১৯. ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

চ্যাপ্টার

নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোস-এর বিমানবন্দরে নেমে যখন আহমদ মুসা জানতে পেরেছিল, ‘দুয়ালা’র বিমান ধরার জন্যে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হবে, তখন মনটা তার তেতো হয়ে গিয়েছিল। পরে কিন্তু এই তেতো ভাবটা আর থাকেনি।
টার্মিনাল লাউঞ্জের উত্তরের জানালা দিয়ে গরানের সবুজ বুকের উপর দৃষ্টি ফেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার মন। এই নাইজেরিয়া আবু বকর বালেবা তাফাওয়ার নাইজেরিয়া, আহমদ বেল্লুর নাইজেরিয়া। আবু বকর বালেবা তাফাওয়া ছিলেন নাইজেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং আহমদ বেল্লু ছিলেন উত্তর নাইজেরিয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। এ দু’জন ছিলেন ইসলামের অকুতোভয় সৈনিক। তাদের শাসনামলে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের সুবাতাস নাইজেরিয়ায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। ইসলামের কল্যাণ রূপ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মাত্র এক বছরে নাইজেরিয়ায় নয় লাখ উপজাতি ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ক্রিসেন্টের এই অগ্রগতি হিংসায় উন্মত্ত করে তুলেছিল ক্রসকে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসের এক কালো দিন। এ দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলো নাইজেরিয়ার এই দুই মহান নেতা। ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জনসন ইরোনসি এবং শান্ত হয় ক্রসের হিংসার আগুন।
গরান বনের উপর দিয়ে দিগন্তে চোখ নিবদ্ধ করতে গিয়ে ইতিহাসের সে ঘটনাগুলো আহমদ মুসার চোখে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তার চোখে ভেসে উঠেছিল নাইজেরিয়ার মানচিত্র। সামনের এই গরান বন পেরিয়ে একটু এগোলেই পাবে ওকুতা নামের নগর। সেখানে ট্রেনে চাপলেই নতুন নানা জায়গা পেরিয়ে পৌঁছা যাবে ঐতিহাসিক নগরী ‘কানো’তে। উত্তর নাইজেরিয়ার এই ‘কানো’ নগরী ছিল নাইজেরিয়ায় ইসলামের সিংহদ্বার।
উত্তর থেকে ইসলামের আলো এই দ্বারপথেই নাইজেরিয়াকে আলোকিত করে। উত্তর নাইজেরিয়া এখনো ইসলামের দুর্গ। আবু বকর বালেবা তাফাওয়া এবং আহমদ বেল্লু ছিলেন এই দুর্গের সেনাধ্যক্ষ। তাদের হত্যা করা হয়েছিল এই দুর্গে ধ্বস নামানোর জন্যেই।
আযানের একটা মিষ্টি সুর আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ ঘটাল। চারদিকে তাকিয়ে বুঝল, আযানটা টার্মিনাল ভবনের উপর তলা থেকে আসছে।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, বেলা সাড়ে বারটা। এ সময় আযান কেন? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, আজ শুক্রবার, জুময়ার নামাজ। খুশি হলো আহমদ মুসা।
উৎকর্ণ হয়ে গভীর মনোযোগের সাথে আযান শুনল আহমদ মুসা। বেশ ক’দিন পর এমন মুক্তকণ্ঠের আযান শুনছে সে। অমুসলিম অনেক দেশের মত ফ্রান্সেও মুক্ত কণ্ঠ আযানের উপর বিধি-নিষেধ রয়েছে।
আহমদ মুসা ওপরে উঠে গেল মসজিদের সন্ধানে।
বড় একটি হল ঘর নিয়ে মসজিদ।
বেশ সুন্দর ওজুখানাও।
আরবীতে খুৎবা হলো।
নামায শেষে আহমদ মুসা ইমামের সাথে দু’টি কথা বলার জন্যে অপেক্ষা করল।
ইমাম বয়সে যুবক।
আহমদ মুসা তার সাথে আরবী ভাষায় কথা বলল। আহমদ মুসা সময় চাইতেই সে আহমদ মুসার দিকে একবার গভীর দৃষ্টিতে চাইল। রাজি হলো সে এবং আহমদ মুসাকে তার কক্ষে নিয়ে গেল।
দু’টি সোফায় মুখোমুখি দু’জন বসল।
‘আমি আবদুর রহমান ইরোহা। আপনার পরিচয় বলুন।’ বলল ইমাম সাহেব।
ইমাম আবদুর রহমান ইরোহা মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। এবং সৌদি সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন মুবাল্লেগ।
ইমামের প্রশ্নের পর আহমদ মুসা তার মুখের দিকে আরেকবার তাকাল। বলল, ‘আমি আহমদ মুসা।’
ইমাম আবদুর রহমান মুখ তুলে একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার চোখে সামান্য একটু কৌতুহল। বলল, ‘বলুন, আপনি কি বলতে চান?’
‘আমার দু’টি প্রশ্ন। একটি হলো, নাইজেরিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হার কমেছে কেন?’
‘প্রকৃতপক্ষে সংখ্যা কমেনি। কিন্তু কম যে দেখানো হচ্ছে তার রহস্য হলো, নাইজেরিয়ার দক্ষিণ ও পূর্ব এলাকা থেকে মুসলমানদের বিভিন্ন কৌশলে ব্যাপক উচ্ছেদ করা হয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে মুসলমানদের হার কমে গেছে। পশ্চিমী বা খৃস্টানদের পরিসংখ্যানে নাইজেরিয়ার মুসলিম জনসংখ্যা থেকে এদের কম দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরা যে পশ্চিম ও উত্তরে গিয়ে সেখানকার মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করেছে, সেটা আর পরিসংখ্যানে দেখানো হয়নি।’
‘ধন্যবাদ। আমি ক্যামেরুনে যাচ্ছি। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ক্যামেরুন সংক্রান্ত। সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুন মুসলিমশূন্য হয়ে পড়েছে, এটা আপনারা জানেন কিনা? জানলে আপনারা এ ব্যাপারে কি করেছেন?’
‘আমরা জানি। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ ও পূর্বে মুসলিম জনসংখ্যার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, সেটাই পরিপূর্ণ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ক্যামেরুনে।’
একটু থামল ইমাম আবদুর রহমান। তার বুক থেকে একটা ছোট-খাট দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। বলল, ‘আমরা নাইজেরিয়াতেই কিছু করতে পারছি না, ক্যামেরুনের জন্যে আর আমরা কি করব?’
‘মাফ করবেন, কি করা যেত বলে আপনি মনে করেন?’
‘মুসলমানদের সচেতনতা ও ঐক্যের অভাব এবং তাদের দারিদ্র্য ও অভিভাবকহীনতার কারণেই এমনটা ঘটতে পারছে। এই দুর্বলতাগুলো দূর করা যেত।’
‘অভিভাবকহীনতা বলতে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন?’
‘উপরোক্ত দুর্বলতা দূর করার জন্যে বাইরে থেকে সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী সাহায্য। খৃস্টানদের জন্যে যা হচ্ছে।’
কথাগুলো শেষ করেই ইমাম আবদুর রহমান আহমদ মুসার উপর দৃষ্টি স্থির করে বলল, ‘দেখুন, আমার তিরিশ বছরের জীবনে এমন প্রশ্ন কেউ আমাকে করেনি, আমিও এ প্রশ্ন কাউকে কখনও করিনি। আপনিই প্রথম এমন প্রশ্ন তুললেন। কে আপনি?’
‘হতভাগ্য জাতির একজন সেবক।’ বলল ম্লান হেসে আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি উঠি, প্লেনের সময় হয়ে এল।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ইমাম আবদুর রহমানের স্থির দৃষ্টি তখনও আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। বলল, ‘আপনাকে কোথাও যেন আমি দেখেছি।’
হঠাৎ তার চোখ দু’টি উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠল। সাংঘাতিক কি যেন মনে পড়েছে তার। উঠে দাঁড়াল সে সোফা থেকে এক লাফে। মুখোমুখি হলো সে আহমদ মুসার। বলল, ‘চিনতে পেরেছি, আপনি আহমদ মুসা- আমাদের সেই স্বপ্নের মানুষ!’
বলে আহমদ মুসার দু’হাত ধরে তাতে চুমু খেল। বলল, ‘কি সৌভাগ্য, আমার ঘরে আপনার দেখা পেলাম!’
কথাগুলো বলতে বলতে আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেলল যুবক ইমাম। আরও বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন, আরো আগে আপনাকে চেনা আমার উচিত ছিল। আমি আপনার যে ছবি দেখেছি তাতে ছিল আপনার আরবীয় পোশাক। এ কারণেই আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছি।’
‘তাতে কি! ধন্যবাদ আপনাকে। খুব খুশি হলাম আপনার সাথে পরিচিত হয়ে। জানতে পারলাম মূল্যবান কিছু আপনার কাছ থেকে। এখন আমাকে যেতে হবে।’
‘এ সৌভাগ্য আমার আর হয়তো হবে না। আমার ঘরে আসলেন, আমি মেহমানদারী করলাম না, এ হতে পারে না। সুতরাং…’
আহমদ মুসা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘মাফ করুন, এয়ারপোর্টের বেশ কিছু ফরমালিটি এখনো বাকি আছে। সময় বেশি নেই।’
কয়েক মুহূর্ত কিছু বলল না ইমাম আবদুর রহমান। তাকিয়েছিল সে আহমদ মুসার দিকে। যেন সমস্ত মনোযোগ উজাড় করে সে দেখছিল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমি জানি, আপনার মতই আপনার সময় মূল্যবান। আপনার স্বাধীন গতিতে বাঁধা দেয়া ঠিক নয়। নিশ্চয় বড় কোন কাজ নিয়ে আপনি ক্যামেরুনে যাচ্ছেন?’
‘কাজটা অবশ্যই বড়।’
‘আপনি কি প্রথম ক্যামেরুনে যাচ্ছেন?’
‘প্রথম।’
‘কেউ পরিচিত আছে আপনার সেখানে?’
‘ক্যামেরুনের একজনকে মাত্র চিনি। কিন্তু সে এখন পণবন্দী। তাকে উদ্ধার করতেই যাচ্ছি।’
বলে আহমদ মুসা খুব সংক্ষেপে তাকে ওমর বায়ার কথা জানাল।
শুনে আবেগে ইমাম আবদুর রহমানের চোখ দু’টি আবার অশ্রু সজল হয়ে উঠল। বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে সৃষ্টি করেছেন জাতির জন্যে। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।’
একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘রাজধানী ইয়াউন্ডির বেলাল জামে মসজিদের ইমাম ‘উসমান বাহনাজ সঙ্গ’ আমার ক্লাসমেট। মদিনায় দু’জন একসাথে পড়েছি। উনিও একজন সৌদি মুবাল্লেগ। খুব তেজী ঈমানের মানুষ। তাকে আপনি পাশে পেতে পারেন। আমি কথা বলব তার সাথে টেলিফোনে।’
আহমদ মুসা নাম নোট করে নিয়ে বিদায় নেবার জন্যে হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের জন্যে।
ইমাম আবদুর রহমান ইরোহা হ্যান্ডশেক করে হাত ছেড়ে দিল না। হাত ধরে মসজিদের বাইরে এসে সে বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ফিরে এল লাউঞ্জে তার জায়গায়। কিন্তু দেখল, তার যে কয়জন সহযাত্রী ছিল তারা চলে গেছে। আহমদ মুসা টিভি স্ক্রীনের ফ্লাইট ইনফরমেশনের দিকে তাকাল। দেখল, বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তার ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পাশের দুই চেয়ারের পাশে চোখ পড়তেই দেখল, একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে।
মানিব্যাগটি হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। মানিব্যাগের ভাঁজ খুলতেই আহমদ মুসা নেমকার্ডের পকেটে একটা কার্ড দেখতে পেল। পড়ল, থমাস নিকানো, কাস্টমস কমিশনার, দুয়ালা, ক্যামেরুন।
আহমদ মুসা দেখল, মানিব্যাগে একটা রিসিট এবং আড়াই হাজার পাউন্ড ছাড়া আর কিছু নেই।
আহমদ মুসা মানিব্যাগটি পকেটে রাখতে রাখতে ভাবল, ক্যামেরুনে পৌঁছার আগেই আল্লাহ বড় দুটো সাহায্য করলেন। একটি হলো, ইয়াউন্ডির বেলাল মসজিদের উসমান বাহনাজ সঙ্গ-এর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ। দুই, থমাস নিকানোর সাথে পরিচিত হবার একটা মাধ্যম। এই শেষ সুযোগটি আহমদ মুসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
আহমদ মুসা বিমানে উঠল।
যাত্রীদের অধিকাংশই আফ্রিকান। আহমদ মুসার সারিতে সবাই আফ্রিকান।
লাগোস থেকে ক্যামেরুনের দুয়ালা পাকা তিন ঘণ্টার পথ।
আহমদ মুসা বিমানের সিটে বসেই আসরের নামায পড়ে নিল। নামায পড়ার আগে পাশের ভদ্রলোককে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘আমার এখন প্রার্থনার সময়, আপনার কোন অসুবিধা হবে না তো?’
ভদ্রলোকটি মধ্যবয়সী আফ্রিকান। গায়ে ইউরোপীয় পোশাক। চেহারা পরিচ্ছন্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত। আহমদ মুসার কথা শুনে বলল, ‘না, না, ওয়েলকাম, আমার কোন অসুবিধা হবে না।’
আহমদ মুসা নামায পড়ল।
তার নামায শেষ হলে ভদ্রলোকটি বলল, ‘আপনি মুসলিম?’
‘জ্বি, হ্যাঁ।’
‘কোথায় দেশ?’
‘সেন্ট্রাল এশিয়া।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘দুয়ালা। তারপর ক্যামেরুন দেখব।’
‘ওয়েলকাম।’
এ সময় বিমানের পক্ষ থেকে ঘোষণা এল, দুয়ালায় নামতে যাচ্ছি আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই। সিটবেল্ট বাঁধতে হলো সকলকে।
আহমদ মুসা সিটবেল্ট বেঁধে বলল, ‘ক্যামেরুন আপনার দেশ বুঝি?’
‘হ্যাঁ। আমি থমাস নিকানো। থাকি দুয়ালায়।’
নামটা শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ‘মানিব্যাগের নেমকার্ডে এই নামই লেখা আছে’- ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কিছু হারিয়েছেন আজ?’
প্রশ্ন শুনেই লোকটি চমকে উঠে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। মুখটা তার হঠাৎ করে মলিন হয়ে গেছে। যেন খারাপ কিছু তার মনে পড়ে গেছে।
‘হারিয়েছি। মানিব্যাগ। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে, আমার কিছু হারিয়েছে?’ বলল লোকটি।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে লোকটির দিকে তুলে ধরে বলল, ‘দেখুন, এটা কিনা।’
লোকটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। মানিব্যাগটি হাতে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমার মানিব্যাগ। অনেক ধন্যবাদ, আপনি কোথায় পেলেন?’
‘লাউঞ্জে ফেলে এসেছিলেন। ওতে কত টাকা ছিল আপনার?’
‘আড়াই হাজার পাউন্ড। কিন্তু আড়াই হাজার পাউন্ডের চেয়ে আমার কাছে মূল্যবান রশিদটা। ওটা হারালে দশলাখ টাকার একটি সম্পত্তি হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা ছিল।’
‘টাকাটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিন।’
‘ঠিক আছে।’
‘না দেখেই বলছেন কেমন করে?’
‘মানিব্যাগ ফেরত পাওয়াই এর প্রমাণ। যিনি টাকা এদিক-সেদিক করতে পারেন, তিনি মানিব্যাগ ফেরত দিতেন না।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না। থমাস নিকানোই আবার কথা বলল, ‘আপনি দুয়ালার কোথায় যাবেন? এর আগে আপনি এসেছেন ক্যামেরুনে?’
‘না, আসিনি। ঠিক করিনি। কোন হোটেল-টোটেলে উঠব।’
একটু থেমে আহমদ মুসাই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বিমান ল্যান্ড করল ঐ সময়। সবাই নামার জন্যে তোড়জোড় শুরু করল। থমাস নিকানো বলল, ‘চলুন, নামি।’
থমাস নিকানো আহমদ মুসার সাথেই বিমান থেকে নেমে এল।
তাদের কারো সাথেই লাগেজ ছিল না। ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি সারতেও কোন দেরি হলো না। লাইনেও দাঁড়াতে হলো না আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা দেখল, সর্বত্রই থমাস নিকানোর সাংঘাতিক প্রভাব। তাকে দেখে সব অফিসারই ভয় অথবা বিনয়ে মোমের মত নরম হয়ে যাচ্ছে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। তার যে সাহায্য এখন প্রয়োজন, তা এই লোকটি করতে পারবে।
ডিপারচার লাউঞ্জে এসে আহমদ মুসা বলল, ‘ক্যামেরুনের একজনের সাথে কুমেটে আমার পরিচয় হয়েছিল। কথা হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, নামটা ভুলে গেছি। আজ ভোরে দুয়ালা এসেছে। তার খোঁজ পেলে ভাল হতো।’
‘কুমেট থেকে সে ফ্লাইটে অনেকেই আসতে পারে। নাম না জানলে বের করা মুশকিল।’
আহমদ মুসা নিশ্চিত, পিয়েরে পল ও ফ্রান্সিস দু’জনেই দুয়ালা এসেছে। কিন্তু আহমদ মুসা ওদের নাম নিতে চায় না। তাছাড়া কি নামে ওদের পাসপোর্ট, সেটাও আহমদ মুসা জানে না। ওদের নামের চেয়ে আহমদ মুসার কাছে কফিন দুটোই বড়। আহমদ মুসার টার্গেট কফিন দুটো। কফিন কোথায় গেছে সেটা জানা। কিন্তু কফিনের প্রতি তার এই আগ্রহ সে প্রকাশ করতে চায় না। আহমদ মুসা ভাবল, এখন কফিনের কথা বলা যায়।
‘তার সাথে দুটো কফিন এসেছে।’
‘কফিন? তার কেউ মারা গিয়েছিল? এ জন্যেই বুঝি তার সাথে দেখা করতে চান?’
বলে একটু থামল। তারপর বলল, ‘কোন চিন্তা নেই, এখন ওদের ঠিকানা বের করা যাবে। আমি টেলিফোনে জেনে নেব সেটা। এখন চলুন।’
‘কোথায়?’
‘দুয়ালায় ভালো হোটেল আছে, সেখানে আপনি খুব ভালো থাকবেন। কিন্তু আমি খুব খুশি হতাম, যদি আপনাকে মেহমান হিসেবে পেতাম। পশ্চিমে মেহমানদারী নেই। কিন্তু অতিথিকে এখনও আমরা ভুলতে পারিনি।’
‘পশ্চিম থেকে এটা উঠে গেছে এই কারণে যে, মেহমানদারীতে কষ্ট আছে, বাড়তি ঝামেলা অনেক সময় খুবই কষ্টকর হয়।’
‘এটা অনেকটা মানসিকতার ব্যাপার। আপনাদের ধর্মে তো এটা খুবই গৌরবের। মেহমানদারী আমাদের আফ্রিকারও একটা কালচার। সুতরাং আপনি রাজি হলে খুশি হবো।’
আহমদ মুসার প্রতি থমাস নিকানোর এই আহবানটা আন্তরিক। আহমদ মুসার দুর্লভ সততা খুবই মুগ্ধ করেছে থমাস নিকানোকে। বিমানের সিটে আহমদ মুসার প্রার্থনার চিত্রটিও থমাস নিকানোর মনে পড়েছে। চার্চের ফাদারদের মতই নিষ্পাপ এবং পবিত্রতার ছাপ সে দেখেছে আহমদ মুসার চেহারায়। সব মিলিয়ে আহমদ মুসার প্রতি একটা সম্ভ্রমের ভাবও সৃষ্টি হয়েছে থমাস নিকানোর মনে।
‘ঠিক আছে। আপনাদের সবার সাথে পরিচিত হলে খুশিই হবো।’
থমাস নিকানোর গাড়ি এসেছিল তাকে নেবার জন্যে। এসেছিল থমাস নিকানোর স্ত্রী, তার মেয়ে এবং ড্রাইভার।
পরিবারটি নিগ্রো। তবে রক্তের সংমিশ্রণের কারণে তাদের কালো রংয়ে এবং দেহের গড়নে নিগ্রোদের চেয়ে অনেক ভিন্নতা এসেছে। আকার-আকৃতিতে ওরা অনেকটা ‘কালো ইউরোপীয়ান’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোশাকও তাদের ইউরোপীয়ান।
থমাস নিকানো তার স্ত্রী ও মেয়ের সাথে আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল। আহমদ মুসা যে মুসলমান এবং দয়া করে তার মেহমান হতে রাজি হয়েছেন, তাও বলে দিল।
থমাস নিকানোর স্ত্রী ও মেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল হ্যান্ডশেকের জন্যে।
‘স্যরি। মাফ করবেন। আমাদের মুসলিম কালচার এর অনুমতি দেয় না।’- কথাগুলো আহমদ মুসা বলেছিল বিনীতভাবে হাত না বাড়িয়ে।
‘ঠিক আছে। ধন্যবাদ।’ বলেছিল থমাসের স্ত্রী।
কিন্তু বিস্মিত হয়েছিল থমাসের মেয়ে। সে তো অনেক মুসলমানকে এমন হ্যান্ডশেক করতে বহুবার দেখেছে।
‘মেরী, তুমি সামনের সিটে বস। মুসা সাহেব আমাদের সাথে আসুন।’
থমাস নিকানোর মেয়ের নাম মেরী আকামি এবং স্ত্রীর নাম নিদিপা আকামি।
থমাস নিকানো গাড়িতে বসার যে ব্যবস্থা করেছে, চলমান কালচার হিসেবে সেভাবেই বসতে হয়। কিন্তু বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। এটা মুসলিম কালচার নয়।
আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে আবার বলল, ‘আমি যদি সামনে বসতে চাই!’
‘না, তার দরকার নেই। মেরীই ওখানে বসবে।’ থমাস নিকানো আহমদ মুসাকে সম্মান দেখাতে চাইল নিজের কাছে বসিয়ে।
‘আমি সামনে ভিন্ন সিটে বসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো বেশি। এটা আমার কালচার সম্মত হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
থমাস নিকানো এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। হেসে উঠল সে। বলল, ‘ভুলে গিয়েছিলাম আপনাদের পর্দার বিষয়। ওয়েলকাম। আপনি সামনে বসুন। মা মেরী, তুমি এস।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে হাসল আহমদ মুসা। সে সামনের সিটে উঠে বসল।
মেরী আকামি গিয়ে পেছনে মায়ের পাশে বসল। তার চোখে আবার সেই পুরানো বিস্ময়, ‘দুয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছেলে-মেয়ে আছে। কই, তাদের মেলামেশা, উঠাবসার কোথাও তো এই কালচার দেখি না!’
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
দুয়ালার অভিজাত এলাকায় বিরাট এলাকা জুড়ে সুন্দর বাড়ি থমাস নিকানোর। আমদানিবহুল উন্নয়নশীল দেশে ‘কাস্টমস কমিশনার’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা সাধারণত পয়সার মালিক হয়ে থাকেন।
রাত দশটা।
থমাস নিকানো মেয়ে মেরীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মা, একটু দেখে এস, মেহমান শুয়েছে কিনা। তার কোন অসুবিধা আছে কিনা।’
‘তোমার আজীব মেহমান আব্বা। এমন মুসলমান তো আমার চোখে পড়েনি।’
‘ক’জন মুসলমানই বা তুমি দেখেছ। ভাল মুসলমানরা এ রকমই হয়।’
‘কিন্তু আব্বা, সৌজন্যের খাতিরেও তো কিছু অ্যাডজাস্ট করতে হয়!’
‘কিন্তু মা, নীতির ক্ষেত্রে এই অ্যাডজাস্ট পরিণামে বড় ক্ষতিরই কারণ হয়। আমরা খৃস্টানরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই ক্ষতির শিকার হয়েছি।’
‘দেখলে তো, মাছ ছাড়া কিছুই খেলেন না। শূকর হারাম, ঠিক আছে। কিন্তু গরু ও মুরগী কোন দোষ করল?’
‘দোষ আছে মা। তাদের জন্যে হালাল কোন প্রাণীও যদি আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই না করা হয়, তাহলে তা হারাম হয়ে যায়। তারা সেটা খায় না।’
‘এটা উৎকট একটা গোঁড়ামী আব্বা।’
‘না, মা। এর পেছনে একটা বিরাট দর্শন রয়েছে। আমিও একদিন তোমার মতই মনে করতাম, তারপর মত পাল্টেছি।’
‘দর্শনটা কি?’
‘দর্শনটা হলো, দুনিয়ার সব কিছু ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বর এসব সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্যে, ঈশ্বরের দান এগুলো মানুষের জন্যে। পশু প্রাণীও তা-ই। মানুষ এগুলো হত্যা করে খায়। এ হত্যা করে খাওয়ার অধিকার ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন। জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নেয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা একদিকে এই অধিকারের কথা স্মরণ করে, অন্যদিকে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সব কিছুই যে আল্লাহর, তার নয়, সে ভোগ করছে মাত্র- এই অনুভূতিও এর মাধ্যমে তীব্র হয়।’
‘তুমিও দেখছি কম দার্শনিক নও। সত্যি আব্বা, এভাবে তো দুনিয়াকে কখনও আমি দেখিনি। ঠিক আছে আব্বা, ওদিক থেকে তাহলে আসি।’
বলে মেরী আকামি চলতে শুরু করেছে।
‘শোন মা, ওকে বলো, ওর তথ্যটা নেবার জন্যে কয়েকবার টেলিফোন করেছি। সংশ্লিষ্ট লোক নেই বলে তথ্য দিতে পারেনি। দশটায় ওরা টেলিফোন করতে বলেছে। এখনি টেলিফোন করছি।’
‘আচ্ছা বলব।’ বলে চলে গেল মেরী।
আহমদ মুসা বেড-সাইড টেবিলে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিল।
মেরী আকামি উঁকি দিয়ে এটা দেখল। কিন্তু প্রবেশ না করে দরজায় নক করল।
আহমদ মুসা উঠে এসে দরজা খুলে ধরল। মেরী আকামিকে দেখেই আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি? ওয়েলকাম। আসুন।’
আহমদ মুসা দরজা খোলা রেখেই তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এল।
মেরী আকামি দরজা বন্ধ করতে গিয়েছিল। এয়ার কন্ডিশন করা ঘরের দরজা বন্ধ রাখাই নিয়ম।
‘দরজা খোলা থাকলেই ভাল হয়।’ মেরীকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা অনেকটা অনুরোধের স্বরে।
‘কেন ভাল হয়?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটাও আমাদের একটা কালচার।’
‘দরজা খুলে রাখা? সব সময় কি দরজা খুলে রাখা যায়, না খুলে রাখা উচিত?’
আহমদ মুসা একটু গম্ভীর হলো। বলল, ‘সব সময়ের জন্যে এটা নয়। কোন মহিলা মেহমান যদি ঘরে আসেন বা কোন আগন্তুক মহিলা যদি ঘরে থাকেন, তাহলে ঘরের দরজা খুলে রাখা নিয়ম।’
কথা শুনে মেরী কিছুক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে কিছুটা গাম্ভীর্য নেমে এসেছে। বলল, ‘মিঃ মুসা, খুব বিস্ময়কর লাগছে আমার কাছে এই নিয়ম। পৃথিবীতে কোথাও কোন ধর্মে এই নিয়ম আছে বলে আমার জানা ছিল না। কিন্তু খুবই ভাল লাগছে এই নিয়ম আমার কাছে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা টেবিলের কোরআন শরীফ বন্ধ করে টেবিলের একপাশে রেখে সোফার দিকে ইংগিত করে মেরীকে বসতে বলে নিজে বসল টেবিলের চেয়ারে। বলল, ‘একটু চিন্তা করলে আমাদের সব কালচারই আপনার ভালো লাগবে।’
মেরী সোফায় বসছিল। বসে বলল, ‘জানি না। কিন্তু পর্দা নামক ‘অবরোধ’ সমর্থনযোগ্য নয় কোনক্রমেই।’
‘পর্দার প্রকৃতি, পরিমাণ, আকৃতি, আকার প্রভৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি কিছু আছে। কিন্তু নারীদেহ শোভনভাবে ঢেকে রাখা মানব-প্রকৃতির সাথে সংগতিশীল, এটা অসমর্থনযোগ্য হতে পারে না।’
‘পুরুষের দেহ ঢেকে রাখা নয় কেন? যে কারণে নারী তার দেহ ঢাকবে, সে কারণে পুরুষেরও তার দেহ ঢাকা উচিত।’
‘নারী দেহ ও পুরুষ দেহের বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। তাছাড়া আত্মরক্ষার কথা তাকেই বেশি চিন্তা করতে হয় যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা যার ক্ষতির আশংকা বেশি।’
মেরী আকামি উত্তর দিল না সংগে সংগেই। তার কপাল কুঞ্চিত হয়েছে। আবার সেই বিস্ময় তার চোখে-মুখে। ধীরে ধীরে তার মুখে একটা সলজ্জ মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি কি সাইকোলজি বা সমাজতত্ত্বের ছাত্র?’
‘কেন?’
‘উত্তরগুলোকে আপনি মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের এমন সব অলংঘনীয় যুক্তি দিয়ে সজ্জিত করেন, যার পাল্টা কিছু বলার সুযোগ থাকে না। আপনাকে আবার ধন্যবাদ। আপনি একটা বিরাট গ্রন্থকে দু’টি বাক্যের মধ্যে নিয়ে এসেছেন।’
‘কৃতিত্ব আমার নয়। এ যোগ্যতা আমাকে দিয়েছে আমার ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন।’
‘ঐটা কি পড়ছিলেন?’ টেবিলের কোরআন শরীফের দিকে ইংগিত করে বলল মেরী আকামি।
‘ওটাই কোরআন শরীফ।’
‘ধর্মগ্রন্থ সব সময় আপনি সাথে রাখেন?’
‘হ্যাঁ, সময় পেলেই পড়ি।’
‘আপনি খুব ধার্মিক। কি উদ্দেশ্যে আপনি ক্যামেরুন সফর করছেন?’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। একটু ভাবল, মিথ্যা কিভাবে এড়ানো যায়। অবশেষে বলল, ‘বিপদগ্রস্থ এক ভাইকে সাহায্য করতে এসেছি।’
‘আচ্ছা।’ বলে উঠে দাঁড়াল মেরী আকামি। বলল, ‘আব্বা জানতে পাঠিয়েছেন, সব ঠিক আছে কিনা, কোন অসুবিধা নেই তো আপনার?’
‘এত সুবিধা পেয়েছি, আমার কপাল!’
‘বিদ্রুপ করবেন না। অন্ধকার আফ্রিকার অন্ধকার ক্যামেরুনের একজন আমলার অতি সামান্য আয়োজনকে ‘এত সুবিধা’ বলছেন!’
‘বিদ্রুপ করিনি মিস মেরী। আমার জাতিকে আপনি চেনেন। অন্ধকার আফ্রিকার চেয়ে আলোকিত নয় আমার জাতি। আমি সেই জাতিরই একজন।’
‘আপনার জাতিকে আপনি খুব ভালবাসেন, তাই না?’
‘আমি জাতির মিশনকে বেশি ভালবাসি। মিশনকে ভালবাসি বলেই জাতিকে ভালবাসি।’
‘অন্য সব জাতি বা মানুষকে বাদ দিয়ে বিশেষ এক জাতিকে এরকম ভালবাসা কি সাম্প্রদায়িকতা নয়?’
‘আমি তো বলেছি মিস মেরী, জাতির মিশনের জন্যেই আমি জাতিকে ভালবাসি এবং এই মিশন আমার জাতির জন্যে শুধু নয়, পৃথিবীর গোটা মানব সমাজের মঙ্গল ও মুক্তির জন্যে। সুতরাং, আমার জাতির মিশনকে ভালবাসি অর্থ গোটা মানব সমাজকেই আমি ভালবাসি। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয়, এটা মানবতা।’
‘ চমৎকার! চমৎকার!! আপনার পেশা আমি জানি না, কিন্তু আপনার অধ্যাপনা করা প্রয়োজন ছিল। যাক, আপনি যে মিশনের কথা বললেন, তেমন মিশনের কথা তো সব জাতি প্রেমিকরাই বলতে পারে। তাহলে তো সাম্প্রদায়িকতাই আর থাকে না।’
‘সবাই বলতে পারে না মিস মেরী। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত মিশনই শুধু মানবিক হতে পারে- সব মানুষের জন্যে সমান কল্যাণকর হতে পারে।’
মেরী হাসল। বলল, ‘আমি জানি এরপর কি বলবেন। এখন আমার মনে হচ্ছে, মিশনারী হলেই আপনি সবচেয়ে ভাল করতেন। যাক, আমি চলি। গুড নাইট।’
বলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল।
মেরী যখন ফ্যামিলি ড্রইং রুমে প্রবেশ করছিল, তখন দেখল, তার আব্বা টেলিফোনের রিসিভার রাখছে ক্র্যাডলের উপর। তার মনে হলো, তার আব্বার হাত যেন কাঁপল টেলিফোন রাখার সময়। তার আব্বার মুখটাও মলিন। সেখানে ভয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন।
শংকিত হলো মেরী। তার আব্বা কি অসুস্থ হয়ে পড়লেন? তার আব্বা ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে টেলিফোন রেখে।
মেরী তার দিকে এগিয়ে বলল, ‘আব্বা, তুমি কি অসুস্থ?’
‘না মা। দেখি, তোমার মা কোথায়?’
বলে থমাস নিকানো দ্রুত বেরিয়ে গেল ড্রইং রুম থেকে।
মেরীর মনে হলো, কথা বলার সময় তার আব্বার গলা কেঁপেছে।
কেন, কি হলো তার আব্বার হঠাৎ! কোনো খারাপ সংবাদ!
মেরী ঘুরে দাঁড়াল। তার আব্বা যে পথে গেছে, সেই পথে সেও ছুটল।
মেরী ঘরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। তার আব্বা-আম্মা কথা বলছিল। মেরী ঘরে ঢোকা ঠিক মনে করল না। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল মেরী।
‘বিপদ, কি বিপদ?’ বলছিল মেরীর মা নিদিমা আকামি।
‘আজ ভোরে কুমেট থেকে বিমানে দু’টি কফিন বুক হয়ে এসেছিল। ও দুটো কফিন আমাদের মেহমানের স্বল্প পরিচিত লোকের। তার নাম ভুলে যাওয়ায় কফিনের অ্যাড্রেস দেখে সে তার ঐ বন্ধুর ঠিকানা যোগাড় করতে চেয়েছিল। সেই ঠিকানা যোগাড় করতে গিয়েই এমন বিপদ ঘটেছে।’
‘কেমন বিপদ?’
‘ও দুটো কফিন নাকি ‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর। কফিনের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়। যে অফিসারকে আমি কফিনের ঠিকানা সংগ্রহ করতে বলেছিলাম, সে তা করতে গিয়েই বিপদ সৃষ্টি হয়েছে।’
‘কিন্তু তুমি বিপদটার কথা বলছ না।’
‘বলছি। ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়া মনে করছে, তাদের শত্রুপক্ষ কফিনের খোঁজ করছে। সুতরাং, তারা এখন আমার মানে আমাদের মেহমানের সন্ধানে হন্যে হয়ে উঠেছে। অফিসারটি জানাল, ‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর লোকরা নাকি বলেছে, কফিনের যে-ই খোঁজ করুক, সে অত্যন্ত ভয়ংকর লোক। ‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’ তাকে যে কোন মূল্যে ধরবেই।’
‘কফিনের খোঁজ করায় একজন লোক ভয়ংকর হয়ে গেল কিভাবে?’
‘সেটাই তো কথা। নিশ্চয় কোন রহস্য আছে।’
‘এখন কি হবে?’
‘‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর লোকরা নাকি আমার বাড়ির ঠিকানা নিয়েছে।’
‘তারা কি এখানে আসবে?’
‘তারা আমাদের মেহমানকে ধরতে চায়। আমাদের কোন ভয় নেই। মেহমানটি এখানে কিভাবে এল সব ওরা শুনেছে।’
‘‘ওকুয়া’কে আমি চিনি। গোপন সশস্ত্র সংগঠন। খ্রিস্টান মিশনারীদের বিপদে-আপদে এরা সাহায্য করে। খ্রিস্টানদের শত্রু এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের এরা নির্মূল করে। কিন্তু ‘ব্ল্যাক ক্রস’ কি?’
‘আমিও খুব বেশি জানি না। তবে শুনলাম, ‘ওকুয়া’র মতই ওটা খ্রিস্টানদের একটা গোপন সশস্ত্র সংগঠন। তবে ‘ওকুয়া’ পশ্চিম আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ, আর ব্ল্যাক ক্রস গোটা দুনিয়াজুড়ে কাজ করছে।’
‘এখন কি করবে? ওরা কখন আসবে এদিকে? মেহমানকে সাবধান করা যায় না?’
‘যায়। কিন্তু তাতে বিপদ হবে আমাদের। অফিসার আমাকে জানাল, ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়া’র সাথে গণ্ডগোলে আমরা যেন জড়িয়ে না পড়ি। ওরা এসে যদি মেহমানকে না পায়, তাহলে আমরা তাকে পালিয়ে যেতে দিয়েছি বলে ওরা ধরে নেবে। সে ক্ষেত্রে ওদের ক্রোধ এসে পড়বে আমাদের উপর।’
‘তাহলে?’
‘সেই চিন্তাই করছি। মেহমান লোকটিকে আমার খুব ভাল মনে হয়। কোন খারাপ লোক সে হতেই পারে না।’
‘কিন্তু তাহলে ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়া’র সাথে তার বিরোধ বাঁধল কেন?’
‘ওদের বিরোধ ভাল লোকদের সাথেই বেশি বাঁধে। বিশেষ করে মেহমান মুসলমান। ক্যামেরুনে তো এখন ‘ওকুয়া’ ও ‘কোক’-এর মত খ্রিস্টান সংগঠনগুলো মুসলমানদের নাম্বার ওয়ান শত্রু মনে করে। এই দিক থেকেও আমাদের মেহমান তাদের শত্রু হতে পারেন।’
‘মেহমান ভদ্রলোক ওদের হাতে পড়লে নির্ঘাত মারা পড়বে।’
‘কিন্তু আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। ভাল লোকটি বাঁচুক আমি চাই, আবার বাঁচাবার জন্যে পালিয়েও যেতে দিতে পারছি না। কারণ, তাতে আমরা মারা পড়ব।’
‘কি সংকট ঈশ্বর আমাদের উপর চাপালেন!’
‘ভয়ানক সংকট।’
দু’জনেই নীরব এরপর। অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল মেরীর আম্মা নিদিপা আকামি। বলল, ‘আমার মনে হয়, আমরা কিছুই জানি না, এভাবে চুপ করে থাকি। যা ঘটবার তা-ই ঘটবে। মনে কর, অফিসার তোমাকে কিছুই জানায়নি।’
‘হয়তো এছাড়া আমাদের কাছে দ্বিতীয় পথ নেই। কিন্তু বিবেকের কাছে অপরাধী হবো এর ফলে।’
‘হয়তো কিছুটা হবো। তাকে বাঁচাতে গেলে আমাদের গোটা পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।’
থমাস নিকানো আর কিছু বলতে পারলো না। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে বসে থাকল।
নিদিপা আকামি তার স্বামীকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে তার কাঁধে হাত রাখল।
মেরী আকামি নিঃশব্দে সরে এল পর্দার আড়াল থেকে।
হৃদয়ে তখন ঝড় বইছে মেরী আকামির। লোকটি এভাবে জীবন দেবে ওদের হাতে? তার আব্বা-আম্মার সিদ্ধান্ত সে বুঝে ফেলেছে, ওরা চুপ করে থাকার পথ অনুসরণ করবেন। অন্য কথায়, ওরা মেহমানকে তুলে দেবেন ‘ওকুয়া’র হাতে।
মনটা বিদ্রোহ করে উঠল মেরী আকামির। মেহমান ভদ্রলোকের সাথে সে যেটুকু আলাপ করেছে তাতে বুঝেছে, লোকটা অবশ্যই ভালো লোক। জ্ঞান ও চরিত্রের অত সুন্দর সম্মিলন কোথাও তার চোখে পড়েনি। ঘরের দরজা বন্ধ রেখে একজন বেগানা মহিলার সাথে কথা বলা শোভন নয়- এমন অপরিচিত নীতিবোধ যিনি মেনে চলেন, তিনি কোন অন্যায় করতে পারেন না, কোন অপরাধী হতে পারেন না।
কিন্তু কি করবে সে? বলে দেবে কি মেহমানকে সব কথা! কিন্তু তার পরিবারের কি হবে? পরিবার যদি এই কারণে তাদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়!
কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, তার পরিবার জুলুম-নির্যাতনের শিকার হবে কি হবে না, সেটা অনেকটা অনিশ্চিত। কারণ তাদের বলা যাবে, খাওয়া-দাওয়া করেই মেহমান চলে গেছে। কিন্তু মেহমান ওদের হাতে পড়লে তার আর রক্ষা হবে না।
এসব ভেবে মেরী আকামি মেহমানকে সব কথা বলে তাকে চলে যেতে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
ধীরে ধীরে এগোলো সে আহমদ মুসার ঘরের দিকে।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার উপর একটু চাপ দিয়ে বুঝল, দরজা বন্ধ।
দরজায় টোকা দিল সে।
মুহূর্তের মধ্যেই ভেতর থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, ‘দাঁড়াও মিস মেরী, খুলে দিচ্ছি।’
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো মেরী আকামির, ‘আমি দরজায় নক করেছি, এটা বুঝল কি করে সে?’
দরজা খুলে গেল।
দরজার সামনে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
কিন্তু মেরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসার মুখভাবে পরিবর্তন ঘটল। বলল, ‘কিছু ঘটেছে মিস মেরী? আসুন, ভেতরে আসুন।’
এবারও দরজা খোলা রাখল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আগেই টেবিলের চেয়ারে বসল এবং মেরী গিয়ে বসল সেই সোফায়।
মেরীর মুখ গম্ভীর, ম্লান।
‘কিছু ঘটেছে অবশ্যই, বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার আগে বলুন, আপনি কি করে বুঝলেন, আমি দরজায় নক করেছি? নাকি জানতেন আমি আসব?’
‘জানতাম না। আপনার নক করা দেখে চিনেছি।’
‘কেমন করে?’
‘প্রথমবারও আসার সময় আপনি দরজায় নক করেছিলেন। সুতরাং, এবার নক করা শুনেই বুঝতে পেরেছি, এ আপনার নক।’
‘অদ্ভুত মানুষ আপনি। চিরদিন মনে রাখার মত একজন মানুষ আপনি।’
‘এখন বলুন, আপনি কি বলতে এসেছেন।’
‘কি করে বুঝলেন আমি কিছু বলতে এসেছি?’
‘যে কেউ আপনার মুখ দেখে এ কথা বলবে।’
‘যে কেউ নয়, আপনার মত কেউ।’
‘বলুন।’
তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না মেরী। মুখ নিচু করল সে। মুখটা আরও ম্লান হয়ে উঠেছে তার।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল মেরী। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘এই রাতে এখনি এখান থেকে আপনার চলে যেতে হবে।’
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘কফিনের ঠিকানা সন্ধান করতে গিয়ে তোমার আব্বা নিশ্চয় কিছু শুনেছেন। কি শুনেছেন?’
মেরী স্তম্ভিত হলো যে, মেরীর কথা শুনে আহমদ মুসার মুখভাবের সামান্য পরিবর্তনও হয়নি। কোন প্রশ্ন বা কোন উদ্বেগের সামান্য চিহ্নও দেখা গেল না তার মুখে। বরং ফুটে উঠল তার মুখে হাসি। যে হাসিতে দুর্ভাবনার সামান্য ক্লেদও ছিল না।
মেরী পর্দার আড়ালে তার পিতার কাছ থেকে যা শুনেছিল, সব খুলে বলল আহমদ মুসাকে। শুধু জানাল না তাদের পরিবারের বিপদের কথা এবং তার পিতা-মাতার সিদ্ধান্তের কথা। কথা শেষ করে মেরী আবার অনুরোধ করল, ‘ওরা যে কোন সময় চলে আসতে পারে। আপনার চলে যাওয়া উচিত।’
আহমদ মুসা আগেই আঁচ করেছিল, কফিনের সন্ধান নিতে গেলে শত্রুপক্ষ টের পেয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কারণ, বিমানবন্দরে ব্ল্যাক ক্রস বা ওকুয়া’র লোক অবশ্যই আছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খবরটা পিয়েরে পল পর্যন্ত পৌঁছবে, তা সে মনে করেনি। মেরীর তাকে এইভাবে সাবধান করতে আসা এবং তার আব্বা থমাস নিকানোর তাকে কিছু না বলার ব্যাপার নিয়েও ভাবল। তারপর বলল, ‘ধন্যবাদ মিস মেরী। পরিচিত এক ভাইয়ের প্রতি আপনার এই আন্তরিকতা চিরদিন আমার মনে থাকবে। কিন্তু আমার চলে যাওয়া কি ঠিক হবে?’
মেরীর লাবণ্যময় কালো মুখ এবং উজ্জ্বল দু’টি চোখে একসাথে যেন সহস্র প্রশ্ন জেগে উঠল। বলল, ‘কেন, ঠিক হবে না কেন?’
‘কারণ, যারা আমাকে ধরতে আসবে বলে ভয় করছেন, তাদের আমি চিনি। তারা আমাকে না পেলে আপনাদের দায়ী করবে।’
‘আপনি কি করে জানেন? আপনার এ ধারণা ঠিক নয়।’
‘জানি। আপনার আব্বাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। উনিও জানেন। জানেন বলেই উনি নিজের মুখে আমাকে এ খবর দিতে ভয় করেছেন।’
বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে উঠেছে মেরীর মুখ। বলল, ‘আপনার কাছে কোন কথা লুকানো নিরর্থক। কিন্তু এ বিষয়টা আপনি জানলেন কেমন করে?’
‘কারণ, ওদেরকে আমি চিনি। ওরা আপনার আব্বাকে কি বলতে পারে, এই অবস্থায় তা বোঝা কঠিন নয়। তাছাড়া আপনার আব্বা সরাসরি এ খবরটা আমাকে না দিতে পারায় বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে।’
‘যাক, সবই আপনি জানেন। আপনার চলে যাওয়া উচিত এ মুহূর্তেই।’
‘মিস মেরী, নিজের বিপদ অন্যের ঘাড়ে তুলে দিয়ে আমি চলে যাই না।’
‘কি বলছেন আপনি! ওদের হাতে পড়লে আপনার জীবন বাঁচবে না।’ আর্তকণ্ঠ মেরীর।
‘একই দশা হতে পারে আপনাদের। ওদের আপনারা চেনেন না।’
‘দেখুন, আমাদের সাথে তাদের কোন শত্রুতা নেই। আর আপনি চলে যাবার ব্যাপারে দেবার মত আমাদের যথেষ্ট যুক্তি আছে। আপনার এ দিকটা চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মিস মেরী, আপনি ওদের চেনেন না। আপনার আব্বা কিছুটা চেনেন। কিছু চেনেন বলেই উনি ভয় করেছেন তারা অসন্তুষ্ট হয় এমন কিছু করতে। সুতরাং, আপনি যান, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। পারলে দরজা লক করে যান, তারা এতে খুশি হবে।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই মিস মেরী উঠে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে অপমানের চিহ্ন। বলল, ‘আপনি আমাদের হৃদয়হীন অমানুষ মনে করছেন। মনে করছেন, আমরা আমাদের জীবন বাঁচাবার জন্যে আমাদের একজন অতিথিকে তার শত্রুর হাতে তুলে দেবার জন্যে উম্মুখ হয়ে আছি। যাচ্ছি আমি আব্বার কাছে।’ বলে মেরী খোলা দরজা পথে এক দৌঁড়ে বের হয়ে গেল। আবেগ-অভিমানে তার গলা কাঁপছিল। কথা বলার সময় ভারিও হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
মেরী ভুল বুঝলেও আহমদ মুসা অন্তর থেকেই কথাগুলো বলেছিল। আহমদ মুসার কাছে গোটা ব্যাপারটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। ব্ল্যাক ক্রস এবং ওকুয়া নিশ্চিত হয়েছে যে, ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে কফিনে করে নিয়ে আসার ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেছে এবং তাদের ফলো করা হয়েছে। এখন ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়ার প্রথম কাজ হলো, যে বা যারা ফলো করছে তাদেরকে শেষ করে তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়নকে নিষ্কণ্টক করা। সুতরাং তারা নিশ্চয় এ বাড়ির দিকে এখন ছুটে আসছে এবং এসে তাকে না পেলে তাকে পালিয়ে যেতে দেয়ার জন্যে দায়ী করবে এই পরিবারকে। সুতরাং একটা পরিবারকে ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়ার মত জঘন্য সংগঠনের রোষের মুখে তুলে দিয়ে পালিয়ে যেতে তার বিবেকে বাঁধছে। সে মনে করছে, যদি পালাতে হয় ওদের হাত থেকে পালানোই ভাল। আরেকটা বড় আশার বিষয় হলো, তাকে আহমদ মুসা বলে তারা মনে করেনি। আহমদ মুসা গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত- এটাই এখনো তাদের ধারণা। সেদিন কুমেটে ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটিতে ওমর বায়া ও ডঃ ডিফরজিসকে উদ্ধারের যে অভিযান হলো, সেটা আহমদ মুসার দ্বারা হয়েছে তা তারা বুঝতে পারেনি। সুতরাং তুলনামূলকভাবে তাদের কম সতর্কতার একটা বেনিফিট সে পাবে।
এসব চিন্তা করে শোবার জন্যে উঠে দাঁড়াল এবং দরজা বন্ধ করে এগোচ্ছিল বেডের দিকে। পেছনে দরজায় আবার সেই পরিচিত টোকার শব্দ। আহমদ মুসা বুঝল, এবার মেরী নিশ্চয় তার আব্বাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।
ফিরে গিয়ে দরজা খুলে দিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার অনুমানে দেখা গেল ভুল হয়েছে। শুধু মেরী ও তার আব্বা নয়, মেরীর আম্মাও এসেছে।
আহমদ মুসা তাদেরকে সহাস্যে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘আপনারা কষ্ট করেছেন। আমাকে ডাকলেই তো যেতাম।’
আহমদ মুসার নিশ্চিন্ত হাসির দিকে চেয়ে বিস্মিত হলো তারা তিনজনই।
মেরীর আব্বা-আম্মাকে আহমদ মুসা নিয়ে গিয়ে সোফায় বসাল এবং মেরীকে টেবিলের পাশের চেয়ারে বসতে বলে নিজে বেডের দিকে এগোলো। কিন্তু মেরী তার আগেই বেডের এক পাশে গিয়ে বসল। আহমদ মুসা ফিরে এসে বসল চেয়ারে।
‘আমরা দুঃখিত মিঃ মুসা। মেরীর কাছ থেকে আপনি সব শুনেছেন, আমরাও তার কাছ থেকে সব শুনলাম। প্রকৃতপক্ষে আমার ভুলের কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আপনি কোথায় আছেন, সে কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। অন্যভাবেও কফিনের ঠিকানা যোগাড় করা যেত।’
‘না মিঃ থমাস, আপনার কোন ভুল নয়, কফিনের ঠিকানা যোগাড় করতে গিয়েই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই ঠিকানা যোগাড়ের কথা আমিই আপনাকে বলেছিলাম। সুতরাং সংকট সৃষ্টির প্রকৃত দায়িত্ব আমার।’
‘কিন্তু মেরী ঠিকই বলেছে। আমাদের বিপদটা নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে তাদের কথা শুনে যা মনে হয়েছে, আপনাকে পেলে ওরা ছাড়বে না। সুতরাং আমাদের একান্ত অনুরোধ, আপনি অবিলম্বে স্থান পরিবর্তন করুন। আমার এক আত্মীয়কে বলে এলাম। আপনি ওখানে গিয়ে থাকবেন। মেরী আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেবে।’
থমাস নিকানো কথা শেষ করতেই মেরী উঠে দাঁড়াল। সামনে এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার। বলল, ‘আব্বার অনুরোধ আপনি না করবেন না। আপনি চলুন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ধন্যবাদ মেরী।’ বলে আহমদ মুসা ঘুরল থমাস নিকানোর দিকে। বলল, ‘মিঃ থমাস, আপনারা সংকটটাকে ছোট করে দেখছেন। আমি ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এবং ‘ওকুয়া’কে ভালো করে চিনি। আপনাদের কারণে ওদের শিকার হাতছাড়া হলে ওরা আপনাদের ছাড়বে না।’
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আপনার সব জানেন না। ব্ল্যাক ক্রস-এর প্রধান পিয়েরে পল স্বয়ং কফিন দু’টি নিয়ে এসেছেন ক্যামেরুনে অত্যন্ত গোপনে। সুতরাং, এর গোপনীয়তা লংঘন তাদের কাছে খুব বড় বিষয়।’
মেরীসহ থমাস নিকানো ও নিদিপা আকামির চোখে-মুখে নতুন উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠেছে। থমাস নিকানো বলল, ‘কফিন দু’টি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?’
‘আসলে মৃতের কোন কফিন ছিল না ওদুটো। কফিন দুটোতে দু’জন লোককে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে।’
‘দু’জন লোক? অসম্ভব। চেকিং-এর তো সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আছে কুমেটে এবং আমাদের দুয়ালাতেও।’ চোখ কপালে তুলে বলল থমাস নিকানো। তার এবং মেরী ও মেরীর মায়ের মুখ ভয়ে পাংশু হয়ে গেছে।
‘সবখানেই ওদের লোক আছে। সবাই জানে। চেকিং হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনার সাথে শত্রুতা কেন? কেনই বা আপনি কফিনের ঠিকানা চেয়েছিলেন?’
‘কফিনে যে দু’জন লোককে ওরা কিডন্যাপ করে এনেছে, ওদের আমি মুক্ত করতে চাই।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও ওরা তিনজন কেউ কথা বলতে পারল না। ওদের পাংশু মুখের বিস্ময়-দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখে নিবদ্ধ।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল থমাস নিকানো। বলল, ‘‘ব্ল্যাক ক্রস’ ও ‘ওকুয়া’র বিরুদ্ধে লড়াই করবেন? আপনি? একা?’
‘প্রয়োজন একাকীত্ব কিংবা অসম্ভাব্যতা কিছুরই তোয়াক্কা করে না।’
‘ওদের যদি উদ্ধার করতেই এসে থাকেন, তাহলে ওদের হাতে ধরা দিতে চাচ্ছেন কেন? সরে যেতে রাজি হচ্ছেন না কেন?’
‘সরে যাচ্ছি না। কিন্তু ওদের হাতে ধরা দেব তা বলিনি।’
আহমদ মুসার কথায় এবং তার নির্বিকার-নিশ্চিন্ত চেহারা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল ওরা তিনজন। ভাবল তারা, বিপদ তাদের হতে পারে, কিন্তু ওর দিকে বিপদ ধেয়ে আসছে, সাংঘাতিক বিপদ। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার কিছুই ঘটেনি। কিছুই ঘটবে না। আশ্চর্য কঠিন নার্ভের মানুষ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল থমাস নিকানো। এ সময় গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ এল গাড়ি বারান্দা থেকে। এবং তারপরই পাওয়া গেল অনেকগুলো পায়ের দ্রুত এগিয়ে আসার শব্দ।
‘ওরা এসেছে মিঃ থমাস।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে না হতেই ভয়ালমূর্তি নিয়ে চারজন এসে দাঁড়াল ঘরের দরজায়।
দু’জনের হাতে স্টেনগান এবং দু’জনের হাতে রিভলভার। সবগুলোই তাক করা আহমদ মুসার দিকে।
মিঃ থমাস, তার স্ত্রী নিদিপা আকামি এবং মেয়ে মেরী আকামি সকলের চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। মেরী গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে তার মাকে।
চারজন ওরা ঘরে ঢুকল। ঘিরে দাঁড়াল এসে আহমদ মুসাকে। স্টেনগানধারী দু’জন আহমদ মুসার দু’পাশে এবং রিভলভারধারী দু’জন সামনে।
মেরীদের ভয়ার্ত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু তারা দেখল, আহমদ মুসা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র, তার মুখে সামান্য কোন ভাবান্তরও নেই। শেষ কথাটি বলার সময় তার ঠোঁটে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, সে হাসি তার মুখে এখনও লেগেই আছে।
রিভলভারধারীদের একজন এসে আহমদ মুসার পকেট ও দেহ পরীক্ষা করল, কোথাও কোন অস্ত্র লুকানো আছে কিনা। কিছু পেল না।
তারপর সে থমাস নিকানোর দিকে চেয়ে বলল, ‘এ শয়তান যে পালাবার সুযোগ পায়নি, এ জন্যে ধন্যবাদ স্যার।’
কথা বলেই ঘুরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘চল শয়তানের বেটা শয়তান। বস তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন তুমি যে কফিনের সন্ধান করছিলে সেই কফিন নিয়ে। তোমাকে একদম স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে।’
‘স্বর্গ বোধহয় তোমাদের বসের একদম হাতের মুঠোয়?’ সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল আহমদ মুসা। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
আহমদ মুসার কথা শুনে বিস্ময়ের সীমা থাকল না মেরীদের। আহমদ মুসা যেন বন্ধুদের সাথে রসিকতা করছে! মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এ কি কাণ্ড তার!
রিভলভারধারীদের একজন থমকে দাঁড়াল। প্রায় মুখোমুখি হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘বিদ্রুপ করছ আমাদের। কিন্তু বস-এর শিকারে আমরা সহজে হাত দেই না।’
বলে সামনে ফিরে আবার সে হাঁটতে শুরু করল।
স্টেনগানধারী দু’জন তার পাশাপাশি হাঁটছে। আর রিভলভারধারী দু’জন তার সামনে। ঘর থেকে তারা বেরিয়ে এল।
মেরীরাও উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল। মেরীরাও পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল।
ওদের চারজনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসা ওদের একটা অ্যাসেসমেন্ট করে ফেলল। চারজনের দু’জন ব্ল্যাক আফ্রিকান এবং রিভলভারধারী দু’জন সাদা ইউরোপীয়ান। দ্বিতীয়ত, আহমদ মুসা বুঝল, এরা ব্ল্যাক ক্রসের লোক নয়। এদের শক্তির তুলনায় বুদ্ধি কম। তৃতীয়ত, আহমদ মুসার সাথে ওদের হাঁটা দেখে বুঝল, ওরা যথেষ্ট সতর্ক নয়। স্টেনগানধারী দু’জন তার সমান্তরালে হাঁটার সময় মাঝে মাঝেই ওদের স্টেনগানের ব্যারেল নিচে নেমে যাচ্ছে।
থমাস নিকানোর বিশাল ড্রইং রুম থেকে বাইরে বেরুলে একটা প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি পেরিয়ে গাড়ি বারান্দায় নামতে হয়।
আহমদ মুসারা এ সিঁড়ির প্রান্ত পর্যন্ত এসেছে। রিভলভারধারী দু’জন গাড়ি বারান্দায় নেমে গেছে। আহমদ মুসা এবং তার দু’পাশের স্টেনগানধারী দু’জন সিঁড়ির প্রথম ধাপে নামার জন্যে পা বাড়াতে যাচ্ছে। তারা দু’জন সিঁড়ির প্রথম ধাপে নামার জন্যে সামনের দিকে একটু ঝুঁকেছে। ওদের স্টেনগানের ব্যারেলও অনেকখানি নিচে নেমেছে। বামদিকের লোকটির ডান হাতের স্টেনগান আহমদ মুসার বাম হাতের নাগালের মধ্যে।
আহমদ মুসা তার ডান পাশের লোকটির পা ফেলার দিকে লক্ষ্য রেখে নিখুঁত হিসেব করে পা ফেলছিল। ডান পাশের স্টেনগানধারী যখন তার বাম পা টা নামিয়ে দিচ্ছিল সিঁড়িতে, আহমদ মুসা তার ডান পা একটু ডান দিকে বাড়িয়ে এগিয়ে দিল তার বাম পায়ের সামনে। আহমদ মুসার বাড়িয়ে দেয়া ডান পায়ের সাথে ডান পাশের স্টেনগানধারীর বাম পা মৃদু একটু ধাক্কা খেল এবং সংগে সংগেই লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল গাড়ি বারান্দার উপর। তার দু’পা থাকল সিঁড়ির উপর।
আহমদ মুসা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি। ডান পাশেরজন যখন পড়ে যাচ্ছিল, তখন বাম পাশের স্টেনগানধারী চমকে উঠে বোঝার চেষ্টা করছিল। আহমদ মুসা ততক্ষণে তার বাম হাত দিয়ে কেড়ে নিল তার স্টেনগান এবং বাম পা দিয়ে লোকটির বাম হাঁটুর পেছন দিকে একটা শক্ত কিক চালাল। সেও উল্টে পড়ে গেল সিঁড়ির উপর। তারপর গড়িয়ে পড়ল গাড়ি বারান্দায়।
আহমদ মুসা এক ধাপ পেছনে সরে এসে স্টেনগান তাক করল রিভলভারধারী দু’জনের দিকে। পেছনে শব্দ শুনে ওরা ফিরে দাঁড়াচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘যে যেভাবে আছ, সেইভাবে থাক। একটু সরার চেষ্টা করলে সবাই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।’
পড়ে যাওয়া দু’জন উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তারা আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে আর উঠার চেষ্টা করল না। রিভলভারধারী দু’জন আর ঘুরে দাঁড়াল না। কিন্তু রিভলভার ফেলে দিল না। আহমদ মুসা বলল, ‘দেখ, আমি দু’বার নির্দেশ দেই না, অহেতুক হত্যাও আমি পছন্দ করি না। রিভলভার ফেলে দাও।’
ওরা নির্দেশ পালন করল। ফেলে দিল তাদের রিভলভার।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দায় নেমে এল। রিভলভারধারীদের একজনকে তার জামা খুলে ফেলতে বলল। জামা খোলার পর জামা ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ফেলতে বলল। ছেঁড়া হলে তিনজনকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিল। তিনজনকে বাঁধা হয়ে যাবার পর চতুর্থজনকে আহমদ মুসা বাঁধল।
ড্রইং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে মেরীরা তিনজন অবাক-বিস্ময়ে আহমদ মুসার কাজ দেখছিল। মনে হচ্ছিল তাদের, তারা যেন সিনেমার কোন দৃশ্য দেখছিল। দু’চোখকে তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না।
বেঁধে ফেলার পর উঠে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা তোমাদের নেতা পিয়েরে পল ও ফ্রান্সিস বাইককে বলো, জুলুমের একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রম করলে জুলুম জালেমকেই গিয়ে ঘিরে ধরে। সেদিন তাদের আসছে।’
বলে আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকাল মেরীদের দিকে। কোন কথা বলল না। হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল।
হতভম্ব মেরীরা আহমদ মুসার জবাবে হাতও নাড়তে পারল না।
আহমদ মুসা গাড়ি চালিয়ে চলে গেলে মেরীর আব্বা থমাস নিকানো বলল, ‘চল যাই, আমরা ওদের খুলে দেই, না হলে আমরা দোষে পড়ব।’
থমাস নিকানো এসে সকলের বাঁধন খুলে দিল। ওরা মুক্ত হয়েই থমাসকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে যে যার অস্ত্র নিয়ে ছুটল গাড়ি যেদিকে গেছে সেদিকে।
ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে তাকিয়ে ছিল থমাস নিকানো।
মেরী ও তার মা তার পাশে এসে দাঁড়াল।
‘আব্বা, অতিথি তার ব্যাগ-পত্র রেখে গেছে।’
‘নিয়ে যাবার সময় পায়নি। যাও, ওগুলো নিয়ে এস। ভালো করে রেখে দিতে হবে।’
মেরী ছুটল আহমদ মুসার ঘরের দিকে। থমাসরাও ফিরে এল তার ঘরের দিকে।
মেরী আহমদ মুসার কোরআন ও ব্যাগ নিয়ে এল তার আব্বার কাছে।
‘লোকটি কে সেটাই জানা গেল না।’ বলল থমাস।
‘যেই হোক, ভাল মানুষ আব্বা।’
‘শুধু ভালো মানুষ নয়, কোন বড় কেউ মা। তার আত্মবিশ্বাসটা দেখেছ! চারজন অস্ত্রধারীর চার অস্ত্রের মুখে তার চেহারায় ভয়ের কোন ছায়া পড়েনি। তারপর দেখ, চারজনকে কেমন পুতুলের মত কাবু করে চলে গেল।’
‘এতটুকু বয়সে কত দূরদৃষ্টি, কত বিবেচনা দেখ। আমাদের বিপদ হতে পারে ভেবে নিজেকেই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিল। এমন মানুষ দুনিয়াতে খুব কম দেখা যায়।’ বলল মেরীর মা।
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
মেরী গিয়ে টেলিফোন ধরল।
‘হ্যালো, কে?’ বলল মেরী।
‘আমি। হতভাগ্য অতিথি। আপনাদের কোন অসুবিধা হয়নি তো?’
‘না, কোন অসুবিধা হয়নি। আপনি ভাল আছেন?’
‘আল্লাহ ভাল রেখেছেন। আজ যে কোন সময় গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসব।’
‘আমাদের সকলের একটা প্রশ্ন।’
‘কি প্রশ্ন?’
‘আপনি আসলে কে?’
‘আমি মানুষ।’
‘আমাদের মত কোন মানুষ নয় তা আমরা দেখলাম। বিশেষ মানুষ। সুতরাং…।’
‘সুতরাং, আমি কে জানতে চান। বলব। টেলিফোনে নয়। আসি। শুভরাত্রি।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল আহমদ মুসা।
মেরী টেলিফোন রাখতেই তার আব্বা থমাস নিকানো বলল, ‘নিশ্চয় আমাদের অতিথি? পরিচয় কিছু বলল?’
‘না, আব্বা। বললেন, টেলিফোনে বলা যাবে না।’
‘ব্যাগের কথা কি বলল?’
‘ব্যাগ নিতে আসবে।’
টেলিফোন বেজে উঠল আবার।
এবার টেলিফোন ধরল থমাস নিকানো।
‘হ্যালো। কে?’
‘চিনবেন না। আমাদের নেতার তরফ থেকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে টেলিফোন করেছি।’
‘কিসের জন্যে?’
‘যদিও সে ভয়ানক শত্রুকে আমাদের লোকেরা ধরে রাখতে পারেনি, তবু এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য আমাদের খুশি করেছে।’
‘ও, বুঝেছি। সে শত্রুটি কে?’
‘আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে তাকে আহমদ মুসা বলে। কারণ, সে ছাড়া এমন ঠাণ্ডা মাথার, এমন ভয়ানক, এমন অপ্রতিরোধ্য, আবার সেই সাথে এমন হিসেবী আর কেউ হতে পারে না।’
‘‘হিসেবী’ অর্থ?’
‘অহেতুক খুন-জখম থেকে সে সব সময় বিরত থাকে। আপনাদের ঐখানে আমাদের চারজন লোককেই তার খুন করা উচিত ছিল তার মিশন অনুসারে, কিন্তু তা সে করেনি। আচ্ছা রাখি।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল ওপার থেকে।
ওপার থেকে টেলিফোন রাখলেও থমাস নিকানো টেলিফোন রাখতে যেন ভুলে গেল। তার কানে বাজছে তখনো আহমদ মুসার নাম এবং তার সম্পর্কে কথাগুলো।
মেরী তার আব্বার হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে বলল, ‘কি শুনলে আব্বা, কোন দুঃসংবাদ?’
‘না, মা।’ বলে থমাস নিকানো সোফায় বসে যা শুনল সব কথা ওদের জানাল এবং বলল, ‘বিশ্বজোড়া নামের বিপ্লবী পুরুষ আহমদ মুসা আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন?’
মেরী এবং তার মা’র মুখে কোন কথা যোগাল না। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না তারা। অপার বিস্ময়ের খেলা তাদের চোখে-মুখে।
অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে মুখ খুললো মেরী। বলল, ‘তিনি আহমদ মুসা হলেই শুধু তার কথা, তার আচরণ, তার ধার্মিকতা, তার মানবিকতা, তার ক্ষিপ্রতা, তার সাহস ইত্যাদির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আব্বা।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে আহমদ মুসার সাথে তার কথা বলার সময়কার দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক সুখ স্বপ্নের মত।
মনে হলো তার, এ দুর্লভ সুখ স্বপ্ন যদি তার না ভাঙত!

Top