১৪. গোয়াদেলকুইভারে নতুন স্রোত

চ্যাপ্টার

রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ। ঘুমিয়ে আছে মাদ্রিদের ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ। পুলিশের অথবা নাইট ক্লাব ফেরত দু’একটা গাড়ী মাঝে মাঝে এই ঘুমে কিছুটা বিরক্তি উৎপাদন করছে মাত্র।
ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর ওপর দাঁড়ানো কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানের বিশাল পাঁচ তলা অফিসটিও জেগে জেগে অবশেষে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’একটি ঘরের জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু বড় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওগুলোকে। যেন ওগুলোর চোখেও ঘুমের ঝিমুনি।
কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টারটি ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর পশ্চিম পাশে। এভেনিউটি উত্তর-দক্ষিণ প্রসারিত। আর কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টারটি প্রসারিত পূর্ব -পশ্চিমে। পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হেড কোয়ার্টারের গেটটি ফার্ডিন্যান্ড এভেনিউ-এর গা ছুঁয়ে দাঁড়ানো। লোহার ফোল্ডিং গেট। গেটের ভেতরে লিফট রুম ও সিঁড়ির মাঝখানে দু’জন প্রহরী চেয়ারে বসে তাদের কাঁধে স্টেনগান ঝুলছে। প্রহরী দু’জনও ঝিমুচ্ছে।
বিল্ডিং-এর বাইরে আর কোন প্রহরী নেই। ভেতরে প্রত্যেক ফ্লোরে একজন করে সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে।
সব মিলিয়ে নিরাপত্তার মিনিমাম ব্যবস্থা। এর কারণ, যে বাঘ সব সময় শিকার ধরতেই অভ্যস্ত, সে কাউকে শিকার হওয়ার ভয় করে না। কু- ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান সবার ঘরে ঢুকে, সবাইকে তাড়া করে, তার ঘরে আবার ঢুকবে কে। এমন সাহস কারও আছে বলে তারা মনে করে না।
পূর্ব পশ্চিম লম্বা অফিস বিল্ডিং এর তৃতীয় তলার একদম পশ্চিমের রুমটি ভাসকুয়েজের। এই তলাতেই মিনাত্রা সেন্ডোর স্থলাভিসিক্ত কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের নতুন অপারেশন কমান্ডার জুরি জুরিটার অফিস। তবে তার একটি বিশ্রাম কক্ষ চারতলায়। কাজের অবসরে সে এখানে বিশ্রাম নেয়, রাত বেশী হলে সেখানে মাঝে মাঝে রাত যপিনও করে। আজও যেমন সে বাড়ি যায়নি-তার বিশ্রাম কক্ষেই সে রাত কাটাচ্ছে। রাত আড়াইটায় সে ফিরে এসেছে পাহারার তদারকি থেকে।
রাত ঠিক তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আহমদ মুসার গাড়ী সাপের মত নিঃশব্দে এসে থামল কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যান বিল্ডিং-এর পশ্চিম দিকে একটা ঝাউ গাছের পাশে।
কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টারের পশ্চিম পাশে আরেকটা অফিস। সেটাও পাঁচ তলা। দুই বিল্ডিং-এর মাঝখানে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সম্ভবতঃ পার্কিং প্লেস হিসেবে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি দু’টি ঝাউগাছ থাকায় জায়গাটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী অন্ধকার।
আহমদ মুসা একটা ঝাউ গাছ ঘেঁষে তার গাড়ীটি দাঁড় করিয়ে নিঃশব্দে গাড়ী থেকে নেমে এল।
তারপর আশ-পাশটা ঘুরে দেখল কোন প্রহরী কোথাও নেই।
আহমদ মুসা ওপর দিকে তাকিয়ে ভাসকুয়েজের অফিস রুমটা একবার দেখে নিল। ভেতর থেকে আলোর কোন রেশ কোন দিক থেকে আসছে না।
পিঠের ব্যাগ থেকে আহমদ মুসা হুক লাগানো নাইলন কর্ড বের করে নিল।
হুকটা ছুড়ে মারল তিন তলার কার্নিশে। নিখুঁত নিশানা। হুকটা গিয়ে আটকে গেল তিন তলার কার্নিশে।
আহমদ মুসা চারদিকে একবার চেয়ে নিয়ে দড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে তিন তলার কার্নিশে গিয়ে বসল।
উত্তর দক্ষিণে বিলম্বিত বিশাল কক্ষ ভাসকুয়েজের। পশ্চিম দিকে তিনটি জানালা। আহমদ মুসা মাঝখানে জানালার মুখোমুখি উঠে বসেছে।
জানালা পুরু লোহার গরাদে ঢাকা।
‘জানালা কি ভেতর থেকে লক করা?’ ভাবল আহমদ মুসা।
জানালার গরাদে হাত দিতে গিয়েও হাত টেনে নিল আহমদ মুসা। ভাবল, ভাসকুয়েজ জানালাকে বিদ্যুতায়িত করে রাখতে পারে।
পকেট থেকে ডিক্টেটর স্ক্রুড্রাইভার বের করে পরীক্ষা করল গরাদ। না, জানালা বিদ্যুতায়িত নয়।
গরাদ ভেতর থেকে লক করা আছে কি না তা দেখার জন্যে আহমদ মুসা স্ক্রুড্রাইভারের ধারাল অগ্রভাগ গরাদের নিচে ঢুকিয়ে ওপরের দিকে একটা চাপ দিল।
গরাদটি নিঃশব্দে নড়ে উঠে সিকি ইঞ্চি পরিমাণ ওপরে উঠে গেল। মুখে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ভাসকুয়েজ। তার কক্ষের নিরাপত্তার সাধারণ ব্যবস্থাটুকুও রাখেনি।
গরাদের দু’প্রান্তে দু’হাত লাগিয়ে এক টানে ওপরে উঠিয়ে ফেলল গরাদটি।
লোহার গরাদের পর জানালার কাঁচের আরো একটি গরাদ। একই ভাবে সেটিও তুলে ফেলল আহমদ মুসা।
ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আহমদ মুসা স্মরণ করল, মাঝের এই জানালাটি পুব দিক থেকে অর্থাৎ ভেতর থেকে ঘরে ঢুকার একমাত্র দরজা বরাবর এবং জানালার সামনে ভেতরটা ফাঁকা।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সন্তর্পনে পা রাখল কার্পেটের ওপর।
কার্পেটের ওপর কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরের অন্ধকারকে গা সহা করে নিল।
আহমদ মুসার লক্ষ্য ছিল ভাসকুয়েজের টেবিল। ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে এক খন্ড জমাট অন্ধকারের মত ভেসে উঠল ভাসকুয়েজের টেবিলটা। ভাসকুয়েজের টেবিলের ওপাশে কম্পিউটারের সাদা পর্দা অন্ধকারের বুকে ধোয়াটে সাদা চোখের মত মনে হলো তার কাছে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো কম্পিউটারের দিকে।
অতি সন্তর্পনে টেবিল ঘুরে আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল কম্পিউটারের সামনে।
এই কম্পিউটারের জন্যেই ভাসকুয়েজের অফিসে এসেছে আহমদ মুসা। তার বিশ্বাস, মাদ্রিদের মসজিদ কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান গুলোতে তেজস্ক্রিয় পাতার পরিকল্পণা ভাসকুয়েজ নিশ্চয় তার রেকর্ডে রেখেছে। সে রেকর্ড ভাসকুয়েজ যেখানে যেখানে রাখতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান হলো তার কম্পিউটার মেমোরী। আহমদ মুসা তাই ভাসকুয়েজের কম্পিউটারে মেমোরী সন্ধান করে দেখার জন্যেই তার অফিসে ছুটে এসেছে।
কম্পিউটারের সামনে চেয়ারে বসে পড়ল আহমদ মুসা। অন্ধকার, কিছুই ঠাহর করতে পারল না।
আহমদ মুসার পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে প্রথমে দেখে নিল বিদ্যুত কানেকশন ঠিক আছে কি না। তার পর দেখল কম্পিউটার স্টার্ট নেয় কি না। বোতাম টিপে দেখল ঠিক আছে। খুশী হলো আহমদ মুসা।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সর্বশেষ মডেলের কম্পিউটারে গোপন লক সিস্টেম আছে, যা দিয়ে কম্পুটারের মেমোরী ফাইল লক করে রাখা যায়। কোড না জানলে তা আনলক করা যায় না। যিনি লক করেন তিনি যে কোডে লক করেছেন, সেই কোডেই শুধু আনলক করা যাবে।
আহমদ মুসা দুরুদুরু বুকে বাম হাতে টর্চ ধরে, ডান হাতে মেমোরী উইনডো স্থাপন করার জন্যে নির্দিষ্ট বোতামটিতে চাপ দিল।
মিষ্টি একটা টক্ শব্দ উঠলো সুইচের। কম্পিউটারের পর্দায় স্থির ছিল আহমদ মুসার দৃষ্টি। আনন্দে নেচে উঠল আহমদ মুসার চোখ। দেখল, সুইচ টেপার সাথে সাথেই কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল মেমোরী উইনডো। প্রশ্ন ভেসে উঠল, জানতে চাইল পরবর্তী নির্দেশ কি?
আহমদ মুসা হাপ ছেড়ে বাঁচল, মেমোরি লক করা নেই। ভাসকুয়েজ লক করার প্রয়োজন মনে করেনি। তাঁর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস যে, কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের গুহায় হানা দেয়া তো দূরে থাক-এ চিন্তাও স্পেনে কেউ করতে পারে না। মনে মনে আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল, ভাসকুয়েজের এই আত্মবিশ্বাস তাকে সাহায্য করেছে।
আহমদ মুসা চিন্তা করতে লাগল কম্পিউটারকে পরবর্তী নির্দেশ তিনি কি দেবেন? মেমোরির ফাইল ডাইরেক্টরী সে চাইতে পারে, ভাবল আহমদ মুসা। ফাইল ডাইরেক্টরীতে নিশ্চয় কোন ফোল্ডার থাকবে যেখানে রেকর্ড করা আছে স্পেনে মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ ধ্বংসের সেই ঐতিহাসিক পরিকল্পনা।
আহমদ মুসা বোতাম টিপে কম্পিউটারকে মেমোরি ফাইল ডাইরেক্টরী জ্ঞাপন করতে নির্দেশ দিল।
সংগে সংগে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল একটা স্বতন্ত্র উইনডো। উইনডোর বুকে ভেসে উঠল বোড়া বর্ণমালার দীর্ঘ তালিকা। ওদিকে তাকিয়ে হতাশ হলো আহমদ মুসা। ফাইল বা ফোল্ডার গুলোর নাম সাংকেতিক ভাবে লেখা। দু’টি করে বর্ণ দু’টি শব্দের প্রতিনিধিত্ব করে না একটি শব্দের, তাও বোঝা মুশকিল। তালিকার শীর্ষের ফাইলটির নাম PL বর্ণে লেখা। তার পরেরটি ON এই ভাবে দশটি ফাইলের তালিকা ফাইল ডাইরেক্টরীতে রয়েছে। কোড ভাঙার জন্যে আহমদ মুসা প্রত্যেকটি ফাইলের সাংকেতিক বর্ণমালা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করল। শেষ দু’টি নামে এসে আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল। একটির সাংকেতিক নাম EP আহমদ মুসা এর অর্থ করল Enemy Personal. আর সর্বশেষটির নাম OF সে এর অর্থ বের করল Operation Final. যেহেতু কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যান স্পেনে কোন মুসলিম ব্যক্তিত্বকে টার্গেট করেনি, টার্গেট করেছে মুসলমানদের ঐতিহাসিক সম্পদকে এবং এটা স্পেন থেকে মুসলমানদের চিহ্ন মুছে ফেলারই চক্রান্ত। তাই যথাযথভাবেই এটা Operation Final হতে পারে।
খুশি হল আহমদ মুসা। সেই সাথে আশাবাদের একটা প্রচন্ড শিহরণ খেলে গেল তার দেহে। অবশেষে সে দুর্লভ পরিকল্পনাটি পেতে যাচ্ছে। নিশ্চয় পরিকল্পনার সাথে ডায়াগ্রামও থাকবে।
আনন্দ কম্পিত হাতে বোতাম টিপে OF ফাইলটি নিয়ে এল আহমদ মুসা।
ফাইলটি ভেসে উঠল কম্পুটারের স্ক্রীনে।
স্ক্রীনের ওপর চোখ পড়তেই ম্লান হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ।
স্ক্রীনে ভেসে ওঠা উইনডোতে একটি মাত্র বাক্য লিখা, ‘সাইট গুলোতে রেডিয়েশন বক্স সাফল্যজনক ভাবে স্থাপিত, ডকুমেন্ট ‘ELDER’ -এর কাছে নিরাপদ।’
আহমদ মুসার হতাশ চোখ দু’টি কম্পিউটারের স্ক্রীনে যেন আঠার মত লেগে আছে কিংবা চোখ সরাতে ভুলে গেছে যেন।
হঠাৎ করে ঘিরে ধরা হতাশার আঘাত হজম করছে আহমদ মুসা।
ঠিক এই সময়ই দরজার নব ঘুরাবার মত ‘ক্লিক’ করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা এল তার পেছন থেকে-দরজার দিক থেকে।
এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ঠিক সেই সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল, উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেল ঘর।
আহমদ মুসা দেখল, স্টেনগান হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক। ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি, স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সে আহমদ মুসার দিকে। মুখে তার বিজয়ের হাসি। তার স্টেনগানের নল আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে হা করে আছে।
খোলা দরজা পথে আরও চারজন ঘরে প্রবেশ করল। তাদের হাতেও উদ্যত স্টেনগান।
ঘর ফাটানো শব্দে হো হো করে হেসে উঠল দরজায় দাঁড়ানো সেই লোকটি। বলল, আমাদের খুব ভুগিয়েছ আহমদ মুসা। আমাদের জাল গলিয়ে তুমি কেমন করে মাদ্রিদে ঢুকলে?
থামল লোকটি। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার শুরু করল, ভালই হলো, শিকার নিজ পায়ে হেটে এসে ফাঁদে পড়েছে।
বলেই লোকটি পাশেই দাঁড়ানো চার জনের একজনকে বলল, ‘জন ওর পিঠ থেকে ব্যাগ নিয়ে ওকে একটু হালকা কর। আর পকেট আর শোল্ডার হোল্ডারও খালি কর।’
জন লোকটি গিয়ে আহমদ মুসার পিঠ থেকে ব্যাগটি নামিয়ে নিল। রিভলবার, রুমাল, চাবির রিং, এমনকি কলম হাতিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার পকেট ও শূন্য করল।
জন ফিরে এলো ওসব নিয়ে।
সেই হেড়ে গলায় আবার হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘আমি শুনেছিলাম তুমি খুব চালাক, কিন্তু তুমি এই বোকামিটা কি করে করলে যে, মিষ্টার ভাসকুয়েজের ঘর মানে, কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টরের কেন্দ্র বিন্দুটা এতই অরক্ষিত। তুমি বুঝতে পারোনি, এই ঘরে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তোমার চোখের পলক পড়া পর্যন্ত নিখুঁত রিপোর্ট হয়েছে ইনফ্লারেড টেলিভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে। আমাদের কনট্রোল রুমের সিকুরিটি এটেনডেন্ট মাঝখানে সামান্য ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে একটু দেরি হয়ে গেছে আমাদের।’
আহমদ মুসা অবাক হলোনা। সেও আগেই একথা বুঝতে পেরেছিল, কোন সংকেত পেয়েই ওরা এসেছে। লোকটির কথা শেষ হবার সাথে সাথে আহমদ মুসার দৃষ্টি চারদিক একবার ঘুরে এল।
ক্যামেরা খুঁজছো বুঝি? লোকটির মুখে বিদ্রুপের হাসি।
‘ঠিকই বলেছেন।’ বোকা বোকা কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘উপরে দেখ ছাদের মাঝখানে একটা তিলক চিহ্ন। ওটা ক্রংক্রিটের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা শক্তিশালী একটা ইনফ্রারেড ক্যামেরার চোখ।’
‘আমার বুদ্ধির কি দোষ বলুন, অন্ধকার ঘরে তো ওটা দেখতে পাওয়ার কথা নয়।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল, আহমদ মুসা।
‘কিন্তু বুঝতে পারার তো কথা। কু-ক্লাস্ক-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টারের এত অরক্ষিত থাকার কথা নয়।’
‘ঠিক আছে, আমারতো হার হয়েছে।’
‘এবার নিয়ে তিনবার তুমি আমাদের হাতে এলে। দু’বার জাল কেটে পালিয়েছো, আর সে সুযোগ তুমি পাবেনা।’
‘সুযোগ সব সময় আসেনা এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘এমন ভাবে কথা বলছো, মনে হচ্ছে যেন তুমি শ্বশুর বাড়ী এসেছো। জান তোমার অপরাধ কত, কি শাস্তি অপেক্ষা করছে জন্য?’
‘অপরাধের কথা জানি, কিন্তু শাস্তির কথা জানিনা।’
‘কি শাস্তি হওয়া প্রয়োজন বলে তুমি মনে কর?’
‘আপনাদের যে শাস্তি হওয়া উচিত, তার থেকে অনেক কম।’
চোখ দু’টি জলে উঠল লোকটির। বলল, ‘খুব বেশী সাহস দেখাচ্ছ তুমি। জান আমি কে?’
‘না জানিনা।’ ঠোটে হাসি টেনে বলল, আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ঠোটে হাসি দেখে লোকটির মুখ ক্রোধে আরও বিকৃত হয়ে গেল। সে দু’ধাপ এগিয়ে এল এবং ভাসকুয়েজের টেবিল থেকে পেপার ওয়েট তুলে ছুড়ে মারলো আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।
ক্রিকেট বলের মত ছুটে আসা পেপার ওয়েট আহমদ মুসার বুকে আঘাত করত, কিন্তু আহমদ মুসা চকিতে এক পাশে সরে দাড়ানোর কারনে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে পেপার ওয়েট টি আঘাত করলো কম্পিউটারের স্ক্রীনে। কম্পিউটারের স্ক্রীন ফেটে গেল, তার একটা অংশ ফুটো হয়ে গেল।
মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত ভাব দেখা দিল লোকটির চেহারায়। পরক্ষনেই হুংকার দিয়ে উঠল। ক্রোধে কাঁপছে সে। ষ্টেনগানধারী চারজনের দিকে চেয়ে নির্দেশ দিল, একে নিয়ে চল।
ষ্টেনগানধারী চারজনের দু’জন এসে আহমদ মুসার দু’হাত দু’দিক থেকে চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে। অন্য দু’জন ষ্টেনগানধারী আহমদ মুসার পেছনে। তাদের ষ্টেনগানের নল আহমদ মুসার পিঠ লক্ষ্যে উদ্যত। সবার পেছনে লোকটি।
ভাসকুয়েজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে লম্বা-লম্বি করিডোর দিয়ে এগুলো তারা।
করিডোরের মাঝখানে এসে তারা লিফটে প্রবেশ করলো।
নামতে শুরু করল লিফট।
থামল এক জায়গায় এসে। আহমদ মুসা অনুভব করল তারা ইতিমধ্যেই চারতলা পরিমান স্পেস পেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ তাকে ভূগর্ভস্থ কোন কক্ষে আনা হল।
লিফটের দরজা খুলে গেল।
আহমদ মুসাকে নামতে সুযোগ না দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে দিল কক্ষের মধ্যে। ধাক্কা দিয়েছিল স্টেনগানধারীরা নয়, সেই লোকটি। তার রাগ এখনও কমেনি।
আহমদ মুসা এমনকিছু ঘটবে তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে ছিটকে পড়ে গেল ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে।
শেষ মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়া থেকে রক্ষা পেতে চেষ্টা করেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। কপালের বাম পাশটা ঠুকে গেল কংক্রিটের মেঝের সাথে। বাম চোখের ওপরটা ফেটে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। মুখ ভেসে গেল সে রক্তে।
আহমদ মুসা উঠে বসল।
হো হো করে হেসে উঠল সেই লোকটি। তার চোখে ক্রুর দৃষ্টি। বলল, মিনাত্রা সেন্ডোকে তুমি চিনতে। আমি জুবি জুরিটা তার জায়গায়, এখন অপারেশন কমান্ডার। সেন্ডোকে হত্যা করেছ, সে হত্যার প্রতিশোধ আমরা নেব। সব হত্যারই প্রতিশোধ আমরা নেব তিল তিল করে।
আহমদ মুসা উঠে বসেছিল। সে কোটের হাতা দিয়ে চোখের ওপর আসা রক্ত মুছে নিয়ে বলল, ‘মিঃ জুবি জুরিটা আমার প্রতি রুঢ় না হয়ে আপনার কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। সেন্ডো বেঁচে থাকলে আপনার এ পদ জুটতোনা।’
‘ফের বিদ্রুপ করছ। দেখ এতক্ষণে তোমাকে কুকুরের মত গুলি করে মারতাম। কিন্তু কি করব, বস কথা দিয়েছেন আমেরিকার কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানকে তাদের হাতে তোমাকে তুলে দেবার। কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা তো’।
‘এই না বললেন বিচার আপনারাই করবেন তিলে তিলে?’
‘তা বটে, আমরা ওদের হাতে একটা সজীব কংকাল তুলে দেব মাত্র। আমাদের শাস্তি আমরা দিয়ে নেব।’
‘ঈশ্বরের যে নাম নিলেনা। কথায় আছে না, মানুষ ভাবে একটা, আল্লাহ করেন আরেকটা।’
‘ঈশ্বরের আর খেয়ে কাজ নেই, এখানে আসবেন নাক গলাতে। দু’বার পালিয়েছ, আর সে আশা করোনা। যেখানে রেখে গেলাম, তার পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতে পার, কিন্তু রেরুতে পারবে না।’
‘মাথা ঠুকে মরার কোন ইচ্ছা আমার নেই।’
‘তুমি মরলে তো আমাদের ক্ষতি। শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে, আবার আমাদের ব্যবসাও মাঠে মারা যাবে। তবে তোমাকে এখানে বেশী দিন থাকতে হবে না, ভাসকুয়েজ আসা পর্যন্তই। জরুরী কাজে আজই গেল সানফ্রান্সিসকো, খবর পেলে কাল সকালেই এসে হাজির হবে। খুব বেশী হলে সন্ধ্যাতক সময় লাগবে।
জুবি জুরিটা উঠে যাবার জন্যে লিফটের বোতামের দিকে হাত বাড়িয়েও আবার হাত টেনে নিল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, শুন, রোবট ‘ডেভিল’ তোমাকে খাবার দিয়ে যাবে। দেখ ওর সাথে বেয়াদবির কোন চিন্তাও যেন করোনা। ও চোখের দৃষ্টি দেখেই চিন্তা ধরে ফেলতে পারে। ওর দশ চোখ, ওকে ফাকি দেবার কোন উপায় নেই। আর ও আসার পর হাত কখনও ওপরে তুলবেনা। কোন হাত যখন তার লক্ষ্যে ওপরে ওঠে, তখন সে পাগল হয়ে যায়। ও তখন তুলাধুনো করে ছাড়বে মনে রেখ। ও কাউকে প্রাণে মারেনা, কিন্তু কেউ ওর হাতে পড়লে তাকে ছয় মাস হাসপাতালে থাকতে হয়, জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যায় সে।’
বলে জুবি জুরিটা মুখ ফিরিয়ে লিফটের বোতামে চাপ দিল। বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা, সেই সাথে কক্ষের দরজাও।
আহমদ মুসা কোটের হাতা দিয়ে বাম চোখের পাশে জমে ওঠা রক্ত আবার মুছে নিল। তারপর ঘরের চারদিকে নজর বুলাল। সত্যই অন্ধকূপ একটা। চারদিকেই পাথরের দেয়াল। লিফটের দরজা ছাড়া কোন দরজা জানালা নেই। ওপরে ছাদের মাখানে ক্রিকেট বলের মত গোলাকার একটা জায়গায় স্টিলের একটা জাল লাগানো। আহমদ মুসা বুঝল, ঐ পথ দিয়ে ঘরের শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, হয়তো ক্যামেরাও ওখানে সেট করা থাকতে পারে। তবে ভাসকুয়েজের ঘরের মত কোন কাল চোখ আহমদ মুসা সেখানে দেখল না।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে লিফটের দরজা পরীক্ষা করল। টোকা দিয়ে দেখল, পুরো স্টিলের দরজা। লিফটের সাথে এ দরজা খোলে ও বন্ধ হয়। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লিফটে।
আহমদ মুসা দরজা থেকে ফিরে এসে মেঝের মাঝখানে বসল। এই অন্ধকূপের মধ্যে দুনিয়াটাকে খুব সংকীর্ণ মনে হল আহমদ মুসার। মনের দরজায় এসে উদ্বেগ উকি দিল, এ অন্ধকূপ থেকে মুক্তির উপায় কি?
আহমদ মুসা তাড়িয়ে দিল উদ্বেগটাকে মনের দুয়ার থেকে। বলল, এ চিন্তার সময় পাওয়া যাবে, ভাসকুয়েজ আসতে কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা দেরী আছে। এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। মেঝেয় টান হয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। শীঘ্রই তার দু’চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম।

মারিয়া গ্রাউন্ড ফ্লোরের ড্রইং রুমের দরজায় উদ্বিগ্ন ভাবে দাঁড়িয়েছিল। দৃষ্টি বাইরে লনের ওপর। লনের মাঝখান দিয়ে একটা কংক্রিটের রাস্তা বন্ধ গেটে গিয়ে স্পর্শ করেছে। মারিয়ার দৃষ্টি বন্ধ গেটের ওপর গিয়ে বার বার আছড়ে পড়ছে।
মারিয়ার বাইরের চেয়ে ভেতরটা বেশী চঞ্চল। একটা অশুভ আশংকা এসে তার হৃদয়ে বার বার উকি দিচ্ছে। বড় কিছু ঘটেনি তো আহমদ মুসার? ভাবতে গিয়ে হৃদয় কেঁপে উঠল মারিয়ার। আহমদ মুসা যে মিশন নিয়ে কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হেড কোয়ার্টারে গেছে, তাতে বেশী সময় লাগার কথা নয়। বেশ রাত থাকতে এজন্যেই তিনি বেরিয়েছেন যাতে রাত শেষ হবার আগেই ফিরতে পারেন। রাত সাড়ে তিনটায় বেরোনা দেখে মারিয়া এটাই বুঝেছে। তিনি বার বারই বলেছেন, একটা বিষয় অনুসন্ধানের জন্যেই তিনি যাচ্ছেন, কোন সংঘাতে জড়াতে নয়। তাই তিনি যেমন রাতের আঁধারে গেছেন, তেমনি কাউকে সাথেও নিতে চাননি। কিন্তু এত দেরী হচ্ছে কেন? তিনি কি আর কোথাও গেলেন? না তা কেন হবে? যে বিষয়ের সন্ধানে তিনি গেছেন, সে জন্যে যদি কোথাও যেতে হয়, তাহলে ফিরে এসে সবাইকে বলে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। আবার সেই কাল উদ্বেগটা এসে জেঁকে বসল মারিয়ার হদয়ে। আর চিন্তা করতে পারেনা মারিয়া। হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে একটা বেদনা গুমরে উঠছে।
সিঁড়ি দিয়ে উপর থেকে নেমে এল, সুমানো। সুমানো মারিয়ার আত্মীয় এবং বান্ধবী। বেড়াতে এসেছে গতকাল।
সুমানো এসে দাঁড়াল মারিয়ার পেছনে। ধীরে ধীরে হাত রাখল মারিয়ার কাঁধে।
মারিয়া একটা হাত তুলে ধীরে ধীরে সুমানোর হাতটা ধরল। মুখ ফিরালোনা, চোখও তার ফিরালোনা পথের ওপর থেকে।
‘ওপরে চল, খাবে। ফুফু আম্মা অপেক্ষা করছেন।’ বলল সুমানো।
মারিয়া কিছু বলল না।
সুমানো মারিয়ার ঘাড়ে চাপ দিল। বলল, ‘মারিয়া চল।’
‘আমি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।’ না তাকিয়ে নিবির্কার কন্ঠে বলল মারিয়া।
‘সত্যিই ভাইয়ার জন্য?’ সুমানোর ঠোঁটের কোণে হাসি।
মারিয়া মুখ ফিরাল সুমানোর দিকে। অন্য সময় হলে মারিয়া হাসত কিংবা শাসন মূলক কোন কথা ছুড়ে দিত সুমানোর দিকে। কিন্তু এখন তেমন কিছুই করল না মারিয়া। একটা খবরের জন্য অপেক্ষা করছি।’
শুকনো কন্ঠস্বর মারিয়ার। চেহারাও তার পাংশু।
সুমানোর ঠোটের হাসি মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হল সুমানো। বলল, ‘ফুফু আম্মার কাছে কিছু শুনলাম। তিনি কে মারিয়া? মারিয়া এমন উদ্বিগ্ন হয়ে কারো পথ চেয়ে থাকতে পারে ভাবতে আমার বিস্ময় লাগছে।’
‘তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন সুমানো।’
সুমানো মারিয়ার গলা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘শুধু সে জন্যই কি মারিয়া? আমিও তোমার মত মেয়ে, তোমার চোখ যে কথা বলছে তাতো আমি পড়ছি মারিয়া। সে জন্যই জানতে চেয়েছিলাম, কে তিনি? তিনি অবশ্যই সাধারণ মানুষ হবেন না।’
‘সত্যিই সুমানো আমার চোখে তা তুমি দেখছ! কিন্তু আমি তো চাইনি আমার চোখে তা আসুক। এ আমার ব্যর্থতা সুমানো।’ মারিয়ার কন্ঠ কান্নার মতই করুণ।
‘কেন মারিয়া, লুকানোর এ প্রয়াস কেন তোমার?’
‘থাক সুমানো।’
থামলো মারিয়া। পরক্ষণেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘ঐযে ভাইয়ার গাড়ী, ভাইয়া আসছেন।’
গাড়ী ধীর গতিতে এসে গাড়ী বারাসায় দাড়াঁল।
মারিয়ার চোখ ছুটে গেল গাড়ীর ভেতরে। ড্রাইভিং সিটে একজনই মানুষ-মারিয়ার ভাই ফিলিপ। ধক্ করে উঠল মারিয়ার বুকটা। তার ভাইজান কি খবর নিয়ে আসছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে চাইল মারিয়ার।
গাড়ী থেকে নামল ফিলিপ। তার সুন্দর চেহারার উপর একটি কাল মেঘ।
গাড়ী থেকে নেমেই দরজায় দাঁড়ানো বোনের দিকে তাকাল। বোনের স্লান মুখ ও চোখের শংকিত দৃষ্টির দিকে চোখ পড়তেই তার বুকের বেদনাটা আরও চিন্ চিন্ করে উঠল।
ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে এগুলো দরজার দিকে ফিলিপ। কিন্তু তার ঠোঁটের এই হাসিটা কান্নার মত করুণ মনে হলো।
মারিয়ার পাশে সুমানো নিবার্ক দাড়িঁয়েছিল। ফিলিপকে দেখে সেও একটা খারাপ খবর আঁচ করেছে।
দরজায় হেলান দিয়ে স্থানুর মত দাড়িঁয়ে থাকা বোনের একটা হাত ধরে ফিলিপ বলল, ‘চল বসি।’
সোফায় এসে বসল তারা। বসে সোফায় হেলান দিয়ে মুহূর্ত কয়েক মাথা নিচু করে থেকে বলল, ‘আমাদের আশংকা ঠিক মারিয়া, উনি আটকা পড়েছেন।’
মারিয়ার মুখে একটা কাল ছায়া নেমে এল।
‘ফিলিপ থেমেছিল।’ একটা বাক্য উচ্চারণ করে, একটু দম নিয়ে সে শুরু করল, ‘বুট পালিশ কারীর ছদ্মবেশে একজন লোক পাঠিয়েছিলাম ওদের হেড কোয়ার্টারে। তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ভেতরে। গেটের প্রহরী বলেছে, ‘আজ অফিস বন্ধ। অফিসের লোক ছাড়া অন্য সকলের ঢোকা নিষিদ্ধ।’
‘কেন? কেন? জিঞ্জেস করেছিল আমার লোক।
‘রাতে বড়কর্তার ঘরে লোক ঢুকেছিল ধরা পড়েছে।’
‘তো কি হয়েছে, এমনতো কতই হচ্ছে। পুলিশে দিলেই তো ঝামেলা যায়।’
‘বড় কর্তার অফিস ঘরে চোর ঢুকবে নাকি, এটা অন্য ব্যাপার। যাও ভাগ।’
ফিলিপ থামল।
কিছুক্ষণ পর ধীর কন্ঠে মারিয়া বলল, ‘ভাইয়া এ নিয়ে উনি তিনবার ওদের হাতে পড়লেন। আর ট্রিয়স্টের ব্যাপার নিয়ে ওরা ওঁর ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। আমার……’
কথা শেষ করতে পারলোনা মারিয়া। কন্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে এল।
‘তুমি যে আশংকা করছ, ওমন কিছু ঘটেনি মারিয়া।’
একটু থামল ফিলিপ। তারপর আবার শুরু করল।
‘লোকটি ফিরে এলে একটা সাপ্লায়ার কোম্পানীর এজেন্ট ছদ্মবেশে আমি গিয়েছিলাম ওদের হেড কোয়ার্টারে। আমাকে রিসেপশন পর্যন্ত যেতে দিয়েছিল। রিসেপশনের লোকটিও আমাকে ঐ কথায় বলেছিল। শুনে আমি বলেছিলাম, এ নিয়ে এত রাখ-ঢাক কেন, পুলিশে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।’
রিসিপশনিস্ট লোকটি বলেছিল,‘পুলিশে দেব কেন? আমরা পুলিশের বাবা। ও রকম কত লোককে আমরা হজম করেছি।’
‘তাহলে আর সমস্যা কি?’ বলেছিলাম আমি।
‘সমস্যা হলো বড় কর্তা নেই। আমেরিকা গেছেন। তার নির্দেশ ছাড়া কিছুই এখানে হয় না।’
‘ও বুঝেছি, তিনি না ফেরা পযর্ন্ত চোরকে রাখতে হবে, তাই এই সতর্কতা।’
‘আঃ কি বললেন, ও ব্যাটা চোর না। চোর না হলে কি কোন মাথা ব্যাথা হতো।’ তাহলে?
‘সাংঘাতিক এক লোক সে। কি মুসা যেন নাম। আমাদের বহু লোককে খুন করেছে। বড় কর্তা এবার ওকে চিবিয়ে খাবে।’
‘সাংঘতিক লোক তো তাহলে, পালাবে না তো? আপনাদের কড়াকড়ি ঠিকই হয়েছে।’
‘দু’বার ও পালিয়েছিল। আর নয়। এবার মাটির নিচে অন্ধকুপে রাখা হয়েছে। স্বয়ং শয়তান এলেও উদ্ধার করতে পারবে না।’
‘অন্ধকূপ? সে আবার কি জিনিস? কোথায়?’
প্রশ্ন করেই ভেবেছিলাম এমন খোলামেলা প্রশ্ন বোধ হয় ঠিক হয়নি। আমার মতলব সে ধরে ফেলতে পারে।
কিন্তু সে পারেনি ধরতে, গল্প তাকে পেয়ে বসেছিল। সে যে অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক, তা প্রকাশের একটা সুযোগ পাওয়ায় সে খুশী হয়ে উঠেছিল। বলল, ‘অন্ধকূপ সাংঘাতিক শত্রুর জন্য কয়েদ খানা। এই অফিসের মাটির নিচেই।’
এই সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলাম। কে যেন নামছে। আমি চলে এলাম।’
‘সুতরাং,’ বলতে শুরু করল ফিলিপ। ‘মুসা ভাইয়ের ক্ষতি হয়নি নিশ্চিত, ভাসকুয়েজ না আসা পযর্ন্ত,তার কোন ক্ষতি হবারও সম্ভাবনা নেই।’
‘খবর পেলে ভাসকুয়েজ দেখো কালই চলে আসবে।’ম্লান কন্ঠে বলল মারিয়া।
‘জানি।কিন্তু কাল আসার আগেই আমারা কাজ সেরে ফেলব। আমি ওদের হেড কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে যিয়াদের ওখানে গেছিলাম। সব আলোচনা হয়েছে। আজ রাতেই আমারা হানা দেব।
মারিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার চোখে ভেসে উঠল আহমদ মুসার চেহারা। সেই সাথে মনে পড়ল আহমদ মুসার সাথে নির্জন তার সময় গুলোর কথা। একজন মানুষ যে অমন অবিশ্বাস্য পবিত্র চরিত্রের হতে পারে, তা না দেখলে মারিয়ার কোন দিনই বিশ্বাস হতো না। তার হৃদয়ের এক গহীন প্রান্ত থেকে একটি পরিচিত বেদনা চিন চিন করে উঠল। কেঁপে উঠল মারিয়া। এই বেদনাকে সে প্রাণপণে চেপে রাখতে চায়।
ফিলিপ তাকিয়েছিল বোনের দিকে। ফিলিপ সব জানে। কিন্তু কোন দিন কিছু বলেনি অতি আদরের ছোট বোনটিকে। মারিয়া নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে এটা ফিলিপ জানে।
নিরবতা সুমানো। সে মারিয়ার পাশে বসেছিল। বলল, ‘ভাইয়া লোকটি দেখছি মারিয়াকে নিঃশেষ করেছে, তোমাকে ও পাগল করেছে। আবার অন্ধকুপে তার বন্দি হবার ভয়ানক সংবাদও তুমি দিলে। কে এই সাংঘাতিক লোকটি ভাইয়া?’
‘তুমি মারিয়ার কাছে শোন। আমার কাজ আছে যাই।’ বলে ফিলিপ উঠে দাঁড়াল।
‘মারিয়া মুখ খুলছেনা। জান ভাইয়া, মারিয়া এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি, নিচে থেকে উপরে উঠেনি।’
ফিলিপ চলে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়াল মারিয়ার দিকে।
মারিয়া মুখ নিচু করে আছে।
ফিলিপ দু’ধাপ এগিয়ে গেল মারিয়ার দিকে। নরম কণ্ঠে বলল, ‘বোন মারিয়া উনি শুনলে ভীষণ রাগ করবেন। চিন্তার কি আছে? তুমি তো জান, এর চেয়ে কত বড় বড় বিপদের তিনি মোকাবেলা করেছেন।’
বলে ফিলিপ আবার ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল সে।
ফিলিপের কথা শেষ না হতেই মারিয়া দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল।
সুমানো ফিলিপের সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ফিলিপ চলে গেলে সুমালো মারিয়ার পাশে বসল।
ফিলিপের কথার প্রথম বাক্যটি মারিয়ার হৃদয়ের গহীনে লুকানো বেদনাকেই গিয়ে আঘাত করল। ‘তিনি ভীষণ রাগ করবেন’ কথাটা মারিয়াকে গত রাতের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিল। ঐ রাতে সিড়ির গোড়ায় মারিয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকাকে আহমদ মুসা অন্য ভাবে নিয়েছিল। তার মনের এই ভাবটা কণ্ঠের কঠোরতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশও পেয়েছিল। কোন কথা না বলে কান্না চেপে মারিয়া ছুটে ওপরে উঠে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ল। অনেক কান্দলো মারিয়া। এখন ফিলিপের কথায় মারিয়ার সেই কান্না উথলে উঠলো। তার মন যেন চিত্কার করে বলে উঠল, মারিয়ার না খেয়ে থাকার কথা শুনে ঐভাবে উনি ভুল বুঝবেন এবং রাগ করবেনই তো?
সুমানো মারিয়ার পাশে বসেই বুঝতে পারল মারিয়া কাঁদছে।
সুমানো মারিয়ার হাত দু’টি সরিয়ে নিল তার মুখ থেকে। অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে মারিয়ার মুখ।
মারিয়া তাড়াতাড়ি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ফেলল।
সুমানো মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘আমি শুধু তোর বোন না, বয়সে কিছু বড়ও। বলবিনা কি হয়েছে তোর? কিছু বুঝিনি তা নয়, কিন্তু এ কান্নার অর্থ আমি বুঝিনা।’
সোজা হয়ে বসল মারিয়া। বলল, ‘আমাকে মাফ কর সুমানো। এ কিছু না। আমার একটা অন্যায়। একটা অন্যায়ের আগুনে আমি জ্বলছি। চল উঠি।’
উঠতে চাইল মারিয়া।
কিন্তু সুমানো তাকে ধরে রাখল। বলল, জানি, তুমি না বললে আর হ্যাঁ বলানো যাবে না। কিন্তু উনি কে তাকি জানতে পারবনা?
‘তিনি যেমন মহৎ, যেমন বিরাট, যেমন বিস্ত্মৃত, তেমনি হতভাগা। সর্বক্ষণ বিপদ তাঁকে তাড়া করে ফিরছে।’ এক ধরণের উদাস কণ্ঠ মারিয়ার।
‘মারিয়া! এটা কারো কোন পরিচয় হলো? এ পরিচয় দিয়ে কাউকে চেনা যায়?’
মারিয়া সুমানোর দিকে ফিরল। নরম কণ্ঠ বলল, ‘আহমদ মুসাকে জান তুমি?’
সুমানো চোখ বন্ধ করল। ভাবল একটু। তারপর বলল, ‘এই কিছুদিন আগে টাইম ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিন এক আহমদ মুসাকে নিয়ে কভারস্টোরী করেছিল। সেতো জগৎ কাঁপানো এক বিপ্লবী। তুমি কি তার কথা বলছ?’
‘আমি তোমার সেই জগৎ কাঁপানো বিপ্লবীর কথাই বলছি।’ মারিয়ার ঠোঁটের কোণে বেদনাময় এক হাসি।
‘কি বলছ মারিয়া, ইনি তিনি?’ সুমানোর কণ্ঠ কাঁপা এবং চোখে মুখে অপার বিস্ময়।
‘হাঁ সুমানো, ইনিই সেই তিনি।’
সুমানো কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা। যেন বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে তার।
মারিয়া কিছু বলার জন্যে মুখ খুলছিল। সুমানো বাধা দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘একটু ভাবতে দাও মারিয়া আমাকে। কোথায় কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে ওঠা সেই আহমদ মুসা; কোথায় মাদ্রিদ, কোথায় আমার বোন মারিয়া- আমি অংক মিলাতে পারছিনা। আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো?’
‘স্বপ্ন নয়, কিন্তু স্বপ্নের চেয়েও বিস্ময়কর।’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল মারিয়া।
‘কিন্তু তোমার কান্নাকে আর বিস্ময়কর মনে হচ্ছে না আমার কাছে। শুধু এখন বড় বেশি জানতে ইচ্ছে করছে- তুমি যা বলতে চাও না সেই কাহিনী, কি করে এই অসম্ভব মিলন ঘটল। সেই কাহিনী।’
বলতে শুরু করল মারিয়া। ঘাড় ফিরিয়ে সুমানোর দিকে চেয়ে বলল, ‘দুনিয়াতে যত কাহিনী সৃষ্টি হচ্ছে তার অল্পই মানুষ জানে সুমানো।’
সুমানো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মারিয়া এক দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
পলায়নপর মারিয়ার দিকে চেয়ে হাসল সুমানো, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ নয় বেদনা ঝরে পড়ল। তার মুখ থেকে স্বগতঃ উচ্চারিত হলো, ‘বোন আমার কাছ থেকে পালালে, কিন্তু জীবন থেকে পালাতে পারবে না।’

বেশ আগে ঘুম থেকে উঠেছে আহমদ মুসা। অনুমান করে মাগরিবের নামাজটাও পড়ে নিয়েছে। এই অন্ধকুপে সময়ের বিচার একেবারেই অসম্ভব। নাস্তা ও দুপুরের খানা থেকে সময়ের একটু পরিমাপ করে নিয়েছে আহমদ মুসা। এই হিসেব থেকে সে যোহর ও আছরের নামায পড়েছে। আছরের নামাজ পড়ে সে আবার ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে আহমদ মুসা অনুমান করেছিল দু’ঘন্টার বেশী সে ঘুমায়নি। সুতরাং সে ঘুম থেকে উঠেই মাগরিবের নামাজ পড়ে নিয়েছে।
সকালেও একবার ঘুমিয়েছে আহমদ মুসা। রোবটের পায়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙেছিল। চোখ খুলেই সে দেখতে পেয়েছিল রোবটকে। লিফট থেকে বেরিয়ে হেঁটে আসছে মেঝের উপর দিয়ে। নিঃশব্দ গতি, তার মুখ দিয়ে অব্যাহতভাবে একটা শব্দ বেরুচ্ছে ‘নাস্তা নাস্তা।’ এই শব্দেই তার ঘুম ভেঙেছিল।
রোবটের হাতে ছিল একটা টিফিন বক্স। সে বক্সটি এনে আহমদ মুসার সামনে রেখেছিল। রাখার সংগে সংগেই তার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসা আগেই উঠে বসেছিল।
রোবটের উচ্চতা সাড়ে চার ফুটের মত হবে, আহমদ মুসা অনুমান করে নিয়েছিল। ঠিকই বলেছিল জুবি জুরিটা, রোবটের মাথায় দশটি চোখ। দশটি চোখেই উজ্জ্বল দৃষ্টি। রোবটের হাত দুটি দীর্ঘ এবং বলিষ্ঠ। হাতের দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা বুঝেছিল, হাত দু’টি সামনে পিছনে, ডানে বামে সব দিকে সমানভাবে সক্রিয় হতে পারে। আস্থার সাথে নিখুঁতভাবে পা ফেলে সে। সবই ঠিক আছে, শুধু মুখ দেখেই বলা যায় তার ‘ডেভিল’ নাম স্বার্থক। কুৎসিত এবং ভয়ংকর তার মুখ। ঐ মুখ নিয়ে যখন সে এগিয়ে আসে মনে হয় খুন করতেই আসছে।
টিফিন বক্স রেখে রোবট দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা বুঝেছিল, সে খেলে টিফিন বক্সটি ফেরত পাবে, তার পরেই রোবট যাবে।
টিফিন বক্সটি বিরাট। তার মধ্যে নাস্তা পানি সবই আছে।
বক্সটি খুলল আহমদ মুসা।
রোবট সম্পর্কে সাবধান হওয়ার ব্যাপারে জুবি জুরিটার কথা আহমদ মুসার মনে ছিল কিন্তু হঠাৎ এক সময় মাথা চুলকাবার জন্যে তার ডান হাত উপরে উঠে গেল। আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা, এই বুঝি কি ঘটে যায়। কিন্তু কিছুই ঘটল না। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পরক্ষণেই ভাবল, হাতটা বিশেষ ভংগিতে না উঠলে সম্ভবতঃ রোবট প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবেনা। সে বিশেষ ভংগিটা কি, অনুমান করতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। নিশ্চয় হাত রোবটের দিকে টার্গেট হতে হবে এবং চোখও বোধ হয় রোবটের দিকে নিবদ্ধ হতে হবে। কাউকে আক্রমণের সময় মানুষের চোখ ও হাতের এমন অবস্থানই হয়ে থাকে। এমন ভাবে চিন্তা করতে পারায় আহমদ মুসা খুশী হলো। তার এই চিন্তা সঠিক কি না দুপুর বেলা আহমদ মুসা পরীক্ষা করল।
সকালে যেমন রোবট লিফটে করে একা এসেছিল দুপুরেও তাই এলো। আহমদ মুসা বুঝল রোবট লিফট চালাতেও জানে।
রোবট খাবারের বক্স ঘরের ঠিক মাঝখানে রেখে দাঁড়িয়েছিল।
রোবট যখন ঢোকে, তখন আহমদ মুসা ঘরে পায়চারি করছিল।
রোবট খাবারের বাক্স রেখে দাঁড়ালে আহমদ মুসাও খাবারের বাক্সের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর সে দু’হাত তুলে গা থেকে কোট খুলে হাতে নিয়ে বসে পড়ল। এ সময় আহমদ মুসার চোখ ছিল নিচু। কি ঘটে সেই চিন্তায় তার দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রী টান টান হয়ে উঠল।
না, কিছুই ঘটলনা। রোবট হাত নিচু রেখে যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল। আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়ে গেল, তার চিন্তা ঠিক। হাত ও চোখ এক সাথে রোবটের দিকে টার্গেটেড না হলে রোবট সক্রিয় হবে না, শত্রুতা করবেনা। আহমদ মুসা জানে, রোবটের চোখ গুলো হলো দূরনিয়ন্ত্রিত টিভি ক্যামেরা অথবা এ চোখ গুলোর সাথে রোবটের ভেতরের কমান্ডসেল যুক্ত রয়েছে। চোখগুলো দিয়ে দেখেই কমান্ডসেল রোবটকে নির্দেশ দেয়।
এই চিন্তা সামনে রেখে আহমদ মুসা একটা পরিকল্পনা আঁটলো। রোবট খাবার বক্স নিয়ে চলে যাবার পর অন্ধকূপের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আহমদ মুসা তার পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিল। এবং স্থির করল, আল্লাহর ওপর ভরসা করে রাতেই সে তার পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্যোগ নেবে।
মাগরিবের নামাজের পর আহমদ মুসা ঘণ্টা খানেক ধরে হালকা ব্যায়াম করল। তারপর ঘরময় সে পায়চারি করতে থাকে।
কতক্ষণ পায়চারি করেছে, কত রাত হয়েছে কে জানে। তবে রাতের খাবার সময় পার হয়ে যায়নি, কারণ রোবট খাবার নিয়ে আসেনি। ঠিক খাবারের সময়েই রোবট খাবার নিয়ে আসবে। মনে মনে আহমদ মুসা জুবি জুরিটার প্রশংসা করল। অন্ততঃ খাবারটা সে ঠিকমত দিচ্ছে। শিকারকে খাইয়ে দাইয়ে সম্ভবতঃ মোটা তাজা করে নিতে চায় জুবি জুরিটা।
খুট করে একটা শব্দ হলো লিফটের দরজায়। খুলে গেল লিফটের দরজা ধীরে ধীরে। খোলা দরজা দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল রোবট। আগের দু’বারের মত রোবট খাবারের বক্সটি এনে মেঝের ঠিক মাঝখানে রাখল।
আহমদ মুসা বিপরীত দিকের দেয়ালের কাছে তখন। লিফটের দরজা খোলার সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রোবট খাবারের বক্সটি মেঝেতে নামিয়ে রাখার পর আহমদ মুসা ধীরে ধীরে সেদিকে এগুলো। আহমদ মুসার দৃষ্টি রোবটের দিকে নয়, খাবারের বক্সে দিকে। আহমদ মুসা যতই খাবারের বক্সে কাছাকাছি হচ্ছে, ততই তার স্নায়ুতন্ত্রীর উত্তেজনার চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আল্লাহ তাকে সফল করবেন তো? আহমদ মুসার হিসেব যদি ঠিক না হয়ে থাকে, যা সে চিন্তা করেছে তার চেয়ে ভিন্ন ধরণের যদি হয় রোবটের প্রকৃতি। আহমদ মুসা জীবনে বার বার ঝুঁকি নিয়েছে, কিন্তু এমন অনিশ্চিয়তার মুখোমুখি সে কোন দিন হয়নি।
রোবট খাবার বক্স থেকে এক গজেরও কম দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা খাবারের বক্সের এক ফুটের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। তার নিম্নমুখী চোখ রোবটের পা দেখতে পাচ্ছে। সে ঠিক দুপুরের মতই চোখ নিচু রেখে হাত দু’টি তুলে কোট খুলতে লাগল। কোট খুলে দু’হাত দিয়ে ধরে সামনে নিয়ে এল। তারপর ঠিক ভাজ করার জন্যে কাপড় যেভাবে মানুষ টান করে ধরে -ঠিক সেভাবে দু’হাতে কোট টান করে সামনে ধরল। এর পরেই চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। আহমদ মুসা বিদ্যুত বেগে দু’হাতে ধরা কোটটি আর একটু ওপরে তুলে ছুড়ে দিল রোবটের মাথায়।
নিখুঁত টার্গেট। প্রসারিত কোটটি গিয়ে রোবটের মাথার গোটাটাই ঢেকে দিল।
কোট ছুঁড়ে দিয়েই ছুটল সে খোলা লিফটের দিকে।
লিফটে গিয়ে উঠল আহমদ মুসা।
লিফটের দরজা ক্লোজ করার বোতামে টিপ দেবার আগে আহমদ মুসা রোবটের দিকে তাকিয়ে দেখল, রোবট ঘুরছে, উথাল পাথাল করছে, কিন্তু হাতে দুটি তাঁর মাথা থেকে কোট সরাতে পারছে না। কারন চোখ বন্ধ থাকায় এ ধরনের কাজের কমান্ড সে পাচ্ছে না। রোবটের চোখ বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে ভেতরের কমান্ড সেলও অন্ধ হয়ে গেছে। রোবট বুঝতেই পারলনা আহমদ মুসা লিফটের চলে গেছে।
লিফটকে ক্লোজ করার বোতাম টিপে দিল আহমদ মুসা। কোন তলায় গিয়ে লিফট থেকে নামবে, সেটা ঠিক করতে গিয়ে সুইচ প্যানেলে দেখল, একতলা ও দোতলায় কোন স্টপেজ নেই। স্টপেজ আছে তিন, চার ও পাঁচ তলায়। আহমদ মুসা বুঝল, এটা বিশেষ লিফট, এ লিফট দিয়ে বাইরে বেরুনো যাবে না।
আন্ডার গ্রাউন্ড সেলে নামানো হয়েছিল। আহমদ মুসা তিন নম্বর বোতামটিই টিপে দিল। তিন তলায় নামবে সে।
তিন তলায় এসে লিফট থেমে গেল।
আহমদ মুসার মনে আছে, যাবার সময় লিফটের এ দরজায় একজন প্রহরী দেখেছিল। তাঁর হাতে তখন স্টেনগান ছিল। লিফটের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে। আহমদ মুসা ভাবল, প্রহরী নিশ্চয় মনে করছে রোবট নামবে লিফট থেকে। অথবা যদি রোবট তিন তলায় নামার ব্যাপার নয়, তাহলে মনে করতে পারে কোন অফিসার আসছেন। অথবা এ সময় এখানে যদিও কারও নামার কোন ব্যাপার না হয়, তাহলে প্রহরী সন্দেহ করতে পারে। আহমদ মুসা যে কোন অবস্থার জন্য নিজেকে তৈরি করল।
লিফটের দরজা অর্ধেকটা খোলা হতেই আহমদ মুসা লিফট থেকে এক লাফে করিডোরে পড়ল।
প্রহরী দরজার এক পাশে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা গিয়ে একদম তাঁর মুখের সামনেই পড়ল।
ভুত দেখার মত আঁতকে উঠল প্রহরী। পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে নিল। মনে হলো সে চিনতে পেরেছে আহমদ মুসাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রহরী তাঁর স্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না। আহমদ মুসার ডান হাতের প্রচণ্ড এক কারাতে গিয়ে পড়ল তাঁর বাম কানের নিচে ঘাড়টায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে টেনে লিফটে নিয়ে এল। তারপর লিফট ক্লোজ করে আন্ডার গ্রাউন্ড বোতাম টিপে দ্রুত বেরিয়ে এল। তারপর পড়ে থাকা স্টেনগান টি করিডোরে থেকে তুলে নিয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল, কোন দিকে যাবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। করিডোরে একদম ফাকা। প্রহরী শ্রেণী ছাড়া অফিসে রাতে সাধারণ কর্মচারীরা কেও থাকে না।
করিডোরের পূর্ব প্রান্তে বেরিয়ে যাবার লিফট ও সিঁড়ি। নিশ্চয় রাতে বাইরে বেরুবার গেট বন্ধ, তাঁর উপর সেখানে আছে দু জন প্রহরী। তাছাড়া তাঁর পালাবার খবর প্রকাশ হতে দেরী হবে না। সে ক্ষেত্রে প্রথমে সবাই গেটের দিকেই ছুটবে। করিডোরটি পশ্চিমে গিয়ে ভাস্কুয়েজের কক্ষে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা ভাস্কুয়েজের কক্ষের দিকেই ছুটল। তাকে খোঁজার জন্য। প্রথম দিকে অবশ্যই কেও এদিকে আসবেনা।
ভাস্কুয়েজের বন্ধ দরজার সামনে দাড়িয়ে আহমদ মুসা দ্রুত জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার নাইফ বের করে নিল। তারপর ল্যাসার বিম দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে এর গলিয়ে ফেলল লোক।
আহমদ মুসা ভাস্কুয়েজের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। মেঝেয় পা বারাতে গিয়ে, ছাঁদ থেকে তাকিয়ে থাকা ইনফারেড ক্যামেরা এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল বটে, কিন্তু বিকল্প সন্ধানে এর তখন কোন সময় ছিল না। তাছাড়া করিডোরেও তো ক্যামেরা থাকতে পারে। সুতরাং তাঁর গতি বিধি ধরা পড়ে যাবেই। যতক্ষণ সুযোগ আছে, তাঁর দ্রুত সদ্ব্যবহার করতে হবে।
আহমদ মুসা দৌড় দিল জানালা লক্ষ্য। দৌড় দেয়ার জন্য পা তলার পরেই তাঁর ডান পা টি কিসের সাথে ধাক্কা খেল। থেমে ঝুকে হাত দিয়েই বুঝতে পারল তাঁর ব্যগ। আহমদ মুসা র মনে পড়ল তাঁর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে একজন প্রহরী দরজার সামনে ডান পাশটায় রেখে দিয়েছিল। ব্যাগটা ওখানই আছে। ওরা নিয়ে যায়নি, রেখে দিয়েছে ভাস্কুয়েজের জন্য। অথবা তারা ভুলেই গেছে ব্যাগের কথা, আহমদ মুসাকে পাওয়ার আনন্দে।
খুশী হল আহমদ মুসা ব্যাগটি পেয়ে। ব্যাগ হাতে তুলে আবার ছুটল আগের সেই জানালার দিকে।
জানালার গরাদ পরীক্ষা করে খুশী হল। আজকেও জানালার গরাদ লক করা নেই। আহমদ মুসা ধরা পড়ার পর এর প্রয়োজন বোধ হয় তারা মনে করেনি।
আহমদ মুসা জানালার গরাদ উঠিয়ে সংকীর্ণ কার্নিশটি তে নেমে এল। কার্নিশে দাড়িয়ে নিচে তাকিয়ে হতাশ হল আহমদ মুসা। সেদিন যেমন এ পাশটা অন্ধকার ছিল, আজ অন্ধকার নয়। এ পাশে নতুন একটা লাইট পোস্ট বসানো হয়েছে। তবে আহমদ মুসা খুশী হল, ছোট ঝাউ গাছটার ওপাশে তাঁর গাড়িটা সে যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নিচটা ভাল করে দেখতে গিয়ে আরও হতাশ হল আহমদ মুসা। তাঁর সোজাসুজি নিছের জায়গাটা থেকে গজ তিনেক দক্ষিণে স্টেনগান হাতে একজন প্রহরী দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। তবে ভাগ্যটা এখনও এই টুকু ভাল যে, লোকটা এদিকে তাকিয়ে নেই। দক্ষিন মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিন দিকে অল্প দূরে দাঁড়ানো একটা বিল্ডিং থেকে পিয়ানোর সুন্দর সুর ভেসে আসছে। প্রহরী ওদিকে চেয়ে সম্ভবত সে সুরেই শুনছে।
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক অপেক্ষা করে সিল্কের কর্ডের হুকটি জানালায় লাগিয়ে নিল এবং বিসমিল্লাহ বলে নিঃশব্দে কর্ডে ঝুলে পড়ল। এই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। অপেক্ষা করার উপায় নেই। সময় যত যাবে, বিপদ ততই বাড়বে।
স্টেনগান দাঁতে কামড়ে দ্রুত নামছে আহমদ মুসা। অর্ধেক পথ নেমেছে এমন সময় কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান হেড কোয়ার্টার এর ভেতর থেকে সাইরেন বেজে উঠল। আহমদ মুসার গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। সে পালিয়েছে একথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রহরীদের সতর্ক করা হচ্ছে।
আহমদ মুসা নিচে একবার তাকিয়ে কর্ড ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়ল। একটু দখিনে দাঁড়ানো প্রহরী সাইরেন এর শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে তাকাচ্ছিল পূর্ব দিকে – বিল্ডিং এর যেদিকে গেট। আহমদ মুসার লাফিয়ে পড়ার শব্দ হল।
চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল প্রহরী। দেখতে পেল আহমদ মুসা, সেই সাথে ঝুলে থাকা কর্ডটি। শত্রুকে চিনতে তাঁর দেরী হল না। হাতের স্টেনগান টি তুলতে গেল সে।
আহমদ মুসা লাফিয়ে পড়েই স্টেনগান তুলতে গেল আহমদ মুসাকে গুলি করার জন্য, তখন আহমদ মুসাকে ট্রিগার টিপতেই হল। আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে বেরিয়ে গেল এক পশলা গুলি।
প্রহরী যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ছুটল ঝাউ গাছের ওপাশে গাড়ির কাছে। গাড়ি খোলাই রেখেছিল আহমদ মুসা, চাবিও রেখে গিয়েছিল কি হলে। চাবি কি হলে ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে। সে কিছুটা বিস্মিত হল। ওরা কি এদিকে কোন খোঁজ করেনি। কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মত সংগঠনের জন্য এটা অস্বাভাবিক মনে হল তাঁর কাছে।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি যখন বেরিয়ে আসছিল লন থেকে, তখন ঝাউ গাছের ওপাশে শোর-গোল শুনতে পেল। স্টেনগান বাগিয়ে কয়েকজন ছুটে এল ঝাউ গাছের এ পাশে। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটে এল অনেক দূরে।
ওদের জেদ দেখে হাশ্ল সে।
আহমদ মুসা এ গলি সে গলি ঘুরে অবশেষে ফারদিনান্দ এভেনিউতে উঠে এল।
রাতের রাস্তা, গাড়ি চলাচল অপেক্ষাকৃত কম। তীব্র গতিতে ছুটছে আহমদ মুসার গাড়ি। সারাদিন পর মনে পড়ল মারিয়ার কথা, ফিলিপের কথা। নিশ্চয় ওরা উদ্বেগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফিলিপ নিশ্চয় তাঁর খোঁজে এদিকে এসেছে। সে তো বসে থাকার ছেলে নয়। মারিয়া যে তাকে একা আসতে না দেবার জেদ ধরেছিল, তাও মনে পড়ল আহমদ মুসার। মারিয়ার সে আশংকাই সত্য হল। নিশ্চয় মারিয়া অনেক কথা বলবে। কেন বলবে? কেন তাকে নিয়ে মারিয়ার এত আশংকা? একথা ভাবতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। ভুল পথে চলেছে মারিয়া। এ ভুল পথ থেকে মারিয়াকে ফেরাতে হবে। ভোরে মারিয়াকে ঐ ভাবে শক্ত কথা বলা যদিও খারাপ হয়েছে, মারিয়া এতে নিশ্চিত কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু মারিয়াকে শোধরাতে হলে এমন কঠোরতার প্রয়াজন আছে। আহমদ মুসার মন থেকে তৎক্ষণাৎ কে যেন বলে উঠল, মারিয়াকে এই কষ্ট দেয়া হবে, তাঁর অপরাধ কি? মারিয়ার যে বিষয়কে ভুল বলা হচ্ছে, তাঁর জন্য মারিয়া কতটুকু দায়ী ? আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ এর কোন জবাব দিতে পারলনা। মারিয়া ভুল পথে চলছে বলা যায়, কিন্তু তাকে তো অপরাধী বলা যায় না। মেইলিগুলিকে তো আমি অপরাধী বলিনি বরং তাকে তো আপন করে নিয়েছি। আর মারিয়া যে ভুল পথে চলছে, তাঁর জন্য ও মারিয়া তো প্রকৃত পক্ষে দায়ী নয়, সে পরিস্থিতির শিকার। আমার সাথে তাঁর দেখা, তাঁর পরিচয়, তাঁর আলাপ কোনটাই তাঁর সৃষ্ট নয়, আর আমিও এর জন্য দায়ী নই। আমিও ছিলাম অবস্থার শিকার, যে জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়েছেন তাঁর নির্দেশে আমি কাজ করছি। আমি জ্ঞানত কোন সীমা লঙ্ঘন করিনি। আবার কে যেন অন্তর থেকে বলে উঠল, মারিয়া কোন অন্যায় না করার পরও মারিয়ার প্রতি তুমি কঠোর হয়েছ এবং তাকে ভুল পথে চলার কথা বলছ তোমার স্বার্থ সামনে রেখেই। আসল কথা হল, মেইলিগুলিকে যা দিয়েছ, তাঁর অংশ তুমি কাওকে দিতে চাও না। এই কথায় আহমদ মুসা নিজেকে খুব দুর্বল অনুভব করল, তাঁর চিন্তা ঝাপসা হয়ে এল। বলল সে, আমি যা পারিনা তা না পারা কি অন্যায় ?
এই সময় আহমদ মুসার গাড়ি এসে মারিয়াদের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল তাঁর।
হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। গেট খোলার কৌশল সে জানে। বাইরে থেকে সুইচ টিপে গেট খোলা যায়, আবার সুইচ টিপে বন্ধ করা যায়।
একটি বিশেষ স্থান দিয়ে হাত দিয়ে সুইচ টিপল। খুলে গেল দরজা। গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
দরজা খোলাই থাকল। মনে করল, পরে এসে বন্ধ করে দিয়ে যাবে।
আহমদ মুসার গাড়ী, গাড়ী বারান্দায় প্রবেশের আগেই ফিলিপকে ছুটে আসতে দেখল।
গাড়ী বারান্দায় প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ী।
গাড়ী দাঁড়াতেই পাশে পাশে ছুটে আসা ফিলিপ গাড়ীর দরজা খুলে ফেলল।
বলল, ‘মুসাভাই আপনি ভাল আছেন তো?’
আহমদ মুসা গাড়ী থেকে নামতে নামতে বলল, ‘ভাল আছি ফিলিপ। তোমাদের সব ভালতো?’
গাড়ী থেকে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল মারিয়াকে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার শান্ত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
‘সব ভাল, তবে মারিয়া আজ সারাদিন এই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।’ বলল ফিলিপ।
‘ভাইয়া তুমি সত্য বলছ না।’ প্রতিবাদ করল মারিয়া।
‘ঠিক আছে, খাবার জন্যে একবার ‌ওপরে উঠে গিয়েছিলি, তারপর দরজা থেকে মাঝে মাঝে গিয়ে ড্রইংরুমে বসেছিস, হলো তো? সত্য কথাই বললাম।’
মারিয়া আর কিছু বলল না।
ফিলিপ আহমদ মুসার একটা হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে চলল। মারিয়া আগেই ঢুকে গিয়েছিল ড্রইং রুমে।
আহমদ মুসার বাম ভ্রুর ওপর রক্ত শুকিয়ে থাকা ক্ষতচিহ্ন এবং মুখে শুকিয়ে থাকা রক্ত প্রথম দেখতে পেল মারিয়া। দেখেই বলে উঠল, ‘ভাইয়া তুমি দেখ, উনি আহত।’ আর্তনাদের মত শোনাল মারিয়ার কন্ঠ।
শুনেই ফিলিপ মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ইস্ খুশিতে এদিকে খেয়ালই হয়নি। কপালটা সাংঘাতিক ফেটে গেছে। আসুন।’
বলে টেনে আহমদ মুসাকে ড্রইংরুমের শোফায় নিয়ে বসাল।
ক্ষতটা পরীক্ষা করে ফিলিপ বলল, মারিয়া তুই যা ফাষ্টএইড বক্স নিয়ে আয়, একটু পরে ডাক্তার ডাকব।
মারিয়া এক দৌঁড়ে ওপরে উঠে গেল।
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে এল মারিয়া, এক হাতে ফাষ্ট এইড বক্স, অন্য হাতে একটা পাত্র, তাতে পানি।
সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরের দরজা বরাবর এসে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে উঠল মারিয়া। মরিয়া দেখল গাড়ী বারান্দা থেকে শিকারী বিড়ালের মত পা টিপে টিপে দরজার দিকে উঠে আসছে একজন লোক। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।
আহমদ মুসা সোফায় বসেছিল। পাশের সোফায় বসে ফিলিপ মারিয়ার অপেক্ষা করছিল, আর কথা বলছিল আহমদ মুসার সাথে।
মারিয়ার চিৎকারে দু’জনই চমকে উঠে মারিয়ার দিকে চোখ ফেরাল। তারপর তাদের চোখ গিয়ে পড়ল দরজার ওপর। দরজায় উদ্যত রিভলভার হাতে দাঁড়ানো একজন লোক। ফেল্টহ্যাটে কপালটা ঢাকা থাকলেও জুবি জুরিটাকে চিনতে আহমদ মুসার অসুবিধা হলোনা।
দরজায় রিভলভার হাতে লোক দেখেই ফিলিপ বিদ্যুত গতিতে তার রিভলভার বের করল।
ফিলিপের হাতে রিভলভার উঠতে দেখে জুবি জুরিটার রিভলভার ধরা হাতটি একটু নড়ে স্থির হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না মারিয়ার। সে হাত থেকে ফাষ্টএইড বক্স ও পানির পাত্র ছেড়ে দিয়ে পাগলের মত ছুটে গিয়ে আহমদ মুসাকে আড়াল করে দাঁড়াল। আর ঠিক সে সময়েই জুবি জুরিটার রিভলভার অগ্নি উৎগিরণ করল। গুলি গিয়ে বিদ্ধ হলো মারিয়ার বুকে। মারিয়া বুক চেপে ধরে উল্টে পড়ে গেল ঠিক আহমদ মুসার পায়ের ওপর।
জুবি জুরিটার রিভলভার গর্জন করার সাথে সাথেই ফিলিপের রিভলভার গর্জন করে উঠল। ফিলিপের গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল জুবি জুরিটার বুক। জুবি জুরিটাও উল্টে পড়ে গেল দরজার ওপর।
ফিলিপ গুলি করার পরই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মুসা ভাই আপনি মারিয়াকে দেখুন। আমি বাইরেটা একটু দেখি, আরও কেউ থাকতে পারে।’
ফিলিপ ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা সোফা থেকে নেমে মারিয়ার মাথা তুলে নিল। মারিয়ার চোখ তখন বোজা।
‘মারিয়া, মারিয়া।’ আহমদ মুসা ডাকল।
মারিয়া চোখ খুলল। তার চোখে আতংক নেই, সেখানে একটা প্রশান্তি।
ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি ভাল আছেন, আপনার গুলি লাগেনিতো?’
‘তুমি এ কি করলে, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে…?’
কথা শেষ করতে পারলনা আহমদ মুসা। তার বাক রুদ্ধ হয়ে গেল।
ওপর থেকে সুমানো ও অন্যান্যরা এবং বাইরে থেকে ফিলিপ এসে মারিয়ার পাশে বসল। আতংক, উদ্বেগ, আকষ্মিকতায় কথা বলতেও সবাই যেন ভুলে গেছে।
মারিয়া তখন আহমদ মুসাকে বলছিল, ‘এমন সুখের মৃত্যু, এমন তৃপ্তির মৃত্যু পৃথিবীতে কদাচিৎ দু’একজনের ভাগ্যে জোটে জনাব।’
মারিয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। আহমদ মুসা দ্রুত ফিলিপকে বলল, ‘চল একে হাসপাতালে নিতে হবে।’
ফিলিপ উঠে দাঁড়াল।
মারিয়া আবার চোখ খুলল। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘ভাইয়া তুমি আমার পাশে বস। আমার সময় বেশী নেই।’
কেঁদে উঠল ফিলিপ।
কেঁদে উঠল সবাই, আহমদ মুসা ছাড়া।
বসল ফিলিপ মারিয়ার পাশে। বলল, ‘এ কি হলো বোন তোর?’
মারিয়া চোখ টেনে টেনে ফিলিপের দিকে তাকাল, বাম হাতটা তুলতে চেষ্টা করল, পারলনা। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘ভাইয়া তুমি সব সময় তোমার আদরের বোনের সুখ দেখতে চেয়েছ না? আজ আমার চেয়ে সুখি আর কেউ নেই। সমগ্র দুনিয়া তুমি দিলেও এত সুখ আমাকে দিতে পারতে না। তুমি হাস ভাইয়া, তোমার হাসি দেখে যেতে চাই।’
কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল ফিলিপ।
মারিয়া তার মুখের কাছে বসা সুমানোর দিকে চোখ তুলে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘দেখ সুমানো আমি আর কাঁদছিনা, হাসছি তাই তোমার প্রশ্নের জবাবের আর কোন প্রয়োজন নেই।’ আরও ক্ষীণ হয়ে উঠল মারিয়ার কন্ঠ।
তখনও আহমদ মুসার কোলে মারিয়ার মাথা।
মারিয়া চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। টেনে টেনে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘মুসলমান কি ভাবে হতে হয়?’
“এক আল্লাহকে স্বীকার করা এবং মুহাম্মদ (সঃ) কে শেষ রসূল হিসেবে মেনে নেয়া।’
‘আমি স্বীকার করছি আল্লাহ এক, মুহাম্মদ তার রসূল।’ ক্ষীণ কন্ঠে কাঁপা গলায় বলল মারিয়া।
এতক্ষণে আহমদ মুসার দু’চোখ থেকে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু। বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দিব মারিয়া শেষ বিচারের সেই দিনে, তুমি আল্লাহর সত্য দ্বীন গ্রহণ করেছ।’
আবার ঠোঁট নড়ে উঠল মারিয়ার। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘সেখানে আপনার সাথে দেখা হবে কি আমার?’
‘আশা করা যায়।’ কাঁপা গলায় বলল আহমদ মুসা।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিয়ার। প্রশান্তিতে চোখ বুজল। আবার চোখ খুলল মারিয়া। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল-
‘আমার পক্ষ থেকে মেইলিগুলি আপাকে একটা কথা বলবেন?’ আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ অনুনয় জানাল মারিয়া।
‘বল, কি কথা?’
‘বলবেন, আমি খুব ভালোবেসেছি তাঁকে, জগতের মধ্যে সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী তিনি।’
আহমদ মুসার চোখের অশ্রু আবার সজীব হয়ে উঠল। বলল, ‘বলব।’
একটু থেমে, একটা ঢোক গিলে আহমদ মুসা বলল, ‘আমাকে তুমি মাফ করে দিও মারিয়া, আমি তোমার প্রতি কঠোর হয়েছিলাম।’
‘না কঠোরতা নয়, আপনি ঠিক করেছিলেন। এ না করলে অন্যায় দাবির কাছে পরাজিতের মত আপনি সাধারণ হয়ে যেতেন। তাহলে আজকের জগতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিকে ভালোবাসার বুক ভরা গৌরব নিয়ে আমি মরতে পারতাম না।’
মারিয়ার শেষ কথা গুলো টেনে টেনে বেরিয়ে এল, ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। সেই সাথে চোখ বুজে গেল তার। যেন গভীর এক প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। যে ঘুম কোনদিন ভাঙবেনা।
আহমদ মুসা ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে মাথাটা অতি আস্তে নামিয়ে রাখল কার্পেটে।
ফিলিপ, সুমানো কেঁদে উঠে আছড়ে পড়ল মারিয়ার দেহের ওপর।
সুমানো চিৎকার করে বলল, আজ দুপুরে বলেছিলাম, জীবন থেকে তুই পালাতে পারবিনা। কিন্তু একদিনও তুই পার হতে দিলিনা। পালিয়ে গেলি এমন করে।
ফিলিপ শান্ত হলে আহমদ মুসা বলল, ‘ফিলিপ আমি যখন ওদের অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসি, কোন গাড়ী অবশ্যই আমাকে ফলো করেনি। তাহলে জুবি জুরিটা এখানে এল কি করে?’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, চলো তো গাড়ীটা একটু পরীক্ষা করি, আমার মনে হচ্ছে ওরা গাড়ীতে কোন ফাঁদ পেতে রেখেছিল।’
আহমদ মুসা ও ফিলিপ গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ীর ভেতর বাহির তন্ন তন্ন করে খুজে দেখল। পেল তারা। গাড়ীর নিচে চেসিসের সাথে টেপ দিয়ে বাঁধা একটি স্বয়ংক্রিয় অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার। সেটাই সংকেত দিয়ে ডেকে এনেছে জুবি জুরিটাকে।
অয়্যারলেসটাকে গাড়ী থেকে খুলে নিয়ে আহমদ মুসা ওটা বন্ধ করে দিল। বলল, গাড়ীটা যথাস্থানে থাকাটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন এ নিয়ে ভাবার খেয়ালও হয়নি, সুযোগও ছিলনা। আসলে জুবি জুরিটা আমাদের ঠিকানা চিহ্নিত করার জন্যেই গাড়ীতে অয়্যারলেস পেতে রেখেছিল। সে নিশ্চিত ছিল আমার খোঁজে কেউ না কেউ যাবে এবং গাড়িটা পেয়ে গেলে নিয়ে আসবে। এ থেকে আরও একটা জিনিস বুঝা যায়, শুধু আমাকে নয়, আমার সাথে আরও যারা আছে তাদেরকেও তারা খুঁজে পেতে চায়।’
‘কিন্তু জুবি জুরিটা একা এল কেন, আরও কেউ এখানে আসবে বলে মনে করেন?’ চিন্তিত কন্ঠে বলল ফিলিপ।
‘আমার মনে হয় জুবি জুরিটা প্রস্তুতি ছাড়াই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে, খবর পেয়ে সম্ভবতঃ অফিস থেকে আসেনি। একারণেই তার সাথে কেউ আসতে পারেনি। আর তার এ মিশনের খবর অফিস অবশ্যই জানেনা। জানলে এতক্ষণ একটা দল এসে পড়ত। আর অয়্যারলেসের সংকেতের ব্যাপারটা মনে হয় জুবি জুরিটাই জানত শুধু। সুতরাং আর কেউ এখানে আসবে বলে মনে করিনা।’
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘জুবি জুরিটার লাশটা সরিয়ে ফেলতে হবে। চল ওকে ওর হেডকোয়ার্টারের সামনেই রেখে আসি।’
‘ঠিক বলেছেন।’ বলে উঠল ফিলিপ।
জুবি জুরিটার লাশ রেখে যখন আহমদ মুসা ও ফিলিপ ফিরে এল, তখন রাত এগারটা। এসে দেখল, যিয়াদ বিন তারিক তার লোকজন সহ এসে গেছে। পরিকল্পনা ছিল রাত ১২টায় ভাসকুয়েজের হেডকোয়ার্টারে তারা যাবে, রাত তিনটায় তারা হানা দেবে। ফিলিপের লোকরা আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১২টার পর ওখানে জমায়েত হবে। আহমদ মুসার মুক্তি ও জুবি জুরিটার নিহত হওয়া যিয়াদের যে আনন্দ দিতে পারতো, মারিয়ার মৃত্যু তা হতে দিল না। সবাই বিষন্ন।
সবাই গোল হয়ে বসেছিল ড্রইংরুমে।
ফিলিপ বলল, ‘মারিয়ার সৎকার কিভাবে হবে মুসা ভাই, সে তো মুসলমান হয়েছে।’
‘তুমি আপত্তি না করলে মুসলিম হিসেবে তার দাফন হওয়া উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপত্তির প্রশ্নই ওঠেনা, মারিয়ার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’
‘কিন্তু মারিয়ার কবর কিভাবে হবে। স্পেনে তো প্রকাশ্যে এটা হতে পারেনা, মাদ্রিদে তো নয়ই।’
‘কিছু ভাববেন না মুসা ভাই, মারিয়া আমার এবং আমার পরিবারের সবচেয়ে আদরের। ওর কবর লা গ্রীনজায় আমার বাড়ীতে হবে। ও যাতে সব সময় আমার চোখের সামনে থাকে।’
অশ্রু গড়িয়ে এল ফিলিপের চোখ থেকে।
ফিলিপ কথা শেষ করেনি, বলছিল, ‘জেরামা হ্রদের তীরে লা গ্রীনজা পার্বত্য নগরীকে মারিয়া অত্যন্ত ভালবাসত। সবচেয়ে ভালোবাসত লা-গ্রীনজার আমাদের বাড়ীটাকে। মারিয়া ওখানেই ঘুমিয়ে থাকবে।’
‘ধন্যবাদ ফিলিপ, কিন্তু খৃষ্টান বাড়ীতে মুসলিম কবর নিয়ে কেউ কথা তুলবেনা তো?’
হাসল ফিলিপ। হাসিটা কান্নার মত। বলল, ‘মারিয়া আমার আদরের বোন, চিন্তার সাথীও। কেউ আমরা কোন কথা গোপন করতাম না। আমার মনের কথাই মারিয়া আমার আগে বলে গেছে। আমার আর মারিয়ার পথ আলাদা নয়।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ফিলিপকে। বলল, ‘বলনি তো এতদিন ফিলিপ।’
‘মারিয়ার নিষেধ ছিল। ও বলেছিল একটা উপযুক্ত সময়ে দু’ভাই বোন মিলে আপনাকে ‘সারপ্রাইজ’ দেয়া হবে।’
‘সে কথা রেখেছে ফিলিপ।’ আহমদ মুসার কন্ঠ খুব ভারি শোনাল।
এই সময় ফিলিপের সহকারী আবদুর রহমান এবং বাস্ক গেরিলাদের অন্য কয়েকজন নেতা প্রবেশ করল ড্রইং রুমে।
ফিলিপ আহমদ মুসার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবদুর রহমানকে প্রশ্ন করল, লা –গ্রীনজায় যাত্রার সব রেডি হয়েছে কি না।
আবদুর রহমান মাথা নেড়ে বলল, ‘সব রেডি।’
ফিলিপ আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি হুকুম দিন ভাইয়া, আমরা যাত্রা করি।’
‘চল’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই উঠে দাঁড়াল।

Top