২৩. রাজচক্র

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসার গায়ে কোট নেই। শার্ট রক্তাক্ত। আহমদ মুসা পড়ে আছে মেঝেতে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে টম চামড়ার চাবুক হাতে।
মায়োভস্কি ঘরে প্রবেশ করল।
‘স্যার এ ব্যাটা মানুষ নয়। হাতিকে এভাবে পেটালে হাতিও কথা বলতো। কিন্তু এঁকে কথা বলানো যায়নি।’ বলল টম নামের ভীমাকৃতি সেই লোকটি।
‘প্লেখভ কোথায়?’
‘এইমাত্র গেলেন। পাশের রুমে রেস্ট নিচ্ছেন।’
মায়োভস্কি চেয়ার টেনে আহমদ মুসার পাশে বসল। পড়ে থাকা আহমদ মুসার দিকে মাথাটা ঝুকিয়ে বলল, ‘প্লেখভ ও টমের হাতে তোমাকে ছেড়ে দিতে চাইনি। কিন্তু তুমি আমার সব কথা, সব অনুরোধ ব্যর্থ করে দিয়েছ। তাতিয়ানা সম্পর্কে কোন তথ্যই দাওনি।’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে উঠে বসল। কোন কথা বলল না।
‘শোন, কথা না বলে তুমি বাঁচবে না, তাতিয়ানাকে বাঁচাতে পারবে না, ক্যাথারিনকেও নয়।’
হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আপনারা নাকি রাজ পরিবারের শুভাকাঙ্খী, ক্যাথারিন ও তাতিয়ানার শুভাকাঙ্খী?’
সংগে সংগে উত্তর দিল না মায়োভস্কি। কিছু সময় নিয়ে বলল, ‘তুমি তো মরতে যাচ্ছ। মরার আগে তাহলে শোন। রাজ পরিবার আবার সিংহাসন ফিরে পাক, এ ব্যাপারে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। বরং সরকার সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়ার নামে তাতিয়ানা ও ক্যাথারিনকে হাত করে রাজ পরিবারের গুপ্তধন ভান্ডার হাত করতে চায়। আমরা তা হতে দেব না। আমরা হাত করতে চাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সে গুপ্তধন ভান্ডার।’
‘রাজ পরিবারের গুপ্তধন হাত করার জন্যে এত কিছুর প্রয়োজন কি। নিশ্চয় প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও তাতিয়ানা সাথে নিয়ে বসে নেই সেই ধন ভান্ডার?’
‘তাতিয়ানাকে আমাদের প্রয়োজন। কারণ তার হাতেই রয়েছে রয়্যাল আংটি এবং তারই কাছে রাজকীয় ডাইরীও আছে। ও দু’টি আমাদের প্রয়োজন।’
চমকে উঠল আহমদ মুসা আংটি এবং ডায়েরীর কথা শুনে। একটু সময় নিয়ে বলল,‘ও দু’টি দিয়ে কি কাজ?’
হাসল মায়োভস্কি। বলল, ‘আংটির মধ্যে রয়েছে গুপ্তধনের নক্সা এবং ডায়েরীতে পাওয়া যাবে রাজ পরিবারের কে কোথায় রয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ।’
‘আপনারা রাজ পরিবারের লোকদের চান, না ঐ দু’টি জিনিস চান, আমি বুঝতে পারছি না।’
আবার হাসল মায়োভস্কি। বলল, ‘আমরা জিনিস দু’টিও চাই, লোকদেরও চাই। আমরা গুপ্তধন দখল করব, কিন্তু ওদের বাঁচিয়ে রাখলে সব কিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুতরাং যখন গুপ্তধন দখল করব, তখন ওরা কেউ দুনিয়াতে থাকবে না।’
বলেই মায়োভস্কি উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘এখনও সময় আছে, আমাদের সহযোগিতা কর। তাহলে তোমার শুধু জীবনই বাঁচবে না, লাভবানও হবে।’
‘আমি চাইলেই বাঁচতে পারি না, আপনি চাইলেই আমাকে মারতে পারেন না।’
‘টম একে নিয়ে চল।’ বলে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল মায়োভস্কি।
টম টেনে দাঁড় করাল আহমদ মুসাকে। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল তাকে।
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল চার স্টেনগানধারী। তারাও পেছনে পেছনে চলল।
একটা প্রশস্ত করিডোরে ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে এল।
করিডোরটা একটা মিটিং প্লেসের মত। আহমদ মুসা চারদিকে চেয়ে দেখল। বিভিন্ন দিক থেকে কয়েকটি করিডোর এসে মিশেছে প্রশস্ত এ চত্বরে। উপরের ছাদটি তিন তলার মত উঁচুতে। উপরে দু’টি ফ্লোরেরই ব্যালকনি প্রশস্ত করিডোরটির চারদিকে ঘুরানো।
করিডোরে প্রবেশ করতেই আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে। দোতলার ব্যালকনিতে এনে বসানো হয়েছে তাঁকে।
আহমদ মুসার রক্তাক্ত জামা-কাপড়ের দিকে চেয়ে চমকে উঠেছিল প্রিন্সেস ক্যাথারিন। ধীরে ধীরে তার মুখটি উদ্বেগ ও বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
মায়োভস্কি আহমদ মুসাকে ব্যালকনির সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। প্রিন্সেসকে লক্ষ্য করে কিছু বলতে যাচ্ছিল মায়োভস্কি।
হঠাৎ তার হাতের টেলিফোন বিপ বিপ সংকেত দিয়ে উঠল।
‘মাফ করবেন ইয়োর হাইনেস। টেলিফোনে কথাটা বলে নেই।’
একটু আড়ালে চলে গেল মায়োভস্কি টেলিফোনে কথা বলার জন্যে। মিনিট খানেক পরে ফিরে এল।
‘প্লেখভ, শফরোভিচকে ডাক। জরুরী কল এসেছে। আমাকে এখুনি যেতে হবে।’
প্লেখভ দ্রুত চলে গেল।
মায়োভস্কি প্রিন্সেসের দিকে চেয়ে বলল, ‘ইয়োর হাইনেস, আপনার বন্ধু যুবকটি একেবারেই নির্বোধ বেয়াড়া। আমাদের সহযোগিতাই সে করেনি। মৃত্যুর জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। আপনার সামনে এবার তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করার নাটকই অনুষ্ঠিত হবে।’
একটু থামল মায়োভস্কি। একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করল, ‘একটা শেষ সুযোগ।’ আপনাকে দিচ্ছি ইয়োর হাইনেস। আপনি তাকে বলে দেখতে পারেন, প্রিন্সেস তাতিয়ানা এবং তার সেই দু’টি জিনিস কোথায় আছে সে বলুক।’
মায়োভস্কি কথা শেষ করতেই প্লেখভ শফরোভিচকে নিয়ে হাজির হলো।
‘মিঃ শফরোভিচ, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হচ্ছে। টেলিফোন এসেছে। আপনি এদিকটা দেখুন। সবই আপনি জানেন। হার হাইনেস প্রিন্সেসকে অনুরোধ করেছি শেষ চেষ্টা করার জন্যে। ব্যর্থ হলে যেভাবে কথা আছে, সেভাবে হত্যা করবেন। যাতে সে দৃষ্টান্ত অন্যদের মুখ খুলতে সাহায্য করে।’
বলে মায়োভস্কি প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে একটা ছোট্ট বাউ করে বেরিয়ে গেল করিডোর থেকে।
শফরোভিচ প্রিন্সেসকে ছোট্ট একটা বাউ করে বলল,‘ইয়োর হাইনেস আপনি কি বলবেন, না আমরা কাজ শুরু করে দেব।’
‘প্রিন্সেসের কিছু বলার নেই। তিনি নিজেই তোমাদের বন্দী। বন্দী আরেক বন্দীকে কোন নির্দেশ দিতে পারেন না, অনুরোধও নয়। এখন তিনি যা বলবেন সেটা তাঁর কথা নয়, তোমাদের কথা।’
প্রিন্সেস ক্যাথারিনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার কথা শুনে। অপার বিস্ময় ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। সে ভাবতেই পারছে না, রাজ পরিববারের সাথে সম্পর্কহীন একজন নিপীড়িত রক্তাক্ত যুবক মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে রাজ পরিবারের স্বার্থে এইভাবে কথা বলতে পারে কেমন করে! কে এই যুবক! একজন এশিয়ানের মধ্যে এই তেজ!
কোন কথা বলতে পারল না প্রিন্সেস। কি বলবে সে! যুবক যা বলেছে, সেটাই তো সত্য।
শফরোভিচ ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপর টম এর দিকে তাকিয়ে বলল,‘তোমার আয়োজন প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ।’ বলে টম কয়েক পা এগিয়ে এসে করিডোরের ঠিক মাঝখানে মানুষ পরিমাণ উঁচু কোন কিছুর উপর ছড়িয়ে রাখা কালো পর্দা তুলে ফেলল।
দেখা গেল বিরাট একটা বোর্ড। তাতে মানুষ পরিমাণ ক্রুশ আঁকা।
হেঁসে উঠল শফরোভিচ। বলল,‘ইয়োর হাইনেস, এই ক্রুশে চড়ানো হবে আপনার এই দুর্বিনীত বন্ধুকে। তারপর যিশু খৃস্টের মত করেই পেরেক দিয়ে তার দেহকে গেঁথে দেয়া হবে বোর্ডের সাথে। তারপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হবে। কুকুরটি সাত ফিট উপর পর্যন্ত লাফিয়ে উঠে শিকারের গোশত ছিঁড়ে আনতে পারে।’
মুহূর্তে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের চেহারা পাংশু পান্ডুর হয়ে গেল। মুখে যেন তার এক ফোঁটাও রক্ত নেই।
‘মৃত্যুকে এখন দেখতে পাচ্ছ শয়তান?’ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল শফরোভিচ।
‘না আমি দেখতে পাচ্ছি না। তুমি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছ?’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে না হতেই শফরোভিচের একটা প্রচন্ড ঘুষি গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মুখে। মুখ সরিয়ে নেবারও সময় পেল না সে।
ঠোঁট ফেটে দর দর করে রক্ত নেমে এল।
ঘুষি দিয়েই শফরোভিচ বলল,‘তোমরা এ শয়তানকে নিয়ে যাও ক্রুশে। মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে দাও মৃত্যুকে।’
আচানক ঘুষি খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা।
দু’জন স্টেনগানধারী এগিয়ে গিয়ে দু’জন দু’দিক থেকে এক হাতে স্টেনগান ধরে, অন্য হাতে আহমদ মুসাকে তুলে দাঁড় করিয়ে ক্রুশ বোর্ডের দিকে নিয়ে চলল।
অন্য দুই স্টেনগানধারী এবং প্লেখভ, টম এবং শফরোভিচ সবাই ক্রুশ বোর্ডের সামনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে-মুখে উৎসবের আমেজ।
প্রিন্সেস ক্যাথারিনের চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে গেছে। উদ্বেগ-আতংকে তার ঠোঁট দু’টি কাঁপতে শুরু করেছে। এর মধ্যেও তার মনে অপার বিস্ময়, যার পরিণতির কথা ভেবে সে উদ্বেগ-আতংকে মরে যাচ্ছে, তার মুখে-চোখে কিন্তু ভয়ের লেশ মাত্র নেই। কে এই অদ্ভুত যুবক!
দু’জন স্টেনগানধারী আহমদ মুসার দেহকে ক্রুশ বোর্ডের সাথে শেঁটে দেবার জন্যে তার সামনে দাঁড়িয়ে স্টেনগান দুই হাঁটুর মাঝখানে চেপে রেখে ক্রুশ বোর্ডের লকে আহমদ মুসার হাত-পাকে আটকাতে যাচ্ছিল।
ক্রুশ বোর্ডে ঠেশ দেয়ার সময় আহমদ মুসার দেহ হঠাৎ স্প্রিং-এর মত ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার সামনে দাঁড়ানো তার উপর ঝুঁকে পড়া দু’জন ছিটকে পড়ে গেল। তারা পড়ে যাবার আগেই তাদের একজনের স্টেনগান তুলে নিয়ে আহমদ মুসা ট্রিগার চেপে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরিয়ে নিল সামনে।
সামনে দাঁড়ানো ওরা চারজন চোখের পলকে লাশ পড়ে গেল।
আহমদ মুসার সামনে পড়ে যাওয়া দু’জন উঠে ছুটে পালাচ্ছিল। ওরাও স্টেনগানের খোরাকে পরিণত হলো।
আহমদ মুসা তাকাল প্রিন্সেসের দিকে। দেখল সে উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার থেকে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, বিস্ময়, উত্তেজনা ঠিকরে পড়ছে।
আহমদ মুসা চারদিক তাকিয়ে দোতলায় উঠটার কোন পথ দেখতে পেল না।
আহমদ মুসাকে এ করিডোরে আনা হয়েছিল ভূগর্ভস্থ কোন কক্ষ থেকে। আগের দিন প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কক্ষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক ঘর, দরজা ও করিডোর ঘুরিয়ে।
আবার আহমদ মুসা তাকাল প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দিকে।
তাকিয়েই আহমদদ মুসা নিজের দেহটাকে এক পাশে মেঝের উপর ছুড়ে দিল। আর সংগে সংগেই একটা গুলী ক্রুশ বোর্ডকে এসে বিদ্ধ করল। আহমদ মুসা সরে না দাঁড়ালে গুলীটা তার মাথা গুড়ো করে দিত।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই শরীরটাকে গড়িয়ে ক্রুশ বোর্ডের আড়ালে নিয়ে গেল।
ওদিক থেকে আরও কয়েকটি গুলী বর্ষণ হলো। সবগুলো এসে আঘাত করলো ক্রুশ বোর্ডকে।
আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দিকে দ্বিতীয়বার তাকিয়েই দেখতে পেয়েছিল, একজন লোক রিভলবার বাগিয়ে ঘরের ভেতর থেকে ব্যালকনিতে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা ক্রুশ বোর্ডের পাশ দিয়ে উঁকি দিল ব্যালকোনির দিকে। দেখল, রিভলবারধারী লোকটি প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সামনে রেখে আহমদ মুসার খোঁজ করছে।
আহমদ মুসা মুখ বের করতেই লোকটি রিভলবার ঘুরিয়ে গুলী করল।
আহমদ মুসা মাথা সরিয়ে নিয়েছিল। গুলীটা ক্রুশ বোর্ডের পাশ ঘেঁষে চলে গেল। অব্যর্থ নিশানা।
ব্যালকোনি থেকে লোকটি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল, ‘বেরিয়ে এস আড়াল থেকে অস্ত্র ফেলে দিয়ে। না হলে গুলী করব প্রিন্সেসকে। বেরিয়ে এসে ৫ গোনার মধ্যে।’
‘প্রিন্সেসকে গুলী করার ক্ষমতা তোমার নেই।’
এ সময় পেছনে কোথাও অনেকগুলো পায়ের শব্দ হলো।
আহমদ মুসা দ্রুত ক্রুশ বোর্ডটি ঠেলে প্রিন্সেস ক্যাথারিন এবং রিভলবারধারী লোকটি পশ্চিমের যে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার নিচে চলে গেল এবং বোর্ডের আড়ালে ওঁত পেতে বসল।
সেখান থেকে পূর্ব দিকের করিডোর আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে। পশ্চিম দিকের করিডোরটি একদম তার বাম হাতের পাশেই। দক্ষিণ দিকের করিডোরটিও তার চোখের সামনে। উত্তর পাশে কোন করিডোর নেই।
পুব দিকের করিডোর দিয়ে যারা ছুটে আসছিল তারা প্রায় করিডোরের মুখে এসে পড়েছিল। ব্যালকোনি থেকে সেই লোকটি চিৎকার করে উঠল, ‘সাবধান এদিকে বোর্ডের আড়ালে লুকিয়ে আছে শত্রু।’
ওদিকে পায়ের শব্দ থেমে গেল। তার বদলে ছুটে এল গুলী বৃষ্টি।
অধিকাংশ গুলী এসে বিদ্ধ করল ক্রুশ বোর্ড।
ক্রুশ বোর্ডটি আসলে কোন বড় গেটের দরজা। দেড় ইঞ্চি পুরু কাঠের পাল্লার এক পাশে ইস্পাতের প্লেট বসানো।
অব্যাহত গুলী বৃষ্টির মুখে আহমদ মুসা করিডোরটির দিকে স্টেনগান তাক করতে পারছিল না। এ সময় পশ্চিমদিকের করিডোরেও ছুটে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। প্রমাদ গুণল আহমদ মুসা।
পশ্চিম করিডোর দিয়ে যারা আসছে তাদের গুলীর মুখে পড়ে যাবে সে। ওদেরকেও টার্গেট করা যাবে না এখান থেকে। ওদের ঠেকাতে গেলে পুব দিক থেকে ওরা এগিয়ে আসবে, আবার পুব দিকে নজর দিলে পশ্চিম দিকের ওরা তাকে টার্গেট করার সুযোগ পেয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা ক্রুশ বোর্ডের আড়াল থেকে বের হবার তার কোন সুযোগ নেই। এই অবস্থায় দক্ষিণ দিকের করিডোর দিয়ে যদি কেউ প্রবেশ করে, তাহলে সে সরাসরি তাদের গুলীর মুখে পড়ে যাবে।
আহমদ মুসা দ্রুত চারদিকে তাকাল। পেছনেই দেয়ালে একটা দরজা। কিন্তু বন্ধ। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ক্রুশ বোর্ডের কভার নিয়ে আহমদ মুসা দ্রুত দক্ষিণ দিকের করিডোরের দিকে ছুটল।
পেছনে গুলী ছুটে এল পুব দিক থেকে। তারপর পশ্চিম দিক থেকেও।
বোর্ডে আঘাত করা ছাড়াও আহমদদ মুসার দু’পাশ দিয়ে ব্রষ্টির মত গুলী বেরিয়ে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা বুঝল ওরা গুলী করতে করতে ছুটে আসছে।
আহমদ মমুসা করিডোরে প্রবেশ করে ছুটল করিডোর দিয়ে। অল্প যাওয়ার পরই সে দেখল, করিডোরের দু’পাশ থেকে দু’টি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। আর সিঁড়ি দু’টির পাশ দিয়ে করিডোরটি দু’ভাগ হয়ে একটা পশ্চিমে, অন্যটা পুবদিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসা কোন দিকেই এগুলো না।
পশ্চিমমুখী করিডোরের মুখে স্টেনগান বাগিয়ে দেয়ালের আড়ালে শুয়ে পড়ল। শত্রুকে বিভ্রান্তিতে ফেলে মোকাবিলা করার একে একটা উপযুক্ত জায়গা বলে আহমদ মুসা মনে করল।
আহমদ মুসা বুঝল ওরা করিডোরে প্রবেশ করেছে। ওরা গুলী বৃষ্টি থামায়নি। আহমদ মুসা ক্রুশ বোর্ডটি সিঁড়ি বরাবর ফেলে রেখে দেয়ালের আড়ালে পজিশন নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ওদের ধারণা দেয়া যে আহমদ মুসা উপরের দিকে পালিয়েছে। এইভাবে ওদের সেখানে থামতে বাধ্য করা। স্বাভাবিকভাবেই তখন তাদের সামনের দিকে গুলী বর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে।
ওদের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি উৎকর্ণ আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগারে হাত রেখে অপেক্ষা করছে।
আহমদ মুসার পরিকল্পনা সফল হলো। সত্যিই ওরা সিঁড়ি বরাবর এসে মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। বিভিন্ন দিকে যাবার জন্যে ভাগ হবার সময় তাদের গুলী বর্ষণও মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিল।
এমন একটা মুহূর্তেরই অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ট্রিগারে হাত রেখে। তারপর ট্রিগার চেপে স্টেনগান ঘুরিয়ে নিল অর্ধচন্দ্রাকারে।
ওরা ছুটে এসেছিল পাঁচজন। পাঁচজনই লাশ হয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা পা পা করে চত্ববরের প্রান্তে ফিরে এল আবার। দেখল, প্রিন্সেস ক্যাথারিন আগের মতই চেয়ারে বসে আছে। একা।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্রিন্সেস একা কেন? দু’পা এগুলো সে ক্যাথারিনের দিকে।
ঠিক এ সময়েই প্রিন্সেস ক্যাথারিন তার তর্জনী তুলে ধরল। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা ভূত দেখার মতই চমকে উঠে মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরটাকে গুটিয়ে নিয়ে বলের মত দ্রুত গড়িয়ে চলল পুবের করিডোরের দিকে।
আহমদ মুসা মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংগে সংগেই তার মাথার উপর দিয়ে একটা রিভলবারের গুলী চলে গেল।
এরপর আরও গুলী তাকে ফলো করল। কিন্তু আহমদ মুসা তীব্র গতির বলের মত গড়িয়ে পুবে করিডোরে ঢুকে গেল।
করিডোর লক্ষ্যে তখনও গুলী আসছিল।
আহমদ মুসা করিডোর থেকে একটা স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
পশ্চিমের করিডোর থেকে গুলীর আওয়াজ শুনল আহমদ মুসা। সেই সাথে শুনল বেশ কিছু পায়ের শব্দ। এ করিডোর লক্ষ্যেই গুলী আসছে।
আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কাছে পৌঁছা এবং তাকে উদ্ধারের চিন্তা বাদ দিল।
সে ছুটল বেরুবার জন্যে করিডোর ধরে পুব দিকে।
সামনে গিয়েই উত্তর-দক্ষিণ একটা করিডোর পেয়ে গেল আহমদ মুসা। দেখল, করিডোরটি দিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসছে একজন।
একেবারে তার মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। তার তর্জনি ট্রিগারে প্রস্তুত ছিল। তর্জনি ট্রিগারে চেপে ধরতেই এক ঝাক গুলী গিয়ে ঘিরে ধরল লোকটিকে।
লোকটির দেহ দক্ষিণ দিকে ছিটকে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা অনুভব করল, এ করিডোরে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বাতাস। দক্ষিন দিক থেকে আসছে। বুঝল আহমদ মুসা, গেটটা দক্ষিণ দিকে এবং কাছেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে লাশটি ডিঙিয়ে ছুটল দক্ষিণ দিকে।
কিছুদূর এগিয়েই একটা কক্ষের বড় দরজায় গিয়ে শেস হলো করিডোরটি।
দরজাটি খোলা।
পেছনে করিডোরের ওপ্রান্ত থেকে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ সে শুনতে পেল।
আহমদ মুসা দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল।
দেখল, সোজা সামনেই ঘরের বিপরীত দিকে আরেকটা বড় দরজা। দরজার উপরের দিকটা জানালা। খোলা। দরজা বন্ধ।
দরজা খুলে আহমদ মুসা দেখল, সামনে একটা ছোট চত্বর। তারপরেই বাইরে বেরুবার গেট।
আহমদ মুসা স্টেনগানটি ঘরে ফেলে দিয়ে হাতের গ্লাভসটি খুলে পকেটে ফেলে বেরিয়ে এল গেট দিয়ে। তারপর ছুটল পাবলিক কল অফিসের সন্ধানে।
বাড়িটার পাশেই মোড়ের উপর পেয়েগেল একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ।
টেলিফোন করল রুশ রাষ্ট্রদূত মিখাইল পাভেলের কাছে। পেয়ে গেল তাকে। বলল, ‘জোয়ান অব আর্ক অ্যাভেনিউ-এর ৭১ নম্বর বাড়িতে এই মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিন্সেস ক্যাথারিন বন্দী আছেন। অবিলম্বে বাড়িটি সার্চ করতে পারলে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করা যেতে পারে।’
‘তুমি কোথায়?’
‘বাড়িটার পাশ থেকে টেলিফোন করছি। আমাকে আটকে রেখেছিল সেখানে। আমি বেরুতে পেরেছি।’
‘প্রিন্সেস ঠিক আছেন?’
‘ভাল আছেন।’
‘ওকে পুলিশকে জানিয়ে আমি এখুনি আসছি।’
আহমদ মুসা টেলিফোন রেখে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে বন্দী করে রাখা সেই বাড়িটার সামনে এসে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
ওদিকে যারা আহমদ মুসাকে তাড়া করে এসেছিল গেট পর্যন্ত, তারা ফিরে গেল প্রিন্সেস ক্যাথারিন যেখানে বসেছিল সেই ব্যালকোনির সামনে। তাদের মধ্যে একজন ব্যালকোনিতে রিভলবার হাতে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের পাশে দাঁড়ানো লোকটির দিকে চেয়ে বলল, ‘মিঃ উস্তিনভ, শয়তানটা পালিয়েছে।’
‘খবরটা বলতে লজ্জা করছে না? তোমরা কয়েক ডজন মানুষ তাকে আটকাতে পারলে না, মারতেও পারলে না।’ বলল উস্তিনভ।
কোন কথা বলতে পারলো না নিচে দাঁড়ানো লোকটা। নিরুত্তর লোকটি মাথা নত করল।
‘কতজন মারা গেছে আমাদের?’
‘এগার জন স্যার।’
‘যাও এখন আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজে জমায়েত হও।’
বলে প্রিন্সেস ক্যাথারিনের দিকে চেয়ে একটা ছোট্ট বাউ করে বলল, ‘চলুন মহামান্য প্রিন্সেস। লোকটি বড় এক ক্রিমিনাল। নিশ্চয় কোন বড় গ্যাং-এর সদস্য। আপনাকে পণবন্দী করে টাকা আদায় ওদের লক্ষ্য। আমরা চেষ্টা করেছিলাম, প্রিন্সেস তাতিয়ানা ওদের কবলে পড়েছে কি না তা জানতে।’
প্রিন্সেস ক্যাথারিন উঠে দাঁড়াল। মনে মনে হাসল তার কাহিনী সাজানোর বহর দেখে। বলল মনে মনে, যারা টাকার লোভে কিছু করে, তারা টাকার চেয়ে জীবনকে বড় করে দেখে। সুতরাং তারা এক পাশে টাকা, অন্যপাশে জীবন থাকলে জীবনকেই বেছে নেয়। কিন্তু লোকটি তো তা নেয়নি। জীবন দিতে সে রাজী হয়েছিল, তবু কোন কথাই সে প্রকাশ করতে রাজী হয়নি। তার রক্তাক্ত দেহটা প্রমাণ করেছে কি অকথ্য নির্যাতন সে সহ্য করেছে। টাকার জন্যে কেউ এত কষ্ট সহ্য করে না, বরং টাকার বিনিময়ে সে নির্যাতন থেকে বাঁচতে চায়, কথাও প্রকাশ করে দেয় বাঁচার জন্যে।’
প্রিন্সেস হাঁটতে হাঁটতে আরও ভাবল, লোকটির সাথে তার আরও ভাল ব্যবহার করা উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল তার জানা অনেক কথা। নিশ্চয় লোকটি তাকে সাহায্য করতেই এসেছিল। এদেরও সন্দেহ এবং লোকটির কথায় পরিষ্কার হয়ে গেছে, তাতিয়ানা সম্পর্কে সব তথ্য সে জানে।
খুবই আপসোস হলো প্রিন্সেস ক্যাথারিনের লোকটিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারার জন্যে।
কিন্তু আবার ভাবল, তার দোষ কি! একজন এশিয়ান রুশ প্রিন্সেসদের সাহায্য করতে আসবে, একথা তো স্বাভাবিক নয়।
আসলে কে লোকটি! যেই হোক সে অসাধারণ। এমন লোকের মুখোমুখি সে জীবনে হয়নি। শুধু এগারজন লোককে মেরে পালাতে পেরেছে বলে নয়, একজন রুশ প্রিন্সেসের সাথে তার কথা বলার সময় ঋজুতা তার মধ্যে দেখা গেছে। সেটাও ক্যাথারিনের কাছে নতুন।
আনমনা হয়ে ক্যাথারিনের চলা ধীর হয়ে পড়েছিল।
‘মহামান্য প্রিন্সেস একটু দ্রুত চলতে হবে, আমাদের তাড়া আছে।’
বলল উস্তিনভ।
‘আপনারা বলছেন, আপনারা আমাদের সাহায্য করার জন্যেই সবকিছু করছেন। কিন্তু আমরা তো এই খুনোখুনি চাইনি। চাই না।’
উস্তিনভের কঠিন ঠোঁটে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘প্রয়োজনেই এসব হচ্ছে। আমরা তো শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারি না, আপনাকে তাদের হাতে তো তুলে দিতে পারি না।’
‘কিন্তু লোকটিকে তো আপনারাই ধরে এনেছিলেন, সে তো চড়াও হতে আসেনি!’
‘ম্যাডাম প্রিন্সেস, মাফ করবেন। আপনার এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়িত্ব আমার নয়।’
বলে দ্রুত চলার জন্যে প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে আবার তাড়া দিল উস্তিনভ।

রুশ রাষ্ট্রদূত পাভেলের ফ্যামিলি ড্রইং রুমে আহমদ মুসা দুই হাত ছড়িয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসে। জীবন্ত একটা হতাশা খচ খচ করছে তার অন্তরে।
প্রায় মুঠোর মধ্যে পেয়েও প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সে উদ্ধার করতে পারলো না। তাঁকে রেখেই তাকে পালিয়ে আসতে হলো।
আহমদ মুসা টেলিফোন করার ৫ মিনিটের মধ্যেই একটা অগ্রবর্তী পুলিশ দল সেখানে পৌঁছেছিল। তারা ঘিরে ফেলেছিল বাড়িটিকে। সাত মিনিটের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পাভেল সেখানে পৌঁছে। আরও পুলিশও পৌঁছেছিল।
কিন্তু বাড়িতে কিছুই পাওয়া যায়নি। পাওয়া গিয়েছিল শুধু এগারটি লাশ।
প্রিন্সেস ক্যাথারিন যে ঘরে ছিল, সে ঘরেও আহমদ মুসা তাদের নিয়ে গিয়েছিল। সে ঘরে তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও কাপড়াদি পাওয়া গেছে। সে সবে তাঁর ফিংগারপ্রিন্টও পাওয়া গেছে।
আহমদ মুসারা পৌঁছার আগেই ওরা পালিয়েছে প্রিন্সেসকে নিয়ে। পালাবার পথও খুঁজে পাওয়া গেছে। বাড়ির আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে একটা টানেল বাইরে বেরিয়ে গেছে। সে পথেই তারা পালিয়েছে।
আহমদ মুসার সামনে অন্ধকার। কোন পথে এগুবে তার কোন ইংগিত তার কাছে নেই। এমনকি প্রিন্সেসকে কিডন্যাপকারী ঐ লোকদের দলের বা গ্রুপের নাম-পরিচয় পর্যন্ত জানা হয়নি।
আহমদ মুসার চেয়েও হতাশ বেশী রুশ রাষ্ট্রদূত পাভেল। খবরটি মস্কোকে জানাবার পর সে ভয়ানক বকুনি খেয়েছে সেখান থেকে। পাভেলই ডেকে এনেছে আহমদ মুসাকে সামনে এগুবার কোন পথ বের করা যায় কিনা তা আলোচনার জন্যে।
পাভেলও হাত কপালে রেখে গা এলিয়ে দিয়েছিল সোফায়।
একসময় সে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘তোমাকে মোবারকবাদ ইয়ংম্যান, তুমি প্রিন্সেসের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলে এবং তাকে উদ্ধারের চেষ্টাও করেছ। এখন কি করা যায়, ঐ ধরনের সুযোগ আবার কি করে সৃষ্টি করা যায়?’
আহমদ মুসাও সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ওঁকে যারা কিডন্যাপ করেছে তারা রাশিয়ান। আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমার মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
‘হ্যাঁ তার পারে। কিন্তু এখনও কিছুই পারেনি।’
‘ফ্রান্সে বিশেষ করে প্যারিসে রুশ কম্যুনিটির খোঁজ খবর তো আপনারা অবশ্যই রাখেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘কম্যুনিস্ট সরকারের আমলে এটা রুশ দূতাবাসের একটা প্রধান দায়িত্ব ছিল। কিন্তু এখন ঐভাবে খোঁজ-খবর রাখা হয় না।’
একটু থামল। থেমেই আবার শুরু করল রাষ্ট্রদূত পাভেল, ‘তবে একটা যোগাযোগের ব্যবস্থা সবার সাথেই আছে। তারাও দূতাবাসে আসে। আমরাও তাদের আমন্ত্রণে তাদের আয়োজন-অনুষ্ঠানে গিয়ে থাকি।’
‘এসব আয়োজন ও আয়োজকদের ফটো এ্যালবাম আপনারা সংরক্ষণ করেন না?’
‘হ্যাঁ, কিছু কিছু আমরা করি। দেখতে চাও এ্যালবাম?’
‘দেখালে বাধিত হবো।’
‘অল রাইট’ বলে রাষ্ট্রদূত পাভেল টেলিফোন তুলে নিল হাতে। ডায়াল করল। বলল, ‘ওলগা মা, আমার কম্প্যুটারে দেখ প্যারিসের রুশ কম্যুনিটির একটা ফাইল আছে। ফাইলের একটা প্রিন্ট নিয়ে এস তো মা।’
‘এত বড় ফাইলের কেন দরকার পড়ল? তোমার সাথে ওখানে কে আব্বা?’ ওপার থেকে বলল তার মেয়ে ওলগা।
‘কেন তোমাদের সেই সেভিয়ার, এশিয়ান ইয়ংম্যান।’
‘ও, নাইস, আসছি আব্বা।’
ক’মিনিটের মধ্যেই ওলগা এসে প্রবেশ করল ড্রইং রুমে।
প্রবেশ করেই আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ আব্দুল্লাহ, আপনাকে অভিনন্দন। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ ও ফরাসি পুলিশ যা করতে পারেনি, আপনি তাই পেরেছেন। প্রিন্সেস উদ্ধার হয়নি বটে, কিন্তু জানা গেল তিনি কি অবস্থায় আছেন।’
‘ওয়েলকাম মিস ওলগা। উদ্ধার আসল কাজ, সেটাই তো হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাঁর কাছে পৌঁছতে পারা, তার অবস্থার কথা জানা, এটাও ছোট খবর নয়।’
মুহূর্তের জন্যে থামল ওলগা। আবার শুরু করল। ‘আপনার শরীর এখন কেমন? মুখের আহত জায়গা সম্পূর্ণ সারেনি দেখছি।’
‘কিছু অসুবিধা আছে। কিন্তু আমি সুস্থ।’
‘মা, ফাইলটা দাও’ আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল রাষ্ট্রদূত।
আহমদ মুসা ফাইলটি ওলগার হাত থেকে নিল। ফাইলে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
‘আসছি আব্বা, আসছি মিঃ আব্দুল্লাহ’ বলে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল ওলগা।
ফাইলে অনেক ফটো। কোনটি গ্রুপ, কোনটি সিংগেল। ফটোর ক্যাপশনে প্রত্যেকের পরিচয় লেখা আছে।
আহমদ মুসা শুধু ফটোগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে চলল। দরকার হলে ক্যাপশন দেখে নেয়া যাবে।
দু’টো ফাইল। প্রথমটিতে প্যারিসের রুশ কম্যুনিটির লোকদের নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের ছবি। আর দ্বিতীয় ফাইলে রয়েছে দূতাবাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছবি ও তাদের পরিচয়।
প্রথম ফাইলে সন্দেহ করারর মত কাউকেই পেল না। হাতে তুলে নিল দ্বিতীয় ফাইল-দূতাবাস কমকর্তা সচিত্র ডসিয়ার।
‘ও ফাইলে কিছু পেলে না, না? তাহলে ক্রিমিনালরা আরও অপরিচিত কেউ।’
আহমদ মুসা দূতাবাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফটো ডসিয়ারটা বন্ধ করে টিপয়ের
উপর রাখতে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রদূত পাভেল বলল, ‘ডসিয়ারটা দেখ। আমাদের সবাইকে তো চেননা। চেনা থাকলে উপকার হতে পারে তোমার আমাদের সকলেরই।’
আহমদ মুসা আবার হাতে তুলে নিল ফটো ডসিয়ারটা।
রাষ্ট্রদূত পাভেল একটা খবরের কাগজের পাতায় মনোযোগ দিয়েছিল। আর আহমদ মুসা একের পর এক পাতা উল্টিয়ে দেখে যাচ্ছিল ডসিয়ারটা।
হঠাৎ একটা ফটোর উপর চোখ পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আহমদ মুসা। আবার চট করে তাকাল রাষ্ট্রদূত পাভেলের দিকে। দেখল, তার চোখ দু’টি কাগজে নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা ছবিটির পাশের পরিচিতি পড়ল। পড়ে আরেক দফা চমকে উঠল সে। মায়োভস্কি ফ্রান্সের রুশ দূতাবাসের কেজিবি প্রধান?
ছবিটি মায়োভস্কির। প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে যারা বন্দী করে রেখেছে, মায়োভস্কি তাদেরই একজন। আহমদ মুসাকে ক্যাথারিনের বন্দীখানায় ইন্টারোগেট করেছে, নির্যাতন করেছে এই মায়োভস্কিই।
গোটা দেহে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার। গোটা দূতাবাস কি প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কিডন্যাপের সাথে জড়িত? রাষ্ট্রদূত পাভেল কি তার সাথে অভিনয় করছেন? খেলছেন কি তিনি আহমদ মুসার সাথে? এই খেলা, এই অভিনয়ের উদ্দেশ্য কি? এই আশংকার পাশেই আবার ভাবল সে, সরকারের মধ্যেও সরকার থাকে। হতে পারে, মায়োভস্কি এবং তার সাথীরা দূতাবাসের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু কোনটা সত্যি তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। কূটনীতিকদেরকে নিখুঁত অভিনয়ও জানতে হয়। সুতরাং হঠাৎ করে তাদের স্বরূপ সন্ধান মুশকিল।
‘কি ভাবছ তুমি? মনে হচ্ছে তুমি বিমূঢ় হয়ে পঢ়েছ।’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
আহমদ মুসা হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। চারদিকে অন্ধকার দেখছি। বুঝতে পারছি না কোন পথে এগুব।’
‘আমারও তো একই অবস্থা। কিন্তু এ নিয়ে তো ভেংগে পড়ার দরকার নেই।’
‘আপনাদের এখানকার গোয়েন্দা দফতরে কি এ এলাকার ক্রিমিনালদের কোন তালিকা আছে?’
‘আছে। কিন্তু তা দিয়ে কি হবে? কাউকে সন্দেহ করলে না তার সন্ধান করবে ছবিতে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কিডন্যাপকারী যাদের তুমি দেখেছ, তাদের সন্ধান করতে চাচ্ছ?’
আহমদ মুসা মুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, ‘ওরা আপনার এ্যালবামে থাকবে না।’
ভ্রু-কুঞ্চিত করল রাষ্ট্রদূত পাভেল। প্রশ্ন করল, ‘তার অর্থ?’
“অর্থ হলো, আপনি দেখেছেন কিডন্যাপকারীদের সবগুলো লাশ রুশ। এর অর্থ প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে কিডন্যাপ করার সাথে রুশদের কোন গ্রুপ জড়িত। তাদের ফটো নিশ্চয় আপনার এ্যালবামে থাকবে না। নিশ্চয় আপনারা রীতি হিসাবে ফরাসি ও প্রতিপক্ষ ও অপরাধীদের উপরই শুধু চোখ রাখেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কিডন্যাপের সাথে শুধু রুশরা জড়িত থাকলে ফরাসি ক্রিমিনালদের ছবি দেখতে চাচ্ছ কেন?’
‘ক্রিমিনালরা অনেক সময় সাহায্যও করে।’
ক্রিমিনালদের ফটো ফাইল দেখল আহমদ মুসা। আসলে ফটো দেখা নয়, ক্রিমিনাল এরিয়ার লোকেশান সম্পর্কে একটা আইডিয়া নেয়াই তার উদ্দেশ্য। আহমদ মুসার বিশ্বাস, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে যদি প্যারিসে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে অপরাধ জগতের কোন বলয়ের প্রশ্রয়েই তাকে রাখা হবে। ক্যাথারিনের কাছে পৌঁছার বিশ্বস্ততম সূত্র তার কাছে এখন মায়োভস্কি। আহমদ মুসা যেখানে পৌঁছবে সেই সম্পর্কে আগাম একটা ধারণা পেতে চায়।
মায়োভস্কির কথা মনে হতেই আহমদ মুসার মনে আরেকটা প্রশ্নের সৃষ্টি হলো। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের কিডন্যাপের সাথে মায়োভস্কির জড়িত থাকার ব্যাপার যদি রাষ্ট্রদূত পাভেল জানতেন কিংবা তিনি নিজেও জড়িত থাকেন ঘটনার সাথে, তাহলে এমন অভিনয় কি সম্ভব? আহমদ মুসার অন্তর্ভেদী চোখেও মিঃ পাভেলের কোন অস্বাভাবিকতা তার চোখ-মুখ থেকে ধরা পড়ছে না।
পুনরায় আগের চিন্তাই আহমদ মুসার মনে আবার ফিরে এল, কূটনীতিকরা চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের চেয়েও সিরিয়াসস অভিনেতা হয়ে থাকে। আহমদ মুসাকেও অভিনয় করতে হবে। রাষ্ট্রদূত পাভেলের বাসায় না এলে তো মায়োভস্কির পরিচয় ও ঠিকানা জানা যেত না। মায়োভস্কি আহমদ মুসার কাছে এখন সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি।
আহমদ মুসার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। মায়োভস্কির বাসা কোথায়? ওর উপর চোখ রাখলেই নিশ্চিত ক্যাথারিনের কাছে পৌঁছা যাবে।
‘অনুমতি দিন, আমি উঠতে চাই।’ একটু সময় নিয়ে আহমদ মুসাই আবার বলল।
‘তাহলে কি ঠিক হলো? কি ভাবছ তুমি এখন?’ বলল রাষ্ট্রদূত পাভেল।
‘চিন্তা করছি। আপনার গোয়েন্দা বিভাগ আজকের ঘটনার সূত্র ধরে কি করছে সেটাও দেখুন।’ উঠতে উঠতে বলল আহমদ মুসা। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাষ্ট্রদূত পাভেলের চোখের উপর নিবদ্ধ। প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায় আহমদ মুসা।
‘মায়োভস্কিদের সাথে কথা বলেছি। তারা চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি আশাবাদী নই।’
‘কিন্তু আমার মতে আশাবাদী বেশী হবার কথা। রুশ ক্রিমিনালদের সম্পর্কে সবকিছুই কেজিবি’র জানার কথা।’
‘রুশরা জড়িত থাকার ব্যাপারটা এই প্রথম জানা গেল। এখন এ বিষয়টাকে তারা সিরিয়াসলি দেখবে। তবু আমি খুব আশাবাদী নই।’
‘কারণ?’
একটা ঢোক গিলল রাষ্ট্রদূত পাভেল। বলল, ‘তুমি যে কেজিবি’কে চেন, সে কেজিবি এখন নেই। এখন আমরা অফেনসিভ নই, ডিফেনসিভ। কোন মিশন না থাকলে এমন ডিফেনসিভ হয়ে পড়তে হয়।’
‘ঠিকই বলেছেন।’ বলে আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল পাভেলের দিকে।
আহমদ মুসা রাষ্ট্রদূত পাভেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবল, পাভেলের শেষ কথাটা একটা সত্যের প্রকাশ, না ক্ষোভের বিস্ফোরণ! ক্ষোভের বিস্ফোরণ হলে সে এবং মায়োভস্কি এক পক্ষের লোক হতে পারে।

রাষ্ট্রদূত পাভেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আহমদ মুসা খুবই একাকিত্ব বোধ করছিল। সে নিশ্চিত হয়েছিল, রাষ্ট্রদূত পাভেলের কোন কথার উপর বিশ্বাস করা তার ঠিক হবে না। মায়োভস্কি এবং পাভেল যে আলাদা তা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করা যাবে না।
মায়েভস্কির উপর চোখ রাখছিল আহমদ মুসা।
সেদিন মেঘ না চাইতেই পানি।
রুশ দূতাবাসের বিপরীত দিকের কার পার্কে তার গাড়িতে বসে আহমদ মুসা দেখল, মায়োভস্কি এবং তার সাথে একজন লোক গাড়িতে উঠছে। দ্বিতীয় লোকটিকে আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সেই বন্দী খানায় দেখেছিল মায়োভস্কির সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময়। খুশী হলো আহমদ মুসা, তারা দু’জন এক সাথে গাড়িতে উঠার অর্থ তারা কোন মিশনে যাচ্ছে।
প্রথমে গাড়িতে উঠল দ্বিতীয় লোকটি। তারপর মায়োভস্কি হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উটে বসল।
ছুটে চলল ওদের গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি ফলো করল তাদের।
শুরুতেই মায়োভস্কিদের গাড়ি লাফিয়ে উঠে তীব্র গতিতে চলতে শুরু করেছে। মায়োভস্কির হাত ঘড়ি দেখা এবং শুরু থেকেই তাদের গাড়ির এমন গতি থেকে আহমদ মুসা বুঝল, সুনির্দিষ্ট সময়ের কোন সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামে ওরা যাচ্ছে। দেরী হওয়ায় সময় কভার করতে চাচ্ছে জোরে গাড়ি চালিয়ে। একান্ত গরজে না পড়লে প্যারিসের রাস্তায় এভাবে কেউ গাড়ি চালায় না।
একই গতিতে চলছিল আহমদ মুসা ওদের পেছনে নিরাপদ একটা ব্যবধান রেখে।
সময়টা বিকেল। শহরের উপকণ্ঠে চলে এসেছে তাদের গাড়ি।
মায়োভস্কির গাড়ির গতি আরও বেড়েছে। ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলছে তার গাড়ি।
হঠাৎ মায়োভস্কির গাড়ি ওভারটেক করার জন্যে ভিন্ন লেনে টার্ন নিতে গিয়ে সামনের একটি পিকআপের সাথে একসিডেন্ট করে বসল।
মায়োভস্কির গাড়ি পিকআপটিকে পেছন থেকে ঠুকে দিয়ে সামনে বেরিয়ে গিয়েছিল। পিকআপটি ছিটকে গিয়ে কাত হয়ে পড়েছিল।
মায়োভস্কির গাড়ি চলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা স্পটটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে দেখল, একটি বালক গাড়ি থেকে ছিটকে মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটির উপর। রক্তে লাল হয়ে উঠেছে মাটি।
আহমদ মুসা ভুলে গেল মায়োভস্কিকে অনুসরণ করার কথা।
আহমদ মুসা তার গাড়ি রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে ছুটল বালকটির দিকে। বালকটিকে কোলে তুলে নিয়ে তার গাড়ির দিকে আসার জন্যে পা বাড়িয়ে তাকাল পিকআপটির দিকে। দেখল, একটি মেয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। সেও আহত।
আহমদ মুসা তার দিকে এগিয়ে বলল, ‘আসুন আমার গাড়িতে।’
বালকটিকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিল আহমদ মুসা। মেয়েটি উঠে বসল তার পাশে।
মেয়েটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ বছর। তীক্ষ্ণ চোখ। স্লীম শরীর, স্পোর্টসম্যান ফিগার। লাবণ্য ভরা মিষ্টি চেহারা।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার পরিচিত কোন ক্লিনিক…।’
‘আমাদের বাড়ির দিকে সোজা সামনে চলুন।’
আহমদ মুসার গাড়ি তীর বেগে এগিয়ে চলল সামনে। মায়োভস্কির গাড়িও এ পথেই গেছে।
আমরা কি কোন ক্লিনিকে যাচ্ছি?’ ঘাড়টা ঈষৎ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ফ্যামেলি ক্লিনিকে সব ব্যবস্থা আছে। পিটার দেখা যাচ্ছে জ্ঞান হারায়নি।’
‘ছেলেটার নাম পিটার?’
‘হ্যাঁ, পিটার পাওয়েল। আর আমি জাহরা ইভানোভা।’
‘ওয়েলকাম। দু’টোই সুন্দর নাম।’
গাড়ির চলার বেগটা আরও বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল আহমদ মুসা।

প্যারিস উপকণ্ঠে একটা সবুজ গ্রাম। একটা সবুজ টিলার উপর দূর্গ সদৃশ বাড়ি।
বাড়িটা থেকে একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে এসেছে উপত্যকায়। আর একটা গাড়ির রাস্তা টিলার গা বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে বাড়িটার বিশাল গেটে।
গেটের সামনে লম্বা আকৃতির একটা বাগান। তার একদিকের রাস্তা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করে, অপরদিকেরটা দিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যায়।
বাড়িটার কেন্দ্রবিন্দু বরাবর ভুগর্ভস্থ একটা বিশাল কক্ষ। কক্ষের মধ্যখানে একটা টেবিলের তিন দিকে বসে গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ এবং মায়োভস্কি। গ্রেগরিংকো রাশিয়ার ‘গ্রেট বিয়ার’-এর হোম এ্যাফেয়ার্সের প্রধান। উস্তিনভ ‘গ্রেট বিয়ার’-এর ‘অপারেশন রাজচক্র’কে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর মায়োভস্কি প্যারিসস্থ রুশ দূতাবাসের কেজিবি প্রধান এবং অপারেশন রাজচক্র-এর ইউরোপীয় ইউনিটের প্রধান।
‘এশিয়ান লোকটি কে? এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা সে ঘটাল, বিশ্বাস করতে বল?’ কথা বলছিল গ্রেগরিংকো। তার চেহারায় প্রবল বিরক্তির ছাপ।
‘অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে আমার কাছেও। জরুরী কল পেয়ে আমাকে যখন চলে আসতে হয়, তখন তাকে ক্রুশ বোর্ডে সেট করা শুধু বাকি ছিল। চারটি স্টেনগান ও একটা রিভলবারেরর বেষ্টনির মধ্যে ছিল সে। এই অবস্থায় এত কিছু ঘটা কিভাবে সম্ভব আমি বুঝতে পারছি না।’ বলল মায়োভস্কি শুকনো কণ্ঠে।
‘যে বিবরণ শুনলাম, তাতে তোমার পাঁচজন কি করবে। মুক্ত অবস্থায় শতজনের কাছেও সে ভয়ংকর। কে এই লোক।’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘জানা যায়নি। তবে কেউ তাকে নিয়োগ করেছে।’ বলল উস্তিনভ।
‘কেন, কি উদ্দেশ্যে? ক্যাথারিনকে উদ্ধার করার জন্যে?’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘এ বিষয়টা তো পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুক্ত হবার পর সে পুলিশ নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছিল। রুশ রাষ্ট্রদূতও সেখানে গিয়েছিল।’
‘তাহলে আমাদের রুশ সরকার কি তাকে নিয়োগ করেছে বলে আমরা ধরে নেব?’
‘ঘটনাচক্র তাই বলে। কিন্তু ব্যাপারটা সত্য নয়। রুশ সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অবশ্যই আমি জানতাম। তাছাড়া এই কাজে একজন এশিয়ানকে নিয়োগ করার মত অসহায় অবস্থায় রুশ সরকার নিশ্চয় পৌঁছেনি।’ বলল মায়োভস্কি।
‘তোমার কথায় যুক্তি আছে মায়োভস্কি, কিন্তু তাহলে তার পরিচয় কি, এল কোত্থেকে?’ প্রশ্ন তুলল গ্রেগরিংকো।
সেটাই প্রশ্ন। প্যারিসে হঠাৎ করেই উদয় হয়েছে তার। মনে হয় তার উদয়ের সাথে তাতিয়ানার কোন সম্পর্ক আছে।’ বললো উস্তিনভ।
‘তাহলে তো ব্যাপারটা আরও সাংঘাতিক। আমরা তো তাতিয়ানার সাথে যুদ্ধে নামিনি, তাহলে তার লোকের সাথে আমাদের যুদ্ধ কেন? আমরা ক্যাথারিনের মত তাতিয়ানাকেও হাতে পেতে চাই।’ বলল গ্রেগরিংকো।
‘তার সাথে তাতিয়ানার সংশ্লিষ্টতার বিষয় স্পষ্ট নয়।’ বলল মায়োভস্কি।
‘সে কেন প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করতে চায়, কেন তার পক্ষে সে কাজ করছে, এ বিষয়টা পরিষ্কার হলেই ও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ বলল উস্তিনভ।
গ্রেগরিংকো নড়ে-চড়ে বসে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল এ সময় সামনের দেয়ালে সেট করা কম্পিউটারে রেড সিগন্যাল জ্বলে উঠল, সেই সাথে বিপ বিপ শব্দ।
ওরা তিনজনই মুখ তুলে সে দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তিনজনই ওরা এ্যাটেনশন হয়ে বসল। ওদের চোখে-মুখে প্রবল ভয় ও ভক্তির ছাপ।
ওদের সামনে দেয়ালে টিভি স্ক্রিন। ওদের তিন জোড়া চোখ সে স্ক্রিনের উপর নিবদ্ধ।
টিভি স্ক্রিনে ধীরে ধীরে মুখোশ ঢাকা একটা মুখ ভেসে উঠল।
ওরা তিনজনই মাথা নুইয়ে তাকে বাউ করল। মুখে উচ্চারণ করল ‘মহামান্য আইভান দি টেরিবল, আমরা আপনার খেদমতে।’
গ্রেট বিয়ারের বর্তমান নেতা ‘আইভান দি টেরিবল’ নাম গ্রহণ করেছে। রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় পিটার দি গ্রেটের পর সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেন আইভান দি টেরিবল। অতি নিষ্ঠুর এই শাসকের সময়েই সাইবেরিয়া এবং ভলগা নদী পর্যন্ত ভূখন্ড রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। রুশ রাজধানী হিসেবে মস্কোর পত্তন তিনিই করেন।
আইভান দি টেরিবলের অনুসরণে গ্রেট বিয়ার রুশদের জন্যে উৎকট ধরনের পুঁজিবাদী ডিক্টেটরশীপ কায়েম করতে চায়। রুশ সরকার নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধীনে রাশিয়ায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তারও বিরোধী এরা।
মুখোশধারীর মুখ নড়ে উঠল। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো,‘রাশিয়ার প্রিয় সন্তানগণ, রাশিয়ার বার জন মহান সন্তান নিহত হওয়ার ঘটনায় আমি যারপরনাই দুঃখিত ও বিস্মিত। বিস্ময় এজন্যে যে তোমাদেরকে কারো হাতে পরাজয় বরণের জন্যে পাঠানো হয়নি। বিস্ময় আরও এজন্যে যে, হত্যাকারীকে এখনও তোমরা ধরতে পারনি, সে এখনও জীবিত। তোমাদের এই ব্যর্থতার কারণে আমাদের গোপন পরিকল্পনা বাইরে প্রকাশ হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে, এটা ক্ষমার যোগ্য নয়।’ থামল মুখোশধারী।
এদের তিনজনেরই মুখ তখন ভয়ে ফ্যাকাশে। আবার কণ্ঠ ধ্বনিত হলো মুখোশধারীর। বলল, ‘আমি তোমাদের আরও কিছু সময় দিচ্ছি। মনে রেখ তার এক মুহূর্ত জীবিত থাকার অধিকার নেই। সে জীবিত থাকলে তোমরা বেঁচে থাকার অধিকার হারাবে। সব ঘটনার পর্যালোচনায় বুঝতে পারছি, প্রিন্সেস ক্যাথারিন তাতিয়ানার খবর জানে না এবং আংটি ও ডায়েরীর খবরও তার জানা নেই। তাতিয়ানাকে হাতে পাওয়াই আমাদের এখন প্রধান কাজ। তাতিয়ানাকে খুঁজতে হবে তোমাদেরকেই। ইন্টারনেট-এর সাহায্য নিয়ে তোমরা গত ছয় মাসের ইউরোপীয় সব বিমান বন্দরের যাত্রী তালিকা নাও। বের কর সর্বশেষ তাতিয়ানা কোথায় ল্যান্ড করেছে। লোকেশন চিহ্নিত করার পর সেখানে জালের ছাঁকুনি দাও। পেতেই হবে তাতিয়ানাকে। প্রথমে গুপ্তধন উদ্ধার তারপর ওদের দেখে নেব। দীর্ঘজীবী হোক রাশিয়া এবং রাশিয়ার সন্তানরা।’ থামমল মুখোশধারী। তার ছবিও সরে গেল স্ক্রীন থেকে।
ওরা তিনজন তখনও পাথরের মূর্তির মত বসে আছে।
নীরবতা ভাঙলো গ্রেগরিংকো। বলল, ‘উস্তিনভ তুমি তোমার সর্বশক্তি নিয়ে তাতিয়ানার খোঁজে লেগে যাও। ইউরোপের ছয় মাসের যাত্রী চার্ট যোগাড় করো আজ, কাল দু’দিনের মধ্যেই। আর মায়োভস্কি, তোমার দায়িত্ব হলো এশিয়ান যুবককে জন্মের মত শিক্ষা দেওয়া। তাকে হত্যা কর যেখানে পাও।’
মায়োভস্কি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল ইন্টারকম। বলল, ‘মহামান্য গ্রেগরিংকো, জাহরা ইভানোভা এবং পিটার পাওয়েল এ্যাকসিডেন্ট করেছে। পিটার সাংঘাতিক আহত, ইভাও ছোট-খাট আঘাত পেয়েছে।’
জাহরা ইভানোভা এবং পিটার পাওয়েল বাড়িটার মালিক নিকিতা স্ট্যালিনের দুই সন্তান। নিকিতা ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণকারী একজন ধনাঢ্য রুশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন ভিন্নমতালম্বী বিদ্রোহী হিসেবে সে ফ্রান্সে আশ্রয় পায়। কিন্তু কার্যত সে ছিল কেজিবি’র হার্ডকোর লবীর একজন প্রতিভাবান এজেন্ট। সে এখন ফ্রান্সে গ্রেট বিয়ারের প্রধান অবলম্বন। কোটিপতি নিকিতা এখন গ্রেট বিয়ারের গড ফাদারের ভূমিকা পালন করছে। তার মেয়ে জাহরা ইভানোভাও গ্রেট বিয়ারের একজন কর্মী।
‘ও গড! মিঃ নিকিতাকে জানান হয়েছে?’
‘তিনি এখন লন্ডনে। জানানো হচ্ছে।’
‘ডাঃ জ্যাকভ আছেন?’
‘তাকে টেলিফোন করা হয়েছে, আসছেন তিনি।’
‘অল রাইট, আমরা আসব।’
টেলিফোন রেখে গ্রেগরিংকো বলল, ‘ইভানোভা ও পিটার এ্যাকসিডেন্ট করেছে, চল দেখি।’
বলে গ্রেগরিংকো উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে অপর দু’জনও।

বাড়ির কাছাকাছি হয়েই ইভানোভা গাড়িরর ইমার্জেন্সী সাইরেনের সুইচ অন করে দিয়েছিল।
গাড়ি নিয়ে আহমদ মুসা ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়াল।
গ্রামীণ পরিবেশে টিলার উপরে নির্মিত বাড়িটি মুগ্ধ করল আহমদ মুসাকে।
বাড়ির ক্লিনিক অংশটি বাড়ির এক প্রান্তে। বাড়ির সম্মুখস্থ মূল চত্বর অতিক্রম করেই ওখানে যেতে হয়।
গাড়ি দাঁড়াবার সাথে সাথেই অপেক্ষমান দু’জন এ্যাটেনড্যান্ট ছুটে এলে।
ইভানোভা হেঁটেই ক্লিনিকে প্রবেশ করল। পিটার পাওয়েলকে নেয়া হলো স্ট্রেচারে।
কিন্তু সার্বক্ষনিক ডাক্তার তখন ক্লিনিকে হাজির নেই। জরুরী কল পেয়ে কোথাও গেছেন। বিকল্প এখনও এসে পৌঁছেনি।
অপেক্ষা করার সময় ছিল না।
আহমদ মুসাই পিটার পাওয়েল এবং ইভানোভার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। রক্ত পড়া বন্ধ হলো পাওয়েলের। দু’টি দাঁত ভাঙা ও চোখের নিচটায় বড় একটা ক্ষতের সৃষ্টি হওয়া ছাড়া বড় কোন ক্ষতি তার হয়নি। ইভানোভার কপালের একপাশ থেতলে ও কেটে গেছে। আরও কয়েক জায়গায় ছোট খাট আঘাত পেয়েছে ইভানোভা।
ব্যান্ডেজ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানোভা বলল, ‘আপনি কি ডাক্তার?’
‘না।’
‘ও তাহলে কোথাও কাজ করেছেন বুঝি?’
‘না তাও নয়।’
বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল ইভানোভার চোখে মুখে। ভাবল, ফাস্ট এইড-এর কাজ অনেকেই জানে, কিন্তু এমন নিখুঁত হাতের কাজ প্রোফেশনাল ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভানোভা। একজন এ্যাটেনডেন্ট ছুটে এসে বলল, ‘মিঃ গ্রেগরিংকো আসছেন।’

তার কথা শেষ না হতেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করল উল্লেখিত গ্রেগরিংকোরা।
আহমদ মুসা, ইভানোভা ও সাথের অন্যান্যরা তখন ইমার্জেন্সী হল রুমে।
আহমদ মুসা গ্রেগরিংকোদের দিকে তাকিয়েই ভূত দেখার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সকলের পেছনে এসে মুহূর্ত কয়েক দাঁড়াল। তারপর হাঁটা দিল বিপরীত দিকের দরজার দিকে।
গ্রেগরিংকা, উস্তিনভ ও মায়োভস্কি এক সংগে প্রবেশ করেছে হল ঘরে।
ইভানোভা তাদের স্বাগত জানিয়ে ঘটনার বিবরণ দিল। তারপর আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে পেছন দিকে চাইল। পেছনে তাকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হলো ইভানোভা। ইভানোভা মনে করেছিল, অপরিচিত বলেই বোধহয় সামনে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। এখন পেছনে আহমদ মুসাকে না দেখে বলা যায় চমকেই উঠল ইভানোভা। গ্রেট বিয়ারের কর্মী হিসেবে এর মধ্যে প্রবল একটা অস্বাভাবিকতা আঁচ করল। কিন্তু ব্যাপারটা গ্রেগরিংকোদের কাছে প্রকাশ করতে চাইল না।
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,‘সম্ভবত উনি টয়লেটে গেছেন পরিষ্কার হবার জন্যে। অনেক পরিশ্রম হয়েছে ওর। চলুন পাওয়েলকে দেখবেন।’
বলে গ্রেগরিংকোদের নিয়ে ইভানোভা পাওয়েলের কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভদ্রলোকের নাম কি? কোথায় থাকেন?’ বলল উস্তিনভ।
ইভানোভা ঘুরে দাঁড়িয়ে সলজ্জ হেসে বলল,‘স্যরি, তাড়াহুড়োর মধ্যে কোনটাই জানার সুযোগ হয়নি।’
এই সময় ডাক্তারও এসে পৌঁছল।
ডাক্তারসহ সবাই পিটার পাওয়েলের কক্ষে প্রবেশ করল।
পিটার পাওয়েলকে দেখে ওরা চলে গেল। গাড়িতে ওদের বিদায় দিয়ে ইভানোভা ফিরে এল পাওয়েলের কক্ষে। দেখল, পাওয়েলকে নিয়ে ডাক্তার এবং নার্সরা অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেছে।
ইভানোভা আবার চারদিকে চাইল। আশেপাশে খোঁজ করল। কিন্তু আহমদ মুসাকে কোথাও পেল না।
ইভানোভার মনে প্রশ্নের অন্ত নেই। লোকটিকে যতটুকু সে বুঝেছে, তাতে এরকম কান্ড ঘটাবার লোক সে নয়। অত্যন্ত সপ্রতিভ, সতেচন, বুদ্ধিমান, স্পষ্ট, ঋজু ও সংবেদনশীল প্রকৃতির লোক সে। কিন্তু ওভাবে সে সরে পড়ল কেন? এখন ইভানোভার স্পষ্ট মনে হচ্ছে, গ্রেগরিংকোদের দেখার পরেই সে পেছনে সরে যায়। তাহলে কি সে গ্রেগরিংকোদের চেনা? কিন্তু চেনা হলেই সরবে কেন! চমকে উঠল ইভানোভা। তাহলে কি লোকটির পরিচয় এমন যে গ্রেগরিংকোদের সামনে পড়লে তার অসুবিধা হতো! কি সেই অসুবিধা যে তাকে অসৌজন্যমূলকভাবে পালাতে হলো? বড় ধরনের কোন ব্যাপার না হলে এমনটা ঘটতে পারে না।
এসব চিন্তা ভয়ানক উৎসুক করে তুলল ইভানোভাকে আহমদ মুসার ব্যাপারে।
ইভানোভা ছুটল আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে পার্ক করা ছিল সেখানে। না, গাড়ি ঠিকই আছে। তাহলে নিশ্চয় সে চলে যায়নি। কিন্তু কোথায় সে?
ইভানোভা ছুটল গেটে। জিজ্ঞেস করল গেটম্যানকে চেহারা ও পোশাক আশাকের বিবরণ দিয়ে।
গেটম্যান তার কম্প্যুটারে গেটের টিভি ক্যামেরার কয়েক ঘন্টার ছবি সামনে নিয়ে এসে দেখাল। না, লোকটি গেট দিয়ে বের হয়নি, স্বগত উচ্চারণ করল ইভানোভা।
গেট ছাড়া অন্যদিক দিয়ে বের হওয়া কঠিন। বাড়ির চারদিকের প্রাচীর বরাবর টিভি ক্যামেরার পাহারা রয়েছে। রয়েছে ঝটিকা পাহারাদারদের ক্যাম্প। যারা সন্দেহজনক কাউকে দেখলে পর মুহূর্তেই তাকে পাকড়াও করবে।
সুতরাং লোকটি ভেতরেই আছে, এই সিদ্ধান্তে স্থির হলো ইভানোভা।
ইভানোভা দ্রুত ফিরে এল। গিয়ে প্রবেশ করল পিতার কনট্রোল রুমে।
বিশাল বাড়িটার ঠিক মাঝ বরাবর স্বতন্ত্র একটা ব্লক নিয়ে তাদের বাড়ি। বাড়ির অবশিষ্ট অংশ গ্রেট বিয়ারের গোপন ঘাটি হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে ইভানোভাদের ব্লকের সাথে গোটা বাড়ির সংযোগ রয়েছে গোপন সুড়ঙ্গ পথের মাধ্যমে। আবার গোটা বাড়ির উপর নজর রাখার জন্যে টিভি ক্যামেরার একটা স্বতন্ত্র নেটওয়ার্ক-এর নিয়ন্ত্রণ হয় ইভানোভার আব্বার কনট্রোল রুম থেকে। ঘাটি এলাকার জন্যে ঘাটির একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে যা গ্রেট বিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ঘাটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে।
ইভানোভা টিভি প্যানেলের সামনে বসে কনট্রোল সুইচ এক এক করে টিপে চলল। একটি সুইচ টেপার সাথে সাথেই একটি কক্ষ বা করিডোরের চিত্র ভেসে উঠেছে।
এক সময় একটা সুইচ টিপতেই একটা ঘরের বন্ধ দরজায় আহমদ মুসাকে দাঁড়ানো দেখলো ইভানোভা।
চমকে উঠে ইভানোভা ঝুকে পড়ল টিভির উপর। সে দেখল, ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার লক গলিয়ে আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের চারদিকটা দ্রুত দেখল সে। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে একইভাবে পাশের ঘরে প্রবেশ করল। ঐভাবেই সারা ঘরে সে নজর বুলিয়ে চলল।
শিউরে উঠল ইভানোভা। ভাবল সে, লোকটা নিশ্চয় শত্রু পক্ষের সাংঘাতিক কেউ হবে। কিছু খুঁজছে সে? কি খুঁজছে? তাঁর টার্গেট কি গ্রেট বিয়ারের এ ঘাটির কনট্রোল রুম?
ইভানোভার গোটা শরীর শক্ত হয়ে উঠল উৎকণ্ঠায়। সে টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে টেলিফোন তুলে নিল হাতে। পেল ডিউটি অফিসারকে। বলল,‘মিঃ গ্রেগরিংকোকে এখনি জানান, আপনাদের ঘাটিতে সন্দেহজনক কেউ ঢুকেছে।’
কথা বলা অবস্থায়ও ইভানোভা সুইচ টিপে আহমদ মুসাকে অনুসরণ করছিল।
টেলিফোন করার পর ইভানোভার মনে কোথাও যেন একটা খোঁচা লাগল। যেই হোক লোকটা তার উপকার করেছে। ইভানোভা ও পিটার তার কাছে অনেক ঋণী। তাছাড়া অপরাধ প্রবণ মানুষকে সে চেনে। লোকটিকে দেখে চোখ, মুখ, কথা, আচরণ, হাসি-কোনদিক দিয়েই অপরাধী বলে মনে হয়নি।
মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল ইভানোভার। গ্রেগরিংকোদের হাতে পড়লে লোকটা নির্ঘাত মারা পড়বে।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, এমন শত্রুপুরিতে যে একা ঢুকতে পারে, অত্যাধুনিক লেসার বীম যার অস্ত্র সে সাধারণ শত্রু নয়। এমন শত্রুর শাস্তি হতেই হবে।
টিভি স্ক্রীনে ইভানোভার চোখ ফলো করছিল আহমদ মুসাকে। হঠাৎ এক সময় দেখল, আহমদ মুসা একটা কক্ষ সার্চ শেষে দরজা বন্ধ করে প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে গেল দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে।
ইভানোভা দেখেই বুঝতে পারল, ওটা মুসলমানদের নামায।
আহমদ মুসার এই মুসলিম পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথেই ইভানোভার মনে হঠাৎ করেই একটা বিস্ময়-বিমূঢ়তা নেমে এল। লোকটি তাহলে মুসলমান।
এই পরিচয় পাওয়ার সংগে সংগে ইভানোভার হৃদয়ের একটা বন্ধ দুয়ার যেন খুলে গেল। স্মৃতির দিগন্তে কিছু স্মৃতি ভীড় করে উঠল।
কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল ইভানোভা।
পরক্ষণেই সতর্ক হয়ে উঠল। কিন্তু দেখল, সে ঘরটিতে আহমদ মুসা নেই।
পরে পেয়ে গেল তাকে করিডোরে।
আহমদ মুসা একের পর এক ঘর সার্চ করে চলল, আর ইভানোভার চোখ তাকে অনুসরণ করল। ইভানোভা উদ্বেগের সাথে সাথে লক্ষ্য করলো, আহমদ মুসা ঘাটির কেন্দ্রীয় কনট্রোল রুমের কাছে এসে পড়েছে। সে কি এই কনট্রোল রুমেরই খোঁজ করছে? কে এই লোকটি? বিপজ্জনক লোক তো?
ইভানোভার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।
ইভানোভা তুলে নিল টেলিফোন।
গ্রেগরিংকোর টেলিফোন। বলল, ‘ধন্যবাদ মা, আমরা এসেছি। লোকটাকে আমরা লোকেট করেছি। সে আমাদের কনট্রোল রুমে ঢোকার চেষ্টা করছে। সব দিক থেকে আমরা ভেতরে প্রবেশ করছি।’
একটু থেমে গ্রেগরিংকো আবার শুরু করল,‘তুমি খবর দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তুমি কেমন করে বুঝতে পেরেছিলে যে, কেউ প্রবেশ করেছে?’
‘আমাদের যে লোকটি পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে যখন কোথাও খুঁজে পেলাম না, যখন দেখলাম তার গাড়িও আছে এবং গেটে জানলাম যে, সে গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়নি, তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, সে আমাদের ঘাটিতে প্রবেশ করতে পারে।’
ইভানোভা ইচ্ছা করেই সত্য গোপন করল। সত্য গোপনের আরেকটা কারণ, ঘাটি পর্যবেক্ষণ করার আলাদা টিভি ক্যামেরার নেটওয়ার্ক যে তার আব্বার আছে এটা গোপন বিষয়।
‘তোমাকে আবার ধন্যবাদ। তোমার অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়েছে। লোকটা বিপজ্জনক।’ বলল গ্রেগরিংকো ইভানোভা থামার সাথে সাথেই।
‘চেনেন তাকে?’
‘আমি চিনি না, কিন্তু উস্তিনভ ও মায়োভস্কি ওকে দেখেছে। এই লোকটিই সেদিন আমাদের ডজন খানেক লোক হত্যা করে আমাদের প্যারিসের ঘাটি থেকে পালায়।’
শুনে বিস্ময়-বিস্ফারিত হয়ে উঠল ইভানোভার চোখ।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভানোভা। কিন্তু ওপার থেকে গ্রেগরিংকো বলে উঠল,‘এখন রাখি মা। ওরা এগুচ্ছে, আমিও উঠি।’
টেলিফোন রেখে দিয়ে ইভানোভা টিভি স্ক্রীনের উপর ঝুঁকে পড়ে খুঁটে খুঁটে দেখল আহমদ মুসাকে। না, নিষ্পাপ একটি মুখ। চোখে-মুখে একটা উৎকণ্ঠা। কিন্তু সে উৎকণ্ঠায় কোন অপরাধের ছবি নেই। তার উৎকণ্ঠা বলছে, কোন হারানো জিনিস যেন সে খুঁজে পাচ্ছে না।
অন্য একটা টিভি স্ক্রীনের নব ঘুরিয়ে ইভানোভা দেখল, গ্রেগরিংকোর দল চারদিক থেকে ছুটে আসছে আহমদ মুসার দিকে।
হঠাৎ একটা উদ্বেগে ছেয়ে গেল ইভানোভার মন। প্রায় দেড় ডজন স্টেনগান ঘিরে ফেলেছে লোকটিকে। লোকটিকে হয় মরতে হবে, নয়তো আত্মসমর্পণ করতে হবে। কিন্তু তার সম্পর্কে যেটুকু জানল তাতে মনে হয়, সে আত্মসমর্পণ করার বদলে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। কারণ সে জানে, গ্রেট বিয়ারের ডজনখানেক লোক হত্যার শাস্তি তার কি হতে পারে। সুতরাং আত্মসমর্পণের তার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে সে মরবে?
কথাটা মনে হতেই হৃদয়ের কোথায় যেন যন্ত্রণা অনুভব করল। লোকটি তার এবং পিটারের উপকার বলেছে বলে নয়, কোন মুসলমানকে দেখলে এক ধরনের আবেগ অনুভব করে সে। এই আবেগ থেকেই এই যন্ত্রণা। মুসলিম লোকটি এমন বেঘোরে প্রাণ হারাবে তা তার হৃদয় মেনে নিতে পারছে না। অন্যদিকে আহমদ মুসাকে ক্রিমিনাল বলেও মনে করতে পারছে না।
প্রবল দ্বিধার মধ্যে পড়েছিল ইভানোভা।

এর মধ্যেই সে দেখল, গ্রেগরিংকোরা ঘিরে ফেলেছে আহমদ মুসাকে। গ্রেগরিংকোর হাতে হ্যান্ড মাইক। সে মাইক মুখের সামনে তুলে ধরল। ইভানোভা বুঝল, কিছু বলছে সে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগেই সে দেখল, ভূ-গভর্স্থ কনট্রোল রুমে নামার সিঁড়ি মুখের দরজায় দাঁড়ানো আহমদ মুসা সোল্ডার গোলস্টার থেকে ভয়ানক এম-১০ মেশিন রিভলবার হাতে তুলে নিয়েছে। তার মনে হলো, মুহূতে আহমদ মুসার দেহ যেন ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে গেল। যুদ্ধের জন্যে সে প্রস্তুত।
এ যুদ্ধের ফল কি হবে তা বুঝতে বাকি রইল না ইভানোভার। তার মনে তখন ঝড় বইছে।
এক সময় তার দেহটাও শক্ত হয়ে উঠল একটা সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায়। সে সিদ্ধান্ত নিল, আহমদ মুসার পরিচয় না জেনে সে তাকে মরতে দিবে না।
সিদ্ধান্ত নেবার পর ইভানোভা দ্রুত ভূ-গভর্স্থ সিঁড়ি মুখের দরজায় আহমদ মুসার লোকেশন আবার দেখে নিয়ে ছুটল পাশের দেয়ালে।
দেয়ালের একটা স্থানে চাপ দিতেই দেয়াল রংয়ের একটা ইস্পাতের প্লেট সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা সুইচ বোর্ড। বোর্ডে পাশাপাশি দু’টি সুইচ।
দু’টি সুইচের একটি ঘাটির বিদ্যুত ট্রান্সমিটার, আরেকটা জেনারেটরের সাথে যুক্ত। সুইচ দু’টি ডেটনেটরের কাজ করে। অন করলেই জেনারেটর ও ট্রান্সমিটারের বিশেস টিউবে রক্ষিত বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটায়। তার ফলে অন্ধকারে ঢেকে যাবে ঘাটি।
ইভানোভা সুইচ দু’টি অন করে দিয়ে ছুটল টর্চ হাতে ভূ-গর্ভস্থ টানেলে নামার গোপন সিঁড়ি মুখের দিকে। ভূ-গর্ভস্থ এই টানেলটি গিয়ে উঠেছে ঘাটির কনট্রোল রুমে।
ট্যানেল দিয়ে দ্রুত এগিয়ে ইভানোভা গিয়ে উঠল সেই কনট্রোল কক্ষে। এই কনট্রোল রুম থেকেই কিছুক্ষণ আগে গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ এবং মায়োভস্কিদের কথা বলতে দেখা গেছে।
ইভানোভার এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে রিভলবার।
কনট্রোল রুমে ঢুকে প্রথমেই ইভানোভা ডেটোনেটিং সুইচ দু’টি অন করে দিল গ্লাভস পরা হাত দিয়ে, যাতে বুঝা না যায় এই সুইচ অন করেই ট্রান্সফর্মার ও জেনারেটরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।
তারপর ইভানোভা এগুলো বাইরে বেরুবার সিঁড়ি মুখের দরজার দিকে। এই দরজার ওপারেই আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। দরজাটি বাইরে থেকে বন্ধ। কিন্তু ভেতরের নব ঘুরালেই দরজা খুলে যাবে।
নব ঘুরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ইভানোভা। টর্চ জ্বালিয়ে দরজা খোলা যাবে না। টর্চের আলো দরজায় দাঁড়ানো আহমদ মুসা এবং গ্রেগরিংকোদের লোক দু’পক্ষেরই টার্গেট হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভাবল, আহমদ মুসার নাম সে জানে না, কিভাবে ডাকবে? নিজের পরিচয় দিয়ে ডাকাও সে নিরাপদ মনে করলো না, গ্রেগরিংকোর লোকেরা কত কাছে এসেছে কে জানে। তৃতীয়ত, আহমদ মুসা দরজার সামনেই আছে কিনা। এই তৃতীয় বিষয়ে ইভানোভা নিশ্চিত যে, আহমদ মুসা দরজা ছেড়ে যায়ন্ িকারণ সে বাবছে আলো নিভিয়ে দেয়া শত্রু পক্ষের কাজ। নিশ্চয় অন্ধকারের মধ্যে তাকে ঘেরাও করে এগিয়ে এসে বন্দী করাই শত্রু পক্ষের লক্ষ্য। আর জায়গাটা আহমদ মুসার জন্যে অপরিচিত। তাই সে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শত্রুর অপেক্ষা করাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করবে।
শত্রুর জন্যে অপেক্ষমান আহমদ মুসার এম-১০ এর টার্গেট ইভানোভাকে না হতে হয়, এ ভয় ইভানোভা করল।
কিন্তু নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই ইভানোভার। গ্রেগরিংকোর লোকেরা নিশ্চয় এগিয়ে আসছে। তারা বিকল্প আলোরও ব্যবস্থা করতে পারে। তার আগেই আহমদ মুসাকে সরিয়ে নিতে হবে।
ইভানোভা ঠিক করল, নব ঘুরিয়ে দরজা একটু ফাঁক করেই সে ফিস ফিস কণ্ঠে নিজের নাম জানিয়ে বলবে সে সাহায্য করতে এসেছে।
এর পরেও দ্বিধা থাকল ইভানোভার মনে। কাকে সাহায্য করতে এসেছে না বললে সে কি বিশ্বাস করবে!
কিন্তু বিকল্প নেই।
ইভানোভা খুব সন্তর্পণে নব ঘুরাল। মৃদু ধাতব এক শব্দ তুলে দরজা আনলক হয়ে গেল। দরজাও নড়ে উঠেছিল সেই সাথে।
ইভানোভা ধীরে ধীরে দরজা টানতে যাচ্ছিল। এই সময় দরজার আকস্মিক তীব্র ধাক্কায় ইভানোভা ছিটকে পড়ে গেল এবং সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সিঁড়ির গোড়ায় কনট্রোল রুমের মেঝেতে।
পড়ে গিয়েও ইভানোভা তার হাতের টর্চ ছাড়েনি। পড়ে গিয়ে মাথার এক পাশের খানিকটা জায়গা থেতলে গেছে। কপালের কাটাটায় আবার আঘাত লেগেছে।
কিন্তু আঘাতের কথা ভুলে গেল ইভানোভা। ব্রাশ ফায়ার ছুটে আসার আগে তাকে কিছু করতে হবে। মাথায় বুদ্ধি এসে গেল।
ইভানোভা তাড়াতাড়ি টর্চ জ্বেলে নিজের মুখে ধরল। উদ্দেশ্য, আহমদ মুসাকে তার পরিচয় দেয়া এবং এ ধারণা দেয়া যে, সে শত্রু নয়।
না, ব্রাশ ফায়ার এলো না। তার বদলে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ এবং একটি ফিসফিসে কণ্ঠ কানে এল,‘জাহরা ইভানোভা আপনি?’
জাহরা ইভানোভা উঠে বসল এবং বলল,‘সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসুন নিঃশব্দে।’

আহদ মুসা একবার পিছন দিকে তাকিয়ে দ্রুত উপরে উঠে সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে এল।
ইভানোভা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা এসে তার সামনে দাঁড়াতেই টর্চের আলো আহমদ মুসার মুখে একবার ফেলে আহমদ মুসার একটা হাত ধরে চলতে শুরু করে বলল,‘আমার সাথে আসুন।’
‘কিন্তু জাহরা ইভানোভা, আপনি এখানে কিভাবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘সব দেখবেন। এখন আসুন। ওরা আলোর বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারে এবং ওরা এই ঘরে নিশ্চয় আসবে।’
বলে টর্চ জ্বেলে কক্ষের ফাঁক হয়ে থাকা দেয়ালের সুড়ঙ্গ পথের দিকে ছুটল ইভানোভা। আহমদ মুসাও।
দেয়াল পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে ইভানোভা পেছন ফিরে টর্চ জ্বেলে সুড়ঙ্গের ছাদের বিশেষ একটা স্থানে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের সুড়ঙ্গ পথ বন্ধ হয়ে গেল।
এ সুড়ঙ্গ পথ শুধু এপার থেকেই খোলা যায়।
এবার ইভানোভা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা চলল তার পেছনে পেছনে।
সুড়ঙ্গ পথ শেস করে ইভানোভা প্রবেশ করল তার পিতার কনট্রোল কক্ষে।
আহমদ মুসাও।
ইভানোভা ফিরে দাঁড়িয়েছিল সুইচ টিপে সুড়ঙ্গ পথের মুখ বন্ধ করার জন্যে।
আলো প্লাবিত কক্ষে ইভানোভার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। দেখল, ইভানোভার কপাল ও মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আগের কেটে যাওয়া জায়গা থেকে আবার রক্ত ঝরছে। দেখল, মাথার বাম পাশের এক জায়গাও থেতলে গেছে। রক্তে চুল ভিজে উঠেছে। বলল আহমদ মুসা,‘ইস আপনি মারাত্মকভাবে আহত, কিছু বলেননি তো? আর কোথাও লেগেছে?’
দেয়ালের একটা কক্ষের সুইচ অফ করে দিচ্ছিল ইভানোভা।
সুইচ অফ করার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁক হয়ে থাকা দেয়ালটা বুজে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সুড়ঙ্গের মুখ।
ইভানোভা ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনার ব্রাশ ফায়ার থেকে বেঁচে গেছি।’
একটা বেদনার ছায়া নামল আহমদ মুসার মুখে। বলল,‘ঠিকই বলেছেন, সে সময় টর্চের আলোতে যদি আপনার মুখ না দেখতে পেতাম, তাহলে ব্রাশ ফায়ার হতো। ট্রিগার চাপতে যাচ্ছিলাম।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল,‘চলুন ক্লিনিকে, আগের চেয়ে এ আঘাত আপনার অনেক মারাত্মক।’
ইভানোভা ঠোঁটে আঙুল ছেকিয়ে বলল, ‘ক্লিনিকের নাম বলবেন না। ওখানে গেরে ধরা পড়ে যাবো। আপনি তো ওদিকে যেতেই পারবেন না।’
‘তাহলে…।’ আহমদ মুসার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আমাদের ফাস্ট এইড বক্সে যা আছে তাতেই চলবে।’ বলে ইভানোভা ফাস্ট এইড বক্স বের করে এনে বলল, ‘নার্সকে ডাকব?’
‘যে কারনে আপনি ক্লিনিকে যাচ্ছেন না, সে কারণে কি এ ক্ষেত্রেও নেই। আর মনে হয়, ড্রেসিং আমি খারাপ করি না।’
‘ধন্যবাদ। আহত স্থান দু’টো শুধু আপনি ড্রেসিং করুন। বাকি কাজ আমি করব।’
বলে ইজি চেয়ারে বসল ইভানোভা।
আহমদ মুসা ড্রেসিং শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখল ইভানোভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুলা ভিজিয়ে মুখ-গলা পরিষ্কার করছে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে ছিল।
ইভানোভা কাজ শেষ করে আহমদ মুসার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। গম্ভরি কণ্ঠে বলল,‘আপনি কে?’
আহমদ মুসাও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল,‘তার আগে বলুন গ্রেট বিয়ারের সাথে আপনার সম্পর্ক কি?’
ম্লান হাসল ইভানোভা। বলল,‘আমি গ্রেট বিয়ারের একজন কর্মী।’
ভ্রু-কুঞ্চিত করলো আহমদ মুসা। একটু সময় নিয়ে বলল,‘আমাকে বাঁচিয়ে ঋণ শোধ করলেন বুঝি। কিন্তু আমি তো আপনাকে বাঁচাইনি, বাড়ি পৌঁছে দেয়ার সামান্য কাজ করেছি মাত্র।’
‘আমি আপনার কাছে ঋণী বলে কি আপনি মনে করেন?’
‘পেছন থেকে গুলী করার বদলে মুক্তির দ্বার কেন উন্মুক্ত করে দিলেন, এ থেকেই কথাটা এসে যায়।’
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর পরে দেব, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
‘আমি প্রিন্সেস তাতিয়ানার বন্ধু। আমি এসেছি প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধার করতে।’
অপার বিস্ময় নিযে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে রইল ইভানোভা কিছুক্ষণ। তারপর বলল,‘আপনি কে?’
সংগে সংগেই আহমদ মুসা উত্তর দিল না। দ্বিধার মধ্যে পড়ল।
‘অসুবিধা থাকলে দরকার নেই। আমি প্রশ্নটা প্রত্যাহার করছি।’ ম্লান হেসে বলল ইভানোভা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল,‘অবিশ্বাসের অসুবিধা না থাকলে আর কোন ভয় থাকে না।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখমন্ডল। বলল,‘আমার নাম আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসা নাম শোনার সাথে সাথে শক খাওয়ার মত চমকে উঠেছিল ইভানোভা। কিন্তু সামলে নিয়েছিল নিজেকে পরক্ষণেই। তার চোখ দু’টি কিন্তু আঠার মত আটকে আছে আহমদ মুসার মুখে।
ইভানোভার ঠোঁটে একটা শক্ত হাসি ফুটে ইঠল। বলল,‘তাহলে আমি কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ওয়ার্ল্ড রেড ফোর্সেস (WRF) এবং মধ্য এশিয়ার গ্রেট বিয়ার-এর ধ্বংসকারী এবং WRF নেতা জেনারেল বোরিস এবং গ্রেট বিয়ার নেতা ও তাতিয়ানার আব্বা………….. হত্যাকারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি?’
‘আমার দুর্ভাগ্য যে, এই অপ্রীতিকর কাজগুলো আমাকে করতে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার এখন কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না যে, তাতিয়ানা আপনার বন্ধু এবং ক্যাথারিনকে মুক্ত করতে চান।’
‘আপনাকে বিশ্বাস করবার জন্যে এখন যা বলতে হয়, তা বলার সময় আমার নেই। সুতরাং বিশ্বাস করতে আমি আপনাকে বলব না।’
‘সময় নেই মানে আপনি কি চলে যেতে চান? আপনার পরিচয় পাওয়ার পর আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি?’ বলর ইভানোভা মুখ গম্ভীর করে।
‘আহমদ মুসাকে আপনি আটকাতে পারবেন না, এটা আপনিও জানেন।’
‘আমার বিস্ময় এখনও যায়নি। আমার ধারণা ছিল আহমদ মুসা হবে ছয় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা আর হবে তার হারকিউলিসের মত শরীর। আপনার মত ভদ্র সন্তান বলে তাকে আমি ভাবিনি।’
‘আমাকে আহমদ মুসা না ভাবলেই তো আমার মুক্তি ত্বরান্বিত হতে পারে।’
‘অবশ্যই না। বিশ্বাস না হলেও সন্দেহ করে ধরে রাখা যায়।’
কথা শেষ করে দুই পকেট থেকে দু’টি মিনি রিভলবার বের করে সোফার উপর রাখতে রাখতে বলল,‘দেখুন এ দু’টি রিভলবারের একটির ক্লোরোফরম স্মোক স্প্রে করে সেকেন্ডের মধ্যে আপনাকে ঘুমিয়ে দিতে পারি। তারপর গিয়ে পড়বেন গ্রেট বিয়ারের হাতে।’
‘না, তা পারবেন না। ক্লোরোফরম স্মোক স্প্রে করার পর সংজ্ঞা হারিয়ে ঢলে পড়ব ঠিকই, কিন্তু আপনাকে বিমূঢ় করে দিয়ে পরক্ষণেই আমি উঠে দাঁড়াব এবং আমি পালিয়েও যাব।’
‘কিভাবে এটা সম্ভব হবে?’ বলল ইভানোভা।
‘ক্লোরোফরম বোমার কার্যকারিতা দুই মিনিট। এই দুই মিনিট আমি সংজ্ঞাহীনের ভান করে দম বন্ধ করে পড়ে থাকব। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আপনার অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে আপনাকে রিভলবারের টার্গেটে রেখে নিরাপদে সরে যাব।’
ইভানোভা মুগ্ধ চোখে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ইভানোভার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোন তুলে নিল ইভানোভা। কথা বলল। বলতে গিয়ে তার চোখে-মুখে ম্লান ছায়া নেমে এল।
টেলিফোন রেখে দিয়ে সে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। বলল,‘গ্রেগরিংকোর টেলিফোন। বলছে, ‘শত্রুকে ঘাটির কোথাও পাওয়া যায়নি। দুর্বোধ্য কারণে একই সাথে বিদ্যুত ট্রান্সমিটার ও জেনারেটর নষ্ট হওয়ায় অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সে পালিয়েছে। তবে আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি। মনে হয় কোন দিক দিয়ে সে আপনাদের বাড়িতে গিয়ে লুকাতে পারে। আমরা খোঁজ করে দেখতে চাই।’
ইভানোভা কথা শেষ করতেই আবার তার টেলিফোন বেজে উঠল।
টেলিফোনে কথা বলতে বলতে চঞ্চল হয়ে উঠল ইভানোভা।
টেলিফোন রেখে দিয়েই সে বলল,‘আব্বা এসেছেন। শিঘ্রী উঠুন, পালাতে হবে আপনাকে।’
বলে ইভানোভা উঠে দাঁড়ালো। বলল,‘বাইরে আব্বা গ্রেগরিংকোদের সাথে কথা বলছেন। এখনি ওরা এসে পড়বেন।’
কথা বলতে বলতেই দ্রুত হাঁটা শুরু করেছে ইভানোভা।
কনট্রোল রুমের দরজার পাশে গিয়ে সুইচ বোর্ডের উপরের দেয়ালের এক জায়গায় বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিল।
সংগে সংগে পাশের দেয়াল সরে গেল এবং বেরিয়ে পড়ল নিচে নামার সিঁড়ি।
আহমদ মুসাকে দ্রুত আসার ইশারা করে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় দৌড়েই নামতে শুরু করল ইভানোভা।
আহমদ মুসা বুঝল, ইভানোভা সত্যিই উদ্বেগ বোধ করছে। আহমদ মুসাকে সরিয়ে দিতে পারলে সে বেঁচে যায়।
আহমদ মুসা ছুটে চলল ইভানোভার পেছনে।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোর পেরিয়ে ইভানোভা প্রবেশ করল একটা সুড়ঙ্গে।
‘এই সুড়ঙ্গ নিয়ে যাবে টিলার একদম গোড়ায় ডাম্প হাউজের সাথে যুক্ত একটা ছোট কক্ষে। ঘরটির বন্দ দরজা নব ঘুরালেই খুলে যাবে। ঐ পর্যন্ত পাহারা নেই। সুতরাং…..।’
কথা শেষ করার প্রয়োজন বোধ করল না ইভানোভা। দ্রুত হাঁটছিল সে।
এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ইভানোভা।
পেছনে একবার তাকিয়ে বলল,‘এসে গেছি। সামনের স্টিলের দরজাটা পেরুলেই ডাম্প হাউজের সেই ঘর।’
বলে ইভানোভা স্টিরের দরজার গায়ে মিশে থাকা ক্ষুদ্র একটা বোতামে চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল।
ইভানোভা দরজার এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল,‘যান। আই উইশ ইউ গুড লাক।’
আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। মুখ একবার নিচু করল। দ্বিধা করল। তারপর বলল,‘শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘অবশ্যই, বলুন।’
‘প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে গ্রেট বিয়ার কোথায় রেখেছে?’
হাসল ইভানোভা। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল,‘ওটুকু পারবো না। বিশ্বাসঘাতকতার ওটুকু বাকি থাক।’ ইভানোভার কণ্ঠে বেদনার সুর।
আহমদ মুসার মুখেও লজ্জার একটা ছায়া নামল। বলল, ‘স্যরি। আমার অনুরোধ প্রত্যাহার করলাম।’
একটু থেমে আবার বলল,‘কিন্তু বিশ্বাসঘাতক তো আপনি হয়েই গেছেন।’
‘ওটুকুর জন্যে আমার কাছে জবাব আছে। যার ফলে নিজের কাছে অন্তত অপরাধী নই।’ ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল ইভানোভার ঠোঁটে।
‘প্রশ্নটা শুরুতেই আমি করেছিলাম। জবাব দেননি। জানতে পারি কি, পিতা ও দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে একজন শত্রুকে বাঁচাবার কারণটা কি?’
হাসল ইভানোভা। বলল,‘বলার এখন সময় নেই। সময় কখনও এলে জানবেন।’
বলেই ইভানোভা ফেরার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। বলল,‘আব্বা এসে পড়বে, আমি যাই।’

ইভানোভার আব্বা নিকিতা স্ট্যালিনের খাস ড্রইং রুমেই কথা হচ্ছিল দারুণভাবে উত্তেজিত চিন্তিত গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ, মায়োভস্কির মধ্যে। তাদের বৈঠকে নিকিতা স্ট্যালিনও হাজির ছিলেন।
কথা বলছিল গ্রেগরিংকো, ‘একজন মাত্র লোক, তাও এশিয়ান, আমাদের সব কাজ ওলট-পালট করে দিল।’
‘যে কোন মূল্যে তাকে ধরতে হবে, নয়তো শেষ করে দিতে হবে।’ বলল উস্তিনভ।
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, সে পালাল কিভাবে?’ বলল নিকিতা স্ট্যালিন।
‘আমার মনে হয়, সে সব রকম প্রস্তুতি নিয়েই ঘাটিতে প্রবেশ করেছিল। ট্রান্সফরমার ও জেনারেটরে বিস্ফোরণ তারই প্রমাণ। তার কাছে অবশ্যই ইনফ্রারেড গগলস ছিল। যার দ্বারা সে আমাদের বোকা বানিয়ে আমাদের সকলের পাশ দিয়েই চলে গেছে। পাহারাদারদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।’
‘এ রকম একটা কিছুই ঘটেছে। কিন্তু আমরা এখন কি করব। এ খবর পৌঁছার পর মহামান্য আইভানের যে কি মূর্তি হবে, কলিগরা নিশ্চয় তা অনুভব করেছেন।’
আইভানের নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথে সকলের চোখে-মুখে ভয় ও চিন্তার চিহ্ন ফুটে উঠল।
কারো মুখে কোন কথা নেই। নীরব সবাই।
এই মুহূর্তে এ বাড়ি এবং ঘাটি পরিত্যাগ করতে হবে, এ অনুমতিও তোমাদেরকে আইভানের কাছ থেকে নিতে হবে।
‘জি, ঠিকই বলেছেন।’ বলল গ্রেগরিংকো।
আর এক দফা সকলের মুখ মলিন হয়ে গেল। পর পর এই বিপর্যয়কে কোন যুক্তি দিয়েই যৌক্তিক প্রতিপন্ন করা যাবে না। এই একই চিন্তা সবার মনকে পীড়া দিচ্ছে।
‘আমাদের এত বড় সর্বনাশ যে করল তার কি হবে? তাকে কোথায আমরা পাব? তাকে ধ্বংস করতে পারলে আমাদের সব ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে।’ বলল মায়োভস্কি চোখ লাল করে।
‘এ দায়িত্ব মায়োভস্কি তোমার। আমরা প্রিন্সেস তাতিয়ানার বিষয়টা দেখছি।’
মায়োভস্কি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। বলল,‘সমস্যা হলো প্রিন্সেস ক্যাথারিনের বাড়ি ছাড়া তাকে লোকেট করার আর কোন জায়গার কথা আমাদের জানা নেই।’
‘লোকটির গাড়ি থেকে কোন ক্লু পাওয়া যায়নি?’ বলল নিকিতা স্ট্যালিন।
‘গাড়ির নাম্বার এবং কাগজপত্র সবই ভূয়া।’ বলল মায়োভস্কি।
কারো মুখে কোন কথা নেই। নীরবতা।
নিকিতা স্ট্যালিন উঠে দাঁড়াল। বলল,‘গুড নাইট।’

Top