১৭. ব্ল্যাক ক্রসের কবলে

চ্যাপ্টার

প্যারিসে যখন ল্যান্ড করল বিমানটি রাত তখনও বাকি।
ছোট্ট একটি এ্যাটাসি কেস হাতে লাউঞ্জে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
চারদিক তাকাল।
তার চোখ দু’টি সন্ধান করল ফিলিস্তিন এ্যামবেসির কাউকে। কিন্তু কাউকে দেখল না। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
প্যারিস যাত্রার এক ঘন্টা আগেও ওদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এ্যামবেসিতেই আহমদ মুসার প্রথম যাবার কথা। ওখান থেকেই কিডন্যাপ হয়েছে ওমর বায়া। সামনে এগুতে হলে কিছু জানতে হবে ফিলিস্তিন দুতাবাস থেকে।
বিস্মিত আহমদ মুসা বেরিয়ে এল বিমান বন্দর থেকে।
যাত্রীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। লাউঞ্জে বেশ দেরী করেছিল আহমদ মুসা।
বাইরে এসে ট্যাক্সির জন্যে সে সামনের দিকে নজর করতেই একটা হর্ণ কানে এল আহমদ মুসার। চমকে উঠে সেদিকে তাকাল। বুঝল ওটাই ফিলিস্তিন এ্যামবেসির গাড়ি। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা সাইমুমের কোডে হর্ণ দিয়েছে।
আহমদ মুসার কাছে সবটা পরিস্কার হয়ে গেল। শত্রুপক্ষের নজর এড়াবার জন্যেই এ্যামবেসির পরিচিত কেউ বিমান বন্দরে আসেনি। সম্ভবঃত যে গাড়িটা এসেছে তাও এ্যামবেসির নয় এবং এ্যামবেসি থেকে আসা নয়।
আহমদ মুসার মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। গাড়ির দিকে এগুলো আহমদ মুসা।
গাড়ির কাছাকাছি যেতেই আবার হর্ণ বাজিয়ে গাড়িটা নড়ে উঠল। কোডেড এ হর্ণের অর্থ হলো- স্বাগতম।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে দাঁড়াতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। জ্বলে উঠল গাড়ির ভেতরের আলো।
আহমদ মুসা দেখল, ড্রাইভিং সিটে একজন এবং তার পাশের সিটে আরেকজন বসা। দু’জনেই অপরিচিত, কিন্তু দু’জনেই আরব।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসল। পেছনের সিটে।
আহমদ মুসা সালাম দিল। উত্তর দিল ওরা দু’জনেই।
গাড়ি লাফিয়ে উঠে যাত্রা শুরু করল।
বিমান বন্দর এলাকা থেকে বেরিয়ে এল গাড়ি।
‘আমরা নিশ্চয় এ্যামবেসিতে যাচ্ছি?’ প্রথমে নীরবতা ভাঙল আহমদ মুসা।
‘জি, জনাব’। পাশের লোকটি বলে উঠল।
‘গাড়িটা নিশ্চয় এ্যামবেসি থেকে আসেনি?’
‘জনাব ঠিকই বলেছেন’।
‘ওরা কি এ্যামবেসির উপর খুব নজর রাখছে?’
‘সম্ভবঃত ব্যাপারটা তেমন নয়, কিন্তু সাবধানতার জন্যেই এটা করা’।
‘তোমরা?’
‘আমরা আপনার সাইমুমের খুব নগণ্য কর্মী। প্যারিসের দু’টি ফার্মে আমরা দু’জন চাকরী করি। আপনাকে এ্যামবেসিতে পৌছে দেয়া আমাদের উপর নির্দেশ’।
এয়ারপোর্ট-হাইওয়ে ধরে ছুটে চলল সাইমুমের গাড়ি আহমদ মুসাকে নিয়ে।
নীরব চারদিক। হাইওয়েতেও গাড়ির ভীড় খুব কম। একশ পচিঁশ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি।
‘সুন্দর ড্রাইভিং কর তো দেখছি। তোমার নাম কি?’ ড্রাইভিং সিটের দিকে চেয়ে হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘জনাব পর্বত কি টিলার প্রশংসা করতে পারে? আপনার ড্রাইভিং-এর কথা শুনেছি স্যার’।
একটু থেমেই লোকটি বলল, ‘আমার নাম আবু আবদুল্লাহ আমর। আর ওর নাম আহমদ জিয়াদ’।
‘তোমরা কতদিন আছ প্যারিসে?’
‘পাঁচ বছর’।
‘অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে?’
‘কোনদিক দিয়ে স্যার?’
‘এখানকার সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠী বিশেষ করে মুসলমানদের কথা বলছি’।
‘তাদের অধিকারের সীমানা ক্রমশঃ সংকীর্ণতর হয়ে উঠছে’।
‘তোমার মতে এর কারণ কি বলত?’
‘গভীরভাবে ব্যাপারটাকে আমি কখনও ভেবে দেখতে চেষ্টা করি নি। তবে আমার মনে হচ্ছে, এরা ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ থেকে সরে আসছে’।
‘সরে কোথায় আসছে?’ কথার সাথে আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘ধর্মীয় জাতীয়তার দিকে’।
‘তোমার এ চিন্তার কারণ?’
গাড়িটা হঠাৎ ডান দিকে টার্ন নিল এবং আবার ছুটতে শুরু করল।
‘হাইওয়ে ছাড়লে কেন? কোন পথে যাবে?’ বলল আহমদ মুসা বাইরের দিকে নজর বুলিয়ে।
‘আমরা যাচ্ছি শহরের এ প্রান্তের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে। এ রাস্তাটি নিরিবিলি ও সংক্ষিপ্ত হবে’। বলল আবু আবদুল্লাহ আমর। সত্যিই এ রাস্তাটা একেবারেই জনশূন্য। একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে চাইল। সূর্য উঠার আরও দেড় ঘন্টা বাকি। ‘আর কতক্ষণে আমরা পৌঁছব আমর?’ বলল আহমদ মুসা।
‘পনের মিনিট স্যার’।
কথা শেষ করেই ড্রাইভার আবু আবদুল্লাহ আমর দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘স্যার রাস্তায় একজন লোক পড়ে আছে’।
আহমদ মুসারও চোখে পড়ে গেছে। বলল, ‘হ্যাঁ লোকটার হাত-পা চোখ বাঁধা মনে হচ্ছে’।
বলতে বলতে গাড়িটা লোকটার সমান্তরাল এসে পৌছল।
‘গাড়ি থামাও’। দ্রুতকন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
লোকটার প্রায় পাশে এসে গাড়ি থামল।
গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। তার সাথে আহমদ জিয়াদও।
পড়ে থাকা লোকটি উঠে বসেছে। সত্যিই তার দুই হাত-পা ও চোখ বাধা। বয়স সত্তরের বেশী হবে। মাথায় টাক। টাকের প্রান্ত দিয়ে চুলগুলো তুলোর মত সাদা। চোখ-মুখে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ছাপ।
আহমদ মুসা ও আহমদ জিয়াদ দু’জনেই গিয়ে দ্রুত তার চোখ ও হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল।
‘ধন্যবাদ ইয়ংম্যান তোমাদের সাহায্যের জন্যে’। লোকটি উঠে দাড়িয়েঁ কোটের কলার ও টাই ঠিক করতে করতে বলল।
‘ধন্যবাদ। আপনাকে আমরা আর কি সাহায্য করতে পারি? কোথায় যেতে চান আপনি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ সময় বোধহয় গাড়ি পাব না। আমাকে বাড়ি পৌছে দিলে খুশী হবো’।
‘নিশ্চয় পৌছে দেব। আসুন’। বলে আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে ধরল।
গাড়িতে উঠে বসল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা বন্ধ করে ওপাশ দিয়ে বৃদ্ধের পাশে উঠে বসল।
‘শার্লেম্যান সার্কেল। এখান থেকে বেশ দুর। অসুবিধা হবে না তো তোমাদের?’ বলল বৃদ্ধটি।
‘না, কোন অসুবিধা নেই। আমর তুমি চেননা শার্লেম্যান সার্কেল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘চিনি জনাব’। বলল ড্রাইভার।
গাড়ি ঘুরে আবার এয়ারপোর্ট হাইওয়েতে ফিরে এল। তারপর আবার ছুটে চলল শহরের দিকে। শার্লেম্যান সার্কেল শহরের একেবারে বিপরীত প্রান্তে। শহরের একটা অভিজাত এলাকা ওটা।
‘তোমরা তো সবাই বিদেশী দেখছি। কিন্তু তুমি তো এই রাতে প্যারিসে ল্যান্ড করলে?’ আহমদ মুসার দিকে একটু মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল বৃদ্ধটি।
‘কি করে বুঝলেন?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়ের সুর।
‘খুব সহজ ইয়ংম্যান, তোমার দিক থেকে একটা সেন্ট আসছে। সে সেন্টটা প্যান ইসলামিক এয়ারলাইন্সের রিফ্রেসারেই শুধু পাওয়া যায়। এবং এ সেন্ট এক ঘন্টার বেশী থাকে না। সুতরাং …’।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে বৃদ্ধের দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল, লোকটিকে সে যতটা অসাধারণ মনে করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী অসাধারণ।
‘জি, ঠিকই বলেছেন। আমি এক ঘন্টার মত হলো ল্যান্ড করেছি’।
‘তোমার খুব কষ্ট হলো। তোমরা তো যাচ্ছিলে ডিপ্লোম্যাটিক জোনে। এতক্ষণ তুমি রেস্টে যেতে পারতে’।
আহমদ মুসার আবার বিস্মিত হবার পালা। বলল, ‘কেমন করে বুঝলেন আমরা ডিপ্লোম্যাটিক জোনে যাচ্ছিলাম?’
‘খুব সোজা। প্যারিসের ম্যাপ তোমার সামনে থাকলে তুমিও বলতে পারতে। এ রাস্তায় যারা আসে, তারা হয় ডিপ্লোম্যাটিক জোনে যায়, নয়তো শহর পেরিয়ে ওদিকে চলে যায়’।
শার্লেম্যান সার্কেলে প্রবেশ করল গাড়ি। বৃদ্ধ আমরকে বুঝিয়ে দিল কোন পথে কোথায় যেতে হবে।
বাগান ঘেরা সুন্দর একটা বাঙলোর সামনে এসে গাড়ি থামল।
গেট বক্স থেকে দু’জন পুলিশ ছুটে এল।
উকি দিয়ে বৃদ্ধকে দেখেই লম্বা স্যালুট দিল তাকে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দের বিচ্ছুরণ।
স্যালুট শেষ করে একজন ছুটে গেল ভেতরে।
বৃদ্ধ নামল গাড়ি থেকে। আমন্ত্রণ জানাল আহমদ মুসাদেরকেও নামার জন্যে।
‘ধন্যবাদ জনাব, আপনাকে আর কষ্ট দেব না’। বলল আহমদ মুসা।
‘দেখ, তোমার রেস্ট নেবার জায়গা এখানেও আছে। নেমে এস’।
নামল আহমদ মুসারাও।
বাড়ির ভেতর থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা এবং এক তরুণী।
বৃদ্ধকে এসে জড়িয়ে ধরল মহিলা ও তরুণীটি।
আহমদ মুসা ও তার সাথের দু’জন বসেছিল ড্রইং রুমে। মিনিট পাচেঁক পর বৃদ্ধটি ড্রইং রুমে ফিরে এল। তার সাথে মহিলা ও তরুনীটিও।
ওরা ড্রইং রুমে ঢুকতেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমাদের ফজর নামাযের সময় হয়েছে। আমরা কি…’।
‘ফজর নামায?’ বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল বৃদ্ধটি।
‘মর্নিং প্রেয়ার’। বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি, কি দরকার বল’।
‘কিছু নয়। আমরা একটু টয়লেট ব্যবহার করব। এই কার্পেটে কিংবা করিডোরেও নামায হতে পারে’।
‘ঠিক আছে। এস’। বলে মহিলাটি হাসি মুখে গিয়ে টয়লেট দেখিয়ে দিল’।
ড্রইং রুমের এক পাশে তিনজনে ওরা নামায পড়ল।
ওরা তিনজন নীরবে বসে নামায দেখছিল। ওদের সবার মুখ বিস্ময়ে বিমুগ্ধ।
নামায শেষ করে আহমদ মুসারা এসে বসল।
‘এদের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি ইয়ংম্যান’। তারপর মহিলাকে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার স্ত্রী, আর ও আমার মেয়ে ক্লাউডিয়া’।
বৃদ্ধ কথা শেষ করতেই মহিলাটি বলল, ‘তোমাদের প্রেয়ার তো খুবই সুন্দর। তুমি উচ্চারণ করলে ওটা কোন ভাষা?’ আহমদ মুসার দিকে লক্ষ্য মহিলাটির।
‘ওটা আরব ভাষা’।
‘মাতৃভাষা?’
‘মাতৃভাষা যাই হোক, প্রার্থনার ভাষা আরবী’।
‘সামনে যে দাঁড়ায় তিনি বুঝি নামায পরিচালনা করেন?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘হ্যাঁ’। বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি ধর্ম নেতা, যেমন আমাদের বিশপ, ফাদার?’
‘না। মুসলমানদের নামায পরিচালনা যে কোন মুসলমানই করতে পারে’।
ক্লাউডিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে বৃদ্ধ বলল, ‘ওরা খুব টায়ার্ড। কিছু দাও এদের’। বৃদ্ধের দৃষ্টি মহিলার দিকে।
‘বলে দিয়েছি। আসছে’। বলল মহিলা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমরা তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ বাবারা। ওকে উদ্ধার করে কষ্ট করে নিয়ে এসেছ’। মহিলার কণ্ঠস্বর ভারি।
‘এইটুকু কাজের জন্যে এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে ছেলেদের প্রতি অন্যায় করা হয় মা’। বলল আহমদ মুসা।
‘তোমরা সত্যিই ভাল ছেলে। তোমরা ঈশ্বরের প্রার্থণা কর। এমনটা তো আজ দুর্লভ’। বলল মহিলা।
‘এই দেখ তোমাদের নামটাও জানা হয়নি’। বলল বৃদ্ধ।
আহমদ মুসা মুহুর্তকাল দ্বিধা করল। তারপর ওদের দু’জনের নাম বলে নিজের নাম বলল, আহমদ মুসা।
হঠাৎ করেই চোখটা কিছুটা তীক্ষ্ম হয়ে উঠল বৃদ্ধের।
এই সময় নাস্তা এল। নাস্তা বলতে কিছু স্ন্যাকস এবং শ্যাম্পেন।
আহমদ মুসারা সবার সাথে স্ন্যাকস খেল। কিন্তু মদ স্পর্শ করল না।
‘কি, তোমরা শ্যাম্পেন খাও না?’ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল মহিলাটি।
‘না, আমরা মদ খাই না’।
‘খাও না?’ মহিলাসহ সবার চোখে এক রাশ বিস্ময়।
কিন্তু বৃদ্ধের চোখে বিস্ময় নেই। তার চোখে আগের সেই তীক্ষ্মতা এবং দুর্লভ কোন জিনিস খুজেঁ পাওয়ার ঔজ্জ্বল্য।
‘তোমরা খুবই ভাল ছেলে। এমনটা আমি চোখে দেখিনি’। বলল মহিলাটি।
‘মুসলমানদের কয়েকজনকে তো আমি মদ খেতে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে?’ বলল ক্লাউডিয়া।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আইন ও নীতি তো সবাই মানে না’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আপনাদের আর কষ্ট দেব না। আমরা এখন উঠতে চাই’।
বৃদ্ধের ঠোটেঁ হাসি। একটু নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘কিন্তু তোমরা তো আমার কথা আমার পরিচয় কিছুই জিজ্ঞাসা করলে না?’
আহমদ মুসা সলজ্জ হেসে বলল, ‘আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তবে যারা কিডন্যাপ করেছিল তারা মনে হয় আপনাদের শত্রু নয়’।
‘কি করে বুঝলে এসব কথা?’ বৃদ্ধের মুখে হাসি।
‘আপনার পোষাক-পরিচ্ছদ, কলম, ঘড়ি, চশমা, হ্যাটসহ যে ভাবে আপনাকে পেয়েছি তাতে এটাই মনে হয়েছে’। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আপনি ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ একজন সাবেক সদস্য’।
‘কি করে বুঝলে?’
‘পুলিশের স্যালুট দেয়া এবং আপনাকে দেখে’।
মহিলাটি এবং ক্লাউডিয়া নীরবে শুনছিল। তাদের চোখে বিস্ময়।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, ‘আমার কিন্তু জানতে ইচ্ছা করছে, শত্রু নয় অথচ ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করল কেন?’
‘বলব আমি কিন্তু তার আগে বল, তোমাকে আমি যা ভাবছি তুমি তাই কিনা?’
আহমদ মুসা মুখ তুলে পূর্ণভাবে তাকাল বৃদ্ধের দিকে।
বৃদ্ধের এই কথায় তার স্ত্রী এবং কন্যা ক্লাউডিয়া বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকাল একবার বৃদ্ধের দিকে আরেকবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
‘আপনার ভাবনা ঠিক হতেই হবে’। মুখ নিচু করে বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘ওয়েলকাম। তোমাকে ‘তুমি’ বলার জন্যে আমি দুঃখিত। কিছু মনে করো না। আমি তোমার পিতার বয়সের’।
মহিলা এবং ক্লাউডিয়া দু’জনেরই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে।
‘আব্বা, কি বলছ আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না’। বলল ক্লাউডিয়া।
‘মা, তোমরা যাকে চোখে দেখছ, যার সাথে কথা বলছি, তিনি বিস্ময়কর চরিত্র, কিংবদন্তির নায়ক আহমদ মুসা’।
‘কি বলছেন আব্বা‍!’- বলে বিস্ময়ে দাড়িয়েঁ গেছে ক্লাউডিয়া। আর তার মা’র চোখে বোবা দৃষ্টি।
‘অবিশ্বাস্যই মা’।
‘আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না। আমি আমার জাতির একজন নগণ্য কর্মী’। বিব্রত আহমদ মুসার মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
‘আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি আহমদ মুসা তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে। অনেক ভেবেছি আমি তোমার কথা। আমার বাড়িটা সত্যই ধন্য হলো। এটা আমার জন্যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা’।
একটু থেমেই আবার বলল, ‘কিছু মনে করো না। আমার কৌতুহল হচ্ছে, ফ্রান্সে তোমার আগমন কেন? বড় কিছু না ঘটলে তুমি কোথাও যাও না। এই কিছুদিন আগে তো ফ্রান্স থেকে গেলে’।
সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ, ক্লাউডিয়া এবং তার মা সকলের উদগ্র দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার মুখ নিচু।
ক্লাউডিয়া এবং তার মা ভেবে পাচ্ছে না, এমন শান্ত ও সলজ্জ মানুষ এত বড় বিপ্লবী কি করে হতে পারে।
আহমদ মুসা একটু মুখ তুলল। বলল, ‘বড় কোন ঘটনা ঘটেনি। আমাদেরই এক ভাইকে কিডন্যাপ করা হয়েছে’।
‘কিন্তু এই ঘটনায় তোমার আসাটা……’।
কথা শেষ না করেই থামল বৃদ্ধ।
‘সে একজন ব্যক্তি মাত্র নয়। তার ধ্বংস হওয়ার মধ্যে দিয়ে গোটা দক্ষিণ ক্যামেরুনকে মুসলিম স্বার্থের ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়ে যাবে’।
‘বুঝেছি। তাকে কারা কিডন্যাপ করল?’
‘ঠিক জানি না। তবে পশ্চিম আফ্রিকার খৃষ্টান মিশনারী এবং সেখানকার গোপণ খৃষ্টান জংগ সংগঠন তাকে তাড়া করে ফিরছে’।
‘ঐ সংগঠন কি ‘কোক’ (কিংডোম অব ক্রাইস্ট) এবং ‘ওকুয়া’ (আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট আফ্রিকা)?’
‘জি’।
একটু চিন্তা করল বৃদ্ধ। তারপর বলল, ‘কোক’ কিংবা ‘ওকুয়া’র কোন ক্ষমতা নেই ফ্রান্সে কোন অপারেশন চালাবার’।
থামল। একটু ভাবল বৃদ্ধ। বলল আবার, ‘কোত্থেকে কিভাবে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?’
‘ফিলিস্তিন দুতাবাসের গাড়ি থেকে। দিনের বেলা। দুতাবাসের সামনের রাস্তা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়’। বলল আবু আবদুল্লাহ আমর।
‘আহমদ মুসা, আমি নিশ্চিত এ কাজ ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর, তবে এরা কোন অপরাধী সংগঠন নয়’।
‘ব্ল্যাক ক্রস?’ প্রশ্ন আহমদ মুসা। তার কপাল কুঞ্চিত।
‘ইউনিভারসাল হোলিক্রস- নামক এন.জি.ও’এর নাম নিশ্চয় তুমি জান’।
‘জি’।
‘এই ইউনিভারসাল হোলিক্রস’- এরই আন্ডার গ্রাউন্ড নাম ‘ব্ল্যাস ক্রস’। এক সংগঠনের দুই মুখ। ইউ এইচ সি (UHC)-এর নামে তারা দুনিয়ায় সেবামূলক কাজ করে এবং ব্ল্যাক ক্রস-এর নামে তারা খৃষ্টান স্বার্থে যা প্রয়োজন তাই করে’।
‘এরা কি অপরাধী সংগঠন নয়?’
বৃদ্ধ হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ আমি বলেছি ওরা অপরাধী সংগঠন নয়। তার অর্থ হলো, নিছক অর্থ-সম্পদের জন্যে এরা সন্ত্রাস বা খুনোখুনি করে না। অর্থ-সম্পদ এদের লক্ষ্য নয়। এদের লক্ষ্য গোটা বিশ্বের খৃষ্টকরণ। খৃষ্টান বিশ্বাসের, অন্যকথায় খৃষ্টান নিয়ন্ত্রণ প্রসারের জন্যে কোন কিছু করতেই তারা পিছপা হয় না। সুতরাং সাধারণভাবে অপরাধী বলতে যা আমরা বুঝি, সে ধরণের অপরাধী তারা নয়’।
‘ব্ল্যাক ক্রসের সাথে যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, সেই ওমর বায়ার তো কোন শত্রুতা নেই। তাহলে তারা তাকে কিডন্যাপ করলো কেন?’
‘আমি মনে করছি, ‘ওকুয়া’ ব্ল্যাক ক্রসের সাহায্য চেয়েছে। ব্ল্যাক ক্রস এতে সাড়া দিয়ে তাকে সাহায্য দিচ্ছে। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। খৃষ্টান ধর্মের সম্প্রসারণ উভয়েরই লক্ষ্য। তাছাড়া কিছু অর্থযোগও থাকতে পারে’।
‘বুঝেছি জনাব। আমাদের সংঘাতটা তাহলে ব্ল্যাক ক্রস- এর সাথে’।
‘ঠিক। কিন্তু তুমি কি ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে লড়াইয়ে নামতে চাও? বাঘদের রাজ্যে কি বাঘের সাথে লড়াইয়ে নামা উচিত?’
‘উচিত কি না সে বিচার তখন করা যায়, যখন বিকল্প থাকে। আমাদের সামনে কোন বিকল্প নেই জনাব’।
‌‌‘ঠিক বলেছ বৎস। কিন্তু আমি ভাবছি জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া কি ঠিক? তুমি বোধ হয় জান না, ফরাসি পুলিশ অফিসারদের উপর ‘ব্ল্যাক ক্রস’- এর প্রভাব। বলতে পার, ব্যক্তিগত ভাবে পুলিশ ও পুলিশ অফিসাররা তাদের প্রতি অনুগত বা সহানুভূতিশীল। সুতরাং পুলিশের সত্যিই কোন সাহায্য পাবে না। আর ব্ল্যাক ক্রস- নাজীদের গেষ্টাপো বাহিনীর মতই সর্বব্যাপী এবং তাদের মতই নিষ্ঠুর। ফ্রান্সে এসে তুমি ওদের সাথে লড়াইয়ে নাম, আমার মন এতে কিছুতেই সায় দিচ্ছে না’।
‘আপনার শুভেচ্ছার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জয়ের জন্যে ওদের সাথে লড়াইয়ে নামছি না জনাব। আমার কাজ একজন মজলুম মানুষকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করা। এটা আত্মরক্ষার লড়াই। জয়ের জন্যে যে লড়াই সেখানে অনেক হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন হয়, আত্মরক্ষার লড়াইয়ে তার কোন হিসেব-নিকেশের অবকাশ থাকে না’।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল। দু’পা এগিয়ে এসে আহমদ মুসার পিঠ চাপড়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, আবিস্মরণীয় একটা কথা বলেছ বৎস। তুমি শুধু বিপ্লবী নও, বিপ্লবীর চেয়ে বড় তুমি মানুষ। ভালবাসা ছাড়া শুধু দায়িত্ববোধ মানুষকে এতবড় করতে পারে না’।
‘ধন্যবাদ জনাব। মানুষের এইভাবে ভালবাসা আমাদের ধর্মের শিক্ষা’।
‘এ শিক্ষা তো খৃষ্টেরও’। বলল ক্লাউডিয়া। ক্লাউডিয়া এবং তার মা মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ এই আলাপ শুনছিল।
আহমদ মুসা মুখ তুলে ক্লাউডিয়ার দিকে তাকাল। ঠোটেঁ এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল তার। বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু খৃষ্টের এ শিক্ষার সাথে দায়িত্বরোধের তাগিদ নেই। আমাদের ধর্মে মানুষকে ভালবাসার সাথে সাথে অন্যায়কে প্রতিরোধ করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ অর্পিত দায়িত্বের দাব হলো, অসীম ভালবাসা নিয়ে মানুষের দুঃখে বসে বাসে আমি শুধু কাঁদব না, দুঃখের যা কারণ তার প্রতিরোধেও এগিয়ে যাব’।
‘এতে দায়িত্ব পালন হবে ঠিকই, কিন্তু এই দায়িত্ব পালন আবার অনেক দুঃখ, অনেক অশ্রু এবং এমনকি অনেক জীবনহানিরও কারণ ঘটাবে’। বলল ক্লাউডিয়া। সামনে দিয়ে আড়াআড়ি রাখা ডান হাতের উপর ঠেস দেয়া বামহাতের তালুতে রাখা ক্লাউডিয়ার মুখ। তার মুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
বিশ-একুশ বছরের মত বয়স ক্লাউডিয়ার। পরনে কাল প্যান্ট, সাদা শার্ট। প্রথমে নাইট গাউন পরেই ছুটে বাইরে এসেছিল। পরে ভেতরে গিয়ে বদলে ফেলেছে। ক্লাউডিয়ার সোনালী চুলের নিচে নীল চোখ এবং নীল-সাদায় মিশানো মুখ।
‘গাছ রক্ষার জন্যে আগাছা নির্মূলের প্রয়োজন হয়। একজন অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে শত অপরাধের পথ বন্ধ করতে হয়। গোটা প্রকৃতি জুড়েই এই দৃশ্য মিস ক্লাউডিয়া। সূর্যের আলো প্রতিবিম্বিত করে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যেই চাঁদকে মরতে হয়েছে’।
ক্লাউডিয়ার চোখে বিস্ময় বিমূঢ়তা। ক্লাউডিয়ার মা এবং তার আব্বা বৃদ্ধের চোখেও সপ্রশংস দৃষ্টি।
আপনি বিপ্লবী না দার্শনিক। আমি পলিটিক্যাল সাইন্সের ছাত্রী। জগতের পরিচিত বিপ্লবীদের আমি জানি। তাদের মধ্যে আমি দেখেছি বিপ্লবের জন্যে স্বেচ্ছাচারিতা। কিন্তু আপনার লক্ষ্য দেখছি সত্যনিষ্ঠার জন্যে বিপ্লব। এ হলো দার্শনিক বা ভাববাদীর দৃষ্টি। ক্লাউডিয়া বলল।
‘আমি কিছুই নই মিস ক্লাউডিয়া। আমি মুসলিম। সব ভাল দৃষ্টি, সব ভাল গুণ নিয়েই একজন মানুষ মুসলিম হয়। একজন মুসলিমের সাথে তাই অন্য বিপ্লবীদের পার্থক্য হবেই’। গম্ভীর কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘মুসলিম ছাড়াও তো কেউ এই গুণগুলো অর্জন করতে পারে’। বলল ক্লাউডিয়াই। তারও গম্ভীর কন্ঠ।
‘তা পারে। কিন্তু সেটা তার নিছক ইচ্ছার অধীন। ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটলে সব কিছু্রই পরিবর্তন ঘটতে পারে। অন্যদিকে মুসলমানদের এই পারাটা ঐশী আইনের অধীন। যা মুসলমানরা ভংগ করতে পারে না। কারণ ঐশী বিধানই বলেছে, প্রত্যেক কাজের জন্যে তাকে পরকালে জওয়াবদিহি করতে হবে।। যার ফল হিসেবে সে পাবে অনন্ত পুরস্কার, অথবা সম্মুখীন হবে অনন্ত শাস্তির’।
ক্লাউডিয়া আর কথা বলল না। তার চোখে আনন্দ, বিস্ময় আর গভীর ভাবনার ছাপ।
কথা বলল ক্লাউডিয়ার আব্বা সেই বৃদ্ধ। বলল, ‘আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে। তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয় মনে হচ্ছে আমার কাছে পৃথিবীর শত কোটি মানুষের ভীড়ে দৃষ্টান্ত হওয়ার মত একজন মানুষ তুমি। ধার্মিকতা, চরিত্র, সাহস ও সংগ্রাম সবই আছে যার মধ্যে। তাই আমার কষ্ট হচ্ছে তোমার সামনের অন্ধকার পথের দিকে তাকিয়ে’।
একটু থেমেই বৃদ্ধ আবার শুরু করল, আমার বয়স হয়েছে। করণীয় কিছু্ই ভাবতে পারছি না। দেখ, আমি ক্লাউডে বেবিয়ার, দশ বছর ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগের চীফ ছিলাম। তিনদিন আগে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়। যদিও এই তিন দিনই আমার চোখ বাঁধা ছিল, যদিও লাউড স্পিকারে আমার সাথে ওরা কথা বলেছে, তবু আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি ওরা ‘ব্ল্যাক ক্রস’- এর লোক। কতখানি…।
আহমদ মুসা বৃদ্ধ মিঃ ক্লাউডে বেবিয়ারের কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক ক্রস আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল? কেন?’
হাসল বৃদ্ধ ক্লাউডে বেবিয়ার। বলল, ‘আমি নাকি এমন ‘থট রিডিং’ জানি এবং এমন সম্মোহন আমি জানি যে, মানুষের মনের কথা বের করে আনতে পারি এবং মানুষকে বশে এনে যা ইচ্ছা বলাতে পারি। তারা চেয়েছিল আমি তাদেরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করি’।
‘কিন্তু কিডন্যাপ করল কেন? এমনিতেই তো সাহায্য চাইতে পারতো’।
‘এ ধরনের কোন কাজে সাহায্য আমি তাদের করব না, এটা তারা জানে। তাছাড়া পেশায় থাকতে যা আমি করেছি, তা এখন আর আমি করি না এটাও তারা অবগত’।
‘আপনি নিশ্চয় ওদের সাহায্য করেননি, তাহলে ওরা ছাড়ল কেন আপনাকে?’
‘অনুরোধসহ চাপ, হুমকি, সবই তারা শুরু করেছিল, আরও কি করতো জানি না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হঠাৎ তাদের মর্তের পরিবর্তন ঘটে। তাদের আচার-আচরণে বুঝেছি তাতে যে কারণে আমাকে ওরা নিয়ে গিয়েছিল, সে প্রয়োজন তাদের মিটেছে’।
‘হতে পারে। ব্ল্যাক ক্রসের সাম্রাজ্য তো শুধু ফ্রান্স নয়’।
আহমদ মুসা চিন্তা করছিল। একটু পরে বলল, তারা কার থট রিডিং বা কাকে তারা সম্মোহন করতে চেয়েছিল তা কি আপনি জানতে পেরেছেন?’
‘না বৎস। কেন?’
‘আমার অনুমান মিথ্যা না হলে তাদের সেই টার্গেট লোকটি ওমর বায়া, আমাদের লোক যাকে ওরা কিডন্যাপ করেছে’।
‘হতে পারে, তাদের টার্গেটকে ওরা বিদেশী একজন ঘোর শত্রু বলে পরিচয় দিয়েছে’।
আহমদ মুসার মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওমর বায়া বেঁচে আছে এ ব্যাপারে সে অনেকখানি নিশ্চিত হলো।
বৃদ্ধ ক্লাউডে বেবিয়ার কথা শেষ করতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
মিঃ ক্লাউডে উঠে গেল টেলিফোন ধরতে।
সবাই চুপচাপ।
ক্লাউডিয়া এবং তার মা তাকিয়ে টেলিফোনের দিকে। তাদের চোখে-মুখে প্রশ্ন। এই সাত সকালে টেলিফোন এখানে অস্বাভাবিক।
‌আহমদ মুসাও সেদিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসা দেখল টেলিফোন ধরেই মিঃ ক্লাউডের ভ্রু কুঁচকে গেল। দু’এক কথা বলছে, শুনছেই বেশী। ধীরে ধীরে তার মুখ উদ্বেগে ভরে গেল।
টেলিফোন শেষ করে ফিরে এল মিঃ ক্লাউডে। তার বিব্রত, উদ্বিগ্ন দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
ক্লাউডিয়া ও তার মা দু’জনের চোখেই উদ্বেগ এবং একরাশ প্রশ্ন।
মিঃ ক্লাউডে বসতে বসতে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রসের কাছে আমাদের সব কথা চলে গেছে আহমদ মুসা’। গম্ভীর মুখ ক্লাউডের।
‘খুবই স্বাভাবিক’। নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘স্বাভাবিক বলছ? তাহলে ওরা এখানে কোথাও কোন গোয়েন্দা ফোন ট্রান্সমিটার রেখে গেছে?’
‘রেখে গেছে নয়, পাঠিয়েছে’।
‘বলছ, আমার দেহে কোথাও গোয়েন্দা ট্রান্সমিটার চিপস আমি বহন করছি?’
‘আমি তাই মনে করছি জনাব’।
‌একটু ভাবল মিঃ ক্লাউডে। বলল, ‘বহনকারী সে স্থান সম্বন্ধে তুমি সন্দেহ করেছ?’
‘আপনার চুল ধুয়ে ফেলবেন, পোষাক পাল্টাবেন, জুতাও। সুতরাং এগুলো ট্রান্সমিটার চিপস-এর জন্যে নিরাপদ নয়। আপনার দেহে নিরাপদ জিনিস একটাই, সেটা হলো আপনার আংটি। ওখানেই আছে ওদের গোয়েন্দা চিপসটা’।
মিঃ ক্লাউডের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ধন্যবাদ। তুমি অনন্য আহমদ মুসা। এত দ্রুত তুমি সিদ্ধান্ত করতে পার!’
বলেই ক্লাউডে হাত থেকে আংটি খুলে রুমালে জড়িয়ে বলল, ‘আমি এখনি রেডিও সিগন্যাল ও বিকিরণ টেষ্টের জন্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি’।
‘আপনার পোষাক এবং জুতাও পাল্টে ফেলা দরকার জনাব’।
‘ঠিক বলেছ’ বলে উঠে গেল মিঃ ক্লাউডে।
পোষাক পাল্টে দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল।
কথা বলছিল তখন বিস্ময় বিমূঢ় ক্লাউডিয়া। ‘আপনি তো গোয়েন্দা কর্মী নন। শীর্ষ নেতারা গোয়েন্দা কর্মী ব্যবহার করেন এসব কাজে কিন্তু আপনি কি করে এতবড় অনুমান করতে পারবেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গোয়েন্দা, অগোয়েন্দা সকলের একই চোখ, একই মাথা’।
মিঃ ক্লাউডে ফিরে আসতেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমাদের এবার উঠতে হবে জনাব’।
মিঃ ক্লাউডে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস কি বলল সেটা বলাই হয়নি’।
‘কি বলেছে জানি জনাব’।
আহমদ মুসাকে বসতে বলে নিজে বসতে বসতে বলল মিঃ ক্লাউডে, ‘জান তুমি? বলত কি বলতে পারে?’
আপনাকে ‘আহমদ মুসা নামক লোকটিকে জানাতে বলেছে, আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের সন্ধান যেন না করি। ওমর বায়ার ব্যাপারে নাক গলালে, নাক নয় জীবনটাই ছিড়েঁ ফেলা হবে। ইত্যাদি’।
‌‌‘বিস্ময় বোধ করছি না আহমদ মুসা। তোমার কাছে বোধ হয় অসম্ভব কিছু নেই। তবে আরেকটি কথা ওরা বলেছে। আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে চাইনি বলে। আর আমার কাছে ওরা মাফ চেয়েছে’।
একটু থামল মিঃ ক্লাউডে। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমাকে সহযোগিতা করার আমার সত্যিই কিছু নেই। শুধু তোমাকে কয়েকটা তথ্য দিচ্ছি এক, ওদের প্রত্যেকের গলায় ব্ল্যাক ক্রস ঝুলানো থাকে। ওটাই ওদের চিহ্ন। দুই, ওরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা। এটাই ওদের দুর্বলতা এবং তিন, কোন শত্রুকে হাতে পেলে আর বাচিয়েঁ রাখে না’।
‘ধন্যবাদ জনাব। তিনটাই অত্যন্ত মূল্যবান ইনফরমেশন’।
আহমদ মুসা থামতেই ক্লাউডিয়ার মা নরম কন্ঠে বলে উঠল, ‘তোমার কে আছে? বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী …’।
আহমদ মুসা মুখ নিচু করল। হঠাৎ করেই যেন বেদনার একটা ছায়া নেমে এল তার সারা মুখ জুড়ে। বলল, ‘আমার কেউ নেই মা। কিন্তু সবই আছে। পৃথিবী জুড়ে সব মা’ই আমার মা, সব বাবাই আমার আব্বা, সব ভাই-বোনই আমার ভাই-বোন’।
‘কেউ নেই? তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?’
‘যার কেউ নেই তার বাড়ি থাকারও প্রয়োজন হয় না মা। যখন যেখানে থাকি সেটাই আমার বাড়ি’।
‘কি বলছ তুমি, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এতবড় আহমদ মুসা এত একা, এত নিঃস্ব‍!’
‘মায়েরা এভাবেই ভাবে কিন্তু আমি নিঃস্ব, একা নই মা’। নরম কন্ঠ আহমদ মুসার।
‘মায়েদের ভাবনাকে কি বেঠিক বলবে?’
‘না তা পারি না মা। কিন্তু মেনে নেয়াও উচিত মনে করি না’।
‘দায়িত্ব দিয়ে হৃদয়ের দহনকে তুমি আড়াল করতে পার, কিন্তু অস্বীকার করতে পার না বাছা’।
‘ধন্যবাদ মা, সন্তানকে মায়েদের চেয়ে আর কেউ ভালো জানতে পারে না’। ম্লান হাসি আহমদ মুসার ঠোটে, আর কষ্টকর এক বেদনা তার মুখে।
‌‌ক্লাউডিয়া নিষ্প্রাণ মূর্তির মত বসে আছে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে। তার ঠোঁট শুকনো। দু’চোখে তার সজল বেদনার একটা আস্তরণ। একজন অনন্য বিপ্লবীর এক অন্তহীন নিঃস্বতার বেদনা তার হৃদয়কে মুষড়ে দিয়েছে। এই নিঃস্ব আহমদ মুসাকেই তার সবচেয়ে বড় সব চেয়ে কাছের, সবচেয়ে স্বচ্ছ মনে হচ্ছে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করেই মিঃ ক্লাউডের দিকে চেয়ে বলল, ‘এবার আমাদের উঠতে হয়’।
‘আপনি আপনার বিপদ বুঝতে পারছেন? রাস্তায় নামলেই আপনি আক্রান্ত হতে পারেন। আব্বাকে ওরা প্রকাশ্যে দিবালোকে কিডন্যাপ করেছিল’। শুকনো কন্ঠে বলল ক্লাউডিয়া।
আহমদ মুসা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি তো এটাই চাচ্ছি। আমি ওদের চিনি না। ওরা আমার কাছে না এলে, আমার পক্ষে ওদের কাছে পৌছা মুস্কিল হবে’। ম্লান হাসি আহমদ মুসার ঠোটেঁ।
‘আপনি তো শুনলেন, ওরা কোন শত্রুকেই জীবিত রাখে না’।
‘এটা ওদের চেষ্টা। ওদের সব চেষ্টাই কি সফল হয়েছে, না হবে?’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই।
মিঃ ক্লাউডে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ধরল।
বেরিয়ে এল সকলে।
করিডোর দিয়ে হাঁটছিল সবাই। সবার আগে হাঁটছিল মিঃ ক্লাউডে। তার ডান পাশে আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ডান পাশে মিস ক্লাউডিয়া।
‘আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ভোর আজ। আপনার জীবনে তো অজস্র বড় ঘটনা, এমন দিনের কথা অবশ্যই আপনার মনে থাকবে না’।
‘অধিকাংশ স্মৃতিই কষ্টের হয়। সুতরাং ভুলে যাওয়ার মধ্যেই তো মঙ্গল’।
‘কিন্তু এই কারণে যারা ভুলে যেতে চায়, তারা কিন্তু ভুলতে পারে না’।
আহমদ মুসা চোখ তুলে তাকাল মিস ক্লাউডিয়ার দিকে। বলল, ‘আপনি কিসের ছাত্রী?’
‘বলেছি আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্রী’।
এই সময় কথা বলে উঠল মিঃ ক্লাউডে। বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস শুধু হিংস্র নয়, ওরা অত্যন্ত ক্ষীপ্র। সময় নষ্ট ওরা করে না। সুতরাং ক্লাউডিয়ার কথা ফেলে দিও না। রাস্তায় তোমাকে সাবধান হতে হবে’।
গাড়ির কাছে ওরা পৌছে গিয়েছিল।
‘ধন্যবাদ জনাব মনে থাকবে’। বলে ক্লাউডিয়ার মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, অসময়ে আপনাদের কষ্ট দিয়ে গেলাম’।
তারপর মিঃ ক্লাউডে’র সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়ির দিকে ফিরল।
আমররা গাড়িতে উঠে বসেছিল।
আহমদ মুসা গাড়ির দিকে ঘুরতেই মিস ক্লাউডিয়া গাড়ির দরজা খুলে ধরল।
আহমদ মুসা ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ’।
বলে গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা।
মিস ক্লাউডিয়া একটু নিচু হয়ে মুখটা গাড়ির দরজার ফাকেঁ এনে বলল, ‘সৃষ্টির চলার পথ কিন্তু বৃত্তাকার। সুতরাং দেখা তো হবারই কথা’।
মিস ক্লাউডিয়ার মুখে হাসি নয়, গাম্ভীর্য।
‘ঠিক, কিন্তু মানুষ আকাশের কোন গ্রহ বা জ্যোতিস্ক নয়। তাই পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ কিন্তু ঠিক বৃত্তাকার নয়।
‘সত্য। কিন্তু চলার পথটা বুনানো কাপড়ের মত এতটাই একে অপরকে স্পর্শ করে আছে যে জীবনের অজস্র মোড়ে দেখা হওয়ার অজস্র সম্ভাবনা’। বলল ক্লাউডিয়া।
‘চলার পথ কিন্তু বুনানো সুতার মত নিয়ম মেনে চলে না’। বলল আহমদ মুসা।
‘এই অনিয়ম আশংকারও তেমনি সম্ভাবনারও। সম্ভাবনার স্বপ্নই মানুষ বেশী দেখে’।
বলেই ক্লাউডিয়া একটা হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল।
গাড়ি নড়ে উঠে চলতে শুরু করল।
সূর্যের আলোতে চারদিক তখন ঝলমল করছে।
যে কোন কারনেই হোক ঘন কুয়াশা আজ নেই।
‘ওরা কি পথে ওৎ পেতে থাকতে পারে? আপনি কি ভাবছেন?’ বলল আমর।
‘ব্ল্যাক ক্রসকে কোন আঘাত না করলে আমরা তাদের টার্গেট হবো না। যেহেতু ওদের টার্গেট ওদের হাতে তাই এই ব্যাপারে কোন ঝামেলায় জড়াতে না হয় সেটাই তারা চাইবে’।
‘ঠিক বলেছেন স্যার, তাহলে এটাই কি ঠিক যে ব্ল্যাক ক্রসই ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করেছে? ‘ওকুয়া’রাও তো বিভ্রান্ত করার জন্যে এটা বলতে পারে’।
‘তোমার কথায় যুক্তি আছে আমর। কিন্তু মিঃ ক্লাউডে যেটা বলেছেন, সেটাই সত্য। এখন বিষয়টা পরিষ্কার। যারা ক্লাউডেকে কিডন্যাপ করেছিল, তারাই ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করেছে’।
‘বুঝতে পেরেছি জনাব’।
আহমদ মুসা আর কোন কথা বলল না।
ওরা দু’জনও নীরব।
সবারই দৃষ্টি সামনে।
সকালের গাড়ি-বিরল রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।

ডুপ্লের চিঠি পড়া শেষ করে মুখ তুলেই জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা, এ চিঠি তোমরা কবে পেয়েছ?
প্যারিসের ফিলিস্তিন দূতাবাসের বিশাল কক্ষ। একটা বড় টেবিল ঘিরে বসে আছে আহমদ মুসা, ফিলিস্তিনের রাষ্টদুত ফারুক আল আশরাফ এবং দুতাবাসের আরও দু’জন দায়িত্বশীল।
আহমদ মুসা কথা বলছিল ফারুক আল-আশরাফের দিকে লক্ষ্য করে।
‘চিঠি গতকাল পেয়েছি জনাব’। বলল ফারুক আল-আশরাফ।
‘কিভাবে পেলে?’
‘আমাদের ডাক বাক্সে পেয়েছি’।
‘আল-হামদুলিল্লাহ। শুরুটা আমাদের ভাল বলতে হবে আশরাফ। তোমার এখানে পৌছার আগেই মিঃ ক্লাউডে’র কাছ থেকে জানলাম ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে কিছু তথ্য এবং নিশ্চিত হওয়া গেল ব্ল্যাক ক্রসই ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করেছে ‘ওকুয়া’র পক্ষে। আবার দেখ, তোমার এখানে পৌছেই খোদ ব্ল্যাক ক্রস-এর একজনের কাছ থেকে চিঠি পেলাম’।
‘কিন্তু লোকটি তো তার এই পরিচয় দেয়নি’।
‘পরিচয় না দেয়াই প্রমাণ করে সে ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক। তাছাড়া যে ইনফরমেশন সে দিয়েছে এবং যেখানে দিয়েছে তাও প্রমাণ করে সে ব্ল্যাক ক্রয়-এর লোক’।
ডুপ্লে তার চিঠিতে ওমর বায়াকে যেখানে নিয়ে প্রথমে বন্দী করে রাখা হয় সেখানকার ঠিকানা দিয়েছে এবং জানিয়েছে ওমর বায়াকে প্যারিসেরই অজ্ঞাত কোন একটি জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
‘আপনি ঠিক বলেছেন জনাব, একমাত্র ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকরাই জানে যে ওমর বায়াকে ফিলিস্তিন দুতাবাসের আশ্রয় থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। পত্র প্রেরক অন্য কেউ হলে ওমর বায়ার খবর ফিলিস্তিন দুতাবাসে পাঠাতো না’। বলল ফারুক আল আশরাফ।
প্যারিসের মানচিত্রের উপর তখন নজর বুলাচ্ছিল আহমদ মুসা।
ডুপ্লের চিঠিতে লিখা রোডটি পাওয়া গেল একদম দক্ষিণ প্যারিসে। এটা প্যারিসের একটা নতুন এলাকা। বিশ বছরের বেশী বয়স নয়।
রাস্তাটির নাম লা ম্যাজারিন। ঠিকানা ’৭৭, লা ম্যাজারিন’।
আহমদ মুসা তার কাঠ পেন্সিলের মাথা ঠিকানায় স্থাপন করে বলল, ‘চিঠি সত্য হলে এটাই হবে ব্ল্যাক ক্রস-এর একমাত্র ঘাটিঁ যা আমাদের জানার মধ্যে এল। এটাই হবে ‘ব্ল্যাক-ক্রস’-এর অন্ধকার রাজ্যে প্রবেশের আমাদের দরজা’।
একটু থামল আহমদ মুসা।
তারপর আবার শুরু করল, ‘কিন্তু ওরা ওখান থেকে ওমর বায়াকে অন্যত্র সরিয়ে নিল কেন?’ প্রশ্নটা ছিল আহমদ মুসার স্বগত ধরণের উক্তি।
‘মনে হয় আরও নিরাপদ জায়গায় তাকে সরিয়ে নিয়েছে’। বলল আল-আশরাফ।
‘কিন্তু ব্ল্যাক ক্রস ওমর বায়াকে প্রথমে কম নিরাপদ স্থানে তুলেছিল এটা যুক্তি বলে না। আমার মনে হয়, কোন কারণে সেখানে নিরাপত্তার অভাব ঘটেছিল। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ হুমকিটা কোত্থেকে এসেছিল তা বলা মুস্কিল। ঐ চিঠি পাঠানো থেকে মনে হচ্ছে, নিরাপত্তার অভাব ভেতরের দিক থেকেই ঘটেছিল’। বলল আহমদ মুসা।
‘সেটা কেমন?’
‘বলা কঠিন। তবে অবিশ্বস্ততার ঘটনা সেখানে ভেতরে থেকেই ঘটেছে বলে মনে হয়’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল রাত ১১টা।
‘আশরাফ তুমি একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দাও। আমি লা-ম্যাজারিনে যাব। ব্ল্যাক ক্রস-এর দরজায় নক করে দেখি কিছু পাই কিনা’। আল-আশরাফের দিকে চেয়ে বলল আহমদ মুসা।
‘ট্যাক্সি কেন জনাব, এমবেসির সব গাড়ি আপনার’। বলল আল-আশরাফ।
‘হ্যাঁ। তোমার এমবেসির গাড়ি নিয়ে গিয়ে পা বাড়াবার আগেই ওদের নজরে পড়ে যাই’।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এই কারণেই তো আমরা এয়ারপোর্টে এমবেসির গাড়ি পাঠাইনি’।
ঘন্টা খানেক পরে আহমদ মুসা ট্যাক্সি করে রাস্তায় নেমে এল। একাই। কাউকে সাথে নিতে রাজী হয়নি। এমবেসি জেদ ধরলে আহমদ মুসা বলেছিল, এ অনিশ্চিত, গোপন ও অনুসন্ধানী অভিযানে একা যাওয়াই নিরাপদ বেশী। এমসেবি আহমদ মুসার কথার উপর কথা বলতে পারেনি। এমবেসেডর আল-আশরাফ সাইমুমের একজন অনিয়মিত ছাত্র-কর্মী ছিল ফিলিস্তিনের বিপ্লবের সময়। তার কাছে আহমদ মুসা পর্বত প্রমাণ উঁচু। তার সাথে সে কথা বলতে পারছে-এই বেশী। আহমদ মুসার কথার উপর কথা বলার তার সাহস আসবে কোত্থেকে। তার উপর ফিলিস্তিনের স্বয়ং প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে তাকে বলে দিয়েছে, ফিলিস্তিন এমবেসির সব সম্পদ, সব মানুষ এবং সব শক্তি আহমদ মুসা যে ভাবে চাইবেন সেভাবেই চলবে। সুতরাং আহমদ মুসার সিদ্ধান্তের সাথে আল-আশরাফ একমত হতে না পারলেও আহমদ মুসার কথা সে অবনত শিরে মেনে নিয়েছে।
গাড়ি চলছিল।
আহমদ মুসার চেখে তন্দ্রার ভাব এসেছিল।
গাড়ি থামার ঝাকুনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল আহমদ মুসার।
‘এসে গেছি জনাব। পাশের বাড়িটাই ষাট নম্বার, এটা গীর্জা। এর আশে-পাশেই আপনার নম্বারটা পেয়ে যাবেন’।
আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বাড়ির নম্বার বলেনি। বলেছিল, বাড়ি দেখলেই চিনতে পারব। নম্বারটা ষাট-বাষট্টি ধরনের কিছু হবে।
ভাড়া চুকিয়ে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
খুজেঁ বের করল ৭৭ নম্বর বাড়ি। বাড়িটি প্রধান রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। প্রধান রাস্তা থেকে একটা ছোট্ট রাস্তা গিয়ে বাড়িটির গেটে শেষ হয়েছে।
বাড়িটা তিনতলা এবং বেশ বড়। গেটের দরজা স্টিল শিটের তৈরী।
গেটের পাশে গেটম্যান বক্স নেই। আহমদ মুসা বুঝল গেটটা দুরনিয়ন্ত্রিত। তাহলে কি গেটে ক্যামেরাও থাকতে পারে?
আহমদ মুসা গেট থেকে দুরে একটা বিল্ডিং-এর ছায়ায় আলো-আঁধারির মধ্যে দাড়িয়েঁছিল।
আহমদ মুসা ভাবছিল গেটের এদিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকা যাচ্ছে না। শুরুতেই হাঙ্গামা বাধালে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। আহমদ মুসার প্রথম কাজ, ওদের সম্পর্কে বিশেষ করে ওমর বায়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। তারপর ওমর বায়ার খোঁজ পাওয়া গেলে সেখানেই দ্রুত আঘাত হানতে হবে। যাতে শত্রুদের সাবধান হওয়ার আগেই ওমর বায়াকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
এসব চিন্তা করে আহমদ মুসা বাড়ির পেছন দিকে যাবার জন্যে পা তুলতে যাচ্ছিল। এই সময় সেই ছোট রাস্তার উপর আলোর একটা ফ্লাশ জ্বলে উঠল।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। তার বুঝতে বাকি রইল না একটা গাড়ি আসছে, সম্ভবতঃ তার টার্গেট-বাড়িটাই লক্ষেই।
আহমদ মুসার গোটা শরীরে একটা উষ্ণতার আমেজ বয়ে গেল। ব্ল্যাক ক্রসের কেউ কি আসছে? তাহলে সে কি দেকতে পেতে যাচ্ছে ব্ল্যাক ক্রসের কাউকে?
হঠাৎ আহমদ মুসার দেহটা বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মত যেন ঝাকুনি খেল। এখানে দাড়িয়েঁ থাকলে তো সে এখনি ধরা পড়ে যাবে চারদিকে একবার নজর বুলিয়েই আহমদ মুসা কয়েক গজ সামনের বর্জ ফেলা বাক্সের পেছনে গিয়ে বসে পড়ল।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বর্জ ফেলা বাক্সের সামনেটাসহ গোটা রাস্তা আলোর বন্যায় ভেসে গেল।
দ্রুত একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল সেই গেটের সামনে।
আহমদ মুসা দেখল, ক্যারিয়ার ধরনের গাড়ি। পেছনের ক্যারিয়ারে একটা বড় বাক্স ছাড়া আর কিছু নেই। লোকজন কেউ নেই। বাড়তি লোকজন থাকলে সম্ভবতঃ তারা ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটগুলোতে থাকতে পারে।
চট করে আহমদ মুসার মাথায় এল, সে ক্যারিয়ারের পেছনটায় সওয়ার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
যেমন চিন্তা তেমনি কাজ।
বর্জ বাক্সটা থেকে ক্যারিয়ারের পেছনের শেষ প্রান্তটা আট দশ গজের বেশী হবে না।
আহমদ মুসা দুই হাতে দু’পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে শরীরটা বাঁকিয়ে পা এবং মাথা এক সমতলে এনে ফুটবলের মত গড়িয়ে চোখের নিমিষে ক্যারিয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর অপেক্ষা করল গাড়ি স্টার্ট নেয়ার।
গাড়িটা গেটের সামনে দাড়িয়েঁ নির্দিষ্ট বিরতিতে তিনবার হর্ণ দিল। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই খুলে গেল দরজা।
গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো। নড়ে উঠল গাড়ি।
গাড়ি নড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা একজন এ্যাক্রোব্যাটের মত দেহটাকে কুন্ডলি পাকিয়ে ক্যারিয়ারের তলায় ঝুলে পড়ল এমনভাবে যাতে গেটে ক্যামেরা থাকলেও তা যেন তার নাগাল না পায়।
গাড়ি এসে দাঁড়াল গাড়ি বারান্দায়। আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল গাড়ির তলায় গাড়ি বারান্দার উপর।
গাড়ি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। একজন বলল, দুবোয়া তুমি এস, ট্রলি ও কয়েকজনকে নিয়ে এসে বাক্সটা নামিয়ে নিয়ে যাবে।
আহমদ মুসা দেখল, জিনস পরা জ্যাকেট গায়ে একজন প্রায় দৌড়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। লোকটি দরজার গায়ে যে নব তাতে হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।
তাহলে এ দরজাও কি স্বয়ংক্রিয়, এ দরজাতেও কি ক্যামেরার পাহারা আছে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে নামা দ্বিতীয় লোকটিও দরজার দিকে এগুলো। সেও গিয়ে দরজার নবে হাত দিলেই দরজা খুলে গেল। সে দরজার পাল্লা টান দিয়ে খুলে রেখে ভেতরে গেল।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, দরজা স্বয়ংক্রিয় নয় এবং তাহলে ক্যামেরার পাহারাও নেই। নিশ্চয় নবের কোন গোপন অংশে কোন সুইচ বা বোতাম আছে। লোকটি ট্রলি নিয়ে আসার জন্যেই দরজা খোলা রেখে গেছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
গড়িয়ে সে বেরিয়ে এল গাড়ির তলা থেকে। তারপর স্প্রিং-এর মত উঠে দাড়িঁয়েই ছুট দিল সে দরজার দিকে। ভাবল, ভেতরে ঢোকার এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
কিন্তু দরজায় পা দিয়েই আহমদ মুসা মুখোমুখি হয়ে গেল তিনজন লোকের। একজন ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছিল, আর দু’জন ছিল দু’পাশে।
আহমদ মুসাকে দরজায় দেখে ওরা প্রথমটায় ভুত দেখার মত আঁৎকে উঠল। কিন্তু তার পর মুহুর্তেই দু’জন চোখের নিমিষে বাঘের মত ঝাপিয়েঁ পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসাও ওদেরকে দেখে মুহুর্তের জন্যে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। ওরা ঝাপিয়ে পড়লে আহমদ মুসা চকিতে ডান দিকে একটু সরে ডান দিকে থেকে যে আসছিল তাকে বাঁ হাত দিয়ে ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে তার কোমরের বেল্ট ধরে হ্যাচকা টানে শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলল বাঁ দিক থেকে আসা লোকটির উপর।
লোকটিকে ছুড়ে দিয়েই মাথা নিচু করে আহমদ মুসা ঝাপিয়ে পড়ল ট্রলি ঠেলে আসা লোকটির উপর। সে রিভলবার তুলেছিল গুলি করার জন্যে।
গুলি সে করল। তার আগেই আহমদ মুসা ঝাপিয়ে পড়েছিল তার উপর। কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে আঘাত করল আহমদ মুসার উপর ঝাপিয়েঁ পড়া দু’জনের একজনকে। ওরা তখন উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা ট্রলি সমেত লোকটিকে নিয়ে পড়ে গেল। রিভলবার ছিটকে পড়ে গেল লোকটির হাত থেকে।
লোকটি পড়ে থেকেই তার হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিল প্রাণপণে। কিন্তু রিভলবারটি আহমদ মুসার নাগালের মধ্যে। সে রিভলবারটি তুলে নিল।
এই সময় দেখল তার উপর ঝাপিয়ে পড়া দ্বিতীয় লোকটি ছুড়ে মারছে একটা ছুরি। রিভলবার তাক করার সময় তখন পার হয়েছে। কোন উপায় না দেখে আহমদ মুসা দেহটা একদিকে বাঁকাতে চেষ্টা করে বাম হাত দিয়ে ধরে ফেলল ছুরিটা। ধরে ফেলল মানে ছুরিটি এসে বিধল আহমদ মুসার বাম হাতের তালুতে।
বেদনায় বিকৃত হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। কিন্তু এর মধ্যেই আহমদ মুসার ডান হাতটি বিদ্যুতগতিতে উপরে উঠেছিল এবং নিক্ষিপ্ত গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো ছুরি ছুড়ে মারা লোকটির বুকে।
ঠিক এই সময়েই আহমদ মুসার নিচে পড়ে থাকা লোকটির একটা মুষ্টাঘাত এসে পড়ল আহমদ মুসার ডান হাতে। আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ল। লোকটি রিভলবার তুলে নিল সংগে সংগেই।
কিন্তু আহমদ মুসা তার হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ে যাবার সংগে সংগেই বাম হাতের তালু থেকে ছুরিটি খুলে নিয়ে আমুল বসিয়ে দিল লোকটির বুকে।
ছুটে এল ৫জন লোক এই সময় ঘরে। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত স্টেনগান।
একজন স্টেনগান তুলেছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। একজন হাত তুলে নিষেধ করে বলল, গুলী খরচ নয়।
আহমদ মুসা ছুরিটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাম হাতের আহত তালু চেপে ধরল। ওখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল।
যে লোক গুলী করতে নিষেধ করেছিল, সে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এসে বলল, আমাদের তিন লোককে খুন করেছিস। কে তুই?
‘তিনজন নয় দুইজনকে’। শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমাকে শিক্ষা দিচ্ছিস। সাংঘাতিক শেয়ানা তো দেখছি’। বলেই সে বিদ্যুতগতির একটা কিক লাগালো আহমদ মুসার কাঁধ এবং পাঁজরের সন্ধিস্থলে।
কাত হয়ে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
‘একে বেঁধে ফেল আমি আসছি’। বলে লোকটি ভেতরে চলে গেল।
দু’জন এগিয়ে এল। আহমদ মুসা উঠে বসছিল। একজন লাথি দিয়ে আবার ফেলে দিল এবং বলল, ‘মরতে এসেছিস শয়তান, গুলীতে মরলে তোর ভালই হতো। বস মনে হয় তোর জন্যে বড় পরিকল্পনা করেছেন’।
আহমদ মুসাকে বেঁধে ফেলল ওরা।
মিনিট পাচেক পরে ফিরে এল লোকটি। লোকটি বার্নেস। ব্ল্যাক ক্রসের এই ঘাটির প্রধান। সে গিয়েছিল ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান পিয়েরে পলের সাথে আলোচনা করতে। শুনেই পিয়েরে পল বলেছে, যে দিন ওমর বায়ার চিঠি ধরা পড়ল সেদিনই এ ঘাটি ত্যাগ করা দরকার ছিল। আমাদের ভুল হয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে এ ঘাটিঁ এখনই ছেড়ে দিতে। ব্ল্যাক ক্রসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট গোপনীয়তা। পুলিশ তাদের শত্রু না হলেও ফরাসি পুলিশ ব্ল্যাক ক্রস-এর কোন ঘাটি এবং লোককে চেনে না। কোন ঘাটিতে শত্রুর স্বাধীন স্পর্শ পড়লে সে ঘাটি তারা এক মুহুর্ত রাখে না। বার্নেস বন্দী অর্থাৎ আহমদ মুসাকে কি করবে জানতে চেয়েছিল। পিয়েরে বলেছিল, তুমি নানতেজ যাচ্ছ, ওকে নিয়ে যাও। আমাদের বধ্যভুমি হাঙ্গর রাজ্যের ভাল শিকার হবে সে। বার্নেস বলেছিল, তার পরিচয় কি জেনে নেয়া দরকার নয়? পিয়েরে পল বলেছিল, দেখ আমরা কোন গোয়েন্দা সংস্থা নই, এর জন্যে ভিন্ন সংস্থা আছে। আমরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছি। শত্রু সাফ করে এগিয়ে যাওয়া আমাদের কাজ। শত্রুকে যখনই হাতে পাবে, হত্যা কর। এতে ঝুকি কম আছে। গোটা দুনিয়ার ইতিহাস তুমি সামনে আনলে দেখবে, কোন বড় শত্রু ধরা পড়লে তাকে প্রথমেই হত্যা করা না হলে পরে খুব কমই তাদের হত্যা করা গেছে। এভাবে কিংবা সেভাবে তারা ছাড়া পেয়ে গেছে’। পিয়েরে পল আরও উপদেশ দিয়ে বলেছে, ওমর বায়া মনে হয় আমাদের ভোগাবে। তাকে উদ্ধারের মিশন নিয়ে আহমদ মুসা ফ্রান্সে এসেছে। সে একা এলেও তার একটা গ্রুপ নিশ্চয় এখানে এসেছে। আমাদের ঘরে তাকে আমরা ভয় করি না। কিন্তু ঘাটিগুলোকে আরও সাবধান থাকতে হবে।
ঘরে প্রবেশ করেই বার্নেস বলল, শয়তানটাকে আমার গাড়িতে তুলে দাও। ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তারপর তুলবে গাড়িতে। আমার সাথে যারা যাচ্ছ তারা বাদে সকলে পাশের নতুন ঘাটিতে চলে যাও। লাগেজ পরে সরিয়ে নেয়া হবে।
সংজ্ঞাহীন করে আহমদ মুসাকে গাড়িতে তোলা হলো। বার্নেস এবং ড্রাইভার সামনের সিটে। আহমদ মুসার পাশে উঠে বসল আরেকজন।
গাড়ি বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।
ছুটে চলল গাড়ি নানতেজ শহর-অভিমুখে। শহরটি লোরে নদীর মুখে অবস্থিত। নদীটি পশ্চিমে আরও কিছু এগিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়েছে।
তখন রাত ৩টা। ঘুমন্ত প্যারিস নগরী। প্রায় ঘুমন্ত তার রাজপথও।
এরই মাঝে ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে নিয়ে এগিয়ে চলল রাতের নিঃশব্দ বুক চিরে।

Top