১৫. আবার সিংকিয়াং

চ্যাপ্টার

মেইলিগুলির গাড়িটা বিশ্রী শব্দ করে থেমে গেল। ফুয়েল ট্যাংকার শুন্য।এক ফোটাও তেল নেই।
ফুয়েল ট্যাংকারের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল মেইলিগুলি। আঁতকে উঠার সাথে সাথে আল্লাহর শুকরিয়াও আদায় করল। এতদূর আসতে পেরেছে সে।
গাড়িটাকে সে আল্লাহর মহা দান হিসাবে পেয়েছে। ঐ ভাবে সে রাস্তায় গাড়ি পাবার কথা নয়। সুড়ঙ্গ পথে বাড়ি থেকে পালিয়ে রাস্তায় উঠেই এই প্রাইভেট ট্যাক্সিকে সে দাঁড়ানো দেখতে পায়। প্রথমে ভয় পেয়েছিল শ্ত্রুর ট্র্যাপ ভেবে। পরে দেখে ভাড়ার ট্যাক্সি।
দ্রুত চারদিকে তাকায় মেইলিগুলি। কিন্তু কাউকে দেখে না।তাহলে নিশ্চয় ড্রাইভার পাশের কোন বাড়িতে কোন কাজে গেছে।
মেইলিগুলির আর চিন্তা করার অবসর নেই কিংবা ড্রাইভারের জন্যে সে অপেক্ষা করতে সম্মত হবে কিনা, সেও একটা প্রশ্ন।
সুতরাং মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে মেইলিগুলি। বাম পাটা পুড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়। গুলি লেগেছে বাম পায়ের হাঁটুর নিচের গিটটায়। স্রোতের মত রক্ত নামছে আহত স্থান থেকে।মেইলিগুলি সিটের ওপর পড়ে থাকা তোয়ালে দিয়ে দ্রুত ক্ষতস্থান সাধ্যমত কষে বাঁধল। অনেক রক্ত গেছে ইতিমধ্যে, যে কোন ভাবে রক্ত বন্ধ করতে হবে।
ক্ষতস্থানটি বেঁধে স্টার্ট দিল মেইলিগুলি। বিবেক একটু বিদ্রোহ করেছিল, হয়ত কোন গরীব বেচারাকে বিপদে ফেলে সে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পরে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিল এই বলে যে, সময় এলে অবশ্যি তার সব ক্ষতিপূরণ করে দেবে।
গোটা পথে তার ফুয়েল ট্যাংকারের দিকে তাকাবার কথা মনে হয়নি। হলেই বা সে কি করত। না ছিল দাঁড়াবার সময়, না পেট্রল কেনার মত টাকা। যে অবস্থায় সে আব্বা-আম্মার সাথে বসে গল্প করছিল সে অবস্থায় তাকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। ভাগ্য ভাল রিভলবারটা হাতের কাছে পেয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। অবশ্য শিহেজী উপত্যকায় গেলে হয়তো তেল এবং আশ্রয় পাওয়া যেতো। কিন্তু মেইলিগুলি ওখানে যাওয়া ঠিক মনে করেনি। সে বুঝে নিয়েছে, বড় রকমের কোন রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন না ঘটলে তার বাড়িতে এই হামলা হওয়া সম্ভব ছিলনা। আহমদ মুসা চলে যাবার পর থেকে গভর্নর লি ইউয়ানের নির্দেশে সেনাবাহিনীর ৫ সদস্যের একটা ইউনিট সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছে। সে সৈনিকরা জেনারেল বরিসদের কোনই বাধা দেয়নি। বাধা দিতে না পারলে তাদেরকে বিপদ সংকেত দিতে পারতো, তাও দেয়নি। অর্থাৎ সে সেনা ইউনিট কে প্রত্যাহার বা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তাই যদি হয়, বড় রকমের রাষ্ট্রীয় কোন প্রতিকুল পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাহলে তার বাড়ির মত শিহেজীও বিপদ্গ্রস্ত হবে। এ কারণেই শিহেজী উপত্যকার দিকে গাড়ি ঘুরিয়েও আবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসে সে শিহেজী উপত্যকা বাঁইয়ে রেখে উসু-তাসেং পাহাড়ী হাইওয়ের পথে অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার দিকে চলে এসেছে। এ পথে এসে উসু উতাই এর পথে সোজা পশ্চিমে গেলে কাজাখস্থানের আলমা আতা অনেক কাছে হতো। কিন্তু সে পথে যাওয়া মেইলিগুলি ঠিক মনে করেনি। পথটা যেমন জনবহুল, তেমনি তাকে প্রথমে ঐ পথেই খোঁজা হবে।
পেট্রল ফুরিয়ে গাড়ি থেমে যাবার পর স্টিয়ারিং হুইলে গা এলিয়ে দিয়ে এ সব ভাবছিল মেইলিগুলি। দুর্বলতা, ক্লান্তি ও গুলিবিদ্ধ পায়ের যন্ত্রণায় গোটা শরীর তার ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। এখন কি করবে সে। রাত পোহাবার আর দেরী নেই। এই গাড়িতে বসে থাকলে হয় সে ধরা পড়ে যাবে, নয়তো অনাহারে, অচিকিৎসাসহ ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি তাকে হতে হবে। তার চেয়ে তাকে চেষ্টা করতে হবে কোন আশ্রয় খুঁজে নিতে। এই পথের আশে পাশে কাজাখ ও উইঘুর পল্লী আছে। একটি অবশ্যই তাকে খুঁজে পেতে হবে।
গাড়ি থেকে নামার আগে মেইলিগুলি ক্ষতটা ভালো করে বেঁধে নিল। তোয়ালে রক্তে ভিজে গিয়েছিল। তোয়ালে ফেলে দিয়ে ওড়না দিয়ে শক্ত করে বাঁধল ক্ষতটা। তারপর গাড়ি থেকে নেমে এল।
দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরে গেল মেইলিগুলির। গাড়ি ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শরীরটা ঠিক করে নিল। তারপর বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা শুরু করল রাস্তা ধরে উত্তর দিকে।
কিন্তু কিছু দূর যেয়েই বুঝতে পারল তার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। রক্ত অনেক গেছে, গোটা শরীর তার ঝিম ঝিম করছে। তার উপর আহত পাটা ভীষণ ভারী বোধ হচ্ছে, প্রতি পদক্ষেপই তাকে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে হচ্ছে।
রাস্তার উপর বসে পড়ল মেইলিগুলি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল।
শরীরটা টেনে নিয়ে আবার সে উঠল। না উঠে উপায় নেই। যতই সময় যাবে ততই সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং দেহে শক্তি অবশিষ্ট থাকতেই তাকে আশ্রয় খুঁজে পেতে হবে।
মেইলিগুলি চলছিল উঁচু পার্বত্য পথের উপর দিয়ে। বুঝল সে, এটা আলাত পাহাড় শ্রেণীর সর্ব উত্তরের অংশ। তার জানা লোকালয় তোলিতে পৌছতে হলে তাকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
কিন্তু উঁচু নিচু পার্বত্য পথ শীঘ্রই মেইলিগুলির দেহের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিল। তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। তবু পাগলের মতই দু’পা টেনে নিয়ে চলল মেইলিগুলি। তাকে বাঁচতে হবে। সে প্রার্থনা করতে লাগল আল্লাহর কাছে, হে আল্লাহ তুমি ছাড়া তো আর কোন সাহায্যকারী আমার নেই। আমার দেহের শক্তি শেষ, চোখও দেখতে পাচ্ছেনা আর সামনে, এখন তুমিই আমার ভরসা। তুমি আমাকে সাহায্য কর। আমি আর কিছু চাই না, শেষ বারের মত একবার ওকে- আমার স্বামী আহমদ মুসাকে দেখতে চাই। তুমি আমার এ প্রার্থনা মঞ্জুর কর।’
এই প্রার্থনা মুখে নিয়ে টলতে টলতে অন্ধের মত এগিয়ে চলল মেইলিগুলি। পায়ের ব্যথারও তার এখন কোন পরোয়া নেই তাই।
কিন্তু এ চলার শক্তিটুকুও অবশেষে এক সময় শেষ হয়ে গেল। তার চোখের সামনের অস্পষ্ট আলোটুকুও এক সময় দপ করে নিভে গেল। ওলট পালট হয়ে গেল তার পায়ের তলার পৃথিবী। লুটিয়ে পড়ল মেইলিগুলি রাস্তার ওপরেই। শক্ত মাটির ওপর পড়ে স্থির হয়ে গেল মেইলিগুলির দেহ।
এই পথেই এগিয়ে আসছিল শিহেজী উপত্যকার বাস্তুত্যাগী উইঘুরদের পাঁচ সদস্যের এক কাফেলা-স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে পাঁচ জন। তিনটি ঘোড়া, পাঁচ জন মানুষ।
মৃত কেউ পড়ে আছে মনে করে ওরা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল।
‘মেয়েটি মুসলিম হবে। পোশাক মুসলমানদের।’ ঘোড়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল কাফেলার প্রধান পুরুষ ব্যক্তি।
‘আব্বা নিশ্চয় বেঁচে আছে মেয়েটি। দেখুন পায়ের ব্যান্ডেজে তাজা রক্ত। ‘চিৎকার করে উঠল তার পেছনে বসা কশোর বয়সের একটি ছেলে।
সবাই ঘোড়া থেকে নামল।
বয়স্ক লোকটি ছুটে গিয়ে মেইলিগুলির হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল। নাড়ি দেখে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। বলল, ‘ঠিক বলেছ বেটা, বেঁচে আছে মেয়েটি। কিন্তু খুবই দুর্বল।’
দ্বিতীয় ঘোড়া থেকে নেমে আসা চিন্তান্বিত যুবক ছেলেটি তার পিতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘আব্বা আমরা রাস্তার উপর যে রক্তাক্ত গাড়ি দেখে এলাম, এ নিশ্চয় সে গাড়িতেই আসছিল। বোধ হয় গাড়ি খারাপ হওয়ায় হেঁটেই রওয়ানা দিয়েছিল।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। মেয়েটি শিক্ষিত ও অভিজাত ঘরের। আমাদের মতই দূর্ভাগা কেউ হতে পারে। হয়ত পালাচ্ছিল। এখন কি করি! এই অজ্ঞান মানুষ পথ চলার ভার সইতে পারবে না, মরে যাবে। কি করে একে বাঁচানো যায়?’ বলল বয়স্ক লোকটি।
সেই যুবক ছেলেটি বলল, ‘কেন আব্বা, এখান থেকে পশ্চিমে এক মাইলের মধ্যেই তো একটা উইঘুর পল্লী আছে।’
‘উঃ তাই তো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ঐ উইঘুর কবিলার সর্দার ইব্রাহিম আওয়ায় তো আমার বন্ধু লোক। আর কোন কথা নয়, ওরই হাওয়ালা করে দিয়ে আসি মেয়েটিকে।’
উঠে দাঁড়াল লোকটি। যুবকটিকে বলল, ‘তুমি ঘোড়াগুলোকে একটু পাহাড়ের আড়ালে নিয়ে কাফেলা পাহারা দাও।’
এরপর কিশোর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বন্দুক নিয়ে আমার সাথে চলো। আমি মেয়েটিকে নিচ্ছি।’
বলে যুবকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সংজ্ঞাহীন মেইলিগুলিকে কাঁধে তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল তারা সেই উইঘুর পল্লীতে। পল্লীটি একটি উপত্যকা। মাইল খানেক উত্তরের একটা ঝরণা থেকে সৃষ্ট একটা পাহাড়ী নদী এই উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। কৃষি ও পশুপালন এই উপত্যকার মানুষের জীবিকা।
উপত্যকার পূর্ব প্রান্ত জুড়ে পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে গ্রাম।
অনেক কৌতুহলী চোখের ওপর দিয়ে লোকটি মেইলিগুলিকে নিয়ে গ্রামের সর্দার ইব্রাহীম আওয়াং এর বাড়িতে পৌঁছল।
উঠানেই একটা দড়ির খাটিয়া পাতা ছিল। মেইলিগুলিকে তাকে শুইয়ে দিল লোকটি।
পিছে পিছে আসা কৌতুহলী ছেলেরা দৌড়ে ভেতরে গিয়ে খবর দিল ইব্রাহিম আওয়াংকে। ভেতর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ। মেইলিগুলিকে বয়ে আনা লোকটির ওপর চোখ পড়তেই খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, ‘কি বকর দিনে যে চন্দ্র উদয়! ও কে?’ মেইলিগুলির দিকে ইংগিত করল ইব্রাহিম আওয়াং।
মেইলিগুলির দিকে ইংগিত করল ইব্রাহিম আওয়াং।
মেইলিগুলিকে বইয়ে আনা লোকটির পুরো নাম বকর লি শাওচি।
বকর লি শাওচি মেয়েটিকে পাওয়ার সব ঘটনা খুলে বলে শেষে অনুরোধ করল, ‘মেয়েটিকে তুমি বাঁচাও। বিপদগ্রস্তা মেয়ে। আল্লাহ্‌ তোমার ভাল করবে। তাছাড়া তুমি হাকিম, তোমার এটা দায়িত্বও।’
ইব্রাহিম আওয়াং একজন ভাল হাকিম। নাম ডাক আছে তার পাহাড়ী অঞ্চলে।
‘এত কথা বলার প্রয়োজন আছে বকর। তুমি আমাকে জান না? আমার মেয়েকে যেভাবে দেখতাম, একেও সেভাবে দেখব। আমার সৌভাগ্য আল্লাহ এমন সেবার সুযোগ দিলেন।’
বলেই বাড়ির ভেতর দিকে চিৎকার করে বলল, ‘রোকেয়া, তোমার মাকে দুধ গরম করতে বলো আর তুমি তাড়াতাড়ি এদিকে এস।’
অল্পক্ষণ পরেই গায়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে এক তরুণী এসে হাজির হলো।
‘খাটিয়ার ওমাথা ধর, একে ভেতরে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফেরানো দরকার।’
বকর শাওচি বলল, ‘আমাকে বিদায় দাও ভাইয়া, আমার কাফেলা দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ ভরসা। পারলে খোঁজ নেব।’
‘যাবে? মেহমানদারী করতে পারলাম না। একটু বস না।’
‘না ভাই, তোমাকে যে কাজ দিয়ে গেলাম, সেটা করো, হাজারবার খাওয়ার চেয়ে খুশী হবো।’
বলে সালাম জানিয়ে পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করল বকর শাওচি।
আর ইব্রাহিম আওয়াং এবং তার মেয়ে ধরাধরি করে খাটিয়া সমেত মেইলিগুলিকে ভেতরে নিয়ে গেল।

তিন দিন পর।
উচু-তাসেং রোড ধরে উত্তর দিকে ছুটে আসছে আরেকটি গাড়ি। গাড়িতে চারজন আরোহী। একজন ড্রাইভিং সিটে। তার পাশের সিটে একজন। পেছনের সিটে দু’জন। তাছাড়াও রয়েছে একটি কুকুর।
এরা জেনারেল বরিস ও ডাঃ ওয়াং এর লোক। তাদের নির্দেশে খুঁজেতে বেরিয়েছে মেইলিগুলিকে। তাদের সাথে দেয়া হয়েছে শিকারী কুকুর। কুকুরটিকে মেইলিগুলির ব্যবহার্য জিনিস শুকিয়ে পরিচিত করানো হয়েছে মেইলিগুলির গন্ধের সাথে।
শুরুতেই তারা ভাল ফল পেয়েছে। উসু-এর একটু পূর্ব পাশে কোয়েতুনের আরেকটা সড়ক সোজা উত্তরে কারামে হয়ে সোমলিয়া সীমান্তের দিকে চলে গেছে। কোয়েতুনে এসে কুকুরকে গাড়ি থেকে নামানো হলো। কিন্তু কুকুর কোয়েতুন কারামে সড়কের দিকে মুখই ফিরাতে চাইল না, ছুটতে চেষ্টা করল উসু-এর দিকে। অনুরূপভাবে উসু থেকে একটা রাস্তা পশ্চিমে, আরেকটা রাস্তা গেছে উত্তর পশ্চিমে। এখানে এসেও কুকুর ছুটছে গাড়ি উত্তর পশ্চিমের রাস্তা ধরে।
রাস্তার এক পাশে মেইলিগুলির গাড়ি তখনও দাড়িঁয়ে ছিল।
বরিস ওয়াং এর প্রেরিত ঐ দলটি যখন মেইলগুলির এ গাড়ির কাছে এল কুকুরটি ভীষণ ঘেউ ঘেউ করে উৎপাত শুরু করে দিল।
গাড়ি থামাল ড্রাইভার।
ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটি পেছনের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘সু লীন, কুকুর নিয়ে নিচে যাও। আমার সন্দেহ হচ্ছে এই গাড়ির সাথে মেইলিগুলির কোন সম্পর্ক আছে। তা না হলে গাড়ির কাছে আসার পর টম ব্যাটা এত উৎপাত করছে কেন?’
সু লীন নামের লোকটার হাতেই কুকুর। সে এবং তার পাশে বসা সাথী দু’জনেই নেমে এল গাড়ি থেকে কুকুর নিয়ে।
সু লীনই এগিয়ে এসে গাড়ির বন্ধ দরজা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর হুমড়ি খেয়ে পড়ল গাড়ির ভেতরে।
সু লীন ও তার সাথী চ্যাং ওয়া গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটের নিচে ও পা দানিতে প্রচুর শুকিয়ে যাওয়া রক্ত দেখতে পেল। সেই রক্তের ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কুকুর।
‘হোয়াং, এস, দেখ গাড়িতে রক্ত।’ চিৎকার করে উঠল সু লীন।
ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা দলনেতা অর্থাৎ হোয়াং তার হাতের অয়্যারলেসটি সিটের ওপর রেখে দ্রুত নেমে এল।
সেও এসে দেখল শুকিয়ে যাওয়া জমাট রক্ত। গাড়ির চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে বলল, কোন সন্দেহ নেই এই গাড়ি নিয়েই মেইলিগুলি পালিয়েছিল। দেখ, ফুয়েল মিটারের কাঁটা শূন্যের কোঠায়। অর্থাৎ এখানে এসে গাড়ির তেল শেষ হওয়ায় সে নেমে গেছে।
হোয়াং তারপর গাড়ির কাছ থেকে সরে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। শুকিয়ে গেলেও রক্তের চিহ্ন সে খুঁজে পেল। অনেক দূর পর্যন্ত এগুলো। রক্তের চিহ্ন সব জায়গায় খুঁজে না পেলেও সে নিশ্চিত হলো, গাড়ির তেল শেষ হবার পর এ রাস্তা ধরেই সে উত্তরে এগিয়ে গেছে পায়ে হেঁটে।
হোয়াং পেছন ফিরে সাথীদের ডাক দিয়ে বলল, ‘তোমরা কুকুর নিয়ে এস। রক্তের দাগ অনুসরণ করে আমাদের হেঁটেই এগুতে হবে। যদিও দাগ সব জায়গায় নেই, মুছে গেছে, টম কিন্তু ঠিকই ধরতে পারবে। অসুবিধা হবে না। গাড়িটা পেছনে আসুক।
গাড়ি ও সাথীরা এসে হোয়াং এর পাশে দাঁড়াল। হোয়াং তার সিট থেকে অয়্যারলেস সেট তুলে নিয়ে বলল, ‘বস, ওয়াং ও বরিসকে কথাটা জানিয়ে দেই।’
হেড কোয়ার্টারের মিটারে টিউন করতেই পেয়ে গেল ডাঃ ওয়াং এর গলা। হোয়াং তাকে জানাল এ পর্যন্ত যা দেখেছে, পেয়েছে সব।
তারপর নির্দেশ শুনে নিয়ে অয়্যারলেস বন্ধ করে বিরাট হাসি দিয়ে বলল, ‘শুন তোমরা, বস ভীষণ খুশী। আমাদের প্রত্যেকের জন্য ৫ হাজার ইউয়ান করে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। আর যদি মেইলিগুলিকে আমরা ধরতে পারি তাহলে আমরা প্রত্যেকে ১০ হাজার ইউয়ান করে পাব। মেইলিগুলির খোঁজ পাওয়ার সংগে সংগেই জানাতে হবে।’
কুকুরকে সামনে নিয়ে ওরা আবার যাত্রা শুরু করল।
যেখানে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মেইলিগুলি, সেখানে এসে থমকে দাঁড়াল কুকুর। শুকে চলল এক জায়গার মাটি।
হোয়াং এগিয়ে এল সেখানে। জায়গাটা রাস্তার ওপাশে। হোয়াং ঝুঁকে পড়তেই শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিহ্ন তার চোখে পড়ল। ফোটা ফোটা নয়, পরিমাণে বেশ। ভ্রু কোঁচকালো হোয়াং। এখানে কি তাহলে মেইলিগুলি বসেছিল! হতে পারে।
হোয়াংরা কুকুর নিয়ে আরও সামনে এগুতে চাইল। কিন্তু কুকুর কিছুতেই রাস্তা ধরে উত্তরে এগুতে আর রাজি হলো না। এবার ছুটতে চায় সে পশ্চিম দিকে।
কিন্তু হোয়াংরা বহু খুঁজেও আর রক্তের দাগ কোন দিকে পেল না। রাস্তা ছেড়ে পশ্চিম দিকে মেইলিগুলি যেতে পারে। কিন্তু রক্তের দাগ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল কেন? রহস্যের সমাধান হোয়াংরা করতে পারলো না।
অবশেষে কুকুরের ওপরই নির্ভর করল তারা।
এবার পশ্চিমে যাত্রা শুরু হলো তাদের।
আগে আগে কুকুর দৌড়ে চলেছে। পেছনে তারা চারজন। গাড়ি লক করে একটি টিলায় তারা রেখে দিয়েছে।
বেলা দশটা নাগাদ হোয়াংরা গ্রামে গিয়ে পৌঁছল।
তখনও গ্রামে প্রবেশে দেরী আছে। হোয়াং সাথীদের বলল, ‘তোমাদের পিস্তল ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ।’ সবাই উত্তর দিল।
‘দেখ আমরা মারামারি করতে চাই না। বলব, আমরা সরকারী লোক, আসামীর খোঁজে এসেছি। আক্রান্ত না হলে আমরা কাওকে কিছু বলবনা, মেইলিগুলিকে পেলে হেডকোয়ার্টার জানিয়ে দিয়ে আমরা নির্দেশের অপেক্ষা করবো।’
‘গ্রামটা মনে হচ্ছে উইঘুরদের।’ বলল সু লিন।
‘হ্যাঁ, উইঘুরদের।’
গ্রামে ঢোকার মুখে হোয়াং দেখল একটা বালক একটা ভেড়া তাড়িয়ে এদিকে আসছে। হোয়াংদের এবং কুকুর দেখে সে দাড়িয়ে পড়েছে।
হোয়াং একটু এগিয়ে উইগুরদের ভাষায় ছেলেটিকে কাছে ডাকল।
ছেলেটি এল, খুব কাছে এল না।
হোয়াং নরম ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে একজন আহত মেয়ে এসেছে না?’
‘এসেছে। সে তো তিন দিন আগে।’
‘আছে কোথায়?’
‘শাইখ হাকিম দাদার বাড়িতে।’
এ জিজ্ঞাসার কোন দরকার ছিল না হোয়াংদের। কুকুর তাদের ঠিকই নিয়ে যাবে মেইলিগুলি যেখানে আছে, সেখানে। তবু একটা কৌতূহল মেটাল।
ছেলেটির পিঠ চাপড়ে হোয়াং রা আবার হাটা শুরু করল। ঢুকে পড়ল গ্রামে।
গ্রামে পুরুষ লোক কেউ তেমন নেই। সবাই মাঠে। গ্রামে কুকুরসহ চারজন অপরিচিতকে ঢুকতে দেখে বালক কিশোরদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। শুরু হয়েছে ছুটাছুটি।
বৃদ্ধ ইব্রাহিম আওয়াং উঠানে বসে কাজ করছিল। কয়েকজন কিশোর ছুটে এল তাঁর কাছে। বলল ঘটনা।
সব শুনে ভ্রু কুচকালো ইব্রাহিম আওয়াং। বলল, ‘শিকারি কুকুর নিয়ে এসেছে! লোকগুলো দেখতে কেমন?’
‘কুকুর আগে আগে হাঁটছে। পেছনে ওরা। ওরা উইঘুর নয়, হান।’
‘হান? বলেই বৃদ্ধ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোরা মাঠ এ যা, সবাইকে আসতে বল, এই মুহূর্তে। বলবি শত্রু গ্রামে ঢুকেছে।’
কিশোর বালকের দল সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন পথে ছুটল মাঠের দিকে।
আর ইব্রাহিম আওয়াং বৈঠকখানা থেকে তাঁর স্বয়ংক্রিয় রাইফেল টি বের করে এনে উঠানের প্রান্তে উঠানে প্রবেশের মুখে তৈরি বাড়ির প্রতীক্ষা কুঠুরিতে উঠে বসল। কুঠুরিতে রাইফেলটা চালাবার জন্য ঘুলঘুলি আছে এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গুলি করার মত জায়গা আছে।
অন্যদিকে বাড়ির ভিতরে একটি অতান্ত পরিপাটি নরম এক সজ্জায় শুয়ে আছে মেইলিগুলি। তাঁর গায়ে জ্বর। ইব্রাহিম আওয়াং ক্ষতস্থানে ভাল করে পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করার পরদিন থেকেই রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু জ্বর এসেছে, তা আর ছাড়েনি। দুধ, গোস্তের সুপ সহ পুষ্টিকর যা পাওয়া সম্ভব মেইগুলিকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু তাঁর পরও এখনও হাটার মত শক্তি তাঁর ফিরে আসেনি। মেইলিগুলি তাঁর আসল পরিচয়, সে আহমদ মুসা স্ত্রী, একথা প্রকাশ করতে চায়নি। প্রথম দিকে গোপন রেখেছিল। কিন্তু পিতাতুল বৃদ্ধ ইব্রাহিম আওয়াং এর কাছে মিথ্যা কথা বলতে অন্তর সায় দেয়নি মেইগুলি। ফলে, পরিচয় তাঁর প্রকাশ করতে হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ করে আরেক বিপদে পড়েছে সে। আদর ও সম্মানের বাহুল্য সে ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগছে। তাকে মাথায় রাখবে না কোথায় রাখবে তা তারা যেন ঠিক করতে পারছে না। আর সে গ্রামের সকলের দর্শনীয় বশ্তুতে পরিণত হয়েছে। আর মাঝে মাঝে গর্বে বুক ফুলে উঠে মেইলিগুলির, দেশের এক নিভৃত কোনের এক পাহাড়ি পল্লীতেও তাঁর আহমদ মুসা এত পরিচিত, সকলের এত প্রিয় পাত্র। আবার বুক ফেটে মাঝে মাঝে কান্না আসে তাঁর, কোথায় তাঁর আহমদ মুসা। সে কি জানে তাঁর মেইলিগুলি কি হাল!
চিত হয়ে শুয়ে ছিল মেইলিগুলি। ইব্রাহিম আওয়াং এর মেয়ে রোকেয়া তাঁর মাথায় পানিপটি দিচ্ছে। জ্বর কম রাখার চেষ্টা এটা।
‘আপা, আহমদ মুসা ভাইয়া কোথায়?’ ভেজা কাপড়ের একটা নতুন পটি কপালে লাগাতে লাগাতে বলল রোকেয়া।
‘স্পেনে।’
‘সে তো বহু দূর। আসবেন না ?’
‘খবর কি উনি জানেন?’
‘আপনার খবর পেলে তো ছুটে আসবেন।’
মেইলিগুলি মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্য, রোকেয়ার মা ঘরে ঢুকল এক গ্লাস দুধ নিয়ে।
এসে মেইলিগুলির খাটিয়ার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘মা দুধ টুকু খেয়ে নাও মা।’
‘মা, আপনি উঠুন। দুধ দিন, আমি খেয়ে নিচ্ছি।’ মাথা তুলে হাত বাড়িয়ে বলল মেইলিগুলি।
‘তা কি হয় মা। তুমি অসুস্থ, দুর্বল। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
মেইলিগুলির আপত্তি টিকল না। রোকেয়ার মা দুধ খাইয়ে দিল। গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় ঘরে ঢুকল দু’জন বালক। রোকেয়ার মা’র হাতে মুখোমুখি দাড়িয়ে তাদের একজন বলল, ‘শুনছেন দাদি হুজুর, শিকারি কুকুর নিয়ে চার জন লোক গ্রামে ঢুকেছে। এদিকেই আসছে।’
‘তো কি হয়েছে বাছারা।’ বালকদের কথাকে পাত্তাই দিল না রোকেয়ার মা।
কিন্তু কথাটা শুনেই কপাল কুঞ্চিত হয়েছে মেইলিগুলির। সে মাথাটা হঠাৎ উঁচু করে বলল, ‘শিকারি কুকুর নিয়ে চার জন লোক! লোকগুলো কেমন?’
‘হান।’
‘হান?’ বলেই উত্তেজিত ভাবে উঠে বসল মেইলিগুলি। কপাল থেকে পানিপট্টির কাপড় খসে পড়ে গেল কোলের উপর।
‘জি। ওরা তো খারাপ লোক। দাদা হুজুর তো বন্দুক নিয়ে সে আছে ওদের জন্য। আমাদেরকে ওদিকে যেতে সবাই নিষেধ করেছে।’ মেইলিগুলি মুখে অন্ধকার নেমে এল। রোকেয়া এবং রোকেয়ার মা এক সাথে বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার, ওরা কারা, চিন ওদের ?’
‘চিনি না, জানিনা কারা আসছে। তবে শুনে আমার সন্দেহ হচ্ছে, যারা আমাকে হত্যা করতে চায়, ওরা তারাই।’
রোকেয়া ও রোকেয়ার মা দু জনেই মুখে মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। রোকেয়ার মা ফিরে এল ঘরে আবার। রোকেয়া এসে জড়িয়ে ধরল মেইলিগুলিকে। বালকরা তখন চলে গিয়েছিল।
রোকেয়ার মা রোকেয়াকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যাও তো দেখে এস ব্যাপার কি ?’
‘আম্মা, তুমি আপার কাছে বস। আমি আসছি।’
বলে বেরিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পড়ে ফিরে এল রোকেয়া কাঁপতে কাঁপতে।
রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে রোকেয়ার মা আতঙ্কে উঠে দাঁড়াল।
বলল, ‘কি হয়েছে রোকি?’ আর্তনাদ এর মত শুনাল রোকেয়ার মার কণ্ঠ।
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। কি ঘটেছে কে জানে? বন্দুক, তীর-ধনুক, তলোয়ার-বর্শা যে যা পারছে তা নিয়ে গ্রামের সব মানুষ এসেছে, আরও আসছে। সে চারজন লোককে ঘিরে ফেলেছে সবাই। শুনলাম, ঐ চারজন দাবী করেছে, ‘আমরা সরকারী লোক। আমরা আসামী ধরতে এসেছি। আসামীকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।’ আর আমাদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, অস্ত্র ফেলে দিলে আত্মসমর্পণ না করলে চারজনকেই হত্যা করবে।’ ওদের চারজনের হাতেই রিভলবার। ওরা নাকি হুমকি দিয়েছে, সব ঘটনা তারা ওয়ারলেসে জনিয়ে দিয়েছে রাজধানীতে। ওখান থেকে হেলিকপ্টার বোঝাই সৈন্য আসছে। জবাবে আমাদের তরফ থেকে বলা হয়েছ, গ্রামের একজন লোক বেঁচে থাকা পর্যন্ত তারা লড়াই করবে। একজন লোক বেঁচে থাকা পর্যন্ত মেইলিগুলি আপাকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে না। আমার মনে হচ্ছে যে কোন সময় গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে।’
থামল রোকেয়া।
রোকেয়ার মা পাঁথরের মত স্থির হয়ে গেছে।
কিন্তু মেইলিগুলির মুখ এখন অন্ধকার নয়। চোখ দুটি তাঁর উজ্জ্বল। মুখে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় এর ছাপ। বলল, ‘রোকেয়া চাচাজান কে আমার কাছে ডাক। উনি আসতে দেরী করলে আমি সেখানে গিয়ে হাজির হব।’ অত্যন্ত স্পষ্ট ও দৃঢ় মেইলিগুলির কণ্ঠস্বর। রোকেয়া ও রোকেয়ার মা বিস্মিত হয়ে তাকাল মেইলিগুলির দিকে। তারা দেখল, রোগ কাতর মেইলিগুলি এবং এই মেইলিগুলি যেন এক মেইলিগুলি নয়।
রোকেয়া ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর তাঁর আব্বা ইব্রাহিম আওয়াং সহ ফিরে এল। তাঁর হাতে রাইফেল।
এসেই বলল, ‘মা তুমি ওখানে গিয়ে হাজির হবে এ হুমকি না দিলে আসতাম না। আসা যায় না। ওরা আমাদের কাপুরুষ ভেবেছে। আজ একটা নিকেশ হয়ে যাবে। কি বলবে তাড়াতাড়ি বল মা।’
‘চাচা জান’, বলতে শুরু করল মেইলিগুলি, ‘আপনি এ গ্রামের সর্দার, আপনি বিজ্ঞ, আপনি অন্যদের মত আবেগপ্রবন হবেন না, এই আশা নিয়েই আমি কয়েকটা কথা বলব।’
‘বল মা।’ বলে চেয়ার টেনে বসল ইব্রাহিম আওয়াং।
‘চাচাজান এ গ্রামে কোন রক্তপাত হতে পারবে না।’
‘আমরাও তাই চাই, কিন্তু ওরা তো তোমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়। তাহলে তো রক্তপাত হবেই।’
‘চাচাজান ওদের আপনি চেনেন না। ওরা ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের লোক। এখন যে সরকার চলছে তা ওদেরই সরকার। ওদের সাথে এইভাবে লড়াইয়ে নামা ঠিক হবে না।’
‘আমরা তো লড়াইয়ে নামছি না। ওরাই তো লড়াই করতে আসছে। আমরা লড়াই বন্ধ করব কিভাবে?’
‘পথ আছে চাচাজান।’
‘কি পথ?’
‘আমাকে পেলেই আর ওরা কারো গায়ে হাত এখন দেবে না।’
‘কি বলছ? তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব? গ্রামের একটি লোক বেঁচে থাকতেও তা হবে না।’
‘চাচাজান, আপনি আবেগপ্রবণ হবেন না। আপনি গ্রামের সর্দার। গ্রামের শত শত নারী, শিশু, বৃদ্ধের কথাও আপনাকে ভাবতে হবে।’
‘আর তোমার কথা, আহমদ মুসার স্ত্রীর কথা আমরা ভাববো না বুঝি?’
‘না।’
‘যদি তাই হয়, তাহলে এমন পথ কি আমরা বের করতে পারি না যে, গ্রামবাসীও বাঁচবে, আমার বাঁচারও একটা সম্ভাবনা থাকবে।’
‘সেটা কিভাবে?’
‘ধরুন, আমাকে আপনারা ওদের হাতে দিলেন, তাতে গ্রাম বেঁচে গেল। আমি বন্দী হলাম। কিন্তু বন্দী হওয়ার মানে মৃত্যু নয়। আহমদ মুসা, আমার স্বামী, কতবার বন্দী হয়েছেন, কিন্তু আবার বেরিয়ে এসেছেন, আসতে পেরেছেন, আল্লাহ সুযোগ করে দিয়েছেন। তেমনি আল্লাহ আমাকেও সাহায্য করতে পারেন। আমি মুক্ত হতে পারি।’
থামল মেইলিগুলি।
ইব্রাহিম আওয়াং সংগে সংগে কথা বলতে পারলেন না। বিস্ময়ে তার দুই চোখ বিস্ফোরিত। এত বুদ্ধি এইটুকুন মেয়ের! এত শান্ত ভাবে, এত দূর দিয়ে চিন্তা করতে পারল কি করে সে এই দুঃসময়ে। এখন তো তার ভয়, আশংকা, উদ্বেগে ভেঙে পড়ার কথা। কিন্তু গত কয়েকদিনের মধ্যে আজকেই সে সবচেয়ে স্বাভাবিক। যেন সে অসুস্থও নয়।
আর রোকেয়া ও রোকেয়ার মা বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে মেইলিগুলির কথা শুনে।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল ইব্রাহিম আওয়াং। বলল, ‘তোমার কথার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু গ্রামের কেউ এটা মেনে নেবে না। নিজেদের মেয়েকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে রাজি হবে না কেউ।’
‘গ্রামের প্রধান প্রধান লোকদের আমার কাছে ডাকুন। আমি তাদের বুঝাব।’
‘কিন্তু মা এমন একটা ব্যবস্থাকে আমিও যে মেনে নিতে পারছি না।’
‘চাচাজান, আপনারা সম্মত না হলে আমি নিজ সিদ্ধান্তে ওদের হাতে গ্রেফতার হব। আহমদ মুসার স্ত্রী হিসেবে এমন একক সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে। আমি কিছুতেই এই মুসলিম জনপদকে আমার জন্যে বিরাণ হতে দেব না।’ কঠোরতা ঝরে পড়ল মেইলিগুলির কন্ঠে।
‘ঠিক আছে মা, আমি বয়সে বড় হলেও তুমি আমাদের সম্মানিত নেতার স্ত্রী, আমাদের নেত্রী। ঠিক আছে, আমি গ্রামের প্রধানদের ডেকে তোমার সব কথা বলে তাদের বুঝাতে চেষ্টা করব। দরকার হলে তোমার কাছে তাদের নিয়ে আসব।’
বলে চলে যাচ্ছিল ইব্রাহিম আওয়াং।
মেইলিগুলি ডেকে বলল, ‘আরেকটা কথা চাচাজান, গ্রামের প্রধানদের ডেকে নেয়ার আগে আপনি সেখানে ঘোষণা করুন, আমার পক্ষ থেকে অনুরূপ আমাদের আলোচনা শেষ হওয়ার আগে আমাদের কেউ যাতে কোন ঘটনা না ঘটায়।’
‘ধন্যবাদ মা। ভালো কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ।’
বলে চলে গেল ইব্রাহিম আওয়াং।
অনেক্ষণ পর বার-চৌদ্দজন লোককে নিয়ে ফিরে এল সে। লোকরা সবাই দরজার বাইরে উঠানে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। শুধু দরজায় এসে দাঁড়াল ইব্রাহিম আওয়াং। বলল, লোকদের দিকে ফিরে, ‘আমাদের মা, আমাদের নেত্রী আমাকে যা বলার জন্যে বলেছিলেন, আমি তা তোমাদের বলেছি। আমি তোমাদের তাঁর কথায় রাজি করাতে পারিনি। এখন বল তোমাদের কথা মা’র কাছে।’
‘আমরা তাঁকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবো না। কোন অবস্থাতেই না।’ সমস্বরে বলে উঠল সবাই।
মেইলিগুলি একটু শুয়েছিল। উঠে বসল। মুহূর্ত কয়েক চোখ বন্ধ করে থাকল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আপনারা কেউ আমার পিতা, কেউ ভাইয়ের মত। সবাইকে আমার অনুরোধ, কোন ক্ষতি স্বীকার না করে কিভাবে এ সংকট থেকে বাঁচা যায় তা ভাববার জন্যে। সেদিন ওরা আমাকে ধরতে না পেরে আমার আব্বা-আম্মাকে হত্যা করেছে। এখন আমাকে ধরতে বাধা দিলে সব গ্রামবাসীকে হত্যা করতে ওরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। এমন যদি হতো গ্রামবাসী সবাই নিহত হওয়ার বিনিময়েও আমি বাঁচব, তাহলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু তা হবে না। সুতরাং অনর্থক এভাবে জীবন দেয়ার আমি বিরোধী। আমি বন্দী হলে কি হবে? আসলে ওরা আমাকে বন্দী করতে চায়, আমাকে বন্দী রেখে আহমদ মুসাকে হাতে পেতে চায়। সুতরাং প্রথমেই আমাকে ওরা হত্যা করবে না। আর বন্দী করলেই কাউকে মারা যায় না। আল্লাহ আবার তাকে মুক্ত করতে পারেন। সুতরাং আপনাদের চিন্তার কিছু নেই।’
থামল মেইলিগুলি।
‘আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এসব চিন্তা করে কি কেউ তার মেয়ে বা বোনকে শত্রুর বন্দীখানায় ঠেলে দিতে পারে? আমরা তা পারব না।’
‘দেখুন আহমদ মুসা এখানে নেই। তিনি থাকলে আমি যা বলছি সে কথাই তিনি বলতেন। তিনি কিছুতেই রাজি হতেন না তাঁর জন্যে নারী, শিশুসহ একটি গ্রামের মুসলিম জনপদ ধ্বংস হয়ে যাক। তিনি থাকলে যে নির্দেশ দিতেন, সেই নির্দেশই আমি দিচ্ছি, আপনারা গিয়ে বন্দী করতে আসা ঐ চারজন সহ সকলের কাছে ঘোষণা করে দিন, আহমদ মুসার স্ত্রী মেইলিগুলি স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব মেনে নিয়েছে। সুতরাং আর কোন শত্রুতা নেই। সবাই অস্ত্র সংবরণ করে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যান।’
থামল মেইলিগুলি।
সবাই এক এক করে নত মস্তকে চলে গেল। শুধু থাকল ইব্রাহিম আওয়াং। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। তারও মাথা নত। চোখ থেকে গড়িয়ে আসা অশ্রুতে তার দাড়ি ভিজে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর সে মুখ তুলল। ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, তুমি অনেক বড় মা। আল্লাহ আহমদ মুসাকে তাঁর যোগ্য স্ত্রী দিয়েছেন।’
চলে গেল বৃদ্ধ ইব্রাহিম আওয়াং।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিল যেন রোকেয়া এবং রোকেয়ার মা। মেইলিগুলিকে তাদের মনে হচ্ছে একজন অতি সাহসী হিসেবে। এই নরম মেয়েটির মধ্যে এত মহত্ব, এত সাহস, এত তেজ লুকিয়ে ছিল। শ্রদ্ধায় নুয়ে গেল তাদের মাথা।
কিছুক্ষণ পর গ্রামের আকাশে শোনা গেল দুটি হেলিকপ্টারের আওয়াজ।
নেলে এল হেলিকপ্টার।
সেই চারজন আগেই অয়ারলেসে জানিয়ে দিয়েছিল সব খবর। তবু দুই হেলিকপ্টারের একটি থেকে নেমে এল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত প্রায় ডজন দুই মানুষ। অন্যটি থেমে নেমে এল ডাঃ ওয়াং এবং আরও কয়েকজন। এই অভিযানে আসার কথা ছিল জেনারেল বরিসের। কিন্তু এক মোটর এক্সিডেন্টে সে আহত বলে আসতে পারেনি।
স্ট্রেচারে করে মেইলিগুলিকে এনে তোলা হল হেলিকপ্টারে। গ্রামের মানুষ চারদিকে দাঁড়িয়ে দেখল সব। কারও মুখেই একটিও কথা নেই। সবার মধ্যেই যেন অসহ্য এক যন্ত্রণা। সে যন্ত্রণা নিরব অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে অনেকের চোখ থেকে। শুধু সেই মানুষের সারিতে হাজির ছিল না ইব্রাহিম আওয়াং, রোকেয়া এবং রোকেয়ার মা। ইব্রাহিম আগেই সরে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। আর রোকেয়া ও তার মা কাঁদছিল ভেতর বাড়ির উঠানে লুটিয়ে পড়ে।
মেইলিগুলিকে নিয়ে ডাঃ ওয়াং ও তার দলবল হেলিকপ্টারে উঠে গেলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধারীরা এক সাথে আকাশে গুলী করে বিজয় ঘোষণা করে নিজেরাও উঠে গেল হেলিকপ্টারে।
আকাশে উড়ল হেলিকপ্টার দু’টি।
চক্কর দিল গ্রামের ওপর কয়েকবার।
হেলিকপ্টারের ফ্লোরে স্ট্রেচারের ওপরই শুয়ে ছিল মেইলিগুলি। সামনে এক সারি চেয়ারে বসেছিল ডাঃ ওয়াং এবং তার সাথীরা।
হেলিকপ্টার দু’টো গ্রামের উপর দিয়ে চক্কর দেয়ার এক পর্যায়ে ডাঃ ওয়াং পাশের একজনকে ইশারা করল। সংগে সংগে সে উঠে গিয়ে একটি কি বোর্ডের প্যানেলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর চারটি সুইচ টিপে দিল।
বিষয়টা মেইলিগুলির নজর এড়াল না। সেটা ডাঃ ওয়াংও টের পেল। মেইলিগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মন খারাপ করো না ম্যাডাম। মাত্র চারটি বোমা পড়েছে। কি আর তেমন ক্ষতি হবে। কিছু বাড়ি পুড়বে। দু’চারজন মানুষ মরতেও পারে।’
অসহ্য বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়ল ডাঃ ওয়াং এর কথায়। মেইলিগুলি মোটেই বিস্মিত হলো না তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতায়। এরা যে কোন পর্যায় পর্যন্ত নামতে পারে। আপনাতেই মেইলিগুলির হাতটা গিয়ে স্পর্শ করল আন্ডারওয়্যারের পকেটে ক্ষুদ্র পিস্তলটিতে। সেবার বিদায়ের সময় আহমদ মুসা মেইলিগুলির জন্যে যে ক্ষুদ্র ব্যাগ রেখে গিয়েছিল, তার মধ্যে যে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ছিল, তার মধ্যে ছিল এই পিস্তলটি। স্বামীর উপহার এই পিস্তলটিকে এক গোসলের সময় ছাড়া কোন সময়ই কাছ ছাড়া করতো না। দেখলে সবাই খেলনা পিস্তল মনে করবে। কিন্তু ওতে ছয়টি গুলি থাকে। গুলি গুলো দেহের ভিতর গিয়ে বিস্ফোরিত হয় বলে ক্ষতি করে বড় রিভলবারের সমান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল মেইলিগুলি। এক চরম অনিশ্চিতের যাত্রা তার এটা। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী সে কোন দিনই হয়নি। মেইলিগুলি ভাবতে লাগল, এমন পরিস্থিতিতেও আহমদ মুসা কি কি করত। ভাবতে ভাবতে চোখ ধরে এল মেইলিগুলির।

যুবায়েরভ, আলদর আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ শিহেজী পর্যন্ত নিরুপদ্রুপে পৌঁছেছিল। সীমান্ত পাড়ি দিতেও তাদের বেগ পেতে হয়নি। তাদের কাছে আছে বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা।
শিহেজী পর্যন্ত পৌঁছে তারা থামে। লক্ষ্য শিহেজীর মুসলিম বসতির খবর নেয়া, সেই সাথে উরুমুচীতে কি ঘটেছে তার বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করা।
হাইওয়ে থেকে শিহেজী উপত্যকা বেশী দূরে নয়। যুবায়েরভরা তাদের গাড়ি একটা টিলার আড়ালে রেখে পায়ে হেঁটে যাত্রা করল। তাদের পরনে হানদের পোশাক। ইচ্ছে করেই পরেছে, যাতে করে প্রথমেই তারা কারো সন্দেহের স্বীকার না হয়।
উপত্যকার মাঠ পেরিয়ে যুবায়েরভরা যখন উপত্যকার সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং তাদের পরিচিত গ্রামের উপকন্ঠে পৌঁছল, তখন রাত আটটা। এশার আজানের সময়।
গ্রামে ঢোকার মুখেই মসজিদ। যুবায়েরভরা মনে করল মসজিদের নামাজেই সবার সাথে দেখা হবে।
কিন্তু মসজিদের কাছাকাছি যখন তারা পৌঁছল, তখন আটটা দশ মিনিট। বিস্মিত হলো আবদুল্লায়েভ আজান হলো না কেন?
মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনটা কেঁপে উঠল আবদুল্লায়েভ-এর। তাহলে তাদের শিহেজী উপত্যকা এখন আর তাদের নেই। যুবায়েরভরা দেখল, মসজিদের মিনার ভেঙে পড়ে আছে। তারা আরও এগিয়ে গেল মসজিদের কাছে। দেখল, মসজিদের জানালা দরজা একটিও নেই। বুঝল তারা শিহেজীতে কোন মুসলমান অবশিষ্ট নেই। তারা কার কাছে যাবে, কার কাছে খবর নেবে।
‘চলুন ফিরে যাই।’ বলল যুবায়েরভ।
‘আমরা গ্রামের ভেতরে গিয়ে একটু দেখতে পারি না?’ বলল আবদুল্লায়েভ।
‘অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমাদের আসল কাজ মেইলিগুলির সন্ধান, আমরা সে কাজ শুরুই করতে পারিনি। শিহেজী এবং অন্যান্য জায়গায় যা ঘটেছে, তার প্রতিবিধানে আমরা হাত দেব পরে।’
‘ঠিক বলেছেন, চলুন ফেরা যাক।’ বলল আবদুল্লায়েভ।
তারা ফিরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল সেই মাঠের মধ্যে দিয়ে।
‘কোথায় যাব আমরা, কোত্থেকে কাজ শুরু করব।’ স্বগত কন্ঠে বলল যুবায়েরভ।
‘মনে হয় আগে আমরা গাড়িতে ফিরি, তারপর চিন্তা করা যাবে।’ বলল আলদর আজিমভ।
তারা ফিরে এল শিহেজীর দক্ষিণ প্রান্তে এবং হাইওয়ের উত্তরে তাদের গাড়ি রাখা টিলাময় পার্বত্য স্থানটিতে। রাত তখন দশটা।
তারা খুঁজে খুঁজে একটা গুহা মত স্থান বের করল। সিদ্ধান্ত নিল, এশার নামাজটা এখানে পড়ে খাওয়া দাওয়া সেরে গুহায় একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত ১২টার দিকে বেরুবে। প্রথমে তাদের উরুমচি যেতে হবে। সেখানে না গেলে বুঝা যাচ্ছে সামনে এগোবার মত তথ্য পাওয়া যাবে না।
তায়াম্মুম করে তারা সামাজ পড়ল।
নামাজে ইমামতি করল বয়সে সবার বড় আলদর আজিমভ। পাহাড়ের নিরব বুকে তার অনুচ্চ নরম তেলওয়াত যেন চারদিকে একটা করুণ মুর্চ্ছনার সৃষ্টি করে দিল।
নামাজ শেষে তারা গল্প গুজব করছে। গাড়ি থেকে খাবার ও পানি এনে আবদুল্লায়েভ তাদের সাথে বসল। তারা এখন খাওয়া শুরু করবে।
এই সময় অন্ধকার ফুঁড়ে একজন লোক এসে তাদের সামনে দাঁড়াল।
লোকটি একজন তরুণ। তার পিঠে রাইফেল ঝুলানো। পরনে উইঘুর পোষাক।
হঠাৎ যুবকটিকে এস দাঁড়াতে দেখে বিস্মিত হয়েছে জুবায়েরভরা সবাই। কিন্তু কোন উদ্বেগ বোধ করেনি। তরুণটির মধ্যে শত্রুতার কোন মতলব নেই সেতা তার ঘাড়ে রাইফেল রাখা দেখেই বুঝেছে।
তরুণটি সামনে এসে দাঁড়িয়েই সালাম দিয়ে বলল, ‘আল হামদুলিল্লাহ, আপনাদের নামাজ বাঁচিয়েছে আপনাদের, আমাকেও। আমি আপনাদের হত্যা করার জন্যে গাড়ি পাহারা দিয়ে বসে আছি। আমি যখন আপনাদের দিকে রাইফেল তাক করেছি, সেই সময়েই আপনারা নামাজে দাঁড়ালেন।’
‘তুমি কে? আমাদের হত্যা করতে চেয়েছিলে কেন?’ বলল যুবায়েরভ।
‘আমি আপনাদেরকে হানদের বন্ধু মনে করেছিলাম। আমার শপথ, হান কিংবা হান পন্থীয় কাউকে হত্যা না করে প্রতিদিনের খাবার স্পর্শ করবো না। আজ কোন হানকে আমি সুযোগের মধ্যে পাইনি।’
‘তোমার পরিচয় তো বললে না।’ বলল আলদর আজিমভ।
‘আমি উইঘুর মুসলিম। শিহেজীর এক বাসিন্দা ছিলাম। আমরা তখন ঘুমিয়ে। শেষ রাতের দিকে হাজার হাজার হান গিয়ে হত্যা, লুন্ঠন চালিয়ে, অগ্নি-সংযোগ করে শিহেজীর সব মুসলমানকে উচ্ছেদ করেছে তারা। আমার আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন সবাই নিহত হয়েছে ওদের হাতে।’
‘তোমরা কিছূ জানতে পারনি আগে?’ বলল আবদুল্লায়েভ।
‘কিছুটা আঁচ করেছিলাম। গ্রাম আক্রমনের আগে অনেকেই সরে পড়তে পেরেছে। কিন্তু বেশীর ভাগই গ্রাম ছাড়েনি। তারা সন্দেহ করলেও এতটা আশা করেনি।’
‘শিহেজীর অবশিষ্ট মুসলমানরা এখন কোথায়?’
‘অনেকে গেছে উত্তরের আলদাই পাহাড় অঞ্চলে, তবে অধিকাংশই গেছে দক্ষিনের বাবাহরো পাহাড় এলাকায়।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার মতই কাউকে খুঁজছিলাম। তুমি উরুমচির কোন খবর জান?’
‘কিন্তু তার আগে আপনাদের পরিচয় বলুন।’
‘তোমার কি ধারনা?’ বলল যুবায়েরভ।
‘আপনারা মুসলমান কিন্তু বিদেশী।’
‘কেমন করে বুঝলে?’
‘গাড়ি দেখে। ওটা কাজাখাস্থানের গাড়ি।’
‘আমাদের সম্পর্কে কি ধারণা করেছিলে?’
‘কাজাখাস্ষান থেকে এসেছেন ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের সাহায্য করতে।’
‘জেনারেল বরিসকে চেন?’
‘সে এবং ডাঃ ওয়াং তো সমস্ত নষ্টের মূল।’
‘এখন বল উরুমচিতে কি ঘটেছে, তুমি জান?’
‘কিন্তু আপনারা বলেননি আপনাদের আসল পরিচয়। কেন আপনারা এসেছেন? কেন এ খবর আপনারা জানতে চান?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে।’
বলে যুবায়েরভ একটু থামল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘সিংকিয়াং এর এই বিপর্যয়ের খবর আমরা ওপার থেকে পেয়েছি। জানতে পেরেছি, গভর্নর লি ইউয়ান তার পরিবার সমেত গ্রেপ্তার হয়েছেন। মেইলিগুলির পিতা মাতা নিহত হয়েছেন এবং মেইলিগুলি আহত ও নিখোঁজ। এটুকু খবর পেয়েই আমরা ছুটে এসেছি।’ বলল যুবায়েরভ।
‘মেইলিগুলিকে আপনারা চেনেন? কেমন করে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল ছেলেটি।
‘চিনব না কেন? আমরা আহমদ মুসার সহকর্মী। আমরা অনেকেই গতবার তাঁর সাথে এখানে ছিলাম।’ বলল আবদুল্লায়েভ।
‘আহমদ মুসাকেও আপনারা চেনেন? আপনারা তার সহকর্মী!’ ছেলেটির বিস্ময়টা এবার বড় রকমের।
‘কেন, মধ্য এশিয়ার বিপ্লবে তো তিনিই আমাদের নেতা ছিলেন।’
‘বুঝলাম। মাফ করবেন আমাকে। আর কোন প্রশ্ন আপনাদের?’
বলে বসে পড়ল ছেলেটি। বলল, ‘আমার দুর্ভাগ্য আমি আহমদ মুসাকে দেখিনি।’
‘দুঃখ করো না। তিনি আসবেন। তাকে অবশ্যই তুমি দেখবে।’ বলল যুবায়েরভ।
‘দেখতে পাব? আসবেন তিনি?’ ছেলেটির চোখ আনন্দে চক চক করে উঠল।
‘বিশ্বের যেখানেই তিনি থাকুন, সিংকিয়াং এর খবর পাওয়ার সংগে সংগে তিনি চলে আসবেন।’
যুবায়েরভ কথা শেষ করতেই আলদার আজিমভ বলল, ‘তোমার নাম কি ?’
‘ওমর মা চাং।’
‘মা চাং কে ছিল জান?’
‘হুই মুসলমানদের বিখ্যাত নেতা। তার নামেই আমার নাম রেখেছেন আব্বা।’
‘তুমি মুসলমানদের নেতা হতে চাও।’
‘কিছু হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু প্রতিশোধ নিতে চাই। যত পারি হত্যা করতে চাই হানদের।’
‘কিন্তু সব হানতো অপরাধী নয় ওমর!’
‘না, ওরা সবাই অপরাধী। সবাই মিলে ওরা মেরেছে আমাদের, মারছে এখনও।’
‘না, তা নয় ওমর, বহু হান পরিবার এমন আছে, এ সব ব্যাপারে কিছুই জানে না। ওদের গায়ে হাত তুললে তো পাপ হবে। তুমি মুসলিম। তুমি এটা করতে পার না।’
‘হয়তো আপনার কথা ঠিক। কিন্তু বাছাই করার সময় এটা নয়।’ ভারী কন্ঠে বলল ওমর।
‘ঠিক আছে এ আলোচনা পরে করা যাবে। এস আমরা খেয়ে নেই।’
‘না আমি আমার শপথ ভাঙ্গতে পারব না।’ ম্লান কন্ঠে বলল ওমর মা চাং।
‘আমরা কে তুমি জান ওমর?’ বলল যুবায়েরভ। গম্ভীর কন্ঠ তার।
‘জানি।’
‘জান কি ডাঃ ওয়াং ও জেনারেল বরিসের কর্তৃত্বে হানরা মুসলমানদের যেভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে, আমরা সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করতে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে চাই?’
‘জি বিশ্বাস করি।’
যুবায়েরভ ওমরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দেখি তোমার হাত দাও।’
ওমর মা চাং তার ডান হাত বাড়িয়ে দিল।
যুবায়েরভ তার হাতটি হাতে রেখে বলল, ‘নতুন করে শপথ গ্রহন কর, আমি যা বলছি তা বল।’
কথা শেষ করেই যুবায়েরভ বলতে শুরম্ন করল, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যে শক্তি ও যোগ্যতা দিয়েছ তা আজ জাতির দূর্দিনে ব্যায় করব এবং নিরপরাধ মানুষের এই দূর্গতির জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি বিধান করব। তুমি তওফিক দাও। আমার দূর্বলতা, অসামর্থকে তুমি মাফ কর।’
ওমর মা চাং খুব গাম্ভীর্যের সাথে এই কথাগুলো যুবায়েরভের সাথে সাথে উচ্চারন করল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ওমর তুমি নতুন শপথ গ্রহন করেছ, আগের শপথ শেষ। এবার এস।’ বলল আজিমভ।
ইতিমধ্যে আজিমভ খাবার সাজিয়ে ফেলেছে পেপার প্লেটে। খুবেই সংক্ষিপ্ত খাবার। রুটি ও পনির। তার সাথে ফল।
ওমর আর কোন কথা বলল না। সবার সাথে খাবারে বসে গেল।
খেতে খেতে ওমর মা চাং উরুমুচিতে কিভাবে মুসলমানরা লুন্ঠিত ও উচ্ছেদ হয়েছে, কিভাবে সরকার উৎখাত হয়েছে, কিভাবে মেইলিগুলির আব্বা আম্মা আহত ও নিহত হয়েছে বিস্তারিতভাবে বলে গেল। কিন্তু মেইলিগুলি কোথায়, কোন দিকে পালিয়েছে তা কেউ জানে না। কারও কাছে সে তথ্য পায়নি। তবে খাওয়া শেষ করে হাত মুছতে মুছতে ওমর একটা কাহিনী শুরু করল। ওমর মা চাং বলল, ‘আজ সকালে উমুর এক সরাইখানায় ট্যামেং হয়ে আসা একজন মংগোলীয় মুসলিম সওদাগরের সাথে দেখা হলো। সে কথায় কথায় জানাল, ট্যামেং এর শিহেজী থেকে যাওয়া এক উদ্বাস্তু পরিবারের একজন তাকে বলেছে, আলতাই পর্বত এলাকায় রাস্তার ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা এক মুসলিম মহিলাকে তারা পায়। মহিলাটির বাম পা সম্ভবত গুলিতে আহত। যে জায়গায় তারা মহিলাকে পায় তার বেশ দক্ষিনে রাস্তার ওপর একটা ট্যাক্সি পায় তারা। ট্যাক্সির ড্রাইভিং সিটের নিচে রক্ত জমে ছিল। আর ট্যাক্সির ফুয়েল ট্যাংকারে কোন পেট্রল ছিল না। তাদের ধারনা, অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া মহিলাটিরই এ ট্যাক্সি। তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় হেঁটেই সে যাত্রা করেছিল। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরন ও দুর্বলতার কারনে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে তারা রাস্তার পশ্চিম পাশে কিছু দূরে একটা উইঘুর পল্লীতে। পল্লীর সরদার ইব্রাহিম আওয়াং-এর বাড়িতে রেখে তারা গন্তব্যের পথে চলে যায়। ওরা মংগোলীয় সরদারকে অনুরোধ করেছে ফেরার পথে তারা যেন মেয়েটির খোঁজ নিয়ে যায়।’
কাহিনীটি শুনে যুবায়েরভ, আজিমভ ও আবদুলস্নায়েভ- এর চোখ উজ্জল হয়ে উঠল। মেইলিগুলির অবস্থার সাথে কাহিনীর ঐ মেয়েটির অবস্থা সম্পূর্ন মিলে যায়। ব্যাগ্র কন্ঠে যুবায়েরভ জিজ্ঞাসা করল, ‘মহিলাটি কোন গোত্রের তা কি বলেছে?’
‘জি। মেয়েটি উইঘুর।’
‘আচ্ছা, ঐ গাড়িটি ঐখানে আছে কি না?’
‘জি, গাড়িটি মংগোলীয় সওদাগর দেখে এসেছেন।’
‘যেখানে ঐ অজ্ঞাত মেয়েটিকে রেখে গেছে সেই উইঘুর পল্লীর লোকেশন সম্পর্কে কি সওদাগর কিছু বলেছে?’
‘যেখানে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মাইল দুই উত্তরে এমন একটা জায়গা পাওয়া যাবে যেখানে থেকে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পশ্চিমে একটা করিডোর নেমে গেছে। ঐ করিডোর ধরে নেমে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে পশ্চিমে দুই মাইল এগুলেই সেই পল্লী পাওয়া যাবে।’
‘ধন্যবাদ ওমর, আমার মন বলছে ঐ মহিলাটিই আমাদের মেইলিগুলি হবে।’ বলল যুবায়েরভ।
‘সওদাগরের মুখে কাহিনী শুনে আমারও তাই মনে হয়েছে স্যার। বলল ওমর মা চাং।
যুবায়েরভ, আলদর আজিমভ ও আবদুল্লায়েভের দিকে তাকাল। তারাও মাথা নেড়ে বলল, ‘আমাদের মন এটাই বলছে।’
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যুবায়েরভের। বলল, ‘তাহলে আর দেরি নয়, চলুন আমরা এখন যাত্রা করব।’
‘আমাদেরও এটাই মত।’ বলল আজিমভ ও আবদুল্লায়েভ।
‘আমাকে কি দয়া করে আপনারা সাথে নেবেন ?’ ম্লান মুখে বলল ওমর মা চাং।
যুবায়েরভ উঠে দাঁড়িয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আমরা টিমে ছিলাম তিন জন, এখন হলাম চারজন। তুমি সব সময় আমাদের সাথে থাকবে।’
যুবায়েরভের কথা শেষ হবার আগেই তরুন উইঘুর যুবক ‘আলস্নাহু আকবার’ বলে এমন প্রচন্ড লাফ দিয়ে উঠল যে, মনে হল সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে।’
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে।
গাড়িতে গিয়ে উঠল সবাই।
ড্রাইভিং সিটে উঠল যুবায়েরভ। আলদর আজিমভ পাশের সিটে। আর আবদুল্লায়েভ ও ওমর মা চাং পেছনের সিটে।
গাড়ি স্টার্ট নেবার আগে ওমর মা চাং বলল, ‘আপনাদের অস্ত্র শস্ত্র?’
‘আমাদের যথেষ্ট অস্ত্র আছে, সময় এলে দেখবে।’ হেসে বলল আবদুল্লায়েভ।
গাড়ি ষ্টার্ট দিল।
টিলার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এবড়ো-থেবড়ো চড়াই অতিক্রম করে গাড়ি এসে হাইওয়েতে উঠল।
ছুটে চলল গাড়ি তীব্র বেগে।
ড্রাইভিং সিট থেকে যুবায়েরভ বলল, ‘উসু থেকে উত্তরে বাঁক নেবার পর হাইওয়েতে কি ডানে বামে কোন রাস্তা আর আছে ওমর?’
‘না ডানে বামে কোন রাস্তা নেই। কিন্তু হাইওয়েটা খুব একটা ভাল নয় স্যার। বড় বড় বাঁক আছে যেমন,তেমনি রাস্তাও মাঝে মাঝে খুব এবড়ো-থেবড়ো।’
‘ধন্যবাদ ওমর, বলে ভাল করেছ।’
কিছুক্ষন সবাই চুপ চাপ।
‘ওমর তুমি কি রেড ড্রাগন ও ‘ফ্র’ এর হেড কোয়ার্টার চেন ?’ অনেকক্ষণ পরে কথা বলল আলদর আজিমভ।
‘ডাঃ ওয়াং এর অফিস তো স্যার?’
‘হ্যাঁ।’
‘চিনি স্যার।’
‘স্যার, জেনারেল বরিসের ভিন্ন কোন অফিস নেই। ডাঃ ওয়াং এর অফিসেই তিনি বসেন।’
‘এই যে বিপ্লব হলো, তারপর ডাঃ ওয়াং এর অফিস বদলে যায়নি তো?’
‘না স্যার, এইতো গতকালও আমি গিয়েছি।’
‘গতকাল গিয়েছ? তোমাকে ওরা চিনেনি?’
‘স্যার, আমার মা হান। তাঁকে মুসলমান করে আব্বা তাকে বিয়ে করেন। আমি হানদের পোশাক পরলে আমাকে হান বলে অনেকেই ভুল করে। হানদের পোশাক পরে আমি ডাঃ ওয়াং এর অফিসে ঢুকেছিলাম। কোন অসুবিধা হয়নি।’
‘কেমন দেখলে, কারও সাথে কথা বলেছ, কিছু আন্তরিকতা?’
‘আমি গিয়েছিলাম ডা: ওয়াংকে দেখতে। ডা: ওয়াং কিংবা জেনারেল বরিস কেউই ছিলেন না। অনেকক্ষণ বসেছিলাম রিসেপশনে। জেনেছি, রিসেপশনের ঠিক ওপরেই দুতলায় ডা: ওয়াং ও জেনারেল বরিস পাশাপাশি রুমে বসেন। আমি রিসেপশনে বসে থাকার সময়েই নেমে এসেছিলেন ডা: ওয়াং ও বরিসের পি.এ. মিস নেইলি ও মিস কিয়ান। ওদের কথা থেকে বুঝলাম, ওরা তাদের বসের ওপর সন্তুষ্ট নয়।’
‘কি করে বুঝলে?’
‘তখন বেলা দু’টা। সময়টা ছিল শিফট চেঞ্জ ও লাঞ্চের। আমি আগেই রিসেপশনিষ্টকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। মিস নেইলি ও মিস কিয়ান যাচ্ছিল লাঞ্চে। আমরা তাদের সাথে বেরিয়েছিলাম। অফিসের পাশেই একটা রেষ্টুরেন্ট। লাঞ্চ করেছি এক সাথে বসে। কথায় কথায় আলোচনা উঠেছিল চাকুরীর ভালমন্দ নিয়ে। মিস নেইলি ও মিস কিয়ান তাদের চাকুরীর ব্যাপারে তীব্র অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিল, তাদের খেয়ে বেঁচে থাকার কোন উপায় থাকলে ঐ অফিসে তারা আর পা দিতনা। তারা বলেছে, কয়েকটা টাকা দিয়ে বসরা মনে করে তারা আমাদের শুধু নির্দিষ্ট সময় নয়, আমাদের সবটাই তারা কিনে নিয়েছে। আমি সবার লাঞ্চের পয়সা দিয়েছিলাম। ওরা খুব খুশী।’
‘তুমি তো দারুণ ছেলে ওমর। মেইলিগুলি সম্পর্কে কোন দিক দিয়ে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সুযোগ পাওনি।’
‘দু:খিত, আমার ঐ সব কথা মনেই হয়নি। আমার লক্ষ্য ছিল ওদের সাথে খাতির করে ওদের অফিসের যত্রতত্র যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সুযোগ মত ডা: ওয়াং ও জেনারেল বরিসকে খুন করা।’
আলদর আজিমভ হাসল। বলল, ‘তুমি ভুলে গিয়েছিলে ওদেরকে খুন করার চেয়ে বড় কাজ আরও আছে। যাক, তোমার মিশন কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। তোমার সাথে ওয়াং-এর অফিসের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’
‘গর্ভনর ইউয়ান, নেইজেন, আহমদ ইয়াংদের কোন খোঁজ জান? ওরা কোথায়?’ বলল যুবায়েরভ।
‘আমাদের বিভিন্ন লোকের কাছে যা শুনেছি, তাতে তাদেরকে জেলখানার রাজনৈতিক অংশে রাখা হয়েছে। আরও শুনেছি, সাবেক গভর্নর ও তার পরিবারকে নিয়ে বর্তমান গর্ভনর অর্থাৎ সরকারের সাথে ডা: ওয়াংদের মত পার্থক্য ঘটেছে। ডা: ওয়াংরা এখনি বিচারের পক্ষপাতি। অনেকের আশংকা, ওয়াংরা জেলখানার ভেতরে অথবা বাইরে এনে তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।’
‘সাংঘাতিক কথা শোনালে ওমর তুমি। আমার মনে হচ্ছে এ আশংকাটা সত্য।’
‘ওদিকেও তাহলে ত্বরিত নজর দিতে হয় যুভায়েরব।’ বলল আজিমভ।
‘আমাদের ভাবী সাহেবের ব্যাপারটার কোন কিনারা না হলে কোন দিকেই আমরা নজর দিতে পারছিনা।’
আবার সবাই নিরব।
গাড়ি ছুটে চলেছে আলতাই এর পার্বত্য পথ ধরে। ফাঁকা রাস্তা, কিন্তু ঘন ঘন বাঁক, আর চড়াই উতরাই- এর জন্যে গাড়ি মনের মত করে চালাতে পারছেনা যুবায়েরভ।
রাত তিনটা নাগাদ যুবায়েরভের গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মেইলিগুলির গাড়ির কাছে থামল। সকলেই গাড়ি থেকে নামল।
মেইলিগুলির গাড়ির দরজা বন্ধ ছিল গাড়ির দরজা খুলে টর্চ জ্বেলে তারা পরীক্ষা করল গাড়ি।
পরীক্ষা শেষে তীক্ষ্ন দৃষ্টি আজিমভ এক খন্ড সুতা দেখিয়ে বলল, ‘এটা সিল্কের সুতা। নিশ্চয় ওড়নার। সুতার একটা অংশে রক্ত। তাহলে বুঝা যাচ্ছে ওড়না দিয়ে আহত স্থানটি বাঁধা হয়েছিল। অর্থাৎ যিনি আহত হয়েছেন ও গাড়ি চালিযেছেন তিনি মহিলা। অন্যদিকে এই ভাড়াটে ট্যাক্সির যিনি ড্রাইভার ব্লু বুক অনুসারে তিনি পুরুষ এবং তিনি যেমন গাড়ি চালাননি, তেমনি গাড়িতেও ছিলেননা। থাকলে গাড়ি এভাবে পড়ে থাকতোনা। এর অর্থ গাড়ি যিনি চালিয়েছেন সেই মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ি কেড়ে বা হাইজ্যাক করে নিয়ে এসেছেন। আর একটি জিনিস যিনি গাড়ি এভাবে নিয়ে এসেছেন তিনি ফুয়েল ইন্ডিকেটরের দিকে নজর দেবার সময় পাননি, অথবা জ্বালানি সংগ্রহের সাধ্য, সামর্থ ও সুযোগ তার ছিলনা। এটা হতে পারে এই কারণে যে, তিনি নিজে পলায়নপর ছিলেন এবং সেই সাথে ছিলেন আহত। নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়াই তার লক্ষ্য ছিল, অন্য কোন দিকে লক্ষ্য তার ছিলনা।’ থামল আজিমভ।
‘সব মিলে যাচ্ছে। নিশ্চয় তিনি আমাদের ভাবী মেইলিগুলি হবেন।’ আনন্দে শিশুর মত চিৎকার করে উঠল যুবায়েরভ।
আবার যাত্রা শুরু হল তাদের।
এবার গাড়ি আস্তে চালান। সবার চোখ রাস্তার পশ্চিম পাশে। সবাই খুঁজছে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে একটা করিডোর। সকলের মনে আশা নিরাশার দোলা। যদি এমন করিডোর না থাকে, যদি তারা তা খুঁজে না পায়, তাহলে সব আশা যে তাদের গুড়িয়ে যাবে। মংগোলীয় সওদাগর ঠিক বলেছে তো, বলতে ভুল করেনি তো সে!
অবশেষে সকল উদ্বেগের অবসান ঘটল। এক সাথেই সকলের চোখে পড়ল করিডোরটি। থেমে গেল গাড়ি। যুবায়েরভ দূরত্ব নির্দেশক মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখল, পরিত্যক্ত সেই গাড়িটি থেকে দুই মাইলের চেয়ে কয়েকগজ বেশী এসেছে মাত্র। ওদের হিসাব সত্যিই নিখুঁত।
গাড়িটা একটা টিলার আড়ালে লুকিয়ে রেখে তারা সেই করিডোর ধরে পশ্চিমে যাত্র শুরু করল। রিভলভার ছাড়া ভারী কোন অস্ত্র নিল না। ওমর মা চ্যাং-এর রাইফেলও গাড়িতে রেখে দেয়া হলো। তাকেও দেয়া হলো একটি রিভলবার। রিভলভার পেয়ে সে মহাখুশী। জীবনে এই প্রথম সে রিভলভার হাতে পেল। পাওয়ার সাথে সাথেই তার মন বলে উঠল, আর যদি ফেরত না দিতে হতো! এই সহজ-সরল তরুণের ইচ্ছা আল্লাহ পূরণ করলেন।
ওমরের আনন্দ দেখে যুবায়েরভ বলল, ‘রিভলভার খুব ভালো লাগছে না? ঠিক আছে, আমরা তোমাকে ওটা প্রেজেন্ট করলাম।’
উইঘুর তরুণ আনন্দে ‘আল্লাহ আকবার’ বলে লাফ দিয়ে উঠল।
ওমরের আনন্দ থামলে যুবায়েরভ বলল, ‘শুন ওমর, আমরা সাথে থাকলে তুমি কোন অবস্থাতেই প্রথমে গুলি ছুড়বে না। ঠিক আছে?’
মাথা নেড়ে সায় দিল ওমর মা চ্যাং।
নানা জায়গায় ঠেকে, নানা পথ ঘুরে ৫টার দিকে তারা গ্রামে গিয়ে পৌছল।
একটা পায়ে চলা পথ গ্রামে ঢুকে গেছে।
যুবায়েরভ চলছিল আগে। তার পেছনে ওমর। তারপর আজিমভ এবং আবদুল্লায়েভ।
যুবায়েরভ গ্রামের সীমায় পা দিয়েছে এমন সময় চারদিক থেকে অনেকগুলো রাইফেল তাদের ঘিরে ফেলল। মানুষগুলো পাশের ঝোপঝাড় ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এল।
যুবায়েরভ দাঁড়িয়ে গেছে। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, ৫টি রাইফেল ও একটি স্টেনগান তাদের দিকে হা করে আছে।
‘আপনারা কে? আমাদের এভাবে আটকালেন কেন?’ উইঘুর ভাষায় বলল যুবায়েরভ।
‘গ্রামে প্রবেশের অনুমতি নেই রাতে।’ বলল স্টেনগানধারী লোকটি।
‘আপনারা এই গ্রামের লোক?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা আপনাদের শত্রু নই। আমরা ইব্রাহিম আওয়াং এর বাড়ি যাব।’
‘ঠিক আছে, সকালের আগে যেতে পারবেন না। এ অনুমতি নেই।’
‘তাহলে আমাদের একটা মসজিদে নিয়ে চলুন।’
‘কেন?’
‘ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে।’
‘দু:খিত, এ অনুমতিও নেই। খবর দেবার জন্য একজনকে পাঠিয়েছি, দেখি কি খবর নিয়ে আসে।’
‘কিন্তু নামাজের সময়তো চলে যাবে। তাহলে আমরা এখানেই নামাজ পড়ি। অজু করব কোথায়?’
স্টেনগানধারী- যে কথা বলছিল, সে তার স্টেনগানটা ঠিক ধরে রেখে, চোখের পলক পর্যন্ত না ফেলে বলল, ‘একজন গিয়ে আমাদের পানির মশক নিয়ে এসে এদের দাও।’
কয়েক মুহূর্তেও মধ্যে একজন পানির মশক নিয়ে এল।
যুবায়েরভরা চারজন একে একে অজু করল। তারপর নামাজে দাঁড়াল কংকরময় মাটির ওপর। প্রথমে দু’রাকাত সুন্নত নামাজ আদায় করল তারা। তারপর দাঁড়াল তারা এক সাথে ফরজ দু’রাকাত পড়ার জন্যে। ইমাম হিসাবে দাঁড়াল যুবায়েরভ।
ইতিমধ্যে গ্রামে খবর পৌছে গেছে। মসজিদে নামাজ হচ্ছিল তখন। খবর পেয়ে মসজিদের সবাই ছুটে এল কারা গ্রামে ঢুকতে এসেছে, কারা ধরা পড়েছে তা দেখার জন্যে। এদের সাথে রয়েছে ইব্রাহিম আওয়াং, যিনি গ্রামের সর্দার হবার সাথে সাথে মসজিদের ইমামও।
গ্রামের লোকজন এসে যখন জমা হলো, তখন নামাজ চলছে। . . . . .
সেই ছয়জন অস্ত্রধারী রাইফেল উচিয়ে তখনও পাহারা দিচ্ছে যুবায়েরভদের।
নামাজে যে কুরআন তেলাওয়াত করছিল যুবায়েরভ তা উচ্চস্বরে না হলেও উপস্থিত সবার কানে পৌঁছাচ্ছিল। অত্যন্ত মধুর কুরআন তেলাওয়াত যুবায়েরভের। উপস্থিত মানুষের মধ্যে যেমন বিস্ময় ছিল, তেমনি অভিভূত হয়ে পড়ল কুরআনের এই মধুর তেলাওয়াতে।
সবার মত অভিভূত হয়ে পড়েছিল ইব্রাহিম আওয়াংও। এমন মধুর তেলাওয়াত তারা জীবনে শোনেনি। কারা এরা?
ইব্রাহিম আওয়াং প্রহরীদের রাইফেল নামিয়ে দিতে এবং পাহারা থেকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল।
নামাজ ওদের শেষ হয়ে গেছে।
সালাম ফিরিয়েছে তারা।
তারা উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
ইব্রাহিম আওয়াং দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে সালাম দিল এবং বলল, ‘মাফ করবেন আমাদের, আপনাদের এভাবে কষ্ট করতে হলো। গতকাল গ্রামে একটা বড় দূর্ঘটনা ঘটে গেছে তো তাই গ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।’
ইব্রাহিম আওয়াং এর কথা শুনে মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল যুবায়েরভের! উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘কি ঘটনা ঘটেছে?’
‘খুব বড় ঘটনা।’
‘কি?’
‘তার আগে বলুন আপনারা কে?’
যুবায়েরভ ওমর মা চ্যাংকে দেখিয়ে বলল, ‘এ শিহেজী উপত্যকার লোক। আর আমরা তিনজন এসেছি তাসখন্দ থেকে?’
‘তাসখন্দ থেকে এখানে? কেন?’
‘একজন সওদাগর কি একজন সংজ্ঞাহীন মহিলাকে আপনাদের এখানে রেখে যায়নি?’
‘আপনারা তাকে চেনেন?’
‘সে মেইলিগুলি হলে তাকে আমরা জানি। সে আহমদ মুসার স্ত্রী। আমরা তার সন্ধানেই এসেছি।’
বৃদ্ধ কথা বলল না।
ধীরে ধীরে তার মাথা নিচু হলো।
কিছুক্ষণ পর যখন মাথা তুলল, তখন দেখা গেল তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
‘না মা নেই, আমরা তাকে হারিয়েছি।’ অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলল বৃদ্ধ।
ছ্যাত করে উঠল যুবায়েরভের বুক। অন্যদেরও এই একই অবস্থা। উৎকন্ঠা, উত্তেজনায় তাদের বুক ধড়ফড় করে উঠল। অসুস্থ অজ্ঞান মেইলিগুলি মারা গেছে কি? সেই কথাই বৃদ্ধ ওভাবে বলছে?
‘নেই মানে? অসুস্থ মেইলিগুলি কি………’ কথা আটকে গেল যুবায়েরভের। উচ্চারণ করতে পারলো না সে শেষের কথাগুলো।
বৃদ্ধ চোখ মুছে বলল, ‘না, তোমরা যা ভাবছ তা নয়। মরে গেলে তো আমার মা বেঁচে যেত। তার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছে!’
‘ওঁকে কি ধরে নিয়ে গেছে তাহলে ওরা?’
‘হ্যাঁ, ডা: ওয়াং এবং তার লোকেরা।’
‘কতজন লোক এসেছিল ওরা?’
‘প্রথমে চারজন, তারপরে হেলিকপ্টারে করে ডাঃ ওয়াং এবং দলবল।’
‘আপনারা বাধা দেননি ওদের?’ যুবায়েরভের মুখ ঝড় বিধ্বস্ত পাখির নীড়ের মত। অন্যদিকে তার চোখে মুখে কিছুটা শোবা-সন্দেহ। এদের কোন যোগসাজসে কি মেইলিগুলি ওদের হাতে গিয়ে পড়ল।
যুবায়েরভের এ প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধের চোখে আরেক দফা অশ্রুর ঢল নামল। বলল, সে এক কাহিনী বৎস, বলে বৃদ্ধ মেইলিগুলির আসা থেকে সে দিনের সব কাহিনী বণর্না করল। তারপর বলল, গ্রাম ও গ্রামবাসীদের বাঁচাবার জন্য মা তাঁর কথা আমাদের মেনে নিতে বাধ্য করে নিজে বন্দীত্ব বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু মায়ের মহত্বকে শয়তানরা শুরুতেই একদফা ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। যাবার সময় হেলিকপ্টার থেকে চারটি বোমা ফেলেছে। গ্রামের তিরিশটি বাড়ি ধ্বংস এবং ৫০ জন লোক নিহত হয়েছে।’
বৃদ্ধ থামল।
যুবায়েরভ কোন কথা বলতে পারলো না। বসে পড়ল মাটিতে। দু’হাতে চেপে ধরল মাথা। গুলিবিদ্ধ, জ্বরাক্রান্ত মেইলিগুলির এখন কি অবস্থা কে জানে? কিছুই করতে পারলো না যুবায়েরভরা। ব্যর্থ হলো তাদের মিশন। রক্ষা করতে পারলো না মেইলিগুলিকে শয়তানদের হাত থেকে। ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যুবায়েরভের। চোখ দিয়ে অশ্রুর বদলে বেরুচ্ছে আগুনের শিখা। হঠাৎ তার মনে হল, রেড ড্রাগন অর্থাৎ ডা: ওয়াং এর হেডকোয়ার্টার তো ওমর মা চ্যাং চেনে। সংগে সংগে গোটা শরীরে তার আগুন জ্বলে উঠল। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল যুবায়েরভ। চিৎকার করে বলল, ‘আজিমভ, আবদুল্লায়েভ, ওমর মা চ্যাং এবার ডা: ওয়াং এর হেড কোয়ার্টার। হয় সে দুনিয়াতে থাকবে, না হয় আমরা। চলো।’
ঘুরে দাঁড়াল যুবায়েরভ।
চলতে শুরু করল সে।
বৃদ্ধ ইব্রাহিম আওয়াং ছুটে এসে যুবায়েরভের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বৃদ্ধের বাড়িতে একটু চল বাবা। একটু সুযোগ দাও আমাকে।’
যুবায়েরভ দাঁড়াল। বলল, ‘জনাব, এখন একটা মুহূর্ত নষ্ট করার সময় নেই। শয়তানদের হাত থেকে মেইলিগুলিকে বাঁচাতে হবে। আপনারা তো আমাদের মতই মেইলিগুলির মংগল চান।’
বৃদ্ধ মাথা নিচু করে সরে দাঁড়াল যুবায়েরভের সামনে থেকে। সেই সাথে অশ্রু রুদ্ধ কন্ঠে বলল, ‘আমরা কি কোন সাহায্য করতে পারি না? আমরা মরতে ভয় পাইনি। কিন্তু মা আমাদের মরতে দেয়নি। গ্রামের প্রত্যেকে তৈরী আছে মরার জন্যে।’
‘যুবায়েরভ বৃদ্ধের একটা হাত তুলে নিয়ে চুম্বন করে বলল, ‘আমরা সেটা জানি। কিন্তু দল বল নিয়ে ওদের সাথে পারা যাবে না। যেতে হবে কম সংখ্যায়, জিততে হবে বুদ্ধির যুদ্ধে। দরকার হলেই আপনাদের ডাকব আমরা।’
‘তোমরা কে বাবা। তোমাদের মত আমরা হলে মাকে ওদের হাতে তুলে দিতাম না, মাকে বাঁচাতে পারতাম। ভুল করেছি আমরা বাঁচাতে চেয়ে।’
‘না ভুল আপনারা করেননি। মেইলিগুলি আহমদ মুসার স্ত্রী। সে ঠিকই নির্দেশ দিয়েছিল। আহমদ মুসা হলেও এটাই করতেন। আর আমাদের পরিচয়? আমরা আহমদ মুসার নগণ্য কর্মী।’
বলে আবার সালাম জানিয়ে হাঁটা শুরু করল যুবায়েরভ। তার পেছনে অন্য তিনজন।
বৃদ্ধ ঠায় দাড়িয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তার পেছনে গ্রামবাসীরা। যাদের হাতে রাইফেল ছিল, অনেকক্ষণ আগে তাদের হাত থেকে রাইফেল পড়ে গেছে। তাদের সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি এগিয়ে চলা ঐ চারজনের প্রতি। সবকিছু ছাপিয়ে একটা কথা তাদের সামনে বড় হয়ে উঠছে, আহমদ মুসার নগণ্য কর্মীর চেহারা যদি এমন হয়, তাহলে আহমদ মুসা কেমন!

Top