোককে। লাশ সরিয়ে ফেলার পর মিলেশ বাহিনীর আরও কয়েকজন সেখানে যায়। আমি হত্যা করেছি বা লোকটি ঐখানেই নিহত হয়েছে এমন কোন প্রমাণ তারা পায়নি। কিন্তু তারা আমাকে সন্দেহ করেছে। আজ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল আরও নিশ্চিত হতে।
-প্রিষ্টিনা অভিযানের পর জারজেস জিবেঙ্কু বেঁচে থাকলে তুমি আরও আগে সন্দেহের শিকার হতে, সেটা একটু পরেই হয়েছ।
-আহমদ মুসা ভাই আপনিতো সব শুনেছেন, এখন আমার আব্বা-আম্মা এবং পরিবারের কি হবে। আমাকে হারিয়ে তো ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে যাবে। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল জাকুব।
-চিন্তা করোনা, কালকে তোমার আব্বা-আম্মা বেলগ্রেডে কোন দিক দিয়ে পৌছবেন?
-বিমানে আনা হচ্ছে শুনেছি।
-কয়টার বিমান?
-কাল দশটায়।
-ঠিক আছে, সকাল দশটায় প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলেই বোঝা যাবে ঐ বিমানে তারা আসছেন কিনা। চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আরেকটা খবর মুসা ভাই।
-কি?
-ওরা নাকি হাসান সেনজিকের মাকে সাত দিন সময় দিয়েছিল। কাল সেই সপ্তম দিন। তারা হাসান সেনজিককে না পেলে তার মাকেই তার বাড়ী থেকে নিযে যাবে-এ পরিকল্পনা তারা চূড়ান্ত করেছে।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, তাই নাকি?
-হ্যাঁ। বলল জাকুব।
আহমদ মুসা আবার চলতে শুরু করল। চলতে চলতে বলল, ওদের শক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা জাকুব?
জাকুব বলল, ওদের সংগঠনের ষ্ট্রাকচারটা, আমি যেটা দেখেছি, ভূমির উপর একটা লম্ব এর মত। ভূমিটা হলো জনশক্তি। এই জনশক্তি বিশাল। কিন্তু নেতৃত্বটা ‘লম্ব’-এর মত। অর্থাৎ নেতৃত্বে লোক খুব কম। প্রতিটি শহরের নেতৃস্থানীয় লোক দু’একজনের বেশি নেই। কেন্দ্রেও নেতৃত্বের টিম খুব ছোট। সে ছোট টিমটিও এখন ভেঙ্গে পড়েছে। আজকেই তিনজন নেতা তাদের নিহত হয়েছে। একজন বোটানিক্যাল গার্ডেনে, একজন শহীদ মসজিদ রোডের ঐ ঘটনায়, আর এখানে একজন এর আগে মারা গেছে ইয়েলেস্কু। বলা যায় কনস্টানটাইনের হাত পা প্রায় কেটে গেছে। কনস্টানটাইনকে সরাতে পারলে সংগঠনের গোটা ষ্ট্রাকচার ধ্বসে পড়বে। রাজা মারা গেলে যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকলে রাজ্য যেমন বিপন্ন হয় সেই রকম। কনস্টানটাইন একাই সব ক্ষমতা ভোগ করতে চান, তাই তার চারপাশে কিছু হুকুম বরদার ছাড়া উপযুক্ত লোক তৈরি করেননি।
আহমদ মুসা খুশি হয়ে বলল তোমাকে ধন্যবাদ জাকুব। তুমি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য দিয়েছ।
এই সময়ে একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল। জাকুব ডাকল ট্যাক্সিকে।
ভাড়া ঠিক করে তারা উঠে বসল। আহমদ মুসা মাজুভদের গেটে নেমে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। গেটে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিল আহমদ মুসা।
দরজা খুলে হাসান সেনজিক আহমদ মুসাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। আমার গোটা জগৎ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল মুসা ভাই। আমি আল্লাহর কাছে বলেছিলাম, আমার অন্য সব চাওয়ার বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে ফিরিয়ে দিন।
আহমদ মুসা তার পিঠ চাপড়ে সান্তনা দিল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, না হাসান সেনজিক এভাবে বলে না। আল্লাহ কাকে রাখবেন, কাকে কখন টান দিয়ে নিয়ে নেবেন সেটা আল্লাহরই পরিকল্পনা। আর আল্লাহ কোন স্থানই শূন্য রাখেন না। সুতরাং কোন অবস্থাতেই ভেঙে না পড়ে আল্লাহর ইচ্ছাকেই সবার উপরে রাখতে হবে।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল হাসান সেনজিকের সাথে আহমদ মুসা এবং জাকুব।
ড্রয়িং রুমের ভেতরের দরজার পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে মুখ বের করল নাতাশা। বলল, আপনি সুস্থ আছেন তো?
-হ্যাঁ। বলল আহমদ মুসা মাথা নিচু করে।
-মাজুভকে এ খবর কি করে জানানো যায়! তার মাথা ঠিক নেই, কোথায় কি করে বসে!
আহমদ মুসা হাসান সেনজিকের দিকে চেয়ে দ্রুত বলল, মাজুভ কোথায়?
-প্রথমে গেছে ওমর বিগোভিকের বাড়িতে। সেখান থেকে…… বাঁধা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ওমর বিগোভিক কে? তাকে মাজুভ চিনল কেমন করে?
হাসান সেনজিক বলল, শহীদ মসজিদ রোড থেকে মাজুভের সাথে এসেছিল সালেহ বাহমন। সে হোয়াইট ক্রিসেন্টের লোক। আমার পরিবারের সাথেও যোগাযোগ আছে। তার সাথেই গেছে ওমর বিগোভিকের বাড়িতে। ওমর বিগোভিকের মেয়ে নাদিয়া নুরের মাধ্যমেই আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছিল সালেহ বাহমন। সেখানেই খবরটা জানাতে গেছে আমার এবং আপনার দুই খবরই। এখন পর্যন্ত ওরা এবং আমার পরিবার জানেনা আমরা কোথায় আছি।
সালেহ বাহমনকে আহমদ মুসা চিনতে পারল। জাকুবের কাছে তার কথা আহমদ মুসা শুনেছে। কিন্তু ওমর বিগোভিক? মেয়ে দু’টিকে আহমদ মুসা সেদিন যে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল, সে বাড়ির মালিকের নামও তো ওমর বিগোভিক। মেয়ে দু’টির নাম তো সে জিজ্ঞাসা করেনি। হতে পারে ওমর বিগোভিকের মেয়ে নাদিয়া ঐ দু’টি মেয়ের একজন হবে।
‘কিন্তু তুমি কি যেন বলছিলে? সেখান থেকে তারা…..’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ ওমর বিগোভিকের ওখান থেকে তারা তৈরি হয়ে মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যাবে আপনার সন্ধানে।’ বলল হাসান সেনজিক।
‘সর্বনাশ মিলেশ বাহিনীর লোকেরা তো ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে আছে। ওদের হাতে গিয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, চল জাকুব আমরা প্রথমে ওমর বিগোভিকের বাড়িতে খোঁজ করি, না পেলে আমাদেরকেও মিলেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে।
জাকুব উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বলল এদিকে কোথায় গাড়ি তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে?
নাতাশা পর্দার ওপারেই দাঁড়িয়েছিল। সে রিটার মা’র সাথে আলোচনা করে পর্দার এপারে মুখ বাড়িয়ে বলল, ভাইজান, কার আছে ওটাই নিয়ে যান।আপা তাই বললেন।
‘শুকরিয়া’ বলে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা ড্রয়িং রুম থেকে।
গ্যারেজে গাড়ির কাছে পৌঁছতেই রিটা চাবি নিয়ে এল।
আহমদ মুসা রিটাকে দু’হাতে তুলে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, মা মনি তুমি অনেক বড় হও।
‘না অনেক বড় নয়, তোমার মত বড় হব।’ বলল রিটা।
‘কেন আমার মত কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি ভাল’ বলল রিটা।
সবাই হেসে উঠল।
‘না মানুষ সবাই ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না সবাই ভাল না, কাল জেমস আমার পেনসিল চুরি করেছিল।’ বলল রিটা।
‘জেমসও আগে ভাল ছিল, পরে খারাপ হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মানুষ কেন খারাপ হয়?’ বলল রিটা।
‘অন্যায় লোভ মানুষকে খারাপ করে।’ বলল আহমদ মুসা।
এই সময় রিটার মা দরজায় এসে রিটাকে ডাকল। রিটা ছুটল তার মায়ের দিকে। এভাবে রিটার মা এসে আহমদ মুসাকে রিটার হাত থেকে উদ্ধার না করলে আরও কতক্ষণ তার জিজ্ঞাসা চলত কে জানে?
আহমদ মুসারা গাড়িতে উঠল।
গাড়ি ছুটে চলল ওমর বিগোভিকের বাড়ির দিকে। জাকুব ওমর বিগোভিকের বাড়ি চেনে। সালেহ বাহমনের সাথে একদিন সে ঐ বাসায় গিয়েছিল।
ওমর বিগোভিকের বাসা চিনতে অসুবিধা হলো না।
বাড়ির গেটে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ির দরজা খুলে প্রথমেই নামল আহমদ মুসা। সে গেটে গিয়ে দরজায় নক করল।
মাত্র ১ মিনিট। দরজা খুলে গেল।
দরজা খুলেছে নাদিয়া নূর। সে আহমদ মুসাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। পরক্ষনেই আনন্দে ভরে গেল নাদিয়া নুরের মুখ। বলল, আপনি ভাল আছেন? আপনাকে না মিলেশরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল?
আহমদ মুসা বলল, ভাল আছি। হ্যাঁ ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
‘আমি নাদিয়া নুর। ওবেলা আপনি আপনার পরিচয় দেননি, আপনার দেয়া বই থেকে আপনার নাম জানতে পারি।’ বলল নাদিয়া নুর।
একটু থেমেই সে আবার শুরু করল, আপনার নাম, পরিচয় জিজ্ঞাসা না করায় আব্বা আমাদের খুব বকেছেন। হেসে বলল নাদিয়া নুর।
‘কি আমি বকলাম, কার সাথে কথা বলছিস নাদিয়া?’ বলতে বলতে ভেতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওমর বিগোভিক।
‘আব্বা আসুন দেখুন কে এসেছেন।’ বলে নাদিয়া তার আব্বার দিকে মুখ ফিরাল।
ওমর বিগোভিক নাদিয়ার পাশে এসে দাড়াল। জাকুব দেখেই চিনতে পারলো ওমর বিগোভিককে। জাকুবের পাশেই দাঁড়িয়ে সুন্দর, সুঠাম এক যুবক। যুবকটির শান্ত ও গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে মনোরম এক আকর্ষণ।
ওমর বিগোভিক নাদিয়ার কাছে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, আমি আহমদ মুসা।
নাম শুনেই ওমর বিগোভিক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
বুকে জড়িয়ে আর ছাড়লো না। অনেকক্ষণ তাকে বুকে জড়িয়ে থাকল। বুকে জড়িয়ে রেখেই বলল, কি বলে তোমাকে স্বাগত জানাব বাবা। এই মুহুর্তে আমার চেয়ে সৌভাগ্যশালী দুনিয়াতে আর কেউ নেই। তোমার পদধুলি পড়েছে আমার বাড়িতে, আমার সৌভাগ্য।
ওমর বিগোভিকের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে আহমদ মুসা বলল, আমাকে এভাবে ভাবলে খুব খারাপ লাগে আমার। মনে হয়, আমি যেন আপনাদের একজন নই।
‘তুমি অব্যশই আমাদের একজন, কিন্তু অসাধারণ একজন, অসামান্য একজন, অদ্বিতীয় একজন।’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘এটাও ঠিক নয় জনাব, বিভিন্ন দেশে আমি যাদের নিয়ে কাজ করেছি, সবাই আমরা সমান।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু তবু আহমদ মুসা তো একজনই।’ বলল ওমর বিগোভিক।
কথা শেষ করেই ওমর বিগোভিক ব্যস্ত হয়ে বলল, দেখো কি ব্যাপার! আমরা দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি। চল, ভেতরে চল।
দু’পা এগিয়েই আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল, সালেহ বাহমন ও মাজুভ কোথায় চাচাজান?
‘ওরা তো বেরিয়ে গেছে প্রায় আধাঘন্টা আগে।’ বলল ওমর বিগোভিক।
আহমদ মুসা বলল, আমরা বসতে পারছি না।
‘কেন?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল ওমর বিগোভিক।
‘সালেহ বাহমন ও মাজুভ জানে মিলেশ বাহিনী আমাকে তাদের হেডকোয়ার্টারে আটকে রেখেছে। আমাকে উদ্ধারের জন্যেই ওরা মিলেশ বাহিনীর ঘাটিতে গেছে। ওরা উত্তেজিত, উত্তেজিত হলে ভুল হয় বেশি। ওরা যদি মিলেশ বাহিনীর হাতে পড়ে যায়, তাহলে বিপদ হবে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে এখনই আমাদের মিলেশ বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যেতে হবে।’ শান্ত, অথচ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনে উদ্বেগ ফুটে উঠল ওমর বিগোভিক ও নাদিয়া নুর দু’জনের মুখেই।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। বলল, তাহলে চাচাজান আসি।
বলে আহমদ মুসা সামনের দিকে পা বাড়াল। সত্যি আহমদ মুসার চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে যা সচরাচর হয় না। সালেহ বাহমন ও মাজুভের জন্যে সত্যিই সে চিন্তিত। তার জন্যে ওরা না বিপদে পড়ে।
‘তোমাকে এক মুহূর্তও দেরি করতে বলতে পারিনা বাবা। কিন্তু ওয়াদা দাও, তুমি আবার আসবে।’ বলল ওমর বিগোভিক।
আহমদ মুসা থমকে ঘুরে দাঁড়াল। অত্যন্ত শান্ত ও কোমল কণ্ঠে বলল, চাচাজান আমরা এক কঠিন জীবন-মৃত্যুর খেলায় রত। আমি কি এ ওয়াদা করতে পারি? যদি আমার সামনের এ পদক্ষেপটা শেষ পদক্ষেপ হয়, যদি আর না ফিরি! বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা চালাল সামনে।
আহমদ মুসার এই শান্ত ও কোমল কথা এত মর্মস্পর্শী ছিল যে, ওমর বিগোভিক ও নাদিয়া নুর দু’জনের চোখ দিয়েই ঝর ঝর করে নেমে এল অশ্রু।
ওরা অশ্রু সজল চোখে আহমদ মুসার গমন পথের দিকে চেয়ে রইল। ওরা গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ষ্টার্ট নিয়ে চলে গেল।
গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে গেল তবু ওরা সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারলো না।
নাদিয়া নুর ধীরে ধীরে এসে তার পিতার কাঁধে হাত রাখল।
ওমর বিগোভিক চমকে উঠে ফিরে তাকাল। বলল, কি মা!
‘জানি উনি কত শক্ত মানুষ, কত বিপ্লবের উনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ওর মন এত সংবেদনশীল, এত নরম!’ বলল নাদিয়া নুর।
‘পুর্ণ মানুষ বলেই হয়তো। একজন পূর্ণ মানুষ যেমন শক্ত হন, তেমনি হন নরমও।’ বলল ওমর বিগোভিক।
‘মৃত্যুকে ওরা এত সহজভাবে, এত সাধারণভাবে দেখেন আব্বা!’ বলল নাদিয়া নুর।
‘এটা তারাই পারে মা, যারা নিজের জন্য ভাবেন কম। ওরা ওদের জীবন আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন।’ বলল ওমর বিগোভিক।
নাদিয়ার মা নাদিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আল্লাহ তাঁর এ সৈনিকদের সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিজয় এদের জন্যেই।
ওমর বিগোভিক এবং নাদিয়া দু’জনেই তাকাল তার দিকে। বলল, আমিন।

Top