২২. অদৃশ্য আতঙ্ক

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার সামনে বড় একটি টেবিল। টেবিলের তিন দিক ঘিরে আরও চারজন।
জেনেভায় ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী (WNA)-এর অফিস।
আহমদ মুসা এসে জেনেভার একটি ট্যুরিস্ট বাংলোতে উঠেছে।
WNA এবং FWTV-এর সবাই তাকে তাদের গেস্ট হাউজে ওঠার জন্যে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ দু’টি সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ঠিক মনে করেছিল। সম্পূর্ণ তৃতীয় অবস্থানে থেকে সে ঘটনার উপর দৃষ্টি রাখতে চায়।
আহমদ মুসার সামনে বসেছিল WNA এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান এবং সংস্থা দু’টির চীফ এডিটর।
খুব অভিনিবেশ সহকারে আহমদ মুসা কাগজগুলোর উপর নজর বুলাচ্ছিল।
কাগজগুলি দু’টি সংস্থার রহস্যজনক মৃত্যুর পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট ল্যাবরেটরি পরীক্ষার রিপোর্ট এবং পুলিশ রিপোর্ট।
পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বেদনাহীন ও যন্ত্রনাহীন এ ধরনের বিষের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছে। বলেছে, ঐ বিষ দেহে প্রবেশের তিন ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে। মৃত দেহের ব্যাপক পরীক্ষা করে যেখান থেকে বিষ গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই উৎসে গিয়ে ম্যাক্রো-মাইক্রোস্কপিক পরীক্ষায় অত্যন্ত সুক্ষ আঘাত পাওয়া গেছে, যা সুক্ষ ও জীবন্ত কিছুর আঘাতে সৃষ্টি।
আর ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় বিষয়টিকে বিশেষ ধরনের সিসি মাছির বিষ বলে চিহ্নিত হয়েছে। ল্যাবরেটরি রিপোর্টেও বিষের প্রকৃতি কে বেদনাহীন, যন্ত্রনাহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিষের এই প্রকৃতির কথা পড়তে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। পৃথিবীর বিষাক্ততম প্রানী ‘বক্স জেলিফিশ’-এর বিষও বেদনাহীন, যন্ত্রনাহীন! এ বিষের কোন কারসাজী কি আছে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাবলীর মধ্যে। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা জাগল আহমদ মুসার মনে, ল্যাবরেটরি তো বিষকে সিসি মাছির বলে চিহ্নিত করেছে। তাছাড়া বক্স জেলিফিশের বিষে তো মাত্র কয়েক মিনিট আক্রান্তেই মৃত্যু হয়। চিন্তার কোন খেই মিলল না আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা কাগজগুলো থেকে চোখ উঠিয়ে চেয়ারে হেলান দিল। চোখ দু’টি বুজে এল তার। যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আহমদ মুসা।
-কি ভাবছেন, মিঃ আহমদ মুসা? বলল, FWTVএর চেয়ারম্যান বি, জারমিস(বাকের জারমিস)।
-ভাবছি কিন্তু কোন কিনারা পাচ্ছিনা। বলল, আহমদ মুসা।
-কাগজপত্র দেখে কি বুঝলেন? বলল, WNAএর চেয়ারম্যান জি, গটেফ (জামাল গটেফ)।
-কাগজ পত্র থেকে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার অজানা এক ধরনের সিসি মাছির কামড় থেকে উদ্ভুত বিষে তাদের মৃত্যু হয়েছে!
-সবারই তাই বিশ্বাস। বলল, মিঃ জারমিস।
-আপনারা কি মনে করছেন?
-পুলিশ এবং বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা মেনে না নেবার পেছনে কোন যুক্তি আমরা পাচ্ছিনা। বলল, মিঃ জারমিস।
‘কিন্তু মাছি শুধু WNA এবং FWTV এই দুই প্রতিষ্ঠানে আক্রমন চালাচ্ছে কেন?’ বলল, আহমদ মুসা।
-এটাই আমাদের কাছে রহস্য। এই রহস্যের কোন সমাধান আমরা পাচ্ছি না। বলল, মিঃ গটেফ।
-পুলিশের বক্তব্য কি এ ব্যাপারে? বলল, আহমদ মুসা।
-পুলিশ একে ‘কো-ইন্সিডেন্স’ বলছে এবং সন্দেহ করছে যে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোথাও সিসি মাছি এসে বাসা বেঁধেছে। তারা বলছে, যেহেতু ছুটিতে থাকা কারও মৃত্যু এ পর্যন্ত ঘটেনি এবং যারা মরেছে, তারা সবাই অফিস থেকে যাবার নির্দিষ্ট সময় পরে, সুতরাং অফিসেই তারা সিসি মাছির কামড় খেয়েছে। বলল, মিঃ জারমিস।
-তার মানে সন্দেহ করছে আপনাদের উপর?
‘কতকটা তাই।’ বলল, মিঃ গটেফ।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। চোখ বুজে আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
টেবিল ঘিরে অন্যান্য সকলে। সকলের মাথা নিচু। ভাবছে সবাই।
অল্পক্ষণ প আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমার কাছে মৃত্যুগুলোর চাইতে সবগুলো ঘটনা এই দুই প্রতিষ্ঠানে ঘটার ব্যাপারটাই বেশী বিস্ময়কর। এই রহস্যের সমাধান হলে মৃত্যু রহস্যেরও সমাধান হয়ে যাবে।’
-তার মানে মৃত্যুগুলো এই দুই প্রতিষ্ঠানে ঘটার মধ্যেই বড় রহস্য লুকিয়ে আছে বলে আপনি মনে করছেন? বলল, মিঃ গটেফ।
-হ্যাঁ তাই। আমি একে কো-ইন্সিডেন্স বলে মনে করিনা।
-তার মানে একে পরিকল্পিত বলে মনে করেন? বলল, মিঃ গটেফ।
-তাই মনে করি।
-তার মানে কেউ উদ্দ্যেশ্যমুলক ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে? বলল, মিঃ গটেফ।
মিঃ গটেফ, মিঃ জারমিস এবং wna-এর চীফ এডিটর হাসান আলবার্তো- সকলেরই মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠল আতংক।
-কিন্তু মৃত্যুগুলোর কারণ যদি বিষাক্ত সিসি মাছির কামড় হয়, তাহলে এটা পরিকল্পিত হওয়া কিভাবে সম্ভব? শুকনো কণ্ঠে বলল, হাসান আলবার্তো।
-এ রহস্যের সমাধান আমার কাছে নেই, তবে আমার মন এ ব্যাপারে দ্বিধাহীন যে, ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। আহমদ মুসা বলল।
মিঃ জামাল গটেফের সেলুলার টেলিফোন সংকেত দিয়ে উঠল।
টেলিফোন ধরল মিঃ গটেফ।
ওপারের কিছু কথা শুনেই ‘কি বলছ তুমি’ বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল মিঃ জারমিস। তার চোখ-মুখ মৃতের মত পান্ডুর হয়ে উঠল মুহূর্তে।
সবশুনে টেলিফোন ক্লোজ করে গুটিয়ে রেখে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলল, ‘আমাদের এ্যাসোসিয়েট এডিটর ওমর ফার্ডিনেন্ড মেয়ার একই ভাবে মারা গেছে।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মিঃ গটেফ।
যেন বজ্রপাত হল টেবিলটার উপর। পাথরের মত স্থির দৃষ্টি শুন্যে নিবদ্ধ।
কথা বলল আহমদ মুসা, ‘কোথায় তার মৃত্যু হয়েছে?’
-তার বাড়িতে। বলল, মিঃ গটেফ।
-ক’টায়?
-রাত ১১ টায়। সন্ধ্যে ৭ টায় অফিস থেকে ফেরে।
একটু থেমেই মিঃ গটেফ বলল, ‘শুনলাম সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় WNA কয়েকদিন বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে।’
ভ্রু কুঞ্চিত হল আহমদ মুসার। বলল, ‘কখন তারা এ অনুরোধ করেছে?’
‘মৃত্যুর খবর তারা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই। আমি টেলিফোন পাবার একটু আগেই একটা ফ্যাক্স মেসেজ এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে।’
মিঃ জারমিসের কথা শেষ হতেই মিঃ জারমিস-এর পি,এ কক্ষটির দরজায় এসে দাঁড়াল। অনুমতি চাইল কক্ষে প্রবেশের। তার হাতে এক খন্ড কাগজ।
মিঃ জারমিস তাকে ডাকল।
সে এসে কাগজখন্ডটি মিঃ জারমিসের হাতে তুলে দিল।
মিঃ জারমিস তাতে দ্রুত চোখ বুলাল। তারপর কাগজ খণ্ডটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে। আহমদ মুসা দেখল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে চিঠিটা লিখেছেন জেনেভার পুলিশ কমিশনার। পড়ল আহমদ মুসা। যার সারাংশ হল “ঘটনাবলী থেকে দেখা যাচ্ছে সিসি মাছির আক্রমন WNA এবং FWTV এই দুই অফিসকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হচ্ছে। আজও আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকদের নিরাপত্তার স্বার্থে অফিস দু’টি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা উচিত বলে মনে করছি। আশা করি আপনারাও একমত হবেন। পুলিশ ঘটনাবলীর তদন্ত করছে। আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই রহস্যের কিনারা করা যাবে”।
আহমদ মুসা চিঠিটি মিঃ গটেফের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখুন, সম্ভবত এই চিঠিটা আপনারাও পেয়েছেন।’
মিঃ গটেফ চিঠিটা পড়ল। পড়ল WNA এবং FWTVএর দুই চীফ এডিটরও।
-চিঠি দেখেছেন, এখন বলুন করণীয় কি? বলল, মিঃল গটেফ।
-আপনারা কি করতে চান?
মিঃ গটেফ মিঃ জারমিসের দিকে একবার চাইল। তারপর একটু ভাবল। বলল ধীরে ধীরে, ‘পুলিশ কমিশনার যে যুক্তি দিয়েছেন তার সাথে আমি একমত। সাময়িক বন্ধ করে দিয়ে যদি এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু এড়ানো যায়, তাহলে বন্ধ করাই প্রয়োজন।’
আহমদ মুসা তাকাল মিঃ জারমিসের দিকে।
মিঃ জারমিসও ভাবছিল। বলল, ‘আমারও মত তাই, কর্মরত লোকজনদের নিরাপত্তাকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
‘সাংবাদিক কর্মচারীদের মত কি হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত অগ্রহনযোগ্য হলেও বিশেষ অবস্থায় সাময়িক ভাবে সাংবাদিক কর্মচারীরা তা মেনে নিতে পারে। কারণ সংকটের কোন রিমোর্ট তাদের হাতে নেই।’ বলল, হাসান আলবার্তো, WNA-এর চীফ এডিটর।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষনেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘আর পুলিশের এ অনুরোধ উপেক্ষা করে যদি প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়, তাহলে সাংবাদিক কর্মচারীরা কাজ করবে কি?’
ওরা চারজনই নীরব। একটু পর মুখ খুলল FWTV-এর চীফ এডিটর কামাল কনরাও। বলল, ‘কাজ তারা অবশ্যই করবে, কিন্তু এতবড় ঝুঁকি নেয়া আমাদের ঠিক হবে না। বিশেষ করে পুলিশের অনুরোধের পর।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কথা বলল না। একটু পর ধীরে ধীরে বলল আহমদ মুসা, ‘আপনাদের কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমি ভাবছি, প্রতিষ্ঠান দু’টো বন্ধ করে দিলে শত্রুর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়, তাদের বরং সাহায্যই করা হয়।’
‘কিভাবে? শত্রু কে?’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল মিঃ গটেফ এবং মিঃ জারমিস।
-শত্রুর নাম পরিচয়কে এখনও আমি চিহ্নিত করতে পারিনি। তবে আমি নিশ্চিত, এ দু’টি সংবাদ মাধ্যম যাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত দিচ্ছে, তাদেরই কেউ এই শত্রু। তারা চাচ্ছে এ দু’টি সংবাদ মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাক। এই হত্যাকান্ডগুলো মনে হচ্ছে সেই লক্ষ্যেই। বলল, আহমদ মুসা।
‘এই মৃত্যুগুলোকে আপনি হত্যাকাণ্ড মনে করেন? সত্যিই আপনি মনে করেন যে, আমাদের দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার জন্যে কেউ হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে?’ দু’টি চোখ কপালে তুলে বলল মিঃ গটেফ।
অন্য সবারই চোখে ফুটে উঠেছে নতুন আতংকের ছাপ।
‘আমি জানি, আপনারা সিসি মাছি পোষেন না। তাহলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের লোক তথাকথিত সিসি মাছির কামড়ে মরবে কেন? আমি মনে করি সিসি মাছি এই দুটি সংবাদ মাধ্যমের শত্রু নয়। তাহলে তারা এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের উপর চড়াও হবে কেন? সুতরাং সিসি মাছি হোক বা অন্য কিছু- এদেরকে কেউ ব্যবহার করছে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।’ আহমদ মুসা বলল।
সবাই নীরব। সবার চোখে বিস্ময়।
নীরবতা ভাঙল মিঃ জারমিস। বলল, ‘আমরা এভাবে তো চিন্তা করিনি। এখন মনে হচ্ছে আপনার কথা ঠিক।’
‘আমারও এরকমই মনে হচ্ছে। তবে সে রকম কিছু যদি হয়, তাহলে হত্যাকান্ড এভাবে ঘটবে কেন?’
‘সেটা আমি জানিনা। তবে আমার মনে হয়, হত্যাকারীরা রহস্য সৃষ্টি করে আড়ালে থাকতে চায়।’ বললআহমদ মুসা।
সবাই আবার নীরব। সবাই ভাবছে।
সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ-আতংকের ছাপ।
-আমরা এখন কি করব? পুলিশকে কি এসব কথা আমরা বলব?
‘পুলিশ কি করবে? তারা রহস্য উদঘাটনের তো চেষ্টা করছেই। বাড়তি কোন সাহায্য তাদের কাছে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। তারা বরং আরো বেশী করে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠান দু’টি বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি দেবে।’
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয়?’
‘প্রতিষ্ঠান দু’টি খোলা থাকবে। যেভাবে কাজ চলছিল সেভাবে কাজ চলবে।’
‘কিন্তু আবার যদি কিছু ঘটে?’ বলল, মিঃ গটেফ।
-কিন্তু বন্ধ করলে আর খোলার সাহস পাওয়া যাবেনা। কারণ খোলার পর আবার হত্যাকান্ড শুরু হবে, এ ভয় সব সময় তাড়া করে ফিরবে। আর সে ভয় উপেক্ষা করে খুললেও আবার সেই হত্যাকান্ডই শুরু হতে পারে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রহস্যের উন্মোচন করা যাবে না, শত্রুর পরিচয় অজানাই থেকে যাবে।
‘আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। আপনার কথাগুলো দৈববাণীর মত মনে হচ্ছে। আমরা জীবন দিয়ে হলেও প্রতিষ্ঠান দু’টোখুলে রাখবো।’ আবেগঘন কণ্ঠে বলল হাসান আলবার্তো।
আলবার্তো থামতেই WNA-এর চেয়ারম্যান জামাল গটেফ এবং FWTV-এর চেয়ারম্যান বাকের জারমিস এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘আলবার্তোর সাথে আমরা একমত। আমাদের জীবনের চেয়ে মুল্যবান সংবাদ সংস্থা দু’টিকে আমরা বন্ধ হতে দেবনা, শত্রুদের ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেবনা।’ এতক্ষনের ভয় আতংক কেটে গিয়ে তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষন নীরবতা।
গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত আহমদ মুসা। তার মাথাটা ঈষৎ নুয়ে পড়ল।
একটু পর মাথা তুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমরা ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু এর বিকল্প নেই। শত্রুকে চিহ্নিত করা ছাড়া আমাদের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সংবাদ সংস্থা দুটিকে বাঁচানো যাবে না। কিছু কোরবানি দিয়ে হলেও আমাদেরকে সমাধানে পৌছতে হবে।’ ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘কিছু মনে করবেন না, এটা শত্রুর ষড়যন্ত্র এ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত?’ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল হাসান আলবার্তো।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমি বলছি আমার বিবেচনা থেকে। সত্য অন্য কিছুও হতে পারে। নিশ্চিত ব্যাপারটা আল্লাহই জানেন।’ আহমদ মুসা থামল।
কিন্তু কেউ কথা বলল না।
নীরবতা ভেঙে কথা বলল মিঃ গটেফ। বলল, ‘আমরা এত দিন একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। আপনি আমাদের আলোতে নিয়ে এসেছেন। সংকটকালে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার মুসলমানরা আপনার সাহায্য পেয়ে ধন্য হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের মুসলমানরা আপনার মেহেরবানী থেকে বঞ্চিত হবেনা। নরম ও সশ্রদ্ধ কণ্ঠ মিঃ গটেফের।
‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী এবং ফ্রী ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন তো তাঁরও প্রতিষ্ঠান। বলল FWTV-এর চীফ এডিটর কনরাত।
‘এ প্রতিষ্ঠান দু’টি বিশ্বের সব মুসলমানের। আমি তাদেরই একজন মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের বিপদ দেখে তো সব মুসলমান ছুটে আসেনি, আপনি এসেছেন।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সব দায়িত্ব সবার জন্য নয়।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার সংস্থার সিনিয়র সদস্যরা সবাই কি গাড়িতে যাতায়াত করেন?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘আপনাদের কার পার্কে বাইরের কেউ কার পার্ক করে?’
‘না করে না। তবে যারা আমাদের অফিসে আসেন, তারা তো অবশ্যই করবেন।’
‘দেখলাম, আপনাদের অফিসে প্রবেশ রেস্ট্রিকটেড। কিন্তু বাইরের কেউ ঢুকেই না বলে মনে করেন?’
‘সংবাদ সংক্রান্ত ব্যাপারে যারা আসেন, তাড়া রিসেপশনের নিউজ কাউন্টার পর্যন্ত আসতে পারেন। তার বেশী নয়। আর অর্থ বা প্রশাসনিক কোন ব্যাপারে যারা আসেন, তারাই শুধু তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার পর প্রশাসন বিভাগে যেতে পারেন। সে যাওয়াটাও স্বাধীনভাবে নয়। সংশ্লিষ্ট অফিসার এসে তাকে নিয়ে যান এবং আবার রিসেপশনে রেখে যান। বলল, মিঃ গটেফ।
‘নিউজের স্টাফদের কোন মেহমান বা পরিচিত জোন যদি আসেন?’
‘সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা হল, রিসেপশনের গেস্টরুমে তাদের বসানো হয়। সেখানেই এসে সংশ্লিষ্ট নিউজ স্টাফ তাদের সাথে কথা বলেন।’
‘এডিটর, নিউজ এডিটর পর্যায়ের কারও কাছে যদি আসে?
-তাদের ক্ষেত্রেও ঐ একই ব্যাবস্থা।
-তার মানে নিউজ ও ট্রান্সমিশন ডিপার্টমেন্টে বাইরের কেউই প্রবেশ করেনা?’
‘হ্যাঁ তাই।’
আহমদ মুসা কিছু বলল না।
তার শুন্য দৃষ্টি সামনের দেয়ালের দিকে নিবদ্ধ। ভাবছিল সে।
‘FWTV-এর কথা জিজ্ঞেস করবেন না?’ নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ জারমিস।
‘FWTV-এর কথা পরে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন?’
‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে তথাকথিত সিসি মাছির আক্রমন WNA-এর উপরই আবার হবে।’
‘ WNA-এর উপর?’ মিঃ গটেফ অনেকটা আর্তনাদ করে বলে উঠল।
সকলের মুখেই এবার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। একটা নীরবতা নেমে এল।
‘আপনার অনুমানের কারণ?’ নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ জারমিস।
‘তথাকথিত সিসি মাছিকে খুব হিসেবি মনে হচ্ছে। সংখ্যা সমতা রক্ষার জন্যে এবার আক্রমন WNA-এর উপর হবার কথা।’
আহমদ মুসার এই কথা আবার যেন একটা ভয় ছড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা থামলে আবার একটা নীরবতা নেমে এল।
একটু পর হাসান আলবার্তো বলল, ‘বাইরে লোক অফিসে আসা-যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতেও এটা হতে পারে। সেটা তো জিজ্ঞেস করলেন না।’
‘সেটা তো বাড়িতেই জিজ্ঞেস করতে হবে। সেটা করব।’
‘কিন্তু অবিলম্বে অফিসের মতই সবার বাড়িতে বাইরে লোকের আগমন নিষিদ্ধ করা যায়না?’ বলল কামাল কনরাড ।
‘হ্যাঁ তা করা যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঘটনা তো জীবন্ত সিসি মাছি অথবা এ জাতীয় পতঙ্গ নিয়ে। আপনি বাইরের লোকের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। আপনি কি এই দুইকে এক করে দেখছেন?’ বলল মিঃ হাসান আলবার্তো।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘আমি নির্দিষ্ট করে কিছুই ভাবছি না। কিছু সম্ভাবনা সামনে রেখেছি। এভাবেই সামনে এগুচ্ছি।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আপনাদের আর কোন কথা না থাকলে এখন আমরা উঠতে পারি।’
‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা।’ বলে উঠে দাঁড়াল মিঃ জারমিস।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েই হঠাৎ মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার একটা অনুরোধ।
‘বলুন।’ বলল মিঃ গটেফ।
‘চীফ এডিটরসহ সব সিনিয়র নিউজ স্টাফ আজ অফিসে থাকলে ভাল হয়। শুধু আজকের রাতটাই। ইতিমধ্যে আরও কিছু ভাববার সুযোগ পাব।’
মিঃ গটেফ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলবেন, সেটাই হবে। আল্লাহ আপনাকে দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করুন। আপনি কাজ শুরু করেছেন দেখে আমার খুব আনন্দ লাগছে, নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।’ মিঃ গটেফের শেষের কথা আবেগে ভারি হয়ে উঠল।

আহমদ মুসা সন্ধ্যা থেকে WNA-এর কার পার্কে রাখা সিনিয়র সাংবাদিকদের গাড়ির উপর চোখ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গভীর পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সে।
যাদের মৃত্যু ঘটেছে, তাদের বাড়িতে গিয়ে স্থান-কাল বিবেচনা করে সে দেখেছে, অফিস থেকে যাওয়ার পর সবাই পরিবারের মধ্যে থেকেছে এবং ঘুমিয়েছেও স্ত্রীর সাথে। তাই সিসি মাছি কিংবা অন্য কোন পোকা পতঙ্গ যাই হোক শুধু WNA এবং FWTV-এর সাংবাদিকদেরই কামড়াবে, একটি ক্ষেত্রেও বাড়ির অন্য কাউকে নয়, এটাই স্বাভাবিক নয় মোটেই। তাছাড়া ল্যাবরেটরির বিশ্লেষণে সিসির কামড় এবং তাদের মৃত্যুর যে ব্যবধান পাওয়া গেছে, তার সাথে তাদের অফিস থেকে বাড়িতে ফেরা ও তাদের মৃত্যুর সময়ের ব্যবধান মিলে না। সুতরাং তারা বাড়িতে তথাকথিত সিসি মাছি বা পোকার দ্বারা দংশিত হয়নি। আবার তাদের অফিসের যে পরিবেশ এবং নিহত হওয়ার দিনগুলোতে অফিসে নিহতের সময় চুলচেরা হিসেব নিয়ে সে দেখেছে, তারা বাইরের কারো সাথে দেখা করেনি, তাতে সে নিশ্চিত হয়েছে সিসি মাছি তাদের অফিস সময়ে দংশন করেনি। তথাকথিত মাছির দংশন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ব্যাবধানও এ কথাই প্রমাণ করে। এ হিসেব থেকে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছে, সিসি মাছি বা কোন বিষাক্ত পোকার দংশনই যদি তাদের মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে তা ঘটেছে তাদের অফিস থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি পৌছা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। যারা নিহত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই এ সময়টা গাড়িতে কাটিয়েছে। অতএব দংশন বা কামড় যাই ঘটুক তা ঘটেছে গাড়িতে।
এই উপসংহারে পৌছার পর আহমদ মুসার কাছে প্রশ্ন দেখা দিল, সিসি মাছি হোক, বিষাক্ত পোকা-পতঙ্গ হোক কিংবা বিষাক্ত কোন অজ্ঞাতনামা অস্ত্র হোক তা গাড়িতে প্রবেশ করল কখন। জেনেভার এই শীতে তারা নিশ্চয় গাড়ির জানালা খোলা রেখে গাড়ি চালায় নি। সুতরাং গাড়িতে কিছু প্রবেশের প্রশ্নই ওঠেনা।
এই অবস্থায় আহমদ মুসার কাছে সম্ভাব্য যে সময়টুকু অবশিষ্ট থাকে, তা হল অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠার সময়টুকু। আহমদ মুসা সিদ্ধান্তে পৌঁছল, হয় এই সময়ে কিছু ঘটেছে অথবা গাড়ি পার্ক করে রাখা অবস্থায় কিছু ঘটেছে। আহমদ মুসা ভাবল, পার্ক করা অবস্থায় গাড়িতে যদি কিছু ঘটে থাকে তাহলে তা সন্ধ্যা উত্তর অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশেই ঘটা স্বাভাবিক।
এসব বিবেচনা থেকেই আহমদ মুসা রহস্য উদঘাটনের একটা পথ হিসেবে WNA-এর কার পার্কসহ অফিসের মূল প্রবেশের পথের উপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পরপর চারদিন সে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় কারপার্কের প্রবেশ পথের বাম পাশে দাড় করিয়ে রাখা একটা অচল মাইক্রো বাসের সিটে সবার অলক্ষ্যে বসে কাটিয়েছে। এখান থেকে গোটা কারপার্ক এবং মূল প্রবেশপথ দেখা যায় পরিষ্কার ভাবে।
আহমদ মুসা হতাশ হয়নি। কিন্তু মিঃ গটেফরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বলেছে, ‘আপনার এত কষ্ট! আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি তো?’
আহমদ মুসা হেসে বলেছে, ‘আল্লাহই শুধু এটা জানেন। তবে আল্লাহ যে বিচার বুদ্ধি দিয়েছেন, তাতে সামনে এগুবার আর দ্বিতীয় পথ আমার সামনে আপাতত নেই। সিদ্ধান্ত নিতে আমি কোন ভুল করেছি, এটাও এখনও প্রমাণ হয়নি।’
আহমদ মুসার উপর পর্বত প্রমাণ আস্থা, তবু মিঃ গটেফের বুকের দুরু দুরু ভাব যায়নি। পথ যদি ঠিক চিহ্নিত না হয়ে থাকে, তাহলে যে কোন সময় আরেকটা সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। পরক্ষনেই বুকে বল পেয়েছে এই ভেবে যে, আহমদ মুসা নিশ্চিত না হয়ে সামনে এগোন না।
সেদিন রাত ১১টা।
আহমদ মুসা একইভাবে বসেছিল মাইক্রোবাসের সিটটায়।
তার দৃষ্টি কারপার্কের বিশেষ গাড়িগুলোর দিকে। মাঝে মাঝে তার দৃষ্টি ঘুরে গিয়ে নিবদ্ধ হচ্ছে অফিসের মূল প্রবেশ পথটার উপর।
আহমদ মুসার শুন্য দৃষ্টি হঠাৎ তীক্ষ্ন হয়ে উঠল কারপার্কে প্রবেশকারী একজনের পদক্ষেপে অপরাধমূলক সতর্কতা।
মানুষের চোখের যেমন ভাষা আছে, তেমনি পায়ের চলায়ও একটা ভাষা আছে। চলার সময় সে ভাষার প্রকাশ ঘটে। আহমদ মুসা লোকটির চলায় অপরাধীর ভাষা দেখতে পেল।
গেট বক্সটির পাশ দিয়ে লোকটি প্রবেশ করেছে।
কার পার্কের একটা গেট বক্স আছে। একজন গেট ম্যান থাকে এখানে সার্বক্ষণিক।
প্রবেশকারী লোকটির চলায় অপরাধের ভাষা দেখে আহমদ মুসার চোখ দুটি সতর্ক হয়ে উঠল। নড়ে চড়ে বসল সে।
লোকটির যখন মুখ দেখতে পেল আহমদ মুসা, তখন মুহূর্তেই তার সব আনন্দ এক সঙ্গে উবে গেল। লোকটি কার পার্কের গেটম্যান।
কিন্তু গেটম্যানের চলায় অপরাধীর ছাপ কেন? নিরাশার মধ্যেও আশা জাগতে চাইল আহমদ মুসার মনে।
গেটম্যান গাড়ির দিকে এগুচ্ছে।
কেউ রং পার্কিং করেছে কিন? না অবাঞ্ছিত কোন পার্কিং হয়েছে?
আহমদ মুসার কৌতূহলী চোখ তাকে অনুসরণ করলো।
গেটম্যান গিয়ে দাঁড়াল একটা গাড়ির সামনে দরজার পাশে।
আহমদ মুসা দেখল গাড়িটা WNA-এর ব্যুরোসমুহের নির্বাহী সম্পাদক(ব্যুরো এডিটর) মিসেস ফাতেমা হিরেনের গাড়ি।
গড়িটার পাশে দাঁড়িয়েই গেটম্যান তার হাত বাড়িয়ে দিল গাড়ির ‘লক’-এর দিকে।
আহমদ মুসা ভাবল, গেটম্যান তাহলে কি গাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেবে!
গেটম্যান গড়িটার দরজা ঈষৎ ফাঁক করেই তার কোটের পকেট থেকে ছোট নলের মত একটা কিছু বের করল এবং নলটি গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের মত তার গোড়ায় একটা চাপ দিয়েই নলটি বের করে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে দরজা লক করে ফিরে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসার চিন্তা যত দ্রুত চলল, তার চেয়েও দ্রুত কাজগুলো শেষ হয়ে গেল।
গেটম্যান গাড়ির দরজা খুলল কেন? আবার বন্ধই বা করল কেন? নলটি কি? কি করল তা দিয়ে? আর তার ফিরে আসার মধ্যেও সেই গভীর অপরাধী পদক্ষেপ কেন?
প্রশ্নগুলোর সমাধান পাবার আগেই গেটম্যান গেটবক্সের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
গেটম্যানকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি?
আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। এগুলো গেটম্যানের পেছনে।
আহমদ মুসা যখন গেট বরাবর পৌঁছল, তখন গেটম্যান রাস্তায়।
রাস্তায় গেটের একপাশে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়েছিল। গেটম্যান সেদিকেই এগুচ্ছে।
হঠাৎ আহমদ মুসার গোটা চেতনা যেন ঝড়ের বেগে জেগে উঠল। গেটম্যান কারও পক্ষে কিছু করলো না তো! ঐ গাড়ির কাছ থেকে বেরিয়ে সোজা ঐ গাড়ির কাছে যাচ্ছে কেন?
আহমদ মুসার দিকে পেছন ফিরে একবার দেখে গেটম্যান দ্রুত এগুলো গাড়ির দিকে। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে একজনকে দেখা যাচ্ছে। সেও তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাও তার হাঁটা দ্রুত করল। এ সময় আহমদ মুসার সামনেই পুলিশের একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। দু’জন পুলিশ অফিসার নামছে গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা দেখল, গেটম্যান সেই নলটা তুলে দিল গাড়ির খোলা জানালার সেই লোকটির হাতে।
লোকটি বাম হাতে নলটি নিল। পরক্ষনেই তার ডান হাত জানালায় উঠে এল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা, তার হাতে রিভলবার।
পরক্ষনেই গুলীর শব্দ। পর পর দু’টি।
রাস্তার উপর আছড়ে পড়ল গেটম্যানের লাশ।
আহমদ মুসা ছুটল, তার পেছনে পেছনে দু’জন পুলিশ অফিসারও ছুটল সেদিকে।
গুলীর শব্দের পরই গাড়িটা ছুটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসারা যখন গেটম্যানের কাছে পৌঁছল, গাড়ি তখন হাওয়া হয়ে গেছে।
মাথায় গুলী লেগেছে গেটম্যানের। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটেছে তার।
লাশ পুলিশের হাওয়ালা করে দিয়ে, অন্যান্য ফর্মালিটিজ চুকিয়ে আহমদ মুসা মিঃ গটেফকে নিয়ে অফিসে ফিরে এল।
পুলিশ কেসটি রেকর্ড করেছে বাদানুবাদ জনিত অন দি স্পট হত্যাকান্ড বলে।
হত্যার কোন মটিভ আছে কিনা পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল। আহমদ মুসার পরামর্শ অনুসারে মিঃ গটেফ বলেছিল আমরা কিছু জানিনা।
পুলিশ অফিসার বলেছিল, ‘ব্যক্তিগত কোন শত্রুতার ফল হতে পারে।’
একটু থেমেই পুলিশ আবার বলেছিল, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠানে যে সব অঘটন ঘটে চলেছে, তাতে পুলিশ কমিশনারের অনুরোধ অফিস কয়েকদিন বন্ধ রাখলে ভাল করতেন।’
আহমদ মুসা অফিসে ঢুকেই বলল মিঃ গটেফকে, ‘আমি যা বলেছিলাম- মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি না খোলা, তার গাড়িতে কেউ হাত না দেয়া এবং তাকে অন্য গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেয়া- তা নিশ্চিত করা হয়েছে?’
‘হয়েছে। কিন্তু জনাব আহমদ মুসা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।’
‘আসুন বলছি।’ বলে তাদেরকে নিয়ে মিঃ গটেফের অফিস কক্ষে প্রবেশ করল।
মি; গটেফের সাথে তার টেবিল ঘিরে বসল চীফ এডিটর মিঃ কামাল কনরাড, মিসেস ফাতেমা হিরন এবং আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ছাড়া সকলেরই মুখ শুকনো। চোখে-মুখে আতংক।
বসেই মিঃ গটেফ বলল, ‘সাংবাদিক কর্মচারীদেরমধ্যে নতুন করে আবার ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি ও তার ব্যাপারটা ভীতিকে আবার আতংকে পরিনত করেছে। কি ঘটনা বলুন জনাব।’
‘সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, ‘সাহসী হতে হবে জনাব। গেটম্যানের মৃত্যু আমাকে আনন্দিত করেছে। মনে হচ্ছে, বোধ হয় আমি রহস্যের একটা দরজায় পৌছতে পেরেছি।’
সকলের বিস্ময় দৃষ্টি এক সঙ্গে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ হল। তাদের চোখে-মুখে একরাশ প্রশ্ন ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু কারও মুখ থেকে কোন কথা বেরুল না।
আহমদ মুসাই কথা বলল, ‘চূড়ান্ত কথা আমি বলছি না, তবে যেটুকু প্রমাণ পেয়েছি তাতে গেটম্যান অন্যের পক্ষে কাজ করছিল। যাদের পক্ষে করছিল, তারাই তাকে হত্যা করেছে।’
‘কেন?’ কণ্ঠে উদ্বেগ মিঃ গটেফের।
‘যখন তারা বুঝল গেটম্যান আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে, সেই মুহূর্তেই তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
‘সে ধরা পড়েছিল আপনার কাছে?’ বলল মিঃ গটেফ।
‘আমি তাকে সন্দেহ করেছিলাম।’
‘শত্রুর পক্ষে কি কাজ করছিল সে?’ গটেফ বলল।
‘ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। কালকে মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি খোলার পর হয়ত কিছু বলা যেতে পারে।’
‘গাড়ির সাথে তার সম্পর্ক?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ফাতেমা হিরন।
‘বলছি। গেটম্যান মিসেস হিরনের গাড়িতে কিছু ঢুকিয়েছে একটা ছোট পাইপ দিয়ে এবং সেই পাইপটা সে ফেরত দিয়েছে যে তাকে হত্যা করেছে। পাইপটা ফেরত দেয়ার পরই সে গুলী খেয়েছে। গেটম্যানের পিছু নিয়েছিলাম আমি, সেটা গেটম্যান এবং হত্যাকারী দু’জনেই দেখে ফেলে।
সবার চোখে-মুখে নতুন আতংক। ফাতেমা হিরনের মুখ মৃত্যুর মত ফ্যাকাশে।
‘কি ঢুকিয়েছে সে গাড়িতে। চাবি পেল কোথায়?’ শুকনো কণ্ঠে বলে ফাতেমা হিরন হাত ব্যাগ থেকে গাড়ির চাবি বের করল।
‘নিশ্চয় সে ধরনের চাবি সে জোগাড় করে বা তাকে জোগাড় করে দেয়া হয়। গাড়িতে কি ঢুকিয়েছে আমি জানিনা, তবে আমার মনে হয়েছে মৃত্যুর যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার সাথে এর সম্পর্ক আছে।’
‘আল্লাহ’ বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠল মিসেস হিরন।
‘বুঝেছি মিঃ আহমদ মুসা, সব বুঝেছি।’ ভাঙ্গা গলায় বলল মিঃ গটেফ।
একটু থেমে আবার বলে উঠল মিঃ গটেফ, ‘মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি পাহারা দেবার ব্যবস্থা করি। অন্য গাড়িতে মিসেস হিরণকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই।’
‘তাই করুন।’
‘আমার ভয় করছে বাড়িতে যেতে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল মিসে হিরন।
‘আমাকে বিশ্বাস করুন বোন। সামান্য আশঙ্কা থাকলেও আমি আপনাকে বাড়িতে যেতে বলতাম না।
মিঃ গটেফ উঠে দাঁড়াল। সবাই উঠল সেই সাথে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ গটেফ আপনি টেলিফোনে FWTV-কে বলে দিন তাদের কার পার্কিং-এর গেটম্যান কে যেন আপাতত ছুটি দেয়া হয় এই মুহূর্ত থেকে।
‘জি আচ্ছা’ বলে অফিসের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল মিঃ গটেফ।
WNA-এর চীফ এডিটর কামাল কনরাড বলল, ‘শুধু কারপার্কের গেটম্যানরাই কি সন্দেহের মধ্যে পড়ে? আরও চিন্তা কি আমাদের করতে হবে?’
‘আপাতত নয়।’
সবাই দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

পরদিন সকালে মিসেস ফাতেমা হিরনের গাড়ি খুব সাবধানতার সাথে খোলা হয়েছিল।
প্রথমে বাইরে থেকে গাড়ি ভালভাবে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু গাড়ির ভেতরে ফেলা হয়েছে, এমন বাড়তি কিছুই গাড়ির ভেতরে দেখা যায়নি। মিসেস ফাতেমা হিরনও সব দিক থেকে খুঁটে খুঁটে দেখেন কিন্তু কিছু মেলেনি।
কিন্তু আহমদ মুসা তা মেনে নিতে পারেনি। সে নিজ চোখে দেখেছে টিউব থেকে ভেতরে কিছু ফেলা হয়েছে এবং সে টিউবটা গেটম্যান তার হত্যাকারীকে ফেরত দিয়েছে। আহমদ মুসা ভাবে, টিউব কি কোন গ্যাস স্প্রে করে? গ্যাস তো চোখে দেখা যাবে না।
গাড়ির ভেতরের বাতাস পরীক্ষা করলে তা হয়ত জানা যাবে। কিন্তু তার আগে গাড়ির ভেতরটার মাইক্রোসকপিক পরীক্ষা হওয়া দরকার।
মাইক্রো টেলিলেন্স দিয়ে গাড়ির ভেতরটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এ লেন্সের মাধ্যমে দশ ফুট দূরের পিঁপড়াও তার সাইজের দশগুন বড় দেখা যায়।
গোটা গাড়ি সার্চের পর গাড়ির ড্যাস বোর্ডের একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে ড্যাস বোর্ড ও উইন্ড শিল্ড একসাথে মিশেছে সেখানে একটা বেশ বড় মাছি পাওয়া গেল।
পরীক্ষা করছিল আহমদ মুসা নিজে। চমকে উঠেছিল সে মাছি দেখে। বহুচেনা সিসি মাছি চিনতে তার কষ্ট হলনা।
গোটা দেহ আহমদ মুসার রোমাঞ্চ দিয়ে উঠছিল।
টেলি মাইক্রোসকোপটা আহমদ মুসা মিঃ গটেফের হাতে তুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘দেখুন ওখানে।’
চোখ বুলিয়েই সে বলেছিল, ‘কি ওটা? একটা মাছির মত।’
‘ওটাই সিসি মাছি।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
শব্দটা মিঃ গটেফের কানে পৌছার সাথে সাথেই তার গোটা দেহ আতংকের প্রচন্ডতায় অবশ হয়ে গিয়েছিল।
হাত থেকে তার টেলি মাইক্রোসকোপ পড়ে গিয়েছিল।
সামনেই দাঁড়িয়েছিল চীফ এডিটর কামাল কনরাড এবং ব্যুরো এডিটর মিসে ফাতেমা হিরেন।
তারা কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘কি হয়েছে জনাব?’ বলে তারা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার ঠোঁটে ছোট এক টুকরো হাসি। বলেছিল, ‘কিছু হয়নি, উনি ভেতরে একটা সিসি মাছি দেখতে পেয়েছেন।’
‘সিসি মাছি? গাড়ির ভেতরে? দুই জন প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠেছিল, কিন্তু মিসেস ফাতেমা হিরনের কণ্ঠে আর্তনাদ, আর কামাল কনরাডের কণ্ঠ কাঠ শুকনো।’
মিসেস ফাতেমা হিরনের চোখে ফুটে উঠেছিল মৃত্যুর আতংক। বলেছিল, ‘কাল যদি গাড়িতে উঠতাম, তাহলে…’ কান্নার তোড়ে কথা শেষ করতে পারেনি।
অস্থিরতার জন্যে তার মুখের নেকাব খুলে গিয়েছিল। নেকাব ঠিক করে ফাতেমা হিরন আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলে, ‘আপনি আমাকে বাচিয়েছেন আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন।’
আহমদ মুসা মৃত সিসি মাছি গাড়ি থেকে বের করে। নিজেদের বিস্বস্ত একটা ল্যাবরেটরীতে মাছিটার পরীক্ষা করা হয়।
পরীক্ষা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেল আহমদ মুসা।
বিশ্লেষণে মৃত সিসি মাছির মধ্যে দু’ধরনের বিষ পাওয়া গেছে। এক ধরনের বিষ মাছির ভেতরে যা সিসি মাছির নিজস্ব। আরেক ধরনের বিষ পাওয়া গেছে মাছির ‘হুল’- এ। সিসি মাছির ‘হুল’ কে বিশেষ নিয়মে এক বিশেষ ধরনের বিষে সিক্ত করা হয়েছে। মাছির কামড়ে এই বিষটি মানুষের দেহে প্রবেশ করলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে মাছিও বিষটির প্রভাবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মরে যায়। সেদিন রাত পৌনে ১২ টার দিকে মাছির হুল কে বিশেষ ধরনের ঐ বিষে সিক্ত করা হয়। এরপর খুনে রক্তপায়ী মাছিটি কোন মানুষ পেলে দংশন করত। মানুষটি মারা যেত, সেও মারা যেত।
বিশেষ বিষটির নাম পরিচয় ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া যায়নি। আহমদ মুসাই তাদের বলে যে, এই বিষে প্রকৃতির বিষের সাথে নতুন আবিষ্কৃত বিশেষ এক শ্রেনীর বক্স জেলিফিসের মিল আছে।
ল্যাবরেটরি পরিক্ষায় পরে প্রমানিত হয় আহমদ মুসার অনুমান ঠিক।
ল্যাবরেটরি রিপোর্ট, অন্যান্য তথ্য এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে বৈঠক বসল WNA-এর মিটিং রুমে।
মিঃ বাকের জারমিস, মিঃ জামাল গটেফ, মিঃ কামাল কনরাড, মিঃ হাসান আলবার্তো, জেনেভা মুসলিম কম্যুনিটির প্রধান আব্দুল মজিদ ম্যাক্স-ফ্রিস এবং আহমদ মুসা- এই ৬জন একটা বড় টেবিল ঘিরে বসেছে।
গোটা পরিস্থিতি ব্রিফ করল WNA-এর চেয়ারম্যান মিঃ গটেফ। শেষে বলল, ‘গোটা বিষয়টা ড্রিল করেছেন আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা। আরও কিছু জানার থাকলে তিনি বলবেন।’
‘সব বিষয় কি পুলিশকে জানানো হয়েছে?’ প্রথমেই কথা বললেন মিঃ ম্যাক্স ফ্রিস।
‘না জানানো হয়নি। আমার মনে হয় বিষয়টা জনাব আহমদ মুসা বুঝিয়ে বললে ভাল হয়। অনেকের মনে এ প্রশ্নটা আছে।’ বলল মিঃ গটেফ।
আহমদ মুসা বলল, ‘ আমাদের শত্রু আসলে কে আমি জানিনা। তবে তারা নিঃসন্দেহে শক্তিমান ও প্রভাবশালী হবে। তারা দু’টি মুসলিম সংবাদ মাধ্যমকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। এরা ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এর মত কোন দল যদি হয়, তাহলে তাদের সাথে পুলিশের একটা অংশের সম্পর্ক থাকতে পারে। সুতরাং সব বিষয় যদি আমরা পুলিশকে জানাই, তাহলে শত্রুদের সবকিছু জেনে ফেলার সম্ভাবনা আছে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া আমাদের কঠিন হবে। আমরা তাদের কিছুই জানিনা। গোপনে অগ্রসর না হলে বর্তমান অবস্থায় তাদের নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
‘জনাব আহমদ মুসার বলার পর আমাদের আর কিছু বলার থাকেনা। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, পুলিশকে একদমকিছু না জানানো কি ঠিক হবে। অন্তত সিসি মাছি পাওয়ার ব্যাপারটা।’ বলল আবার ম্যাক্স ফ্রিস।
‘এটাই তো আসল কথা। এ বিষয়টা যদি পুলিশকে জানানো হয়, কালকেই এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যাবে। শত্রু তার কৌশল পরিবর্তন করবে। আমরা তাদের মুখোমুখি হবার একটা যোগসুত্র হারিয়ে ফেলব।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামল। সবাই নীরব।
বেশ কিছুক্ষন পর মিঃ জারমিস বলল, ‘আহমদ মুসার সাথে আমি একমত।’
অন্য সবাই মাথা নেড়ে মিঃ জারমিসের কথায় সায় দিল। ম্যাক্স ফ্রিসও।
‘আমি বলেছি আমার যুক্তি হিসেবে। সবাইকে এর সাথে একমত হতে হবে তা ঠিক নয়। আমি কিছুটা এগিয়েছি, কিন্তু সামনে কোন পথে চলব আমার জানা নেই। আমি সফল হব এর কোন নিশ্চয়তা নেই। পুলিশের সাহায্য উপকারীও হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
মিঃ ম্যাক্স ফ্রিস চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমিও বলেছি আমার একটা যুক্তি হিসেবে। আমার আস্থা পুলিশের উপর নেই। তারা তো কেসটা নিয়ে ড্রিল করছে আপনি এখানে আসারও অনেক আগে থেকে। তারা এক পাও এগুতে পারেনি। আপনি শত্রুকে ধরতে পারেননি এখনও কিন্তু মাত্র কদিনে রহস্য উদঘাটন করেছেন। আল্লাহই আপনাকে এখানে এনেছেন। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
ম্যাক্স ফ্রিস থামতেই সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, ‘আর কোন কথা নয়। আমরা ম্যাক্স ফ্রিসের কথার সাথে একমত।’
কিছুক্ষন সবাই নীরব।
নীরবতা ভেঙে হাসান আলবার্তো বলল, ‘শত্রু কারা আপনি কি অনুমান করছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘অনুমান দিয়ে কি লাভ হবে?’
‘অনুমানের পেছনেও যুক্তি থাকে।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘অনুমানটা জানতে পারলে আমরাও স্বান্তনা পেতাম।’ বলল মিঃ জারমিস।
‘উদ্বেগও বাড়তে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে বোঝা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই আপনি কিছু আঁচ করেছেন। বলুন সেটা কি?’ বলল কামাল কনরাড।
‘আমি সন্দেহ করছি ব্ল্যাক-ক্রস কে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ব্ল্যাক-ক্রস কে?’ একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠল।
তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন।
‘হাঁ ব্ল্যাক-ক্রস কে। সন্দেহ আমার দুটি কারনে। এক, সম্প্রতি WNA এবং FWTV ক্যামেরুনে ব্ল্যাক ক্রসের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে সাহায্য করেছে। এই সেদিন বোমাসার ঘটনার যে কভারেজ WNA এবং FWTV দিয়েছে, তাতে গোটা দুনিয়ার ব্ল্যাক ক্রস-এর মুখে কালমা লেপন হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হল, মধ্য আফ্রিকার সিসি মাছির ব্যবহার। ব্ল্যাক ক্রসের বড় বড় অনেক নেতা সাম্প্রতিককালে মধ্য আফ্রিকা গিয়েছেন। তাদের মাথায় সিসি মাছির ব্যবহারের চিন্তা আসা স্বাভাবিক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার অনুমান সত্য হলে এ শত্রু তো সাংঘাতিক।’ বলল হাসান আলবার্তো।
‘সাংঘাতিক তো বটেই। পুলিশ কে বোকা বানিয়ে কি কৌশলে দেখুন ওরা মানুষ হত্যা করে চলেছে।’
‘শত্রু যদি ব্ল্যাক ক্রসই হয়, তাহলে তো পুলিশের মধ্যে ওদের সাথী সমর্থক থাকতে পারে, প্রভাব তো আছেই। নিশ্চয় এ জন্যেই আপনি পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছেন। বলল ম্যাক্স ফ্রিস।
‘ঠিক বলেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সম্পর্কে যত শুনেছি, যত ভেবেছি, তার চেয়েও আপনি অনেক বড়। এতদিন ভাবতাম, অস্ত্র চালনায় আপনার জুড়ি নেই। কিন্তু এখন দেখছি, বুদ্ধি চালনায় পুলিশ গোয়েন্দা আপনার কাছে কিছু নয়।’ বলল ম্যাক্স ফ্রিস।
কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে আহমদ মুসা মিঃ গটেফের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার জরুরী কিছু কাজ আছে, উঠতে পারি কিনা।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনার কোন সময় নষ্ট করা আমাদের উচিত নয়।’ বলে গটেফ ম্যাক্স ফ্রিসের দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল।

Top