১৪. গোয়াদেলকুইভারে নতুন স্রোত

চ্যাপ্টার

মাদ্রিদের সেন্টপল গীর্জার দক্ষিণ পাশের বাগান। বাগানের একদম দক্ষিণ পাশে একটা গোলাপ ঝোপের আড়ালে একটা বেঞ্চিতে একা বসে আছে জেন। নির্জন এবং অন্ধকার জায়গাটা।
সূর্য ডুবে মাত্র অল্পক্ষণই হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনেক রাত। চারদিকের গাছপালা এবং ঝোপঝাড়ই সেখানে বাড়তি অন্ধকার সৃষ্টি করেছে।
অন্ধকারে জেনকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কাল স্কার্টের ওপর কাল কোট পরেছে জেন। অন্ধকারের মধ্যে গোটা দেহটাই তার হারিয়ে গেছে শুধু শ্বেত স্বর্ণাভ মুখটি ছাড়া। কিন্তু মুখটি তার বড় বিষন্ন। ঠোঁট তার শুকনো। চোখ থেকে রাজ্যের উদ্বেগ যেন ঠিকরে পড়ছে।
মাদ্রিদের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় গীর্জা সেন্ট পল। গীর্জার চারদিক ঘেরা বিশাল বাগান। বাগানটাকে পার্ক বলাই ভালো। বাগানের মধ্যে জালের মত বিছানো রাস্তা। মাঝে মাঝে বেঞ্চি। বাগানে বেড়ানো যায়,বিশ্রাম করা যায়। যারা গীর্জায় প্রার্থনার জন্যে আসেন, যারা গীর্জার সান্নিধ্যে সময় কাটাতে চান কিংবা যারা দেখতে আসেন গীর্জা, তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা। গীর্জার গেট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সবার জন্যে খোলা থাকে এই বাগান। গীর্জার বাগান, তাই বোধহয় লোকজন সব সময় কম থাকে, একমাত্র রোববার ছাড়া।
সন্ধ্যার পর বাগানে সেদিন লোকজন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে গীর্জার পেছনের অংশ-দক্ষিণ অংশে কেউ নেই একমাত্র জেন ছাড়া।
জেন বেঞ্চি থেকে মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করছে। আর বেঞ্চির পাশ দিয়ে উত্তরে এগিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকাচ্ছে বার বার।
জেন অপেক্ষা করছে জোয়ানের।
ইতালির ট্রিয়েস্ত থেকে আসার পর জেন-জোয়ানের মধ্যে আর দেখা হয়নি। জোয়ানের দেখা করতে আসার তো প্রশ্নই ওঠে না, জেনও ভয়ে জোয়ানের ওদিকে পা তুলতে পারেনি। ইতালি থেকে আসার পর জেন ভয়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়েছে। তার উদ্বেগ জোয়ানের নিরাপত্তা নিয়ে, দুশ্চিন্তা জোয়ানদের ভবিষ্যত নিয়ে।
হান্নার মাধ্যমে জোয়ানের এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছে জেন। জায়গাটা জেনেরই সিলেকশন।
পায়চারি থামিয়ে হঠাৎ রাস্তার ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াল জেন। গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ের পাশ গলিয়ে একটা ছায়ামূর্তি এদিকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্ত খানেক ওদিকে চেয়ে জেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, জোয়ান আসছে।
জোয়ান এলো।
জেন দু’ধাপ সামনে এগিয়ে জোয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘উঃ এলে! পথ চেয়ে অপেক্ষা করা যে কত কঠিন।’
জেনের সাথে হ্যান্ডশেক না করে জোয়ান বলল, ‘মাফ কর জেন, আমি এখন শুধু জোয়ান নই, মুসা আবদুল্লাহ। আমি মেয়েদের সাথে হ্যান্ডশেক করিনা এবং পারতপক্ষে মেয়েদের সাথে আগের মত মেলামেশাও করি না।’
‘মাফ কর জোয়ান, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ বলল জেন।
‘এস বসি’ বলে জেন গিয়ে বেঞ্চিতে বসল।
জোয়ান গিয়ে বসল তার পাশে।
‘অনেকক্ষণ থেকে বুঝি অপেক্ষা করছ তুমি? কষ্ট পেয়েছ না?’
‘এমন কষ্টের সুযোগ যদি প্রতিদিন পেতাম!’ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল জেন।
‘কেমন আছ?’ জোয়ান বলল।
‘কেমন আছি বলে তুমি মনে কর?’
জোয়ান তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
‘জেন?’ মুহূর্ত কয়েক পরে ডাকল জোয়ান।
‘বল’।
‘তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সুযোগ আমার হয়নি’।
‘কিসের কৃতজ্ঞতা?’
‘তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ।’
‘তুমি একথা বলতে পার? তুমি না মুসলমান? জীবন মৃত্যু কি এককভাবে স্রষ্টা-আল্লাহর হাতে নয়?’
‘ঠিক বলেছ জেন, কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে যে অবিশ্বাস্য কাজ তুমি করেছ………।’ কথা শেষ না করে থেমে গেল জোয়ান। তার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠল।
‘বড় কিছু কি করেছি? তুমি হলে আমার জন্যে এটা করতে না?’
জবাব দিলনা জোয়ান। একটু নিরব থেকে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে আমার খুব ভাবনা হয় জেন?’
‘কি ভাবনা?’
‘চরম বিপদগ্রস্ত এবং অনিশ্চিত একটা জীবনের সাথে তুমি নিজেকে জড়িয়েছ।’
‘হান্নাও একথা আমাকে বলে। কিন্তু আমার কি করার ছিল। তুমি ছিলে আমার চির প্রতিদ্বন্দ্বি। কিন্তু আমি কি জানতাম অজান্তে প্রতিদ্বন্দ্বির কাছে আমার সবকিছু হারিয়ে বসে আছি। যখন তোমার বিপদ এল, আমার অজানার অর্গল ভেঙে গেল। তারপর প্রবল স্রোতের এক ঘূর্ণি আমার জীবনকে মিশিয়ে দিল তোমার জীবনের সাথে।’ ভারী গলায় বলল জেন।
‘কিন্তু এর পরিণতি কি?’
‘পরিণতির চিন্তা আমি করিনা। ওটা আল্লাহর কাজ। আমি শুধু জানি, আমি কোন অন্যায় করিনি, কোন পাপ চিন্তাও কোনদিন আমার মধ্যে জাগেনি।’ আবেগ কম্পিত কন্ঠে বলল জেন।
জোয়ান কোন কথা বলল না।
জেন একটু থেকে আবার শুরু করল, ‘কেন তোমাকে ডেকেছি জান?’
‘জানি না’।
‘একটা অনুরোধ করার জন্যে’।
‘কি অনুরোধ?’
̒’আমার প্রথম অনুরোধ তুমি প্রকাশ্যে চলাফেরা করো না, দ্বিতীয় অনুরোধ, তুমি আপাতত মাদ্রিদ থেকে দূরে কোথাও সরে থাক।’
‘কেন?’
‘কেন বলছি তুমি জান। ট্রিয়েষ্টের হত্যাকান্ডের জন্যে, যাবতীয় তৎপরতার জন্য তোমাকে মধ্যমনি ভাবা হচ্ছে। সেই থেকে ওরা তোমার উপর ভীষন ক্ষেপে আছে। এই সেদিন কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান অফিসে আহমদ মুসার হানা এবং কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অপারেশন কমান্ডার জুবিজুরিটার হত্যাকান্ডের জন্য তোমাকে কেন্দ্রবিন্দু ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আহমদ মুসা যদিও তাদের এক নাম্বার টার্গেট, তবু তুমি এদেশীয় বলে তোমার উপর রাগ তাদের শতগুণ বেশী। যেমন করেই হোক তোমাকে ওরা ধরবে। অতএব তোমাকে সরে থাকতেই হবে।’
‘জেন তুমি বল, মুসা ভাই ও অন্যান্যদের মাঠে রেখে আমি জীবনের ভয়ে সরে থাকতে পারি?’
‘জানি আমি-তুমি একথা বলবে। কিন্তু আমার কথা হলো, তুমি একাজের লোক নও, তুমি বিজ্ঞানী, তুমি ভিন্ন জগতের মানুষ।’
‘জোয়ান বিজ্ঞানী কিন্তু মুসা আবদুল্লাহ বিজ্ঞানী নয়।’
‘তুমি তর্ক করবে জানি। কিন্তু আবার বলছি তোমাকে ছোটবেলা থেকে আমি জানি। তুমি মারামারি করা ও গোলাগুলি চালানোর লোক নও।
‘হতে পারিনা? জেন তুমি জাননা, একজন মুসলমানকে একই সাথে গৃহী, পুলিশ ও সৈনিকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। একজন মুসলমান যেমন সার্বক্ষণিক গৃহী, তেমনি সার্বক্ষণিক পুলিশ এবং সৈনিকও।’
‘জোয়ান সবাই কি এক ফ্রণ্টে কাজ করে, কাজের বিভাগ কি থাকে না?’
‘থাকতে পারে কিন্তু সে কার্য বিভাগের দায়িত্ব তো আমার নয়।’
‘যদি এ বিষয়টা আমি আহমদ মুসা ভাইকে বলি ?’
‘বলার আগে জেন তুমি কি আমার দিকটা চিন্তা করবেনা, শুধু মাত্র জীবন বাঁচানোর জন্যে সংগ্রামের ক্ষেত্র থেকে আমি চলে যেতে পারি? তুমি কি চলে যেতে পারতে?’
‘জেন কোন উত্তর দিল না। কিন্তু চোখ ফেটে কান্না এলো। একটু পরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, তোমার কি বিপদ তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। ওদের কাছে তোমার ব্যাপারটা অন্যদের থেকে আলাদা।’
‘জানি জেন। তোমার কথা আমি বুঝেছি। তোমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছিনা তাও না। কিন্তু ওঁদের রেখে যে আমি যেতে পারি না। তুমি জান আমার জাতির ওপর কতবড় বিপদ। ওরা সকল মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ও সম্পদ ধ্বংসের জন্য গোপনে মাটির তলায় তেজস্ক্রিয় স্থাপন করেছে। এর ফলে মুসলিম ঐতিহাসিক স্থান ও কেন্দ্রগুলো আপনাতেই ধ্বসে পড়ার এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মুসলমানরাও ঐ তেজস্ক্রিয়ের প্রভাবে চিরতরে পঙ্গু,তারপর ধ্বংস হয়ে যাবে। এ তেজস্ক্রিয়ের কোন প্রতিষেধক নেই। একমাত্র উপায় ঐ তেজস্ক্রিয় গুলো তুলে ফেলা। কিন্তু তেজস্ক্রিয় গুলো ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়। সুতরাং তেজস্ক্রিয় স্থাপনের যে প্ল্যান ও মানচিত্র কু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের কাছে আছে তা উদ্বার করা গেলেই শুধু তেজস্ক্রিয় গুলো তুলে ফেলা যাবে। ট্রিয়েষ্ট থেকে ফিরে আহমেদ মুসা পাগলের মত খুঁজে ফিরছে সেই প্ল্যান ও মানচিত্র। সেদিন ভাসকুয়েজের অফিসে আহমদ মুসা হানা দিয়েছিল ঐ দু’টি দলিলের সন্ধানেই। তুমি জান সেই অভিযানে আহমদ মুসা ধরা পড়েছিল, আহত হয়েছিল এবং পরে মারিয়া জীবন দিয়েছে আহমদ মুসাকে রক্ষা করতে গিয়ে। যে গুলিটা আহমদ মুসার মাথা গুড়ো করত, সেই গুলি মারিয়ার বক্ষ বিদ্ধ করেছে। এই অবস্থায় বল জেন -তুমি চাইতে পার আমি কাপুরুষের মত মাঠ থেকে চলে যাই!’
জোয়ান কথা শেষ করার পরও জেন অনেকক্ষণ কথা বলল না। সব শুনে তার মুখ দিয়ে কথা সরছেনা। অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমাকে মাফ কর জোয়ান, এত কিছু আমি জানতাম না, এত বড় জঘন্য ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র তারা করছে। এ ষড়যন্ত্র মুসলমানের বিরুদ্বে নয়, স্পেনের স্বার্থের বিরুদ্ধেও।’
একটু থামল জেন, তারপর আবার শুরু করল, ‘তাহলে জোয়ান, আমার প্রথম অনুরোধের কথা বলছি, তুমি প্রকাশ্যে চলাফেরা করোনা। তুমি যদি ধরাই পড়ে যাও তাহলে কাজ করবে কি করে।’
‘গোপনেই তো এখন চলাফেরা করছি।’
‘আরেকটা অনুরোধ।’
‘কি?’
‘প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে না পারার কারণে তোমার যা করতে অসুবিধা হয়, সে দায়িত্ব তুমি আমাকে দেবে এবং আরও যা করা দরকার তা আমাকে নির্দশ দিবে।’
‘তুমি করবে?’ জোয়ানের চোখে মুখে আনন্দ।
‘কেন তোমার কাজ কি আমার কাজ নয়?’
‘যতখানি আমার কথা ভাব,তার একাংশ কি ভাব নিজের কথা?’
‘ভাবি বলেই তো এত সাবধানতা। কোথায় এসে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করি দেখনা। আমি ভাবেছিলাম কি জান, এই রাতে এই নির্জনে তুমি আসতেই চাইবে না।’
‘চাইতাম না তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘উঠতে বলছো?’
‘কেন উঠতে মন চাইছে না?’
‘তোমার চাইছে?’
‘আবার দেখা হবে?’
‘সেটা তোমার হাতে। আন্ডারগ্রাউন্ডে ঠেলে দিচ্ছ তো আমাকে।’
‘ঠিক আছে আমার হাতেই থাকল। কিন্তু কথা রইল তুমি প্রকাশ্যে কোথাও বেরুবে না।’
‘আহমদ মুসা ভাইয়ের জন্য কিছু বলবে না? জান ট্রিয়েষ্টে আমার রুমের দরজায় তুমি দু’জন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে আমাকে বাঁচালে, তখন মুসা ভাই বলেছিলেন, এ কাজ একমাত্র জেনই করতে পারে।’
‘কি করে উনি বললেন?’ জেনের চোখ ভরা বিস্ময়।
‘আমি জানি না, মনে হয় তার তৃতীয় একটা চোখ আছে, সেটা দিয়ে তিনি অদৃশ্য সবকিছু দেখতে পান।’
‘জোয়ান, আমরা তাঁকে যত বড় বলে মনে করি, তার চেয়েও তিনি বড়।’
‘সেই সাথে সকলের মত স্পর্শকাতর একটা মন তাঁর আছে।’
‘কেন একথা বলছ?’
‘মারিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর মনটা খুব ভারি দেখছি।’
‘স্বাভাবিক, মারিয়া তাঁর জন্যে জীবন দিয়েছে।’
‘আরও কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘না, থাক জেন, অহেতুক আলোচনা এখন এটা।’
‘মারিয়ার কথা বলতে চেয়েছিলে তো। আমি জানি মারিয়া একটা ভুল করেছিল। এই ভুল আহমদ মুসাকে কষ্ট দিয়েছে।’
‘তুমি জানলে কি করে?’
‘লা-গ্রীনজায় আমাদের পার্বত্য নিবাসটা ওদের পাশের টিলায়। ছোটবেলা থেকে ওর সাথে আমার পরিচয়। মাদ্রিদে এলে ও আমার সাথে দেখা করেই।’
‘তাহলে তো সব জানই। কিন্তু বলত মারিয়ার ভুল কি স্বাভাবিক ছিল না?’
‘ওদের পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল, সেখানে অস্বাভাবিকটাও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে তোমাদের ইসলামী মূল্যবোধে এতবড় ভুলের কোন সুযোগ নেই, সেখানে আবেগের সাথে অবগতিও একটা শর্ত।’
‘এ শর্ত কি তুমি আমার ক্ষেত্রে মেনেছিলে?’
‘পুরোপুরি জানতাম তোমাকে আমি।’
‘আমি মরিস্ক তা তো জানতে না।’
‘তুমিও জানতে না।’
‘যখন জানলে…?’
‘তখন আর করার কিছু ছিল না।’
‘কতকটা তোমার ভুলের মতই ছিল মারিয়ার ভুল।’
‘রাত অনেক হয়েছে। তোমার সাথে তর্ক করার এখন আর নেই। তবে সমগ্র অন্তর দিয়ে আমি কামনা করি, মারিয়ার মত অমন পরম মৃত্যুর সুযোগ যদি আমারও হতো।’ কন্ঠ ভারি শোনাল জেনের।
‘যাও বাজে বকো না। চল উঠি।’
‘বলে জোয়ান উঠে দাঁড়াল। তার সাথে জেনও।

জেনের আব্বা জেমেনিজ ডে সিসনারোসার লাইব্রেরী কক্ষ।
একটা বিশাল কক্ষের চারদিকে ঘোরানো র‌্যাকে ঠাসা বই। সব ধরনের বইয়ের একটি সুনির্ধারিত সংগ্রহ এ লাইব্রেরী।
জেন এবং জেনের আব্বা জেমেনিজ পাশাপাশি চেয়ারে বসে। জেনের সামনে খোলা বিজ্ঞান ম্যগাজিন ‘নিউ ফিজিক্স’-এর সর্বশেষ সংখ্যা, আর জেমেনিজ পড়ছে চলতি সপ্তাহের ‘টাইম ইন্টারন্যাশনাল’।
লাইব্রেরীটি এই কার্ডিনাল পরিবারের একটি মিলন কেন্দ্র। ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারের সবাই মোটামুটি পড়ুয়া। তারা ড্রইংরুমে বসে গাল-গল্পে সময় কাটানোর চাইতে লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তে ভালবাসে। এমনকি পারিবারিক গল্প-গুজব বেশিরভাগই তাদের লাইব্রেরীতে বসেই হয়।
জেমেনিজ ডে সিসনারোসা পড়তে পড়তে পত্রিকা থেকে মুখ তুলল। জেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এ সংখ্যা টাইম দেখেছ?’
‘না,আব্বা।’ বই থেকে মুখ তুলে বলল জেন।
‘ট্রিয়েষ্টের ঘটনার ওপর মজার একটা স্টোরি করেছে।’
‘ট্রিয়েষ্টের ঘটনার ওপর? কি লিখেছে?’ জেনের চেহারা ম্লান হয়ে উঠল।
‘স্টোরির দুইটা অংশ। প্রথম অংশে পুলিশ এবং গবেষণাকেন্দ্রের সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়োরিটিক্যাল ফিজিক্স’গবেষণা কেন্দ্রটি একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের অর্ডার পায়। যেদিন এ পরীক্ষণটি সম্পূর্ণ হয়, সেদিনই পরীক্ষণটি হারিয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেই পরীক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিহত হন এবং অন্যান্য হত্যাকান্ড ঘটে। পুলিশের মতে দুই পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই হত্যাকান্ড সমূহ ঘটেছে। পরীক্ষণের বিষয় কি ছিল তাও পুলিশ উদ্বার করতে পারেনি। কারণ স্যাম্পুল, পরীক্ষণ রেজাল্ট ও কম্পিউটার ডিস্ক সবই চুরি হয়ে যায়। মনে করা হচ্ছে, পরীক্ষণের সাথে সংশিস্নষ্ট বৈজ্ঞানিকের যোগসাজশেই চুরির ঘটনা ঘটে। প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি পক্ষ পরীক্ষণের ফল হাত করতে গিয়েই ঐ হত্যাকান্ড সমূহ সংঘটিত হয়। যারা পরীক্ষণের অর্ডার দিয়েছিল, তাদের ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের ঠিকানা যা গবেষণাকেন্দ্রে লিপিবদ্ব আছে তা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।
ষ্টোরির দ্বিতীয় অংশটাই মজার। অপ্রকাশযোগ্য বিশেষ সুত্রের বরাত দিয়ে এ অংশে বলা হয়েছে, ট্রিয়েষ্টে যা ঘটেছে তার গোড়া স্পেনে। স্পেন ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যমনি হিসাবে কাজ করছেন আহমদ মুসা। মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যায়ের কৃতি ছাত্র জোয়ান ফার্ডিন্যান্ড এবং স্পেনের মরিস্করা তার সহযোগী হিসাবে কাজ করছে।’
জেনের মনে ভয় ও শংকার চেয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো বেশী। এ ধরনের উল্টো ষ্টোরি টাইম ইন্টারন্যাশনালে’র মত একটা পত্রিকা করতে পারল। কারা ষড়যন্ত্র করছে, আর ষড়যন্ত্রের দায় চাপাচ্ছে কার ঘাড়ে।
জেন তার আব্বা বলা শেষ করলে বলল, ‘কিন্তু আব্বা তুমিও জান, আমিও জানি, জোয়ান একজন পিওর একাডেমিশিয়ান। ছোটবেলা থেকেই পড়া শুনার বাইরে আর কোন কিছুতে আগ্রহ নেই। দেশের বিরুদ্ধে সে কোন ষড়যন্ত্র করতে পারে তুমি বিশ্বাস কর?’
‘তুমি আগের জোয়ানের কথা বলছ মা। এখনকার জোয়ান আর আগের সেই জোয়ান এক নয়। নিজের মরিস্ক পরিচয় জানার পর সে ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে। মুসলমানদের তুমি জান না। সময় বদলায়, মুসলমানরা বদলায় না। মুসলমানরা তাদের ঈমান নষ্ট করে না।’
‘কিন্তু আব্বা স্পেনে মরিস্কদের পূর্ব পুরুষ মুসলমান ছিল। এখন মুসমানিত্বের কি অবশিষ্ট আছে তাদের? নামটাও তো নেই।’
‘বাইরে থেকে দেখলে এমনই মনে হয় মা। কিন্তু ওদের মনে উঁকি দিলে দেখবে, চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে ওরা মুসলমানই রয়ে গেছে।’
‘কেউ যদি মনে মনে তার বিশ্বাস লালন করতে চায়, তাহলে ক্ষতি কি? স্পেনে মরিস্করা কয়জন? ওরা যদি পুরোপুরি মুসলিম হিসাবেও জিন্দেগী যাপন করে, তাহলে কি আর ক্ষতি করতে পারবে স্পেনের?’
‘ইসলাম সংক্রামক ব্যাধি, আর মুসলমান সে ব্যাধির দক্ষ জীবানুবাহী। ওদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে অল্প দিনেই দেশের সকল মানুষকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বে।’
‘কি ভাবে?’
‘বললাম না ইসলাম সংক্রামক ব্যাধির মত। ওদের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে, তার ওপর স্পেনের সাধারণ লোকদের মধ্যে স্পেনের মুসলিম শাসনকালের প্রতি একটা বিরাট মোহ আছে। তারা মনে করে, স্পেন থেকে মুসলিম শাসন চলে যাবার পরই, স্পেন ইউরোপে তার নেতৃত্ব হারিয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সভ্যতা, কৃষি, বাণিজ্য সবদিক দিয়েই স্পেন পিছিয়ে গেছে। মুসলিম শাসন ছিল স্পেনের সৌভাগ্যের প্রতীক।’
‘কথাটা কি মিথ্যা? আব্বা?
‘মিথ্যা নয় বলেই তো মুসলমানদের নাম আমরা স্পেনে রাখতে চাই না।’
‘তাহলে বল দোষটা জোয়ানের ওপর চাপাচ্ছ কেন ষড়যন্ত্র তো তাহলে ওরা করছে না?’
‘না মা ষড়যন্ত্র ওরা করছে। না হলে আহমদ মুসা স্পেনে এসেছে কেন? তাঁর মত লোক, কোন বড় মিশন না নিয়ে কোথাও যায়না।’
‘কি ধরনের ষড়যন্ত্র তারা করছে বলে মনে কর আব্বা?’
‘ঐতো, তাদের মতলব কি, ষড়যন্ত্রের স্বরম্নপ কি, সেটারই তো আমরা সন্ধান করছি।’
‘ষড়যন্ত্রই যখন এখনও চিহ্নিত হয়নি, তখন ওদেরকে ষড়যন্ত্রকারী বলে ফেলা কি ঠিক আব্বা?’
‘অনেক ব্যাপার আছে, তুমি সব বুঝবে না।’
‘আব্বা, পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাস ভূলে গিয়ে দেশের মানুষ আমরা সবাই কি এক হতে পারি না? কেউ যদি দেশের আইনের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করে, তাকে দেশের হাতে সোপর্দ করতে পারি।’
‘তুমি ছোট, সব জান না। যেমন তুমি সরল, দুনিয়াটা তেমন সরল নয় মা!’
‘ঠিক এই সময়ই পাশের ইন্টারকম কথা বলে উঠল। রিসেপশন থেকে কথা বলছে। বলল, ‘মিঃ ভাসকুয়েজ এসেছেন।’
জেমেনিজ চট করে ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম ভাসকুয়েজ আসার কথা।’
তারপর জেমেনিজ রিসেপশনকে বলল, ‘লাইব্রেরীতে পাঠিযে দাও।’
আধ মিনিটের মধ্যেই ভাসকুয়েজ ‘শুভ বিকেল’ জানাল জেমেনিজকে।
‘শুভ বিকেল’ কেমন আছেন মিঃ ভাসকুয়েজ?’
জেনও উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল মিঃ ভাসকুয়েজকে।
জেমেনিজও উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ভাসকুয়েজের সাথে হ্যান্ডশেক করে জেমেনিজ ঘরের ওপাশে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, ‘চল আমরা ঘরের ওখানে বসি।’
জেমেনিজ ও ভাসকুয়েজ অল্প দূরে বিপরীত দিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।
লাইব্রেরী ঘরের পাশেই জেমেনিজের খাস বৈঠক খানা। সম্ভবত জেমেনিজ লাইব্রেরীতে বসেছিল বলে সেখান থেকে আর বেরুতে চাইল না।’
জেমেনিজ সামনের চেয়ারে আসন নেয়ার পর, ভাসকুয়েজ বাঁকা চোখে একবার জেনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুরু করল, ‘জরুরী একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি।’
ভাসকুয়েজকে নিয়ে তার আব্বাকে এ ঘরেই বসতে দেখে জেন অস্বাভাবিক বোধ করছিল। চলে যাবে কি না ভাবছিল, এই সময় ভাসকুয়েজের ‘জরুরী একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি’ কথাটা কানে গেল জেনের। জরুরী কথাটা কি? জোয়ানদের কথা নয়তো? জেন আগ্রহী হয়ে উঠল।
চোখটা ম্যাগাজিনের পাতায় নিবদ্ধ রেখে কানটাকে উৎকর্ণ রাখল জেন ভাসকুয়েজের দিকে।
‘জরুরী তাতো বুঝতেই পারছি।’ ভাসকুয়েজের কথার উত্তরে বলল জেমেনিজ।
একটু থেমে জেমেনিজই আবার প্রশ্ন করল, ‘জুবিজুরিটাকে কোথায় হত্যা করল জানা গেছে?’
‘না জানা যায় নি।’
‘জুবি জারিটার গড়ীর সন্ধান পাওয়া যায়নি?’
‘পাওয়া গেছে একটা নাইট ক্লাবের সামনে।’
‘গাড়ীতে জুবিজুরিটি ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ আছে?’
‘না।’
‘নাইট ক্লাব অর্থাৎ নারী ঘটিত কোন ব্যাপার নেইতো জুবিজুরিটার হত্যার পেছনে?’
‘না স্যার।’ প্রবল ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ভাসকুয়েজ। আরো বলল সে, ‘অফিস থেকে টেলিফোন পেয়ে সে বেরিয়েছে। অফিসকে সে জানিয়েছে, আমি ওকে ফলো করছি, পালাতে পারবে না। আমি তোমাদের জানাব। সুতরাং নির্ঘাত আহমদ মুসাকেই সে ফলো করেছিল।’
‘আছা বলত, ডেভিলের মত রোবটকে ফাঁকি দিয়ে আহমদ মুসা পালাল কি করে?’
‘সে ধড়িবাজের শিরোমনি স্যার, তার বুদ্ধির শেষ নেই।’
‘আচ্ছা শাহ ফয়সল মসজিদ কমপ্লেক্স পাহারা দিয়ে সব কটিকেই তো ধরা যায়।’
‘পাহারা বসিয়েছি কিন্তু কোন কাক পক্ষী ওদিকে যায়নি।’
‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুলের ব্যাপারটা ওদের কাছে ধরা পড়ল কি করে? অত্যন্ত সুপার সিক্রেট ব্যাপার ছিল এটা। কোনও ভাবে এটা ডিটেকটেবলও নয়। জানল কেমন করে ওরা?’ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তো?’
‘না স্যার সেরকম কিছু সম্ভব নয়। শীর্ষ পর্যায়ের আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেই জানে না। যে ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে আমরা তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল গুলো পেতেছি, সেও জানে না। সে জানত ওগুলো প্রত্নতাত্বিক গবেষনার কোন ব্যাপার। তাছাড়া সে ইঞ্জিনিয়ার বেঁচে নেই।’
‘তাহলে ওদের জানার রহস্য কি?’
‘স্যার আহমদ মুসা সব পারে, সে যাদু জানে।’
‘যাদু জানে বলছ কি তুমি?’
যাদুর মতই ব্যাপারটা স্যার। যুগোশস্লাভিয়া, ককেশাস ও মধ্য এশিয়া থেকে আমরা খবর নিয়েছি তার ভিন্ন একটা চোখ আছে। যা আমরা দেখি না, তাও সে দেখে।’
‘ভাসকুয়েজ আমি পড়েছি, সব খাঁটি মুসলমানরাই নাকি ওরকম। অনেক অলৈাকিক কাজ তারা করতে পারে। ওটাকে ওরা বলে আল্লাহর সাহায্য।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার, চরম বিপদের মধ্যেও তারা হাসতে পারে নাকি এই কারণেই। আমারও না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আহমদ মুসা বন্দী হলো কয়েকবার আমাদের হাতে। মৃত্যুর মুখোমুখি তাকে দাড়াতে হয়েছে। কিন্তু তাকে সামান্য চিন্তিত হতেও দেখা যায় নি।’
‘এখানেই তো আমাদের বিপদ ভাসকুয়েজ, সব মুসলমান যদি যদি খাঁটি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে জগতের কোন শক্তিই তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
‘এটা যাতে না ঘটে তারই তো চেষ্টা হচ্ছে স্যার সব জায়গায়। স্পেন থেকে ওদের আমরা নিশ্চি‎‎হ্ন করবই।’
‘এখন বল তোমার নিশ্চি‎হ্ন করার কাজ কতদূর? তোমার আজকের জরুরী বিষয়টা কি?’
‘বলছি স্যার’ শুরু করল ভাসকুয়েজ, ‘স্যার ওরা হন্যে হয়ে খুজছে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল স্থাপনের প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম। আহমদ মুসা সেদিন আমার অফিসে হানা দিয়েছিল এর খোঁজে।’
‘তাই কি করে বুঝলে?’ চোখ দুটি বড় করে নড়ে চড়ে বসে প্রশ্ন করল জেমেনিজ।
‘কম্পিউটার পরীক্ষা করে জানা গেছে। কম্পিউটারের সাবজেক্ট ফাইল থেকে সে ঐ সংক্রান্ত ফাইলটিই বের করেছে।’
কি করে জানলো অমন ফাইল ওখানে আছে?
‘বলেছি না স্যার আহমদ মুসা বাতাস থেকে গন্ধ পায়!’
‘কিন্তু ভাসকুয়েজ, এবার সে বাতাস থেকে গন্ধ পায়নি। এবার সে ব্যর্থ হয়েছে।’
‘একেবারে ব্যর্থ সে হয়নি। কম্প্যুটারের সে ফাইলে তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল স্থাপনের প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম ছিল না বটে, কিন্তু কোথায় থাকতে পারে তার একটা ক্লু সে পেয়ে গেছে। এই বিষয়টাই আমি আপনাকে জানাতে এসেছি স্যার।’
‘কি বলছ তুমি?’
‘জি স্যার, ফাইলে বলা আছে ‘ডকুমেন্ট ‘Elder’ এর কাছে নিরাপদ।’
‘Elder’ থেকে তারা কি বুঝবে’
‘কি বুঝবে বলা মুশকিল, তবে ‘Elder’ এর সন্ধান তারা করবে এটা নিশ্চিত।’
‘আমাদের করণীয় সম্পর্কে কি বলতে চাচ্ছ?’
‘আপনার এখন সাবধান হওয়া দরকার।’
‘কেমন সাবধান, চলা পেরার ব্যাপারে?’
‘সেটা বোধহয় দরকার হবে না। একটা প্রশংসা ওদের করতে হয়। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হলে শত্রকে ওরা চোরাগোপ্তা হামলা করে না।’
‘তাহলে কি সাবধানের কথা বলছ?’
‘আপনার বাসার নিরাপত্তার কথা ভাবছি, এখানে পাহারার জন্যে লোক বসাব কিনা চিন্তা করছি।’
‘ও বুঝেছি ঐ কারণে।’ বলে একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার শুরু করল, ‘তার চেয়ে ভাসকুয়েজ ডকুমেন্টটা আমার বাসা থেকে সরিয়ে নাও না’।
ম্যাগাজিনে জেনের চোখটা আটকা থাকলেও সমস্ত মনযোগ একত্রিত করে উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল তাঁর আব্বার সাথে ভাসকুয়েজের আলাপ। ‘ডকুমেন্টটা আমার বাসা থেকে সরিয়ে নাও না’ কথাটা জেনের কানে পৌছাতেই বিদ্যুত চমকিত হলো তার শরীর। যে ডকুমেন্টটা আহমদ সুসা জোয়ানরা পাগলের মত খুঁজছে সেটা তাদের বাসায়। আনন্দ উত্তেজনা- শংকায় জেনের বুকে যেন কাঁপন ধরে গেল। কিন্তু কান সে পেতে রাখল সেই কথোপকথনের দিকে।
‘কোথায় নেব, অফিস আর নিরাপদ নয়। আমাদের বাসা তো ওদের শ্যোন দৃষ্টির মধ্যে।’ জেমেনিজের প্রস্তাবের উত্তরে বলল ভাসকুয়েজ।
‘ওগুলোর কাজ তো শেষ। এখন পুড়িয়ে ফেললে হয় না ওগুলো?’
‘না, স্যার ওগুলোর সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। টার্গেট ধ্বংসের কাজ যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন ওগুলোকে তুলে ফেলতে হবে। না হলে ওর কার্যকারিতা চলতেই থাকবে, যা ছড়িয়ে পড়বে গোটা এলাকায়। সংশ্লিষ্ট এলাকায় যা পাবে তাকেই ঠেলে দেবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে।’
‘সাংঘাতিক, তাহলে তো ওগুলো ভীষণ জরুরী।’
‘ঠিক স্যার।’
‘তাহলে?’
‘কার্ডিনাল পরিবারের আশ্রয়ের চেয়ে নিরাপদ স্থান স্পেনে আর নেই স্যার।’
‘এই প্রশংসায় খুশি হলো জেমেনিজ। তার পূর্ব পুরুষ কার্ডিনাল ফ্রান্সিস জেমেনিজ ডে সিসনারোসা ছিলেন স্পেনের প্রতিষ্ঠাতা রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রাণী ইসাবেলার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শুরু। স্পেনে খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও তার সংহত করণে তার অমূল্য অবদান রয়েছে। এই জন্যে কার্ডিনাল পরিবার এখনও গোটা স্পেনের খৃষ্টান মহলে অত্যন্ত সম্মানিত। এই পরিবারের মত সম্মান স্পেনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরাও পান না। এখনও রাস্তা-ঘাটে বাজারে কার্ডিনাল পরিবারের কাউকে দেখলে মানুষ দাঁড়িয়ে যায়।
প্রশংসায় মুগ্ধ জেমেনিজ বলল, ‘ঠিক আছে ভাসকুয়েজ, তাহলে এটা এখানে থাক।’
‘চিন্তা নেই স্যার, ওগুলো আপনার এখানে একটা নিরাপদ ব্যবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া আপনাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষ। নিজেই সিন্ধুকের মত দুর্ভেদ্য। তার ওপর আমরা চোখ রাখব। কারও চোখ এদিকে পড়বে বলে মনে করি না।’
‘না ভাসকুয়েজ, কোন প্রহরী আমি চাই না। মানুষ কি বরবে। কার্ডিনাল পরিবারের নিরাপত্তার জন্যে কোন সময়ই প্রহরী বসান হয়নি।’
‘ঠিক আছে স্যার। তাহলে এখন উঠি।’
‘ওদিকে জেনের ভেতরটা থর থর করে কাঁপছে। তাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে আছে ঐ ডকুমেন্ট!
ভাসকুয়েজের উঠার কথায় শংকিত হয়ে উঠল জেন। ওকে বিদায় দিতে হবে, তার আব্বার সাথে কথা বলতে হবে। জেনের মুখ দেখলে নিশ্চয় ওদের অভিজ্ঞ চোখ সবকিছু ধরে ফেলবে। কিছুতেই মনকে সে স্বাভাবিক করতে পারছে না।
অপ্রত্যাশিত ভাবে একটি সুযোগ জেনের জুটে গেল।
ভাসকুয়েজের উঠার কথায় জেমেনিজ বলল, মুখে কিছু না দিয়ে যাবে কি করে? বলে জেমেনিজ উঠে ইন্টারকমের দিকে এগিয়ে এল। এই সময় জেন তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আমি যাচ্ছি আব্বা, পাঠিয়ে দিচ্ছি নাস্তা।’
বলে জেন মুখ নিচু রেখেই ছুটল।
বাইরে বেরিয়ে গেল জেন। আল্লার শুকরিয়া আদায় করল সে। আল্লাহ তাকে একটা নাজুক অবস্থার থেকে উদ্ধার করেছেন।

অনেক ভেবেই জেন সিন্ধান্ত নিয়েছে, বিষয়টা জোয়ানদের জানাবে না। ওরা যদি বিষয়টার সাথে জড়িত হয়, ডকুমেন্ট উদ্ধারের জন্যে ওরা জেনদের বাড়ীতে অভিযান চালায় বাইরে থেকে এসে, তাহলে তাদের বাড়ীতে বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার চেয়ে জেন একাই চেষ্টা করবে। সফল না হবার কোন কারণ সে দেখে না। তার নিজের বাড়ীর একটা জিনিস সে সরিয়ে ফেলতে পারবে না কেন?
এই সিন্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তার পিতার দিকটা এবং পরিবারের দায়িত্বের প্রশ্ন তাকে কিছুটা দোটানায় ফেলে দিল। সে কার্ডিনাল পরিবারের মেয়ে। আজ তার দেশ স্পেন যে রাষ্ট্রীয় বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে, সে বুনিয়াদ তার পূর্ব পুরুষের হাতে গড়া। তার ওপর এই বুনিয়াদকে পাকাপোক্ত করার জন্যে সে সংগঠন কাজ করছে সেই কু-ক্ল্যাস্ক-ক্ল্যান –এর উপদেষ্টা তার আব্বা। সুতরাং তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল স্থাপনের প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম জোয়ানদের হাতে পাচার করে তাদের সাহায্য করার অর্থ হবে তার পিতা, তার পরিবার এবং রাষ্টীয় বুনিয়াদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
কিন্তু এই যুক্তি জেনের মনে বেশীক্ষণ টিকেনি। জেনের বিবেক এই যুক্তির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে বলেছে, কোন অন্যায় সে করছে না, বরং অতি জঘন্য ও সর্বনাশা এক অন্যায়ের প্রতিবিধানই করতে যাচ্ছে। তার পিতা এবং তার পিতার সংগঠন একটা জাতি শুধু নয়, তার দেশের ঐতিহাসিক সম্পদের বিরুদ্ধেও এক হিংসাত্মক ও ধ্বসাত্মক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। এর প্রতিবাদ করা, একে বানচাল করার চেষ্টা করা মানুষ হিসেবেও তার নৈতিক দায়িত্ব। তাছাড়া সে শুধু মানুষ নয়, সে জেন। জোয়ানকে সে সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছে।
সিদ্ধান্ত নেবার পর জেন একটা অসুবিধা অনুভব করতে লাগল। সর্বক্ষণ তার মনে হতে লাগল এই বুঝি তার মনের কথা সবাই জেনে ফেলল, ধরা পড়ে গেল বুঝি সে। বাপ, মা সহ বাড়ীর লোকদের চোখের দিকে তাকাতে তার ভয় হতে লাগল। তার মনে হতে লাগল তার চোখ দেখে সবাই তাকে বুঝে ফেলবে। আগের মত সবার সাথে সে মন খুলে কথা বলতে পারে না। মনে হয় তাদের সাথে তার কত ব্যবধান। এই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে অথবা পড়ার টেবিলে বসে সময় কাটাতে লাগল সে।
সেদিন শুয়ে আছে জেন। বাম হাতটা তার কপালে। চোখ দু’টি তার বোজা।
জেনের মা ঘরে ঢুকল। জেনের খাটের পাশে এসে কিছুক্ষণ দাড়াল। তার চোধ দু’টি নিবদ্ধ জেনের মুখে। জেনের মুখ ম্লান, ঠোঁট শুকনো। জেনের মা চিন্তিত মুখেই জেনের ঘরে প্রবেশ করেছে। তার চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
ধীরে ধীরে গিয়ে জেনের মা জেনের মাথার পাশে বসল।
সাড়া পেয়েই চোখ খুলল জেন।
‘আম্মা তুমি’ বলে সে উঠে বসতে গেল।
তার মা তাক হাত দিয়ে আটকে আবার শুইয়ে দিল। বলল, ‘শুয়ে থাক মা, আমি মাথায় হাত বলিয়ে দেই।’
‘আহা, আম্মা আমি ছোট নাকি যে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুমিয়ে দেবে?’
‘খুব বড় হয়েছ না? তাই বুঝি মাকে কোন কথা কোন চিন্তার ভাগ দাওনা?’
মায়ের কথায় চমকে উঠল জেন। মা সব বুঝে ফেলল নাকি। মায়ের দিকে না তাকিয়েই একটু শাস্ত গলায় বলল, ‘তুমি কি বলছ আম্মা, আমি কোন চিন্তার ভাগ দেইনা?’
জেনের মা তার মাথায় হাত বুলাচ্ছিল। বলল, ‘মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না জেন। অনেক দিন থেকে বিশেষ করে গত কয়েকদিন থেকে তোমাকে অত্যন্ত মন মরা দেখছি। সেই হাসি নেই, উচ্ছলতা নেই। কথাও তেমন বল না কারো সাথে। দেখলে মনে হয় পালিয়ে বেড়াচ্ছ। ক’দিন থেকেই বুঝছি, বড় একটা কিছু হয়েছে বা ঘটেছে। কি ঘটেছে মা?’
মনে মনে শংকিত হলো জেন। মায়ের আদরে, স্নেহ মাখা নরম কথায় তার মনটা ভিজে উঠল। জেন বলল, ‘সত্যি আমার তেমন কিছু ঘটেনি মা। এমনি শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’
‘জেন তোমার অসুখ হলে মুখ দেখলেই আমি বুঝি, তোমার শরীর খারাপ হয়নি। আমি তোমার মন খারাপ দেখছি।’
জেনের মা থামল।’
জেন নিরব। কি উত্তর দেবে মায়ের কথার। সত্যিই মায়ের চোখ ফাকি দেয়া যায় না। পাকি সে দিতে পারেনি। এখন মাকে সে কি বলে বোছাবে। কোন কথাই তার মুখে এল না। চোখ বুজল সে।
জেনের মা একটু মাথা নিচু করল। তার কপালে চুমু খেল। বলল, মা জেন তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমার মলিন মুখ যে আমি সইতে পারি না। আমি বুঝতে পারছি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। তোমার এ কষ্ট যে আমাকে কষ্ট দেয় তোমার চেয়ে বেশী।
জেনের চোখ ফেটে অশ্রু নেমে এল। মাথা তুলে মায়ের কোলে মুখ গুজল। বলল, আম্মাগো, তুমি চিন্তা করো না, কষ্ট পেয়ো না। আমি মানুষ, মানুষের জীবনে কিছু চিন্তা ভাবনা, দুঃখ কষ্ট থাকেই।
তার মা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। জেনের মাথায় তখনও তার মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দৃষ্টিটা তার উদাস। তার উদাস, শূণ্য দৃষ্টিটা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে। এক সময় সে ধীরে ধীরে বলল, তুমি তোমার বাপের মত হয়েছ। একটা কথা বললে তা থেকে আর নড় চড় নেই।’
একটু থামল জেনের মা। থেমেই আবার শুরু করলো, ‘সোনার টুকরো ছেলে জোয়ান। তোদের দু’জন কে ঘিরে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে স্বপ্ন নির্মম ভাবে ভেঙে গেল।’
জেন মুখ তুলে মায়ের দিকে একবার চাইল। দেখল মায়ের বেদনা পাংশু মুখ এবং শূণ্য দৃষ্টি। জেনের ভিতরের বিস্ময় ও আনন্দের একটা শিহরন। তার মাও ভেবেছে তাদের নিয়ে।
মায়ের কোলে আবার মাথা রেখে জেন বলল, ‘মাগো, তুমি সত্যিকার মা। কিন্তু আম্মা, স্বপ্নটা ভেঙে গেল কেন?’
‘সব স্বপ্ন সব সময় সফল হয় না, চাওয়ার সাথে পাওয়া সব সময় মেলে না’।
‘এই না মেলানোর অংকটা যদি গায়ের জোরে হয়, চাপিয়ে দেয়া হয়, অন্যায় হয়, তাহলেও কি সান্তনা নিতে হবে?’
‘অনেক সময় নিতে হয় মা। সবাইকে নিয়ে সমাজকে নিয়েই তো আমরা!’
‘অনেক নিতে পারে, কিন্তু সবাই তা নাও পারে।’
জেনের মা তার শূন্য চোখটা ফিরিয়ে আনলো বাইরে থেকে। তাকাল জেনের দিকে। জেনের মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘মা আমার, এমন কথা বল না। অনেক অংক আছে, কোনদিনই মেলানো যায়না।’
জেন কোন কথা বলল না।
জেনের মা জেনের মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে নিল। বলল, ‘ক’দিন থেকে তোমার মুখে হাসি দেখিনি। একটু হাস মা।’
জেন হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা তার কান্নার চেয়েও করুণ দেখাল।
জেনের মা মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বলল, ‘এত ব্যথা তোর বুকে, অথচ আমাকে কেন জানাস নি এতদিন?’ ভারি কাঁপা কণ্ঠস্বর জেনের মার।
জেনের চোখ ভরে উঠেছিল অশ্রুতে। তাড়াতাড়ি মুছে বলল, ‘আম্মা তুমি চিন্তা করো না, কষ্ট পেয়ো না আম্মা। আমাকে তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।’
‘কোন বাপ মা তা পারে বুঝি! যখন মা হবে…’
এই সময় পরিচারিকা দড়জায় এসে দাঁড়াল। বলল, ‘সাহেবের টেলিফোন মেম সাব।’
জেনের মা জেনের কপালে চুমু খেয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে বলল, আসি মা, দেখি ওদিকে।
চলে গেল জেনের মা।
মায়ের সাথে কথা বলে, মাকে কিছু কথা বলতে পেরে অনেকটা হালকা অনুভব করছে জেন। ভালোই হলো, জোয়ানের সাথে তার ব্যাপারটা অন্তত তার মা জানে।
মন হালকা হওয়ার সাথে জেন আশংকাও অনুভব করল। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে, বেশি দেরী করা ঠিক হবে না, কখন কি ঘটে বলা যায় না। আম্মা যেমন উদ্বিগ্ন হয়ে ঊঠেছে তাতে যদি বলে বসে যে, যাও কিছুদিন বেড়িয়ে এস। আম্মা কিছু বললে তাঁকে ঠেকানো যায় না, কান্নাকাটি শুরু করেন।
সবদিক চিন্তা করে জেন ঠিক করল, আজ রাতেই সে তার মিশনে হাত দেবে।
জেন তার মিশন নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক চিন্তা ভাবনা করেছে।
তাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষ তাদের বাড়ীর পেছন অংশে। আব্বা আম্মা ও তার শয়ন ঘর এবং কিচেনের নিচে বিস্মৃত জায়গা নিয়ে বিশাল ভূগর্ভস্থ কক্ষটি।
ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামার দু’টি পথ। একটি সিড়ির গোড়ায়, অন্যটি তার আব্বার ঘরের মধ্য দিয়ে। সিড়িরগোড়ায় ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামার যে পথ আছে, তা বিশাল এক লোহার পাল্লা দিয়ে বন্ধ। লোহার পাল্লাটি দেড় ইঞ্চি পুরু। দরজাটি স্বয়ংক্রিয়, এর সুইচ আছে জেনের আব্বার ঘরে দেয়ালের এক কেবিনে লুকানো সুইচ বোর্ডে। আরেকটি দরজা দেয়ালের সাথে তৈরী একটা আলমারির মধ্যে দিয়ে।
আলমারিটি খুললেই নিচে নামার সিড়ি বেরিয়ে পড়ে। এই পথ দিয়েই সাধারণ বা প্রাত্যহিক প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামা হয়। আর সিঁড়ির দরজাটি কোন বিপদকালীন সময়ে পরিবারের সকলের এক সাথে ব্যাবহারের জন্যে। সিঁড়ির দরজা দিয়ে নামা যাবেনা কোন ক্রমেই। সিঁড়ির দরজা খোলার যে সুইচ জেনের আব্বার ঘরে আছে তা অন করলে সংগে সংগে বাড়ির সব প্রান্তে ছড়িয়ে পরার মত একটা সাইরেন বেজে উঠে। অতএব ভূগর্ভস্থ কক্ষে নামার একটাই পথ খোলা। সেটা তার আব্বার ঘরের সেই আলমারির মধ্য দিয়ে।
জেন ঠিক করল তার আব্বার ঘরের এই পথই ব্যবহার করবে। আই পথ দিয়ে নামার অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। বিভিন্ন কারনে কখনও একা, কখনও অন্যের সাথে বহুবার সে ভূগর্ভস্থ কক্ষে এ দরজা দিয়ে নেমেছে।
কিন্তু কখন নামবে? তার আব্বার সামনে দিয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষে যাওয়া যাবেনা। অহেতুক কৌতুহলী হয়ে উঠতে পারেন অথবা সাথে তিনিও নামতে পারেন। সুতরাং নামতে হবে তার আব্বা যখন বাড়ী না থাকেন তখন এবং সব দিক দিয়ে সেই উপযুক্ত সময় সন্ধ্যারাত। জেনের আব্বা প্রায় সন্ধ্যারাতে বাইরে থাকেন। হয় কোন মিটিং এ যান, নয়তো ক্লাবে।
কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান এখনও জেন করতে পারেনি। তেজস্ক্রিয় পাতার প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম ভূগর্ভস্থ কক্ষের কোথায় খুঁজে পাবে সে। এই প্রশ্নের সমাধান তখনও সে করতে পারেনি।
রাত তখন ৮টা।
তার ঘরে শুয়ে ছিল জেন।
তার আব্বা-আম্মা মার্কেটে যাচ্ছে। জেনকেও বলেছিল যেতে, কিন্তু জেন রাজী হয়নি। খুব খুশী হয়েছে জেন। তার আব্বা-আম্মা একসাথে যাওয়ায় তার দারুন সুবিধা হবে। নিরাপদে কাজ সারতে পারবে। জেন তার আব্বা-আম্মাদের যাওয়া টের পেয়ে উঠে দাঁড়াল।
এক পা, দু’পা করে দরজার দিকে পা বাড়াল, বুকটা তার কেঁপে উঠল। কেমন একটা আড়ষ্টতা ও ভয় এসে তাঁকে ঘিরে ধরল। মন বলল, যা সে করতে যাচ্ছে, তা প্রকাশ হওয়ার পর কিংবা ধরা পড়লে তার কি হবে।
কিন্তু ভয় ও পরিণতির কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলল সে। জোয়ানকে সাহায্য করার, আহমদ মুসাকে সাহায্যে করার, মজলুমদের সাহায্য করার এর চেয়ে বড় সূযোগ আর সে পাবে না।
জেন প্রস্তুত হয়ে তার আব্বার ঘরের দরজার নব ঘুরিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। প্রতিদিন শতবার করে এ ঘরে প্রবেশ করে কিন্তু আজকের প্রবেশটা তার সেরকম নয়। বুঝতে পারছে তার হার্ট বিট বেড়ে গেছে। গোটা দেহে অপরাধী সুলভ একটা আড়ষ্টতা।
মেঝেটা পার হয়ে ওয়াল আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল জেন।
হাতল ধরে টেনে দেখল আলমারি বন্ধ।
আলমারির কন্বিনেশন লকের কোড সে জানে। লক ঘুরিয়ে কম্বিনেশন মিলিয়ে সে খুলে ফেলল আলমারি। আলমারিতে প্রবেশ করল জেন। আলমারির পর নিচে নামার সিঁড়ির মুখে আরেকটা দরজা। দরজাটি পুরো স্টিলের, বোমায় ভাঙবে না এমন। সে দরজাতেও কম্বিনেশন লক। কিন্তু লক করা নেই দরজা।
জেন ভারি দরজা টেনে খুলে সিঁড়িতে নামল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল জেন। কিন্তু সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে আবার উঠে এল জেন ওপরে সিঁরির দরজায়। সিঁড়ির মুখের দরজা লাগিয়ে হুড়কো এটে দিল দরজায়। সে ভেতরে থাকা অবস্থায় কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা।
দরজা বন্ধ করে ভূগর্ভস্থ কক্ষে নেমে এল জেন।
বিশাল কক্ষ।
শুধু মূল্যবান জিনিসের স্টোর হিসাবে নয়, আপাতকালীন আশ্রয়স্থল হিসাবেও এই ভূগভস্থ কক্ষ তৈরী হয়েছে। বিশাল কক্ষটিতে ছয়টি শয্যাপাতা আছে। খাদ্য সংরক্ষণের জন্যে রয়েছে অনেক গুলো বিরাট রিফ্রেজারেটর। কাপড়-চোপড় রাখার জন্যে রয়েছে কয়েকটি আলমারি। কয়েকটি র‍্যাকে রাখা আছে বিভিন্ন তৈজসপত্র। র‍্যাক, আলমারি, রিফ্রেজারেটর সবগুলোই কক্ষের দেয়ালে নির্মিত কেবিনে রাখা।
কোথায় রাখা আছে ডকুমেন্টগুলো? কোথেকে খোঁজা শুরু করবে সে। হঠাৎ কক্ষের নিরাপত্তা-সিন্দুকের কথা মনে পড়ল জেনের। পরিবারের সকল মূল্যবান দলিল এবং দ্রব্য সেই নিরাপত্তা সিন্দুকে রাখা আছা। জেনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল, সন্দেহ নেই তেজস্ক্রিয় পাতার সেই অতিমূল্যবান ডকুমেন্ট ঐ নিরাপত্তা সিন্দুকেই থাকবে। খুশীতে তুড়ি বাজাতে গিয়ে হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল জেনের মুখ। এ নিরাপত্তা সিন্দুক কোথায় আছে, কিভাবে খুলতে হয় জানা নেই জেনের। এতক্ষনে তার মনে হল বিরাট ভূল করেছে সে। কিন্তু ফিরতেও আর মন চাইল না। সে আজ যে সূযোগ পেয়েছে, এ সূযোগ দু’চারদিনের মধ্যে আবার যে পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সুতরাং এসে পড়েছে যখন তখন যে দায়িত্ব সে পালণ করতে চেয়েছে, তা সম্পূর্ন সে করবেই।
হঠাৎ তার মাথায় এলো, ওপরে সিঁড়ির গোড়ার ভূগর্ভস্থ কক্ষের দরজা খোলার ব্যবস্থা তো স্বয়ংক্রিয়। অন্য এক জায়গায় রক্ষিত একটা সুইচ টিপলেই সেই দরজা খুলে যায়। নিশ্চয় নিরাপত্তা সিন্দুক খোলার জন্যে সে রকম কোন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাই থাকবে। নিরাপত্তা সিন্দুকের সুইচ এ ঘরেরই কোথাও রয়েছে। তাকে এখন সে সুইচ খুঁজে বের করতে হবে।
কোথায় থাকতে পারে সে সুইচ? ঘরের দেয়ালে কোথাও সুইচ বক্স আছে কি? তৈজস পত্রের র‍্যাক থেকে একটা ছোট্ট হাতুড়ি নিয়া জেন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দেওয়াল পরীক্ষা করতে লাগল। ফাঁপা শব্দ কোথাও থেকে আসে কি না। সুইচ বাক্স খুঁজতে গিয়ে নিরাপত্তা সিন্দুকের সন্ধান সে পেল। নিরাপত্তা সিন্দুকের পাল্লার রং দেয়ালের মত হলেও হাতুড়ির ঘা পড়ায় তা ঠন্‌ ঠন্‌ করে উঠল। নিরাপত্তা সিন্দুকের আকার হবে চারফিট বাই দুই ফিটের মত। ভূগর্ভস্থ কক্ষের চার দেওয়াল জেন তন্ন তন্ন করে দেখল, কোথাও সুইচ বক্স পেল না। তারপর সে কক্ষের মেঝেতে পাতা শয্যাগুলোর তলাসহ মেঝের প্রতিইঞ্চি হাতুড়ি পিটিয়ে পরীক্ষা করল সেখানে কোন সুইচ বাক্স আছে কিনা। হতাশ হল জেন, মেঝেতে কোন সুইচ বক্স নেই।
পরিশ্রম ও উত্তেজনায় ইয়ার কন্ডিশন ঘরেও ঘেমে উঠেছে জেন। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল অনেক সময় খরচ হয়েছে। সময় নষ্ট করা যায় না। আবার লেগে গেল সুইচ বক্স তালাশে। এবার তৈজস্পত্রের র‍্যাক, কাপড় চোপড়ের আলমারি, একনকি বড় বড় রিফ্রেজারেটরের আশ-পাশ পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজল। না কোথাও কোন সুইচের নাম গন্ধ নেই।
ক্লান্ত জেন একটা বিছানায় এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। হতাশা এসে তাকে ঘিরে ধরল। ঘরে কোন জায়গাই খুঁজতে সে বাকি রাখেনি। বহু সময় সে নষ্ট করেছে। তাঁর আব্বা আম্মা বাড়ী ফিরলে তাঁর মিশন পন্ড হয়ে যাবে। উদ্বেগ বোধ করল সে। তাহলে সে কি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে!
জেন যে বিছানায় শুয়েছিল তার পাশেই নিরাপত্তা সিন্দুকের দেয়ালটি। জেন হতাশ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। আহমদ মুসা হলে নিশ্চয় এটা খোলার বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু তাঁর মাথায় তো কিছু আসছে না। পিটিয়ে তো পুরু ষ্টিলের নিরাপত্তা সিন্দুক ভাঙা যাবে না। একবার জেনের মনে হলো নিরাপত্তা সিন্দুকের সুইচ তাঁর আব্বার ঘরের কোথাও তো লুকানো থাকতে পারে! এ সম্ভাবনা জেন উড়িয়ে দিতে পারলো না। কিন্তু তাঁর আব্বার ঘর খুজে সুইচ বের করে সিন্দুক খোলার মত সময় আর নেই। তাহলে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে? আবার কবে সুযোগ পাবে সে!
অস্থির ও ভাঙা মন নিয়ে শোয়া থেকে উঠল জেন। ধীর পায়ে আবার গিয়ে দাঁড়াল নিরাপত্তা সিন্দুকের সামনে। আবার তীক্ষভাবে নজর বুলাল সে নিরাপত্তা সিন্দুকের গায়ে। মেঝের দুই ইঞ্চি ওপর থেকে শুরু হয়েছে নিরাপত্তা-সিন্দুক ও মেঝের মাঝখানে দুই ইঞ্চি পরিমান জায়গার এক স্থান জুড়ে আঙুলের শীর্ষ ভাগের একটা ছবি দেখতে পেল জেন। কেও যেন সূক্ষ্ম পেন্সিল স্কেচে বুড়ো আঙুলের নখ এঁকে রেখেছে। ভালো করে বুঝা যায় না, দেখতে কতকটা ছায়ার মত।
জেন বসে পড়ল মেঝেয়। আরো ভাল করে নজর বুলালো স্কেচের ওপর। দেখল, অলস হাতের বিশৃঙ্খল আচড়ে কেউ বুড়ো আঙুলের শীর্ষ ভাগের স্কেচটি এঁকেছে। খুব যত্ন ও পরিষ্কার ছাপ এতে নেই। দেখলে মনে হয় খেয়ালি কেউ বসে বসে এই কাজ করেছে। হাত দিলেই যেন ওটা মুছে যাবে।
জেন স্কেচটার ওপর আঙুল দিয়ে ঘষা দিল। না মুছল না। পাকা কালির পারমানেন্ট একটা ছবি ওটা।
কেন এই ছবিটি আঁকা এখানে? এমনি এমনি কি কেউ এঁকে রেখেছে এটা এখানে? কেন?
হঠাৎ জেনের মনে হলো এটা কোন ইংগিত হতে পারে না কি? হাতের চাপ দেওয়ার কাজ একটু বড় হলে মানুষ বুড়ো আঙুল দিয়েইতো করে। আনন্দের একটা শিহরণ কেহ্লে গেল জেনের দেহে।
বুড়ো আঙুলের স্কেচের শীর্ষ ভাগ ওপরের দিকে। জেন তার বাম হাতের বুড়ো আঙুল ঠিক স্কেচের ওপর সেট করে প্রচন্ড এক চাপ দিল চোখ বন্ধ করে। উত্তেজনায় তার বুক টিপ টিপ করে উঠল।
আনন্দের সাথে চোখ খুলল জেন। দেখল, নিরাপত্তা সিন্দুকের সামনের পাল্লাটা পাশের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে নিরাপত্তা সিন্দুক। নিরাপত্তা সিন্দুক বহু কক্ষ বিশিষ্ট একটি আলমারি। কক্ষ গুলির কোনটায় কি আছে তাঁর সংকেত দেয়া নেই।
জেন ঘেমে উঠেছে। যার জন্যে তার এত চেষ্টা তাকি আসলেই এখানে আছে! পাবে কি সে!
নিরাপত্তা সিন্দুকের কক্ষগুলোর কোনটাই বন্ধ নয়। একে একে খুলতে লাগল জেন। কোনটাতে অলংকার, কোনটাতে স্বর্ণ, কোনটাতে টাকা ভর্তি। জেন খুজছে কাগজ, এসব নয়। মাঝখানে কয়েকটি কেবিনে কাগজপত্র পেল। সেগুলো জেনের আব্বার কোম্পানীর ও নানা ধরনের দলিলপত্র।
অবশেষে পেল জেন তেজস্ক্রিয় পাতার সেই প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম। একটা কেবিনে বড় খামের মধ্যে পেল ডকুমেন্ট গুলো।
ডকুমেন্টগুলো আবার খামে ভরে ভাজ করে পকেটে পুরে উঠে দাঁড়াল জেন। ঠিক এই সময়ই তাঁর আব্বার ঘরের সাথে সংলগ্ন সিড়ি মুখের ষ্টিলের দরজায় ধাক্কা দেয়ার শব্দ হলো।
চমকে উঠলো জেন।
ধাক্কা অব্যাহত ভাবে হতে লাগল।
জেন বুঝল তার আব্বা এসেছে। কিন্তু বুঝতে পারলো না, এত তাড়াতাড়ি তাঁর তো বুঝার কথা নয়। সে আসার সময় আলমারি বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। কেউ ভেতরে ঢুকেছে এটা তার বুঝার কথা নয়। কিন্তু আসার সংগে সংগে তিনি বুঝলেন কি করে।
হঠাৎ জেনের মনে পড়ল, নিরাপত্তা সিন্দুকের ওপেনিং সিষ্টেমের সাথে অনেক ক্ষেত্রে সাইরেন যুক্ত থাকে যা চোর ডাকাতদের ধরতে সাহায্য করে। এখানেও নিশ্চয় তাহলে সাইরেন যুক্ত আছে। সুইচ টেপার সংগে সংগেই তা বেজে উঠেছে। তাঁর প্রবেশ ধরা পড়ার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
সিঁড়ি মুখের দরজায় এখন হাতুড়ী পেটার প্রচন্ড শব্দ হতে শুরু করেছে।
জেন সিদ্ধান্ত নিল এই ডকুমেন্ট সহ তাকে ধরা পড়া চলবেনা। আর ডকুমেন্ট সরাবার এই সু্যোগ ব্যর্থ হলে একে আর উদ্ধার করাও যাবে না। সুতরাং যে মিশনে সে এসেছে সেখান থেকে পিছপা হবে না।
কিন্তু কিভাবে বেরুবে সে এখান থেকে। তাঁর বেরুবার পথ বন্ধ। হঠাৎ জেনের মনে পড়ল, এই কক্ষের ছাদের পেছন দিকের প্রান্তে কক্ষ থেকে বেরুবার জরুরী দরজা আছে। সেটা ভেতর থেকে হুড়কো দিয়ে বন্ধ। এ দরজা দিয়ে বেরুলে তাদের বাড়ীর পেছন দিকের একটা করিডোরে পৌঁছা যায়।
বের হবার এ বিকল্প পথের কথা মনে হবার সাথে সাথে জেন সিদ্ধান্ত নিল এ পথেই সে বেরুবে। একবার তাঁর মনে হলো এ পথে যদি সে চোরের মত পালিয়ে যায়, তাহলে আবার সে ফিরবে কি করে! সে যে এখানে প্রবেশ করেছে তা ইতিমধ্যে প্রকাশ না হয়ে থাকলে প্রকাশ হয়ে পড়বেই। এছাড়া তার মনে হলো, বিকল্প পথে বেরুবার পথ বন্ধ করতেও কেউ আসতে পারে। কিন্তু জেন আবার ভাবল, হয়তো আসতে পারে, কিন্তু এছাড়া তো তার বেরুবার আর কোন পথ নেই। আবার তার মনে খোঁচার মত বিধল, সে এভাবে পালালে আবার ফিরবে কি করে? কিন্তু পরক্ষনে এ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে জেন ভাবল পরিণতির চিন্তা আমি করি না। ট্রিয়েষ্টে জোয়ানকে বাঁচাবার জন্যে যখন পিস্তল হাতে বেরিয়েছিলাম, তখন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়েই বেরিয়েছিলাম। আমি যদি জীবন দিয়েও ওদের উপকার করতে পারি, আমার পরিবারের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি, সেটাই হবে আমার জীবনের সার্থকতা।
সিদ্ধান্ত নিয়েই জেন সিঁড়ির গোড়ার দরজা দিয়ে এ কক্ষের প্রবেশের দ্বিতীয় দরজাটি হুড়কো দিয়ে বন্ধ করে কক্ষ থেকে বেরুবার জন্যে জরুরী দরজার দিকে ছুটল। যাবার সময় একটু আলমারি থেকে ওভারকোট নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নীল।
কক্ষের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে বেরুবার জরুরী দরজা পর্যন্ত। সিঁড়ি বেয়ে উঠে জেন হুড়কো খুলে নিচে ফেলে দিল।
জরুরী দরজাটা বর্গাকার। এখানেও স্টিলের পাল্লা, একদম এয়ার টাইট। জেন সিড়িতে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে পাল্লা আলগা করার চেষ্টা করল। কিছুই হলো না। পরে জেন সিড়ির আরও এক ধাপ উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে কাঁধ লাগাল দরজার পাল্লায়। তারপর সর্বশক্তি লাগিয়ে কাঁধ দিয়ে ঠেলল দরজা। কাঁধ ব্যাথায় টন টন করে উঠল, কিন্তু দরজা সরা দূরে থাক সামান্য নড়লও না।
জেন সিড়ির একধাপ নিচে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভাবল, দরজা মরিচা বা অন্য কোন ভাবে আপনা আপনি আটকে যাবার কথা নয়। নিশ্চয় হুড়কো ছাড়াও আর কিছু বাড়তি ব্যবস্থা আছে দরজা বন্ধ রাখার।
জেন দ্রুত নজর বুলাল বর্গাকার দরজা এবং তার দেয়ালের চারপাশে। অত্যন্ত শ্যেন দৃষ্টি জেনে যাতে তিল পরিমান কোন অস্বাভাবিকতাও তার নজর না এড়ায়। দরজার দেয়ালে একটি বালিকার ছোট্ট মুখাবয়বের ওপর গিয়ে জেনের চোখ আটকে গেল। এ মুখাবয়বটিও পেন্সিল স্কেচে করা মনে হল। মুখবয়বটির কপালে লাল একটি ফোঁটা। স্কেচের আয়তন অনুসারে ফোঁটাটা বেশ বড়।
ফোঁটাটির দিকে তাকিয়ে জেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চটকরেই তার মনে হল লাল, ফোটা বা বোতাম টিকে ক্যামফ্লেজ করার জন্যেই মুখায়বটি আঁকা হয়েছে।
চিন্তার সাথে সাথেই জেন তার ডান হাতের তর্জনি দিয়ে লাল বোতামটির ওপর চাপ দিল। সংগে সংগেই অস্পষ্ট একটা শিষ দিয়ে উঠে স্টিলের বর্গাকার দরজাটা সরে গেল তার মাথার ওপর থেকে।
প্রথমে একটু মাথা তুলে জেন দেখল চার দিকটা। না কেউ কোথাও নেই। করিডোর একদম ফাকা।
এই সময় জেনদের বাড়ীর ভেতরের অংশ থেকে, একটা পায়ের শব্দ এলো কেউ যেন এদিকে এগিয়ে আসছে।
জেন লাফ দিয়ে করিডোরে উঠে এল।
যে করিডোরে জেন এসে দাঁড়াল তার একটি মাথা দক্ষিণ দিকে জেনদের বাগানের দিকে চলে গেছে। অন্য মাথাটি বাড়ীর পূবদিকে ঘুরে গাড়ী বারান্দা অর্থাৎ উত্তরের লনে গিয়ে শেষ হয়েছে।
জেন করিডোরে উঠে ওভার কোট দিয়ে গা মাথা ভাল করে ঢেকে নিয়ে দৌড় দিল গাড়ী বারান্দার দিকে।
জেন কিছুটা এগিয়েছে, এই সময় বেছন থেকে চিৎকার উঠল, কে কে?
জেন চিনতে পারল তার আব্বার কণ্ঠস্বর।
জেন দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল।
পেছন থেকে পায়ের শব্দ এল। জেন বুঝতে পারল তার আব্বাও ছুটছে তার পেছনে।
জেন শেষ মুহুর্তে ধরা পড়তে চায় না। খোয়াতে চায় না ডকুমেন্ট।
জেন করিডোরের মুখে পৌঁছে দেখল তার গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। জেন ছুটল গাড়ীর দিকে।
জেন গাড়ীর দরজা খুলেছে। এক পা ঢুকিয়েছে গাড়ীর ভেতরে, সেই সাথে মাথাটাও। একটা পা তখনও বাইরে।
এই সময় করিডোরের মুখ থেকে চিৎকার এল, পালাল, পালা। সেই সাথে এল গুলির শব্দ।
জেন তার বাইরের পাটি তুলতে যাচ্ছিল এই সময় গুলি এসে বিদ্ধ করল সে পা। গুলি লাগল হাটুর ঠিক নিচেই।
জেনের দেহ কেঁপে উঠলো। একটা চিৎকার বেরুল মুখ থেকে। কিন্ত তার পরেই জেন নিজেকে সামলে নিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে দু’হাত দিয়ে পাটা তুলে নীল গাড়ীর ভেতরে। তারপর ডান হাত দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে দিল গাড়ীর।
কম্পিত দেহটাকে জেন গাড়ীর সিটের সাথে সেঁটে রেখে গাড়ী স্টার্ট দিল।
জেনের নজরে এল সামনেই দারোয়ান বোবার মত দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’টি চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।
দারোয়ানের পাশ দিয়ে তীর বেগে জেনের গাড়ী খোলা গেট দিয়ে গিয়ে পড়ল রাস্তায়।

চিৎকার কানে যেতেই জেনের আব্বা জেমেনিজ থমকে দাঁড়িয়েছিল। চিৎকার সে চিনতে পেরেছে।
পিস্তল ধরা হাতটি তার স্থির হয়ে গেল, পা দু’টি তার যেন মাটিতে আটকে গেল। চোখে বোবা দৃষ্টি।
জেনের যেখানে গুলি লেগেছে, সেখানে এক থোক রক্ত গড়াচ্ছে তখনও।
পাথরের মূর্তির মত স্থির পা চালিয়ে জেমেনিজ এসে দাঁড়াল লাল তাজা সেই রক্তের সামনে। তার চোখ সেই রক্তের উপর পাথরের মত স্থির।
জেনের মা ছুটে এল বাড়ীর ভেতর থেকে। গুলির শব্দ সেও শুনেছে।
‘ওগো শুনেছ, জেন তো ঘরে নেই’ বলতে বলতে জেনের মা এসে দাঁড়াল জেমেনিজের কাছে সেই রক্তের সামনে।
রক্তের সামনে জেমেনিজকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে জেনের মা একবার রক্তের দিকে, একবার জেমেনিজের দিকে তাকাতে লাগল।
তারপর আর্ত কন্ঠে বলল, ‘তোমার কি হয়েছে, এ রক্ত কার? শুনেছ, জেনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
মূর্তির মত দাঁড়ানো জেমেনিজের হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল।
জেনের মা ছুটে এসে জেমেনিজের একটা হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, ‘বল, এ রক্ত কার? কথা বলছ না কেন?’
জেমেনিজ রক্তের দিকে তাকিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়েই রইল।
অল্পদূরে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়েছিল দারোয়ান। জেনের মা ছুটে গেল তার কাছে। কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখেছ তুমি, এ রক্ত কার? জেন কোথায়?’
দারোয়ান দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। হাউ মাউ করে উঠে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল, ‘খুকু মনির রক্ত, গুলি লেগেছে…।’ কথা শেষ করতে পারল না দারোয়ান। একটা চিৎকার করে জেনের মা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তখন অনেক রাত।
দূরে গীর্জার কোন পেটা ঘড়িতে ১২ টা বাজার শব্দ ভেসে এল।
জেনের ঘরে মেয়ের বিছানায় পড়ে বিছানা আঁকড়ে ধরে কাঁদছে তার মা।
বাইরের ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে জেমেনিজ। তার পাশের সোফায় ভাসকুয়েজ।
ভাসকুয়েজ কথা বলছিল, ‘আপনি শান্ত হোন স্যার। আপনি দেশের গৌরব। আপনি সন্তানকেও রেহাই দেননি। জেনকে আপনি গুলি করেছেন- আপনার এ জাতি প্রেম সবাইকে অভিভূত করার মত।’
একটু থামল ভাসকুয়েজ। তারপর বলল, ‘জোয়ান ছেলেটাই শয়তানির মূল। সেই মা জেনের মাথা খারাপ করেছে। আমাদের এখন প্রথম কাজ আহত জেন এবং ডকুমেন্ট গুলোকে উদ্ধার করা। তারপর শয়তান জোয়ান এবং আহমদ মুসাদের পাকড়াও করা। আহত জেন নিশ্চয় কোন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে উঠবে। আমরা মাদ্রিদের সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আমাদের লোকদের সতর্ক করে দিয়েছি। আমাদের শত শত কর্মী গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের পাকড়াও করার জন্যে। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগেরও সাহায্য কামনা করেছি আমি। আমি তাদের বলেছি, আপনার মেয়েকে আহত করে কিডন্যাপ করেছে আহমদ মুসার দল। এই সংবাদে সরকারের উচ্চ মহল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ পূর্ণ উদ্যমে কাজে নেমেছে। চিন্তা করবেন না স্যার ধরা তাদের পড়তেই হবে।’
জেমেনিজ শুকনো মুখে বসে ছিল। তার চোখটা ভাসকুয়েজের দিকে নিবদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু মনটা ছুটে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও। ভাসকুয়েজের সব কথা কানে গিয়েছে বলে মনে হলো না। কিন্তু ভাসকুয়েজের শষ কথায় জেমেনিজ নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। আমি ভয় করছি, ঘটনা না প্রকাশ হয়ে পড়ে। আমি চাই না, জেন কিডন্যাপ হওয়ার কাহিনী প্রচার হোক।’ শুষ্ক ও নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল জেমেনিজ।
‘না স্যার, সে ব্যবস্থা নিয়েছি। হোম মিনিস্টার, পুলিশ প্রধান ও আমি ছাড়া ঘটনা কেউ জানে না। অন্যদের শুধু ফটো সরবরাহ করে বলা হয়েছে, খুঁজে বের করে সসম্মানে পৌঁছে দিতে। হারিয়েছে, পালিয়েছে না কিডন্যাপ হয়েছে। কিছুই বলা হয়নি এবং জেনের পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়নি।’
‘ধন্যবাদ ভাসকুয়েজ।’
একটু থামল জেমেনিজ। তারপর আবার বলল, ‘ডকুমেন্ট গুলো যদি ওদের হাতে যায় ভাসকুয়েজ?’
‘প্ল্যান ও ডায়াগ্রাম পেয়ে ওরা যা করতে পারে তা হলো, তেজস্ক্রীয় ক্যাপসুলগুলো ওরা তুলে ফেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে সাধ্য তাদের হবে না। কাজে নামলেই ওদের টিপে টিপে মারবো আমরা।’
কথা শেষ করেই ভাসকুয়েজ বলল, ‘এখন উঠতে পারি স্যার? ওদিকে অনেক কাজ আছে।’
‘ঠিক আছে ভাসকুয়েজ, কোন খবর পেলেই আমাকে জানিও। জেনের মা একদম ভেঙে পড়েছে। কোন সান্ত্বনাই মানছে না। সবকিছুর জন্যে সে আমাকে দায়ী করছে। আমার রাজনীতিই নাকি জেনের এই অবস্থার জন্যে দায়ী।’ জেমেনিজের শুকনো কন্ঠ শেষের দিকে ভারি হয়ে উঠল।
‘মায়ের মন তো, একটু ভিন্ন রকম হবেই। ধৈর্য ধরতে বলুন স্যার, আমরা জেনকে বের করেই ফেলবো।’ বলে ভাসকুয়েজ উঠে দাঁড়াল।
জেমেনিজও উঠে দাঁড়িয়ে ভাসকুয়েজের সাথে হ্যান্ডশেক করে ভেতরের দিকে পা বাড়াল।

Top