২৪. জারের গুপ্তধন

চ্যাপ্টার

মস্কোর দক্ষিণ অংশে মস্কোভা নদী লেনিন হিলস-এর পাদদেশে এসে ‘ইউ’ টার্ন নিয়েছে। এই ‘ইউ’ টার্নের যেখানে কমসোমলস্কায়া হাইওয়ে দক্ষিণ থেকে এসে মস্কোভা নদী অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে সেদোভায়া রিং-এর দিকে, সেখানে মস্কোভা নদীর তীরে একটি দুর্গ সদৃশ বাড়ি।
বাড়িটার বিশাল গেটে একটা সুদৃশ্য সাইনবোর্ড। লেখা, ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’। সাইনবোর্ডে ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘সোশ্যাল রিসার্চ ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’।
সরকারী কাগজে কলমে সংস্থাটি একটি জাতীয় এনজিও। এই এনজিও সাইনবোর্ডের আড়ালে এটাই গ্রেট বিয়ারের হেডকোয়ার্টার।
বাড়িটা এক সময় সোভিয়েত রাজবন্দীদের বধ্যভূমি বলে কথিত কেজিবি’র জেলখানা ‘লুবিয়াংকা’র অংশ ছিল। কমিউনিজমের পতনের পর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়। এই পরিত্যক্ত বাড়িটাই ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর নামে গ্রেট বিয়ার কিনে নিয়েছে। গ্রেট বিয়ার লুবিয়াংকার ‘হেরিটেজ’ ঠিকই রক্ষা করছে একে আর একটা বধ্যভূমিতে পরিণত করে। লুবিয়াংকা ছিল কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার বধ্যভূমি, গ্রেট বিয়ারের হাতে এসে এটা এখন হয়েছে রুশীয়করণের বধ্যভূমি। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভূগর্ভস্থ দু’টি তলা গ্রেট বিয়ারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাড়িটা দুর্গ সদৃশ, কারণ পাঁচতলা উঁচু বিরাট এলাকা নিয়ে তৈরি বিরাট বাড়িটার উত্তর দিকের প্রধান গেটটি ছাড়া আর কোন দরজা, জানালা, কার্নিশ, ব্যালকনি ইত্যাদি কিছুই নেই। বাড়ির বহির্দেয়ালের নিচ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত প্রতি পনের ফুট দূরত্বে বিল্ডিং-এর চারদিক ঘুরে একসারি করে ঘুলঘুলি। ঘুলঘুলির আয়তন এক বর্গফুটের বেশি হবে না।
দুর্গ সদৃশ বাড়ির দক্ষিণ অংশে পাঁচ তলায় বিরাট একটি হলঘর।
ঘরে ডজন দুই বড় সাইজের কুশন চেয়ার। চেয়ারগুলোর সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটার পরে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু একটা মঞ্চ।
মঞ্চের ঠিক মাঝখানে সাত ফুট উঁচু আরও একটা মঞ্চ। মঞ্চটির আয়তন পাঁচ বর্গফুটের মত হবে।
হলরুমের মেঝে থেকে এই মঞ্চটিকে সলিড মেঝে বিশিষ্ট বলে মনে হয়। আসলে মঞ্চটি দশ ফুট কংক্রিটের দেয়াল বিশিষ্ট একটা ফাঁকা চোঙা।
হলঘরের পঁচিশটি চেয়ারে পঁচিশজন লোক বসে। ওদের দিকে তাকালে ওদের পোশাক, স্বাস্থ্য, চেহারা, গাম্ভীর্য ইত্যাদি বলে দেয়, ওরা সবাই রাশিয়ার এক একজন দিকপাল।
ওদের স্থির এবং সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টি মঞ্চের উপরে মঞ্চের শীর্ষদেশটার উপর নিবদ্ধ।
তাদের চোখের সামনে বরাবরের মতই একটা সোনালী সিংহাসন উঠে এল মঞ্চের শীর্ষে। সোনালী সিংহাসনে সোনালী বর্মে ঢাকা একজন মানুষ। মুখেও সোনালী মুখোশ।
সোনালী সিংহাসনটি মঞ্চ শীর্ষে উঠে আসার সাথে সাথে হলের চেয়ারে বসা সকলে উঠে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে মাথা নিচু করল।
মঞ্চ শীর্ষ থেকে গমগমে দু’টি শব্দ বেরিয়ে এল, ‘বস তোমরা।’
মাথা নিচু করে বসল সবাই।
সেই কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো। মঞ্চ শীর্ষ থেকে ভেসে এল কথা, ‘রাশিয়ার গর্বিত সন্তানগণ, আপনাদের মাধ্যমে সকলের প্রতি আমার শুভেচ্ছা।’
বলে একটু থামল। মুহূর্তকাল পরে গম গম করে উঠল সেই কণ্ঠ আবার। বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ, আমাদের ‘অপারেশন প্যারিস প্রজেক্ট’ সম্পর্কে বলার জন্যে তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি।’
‘মহামান্য আইভান দীর্ঘজীবী হোন।’
বলে সামনের সারি থেকে উঠে দাঁড়ানো মাজুরভ একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করল, ‘প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও ফরাসী রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স প্লাতিনিকে মস্কো নিয়ে আসতে পারার সাফল্য বাদে আমাদের প্যারিস অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে। রাজকীয় ডায়েরী ও রাজকীয় রিং-এর সন্ধান পেয়েও এবং কার কাছে আছে জেনেও তা উদ্ধার করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সেই লোককে তিন বার ধরেও আমরা আটকাতে পারিনি। সেখানে পাঠানো প্রায় পুরো জনশক্তি আমাদের ধ্বংস হয়ে গেছে মাত্র একজন লোককে মোকাবিলা করতে গিয়ে। আমরা সেখানে আক্রমণের পর্যায় থেকে আত্মরক্ষার অবস্থানে নেমে এসেছি। আহমদ মুসা প্রিন্সেস ক্যাথারিন ও মিঃ প্লাতিনিকে উদ্ধার করার জন্যে ইতোমধ্যেই রাশিয়া যাত্রা করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’ থামল মাজুরভ।
মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ বেজে উঠল আবার। বলল, ‘আরও সফলতা আছে। গ্রেগরিংকো, উস্তিনভ, ম্যালেনকভ, মায়োভস্কির মত অপদার্থদের দেশে ফিরে আসতে হয়নি। ওদের জন্যে আমাদের কোন বুলেট খরচ করতে হয়নি।’ থামল কণ্ঠটি।
হলে চেয়ারে বসা সকলের মুখ ম্লান হয়ে গেল। গ্রেট বিয়ারের আইনে ব্যর্থতার কোন জায়গা নেই। মৃত্যুই এর একমাত্র মূল্য। চেয়ারে উপবিষ্ট সকলের ম্লান মুখে এই ছবিই ভেসে উঠেছিল।
মঞ্চ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ থামতেই মাজুরভ সামনের দিকে মাথা নুইয়ে বলে উঠল, ‘মহামান্য আইভান দীর্ঘজীবী হোন’।
সেই কণ্ঠ আবার। বলল, ‘ভ্লাদিমির খিরভ, তোমার পরিকল্পনা জানাও।’
সামনের সারির মাজুরভের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল একজন। মাথা নুইয়ে সামনের দিকে দেহটা একবার ঝুঁকিয়ে বলল, ‘মহামান্য আইভান, আমাদের এ প্রজেক্টের নাম ‘অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট’। সংক্ষেপে ওএফপি (OFP)। এর লক্ষ্য, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে সিংহাসনে বসিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সরকারী প্রয়াস বানচাল করা এবং নতুন আইভানের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সেই আইভানের গৌরব-যুগ আবার ফিরিয়ে আনা। এজন্যে এ প্রজেক্টের মূল কাজ হলো, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখা এবং আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় এনে রাজকীয় ডায়েরী ও রাজকীয় আংটি উদ্ধার করা।’ থামল ভ্লাদিমির খিরভ।
কথা শেষ করেও দাঁড়িয়ে থাকল। মঞ্চের সেই কণ্ঠ থেকে বসার নির্দেশ এলে তবেই সে বসল।
‘মাজুরভ, এবার তুমি বল।’ ধ্বনিত হল মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ।
মাজুরভ উঠে দাঁড়িয়ে তার নিচু মাথা সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আমরা মনে করছি, আহমদ মুসা রাশিয়া যাত্রা করেছে। তবে আমরা জানতে পারিনি সে কোন পথে রাশিয়া আসছে। আমাদের অনুমান, সে আকাশপথ নয়, স্থলপথকেই নিরাপদ মনে করবে। যতদূর জানা গেছে, লুই প্রিন্সেস মারিয়া জোসেফাইন তার সাথে রয়েছেন। আহমদ মুসা ও মারিয়া জোসেফাইন রুশ অ্যাম্বেসি থেকে ভিসা নিয়েছে, কিন্তু কি নামে নিয়েছে, কি বেশে নিয়েছে তা আমরা জানতে পারিনি। তাদের ভিসার কোন দরখাস্ত দূতাবাসের ভিসা সেকশনে নেই। স্বয়ং রাষ্ট্রদূত তাদের ভিসা ইস্যু করেছেন এবং সমস্ত রেকর্ড তার কাছেই রয়েছে। আমাদের সূত্র মনে করেন যে, এমনও হতে পারে যে, তাদের কোন রেকর্ডই অ্যাম্বেসিতে রাখা হয়নি।’
‘তারপর?’ মাজুরভ থামার সাথে সাথেই মঞ্চ থেকে কণ্ঠটি ধ্বনিত হলো।
‘পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাংগেরী, রুমানিয়া সীমান্তের যে কোন পয়েন্ট দিয়ে তারা রাশিয়া প্রবেশ করতে পারে। সীমান্তেই যাতে তাদের ফাঁদে ফেলা যায়, এ জন্যে আমাদের লোকদের এবং মিত্র রুশ পুলিশ ও বন্ধু দেশের পুলিশদের আমরা সতর্ক করে দিয়েছি।’
‘বলে যাও।’ মাজুরভ থামতেই মঞ্চের সেই কণ্ঠ ধ্বনিত হল অনেকটা বজ্রপাতের মতো।
মাজুরভ আবার শুরু করল, ‘সরকারের তৎপরতার দিকে আমরা নজর রাখছি। তারা এখন নিশ্চিত, প্রিন্সেস ক্যাথারিন রাশিয়ায়। তারা তাদের গোয়েন্দা ও পুলিশ বাহিনীকে সর্বাত্মক অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে। তাদের ধারণা, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে মস্কো অথবা লেনিনগ্রাডেই রাখা হয়েছে। তারা আরও নিশ্চিত হবার পর কম্বিং অপারেশনেও যেতে পারে।’
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করল মাজুরভ। বলল, ‘মিঃ প্লাতিনিকে রাশিয়ায় নিয়ে আসায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ফ্রান্সের সরকারী মহলে। ব্যাপারটা প্রকাশিত হলে জনগণের চাপে সরকার খারাপ অবস্থায় পড়বে। সুতরাং ফরাসী সরকার হুমকি দিচ্ছে, সত্বর তাকে মুক্তি না দিলে তারা রুশ সরকারকে জানানো ছাড়াও ইন্টারপোল ও জাতিসংঘের সাহায্য নেবে। আমরা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে, ফরাসী প্রিন্সকে খুবই সম্মানের সাথে রেখেছি। আহমদ মুসাকে আমাদের মুঠোয় আনার জন্যে আর কোন উপায় ছিল না বলেই সাময়িকভাবে তাকে আমাদের পণবন্দী করতে হয়েছে। কিন্তু তারা এসব কিছুই শুনতে রাজি নয়। তারা আমাদের পনের দিন সময় দিয়েছে। এর মধ্যে তাকে রিলিজ করতে হবে। আর ইতোমধ্যে মিঃ প্লাতিনিকে ফরাসী প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে দিতে হবে।’ থামল মাজুরভ।
‘এসবই তোমাদের ব্যর্থতার মাশুল। তোমরা এক ছোকরা আহমদ মুসাকে হাতের মুঠোয় আনতে ব্যর্থ হয়ে ধরে এনেছ এক ফরাসী বুড়ো ভদ্রলোককে।’
একটু থামল মঞ্চ থেকে ছুটে আসা কণ্ঠটি। পরক্ষণেই আবার গর্জন করে উঠল, ‘তোমরা বুড়োকে ঠাণ্ডা কর। পারলে তাকে রাজি করিয়ে তার পরিবারের জন্যে তার কাছ থেকে মেসেজ নাও যে, তিনি ভাল আছেন। সত্বরই দেশে ফিরবেন। দেখ, লক্ষ্যে পৌঁছার আগে এসব নিয়ে আমরা কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না।’
মঞ্চের সিংহাসনটি নড়ে উঠল। সেই সাথে জ্বলে উঠল মঞ্চে একটা নীল বাতি।
মুহূর্তেই হলে চেয়ারে বসা সকলে যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়াল। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘দীর্ঘজীবী হোন, মহামান্য আইভান।’
মঞ্চ থেকে সেই কণ্ঠ গম গম করে বেজে উঠল, ‘ দীর্ঘজীবী হোক রাশিয়া। দীর্ঘজীবী হোন রাশিয়ার মহান সন্তানরা। শুনে রাখ সবাই, ব্যর্থতা ও ব্যর্থ দু’টিই রাশিয়া ও রাশিয়ার মহান জনগণের শত্রু।’
তার কণ্ঠ থামার সাথে সাথেই সেই স্বর্ণ সিংহাসন হারিয়ে গেল মঞ্চের বুকে।
সবাই সার বেঁধে একে একে বেরিয়ে গেল হল থেকে।
হল থেকে বেরিয়েই গ্রেট বিয়ারের গোয়েন্দা প্রধান মাজুরভ অপারেশন ফরচুন প্রজেক্ট (OFP)-এর প্রধান ভ্লাদিমির খিরভকে কানে কানে বলল, ‘চলুন, মিঃ প্লাতিনির কাছে এখনি যেতে হবে।’
মিঃ খিরভ মাথা নেড়ে সায় দিল।
মাজুরভের পাশেই হাঁটছিল আরেকজন। সে মাজুরভকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মিঃ মাজুরভ, আহমদ মুসাকে কি আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না?’
প্রশ্ন করল নিকোলাস বুখারিন। রুশ সেনাবাহিনীর সদ্য বরখাস্তকৃত প্রতিভাবান এক যুবক জেনারেল। চরমপন্থী আচরণের জন্যে তাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়েই সে গ্রেট বিয়ারের সক্রিয় কর্মী ছিল। এখন সে গ্রেট বিয়ারের শীর্ষ অপারেশন কমান্ডার।
প্রশ্ন শুনে হাসল মাজুরভ। বলল, ‘আমরা তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এই গুরুত্ব সে আদায় করে নিয়েছে।’
‘আমিও কিছু জানি তাকে। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তাকে মনে করাই তার মোকাবিলায় আমরা দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ।’
‘আপনার এই মনোভাবকে আমি অভিনন্দিত করছি, কিন্তু সেই সাথে সাবধানও করছি। কাউকে ওভারএস্টিমেট করার মধ্যে ক্ষতি আছে, কিন্তু কাউকে আন্ডারএস্টিমেট করার ক্ষতি অনেক বেশি।’ বলল মাজুরভ।
‘এই নীতিকথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য, কিন্তু একজন এশিয়ানকে আমরা খুব বেশি উপরে তুলেছি। ওখান থেকে তাকে নামাতে হবে।’
‘ধন্যবাদ নিকোলাস। একজন অপারেশন কমান্ডারের কাছ থেকে আমরা এটাই চাই। কিন্তু আবার বলি, আহমদ মুসার ব্যাপারে সাবধান।’ মাজুরভ বলল।
নিকোলাস বুখারিন তার দুই তর্জনী দুই কানে ঢুকিয়ে বলল, ‘দুর্বলতার সূচক এই কথাগুলো আমি শুনতে চাই না, মিঃ মাজুরভ।’
মাজুরভ হাসল। বলল, ‘দুর্বলতার কথা শুনে হজম করাই কিন্তু সবলতার লক্ষণ জেনারেল।’
‘একটা যুদ্ধের জন্যে যা সত্য, তা একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সত্য করার প্রয়োজন নেই মিঃ মাজুরভ।’
‘ব্রাভো মিঃ নিকোলাস বুখারিন। এই ধরনের ডেসপারেট যোদ্ধাই আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ভ্লাদিমির খিরভ।
কয়েক মুহূর্ত তিনজনই চুপচাপ।
নীরবতা ভাঙল নিকোলাস বুখারিন। বলল মাজুরভকে লক্ষ্য করে, ‘একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘এখন আপনার জন্যে সব প্রশ্নই সংগত ধরে রাখুন।’ মাজুরভ বলল।
‘আমরা এখন কোন লক্ষ্যে কাজ করছি, দেশপ্রেমহীন বিদেশের ক্রীড়নক সরকারের পতন ঘটানো, না জারের গুপ্তধন দখল?’ প্রশ্ন করল নিকোলাস বুখারিন।
‘এখন প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য জারের গুপ্তধন দখল। এই দখলের মাধ্যমে আমরা রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু করে সরকারের শেষ রক্ষার প্রয়াসকে নস্যাৎ করতে চাই। এই গুপ্তধনের অর্থশক্তিই আমাদেরকে সাহায্য করবে রাশিয়ার জন্যে রাশিয়ার সরকার কায়েম করতে এবং গুপ্তধনের নকশার জন্যে চাই রাজকীয় আংটি এবং রাজকীয় আংটির জন্যে আহমদ মুসাকে।’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আহমদ মুসাকে হাতে পেলেই কি রাজকীয় আংটি এবং ডায়েরী আমরা পেয়ে যাব? ওগুলো কি তিনি আমাদের দেবার জন্যে পকেটে করে নিয়ে আসছেন?’
‘তা হয়তো নিয়ে আসছেন না। কিন্তু কান টানলে মাথা আসার মত, আহমদ মুসা হাতে এলে জিনিসও হাতে এসে যাবে।’ বলল মাজুরভই।
‘তা আসতে পারে। কিন্তু সেটা হতে পারে প্যারিস থেকে নিয়ে আসার ব্যাপার। আমরা কেন আহমদ মুসাকে রাশিয়ায় টেনে নিয়ে আসছি। প্যারিসে তাকে এবং জিনিসগুলোকে একসাথে পাওয়া সহজ ছিল।’
‘সে চেষ্টা তো হয়েছে জেনারেল।’
‘কোন চেষ্টাকেই শেষ চেষ্টা বলা ঠিক নয়।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ঘটনার সাথে লুই রাজপরিবার জড়িয়ে পড়ার পর ফ্রান্স আমাদের জন্যে নিরাপদ ছিল না। এ দিকটা আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন।’
জেনারেল নিকোলাস বুখারিন কোন উত্তর দিল না। ভাবছিল সে। তার মুখ আগের চেয়ে এখন প্রসন্ন।
‘প্রশ্ন শেষ তো মিঃ নিকোলাস?’
বলল ভ্লাদিমির খিরভ হাসিমুখে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে।
‘জ্বি, আপাতত। এখন আসতে পারি স্যার?’ মাজুরভ ও খিরভের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল নিকোলাস।
‘গুড নাইট জেনারেল নিকোলাস।’ প্রায় একসাথেই বলে উঠল মাজুরভ এবং খিরভ।
মাজুরভ ও খিরভ গিয়ে একটা লিফটে প্রবেশ করল।
লিফট গিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামল।
লিফট থেকে বেরিয়ে মাজুরভ ও খিরভ বিশাল এক চত্বরে এসে দাঁড়াল। বিশালতার জন্যে চত্বর বলে মনে হয়, কিন্তু আসলেই এটা একটা হলরুম। দেখতে ডিম্বাকৃতি। হলের চারদিক ঘুরে ঘরের সারি। ডিম্বাকৃতি এই হলরুমের মাঝখানে লিফট কক্ষ। কক্ষটির চারদিকে চারটা লিফট। চারটা লিফটের তিনটির দরজা থেকে বেরুলেই লাল কার্পেটে গিয়ে পা পড়ে। লাল কার্পেটের তিনটি রাস্তা সোজা এগিয়ে সারিবদ্ধ ঘরের তিনটি করিডোরে গিয়ে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু মাজুরভ ও খিরভ যে লিফট থেকে বাইরে বেরুল, সেখানে লাল কার্পেট নেই এবং সেই দরজা থেকে সোজা এগোলে ঘরগুলোর সারিতে কোন করিডোরও পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যায় একটা বন্ধ দরজা।
মাজুরভ ও খিরভ লিফট থেকে বেরিয়ে চত্বরে মুহূর্তকালের জন্যে দাঁড়াল। চারদিকে একবার তাকাল। তারপর লিফটের দরজা থেকে নাক বরাবর সোজা এগোলো। দাঁড়াল গিয়ে বন্ধ দরজার সামনে।
সংগে সংগেই দরজা খুলে গেল।
দরজার পরেই ছোট্ট একটা কক্ষ। কক্ষের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের তিন দিকে ছয়টা চেয়ার।
ঘরে ঢুকে মাজুরভ ও খিরভ টেবিলের দু’পাশের দু’টি চেয়ারে গিয়ে বসল।
বসার সাথে সাথেই কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং গোটা কক্ষটি দ্রুত নিচে নামতে শুরু করল।
কক্ষটি এক জায়গায় গিয়ে স্থির হলো। সাথে সাথেই মাজুরভ ও খিরভ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সংগে সংগে খুলে গেল কক্ষের দরজা।
মাজুরভ ও খিরভ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেখানে পা রাখল, সেটা একটা প্রশস্ত করিডোর। সাদা কার্পেটে মোড়া।
করিডোর ধরে হাঁটছিল মাজুরভ ও খিরভ।
করিডোরটির একদম শেষ প্রান্তে আরেকটা প্রশস্ত করিডোর। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। এ করিডোরটির পূর্ব ধার ঘেঁষে পাঁচটি স্বতন্ত্র কক্ষ। কক্ষ না বলে এগুলোকে ভিআইপি স্যুট বলাই ভাল। বিশাল কক্ষের প্রত্যেকটিতে শয়নকক্ষ, ড্রইং ও ডাইনিং কক্ষ রয়েছে। রয়েছে প্রশস্ত বাথ।
পাঁচটি কক্ষের দক্ষিণ দিক থেকে দ্বিতীয় কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে দু’জন দাঁড়াল।
দরজায় একদম মুখ বরাবর উঁচুতে একটা ডিজিটাল কী-বোর্ড।
মাজুরভ তর্জনী দিয়ে কী-বোর্ডের কয়েকটা পয়েন্টে নক করল।
খুলে গেল দরজা।
সুসজ্জিত কক্ষের একটা সুদৃশ্য চেয়ারে বসে প্লাতিনি। তার সামনে টেবিল। টেবিলে বেশ কিছু বই। একটা বই খোলা ছিল প্লাতিনির সামনে।
‘ভেতরে আসতে পারি প্রিন্স প্লাতিনি?’ বলল মাজুরভ।
দু’জনের পায়ের শব্দে ওদের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল প্লাতিনি।
ওদের দেখেই মুখটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিল প্লাতিনির। কিন্তু মুখে হাসি টেনেই বলল, ‘আসুন।’
প্লাতিনিকে ধন্যবাদ দিয়ে টেবিলের সামনে দেয়াল বরাবর রাখা সোফায় বসে পড়ল মাজুরভ ও খিরভ।
বসেই মাজুরভ বলল, ‘সম্মানিত প্রিন্স, আমরা দুঃখিত, অন্যের পাপের খেসারত আপনাকে দিতে হচ্ছে।’
‘কার পাপের কথা বলছেন?’
‘কেন, আহমদ মুসার পাপেই তো আপনি বন্দী?’ মাজুরভই বলল।
‘আপনাদের প্রিন্সেসের দেয়া দায়িত্ব সে পালন করতে চাচ্ছে শত বিপদ মাথায় নিয়ে। দায়িত্ব পালন, সততা, ওয়াদা রক্ষা ইত্যাদি কি পাপ?’
‘সে অনাহুত বিদেশী। আমাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ তার অন্যায়।’
‘সে অনাহুত নয়। আপনাদের ক্রাউন প্রিন্সেসের দ্বারা সে দায়িত্বপ্রাপ্ত।’
‘মান্যবর, খৃস্টান তথা পশ্চিমের শত্রু একজন ব্লাডি এশিয়ানের পক্ষে আপনার এই পক্ষপাতিত্ব লজ্জাকর। আমাদের সাহায্য করা আপনার কর্তব্য।’
‘মজলুমের পক্ষ নেয়া লজ্জার নয়। গৌরবের। সম্পদ আত্মসাতে সাহায্য করা কি বৈধ?’
‘আমরা দুঃখিত, আপনার অসুবিধা আপনি বাড়াচ্ছেন মিঃ প্লাতিনি। সাহায্য যদি না করেন, আপনার কন্যাও তাহলে আমাদের পণবন্দী হয়ে এখানে আসবে। সুন্দরী ফরাসী প্রিন্সেস রুশদের হাতে পড়া কি তার সম্মানের জন্যে মানানসই হবে?’
চমকে উঠে মিঃ প্লাতিনি তাকাল মাজুরভের দিকে। মিঃ প্লাতিনির শান্ত মুখে এবার কিছু উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
হাসল মাজুরভ। বলল, ‘মিঃ প্লাতিনি, আপনি যতটা সম্মানের, আহমদ মুসার বাগদত্তা আপনার কন্যা আমাদের কাছে ততটা সম্মানের নয়।’
প্লাতিনি নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বলল, ‘এই ভয় দেখিয়ে আমার কাছে আপনারা কি চাচ্ছেন?’
‘আমরা যেভাবে বলব সেভাবে একটা চিঠি আপনি লিখবেন আপনার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে। এই বিল্ডিং-এর একজন সুইপার আপনার টাকার লোভে চিঠিটি অতি গোপনে নিয়ে পৌঁছাবে ফরাসী দূতাবাসে।’
‘তারপর?’
‘তারপর আপনার জানার আর কিছু নেই।’
‘তারপরের কথা আমি বলছি। আমার চিঠি পেয়ে আমার দেয়া ঠিকানায় ছুটে আসবে আমার মেয়ে এবং আপনারা তাকে পণবন্দী করবেন।’
‘বলেছি তো, এই সহযোগিতা করলে আপনার মেয়ের গায়ে আমরা হাত দেব না। আপনার মেয়ে আমাদের শত্রু নয়, শত্রু আমাদের আহমদ মুসা।’
প্লাতিনি চিন্তা করল। ভাবল, আহমদ মুসার জন্যে এ ধরনের চিঠিতে কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি আছে কিনা? এ চিঠির মন্দ দিক তো পরিষ্কার, কিন্তু কোন ভাল দিকও আছে কিনা। অনেক ভাবনার পর সে বলল, ‘চিঠি কাল নিয়ে আসবেন, লিখে দেব।’
‘ধন্যবাদ প্রিন্স।’ বলে মাজুরভ ও খিরভ উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এল তারা ঘর থেকে।
লিফট দিয়ে উঠতে উঠতে খিরভ বলল, ‘তার মেয়েকে পণবন্দী করার ভয় দেখানোতে কাজ হয়েছে। এখন শিকার ফাঁদে পড়লেই হয়।’
‘ফাঁদে পড়তেই হবে। ফরাসী দূতাবাসে চিঠিটা পৌঁছার সাথে সাথে ফ্যাক্সে তা চলে যাবে প্যারিসে ডোনা জোসেফাইনের কাছে। আর ডোনা জোসেফাইন পেলে সংগে সংগেই তা সে জানাবে আহমদ মুসাকে।’
হাসল খিরভ। হাসল মাজুরভও।

ক্রেমলিনে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র এবং কেজিবি প্রধান মার্শাল জুকভ এক টেবিলে মুখোমুখি বসে।
কথা বলছিল মার্শাল জুকভ।
‘না, আমি মনে করি, প্রিন্সেস ক্যাথারিনের উদ্ধার এবং রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ঘোষণার কাজ আমরা শিডিউল অনুসারে মার্চেই করতে পারবো।’
‘কিন্তু ‘মনে করি’ বলছেন, নিশ্চিত নয় কেন? এখানেই আমার উদ্বেগ।’ বলল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
মার্শাল জুকভ হাসল। বলল, ‘ঈশ্বরের জন্যে কিছু রেখেছি। বিষয়টা সম্ভবের মধ্যে না থাকলে ‘মনে করি’ বলতাম না। কোন সন্দেহ নেই, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে এখন হয় মস্কোতে, না হয় সেইন্ট পিটার্সবার্গে রাখা হয়েছে। আর আহমদ মুসার কাছে রাজকীয় রিং ও ডায়েরী রয়েছে, সেটাও জানা গেছে। এবং আহমদ মুসা ক্যাথারিনের সন্ধানে রাশিয়া এসেছে, সেটা আমাদের প্যারিস দূতাবাস জানিয়ে দিয়েছে।’
‘আহমদ মুসা আমাদের জন্যে সমস্যা নয়। ক্যাথারিনকে আমরা হাতে পেলে, ঐ জিনিসগুলো ক্যাথারিনের হাতে আসবে এবং তার মাধ্যমে আসবে আমাদের হাতে। সুতরাং ক্যাথারিনকে উদ্ধার করাটাই আসল বিষয়। সে ব্যাপারে বল।’
‘এজন্যে আমরা দেশব্যাপী জাল পেতেছি। কিন্তু সত্য বলতে কি, গ্রেট বিয়ার একটা অতি দক্ষ, কুশলী এবং হিংস্র সংগঠন। আমাদের প্রশাসন, পুলিশ, এমনকি সেনাবাহিনীতেও ওদের লোক আছে। বেশ কিছুকে চিহ্নিতও আমরা করেছি। তাদের অনেককে ডাবল এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সকলেরই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। আমরা মনে করছি, গ্রেট বিয়ারের কাছে তারা ধরা পড়ে যায় এবং সে কারণেই তারা নিহত হয়। আমরা আমাদের লোকদের আরও সাবধান করেছি। কিন্তু ভীষণ সাবধান ওরা। বার বার ওদের কাছাকাছি হয়েও আমরা ওদের গায়ে হাত দিতে পারছি না।’
‘নিশ্চয় আপনাদের পরিকল্পনা পাচার হয় কোন রকমে। প্যারিসে মায়োভস্কি আমাদের এক ইঞ্চি এগোতে দেয়নি। এমন মায়োভস্কি নিশ্চয় আরও আছে।’
‘আমি আপনার সাথে একমত স্যার। আমরা তাদেরও সন্ধান করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রেট বিয়ারের চরম জাতীয়তার শ্লোগান বিশেষ করে তরুণদের খুবই আকৃষ্ট করছে।’
‘জানি আমি। বিকৃতি কোন সময়ই সুস্থতাকে অতিক্রম করে না। স্বীকার করতে হবে, অযোগ্যতাই আমাদের বড় বাঁধা। পাভেলের রিপোর্টে দেখলাম, একা এক মানুষ আহমদ মুসা তিনবার ওদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেছে এবং গুঁড়িয়ে দিয়েছে গ্রেট বিয়ারের সেখানকার শক্তিকে। চিন্তা করতে বিস্ময় লাগে, গ্রেট বিয়ারের প্যারিস অপারেশনে যাওয়া কোন নেতাই বাঁচেনি।’
‘আপনার সাথে আমি একমত স্যার। আহমদ মুসার তুলনা শুধু আহমদ মুসাই। কিছু দিন আগে সেন্ট্রাল এশিয়াতেও গ্রেট বিয়ারের সাথে আহমদ মুসার লড়াই হয়েছে। সে লড়াইতেও আহমদ মুসা মধ্য এশিয়ার গ্রেট বিয়ারকে ধ্বংস করেছিল। সবচেয়ে ভাল হতো যদি তাকে আমরা ব্যবহার করতে পারতাম।’
‘আমাদের রাষ্ট্রদূত পাভেল তো সে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে আমাদের কথায় আসেনি।’
‘এরপরও রাশিয়ায় এসে সে যা করবে তা আমাদের সাহায্যেই আসবে। তাকে অনুসরণ করলেও আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ হতে পারে। গ্রেট বিয়ার ও আহমদ মুসা দু’পক্ষেরই একসাথে সর্বনাশ আমাদের জন্যে লাভজনক।’
‘ঠিকই বলেছেন। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাথে আহমদ মুসার সাক্ষাৎ ভিন্ন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’
‘প্রিন্সেস তাতিয়ানার সাথে আহমদ মুসার প্রেম আপনার যু্ক্তিকে সমর্থন করছে স্যার।’
‘পাভেলের রিপোর্ট অনুসারে বন্দী অবস্থায় প্রিন্সেস ক্যাথারিনের সাথে আহমদ মুসার এ পর্যন্ত দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রিন্সেস ক্যাথারিনের এ বিশ্বাস হওয়া স্বাভাবিক, আহমদ মুসাই একমাত্র তাকে উদ্ধারের জন্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।’
‘ঠিক স্যার।’
‘সুতরাং আপনি ঠিকই বলেছেন, গ্রেট বিয়ার ও আহমদ মুসাকে একসাথে আমাদের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়ার মধ্যেই আমাদের লাভ।’
‘কাজটা সহজ হবে না।’
‘তা তো বটেই। তবে সুবিধা হলো, আহমদ মুসা এখানে কোন গ্রাউন্ড সাপোর্ট পাবে না। মধ্য এশিয়ার তুর্কি কমিউনিটির লোক ছাড়া তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। চোখ রাখতে হবে এদের উপর। আহমদ মুসার লোকেশন ডিটেক্ট করার জন্যেও এটা প্রয়োজন।’
‘আপনার পরামর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এদিকে লক্ষ্য রাখব।’
‘তবে মার্শাল জুকভ, প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে উদ্ধারের মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদেরকে খুব সন্তর্পণে এগোতে হবে।’
‘আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক স্যার।’
জেনারেল জুকভের কথা শেষ হতেই ইন্টারকমে প্রধানমন্ত্রীর পিএস-এর গলা শোনা গেল। বলল, ‘স্যার, জরুরী একটা ফাইল এসেছে।’
‘পাঠাও।’ নির্দেশ দিল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
বলে কেরনস্কী জুনিয়র তার বাম পাশের কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকাল। তারপর প্রিন্টারের একটা বোতামে নক করল।
সংগে সংগেই বেরিয়ে এল কাগজের একটা লম্বা শীট।
শীটটির উপর একবার নজর বুলিয়ে তা এগিয়ে দিল মার্শাল জুকভের দিকে।
মার্শাল জুকভও কাগজটির উপর নজর বোলাতে লাগল।
‘গ্রেট বিয়ার পাগল হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।
কাগজ থেকে মুখ তুলে মার্শাল জুকভ বলল, ‘তাই তো দেখছি। আহমদ মুসার মত দেখতে বলেই নিশ্চিত না হয়ে একটি দম্পতিকে হত্যা করে ফেলল?’
‘হত্যা করার লক্ষ্য অবশ্যই ছিল না। কিন্তু স্বীকারোক্তি করাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার রাগে প্রথমে হত্যা করে স্ত্রীকে। তাতেও স্বীকারোক্তি না করায় লোকটির উপর যে নির্যাতন চলে তাতেই সে মারা যায়।’
‘বোঝা যাচ্ছে, পথেই আহমদ মুসাকে পাকড়াও করার জন্যে গ্রেট বিয়ার সর্বাত্মক জাল ফেলেছে। আহমদ মুসা ওদের হাতে গেলে যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছা আমাদের জন্যে যেমন কঠিন হবে, তেমনি জারের ধনভাণ্ডার উদ্ধারের চাবিকাঠি গ্রেট বিয়ারের হাতে চলে যাবে। যার ফলে জগতের শ্রেষ্ঠ ধনভাণ্ডার চিরতরে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।’
‘ফ্রান্স থেকে রাশিয়ামুখী সকল পথের উপর আমাদের প্রহরা গ্রেট বিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্ছিদ্র করে তুলতে হবে। আহমদ মুসাকে ওদের হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। ওকে বন্দী করে রয়্যাল রিং এবং রয়্যাল ডায়েরী রক্ষা করতে হবে গ্রেট বিয়ারের হাত থেকে।’
প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়রের কথা শেষ হতেই তার ইন্টারকম আবার কথা বলে উঠল। কথা বলছে তার পিএস, ‘স্যার, আরেকটা ফাইল এসেছে। পাঠিয়েছেন প্যারিস থেকে রাষ্ট্রদূত পাভেল।’
‘হ্যাঁ। ওর কাছ থেকে একটা জরুরী মেসেজ আসার কথা। ও, কে।’
বলে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র কম্পিউটারের দিকে ঘুরল। কম্পিউটারে ফাইল কন্ডিশন দেখে নিয়ে ফাইলের একটা প্রিন্ট বের করে নিল।
দ্রুত চোখ বোলাল কাগজের শীটটার উপর। বলল মার্শাল জুকভকে লক্ষ্য করে, ‘আহমদ মুসার যে ছবি আমাদের কাছে আছে এবং ভিডিও-তে দেখা গেছে, সেই ছবিতেই সে ভিসা নিয়েছে।’
‘সাংঘাতিক দুঃসাহসী লোক সে। তার অজানা নয় যে, তার এই ছবি গ্রেট বিয়ার এবং আমাদের কাছে রয়েছে। নামও কি ঠিক রেখেছে ভিসায়?’ বলল জুকভ।
‘না। ‘আবদুল্লাহ’ নামে নিয়েছে।’
‘প্রবেশ পথ সম্পর্কে কি বলেছে?’
‘স্থল ও বিমান দুই-ই রেখেছে।’
‘তার উচ্চতা?’
‘পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি।’
‘ওজন?’
‘একশ পঁচিশ পাউন্ড।’
‘এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দূতাবাস থেকে প্রকাশ হয়ে পড়বে, সেটা তো অবশ্যই সে জানত।’
‘অবশ্যই জানার কথা।’
‘আহমদ মুসার মত লোক কি এত বড় দুর্বলতা নিয়ে রাশিয়া প্রবেশ করতে আসছে?’
‘ভিসা যখন নিয়েছে, তখন তো এর বিকল্প নেই।’
‘হতে পারে ভিসা নেয়াটা তার লোক দেখানো।’
‘অর্থাৎ সে ভিসা ব্যবহার করবে না মনে করছেন?’
‘আমার তা-ই মনে হয়। তার ছবি আমাদের ও গ্রেট বিয়ারের হাতে আছে জানার পর সে পাসপোর্ট ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না।’
‘যদি তাই হয়, যদি সে ছদ্মবেশ নিয়ে সীমান্ত ক্রস করে, তাহলে তার সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো আমাদের উপকারে আসবে।’
বলে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র কাগজের শীটটি মার্শাল জুকভের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখুন, এতে আরও কিছু তথ্য আছে। এগুলো সর্বত্র আমাদের লোকদের জানিয়ে দিন।’
‘অবশ্যই স্যার।’ বলে কাগজের শীটটি হাতে নিয়ে বলল, ‘এখন উঠতে পারি স্যার?’
‘এস।’
উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেইক করে বিদায় জানাল মার্শাল জুকভকে প্রধানমন্ত্রী কেরনস্কী জুনিয়র।

Top