১৮. ব্ল্যাক ক্রসের মুখোমুখি

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসা ঘুম থেকে জাগল। মনে হল দীর্ঘক্ষণ সে ঘুমিয়েছে। ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকাল আহমদ মুসা। রাত ২টা। দুঃখের মধ্যেও খুশি হলো আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের ওপর। ওরা তাকে সার্চ করে রিভলবার ও ছুরি নিয়ে গেছে কিন্তু ঘড়ি নিয়ে যায়নি। রিভলবারের চেয়েও যা এখন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরও খুশি হলো এই জন্য যে তাকে ওরা পিছমোড়া করে বাঁধেনি। সম্ভবত ওরা হতে লোহার হাতকড়া পরিয়েই নিশ্চিত হয়েছিল। এ ধরনের হাতকড়া ভাঙা এবং খোলা দুই-ই অসম্ভব। পিছমোড়া করে না বাঁধায় ঘড়ি দেখতে পাবার ফলে যে আনন্দ হয়েছিল, শীঘ্রই তা উবে গেল। লোহার এ হাতকড়া সে ভাঙবে কি করে! আজকের এ রাতটা তার জন্যে মহামূল্যবান। সকালে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান আসবে, তার আগেই কিছু একটা করার সুবর্ণ সুযোগ।
কিন্তু হাতকড়া খোলার কোন পথ পেল না। হাতকড়া হাতের সাথে এমনভাবে লাগানো, যার ফলে হাতকড়ায় আঘাত করলে সে আঘাত গিয়ে লাগে হাতে।
ইতিমধ্যে রাত বাজল আড়াইটা। ঘড়ি দেখে অস্থির হয়ে উঠল।
কিন্তু উপায় কি?
হঠাৎ তার মনে পড়ল ডোনার দেয়া আংটির কথা। সাথে সাথে গোটা দেহ একটা আনন্দের স্রোত বয়ে গেল।
সংগে সংগে ডান হাতের মধ্যমা থেকে আংটি খুলে ফেলল। অন্ধকারের মধ্যেও আংটির সেই ভয়ংকর বিন্দুটি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় বিন্দুটিকে পরিকল্পনা করেই রেডিয়াম করা।
আহমদ মুসা আংটিকে পায়ের দুই বুড়ো আঙুলের ফাঁকে ধরে তারপর জোরে জোরে আংটির বিন্দুটার উপর চেপে ধরল হাতকড়ার লকটিকে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। লক উড়ে গেল বোধ হয় হাওয়ায়। আলগা হয়ে গেল হাতকড়া। খুলে পড়ে গেল হাত থেকে।
পায়ের বেড়িও খুলে ফেলল সে। আংটি আবার পরে নিল হাতে।
অন্ধকারের মধ্যে দেয়াল ধরে এগিয়ে গিয়ে পেয়ে গেল দরজা। হাত দিয়ে বুঝল দরজা স্টিল শিটের।
খুঁজে খুঁজে আহমদ মুসা দরজার লক বের করল। পরীক্ষা করে বুঝল দরজা দু’দিক থেকেই লক করা যায়।
আহমদ মুসা তার মধ্যমা চেপে ধরল দরজার লকের ওপর। চার-পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা নড়ে উঠল। দরজা খুলে গেছে বুঝল আহমদ মুসা। ধীরে ধীরে টানল দরজা।
একটু ফাঁক হতেই এক ঝলক আলো এসে ঢুকল ভেতরে। ঠিক এই সময়ই পায়ের শব্দ পেল দরজার বাইরে। একজনের পায়ের শব্দ। থেমে গেছে পায়ের শব্দটি।
সংগে সংগেই বুঝল আহমদ মুসা, দরজা খুলে যাওয়া নিশ্চয় প্রহরীর নজরে পড়ে গেছে। বুঝার সাথে সাথেই আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ওকে প্রস্তুতির এক মুহূর্তও সময় দেয়া যাবে না। এখন আক্রমণই সবচেয়ে বড় আত্মরক্ষা।
আহমদ মুসা এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল। দেখল, বিস্ময়- বিমুঢ় লোকটা তার স্টেনগান তুলছে।
আহমদ মুসা দরজা খুলেই লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বাম হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে ডান হাত দিয়ে তার স্টেনগান কেড়ে নিয়ে তাকে দ্রুত টেনে নিয়ে এল ঘরে।
লোকটি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তাকে ঘরে তোলার সময় আহমদ মুসার বাম হাতটা অনেকখানি ঢিলা হয়ে পড়েছিল।
লোকটি দু’হাতে আহমদ মুসার বাম হাত ধরে এক মোচড় দিয়ে নিজেকে খুলে নিল এবং আহমদ মুসার বাম হাতকে মুচড়ে তাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা স্টেনগানটি ডান হাত থেকে ফেলে দিয়ে ডিগবাজী খেয়ে এক পাক ঘুরে বাম হাতের মোচড়টা আলগা করে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই ডান হাতের একটা প্রচণ্ড কারাত চালাল লোকটার ঠিক কানের ওপর।
মুহূর্তেই লোকটা আহমদ মুসার বাম হাত ছেড়ে দিয়ে পাক খেয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত তার ইউনিফরম খুলে নিয়ে পরে নিল এবং লোকটির জামা খুলে তা দিয়ে তাকে পিছমোড়া করে বাধল। স্টেনগানের ফিতা খুলে নিয়ে বাঁধল তার পা এবং তার মুখে রুমাল ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। প্রহরীর ইউনিফরম ও তার হ্যাট পরার পর আহমদ মুসাকে দূর থেকে চেনার আর কোন উপায় রইল না। কোন দিকে যাবে সে?
তার মনে আছে, প্রধান গেট থেকে অল্প কিছু আসার পর একটা সিঁড়ির নিচে একটা স্টিল স্ল্যাব সরিয়ে একটা সিঁড়ি পথে তাকে আন্ডার গ্রাউন্ডে নামিয়ে এনেছিল।
উপরে উঠার জন্যে এই একটা পথই তার জানা। তাকে ওপরে উঠতে হবে, তিন তলার বাংলোতে আছে ওমর বায়া।
ভূগর্ভ থেকে উঠার সিঁড়ির খোঁজে চলল আহমদ মুসা।
যে পথে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল সেই পথেই সে এগিয়ে চলল।
চলার পথে কাউকে পেল না আহমদ মুসা। ভাবল, তাকে পাহারা দেয়ার জন্যে তাহলে ওখানে একজনকেই রাখা হয়েছিল। আহমদ মুসার মনে পড়ল যাকে সে কিডন্যাপ করেছিল তার কথা। সে বলেছিল, ওমর বায়ার ওখানে ছাড়া আর কোন প্রহরী নেই। প্রধান গেটের সামনে সিকিউরিটি পুলে সব প্রহরী থাকে। ইন্টারকম বা ওয়াকিটকি’তে তাদের প্রয়োজন মত নির্দেশ দেয়া হয়।
খুশি হলো আহমদ মুসা। সিকিউরিটি পুলকে যদি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া যায়, তাহলে তার পথ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সিঁড়ি অবশেষে খুঁজে পেল আহমদ মুসা।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল সে।
সিঁড়ির মুখ স্টিল স্ল্যাব দিয়ে বন্ধ করা। এ স্ল্যাব সরিয়েই তাকে ভূগর্ভে নামানো হয়েছিল।
আহমদ মুসা স্টিল স্ল্যাবে কোন ‘কি হোল’ খুঁজে পেল না। স্টিল স্ল্যাবটা প্রধান গেটের মতই কি দূর নিয়ন্ত্রিত?
ভাল করে মনে করতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। একটা সিঁড়ির নিচে অবস্থিত স্ল্যাবটির কাছাকাছি তারা পৌঁছার সংগে সংগেই স্ল্যাবটি খুলে যায়নি তার পরিষ্কার মনে পড়ছে, একজন লোক একটু অগ্রবর্তী হয়ে স্ল্যবটির এক প্রান্তে দু’পা জোড় করে দাঁড়িয়েছিল কেন? দূর-নিয়ন্ত্রকদের জন্যে এটা কোন সিগন্যাল, না দু’পা জোড় করে দু’পা বা দু’বুড়ো আঙুল দিয়ে কারও ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ দিয়েছিল সে?
দূর-নিয়ন্ত্রিত হলে এ রকমটা হতো না, সুতরাং শেষোক্ত সম্ভাবনাকেই আহমদ মুসা ঠিক মনে করল।
পা দিয়ে চাপ দেয় সেই প্রান্ত কোনটা ছিল, মনে করতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। স্ল্যাবটি পূর্ব-পশ্চিম লম্বা। পূর্ব প্রান্ত ছিল সিঁড়ির গোঁড়ার দিকে। এর বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে লোকটি চাপ দিয়েছিল পরিষ্কার মনে পড়ল আহমদ মুসার।
উপরের দৃশ্যটা আহমদ মুসা নিচে এসে সেট করল এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, সিঁড়ির মুখ ও স্ল্যাব যেখানে একত্রিত হয়েছে সেটাই পূর্ব দিক। তাহলে চাপ দেয়ার জায়গাটা দাঁড়াচ্ছে আহমদ মুসার মাথার ওপর কোথাও।
আহমদ মুসা এক ধাপ নিচে নেমে মাথার ওপরের জায়গাটা পরীক্ষা করল। দেখতে পেল, স্টিল স্ল্যাবটি নিখুঁতভাবে সিঁড়ির কংক্রিট ছাদে ঢুকে যাওয়া ছাড়া আর কোন চিহ্ন কোথাও নেই।
আহমদ মুসা স্পষ্ট মনে পড়ছে, চপ দেয় হয়েছিল স্ল্যাবের ওপর নয়, স্ল্যাব-প্রান্তের ফ্রেমের ওপর। ফ্রেম এবং স্টিল স্ল্যাবের রং ছিল একই রকমের। কিন্তু এখানে তো স্ল্যাবের কোন ফ্রেম নেই।
আহমদ মুসা স্টেনগানের মাথা দিয়ে টোকা দিতে লাগল স্ল্যাব এবং কংক্রিটের ছাদের ওপর। খুশি হলো আহমদ মুসা। স্টিল স্ল্যাব যেখানে কংক্রিটের ছাদে ঢুকে গেছে, সেখানে কংক্রিটের প্রান্তে টোকা দিলে ধাবত শব্দ পেল। বুঝল আহমদ মুসা রংটা কংক্রিটের মত হলেও ওটাই আসলে স্ল্যাব মুখের স্টিল ফ্রেম। আহমদ মুসার অনুমান অনুসারে এই ফ্রেমে চাপ দিলেই সিঁড়ি মুখের স্ল্যাব সরে যাওয়ার কথা।
আহমদ মুসা স্টেনগানটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত ওপরে তুলে চাপ দিল ফ্রেমটিতে। কিন্তু বার বার চাপ দিয়েও সিঁড়ি মুখের স্ল্যাবের কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেল না।
মনে পড়ল আহমদ মুসার। লোকটি দু’পা লাগিয়েছিল, তাকেও তাহলে দু’পা লাগাতে হবে।
কিন্তু না দু’পায়ে চাপ দিয়েও কোন ফল হলো না।
আহমদ মুসা সিঁড়ির ওপর বসে চোখ বন্ধ করে ভাবল, তার কিছু কি ভুল হচ্ছে? না তার অনুমান গোটাটাই ভুল?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগল, লোকটা দু’পা জোড় করে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়েছিল?
লোকটার ছবি ভেসে উঠল আহমদ মুসার চোখের সামনে। সে দু’পা জোড় করে ফ্রেমের ওপর রেখেছিল এবং জায়গাটা ছিল ফ্রেমের ঠিক মাঝখানে।
চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। উঠে দাঁড়াল বসা থেকে।
ছাদ রঙা ফ্রেমটা অনুমানে মেপে নিয়ে আহমদ মুসা ঠিক মাঝখানে দু’হাত লাগিয়ে চাপ দিল। সংগে সংগেই স্ল্যাবটা আহমদ মুসার চোখের সামনে থেকে সরে ছাদের ভেতরে ঢুকে গেল।
এক ঝলক তাজা বাতাস এসে আহমদ মুসার মুখ চোখ জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
এই সাথে আহমদ মুসা মানুষের কথা শুনতে পেল। ঠিক মাথার ওপরেই।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে সিঁড়ির নিচে গিয়ে দাঁড়াল।
বুঝল আহমদ মুসা, কেউ দু’জন কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে।
একজন বলছে, ‘কর্তা এই রাতেই আসছেন যে! আগামী কাল না আসার কথা?’
অন্যজন বলছে, ‘কোন বড় পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই। তাছাড়া যে শত্রু ধরা পড়েছে, সে অত্যন্ত ভয়াবহ। এই-ই নাকি আহমদ মুসা, তার ছবির সাথে নাকি এ মিলে গেছে। এটা জানতে পেরেই কর্তা রওয়ানা দিয়েছেন।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার পরিচয় তাহলে এতদিনে ব্ল্যাক ক্রসের কাছে ধরা পড়ে গেল! ওরা তো এখন পাগল হয়ে যাবে!
আহমদ মুসা ভাবল, পিয়েরে পল তাহলে আসছে! রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। কয়টায় কে জানে? যে কোন সময়ই এসে পৌছতে পারে সে। সে আসা মানে একটা বড় দলবল নিয়েই সে আসবে, বিশেষ করে যখন আহমদ মুসার খবর পেয়েছে।
আহমদ মুসা আরও ভাবল, তার আসা অর্থাৎ বাড়তি শক্তি এখানে এসে পৌঁছার আগের এই সময়টাই ওমর বায়াকে উদ্ধারের সুবর্ণ মুহূর্ত।
আহমদ মুসা নিশ্চিত, এই এক তলারই কোন এক স্থানে বন্দী আছে ওমর বায়া। ব্ল্যাক ক্রসের যে লোককে সে কিডন্যাপ করেছিল, তার কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। ওমর বায়া বন্দী আছে এক তলার ভাসমান একটা বাংলোতে। অতএব আহমদ মুসা সিদ্ধান্তে পৌঁছল, সাগর যেহেতু গীর্জার পশ্চিম দিকে, তাই সে যে চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকে পশ্চিম দিকে গেলেই ভাসমান বাংলো এলাকা সে পেয়ে যেতে পারে।
সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা ছোট্ট চত্বরটার চারদিকে নজর বুলাল। চত্বর থেকে তিনটা করিডোর তিনদিকে গেছে। পূর্ব দিকের করিডোরটা গেট পর্যন্ত গেছে বুঝল আহমদ মুসা। আর উত্তরেরটা বাড়ির উত্তর অংশে গেছে। তাহলে পশ্চিমের করিডোরটাই গেছে সাগরের দিকে। এ পথেই তাকে যেতে হবে।
তিনটি করিডোরের মুখেই দরজা আছে। কিন্তু তিনটি দরজাই খোলা।
আহমদ মুসা পশ্চিম দরজার দিকে এগোলো।
যাওয়ার সময় তার মনে জাগল, সিকিউরিটি পুল নিষ্ক্রিয় না করে তার এগোনো ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু আবার পরক্ষণেই ভাবল, সময় খুব কম। সিকিউরিটি পুলের ওখানে গিয়ে হাঙ্গামায় পড়লে ওমর বায়ার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যেতে পারে। আগে ওমর বায়াকে উদ্ধার, পরে বের হবার পথ আল্লাহ একটা বের করে দেবেন।
দরজা পেরিয়ে করিডোর দিয়ে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা।
কয়েকটা বাঁক ঘুরে একটা করিডোরের মুখে এসে দাঁড়াল। এ মুখেও একটা দরজা আছে, তাও খোলা।
করিডোরের মুখই তিন তলা বিল্ডিংএর শেষ প্রান্ত। তারপরেই উন্মুক্ত আকাশের নিচে ফাঁকা চত্বর। চত্বরটি উঁচু প্রাচীর ঘেরা। আহমদ মুসার সোজা সামনে প্রাচীরের বড় একটি দরজা।
প্রাচীরের ভেতরে বাংলোর চালাগুলো দেখতে পেল আহমদ মুসা। খুশি হলো তার মন। ঐ বাংলোর কোন একটিতে ওমর বায়া বন্দী আছে।
প্রাচীরের বাইরের পাশ বরাবর চত্বরটি ফাঁকা। আহমদ মুসা দেখল প্রাচীরের এ পাশ বরাবর প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে। চারজনকে সে দেখতে পাচ্ছে। দু’জন গেটে। আর দু’জন গেটের ডান ও বাঁ পাশে বেশ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে।
দরজায় দাঁড়ানো প্রহরী দু’জন স্টেনগান হাতে ঝুলিয়ে দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।
এই সময় আহমদ মুসা শুনতে পেল তার পেছন থেকে অনেকগুলো পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। অনেকটা চমকে উঠেই পেছনে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা। কাউকে দেখল না, কিন্তু পায়ের শব্দ তার কাছে আরও স্পষ্টতর হলো। ওদের কথা বার্তাও শুনা যাচ্ছে। আহমদ মুসা বুঝল ওরা খুব কাছে চলে এসেছে। বাঁকের আড়াল না থাকলে এতক্ষণ সে তাদের চোখে পড়ে যেত।
আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে দ্রুত দরজার আড়ালে গিয়ে লুকালো।
দরজার আড়াল থেকে আহমদ মুসা দেখল, জনা দশেক প্রহরী এগিয়ে আসছে করিডোর দিয়ে গল্প করতে করতে।
একজন লোক বলছে, একজন বন্দী লোক নিয়ে কর্তাদের এত ভয় কেন, বুঝলাম না?
গর্দভ, আহমদ মুসা একজন নয়, সে একাই একশ। বলল অন্য একজন।

ঠিক আছে। সে তো বন্দী। আমাদের কি কাজ এখানে? প্রহরী তো আছেই। বলল আগের লোকটি।
আমাদের কিছু কাজ নেই। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওমর বায়ার ঘর পাহারা দেয়া। কর্তা এসে ওমর বায়াকে নিয়ে যাবে, তারপরেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। বলল দ্বিতীয় লোকটি।
দরজা বরাবর চলে এসেছে ওরা।
আহমদ মুসা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল।
ওদের শেষ লোকটি যখন দরজা বরবর তখন আহমদ মুসা দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের পেছনে পেছনে চলতে লাগল। মাথার হ্যাটটাকে কপাল পর্যন্ত নামিয়ে ওদের পেছনে একটু আলগা হয়ে চলতে লাগল আহমদ মুসা।
দলটি দরজার কাছে পৌছতেই দরজা খুলে গেল। গেটের প্রহরী দু’জন দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। আর ওরা ঢুকে গেল ভেতরে।
আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই একটু পেছনে পড়েছিল।
গেটের প্রহরীদের একজন বলল, তাড়াতাড়ি কর দরজা বন্ধ করে দেব।
বলেই লোকটি তার সঙ্গী প্রহরীর লাইটারে সিগারেট ধরাতে গেল। তার সঙ্গী তখন সিগারেট ধরাচ্ছিল।
তাদের তাড়া খেয়ে লাফ দিয়েই যেন দরজায় গিয়ে পৌছল আহমদ মুসা।
সু্যোগ সে নষ্ট করল না।
আকস্মাৎ সে প্রহরী দু’জনের কাছাকাছি গিয়ে তাদের দু’জনের মাথা ধরে ভীষন জোরে ঠুকে দিল। পরপর দু’বার।
ওরা সংগে সংগেই সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা দ্রুত ওদের বেল্ট থেকে দু’টি রিভলবার নিয়ে দু’পকেটে পুরে স্টেনগানটা হাতে নিয়ে দরজা পেরিয়ে ঢুকল ভেতরে।

খোলা চত্বরটিতে তিনটি বাংলো। একটি দক্ষিণ প্রান্তে, আরেকটি উত্তর প্রান্তে এবং মাঝখানে একটি। মাঝখানেরটি ওই দু’টি বাংলোর সাথে এক লাইনে না হয়ে কিছুটা পশ্চিমে এগিয়ে।
মাঝখানের বাংলোতেই থাকে ওমর বায়া। আহমদ মুসাও এটা বুঝতে পারল মাঝখানের বাংলোর সামনে সেই দশ প্রহরীর জটলা দেখে।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগুলো সেদিকে। তার স্টেনগানের ব্যারেল নামানো কিন্তু তার আঙুলটি স্টেনগানের ট্রিগার স্পর্শ করে আছে।
ওদের কাছাকাছি পৌছেছে এই সময় পেছনে ফেলে আসা গেটের দিক থেকে কথার শব্দ পেল। চকিতে পেছনে ফিরেই দেখল গেট দিয়ে কয়েকজন প্রবেশ করছে। তৎক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, সামনের দৃশ্যপটও পাল্টে যাচ্ছে। একজন ওয়াকি-টাকিতে কথা বলছে, অন্যরা এ্যাটেশনের ভংগিতে দাঁড়াচ্ছে।
আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না যে, সে ধরা পড়ে গেছে। সংগে সংগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।
চোখের পলকে শরীরটা সামনের দিকে একটু বাঁকিয়ে স্টেনগানের মাথা উঁচু করে ট্রিগারে আঙুল চেপে সামনের ওদের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল।
স্টেনগানের ব্যারেল ওদের ওপর দিয়ে ঘুরে আসার পর কাউকেই দাঁড়ানো দেখা গেল না।
গুলী করেই আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছে।
গড়িয়ে চলল ওমর বায়ার বাংলোর দিকে। সামনের মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে পড়ে থাকা ঝাঁঝরা লাশগুলোর কাছে না পৌছাতেই গেটের দিক থেকে গুলী বৃষ্টি শুরু হলো।
কিন্তু গেটের সে স্থান থেকে আহমদ মুসার দুরত্ব স্টেনগানের পাল্লার জন্যে খুব অনুকূল নয়।
এ সুযোগে আহমদ মুসা চরকির মত গড়িয়ে ওমর বায়ার বাংলোর বারান্দায় গিয়ে উঠল। যাবার সময় আহমদ মুসা ওদের একটা স্টেনগান ও এল এম জি টেনে নিয়ে গেল।
বারান্দায় উঠে একটা থামের আড়াল নিল সে।
ওরা গুলী করতে করতে এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা জবাব দিল না ওদের গুলীর।
আহমদ মুসা ওদের বিভ্রান্ত করতে চায়, সাহসীও করে তুলতে চায়। ওদের এই ধারনা দিতে চায় যে আহমদ মুসা ওদের ঠেকানোর চাইতে এখন ওমর বায়াকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত।
এটা ছিল আহমদ মুসার কৌশল।
ওদের একজন বলল, নিশ্চয় শয়তানটা ভেতরে ঢুকে গেছে, এখন ওমর বায়াকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে। দৌড় দাও।
ওরা তিনজন মাথা নিচু করে দৌড় দিল ওমর বায়ার বাংলোর দিকে।
ওদেরকে আসতে দিল আহমদ মুসা।
কাছাকাছি এলে পিলারের আড়াল থেকে মাথা বের করে আবার এক পশলা গুলী বৃষ্টি করল স্টেনগান থেকে।
মাটির ওপর ঝরে পড়ে গেল ও তিনজন ও।
কিন্তু এ তিনজনের কাহিনী সাঙ্গ হতে না হতেই প্রাচীরের সেই গেটে এসে দাঁড়াল আরও বেশ কয়েকজন।
ঠিক এই সময় আহমদ মুসা পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরল। দেখল উদ্যত রিভলবার হাতে একটি মেয়ে। তার পিস্তলের নল আহমদ মুসার কপাল ছুই ছুই করছে। বলল মেয়েটি কে আপনি? কোন পক্ষের?
মেয়েটি এলিসা গ্রেস।
ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের সাথে লড়াই করতে দেখেও তাদের মারতে দেখেও যখন আপনি এই প্রশ্ন করেছেন, তখন আমি নিশ্চয় আপনার পক্ষের। আমি ওমর বায়াকে মুক্ত করতে এসেছি।
আহমদ মুসার কপাল থেকে মেয়েটির রিভলবার নেমে গেল। বলল, আপনি কি আহমদ মুসা?
হ্যাঁ, এ নাম জানলেন কি করে?
ওমর বায়ার কাছে শুনেছি। শুনেছি, তাকে উদ্ধার করতে আপনিই আসতে পারেন।
ওমর বায়া কোথায়?
এই তো উনি আসছেন।
ওমর বায়া বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা ও ওমর বায়া সালাম বিনিময় করে একে ওপরকে জড়িয়ে ধরল। কেঁদে উঠল ওমর বায়া।
আহমদ মুসা ওমর বায়ার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, এই সংগ্রামের নামই তো জীবন।
এই সময় গেটের দিক থেকে অব্যাহত গুলীর শব্দ ভেসে এল। ওরা এগোচ্ছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান তুলে ওদের দিকে এক পশলা গুলী বৃষ্টি করল।
ভাই জান আমি পালানোর একটা ব্যবস্থা করেছি। ওদের সংখ্যার কাছে আমরা দাঁড়াতে পারব না। চলুন আমরা যাই।
কোন পথে স্টেনগান থেকে গুলী করতে করতেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা?
গেট থেকে যারা অগ্রসর হচ্ছিল তারা শুয়ে পড়েছে। ওদের সামনে অগ্রসর হওয়া বন্ধ হয়েছে।
এই চত্বর থেকে সাগরে নামার একটা গোপন পথ আছে। সেখানে আছে একটা গোপন জেটি। মি. লিটল পথ চেনে। আমি একটা বোটের ব্যবস্থা করেছি।
ধন্যবাদ বোন। মি. লিটল কে?
সে এই বাংলোর একজন পরিচালক। এখনকার একজন পুরানো লোক।
গোপন জেটিতে নামার পথ কোথায়?
সামনে সুইমিং পুলের ঐ যে টাওয়ার। টাওয়ারের গোড়ায় নিচে নামার একটা সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে নামলে কিছু টয়লেট ও ভিডিও গেম স্টল। এখানকার একটা গোপন কক্ষ থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে জেটিতে। লিটল চেনে। সে এখন টাওয়ারের নিচে অপেক্ষা করছে।
গার্ড নেই?
গার্ড নেই। তবে জেটিতে ঢোকার যে দরজা সেটার লক দূর নিয়ন্ত্রিত। কোন চাবি দিয়ে ওটা খোলা যাবে না। ভাঙতে হবে। ওটাই এখন প্রধান সমস্যা।
আপনারা প্রস্তুত?
জি, হ্যাঁ। বলল, এলিসা গ্রেস।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা স্টেনগান তুলে গুলী করল চত্বরের লাইট পোস্টের বাল্ব লক্ষ্যে। তারপর ভেঙে দিল সুইমিং টাওয়ারের বাল্বগুলোও।
ওমর বায়ার বাংলোর আলো আগে থেকেই নেভানো ছিল।
গোটা এ দিকটা অন্ধকারে ঢেকে গেল।
আহমদ মুসা দেখল, গেটের দিক থেকে এগিয়ে আসায়ে ওরা দু’ভাগ হয়ে এক ভাগে দক্ষিণের বাংলো এবং অন্য ভাগ উত্তরের বাংলোর দিকে এগোবার উদ্যোগ নিচ্ছে। ঠিক এই সময় আরও কয়েকজন এসে সেই গেটে দাঁড়াল। আহমদ মুসা বুঝল, ওরা পাশের দু’বাংলোর কভার নিয়ে দু’পাশ ও সামনে এই দিক থেকেই আহমদ মুসাদের ঘিরে ফেলতে চায়।
ওদের এই উদ্যোগে বাঁধা দেয়ার জন্যে আহমদ মুসা লাইট মেশিনগান পেতে দিয়ে ওমর বায়া ও এলিসা গ্রেস কে বলল, তোমরা গড়িয়ে গিয়ে টাওয়ারের নিচে নেমে যাও। আমি ওদের দেখছি।
আপনি? বলল, এলিসা।
আমি ওদের কিছুটা পিছু হটিয়ে দিয়ে আসছি।
বলেই আহমদ মুসা তার লাইট মেশিনগান থেকে গুলী বৃষ্টি শুরু করল।
আহমদ মুসা আড়াল নিয়ে গুলী করছে। ওদের আড়াল নেয়ার কিছু নেই। আর ওদের অবস্থান তখন পুরোপুরি লাইট মেশিনগানের আওতায়।
আহমদ মুসার লাইট মেশিনগান ব্যবহার খুবই কার্যকরী হলো।
ওরা দ্রুত পিছু হটল। যারা দু’পাশের বাংলোর দিকে যাচ্ছিল, তারাও দৌড় দিল গেটের দিকে।
আহমদ মুসা গুলী বন্ধ করে দ্রুত ক্রলিং করে এগোলো টাওয়ারের দিকে।
টাওয়ারের সিঁড়ি মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল ওমর বায়া। আহমদ মুসা তাকে নিয়ে দ্রুত নিচে গেল। যাওয়ার সময় সিঁড়ি মুখের দরজা লক করে গেল।
তারা নামতেই এলিসা গ্রেস ডাকল।
সে দাঁড়িয়ে ছিল পশ্চিম প্রান্তের একটা খোলা দরজার সামনে।
আহমদ মুসা ও ওমর বায়া দৌড় দিয়ে সেখানে পৌছল।
এলিসা গ্রেস ঘরের দিকে ইংগিত দিয়ে তার বিপরীত দিকের একটা দরজা দেখিয়ে বলল, ওটা খুললেই জেটির সিঁড়ি। লিটলকে পাঠিয়েছি জেটি মুখের তালা ভাঙার জন্যে।
এই সময় ওপরের চত্বরে অব্যাহত গুলী বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল তারা।
চল তাড়াতাড়ি। ওরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছে। অল্পক্ষনের মধ্যেই এসে পড়বে। জেটিতে বোট কখন আসবে? বলল, আহমদ মুসা।
এলিসা গ্রেস দ্রুত ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, এতক্ষণে এসে গেছে। জেটি থেকে একটু দূরে অপেক্ষা করবে, সিগন্যাল দিলেই এসে ভিড়বে।
প্রায় মাথার ওপরেই এ সময় গুলীর শব্দ হলো। ওরা তাহলে টাওয়ারের গোড়ায় এসে গেছে
ওমর বায়া ও এলিসা গ্রেসের মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল।
তোমরা নেমে যাও। আমি এ দরজায় আছি। ওদের লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
ওমর বায়া ও এলিসা দ্রুত নিচে নেমে গেল।
টাওয়ারের গোড়ায় তখন অব্যাহত গুলীর শব্দ হচ্ছে। গুলীর শব্দ নিচে নেমে আসছে। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা দরজা ভেঙে সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান বাগিয়ে জেটিতে নামার সিঁড়ি মুখের দরজায় বসল। তার মাথা ছাড়া পেছন দিকটা সিঁড়িতে। অন্ধকারের কারণে সামনের করিডোর থেকে তার মুখও দেখা যাবে না।
মূহুর্ত কয়েক পরেই গুলী করতে করতে নেমে এল ওরা একদল। সাত আটজন।
নেমেই ওরা এগোলো আহমদ মুসা যেখানে বসে অপেক্ষা করছে সেই ঘরের দিকে। সমানে তারা গুলী করছে।
এবার ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা। কয়েক সেকেন্ড ধরে গুলী বৃষ্টি করল তার স্টেনগান। যারা করিডোরে নেমেছিল তারা কেউ বাঁচল না।
আহমদ মুসা এবার দ্রুত নামল সিঁড়ি দিয়ে এবং ছুটল সিঁড়ির জেটির গেটের উদ্দ্যেশে।
বিশাল গেট।
আহমদ মুসা সেখানে পৌছে দেখল সবার মুখ ভয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। এলিসা গ্রেস বসে পড়েছে মেঝেতে অসহায়ভাবে। তীক্ষ্ণ মুখ বিশিষ্ট শাবল দিয়ে গেটের তালা ভাঙার চেষ্টা করছে হস্তি দেহ লিটল।
আহমদ মুসা পৌছতেই এলিসা গ্রেস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সর্বনাশ দূর নিয়ন্ত্রিত এ লক খোলা যাবে না।
আবার ওপরে শোনা গেল স্টেনগানের অব্যাহত গুলীর শব্দ। মনে হলো ওরা টাওয়ারের নিচের করিডোর দিয়ে জেটিতে নামার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে।
এবার ভয়ে লিটলেরও হাতুড়ি থেমে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে এলিসা গ্রেস বসে পড়ল আবার মেঝেতে।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমরা ভয় করছ কেন? ব্ল্যাক ক্রসের কয়েকটা স্টেনগানের চেয়ে কি আল্লাহর শক্তি বড় নয়?
বলে আহমদ মুসা এগোলো সেই লকের দিকে।
লকটা পরীক্ষা করে বুঝল এটা কোন জটিল লক নয়। কোন প্রকারে লকের হুকটা সরিয়ে দিতে পারলেই দরজা খুলে যাবে।
আহমদ মুসা তার ডান হাতের মধ্যমা ধীরে ধীরে গোটা লকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল গোটা লক। আর সংগে সংগেই দরজা শিথিল হয়ে গেল।
হাত দিয়ে দরজা টেনে ফাঁক করল আহমদ মুসা।
লাফিয়ে উঠল এলিসা গ্রেস। তার এবং লিটলের চোখে ভূত দেখার মত বিস্ময়।
গুলীর শব্দ কাছে চলে এসেছে। জেটিতে নামার সিঁড়ি পেরিয়ে এসেছে ওরা।

আহমদ মুসা দ্রুত ওদের জেটিতে চলে যাবার নির্দেশ দিয়ে এলিসা গ্রেসকে বলল, আপনার বোটকে দেখুন। আমাদের হাতে সময় নেই।
সবাই চলে গেল জেটিতে।
আহমদ মুসা কাঁধ থেকে স্টেনগান নামিয়ে হাতে নিল। দরজা টেনে দিয়ে সামান্য খোলা রেখে তার সামনে একটা ক্রেন টাওয়ারের কভার নিয়ে বসল সে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই দরজার ওপাশটা গুলীতে ভরে গেল। অবিরাম গুলীর আঘাতে স্টিলের দরজা অদ্ভূত এক বাদ্যযন্ত্রের রূপ নিল।
আহমদ মুসা কোন গুলী করল না।
কিছুক্ষণ গুলী করার পর ওদের কয়েকজনকে এক সাথে ছুটে আসতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা ধীরে সুস্থে ওদের তাক করল। ট্রিগারে চাপ দিল আঙুল দিয়ে। ছুটে গেল এক পশলা গুলী ওদের দিকে।
দরজার কয়েক হাত দূরে ওরা আছড়ে পড়ল স্টিলের মেঝের ওপর।
কয়কজন ছুটে আসছিল। ওরা শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পিছু হটে গেল।
গুলী বন্ধ করল আহমদ মুসা। কিন্তু ওদের তরফ থেকে গুলী আসছে অবিরাম।
আহমদ মুসা ভাই, আসুন। সব রেডি। চাপা চিৎকার করে বলল ওমর বায়া।
আহমদ মুসা পেছন দিকে একবার চাইল। আবার সামনে তাকিয়ে আরও এক পশলা গুলী বর্ষণ করল। তারপর পিছন ফিরে ছুটল বোটের দিকে।
সবাই উঠেছে বোটে। বেশ বড় বোট।
আহমদ মুসা যখন বোটে উঠছিল তখন ওদের গুলীর আওয়াজ অনেকটা নিকটবর্তী মনে হলো। আহমদ মুসা ভাবল ওরা গুলী করতে করতে জেটির গেট পার হয়ে ছুটে আসছে।
আহমদ মুসা বোটে উঠার সংগে সংগে বোট ছেড়ে দিয়েছে। বোটের আলো নেভানো।
আহমদ মুসা বোটের চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রেষ্ট নিল কিছুক্ষণ।
তারপর চোখ খুলল।
বোট চালাচ্ছিল বিশ বাইশ বছরের এক তরুন। আহমদ মুসার অচেনা।
এছাড়া বোটে আরও চারজনকে দেখল। একজন ওমর বায়া, অন্যজন এলিসা গ্রেস। তৃতীয় জন একটি তরুনী। এলিসা গ্রেসের গা ঘেঁষে বসে আছে। মাথা নিচু করে বসা। চিনতে পারল না আহমদ মুসা। চতুর্থ জন বিশাল বপু লিটল।
পেছনে ফেলে আসা ব্ল্যাক ক্রসের জেটি এবং চারদিকে একবার চেয়ে আহমদ মুসা এলিসা গ্রেসকে লক্ষ্য করে বলল, ধন্যবাদ আপনাকে, সুন্দর ব্যবস্থা আপনি করেছেন। এমন পরিকল্পনার জন্যে আপনাকে আবার ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ পাওয়া উচিত লিটলের। সেই আমাকে এ বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছে। সাহসও দিয়েছে। আর এই পিয়েরা পেরিন এবং সাহায্য না করলে কিছুই করতে পারতাম না।
ওদেরকেও ধন্যবাদ। বলে একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল এলিসা গ্রেসকে, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
পিয়েরা পেরিন নামক তরুনী মুখ তুলল। আহমদ মুসার সাথে চোখাচোখি হলো।
আপনি? বলল আহমদ মুসা। তার কন্ঠে বিস্ময়!
জি আমি। ছোট্ট করে বলল মেয়েটি।
আপনারা পরস্পরকে চেনেন? কেমন করে? বলল এলিসা গ্রেস।
আমি তো ওদের রেস্টুরেন্টেই কয়েকদিন খানা খেয়েছি। ব্ল্যাক ক্রস তো আমাকে ওখান থেকেই ধরে নিয়ে আসে।
সেটা শুনেছি। তাহলে সেই আপনি? এলিসা গ্রেস বলল।
মিস পিয়েরাও আমাকে তার মুসলিম বংশোদ্ভূত একজন বান্ধবীর কথা বলেছিলেন, তাহলে সেই আপনি? এলিসা গ্রেসকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
পিয়েরা জবাব দিল জি হ্যাঁ।
তাহলে মিস এলিসা গ্রেস আপনার মা মুসলিম ছিলেন?
এলিসা গ্রেস মাথা নেড়ে তার মা ও তার নানীর কথা বলল। তারপর জানাল, পিয়েরা আমার কথা বলেছে কিন্তু তার কথা বলে নি। তার দাদাও একজন একজন আলজেরীয় মুসলিম পিতার সন্তান।
ঠিক। কিন্তু সেই শিকড়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি সব ভুলে গেছি। বলল পিয়েরা।
শিকড় থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, বিশেষ করে মুসলিমরা। আমি পারিনি। তুমিও তো পারলে না। যদি পারতে তাহলে জীবন বিপন্ন করে কেন এসেছ ওমর বায়াকে সাহায্য করতে?
হয়তো হবে। আমি আমাকেই জানি না। এটা ঠিক যে, একে যখন রেস্টুরেন্টে মুসলিম বলে জানলাম এবং যখন মি. ওমর বায়া মুসলিম হওয়ার কথা তোমার কাছে শুনলাম, তখন আমার যে আনন্দ হয়েছিল তার সাথে অন্য কোন আনন্দের তুলনা চলে না।
আপনারা দু’জনে আমার হৃদয়ের একান্ত শুভেচ্ছা গ্রহন করুন। নিজের বোনকে অনেকদিন পরে কাছে পেলে যে আনন্দ হয়। আপনাদের দেখে সে আনন্দই আমার হচ্ছে। বলল, আহমদ মুসা এলিসা গ্রেস ও পিয়েরাকে লক্ষ্য করে।
এলিসা গ্রেস ড্রাইভিং সিটে বসা তরুনের দিকে চেয়ে বলল, ও লুই ডোমাস। খাস ফরাসি। ও পিয়েরার বন্ধু।
বলেই পিয়েরার দিকে চেয়ে বলল, নাকি আরও কিছু পিয়েরা?

তোমার মুখে কিছু বাধে না। এটা কি সময় এসব বলার? আমি বলব তোমার কথা? যাক ওমর বায়াকে আমি লজ্জায় ফেলতে চাই না।
এলিসা গ্রেসের মুখ লাল হয়ে গেছে। ওমর বায়া তার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। সে এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়ার দিকে এক পলক চেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসা তরুনের দিকে চেয়ে বলল, ওয়েলকাম ব্রাদার লুই ডোমাস। আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার পরিচয় এলিসার কাছে শুনলাম। গর্ববোধ করছি আপনার পাশে বসতে পেরে। আমার জীবনে এটা সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হবে।
তোমার জীবন সুন্দর হোক ডোমাস। বলে আহমদ মুসা পিয়েরার দিকে চেয়ে বলল কোথায় যাচ্ছি আমরা বোন।
পিয়েরা সামনের দিকে চেয়ে বলল, আর মাইল খানিক পরে আমরা একটা প্রাভেট জেটিতে নামব। সেখানে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়িতে করে আমরা আমার বাড়িতে উঠব। ছোট ফ্ল্যাট, কষ্ট হবে আপনাদের। কিন্তু আমি খুশি হব।
আমাদের জন্যে ও এটা খুশির খবর। কিন্তু এই বিপদে জড়ানো কি তোমার ঠিক হবে। এলিসা গ্রেসকে তো বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে।
এলিসার জড়িয়ে পড়া আর আমার জড়িয়ে পড়া একই কথা। তাছাড়া আমাদের পাড়াটা নিরাপদ। এলিসারও বাড়ি সেখানে। এই পাড়ায় আলজেরিয়া বংশোদ্ভূত অনেকগুলো পরিবার আছে।
তাহলে পিয়েরা ঐ পাড়ায় বিপদ ডেকে আনা ঠিক হবে না। বিনা কারনে, বিনা অপরাধে অনেক পরিবার বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারে।
ব্ল্যাক ক্রস মনে করতে পারে আমার প্রতি, ওমর বায়ার প্রতি সকলের সহযোগিতা আছে।
তাহলে?
বলে পিয়েরা একবার এলিসা গ্রেস এবং একবার লুই ডোমাসের দিকে তাকাল।
কোন খালি বাড়ি বা কোন রেস্টহাউজ নেই, যেখানে গিয়ে আপাতত উঠা যায়?
একটা রেস্টহাউজ আছে চার পাঁচটা ঘর। নাম লা আটলান্টিক। একটা ছোট টিলার ওপরে সাগরের তীরে। একদম নির্জন। পর্যটকদের খুব প্রিয় জায়গাটা। কিন্তু ভাড়াটা অত্যন্ত বেশী।
খালি আছে? খুশি হয়ে বলল, আহমদ মুসা।
খালি থাকার কথা। সন্ধ্যা রাতেও খালি ছিল।
ধন্যবাদ লুই ডোমাস। আপাতত ঐখানেই আমরা উঠব।
লুই ডোমাস মাথা ঝুকিয়ে সায় দিয়ে সামনের দিকে নজর দিল।
ঘড়ির দিকে একবার তাকাল।
বোটের স্পীড বাড়িয়ে দিল সে।

Top