১৫. আবার সিংকিয়াং

চ্যাপ্টার

উংফু এভেনিউয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো বিশাল একটা বাড়ি। বাড়িটা পুরানো হলেও খুব সুন্দর। মাও সেতুং এর বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত সিংকিয়াং মুসলিম বোর্ডের প্রধান অফিস ছিল এটা। তখন কার্যত মুসলমানরা স্বাধীন ভাবেই তাদের শাসন কাজ পরিচালনা করতো। এই উরুমচি ছিল তাদের রাজধানী। আর বোর্ড অফিস ছিল তাদের ধর্মীয় বিষয়াবলী পরিচালনার কেন্দ্র। মাও সেতুং ক্ষমতায় আসার পর ছলে-বলে, নানা কৌশলে মুসলমানদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা যেমন কেড়ে নেয়, তেমনি উল্লেখযোগ্য অনেক ধর্মীয় কেন্দ্রও তারা দখল করে নেয়। এই সময় মুসলিম বোর্ড অফিসও কম্যুনিস্টদের হাতে চলে যায়। তারপর মাও সেতুং-এর যুগ শেষ হলে পরবর্তী সরকার এক সময় অন্যান্য ধর্মীয় স্থান ছেড়ে দেয়, এর সাথে এই বোর্ড অফিসও ছাড়া পায়। ধর্মীয় বোর্ডের কাজ আবার চালু হয়। কিন্তু গভর্নর হিউ ইউয়ান ক্ষমতাচ্যুত হবার পর রেড ড্যাগন এই বাড়িটা দখল করে নেয়। এখন রেড ড্যাগনের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টার এটা।
বাড়িটার সামনে বিরাট এক উম্মুক্ত লন। আগে এখানে একটা সুন্দর বাগান ছিল। রেড ড্যাগনরা বাগানটিকে এখন একটা পার্কিং প্লেসে পরিণত করেছে। বাড়ির সামনে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
রেড ড্যাগনের এই হেড কোয়ার্টারে জেনারেল বরিস ও ‘ফ্র’ এসে আড্ডা গেড়েছে। বস্তুত সিংকিয়াং এর গভর্নর লি ইউয়ানের ক্ষমতাচ্যুতি ও সিংকিয়াং এর মুসলিম বিরোধী বর্তমান পরিবর্তনের জন্যে মুলত রেড ড্যাগন ‘ফ্র’ –ই দায়ী। রেড ড্যাগনের প্রধান ডাঃ মাও ওয়াং এবং ‘ফ্র’ এর প্রধান জেনারেল বরিস নিজেরা নানা ভাবে এবং নানা জনকে দিয়ে বেইজিং সরকারকে বুঝিয়েছেন যে, সিংকিয়াং –এর গভর্নর লি ইউয়ান কাজাখ বংশোদ্ভূত। সে হান মেয়েকে বিয়ে করে কম্যুনিস্ট হওয়ার কথা বললেও সে একজন মুসলমান। সে তার একমাত্র মেয়ে জেনকে বিয়ে দিয়েছে সিংকিয়াং এর মুসলিম বিপ্লবী সংগঠন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ –এর নেতা আহমদ ইয়াংয়ের সাথে। এখন গভর্নর তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে মুসলমানদের সংঘবদ্ধ ও পুনর্বাসিত করার কাজে। সে ক্ষমতায় থাকলে খুব অল্প সময়েই সিংকিয়াং স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে।
বেইজিং এর পরিবর্তিত সরকার রেড ড্যাগনের অনেকটা চাপের মুখেই সিংকিয়াং এর গভর্নর লি ইউয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত ও তাকেসহ তার পরিবারকে গ্রেফতার করে। নতুন গভর্নর হন লি পিং। খাঁটি হান। দৃশ্যত সে কট্টরপন্থী কম্যুনিষ্ট। কিন্তু মনে মনে সে সংস্কারবাদী-দেংজিয়াও পিং অনুসারী।
এই পরিবর্তনের সুযোগে রেড ড্রাগন এবং ‘ফ্র’ সন্ত্রাসের ঝড় বইয়ে দেয় গোটা সিংকিয়াং-এ। হত্যা করা হয় শত শত নেতৃস্থানীয় লোককে, বিরাণ হয় অসংখ্য মুসলিম জনপদ। মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সেখানে এনে বসানো হয় হানদের।
উন্মুক্ত লনের মধ্য দিয়ে সামনে এগুলে উঁচু বারান্দা। বারান্দার পরেই বিশাল হলরুম। রেড ড্রাগন হেড কোয়ার্টারের অভ্যর্থনা কক্ষ এটা। কক্ষের ওপারে কক্ষের লম্বালম্বি একটা করিডোর। করিডোরটা দু’পাশে এবং সামনে প্রলম্বিত। দু’পাশে করিডোরের দুই প্রান্ত দিয়ে দুইটি সিড়ি দু’তলার উঠে গেছে। অভ্যর্থনা কক্ষের ঠিক উপরেই দু’তলায় ডাঃ মাও ওয়াং এর অফিস। জেনারেল বরিসের অফিসও এর পাশেই।
জেনারেল বরিস তার অফিসে বসে।
সামনেই একটা অয়াররেস সেট।
বামপাশের র‌্যাকে দুটা টেলিফোন।
তার মাথার হ্যাটটিও র‌্যাকের ওপর শোভা পাচ্ছে। পরণে কাল সুট।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কোর্টের বাম হাতটি বেঢপভাবে ঝুলছে। এর কারণ, জেনারেল বরিসের কনুই থেকে বাম হাতটি কেটে ফেলা।
মেইলিগুলির বাড়িতে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে জেনারেল বরিস এই হাতটি হারায়।
জেনারেল বরিস টেলিফোনে কথা বলছিল।
টেলিফোন রাখতেই ঘরে প্রবেশ করল ডঃ মাও ওয়াং। তার মুখ কিছুটা বিষণ্ন।
জেনারেল বরিস উঠে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে তার সাথে করমর্দন করে বলল, ‘কি খবর মিঃ ওয়াং?’
মাও ওয়াং ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।
‘হারামজাদার বাচ্চা, ক্ষমতায় বসেই সব ভুলে গেছে।’ মুখ ফসকেই যেন কথাগুলো বেরিয়ে এল ডাঃ মাও ওয়াং এর মুখ থেকে।
কুইনাইন খাওয়ার মত বাঁকা ডাঃ ওয়াং এর মুখ।
‘কি ব্যাপার ওয়াং, খারাপ কিছু ঘটেছে?’ মুখ কালো করে বলল জেনারেল বরিস।
‘কি আর ঘটবে! ব্যাটা গভর্নরের বাচ্চা লিপিং বলছে কিনা, লি ইউয়ান সরকারের হাতে বন্দী। তার এবং তার পরিবারের বিচার সরকারই করবে।’
‘কেমন করে সরকারের হাতে বন্দী হলো? আমাদের লোকরাই তো তাকে এবং তার পরিবারকে আটক করেছিল। আমরা তা না করলে সরকারী বাহিনী হুকুম পেয়ে আসলে লি ইউয়ান তার পরিবার নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারতো।’
‘তুমি ভুল বলছ জেনারেল। হুকুম পেলেও সিংকিয়াং এর সে সময়ের কমান্ড সরকারের আদেশ পালন করতো না। লি ইউয়ান তার লোক দিয়েই সরকারী বাহিনীর কমান্ড সাজিয়েছিল। দেখনি, সব জানার পরেও ওরা আমাদের বাঁধা দিয়েছে, আমাদের পাঁচ জন লোককে হত্যা করেছে। ওরা সময় পেলে আমাদেরকেও পাকড়াও করতো। বেইজিং থেকে নতুন বাহিনী না এলে কিছুই করা যেত না।’
‘ঠিক বলেছেন, এ সব কথা তো গভর্নর লি পিং-এর ভুলে যাবার কথা নয়।’
‘কুত্তার বাচ্চা এখন আইনের কথা বলে।’
‘আইন কি? আমাদের বন্দী আমাদের হাতে ছেড়ে দেবে।’
‘আমাদের ভুল হয়েছে। কুত্তার বাচ্চাদের হাতে ওদের দেয়াই আমাদের ঠিক হয়নি। সেই গন্ডগোলের মধ্যে ওদের সবাইকে নিকেশ করা আমাদের উচিত ছিল।’
‘ব্যাপারটা আমরা বেইজিংকে বলতে পারি না?’
‘কোন লাভ হবে না। সব শিয়ালের এক রা। মতব্বরী ফলাবার সুযোগ পেয়েছে, ছাড়বে কেন?’
‘তাহলে?’
‘তাহলে….।’ টেবিলে মুষ্টাঘাতের সাথে কথাটা বলল ডাঃ ওয়াং, ‘লি ইউয়ান ও তার পরিবারের কাউকেই ছাড়বো না। চিবিয়ে খাব সবাইকে। বেইজিং এর সে সময়ের সরকারকে ফুসলিয়ে সে আমাদের যে সর্বনাশ করেছে তার একটিও ভুলিনি। শিহেজী উপত্যকায় আমাদের বাড়া ভাতে সে ছাই দিয়েছে। সিংকিয়াং-এ আমাদের আসার দরজা সে বন্ধ করে দিয়েছিল। এর প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত আমার রক্ত শান্ত হবে না।’
‘কিভাবে?’
হো হো করে হেসে উঠল ডাঃ ওয়াং। বলল, ‘তোমার মুখে এমন হতাশা তো মানায় না জেনারেল। শয়তানরা এক দরজা বন্ধ করেছে, সব দরজা বন্ধ করতে পারেনি। কারাগার থেকে লি ইউয়ানদের কিডন্যাপ করব। বন্দীদের বশ করতে কিংবা কাবু করতে ডাঃ ওয়াং- এর গায়ে তেমন বাতাসও লাগবে না।’
জেনারেল বরিসের চোখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমার সাথে আমি একমত ওয়াং। আমার খুব খুশী লাগছে। এমন ভাবে জয় করে নিয়ে শিকার করার মধ্যে আনন্দ আছে।’
একটু থামল জেনারেল বরিস। তারপর বলল, ‘আমার একটা দুঃখ ওয়াং, মেইলিগুলিকে আমি আটকাতে পারলাম না। ওকে আটকাতে পারলে আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় আনা যেত।’
‘শুধু দুঃখ বলছ জেনারেল। এটা তো রীতিমত বিপর্যয়। এক আহমদ মুসা শত সিংকিয়াং-এর সমান। কিন্তু মেইলিগুলি পালাল কি করে?’
‘বাড়ির চারদিকটা ঘিরে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আকস্মিকভাবেই মেইলিগুলির ঘরে প্রবেশ করি। ঘরে মেইলিগুলি এবং তার আব্বা পেছন দরজার দিকে যায়। সংগে সংগে আমি গুলি করি। গুলি তার লাগে। সে দরজার ওপারে পড়ে যায়। এই সময় মেইলিগুলির বাবা মা আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বাধা দুর করার জন্যে অবশেষে দু’জনকেই হত্যা করতে হয়। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। বুঝলাম, দরজার এপারে আমাকে আটকিয়ে সে পালিয়েছে।
ছুটলাম তখন অন্য পথের সন্ধানে। এতে সময় খরচ হলো মিনিট খানেকের মত। যখন বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে পৌছলাম, ঐ সময়ে বাগানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মেশিনগানের গুলি শুরু হলো। বুঝলাম, আহত মেইলিগুলি প্রাচীর ডিঙিয়ে পালাতে পারেনি। এখন সে বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে। হাসি পেল আমার। প্রাচীরের বাইরে যারা পাহারায় ছিল, তাদেরকেও আমি প্রাচীরের ওপার থেকে তাকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দিলাম, যাতে প্রাচীর ডিঙিয়ে কোনও ভাবে ও পালাতে না পারে। ওর গুলি ফুরিয়ে যাবে এই ভেবে আমরা ধীরে সুস্থে এগুলাম। এক সময় গুলি সত্যিই থেমে গেল। বিভিন্ন দিক থেকে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে এগুলাম। যখন কাছাকাছি পৌছলাম, আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। দেখলাম মা-চু, মেইলিগুলি নিয়োজিত আহমদ মুসার রক্ষী, একটা পাথরের ওপর নির্বিকার ভাবে বসে আছে।
হতাশা, অপমানে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। আমি গিয়ে রিভলবারের বাট দিয়ে ওর ঘাড়ে একটা আঘাত করে বললাম, ‘বল মেইলিগুলি কোথায়? মা-চু দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘জানেন জেনারেল বরিস, আমাদের নবী (স.) কে মরুর কাফেররা তাঁর ঘর এইভাবে ঘিরেছিল। পরে সকাল হলে ঘরে গিয়ে দেখে হযরত আলী (রা) শুয়ে আছেন, নবী (স) নেই। তখন কাফেররাও হযরত আলীকে এমন ধরণের প্রশ্নই করেছিল। হযরত আলী কি জবাব দিয়েছিল জানেন?’ বুঝলাম সে আমাদের সময় নষ্ট করতে চাইছে, মেইলিগুলিকে পালিয়ে যেতে দেবারই এটা কৌশল। আমি তৎক্ষনাৎ রিভলবার তুলে ওর কপাল বরাবর একটা গুলি করে চিৎকার করে বললাম, ‘বাড়ি ও বাড়ির চারদিকে খোঁজ, পালাতে না পারে যাতে শয়তানী।’
কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল মেইলিগুলিকে নয়, মেইলিগুলি যে পথ দিয়ে পালিয়েছে সেই জায়গা। বাড়ির পেছন দিকে প্রাচীরের ঠিক উত্তর প্রান্তে প্রাচীরের নিচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেল। সুড়ঙ্গের বাইরের মুখটা একটা ছোট ঝোপের আড়ালে লুকানো। মুখে ষ্টিলের একটা সাটার, ভেতর থেকেই বন্ধ ও খোলা যায়। মা-চু মেশিনগানের গুলির শব্দে আমাদের সবাইকে যখন ওদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ফাঁকে মেইলিগুলি এদিক দিয়ে পালিয়েছে। রক্তের দাগ অনুসরণ করে দেখলাম, রাস্তায় উঠে সে গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে। রাস্তার পেশে এক জায়গায় বেশ রক্ত জমে আছে, কিন্তু তারপর রক্তের চিহ্ন নেই। রাগে-দুঃখে নিজের চুল ছেড়া ছাড়া আর করার কিছুই থাকল না।’
‘বলতেই হবে জেনারেল, মেইলিগুলি আহমদ মুসার যোগ্য স্ত্রী। দেখ আহত হবার পর কেমন করে তোমাকে বোকা বানাল। একেবারে যুদ্ধের স্ট্যাটেজী। মা-চু জীবন দিয়ে মেইলিগুলিকে বাঁচার নিরাপদ পথ করে দিল।’
‘মা-চু সেনাবাহিনীতে ছিল তুমি জান। সুতরাং কায়দা কৌশল তার অজানা নয়।’
‘কায়দার চেয়ে এখানে বড় মা-চু’র ত্যাগ। এই আত্মত্যাগ না থাকলে কৌশল কোন কাজে আসতো না জেনারেল।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ ওয়াং। মুসলমানরা এদিক দিয়ে সবার শীর্ষে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তো আমরা হারলাম তাদের চরিত্রের কাছে।’
‘কারণ কি বলত?’
‘ওদের ধর্মের লক্ষ্য ওরা বলে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। ইহকালীন শান্তি বলতে ওরা বুঝে ইসলামকে বিজয়ী করার মাধ্যমে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজে কেউ যদি জীবন দেয়, তাহলে পরকালীন মুক্তি সবচেয়ে বেশী নিশ্চিত হয়। শহীদরা ওদের কথায়, সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাত লাভ করে। এই কারণেই তারা হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে, যা আমরা পারিনা।’
ডাঃ ওয়াং কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় জেনারেল বরিসের ওয়্যারলেস বিপ বিপ করে সংকেত দিয়ে উঠল।
জেনারেল বরিস ওয়্যারলেসটি তুলে ধরল কানের কাছে।
কথা শুনতে শুনতে তার মুখ বদলে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠল তার মুখ। এক সময় সে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘সব অপদার্থের দল। আহত একটা মেয়ে লোক যাবে কোথায়? নিশ্চয় তোমাদের বোকা বানিয়ে শিহেজী থেকে আবার সে পালিয়েছে। শুন, যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে সে শিহেজীর পথেই পালিয়েছে। উরুমচি-উসু রাস্তা হয়ে পশ্চিমে কোথাও সরে পড়ার দু’টি পথই আছে। উসু-ট্যামেং পথে সে উত্তরে এগিয়ে তারবাগতায় পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে কাজাখস্তানে প্রবেশ করতে পারে। অথবা উসু-জিংগে উতাই পথে পশ্চিমে এগিয়ে হরকেস হয়ে সে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। আর যদি সে তা না করতে চায় তাহলে এই দুই রাস্তার মধ্যবর্তী অথবা আশে-পাশের কোন পাহাড় উপত্যকায় আশ্রয় নেবে। তোমাদের এসব কিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হবে। আর মনে রেখ, কোন ব্যর্থতা আমি দেখতে চাই না।’
কথা শেষ করেই অয়্যারলেস বন্ধ করে টেবিলে রেখে দিল।
‘শিহেজীর কি খবর জেনারেল?’
‘ভাল। বিনা ঝামেলায় শিহেজী দখল হয়ে গেছে। হানরা ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছিল। শিহেজীতে ওদের বসানো শেষ। সবকিছু ছেড়ে মুসলমানরা আগেই পালিয়েছে। অল্প কিছু ছিল। তাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। যারা বেঁকে বসেছিল তাদের জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে। ঐ অপদার্থদের জন্যে বুলেট খরচ ঠিক মনে করা হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো মেইলিগুলিকে পাওয়া যায়নি। অথচ আশা ছিল, ওখানেই তাকে পাওয়া যাবে।’
‘এমন চিন্তা করাই ভুল হয়েছে। যার ফলে অন্য কোন দিকে নজর রাখা হয়নি।’
‘তবে শয়তানীকে ছাড়ব না ওয়াং। সে যাবে কোথায়। সব এলাকা চষে ফেলব। তাকে না পেলে তো আহমদ মুসাকে পাবনা।’
‘কি জেনারেল, আহমদ মুসার জন্যে মেইলিগুলিকে চাও, না মেইলিগুলির জন্যে মেইলিগুলিকে চাও?’ ডাঃ ওয়াং-এর ঠোঁটে হাসি।
‘না ওয়াং আমি চাই আহমদ মুসাকে। শত সহস্র মেইলিগুলি বাজারে পাওয়া যাবে, কিন্তু আহমদ মুসা দুনিয়াতে একজনই আছে। এই লোকটিকে দুনিয়ায় রেখে আমি দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে চাই না। এও ঠিক, মেইলিগুলিই একমাত্র মেয়ে যে আমাকে অপমানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এর নিকেশ আমি করব, কিন্তু তার আগে আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে আমি সরিয়ে দিতে চাই। এটা শপথ আমার।’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আহমদ মুসা পাকা ফলের মত যেন তোমার হাতে এসে পড়ছে।’
‘তুমি নিশ্চিত থাক ওয়াং, সিংকিয়াং এর খবর পাওয়ার পর আহমদ মুসা স্পেনে আর একদিনও থাকবে না। তাকে আমি চিনি।’
‘তাহলে তো আমাদের সতর্ক হতে হয় জেনারেল?’
‘অবশ্যই। তুমি নির্দেশ পাঠাও সিংকিয়াং এর পশ্চিম সীমান্ত বিশেষ করে উত্তরে তারাবাগতাই পাহাড় থেকে দক্ষিণে তিয়েনশান পর্যন্ত গোটা সীমান্তের ওপর চোখ রাখতে হবে। আমার ধারণা, এই অঞ্চল দিয়েই আহমদ মুসা সিংকিয়াং এ প্রবেশ করতে চাইবে। আর সীমান্তের ওপারে আমার লোকদের আমি নির্দেশ দিয়েছি আলমা আতায় কান খাড়া করে রাখার জন্য। আর বিশেষভাবে উসু-টামেং রোডের মুখে ও দরজায় শহর এবং উসু-উতাই রোডের মুখে হরকেস ও পামফিলভ শহরের ওপর নজর রাখতে এবং তৈরী থাকতে।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল, তোমার সতর্কতা ও প্রস্তুতির জন্যে। আমার লোকদের আমি নির্দেশ পাঠাচ্ছি।’
ডাঃ ওয়াং এর কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল ডঃ ওয়াং এর পি. এ. মিস নেইলি।
নেইলি’র বয়স বিশ একুশের বেশী হবে না। পরনে মিনি স্কার্ট, গায়ে শার্ট। শার্টের বুকে কোন বোতাম নেই। ঠোঁটে এক টুকরো পোশাকি হাসি।
‘স্যার, গভর্ণর হাউজ থেকে একজন অফিসার রিসেপশনে এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।’ বলল নেইলি।
ডাঃ ওয়াং নেইলি’র মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই তো স্মার্ট লাগছে।’ বলে ডাঃ ওয়াং জেনারেল বরিসের দিকে চেয়ে বলল, নেইলি ক’দিন আগে কাজে যোগ দিয়েছে। তোমার পি.এ. মিস কিয়ান একে যোগাড় করে দিয়েছে। কাজে ভাল কিন্তু সেকেলে চিন্তার। স্কার্ট কিছুতেই হাটুর ওপর তুলবে না, গলাবন্ধ ফুলহাতা শার্ট ছাড়া পরবে না। আমি বলেছি, চাকুরী করলে এসব সেকেলেপনা চলবে না। দু’দিনে লজ্জার দেয়ালটা ভেংগে দিয়েছি।’
কথা শেষ করে ডাঃ ওয়াং নেইলিকে বলল, ‘কি বললে যেন তুমি?’
নেইলি তার আগের কথার পুনরাবৃত্তি করল।
‘গভর্ণর হাউজ থেকে? তুমি ঠিক শুনেছ?’
‘জি স্যার।’
‘কি ঝামেলা, এইনা আমি ওখান থেকে এলাম।’
‘গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার নিশ্চয় ওয়াং।’
‘ঠিক আছে এখানেই আসতে বলো।’ নির্দেশ দিল ডাঃ ওয়াং নেইলি’কে।
নেইলি চলে গেল ওপাশের কক্ষে- ডাঃ ওয়াং- এর রুমে, তারপর নিজের কক্ষে। তার ঠোঁটে সেই পোশাকি হাসিটি এখন আর নেই, তার বদলে সেখানে একরাশ ঘৃণা।
ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল নেইলি। ইন্টারকমে নির্দেশ দিল গেস্টকে ওপরে পাঠিয়ে দিতে।
অল্পক্ষণ পরেই একজন এ্যাটেনডেন্ট গভর্ণর হাউজ থেকে আসা অফিসারকে নেইলি’র কক্ষে পৌঁছে দিয়ে গেল।
মাঝ বয়সী মানুষ। রাশভারী চেহারা। সবদিক থেকে একজন নিরেট আমলা।
‘গুড ইভিনিং স্যার।’ উঠে দাঁড়িয়ে নেইলি স্বাগত জানাল অফিসারকে। বলল, ‘চলুন স্যার, স্যার জেনারেল বরিসের কক্ষে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
বলে তাকে নিয়ে গেল জেনারেল বরিসের রুমে।
সম্ভাষণ বিনিময় ও আসন গ্রহণ করার পর ডাঃ ওয়াং বলল, মিঃ ………
‘আমি চ্যাং ওয়া। গভর্ণরের পলিটিক্যাল সেক্রেটারী।’
‘মিঃ চ্যাং ওয়া এখানে কথা বলতে তো অসুবিধা নেই?’
‘জ্বি না।’
‘তাহলে বলুন। আর তর সইছে না। আমি তো এইমাত্র এলাম গভর্ণরের কাছ থেকে। ভাবছি, গভর্ণরের মন গললো কি না।’
‘স্যার এইমাত্র একটা মেসেজ দিয়েছেন আপনাকে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।’
‘চিঠি?’ জানতে চাইল ডাঃ ওয়াং।
‘জ্বি হাঁ। বলে মিঃ চ্যাং ওয়া পকেট থেকে একটা মুখ বন্ধ খাম বের করে ডাঃ ওয়াং এর হাতে তুলে দিল। বলল, ‘স্যার আমি যেতে পারি?’
‘যাবেন? চা যে খাওয়ানো হলো না?’
‘ধন্যবাদ স্যার।’ বলে উঠে দাঁড়ার চ্যাং ওয়া।
উঠে দাঁড়িয়ে ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিস হ্যান্ডসেক করল চ্যাং ওয়া’র সাথে।
বেরিয়ে গেল চ্যাং ওয়া।
ডাঃ ওয়াং ইনভেলাপ থেকে চিঠি বের করল। মেলে ধরল চারভাজ করা চিঠিটি।
টাইপ করা চিঠি।
পড়তে শুরু করল ডাঃ ওয়াং
‘প্রিয় ডাঃ ওয়াং,
আমি আদিষ্ট হয়ে আপনাকে জানাচ্ছি, শিহেজী উপত্যকা এবং উরুমুচি শহর সহ ডজন খানেক জনপদে গত কয়েক দিনে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রতি বেইজিং সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এসব স্থান থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ সাধন, তাদের সহায় সম্পত্তি লুণ্ঠন, হত্যাকান্ড সংঘটিত করা, ঐ সব জনপদে হানদের বসানো, ইত্যাদি ঘটনার সাথে সরকারের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। অথচ এই ঘটনা গুলো বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়লে সরকারকেই প্রবল চাপের মুখে পড়তে হবে। অতএব আপনাকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে, যা বহিঃর্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং যার জন্যে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে। আপনাদের জাতি ও দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু জাতিপ্রেম ও দেশ প্রেমের এই ধরণের প্রকাশ দেশ ও জাতির ক্ষতি করতে পারে।
শুভেচ্ছান্তে-
লি পিং
গভর্ণর, সিংকিয়াং।
চিঠিটি সরকারী প্যাডে লেখা এবং চিঠির শেষে যথারীতি সরকারী সিল ছাপ্পর রয়েছে।
চিঠি টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ডাঃ ওয়াং টেবিলে এক ঘুষি মেরে বলল, ‘পার হলে সবাই বলে পাটনি শালা।’
একটু থামল ডাঃ ওয়াং শুরু করল আবার, ‘ও সব নীতি কথা আমি জানি না। যদি সাধুই সাজতে হবে তাহলে লি ইউয়ান কি দোষ করেছিল। তাকে বিদায় দেয়া হল কেন? শোন জেনারেল, যা করবার, বুঝতে পারছি, তা তাড়া তাড়িই করে ফেলতে হবে। আমাদের পর্যায়ক্রমিক পরিকল্পনাকে জরুরী কর্মসূচীর রূপ দিতে হবে এবং এটা আজ থেকেই শুরু করতে হবে করতে হবে।’
বলে ডাঃ ওয়াং উত্তেজিতভাবে উঠে দাড়াল। কয়েক পা সামনে এগিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না কি জেনারেল তুমি ভয় পেলে? কথা বললে না যে?’
‘তোমার অবস্থান এবং আমার অবস্থান।’ বলতে শুরু করল জেনারেল বরিস, ‘এক নয় ওয়াং। তবে তুমি শুনে রাখ জেনারেল বরিস একবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলে সেখান থেকে আর ফিরে আসে না।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’ বলে ডাঃ অয়াং ঘুরে দাড়িয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

অনেক আগেই আহমদ ইয়াং- এর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে তার মাথায় এসে ভর করল হাজার চিন্তা। আজ তাদের কারাগার জীবনের দ্বিতীয় রাত। ভেবে পাচ্ছে না কেন এমন হল? বেইজিং এর ক্ষমতার হাত বদল হয়ছে ঠিক, কিন্তু সিংকিয়াং বিশেষ করে তার শ্বশুর লি ইঊয়ান তো বেইজিং এর কোন গ্রুপ পলিটিক্সের সাথেই জড়িত নন। এটা ঠিক যে মুসলমানদের তিনি সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রকার অন্যায় বা বৈষম্য চিন্তা তো সেখানে নেই। হানদের অনেক অন্যায় আবদার তিনি মেনে নেননি ঠিক কিন্তু তাদের প্রতিটি ন্যায্য অধিকার তিনি রক্ষা করেছেন। গৃহনির্মাণ খাতে হানদের তিনি এত সাহায্য করেছেন যে প্রতিটি হান পরিবার আজ নতুন বাড়ির মালিক। লি ইঊয়ান প্রথম গভর্নর যিনি সিংকিয়াং এর হানদের মধ্যে কুটির শিল্পের প্রবর্তন ঘটিয়েছেন এবং তাদের প্রতিটি সন্তানের লেখা পড়ার সুযোগ নিশ্চিত করেছেন। এরপরও তার ওপর বিপর্যয় নেমে এল কেন? হঠাৎ আহমদ ইয়াং এর চোখে রেড ড্রাগনের প্রধান ডাঃ ওয়াং এবং ‘ফ্র’ এর প্রধান জেনারেল বরিসের চিত্র ভেসে উঠল।
সেদিন ভোরে চারটায় যারা গভর্নর ভবনের উপর হামলা চালিয়েছিল সে তো তারা- ‘এফ’ তাদের বাহিনী। তারাই গভর্নর ও তার পরিবারকে বন্দী করে পরে সরকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। এটা পরিষ্কার বেইজিং এর পরিকল্পনা ও নির্দেশেই সব হয়েছে, কিন্তু ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের আগ্রহ বেশী প্রমাণিত হয়েছে। মনে হয় রেড ড্রাগন ও ‘ফ্র’ বেইজিং এর ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাদের কার্যসিদ্ধি করেছে। যদি তাই হয়, তাহলে সিংকিয়াং এর অবস্থা তো আজ ভয়ানক রূপ নিয়েছে।
এই সময় দেওয়াল ঘড়িতে পাঁচটা বাজার শব্দ হলো।
এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসল আহমদ ইয়াং। কি ব্যাপার আযান হলো না! পৌনে পাঁচটায় আজান, কোন আজানের শব্দও কোথা থেকে এল না! শোনা যাবে না এমন তো কোথা নয়। উরুমুচির গোটা আকাশ এ সময় আজানের শব্দে গম গম করে। তাহলে কি হলো আবার! রেড ড্রাগন আর ‘ফ্র’ এর কালো হাত কি মসজিদের কণ্ঠরোধ করা পরজন্ত বিস্তৃত হয়েছে? মুসলমানদের অবস্থা তাহলে সেখানে কি? ভাবতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠল আহমদ ইয়াং- এর।
হতাশ ভাবে আহমদ ইয়াং বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
শোবার পর চোখ গিয়ে পড়লো পাশের খাটে শোয়া নেইজেনের ওপর। ভোরের আলো ঘরের অন্ধকারকে অনেক ফিকে করে দিয়েছে। নেইজেন ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার দেহটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। নেইজেন কাঁদছে!
জেলখানায় আসার পর থেকেই যেন বোবা হয়ে গেছে নেইজেন। চোখে তার ফ্যাল ফেলে বোবা দৃষ্টি। যেন অনুভূতি শূন্য মাঝে মাঝে মনে হয় জেগে থেকেই যেন ঘুমাচ্ছে। এই বিপর্যয়, এই জেলখানা নেইজেন এর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। প্রচণ্ড ধরণের আঘাত তার পাবারই কথা।
তবে আহমদ ইয়াং যে ঘটনা আশংকা করেছিল ততটা খারাপ পরিবেশে জেলখানায় রাখা হয়নি। বিশাল উরুমুচি জেলখানার একটি বিশেষ বিভাগে ছোট ছোট অনেকগুলো বাংলো। চীনের কম্যুনিস্টদের স্বর্ণযুগ অর্থাৎ রেডগার্ড আন্দোলনের সময় বড় বড় রাজনীতিক, আমলা, বিজ্ঞানী, ভিআইপি যারা ভিন্ন মতাবলম্বী হলেও যাদের সম্পর্কে কম্যুনিস্টরা আশা ছাড়েনি, তাদেরকে স্বপরিবারে এখানে এনে অন্তরীন করে রাখা হতো এবং মগজ ধোলাই এর কাজ চলতো। এমন একটি বাংলোতেই গভর্নর লি ইঊয়ান সহ তাদেরকে রাখা হয়ছে। লি ইঊয়ান একক একটি কক্ষ পেয়েছেন, তার স্ত্রী ইঊজিনাও তাই। আহমদ ইয়াং ও নেইজেন এর ভাগে পড়েছে একটা রুম। রুমটা সাদামাটা হলেও সুন্দর। মেঝেতে কার্পেট আছে আছে এটাস্ট বাথ। খাওয়ারও খুব অসুবিধা নেই। দুই বেলা রান্না করা খাবার দিয়ে যায় বাবুর্চিরা। সকাল ও বিকালে নাস্তা খাইয়ে যায় তারা।
আহমদ ইয়াং শোয়া থেকে উঠল। নেমে এল বিছানা থেকে, বসল গিয়ে নেইজেন এর পাশে। টেনে এ পাশ ফিরাল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কষ্ট হচ্ছে নেইজেন?’
কথা বলল না নেইজেন। তার কান্না আরও বেড়ে গেল। দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
আহমদ ইয়াং নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমরা বন্দি বটে তবে আল্লাহ আমাদের ভালো রেখেছেন। বাইরে অবস্থা খুবই খারাপ বলে মনে হচ্ছে উঠে। চল, নামাজ পড়ি।’
নেইজেন ধড়মড় করে উঠে বসল। কান্না জড়িত গলায় বলল, ‘কেমন করে বুঝলে বাইরে অবস্থা খুবই খারাপ?’
‘উরুমুচির কোন মসজিদেই আজ ফজরের আজান হলো না নেইজেন। মনে হয় গতকাল ও কোন আজান আমি শুনিনি।’
‘তার অর্থ ?’
‘তার অর্থ নামাজিরা পালিয়েছে, ইমাম মুয়াজিন সবাই পালিয়েছে, নামাজ হচ্ছে না মসজিদে। অথবা আজান, নামাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল নেইজেনের, বিমূড়ের মত তাকিয়ে রইল আহমদ ইয়াং এর দিকে। এক সময় তার ঠোঁট কাপতে লাগল। বলল, ‘মেইলিগুলি আপার তাহলে সর্বনাশ হয়েছে।’ ব্যর্থ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নেইজেন।
বিদ্যুৎ শকের মতই কথাটা এসে আঘাত করল আহমদ ইয়াংকে। মেইলিগুলির কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। তাদের চেয়েও বড় বিপদ মেইলিগুলির জন্য বরাদ্দ এ কথা তার মনেই আসেনি। অথচ ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসকে দেখার পর এই কথাটা তার প্রথম মনে আশা উচিৎ ছিল। জেনারেল বরিস সবাইকে ছাড়তে পারে সব ছাড়তে পারে কিন্তু আহমদ মুসা এবং তার স্ত্রীকে ছাড়তে পারে না। আতংক আশংকায় গোটা শরীর কেঁপে উঠল আহমদ ইয়াং এর সেই সাথে ভেসে উঠল তার চোখের সামনে আহমদ মুসার মুখ মেইলিগুলির যদি কিছু হয় কি জবাব দিব আমরা তাঁকে। দু’চোখ ফেটে ঝর ঝর করে নেমে এত অশ্রু। বলল, ‘সত্যি বলেছ নেইজেন মেইলিগুলির যদি কিছু হয়!’ আহমদ ইয়াং এর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল কান্নায়।
নেইজেন মুখ তুলল। আহমদ ইয়াং এর দু টি হাত চেপে ধরে বলল, ‘না, তুমি কাঁদতে পারবে না। তুমি আমাকে আসার কথা শোনাও। বল, মেইলিগুলি আপার কিছু হয়নি। ভাইয়ার জন্যেই মেইলিগুলির কোন দুঃসংবাদ আমরা সইতে পারবোনা।’
‘কেঁদোনা জেন, সবার ওপর তো আল্লাহ আছেন। তিনি আমাদের সাহায্য করবেন।’
একটু থেমে চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘চল নামাজ পড়ি।’
আহমদ ইয়াং ও নেইজেন দু’জনেই বিছানা থেকে উঠল।
সেদিনই নাস্তার টেবিলে।
টেবিলে নাস্তা ও প্লেট সাজিয়ে রেখে বাবুর্চি চলে গেছে। তারা চলে যাবার পর লি ইউয়ান ও অন্যান্য সকলে নাস্তা খাবার জন্য এসেছে। খেয়ে চলে গেলে ওরা এসে সব নিয়ে ও টেবিল সাফ করে চলে যাবে। এই ফাঁকে কখনো কখনো সাক্ষাত ঘটে যায়। কিন্তু কথা হয়না। কথা বলা নিষেধ তাদের জন্য। বাংলোর গেটে ২৪ ঘণ্টা দু’জন প্রহরীর পাহারা। গেট থেকে ডাইনিং রুমের প্রতিটি ইঞ্চি দেখা যায় তাদের জন্য দৃষ্টি সব সময় এদিকে নিবন্ধ থাকে।
পাহারাদর পুলিশ ও সৈনিক গোটা জেলখানায় সবাই হান।
বাবুর্চিরাও তাই। ঊইঘুর, হুই প্রভৃতি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাউকেই বিশ্বাস করা হচ্ছে না।
নাস্তার টেবিলটি গোল।
লি ইঊয়ান ডান দিকে বসেছে আহমদ ইয়াং, বাম পাশে বসেছে নেইজেন এবং নেইজেনের পাশে বসেছে তার মা ইউজিনা।
নাস্তার জন্যে টেবিলে সাজানো আছে বেকারী ব্রেড, মাখন, ডিম এবং চা।
বেতের একটা ছোট্ট সুন্দর ঝুড়িতে সাদা কাগজ বিছিয়ে তার ভেতর আট পিস ব্রেড। নেইজেন রুটি সবার প্লেটে তুলে দিল। শেষ রুটি খণ্ডটি তুলেই চমকে উঠল নেইজেন। দেখল, রুটির নিচে একটা চারভাজ করা কাগজ। তার মন যেন আপনাতেই বলে উঠল ওটা একটা চিঠি। হঠাৎ তার মনে হলো গেট থেকে চারটে শ্যেন দৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কোন দিকে মাথা তুলতেও ভয় পেল। তাড়াতাড়ি সে হাত থেকে রুটিটি ঝুড়িতে সেই চিঠির ওপর রেখে ঝুড়িটি নিজের কাছে টেনে নিল।
নেইজেন-এর মুখটা আহমদ ইয়াং এর দৃষ্টি এড়ায়নি। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল নেইজেন-এর দিকে। নেইজেনও তার দিকে চোখ তুলেছিল। বুঝতে পারল নেইজেন আহমদ ইয়াং এর মনের ভাব। নেইজেন তাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল।
খাওয়ার এক পর্যায়ে নেইজেন রুটির ঝুড়ি থেকে সেই ভাজকরা কাগজ সমেত রুটি তুলে নিয়ে নিজের প্লেটে রাখল। তারপর রুটি খেতে খেতে এক সময় রুটির নিচ থেকে কাগজটি হাতে নিয়ে মুঠোর মধ্যে দলা পাকিয়ে ফেলল। তারপর এক ফাঁকে তা সে গাউনের পকেটে রেখে দিল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নেইজেন। মুখ না বাড়িয়েই একটু আড় চোখে তাকিয়ে দেখল, গেট থেকে ওরা দুজন পাথরের মুর্তির মত এদিকে তাকিয়ে আছে।
নাস্তা শেষে সবাই উঠে এল নাস্তার টেবিল থেকে। লি ইউয়ান ড্রইংরুমে ঢুকতে যাচ্ছিল। নেইজেন বলল, আব্বা তুমি আমাদের ঘরে একটু এস।
সবাই চলল নেইজেনদের রুমে।
যেতে যেতে লি ইউয়ান বলল, ‘নেইজেন, তোমাকে আজ খুব বেশী মলিন লাগছে। খুব চিন্তা করছ বুঝি?’
নেইজেন কোন উত্তর দিল না।
‘আব্বা, ও আজ খুব কেঁদেছে।’ বলল আহমদ ইয়াং।
‘তুমি বুঝি কাঁদনি?’ সংগে সংগে পাল্টা অভিযোগ ছুড়ে দিল নেইজেন।
‘কেন, তোমরা কেঁদেছ কেন?’
‘আমরা ভাবছি মেইলিগুলির কিছু হলে আহমদ মুসাকে কি জবাব দিব আমরা।’ আহমদ ইয়াংই জবাব দিল।
‘তাই তো। মেইলিগুলির কথা এ দুদিনে আমার স্মরণই হয়নি। ডাঃ ওয়াং আর জেনারেল বোরিসের সব ক্রোধ তো মেইলিগুলির ওপর পড়বে।’
একটু থামল লি ইউয়ান। বলল তারপর, ‘আমরা তো কিছুই জানতে পারছি না বাইরের খবর। অহেতুক চিন্তা করে তো লাভ নেই। হয়তো হতে পারে কিছুই হয়নি।’
ঘরে ঢুকে লি ইউয়ান ও নেইজেন দু’টি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলল লি ইউয়ান, ‘তোমার ঘরে আসতে বললে কেন নেইজেন?’
নেইজেন পকেট থেকে সেই দলা পাকানো কাগজটি বের করে ধীরে ধীরে খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।
সবাই এটা লক্ষ্য করেছে। সবার দৃষ্টি নেইজেনের দিকে। লি ইউয়ান বলেই বসল, ‘কি ওটা নেইজেন?’
কাগজের দিকে নজর পড়ার পর নেইজেনের মুখের আলো যেন হঠাৎ করে নিভে গেল। বেদনায় বিবর্ণ হয়ে গেল তার মুখ। কাগজটি তার হাত থেকে পড়ে গেল। বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল নেইজেন।
আাহমদ ইয়াং নেইজেন এর পেছনেই দাড়িয়ে ছিল। সে দ্রুত এগিয়ে এসে কাগজটি তুলে নিয়ে তার ওপর চোখ বুলাল। পড়ে আহমদ ইয়াং এরও মুখের ভাব পাল্টে গেল। কপাল তার কুঞ্চিত হলো, ঠোট দুটি কেপে উঠল। বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে আব্বা, বলে কাগজটি আহমদ ইয়াং তুলে দিল লি ইউয়ানের হাতে।
লি ইউয়ান ও নেইজেন দুজনেই ঝুকে পড়ল কাগজের ওপর। মাত্র কয়েকটি লাইন লেখাঃ
“বাইরের অবস্থা খুবই খারাপ। শিহেজী সহ বহু জনপদ বিরাণ হয়ে গেছে। মেইলিগুলিরব আব্বা-আম্মা নিহত। আহত মেইলিগুলি পালিয়ে গেছে, অথবা নিখোজ।”
চিঠিতে যেমন কোন সম্বোধন নেই, তেমনি নেই স্বাক্ষরও।
‘চিঠি কোথায় পেলে নেইজেন?’
‘ব্রেড এর ঠোঙ্গায়।’
‘ব্রেড এর ঠোঙ্গায়?’
‘জ্বি আব্বা, ঠোঙ্গার একদম তলায়। এক খণ্ড ব্রেড এর নিচে সুন্দর ভাজ করে রাখা ছিল।’
‘কে রাখতে পারে?’
‘আমার মনে হয় বাবুর্চিদেরই কেউ একজন।’ বলল আহমদ ইয়াং।
‘কেন বড় আর কেউ হতে পারে না?’ বলল লি ইউয়ান।
‘হতে পারে। বাবুর্চিদের নজর এড়িয়ে কেউ এভাবে রাখতে পারে। কিন্তু এ সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। কারণ তাতে ঝুকি আছে, বাবুর্চিদের কাছে ধরা পড়ার ভয় আছে। বাবুর্চিদের কেউ একজন হলে এ ভয় তার থাকে না।’
‘ঠিক বলেছ ইয়াং।’
‘ডাঃ ওয়াংরা এতবড় খুনী, এতবড় জঘন্য? নিরপরাধ মানুষকে এভাবে তারা মারতে পারে?’ বলল নেইজেন।
‘ওরা পশু মা। তার ওপর আহমদ মুসার ওপর ওদের পর্বত প্রমাণ প্রতিহিংসা।’
‘এখন কি হবে, বাইরে তো সবই শেষ। আহত মেইলিগুলি আপা কোথায় যাবেন, কে তাকে আশ্রয় দেবে?’ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল নেইজেন।
নেইজেন এর এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? সবারই তো একই প্রশ্ন? সবাই নির্বাক রইল। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলো না।
কিছুক্ষণ পর লি ইউয়ান উঠতে উঠতে বলল, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা করা ছাড়া তো আমাদের করার কিছু নেই। আল্লাহকেই আমাদের ডাকতে হবে।’
লি ইউয়ান এবং নেইজেন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

একদিন পর। একই ভাবে আরেকটি চিঠি পাওয়া গেল। সে চিঠিতে পাওয়া গেল গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা তথ্য। বলা হয়েছে, ডাঃ ওয়াংরা নতুন গভর্নরের ওপর ভয়ানক ক্রুব্ধ। ক্ষমতাচ্যুত লি ইউয়ান ও তার পরিবারকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এটাই তার কারণ। নিজেদের হাতে শাস্তি দেবার জন্যে তারা লি ইউয়ান ও তার পরিবারের লোকদের হাতে পাওয়ার জন্যে চেষ্টা শুরু করেছে।
এ খবর বিশেষ করে নেইজেন ও তার মা ইউজিনাকে আতংকিত করে তুলল। তাদের হাতে পড়ার চেয়ে যমের হাতে পড়া ভাল।
পরবর্তী কি খবর আসে তার জন্যে তারা সকলে উদগ্রীব হয়ে উঠল।
কিন্তু একদিন, দুদিন করে চার পাচদিন গত হল কোন চিঠি আর আসে না। প্রতিদিনই তারা ব্যাকুলভাবে রুটির ঝুড়ি তালাশ করে, হতাশা ছাড়া আর কিছুই মেলে না।

অষ্টম দিন।
সকাল ৮টা।
লি ইউয়ান টয়লেটে ঢুকতেই কমোডের ঢাকনির ওপর বহু ভাজ করা এক দলা কাগজের ওপর গিয়ে নজর পড়ল। এমন কাগজ কমোডের ঢাকনির ওপর এল কি করে! বিস্মিত লি ইউয়ান গিয়ে কাগজের দলাটা তুলে নিল। সবচেয়ে বিস্মিত হলো লি ইঊয়ান যে, দুমিনিট আগে টয়লেট পরিস্কার করতে আসা লোকরা তাদের কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেছে। তাহলে কি ওদের কেউ এটা…………
মনে একটা আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল লি ইউয়ানের। টয়লেটে দাড়িয়েই ঝটপট খুলে ফেলল ভাজ করা দীর্ঘ চিঠি।
উত্তেজিত লি ইউয়ান চিঠিটা হাতে ধরেই বেরিয়ে এল টয়লেট থেকে। সামনেই পেল আহমদ ইয়াং ও নেইজেনকে। ওদের দিকে তাকিয়ে ‘তোমরা এস’ বলে লি ইউয়ান নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
লি ইউয়ানের হাতের খোলা কাগজটা আহমদ ইয়াং ও নেইজেন এরও চোখে পড়েছিল। একরাশ কৌতুহল নিয়ে তারাও লি ইউয়ানের পেছনে পেছনে এসে ঘুরে ঢুকল।
সবাইকে এক সাথে ঘরে ঢুকতে দেখে এবং সবার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে ইউজিনা চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার? তোমার হাতে ওটা কি কাগজ লি?’
চেয়ারে বসতে বসতে লি ইউয়ান বলল, ‘টয়লেটে কমোডের ঢাকনার ওপর এই চিঠি পেলাম। আগের সেই একই হাতে লেখা।’
‘কমোডের ওপর?’ সমস্বরে বলে উঠল ইউজিনা, নেইজেন এবং আহমদ ইয়াং।
ও নিয়ে আলোচনা পরে করা যাবে, এস আগে চিঠি পড়া হোক।
বলে লি ইউয়ান চিঠি পড়তে শুরু করল-
“এই যে চিঠিটা লিখছি তা আপনি পাবেন কিনা জানি না। আমার পুরানো সহকর্মী যিনি জেলের একজন কয়েদী এবং ক্লিনার। হঠাৎ করে তার সাথে দেখা হলো। তিনি আমার এ চিঠি আপনার কাছে পৌছে দিয়ে আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা পুরণে রাজি হয়েছেন।
আমি অধম আপনার কোন উপকার করব সে আশা করিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম আপনার কাছে কিছু পৌছিয়ে আমার মনের জ্বালা জুড়াতে। কিন্তু পারলাম না। তৃতীয় চিঠিটিই ধরা পড়ে গেল। আজ বিচার হয়েছে। আগামী কাল আমার কোর্ট মার্শাল। বিশ্বাসঘাতকের শান্তি মৃত্যুদণ্ড, সে শাস্তিই আমি পেয়েছি। মরতে আমার একটু দুঃখ নেই। কিন্তু ওরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলেছে, এটাই আমার বুকে লেগেছে। আমি বিশ্বাসঘাতক নই। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমার একথা। আমি যা করতে চেয়েছিলাম বিশ্বাস রক্ষার জন্যেই করতে চেয়েছিলাম।
সাংহাই এর এক এতিমখানায় আমি মানুষ। যখন বুদ্ধি হলো মনে জাগল বাপ – মা কোথায়? কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি। প্রায় সবারই আত্মীয় স্বজন বা আপনজন কেউ না কেউ আসত। কিন্তু আমার জন্যে কেউ আসেনি। খুব অভিমান হতো। খুব হিংসা হতো অন্যদের। কারও সাথে মিশতাম না, নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। মনে আনন্দ ছিল না, আত্মবিশ্বাস ছিল না। তাই লেখা পড়ায় ভাল করতে পারলাম না। ক্যাটারিং এ ট্রেনিং দায়ানো হলো। আঠার বছর বয়সে সেনাবাহিনীর ক্যাটারিং বিভাগে ভর্তি করানো হলো।
ইয়াতিমখানা থেকে বিদায় নেবার দিন ইয়াতিমখানার গ্র্যান্ডমাদার তাঁর কক্ষে আমাকে ডাকলেন। আমি গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালে আমার হাতে একটা বড় বাদামী ইনভেলাপ তুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্যে তোমার মায়ের দেয়া আমানত, আমার কাছে এতদিন ছিল।’
গ্র্যান্ডমাদারের ঐ বাক্য আমার গোটা হৃদয়ে, গোটা সত্তায় কি যে এক জ্বালাময় আনন্দ ছড়িয়ে দিল! আমি চিঠি নেবার জন্যে হাত তুলতে পারলাম না। মুখ ফেটে বেরিয়ে এল, আমার মা ছিল? ‘মা’ শব্দ বেরুবার সাথে একটা ভয়ংকর উচ্ছ্বাস এসে আমাকে ভাসিয়ে দিল। আঠার বছরের সব অপেক্ষা, সব আবেগ, সব অভিমানের জমাট পাহাড় যেন অশ্রুর ঢল হয়ে নেমে এল আমার দু’ চোখ দিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বসে পড়লাম দু’হাতে মুখ ঢেকে।
গ্র্যান্ডমাদার আমার মাথায় হাত বুলালেন। অনেক সান্ত্বনা দিলেন। বললেন, ‘তোমার মায়ের সাথে হাসপাতালে ঘন্টা খানেকের পরিচয়। খুব ভাল মেয়ে ছিলেন।’
আমি উঠে বসলাম চেয়ারে। গ্র্যান্ডমাদার ফিরে গেলেন তাঁর আসনে।
‘হাসপাতালে কেন, তিনি কি করতেন?’ আমি বললাম।
‘তিনি আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন।’ বললেন গ্র্যান্ডমাদার।
‘কিসে কিভাবে আহত?’
‘মারাত্মক ছুরিকাহত ছিলেন।’
‘কেন?’
‘সেটা জানার সুযোগ পাইনি বাছা। তোমাকে ইয়াতিমখানায় দেবার জন্যে তিনি শেষ মুহুর্তে আমাকে ডেকেছিলেন।’
‘তাঁর আর কেউ ছিল না?’
‘না, এক বছরের এক তুমি ছাড়া আর কেউ ছিল না।’
আবার আমার বুক থেকে প্রবল একটা উচ্ছ্বাস উঠে আসতে চাইলে চোখ-মুখ ফুঁড়ে। কথা বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। পরে বললাম, ‘তারপর গ্র্যান্ডমাদার?’
‘উনি তোমাকে এবং এই ইনভেলাপ আমার হাতে তুলে দিলেন।’
‘তারপর কি হল?’
‘ও টুকু আর শুন না বাছা।’
‘আমি জানি, তারপর তিনি……।’ চেষ্টা করেও সেদিন আম্মার মৃত্যুর কথাটা উচ্চারণ করতে পারিনি। গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
অনেক পরে চোখ মুছে বললাম, ‘এসব কথা এতদিন কেন বলেননি, এই ইনভেলাপ এতদিন কেন দেননি গ্র্যান্ডমাদার?’
‘তোমার মা’র নির্দেশ ছিল তুমি কর্মজীবনে প্রবেশ করবার আগে যেন এ সব কথা তোমাকে না বলি, এই ইনভেলাপ তোমাকে দেই।’
ধন্যবাদ দিয়ে ইনভেলাপ নিয়ে উঠে দাড়ালাম। তিনি বললেন, ‘বাছা, ইনভেলাপে কি আছে আমি জানি না। নিজের পরিচয়কে গর্বের মনে করবে। আত্ম-পরিচয়ই মানুষের শক্তি।’
আবার ধন্যবাদ জানিয়ে আমি গ্র্যান্ডমাদারের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। গ্র্যান্ডমাদার ঠিকই বলেছেন। আমার গোটা শূন্য জীবনটাকে ভরে দিয়েছে এই ইনভেলাপ। এতদিন যে আত্মবিশ্বাস আমার ছিল না, সেই আত্মবিশ্বাস যেন ফিরিয়ে দিল এই ইনভেলাপ।
আমার প্রথম কর্মস্থল হলো মংগোলিয়া সীমান্তের কান্ত প্রদেশে। ওখানে গিয়ে প্রথম রাতেই আমার ঘরে বসে ইনভেলাপটি খুললাম।
ইনভেলাপ থেকে বেরুল, একটা চিঠি, কোন বইয়ের দুইটি ছেড়া পাতা, ৫শ’ ইউয়ানের একটা নোট এবং একটা ফটোগ্রাফ।
আমি প্রথমে ফটো তুলে পাগলের মত হয়ে গেলাম। আমার আব্বা আম্মার ফটো কি? হ্যাঁ তাই। ফটোর নিচে ক্যাপশান – ‘তোমার আব্বা-আম্মা।’ ফটোতে হাস্যোজ্জল এক তরুণ ও তরুণী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দু’জনেরই পরনে বিয়ের পোশাক। কতক্ষন ফটোর দিকে তাকিয়েছিলাম কে জানে। যখন সম্বিত ফিরে পালাম দেখলাম, চোখ থেকে কখন ফোটা ফোটা অশ্রু নেমে ফটোর ওপর গিয়ে পড়েছে। সে সময়ের মনের ভাব বুঝাতে পারবো না। মনে হয়েছিল, জীবনের সব চাওয়া পাওয়া যেন পূর্ণ হলো। ফটোর উল্টো পিঠে দেখলাম লেখা – আব্বার নাম উসামা চ্যাং এবং আম্মার সাযেয়া জিয়াং। নাম বিদঘুটে মনে হলো আমার কাছে।
তারপর চিঠি হাতে তুলে নিলাম আমি। সুন্দর হস্তাক্ষর। আম্মার হাতের লেখা? পড়তে শুরু করলাম-
বেটা জায়েদ চ্যাং,
আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে এই চিঠিটা লিখে যাচ্ছি। তুমি যদি বেঁচে থাক, তাহলে আমার পরিচয় যাতে তুমি পাও এই আশায়।
কানশুর উমেন – এ আমাদের সুখের সংসার ছিল। অভাব ছিল না কিছুরই। সময় পাল্টে গেল। আমরা মুসলমান এই পরিচয়ই হয়ে দাঁড়াল আমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। ছোট খাট অনেক অত্যাচার সইলাম। অবশেষে দুর্যোগ একদিন এল। দলে দলে হানরা এসে এক রাতে চড়াও হলো আমাদের গ্রামের ওপর। হত্যা – লুন্ঠনের মহোৎসব চলল। আমার বুক ফাটা কান্না পায়ে দলে ওরা হত্যা করল তোর বাপকে। তোর বাপ ছিল হুই, আর আমি ছিলাম হান বংশোদ্ভুত। হান বলেই আমাকে ওরা মারলো না। কিন্তু সেদিন মরলেই ভাল ছিল। সেদিন রাতের আধারেই সদ্যজাত তোকে বুকে নিয়ে বিরাণ বাস্তুভিটা ছেড়ে একটা পুটলি সম্বল করে ট্রেনে উঠলাম দেশের পূর্বাঞ্চলে আসার জন্যে। বাঁচার সংগ্রাম শুরু হলো। সম্মান নিয়ে বাঁচা যে কত কঠিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। শেষ পর্যন্ত সম্মান এবং জীবন এক সাথে ধরে রাখতে পারলাম না। সম্মান বাচালাম, কিন্তু জীবন হারালাম। তোমাকে আল্লাহর হাতে রেখে যাচ্ছি।
এই চিঠির সাথে পাঁচশ ইওয়ানের একটা নোট রেখে যাচ্ছি। ওটা তোমার পুণ্যবতী দাদীর স্মৃতি। যে দিন নব বধূ হয়ে আমি শ্বশুর বাড়ি এসেছিলাম, সেদিন এই উপহার তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। শত বিপাকেও আমার পূণ্যবতী শ্বাশুড়ির স্মৃতি আমি নষ্ট করিনি। আর রেখে যাচ্ছি তোমার ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের দু’টো ছেড়া পাতা। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় লুন্ঠিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির উঠান থেকে ও দু’টো পাতা আমি কুড়িয়ে এনেছিলাম। তোমার দাদার কাছ থেকে পাওয়া আমাদের কুরআন শরীফের পাতা ঐ দু’টো। এই সাথে রেখে যেতে পারলাম তোমার বাপ-মার একটা ফটো। বাপ মাকে দেখার তো ভাগ্য হলো না। অন্তত ফটো দেখে সান্ত্বনা হবে তোমার পিতা-মাতা ছিল।
আর লিখতে পারছিনা। খুবই কষ্ট লাগছে তোমাকে এভাবে রেখে যেতে। দুঃখের সান্ত্বনা এই যিনি এভাবে নিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই তোমার জন্যে থাকলেন। আর তাঁর চেয়ে বড় হেফাজতকারী আর কেউ নেই।
তোমার মা
সাযেয়া জিয়াং”
প্রচন্ড এক ভাবালুতার মধ্যে চিঠি পড়া শেষ করলাম। কতটা সময় যে গেল তারপর অনুভূতি শুন্যতায়, তা বলতে পারবো না। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, তখন মনে হলো আমি নতুন মানুষ। আগে ছিলাম আমি একজন গর্বিত হান, এখন নির্যাতীত মুসলিম সমাজের একজন। আমার নতুন পরিচয় আমার জগত সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল। একটা প্রশান্তি এসে আমার হৃদয়কে শীতল করে দিল। মনে হলো, কষ্ট, লাঞ্চনা ও অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিজের ঠিকানা খুজে পেলাম। প্রথমে কুরআন শরীফের দু’টো পাতা তুলে নিয়ে চুমু খেলাম। পড়তে ত পারব না। দীর্ঘক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তারপর দাদীর টাকার সে নোটটি মুখে বুকে ছোয়ালাম। সব চেয়ে আমি বিস্মিত হলাম, আম্মা যেখান থেকে এসব জিনিস নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে এসেই আমি এ জিনিসগুলো ফিরে পেলাম। চাকুরীতে যোগদানের পর আমার প্রথম পোস্টিং হলো কানশুর উমেন – এ।
আমার আব্বা-আম্মার উমেন এবং আজকের উমেন এক নয়। উমেন শহরে এখন আর কোন মুসলমান নেই। বহু চেষ্টা করেও আমার আব্বা-আম্মার বাড়ির কোন চিহ্ন খুজে পাইনি।
আজ ১৭ বছর সেনাবাহিনীর ক্যাটারিং বিভাগে দক্ষতার সাথে চাকুরী করছি। আমার দায়িত্বের যেমন বিশ্বাস রেখেছি, তেমনি আমার ঈমানের প্রতিও আমি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। জাতির জন্য কোন কাজ করতে পারলে, আমার জাতির কারও উপকার করতে পারলে গৌরব বোধ করেছি, মনে অফুরন্ত তৃপ্তি ও শান্তি পেয়েছি। মনের সেই তৃপ্তি ও শান্তির জন্যেই আমি আপনার কাছে খবর গুলো পাঠিয়েছি। এতে খুব উপকার হয়নি, কিন্তু আমি শান্তি পেয়েছি। আমার যে চিঠি ধরা পড়েছে তাতে আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম, আমি টের পেয়েছি কে বা কারা আপনাকে জেলখানা থেকে কিডন্যাপ অথবা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।
আপনার প্রয়োজন নেই এমন অনেক কথা আপনাকে আপনার প্রয়োজন নেই এমন অনেক কথা আপনাকে শুনালাম। দুনিয়াতে কেউতো নেই আমার, কার কাছে কথাগুলো রেখে যাব। না রেখে যেতে পারলে যে আমার সাথে সাথে কথাগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে।
আল্লাহর কাছে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু পাথেয় কিছু নেই। কুরআন জানিনা, নামাজ কোনদিন পড়িনি, জানিও না পড়তে। আল্লাহর কাছে মাফ চাইব, সে ভাষাও জানিনা। আমার অসহায় ঈমান কি কোন মূল্য পাবে তাঁর কাছে?
আপনার জাতির দুর্ভাগা একজন
যায়েদ উ-চ্যাং।”
লি ইউয়ান চিঠি পড়া শেষ করে রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছে সবার দিকে তাকাল। দেখল,সবার চোখ দিয়েই অশ্রু গড়াচ্ছে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
‘দুর্ভাগা বেচারা!’ অনেক্ষণ পর কথা বলে উঠল নেইজেনের মা ইউজিনা।
‘এ মৃত্যু কি শহীদের মৃত্যু নয়?’ বলল নেইজেন।
‘নিশ্চয় এটা শহীদের মৃত্যু, জাতির কাজেই জীবন দিল যায়েদ উ-চ্যাং।’ কান্না চাপতে চাপতে বলল আহমদ ইয়াং।
‘আমরা এখন যখন কথা বলছি, তখন আমাদের এই যায়েদ এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। এস আমরা দোয়া করি তার জন্যে।’ নরম কন্ঠে বলল লি ইউয়ান।
বলে লি ইউয়ান তার দু’টি হাত উপরে তুলল।
তার সাথে সাথে ইউজিনা, নেইজেন ও আহমদ ইয়াং সবার হাতই উপরে উঠল।

Top