১৮. ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

চ্যাপ্টার

উল্টে-পাল্টে কাগজটা আহমদ মুসা বার বার পড়ল। না পরিষ্কার লেখা। লেখায় বিন্দুমাত্র দ্ব্যর্থবোধকতা নেই। ‘১৩১-এর সি, রূয়ে আনাতলে ডেলা ফর্গ’-স্পষ্টাক্ষরে লেখা। কিন্তু এই নাম্বারে কোন বাড়ি নেই।
গতকাল দু’বার এসে সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে গেছে। খোঁজায় কোন ফাঁক রাখেনি। কিন্তু বাড়িটা পাওয়া যায়নি। একশ’ একত্রিশ-এর এ,বি,সি, কিছুই নেই।
কিন্তু মন তার মানছে না। পরাজয় স্বীকার করে নিতে রাজি হচ্ছে না তার মন।
গতকাল দু’বারই দিনের বেলা খুঁজেছে। আর রাতে খুঁজবে মনে করে রুয়ে আনাতলে রোডের সেই নির্দিষ্ট স্থানে এসে নামল আহমদ মুসা ট্যাক্সি থেকে। রাত তখন ৯টা।
ঠিকানার সন্ধানে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর আহমদ মুসা ঠিক করল লোকদের আজকে সে জিজ্ঞেস করবে। ১৩১নং বাড়িতে গিয়ে নক করল আহমদ মুসা। মুহূর্ত কয়েক পরে দরজা খোলার শব্দ হলো। দরজা অল্প ফাঁক করে একটা মুখ বলল, ‘কি সহযোগিতা করতে পারি আপনাকে। কাকে চাই আপনার?’
‘আমি একজন বিদেশী। ‘১৩১-এর সি’ বাসাটা আমি খুঁজছি। দয়া করে সাহায্য করতে পারেন?’ বিনীতভাবে বলল আহমদ মুসা।
দরজাটা এবার খুলে গেল।
একজন তরুণী খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, ‘নাম্বারটা আপনি কোথায় পেলেন?’
‘নাম্বারটির মালিক যিনি তারই লেখা ঠিকানা থেকে তুলে নিয়েছি’।
‘যাই হোক, আপনার ভুল হয়েছে। এ ধরণের কোন নাম্বার এ রাস্তায় নেই। এ রাস্তায় কোন নাম্বারের সাথেই এ,বি,সি ইত্যাদি ধরণের কোন কিছুর সংযোজন নেই।’
আহমদ মুসা ভাবছিল। মেয়েটির কথার জবাবে কিছু বলল না।
‘আপনার অসুবিধার জন্যে দুঃখিত। ওকে’। বলে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল মেয়েটি। আহমদ মুসা বলল, ‘দয়া করে কি বলবেন, আপনার আব্বার নাম কি?’
মেয়েটির মুখ মুহুর্তের জন্যে মলিন দেখা গেল। তারপরই হেসে উঠে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি আপনি জানতে চাচ্ছেন এ বাড়িটাই আপনার বাঞ্ছিত বাড়ি কিনা। না তা নয়। আমি ও আমার আম্মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন না’।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা সরে এল তাদের বাড়ির গেট থেকে। পিতার নাম জিজ্ঞেস করায় মেয়েটির মুখ মলিন হওয়া থেকে আহমদ মুসা বুঝল, তার আব্বা নেই। ওরা ‘সিংগল’ প্যারেন্ট ফ্যামেলি। এমন বিয়ে বহির্ভূত মা ও সন্তানের সিংগল ফ্যামিলি এখন পাশ্চাত্যে হাজার হাজার। কিন্তু বিরাট এক দুর্ভিক্ষ তাদের মনে। মেয়েটির ম্লান মুখে দেখা গেছে তারই একটা প্রতিচ্ছবি।
রাস্তায় নেমে এল আহমদ মুসা। কিন্তু কোথায় যাবে সে!
আহমদ মুসা শিথিল পায়ে আনমনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। ডুপ্লের ঠিকানা নিয়েই সে ভাবছে। তার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে, মি. ফ্রাংক তাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিংবা ডুপ্লে ভুল ঠিকানা লিখেছে। কিন্তু সে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে ১৩১-এর সাথে কোন এ,বি,সি নেই এবং মেয়েটিও তাই বলল। তাহলে?
ঠিকানা লেখা কাগজটির ওপর আবার নজর বুলাল আহমদ মুসা। দেখল, ১৩১-এর ‘সি’ লিখে তার পাশে আবার ‘+’ চিহ্ন দেয়া আছে। চমকে উঠল আহমদ মুসা। এখানে ‘+’ চিহ্ন কেন? এর অর্থ কি এই যে, ১৩১ থেকে ‘প্লাস’ অর্থাৎ সামনের দিকে ‘সি’ অর্থাৎ তিন নাম্বার বাড়িটাই ডুপ্লের হবে? সংকেতে কি এটাই বুঝাতে চেয়েছে?
আহমদ মুসা মুখ তুলে দেখল। সে যে বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়েছে, সেই বাড়িটিই ১৩১-এর পর তিন নাম্বার বাড়ি। তাহলে এখানেই কি ডুপ্লে থাকেন?
কিন্তু আবার ভাবল, ডুপ্লে ঠিকানা এভাবে লিখবে কেন? না, এখানে ঠিকানা লেখার এরকম একটা প্রচলন আছে, যা অনেকেই ইচ্ছা হলে লিখে থাকে।
হঠাৎ একাধিক নারী কন্ঠের চাপা চিৎকারে আহমদ মুসা চমকে উঠল। আহমদ মুসা যাকে ডুপ্লের বাড়ি বলে ভাবছে, সেখান থেকেই এই চিৎকার আসছে। ধ্বস্তাধ্বস্তির একটা শব্দও কানে আসছে আহমদ মুসার।
রাস্তা থেকে ছুটল আহমদ মুসা বাড়িটার দিকে।
বাড়ির সামনে দু’টো গাড়ি দাড়িয়ে আছে। একটা সাধারণ মাইক্রোবাস, আরেকটা অত্যন্ত দামী গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দা পার হয়ে লাফ দিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠল। সামনেই একটা দরজা। সম্ভবত বাড়ির ড্রইং রুম। ধ্বস্তাধ্বস্তি থেমে গেছে। ভয়ার্ত নারী কন্ঠ এবার চিৎকারের বদলে কেঁদে কেঁদে জীবন ভিক্ষার জন্যে অনুনয়-বিনয় করছে।
আহমদ মুসা দরজায় মৃদু চাপ দিল। দরজা নড়ে উঠল। খুশি হলো আহমদ মুসা, দরজা খোলা আছে দেখে। দরজা ঠেলে কৌতুহলী আগন্তুকের মত ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। যখন আহমদ মুসা ঘরের ভেতর পা রাখল, তখন একটি কন্ঠ চিৎকার করে বলছে, ‘শোরগোল না থামালে তোমাদেরও বেঁধে নিয়ে যাব আমরা। তাতে আমাদের মজাই হবে। আহমদ মুসা দেখতে পেল, একজনের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে একজন মহিলা কাঁদছে। পাশেই আরেকটি তরুণী গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। এদেরকে লক্ষ্য করেই ঐ কন্ঠটি চিৎকার করে উঠেছিল। আর আহমদ মুসা, তার সামনেই দেখতে পেল হাত-পা বাঁধা একজন লোককে দু’জন লোক নিয়ে আসছে। একজন ধরেছে দুই পা, আরেকজন হাত।
আহমদ মুসাকে ঢুকতে দেখেই লোক দু’টি বাঁধা লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্য দিকে পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়া মহিলাকে শাসাচ্ছিল যে লোকটি সেও ফিরে দাঁড়াল।
মোট ওরা তিনজন।
‘কে তুই? কি চাস এখানে?’ সামনে দাড়ানো দু’জনের একজন চিৎকার করে বলল।
তার চিৎকারে মেঝেয় গড়াগড়ি দেয়া মেয়ে দু’টি এদিকে ফিরে তাকিয়েছে।
‘রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, কান্নাকাটি দেখে এলাম’। অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে গোবেচারা ভংগীতে বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে প্রাণের ভয় থাকলে যেদিক দিয়ে এসেছিস সেদিক দিয়ে কেটে পড়’। বলল ওদের একজন।
‘কিন্তু বুঝতে পারছি না আমি, এখানে কি হচ্ছে?’
‘আবার কথা’ বলে একজন তেড়ে এল আহমদ মুসার দিকে। কাছাকাছি এসে বলল, ‘তুই কি কানে শুনতে পাস না? আমরা কি বলেছি?’
‘শুনতে পেয়েছি। কিন্তু লোকটির কি অপরাধ? তাকে এইভাবে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘ছুঁচোটা দেখছি বড় পাজি, বলে কাছাকাছি এসে দাঁড়ানো লোকটি আহমদ মুসার নাক লক্ষ্যে প্রচন্ড এক ঘুষি চালাল।
আহমদ মুসা মাথা একটু নিচু করে তার ঘুষি চালানো হাতটাকে বাঁহাত দিয়ে কনুই বরাবর ধরে ফেলে ডান হাত দিয়ে তার কোমরের বেল্টটা ধরে তাকে একটানে শূন্যে উঠিয়ে নিল এবং ছুড়ে মারল তার সামনের দ্বিতীয় লোকটির ওপর। ওরা দু’জনেই আছড়ে পড়ল মাটিতে।
তৃতীয় জন যে মহিলাকে শাসাচ্ছিল সে হাতে রিভলবার তুলে নিয়েছে।
কিন্তু আহমদ মুসা লোকটিকে ছুঁড়ে ফেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ লোকটির ওপর। সে রিভলবার তাক করার আগেই আহমদ মুসা তার ওপর গিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা পড়ে গিয়েই তার হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিল। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার।
ততক্ষণে ঐ দু’জন লোক উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা ছুটে আসছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা রিভলবার হাতে নিয়েই তা ঘুরিয়ে ধরল ঐ দু’জনের দিকে। পর পর দু’বার ফায়ার হলো। নিঃশব্দে দু’টো গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল ওদের দু’জনকে। বুক চেপে ধরে ওরা গিয়ে আছড়ে পড়ল হাত-পা বাঁধা মেঝেয় পড়ে থাকা লোকটির ওপর।
সময় পেয়েছিল আহমদ মুসা যার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই লোকটি। সে চাকু বের করে নিয়েছিল। চাকু উঠাচ্ছিল সে আহমদ মুসার পাঁজর লক্ষ্য করে।
এই সময় একটা নারী কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, ‘আহমদ মুসা, পেছনে চাকু’।
শব্দটি এল কক্ষের বাইরে বাড়ির ভেতরের দিক থেকে।
চিৎকারটি কান স্পর্শ করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা স্প্রিং-এর মত ছিটকে উঠল উপরের দিকে। চাকুর আঘাতটাকে সম্পূর্ণ এড়াতে পারল না আহমদ মুসা। মারাত্বক চাকুটা পাঁজরের বদলে আঘাত করল আহমদ মুসার ডান হাঁটুর নিচের মাসলটাকে।
কেঁপে উঠেছিল আহমদ মুসার দেহটা। অবচেতনভাবেই আহমদ মুসার দেহ সামনে একটু বেঁকে গিয়েছিল। কিন্তু রিভলবারটা হাতে স্থির ছিল।
চাকু মেরেই লোকটা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছিল। পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল আর একটা চাকু। ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসার রিভলবার স্থির করাই ছিল লোকটির দিকে। শুধু আঙুলের চাপ পড়ল ট্রিগারের ওপর। সরাসরি বুকে গুলী খেয়ে দু’হাতে বুক চেপে ধরে উল্টে পড়ে গেল লোকটি।
ছুটে ঘরে এসে প্রবেশ করল একটি মেয়ে। বসল আহমদ মুসার পায়ের কাছে। পেশীর মধ্যে গেঁথে যাওয়া ছুরিটা টান মেরে বের করে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। চেপে ধরল দু’হাতে আহমদ মুসার আহত জায়গাটা।
‘ডোনা তুমি ঐ লোকটির বাঁধন আগে কেটে দাও তো ঐ ছুরি দিয়ে’। বলল আহমদ মুসা।
মেঝেয় গড়াগড়ি যাওয়া ক্রন্দনরত মহিলা ও তরুণীটি ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল। এখনও কাঁপছে তারা। কন্ঠে তাদের কোন কথা নেই। যেন বোবা হয়ে গেছে তারা।
বাঁধা অবস্থায় মেঝেয় পড়ে থাকা লোকটি এতক্ষণ আতংকিত চোখে নির্বাকভাবে সবকিছু দেখছিল। দু’জন লোক গুলী খেয়ে তার ওপর পড়ে গেলেও সে একটুও সরার চেষ্টা করেনি। যেন ওদের সাথে সেও মরে গেছে।
এবার সে লাশের নিচ থেকে সরে এল এবং বলল, ‘লেটিছিয়া তোমরা ওদের সাহায্য কর, আমার বাঁধনটা খুলে দাও’।
কাঁপতে কাঁপতে ঘরের কোণে দাঁড়ানো বড় মেয়েটি এগোলো বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকা লোকটির দিকে ছুরি বা চাকু ছাড়াই।
তার সাথের তরুণীটি ছুটে এসে চাকু কুড়িয়ে নিয়ে তুলে দিল মহিলাটির হাতে।
দরজায় এসে দাড়িয়েছিল সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধ। ঝড়-বিধ্বস্ত চেহারা তার।
সেই বৃদ্ধের দিকে চেয়ে দু’হাত দিয়ে আহমদ মুসার আহত স্থান ধরে রাখা ডোনা বলল, ‘আব্বা, দেখ এদের ফাস্ট এইড বক্স কোথায়, প্রচুর তুলা দরকার। প্রচুর রক্ত আসছে’।
বৃদ্ধটি কিছু করার আগেই মহিলাটির সাথের তরুণীটি বলল, ‘মাফ করুন প্রিন্সেস, আমি নিয়ে আসছি।’ বলে মেয়েটি ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে।
ডোনা ওপর দিকে মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মাথার রুমালটা আমাকে দাও’।
‘ব্যস্ত হয়ো না ডোনা। ওরা তুলা নিয়ে আসছে’। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
ডোনা আর কিছু না বলে এক হাতে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরে অন্য হাতে রুমাল টেনে নিল মাথা থেকে।
এই সময় ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে তরুণীটি ছুটে এল।
মেঝেয় পড়ে থাকা লোকটি বাঁধনমুক্ত হয়েছিল।
সে ছুটে এল ডোনার কাছে এবং ঝুকিয়ে ডোনাকে একটা বাউ করে বলল, ‘মাননীয়া প্রিন্সেস আমাদের আর অপরাধী করবেন না। আমাকে দিন। আপাতত চলার মত ব্যান্ডেজ আমি বাঁধতে পারব’।
ডোনা কথা বলল না। মাথাও তুলল না। আহমদ মুসার প্যান্ট হাটু পর্যন্ত ওপরে তুলে অত্যন্ত দ্রুত ও দক্ষ হাতে বাইরের রক্ত মুছে ফেলে এন্টি সেপটিক ক্রিম মাখানো এক মুঠো তুলা আহত স্থানে লাগিয়ে রুমাল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। তুলায় ক্রিম মাখিয়ে দিয়েছিল এবং ডোনাকে সাহায্য করছিল তরুণীটি। উঠে দাঁড়ালো ডোনা।
‘ডোনা ওকে বসিয়ে দাও সোফায়’। বলল বৃদ্ধটি, ডোনার আব্বা মি. প্লাতিনি।
‘ধন্যবাদ। আমি ভালো আছি জনাব। লাশগুলোর ব্যবস্থা হওয়া দরকার। পুলিশে খবর দেয়া দরকার কিনা?’ বলে আহমদ মুসা তাকাল সদ্য বাঁধনমুক্ত লোকটির দিকে।
‘পুলিশে খবর দেয়া যাবে না। আমাদের এই বাড়ি থেকে সরে পড়তে হবে এখনি। আর এক ঘন্টার মধ্যে এ বাসায় আক্রমণ হবে বলে আমি আশংকা করছি’। বলল লোকটি।
আহমদ মুসা মুহুর্ত কয়েক লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি কি ডুপ্লে, ব্ল্যাক ক্রসের লোক?’
প্রশ্ন শুনেই লোকটির মুখ মলিন হয়ে গেল। বলল, ‘জি হ্যাঁ, আমি একজন হতভাগ্য। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, আমার পরিবারকে বাঁচিয়েছেন। কে আপনি? চিনলেন কি করে আমাকে?’
আহমদ মুসা তার কথার কোন জবাব না দিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ডোনার দিকে, তারপর ডোনার আব্বার দিকে।
ডোনার আব্বার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘সবই জানবে। এতটুকু শুনে রাখ, আমরা দ্বিজন থেকে আসছি। তুমি ডুপ্লের ঠিকানা যেখান থেকে নিয়েছ, আমরাও সেখান থেকে নিয়েছি। তোমার খোঁজ পাবার জন্যেই আমরা এখানে এসেছিলাম। তার পরপরই এই বিপদ’।
‘আপনারা দ্বিজনে কেন?’ আহমদ মুসার কন্ঠে তখনও বিস্ময়।
‘তোমার সন্ধানে’। বলে ডোনার আব্বা তাকাল ডোনার দিকে। আহমদ মুসাও তাকাল ডোনার দিকে।
ডোনা মুখ নিচু করল। বলল, ‘এখন কোনো কথা নয়। চলুন, ডাক্তারকে দেখাতে হবে’।
‘ঠিকই বলেছে ডোনা। তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন। চল আমরা যাই’।
এই সময় ডুপ্লে ছুটে ডোনার আব্বার সামনে এসে বাউ করে বলল, ‘সম্মানিত প্রিন্স, আমাকে একটু সময় দিন’। বলে ঝপ করে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর আহমদ মুসার পায়ে কপাল ছুঁইয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার পরম সৌভাগ্য আহমদ মুসাকে আমি দেখলাম এবং আরও সৌভাগ্য যে তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন’।
‘কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না। এ ক্ষমতার মালিক শুধু আল্লাহ। আর শুনুন, কোন মানুষের মাথা কোন মানুষের কাছে নত হওয়া ঠিক নয়, পা পর্যন্ত তো চলতেই পারে না’। বলল আহমদ মুসা ডুপ্লেকে লক্ষ্য করে।
ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে লেটিছিয়া এবং সেই তরুনী বেরিয়ে এল ড্রইং রুমে।
‘চলুন, আমরাও চলে যাব’। বলল ডুপ্লে।
‘কোথায় যাবেন আপনারা? আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে’। বলল আহমদ মুসা ডুপ্লেকে লক্ষ্য করে।
‘আমি একটা ফ্ল্যাট ঠিক করে রেখেছি। দু’একদিনের মধ্যেই সেখানে চলে যেতাম। সেখানেই এখন যাব। আপনি কি আমাদের ওখান হয়ে যাবেন কিংবা ঠিকানা রাখবেন?’
‘ঠিকানা দিন। পরে যোগাযোগ করা যাবে’। বলল ডোনা, আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই।
‘না ডোনা, বিষয়টা অন্য একটা দিনের জন্যে ফেলে রাখার মত নয়’। বলল আহমদ মুসা ডোনার দিকে চেয়ে।
একটু থামল। থেমেই আবার ডোনার আব্বার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা না হয় চলে যান, আমি ওর বাড়ি হয়ে যাব’।
‘না তা হবে না। আমরাও যাব আপনার সাথে। চলুন’। গলা উপচানো একটা ক্ষোভ ফুটে উঠল ডোনার কন্ঠে। চোখ-মুখটা ভারী হয়ে গেলে তার।
সবাই বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।
‘আপনার বোধ হয় গাড়ি নেই’। ডুপ্লের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করর আহমদ মুসা।
‘নেই। কিন্তু এদের মাইক্রোবাসটাই নিয়ে যাব’। বলল ডুপ্লে।
‘ব্ল্যাক ক্রসের এই মাইক্রোবাসটা তো?’
‘জি হ্যাঁ’।
‘না এ গাড়ি আপনার নতুন বাড়িতে নেয়া চলবে না। এতে আপনার নতুন বাড়িটা এদের নজরে পড়তে পারে। তাছাড়া রাস্তায়ও এ মাইক্রোবাস এদের নজরে পড়তে পারে’।
ডুপ্লে বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন আপনি। আমি সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলাম’।
একটু ঢোক গিলল ডুপ্লে। একটু থেকে সে বলল, ‘এ জন্যেই আপনি আহমদ মুসা। কিছুই আপনার নজর এড়ায় না’।
‘তাহলে মি. ডুপ্লে আমার গাড়িতেই চলুন। অসুবিধা হবে না’। বলল ডোনার আব্বা।
‘ধন্যবাদ। আপনার অনুগ্রহ’।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠতে যাচ্ছিল ডোনা বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনি অসুস্থ। বিশ্রাম নিন। আমি ড্রাইভ করব’।
‘আমার অনুরোধ ডোনা। আমিই বসি। পাশের সিটে তুমি বস’।
কোন কথা না বলে ডোনা মাথা নিচু করে মুখ ভার করে গাড়ি ঘুরে পাশের সিটের দিকে চলে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিয়েও তা আবার বন্ধ করে দিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। নেমে পকেট হাতড়িয়ে কিছু খুঁজল। পেল না। গাড়ি ঘুরে ডোনার জানালায় এসে বলল, ‘তোমার রুমাল আছে?’
‘আছে’ বলে ডোনা রুমাল বের করে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা রুমাল নিয়ে গাড়ির পেছনে চলে গেল। গাড়ির নাম্বার প্লেটটি সে ঢেকে দিল রুমাল দিয়ে।
ফিরে এল সে তার সিটে। সিটে বসে তাকাল পাশের মাইক্রোবাসটির দিকে। তারপর পকেট থেকে সাইলেন্সার লাগানো সেই রিভলবার বের করল। গুলী করল মাইক্রোবাসের সামনের একটা টায়ার লক্ষ্যে। শব্দ করে ফেটে গেল টায়ার।
ভ্রু কুঞ্চিত করল ডোনা। কিন্তু কিছু বলল না। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, ‘রুমালটা কি করলেন?’
‘গাড়ির নাম্বার প্লেটটা ঢেকে দিয়েছি ওটা দিয়ে’।
আবার সেইভাবে ভ্রু কুঞ্চিত হলো ডোনার। কিন্তু কোন প্রশ্ন করল না। ডোনার আব্বা ও ডুপ্লেসহ সকলের মনেই ডোনার মত প্রশ্ন উকি দিয়েছে। কিন্তু সবাই নীরব থাকল।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন ডুপ্লের বাড়ির গেট দিয়ে বেরুচ্ছে, সেই সময় আহমদ মুসা দেখল, রাস্তা থেকে একটা গাড়ি এদিকে নেমে আসার জন্যে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তার সাথে গাড়িটার হর্ন বেজে উঠল কয়েকবার। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আহমদ মুসার। ব্ল্যাক ক্রসের কোডে হর্ন দিয়েছে গাড়িটি।
আহমদ মুসার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠল। ও গাড়িটা নিশ্চয় দেখেছে আমরা ডুপ্লের বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি। সুতরাং….।
আহমদ মুসা মুখ না ফিরিয়েই দ্রুত বলল, ‘ডোনা এবং আপনারা সবাই মাথা নিচু করুন’। বলে আহমদ মুসা রিভলবারটা তার ডান হাতে তুলে নিল আবার।
ডোনা সামনের গাড়িটা দেখতে পেয়েছিল এবং আহমদ মুসার মধ্যেকার পরিবর্তনটাও লক্ষ্য করেছিল। এবার আহমদ মুসার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তার বুকের হার্ট বিট বেড়ে গেল। সে উদ্বেগের সাথে আহমদ মুসার আহত পায়ের দিকে তাকাল।
রাস্তা থেকে গাড়িটা নেমে আসছিল নব্বই ডিগ্রি এ্যাংগেলে ডুপ্লের বাড়ির গেটের দিকে।
আহমদ মুসা গেট থেকে বেরিয়ে গাড়ি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এ্যাংগেলে নিয়ে রাস্তায় উঠার জন্যে ছুটল। আহমদ মুসার বাম হাত ছিল স্টেয়ারিং হুইলে এবং ডান হাতে ছিল রিভলবার।
আহমদ মুসার গাড়ির গতি দেখে ঐ গাড়িটাও তার গতি চেঞ্জ করল। আহমদ মুসা বুঝল ওরা গাড়ির সামনে এসে পথটা ব্লক করতে চায়।
আহমদ মুসা গাড়িটাকে সে সুযোগ দিতে চাইল না। প্রথম গুলীটি ছুঁড়ল সে ঐ গাড়িটার সামনের বাম চাকা লক্ষ্য করে। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবারের অবশিষ্ট দু’টি গুলীর একটি এটি। মূল্যবান গুলীটি ব্যর্থ হলো না। টায়ারটি ভীষণ শব্দে ফেটে গেল। গাড়িটি একদিকে কাত হয়ে গেল। গতি স্লো হয়ে গেল গাড়িটির।
এই সুযোগে আহমদ মুসা তার গাড়ি বের করে নিয়ে এল ঐ গাড়িটির সামনে দিয়ে।
আহমদ মুসার গাড়ি ঐ গাড়িটি পার হবার সাথে সাথেই থেমে গেল ঐ গাড়িটি। ডান দিকের দরজা দিয়ে লাফ দিয়ে নামল দু’জন স্টেনগানধারী। নেমেই ব্রাশ ফায়ার করল আহমদ মুসার গাড়ি লক্ষ্যে।
কিন্তু এতক্ষণে আহমদ মুসার গাড়ি রাস্তায় উঠে দ্রুত চলতে শুরু করেছে। মাত্র দু’তিনটা গুলী এসে আঘাত করল আহমদ মুসার গাড়ির পেছনটাতে। যা গাড়ির গায়ে কয়েকটা ফুটোর সৃষ্টি করল, কিন্তু টায়ার অক্ষত থাকল।
আহমদ মুসা মোড় ঘুরাবার আগে মুখ বাড়িয়ে পেছনের দিকে চাইল। দেখল, এরা সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে ডুপ্লের বাড়ির গেটের দিকে ছুটছে। আহমদ মুসা বুঝল ওদের টার্গেট ডুপ্লের গাড়ি বারান্দায় ব্ল্যাক ক্রসের সেই মাইক্রোবাস। হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ডোনা ওরা মাইক্রোবাসটার জন্যে ছুটছে। ওদের আশা, ঐ মাইক্রোবাসটা নিয়ে আমাদের ফলো করবে’।
স্তম্ভিত ডোনা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। এতক্ষণে ডোনা বুঝল কেন আহমদ মুসা মাইক্রোবাসটির টায়ার ফাটিয়ে দিয়েছিল। ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনন্দে হৃদয় ভরে গেল ডোনার।
আরও কিছুটা এগিয়ে জনবিরল একটা জায়গায় রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা। তারপর নেমে গিয়ে রুমালটা খুলে নিয়ে এল গাড়ির নাম্বার প্লেট থেকে।
রুমাল নিয়ে ফিরে ডোনার কাছের দরজায় এসে বলল, ‘ডোনা এবার তুমি ড্রাইভিং সিটে যাও’।
ডোনা মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে একবার চেয়ে ঠোটে এক টুকরো হাসি নিয়ে চলে গেল ড্রাইভিং সিটে।
আহমদ মুসা তার সিটে উঠে বসে পেছন দিকে চাইল। দেখল, ডুপ্লে, তার স্ত্রী এবং তাদের মেয়ে ডোনার আব্বার পাশে গাড়ির সিটে বসে নেই। সিটের নিচে বসে আছে তারা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘মিঃ ডুপ্লে এবার ডোনাকে আপনার বাড়ির লোকেশন বলুন’।
ডুপ্লের বাড়ির সামনে আহমদ মুসাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল, তখন রাত সাজে দশটা।
গাড়ি থেকে নামল সবাই।
ডুপ্লের নতুন বাসা বহুতল ভরনের একটা ফ্ল্যাট।
প্রবেশ করল তারা ফ্ল্যাটে।
ড্রইং রুম এলোমেলো।
‘ডোনার আব্বা, ডোনা ও আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে ডুপ্লে বলল, আসুন, কোন কিছুই ঠিক অবস্থায় নেই। আপনারা দয়া করে বসুন’।
বসল ওরা তিনজন সোফায়।
ডুপ্লে, ডুপ্লের স্ত্রী ও মেয়ে বসল সোফার সামনে কার্পেটের ওপর।
বসেই বলল ডুপ্লে, ‘জনাব আহমদ মুসার সাথে এঁদের পরিচয় করিয়ে দেই’। বলে তার স্ত্রী ও মেয়ের না পরিচয় দিল আহমদ মুসার কাছে।
‘জনাব আমৃত্যু আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমরা। আপনি শুধু ডুপ্লেকে নয়, একটা পরিবারকে ধ্বংস থেকে বাচিয়েছেন’। ডুপ্লের স্ত্রী লেটিছিয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল।
‘কল্পনা করতে পারি না এতক্ষণ আমাদের কি হতো, কোথায় থাকতাম আমরা। বেঁচে থাকলেও সে জীবনটা হতো মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক’। বলে ডুপ্লের মেয়ে রোসা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর রোসা। যে আল্লাহ তোমার মধ্যে মায়ার সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহই ওকে রক্ষা করেছেন’। বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি ছিলেন সেই ঈশ্বরের দুত’। বলল রোসা।
‘না রোসা, তোমাদের যিশু আমাদের মোহাম্মদ স. এবং এ ধরণের নবী-রসূল যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ঈশ্বরের দূত। আমি আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ডুপ্লের দিকে চেয়ে বলল, ‘মি. ডুপ্লে আমি আপনার কাছে এসেছি ব্ল্যাক ক্রসের হেড কোয়ার্টার কোথায় তা জানার জন্য। আপনি সাহায্য করলে বাধিত হবো’।
ডুপ্লের মুখ মলিন হয়ে উঠল। বলল, ‘আমার খুব কষ্ট লাগছে। আপনি হয়তো ভাববেন আমি মিথ্যা বলছি। এই আমার মেয়ের মাথা ছুঁয়ে বলছি, বলে ডুপ্লে মেয়ে রোসার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘হেড কোয়ার্টার কোথায় আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি ‘একটা ঐতিহাসিক গীর্জা’কে কেন্দ্র করে ওদের হেড কোয়ার্টার গড়ে উঠেছে। গীর্জাটি ইংলিশ চ্যানেলের মুখে আটলান্টিকের তীরে কোন একটি শহরে’।
‘ধন্যবাদ মি. ডুপ্লে। আপনাকে বিশ্বাস না করলে আপনার কাছে আসতাম না’।
‘মাফ করবেন, আমার একটা প্রশ্ন, আপনি কি করে জানলেন আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ কৌতুহল ডুপ্লের চোখে।
‘ফিলিস্তিন দূতাবাসে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সে চিঠি পড়ে’।
‘আরেকটি প্রশ্ন’ বলল ডুপ্লে, ‘আমি এখনও বুঝতে পারিনি, কেন আপনি ব্ল্যাক ক্রসের মাইক্রোবাসের টায়ার নষ্ট করলেন এবং কেন গাড়ির নাম্বার প্লেটের ওপর রুমাল লাগিয়েছিলেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। আমি খুব খারাপটাই চিন্তা করেছিলাম, আমরা বের হবার সময়ই ওরা আসবে এবং ওদের সাথে সংঘাত বাঁধবে আমাদের। তারই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম ও দুটি কাজ করে। ওদের গাড়ি নষ্ট হলে যাতে মাইক্রোবাসটি নিয়ে ওরা আমাদের অনুসরণ না করতে পারে সেজন্যই টায়ার নষ্ট করেছিলাম। আমাদের অনুসরণ করতে না পারলে চেষ্টা করবে আমাদের গাড়ির নাম্বার নিয়ে ওয়্যারলেসে তাদের দলের লোকদের জানিয়ে দিতে, যাতে ওরা আমাদের পিছু নিতে পারে। এই পথ বন্ধের জন্যই নাম্বার প্লেট ঢেকে দিয়েছিলাম’।
ডোনার আব্বা, ডোনা, ডুপ্লে, তার স্ত্রী ও মেয়ে রোসা অভিভূতের মত তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
‘আজ বুঝলাম দুনিয়ায় এত বড় বড় কাজ আপনি কিভাবে করেছেন। বুঝলাম, ব্ল্যাক ক্রসের প্রায় তিন ডজন লোক আপনার হাতে মরল কি করে’। নীরবতা ভেঙে বলল ডুপ্লে।
‘ঈশ্বর ওকে দিয়ে করান। তা না হলে খালি হাতে এভাবে সশস্ত্র তিনজনকে কুপোকাত করা অবিশ্বাস্য’। বলল রোসা।
‘ঠিক বলেছ তুমি রোসা’। হেসে বলল আহমদ মুসা। তারপর ডোনার আব্বার দিকে চেয়ে বলল, ‘জনাব আমার কাজ শেষ। আমরা এবার উঠতে পারি’।
‘চল উঠি’। বলে ডোনার আব্বা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা বাইরে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল, ‘মি. ডুপ্লে আপনার পরিকল্পনা কি? ব্ল্যাক ক্রসের সাথে এবার আপনার প্রকাশ্য সংঘাত শুরু হলো’।
মুখ ম্লান হয়ে গেল ডুপ্লেসহ তার স্ত্রী ও মেয়ে সকলের।
‘ঠিক করেছি, আজ ভোরের মধ্যেই বৃটেন চলে যাব। সেখান থেকে আমেরিকা। আমেরিকায় ব্ল্যাক ক্রসের কাজ কম। ওখানে ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান শক্তিশালী’। শুকনো কন্ঠে বলল ডুপ্লে।
‘আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ ডুপ্লে। আমরা তোমার শুভ কামনা করছি’। বলল ডোনার আব্বা।
ডোনার আব্বা ও ডোনা দরজায় পৌছে গিয়েছিল বাইরে বেরুবার জন্যে। ডুপ্লেরা তিনজন মাথা নিচু করে শরীর সামনে বাঁকিয়ে বাউ করল ডোনার আব্বা ও ডোনাকে। তাদের চোখে সম্মান ও শ্রদ্ধা ঠিকরে পড়ছিল। আহমদ মুসা আগের মতই বিস্মিত হলো সম্মান প্রদর্শনের এই বাদশাহী কায়দা দেখে। আবার আহমদ মুসা যখন চলে আসছিল, তখন সাধারণভাবেই তাকে বিদায় দিল ‘গুড ইভিনিং’ বলে। এই পার্থক্য আহমদ মুসাকে খুবই বিস্মিত করল।
সামনে হাঁটছিল ডোনা ও ওর আব্বা। ওরা লিফটের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিল। আহমদ মুসার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার চেষ্টা করেও খোঁড়াতে হচ্ছে তাকে।
হঠাৎ ডোনা পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল আহমদ মুসাকে। ছুটে এল সে। একটা হাত ধরে বলল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার? ধরি আপনাকে একটু?’ নরম বেদনাভরা কন্ঠ ডোনার।
‘আমাকে নির্ভরশীল করো না ডোনা। তোমাকে তো সব জায়গায় পাব না’। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার সে যোগ্যতা নেই। কিন্তু যতটুকু পারি করতে দেবেন না?’ ভারী কন্ঠে বলল ডোনা।
‘অতটা অচল হইনি। সে রকম হলে তো তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করেই ধরে ফেলতে’।
ডোনার আব্বাও দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসারা সেখানে এলে বলল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে আহমদ মুসা?’
‘জি না। সেই অর্থে কোন কষ্টই হচ্ছে না জনাব’।
লিফটে নেমে এল ওরা নিচে।
লিফট থেকে নেমে ডোনা আহমদ মুসার হাত ধরতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা হাতটা টেনে নিয়ে মাথা চুলকালো। যেন মাথা চুলকাবার জন্যেই সে তাড়াতাড়ি হাতটা টেনে নিয়েছে।
কিন্তু ডোনার কাছে ব্যাপারটা বোধ হয় ধরা পড়ে গেছে। সে একবার চকিতে আহমদ মুসার দিকে মুখ তুলে চাইল। আহমদ মুসা দেখল ডোনার মুখে ক্ষোভের চিহ্ন।
‘ডোনা গাড়িতে টেলিফোন আছে?’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল আহমদ মুসা।
‘আছে, কেন?’
‘ফিলিস্তিন এমবেসিকে গাড়ির জন্যে বলতে হবে। তোমাদের গাড়ি নিয়ে এমবেসিতে যাওয়া ঠিক হবে না’।
‘এমবেসিতে যেতে হবে কেন?’ ক্ষোভ এবং গম্ভীর কণ্ঠ ডোনার। গাড়ির কাছে সবাই এসে পৌছল।
‘কে এমবেসিতে যাবে?’ জিজ্ঞেস করল ডোনার আব্বা ডোনাকে।
ডোনা কোন উত্তর দিল না।
মাথা নিচু করে সে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। আষাঢ়ের মেঘের মত তার মুখ থমথমে।
‘আমি বলছিলাম এমবেসিতে ফেরার কথা’। আহমদ মুসা বলল।
‘কেন? এমবেসিতে কেন?’
‘ছিলাম তো ওখানে। আর আপনাদের কষ্ট দেয়া হবে’।
হাসল ডোনার আব্বা মি. মিশেল প্লাতিনি। বলল, ‘কোনটা আমাদের জন্যে কষ্টের হবে? তোমার আমাদের সাথে যাওয়া বা না যাওয়া? বল তো তুমি?’
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। উঠে বসল ডোনার ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে।
ডোনার আব্বা পেছনের সিটে উঠে বসেছে।
ডোনা দু’হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে চুপ করে বসে আছে।
‘কই চল মা?’ বলল ডোনার আব্বা পেছনের সিট থেকে।
‘কোথায় আব্বা?’
‘কেন বাড়িতে?’
‘উনি তো কিছু বলেননি’। মুখ নিচু রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বলল ডোনা।
‘পাগল মেয়ে। সব কথা ধরতে হয়। এমবেসিতে ছিল, ওখানে ফেরার কথা তো বলবেই। আমি এখনি টেলিফোনে বলে দিচ্ছি, আহমদ মুসা আমার ওখানে থাকছে’। ডোনার আব্বার মুখে স্নেহপূর্ণ হাসি।
আহমদ মুসা ডোনার আষাঢ়ে মুখের দিকে চাইল। কিছু বলল না। চাপা গর্জন করে উঠে স্টার্ট নিল ইঞ্জিন। চলতে শুরু করল বাড়ি। কিছু দূর এগোনোর পর ডোনা বলল, ‘আব্বা ডাক্তারকে বলে দাও আমরা বাড়িতে পৌছেই যেন তাঁকে পাই’।
‘ঠিক বলেছ মা’। বলে টেলিফোনটা পাশ থেকে আবার তুলে নিল।
এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে ডোনা। একবারও সে ফিরে তাকায়নি আহমদ মুসার দিকে। অবস্থা অন্ধকারেই দেখা যাচ্ছে তার সে আষাঢ়ে মুখের কোন পরিবর্তন হয়নি।
আহমদ মুসার ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। ভাবল, ডোনার কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই প্রচন্ড অভিমানী আর জেদী এখনও সে। তবে রক্ষা যে, এই রাজকীয় অভিমান ও জেদের পাশে রাজকীয় ধরনের বড় একটা মন তার আছে বলেই তার জেদ ও অভিমানটাও সুন্দর হয়ে উঠেছে।
একটা বিশাল গেটের সামনে এসে গাড়ির গতি স্লো হয়ে পড়ল।
‘আমরা এসে গেছি’। আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল ডোনা।
‘ধন্যবাদ’। বলল আহমদ মুসা।
বিশাল গেট পেরিয়ে বিরাট চত্বরের সুন্দর বাগানের মধ্যে দিয়ে বিরাট একটা রাজকীয় ভবনের গাড়ি বারান্দায় গিয়ে বাড়ি থামল।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো বিরাট গাড়ি এবং তার বিশাল এরিয়া দেখে। এমন বাড়ি তো দূরে থাক, প্যারিসে ডোনাদের কোন বাড়ি আছে বলেও আহমদ মুসা জানতো না।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই ডোনা নেমে পড়ল। তারপর গাড়ি ঘুরে আহমদ মুসার দরজার সামনে এল। আহমদ মুসা ততক্ষণে গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছিল। বাম পাটা নামিয়ে দিয়েছিল। ডান পাটা নাড়তেই ব্যথা করে উঠল।
ডোনা এসে আহমদ মুসার একটা হাত ধরে নামিয়ে নিল তাকে গাড়ি থেকে।
‘ধন্যবাদ ডোনা। পা’টা সত্যিই কাজ করছে না’।
‘গালি দিন, ধন্যবাদ দেবেন না। জোর করে নিয়ে এসেছি’। ফিস ফিস করে বলল ডোনা। একটু থামল। তারপর কণ্ঠ একটু চড়িয়ে বলল, ‘আঘাতটা ডিপ ছিল, তাই বেদনা একটু বেশি হবেই’।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ডোনা ও তার আব্বা লিফটের দিকে এগিয়ে চলল।
দু’পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মাথা নত করে শরীর বাঁকিয়ে বাউ করল তাদের। যেন রাজারা ঢুকছেন রাজ দরবারে।
এই দৃশ্য আগের মতই বিস্মিত করল আহমদ মুসাকে।

Top