১২. কর্ডোভার অশ্রু

চ্যাপ্টার

মাদ্রিদে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হেডকোয়ার্টার। অপারেশন ডিরেক্টরের কক্ষ। অপারেশন ডিরেক্টর সিনাত্রা মেন্ডো তার রিভলভিং চেয়ারে বসে। তার সামনে বিশাল টেবিল।
সিনাত্রা মেন্ডো একটা ফাইল ওপর চোখ বুলাচ্ছে। ফাইলটি এসেছে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান প্রধান বুটাগুয়েনা ভাসকুয়েজের কাছ থেকে। বাস্ক গেরিলা কন্যা মারিয়া পণবন্দী হিসেবে আটক হওয়ার পর হাত থেকে ফসকে যাওয়া, মাত্র একজন লোক ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ৫ জন লোককে হত্যা করে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ঘেরাও বিধ্বস্ত করে দিয়ে মারিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার ওপর মন্তব্য করেছে বুটাগুয়েনা ভাসকুয়েজ। এমন বিপর্যয় স্পেনের ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের জীবনে আর আসেনি। এমন লজ্জাকরভাবে পরাজিত, অপমানিত তাকে আর হতে হয়নি কখনও। এই ব্যর্থতার জন্যে ভাসকুয়েজ অপারেশন ডিরেক্টর সিনাত্রা মেন্ডোকেই দায়ী করেছে। ভাসকুয়েজ হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছে, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কোন ব্যর্থতাকেই ক্ষমা করে না, তবে মেন্ডোকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।
রিপোর্ট পড়ে ঘামছিল সিনাত্রা মোন্ডো। এই সুযোগ যে তার শেষ সুযোগ তা মেন্ডো মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল। এরপর যে কোন ব্যর্থতা তার জন্যে নিয়ে আসবে কাল মৃত্যু। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অভিধানে ব্যর্থতার অন্য নাম মৃত্যু একথা সবাই জানে।
সিনাত্রা মেন্ডো সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ছিল সেই লোকটির ওপর, যে মারিয়াকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল এবং যে তাদের এত বড় বিপর্যয়ের মূল হোতা। এই সময় পকেটের অয়্যারলেস সেট ‘ক্লিক দেয়া শুরু করল।
তাড়াতাড়ি অয়্যারলেসটি বের করে নিয়ে এন্টেনাটা টেনে দিয়ে কানের কাছে ধরল। শুনেতে শুনতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শুনে নিয়ে সে বলল, ‘ওকে, তোমরা ফল করো। আমরা আসছি, পরে যোগাযোগ করব।’ বলে এন্টেনা ক্লোজ করে অয়্যারলেসটি রেখে দিল পকেটে। তারপর টেবিরে একটা মুষ্ঠাঘাত করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ছুটল সে বুটাগুয়েনা ভাসকুয়েজের কক্ষে প্রবশে করে আসামীর মতো গুড়ি মেরে দাঁড়াল ভাসকুয়েজের টেবিলে সামনে।
ফাইল থেকে ধীরে ধীরে মুখ তুলে ভাসকুয়েজ বলল, ‘কোন খবর ?
‘জি, স্যার, সেই লোকটির দেখা পাওয়া গেছে।
‘কোন লোকটির?’
‘বাস্ক গেরিলা কন্যা মারিয়াকে যে উদ্ধর করে নিয়ে গেছে।’
‘কোথায়?’
‘তাকে দেখা গেছে বাট্রাগো ডে লুজিয়ার মাদ্রিদ হাইওয়েতে। সে মাদ্রিদের দিকে আসছে।’
‘তারপর?’
‘আমি তাকে ফলো করার নির্দেশ দিয়ে আপনার কাছে এসেছি।’
‘সে একা?’
‘তার সাথে মাত্র একজন ড্রাইভার।’
‘তোমার কি পরিকল্পনা?’
‘খবরটা পেয়েই আমি আপনার কাছে এসেছি।’
ভাজকুয়েজ দেয়ালে সেট করা বিশাল মানচিত্রের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, ‘সে যেই হোক, তাকে যে আন্ডারএস্টিমেট করা যায় না তা বোধ হয় বুঝেছ তুমি।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার সে বলল, ‘মাদ্রিদের ৩০ মাইল উত্তরে ঐ যে আল কামেন্দা শহর, তার উপকন্ঠে একটা উন্মুক্ত উপত্যকায় দেখ পূর্ব-পশ্চিম একটা রোড মাদ্রিদ হাইওয়েকে ক্রস করেছে। এখানেই ওকে চারদিক থেকে আটকাও।’ বলে মাথা নিচু করল ভাসকুয়েজ।
সেন্ডো বুঝল, কথা শেষ, মাথা নিচু করার অর্থ তার চলে যাবার নির্দেশ।
সেন্ডো বেরিয়ে এলো ভাসকুয়েজের রুম থেকে।
অফিসে এসে সেন্ডো আল কামেন্দার ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান অফিসসহ টেলিফোনে কয়েকটি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে এলো সেন্ডো। সুসজ্জিত দু’টি গাড়ি একটি মাইক্রোবাস, আরেকটি জীপ রেডি হয়ে গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। লোকজন যা নেয়ার তারাও গাড়িতে উঠে বসেছে। সেন্ডো জীপের সামনের সিটে গিয়ে উঠল।
গাড়ি দু’টি স্টার্ট নিল।
গাড়ি ছুটতে শুরু করল আল কামেন্দার শহরের উদ্দেশে।
মি. সেন্ডো বাট্রাগো ডে লুজিয়া থেকে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের যে গাড়িটি ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের নতুন টার্গেট আহমদ মুসাকে অনুসরণ করছিল তার সাথে অয়্যারলেসে যোগাযোগ করে তাদের অবস্থান ও গাড়ির স্পিড জেনে নিল। সেন্ডো হিসেব করল, যে গতিতে তারা আসছে তাতে আল কামেন্দার সেই উপকন্ঠে পৌঁছতে ওদের সাড়ে ৬টা বেজে যাবে। আবার ওয়্যারলেস তুলে নিয়ে মি. সেন্ডো আল কামেন্দার অফিসের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল।
একদিকে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের যখন এই আয়োজন, তখন আহমদ মুসা নিশ্চিন্ত মনে চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে ছুটে আসছিল মাদ্রিদের লক্ষ্যে।
গাড়িটা ছিল নতুন। গাড়িটা চলতে শুরু করলেই আহমদ মুসা বুঝেছিল ড্রাইভারও যথেস্ট দক্ষ। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে আহমদ মুসা সমগ্র হৃদয় দিয়ে সফরটাকে উপভোগ করছিল।
আহমদ মুসার এ উপভোগে বাধ সাধল একমাত্র সাথীটি- ড্রাইভার। বলল, ‘স্যারের বাড়ি কোথায়?’
‘কেন স্পেন যদি হয় আপত্তি করবে?’
‘কেন করব, কিন্তু শুনেছি স্যার বাইরে থেকে এসেছেন।’
‘ঠিক। আসলে কি জানো, গোটা দুনিয়াকেই আমার ঘর মনে করি।’
‘আমার স্যার বলেছিলেন, আপনি খুব বড় বিপ্লবী, আজকের দুনিয়ায় আপনার তুলনা নেই। কিন্তু শুনলাম আপনি মুসলমান।’
‘কেন মুসলমানরা কি বড় হতে পারে না, দুনিয়ার সেরা বিপ্লবী হতে পারে না?’
‘স্পেনে তো মুসলমানদের খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল, তাই বলছিলাম।’
‘তোমার কথা ঠিক। ৮শ’ বছর পর্যন্ত স্পেনকে শিক্ষা, সভ্যতা ও সমৃদ্ধিতে সাজিয়েও মুসলমানরা স্পেন থেকে উৎখাত হয়ে যায়। যারা অবশিষ্ট ছিল তাদেরকে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। এই অবস্থায় মুসলমানদের সম্পর্কে বড় কিছু চিন্তা করা স্বাভাবিক নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেও ওদের কোন লাভ হয়নি স্যার। চাকরি-বাকরির দরজা ওদের জন্যে বন্ধ, কায়িক শ্রমই ওদের সম্বল। জমি রাখতে ও জমি কিনতে পারে না বলে ওদের নিজের কোন বাড়ি নেই। আমাদের গ্রামে দক্ষিণ স্পেন থেকে একটা পরিবার এসে জমি কিনে বাড়ি করেছিল। পরে প্রকাশ হয়ে পড়ল ওরা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণকারী ছদ্মবেশী মুসলমান-মরিসকো। আশেপাশের বাইবেল সোসাইটির লোকেরা এসে প্রতারণার অভিযোগে বাড়ির মালিক লোকটাকে মারতে মারতে মেরে ফেলে এবং বাড়ি ও সহায়-সম্পদ সব কেড়ে নিয়ে বাড়ির নারী ও শিশুদের রাস্তায় নামিয়ে দেয়। পরে শুনেছি মাদ্রিদ যাবার পথে ডে মাজুরা গিরিপথে ঠান্ডায় বরফে জমে পরিবারটির সবাই মারা যায়।’
‘মরিসকোদের কেউ সাহায্য করে না?’
‘অনেকেই করতে চায়। কিন্তু সাহস পায় না, সমাজে একঘরে হবার ভয় আছে। তা’ছাড়া ঐ বাইবেল সোসাইটির মতো দেশে অনেক সংগঠন আছে, যারা মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু।’
‘সরকারের ভূমিকা কি?’
‘সরকারী আইন তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তবে সরকার প্রকাশ্যে মরিসকোদের ওপর জুলুম-অত্যাচার করতে আসে না। চার্চ, ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান প্রভৃতি শক্তিশালী সংস্থাগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব রকম ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।’
‘তুমি অনেক বিষয় জানো দেখছি।’
‘স্যার, এসব তো চোখে দেখি, না জেনে উপায় কি?’
একটু থেমেই ড্রাইভার আবার বলল, ‘স্যার, মুসলমানদের জন্যে কিছু কি করবেন?’
‘একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’
‘মুসলমানদের একজন নেতা আপনি, আপনারা না ভাবলে মুসলমানদের কথা ভাববে কে?’
‘কি করা যায় বলত?’
‘এখানকার মরিসকো ও মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু নেই। তারা সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ নয়। তাদেরকে সচেতন করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে।’
‘তুমি তো মুসলমাদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল, ভালোবাস তো মুসলমানদের?’
‘স্যার, আমরা বাস্করা তো মুসলমানদের মিত্র! আমরা যতটুকু পারি ওদের জন্যে করি। আমাদের এলাকায় ওদের সমস্যা নেই স্যার।’
‘আমি জানি, তোমরা খুব ভালো।’
এই সময় ড্রাইভার উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘স্যার, বহুক্ষণ ধরে একটা গাড়ি একই গতিতে আমাদের পেছনে আসছে। আমি গাড়ির স্পিড কমিয়ে দেখেছি ও গাড়িরও স্পিড কমিয়েছে।’
সন্ধা তখন পার হয়ে গেছে। আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। দেখল, পেছনে একটা হেড লাইট ছুটে আসছে।
পেছন থেকে চোখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমরা এখন কোথায় ড্রাইভার?’
‘আল কামেন্দা শহরের প্রায় উপকন্ঠে পৌঁছে গেছি আমরা।’
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক ভাবল। তারপর বলল, ‘গাড়িটা নিশ্চয় আমাদেরকে বাট্টাগো ডে লুজিয়া থেকে ফলো করছে। মাঝখানে আমরা কোথাও থামিনি, সুতরাং মাঝপথে আমরা কারো নজরে পড়ার কোন আশংকা নেই।’
‘আমারও তাই মনে হয়।’ বলল ড্রাইভার।
‘যদি তাই হয় তাহলে বড় বিপদটা আসবে আমাদের সামনে থেকে।’
’কিভাবে?’
‘গাড়িটা ঐভাবে নিশ্চিন্তে আমাদের ফলো করার কারণ হলো, তার দায়িত্ব শুধু ফলো করা, পেছন থেকে আমাদের পাহারা দেয়া যে, ঠিক যাচ্ছি আমরা।’
‘তাহলে আমাদের খবরটা মাদ্রিদ কিংবা অন্য কোথাও অনেক আগে পৌঁছে গেছে!’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
‘কিভাবে?’
‘অয়ারলেস অথবা টেলিফোনে।’
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘সামনে এই হাইওয়ে ছেড়ে ডাইনে বা বাঁয়ে যাবার কোন পথ কি কাছাকাছি আছে?’
‘আছে। আল কামেন্দা শহরে ঢোকার মুখে পুব – পশ্চিম একটা সড়ক এই মাদ্রিদ হাইওয়েকে ক্রস করেছে।’
‘পুব ও পশ্চিম এর মধ্যে কোন দিক দিয়ে মাদ্রিদ পৌঁছা সহজতর হবে?’
‘বাঁ দিক দিয়ে।’
‘তাহলে ঐ ক্রসিং পর্যন্ত পৌঁছে আমরা বাঁ দিকে মোড় নেব।’
ক্রসিং কাছে এসে গেছে। আহমদ মুসা দেখল, পুব-পশ্চিম সড়কটি ফ্লইওভার দিয়ে মাদ্রিদ হাইওয়েকে ক্রস করেছে। সোজা হাইওয়েটি চলে গেছে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে। আর হাইওয়ের থেকে একটা রাস্তা ধনুকের মত বেঁকে গিয়ে পুবের রাস্তার সাথে মিশেছে। অনুরূপ অন্য একটি শাখা পশ্চিমের রাস্তার সাথে মিশেছে। একইভাবে ফ্লাইওভারের অপর পার্শ্ব থেকেও হাইওয়ে থেকে দু’টি শাখা ঐভাবে পুব ও পশ্চিমের রাস্তার সাথে গিয়ে মিশেছে।
আহমদ মুসার গাড়ির ড্রাইভার ক্রসিং এর মুখে এসে বাম দিকে টার্ন নিয়ে বামের রাস্তাটি ধরে পুবের রাস্তাটির ওপর ওঠার জন্যে এগিয়ে চলল। ফ্লাইওভারের পুব দিকের শেষ প্রান্ত যেখানে, সেখানে গিয়ে মিশেছে হাইওয়ে থেকে আসা রাস্তা।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন পুবের রাস্তাটিতে উঠে ৫০ গজের মতো এগিয়ে গেছে, এমন সময় সামনে একসংগে চারটে হেডলাইট জ্বলে উঠল মাত্র কয়েক গজ সামনে, একেবারে নাকের ডগা বরাবর। চারটি হেডলাইট পাশাপাশি। দু’টো গাড়ি, একটা ট্রাক, একটা মাইক্রোবাস।
এ্যাকসিডেন্ট এড়াবার জন্যে আহমদ মুসার গাড়ি বিশ্রী এক শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে গেল।
সামনের গাড়ি দু’টোর দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা পেছন ফিরে চারদিকে একবার নজর বুলাল। ঠিক যা সে সন্দেহ করেছে তাই, দু’পাশ থেকে দু’টো করে চারটে এবং পেছন থেকে চারটে হেডলাইট প্রায় এসে পড়েছে তাদের ওপর।
নতুন কিছু ভাবার আগেই দু’পাশ থেকে চারটে এবং পেছন থেকে দুটো গাড়ির ব্যারিকেডের মধ্যে পড়ে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
সামনের গাড়ি দু’টোও এগিয়ে আসছে।
ড্রাইভার পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলল, ‘স্যার, পিস্তলটা কি আপনার কাজে আসবে।?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। যে ফাঁদ এড়াতে চেয়েছিলাম, সে ফাঁদে পড়ে গেছি। শোন, তুমি পিস্তলটা লুকিয়ে ফেল। ভাড়াটে ড্রাইভর বলে নিজের পরিচয় দেবে। তোমার অসুবিধা হবে না, ট্যাক্সিটা লা-গ্রীনজা ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের নামে রেজিস্ট্রি।’
কিন্তু স্যার, আপনার কি হবে….।’ কথা শেষ করতে পারল না ড্রাইভার। উদ্বেগে তার স্বর বন্ধ হয়ে গেল।
‘শত্রুর মোকাবিলায় সাধ্যমত সব কিছুই করতে হয়। কিন্তু যখন করার কিছু থাকে না, তখন যা ঘটে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মধ্যে কোন লাভ নেই।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
এই সময় আহমদ মুসার গাড়ির দরড়া দু’দিক থেকেই খুলে গেল। দু’পাশেই জনা চারেক করে লোক। দু’পাশ থেকেই উদ্যত স্টেনগান। দক্ষিণ পাশের গেটে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে সিনাত্রা সেন্ডো। সে পিস্তল নাচিয়ে হুংকার দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘নেমে এসো বাছাধন, কত ধানে কত চাল এবারে দেখিয়ে ছাড়ব!’
বেরিয়ে আসার সংগে সংগে সেন্ডা তার সুঁচালো বুটের একটা লাথি হাঁকালো আহমদ মুসার তলপেটে এবং সেই সাথেই বাম হতের একটা কারাত চালাল কানে নিচে ঘাড়ের নরম জায়গায়।
আহমদ মুসা এই ধরনের আক্রমণ আশা করেনি। তাই প্রস্তুত হতে পারেনি।
আহমদ মুসা ঘুরে পড়ে গেল।
দু’জন তাকে টেনে তুলল গাড়িতে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব সাঙ্গ হয়ে গেল।
ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের ৭টি গাড়ির মিছিলের মতো সার বেঁধে মাদ্রিদের পথে যাত্রা করল।
গাড়ির মিছিলটি যখন ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছল, তখন সেখানে মহোৎসব। যেন সেন্ডো বিশ্বজয় করে এসেছে! আহমদ মুসা প্রদর্শনীর বস্ত্ত হয়ে দাঁড়াল। ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের হেডকোয়ার্টারে আহমদ মুসার বিরাট ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানকে শুধু পরাস্ত করা নয়, ৫জন গুরুত্বপূর্ণ লোককে হত্যাও করেছে। সুতরাং আহমদ মুসাকে এক নজর সবাই দেখতে চায়। তাকে দেখে কিন্তু কেউ তেমন খুশি হয় না। সবারই আশা বিরাট ধরনের ষন্ডামার্কা লোককে তারা দেখবে, কিন্তু তার বদলে তারা দেখে শান্ত সরল চেহারার এক ভদ্রলোককে। তারা বুঝতে পারে না, এমন ধরনের লোক কি করে ক্রিমিনাল হয়!
গাড়িতেই আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ধাক্কিয়ে হেডকোয়ার্টারের ভেতরে এনে তিনতলায় বিশেষভাবে তৈরি বন্দীখানায় রাখল।
বন্দীখানাটা একটা সেলের মতো। ঘুলঘুলির মতো ছোট একটা জানালা উত্তর দেওয়ালে। দক্ষিণ দিকে পুরু স্টিলের দরজা। সেলের মধ্যে আছে একটা খাটিয়া আর কিছু নায়।
আহমদ মুসা কম্বল বিছানো খাটিয়াতে গিয়ে বসেছিল। সেন্ডো ঘরে ঢুকে বলল, ‘আরাম করে নাও, এরপর আরামের সময় কম পাবে। আসছি আমরা।’
বলে বাইরে পা বাড়াচ্ছিল, এমন সময় একজন এসে বলল, ‘বস আসছেন।’
অর্থাৎ বাটা গুয়েনা ভাসকুয়েজ আসছেন। সেন্ডো সংগে সংগেই এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা সেন্ডোর এ পর্যন্তকার বীরত্ব ও এখনকার বসভীতি দেখে মনে মনে হাসল। বলল, ‘মি.সেন্ডো, আপনি কি সেনাবাহিনীতে ছিলেন কখনও?’
‘কেন?’ সেন্ডো কটমট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
‘বসকে দেখে এধরনের এ্যাটেনশন হওয়ার অভ্যাস সেনাবাহিনীর লোকদের।’
‘ও, তখন দু’টো ঘা খেয়েও দেখি শিক্ষা হয়নি।’
‘নিরস্ত্র শত্রু যখন নিজের ইচ্ছাতে ধরা দেয়, তখন তার ওপর দুটো ঘা লাগানোর মধ্যে কো বীরত্ব নেই মি. সেন্ডো।’
সেন্ডো মুখ লাল করে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় করিডোরে জুতার শব্দ পাওয়া গেল।
মি. সেন্ডো আহমদ মুসার দিকে একবার বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল। বাটা গুয়েনা ভাসকুয়েজ এলো।
সেলের দরজায় দাঁড়ানো মি. সেন্ডোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি দেখছি নিজে এবার সেলের দরজায় পাহারায়, সাবধান হওয়া ভালো।’
মি. সেন্ডো মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘লোকটি সাংঘাতিক ঘাড়েল স্যার! সাতটি গাড়ি দিয়ে ঘেরাও করে অনেক কষ্টে তবে……..’
‘গ্রেপ্তার করেছ তাই না? কিন্তু শুনলাম একটি গুলীও নাকি খরচ হয়নি?’
‘স্যার, নিখুঁত পরিকল্পনা…….।’
মি. ভাসকুয়েজ সেন্ডোর পিঠ চাপড়ে সেলে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা শুনছিল ভাসকুয়েজ ও মি. সেন্ডোর কথোপকথন। কৌতুক বোধ করছিল তাদের কথার ঢংয়ে।
মি. ভাসকুয়েজ সেলে ঢুকে নিশ্চিন্ত মনের শান্ত চেহারার একজন মানুষকে দেখল। ভাসকুয়েজ বিস্মিতই হলো। বন্দী তো এমন হয় না!
বন্দীর দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে চমকে উঠল ভাসকুয়েজ। মুখটি তার যেন চেনা! হঠাৎ একটি নাম তার মনে ঝলসে উঠল। একি সেই আহমদ মুসা! মনটা কেঁপে উঠল ভাসকুয়েজের।
উত্তেজিতভাবে ভাসকুয়েজ ঘুরে দাঁড়াল। সেন্ডোকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বন্দীকে আমার কক্ষে নিয়ে এসো।’
বলে ভাসকুয়েজ হন হন করে ছুটল তার কক্ষের দিকে।
আহমদ মুসা ভাসকুয়েজের আচরণে খুব বিস্মিত হলো না। ভাবল, ভাসকুয়েজ সম্ভবত তাকে চিনতে পেরেছে অথবা সন্দেহ করেছে।
কিন্তু বসের আচরণ দেখে মি. সেন্ডো শুধু বিস্মিত নয়, উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল। বস কি দেখলেন, কি ভাবলেন, কি হলো ইত্যাদি চিন্তা তার মনে উঁকি দিতে লাগল।
বস্ চলে গেলে মি. সেন্ডো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ওঠ, এসো। বস কোন প্রকার এদিক-সেদিক পছন্দ করেন না।’
‘বসকে তুমি বুঝি খুব ভয় কর?’
‘বক বক করো না। চল, বসকে দেখতে পাবে। ডেকেছেন যখন, একটা কিছু দেখাবেন নিশ্চয়।’
মি. সেন্ডো আহমদ মুসাকে নিয়ে ভাসকুয়েজের কক্ষে হাজির হলো।
ভাসকুয়েজেরে বন্ধ কক্ষের দরজায় দু’জন স্টেনগানধারী প্রহরী।
ঘরটি বিরাট। লাল কার্পেটে আগাগোড়া মোড়া। দেয়ালও কার্পেটিং করা। ঘরের মাঝেখানে বিশাল টেবিল।
বিশাল এক রিভলভিং চেয়ারে বসেন মি. ভাসকুয়েজ। তার বাম পাশের একটা টেবিলে কম্পিউটার। মি. ভাসকুয়েজ কম্পিউপটারের সামনে বসে। মি. সেন্ডো আহমদ মুসাকে নিয়ে সেই বিশাল টেবিলটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
মি. ভাসকুয়েজের সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনে একের পর এক ফটো ভেসে উঠছিল, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা পরিষ্কার বুঝতে পাল, ভাসকুয়েজ কি খুঁজছে।
একটি ফটো অবশেষে মি. ভাসকুয়েজের কম্পিউটার স্ক্রিনে স্থির হয়ে দাঁড়াল।
মি. ভাসকুয়েজ উঠে দাঁড়াল। ফিরল। তার মুখে বিস্ময়, সেই সাথে আনন্দও। সে মি. সেন্ডোর দিকে চেয়ে বলল, ‘কম্পিউটার স্ক্রিনের ফটোগ্রাফ ও ইনি কি এক ব্যক্তি মনে হচ্ছে?’
‘জি, স্যার।’ আরেকটু ভালোভাবে দেখে নিয়ে বলল সেন্ডো।
‘কে, চেন?’
‘না, স্যার।’ আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে বলল সেন্ডো।
‘যখন ধরলে নাম জিজ্ঞেস করনি?’
‘না, স্যার।’
‘সব অপদার্থ!’
বলে একটু থেমে ঢোক গিলে বলল, ‘জানো দুনিয়ায় সমচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি এখন ইনি এবং সবচেয়ে দামি পণবন্দী ইনি হতে পারেন?’
মি. সেন্ডো একটু বিমূঢ় হলো। যেন বুঝতে পারল না ভাসকুয়েজের কথা! নিরব রইল সেন্ডো।
এবার ভাসকুয়েজ আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘চেনেন ঐ ফটোগ্রাফকে?’
‘ফটো খোঁজার দরকার ছিল না। নাম জিজ্ঞেস করলেই বলতাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হয়তো ছিল না, কিন্তু ঘটনাটা এত বড় যে, আমি আগে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম।’
বলে ভাসকুয়েজ বিমূঢ় সেন্ডোকে জিজ্ঞেস করল, ‘আহমদ মুসার নাম শুনেছ?’
‘জি, স্যার।’
‘আহমদ মুসার ফটোগ্রাফ দেখনি?’
‘দেখেছি, একবার।’
‘একে চিনতে পার?’ আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল ভাসকুয়েজ।
‘ইনিই আহমদ মুসা!’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল সেন্ডো। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। যার কাহিনী রূপকথার মতো এসেছে তাদের কাছে, যার ভয়ংকর একটা ইমেজ তাদের কাছে সর্বদা জীবন্ত, এই সেই আহমদ মুসা! এমন একজন সরল, শান্ত, ভদ্র চেহারার যুবক দেশে দেশে এত কাহিনীর সৃষ্টি করেছে! আহমদ মুসার ওপর থেকে চোখ যেন সরতে চাইছেল না মি. সেন্ডোর!
‘কি সেন্ডো, ভয় পেলে, না প্রেমে পড়লে? বিরোধীকে বোকা বানাবার কিংবা বশ করবার মতো ভয়ংকর যাদু জানে কিন্তু এ।’
‘না, স্যার।’ এ্যাটেনশন হয়ে বলল মি. সেন্ডো।
ভাসকুয়েজ আহমদ মুসার আপাদমস্তক এবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আপনি ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের হাতের মুঠোয়, কেমন লাগছে আপনার?’
‘বিনা শ্রমে আপনাদের এত বড় সৌভাগ্য লাভ দেখে খারাপ লাগছে।’
‘ঠিক বলেছেন, আকাশের চাঁদ যেন নিজে এসে আমাদের হাতে ধরা দিয়েছে, অথচ তাকে ধরার জন্যে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান অতীতে কী করেনি?’
একটু থামল ভাসকুয়েজ। তারপর আবার শুরু করল, ‘মি. আহমদ মুসা, যে ভাগ্য আপনাকে সব সময় বাঁচিয়েছে সেই ভাগ্য এখন আপনার বিরুদ্ধে। সব কিছুরই একটা শেষ আছে। আপনার খেলাও এবার সাঙ্গ হবে। ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের বিশ্ব-হেডকোয়ার্টার প্রতিশোধের জন্যে পাগল হয়ে আছে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ওয়ার্ল্ড রেড ফোর্সেস’ আপনাকে চিবিয়ে খাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। আমরা যদি আপনাকে তাদের হাতেও তুলে দিতে চাই, তাহলেও শত শত বিলিয়ন ডলার ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান পাবে।’
‘আপনাদের এই বড় ব্যবসায়ের সংবাদে আমি আনন্দই বোধ করছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এসব কথা বলে মনকে সান্তনা দিন ক্ষতি নেই, কিন্তু জেনে রাখুন, সব খেলা আপনার সাঙ্গ হয়ে গেছে। যে স্পেন মুসলমানদের সমাধি রচনা করছে, সেই স্পেনেই আপনার সব জারিজুরি শেষ হয়ে গেল।’
আহমদ মুসার মনে একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল। বলল, ‘স্পেনে মুসলমানদের কোথায় সমাধি হলো, তারা তো আবার মাথা তুলছে। এই মাদ্রিদেই তো তাদের মসজিদের মিনার আবার মাথা তুলেছে।’
হেসে উঠল ভাসকুয়েজ হো হো করে। বলল, ‘আপনার দেখার সময় হবে না, তা না হলে দেখতেন ঐ মিনার গুঁড়ো হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে।’
‘পারবেন না, মি. ভাসকুয়েজ, যে কারণে আপনাদের সরকার মসজিদ তৈরির অনুপতি দিতে বাধ্য হয়েছেন, সেই কারনেই আপনারা পারবেন না মসজিদ গুঁড়ো করতে।’
হাসল ভাসকুয়েজ। এবার আরও জোরে। বলল, ‘আপনি বুদ্ধিমান হয়েও অবুঝের মতো কথা বলছেন। সরকার ভাঙবে কেন? আপনাতেই মসজিদ ভেঙে পড়বে। শুধু ঐ মসজিদ নয়, স্পেনের মাটিতে দাঁড়ানো সব মুসলিম স্মৃতি চিহ্নই ধ্বসে পড়বে আপনা আপনি। সে সাথে ক্রিপলড হয়ে যাবে মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়িয়ে ওটা মুসলিম সমাজ।’
‘অবাস্তব আপনার আশাবাদ মি. ভাসকুয়েজ।’
‘অবাস্তব নয়, ধ্বংসের কাজ শুরু হয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়েও কোন চোখ দেখতে পাবে না। কিন্তু দেখবে একের পর এক সব ধ্বসে পড়ছে ইশ্বরের বিষদৃষ্টিতে। কিন্তু তা দেখার জন্যে আপনি বেঁচে থাকবেন না।’
কেঁপে উঠল আহমদ মুসার হৃদয়। গোপন তেজস্ক্রিয় দিয়ে মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্স ও স্পেনের জগৎবিখ্যাত মুসলিম স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংসের কাজ তা’হলে শুরু হয়ে গেছে!
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কথা বলে উঠল ভাসকুয়েজ সেন্ডোকে লক্ষ্য করে। বলল, ‘শোন সেন্ডো, বুঝতে তো পেরেছ, ইনি দুনিয়ার সমচেয়ে মূল্যবান মানুষ, আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান বন্দী। একে এই খোলামেলা হেডকোয়ার্টারের জনবহুল পরিবেশে রাখা যাবে না। কোথায় রাখতে হবে বুঝতে পেরেছ?’
‘জি স্যার।’
‘কোথায়?’
‘কার্ডিনাল হাউজের আন্ডার গ্রাউন্ড সেলে।’
‘কিভাবে নিয়ে যাবে, যথেষ্ট ফোর্স তোমার আছে?’
‘পুলিশের হাত থেকে ফসকেছিল শুনেছ তো।’
‘জি।’
‘বেশ যাও।’
বলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যান এর সাথে। আপনার সাথে অহেতুক খারাপ ব্যবহার আমরা করতে চাই না। কিন্তু এবার পালাবার সামান্য মতলব আমাদের কাছে ধরা পড়লে সংগে সংগে আমরা কুকুরের মতো গুলী করে মারব। আর যেখানে আমরা রাখছি, পালাবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হবে না।’
ভাসকুয়েজ কথা শেষ করে তার চেয়ারে ফিরে গেল। আহমদ মুসা বেরিয়ে এলো মি. সেন্ডোর সঙ্গে।
করিডোর ধরে আহমদ মুসা ও মি. সেন্ডো পাশাপাশি চলছিল। পেছনে দুই স্টেনগানধারী।
হাঁটতে হাঁটতে সেন্ডো বলল, ‘ভালো জায়গা নির্ধারিত হয়েছে আপনার থাকার।’
‘কেন?’
‘আমার জানামতে ওখান থেকে কেউ জীবন্ত বের হয়নি। যারা পালাতে চেষ্টা করেছে, সবাই দানবের হাতে গুলী খেয়ে মরেছে।’
‘দানব কি গুলী চালায় নাকি, এমনিতেই তো ঘাড় মটকাতে পারে।’ দানবটা কি জানার লক্ষ্যেই প্রশ্নটি করল আহমদ মুসা।
‘দানব মানে সে দানব নায়, যন্ত্র দানব! ওর ম্যাগনেটিক চোখকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না এবং ওর ম্যাগনেটিক গানও অব্যর্থ।’
লিফটের দরজায় এসে দাঁড়াল মি. সেন্ডো এবং পেছন ফিরে তাকাল দু’জন প্রহরীর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের একজন আহমদ মুসার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
‘কিছু মনে করবেন না, এটাই ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের নিয়ম। বন্দীকে রাস্তায় বের করলে তার হাতে হাতকড়া থাকবে।’ মুখে বাঁকা হাসি টেনে বলল সেন্ডো।
‘লিফটের যেখানে শেষ-গ্রাউন্ড ফ্লোর-ওটাই গাড়ি বারান্দা। তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। মাঝখানের মাইক্রোবাসে আহমদ মুসাকে তুলল। তার সাথে স্টেনগানধারী দুই প্রহরী। সামনের সিটে উঠল সেন্ডো নিজে।
তিন গাড়ির মিছিল বেরিয়ে এলো ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টার থেকে। চলতে শুরু করল গাড়ি।
‘মি. সেন্ডো, আপনার কার্ডিনাল না কি ভবন, ওটা কোথায় মাটির ওপরে, না মাটির নিচে?’
সেন্ডো তার হাতের পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘রাস্তায় নামার পর ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের বন্দীদের কথা বলা নিষেধ। দ্বিতীয় আর একটি কথাও বলবেন না।’
অহেতুক ক্ষ্যাপানো ঠিক মনে করল না আহমদ মুসা। অনেক কথা বের হয়েছে সেন্ডোর মুখ থেকে। আরও বের হতে পারে ধৈর্য ধরলে।
সবাই চুপচাপ। ছুটে চলেছে গাড়ি।

দক্ষিণ মাদ্রিদের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট নদী তাগুনা।
নদীর প্রায় তীরেই ‘কার্ডিনাল হাউজ’। ৫শ’ বছরের পুরোনো বাড়ি। মাঝে মধ্যে সংস্কার হলেও বাড়ির কাঠামোতে হুবহু একই রাখা হয়েছে। বাড়িটি স্পেনের খৃষ্ট ধর্মীয় মহলের কাছে একটা সম্মানিত তীর্থক্ষেত্র।
বাড়িটি কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো জিমেনিজ সিসনা রোজ তার দরবার গৃহ হিসেবে তৈরি করে ১৪৯৯ সালে। কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো ছিলেন মুসলিম শাষনোত্তর খৃষ্টান স্পেনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাণী ইসাবেলার ধর্মগুরু। ইনি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা। সে সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল ইউনিভার্সিটি অব আলফালা। কিন্তু কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো যে কারনে খৃষ্টান মহলে প্রাতঃস্মরনীয়, সেটা হলো তারই উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে স্পেন থেকে মুসলিম উচ্ছেদ শুরু হয়। তার এই দরবার গৃহ, কার্ডিনাল হাউজ ছিল তার এই উচ্ছেদ অফিযানের একটা কেন্দ্রবিন্দু।
কার্ডিনাল পরিবারই এখনও বাড়িটির মালিক। সেই সূত্রে কার্ডিনাল পরিবারের বর্তমান উত্তর পুরুষ ফ্রান্সিসকো জিমেনিজ, জেনের আব্বা, এই কার্ডিনাল হাউজের মালিক। বাড়িটি ৩ তলা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নিয়ে গড়ে উঠেছে একটা লাইব্রেরি। এখানে দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ আছে, যার একটা অংশ মুসলিম লাইব্রেরি থেকে লুট করে আনা। এই লাইব্রেরি সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত নয়। শিক্ষক, ছাত্র ও গবেষকরা অনুমতি নিয়ে লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারে। ৪টি তলার প্রথম তলাটির মাটির নিচে আরেকটা ফ্লোর আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড ও প্রথম তলা স্পেনের কেন্দ্রীয় চার্চকে ব্যবহারের জন্যে দেয়া হয়েছে। কার্যত ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান এই ফ্লোরে। কারও সেখানে প্রবেশ অধিকার নেই। প্রধান গেটে চবিবশ ঘন্টা প্রহরী থাকে।
কার্ডিনাল হাউজের সামনেথেকে শুরু করে নদীর তীর পর্যন্ত একটা সুন্দর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও পার্ক তৈরি করা হয়েছে। এই পার্ককে দক্ষিণ মাদ্রিদের নার্ভ বলেও অভিহিত করা যায়। দর্শক ও ভ্রমণকারীদের পদভারে সব সময় গমগম করে গার্ডেনটি।
বোটানিক্যাল গার্ডেনকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে কার্ডিনাল হাউজ। বাড়িটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দেয়াল ঘেরা বাগান। এখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
কার্ডিনাল হাউজের উত্তর পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা সুন্দর একটি চত্বর। সে চত্বর পেরোলেই বোটানিক্যাল গার্ডেন। মাঝখান দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লাল ইটের একটা রাস্তা।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিক থেকে কার্ডিনাল হাউজের দ্বিতলে ওঠার সিঁড়ি সবুজ চত্বরের মাঝখান থেকে সোজা উঠে গেছে দু’তলার বারান্দায়।
আর বেশ উঁচুতে দাঁড়ানো একতলায় ওঠার সিঁড়ি পুব দিকে থেকে। পুব দিকের বাগানের উত্তর দেয়ালে একটা দরজা। সে দরজা পেরুলে পাওয়া যাবে লাল ইটের একটা রাস্তা। রাস্তাটি সিঁড়িমুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সিঁড়ির মাথায় একটা দরজা। দরজাটা স্টীলের। এ দরজা ছাড়া একতলায় ওঠার কোন দ্বিতীয় পথ নেই।
বাড়ির পুব পাশের বাগানের উত্তর দেয়ালের গেটে সর্বক্ষণ পাহারা থাকে। বাগানের ভেতরে দরজা সংলগ্ন একটা গেট রুম। গেট রুমের ঘুলঘুলি দিয়ে দেখা যায় বাইরে দরজায কে এসেছে।
কার্ডিনাল হাউজের আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের প্রশস্ত একটি কক্ষ। সম্পূর্ণ এয়ারকন্ডিশন করা। মেঝেয় ব্রাউন রংয়ের কার্পেট। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা স্টিলের খাট পাতা। মেঝের সাথে ফিক্সড করা। ঘরে একটি দরজা, কোন জানালা নেই। ঘরে একটা বাথরুম। বাথরুমের কোন জানালা নেই।
বাথরুমের দরজার দক্ষিণ পাশে ঘরের পশ্চিম দেয়ালের সাথে বেসিন। বেসিন একটা ট্যাপ। ওটা থেকে খাবার পানি পাওয়া যায়। বেসিন থেকে ঠিক ওপরে মাথা বরাবর উঁচুতে দেয়ালের সাথে লাগানো একটা তাক। তাকের সাথে ফিক্সড করা স্টিলের একটা বাক্স মতো কনটেইনার। ছাদ থেকে বেশ মোটা পাইপ ক্রমে সেই কনটেইনারের পেটে ঢুকে গেছে। এই পাইপ দিয়ে বাক্সের মধ্যে আসে খাবার। ঠিক সময়ে খাবার আসে। কনটেইনারের পাশের ছোট দরজাটা খুলে খাবার খেতে হয়। খাবার কিছু উচ্ছিষ্ট থাকলে কনটেইনারের নির্দিষ্ট পটে রাখলে সেটা তুলে নেয়া হয়।
প্রথম দিনেই এসব কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে আহমদ মুসাকে।
অদ্ভুত এ বন্দীখানা! বিছানায় শুয়ে সাদা ছাদটার দিকে চোখ নিবদ্ধ করে ভাবছিল আহমদ মুসা। একটা শব্দও কোথাও থেকে কানে আসছে না। মৃতপুরীর মতোই অখন্ড নিরবতা। মৌনতা যে কত ভয়ংকর এ ক’দিনে আহমদ মুসা হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করেছে। মানুষের কন্ঠ, পাখির কিচির-মিচির, গাড়ির ভেঁপু মনে হচ্ছে কতদিন শোনেনি। এখানে প্রবেশের পর মাঝখানে একদিন ভাসকুয়েজ এসেছিল বৃটিশ ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান-এর প্রধান মি. টমাসকে সাথে নিয়ে। টমাস দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পথে মাদ্রিদে যাত্রা বিরতি করেছিল। ভাসকুয়েজের কাছ থেকে খবরটা শুনে সে ছুটে এসেছিল আহমদ মুসাকে দেখতে।
তার প্রথম প্রশ্নট ছিল, ‘যুগোশস্নাভিয়ায় আপনার কাজ শেষ?’
আমি তো যুগোশস্নাভিয়ায় কোন কাজ নিয়ে যাইনি! গিয়েছিলাম একজন বিপদগ্রস্ত লোককে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু সেখানে তো বড় কাজ করেছেন!’
‘কি কাজ করেছেন?’ বলল ভাসকুয়েজ।
‘মিলেশ বাহিনীকে শেষ করেছেন। মিলেশ বাহিনীর নেতা কনস্টেনটাইন নিহত, দলের মাথা বলতে কেউ বেঁচে নেই।’
‘কি বলছ টমাস? মিলেশ তো আমাদের বন্ধু-সংগঠন ছিল!’ বলে ভাসকুয়েজ বিষদৃষ্টিতে তাকায় আহমদ মুসার দিকে। তারপর বলে আবার, ‘মি. আহমদ মুসা, আপনার অপরাধ ক্রমশই বাড়ছে। বন্ধু সংগঠনের পক্ষে প্রতিশোধ নেয়ার দায়িত্ব আমাদের।’
‘ভাসকুয়েজ ছোট প্রতিশোধের পণ্য বানিয়ে এ সম্পদকে শেষ করো না।’ বলল মি. টমাস।
‘না, তা করছি না। আমেরিকার বেঞ্জামিন এ সপ্তাহের শেষে আসছেন।’
‘বেঞ্জামিন কিবলে?’
‘বিনিময়ে যা চাই তাই দেবে বলেছে।’
‘এ পণ্য হাতে পেলে শুধু মূল্যবান তথ্য উদ্ধার নয়, কিছু মুসলিম দেশের যে সুবিধা আদায় করতে পাবে তার মূল্য টাকার অংকে হিসেব করা যাবে না। আমেরিকান ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান-এর অনেক স্বার্থ আছে আরব ও ইসলামিক দেশে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ফিলিস্তিনে আমেরিকান ইহুদি মাইগ্রশনের অধিকার লাভ। আমেরিকান ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যান আমেরিকান ইহুদিদের আমেরিকা থেকে তাড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু জায়গা পাচ্ছে না।’ বলল টমাস।
মি. টমাস কথা শেষ করে আহমদ মুসার দিকে তাকায় ও জিজ্ঞেস করে, ‘স্পেনে আপনি কি মিশনে আহমদ মুসা?’
‘কেন বেড়াতে আসতে বারণ আছে?’
‘আমি যতদূর জানি, আহমদ মুসা কোথাও বেড়াতে যায় না।’
‘ঠিক বলেছেন মি. টমাস। প্রশ্নটা তো আমাদের মাথায় আসেনি। বলল মি. ভাসকুয়েজ। তারপর মি. ভাসকুয়েজ আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘ওঁর সাথে আমিও একমত, আহমদ মুসা শুধুই সফরে আসে না।’
‘আমি সময় কাটাবার মতো কোন সফরে আসিনি। এখানকার মুসলমানদের অবস্থা জানা এবং মুসলিম স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখা আমার জন্যে ছোট ব্যাপার নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখানে মুসলমান কোথায়, কি অবস্থা দেখবেন?’
‘সংখ্যা যাই হোক, আছে তো কিছু।’
‘তাদের সাথে যোগাযোগ আছে বুঝি?’
‘যোগাযোগ দূরের কথা, তাদের ঠিকানাও আমার জানা নেই।’
আহমদ মুসা কথাগুলো বলার পরেও ভাসকুয়েজের মুখ থেকে সন্দেহের চিহ্ন যায়নি। বলে ওঠে, ‘ষড়যন্ত্র হতে পারে, এমন আশঙ্কা আমরা আগেই করেছিলাম। সরকারকে আমরা বলেছিলাম, একজন মুসলমানকেও মুসলমান পরিচয় নিয়ে জায়গা দেয়া যাবে না। সরকার আমাদের কথা শোনেনি। সউদি আরবের পেট্রোডলারকেই বেশি মূল্য দিয়েছে। তাদের চাপে শুধু মুসলমানদেরকে একটা মাইনরিটি কম্যুনিটি হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি দেয়াই নয়, তাদেরকে মাদ্রিদের বুকের ওপর বিশাল একটা মসজিদ কমপ্লেক্স গড়ারও অনুমতি দিয়েছে। আমাদের কথাই সত্য হয়েছে। ওরা এখন দেশের দুষ্টক্ষত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে।’
‘দেখুন মি. ভাসকুয়েজ, দেশজোড়া সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্যে যে শক্তি, সামর্থ্যের দরকার হয়, স্পেনের অতি ক্ষুদ্র মুসলিম কম্যুনিটির তার কিছুই নেই। এমন একটি মাইনরিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে অহেতুক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলে বুঝতে হবে সে মাইনরিটিরাই তা’হলে ষড়যন্ত্রের শিকার।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল ভাসকুয়েজ। বলল, ‘দেখুন আহমদ মুসা, মুখ সামলে কথা বলবেন। আপনার বিচারের জন্যে আপনাকে সঠিক ব্যবহারের জন্যে আপনার সবচেয়ে বড় শত্রুর হাতে আপনাকে তুলে দিতে চাই বলেই আপনি এখনও বেঁচে আছেন। আপনাকে টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়ালেও আপনার অপরাধ শেষ হবে না।’
সেদিন ভাসকুয়েজ ও টমাস আরও অনেক কথা বলে। শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ভাসকুয়েজ বলেছিল, ‘বেশি নয়, আর মাত্র ক’টা দিন মি. আহমদ মুসা। শনিবারেই হয় আপনি উড়বেন আমেরিকার পথে, হয়তো ……।’
কথা শেষ না করেই ভাসকুয়েজ বেরিয়ে গেল। কথা শেষ না করলেও ভাসকুয়েজের না বলা কথাটা আহমদ মুসা বুঝেছে। আমেরিকান ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলার পেলে আহমদ মুসাকে তাদের হাতে তুলে দেবে, তা না হলে এরা আহমদ মুসাকে হত্যা করবে। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।
আহমদ মুসা পাশ ফিরে শু’ল। তার চোখটা গিয়ে দরজার ওপর পড়ল। অন্যদিকে ধাবিত হলো আহমদ মুসার চিন্তা। বিস্ময়কর সিকুরিটি সিস্টেম এই বন্দীখানার! সম্ভবত রাতে অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকার সময়টা ছাড়া সর্বক্ষণ টেলিভিশন ক্যামেরা তাকে পাহারা দিচ্ছে, তার সব গতিবিধি রেকর্ড করছে। ঘর থেকে বেরুবার একমাত্র দরজাটি কনট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রিত। দরজার সামনে দাঁড়ালে টেলিভিশন ক্যামেরায় তা তারা দেখে, তারপর দরজা খুলে দেয়। বাইরের গেট ছাড়া আর কোথাও যে পাহারাদার দেখেনি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার মুখে যে দরজা তাও দূর নিয়ন্ত্রিত। কনট্রোল রুম থেকে টেলিভিশন ক্যামেরা দেখে দরজা বন্ধ কিংবা খুলে দেয়া হয়। দোতলা থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে নামার পথে সিঁড়ির মুখে আরেকটা দরজা আছে সেটাও ঐভাবে দূর নিয়ন্ত্রিত।
সেদিন দোতলা থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে নামবার সময় আহমদ মুসা সিনাত্রা সেন্ডোকে বলেছিল, ‘আপনাদের সেই দানবকে তো দেখছি না?’
‘দেখতে চান?’
‘অমন আশ্চর্য জিনিস কে না দেখতে চায়?’
‘এখন ও ঘুমিয়ে আছে। পাহারায় নিয়োগ করা হয়নি ওকে। ও যখন পাহারায় থাকবে, সেই হবে গোটা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের মালিক। চলন্ত সব জিনিসই তার শত্রু।’
‘আপনাদের লোকদের ওপর আপনাদের আস্থা বোধ হয় খুব কম। তাই না?’
‘কেন?’
‘রোবটকে রেখেছেন পাহারায়।’
হেসেছিল মি. সেন্ডো। বলেছিল, ‘রোবটটা আমাদের অগ্রবাহিনী। সে সক্রিয় হবার সাথে সাথে মানুষ প্রহরীরাও ছুটে আসবে। ওরা ষ্ট্যান্ডবাই থাকে ওদের ডিউটি রুমে।’
‘একজন বা দু’জন বন্দীর জন্যে আপনাদের এত আয়োজন!’
‘যুদ্ধের আশংকা না থাকলেও সৈন্য রাখা কেউ বাদ দেয় না।’
‘তাছাড়া বন্দী পালাতেও তো পারে না?’
‘পারে। কিন্তু আমাদের এখান থেকে সম্ভব নয়। অতীতে কয়েকজন পালাবার চেষ্টা করেছিল, যারা খাবার নিয়ে যেত তাদের পরাভূত করে। কিন্তু এখন সে সুযোগও নেই।’
একটু থেমেই মি. সেন্ডো আবার বলল, ‘তবে যারা পালাবার চেষ্টা করেছিল সবাই মারা পড়েছিল আমাদের যন্ত্র দানবের হাতে।’
যন্ত্র দানব তো নয়, আপনারা মেরেছেন। আপনারা তার গুলী করা বন্ধ করতে পারতেন।’
‘কেমন করে জানলেন?’
‘কেন, ওর কমান্ড কম্পিউটার আপনাদের হাতে ছিল, এতো সবারই জানা!’
‘ঠিক বলেছেন, আমরা পলাতককে বাঁচাই না, তার প্রাপ্যই হলো মৃত্যুদন্ড।’
কথা বলতে বলতে তারা এই ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। কথা আর হয়নি তারপর। কিন্তু আহমদ মুসার বুঝার আর বাকি ছিল না, তারা অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
আহমদ মুসা জানে, রোবটের চোখ রোবট দেখে না, দেখে কমান্ডো কম্পিউটারের পরিচালক। তাছাড়া বন্দীখানার সব কক্ষ ও করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে টেলিভিশন ক্যামেরার চোখ। কমান্ডো কম্পিউটারের পরিচালক তার চারদিকে টিভি স্ক্রীনে সবটাই দেখতে পায় এবং সব দেখেই রোবটকে নির্দেশ দেয়। ওদের টিভি স্ক্রিনে এ ঘরের প্রতিটি কাজ ধরা পড়ছে। রাতেও ইচ্ছামত আলো জ্বালিয়ে তাকে ওরা দেখে। ঘুমের ভান করে সে দেখেছে, ঘুমাচ্ছে জেনেও ওরা মাঝে মাঝে আলো জ্বালিয়ে দেখেছে। অতএব, ঘর থেকে বেরুবার যে কোন চেষ্টা ওদের চোখে ধরা পড়ার আশংকা আছে। আর ঘর থেকে কোনমতে বেরুলেও করিডোরে পা রাখার সাথে সাথে রোবটের বন্দুকের মুখে পড়তে হবে। সুতরাং সব বিচারেই বড় কঠিন জায়গা এটা, স্বীকার করল আহমদ মুসা।
আবার পাশ ফিরল আহমদ মুসা। আবার সেই ভাবনা, বড় কঠিন জায়গা হলেও কিছ একটা করতে হবে তাকে। কাল শনিবার, এ বন্দীখানার শেষ দিন তার, সে কথা ভাসকুয়েজ বলেই গেছে। হয় কাল সকালে বিক্রি হয়ে তাকে আমেরিকার ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের নতুন বন্দী হিসেবে উড়তে হবে, নয়তো তাকে এরাই হত্যা করবে। এ বিকেল ও আজকের রাতটাই তার হাতে মাত্র কিছু চিন্তা করার। কিন্তু কী চিন্তা করবে সে?
পুনরায় পাশ ফিরল আহমদ মুসা। চোখ বুঝল সে। কপাল তার কুঞ্চিত হযে উঠিল।
বুঝা গেল কোন গুরুতর চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করেছে।

কার্ডিনাল হাউজের সামনের পার্ক। সন্ধ্যা তখন পেরিয়ে গেছে।
কার্ডিনাল হাউজের তিনতলায় অবস্থিত লাইব্রেরি থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো জেনের আব্বা ফ্রান্সিসকো জেমেনিজ, জেনের মা ও জেন।
কার্ডিনাল পরিবারের সদস্যরা প্রায় বেড়াতে আসে কার্ডিনাল হাউজে। আজও তেমনি ধরনের বেড়াতে আসা। তবে আজকের বেড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য জেনকে নিয়ে মুক্ত হওয়ায বেড়ানো। সে হাসপাতাল থেকে ক’দিন হলো বের হয়েছে। তার মুখ ম্লান, শরীরটা অনেকখানি কৃশ।
চোখে তার সবুজ গগলাস। তার বাম চোখের দৃষ্টি শক্তি প্রায় নেই। ডাক্তারের পরামর্শ, জটিল একটা অপারেশন আছে যা তার চোখ পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সে অপারেশনের জন্যে জেনকে সুস্থ হওয়া প্রয়োজন।
ফ্রান্সিসকো জেমেনিজরা সিঁড়ির গোড়ায় নামতেই তাদের দেখা হলো ভাসকুয়েজের সাথে।
ফ্রান্সিসকো জেমেনিজ স্প্যানিশ ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের উপদেষ্টা পরিষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য।
ভাসকুয়েজের সাথে দেখা হতেই ফ্রান্সিসকো ভাসকুয়েজকে স্বাগত জানিয়ে বলে উঠল, কি মি. ভাসকো শেষ খবরটা কি?’
‘আজ রাত ২টার ফ্লাইটে আমেরিকা থেকে ওরা আসছেন। ১ বিলিয়ন ডলারে রফা হয়েছে। আমরা আজ রাতেই আহমদ মুসাকে ওদের হাতে তুলে দেব।’ বলল ভাসকুয়েজ।
‘একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে মি. ভাসকো। আহমদ মুসা যে আমাদের হাতে এবং তার যে এই ধরনের পরিণতি ঘটতে যাচ্ছে- এই গোটা ব্যাপারটাই আমার কাছে এখনও স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।’
‘ঠিক বলেছেন। আজকের দুনিয়ার বলা যায় সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি আহমদ মুসা যে এভাবে আমাদের হাতে আসবে, তা আমরা কোনদিন কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ মি. ভাসকো। আপনার কৃতিত্ব এটা।’
‘ধন্যবাদ, মি. ফ্রান্সিসকো।’
বলে একটু থেমে মি. ভাসকো আবার বলল, ‘আপনি তো আরও কিছু সময় আছেন, আমি আসছি একটু ভেতর থেকে।’
বলে মি. ভাসকো কার্ডিনাল হাউজের দ্বিতলের দিকে চলে গেল।
মি. ভাসকো চলে যেতেই জেন তার আব্বার কাছে সরে এলো। বলল, ‘এ কোন আহমদ মুসা আব্বা?’
‘কেন তুমি জান না তাকে? সেই যে ফিলিস্তিন বিপ্লব, মিন্দানাও বিপ্লব, মধ্যএশিয়া বিপ্লব, ককেশিয়া বিপ্লব,….’
তার আব্বার কথা শেষ না হতেই জেন বলল, ‘তাকে চিনব না! কাগজে কত পড়েছি। সাবই তো তাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা বলে।’
‘হ্যাঁ, সেই শ্রেষ্ঠ নেতাই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।’
‘কিভাবে?’
‘সে এক মজার কাহিনী’ বলে মি. ফ্রান্সিসকো আহমদ মুসা কিভাবে বাস্ক গেরিলাপ্রধানের বোন মারিয়াকে বাঁচাতে গিয়ে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের হাতে বন্দী হয়, কিভাবে ক্লু-ক্ল্যক্স-ক্ল্যানের সতর্কতা ও প্রতিরোধকে পরাভূত করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে পালিয়ে যায় এবং কিভাবে আবার সেধরা পড়ে। সব কাহিনী জেনকে শুনিয়ে বলল, ‘আহমদ মুসার বিপ্লবী জীবনের সব লীলাখেলা এবার শেষ হচ্ছে।’
জেনের কাছে তার আব্বার কথা ভালো লাগল না, বরং মনটার কোথায় যেন খচখচ করতে লাগল! জোয়ানের মুখটাও তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভাবল, জোয়ান যেহেতু মুসলমান, তাই এ খবরটায় নিশ্চয় সে বড় রকমের আঘাত পাবে। জেন বলল, ‘আব্বা এ ধরনের একজন বিপ্লবী নেতাকে বিক্রি করা কি সম্মানজনক? এমন ব্যবসায় মনোবৃত্তি কি ভালো দেখায়?’
‘তুমি জান না জেন, এটা বিক্রির ব্যাপার নয়, একধরনের বিনিময় বলতে পার। আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে আহমদ মুসা দ্বারা তার একটা অংশ পুরণ করলাম আমরা এর মাধ্যমে।’
‘শুনেছি লোকটি নাকি খুবই ভালো। যা কিছু করছেন জাতির জন্যে, নিজের জন্যে কিছুই নয়। আহমদ মুসার চরম বৈরী কাগজ ‘ওয়ার্ল্ড টাইমস’ তার ওপর একটা কভার স্টোরি করছিল। তাতে বলা হয়েছিল আহমদ মুসা ফিলিস্তিন বিপ্লব সমাপ্ত করে যখন ফিলিস্তিন থেকে চলে যান, তখন এক শুভাকাঙক্ষীর কাছ তেকে ১ হাজার ডলার ধার নেন। সব ক্ষেত্রেই অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে্। তিনি কোথাও থেকে ব্যক্তিগতভাবে কোন ফায়দা নেননি। এমন নিঃস্বার্থ বিপ্লবী দুনিয়াতে দুর্লভ আব্বা। দুনিয়াতে যারা কষ্ট করে বিপ্লব করেছে, তারা সবাই রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করেছে, বিপ্লবের সকল সহায় সম্পদের মালিক হয়েছে।’
‘তোমার কথা অস্বীকার করছি না জেন। কিন্তু তার বিপ্লব যাদের ক্ষতি করেছে, আমরাও তাদের মধ্যে। সুতরাং আমরা তাকে ঐভাবে বিচার করব না। তিনি আমাদের শত্রু।’
‘শত্রু হলেও মহৎ শত্রু আব্বা।’ আমি এ কভার স্টোরিতে পড়েছি, বিপ্লবের সময় ও বিপ্লব কর্মকান্ডের বাইরে তিনি কারও কোন ক্ষতি করেননি, ক্ষতি করেন না।’
‘কিন্তু তার পরেও তিনি আমাদের স্বার্থের শত্রু।’
জেন কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আব্বা বলল, ‘চল, পার্কে গিয়ে বসি। আরও কিছুটা সময় আমরা কাটাতে পারি ওখানে গিয়েই আমরা কথা বলব।’
ওরা সকলেই পা বাড়াল পার্কের দিকে।

আহমদ মুসা বুঝল বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
ধীরে ধীরে সে গিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল।
বাথরুমের মেঝেয় দাঁড়িয়ে আহদম মুসা বাথরুমের ছাদের দিকে তাকাল। যা ভেবেছিল তাই, পয়ঃপাইপ যেখান দিয়ে নেমে এসছে তার পাশের জায়গাটা ছাদের অন্য জায়গা থেকে আলাদা। ছাদের এ এলাকাটা ভেঙে পয়ঃপাইপ বসানো হয়েছে। পরে ছাদের ঐ অংশ আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ল্যাসার কাটার বের করে হাতে নিল। তারপর পয়ঃপাইপ বেয়ে ওপরে উঠে গেল। ডান হাতে পাইপ ধরে রেখে বাম হাতে কাটারের সূক্ষ আগা দিয়ে নতুন তৈরি ছাদটা পরীক্ষ করল। দেখল, লোহার দুই বীমের ওপরা স্টিলের শীট চাপিয়ে তার ওপর ছাদ ঢালাই করা হয়েছে। নিচে থেকে তা অবশ্য বুঝা যায় না রংয়ের কারণে। আহমদ মুসা লেসার কাটার চালু করে স্টিল শীটের যে পাশটা লোহার বিমের ওপর আটকানো, সে পাশটা লেসার বিম দিয়ে কেটে ফেলল। তারপর ষ্টিল শিটের সে অংশটা দেয়ালের মধ্যে ঢুকানো দেয়াল বরাবর সে পাশটাও কেটে ফেলল। কিন্তু ষ্টিল শিটটা পড়ে গেল না। টানাটানি করল, তবু পড়ল না। আহমদ মুসা নেমে এলো নিচে। টয়লেটের ফ্লাশের স্টিলের হাতলটা কেটে নিল। হাতলটার এক প্রান্ত বেশ চোখা।
আবার উঠল আহমদ মুসা। অনেকক্ষনের প্রচেষ্টায় হাতলের সুঁচালো প্রান্ত স্টিল শিটের ওপর দিয়ে ছাদের ভেতর ঢুকানো গেল। তারপর হাতল ধরে অনেক টানাটানির পর স্টিল শিটের একটা প্রান্ত আগলা করা গেল। দেরি সইছিল না। আহমদ মুসা আলগা অংশটা দু’হাতে ধরে ঝুলে পড়ল। কাজ হলো। আহমদ মুসা আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর, তার সাথে সশব্দে এসে পড়ল স্টিল শিটটি।
পাইপ বেয়ে আবার উঠে গেল আহমদ মুসা। স্টিল শিটের ওপর ছিল সিমেন্ট দিয়ে পাথর জমানো আস্তরণ। আহমদ মুসা আগের মতোই এক হাতে পাইপ ধরে অন্য হাতে লেসার বিম দিয়ে সিমেন্ট গলিয়ে এক এক করে পাথর খুলতে লাগল। বড় কষ্টকর এই কাজ। ঘেমে উঠল আহমদ মুসা। মেঝেতে আছড়ে পড়ায় পায়ের গোড়ালিতে লেগেছিল, সে জায়গায় চিন চিন করছে। তা’ছাড়া স্টিল শিটটি মাথায় আঘাত করেছিল। সে জায়গাটাও টন টন করছে। কিন্তু বিশ্রাম নেবার সুযোগ নেই। বেশি দেরি হলে ধরা পড়ার আশংকা। বাথরুমে ওদের টিভি ক্যামেরার কোন চোখ নেই বলে রক্ষা। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘর থেকে অনুপস্থিত থাকলে ওরা সন্দেহ করতে পারে।
আস্তরণটির ওপরের অংশটা ছিল গুঁড়ো পাথর ও সিমেন্টে জমানো। আহমদ মুসা যতটা পারল লোহার বিম ও দেয়ালের পাশ বরাবর জায়গায় সিমেন্ট গলিয়ে ফেলল। তারপর লেসার কাটার পকেট পুরে দু’হাতে পাইপ আঁকড়ে ধরে দু’পা জোড়া করে ওপরে তুলে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি দিতে লাগল। তিন-চারটি লাথির পরই পাতলা আস্তরণটি তার পায়ের ওপর নেমে এলো, তারপর সশব্দে গড়িয়ে পড়ল নিচে মেঝেতে।
ওপরে ছাদে বেশ বড় একটি গহবরের সৃষ্টি হলো। আহমদ মুসা লোহার বিম ও ভাঙা ছাদের প্রান্ত ধরে দ্রুত ওপরের মেঝেতে উঠে গেল। একবার চোখ তুলে তাকাল বাথরুমের দরজার দিকে। দরজা বন্ধ। আহমদ মুসা গভীর ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ল মেঝেতে। বড় বড় দম নিয়ে সে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে দুনিয়ার মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে লোভনীয় মনে হচ্ছে বিশ্রামকে।
কিন্তু মিনিট দুয়েকের বেশি সময় সে নষ্ট করতে পারল না। উঠে দাঁড়াল। গোটা গা ধুলো-বালিতে ভরে গিয়েছিল। একটু ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। চারদিকে তাকিয়ে বাথরুমটাকে তার কাছে নোংরাই মনে হলো অর্থাৎ বাথরুমটা সাধারণের ব্যবহারের জন্যে! আহমদ মুসার মনে পড়ল এঘরটি তার ওপরের ঘর। এখান থেকেই তার ঘরে খাদ্য সরবরাহ হতো। সুতরাং এঘরটা কিচেন, স্টোর রুম ইত্যাদি জাতীয়ই কিছু হবে।
আহমদ মুসা বাথরুমের দরজার নব ঘুরাতে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজার নব ঘরে গেল। সংগে সংগে খুলে গেল দরজা।
একেবারে মুখোমুখি। মাঝারি লম্বা, মোটা সোটা একজন লোক। শক্ত-সমর্থ শরীর। আহমদ মুসাকে সামনে দেখে তার চোখ ছানাবড়া!
বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আহমদ মুসা তার ডান হাতের একটা কারাত চালাল লোকটির কানের নিচে নরম জায়গাটায়। লোকটা নিঃশব্দে গোড়া কাটা গাছের মতো দরজার ওপর পড়ে গেল।
আহমদ মুসা নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। কেউ এলো না। আহমদ মুসা বুঝল, এঘরে কেউ নেই।
লোকটিকে টেনে বাথরুমে ঢুকিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল সে।
ঘরটি আসলেই একটা স্টোর রুম।
ঘরের চাদিকে একবার নজর বুলাল আহমদ মুসা। পাশেই একটা বাক্সে সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দেখতে পেল। তারপর সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজার সামনে একটু দাঁড়িয়ে নব ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা একটু ফাঁকা করে বাইরে উঁকি দিল। দেখল লম্বালম্বি একটা করিডোর।
আহমদ মুসার মনে পড়ল এ ধরনের একটা করিডোরের মুখেই নিচে নামার সিঁড়িটি করিডোরে গিয়ে উঠেছে। আহমদ মুসার আরও মনে পড়ল সিঁড়ির পাশেই ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ড। বিশাল মাষ্টার সুইচটাকে সে ওখানেই দেখেছে।
আহমদ মুসা দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে বিদ্যুৎ গতিতে পেছনে ফিরল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তখন। একটা লোহার রড নেমে আসছে তার মাথা লক্ষ্যে। শেষ মুহূর্তে তার মাথাটা কাত করে একদিকে সরিয়ে নিতে পারল। মাথাটা বাঁচল, কিন্তু আঘাতটা এসে লাগল গলা ও ঘাড়ের সন্ধিস্থলে।
মাটিতে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
ঘাড়ের পেশিটা থেঁতলে গেল বলে মনে হলো। মাথাটাও চিন চিন করে উঠল ব্যথায়। ঘুরে উঠেছিল মাথাটা।
মাটিতে পড়েই আহমদ মুসা দেখল, লোকটি রডটা তুলে নিচ্ছে, আরেকটা আঘাত নেমে আসছে তার ওপর।
আহমদ মুসা এক পাশে নিজেকে ছুঁড়ে দিল। রডের আঘাতটি গিয়ে কংক্রিটের মেঝের ওপর পড়ল।
আহমদ মুসা এক পাশে সরে গিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
লোকটি তৃতীয়বার রডটি তোলার আগেই আহমদ মুসার ডান হাতের কারাত লোকটির বা কানের নিচে ঠিক আগে জায়গাটায়। লোকটি রড আর তুলতে পারল না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রডের ওপরেই।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে আবার দরজা দিয়ে উঁকি দিল বাইরের করিডোরে। না, কোন লোক নেই। আহমদ মুসা মুখটা নিচু করে করিডোর ধরে উত্তর দিকে দৌড় দিল। লক্ষ্য, সিঁড়ির ঘর।
আহমদ মুসার স্মৃতি ঠিকই বলেছিল। যেখানে করিডোরটি পুব দিকে মোড় নিয়েছে, সেখানেই পেয়ে গেল সে সিঁড়ি ঘর। সিঁড়ি মুখের পুব পাশে দেয়ালেই সুইচ বোর্ড।
আহমদ মুসা এক লাফে গিয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে দাঁড়াল। মাষ্টার সুইচের ওপর নজর বুলাল। পাশাপাশিই অন ও অফ এর বোতাম। আহমদ মুসা চকিতে একবার পুব দিকে তাকিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা দেখে নিল।
তারপর মুখ ঘুরিয়ে যখন অফ-এর বোতামের দিকে হাত বাড়াল, তখনই বেজে উঠল সাইরেন।
আহমদ মুসা দ্রুত অফ- এর বোতামটি চেপে দৌড় দিল করিডোরে ওঠার সিঁড়ির দিকে।
অন্ধকারে সিঁড়ির রেলিং এর সাথে সে ধাক্কা খেল। তবু খুশি হলো সিঁড়ি পেয়ে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল বারান্দায়।
দোতলার বারান্দায় যখন সে উঠল, বিভিন্ন দিকে পায়ের শব্দ ও হৈ চৈ শুনতে পেল। হঠাৎ বিদ্যুত চলে যাওয়ায় বুঝা গেল তারা উত্তেজিত ও আতংকিত হয়ে পড়েছে।
আহমদ মুসা ভাবল, তারা অবিলম্বে আলোর ব্যবস্থা করবে। নিজস্ব জেনারেটরও থাকতে পারে। মাঝেখানে যেটুকু সুযোগ পাবে, তাকেই কাজে লাগাতে হবে।
ভাবল আহমদ মুসা, বারান্দা দিয়ে আরেকটু সামনে এগোলেই নিচের বাগানে নামার সিঁড়িমুখের দরজা। কিন্তু আহমদ মুসার মন বলল, ও পথটা নিরাপদ নয়। সাইরেন যখন বেজেছে, তখন বেরুবার ঐ পথটাই তারা আটকেছে প্রথম। বেরোলেই ওদের ফাঁদে পড়তে হবে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, ভাসকুয়েজ বলেছিল কার্ডিনাল হাউজের দু’তালা, তিনতালায় লাইব্রেরি আছে। কথাটা মনে পড়ায় আহমদ মুসার মন খুশি হয়ে উঠল। সেন্ডোর সাতে একতলার করিডোরে ওঠার পর সে লক্ষ্য করেছে, যে সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নামা যায় সে সিঁড়িটিই ঘুরে দু’তলায় উঠে গেছে। হয়তো সিঁড়ির মাথায় দরজা কিংবা কিছু দিয়ে তিনতলায় উঠে গেছে। হয়তো সিঁড়ির মাথায় দরজা কিংবা কিছু দিয়ে তিনতলায় ওঠার পথ বন্ধ করা হয়েছে। তা হোক, ঐ প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা অনেক নিরাপদ হবে।
চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা দেয়ালের গা ঘেঁষে দু’তলার সিঁড়ি মুখের দিকে এগোলো। এ সময় করিডোর দিয়ে বেশ কয়েকজন লোকের ছুটে আসার শব্দ পাওয়া গেল। আহমদ মুসা দেয়ালের সাথে সেঁটে নিঃশ্বস বন্ধ করে দাঁড়াল।
ছুটে আসা লোকরে কয়েকজন তা সামনে দিয়ে ছুটে বারান্দার দিকে বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসা বুঝল, ওরা নিচে নামার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
আহমদ মুসা এবার হাতড়িয়ে দু’তলায় ওঠার সিঁড়িমুখ খুঁজে নিল। তারপর দু’হাত ও দু’পা ব্যবহার করে হামাগুড়ি দেয়ার মতো করে দ্রুত সিঁড়ির মাথায় উঠে গেল। হাতড়িয়ে দরজাটা বের করল। টোকা দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝল স্টিলের দরজা।
এই সময় সিঁড়ির অন্ধকারটা অনেকখানি ফিকে হয়ে গেল। আহমদ মুসা বুঝল, মাষ্টার সুইচ তারা অন করেছে। আহমদ মুসা উদ্বিগ্ন হলো, এ সিঁড়িতেও তারা উঠতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই আশ্চর্য হলো এই বলে যে, নিচের তিনটি ফ্লোর খোঁজা কমপ্লিট না করে তারা এ সিঁড়িতে আসবে না। এ সময়ের মধ্যে তাকে সরে পড়তে হবে।
আহমদ মুসা দরজা পরীক্ষা করে বুঝল, স্টিলের দরজাটা ওয়েল্ডিং করে স্থায়ীভাবে আটকে দেয়া হয়েছে।
সে আর সময় নষ্ট করল না। লেসার কাটার বের করে দরজার মাঝখানটা কেটে একটা ফোকর সৃষ্টি করল।
আহমদ মুসা সেই ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এলো দু’তলার বারান্দায়।
কেউ কোথাও নেই।
আহমদ মুসা চিন্তা করল কার্ডিনাল হাউজের সম্মুখ ভাগ উত্তর দিকটা। সুতরাং নিচে নামার সিঁড়ি উত্তর দিকেই থাকবে। তখন সন্ধ্যা। লাইব্রেরিতে লোকজন থাকতে পারে। বারান্দাতেও কেউ থাকা বিচিত্র নয়। আহমদ মুসা মাথার চুলটা একটু ঠিক করে ধীর পায়ে এগোলো বারান্দা দিয়ে উত্তর দিকে।
ঘুরানো বারান্দা। উত্তর দিকে কিছুটা ঘুরে আবার পশ্চিম দিকে গেছে।
আহমদ মুসা পশ্চিম দিকে ঘুরেই নিচে নামার সিঁড়ি দেখতে পেল।
সিঁড়িমুখে একজন চেয়ারে বসে আছে। আহমদ মুসা বুঝল, সে প্রহরী। লাইব্রেরীতে প্রবেশ তাহলে নিশ্চয় নিয়ন্ত্রিত।
সে ধীর পায়ে সিঁড়ি মুখের দিকে এগোলো।
সিঁড়ির মুখের লোকটি আগেই দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসাকে। তার চোখে কিছুটা বিস্ময়। আহমদ মুসা কাছে আসতেই সে উঠে দাঁড়াল বলল, ‘স্যার, ওদিকে কেন? কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘এই দেখলাম আর কি!’ মুখে হাসি টেনে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল আহমদ মুসা।
কিছু বলতে যাচ্ছিল প্রহরী। আহমদ মুসা তার আগেই বলল, ‘তোমার কোন ভয় নেই, ওদিকে কোন সোনাদানা থাকে না। আর আমি খালি হাতে দেখতেই তো পাচ্ছ।’
বলে আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।
প্রহরী কিছু বলতে গিয়েও আবার চুপ করে গেল। সংকোচের একটা ভাব তার চোখে-মুখে প্রকাশ পেল। সম্ভবত আহমদ মুসার মতো একজন সুন্দর ভদ্রলোককে আর কিছু বলতে তার মন সায় দেয়নি।
এই প্রহরী লোকটি ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান থেকে নিয়োগ করা। তার দায়িত্বের মধ্যে একটি হলো লাইব্রেরি ছাড়া বাড়ির অন্য অংশে কেউ না যায় তা নিশ্চিত করা। তার আরেকটি দায়িত্ব হলো, সাদা চামড়ার লোক ছাড়া আর কেউ যেন লাইব্রেরিতে ঢুকতে না পারে, তা দেখা।
আহমদ মুসা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাড়ির সামনের লনটা পেরিয়ে লাল ইটের সেই রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
এই সময় আহমদ মুসা পেছনে বাড়ির দু’তলার বারান্দায় হৈ চৈ ও দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পেল। আহমদ মুসা পেছনে না তাকিয়েই বুঝল, সে যে দু’তলার সিঁড়িপথ দিযে পালিয়েছে তা ওরা টের পেয়েছে।
আহমদ মুসা দেখল সেই লাল ইটের রাস্তায় একটা নতুন কার দাঁড়িয়ে আছে। পার্কের গেট পেরিয়ে একজন বয়স্ক লোক, একজন তরুনী ও একজন মহিলা রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে।
এই সময় দু’তলা থেকে গুলীর শব্দ হলো। পিস্তলের গুলী। না তাকিয়েও আহমদ মুসা বুঝল, তাকে লক্ষ্য করেই গুলী করা হয়েছে। কিন্তু পিস্তলেল গুলী এত দূর আসবে না। পূর্বদিকের ঘেরা প্রাচীরের গেটেও কয়েকজনের জটলা দেখতে পেল সে। গুলীর শব্দ শুনে ওরা এদিকেই আসছে।
আহমদ মুসা অন্য কিছু আর ভাবতে পারল না। পাশে দাঁড়ানো গাড়ির ড্রইভিং সিটে চোখের পলকে সে উঠে বসল। চাবি স্টার্টারের সাথেই ছিল।
এক হাতে আহমদ মুসা দরজা টেনে বন্ধ করল, অন্য হাতে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি ষ্টার্ট দিল।
ঘুমন্ত গাড়িটা জেগে উঠেই লাফ দিয়ে চলতে শুরু করল। কেউ কিছু বুঝার আগেই গাড়ি কার্ডিনাল হাউজের সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
রাস্তায় পড়ে ভাবল আহমদ মুসা, কোথায় যাবে সে। হোটেলে যাওয়া রিস্কি। শহরে নিজের তো কেউ নেই। চিন্তা করে সময় নষ্ট করার তার সময়ও নেই। ওরা নিশ্চয় পিছু নেবে, অন্যদিকে গাড়ির নাম্বার পুলিশকে জানালে তারাও পাহারা বসাবে। পুলিশ এলার্ট হবার আগেই তাকে নিরাপদ কোথাও পৌঁছতে হবে।
দক্ষিণগামী একটা হাইওয়ে খুব কাছেই। দক্ষিণ দিকে শহর বেশি নেই। শহর পেরুই উঁচু-নিচু পাহাড়ী এলাকা। সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জলপাই বাগান। জংগলে ভরা। শহরের ম্যাপ যেটুকু সে দেখেছে তাতে এতটুকু মনে পড়ছে।
আহমদ মুসা দক্ষিণ হাইওয়ের দিকেই ছুটে চলল। রিয়ার ভিউতে তার পেছনে কোন গাড়ি সে আসতে দেখছে না। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গাড়ি আছে প্রাচীর ঘেরা বাগানে। সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে গাড়ি বের করতে অবশ্যই সময় লাগবে।
আহমদ মুসা শহর থেকে বেরিয়ে সেই জলপাই বাগানে এসে পৌঁছল। সে হাইওয়ে থেকে গাড়িটি বাগানে ঢুকিয়ে একটা বড় ঝোপের আড়ালে এনে দাঁড় করাল। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশটা একবার দেখে নিল। জায়গাটাকে তার খুবই নিরাপদ মনে হলো। শহর থেকে বেরুবার পর সে গাড়ির আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং তার বাগানে প্রবেশ কারও নজরে পড়ার কথা নয়। কেউ তাকে ফলো করেনি। অন্তত তার এটা নজরে পড়েনি।
নতুন গাড়ি। খুব দামি গাড়ি। গাড়ির কাচ রঙীন। বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু ভেতর থেকে বাইরের সব কিছুই দেখা যায়।
আহমদ মুসা গাড়ির আলো জ্বালিয়ে ভেতরটা একবার ভালো করে দেখল। একটি ভ্যানিটি ব্যাগ দেখল পেছনের সিটে। তাছাড়া আরও পেল কয়েক কৌটা ফলের রস ও কেকের প্যাকেট। শেষ দু’টো পেয়ে আহমদ মুসা খুব খুশি হলো। গাড়িতে যারা এসেছিল তারা এগোলো এনেছিলন পার্কে বসে খাবার জন্যে। কিন্তু বোধ হয় তাদের প্রয়োজন হয়নি। এখন যেহেতু ক্ষুধার্ত সে, তাই সে এগোলো খেতে পারে। গাড়ি ফেরত দেবার সময় ওদের অনুমতি নিলেই চলবে।
সত্যিই খুব ক্ষুধা পেয়েছিল আহমদ মুসা। অনেক পরিশ্রম ও ধকল গেছে তার।
গোটা কেকটাই খেয়ে নিল আহমদ মুসা। তার সাথে তিন কৌটা ফলের জুস। খেয়ে খুব আরাম লাগল তার। মনে হলো, যথাসময়ে পরিশ্রমের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ হলো।
খাবার পর গাড়ির সিটে গা এলিয়ে একটু বিশ্রাম নিল সে।
শুয়ে শুয়েই ভাবল গাড়িটা কার কি করে মালিককে খুঁজে পাবে সে! হঠাৎ তা সেই ভ্যানিটি ব্যাগটার কথা মনে পড়ল।
ভ্যানিটি ব্যাগটি তুলে নিয়ে খুললো সে। ভেতরে টাকা, ছোট্ট একটা বিউটি বক্স ও ছোট্ট একটা চিরকুট পেল। তাতে লেখা, ‘জেন, তোর দেখা না পেয়ে এই চিঠিটা তোর ব্যাগে রেখে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো তোর শরীর হয়েছে, কিন্তু যাচ্ছিস না। এটা ঠিক নয়। লেখাপড়ায় তোর মনোযোগী হওয়া দরকার। মনটাও তাতে ভালো হবে। – হান্না।’
আহমদ মুসা ভাবল, গাড়ির মালিক মেয়েটির নাম তাহলে ‘জেন’! নাম পাওয়া গেল, কিন্তু ঠিকানা?
হঠাৎ আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। গাড়ির ব্লু-বুকেই তো সব পাওয়া যাবে!
চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ব্লু-বুক বের করে আনল। খুলে নাম-ঠিকানার ওপর চোখ বুলাল। নাম-ঠিকানা পড়ে আহমদ মুসা স্বগত উচ্চারণ করল জেনের পিতার নাম ফ্রান্সিসকো জেমিনেস ডে সেজনারোসা। ঠিকানা কার্ডিনাল হাউজ দেখে ভাবল, এরা কি তাহলে কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো ডেমেনিজ ডে সাজনারোসার পরিবার। তা’হলে এর কি ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানেরও কেউ?
রাত দশটার দিকে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে বাগান থেকে বেরুল। গাড়ির নাম্বার সে পাল্টে ফেলেছে্। গাড়ির এমারজেন্সী কেবিনে পেস্টি টেপ ও ছোট কাঁচি পেয়েছিল। ছোট একটা সাদা প্যাড পেয়েছিল‘ ব্লু-বুকের সাথে। আহমদ মুসা নিখুঁতভাবে কাগজ কেটে গাড়ির নাম্বারের দ্বিতীয় অংক ও শেষ অংক পরিবর্তন করেছিল। পরিবর্তিত নাম্বারটা ফিডেল ফিলিপের গাড়ির নাম্বার হয়ে গেল। আহমদ মুসার গন্তব্য কার্ডিনাল হাউজ। লক্ষ্য, গাড়িটা ফেরত দেয়া। গাড়িটা ফেরত না দেয়া পর্যন্ত সে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। গাড়ি চুরি করার জন্যে ওরা কি পরিমাণ গাল-মন্দ করছে কে জানে!
মাদ্রিদ শহরের রোড় ম্যাপের একটা কপি তার পকেটে সব সময়ই আছে। গাড়ি ছাড়ার আগে সে একবার ওটাতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে।
রাস্তা চিনে নিতে কোন অসুবিধা হলো না আহমদ মুসার। ঠিক রাত সাড়ে দশটায় কার্ডিনাল কটেজের গেটে থামাল আহদম মুসা।
কার্ডিনাল কটেজটি প্রায় একটি রাজপ্রাসাদ।
গাড়ি থামতেই গেট রুম থেকে গেটম্যান উঁকি দিল। আহমদ মুসা বলল, ‘মি. ফ্রান্সিসকো আছেন?’
‘না, নেই।’ বলল গেটম্যান।
‘জেন আছে?’
‘আছে।’
‘তাকে হলেও চলবে।’
‘আমি ওর হারানো গাড়ির খোঁজ নিয়ে এসেছি।’
গেটম্যান সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল জানালা থেকে।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই গেট খুলে গেল। আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
গাড়ি দিযে দাঁড়াল গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি বারান্দা থেকে দু’ধাপ উঠলেই লম্বা করিডোর।
গাড়ি বারান্দায় পৌঁছে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতে নামতে দেখতে পেল একটি তরুণী এসে করিডোরে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে বিস্ময়!
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমেই দু’ধাপ পেরিয়ে করিডোরে উঠে গাড়ির চাবিটি জেনকে দিতে দিতে বলল, ‘বাধ্য হয়ে আপনার গাড়ি বিনা অনুমতিতে নিতে হয়েছিল, এজন্যে আমি দুঃখিত। আপনার ব্যাগ গাড়িতে আছে।’
আহমদ মুসা একটু থেমেছিল ঢোক গেলার জন্যে।
সেই ফাঁকেই মেয়েটি বলল, ‘আপনার নাম আহমদ মুসা?’ মেয়েটির গলা কাঁপছিল।
‘হ্যাঁ, আমি আহমদ মুসা। আপনি কেমন করে জানেন আমার নাম?’
‘আপনার নাম আগে থেকেই জানতাম। মি. ভাসকুয়েজের কাছ থেকে জেনেছিলাম আপনিই আমার গাড়ি নিয়ে গেছেন।’
‘আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের কেক ও ফলের জুসও আমি খেয়েছি, আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। এর জন্যেও আমি ক্ষমা চাই।’
‘আপনি এই ভাষায় কথা বলায় আমি বিব্রত বোধ করছি। আপনি আমাকে গাড়ি ফেরত না দিলেও কিছু মনে করতাম না। ভাবতাম, আমার গাড়ি একজন মহান বিপ্লবীর কাজে লাগছে। আপনি ভেতরে আসুন, বসবেন।’
‘ধন্যবাদ। আপনার পরিচয় কি জানি না। কিন্তু আপনাকে আমার কাছে বিস্ময়ের মনে হচ্ছে।’
‘ভেতরে আসুন, বলব সব।’
‘ধন্যবাদ বোন, আমার সময় কম আর সম্ভবত আমার সব বিষয় তুমি জানো।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘গাড়ির নাম্বারটি বদলে নিও বোন।’
আহমদ মুসা দ্রুত পা চালাল সামনে।
জেন আরও কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। নির্বাক বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। মনে তার প্রবল আলোড়ন, যার সাথে দেখা হলো, কথা হলো, এই সুন্দর সারল্যে ভরা মুখের এই যুবকটিই কি বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী নেতা?
আহমদ মুসা চলে গেছে জেনদের গেট পেরিয়ে। কিন্তু দাঁড়িয়েই আছে জেন। স্মৃতিচারণ করছে জেন বিস্ময়ভরা মুহূর্তগুলোর। আহমদ মুসা তাকে বো বলেছে। একজন এত বড় বিপ্লবী এত নরম ভাষায় কথা বলে! সত্যিই মানুষকে আপন করে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা তারা ঐ ধরনের বিপ্লবীরা কখনও কি এভাবে গাড়ি ফেরত দিতে আসে। গাড়ি ব্যবহারের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে! না বলে জুস ও কেক খাওয়ার জন্যে মাফ চায়! সত্যি আহমদ মুসা সম্পর্কে সে যা শুনেছিল তার চেয়েও অনেক বড় সে।
ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে এগোলো জেন।
দেখল তার ভ্যানিটি ব্যাগ সিটের ওপর পড়ে আছে। জুসের খালি টিন ও কেন বাঁধা কাগজ গাড়ির মেঝেয় পড়ে আছে। গাড়ি খুলে ভ্যানিটি ব্যাগের সাথে জুসের টিন তিনটিও নিয়ে নিল জেন। আহমদ মুসার স্মৃতিগুলো। জোয়ান দেখলে নিশ্চয় খুব খুশি হবে।
ওদিকে আহমদ মুসা এক ভাড়াটে ট্যাক্সি নিয়েছে। ভাবছে কোথায় যাবে। হঠাৎ তার মনে পড়ল হোটেল পিরেনিজ- এর কথা। ভুলেই গিয়েছিল সে এই হোটেলের ব্যাপারটা। মারিয়ার ভাই ফিডেল ফিলিপ এই হোটেলের কথাই বলেছিল। হোটেলের মালিক বাস্ক গোষ্ঠীর একজন এবং বাস্ক গেরিলার একজন সক্রিয় সদস্য। ফিলিপ টেলিফোন করে হোটেল মালিককে আহমদ মুসার কথা বলে রেখেছে। তা’ছাড়া ফিলিপের একটা কোড চিহ্নও তাকে দিয়েছে ফিলিপ। ওটা এখনও তার জুতার সুখতলার নিচে রয়েছে।
রোডের নাম এখনও মনে আছে তার। আহমদ মুসা ড্রাইভারকে হোটেল পিরেনিজ-এর নাম বলল।
‘খুব চালু হোটেল স্যার, সিট বুক করা আছে?’ বলল ড্রাইভার।
‘না, নেই।’
‘তাহলে কি সিট মিলবে?’
‘দেখি চেষ্টা করে। হোটেলটি খুব চালু, তাই না?’
’হ্যাঁ, ব্যবহার ভালো। খুব ভালো সার্ভিস।’
‘মালিক কোন ধর্মের?’
স্পেনে তো প্রায় একটাই ধর্ম। খৃষ্ট ধর্ম।
‘কেন, ইহুদি, মুসলমান নেই?’
‘ইহুদি কিছু আছে, কিন্তু মুসলমান কোত্থেকে আসবে?’
‘কেন, মুসলমান তো আছে!’
‘চোরের মতো থাকাকে থাকা বলে না।’
‘চোরের মতো কেন?’
‘চোরের মতো ওরা নাম ভাঁড়িয়ে চলে।’
‘কেন?’
‘মুসলমান জানলে চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, এমনকি লেখা-পড়ায় পর্যন্ত সুযোগ-সুবিধা পায় না।’
‘এর জন্যে দায়ী কে?’
‘কি বলব স্যার, দায়ী ওদের অতীত।’
‘অতীতে ওরা স্প্যানিশদের ওপর অত্যাচার করেছে?’
‘না, তা নয়, ওদের অতীত র্শৌয, শক্তি, জ্ঞান ও গৌরবই ওদের কাল।’
‘তুমি এত জান কি করে?’
জবাব দিল না ড্রাইভার।
আহমদ মুসা আবার তার প্রশ্নের পুনারাবৃত্তি করল।
‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়েছি।’
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে ড্রাইভিং এ এসেছ কেন, রেজাল্ট বুঝি ভালো হয়নি?’
‘না স্যার, আমি প্রথম শ্রেনী পেয়েছিলাম।’
‘তারপরও তুমি এ পেশায় কেন?’
‘চাকরি আমার কোথাও মেলেনি।’
‘প্রতিযোগিতায় টিকতে পারোনি?‘
‘প্রতিযোতিায় টিকেছি, ভাগ্য দোষে চাকরি হয়নি।’
‘কেমন?’
উত্তর দিল না ড্রাইভার।
একটু পরেই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘আপনি বিদেশি বলা যায়।’
বলে একটু থামল। তারপর বললক, ‘আমার দুর্ভাগ্য হলো আমি মরিসকো। চাকরিতে যখন ঢুকতে গেছি এ কথা প্রকাশ হয়ে গেছে। তাই চাকরি কোথাও জোটেনি।’
‘সব মরিসকোর বেলায় কি এটাই ঘটছে?’
‘হ্যাঁ, প্রকাশ হয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই।’
‘কি হয়েছে তাহলে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহন করে?’
‘এ পাপ আমাদের পূর্বপুরুষদের, কিন্তু বাধ্য হয়েই তারা এটা করেছে, এছাড়া বাঁচার তাদের আর কোন উপায় ছিল না।’
‘পূর্বপুরুষদের ঐ পাপ কি মুছে ফেলা যায় না?’
‘এমন চিন্তা আমাদের অনেকের মাথায় এসেছে, কিন্তু স্পেনে থেকে তা সম্ভব নয়।’
‘এ চিন্তা কিছু সংখ্যক মরিসকোর মধ্যে আছে?‘
‘শিক্ষিত সব মরিসকোই এমন চিন্তা করে।’
একটু থেমেই ড্রাইভার প্রশ্ন করল, ‘স্যারের কি ধর্ম?’
‘তুমি কি মনে কর?’
‘মুসলমান।’
‘কেমন করে বুঝলে?’
‘মুসলমানদের প্রতি, বিশেষ করে মরিসকোদের প্রতি এমন সহানুভূতি কোন অমুসলমান দেখাতে পারে বলে আমি জানি না।’
‘ঠিকই বলেছ ভাই, আমি মুসলমান।’
ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমার কি যে আনন্দ লাগছে, একজন মুসলমানের সাথে এই প্রথম আমি কথা বললাম।’
‘মুসলমানদের ভালোবাস, ইসলামকে ভালবাসে তুমি?’
‘ভালোবাসি কিনা জানি না, কিন্তু গৌরব বোধ করি এজন্যে যে, আমার পূর্বপুরুষরা মুসলমান ছিল। যতবার কর্ডোভায় গেছি, গ্রানাডায় গেছি, না কেঁদে থাকতে পারিনি।’
‘তুমি যাকে গৌরব বলছ, সেটাই তো ভালোবাসা। যাকে মানুষ ভালোবাসে না তার জন্যে গৌরবও বোধ করে না।’
‘স্যার, আমার খুব সাধ হয় মক্কা দেখতে, মদিনা দেখতে। কিন্তু আমি মরিসকো হই, যাই হই, পরিচয় যে আমার খৃষ্টান! আমি কা’বার একটা ফটো যোগাড় করেছি ইতিহাস বই থেকে। সুযোগ পেলেই ওটা দেখি। ওদিকে তাকালে আর চোখ সরাতে পারি না।’ শেষের দিকে গলাটা ভারি হয়ে উঠল ড্রাইভারের। সে চোখ মুছল।
আহমদ মুসার বুকটাও যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। মরিসকো পরিচয়ে এ যুবকটির বুকে তার স্বজাতি ও স্বধর্মের প্রতি যে অসহায় ভালোবাসা বিরাজ করছে এবং যে মানসিক দ্বন্দ্বে সে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত তা আহমদ মুসাকে অভিূত করে তুলল। তার মনে হলো, গোটা স্পেনে হাজার হাজার মরিসকো যুবক, বৃদ্ধ ও নারনারীর হৃদয় এভাবে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদেই তারা শেষ হয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাবে। দুনিয়ার কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাদের হৃদয়ের এই কান্না। দেখতে তো একজন পাচ্ছেন যিনি সর্বশক্তিমান। কবে তাঁর দয়া এদের ওপর বর্ষিত হবে, কবে আসবে এদের মুক্তির সোনালি দিন, কান্নার শেষ!
আহমদ মুসার চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে সে বলল, ‘ভাই, আশা ছেড়ো না, আল্লাহ তাঁর বান্দার কোন একান্ত ইচ্ছা সাধারনত অপূর্ণ রাখেন না।’
গাড়ি এই সময় এসে হোটেল পিরেনিজ এর গাড়ি বারান্দায় প্রবেশ করল।
‘ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয় পেছন ফিরে বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ স্যার, আপনার কথা সত্য হোক!’
আহমদ মুসা মিষ্ট হেসে বলর, ‘আমাকে স্যার নয়, ভাই বলবে। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই।’
‘কিন্তু আমি কি মুসলমান?’
‘তোমার মন মুসলমান।’
কী এক ঔজ্জ্বল্যে ড্রাইভারের মুখ ভরে গেল! কিন্তু রাজ্যের কান্না এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন তার গলায়! সে কথা বলল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে মনে হলো নিজেকে সে সংযত করছে।
আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সে ঘুরে এসে ড্রাইভারের দরজার কাছে দাঁড়াল। ড্রাইভার বেরিয়ে এলো চোখ মুছতে মুছতে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করল।
তা দেখে ড্রাইভার দুই হাত জোড় করে বলল, ‘আপনি ভাই ডেকেছেন। অনুরোধ করব, টাকা দিয়ে ভাইয়ের গৌরব ম্লান হতে দেবেন না।’
আহমদ মুসা মানি ব্যাগ পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘টাকা দিচ্ছি না একটা শর্তেই যে, কাল তুমি এই হোটেলে আসবে। আর বলো তোমার না কি?’
ড্রাইভার খুশি হয়ে বলল, ‘অবশ্যই আসব, কি বলে খোঁজ করব? আমার নাম রবার্তো।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘কাল টিক ন’টায় এসো, আমি রিসিপশনে দাঁড়িয়ে থাকব।’
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে।
আহমদ মুসাও পা বাড়াল হোটেলের রিসেপশন লাউঞ্জের দিকে।
সূর্য তখনও ওঠেনি। একটা দামি শেভ্রলেট গাড়ি এসে থামল হোটেল পিরেনিজ এর গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি থেকে নামল ফিডেল ফিলিপ ও মারিয়া।
ফিলিপকে চেনার উপায় নেই। মুখে বিরাট গোঁফ এবং মাথায় বড় বড় চুল। ছদ্মবেশ নিয়েছে ফিলিপ। ছদ্মবেশ না নিয়ে সে রাস্তায় বেরোয় না। যদিও সরকারে সাথে বাস্ক গেরিলাদের একটা সমঝোতা হয়েছে, তবু সরকার সুযোগ পেলে তাকে সরিয়ে দিতে ছাড়বে না, এটা সবাই জানে।
স্বয়ং হোটেল মালিক মি. আলেকজান্ডার সেসনারোসা গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ফিলিপরা গাড়ি থেকে নামরে তাদের তিনি স্বাগত জানালেন এবং ভেতরে নিয়ে চললেন।
‘কোথায় উনি?’ হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞাসা করল ফিলিপ আলেকজান্ডারকে।
‘উনি এসেছেন রাত এগারটায়। সরকারের রিজার্ভড পাঁচটি স্যুট ছাড়া আর কোন স্যুট, কেবিন কিছুই খালি ছিল না। আমাদের ফ্যামিলি স্যুটটাই তাঁকে দিয়েছি।’
ফিলিপ থমকে দাঁড়িয়ে আলেকজান্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তাঁকে তার উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন।’
আবার হাঁটতে লাগল তারা।
‘তাঁর পরিচয়টা কিন্তু দেননি।’ বলল আলেকজান্ডার।
‘বলব, চলুন। এইটুকু জেনে রাখুন তিনি বিশ্বের একজন মহান বিপ্লবী। তার সংগ্রাম ও সাফল্যের কাছে আমরা শিশু।’
ফিলিপরা সবাই তৃতীয় তলায় আলেকজান্ডারের স্যুটে এসে বসল।
আহমদ মুসা রয়েছে ৩১ তম তলায়।
‘মারিয়া, ওকে টেলিফোন কর। বলো আমরা আসছি।’ বলল ফিলিপ।
মারিয়া উঠে টেলিফোন ডেস্কে গেল।
‘ক’দিন খুব উদ্বেগে কেটেছে আলেকজান্ডারের। ওর কিছু হলে সারা জীবন দুঃসহ এক বেদনায় জর্জরিত হতে হতো।’
মারিয়া ফিরে এলো ডেক্স থেকে। বলল, ‘নো রিপ্লাই হচ্ছে।’
বিস্মযে চোখ কপালে তুলল ফিলিপ! ‘উনি তো এ সময় ঘুমান না!’ বলল ফিলিপ।
‘অসম্ভব ভাইজান, উনি এ সময় ঘুমাতে পারেন না।’
ফিলিপ উঠে গিয়ে আবার টেলিফোন করল। নো রিপ্লাই আগের মতোই।
ফিলিপ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না।’
লিফটে গিয়ে উঠল তারা তিনজন। আলেকজান্ডার বলল, ‘ঘুমিয়েও থাকতে পারেন। কাল যখন তাঁকে দেখেছি, খুব টায়ার্ড মনে হয়েছে। গোটা গা ছিল ধূলিধূসরিত।’
‘কিছু বলেছিলেন আপনাকে?’
‘আমি যখন স্যুট, কেবিন খুঁজতে ব্যস্ত, তিনি বললেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন, সেটা করিডোর হলেও আমার আপত্তি নেই। তার এ কথার পর আমি আর দেরি করিনি, আমার ফ্যামিলি স্যুটটাই দিয়ে দিয়েছি।’
চোখ দু’টি ভারি হয়ে উঠল মারিয়ার। মুখ নিচু করল সে। ভাবল, আহমদ মুসার মতো শক্ত মানুষ কেমন অবস্থয় পড়লে করিডোরে হলেও বিশ্রাম নেবার প্রস্তাব করতে পারেন।
আহমদ মুসার স্যুটের দরজায় এসে দাঁড়াল তারা তিনজন।
দরজায় নক করল ফিলিপ। একবার নয় তিনবার। কোন সাড়া সেই ভেতর থেকে।
ফিলিপ শুকনো মুখে তাকাল আলেকজান্ডারের দিকে।
‘ঘুমিয়ে থাকতে পারেন, আমার কাছে মাষ্টার কি আছে, খুলব দরজা?’
মাথা নেড়ে সম্মতি দিল ফিলিপ।
আলেকজান্ডার দরজা খুলল। প্রথমে ঘরে ঢুকল ফিলিপ, তার পেছনে আলেকজান্ডার। সবার পরে মারিয়া। মারিয়ার বুক দুরুদুরু করছে।
বিছানায় শোয়া আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই অনেকখানি আশ্বস্ত হলো মারিয়া।
চিৎ হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে আহমদ মুসা। মনে হয় গভীর ঘুমে, কিন্তু তার মুখটা লাল।
ফিলিপ এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠল। বলল, ‘উঃ গা পুঢ়ে যাচ্ছে!’
গায়ে হাত রাখল আলেকজান্ডারও। বলল, ‘ভয়ানক জ্বর ফিলিপ। ডাক্তার ডাকতে হবে।’
বলে আলেকডান্ডার দ্রুত সরে এলো টেলিফোনের কাছে।
ফিলিপ হাত বুলাতে লাগল আহমদ মুসার আগুনের মতো কপালটায়।
‘ওঁর তো জ্ঞান আছে ভাইয়া?’ বলল মারিয়া।
এই সময় আহমদ মুসা চোখ খুলল। চোখ খুলেই দেখল ফিলিপকে, তারপর দাঁড়ানো মারিয়াকে। ঠোঁটে তার হাসি ফুটে উঠল। উঠে বসতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। মাথাটা তুলেই ‘আঃ’ বলে চিৎকার করে উঠল সে, মাথাটা আবার তার বালিশে পড়ে গেল। যন্ত্রণায় তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।
আবার চোখ বুজে গেল আহমদ মুসার।
‘কি হয়েছে মুসা ভাই আপনার, কোথাও আঘাত?’ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ফিলিপ।
ডাক্তার এসে ঘরে প্রবেশ করল। ফিলিপ একটু সরে বসল।
ডাক্তার জ্বর পরীক্ষা করে গা থেকে কম্বল সরিয়ে গোটা শরীর পরীক্ষা করতে লাগল। ‘গোটা গা নয়, ডাক্তার। আঘাতের কারণে যদি জ্বরটা হয়ে থাকে তাহলে সেটা মাথায় ও বাম কাঁধে।’ নরম কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
মাথা ও ঘাড় পরীক্ষা করল ডাক্তার।
‘মাথা ও ঘাড়ে কি যন্ত্রনা আছে?’ বলল ডাক্তার।
‘যন্ত্রণা নেই, তীব্র ব্যধা।’
‘ঈশ্বর রক্ষা করেছেন, ফ্যাকচার হয়নি। জায়গা দু’টো ভয়ানক থেঁতলে গেছে।’
ডাক্তার একটু থামল। একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আঘাতটা কোন ভোঁতা অস্ত্রে হয়েছে, কিসের আঘাত?’
‘মাথার আঘাতটা স্টিল শিটের, ছাদ থেকে বড় একটা স্টিল শিট মাথায় পড়েছিল। কাঁধে পেয়েছিলাম লোহার রডের আঘাত। গত সন্ধ্যায়।’
‘রাতে ওষুধ খেলে কিন্তু অনেক সুস্থ থাকতেন।’
‘রাত ১১টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি, কিছুই বঝিনি। শুতে গিয়ে বুঝলাম বড় ধরনের আঘাত খেয়েছি।’
‘ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডাক্তার। যেতে যেতে বলল, ‘আমি ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। জ্বর, ব্যথা কমে যাবে।’
‘প্লিজ ডাক্তার, আগামী কাল আমি বাইরে বেরুতে চাই। আপনি দয়া করে ব্যবস্থা করুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা ওষুধ দিই, রোগ ভালো করেন ঈশ্বর। তাকে বলুন।’ বলে হেসে বেরিয়া গেল ডাক্তার।
ডাক্তার চলে যেতেই আহমদ মুসার কাছে সরে এলো ফিলিপ ও মারিয়া।
‘আপনার অন্তত ৭দিন বিশ্রাম নিতে হবে। কোথাও বেরুবার পরিকল্পনা বাদ দিন।’ গম্ভীর কন্ঠে বলল মারিয়া।
‘আমি সময় দিতে রাজী, কিন্তু ষড়যন্তকারীরা কি সময় দেবে মারিয়া?’
মারিয়ার মুখ ভর করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ফিলিপ বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এসব কথা থাক। আগামীকাল আসুক দেখা যাবে। আমার জানতে কৌতূহল হচ্ছে মুসা ভাই, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মৃত্যুপুরী থেকে কি করে বেরুলেন? ওখানে যে গেছে, কেউ আর ফিরে আসতে পারেনি। গত ৫শ’ বছরের ইতিহাস এটা ঐ মৃত্যুপুরীর।’
‘সেখানে ছিলাম আমি কি করে জানলে?’
‘আমরা ঐদিনই ড্রাইভারের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম, আপনি ওদের হাতে ধরা পড়েছেন। পরদিনই আমি ও মারিয়া চলে আসি মাদ্রিদে। সেদিন থেকেই আমরা জানতে পারি কার্ডিনাল হাউজের ভূগর্ভের জিন্দানখানায় আপনাকে রেখেছে। এ খবর আমাদের হতাশ করে। সবাই আমরা জানি, অত্যন্ত কঠিন জায়গা ওটা। সর্বশেষ স্থান ওটা। অবশেষে গতকালই আমরা ভাসকুয়েজকে পণবন্দী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
‘ঠিক বলেছ ফিলিপ, কঠিন জায়গা ওটা। আমার গোটা জীবনে এমন সুচিন্তিত বেষ্টনীর মধ্যে পড়িনি।’
‘ঐ মৃত্যুপুরীর ভয়ংকর অনেক কথা আমরা শুনেছি, ওর প্রকৃতি আমরা জানি না। বলুন কি দেখেছেন, কিভাবে বেরুলেন!’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গোটা কাহিনী ওদের শোনাল। তারপর বলল, ‘তোমরা ভাসকুয়েজকে পণবন্দী করেও আমাকে পেতে না। আমাকে এতক্ষণ আকাশে উড়তে হতো আমেরিকার পথে। স্প্যানিশ ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আমাকে এক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছিল আমেরিকান ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হাতে।’
মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল ফিলিপের।
কেঁপে উঠেছিল মারিয়া।
‘আমেরিকার ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এক বিলিয়ন ডলারে আপনাকে কিনবে কেন?’ বলল ফিলিপ।
‘তারা মনে করে আমার কাছ থেকে ইসলামী বিশ্বের অনেক মুল্যবান তথ্য পাবে। তাছাড়া আমাকে পণবন্দী সাজিযে ইসলামী সরকারগুলোর কাছ থেকে বহু বিলিয়ন ডলার কামাই করতে পারবে। সবশেষে আমাকে হত্যা করে তারা অনেক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিত।’
ফিলিপ ও মারিয়া উভয়েরই মুখ বিস্ময় ও বেদনায় বিবর্ণ!
‘আপনার এত বিপদ, আপনার এত শত্রু!’ কাঁপছিল মারিয়ার গলা।
‘এরা আমার শত্রু নয় মারিয়া, এরা মুসলমানদের শত্রু। মুসলমাসদের জন্যে আমি কিছু করি বলে তারা আমার অস্তিত্ব বরদাশত করতে পারে না।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার একা বেরুনো আর ঠিক নয়। সেদিন আপনাকে একা ছেড়ে দেয়া আমাদের ঠিক হয়নি।’
‘সেদিন আমার সাথে আর একজন থাকলে কি হতো, দু’জনেই ওদের হাতে পড়তাম। আসলে মারিয়া, আমি তো কখনই একা থাকি না। আল্লাহ তো সাথে থাকেন! তাঁর সাহয্য না হলে গতকাল ঐ মৃত্যুপুরী থেকে বের হতে পারতাম না।’
ওষুধ এলো এ সময়। মারিয়া বেয়ারার হাত থেকে ওষুধ নিয়ে প্রেসক্রিপশনের ওপর নজর বুলাল। তারপর ওষুদের মধ্যে থেকে একটা ট্যাবলেট ও একটা ক্যাপসুল বেছে নিয়ে অন্য ওষুধগুলো টেবিলে রেখে দিল। এক গ্লাস পানি নিয়ে এগোলো আহমদ মুসার দিকে। ফিলিপকে বলল, ‘ভাইয়া, ওনার মাথা একটু তুলে ধর।’
ওষুধ খাইয়ে দিল মারিয়া।
‘মারিয়া, তুমি একটু লাউঞ্জে গিয়ে দেখ রবার্তো এসেছিল কিনা। তাকে ওপরে পাঠিয়ে দাও। সে দরজায় পাহারায় থাকবে। তারপর তুমি বাসা থেকে ঘুরে এসো একটু, কিছু খবর আসার কথা আছে। হেডকোয়ার্টার থেকে।’ বলল ফিলিপ।
‘মারিয়া, রিসেপশনকে বলো, রবার্তো নামের এই রকম চেহারার একজন লোক ঠিক ৯টায় সেখানে আসবে। তাকে এখানে পাঠিয়ে দিতে বলবে।’ বলল আহমদ মুসা।
মারিয়া দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল, ‘ভাইয়া, ওকে বাসায় নেয়া সবদিক থেকে নিরাপদ।’
‘আমারও এই মত।’ বলল ফিলিপ।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ বলে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল মারিয়া।

Top